০৫. ট্রেভিলিয়ানের ঠিকে রাঁধুনি

০৫.

ট্রেভিলিয়ানের ঠিকে রাঁধুনি ইভানস খাবার ঘরে একটি চেয়ারে বসেছিল, সার্জেন্ট পোলককে সঙ্গে নিয়ে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট যেখানে আসতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে।

ইভানস বেঁটেখাটো স্বাস্থ্যবান চেহারার লোক, তার হাত দুখানা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ লম্বা, দুহাতের মুঠো অর্ধেক বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকার অভ্যেস আছে তার। ইভানসের দাড়ি গোঁফ পরিষ্কার কামানো, তার গোলাকার মুখে ক্ষুদে দুটি চোখের চাউনি খুব সতর্ক আর তীব্র, হঠাৎ দেখলে বুলডগের কথা মনে পড়ে। ইভানস যে অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও ধূর্ত প্রকৃতির লোক তা একনজর তাকে দেখেই বুঝতে পারলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট।

তোমার পুরো নাম কি?

হাত নেড়ে ইসারায় তাকে বসতে বলে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট।

আজ্ঞে রবার্ট হেনরী ইভানস।

ভাল, খুব ভাল। এবার বলো তো বাপু, ওই খুনের ঘটনা সম্পর্কে তুমি কতটুকু জানো?

আজ্ঞে আমি কিছুই জানি না স্যার, ইভানস কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, কাপ্তেন আর আমি আগে বহু জাহাজে একই সঙ্গে কাজ করেছি, উনি ছিলেন জাহাজের কম্যান্ডার, আর আমি ছিলাম ওঁর জাহাজের রান্নাঘরের হেড বাবুর্চি। আমার হাতে তৈরি রান্না কাপ্তেনের খুব প্রিয় ছিল। ওঁর মৃত্যুতে তাই আমার বুকের পাঁজরগুলো ভেঙ্গে গেছে। হতে পারেন উনি ছিলেন বড় অফিসার আর আমি এক খুদে খালাসী, তাহলেও একসঙ্গে অনেকগুলো বছর আমরা কাটিয়েছি তো, গত বিশ্বযুদ্ধেও লড়েছি।

ইভানস তার মনের যে ভাব প্রকাশ করতে চাইছে তার পুরোটাই যে ছলনা নয় সে সম্পর্কে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট নিঃসন্দেহ হলেন।

গতকাল শেষবার কখন তুমি ওঁকে জীবিত অবস্থায় দেখেছিলে?

তখন বেলা প্রায় দুটো হবে স্যার,ইভানস বলল, কাপ্তেনের লাঞ্চ খাওয়া শেষ হলে আমি তার এঁটো বাসনপত্র সরিয়ে নিয়েছিলাম টেবিল থেকে। কাপ্তেন নিজেই বললেন যে বিকেলে আমার আসবার দরকার নেই।

পরশুদিন বিকেলে তুমি এ বাড়িতে কাজ করতে এসেছিলে? ইন্সপেক্টর ন্যারাকট জানতে চাইলেন।

আজ্ঞে না স্যার, ইভানস বলল, যেভাবে একটানা তুষার পড়েছিল তাতে বিকেলে আর বাড়ি থেকে আমি বেরোতে পারিনি। কাপ্তেন অবশ্য এজন্য আমাকে কিছু বলেননি, এদিক থেকে উনি ছিলেন খুব ভালো মনিব, খুব বিবেচক। যতক্ষণ পর্যন্ত আমি ভালোভাবে কাজ করছি, চুরিচামারি করছি না, ততক্ষণ পর্যন্ত উনি আমায় ঘাঁটাবেন না এই ধাঁচের মনিব ছিলেন উনি। বহুদিন ধরে তো দেখছি, কাপ্তেন বরাবর এইরকমই ছিলেন।

গতকাল দুপুরে উনি তোমায় ঠিক কি বলেছিলেন তা মনে আছে?

আছে হুজুর,ইভানস রুমালে চোখ মুছে বলল, জানালা দিয়ে বাইরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন কাপ্তেন, তারপর নিজের মনে বলে উঠলেন, মনে হচ্ছে আজ বারনাবি আসতে পারবে না, এই বিশ্রী দিনে আসবেই বা কি করে। কাপ্তেনের পুরোনো বন্ধু মেজর বারনাবি প্রত্যেক শুক্রবার এখানে আসতেন আবার প্রত্যেক মঙ্গলবার কাপ্তেন যেতেন ওঁর কাছে। দুই বন্ধু দাবা খেলতেন, আর ছিলেন ক্রসওয়ার্ড পাজলের ভক্ত। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে কাপ্তেন হঠাৎ বলে উঠলেন, ইভানস তুমি বাড়ি যেতে পারো, আজ বিকেলে আর আসবার দরকার নেই। আবার কাল সকালে এসো।

মেজর বারনাবি ছাড়া তোমার মনিব আর কারো কথা বলেছিলেন কি যার এখানে আসবার কথা ছিল?

না স্যার, তেমন কিছু তো গতকাল ওঁকে বলতে শুনিনি।

ওঁর কথাবার্তায় বা আচরণে এমন কিছু দেখেছিলেন যা তোমার চোখে অস্বাভাবিক ঠেকেছিল?

না স্যার।

 আচ্ছা ইভানস, তুমি হালে বিয়ে করেছ তাই না?

হ্যাঁ স্যার, ইভানস বলল, মিসেস বেলিংয়ের মেয়েকে আমি বিয়ে করেছি।

কিন্তু শুনলাম তোমার এই বিয়ের ব্যাপারে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান নাকি খুশি হয়নি, কথাটা সত্যি?

ঠিকই শুনেছেন স্যার। ইভানস ধীরে ধীরে বলল, আমার স্ত্রী রেবেকার রান্নার হাত খুব ভালো আর তাই আমি একসময় স্থির করেছিলাম যে তাকেও এখানে ঠিকে কাজে লাগিয়ে দেব। এ বাড়িতে আর কেউ তো নেই, কাপ্তেনকে বিপদে আপদে দেখাশোনা করার কেউ নেই, রেবেকা থাকলে এই অভাব মিটতো। কিন্তু কাপ্তেন আমার সে প্রস্তাবে একবারও রাজি হননি, বারবার আমায় বলতেন যে বাড়িতে কাজের লোক হিসেবে কোন মেয়েকে তিনি কাজে বহাল করবেন না। এরপর কাপ্তেন মিসেস উইলেটকে ওঁর সিটাফোর্ড হাউস বাড়িটা ভাড়া দিলেন আর নিজের থাকার জন্য এই হ্যাজেলমুর বাড়িটা ভাড়া নিলেন। সেই থেকে আমি কাপ্তেনের দুবেলা রান্নাবান্না আর ঘরদোর দেখাশোনার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলাম। বিশ্বাস করুন স্যার, আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে শীতের শেষে মিসেস উইলেট আবার ফিরে যাবেন দক্ষিণ আফ্রিকায় আর তখন কাপ্তেনও ভাড়া বাড়ি ছেড়ে ফিরে যাবেন ওঁর নিজের বাড়িতে। তখন রেবেকাকেও আমি সেখানে নিয়ে যেতে পারতাম। একরকম ঠিক করেই রেখেছিলাম যে রেবেকা সারাদিন রান্নাঘরেই ব্যস্ত থাকবে, আমি অন্যান্য কাজকর্ম করব, রেবেকার মুখ যাতে কাপ্তেন সারা দিনে একবারও দেখতে না পান সে ব্যবস্থা আমি করব। কিন্তু সবই পোড়াকপাল, মাঝখান থেকে সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল।

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান মেয়েদের ওপর এমন হাড়ে হাড়ে চটেছিলেন কেন তা বলতে পারো?

হাড়ে হাড়ে চটা নয় স্যার, ইভানস মুচকি হেসে বলল, আসলে উনি ছিলেন খুব লাজুক স্বভাবের লোক তাই মেয়েদের সঙ্গে নিজে থেকে মেলামেশা করতে পারতেন না। এমন ধাঁচের পুরুষ আকছার দেখা যায়, সাধারণত অল্পবয়সে মেয়েদের হাতে কোনো কারণে নাকাল হলে এরা সবাই মেয়েদের ওপর এমনি রেগে যায়।

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান বিয়ে করেছিলেন?

 না, স্যার, উনি ছিলেন চিরকুমার।

ওঁর আত্মীয়রা কোথায় আছেন জানো?

স্যার, যতদুর জানি এক্সেটারে কাপ্তেনের এক বোন থাকেন,ইভানস বলল, তাছাড়া ওঁর মুখ থেকেই এক ভাইপো না ভাইঝির কথাও শুনেছিলাম।

এঁরা কেউ ওঁর সঙ্গে কখনো দেখা করতে আসতেন না?

না স্যার, ইভানস বলল, যতদূর জানি ওঁর এক বোন এক্সেটারে থাকেন। তার সঙ্গে ওঁর ঝগড়াঝাটি হয়েছিল।

ভদ্রমহিলার পদবী কি জানো?

গার্ডনার, স্যার, নাম কি তা বলতে পারব না।

ওঁর ঠিকানা দিতে পারবে?

না স্যার, ওঁর ঠিকানা তো আমার জানা নেই।

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বৈষয়িক দলিলপত্র যে আমাদের খুঁটিয়ে দেখতে হবে তা আর নতুন করে বলার দরকার নেই। যাক, ইভানস, এবার বলো তো, গতকাল বিকেল চারটের পর থেকে তুমি কি করছিলে?

আমি বাড়িতে ছিলাম স্যার।

তোমার বাড়ি কোথায়?

এই তো মোড়ের মাথায় স্যার, ৮৫ নম্বর, ফোর স্ট্রীট।

বিকেলবেলা একবারও বাড়ি থেকে বেরোওনি তুমি?

না স্যার, ইভানস মুখ নামিয়ে বলল, তাছাড়া যেভাবে তুষার পড়ছিল তাতে বাইরে বেরোবোই বা কি করে?

সে তো বটেই। আচ্ছা ইভানস, তুমি যা বলছ তা যে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি, তা প্রমাণ করতে পারো?

আপনার কথাটা আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না স্যার।

আমি বলতে চাইছি ওই সময় কেউ তোমায় বাড়িতে থাকতে দেখেছিল? এমন লোক কেউ আছে?

আছে স্যার, ইভানস বলল, আমার স্ত্রী নিজে চোখে দেখেছে আমি বাড়ি ছেড়ে এক পাও বেরোইনি।

তাহলে তুমি আর তোমার স্ত্রী, দুজনেই গতকাল বিকেলে তোমাদের বাড়িতে ছিলে?

হ্যাঁ, স্যার।

মনে হচ্ছে তুমি সত্যি কথাই বলছ। যাক, তোমায় আর কোনো প্রশ্ন আপাতত করব না আমি।

স্যার, ইভানস বলল, যদি অনুমতি দেন তাহলে এবার আমি ঘরদোর সব সাফ করে ফেলতে পারি।

তা তো হবার নয় ইভানস, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, আমাদের তদন্তের কাজ যতদিন না শেষ হচ্ছে ততদিন যেখানে যা কিছু যে অবস্থায় আছে ঠিক সেই অবস্থায় রাখতে হবে, কিছু সরানো বা এদিক ওদিক করা চলবে না।

ঠিক আছে স্যার,ইভানস ঘাড় নেড়ে বলল, আপনি যখন বলছেন তখন তাই হবে।

আমি চারপাশে সবকিছু একবার ভাল করে দেখে নিই ইভানস, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি বরং অপেক্ষা করো, দরকার হলে তোমায় পরেও কিছু প্রশ্ন হয়তো করতে হতে পারে।

তাই হবে স্যার।

 ইভানসের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট এবার টেবিলের দিকে তাকালেন। রাতের খাবার টেবিলের ওপর খাবার সাজিয়ে রেখেছে ইভানস মোষের সেদ্ধ করা জিভ, চাটনি, পনীর, বিস্কুট, এছাড়া টেবিলের পাশেই গ্যাস উনুনের ওপর রাখা ডেকচিতে টগবগ করে ফুটছে স্যুপ। সাইডবোর্ডে সাজানো রয়েছে সোডার বোতল, গ্লাস আর দু বোতল বিয়ার। একপাশে ছোট একটি মীট সেফের ওপর থাকে থাকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে এক প্রস্থ রূপোর কাপ-ডিস, তাদের পাশে শোভা পাচ্ছে তিনটে উপন্যাস, একদম আনকোরা।

উপন্যাস তিনটে হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, তাদের নাম–প্রেম যেখানে শেষ কথা, লিংকটের ফুর্তিবাজেরা, প্রেমের বন্দী।

ক্যাপ্টেন নারীবিদ্বেষী হলেও বাছাই করার ব্যাপারে খুব রসিক পুরুষ ছিলেন দেখছি, চাপা গলায় মন্তব্য করলেন তিনি।

চাপাগলায় মন্তব্য করলেও ইভানসের কান এড়াল না, সে বলল, ভুল করলেন স্যার, পড়ার জন্য নয়, ক্যাপ্টেন ওই তিনটে বই একটা নামকরণ প্রতিযোগিতায় জিতে পুরষ্কার পেয়েছিলেন। এই বই তিনটি কোনোদিন ওঁকে পড়তে দেখিনি, পাতাও উল্টে দেখেননি।

খাবার ঘরখানা আকারে মাঝারি, এককোণে একটি আলমারি, তার সামনে এসে দাঁড়ালেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট। সার্জেন্ট পোলক এতক্ষণ তার পাশেই ছিলেন, একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি তিনি, এবার ইন্সপেক্টর ন্যারাকটের অনুমতি নিয়ে তিনি আবার ফিরে গেলেন স্টাডিতে যেখানে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন হয়েছিলেন।

আলমারির সামনে এসে দাঁড়াতে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট দেখতে পেলেন এক জোড়া স্কি, মাছ ধরার ছিপ, গলফ খেলার সরঞ্জাম, আর শিকার করার কিছু অত্যাবশ্যক সাজসরঞ্জাম ভেতরে শোভা পাচ্ছে। হাতির কেটে নেয়া পদ্মের পাতার মতো কান, জলহস্তীর চোয়াল, আর একটা চিতাবাঘের চামড়াও তার চোখে পড়ল। শুধু নারী বিদ্বেষী নয়, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান যে সর্বার্থে একজন খাঁটি পুরুষ ছিলেন এইসব দেখে সে সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হচ্ছিলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট।

আচ্ছা ইভানস, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন, সিটাফোর্ড হাউস তো মাস কয়েকের জন্য মিসেস উইলেটকে ভাড়া দিয়েছিলেন কাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান, তাই না?

হ্যাঁ স্যার, ইভানস বলল, আপনি ঠিকই শুনেছেন?

তাহলে খামোকা এসব জিনিস উনি এতদূরে এই ভাড়াবাড়িতে বয়ে আনলেন কেন? সিটাফোর্ড হাউসেই তো রেখে দিতে পারতেন?

সেটা আপনি বোঝেন, আমিও বুঝব, কিন্তু ক্যাপ্টেনকে বোঝাবে কে? ইভানসকে কিছুটা বিরক্তি মেশানোর গলায় বলল, ঠেলাগাড়িতে চাপিয়ে এসব জিনিস এতদূর বয়ে নিয়ে আসা কি কম ঝক্কি? ক্যাপ্টেনকে বহুবার বলেছি কিন্তু উনি কিছুতেই বুঝবেন না, বারবার বলতেন, ইভানস, যাকে বাড়ি ভাড়া দিয়েছি সে মেয়েমানুষ, আর আমার এইসব সাধের জিনিসের মর্ম বোঝ কোনো মেয়েমানুষের কর্ম নয়, আলমারির কাঁচ ভেঙ্গে চুরে সবকিছু ছড়িয়ে তছনছ করবে। তাই ওগুলো এখানে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম। আলমারির ভেতরে যা কিছু দেখছেন ক্যাপ্টেন ওগুলোকে নিজের ছেলেমেয়ের মতো ভালোবাসতেন।

আচ্ছা ইভানস,ইচ্ছে করেই ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রসঙ্গ পাল্টালেন, সিটাফোর্ড হাউস ট্রেভিলিয়ান যাকে ভাড়া দিয়েছিলেন, সেই মিসেস উইলেটের সঙ্গে ওঁর কি আগেই পরিচয় ছিল?

না স্যার,ইভানস বলল, উইলিয়ামসনস নামে একটা বড় কোম্পানি আছে যারা জমি আর বাড়ির দালালী করে, মিসেস উইলেট ওদের মাধ্যমেই এসেছিলেন।

 বাড়িটা ভাড়া নেবার আগে ওঁদের দুজনের দেখাসাক্ষাৎ হয়নি?

তা হয়েছিল বৈকি, মিসেস উইলেট বাড়ি দেখতে এলেন তখন ক্যাপ্টেনের সঙ্গে ওঁর পরিচয় হল।

আজ্ঞে ঠিক তাই।

 ক্যাপ্টেনের সঙ্গে মিসেস উইলেটের সম্পর্কটা বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল কি?

হ্যাঁ স্যার, ইভানস বলল, ভদ্রমহিলা ক্যাপ্টেনের সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেছিলেন।

আর তোমার মনিব?

স্যার, আমার মনিব ছিলেন এক পোড়খাওয়া জাহাজী,ইভানস মুখ টিপে হাসল, ওঁর মতো লোককে পটানো মিসেস উইলেটের কম্মো ছিল না। কিন্তু তাই বলে আমার মনিব কোনোদিন মিসেস উইলেটের সঙ্গে অভদ্রতা বা খারাপ ব্যবহার করেননি, তবে মিসেস উইলেট যখনই ওঁকে খাবার নেমতন্ন করতো ক্যাপ্টেন কোনো না কোনো ছুতোয় ঠিক তা এড়িয়ে যেতেন।

কেন, কোন উদ্দেশ্যে মিসেস উইলেট প্রায়ই কাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানকে খাবার নেমতন্ন করতেন? নিজের মনে নিজেকে প্রশ্ন করলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, ভদ্রমহিলা কি কাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের অংশটা পাকাপাকিভাবে দখল করতে চেয়েছিলেন যার পরিণতিতে শেষপর্যন্ত খুন হতে হল তাকে? হয়তো ভদ্রমহিলা ধরে নিয়েছিলেন খুব ঘনিষ্ট হবার পরে তিনি বাড়ির একটা অংশ নিজে কিনে নেবেন আর ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান তারপর বাকি জীবনটুকু তার বন্ধু মেজর বারনাবির বাড়িতে তারই সঙ্গে ভাগাভাগি করে কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু পরক্ষণেই ন্যারাকটের মনে পড়ল যে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান ভয়ানক বৈষয়িক লোক ছিলেন, প্রাণ গেলেও সিটাফোর্ড হাউসের তাঁর অংশটুকু তিনি কাউকে বিক্রি করবেন না, আর একজন মহিলাকে তো নয়ই।

মিসেস উইলেট মানুষ হিসাবে চমৎকার স্যার। ইভানস বলল, লোককে খাওয়াতে খুব ভালবাসেন। রোজ ওঁর বাড়িতে আত্মীয় বন্ধু কেউ না কেউ নিমন্ত্রিত হন।

ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বুঝলেন তিনি যা জানতে চাইছেন সে সম্পর্কে ইভানস এর চাইতে বেশি আলোকপাত করতে পারবে না। অগত্যা মিসেস উইলেটের সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি।

ইভানসকে পাঠিয়ে স্টাডি থেকে সার্জেন্ট পোলককে ডাকিয়ে আনলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলেন দুজনে।

কিরকম মনে হল স্যার? ইভানস সম্পর্কে ইশারায় মন্তব্য করলেন সার্জেন্ট পোলক, ওর বক্তব্যের মধ্যে সন্দেহজনক কিছু পেলেন কি?

না, ওসব কিছু নেই, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট উত্তর দিলেন, ইভানস আমার প্রশ্নের উত্তরে যা কিছু বলেছে তার মধ্যে মিথ্যে বা সন্দেহজনক কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। তবে ভবিষ্যতে ওর চরিত্রের কোনো পরিবর্তন ঘটবে কিনা তা কে বলতে পারে? অবশ্য একথা মানতেই হবে যে ইভানস খুব বুদ্ধিমান লোক, খুব হুঁশিয়ার হয়ে তবেই সে আমার এক একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে।

সার্জেন্ট পোলককে সঙ্গে নিয়ে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট এবার বাকি ঘরগুলো খানাতল্লাসি শুরু করলেন। গোটা বাড়িতে শোবার ঘর মোট তিনটে, এছাড়া আছে বাথরুম আর রান্নাঘর। দুটি শোবার ঘর একদম ফাঁকা। ভেতরে আসবাব দূরে থাক একটুকরো কাগজও পড়ে নেই। চারদিকে একপলক চোখ বুলিয়ে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট এ বিষয়ে নিশ্চিত হলেন যে গত কয়েক সপ্তাহ কেউই ওই দুটো ঘরের একটিতেও থাকেনি। এরপর তারা দুজনে এসে ঢুকলেন ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের নিজের ঘরটিতে। এ ঘরটি দিব্যি ছিমছাম ও ঝকঝকে, তকতকে, সবকটি আসবাবই যথেষ্ট রুচিসম্মতভাবে সাজানো। আসবাবগুলোর দেরাজ আর আলমারি খুলে ভেতরে সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলেন তারা দুজনে, কিন্তু কোনোরকম বিশৃঙ্খলা তাদের চোখে পড়ল না। প্রত্যেকটি জিনিস যথাস্থানে রয়েছে। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান যে খুব পরিপাটি স্বভাবের লোক ছিলেন সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট।

ট্রেভিলিয়ানের নিজের শোবার ঘর খানাতল্লাসি সেরে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট পোলককে সঙ্গে নিয়ে ঢুকলেন লাগোয়া বাথরুমে, কিন্তু সেখানেও সন্দেহজনক কোনো কিছু তাদের চোখে পড়ল না।

ওপরে তো কিছুই পাওয়া গেল না স্যার, সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে সার্জেন্ট পোলক মন্তব্য করলেন।

তাই তো দেখছি, সার্জেন্ট, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট মন্তব্য করলেন, কিন্তু স্টাডিতে যেসব কাগজপত্র আছে সেগুলো এখনও আমাদের দেখা হয়ে ওঠেনি। আমি চাই এই কাজটা আপনি নিজে করুন তাছাড়া ইভানসকে এখনকার মতো আমি ছেড়ে দিচ্ছি, ও বাড়ি চলে যাক। পরে দরকার মতো আমি নিজে ওর বাড়িতে গিয়ে দেখা করব ওর সঙ্গে।

তাই হবে স্যার। সার্জেন্ট পোলক গোড়ালি ঠুকে অভিবাদনের ভঙ্গিতে সায় দিল।

লাশ এবার সরানোর ব্যবস্থা করুন, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, আচ্ছা, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের লাশ যিনি প্রথম পরীক্ষা করেছিলেন সেই ডঃ ওয়ারেন তো কাছেই থাকেন, তাই না পোলক?

হ্যাঁ স্যার।

ওঁর সঙ্গে একবার দেখা করা দরকার, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, থ্রি ক্রাউনসের এপাশেই তো থাকেন উনি কেমন?

হ্যাঁ স্যার, পোলক ঘাড় নেড়ে হাসলেন।

তাহলে আমি আগে থ্রি ক্রাউনসের দিকেই যাব। নিন আপনি এখোন, সার্জেন্ট।

সার্জেন্ট পোলক দুটি আঙুল কপালের একপ্রান্তে ঠেকিয়ে আলতোভাবে স্যালুট করলেন তার ওপরওয়ালাকে। তারপর খাবার ঘরে ঢুকলেন তিনি। ইন্সপেক্টর ন্যারাকট সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলেন সেই বাড়ি থেকে, থ্রি ক্রাউনসের দিকে এগিয়ে চললেন তিনি।

.

০৬.

থ্রি ক্রাউনস সরাইখানার মালিক মিসেস বেলিং ইন্সপেক্টর ন্যারাকটকে খাতির করে বসালেন। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের খুনের প্রসঙ্গ উঠতেই গলা চড়িয়ে বলে উঠলেন তিনি, খুনীর আর দোষ কি, বাড়িতে ওঁর দেখাশোনা করার মতো দ্বিতীয় কেউ ছিল না, একটা কুকুর পর্যন্ত নয়। অথচ আপনিই দেখুন এখান থেকে এই বাড়ি কত কাছে। তাছাড়া এটা গন্ডগ্রাম হলেও আমার এই সরাইয়ের নাম অনেকেই জানে, বিশেষতঃ যাদের প্রায়ই ঘোরাঘুরি করতে হয়। খদ্দের তো এখানে কতই আসে, রাতও কাটায়, কিন্তু তাদের মনে কি অভিসন্ধি চাপা আছে তা কি জানা সম্ভব? আমি তো সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকি কখন কি হয় এই ভেবে?

আচ্ছা মিসেস বেলিং, ইন্সপেক্টর প্রশ্ন করলেন, গতকাল রাতে আপনার এখানে কে কে ছিল বলতে পারেন?

হ্যাঁ, পারব না কেন, মিসেস বেলিং একটু ভেবে নিয়ে বললেন, মোট তিনজন গতকাল রাতে এখানে ছিলেন তাদের দুজনেই সেলসম্যান। তৃতীয়জন এসে পৌঁছেছিলেন শেষ ট্রেনে, বয়স নিতান্তই কম। ওর নামটা মনে করতে পারছি না। ওহো, আরও একজন ছিল বটে। সে এসেছিল লন্ডন থেকে, ওর নামটাও রেজিস্টারে লেখা আছে। আজ সকালবেলাই সে চলে গেছে, বলেছিল ছটা দশের ট্রেন ধরে এক্সেটারে যাবে। এই লোকটিকে আমার একটু অদ্ভুত বলে মনে হয়েছিল।

কি কাজে এখানে এসেছে তা ও বলেছিল?

আজ্ঞে না, আমি বারবার জানতে চেয়েছিলাম কিন্তু এ বিষয়ে ও একবারও মুখ খোলনি।

ছেলেটাকে দেখতে কেমন ছিল? ইন্সপেক্টর ন্যারাকট জানতে চাইলেন।

দেখতে বেশ সুন্দর আর স্বাস্থ্যবান, মিসেস বেলিং বললেন, তবে চোখের চাউনি দেখলে মনে হয় যে মারাত্মক কোনো দুশ্চিন্তা সবসময় ওকে কুরে কুরে খাচ্ছে। ছেলেটা এসে হাজির হল ঠিক লাঞ্চের সময়, খেয়েদেয়ে সাড়ে চারটে নাগাদ একবার বাইরে বেরোলো, যখন ফিরে এল তখন ছটা ছাব্বিশ।

লাঞ্চের পরে ও কোথায় গিয়েছিল তা বলতে পারেন? ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন।

না স্যার, দুঃখিত, মিসেস বেলিং জবাব দিলেন, ও ভীষণ চাপা, মুখচোরা স্বভাবের ছেলে। নিজে থেকে কোনো কথাই বলে না। কথা শেষ করে মিসেস বেলিং রেজিস্ট্রারের পাতা খুলে এগিয়ে দিলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকটের দিকে।

জেমস পিয়ার্সন, লন্ডন, রেজিস্টারে নাম ঠিকানা দেখে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট মন্তব্য করলেন, শুধু এইটুকু দেখে কিছুই বোঝা যায় না, তবু জেমস পিয়ার্সন সম্পর্কে আমাদের খোঁজখবর নিতে হবে। ভালো কথা, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বন্ধু মেজর বারনাবিকে এখন কোথায় পাওয়া যাবে বলতে পারেন?

এখানে পাবেন, মিসেস বেলিং জানালেন, ডাইনিং হলে উনি অনেকক্ষণ হল ব্রেকফাস্ট খেতে ঢুকেছেন, এই তো একটু আগে আমি ওঁকে কফি দিয়ে এলাম।

ইন্সপেক্টর ন্যারাকট ডাইনিং হলে ঢুকে দেখলেন ভেতের কেউ নেই, শুধু এককোণে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক খবর কাগজ পড়তে পড়তে কফির পেয়ালায় চুমুক দিচ্ছেন। ইন্সপেক্টর ন্যারাকট এগিয়ে এসে তার মুখোমুখি বসলেন, কোনো ভূমিকা না করে নিজের পরিচয়পত্রখানা তুলে ধরলেন তার সামনে, বললেন, আপনিই মেজর বারনাবি?

হ্যাঁ, প্রৌঢ় ভদ্রলোক কফির পেয়ালায় আরেকবার চুমুক দিয়ে বললেন, আপনি হলেন গিয়ে–ইন্সপেক্টর ন্যারাকট। এখানে কেন এসেছেন তা বুঝতে পেরেছি।

আপনার ঘনিষ্ট বন্ধু ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের খুনের তদন্তের দায়িত্ব আমাকেই দেওয়া হয়েছে মেজর, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, আশা করব এ কাজে আপনি আমায় প্রয়োজনীয় সহয়তা করবেন।

বলুন কি জানতে চান, কফির খালি পেয়ালা পাশে সরিয়ে রেখে মেজর বারনাবি বললেন, আমি যতদূর সম্ভব আপনাকে সহায়তা করব।

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের কি কোনো শত্রু ছিল?

আমি যতদূর জানি দুনিয়ায় ওঁর কোনো শত্রু ছিল না? বারনাবি জবাব দিলেন।

ওঁর রান্নার লোক ইভানসকে কি আপনার বিশ্বাসী বলে মনে হয়?

নিশ্চয়ই, বারনাবি জোর গলায় বললেন, আমি জানি ট্রেভিলিয়ান ওকে খুব বিশ্বাস করতেন।

ইভানস হালে বিয়ে করায় ট্রেভিলিয়ান কি ওর ওপর খুব রেগে গিয়েছিলেন?

রেগে যাননি, বারনাবি মুচকি হেসে বললেন, তবে ভেতরে ভেতরে ওর ওপর কিছু বিরক্ত হয়েছিলেন যদিও এ ব্যাপারে ইভানসকে কোনোদিন মুখ ফুটে কিছু বলেননি তিনি। আসলে ট্রেভিলিয়ান নিজে ব্যাচেলার ছিলেন তাই।

আচ্ছা, আপনি তো ওঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন মেজর, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান কোনো উইল করেছিলেন কিনা বলতে পারেন? উনি ব্যাচেলার ছিলেন তাই জানতে চাইছি যে উইল তৈরি না করলে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের অবর্তমানে ওঁর সম্পত্তির মালিক কে হবে?

ট্রেভিলিয়ান উইল করে গিয়েছেন, মেজর বারনাবি বললেন, সেই উইলের এক্সিকিউটর উনি আমাকেই করেছেন।

টাকাকড়ি কি অবস্থায় উনি রেখে গেছেন তা বলতে পারেন?

দুঃখিত, ইন্সপেক্টর তা আমি বলতে পারব না।

ট্রেভিলিয়ানের অবস্থা নিশ্চয়ই খুব স্বচ্ছল ছিল?

শুধু স্বচ্ছল নয়,বারনাবি বললেন, উনি ছিলেন রীতিমতো ধনী, ওঁর মতো ধনী লোক এ তল্লাটে আর একজনও নেই।

ওঁর জীবিত আত্মীয়রা কে কোথায় আছেন তা বলতে পারেন?

আত্মীয়? ভুরু কুঁচকে কি ভেবে নিয়ে মেজর বারনাবি জানালেন, যতদূর জানি এক বোন আর কয়েকটি ভাইপো আর ভাইজি আছে। তবে তাদের কাউকেই আমি কখনো দেখিনি। আত্মীয়দের সঙ্গে ট্রেভিলিয়ানের কোনো ঝগড়াঝাটি বা মনোমালিন্য হয়েছে বলেও কখনো শুনিনি।

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান ওর উইল কোথায় রেখেছেন জানেন?

ওয়ালটার্স অ্যান্ড কার্বউডের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন, মেজর বারনাবি বললেন, ওরা এই এক্সহাম্পটনের বহুদিনের পুরোনো সলিসিটর। উইলটা ওরাই তৈরি করেছিল, ওদেরই জিম্মায় তা রয়েছে।

তাহলে মেজর বারনাবি, আমি এক্ষুনি একবার ওয়ালটার্স অ্যান্ড কার্বউডে যাব, আপনাকেও আমার সঙ্গে যেতে হবে।

তার মানে? মেজর বারনাবি বলে উঠলেন, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের খুনের তদন্তের সঙ্গে ওঁর উইলের কি সম্পর্ক?

মেজর, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট শান্তভাবে বললেন, আপনি আপনার বন্ধুর খুনের মামলাটাকে যতটা সাধারণ ভাবছেন বাস্তবে তা কিন্তু ততটা সাধারণ নয়। ভালো কথা, আপনাকে আরেকটা প্রশ্ন করব। মেজর বারনাবি, আমি জানতে পেরেছি ডঃ ওয়ারেনকে প্রশ্ন করেছিলেন বিকেল পাঁচটা পঁচিশ মিনিট নাগাদ ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের মৃত্যু ঘটেছিল কিনা?

যদি প্রশ্নটা করেই থাকি, মেজর বারবি কিছুটা রাগতসুরে বললেন, তাতে এমন কি অন্যায় হয়েছে?

ন্যায় অন্যায়ের প্রশ্ন উঠছে না মেজর, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, আমার ধারণা কোনো কারণে নিশ্চয়ই মৃত্যুর এই সঠিক সময়টা আপনার মাথায় গেঁথে গিয়েছে।

পাঁচটা বেজে পঁচিশ মিনিট বলে এমন কি অন্যায় করেছি তাই তো বুঝতে পারছি না, বারনাবি আবার একইরকম রাগতসুরে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ইচ্ছে করলে আমি দুটো বেজে পঁচিশ অথবা চারটে বেজে কুড়ি মিনিটও বলতে পারতাম, তাতে কিছুই আসে যায় না।

সে তো বটেই, বলে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট থেমে গেলেন, এই মুহূর্তে তিনি মেজর বারনাবিকে আর চটাতে চাইলেন না।

যাকগে, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, আরেকটা ব্যাপার আমার কাছে অদ্ভুত ঠেকছে।

কোন ব্যাপার বলুন তো?

এই সিটাফোর্ড হাউস ভাড়া দেবার ব্যাপার কি? জানি না আপনার নিজের অভিমত কি, কিন্তু আমার কাছে এটা সত্যিই অদ্ভুত।

এ ব্যাপারে আমি আপনার সঙ্গে একমত, মেজর বারনাবি বললেন, শুধু আমি নই, সবাই এই একই কথা বলবে এবং সেই দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ইংল্যান্ডের এই গন্ডগ্রামে বাড়ি ভাড়া নেওয়া আমার মনে হয় ভদ্রমহিলার নিজের মাথার ঠিক নেই।

ভদ্রমহিলা আপনার পরিচিত?

নিশ্চয়ই, আমি তো ওঁর বাড়িতেই ছিলাম যখন

 যখন কি? প্রশ্ন করলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট।

ও কিছু নয়, বাদ দিন,বলে এমনভাবে হাত নাড়লেন বারনাবি যেন এ প্রসঙ্গে আর কিছু বলতে চান না তিনি।

তীক্ষ্ণ চোখে মেজর বারনাবির চোখের দিকে তাকালেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট। বারনাবি যে ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক কিছু যে তার কাছে গোপন করতে চাইছেন সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হলেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি এও বুঝতে পারলেন যে এক তীব্র দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে বারনাবির মনে, যার আভাস তিনি তখনও পর্যন্ত দেননি।

আপনি নিজ মুখে এক্ষুনি বললেন, যে আপনি সিটাফোর্ড হাউসে ছিলেন, গলা সামান্য চড়ালেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, ভদ্রমহিলা ওখানে কতদিন আছেন?

তা মাস কয়েক তো বটেই।

ভদ্রমহিলা বিধবা, একটি মাত্র মেয়ে ওঁর সঙ্গে থাকে, তাই না?

ঠিক বুলেছেন, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট।

তা এত জায়গা থাকতে হঠাৎ এই গণ্ডগ্রামে উনি থাকতে এলেন কেন সেকথা ভদ্রমহিলা বলেছেন?

বলেছিলেন, মেজর রুমালে নাক মুছে বললেন, আসলে ভদ্রমহিলা বড্ড বেশি কথা বলেন–শহরের কোলাহলের বাইরে বহুদূরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে থাকতে চান, এসব উনি বলেছিলেন, কিন্তু

আবার কথা শেষ না করে মঝপথে থেমে গেলেন মেজর বারনাবি।

কিন্তু এই কারণকে আপনার স্বাভাবিক বলে মনে হয়নি তাই না মেজর? ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন।

ঠিক তাই, মেজর বারনাবি মাথা নেড়ে সায় দিলেন, ভদ্রমহিলা সুন্দরী, কথা বলে বোঝা যায় বিদূষী, রুচিশীলা ও ফ্যাশান সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। ওঁর মেয়েটিও শিক্ষিতা, সুন্দরী ও স্মার্ট। ওঁদের এই গণ্ডগ্রামে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকাটা খুবই বেমানান।

মেজর, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন। আপনার কি ধারণা ওরা মা আর মেয়ে কারো কাছ থেকে পালানোর জন্যই এই গণ্ডগ্রামে এসে উঠেছে? ওরা কি এখানে লুকিয়ে আছে?

না, কখনোই তা আমার মনে হয় না, বারবি জবাব দিলেন, এই সিটাফোর্ড খুব ছোট জায়গা, এখানে কোনো কিছুই গোপন থাকে না। ওরা খুব মিশুকে আর অতিথিবৎসল। কেউ না কেউ রোজই বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়। আচার-আচরণেও খুব বনেদী।

আপনার কি মনে হয় ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের সঙ্গে ভদ্রমহিলার আগে পরিচয় হয়েছিল?

না, তা হতে পারে না।

এত নিশ্চিভাবে কি করে বলছেন?

আচ্ছা, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের সঙ্গে পুরানো পরিচয়টাকে কোনোভাবে কাজে লাগানোর পরিকল্পানা ওদের ছিল কি না একথা একবারও কি আপনার মনে হয় নি?

দেখুন, একটু ভেবে নিয়ে মেজর বারনাবি বললেন, সত্যি বলতে কি এভাবে ব্যাপারটা আদৌ আমি ভাবিনি, তবে আমার মনে হয় এই জাতীয় কোনো পরিকল্পনা ওদের ছিল না। জীবনের বহুসময় বিদেশে কলোনীতে কাটানো আর পাঁচজন ইংরেজের সঙ্গে ওদের কোনো তফাৎ নেই।

বেশ, তাই মেনে নিচ্ছি, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, এবার অন্য প্রসঙ্গে আসছি। মেজর, বাড়ি ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান নিজে বানিয়েছিলেন, তাই না?

হ্যাঁ,

 আগে কখনো বাড়িটি ভাড়া দেওয়া হয়নি, এটাও ঠিক?

 নিশ্চয়ই।

তাহলে এই বাড়িতে এমন কিছু অবশ্যই নেই যার আকর্ষণে মিসেস উইলেট সেটা ভাড়া নিয়েছেন।

এটা একটা ধাঁধা, যদিও এর সঙ্গে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান হ্যাজেলমুর নামে যে বাড়িটা ভাড়া নিয়েছিলেন সেটা কার সম্পত্তি?

হ্যাজেলমুরের মালিক এক মাঝবয়সি অবিবাহিতা মহিলা, নাম মিস গারপেন্ট। প্রত্যেক বছর শীতের সময় উনি চেল্টেনহ্যাম বেড়াতে যান, সেখানে একটা বোর্ডিংয়ে ওঠেন। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

মেজর বারনাবির উত্তরে এমনকিছুই ইন্সপেক্টর ন্যারাকট খুঁজে পেলেন না যা তদন্তের কাজে কোনোভাবে তাকে পথ দেখাতে পারে। বিরক্তিসূচক ভাবে ঘাড় নেড়ে তিনি আবার প্রশ্ন করলেন।

এই বাড়ির এজেন্ট তো উইলিয়ামসনস?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

ওদের অফিসটা তো শুনেছি এক্সহ্যাম্পটনেই, তাই না?

ওয়াল্টার্স অ্যান্ড বার্কউডের পাশের কামরায়।

বাঃ! হঠাৎ উৎসাহিত হয়ে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, তাহলে মেজর আসুন না। এক্ষুনি একবার ওখান থেকে ঘুরে আসা যাক, অবশ্য যদি আপনার আপত্তি না থাকে।

বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই, মেজর বারনাবি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, উকিলরা কি চীজ, তা নিশ্চয়ই জানেন। বেলা দশটার আগে মিঃ বার্কউডকে ওঁর অফিসে পাবেন না।

.

০৭.

মেজর বারনাবিকে সঙ্গে নিয়ে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রথমে এলেন এস্টেট এজেন্ট মেসার্স উইলিয়ামসনের অফিসে। এরা বাড়ি আর জমির দালালী করে, এদের মাধ্যমেই মিসেস উইলেট সিটাফোর্ড হাউস ভাড়া নিয়েছিলেন। জনৈক অল্পবয়সি কর্মচারী তাদের অভ্যর্থনা জানাল, মেজর বারনাবি তার সঙ্গে ইন্সপেক্টর ন্যারাকটের পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং তিনি যে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের খুনের তদন্তে এসেছেন তাও জানালেন।

কি ভয়ানক নৃশংস কান্ড। অল্পবয়সি কর্মচারীটি নিজের থেকেই হঠাৎ মন্তব্য করল, এই খুনের কথা বলছিলাম। এমন কান্ড এর আগে কখনো এক্সহ্যাম্পটনে ঘটেছে বলে শুনিনি।

বেশি কথা বা বাজে কথা একদম বলবেন না। ইন্সপেক্টর ন্যারাকট তার পেশাদারী কড়া মেজাজে চাপা ধমক দিলেন, যে প্রশ্ন করব ঠিক তার জবাবটুকু বাস, তার বেশি কিছু নয়। এই সিটাফোর্ড হাউস তাহলে আপনাদের মাধ্যমেই ভাড়া দেওয়া হয়েছিল তাই না?

আজ্ঞে হ্যাঁ, পুরোনো একটা খাতা খুলে তাতে চোখ বুলিয়ে কর্মচারীটি জবাব দিল, লন্ডনে বালটিন হোটেল থেকে উনি আমাদের বাড়ি ভাড়া চেয়ে একটা চিঠি লিখেছিলেন।

চিঠিতে কি উনি সিটাফোর্ড হাউসের নাম উল্লেখ করেছিলেন?

না, তা করেননি, শুধু লিখেছিলেন যে শীতের সময়টা কাটানোর জন্য ওঁর একটা বাড়ি খুব দরকার, আর সে বাড়িটা ডার্টমুর অঞ্চলে হলেই ভালো হয়। উনি এও উল্লেখ করেছিলেন যে ওঁর কম করে আটটা ঘর দরকার।

সিটাফোর্ড হাউসের নাম কি আপনাদের খাতায় ছিল?

আজ্ঞে না। তা ছিল না, তবে ভদ্রমহিলা ঠিক যেমনটি চেয়েছিলেন এই বাড়িতে সেসব তেমনটিই ছিল। উনি মোটা টাকা ভাড়া দিতে রাজি হয়ে গেলেন।

মিসেস উইলেট কি বাড়িটা নিজে দেখতে এসেছিলেন?

আজ্ঞে না স্যার, খুবই আশ্চর্যের বিষয় যে বাড়িটা নিজে চোখে একবারও না দেখেই মিসেস উইলেট তা ভাড়া নিতে রাজি হয়েছিলেন। চুক্তিনামায় সই করার বেশ কিছুদিন বাদে উনি গাড়ি চালিয়ে এসে হাজির হলেন সিটাফোর্ডে। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান-এর সঙ্গে আলাপ পরিচয় করলেন, তারপর সেদিনই বাড়িতে ঢুকলেন। পরে আমাদের জানিয়েছিলেন যে বাড়িটা ওঁর খুব পছন্দ হয়েছে।

নিজে চোখে না দেখে শুধু দালালের মুখ থেকে শুনেই ভদ্রমহিলা বাড়িটা নিতে রাজি হলেন, বাড়িতে ঢোকার পরে জানালেন এটা তার খুব পছন্দসই হয়েছে, এসব দেখে আপনার মনে কি ধারণা হয়েছিল খুলে বলবেন?

দেখুন, আমি যে ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত আছি, কর্মচারীটি মুচকি হেসে জবাব দিল, সেখানে এই শিক্ষাই পেয়েছি যে কোনো কিছু দেখেই অবাক হতে নেই।

আমার আর কোনো প্রশ্ন নেই, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, সহযোগিতা করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

মেজর বারনাবিকে সঙ্গে নিয়ে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট এবার পাশের কামরায় এসে ঢুকলেন। ওয়াল্টার্স অ্যান্ড বার্কউড সলিসিটার্স প্রতিষ্ঠানের অফিসটি এখানে। কার্ড পাঠাতেই মিঃ বার্কউড তাদের নিজের কামরায় ডেকে পাঠালেন।

মিঃ বাকউড বয়সে প্রবীন, সুন্দর সুপুরুষ এই পোঢ় এক্সহ্যাম্পটনের পুরানো বাসিন্দা, তার আগে তার বাবা আর ঠাকুরদাও এই প্রতিষ্ঠানের অংশীদার ছিলেন। মেজর বারনাবি পরিচয় করিয়ে দিতে তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে ইন্সপেক্টর ন্যারাকটের সঙ্গে করমর্দন করলেন।

আপনার কাছ থেকে কিছু তথ্য পাব আশা করেই এতদূর এসেছি,ইন্সপেক্টর ন্যারাকট উল্টোদিকের চেয়ারে বসে বললেন।

আমার পক্ষে যতদূর সম্ভব সহায়তা করব, মিঃ বার্কউড গম্ভীর গলায় বললেন, বলুন কি জানতে চান।

আমি যতদূর শুনেছি ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান তার শেষ উইল আপনাকে দিয়েই করিয়েছিলেন, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, সেটা একবার দেখাতে পারেন?

আপনি ঠিকই শুনেছেন, ইন্সপেক্টর, মিঃ বার্কউড বললেন, আমি এক্ষুনি উইলটা নিয়ে আনার ব্যবস্থা করছি। কথা শেষ করে মিঃ বার্কউড টেলিফোনে তাঁর জনৈক সহযোগীকে নিহত ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের উইলটা নিয়ে আমার নির্দেশ দিলেন। মিনিট পাঁচেক বাদে একজন ছোকরা কামরা থেকে একটি মুখ বন্ধ খাম এনে রাখল তার সামনে। কেরানীটি ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পরে মিঃ বাকউড খামের মুখ খুলে ফেললেন, ভেতর থেকে টাইপ করা একটি দলিল বের করে পড়তে শুরু করলেন তিনি।

১। ……আমি জোসেফ অর্থার ট্রেভিলিয়ান, ঠিকানা সিটাফোর্ড হাউস, থানা সিটাফোর্ড, জেলা ডিভনসায়ার, আজ ঊনিশশো ছাব্বিশ সালের তেরোই অগাস্ট তারিখে আমার শেষ উইল লিখছি। সিটাফোর্ড হাউসের এক নম্বর বাংলোর বাসিন্দা মেজর জন এডওয়ার্ড বারনাবি এবং এক্সহ্যাম্পটনের সলিসিটর মিঃ বার্কউডকে আমি এই উইলের এক্সিকিউটার আর ট্রাস্টি হিসাবে নিয়োগ করছি।

২। আমার বহুদিনের পুরোনো ও বিশ্বস্ত পরিচারক রবার্ট হেনরি ইভানসকে আমি একশো পাউন্ড দিয়ে গেলাম যা সবরকম করের আওতা থেকে মুক্ত। তবে আমার মৃত্যু পর্যন্ত যদি ইভানস আমার অধীনে কাজে বহাল থাকে এবং অন্যকোথাও যাবার আগাম নোটিশ না দেয় শুধু সেক্ষেত্রেই ওই টাকা তার প্রাপ্য হবে।

৩। জীবিত অবস্থায় খেলাধুলায় জয়ী হয়ে যেসব পুরস্কার আমি অর্জন করেছি সেসবই বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসাবে আমি দিয়ে গেলাম আমার বন্ধু মেজর এডওয়ার্ড বারনাবিকে, আমি এ পর্যন্ত যেসব জন্তু শিকার করেছি তাদের মাথা এবং দেহের অন্যান্য অংশের মালিকানাও তারই ওপর বর্তাবে।

৪। আমার যাবতীয় স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রী করে তা নগদ টাকায় পরিণত করার অধিকার বর্তাবে এই উইলের দুই এক্সিকিউটর ও ট্রাস্টির ওপরে। আমার মৃত্যুর পরে সরকার যেসব কর ধার্য করবেন সেই টাকা থেকে তারা তা মেটাবেন এবং এই টাকা তারা বিভিন্ন ধরনের লগ্নী ও লাভজনক ব্যবসায় খাটাতে পারবেন।

৫। আমার যাবতীয় বিষয় সম্পত্তির মোট চারভাগের একভাগ পাবেন আমার ভগিনী জেনিফার গার্ডনার। ওই টাকা জেনিফার নিজেই ইচ্ছা ও প্রয়োজন মত খরচ করতে পারবে।

৬। আমার অপর ভগিনী মেরী পিয়ার্সন কিছুদিন আগে মারা গেছেন, তাঁর তিনটি সন্তানের প্রত্যেকেই আমার যাবতীয় সম্পত্তির মোট চারভাগের একভাগ সমানভাবে পাবে। উইলের নীচে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের স্বাক্ষর আর দুজন সাক্ষীর স্বাক্ষর, দুজন কর্মচারী এই উইলের সাক্ষী ছিলেন। এ দুটো স্বাক্ষর ওঁদেরই।

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বোন মেরী পিয়ার্সন মারা গেছেন, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট জানতে চাইলেন, ওঁর সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন, মিঃ বার্কউড?

তেমন বিশেষ কিছুই, নয়, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, মিঃ বার্কউড জবাব দিলেন, মেরি খুব বেশিদিন হয়নি মারা গেছে। ওর স্বামী ছিলেন শেয়ারের দালাল, তিনি আগেই মারা গেছেন। আমি যতদূর জানি, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান সিটাফোর্ড সম্পত্তি কেনার পর মেরী একবারও তার সঙ্গে দেখা করতে আসেনি।

আচ্ছা, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির মোট পরিমান কত হবে বলতে পারেন? ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন।

তা আশি নব্বই হাজার পাউন্ড তো বটেই, মিঃ বাকউড জবাব দিলেন, তার বেশি ছাড়া কম হবে না।

আগেই বলেছিলাম আপনাকে যে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান ছিলেন ধনী লোক। বারনাবি এতক্ষণ বাদে মন্তব্য করলেন, প্রচুর টাকার মালিক ছিলেন উনি।

আচ্ছা, মিঃ বার্কউড, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট চেয়ার ছেড়ে উঠতে বললেন, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বোনেদের ঠিকানা আপনার কাছে আছে?

মেরী পিয়ার্সনের ঠিকানা আমার জানা নেই, মিঃ বার্কউড জবাব দিলেন, তবে জেনিফারের ঠিকানা দিতে পারি আপনাকে। লিখে নিন–মিসেস জেনিফার গার্ডনার, দ্য লরেন্স, ওয়াল্ডক রোড, এক্সেটার।

আরেকটা প্রশ্ন, ঠিকানা লিখতে লিখতে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, মিসেস পিয়ার্সনের মোট কটি সন্তান?

যতদূর শুনেছিলাম তিনজন, মিঃ বার্কউড জবাব দিলেন, দুই মেয়ে আর এক ছেলে অথবা দুই ছেলে আর এক মেয়ে ঠিক মনে পড়ছে না।

আপনার সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ মিঃ বার্কউড বলে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট তার কামরা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। মেজর বারনাবিও এলেন তার পিছন পিছন। বাইরে বেরিয়ে আসার পরে কেউ কারো সঙ্গে একটি কথাও বললেন না, রাস্তা পেরিয়ে মোড়ের কাছে আসতেই ইন্সপেক্টর ন্যারাকট হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন। মেজর বারনাবিকে প্রশ্ন করলেন, এবার আপনাকে একটা প্রশ্ন করছি। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান ঠিক বিকেল পাঁচটা বেজে পঁচিশ মিনিটে মারা যান বলে আপনি একটা ভবিষ্যবাণী না এই ধরনের কিছু যেন বলেছিলেন শুনেছিলাম। ব্যাপারটা আসলে কি ঘটেছিল বলুন তো?

ইন্সপেক্টর ন্যারাকটের প্রশ্ন শুনে মেজর বারনাবির মুখ অপমানে লাল হয়ে উঠল, সেকথা তো আগেই আপনাকে বলেছি।

খোলাখুলিভাবে কিছুই বলেননি, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট মন্তব্য করলেন, আপনি যা বলেছেন আইনের পরিভাষায় তাকে বলে সত্যগোপন করা যা অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ। আপনি যে খুনের নির্দিষ্ট সময়টি ডঃ ওয়ারেনকে সঠিকভাবে জানিয়েছিলেন নিশ্চয়ই তার পেছনে কোনো উদ্দেশ্য ছিল। আমার মনে হয় সেই উদ্দেশ্যটা আমার জানতে আর বাকি নেই।

যদি জানেনই তাহলে আবার আমাকে প্রশ্ন করছেন কেন? বিরক্ত সুরে পাল্টা প্রশ্ন করলেন মেজর বারনাবি।

আমার মনে হয় ওইদিন বিকেল পাঁচটা পঁচিশ মিনিটে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের সঙ্গে কারো দেখা করার কথা ছিল, তাই না মেজর বারনাবি?

আজ্ঞে না, একইরকম বিরক্তিভরা গলায় মেজর বারনাবি জবাব দিলেন, তেমন কিছুই ঘটেনি।

আপনাকে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি মেজর বারনাবি, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট গম্ভীর গলায় বললেন, যা জবাব দেবেন ভেবেচিন্তে দেবেন। আচ্ছা, জেমস পিয়ার্সনের খোঁজখবর আপনি রাখেন?

জেমস পিয়ার্সন? অবাক হয়ে মেজর বারনাবি প্রশ্ন করনেল, কে সে? আপনি যার কথা বলছেন সে কি ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের ভাগ্নেদের একজন?

আমার তো তাই মনে হচ্ছে, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট জবাব দিলেন, তাদের মধ্যে একজনের নাম ছিল জেমস, তাই না?

এ সম্পর্কে আমার কিছুই জানা নেই, মেজর বারনাবি রাগত গলায় বললেন, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান-এর কটি ভাগ্নে ছিল তা জানি, কিন্তু তাদের কার কি নাম সে আমার জানা নেই।

আমি যার কথা বলছি সেই জেমস পিয়ার্সন গতকাল রাতে থ্রি ক্রাউন্স সরাইখানায় ছিল। আশা করি আপনি সেখানে তাকে ঠিক চিনতে পেরেছিলেন?

ভুল করছেন, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, একইরকম বিরক্তি আর রাগতসুরে মেজর বারনাবি জবাব দিলেন, আমি কাউকে চিনতে পারিনি, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের ভাগ্নেদের কাউকে জীবনে দেখিনি।

কিন্তু এইটুকু নিশ্চয়ই জানেন যে, গতকাল বিকেল পাঁচটা পঁচিশ মিনিটে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের সঙ্গে ওঁর কোনো এক ভাগ্নের দেখা করার কথা ছিল?

না, আমি এই সবের কিছুই জানি না। গর্জে উঠলেন ফের বারনাবি।

তাহলে এই বিকেল পাঁচটা পঁচিশ মিনিটের ব্যপারটা কি তাই খুলে বলুন।

বেশ, তাই বলছি, মেজর বারনাবি জবাব দিলেন, গোটা ব্যাপারটা এক ধরনের ছেলেমানুষি ছাড়া কিছুই নয়। অনেকেই এসব বিশ্বাস করেন না। শুনুন ইন্সপেক্টর, সামাজিকতা রক্ষা করতে এক একসময় মহিলাদের মন যে রক্ষা করতে হয় তা নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়, আর সেইভাবেই টেবিলটার্নিং নামে প্রেতচর্চার এক অনুষ্ঠানে আমি ওই দিন জড়িয়ে পড়েছিলাম। বলে মেজর বারনাবি সেদিন বিকেলে মিসেস উইলেটের বাড়িতে যা ঘটেছিল সংক্ষেপে তার বর্ণনা দিলেন।

আপনি বলতে চান মেজর বারনাবি, যে ওই প্রেতচর্চার অনুষ্ঠানে টেবিলের পায়ার ওঠানামার ঠক ঠক শব্দ ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের মৃত্যুর খবর আমাদের জানিয়েছিল?

আমি নিজে পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও ব্যাপারটা ঠিক তেমনই ঘটেছিল।কপালের ঘাম রুমালে মুছে মেজর বারনাবি জবাব দিলেন, ওই ঘটনার পরেই আমি অস্থির হয়ে পড়ি আর তাই ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান কেমন আছেন তা দেখার জন্য সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তখনই বেরিয়ে পড়ি।

মেজর বারনাবি মুখে অবিশ্বাসের কথা বললেও সেদিনের ওই ঘটনা যে তাকে খুব প্রভাবিত করেছিল সে সম্পর্কে ইন্সপেক্টর ন্যারাকটের মনে কোনো সন্দেহই রইল না। কিন্তু ভূতপ্রেত নিয়ে এই খেলার সঙ্গত কোনও ব্যাখ্যাই তিনি সেই মুহূর্তে খুঁজে পেলেন না।

নিশ্চয়ই এই প্রেতচর্চার পেছনে অন্য কোনো গভীর রহস্য আছে। এই রহস্যঘন খুনের মামলার তদন্তের দায়িত্ব আগে কখনো তাঁর হাতে আসেনি।

মেজর বারনাবি প্রেতের দ্বারা প্রভাবিত হোন বা নাই হোন তাতে তার কিছুই যায় আসে না। তাঁর কাজ হল ট্রেভিলিয়ানের হত্যাকারীকে খুঁজে বের করা যার সঙ্গে ভূতপ্রেতের কোনো সম্পর্ক নেই।

.

০৮.

মেজর বারনাবির সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ হাতঘড়ির দিকে তাকলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, দেখলেন এক্ষুনি তাড়াহুড়ো করে স্টেশনে পৌঁছতে পারলে এক্সেটারে যাবার ট্রেনটা ধরতে পারবেন তিনি। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বোনকে জেরা করার এই সুবর্ণ সুযোগ নষ্ট করতে চাইলেন না তিনি। মেজর বারনাবির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুতপায়ে স্টেশনের দিকে এগোলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট। অন্যদিকে মেজর বারনাবি নিজে এগোলেন থ্রি ক্রাউনস সরাইয়ের দিকে। সরাইয়ে সবে ঢুকেছেন মেজর বারনাবি এমন সময় সুন্দর সুপুরুষ চেহারার এক অচেনা তরুণ তার সামনে এসে দাঁড়াল।

আপনি তো মেজর বারনাবি? অচেনা তরুণটি জানতে চাইল।

হ্যাঁ।

এক নম্বর সিটাফোর্ড কটেজ তো আপনারই ঠিকানা?

হ্যাঁ, কিন্তু আপনার

আমি ডেইলি অয়্যার খবরের কাগজের রিপোর্টার, আমি

তার কথা শেষ হবার আগেই রাগে বোমার মতো ফেটে পড়লেন মেজর বারনাবি।

আর একটি কথাও নয়, আপনি কি উদ্দেশ্যে এখানে এসেছেন তা জানতে আমার বাকি নেই। তবে এটাও জেনে রাখবেন, যতই প্রশ্ন করুন না কেন, আমার পেট থেকে একটি কথাও বের করতে পারবেন না। যদি কিছু জানবার থাকে তো সোজা পুলিশের কাছে চলে যান, আমায় খামোক বিরক্ত করতে এসেছেন কেন শুনি? যিনি খুন হয়েছেন আপনার এহেন আচরণে তার আত্মা অবশ্যই শান্তি পাচ্ছেন না!

ভুল করছেন, অল্পবয়সি রিপোর্টারটি এতটুকু দমে না গিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল, কোনো খুনের ব্যাপারে খবর যোগাড় করতে নয়, এই খামটা আপনার হাতে তুলে দেবার জন্যই আমি এতদূরে ছুটে এসেছি। কথা শেষ করে সে কোটের ভেতরের পকেট থেকে একটা মুখ বন্ধ খাম বের করে তুলে দিলেন মেজর বারনাবির হাতে।

এই খামের ভেতরে কি আছে? মেজর বারনাবি প্রশ্ন করলেন।

আমাদের ফুটবল প্রতিযোগিতা সংক্রান্ত একটি ধাঁধার সঠিক উত্তর আপনি পাঠিয়েছিলেন, রিপোর্টার ছোকরাটি জবাব দিল, সেই বাবদ আপনি পাঁচ হাজার পাউন্ড জিতেছেন, খামের ভেতরে সেই অঙ্কের চেক আছে। পুরস্কার পাবার জন্য আমি আপনাকে আমার নিজের তরফ থেকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।

ব্যাপারটা যে এরকম দাঁড়াবে তা মেজর বারনাবি স্বপ্নেও ভাবেননি। পাঁচ হাজার পাউন্ড তার কাছে অনেক টাকা, এত টাকা এক থোক হাতে পাবার কথা কল্পনাও করতে পারেননি তিনি। আর একটি কথাও জোগাল না তার মুখে, ঘাবড়ে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে গেলেন।

পুরস্কার পাবার খবর জানিয়ে আমরা গতকাল সকালেই তো আপনাকে চিঠি পাঠিয়েছিলাম, রিপোর্টারটি বলল, পাননি চিঠি?

কি করে পাব বলুন? মেজর বারনাবি বললেন, সিটাফোর্ড এলাকাটার যে পুরো দশ ফিট তুষারের নীচে চাপা পড়ে আছে সে খোঁজ তো আপনাদের জানা নেই। কদিন ধরে তাই চিঠিপত্রও ঠিকমতো বিলি হচ্ছে না।

 কিন্তু আজ সকালের কাগজে তো আপনার নাম ছাপা হয়েছে, সেটাও কি আপনার চোখে পড়েনি?

এই দেখুন, এখনও পর্যন্ত নিজের পরিচয়টাই আপনাকে দেওয়া হয়নি, রিপোর্টারটি বিনীতসুরে বলল, আমার নাম চার্লস এন্ডারবি, গতকাল রাতেই এখানে এসে পৌঁছেছি, তারপর আজ রওনা হয়েছিলাম সিটাফোর্ডের দিকে। আমরা আমাদের প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের প্রাপ্য চেক সবসময় নিজেরা গিয়ে হাতে হাতে দিয়ে আসি, এটাই আমাদের কাগজের রেওয়াজ, সেইসঙ্গে বিজয়ীর একটি সাক্ষাঙ্কারও প্রকাশ করি। হয়তো আপনার খোঁজ পেতাম না কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে এই থ্রি ক্রাউনসের মালিক, ওয়েটার, রাঁধুনি থেকে শুরু করে নিয়মিত খদ্দের সবাই দেখলাম আপনাকে চেনে।

কিছু মনে করবেন না। চেকসমেত খামটা সাবধানে পকেটে পুরে মেজর বারনাবি নরম সুরে বললেন, গোড়ায় আপনাকে অনেক কুকথা অকথা শুনিয়েছি। আমরা হলাম গিয়ে পুরোনো জমানার মিলিটারি অফিসার। যখন তখন মাথা গরম হয়ে ওঠে। যাকগে, আমার জন্য এত কষ্ট করেছেন আপনি, শুধু মুখে আপনাকে ছাড়ছি না। কি খাবেন বলুন।

শুধু একটা বিয়ার, এন্ডারবি মুচকি হেসে বলল।

দুটো বিয়ার অর্ডার দিয়ে সাংবাদিক ছোরার মুখোমুখি বসলেন মেজর বারনাবি, হঠাৎ বিষণ্ণ সুরে বললেন, তাছাড়া যিনি খুন হয়েছেন তিনি ছিলেন আমার বহুদিনের পুরানো বন্ধু, তাঁর বিয়োগ ব্যথা আমি বহু চেষ্টা করেও ভুলতে পারছি না।

হ্যাঁ, এন্ডারবি সায় দিয়ে বলল, পথে আসতে যাকে দেখলাম, তারই মুখে শুনলাম এই খুনের প্রসঙ্গ। সবারই মুখে এককথা। সবদিক থেকেই এই খুনকে রীতিমতো রহস্যজনক বলা চলে। আচ্ছা ওঁর কি কোনো শত্রু ছিল?

না, মেজর বারনাবি জবাব দিলেন।

ডাকাতি করতে এসে কেউ ওঁকে খুন করেছেন পুলিশ তা জানাতে নারাজ, এন্ডারবি বলল।

একথা আপনি জানলেন কি করে?

এন্ডারবি এ প্রশ্নের উত্তর দিল না, খবরের সূত্র ফাঁস করতে চায় না সে।

আপনি যে টাকাটা পেয়েছেন তার একটা রসিদ আমায় দিন, এন্ডারবি বলল।

এক্ষুনি দিচ্ছি, বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন মেজর বারনাবি, পকেট থেকে খামটা বের করে খুলে দেখলেন ভেতরে সত্যিই পাঁচ হাজার পাউন্ডের চেক আছে কিনা। সে সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে এক চিলতে কাগজে সই করে দিলেন তিনি।

ধন্যবাদ, রসিদটা পকেটে রেখে এন্ডারবি বলল, এবার আর কয়েকটা কাজ আমার করার আছে। এক, আপনার বাড়ির একটি ফটো তুলতে হবে, আপনি নিজে হাতে আপনার পোষা শুয়োরের বাচ্চা, বেড়াল নয়তো কুকুরকে খাওয়াচ্ছেন, বাগানে ফুল গাছের গোড়ায় সার দিচ্ছেন এমন কিছু ফটোও তুলব। দুই, আপনার একটি ছোট সাক্ষাৎকার আমায় নিতে হবে। তেমন কিছু নয়, পাঁচহাজার পাউন্ড কিভাবে আপনি খরচ করতে চান এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে আপনাকে। বেশ মুখরোচক ভাবে সাক্ষাৎকার লিখতে হবে আমায়।

বুঝেছি, ব্যাজার মুখে মেজর বারনাবি জানালেন, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই বিশ্রী আবহাওয়ায় সিটাফোর্ডে যাওয়া তো একরকম অসম্ভব ব্যাপার, গত তিনদিন ধরে একটি গাড়িও পথে বেরোয়নি, তুষারপাত বন্ধ হলেও পথঘাট সাফ হতে হতে আরও দিন তিনেক লেগে যাবে।

কি আর করব, আজ তাহলে উঠি,বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল এন্ডারবি, করমর্দন শেষে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সে দরজার দিকে।

বাইরে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে স্থানীয় পোস্ট অফিসে এসে হাজির হল এন্ডারবি, সেখান থেকে অফিসে টেলিগ্রাম করল। তাতে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের রহস্যময় খুনের ঘটনা উল্লেখ করল সবিস্তারে আর এও জানাল যে এই খুন সংক্রান্ত বিশদ রিপোটিং সে এখান থেকে পাঠতে পারবে।

অফিসে টেলিগ্রাম করেই কাজের পরবর্তী ধারা সম্পর্কে স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল এন্ডারবি। নিহত ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের রাঁধুনি ও আংশিক সময়ের পরিচারক ইভানসের ঠিকানা ইতিমধ্যেই যোগাড় করেছিল এন্ডারবি। পোস্ট অফিসে থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সোজা ইভানস-এর পাড়ায় এসে সে হাজির হল।

ইভানস তার নগণ্য পেশার কারণে এতদিন পাড়ার লোকের কাছে তেমন পাত্তা পায়নি বটে কিন্তু মনিব খুন হবার ফলে রাতারাতি সে বিখ্যাত ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে। ফোর স্ট্রীটের এক বাসিন্দাকে ঠিকানা জিজ্ঞেস করতেই সে এন্ডারবিকে এনে হাজির করল ইভানসের বাড়ির দোরগোড়ায়।

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের খুনের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে খবরের কাগজের এক রিপোর্টার নিজে এসে হাজির হয়েছে তার কাছে এটা ইভানসের কাছে স্বপ্নেরও অতীত, এন্ডারবি মেজর বারনাবির নাম করতে সে তাকে খাতির করে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসল। তার নববিবাহিত স্ত্রীর সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিল। ইভানসের বউ-এর বয়স খুবই কম, আর চেহারায় চটক আছে। তার মেদহীন সরু কোমর, একমাথা কালো কোঁকড়ানো চুল আর রক্তাভ দুটি গালের দিকে তাকিয়ে এন্ডারবি মুগ্ধ না হয়ে পারল না, মনে মনে পাত্রী পছন্দের ক্ষেত্রে ইভানসের রুচির তারিফ করল সে।

বুঝতেই পারছ, কেন তোমার কাছে এসেছি, এন্ডারবি হেসে বলল, তোমার মনিবের খুনের ব্যাপারে কিছু খবর আমার চাই। আশাকরি আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে তোমার আপত্তি নেই?

আজ্ঞে না, ইভানস বিস্ময়ে বিগলিত হয়ে বলল, বলুন কি জানতে চান, আমি সাধ্যমতো উত্তর দেব।

তোমার মনিব ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানকে কে খুন করেছে বলে তোমার মনে হয়?

স্যার,ইভানস গলা নামিয়ে বলল, আমার ধারণা এটা নির্ঘাৎ কোনো গুন্ডা বদমাসের কাজ। নিশ্চয়ই ব্যাটা আকণ্ঠ মদ খেয়ে কোন গতিকে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়েছিল, ক্যাপ্টেন তাকে দেখতে পেয়ে ঘাড় ধরে বের করে দিতে চান, সেই, ফাঁকে ব্যাটা তাকে খুন করে।

ভুল করছ ইভানস, এন্ডারবি একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, তোমার এই ধারণার সঙ্গে পুলিশ একমত নয়।

আজ্ঞে? পুলিশের মতে খুনটা পূর্বপরিকল্পিত, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানকে খুন করবে বলেই সেদিন আততায়ী তার বাড়িতে ঢুকেছিল। আর আততায়ী নিছক মাতাল গুন্ডা বদমাইস নয় বলেই পুলিশের ধারণা।

এসব কথা আপনাকে কে বলল, স্যার? ভীতু গলায় ইভানস প্রশ্ন করল।

উত্তর না দিয়ে এন্ডারবি নিজেকে সামলে নিল। এসব খবর কিছুক্ষণ আগে থ্রি ক্রাউনস সরাইয়ে বসে মদ খেতে খেতে সেখানকার এক ওয়েটারের মুখে শুনেছে সে, যার বোনের জামাই খোদ কনস্টেবল গ্রেভস নিজে যাকে সঙ্গে নিয়ে মেজর বারনাবি ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের খুন হবার পরে তাঁর বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন।

খবর পেয়েছি, পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে, ভারিক্কি চালে বলল এন্ডারবি, যাতে পুলিশ সন্দেহ করতে না পারে সেই উদ্দেশ্যে আততায়ী জানালা দিয়ে বাড়িতে ঢুকেছিল যা দেখে সবাই ধরে নেবে চুরি বা ডাকাতি করার মতলবে এক বা একাধিক লোক হ্যাজেলমুরে হানা দিয়েছিল, তাদের বাধা দিতে গিয়েই খুন হয়েছেন তোমার মনিব ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান। আততায়ী এইভাবেই সাজাতে চেয়েছে ব্যাপারটাকে।

সত্যিই, এমন নৃশংস কাজ কে করতে পারে? পরোক্ষে এন্ডারবির দিকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল ইভানসের যুবতী স্ত্রী।

আঃ রেবেকা,ইভানস চাপা ধমকের সুরে বলে ওঠে, সব ব্যাপারে কথা বলা তোমার সাজে না, এ সবের মাঝে তুমি মাথা গলাবে না। বউকে শাসন করেই গলা নামিয়ে এন্ডারবিকে প্রশ্ন করল ইভানস, স্যার আপনি সত্যিই পুলিশের গোয়েন্দা নন তো? বিশ্বাস করুন স্যার, আমি নেহাৎ ছাপোষা লোক, শুধু পেটের দায়েই এতদিন ক্যাপ্টেন-এর কাছে চাকরি করেছি। ওঁর খুনের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।

তুমি মিছেই ভয় পাচ্ছ ইভানস, আশ্বাসের সুরে এন্ডারবি জানাল, আমি সত্যিই একজন রিপোর্টার, এই দেখো আমার পরিচয়পত্র, বলে পকেট থেকে আইডেন্টি কার্ড বের করে ইভানসের চোখের সামনে সে মেলে ধরল।

তোমার মনিবের খুনের ব্যাপারে খবর নেওয়া ছাড়া আরও একটা কারণে আমায় আসতে হয়েছে। মেজর বারনাবি আমাদের খবরের কাগজে একটা ফুটবল খেলার ধাঁধায় সঠিক উত্তর পাঠিয়ে পাঁচ হাজার পাউন্ড জিতেছেন, আমি ওই টাকার চেক তাকে দিতে এসেছিলাম।

কি বললেন আপনি, ইভানসের গলায় চাপা উত্তেজনা ফুটে বেরোল, এসব ধাঁধা তাহলে জোচ্চুরি নয়, সঠিক উত্তর পাঠালে লোকেরা তাহলে সত্যিই টাকা পায়?

পায় যে তা তো দেখতেই পাচ্ছ? এন্ডারবি বলল, মেজর বারনাবিকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবে আমার কথা সত্যি কিনা।

কিন্তু আমার মনিব ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান যে বলতেন এসব পুরোপুরি জোচ্চুরি, পুরস্কারের টাকা সবসময় ওরা আগে থেকে নিজেরাই হজম করে ফেলে, নয়তো এমন কাউকে কখনো পুরস্কার দেয় যে ওদের পেটোয়া লোক।

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান, যে একবার ক্রসওয়ার্ড ধাঁধার সঠিক উত্তর পাঠিয়ে তিনটে উপন্যাস পুরস্কার পেয়েছিলেন আর খুন হবার আগের দিন পর্যন্ত সে উপন্যাস তিনটের একটিও তিনি যে খুলে দেখেননি সেকথাও এই প্রসঙ্গে জানাল ইভানস।

ইভানসকে মোচড় দিয়ে অনেক কিছু জেনে নিল এন্ডারবি, এই বিশ্বস্ত পুরোনো ভৃত্যকে নিয়ে একটি সরেস ফিচার লেখার পরিকল্পনা অনেকক্ষণ থেকে ঘুরপাক খাচ্ছে তার মাথায়। ইভানসের রূপসী যুবতী বউ রেবেকার চোখেমুখে সবসময় এক অজানা ভীতি থেকে থেকে উঁকি দিচ্ছে কেন তাও এন্ডারবির চোখ এড়াল না। কিন্তু এ নিয়ে মাথা ঘামাল না সে।

নিজের সাধ্যমতো আতিথেয়তার ত্রুটি করল না ইভানস, তার বউ-এর দেওয়া পানীয়ের গেলাসে শেষে চুমুক দিয়ে একসময় উঠে পড়ল এন্ডারবি, ব্যস্ত গলায় বলল, এবার তাহলে আমায় রওনা হতে হবে, সহযোগিতার জন্য তোমাদের দুজনকেই ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তবে তোমার মনিব যখন আমাদের কাগজের ক্রসওয়ার্ড ধাঁধায় জিতেছিলেন বলছ, তখন এটা জেনে রেখো যে তার খুনীকে ধরতে আমি ব্যক্তিগতভাবে সবরকম চেষ্টা করব।

দয়া করে তাই করুন স্যার,ইভানস হাত কচলে বলল, আপনারা খবরের কাগজের রিপোর্টাররা অনেক অসাধ্য সমাধান করতে পারেন।

ইভানসের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সাংবাদিক এন্ডারবি ফিরে এল থ্রি ক্রাউনস সরাইয়ে।

মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যে ট্রেনে চেপে এক্সহ্যাম্পটন থেকে এক্সেটারে পৌঁছে গেলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট। ট্রেন থেকে নেমে লরেনস নামে বাড়িটির কলিংবেলের ঘন্টা যখন তিনি বাজাচ্ছেন তখন দুপুর বারোটা বাজতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি।

লরেনস বাড়িটা শুধু যে পুরোনো তাই নয়, এখন সবদিক থেকেই তার জীর্ণদশা চলছে। বাড়ির বাইরের দেওয়ালের রং আর পলেস্তারা কবে উঠে গিয়ে ভেতরের ইট বেরিয়ে পড়েছে, বাড়ির চারপাশের বাগানের জায়গায় জায়গায় জমেছে আগাছা আর শ্যাওলা।

এদের আর্থিক অবস্থা যে ভাল নয় তা তো এই বাড়ির হাল দেখেই বোঝা যাচ্ছে, নিজের মনে মন্তব্য করলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট।

.

০৯.

দরজা খোলার আওয়াজ শুনে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট মুখ তুলে তাকালেন, দেখলেন এক যুবতী খোলা দরজার পাল্লা দুহাতে ধরে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। যুবতী যে এই বাড়ির পরিচারিকা তার চেহারা আর পোষাক দেখেই সে সম্পর্কে নিশ্চিত হলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট।

গুড আফটারনুন,ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, আমি ইন্সপেক্টর ন্যারাকট। কিছুদিন আগে এক্সহ্যাম্পটনে মিসেস গার্ডনারের ভাই ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন হয়েছেন নিশ্চয়ই শুনেছেন, সেই খুনের তদন্তের ব্যাপারে ওঁকে কিছু প্রশ্ন করব, বলে এসেছি। মিসেস গার্ডনার ওঁর ভাইয়ের খুনের খবর শুনেছেন কি?

আজ্ঞে হ্যাঁ, মহিলা ঘাড় নেড়ে চাপা গলায় জবাব দিলেন, ওঁর উকিল মিঃ বাকউড টেলিগ্রাম করে খবরটা জানিয়েছেন।

ইন্সপেক্টর ন্যারাকট কোনো মন্তব্য করলেন না। সেই মহিলা অর্থাৎ মিসেস গার্ডনারের পরিচারিকা এবার তাকে নিয়ে এলেন ড্রইংরুমে। ড্রইংরুমে দেয়ালের চেহারাও বাড়ির বাইরের মতোই জীর্ণ ও করুণ। ইন্সপেক্টর ন্যারাকট একটা কৌচে গা এলিয়ে বসলেন।

তোমার মনিব অর্থাৎ মিসেস গার্ডনার নিশ্চয়ই এখনও শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি, পরিচারিকার দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট।

যতটা ভাবছেন ততটা নয়, পরিচারিকা জবাব দিল, কারণ উনি ওঁর ভাইকে খুব বেশি দেখেননি, তেমন ঘনিষ্ঠতাও ওঁদের মধ্যে কখনো চোখে পড়েনি।

তোমার নাম কি? ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন।

আজ্ঞে আমার নাম বিয়াত্রিস স্যার।

আচ্ছা, বিয়াত্রিস, জেরা করার ভঙ্গিতে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন, মিঃ বাকউড তোমার মনিব মিসেস গার্ডনারকে যে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন তাতে কি ওঁর ভাইয়ের খুন হবার উল্লেখ ছিল?

কি বললেন আপনি? দুচোখ বড় বড় করে বিয়াত্রিস তার দিকে তাকাল, ভীতি মেশানো গলায় পাল্টা প্রশ্ন করল, ওঁর ভাই তাহলে খুন হয়েছেন?

হ্যাঁ, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট ঘাড় নেড়ে বললেন, তার মানে এই দাঁড়াচ্ছে যে পাছে তোমার মনিব আঘাত পান সেই ভয়ে মিঃ বার্কউড গোড়াতেই ব্যাপারটা ইচ্ছে করে জানাননি তাকে। কিন্তু এভাবে কি আর এতবড় খবর চেপে রাখা যায়? আজ বিকেলের সব কটা সান্ধ্য দৈনিকেই দেখবে এই খুনের খবর ঠিক ছেপে বেরোবে।

ওঁর ভাই যে খুন হয়েছেন তা আমি এই প্রথম আপনার মুখ থেকে শুনলাম। খুন সে তো এক বীভৎস ব্যাপার, তাই না? তা আততায়ী কি ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের মাথায় আঘাত করেছিল, না কি ওঁকে গুলি ছুঁড়ে খুন করেছিল?

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান কি ভাবে খুন হয়েছেন তা সংক্ষেপে বিয়াত্রিসকে বলে তার কৌতূহল চরিতার্থ করলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট। তারপর বললেন, আমি শুনলাম গতকাল বিকেলে তোমার মনিবের এক্সহ্যাম্পটনে যাবার কথা ছিল, কিন্তু হয়তো আবহাওয়া খারাপ থাকার জন্য শেষ পর্যন্ত ওঁর সেখানে যাওয়া হয়নি।

দুঃখিত, বিয়াত্রিস বলল, তেমন কিছু তো শুনিনি, আমার মনে হচ্ছে আপনি ভুল খবর শুনেছেন। আমার মনিব মিসেস গার্ডনার কিছু কেনাকাটা করতে বিকেলে একবার বেরিয়েছিলেন ঠিকই, তারপর উনি সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন।

উনি কটা নাগাদ বাড়ি ফিরেছিলেন?

তা তখন সন্ধ্যে ছটা হবে।

 আচ্ছা, মিসেস গার্ডনার কি বিধবা?

আজ্ঞে না,বিয়াত্রিস চাপা হেসে বলল, ওঁর স্বামী জীবিত।

তিনি কি কোনো কাজকর্ম করেন?

আজ্ঞে না, তিনি পঙ্গু, সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকেন। বেচারা হাঁটাচলা করতে পারেন না তাই একজন নার্স দিনরাত ওঁর সেবা করে।

খুবই দুঃখজনক ব্যাপার, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, আচ্ছা বিয়াত্রিস, এবার তাহলে তুমি ভেতরে গিয়ে তোমার মনিব মিসেস গার্ডনারকে একবার এখানে পাঠিয়ে দাও। ওঁকে বলল যে মিঃ বার্কউডের তরফ থেকে আমি এসেছি।

বিয়াত্রিস ঘর থেকে বেরিয়ে গেল আর তার মিনিটখানেক বাদেই এক মাঝবয়সি মহিলা ড্রইংরুমে ঢুকলেন। মিসেস গার্ডনার দেখতে লম্বা, মুখের গড়নটাও তার কিছুটা অস্বাভাবিক –কপালের দুই ভুরু বরাবর মুখখানা চওড়া আকার নিয়েছে, কানের পাশে রগে বেশ কিছুটা চুলে রূপোলি আভা ধরেছে।

আপনি মিঃ বার্কউডের তরফ থেকে এসেছেন?

মিঃ বার্কউডের কাছ থেকে আপনার নামটুকু শুধু জানতে পেরেছি তবে আমি তার পেশার সঙ্গে যুক্ত নই,ইন্সপেক্টর ন্যারাকট কৌচ ছেড়ে শিষ্টাচার দেখাতে সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে বললেন, আমি ডিভিশন্যাল ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, গতকাল বিকেলে আপনার ভাই ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন হয়েছেন তা নিশ্চয়ই জানেন, ওই খুনের তদন্তের দায়িত্ব এখন আমিই পেয়েছি।

 তীক্ষ্ণ দুটি চোখের চাউনিতে ইন্সপেক্টর ন্যারাকটকে কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে দেখলেন মিসেস গার্ডমার, তারপর মন্তব্য করলেন, আপনি তাহলে পুলিশ অফিসার? বলছেন আমার ভাই খুন হয়েছে? কি আশ্চর্য। জো ছিল এক শান্ত নির্বিরোধী মানুষ, ওকে খুন করে কে লাভবান হল?

সেটা খুঁজে বের করাই তো আমার কর্তব্য, মিসেস গার্ডনার, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, আর এই তদন্তের ব্যাপারে কিছু খোঁজখবর নেবার জন্যই আপনার কাছে ছুটে এসেছি।

বেশ, মিসেস গার্ডনার বললেন, আমি যতদূর সম্ভব আপনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করব কিন্তু তাতে কতটা কাজ হবে তা এখনই বলতে পারছি না। গত দশ বছর আমার ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখাসাক্ষাৎ খুব কমই হয়েছিল। এই সময়ের ভেতরে ওর সঙ্গে যদি কারো বন্ধুত্ব বা সম্পর্ক গড়ে ওঠে তবে সেসব আমার কিছুই জানা নেই।

মাফ করবেন মিসেস গার্ডনার, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন আপনার সঙ্গে কি আপনার এই ভাইয়ের কোনো ঝগড়াঝাটি হয়েছিল?

ঝগড়াঝাটি বলতে যা বোঝায় জোর সঙ্গে আমার তা হয়নি, মিসেস গার্ডনার এতক্ষণ পরে ইন্সপেক্টর ন্যারাকটের মুখোমুখি একটি কোচে বসে বলতে লাগলেন, তবে অনেক সময় ও আমাকে ঠিক বুঝতে চাইতো না। এসব পারিবারিক খুঁটিনাটি ব্যাপার অনেক জটিল, সব আপনাকে বলত পারব না, শুধু এটুকু বলছি যে আমার ভাই জো আমার বিয়েতে বাধা দিয়েছিল। আমাদের এক নিঃসন্তান পিসিমা মারা যাবার আগে তার যাবতীয় বিষয় সম্পত্তি দিয়ে গিয়েছিল আমার ভাই জোকে, অল্প বয়সে প্রচুর টাকার মালিক হয়েছিল সে। আমার আর আমার ছোট বোনের স্বামী দুজনেই গরিব ঘরের ছেলে। আমার স্বামী গত বিশ্বযুদ্ধে অনেকের মতোই যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন, বিদেশে লড়াই করতে গিয়ে কামানের গোলার আঘাতে তিনি আহত হন। দেশে ফেরার পরে উপযুক্ত চিকিৎসা করালে উনি আবার আগের মতো স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করার ক্ষমতা ফিরে পেতেন কিন্তু সেই চিকিৎসা ছিল খরচ সাপেক্ষ। আমি এই চিকিৎসার খরচের টাকাটা জোয়ের কাছে ধার হিসাবে চেয়েছিলাম কিন্তু ও কিছুতেই টাকাটা আমায় দিতে চাইল না। তারপর থেকেই আমাদের দুজনের মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ কমে গিয়েছিল। চিঠিপত্র লেখাও একরকম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

অদ্ভুত শক্ত চরিত্রের মহিলা, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট নিজের মনে বলে উঠলেন, তার চেয়েও আশ্চর্যকর তার ভাই। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান কিভাবে খুন হয়েছেন সে সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন একবারের জন্যও তিনি করলেন না, কোনো কৌতূহলও প্রকাশ করলেন না।

এক্সহ্যাম্পটনের ঘটনাটা কি ঘটেছিল তা কি আপনি জানতে চান না? ইন্সপেক্টর ন্যারাকট ইচ্ছে করেই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন মিসেস গার্ডনারের দিকে।

জানার সত্যিই তেমন প্রয়োজন আছে কি? ভুরু কুঁচকে মিসেস গার্ডনার উত্তর দিলেন, আমার ভাই খুন হয়েছে সে খবর তো আপনিই নিজের মুখেই দিলেন, আশাকরি তাকে মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়নি।

তা হয়নি ঠিকই।

তাহলে আর এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত কিছু জানার আগ্রহ আমার নেই।

অস্বাভাবিক চরিত্র, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট আবার নিজের মনে বলে উঠলেন, এমনটা সচরাচর দেখা যায় না।

ইয়ে আমি আপনার আত্মীয়দের সম্পর্কে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন।

করুন।

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের মৃত্যুর পরে এখন আপনার নিকটাত্মীয়দের মধ্যে আর কে কে বেঁচে আছেন?

আমার ছোট বোন মেরী পিয়ার্সনের দুই ছেলে জেমস, ব্রায়ান আর মেয়ে সিলভিয়া।

 এদের সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে আমি কিছু জানতে চাই, আপনি পর পর বলে যান। বেশ, বলছি। মেরীর তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে জেমস সবার বড়, ওর বয়স আঠাশ, একটা বীমা কোম্পানিতে ভাল চাকরি করছে।

জেমস কি বিবাহিত?

না, তবে একটি মেয়েকে ও বহুদিন ধরে ভালবাসে। মেয়েটি সুন্দরী, শিক্ষিতা ও বুদ্ধিমতী শুনেছি, কিন্তু এখনও পর্যন্ত তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি।

জেমসের বর্তমান ঠিকানা কি?

 ২১, ক্রসওয়েল স্ট্রীট, লন্ডন, এস ডব্লিউ-৩।

তারপর? বলে যান, মিসেস গার্ডনারের বক্তব্য লিখে নিতে নিতে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, জেমসের বোন সিলভিয়া আসছে তারপর, ওর সম্পর্কে যা জানেন, বলুন।

সিলভিয়ার বিয়ে হয়েছে মার্টিন ডেরিংয়ের সঙ্গে। মার্টিনের নাম আশা করি শুনেছেন, ও লেখক, ওর লেখা কতগুলো বই বাজারে প্রচুর কাটছে।

ঠিকানা?

 দ্য লুক, সারে রোড ইমুলডন।

তারপর?

সবার ছোট হল ব্রায়ান, সে কিছুদিন আগে অস্ট্রেলিয়ায় গেছে। কাজেই তার ঠিকানা এই মুহূর্তে আপনাকে দিতে পারছি না। ওটা ওর ভাই বা বোনের কাছ থেকে পেয়ে যাবেন।

ধন্যবাদ, মিসেস গার্ডনার। এবার নিয়মমাফিক একটি মামুলি প্রশ্ন আপনাকে করছি। গতকাল বিকেলটা আপনি কিভাবে কাটিয়েছিলেন?

গতকাল বিকেলে আমি কিছু কেনাকাটা করতে বেরিয়েছিলাম, কেনাকাটা সেরে একটা সিনেমায় গিয়েছিলাম। ছবিটা দেখতে দেখতে মাথা ভীষণ ধরেছিল যে কারণে বাড়ি ফেরার পরে ডিনারের কিছু আগে পর্যন্ত চুপ করে শুয়েছিলাম।

আপনাকে যথেষ্ট ধন্যবাদ, মিসেস গার্ডনার।

আর কিছু জানতে চান?

না, আপনাকে আর কোনো প্রশ্ন করার নেই, আমি এবার আপনার ছোট বোনের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে যোগাযোগ করব। ভাল কথা, মিঃ বার্কউডের কাছ থেকে জানতে পারবেন যে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান খুন হবার আগে যে উইল করেছিলেন তাতে তার সম্পত্তির কিছু অংশ আপনাকে আর আপনার বোন মেরীর ছেলেমেয়েদের দিয়ে গেছেন।

বাঃ, মন্তব্য করলেন মিসেস গার্ডনার, এ তো রীতিমতো সুসংবাদ। ইন্সপেক্টর ন্যারাকট লক্ষ্য করলেন সম্পত্তির অংশ পাবার খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে মিসেস গার্ডনারের বিপদমলিন কঠিন মুখখানা হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। দুটি গালে ফুটে উঠল রক্তিমাভা।

ঠিক তখনই ওপরের একটি ঘর থেকে ভেসে এল পুরুষের কাতরকণ্ঠ।

জেনিফার! জেনিফার! তুমি কোথায় চলে গেলে? এখানে একটিবার এসো না!

মাপ করবেন। মিসেস গার্ডনার কৌচ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমার স্বামীর হয়তো কোনো কিছুর দরকার হয়েছে, তাই আমায় ডাকছেন।

মিসেস গার্ডনার ড্রইংরুম ছেড়ে বেরোতে যাবেন কিন্তু তার আগেই আবার ওপর থেকে সেই গলা ভেসে এলঃ

কি হল জেনিফার! কোথায় গেলে তুমি?

আসছি বাপু! বলতে বলতে মিসেস গার্ডনার ড্রইংরুমের দরজা খুলে এগোলেন, একটু ধৈৰ্য্য ধরুন আসছি।

মিসেস গার্ডনারের পেছন পেছন ইন্সপেক্টর ন্যারাকটও বেরিয়ে এলেন ড্রইংরুম থেকে। সামনে বিশাল হলঘর, তারপর দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে এক স্বাস্থ্যবতী যুবতী নেমে আসতেই মিসেস গার্ডনার তার পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলেন। যিনি নেমে এলেন তার পরনে নার্সের ধোপদুরস্ত ইউনিফর্ম, তাকে দেখেই ইন্সপেক্টর ন্যরাকট ইচ্ছে করে তার পথ আটকে দাঁড়িয়ে পড়লেন, হেসে বললেন, মাপ করবেন, আমি একজন পুলিশ অফিসার, মিসেস গার্ডনারের ভাইয়ের খুনের তদন্তে এসেছি, আপনাকে দু একটা প্রশ্ন করতে পারি?

নার্স যুবতীটি বেশ ছটফটে, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট পথ আটকে দেওয়া সত্ত্বেও তিনি অদ্ভুত ভঙ্গিতে তার পাশ কাটিয়ে দ্রুতপায়ে এসে ঢুকলেন ড্রইংরুমে, ইন্সপেক্টর ন্যারাকটও এলেন তার পেছন পেছন।

খুনের খবর শুনে আমার পেশেন্ট অর্থাৎ ক্যাপ্টেন গার্ডনার আচমকা খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছেন। নার্স বললেন, আসলে এই গোলমাল পাকিয়েছে ওই হতচ্ছাড়ী বিয়াত্রিস। কিছুক্ষণ আগে ওই ওপরে গিয়ে চেঁচিয়ে ক্যাপ্টেন গার্ডনারকে বলছিল যে ওঁর শ্যালক ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানকে খুন করা হয়েছে। বিয়াত্রিসের ঘটে এতটুকু বুদ্ধি নেই।

আচ্ছা, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন, আপনার পেশেন্ট ক্যাপ্টেন গার্ডনারের অসুখটা কি খুব জটিল

হ্যাঁ, তা বলতে পারেন, নার্স গম্ভীর গলায় বললেন, বাইরে থেকে দেখে কিছু বোঝ যায় না বটে কিন্তু গোলার আঘাতে ওঁর মস্তিষ্কের স্নায়ুকেন্দ্র এমন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে যে উনি দেহের কোনও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আর নাড়াতে পারেন না, উপযুক্ত চিকিৎসা হয়নি তাই ভবিষ্যতে সুস্থ হয়ে উঠবেন সে সম্ভাবনাও নেই।

আচ্ছা, গতকাল বিকেলে ক্যাপ্টেন গার্ডনার কি কোনও মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন অথবা উত্তেজিত হয়েছিলেন?

কই, নার্স অবাক সুরে বলল, তেমন কিছু ঘটেছে বলে তো শুনিনি।

 গতকাল পুরো বিকেলটাই কি আপনি ওঁর কাছে ছিলেন?

না, নার্স একটু ভেবে নিয়ে বলল, ক্যাপ্টেন গার্ডনারের দুটো বই পাল্টে আনার জন্য একবার লাইব্রেরীতে গিয়েছিলাম। এ কাজটা সাধারণতঃ ওঁর স্ত্রী নিজেই করেন কিন্তু গতকাল ওঁর স্ত্রী আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন তাই ক্যাপ্টেন আমাকেই লাইব্রেরীতে যেতে অনুরোধ করেছিলেন। ফেরার সময় ওঁর অনুরোধমতো মিসেস গার্ডনারের জন্য কয়েকটা ছোট উপহারও কিনেছিলাম। কাপ্টেন বলে দিয়েছিলেন ফেরার পথে আমি যেন রেস্তোরাঁয় বিকেলের চা, জলখাবার খেয়ে নিই আর সেই খরচও উনি বেরোবার সময় আমায় দিয়েছিলেন। আমি গতকাল বিকেলে যখন বেরোই তখন চারটে বেজে গেছে, সন্ধ্যে ছটার পর বাড়ি ফিরেছিলাম। ফিরে এসে শুনলাম আমি যতক্ষণ বাইরে ছিলাম সেই সময়টা ক্যাপ্টেন গার্ডনার দিব্যি ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন।

বাড়ি ফিরে এসে মিসেস গার্ডনারকে দেখতে পেয়েছিলেন? ইন্সপেক্টর ন্যারাকট গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন।

হ্যাঁ, উনি আমার আসার আগেই ফিরে এসেছিলেন, নার্স বলল, শুনলাম মাথা ধরেছে বলে উনি শুয়ে আছেন।

মিসেস গার্ডনার ওঁর স্বামী ক্যাপ্টেন গার্ডনারকে খুব ভালবাসেন। তাই না?

স্বামী স্ত্রীর পরস্পরকে ভালবাসা এমন কিছু নতুন নয়। নার্স বলল, তেমন ভালবাসা অনেক দেখেছি। কিন্তু মিসেস গার্ডনারের বাপার পুরো আলাদা। উনি ওঁর স্বামীকে এককথায় পুজো করেন, ওঁর জন্য এমন কোনও কাজ নেই যা উনি করতে পারেন না। স্বামীকে এমনভাবে ভালবাসতে আমি আগে কখনও কোনও স্ত্রীকে দেখিনি। এই ভালবাসার তুলনা হয় না। এই তো গতমাসে

মাপ করবেন, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, এবার আমায় রওনা দিতে হবে নয়তো ট্রেন ধরতে পারব না।