১০. কী আর বলি

১০.

কী আর বলি, মঁসিয়ে পোয়ারো, হাতের ডাক্তারি ব্যাগটা টেবিলের ওপর রাখলেন ডঃ গ্রাহাম, খুব গম্ভীর দেখাচ্ছে তাকে একটা খারাপ খবর নিয়ে এসেছি।

খারাপ খবর। পোয়ারো মনে মনে খুশি হলেন, নিশ্চয়ই স্যার ক্লড অ্যামরির মৃত্যুর কারণ জানা গেছে। আর সেটাই বলতে এসেছেন, তাই না?

–ঠিকই ধরেছেন। ডঃ গ্রাহাম। ঘাড় নেড়ে বললেন, পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট বলছে, বিষ ক্রিয়াই স্যার ক্লডের মৃত্যুর কারণ কফির সঙ্গে ওই বিষ মেশানো হয়েছিল।

বিষটা নিশ্চয়ই হিসকোসিন হাইড্রোব্রোমাইড বা ওই জাতীয় কিছু, তাই না ডঃ গ্রাহাম।

–হুঁ, কিন্তু আপনি জানলেন কী করে?

টেবিলের ওপর রাখা ওষুধভরা টিনের বাক্সটা যাতে ডঃ গ্রাহামের নজরে না পড়ে, তাই পোয়ারো সেটা রেখেছিলেন গ্রামোফোনের আড়ালে।

–কিন্তু কেনেথ, রিচার্ড বসেছিল সোফার একপাশে, সে এবার মুখ খুলল, আমি তো এসবের মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।

–জেনে রাখো, রিচার্ড, এই কেসটা পুলিশের হাতে চলে গেছে। অতএব খানাতল্লাশি বা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য যে কোনো সময় তোমাদের বাড়িতে চলে আসতে পারে, প্রস্তুত থেকো। মনে রেখো এটা একটা খুনের মামলা।

–ওফ, কী সাংঘাতিক ব্যাপার, রিচার্ড চেঁচিয়ে উঠল, পুলিশ, খুন–এসব তো ভাবতেই পারছি না। ভাই কেনেথ, তোমায় অনুরোধ করছি, ব্যাপারটা এখানেই থামিয়ে দাও, আর গড়াতে দিও না, সর্বনাশ হয়ে যাবে।

রিচার্ড, উত্তেজিত হয়ো না। ডঃ গ্রাহাম সান্ত্বনার সুরে বললেন–আমি তোমাদের শুভাকাঙ্খী, মনে রেখো, কিন্তু পুলিশি ঝামেলা থেকে তোমাদের রক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, দুঃখিত। ব্যাপারটা করোনার পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, ধামা চাপা দেবার উপায় নেই। তাছাড়া পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট পরিষ্কার লিখেছে–আত্মহত্যাজনিত মৃত্যু নয়, এটা খুন।

তার মানে বিষমেশানো কফি খাইয়ে বাবাকে হত্যা করা হয়েছে?

রিচার্ডের প্রশ্নের জবাবে ডঃ গ্রাহাম বললেন–পরিস্থিতি তাই বলছে। রিচার্ড, আর একটা খবর শুনে রাখো। করোনারের হাতে সব তথ্য এসে গেছে, অতএব দেরি না করে ওরা আগামীকালই বিংস আমর্স-এ তদন্তের কাজ শুরু করবে।

পুলিশি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তেই হচ্ছে, এটাই তোমার শেষ কথা, তাই তো?

রিচার্ড উত্তেজিত। ডঃ গ্রাহাম শান্ত সংযত কণ্ঠে বললেন রিচার্ড, এসময় মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করতে হয়। তোমাকে আবারও বলছি, পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট তোমার বাবার মৃত্যুর কারণ দেখিয়েছে মারাত্মক বিষজনিত ক্রিয়া। তাই তোমাদের ভালোর জন্য এক্ষেত্রে যা যা করণীয়, সময় থাকতেই আমি করেছি। এছাড়া আর কিছু উপায় নেই।

-হা ঈশ্বর! রিচার্ডের গলা থেকে আক্ষেপ ঝরে পড়ল। এবারে পুলিশি তদন্তের পরিণতি শেষ পর্যন্ত কোথায় দাঁড়াবে কে জানে! এদিকে মঁসিয়ে পোয়ারোও বসে নেই, বরং উনি পুলিশের আগে ছুটছেন। আমার তো এখন মাথা খারাপ হবার উপক্রম, কেনেথ, কিছু করো ভাই।

পুলিশি তদন্তের ব্যাপারটা তোমাকে যথেষ্ট ধাক্কা দিয়েছে বুঝতে পারছি, সহানুভূতিপূর্ণ কণ্ঠে ডঃ গ্রাহাম বললেন, তবে এখন আমার দু-চারটে প্রশ্নের জবাব দাও তো। ঠিক-ঠিক জবাব চাই, মনে রেখো।

-বেশ, বল। কী তোমার জানার আছে? রিচার্ড বুঝি একটু ধাতস্থ হল।

–প্রথম প্রশ্ন, গতরাতে ডিনারে তোমার বাবা কী কী খেয়েছিলেন, মনে আছে?

–গতরাতে আমরা সবাই ডিনার করতে বসেছিলাম, রিচার্ড সামান্য চুপ করে বলল, হা, মনে পড়ছে, সুপ, ভাজা শশাল মাছ, কাটলেট দু-তিনটে, শেষ পাতে আইসক্রিম–ফুট স্যালাড।

–ডিনারে কোনো ড্রিঙ্কস?

–আগাগোড়াই ডিনারে আমরা ভালো ফরাসী মদ্য পান করে থাকি। এটা আমাদের পরিবারের ঐতিহ্য বলতে। গতরাতে বাবা খেয়েছিলেন বাগান্ডি। পিসিমা ও বাবার সেক্রেটারি এডওয়ার্ড রেনরও ওই ড্রিঙ্কস নিয়েছিলেন। ডিনারে বসে হুইস্কির সাথে সোড়া মিশিয়ে খাওয়ার অভ্যাস আর্মিতে থাকাকালীনই হয়ে গিয়েছিল, ওটা আর ছাড়তে পারিনি, ভাই। আর যদুর মনে পড়ে, ডঃ কারোলি হোয়াইট ওয়াইন নিয়েছিলেন, সম্ভবত ওই সস্তার মদই ওর সয়।

–ডঃ কারোলি বলতে তুমি ওই ইটালিয়ান ডাক্তারের কথা বলছ তো! সত্যি আজব লোকটা। ডঃ গ্রাহাম এবার জানতে চাইলেন, এবার বলল রিচার্ড, এই লোকটার সঙ্গে তোমার কতদিনের পরিচয়, কিছু লুকিয়ো না, সব আমার জানা দরকার।

ওদের কথাবার্তা কর্ণকুহরে ধরে রাখার জন্য পোয়ারো চোখ ইশারা করলেন, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস ধীর পায়ে ওদের কাছাকাছি এসে দাঁড়ালেন।

–পরিচয়। কী বলছ, কেনেথ, লোকটাকে চিনিও না, এমনকি ওর নামটাও শুনিনি। কখনো, গতকালই লোকটাকে প্রথম আমি দেখেছি।

–তবে শুনেছি যে, উনি তোমার বউ লুসিয়ার বন্ধু, কথাটা কি ঠিক?

বন্ধু নয়, কোনো একসময় লুসিয়ার সঙ্গে ওর পরিচয় হয়েছিল মাত্র, লুসিয়া সেইরকমই বলেছিল।

–তারমানে দুজনের মধ্যে মনের কোনো টান নেই, তাইতো?

–হ্যাঁ, তাই-ই।

–আচ্ছা, বেশ, ডঃ গ্রাহাম মুখে সামান্য একটা আওয়াজ করলেন। তারপর বললেন–যে সম্পর্কই থাকুক না কেন, ওই ডাক্তার কিন্তু কোনো ভাবেই এ বাড়ি ছেড়ে বাইরে যেতে পারবেন না। রিচার্ড, এটা ওঁকে বুঝিয়ে বলার দায়িত্ব তোমার।

–তুমি বলার আগেই ওঁকে একথা গতরাতেই শুনিয়ে দিয়েছি, কেনেথ। বলেছি, বাবার চুরি যাওয়া ফর্মুলার সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত তাকে এই বাড়িতে থাকতে হবে, কোথাও যাওয়া চলবে না। গ্রামের এক কম দামের সরাইখানায় উনি উঠেছিলেন। গতকাল সকালে আমার নোক গিয়ে ওঁর জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে।

উনি আসতে রাজী হয়ে গেলেন?

 ডঃ কেনেথ গ্রাহামের জবাবে রিচার্ড চোখ বড় বড় করে বলল–কোনোরকম উচ্চবাচ্যই করেননি, বরং এখানে আসতে পেরে উনি বুঝি বর্তে গেলেন, এমনই ভাব দেখালেন।

-বুঝেছি। ডঃ গ্রাহামের গম্ভীর মুখ আরও গম্ভীর হল। যাক, এবার বলো, তোমার বাবার মৃত দেহ এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরে এ ঘরের দরজা জানলাগুলো বন্ধ, না খোলা ছিল?

 আমি বলছি, ডঃ গ্রাহাম, পোয়ারো এবার জবাব দিলেন। স্যার ক্লডের মৃতদেহ করোনারে পাঠানোর পর এঘরের দরজা জানলা বন্ধ ছিল। আমার নির্দেশে শুতে যাবার আগে ট্রেডওয়েল সবকটা দরজা জানলা ভেতর থেকে ভালো করে এঁটে তালা লাগিয়ে দিয়েছিল। চাবি আমার হাতে দিয়ে সে চলে গিয়েছিল। ঘরের ভেতরের জিনিসপত্র যেমন এখন আছে দেখছেন, তেমনই ছিল, কোনো নড়চড় হয়নি, শুধু কয়েকটা চেয়ার ছাড়া। আমাদের বসার জন্যই চেয়ারগুলোর অবস্থানের পরিবর্তন ঘটেছে।

টেবিলের ওপরে গত সন্ধ্যার একটা এঁটো কফির কাপ তখনও পড়ে ছিল। ডঃ গ্রাহামের নজর সেদিকে পড়ল। তিনি কাপটির দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন–রিচার্ড, এটাই কি সেই কাপ? মনে হয় এটাতেই তোমার বাবা শেষ কফি খেয়েছিলেন?

রিচার্ড এ প্রশ্ন শুনে হতভম্ব হয়ে গেল, জবাব খুঁজে পেল না বলার মতো।

ডঃ গ্রাহাম কফি টেবিলের কাছে এগিয়ে গিয়ে কাপটা তুলে নিলেন–এটা আমায় নিয়ে যেতে হচ্ছে তদন্তের স্বার্থে। যতটুকু তলানি পড়ে আছে, পরীক্ষা করলে ধরা পড়ে যাবে, আশা করি বিষের চিহ্ন পাওয়া যাবে। কাপটা তিনি নিজের ব্যাগের মধ্যে রাখার জন্য তৈরি হলেন।

রিচার্ড এগিয়ে এল–তুমি কি নিশ্চিত এই কাপে বিষ আছে? কোনোরকমে রিচার্ড বলল, কিন্তু প্রমাণ সোপাটের চেষ্টা করল না।

-হ্যাঁ, আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি, স্যার ক্লডের ডিনারে কোনো বিষ দেওয়া হয়নি। অতএব ধরে নেওয়া যেতে পারে, ডঃ গ্রাহামের চাপা কণ্ঠস্বর, বিষ মেশানো হয়েছিল তোমার বাবার কফিতে হিসকোসিন হাইড্রোব্রোমাইড।

আমি, আমি কথাটা বলে রিচার্ড এগিয়ে এল, তীব্র হতাশা তাকে গ্রাস করেছে, কী মনে করে খোলা ফ্রেঞ্চ উইন্ডোর কাছে এসে দাঁড়াল, লাফিয়ে বেরিয়ে এল বাগানে।

উঃ গ্রাহাম ব্যাগ খুলে কিছুটা তুলো বের করলেন, কাপটা ভালো করে জড়িয়ে নিলেন। তারপর একটা ছোট কার্ডবোর্ডের বাক্সে ভরে চালান করে দিলেন নিজের ডাক্তারি ব্যাগের মধ্যে।

হাতের কাজ সারতে সারতে পোয়ারোকে উদ্দেশ্য করে ডঃ গ্রাহাম বলে চললেন–মঁসিয়ে পোয়ারো, কী বিশ্রী ব্যাপার বলুন তো। আগামী দিনগুলি তাকে কোন পরিস্থিতির সামনে দাঁড় করাবে, সে কথা ভেবে বেচারা রিচার্ড দারুণ মুষড়ে পড়েছে। রাজ্যের খবরের কাগজগুলোর কথাই ধরুন। স্যার ক্লড অ্যামরিকে হত্যা, সঙ্গে ওর স্ত্রীর ইটালিয়ার ডাক্তারের বন্ধুত্ব, ব্যাপারটাকে কি ওরা ভোলা চোখে দেখবে। এই কেচ্ছা কেলেঙ্কারির কথা ওরা রসিয়ে রসিয়ে কাগজগুলোতে ছাপবে। স্বাভাবিকভাবেই এই নোংরা কাদার ছিটে এসে পড়বে রিচার্ডের বউ লুসিয়ার গায়ে, শুরু হবে পারিবারিক অশান্তি। বেচারী, লুসিয়া, আমি জানি, ও সম্পূর্ণ নির্দোষ, এ বিষ প্রয়োগের ঘটনার সঙ্গে কোনো মেয়ে জড়িত নয় জানবেন।

ডঃ গ্রাহাম একটু থামলেন। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন–আমার কী মনে হয় জানেন, মঁসিয়ে পোয়ারো? রিচার্ড মুখে যাই বলুক না কেন, আসলে কিছু জানে না। বেচারী লুসিয়া। কম বয়স, তার ওপরে ধনী গবেষকের একমাত্র ছেলের স্ত্রী। কথাটা জানতে পেরে ওই ইটালিয়ান ডাক্তার লুসিয়ার সঙ্গে ভাব জমিয়েছে এবং ধীরে ধীরে একধরনের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। মাফ করবেন, বলতে বাধ্য হচ্ছি, ডঃ কারোলির মতো বিদেশীরা প্রচণ্ড ধড়িবাজ, এরা নিজের উদ্দেশ্য সফল করার জন্য যে কোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।

তার মানে আপনি এ পরিবারের সকলকে সন্দেহের বাইরে রাখছেন, ডঃ কারোলিকেই অপরাধী মনে করছেন, তাই না?

কথাটা বলতে বলতে পোয়ারো বাঁকা চোখে একবার তার সহকারী ক্যাপ্টেন হেস্টিংস-এর দিকে তাকালেন।

ডঃ গ্রাহাম কী বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। এদিক-ওদিক তীক্ষ্ণ চোখে জরিপ করলেন। তারপর চাপা গলায় বললেন, আমরা সকলেই জানি, স্যার ক্লডের হারিয়ে যাওয়া ফর্মুলাটা কতখানি মূল্যবান। অতএব এক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, একজন বিদেশী, যার নাম এই বাড়ির কেউ কোনোদিন শোনেনি, তার পক্ষে ওই ফর্মুলা জানা কী ভাবে সম্ভব? তবে ভুলে যাবেন না। ওই ইটালিয়ান ডাক্তার এখানে আসার পরেই প্রথমে চুরি হল ফর্মুলা, তারপর রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হল স্যার ক্লড অ্যামরির।

ডঃ গ্রাহাম সামান্য বিরতি নিলেন–জানেন তো, ইটালিয়ানদের একটা কুখ্যাতি আছে, বিষপ্রয়োগে হত্যার ক্ষেত্রে তাদের জুড়ি মেলা ভার।

–ঠিক, ঠিক, পোয়ারো গলার আওয়াজ চড়িয়ে বললেন–ওই বর্গিয়ার আংটির মতো।

পোয়ারোর শেষ কথা দুটি সম্ভবত ডঃ গ্রাহাম শুনতে পাননি, তাই তিনি কান এগিয়ে বললেন–দুঃখিত বুঝলাম না, কার কথা যেন আপনি বললেন।

বাদ দিন ওসব কথা। পোয়ারো বর্গিয়ার বিষয়ে কোনো কথা বাড়াতে চাইলেন না।

 টেবিল থেকে ব্যাগটা তুলে নিতে নিতে ডঃ গ্রাহাম বললেন–মঁসিয়ে পোয়ারো, আমাকে এবার বিদায় নিতে হচ্ছে। কিছু মনে করবেন না, পুলিশ কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে আশা করি। আপনি ততক্ষণ কোনো জিনিসকে কাউকে হাত দিতে দেবেন না, নজর রাখবেন। এ আমার অনুরোধ, জানেনই তো ব্যাপারটা কত গুরুত্বপূর্ণ। এ বাড়ির সকলকে এই ঘটনার গুরুত্ব সম্পর্কে বোঝানো সম্ভব নয়।

ডঃ গ্রাহাম পোয়ারোও হেস্টিংস-এর সঙ্গে হান্ডশেক করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

–আপনি সম্পূর্ণভাবে আমার ওপর ভরসা করতে পারেন। কথা দিচ্ছি, এ ঘরের কোনোকিছু এধার ওধার হবে না।

ডঃ গ্রাহাম বসার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ক্যাপ্টেন হেস্টিংস দরজার পাল্লা এঁটে দিতে দিতে বললেন, সত্যি বলছি পোয়ারো, এ বাড়িতে পড়ে আছি, কখন যে খাবারের মধ্যে কী বিষ মিশিয়ে দেবে জানি না, এক মারাত্মক খুনি চোখের সামনে বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তারওপর ওই ডঃ কেনেথ গ্রাহাম, নোকটা সুবিধার মনে হয় না। তার ওপর এ পরিবারের মেয়ে বারবারার সঙ্গে লুকিয়ে চুরিয়ে ফস্টিনষ্টি করে, এ বাড়ির কারো সঙ্গে তার তেমন ভাব আছে বলে আমার মনে হয় না।

-তুমি কি ভাবছ, খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে আমাদের কেউ মারাত্মক অসুস্থ করে দেবে। ভয়ে হাত-পা সোঁধয়ে যাচ্ছে, তাই না? পোয়ারো ভুরু কুঁচকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালেন ক্যাপ্টেন হেস্টিংস এর দিকে। তারপর তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন–ক্যাপ্টেন ওসব ভয় মনের ভেতর এনো না। সত্যি সত্যি তেমন কোনো মারাত্মক অসুখে পড়ার আগেই হয়তো তল্পিতল্পা গুটিয়ে আমাদের ফিরে যেতে হবে। যাইহোক বন্ধু, এসো, বসে না থেকে কাজ শুরু করি।

-তুমি কী বলতে চাইছ, খুলে বলল, বুঝতে সুবিধা হবে।

হেস্টিংস-এর কথা শুনে পোয়ারো সামান্য হেসে বললেন–সিজারে বর্গিয়াকে জেরা করব এবার। শুধু আমি নয়, তুমিও সঙ্গে থাকবে আমার।

কথা শেষ করেই পোয়ারো দেওয়ালে সাঁটা কলিং বেলের সুইচ টিপলেন। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেডওয়েল বসার ঘরের মধ্যে পা রাখল–বলুন, স্যার, ডাকছেন কেন?

–হ্যাঁ, ট্রেডওয়েল, পোয়ারো বললেন, ডঃ কারোলিকে ডেকে দাও তো, কিছু প্রশ্ন আছে।

ট্রেডওয়েল ঘাড় কাত করে নিঃশব্দে চলে গেল।

পোয়ারো বললেন ক্যাপ্টেন, এই টিনের বাক্সটা এখান থেকে চট করে সরিয়ে ফেলো, ডঃ কারোলি এসে যেন দেখতে না পায়।

বাক্সটা তিনি তুলে দিলেন ক্যাপ্টেনের হাতে, একটা চেয়ার টানতে টানতে নিয়ে এলেন বুক শেলফ-এর কাছে। বললেন, বাক্সটা আমার হাতে দিয়ে উঠে পড়ে।

হেস্টিংস চেয়ারে উঠে পড়লেন, বাক্সটা নিয়ে আগে যেখানে ছিল, সেখানে রেখে দিলেন।

-হেস্টিংস, পোয়ারো বলতে থাকলেন, একটা রহস্য সমাধানের ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্নতা ও শৃঙ্খলতার দাম অনেক। মুখ টিপে হাসলেন। আবার বললেন, এবার তা তুমি দেখতে পারবে, আশাকরি।

সেই সাদৃশ্যের ওপরে কী যেন বলছিলে, তাই না? হেস্টিংসও সামান্য হাসলেন, হ্যাঁ, এবার তোমার বক্তব্য পরিষ্কার বুঝতে পারছি।

-তাই নাকি হে? বল, বল, কী বুঝেছ?

তোমার ভাবগতিক দেখে আমার মনে হচ্ছে, ডঃ কারোলিকে ঘাবড়ে দেওয়ার জন্য কিছু একটা করতে চাও। গত রাতে এই টিনের বাক্সের ওষুধের শিশিগুলো নিয়ে যারা ঘাঁটাঘাঁটি করছিলেন, ডঃ কারোলি তাদের দলভুক্ত। অন্যদিকে তুমি চাও, উনি যাতে আগে আগে সাবধানী না হয়ে যান, তার ব্যবস্থা করতে, ঠিক বলেছি?

–বাঃ, তোমার মগজের প্রশংসা করতে হয়, ভাবতে পারিনি, বয়সের সাথে সাথে তোমার বুদ্ধি এত পাকা হতে পারে। পোয়ারো বন্ধুর কাঁধে সামান্য চাপ দিয়ে বললেন।

বন্ধু, ভুলে যেও না, তোমার সাথে আমার আজকের পরিচয় নয়। আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া তোমার পক্ষে সম্ভব নয়।

বইয়ের শেলফের ওপর আঙুল বুলিয়ে পোয়ারো বললেন, কত ধুলো জমেছে দেখ, নিজের ধুলো মাখা আঙুল তুলে দেখালেন, এদিকটায় কাজের লোকেরা চোখ দেয় না বুঝতে পারছি। নিজেই আমি জায়গাটা পরিষ্কার করে দিতাম, যদি একটা ভেজা ন্যাকড়া……..

কথা শেষ না করেই তিনি চেয়ার থেকে নেমে পড়লেন, সেটাকে পূর্বের জায়গায় বসিয়ে দিলেন। হেস্টিংস তাকিয়ে আছেন তার দিকে কেমন অস্বাভাবিক চাউনি, থমথমে মুখ।

–কী হল? হেস্টিংস অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, মুখ চোখ দেখে মনে হচ্ছে কিছু পেয়েছ?

-পেয়েছি, পোয়ারো চাপা গলায় বললেন–পেয়েছি, কাঁড়ি কাঁড়ি ধুলো, যা বহুদিন ধরে জমেছে।

এমন সময় ঘরে এসে পা রাখলেন ডঃ কারোলি।

–বলুন মঁসিয়ে পোয়ারো, খাঁটি ইটালিয়ান ভাষায় ডঃ কারোলি জানতে চাইলেন আপনি নাকি আমায় কিছু জানার জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন?

-হ্যাঁ, ডঃ কারোলি,

ইটালিয়ান ভাষায় জবাব শুনে ডঃ কারোলি এবার পোয়ারোর মাতৃভাষা ফরাসিতে বললেন–ইটালিয়ান ভাষা বেশ ভালোই বলেন দেখছি, মঁসিয়ে পোয়ারো।

ক্যাপ্টেন হেস্টিংস ওদের কথাবার্তা শুনছিলেন, কিন্তু অর্থ বুঝতে পারছিলেন না। তাই বিরক্ত ভরে বলেন–কোন ভাষা?

দুঃখিত ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, ডঃ কারোলি সঙ্কোচ বোধ করলেন–আমি জানতাম না, আপনি ইটালিয়ান জানেন না। মাসিয়ে পোয়ারো, একটা কথা জানিয়ে রাখি আগেই আমার হাতে সময় কম। লন্ডনে কিছু জরুরি কাজ আছে। সেগুলো সারতে আজই আমাকে চলে যেতে হচ্ছে।

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। দরকার হলে, আর এখানকার কাজ শেষ হলে তবেই যাবেন। মিছিমিছি আপনাকে বাধা দিতে যাব কেন বলুন। এসব কথায় পরে আসছি। আগে আমার প্রশ্নের জবাব দিন। গতরাতে আমরা দুজনে অর্থাৎ ক্যাপ্টেন হেস্টিংস আর আমি এখানে আসার আগে কী কী ঘটেছিল, সে সম্পর্কে জানতে চাইছি। খুঁটিয়ে বলুন, কিছু বাদ দেবেন না, ডঃ কারোলি।

বেশ, বলছি, গত সন্ধ্যায় ডিনার শেষ করে বাড়ির সকলে এ ঘরে এসে ঢুকলেন। আমিও তাদের অনুসরণ করলাম। স্যার ক্লড তার সেক্রেটারি এডওয়ার্ড রেনরকে ডাকলেন, তাঁরা স্টাডিতে ঢুকে পড়লেন। কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর স্যার ক্লড স্টাডি থেকে বেরিয়ে এসে জানালেন যে একটা কাগজ তিনি খুঁজে পাচ্ছে না, অর্থাৎ সেটি খোয়া গেছে।

–কাগজটা কীসের তা নিশ্চয়ই উনি বলেছিলেন? পোয়ারো শ্যেন দৃষ্টিতে ডঃ কারোলিকে জরিপ করতে লাগলেন।

-হ্যাঁ, বলেছিলেন। একটু চুপ করলেন ডঃ কারোলি, সম্ভবত কিছু বললেন। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন–কাগজটায় নাকি একটা ফর্মুলা লেখা ছিল, প্রচণ্ড ধ্বংসাত্মক এক পারমাণবিক বোমার তৈরির ফর্মুলা। স্যার ক্লড আরও বললেন, তার ধারণা যে, ফর্মুলা-চোর এখনও এঘর থেকে সরে পড়েনি, অর্থাৎ পরিবারের সকলের মধ্যেই আছে। কথাটা শুনে আমি খুব মুশকিলে পড়লাম, কারণ ঘরে যারা আছেন, সকলেই এই পরিবারের একমাত্র আমি ছাড়া, যার সাথে এদের পারিবারিক সম্পর্ক নেই। স্যার ক্লডের কথা শুনে সকলের মধ্যে থেকে কে একজন যেন বলে উঠলেন, বেশ, আমাদের তল্লাসি করা হোক। প্রত্যেকে এ প্রস্তাবে রাজী হলেন, আমারও আপত্তি নেই জানিয়ে দিলাম। হতে পারি আমি বিদেশী, কিন্তু আমার তো আত্মসম্মান আছে। এমন একটা সন্দেহ যখন ওদের মনের কোণে উঁকি দিয়েছে, তখন ওদের সাথে তাল দেওয়া ছাড়া আমি আর কি করতে পারতাম বলুন আপনি?

–ঠিকই করেছেন। পোয়ারো সায় দিয়ে বললেন, ওই মুহূর্তের পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজটা আপনি ঠিকই করেছেন। কিন্তু আজ? আজকের ব্যাপারটা কিভাবে সামলাবেন বলুন।

-মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনাকে আগেই জানিয়েছি, আবার বলছি, লন্ডনে অত্যন্ত জরুরী কাজ পড়ে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে লন্ডনের পথে রওনা হতে হবে।

–তাহলে আপনাকে যেতেই হবে, কী বলেন ডঃ কারোলি?

–অবশ্যই আমাকে যেতে হবে, কোনো উপায় নেই। বোঝা গেল ডঃ কারোলি বেশ চটে গেছেন।

–ওনার কথায় যুক্তি আছে। ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, তুমি কী বলে?

হেস্টিংস তার বন্ধুর দিকে ভাবলেশহীন চোখে তাকালেন, অর্থাৎ ডঃ কারোলির কথা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।

–মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার কাছে একটা অনুরোধ রাখছি। দয়া করে আপনি মি. রিচার্ড অ্যামরিকে বুঝিয়ে বললেন। আমার এভাবে চলে যাওয়া উনি হয়তো পছন্দ করবেন না। এই নিয়ে ওদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অশান্তি হোক, তা আমি চাই না।

আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, ডঃ কারোলি। পোয়ারো হাত তুলে অভয় দিলেন, বললেন, এবার একটা প্রশ্নের ঠিক-ঠিক উত্তর দিন তো। মাদাম লুসিয়া অ্যামরির সঙ্গে আপনার কি আগেই পরিচয় ছিল?

নিশ্চয়ই, ডঃ কারোলি জোরের সঙ্গে বললেন, আপনার কাছে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, এতবছর পর এই গ্রাম্য পরিবেশে ওকে দেখে আমি যতটা অবাক হয়েছি, খুশিও হয়েছি ততটা। সত্যি, এ অভাবনীয়, অকল্পনীয়……

–কী বললেন? অভাবনীয় ও অকল্পনীয়?

–ঠিক তাই। আড়চোখে ডঃ কারোলি তাকালেন পোয়ারোর মুখের দিকে।

পোয়ারো নিজেকে নিজে শুনিয়ে বললেন–সত্যিই অকল্পনীয় বটে! তারপর বিস্ময়ভাব কাটিয়ে বললেন–আপনার কল্পনার প্রসারতা দেখে তাজ্জব বনে যাচ্ছি। দারুণ! দারুণ!

পোয়ারো ও হেস্টিংস বাঁকা চোখে ডঃ কারোলিকে লক্ষ্য করলেন, বোঝা গেল, পোয়ারো নীচু স্বরে কথাগুলো বললেও ডঃ কারোলির কানে বেশ ভালো ভাবেই প্রবেশ করেছে।

ডঃ কারোলি তবুও নীরব। পোয়ারো এবার জানতে চাইলেন–এই যে বিশ্বে নিত্যদিন কিছু না কিছু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ঘটে চলেছে, এ সম্পর্কে আপনার আগ্রহ কতটা?

–ডঃ কারোলি সামান্য হেসে বলেন–সম্পূর্ণ মাত্রায়। আমি যেহেতু একজন ডাক্তার, তাই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সম্পর্কে আমার আগ্রহ থাকাই স্বাভাবিক।

স্বীকার করছি। পোয়ারো বললেন, আপনার পেশার সাথে যেসব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, এই ধরুন, দুরারোগ্য ব্যাধির কোনো টিকা, নতুন বীজানুর সন্ধান, রোগ সারাতে অমুক রশ্মির সাহায্য গ্রহণ–এসব ক্ষেত্রে আপনার আগ্রহ থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু মারাত্মক ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বোমা বা বিস্ফোরক আবিষ্কার, এসবে আপনার আগ্রহের কারণ কী? আপনাদের চিকিৎসাবিজ্ঞানের কোন উন্নতির কাজে এসব সহায়ক?

-কিছু মনে করবেন না, মঁসিয়ে পোয়ারো, রোগ সারানোর টিকা বলুন, আর পরমাণু বোমা বলুন, সবইতো বিজ্ঞানের অবদান, এটা মানতেই হবে। অর্থাৎ প্রকৃতিকে জয় করার নমুনা মাত্র। প্রকৃতির বিরোধিতাকে অগ্রাহ্য করে মানুষ বিজ্ঞানের হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অতএব, পরমাণু বোমা বা বিস্ফোরক সম্পর্কে আমার আগ্রহ থাকাটাই স্বাভাবিক বলে মনে করি।

বাঃ, কী সুন্দর সহজভাবে বুঝিয়ে দিলেন। পোয়ারো মুচকি হাসলেন। যেন একটা কবিতা, পরক্ষণে গম্ভীর মুখে বললেন কিন্তু ক্যাপ্টেন হেস্টিংস এর উপদেশ তুললে আমার চলবে না–আমি একজন রসহীন গোয়েন্দা। বাস্তব দৃষ্টি ভঙ্গি দিয়ে সবকিছু খুঁটিয়ে বিচার করা আমরা কাজ। ডঃ কারোলি, আমার ধারণা, স্যার ক্লড অ্যামরির আবিষ্কৃত পরমাণু বোমার ফর্মুলাটির দাম কয়েক লাখ পাউন্ড তো হবেই। আপনিও কি তাই বলেন?

হতে পারে, নিস্পৃহ কণ্ঠে ডঃ কারোলি জবাব দিলেন, আসলে এসব ব্যাপারে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই।

-বুঝতে পারছি, আপনি আর পাঁচজন সাধারণের মতো নন, আপনি উন্নত দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন মহানুভব ব্যক্তি। দেশে দেশে ভ্রমণ করা অর্থাৎ ঘুরে বেড়ানো ব্যয় সাপেক্ষ ব্যাপার। আপনার অর্থের অভাব নেই। তাই অনায়াসে যেখানে খুশি বেড়াতে পারেন।

দুনিয়াটা ঘুরে দেখার চেষ্টা করা কি অস্বভাবিক কিছু? যে পৃথিবীতে বাস করছি, তার চেহারাটা দেখতে হবে বৈকি!

নিশ্চয়ই দেখবেন, তবে দেশের চেহারা দেখলেই চলবে না, বিভিন্ন মানসিকতার লোক রয়েছে, অনেকে বদ মতলবে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায় তাদের চেহারাটাও দেখা দরকার বলে মনে করি। যেমন স্যার ক্লডের ফর্মুলাটা যে চুরি করেছে, তার কথা ধরুন। তার মানসিকতা কী ধরনের সেটা জানার জন্য চোরের চেহারাটা দেখা দরকার আপনার মতো যারা নানা দেশে ঘুরে বেড়ায়, তাদের পক্ষেই সম্ভব।

-তা যা বলেছেন কারোলি খুশি মনে বললেন–অদ্ভুত মানসিকতার লোক বটে।

–এরা ব্ল্যাকমেলার। পোয়ারো চাপা গলায় বলে উঠলেন।

–মানে? ডঃ কারোলি বললেন–কী বলতে চান?

–বিশেষ কিছু নয়। আমি বললাম, ওই বিচিত্র মানসিকতার লোকটি ব্ল্যাকমেলার হতে পারে।

পোয়ারো থামলেন। খানিকবাদে তিনি নড়েচড়ে বসলেন। বললেন–আমরা কথায় কথায় মূল প্রসঙ্গ থেকে ক্রমশ সরে যাচ্ছি। অর্থাৎ স্যার ক্লড অ্যামরির মৃত্যুরহস্য।

–স্যার ক্লডের মৃত্যু! ডঃ কারোলি বাধা দিয়ে বললেন, স্যার ক্লডের মৃত্যু আমাদের আলোচনায় আসছে কী করে?

–কেন নয়? আমার মনে আছে, স্যার ক্লডের আধবসা পাথরের মতো দেহটাকে দেখে আপনি প্রথম পরীক্ষা করে রায় দিয়েছিলেন, হার্ট অ্যাটাকে ওঁর মৃত্যু হয়েছে। অবশ্য পরে, পোস্টমর্টেম করে জানা যায়, হার্ট অ্যাটাক নয়, বিষ খাইয়ে ওঁকে খুন করা হয়েছে। অর্থাৎ ওঁর খাবারে বা পানীয়ে বিষ মেশানো হয়েছে।

-ওঃ, তাই নাকি। ডঃ কারোলি অবাক হওয়ার ভান করলেন।

–আপনার ধারণা আর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট–দুটোর মধ্যে মিল নেই কেন, এটা ভেবে আশ্চর্য হচ্ছেন নিশ্চয়ই।

-একটুও নয়, জোর গলায় ডঃ কারোলি বললেন, কাল রাতে ওঁকে পরীক্ষা করে আমার এই ধারণাই হয়েছিল।

-এবার বুঝতে পারছেন, ব্যাপারটা আর সহজ সরল নেই, কেমন জট পাকানো। অতএব পোয়ারো কঠিন কণ্ঠে বললেন, ডঃ কারোলি, আপনি কোনো ভাবেই এ বাড়ি ছেড়ে এখন যেতে পারছেন না।

ডঃ কারোলি অসহায়বোধ করলেন–আপনার কী ধারণা, ওই ফর্মুলা চুরির আড়ালে আমার কোনো হাত আছে?

-অবশ্যই। আপনি কি নিজেকে সন্দেহের বাইরে মনে করেন?

-ফর্মুলার কথা বাদ দিলে থাকে স্যার ক্লডের মৃত্যুর ঘটনা। ডঃ কারোলি বলতে থাকলেন–এই পরিবারের কোনো একজনকে দেখাতে পারবেন, যিনি ওঁর মৃত্যু কামনা করেননি। মাফ করবেন, একটা অপ্রিয় সত্যি কথা বলি, বহুদিন ধরে এই পরিবারের লোকেরা ওনার শাসনে জর্জরিত ছিল। কারো প্রতি ওনার প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা ছিল না। তিনি কেবল জানতেন নিজের আবিষ্কারে মেতে থাকতে। কাজই ছিল তাঁর প্রথম ও শেষ ভালোবাসা। ফলে প্রচুর টাকার মালিক হতে পেরে ছিলেন। যার সুবাদে পরিবারে এমন এক বাতাবরণ সৃষ্টি করেছিলেন যার থেকে মুক্তি পাবার জন্য সকলেই হাঁস ফাঁস করছিলেন, তাছাড়া স্যার ক্লড ছিলেন অত্যন্ত কিপটে, আঙুলের ফাঁক দিয়ে পয়সা বেরোত না। এই অবস্থায় স্যার ক্লডের আকস্মিক মৃত্যু পরিবারের সকলকে শান্তি দিয়েছে বলে আমি মনে করি।

অবাক করা ব্যাপার! স্যার ক্লডের চরিত্রের এত বৈশিষ্ট্য আপনি কি গত সন্ধ্যাতেই লক্ষ্য করেছিলেন, ডঃ কারোলি?

মঁসিয়ে, পোয়ারো, আমি অন্ধ নই। সুতরাং সব কিছু নজরে পড়াই স্বাভাবিক। এই পরিবারের তিনজনকে জানি, যাঁরা স্যার ক্লডের মৃত্যু চেয়েছিলেন। অবশ্য এ ব্যাপারে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই।

–ডঃ কারোলি, পোয়ারোর চোখে কৌতূহলের ইশারা, আপনি যতই শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চান না কেন, আপনাকে আমি কোনো রকম সাহায্য করতে পারছি না, অমি নিরুপায়।

–আশা করি, আপনার প্রয়োজন মিটেছে। যেতে পারি?

–এই মুহূর্তে আর কোনো প্রয়োজন নেই, পরে দরকার হলে ডাকব।

ডঃ কারোলি আর অপেক্ষা না করে দরজার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন। হঠাৎ কী মনে করে ঘুরে দাঁড়ালেন। বললেন–একটা কথা জানবেন মঁসিয়ে পোয়ারো, এমন কিছু মহিলা আছে, যাদের আমরা চিনি, আমাদের আশে পাশেই ঘুরঘুর করছে, তারা কিন্তু কম বিপজ্জনক নয়, মানুষ খুন করা তাদের কাছে তুচ্ছ ব্যাপার। তাদের বাড়বাড়ন্ত বা স্বেচ্ছাচারিতা কোনোটাই সুখের কারণ নয়।

বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে ডঃ কারোলি ঘর ছেড়ে চলে গেলেন।

.

১১.

–পোয়ারো, ডঃ কারোলি বিদায় নিলে ক্যাপ্টেন হেস্টিংস বললেন, ওনার কথাগুলো শুনলে? কিছু হয়তো বোজাতে চাইছিল মনে হয়।

-না না, কাজের কাজ কিছু নয়, পোয়ারো বিরক্ত হয়ে জবাব দিলেন, আসলে, এসব হলো ওঁর ফন্দি-ফিকিরি কথাবার্তা, আমার তদন্তের কাজের মোড় ঘুরিয়ে নেবার অপচেষ্টা মাত্র। হেস্টিংস, একবার ওঠো তো, বেল টেপো, ট্রেডওয়েলকে চাই। একটু থামলেন তিনি, তারপর বললেন–বন্ধু, তোমার হয়তো মনে নেই, গোয়েন্দাগিরির প্রথম শর্ত হল ধৈর্য। ধৈর্য হারালে সফল হবে কীভাবে?

ঘন্টা ধ্বনি শুনে দরজা ঠেলে মুখ বাড়াল ট্রেডওয়েল–বলুন স্যার, কী করতে হবে?

এসো ট্রেডওয়েল। দুটো কাজ তোমায় করতে হবে। প্রথমত, মিস ক্যারোলিন অ্যামরিকে গিয়ে বলল, আমি ডাকছি, এখুনি যেন উনি আসেন। আর দু’নম্বর হল, ওই ডঃ কারোলির ওপর নজর রাখা। উনি যেন কোনো মতেই এই বাড়ির বাইরে যেতে না পারেন। কথাটা অন্যান্য কাজের লোকদেরও জানিয়ে দিও। আর হ্যাঁ, মিস অ্যামরিকে বলল, বেশি সময় ওনাকে আটকে রাখব না। ওঁর জন্য আমরা এখানে অপেক্ষা করছি।

-ঠিক আছে, স্যার। দরজার পাল্লা ভেজিয়ে দিয়ে ট্রেডওয়েল ফিরে গেল।

-তুমি মিস ক্যারেলিনকে ডেকে পাঠালে, উনি কি আসবেন? ক্যাপ্টেন হেস্টিংস প্রশ্ন করলেন, রিচার্ডের মুখে যতদূর শুনেছি, ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদে তিনি এতই শোকাতুরা যে বিছানা ছেড়ে বাইরে বেরোতে পারছেন না। খাওয়া-দাওয়া নিজের ঘরে বসেই সেরে নিচ্ছেন। বাড়ির সবাইকে বলে বেড়াচ্ছেন, উনি অত্যন্ত অসুস্থ, তা হলে?

-তোমার তো অজানা কিছু নেই হে। পোয়ারো সামান্য হাসলেন, অন্যন্যদের মতো তোমার কি মনে হয়, উনি বিছানা আঁকড়ে পড়ে আছেন?

-সাধারণ ব্যাপার নয় কি?

–ব্যাপারটা সাধারণ কী অসাধারণ, তার সন্ধান তুমি যতই ব্যঙ্গ করো না কেন, রিচার্ড যা বলেছে, তাই বললাম।

হেস্টিংস, পোয়ারো বলতে থাকলেন, গত সন্ধ্যায় নিজের বাড়িতে এইখানে দেশের এক শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীর রহস্যজনক মৃত্যু তুমি দেখেছ। তাকে খুন করা হয়েছে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট তাই বলছে, বিষমিশ্রিত খাবার বা পানীয় তাকে খাওয়ানো হয়েছে। এ এক সাংঘাতিক নিদারুণ ঘটনা, অথচ তার পরিবারের লোকগুলোকে দেখ রহস্য উদঘাটনে সাহায্য না করে আমায় ভুল পথে চালনা করতে চেষ্টা করছে। লুসিয়া অ্যামরির কথাই ধরো না, গত সন্ধ্যায় যে আমাকে প্রায় হাতে পায়ে ধরে তদন্তের কাজ চালিয়ে যাবার জন্য অনুরোধ করেছিল, সে আজ পালটি খেয়ে গেল। সে আমাকে তদন্তের কাজ বন্ধ রেখে বিদায় নিতে বলছে। লুসিয়ার স্বামীও চাইছে, আমি এখান থেকে চলে যাই। রিচার্ড ওর পিসিমা ক্যারোলিনকে আমার সঙ্গে দেখা করতে দিতে নারাজ। ক্যারোলিনের কাছে নিশ্চয়ই, এমন কোনো তথ্য আছে, যা ফাঁস হলে রিচার্ডের বিপদ বাড়বে। এইসব কেনর জবাব আমায় জানতে হবে, বন্ধু। জঘন্য অপরাধ তো করেছেই, তার ওপর বাড়িতে ঘটে চলেছে একের পর এক নাটকীয় দৃশ্য। যে নাটকের প্রতিটি অঙ্গে আছে তীক্ষ্ণ খোঁচা দেবার শাণিত ক্ষমতা।

এমন সময় দরজা খুলে চৌকাঠ ডিঙোলেন মিস ক্যারোলিন ট্রেডওয়েল বলল, আপনি নাকি আমায় ডেকেছেন, মঁসিয়ে পোয়ারো। কী সব প্রশ্ন-ট্রশ্ন করতে চান।

কথা বলতে বলতে ক্যারোলিন ঘরের একেবারে ভেতরে চলে এলেন।

–ঠিকই বলেছেন, মাদাম পোয়ারো তার দিকে এগিয়ে এলেন, গুটি কয়েক প্রশ্ন, বেশি সময় নেব না, কথা দিচ্ছি।

ক্যারোলিনকে একটা চেয়ারে বসতে বলে নিজে একটা চেয়ার টেনে তার মুখোমুখি বসলেন। এই মুহূর্তে পোয়ারোর মুখ-চোখ দেখে মনে হচ্ছে, উনি বোধহয় মিস ক্যারোলিনের দুশ্চিন্তায় ডুবে আছেন।

-সত্যি, আপনার মুখ চোখের যে হাল হয়েছে, বোঝা যায় গতকালের ঘটনা আপনাকে কতখানি শোকাহত করেছে। পোয়ারোর কথায় সহানুভূতির সুর।

–আপনি হয়তো জানেন রিচার্ডের মা অকালে মারা যায়। তারপর থেকে এই সংসারের দায়িত্ব নিয়ে ভাই ক্লডের পাশে দাঁড়িয়েছি। নিজের সুখ-শান্তির দিকে নজর দিইনি, সেই ভাই আজ আর বেঁচে নেই।

-আমি তো মেনে নিতে পারছি না, ক্যারোলিনের গলায় কান্না উঠে এল।

………কী আর বলি, অসুস্থ হয়ে বিছানা নিতে হয়েছে। আর বাড়ির লোকগুলোকে দেখুন, এমন একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল, কাজের লোকগুলোর কোনো হেলদোল আছে, যা নয়, তাই করে চলেছে আমার শরীর খারাপ, ওদের ওপর ছড়ি ঘোরাবারও কেউ নেই। যখন তখন খেয়াল খুশি মতো যেমন তেমন করে কাজ সারছে। ফ্রিজে তুলে রাখা খাবার বলা নেই কওয়া নেই, বের করছে, গরম করছে আর খাচ্ছে। ওরা এখন হাতির পাঁচ পা দেখেছে। কে বলবে, বাড়িতে একজন মারা গেছে, বুঝি বিয়ের মহোৎসব চলেছে। লুসিয়া আর বারবারারই কী দোষ বলুন। ওদের কি আমার মতো বয়স হয়েছে। নেই কোনো অভিজ্ঞতা, নেই ধমকে-ধামকে কাজ করানোর বুদ্ধি। এ এক চরম বিশৃঙ্খলা! ভাগ্যিস কেনেথ ছিল, মানে ডঃ গ্রাহাম। ও আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। গতবছর নিউরাইটিসে ভুগেছিলাম। ছেলেটা আমায় চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলেছিল।

ক্যারোলিন একটানা বলে চললেন-বারবারা আর কেনেথের মধ্যে ভাব–ভালোবাসা আছে। ওরা বিয়ে করে ঘর-সংসার করার মনস্থ করেছে। কিন্তু কেন যে রিচার্ড ওদের পছন্দ করে না, জানি না। আমি অসুস্থ, লুসিয়ারও শরীর ভালো নেই। কেনেথের মতো একজন ডাক্তার জামাই পেলে তো আমাদের সুবিধা। আরে, কী সব বলে চলেছি। গত সন্ধ্যার কথাই ভাবুন। রাতের খাবার খেতে খেতেই লুসিয়ার শরীর হঠাৎ খারাপ হয়ে পড়ল, বুজি বা জ্ঞান হারাবে। কিন্তু না, কোনো মতে নিজেকে সামলে মেয়েটা এখানে চলে এল। বুঝতেই পারছেন, কতই বা বয়স বেচারীর, তার ওপর নার্ভও বিশেষ ভালো নয়। অবশ্য ইটালিয়ান রক্ত যার শরীরে, তার নার্ভ মজবুত হতে পারে না। সেদিনের কথা আজও আমার স্পষ্ট মনে আছে। কয়েক মাস আগের ঘটনা, লুসিয়ার হীরের নেকলেসটা চুরি হল। তখন………..

ক্যারোলিন থামলেন। বুঝি বা দম নিতে।

এই সুযোগে পোয়ারো একটা সিগারেট ধরালেন। জানতে চাইলেন মিসেস লুসিয়া অ্যামরির হীরের নেকলেস চুরি হয়েছিল? কতদিন আগের ঘটনা বলতে পারেন, মাদাম?

–ঠিক দিন ক্ষণ স্থির করে বলতে পারব না, দাঁড়ান বলছি–ক্যারোলিন মনে মনে কী যেন হিসাব করলেন। বললেন–মাস দুয়েক আগে। রিচার্ড আর ওর বাবার মধ্যে কথা কাটাকাটি, এমনকি ঝগড়াও হয়েছিল। তারপরেই, যদুর মনে পড়ছে নেকলেসটার খোঁজ পাওয়া যায়নি।

পোয়ারোর হাতে জ্বলন্ত সিগারেট, তিনি আনমনে আঙুলের দিকে তাকালেন, ধীর পায়ে টেবিলে রাখা অ্যাশট্রের দিকে এগিয়ে এলেন। টোকা মেরে ছাই ঝাড়লেন। বললেন, আমি ধুমপান করছি, আপনার মনে হয় বিরক্ত লাগছে, তাই না, মাদাম?

-না না, ওসব বাতিক আমার নেই, মঁসিয়ে পোয়ারো, ক্যারোলিনের ঠোঁটে হাসি খেলে গেল–তাছাড়া পুরুষ ধূমপান করবে, এটাই তো স্বাভাবিক, আমার বেশ ভালো লাগে।

–ধন্যবাদ। আচ্ছা মাদাম, বলুন তো স্যার ক্লড আর তার ছেলের মধ্যে কী নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল? আপনি কি জানেন?

-কেন জানব না? বলছি শুনুন। রিচার্ড প্রচুর টাকা ধার করত, অবশ্য ব্যাপারটা ক্রমশ সীমার বাইরে চলে যাচ্ছিল। অবশ্য আমি এটাকে দোষ বলে মনে করি না, ওই বয়সের ছেলেরা দেনা করবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে ওর বাবার কথা স্বতন্ত্র। ছোটবেলা থেকেই পড়া শোনায় ভালো, বলতে পারেন মেধাবী। এমন কোনো নেশা ছিল না, যা ধার-দেনা করে চালাতে হত। পরে গবেষণা করে প্রচুর টাকার মালিক হয়েছে, একথা অজানা নেই। তবে ওর কি দোষ ছিল না? রিচার্ড আর্মিতে চাকরি করত, জানেন। এটা-সেটা বোঝাল, চাকরিটা তাকে ছাড়তে বাধ্য করল। কিন্তু হাত খরচের টাকা পাবে কোথায়? বাবা কথা দিয়েও কথা রাখেনি। শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা অশান্তিতে পরিণত হল। কদিন পরেই, শোনা গেল, লুসিয়ার হার পাওয়া যাচ্ছে না, আশ্চর্যজনকভাবে। পুলিশে ব্যাপারটা জানানো হয়নি, কারণ লুসিয়ার আপত্তি। এটাও আমাদেরকে আরও বেশি আশ্চর্য করেছে।

-সত্যিই আশ্চর্য, মাদাম, পোয়ারো সায় দিলেন, লুসিয়ার মতো সুন্দরী তরুণী, দামী হীরের নেকলেস খুঁজে না পেয়ে কোনোরকম হৈ-চৈ করল না। ব্যাপারটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।

-লুসিয়াকে দেখে তখন মনে হত, সামান্য এক নেকলেশ হারিয়েছে তো অ্যামরি কী যায়-আসে, এমনই ভাব। আম’লো যা, আপনাকে এসব বকবক করে কী বলছি, আপনার কোন কাজে লাগবে?

-মাদাম, আপনি দ্বিধা বোধ করছেন নিশ্চয়ই, কিন্তু আমি বলছি, আপনার মুখ থেকে এ পর্যন্ত যে সব তথ্য আমি পেলাম, আমার তদন্তের কাজে তা সাহায্য করতে পারে। মিস অ্যামরি, কোনোরকম সঙ্কোচ করবেন না, যেসব ঘটনা ঘটে গেছে, তা যত খুঁটিয়ে আমায় বলতে পারবেন, ততই আমার তদন্তের সুবিধা হবে। হ্যাঁ, পোয়ারো জানতে চাইলেন–গত সন্ধ্যায় ডিনারের টেবিলে বসে লুসিয়ার শরীর খারাপ লাগছিল, আপনি বলেছেন, তারপর? তারপর সে কি তার ঘরে চলে গিয়েছিল?

-নিজের ঘরে যেতে ওর বয়ে গেছে। ক্যারোলিনের মেজাজ বিগড়ে গেল। ডিনার হল থেকে বেরিয়ে ও সোজা এই লাইব্রেরি ঘরে এসে ঢুকেছিল। পরমুহূর্তে আমি এসে ঢুকলাম। কত রকম বুঝিয়ে সুজিয়ে সোফায় বসিয়ে দিয়েছিলাম। রিচার্ড আর লুসিয়া কী সুন্দর জুটি বলুন তো। গত বছর রিচার্ড ইটালিতে গিয়েছিল। ওখানেই লুসিয়ার সঙ্গে পরিচয়। এবং প্রেম। নভেম্বরে বিয়ে করে বউকে নিয়ে রিচার্ড দেশে ফিরে আসে।

ক্যারোলিন একটু দম নিলেন। আবার বলতে শুরু করলেন–মাতৃপিতৃহীন মেয়েটা অনাথ আশ্রমে মানুষ হয়েছে। ওর আত্মীয় স্বজনও বোধহয় কেউ নেই। না থেকে ভালোই হয়েছে। হাজার হোক বিদেশী তো। সর্বক্ষণ পেছনে লেগে থাকত, সুযোগ সুবিধা লাভের আশায়। বিদেশীদের স্বভাব-আচরণ আমার মোটেও সহ্য হয় না, সহ্য করা দায়। মাফ করবেন মঁসিয়ে পোয়ারো, আমার কথাটা আপনি আবার গায়ে নেবেন না। আপনি বিদেশী, তবে বেলজিয়ান। ইউরোপের প্রত্যেকটা যুদ্ধের আঁচ আপনাদের গায়ে লেগেছে, আপনারা, অর্থাৎ বেলজিয়ানরা কী দারুণ সাহসী, তা আমার জানা।

আসুন মাদাম, ওসব কথা বাদ দিয়ে আমরা কাজের কথায় আসি। বইয়ের শেলফে ওষুধ ভরতি ওই কালো টিনের বাক্সটা, সম্ভবত ওটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এসেছিল, তাই না? আপনারা গত সন্ধ্যায় এঘরে বসে ওটা খুলে ওষুধ ঘাঁটা ঘাঁটি করছিলেন তো।

-মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার কথাই ঠিক। ক্যারোলিন একটু থামলেন, কী ভাবলেন, তারপর আবার বললেন–আমিই ওটা নামিয়ে নিয়ে আসতে বলেছিলাম। ভাবলাম, যদি স্যালভলটাইল বা ওই জাতীয় কোনো ওষুধ থাকে, তাহলে লুসিয়ার জ্ঞান ফেরাতে কাজে লাগবে। আমার কথা মতো বারবারা চেয়ারে উঠে ওটা পেড়ে নিয়ে এল। সেই সময় ঘরে এসে ঢুকল আমার ভাই, আর ওর সেক্রেটারি এডওয়ার্ড রেনর ও আমার ভাইপো। ডঃ কারোলিও এসে জুটেছিল। দেখলাম ওষুধগুলো সম্পর্কে ডঃ কারোলির কৌতূহল বেশি। তিনি ওষুধগুলো তুলে তুলে দেখছিলেন, নাম বলছিলেন আর ওদের শক্তির পরিচয় দিচ্ছিলেন। শুনে আমার তো চক্ষু ছানাবড়া।

–যেন ডঃ কারোলি এমন কোন ওষুধের গুণাবলীর কথা জানিয়ে দিলেন, যার ফলে আপনি ঘাবড়ে গেলেন?

–একটা টিউব উনি, অর্থাৎ ডঃ কারোলি তুলে নিলেন। টিউবের গায়ে ওষুধের নাম লেবেলে লেগে আছে। নামটা শুনে আমার সাধারণ ওষুধই মনে হচ্ছে। সমুদ্রে জাহাজে চেপে বেড়ানোর সময় সি-সিকনেস দূর করার জন্য যে ওষুধ আর কী, ওর ক্ষমতা আমার জানা আছে। বহু বার খেয়েছি কিনা। কিন্তু ডঃ কারোলি আমার ধারণা মিথ্যে করে দিলেন। তিনি জানালেন যে, এই ওষুধ এমন মারাত্মক ক্ষমতা সম্পন্ন বিষ, যার ক্রিয়ার ফলে অন্তত বারোজন শক্তিশালী পুরুষের জীবন কেড়ে নিতে পারে।

–ওষুধটার নাম সম্ভবত হিসকোসিন হাইড্রোব্রোমাইড?

-কারোলির কাছ থেকে সবাই জানলাম, এই ওষুধের বড়ি দশ-বারোটা খেলেই চলবে, নিশ্চিন্তে নিরুদ্বেগে ঘুম, যে ঘুম জীবনে আর ভাঙবে না। তার হাত থেকে লুসিয়া টিউবটা একবার নিল। আহা! ডঃ কারোলির বর্ণনা শুনে কবি লর্ড টেনিসনের কথা মনে পড়ে যায়। টেনিসন মারা যাবার পর মৃত্যুর এমন কাব্যিক বর্ণনা কারো লেখায় পড়িনি।

–এই খেয়েছে, পোয়ারো আপনমনে বললেন, বুড়ি হয়েছে, অথচ রোমান্স কমেনি। কী যে করি এখন….. পোয়ারো নিজেকে স্বাভাবিক করলেন, বললেন আপনার মুখে লর্ড টেনিসনের নাম শুনে আমার মনে পড়ে গেল তার অমর কীর্তি চার্জ অব দ্য লাইট ব্রিগেড-এর দুটো লাইন যেখানে বলা হয়েছে ক্যাননস্ ইন ফ্রন্ট অব দেম ভলিড অ্যান্ড থান্ডার্ড’। যাক টেনিসন ছেড়ে দিয়ে, যা বলছিলেন, তাই বলুন।

-কী বলছিলাম বলুন তো, মঁসিয়ে পোয়ারো ক্যারোলিন চুপ করলেন, মনে করার চেষ্টা করলেন। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল, তিনি আবার বলতে শুরু করলেন–খেয়াল করতে পারছিলাম না, সামান্য হাসি দেখা গেল তার ঠোঁটে, গুচ্ছের পুরোনো বাজনার রেকর্ড ছিল বুঝলেন, বারবারা কী খেয়ালে একটা টেনে নিয়ে এসে গ্রামোফোনে লাগিয়ে ছিল। মা গো মা, বিশ্রী রেকর্ড। যাচ্ছেতাই, ছেলেবেলায় ওই রেকর্ড শুনেছি। সকলে ছিঃ ছিঃ করত। যেমন তার কথা, তেমনই অর্কেস্ট্রা। মাথা গরম হয়ে গেল। চট করে উঠে গিয়ে ওটা থামিয়ে দিলাম।

তারপর? তারপর সেই পুরোনো ওষুধের টিউবের কথা বলছিলাম, ওটাই তো ডঃ কারোলি চোখের সামনে তুলে ধরেছিলেন, তাই না? আচ্ছা মাদাম, ওই টিউবটা কি ওষুধে পূর্ণ ছিল? নাকি….

-না, কোনো ফাঁক ছিল না, টিউবের মুখ অব্দি বড়িগুলো ছিল, চট করে জবাব দিলেন ক্যারোলিন। ডঃ কারোলির বলা কথাগুলো আমার খুব ভালো করেই মনে আছে। ওই টিউবের যতগুলো বড়ি আছে, তার অর্ধেকটাই নাকি দশ বারোজন শক্ত সমর্থ লোককে হত্যা করতে যথেষ্ট।

আবেগের বশে ক্যারোলিন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, নিজের মনে বলে চললেন–মঁসিয়ে পোয়ারো, জানেন, ওই ইটালিয়ান ডাক্তারটিকে গোড়া থেকেই আমার কেমন যেন মনে হত। তবে লুসিয়ার পুরোনো বন্ধু কিনা তাই কঠোর আচরণ করতে পারিনি। তবে পছন্দও করতে পারিনি। আপনি যাই বলুন না কেন, লোকটা ফর্মুলা চুরি করার মতলব নিয়েই লুসিয়ার সাথে বন্ধুত্ব করেছে। তার বিশ্বাস অর্জন করেছে এবং শেষে এ বাড়ির অতিথির ছদ্মবেশে ঢুকে পড়েছেন।

পোয়ারো নির্বিকার চিত্তে কারোলিনের দিকে তাকালেন। তাকে আরও যাচাই করার জন্য প্রশ্ন করলেন–মাদাম, স্যার ক্লডের ফর্মুলা যে ওই ডঃ কারোলিই হাতিয়েছে এ ব্যাপারে আপনি ষোলো আনা নিশ্চিত, তাই তো?

-না হলে আর কে বা হতে পারে বলুন আপনি? গত সন্ধ্যায় যখন ঘটনাটি ঘটে, তখন আমরা সবাই বাড়ির লোক উপস্থিত ছিলাম এখানে, একমাত্র উনি ছাড়া। আমার ভাই স্যার ক্লডও মনে হয় তাকেই সন্দেহ করে ছিলেন। এবং নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, ডঃ কারোলিই তার ফর্মুলা-চোর, কিন্তু সরাসরি তাকে চোর সাব্যস্ত করতে তার আভজাত্যে বেধেছিল। কারণ ডঃ কারোলি লুসিয়ার পুরোনো বন্ধু, সেই সুবাদে এবাড়ির অতিথি। তাই ক্লড বুদ্ধি করে বাড়ির আনোগুলো নিভিয়ে দেবার নির্দেশ দিয়েছিল। যাতে চোর আধারের সুযোগ পেয়ে জিনিসটি ফেরত দিতে পারে। ফলে চোরেরও সম্মান রক্ষা হল, আবার হারানো অমূল্য সম্পদ হাতে ফিরে এল। বলুন, স্যার ক্লড কি বোকমির কাজ করেছিল?

-মোটেও না, পোয়ারো সায় দিলেন। বরং স্যার ক্লড বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। মিস অ্যামরি, আমি দেখতে চাই গতকাল সন্ধ্যায় আপনি ঠিক কোন অবস্থানে ছিলেন। দয়া করে একবার সেখানে গিয়ে বসবেন?

ক্যারোলিন কথা না বাড়িঠে উঠে গিয়ে বসলেন সোফার একটা ধারে।

বাঃ ঠিক আছে। এবারে দু-চোখের পাতা এক জায়গায় করুন। করেছেন তো? ফিরে যান গত সন্ধ্যায়, আলো নিভে গেল, চারপাশ অন্ধকার। ঠিক আছে? নিঃসীম অন্ধকার। নিজেকে নিজে দেখা যায় না। এরকমই বিশ্রী এক অন্ধকারের মধ্যে কোনো ছোট-বড় আওয়াজ আপনার কানে এসেছিল? মনে করুন, চেষ্টা করুন।

ক্যারোলিন দু-চোখের পাতা এক জায়গায় করে বসে আছেন। ফিরে গেছেন গত সন্ধ্যার সেই নিকষ কালো অন্ধকারের গর্ভে।–হ্যাঁ, মনে আছে, একটা আওয়াজ, কেউ যেন হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে দম নিচ্ছে, পরক্ষণেই কানে এল চেয়ার উলটে পড়ার আওয়াজ, সঙ্গে সঙ্গে আর একটা আওয়াজ, ছোটখাট ধাতব টুকরোর জিনিস মাটিতে ফেলে দিলে যেমন হয়, ঠিক তেমনই শব্দ।

এখন দেখুন পোয়ারো একটা চাবি বের করে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেললেন। বললেন–এরকম আওয়াজ ছিল কি?

-আশ্চর্য! দুটো আওয়াজের মধ্যে এত মিল। মঁসিয়ে পোয়ারো, ঠিকই ধরেছেন। আওয়াজটা এরকমই পেয়েছিলাম। মাদাম তখনও চোখ বুজে আছেন।

মিস অ্যামরি, মনটাকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান। দয়া করে থামবেন না।

এরপরেই লুসিয়ার আর্ত চিৎকার, সে তার শ্বশুরের নাম ধরে চিৎকার করছিল। পরক্ষণেই বাইরে আওয়াজ, দরজায় কে যেন টোকা দিচ্ছিল।

এই পর্যন্তই, আর কিছু নয়। মাদাম, আর একটু কষ্ট করুন। মনে করে দেখুন, দোহাই

–সবুর করুন, ভাবতে দিন। ক্যারোলিন মুহূর্ত খানেক পর আবার বললেন–হ্যাঁ, কাপড় ছেঁড়ার শব্দ, প্রথমেই শুনেছিলাম, মনে হল কে যেন তার পরনের পোশাক ছিঁড়ছে। বারবারা আমার পাশেই বসেছিল, অতএব সে নয়। লুসিয়া হতে পারে। সে-ই তার নিজের কাপড় ছিঁড়ছিল। মঁসিয়ে পোয়ারো আর চোখ বন্ধ করে থাকতে পারছি না। বলেন তো…….।

-হ্যাঁ, খুলুন। পোয়ারো এবার জানতে চাইলেন, গত সন্ধ্যায় স্যার ক্লডের জন্য কাপে কফি কি আপনিই ঢেলেছিলেন?

-না, আমি নয়, বেশ জোরালো কণ্ঠস্বর ক্যারোলিনের। আমার খুব ভালো ভাবেই মনে আছে, লুসিয়াই তার শ্বশুরের জন্য কাপে কফি ঢেলেছিল?

-কখন বলতে পারেন?

–ডঃ কারোলি যখন ওই মারাত্মক সর্বনাশা ওষুধগুলোর ক্ষমতা সম্পর্কে জ্ঞান দিচ্ছিল, তার পরেই।

-কাপে কফি ঢালার পর স্টাডিতে কে নিয়ে গিয়েছিল? লুসিয়া?

–না, লুসিয়া কফি ঢেলে রেখেছিল। যতদূর খেয়াল আছে, ও নিয়ে যায়নি স্টাডিতে।

 –তাহলে?

-তাহলে? থামুন, ভাবতে দিন, বলছি। ক্যারোলিন ফিরে গেলেন গত সন্ধ্যার দৃশ্যপটে। খানিক হাতড়ে বেড়ালেন। তারপরেই, লাফিয়ে উঠলেন–হ্যাঁ, পেয়েছি, লুসিয়া নয়, ও কেবল কফি ঢেলে ছিল। ওটা স্টাডিতে নিয়ে যাচ্ছিল স্যার ক্লডের সেক্রেটারি এডওয়ার্ড রেনর। লুসিয়া ওকে বাধা দিয়ে বলল, ওটা স্যার ক্লডের কফির কাপ নয়, এটা। বলে ইঙ্গিতে অন্য একটা কাপ দেখিয়ে দিল। তবে আশ্চর্যের কী জানেন, দুটো কাপের কফিই ছিল দুধ ছাড়া, অর্থাৎ কালো, আর চিনিও ছিল না।

তার মানে মঁসিয়ে রেনররই স্যার ক্লডকে কফির কাপটা দিয়ে এসেছিলেন। ব্যাপারটা তাই তো দাঁড়াচ্ছে? পোয়ারোর কপালে কুঞ্চন রেখা।

-হ্যাঁ, পরক্ষণেই মত পালটে ক্যারোলিন বললেন, না, ভুল বলা হল, ঠিক ওই সময় বারবারা তার ফক্ৰটট নাচের সঙ্গী হতে রেনরকে অনুরোধ করল। তাই রিচার্ড এগিয়ে এসে রেনরের হাত থেকে কাপটা নিয়ে ঢুকেছিল বাবার স্টাডিতে।

-ওহো, তাই বলুন। মঁসিয়ে রিচার্ডই শেষ পর্যন্ত কাজটা করেছিলনে তো?

— হ্যাঁ, কঠিন গলায় ক্যারোলিন সায় দিলেন।

-আচ্ছা, তার আগে রিচার্ড কী করছিলেন? উনিও কি বাজনার তালে তালে নাচছিলেন?

-না, রিচার্ড নাচের ধারে কাছে যায়নি। ও টিনের বাক্সে ওষুধগুলো ঠিকঠাক সাজিয়ে রাখছিল।

-তারপর কী কী ঘটল?

-তারপরে স্যার ক্লড স্টাডি থেকে বেরিয়ে এল, হাতে শূন্য কাপ। আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিল। বলল, কফিটা কেমন বিশ্রী রকমের তেতো লেগেছে। একবার নয়, একই কথা কয়েকবার বলেছিল। আমি তো অবাক, দারুণ তেতো কী করে হবে? আমি নিজে অর্ডার দিয়ে ওই কফি পাউডার তৈরি করিয়ে আনি, সেরা কফি। লন্ডনের আর্মি নেভি স্ট্রোস-এর দোকান আছে ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটে, রেলস্টেশন লাগোয়া দোকান আমি..

ক্যারোলিনকে কথা থামাতে হল। কারণ তখন দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়েছে এডওয়ার্ড রেনর। মাথা সোজা না করে পোয়ারোকে উদ্দেশ্য করে বলল–আপনার সঙ্গে কিছু দরকার ছিল, মঁসিয়ে পোয়ারো। আপনি ব্যস্ত দেখছি, আমি না-হয় পরে আসব।

পোয়ারো সামান্য হাসলেন–না না, ব্যস্ত নই। আপনি বসুন, আমি মিস অ্যামরিকে দরজা পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে আসি।

-মঁসিয়ে পোয়ারো। ক্যারোলিন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন–মনে হয় না, আমার এ তথ্য আপনার কোনো কাজে লাগবে।

কারোলিন দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। পোয়ারো তার পেছন পেছন এসে দরজার পাল্লা খুলে দিলেন। ক্যারোলিন চৌকাঠের বাইরে পা রাখতে চলেছেন। এমন সময় ফিসফিসিয়ে পোয়ারো জানালেন মাদাম, আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আপনাকে আন্তরিকভাবে জানাচ্ছি, এসব তথ্য আপনি না বললে, হয়তো আমার অগোচরেই থেকে যেত।

বিদায় অভিবাদন জানিয়ে দরজার পাল্লা এঁটে দিয়ে পোয়ারো ঘরের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন–মঁসিয়ে রেনর, কী মনে করে আমার কাছে?

রেনরের সামনে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন পোয়ারো–বলুন, কী বলতে এসেছেন? নিঃসঙ্কোচে বলতে পারেন।

মঁসিয়ে পোয়ারো, সত্যি আশ্চর্যের ব্যাপার, রেনর বলতে থাকল, সার ক্লডের কীভাবে মৃত্যু ঘটেছে, এই একটু আগে জানতে পেরেছি। মি. রিচার্ড অ্যামরি সব আমায় বলেছেন।

রেনরের চোখে আন্তরিকতা ঝরে পড়ছে। পোয়ারো তা লক্ষ্য করে জবাব দিলেন তাই বুঝি! আচ্ছা মি. রেনর….. কথা বলতে বলতে পোয়ারো তাঁর জ্যাকেটের পকেট থেকে সেই চাবিটা বের করলেন, যেটা স্যার ক্লড মারা যাবার পরে তার মৃতদেহের কাছে উলটে পড়ে থাকা চেয়ারের নীচে পড়েছিল। …এটা দেখুন, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবেন। কী মনে হয়?

পোয়ারো তার সন্ধানী চোখে রেনরকে জরিপ করতে লাগলেন।

চাবিটা হাতে নিয়ে রেনর দেখতে লাগল, এটা তো স্যার ক্লডের সিন্দুকের চাবির মতো দেখতে। খুঁটিয়ে আবার দেখল। তারপর সেটা পোয়ারোর হাতে ফেরত দিতে দিতে বলল–এটা কী করে সম্ভব! আমি যতদূর জানি সিন্দুকের চাবিটা চাবির গোছাতেই আছে, রিচার্ডের মুখে অবশ্য শুনেছি।

-মঁসিয়ে রিচার্ড ভুল বলেননি, আপনার অনুমানও ঠিক, এটা স্যার ক্লডের সিন্দুকেরই চাবি, তবে, পোয়ারো তীক্ষ্ণ চোখে আবার সামনে বসে থাকা রেনরের দিকে তাকালেন বলতে পারেন এটা ওই চাবির দোসর, অর্থাৎ নকল। এবার পোয়ারো তার কণ্ঠস্বর এক পর্দা উঁচুতে তুলে, অবশ্য ইচ্ছাকৃত, বললেন–গত সন্ধ্যায় এঘরে আপনি যে চেয়ারে বসেছিলেন, তার তলা থেকে এটা পাওয়া গেছে।

একথা শুনে রেনরের চোখে-মুখের কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল না। আগের মতোই সাবলীল ভঙ্গিতে বলল–আপনার কি ধারণা, চাবিটা আমিই চেয়ারের তলায় ফেলে দিয়েছিলাম? তাহলে বলব, আপনার অনুমান সম্পূর্ণ ভুল, মঁসিয়ে পোয়ারো।

পোয়ারো নীরব হলেন। রেনরকে দেখতে লাগলেন-সন্ধানী দৃষ্টিতে। তারপর ঘাড় নাড়লেন–আপনার কথাই ঠিক হয়তো।

পোয়ারো এবার চেয়ার ছেড়ে চলে এলেন সোফার একধারে। বসলেন, হাতের ওপর হাত রেখে ঘষে নিলেন। তারপর তাকালেন রেনরের দিকে–মঁসিয়ে রেনর, আসুন, আমরা এবার আপনার কাজ সম্পর্কে কিছু বলি। আপনিই তো স্যার ক্লডের সেক্রেটারি ছিলেন?

-হ্যাঁ।

তার মানে আপনি ওঁর গবেষণার কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ফলে অনেক গোপনীয় তথ্য আপনার জানা আছে, তাই না?

যেহেতু, আমি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম, তাই গবেষণার কাজে স্যার ক্লডকে একটু আধটু সহায়তা করতে হয়েছে বৈকি!

গবেষণার সঙ্গে যুক্ত নয়, অথচ এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার ওপর আলোকপাত করতে পারে, এমন কিছু কি আপনার নজরে পড়েছে? এমন কিছু যার সঙ্গে স্যার ক্লডের হত্যাকান্ডটি সম্পর্কিত?

মি. রিচার্ড অ্যামরি তার বাবার কাছে আসা চিঠিপত্রগুলি বেছে আমাকে আলাদা করে রাখতে বলেন। সেইমতো বিদেশ থেকে আসা চিঠিপত্রের গোছা থেকে চিঠিটা পেয়েছি, দু-দিন আগে এটা এসেছিল। রেনর একটা খাম পোয়ারোর দিকে এগিয়ে দিল।

পোয়ারো তাকালেন, খামের মুখটা ছুরি দিয়ে কাটা হয়েছে বোঝা গেল। পোয়ারো হাত বাড়িয়ে খামটা নিলেন। ভেতর থেকে চিঠিটা বের করলেন। ঘরে উপস্থিত সকলকে শুনিয়ে পড়তে লাগলেন–

………….আপনি একটা সাংঘাতিক বিষাক্ত সাপকে স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে বুকে আশ্রয় দিয়েছেন।

–হুক-এর অর্থ এখানে কী হতে পারে? পোয়ারো তাকালেন তার সহকারী ক্যাপ্টেন হেস্টিংস-এর দিকে, মনে হল প্রশ্নটা তিনি তার উদ্দেশ্যেই ছুঁড়ে দিয়েছেন।

তারপর আবার চিঠির পাতায় নজর দিলেন পোয়ারো–বিষধর নাগিনী সেলমা গেতজ……..

–এই মহিলার পরিচয় কী?

–জানতে চান, তাহলে শুনুন। পোয়ারো সোফায় হেলান দিয়ে আরাম করে বসলেন, বললেন–সেলমা গেতজ একজন মহিলা গুপ্তচর। মেয়ে গুপ্তচরের তালিকায় তার নাম সবার ওপরে ছিল। অসাধারণ সুন্দরী ছিল, কাজের সফলতায় সে ছিল সবার সেরা। ইটালি, ফ্রান্স, জার্মানির হয়ে সে নির্ভয়ে কাজ করত, সব শেষে রাশিয়াও ওকে গুপ্তচরগিরিতে কাজে লাগিয়েছিল।

-’ছিল’ মানে! এ কি অতীত? রেনর জানতে চাইল।

তার মানে হল………..

তার মানে হল সেলমা গেতজ সত্যিই আজ অতীত হয়ে গেছে। জেনোয়ার এক বন্দীশালায় তার মৃত্যু হয়েছিল।

এই চিঠির অন্তর্নিহিত অর্থ যে ক্যাপ্টেন হেস্টিংস-এর বোধগম্য হয়নি তা বুঝতে দেরি হল না পোয়ারোর। তিনি হাত বাড়িয়ে বন্ধুর কাছ থেকে চিঠিটা ফিরিয়ে নিলেন।

–বোকা বানানোর জন্য এই চিঠি। রেনর তার অভিমত প্রকাশ করল।

সেলমা গেতজ আর তার ডিম ফুটে বাচ্চা………–কথাগুলি নিয়ে পোয়ারো আপন মনে বিড়বিড়িয়ে উচ্চারণ করতে লাগলেন, বাচ্চা বেরিয়েছে কথার অর্থ কী? কী বলতে চাইছে?

খানিকবাদে তিনি তার চিন্তার তল থেকে উঠে এলেন। বললেন–সেলমা গেতজের একটা মেয়ে ছিল বলে জানি, মায়ের মতোই, সে ছিল অপরূপ সুন্দরী। সেলমা গত হলে মেয়েটির আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। কোথায় গেছে কেউ জানে না, কেমন এক রহস্যজনক ব্যাপার…..

চিঠিটা খামের মধ্যে ভরে পোয়ারো সেটাকে নিজের জ্যাকেটের পকেটে চালান করে দিলেন।

–হতে পারে………রেনর কী বলতে গিয়ে ও বলল না।

 পোয়ারো তাড়া দিলেন–কী হল, থেমে গেলেন কেন? বলুন, কী বলতে চাইছেন

–একটা ইটালিয়ান মেয়ের কথা বলছি। রেনর বলে চলল, একটু নীচু গলায়–এবাড়ির বউ, শ্ৰীমতী লুসিয়া অ্যামরি, ইটালি থেকে আসার সময় সঙ্গে করে একটি মেয়েকে নিয়ে আসেন। নাম ভিক্টোরিয়া সুজিও। এ-ও সুন্দরী। সে মিসেস অ্যামরির খাস চাকরানি বলতে পারেন। মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি যার কথা বলছিলেন, মানে সেলমা গেতজ-এর মেয়ে এ হতে পারে, তাই নয় কি!

হতে পারে। পোয়ারো আনমনে জবাব দিলেন, তবে দারুণ তথ্য, তলিয়ে ভাবতে হবে।

–তাহলে, মঁসিয়ে পোয়ারো বৃথা সময় অপচয় করার দরকার নেই। আমি এখুনি ওকে ডেকে দিচ্ছি। রেনর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, খোঁজ খবর নিন, দেখুন জবাব মেলে কিনা।

আরে, এত ব্যস্ত হওয়ার কী আছে! পোয়ারো বাধা দিয়ে বললেন–আগেভাগে জেনে গেলে মেয়েটা সাবধান হয়ে যাবে। বরং মিসেস লুসিয়া অ্যামরির কাছে জানতে হবে মেয়েটা সম্পর্কে। আশা করি কিছু তথ্য হাতে পাব।

হতে পারে। তাহলে মিসেস লুসিয়া অ্যামরিকেই বলে দিচ্ছি, আপনি তাকে ডাকছেন।

কথা শেষ করে রেনর বিদায় অভিবাদন জানিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

-এতক্ষণে ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার হল। ক্যাপ্টেন হেস্টিংস-এর কথায় উত্তেজনা ঝরে পড়ল। ডঃ কারোলি আর লুসিয়ার কাজের মেয়েটি আসলে কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের গুপ্তচর। স্যার ক্লড অ্যামরির মূল্যবান ফর্মুলা হাতানোর জন্য সুঁচ হয়ে ঢুকে পড়েছে এ বাড়িতে ঠিক তত?

বন্ধুর কথা পোয়ারোর কানে গেল বটে, কিন্তু সাড়া দিলেন না, তিনি তখন গভীর চিন্তায় ডুবে আছেন।

হেস্টিংস, পোয়ারোর এই উদাসীনতায় রেগে গিয়ে বললেন–কী হল? তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছে না। এবার একটু চড়া গলায় আগের কথাগুলি পুনরাবৃত্তি করলেন স্যার ক্লডের ফর্মুলা ওই ডঃ কারোলি আর লুসিয়ার কাজের মেয়েটা চুরি করেছে, তাই কিনা? ওরা কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের গুপ্তচর?

-তোমার বুদ্ধির বহর দেখে হাসি পাচ্ছে। পোয়ানোর ঠোঁটে হাসির ঝিলিক।

–হাসছে যে! হেস্টিংস চড়া সুরে জানতে চাইলেন, তোমার কি ধারণা বলল।

–এখনও কিছু বলার সময় হয়নি, ভায়া। প্রশ্নের পর প্রশ্ন এসে ভিড় করেছে। আগে এগুলোর ঠিকঠাক জবাব পাই, তার পর না-হয় সিদ্ধান্তে যাওয়া যাবে। পোয়ারো বললেন, ধরো এই প্রশ্নটা লুসিয়া অ্যামরির হীরের নেকলেস চুরি হওয়া সত্ত্বেও পুলিশে খবর তিনি দিতে দিলেন না। কেন বলতে……

পোয়ারোর কথা শেষ হল না, ঘরের ভেতরে এসে পা রাখল লুসিয়া, হাতে ঝুলছে। সেই ব্যাগটা।

-বলুন, মঁসিয়ে পোয়ারো, কোনো ভনিতা না করে লুসিয়া জানতে চাইল, তার কথায় বা আচরণে ভয়ের ছাপ নেই, বেশ সপ্রতিভ বলা চলে। কী জন্য ডেকেছেন?

-হ্যাঁ, মাদাম। বলছি। একটা চেয়ার দেখিয়ে দিয়ে পোয়ারো বললেন বসুন। তারপর আমার প্রশ্ন শুনবেন।

লুসিয়া চেয়ারে বসল। পোয়ারো চাইলেন না, এই প্রশ্নোত্তর পর্বে ক্যাপ্টেন হেস্টিংস যোগ দিল। খোলা ফ্রেঞ্চউইন্ডোর দিকে হেস্টিংসের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, বন্ধু, দেখেছ বাইরের দিকে, কী সুন্দর পরিবেশ। ঘরের মধ্যে বসে না থেকে, যাও, প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করো। এমন সুযোগ কখনো ফিরে পেতে নাও পারো।

হেস্টিংস-এর ইচ্ছা ছিল না, তবু পোয়ায়োর নির্দেশ অমান্য করতে পারলেন না। তিনি একটা জানলা টপকে ঘরের বাইরে চলে এলেন, পা রাখলেন বাগানে।

অযত্নে বড় হয়ে উঠেছে ফণিমনসার ঝোপ, আরও কত নাম না জানা গাছ। ঘাসের ডগাগুলো না ছাঁটার ফলে বেশ মাথা তুলেছে। ঝোপগুলোকে এড়িয়ে হেস্টিংস লম্বা লম্বা পা ফেলে এগোলেন।

হঠাৎ তাকে থামতে হল। কান পাতলেন। স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে এক নারী ও পুরুষ–দু’জনের মধ্যে কথা বলাবলি করছে। ওদের কণ্ঠ চিনতে দেরি হল না তার –নিশ্চয়ই বারবারা আর ডঃ কেনেথ গ্রাহাম। চুপিসাড়ে হেস্টিংস এসে দাঁড়ালেন একটা বড় গাছের আড়ালে। হ্যাঁ যা ভেবেছেন ঠিক তাই দুজনে খুব কাছাকাছি বসে আছে একটা বেঞ্চে। ওরা কী বিষয় নিয়ে কথা বলছে? স্যার ক্লড ও তার ফর্মুলা চুরির বিষয়ও হতে পারে। শুনতে হয়।

হেস্টিংস অত্যন্ত সতর্কভাবে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে সেই বেঞ্চের কাছাকাছি চলে এলেন। কান পাতলেন

-রিচার্ড মুখেই আমায় বন্ধু বন্ধু বলে, আসলে, ডঃ গ্রাহামের কণ্ঠস্বরে ক্ষোভ ঝরে পড়ছে, সে আমাকে একটা গেঁয়ো ডাক্তার ছাড়া আর কিছু মনে করে না। আর তাই সে আমাদের এই মেলামেশা বরদাস্ত করতে পারছে না।

ফুঃ, রিচার্ডের কথা ছাড়ো তো। বারবারা তুড়ি মেরে সরিয়ে দিল গ্রাহামের অভিযোগ, ও একটা মেরুদণ্ডহীন পুরুষ। মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারে চাকরি করার সময়ও দেখিনি, চাকরি ছাড়ার পরেও নয়–বাবার বিরুদ্ধে কোনোদিন রুখে দাঁড়িয়েছে? ও একটা মেনিবেড়াল। না হলে বউকে নিয়ে কবেই এখান থেকে কেটে পড়ত। কেনি, তুমি রিচার্ডকে নিয়ে মাথা ঘামিও না। আমায় দেখতো, আমি তো ওর খুড়তুতো বোন, আমি ওকে গ্রাহ্য করি!

-রিচার্ডকে আমি গ্রাহ্যের মধ্যে ধরি না। যাক, সে কথা, ডঃ গ্রাহাম বলে চললেন, শোনো বারবারা, তোমাকে যেজন্য এখানে ডেকে পাঠিয়েছি, তার প্রথম কথাটা আগে বলি। তোমার জ্যেঠুকে গত সন্ধ্যায় বিষ খাইয়ে কেউ বা কারা খুন করেছে।

–এ বাসি খবর। বারবারার চোখে মুখে বিরক্তি ওই বেঁটে লোকটা, গোয়েন্দাগিরি চালিয়ে সারা বাড়িতে হুলস্থুল ফেলে দিয়েছে। এসব কথা কি জানতে কারো বাকি আছে গো!

–খবরটা তোমাকে চমকে দেয়নি? মন নিশ্চয়ই খারাপ হয়েছে, তাই না?

–নিশ্চয়ই, বাড়ির কেউ মারা গেলে মন বিষণ্ণ হবেই। ব্যাস এইটুকুই, কেনি।

বারবারার চাছা ছোলা কথা শুনে ডঃ গ্রাহাম বুঝি একটু অবাক হলেন।

-কেনি, আমি ন্যাকা-ন্যাকা কথা বলতে পছন্দ করি না। জেনে রেখো, ওই বুড়োটা মরেছে, আমার হাড় জুড়িয়েছে।

বারবারা! ডঃ গ্রাহাম কঠিন গলায় বললেন, কী আবোল তাবোল বকছু!

-কেনি, আমাকে ধমকিয়ো না, হতে পারে বড় বিজ্ঞানী, কিন্তু লোকটা ছিলেন হিংসুটে আর স্বার্থপর। নীচু মনের মানুষ। তোমাকে আমার জ্যেঠুর এমন অনেক ঘটনার কথা এখানে বসেই আগে কত শুনিয়েছি। উনি কেবল নিজের গবেষণা আর টাকাকে চিনতেন। পরিবারের কারো প্রতি ভালো ব্যবহার কখনো করেননি। এমনকি নিজের ছেলের প্রতিও নিন্দনীয় ব্যবহার করেছেন। কেনি, তুমি তো জানো, বাবার কথায় রিচার্ড মিলিটারির চাকরিটা ছেড়ে দিল। কিন্তু তার চলবে কী করে? জ্যেঠু তাকে এক পয়সাও হাত খরচা হিসাবে দিতেন না। কিপটে বুঝলে হাড় কিপটে। রিচার্ডের বউটার কথা ভেবে দেখ। সুন্দরী অল্প বয়সী মেয়ে। সেও ছিল। জ্যেঠুর চোখের শুল। উঠতে-বসতে বউটাকে কম অপমান করেননি। তাই বলছি, রিচার্ড যদি সত্যিই পুরুষের মতো পুরুষ হত তাহলে বউকে নিয়ে কবেই অন্য কোথাও চলে যেত।

বারবারা বলে চলল–আহা, বেচারী, মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতে পারতাম না। লজ্জায় অপমানে সাদা গালদুটো লাল হয়ে উঠেছে। এসব দেখে আমার বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠত। জ্যেঠুর দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদ যে করব, সে অধিকার আমার কোথায়, আমি নিজেই অসহায় এক আশ্রিতা।

বারবারা, আমায় বলো তো, তোমার জ্যেঠুকে যে বিষ খাইয়ে খুন করা হল, এর অন্তরালে কার হাত আছে বলে তোমার মনে হয়? ধরো টাকা কড়ি–বিষয় সম্পত্তির লোভে, মানে রিচার্ড, সে কি তার বাবার খুনী? তোমায় কথা দিচ্ছি, তুমি যেসব গোপনকথা বলবে, তা আর তৃতীয় কানে পৌঁছবে না। তোমার যাতে বিপদ না হয়, সে ব্যবস্থাও করব, কথা দিচ্ছি, এমনকি পুলিশি ঝামেলা থেকে তোমাকে বাঁচাব।

-কেনি, দয়া করে এবার থামবে, আমার আর এসব শুনতে ভালো লাগছে না। বারবারা খেঁকিয়ে উঠল। পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিল দেখ, কী সুন্দর সোনালী রোদে চারদিক ভরে উঠেছে। এসো, দুজনে মিষ্টি মধুর প্রেমের গল্প করি। রিচার্ডের বাবার খুনের পর্ব বাদ দিয়ে সুন্দর একটা কবিতা শোনাতে পারো তো? তুমি কি আমার কাছ থেকে জানতে চাইছ, ছেলে তার বাবাকে খুন করেছে কিনা। সত্যি বলছি কেনি, তোমার মনোভাব আগাম জানতে পারলে কে আসত তোমার ডাকে।

–শান্ত হও, বারবারা। তোমার জ্যেঠুর মৃত্যুটা যে স্বাভাবিক নয়, তা তো তুমি স্বীকার করো। রিচার্ডকে আমি খুনী বলে সন্দেহ করি না, তবে ওর বাবার খুনের কিনারা করার জন্য পুলিশের দ্বারস্থ হতে চায় না। এর কারণ কী? ওর ভাবগতিক দেখে মনে হয়, পুলিশি তদন্ত হলে এমন কিছু গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যাবে, যা ওকেই দোষী বলে সাব্যস্ত করবে। তবে পরিস্থিতিটা এখন এমন পর্যায়ে এসে গেছে যে, ও কেন, অন্য কেউ চাইলেও পুলিশি তদন্ত বন্ধ করতে পারবে না। কারণ এটা একটা খুনের মামলা। তোমার জ্যেঠুর পাকস্থলীতে মারাত্মক বিষ মেশানো কফি পাওয়া গেছে। রিচার্ড আমার ওপর ক্ষেপে আছে। ও মনে করে আমি ইচ্ছে করে ওর বাবার ডেথ সার্টিফিকেট দিইনি। আমি ওদের পুলিশি ঝামেলায় ফেলতে চাই। ডাক্তার হয়ে ওর ইচ্ছে মতো ডেথ সার্টিফিকেট কী ভাবে দিই বলল তো।

-বুঝলাম, চুলোয় যাক এসব, শোনো, আর দেরি করা যাবে না, বারবারা বলল, আমি জানলা দিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়ছি, তুমিও বাগান থেকে বিদায় হও। পরে দেখা করব, বুঝেছ?

কথা শেষ করে বারবারা ঝোঁপের পাশ ধরে জানলার দিকে পা চালাল। অগত্যা ডঃ গ্রাহামকে উঠতে হল, বড় একটা নিশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলেন নিজের পথে।

এতক্ষণ ক্যাপ্টেন হেস্টিংস ঘাপটি মেরে বসে সব শুনছিলেন। বারবারা ও ডঃ কেনেথ চলে যেতেই পায়ে পায়ে এগিয়ে এলেন খোলা জানলার দিকে।

***

লুসিয়া মুখ টিপে বসেছিল। ক্যাপ্টেন হেস্টিংস জানলা দিয়ে ঘরের বাইরে চলে যেতে বুঝি সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। বলল–মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি নাকি আমার কাজের মেয়েটাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে চান। মি. রেনরের কাছে শুনলাম।

কাজের মেয়ে নয়, আপনার সঙ্গেই আমার কথা আছে, মাদাম।

একথা শুনে লুসিয়া চমকে উঠল, পোয়ারোর চোখ তা এড়াল না।

–আমার দোষ নেবেন না, মাদাম। মিঃ রেনরের ইচ্ছে হয়েছে, তিনি বলেছেন, এক্ষেত্রে আমার কী করার আছে বলুন। বিশ্বাস করুন, আপনার কাজের মেয়ে সম্পর্কে কোনো তথ্যের প্রতি আমি আগ্রহী নই।

–তাহলে? আপনাকে তো আমি সবই বলেছি, মঁসিয়ে পোয়ারো, তাহলে আবার কেন?

পোয়ারো লক্ষ্য করলেন, লুসিয়ার মুখে-চোখে সে ভীতিভাব এখন অনুপস্থিত।

-মাদাম, আপনি কি ভুলে গেছেন, লুসিয়ার চোখে চোখ রাখলেন পোয়ারো, গত সন্ধ্যায় স্যার ক্লডের আকস্মিক মৃত্যুর পর এ বাড়ির সকলে আমাকে তক্ষুনি বিদায় করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু একমাত্র আপনিই আমাকে তদন্তের কাজ চালাতে অনুরোধ করেছিলেন এমনকি আপনি যে আমার ওপর সম্পূর্ণ মাত্রায় আস্থাশীল, সে কথাও জানিয়ে ছিলেন। কী, আমি কি মিথ্যে বললাম?

-হয়তো না। লুসিয়া উদ্ধত গলায় জবাব দিল, কিন্তু তাতে কী হল?

–এখন আপনাকে আমি বলছি, আপনি আমার প্রতি সত্যিই আস্থা রাখতে পারেন।

–মঁসিয়ে পোয়ারো, ভনিতা না করে কাজের কথায় আসুন।

-মাদাম, পোয়ারোর কণ্ঠস্বর কঠিন, আপনার জীবনে কোনোকিছুর অভাব আছে কি? আপনি রূপসী যুবতী, প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা–শ্রদ্ধা ভক্তি লাভ করেছেন। আছে সাধারণ ভদ্রতাবোধ। শুধু একটা জিনিসের অভাব আছে, সেটি হল এমন কোনো বিশ্বাসী লোক, যাকে ভরসা করতে পারেন, মনের না বলা কথা উজাড় করে তাকে শোনাতে পারেন। পোয়ারো তাকালেন লুসিয়ার দিকে আপনি বয়েসে আমার থেকে অনেক ছোট, আপনার বাপের বয়সী, মনে করলে আমাকে অনায়াসে বিশ্বাস করতে পারেন।

লুসিয়া কিছু বলতে গিয়ে বাধা পেল। পোয়ারো আবার বললেন আমার কথাগুলো ভালোভাবে চিন্তা করুন। আপনি আমার সহায়তা চেয়েছিলেন, আমি সায় দিয়ে থেকে গেলাম এখানে। আপনাকে আমি সত্যিই সাহায্য করতে চাই, বিশ্বাস করুন, মাদাম।

–আপনার কি মনে পড়ে, আজ সকালের কথা, কী বলেছিলাম? বলেছিলাম, আপনার এখানে থাকার দরকার নেই, চলে যান। লুসিয়া সহজভাবে বলে চলল, হ্যাঁ, মানছি আপনি আমায় সাহায্য করতে চান, আমিও তা আশা করি, মঁসিয়ে পোয়ারো। আপনি চলে গেলেই আমার সহায়তা হবে।

-মাদাম, ভুলে যাবেন না, এখান থেকে চলে যাওয়াটা আপনার মর্জির ওপর নির্ভর করছে না, সেটা আমার ইচ্ছের অধীন। মনে চাইলে এক্ষুনি চলে যেতে পারি। কিন্তু মাদাম, আপনি আমাকে তাড়ালেও পুলিশের তদন্ত বন্ধ করবেন কী করে? আপনি হাজার বারণ করলেও গ্রাহ্য করবেনা। তদন্তের কাজ শেষ করে তবে অন্য কথা। এটা কি আপনি ভেবে দেখেছেন? তাছাড়া যাদের হয়ে আপনি ওকালতি করছেন, তারাও নিশ্চয়ই ব্যাপারটা তলিয়ে দেখছেন না।

-কী বললেন, পুলিশ? বোঝা গেল লুসিয়া একটু ঘাবড়ে গেছে। ওদের এখানে কী দরকার?

-স্যার ক্লডের পাকস্থলী কাটাছেঁড়া করে বিষ মেশানো কফি পাওয়া গেছে, ডঃ গ্রাহামই পুলিশে খবর দিয়েছেন। অতএব সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে পুলিশের আগমন।

….ন…. ..ন… আ….. না। এ কখনো হতে পারে না। লুসিয়া ভয়ে কেঁদে ফেলল।

–পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে আপনার বারণে কিছু যায় আসে না। এবার ভেবে দেখুন, আপনি কী করবেন? সিদ্ধান্ত আপনার। তবে এখনও পর্যন্ত আপনাকে সহায়তা করার চেষ্টা করে যাচ্ছি, অবশ্য আপনি চাইলে। পরে হয়তো পুলিশ আর আইনকে সহায়তা করতে বাধ্য হব।

বেশ, আমি রাজী। লুসিয়া সরাসরি পোয়ারোর দিকে তাকাল, বলুন, কী জানতে চান?

–আমি জানতে চাইছি, আপনি কেন সত্যি কথাটা গোপন রেখেছেন? পোয়ারো সহজভাবে জানতে চাইলেন।

কী যা-তা বলছেন, মঁসিয়ে পোয়ারো। কোন সত্যি কথা আমি চেপে রেখেছি। আপনাকে বোঝা দুষ্কর। বলুন, কী বলবেন? কথা দিচ্ছি, সব বলব!

পোয়ারো তার ঝুলি থেকে সেই চিঠিটা বের করলেন, যেটা খানিক আগে এডওয়ার্ড রেনরের কাছ থেকে পেয়েছেন কয়েকদিন আগে এই চিঠিটা স্যার ক্লডের কাছে এসেছিল। চিঠিটা লুসিয়ার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন পোয়ারো, নজরদার’ শব্দটা লক্ষ্য করুন। আমি নিঃসন্দেহ, প্রেরক নিজের নাম গোপন রাখতে চায়, তাই ওই শব্দের ব্যবহার।

লুসিয়া খুব মন দিয়ে তীক্ষ্ণ নজরে চিঠিটা পড়ল। তারপর মাথা তুলে অবাক বিস্ময়ে জানতে চাইল–এসবের মানে কী?

লুসিয়া যে ভেতরে ভেতরে ভীষণ ঘাবড়ে গেছে, পোয়ারোর তা বুঝতে দেরি হল না, কিন্তু তার মুখে-চোখে প্রকাশ ঘটেছে।

পোয়ারো সহজভাবে জানতে চাইলেন–সেলমা গেতজ-এর নাম লেখা আছে, দেখেছেন নিশ্চয়ই। এই নামের সঙ্গে আপনার পরিচিতি আছে কি?

-সেলমা গেতজ। এমন নাম জীবনে শুনিনি। কে ইনি?

গেল বছর নভেম্বরে জেনোয়ার এক জেলে তার মৃত্যু হয়েছে।

–তাই?

–হয়তো সেখনেই আপনার সাথে ওঁর দেখা হয়েছিল, চিঠিটা জ্যাকেটের পকেটে রাখতে রাখতে পোয়ারো বললেন, এ ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ মাত্রায় নিশ্চিত।

–মঁসিয়ে পোয়ারো, লুসিয়া ভীষণ চটে গেছে, কর্কশ কণ্ঠে বলল–জেনোয়ায় কোনোদিন আমি যাই-ই নি, ওর সঙ্গে দেখা হওয়াতো দূরান্ত।

–মিথ্যে বলছেন, যদি বলেন, জেনোয়াতে আপনাকে সেলমা গেতজের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে, তাহলে কী বলবেন?

-বলব, তার দেখার মধ্যে ত্রুটি রয়ে গেছে। 

কিন্তু মাদাম, আমাকে আপনি ঠকাতে পারবেন না, পোয়ারো জোর দিয়ে বললেন, জেনোয়াতেই আপনার স্বামী রিচার্ডের সঙ্গে আপনার প্রথম দেখা হয়েছিল। এই ধরনের খবর আমি পেয়েছি।

–কে দিয়েছে আপনাকে এ খবর? রিচার্ড নিশ্চয়ই? নাঃ, রিচার্ডের স্মরণশক্তি অত্যন্ত দুর্বল। ও কি করে ভুলে গেল আমাদের প্রথম দেখার সেই জায়গাটা। মঁসিয়ে পোয়ারো, ওটা জেনোয়া নয়, মিলান।

-তাহলে জেনোয়াতে যে মহিলার সঙ্গে আপনি ছিলেন……

–এক কথা বারবার কেন বলছেন? জেনোয়াতে আমি এবয়সে এখনও যাইনি, বুঝেছেন?

বোঝা গেল লুসিয়া খুব চটে গেছে।

হতে পারে, দুঃখিত মাদাম, আসলে ব্যপারটা এতই গোলমেলে যে—

গোলমেলে! কোন ঘটনার কথা বলছেন?

–জানতে যখন চাইছেন তখন আর আড়াল করব না।

এরকুল পোয়ারো বেশ আয়েস করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন। আমার এক বন্ধু আছেন, লন্ডনেই থাকে। প্রেস ফটোগ্রাফার। ওর বাছাই করা ভোলা ছবি বেশ নামকরা কাগজগুলোতে ছাপা হয়। ম্যাগাজিনগুলোও বাদ যায় না। ফটো ভোলার দৌলতে বেচারাকে চরকির মতো ঘুরতে হয়। নামজাদা ফ্যাশান মডেল, সম্ভ্রান্ত পরিবারের বিদুষী ও সুন্দরী যুবতীদের ফটো তুলে লন্ডনের প্রেসে পাঠিয়ে দেয়। সেগুলো ছেপে বের হয় কাগজে। সমুদ্রের ধারে বালির ওপর শুয়ে কোনো রূপসী কন্যা রোদন করছে–এমন কত ছবি।

….গতবছরের কথা বলছি। নভেম্বর মাস। বন্ধু তখন জেনোয়াতে গিয়েছিলেন নিজের পেশার সুবাদে। সেখানে এক রূপসী মহিলার সঙ্গে ওর আলাপ হয়েছিল। মহিলার নাম ব্যারোনেস দ্যা গিয়ার্স। কোন নামজাদা ফরাসী কূটনীতিকের রক্ষিতা। এ ব্যাপারে মহিলার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তাছাড়া ওই কূটনীতিক তার গোপন প্রেমলীলা বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করে দিয়েছিলেন, অর্থাৎ তিনি সত্যকে আড়াল করার পক্ষপাতী ছিলেন না, মাদাম, এবার বুঝতে পারছেন, সত্য একদিন যেভাবেই হোক প্রকাশিত হবে, চাপা রাখা যায় না। আপনার শুনতে কি ভালো লাগছে না?

-আপনি যে ছাই কী বলতে চাইছেন, তাই বুঝতে পারছি না।

–বেশ, একটু সময় দিন। বুঝিয়ে দিচ্ছি। কথা বলতে বলতে পকেট থেকে পোয়ারো নোটবইটা টেনে বের করলেন। পাতা ওল্টাতে থাকলেন। বললেন–কাজের কথায় আসি। ওই মহিলা অর্থাৎ ব্যারোনেস দ্য গিয়ার্স নামে যিনি নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন, তার ফটো আমি দেখেছি, অর্থাৎ আমায় বন্ধুটি দেখিয়েছিলেন। মহিলার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল একজন প্রাক যুবতী। আমি অবাক বিস্ময়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। অপরূপ সুন্দরী, কেবল আমি নয়, যে দেখবে, সে আর জীবনে ওই মুখচ্ছবি ভুলতে পারবে না।

পোয়ারো উঠে দাঁড়ালেন, নোটবইটা চালান করে দিলেন পকেটে। বললেন–সেই মুখ আবার আমি দেখতে পেলাম। কোথায় জানেন? এই বাড়িতে যেদিন সন্ধ্যায় এসে পা রাখলাম। ফটোয় দেখা মেয়েটির সাথে হুবহু একরকম। তাকে চিনতে আমার দেরি হল না।

–হুঁ, লুসিয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। কী যেন চিন্তা করল। তার ঠোঁটে ফুটে উঠল কৃত্রিম হাসির ঝিলিক–আপনি আমার থেকে কী জানতে চাইছেন বুঝতে পেরেছি। ফটোর ওই মহিলা, মানে ব্যারোনেস দ্য গিয়ার্সকে আমি খুব ভালো ভাবেই চিনি। ওঁর সৌন্দর্য আমাকে পাগল করে দিত। ওর সঙ্গ ভালো লাগত। তাই প্রায়ই সময় ওর বেড়ানোর সঙ্গী হতাম। আর ওর মেয়েটার কথা বলছেন? ও তো একটা ক্যাবলা, বুদ্ধিসুদ্ধি বলে কিছু নেই। মনে হয়, যখন আমি ওই মহিলার সঙ্গে বেড়াচ্ছিলাম, তখন আপনার দেখা ফটোটা তোলা হয়েছিল। মঁসিয়ে পোয়ারো, আমার কথা বিশ্বাস করতে পারেন।

পোয়ারো চুপ, কেবল আলতোভাবে ঘাড় নাড়লেন, লুসিয়া বুঝি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

-কিন্তু মাদাম, পোয়ারো সামান্য ঝুঁকে পড়ে চোখ ছোট করে জানতে চাইলেন, আপনি যে কখনোই জেনোয়াতে যাননি, তাহলে..

আচমকা ধরা পড়ে যাওয়ায় লুসিয়া নিজেকে গুটিয়ে নিল। পোয়ারোকে নিরীক্ষণ করতে থাকল। আর পোয়ারো? তিনি পকেট থেকে নোটবইটা আবার বের করলেন বটে, পরক্ষণে সেটা জ্যাকেটের চোরা পকেটে রেখে দিলেন।

-কই, ফটোটা দেখান তো?

লুসিয়ার প্রশ্নের জবাবে পোয়ারো বললেন তা সম্ভব নয়, কারণ আমার কাছে কোনো ফটো নেই। সত্যি বলছি, তবে কুখ্যাত গুপ্তচর সেলমা গেতজ যে গতবছর নভেম্বরে জেনোয়ার বন্দী শালায় মারা গেছে, এ তথ্য নির্ভুল। সত্যি বলেই জানবেন। আর বাদবাকি যা বলেছি, অর্থাৎ আমার ওই ফটোগ্রাফার বন্ধু আর তার ফটো–এসব সবই আমার মনগড়া গল্প ছিল।

তার মানে আমার পেটের কথা বের করার এটা আপনার একটা মতলব, তাই না?

–হ্যাঁ, পোয়ারো সামান্য হাসলেন, মাফ করবেন, এই টোপ না ফেললে আপনার আসল পরিচয় জানতে পারতাম না।

কিন্তু এসবের সঙ্গে স্যার ক্লড অ্যামরির হত্যার কী সম্পর্ক, বলতে পারেন? লুসিয়া চাপা গলায় জানতে চাইল।

শুনেছি, পোয়ারোর কণ্ঠস্বর গম্ভীর, কিছুদিন আগে আপনার একটা দামী হীরের নেকলেস হারিয়ে গিয়েছিল, খবরটা কি ঠিক?

লুসিয়া পোয়ারোর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল–আপনি কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব দেননি। বলুন মঁসিয়ে পোয়ারো, স্যার ক্লডের মৃত্যুর সাথে এর কী সম্পর্ক?

সম্পর্ক তো আছেই, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, পোয়ারো শান্ত কণ্ঠে বললেন, আপনার দামী হীরের নেকলেস, কদিন বাদে স্যার ক্লডের মূল্যবান ফর্মুলা উধাও দুটোর কোনোটাই অদামী নয়, আপনি অস্বীকার করতে পারেন?

-আপনি কী বলতে চাইছেন, মঁসিয়ে? লুসিয়ার মুখ ফ্যাকাশে। বুকে ঢিবঢিবানি শুরু হয়ে গেছে।

–না বোঝার মতো তো কিছু নেই, মাদাম। জলের মতো সোজা ব্যাপার। পোয়ারো গম্ভীর হলেন। বলুন, ডঃ কারোলি আপনার কাছে এবার কত টাকা দাবি করেছিলেন?

টাকা–কেন? কেন? লুসিয়া ছিটকে সরে যেতে যেতে কোনো রকমে বলল।

-বুঝতে পারছি, আপনি ভীষণ ঘাবড়ে গেছেন।

-কখখনো নয়। সেই থেকে আপনি আবোল-তাবোল বলে চলেছেন। বুঝতে পারছি না, ডঃ কারোলিকে টাকা দেওয়ার প্রশ্নটা আসছে কোত্থেকে?

–আপনাদের দুজনের মঙ্গলের জন্য। সর্বোপরি ডঃ কারোলিও যাতে মুখ না খোলেন, তার ব্যবস্থা হিসাবে। কুখ্যাত নারী গুপ্তচর বাহিনীর সেলমা গেতজ-এর সুন্দরী কন্যা আভিজাত অ্যামরি পরিবারের ঘরণী হয়েছে, এই ঘৃণিত খবরটা পাঁচ কান হয়ে গেলে সর্বনাশ। আপনারা দুজনেই জানেন বাড়ির কেউ ব্যাপারটা মেনে নেবেন না। তাই আপনারা একটা রফা করলেন। ডঃ কারোলি টাকার বিনিময়ে আপনাকে সুখ দিলেন। আপনি হলেন ওঁর ব্লাকমেলের শিকার। ব্যস, এই পর্যন্ত।

লুসিয়া বড় বড় চোখে পোয়ারোর দিকে তাকাল, যেন আগুন ঝরে পড়ছে। পরক্ষণে চোখ নামিয়ে নিল। দু-হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরল। মিনমিনিয়ে বলল–রিচার্ডকে এসব জানিয়েছেন নাকি?

-না, এখনও ওনাকে কিছু জানানো হয়নি।

-দোহাই আপনার, ওকে কিছু বলবেন না। লুসিয়া তখন অসহায় হয়ে পড়েছে। হাত জোড় করে আকুতি জানান, মঁসিয়ে পোয়ারো, রিচার্ডকে কিছু বলবেন না। আমার অতীত ওদের বংশগরিমাকে কালিমালিপ্ত করবে। ও আমার আসল পরিচয় জানে না। ইচ্ছে করেই বলিনি। কী করব বলুন। এছাড়া ভালো মতো বেঁচে থাকার উপায় আমার জানা ছিল না। তখন আমি আমার নিদারুণ দুর্ভাগ্যকে বহন করে চলেছি। সহায়-সম্বলহীন এক মেয়ে। মায়ের ঘৃণিত জীবন আমাকে সর্বদা কুরে কুরে খেত। বিশ্বাস করুন, সর্বদা ভাবতাম, কীভাবে এই অন্ধকার গহ্বর থেকে বেরোনো যায়। কিন্তু হায়, কোনো উপায় ছিল না। অবশেষে ঈশ্বর বুঝি সদয় হলেন। দুরারোগ্য ক্যানসারে মায়ের মৃত্যু হল। শোক হলনা, বরং হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। অন্তরাত্মা উল্লসিত হল। এই ঘটনার কিছুদিন পর রিচার্ডের সাথে আমার দেখা হল। তারপর পরিচয়, প্রেম এবং অবশেষে বিয়ে। কিন্তু আমার ঘৃণিত অতীত কাহিনী সাহস করে ওকে বলতে পারলাম না। অথচ মনের মধ্যে চলছে দোলাচল। এক গুপ্তচর নারীর রক্ত আমার ধমনীতে, একথা বলে নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মারতে পারলাম না। অতএব…..।

বুঝলাম, পোয়ারো গম্ভীর গলায় বললেন, আপনাকে বধুবেশে রিচার্ড নিয়ে এলেন এই বাড়িতে। দাম্পত্য জীবন বেশ সুখেই কাটছিল। হঠাৎ একদিন ধুমকেতুর মতো আবির্ভূত হলেন ডঃ কারোলি। তিনি আপনাকে চিনতে ভুল করেননি। গুপ্তচর সেলমা গেতজের সুন্দরী কন্যা স্যার ক্লড অ্যামরি পরিবারের বউ–উনি তখন আপনাকে ভয় দেখাতে শুরু করেন। টাকার দাবি করেন। আপনি যদি ওঁর দাবি না মেনে নেন, তাহলে সবকথা ফাঁস করে দেবেন। সর্বক্ষণ এই কথা বলে আপনাকে উত্যক্ত করে তুলত, তাই না?

-আপনার অনুমানই ঠিকই, কিন্তু অত টাকা আমি কোথায় পাব লুসিয়া গড়গড় করে বলে চলল, কোনো উপায় না পেয়ে শেষ পর্যন্ত দামী হীরের নেকলেসটাই বিক্রি করতে হল, ওটা রিচার্ড আমায় উপহার দিয়েছিল বুঝলেন। ডঃ কারোলিকে শান্ত করলাম, কিন্তু ডঃ কারোলির ওই টাকাতে পেট ভরে নি, তার আরও চাই। গত সন্ধ্যায় উনি এ ঘরে এসে হাজির হলেন, সকলের সামনে এমন ভান করলেন, যেন উনি আমার পরিবারের বন্ধু ও শুভাকাঙ্খী। রিচার্ডের বাবা আর পিসিমা ওর মন গলানো কথাবার্তায় ভিজে গেলেন। তারা তাঁকে এই পরিবারে কদিন থেকে যাওয়ার অনুরোধ করলেন। ডঃ কারোলির তখন পোয়া বারো। তিনি তখন বড় দাও মারার জন্য ঠুকঠুক করছেন। স্যার ক্লড যে মারাত্মক শক্তিশালী পরমাণু বোমার ফর্মুলা আবিষ্কার করেছেন, এখবরটা ওঁর কানে পৌঁছে গিয়েছিল, জানি না, কে বলেছিল। উনি আমাকে সেই ফর্মুলা চুরি করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে থাকলেন।

লুসিয়া এবার থামল। একটানা কথাগুলো বলে সে তখন হাঁফাচ্ছে।

-তারপর? তারপর কী হল? পোয়ারো লুসিয়ার কাছাকাছি বসলেন–শেষ পর্যন্ত ফর্মুলাটা ওঁর হাতে তুলে দিলেন, তাই তো?

জানি, হাজার সত্যি বললেও আপনি বিশ্বাস করবেন না। লুসিয়ার মুখ শুকনো, তবুও যা করিনি, তা মানব কেন? ফর্মুলা আমি হাতাই নি, এক বিন্দুও মিথ্যে বলছি না।

পোয়ারো সরাসরি তাকালেন লুসিয়ার দিকে, দৃষ্টিতে ঝরে পড়ছে সহানুভূতি। নরম লুসিয়াকে আশ্বাসবাণী শোনালেন। নরম কণ্ঠস্বরে বললেন–আবার বলছি মাদাম, হতে পারি আমি কাঠখোট্টা এক গোয়েন্দা, কিন্তু মন বলে কিছু আমারও আছে। আমি আপনার বাবার বয়সী। আপনার মনে যথেষ্ট সাহস আছে, এত সহজে ভেঙে পড়লে চলবে, মন শক্ত করুন। আপনার প্রতিটি কথা বিশ্বাসযোগ্য। তবু আবার জানতে চাইছি, সত্যিই কি আপনি ফর্মুলা চুরি করেন নি?

-না। লুসিয়া এবার কেঁদে ফেলল, আপনাকে কী করে যে বোঝাই, ডঃ কারোলি ফর্মুলা চুরি করার কথা বলেছিলেন ঠিকই, আমিও সেটা হাতাবার জন্য তোড়জোড় করছিলাম, করা হয়ে ওঠেনি।

-তোড়জোড় করছিলেন? কীভাবে?

–ডঃ কারোলি একটা চাবি তৈরি করেছিলেন, ওটা আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেন, স্টাডিতে ঢুকে সিন্দুক থেকে ওটা নিয়ে আসতে।

আচ্ছা, হ্যাঁ, পোয়ারো পকেটে হাত ঢোকালেন, একটা চাবি বের করলেন, এই চাবিই তিনি এডওয়ার্ড রেনরকেও দেখিয়েছিলেন, বললেন, দেখুন, চিনতে পারেন কিনা। ভালো করে খুঁটিয়ে দেখুন।

লুসিয়া চাবিটা হাতে নিয়ে উলটে পালটে দেখল–খুব সম্ভবত। তারপর কী হল, বলি। চাবি হাতে নিয়ে ঢুকলাম গিয়ে স্টাডিতে, সিন্দুকের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি কী দাঁড়াইনি, ঠিক এই সময় মূর্তিমান বিভীষিকার মতো স্যার ক্লড এসে ঢুকলেন। ওইভাবে সিন্দুকের পাশে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার মুখে ক্রুর হাসি ফুটে উঠল। ভাবতে পারবেন না, তখন ওঁর মুখের চেহারা কী কদর্য হয়ে উঠেছিল। বিফল হয়ে ফিরে এলাম। তারপর কে কী ভাবে ওটা হাত সাফাই করল, বিশ্বাস করুন, আমার জানা নেই।

–মানছি আপনার প্রতিটি কথা সত্যি, চাবিটা স্বস্থানে রাখতে রাখতে পোয়ারো বললেন, তার মানে আপনার শ্বশুর আপনাকেও সন্দেহ করতে শুরু করেছিলেন। তাই স্যার ক্লড অন্ধকার ঘরে আসল চোরকে ফর্মুলা ফিরিয়ে দেবার সুযোগ দিলেন, তখন আপনি আপত্তি করলেন না, তাইতো?

এছাড়া আমি আর কী বা করতে পারতাম, বলুন। ওঁর প্রস্তাবে সায় না দিলে শুরু হত খানাতল্লাসী, আমার কাছে তখন রয়েছে ডঃ কারোলির দেওয়া চাবি আর একটা ছোট্ট কাগজের টুকরো। ওগুলোর কথা ওরা জেনে ফেলত।

–ওই কাগজের টুকরোতে কী লেখা ছিল?

–ডঃ কারোলির নিজের হাতে লেখা কয়েকটি শব্দ–যে কাজের দায়িত্ব দিয়েছি, সেটা তুমি করেছ?

-থামবেন না, এগিয়ে যান।

–দুম করে ঘরের আলোগুলো নিভে গেল। অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে গুপ্ত জায়গা থেকে চাবিটা ছুঁড়ে দিলাম, গিয়ে পড়ল ওইখানে। লুসিয়া আঙুল তুলে দেখাল, অর্থাৎ গত সন্ধ্যায় এডওয়ার্ড রেনর সে চেয়ারে বসেছিল, তার তলাটা।

–আর কারোলির লেখা কাগজের টুকরোটা? ওটা কী করলেন?

-ওটা আমার কাছেই ছিল, আমার জামার পকেটে লুকিয়েছিলাম। আজ সকালে পকেট থেকে বের করে এই বইটার ভেতর রেখে দিয়েছি।

টেবিলের ওপর থেকে নির্দিষ্ট বইটির পাতা উলটে কাগজটা বের করে লুসিয়া এগিয়ে দিল পোয়ারোর দিকে।

-না না, ওটা আমার লাগবে না। আপনার কাছেই থাক।

 লুসিয়া কাগজের টুকরোটাকে কুচিয়ে হাতব্যাগে রেখে দিল।

–আর একটা প্রশ্ন আছে। পোয়ারো জানতে চাইলেন, আপনি কি কাল সন্ধ্যায় অন্ধকারের মধ্যে আপনার জামা ছিঁড়ছিলেন?

–জামা! আমি! না না, ওসব করার দরকার পড়েনি। লুসিয়া অবাক হল।

–ও, তাহলে আপনি নিশ্চয়ই পোশাক ছেঁড়ার আওয়াজ শুনেছিলেন?

-হ্যাঁ, শুনেছিলাম। লুসিয়া একটু ভেবে জবাব দিল, আমিও অন্ধকারের মধ্যে পোশাক ছেঁড়ার আওয়াজ শুনেছিলাম। হবে হয়তো পিসিমা বা বারবারার কাজ, তবে আমি নই।

হুঁ, স্যার ক্লডের কাপে গত সন্ধ্যায় কে কফি ঢেলে দিয়েছিল, বলতে পারেন, মাদাম?

-কেন বলতে পারব না? আমি নিজেই তো ঢেলেছিলাম। লুসিয়ার সোজা জবাব।

–নিজের কাপের পাশে টেবিলে ওটা রেখেছিলেন তো?

–হ্যাঁ।

ব্ল্যাক কফি পোয়ারো চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর কী করলেন? হিসকোসিন বিষটা কোন কাপে মিশিয়ে ছিলেন, মাদাম?

তীর খাওয়া পাখির মতো লুসিয়া আঁতকে উঠল, উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে তার শরীর–একথা কে বলল…

মাদাম, পোয়ারো মোলায়েম সুরে বললেন, ভুলে যাবেন না, আমি একজন। গোয়েন্দা, সব কিছু জানাই আমার কাজ। এমনকি লোকে যা দেখতে পাচ্ছে না, আমার কঠিণ দৃষ্টিতে তার ধরা পড়ে। বাদ দিন, দেরি না করে আমার প্রশ্নের জবাব দিন, কোন কাপে মিশিয়ে ছিলেন?

–আমার কাপটাতে…..লুসিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

–আমার কাপে। কথাটা বুঝি পোয়ারোর বিশ্বাস হল না। জানতে চাইলেন, কিন্তু কেন, মাদাম?

আমি নিজেকে আর বাঁচিয়ে রাখতে চাইছিলাম না, তাই। ডঃ কারোলির আসল উদ্দেশ্য রিচার্ডের কাছে ছিল অজানা। ওর ধারণা, আমার সাথে ডঃ কারোলির অবৈধ প্রণয় আছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, মঁসিয়ে পোয়ারো, ওই লোকটা আমার চক্ষুশূল, একদণ্ড ওঁকে সহ্য করতে পারতাম না। অবশেষে যখন ওঁর কথামতো ফর্মুলা চুরি করতে অসফল হলাম, তখন অসহায় বোধ করলাম। একটা ভয় আমার আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরল নিশ্চয়ই ডঃ কারোলি রিচার্ডকে সব বলে দেবে। তখন রিচার্ডের সামনে কোন মুখে দাঁড়াব। তাছাড়া ওর বাড়ির লোকেরা? ছেড়ে কথা বলবে না। তাড়িয়ে ছাড়বে।

টেবিলের ওপর তখনও গত রাতের একটা কফির কাপ পড়েছিল। খালি নয়। সেদিকে আঙুল তুলে পোয়ারো জানতে চাইলেন–এটাই আপনার কাপ নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু কাপে ঠোঁট ঠেকানো হয়নি বুঝতে পারছি, কিন্তু মাদাম, নিজেকে চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দেবেন বলে যে বিষ মেশালেন, সেই কফি শেষ পর্যন্ত ছুঁয়েও দেখলেন না, কেন?

সে অবসর পেলাম কোথায়? রিচার্ড এসে পাশে দাঁড়াল, লুসিয়া বলল, ও ফিসফিসিয়ে সবার অলক্ষে বলল, আমায় নিয়ে ও এ বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথায় চলে যাবে। এজন্য টাকার ও জোগাড় করবে। তখন মনে বাঁচার তাগিদ অনুভব করলাম, ঠিক করলাম, জীবনকে আর একটা সুযোগ দেওয়া যাক। তাই বিষ মেশানো কফি যেমন কি তেমনই পড়ে রইল।

আমার এই কথাগুলো মন দিয়ে শুনুন, আপনাকে জানিয়ে রাখি, স্যার ক্লডের মৃতদেহের পাশে যে কফির কাপটা পড়েছিল, আজ সকালে ডঃ গ্রাহাম এসে ওটা পরীক্ষার জন্য নিয়ে গেছেন।

-তাই বুঝি? লুসিয়া হকচকিয়ে গেল।

-তবে ওরা যতই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করুক না কেন, বিষের ছিটেফোঁটাও পাবে না, পাবে কেবল কফির তলানিটুকু, এ আমি হলফ করে বলতে পারি। পোয়ারো কথা আর বাড়ালেন না।

–ঠিকই ধরেছেন, লুসিয়া আনমনে জবাব দিল।

–আচ্ছা মাদাম, পোয়ারো আবার বলতে শুরু করলেন, ওরা গতকাল রাতেই কাপটা নিয়ে যেত, তাহলে কী হত? এ প্রশ্ন আমার মনে জেগেছে। উত্তরটাও আমার জানা। কথা শেষ করে পোয়ারো পায়ে পায়ে এগিয়ে এলেন দরজার দিকে, যেখানে চারা গাছ সমেত টবটা রাখা আছে। নিঃশব্দে টবের আলগা মাটি সরিয়ে ফেললেন, বের করলেন একটা কাপ। কাপটা আঙুলের মাথায় আঁকশির মতো ঝুলিয়ে নাচাতে নাচাতে বললেন–এমনও হতে পারত, ডঃ গ্রাহাম এই কাপটা নিয়ে গেলেন, তাহলে? তাহলে কী হত, মাদাম?

–সব তথ্যই দেখছি আপনার হাতে চলে এসেছে।

লুসিয়া নিজেকে আর সংযত রাখতে পারল না, দু-হাতে মুখ ঢাকল, বোঝা গেল লজ্জাজনিত অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ছে তার দু-চোখ থেকে।

পোয়ারো পায়ে পায়ে আবার চলে এলেন লুসিয়ার কাছাকাছি আগেই বলেছি, ডঃ গ্রাহাম সকালে যে কফির কাপটা নিয়ে গেছেন, তা থেকে ওরা কিছুই প্রমাণ করতে পারবে না। কিন্তু এই কাপটা আপনাকে জানিয়ে রাখি, এর তলানির কিছুটা আমি আগেই সরিয়ে রেখেছিলাম, যার মধ্যে পাওয়া গেছে মারাত্মক হিসকোসিন বিষ, এটাই স্যার ক্লডের কফির কাপ, যা খেয়ে ওনার মৃত্যু হয়েছে।

লুসিয়া একথা শুনে ভয়ে শিউরে উঠল–আপনি ধরে ফেলেছেন আমার কারসাজি? হা, হা, আমিই আমার শ্বশুরের মৃত্যুর জন্য দায়ী। আমিই তাকে হত্যা করেছি, হিসকোসিন বিষ আমিই কফিতে মিশিয়ে দিয়েছিলাম।

উন্মাদের মতো লুসিয়া ছুটে এল টেবিলের ওপর, সেখানে তখনও কফি ভরতি কাপটা পড়েছিল। সে সেটা তুলে নিতে নিতে বলল–এটার মধ্যে কোনো বিষ নেই। কথা শেষ করেই কফিতে চুমুক দিতে উদ্যত হল, কিন্তু তার সে প্রয়াস ব্যর্থ হল।

পোয়ারো এক লাফে এগিয়ে এসে ছোঁ মেরে তুলে নিলেন সেই কফি ভরতি কাপ। টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখলেন।

কী হল মঁসিয়ে পোয়ারো, ওটা কেড়ে নিলেন কেন? লুসিয়ার চোখ আবার জলে ভরে উঠল।

-আমি নিশ্চিত, ওই কফি নির্ভেজাল নয়, বিষ আছে। পোয়ারো তাকালেন লুসিয়ার দিকে, স্নেহার্দ্র কণ্ঠে জানতে চাইলেন এই সুন্দর পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে কেন চিরদিনের জন্য চলে যেতে চাইছেন, অসময়ে?

-হা অদৃষ্ট! লুসিয়া কুশনে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল।

–আপনি আমায় এপর্যন্ত যা বললেন, সব বিশ্বাস করছি, তবে এখনও একটা প্রশ্নের উত্তর জানা হয়নি, পোয়ারো আন্তরিকতার সুরে বললেন, আমি জানি, আপনি নিজের কফিতে হিসকোসিন মিশিয়ে ছিলেন। অন্য আর একটি কফির কাপেও ওই একই বিষ মেশানো হয়েছিল। এই কাজ কে করেছে, আপনি জানেন কি?

-মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি কেন আমাকে ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন? কাঁদো কাঁদো গলায় লুসিয়া জানতে চাইল, অন্য কেউ নয়। আমি ওটাতেও হিসকোসিন মিশিয়ে ছিলাম। আমিই অপরাধী।

বুঝতে পারছি, আপনি একজনকে বাঁচাতে চাইছেন, কিন্তু কে সে? তার নাম কী?

 এমন সময় দরজায় টোকার শব্দ।

–ওরা এসে গেছে, মানে পুলিশ। স্বাভাবিক কণ্ঠে পোয়ারো বললেন, আর কিছু জানার নেই আমার। যাওয়ার আগে একটা কথা জেনে যান, আপনাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমার।

-কিন্তু আমিই তো স্যার ক্লডের খুনি, লুসিয়ার কণ্ঠস্বর কাঁপছে, তাহলে কেন আমাকে……..

-আবারও বলছি, আপনাদের মানে আপনি এবং আপনার স্বামী রিচার্ডকেও রক্ষা করব, এ আমার অঙ্গীকার।

লুসিয়া অবাক হল, কোনো কথা বলল না, কৃতজ্ঞতাপূর্ণ চোখে কেবল তাকিয়ে রইল সামনের বেঁটে খাটো চেহারার গোয়েন্দা ভদ্রলোকের দিকে।

এইসময় দরজাটা খুলে গেল। মুখ বাড়াল বাটলার ট্রেডওয়েল। জানাল, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর জ্যাপ এসেছেন, মঁসিয়ে পোয়ারো।

.

১২.

ইতিমধ্যে খোলা ফ্রেঞ্চ উইন্ডো গলিয়ে ক্যাপ্টেন হেস্টিংস বসার ঘরে এসে প্রবেশ করেছেন।

জ্যাপের সঙ্গে এক ছোকরা কনস্টেবল, নাম জনসন। মাঝবয়সী জ্যাপের হাতুড়ি পেটা চেহারা।

তিনি জনসনকে উদ্দেশ্য করে বললেন–জনি, এনাকে তুমি চেনো। খ্যাতনামা গোয়েন্দা এরকুল পোয়ারো। উনি বেলজিয়ান পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান ছিলেন, সেই সময় থেকেই ওনার সঙ্গে আমার ভাব জমে উঠেছে। দুজনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রহস্যানুসন্ধানে মেতে উঠেছি। অপরাধীকেও ধরেছি একসঙ্গে। ও, সেসব দিনের কথা আজও স্পষ্ট মনে পড়ে। সেই যে, অ্যাবারক্ৰম্বি’ জালিয়াতি কেসটা, বলুন না মঁসিয়ে পোয়ারো, আরে যে লোকটাকে আমরা দুজনে মিলে ব্রসলেসে ধরলাম, মনে পড়ছে না? তারপর ব্যারণ অ্যালটারা? কী দুর্ধর্ষ লোক! ইউরোপের প্রায় সব দেশের পুলিশ ওর পেছনে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, অথচ ধরতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত অ্যালট ওয়ার্ডে লোকটাকে পেলাম, আমরা দুজনে মিলে ওকে ধরে ফেললাম, নিশ্চয়ই মনে পড়ছে আপনার! তারপরে বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে, আপনি চাকরি থেকে অবসর নিলেন। লন্ডনেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু হল। ফলে দেখা সাক্ষাত প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। আপনি তো এখানে এসেই স্টাইলস-এর সেই অদ্ভুত রহস্যের কিনারা করেছিলেন, তাই না? আপনার সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল প্রায় দু-বছর আগে। এক ইটালিয়ান ভদ্রলোককে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা রহস্যের জট ছাড়া আপনি-আমি একসঙ্গে কাজ করেছিলাম, তাইতো মঁসিয়ে পোয়ারো? তারপর আজ, এখানে। আপনাকে দেখে, বিশেষ করে আপনার সাথে কাজ করছি ভেবে মনটা ভারি খুশি-খুশি লাগছে।

ইন্সপেক্টর জ্যাপ এবার কাজের কথায় এলেন–আমি এসে শুনলাম, আপনি এক সুন্দরীর সাথে কথা বলছেন, পরে দেখলাম, সম্ভবত রিচার্ড অ্যামরির স্ত্রী ঠিক বলেছি? আসলে কি জানেন, ওইসব বিষ-টিষ খাইয়ে হত্যা করার ব্যাপারগুলো, আমার মোটেও পছন্দ হয় না। এই ধরনের মামলায়, তদন্তের কী আছে বলুন? কেবল ওই ঘোড়-বড়ি-খাড়া। কেবল মৃত ব্যক্তি কী খেয়ে ছিল, কী পান করেছিল, এসব তাকে কে দিয়েছিল, এসব মামুলি তথ্য ছাড়া উর্বর মস্তিষ্ক খাটানোর কী আছে? ডঃ গ্রাহাম জানিয়েছেন, কফিতে বিষ মেশানো হয়েছিল, যা সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু ঘটানোর পক্ষে যথেষ্ট। করোনারের রিপোর্টের সঙ্গে যদি তার বক্তব্য মিলে যায়, তাহলে স্বীকার করছি, এতথ্য নির্ভরযোগ্য। কিন্তু এর বাইরেও বহু কাজ আছে।

কথা বলতে বলতে জ্যাপের সন্ধানী চোখ দুটো ঘরময় বাঁইবাঁই করে ঘুরছিল। তিনি উঠে দাঁড়ালেন–এ ঘরে যা দেখার দেখে নিয়েছি। এবার জিজ্ঞাসাবাদের পালা প্রথমে রিচার্ড অ্যামরি, তারপরে ডঃ কারোলিকে ঝামা ঘষতে হবে। ওই ব্যাটা কারোলিকেই আমার কালপ্রিট মনে হচ্ছে, অবশ্য তথ্য প্রমাণাদি বিচারের পর। একটা কথা সবসময় মনে রাখতেই হবে, খোলা মন ও খোলা চোখ দিয়ে সব কিছু বিচার করব।

জ্যাপ বাইরে খাবার জন্য পা বাড়ালেন। কী খেয়ালে পেছন ফিরে পোয়ারোকে লক্ষ্য করে বললেন–কী, আপনি যাবেন না?

নিশ্চয়ই, পোয়ারো সহজ কণ্ঠে বললেন, আমি তো সর্বদা আপনাদের সাথেই আছি।

–আর ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, ইশারায় তাকে দেখিয়ে বললেন–উনি কি খাবেন না?

–জ্যাপ, ওকে ছেড়ে দাও। পোয়ারো চট করে জবাব দিলেন।–ও বেচারার বোধহয় এখানে থাকতেই ভালো লাগছে।

-হ্যাঁ, পোয়ারো ঠিকই বলেছেন, বন্ধুর মনোভাব আঁচ করতে পেরে হেস্টিংস বললেন–এখানে থাকাই আমার পক্ষে মঙ্গল।

জ্যাপ, কনস্টেবল জনসন আর পোয়ারো বসার ঘর থেকে বেরিয়ে ওপরে যাওয়ার সিঁড়ি ধরলেন।

অন্যদিকে ঠিক একই সময়ে ফ্রেঞ্চ উইন্ডো দিয়ে ভেতরে এল বারবারা। গোলাপি রঙের ব্লাউজ আর হাল্কা রংয়ের স্ন্যাকস তার পরণে।

-আঃ, বড়জোড় বাঁচালেন, বারবারা সরাসরি তাকাল ক্যাপ্টেন হেস্টিংস-এর দিকে শেষ পর্যন্ত পুলিশ ঢুকল এ বাড়িতে, কী বলেন।

বারবারা ধপ করে বসে পড়ল একধারে।

-হ্যাঁ, মাদাম। হেস্টিংস জবাব দিলেন, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে তদন্তের কারণে ইন্সপেক্টর জ্যাপকে পাঠানো হয়েছে। পোয়ারোর সঙ্গে ওনার বহুদিনের পরিচয়, ওঁরা একসঙ্গে বহু রহস্যের কিনারা করেছেন। দুজনেই এখন ওপরে গেলেন, রিচার্ডকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে।

-বলুনতো, ওঁরা কি আমার সঙ্গেও কথা বলতে চাইবেন?

-খুব সম্ভব নয়। হেস্টিংস তাকে আশ্বস্ত করলেন, বললেন, আর যদি বা করে, তাতে আপনার ঘাবড়ানোর কী আছে?

-না না, ওসব নিয়ে আমার কোনো ভয়-ডর নেই। বারবারা সহজ ভঙ্গিতে বলল, আসলে কী জানেন, এক্ষেত্রে বুদ্ধিই হল আসল। তলিয়ে দেখতে হবে, এর মধ্যে আবেগের মিশেল আছে কিনা। আচ্ছা, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, আপনি কি আবেগের ধার-ধারেন না? ইচ্ছে করে না আবেগে মনকে ভাসিয়ে দিতে?

-মানে, হেস্টিংস ঢোক গিললেন, হ্যাঁ, করে বৈকি। আবেগ তলিয়ে দেখতে আমিও ভালোবাসি।

–আপনাকে মাঝে মধ্যে বুঝে উঠি না, কেমন জটিল প্রকৃতির লোক বলে মনে হয়। হঠাৎ গলার স্বর চড়িয়ে সে জানতে চাইল আগে আপনি কোথায় থাকতেন, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস?

দক্ষিণ আমেরিকায়। বলতে পারেন জীবনের তিন ভাগ সেখানেই কেটে গেছে। আমার। হেস্টিংস-এর ঠোঁটে হাসির আভাস।

–জানতাম, আপনি এই জবাবই দেবেন। দক্ষিণ আমেরিকা! কী দারুণ জায়গা, না? যেদিকে চোখ যায়, কেবল সবুজে ঢাকা মাঠ, মাঝে মধ্যে বনাঞ্চল, কখনো চোখে পড়ে উঠতি বয়সের কাউবয়দের, ঘোড়ায় চেপে চলেছে, হাতে দড়ির ল্যাসো, এ প্রান্ত ও প্রান্ত ছুটে বেড়াচ্ছে, চোখে পড়ে নদী, তার ওপর সেতু, তৈরি হয়েছে ছোট গোছের রেলপথ। কয়লার ইঞ্জিন রেললাইন ধরে ঝিকঝিক কণ্ঠে সামনে এগিয়ে চলেছে। মান্ধাতা আমলের রেল গাড়ি। তাই তো বলি, আপনাকে কেন মাঝ মাঝে সেকেলে মনে হয়। এখন বুঝতে পারছি। তবে সেকেলে হলেও আপনি যে রুচিশীল ব্যক্তি, তা স্বীকার করতেই হবে।

তার মানে? ঠিক বোধগম্য হলনা। হেস্টিংস নরম গলায় বললেন।

-বুঝতে পারলেন না, তাই না? বারবারার ঠোঁটে হাসির ঝিলিক। তার মানে আপনার আচার ব্যবহার। আপনি যেমন যেকোনো পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন, আবার প্রয়োজনে মিথ্যে কথা বলা, এই সব আর কী!

–কেন, ভদ্রতা, নম্রতা, দুঃখ, ভালোবাসা, এসব আবেগ কি আপনার মধ্যে নেই।

হেস্টিংস-এর কথাগুলি এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিল বারবারা আমার কথা ছাড়ুন, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস। এই বাড়ির লোকগুলোকে তলিয়ে দেখুন। দু-দিনও হয়নি, একটা জলজ্যান্ত লোক মারা গেল, অথচ ছিটেফোঁটা দুঃখ আছে মনে!

-কী বলছেন, মাদাম। হেস্টিংস অবাক হলেন, দুঃখ পায়নি বলছেন?

-হা আমার পোড়াকপাল, বারবারা কপাল ঠুকতে এগিয়ে এল। কফি টেবিলের ধারে একটা চেয়ারে বসল–ওই মানুষটা, মানে আমার জ্যেঠুর কথা বলছি, সারা জীবন টাকা রোজগারের পেছনে কাটিয়ে দিয়েছেন, ভুরি ভুরি টাকা জমিয়েছেন। কিন্তু হাত খুলে যে খরচ করবেন, সে মন কোথায়? হাড়কিপটে, বুঝলেন কেবল নিজের স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে ছিল টনটনে জ্ঞান। যথেষ্ট বয়স হয়েছিল, অথচ লজ্জা শরমের বালাই ছিল না। জ্যেঠুর এইসব বদগুণের জন্য এই বাড়ির লোকদের কতবার সম্মান হানি হয়েছে, কী বলব।

বারবারার কথাশুনে ক্যাপ্টেন হেস্টিংস চমকে উঠলেন। তার বিস্ময়ের মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পেল। একফাঁকে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল দুটি অস্ফুট শব্দ–কী বলছেন?

বারবারা হাত ইশারায় বাধা দিয়ে বলল–থামুন তো। সত্যি যা, তাই বলছি। অত ঢাক গুরগুর কীসের? আমি স্পষ্ট কথা বলতেই ভালোবাসি। জ্যেঠুর স্বভাব চরিত্রের বদগুণ না বলে, আমি যদি কালো পোশাক পরে শোক পালন করতাম, তাহলে আপনার নিশ্চয়ই পছন্দ হত, তাই না? ন্যাকা গলায় বলতাম–আহা-হা, আমার জেঠুর মতো ভালো মানুষ পৃথিবীতে খুব বেশি দেখা যায় না। আমাদের সবার প্রতি যথাযথ কর্তব্য পালন করেছেন।

-সত্যি, আপনার এসব কথা শুনে যে কেউ অবাক হবে।

-তাই বুঝি, কিন্তু আমার তো লজ্জা-সঙ্কোচ হচ্ছে না। আসলে কী জানেন ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, আমি মেয়েটাই এরকম, বারবারা বেশ ফলাও করে বলতে লাগল–সারাজীবন নিজের কাজ গোছাবার জন্য গাদা গাদা মিথ্যে বলব, আর এক-আধবার লোকদেখানো ভালোমানুষ সাজব,–এমনটাই ছিলেন আমার জ্যেঠু। মোদ্দাকথা, ওনার দুর্ব্যবহারই ওনাকে সকলের কাছে অপছন্দের করে তুলেছিল। তাই ওনার মৃত্যু, কারো মনে শোক-তাপ সৃষ্টি করতে পারেনি। লক্ষ্য করলে বুঝতে পারবেন, এই পরিবারের সকলের ভাবখানা এমন–যাক, আপোদ বিদেয় হয়েছে গোছের। ক্যারোলিন পিসির কথাই ধরুন না। আহা বেচারী। জ্যেঠি মারা যেতে পিসিমা এসে জ্যেঠুর সংসারের হাল ধরলেন বটে, কিন্তু শান্তিতে ছিলেন কি? পিসিমা পর্যন্ত তার ভাইকে পছন্দ করতেন না, জ্যেঠুর জন্য তার মনে জমে আছে একরাশ বিতৃষ্ণা। সব কিছু মুখ বুজে তবুও তাকে সহ্য করতে হয়েছে, কারণ অন্য কোনো আশ্রয় তার নেই।

বারবারা থামল, দম নিল, কী যেন চিন্তা করল। তারপর আবার বলতে শুরু করল আমার এক-একবার কী মনে হয় জানেন তো, পিসিমাই তার ভাইকে খুন করেছেন। গতকাল সন্ধ্যায় জ্যেঠুর হার্ট অ্যাটাকের যে ব্যাপারটা ঘটল, এখনও ভাবতে অবাক লাগে, বিশ্বাসই হয় না হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। পিসিমার ওপর দিনের পর দিন ক্লড জ্যেঠু মানসিক অত্যাচার চালিয়ে গেছেন। পিসিমা একবারও এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াননি, নিজেকে সামলে রেখেছেন, আর মনের ভেতর তৈরি হয়েছে আক্রোশের পাহাড়। হয়তো আমাদের অগোচরে কোনো একদিন ভাই-বোনের মধ্যে এমন কিছু ঘটে গেছে, যা পিসিমার সহ্যের ঠাই ভেঙে দিয়েছে। জমে থাকা আক্রোশের চাপে পড়েই পিসিমা হয়তো তার ভাইকে বারবারা তার কথা শেষ করল না।

–আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, হলেও হতে পারে। ক্যাপ্টেন হেস্টিংস চাপা গলায় বললেন।

-তারপরে ওই ফর্মুলা চুরির ব্যাপারটাও ভেবে দেখুন। সকলের সন্দেহের আঙুল ওই ইটালিয়ান ডাক্তারের ওপর। কিন্তু আমার তাত মনে হয় না। ট্রেডওয়েলকেই আমি সন্দেহ করি।

–ট্রেডওয়েল, মানে আপনাদের বাটলারের কথা বলছেন! ক্যাপ্টেন হেস্টিংস বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন–ট্রেডওয়েলকেই আপনার সন্দেহ হয় কেন? বাড়িতে তো আপনাদের কাজের লোকের অভাব নেই, তারা কি ভালো মানুষ?

হা, ট্রেডওয়েলকেই জ্যেঠুর খুনী বলে মনে হয় আমার, কারণ সে জ্যেঠুর স্টাডির পাশে পাশেই আসেনি, তাই।

–তাহলে কেন আপনার মনে এই ধারণা হল?

ক্যাপ্টেন হেস্টিংস হালকা সুরে জানতে চাইলেন।

–জানেন ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, আমাদের দুজনের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে অনেক মিল আছে। আপনার মতোই গোঁড়া আর সেকেলে। নিরীহ গোবেচারা গোছের লোকেরা হয় সবচেয়ে বেশি শয়তান, অথচ মুখে ভালো মানুষের মুখোশ আঁটা। অনেক গোয়েন্দা এসব ব্যাপারকে আমল দেন না। এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। সকলের চোখে ট্রেডওয়েল এক শান্ত ভদ্র, নিরীহ, নিরাপরাধ লোক।

–কিন্তু সেভাবে ভেবে দেখলে শুধু ট্রেডওয়েল কেন, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলেন না, আপনার নামটাও সন্দেহভাজনদের তালিকায় থাকা উচিত বলে মনে করি। নিরীহ আর নির্দোষ যুবতীর মুখোস এঁটে বেমালুম সহজভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

-তাই বুঝি, বারবারা সামান্য হাসল, মনের ভেতর কোনো গলদ না রেখে পেট ঝেড়ে সব বলে দিলাম কিনা–সত্যি আজব এক লোক বটে আপনি!

–আজব হলাম কী ভাবে?

 ক্যাপ্টেন হেস্টিংস নিজের চেয়ার ছেড়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন।

–হ্যাঁ, জবাব দেব, কিন্তু তার আগে, বারবারাও তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। খোলা জানলার দিকে চোখ বেঁকিয়ে বলল, উত্তর পেতে চান, তাহলে বাইরে চলুন। বদ্ধ ঘরের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে আসছে। আসুন, বাগানের খোলা হাওয়াতে বসে গল্প করি।

বারবারা একটা খোলা ফ্রেঞ্চ উইন্ডোর দিকে এগিয়ে গেল কই, আসুন।

–কিন্তু আমি তো যেতে পারব না। হেস্টিংস সহজ সুরে বললেন–মঁসিয়ে পোয়ায়োর নিষেধ আছে, এঘর পাহারা দেবার জন্যই আমাকে বসিয়ে গেছেন।

-ওসব বাজে কথা ছাড়ুন, আসলে এঘরের মায়াতে জড়িয়ে পড়েছেন আপনি, তাই খোলা আকাশের নীচে যেতে মন চাইছে না। বেশ, গত রাতের কথাই বলি। ভাবুন ক্লড জ্যেঠুর কথা। ওইখানে, ওই আরাম চেয়ারে উনি বসে আছেন, আমরা সকলেই এখানে উপস্থিত। অথচ আমরা কেউ টের পাইনি বিষক্রিয়ায় ওনার হৃৎস্পন্দন ধীরে ধীরে বন্ধ হতে চলেছে, বা অনেকক্ষণ আগেই ওঁর মৃত্যু ঘটেছে। শুধু এটুকু জানতে পেরেছি, জ্যেঠুর সিন্দুক থেকে রহস্যজনকভাবে তারই তৈরি একটা ফর্মুলা চুরি হয়ে গেছে। সত্যি, অদ্ভুত এক পরিস্থিতি। ঠিক এই সময় আপনার পদধূলি পড়ল এঘরে। ঘরের চারদিকে চোখ বুলোলেন, মোহিত হলেন। রিচার্ডকে বললেন, বাঃ, কী চমৎকার ঘর মি. অ্যামরি। আর আপনার সঙ্গের ওই মাঝবয়সী বেঁটে লোকটা। মাথা জুড়ে মস্ত এক টাক, উঁহু-হুঁ, মুরগির ডিম। কত লম্বা হবে? বড়ো জোর পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি। বাটকুল হলে কী হবে, লোকটার এলেম আছে, ওঁর প্রতিটি পদক্ষেপ, তাকানোর ভঙ্গিমা, কথা বলার স্টাইল সব মিলিয়ে এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন পুরুষ। আমার মতো মেয়েকেও কাত করে দিয়েছিলেন, মুগ্ধ দৃষ্টিতে অপলক চোখে ওনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। আর আপনার কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছিল, আপনি অত্যন্ত ভদ্র ও অমায়িক। আচ্ছা, আপনার জন্ম কবে? গেল মহাযুদ্ধের পরে কি?

-পোয়ারোকে ওপর-ওপর ওরকমই দেখতে লাগে। হাসতে হাসতে হেস্টিংস বললেন। আসলে লোকটা অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নিখুঁত পরিপাটি ভাবে সবকিছু দেখতে চান। অনেক জিনিস আছে, যেগুলো আমরা ধর্তব্যের মধ্যে আনি না, পড়ে থাকলেও ঘুরে তাকাই না, সেইসব তুচ্ছ জিনিসকে উনি মহামূল্যবান বলে মনে করেন, সাজিয়ে গুছিয়ে সেগুলো তুলে রাখেন। যেমন তেমন করে সাজানো গয়নার সেট বা কারো পোশাকে একটু ধুলো–এসব পোয়ারো একেবারেই বরদাস্ত করতে পারেন না। মনে মনে এতটাই ক্ষুব্ধ হয়, যা আপনাকে বোঝানো যাবে না। এককথায় লোকটা অত্যন্ত খুঁতখুঁতে। আমি মাঝে মাঝে ওঁকে দেখি আর ভাবি, দীর্ঘদিন ধরে ওঁর সঙ্গে মেলামেশা করছি, অথচ ওঁর মতো খুঁতখুঁতে স্বভাবের হতে পারিনি কেন?

–অর্থাৎ, আপনাদের দুজনের স্বভাবের মধ্যে বিস্তর ফারাক, বলতে পারেন একেবারে উলটো। বারবারা হেসে ফেলল।

হেস্টিংস বিরক্ত হলেন–আপনার হাসি পাচ্ছে? আর ওঁর কাজ? প্রতিটি কাজ সুশৃঙ্খলের পরিচায়ক। সম্পূর্ণ নিজের পদ্ধতিতে আসল অপরাধীকে খুঁজে বের করেন। অনেক গোয়েন্দাকে দেখেছি, অপরাধীর পদচিহ্ন কোথায় পড়েছে, কোথায় সে সিগারেটের ছাই বা চুরুট ফেলেছে, এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না, এসব নাকি রহস্য সমাধানে সাহায্য করে না, অথচ পোয়ারোর মতে, তদন্তের কাজ করে গোয়েন্দার মাথা আর তার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা………..

-দারুণ! গোয়েন্দাদের দাদাঠাকুর, বারবারা হাসতে হাসতে বলল। তাইতো এমন কথা বলতে পারেন। তবু বাঁচোয়া, আপনার মতো সুরেলা মোলায়েম স্বরে বলেননি, কী চমৎকার ঘর, মি. অ্যামরি’! নিজের কৌতুকে বারবারা আর এক দফা হেসে উঠল।

-এখনও আমি বলছি, মাদাম, এ দুদিনে ঘরটার ওপর দিয়ে কম ঝড় বয়ে গেল না, তবুও আমার চোখে আগের মতোই খাসা চমৎকার হয়ে আছে।

–আমার দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা, বিচার বিবেচনার সঙ্গেও কারো মিল নেই, আমি স্বতন্ত্র কথা শেষ না করেই বারবারা টানতে টানতে হেস্টিংসকে নিয়ে এল খোলা জানলার কাছে। তারপর ফিক করে হেসে বলল–আর দেরি নয়, চলুন, বাগানে যাই। মেলা জ্ঞান শুনেছি আপনার, চুপ করে মাথা ধরে গেছে। বাইরের খোলাবাতাস না হলে চলবে না। মাথা ঠাণ্ডা করে, তারপরে অন্য কথা। কী হল, এখনও দাঁড়িয়ে আছেন, আসুন বলছি।

বারবারার কণ্ঠে স্নিগ্ধ ধমকানির সুর।

নিজেকে বারবারার কবল থেকে মুক্ত করে অসহায়ের মতো ক্যাপ্টেন হেস্টিংস বললেন–আপনার অনুরোধ আমি মানতে পারছি না। কেন, তা বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়। শুধু এইটুকু জেনে রাখুন, মঁসিয়ে পোয়ারো না ফিরে আসা পর্যন্ত আমাকে এই ঘরেই থাকতে হবে।

-আশ্চর্য, বারবারা হেস্টিংসের ঠিক পেছনে এসে দাঁড়াল। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিসে বলল–ক্যাসাবিয়াংকার কথা জানেন তো? আহা বেচারা, আপনার অবস্থাও ঠিক তাই

…দ্য স্টুড অন দ্য বার্নিং ডেক…… হোয়েন অলবাট হি ব্যাড ক্লেড…….. কিন্তু বন্ধু, আপনার এ হাল কেন, খুলে বলুন তো।

-আপনি আসলে কী করতে চাইছেন বলুন তো, কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে হেস্টিংস বললেন, মাঝে মাঝে আপনার কান্ডকারখানা দেখে তাজ্জব বনে যাই।

-বাজে কথা রাখুন, বারবারার ঠোঁটে হাসি–সত্যি বলছি, আপনার সান্নিধ্য পাবার জন্য মন আমার ছটফট করছে। পুরুষ মানুষ তো কম দেখিনি, কিন্তু আমার চোখে আপনি তাদের মতো নয়, সম্পূর্ণ আলাদা।

–আপনার মতো অদ্ভুত মার্কা মেয়ে জীবনে এই প্রথম আমি দেখলাম।

–এমন খুশির খবর আগে কেউ দেয়নি আমায়। এটা সুলক্ষণের একটা নমুনা। বারবারা আবার হেস্টিংসের হাতে হাত রাখল, ছেলেদের মুখে এমন কথা শুনলে আমার মতো মেয়েদের মনোবল বেড়ে যায়।

কথা শেষ করে বারবারা হেস্টিংসের হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মারল। একসময় তারা। দুজনেই এসে দাঁড়াল খোলা আকাশের নীচে, বাগানের মধ্যে।