০৭. ক্যাপ্টেন হেস্টিংস জানতে চাইলেন

০৭.

–কি মনে হচ্ছে, পোয়ারো, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস জানতে চাইলেন।

–আগে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এস।

বন্ধুকে এই নির্দেশ দিয়ে পোয়ারো ঘরটি তীক্ষ্ণচোখে জরিপ করলেন। হঠাৎ এক জায়গায় এসে তার চোখ আটকে গেল। তিনি এগিয়ে এলেন ওল্টানো চেয়ারটার কাছে, যেটা মৃত স্যার ক্লড থেকে সামান্য দূরে। ওই চেয়ারটিতেই বসেছিলেন স্যার ক্লড অ্যামরির সেক্রেটারি এডওয়ার্ড রেনর।

ওটা কি? পোয়ারো নীচু হয়ে কি যেন একটা তুলে নিলেন।

ক্যাপ্টেন বন্ধু জানতে চাইলেন–কি পেলে?

–চাবি, পোয়ারো, জবাব, নিখুঁত একটা চাবি। শশব্যস্ত হয়ে বললেন, বন্ধু, চট করে স্টাডিতে যাও তো। ওঘরে একটা সিন্দুক আছে দেখেছি এই চাবিটা লাগিয়ে দেখ খোলে কিনা। কেউ আসার আগেই কাজটা সেরে ফেলা দরকার।

চাবি নিয়ে ক্যাপ্টেন হেস্টিংস এসে ঢুকলেন স্টাডিতে। পোয়ারো ইতিমধ্যে মৃত স্যার ক্লডের কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। চারপাশে একবার সতর্ক চোখে তাকালেন, কান খাড়া করলেন। না, প্রশস্ত সময়। তিনি চট করে স্যার ক্লডের ট্রাউজার্সের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিলেন। টেনে বের করলেন একটা চাবির গোছা। সন্ধানী চোখে প্রত্যেকটা চাবি পরখ করলেন।

ইতিমধ্যে স্টাডি থেকে বেরিয়ে এসেছেন ক্যাপ্টেন হেস্টিংস ঠোঁটে খুশির ঝিলিক তুমি ঠিকই ধরেছ, বন্ধু, এই চাবি ওই সিন্দুকেরই, গর্তে ঢোকাতেই কেমন টুক করে ঘুলে গেল, আবার বন্ধ হল। এবার আমি এই ঘটনার গলদ কোথায়, ধরতে পেরেছি।

-বন্ধু, অত সহজ ভেবো না, কেসটা যেমন জটিল, তেমন রহস্যঘন, সময় লাগবে জট খুলতে, পোয়ারো হাত বাড়িয়ে বললেন, দাও, চাবিটা দাও দেখি।

বন্ধু-তথা সহকারীর কাছ থেকে চাবি পোয়ারো এক হাতে নিলেন, অন্য হাতে স্যার ক্লডের পোশাকের পকেট থেকে পাওয়া চাবির গোছর নির্দিষ্ট একটি চাবি তুলে ধরলেন। দুটো চাবি মিলিয়ে দেখলেন। একই তালার চাবি নিখুঁত ভাবে তৈরি কোনটা নকল আর কোনটা আসল, বোঝা মুশকিল।

চাবির গোছাটা আগের জায়গায় রেখে দিয়ে পোয়ারো হাতের চাবিটা দেখিয়ে বললেন–খুব তাড়াহুড়ো করে তৈরি হলেও নিখুঁত, এর সাহায্যেই কাজ হাসিল হয়েছে নিঃসন্দেহে।

তাহলে তো এর মানে হল………. ক্যাপ্টেন হেস্টিংস-এর উত্তেজিত কণ্ঠস্বর।

হঠাৎ শোনা গেল দরজায় লাগানো তালা খোলার মৃদুশব্দ। পোয়ারো সচকিত হলেন এবং ক্যাপ্টেন হেস্টিংসকে চুপ থাকতে বললেন। এগিয়ে গেলেন দরজার কাছে। কপাট দুটো ভেতর থেকে টেনে দিলেন, দরজা খুলে গেল। ট্রেডওয়েলকে দেখা গেল।

-মাফ করবেন, স্যার, পোয়ারোকে লক্ষ্য করে ট্রেডওয়েল বলল–উনি, আমার মনিব, ইশারায় আরামকেদারায় আধ শোওয়া স্যার ক্লডকে দেখিয়ে বলতে থাকল, তার হুকুমেই আমি এ ঘরের দরজা বাইরে থেকে তালা এঁটে দিয়েছিলাম। আপনি এখানে না আসা পর্যন্ত এই ব্যবস্থা বজায় থাকবে–তাও বলেছিলেন।

–আমার ধারণা, তোমার মনিবের মৃত্যু হয়েছে। তোমার নাম কি, ছোকরা।

–আজ্ঞে, ট্রেডওয়েল। বলতে বলতে সে স্যার ক্লডের মৃত দেহের কাছে এসে দাঁড়াল। আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ল–ওঃ ভগবান! তোয়ালে দিয়ে চোখ মুছল। শোক সংবরণ করে জানতে চাইল–ওর মৃত্যুর কারণ কি স্বাভাবিক, নাকি ইচ্ছে করে মারা হয়েছে?

-তার মানে? কি বলতে চাইছ তুমি?

 ট্রেডওয়েলের চোখে চোখ রেখে পোয়ারো জিজ্ঞাসা করলেন।

-আজ সন্ধ্যার পর থেকে এ বাড়িতে এমন কিছু ঘটেছে, যা আমার মনে… ট্রেডওয়েল থামল।

-তাই বুঝি। পোয়ারো ট্রেডওয়েলের কথায় সায় দিলেন। তারপর বন্ধুর দিকে তাকিয়ে ইশারায় ট্রেডওয়েলের বক্তব্য বোঝাবার চেষ্টা করলেন।

ট্রেডওয়েল, তোমার এমন কিছু ঘটনার কথা আমার জানা খুব জরুরি। পোয়ারো বললেন–বল, এমন কি ঘটেছে, যা তোমার মনে খটকা জাগিয়েছে।

–ভেবে পাচ্ছি না স্যার, কোথা থেকে এই ঘটনার শুরু, ট্রেডওয়েল সহজ ভঙ্গিতে বলে চলল–তবে এখন আমার, পরিষ্কার মনে হচ্ছে, যেদিন ওই ইটালিয়ান ভদ্রলোক এ বাড়ির সকলের সঙ্গে বিকেলে চায়ের আসরে যোগ দিয়েছিলেন, তখনই প্রথম মনে হয়েছিল, কোথাও কোন গোলমাল হয়েছে।

ইটালিয়ান ভদ্রলোক? তার নাম কি?

–ডঃ কারোলির কথা বলছি, স্যার।

-উনি বিকেলে চায়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আসছেন, এটা নিশ্চয়ই বাড়ির সকলে জানতেন না?

-ঠিক বলেছেন, স্যার। উনি মিসেস লুসিয়া রিচার্ডস-এর বন্ধু, তাই মিস ক্যারোলিন তাঁকে অতিথি হয়ে এখানেই থাকতে বলেন। তবে কথা শেষ না করে ট্রেডওয়েল মুখ বন্ধ করল।

–কী হল, থেমে গেলে কেন? পোয়ারো জানতে চাইলেন, তবে কি?

-আমি কেন চুপ করে গেলাম, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, স্যার ট্রেডওয়েলের বিনীত কণ্ঠস্বর। এই পরিবারে যা কিছু ঘটছে, তা পাঁচকান করা উচিত নয়। এতদিন যাঁর সম্মানের কথা ভেবে কিছু বলিনি, তিনি যখন আজ আর বেঁচে নেই, তবে আর ভয় কিসের? তাই আমি মনে করি……..

ট্রেডওয়েল তার মনিবের মৃত্যুতে যে মানসিকভাবে অত্যন্ত ভেঙে পড়েছে, পোয়ারোর বুঝতে দেরি হল না। তিনি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে। সহানুভূতির সুরে বললেন ট্রেডওয়েল, তুমি মুখে না বললেও আমি আঁচ করতে পারছি তোমার মনের কথা। তুমি এই পরিবারের বাটলার, সাবেক রীতিনীতিতে আটকে আছ। অন্যদিকে তোমার মনিবের প্রতি শ্রদ্ধা ভালবাসা এসব ছেড় বাইরে বেরোতে পারছ না। তাইতো?

ট্রেডওয়েল নীরবে ঘাড় নেড়ে পোয়ারোর কথায় সায় দিল।

তবে তোমাকে জানিয়ে রাখি, তোমার মনিবের ডাকেই আমি এখানে এসেছি। সাক্ষাতে তিনি সব আমায় বলতেন। অতএব, আমি চাই, তুমি যা কিছু জানেনা, সব ঝেড়ে বলে ফেলল।

–বেশ, তাই হোক। ট্রেডওয়েল বলতে শুরু করল, মিস ক্যারোলিন অ্যামরি এই ডঃ কারোলিকে পরিবারের সকলের সঙ্গে ডিনারে আমন্ত্রণ জানালে লুসিয়া রিচার্ডস মোটেই খুশি হননি। ওঁর চোখ মুখ ও আচরণে তা প্রকাশ পেয়েছিল।

–আচ্ছা, এবার বল, পোয়ারো জিজ্ঞাসা করলেন–ওই ইটালিয়ান লোকটাকে দেখে তোমার কি মনে হয়?

–স্যার, ডঃ কারোলির ওপর ট্রেডওয়েল যে বিরক্ত, তা বোঝা গেল, মাফ করবেন স্যার, ডঃ কারোলিকে অন্যান্যদের কেমন লাগে জানি না, তবে আমার তাকে গোলমেলে লোক বলে মনে হয়।

–অর্থাৎ তুমি বলতে চাইছ, পোয়ারো বললেন, ডঃ কারোলি এই পরিবারে আসার পর থেকেই তোমার অদ্ভুত ও অস্বাভাবিক বলে মনে হয়েছে, ঠিক বলেছি?

-হ্যাঁ, স্যার, ঠিক তাই।

–এমন কোন ঘটনা ঘটেছিল, যার ফলে, তোমার মনে ডঃ কারোলি সম্পর্কে সন্দেহজনক ধারণার জন্ম হয়েছে?

-তাহলেও বলি, স্যার। ট্রেডওয়েল বলে চলল, আজ বিকেলে সকলে যখন চা পানে ব্যস্ত, সেই সময় স্যার ক্লড আমাকে ডেকে লাইব্রেরি অর্থাৎ এ ঘরের দুটো ফ্রেঞ্চ উইন্ডোর পাল্লা ভেতর থেকে বন্ধ করে তালা আটকে দিতে বলেছিলেন, এমনকি দরজায় লাগানো তালাও। তারপর ডিনার শুরু হল। পরিবারের সদস্যরা ডিনার টেবিলে হাজির। ডিনারের ফাঁকে স্যার ক্লড আমাকে হুকুম দিলেন গ্যারাজে ফোন করতে, গাড়ি পাঠিয়ে স্টেশন থেকে আপনাকে নিয়ে আসার জন্য। মিসেস লুসিয়া রিচার্ড, তার হাবভাবেও অস্বাভাবিকতা ছিল। ডিনার শেষ না করেই টেবিল ছেড়ে কোনরকমে বেরিয়ে এসেছিলেন। ওনার আবার ফিটের অসুখ আছে, কোথায় কখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবেন, আগে ভাগে কেউ বলতে পারে না। তাই উনি তেড়ে খুঁড়ে চলে আসাতে, সকলে ভাবলেন, নিশ্চয়ই লুসিয়ার শরীর খারাপ করছে, জ্ঞান হারাবে। অতএব একে একে খাওয়া না সেরে সবাই টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লেন।

পোয়ারো শান্তভাবে চিন্তা করতে লাগলেন, স্যার ক্লড আমাকে উইক এন্ডেই আসতে বলে ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ উনি মত পালটে শুক্রবার অর্থাৎ আজই আমায় অনুরোধ করেন। কিন্তু কেন? এখন ব্যাপারটা সামান্য হলেও আঁচ করতে পারছি।

-ডিনার টেবিল থেকে লুসিয়া তাহলে সোজা এঘরেই এসে ঢুকেছিলেন, তাই না ট্রেডওয়েল?

-হ্যাঁ, পোয়ারোর প্রশ্নের জবাবে ট্রেডওয়েল বলল।

বাটলার ট্রেডওয়েলের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে পোয়ারোর অনুসন্ধানী দৃষ্টি ঘুরে বেড়াচ্ছিল ঘরময়। টেবিলের ওপর একটা ব্যাগ দেখে হাতে তুলে নিলেন লেডিস ব্যাগ।

–কোন মহিলা বোধহয় মনের ভুলে তার ব্যাগটা ছেড়ে চলে গেছেন। ট্রেডওয়েল, বলতে পার, এটা কার ব্যাগ?

-ওটা মিসেস লুসিয়া রিচার্ডস-এর, ট্রেডওয়েল বলল, আমার পরিষ্কার মনে আছে এঘর ত্যাগ করার সময় উনি ব্যাগটা টেবিলে রেখে চলে গেলেন।

পোয়ারো তার বন্ধু ও সহকারীর দিকে তাকালেন, অর্থাৎ বন্ধু, এ সম্পর্কে তোমার কি ধারণা।

–ট্রেডওয়েল মিথ্যে বলছে না। ক্যাপ্টেন হেস্টিংস বললেন–ঘর ছেড়ে চলে যাবার সময় মিসেস লুসিয়া টেবিলে ওই হাত ব্যাগটা রেখে চলে গেলেন, আমি নিজের চোখে দেখেছি।

–ঘর থেকে বেরোলেন, অথচ নিজের ব্যাগ নিতে ভুলে গেলেন। সত্যিই আজব ব্যাপার।

কথা বলতে বলতে এরকুল পোয়ারো লেডিস ব্যাগটা সোফার ওপর রেখে দিলেন। এখন তার মনে নানা সম্ভাবনা উঁকি দিয়েছে। ব্যাগটা তাকে ভাবিয়ে তুলল। দুদে গোয়েন্দা এরকুল পোয়ারো এখন গভীর চিন্তার সমুদ্রে তলিয়ে গেলেন।

ট্রেডওয়েলের কথাতে তাঁর চিন্তার ঢেউগুলো ছড়িয়ে পড়ল। তিনি সম্বিত ফিরে পেলেন।

–আর একটা ব্যাপার, স্যার, খানিকটা থেমে ট্রেডওয়েল আবার বলতে শুরু করল এ ঘরের দরজা জানলা ভাল করে বন্ধ করার কথা বলছি। স্যার ক্লড আমায় বলেছিলেন…….. ট্রেডওয়েল কথা শেষ না করে চুপ করে গেল।

-বল বল। পোয়ারো আগ্রহ ভরে জানতে চাইলেন, বল, তোমার মনিব কি বলেছিলেন, কোনো কিছু গোপন করো না এসো, আমরা বরং বাড়ির সামনের দরজা দেখিয়ে তিনি বললেন ওপাশে গিয়ে কথা বলি।

ট্রেডওয়েলের পেছন পেছন পোয়ারোকে এগিয়ে যেতে দেখে ক্যাপ্টেন হেস্টিংস বললেন–তোমরা যাও, আমি এখানেই থাকি কি বল?

হাসতে হাসতে ক্যাপ্টেন হেস্টিংসও তাদের সঙ্গী হলেন।

একে একে তিনজনে বসার ঘর থেকে বেরিয়ে এল। বাইরে থেকে দরজার কপাট ভাল করে বন্ধ করল ট্রেডওয়েল।

এরপর কেটে গেছে কিছুটা সময়। হঠাৎ ভেতর থেকে ওই ঘরের দরজা খুলে গেল, বেড়ালের মতো অতি সাবধানে পা ফেলে ঢুকল লুসিয়া। চারপাশে তার সজাগ দৃষ্টি। না, কেউ কোথাও নেই, ঘর একেবারে ফঁকা। নিশ্চিন্ত হল। চলে এল কফি টেবিলের সামনে। এখন তাকে দেখে মনে হচ্ছে, কোন মন্ত্রবলে সে এক ডাইনিতে পরিণত হয়েছে। মুখের কোমল নিরপরাধ ভাব উঠে গেছে, কুটিলতা মাখা মুখে শেয়ালের ধূর্তামি। বয়সটাও এক ধাপে বুঝি অনেকটা বেড়ে গেছে।

খুব সাবধানে নিঃশব্দে স্যার ক্লডের এঁটো কফির কাপটা তুলে নিল। এবার সে কি করবে? কিছু করার আগেই বাইরের দিকের দরজা দিয়ে পোয়ারো ঢুকে পড়লেন ভেতরে। ভূত দেখার মতো চমকে উঠল লুসিয়া।

কিছু মনে করবেন না, মাদাম, পোয়ারো তড়িঘড়ি কফির কাপটা লুসিয়ার থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিলেন।

–আমার ব্যাগটা যে কোথায় গেল, এক নিঃশ্বাসে লুসিয়া কথাগুলো বলল, মনে হয় এখানে রেখেছিলাম, তাই……..।

-ব্যাগ খুঁজছেন? পোয়ারোর ঠোঁটে হাসির রেখা, আপনার এ ঘর ছেড়ে চলে যাবার পর একটা লেডিস ব্যাগ দেখেছিলাম খুব সম্ভবত। কোথায় দেখেছি, কোথায় দেখেছি, হা, ওইতো পড়ে আছে সোফার ওপর।

পোয়ারো নিজে ব্যাগটা তুলে এনে লুসিয়াকে দিলেন।

লুসিয়া তাকাল পোয়ারোর দিকে। একগাল মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বিদায় নিল। ভেতরের দরজা দিয়েই সে চলে গেল।

পোয়ারো কি মনে করে স্যার ক্লডের ব্যবহার করা কফির কাপটা সামনে তুলে ধরলেন, কিছুটা তলানি পড়ে আছে, নাকের কাছে এনে গন্ধ নিলেন। পকেট থেকে একটা কাঁচের নল বের করলেন। সাবধানে কিছুটা তলানি টেস্টটিউবে ঢেলে নিলেন। কর্কের ছিপি লাগিয়ে টিউবের মুখ বন্ধ করলেন। জ্যাকেটের ভেতরের পকেটে সেটা চালান করে দিলেন। কাপটা যথাস্থানে ট্রে-র ওপর রেখে দিলেন। গুণে দেখলেন, ট্রে-তে মোট ছটি কাপ রয়েছে।

পোয়ারো আবার চিন্তার সমুদ্রে ডুব দিলেন। ভুরু কুঁচকে সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজতে লাগলেন। হঠাৎ তার মুখ-চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বুঝিবা কোন পথ পাওয়া গেছে।

পোয়ারো আবার বাইরের দরজাটা ব্যবহার করলেন। বেরিয়ে এসে বাইরে থেকে সশব্দে দরজার পাল্লা দুটো টেনে দিলেন। দুটো ফ্রেঞ্চ উইন্ডো, পুরু পর্দা লাগানো, জানলা ছাড়িয়ে নীচ পর্যন্ত ঝুলছে।

পোয়ারো নিজেকে লুকিয়ে রাখলেন একটি পর্দার আড়ালে। বাইরে থেকে সজাগ দৃষ্টি রইল বসার ঘরের ভেতরে।

হ্যাঁ, আবার সে এসেছে। তবে আগের চেয়ে আরো বেশি সাবধানী। একটুও আওয়াজ না করে লুসিয়া ঘরের মাঝখানে চলে এল। জানলার পর্দার আড়াল থেকে পোয়ারো সব কিছু লক্ষ্য করলেন।

লুসিয়া ওই কাপটা তুলে নিল, একটু আগে তিনি যেটি সরিয়ে রেখেছিলেন। ওই কাপটা লুসিয়ার কোন কাজে লাগবে? পোয়ারো দেখলেন, পায়ে পায়ে লুসিয়া চলে এল একটা টুলের সামনে, যেখানে রয়েছে বড় ধাতুর একটা টব, তাতে ঘর সাজাবার বাহারি পাতার চারা গাছ পোঁতা। বাইরে বেরোবার দরজার কাছেই টবটা রাখা।

মাটিটা বেশ শক্ত হয়ে আছে, খুঁড়ে বেশ খানিকটা মাটি ওপর দিকে তুলে ফেলল, একটা ছোট গর্ত সৃষ্টি হল। এবার জল ঢেলে চারপাশের শক্ত মাটিকে নরম করল। হাতের কাপটা বসিয়ে দিল গর্তের মধ্যে, তার ওপর খোঁড়া মাটি ঢাকা দিল। হাত দিয়ে সমান করে দিল, কিছু বোঝার উপায় রইল না।

হাতে লেগে থাকা মাটি জলে ধুয়ে পাত্রটা সরিয়ে রাখল। সমস্ত প্রমাণ লোপাট করে লুসিয়া বুঝি এবার নিশ্চিন্ত হল।

ঠিক এই সময় ওই ঘরে রিচার্ডকে ঢুকতে দেখা গেল, পেছনে এক সুদর্শন যুবক, হাতের ডাক্তারি ব্যাগই তার পরিচয় জানিয়ে দিল।

আচমকা লুসিয়াকে দেখে রিচার্ড ঘাবড়ে গেল–তুমি? এখানে কি কাজ?

দরকার ছিল, লুসিয়া হাসতে হাসতে বলল, ওপরে গিয়ে ব্যাগটা না পেয়ে ভাবলাম এঘরেই ফেলে রেখে গেছি, তাই আর কি! আরে ডঃ গ্রাহাম যে, ভাল আছেন তো? বাড়ির খবরও নিশ্চয়ই ভাল। দুঃখিত, আমাকে এক্ষুনি ওপরে যেতে হবে। আসি।

ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তড়িৎ গতিতে লুসিয়া ঘর থেকে বেরিয়ে এল। রিচার্ড বোকার মতো স্ত্রীর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল–সত্যি, তোমার মতিগতি বোঝা ভার, মনে মনে বলল রিচার্ড।

পোয়ারোর এবার প্রকাশিত হওয়ার পালা। তিনি পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন। মৃদু হেসে রিচার্ডের সামনে এসে দাঁড়ালেন।

-আসুন মঁসিয়ে পোয়ারো, এনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই, রিচার্ড বলল আমাদের পারিবারিক চিকিৎসক, ডঃ কেনেথ গ্রাহাম।

ডাক্তার ভদ্রলোক মাথাটা সামান্য সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে পোয়ারোকে অভিবাদন জানাল। এবার এগিয়ে গেলেন আর্মচেয়ারের কাছে, যেখানে মৃত স্যার ক্লড আধবসা অবস্থায় পড়ে আছেন। রিচার্ডও ডাক্তারের পাশে এসে দাঁড়াল।

পোয়ারো ওদিকে না গিয়ে ইচ্ছে করে তফাতে রইলেন। কফির কাপগুলো রাখা যে টেবিলে, তার সামনে চলে এলেন, কান তার সজাগ রইল, ওরা কি কথা বলাবলি করে, তা শুনতে হবে বৈকি।

পোয়ারো কফির কাপগুলোর ওপর নজর দিলেন। পাঁচটা কাপ, একটা উধাও।

ডঃ গ্রাহাম খুব মনোযোগ দিয়ে স্যার ক্লডকে দেখতে থাকলেন। গায়ে হাত না দিয়ে দূর থেকে যা যা ডাক্তারি নিরীক্ষা করা চলে, তাই করলেন। তারপর ঘাড় নাড়লেন, মুখে অসহায়তার ছাপ।

ডঃ গ্রাহাম শান্ত কণ্ঠে বললেন, পোয়ারো শুনতে পেলেন–দুঃখিত রিচার্ড, মৃত্যুজ্ঞাপক প্রমাণ পত্র এই মুহূর্তে আমি দিতে পারছি না।

-কেন? রিচার্ড কৈফিয়তের সুরে জানতে চাইল। সমস্যা কি? আচমকা হার্ট অ্যাটাকেই তো বাবার মৃত্যু হয়েছে, তাহলে কেন ডেথ সার্টিফিকেট দিতে পারবে না?

-দেখ ভাই, তোমার মতে যা হার্ট অ্যাটাক, আমার কাছে তা নয়, ডঃ গ্রাহামের গম্ভীর কণ্ঠস্বর তোমার বাবার স্বাস্থ্য মোটেও খারাপ ছিল না, হার্টের অসুখেও ভোগেন নি, পরীক্ষা করে যা বুঝলাম, হার্ট ফেল উনি করেননি। মারাত্মক বিষাক্ত কিছু ওঁর শরীরে প্রবেশ করেছে, যার ফলে মৃত্যু।

ডাক্তার বলে চললেন–অতএব আমাকে নিশ্চিত হওয়ার জন্য মৃতদেহ মর্গে পাঠাতে হবে, জানতে হবে গত আট দশ ঘন্টায় ওনার পাকস্থলীতে কী কী প্রবেশ করেছে। এসব করার আগে তুমি মৃতদেহ সৎকার করতে পারবে না, মাফ কর, আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারছি না। আসি।

ডঃ গ্রাহাম কথা শেষ করে ডাক্তারি ব্যাগটা হাতে তুলে নিলেন, গট গট করে চলে গেলেন দরজা পেরিয়ে বাইরে। রিচার্ড আর কি করবে? সে বোবার মতো অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ডঃ গ্রাহামের চলে যাওয়ার দিকে।

পোয়ারোর এখানে থাকার প্রয়োজন আপাতত মিটেছে, ওপরে যাবেন ভাবছেন, এমন সময় ট্রেডওয়েল বসার ঘরে এসে ঢুকল, বলল–স্যার, আপনাদের দু’জনের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে, সিঁড়ির ওপর দুটো ঘর, পাশাপাশি থাকবেন। আপনাদের রাতের খাবারও তৈরি, আসুন স্যার, খাওয়া-দাওয়া সেরে নিন।

–অনেক-অনেক ধন্যবাদ, ট্রেডওয়েল। পোয়ারো তাকে মনে করিয়ে দিয়ে বলল, রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে এঘরের দরজা জানালাগুলো পরীক্ষা করে নিও, ভালভাবে তালা এঁটে লাগিও, মনে থাকবে তত?

-আপনি ওসব নিয়ে চিন্তা করবেন না, স্যার। অনুগত ভৃত্যের মতো ট্রেডওয়েল বলল, আমি রাতে বিছানায় যাবার আগে সবকটা দরজা জানলা ভালভাবে এঁটে দেব। এবার ডিনার হলে চলুন।

-আচ্ছা চল, বাঁকা চোখে রিচার্ডকে একবার লক্ষ্য করে পোয়ারো বসার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, সামনে চলেছে বাটলার ট্রেডওয়েল, গন্তব্য ডিনার হল।

.

০৮.

রাতে বিছানায় গেলেন এরকুল পোয়ারো। পরম সুখে নিদ্রা গেলেন। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল। প্রাত্যহিক কাজ সেরে ফাস্ট টেবিলে এসে বসলেন–অবাক হলেন, টেবিল খালি, কেউ কোথাও নেই। পোয়ারো নিজের মনে ব্যাপারটা ভাববার চেষ্টা করলেন।

এমন সময় ট্রেডওয়েল এসে ঢুকল, হাতে কফির ফ্ল্যাক্স আর পোয়ারোর জন্য ব্রেকফাস্ট।

পোয়ারো ফিসফিসিয়ে জানতে চাইলেন–কাউকে তো দেখছি না, পরিবারের সকলের টি ব্রেকফাস্ট সারা হয়ে গেছে, আমার সঙ্গে ব্রেকফাস্ট করবে না বলে সকলে দলবদ্ধ হয়েছে।

-ঠিক ধরেছেন, স্যার। কফির ফ্ল্যাক্স-টেবিলে নামিয়ে রেখে, নীচুস্বরে ট্রেডওয়েল বলল–আজ সকলের আগে ব্রেকফাস্ট সেরেছেন সেক্রেটারি এডওয়ার্ড রেনর, তারপর স্টাডিতে ঢুকতে দেখেছি। রিচার্ড দম্পতি ঘুম থেকে উঠে পড়লেও বাইরে বেরোননি, এই তো একটু আগে ওদের ঘরে ব্রেকফাস্ট দিয়ে এলাম। মিস ক্যারোলিন অ্যামরিও তাই করেছেন, নিজের ঘরে বসেই জল খাবার খেয়েছেন। এপরিবারের আর একজন আছেন, স্যারের ভাইঝি মিস বারবারা অ্যামরি। তিনি সোজা রান্না ঘরে এসে দুটো সেদ্ধ ডিম আর দুটো টোস্ট নিজে হাতেই বানিয়ে নিয়েছেন, আমাকে কেবল তিন কাপ কফি করে দিতে বললেন, আমি কফি তৈরি করে ফ্ল্যাক্সে ভরে দিতে উনি সবকিছু নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাগানে চলে গেলেন। পুরনো খবরের কাগজ বিছিয়ে নিয়ে একা একা ব্রেক ফাস্ট করছেন।

দোতলায় একটা ঘর ক্যাপ্টেন হেস্টিংসকে দেওয়া হয়েছে। সকালের আলো এসে ঘরে ঢুকল, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস চোখ মেললেন। বিছানা লাগোয়া ঘোট টেবিলে সকালের রাত টাইমস পত্রিকা দেখে তিনি খুশি হলেন, ট্রেডওয়েলই যে এসব ব্যবস্থা করে গেছে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। ঘরের বাইরে সরু একফালি ব্যালকনি, সেখানে একটা আরাম কেদারা রয়েছে। ক্যাপ্টেন হেস্টিংসের মন খুশিতে নেচে উঠল। তিনি বিছানা ত্যাগ করলেন। চোখে মুখে জল দিলেন। আরাম কেদারায় এসে বসতে গিয়ে বাধা পেলেন। অল্প কিছু দূরে একটা গাছের নীচে গিয়ে চোখের দৃষ্টি আটকে গেল–হ্যাঁ, বারবারাই, নিঃসঙ্গ বসে ব্রেকফাস্ট সারছে।

এমন সময় ট্রেডওয়েল এ ঘরে এসে ঢুকল। সকালের চায়ের কাপটা নিয়ে যাবে বলে। তা দেখে ক্যাপ্টেন হেস্টিংস বললেন–ট্রেডওয়েল, ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি বরং আমার খাবারটা এখানেই দিয়ে যাও।

–বেশ, যেমন বলবেন, ট্রেডওয়েল লক্ষ্য করল, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস অপলক চোখে বারবারাকে লক্ষ্য করছেন, মজা বোধ করল সে, মনে মনে খানিক হেসে নিল।

শোনো, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস ঘাড় ঘুরিয়ে ডাকলেন ট্রেডওয়েলকে, মানে, বলছিলাম কি, আজকের জলখাবারে কি কি পদ আছে।

আজ্ঞে, আছে টোস্ট, ডিমের পোচ, বেকন ভাজা আর কফি। আপনি এখানেই বসুন, সব তৈরি আছে, নিয়ে আসতেই যা দেরি।

ট্রেডওয়েল চলে যেতে ক্যাপ্টেন হেস্টিংস খবরের কাগজ হাতে নিয়ে আরাম কেদারায় বসলেন। কিছুক্ষণ বাদেই ট্রেডওয়েল এসে ঢুকল, ব্রেক ফাস্ট চিলতে সরু টেবিলের ওপর সাজিয়ে দিল।

–মশিয়ে পোয়ারোর কি খবর? কোন হাঁকডাক শুনতে পাচ্ছি না, হাসতে হাসতে ক্যাপ্টেন হেস্টিংস জানতে চাইলেন, এখনও ঘুম ভাঙেনি, নাকি ঘরের মধ্যে বসে আছেন?

সেসব কিছুই না, স্যার। ট্রেডওয়েল স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে চলল, উনি অনেকক্ষণ আগে বিছানা ত্যাগ করেছেন। ব্রেক ফাস্ট সেরে এই একটু আগে গ্রামের দিকে গেলেন, কি যেন দরকার আছে।

-হুম, একটা গম্ভীর আওয়াজ করলেন ক্যাপ্টেন হেস্টিংস। দেখলেন, বারবারার কফি পান এখনও চলছে। তিনি এবার খবরের কাগজে মন দিলেন। স্যার ক্লড অ্যামরির মৃত্যু সংবাদ নিশ্চয়ই কাগজে ছাপা হয়েছে–শোকসংবাদ কলমে চোখ বোলালেন, না, কিছুই বেরোয়নি। সম্পাদকীয় প্রবন্ধ পড়তে শুরু করলেন। খানিকবাদে তার তন্দ্রা এল দু’চোখের পাতায়, ঢুলে পড়লেন, চোখ মেলার চেষ্টা করলেন, ধীরে ধীরে হাত থেকে খবরের কাগজটা আপনা-আপনি পড়ে গেল, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস-এর খেয়াল নেই, তিনি তখন নরম রোদের আভা লাগিয়ে দিব্যি ঘুমোচ্ছন।

এর পর কেটে গেল প্রায় তিরিশ মিনিট।

-বাঃ, দারুণ। এই সাত সকালে খবরের কাগজ ছেড়ে দিয়ে কিভাবে যে মানুষ ঘুমোয় জানি না।

পরিচিত কণ্ঠস্বর। ক্যাপ্টেন হেস্টিংস-এর ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে তাকালেন, দেখলেন, একটু দূরে দাঁড়িয়ে এরকুল পোয়ারো, ঠোঁটে স্মিত হাসি।

-কে বলল, আমি ঘুমোচ্ছি! ক্যাপ্টেন হেস্টিংস মৃদু প্রতিবাদ করে বললেন, আমি ঘুমোইনি, আসলে ব্রেকফাস্ট সেরে কাগজে চোখ রেখে ভাবছিলাম, কাল সন্ধ্যে থেকে অব্দি এখানে যা যা দেখেছি, সেইসব ঘটনা পরম্পরা হয়তো বা তন্দ্রা লেগেছিল একটু।

-তন্দ্রা আসতেই পারে, এ অস্বাভাবিক কিছু নয়। পোয়ারো বললেন, শুধু স্যার ক্লডের খুন নয়, ওই সঙ্গে ওঁর ফর্মুলা চুরির ব্যাপারটাকেও মাথায় রাখতে হবে, হেস্টিংস প্রথমটার মতো দ্বিতীয়টিও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

-তাইতো, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস জানতে চাইলেন, কতটা কাজ হল?

–সামান্যই, একজনকে আমি সন্দেহ করছি, জানি না ঠিক কিনা। পোয়ারো বলতে থাকলেন। সন্দেহটাকে মজবুত করার জন্যই গ্রামে গিয়ে ছিলাম একা। দেরি নেই, মনে হয় টেলিফোন মারফত খবর আসবে। তখন বলা যাবে, ঠিক পথে এগোচ্ছি কিনা।

–দোষী বলে কাকে তোমার মনে হচ্ছে পোয়ারো? ক্যাপ্টেন হেস্টিংস জানতে চাইলেন।

–ধীরে বন্ধু, ধীরে, পোয়ারো সামান্য হেসে জবাব দিলেন–এ বড় প্যাচানো গেরো, আনমনে দূরের দিকে তাকালেন। গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে দৃষ্টি চলে গেল অনেক দূর, বললেন, খোলার উপায় তাড়াতাড়ি বলা যাবে না। তুমি বরং চোখ কান খুলে রেখে সব কিছু শুনে যাও, ক্যাপ্টেন, এ এক ম্যাজিক, বুঝেছ।

পোয়ারো আবার হাসলেন–বাদ দাও এসব কথা। শোনো বন্ধু, আজ দুপুরে স্যার ক্লড অ্যামরির ছেলে রিচার্ড অ্যামরিকে দেখা করতে বলেছি। ওইসময় নীচের লাইব্রেরী ঘরে থেকে আমায় সহায়তা করো। চারদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা হল। তোমার কাজ, মনে থাকে যেন।

নিশ্চয়ই, পোয়ারো। আমি সর্বদা তোমার পাশে আগেও ছিলাম, এখনও আছি, পরেও থাকব।

.

কিছুক্ষণবাদে কয়েকজন লোক এল স্থানীয় করোনারের মর্গ থেকে। ডঃ গ্রাহামের নির্দেশে তারা এসেছে, স্যার ক্লড অ্যামরির মৃত দেহ নিয়ে তারা চলে গেল।

এরকুল পোয়ারো ও তার সহকারী লাঞ্চে বসে বিশেষ কিছুই খেতে পারলেন না, কারণ ব্রেকফাস্টেই পেট ভরা ছিল। অতএব সামান্য একটু চিকেন সুপ আর টোস্ট খেয়ে টেবিল থেকে উঠে এলেন।

দুপুরের খাওয়া সেরে পোয়ারো সোজা নীচে নেমে এলেন, সঙ্গে বন্ধু ক্যাপ্টেন হেস্টিংস। তারা এসে ঢুকলেন লাইব্রেরিতে।

কিছুটা সময় কেটে গেল। দেখা গেল রিচার্ড অ্যামরিকে। পোয়ারোর কথা মতো সে এসে ঢুকল লাইব্রেরিতে। আজ সকাল পর্যন্ত যে আরাম কেদারায় স্যার ক্লডের দেহ পড়েছিল, সেখানে রিচার্ড বসল স্বাভাবিক ভঙ্গিতে, পোয়ারো একটা চেয়ার টেনে তার উল্টোদিকে বসলেন, কাপ্টেন হেস্টিংস সামান্য দূরে একটা চেয়ার দখল করলেন। ওদের আলোচনায় যোগ দিলেন না বটে, কিন্তু কান থাকল ওদের কথার দিকে।

পোয়ারো প্রথম কথা বলতে শুরু করলেন–মঁসিয়ে অ্যামরি, তিনি রিচার্ডের দিকে সরাসরি স্পষ্ট চোখে তাকালেন, আমি এখানে আসার আগে যা ঘটেছিল তা আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই, এমনকি স্যার ক্লড কি করেছিলেন, তার মানে আপনি যা দেখেছেন, আপনার সঙ্গে তিনি কি কি কথা বলেছিলেন, সব আমায় পরপর বলুন। তবে হ্যাঁ, কোন কিছু গোপন রাখার চেষ্টা করবেন না।

গতকাল রাতে রিচার্ডকে যেমন অস্বাচ্ছন্দ্য দেখা গিয়েছিল, আজ তার উল্টো ঘটনা। এমনকি পোয়ারোর সঙ্গেও তুলনামূলকভাবে ভাল ব্যবহার করছে। পোয়ারো এখানে পৌঁছবার আগে যা যা ঘটে ছিল, এমনকি তার বাবা তাকে কি বলেছিল, সব রিচার্ড শুনিয়ে দিল। তার কথাবার্তায় এতটুকু অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ল না। পোয়ারো কঠিন মুখে নিবিষ্ট চিত্তে নীরবে সব শুনলেন।

রিচার্ডের কথা বলা এক সময় শেষ হল। সে জানতে চাইল, বলুন মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনাকে আশা করি সব ঠিকঠাক বোঝাতে পেরেছি?

নিশ্চয়ই, মাসিয়ে অ্যামরি। চেয়ারে হেলান দিয়ে পোয়ারো নড়েচড়ে বসলেন, আপনার বলা ঘটনাগুলো এখন পরস্পর ছবির মতো আমার চোখের সামনে সার দিয়ে দাঁড়িয়েছে। এই তো, স্যার ক্লড অ্যামরি ওই আরাম কেদারায় বসেছিলেন, এখন আপনি যেটাতে বসে, তারপর একসময় সারা ঘর অন্ধকারে ডুবে গেল, বাইরে থেকে দরজায় ঢোকার শব্দ, আপনাদের কানেও গেল। সত্যি, এ এক নাটকীয় ক্ষণ স্বীকার করতেই হয়।

–তাহলে আমার কাজ শেষ, যা জানতে চেয়েছিলেন জানা হয়ে গেছে আপনার। আমি এখন

কথা বলতে বলতে রিচার্ড চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল।

পোয়ারো ইশারায় তাকে বসিয়ে দিলেন–আরে, বসুন, বসুন, আরও কিছু জানার আছে।

-বেশ বলুন, কি জানতে চাইছেন? রিচার্ড পা ছড়িয়ে আরাম করে বসল, যা-যা চেয়েছিলেন, সব তথ্য তো পেয়ে গেছেন।

-না, গতকাল সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কি কি ঘটেছে, তা জানা বাকি থেকে গেছে। আমি বলতে চাইছি, ডিনারের ঠিক পরেই কি ঘটেছিল, বলুন।

–আচ্ছা বলছি, একটু হেসে রিচার্ড বলল, আসলে মামুলি ব্যাপার, তাই আপনাকে বলার প্রয়োজন করিনি। তবে আপনার না জানলেই যখন নয়, তখন বলছি, ডিনারের পরে আমরা সবাই এই বসার ঘরে এসে ঢুকি, আর বাবা তার সেক্রেটারি এডওয়ার্ড রেনরকে নিয়ে তার স্টাডিতে চলে গেলেন।

–তারপর আপনারা কি করলেন?

–কি আর করব, ডিনারের পরে যেমনটি হয়ে থাকে। সকলে মিলে হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠলাম। মেয়েরা পরচর্চা পরনিন্দায় মেতে উঠল। আমার খুরতুতো বোন বারবারাকে তো দেখেছেন। বড্ড খেয়ালি। পুরনো আমলের গুচ্ছের খানেক রেকর্ড বের করল। ফক্সট্রট রেকর্ডটা পছন্দ হল। গ্রামোফোনে লাগিয়ে দিয়ে বাজনার তালে তালে নাচতে শুরু করে দিল। খানিকবাদে স্টাডি থেকে বেরিয়ে এডওয়ার্ড রেনর ওর নাচের সঙ্গী হল। ওরা একসঙ্গে নাচতে থাকে।

গুরুত্বপূর্ণ কোন ঘটনা সেই সন্ধ্যায় কি ঘটেছিল? পোয়ারো সন্ধানী দৃষ্টিতে রিচার্ডকে জরিপ করতে লাগলেন, মনে করার চেষ্টা করুন, মঁসিয়ে অ্যামরি। দেখুন, তেমন কিছু বাদ চলে গেল কিনা।

না, মনে রাখার মতো কিছু ঘটেনি, রিচার্ড চটপট জবাব দিল, যা বললাম, ওই পর্যন্তই।

-ডিনারের কত পরে কফি পরিবেশন করা হয়েছিল?

–ডিনারের ঠিক পরেই।

–বাটলার ট্রেডওয়েল নিজে কফি তৈরি করে এনেছিল, নাকি জগ ভরতি কফি দিয়ে গিয়েছিল?

-মনে নেই।

–ঘরের সকলে কফি পান করেছিলেন?

পোয়ারোর প্রশ্নের জবাবে রিচার্ড তড়িঘড়ি জবাব দিল–হ্যাঁ, সকলেই তবে একজন ছাড়া এডওয়ার্ড রেনর, কফি ওর চলে না।

–আর আপনার বাবা? ওনার কফি কি স্টাডিতে দিয়ে আসা হয়েছিল?

-হ্যাঁ, তেমনই মনে পড়ছে এবার রিচার্ড সত্যিই বিরক্ত হল। জানতে চাইল, এসব সাদামাটা ব্যাপার শুনে আপনার কোন কাজে লাগবে?

-মঁসিয়ে অ্যামরি, বুঝতে পারছি, আপনি আমার ওপর চটে যাচ্ছেন। পোয়ারো একটু থামলেন–আসলে কি জানেন, আপনার মুখ থেকে শোনা ঘটনাগুলো আমার মনের ক্যানভাসে ছবি করে ধরে রাখতে চাইছি। তার চেয়েও জরুরি যেটা সেটা হল আপনার বাবার চুরি হয়ে যাওয়া ফর্মুলা উদ্ধার, আপনারা সকলে তো তাই-ই চান, নয় কি?

-মনে হয়। রিচার্ড অবহেলা ভরে উত্তর দিল। পরক্ষণে নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলল–হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই, আমরা সকলেই চাই ফর্মুলাটা ফেরত পেতে।

–বেশ, পোয়ারো খুশি মনে জানতে চাইলেন, স্যার ক্লড অর্থাৎ আপনার বাবা কখন। স্টাডি থেকে এঘরে এসে ঢুকেছিলেন?

-ওরা যখন দরজাটা খোলার চেষ্টা করছিল, তখন।

–ওরা, অর্থাৎ কারা?

ঘরের সকলে।

–কে প্রথম দরজা খুলতে চেয়েছিলেন, মনে আছে?

-মনে আছে, আমার স্ত্রী লুসিয়া, রিচার্ড বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করল, সমস্ত সন্ধ্যেটা ও অসুস্থ বোধ করছিল তাই।

উনি এখন কেমন আছেন? আশা করি গতকালের তুলনায় ভাল। পোয়ারোর কণ্ঠে সহানুভূতির ছোঁয়া তার সাথেও কয়েকটা কথা বলতে চাই।

-মনে হয় না, আপনার চাওয়া পূরণ হবে। ব্যস্ত হয়ে রিচার্ড জবাব ছিল–আজ সকাল থেকে মুখ টিপে বসে আছে, চেনা অচেনা কারো সঙ্গে একটি কথাও বলছে না। তার নীরবতার কারণও বলছে না। আমার মনে হয় না, এমন কোন প্রশ্নের উত্তর কেবল এর জানা আছে। আপনি বরং আমায় প্রশ্ন করুন। বলুন আর কি জানতে চান।

-বুঝেছি, পোয়ারো ঘাড় কাত করে বললেন–তবে কি জানেন মঁসিয়ে মেয়েদের একটা স্বভাব। যা পুরুষদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এমন অনেক ব্যাপার আছে, যা পুরুষদের নজরে পড়ে না, অথবা পড়লেও গুরুত্ব দেয় না। ছাড়ুন ওসব কথা। আপনার পিসিমার খবর বলুন। প্রয়োজনে ওঁকেও আমি প্রশ্ন করতে পারি।

পিসিমার কথা কি আর বলব, মঁসিয়ে পোয়ারো। আমার মা গত হবার পর থেকে পিসিমাই আমাদের সংসারটাকে ধরে রেখেছেন। ভাইয়ের আচমকা মৃত্যু, কোন বোন সহ্য করতে পারে বলুন। গতকাল রাত থেকে বিছানাই হয়েছে তার পরম আশ্রয়। ট্রেডওয়েল বহুবছর ধরে এ বাড়িতে আছে। পিসিমার ভাবগতিক তার জানা আছে। সে জোর করে সকালের ব্রেকফাস্ট খাইয়ে দিয়ে এসেছে। লাঞ্চও তার ঘরে দিয়ে এসেছিল।

–এরকমই হবার কথা। পোয়ারো আবার ঘাড় নেড়ে রিচার্ডের কথায় সায় দিলেন।

আরাম কেদারা ছেড়ে রিচার্ড এগিয়ে গেল ফ্রেঞ্চ উইন্ডোর দিকে। দুটোই বন্ধ। রিচার্ড বলল–ভেতরটা বড্ড গুমোট হয়ে আছে, বাইরের খোলা বাতাস ঢুকলে ভাল হয়।

এব্যাপারে আপনারা অর্থাৎ ইংরেজদের মধ্যে কোন মতপার্থক্য নেই। পোয়ারো হাসতে হাসতে বললেন খোলাবাতাসকে বাইরে থাকতে দিতে আপনাদের আপত্তি। যে কোন উপায়ে ঘরের মধ্যে টেনে এনে তবেই শান্তি।

আমি যদি একটা জানলা খুলে দিই, আপনার অসুবিধা হবে, মঁসিয়ে পোয়ারো। রিচার্ড জানতে চাইল।

-না না, কখনো নয়। পোয়ারো রসিয়ে রসিয়ে বলতে লাগলেন বহু বছর আগে বেলজিয়াম থেকে লন্ডনে চলে এসেছি। সেই থেকে আপনাদের রীতিনীতি, আদব কায়দাকে নিজের মতো করে মানিয়ে নিয়েছি। কিন্তু আপনি জানলা খুলবেন কি করে? শুনেছি আপনার বাবা বিশেষ ধরনের তালা-চাবি তৈরি করেছিলেন, যা ওই

পোয়ারোর কথা থামিয়ে রিচার্ড বলল–একদম ঠিক। বাবার চাবির আছে এখন আমার কাছে।

রিচার্ড এক থোকা চাবি নিজের জ্যাকেটের পকেট থেকে বের করল, পোয়ারো আড়চোখে দেখলেন, এ সেই চাবির গোছা, যা তিনি গতকাল রাতে সবার অগোচরে মৃত স্যার ক্লডের ট্রাউজার্সের পকেট থেকে বের করেছিলেন।

রিচার্ড সেই চাবির থোকা থেকে একটা চাবি বের করে বিশেষ পদ্ধতিতে বন্ধ ফ্রেঞ্চউইন্ডো খুব সহজে খুলে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে একরাশ বাঁধ না মানা ঠাণ্ডা বাতাস ঘরে ঢুকে পড়ল।

-মঁসিয়ে পোয়ারো, রিচার্ড ঘুরে দাঁড়াল, আপনাকে আমার স্ত্রী গতরাতে এখানে থাকার অনুরোধ জানিয়েছিল, এই সমস্যা সমাধানের কথা বলেছিল, তবে কথা কি জানেন, ও মানসিক ভাবে অসুস্থ। ফিটের অসুখ আছে। সামান্য উত্তেজনার ঘটনা দেখলে ও আর ঠিক থাকতে পারে না, বেহুশ হয়ে পড়ে। ওই অবস্থায় কাকে কি বলছে বুঝতে পারে না। গতরাতের ব্যাপারটাও তেমনই। বাবার আকস্মিক মৃত্যুতে বেচারি জ্ঞানবুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছিল। ঘোরের বশে যা কিছু আপনাকে বলেছে, সে সম্পর্কে কোন ধারণা ওর ছিল না। তাই বলছি, ওর কথা বাদ দিন, আমি যা বলছি, সেটাই শেষ কথা বলে জানবেন।

রিচার্ড বলে চলল–বলতে আপত্তি নেই। আমার বাবার অর্থের অভাব ছিল না। প্রচুর সম্পত্তি রেখে গেছেন আমার জন্য। তাই হারিয়ে যাওয়া ফর্মুলা ফিরে পাওয়া গেল, কি গেল না তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। তবে স্বীকার করি, ওটার দাম প্রচুর। তবুও ওটা না পেলে আর্থিক ভাবে আমি পঙ্গু হয়ে পড়ব না। আমার চাওয়া খুবই ছোট। যেটুকু বাবা রেখে গেছেন, তাতেই আমি সন্তুষ্ট। তাছাড়া আমি মনে করি ধীরে ধীরে কত রকমের উন্নত অস্ত্র তৈরি হচ্ছে। বাড়তি কোন মারণাস্ত্র তৈরি না হলে দুনিয়ার কোন লোকসান হবে না। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, খোয়া যাওয়া ফর্মুলার পেছনে আর না ছুটে, এখানেই থেমে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। এতে সকলের মঙ্গল হবে।

–অর্থাৎ আপনি চাইছেন, আমি এখান থেকে বিদায় নিয়ে ঘরে ফিরে যাই, তাইতো? পোয়ারো ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলেন।

-ঠিক ধরেছেন। রিচার্ডের গলায় অস্বস্তি, আপনি কি সহজে আমার বক্তব্য বুঝে গেলেন বলুন তো। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে, মঁসিয়ে পোয়ারো।

কিন্তু একটা সমস্যা থেকেই যাচ্ছে, পোয়ারো বলতে থাকলেন, ধরুন, আপনার সিদ্ধান্ত মেনে মাঝপথে তদন্তের কাজ থামিয়ে আমি ফিরে গেলাম, কিন্তু সেখানেই কি ব্যাপারটা থেমে থাকবে, মঁসিয়ে অ্যামরি? ব্যাপারটা যে কত দূর প্রসারতা লাভ করবে, তা আপনার ধারণার বাইরে। চুরি করা ফর্মুলা প্রচুর টাকার বিনিময়ে কোন বিদেশি রাষ্ট্রের হাতে চলে যাবে। ওই ফর্মুলা মাথায় রেখে একের পর এক ধ্বংসাত্মক পারমাণবিক বোমা তৈরি হবে। ব্যাপারটার গুরুত্ব নিশ্চয়ই এবার অনুধাবন করতে পারছেন?

-সত্যি, এতটা তলিয়ে দেখিনি স্বীকার করছি, কিন্তু তাহলে

গতকাল, সন্ধ্যের পর এঘরে মোট পাঁচজন উপস্থিত ছিলেন। তাদের প্রত্যেকেরই ফর্মুলাটা চুরি করার সুযোগ ছিল। অতএব সন্দেহ সকলের ওপর বর্তায়। সকলেই দোষী, যতক্ষণ না আসল দোষীকে সাব্যস্ত করা যাচ্ছে।

পোয়ারোর বক্তব্য রিচার্ডের কাছে পরিষ্কার হল না, সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

ঠিক এই সময় ঘরে এসে প্রবেশ করল বাটলার ট্রেডওয়েল। রিচার্ডের কাছে এগিয়ে এল মাপ করবেন, স্যার। ডঃ গ্রাহাম এসছেন, আপনাকে চাইছেন।

-বেশ, চল। রিচার্ড চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। পেয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল মঁসিয়ে পোয়ারো, কথার মাঝখানে চলে যেতে হচ্ছে বলে দুঃখিত। ভাববেন না, কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি আবার ফিরে আসছি।

দ্রুত পায়ে ঘর থেকে অদৃশ্য হল রিচার্ড অ্যামরি।

এরকুল পোয়ারো ও রিচার্ড অ্যামরির আলোচনা এতক্ষণ নীরবে শুনছিলেন ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, আর উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছিলেন। রিচার্ড বিদায় নিতেই সোফা ছেড়ে চলে এলেন পোয়ারোর সামনে।

–সমস্ত ঘটনাটা আমার কাছে জলের মতো হয়ে গেছে। স্যার ক্লডের বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে।

-কিছু বলছ নাকি, বন্ধু। আনমনে পোয়ারো বললেন।

ক্যাপ্টেন হেস্টিংস সহজ ভাবে বললেন বিষ খাইয়ে স্যার ক্লড অ্যামরিকে খুন করা হয়েছে, উদ্দেশ্য ফর্মুলা চুরি, আমি নিঃসন্দেহ।

.

০৯.

–জবাব নেই, সহকারীর দিকে তাকিয়ে পোয়ারো হেসে উঠলেন, কি তাড়াতাড়ি তুমি কেমন সমস্যাটা সমাধান করে দিলে। তোমার বুদ্ধির তারিফ না করে পারছি না, আমার যদি তোমার মতো একটু মগজ থাকত। স্বীকার করছি, ভায়া, তোমার উজ্জ্বল সিদ্ধান্ত তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবার ক্ষমতা আমার নেই।

–আমার সঙ্গে মজা করছ? হেস্টিংসয়ের গলায় মেজাজি সুর, আমি একশো শতাংশ নিশ্চিত যে, তুমিও খুব ভালভাবে বুঝতে পারছ, স্যার ক্লডের মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়। এমনকি ওঁর ছেলে রিচার্ডের কথাই ধরো না। যখন ডঃ গ্রাহাম মৃতদেহ পরীক্ষা করে বললেন, ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়, তখন রিচার্ডের পিলে চমকে উঠেছিল। সেও ষোলো আনা নিশ্চিত, তার বাপ হার্ট ফেল করেনি, অতএব পোস্ট মর্টেম করতে বাধা দেয়নি।

-আমি স্বীকার করি, চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল পোয়ারোর বুক থেকে। দেখ, গ্রাহাম এখন এসেছেন ওই পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট জানাতে।

পোয়ারো এখানেই কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন। ধীর পায়ে ফায়ার প্লেসের কাছে চলে এলেন। বড় ফুলদানিটা গড়িয়ে পড়েছে, মোম, নানা মাপের কাগজের টুকরো ম্যান্টেলপিসের ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে, ফায়ারপ্লেসের কাঠে আগুন ধরানোর জন্যই ওগুলো রাখা।

পোয়ারো বস্তুগুলো এক জায়গায় গুছিয়ে রাখার চেষ্টা করলেন। সেদিকে নজর রেখে ক্যাপ্টেন হেস্টিংস বললেন, সত্যিই পোয়ারো, তোমার পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা প্রশংসার দাবি রাখে। কেমন সুন্দর সব গুছিয়ে রাখছ বল তো।

-চুপ, চুপ, পোয়ারো মুখে আঙুল তুলে বললেন, সব কিছুর ঊর্ধে সদৃশতার অবস্থান। এমনকি মগজের প্রতি কোষও, পরিচ্ছন্ন আর শৃঙ্খলা বজায় না থাকলে সেখানে সাদৃশতার প্রকাশ ঘটবে কি করে? নিজের টাক মাথায় আলতো টোকা দিয়ে পোয়ারো বললেন।

তোমার চিন্তা যে কত সুদূরপ্রসারী হতে পারে, তা আমার চেয়ে ভাল কেউ জানে না, ক্যাপ্টেন স্মিত হেসে জানতে চাইলেন, তোমার সাথে আমার নতুন পরিচয় হয়নি। অতএব ঝেড়ে কাশো, আসল ঘটনাটা আমাকে স্পষ্ট করে বল।

–আমি শোনাব। তা তোমার মগজের কাজ কি, বন্ধু! নিজের মাথাটা ইশারায় দেখিয়ে পোয়ারো বললেন, এই যে ঘাড়ের ওপর এটা, ঈশ্বরের দান, বয়ে বেড়াচ্ছি সকলে, এটার দাম কি?

কথা থামিয়ে দিলেন পোয়ারো, চোখ দুটো কুঁচকে ছোট হল, যেন ঝিমধরা বেড়াল। প্রসঙ্গ পালটে পোয়ারো বললেন–ডঃ গ্রাহাম যে কোন সময় এঘরে চলে আসতে পারেন, রিচার্ড বাদ যাবে না। বরং এস, এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে নিজেদের একবার ঝালিয়ে নিই, যা যা অস্বাভাবিক ঠেকছে সে সম্পর্কে আলোচনা আর কি!

–গত রাতে এ বাড়িতে আমরা আসার আগে বাড়ির সব আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছিল, হেস্টিংস বলে চললেন, স্যার ক্লড বসেছিলেন ওখানে, ইঙ্গিতে আর্মচেয়ারটি দেখিয়ে দিলেন, তখনও মারা যাননি তিনি। নিঃসীম অন্ধকারে এঘর তখন ঢেকে আছে, যেভাবেই হোক একটা চেয়ার উলটে গেল, ওটাতে স্যার ক্লডের সেক্রেটারি এডওয়ার্ড রেনর বসেছিল, ওই চেয়ারের নীচে থেকে একটা চাবি তুমি পেয়েছিলে, যার সাহায্যে স্যার ক্লডের সিন্দুকের তালা সহজে খোলা সম্ভব হয়। ব্যাপারটা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে, ওই ইটালিয়ান ডাক্তার, কারোলিই হল এই ঘটনার মূল পাণ্ডা। ওকে আমি সবচেয়ে বেশি সন্দেহ করি।

–ডঃ কারোলি, তাই না? পোয়ারোর আনমনে বলে উঠলেন, ওই লোকটাকে আমারও রহস্যজনক বলে মনে হয়।

–তা নয়, তো কি? হেস্টিংস জোরালো কণ্ঠস্বরে বলতে লাগলেন–লোকটা এতদূরে গ্রামের ভেতরে এসে ঢুকেছে। এটা এক বিখ্যাত বিজ্ঞানীর বাড়ি, ওর ডাক্তারির জায়গা নয়। এখানে ওর কি কাজ থাকতে পারে বলে তোমার মনে হয়, পোয়ারো? স্যার ক্লডের ওই বিধ্বংসী ফর্মুলা হাতিয়ে নেবার জন্য অনেক শক্তিশালী রাষ্ট্রই চেষ্টা করছে, ওরা আমাদের কোন দেশের গুপ্তচর হয়ে এখানে এসে সেঁধিয়েছে। মূল্যবান ফর্মুলা হাতিয়ে নেওয়াই ওর কাজ, বুঝেছ?

-বুঝলাম, পোয়ারো সামান্য হাসলেন, বাঃ অনেকদিন পর এমন একটা নিখুঁত সিনেমার গল্প শুনলাম। আমি কচ্চিৎ কদাচিত সিনেমা দেখতে যাই, জান তো তুমি।

–স্যার ক্লডকে সত্যিই বিষ খাইয়ে হত্যা করা হয়েছে, এটা একবার প্রমাণ করতে পারলে, ডঃ কারোলি তাহলে থাকবেন সন্দেহ ভাজন তালিকায় সবার ওপরে। তোমার নিশ্চয়ই সেই প্রাচীন কাহিনীর কথা মনে আছে বিষপাথর বসানো আংটির গল্প।

বিষক্রিয়াজনিত হত্যার ঘটনা ইটালির জনজীবনে ভুরি ভুরি ঘটেছে। কিন্তু আমার মনে আশঙ্কা কি জান, ধরা পড়ার আগে চোর বামাল সমেত উড়ে না যায়।

বন্ধু, এমন আশঙ্কা কর না। হেস্টিংস জোর দিয়ে বলল কখনো পালিয়ে যাবার সাহস ডঃ কারোলি কখনো দেখাবেন না।

–এত জোর দিয়ে বলার কারণ? ভুরু কুঁচকে পোয়ারো জানতে চাইলেন।

বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়। পোয়ারোর জবাবে হেস্টিংস বললেন–কারণ, আমিও সম্পূর্ণ ভাবে নিশ্চিত নই। তবে জেনো, ফর্মুলা চুরির ব্যাপারটা আমার মগজকেও তোলপাড় করে তুলেছে।

–আচ্ছা হেস্টিংস, ফর্মুলাটা কোথায় এখন রাখা আছে বলে তোমার মনে হয়?

–বলতে পারছি না।

–ভায়া, মাথাটাকে কাজে লাগাল। মৃদু হেসে পোয়ারো জবাব দিলেন–ওটা একটা জায়গাতেই আছে।

–কোথায়?

–এই ঘর, পোয়ারো বললেন, এ ব্যাপারে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত। এ ঘরের বাইরে এখনো ওটা যায় নি।

-কি বলছ হে?

–হ্যাঁ, ঠিক তাই। পোয়ারোর মুখ কঠিন হল। আমরা যা জেনেছি বা দেখেছি, সবটা পরপর সাজালে কেমন হয়? ট্রেডওয়েলের কাছ থেকে জানা গেছে, ফর্মুলা চুরি হওয়ার আশঙ্কায় স্যার ক্লড অ্যামরি নানারকম ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। এই ঘরের ভেতরটা সুরক্ষিত করার জন্য তিনি নিজে বিশেষ ধরনের তালা আবিষ্কার করেছিলেন, যাতে অন্য কেউ সহজভাবে ওই তালা না খুলতে পারে। সেইমতো ফ্রেঞ্চ উইন্ডো দুটো বিশেষভাবে তালা এঁটে দিয়েছিলেন, যার চাবি পাওয়া গেছে ওনার চাবির গোছায়। আমরা এখানে পৌঁছনোর আগেই চোর কম্মটি সেরে ফেলেছিল, আমার ধারণা। স্যার ক্লডের মনে সন্দেহ হওয়াতে সিন্দুক খোলেন এবং দেখেন ফর্মুলাটি হাওয়া হয়ে গেছে। তিনি নিশ্চিত বুঝতে পেরেছিলেন যে, ফর্মুলা-চোর এই ঘরেই পরিবারের সকলের মধ্যে মিশে আছে। কথাটা তিনি গোপন না রেখে ফাঁস করে দিয়েছিলেন।

পোয়ারো চোখ বুজে বলে চললেন–এতদূর পর্যন্ত ঠিক আছে। এরপরে প্রশ্ন হল, চুরি করা জিনিসটা কোথায় গেল? অনুমান করা যেতে পারে, স্যার ক্লডের নির্দেশ মেনে অন্ধকার ঘরের মধ্যে তার সামনের টেবিলে ওটাকে রেখে দেওয়া, দ্বিতীয়ত ফর্মুলা চোর আঁধারের সুযোগ নিয়ে অন্য কোথাও লুকিয়ে রাখতে পারে। তবে প্রথম পথে চোর যায়নি, তা আমরা নিশ্চিত। রইল খোলা দ্বিতীয় পথ। অতএব আমি জোর গলায় বলতে পারি, ওই ফর্মুলা এই ঘরের কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে।

–পোয়ারো, তোমার কথাকেই আমি সমর্থন করছি। তাহলে আর দেরি কেন, উত্তেজিত হেস্টিংস চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, এস, কাজে লেগে পড়ি।

-সত্যিই যদি ইচ্ছে হয়, তাহলে খোঁজার কাজে হাত লাগাও। ওটা খুঁজে বের করতে তোমায় যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হবে, সময়ও লাগবে। কিন্তু আমি একজনকে জানি, পোয়ারোর ঠোঁটে রহস্যপূর্ণ হাসি, যে তোমার চেয়ে কম সময়ে ও কম পরিশ্রমে চট করে দিতে পারে।

–কে সে? হেস্টিংস উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলেন।

–যে চুরি করে ফর্মুলাটা লুকিয়ে রেখেছে, সে। চুরি করা ও লুকিয়ে রাখার মধ্যে একজনেরই হাত আছে। গম্ভীর মুখে পোয়ারো তার গোঁফ জোড়াকে আদর করতে লাগলেন, বোঝা গেল, তিনি এখন তার পুরনো মেজাজে ফিরে এসেছেন।

এর পরের কথা……

–হ্যাঁ, এর পরের কথা হল, চোরবাবাজী আজ-কালের মধ্যেই জিনিসটা এ ঘর থেকে সরিয়ে নেবার চেষ্টা করবে। তাই আমাদের সর্বদা সজাগ থাকতে হবে। এই ঘরের ওপর নজরদারি চালাতে হবে আমাদের যে কোনো একজনকে।

এই সময় লাইব্রেরির দরজা ভেতর থেকে খুলে গেল, অবশ্য একটুও শব্দ না করে। পোয়ারো সচকিত হলেন। পোয়ারোর ইঙ্গিতে ক্যাপ্টেন গ্রামোফোনের আড়ালে চলে গেলেন।

ঘরে যে ঢুকল, তাকে দেখার জন্য পোয়ারো বা তার সঙ্গী প্রস্তুত ছিলেন না। তারা নজর রাখলেন। দেখলেন, মিস বারবারা অ্যামরি একটা চেয়ার টেনে নিয়ে এল বইয়ের তাকের কাছে। চেয়ারে উঠে দাঁড়াল, এবার হাত বাড়িয়ে টিনের কালো বাক্সটা নামানোর চেষ্টা করল, যাতে ওষুধপত্রগুলি আছে।

সময় হয়েছে বুঝে পোয়ারো ফাঁচ করে হেঁচে উঠলেন। বারবারা চমকে উঠল। তার হাত থেকে সশব্দে টিনের বাক্সটা মেঝেতে এসে পড়ল।

বারবারা ঘাবড়ে গেল–ও আপনি, মঁসিয়ে পোয়ারো নিজেকে সামলে নিল, ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল, আপনাকে এখানে দেখতে পাব, আশা করিনি।

ক্যাপ্টেন হেস্টিংস এবার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন। হাসতে হাসতে মেঝে থেকে টিনের বাক্সটা তুললেন।

–কিছু মনে করবেন না, মাদমোয়াজেল, পোয়ারো বললেন, ভারী টিনের বাক্সের ভার আপনি সহ্য করতে পারেন নি, তাই হাত ফসকে পড়ে গেছে। বাক্সটা টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে বললেন, আরে, এটার তো বেশ ওজন, কী রেখেছেন এতে? পাখির বাসা, নাকি সমুদ্র থেকে কুড়িয়ে আনা ঝিনুকের খোলা?

-না না, ওসব কিছু নয়, সামান্য কিছু ওষুধপত্র আছে মাত্র। বারবারা জবাব দিল।

–কিন্তু মাদাম, আপনার স্বাস্থ্য তো বেশ ভালোই দেখছি, কেমন উজ্জ্বল, তাহলে এইসব ছাইপাঁশ বাক্সবন্দী করে রেখেছেন কেন?

-না না, আমার জন্য নয়। বারবারা বলে চলল–এগুলো লাগে রিচার্ডের বউ লুসিয়ার। শুনেছেন তো, ওর একটা অসুখ আছে, যখন তখন জ্ঞান হারায়, একবার মাথা ধরলে আর রক্ষে নেই। ওর কথা ভেবেই এসব ওষুধ। বেচারী লুসিয়া, আজ সকালেও মাথা যন্ত্রণায় কষ্ট পেয়েছে।

-ও, তাই বুঝি আপনি ওর জন্য মাথা যন্ত্রণার ওষুধ নিতে এসেছেন?

–হ্যাঁ, বারবারা বলল। অ্যাসপিরিনের বড়ি আমার কাছে দুটো ছিল, ও খেল, তবুও মাথা যন্ত্রণা কমেনি, বুঝলাম, আরও কড়া ওষুধ চাই। তাই গোটা বাক্সটাই নিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আপনারা যে এখানে ঘাপটি মেরে বসে থাকবেন, তা আগে বুঝতে পারিনি।

টিনের বাক্সের ওপর হাত বুলোতে বুলোতে পোয়ারো জানতে চাইলেন তার মানে আপনার ওষুধের বাক্স নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে আমাদের কী সম্পর্ক? আমি তো বুঝতে পারছি না।

-কী বলি আপনাকে? সামান্য শরীর খারাপ হলেই হল, ওষুধ খুঁজতে চলে আসে এই ঘরে, সব্বাই, কেউ বাদ নেই। এমনকি পিসিমা বা ওই রিচার্ড। ওরা বাক্সের ওষুধের শিশিগুলো ঘাঁটা ঘাঁটি করে, লন্ডভন্ড করে যাচ্ছেতাই করে রাখে।

মাদাম, চোখের ইঙ্গিতে বাক্সটা দেখিয়ে পোয়ারো বললেন, বাক্সটা দেখেছেন, একটুও ধুলো ময়লা নেই, তাই কিনা? আপনাদের বাড়ির কাজের লোকদের রোজ কত খাটতে হয় বলুন তো। যখন তখন চেয়ার টেনে উঠে দাঁড়াতে হয়, অত উঁচুতে বাক্স, ধুলো ময়লা পরিষ্কার করা কম ঝামেলা বলুন।

-মঁসিয়ে পোয়ারো, সত্যিই তাই। বারবারা খুশি মনে বলল–তাইতো গতরাতে এটা পরিষ্কার দেখেছি।

–গত রাতে এই ঢাউস বাক্সটা নামিয়ে ছিলেন নাকি?

পোয়ারোর প্রশ্নের উত্তরে বারবারা বলল–হ্যাঁ, ডিনারের পরে। হাসপাতালের যত পুরোনো ওষুধে এটা বোঝাই।

–দেখি, দেখি, কী কী ওষুধ আছে। কথা শেষ করে পোয়ারো বাক্সটা সামান্য টেনে নিয়ে ঢাকনা খুলে ফেললেন, একটা একটা করে কতগুলো শিশি তুলে ধরলেন, শিশির গায়ে কাগজে সাঁটা ওষুধের নাম দেখে তার চক্ষু চড়কগাছ, বিস্মিত হলেন–আরে এসব কী দেখছি–স্ত্রিকনিন অ্যাট্রাপিন…… আর এটা? ওষুধের টিউবটা সামনে তুলে নিয়ে আঁতকে উঠলেন, সর্বনাশ, এ তো যেমন তেমন ওষুধ নয়–হিস্কোসিন হাইড্রোক্সোমাইট, অবশ্য সামান্য ওষুধ, রয়েছে টিউবে। বাঃ, মানুষ খুন করার সরঞ্জাম দেখছি থরে থরে সাজানো।

-কী বলছেন, মঁসিয়ে পোয়ারো, বারবারা অবাক চোখে পোয়ারোর হাতে ধরা ওষুধের টিউবের দিকে তাকাল–গতরাতেও এটাকে ভরতি দেখেছি, ফাঁকা কেন।

বাঃ, ভারি মজার ব্যাপার। পোয়ারো নিজের মনেই উচ্চারণ করলেন। তারপর জানতে চাইলেন–আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, গতরাতে এই শিশিটায় ওষুধ ছিল। মাদামোয়াজেল, আপনার কি মনে আছে গত রাতে এই ওষুধের শিশিগুলো কোথায় ছিল?

বাক্সটা এই টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখা হয়েছিল। ডঃ কারোলি এক একটা শিশি তুলে ধরে লেবেলে চোখ বুলিয়ে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে ওষুধের নাম ও কার্যকারিতা সম্পর্কে বলছিলেন।

বারবারা নিজেকে আর সামলে রাখতে পারল না, তার চোখ ফোটে জল গড়িয়ে পড়ল।

এমন সময় ঘরে লুসিয়ার প্রবেশ ঘটল, পোয়ারো আর তার বন্ধুকে এঘরে এসময়ে দেখবে, তা ছিল লুসিয়ার ধারণার বাইরে। তাই সে ওদের দেখে হকচকিয়ে গেল।

লুসিয়াকে দেখে বারবারার কান্না উঠে গেল। সে তখন লুসিয়াকে সামলাতে ব্যস্ত, যা বোকা ক্যাবলা মেয়ে, পোয়ারোর মতো ধুরন্ধর গোয়েন্দা যদি একটু চাপ দেয় তাহলে লুসিয়ার পেট থেকে হুড়হুড় করে সব বেরিয়ে আসবে। কোনো অপ্রিয় সত্য কথা বলে ফেললে সর্বনাশ। তাই সে স্নেহ ভরে ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে মৃদু স্বরে বলল–সকাল থেকে যন্ত্রণায় মাথা তুলতে পারছ না, অথচ লাইব্রেরিতে ছুটে এলে, আমি তো যাচ্ছিলাম তোমার কাছে, তর সইল না বুঝি।

-এখন আমি একটু ভালো আছি, বারবারা। পোয়ারোর দিকে তাকাতে তাকাতে বলল–তাছাড়া মঁসিয়ে পোয়ারোর সঙ্গে দরকার ছিল। তাই আসতে হল এখানে।

বেশ তো, পরে বললেই তো হয়, তাই না?

দয়া করো বারবারা, লুসিয়ার কণ্ঠে বিরক্তি, আর তোমাকে আমার জন্য ভাবতে হবে না।

-তাই বুঝি? বেশ, যা মন চায় করো।

লুসিয়ার মন্তব্য শুনে বারবারা খুশি হতে পারেনি, বোঝা গেল তার হাঁটা দেখে। সে চলে যাবার জন্য দরজার দিকে এগিয়ে এল। পোয়ারো দরজাটা খুলে দিলেন। বারবারা বেরিয়ে যেতে যেতে পেছন ফিরে তাকাল, তারপর চলে গেল।

দরজাটা এঁটে বন্ধ করে পোয়ারো লুসিয়ার দিকে এগিয়ে এলেন।

-মঁসিয়ে পোয়ারো….. লুসিয়া কী যেন বলতে গিয়েও বলতে পারছে না।

লুসিয়ার মনের ভয় ও সঙ্কোচ দূর করার জন্য পোয়ারো বললেন মাদাম, বলুন, আপনি কী বলতে এসেছেন। সঙ্কোচ করবেন না, বলুন।

-হ্যাঁ, এই তো বলছি–লুসিয়ার গলা তখন কাঁপছে উত্তেজনায়। তারপর কেটে বলল–আপনাকে আমিই এ বাড়িতে থেকে যাবার জন্য গত রাতে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু আজ সকালে সে ভুল আমার ভেঙে গেছে। ওইভাবে আপনাকে অনুরোধ উপরোধ করা উচিত হয়নি আমার।

-সত্যি বলছেন, মাদাম।

–ষোলো আনা সত্যি। লুসিয়া বলে চলল–আসলে গত রাতের ওই আকস্মিক পরিস্থিতিই এর জন্য দায়ী। বিশ্বাস করুন মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি কেমন ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, তাই কী বলতে কী বলে ফেলেছি, আজ আমার ভুল ভেঙেছে। তাই আপনাকে অনুরোধ করছি, যা কিছু বলেছিলাম, তা মনে না রেখে এখান থেকে চলে যান, তাতে সকলের মঙ্গল হবে।

–এতক্ষণে ব্যাপারটা পরিষ্কার হল, কেন আপনি আমার কাছে এসেছেন?

-বুঝতেই যখন পেরেছেন, তাহলে আর দেরি কেন? লুসিয়া ভীত চোখে পোয়ারোর দিকে তাকাল আজই এ বাড়ি ছেড়ে নিজের জায়গায় ফিরে যান।

–আপনি কী করে ভাবলেন, আপনার কথা আমি মেনে নেব। পোয়ারো স্থির চোখে লুসিয়ার দিকে তাকালেন, গলার পর্দা একটু চড়ল–গত রাতে আপনিই আমাকে আপনার শ্বশুর স্যার ক্লড অ্যামরির মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয় বলে জানিয়ে ছিলেন, খেয়াল আছে। নিশ্চয়ই।

-বলছি তো, যা বলেছিলাম ভুলে যান না। লুসিয়ার গলায় অসহায়তার সুর। তখন আমি অত শত ভেবে বলিনি। আর কী বলেছি, না বলেছি, তাও মনে নেই।

–আপনার কথা অনুসারে তাহলে বলতে হয়, আপনার শ্বশুরের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে, এর মধ্যে কোনো গলদ ছিল না। তাই তো?

-হ্যাঁ, তাই-ই। জোর গলায় লুসিয়া বলল, কিন্তু আপনি অমন জ্বলজ্বলে শিকারির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কেন?

-কেন জানেন, মাদাম? পোয়ারো একইভাবে তাকিয়ে থেকে বললেন–আমরা, অর্থাৎ যারা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে চাকরি করেছেন বা করছেন, তাঁরা নিজেদের শিকারি কুকুরের সঙ্গে তুলনা করে থাকে। শিকারি কুকুরকে সহজে শিকারের পেছনে লেলিয়ে দেওয়া যায় না। তবে একবার যদি শিকার অর্থাৎ অপরাধীর গন্ধ পায় তাহলে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বা ঘায়েল করে তবেই শান্তি। আমিও ওই শিকারি কুকুরের থেকে কম যাই না, জানবেন।

–এসব আমাকে বলে লাভ নেই। এসব জানতে বা বুঝতে চাই না। আমি একটাই কথা জানি, আপনাকে এ বাড়ি থেকে বিদায় করতে হবে। এখানে থেকে আপনি আমার কী সাংঘাতিক ক্ষতি করছেন, তা জানা নেই আপনার, মঁসিয়ে পোয়ারো।

ক্ষতি? সাংঘাতিক ক্ষতি? কি ভাবে?

-হ্যাঁ, করছেন? লুসিয়া নিজেকে সংযত করল। বলল–কেবল, আমার নয়, এবাড়ির সকলের ক্ষতি করে চলেছেন। আপনাকে বুঝিয়ে বলার আর কিছু নেই। তবে জানবেন, যা বলছি, তার সবটাই সত্যি। গতরাতে আপনাকে দেখে আমার কেমন ভরসা জেগেছিল, আপনার প্রতি আস্থা রাখতে শুরু করেছিলাম। সে কথা মাথায় রেখেই বলছি, এসব অনুসন্ধানের কাজ বন্ধ করে ফিরে যান। এ বাড়ি ত্যাগ করুন।

লুসিয়া নিজেকে সামলাতে না পেরে কান্নায় ভেঙে পড়ল।

এমন সময় ঘরের দরজা ঠেলে পা রাখল রিচার্ড অ্যামরি, পেছনে ডঃ কেনেথ গ্রাহাম।

-একী, লুসিয়া, তুমি? বউকে দেখে রিচার্ড সত্যিই অবাক হল। ভীষণ রেগে গেল। প্রকাশ না করে বলল–সকাল থেকে বিছানা আঁকড়ে পড়ে আছো, শরীর খারাপ। অথচ এখানে? কী জন্য?

কেন, রিচার্ড, কী হয়েছে? স্বামীর কথা শুনে লুসিয়ার বুকটা আঁতকে উঠল, নতুন কিছু নিশ্চয়ই ঘটেছে, তোমার মুখমণ্ডলই তা বলে দিচ্ছে, বলল না কী হয়েছে?

–আঃ, লুসিয়া, শান্ত হও। বউকে আশ্বস্ত করল রিচার্ড। কিচ্ছু হয়নি। আমরা এখানে কিছু কথা বলব, তুমি বরং তোমার ঘরে যাও, লক্ষ্মীটি।

-কেন, আমার সামনে কি…… আর কিছু বলার সাহস হল না লুসিয়ার, রিচার্ড দরজা খুলে দিল, পায়ে পায়ে লুসিয়া বসার ঘর থেকে অদৃশ্য হল।