১৩. পিসিমা ক্যারোলিন

১৩.

পিসিমা ক্যারোলিন লাইব্রেরি তথা বসার ঘরে এসে পা রাখলেন, হাতে তার সেলাইয়ের থলে। সোফার ধারটাই তার পছন্দ, বসার জন্য তৈরি হলেন। ঠিক এই সময় সেখানে হাজির হলেন ডঃ কারোলি, হাতে টুপি আর একটা ছোট স্যুটকেস।

ডঃ কারোলির চোখে-মুখে বিরক্তির রেখা প্রকাশ পেল, বোঝা গেল বুড়ি ক্যারোলিনই তার বিরক্তির কারণ, তিনি ভেবেছিলেন ঘরটা এখন ফঁকাই আছে, সে গুড়ে বালি।

ডঃ কারোলির উপস্থিতি টের পেয়ে আপন মনে ক্যারোলিন বলতে থাকলেন–সুঁচটা যে কোথায় ফেললাম, চারপাশ খুঁজে বেড়াচ্ছি, এখানেও ভুল করে ফেলে যেতে পারি, দেখি পাওয়া যায় কিনা। তারপর গলার স্বর বাড়িয়ে বললেন–কী হল ডঃ কারোলি, স্যুটকেস নিয়ে কোথায় চললেন? এখানে বুঝি আর থাকতে ভালো লাগছে না?

-কিছু মনে করবেন না, মাদাম, হাতে ধরা টুপি আর সুটকেস একটা চেয়ারের ওপর রাখতে রাখতে বললেন, এখানে তো দু-দিন মজায় কাটালাম, আর থাকাটা সমীচীন নয়, অনেকেরই অপছন্দ। তাছাড়া লন্ডনে আমার কিছু জরুরী কাজ পড়ে আছে, তাই মন না চাইলেও যেতে হচ্ছে।

–আপনাকে কে অনুমতি দিল? এ বাড়ির কাউকে বাইরে যাওয়ার হুকুম নেই বলেই তো জানি।

–চিন্তা করবেন না, মাদাম, অবজ্ঞার সুরে ডঃ কারোলি বললেন, ওসব সামলে নেব।

–একান্তই যখন যেতে হয়, তখন একটা গাড়ি ডেকে দিতে বলি। ক্যারোলিন এগিয়ে এলেন দেওয়ালের দিকে। সেখানেই কলিং বেলের বোতাম।

–মাদাম, ব্যস্ত হবেন না, কলিংবেলে হাত রাখতে গিয়েও নামিয়ে নিলেন ক্যারোলিন, ও কাজটা আমিই সেরে রেখেছি।

-কী আর করি, বলুন, ক্যারোলিন স্বাভাবিক কণ্ঠে বলতে লাগলেন, বাড়ির কাজের লোকগুলোকে দেখছেন তো। বুদ্ধি বলে কিছু আছে। আপনি ডাক্তার মানুষ তায় আবার এ পরিবারের মাননীয় অতিথি, কোথায় আপনার স্যুটকেসটা গাড়িতে তুলে দেবে, তা নয়। ওদেরই বা দোষ দিই কী করে? মনিব মারা গেছেন, তাঁর মৃত্যু রহস্যের কুলকিনারা করতে বাড়িতে হোমরা-চোমরা মানুষদের ভিড়। গোয়েন্দা, পুলিশ কে নেই বলুন। এসব দেখে বেচারারা মাথা ঠিক রাখতে পারে বলুন? আমার বয়স হয়েছে, তার ওপর মনমেজাজ ভালো নেই। কিন্তু আরও দুটো মেয়ে তো আছে, একজন ফিটের ব্যামো নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, আর অন্যজন ডঃ গ্রাহামের সঙ্গে যখন-তখন দেখা করার জন্য ছুটছে কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই। ছিঃ ছিঃ, লজ্জায় মরে যাই আর কী!

–আমার একটা ফোন করা দরকার, আপনি যদি, আঙুল তুলে ডঃ কারোলি টেলিফোনটা দেখালেন।

-ফোন? ক্যারোলিন বিড়বিড় করে কী যেন বললেন, তারপর ঘাড় কাত করে বললেন–করুন, দরকার যখন, নিশ্চয়ই করবেন। আপনি সোয়া বারোটার ট্রেনেই যাচ্ছেন বুঝি। কিন্তু ও গাড়ি লন্ডনে পৌঁছতে যথেষ্ট সময় নেয়।

-জানি, সংক্ষেপে জবাব দিয়ে ডঃ কারোলি টেলিফোনের দিকে এগিয়ে এলেন। ডিরেক্টরির পাতা ওল্টাতে লাগলেন, ক্যারোলিনের নজর অন্যদিকে ফেরানোর প্রচেষ্টা আর কী। বললেন–বাগানের দিক থেকে চেনা-চেনা গলা পেলাম। মনে হয় আপনার ভাইঝি, মাদাম।

আমার ভাইঝি! তার মানে বারবারার কথা বলছেন, না? খোলা জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন ক্যারোলিন, চাপা গলায় বলতে শুরু করলেন, মেয়েটা ওপরেই অমন ছলবলে, অথচ বুকের ভেতর দুঃখের পাহাড়, নিঃসঙ্গ, ভাই আছে বটে একটা, নামে মাত্র। জ্যেঠু ছিল, তাও মরে গেল। ছন্নছাড়া জীবন আর কী! আর ওর মতো বয়সে আমরা মা-মাসীর আদর-যত্ন পেয়েছি। সেই সময় বীসওয়াক্স’ নামে একটা ওষুধের খুব চাহিদা ছিল। ওর মধ্যে ভিটামিন এ, বি, সি, ডি–চারটে গুণই ছিল। রোজ নিয়ম করে খেতে হত।

ক্যারোলিনের শেষ কথাগুলো শুনে ডঃ কারোলি সচকিত হলেন–বীসওয়াক্স! আপনি এই কথাটাই বললেন তো?

হ্যাঁ, ওইরকমই বিশ্রী রকমের কিছু হবে। ক্যারোলিন বলে চললেন–বেরিবেরির জন্য ওই চার ভিটামিনওয়ালা ওষুধ ছিল। এদেশে ও রোগ খুব কম হয়। শুনেছি নেটিভ দেশগুলোতে বেরিবেরি বেশি হয়। যারা ধান থেকে চাল বাছাই করে, মানে চাষা ভূযো আর কী, ওদের মধ্যে নাকি এই অসুখের প্রকোপ বেশি। অন্যদের কি হয় না? মি. রেনরের কথাই বলি। উনি তো আর চাষের কাজ করেন না, অথচ মুখখানা হলদে-সাদাটে হয়ে গিয়েছিল। ব্রেকফাস্টের পরে রোজ সকালে আমার কথামতো একটা করে বড়ি খেত। লুসিয়াকেও বলেছিলাম জানেন, আমার কথা কানে নিলে তো, মেয়েটার ভাব-গতিক বুঝি না, কেমন মনমরা গোছের। যাক গিয়ে, আমি হাঁফিয়ে মরি কেন, এখানকার ছেলেমেয়েরা কি এই বুড়ির উপদেশ মানতে চায়? জানেন ডঃ কারোলি, আমার বাবার আশি বছর বয়সেও চোখের জ্যোতি ছিল স্বাভাবিক। চশমার প্রয়োজন হয়নি তার। দিব্যি বাইবেল পড়েছেন। গোয়েন্দা গল্প, খবরের কাগজ পড়তে একটুও অসুবিধা হয়নি। বাবা কখনো রাতে জানলা খুলে শুতেন না, রাতের হাওয়া নাকি শরীরে লাগানো ভালো নয়, কিন্তু গেঁটে বাতের ব্যথা যখন বেড়ে গেল, তখন তার দেখাশোনার জন্য একজন মহিলা ছিল। ওই নার্স রাতে সব জানলা খুলে দিত। ব্যাস, ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকল, বাবাকে কাবু করে ফেলল। শেষ পর্যন্ত মৃত্যু।

–হ্যালো এক্সচেঞ্জ? তখনও ক্যারোলিন বিড়বিড় করে চলেছেন। ডঃ কারোলির মন তখন টেলিফোনের দিকে–হ্যালো, হ্যালো, এক্সচেঞ্জ। মাকে ক্লিভ থ্রি। থ্রি-ওয়ান থেকে বলছি। লন্ডনে একটা কানেকশন চাই। ……হ্যাঁ, নম্বর বলছি…….. সোহো ডবল এইট ফাইভ থ্রি……. হ্যাঁ, ফাইভ থ্রি…….. আপনারাই ডাকবেন? …….বেশ, অপেক্ষা করছি।

ডঃ কারোলি রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। ক্রমশ তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে, উত্তেজনার তাড়নায় দাঁত দিয়ে নখ কাটতে লাগলেন, কেমন অস্থির ভাব।

খানিকক্ষণ কেটে গেল। এসে ঢুকলেন এডওয়ার্ড রেনর। ঘরের ভেতর পা দিয়ে সজাগ দৃষ্টি ছড়িয়ে দিলেন। এবার ধীর পায়ে ফায়ার প্লেসের পাশে এসে দাঁড়ালেন, এখানেই রয়েছে ম্যান্টেলপিসের ওপর রাখা মাঝারি মাপের ফুলদানিটা, যার মধ্যে আগুন ধরানোর জন্য কুচানো কাগজ আর মোমের ছোট ছোট খণ্ড রাখা আছে।

ফুলদানিতে হাত দিতে গিয়েও থমকে দাঁড়াতে হল রেনরকে। দরজা বন্ধ করার শব্দ কানে এল, সচকিত হয়ে ঘাড় ফেরালেন। হা, স্টাডির দরজা ঠেলে ডঃ কারোলি ভেতরে ঢুকছেন। তাকে দেখে রেনর যথেষ্ট ঘাবড়ে গেলেন।

অবাক হয়ে জানতে চাইলেন আপনি? এখানে? কী মনে করে?

–আমার একটা ফোন কল আসার কথা, তাই…..

 ডঃ কারোলির কৈফিয়ত রেনরের পছন্দ হল না, তিনি চুপসে গেলেন।

–শুনলাম পুলিশ এসেছে, কতক্ষণ?

ডঃ কারোলির প্রশ্নের উত্তরে রেনর জানালেন বেশীক্ষণ নয়, কুড়ি-পঁচিশ মিনিট হবে। ওই সবজান্তা গোয়েন্দাটার সঙ্গে পুলিশ অফিসারের খুব ভাব। আরে কী যেন নাম লোকটার জ্যাপ, বেঁটে গোয়েন্দার সঙ্গে বেশ খাতির করে কথা বলছে। চেনেন নাকি ওই পুলিশ অফিসারকে?

-কী নাম বললেন? জ্যাপ না? ডঃ কারোলি থামলেন, পরক্ষণে বললেন, চিনি মানে, একবার দেখেছি, তাও দুর থেকে।

-উনি নাকি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দা ইন্সপেক্টর, বাড়ির কাজের লোকগুলো বলাবলি করছিল, তাতেই শুনলাম। কাছে পিঠে কোথায় একটা তদন্তের কাজে এসেছিলেন। স্থানীয় থানা থেকে খবর পেয়ে এ মৃত্যুর কিনারা সন্ধানে ঢুকেছেন এখানে।

এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। কথা থামিয়ে রেনর ঘরের একপাশে চলে গেলেন।

ডঃ কারোলি রিসিভার তুলে নিলেন। ফিসফিসিয়ে বললেন–হ্যালো, মিওয়েল নাকি?

…হ্যাঁ, ভাই, আমি ……..না না, শেষ রক্ষা হল কই, বুড়োটা যে কাল রাতেই পরলোকে যাত্রা করেছে……. না না, ডেথ সার্টিফিকেট পাওয়া যায় নি। লাশ কাটাছেঁড়া হয়েছে, শুনছি তো পাকস্থলীতে বিষমেশানো কফি পাওয়া গেছে…….কী বলছ? পুলিশ? হ্যাঁ এসেছে। ওই লোকটা। জ্যাব। একটু আগেই ঢুকেছে। ইন্সপেক্টার জ্যাপকে ভুলে গেছো নাকি?……হ্যাঁ, ঠিক বলেছ, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ইন্সপেক্টার ……না না, আমার মুখ দেখবার সুযোগ পেল কই? যাক, ছাড়ো ওসব কথা, আমি খুব শিগগিরই পৌঁছে যাচ্ছি হ্যাঁ, মোহোর ওই পুরনো ঠেক–ওখানেই আমায় পাবে। আজ রাত সাড়ে নটা নাগাদ চলে এসো, বুঝেছ, ভুল করো না। রাখছি, ঠিক আছে।

ফোনে কথা বলা শেষ করে ডঃ কারোলি হাতে টুপি আর স্যুটকেস তুলে নিলেন। খোলা ফ্রেঞ্চ উইন্ডোই এখন তার লক্ষ্য। দু-পা এগিয়েছেন কী এগোননি, এমন সময় জানলা দিয়ে ভেতরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ইন্সপেক্টর জ্যাপ, পেছনে তার দোসর এরকুল পোয়ারো।

পোয়ারোর বুঝতে দেরি হল না, কারোলি পালাতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তা তো হবার নয়। তিনি একেবারে ডঃ কারোলির সামনে এসে দাঁড়ালেন।

ডঃ কারোলি চটে গেলেন খেলা করছেন নাকি! পথ ছাড়ুন। সময় নেই হাতে। এক্ষুনি বেরোতে হবে।

-মাফ করবেন, পোয়ারো বললেন, এ বাড়ির কাউকেই এক পাও বাইরে বেরোতে দেওয়া হচ্ছে না জানেন।

–ওসব বাজে কথা রাখুন। ভালো চান তো সরে দাঁড়ান। ডঃ কারোলি প্রায় ধমকে। উঠলেন।

–আমার ভালো-মন্দ আপনি বিচার করবেন?

তখন পোয়ারোকে খ্যাপা মোষের রোগ চেপে ধরেছে। তিনি সামান্য সরে এলেন, নিজের ডান পা ঢুকিয়ে দিলেন ডঃ কারোলির দুপায়ের ফাঁকের মাঝে, তারপর দিলেন এক ল্যাং। ব্যাস, সঙ্গে সঙ্গে কুপোকাত। ডঃ কারোলি একেবারে গিয়ে পড়লেন একটা খালি চেয়ারে।

ইতিমধ্যে কনস্টেবল জনসনও সেখানে পৌঁছে গেছে। পোয়ারো তাকে ইশারা করলেন। সে ডঃ কারোলির হাত থেকে স্যুটকেসটা কেড়ে নিল।

-ও-হো-হো, কী করছেন, মশাই? ঠিক করে বসুন, পড়ে যাবেন যে, বলতে বলতে ইন্সপেক্টার জ্যাপ এগিয়ে এলেন, বয়সের কথা ভুলে গেলে চলবে! চেয়ার থেকে ডঃ কারোলিকে টেনে তুললেন, তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলন জ্যাপ, অবাকও হলেন।

-আরে, এ কাকে দেখছি? চোখ পাকিয়ে জ্যাপ বললেন–এ কাকে দেখছি, তুই টোনিও না, হা, ঠিক ধরেছি। সেই পোড়খাওয়া শয়তান। তা হতচ্ছাড়া, বাইরে কি ভাগাড়ের আকাল পড়েছে। কোন ধান্দায় এখানে এসে সেধিয়েছিস শুনি।

 পোয়ারোও হতবাক। ডঃ কারোলির দিকে আঙুল তুলে জানতে চাইলেন–একে চেনেন? আপনার পুরোনো লোক বুঝি।

–তা যা বলেছেন, পুরোনো লোকই বটে, জ্যাপ মুচকি হাসলেন। এরা হল চোর আর ব্ল্যাকমেলারের দল। ইটালি থেকে ধাওয়া খেয়েছে, ঘাঁটি গেড়েছে এই শহরে। এ হল ওই দলের নাটের গুরু। চাঁদু অত্যন্ত ধড়িবাজ, ভাগ্যিস আপনি সময় মত ওকে ল্যাং মেরে কাত করে দিয়েছিলেন, তাইতো হতভাগাকে ধরা গেল, না হলে আমার হাত পিছলে বেরিয়ে পগাড় পার হত। টোনিও, তোর কপালটা মোটেই ভালো নয়, দুঃখ হচ্ছে। কয়মাস আগের কথা মনে পড়ে তোর? মিলানের আর্ট মিউজিয়াম থেকে রেমরুনের আঁকা আসল ছবিটা চুরি করেছিলিস, তোরই এক সাগরেদ ওটা বেচতে গিয়ে হাতে-নাতে ধরা পড়েছে। কেসটা আমাদের হেপাজতেই এখনও পর্যন্ত রয়েছে। তোর মদতেই চুরিটা হয়েছিল, ও সেটা বলে দিয়েছে, বুঝেছিস। ট্যা-ফু না করে সঙ্গে কী কী আছে বের কর। তারপর কনস্টেবলকে লক্ষ্য করে জ্যাপ বললেন–জনি, দাঁড়িয়ে না থেকে ওর পকেট সার্চ করো।

জনসন তার ওপরওয়ালার হকুম তামিল করল। ডঃ কারোলির পকেটগুলি হাতড়ে বেড়াল। শেষ পর্যন্ত তার জ্যাকেটের ভেতরের পকেট থেকে বের করল একটা অটোমেটিক পিস্তল ছোট এবং নলটা থ্যাবড়া মুখো। এবার ট্রাউজারের হিপপকেট, পাওয়া গেল একটা চাকু, কয়েকটি ফলা সেটির, খুব শান বোঝা গেল। এবার স্যুটকেস ঘাঁটা হল–বিশেষ কিছুই নেই। পাওয়া গেল একটা স্টেথোস্কোপ ব্লাডপ্রেসার মনিটর, আর একটা পুঁচকে টর্চ।

–টোনিও, তোর জবাব নেই। ভণ্ড ডাক্তার সেজে টুক করে ঢুকে পড়েছিস। হাসতে হাসতে জানতে চাইলেন বলি কোন মতলবে এখানে ঢুকেছিলিস? অসুখ-বিসুখের সঙ্গে পিস্তল-চাকুর কী সম্পর্ক?

-নিজেকে রক্ষার কারণে। ডঃ কারোলি জ্বলন্ত দৃষ্টিতে পোয়ারোর দিকে তাকালেন, বুঝি পারলে গিলে খায়, আমার কাছে এমন কোনো আপত্তিকর জিনিস নেই, যা আপনাদের আমাকে আটকে রাখতে সাহায্য করবে, ইন্সপেক্টার জ্যাপ। তাছাড়া আপনার সে ক্ষমতাও নেই। তাই বলছি, আমাকে ছেড়ে দিন।

দাঁড়া, দাঁড়া, কলে-পড়া ইঁদুরের মতো ছটফট করিস না। আগে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের হাজতে যা, একটু সেবাযত্ন নিয়ে শরীরের মস্তি করে নে, তারপর দেখবি, তোকে আটকে রাখার ক্ষমতা আমার আছে কিনা। মঁসিয়ে পোয়ারো, জ্যাপ তাকালেন পোয়ারোর দিকে, আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি এই হারামজাদাই ফর্মুলাটা সরিয়েছে, তারপর স্যার ক্লডকে খুন করেছে। ওর কাছে নিশ্চয়ই এখনও ওই ফর্মুলাটা আছে, নয়তো পালানোর জন্য এত ধানাই-পানাই করছে কেন?

পোয়ারো ভালো করে লক্ষ্য করলেন ডঃ কাবোলির ভেকধারী টোনিওকে–তাঁর এক হাত জ্যাপের বজ্রমুঠির মধ্যে, অন্য হাত সবলে ধরে আছে। রহস্যানুসন্ধানী এরকুল পোয়ারো। স্যুটকেসের ভেতরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন পোয়ারো, তারপর ঢাকনাটা বন্ধ করে দিলেন।

–আপনি নিজেকে কী মনে করেন? আমার সঙ্গে চালাকি করতে আসবেন না। ডঃ কারোলির চাপা হুঙ্কার শোনা গেল। আমি ছাড়াও ও জিনিস চুরি করার জন্য এ বাড়িতে আরও অনেক লোক আছে, সেটা ভেবে দেখেছেন?

–আপনার মুখ বুজে থাকাই মঙ্গল, পোয়ারো হুঁশিয়ারি ছিলেন।

পোয়ারোকে সমর্থন করে জ্যাপ বললেন, উনিও তোকে চুপ থাকতে বলছেন, আমিও বলছি, মুখ খুলে নিজের খারাপ ডেকে আনিস না। জনি, আমি এই শয়তানটাকে দেখছি, তুমি ওপরে যাও, সকলকে বলল, আমি এখুনি ডাকছি, ওরা যেন নীচের এঘরে চলে আসেন।

–বেশ, যাচ্ছি, ডঃ কারোলির হাতটা ছেড়ে দিয়ে কনস্টেবল ঘরের বাইরে চলে গেল। এই সুযোগে এক ঝটকায় জ্যাপের হাত ছাড়িয়ে ডঃ কারোলি খোলা জানলার দিকে ছুটে গেলেন, অবশ্য তাড়াহুড়োতে তার স্যুটকেসটা নিতে ভোলেননি। কিন্তু এবারেও তাকে ব্যর্থ হতে হল। পোয়ারোর জুজুৎসুর প্যাঁচের পাল্লায় যে পড়েছে, সে জানে কত ধানে কত চাল। কারোলির ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। একেবারে সটান মুখ থুবড়ে তিনি পড়লেন মেঝের ওপর। হাতে ধরা স্যুটকেসটা ছিটকে পড়ল খানিক দূরে।

জ্যাপ কঠিন চোখে তাকালেন কারোলির দিকে, স্যুটকেসটা তুলে নিলেন। বাজখাঁই গলায় বললেন–তোর কি এখানে বসেই মারধোর খাওয়ার সখ হয়েছে? আমার এই ছোকরা কনস্টেবলকে তো চিনিস না, তোকে কয়েকটা মোক্ষম দাওয়াই দেওয়ার জন্য ওর হাতটা নিশপিস করছে, বুঝতে পারছি, কেবল আমার হুকুমের অপেক্ষায়। তাই বলছি, শুধু-শুধু মারধোর না খেয়ে ভদ্রছেলের মতো এখানে বোস, আরাম কর।

কারোলির কাঁধ দুটো ধরে জ্যাপ জোর করে তাকে সোফার ওপর বসিয়ে দিলেন। সত্যি ডঃ কারোলি ইন্সপেক্টার জ্যাপের কথা রেখেছেন, আর উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করেননি, বরং গদিতে ঠেস দিয়ে আয়েস করে বসেছেন।

তবে ভেতরে-ভেতরে সাপের মতো ফুঁসছেন, তা বোঝা গেল। মাঝে মধ্যে কঠিন দৃষ্টিতে জ্যাপ ও পোয়ারোকে দেখছেন।

কারোলি এই মুহূর্তে ম্যাপের নাগালের মধ্যেই আছেন বুঝে পোয়ারো সেখান থেকে সরে এলেন, ধীর পায়ে হেঁটে গেলেন খোলা জানলার দিকে। দাঁড়ালেন।

এসময় ক্যাপ্টেন আর বারবারা বাগানে বেড়াচ্ছিলেন। এবার ওঁদের ঘরে ফেরার সময় হয়েছে। দু’জনে হাতে হাত রেখে হাসতে হাসতে হেঁটে আসছেন। ঘরের ভেতরে দাঁড়িয়ে অনিমিখ নয়নে পোয়ালরা এই দৃশ্য উপভোগ করলেন। ওঁরা ভেতরে এসে ঢুকলেন, পোয়ারোকে কেউ দেখতে পাননি।

পোয়ারো এসে দাঁড়ালেন বন্ধু ও সহকারী হেস্টিংস-এর গা ঘেঁষে। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললেন–এসব কী হচ্ছে, হেস্টিংস? আমার অবর্তমানে ঘর থেকে পালিয়ে গেলে ওই ছুকড়ির সাথে প্রেমালাপ করতে? বলিহারি বাপু! দিনে দিনে ছোট হচ্ছো দেখছি। তোমার বউয়ের কানে খবরটা না তুললেই নয় দেখছি, মজা বুঝবে তখন।

নিরুপায় হয়েই, হেস্টিংস লজ্জিত হলেন, একটুকরো হাসি দেখা গেল ঠোঁটে, তোমার কথা মতো এখানেই ছিলাম। কোত্থেকে বারবারা এল। বাগানে যাবার জন্য টানাটানি করতে লাগল, কোনও জোর আপত্তি শুনল না। বিশ্বাস করো, একটু মিথ্যে বলছি না। বুঝলে পোয়ারো, মেয়েটার মস্তিষ্ক বিকৃতি আছে, সামান্য হলেও আছে। না হলে একটানা কেউ অত বকতে পারে। এই কারণেই বোধহয় ডঃ গ্রাহাম ওকে বিয়ে করতে তালবাহানা করছেন।

ইতিমধ্যে অ্যামরি পরিবারের লোকেরা ভেতরের দরজা দিয়ে স্টাডিতে ঢুকতে শুরু করছেন। বারবারা জ্যাপের দিকে তাকাল, একটু হাসল, তারপর সোফাতে বসে পড়ল, অবশ্য ডঃ কারোলির থেকে দূরত্ব বজায় রেখেই।

হবে হয়তো। হেস্টিংসএর কথায় পোয়ারো কোনোরকমে জবাব দিলেন। তারপর বললেন–যাক, এবার কাজের কথায় আসি। এবাড়ির লোকেরা কে কোথায় কোন অবস্থানে দাঁড়িয়ে বা বসে আছেন, তা নিখুঁত ভাবে দেখে নেওয়া তোমার দায়িত্ব। স্মৃতির মধ্যে ধরে থাকবে, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।

-কী কাজে লাগবে, শুনি?

–ফের তর্ক! আস্তে অথচ ধমকের সুরে পোয়ারো বললেন। চোখে হাসির ঝিলিক খেলিয়ে বললেন–আমার কথার অবাধ্য হয়েছে তো, মনে রেখো, আজ রাতেই তোমার বউয়ের কাছে খবর পৌঁছে যাবে।

***

 পোয়ারোর নির্দেশ মতো হেস্টিংস তাঁর কাজ শুরু করে দিলেন। অবশ্য পোয়ারোও সবকিছু লক্ষ্য করছেন। দেখা গেল পিসিমা ক্যারোলিনকে, তার এক হাত রিচার্ড ধরেছে, অন্য হাতটি লুসিয়া। তারা ঘরের মধ্যে চলে এলেন। একটা ছোট টুলে ক্যারোলিনকে বসিয়ে দিয়ে ওরা স্বামী-স্ত্রী এসে বসল টেবিলের ডান পাশের দুটি কাছাকাছি চেয়ারে। লুসিয়ার ওপর নজরদারি চালাতে সুবিধা হবে বলে রিচার্ড তার বউয়ের গা ঘেঁষে বসেছে, তা বুঝতে দেরি হল না স্বনামধন্য গোয়েন্দা এরকুল পোয়ারো ও তার সহকারী ক্যাপ্টেন হেস্টিংস-এর।

তখনও একজন আসতে বাকি। অবশেষে তিনি এসে ঢুকলেন। আরামকেদারায় বসলেন, যেখানে বসে স্যার ক্লড অ্যামরি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। ইনি হলেন স্যার ক্লডের সচিব এডওয়ার্ড রেনর।

রিচার্ড প্রথমে ক্যারোলিন ও বারবারাকে উদ্দেশ্য করে জ্যাপকে দেখিয়ে বলল–উনি হলেন স্কটল্যন্ড ইয়ার্ডের এক নামী ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টার জ্যাপ।

জ্যাপ তার কনস্টেবলকে ঘরের দরজা ভেতর থেকে ভালোভাবে বন্ধ করে দেবার নির্দেশ দিলেন।

এপর্যন্ত ক্যারোলিন জ্যাপের নাম কেবল শুনেছেন, এখন ওই রাশভারী ইন্সপেক্টারের সাথে পরিচয় হতে ঘাবড়ে গেলেন। ভয়ে ভয়ে ভাইপোর কাছে জানতে চাইলেন–অবশেষে স্কটল্যন্ড ইয়ার্ড থেকে হানা দিতে হল? কেন বলতে পারিস?

–কেন? তাহলে শোনো, পিসিমা। রিচার্ড বলল, ডঃ গ্রাহামের রিপোর্টের ভিত্তিতে বাবার মৃতদেহ পোস্টমর্টেমে পাঠানো হয়। সেখানে কাটাছেঁড়া করে ওরা যে রিপোর্ট দিয়েছে, তা বলা হয়েছে, এ স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, বিষ মেশানো কফি খাইয়ে খুন করা হয়েছে।

একথা শুনে ক্যারোলিন ডুকরে চেঁচিয়ে উঠলেন।

–মি. অ্যামরি, এসব কী বলছেন? রেনর ভুরু কুঁচকে চোখ পাকিয়ে বললেন–শেষ পর্যন্ত খুন, তাও যেমন–তেমন নয়, একেবারে বিষ খাইয়ে হত্যা।

-হাঁ, করোনার রিপোর্ট পরিষ্কার লেখা হয়েছে, রিচার্ড কেটে কেটে জবাব দিল বাবার পেটে বিষ মেশানো কফির নমুনা মিলেছে। হিসকোসিন, যা খাইয়ে তাকে খুন করা হয়েছে।

-কী, হিসকোসিন? রেনর চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও সংযত হলেন–আমি জানি, দেখেছিও। ব্যাস, রেনর মুখে কুলুপ আঁটলেন। কেবল বাঁকা চোখে লুসিয়াকে জরিপ করতে লাগলেন।

এবার ইন্সপেক্টার জ্যাপ এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন, কী হল, থামলেন কেন? কী জানেন, কী দেখেছেন, বলুন, মি. রেনর।

-না-না, কিছু জানি না, কিছু দেখিও নি। রেনরকে তখন বুঝি বোবাতে পেয়েছে, অসংলগ্নভাবে জবাব দিলেন।

ঘরের সকলে চুপ, কেবল একটা উসখুসানি শুরু হয়ে গেছে বোঝা গেল। মি. রেনর কী জানেন বা কী দেখেছেন–সেটাই হল মুখ্য প্রশ্ন।

মি. রেনর, জ্যাপ আবার বলেন, আপনি যে কোনো কিছু গোপন রাখতে চাইছেন, তা স্পষ্ট। আমরা আপনার সহায়তা চাইছি। কী এখানে সেদিন ঘটেছিল, ভোলা মনে ভালোয় ভালোয় বলে ফেলুন। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করতে আমাদের বাধ্য করবেন না। যা জানেন বলে ফেলুন।

–বিশ্বাস করুন, এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নয়, রেনরের সেই হেঁয়ালি পূর্ণ, কথাবার্তা আমার বক্তব্য হল খুব স্বাভাবিকভাবে এর কিছু যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা আছে বলে আমি মনে করি না।

ব্যাখ্যা! কীসের ব্যাখ্যা? জ্যাপ গম্ভীর মুখে রেনরের একেবারে সামনে এসে দাঁড়ালেন মশাই, এখনও সময় আছে, মুখ টিপে থাকবেন না। আসল কথাটা সকলকে শুনিয়ে দিন। নয়তো আপনার ভোগান্তির অন্ত থাকবে না আবার বলছি, যা জেনেছেন দেখেছেন, ঘর ভর্তি লোকের সামনে প্রকাশ করুন।

জ্যাপের ধমক খেয়ে রেনর তার দিকে তাকালেন, কী বলতে গিয়ে ঠোঁট খুললেন বটে, কিন্তু পরক্ষণে তা বন্ধ হয়ে গেল। উনি যে খুব ভয় পেয়েছেন, বুঝতে কারো বাকি রইল না।

-কী হল? বোবা হয়ে গেলেন যে, বলুন। জ্যাপের গর্জনে রেনর চমকে উঠলেন।

–হ্যাঁ বলছি। রেনর ঢোক গিললেন, তারপর বললেন, দেখেছিলাম একটা ওষুধের টিউব থেকে কয়েকটা ছোট বড়ি বের করে মিসেস লুসিয়া অ্যামরি হাতের মধ্যে লুকিয়ে রাখছে। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেললেন রেনর।

-কখন ঘটেছিল? জ্যাপ জানতে চাইলেন।

–গতরাতে। ডিনার শেষ করে সবাই এঘরে বসে গল্পগুজব করছিলেন। গ্রামোফোনে একটা পুরনো রেকর্ড চালিয়ে দিয়ে বারবারা নাচছিল ফক্সট্রট নাচ। বারবারাকে ঘিরে সকলে বসে আছে। বাজনার আওয়াজ আমার কানে গেল। স্টাডি থেকে বেরিয়ে এলাম। বারবারার অনুরোধে আমিও ওর সাথে নাচতে শুরু করলাম। তখনই নজর পড়ল লুসিয়া অ্যামরির ওপর। দেখি ওষুধের বাক্স থেকে একটা টিউব বার করলেন। এসময় কোনো দিকে নজর ছিল না তার। টিউব উলটে ধরলেন বাঁ হাতের চেটোতে। আমার ধারণা, ওগুলো হিসকোসিন। এরপরেই স্যার ক্লডের ডাক পড়ল। আমি ফের স্টাডিতে এসে ঢুকলাম।

-আপনি এতসব জানেন, অথচ বলেননি, কেন? জ্যাপ পুলিশি কায়দায় জানতে চাইলেন–মঁসিয়ে পোয়ারো এখানে ছিলেন, তাকে অন্তত বলতে পারতেন।

রেনর অবশ্য পালটা কোনো কথা বললেন না। তিনি চুপ করে বসে রইলেন। লুসিয়া কিছু বলার জন্য উঠে দাঁড়াল। তা বুঝতে পেরে জ্যাপ হাত ইশারায় থামতে বললেন মিসেস অ্যামরি, আপনার পালা এখনও আসেনি। মি. রেনরের সঙ্গে কথা বলা শেষ হোক, তারপর আপনার বক্তব্য শুনব।

-আপনি যাই বলুন, অফিসার, রেনর বলতে শুরু করলেন, আসলে এই ঘটনার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। মি. রিচার্ড অ্যামরির মুখে কফির সঙ্গে হিসকোসিন পাওয়ার খবরটা শুনে মনে পড়ে গেল। অবশ্য মিসেস লুসিয়া অ্যামরির হাতের বড়িগুলো হিসকোসিন নাও হতে পারে, অন্য কোনো ওষুধ হবে হয়তো।

-বুঝলাম, এবার জ্যাপ তাকালেন লুসিয়ার দিকে। বললেন–আপনি কী বলতে চাইছিলেন, এবার বলুন, ম্যাডাম।

-আসলে, আমি ওই বাক্সের ওষুধের টিউবগুলো নেড়ে চেড়ে দেখছিলাম, এমন ওষুধ খুঁজছিলাম, যার একটা খেলে খুব ভালো ঘুম হবে, এক ঘুমেই রাত কাবার।

জ্যাপ এবার রেনরের দিকে তাকালেন–আপনি বললেন, টিউবের ভেতরের প্রায় সব বড়ি হাতে ঢেলে নিয়েছিলেন, তাইতো?

-হ্যাঁ, তেমনটাই দেখেছিলাম।

-ম্যাডাম, জ্যাপ আবার লুসিয়াকে জেরা করতে শুরু করলেন, একটা কী দুটো বড়িই ভালো ঘুমের জন্য যথেষ্ট, কিন্তু অতগুলো বড়ি কী করলেন আপনি? বলুন।

-কী করলাম, মনে পড়ছে না। লুসিয়া একটু থামল, পরক্ষণে কী বলতে গিয়ে বাধা পেল।

ততক্ষণে ওদিকে সোফা থেকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠেছেন ডঃ কারোলি। হিংস্র দৃষ্টিতে লুসিয়ার দিকে তাকালেন। ঘৃণা ভরা কণ্ঠে চিৎকার করে বললেন–ইন্সপেক্টার, ব্যাপারটা দেখলেন তো? আমাকে খামোখা সন্দেহ করে শুধু-শুধু আটকে রাখলেন আপনি এখনও। বুঝতে পারছেন না, ওই কাঁচুমাচু মুখে বসে থাকা মহিলাটিই হল আসল খুনি, যে তার শ্বশুর স্যার ক্লড অ্যামরিকে বিষ খাইয়ে হত্যা করেছে।

কারোলির চিৎকার চেঁচামেচি বারবারার সহ্য হচ্ছিলনা। সে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তক্ষুনি ক্যাপ্টেন হেস্টিংসকে তার কাছ ঘেঁষে দাঁড়াতে দেখা গেল, ভঙ্গী দেখে মনে হল, একমাত্র তিনিই পারেন এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে বারবারাকে রক্ষা করতে।

ইন্সপেক্টার জ্যাপ হাত তুলে ডঃ কারোলিকে সংযত হতে ইঙ্গিত করলেন। বললেন আপনার কথাই শেষ কথা নয়, জানবেন। তাছাড়া আপনার সাথে, চেনাজানার ব্যাপারটা আমার কম দিনের নয়, অতএব আপনি কতটা সৎ বা অসৎ, তা জাহির না করলেও চলবে।

-আপনার মন চাইলে, ইচ্ছে মতো বলতে পারেন, আপত্তি নেই। ডঃ কারোলি গলার স্বর একটুও নামাল না। একই ভঙ্গিতে বললেন–আমি বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলছি না। আসল কথাটা জেনে নিন, ইন্সপেক্টার তাছাড়া আপনি তো জানতে চেয়েছিলেন, কোন মতলবে এ বাড়িতে ঢুকেছি? ওই মহিলা, মানে মিসেস লুসিয়া অ্যামরির ডাকেই আমি এখানে এসেছিলাম, অবশ্য তখন আমার মাথায় কোনো বদ মতলব ছিল না। উনি আমায় বললেন, ওঁনার শ্বশুর স্যার ক্লডের তৈরি করা ফর্মুলা হাত সাফাই করে আমার কাছে বেচে দেবেন। আপনি ভালো করে জানেন ইন্সপেক্টার, এসব কাজে আমি অভ্যস্ত। তাই ওঁর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম।

নিজের দোষ ঢাকবার জন্য বেশ গল্প কেঁদেছেন দেখছি, জ্যাপ আবার ধমকে উঠলেন। আপনি হলেন পুরোনো পাপী। আপনার গুণের কি শেষ আছে, মশাই! ইন্সপেক্টার এবার লুসিয়াকে প্রশ্ন করলেন–ওই লোকটা যা যা বলবেন, সব কি সত্যি, ম্যাডাম?

লুসিয়ার মুখ সাদা হয়ে উঠল, কে যেন বুঝি এক লহমাতে তার পায়ের রক্ত শুষে নিয়েছে। রিচার্ড তাকাল বউয়ের মুখের দিকে, সে ঘাবড়ে গেল, কী জানি বাবা, এক্ষুনি না জ্ঞান হারায়। তার ভীষণ রাগ হল। সে গলা চড়িয়ে বলল–অফিসার, এসবের মানে কী? দেখছেন, আমার স্ত্রীর শরীর ভালো নেই, নাকি বুঝেও বুঝতে চাইছেন না। এসব আমি মোটেই হতে দেব না, বলে রাখছি।

জ্যাপ চোখ রাঙিয়ে বললেন–আপনি কেন বাধা দিচ্ছেন, মি. অ্যামরি? ম্যাডামের আত্মপক্ষ সমর্থনে যদি কিছু ওনার বলার থাকে, তাহলে ওঁকেই বলতে দিন, আপনি দয়া করে থামুন।

লুসিয়া তাকাল রিচার্ডের দিকে, অবশ্য সরাসরি নয়, উঠে দাঁড়াল, কিছু বলবে বুঝি।

 ঠিক এই সময় ডঃ কারোলি রাগত স্বরে বলে উঠলেন উনি আবার কী বলবেন? বলার কী আছে। দেখছেন না সব ফাঁস হয়ে যাওয়াতে কেমন মরা মাছের মতো মুখখানা হয়ে গেছে। ওই মহিলা কার রক্ত বয়ে বেড়াচ্ছে জানেন? শুনলে আপনারা চমকে উঠবেন। ওর মা সেলমা গেতজ, কুখ্যাত নারী গুপ্তচর। নিজের ঘৃণিত পরিচয় গোপন রেখে স্যার গ্লডের ছেলেকে এটা-সেটা বুঝিয়ে বিয়ে করতে বাধ্য করছে। তারপর আদর্শ গৃহবধূর ভান করে ঘর-সংসার করছে। ওইমহিলাকে বিশ্বাস নেই, যখন তখন যার তার সর্বনাশ করতে পারে, ওর সংস্পর্শে না-আসাই মঙ্গল।

-চুপকর, বদমাইস। শার্টের হাতা গুটিয়ে রিচার্ড চেয়ার ঠেলে তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল। কারোলিকে লক্ষ্য করে হুমকি দিল–তুই আমায় চিনিস নারে, শয়তান। এমন ঘুষি লাগাব, নাকটা আর নাকের জায়গায় থাকবে না। তোর ওই মোটা শরীরের হাড়গুলো আস্ত থাকবে না জানিস। তোর হাল বারোটা করে ছাড়ব।

জ্যাপ দু-হাত তুলে রিচার্ডকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। বললেন মি. রিচার্ড, আপনি যদি আগে ভাগে ওর হাড়গোড় গুঁড়ো করে দেন, তাহলে আমাদের ভাগ্যে কী জুটবে। মনে রাখবেন, ও একটা ক্রিমিনাল, পুলিশের খাতায় ভুরি ভুরি অভিযোগ আছে ওর নামে। বর্তমানে কারোলি আমার হেপাজতে। কয়েকদিনের মধ্যে ওকে আদালতে হাজির করা হবে।

রিচার্ড নিজের চেয়ারে আবার বসে পড়ল। এবার জ্যাপ তাকালেন লুসিয়ার দিকে। বলেন–ম্যাডাম, আমরা এই মৃত্যুরহস্যের কিনারা করতে চাইছি। আর আপনারা যদি এভাবে ব্যাগড়া দেন, তাহলে কি কাজ এগোবে। আপনাকে বলছি ম্যাডাম, কারোলির কথা বাদ দিন, আপনার কী বক্তব্য আছে, তাই শুনতে চাইছি আমরা।

লুসিয়া নীরবে ঘুড়ে দাঁড়াল, আড়চোখে রিচার্ডের দিকে তাকাল। পরক্ষণে পোয়ারোর দিকে তাকাল, দৃষ্টিতে ঝরে পড়ছে অসহায়তা, পরক্ষণে কী মনে করে একটা হাত বাড়িয়ে দিল তার দিকে।

পোয়ারো তাকালেন লুসিয়ার দিকে। মাদাম, ঘাবড়ে যাবেন না, মনে বল আনুন। পোয়ারো তাকে সাহস জোগালেন আপনাকে গোড়াতেই বলেছি, আমি আপনার বাবার বয়সী, আপনি নিঃশঙ্কচিত্তে আপনার বক্তব্য পেশ করুন। যা কিছু মিথ্যে ছিল, সব প্রকাশ্যে এসে গেছে। এখন শুধু সত্যি জানার সময় এসেছে। মনে রাখবেন, হাজার চাপা দিয়েও সত্যকে ঢেকে রাখা যায় না, একদিন না একদিন তার প্রকাশ ঘটবেই। তাই বলছি, মাদাম, যা কিছু বলতে চান, বলে ফেলুন, নিজেকে হালকা করুন।

পোয়ারো তার জায়গা ছেড়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন খোলা জানলার সামনে, কিন্তু কান খাড়া।

-হ্যাঁ, লুসিয়া চুপ করল, খানিকটা সময় কেটে গেল, হয়তো বা মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে নিল। পরক্ষণে শোনা গেল লুসিয়ার ধীর ও স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর–সেলমা গেতজ আমার মা, আমি তার গর্ভস্থ সন্তান। ডঃ কারোলির কথানুযায়ী এপর্যন্ত সত্যি। তারপরের যা কিছু, সেগুলো ওনার মনগড়া গল্প। উনি ইচ্ছে করে ওনার দোষটা আমার ঘাড়ে ফেলে দিতে চাইছেন। আসলে ব্যাপারটা ঠিক উলটো। ওঁকে এখানে আসার জন্য আমি পীড়াপীড়ি করিনি, স্যার ক্লডের ফর্মুলা চুরি করে বিক্রি করা কথাটাও সম্পূর্ণ মিথ্যে। ওনার মূল উদ্দেশ্য ছিল আমাকে ব্ল্যাকমেল করা। প্রচুর টাকা কামানোর ধান্দায় এই পরিবারের জাল অতিথি হয়ে ঢুকে পড়েছিলেন।

-কী বলছ, লুসিয়া? রিচার্ড আগুন চোখে স্ত্রীর দিকে তাকাল, লোকটা তোমায় ব্ল্যাকমেল করতে এসেছে?

রিচার্ড লুসিয়ার গা ঘেঁষে এসে দাঁড়াল।

-হ্যাঁ, রিচার্ড। লুসিয়া জোরে জোরে বলতে লাগল, আজ আমি সত্যি বলতে আর ভয় পাই না। উনি সব সময় আমায় ভয় দেখাতেন–ফর্মুলা যদি ওনার হাতে তুলে না দিই, তাহলে আমার অতীত বাড়ির সকলকে বলে দেবেন। কিন্তু ফর্মুলা হাতিয়ে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি, বিশ্বাস করো তুমি। ফর্মুলা-চোর হিসাবে আমার সন্দেহ হচ্ছে ওনাকেই, কারণ যখন-তখন স্টাডিতে ঢোকার সুবিধা উনি পেতেন এখন বুঝতে পারছি, উনি কেন আমার কানে কানে শুনিয়েছেন হিসকোসিনের ক্ষমতার কথা। ওটা নাকি খুব ভালো ঘুমপাড়ানি ওষুধ। আসলে ডঃ কারোলি ধরেই নিয়েছিলেন, আমি হিসকোসিন খেয়ে মরব। ব্যাস, আর ওনাকে পায় কে! চাউর করে দেবেন ফর্মুলা চুরি করে ধরা পড়ার ভয়ে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছি। শয়তানিতে ওঁর জুড়ি মেলা ভার। হাড়ে হাড়ে চিনি ওঁকে, কত মেয়ের যে সর্বনাশ করেছেন, তা আর কী বলব।

লুসিয়া নিজেকে আর সামলাতে পারল না। কান্নায় ভেঙে পড়ল।

রিচার্ড তাকে নিজের কাছে টেনে নিল–শান্ত হও, ডার্লিং। তোমার এই ছোট্ট বুকের মাঝে কত চাপ ধরে রেখেছ, অথচ আমার সঙ্গে ভাগ করোনি। সব যন্ত্রণা একাই বহন করেছ।

কিন্তু ততক্ষণে লুসিয়া বেহুঁশ হয়ে পড়েছে। পিসিমা ক্যারোলিন ছুটে এলেন। রিচার্ড তার সহযোগিতায় লুসিয়াকে ধরে টেবিলের ওপর শুইয়ে দিল।

পোয়ারো এবার জানলা ছেড়ে চলে এলেন ডঃ কারোলির সামনে। বেশ আয়েস করে গদিতে বসেছিলেন ডঃ কারোলি। পোয়ারো এক ঝটকায় কারোলিকে হটিয়ে দিয়ে গদিটা হ্যাঁচকা টানে নামিয়ে নিলেন। সেটা হাতে নিয়ে এলেন টেবিলের কাছে। লুসিয়ার মাথার গদির ওপরে তুলে দিয়ে ফিরে গেলেন আবার আগের অবস্থানে।

ঘটনাটা এত চটজলদি ঘটে গেল যে, নিষ্ফল আক্রোশে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছাড়া ডঃ কারোলির কিছুই করার নেই।

রিচার্ড এগিয়ে এল ইন্সপেক্টার জ্যাপের সামনে। বলল–আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।

জ্যাপের সম্মতি পেয়ে রিচার্ড তার কানের কাছে মুখ এনে অত্যন্ত নীচু স্বরে কী যেন বললেন, যা অন্য কেউ শুনতে পেল না।

-অবশ্যই, জ্যাপ বললেন, উনি আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, যান, ওনাকে নিয়ে নিজের ঘরে শুইয়ে দিন।

জ্যাপের ইঙ্গিতে কনস্টেবল দরজা খুলে দিল। ক্যারোলিন আর রিচার্ড, দুপাশে দু’জন লুসিয়াকে ধরে দোরগোড়ায় এল। ঠিক এই সময় রেনর উঠে দাঁড়ালেন। ব্যথাহত কণ্ঠে বললেন–মাফ করবেন, মি. অ্যামরি, সত্যিই আমি দুঃখিত। তারপর মিনমিনিয়ে বললেন, সত্যিই, মনে হচ্ছে–কথা শেষ না করে রেনর নেমে গেলেন।

রিচার্ড একবার ঘাড় ফিরিয়ে ঘৃণাভরে রেনরকে দেখল। তারপর নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

জ্যাপকে লক্ষ্য করে রেনর বললেন–আমি কি একটু বাইরে যেতে পারি?

নিশ্চয়ই, যেতে পারেন, তবে বাড়ির বাইরে নয়, মনে রাখবেন।

জ্যাপকে ধন্যবাদ জানিয়ে এডওয়ার্ড রেনর ঘর থেকে বিদায় নিলেন।

বাইরে বেরোনোর দরজাটা হাট করে খোলা, অতএব ডঃ কারোলি সময় নষ্ট না করে টেবিল থেকে নিজের টুপি আর স্যুটকেস হাতে নিয়ে ওদিকে এগিয়ে গেলেন। পোয়ারোর দিকে নজর পড়ে গেল। তাচ্ছিলের হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে। ইন্সপেক্টার জ্যাপ লক্ষ্য করলেন সবই, দেখলেন, ডঃ কারোলি কেবল চোরের মতো বেরিয়ে যাচ্ছে ঘর থেকে, অবশ্য, কারোলিকে টের পেতে দিলেন না।

ডঃ কারোলি বসার ঘর থেকে অদৃশ্য হলে জ্যাপ তার কনস্টেবল জনসনকে ডেকে জানতে চাইলেন–বাড়ির সদর দরজায় কোনো পাহারার ব্যবস্থা আছে কিনা।

জনসন জানাল–ওখানে সি আই ডি কনস্টেবল হারল্ড আছেন, স্যার। আপনি যেমনটি বলেছেন, তেমনভাবেই দাঁড়িয়ে আছে।

-তোমার মোবাইল ফোনে হারল্ডের সাথে যোগাযোগ করে ক্যারোলির চেহারার এক নিখুঁত বর্ণনা দিয়ে বলল, ও যেন লোকটাকে অনুসরণ করে। লন্ডনে ট্রেন থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে ওকে যেন পাকড়াও করে ইয়ার্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। হ্যাঁ, আর একটা কথা। লোকটা যেন পাকাল মাছের মতো হাত ফসকে পালিয়ে না যায়। সেদিকে সতর্ক থাকে যেন।

-স্যার, মুচকি হাসল জনসন, ওই লোকটার চেহারার সাথে হারল্ডের পরিচয় আছে। তবু বলছেন যখন, আমি বলে দিচ্ছি।

কথা শেষ করে কনস্টেবল জনসন মোবাইল ফোনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তথ্যগুলি জানিয়ে দিল সি আই ডি কনস্টেবল হারল্ডকে। তারপর ভেতর থেকে। দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে দিল।

বারবারা এতক্ষণ চুপ চাপ সব দেখছিল আর শুনছিল। ঘর ফাঁকা হতে সে উঠে দাঁড়াল। পোয়ারোর দিকে তাকাল, উপহার দিল একঝলক দুষ্ট হাসি। তারপর ক্যাপ্টেন হেস্টিংসকে পাকড়াও করল।

নাছোড়বান্দার মতো তাকে টানতে টানতে নিয়ে এল খোলা জানলার কাছে, হেস্টিংস অসহায় বোধ করলেন, পোয়ারোর দিকে তাকালেন। কিছু বলতে গেলেন বটে, কিন্তু বলা হল না। তার আগেই বারবারার আকর্ষণে তিনি তখন এসে পড়েছেন একেবারে বাগানে। পোয়ারো নীরবে সব কিছু দেখলেন, আর আপন মনে হাসতে থাকলেন।

এরপর কেটে গেল কিছুটা সময়।

 রিচার্ড ঘরে এসে ঢুকল, না-ডাকতেই রিচার্ড যে আবার ফিরে এসেছে, একথা ভেবে জ্যাপ মনে মনে খুশি হলেন। পোয়ারোর দিকে তাকালেন। তারপর বললেন–মাফ করবেন মি. অ্যামরি। খানিক আগে মি. রেনর কী বলেছেন শুনলেন তো। অতএব আমাদের সতর্ক হয়ে এগোতে হবে। আপনি বোধহয় কিছু বলতে চান। বলুন, স্বচ্ছন্দে বলে ফেলুন। তবে হ্যাঁ, পোয়ারোর সামনে আপনার স্বীকারোক্তি দিতে, আপত্তি থাকলে আমি শুনব না। আপনার বক্তব্যের একজন সাক্ষী চাই তো।

-বেশ, আমারও আপত্তি নেই, দুজনেই শুনুন। রিচার্ড কয়েক মুহূর্তের জন্য থামল। মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিল। তারপর বলল–সত্যিটা বলার সময় হয়েছে বুঝতে পারছি। তাই আমি নির্দ্বিধায় স্বীকার করছি যে, আমার বাবার খুনী আমি নিজে। আমিই আমার বাবা স্যার ক্লড অ্যামরিকে বিষ খাইয়ে খুন করেছি। আমিই খুনী, বিশ্বাস করুন।

–উঁহু, হল না। জ্যাপ মুচকি হাসলেন। আপনি যে মিথ্যে বলছেন, তা আপনার মুখ চোখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। দেখুন, মি. পোয়ারোও হাসছেন। কেন অন্যের অপরাধ নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছেন কেন, মি. অ্যামরি? আপনার এই স্বীকারোক্তি আমরা গ্রাহ্য করছি না, দুঃখিত।

-কেন? রিচার্ড অবাক চোখে ওঁদের দিকে তাকাল–আমি যে মিথ্যে বলছি, তার বুঝলেন কী করে?

–আপনি কী ভেবেছেন, বলুন তো, জ্যাপের কণ্ঠস্বর কঠিন হল, আপনি যা বললেন, তা মেনে নিয়ে আপনাকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাব ভেবেছেন? মনে করছেন, এভাবেই সমস্যাটা মিটিয়ে দেবেন। কিন্তু আপনার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল, মশাই। আমি জানি, আপনাদের দাম্পত্য জীবন খুব বেশি দিন আগে শুরু হয়নি। সুন্দরী যুবতী স্ত্রী। জানি তাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন। তাই বলে নিজেকে ফাঁসি কাঠে লটকে তাকে বাঁচানো। না, মশাই, এ হতে পারে না। আমি জানি, আমার কথাগুলো শুনতে আপনার ভালো  লাগছে না। মনে মনে গালিগালাজও করছেন। তবুও না বলে পারছি না, একটা নোংরা খারাপ মেয়ের জন্য নিজের সুন্দর জীবনকে বলি দেবেন, মি. রিচার্ড অ্যামরি?

ইন্সপেক্টার জ্যাপ। রিচার্ড উত্তেজিত গলায় বলে উঠল, সব কিছুরই একটা সীমা আছে জানবেন।

-মানছি, আর এও মানছি যে, কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারের মুখে নিজের স্ত্রীর নিন্দা শুনলে আপনার মতো স্বামীরা চটে যান। কী মাসিয়ে পোয়ারো, আমার এই বক্তব্যকে আপনি নিশ্চয়ই সমর্থন করছেন। এখানে আমি কাজ করতে এসেছি। আসল অপরাধীকে পাকড়াও করে নিয়ে যাওয়াই আমার আসল উদ্দেশ্য। অপরাধী কে, জানতে পেরেছি। এমন কি তার নামও জানতে বাকি নেই। অতএব মি. রিচার্ড অ্যামরি, দুঃখিত, আপনাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারছি না। যাই, ওদিকের খবরটা নিয়ে আসি, তারপর আসল হত্যাকারীকে ধরা যাবে।

কথা শেষ করে ইন্সপেক্টার জ্যাপ দরজায় প্রহরারত কনস্টেবলের দিকে তাকালেন। ইঙ্গিতে কী যেন নির্দেশ দিলেন। তারপর চলে গেলেন বসার ঘরের বাইরে।

রিচার্ড কাচুমাচু মুখে বসে রইল। কখন যে পোয়ারো জানলার ধার থেকে সোফায় এসে বসেছেন, খেয়াল করেনি। হঠাৎ ঘাড় ফেরাল রিচার্ড। দেখল, সিগারেট হাতে পোয়ারো বসে আছেন।

রিচার্ড এবার উঠে দাঁড়াল। ধীর পায়ে পোয়ারোর সামনে এসে দাঁড়াল, আকুতিভরা কণ্ঠে জানতে চাইল–মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি কি বলেন? ইন্সপেক্টার জ্যাপ যাকে অপরাধী বলে মনে করছেন, আপনার কি তাতে সায় আছে?

-মঁসিয়ে অ্যামরি, সত্যি করে বলুন তো, পোয়ারো সিগারেটের ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন–আপনি আপনার স্ত্রীকে বিশ্বাস করেন না, জানি। এই সন্দেহ প্রবণতা কবে থেকে এল আপনার মনের মধ্যে।

–একদম বাজে কথা বলবেন না, মঁসিয়ে পোয়ারো। বোঝা গেল রিচার্ডের আসল জায়গায় আঘাত পড়েছে। টেবিলের ওপর পড়ে থাকা পোয়ারোর দেশলাই বাক্সটা সে মুঠোর মধ্যে চেপে ধরল উত্তেজনা দমনের চেষ্টায়। আমি আমার স্ত্রীকে বিশ্বাস করিনি। কখনো তার প্রতি আমার সন্দেহ জাগেনি।

–চিৎকার করে লাভ নেই, ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন, মঁসিয়ে অ্যামরি। যা সত্যি, দয়া করে তা বলে ফেলুন। আপনি যে আপনার স্ত্রীকে সন্দেহের চোখে দেখেন, এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই, মঁসিয়ে অ্যামরি। আমি এখানে আসার আগে থেকেই সেটা শুরু হয়েছিল বুঝতে পেরেছি। কারণ এ বাড়ি থেকে আমাকে তাড়াবার জন্য আপনি মরিয়া হয়ে উঠতেন না। বলুন, আমি বেঠিক কিছু বলেছি? আমি এরকুল পোয়ারো, যার চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায় না।

পোয়ারো রিচার্ডের দিকে সরাসরি তাকালেন, স্মিত হাসলেন। দেখা গেল দশাসই চেহারার রিচার্ড বাটকুল পোয়ারোর সামনে দয়া ভিক্ষা করার ভঙ্গিতে অসহায় মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

ফের সেই কথা। তবে আপনাকে জানিয়ে রাখি, আপনিও পুলিশের হাত থেকে রেহাই পাবেন না। লুসিয়ার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, সেই একই অভিযোগে অভিযুক্ত করে পুলিশ আপনাকে আদালতে তুলতে পারে। কেন বলছি, শুনুন। আপনার বাবা বেঁচে থাকাকালীন আপনার প্রচুর টাকার দরকার হয়ে পড়েছিল, সেই টাকা জোগাড় করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। স্যার ক্লডের কফির কাপ আপনিই একবার হাতে নিয়েছিলেন, মনে পড়ে? মারাত্মক জীবন নাশক ওষুধগুলো নিয়ে আপনি নাড়াচাড়া করেছিলেন, ব্যাপারটা কারো দৃষ্টি এড়ায়নি। তবে হ্যাঁ, আপনার কাঁধে সব অভিযোগ চাপানোর জন্য একজনকে রেহাই দেওয়া যেতে পারে।

-ইন্সপেক্টার জ্যাপ এ ব্যাপারে আপনাকে সমর্থন করবেন না জানি।

-কী বললেন? জ্যাপ? পোয়ারো সামান্য হেসে বললেন, উনি অবিবেচক নন, এটা যেমন ঠিক, তেমনই উনি যে সেই মহিলা নন, যিনি নিজের স্বামীকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন এটাও তেমন বেঠিক।

পোয়ারোর কথার অর্থ বুঝতে না পেরে রিচার্ড বোকার মতো তাকিয়ে রইল। পোয়ারো তা লক্ষ্য করে বললেন–আপনাকে বোঝানোর মধ্যে আমার খামতি রয়ে গেছে বুঝতে পারছি। এজন্য আমাকে একটা পুরোনো ঘটনার সাহায্য নিতে হচ্ছে। আশা করি, তখন আপনার মাথায় সবই ঢুকবে। এর সঙ্গে সাধারণ মনোবিজ্ঞানের যথেষ্ট সম্পর্ক আছে, বলে দিলাম।

পোয়ারো থামলেন। সিগারেটে ঘন ঘন টান দিলেন, ধোঁয়ার রিং করে বাতাসে ছেড়ে দিলেন। তারপ ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন–আমি সে রাতে এখানে এসে পৌঁছবার পর, আমায় দেখে আপনার পরিবারের সকলে খুব অস্বস্তিতে পড়েছিলেন। স্যার ক্লডের অস্বাভাবিক মৃত্যু ও ফর্মুলা চুরির ব্যাপারে আমি তদন্ত করি সেটাতে এ বাড়ির সকলের আপত্তি ছিল, এমনকি আপনিও। সেরাতেই আমাকে লন্ডনে ফিরে যাবার জন্য আপনি আমায় অনুরোধ করেছিলন, আশা করি ভুলে যাননি। কিন্তু আপনার স্ত্রী বাদ সাধলেন। তিনি একা আমার সঙ্গে কথা বললেন। তার প্রবল ইচ্ছের কথা জানালেন। তার আসল অপরাধীকে খুঁজে বের করার জন্য আমাকে একান্ত অনুরোধ জানিয়ে ছিলেন। এবার প্রশ্ন হল, মাদাম লুসিয়া যদি সত্যিই অপরাধ করে থাকেন, তাহলে কেন আমাকে তদন্তের কাজ চালিয়ে যেতে বলবেন, বলুন? ভেবে দেখেছেন কী? আপনি তো একজন সামরিক ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষিত মানুষ–তলিয়ে দেখুন, জবাব মিলে যাবে।

রিচার্ড খানিকক্ষণ কী যেন ভাবল, তারপর প্রায় লাফিয়ে উঠে বলল–তাহলে আপনি বলতে চান…..

রিচার্ডকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে পোয়ারো বললেন–হ্যাঁ, আমি বলতে চাইছি, আর সময় নষ্ট করবেন না, মঁসিয়ে অ্যামরি। কাল ভোরে আপনি আপনার স্ত্রীর কাছে মাফ চাইবেন। আপনি আপনার আচরণের জন্য কতটা অনুতপ্ত তা তাকে বুঝিয়ে বলবেন। আপনি যে অহেতুক তাকে অপরাধী ভেবে অন্যায় করেছেন, তাও তার কাছে খুলে বলবেন।

-মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি তো আপনার উদ্দেশ্য কী, বুঝতে পারছি না।

–অত নাই-বা বুঝলেন। মঁসিয়ে, আমার ওপর ভরসা রাখুন। আমি আপনাদের শুভাকাঙ্খী। অতএব আপনাদের দুজনকে বাঁচানোর দায়িত্ব আমার। আমি এরকুল পোয়ারো বলছি। অতএব যেমনটি বলছি, তেমনটি করুন।

-বেশ, আপনার পরামর্শ মেনে নিলাম, কিন্তু আপনি কি অমার স্ত্রীকে রক্ষা করতে পারবেন? রিচার্ডের অস্থির চিত্ত তখন মরিয়া হয়ে উঠেছে।

-আপনাকে আগেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, মঁসিয়ে অ্যামরি। পোয়ারোর গলায় কঠিন সুর, তবে এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা যে কত কঠিন কাজ, তা আগে বোধগম্য হয়নি। কিন্তু সময় ক্রমশ সংক্ষিপ্ত হয়ে আসছে, যা কিছু করার এর মধ্যেই শেষ করতে হবে। কিন্তু তার আগে আমি যা বলব, তা পালন করতে হবে। বলুন, মঁসিয়ে পোয়ারো, শপথ নিন, যা বলব, তাই করবেন, কোনো প্রশ্ন করা চলবে না, কোনো ওজোর-আপত্তি শুনব না, ঠিক আছে?

-বেশ, শপথ নিলাম।

পোয়ারো বুঝলেন, রিচার্ড অনিচ্ছার সঙ্গেই কথাটা বলছে

এবার শুনুন, সিগারেটের শেষ অংশটা ফেলে দিয়ে পোয়ারো বললেন, মন দিয়ে শুনুন। কাজটা আপনারা করে ফেলতে পারবেন, আমি জানি। জ্যাপের কথার সুর শুনে বুঝতে পেরেছি, উনি সহজে আপনাদের ছেড়ে দেবেন না, নাচিয়ে ছাড়বেন। আজকালের মধ্যেই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দারা এখানে এসে পড়বে। কেবল ওপর-ওপর তল্লাসী চালিয়ে ওরা ক্ষান্ত হবেন না, সারা বাড়ি তোলপাড় করে ছাড়বেন। ওদের শ্যেন দৃষ্টির হাত থেকে ঘুপচি-ঘাপচিও বাদ যাবে না। আসলে কী জানেন, পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে আমিও তো একসময় চাকরি করেছি, অভিজ্ঞতা কম হয়নি। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, ওদের দৌরাত্মে আপনাদের তিষ্ঠোনো দায় হয়ে দাঁড়াবে। তাই বলছি, এখান থেকে আপনারা অন্য কোথাও চলে যান কয়েক দিনের জন্য, এ আমার অনুরোধ।

–কিন্তু এ বাড়ির দায়িত্ব কার ওপর দিয়ে যাব? পুলিশের ওপর?

রিচার্ডের প্রশ্নের জবাবে পোয়ারো বললেন আপনারা কি এই অঞ্চল ছেড়ে অনেক দুরে কোথাও চলে যাবেন? এখানকারই কোনো হোটেলে ঘর ভাড়া নেবেন। সেখানেই কয়েকদিন থাকবেন। ফলে পুলিশ এবং বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হবে না। কোনো জিজ্ঞাসাবাদ থাকলে সহজেই যোগাযোগ করা সম্ভব হবে।

-স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দারা কবে আসবে? এ সম্পর্কে আপনার কি কোনো ধারণা আছে?

-যে কোনো দিন, যেকোনো সময়। আগামীকাল দিনের বেলাতেই যদি ওদের আগমন ঘটে, সেটা অপ্রত্যাশিত হবে না।

ব্যাপারটা কি সকলে সহজভাবে মেনে নেবে?

–আপনি নিশ্চয়ই তাই ভাবছেন। না, কেউ এটাকে বিশ্রী ব্যাপার ভেবে মাথা ঘামাবে না। বরং আপনি এখানে থাকলে পাগল হয়ে যাবেন। বাড়ির লোকেদের চোখের সন্দেহপূর্ণ চাউনি, চাপাগলায় সমালোচনা, সারা বাড়িময় ফিসফিসানি আর গুজগুজানি, আপনাকে জ্বালিয়ে মারবে। তখন তুচ্ছ কারণেও অনর্থ বেঁধে যাবে। তার চেয়ে, আমার পরামর্শ মেনে নিন, বাড়ির বাইরে কয়েকটা দিন কাটিয়ে আসুন।

–তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু ইন্সপেক্টর জ্যাপ, উনি কি সহজে। আমাদের ছেড়ে দেবেন? রিচার্ডের গলায় অবিশ্বাসের সুর। তাছাড়া বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেও কতখানি লাভ হবে, বুঝতে পারছি না।

–হুঁ, আমিও বুঝতে পারছি, অত সহজে ব্যাপারটা আপনার মাথায় ঢুকবে না। পোয়ারো বুঝি আত্মতৃপ্তি লাভ করলেন। বললেন, আপনি এক কাজ করুন, আপনার যা দেখার বা বোঝার, সব আমার ওপর সম্পূর্ণ ভাবে ছেড়ে দিন, আমি এরকুলো পোয়ারো, আমি সে দায়িত্ব নিলাম। আপনি কেবল, আমার কথা মতো কাজ শুরু করে দিন।

পোয়ারো উঠে দাঁড়ালেন রিচার্ডের কাঁধে হাত রাখলেন–যান, আর দেরি নয়, নিজের ঘরে গিয়ে গোছগাছ সেরে নিন। মনে মনে ভাববেন, কিছু দিনের জন্য বাইরে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছেন। রিচার্ডের কাঁধে ছোট্ট চাপড় মেরে পোয়ারো আবার বললেন জিনিসপত্র গুছিয়ে নেবার কাজটা নিজে পেরে না উঠলে, রেনর তো আছেন, তাকে লাগিয়ে দেবেন। যান, যান, সময় অযথা নষ্ট না করে ঝাঁপিয়ে পড়ুন কাজে। আসুন, আপনাকে দরজা পর্যন্ত এগিয় দিই।

রিচার্ডকে প্রায় ঠেলতে ঠেলতে পোয়ারো তাকে, দরজার সামনে নিয়ে এলেন। রিচার্ড বুঝি মূক হয়ে গেছে, কেবল তার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দুটি চোখ একবার পোয়ারোকে দেখল, তারপর ঘুরে গেল ওপরে যাবার সিঁড়িপথের দিকে।

-বাপরে বাপ! কী ঠ্যাটা! ইংরেজ জাতটাই এমন। পোয়ারো মনে মনে আক্ষেপ করলেন। এবার এগিয়ে এলেন খোলা জানলার কাছে। বাইরের দিকে দৃষ্টি মেলে দিলেন, কাউকে দেখতে পেলেন না, দেখা সম্ভবও নয়। ঝোপঝাড় লক্ষ্য করে পোয়ারো জোর গলায় হাঁক দিলেন মাদমোয়াজেল বারবারা, আপনি কোথায়? আমার বন্ধুটিকে কোথায় সরালেন? কম তো সময় নিলেন না, এবার সামনে আসুন, আপনার শ্রীমুখ দর্শন করি।

–ওফ, বুড়োটা গলা ফাটিয়ে কেমন চিল্লাচ্ছে দেখ। একটা বড় ঝোঁপের তলা থেকে বারবারা বেরিয়ে এল। খেঁকিয়ে জানতে চাইল, কী হল? অত হাঁকডাক কেন শুনি? আপনার বন্ধুকে নিয়ে আমি পালিয়ে গেছি? একটু গল্প করছি, সেটাও অসহ্য লাগছে। আপনাদের যা জবাবদিহির পালা চলল, মাথা গরম হয়ে উঠেছিল। তাই খোলামেলাতে এসে দুজনে বসেছি, গল্প করছি। এতে আপনার আপত্তি কীসের?

–আমায় ভুল বুঝবেন না মাদাম, পোয়ারো মনে মনে একচোট হেসে নিলেন, বললেন, দুঃখিত। বাধ্য হয়ে এভাবে আপনাকে বিরক্ত করছি। গল্প করবেন বলে যাকে টানতে টানতে বাগানে নিয়ে গেলেন, তিনি যে আমার সহকারী, তা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। আমাকে সাহায্য করার জন্যই ক্যাপ্টেন হেস্টিংসকে আমি সঙ্গে করে এখানে নিয়ে এসেছি। এবার দয়া করে অল্পক্ষণের জন্য তাকে ছেড়ে দিন, মাদমোয়াজেল, বড্ড উপকার হয়, কথা দিচ্ছি, কাজ সেরেই ও ফিরে যাবে আপনার কাছে।

-ও, মতলবটা বুঝলাম। তা আমার বন্ধুটিকে কেড়ে না-নিলে আপনার মন ভরছেনা, তাই না? নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠল বারবারা।

-ভুল বললেন, কেড়ে নিচ্ছিনা। কয়েকটা দরকারী কথা আছে। তারপরেই ওঁকে আপনার কাছে পাঠিয়ে দেব।

–বেশ, আপনি যেমনটি চাইছেন মঁসিয়ে পোয়ারো। কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বড় বড় পা ফেলে বারবারা ঝোঁপের কাছে ফিরে এল। ক্যাপ্টেন হেস্টিংস-এর দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হাসি হেসে উঠল। বলল যাও বন্ধু, তোমার তলব পড়েছে। উনি কথা দিয়েছেন, আবার তোমাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেবেন।

–অসংখ্য ধন্যবাদ, মাদমোয়াজেল। ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে হেস্টিংস জানলার দিকে তাকালেন। পোয়ারোকে হাত ইশারা করলেন। একটু বাদেই খোলা জানলা ডিঙিয়ে তিনি পোয়ারোর সামনে এসে দাঁড়ালেন লাজুক মুখে।

আবার, চাপাগলায় ধমকে উঠলেন পোয়ারো, তোমায় একটা কাজের দায়িত্ব দিয়ে নিশিন্ত হয়েছিলাম, ভাবলাম এই অবসরে মাথাটা অন্য ব্যাপারে লাগাব। কিন্তু তুমি দেখছি, সে দায়িত্ব পালন না করে রিচার্ড অ্যামরির খুড়তুতো বোনের সঙ্গে বাগানে গল্প করতে বসে গেছো?

সত্যি বলছি বন্ধু, তোমার এই পরিবর্তন দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি।

-বাঃ, বেশ তো বকাঝকা করছ, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস পাল্টা জবাব দিলেন, মেয়েটা যখন টানতে টানতে আমায় নিয়ে গেল, তুমি তো সামনেই ছিলে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে, অথচ মানা করলে না। পেছন থেকে টেনেও তো ধরতে পারতে। করোনি। আসলে তুমিও বেশ মজা পাচ্ছিলে।

থাক থাক, আর আমায় বুঝিয়ে কাজ নেই। পোয়ারো এবার গলার স্বর নামিয়ে বললেন তোমাকে কেন আমি গাল দিচ্ছি জানো। তোমার-আমার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে কারোলি নাকি এঘরে ঢুকেছিল। শুধু তাই নয়, রেনরও। ওরা টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে কীসব কথাবার্তা বলছিল। জ্যাপের মুখে কারোলির আসল পরিচয় শুনেছ নিশ্চয়ই। ভাবছি, আমাদের দেখতে না পেয়ে কারোলি কোনো প্রমাণ নষ্ট করে দিয়েছে কিনা কে জানে।

-মাফ করো, বন্ধু। হেস্টিংস আন্তরিকতার সুরে বললেন–এদিকের কথা কী করে যে ভুলে গেলাম, জানি না। বিশ্বাস করো, অতশত মাথায় আসেনি।

যদি কারোলি কোনো ক্ষতি না করে থাকেন, তাহলে জানবে আমার কপালের জোরেই হয়েছে। কিন্তু ভায়া, আর তো বসে থাকার সময় নেই। ভেতর ভেতরে একটা তাগিদ বোধ করছি। বুদ্ধি খাঁটিয়ে আমাদের পা বাড়াতে হবে, বুঝেছ হেস্টিংস।

বন্ধুর গাল টিপে পোয়ারো সোহাগ দেখালেন।

-বেশ, চলো, আমি তৈরি, কাজ শুরু করা যাক।

দাঁড়াও, এক্ষুনি নয়। সাবধানী কণ্ঠে পোয়ারো বললেন আমি যে কাজের কথা বলছি, তার সাথে এতদিন যেসব রহস্য সমাধান করেছি, তার সঙ্গে কোনো মিল নেই। বলা যেতে পারে এই রহস্য গোড়া থেকেই দুর্বোধ্য, তাই অত্যন্ত খারাপ।

পোয়ারো চোখ মেলে ছিলেন খোলা জানলা দিয়ে বাগানের দিকে। দেখো, সন্ধ্যা ও রাতের সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে সময়, অন্ধকার চারপাশ। ঠিক গত সন্ধ্যের মতো। আঁধারের কালো কালিমালিপ্ত এই বাড়ি আর তখনই

পোয়ারো চুপ করলেন, সামান্য সময় নিলেন। পরক্ষণে বলতে শুরু করলেন–হ্যাঁ, এই জমাট বাঁধা অন্ধকারই আমাদের আলোর দেশে পৌঁছোতে সাহায্য করবে। হ্যাঁ, হেস্টিংস, এই পথ ধরেই আমরা সফলতার শীর্ষে পৌঁছোতে পারব।

-কী সব হেঁয়ালি করছ বলল তো, হেস্টিংস বললেন, যা বলতে চাইছ বুঝিয়ে বলল, বাপু!

–পোয়ারোর কণ্ঠস্বর হঠাৎ গম্ভীর হল–আচ্ছা বলতে পারো স্যার ক্লড অ্যামরির মৃত্যু হল কীভাবে?

এ কি নতুন কথা। স্যার ক্লড কেন মারা গেলেন, তা কারো অজানা নেই। ওঁর শরীর কাটাছেঁড়া করে পোস্টমর্টের রিপোর্টে বলা হয়েছে মারাত্মক বিষ মেশানো কফিতে ওঁর মৃত্যু হয়েছে, মানে কেউ বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল।

তাতে কারো সন্দেহ নেই, পোয়ারোর বুঝি ধৈৰ্য্য ধরছে না। কিন্তু বলতে পারো, এর কারণ কী? কেন বিষ খাইয়ে খুন করা হল?

সম্ভবত, কথা শেষ না করে মুখ বুঝলেন হেস্টিংস, পোয়ারোর দিকে তাকালেন, ফর্মুলা চোরের মনে কোনো সন্দেহ উঁকি দিয়েছিল, এমনটিও হতে পারে–হেস্টিংস আবার নীরব হলেন।

সহকারীর ব্যাখ্যা শুনে পোয়ারো বুঝি খুশি হলেন, তার ঘাড় নাড়া দেখেই হেস্টিংসের বুঝতে দেরি হল না।

-কিন্তু হেস্টিংস, পোয়ারো প্রশ্ন করলেন, যদি তোমার ধারণার উল্টোটা হয়ে থাকে, মানে ফর্মুলা চোরের মনে কোনো সন্দেহ দেখা দেয়নি। এবার তুমি কী বলবে?

–সত্যি কথা বলছি, ভায়া, ক্লান্ত স্বরে হেস্টিংস বললেন, আমার বুদ্ধি-সুদ্ধি সব গোল পাকিয়ে যাচ্ছে।

পোয়ারো এগিয়ে এলেন, গলা খাঁকানি দিলেন। তারপর বললেন–আচ্ছা বেশ, মগজ খাটাতে হবে না। যা বলছি, শোনো। গত সন্ধ্যায় যেসব ঘটনা ঘটেছিল, তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে। আমি একের পর এক বলে যাচ্ছি, ভুল হলে ধরিয়ে দিও, কেমন!

ক্যাপ্টেন হেস্টিংস কোনো সাড়া না দিয়ে চেয়ারের ওপর ক্লান্ত শরীরটাকে বসিয়ে দিলেন।

পোয়ারো শুরু করলেন–মারা যাবার খানিক আগে স্যার ক্লড অ্যামরি তার স্টাডি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন, বসেছিলেন এই আর্মচেয়ারে, ঘরের একমাত্র আরামকেদারাটিতে নিজে বসলেন। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল নীরবতার মধ্যে, বোঝা গেল পোয়ারো এখন স্মৃতির সমুদ্রে ঘুরে বেড়াচ্ছেন–হ্যাঁ, শেষবারের মতো এবং এই চেয়ারে বসেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন, তাও ঠিক। তার কয়েক মিনিট পরে পরিবারের সদস্যরা ডিনার সেরে এই ঘরে এসে হাজির হয়েছিলেন, এমনকি ডঃ কারোলিও। স্যার ক্লডের অচেতন দেহটা উনিই প্রথম পরীক্ষা করেছিলেন এবং বলেছিলেন উনি মারা গেছেন, হার্ট অ্যাটাকই এর কারণ। এ ব্যাপারে ডঃ কারোলি নিশ্চিত। এর পরে আসেন অ্যামরি পরিবারের চিকিৎসক। দ্বিতীয়বার স্যার ক্লডকে পরীক্ষা করে ডঃ গ্রাহাম জানিয়ে ছিলেন, ওনার হার্ট অত্যন্ত ভালো ছিল। তাঁর কথায়, হার্টফেল নয়, অন্য কোনো কারণ। সেটা কী? উনি খুঁজে না পাওয়ায় ডেথ সার্টিফিকেট দিতে রাজি হননি। তিনিই করোনারের কাছে আবেদন করে স্যার ক্লডের মৃতদেহ পোস্টমর্টেমে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। মর্গে ডাক্তাররা মৃতদেহের পেট চেরাই করে কফির নমুনা সংগ্রহ করেন। তা ল্যাবোরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়, দেখা যায় ওই কফির সঙ্গে হিসকোসিন হাইড্রোব্রোমাইড নামক মারাত্মক বিষ মিশে আছে। অর্থাৎ স্যার ক্লডকে কফির সঙ্গে বিষ খাইয়ে হত্যা করা হয়েছে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে এমনটিই উল্লেখ করা হয়েছে। ঘটনাটি একটি খুনের মামলায় পরিণত হল। সম্ভবত স্যার ক্লড অ্যামরির শবদেহ সৎকারের কাজটি দু-একদিনের মধ্যে হয়ে যাবে। তারপরেই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে গোয়েন্দারা আসবেন। এবাড়ির প্রতিটি কোণ খুঁজে বেড়াবেন। খানাতল্লাশি চালিয়ে স্যার ক্লডের ব্যক্তিগত কাগজপত্র, ডায়েরি যেখানে যা পাবেন সব নিজেদের জিম্মায় নিয়ে নেবেন। এমনকি তার শেষ উইলটিও বাজেয়াপ্ত হবে। সমস্ত কাগজপত্রের প্রত্যেকটা তারা শ্যেন দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবেন। অবশেষে তাঁরা একটি সিদ্ধান্তে আসবেন। পোয়ারো আড়চোখে তাকালেন সহকারীর দিকে বলো তো, সেটা কী? আন্দাজ করো।

হেস্টিংস চুপ। পোয়ারো আবার বলতে শুরু করলেন–সিদ্ধান্ত হল এই যে, স্যার ক্লড যে ফর্মুলা তৈরি করেছেন বলে চারদিকে চাউর হয়ে গেছে, কোনো এক রাষ্ট্রের টাকার গোলাম হয়ে ডঃ কারোলির মতো জঘন্য অপরাধী যা চুরি করতে এখানে এসে জুটেছিলেন, সেই মহামূল্যবান ফর্মুলার নোটগুলো এখনও অসম্পূর্ণ অবস্থাতেই রয়েছে অর্থাৎ পুরোপুরি কাজ শেষ হয়নি। এই সম্ভাবনাকে ধরে নিয়ে একটা প্রশ্ন জোরালো ভাবে দেখা দেবে, তা হল স্যার ক্লড ফর্মুলা তৈরির কাজ আদৌ শেষ করতে পেরেছিলেন কিনা! চোরের মস্ত এক সুবিধা হবে। সেটা কী?

পোয়ারো থামলেন, ঝেকে আক্রান্ত, আপনমনে বলে চললেন–সেটা হল নিরাপত্তা। ফর্মুলা চোর নিজেকে নিরাপদ ভাববে। সন্দেহভরা চোখ তার দিকে আর তাকাবে না। সে এবার নিশ্চিন্তে তার বাকি কাজটুকু গুছিয়ে নেবে। অসম্পূর্ণ হলেও স্যার ক্লডের স্টাডির সিন্দুক থেকে ফর্মুলা চুরি করে সেটা জুতসই জায়গায় লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করবে। যে জায়গার দিকে কেউ কোনোদিন ফিরে তাকায় না, খোঁজার প্রশ্নই ওঠে না। এবার চোর বামাল সমেত পালাবার জন্য সুযোগ খুঁজবে। সকলের চোখে ধুলো দিয়ে চো চো দৌড়, সোজা গিয়ে হাজির হবে তাদের কাছে, যাদের কাছ থেকে সে টাকা খেয়েছে। এইভাবে এই মূল্যবান ফর্মুলা চলে যাবে অন্য এক হাতে। তার গ্যাড়াকলের কলটা যে এভাবে নড়বড়ে হয়ে যাবে, বাছাধন তা কল্পনাও করতে পারিনি।

পোয়ারো পিঠ টান করলেন, মনের ভেতর জড়ো করা ভাবনাগুলোকে ঝালিয়ে নেবার জন্য তৈরি হলেন। বেশ জোরালো গলায় বললেন–এপর্যন্ত যা যা ঘটেছে তার পুনরাবৃত্তি করছি, মন দিয়ে শোনো। সেদিন ওই সময় ঘটনাক্রমে স্যার ক্লড তাঁর স্টাডিতে ঢুকেছিলেন। সিন্দুকের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তার মনে কেমন খটকা হল। তিনি সিন্দুক খুললেন। দেখলেন কয়েকদিন আগে পুরে রাখা ফর্মুলা সমেত খামটা নেই। তার মানে কে হাতিয়ে নিয়েছে। স্যার ক্লডের ধারণা, যে ফর্মুলা চুরি করেছে, সে এই বাড়ি ছেড়ে এখনও বেরোতে পারেনি, তিনি সকলকে শুনিয়ে কথাও বলেছিলেন যে, এই ঘরটা হল ইঁদুর ধরা ফাঁদ, ফর্মুলা চোর অন্যন্যদের সঙ্গে সেই ফাঁদেই আটকে আছে। এসব কথা অবশ্য তাঁর মুখ থেকে আমি শুনিনি। জেনেছি বাড়ির সদস্যদের কাছ থেকে। সত্যি ভায়া এই বসার ঘরটা ইঁদুর ধরার একটা ফাঁদ, মোক্ষম তুলনা। এমনকি তার খুনি সেই ফর্মুলা চোর এমন কিছু জানতো, যা স্যার ক্লডের কল্পনার বাইরে ছিল। ফর্মুলা চোর পুরুষ অথবা মহিলা, যে কেউ হতে পারে। এবার তার একটাই কাজ–ফর্মুলাটাকে সকলের চোখের আড়ালে লুকিয়ে রাখা। কিন্তু তা সম্ভব কী ভাবে? সার ক্লড যখন বললেন, সমস্ত আলো নিভিয়ে বসার ঘরকে অন্ধকার করে দেওয়া হবে, চোর যেন ফর্মুলাটা ফিরিয়ে দেয়। ফর্মুলা চোর ঠিক করল, এই সুযোগটাই গ্রহণ করবে। আঁধারের মধ্যে এমন কোনো জায়গায় ওটা লুকিয়ে রাখবে যা কেউ খুঁজে পাবে না।

পোয়ারো তাকালেন তার সহকারীর দিকে হেস্টিংস, মিস ক্যারোলিন যেমন চোখ বুজে জবাব দিয়েছিলেন, তুমিও তেমনই চোখ বোজো। আমিও বন্ধ করলাম আমার চোখ। ঠিক আছে? এবার কী দেখছ? কিছু না, তাই তো, কেবল চাপ-চাপ অন্ধকার ছাড়া কিছুই নয়। গতরাতের মতো এই মুহূর্তেও নিভে গেছে ঘরের প্রতিটি আলো। আমাদের চোখ বন্ধ, কিন্তু কান খোলা। মিস ক্যারোলিন আমার প্রশ্নের জবাবে যেসব অওয়াজের বর্ণনা দিয়েছিলেন, মনে আছে নিশ্চয়ই, সেগুলো ফের তুমি আমায় শোনাও, কোনোটা বাদ যেন না পড়ে।

ক্যাপ্টেন হেস্টিংস-এর দুটি চোখের পাতা একটির সঙ্গে আর একটি লেপটে আছে। তিনি তখন গভীরভাবে চিন্তা করছেন। তারপর কেটে কেটে জবাব দিলেন–হাঁফানোর আওয়াজ শোনা গেল, কেউ বুঝি হাঁফাচ্ছে।

-বাঃ, দারুণ বলেছ। এরপর? দ্বিতীয় শব্দটা কীসের ছিল?

হেস্টিংস আবার চুপ। পরক্ষণে মাথা নেড়ে বললেন হা, চেয়ার উল্টে পড়ার শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে একটা ধাতব আওয়াজ। মেঝেতে ছোট জিনিসটা ছিটকে পড়েছে বুঝি। আওয়াজটা মেঝেতে চাবি পড়ার আওয়াজের মতোই।

ঠিকই বলেছ, ওটা চাবিরই আওয়াজ ছিল। মিস ক্যারোলিন আর কোন শব্দের কথা বলেছিলেন, বলো।

-এরপর একটা আর্তনাদ শোনা গেল, পরে জানতে পেরেছি, ওটা লুসিয়ার আর্তনাদ, শ্বশুর স্যার ক্লডকে কী যেন বলতে চেয়েছিল। তারপর টোকার আওয়াজ, দরজার বাইরে থেকে। দুঃখিত! প্রথম দিকে মিস ক্যারোলিন ঘরের ভেতর কাপড় ছেঁড়ার আওয়াজ পেয়েছিলেন, বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, বুঝি রেশমি কাপড় কেউ ছিঁড়ছে, অবিকল তেমনই আওয়াজ।

হেসিটংস-এর বলা শেষ, তিনি চোখ খুললেন।

পোয়ারো খুশি– হ্যাঁ, নির্ভুলভাবেই বলেছ, কথা শেষ করে তিনি পায়ে পায়ে ডেস্কের গা ঘেঁষে ফায়ারপ্লেসের একেবারে সামনে এসে দাঁড়ালেন। বিড়বিড়িয়ে বললেন–ওই যে কয়েক মিনিটের আঁধার স্যার ক্লড মারা যাবার আগে তৈরি করেছিলেন, আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি হেস্টিংস, ওই ছোট্ট সময়টুকুর মধ্যেই ফর্মুলা চুরি রহস্যের সমাধানের পথ লুকিয়ে আছে। তবু ঘরের ভেতর আর যাঁরা ছিলেন তারা কিছুই শুনতে পাননি।

হেস্টিংস ঘুরে তাকালেন পোয়ারোর দিকে। দেখলেন, আগুন ধরানোর সুবিধার জন্য কাগজের কুচি আর মোমের খণ্ড খুঁজে রাখা যে বড় ফুলদানিটা ম্যান্টলপিসের ওপর দাঁড় করানো ছিল, সেটা কাত হয়ে একপাশে পড়ে আছে দেখে পোয়ারো যত্নে সেটাকে আগের জায়গায় দাঁড় করিয়েছিলেন।

–ওহ্, তোমার স্বভাব একটুও পাল্টাল না, বন্ধু। হেসিটংস-এর গলায় ভর্ৎসনার সুর।–থাকনা ওটা যেখানে খুশি পড়ে, সামান্য একটা জিনিস, তা নিয়েও মাথা ঘামানোর কী আছে যে বুঝি না। শুধু

হেস্টিংসের কথাগুলো থেমে গেল, পোয়ারোর অস্বাভাবিক তীব্র চাউনি তাকে ভীত করল।

-সামান্য, তাই না? পোয়ারো তাকালেন ফুলদানিটার দিকে, পলকহীন দৃষ্টি, বলে চললেন–আমার খুব ভালোভাবেই মনে আছে, এখানে একটা আওয়াজ হচ্ছিল, প্রায় এক ঘণ্টা আগে, শুনে মনে হয়েছিল, এই ফুলদানির ভেতরের দোমড়ানো কাগজের কুচিগুলো কেউ যেন মুচড়ে সোজা করছে। তাতে ওদের যা হাল হয়েছে তা দেখে মনে হচ্ছে ওগুলো ধরে ধরে দুমড়ে মুচড়ে আবার আগের মতো টান টান করে দিই। পোয়ারোর কণ্ঠস্বর শুনে বোঝা গেল, তিনি অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন।–আচ্ছা, বলোত, এ কাজটা করার ইচ্ছা আমার হল কেন?

-কেন আবার! কাগজগুলো দুমড়ে মুচড়ে আছে, তাই। হেস্টিংস কণ্ঠে সামান্য বিরক্তি ফুটিয়ে বললেন, তোমার যা পিটপিটানি স্বভাব, সব কিছু ঝকঝকে তকতকে না দেখলে চোখে ভালো লাগে না–এটা তারই একটা ছোট্ট উদাহরণ। রেশমি কাপড় ঘেঁড়ার আওয়াজ, না? উল্লাসে ফেটে পড়লেন পোয়ারো। ওটা আসলে কাগজ কুচানোর আওয়াজ। অন্ধকার ঘরে সে রাতে কাগজ ছেঁড়া হয়েছিল, রেশমি কাপড় নয়, অবশ্য দুটো আওয়াজ হুবহু একরকম। কাগজ কুচিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তিনি ম্যান্টলপিস থেকে ফুলদানিটা তুলে নিলেন হেস্টিংস, আবার বলছি, সে রাতে অন্ধকারের মধ্যে মিস ক্যারোলিন অ্যামরি কাগজ ছেঁড়ার আওয়াজই শুনেছিলেন, কাপড় নয়।

পোয়ারো ধীরে ধীরে ম্যান্টলপিসের কাছ থেকে সরে এলেন।

হেস্টিংস আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলেন না, চেয়ার ছেড়ে প্রায় লাফিয়ে এসে দাঁড়ালেন পোয়ারোর সামনে কী ব্যাপার? তুমি হঠাৎ সামনে–কী ব্যাপার? তুমি হঠাৎ এত উত্তেজিত হয়ে পড়লে কেন? ওই ফুলদানির মধ্যে কী রহস্য লুকিয়ে আছে?

পোয়ারো নীরবে ফুলদানিটা হাতে নিয়ে সোফার কাছে চলে এলেন, ফুলদানি উপুড় করে দিলেন। যত কাগজের কুচি ছিল, সব টেনে সোফার ওপর ছড়িয়ে দিলেন। এবার প্রত্যেকটা কাগজের টুকরো টান টান করলেন। তারপর তার মধ্যে থেকে বেছে বেছে তুলে হেস্টিংস-এর হাতে দিতে দিতে বললেন–ধরো, এই নাও আর একটা, হ্যাঁ এই যে আর একটা…..

হেস্টিংস অবাক হয়ে মেলে ধরা কাগজগুলোর দিকে নজর দিলেন, সংক্ষেপে কিছু লেখা সাংকেতিক ভাষা, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলেন। উচ্চারণ করলেন–সি-১৯, এন-২৩, এইচ-২……….. এগুলো কী?

এখনও বুঝলে না? পোয়ারো জোর গলায় বলে উঠলেন–এগুলো স্যার ক্লডের হারিয়ে যাওয়া ফর্মুলার কাগজের টুকরো।

সাবাস পোয়ারো, খুশির দাপটে হেস্টিংস প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন।

–আরে কী করছ! সামলে, দেওয়ালেরও যে কান আছে, ভুলে গেলে? যাক, শেষ পর্যন্ত হদিস মিলল, খানিকটা হাল্কা হলাম এবার কেবল……… হেস্টিংস, দাঁড়িয়ে না থেকে কাগজগুলোকে চটপট যেমন দোমড়ানো মোচড়ানো ছিল, তেমনটি করে ফেলল। তাড়াতাড়ি ফুলদানির মধ্যে ভরে আগের জায়গায় রেখে এসো।

পোয়ারোর নির্দেশ মতো হেস্টিংস কাজ শুরু করলেন।

-আঃ হেস্টিংস, কী হচ্ছে? অত ঢিলেঢালা হলে চলবে না। হাত চালাও, হাত চালাও। আসলে তোমার মনটা যে এখন এদিকে নেই, বুঝতে পারছি, ফিক করে হেসে ঘাড় ঘুরিয়ে বাগানের বাইরেটা দেখিয়ে দিলেন কিছুই অজানা নেই, বন্ধু।

এবার বন্ধুর সাথে পোয়ারোও হাত লাগালেন। দুজনে মিলে ঝটপট সমস্ত কুচানো কাগজ ফুলদানির মধ্যে ভরে ফেললেন। সেটাকে এবার ম্যান্টেলপিসের ওপর রাখলেন, অবশ্য দাঁড় করিয়ে নয়, কাত করে, যেমনটি ছিল আর কী!

হলো একটা বড়ো কাজ! পোয়ারো হাঁফ ছাড়লেন, এবার বলো তো, ওখানে কী রেখে এলাম?

–কী আবার, কুচানো কাগজ আর মোমের টুকরো। তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন হেস্টিংস।

উঁহু, হলো না, পোয়ারো সামান্য হাসলেন, খানিকটা পনির, বুঝলে, পনির রেখে এলাম।

–মানে!

–হ্যাঁ, বন্ধু, কেবল পনির।

-কী সব অবোল-তাবোল বকছ, হেস্টিংস অবাক হলেন, তোমার মাথা বিগড়ে গেল নাকি?

পোয়ারো এসব ব্যঙ্গ বিদ্রুপে কান না দিয়ে নিজের মনে বলে চললেন, পনির আমরা খাই, এছাড়া গৃহস্থের আর কোন কাজে লাগে, জানো? একটু থামলেন, ইঁদুর ধরার কাজে। ইঁদুর ধরার ফলে সামান্য পৰির রেখে দিলেই হল, লোভে লোভে ইঁদুর এসে ঢুকবে ওই কলে, তখনই কলে টান, ব্যাল বন্ধ, বেরোবার পথ নেই। আমিও তেমনই ফাঁদ পেতেছি, অবশ্য পনির নয়, খাদ্য ওই কাগজ কুচানো। এবার আমাদের অপেক্ষা করতে হবে, যতক্ষণ না ইঁদুর বাবাজী আসছে ততক্ষণ চুপ করে থাকতে হবে।

কিন্তু ইঁদুর কখন আসবে, তা জানো?

-জানি বৈকি, পনিররূপী ওই কাগজছেঁড়া খেতে তাকে আসতেই হবে, পোয়ারো বললেন, তাকে আসার জন্য খবর পাঠিয়েছি, সবুর করতে হবে না তোমায়। ওই এল বুঝি!

ঠিক এসময় বসার ঘরের দরজা বাইরে থেকে খুলে গেল। ভেতরে পা রাখল এডওয়ার্ড রেনর।

-আশ্চর্য, আপনারা এখানে বসে আছেন মঁসিয়ে পোয়ারো। দিব্যি গল্পগুজব করছেন, আর ইন্সপেক্টার জ্যাপ আপনাদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন। উনি ওপরে আছেন, আমাকে পাঠালেন। চলুন, এক্ষুনি ডাকছেন।

এডওয়ার্ড রেনর চিৎকার করে কথাগুলো বলল।

.

১৪.

-ইস, কী বিশ্রী ব্যাপার বলুন তো, পোয়ারো মোলায়েম সুরে বলতে থাকলেন, ইন্সপেক্টার জ্যাপ আমাদের জন্য সারা বাড়ি তোলপাড় করছেন, আর আমরা কিনা…… চলুন, যাচ্ছি।

ওঁরা তিনজনে দরজার কাছে এলেন। হঠাৎ পোয়ারো ঘাড় ঘুরিয়ে রেনরের কাছে জানতে চাইলেন–ডঃ কারোলির সঙ্গে আজ সকালে কি আপনার দেখা হয়েছে?

নিশ্চয়ই, দেখা হয়েছে, রেনর খুশি মনে জবাব দিলেন–এখানেই ওঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। উনি টেলিফোন করতে এ ঘরে এসেছিলেন।

–আচ্ছা মি. রেনর, ডঃ কারোলি কি তখন টেলিফোনে কথা বলছিলেন, মানে আমি বলতে চাইছি, ওনাকে ফোন করতে আপনি দেখেছেন কিনা?

-না, মঁসিয়ে পোয়ারো, কী যেন রেনর ভাবলেন, ওনাকে স্যার ক্লডের স্টাডিতে ঢুকতে দেখেছিলাম। আমাকে এঘরে আসতে দেখে উনি বেরিয়ে এসেছিলেন।

কথা বলতে বলতে রেনর ফায়ারপ্লেসের ধারে এসে দাঁড়ালেন।

পোয়ারো প্রশ্ন করলেন–আপনি ওই সময় এঘরের কোন অবস্থানে ছিলেন?

–আমি? এখানে, যেখানে এখন দেখছেন, সেখানেই আমার অবস্থান ছিল।

–টেলিফোনে ডঃ কারোলির কোনো কথা শুনতে পেয়েছিলেন কি?

–না, ঘাড় নাড়লেন রেনর। উনি যে আমার সামনে কথা বলতে চান না, সেটা বুঝেই আমি সরে এসে এখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম।

-বুঝলাম। কী মনে করে পোয়ারো পকেট থেকে তার ছোট্ট নোট বই আর পেন্সিল বের করলেন। খসখস করে কী সব লিখলেন। উপস্থিত দু’জনের দিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে নিলেন। পাতাটা ছিঁড়ে ভাঁজ করে হেস্টিংস-এর হাতে দিলেন, বললেন হেস্টিংস, তুমি এটা নিয়ে ইন্সপেক্টার জ্যাপের হাতে দাও। তাকে বলল, আমি না যাওয়া পর্যন্ত যেন ঠাণ্ডা হয়ে থাকেন। খানিক বাদেই আমি যাচ্ছি।

পোয়ারোর নির্দেশ মাথায় করে ভাঁজ করা কাগজটা হাতে নিয়ে ক্যাপ্টেন হেস্টিংস ঘর থেকে বিদায় নিলেন।

রেনর কৌতূহল আর চেপে রাখতে না পেরে জানতে চাইলেন–কাগজে কী লিখলেন, মঁসিয়ে পোয়ারো, বলবেন কি?

-কেন নয়? নিশ্চয়ই বলব। স্বস্থানে নোটবই আর পেন্সিল ঢুকিয়ে দিতে দিতে পোয়ারো বললেন ওতে লিখেছি, জ্যাপ, খানিক বাদেই হয়তো স্যার ক্লডের হত্যাকারীর নাম জানতে পারব।

পোয়ারো থামলেন, রেনরের আপাদমস্তক কঠিন দৃষ্টিতে জরিপ করলেন, বোঝা গেল রেনর তার ব্যক্তিত্বের কাছে চুপসে গেছেন।

পোয়ারো রসিয়ে রসিয়ে বললেন– হ্যাঁ, মঁসিয়ে রেনর, মনে হচ্ছে এতদিনে সেই খুশির নাম আমি জানতে পেরেছি। অবশ্য এর জন্য বাহবা দিতে হয় কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনাকে। জানেন, লর্ড এডগোঁয়ারের খুনের ঘটনাটাও আচমকাই মনে পড়ে গেল, যা স্যার ক্লডের মৃত্যুর রহস্য সমাধানে আমায় সাহায্য করেছে। লর্ড এডগোঁয়ারকে খুন করে লোকটা পাকাল মাছের মতো পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। আসলে অপরাধী কাজে ছিল অলস, কিন্তু মাথাটা ছিল ধূর্তামিতে ভরা। এই আমি, আমি এরকুল পোয়ারো প্রায় ওর কাছে হারতে বসেছিলাম, শেষ পর্যন্ত জিত আমারই হল। মঁসিয়ে রেনর, আপনি কি জানেন, যাকে আমরা সহজ সরল নিরীহ গোবেচারা বলে মনে করি, সেই ধরনের অপরাধীর সংখ্যা বেশি। অপরাধ করে ভালো মানুষের মতো চুপচাপ এড়িয়ে এড়িয়ে চলে। সেদিক থেকে বলতে পারি, সার ক্লডের আসল খুনি বলে আমার সন্দেহ, সেও বিদ্বান এবং বুদ্ধিমান। তবে নিজের ওপর অত্যন্ত আত্মবিশ্বাস। এর তাড়নায় সর্বদা অস্থির থাকে। কী করব, কী করব, এমন একটা ভাব। হাতের কাছে কাজ না পেলে, লিলিফুলের ছবি আঁকতে বসে যায়।

পোয়ারো থামলেন। তিনি কৌতুক ও আনন্দ বোধ করলেন, কিন্তু প্রকাশ করলেন না, কেবল তা ধরা পড়ল তার বুদ্ধিদীপ্ত দুটি চোখে।

-মঁসিয়ে পোয়ারো, রেনর সামান্য এগিয়ে এলেন, ফিসফিসিয়ে বললেন, আপনি কী বলছেন বুঝতে পারছি না। তাহলে কী মিসেস লুসিয়া অ্যামরি তার শ্বশুরকে খুন করেন নি?

-একদমই নয়, পোয়ারো হাত তুলে তাকে আশ্বস্ত করে বললেন–আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, তাছাড়া ইন্সপেক্টার জ্যাপকে ওই কাগজে লিখে জানিয়েছি, মিসেস লুসিয়া স্যার ক্লডের খুশি নন। ভদ্রমহিলার অতীত আমার অজানা নয়। বহু দুঃখ কষ্ট সয়েছেন। তাই অকারণে সন্দেহের বশে ওঁকে হয়রানি করা যুক্তিযুক্ত বলে মনে করি না।

-তাহলে কাকে আপনি আসল খুনী বলছেন? কে সে? ভেবেচিন্তে রেনর নিজেই বললেন–হ্যাঁ, আমি হলফ করে বলতে পারি, ওই ইটালিয়ান ডঃ কারোলিই খুনী। কী, ঠিক বলেছি?

পোয়ারো তার উৎসাহের গোড়ায় জল দিয়ে বললেন–দুঃখিত মঁসিয়ে রেনর–আমি একজন গোয়েন্দা, পেশাগত স্বার্থে কিছু কিছু নীতি কঠোর ভাবে পালন করতে হয়। তাই বলছি, ধৈর্য ধরুন, শেষ মুহূর্তে দেখুন না কী হয়। এ ব্যাপারে আর কোনো প্রশ্ন করা আমি পছন্দ করছি না।

তারপরেই বিষয়ান্তরে চলে গেলেন। পকেট থেকে সাদা রুমাল বের করলেন কপালের ঘাম মুছলেন আর আপনমনে বলে উঠলেন–কী বিশ্রী গরমরে বাবা, অসহ্য!

সত্যিই গরমটা আজ বেশিই পড়েছে। রেনর ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন–দাঁড়ান, একটু হুইস্কির ব্যবস্থা করি। সঙ্গে সোডা। শরীর ঠাণ্ডা হবে। সবকিছু হাতের সামনেই আছে। কথাটা অবশ্য আমার আগেই বলা উচিত, কী করে ভুল করলাম, লজ্জা করছে। যাক, আমি আসছি।

–আপনার মতো দরাজ মনের মানুষরাই তো খাওয়াতে চান। যান, আমার আপত্তি নেই।

-বেশি সময় নেব না, এই এলাম বলে।

 রেনর দ্রুত পায়ে স্টাডিতে অদৃশ্য হলে পোয়ারো দুলকি চালে পায়ে পায়ে চলে এলেন খোলা জানালার সামনে। বাইরের দিকে তাকালেন, কী যেন চিন্তা করলেন, কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল। আবার ধীরপায়ে চলে এলেন সোফার পাশে, গদিগুলো ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলেন। তারপরেই ম্যান্টলপিসের সামনে এসে পড়লেন, এক পাশে সাজিয়ে রাখা হয়েছে দুটো অ্যান্টিক। তিনি হাতে তুলে নিলেন, বেশ দামি, খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন।

এমন সময় রেনর দুই গ্লাস হুইস্কি ট্রে-তে সাজিয়ে স্টাডির দরজায় এসে দাঁড়ালেন। দেখতে পেলেন পোয়ারো কী যেন মন দিয়ে পরীক্ষা করছেন। তিনি পোয়ারোর কাছাকাছি এলেন, অবশ্য তফাত বজায় রেখে।

–এটা বেশ দামি, তাই না? পোয়ারো ঘর সাজাবার একটা জগ হাতে তুলে নিলেন, খুব সেকেলে বলে মনে হচ্ছে।

–আপনার তাই মনে হচ্ছে? রেনর জবাব দিলেন আসলে কী জানেন, এসব প্রাচীন জিনিস সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। আসুন, আমরা পান করি।

রেনর হাতে ধরা ট্রে-টা ছোট টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন।

–অশেষ ধন্যবাদ, মঁসিয়ে রেনর। পোয়ারো চেয়ারে গা ছেড়ে দিলেন, টেবিল থেকে একটা গ্লাস তুলে নিলেন।

–আপনার শুভেচ্ছা কামনা করি, মঁসিয়ে পোয়ারো। রেনর অন্য গ্লাসটা হাতে নিলেন, কয়েক চুমুকে সবটা শেষ হয়ে গেল।

–আমার তরফ থেকে আপনাকে জানাই শুভেচ্ছা, বন্ধু, ওয়াইনের গ্লাসে হালকা চুমুক দিলেন, বললেন–হ্যাঁ, তখন যেন আপনি কী জানতে চাইছিলেন? আমি কাকে খুনি হিসাবে সন্দেহ করছি, তার কথা, তাই না? হঠাৎই আমার অন্তদৃষ্টি খুলে গেল জানেন, আমি উপলব্ধি করলাম যে

এই পর্যন্ত বলে কথা থামিয়ে দিয়ে পোয়ারো মাথাটা সামান্য ঝাঁকুনি দিলেন, ঘাড় তুলে কী যেন শোনার চেষ্টা করলেন, পরক্ষণে ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরলেন। বোঝাতে চাইলেন, ঘরের বাইরে কেউ পাত পেতেছে, অতএব চুপ।

পোয়ারো এবার নিঃশব্দে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। পা বাড়ালেন। রেনর উঠতে গিয়ে বাধা পেলেন। পোয়ারো তাকে ওইখানে বসে থাকতে বললেন হাত নেড়ে। তারপর টু শব্দটি না করে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। কাউকে কিছু টের পেতে না দিয়ে দরজার হাতল ধরে হ্যাঁচকা টান মারলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এলেন–কিন্তু, কে কোথায়? সব ফাঁকা।

পোয়ারো বিড়বিড় করলেন ভোজবাজি আর কী!

হতাশার চাউনি মেলে এদিক ওদিক তাকালেন। তিনি আবার যথারীতি ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজার পাল্লা ভেজিয়ে দিলেন।

চেয়ারে বসতে বসতে বললেন–সত্যি বলছি, কার যেন হাঁফের অওয়াজ কানে এল, বিশ্বাস করুন, দরজার বাইরেই সে দাঁড়িয়েছিল। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। দেখছি, আমার নিজেরই শোনার ভুল। তবে আমরা, গোয়েন্দারা, এই ধরনের ভুল শোনার ঘটনাকেই একটা বড় ঘটনা হিসাবে গণ্য করি।

–পোয়ারো কথা শেষ করে গ্লাসে আবার চুমুক দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্লাস ফাঁকা।

-আঃ, কী আরাম সত্যি স্বস্তি হল।

–মাফ করবেন মঁসিয়ে রেনর, স্বস্তি হল বললেন কেন বলুন তো?

–না না, তেমন কিছু নয়, বাইরে সন্দেহজনক কাউকে খুঁজে পেলেন না, ফলে মন থেকে দুশ্চিন্তার একটা পাথর সরে গেল, তাই স্বস্তি হল আর কী।

–সত্যি বলতে দোষ কী, বলুন মঁসিয়ে রেনর। হুইস্কি শূন্য গ্লাসটা টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে পোয়ারো বললেন আপনারা মানে ইংরেজরা হুইস্কিই বেশি পছন্দ করেন, বলা হয় এই আপনাদের জাতীয় পানীয়। কিন্তু আমি? চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বেশ কতগুলো বছর আগে, সেই থেকে লন্ডনেই বসবাস, অথচ-এখনও পর্যন্ত হুইস্কিকে আমার বন্ধু বলে জানতে পারলাম কই? এর কারণ আমার জানা নেই। তার ওপর আপনার বানানো এই তরল পানীয় একেবারে তেতো বিষ বুঝতে পারছি না হুইস্কিটা তেতো লাগল কেন?

-তেতো! রেনর বিস্ময় ভরা কণ্ঠে জানতে চাইলেন, আপনি কি আমার সঙ্গে মজা করছেন। তারপর তাকিয়ে রইলেন পোয়ারোর দিকে, প্রখর সে দৃষ্টি। বললেন–কিন্তু আমিও তো একই ড্রিংস নিলাম। আমার ছিটেফোঁটাও তেতো লাগল না। ছাড়ুন ওসব, কাজের কথায় আসুন, তখন কী যেন বলতে বলতে থেমে গেলেন, মনে পড়ছে?

-বলেছিলাম বুঝি। পোয়ারো অবাক হয়ে জানতে চাইলেন–ব্যাপারটা মনে পড়ছে না, মঁসিয়ে রেনর। সত্যি, এই সামান্য সময়ের মধ্যে বুঝি আসল কথাটাই ভুলে গেলেন। মনে হচ্ছে, কোনো এক সময় একটা রহস্য সমাধান করতে কীভাবে তদন্ত করেছিলাম, সেই গল্পই বোধহয় আপনাকে বলতে চেয়েছিলাম। অপরাধীর বিরুদ্ধে একটা প্রমাণ পেলেই হল। তারপর সব প্রমাণ গুলি একটা অন্যটার হাত ধরাধরি করে পাশাপাশি এসে দাঁড়ায়। এভাবেই রহস্য সমাধানের পথ হয় প্রশস্ত। এরপরে যা হাতে আসে, তা আগের প্রমাণের চেয়ে তুচ্ছ, নগণ্য। অন্যদের সঙ্গে খাপ খায় না। ফলে বড় বড় প্রমাণ সাজিয়ে গুছিয়ে যে শেকল তৈরি করা হল, তা গেল কেটে। তাই বলে আমরা কি তদন্তের কাজ থামিয়ে দেব? আবার নতুন করে শুরু হয় অনুসন্ধানের কাজ, খানা-তল্লাসি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা। যে প্রমাণ নগণ্য বলে সরিয়ে রাখা হয়, তার মাধ্যমেই মস্ত এক অপরাধমূলক রহস্যের দ্বার খোলার চাবিকাঠি পেয়ে যাই। অদ্ভুত ভঙ্গিতে পোয়ারো মুচকি হাসলেন, নিজের টাক মাথায় টোকা মেরে বললেন–এটা বড় ভয়ঙ্কর আর অতুলনীয়।

–হুঁ, তেমনটিই দেখছি পোয়ারোর কথার গভীরতা বুঝতে না পারায় রেনর বোকার মতো তার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

–আমার মুখের দিকে ওভাবে তাকিয়ে কী দেখছেন, মঁসিয়ে রেনর। আচমকা ডান হাতের তর্জনী দিয়ে রেনরের গালে একটা খোঁচা মারলেন পোয়ারো। রেনর দ্রুত হাতে মুখ ঢাকলেন, চেয়ার থেকে পড়ে যেতে যেতে রক্ষা পেলেন।

যে গোয়েন্দা ছোট খাট ঘটনাকে উড়িয়ে দেন, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন, ওইসব নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন মনে করেন না, তাদের বরাত অত্যন্ত বাজে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আমি ওই দলভুক্ত নই। প্রমাণ যত নগণ্য হোক না কেন, রহস্য সমাধানে তারও একটা ভূমিকা আছে মানতেই হবে। ফলে ছোট বড়োর মধ্যে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। সবকিছুর মধ্যেই সামান্য হলেও সত্য লুকোনো আছে, গোয়েন্দাকে তা খুঁজে বের করতে হয়।

পোয়ারো চুপ করলেন, নিজের ঝাঁ-চকচকে টাকে হাত বুলোলেন। তারপর বললেন হ্যাঁ, কী নিয়ে যেন আপনার সঙ্গে কথা বলছিলাম বলুন তো, তুচ্ছ প্রমাণ, তাই না? আমিও আপনাকে এক গুরুত্বহীন তুচ্ছ প্রমাণের কথাই বলছি, তা হল ধুলোময়লা!

-ধুলোময়লা! ব্যাস, আর কিছু নয়? রেনর না বুঝে সামান্য হাসলেন।

–হ্যাঁ, মশাই, তাই। পোয়ারো সামান্য হাসলেন আমার বন্ধু ও সহকারী ক্যাপ্টেন হেস্টিংস-এর কথা বলছি। অত্যন্ত করিত্বৰ্মা মানুষ। সব ব্যাপারে আমাকে মনে করিয়ে দেওয়াই ওঁর কাজ। ওঁর কথাতেই আমি উপলিব্ধ করলাম, হ্যাঁ, সত্যিই তো, আমি একজন গোয়েন্দা, এ বাড়ির চাকর নই। কথাটা বন্ধুবর কোন উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, জানি না, তবে আমার উপকারে লেগেছে।

আপাতদৃষ্টিতে বাড়ির কাজের লোক, সে চাকর বা ঝি, যাই হোক না কেন, তার কাজ কী? বাড়ির সমস্ত ঘর সাফ করা। ঘরের যেখানে আলো পৌঁছোয় না, ধুলোময়লা ঘাপটি মেরে পড়ে আছে, সেগুলো ঝাঁটা দিয়ে ঝেটিয়ে পরিষ্কার করে। মঁসিয়ে রেনর, মানছি আমি আপনার থেকে বয়সে বড়ো, কিন্তু শিক্ষা? তাও যথেষ্ট আছে। আপনার সাধারণ জ্ঞানও কিছু কম আছে বলে মনে করি না। আপনিই বলুন, গোয়েন্দাও কি চাকরের মতো কাজ করছেন না?

পোয়ারোর বকবকানি শুনে রেনরের জ্বরু দুটো কুঁচকে গেল, মুখে একরাশ বিরক্তি, অবশ্য তা প্রকাশ্যে নয়। কোনোরকমে মাঝে মাঝে বলছেন, হ্যাঁ, তাই তো, মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার বক্তব্যকে আমি সমর্থন করি।

রেনর বুঝি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারছেন না। তিনি পোয়ারোর কাছাকাছি হবার জন্য নিজের চেয়ারটা টেনে নিয়ে এলেন। ক্ষিপ্ত কণ্ঠস্বরে বললেন আপনি সেই থেকে কীসব বকে চলেছেন বলুন তো! অর্থহীন কিছু সংলাপ। আপনি কি এসব ছাইপাশ শোনাতেই চেয়েছিলেন? এক গ্লাস হুইস্কি পেটে পড়তে না পড়তেই হাবিজাবি বকতে শুরু করে দিলেন?

নেশা আমার একটুও হয়নি, মঁসিয়ে রেনর। পোয়ারো পিঠ টান করে বসলেন–এখনও পর্যন্ত যা কিছু আপনাকে বলেছি, সুস্থ মস্তিষ্কেই বলেছি। হ্যাঁ, আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল ধুলো ময়লা। শুরু করেছি বটে শেষ করা হয়নি। আপনি কিন্তু আমার চোখে ধুলো দিতে পারেননি, অবশ্য ধুলো থাকলে তো দেবেন। পোয়ারোর মাথাটা সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে পড়ল–কী, বুঝতে পেরেছেন? অবশ্য মগজে যদি ঘিলু থাকে।

-না, রেনরের বিরক্তির মাত্রা তখন ধীরে ধীরে বাড়ছে। ভনিতা না করে স্পষ্ট করে বলুন, দয়া করে।

বেশ, তাই বলছি। পোয়ারো হাত তুলে রেনরকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললেন ধুলোময়লা মাদমোয়াজেল বারবারার কথা। শব্দটা আমার মনে দারুণ ভাবে রেখাপাত করে। ওষুধের টিনের বাক্সের ঢাকনায় কোনো ময়লা নেই, অথচ বাক্সটা যার ওপর রাখা হয়েছে, মানে শেল্টা ধুলোতে ঢাকা। বুঝতে আমার দেরি হল না যে ……পোয়ারো চুপ করলেন।

–কী হল, থেমে গেলেন কেন? শেষ করুন।

–বুঝতে দেরি হল না যে, কয়েকদিন আগে ওই ওষুধের বাক্সটা কেউ নীচে নামিয়ে ছিল। ওই সময় স্যার ক্লডের খুনি প্রয়োজন মতো বিষ সরিয়ে রেখেছিল, ফলে ওনাকে খুন করার সময় তাকে আর ওই বাক্সের আশে-পাশে যেতে হয়নি। আর খুনী এই কাজটা করেছিল, সকলের অগোচরে। মঁসিয়ে রেনর, আপনি আপত্তি করলে কী হবে, আমি নিশ্চিত, আপনিই আগে থেকে হিসকোসিন গোপন কোনো জায়গায় সরিয়ে রেখেছিলেন। মঁসিয়ে রিচার্ড কফির কাপ নিয়ে স্টাডিতে ঢুকেছিলেন, এটা ঠিক, কিন্তু আপনি ওই কাপে আগেই বিষ মিশিয়ে দিয়েছিলেন, তারপরে বারবারার সঙ্গে নাচতে চলে যান। আমি ভেবেছিলাম, আপনার এই কুকর্মটি কারো চোখে ধরা পড়েনি, ভুল ধারণা। মাদাম লুসিয়া স্পষ্ট দেখেছিলেন।

-ওঃ ভগবান! রেনর ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ বটে, কিন্তু ঠোঁটে সামান্য হাসি টেনে বললেন–স্যার ক্লডের হত্যাকারী হিসাবে আপনি শেষ পর্যন্ত আমাকেই দোষী সাব্যস্ত করছেন, মঁসিয়ে পোয়ারো। সত্যিই, হুইস্কির নেশা আপনাকে পেয়ে বসেছে দেখছি।

–বেশ, আপনার কথাই সই, কিন্তু আপনি! আপনি তো দিব্যি সুস্থ মাথায় কথা বলছেন। তাহলে আপনি বলুন, আপনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সত্যি, না মিথ্যে?

-না না, একেবারেই মিথ্যে নয়। রেনর রাগে ফেটে পড়লেন। গলা চড়িয়ে বললেন–এ অভিযোগ আমি মেনে নিচ্ছি। এর জন্য মাথা হেঁট? কখনো না। বরং আমি গর্বিত। সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে কত স্বচ্ছ ও সুন্দরভাবে কাজ করতে পেরেছি বলে। শেষ মুহূর্তে, মানে মারা যাবার আগে স্যার ক্লড কী মনে করে সিন্দুকটা খুলে দেখলেন, খাম নেই। যখন তখন সিন্দুক খোলা ওঁর অভ্যাস ছিল না। অথচ সে রাতে….. জানি না। কেন।

-কিন্তু… কিন্তু, পোয়ারো জড়িয়ে জড়িয়ে বললেন–এসব আমাকে শোনাচ্ছেন কেন?

কেন নয়? আপনি আমার পরম সুহৃদ, সহানুভূতিশীল নির্ভেজাল ভদ্রলোক, রেনরের ঠোঁটে কৃতিত্বের হাসি বিশ্বাস করুন, মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার মতো মানুষদের সাথে মন খুলে কথা বলতে ইচ্ছে করে। এ হল এক ব্যর্থতাকে সাফল্যে পরিণত করার প্রয়াস মাত্র, অবশেষে সফলতা পেয়েছি। এর জন্য আমি আনন্দিত ও গর্বিত। ভেবে দেখুন, জিনিসটা লুকিয়ে রাখতে হবে, কিন্তু ভাবনা চিন্তা করার মতো সময় নেই। পলকের মধ্যে জায়গাটা বের করলাম, মাথায় কতখানি বুদ্ধি থাকলে তবেই এমনটি সম্ভব বলুন। যাই বলুন না কেন মঁসিয়ে পোয়ারো, নিজেকেই নিজে বাহবা দিচ্ছি। যাক, ওসব কথা, এবার ওই খোয়া যাওয়া ফর্মুলাটার হদিস আপনাকে দিতে হবে, তাই তো।

কিন্তু পোয়ারো তখন আর স্বাভাবিকত্ব বজায় রাখতে পারছেন না, মাথা সোজা রেখে বসার চেষ্টা করছেন, কিন্তু পারছেন কই। ঝিমিয়ে পড়ছেন, কথাগুলো মুখের ভেতরেই রয়ে যাচ্ছে, কিছু কিছু বেরোচ্ছে, কিন্তু স্পষ্ট নয়।

তাও কোনোরকমে বললেন –মঁসিয়ে রেনর, কী হল বলুন তো? বুঝতে পারছি না।

কী যে করি, তাও মাথায় আসছে না।

আপনার কিছু করার নেই, মঁসিয়ে রেনর, সত্যি বলছি। রেনরের ঠোঁটে শেয়ালের ধূর্ত হাসি খেলে গেল। গোড়াতেই আপনি একটা ছোট ভুল করেছিলেন। আমার বুদ্ধিকে আমল না দেওয়ার ভুল। এ পর্যন্ত আমার বুদ্ধিকে সর্বদা নস্যাৎ করে দিয়েছেন আপনি। সকলের সন্দেহের নজর গিয়ে পড়ল ওই ছাঁচড়া ইটালিয়ানটার ওপর–যার চাল নেই, চুলো নেই। পেটের ধান্দায় যে একে-ওকে ব্ল্যাকমেল করে বেড়ায়। ওই জোচ্চোরটাই যে এ বাড়িতে ঢুকেছিল ফর্মুলা চুরি করতে, আর ওই স্যার ক্লডকে খুন করেছে এ ভাবনা আপনার মতো বুদ্ধিমান লোকের মাথায় কী করে এল, ভেবে হাসি পাচ্ছে। দূর, দূর, আপনাকে এসব কথা বললে কী হবে, কানে তো কিছুই যাচ্ছে না। মশাই, আমি বড়ো গাছে নৌকা বাঁধতে ভালোবাসি। ছোট্ট একটুকরো কাগজ, অথচ কত মূল্যবান। নেবার জন্য খদ্দেরটা বসে আছে। পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার পাউন্ড অনায়াসে পকেটে আসবে। অত অর্থ! কী করব বলুন তো? ধারণা করতে পারেন?

–ধারণা…… আমি ……..না, পারছি না।

–না পারাটাই স্বাভাবিক। কারণ সকলের দেখার চোখ এক নয়। প্রবল আত্মবিশ্বাসের সুরে রেনর বললেন।

-আপনি যতই আমার তারিফ করুন না কেন, আপনাকে আমি কিন্তু ছাড়ছি না, শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে পোয়ারো ধীরে ধীরে বললেন–সবার সামনে আপনার ভালো মানুষের মুখোশটা খুলে দেব, আমি এরকুল পোয়ারো বলছি।

পোয়ারোর মুখ দিয়ে আর কথা বেরোল না, তিনি শরীরটাকে এলিয়ে দিলেন চেয়ারের গায়ে।

–এসব করার সময় আর আপনি পাবেন না মঁসিয়ে পোয়ারো। করুণা ও অবজ্ঞা মিশ্রিত হাসিতে মুখ ভরিয়ে এডওয়ার্ড রেনর বলে চললেন–তার আগে হুইস্কি কেন তেতো লাগল, সে ইতিহাস শুনে যাবেন না? আপনার অত বড়ো মাথাটা কেন যে এর কারণটা আবিষ্কার করতে পারল না, বুঝতে পারছি না। যাক সে কথা। মারা যাবার আগে স্যার ক্লডও কফি খেয়ে বড় তেতো লাগছে বলেছিলেন, এখবর আপনার অজানা নয়, মঁসিয়ে পোয়ারো আপনি ঠিকই ধরেছেন, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, এবাড়িতে আপনি ঢোকার অনেক আগেই সরিয়ে রেখেছিলাম হিসকোসিনের বেশ কয়েকটা শিশি। স্যার ক্লডকে কফিতে যতটুকু ঢেলেছিলাম, মনে হয় আপনার বেলায় তার পরিমাণ বেশি পড়ে গেছে। তাই ফলটাও তাড়াতাড়ি দিচ্ছে। ভালোই হল, আমি তারিয়ে তারিয়ে দেখছি, আপনি কেমন ধীরে ধীরে নির্জীব হয়ে যাচ্ছেন। তবে যন্ত্রণা নেই বলুন, কেমন ঘুমের রাজ্যে চলে যাচ্ছেন। না, কোনো স্বপ্ন পর্যন্ত দেখতে পাবেন না। সব দুঃস্বপ্ন হয়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে আপনার মৃত্যুর সাথে।

-মঁসিয়ে রেনর, থামুন, আপনিই তা হলে……. হেস….টিং…স…..হে-স….

এরকুল পোয়ারো আর কিছু বলতে পারলেন না, দু চোখ বুজে ঢলে পড়লেন।

-ও মশাই, এত তাড়াতাড়ি চোখ বুজলে তো চলবে না। রেনর এগিয়ে এসে পোয়ারোকে ঠেলা দিলেন-নিন, নিন, চোখ খুলুন, জোর করে চোখের পাতা টেনে থাকুন। মরার আগে সেই গুপ্ত জায়গাটার খবর জেনে নি, যেখানে ফর্মুলাটা লুকোনো ছিল।

রেনর আবার তাকালেন পোয়ারোর দিকে, তারপর ফায়ার প্লেসের কাছে চলে এলেন, ম্যান্টেলপিসে রাখা ফুলদানিটা তুলে নিলেন। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে কাগজের টুকরোগুলো বের করলেন। তাড়াতাড়ি সেগুলো জ্যাকেটের ভেতরের পকেটে ঢুকিয়ে দিলেন। তাকালেন পোয়ারোর দিকে। বললেন–কাজ শেষ, চলি মি. এরকুল পোয়ারো।

খোলা ফ্রেঞ্চ উইন্ডো লক্ষ্য করে এডওয়ার্ড রেনর এগিয়ে গেলেন। উদ্দেশ্য জানলা গলিয়ে পগার পার হবেন।

কিন্তু তা আর সম্ভব হল না।

–এ কী! কোথায় চললেন? খামটা নিয়ে যান, যার মধ্যে ফর্মুলাটা ছিল।

পোয়ারোর স্বাভাবিক গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনে রেনর চমকে উঠে ঘাড় ফেরালেন। ঠিক এই সময় বাগান থেকে জানলা টপকে ভেতরে এসে ঢুকলেন ইন্সপেক্টর জ্যাপ, সঙ্গে তার কনস্টেবল জনসন।

রেনর ক্ষণিকের জন্য ঘাবড়ে গেলেও পরক্ষণে পালাবার জন্য জানলার দিকে ছুটে গেলেন। জানলা দিয়ে লাফ দেবার আগেই কনস্টেবল তাকে জাপটে ধরল, হেঁচড়ে হেঁচড়ে নিয়ে এল ঘরের মাঝখানে।

-ধন্যবাদ, জ্যাপ, ঠিক সময়ে তুমি এসে পড়েছ। পোয়ারো গলা খাঁকারি দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। শরীরটাকে এপাশ-ওপাশ করে সহজ করলেন–আর সামান্যতম দেরি হলে ওই মহাগুরু জানলা টপকে বাগান পেরিয়ে নাগালের বাইরে চলে যেত। সত্যি, মোক্ষম সময়ে তুমি এসেছ।

জানলার বাইরের বারান্দায় দাঁড়ালে ঘরের সব কথাবার্তা শোনা যায়, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস-এর কাছে তোমার পাঠানো চিরকুটটা পেয়ে আমি জনসনকে নিয়ে ওখানেই অপেক্ষা করছিলাম, আর তোমাদের কথা চালাচালি শুনছিলাম, একেবারে স্পষ্ট। আগে ওর পকেটটা দেখি, কী আছে?

জ্যাপ হাত ঢুকিয়ে দিলেন রেনরের জ্যাকেটের পকেটে। বেরিয়ে এল কতগুলো টুকরো কাগজ। সেগুলো কফি টেবিলের ওপর রাখলেন। তার আর এক পকেট থেকে পাওয়া গেল হিসকোসিনের লেবেল আঁটা টিউব। বললেন–এটা দেখুন, মঁসিয়ে পোয়ারো, একটা বড়িও নেই।

এইসময় জানলা দিয়ে ভেতরে এসে ঢুকলেন ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, তার হাতে সোড়া মেশানো হুইস্কির গ্লাস। তিনি সরাসরি তাকালেন রেনরের দিকে। তারপর গ্লাসটা এগিয়ে দিলেন পোয়ায়োর হাতে।

-মঁসিয়ে রেনর, মদের গ্লাসটা অন্য টেবিলে রেখে পোয়ারো বললেন, আপনি যে নাটক শুরু করেছিলেন, তাতে আমায় কুশীলব বানাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু দুঃখিত, আমার নাটকে আপনি একক অভিনয় করে হাত তালি কুড়িয়ে নিলেন। জ্যাপকে আমি চিরকুটটা লিখে হেস্টিংস এর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। এবার ভীষণ গরম লাগছে বলে ভণিতা করে আপনাকে খেলতে নামিয়ে দিলাম। আসলে আপনার গ্যাড়াকলটা আমার বুঝতে বাকি ছিল না। তাই টোপ ফেলতে হল। হেস্টিংস জনালার বাইরে দাঁড়িয়েছিল। ও এক গ্লাস হুইস্কি ওপর থেকে নিয়ে এসেছিল। আপনার চোখকে ধুলো দিয়ে আপনার আনা ট্রে থেকে গ্লাস তুলে হেস্টিংস-এর সঙ্গে পালটাপালটি করে নিলাম। ব্যাস নাটক জমে উঠল, অবশেষে যবনিকা পড়ে গেল।

-যে বিষ কফির সাথে মিশিয়ে উনি নিজের মনিব স্যার ক্লডকে হত্যা করেছেন, সেই একই বিষ আপনার হুইস্কিতে মিশিয়ে দিয়েছিলেন, আপনাকে খুন করার জন্য। ওই হুইস্কির গ্লাস ফরেনসিকে পাঠালেই সব জানা যাবে। জ্যাপ বলে চললেন–ফাঁসির দড়ি গলায় ওঁকে পড়তেই হবে। এমন কোনো জাঁদরেল উকিল নেই, যে ওঁকে বাঁচাতে পারে।

রেনর এতক্ষণ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিলেন। এবার চোখ তুললেন, তাকালেন জ্যাপের দিকে। তারপর দৃষ্টি ঘুরে এল পোয়ারোর কাছে। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে কেটে কেটে বললেন–জানেন, জবরদস্ত পরিকল্পনা করেছিলাম, ধাপে ধাপে বেশ এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আপনাকে এ বাড়িতে দেখে সব কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল। এক অজানা ভয় আমায় জাপটে ধরল। ভেবেছিলাম, ওই ফর্মুলাটা হাতিয়ে নিয়ে বেচে দেব। নিদেনপক্ষে ষাট হাজার পাউন্ড তো পেতাম। তারপরে সুন্দর একটা জীবন, তখন আমাকে আর পায় কে? কিন্তু আপনি আসাতে সব মাঠে মারা গেল। এক ফুৎকারে মিলিয়ে গেল আমার সোনালী স্বপ্নগুলো। এখন বুঝতে পারছি, বৃথাই আপনাকে দোষী সাব্যস্ত করছি। দোষ হল আমার মনের ভেতরের প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের, যা আমার জীবনটাকে ছারখার করে দিতে চলেছে।

রেনর একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন–আপনি এখানে হাজির হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমার উচিত ছিল, তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যাওয়া। তবে আমার মনিব হতে পারেন এক যশস্বী বিজ্ঞানী, কিন্তু আমার চোখে তিনি ছিলেন এক অশ্রদ্ধার পাত্র। ছোট থেকে পয়সা কামাতে শিখেছেন বটে, কিন্তু যেমন কৃপণ তেমনি দেমাকি। বাড়ির কেউ তাকে পছন্দ করতেন না। স্নেহ-ভালোবাসা-শ্রদ্ধা বিনা উনি কীভাবে এতগুলো বছর বেঁচেছিলেন, তা ভেবে অবাক হয়ে যাই। তবে এখনও আমার আফশোশ হচ্ছে, ওই নীচ মনের মানুষটাকে শেষ করে তখনই ফর্মুলা নিয়ে পালিয়ে কেন গেলাম না।

-মঁসিয়ে রেনর, পোয়ারো বললেন, আমি যখন ঝিমিয়ে পড়ার ভান করেছিলাম, আপনি তখন জাঁক করে কী বলেছিলেন মনে আছে? আপনি নাকি দারুণ বুদ্ধিমান, গোড়াতেই আমার তা বোঝা উচিত ছিল এবং অবজ্ঞা ভরে উড়িয়ে দেওয়া উচিত হয়নি। তবে যাবার আগে জেনে নিন, ও ভুল আমি করিনি। আপনি যে অত্যন্ত ধূর্ত, তা আমি, এরকুল পোয়ারো আগেই টের পেয়েছিলাম। আপনার মতো উচ্চশিক্ষিত বুদ্ধিমান এক বিজ্ঞান সাধকের এই দুঃখজনক পরিস্থিতি দেখে সত্যিই খারাপ লাগছে।

এবার ইন্সপেক্টর জ্যাপ এগিয়ে এলেন–এডওয়ার্ড রেনর, তার হাতে হাত কড়া পরাতে পরাতে বললেন–সুপরিকল্পিতভাবে ও সুস্থ মাথায় স্যার ক্লড অ্যামরিকে হত্যা করা এবং তাঁর ফর্মুলা চুরি করার অভিযোগে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হল। আপনি একটা কথা জানবেন, এখন থেকে আপনি যা কিছু বলবেন, মামলা শুরু হলে সেগুলো সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসাবে পুলিশ আপনার বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে পারে।

ইন্সপেক্টর জ্যাপ এবার তাঁর কনস্টেবলকে ইঙ্গিত করলেন, এডওয়ার্ড রেনরকে সেখান থেকে নিয়ে যেতে। বললেন জনি, ওই হুইস্কি ভর্তি গ্লাসটা নিয়ে খেতে ভুলো না, ওটাতে বিষ মেশানো আছে, খেয়াল রেখো।

কনস্টেবল জনসন রেনরকে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। ঠিক এই সময় দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ালেন ক্যারোলিন অ্যামরি। রেনরের হাতে হাতকড়া দেখে তিনি আঁতকে উঠলেন। কনস্টেবল তাকে পাশ কাটিয়ে রেনরকে নিয়ে চলে গেল।

বড়ো বড়ো চোখ করে ক্যারোলিন পোয়ারোর কাছে জানতে চাইলেন–মঁসিয়ে পোয়ারো, এসব কী দেখছি? আমার ভাই স্যার ক্লডের খুনি কি ওই এডওয়ার্ড রেনর?

মাদাম, নিজের চোখেই দেখলেন, পোয়ারো জবাব দিলেন, রেনর ফর্মুলা চুরি করে আপনার ভাইকে বিষ মেশানো কফি খাইয়ে মেরেছে। পালাতেই যা বাকি ছিল। কিন্তু বিধি বাম, তাই বামাল সমেত ধরা পড়ে গেলেন।

-ওঃ ভগবান! এসব কী শুনছি। ক্যারোলিনের আর্তকণ্ঠ শোনা গেল, হতবিহ্বল তার দৃষ্টি। –লোকটার পেটে পেটে এত শয়তানি ছিল, বিশ্বাস করতে পারছি না। আমরা ওকে আমাদের পরিবারের একজন করে নিয়েছিলাম। সময়ে-অসময়ে ওর পাশে থেকেছি। শরীর খারাপ হলে ওষুধ দিয়েছি। এই তো ক’দিন আগে, আমি নিজে ওকে বীসওয়াক্স ওষুধ খাইয়েছি। এত কিছু করে পাল্টা আমরা কী পেলাম। ক্যারোলিন ডুকরে কেঁদে উঠলেন। পোয়ারোর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। রুমাল দিয়ে চোখের জল মুছলেন। এইসময় দরজার পাল্লা দুপাশে ধরে রিচার্ড এসে দাঁড়াল। ক্যারোলিন কোনোদিকে না তাকিয়ে রিচার্ডকে সরিয়ে ছিটকে চলে গেলেন বাইরে।

ঠিক এই সময় বাগান থেকে জানলা দিয়ে লাফিয়ে বারবারা ঘরে এসে ঢুকল। সেও শুনল রেনরের গ্রেপ্তারের কাহিনী। প্রথমটায় মানতে সেও পারছিল না। তারপর আপন মনে বলল–আশ্চর্য! রেনর এই কাজ করতে পারে ভাবাই যায় না। ওনার ব্যবহার দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে, আপনিই বলুন মঁসিয়ে পোয়ারো। এখন আমার পরিষ্কার মনে পড়ছে, হাতের কাজ শেষ না করে ওই রেনরই আমাকে ফক্সট্রট নাচে সঙ্গ দেবে বলে স্টাডি থেকে বেরিয়ে এসেছিল, এর খানিক বাদেই জ্যেঠুর মৃত্যু হয়।

–শুধু কী তাই, ইন্সপেক্টার জ্যাপ বারবারাকে লক্ষ্য করে বললেন–লোকটার কুকীর্তির শেষ নেই। যে বিষ খাইয়ে আপনার জ্যেঠুকে খুন করেছে, সেই একই বিষ দিয়ে মঁসিয়ে পোয়ালরার জীবন খতম করতে চেয়েছিল।

তাই নাকি! কী সর্বনাশ কান্ড ঘটে যেত বলুন তো! বারবারা এবার ক্যাপ্টেন হেস্টিংসকে দেখিয়ে কৈফিয়তের সুরে জানতে চাইল কেন উনি, বাগান থেকে বেশ কিছুক্ষণ আগেই চলে এসেছিলেন, কোথায় গিয়েছিলেন?

মঁসিয়ে পোয়ারোর লেখা চিরকুট পেয়ে আমি, জনসন আর ক্যাপ্টেন হেস্টিংস জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম, কখন নাটকের যবনিকা টানা হবে। রেনর যে বিষ মেশানো হুইস্কি মঁসিয়ে পোয়ারোকে দিয়েছিল, সেটা ক্যাপ্টেন হেস্টিংস বদলে দিয়েছেন তা রেনর টের পায়নি। মঁসিয়ে পোয়ারো এমন অভিনয় শুরু করলেন যে, সত্যি সত্যি ওই হুইস্কি খেয়ে তার প্রাণবায়ু এখুনি বেরিয়ে যাবে। রেনর ভাবল, লোকটা তো মরেই যাবে, আমি যদি সত্যি কথাটা বলে দিই, কে আর জানতে পারছে। বেশ জোরালো কণ্ঠস্বরে নিতে অপরাধের কথা স্বীকার করল। স্যার ক্লডকে খুন আর ফর্মুলা চুরি রেনরের এই স্বীকারোক্তি আমরা সকলে স্পষ্টভাবে শুনতে পেলাম। তারপরেই বামাল সমেত অপরাধীকে আমরা ধরে ফেলি। রেনরের দুর্ভাগ্য, আত্মবিশ্বাস যে তার সাথে এমন ছলনা করবে, তা কল্পনাও করতে পারেনি।

মাদমোয়াজেল, ইন্সপেক্টার জ্যাপের দিকে হাত তুলে দেখালেন। পোয়ারো বললেন–এই জটিল রহস্য সমাধানের কৃতিত্বের দাবীদার একমাত্র ইনি, আমার পুরোনো ও খুব ভালো বন্ধু, গোয়েন্দা ইন্সপেক্টার জ্যাপ, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের এক জাঁদরেল অফিসার হিসাবে যিনি পরিচিত।

-মঁসিয়ে পোয়ারো সামান্য হাসলেন, নিরহঙ্কার ভাবটা দেখছি আপনি সযত্নে এখনও পালন করে চলেছেন। সত্যি আপনি একজন খাঁটি ভদ্রলোক।

এসময় কনস্টেবল জনসন ঘরে এসে ঢুকল। সে বিষমেশানো হুইস্কিসহ গ্লাসটা একটা পলি প্যাকে ভরে নিল।

জ্যাপ লক্ষ্য করলেন, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস মুগ্ধ চোখে বারবারাকে দেখছেন। তিনি বললেন অসংখ্য ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, আপনার সযত্নে রক্ষিত জিনিসটি আমি নিয়ে গেলাম। মঁসিয়ে পোয়ারোকে খুন করার প্রচেষ্টা মামলায় এটি সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসাবে লাগবে। চলো হে জনি।

বিদায় অভিবাদন জানিয়ে ইন্সপেক্টর জ্যাপ বসার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

***

এবার বারবারা মুখ খুলল। পোয়ারোর দিকে তাকাল, সামান্য হাসল, লজ্জা ঝরে পড়ল। জানতে চাইল–এবার আসল কথাটা বলুন তো, খুনিকে কে ধরল, আপনি নিশ্চয়ই, ঠিক বলেছি মঁসিয়ে পোয়ারো?

ভুল করছেন আপনি। পোয়ারো ঠোঁটে হাসি বুলিয়ে বন্ধুর সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন–এ রহস্য উন্মোচনের অন্তরালে সবার আগে আছেন ইনি, আমার বন্ধু ও সহকারী ক্যাপ্টেন হেস্টিংস। এমন একটা কথা বলেছিলেন, কোন খেয়ালে বলেছিলেন জানি না, যা ওঁর অজান্তেই আমাকে এগিয়ে নিয়ে গেল সাফল্যের দিকে। দেখুন তাকিয়ে ওর দিকে, বেচারা বন্ধুটি আমার, নিজের কৃতিত্ব জাহির করে বলতে হবে তো, তাই কেমন ছটফট করছে দেখুন।

….মাদমোয়াজেল, আপনাদের বাগানটা সত্যি সুন্দর। যান, ওকে নিয়ে বেড়িয়ে আসুন। কোনো গাছের নীচে বসুন। ওর মুখে শুনবেন খুনিকে ধরার রোমাঞ্চকর কাহিনী, যা শুনে আপনার গায়ে কাঁটা দেবে।

পোয়ারো কথা শেষ করে বারবারা ও হেস্টিংসকে নিয়ে চলে এলেন খোলা জানলার কাছে।

-ও আমার প্রাণের সখা, বিলম্ব কেন, নাটকীয় ভঙ্গিতে সুর করে বলতে বলতে বারবারা হেস্টিংস-এর হাত ধরে জানলা টপকে বাগানের দিকে চলে গেল।

পোয়ারো এখন বসার ঘরে একা। রিচার্ড এসে ঢুকল সে ঘরে। পরক্ষণেই লুসিয়া হাজির। স্বামীকে দেখে আকুল স্বরে তাকে ডাকল–রিচার্ড!

রিচার্ড ঘাড় ফেরাল। স্ত্রীকে দেখে অবাক হল। বলল–লুসিয়া!

-হ্যাঁ, আমি লুসিয়া আর কোনো কথা বলতে পারল না। কী এক ভয় এসে বুঝি তার কণ্ঠ চেপে ধরেছে। হতাশ হয়ে সে ধপাস করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল।

লুসিয়া, তুমি। রিচার্ড দ্রুত লুসিয়ার সামনে এসে দাঁড়াল।

লুসিয়া উঠে দাঁড়াল, চোখে জল। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তারা। রিচার্ডের চোখ থেকে ঝরছে অনুতাপের হাহাকার। কেউ কোনো কথা বলছে না, অনিমিখ তাকিয়ে আছে পরস্পরের দিকে।

হঠাৎ পোয়ারোর দিকে দৃষ্টি পড়ল লুসিয়া। সে অসহায়ের মতো কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এল, যেন বাবার কাছে মেয়ে এসেছে সান্ত্বনা লাভের আশায়। লুসিয়ার দুটি হাত বাড়িয়ে দিল–মঁসিয়ে পোয়ারো, ধন্যবাদ জানিয়ে আপনাকে আর ছোট করব না।

পোয়ারো পরম স্নেহে লুসিয়ার হাত দুটি নিজের মুঠোতে ধরে বললেন–মাদাম, আপনি এবার নিশ্চিন্ত হলেন।

নিশ্চিন্ত হলাম কী করে? আমার শ্বশুরের খুনি ধরা পড়েছে বটে, তাই বলে আমার দুঃখের অবসান কি হল?

কথা বলতে বলতে লুসিয়া তার স্বামীর দিকে তাকাল, অবশ্য সরাসরি নয়।

-হুঁ, বুঝতে পারছি। আপনি এখনও আপনার পারিবারিক সুখ শান্তি, যা আপনার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে, তা ফিরে পাননি, আপনার চোখ-মুখই তার প্রমাণ দিচ্ছে।

-আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আপনি সত্যিই আমার বাবার বয়সি মানুষ তাই তো আমার মনের অশান্তির কথা কেমন পড়ে ফেললেন। বলুন মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি কি আমার হারানো সুখ-শান্তি আর কোনো দিন ফিরে পাব না?

জীবনে ঝড় ওঠে, সমস্ত কিছু লণ্ডভণ্ড করে দেয়, তারপর একসময় থেমে যায়। তখন নতুন জীবন। আশ্বাস দেবার ভঙ্গিতে পোয়ারো বললেন, পরিবারে আবার শান্তি সুখ, সবকিছু ফিরে আসে।

-মাদাম, ভরসা হারাবেন না, আপনাকে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমাকে ভরসা করে ঠকবেন না। হঠাৎ পোয়ারোর মুখ আনন্দে উদ্ভাস হয়ে উঠল, মনে হল লুসিয়ার দাম্পত্য শান্তির হদিস তিনি পেয়েছেন। লুসিয়াকে নিয়ে কফি টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন, এখানেই পড়ে আছে ফর্মুলার টুকরো কাগজগুলো, একটু আগে যেগুলো জ্যাপ বের করেছিলেন রেনরের জ্যাকেটের পকেট থেকে।

হাতের ইশারায় রিচার্ডকে কাছে ডাকলেন। রিচার্ড এলে আঙুল দিয়ে ভাঁজ করা কাগজের টুকরোগুলোকে দেখিয়ে বললেন–এই হল আপনার বাবা স্যার ক্লডের চুরি যাওয়া ফর্মুলা। তবে তিনি যে কাজটা শেষ করে যেতে পারেননি, তা নিশ্চিত জানি। অসম্পূর্ণ হলেও এগুলো যে উদ্ধার করতে পেরেছি, তা ভেবেই গর্ব হচ্ছে। মঁসিয়ে রিচার্ড আর মাদাম লুসিয়া, আপনারা দুজনেই জেনে রাখুন, সামান্য প্রচেষ্টায় এগুলো আবার আগের মতো ছেড়ে দেওয়া যায়, তখন হুবহু আগের মতোই দেখাবে।

ভগবান! এই সেই সর্বনেশে ফর্মুলা, মঁসিয়ে পোয়ারো, রিচার্ড বলতে থাকল, এগুলোর কথা আমি একটুও মনে রাখিনি। আমার বাবা আর তার হতভাগ্য সেক্রেটারির কাছে হয়তো এই কাগজের দাম অনেক অনেক টাকা, কিন্তু একটুও বাড়িয়ে বলছি না, এর দাম আমার কাছে এক কানাকড়িও নয়। ধ্বংসাত্মক বোমার সাথেই ওই কাগজের তুলনা করা যেতে পারে। আমাদের পরিবারকে তছনছ করে দিয়েছে, বাবাকে খুন করেছে, সংসারের সুখ শান্তি কেড়ে নিয়েছে, এমনকি আমাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে চিড় ধরিয়েছে। এমন এক ফর্মুলা আমার কাছে কী দাম পাবে বলুন?

–দাম পাবে না?

তাহলে এটা নিয়ে কী করবে তুমি? লুসিয়া নিস্পৃহ কণ্ঠে জানতে চাইল।

–জানি না। রিচার্ড পাল্টা প্রশ্ন করল, এবার তোমার জবাবটা শুনি।

–যা করব, তার বিরুদ্ধে যাবে না তো? লুসিয়া জানতে চাইল।

–একদমই নয়। কাগজের ভাঁজ করা টুকরোগুলো রিচার্ড হাতের মধ্যে তুলে নিল। লুসিয়াকে দিয়ে বলল–ধরো, যা খুশি করো, আমি কিছু বলব না।

-ধন্যবাদ রিচার্ড, গলার স্বর নীচুতে নামিয়ে লুসিয়া বললো, দেখো, আবার বলছি, আমি আমার মতো এগুলোর ব্যবস্থা করছি, পরে এই নিয়ে কোনো ঝামেলা করো না, বলে রাখছি।

লুসিয়া ফায়ারপ্লেসের সামনে এসে দাঁড়াল। ম্যান্টেলপিস থেকে দেশলাই তুলে নিল। কাঠি জ্বেলে কাগজে আগুন লাগাল। একটা একটা করে ছুঁড়ে দিল ফায়ারপ্লেসের মধ্যে। রিচার্ড নির্বাক হয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছে, বাবার সাধনার ফল কীভাবে একটু একটু করে আগুনে জ্বলে পুড়ে মরছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফর্মুলা লেখা ভাঁজ করা কাগজগুলোর গতি সুসম্পন্ন হল। পড়ে রইল কেবল ছাই।

–আপোদ বিদেয় হল, বাঁচা গেল। আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে লুসিয়া দেশলাইটা জায়গা মতো রেখে দিল। নামী বিজ্ঞানী হয়েছেন, কোথায় মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করবেন, তা না করে মানুষকে ধ্বংস করার কথা ভেবে চলেছেন। রাতদিন মুখ গুঁজে পড়ে আছেন ওই মারাত্মক বোমা তৈরিতে। কারণ হাজার হাজার পাউন্ড পকেটে আসবে, অর্থের বিছানায় শুয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোবেন, সেই স্বপ্নেই বিভোর। সত্যি বলছি, মঁসিয়ে পোয়ারো, ওই ফর্মুলা বিক্রির অর্থের প্রতি আমাদের লোভ নেই, আমরা চাই না বড়ো লোক হতে।

-সাবাস মাদাম, সাবাস। নিজের চোখে যা দেখলাম, তা প্রশংসার যোগ্য। হাজার হাজার পাউন্ড লোভের বশবর্তী না হয়ে আপনি কেমন স্বচ্ছন্দে ওই মারাত্মক বোমার ফর্মুলা পুড়িয়ে ছাই করে দিলেন, আশ্চর্য।

–কিন্তু আমার বিবাহিত জীবন, আমার পরিবার, অশান্তির আগুনে সব এভাবেই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। দুঃখে ভারাক্রান্ত লুসিয়ার মন। ধরা গলায় বলুন মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি কি আবার সেই সুখ শান্তি ফিরে পাব?

নিশ্চয়ই পাবেন, পোয়ারো ধমকের সুরে বললেন, এই আমি, এরকুলো পোয়ারো, আপনার বাবার বয়সি একজন ভদ্রলোক, এখনও কি আমার প্রতি আপনার অবিশ্বাস জমে আছে। যেসব ঘৃণ্য চক্রান্তে আপনি জড়িয়ে পড়েছিলেন, কীভাবে তা থেকে মুক্তি পেলেন, /৩৯ তলিয়ে দেখুন। আবার বলছি মাদাম, এই এরকুল পোয়ারোর ওপর আর একটু আস্থা রাখুন, জীবনের সুখ শান্তি সব ফিরে পাবেন, আমি আপনাকে একাজে সাহায্য করব, প্রতিশ্রুতি দিলাম। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে সেই ফিনিক্স পাখির গল্পের কথা, ছেলেবেলায় পড়েছিলাম, আগুনে পুড়ে পাখিটা ছাই হয়ে গেল বটে, পরক্ষণে ফিরে পেল নতুন দুটো ডানা, মনের খুশিতে ডানা মেলে সে আবার আকাশে উড়ে গেল। আপনি হলেন সেই ফিনিক্স পাখি, যে রাশি রাশি দুঃখ, নিন্দা, কলঙ্ক আর সন্দেহের আগুনে পুড়ে ছাই হবার পরেও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে নতুন ভাবে বেঁচে উঠেছে। আপনাদের বিবাহিত জীবনে সামান্য চিড় ধরেছে মাত্র। এর মূলে আছে ভুল বোঝাবুঝি আর অবিশ্বাস। আপনারা নিজেরাই নিজেদের দুঃখের জীবনকে নতুন সূর্যের আলোতে ভরিয়ে তুলতে পারেন, সেখানে থাকবে না কোনো অবিশ্বাস, থাকবে না সন্দেহের বাতাবরণ, থাকবে শুধু নতুন ভাবে সুখে শান্তিতে বেঁচে থাকার মন্ত্রমালা।

কিন্তু আমি আমার আসল পরিচয় না দিয়ে আমার স্বামীকে ঠকিয়েছি। এই অপরাধবোধ সব সময় আমায় কুরে কুরে খাচ্ছে। এর থেকে মুক্তি পাব কী করে?

লুসিয়া তুমি একাই কি অপরাধ করেছ? রিচার্ডের গলা বুজে এল, আমিও তোমাকে সন্দেহ করেছিলাম, আমার বাবার ফর্মুলা তুমিই চুরি করেছ ভেবেছিলাম।

-মাদাম লুসিয়ার কানের কাছে পোয়ারো মুখ নামিয়ে নিয়ে এলেন। চাপাস্বরে বললেন–স্যার ক্লডও আপনাকে ফর্মুলা-চোর হিসাবে সন্দেহ করেছিলেন, এখবর আমার জানা। অবশ্য স্যার ক্লডকে দোষ দিই না। উনি কেন, ওঁর জায়গায় যে কেউ থাকলে এমনটিই হত। উনি খুন হবার তিন-চারদিন আগে একটা চিঠি পেয়েছিলেন, নামহীন স্বাক্ষরহীন চিঠি। আপনার সম্পর্কে স্যার ক্লডকে হুঁশিয়ারি করে চিঠিটা লেখা। আজ বুঝতে পারছি, চিঠিটা কে লিখেছিল। ডঃ কারোলি নিজে অথবা ওর কোনো চ্যালার কাজ। ওই চিঠিই স্যার ক্লডের মনে আপনার সম্পর্কে সন্দেহের বীজ ঢুকিয়ে দিয়েছিল। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আপনার স্বামী রিচার্ডের কথা ভাবুন তো। পুলিশের জেরার মুখে যাতে আপনাকে না পড়তে হয়, তাই আগে ভাগে তিনি নিজেই ইন্সপেক্টার জ্যাপের কাছে স্বীকার করেছিলেন যে, তিনি স্যার ক্লডের খুনী। উনি কেন একাজ করেছিলেন জানেন? ভালোবাসার বশবর্তী হয়ে। উনি কখনোই চাননি, সন্দেহের বশে পুলিশ আপনাকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাক।

রিচার্ড! অস্ফুটে বলে উঠল লুসিয়া, তাকাল স্বামীর দিকে, সে চাউনিতে ঝড়ে পড়ছে কৃতজ্ঞতা মেশানো ভালোবাসা।

এবার আপনাকে বলি, মঁসিয়ে রিচার্ড, পোয়ারো কঠিন কণ্ঠে বললেন–আপনি কি জানেন, আপনার স্ত্রী আপনাকে বাঁচানোর জন্য সচেষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। উনি বারেবারে আমায় জানিয়েছিলেন, স্যার ক্লডকে উনিই খুন করেছেন। নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে এমন কাজ স্ত্রী করতে পারেন, তার ভালোবাসা মেকি তো হতে পারে না।

–লুসিয়া, আবেগে রিচার্ডের দুটি চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল। সে ধীর পায়ে স্ত্রীর কাছে এগিয়ে এল, চোখে রাখল চোখ। দু’জনের ঠোঁটেই হাসির ইশারা।

-বাবার বয়সি এক প্রৌঢ়ের সামনে কোনো ইংরেজ নারী-পুরুষ পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায় না। জানি, এটা তাদের রীতি বিরুদ্ধ। অনেক দিন তো হল এদেশে বাস করছি, আপনাদের আদব কায়দা আমার জানা হয়ে গেছে। তাই বলছি মঁসিয়ে ও মাদাম অ্যামরি, আমি চলে যাচ্ছি, আপনারা প্রাণভরে দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরুন, চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিন পরস্পরকে।

–মঁসিয়ে পোয়ারো, এগিয়ে এসে লুসিয়া কৃতজ্ঞতা ভরে পোয়ারোর হাত দুটি চেপে ধরল–আপনাকে আমি কোনোদিন ভুলব না।

–আপনিও আমার স্মৃতিপটে বেঁচে থাকবেন চিরকাল। পোয়ারো সামান্য ঝুঁকে পড়লেন, লুসিয়ার হাতে স্নেহের চুম্বন এঁকে দিলেন।

রিচার্ড এবার এগিয়ে এল। লজ্জিত কণ্ঠস্বরে বলল–মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনাকে ভুল বুঝে অনেক বিশ্রী ব্যবহার করেছি, বুঝতে পেরে এখন নিজেই মরমে মরে যাচ্ছি। তবে আমি চিৎকার করে বলতে পারি, আপনার কারণেই আমি জীবন ফিরে পেয়েছি, যে সুস্থ দাম্পত্য জীবন হারিয়ে গিয়েছিল, তা মুঠোবন্দি করতে পেরেছি, আপনার মতো সজ্জন লোককে ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট করতে চাই না। রিচার্ড আর কথা বলতে পারল না, ছলছলে চোখে সে তাকিয়ে রইল।

–প্রচণ্ড এক সঙ্কটের মুহূর্তে আপনাদের পাশে যে দাঁড়াতে পেরেছি, আপনাদের যে আবার বিবাহিত জীবনের সুখসাগরে ভাসিয়ে দিতে পেরেছি…. আবেগে পোয়ারোর কণ্ঠ রুদ্ধ হল। জ্যাকেটের আস্তিনে চোখের জল মুছে নিলেন। এখান থেকে আমি আজ যা নিয়ে যাচ্ছি, এর থেকে বড়ো পাওনা আর কিছু হতে পারে না, মঁসিয়ে অ্যামরি। বিদায়বেলায় চোখের জল মুছে, আসুন, আমরা হেসে উঠি।

হাসি থামিয়ে পোয়ারো বললেন, বদ্ধ ঘরে আর বন্দি থাকবেন না। জানলা তো খোলাই আছে। বাইরে খোলা আকাশ, আর সবুজের হাতছানি। দুজনে হাত ধরাধরি করে ঘুরে বেড়ান, মন হালকা হবে।

লুসিয়া আর রিচার্ড কথা না বাড়িয়ে পোয়ারোর নির্দেশ মেনে ফ্রেঞ্চ উইন্ডো গলিয়ে বাগানে গিয়ে পড়ল।

পেছন থেকে পোয়ারো হাঁক দিলেন–লুসিয়া আর রিচার্ড, আপনাদের দাম্পত্য জীবন সুখময় হয়ে উঠুক, সেই কামনা করি। বাপের বয়সি লোকেরাই এমন আশীর্বাদ করতে পারেন। আর হ্যাঁ, মাদাম, কোনো এক গাছের নীচে আপনার ননদ বারবারাকে পাবেন, সঙ্গে আমার একান্ত অনুগত সহকারী ও বন্ধু ক্যাপ্টেন হেস্টিংসও আছেন। আমার সামনে বারবারাকে দেখলাম, টানতে টানতে হেস্টিংসকে নিয়ে গেলেন বাগানে। ছেলেমানুষ, আপত্তি, করতে পারিনি। কিন্তু এবার যে আমার বন্ধুটিকে ছাড়তে হবে। দয়া করে মাদমোয়াজেল বারবারাকে বুঝিয়ে বলুন, নয়তো লন্ডনে ফেরার ট্রেন ধরতে পারব না। বন্ধুটিকে আমার হাতে ফিরিয়ে দিলে আমি বাধিত থাকব।

নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠলেন পোয়ারো। জানলা ছেড়ে ধীরে ধীরে চলে এলেন ঘরের মাঝখানে। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে এসে দাঁড়ালেন ফায়ারপ্লেসের কাছে। ম্যান্টেলপিসে রাখা ফুলদানিটার গায়ে হাতের পরশ দিলেন। আপনমনে উচ্চারণ করলেন–যাক, শেষ পর্যন্ত সব কিছু ভালোয় ভালোয় মিটল। বিক্ষিপ্তভাবে যেখানে যা কিছু ছড়িয়ে ছিল, সেগুলো আবার শৃঙ্খলাবদ্ধ ও সুচারুভাবে স্ব স্ব জায়গা ফিরে পেল।

আত্মতৃপ্তিতে মন তার পরিপূর্ণ। পৌরুষদৃপ্ত পদক্ষেপে চলে গেলেন ঘরের বাইরে।