২. মেজর ডেসপার্ডের ডিল ছিল

পরের বার মেজর ডেসপার্ডের ডিল ছিল, তিনি পাস দেন। আমি একটা নো-ট্রাম্প দিয়ে ডাক শুরু করলাম। রবার্টস আবার লাফিয়ে বললেন, তিনটে হার্ট। আমার পার্টনার পাস দিলেন। মেজর ডেসপার্ড ডাকলেন চারটে হার্ট। আমি ডবল দিলাম। দুটো শর্ট দিলেন ওরা। পরের তাসে আমরা চারটে স্পেড ডাকলাম কিন্তু একটা ডাউন হয়ে গেলো।

মিসেস লরিমার পরের স্কোরশিটটা তুলে নিলেন।

পোয়ারো বললেন, মেজর ডেসপার্ড কেমন কেটে কেটে লিখেছেন, স্কোর দেখে তাসগুলো মনে করা শক্ত হবে।

যতদূর মনে পড়ছে, প্রথম দুটো ডিলে দুপক্ষই পঞ্চাশ করে শর্ট দিয়েছিলাম। তারপর ডাক্তার রবার্টস পাঁচটা ডায়মণ্ড ডাকলেন। আমরা ডবল দিয়ে তিনটে শর্ট নিলাম। পরের তাসটা আমরা খেলোম তিনটে ক্লাবে। এরপরে ওরা স্পেডে গেম খেলে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে পাঁচটা ক্লাবে গেম করলাম আমরা। পরের তাসটায় শর্ট দিলাম একশো। ওরা আবার একটা হার্ট খেলে গেলেন। কিন্তু পরপর দুটো তাস যথাক্রমে দুটো নো-ট্রাম্প এবং চারটে ক্লাবের খেলা করায় গেম হয়ে গেল। রাবারও পেলাম।

তৃতীয় স্কোরশিটটা তুলে নিলেন মিসেস লরিমার। এই রাবারটা দারুণ উত্তেজনায় হয়েছিল। খুব শান্তভাবে। মেজর ডেসপার্ড আর মিস মেরিডিথ প্রথমে একটা হার্টের খেলা করলেন। তারপর আমরা হার্ট ও স্পেডে গেম ডেকে একটা করে শর্ট দিলাম। ওরা স্পেডে গেম করলেন। রাবার বাঁচাবার আশা খুব কম। এরপর তিনটে তাস একটা দুটো করে শর্ট দিলাম আমরা। অবশ্য ওরা কেউ ডবল দেননি। শেষে আমরা নো-ট্রাম্পে গেম খেলোম। তখন থেকেই যুদ্ধ শুরু হলো। কেউ কাউকে সহজে ছেড়ে দিতে চায় না। ফলে প্রত্যেকেই ডাউন দিতে লাগলাম। ডাক্তার রবার্টসের বীটের তোড়ে একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন মেরিডিথ। তাস ভালো থাকলেও বেশি বীট দিতে ভরসা পাচ্ছিলেন না। এরপ পরেই ডাক্তার রবার্টস গেম ফোর্সিং দুটো স্পেড দিয়ে ডাক শুরু করলেন। আমি বললাম তিনটে ডায়মন্ড। তিনি ডাকলেন চারটে নো-ট্রাম্প। আমি পাঁচটা স্পেড, হঠাৎ ডায়মন্ডে গ্র্যান্ডস্ল্যাম ডেকে বসলেন রবার্টস। ডেসপার্ডও মুখিয়েছিলেন, বললেন ডবল। হার্ট লিডে তাসটায় তিনটে শর্ট ছিল। ভাগ্য ভাল লিড হল ক্লাবের সাহেব। ফলে খেলা হয়ে গেল। দারুণ উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে শেষ হল রাবারটা।

হায় ভগবান! ভালনারেবল গ্র্যান্ডস্ল্যামের খেলা, তার ওপর ডবল! আমি হলে ছয় সাতের ডাকে না গিয়ে গেমেই সন্তুষ্ট থাকতাম।

তা কেন? হাতে ভালো তাস থাকলে নিশ্চয়ই ছয়-সাতের ডাকে যাবেন।

 আপনি তাহলে ঝুঁকি নেবার পক্ষে?

ডাক নির্ভুল হলে ঝুঁকির কোন প্রশ্নই আসে না। এ তো সোজা হিসেব। তবে খুব কম লোকই নির্ভুল বিট দিতে পারে। প্রথমটা হয়ত ঠিকঠাকই শুরু করে কিন্তু শেষরক্ষা করে উঠতে পারে না। সে যাই হোক–এবার চতুর্থ স্কোরশিটটা হাতে নিলেন মিসেস লরিমার, এটাতে ঠিকমত খেলা হচ্ছিল না, কেমন যেন ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে চলছিল। বোধহয় আগের খেলাটা অত উত্তেজনা পূর্ণ হওয়াতে পরেরটা ভাল হচ্ছিল না।

পোয়ারো স্কোরগুলো ভাঁজ করে পকেটে রাখলেন, সত্যি ম্যাডাম, আপনার স্মৃতিশক্তির তুলনা নেই। প্রত্যেকটা তাস বোধহয় আপনার ছবির মত মনে আছে?

তাই তো মনে হয়!

স্মৃতিশক্তি সত্যি একটা অসামান্য উপহার, আমার মনে হয় অতীত বোধহয় আপনার কাছে নতুন, প্রতিটি খুঁটিনাটি ঘটনা মনে হয় সবেমাত্র গতকালের তাই না?

মিসেস লরিমার চকিতে পোয়ারোর দিকে তাকালেন, বড় বড় চোখে হঠাৎ অন্ধকার নেমে এল। কিন্তু কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিলেন, মিসেস লরিমার। কিছুই পোয়ালোর নজর এড়ালো না। নিঃসন্দেহে তার তীর লক্ষ্যভেদ করেছে।

কিছু মনে করবেন না। উঠে দাঁড়ালেন মিসেস লরিমার আমি তো আর অপেক্ষা করতে পারছি না, এক্ষুনি বেরোতে হবে। আপনার কাজেও কোন সাহায্য করতে পারলাম না–

তা কেন? আমি যা জানতে চাইছিলাম আপনার কথা থেকেই আমি পেয়ে গেছি পোয়ারো তাকালেন মিসেস লরিমারের দিকে।

মিসেস লরিমার কিন্তু কোন কথা বললেন না। তিনি কি বলেছেন পোয়ারোই বা কি জানতে চেয়েছিলেন এ সম্পর্কে তার কোন কৌতূহলই নেই।

আমি আজ বিদায় নিচ্ছি মিসেস লরিমার। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। একটা কথা–আপনি ডেকে না পাঠালে আমি কোনদিনই আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করতে আসব না।

কিন্তু মঁসিয়ে পোয়ারো, আমিই বা কেন আপনাকে ডেকে পাঠাব? মিসেস লরিমার জিজ্ঞাসা করলেন।

হয়ত পাঠাবেন, কেমন যেন মনে হচ্ছে আমার। যদি ডেকে পাঠান নিশ্চয়ই আমি আসব।

পোয়ারো বিদায় নিয়ে রাস্তায় পা বাড়ালেন। হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ল মিসেস লরিমার প্রথমে তার প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হননি পরে উত্তর দিলেন। আমার অনুমান ভুল নয় বিড় বিড় করলেন পোয়ারো–ওরকমটাই হবে।

মিসেস অলিভার খুব কষ্টে টু-সিটার গাড়ি থেকে রাস্তায় নামলেন। বেশ কিছুটা সামনে এগোবার পর ওয়েভন কুটীর-এর দেখা মিলল। দু-কামরার বাঙলো প্যাটার্নের একটা বাড়ি। দরজার বেল টিপলেন। ভেতর থেকে কোন সাড়াশব্দ এল না। আরও দু চারবার বেল টিপেও কোন কাজ হল না। মনে হয় ভেতরে কেউ নেই।

অগত্যা মিসেস অলিভার বাইরের বাগানের মধ্যে কিছুক্ষণ পায়চারি করলেন। বাগানের পাশেই ফাঁকা মাঠ। একটু পরেই সেদিক থেকে দুজন তরুণীকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। কাছাকাছি হতেই মিসেস অলিভার এগিয়ে গেলেন ভালো আছেন মিস মেরিডিথ? আমাকে চিনতে পারছেন নিশ্চয়ই?

নিশ্চয়ই! অ্যানা মেরিডিথ করমর্দন করলেন সুপ্রভাত! কিন্তু মেরিডিথের চোখের তারায় আতঙ্ক ফুটে উঠল, নিজেকে সামলাতে সময় লাগল তার।

এই হচ্ছে আমার বন্ধু রোড, রোডা দোবাস। আমরা এক সঙ্গেই থাকি। মিস মেরিডিথ আলাপ করিয়ে দিলেন।

মিস দোবাস সুন্দরী মেরিডিথের চেয়ে কিছুটা লম্বা। রোড উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল, আপনিই বিখ্যাত লেখিকা মিসেস অলিভার?

মাথা নাড়লেন মিসেস অলিভার, তারপর ফিরে তাকালেন মিস মেরিডিথের দিকে। অনেক কথা আছে আমার, কোথাও বসতে পারলে ভাল হত।

মেরিডিথ তাকে পথ দেখিয়ে ড্রয়িং রুমে নিয়ে গেলেন।

চেয়ারে বসতে বসতে মিসেস অলিভার বললেন, আমি গতদিনের খুনের ব্যাপারে আলোচনা করতে এসেছি। আমার মনে হয় এ-ব্যাপারে কিছু করা উচিত আমাদের।

করা উচিত? তার মানে? মিস মেরিডিথ অবাক হলেন।

আলবাত। দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করলেন মিসেস অলিভার এটা কার কীর্তি আমি নিঃসন্দেহে জানি। ঐ যে ডাক্তার, কি যেন নামটা–রবার্টস। হ্যাঁ, আমার দৃঢ় বিশ্বাস ঐ হল আসল অপরাধী। ভদ্রলোক নিশ্চয়ই ওয়েলসের অধিবাসী। ওদের আমি জীবনেও বিশ্বাস করি না। আমার অসুখের সময় একজন নার্স রেখেছিলাম, সেও জাতে ওয়েলস। মেয়েটি একদিন কি করল জানেন! তিন রকমের তিনটে মিক্সচার একঘন্টা অন্তর অন্তর পর পর তিনবার খাওয়ার কথা। কিন্তু সে ভুল করে একই মিক্সচার পর পর তিনবার খাইয়ে দিল। কোন দায়িত্বজ্ঞান আছে? আমি নিশ্চিত, ঐ রবার্টর্স ছাড়া আর কারো কাজ নয়। এখন শুধু প্রমাণের অপেক্ষা-

আচমকা খিল খিল করে হেসে উঠল রোডা। মাপ করবেন–নিজেকে সামলাতে পারলাম না। আসলে আমি আপনাকে মনে মনে যেরকম কল্পনা করেছিলাম তার সঙ্গে কিন্তু আপনার কোন মিল নেই।

সবাই এরকমটাই বলে। সে যাকগে। এখন আমাদের প্রধান কর্তব্য হল রবার্টসের অপরাধের প্রমাণ খোঁজা–তাও করতে হবে নিজেদের বাঁচতে। আপনাকে কেউ খুনি বলে সন্দেহ করুক নিশ্চয়ই আপনি তা চান না মিস মেরিডিথ?

মিস মেরিডিথ ফ্যাকাশে হয়ে উঠল, কেন? আমাকে সন্দেহই বা করবে কেন?

সাধারণ লোক তাই ভাবে। খুনের সঙ্গে জড়িত অন্য তিনজনকেও তারা সমান সন্দেহ করে।

অ্যানা মেরিডিথের শান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, আপনি আমার কাছে কি জন্য এসেছেন মিসেস অলিভার?

কার কাছে যাব? মিসেস লরিমার সারাদিন ক্লাবে বসে ব্রীজ খেলেন, তার দেখা পাওয়া ভার। তাছাড়া নিজেকে বাঁচানোর মত যথেষ্ট বুদ্ধি আর সাহস তার আছে। মিসেস লরিমারের যথেষ্ট বয়স হয়েছে। কে কি ভাবল না ভাবল তাতে তার কিছু আসে যায় না। আর মেজর ডেসপার্ড হলেন পুরুষ। পুরুষদের নিয়ে আমার কোন মাথাব্যাথা নেই। এরা নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরা করে নিতে পারবে। কিন্তু আপনি? আপনি একজন সুন্দরী তরুণী–সমস্ত ভবিষ্যৎ যার সামনে পড়ে আছে। আমার তো আপনাকে নিয়েই বেশি চিন্তা।

ঠিক এ-কথাটাই আমিও বলি। তাছাড়া চুপচাপ বসে থেকে কিছু একটা করা তো ভাল। রোডা মন্তব্য করল।

আমরা এখন তিনজন–তিনজনই নারী। দেখা যাক আমাদের সকলের চেষ্টায় কিছু হয় কি না?

আচ্ছা ডাঃ রবার্টসই যে খুনি একথা ভাবছেন কেন? মিস মেরিডিথ শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করল।

এ-ধরনের কাজের পক্ষে একমাত্র উপযুক্ত লোক তিনি। মিসেস অলিভারের নির্বিকার কণ্ঠস্বর ভেসে এল।

সে ক্ষেত্রে ডাক্তার হিসাবে বিষটাকেই বেছে নেওয়ার কথা–

না না, মোটেই তা নয়। বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হলে ডাক্তারের উপরেই তো সকলের সন্দেহ হবে। ডাক্তার কি অত কাঁচা? আটঘাট বেঁধেই কাজ করেছেন। মাথা দোলালেন মিসেস অলিভার।

তা ঠিক। মেরিডিথ সম্মতি জানালেন, তবে রবার্টস কেনইবা শেটানকে খুন করতে যাবেন?

কত কারণ হতে পারে। হয়ত শেটান অনেক টাকা ধার দিয়েছেন ডাক্তার রবার্টসকে। সেটা শোধ করতে বলায় রবার্টস খুন করলেন তাকে। আবার হয়ত শেটানের কোন নিকট আত্মীয়াকে বিয়ে করেছেন রবার্টস। শেটানের মৃত্যুতে সেই আত্মীয়াটি সব টাকাপয়সা পেয়ে যাবেন–রবার্টস তো বটেই। আর-আর এরকমও হতে পারে শেটান এমন কোন কথা, মানে ডাঃ রবার্টসের কোন গোপন ঘটনা জেনে ফেলেছিলেন। শেটান সেদিন সন্ধ্যায় এরকম একটা কথাও বলেছিলেন, মনে পড়ছে?

মুহূর্তে অ্যানার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। না তো, কিছুই মনে পড়ছে না আমার

আরে–ভুল করে রুগীকে বিষাক্ত ওষুধ খাইয়ে দেওয়া না কি যেন একটা বললেন মনে পড়ছে না আপনার?

বাঁ হাত দিয়ে শক্তভাবে চেয়ারের হাতলটা চেপে ধরল অ্যানা, হ্যাঁ। ঐরকমই কি একটা–অ্যানার ঠিক মনে নেই।

অ্যানা। রোডা বন্ধুর দিকে তাকালেন, এটা গরমকাল নয়। একটা কোট অন্তত গায়ে দিয়ে আসা উচিত ছিল তোর।

মিস মেরিডিথ একটু বিরক্ত হয়ে তাকাল রোডার দিকে।

তাহলে আমার থিওরিটা বুঝতে পারছেন তো? মিসেস অলিভার বলে চললেন লোকে জানল যে ডাঃ রবার্টসের রুগী নিজে ভুলে ওষুধের বদলে বিষ খেয়ে মারা গেছে। আসলে তো সবটাই সাজানো-রবার্টসের কীর্তি। কে জানে এভাবে আরও কত পেশেন্টকে খুন করবেন তিনি!

অবাস্তব–পুরো থিওরিটাই অবাস্তব। এভাবে খুন করে চললে তার নিজেরই তো ক্ষতি–পশার কমে যাবে। মিস মেরিডিথ শক্ত গলায় বলে ওঠেন।

নিশ্চয়ই, গভীর কোন কারণ আছে এর পেছনে।

আপনি ঠিকই বলেছেন মিসেস অলিভার, বলে ওঠে রোড, আপনার আইডিয়াটা দারুণ। ঠিক, একজন ডাক্তারই তো এভাবে খুনটা করতে পারে।

কথার মাঝখানে অ্যানা চেঁচিয়ে উঠল, হা, হা, আমার মনে পড়েছে। মিঃ শোন সেদিনের পার্টিতে ডাক্তারদের সম্বন্ধেই কি যেন একটা বলছিলেন, কি একরম বিষ আছে যা ল্যাবরেটরীর পরীক্ষতে ধরা পড়ে না

ভুল করছেন, শেটান নয়, একথা বলেছিলেন মেজর ডেসপার্ড। আরে, নাম করতে না করতেই ভদ্রলোক একেবারে হাজির। মিসেস অলিভার বেশ অবাক হলেন। বাগানের পথ ধরে ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে দেখা গেল মেজর ডেসপার্ডকে।

মিসেস অলিভার বেরিয়ে এলেন ওয়েভেন কুটীর থেকে। গাড়ির দিকে এগোতে এগোতে মৃদু হাসলেন তিনি। বেশিক্ষণ মিস মেরিডিথের ওখানে থাকা উচিৎ হয়নি তার। মেজর ডেসপার্ড রীতিমত অস্বস্তি বোধ করছিলেন মিসেস অলিভারকে দেখে। তাই দুই বন্ধু এগিয়ে গেল বাড়ির দিকে।

মিস মেরিডিথ মজর ডেসপার্ডের কাছে দেরি হওয়ার জন্য ক্ষমা চাইতেই ডেসপার্ড বলে উঠলেন মিস মেরিডিথ, অযথা সময় নষ্টের দরকার নেই। আমার আসার কারণটা বলি। আপনার ঠিকানা আমি সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেলের কাছ থেকে পেয়েছি। ব্যাটেলও এখানেই আসছেন। আমি তাকে প্যাডিংটন স্টেশানে অপেক্ষা করতে দেখেছি। তাড়াতাড়ি গাড়ি হাঁকিয়ে চলে এলাম। জানতাম ট্রেনের আগে এসে পৌঁছব।

কিন্তু এত তাড়াহুড়োর কি প্রয়োজন ছিল?

নিশ্চয়ই। আপনি একলা, আপনাকে সাহায্য করা দরকার।

কেন? আমিই তো আছি। রোডা ফোঁস করে উঠল। মেজর ডেসপার্ড তাকালেন রোডার দিকে। সত্যিই রোডা হল অ্যানা মেরিডিথের প্রকৃত বন্ধু।

আমি জানি, মিস দোবাস, আপনার মত বন্ধু পৃথিবীতে দুর্লভ। আপনাদের দুজনের বয়স অল্প। ঐ খুনের সঙ্গে জড়িত চারজনের মধ্যে মিস মেরিডিথ একজন। সুতরাং অন্যান্য সকলের সঙ্গে তিনিও সন্দেহের আওতায়। এরকম অবস্থায় আপনাদের একজন অভিজ্ঞ লোকের সাহায্য প্রয়োজন। আমার মতে মিস মেরিডিথ, আপনার উচিত কোন অভিজ্ঞ সলিসিটারের সঙ্গে যোগাযোগ করা। কোন চেনা-শোনা সলিসিটার আছে?

মিঃ বারী নামে একজন সলিসিটার আছেন, তবে প্রায় একশোর কাছাকাছি বয়স, তেমন বলতে চলতে পারেন না- রোডা বলে ওঠে।

আপত্তি না থাকলে আমার সলিসিটার মিঃ মেহর্নের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারেন। ফার্মের নাম জ্যাকব অ্যান্ড জ্যাকব। এদের ফী-ও খুব বেশি নয়।

এসবের কোন প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না। তাছাড়া টাকা-।

না, না, টাকার জন্য তোর কোন চিন্তার কারণ নেই অ্যানা। বাধা দিয়ে বলে ওঠে রোড, সে সব হয়ে যাবে। সত্যিই মেজর ডেসপার্ড আপনি সঠিক উপদেশই দিয়েছেন।

ঠিক আছে। তাহলে যা বলছেন তাই করব। অ্যানা শান্ত গলায় জানায়।

এই তো লক্ষ্মী মেয়ের মত কথা। রোড মন্তব্য করে, তারপর আচমকা প্রশ্ন করে, মেজর ডেসপার্ড, আপনার কাকে খুনি বলে মনে হয়–মিসেস লরিমার না ডাঃ রবার্টস?

কেন? আমিও তো খুনটা করে থাকতে পারি। মেজর ডেসপার্ড ম্লানভাবে হাসলেন।

আপনি? কক্ষনো না। আমরা বিশ্বাস করি না। রোডা মাথা বাঁকিয়ে বলে।

প্রমাণ না পেয়ে সবকিছুকেই সত্যি বলে ভেবে নেবেন না মিস দোবাস। যাক এবার আমি বিদায় নেব। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন মেজর ডেসপার্ড।

সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল কি এদিকেই আসবেন? অ্যানা একটু ইতস্ততঃ করে জিজ্ঞাসা করে। রোডাও হঠাৎ প্রশ্ন করে, ব্যাটেল কিরকম লোক বলুন তো?

খুবই বিচক্ষণ, দক্ষ পুলিশ সুপারিনটেন্ডেন্ট।

কিন্তু অ্যানা যে বলল, বোকা বোকা গোঁয়ার গোবিন্দ টাইপ।

দেখে ওরকম মনে হয়, কিন্তু ওটা ওর মুখোস। আসলে খুবই চালাক চতুর লোক। যাইহোক মিস মেরিডিথ, যাবার আগে আপনাকে একটা কথা বলে যাই। আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি বলতে চাই, হয়ত মিঃ শেটানের সঙ্গে আপনার কোন যোগাযোগ থাকতেও পারে। কিন্তু আপনি হয়ত চান না তা সকলের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ুক-

সেই জানোয়ারটার সাথে আমার কোন সম্পর্কই ছিল না। তাকে আমি চিনতামই না। মিস মেরিডিথ চেঁচিয়ে ওঠে।

মাপ করবেন। আমি আপনাকে আঘাত করতে চাই না। আমার কথা হল যদি সেরকম কোন ব্যাপার থাকে আপনি আপনার সলিসিটারের উপস্থিতি ছাড়া সুপারিনটেন্ডেন্টের কোন কথার উত্তর দিতে বাধ্য নন, এটা আপনার আইন সঙ্গত অধিকার।

সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেলের সমস্ত প্রশ্নের উত্তরই আমি দেবো। গোপন করার মত কিছুই নেই–কিছুই নেই– মৃদুস্বরে বিড়বিড় করে অ্যানা মেরিডিথ।

মেজর ডেসপার্ড বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।

সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল যখন ওয়েভেন কুটীরে এসে পৌঁছলেন তখন বেলা গড়িয়ে এসেছে। এখানে আসবার পথে তিনি মিস মেরিডিথের সম্পর্কে বিভিন্ন লোকের কাছে খোঁজখবর নেন। সব থেকে বেশি খবরাখবর দেন, ওয়েভেন কুটীরের ঠিকে ঝি, মিসেস অস্টওয়েল। ব্যাটেল অবশ্য কাউকেই প্রকৃত পরিচয় দেননি। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম পরিচয় দিয়েছেন–কোথাও কনস্ট্রাকসনের লোক, কাউকে ভ্রমণকারী হিসাবে, নিজের পরিচয় দিয়েছেন। খবর যা জোগাড় করেছেন বলতে গেলে বেশ ভালই।

ওয়েভেন কুটীরে দুই বন্ধু বাস করে–মিস মেরিডিথ ও মিস দোবাস। বছর দুয়েক হল ওরা ঐ কুটীরের বাসিন্দা। মিঃ পিকারগিলের কাছ থেকে ওরা ওয়েভেন কুটীর কিনে নেন। প্রতিবেশীরা সকলেই বেশ পছন্দ করেন ওদের। তবে পুরোনো আমলের কয়েকজন বৃদ্ধ এভাবে দুই অবিবাহিত তরুণীর একা একা থাকাটা বিশেষ পছন্দ করেন না, অবশ্য মেয়ে দুটি খুবই ভদ্র এবং সভ্য। প্রতিবেশীদের মতে মিস দোবাস ও মিস মেরিডিথ লণ্ডনের মেয়ে। কিন্তু মিসেস অস্টওয়েলের মতে এরা দুজনে ডেভনশায়ারের অধিবাসী ছিল। মিস দোবাসের বেশ ভাল টাকাকড়ি আছে, ওয়েভেন কুটীরের মালিক সে-ই, এছাড়া অধিকাংশ খরচ-পত্তর মিস দোবাসই চালায়।

সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল দু-একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা ডায়েরীতে লিখে রাখলেন। কিছুক্ষণ বাদে ওয়েভেন কুটীরে ডোরবেল টিপলেন তিনি। দরজা খুলল এক দীর্ঘাকৃতি সুন্দরী, বলাইবাহুল্য ইনি হলেন মিস রোডা দোবাস। ব্যাটেল নিজের পরিচয় দিতে বসবার ঘরে তাকে নিয়ে এল রোডা। অ্যানা একটা বেতের চেয়ারে বসে ছিল। হাতে তার উষ্ণ কফির কাপ। ব্যাটেল ঢুকতেই অ্যানা এগিয়ে এসে করমর্দন করল।

 একটু অসময় এসে পড়লাম মিস মেরিডিথ, ব্যাটেল মৃদু হাসলেন, ইচ্ছে করেই দেরি করলাম, আগে এলে হয়ত আপনাকে পেতাম না।

রোড, সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেলের জন্য এক কাপ কফি নিয়ে আয়। অ্যানা তাকাল রোডার দিকে।

ব্যাটেল চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন, আপনার আথিতেয়তার জন্য, ধন্যবাদ মিস মেরিডিথ।

রোডা এক কাপ কফি নিয়ে এসে ব্যাটেলের সামনে রাখল। অ্যানা বেশ সহজভাবেই বসে আছে! রোডা চেয়ারে বসে ব্যাটেলের দিকে তাকিয়ে আছেন–দু চোখে অপার কৌতূহল।

অ্যানা প্রশ্ন করল, আপনাকে আমরা আরো আগেই দেখা পাবার আশা করেছিলাম, সে যাক, তদন্ত কতদূর এগোল, কিছু পেয়েছেন?

সেরকম কিছু না, কাজ চলছে। ডাঃ রবার্টসের চেম্বারে গিয়ে তার কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখেছি। কথাবার্তা হয়েছে মিসেস লরিমার-এর সঙ্গে। এখন শুধু বাকি মেজর ডেসপার্ড আর আপনি। অ্যানার ঠোঁটে মৃদু হাসি। বেশ তো প্রশ্ন করুন আমাকে।

কয়েকটা কথা জানবার আছে, মানে–সহজ ভাষায় আপনার আত্মপরিচয়।

নিজেকে তো ভদ্র সভ্য বলেই জানি। আমার জন্ম হয়েছিল-গরিব কিন্তু ভদ্র পরিবারে। ঠাট্টার সুরে বলে উঠল রোডা।

আঃ রোড, এটা একটা সিরিয়াস ব্যাপার। অ্যানা রেগে উঠল।

 মিস দোবাস, আপনার বন্ধুকেই বলতে দিন। বলুন মিস মেরিডিথ কি বলছিলেন।

আমার জন্ম হয়েছিল ভারতবর্ষের এক শহরে কোয়েট্টায়। আমার বাবা মেজর জন মেরিডিথ মিলিটারীতে চাকরী করতেন। আমার এগারো বছর বয়সে আমার মা মারা যান। বাবা এর কয়েক বছরের মধ্যে অবসর নিয়ে কেন্টেনহ্যামে চলে এলেন। বাবা মারা গেলেন আমার আঠারো বছর বয়সে। বাবার মৃত্যুর পর চোখে অন্ধকার দেখলাম, একেবারে ভিখারী, নিঃস্ব অবস্থা। লেখাপড়াও বেশি করিনি, শর্টহ্যান্ড-টাইপ কিছু জানা নেই। এরকম অবস্থায় কি-ই বা চাকরী পাব। বাধ্য হয়ে একজনের বাড়িতে চাকরী নিলাম–দুটো ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে দেখা শোনা করার আর সংসারে ছোটখাট কাজে সাহায্য করা।

সেখানকার ঠিকানা?

কর্ত্রীর নাম মিসেস এলডন। লার্চ শহরের ভেক্টর অঞ্চলে বাড়ি। দু বছর ছিলাম সেখানে। মিসেস এল্ডন এরপর স্বামীর সঙ্গে বিদেশে চলে যান। কাজেই অন্য চাকরী খুঁজতে হল। এরপর রোডা ওর কাকীমা মিসেস ডিঘারিংয়ের বাড়িতে একটা কাজ ঠিক করে দেয়। খুব ভাল ছিলাম সেখানে, মাঝে মাঝে রোডা আসত। দুচারদিন থাকত। খুব মজায় কাটত সে দিনগুলো।

কি করতেন সেখানে?

অ্যানার হয়ে রোডাই উত্তর দিল বাগানের কাজকর্ম দেখাশোনা। যদিও অ্যানার কাজ ছিল কাকির সেবাশুশ্রূষা করা। কিন্তু আমার কাকির আবার বাগানের সখ, অ্যানারও সেই কাজে তাকে সাহায্য করতেই সময় কেটে যেত।

সে চাকরী ছেড়ে দিলেন কেন?

মিসেস ডিঘারিংয়ের স্বাস্থ্য ক্রমশ এত খারাপ হয়ে পড়ল যে একজন পাস করা নার্সের দরকার দেখা দিল।

তার ক্যান্সার হয়েছে। রোডা বলল, শেষ বয়সটা খুব যন্ত্রণায় ভুগছেন। আজকাল কষ্ট বেশি হলে মরফিয়া নেন।

আমার সঙ্গে মিসেস ডিঘারিং বরাবরই ভাল ব্যবহার করেছেন। এত কষ্ট পাচ্ছেন, আমার খুবই খারাপ লাগছে। অ্যানার কথায় বেদনার সুর।

আমার সঙ্গে অ্যানার স্কুলজীবন থেকে বন্ধুত্ব। বোড়া জানায়, অ্যানা যখন অন্য কাজ খুঁজতে লাগল, তখন আমিও গ্রামাঞ্চলে একটা বাড়ির খোঁজ করছিলাম। ইচ্ছে ছিল কাউকে সঙ্গী হিসাবে নেব। মায়ের মৃত্যুর পরে বাবা আবার বিয়ে করলেন। আমার ভাল লাগল না, চলে এলাম। অ্যানাকে আমার সঙ্গে থাকতে বলাতে রাজি হল। তারপর থেকে এখানেই আছি।

আচ্ছা। মিস মেরিডিথ, মিসেস এন্ডনের কাছে দু বছর ছিলেন বললেন, তার বর্তমান ঠিকানা?

ভদ্রমহিলা এখন প্যালেস্টাইনে, তার স্বামী সরকারি কাজে ওখানে গেছেন। কি কারণে অতশত বলতে পারব না।

সে সব আমরা জেনে নেব-মিসেস ডিঘারিংয়ের ওখানে কবছর ছিলেন?

ঠিক তিন বছর। চটপট জবাব দেয় অ্যানা, তার ঠিকানা, মার্শভেন হেস্বারী ডেভবে।

হু। তাহলে এখন আপনার বয়স পঁচিশ। আর একটা প্রশ্ন, কেল্টেনহ্যাম শহরের দুজন সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোকের নাম লিখে দিন, যাঁরা আপনাকে এবং আপনার বাবাকে ভালভাবে চিনতেন।

অ্যানা দুজনের নাম ঠিকানা লিখে দিল।

 মিঃ শেটানের সঙ্গে আপনার কোথায় পরিচয় হল?

রোডা আর আমি সুইজারল্যান্ডের একটা হোটেলে উঠেছিলাম। সেখানেই তার সাথে আলাপ। হোটেলের অন্যান্য বোর্ডাররা একটা ফ্যান্সি ড্রেসের আয়োজন করেছিল। শোন পেয়েছিলেন প্রথম পুরস্কার, শয়তান সেজে।

হোটেলে আর টুরিস্ট ছিল যারা, তাদের নাম ঠিকানা মনে আছে?

আপনি তো খুব সন্দেহবাতিকগ্রস্থ লোক! রোডা বলে ওঠে, এতক্ষণ ধরে কি আমরা আগাগোড়া মিথ্যে বলছি?

ব্যাটেল চোখ মিট মিট করলেন।বুঝতেই পারছেন, কত বড় সাংঘাতিক একটা খুনের তদন্ত চালাচ্ছি, সবদিক দেখেশুনে তো এগোতে হবে।

তবুও আপনি একটা সন্দেহপ্রবণ লোক! মৃত্যু হেসে রোডা কাগজে কতগুলো নাম ঠিকানা লিখে দিল।

ব্যাটেল উঠে দাঁড়ালেন, অসংখ্য ধন্যবাদ মিস মেরিডিথ। আপনার বন্ধুও যখন বলছেন আপনি নির্দোষ জীবন কাটাচ্ছেন তখন ভয় কিসের? কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। শেটানের অদ্ভুত ব্যবহারের কারণটা কি? আপনাকে কোনদিন কোন বিষয়ে কিছু বলেছিলেন?

না না। অ্যানার সঙ্গে কোন বিষয়ে বিশেষ কিছু কথাবার্তা হয়নি। বরাবর খুব ভদ্র ব্যবহার করতেন। অ্যানা চটপট জবাব দিল।

আচ্ছা। এবার আমি বিদায় নেব। শুভ রাত্রি। মিস মেরিডিথ কফির জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

ব্যাটেল চলে যাবার পর গেট বন্ধ করে ড্রয়িংরুমে ফিরে এলো রোডা।দেখলি তো অ্যানা, তুই খালি ভয় পাচ্ছিলি। ভদ্রলোক তো বেশ ভালই, মোটেই সাংঘাতিক কিছু নয়।

হ্যাঁ, সেরকমই তো দেখলাম। আমি ভেবেছিলাম হয়ত জেরায় জেরায় নাজেহাল করে দেবে।

রোডা অল্প ইতস্তত করে বলল, অ্যানা, তুই যে ক্রফটওয়েতে থাকার কথা কিছু বললি না? ভুলে গিয়েছিলি?।

না। অ্যানার শান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এল, মাত্র কদিন সেখানে ছিলাম, আমার মনে হয় কথাটা খুব একটা জরুরী নয়। সেখানকার কোন লোকও আমায় চেনে না। তবে তোর যদি দরকারি মনে হয় আমি ব্যাটেলকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিতে পারি। যদিও মনে হয় না খুব একটা ক্ষতি বৃদ্ধি হবে, ঘাঁটাঘাঁটির প্রয়োজন কি?।

না দরকার আর কি? মনে হলো তাই বললাম। রোডা উঠে দাঁড়াল।

আরে মঁসিয়ে পোয়ারো! পোয়ারোকে দেখে অবাক হলেন মেজর ডেসপার্ড, আপনি এই বাসে? কি আশ্চর্য্য!

পোয়ারো মনে মনে হাসলেন। এইভাবে দেখা হয়ে যাওয়াটায় যে আশ্চর্যের কিছুই নেই তা তিনি ছাড়া আর কে জানে? ডেসপার্ড কখন হোটেল থেকে বেরোবেন তিনি সময়টা আন্দাজ করেছিলেন। সেই অনুযায়ী অপেক্ষাও করেছিলেন রাস্তাতে। দূর থেকে ভদ্রলোককে এগিয়ে আসতে দেখে পোয়ারো এগিয়ে গিয়ে পরের বাসস্টপেজে দাঁড়ান। ডেসপার্ডের মত ঝুঁকি নিয়ে চলন্ত বাসে ওঠেননি তিনি। বাস থামলে ধীরে সুস্থে উঠেছেন।

মিঃ শেটানের ব্যাপারটায় আপনারা কিছু করে উঠতে পারলেন মঁসিয়ে পোয়ারো?

আমি শুধু চিন্তা করি। এই বয়সে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়িয়ে তদন্ত করা আমার সহ্য হয় না।

আরে সেটাই তো সবচেয়ে ভাল ব্যাপার। লোকে অনর্থক দৌড়োদৌড়ি করে। কোন কাজে এগোবার আগে যদি শান্ত হয়ে ব্যাপারটা ভাল ভাবে চিন্তা করে নেয় তবে পণ্ডশ্রম-এর ঝামেলা যাবে না।

জীবন সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কি তাই মেজর ডেসপার্ড?

 প্রায় ক্ষেত্রেই তাই। সহজ মনে উত্তর দিলেন ডেসপার্ড। আমিও আগে জিনিসটা তলিয়ে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করি, কি ভাবে এগোব সেটা ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে নিই-তারপর সেইভাবে কাজ।

পোয়ারোর গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল, এরপর কি আপনার সিদ্ধান্তের নড়চড় হয় না? কোন বাধাই আপনার পথ আটকে দাঁড়ায় না।

না না, ব্যাপারটা সেরকম নয়। ভুল হলে আমি অবশ্যই শোধরাবার চেষ্টা করি।

আপনার ভুল বোধ হয় খুব কম হয়!

 মানুষ মাত্রই তো ভুল করে মঁসিয়ে পোয়ারো। আপনার কি কোনদিনই ভুল হয়নি?

শেষ ভুলটা হয়েছিল আঠাশ বছর আগে। পোয়ারোর শান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, তারপর দু একবার ভুলের সম্ভাবনা দেখা দিলেও কোন ভুল হয়নি।

দারুণ ব্যাপার তো। মেজর ডেসপার্ড উৎসাহের সুরে বলেন, মিঃ শেটানের খুনের তদন্ত কি আপনি করছেন? অবশ্য যা শুনেছি আপনাকে বোধহয় সরকারিভাবে কোন দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।

না, সরকারিভাবে আমাকে তদন্তের ভার দেওয়া হয়নি। তবুও এ-ব্যাপারে কেসটা আমি নিজে থেকেই নিয়েছি। আমারই নাকের ডগায় বসে খুন করে যাবে এতটা স্পর্ধা সহ্য করা যায় না। খুনি শুধু আমাকেই নয় স্কটল্যান্ডে ইয়ার্ডকেও ব্যঙ্গ করেছে। আসলে সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেলকে যতটা বোকা মনে হয় তা তিনি নন, খুবই চালাক চতুর। ব্যাপারটা নিয়ে তিনিও উঠে পড়ে লেগেছেন–

হ্যাঁ আমিও জানি। পেছনের সীটে ঐ কাঠখোট্টা চেহারার লোকটাকে দেখুন।

পোয়ারো পেছন ফিরে তাকালেন, কই কেউ নেই তো!

তাহলে নিশ্চয়ই বাসের মধ্যে কোথাও না কোথাও আছে। আমার পেছনে সবসময় লেগে আছে, ছদ্মবেশ ধরতে ওস্তাদ। তবে আমার কাছে ফাঁকি দেওয়া অত সোজা নয়। কালো নিগ্রো হলেও, আমি একবার যে মুখ দেখি ভুলি না সহজে।

বাঃ ঠিক আপনার মত লোককেই দরকার আমার। পোয়ারো খুশি হয়ে বলেন, যার নজর তীক্ষ্ণ এবং স্মৃতিশক্তিও প্রখর। আপনি হয়ত আমাকে সাহায্য করতে পারবেন। ডাঃ রবার্টস, মিসেস লরিমার কেউই আমার প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারলেন না

আমি আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি? ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না। মেজর ডেসপার্ড অবাক হলেন।

সে সন্ধ্যায় মিঃ শেটানের খুন হবার আগে যে ঘরে বসে আপনারা তাস খেলছিলেন, সেই ঘরের জিনিসপত্রের একটা সঠিক বিবরণ দিন আমাকে। মানে কোন কোন জিনিস আপনার নজরে পড়েছিল–

আমি বোধহয় সেরকম কিছুই বলতে পারব না। যতদূর মনে পড়ছে ঘরটা জিনিসপত্রে ঠাসা ছিল–অনেকগুলো আলনা, সিল্কের জামাকাপড়, আরো কত কি–

ঠিক কি কি জিনিস ছিল?

ডেসপার্ড হতাশভাবে মাথা নাড়লেন, বিশেষ লক্ষ্য করিনি। কয়েকটা ভাল জাতের কম্বল–পারস্য বা ঐ সমস্ত দেশ থেকে আনা নানা রকম কতগুলো মূর্তি, কয়েকটা ছবি দেওয়ালে টাঙানো ছিল, দক্ষিণ আফ্রিকার একটা বড় সাইজের কৃষ্ণসার হরিণের মাথা-ওঃ ওটা বোধহয় পাশের ঘরে টাঙানো দেখেছিলাম।

মিঃ শেটানের শিকারের নেশা ছিল বলে মনে হয় না।

কক্ষনো না। ঘরে বসে তাস দাবা খেলা ছাড়া আর তার কোন কাজ ছিল না। তবে ঘরে আর কি কি ছিল মনে পড়ছে না, টেবিলের ওপর পালিশ করা একটা কাঠের মূর্তি দেখেছিলাম এটা বেশ মনে আছে। আর তো মনে নেই।

পোয়ারো একটু গম্ভীর হলেন, যাকগে, মনে না পড়লে আর কি করা যাবে। মিসেস লরিমারের কিন্তু আশ্চর্য স্মৃতিশক্তি, সেদিনের খেলার প্রত্যেকটা তাসের ডাক কখন কি, রকম হয়েছিল একেবারে নিখুঁতভাবে বলেছিলেন–আপনার বোধহয় তাসের কথা কিছুই মনে নেই মেজর ডেসপার্ড?

না। স্বীকার করলেন ডেসপার্ড। দেখুন, বয়স্কা মহিলারা যাদের খালি ক্লাবে বা পার্টিতে তাস খেলে বেড়ানো অভ্যেস তাদের তো তাসের সমস্ত কথা মনে থাকবারই কথা। তাসই যাদের ধ্যান জ্ঞান। সেদিনের খেলায় দু একটা তাসের কথা আমার মনে পড়ছে। একবার রবার্টসের ভাওতায় ঘাবড়ে গিয়ে পাঁচটা ডায়মন্ডের গেমটা ডাকতে পারিনি। ভদ্রলোক অবশ্য গোটা দু-তিন শট দিয়েছিলেন কিন্তু আমরা ডবল দিইনি বলে লোকসানই হল। আর একটা নো-ট্রাম্প গেমে আমি খেলতে পারলাম না। দুটো শর্ট দিলাম।

আপনি বোধহয় ব্রীজের থেকে স্পেকার খেলতেই বেশি পছন্দ করেন? পোয়ারো তাকালেন মেজর ডেসপার্ডের দিকে।

ঠিকই ধরেছেন, মেজর ডেসপার্ড মৃদু হাসলেন। পোয়ারোর গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, মিঃ শেটানের তাসে খুব একটা উৎসাহ ছিল বলে মনে হয় না।

কিন্তু অন্যকে ভয় দেখানোর খেলায় তার বেশ উৎসাহ ছিল–বিশেষতঃ মেয়েদের ভয় দেখিয়ে খুব আনন্দ পেতেন।

একথা কি আপনি আগেই জানতেন, না এখন মনে হলো। মেজর ডেসপার্ড একটু বিব্রত হয়ে পড়লেও খুব দ্রুত নিজেকে সামলে নিলেন। আমার কথাটার অর্থ বিশদভাবে জানতে চাইছেন তো? এ হল আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা–খুব গোপন সূত্র থেকে জানতে পেরেছি।

ভদ্রলোককে কি ব্ল্যাকমেলার বলে মনে হয় আপনার?

ডেসপার্ড মাথা নাড়লেন, ব্যাপারটা আপনি ঠিক বুঝতে পারছেন না। একভাবে ব্ল্যাকমেলার তো বলা যায়ই–তবে এর পিছনে টাকার চাহিদা ছিল না। শেটান অন্যের গোপন খবর জোগাড় করে মানুষকে ভয় দেখাতে ভালবাসতেন। বলা যেতে পারে নিছক নোংরা আনন্দেই এসব করে বেড়াতেন তিনি। আর মেয়েদের কাছ থেকে গোপন খবর বের করা বেশ সোজা। একবার যদি তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে পারেন যে আপনি ব্যাপারটা জানেন-ব্যাস, বাকিটা তারা নিজেরাই জানিয়ে দেবে আপনাকে।

মিস মেরিডিথকেও কি তিনি এরকম ভয় দেখিয়েছিলেন? শান্ত কণ্ঠে পোয়ারো প্রশ্ন। করলেন, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মেজর ডেসপার্ডের দিকে।

মিস মেরিডিথ! অবাক হলেন ডেসপার্ড–তার কথা তো আমি ভাবছি না। আর শেটানকেই বা তিনি ভয় পেতে যাবেন কেন?

তবে কি মিসেস লরিমার?

আরে না না। বিশেষ কাউকে উদ্দেশ্য করে আমি বলছি না, শেটানের চরিত্র কেমন ছিল–এটাই আমার বক্তব্য। আর মিসেস লরিমারকে ভয় দেখানো অত সোজা নয়।

মেয়েদের মনের কথা, বিশেষ করে গোপন কথা বের করতে মিঃ শেটান খুবই পটু ছিলেন, এটা ঠিকই। পোয়ারো শান্তভাবে বললেন।

লোকটা তো একেবারে নির্বোধ ছিল–সেরকম বিপজ্জনকও নয়–অথচ মেয়েরা কেন যে ভয় পেতকথা বলতে বলতে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন মেজর ডেসপার্ড। আরে, কথা বলতে বলতে আমার স্টপেজ ছাড়িয়ে চলে এসেছি। আচ্ছা, মঁসিয়ে পোয়ারো, কবে আবার দেখা হবে। জানালা দিয়ে একটু লক্ষ্য করুন, আমার অনুসরণকারীকেও দেখতে পাবেন, আমার সাথে সাথে বাস থেকে নামবে নিশ্চয়ই।

লম্বা পায়ে চলন্ত বাস থেকে নেমে পড়লেন মেজর ডেসপার্ড। পোয়ারো অবশ্য তার অনুসরণকারীকে খোঁজার কোন চেষ্টা করলেন না। কেউ হবে হয়ত। তার মাথায় তখন অন্য চিন্তা, বিশেষ কাউকে উদ্দেশ্য করে নয়– বিড় বিড় করে বললেন পোয়ারো, সত্যি ভারী আশ্চর্য্যের তো!

মিসেস লরিমার কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন সিঁড়ির মাথায়। তার মুখে বিভিন্ন অভিব্যক্তির ছাপ একের পর এক খেলে চলেছে–কখনো দ্বিধা, কক্ষনো সংশয়, বিস্ময়, নিশ্চিন্ত। তার দীর্ঘ জ্বজোড়া কুঁচকে উঠল, কি যেন চিন্তা করছেন তারপর নিচে নেমে এলেন ধীরে ধীরে। তখনি রাস্তায় তার চোখ পড়ল অ্যানা মেরিডিথের দিকে, একটা আকাশ ছোঁয়া বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে আছে অ্যানা। মিসেস লরিমার একটু ইতস্তত করে রাস্তা পেরিয়ে তার দিকে এগিয়ে এলেন।

কেমন আছেন মিস মেরিডিথ?

চমকে ফিরে তাকাল অ্যানা, ওঃ আপনি? অনেকদিন বাদে আবার দেখা হল।

লন্ডনেই আছেন এখনো?

না না, একটা বিশেষ কাজে লন্ডনে এলাম আজ। অ্যানা ঘন ঘন ফ্ল্যাট বাড়িটার দিকে তাকাচ্ছে।

ওদিকে অত তাকাচ্ছেন কেন মিস মেরিডিথ? কোন দরকার আছে?

কই না কিছুই নয়।

আমার কিন্তু মনে হচ্ছে কোন ব্যাপার আছে। মৃদু হাসলেন মিসেস লরিমার।

হ্যাঁ–মানে ইয়ে, অ্যানা আমতা আমতা করে, আসলে আমার এক বন্ধুকে যেন বাড়ির মধ্যে ঢুকতে দেখলাম। সত্যি সত্যি রোডাই তো? এই বাড়িতে মিসেস অলিভার থাকেন। আমাদের ওখানে বেড়াতে গিয়ে এ বাড়িটারই ঠিকানা দিয়েছিলেন তিনি।

আপনি কি দেখা করবেন মিসেস অলিভারের সঙ্গে?

না, আজ আর যাব না।

তবে চলুন, এক কাপ চা খাওয়া যাক। মিসেস লরিমার একটা নিরিবিলি রেস্তোরাঁতে অ্যানাকে নিয়ে এলেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর অ্যানাই প্রথম মুখ খুললেন, মিসেস অলিভার আপনার কাছে যাননি?

মঁসিয়ে পোয়ারো ছাড়া আর কেউই আমার কাছে যায়নি।

 আমি ঠিক তা জিজ্ঞসা করিনি।

করেননি? কিন্তু আমার যেন মনে হলো আপনি এটাই জিজ্ঞাসা করছেন। অবাক হলেন মিসেস লরিমার।

অ্যানার চোখে ভয়ের ছায়া দেখা দিল। কিন্তু মিসেস লরিমার আগের মতই নির্বিকার। অ্যানা চট করে সামলে নিল নিজেকে।

মঁসিয়ে পোয়ারো আমার কাছে যাননি। আচ্ছা সুপারিনটেন্ডেন্ট ব্যাটেল কি আপনার কাছে গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ। মিসেস লরিমারের জবাব।

অ্যানা একটু ইতস্তত করে বলে, কি প্রশ্ন করলেন?

যেমন নিয়ম মাফিক প্রশ্ন করে যাকে সে রকমই। তবে ব্যাটেলের ব্যবহার খুব ভাল।

ভদ্রলোক মনে হয় সকলের সঙ্গেই দেখা করেছেন।

মিসেস লরিমার, আপনার কি মনে হয়, অপরাধীকে খুঁজে বের করতে পারবে পুলিশ?

মিসেস লরিমারের চোখে অদ্ভুত একটা ছায়া খেলে গেল, আপনার বয়স কত মিস মেরিডিথ?

আমার বয়স? আমার অ্যানা তোতলাতে লাগল, পঁচিশ।

আমার তেষট্টি, মিসেস লরিমারের শান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এল, আপনার সামনে সারাটা জীবন পড়ে আছে–

কেন? আমি তো আজই অ্যাক্সিডেন্টে মারাও যেতে পারি? অ্যানা ভয় পাওয়া গলায় বলে ওঠে।

হতে পারে। আবার হয়ত সারা জীবনে কোন দুর্ঘটনা ঘটবে না।

 মিসেস লরিমারের কথায় অদ্ভুত ভঙ্গীমায় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল অ্যানা।

জীবন কত জটিল, আপনমনে বলতে থাকেন মিসেস লরিমার, বেঁচে থাকতে গেলে চাই প্রচণ্ড সাহস আর সবকিছু সহ্য করার ক্ষমতা। অথচ জীবনের শেষ সময় দাঁড়িয়ে মনে হয় সত্যিই কি এর কোন দরকার ছিল?

ওভাবে বলবেন না, অ্যানা ভয় পাওয়া গলায় বলে। মিসেস লরিমার মৃদু হাসেন, জীবন নিয়ে কথাবার্তা হয়ত খুব সস্তা দরের নাটকীয়তা হয়ে যাচ্ছে। বড্ড সস্তা। বেয়ারার বিল মিটিয়ে রাস্তায় চলে এলেন দুজনে। একটা ট্যাক্সি পেয়ে অ্যানাকে লিফট দিতে চাইলেন মিসেস লরিমার। অ্যানা ধন্যবাদ জানিয়ে তার কাছ থেকে বিদায় নিল, কেননা একটু দূরেই রোডাকে দেখতে পেয়েছে সে। রোডার কাছাকাছি হতেই অ্যানা তীক্ষ্ম গলায় প্রশ্ন করে, রোডা, তুই মিসেস অলিভারের কাছে গিয়েছিলি?

হ্যাঁ, কেন তাতে কি হয়েছে?

তা হলে ঠিকই ধরেছি।

এতে আবার ধরাধরির কি আছে। আমি কি চুরির দায়ে ধরা পড়েছি না কি? তুইও তো এতক্ষণ দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছিলি।

হঠাৎ মিসেস অলিভারের কাছে গিয়েছিলি কেন?

বাঃ! তিনি তো আমাদের যেতে বলেছিলেন।

সে তো কথার কথা। সকলেই ওরকম বলে। আমি তো তাই নিয়েছি।

না রে তুই ভুল বুঝছিস। ভদ্রমহিলার মধ্যে আন্তরিকতার কোন অভাব নেই। এই যুগের ব্যবহার, দেখ না আমাকে নিজে থেকেই একটা বই উপহার দিলেন।

অ্যানা তবুও নিঃসন্দেহ হতে পারে না। কি ব্যাপারে কথা হল? আমার ব্যাপারে নিশ্চয়ই নয়?

বোকা মেয়ে, কিসব উদ্ভট ধারণা করে বসে আছিস?

সত্যিই কি কিছু বলিসনি? এই খুনের ব্যাপারে কথা হল না?

না না। বরং তার উপন্যাসের খুন-খারাপি নিয়ে, গল্পের প্লট এসব নিয়ে কথা হল। কেমনভাবে প্লট তৈরি করেন বললেন। জানিস অ্যানা আমাকে ব্ল্যাক কফি আর টোস্ট খাওয়ালেন মিসেস অলিভার। গর্বের সুরে বলে রোলা, তারপর অল্প থেমে কুণ্ঠিতভাবে জিজ্ঞাসা করে, তুই চা খেয়েছিস?

হ্যাঁ। মিসেস লরিমার-এর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হল তিনি-ই খাওয়ালেন।

 মিসেস লরিমার? ও! বোধহয় সেই খুনের ঘটনার দিন উপস্থিত ছিলেন তিনি, তাই না? ভদ্রমহিলা কেমন রে?

আগের বার যেরকম দেখেছিলাম, একটু যেন পরিবর্তন হয়েছে। কেমন যেন ব্যাপার মনে হল।

তোর কি মনে হয় খুনটা ভদ্রমহিলাই করেছেন? অ্যানা তীক্ষ্ণ গলায় বলে, রোডা, বহুবার বলেছি এসব আলোচনা আমি পছন্দ করি না।

আচ্ছা, আচ্ছা, বেশ। তোর সেই সলিসিটার কেমন লোক? খুব কাঠখোট্টা? আইনের অন্ধিসন্ধি মুখস্থ?

না, ভদ্রলোক বেশ ভালোই। চল, চল। বাড়ি ফিরব, ঐ দেখ প্যাডিংটন যাবার বাস ছাড়ছে।

আসুন মঁসিয়ে পোয়ারো, মিসেস অলিভারও এসে পড়েছেন দেখছি। আসুন আসুন। সকলের সঙ্গে করমর্দন করেন ব্যাটেল। তিনিই মঁসিয়ে পোয়ারো আর মিসেস অলিভারকে ডেকে পাঠিয়েছেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে।

আমার মনে হয় এখন আমাদের মধ্যে একটা আলোচনা হওয়া দরকার। কে কতদূর এগোলাম, কি কি তথ্য জানা গেল? এ জন্যই আজ আপনাদের ডেকেছি। কর্নেল রেসও এসে পড়বেন এক্ষুনি। ব্যাটেলের কথা শেষ হবার প্রায় সাথে সাথেই কর্নেল রেস ঘরে ঢুকলেন।

আমার বোধহয় দেরি হয়ে গেল। মিসেস অলিভার কেমন আছেন? মঁসিয়ে পোয়ারো। আমার জন্য সকলেই বোধহয় অপেক্ষা করছেন। খুবই দুঃখিত। আসলে আমাকে কয়েকটা দরকারি কাজ সেরে নিতে হল, কালকেই একটা পাটির সঙ্গে বেলুচিস্তান রওনা হব।

আমাদের এ ব্যাপারটায় কোন খোঁজ খবর আনতে পারলেন? প্রশ্ন করেন ব্যাটেল।

হ্যাঁ মেজর ডেসপার্ডের বিষয়ে কিছু খবরাখবর জোগাড় করেছি। কতগুলো টাইপ করা কাগজ ব্যাটেলের দিকে এগিয়ে দিলেন কর্নেল রেস। কখন, কোথায়, কোন দেশে গিয়েছিলেন সবকিছু, তারিখ, নাম, খুঁটিনাটি লেখা আছে। মনেহয় দরকার নেই এগুলোর। মেজর ডেসপার্ডের নামে কোথাও কোন অভিযোগ, নিল শাইনি। শক্ত পোক্ত বলিস্ট পুরুষ। সমাজের সব নিয়ম কানুন মেনে চলেছেন। যখন যেখানে গেছেন প্রিয় হয়ে উঠেছেন, কেউই নিন্দা করেনি মেজর ডেসপার্ডের। কথা বলেন কম, কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায় বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন লোক। তার হাতের টিপ নিখুঁত। বিপদে বুদ্ধি হারান না। দূরদৃষ্টি আছে এবং নির্ভরযোগ্য পাকা ভদ্রলোক।

কোথাও কোন অ্যাক্সিডেন্ট বা আকস্মিক মৃত্যুর সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল? ব্যাটেলের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।

সে ব্যাপারেও খোঁজ নিয়েছি। একবার তার একজন অনুচরকে সিংহের থাবা থেকে বাঁচিয়েছিলেন নিজের জীবন বিপন্ন করে!

মৃদু হাসলেন কর্নেল রেস। তবে হ্যাঁ, আপনার পছন্দমত একটা খবর আমার সংগ্রহে আছে। একবার বিখ্যাত বটানিস্ট ল্যাক্সমোর আর তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে দক্ষিণ আমেরিকার গভীর বনে শিখার করতে গেছিলেন ভদ্রলোক। অধ্যাপক এক ধরনের কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। আমাজন নদীর তীরে, সেই গভীর জঙ্গলের মধ্যেই তাকে কবর দেওয়া হয়।

কালাজ্বর?

হ্যাঁ, তবে এটা গুজবও শুনেছি। ঐ অভিযানে দুএকজন আদিবাসীও কাজের লোক হিসাবে গেছিল। তাদের একজনকে চুরির অভিযোগে বরখাস্ত করা হয়। পরে সে-ই ব্যাপারটা রটিয়ে দেয়। তার বক্তব্য–অধ্যাপক কালাজ্বরে মারা যাননি, তাকে গুলি করে মারা হয়েছিল। অবশ্য মেজর ডেসপার্ড পরিচিত ব্যক্তি, সকলের শ্রদ্ধার পাত্র। তাই ঐ গুজবে কেউ কান দেয়নি।

কতদিন আগেকার ব্যাপার?

কর্নেল রেস মাথা নাড়লেন। আমি কিন্তু মেজর ডেসপার্ডকে খুনি মনে করিনি। এসব খুন-টুন তার দ্বারা সম্ভব নয়।

কিন্তু ভদ্রলোক যদি একবারও ভাবেন, কারো বেঁচে থাকা যুক্তিসঙ্গত নয়, মৃত্যুই তার উপযুক্ত পাওনা তাহলে তাকে সেই যোগ্য শাস্তি দিতে দ্বিধাবোধ করবেন না মেজর ডেসপার্ড।

হতে পারে। তবে ঐ ধরনের কিছু ঘটলে তার সিদ্ধান্তের পেছনে নিশ্চয়ই যুক্তির অভাব হবে না।

ব্যাটেল অধৈর্যভাবে মাথা নাড়লেন, কিন্তু তা বলে সভ্য সমাজে কেউ নিজের হাতে আইন তুলে নিতে পারে না।

তবুও এ-রকমটাই ঘটে চলেছে। চলবেও। সে যাক, আমি বেশিক্ষণ এখানে থাকতে পারব না। বেশ কয়েকটা কাজ বাকি আছে। তবে এই খুনের ব্যাপারটায় শেষ অবধি কি হয় এটা জানতে আমি খুবই আগ্রহী। কোন নিষ্পত্তি না হলেও অবাক হব না। কারণ খুনি কে জানতে পারলেও কোর্টে প্রমাণ করা খুব কঠিন হবে। আমি আমার কর্তব্য করেছি। যদিও আমার মনে হয় ডেসপার্ড খুনি নন। মিঃ শেটান হয়ত কোন ভাবে ল্যাক্সমোরের মারা যাবার ব্যাপারে গুজবটা শোনেন। ডেসপার্ড কিছুতেই খুনি নন। আর মানুষ চিনতে আমার খুব একটা ভুল হয় না।

ব্যাটেল প্রশ্ন করেন, মিসেস ল্যাক্সমোর কিরকম মহিলা?

তিনি এখন লন্ডনেই থাকেন। আপনারা নিজেরাই তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন। এই কাগজে তার ঠিকানাও দেওয়া আছে। তবুও আবার বলছি মেজর ডেসপার্ড আপনাদের লক্ষ্যবস্তু নন।

কর্নেল রেস সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।

হয়ত ঠিকই বলে গেলেন ভদ্রলোক, বিড় বিড় করলেন ব্যাটেল। মানুষের চরিত্র সম্পর্কে ওঁর গভীর জ্ঞান আছে। কিন্তু তবু প্রমাণ ছাড়া কাউকে নির্দোষ ভাবা যায় না। কর্নেল রেসের রেখে যাওয়া কাগজপত্র দেখতে দেখতে ব্যাটেল নিজেও কিছু কিছু নোট করে নিতে লাগলেন।

তাহলে সুপারিনটেন্ডেন্ট, মিসেস অলিভার তাকালেন ব্যাটেলের দিকে, কিভাবে এগোচ্ছেন কিছুই বললেন না?

ব্যাটেল মৃদু হাসলেন, এখনো সুনির্দিষ্ট কোন লক্ষ্যে পৌঁছতে পারিনি। সবই খাপছাড়া।

ওঃ! আপনি আসলে বলতে চাইছেন না, বুঝেছি। মিসেস অলিভার বলে ওঠেন।

না, না। মাথা নাড়লেন ব্যাটেল, আমি সব কিছুই বলতে চাই

তাহলে বলুন! মিসেস আলভার খুব উৎসাহ দেখান।

প্রথমেই যে কথাটা বলব, তা হল মিঃ শেটানকে কে খুন করেছে এ সম্বন্ধে বিন্দুবিসর্গও আমি জানতে পারিনি–মানে কোন সূত্রই পাওয়া যায়নি। চারজনের প্রতিই আমার সমান সন্দেহ রয়েছে। নজর রাখা হয়েছে সকলের ওপরই। যদিও আমার মনে হয় না এতে কোন ফল পাওয়া যাবে। আমার মনে হয় মঁসিয়ে পোয়ারো যা বলেছিলেন সেই একটা পথই আছে-অতীত। এদের চারজনেরই অতীত ঘেঁটে বার করতে হবে কে কি অপরাধ করেছিল। তার থেকেই আমরা হয়ত এই খুনটার হদিশ পেতে পারি। তবে এর মধ্যেও একটা কিন্তু রয়ে যাচ্ছে, সত্যিই কি কোন অপরাধ করেছিল এরা? মিঃ শেটান হয়ত নিছক ঠাট্টা করেছিলেন মঁসিয়ে পোয়ারোর সঙ্গে।

এদের অতীত সম্বন্ধে কোন খবরা খবর করেছেন?

হ্যাঁ, এদের মধ্যে ডাক্তার রবার্টসের ওপরেই আমার কিছুটা সন্দেহ হয়।

কি রকম? মিসেস অলিভার বলে ওঠেন।

মঁসিয়ে পোয়ারো জানেন আমি সব রকমের থিওরিই হাতে-কলমে প্রয়োগ করে দেখেছি। খবর নিয়ে জেনেছি রবার্টসের কোন নিকট আত্মীয়দের মধ্যে কেউই হঠাৎ মারা যাননি। তবে তার অতীত ঘেঁটে একটামাত্র ঘটনার সন্ধান পেয়েছি যা এই খুনের মামলার ব্যাপারে প্রয়োজনীয়। অবশ্য নাও হতে পারে। যাই হোক, আমাদের এখানকার একজন সার্জেন্ট মিসেস ক্যাডক নামে এক মহিলার বাড়ির কাজের লোকের কাছ থেকে ডাঃ রবার্টসের সম্বন্ধে এই তথ্য জোগাড় করেছে।