১০. ট্রেন পাছে ফস্কে যায়

১০.

ট্রেন পাছে ফস্কে যায় এই ভেবে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট একরকম দৌড়েই বেরিয়ে এলেন মিসেস গার্ডনারের বাড়ি থেকে, যাবার আগে ভদ্রতার খাতিরে তাঁর কাছ থেকে বিদায় নেবার সময়টুকু পর্যন্ত পেলেন না তিনি। ঈশ্বর সহায় ছিলেন তাই সময়মতো স্টেশনে পৌঁছে ট্রেনটা পেয়ে গেলেন তিনি।

নির্দিষ্ট স্টেশনে নেমে প্রথমেই গোয়েন্দা পুলিশের দপ্তরে এসে হাজির হলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, যেখানে ওপরওয়ালা পুলিশ সুপারিন্টেডেন্ট ম্যাক্সওয়েলের সঙ্গে দেখা করে প্রাথমিক তদন্তের ফলাফল জানালেন, কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপদেশও নিলেন তার কাছ থেকে। কিছুক্ষণ বাদে ওপরওয়ালার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার স্টেশনে এসে হাজির হলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, দুপুর পৌনে দুটোর ট্রেন ধরে সোজা এসে পৌঁছোলন লন্ডনে।

লন্ডন স্টেশন থেকে ক্রমওয়েল স্ট্রীট খুব বেশিদুরে নয়, যেখানে পৌঁছে একুশ নম্বর বাড়িটি খুঁজে বের করতে বেগ পেতে হল না তাকে। মিসেস গার্ডনারের বড় বোনপো জেমস পিয়ার্সনের খোঁজ নিলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, বাড়ির পরিচারিকা উত্তরে জানাল যে জেমস সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ অফিস থেকে ফিরবে।

জেমসের অফিসে না গিয়ে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট এবার চলে এলেন উইম্বলডনে তার বোন সিলভিয়ার বাড়িতে। সিলভিয়ার বাড়িটা নতুন, বেশ ছিমছাম আর সাজানো গোছানো। কলিংবেল টিপতেই অল্পবয়সী এক পরিচারিকা দরজা খুলে এসে দাঁড়াল, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, তার হাতে ভিজিটিং কার্ড তুলে দিয়ে বললেন যে গৃহকর্ত্রী মিসেস সিলভিয়া ডেরিংয়ের সঙ্গে দেখা করতে চান।

পরিচারিকাটি ইন্সপেক্টর ন্যারাকটকে নিয়ে গিয়ে একতলার ড্রইংরুমে বসাল, আর তার কিছুক্ষণের মধ্যেই সিলভিয়া ডেরিং ওপর পর থেকে নেমে এল, মুখোমুখি একটা সোফায় বসে নিজে থেকেই বলে উঠল।

আপনি নিশ্চয়ই জোসেফ মামার খুনের ব্যাপারে তদন্ত করতে এসেছেন। সত্যিই এ অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। বললে বিশ্বাস করবেন না, মামা খুন হবার পর আমি নিজেও সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকি, কখন কি হয় ভেবে। দিনকাল যা পড়েছে, কখন জানালা ভেঙ্গে চোর ডাকাত বাড়িতে ঢুকবে তা কে বলতে পারে। এই তো দেখুন না গত হপ্তায় বাড়ির সবকটা জানালা আর দরজায় মজবুত কবজা আর ছিটকিনি লাগিয়েছি, অনেকগুলো টাকা তাতে খরচ হয়েছে।

সিলভিয়া ডেরিংয়ের বয়স পঁচিশ ছাব্বিশের বেশি নয়, কিন্তু তার চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট, যে কারণে প্রথমে দেখলে যে কেউ ধরে নেবে তার বয়স ত্রিশ পেরিয়েছে বহু আগেই। সিলভিয়ার গড়ন বেঁটেখাটো, দেহের চামড়ায় রক্তাল্পতার ছাপ ফুটে উঠেছে। গলার সুরে কথা বলার ঢংয়ে সবসময় প্যানপ্যানে নাকি কান্নার ভাব। এই ধাঁচের মেয়েরা সবসময় নিজের কথা বলে, অন্যের অভাব অভিযোগ শোনার কোনো আগ্রহই এদের মধ্যে দেখা যায় না। ইন্সপেক্টর ন্যারাকটকে কথা বলার কোনও সুযোগ না দিয়ে সিলভিয়া আপনমনে বলে চলে।

আপনাকে কোনওভাবে সাহায্য করতে পারলে আমি সত্যিই খুশি হতাম, কিন্তু মুশকিল হল জোসেফ মামার সঙ্গে আমার খুব মেলামেশা কোনদিনই ছিল না। আসলে উনি লোক খুব সুবিধার ছিলেন না, অন্যের নিন্দা আর সমালোচনা সবসময়েই ওঁর মুখে লেগেই থাকতো। এছাড়া সত্যিই, শিল্প, সঙ্গীত, চারুকলা, এইসব সূক্ষ্ম বিষয়ের ধারে কাছে উনি কখনও হাঁটেননি জীবনে। টাকা ছাড়া জীবনে মামা আর কিছুই চিনতেন না, কিন্তু টাকাই জীবনে তো সব নয়।

খবরটা আপনি খুব তাড়াতাড়িই পেয়েছেন দেখছি, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন।

হ্যাঁ সিলভিয়া ঘাড় নেড়ে বলল।

মামার সঙ্গে আপনার বহুদিন দেখা হয়নি, তাই না, মিসেস ডেরিং? ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন।

ঠিক ধরেছেন, সিলভিয়া জবাব দিলেন। বিয়ের পরে এ পর্যন্ত মামার সঙ্গে মাত্র দুবার আমার দেখা হয়েছে। শেষ যেবার গিয়েছিলাম ওঁর কাছে সেবার মার্টিন অর্থাৎ আমার স্বামীর সঙ্গে মামা খুব খারাপ ব্যবহার করেছিলেন। আমার স্বামীর সঙ্গে মামা সেবার যে ব্যবহার করেছিলেন এককথায় অসভ্যতা ছাড়া তাকে আর কিছু বলা চলে না।

অর্থাৎ তোমার স্বামী তোমার মামার কাছে যেবার কিছু টাকা ধার চেয়েছিলেন আর তিনি যে ধার দেননি তাই তোমার এতো রাগ, মনে মনে সিলভিয়ার উদ্দেশ্যে মন্তব্যটা করলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট।

এবার নিয়মমাফিক একটা প্রশ্ন আপনাকে করছি, মিসেস ডেরিং, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, গতকাল বিকেলে আপনি কোথায় ছিলেন, কিভাবে সময় কাটিয়েছেন এসব জানা একান্ত দরকার।

আমার গতিবিধির সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে চান, এই তো? হেসে সিলভিয়া জবাব দিল গতকাল প্রায় পুরো বিকেলটাই আমি ব্রীজ খেলে সময় কাটিয়েছি। পরে আমার এক বান্ধবী এসেছিল। তার সঙ্গেই গল্প করে সন্ধ্যেটুকু কাটিয়েছি, আমার স্বামী বাড়িতে ছিলেন না।

আপনার পরের ভাই ব্রায়ান তো অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন, তাই না মিসেস ডেরিং?

হ্যাঁ,

ওর ঠিকানাটা আমায় যদি দেন–

দেখুন, পুরো ঠিকানাটা এই মুহূর্তে আমার কাছে নেই, তবে ও যে জায়গায় থাকে তার নাম নিউ সাউথ ওয়েলস, শুধু এইটুকু মনে আছে।

ধন্যবাদ, মিসেস ডেরিং তদন্তের কাজে সহযোগিতা করার জন্য পুলিশের তরফ থেকে আপনাকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানাচ্ছি, গুডনাইট।

উইম্বলডন থেকে আবার যখন ক্রমওয়েল স্ট্রীটে এসে হাজির হলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট তখন সন্ধ্যে সাতটা, সিলভিয়ার বড় ভাই জেমস তার অল্প কিছুক্ষণ আগে অফিস থেকে ফিরেছে। জেমস পিয়ার্সন একাধারে সুদর্শন ও সুস্থাস্থ্যের অধিকারী, শুধু দোষের মধ্যে তার একটি চোখ ট্যারা। ইন্সপেক্টর ন্যারাকট লক্ষ্য করলেন তার দুচোখে দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটে উঠেছে। দুচোখের নীচে কালি পড়েছে তাও তার নজর এড়াল না।

আমি ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, আপনার খুনের তদন্তের দায়িত্ব আমাকেই দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আপনার কি কিছু বক্তব্য আছে?

ইন্সপেক্টর ন্যরাকটের কথা শুনে সোফা থেকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল জেমস, ভীত কণ্ঠে প্রশ্ন করল, আপনি কি আমাকে গ্রেফতার করতে এসেছেন?

ভুল করছেন, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট হেসে বললেন, আমি শুধু জানতে চাই গতকাল বিকেলে আপনি কোথায় ছিলেন, কি করছিলেন। আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া না দেওয়া আপনার ইচ্ছে।

উত্তর না দিলে তো সেটা আমার পক্ষে যাবে না, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, জেমস পিয়ার্সন বলল, বুঝতে পেরেছি, আমি যে গতকাল ওখানে গিয়েছিলাম সেটা আপনি খুঁজে বের করেছেন।

আপনি নিজেই হোটেলের রেজিস্ট্রারে আপনার নাম মোটা মোটা হরফে সই করেছেন, মিঃ পিয়ার্সন।

নিশ্চয়ই, এটা অস্বীকার করার মতো ব্যাপার নয়, জেমস বলল, হ্যাঁ, আমি ওখানে গিয়েছিলাম, আর যাবই না কেন?

সে তো বটেই, কিন্তু কেন গিয়েছিলেন জানতে পারি?

 আমি আমার মামাকে দেখতে গিয়েছিলাম।

আপনি যে ওঁকে দেখতে যাচ্ছেন তা আগে থেকে ঠিক ছিল?

তার মানে? জেমস চাপা উত্তেজিত সুরে প্রশ্ন করল, আপনি কি বলতে চাইছেন?

আপনি যে ওখানে যাচ্ছেন তা কি আপনার মামা ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান আগে থেকে জানতে পেরেছিলেন?

না, জানতেন না, হঠাৎ মামাকে দেখার ইচ্ছে হল তাই চলে গেলাম।

বাঃ চমৎকার, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট মুচকি হেসে বললেন, তা ওখানে পৌঁছোনোর পরে কি হল, মামার সঙ্গে আপনার আদৌ দেখা হয়েছিল কি?

হ্যাঁ, কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে জেমস পিয়ার্সন জবাব দিল, হ্যাঁ, মামার সঙ্গে গতকাল আমার ঠিকই দেখা হয়েছিল। শুনুন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, ট্রেন থেকে স্টেশনে নেমে আমি জানতে চেয়েছিলাম। কিভাবে কোন পথে গেলে তাড়াতাড়ি সিটাফোর্ডে পৌঁছোতে পারব। স্টেশনের কর্মচারীরা বলল যে প্রচণ্ড তুষারপাত হবার দরুন পথঘাট সব বন্ধ তাই গাড়িঘোড়াও চলছে না, অতএব সিটাফোর্ডে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। অথচ মামার সঙ্গে দেখা করাটা ছিল খুবই জরুরী।

জরুরী? হঠাৎ প্রশ্ন করলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট।

হ্যাঁ, মামার নাম শোনার পরে স্টেশনের এক পোর্টার জানাল যে সে তাকে ভালভাবেই চেনে এবং তিনি যেখানে থাকেন সে জায়গাটার আসল নাম হল এক্সহ্যাম্পটন। ওই পোর্টারই আমায় বলে দিল হাঁটাপথে কিভাবে এগোলে আমি অল্প সময়ের মধ্যে সেখানে পৌঁছোতে পারব।

তখন কটা বেজেছিল মনে আছে?

তা দুপুর একটা তো বটেই, জেমস পিয়ার্সন বলতে লাগল, এরপর আমি থ্রি ক্রাউনস নামে একটা সরাইয়ে উঠলাম, সেখানে লাঞ্চ খেয়ে মামার কাছে যাব বলে রওনা হলাম।

কটা নাগাদ। মনে আছে?

দুঃখিত, তা ঠিক মনে করতে পারছি না।

 তিনটে? চারটে? সাড়ে চারটে?

ওই ওইরকমই হবে, আমতা আমতা করে জেমস জবাব দিল, তবে তার পরে নয়।

সরাইয়ের মালিক মিসেস বেলিং জানিয়েছেন, আপনি সাড়ে চারটে নাগাদ রওনা হয়েছিলেন। যাক, তারপর কি হল?

তুষার ঢাকা পথ মাড়িয়ে একসময় মামা হ্যাজেলমুর নামে যে বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন সেখানে পৌঁছোলাম, ওঁর সঙ্গে কথাবার্তা সেরে আবার সরাইয়ে ফিরে এলাম।

বেশ, এবার বলুন তো মিঃ পিয়ার্সন, মামার বাড়িতে পৌঁছোনোর পরে আপনি ভেতরে ঢুকলেন কিভাবে?

কেন? আমি নিচে কলিংবেল বাজালাম, তার কিছুক্ষণ পরে মামা নিজেই সদর দরজা খুলে দিলেন।

আপনাকে ওই সময়ে দেখে তিনি নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়েছিলেন, তাই না?

ঠিক ধরেছেন, মামা আমায় দেখে খুব অবাক হয়েছিলেন।

তা ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের সঙ্গে অর্থাৎ আপনার মামার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে গিয়ে কতটা সময় সেখানে কাটিয়েছিলেন মিঃ পিয়ার্সন?

তা পনেরো কুড়ি মিনিট তো বটেই, জেমস আবার আমতা আমতা করে বলল, কিন্তু বিশ্বাস করুন, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, আমি চলে আসার সময় মামা দিব্যি সুস্থ্য শরীরে জীবিত ছিলেন, এ আমি শপথ করে বলছি।

আপনি যখন ওঁর কাছ থেকে বিদায় নিলেন তখন কটা বেজেছিল।

দুঃখিত, দুচোখ নামিয়ে জেমস জবাব দিল, তা আমার ঠিক মনে নেই।

সত্য গোপন করা যে গুরুতর অপরাধ তা নিশ্চয়ই জানেন মিঃ পিয়ার্সন? পুলিশী ধাঁচে কড়া গলায় ধমকের সুরে বলে উঠলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, কটা নাগাদ আপনি আপনার মামার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন তা আপনার ঠিকই মনে আছে। ভাল চান তো সময়টা বলে ফেলুন।

তখন বিকেল সওয়া পাঁচটা বেজেছিল,ভীত গলায় জবাব দিল জেমস।

আবার মিথ্যে বললেন, একইরকম কড়া গলায় বললেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, আপনি বিকেল পৌনে ছটা নাগাদ থ্রি ক্রাউনস সরাইয়ে ফিরে এসেছিলেন। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বাড়ি থেকে হাঁটা পথে ওখানে পৌঁছোতে যে কোন সুস্থদেহী মানুষের সাত, বড়জোর আট মিনিটের বেশি সময় লাগার কথা নয়। তার মানে এটাই দাঁড়াচ্ছে যে মামার কাছ থেকে আপনি যখন বিদায় নিয়েছিলেন তখন ঘড়িতে পাঁচটা সাঁইত্রিশ কি আটত্রিশ বেজেছিল।

সোজাপথে তো সরাইয়ে ফিরে যাই নি, জেমস বলল, আমি একটু ঘুরপথে বেড়াতে বেড়াতে ফিরে এসেছিলাম, শহরের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে।

ওই প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর তুষারপাতের মধ্যে হেঁটে বেড়ানোর সাধ আপনার হল কি করে? যাক, মামার সঙ্গে কথাবার্তা কি হয়েছিল তাই বলুন।

তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনও বিষয় নিয়ে ওঁর সঙ্গে আমার কথাবার্তা হয়নি। জেমস বলল, মামা কেমন আছেন, ওঁর দিন কেমন কাটছে এইসব খোঁজখবর নিলাম, উনিও জানতে চাইলেন আমরা কে কেমন আছি, এইসব।

তোমার মতো পাকা মিথ্যেবাদী গোয়েন্দার জীবনে আমি খুব কমই দেখেছি, মনে মনে তার উদ্দেশ্যে বললেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, মুখে বললেন, তা জেমস, এবার আমার একটা সিধে সরল প্রশ্নের জবাব দিন। মামা খুন হয়েছেন জেনেও থানায় গিয়ে খোঁজখবর না নিয়ে আপনি গতকাল এক্সহ্যাম্পটন ছেড়ে লন্ডনে ফিরে এলেন কেন? কতবড় অন্যায় আপনি করেছেন তা বুঝতে পারছেন?

হয়তো অন্যায় করেছি। মুখ তুলে জেমস অকপটে জানাল, কিন্তু বিশ্বাস করুন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, আমি আসলে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। জানতে পেরেছিলাম আমি দেখা করে চলে আসার কিছুক্ষণ বাদেই মামা খুন হন। এবার আপনিই বলুন, আমার পক্ষে ভয় পেয়ে এইভাবে চলে আসাটা কি খুব অস্বাভাবিক ছিল? খবর পেয়েই আমি জিনিসপত্র সব গুছিয়ে নিই। তারপর স্টেশনে পৌঁছে পরের ট্রেন ধরে ফিরে আসি লন্ডনে। আমি যা করেছি তা পুরোপুরি বোকামি কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আমার পক্ষে আর কিই বা করণীয় ছিল বলতে পারেন?

এইটুকুই আপনার বক্তব্য হিসাবে ধরে নিতে পারি তাহলে?

হাঁ, অবশ্যই।

 তাহলে, মিঃ পিয়ার্সন, আপনাকে এখনই একবার আমার সঙ্গে স্থানীয় থানায় আসতে হবে, যেখানে আপনার এই বক্তব্য স্বীকারোক্তি আকারে আমি লিখে নেব, তারপর তাতে আপনাকে দিয়ে সই করিয়ে নেব।

ব্যাস, শুধু ওইটুকু?

না, আরও আছে, গম্ভীর গলায় ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, তারপরেই আপনি ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরে আসতে পারবেন তা ভাবনে না। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের খুনের তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি আপনাকে থানার হাজতে আটকে রাখব।

হা ঈশ্বর! জেমস পিয়ার্সন বিলাপ করে উঠল, আমায় এই বিপদ থেকে রক্ষা করার মতো কেউ কি এখানে নেই?

ঠিক সেইমুহূর্তে ড্রইংরুমের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল এক যুবতী। শুধু অপরূপ সুন্দরী বললে সেই যুবতীর রূপ বর্ণনা করা যায় না। তার চোখেমুখে জড়িয়ে রয়েছে এমনই এক অপার করুণার উৎস যা বহু চেষ্টা করা সত্ত্বেও ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। প্রথম দর্শনে যে কেউ তাকে এক মহীয়সী পরিত্রাতা বলে মনে করতে পারে।

কি ব্যাপার জিম? যুবতী জেমসকে প্রশ্ন করল, তোমায় এতো নার্ভাস দেখাচ্ছে কেন, কি হয়েছে?

সব শেষ হয়ে গেছে, এমিলি, জেমস ভাঙ্গা গলায় জানাল, ইনি গোয়েন্দা ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, উনি সন্দেহ করছেন যে মামাকে আমিই খুন করেছি, তাই এখন আমায় গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যেতে চাইছেন, বলছেন তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত থানার হাজতে আমায় আটকে রাখবেন।

হাতে পায়েই শুধু বড় হয়েছে। শাসন করার সুরে এমিলি বলতে লাগল, অথচ ঘটে একছিটে বুদ্ধি যদি তোমার থাকতো জিম। উকিল সঙ্গে না থাকলে যে পুলিশ অফিসারদের প্রশ্নের জবাব দিতে নেই এই কথাটা আর কবে তুমি শিখবে, বলতে পারো? নিশ্চয়ই বোকার মতো এমন কিছু বেফাঁস কথা বলে ফেলেছে যার জন্য উনি তোমায় থানায় নিয়ে যেতে চাইছেন। তুমি একটি আস্ত গদর্ভ। ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, আপনি ওকে গ্রেপ্তার করছেন কেন জানতে পারি?

সংক্ষেপে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বুঝিয়ে দিলেন যে মামার সঙ্গে দেখা করে সরাইয়ে ফিরে আসার কিছুক্ষণ পরে জেমস খবর পায় যে তিনি খুন হয়েছেন, তারপর পুলিশের সঙ্গে দেখা না করে ফিরে আসে লন্ডনে। জেমস বলছে যে ঘাবড়ে গিয়েই সে পালিয়ে এসেছে, কিন্তু আইনের চোখে তার এই আচরণ সন্দেহজনক, তাই তাকে গ্রেপ্তার করা ছাড়া আর কোনও পথ এই মুহূর্তে তার সামনে খোলা নেই।

বিশ্বাস করো এমিলি, আর্তনাদ করে উঠল জেমস পিয়ার্সন। এই জঘন্য আর নৃশংস কাজ আমি করিনি, বিশ্বাস করো।

নিশ্চয়ই ডার্লিং, এমিলি সায় দিয়ে বলল, আমি বিশ্বাস করছি যে এ খুন তুমি করোনি। আসলে মামাকে খুন করার হিম্মতই তোমার নেই।

হা ঈশ্বর। দুনিয়ায় বন্ধু বলতে আর কেউ আমার রইল না, যে আমার পাশে এসে দাঁড়াতে পারে! জেমস আবার বিলাপ করতে লাগল।

কে বলল নেই? এমিলি দুহাতে জেমসের গলা জড়িয়ে ধরে ফেলল, এই তো আমি আছি। ঘাবড়াও মাৎ, জেমস। আমার বাঁ হাতের এই অনামিকার দিকে একবার তাকাও

এই যে হীরের আংটিটা জ্বলজ্বল করছে তা তোমারই দেওয়া উপহার জিম। আমি তোমার বিশ্বস্ত প্রণয়নী। এতটুকু না ঘাবড়ে ইন্সপেক্টর ন্যারাকটের সঙ্গে যাও, উনি যা বলেন তাই করো। বাকি সব কিছু আমার ওপর ছেড়ে দাও, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। আর এও জেনে রেখো, তুমি যে একাধারে আস্ত গর্ধভ ও ভীতুর ডিম তা জানতে ওঁর বাকি নেই।

আপনার নামটা কি? ইন্সপেক্টর ন্যারাকট এমিলিকে প্রশ্ন করলেন।

এমিলি ট্রেফুসিস, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট।

গুড ইভিনিং, মিস ট্রেফুসিস। বলেই ইন্সপেক্টর ন্যারাকট জেমসকে নিয়ে দরজার দিকে এগোলেন।

অ রিবোয়ার ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, নিখুঁত ফরাসীতে পাল্টা বিদায় জানাল এমিলি। জেমসের মুখে আর কথা যোগালো না, পাশ থেকে টুপিটা তুলে মাথায় চাপিয়ে সে এমন ভয়ে ভয়ে ইন্সপেক্টর ন্যারাকটের পেছন পেছন যেতে লাগল যেন তাকে ফাঁসী দেবার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। থানায় যাবার আগে প্রেমিকার কাছ থেকে বিদায় নেবার কথাও ভয়ের চোটে ভুলে গেল জেমস পিয়ার্সন।

.

১১.

 ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের খুনের সঙ্গে যুক্ত সন্দেহক্রমে পুলিশ তার এক ভাগ্নেকে গ্রেপ্তার করেছে এই খবর সোমবারের মধ্যে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল গোটা এক্সহ্যাম্পটনে। গোড়ায় স্থানীয় খবরের কাগজগুলোয় যে ঘটনাটি পেছনের পাতায় মাত্র তিন চার লাইনে ছেপে প্রকাশ করেছিল, জেমস পিয়ার্সন গ্রেপ্তার হবার পরে তারাই নেমে পড়ল সত্য উদ্ঘাটনে, প্রথম পাতায় তারাই এই খবরকে যথোচিত গুরুত্ব দিয়ে ছাপতে শুরু করল। কে কত জোরালো সত্য কাহিনী লিখতে পারে তার প্রতিযোগিতা শুরু হল ওইসব কাগজের স্থানীয় রিপোর্টারদের মধ্যে। তবে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের খুনের রহস্য উদঘাটনের গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো যেহেতু চার্লস এন্ডারবিই সবার আগে যোগাড় করেছিল তাই অন্য কোনও খবরের কাগজের ক্রাইম রিপোর্টার তার চাইতে ভাল কভারেজ দিতে পারছিল না।

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের নাড়ীনক্ষত্র সবকিছুরই হদিশ যে মেজর বারনাবি রাখেন এটা সে জানতে পেরেছে আর বারনাবির ফটো ভোলা আর সাক্ষাৎকার নেবার ছুতোয় সে জোঁকের মতো সেঁটে আছে সবসময় তার সঙ্গে সঙ্গে।

দুপুরবেলা নিজের পয়সা খরচ করে মেজর বারনাবিকে লাঞ্চ খাওয়াল এন্ডারবি আর কিছুক্ষণ বাদেই ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা। মেজর বারনাবি লাঞ্চ খেয়ে বিদায় নেবার পরে থ্রি ক্রাউনস সরাইয়ে ঢোকবার সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়েছিল এন্ডারবি, আশে পাশে জমে থাকা তুষার গলতে শুরু করেছে তার ওপর ঠিকরে এসে পড়েছে সূর্যের উজ্জ্বল কিরণ, দুচোখ মেলে সেই দৃশ্য উপভোগ করছিল সে, এমন সময় এক অচেনা নারীকণ্ঠ তার কানে এল, মাপ করবেন–বলতে পারেন এই এক্সহ্যাম্পটনে দেখার মতো কি কি আছে?

মুখ ফিরিয়ে তাকাতেই এন্ডারবির চক্ষুস্থির। আঁটো ট্রাউজার্স আর জ্যাকেট চাপানো কাঁধে ঝোলাব্যাগ এমন এক রূপসী-যুবতীর সঙ্গে তার দৃষ্টি বিনিময় হল যার রূপের বর্ণনা তার মতো ঝানু রিপোর্টারের পক্ষেও দেওয়া সম্ভব নয়। মনে মনে আক্ষেপ করল এন্ডারবি, এই সুন্দরী যদি আমার প্রেমিকা হতো। মুখে বলল, একটা পুরোনো আমলের দূর্গ আছে, এন্ডারবি বলল, যদিও তাকে তেমন কোনও দ্রষ্টব্য কোনমতেই বলা যায় না। আপনি চাইলে আমি আপনাকে পথ দেখিয়ে সেখানে নিয়ে যেতে পারি।

আপনাকে গাইড হিসাবে পেলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করব, যুবতী বলল, আপনিই তো সাংবাদিক মিঃ এন্ডারবি, তাই না?

হ্যাঁ, অবাক হয়ে এন্ডারবি প্রশ্ন করল, কিন্তু আমার পরিচয় আপনি জানলেন কি করে?

এই সরাইয়ের মালিক মিসেস বেলিং বলেছেন, যুবতী বলল, আমার নাম এমিলি ট্রেফুসিস। মিঃ এন্ডারবি আপনার সাহায্য আমার খুব দরকার।

এন্ডারবি পুলকিত হয়ে বলল, নিশ্চয়ই করব, কিন্তু ব্যাপারটা কি বলুন তো?

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের খুনের সঙ্গে যুক্ত বলে সন্দেহক্রমে পুলিশ যাকে গ্রেপ্তার করেছে সেই জেমস পিয়ার্সন আমার প্রণয়ী, ওর সঙ্গে আমার এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে।

ওঃ, চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এন্ডারবি বলল, তাহলে এই ব্যাপার

আজ্ঞে হ্যাঁ, এমিলি বলল, কিন্তু জিম যে এই খুন করেনি সে বিষয়ে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত, আর তা প্রমাণ করব বলেই আমি এখানে ছুটে এসেছি, কিন্তু পুরুষ মানুষ পাশে না থাকলে কি এভোবড় কঠিন কাজ সফল করা সম্ভব? পুরুষ মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি সবই ভাল, মেয়েদের দিয়ে অতো ভালভাবে হয় না।

হ্যাঁ আমতা আমতা করে এন্ডারবি সাহস দিয়ে বলল, এ ব্যাপারে আমি আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত।

জানেন, আজ সকাল থেকে আরও কত বড় বড় রিপোর্টারদের সঙ্গে কথা বললাম, সাহয্য চাইলাম কিন্তু দেখলাম তাদের কারোর ঘটেই সেই বস্তুটি নেই যার নাম উপস্থিত বুদ্ধি, সবাই কেমন যেন বোকা বোকা মুখ করে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন আমার মুখের দিকে আর মাঝে মাঝে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। এঁদের মধ্যে শুধু আপনাকেই বুদ্ধিমান বলে মনে হল, তাই

ভুল করছেন ম্যাডাম, আপনি আমার সম্পর্কে খামোকা বাড়িয়ে বলছেন, আমি নিজেকে অতোটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি না।

আমার একটা প্রস্তাব আছে, এমিলি বলল, আপনি আর আমি দুজনে মিলে একসঙ্গে যদি অংশীদারের মতো এই খুনের তদন্তটা বেসরকারী পর্যায়ে করতে পারি তাহলে আপনি আর আমি দুজনেরই লাভবান হবার সম্ভাবনা।

কিভাবে, এন্ডারবি প্রশ্ন করল। আমি যাকে পুলিশের খপ্পর থেকে বাঁচাতে চাইছি সেই জেমস পিয়ার্সন নির্দোষ প্রতিপন্ন হয়ে বেকসুর খালাস পাবে আর এই রহস্যের তদন্ত করতে গিয়ে যে গোপন খবর আমাদের হাতে আসবে সে সবই আপনি স্কুপ হিসাবে যোগান দিতে পারবেন আপনার কাগজে। বুঝতে পারছেন না, আমি এ ব্যাপারে পুরোপুরি আপনার ওপরেই নির্ভর করতে চাইছি।

মুখে একসঙ্গে কাজ করার লোভ দেখালেও আসলে এমিলি চাইছিল এন্ডারবি তার অধীনে থেকে এক ধরনের বেসরকারী গোয়েন্দার কাজ করুক। এন্ডারবি যে তার রূপে মজেছে এটা বুঝতে তার বেগ পেতে হয়নি তাই এমিলি প্রস্তাব দেবার সঙ্গে সঙ্গে তার তোষামোদও করছিল। এমিলির ভাগ্য ভাল। এন্ডারবি সহজেই তার টোপটা গিলে ফেলল।

সত্যিই আপনার জবাব নেই। দেঁতো হাসি হেসে এন্ডারবি বলল, যেদিক থেকেই দেখা যাক না কেন আপনার তুলনা হয় না। বেশ, এমিলি তোমার প্রস্তাবে আমি রাজী, এখন থেকে সর্বান্তকরণে আমি তোমার সঙ্গে সহযোগিতা করব।

এবার তাহলে বাজে কথা বাদ দিয়ে বলো তো কোন দিক থেকে এগোবো? এমিলি জানতে চাইল।

আমি আজ বিকেলে সিটাফোর্ড যাচ্ছি, এন্ডারবি জানাল, তুমিও আমার সঙ্গে চলো না।

সেখানে কি আছে শুনি।

আছেন একজন,এন্ডারবি বলল, তার নাম মেজর বারনাবি, ক্যাপটেন ট্রেভিলিয়নের বহুদিনের পুরোনো বন্ধু। উনি ভীষণ সেকেলে রুচির লোক, খবরের কাগজের রিপোর্টার দেখলেই চটে যান। অথচ এই লোকই হালে আমাদের কাগজের একটা ফুটবলের খাবার সঠিক উত্তর পাঠিয়ে নগদ পাঁচ হাজার পাউন্ড পুরষ্কার পেয়েছেন।

তাহলে আমি যাচ্ছি, এমিলি বলল, আমি কোথাও গেলে কখনও খালি হাতে ফিরে আসি না, কিছু না কিছু একটা ঠিকই জোগাড় করি।

থ্রি ক্রাউনস সরাইখানা থেকে বেরিয়ে পথ দেখিয়ে এমিলিকে পুরোনো দুর্গের কাছে নিয়ে এল এন্ডারবি, কিন্তু এমিলি দুর্গের ভেতরে ঢোকার কোনও আগ্রহ না দেখিয়ে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান-এর খুনের তদন্ত সম্পর্কে আলোচনায় মেতে উঠল তার সঙ্গে।

আসুন, খাঁটি গোয়েন্দার চোখ দিয়ে আমরা গোটা পরিস্থিতিটা বিচার করে দেখি, বলেই পকেট থেকে নোটবই আর পেনসিল বের করল এমিলি। তার পাতায় পাতায় লেখা নামগুলোয় চোখ বুলিয়ে সে বলতে লাগল :

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের মৃত্যু হলে যারা লাভবান হবে তাদের মধ্যে আছেন–(১) আমার ভদ্রলোক, (২) ওর বোন সিলভিয়া আর ওদের মাসী জেনিফার গার্ডনার যাঁর স্বামী যুদ্ধ থেকে পঙ্গু হয়ে ফিরেছেন। সিলভিয়াকে নির্দোষ হিসাবে ধরে নেওয়া যায়, জীবনে একটা মাছিও মারে নি সে। কিন্তু তার লেখক স্বামীটি খুব সুবিধার লোক নন, মদ আর মেয়েমানুষ সংক্রান্ত যতরকম নোংরামি আছে তার কোনটিতেই তার অরুচি নেই। টাকার পিছনে ও দিনরাত পাগলের মতো ছুটে বেড়াচ্ছে। সিলভিয়া ওর মামার টাকাটা পেলে মার্টিন ঠিক সেটা হাতিয়ে নেবে, তারপর ওকে কিছু না জানিয়ে সরে যাবে ওর জীবন থেকে।

ভদ্রলোক তো খুবই রূপবান, এন্ডারবি বলল, মেয়েরা তো ওকে পুজো করে শুনেছি।

ভুল শুনেছেন, এমিলি বলল, যাদের স্বামী থেকেও নেই, সেইসব সোসাইটি লেডীরা মার্টিনের পেছন পেছন কুকুরের মত ঘুরে বেড়ান, তার সঙ্গে দুরাত কাটাতে পেলে ধন্য হয়ে যান। কিন্তু যাঁরা খাঁটি মানুষ তারা ওকে অন্তর থেকে ঘৃণা করে।

হ্যাঁ, সন্দেহভাজন ব্যক্তি হিসাবে মার্টিনের নামও লেখা যায়, এন্ডারবি নোট নিতে নিতে বলল, লেখকের ছদ্মবেশে এক শয়তান হলেও হতে পারে। আচ্ছা, তুমি কি মনে করো ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান-এর আসল খুনী এই অপরাধের যাবতীয় দায় জেমসের ঘাড়ে চাপাতে চাইছে?

তুমি আর আমি দুজনে মিলে যদি আসল খুনীকে খুঁজে বের করতে পারি তাহলে চারিদিকে দারুণ হৈ-চৈ পড়ে যাবে,এন্ডারবি বলল, আমি তখন হয়ে যাব ডেইলি অয়্যার কাগজের অপরাধ বিশেষজ্ঞ। কিন্তু এমিলি এসব ব্যাপার তো শুধু গল্প উপন্যাসেই ঘটে বলে জানি।

বোকার মতো কথা বোলো না। এমিলি চাপা ধমকের সুরে বলল, আমি যখন তোমার সঙ্গে হাত মিলিয়েছি তখন এসব আমার বেলাতেও ঘটবে জেনে রেখো।

আচ্ছা, এন্ডারবি বলল, তোমার জেনিফার মাসীকে কি সন্দেহের আওতায় রাখা যায়?

জনিফার মাসী লোক হিসাবে খুবই ভাল কিন্তু তাহলেও তদন্তের স্বার্থে ওঁকেও সন্দেহের বাইরে রাখা যায় না। ঘটনার সময় তিনি ছিলেন এক্সেটারে যা এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। এমনও হতে পারে যে জেনিফার মাসী ওঁর ভাইয়ের সঙ্গেও কোনও কারণে দেখা করতে এসেছিলেন। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান হয়তো সেইসময় ওঁর ভগ্নীপতি অর্থাৎ জেনিফার মাসীর স্বামী ক্যাপ্টেন গার্ডনার সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করেছিলেন যা শুনেই মাসী রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন, হাতের কাছে ওই মোটা নলটা দেখতে পেয়ে তাই দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত হেনেছিলেন তার ভাইয়ের মাথায়।

বাঃ, চমৎকার অনুমান। এন্ডারবি তারিফ করার সুরে বলে উঠল, আর কাকে সন্দেহ করছো?

আমি কাউকেই বাদ দিচ্ছি না, এমিলি বলল, এমন কি ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের রাঁধুনি কাম চাকর ইভানসকেও নয়। ইভানসের কাজকর্মে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান অবশ্যই চিরদিনই খুশি ছিলেন, উইলে তাকে বিশ্বস্ত বলে উল্লেখও করেছেন এবং তাকেও একশো পাউন্ড দেবার কথা উইলে লিখেছেন তিনি। থ্রি ক্রাউনস সরাইখানার মালিক মিসেস বিলিংয়ের বোনটিকে ইভানস হালে বিয়ে করেছে। মিসেস বিলিংয়ের পেট খুব আলগা, আমি দেখব ওঁর কাছ থেকে কিছু খবর বের করা যায় কিনা। যে পুলিশ কর্মচারীটি প্রথম ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের মৃতদেহ দেখতে পেয়েছিল সেই কনস্টেবল গ্রেভসের ঘোট শ্যালিকাও ওই সরাইয়ে চাকরী করে, আমি ওকেও হাত করব দেখে নিয়ে। পুলিশ এই খুনের তদন্ত করতে গিয়ে কখন কোন পথে এগোচ্ছে সে সবই আমি ওর কাছ থেকে জানতে পারব। তবে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান যাঁকে বাড়িভাড়া দিয়েছিলেন সেই মিসেস উইলেট আর তার মেয়ে ভায়োলেটকে আমার খুব অদ্ভুত বলে মনে হচ্ছে।

কেন? এন্ডারবি প্রশ্ন করল।

শীতকালের মাঝামাঝি নাগাদ বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন, এমিলি বলল, এটা প্রথম কারণ। দ্বিতীয় কারণ হল ওঁদের প্রেতচর্চার ব্যাপারটা, আচ্ছা তোমার নিজের কি এই ব্যাপারটাকে খুব জটিল ও রহস্যময় বলে মনে হচ্ছে না?

সে তো হচ্ছেই, এন্ডারবি সায় দিয়ে বলে, তবে এ সম্পর্কে কাগজে কিছু লেখার আগে নিয়মিত প্রেতচর্চা করেন এমন কিছু বিশিষ্ট লোকের সঙ্গে আলোচনা করব, তাদের মতামত নেব।

আরে, তেমন লোক তো আমাদের হাতের কাছেই আছেন।

 কে বল তো?

 কেন? এন্ডারবি বলল, স্যার আর্থার কোনান ডয়েল, যিনি শার্লক হোমসের মতো এক গল্পের গোয়েন্দা চরিত্র তৈরি করে প্রচুর নাম যশ অর্জন করেছেন।

স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের সঙ্গে প্রেত-চর্চার কি সম্পর্ক? এমিলি প্রশ্ন করল।

উনি নিজেই এক রহস্যময় মানুষ। এন্ডারবি বলল, গোয়েন্দা গল্প আর ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখে জীবনের অর্ধেক সময় কাটিয়েছেন, এখন বুড়োবয়সে ভূতপ্রেত আছে কি নেই তাই নিয়ে পড়াশোনা করছেন। বই পত্র পড়ছেন, পোভড়া বাড়িতে অর দুর্গে রাত কাটাচ্ছেন, যাকে বলে প্রেততাত্ত্বিক, গবেষণা। তবে এ সম্পর্কে আমার কোনো অভিজ্ঞতা নেই।

ভূতপ্রেতে আমার এতটুকু বিশ্বাস নেই, এমিলি বলল, আর অলৌকিক ব্যাপার বলে কিছু আছে একটা আমি বিশ্বাস করি না। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন হয়েছেন এই খবর সে এসে জানিয়ে গেল কিন্তু কে তার খুনী সে কথা চেপে গেল কেন? আসলে এসবের কোনও ভিত্তি নেই।

আমি একটা গাড়ি ভাড়া করেছি, এন্ডারবি বলল, আধঘণ্টার ভেতর আমরা দুজন তাতে চেপে পৌঁছে যাব সিটাফোর্ডে।

নাঃ, এবার দেখছি আমাকেই বলতে হচ্ছে চার্লস, তোমার জবাব নেই, এন্ডারবির ভাব আর ভঙ্গি অনুকরণ করে মন্তব্য করল এমিলি, যা দেখে এন্ডারবি না হেসে পারল না।

এবার তাহলে চলো, সরাইখানায় ফিরে যাই, এমিলি বলল, জামাকাপড় গুছিয়ে মিসেস বেলিংয়ের পেট থেকে দেখি কোনও খবর বের করতে পারি কিনা। পুলিশ জিমকে ধরে নিয়ে গেছে বলে আমার মন যে ভেঙ্গে গেছে তা বোঝাতে আমায় এবার নাকে কান্না কাঁদতে হবে।

.

১২.

থ্রি ক্রাউনস সরাইয়ে ফিরেই এমিলি দেখল বেলিং হলঘরের মাঝখানে এসে, দাঁড়িয়েছেন।

মিসেস বেলিং, এমিলি বলল, আজ বিকেলেই আমি রওনা হচ্ছি

আজ বিকেলেই? মিসেস বেলিং প্রশ্ন করলেন, তাহলে চারটে দশের ট্রেন ধরে এক্সেটারে যাচ্ছেন?

না, এমিলি জবাব দিল, আমি সিটাফোর্ড যাব। ভালকথা ওখানে আপনার চেনাশোনা এমন কেউ আছেন কি যাঁর কাছে ওঠা যায়?

সত্যি? মিসেস বেলিং প্রশ্ন করলেন, ইয়ে যদি কাউকে না বলেন তাহলে একটা খবর আপনাকে দেব মিস এমিলি।

আপনি নির্ভয়ে আমার কাছে মুখ খুলতে পারেন, এমিলি বলল, আমি ভুলেও কাউকে কিছু জানাব না।

মিঃ পিয়ার্সনকে চেনেন তো? মিসেস বেলিং গলা নামিয়ে বলে উঠলেন, পুলিশ ওঁকে গ্রেপ্তার করেছে।

সে কি? দুঃসংবাদ শুনে এমিলির বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল, কবে গ্রেপ্তার হলেন?

এই তো আজই, মিসেস বেলিং জবাব দিলেন, মাত্র আধঘন্টা আগে।

আমার পক্ষে এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক, মিসেস বেলিং,বলতে গিয়ে এমিলির গলা ধরে এল, দুচোখের কোন বেয়ে জল গড়াতে লাগল, আপনি হয়তো জানেন না যে আমরা দুজনেই পরস্পরকে ভালবাসি, শীগগিরই আমরা বিয়ে করব বলেও স্থির করেছিলাম কিন্তু তার আগেই এমন একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটল! হা ঈশ্বর! বিশ্বাস করুন মিসেস বেলিং এই জঘন্য অপরাধ ও করেনি, পুলিশ মিছিমিছি ওকে গ্রেপ্তার করেছে। এইটুকু বলে মিসেস বেলিংয়ের বুকে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

ঘটনা যখন ঘটেছে তখন শুধু কান্নাকাটি করে কোনও লাভ নেই বাছা,মিসেস বেলিং রুমালে এমিলির চোখের জল মোছাতে মোছাতে সহানুভূতির সুরে বললেন, তার চেয়ে এখন নিজেকে শক্ত করো। যে ভাবেই হোক, জিমকে বাঁচাতেই হবে।

তাহলে তো তোমায় সিটাফোর্ড-এ যেতে হবে, মিসেস বেলিং বললেন, ওখানে ভদ্রভাবে থাকার মতো জায়গা একটাই আছে তাহলে সিটাফোর্ড হাউস। ওই বাড়ির পাঁচ নম্বর মহলে থাকেন মিসেস কার্টিস, গরমের সময় উনি ঘরভাড়া দেন। কিন্তু অতদূর যাবে কিভাবে? গাড়িভাড়া করেছো?

না, এমিলি বলল, আমি মিঃ এন্ডারবির গাড়িতে চেপে যাব।

আর মিঃ এন্ডারবি নিজে কোথায় থাকবেন?

 কেন, এমিলি জবাব দিল, মিঃ এন্ডারবি সম্পর্কে আমার খুড়তুতো ভাই, আমরা দুজনে মিসেস কার্টিসের মহলের একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকব।

তাহলে তো খুবই ভাল হয়, মিসেস বেলিং বললেন, তাহলে আর দেরী না করে চোখেমুখে জল দিয়ে সেজেগুজে তৈরি হয় নাও, আর হ্যাঁ, শোন বাছা, আমি নিজেও এখানে চোখ কান সবসময় খোলা রাখব, তেমন কোনও খবর পেলেই তোমায় জানাব, পুলিশ কিছু টের পাবার আগেই।

সত্যি ম্যাডাম, এতক্ষণ বাদে এমিলি খুশিভরা গলায় মন্তব্য করল, আপনার দয়ার তুলনা হয় না।

চা খেয়ে থাকা খাওয়ার বিল মিটিয়ে এমিলি বেরিয়ে এল থ্রি ক্রাউনস সরাই থেকে। মিঃ এন্ডারবি তার পুরনো ফোর্ড গাড়ি নিয়ে তৈরি হয়েছিল, এমিলিকে দেখতে পেয়েই সে পেছনের দরজা খুলে দিল।

একটা কথা, এমিলি বলল, আপনাকে কিন্তু আমি আমার খুড়তুতো ভাই বলে পরিচয় দিয়েছি তা ভুলে যাবেন না। এটা গ্রামাঞ্চল কিনা, ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশা অনেকেই এখানে ভাল চোখে দেখে না।

বাঃ চমৎকার! এন্ডারবি মন্তব্য করল, তাহলে আমি তোমাকে এমিলি বলে ডাকব, কেমন?

একশোবার, এমিলি ঘাড় নেড়ে মুচকি হাসল। আর তোমায় ডাকব চার্লস বলে।

এমিলির কথা শেষ হতেই এন্ডারবি গাড়িতে স্টার্ট দিল।

.

১৩.

সিটাফোর্ড পৌঁছে সিটাফোর্ড হাউস খুঁজে বের করতে এমিলির আর চার্লসের অসুবিধে হল না, যথাসময়ে মিসেস কার্টিসের কাছে তাদের দুজনের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাও হয়ে গেল। মিসেস কার্টিস এমিলি আর চার্লসের আতিথ্যের ত্রুটি করল না, গোড়াতেই নিজের হাতে চা তৈরি করে খাওয়ালেন তাদের, আর সেই ফাঁকে তাঁর মুখ থেকে সিটাফোর্ড হাউসের বাসিন্দাদের নাম, ধাম, পেশা সবকিছুই কৌশলে জেনে নিল এমিলি। চা পর্ব শেষ হলে চার্লস এমিলিকে সঙ্গে নিয়ে মেজর বারনাবির কটেজের দিকে রওনা দিল। ঘটনাচক্রে তখনই ইন্সপেক্টর ন্যারাকট এসে হাজির হলেন সিটাফোর্ড হাউসে, সোজা মিসেস উইলেটের সঙ্গে দেখা করে নিজের পরিচয় দিলেন তিনি, কথা প্রসঙ্গে জানালেন যে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের খুনের ব্যাপারে তিনি তাদের কিছু প্রশ্ন করবেন। মিসেস উইলেটের মেয়ে ভায়োলেটও সেইসময় বসেছিলেন তার মায়ের গা ঘেঁষে।

আপনি কি জানতে চান বলুন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, মিসেস উইলেট বললেন, আমি যতদূর সম্ভব সঠিক উত্তর দিয়ে সাহায্য করব আপনাকে। হয়তো এই বাড়িতে এমন কোনও সূত্র থাকতে পারে যা এই খুনের তদন্তে আপনাকে সাহায্য করতে পারবে। কিন্তু তেমন কিছু আদৌ আছে কিনা সে বিষয়ে আমার খুব সন্দেহ আছে। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান তাঁর ব্যক্তিগত যা কিছু ব্যবহার্য জিনিসপত্র ছিল সব এ বাড়ি থেকে অনেক আগেই সরিয়ে ফেলেছিলেন, এমনকি ওঁর মাছ ধরার ছিপখানা পর্যন্ত। হয়তো উনি ধরেই নিয়েছিলেন যে ভাড়াটে হিসাবে ওঁর এইসব সৌখীন জিনিসের কোনরকম যত্ন আমি করব না তাই।

তার মানে ওঁর সঙ্গে আপনার আগে থাকতে পরিচয় হয়নি?ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন।

না, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, আমি এই বাড়ি ভাড়া নেবার পরে কতবার চিঠি লিখে ওঁকে আসবার জন্য অনুরোধ জানিয়েছি, এমন কি ডিনারের নেমন্তন্ন পর্যন্ত করেছি, কিন্তু উনি একবারও আসেন নি। আসলে উনি যে ভীষণ লাজুক আর মুখ চোরা লোক ছিলেন তাতে আমার এতটুকু সন্দেহ নেই। অথচ দুঃখের ব্যাপার হল অনেকেই এই স্বভাবের জন্য ওঁকে নারীবিদ্বেষী বলতো।

দেখুন ম্যাডাম, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, আমি যতদূর জেনেছি ক্যাপ্টেন ট্টেভিলিয়ানের মৃতদেহ সবার আগে আবিষ্কার করেন ওঁর পুরোনো বন্ধু মেজর বারনাবি আর এও জেনেছি যে তার আগে এখানে প্রেতচর্চার অনুষ্ঠানে মিলিত হয়েছিলেন।

ইন্সপেক্টর ন্যারাকটের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে ভায়োলেটের গলার ভেতর থেকে ক্ষীণ আর্তনাদের মতো একটা শব্দ বেরিয়ে এল।

বেচারী ভায়োলেট! মেয়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে মিসেস উইলেট মন্তব্য করলেন এই ঘটনা ঘটবার ফলে ও মানসিক দিক থেকে ভয়ানক ভেঙ্গে পড়েছে। অবশ্য শুধু ও একা নয়, আমাদের সবারই একই অবস্থা। আমি কুসংস্কারাচ্ছন্ন নই, কিন্তু তাহলেও ব্যাপারটা অলৌকিকভাবে আমার চোখের সামনে ঘটেছিল।

সত্যি বলছেন? ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন।

নিশ্চয়ই। মিসেস উইলেট জবাব দিলেন, যদিও গোড়ায় আমরা ব্যপারটাকে নিছক মজা বলেই ধরে নিয়েছিলাম। রোনাল্ড গারফিল্ড নামে এক তরুণ সেদিন ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। আমরা গোড়ায় তাকেও সন্দেহ করেছিলাম, ভেবেছিলাম এটি ওঁরই কাজ।

তাহলে গোড়ায় যা নিছক মজা বলে মনে হয়েছিল তাই এখন আপনার কাছে এক অলৌকিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাই না?ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন, সাধারণ ভাবে যার ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না?

ঠিক ধরেছেন, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, মিসেস উইলেট জবাব দিলেন, আমি এখন নিশ্চিত যে যেদিন আমাদের এই প্রেতচক্রের অনুষ্ঠানে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন হয়েছেন বলে যে খবর আমরা পেয়েছিলাম তা নিশ্চয়ই কোনও অশরীরী প্রেতাত্মা আমাদের জানিয়েছিল।

তাই, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট এবার ইচ্ছে করেই প্রসঙ্গ পাল্টালেন, আচ্ছা দক্ষিণ আফ্রিকার কোন অংশে আপনারা থাকতেন?

আমরা কেপ টাউনে থাকতাম, ইন্সপেক্টর, মিসেস উইলেট জবাব দিলেন, আমার মেয়ে আগে কখনও ইংল্যান্ডে আসেনি, তাই এখানে এসে তুষারপাত দেখে ও মুগ্ধ হয়ে গেছে।

তা অন্যান্য জায়গা থাকতে আপনি বেছে বেছে এই এলাকায় এলেন কেন? ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন।

আমরা ডিভনশায়ার বিশেষতঃ ডার্টমুর সম্পর্কে প্রচুর বই পড়েছি, মিসেস উইলেট জবাব দিলেন, জাহাজেও এই জায়গার ওপর গাদা গাদা বই পড়েছি আর তার ফলেই আগ্রহ বেড়েছে।

কিন্তু তাই বলে এক্সহ্যাম্পটনে? ইন্সপেক্টর ন্যারাকট আবার প্রশ্ন করলেন, এতো একেবারে অজপাড়াগাঁ, অনেকেই এর নাম শোনে নি।

আগেই তো আপনাকে বললাম ইন্সপেক্টর যে এই এলাকা সম্পর্কে প্রচুর বইপত্র আমরা পড়েছি। তাছাড়া এখানে আসার পথে জাহাজে একজন যুবকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, এক্সহ্যাম্পটন সম্পর্কে তার মুখেও অনেক প্রশংসা শুনেছি।

তরুণ যুবক? ইন্সপেক্টর ন্যারাকট জানতে চাইলেন, তা ছেলেটির নাম কি বলুন তো?

ভুরু কুঁচকে মিসেস উইলেট জবাব দিলেন, কি যেন ওর নাম, বুলেস না স্মাইথ, তা ঠিক মনে পড়ছে না।

তারপরেই আপনার এই জায়গাটা ভাল লেগে গেল আর আপনি বাড়ির দালালদের ধরে ধরে চিঠি লিখতে লাগলেন যাতে এখানে আপনার পছন্দমত একটা বাড়ি তারা যোগাড় করে দেন, তাই না?

হ্যাঁ, ইন্সপেক্টর, মিসেস উইলেট ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে বললেন, আপনি যা বললেন ঘটনাটা ঠিক তাই ঘটেছিল।

ভদ্রমহিলা নিজেকে খুব চালাক ভাবেন, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট নিজের মনেই মন্তব্য করলেন, আড়চোখে তাকিয়ে দেখলেন ভায়োলেটের দুচোখ আগুনের মতো জ্বলছে। গোটা বাড়িখানা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তল্লাসী করলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, কিন্তু এমন কিছুই তার হাতে এল না যা তদন্তের কাজে সাহায্য করতে পারে। তল্লাসী সেরে ফিরে এসে আবার মিসেস উইলেটের মুখোমুখি কৌচে বসলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, আর তখনই ভায়োলেটের দুচোখে ভয়ের ছায়া স্পষ্ট দেখতে পেলেন তিনি।

এ কিরকম ব্যাপার? নিজের মনে নিজেকে প্রশ্ন করলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের খুনের সঙ্গে সত্যিই, যদি ওদের কোনও সম্পর্ক না থাকে তাহলে ভায়োলেট মিছিমিছি ভয় পাচ্ছে কেন? পেট থেকে কথা বের করার উদ্দেশ্যে একটা তীর ছুঁড়ে দিলেন তিনি ভায়োলেটের দিকে।

আচ্ছা ভায়োলেট, তুমি তো পিয়ার্সনকে ভালভাবেই চেনো, নাই না?

ইন্সপেক্টর ন্যারাকটের মুখের কথা শেষ হবার আগেই ভায়োলেটের দুচোখ হঠাৎ কপালে উঠল। দুহাত দুপাশে ছড়িয়ে সে জ্ঞান হারিয়ে কৌচ থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল মেঝের কার্পেটের ওপর।

বেচারী ভায়োলেট! দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিসেস উইলেট মন্তব্য করলেন, ওর দেহ মন দুদিক থেকেই বড্ড দুর্বল। প্রথমে এই প্রেতচক্র, তারপরে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের রহস্যময় মৃত্যু, এসব ঘটনা ওর স্নায়ুর ওপর প্রভাব ফেলেছে, তাই মাথা ঠিক রাখতে পারেনি, ইন্সপেক্টর।

ধন্যবাদ ম্যাডাম, কৌচ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট জবাব দিলেন, আমার যেটুকু জানার ছিল তা জানা হয়ে গেছে। আজকের মতো আমি বিদায় নিচ্ছি।

কথা শেষ করে তিনি আর একটি মুহূর্ত দাঁড়ালেন না, সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন নিচে।

.

১৪.

দেখুন না মেজর বারনাবি, এমিলির গলায় অসহায় ভাব ফুটে বেরোল, জিম পিয়ার্সনের সঙ্গে আমার বিয়ের সব ঠিকঠাক, এদিকে মাঝখান থেকে পুলিশ খামোকা ওকে খুনী সন্দেহে গ্রেপ্তার করল। এখন আমি কি করি বলুন তো?

সত্যিই তো, মেজর বারনাবি সায় দিয়ে বললেন, এতো রীতিমতো আতঙ্কের ব্যাপার। বিশ্বাস করো এমিলি, তোমায় সমবেদনা জানাবার ভাষা এই মুহূর্তে আমি খুঁজে পাচ্ছি না। বলতে বাধা নেই, আমি একেবারের জন্যও জিম পিয়ার্সনকে সন্দেহজনক বলে মনে করছি না।

পুলিশ না মানলেও আপনি যে জিমকে নির্দোষ হিসাবে মনে করেন তাতেই আমি কৃতজ্ঞ বোধ করছি মেজর। এমিলি মন্তব্য করল, আচ্ছা আপনার কি ধারণা জানতে পারি। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের খুনী কে হতে পারে?

দেখুন ম্যাডাম, মেজর বারনাবি বললেন, আমার ধারণা বাইরে থেকে কেউ বাড়িতে ঢুকে ওঁকে খুন করেছে কিন্তু পুলিশ তা মানতে রাজী নয়। তবে যে যাই বলুক না কেন এটা ঠিক যে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের কোনও শত্রু ছিল না।

আচ্ছা, উনি যাদের বাড়ি ভাড়া দিয়েছিলেন সেই মিসেস উইলেট আর তার মেয়ে মানুষ হিসাবে কেমন? এমিলি প্রশ্ন করল।

ওঁরা তো খুব ভাল লোক বলেই শুনেছি, মেজর বারনাবি জবাব দিলেন, যেমন দয়ালু তেমনি পরোপকারী।

তবু এতো জায়গা থাকতে ওঁরা হঠাৎ সিটাফোর্ডের মতো এক অজ পাড়াগেঁয়ে এসে হাজির হলেন কেন?

দেখুন ম্যাডাম, এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি একবারের জন্যও মাথা ঘামাইনি, মেজর বারনাবি জবাব দিলেন।

ধন্যবাদ মেজর, এন্ডারবি দাঁড়িয়ে উঠে বলল, আজকের মতো আমরা বিদায় নিচ্ছি, কিন্তু আগামীকাল সকালে আমি ক্যামেরা নিয়ে আবার এসে হাজির হব, আপনার একটা ফটো তুলব, তাছাড়া এক সাক্ষাৎকারও নেব।

বেশ তো, নেবেন। বলে মেজর বারনাবি হাত তুলে তাদের দুজনকেই বিদায় জানালেন।

ফিরে এসে মুখোমুখি বসল এমিলি আর এন্ডারবি, মাথার টুপিটা খুলে খাটের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এমিলি বলল, চার্লস, মিসেস উইলেট যে প্রেতচর্চার অনুষ্ঠান করেছিলেন তার নাম টেবল টার্নিং। প্রেতচর্চা বলে উল্লেখ করা হলেও এটা আসলে এক ধরনের খেলা যেখানে মানসিক চিন্তাতরঙ্গ হাতের সূক্ষ্ম পেশীগুলোকে নিয়ন্ত্রিত করে আর তারই ফলে টেবলের পায়া ওঠানামা করে, এর মধ্যে ভূতপ্রেতের কোনও ব্যাপার নেই।

হ্যাঁ, এন্ডারবি ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে বলে, ছাত্রজীবনে হোস্টেলে থাকতে এই খেলা আমিও বহুবার খেলেছি। ব্যাপারটা যে পুরোপুরি মনস্তাত্ত্বিক সেদিক থেকে আমি নিজেও তোমার সঙ্গে পুরোপুরি একমত।

এখন দেখতে হবে সেদিনের ওই অনুষ্ঠানে কারা কারা উপস্থিত ছিলেন, এমিলি বলল, আর সবাইকে বাদ দিলেও মেজর বারনাবি আর মিঃ রাইক্রফটের নাম কেন কে জানে বারবার আমার মনে ওঠাপড়া করছে। ওঁদের দুজনের মধ্যে একজন যদি ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানকে খুন করে থাকেন তবে তা মোটেই অস্বাভাবিক হবে না। এছাড়া ছিলেন, মিঃ ডিউক যার সম্পর্কে এখনও আমরা কিছুই জানি না। এছাড়া মিসেস উইলেট আর তার মেয়ে ভায়োলেট দুজনেই আমার কাছে রহস্যময় চরিত্র।

কিন্তু ট্রেভিলিয়ানকে খুন করার পেছনে তাদের কি স্বার্থ থাকতে পারে? এমিলি প্রশ্ন করল।

বাইরে থেকে দেখলে কোনও স্বার্থ নেই বলেই মনে হয় বটে। এন্ডারবি উত্তর দিল, কিন্তু আমার ধারণা কোথাও নিশ্চয়ই কোনও একটা যোগসূত্র রয়েছে। সেটা কি তাই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।

এমিলি কিছু মন্তব্য করতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই কাছে কোথায় গম্ভীর এক ঘন্টাধ্বনী হল, সেই আওয়াজ অনেকক্ষণ পর্যন্ত প্রতিধ্বনিত হল।

আওয়াজটা শুনলে? বলতে বলতে মিসেস কার্টিস একতলা থেকে দ্রুতপায়ে ওপরে

ঠে এলেন।, এমিলি বলল,লরে প্রিন্সট

শুনলাম, এমিলি বলল, কিন্তু ওটা কিসের ঘণ্টা ম্যাডাম?

এখান থেকে বারো মাইল দূরে প্রিন্সটাউনে জেলের পাগলাঘন্টার আওয়াজ এটা। মিসেস কার্টিস বললেন, এর অর্থ হল জেলখানা থেকে একটু আগে কোনও কয়েদী পালিয়েছে। এইটুকু বলে মিসেস কার্টিস আর দাঁড়ালেন না, আগের মতোই দ্রুতপায়ে আবার নিচে নেমে গেলেন তিনি।

ইস, এন্ডারবি বলল, সময়মতো সবকিছু ঘটে না, এটাই দুঃখের ব্যাপার। গত শুক্রবার দিন যদি এই কয়েদীটা পালাতো তাহলেই সহজেই ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের খুনীকে ধরতে পুলিশের নিশ্চয়ই এতটুকু অসুবিধা হতো না।

হয়তো তাই, সায় দিয়ে বলল এমিলি।

 তা না করে ব্যাটা তিনদিন পরে পালাল, এন্ডারবি বলল, যখন সবকিছু পুরো জটিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

এমিলি এবারে আর কোনও মন্তব্য করল না।