৩. একটা গোলমেলে ব্যাপার

ডাক্তার রবার্টস এক সময় তার এই মহিলা পেশেন্ট মিসেস ক্র্যাডকের সঙ্গে একটা গোলমেলে ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েন। ডাঃ রবার্টসের ওপর প্রচণ্ড রেগে গিয়ে ঝগড়া বাধিয়ে তোলার চেষ্টা করতে থাকেন মিঃ ক্র্যাডক। তার বাড়িতেই মিসেস ক্র্যাডককে দেখতে এসেছিলেন ডাঃ রবার্টস। হঠাৎ ভদ্রমহিলার স্বামী রেগে গিয়ে ডাঃ রবার্টসকে শাসিয়ে দেন তার নামে মেডিক্যাল কাউন্সিলে রিপোর্ট করবেন বলে। ডাঃ রবার্টস তখন ভদ্রলোককে ডেকে নিয়ে শান্ত করে বলেন যে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভুল। মিঃ ক্র্যাডক অযথাই ডাঃ রবার্টসকে সন্দেহ করছেন। তিনি আর কখনই মিঃ ক্র্যাডকের বাড়িতে আসবেন না। এরপর শান্ত হন এবং ডাঃ রবার্টস বাথরুমে গিয়ে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে বিদায় নিয়ে চলে যান। অফিসে চলে যান মিঃ ক্র্যাডক।

তারপর? মিসেস অলিভার-এর কৌতূহলী প্রশ্ন ভেসে এল।

মিঃ ক্র্যাডক এর কিছুদিনের মধ্যেই অ্যানথ্রাক্স রোগে মারা যান।

 অ্যানথ্রাক্স? সে তত গবাদি পশুদেরই হয়ে থাকে?

হ্যাঁ। আপনার হয়ত মনে আছে সস্তা দামের এক ধরণের সেভিং ব্রাশ নিয়ে একসময়ে বাজারে খুব গণ্ডোগোল শুরু হয়েছিল–অধিকাংশই নাকি দূষিত ছিল। মিঃ ক্র্যাডকের সেভিং-ব্রাশটাও দূষিত ছিল বলে পরে প্রমাণিত হয়।

ডাঃ রবার্টস কি তার চিকিৎসা করেছিলেন?

না না। তিনি খুবই ধুরন্ধর। অবশ্য হয়ত মিঃ ক্র্যাডকও চাইতেন না। একটাই মাত্র সন্দেহজনক সূত্র আমার নজরে এসেছে–খোঁজ নিয়ে জেনেছি ডাঃ রবার্টসের একজন পেশেন্ট সে সময় অ্যানথ্রাক্স রোগে ভুগছিলেন।

আপনি কি মনে করেন ডাঃ রবার্টস ভদ্রলোকের সেভিং-ব্রাশটা দূষিত করে রাখেন?

 হ্যাঁ। আমার তাই মনে হয়। যদিও সবটাই অনুমান তবুও একেবারে অসম্ভব নয়।

 মিসেস ক্র্যাডকের কি হল?

তিনিও কিছুদিন বাদে হঠাৎ পাততাড়ি গুটিয়ে শীতকালে মিশরে চলে গেলেন, এক ধরনের সাংঘাতিক সংক্রামক রোগে তিনি ওখানেই মরা যান–তার শরীরে সমস্ত রক্ত দূষিত হয়ে গিয়েছিল। এই অসুখটার কি একটা লম্বা চওড়া নাম আছে। মিশরেই নাকি এই অসুখ হয় বেশি।

এর মধ্যে ডাক্তারের কোন হাত নেই বলতে চান?

সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল মাথা নাড়লেন, এ বিষয়ে আমার এক জীবাণু বিশেষজ্ঞ বন্ধুর সঙ্গে কথা হয়েছে। সে আবার কোন স্পষ্ট কথা বলতেই রাজি নয়–ভাসা ভাসা মতামত দেয়। তবে একটা কথা জানতে পেরেছি এবং সেটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আমার সেই বন্ধুর মতে–ডাক্তার রবার্টসের পক্ষে মিসেস ক্র্যাডকের ইংল্যান্ড ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে তার শরীরে জীবাণু ঢুকিয়ে দেওয়া সম্ভব। কারণ জীবাণু শরীরে ঢোকার বেশ কিছুদিন বাদে এই অসুখের লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে থাকে।

মিসেস ক্র্যাডক কি মিশরে যাবার আগে টাইফয়েডের প্রতিষেধক কোন ইঞ্জেকশন নিয়েছিলেন?

হ্যাঁ।

ঠিক তাই মঁসিয়ে পোয়ারো। মিশরে যাবার আগে মিসেস ক্র্যাডক ডাঃ রবার্টসের কাছে দুটো ইঞ্জেকশন নিতে গিয়েছিলেন, কিন্তু আমরা ঘুরে ফিরে সেই একই সত্যে ফিরে আসছি। প্রমাণ কোথায়? ইঞ্জেকশন দুটো রোগের প্রতিষেধকও হতে পারে অথবা অন্যকিছুও। আমরা নিশ্চিত হতে পারছি কোথায়? সবটাই অনুমান।

পোয়ারো মাথা নাড়লেন। মিঃ শেটানের একটা কথা মনে পড়ছে। তিনি সেই খুনিদের কথাই বলেছিলেন যাদের বিরুদ্ধে কোর্টে কোন প্রমাণ দাখিল করা যাবে না।

কিন্তু মিঃ শেটান এত খবর জোগাড় করলেন কি করে? মিসেস অলিভারের প্রশ্নে তার দিকে তাকালেন পোয়ারো, এ সম্বন্ধে কিছুটা অনুমান করে নেওয়া যায়। শেটান একসময় মিশরে গেছিলেন, সেখানেই মিসেস লরিমারের সঙ্গে তার দেখা হয়। তিনি হয়ত মিসেস ক্র্যাডকের রোগের লক্ষণ সম্পর্কে কোন ডাক্তারের সন্দেহজনক মন্তব্য শুনেছিলেন। ক্র্যাডক পরিবারের গণ্ডগোলে ডাক্তার রবার্টসের জড়িয়ে পড়ার ব্যাপারটা আগে থেকে নিশ্চয়ই জানতেন মিঃ শেটান। তার ফলেই কিছু একটা ভেবে নিয়েছিলেন। ডাঃ রবার্টসও হয়ত অসর্তক কোন মুহূর্তে কোন কথা বলেছিলেন শেটানকে। মিঃ শেটানও লোকের গোপন কথা বের করতে ভালই পারতেন। এখন কথা হল শেটানের সন্দেহ ঠিক কিনা?

আমার মনে হয় তিনি নির্ভুল। ব্যাটেল বললেন, ডাঃ রবার্টস যে একজন খুনি কোন সন্দেহ নেই। মিঃ ক্র্যাডককে তিনিই খুন করেছেন। মিসেস ক্র্যাডককে খুন করাও তার পক্ষে অসম্ভব নয়। কিন্তু মিঃ শেটানকে কি তিনি খুন করেছেন? এখানেই প্রশ্ন থেকে যায়। মিঃ ক্র্যাডককে খুন করার ব্যাপারে তিনি তার চিকিৎসা বিষয়কেই কাজে লাগিয়েছেন। যার ফলে সকলের কাছে মৃত্যুটা স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। আমার মতে যদি তিনি শেটানকে খুন করার কথা ভাবতেন তবে ছুরির বদলে অন্য কোন পদ্ধতির কথা ভাবতেন।

জানাকথাই তো-র ওপর সন্দেহ হয় প্রথমে, সে কখনই খুনি হতে পারে না। ডাক্তার রবার্টস খুনি নন। মিসেস অলিভার মন্তব্য করেন।

তাহলে সন্দেহের লিস্ট থেকে ডাক্তার রবার্টস বাদ পড়লেন, রইল বাকি–তিন! পোয়ারো মৃদু হাসলেন।

ব্যাটেল বলতে শুরু করলেন অন্যদের বিশেষ কিছু খবর নেই। ডেসপার্ডেরটা আগেই শুনলেন। বছর কুড়ি হল বিধবা হয়ে লন্ডনে বাস করছেন মিসেস লরিমার। শীতকালে মাঝে-মধ্যে রিভারিয়া, মিশর এ-সমস্ত দেশে বেড়াতে যান। কোন সন্দেহজনক মৃত্যুর সঙ্গে তার কোন সংযোগ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তার মতো ভদ্রমহিলার যেভাবে জীবনযাপন করা উচিত, সেরকম সম্পূর্ণ স্বাভাবিক সম্মানীয় জীবন কাটাচ্ছেন তিনি। সকলেই তাকে শ্রদ্ধা করে। তার সম্বন্ধে লোকের ধারণাও খুব উঁচু। তার একটাই দোষ, যদি এটাকে দোষ বলা যায়–তবে বোকামি একদম সহ্য করতে পারেন না। আমি সবদিক দিয়ে খোঁজখবর করে দেখেছি কোন দোষ খুঁজে পাইনি। একটা কিছু নিশ্চয়ই আছে, অন্ততঃ মিঃ শোন তো তাই ভাবতেন।

ব্যাটেল হতাশভাবে মাথা নাড়লেন, তারপর সংক্ষেপে মিস মেরিডিথের সম্পর্কে সংগৃহীত তথ্য সকলকে জানিয়ে বললেন, আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি সব খবরগুলোই ঠিক। মেয়েটি মিথ্যে বলছে না।

তারপর সুইজারল্যান্ড, উইলিং ফোর্ড এখানেও তার সম্বন্ধে কোন সন্দেহজনক খবর পায়নি।

তাহলে মেরিডিথও বাদ যাচ্ছে লিস্ট থেকে? জিজ্ঞাসা করলেন পোয়ারো।

ঠিক এ কথা জোর দিয়ে বলতে পারব না। মাথা নাড়লেন ব্যাটেল। কোথাও একটা গোলমাল আছে। মিস মেরিডিথের চোখমুখে প্রায়ই একটা ভয়ের ছাপ ফুটে ওঠে যেটাকে শুধু মাত্র শেটানের জন্য একথা বলতে রাজি নই। চারিদিকেই তাই ভয়-চকিত নজর, সব সময়ই কোন একটা ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে থাকে। নিশ্চয়ই কোন সাংঘাতিক ঘটনার সঙ্গে জড়িত। তবে ঐ যে বললাম মিস মেরিডিথ নির্দোষ জীবনযাপন করে।

মিসেস অলিভারের চোখের তারা চক চক করে উঠল। কিন্তু তবুও অ্যানা একসময় এমন একটা বাড়িতে এক ভদ্রমহিলা ওষুধের বদলে ভুল করে এক ধরণের বিষাক্ত মালিশ খেয়ে মারা যান।

তার কথা শেষ হতে না হতে উত্তেজনায় ব্যাটেল চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, এ খবর আপনি কোথা থেকে পেলেন?

এ হল আমার একটু-আধটু গোয়েন্দাগিরির ফল। মিসেস অলিভারের খুবই গর্বিত জবাব- ওদের ওয়েলডন কুটিরে গিয়ে এক আষাঢ়ে গল্প ফাঁদলাম, ডাঃ রবার্টসকেই আমার সন্দেহ। যোডা মেয়েটা ভাল, কি ভাল ব্যবহার করল আমার সঙ্গে। কিন্তু অ্যানা মোটেই পছন্দ করল না আমাকে এবং সে কথা স্পষ্টভাবে জানিয়েও দিল, খুবই সন্দেহপ্রবণ মেয়ে, যদি গোপন কিছু না-ই থাকবে তবে অত সন্দেহ কিসের? আমি ওদের দুজনকেই লন্ডনে আমার ফ্ল্যাটে আসতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম–রোডাই এসেছিল। ওর মুখ থেকেই সব ঘটনা শুনলাম।

কখন, কোথায় এটা ঘটেছিল জানতে পেরেছেন?

 ডেভনশায়ারে তিন বছর আগে 

সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল ঝড়ের বেগে প্যাডের ওপর পেন্সিল দিয়ে নোট করতে লাগলেন।

চেয়ারে বসে এদিক ওদিক তাকিয়ে পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করলেন মিসেস অলিভার–নিজের কেরামতিতে তিনি খুবই গর্বিত।

আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, মিসেস অলিভার। সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল অভিনন্দন জানালেন। খুব দামী খবর যোগাড় করে আমাদের সকলের ওপর টেক্কা দিয়েছেন আপনি। মিসেস এল্ডনের বোন অবশ্য–

হঠাৎ পোয়ারো প্রশ্ন করলেন মিসেস এল্ডন, অর্থাৎ মিস মেরিডিথ প্রথমে যে বাড়িতে কাজ করত সে বাড়ির কর্ত্রী, তিনি কি খুব অগোছালো টাইপের মহিলা?

ব্যাটেল খুব অবাক হলেন। হ্যাঁ। তার বোনের সঙ্গে কথায় কথায় মিসেস এন্ডনের অগোছালো স্বভাবের কথা উঠেছিল বটে। কিন্তু আপনি কি করে এ খবর পেলেন?

এমনিই, হঠাৎ আমার মনে হল তাই। যাক আপনি যে কথা বলছিলেন বলুন।

বলছিলাম মেরিডিথের কথা। ব্যাটেল আবার শুরু করলেন, মিসেস এন্ডনের বোন আমাকে বলেছিলেন, অ্যানা তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ডেভনশায়ারে চলে যায়। কোথায় গেছে, কার বাড়িতে, এত খবর দিতে পারেনি। তবে মনে হয় সেখানে বেশিদিন থাকেনি। মেয়েটা এত মিথ্যেবাদী, আমাকে ঠকিয়েছে। আর যদি ডেভনশায়ারের ব্যাপারটা দুর্ঘটনাই হবে তো তার এত ভয় কেন? সে যদি সম্পূর্ণ নির্দোষই হয়?

পোয়ারো আপন মনে বিড় বিড় করলেন, সত্যিই আমার ভাবতে খুব অবাক লাগে–

পোয়ারো এখন ক্রম্পটন রোড ধরে হেঁটে চলেছেন। একটু আগেই মিসেস ল্যাক্সমোরের বাড়িতে গেছিলেন পোয়ারো। গেছিলেন অধ্যাপক ল্যাক্সমোরের মৃত্যুর প্রকৃত রহস্য জানতে। প্রথমে মিসেস ল্যাক্সমোর কিছুই বলতে রাজি হননি। কিন্তু পোয়ারো তার নিজের কায়দায় সমস্ত কথাই আদায় করে ছেড়েছেন। ঘটনাটা হল এই :

মিসেস ল্যাক্সমোর তার স্বামীর সঙ্গে আমাজন নদীর কাছাকাছি অঞ্চলে এক অভিযানে গেছিলেন। তার স্বামী অধ্যাপক ল্যাক্সমোর ছিলেন বোটানিস্ট। ঐ অঞ্চলের দুষ্প্রাপ্য লতাগুল্মের সন্ধানেই তিনি যান। মেজর ডেসপার্ডও ঐ অভিযানে অংশ নেন–তিনি ঐ অঞ্চলের আবহাওয়া সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিলেন, এবং অভিযানের বহু প্রয়োজনীয় ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবেন বলেই তাকে সঙ্গে নেওয়া হয়। এক রাত্রে কোন কারণে মেজর ডেসপার্ডের সঙ্গে অধ্যাপক ল্যাক্সমোরের ঝগড়া বাধে। অধ্যাপক ডেসপার্ড আত্মরক্ষার্থে গুলি ছুঁড়েছিলেন যা অধ্যাপক ল্যাক্সমোরের হৃৎপিণ্ড ভেদ করে চলে যায়। সংক্ষেপে এই হল অধ্যাপক ল্যাক্সমোরের মৃত্যু রহস্য।

পোয়ারো মনে মনে বিড় বিড় করলেন সত্যিই অভূতপূর্ব মহিলা–হতভাগ্য ডেসপার্ড। বাড়ির দিকে এগোতে এগোতে হঠাই আপনমনে হাসতে শুরু করলেন পোয়ারো।

বাড়ি পৌঁছানোর পর আধঘণ্টা হতে না হতে মেজর ডেসপার্ড পোয়ারোর বাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন। তার চোখে মুখে রাগের ছাপ। অতিকষ্টে নিজেকে ধরে রেখেছেন তিনি।

কি জন্যে আপনি মিসেস ল্যাক্সমোরের বাড়িতে গেছিলেন? পোয়ারো মৃদু হাসলেন আমার উদ্দেশ্যটা নিশ্চয়ই আপনি এতক্ষণে জেনে গেছেন। অধ্যাপক ল্যাক্সমোরের মৃত্যুরহস্যের আসল তথ্যটা খুঁজে বের করাই আমার উদ্দেশ্য।

আসল তথ্য! ঝাঁঝালো গলায় বলে ওঠেন ডেসপার্ড আপনি কি মনে করেন মেয়েদের পক্ষে সমস্ত ঘটনা জানা সম্ভব?

তা অবশ্য ঠিক। সায় দিলেন পোয়ারো।

আপনি জেনেছেন কতগুলো মিথ্যে কথা, বানানো কথা।

না না। পোয়ারো প্রতিবাদ জানালেন, সেরকম কিছু নয়। ভদ্রমহিলা একটু রোমান্টিক ধাঁচের এই যা–

হ্যাঁ, মিথ্যেটাকেই সত্যি বলে মেনে নেওয়াটাই তার একমাত্র লক্ষ্য। সবটাই ধাপ্পাবাজী। তার ওপর আবার তিনি ভীতু। উঃ কি অশান্তিতেই যে ওদের সঙ্গে কাটিয়েছিলাম!

হ্যাঁ, আমারও একথাটা সত্যি বলে মনে হয়, পোয়ারো মাথা দোলালেন।

হঠাৎ একটা চেয়ারে বসে পড়লেন ডেসপার্ড। তাহলে আসল ঘটনাটা আপনাকে খুলেই বলি মঁসিয়ে পোয়ারো। অল্প থেমে বলতে শুরু করলেন ডেসপার্ড, আমি জানি আমি যা-ই বলি তাতে কারোর এক বিন্দু সমবেদনা পাব না। বরঞ্চ সকলের চোখে সন্দেহের ভাগী হব আমি-ই। তবুও আমার কাছে একটাই পথ খোলা আছে–তা হল ঘটনাটা আপনার কাছে খুলে বলা। বিশ্বাস করুন বা না করুন এই হল আসল ঘটনা।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর মেজর ডেসপার্ড বলতে শুরু করলেন, অধ্যাপক ল্যাক্সমোরের অভিযানের যাবতীয় ব্যবস্থা আমিই করেছিলাম। ল্যাক্সমোর সত্যিই একজন ভদ্রলোক। সবসময় গাছ লতা নিয়ে মেতে থাকতেন। আর মিসেস ল্যাক্সমোরকে তো দেখেই এলেন–অতিরিক্ত ভাবুক। আমি বিশেষ পছন্দ করতাম না তাকে। যাই হোক, ওখানে পৌঁছানোর পর অল্পদিনের মধ্যেই আমরা তিনজনেই জ্বরে পড়লাম। আমি এবং মিসেস ল্যাক্সমোর অল্প ভুগেই সুস্থ হয়ে উঠলাম, কিন্তু অধ্যাপকের জ্বর উত্তরোত্তর বাড়তে লাগল। একদিন আমি তাঁবুর বাইরে সন্ধ্যেবেলা চেয়ারে বসে আছি হঠাৎ দেখি ভদ্রলোক টলতে টলতে ঝোপ-জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে নদীর দিকে এগোেচ্ছন। তিনি যে জ্বরের ঘোরে বেহুঁশ হয়ে এরকম কাণ্ড করতে যাচ্ছেন এতে কোন সন্দেহ ছিল না। আর এক মিনিটের মধ্যে ভদ্রলোক নদীতে গিয়ে পড়বেন। একবার পড়লে বাঁচার কোন সম্ভাবনাই থাকবে না। আমি যে ছুটে গিয়ে তাকে থামাব সে সময়ও নেই। পাশেই গুলিভরা বন্দুকটা পড়ে ছিল। ভদ্রলোকের পায়ে গুলি মেরে তাকে থামাতে চাইলাম আমি। আমার টিপ অব্যর্থ ছিল। বন্দুকটা তুলে সেদিকে তাক করে গুলি ছুঁড়তে যাই এমন সময় হঠাৎ মিসেস ল্যাক্সমোর কোথা থেকে ছুটে এসে আমাকে বাধা দিলেন। তার ধারণা হয়েছিল যে আমি তার স্বামীকে গুলি করে মেরে ফেলছি। ভদ্রমহিলার টানাটানিতে বন্দুকের নলটা ঘুরে গিয়ে গুলিটা সোজা অধ্যাপকের পিঠে গিয়ে বিধল। সঙ্গে সঙ্গে মারা গেলেন তিনি।

ভদ্রমহিলা এত বোকা, তিনিই যে ঘটনাটার জন্যে দায়ী এ-কথা কিছুতেই মানতে রাজী হলেন না। তার ধারনা আমার সঙ্গে ভদ্রলোকের ঝগড়া ছিল যার ফলে রাগে আমি তাকে মেরে ফেলেছি। ভদ্রমহিলা যে কি করে বসেছেন তা নিজেই জানেন না। শেষে তিনি বললেন যে বাইরের লোকেদের কাছে জানানো হবে যে অধ্যাপক ল্যাক্সমোর কালাজ্বরে মারা গেছেন। আমিও শেষ পর্যন্ত তার কথাতেই রাজী হলাম কারণ প্রকৃত ঘটনা জানলে শুধু শুধুই লোকের মিথ্যে সন্দেহে জড়িয়ে বদনামের ভাগী হব। পরদিন সকালে কুলিদের জানিয়ে দিলাম অধ্যাপক ল্যাক্সমোর কালাজ্বরে মারা গেছেন। সকলে মিলে তাকে নদীর ধারে কবর দিলাম। কুলিরা যদিও সকলেই আসল ঘটনা জানত, কিন্তু সকলেই খুব বিশ্বাসী, আমাকে শ্রদ্ধাও করত। তারা আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করল বাইরে কোনদিন কেউ এই ঘটনা কাউকে জানাবে না। তারপর আমরা লন্ডনে ফিরে আসি।

মেজর ডেসপার্ড কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে বলে উঠলেন, এই হল আমার গল্প বা ব্যাখ্যা–যাই বলুন। আমার মনে হয় শেটান কোন ভাবে মিসেস ল্যাক্সমোরের কাছ থেকে এই খবর জানতে পেরেছিলেন এবং সেদিন আমাদের সামনে এই ঘটনারই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।

ব্যাপারটা কিন্তু আপনার পক্ষে বেশ বিপজ্জনক। মিঃ শেটান যখন জানতে পেরেছিলেন- পোয়ারোর শান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এল।

ওসব আমি পরোয়া করি না। যাই হোক, এই গল্পের কোন সাক্ষ্য প্রমাণ আমি হাজির করতে পারব না। আমার মুখের কথাকেই প্রমাণ বলে ধরে নিতে হবে। অবশ্য এর পরিপ্রেক্ষিতে আমি মিঃ শেটানকে খুন করেছি এই ধারণা করে নেওয়াও অস্বাভাবিক নয়। সেজন্যই আপনাকে আসল ঘটনা খুলে বললাম, বিশ্বাস করা না করা আপনার ইচ্ছা।

আপনার মুখের কথাই আমি বিশ্বাস করছি মেজর ডেসপার্ড। পোয়ারো হাত বাড়িয়ে দিলেন ডেসপার্ডের দিকে।

ডেসপার্ডের দু চোখ খুশীতে চকচক করে উঠল। পোয়ারোর দু হাত আঁকড়ে ধরলেন তিনি। অসংখ্য ধন্যবাদ, মঁসিয়ে পোয়ারো।

তুই একটা ভীতু মেয়ে অ্যানা–বোকা মেয়ে। উটপাখির মতো বালির মধ্যে মুখ লুকিয়ে রাখলেই কি চলবে? যেখানে একটা খুন নিয়ে কথা সেখানে তোর না গেলে চলে। বিশেষতঃ যখন সন্দেহভাজনদের মধ্যে তুই একজন–অবশ্য সেভাবে দেখতে গেলে তোর ওপরেই সন্দেহটা কম হওয়া উচিত। রোডা উত্তেজিত হয়ে ওঠে।

সকালের ডাকেই পোয়ারোর আমন্ত্রণ পত্র তাদের কাছে এসে পৌচেছে। অথচ অ্যানা তার কাছে যেতে মোটেই রাজি নয়।

কিন্তু জানিসই তো রোডা, গোয়েন্দা-গল্পে যার ওপর কম সন্দেহ হয় পরে দেখা যায় সেই খুনি। অ্যানা ঠাট্টার সুরে বলে।

তার কথায় কান দেয় না রোডা। তা হলেও তোকে যেতেই হবে। মনে রাখিস, তোর ওপরও নজর করা হচ্ছে, তোকেও সন্দেহের আওতায় রাখা হচ্ছে। এখন আমি খুনের কথা সহ্য করতে পারি না। রক্তের গন্ধে অজ্ঞান হয়ে যাই।…এসব ন্যাকামো চলে না।

বেশ তো পুলিশের কাছে আমি সব প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি আছি। অ্যানা বোঝাবার চেষ্টা করে, কিন্তু কোথাকার কে এক….. পোয়ারো, তার প্রশ্নের জবাব দিতে আমি বাধ্য নই।

তাহলেও ভেবে দেখ, তুই যদি না যাস–ভদ্রলোক হয়ত ভেবে বসবেন তুই খুনি, তাই যেতে ভয় পাচ্ছিস।

কিন্তু আমি খুনি নই। অ্যানা ঠাণ্ডা ভাবে বলে।

আমি যেন তাই বলেছি। আরে বাবা, আমিও জানি তুই কোনদিন হাজার চেষ্টা করলেও কাউকে খুন করতে পারবি না। তবুও দেখ, ভদ্রলোক বাইরের লোক–তার তো এত জানার কথা নয়। তার চেয়ে বরং চল আমরা দেখা করে আসি। নয়ত ভদ্রলোক এখানেই এসে হাজির হবেন। বলা যায় না, হয়ত ততক্ষণে ঝি-চাকরদের কাছ থেকে আমাদের গোপন খবর বার করে নিয়েছে।

ভদ্রলোক কি কারণে যে আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন। অ্যানা বিরক্ত হয়ে পড়ে। তোর কি মনে হয় রোডা, ভদ্রলোক কি রকম?

মোটেই শার্লক হোমসের মত দেখতে নয়, তবে এককালে বেশ নামডাক ছিল। এখন বেশ বুড়ো হয়েছেন-ষাট-পয়ষট্টি বছর বয়স হবে। আমার কি মনে হয় জানিস, ভদ্রলোক স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ওপর টেক্কা দিতে চাইছেন–চল না দেখেই আসি-হয়ত নতুন কোন খবরও পাওয়া যাবে।

তাহলে চল। বিষণ্ণ হয়ে সায় দেয় অ্যানা। তোর যখন এতই ইচ্ছে।

হ্যাঁ, আমার ইচ্ছে, ঝাঁঝালো গলায় বলে রোডা, কারণ আমি তোর ভাল চাই। তোর মত বোকা আমি খুব কম দেখেছি অ্যানা–ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় তুই নজর দিতে জানিস না।

অ্যানা আর রোডা যখন এ-সমস্ত কথা বলছিল ঠিক তখনই ডেভনশায়ার থেকে লন্ডনের ট্রেনে ফিরছিলেন সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল। ডেভনশায়ার থেকে অ্যানা মেরিডিথ সম্পর্কে আরও খবরাখবর জোগাড় করে ফিরছিলেন তিনি। সেখানকার স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে তিনি মিসেস বেনসনের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে মোটামুটি ভাবে খোঁজ নিয়েছেন। যা জানা গেছে তা হল : মিসেস বেনসন ভুল করে কাশির সিরাপের বদলে টুপির পালিশ খেয়ে মারা যান। মিস মেরিডিথ যখন ঐ বাড়িতে কাজ নিয়েছিলেন তখন একদিন টুপির পুলিশের বোতলটা ভেঙ্গে যায়। মিসেস বেনসন ঐ পালিশটা সিরাপের পুরোনো খালি বোতলে ঢেলে রাখতে বলেন মিস মেরিডিথকে। কিন্তু অসাবধানতা বশতঃ ঐ বোতলের গায়ে টুপির পালিশ হিসাবে কোন লেবেল আটকানো হয়নি। পালিশটা একটা খালি সিরাপের বোতলে ভরে সবচেয়ে উঁচু তাকে তুলে রাখা হয়েছিল। কিন্তু ঘটনার দিন রাত্রে ভদ্রমহিলা একটা পাত্রে বেশ কিছু সিরাপ ঢেলে পান করেন, কিন্তু সেটা ছিল সেই টুপির পালিশ, সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে খবর পাঠানো হয় কিন্তু ভদ্রলোক অন্য গ্রামে রুগী দেখতে গিয়েছিলেন। তিনি ফিরে আসবার আগেই ভদ্রমহিলা মারা যান। বাড়ির লোকেদের ধারণা মিস মেরিডিথ মানে তাদের পরিচারিকাটিই ঘরদোর পরিষ্কার করার সময় ভুল করে বোতল দুটো উল্টোপাল্টা করে রেখেছিল।

ব্যাটেল মনে মনে ভাবলেন, ব্যাপারটা কত সহজ। ওপরের তাকের বোতলটা নিচে রেখে, নিচেরটা ওপরে রাখা। ভুলটা কি করে হলো, কে করল–এসব কোনভাবেই ধরা পড়বে না, কেউ ঘুনাক্ষরেও সন্দেহও করবে না। অথচ কি সহজভাবে একটা খুন করা সম্ভব। কিন্তু খুন করার পেছনে মোটিভটা কি?

আরও দুচার জায়গায় ব্যাটেল খোঁজ-খবর করেছিলেন। মিসেস বেনসনের প্রতিবেশীদের কারোরই মিস মেরিডিথকে ভালো মনে নেই। তবে মিসেস বেনসন যে গৃহকর্ত্রী হিসেবে মোটেই ভাল ছিলেন না এটা সবারই মনে ছিল। ঝি-চাকরদের সঙ্গে সব সময়ই তিনি খারাপ ব্যবহার করতেন, এমনকি অল্পবয়সী মেয়েরাও টিকত না তার বারিতে, কারণ কি?

ব্যাটেল ভাবনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে এলেন। ট্রেন তখন লণ্ডনের দিকে ছুটে চলেছে।

 ম্যাডাম আমি আপনার স্মৃতিশক্তির সাহায্য চাই পোয়ারোর শান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।

স্মৃতিশক্তি। বেশ অবাক হয় অ্যানা। একটু আগেই রোডার সাথে এরকুল পোয়ারোর বাড়িতে এসেছে সে।

হ্যাঁ। এর আগেই আমি ডাক্তার রবার্টস, মেজর ডেসপার্ড আর মিসেস লরিমারকে একই প্রহ্ন করছিলাম, কিন্তু কেউ আমাকে সঠিক উত্তর, মানে আমি যে উত্তরটা চাইছি, তা দিতে পারেন নি।

অ্যানা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

আপনি সেদিন সন্ধ্যায় মিঃ শেটানের ড্রয়িং রুমটা মনে করার চেষ্টা করুন। আমি জানি ঘটনাটা খুবই বীভৎস, মনে করতে কষ্ট হয়–বোধ হয় আপনি আগে কোনদিন এরকম ভয়ংকর খুনের মুখোমুখি হন নি, তাই না?

হঠাৎ রোডার চেয়ার একটু নড়েচড়ে উঠল।

অ্যানা বলল, ঠিক আছে। কি জানতে চান বলুন?

আপনি মিঃ শেটানের ড্রয়িংরুমের জিনিপত্রগুলোর একটা বর্ণনা দিন। যেমন ধরুন–চেয়ার, টেবিল, আগেকার দিনের অলংকার, দামী দামী পর্দা–এসবগুলোর একটা বর্ণনা চাইছি আমি।

ওঃ এই ব্যাপার। অ্যানা কুঁচকে চিন্তা করল। কিন্তু এতদিন পরে তো সবটা ঠিক মনে করতে পারব না। এমনকি দেয়ালগুলো কি রঙের ছিল তা ভুলে যাচ্ছি–যতদূর মনে পড়ছে দেওয়ালের মাঝে মাঝে কাজ করা ছিল। কতগুলো দামী কম্বল পাতা ছিল মেঝের ওপর। আর মস্তবড় পিয়ানো ছিল একটা। নাঃ, আর কিছু তো মনে পড়ছে না–

ম্যাডাম, একটু ভালো করে চেষ্টা করুন। কিছু কিছু জিনিসের কথা নিশ্চয়ই মনে পড়বে কোন পুরানো যুগের অলংকার, কোন আসবাবপত্র, আকর্ষণীয় কিছু।

হ্যাঁ এখন মনে পড়ছে। অ্যানা আস্তে আস্তে বলে–জানালার পাশে একটা মিশরের গয়নার বাক্স ছিল।

হ্যাঁ, হা, ঘরের শেষ দিকে একটা জানালার ধারে তার উল্টোদিকের টেবিলেই ছুরিটা পড়ে ছিল।

কোন টেবিলে ছুরিটা ছিল–আমি তা জানি না। অ্যানা শান্তভাবে বলে।

তাই নাকি? মনে মনে বললেন পোয়ারো। তাহলে আর আমার নাম এরকুল পোয়ারোই নয়। কারো চরিত্র সম্পর্কে খুঁটিনাটি না জেনে আমি ফাঁদ পাতি না।

হ্যাঁ, নীল আর লাল রং দিয়ে তৈরি। কয়েকটি হীরের আংটি, কয়েকটা কঙ্কনও ছিল–তবে বিশেষ ভাল না। তাছাড়া ঘরটা তো জিনিসপত্রে বোঝাই

এমন কোন কিছু কথা মনে পড়ছে না, যা আপনার নজরে পড়েছিল।

একটা ফুলদানীতে কতগুলো গোলাপ ছিল মনে পড়ছে। বলতে বলতে অ্যানা মৃদু হাসল। তাতে জল পাল্টানো হয়নি।

পোয়ারো চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ।

অ্যানা বলল, হয়ত আপনার পছন্দমত, সঠিক জিনিসটার ওপর নজর দিয়ে দেখিনি।

তাতে কিছু যায় আসে না। মৃদু হাসলেন পোয়ারো।

ভাল কথা, মেজর ডেসপার্ডের সঙ্গে খুব শিগগির কি আপনার দেখা সাক্ষাত হয়েছে?

ভদ্রলোক বলেছিলেন আমাদের সঙ্গে একদিন দেখা করতে যাবেন। অ্যানা বলে ওঠে।

হঠাৎ রোডা বলে ফেলে, আমরা কিন্তু নিশ্চিত, এ কাজ মেজর ডেসপার্ড করেন নি।

পোয়ারো মনে মনে হেসে ফেলে।

ম্যাডাম। অ্যানাকে লক্ষ্য করে পোয়ারো বললেন, আপনি যদি আমার একটা উপকার করেন-ব্যাপারটা অবশ্য সম্পূর্ণই আমার ব্যক্তিগত।

অবাক হয়ে পোয়ারোর দিকে ফিরে তাকাল অ্যানা।

ব্যাপারটা কিছুই নয়। বড়দিন উপলক্ষে আমি আমার নাতনীদের একটা করে উপহার দিতে চাই। কিন্তু আমার পক্ষে আজকালকার মেয়েদের পছন্দ কি, বোঝা মুশকিল।

আচ্ছা, সিল্কের মোজা উপহার দেওয়া চলে কি?

হ্যা, অ্যানা জবাব দেয়, আজকাল সিল্কের মোজা খুবই চলে।

চলে! যাক নিশ্চিন্ত হলাম। পাশের ঘরে টেবিলের ওপর পনের কি ষোল জোড়া মোজা আছে–বিভিন্ন রঙের। যদি আপনি একটু দেখেশুনে ছজোড়া আলাদা করে বেছে দেন।

ঠিক আছে, আমি বেছে দিচ্ছি। উঠে দাঁড়ায় অ্যানা।

পোয়ারো তাকে সঙ্গে নিয়ে পাশের ঘরের টেবিলের সামনে নিয়ে এলেন। টেবিলের ওপর মোজার বান্ডিল, কিছু খালি চকোলেটের বাক্স, গোটা চারেক পশমের দস্তানা ছড়িয়ে আছে।

এই হল মোজার বাণ্ডিল। এর থেকে ছটা বেছে দিন।

তাদের পেছন পেছন রোডাও সেখানে হাজির হয়েছে। পোয়ারো তার দিকে ফিরে তাকালেন। মিস রোডা, এই ফাঁকে আপনাকে আর একটা জিনিস দেখিয়ে আনি, চলুন। সেটা হয়ত আপনার বন্ধুর বিশেষ পছন্দ হবে না

জিনিসটা কি? রোডা কৌতূহলী হয়। পোয়ারো নীচু গলায় বলে ওঠেন, ছোরা।

যে ছোরা দিয়ে বারো জনকে খুন করা হয়েছিল। এক বিখ্যাত হোটেল মালিক আমাকে ছোরাটা উপহার দেন

বীভৎস! শিউরে ওঠে রোডা। ভাবতেই আমার কেমন লাগছে।

চলুন তো দেখে আসি। রোডা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। পোয়ারো তাকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে এলেন। আলমারি খুলে ছোরাটা রোডাকে দেখাতে দেখাতে মিনিট তিনেক কেটে গেল। রোডাকে নিয়ে পোয়ারো যখন পাশের ঘরে আবার এসে ঢুকলেন তখন অ্যানার মোজা বাছা শেষ।

অ্যানা এগিয়ে এল। এই ছটাই আমার বেশ পছন্দ হল মঁসিয়ে পোয়ারো। গাঢ় রঙের গুলো সান্ধ্য পোশাকে ভালো মানাবে। আর হাল্কা রঙের গুলো গ্রীষ্মকালের জন্য।

ধন্যবাদ ম্যাডাম। অসংখ্য ধন্যবাদ।

 অ্যানা আর রোডা শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নেয়। দরজা পর্যন্ত তাদের এগিয়ে দিলেন পোয়ারো। তারপর টেবিলের কাছে ফিরে এলেন। ছটা প্যাকেট আলাদা সরিয়ে রেখে বাকিগুলো গুনে দেখলেন তিনি। মোট উনিশটা প্যাকেট ছিল, কিন্তু এখন পড়ে রয়েছে সতেরটা। পোয়ারো হাসতে হাসতে আপনমনে মাথা দোলালেন।

***

লণ্ডনে ফিরে ব্যাটেল প্রথমে পোয়ারোর সঙ্গে দেখা করলেন। তারপর ঘণ্টা খানেক আগেই অ্যানা আর রোডা বিদায় নিয়েছে।

ব্যাটেল ডেভনশায়ারের সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন পোয়ারোকে। সবশেষে মন্তব্য করলেন ডাক্তার পর্যন্ত ভেবেছে যে এটা অসাবধানতা বশতঃ হয়েছে। ডেভনশায়ারের কেউ এটাকে খুন বলে ভাবে না–এমনকি পুলিশের ধারণা মিস মেরিডিথ নির্দোষ। মিসেস বেনসনের মৃত্যু যে খুন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবে প্রশ্ন হল মিস মেরিডিথ খুনটা করল কেন?

আমি হয়ত এর কারণ সম্পর্কে আপনাকে একটা আভাস দিতে পারবো। পোয়ারো শান্তভাবে বললেন।

কিভাবে মঁসিয়ে পোয়ারো?

আজ বিকেলে আমি একটা ছোট্ট পরীক্ষা করেছি। মিস মেরিডিথ আর তার বন্ধুকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম। অ্যানা মেরিডিথকে সেই একই প্রশ্ন করলাম, মিঃ শেটানের ড্রয়িংরুমে কি কি জিনিস দেখেছিল সে?

আপনি দেখছি ঘুরে ফিরে সেই একটা প্রশ্নতেই জোর দিচ্ছেন?

কারণ আছে। আমি ঐ একটা থেকেই অনেক কিছু জানতে পারি। মিস মেরিডিথ খুবই সন্দেহ প্রবণ। তাই একটা ফাঁদ পাতলাম। মিস মেরিডিথ গয়নার বাক্সটার কথা বলতেই আমি তাকে ছুরিটার কথা জিজ্ঞাসা করলাম। সেটা ঠিক উল্টোদিকের টেবিলেই পড়েছিল। কায়দা করে আমার ফঁদ এড়িয়ে গেল মিরিডিথ এবং এজন্য মনে মনে খুব গর্বও হল তার। স্বাভাবিকভাবেই তার আত্মরক্ষার শক্তি কিছুটা ঢিলে হয়ে গেল। তাহলে তাকে ডেকে আনার কারণ শুধু এই, ছুরিটা সে দেখেছে কি না এটা স্বীকার করিয়ে নেওয়া? তবে তো সে পোয়ারোকে বেশ কঁকিই দিতে পেরেছে, এই ভেবে অ্যানা খুব হাসিখুশী হয়ে উঠলো। সহজভাবে গয়নার বাক্স, ফুলদানীর গোলাপ ফুল–যার জল পাল্টানো হয় নি, এসব গল্প করল মেরিডিথ।

কিন্তু তাতে হলোটা কি? অবাক হন ব্যাটেল।

বুঝলেন না? এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ধরুন আমারা মেয়েটির স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে কিছুই জানিনা। তার কথাবার্তার মধ্যেই তো তার চরিত্রের একটা আভাস পেতে পারি। ফুলের কথাই তার মনে আছে–তার মানে এই নয় যে সে ফুল ভালবাসে, তাহলে আগেই নজর পড়ত সুন্দর টিউলিপের ওপর, এটা হলো মাইনে করা কাজের লোকের কথা–ফুলদানীর জল পাল্টানো যার কাজ। এ হলো একটা পয়েন্ট। তার মধ্যে একটা নারীসত্তাও আছে, গয়না যার খুব প্রিয়–এবার বুঝতে পারছেন কিছু?

হু। গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন ব্যাটেল এতক্ষণে ব্যাপারটা আমার মাথায় ঢুকেছে?

চমৎকার. আপনার মুখে মিস মেরিডিথের পুরোনো জীবনের কথা শুনলাম। আর মিসেস অলিভারের মুখে সেই অদ্ভুত কথাটা শোনার পর থেকেই আমি চিন্তা করতে শুরু করলাম। খুনটা আর্থিক কোন কারণে মিস মেরিডিথ করেনি, কেননা আমরা দেখেছি এখনও তাকে চাকরী করে খেতে হয়। তাহলে আসল কারণটা কি? ওপর ওপর মিস মেরিডিথের স্বাভাব-চরিত্র সম্বন্ধে একটু একটু ভেবে দেখলাম। সাদামাটা শান্ত মেয়ে। গরীব, কিন্তু সৌখীন সাজপোশাকের ওপর ঝোঁক বেশি। ছোট খাট সুন্দর জিনিসের ওপর লোভ। মনের গড়নটা খুনীর সঙ্গে মানায় না, বরং চোরের সঙ্গে খাপ খায়। আপনার মনে আছে, আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মিসেস এল্ডন আগোছালো টাইপের মহিলা কি না। আপনি আমার কথায় সায় দিয়েছিলেন।

হ্যাঁ, তখন তো বেশ অবাক হয়েছিলাম।

আমি এখন ভেবেচিন্তে একটা ধারণা করলাম। ধরে নেওয়া যাক, মিস মেরিডিথ-এর একটা দুর্বলতা আছে। ঐ যে একধরনের মেয়েরা দোকান থেকে জিনিসপত্র চুরি করে–মেরিডিথ খানিকটা সেই ধরণের। হয়ত মিসেস এন্ডনের ঘর থেকে দুল কি ছোটখাট গয়না,অথবা দুএক শিলিং সরাত মিস মেরিডিথ। মিসেস এল্ডন অতসব খেয়াল করতেনও না কিংবা ভাবতেন নিজেই হারিয়ে ফেলেছেন কিন্তু বেনসনের চোখকে ফাঁকি দেওয়া অত সহজ নয়। তার হাতেই ধরা পড়ল মিস মেরিডিথ। তিনি মেরিডিথকে চোর হিসাবে দায়ী করলেন, হয়ত ভয়ও দেখিয়েছিলেন। আগেই আপনাকে বলেছিলেম মেয়েটা একমাত্র ভয় পেয়েই খুন করতে পারে। সে জানত মিসেস বেনসন চোর বলে প্রমাণ করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে বাঁচবার একটাই পথ আছে–মিসেস বেনসনের মৃত্যু। বোতল দুটো এই জন্যই উল্টোপাল্টা করে রাখল–যার ফলস্বরূপ মিসেস বেনসন মারা গেলেন। ভদ্রমহিলা পর্যন্ত মারা যাবার আগে বিশ্বাস করে গেলেন যে তার নিজের ভুলেই ব্যাপারটা ঘটেছে।

হু, তা হতে পারে। মাথা নাড়লেন ব্যাটেল। কিন্তু এ সবই তো অনুমানের ব্যাপার।

না, কেবল অনুমানই নয়। আমি প্রায় নিশ্চিত। আজ বিকেলে একটা পরীক্ষা করলাম। মিস মেরিডিথকে বললাম, উপহার দেবার উপযোগী কয়েকটা সিল্কের সৌখিন মোজা বেছে দিতে। কায়দা করে জানিয়ে দিলাম, টেবিলের ওপর কজোড়া মোজা আছে তা আমার সঠিক জানা নেই। সিল্কের সৌখিন মোজার লোভ এড়ান, মিস মেরিডিথের পক্ষে কঠিন হবে জানতাম। তাকে একলা থাকার সুযোগ দিয়ে বেরিয়ে গেলাম ঘর ছেড়ে। কি হল জানেন? ঊনিশ জোড়ার মধ্যে এখন রয়েছে সতেরটা। বাকি দুজোড়া মিস মেরিডিথের ব্যাগের মধ্যেই অদৃশ্য হয়েছে।

সর্বনাশ! ব্যাটেল অবাক হলেন, সাংঘাতিক ঝুঁকি নিয়েছে তো।

মনস্তত্বটা লক্ষ্য করুন। মেরিডিথের ধারণা আমি তাকে খুনের জন্য সন্দেহ করি। কিন্তু দুজোড়া সিল্কের মোজা চুরিতে কি আসে যায়? আমি তো আর কোন চোরের খোঁজ করছি না। তাছাড়া এরকম বিকারগ্রস্তদের আত্মবিশ্বাস খুব জোরালো। তারা ভাবে সব সময়ই নির্বিঘ্নে কাজ হাসিল করে সরে পড়তে পারবে।

হ্যাঁ। মাথা নাড়লেন ব্যাটেল। ঠিকই বলেছেন আপনি। তাহলে একটা পরিস্কার সিদ্ধান্তে এসে পড়ছি আমরা, চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ায় অ্যানা মেরিডিথ বোতল দুটো বদলে রেখে দেয়। নিঃসন্দেহে এটা একটা খুন, কিন্তু কোর্টে প্রমাণ করা যাবে না। রবার্টসও সন্দেহমুক্ত থাকতে পেরেছেন। কিন্তু আমাদের এখানকার বিবেচ্য বিষয় হল মিঃ শেটানকে খুন করেছে কে? মিস মেরিডিথ কি?

কিছুক্ষণ চিন্তা করে হতাশাভাবে মাথা নাড়লেন ব্যাটেল। না, ঠিক মিলছে না। ঝুঁকি নেবার মেয়ে সে নয়। বোতল দুটো বদলে রাখা সম্ভব–কেননা কেউ ব্যাপারটা ধরতে পারবে না। মিসেস বেনসন একবার ভালো করে দেখলেই ধরতে পারতেন–মিস মেরিডিথের প্ল্যান সফল নাও হতে পারত। একটা চান্স নেওয়া আর কি? হলে হল, না হলে আর কি করা যাবে। কিন্তু শেটানের ব্যাপারটা অন্য। কেউ প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে ঠান্ডা মাথায়, আত্মবিশ্বাসের ওপর খুনটা করেছে।

হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়–দুটো অপরাধের প্রকৃতি সম্পূর্ণ অন্য। পোয়ারো সায় দিলেন।

তাহলে দেখেছি, মিস মেরিডিথ তার প্রথম খুনটার বেলায় সফল হলেও মিঃ শেটানের খুনের ব্যাপারে তার কোন হাত নেই। লিস্ট থেকে তাহলে বাদ যাচ্ছে। ডাক্তার রবার্টস আর মিস মেরিডিথ। ভালো কথা, মিসেস ল্যাক্সমোরের কাছে গিয়েছিলেন আপনি?

 পোয়ারো সব কথা খুলে বললেন তাকে। মেজর ডেসপার্ডের কথা আপনার বিশ্বাস হয় মঁসিয়ে পোয়ারো? মন্তব্য করলেন ব্যাটেল।

হ্যাঁ, আমি বিশ্বাস করি।

আমারও তাই মনে হয়। ভদ্রলোক শুধু ঝগড়ার জন্য অধ্যাপক ল্যাক্সমোরকে খুন করতে পারেন না। সেরকম টাইপের লোক নন তিনি। মিঃ শোন তাহলে এক্ষেত্রে অত্যন্ত ভুল করেছিলেন–এটা আসলে খুন নয়।

পোয়ারোর দিকে ফিরে তাকালেন ব্যাটেল, তাহলে বাকি রইলেন-

 মিসেস লরিমার। পোয়ারোর শান্ত স্বর ভেসে এল।

হঠাৎ শব্দ করে ঘরের এক কোণে রাখা ফোনটা বেজে উঠল। পোয়ারো এগিয়ে গিয়ে রিসিভার তুললেন। কিছুক্ষণ কথাও বললেন কার সঙ্গে। তারপর ফিরে এসে চেয়ারে বসলেন। গম্ভীর থমথমে মুখ।

মিসেস লরিমার ফোন করেছিলেন। পোয়ারো বললেন, ভদ্রমহিলার ইচ্ছে আমি তার সঙ্গে একবার দেখা করি।

মনে হচ্ছে আপনি এই ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলেন? ব্যাটেলের চোখে সন্দেহের ঝিলিক।

কি জানি! উদাস ভাবে বললেন পোয়ারো, হবে হয়ত। কিন্তু আমার অবাক লাগছে–

তাহলে আর দেরি করবেন না। পোয়ারোর কথা শেষ হবার আগে বলে উঠলেন ব্যাটেল, শেষ পর্যন্ত হয়ত কথাটা আপনিই আদায় করে নিয়ে আসবেন।

আসুন আসুন মঁসিয়ে পোয়ারো। আপনি যে এত তাড়াতাড়ি চলে আসবেন, আমি ভাবতেই পারিনি। মিসস লরিমার অভ্যর্থনা জানালেন পোয়ারোকে। প্রায় অন্ধকার বসবার ঘরের একটা সোফায় বসে আছেন মিসেস লরিমার। তাকে আরো শীর্ণ মনে হচ্ছে, একদিনে যেন অরো কয়েক বছর বয়স বেড়ে গেছে।

আপনার কাজে লাগতে পারলে খুশি হব ম্যাডাম, পোয়ারো বলে ওঠে।

দাঁড়ান, আগে চায়ের ব্যবস্থা করি। ঘন্টি টিপে চা আনতে বললেন মিসেস লরিমার।

আপনার মনে আছে মঁসিয়ে পোয়ারো, এর আগের দিন আপনি আমাকে বলেছিলেন আমি ডেকে পাঠালেই আপনি আসবেন। আপনি হয়ত আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিলেন কি প্রয়োজনে আমি আপনাকে ডেকে পাঠাব, তাই না মঁসিয়ে পোয়ারো?

ইতিমধ্যে চা এসে পড়ায়, কাপে চা ঢালতে শুরু করলেন মিসেস লরিমার। বিভিন্ন প্রসঙ্গে পোয়ারোর সঙ্গে কথা বলতে বলতে মিসেস লরিমার আচমকা প্রশ্ন করলেন, সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল তো আমার সম্পর্কে বেশ খোঁজ-খবর করেছেন, কেমন এগোচ্ছে তাঁর কাজ?

ভদ্রলোক ধীরে সুস্থে এগোনই পছন্দ করেন, তবে শেষ অবধি লক্ষ্যে পৌঁছান ঠিকই।

তাই হবে হয়ত! মিসেস লরিমারের মুখে বিদ্রুপের হাসি। আমার ওপর তার বেশ তীক্ষ্ণ নজর আছে। আমার পুরোনো বন্ধুবান্ধব, ঝি-চাকরদের হাজারো প্রশ্ন করে ইতিহাস ঘেঁটে বেড়াচ্ছে–আমার বাচ্চা বয়স থেকে শুরু করে জীবনের ইতিহাস। কিন্তু ভদ্রলোক বোধহয় এখনও তার জ্ঞাতব্য বিষয়টি জেনে উঠতে পারেন নি। আমি তো তাকে মিথ্যে বলিনি, আমার কথাটা বিশ্বাস করলেই ভালো করতেন। মিঃ শেটানের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয় ল্যাক্সামোরে, তারপর এখানে সেখানে দু-চারবার দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে, কিন্তু আমাদের পরিচয় খুব কম। আচ্ছা আপনি আমার সম্বন্ধে কোন খোঁজ খবর করেননি মঁসিয়ে পোয়ারো?

তাতে কোন লাভ হয় না। মাথা নাড়লেন পোয়ারো।

তার মানে?

ম্যাডাম, তাহলে স্পষ্টভাবে সব কথা খুলে বলি। সেদিন সন্ধ্যায় একটা কথা আমি বুঝতে পেরেছিলাম ঘরে যে কজন উপস্থিত ছিলেন তার মধ্যে সবচেয়ে তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, যুক্তিপ্রবণ এবং স্থির মস্তিষ্ক হলেন আপনি। এখন যদি বাজী ধরে বলতে হয় এই চারজনের মধ্যে কোন প্রমাণ না রেখে কে খুন করতে পারে, তবে আমি আপনার ওপরই বাজী ধরব।

এটাকে কি আমি প্রশংসা বলে ধরে নেব?

তার কথায় কান দিলেন না পোয়ারো। একটা অপরাধকে সফল করে তুলতে গেলে সবচেয়ে প্রথমে তার অগ্রপশ্চাৎ, সবকিছু বিচার বিবেচনা করে দেখতে হয়। সম্ভাব্য প্রতিটি বিষয়ে চিন্তা করে নিতে হয়। কেননা সামান্য ভুলের জন্য গোটা প্ল্যানটাই ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। ডাক্তার রবার্টস অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের জন্য বেঁকের মাথায় কিছু একটা করে বসতে পারেন। মেজর ডেসপার্ড ফলাফল না ভেবে কোন কাজ করেন না, তিনি এ ধরনের কাজ করতে পারেন বলে মনে হয় না আমার। মিস মেরিডিথ হয়ত ভয় পেয়ে কোন কিছু করতে পারেন। কিন্তু সেরকম এক্সপার্ট না হওয়ায় হয়ত নার্ভাস হয়ে শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে যাবেন। কিন্তু আপনি এর কোনটাই করবেন না। আপনার বুদ্ধি স্বচ্ছ, মস্তিষ্ক স্থির, এবং আপনি দৃঢ়চেতা।

মিসেস লরিমার মিনিট কয়েক চুপ করে রইলেন। তার মুখে চোখে এক অদ্ভুত হাসি খেলা করছে।

তাহলে আপনার ধারণা অনুযায়ী আমিই হলাম সেই মহিলা যে কি না নিখুঁত প্ল্যান করে ঠাণ্ডা মাথায় একজনকে খুন করতে পারে

অন্তত এই প্ল্যানকে বাস্তবে রূপ দিতে পারেন আপনি। সেই ক্ষমতা আপনার আছে।

বেশ মজার ব্যাপার। তাহলে, ব্যাপারটা দাঁড়ালো যে একমাত্র আমিই শেটানকে খুন করতে পারি? পোয়ারোর শান্ত স্বর ভেসে আসে, এখানেই একটা অসুবিধা আছে, ম্যাডাম।

কি অসুবিধা মঁসিয়ে পোয়ারো?

একটু আগে আমি যে কথাটা বললাম নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে। কোন অপরাধ সফল করতে হলে সচরাচর সমস্ত খুঁটিনাটি পরিকল্পনা আগে থেকেই ভেবে রাখতে হয়। সচরাচর কথাটা মনে রাখবেন। কারণ আর এক ধরণের সফল অপরাধ করা সম্ভব। ধরুন, আপনি আচমকা কাউকে ঢিল ছুঁড়ে দূরের একটা গাছের গুঁড়িতে লাগাতে বললেন। যাকে বললেন সে হয়ত না ভেবেচিন্তেই ঢিলটা ছুঁড়ে বসল এবং সত্যি সত্যি লক্ষ্যভেদ করতে পারল। একবার সফল হয়েই সে যদি ঐ ঢিল ছুঁড়তে যায় দেখা যাবে ব্যাপারটা আর ততখানি সহজ হবে না। কারণ তখন সে চিন্তা করতে শুরু করেছে। ঢিলটা ছোঁড়ার আগে মনে হচ্ছে একটু ডানদিকে আবার পরক্ষণেই মনে হচ্ছে না না, একটু বাঁদিক ঘেঁষেই ছোঁড়া উচিত। প্রথমটা ছিল অবচেতন প্রক্রিয়া, যেখানে শারীর মনের হুকুম তামিল করেছিল। এই হল এক ধররের ক্রাইম–থেমে, ভেবে দেখবার কোন সময় নেই–এক মুহূর্তেই ঘটে যায়। বলতে বাধা নেই মিঃ শেটানের খুনের পিছনেও এ ধরনেরই একটা মনোভাব কাজ করেছিল।

হঠাৎ একটা প্রয়োজনে না ভেবে-চিন্তে, দ্রুত কাজটা ঘটে গেল। আপনার স্বভাবের সঙ্গে ঠিক এ ধরনের ক্রাইম খাপ খায় না। আপনি শেটানকে খুন করতে চাইলে, খুব ভাল ভাবে পরিকল্পনা নিয়ে খুনটা করবেন।

তাই বুঝি! মিসেস লরিমারের মুখে সেই অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠলো। আপনি বলতে চাইছেন যেহেতু এটা আগে থেকে পরিকল্পনা করা কোন খুন নয়–অতএব আমি শোনকে খুন করিনি।

ঠিক তাই, ম্যাডাম। পোয়ারো ঘাড় নাড়লেন।

কিন্তু তবুও– মিসেস লরিমার সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলে ওঠেন, সিয়ে পোয়ারো, আমিই শেটানকে খুন করেছি।

অনেকক্ষণ দু-জনেই চুপচাপ। একটা অস্বস্তিকর চাপা নীরবতা ঘরের বাতাস ভারী করে তুলেছে, বাইরের অন্ধকার আরো ঘনিয়ে এসেছে। পোয়ারো এবং মিসেস লরিমার দুজনেই ফায়ার প্লেসের দিকে তাকিয়ে আছেন, সময়ও যেন থমকে রয়েছে সেখানেই।

নীরবতা ভাঙলেন পোয়ারো। তাহলে এই হল আসল ঘটনা। কিন্তু ম্যাডাম, কেন আপনি শেটানকে খুন করলেন?

কারণটা আপনি নিশ্চয়ই অনুমান করতে পেরেছেন মঁসিয়ে পোয়ারো

শোন তাহলে আপনার অতীত জীবনের কোন গোপন ঘটনা জানতেন এবং সে ঘটনা সম্ভবত কোন মৃত্যু তাই না মিসেস লরিমার?

মিসেস লরিমার চুপ করে রইলেন। বোঝা গেল মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ।

আজ কেন এ কথা বললেন আমাকে? ডেকেই বা পাঠালেন কেন?

একদিন আপনিই বলেছিলেন, কোন সময়ে হয়ত আমি আপনাকে ডেকে পাঠাতে পারি।

হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক। আমি জানতাম আপনি যদি নিজে থেকে কোন কথা না বলেন তবে কোনদিনই আপনার মুখে থেকে কেউই কিছু আদায় করতে পারবে না। আমার মনে হয়েছিল, অথবা বলতে পারেন একটা সম্ভাবনা ছিল হয়ত কোনদিন নিজের সম্বন্ধে কথা বলবার ইচ্ছে আপনার মধ্যে জেগে উঠতে পারে।

বিমর্ষভাবে মাথা নাড়লেন মিসেস লরিমার। আপনি দূরদর্শী, তাই ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন।

সেদিন ডিনার টেবিলে মিঃ শেটান যে কথা বলেছিলেন, সেটা কি আপনাকে উদ্দেশ্য করেই বলেছিল বলে আপনার ধারণা? শান্ত গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করেন পোয়ারো।

হ্যাঁ, মিঃ শোন বলেছিলেন বিষই হল মেয়েদের প্রধান অস্ত্র। কথাটা আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলা। এর আগেও একদিন অনেকের সামনে এই ধরনের একটা মামলার কথা বলবার সময় তিনি আমাকে লক্ষ্য করেছিলেন। আমার কেমন একটা সন্দেহ হয়েছিল মিঃ শেটান আমার গোপন ব্যাপারটা জানেন, সেদিনই সন্দেহটা দৃঢ় হল। নিশ্চিত হলাম যে, ব্যাপারটা আর অজানা নেই।

ভদ্রলোকের ভবিষ্যৎ ইচ্ছাটাও কি আপনি বুঝতে পেরেছিলেন?

সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল আর আপনার উপস্থিতি যে দৈবাৎ হয়েছে এমন কথা বিশ্বাস করা শক্ত। আমি তা বুঝে নিলাম, এরপর মিঃ শোন বাহাদুরী দেখিয়ে বলবেন, যা কেউ কোনদিন পারেননি আজ তিনি তাই পরিষ্কার করতে পেরেছেন।

মিঃ শেটানকে খুন করবেন,কখন ঠিক করলেন?

অল্প ইতস্তত করেন মিসেস লরিমার, কখন যে ঠিক করলাম বলা শক্ত। তবে ডিনারে যাবার আগেই ছোরাটা আমার নজরে পড়েছিল। ডিনার শেষ করে ড্রয়িংরুমে ফিরে আসার সময় সকলের চোখ এড়িয়ে ছোরাটা তুলে আমার আস্তিনে লুকিয়ে রেখেছিলাম কেউই দেখতে পায়নি ব্যাপারটা।

এ যে একেবারে নিপুণ শিল্পীর মত হাত সাফাই। মন্তব্য করলেন পোয়ারো।

তখনই আমি মনস্থির করে ফেললাম। কাজটা নিঃসন্দেহে খুব ঝুঁকির। কিন্তু আমার তো আর কোন উপায় ছিল না।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মিসেস লরিমার পুরোনো কথার খেই ধরে বলতে লাগলেন-ব্রীজের আসর বসল। খেলা এগিয়ে চলেছে। একসময় সুযোগ এসে গেল। আমি তখন ডামি। পায়চারি করার ভান করে ফায়ার-প্লেসের কাছে হাজির হলাম। চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছিলেন মিঃ শেটান, অন্য তিনজনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, প্রত্যেকেই তাসে মগ্ন। ব্যাস! সুযোগ হাতছাড়া করলাম না-ঝুঁকে পড়ে হৃৎপিণ্ড তাক করে ছুরি চালালাম-

মিসেস লরিমারের গলার স্বর অল্প কেঁপে উঠল। ঠিক তখনই একটা মতলব মাথায় এলো। অন্যের সন্দেহের হাত থেকেও তো বাঁচতে হবে-মিঃ শেটানের সঙ্গে কথা বলার ভান করলাম। পুরোনো দিনের ফায়ার-প্লেসের সম্পর্কে কয়েকটা মন্তব্য করলাম। চুপ করে থাকলাম কিছুক্ষণ–লোকে জানুক অমি তার উত্তরের অপেক্ষা করছি। শেষে বললাম, হ্যাঁ, আমিও তার সঙ্গে একমত-ঘর গরম রাখতে আধুনিক রেডিয়েটারের চেয়ে পুরোনো আমলের চুল্লিই ভাল।

মিঃ শোন কোন চিৎকার করলেন না?

না। কেবল তার গলা দিয়ে একটা মৃদু ঘড়ঘড় শব্দ শোনা গেল। অন্য খেলোয়াড়রা মনে করতে পারে শেটান আমার কথার জবাব দিচ্ছেন। এরপর ব্রীজের টেবিলে গেলাম। তখন সেখানে শেষ তাসটা খেলা হচ্ছে।

আপনি সোজা গিয়ে খেলতে শুরু করলেন?

 হ্যাঁ।

এবং এমন গভীর মনোযোগ দিয়ে খেলোম যে এই ঘটনার দুদিন পরেও আমার কাছে সমস্ত তাসের বিবরণ ছবির মতো বলে যেতে একটুও অসুবিধা হল না। তাসের কথা আমি ভুলি না সহজে। মৃদুস্বরে জবাব দিলেন মিসেস লরিমার।

কিন্তু ম্যাডাম, অমি যে একটা সূত্রের হদিস পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে কোথাও ভুল হচ্ছে। আপনি ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করেন। সবকিছু আগে-ভাগে যাচাই করে নেওয়া আপনার স্বভাব। আপনি হঠাৎ ঠিক করলেন,আপনাকে সাংঘাতিক একটা ঝুঁকি নিতে হবে, অন্য কোন পথ নেই। ঝুঁকি নিলেন এবং সফলও হলেন। অথচ ঠিক দুসপ্তাহ বাদে আপনার মত বদলে গেল–এখন আপনি ধরা দিতে প্রস্তুত–পুরো ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না।

মিসেস লরিমারের মুখে বাঁকা হাসি দেখা দিল, হ্যাঁ। এর মধ্যে একটা ব্যাপার আপনার ঠিক জানা নেই মঁসিয়ে পোয়ারো। সেদিন মিস মেরিডিথের সঙ্গে আমার হার্লে স্ট্রীটে দেখা হয়েছিল।

হু, পোয়ারো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে রইলেন, আমি এখন যেন কিছুটা বুঝতে পারছি।

সেখানে আমি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিনি আভাস-ইঙ্গিতে যা বললেন, আমি আগেই তা আঁচ করেছিলাম। মিসেস লরিমারের মুখে একটা শান্ত কোমল হাসি দেখা দিল।

আর বেশি ব্রীজ আমি খেলবো না। খুব সাবধান থাকলে নিয়ম মেনে চললে কয়েক বছর আমি বেঁচে থাকতে পারি। যাই হোক, সে নিয়ে আমি মাথা ঘামাতে চাই না। বিশেষজ্ঞের চেম্বার থেকে বেরিয়ে মিস মেরিডিথের সঙ্গে দেখা, একসাথে চা খেলাম আমরা। মিসেস লরিমার মিনিট খানেক চুপ করে রইলেন।

সেদিন চা খেতে খেতে অনেক চিন্তা করলাম। আমার কাজের ফলে মিঃ শেটানের প্রাণটাই শুধু গেল না আরও তিনজনের জীবন নিয়ে টানাটানি, শেটানের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। কিন্তু বাকি তিনজন? তারা তো আমার কোন ক্ষতি করেনি। আমার স্বীকারোক্তিতে তারা তো মুক্তি পাবেন। অবশ্য মেজর ডেসপার্ড বা ডাক্তার রবার্টস এদের জন্য মাথাব্যথা নেই। অ্যানা মেরিডিথ একেবারে অল্পবয়সী। কিছু হলে তার গোটা জীবনটাই নষ্ট হয়ে যেতে পারে–এ আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারব না। তাই ভাবনা-চিন্তা করেই আপনাকে ফোন করলাম।

ঘরের মধ্যে আবার সেই থমথমে নীরবতা নেমে এল। কেউই কোন কথা বলছেন না। এরকুল পোয়ারো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মিসেস লরিমারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু মিসেস লরিমারের মুখে কোন ভাবান্তর নেই।

মিসেস লরিমার আপনি ঠিক বলছেন? আগে থেকে প্ল্যান করে আপনি সেদিন সন্ধ্যায় মিঃ শেটানের বাড়িতে হাজির হন নি? এটা আগে থেকে প্ল্যান করা খুন নয়? পোয়ারোর উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল।

একমুহূর্ত পোয়ারোর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন মিসেস লরিমার, তারপর মাথা নাড়লেন, না। নিশ্চয়ই না।

তাহলে ম্যাডাম, খুব দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি–আপনি নিশ্চয়ই আমাকে মিথ্যে বলেছেন।

মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি ভুল করছেন। মিসেস লরিমারের কণ্ঠস্বর বরফের মত ঠাণ্ডা শোনাল।

পোয়ারো অধৈৰ্য্যভাবে চেয়ার ছেড়ে ঘরের মধ্যে বিড়বিড় করতে করতে কয়েক পাক পায়চারি করলেন। হঠাৎ দেওয়ালের দিকে এগিয়ে গিয়ে সুইচ টিপে আলো জ্বালাতেই উজ্জ্বল অপোয় সারা ঘর ভরে উঠল।

আবার নিজের জায়গায় ফিরে গিয়ে বসলেন পোয়ারো। দুই হাত হাঁটুতে রেখে তাকিয়ে রইলেন মিসেস লরিমার-এর দিকে।

এরকুল পোয়ারো কি কখনও ভুল করতে পারে?