০১. মেজর বারবি

মার্ডার অ্যাট হ্যাজেলমুর (অন্যান্য)

০১.

মেজর বারবি তার পুরোনো গরম আর ভারী ওভারকোটখানা গায়ে চাপালেন। পায়ে পরলেন গামবুট, হাতে লণ্ঠন ঝুলিয়ে দরজা খুলে এক ঝলক উঁকি মারলেন বাইরের দিকে।

বাইরে নিকষ কালো আঁধার, লণ্ঠনের ম্লান আলোয় মেজর বারনাবি দেখতে পেলেন সামনে আর আশেপাশে শুধু সাদা তুষারের স্তর পড়ে আছে। যতদূর নজর গেল শুধু তুষার ছাড়া আর কিছুই তার চোখে পড়ল না।

গত চারদিন ধরে গোটা ইংল্যান্ডে একটানা তুষারপাত হয়েছে, যার ফলে ডার্টমুর অঞ্চলের এই ছোট্ট সিটাফোর্ড গ্রামের মাটির ওপর তিন চার ফিট তুষারের আস্তরণ জমে রয়েছে।

লণ্ঠনের আলোয় বাইরের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে কয়েকবার নিঃশ্বাস নিলেন মেজর বারনাবি, তারপর লণ্ঠন হাতে নিয়ে বাংলো থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি। অল্প কিছুক্ষণ বাদে কাছেই একটা গলিতে এসে ঢুকলেন, সামনেই একটা পুরোনো আমলের বাড়ির সদর দরজার পাল্লায় জোরে কয়েকবার টোকা দিলেন মেজর বারনাবি।

চার পাঁচ সেকেন্ড কাটতে না কাটতেই দরজাটা গেল খুলে, অল্প বয়সি এক পরিচারিকা মেজরকে অভ্যর্থনা করে ড্রইংরুমে নিয়ে গিয়ে বসাল। ড্রইংরুমের ভেতরের বৈদ্যুতিক আলোর সাথে ফায়ারপ্লেসের চুল্লিতে গনগন করে জ্বলছে কাঠের গুঁড়ি। মেজর ফায়ারপ্লেসের সামনে এসে গনগনে আগুনে নিজের হাতদুটো মেলে ধরলেন কিছুক্ষণ, তারপর গলায় আঁটা পুরু পশমী স্কার্ফটা খুলে উল্টোদিকের কৌচে বসলেন আয়েস করে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজাটা ঠেলে ড্রইংরুমে ঢুকলেন দুইজন সমবয়সি মহিলা, মেজরকে দেখে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন তারা।

যাক, আপনি এসেছেন দেখে খুব ভালো লাগল মেজর বারনাবি। মহিলাদের মধ্যে যিনি প্রবীন তিনিই মন্তব্য করলেন, ভীষণ একঘেয়ে লাগছিল মিঃ বারনাবি, যেদিকে তাকাই শুধু তুষার আর তুষার।

আমারও একই অবস্থা, মিসেস উইলেট, মেজর উঠে এসে তাদের দুজনের সঙ্গে করমর্দন করতে করতে বললেন।

মিঃ গারফিল্ড আসছেন, মিসেস উইলেট বললেন, মিঃ ডিউকও আসছেন শুনেছি। আর মিঃ রাইক্রফটেরও আসার কথা আছে, কিন্তু যা বিশ্রী আবহাওয়া, শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছোতে পারবেন কিনা জানি না। তাছাড়া ওনার বয়স তো অনেক হয়েছে। ভায়োলেট, মিসেস উইলেট তার সঙ্গী যুবতীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আগুনে আর একটু কাঠ দাও।

থাক, ওটা আমিই দিচ্ছি।বলেই মেজর এগিয়ে এসে পাশে রাখা কাঠের টুকরো তুলে নিয়ে আগুনে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিতে থাকলেন।

আজ থেকে ঠিক দশ বছর আগে রয়্যাল নেভীর ক্যাপ্টেন জোসেফ ট্রেভিলিয়ান চাকরি থেকে অবসর নিয়ে ডার্টমুরের গ্রামাঞ্চলে কিছু জমি কিনে গড়ে তুলেছিলেন সিটাফোর্ড–হাউস। মোট দুটি বাংলো নিয়ে গড়া এই প্রাসাদের একাংশ তিনি হস্তান্তর করেছিলেন তাঁর : পুরোনো পুরোনো বন্ধু ফোর বারনাবিকে। বাকি অংশটুকু তিনি একাই ভোগ করতেন। গোটা বাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান বিদ্যুৎ উৎপাদন যন্ত্র বসিয়েছিলেন, জলের পাম্পও বসিয়েছিলেন জল সরবরাহের জন্য।

অনেক টাকা খরচ করে সাধের বাড়িটি তৈরি করার পরে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের টাকার লোভ গিয়েছিল বেড়ে। বাড়ি করার পরে সেখানে ভাড়াটে বসানোর কোনো ইচ্ছে গোড়ায় তার না থাকলেও শেষ পর্যন্ত তিনি তা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। মিসেস উইলেট নামে আর্থিক সঙ্গতিসম্পন্ন এক ইংরেজ বিধবাকে শেষ পর্যন্ত তিনি বাড়িটি ভাড়া দিয়েছিলেন। শর্ত ছিল একটাই–ট্রেভিলিয়ান নিজে বাড়িতে থাকবেন না। তার অনুপস্থিতিতে গোটা বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ ও দেখাশোনার ভার তাদেরকেই নিতে হবে। মিসেস উইলেটও এই শর্তে রাজি হয়েছিলেন। একমাত্র অবিবাহিত যুবতী কন্যা ভায়োলেটকে সঙ্গে নিয়ে সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকার নাটাল থেকে এসে বাসা বেঁধেছিলেন ইংল্যান্ডের এই পাড়াগাঁয়ে।

সেই থেকে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান বাড়ির বাইরে। এক্সহ্যাম্পটনে একটি পুরানো বাড়ি ভাড়া নিয়ে আছেন তিনি। সপ্তাহের প্রতি মঙ্গলবার সিটাফোর্ডে এসে পুরনো বন্ধু মেজর বারনাবির সঙ্গে কিছু সময় কাটিয়ে যান তিনি। আবার মেজর বারনাবিও সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার ক্যাপ্টেন ট্রাভেলিয়ানের ভাড়া বাড়িতে গিয়ে কিছুটা সময় কাটিয়ে আসতেন। এই ভাবে প্রায় কয়েক বছর যাবৎ দুজনে দুজনের পুরোনো বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছেন। না, মেয়েদের সম্পর্কে প্রৌঢ় ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান এখন আর আদৌ আগ্রহী নন, যদিও যৌবনে তিনি যুবতী মেয়েদের নিয়ে অনেক সময় ব্যয় করেছেন। সিটাফোর্ড হাউসে ট্রেভিলিয়ান তার বন্ধু বারনাবির কাছে আসেন শুধু বন্ধুত্বের খাতিরেই, মিসেস উইলেট বা তার যুবতী মেয়ে ভায়োলেটের আকর্ষণে নয়।

মেজর, মিসেস উইলেটের মেয়ে ভায়োলেট হঠাৎ বলে উঠল, ক্রসওয়ার্ড ধাঁধার উত্তর খোঁজা আপনার নেশা, তাই না?

-হ্যাঁ, তা বলতে পারো, মেজর বারনাবি বললেন, এই তো গত মাসে এক ক্রসওয়ার্ড ধাঁধা প্রতিযোগিতায় জিতে আমি তিনটে মোটা বই পেয়েছি।

-বাঃ চমৎকার! ভায়োলেট মন্তব্য করল, বইগুলো কি ধরনের?

তা ঠিক জানি না, বারনাবি বললেন, এখনও পাতা উল্টে দেখিনি, তবে মনে হচ্ছে ভীষণ বাজে আর বদখত বিষয় নিয়ে লেখা হবে।

–মেজর, ভায়োলেট আবার আপনার বন্ধুকে দেখতে এক্সহ্যাম্পটনে কিভাবে যান? আপনার তো গাড়ি নেই?

–কেন হেঁটে! মেজর বললেন।

হেঁটে! ভায়োলেট বিস্ময়সূচক শব্দ উচ্চারণ করল, হেঁটে ছয় ছয় মোট বারো মাইল পথ আসা-যাওয়া করেন আপনি?

–তাতে কি হয়েছে? বারনাবি বললেন, হাঁটার মতো সোজা ব্যায়াম খুব কমই আছে, যত বেশি হাঁটা যায় শরীর তত সুস্থ থাকে।

-ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের মুখ থেকে শুনেছি যে আপনারা দুজনেই খুব ভালো খেলোয়াড় ছিলেন।

কথাটা ভুল বলেননি উনি, মেজর বারনাবি বললেন, আমরা গরমের সময় দুজনে আল্পস পাহাড়ের চূড়ায় উঠতাম, শীতে স্কি করতাম। কিন্তু এখন দুজনেই বুড়ো হয়েছি তাই হাঁটা ছাড়া আর কোনো ব্যায়াম বা খেলাধূলা করা সম্ভব নয়।

কথা শেষ করে মেজর বারনাবি জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বললেন, আজকেও প্রচুর তুষারপাত হবে বলে মনে হচ্ছে।

কি মজা; আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠলেন ভায়োলেট, আসলে আমি তো দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রচণ্ড গরমের মধ্যে এতদিন থেকেছি, তাই তুষারপাত আমার কাছে খুব রোমান্টিক ব্যাপার!

বোকার মতো কথা বলো না ভায়োলেট, মিসেস উইলেট ধমকের সুরে বললেন, ঠাণ্ডায় পাইপের ভেতরের জল জমে যখন বরফ হয়ে যাবে তখন আর ব্যাপারটা রোমান্টিক থাকবে না।

পরমুহূর্তেই দরজা ঠেলে পরিচারিকা ভেতরে ঢুকে মিসেস উইলেটের কাছে এসে বলল, ম্যাডাম, মিঃ রাইক্রফট আর মিঃ গারফিল্ড দুজনেই এসেছেন। পরিচারিকার কথা শেষ হতে না হতেই দুজনেই ড্রইংরুমে এসে ঢুকলেন একজন মাঝবয়সি অন্যজন যুবক। ড্রইংরুমে ঢুকেই দুজনে সোজা ফায়ারপ্লেসের গা ঘেঁষে দাঁড়ালেন নিজেদের শরীর চাঙ্গা করে নিতে।

যুবক মিঃ গারফিল্ড বললেন, পথে আসার সময় মিঃ রাইক্রফটকে দেখলাম পথের মাঝখানে একা দাঁড়িয়ে আছেন। দেখেই ভয়ে আঁতকে উঠলাম, ভাবলাম প্রচণ্ড তুষারপাতে পথে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে তুষার চাপা পড়ে মারা যাবেন নির্ঘাত, তাই সঙ্গে করে নিয়ে এলাম।’ কথাটা বলতে বলতেই তিনি এগিয়ে এসে ভায়োলেটের সঙ্গে করমর্দন করলেন।

যুবক মিঃ গারফিল্ডকে ভায়োলেটের সমবয়সি বলা চলে, তাকে দেখে একটু বেশি পুলকিতই হয়ে উঠল ভায়োলেট।

-আচ্ছা, আমরা কি কোথাও তুষারের ওপর একটু স্কেটিং করতে পারি না? গারিফল্ড জানতে চাইল।

স্কেটিং দিয়ে কী হবে? ভায়োলেট উত্তর দিল, তার চাইতে বরং চলুন রাস্তার জমে থাকা তুষার সাফ করি, তাতে অনেক মজা আছে।

সে তো আজ সকাল থেকেই করছি। গারফিল্ড বলল, এই দেখোনা আমার দুহাতে ফোস্কা পড়ে গেছে। বলেই নিজের দুহাত ভায়ালোটের দিকে বাড়িয়ে দিল।

মিঃ ডিউক এসেছেন। ড্রইংরুমের দরজা খুলে পরিচারিকা ভেতরে ঢুকে ঘোষণা করল।

স্টিফোর্ড হাউসের ছটা বাংলোর মধ্যে সবশেষ যেটা খালি পড়েছিল গত সেপ্টেম্বর মাসে সেটা কিনেছেন মিঃ ডিউক। দশাসই চেহারার মানুষ মিঃ ডিউক খুব শান্ত স্বভাবের মানুষ দিনরাত শুধু নিজের বাগান নিয়ে পড়ে থাকেন তিনি। পরিচারিকা ঘর থেকে যেতে না যেতেই মিঃ ডিউক ভেতরে ঢুকে মেজর বারনাবির উদ্দেশ্যে বলেলন

মেজর, আজকের এই বিশ্রী আবহাওয়ায় আপনি কি পায়ে হেঁটে এক্সহ্যাম্পটনে বন্ধুর বাড়িতে যাবেন?

-না, মেজর জবাব দিলেন।

–বন্ধু ট্রেভিলিয়ান আমার জন্য নিশ্চয়ই অপেক্ষা করবেন।

 –সত্যিই ভারি বিশ্রী আবহাওয়া, তাই না মিঃ ডিউক।

মিসেস উইলেট বলে উঠলেন, প্রত্যেক বছর তুষারপাতের সময় ঘরে বন্দি হয়ে থাকা যে কি জঘন্য ব্যাপার, বলে বোঝানো যাবে না।

মিঃ ডিউক আর মেজর দুজনেই আড়চোখে তাকালেন তার দিকে কিন্তু মুখে কেউই কোনো মন্তব্য করলেন না।

খানিক পরে পরিচারিকা ট্রেতে চায়ের সরঞ্জাম সাজিয়ে ড্রইংরুমে এসে হাজির হল।

.

০২.

চা-এর পর্ব শেষ হলে মিসেস উইলেট ব্রিজ খেলার প্রস্তাব দিলেন কিন্তু ছোকরা গারফিল্ড তাকে বাধা দিয়ে বলে উঠল, তার চাইতে আসুন একটু প্রেতচর্চা করা যাক।

-প্রেতচর্চা! মিসেস উইলেটের মেয়ে ভায়োলেট চমকে উঠে বলল, সে আবার কি?

হ্যাঁ, গারিফ বলল, আজকের এই আবহাওয়া প্রেতলোকের বাসিন্দাদের আবাহন করার পক্ষে সবদিক থেকে উপযুক্ত। এখানে আসবার আগে মিঃ রাইক্রফটের সঙ্গে এই বিষয়েই আলোচনা করেছিলাম আমি।

ও ঠিকই বলেছে। গারফিল্ডের কথায় সায় দিয়ে মিঃ রাইক্রফট বললেন, আমি নিজে অতিলৌকিক গবেষণা পর্ষদের সদস্য। আমারও মনে হয় প্রেতচর্চা করার পক্ষে আজকের সন্ধ্যেটা আদর্শ। তবে আমরা যা করতে চাইছি তা কিন্তু নিছক আমোদ বা সময় কাটাবার জন্য তা আপনারা সবাই মনে রাখবেন।

তাহলে এবার ঘরের আলো নিভিয়ে দিচ্ছি, ভায়োলেট বলে উঠল একটা জুৎসই টেবিলও তো দরকার। না স্যার ওটা নয়, ওটা বড্ড ভারী।

ভায়োলেট নিজেই পাশের ঘর থেকে একটা ছোট গোল টেবিল নিয়ে এল। ফায়ারপ্লেসের সামনে সেই টেবিলের চারপাশে গোল হয়ে বসল সবাই। এরপরে ঘরের আলো নিভিয়ে দিল ভায়োলেট। মিসেস উইলেট আর ভায়োলেটের মাঝখানে বসলেন মেজর বারনাবি, ভায়োলেটের মুখোমুখি বসল গারফিল্ড। নিজের মনে একবার হাসলেন। বারবি, যৌবনে এই ধরনের প্রেতচর্চা করে তিনিও একসময় অবসর কাটিয়েছেন। এক সুন্দরী সুকেশী বান্ধবীর কথা তার মনে পড়ল, আজ যে আর বেঁচে নেই। প্রেতচর্চার সময় সবার চোখ এড়িয়ে টেবিলের নীচে তারা দুজনে পরস্পরের হাত ধরতেন। একমনে সেই পরলোকগত বান্ধবীর আত্মাকে ডাকতে লাগলেন মেজর বারনাবি।

প্রেত আবাহনের এই আমোদে যাঁরা অংশ নিয়েছেন তারা কেউই চুপ করে নেই, থেকে থেকেই নানারকম মন্তব্য করতে লাগলেন তাঁরা–না, ওদের আসতে বড্ড সময় লাগে দেখছি।

একমনে ডেকে নাও, নয়তো, কেউ সাড়া দেবে না। আঃ, চুপকরুন, গোলমাল করবেন না দয়া করে।

কয়েক সেকেন্ডের ভেতর সবাই চুপ করলেন, ড্রইংরুমের মেঝেতে সূঁচ পড়লেও তার শব্দ শোনা যাবে। হঠাৎ টেবিলটা কেঁপে উঠল।

প্রশ্ন করুন,মিঃ রাইক্রফট গারফিল্ডের উদ্দেশ্যে বলেন, রনি, তুমিই প্রশ্ন করো।

–ইয়ে, কি প্রশ্ন করব বলুন তো?

প্রশ্ন কর কোনো আত্মা এসেছে কিনা, বলল ভায়োলেট।

–ইয়ে। এখানে কোনও আত্মা এসেছেন কি? রনি গারফিল্ড জানতে চাইলে, উত্তরে–টেবিলটা আবার কেঁপে উঠল।

–তার মানে হা, ভায়োলেট বলল, একজন আত্মা ঠিকই এসেছেন।

–আপনি কে? নাম বলুন দয়া করে। কোনো উত্তর নেই।

ওকে নিজের পরিচয় দিতে বলো, মিঃ রাইক্রফট বলে উঠলেন।

–ইয়ে, আপনি নিজের পরিচয় দিন, গারফিল্ড বলল।

সঙ্গে সঙ্গে টেবিলটা কাঁপতে লাগল, কখনো ধীরে, কখনো জোরে।

–সংখ্যা অনুযায়ী ইংরেজি বর্ণমালার হিসাবে সবাই জানলেন উপস্থিত আত্মার নাম ইভা।

–আপনি কি এখানে কাউকে কিছু বলতে চান?’ গারফিল্ড আবার প্রশ্ন করল।

–টেবিল কেঁপে উঠে জানাল যে তার অনুমান ঠিক।

–আপনি কি মিসেস উইলেট বা তার মেয়েকে কিছু বলতে চান?’ গারফিল্ড প্রশ্ন করলেন।

-না।

 –মিঃ রাইক্রফট?

–না।

–মিঃ ডিউক?

–না।

–তাহলে কি আমায় কিছু জানাতে চান?

-হ্যাঁ। এইটুকু জানিয়েই টেবিল বারে বারে আবার কাঁপতে লাগল যেমন কেঁপে উঠছিল নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে।

–মিঃ রাইক্রফট এবং উপস্থিত সবাই দেখতে পেলেন কাগজের বুকে একটি নাম ফুটে উঠেছে ডায়না।

–ডায়না কে রনি? মিঃ রাইক্রফট বললেন, ওই নামে তুমি কাউকে চেনো?

–কই না।

-রনির উত্তর শুনে মেজর বারনাবি হেসে আড়চোখে তাকালেন মিসেস উইলেটের দিকে, তিনি কি যেন ভাবলেন নিজের মনে।

এবার ভায়োলেট আমাকে কয়েকটি প্রশ্ন করল। আত্মা জানাল যে শিগগিরই, সে ইটালি যাবে, লিওনার্ড নামে এক ব্যক্তি তার সঙ্গী হবে। শুনে সবাই হেসে উঠলেন।

–অ্যাই ভায়োলেট, রনি গারফিল্ড বলে উঠল, তুমি কিন্তু জোরে টেবিলটা ঠেলছ।

–মোটেও না,ভায়োলেট প্রতিবাদ করল, আসলে তুমি নিজেই ঠেলে আমার নামে দোষ দিচ্ছ।

কয়েক মুহূর্তের নীরবতার পরে টেবিলের কাঁপুনি থেমে গেল, গারফিল্ড জানতে চাইল, ইভার আত্মা কি এখনও এখানে আছেন?

উত্তরে টেবিল জোরে কেঁপে উঠল। মনে হচ্ছে অন্য কোনো আত্মা এসেছেন,রণি জানতে চাইল, এখানে কি নতুন কোনো আত্মা এসেছেন?

-হ্যাঁ।

–আপনি কি কোনো খবর এনেছেন?

–হ্যাঁ।

–আমার জন্য?

–না।

–ভায়োলেট বা তার মায়ের জন্য?

–না।

–তবে কি মেজর বারনাবির জন্য?

–হ্যাঁ।

–বর্ণমালা অনুযায়ী খবরটা জানান।

–টেবিলের কাঁপুনি অনুযায়ী গারফিল্ড ইংরাজি বর্ণমালার এক একটি অক্ষর লিখতে লাগল, কাঁপুনি শেষ হতে দেখা গেল শব্দটি ট্রেভিলিয়ান।

এ তো আমাদের সবারই চেনা নাম, মিসেস উইলেট বললেন, এখানে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের নাম লেখা হয়েছে।

-ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান? গারফিল্ড প্রশ্ন করল, ওঁর কি হয়েছে?

–আবার শুরু হল টেবিলের কাপুনি। যে দুটি শব্দ কাগজের বুকে ফুটে উঠল তিনি মারা গেছেন।

–কে মারা গেছেন? গারফিল্ড আবার প্রশ্ন করল, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান?

–হ্যাঁ।

–কিভাবে মারা গেছেন?

আমি আর পারছি না, আমায় আপনারা মাফ করুন। মিসেস উইলেট চাপা গলায় কেঁদে নিজের হাত দুটো তুলে নিলেন টেবিলের ওপর থেকে, এসব আমার আর ভালো লাগছে না। মিসেস উইলেটের কথায় সায় দিয়ে বাকি সকলেও হাত তুলে নিলেন টেবিল থেকে।

আলো জ্বালিয়ে দিন। নির্দেশ দিলেন মিঃ রাইক্রফট। মেজর বারনাবি কৌচ ছেড়ে উঠে ঘরের সবকটা আলো জ্বালিয়ে দিলেন। একটু আগে পাওয়া দুঃসংবাদ ঘরের ভেতরে যে বিষণ্ণ পরিবেশ তৈরি করেছিল, হঠাৎ আলোর ঝলকে তা কিছুক্ষণের জন্য কেটে গেল বলেই মনে হল। সবাই সবার মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন, কেউই বলার মতো কিছু খুঁজে পেলেন না।

ধ্যাৎ, এসব রসিকতা। ঘরের ভেতরের থমথমে ভাবটা কাটাবার জন্য রনি গারফিল্ড মন্তব্য করলেন।

এই জাতীয় রসিকতা প্রেতলোকের বাসিন্দাদের মোটেই করা উচিত নয়। মন্তব্য করলেন মিসেস উইলেট।

মানুষের মৃত্যু নিয়ে এ ধরনের রসিকতা করার অর্থই বা কি? প্রশ্ন করল ভায়োলেট।

আগেই বলে রাখি আমি কিন্তু হাত দিয়ে টেবিল ঠেলিনি, বলে উঠল রনি গারফিল্ড।

আমিও ঠেলিনি, একই সুরে বলে উঠলেন মিঃ রাইক্রফট।

আমিও ঠেলিনি,তাদের সঙ্গে একই সুরে গলা মেলালেন মিঃ ডিউক। মেজর বারনাবি কোনো মন্তব্য না করে উঠে পড়লেন, ঘরের জানালার ভেজানো কাঁচের শার্সির সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি।

ঢের হয়েছে, এবার বরং একটু ককটেলের ব্যবস্থা করা যাক, পরিবেশটা হাল্কা করতে বলে উঠলেন মিসেস উইলেট। তার ইঙ্গিতে রনি ঘণ্টা বাজাতেই পরিচারিকা এসে ঢুকল ভেতরে। মিসেস উইলেট তাকে ককটেলের আয়োজন করতে বললেন।

ককটেলের ব্যবস্থা হল অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই। ককটেল তৈরি করে প্রথম গ্লাসটি রনি তুলে দিল মেজর বারনাবির হাতে। গ্লাসের পানীয় পুরো শেষ করে মেজর বারনাবি মিসেস উইলেটকে বললেন, মিসেস উইলেট, আপনাকে এবং বাকি সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি আজকের মতো বিদায় নিচ্ছি, শুভরাত্রি।

সেকি! মিসেস উইলেট অবাক হয়ে বলে উঠলেন, এই দুর্যোগের রাতে আপনি এখান থেকে বেরাবেন কি করে? আজকের রাতটা কি এখানে থেকে যেতে পারবেন না?

ধারেকাছে একটা টেলিফোনও নেই মিসেস উইলেট, বারনাবি বললেন, থাকলে আপনার ইচ্ছেমতো আজ বাড়ি না ফিরলেও পারতাম।

–টেলিফোন? কিছু বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে মেজর বারনাবির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন মিসেস উইলেট।

হ্যাঁ, বারনাবি বললেন, সত্যি বলতে কি, জো ট্রেভিলিয়ান সম্পর্কে আমার খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে। আপনারা হয়তো এটাকে সুসংস্কার বলতে পারেন, কিন্তু তাহলেও আমি নিজে নিশ্চিত হতে চাই। আজ সন্ধ্যের ব্যাপারটাকে আমি পুরো রসিকতা বলে মেনে নিতে পারছি না।

আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি মেজর, মিসেস উইলেট বললেন, কিন্তু এই মিটাফোর্ড গ্রামে কোথাও টেলিফোন পাবেন না আপনি।

অতএব আমায় যেতেই হবে।

-তা তো বুঝলাম, মিসেস উইলেট বললেন, কিন্তু আপনি যাবেন কি ভাবে? রাস্তায় যে পরিমাণ তুষার জমেছে তাতে স্থানীয় কোনো ড্রাইভারই গাড়ি বের করতে রাজি হবে না।

গাড়ির দরকার নেই, মেজর বারনাবি বললেন, আমি হেঁটে যেতে পারব।

হেঁটে! এই দুর্যোগে? আপনার মাথা কি খারাপ হয়েছে, মেজর তীব্র গলায় প্রতিবাদ জানালেন। মিসেস উইলেট, উপস্থিত সবাই তাকে একযোগে সমর্থন করলেন। কিন্তু মেজর বারনাবি ভয়ানক একগুয়ে ধাঁচের লোক, এঁরা কেউই তাকে রুখতে পারলেন না। সবার প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে ওভারকোট গায়ে চাপিয়ে মাথায় টুপি পরলেন তিনি, তারপর বেরিয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে।

কাজটা ভাল করেলন না উনি, জানালা দিয়ে আকাশের দিকে এক পলক তাকিয়ে মিঃ রাইক্রফট মন্তব্য করলেন, একটু আগে মেজর বারনাবি নিজেই বলেছিলেন যে আরও তুষার পড়বে।

ঠিকই বলছেন আপনি, সায় দিয়ে বললেন মিঃ ডিউক, আমাদের মধ্যে কারও ওঁর সঙ্গী হওয়া উচিত ছিল।

ঈশ্বরের নামে শপথ করছি যে আর কোনোদিন সময় কাটানোর জন্য এই প্রেতচর্চার খেলা আর খেলব না, মিসেস উইলেট কঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলেন, বেচারা মেজর বারনাবি। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বাড়িতে পৌঁছোনোর আগেই উনি মাঝপথে নির্ঘাৎ তুষার চাপা পড়ে মারা যাবেন, নয়তো ঠাণ্ডা লাগিয়ে জ্বর বা নিউমোনিয়া বাঁধিয়ে বসবেন। ছিঃ! বুড়ো বয়সে এমন জেদ কখনো দেখাতে হয়? ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান নিশ্চয়ই সুস্থ আছেন।

সে তো একশোবার, উপস্থিত সবাই সায় দিলেন তার কথায়। কিন্তু সায় দেওয়া সত্ত্বেও মনের দিক থেকে কেউই তেমন জোর পেলেন না। সবারই মনে হতে লাগল যদি…… ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের সত্যিই কিছু ঘটে থাকে, তাহলে?

.

০৩.

হাঁটতে হাঁটতে মেজর বারনাবি যখন ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বাড়িতে এসে পৌঁছোলেন তখন রাত প্রায় আটটা।

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান যে বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন তার নাম হ্যাজেলমুর। পথশ্রমে। ক্লান্ত মেজর বারনাবি সিঁড়ি দিয়ে বারান্দায় উঠে এলেন, কলিংবেলের বোতাম টিপে স্যুটে জমে থাকা অসংখ্য তুষারকণা দুহাত দিয়ে ঝেড়ে ফেললেন তিনি। কয়েক মিনিট কেটে গেল, ভেতর থেকে কারো সাড়াশব্দ পেলেন না মেজর, আবার কলিংবেল টিপলেন তিনি।

কিন্তু এবারেও অবস্থা একইরকম রইল। ভেতর থেকে কেউ সদর দরজা খুলল না। তৃতীয়বার আরেকবার কলিংবেল টিপলেন বারনাবি। কিন্তু এবারেও কোনো কাজ হল না, দরজা আগের মতোই বন্ধ রইল। দরজার গায়ে কড়া লাগনো ছিল তাই ধরে খুব জোরে নাড়লেন মেজর বারনাবি, কিন্তু এবারেও কেউ ভেতর থেকে দরজা খুলল না।

ট্রেভিলিয়ানের কি হল? এক অজানা আশঙ্কায় মেজর বারনাবির মনটা ছেয়ে গেল, ওর অসুখবিসুখ করেনি তো? কয়েক মুহূর্ত চুপ করে কি যেন ভাবলেন মেজর বারনাবি! তারপর পেছন ফিরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন রাস্তায়। হ্যাজেলমুর বাড়িটি থেকে মাত্র একশো গজ দূরে স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ি, সেখানে এসে হাজির হলেন তিনি। কনস্টেবল গ্রেভস তার পরিচিত, তাকে সব খুলে বললেন বারনাবি।

আপনি পর-পর তিনবার কলিংবেল টিপলেন, জোড়ে কড়া নাড়লেন, তবু দরজা খুলল না? কনস্টেবল গ্রেভস ভুরু কুঁচকে বললেন, এ ত ভারি অদ্ভুত ব্যাপার।

শুধু অদ্ভুত নয়, মিঃ বারনাবি বললেন, সেই সঙ্গে ভাবনার ব্যাপার।

এই বিশ্রী আবহাওয়ায় ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান নিশ্চয়ই বাড়ি ছেড়ে বেরোননি, কনস্টেবল গ্রেভস মন্তব্য করলেন।

এই কথাটাই আমি বলতে চাইছি, মেজর বারনাবি অনুনয়ের সুরে বললেন, এবার আপনি কিছু করুন।

করতে তো পারি, কনস্টেবল গ্রেভস বললেন। কিন্তু ধরুন, আপনার বন্ধু যদি তাতে কিছু মনে করেন, যদি উনি ব্যাপারটা অন্যভাবে নেন? তার চাইতে আমি দেখি টেলিফোনে ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় কিনা।

কনস্টেবল গ্রেভস একবার নয় পরপর কয়েকবার টেলিফোনে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তাতে কোনো কাজ হল না। ওপাশ থেকে কেউ রিসিভার তুলল না।

মনে হচ্ছে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, কনস্টেবল গ্রেভস বললেন, আমি ডঃ ওয়ারেনকে সঙ্গে নিয়ে এখনই ওঁর কাছে যাব।

ডঃ ওয়ারেন ফাড়ির পাশেই থাকেন। কনস্টেবল গ্রেভসের মুখ থেকে সব শোনার পর তাকে বেশ বিরক্তই দেখাল। তবু কর্তব্যের তাগিদে গরম ওভারকোট আর ভারী গামবুট পড়ে তিনি তখনই বেরিয়ে পড়লেন বাড়ি থেকে। তুষারপাত তখনও চলছে।

মেজর বারনাবি আর ডঃ ওয়ারেনকে সঙ্গে নিয়ে কনস্টেবল গ্রেভস এসে হাজির হলেন হ্যাজেলমুরে, কলিংবেল টিপে আর কড়া নেড়েও কোনো ফল হল না।

বাড়ির পেছনদিকে একবার চলুন, ডঃ ওয়ারেন প্রস্তাব দিলেন, দেখা যাক ওদিক দিয়ে ভেতরে ঢোকা যায় কিনা।

বাড়ির পেছন দিকে এসে পৌঁছোনোর পর হঠাৎ তাদের নজরে পড়ল ট্রেভিলিয়ানের স্টাডির একটা জানালা খোলা। সেই ভোলা জানালা দিয়ে প্রথমে মেজর বারনাবি, তারপর কনস্টেবল গ্রেভস আর সবশেষে ডঃ ওয়ারেন ভেতরে ঢুকলেন। স্টাডির ভেতরে চরম বিশৃঙ্খলার চেহারা লক্ষ্য করলেন তারা। বই, খাতা, কাগজপত্র, দলিল সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। মেঝের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছেন বিশালদেহী ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান, তার হাতদুটো দুপাশে ছড়ানো, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের দেহের পাশে গাঢ় সবুজ রংয়ের একটা ধাতব টিউব পড়ে আছে। ডঃ ওয়ারেন হাঁটু গেড়ে বসে তার নাড়ী আর হৃৎপিন্ডের গতি পরীক্ষা করলেন, কয়েক সেকেন্ড বাদে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।

উনি কি মারা গেছেন? মেজর বারনাবি প্রশ্ন করলেন।

হ্যাঁ, ঘাড় নেড়ে সংক্ষেপে উত্তর দিলেন ডঃ ওয়ারেন, কনস্টেবল গ্রেভসের দিকে তাকিয়ে বললেন, এখন আপনি বলুন আমি কি করব? আপনার ওপরওয়ালা ইন্সপেক্টর সাহেব যতক্ষণ না এসে পৌঁছোচ্ছেন ততক্ষণ এই লাশ পরীক্ষা করাও আমার পক্ষে উচিত হবে না। তবে মৃত্যুর কারণ কি তা বলছি, খুলির গোড়ার হাড় ভেঙ্গে যাবার ফলে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের মৃত্যু হয়েছে, আর মনে হচ্ছে ওই জিনিসটা দিয়েই ওঁর মাথায় আততায়ী জোরে আঘাত হেনেছে, বলে ডঃ ওয়ারেন মৃতদেহের পাশে পড়ে থাকা সবুজ রংয়ের ধাতব টিউবটা ইশারায় দেখালেন।

আততায়ী! ভীতি মেশানো সুরে কনস্টেবল গ্রেভস বলে উঠলেন, তার মানে ডাক্তার, আপনি বলছেন এটা খুন? ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানকে খুন করা হয়েছে?

ডঃ ওয়ারেন কোনো উত্তর না দিয়ে নীরবে শুধু ঘাড় নাড়লেন।

ডাক্তার, মেজর বারবি ডঃ ওয়ারেনকে প্রশ্ন করলেন, কতক্ষণ আগে ওঁর মৃত্যু ঘটেছে তা বলতে পারেন?

তা কম করে দু-তিন ঘণ্টা তো বটেই, ডঃ ওয়ারেন জবাব দিলেন, আমার হিসাবে তাই দাঁড়াচ্ছে।

প্রায় দু-তিন ঘণ্টা? হায় ঈশ্বর! আক্ষেপের সুরে বলে উঠলেন মেজর বারনাবি, তারপর তার বন্ধুর মৃতদেহের পাশেই একটা চেয়ারে বসে পড়লেন, নিজের মনে বিড়বিড় করে বললেন, তাহলে সময় দাঁড়াচ্ছে বিকেল প্রায় পাঁচটা বেজে পঁচিশ মিনিট। হা ঈশ্বর। তাহলে আজ বিকেলে ওখানে প্রেতচক্রে যা ঘটেছিল সে সবই সত্যি।

.

০৪.

ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের স্টাডিটা খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে মুখ তুলে একবার আত্মপ্রসাদের হাসি হাসলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট। উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তের দায়িত্ব অর্পন করেছেন তার ওপর, সেই দায়িত্ব পালন করতে ন্যারাকট ছুটে এসেছেন সুদূর এক্সটার থেকে, তাকে কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তদন্তের কাজে সাহায্য করবেন সার্জেন্ট পোলক।

স্টাডির খোলা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট। বাইরে যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু চোখে পড়ে ধপধপে সাদা ঘন তুষারের স্তর, তার ওপর ঝলসাচ্ছে শীতের সূর্যকিরণ। জানালা থেকে প্রায় একশো গজ দূরে একটা ছোট কাঠের বেড়া দেখা যাচ্ছে, তার কিছুটা দূরেই পাহাড়ে ওঠার খাড়া চড়াই পথ শুরু হয়েছে। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের মৃতদেহ এখনও পড়ে আছে স্টাডিতে। নৌবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নেবার পরেও ট্রেভিলিয়ান নাবিকদের ধাঁচের মতো চাপদাড়ি রাখতেন, লম্বাটে মুখে চিবুকের কাছে দাড়িটা ছুঁচলো হয়ে গেছে। ট্রেভিলিয়ানের বয়স হয়েছিল। প্রায় ষাট, কিন্তু দেখলে মনে হত তিনি সবে পঞ্চাশের কোঠায় পা দিয়েছেন। ইন্সপেক্টর ন্যারাকট নিজে এখনও খেলাধুলা করেন। ট্রেভিলিয়ানের চড়া কাধ, পেশীবহুল অথচ মেদহীন শরীর দেখে তিনি বুঝতে পারলেন তিনিও খেলাধুলার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন।

ব্যাপারটা ভারি অদ্ভুত ঠেকছে, বলে ইন্সপেক্টর ন্যারাকট তাকালেন সার্জেন্ট পোলকের দিকে, এই খুন সম্পর্কে আপনার ধারণা কি বলুন, শুনি।

ইয়ে–বারকয়েক মাথা চুলকালেন সার্জেন্ট পোলক, তারপর বেশ হুঁশিয়ার ভঙ্গিতে মন্তব্য করলেন, ইয়ে স্যার, আমার মনে হয় ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান যখন ওপর তলায় ছিলেন ঠিক সেই সময় আততায়ী বাইরের থেকে জানালা খুলে ভেতরে ঢোকে, তারপর ঘরের জিনিসপত্র তছনছ করতে থাকে। ভেতরে কাউকে দেখতে না পেয়ে ও নিশ্চয়ই ধরে নিয়েছিল যে বাড়িতে কেউ নেই।

হুম, নাক দিয়ে শব্দ করে গম্ভীরগলায় ইন্সপেক্টর ন্যারাকট প্রশ্ন করলেন, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের শোবার ঘরটা কোথায়?

আজ্ঞে ওপরতলায়, স্যার বিনীত ভঙ্গিতে সার্জেন্ট পোলক জানালেন, এই ঘরের ঠিক ওপরে।

এখন রোজই বিকেল প্রায় চারটে নাগাদ সন্ধ্যে হচ্ছে, ন্যারাকট আবার বললেন, আমার ধারণা অনুযায়ী ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান যদি সত্যিই সেইসময় ওপরে থাকতেন, তাহলে ওই ঘরের আলো নিশ্চয়ই জ্বলত, আর জানালার কাছে আসবার সময় বাইরে থেকে তা আততায়ীর চোখে ঠিকই পড়ত।

আজ্ঞে আপনি বলতে চাইছেন যে সে অপেক্ষা করত, তাই না?

যে বাড়ির কোনো ঘরে আলো জ্বলে সেখানে বাইরে থেকে কোনো আততায়ী জানালা দিয়ে চুরি করতে বা খুন করতে ভেতরে ঢোকে না। যাক, তারপর কি ঘটেছিল বলে আপনি মনে করেন?

স্যার, সার্জেন্ট পোলক উৎসাহিত হয়ে বলতে লাগলেন, আমার মনে হয় এবার কোনো আওয়াজ হচ্ছে শুনতে পেয়ে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান ব্যাপারটা কি দেখতে নীচে নেমেছিলেন। আততায়ী ওঁর পায়ের আওয়াজ শুনেই ওঁর মাথায় জোরে আঘাত করার সিদ্ধান্ত নেয়। সে ব্যাটা দরজার আড়ালে গিয়ে লুকোয়, ক্যাপ্টেন, ভেতরে ঢুকতেই ওই ভারি টিউবটা দিয়ে তার মাথায় জোরে আঘাত হানে পেছন থেকে।

হুম, নাক দিয়ে আবার আওয়াজ করলেন ইন্সপেক্টর ন্যারাকট, মানছি আপনার বক্তব্যে যুক্তি আছে। সেক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান নিশ্চয়ই জানালার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু তাহলে পোলক, আপনার যুক্তিটা আমার খুব যুৎসই বলে মনে হচ্ছে না। এ আমার ভাল লাগছে না।

লাগছে না, স্যার?

না, আর তার কারণ একটাই–সন্ধ্যে পাঁচটায় শুধু চুরি করার মতলবে একজন অপরাধী জানালা দিয়ে কারো বাড়িতে ঢুকবে এ আমি বিশ্বাস করি না।

কেন স্যার? সার্জেন্ট পোলক নিজের জেদ বজায় রাখতে বলে উঠলেন, এমন পরিস্থিতিকে সে এক দারুণ সুযোগ বলে ভাবতে পারে।

সুযোগের কথা হচ্ছে না, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট মন্তব্য করলেন, বাইরে থেকে দেখে চুরি বলে মনে হলেও আসল ব্যাপারটা তা নয় সেকি আপনি এখনও বুঝতে পারছেন না?

আচ্ছা, আপনিই বলুন, জানালা দিয়ে চোরের কোন ঘরটিতে ঢোকা উচিত ছিল? রান্নাঘরে, তাই না? যেখানে দামি বাসনপত্র থাকে।

এদিকে থেকে আমি আপনার সঙ্গে পুরোপুরি একমত, সার্জেন্ট পোলক মন্তব্য করলেন।

জানালার দিকে একবার তাকান, সার্জেন্ট ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, ভেতর থেকে তাতে ছিটকিনি আঁটা ছিল না, বাইরে থেকে সহজেই একটানে পাল্লা খুলে ফেলা হয়েছিল। লক্ষ্য করেছেন।

দুপা এগিয়ে এসে সার্জেন্ট পোলক জানালা পরীক্ষা করে বললেন, তারপর বিস্ময়সূচক ধ্বনি উচ্চারণ করে বললেন, কি আশ্চর্য! জানালার পাল্লা দুটো আলতো করে ভেজিয়ে রাখা হয়েছিল, ছিটকিনি আঁটা হয়নি। বোঝাই যায় যে চুরি করার উদ্দেশ্যেই অপরাধী জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকেছিল এটা আমরা ধরে নিই তাই সে চেয়েছিল। এইভাবে সে আমাদের চোখে ধুলো দিতে চেয়েছে, আমাদের বোকা বানাবার চেষ্টা করেছে।

যাক, ব্যাপারটা আপনার মাথায় ঢুকেছে তাহলে। ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ, পোলক।

তাহলে স্যার, সার্জেন্ট পোলক গম্ভীর গলায় বললেন, আমদের এটাই ধরে নিতে হচ্ছে যে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে কেউ ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানকে খুন করেছে।

ঠিক ধরেছেন, এজন্য আবার আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, এবং খুন যে করছে সে যে ট্রেভিলিয়ানের বিশেষ পরিচিত ছিল সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আততায়ী জানালা দিয়েই এ ঘরে ঢুকেছিল আপনার এই যুক্তিও অকাট্য, এবং জেনে রাখুন বাইরের গলানো তুষার পায়ে মাড়িয়ে সে এঘরে ঢুকেছিল যার ফলে ঘরের মেঝেতে ভেজা জুতোর ছাপও পড়েছিল। তবে শুধু এই ঘরেই, এ ছাড়া বাড়ির অন্য কোনো ঘরের মেঝেতে সেই ছাপ পড়েনি অন্তত। কনস্টেবল গ্রেভস বা ডঃ ওয়ারেন কারো চোখেই তা পড়েনি শুধু এই ঘরের মেঝের ওপর সেই গলানো তুষারসমেত ভেজা চামড়ার জুতোর দাগ তাদের চোখে পড়েছিল। এতে যে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে গেল তা হচ্ছে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের চোখের সামনেই আততায়ী এই ঘরের জানালা খুলে ভেতরে ঢুকেছিল। আর সেক্ষেত্রে আপনি জানতে বাধ্য যে আততায়ী এমন কেউ ছিল যে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের বিশেষ পরিচিত। আচ্ছা সার্জেন্ট, আপনি তো এই এলাকারই লোক, বলুন তো যে ধারেকাছে এমন কেউ আছে কিনা যার সঙ্গে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের শত্রুতা গড়ে উঠেছিল।

না স্যার, সার্জেন্ট পোলক জবাব দিলেন, শুধু ধারেকাছে নয়, দুনিয়ায় ওঁর কোনো শত্রু ছিল বলে আমার মনে হয় না। ভদ্রলোক এমনিতে ছিলেন খুবই ফুর্তিবাজ, এছাড়া চাকরি থেকে অবসর নেবার পরে হঠাৎ প্রচুর টাকা রোজগারের নেশা পেয়ে বসেছিল। কিন্তু এজন্য প্রতিবেশীদের কারো সঙ্গে ওঁর কোনোরকম শত্রুতা গড়ে উঠেছিল বলে কখনো শুনিনি।

সে তো এখনকার ব্যাপার, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, কিন্তু নৌবাহিনীতে চাকরি করার সময় কেউ ওঁর শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছিল কিনা তা আমাদের এখনও জানা নেই। সার্জেন্ট, আমার নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে এখানে যদি আপনি কারো শক্ত হন তাহলে অন্য সেখানেই যান না কেন যেখানেও নতুন করে আবার কারো শক্ত হয়ে উঠবেন, আর ট্রেভিলিয়ানের খুনের প্রসঙ্গে সেই সম্ভাবনাটা পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে পারছি না। এবার তাহলে পরবর্তী যুক্তিতে আসা যাক, কি বলেন? আপনি নিজেও একজন পুলিশ অফিসার আর তাই আপনার এটা অজানা নয় যে সাধারণত লাভের উদ্দেশ্যেই একজন অপরাধী ব্যক্তিগত খুনের মতো একটি অপরাধ সংঘটিত করে থাকে। ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান নিশ্চয়ই বেশ পয়সাওয়ালা লোক ছিলেন তাই না?

তা বলতে পারেন স্যার, সার্জেন্ট পোলক বললেন, কিন্তু অন্যদিকে তিনি ছিলেন ভয়ানক কৃপণ, চাদা বা দানধ্যানের ব্যাপারে একটা আধলাও পারতপক্ষে ওঁর হাত দিয়ে গলতো না।

–হুম, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, খুনটা যখন হয় সেইসময় আর কোনো লোক বাড়িতে ছিল না?

আজ্ঞে না, সার্জেন্ট পোলক বললেন, গত পাঁচ ছয় বছর ধরে ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান ছাড়া মাত্র একটি লোককেই আমি এ বাড়িতে দেখেছি তার নাম ইভানস, সে রোজ দু বেলা ওঁর রান্না করে দিত, আবার কাজ শেষ করে বাড়িতে চলে যেত। ইভানস নিজেও নৌবাহিনীতে চাকরি করত, অবসর নেবার পরে ট্রেভিলিয়ানের রাঁধুনির কাজ করত। এখানে মোড়ের মাথায় ফোর স্ট্রীট নামে একটা গলি আছে–দেখেছেন নিশ্চয়ই। ইভানস সেখানেই তার বউকে নিয়ে একটা ঘর ভাড়া করে থাকে। এই তো সবে মাসখানেক হল ইভানস বিয়ে করেছে, কিন্তু ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান ব্যাপারটায় বেশ রেগে গিয়েছিলেন। ইভানস বিয়ে করুক এটা ওঁর ইচ্ছে ছিল না। এ বাড়িতে কোনো মহিলা নেই, তার কারণ ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ান নিজে প্রচণ্ড নারীবিদ্বেষী ছিলেন। যা ইভানসকে আমি নিয়ে এসেছি, আপনি নিজেও ওকে একবার জেরা করুন। ইভানস বলছে রান্নাবান্না আর ঘরের কাজকর্ম সকাল সকাল সারা হয়েছিল বলে গতকাল দুপুর ঠিক আড়াইটে নাগাদ ও ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে বাড়ি চলে যায়।

হ্যাঁ, ইভানসের সঙ্গে আমার দেখা করা খুবই দরকার, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট মন্তব্য করলেন, ও নিশ্চয়ই অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য আমাদের সরবরাহ করতে পারবে।

আপনার কি ধারণা–কথাটা শেষ না করে মাঝপথে থেমে গেলেন সার্জেন্ট পোলক।

আমার ধারণা এই যে খুনের রহস্যের সাথে ছোটখাটো এমন একটা ঘটনা জড়িয়ে আছে যা সাধারণ চোখে বাইরে থেকে ধরা পড়ে না।

একটু উদাহরণ যদি দেন, স্যার?

ইন্সপেক্টর ন্যারাকট কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন, হাসিমুখে শুধু বললেন, এই ইভানস কোথায়? ওকে কোথায় রেখেছেন?

ও খাবার ঘরে অপেক্ষা করছে স্যার।

 লোকটা কেমন?

নৌবাহিনীর নোক, অত্যন্ত বদখত টাইপ,সার্জেন্ট পোলক সংক্ষেপে মন্তব্য করলেন।

মদ খায়?

না স্যার।

 ও হালে বিয়ে করেছে বললেন না?

 ইন্সপেক্টর ন্যারাকট গলা নামিয়ে বললেন, ইভানসের বউ-এর ওপর ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের কোনোরকম দুর্বলতা ছিল না তো?

না স্যার, সার্জেন্ট পোলক মৃদু হাসলেন, ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের ওইরকম কোনো দুর্নাম ছিল না। তাছাড়া আগেই বলেছি যে উনি মেয়েদের খুব ঘেন্না করতেন।

আর এই ইভানস নিশ্চয়ই ছিল ওঁর বিশ্বস্ত ও অনুগত ভৃত্য?

আমরা সবাই তো তাই জানি স্যার। সার্জেন্ট পোলক মুচকি হেসে বললেন, এক্সহ্যাম্পটন জায়গাটা খুব ছোট তা তো নিজের চোখেই দেখছেন। এখানে যা কিছু ঘটুক না কেন, কিছুই চাপা থাকে না।

বেশ, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, তাহলে এ ঘরে আর দেখার কিছু নেই। এবার আমরা ইভানসকে কিছু প্রশ্ন করে তারপর এ বাড়ির বাকি ঘরগুলো আমি পরীক্ষা করব। তারপর আমি থ্রি ক্রাউনসে একবার যাব, মেজর বারনাবির সঙ্গেও দেখা করব। খুনের সময় সম্পর্কে উনি একটা মন্তব্য করেছিলেন আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে পাঁচটা বেজে পঁচিশ মিনিট, মনে পড়ে? হয়তো অজানা কিছু তথ্য ওঁর কাছেও আছে নয়তো খুন কখন হয়েছে তা এত নিখুঁতভাবে উনি বলেন কি করে?

তাহলে এটা আদৌ চুরির প্রচেষ্টা নয়। সার্জেন্ট পোলক দরজার দিকে এগোতে এগোতে বললেন, আসলে অপরাধী গোটা ব্যাপারটাকে ওইরকম চেহারা দিতে চেয়েছিল।

এটা আমার কাছে তেমন অস্বাভাবিক নয়, ইন্সপেক্টর ন্যারাকট মন্তব্য করলেন, এই পরিস্থিতিতে ওইটাই স্বাভাবিক। আসলে জানালাটাই আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে।

জানালাটা? সার্জেন্ট পোলক বললেন, আপনি কি বলতে চাইছেন স্যার?

গতকাল রাতে আবহাওয়া যেমন বিশ্রী স্যাঁতসেঁতে ছিল তাতে খুনী জানালা দিয়ে এঘরে ঢুকতে গেল কেন? বিশেষতঃ যেখানে আমার ধারণা গৃহস্বামী ক্যাপ্টেন ট্রেভিলিয়ানের যে ছিল বিশেষ পরিচিত? এক্ষেত্রে সে তো সহজেই সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারত, নিশ্চয়ই এর পেছনে অন্য কোনো কারণ ছিল।

হয়তো তাই, সায় দিয়ে সার্জেন্ট পোলক বললেন, সদর দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলে রাস্তা থেকে পাছে কেউ দেখে ফেলে এই ভয়েই হয়তো খুনী জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকেছিল।

আপনার যুক্তিটা আদৌ জোরালো নয়, পোলক। ইন্সপেক্টর ন্যারাকট বললেন, গতকালের বিশ্রী আবহাওয়ায় রাস্তায় কজন লোক বেরিয়েছিল যারা ওকে সদর দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকতে দেখতে? তা নয়, অন্য কোনো কারণ লুকিয়ে আছে এর পেছনে যা যথাসময় জানা যাবে।