১০. নিক এর গোপন কথা

১০. নিক এর গোপন কথা

ঘুম যখন ভাঙল তখন সকাল হয়ে গেছে। কিন্তু গতরাতে পোয়ারোকে ঠিক যে জায়গায় যেভাবে বসে থাকতে দেখেছিলাম সেইভাবেই সে বসে আছে। কিন্তু ওর মুখের অভিব্যক্তিতে ব্যাপক বদল ঘটেছে। ওর চোখদুটো যেন জ্বল জ্বল করছে। আমি সোজা হয়ে বসলাম। জনতে চাইলাম পোয়ারোর কাছে তুমি কিছু খুঁজে পেয়েছে তাই না?

সে মাথা নাড়ে। সামনের টেবিলটায় আঙুল ঠুকে তাল বাজায়। হেস্টিংস, আমার তিনটে প্রশ্নের ঠিক ঠিক মতো উত্তর দেবে।

তিনটে প্রশ্ন! (১) মাদাম জোয়েল বার্কলি সম্প্রতি কেন ঠিক ঘুমোতে পারছিলেন না? (২) কালো রং ওনার পছন্দ নয়, তবু কেন তিনি সেই কালো রঙের পোষাক কিনেছিলেন অনুষ্ঠানের দিন পরবার জন্য? (৩) গতরাতে কেন তিনি বললেন, আমার এখন বেঁচে থাকার কোনও অর্থ নেই?

আমি বিস্ময়ের চোখে পোয়ারোর দিকে তাকাই। প্রশ্নগুলো নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হল।

উত্তর দাও হেস্টিংস, প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।

প্রথম প্রশ্নটার উত্তরে বলা যায়, সম্প্রতি উনি খুবই উদ্বিগ্ন, দুশ্চিন্তাগ্রস্থ ছিলেন হয়তো। আর কালো রঙ-এর পোক? সব মানুষই তো একটু বদল চায়, হয়তো উনিও তাই চেয়েছিলেন।

আঃ হেস্টিংস, একজন বিবাহিত পুরুষ হয়েও মানবী মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে তোমার কণামাত্রও স্বচ্ছ ধারণা নেই। যদি কোনও মহিলা একবার ভেবে নেয় কোনও বিশেষ রঙ তাকে মানায় না, কখনোই সে সেই রঙ স্পর্শ পর্যন্ত করবে না। আর তৃতীয় প্রশ্ন? সেই ভয়ঙ্কর রাতের অভিজ্ঞতার পর এধরনের কথা স্বাভাবিক বলেই আমার মনে হচ্ছে তাই নয় কি?

না, আমার কাছে মোটেই সেটা স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না। নিজের সম্পর্কিত বোনের মৃত্যুর পর সেই ভয়াবহতায় আক্রান্ত হয়ে কেউ নিজেকে সেই ঘটনার জন্যে দায়ী ভাবতেই পারে। সেটা স্বাভাবিক ব্যাপার। উনি ক্লান্ত ভাবেই জীবনের কথা বলেছিলেন। যেটা তার কাছে তত প্রিয় নয় তেমন।

এরকম মানসিকতা ওর আগে ওর মধ্যে কখনও আমরা দেখিনি। এর আগে ওর নানা ভঙ্গী, মানসিকতা আমরা দেখেছি। অবিশ্বাসী, একগুঁয়ে, তুড়ি মেরে সব উড়িয়ে দেওয়া, ভয়ার্ত, সবরকম। কিন্তু সেসব মুহূর্তে জীবন ওনার কাছে ছিল মধুরতম। তিনি মৃত্যুকে ভয় পেয়েছিলেন সেসব মুহূর্তে। কিন্তু জীবন ওনার কাছে ক্লান্তিকর হয়ে ওঠেনি কখনও। না, কখনও নয়। মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন। হেস্টিংস, বড়সড়, মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন চরম বিস্মিত করেছে তাকে। কি এমন ঘটেছিল সে রাতে, যাতে মাদাম জোয়েলের দৃষ্টিভঙ্গীতে এত বিরাট একটা পরিবর্তন ঘটে যায়। কিন্তু মনে রেখো হেস্টিংস মিস ম্যাগির মৃত্যুটাকে ধরা ছিল না, আমি সেই পরিবর্তনের কারণ হিসাবে। কি হতে পারে সেটা?

নাহ, আমার তো কিছুই মাথায় ঢুকছে না।

 ভাব হেস্টিংস, ভাব, মস্তিষ্কের গ্রে সেলগুলোকে ব্যবহার করো।

সত্যি কথা বলতে কি……… আমার অসহায় ভঙ্গি দেখেই, কথা শেষ করতে না দিয়েই পোয়ারো বলে ওঠে, শেষবার আমরা ওনাকে ভালভাবে, খুব কাছ থেকে লক্ষ্য করার সুযোগ পেয়েছিলাম?

সম্ভবত রাতে খাওয়া-দাওয়ার সময়।

ঠিক তাই। তারপর আমরা ওনাকে অতিথিদের অভ্যর্থনা করতে, তাদের স্বাগত জানাতে ব্যস্ত থাকতে দেখেছি। পুরোপুরিই গৃহকর্ত্রীর ভূমিকায়। রাতের খাওয়া-দাওয়ার মধ্যে কি ঘটেছিল তোমার মনে আছে হেস্টিংস?

হ্যাঁ, একটা টেলিফোন এসেছিল, উনি সেটা ধরতে গিয়েছিলেন।

যাক, শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা তাহলে তুমি ধরতে পেরেছে। মাদাম জোয়েল টেলিফোনটা রিসিভ করতে উঠে গিয়েছিলেন তা অন্তত পক্ষে মিনিট কুড়ি হবে। আর সেই সময়টা একটা টেলিফোনের জন্য যথেষ্ট বেশি সময় নয় কি? এতসময় টেলিফোনে ওনার সঙ্গে কে কথা বলেছিল এবং সে কি বলেছিল। আদৌ কি সত্যিই টেলিফোন এসেছিল? তুমি কি নিশ্চিত? কিন্তু আমি নিশ্চিত হতে পারছি না। এখন আমাদের কাছে প্রধান কাজ ব্যাপারগুলো ভালভাবে নিরীক্ষণ করে দেখতে হবে যে ওই সময় অর্থাৎ ওই কুড়ি মিনিটে ঠিক কি ঘটেছিল?

তুমি সত্যি–এরকম কিছু ভাবছ?

হ্যাঁ, ভাবছি।

হেস্টিংস, আমি তোমাকে আগেই বলেছি না মাদাম জোয়েল সব কথা আমাদের বলেন নি, একটা কিছু গোপন করে গেছেন–আসলে উনি যে কথাগুলো চেপে গেছেন তার সঙ্গে এই খুন বা আগের খুনের প্রচেষ্টার সম্পর্ক রয়েছে তা তিনি আদৌ বুঝতে পারছেন না বলেই হয়তো বলেন নি। কিন্তু আমি পুরোপুরি অনুমান করছি যে গতকাল খুন এবং আগের খুনের প্রচেষ্টার সঙ্গে সেই কথাগুলোর যোগসাজস অবশ্যই রয়েছে।

একটু থেমে আবার বলতে শুরু করে, সত্যি যদি মাদাম জোয়েলের না বলা কথাগুলোর সঙ্গে এই রহস্যের কোনও যোগাযোগ না থাকত তাহলে ঘটনাটা আমার কাছে ব্যাখ্যা করা খুবই সরল হয়ে উঠত। ওই মিসিং ফ্যাক্টরটাই আসলে আমার কাছে সদর দরজা খোলার আসল চাবি। কিন্তু দুঃখের কথা, মাদাম জোয়েল সেটা বুঝতে পারছেন না। কিন্তু আমি জানি হেস্টিংস, আমি ঠিকই বলছি।

পোয়ারো কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকে। সামনের চেয়ারটায় হেলান দিয়ে বসে দুচোখ বুজে কি যেন ভাবতে থাকে। খানিকক্ষণ পরে বলে ওঠে।

আমাকে প্রথমে ওই তিনটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। তাহলে…… তাহলে……

আমি তড়িঘড়ি আরাম কেদারা ছেড়ে উঠে দাঁড়াই। গতকাল এই আরাম কেদারায় কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতে পারিনি। সারাটা রাত এখানে কেটে গেছে আমার। ঘাড় থেকে মেরুদণ্ড বেয়ে একটা অস্বস্তিভাব হচ্ছে। পোয়ারোকে একলা বসে ভাববার সুযোগ করে দিয়ে আমি সোজা বাথরুমে ঢুকে প্রাতঃকর্মের সঙ্গে স্নানপর্বও শেষ করে নিলাম।

স্নান সেরে সোজা ব্রেকফাস্ট টেবিলে এসে বসলাম। খবরের কাগজটায় চোখ বোলাতে শুরু করলাম। না, নতুন সেরকম কোনও খবর নেই। শুধু একটা খবর ছেপেছে, মাইকেল, সেটনকে এখন মৃত বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে। সম্ভবত আর ওনার জীবিত ফিরে আসবার কোনও সম্ভাবনা নেই। আর মাঝের পাতায় ছেপেছে–সমুদ্রতীরবর্তী অনুষ্ঠানে রহস্যজনকভাবে যুবতী খুন। মনযোগ সহকারে রিপোর্টটা পড়লাম। সেরকম কোনও তথ্য পেলাম না। অনুমান ভিত্তিক আষাঢ়ে গল্প জুড়ে দিয়ে ছেপেছে। ততক্ষণে প্রাতরাশ এসে গেছে। আমি প্রাতরাশে মন দিলাম। আমার খাওয়া প্রায় শেষের দিকে তখনই মিসেস রাইসের উদয় ঘটল। তিনি সোজা এসে আমার টেবিলেই বসলেন। আমি কৌতূহলী চোখে তাকাতে উনি বললেন, আপনি কি জানেন, উনি এখন ঘুম থেকে উঠেছেন কিনা?

হ্যাঁ, চলুন, আমি আপনাকে ওর কাছে নিয়ে যাচ্ছি।

 ধন্যবাদ।

পোয়ারোর কাছে নিয়ে যাবার পথে আমি প্রশ্ন করলাম, অপনি কি খুন হওয়া মেয়েটিকে চিনতেন?

একবার মাত্র দেখেছিলাম স্কারবরোঘ-তে। নিকের সঙ্গে দুপুরের খাবার খেতে এসেছিল একদিন।

যদিও মহিলার কথা বলার ভঙ্গিতে আমার মনে হচ্ছিল না যে উনি খুব একটা শক্ পেয়েছেন বলে। মহিলা আসলে খুবই আত্মকেন্দ্রিক।

পোয়ারো ইতিমধ্যেই ঘরেই ওর প্রাতরাশ সেরে নিয়েছিল। ফ্রেডরিকাকে দেখে সে সাদর অভ্যর্থনার সঙ্গে বসবার জন্যে চেয়ার এগিয়ে দিল। মৃদু হেসে এবং ধন্যবাদ জানিয়ে ফ্রেডরিকা আসন গ্রহণ করল।

বলুন, আমি আপনার জন্য কি করতে পারি।

মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি একটা কথা সুনিশ্চিত ভাবে জানতে চাই–গতকাল রাতে যে দুঃখজনক ভয়ঙ্কর ঘটনাটা ঘটল তার আসল লক্ষ্য কি নিক ছিল?

কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। কথা শেষ হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মাথা নাড়ে পোয়ারো।

স্থির চোখে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে উনি বললেন, নিক তো সবসময় হাসিখুশি, প্রাণোচ্ছল ভাবে বাঁচতে চেয়ে এসেছে।

হ্যাঁ, ভাগ্যের খেলায় ওপর নীচ তো আছেই। জীবন সর্বদা মসৃণ নয়। পোয়ারো নিজের মতো করে বলে।

আমার মনে হচ্ছে, এসবের বিরুদ্ধে লড়াই করাটা অর্থহীন।

 বিষাদ ছাড়াও ফ্রেডরিকার এই কথাগুলোর মধ্যে একটা চোরা স্রোতটান ছিল যা আমি স্পষ্টই অনুভব করতে পারলাম। ওর মধ্যে একটা দুঃশ্চিন্তার ছাপও লক্ষ্য করলাম।

দু’এক মুহূর্ত নীরব থেকে সে আবার বলে, আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি মঁসিয়ে পোয়ারো। আমার তরফে তো বটেই, নিকের হয়েও। সত্যি কথা বলতে কি, গতকাল রাতের ওই ভয়ঙ্কর ঘটনার আগে আমরা কেউই পরিস্থিতির ভয়ঙ্করতা বুঝে উঠতে পারিনি। বিশেষ করে আমি তো স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি যে পরিস্থিতিটা এতোটাই গম্ভীর।

তাই বুঝি? পোয়ারো হাসলেন।

ওর চোখে খুশির চেয়ে চঞ্চলতা বেশি জাগ্রত রয়েছে এটাও লক্ষ্য করলাম।

আমি এবার খুব স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারছি, নিকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের যে বৃত্তটা রয়েছে তাদের মধ্যে নয়। ব্যাপারটা খুবই হাস্যকর, বিরক্তিজনক, কিন্তু বাস্তব। আমি ঠিক বলছি তো মঁসিয়ে পোয়ারো?

আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। পোয়ারো সংক্ষিপ্ত ভাষায় মন্তব্য করে।

আপনি আগে একদিন আমাকে টাকিস্টক নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন না মিঃ পোয়ারো। আমি বুঝতে পারছি, আজ নয়তো কাল আসল সত্যিটা আপনি জেনে যাবেন, কিন্তু আসল সত্যিটা হচ্ছে আমি টাকিস্টকে ছিলাম না।

তাহলে কোথায় ছিলেন?

আমি আর মিঃ লাজারুম গত সপ্তাহের প্রথমদিকে এই অঞ্চলে এসেছিলাম। শেলকম্বে নামের ছোট্ট একটা জায়গায় আমরা ছিলাম।

ওহ, এখান থেকে সাত মাইল দূরে। তাই তো?

হাঁ, ঠিক ধরেছেন।

এবার হঠাৎ পোয়ারো প্রশ্ন করে, মিঃ লাজারুমের সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব কতদিনের ম্যাডাম?

মাস ছয় আগে আমাদের আলাপ-পরিচয় হয়।

হুম, আর আপনারা একজন অন্যজনের প্রতি…….. কথা অসম্পূর্ণ রেখে পোয়ারো একদৃষ্টে চেয়ে থাকে ফ্রেডরিকার চোখের দিকে।

ফ্রেডরিকা কাঁধ বাঁকায়। উনি বেশ ধনী।

আহ, পোয়ারো মাথা নেড়ে বলে, আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর কিন্তু এটা নয়।

এবারে ফ্রেডরিকার মুখে সলজ্জ হাসির রেখা ফুটে উঠতে লক্ষ্য করলাম। বলল, আমার হয়ে আপনিই বলুন না, নিজের মুখে কি বলব?।

পোয়ারো এবার হাসে, ওয়েল, সেটা আপনি নিজের মুখে না বললেও আসলে সত্যিটা সত্যিই। আমি আবার আপনাকে বলছি ম্যাডাম, আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমতী।

বেশ, তাহলে খুব তাড়াতাড়ি আমাকে একটা ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট দিয়ে দেবেন। বলেই ফ্রেডরিকা উঠে দাঁড়ায়।

আমাকে আপনার আর কিছু বলার নেই তো মাদাম জোয়েল?

ফ্রেডরিকা পোয়ারোর দিকে তাকায়, নাঃ আপাতত নেই।

 এবার একবার অন্তত নিককে দেখে আসি সে বেচারা কেমন আছে?

বাঃ খুব ভাল কথা। আপনার সঙ্গে খোলামেলা ভাবে কথাবার্তার জন্য অশেষ ধন্যবাদ।

পোয়ারোর কথাগুলো শুনে ফ্রেডরিকা একবার ঘুরে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসে। ভাবলাম কিছু হয়তো বলবেন উনি। কিন্তু কিছু না বলে এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে। আমি দরজা খুলে ধরতে উনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

মহিলা অতি বুদ্ধিমতী ঠিকই কিন্তু এরকুল পোয়ারোও তো কম নয়। মহিলা চলে যাবার পর পোয়ারো মিটিমিটি হাসে।

আমি প্রশ্ন করি, কি বলতে চাইছো তুমি?

পোয়ারো সরাসরি কোনও উত্তর দেয় না আমার প্রশ্নের। শুধু বিড়বিড় করে বলতে থাকে, মিঃ লাজারুম অত্যন্ত ধনী মানুষ। আমাকে এটা গিলতে বাধ্য করা হয়েছে….

আমি পোয়ারোর কথা শুনে অবাক চোখে তাকাই তার দিকে। জঘন্য, জঘন্য ব্যাপার তাহলে সেটা। না বলে পারি না।

সবসময় ভুল জায়গায় সঠিক প্রতিক্রিয়াটা দেখানোর ব্যাপারে তোমার জুড়ি নেই হেস্টিংস। আসলে তুমি যা বলতে চাইছে, লাজারুমের অর্থের প্রসঙ্গ তুলে মাদাম সঠিক রুচির পরিচয় দেন নি, এ মুহূর্তে আমাদের সেটা বিচার করার সময় নয়। ভেবে দেখো হেস্টিংস, যদি মিসেস রাইসের একজন ধনী বন্ধু থাকেন যে তার সব চাহিদাই পূরণ করতে সক্ষম, তাহলে নিশ্চিতভাবেই মাদাম রাইস তার প্রিয়তম বন্ধুকে সামান্য কিছু অঙ্কের অর্থ প্রাপ্তির লোভে খুন করার চেষ্টা করতে হবে না নিশ্চয়ই।

হ্যাঁ, ঠিকই তো।

আমার মাথায় এ ব্যাপারটা তো আসেই নি। যদিও এটা একটা সম্ভাবনা মাত্র। কিন্তু পোয়ারো, তুমি ওকে নার্সিংহোমে যেতে বাধা দিলে না কেন?

বোকার মতো বলো না হেস্টিংস। আমি কেন তাকে বাধা দিতে যাব। আমার ভূমিকাটা ওর কাছে প্রকাশ করে দিতে যাব কোন দুঃখে শুনি? যদি আমি বাধা দিতে যাব তাহলে নার্সিংহোমের ডাক্তার, নার্সরা রয়েছেন কেন? ভুল আইডিয়া, তুমি তো জানো, হাসপাতালের ওইসব অক্লান্ত নার্সেরা নিয়ম কানুনের ব্যাপারে খুব কড়া এবং কর্তব্যনিষ্ট হয়। 

যদি ওরা ওকে যেতে দেয়? সেই আশাঙ্কাটা কিন্তু থেকেই যায়। হয়তো নিকই তার প্রিয় বান্ধবীকে ভিতরে যাবার জন্য জেদ ধরে বসে, তখন?

সে ব্যাপারে নিশ্চিত থাকো হেস্টিংস। শুধু তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউই সে সুযোগ পাবে না হেস্টিংস। হ্যাঁ, আমাদের আর দেরি না করে এবার হাসপাতালের, দিকে রওনা হওয়া উচিত। পোয়ারোর কথা শেষ হয়নি আর ঠিক তখনই আমাদের বসবার ঘরের দরজাটা খুলে গেল। দেখলাম জর্জ শ্যালিঙ্গার হুড়মুড় করে ঘরের ভেতরে ঢুকে এলেন।

মিঃ পোয়ারো, এসব কি ব্যাপার? ওই বিদঘুঁটে, হতচ্ছাড়া নার্সিংহোম, যেখানে নিক ভর্তি আছে। আমি ওকে দেখতে চাইলাম, ওরা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করল, ডাক্তারের নাকি বারণ আছে। একটু থেমে রাগে গজগজ করতে করতে তিনি আবার বললেন, এসবের মানে কি? আমি জানতে চাই? নিক সত্যিই কি খুব মানসিক আঘাত পেয়ে অসুস্থ?

দুঃখিত মঁসিয়ে, এ ব্যাপারে আমি কি করতে পারি? আমারি কিছু করার নেই। নার্সিংহোমের নিজস্ব আইন, রীতিনীতির মধ্যে আমি নাক গলাতে পারি না।

দেখুন মিঃ পোয়ারো, আমাকে ওসব বোঝাতে আসবেন না। আমার কাকা হারলে স্ট্রীটের একজন ডাক্তার, স্নায়ু বিশেষজ্ঞ এবং মনোবিশ্লেষক। নিয়ম-কানুন আমিও কম জানি না। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে আত্মীয়-বন্ধুদের দূরে সরিয়ে রাখা এটা কি কোনও কারণ হতে পারে? আমি বিশ্বাস করিনা যে নিক এতটাই অসুস্থ যে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কারও সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করতে পারবে না। আসলে এসবের পিছনে রয়েছেন আপনি মিঃ পোয়ারো।

পোয়ারো খুব নরম ভঙ্গিতে হাসল।

আমি বরাবরই পোয়ারোকে লক্ষ্য করে দেখেছি পোয়ারো প্রেমিকদের প্রতি অতিশয় সহানুভূতিশীল। কখনও কখনও পক্ষপাতিত্ব করে বসে। পোয়ারো সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে শুনুন, আমার কথা মন দিয়ে শুনুন–যদি একজন দর্শনার্থীকে ভেতরে যেতে দিতে হয়, তাহলে সবাইকেই যেতে দিতে হবে, তাই নয় কি?

বুঝতে পেরেছি, আপনার কথা বুঝতে পেরেছি, ধরা গলায় বলে শ্যালিঙ্গার। কিন্তু তবুও……..

পোয়ারো হঠাৎ ওর জোড়া দু ঠোঁটের ওপর আঙুল সোজা ভাবে চেপে ধরে বলে, শো-স-স, আর কোনও কথা নয়, এতক্ষণ আমাদের মধ্যে যে কথাবার্তা হয়েছে সেটা ভুলে যাব আমরা। তাই তো?

ঠিক আছে, আমার মুখ দিয়ে আর একটা কথাও বের হবে না। শ্যালিঙ্গার দৃঢ় গলায় বলে।

এখন অতি গোপনীয়তাই হবে আমাদের একমাত্র মন্ত্র, কথাটা ভুললে চলবে না।

বুঝলাম। কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার এবার উঠে দাঁড়ান, দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে যাবার সময় মুহূর্তের জন্য পিছন ফিরে তাকিয়ে বলেন, আশাকরি রোগিনীকে ফুলের তোড়া পাঠানোতে নিশ্চয়ই কোনও বাধানিষেধ নেই?।

পোয়ারো মৃদু হাসে।

শ্যালিঙ্গার চলে যাওয়ার পরে পোয়ারো আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে, কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার, মাদাম রাইস ও মঁসিয়ে লাজারুম এরা তিনজনে ফুলের দোকানে না মারামারি শুরু করেন। এই ফাঁকে আমরা নিঃশব্দে চলো আমাদের গন্তব্যস্থলের রওনা হই। পৌঁছেই প্রথমে প্রশ্ন তিনটের উত্তর জানতে চাইব। যদিও উত্তরগুলো আমি জানি।

কিন্তু কখন তুমি উত্তরগুলো জানতে পারলে?

 কেন, যখন আমি প্রাতরাশ করছিলাম,

 আমাকে বল।

 না, মাদামজোয়েলের নিজের মুখে সব শোনার জন্য ধৈর্য ধর হেস্টিংস।

ব্যাপারটা থেকে আমার মন ঘোরাবার জন্যই সম্ভবত পোয়ারো আমার দিকে একটা খোলা চিঠি এগিয়ে দিল।

এটা হল সেই ছবি বিশেষজ্ঞর দেওয়া রিপোর্ট। যাকে নিকের বাড়িতে সেই বিশেষ ছবিটার মূল্যায়ন করতে পোয়ারো পাঠিয়েছিল। সেই বিশেষজ্ঞই স্পষ্টই জানিয়েছেন, ছবিটার মূল্য কয়েক পাউণ্ডের বেশি মোটেই হবে না। সুতরাং, একটা ব্যাপার পরিষ্কার হওয়া গেল।

আসলে ইঁদুরের গর্তে কোন ইঁদুরই নেই। আমিও পোয়ারোরই বলা উক্তিটা তুলে ধরি।

আমার উক্তিটা তুমি মনে রেখেছ দেখছি, কিন্তু সত্যিই কি তাই হেস্টিংস? কোনও ইঁদুর যদি নাই থাকবে, মিঃ লাজারুম এই ছবিটার জন্য কয়েকগুণ বেশি দর হেঁকেছেন কেন? একজন উঠতি চিত্র ব্যবসায়ীর নিছক মান যাচাইয়ের ক্ষেত্রে গলদ? শুধুই কি তাই?

এ সব কথা আলোচনা করতে করতে আমার নার্সিংহোমে পৌঁছে গেলাম। দোতলার একটা ঘরে আমাদের পৌঁছে দেওয়া হল। ছোটো খাটো চেহারার একজন নার্স আমাদের দেখে এগিয়ে এল। পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে সে হাসিমুখে আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে বলল, কাল রাতে মিস বার্কলি খুব ভাল ঘুমিয়েছেন।

নিক বিছানায় আধশোয়া বসে আছে। খুব ভাল সময় এসেছেন মিঃ পোয়ারো।

পোয়ারো নিকের একটা হাত নিজের দুহাতের মধ্যে নিয়ে বলল, সাহস, মাদাম জোয়েল সাহস। সব সময়ই বেঁচে থাকবার কোনও না কোনও একটা কারণ থাকে।

কথাগুলো নিককে কেমন বাঁকিয়ে দেয়। নিক অদ্ভুত চোখে পোয়ারোর মুখের দিকে তাকিয়েই থাকে। পোয়ারোও তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

আপনি কি এখনও আমাকে বলবেন না ম্যাডাম, কেন আপনি অত্যন্ত উদ্বেগ আর দুঃশিন্তার মধ্যে ছিলেন? চেষ্টা করব? ঠিক আছে মাদামজোয়েল, আমার তরফ থেকে আপনার জন্যে রইল গভীর সমবেদনা।

নিমেষে নিক বার্কলির মুখটা কেমন রক্তশূন্য হয়ে গেল।

তাহলে আপনি জানেন সব? যদিও এখন আর কে কি জানল তাতে আমার কিছুই এসে যায় না। এখন সব কিছু শেষ। আমি আর কখনো ওকে দেখতে পাব না। বলতে বলতে নিকের কণ্ঠস্বর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।

সাহস রাখুন ম্যাডাম, সাহস রাখুন। আমি আপনাকে আগেও বলেছি, এখনও বলছি, মনকে শক্ত করুন।

আমার মনে আর সাহস অবশিষ্ট নেই। গত সপ্তাহগুলোয় একের পরে এক আঘাত আমার সমস্ত মনোবল ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে।

আমি ঘনঘন দুজনের মুখের দিকে তাকাতে থাকি। ওদের কথাবার্তার বিন্দুবিসর্গ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

পোয়ারোও বুঝে নিয়েছে যে বন্ধু হেস্টিংস এসবের মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না। আমরা কি নিয়ে কথা বলছি তার কিছুই জানে না সে।

অসুখী চোখদুটো এবার আমার চোখের সঙ্গে খেলে বেড়ায়। মাইকেল সেটন। আমি ওনার বাগদত্তা ছিলাম। তিনি মারা গেছেন।

.

১১.

 মোটিভ

আমি নির্বাক। ধাতস্থ হবার বেশ কিছুক্ষণ পর পোয়ারোর দিকে ফিরে আমি বললাম, তুমি তাহলে এটাই বোঝাতে চাইছিলে?

অবশ্যই। সকালে।

কি করে বুঝলে তুমি? মানে অনুমান করলে কি করে?

সোজা ব্যাপার, খবরের কাগজের প্রথম পাতায়। তারপরই কাল রাতে খাওয়া দাওয়ার সময়ের সমস্ত কথাবার্তা আমার মনে পড়ে গেল। ছবির মতো পরিষ্কার হয়ে চোখের সামনে ফুটে উঠল সব।

তারপর পোয়ারো আবার নিকের দিকে ফেরে। গতরাতেই আপনি খবরটা শুনেছিলেন?

হ্যাঁ, রেডিওতে, ফোন আসবার পর ধরবার নাম করে আমি অন্য ঘরে চলে যাই। আমি সন্ধ্যের বেতার সংবাদটা শুনতে চেয়েছিলাম। যদি কোনও আশার খবর পাওয়া : যায়। প্রাণপণে উঠে আসা কান্নাটাকে গিলে নেবার চেষ্টা করতে করতে সে বলে, তারপর…… শুনলাম……..

শান্ত হোন, শান্ত হোন।

পোয়ালরা নিকের হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে চাপ দেয়।

মারাত্মক, ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। এদিকে সবাই আসতে শুরু করেছে। আমি যে কি করব। পুরো ব্যাপারটাকে সামলাব কি করে কিছুই বুঝতে পারছি না। সব কিছুকে কেমন স্বপ্ন মনে হচ্ছিল। নিজেকেই যেন দেখতে পাচ্ছি আমি, বাইরে থেকে।

একটু থেমে সে সঙ্গে সঙ্গে, যেন বলতে ভুলে গেছে, এভাবে যোগ করে, ব্যাপারটা যথেষ্ট কষ্টদায়কও।

বুঝতে পারছি। স্বাভাবিক। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে কি যেন ভাবে নিক। তারপর যখন সে আবার কথা বলে ওর গলায় কেমন একটা অসহায় আর্ততা ফুটে ওঠে।

ফ্রেডরিকার জন্যে গায়ে দেবার জিনিসটা আনতে গিয়ে আমি একলা হবার সুযোগ পেয়ে কেঁদে ফেলেছিলাম। ম্যাগি নীচের তলা থেকে বারবার চিৎকার করছিল তাড়াতাড়ি করবার জন্যে। শেষ পর্যন্ত আমার ছেড়ে রাখা শালটাকেই গায়ে দিয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়। আমি চোখের জল ভাল করে মুছে, কান্নার দাগ ঢাকতে মুখে একটু পাউডার বুলিয়ে ফ্রেডরিকা আর ম্যাগির কোট নিয়ে একতলায় নেমে আসি। বাড়ির বাইরে বের হতেই……… ম্যাগিকে দেখতে পাই….. পড়ে রয়েছে…… মৃত……..।

সত্যি, একটা দারুণ শক, নিঃসন্দেহে।

না, আপনি বুঝতে পারছেন না। আমি ভীষণ রেগে গিয়েছিলাম। এটা আমার হবার কথা ছিল, আমি হলে পারতাম। আমার সেরকমই ইচ্ছে করছিল। আমি মরে যেতে চাইছিলাম, অথচ আমি দিব্যি বেঁচে আছি। আর আমাকে নিরাপত্তা দিতে সে বেচারি ম্যাগি বেঘোরে মারা গেল। মাইকেল মারা গেল বহু দূরে প্যাসিফিক সমুদ্রের জলে ডুবে।

বেচারা। পোয়ারো সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করে।

আমি বাঁচতে চাই না। আমি বেঁচে থাকতে চাই না। বলতে বলতে অঝোরে কেঁদে চলে সে।

আমি বুঝতে পারছি মাদাম জোয়েল, আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই এইরকম একটা পর্ব কখনও না কখনও আসে কিন্তু সময়ই সব কিছুকে ভুলিয়ে দেয়। শোক দুঃখকে অতিক্রম করে জীবন এগিয়ে চলে।

আপনি ভাবছেন, অল্প কয়েক দিনের মধ্যে আমি দুঃখ ভুলে যাব, অন্য কাউকে বিয়ে করব। কান্না মেশানো সুরে কথাগুলো বলে নিক।

না, না, আমি সেরকম কিছুই ভাবছি না। পোয়ারো শান্ত গলায় সহানুভূতির গলায় বলে, আপনি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান মাদাম। একজন যথার্থ সাহসী মানুষের ভালবাসা পেয়েছিলেন আপনি কিন্তু ওনার সঙ্গে আপনার আলাপ হয়েছিল কি ভাবে?

গত সেপ্টেম্বর, লা টকটেউ-তে, প্রায় এক বছর আগে।

 আর আপনাদের এনগেজমেন্ট হয়েছিল কবে?

ক্রিসমাসের দুদিন পরে। কিন্তু ব্যাপারটাকে সেটন-এর ইচ্ছেতে গোপন রাখা হয়েছিল।

কেন?

মাইকের কাকা ম্যাথু সেটন পাখি খুব ভালবাসেন। আর উনি মহিলাদের দারুণ ঘৃণা করেন।

তার কারণ জানতে পেরেছিলেন?

মাইকেল যতটুকু বলেছিল–উনি একটু আধপাগল ধরনের ছিলেন। ওনার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল নারী পুরুষের জীবন ধ্বংস করে দেয়।

কিন্তু মিঃ সেটন কেন ব্যাপারটাকে মেনে নিয়েছিলেন?

মাইকেল পুরোপুরি ওনার ওপর নির্ভরশীল ছিল। মাইকেলের ব্যাপারে উনি অত্যন্ত গর্বিত ছিলেন। মাইকেলের বিশ্বব্যাপী উড়ান যানটি তৈরি করা এবং অন্যন্য সমস্তরকম আর্থিক খরচ বহন করছিলেন ম্যাথু কাকা। মাইকেলের ইচ্ছে ছিল বিশ্ব সফর থেকে ফিরে এসেই সে আমাদের বিয়ের কথা ঘোষণা করবে।

বেশ, বুঝলাম। পোয়ারো গম্ভীর গলায় মাথা নাড়ে।

মাইকেল বলেছিল, কোনওভাবে যেন আমাদের এনগেজমেন্ট-এর খবরটা ফাঁস না হয়ে যায়। যদি হয় তাহলে ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া হবে। ম্যাথু কাকা সবরকমের আর্থিক সাহায্য বন্ধ করে দেবেন আর উড়ানের মাধ্যমে তার বিশ্ব সফর মাইকেলের সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল বলে সেটা আমি গোপন রাখব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম তাকে। আমি আমার প্রতিশ্রুতি রেখেছি। আমার প্রিয় বন্ধু ফ্রেডিকেও এ ব্যাপারে কিছুই বলিনি।

পোয়ারো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, শুধু আমাকে যদি একবার ব্যাপারটা জানাতেন।

নিক পোয়ারোর দিকে তাকায়, তাতে কি লাভ হতো? আমার ওপর হামলা বা হত্যার চেষ্টাগুলোর সাথে মাইকেলের তো কোনও যোগাযোগ নেই। তবে হ্যাঁ, এসব কথা গোপন রাখার একটা প্রতিক্রিয়া আমার মনের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছিল। সারাক্ষণ একটা চাপা ভয়, দুশ্চিন্তা আমার মানসিক চাপ প্রচণ্ড বাড়িয়ে তুলেছিল যা এক অসহ্যকর অবস্থায় আমাকে উপনীত করেছিল।

হ্যাঁ, সেটা তো আমরা সবাই দেখেছি। পোয়ারো নিকের কথায় সায় দেয়।

এর আগেও মাইকেল একবার নিখোঁজ হয়েছিল, সেটা আপনি নিশ্চয়ই জানেন। হ্যাঁ, ভারতের দিকে যাবার পথে মরুভূমির মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল। মাইকেল সেটা আমাকে বলেছিল। সে ঘটনাও খুব ভয়ঙ্কর ছিল, যার থেকে শেষ পর্যন্ত ও বের হয়ে আসতে  পেরেছিল। আর আমিও এবার নিজেকে বারবার বলতাম এবারও সেরকম কিছু একটা হবে। আবার নিজেকে বোঝাতাম–সে যতই বিপদের মুখে পড়ুক না কেন, সব বাধা কাটিয়ে সে ফিরে আসবেই। অন্যেরা যখন বলতো সে মারা গেছে, তখন আমি আমার মনকে বোঝাতাম, সে বেঁচে আছে, সুস্থ আছে, সে ফিরে আসবেই। সবাই ভুল বলছে। আর……… তারপর………… কাল রাতে…………. ওর কথাগুলো ক্ষীণ হতে হতে যেন হাওয়ায় মিশে যায়।

পোয়ারো অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে–আমি বুঝতে পারছি, আপনার মনের অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি।

এবার হঠাৎ করে পোয়ারো একেবারে অন্য প্রসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আচ্ছা মাদাম, মিঃ ভাইস-এর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?

নিক হকচকিয়ে যায় পোয়ারোর অপ্রাসঙ্গিক কথায়। প্রশ্ন করে চার্লস হঠাৎ ওর কথা আপনার মাথায় এল কেন?

না, না, এমনিই। আমি শুধু জানতে চাইছি। কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে নয়।

এমনিতে চার্লসের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব ভালোই। তবে একটু ভীতু স্বভাবের মানুষ সে। কখনও সে এই জায়গাটা ছেড়ে অন্য কোথাও যায়নি।

মাদাম জোয়েল আমি শুনেছি, তিনি নাকি আপনার প্রতি নিবেদিত প্রাণ?

এবার নিকের মুখে খানিকটা বিব্রতভাব ফুটে ওঠে। হয়তো। তবে চার্লসের অনেক কিছুই আমার অপছন্দ। আমার জীবনযাত্রার ভঙ্গি, আমার ককটেল পার্টি, আমার বন্ধুরা, আমার কথাবার্তা, আসলে ও ভাবে আমার জীবনের মুড অপরিপক্ক, ও সবসময় আমাকে রিফর্ম করবার কথা চিন্তা করে, আশা করে। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর হঠাৎ নিক তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়, ওর চোখ দুটোয় এক অদ্ভুত ঝিকিমিকি আলো খেলে যায়। কিন্তু এই খবরটা আপনাদের কানে পৌঁছে দিল কোন মহানুভব?

পোয়ারো মৃদু হাসে এই প্রশ্নে। কোনও উত্তর দেয় না। তারপর সেই ফিচেল মার্কা হাসিটা মুখে ধরে রেখেই সে বলে, যাইহোক ম্যাম, আপনি আপাতত এখানেই থাকবেন, হ্যাঁ। এখানকার সব নিয়মকানুন মেনে চলবেন। মনে রাখবেন এখানে যা কিছু হবে আপনাকে যা কিছু করতে বলা হবে তার সব কিছুই হবে আমারই নির্দেশে।

নিক এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আপনার নির্দেশই মেনে চলছি। এখন আর আমি কি করছি না করছি তাতে আমার কিছু যায় আসে না।

যাইহোক, আমরা এবার উঠব। আপনার দুঃখে আর বেশিক্ষণ অনধিকার প্রবেশ করব না। আমরা উঠে দাঁড়াই। দরজার দিকে পা বাড়াই। হঠাৎ পোয়ারো ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, মাদাম একটা কথা মনে পড়ে গেল। আপনি একটা উইল করেছিলেন বলে আমায় জানিয়ে ছিলেন মনে পড়ে?

হ্যাঁ,

সেটা এখন কোথায় আছে?

ওহ, সেটা? এই আছে, কোথাও এদিক সেদিক।

পোয়ারো বলে এন্ড হাউসে নিশ্চয়ই?

 হ্যাঁ, এন্ড হাউসে তো বটেই।

এন্ড হাউসের কোথায়? নিশ্চয়ই কোনও নিরাপদ স্থানে। আপনার ডেস্কে, তালাচাবি দেওয়া তো?

উমম, আমি ঠিক বলতে পারব না। আসলে কাগজপত্র গুছিয়ে রাখার ব্যপারে আমি খুব একটা পটু নই। রেখেছি কোথাও। তবে নিশ্চিত করে বলতে পারব না সেটা কোথায় রেখেছি। খুঁজে দেখতে হবে। তবে হ্যাঁ, লাইব্রেরিতে একটা লেখার টেবিল আছে। তার চারটে ড্রয়ারেই আমি আমার সমস্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, বিল, ভাউচার হিসাবপত্র রাখি। সম্ভবত ওই টেবিলের কোনও এক ড্রয়ারেই নিশ্চয়ই ওটা রেখে থাকতে পারি।

পোয়ারো এবার সবিনয় ভঙ্গিতে বলে, আপনি কি আমাকে উইলটা খুঁজে দেখার অনুমতি দেবেন?

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আপনি যদি চান অবশ্যই দেখতে পারেন। যা খুশি খুঁজে দেখতে পারেন আপনি।

ধন্যবাদ মাদাম জোয়েল, আপনার বদান্যতা এবং ভদ্রতার তুলনা নেই।

.

১২.

এলিন

নার্সিংহোম থেকে বের হবার পর দীর্ঘক্ষণ পোয়ারো কোনও কথা বলল না। তারপর একসময় সে আমার কব্জির কাছটা চেপে ধরল, তুমি দেখলে হেস্টিংস? আমি ঠিক বলেছিলাম। কিছু একটা ছিল, কিছু একটার অভাব, ছোট্ট একটুকরো ধাঁধা। যেটার অভাবেই সেই হারিয়ে যাওয়া সূত্রটার অভাবেই গোটা ব্যাপারটা অর্থহীন হয়ে যাচ্ছিল। ওর এত আনন্দ, উচ্ছ্বাসের কারণ আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কি এমন ঘটেছে? এগোনোর মতো কি কোনও জোরালো সূত্র পাওয়া গেছে?

অথচ দেখো, ব্যাপারটা সবসময়েই কিন্তু আমাদের চোখের সামনে ছিল। আমি দেখতে পাই নি। কি করে দেখতেই বা পাব? কিছু একটা অবশ্যই আছে, জানতে হলে আমাকে তো বুঝতে হতো সেই বিশেষ কিছুটা কি? এবং কেন?

পোয়ারোর বিড়বিড়ানি আমার কাছে ডাচ বা জার্মান ভাষার মতোই দুর্বোধ্য মনে হচ্ছিল। বাধ্য হয়ে প্রশ্ন না করে পারলাম না। তুমি কি অপরাধের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত এরকম কিছু তথ্য, সূত্র বা ঘটনা খুঁজে পেয়েছ?

তুমি দেখতে পাওনি?

সত্যিটা হচ্ছে, না পাইনি। আমি স্বীকার করতে বাধ্য হলাম।

হায় ভগবান, এটাও সম্ভব? আমরা যা খুঁজছিলাম সেই পথ নির্দেশ পেয়ে গেলাম।

আমি অনেক ভেবে বললাম, মোটিভ, অস্বচ্ছ মোটিভ বা কোনও ধরনের ঈর্ষা বোধ, তুমি কি সেরকম কিছু ইঙ্গিত করছ?

ঈর্ষা? না, বন্ধু না। সেই সাধারণ মোটিভ, টীকা, বন্ধুর টীকা, পোয়ারো শান্ত গলায় কথাগুলো বলে গেল।

কোন কথা না বলে আমি খরচোখে ওর দিকে তাকালাম।

মাত্র সপ্তাহ খানেক আগে ম্যাথু সেটন মারা গেছেন। আর উনি ছিলেন কোটিপতি। ইংল্যন্ডের অন্যতম ধনী ব্যক্তি।

হ্যাঁ, ঠিকই….কিন্তু।

ওনার কাছে আত্মীয় বলতে আছে একমাত্র ভাইপো। যাকে তিনি ভীষণ রকম ভালবাসতেন। আমরা বিনা দ্বিধায় ধরে নিতে পারি, স্যার ম্যাথু তার সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী তাকেই করে গিয়েছেন।

মাইকেল সেটনকে? পোয়ারোর কথার মাঝে আমি জানতে চাই। আসলে ব্যাপারটা আমার কাছে তখনও একটা ধাঁধার মতো মনে হচ্ছিল। আমার কথায় আমল না দিয়ে পোয়ারো আমাকে বোঝাবার ভঙ্গিতে বলে চলে, গত মঙ্গলবার মাইকেল সেটন নিখোঁজ হলেন আর মাদাম জোয়েলকে প্রথম হত্যার চেষ্টাটা ঘটল বুধবার। এরপর থেকে একের পর এক মাদামের ওপর হামলা হয়েই চলল। হেস্টিংস, আমি নিশ্চিত, মাইকেল সেটন অনিশ্চিয়তায় ভরা উড়ান যাত্রায় পাড়ি দেবার আগে একটা উইল করেছিলেন।

এবার আমার কাছে ব্যাপারটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকল। পোয়ারো কথাগুলো আরো একটু গুছিয়ে বলে, মাইকেল সেটন তার সেই উইলে সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করেছিলেন তার সদ্য বাগদত্তাকে।

আমি বলি, পোয়ারো সমস্ত ব্যাপারটা তুমি কিন্তু আন্দাজে ধরে নিয়ে বলছ।

হ্যাঁ, তোমার কথা ঠিক।…. আমি কেবল অনুমান করেছি মাত্র। কিন্তু সঙ্গে এটাও ঠিক যে ঘটনাটা এইরকমই ঘটেছে–ঘটতে বাধ্য, আমার থিয়োরিতে বলে অন্যরকম ঘটতে পারে না। আর সত্য যদি অন্য কিছু ঘটত তাহলে এই অপরাধগুলো ঘটত না। তাছাড়া ভেবে দেখ, টাকার অঙ্কটা মোটেই কিন্তু সামান্য কিছু নয়, বিশাল অঙ্কের টাকা, যা অকল্পনীয় ব্যাপার।

আমি আর কোন কথা বললাম না। আমার মনের মধ্যে ব্যাপারগুলো কেবল ঘুরপাক খেতে লাগল। আমার মনে হচ্ছিল একটা হঠকারী পদ্ধতিতে ঘটনাটা পরিণতির দিকে এগোতে চাইছে। যা অসম্ভব। অথচ, আমার মনের ভেতর থেকে অন্য একটা কণ্ঠ বলছিল, পোয়ারোই ঠিক, পোয়ারোর এক স্বচ্ছন্দগতিময় অসাধারণত্ব রয়েছে বরাবর সঠিক থাকবার। হয়তো সেটাই আমাকে পোয়ারোর চিন্তার স্বপক্ষে ভাবতে, সহমত হতে, প্রভাবিত হতে। সঙ্গে অবশ্য এটাও আমার মনে হল, ব্যাপারটাকে প্রমাণ করতে পোয়ারোকে এখনও বহু পথ হাঁটতে হবে।

তোমার থিয়োরির সবচেয়ে বড় দুর্বলতাটা কিন্তু, এনগেজমেন্টের খবরটা কেউই জানে না, জানত না। তাই নয় কি? আমি তর্কের গলায় বলি।

না, না, আমি তা বিশ্বাস করি না। জানে, নিশ্চয়ই কেউ জানতো। সত্যি কথা বলতে কি কেউ একজন সবসময়ই পুরো ব্যাপারটা জানতো। যদি বা নিশ্চিত ভাবে না জেনেও থাকে, সঠিক নিখুঁত ভাবে আন্দাজ করেছিল। মাদাম জোয়েল রাইস কিছুটা সন্দেহ করেছিলেন সম্পর্কের ব্যাপারটা। গত রাতের ডিনারে ওর কথা নিক তো প্রায় মেনেই নিয়েছিলেন, অনেকটাই, নিজের নিশ্চিত বিশ্বাস থেকেই যদি মাদাম জোয়েল রাইস প্রসঙ্গটা তুলে থাকেন সে রাতে?

কিন্তু উনি কি ভাবে আন্দাজ করতে পারবেন?

অনেক রকম ভাবেই সম্ভব। যেমন ধরো মাইকেল সেটনের কোনও প্রেমপত্র যদি ওনার নজরে পড়ে থাকে? আমরা তো ইতিমধ্যে নিশ্চিত ভাবেই জেনে গিয়েছিলাম, কাগজপত্র গুছিয়ে রাখবার ব্যাপারে মিস বার্কলি অত্যন্ত অসতর্ক। সুতরাং এই সম্ভাবনাটা খুবই প্রবলভাবে থাকছে।

এবার আমি চিন্তান্বিত গলায় বলি, তোমার কি মনে হয় মিসেস রাইস বান্ধবীর উইলের ব্যাপারটা জানেন?

নিঃসন্দেহে। পোয়ারো দ্ব্যর্থহীন ভঙ্গিতে উত্তর দেয়। তারপর, একঝলক কি যেন ভেবে নিয়ে বলে ওহহহ, ভাল কথা। আমার তালিকাটা। তোমার মনে আছে নিশ্চয়ই? সন্দেহভাজনদের সেই তালিকাটা? ক,খ,গ,…. নাহ, আর অত দূর এগোবার দরকার নেই। তালিকাটা কাটছাঁট করে খুব ছোট্ট করে এনেছি মাত্র দুইজনে।

আমি অবাক গলায় বলি, মাত্র দু’জন?

পোয়ারো খুশি খুশি ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে, আমার কথায় সায় দেয়, হা।

আমি কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গারকে বাদ দিচ্ছি। যদিও প্লাইমাউথ থেকে এখানে আসতে তিনি আড়াই ঘণ্টা সময় নিয়েছিলেন। মাত্র তিরিশ মাইল দূরত্ব পার হতে কোনোমতেই অতটা সময় লাগবার কথা নয়। তবুও……..। লম্বা নাকের মিঃ লাজারুমকেও হেঁটে ফেলেছি। যদিও মাত্র কয়েক পাউন্ড দামের একটা ছবিকে বেশ কয়েকগুণ বেশি চড়া দামে কেনবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি। খুবই অস্বাভাবিক। যাইহোক আমি অস্ট্রেলিয়ান দম্পতিদেরও বাদ দিচ্ছি। আমাদের তালিকাটাতে তবু কয়েকজন সন্দেহজনক থেকে যাচ্ছেন।

ফ্রেডরিকা রাইস তাদের একজন।

অবশ্যই। তিনি নিঃসন্দেহে তালিকার প্রথম দিকে থাকবেন। উইল অনুযায়ী (নিক বার্কলির) মাদাম জোয়েলের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া হবার সুত্রে অর্থকরী দিক দিয়ে তিনিই নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন। শুধু এন্ড হাউস নয়, গত রাতে মাদাম জোয়েল ম্যাগি বার্কলির পরিবর্তে নিক মারা গেলে, মাদাম জোয়েলে রাইস আজ সকালে প্রচুর সম্পত্তির মালিক একজন ধনী মহিলা হয়ে যেতেন।

আমি ব্যাপারটাকে বিশ্বাস তো দূরের কথা, ভালভাবে হজম করতে পর্যন্ত পারছিলাম না।

তার মানে তুমি বলতে চাও এরকম একজন সুন্দরী মহিলা যে খুনী হতে পারে তুমি বিশ্বাস করতে পারছ না?

পোয়ারো কৌতুকের চোখে আমার দিকে তাকায় তারপর আবার বলতে শুরু করে, জুরিদের মধ্যেও অনেকসময় এই ধরনের মানসিকতা দেখা যায়, তবে তুমি হয়তো ঠিক বলেছ, আরও একজন প্রধানতম সন্দেহভাজন রয়েছে।

কে? তীব্র কৌতূহলের গলায় প্রশ্ন করে, চার্লস ভ্যাইস? কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে সে তো শুধুমাত্র বাড়িটুকুই পেতে পারে বা পাবে।

হ্যাঁ, সম্ভবত সেকথা সে জানে না। তিনি স্বয়ং কি মাদাম জোয়েলের উইল তৈরি করেছেন? সম্ভবত না। তা যদি হত, তাহলে মোটেই নকিং এরাউন্ড সাম হোয়ার এই বাক্যবন্ধই তো ব্যবহার করেছিলেন মাদাম জোয়েল? না সেরকম ও আচরণ করত না। সুতরাং হেস্টিংস, এটাই স্বাভাবিক যে তিনি এই বিষয়ে কিছুই জানতেন না। সুতরাং মিঃ ভাইসের ধারণা থাকতে পারে মাদাম জোয়েল কোনো উইল করেন নি। সেক্ষেত্রে ওর আশা হতে পারে মাদাম জোয়েলের সবচেয়ে কাছের আত্মীয় হিসাবে তিনি মাদাম জোয়েলের অবর্তমানে সম্পূর্ণ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন।

এটা আমার কাছে অনেক বেশি সম্ভব বলে মনে হচ্ছে।

তোমার রোমান্টিক মনই একথা বলছে হেস্টিংস। কুচক্রী আইনজীবী, অসৎ, খল, গল্প-উপন্যাসে যেমন দেখা যায়। তাছাড়া ওর চেহারাটাও মোটেই তেমন সুবিধের নয়। খলনায়ক হবার মতো সবরকম উপাদান ওর মধ্যে অবশ্যই রয়েছে, তোমার মত অনুযায়ী, তবে হাঁ, এটা ঠিক যে, পিস্তলটা হাতিয়ে নেবার এবং ব্যবহার করা সবচেয়ে ভাল সুযোগ ওনারই ছিল।

আর পাহাড়ের চাতাল থেকে অতবড় পাথরটা গড়িয়ে দেবার সুযোগ একমাত্র কোন পুরুষেরই রয়েছে।

হয়তো ঠিকই বলেছ। তবে কোন কিছুর সাহায্যে চাড় দিয়ে পাথরটা সহজেই কোন মহিলাও নাড়িয়ে ফেলতে পারে। আর এটা একটা মহিলার অপরাধী বুদ্ধিজনক ঘটনা। আর যেভাবে পাথরটা ভুল সময়ে ফেলে মাদাম জোয়েলকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করেছে, সেটা দেখে কাজটা কোনো মহিলারই বলে মনে হচ্ছে। আবার গাড়ির ব্রেক খারাপ করে রাখাটা পুরোপুরি পুরুষ অপরাধমনষ্কতারই প্রমাণ যদিও আজকাল অনেক মহিলারই গাড়ি বিষয়ে পুরুষের সমতুল্য জ্ঞানগম্যি থাকে। গাড়ির মেকানিক হিসেবেও তারা দক্ষ হন। তবে, অবশ্যই দুই-একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে মিঃ ভ্যাইসের বিরুদ্ধে থিয়োরিটাতে।

যেমন? আমি কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন করি।

মাদাম জোয়েল রাইসের তুলনায় ওর এনগেজমেন্টের ব্যাপারটা জানতে পারবার সম্ভাবনা কম। সেক্ষেত্রে ওর মত একজন পাকা বুদ্ধির আইনজ্ঞের ঝোঁকের বশে তাড়াহুড়ো করে কোনো কাজ করে বসা, না ওর চরিত্রের সঙ্গে ব্যাপারটা একেবারেই মানাচ্ছে না। বিশেষ করে, সেটনের মৃত্যুর খবরটা যখন মাত্র কাল রাতেই জানতে পারা গেল।

আমরা পাহাড়ী, বাঁকাচোরা পথ ধরে ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। এইভাবে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় আমরা এন্ড হাউসের দরজায় পৌঁছে গেলাম। দরজা ঠেলে ঢোকবার পর আমরা দেখলাম মধ্যবয়সী এক পুরুষ এক মনে ঘাস হেঁটে চলেছে। আমরা বুঝলাম, এই হচ্ছে বাড়ির মালি, অর্থাৎ এলিনের স্বামী। আমরা ওকে অতিক্রম করে ড্রইংরুমে এসে ঢুকলাম। আমি দরজার ঘণ্টাটা বাজালাম। কয়েক মুহূর্ত পরই যথারীতি টিপটপ, কালো পোশাকে সজ্জিতা এলিন এসে হাজির হল। আমাদের দেখে সে মোটেই বিস্মিত হল না। পোয়ারো ওকে জানাল আমরা মিস বার্কলির অনুমতি নিয়ে এসেছি, ঘরটা তল্লাশি করবার জন্যে।

ঠিক আছে স্যার।

 পোয়ারো প্রশ্ন করে, পুলিশের কাজ শেষ হয়েছে?

 হ্যাঁ, স্যার, ওরা সব, কাজ শেষ করে চলে গেছেন।

এলিন এবার ঘর ছেড়ে বের হবার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়। আর ঠিক তখনি পোয়ারো ওকে থামিয়ে দিয়ে একটা প্রশ্ন করে, গত রাতে তুমি যখন শুনলে মিস ম্যাগি বার্কলি গুলিতে মারা গেছেন, খুব অবাক হয়েছিলে কি?

হ্যাঁ, স্যার নিশ্চয়ই। খুবই অবাক হয়েছিলাম। মিস ম্যাগি অত্যন্ত চমৎকার মহিলা ছিলেন। তার এই ভাবে মৃত্যু………. আমি তো চিন্তা করতে পারি না। একমাত্র কেউ শয়তানি বুদ্ধির মানুষ থাকতে পারে যে মিস ম্যাগির ক্ষতি করতে চাইছে।

যদি অন্য কেউ মারা যেত, খুন হত, বোধহয় এত অবাক হতে না। তাই না? পোয়ারোর এই প্রশ্নে এলিন সহসা চমকে ওঠে, থতমত খেয়ে যায়। আপনার কথার সঠিক অর্থ আমি বুঝতে পারছি না স্যার।

কাল রাতে যখন আমি এ ঘরে আসি, তুমি আমাকে প্রশ্ন করেছিলে, কেউ কি আহত হয়েছে? কারও আঘাত লেগেছে? তুমি কি সেই ধরনের কিছু আশা করেছিলে? বা সেইরকম কিছুর জন্যে অপেক্ষা করছিলে?

এলিন চুপ মেরে যায়। বাক্য হারা। হাতের আঙুলগুলো দিয়ে শেষ প্রান্তের ভাজে আঙুল বোলাতে থাকে। যেন সেগুলো সোজা করার চেষ্টা করছে। সেইভাবেই বিড়বিড় করে বলে, বুঝবেন না, আপনারা বুঝবেন না।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই বুঝব। পোয়ারো বলে, যত আশ্চর্য অবাক হবার মত অসাধারণ কথাই আমি ঠিকই বুঝতে পারব। তুমি বরং কষ্ট করে কথাটা বলেই ফেল হে। পোয়ারোর গলায় প্রবল ব্যঙ্গ। এলিন ওর দিকে যথেষ্ট সন্দেহ নিয়ে তাকায়। তারপর মনে হল মনকে আশ্বস্ত করে, পোয়ারোকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করে, আপনি তো নিজের চোখেই দেখছেন স্যার। বাড়িটা ভাল নয়। মনের জড়তা, দ্বিধা কাটিয়ে অবশেষে বলে। আমি ওর কথায় প্রায় আকাশ থেকে পড়লেও পোয়ারোকে দেখে মনে হল না কথাগুলো ওর কাছে আদৌও অস্বাভাবিক মনে হয়েছে।

তুমি বলতে চাও বাড়িটা পুরনো। তাই তো?

 হ্যাঁ, স্যার। এবং বাড়িটা ভালো নয়।

আচ্ছা এলিন, এই বাড়িতে তুমি কতদিন যাবৎ রয়েছ?

ছয় বছর। তবে তার আগে অল্প বয়সেও আমি এই বাড়িতে কাজ করেছি। রান্না ঘরে। রান্না পরিচারিকা হিসেবে। যেটা ছিল বৃদ্ধ স্যার নিকোলের সময়। পোয়ারো প্রখর দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।

এইসব পুরনো বাড়িগুলোতে অশুভ ছায়া পড়ে। ব্যগ্র গলায় এলিন বলে চলে।–আপনি দেখতে পাবেন না। কিন্তু হাওয়ায় সেই অশুভ পরিবেশ টের পাবেন। আমি সবসময় জানতাম এ বাড়িতে অশুভ কিছু ঘটতে চলেছে।

পোয়ারো মাথা নীচু করে কি যেন ভাবে। তারপর স্পষ্ট চোখে এলিনের দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি সঠিক প্রমাণিত হয়েছ।

হ্যাঁ, স্যার সত্যি, ওর গলায় একটা নিশ্চিত আত্মপ্রসাদের চোরাটান ছিল। কিন্তু তুমি ভাব নি এটা ছিল ম্যাগি। পোয়ারো বাঁকা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে। না, সত্যি স্যার। আমি ভাবতে পারিনি। ওনাকে সবাই ভালবাসতো।

আমি ধরতে পারলাম এলিনের কথাগুলো একটা সূত্র। আশা করলাম পোয়ারো এবার সেটা ধরে সুতো গোটাবে।

কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে পোয়ারো সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গান্তরে চলে গেল, তুমি গুলি ছোঁড়ার শব্দ পেয়েছিলে?

না স্যার, আসলে বাজি ফাটছিল অনেক। খুব শব্দ হচ্ছিল। গুলির আওয়াজ আলাদা করে বোঝবার উপায় ছিল না।

তুমি বাজি পোড়ানো দেখতে যাও নি?

 না স্যার, আমার তখনও বাসন ধোওয়া বাকি ছিল।

তোমার সাহায্যকারী হিসাবে কে ছিল?

কেউ না স্যার। সবাই বাজি পোড়ানো দেখতে চলে গিয়েছিল।

তুমি যাওনি কেন? বাজি পোড়ানো দেখতে তোমার ভাল লাগে না?

হ্যাঁ স্যার, নিশ্চয়ই ভাল লাগে। তবে আমি আগে হাতের কাজ সেরে নিতে চেয়েছিলাম।

ওহ, খুব ভাল কথা! তাহলে তুমি শুনেছিলে মাদাম জোয়েল ম্যাগি তার কোট চাইছিলেন?

না স্যার, আমি শুনলাম মিস নিক সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলেন। তারপর মিস ম্যাগি একতলা থেকে কিছু একটা চেয়ে কয়েকবার তাড়া দিলেন। এবং তারপর বললেন–আমি কালো শালটা নিয়ে নিচ্ছি।

এক মিনিট। তুমি কথাগুলো শুনেও কোটগুলো খুঁজে দিতে যাওনি, প্রয়োজন বোধ করনি কেন এলিন?

আমি তো আপনাকে আগেই বলেছি স্যার, আমি হাতের কাজ সারতে ব্যস্ত ছিলাম। পোয়ারো এবার সরাসরি বিদ্ধকারী চোখে এলিনের দিকে তাকায়।

মহিলা দুজনেও তোমায় ডাকেন নি। কারণ তারা জানতেন, প্রতি বছরের মতো, এবারও তুমি বাইরে বাজি পোড়ানো দেখছো। আচমকা এলিনের গাল, চিবুকে রক্তের ছোপ দেখা গেল।

আপনি কি বলতে চাইছেন আমি বুঝতে পারছি না। হ্যাঁ, আমাদের বাগানে যাওয়ার কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু অন্যবারের মতো এবার যদি আমি বাজি পোড়ানো দেখতে না যাই, কাজ সেরে তাড়াতাড়ি বিছানায় যেতে চাই, সেটা নিশ্চয়ই সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাই নয় কি?

আমি তোমাকে কোনওভাবে মনে আঘাত দিতে চাই নি। তুমি কেন তোমার ইচ্ছে মতো কাজ করবে না? অবশ্যই তা পারো। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকবার পর সে আবার বলে এলিন, আর একটা ছোট্ট ব্যাপার, আশাকরি এই ব্যাপারটাতে তুমি আমাকে সাহায্য করতে পারবে। এটা তো একটা বহু পুরনো বাড়ি। তুমি কি জান, এই বাড়িতে কোনো লুকনো, গোপন কক্ষ বা খুপরি আছে?

এই ঘরেই একটা সেরকম জিনিস আছে, পাশ থেকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়া যায়। খুব ছোট বেলায় একবার দেখেছিলাম। তবে, এত বছর পর এখন আমি হুবহু মনে করতে পারছি না, সেটা ঠিক কোথায় রয়েছে।

একজন মানুষের লুকিয়ে থাকবার পক্ষে সেটা যথেষ্ট বড়?

না, না, স্যার। সেরকম কিছু নয়। একটা কাবার্ড ধরনের জিনিস। দেড়-দু ফুট চওড়া। চৌকো আকৃতির।

ওহ, তাহলে যেটা আমি যা খুঁজছি, চাইছি তা নয়। আমি দেখলাম, এবং চরমতম বিস্মিতও হলাম।

এলিনের গালে চিবুকে আবার সেই রক্ত ছোপ লেগেছে। আপনি যদি ভেবে থাকেন আমি কোথাও লুকিয়ে ছিলাম, তা নয় স্যার। তা নয়। আমি মিস নিককে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আসতে এবং বাইরে বের হয়ে যাবার পদ শব্দ শুনি। তারপরই আর্তচিৎকার, কান্না শুনতে পেয়ে এঘরে ছুটে আসি। ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি। এটাই সত্যি। এটাই সত্যি, ঈশ্বরের দিব্যি।

.

১৩.

চিঠিগুলো

পোয়ারো এরপর এলিনকে শান্ত করে এবং সান্ত্বনার প্রলেপ লাগিয়ে ফেরত পাঠাল। তারপর চিন্তাজর্জরিত মুখে আমার দিকে ফিরে তাকাল। এলিন সত্যি কি গুলির শব্দ শোনেননি? নাহ্ সেটা হবার সম্ভাবনা না খুব কম। আমার বিশ্বাস সে শব্দ শুনেছিল। রান্না ঘরের জানালা খুলে বুঝবার, দেখবার চেষ্টা করেছিল। তারপর নিককে সিঁড়ি নেমে আসতে, বের হয়ে যেতে শোনে। নিকের আর্তচিৎকার শুনতে পেয়েই সে এঘরে এসেছিল কি ঘটেছেবুঝতে। এটা ঘটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেই সন্ধ্যেতে কেন সে বাজি পোড়ানো দেখতে বাগানে গেল না? এটাই জানতে চাইবার, এর পিছনে কারণটা কি?

নিছকই কৌতূহল। মনে রেখো, ঝ’-কে আমরা এখনো সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিতে পারিনি।

ঝ? প্রবল বিস্ময়ে প্রশ্ন করি আমি।

হ্যাঁ, মনে নেই? আমার সন্দেহ তালিকার শেষ নাম। অজানা সন্দেহভাজন। সে কে আমরা এখনও জানি না। তবে, এখন আমার ক্রমে সন্দেহ হতে শুরু করেছে ওই ঝ’ কোনোভাবে এলিনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, ঘটনার রাতে সে এই বাড়িতে এসেছিল। গোপন কুঠুরীতে লুকোয়। একটি যুবতাঁকে কালো শাল জড়িয়ে যেতে দেখে তাকে নিক বলে ভেবে নেয় (বা ভুল করে) এবং তাকে গুলি করে। অবশ্যই, অনুসরণ করে বাইরে যাবার পর। যদিও আমরা জেনেছি এই বাড়িতে কোনো লুকনো কুঠুরী নেই। সে রাতে এলিন কেন বাজি পোড়ানো দেখতে বাগানে যায় নি। সে রহস্য আমাকে অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে। তবে তার আগে এসে মাদাম জোয়েলের উইলটা খুঁজে দেখি।

বাইরের ঘর খুঁজে কোনো কাগজপত্র পাওয়া গেল না। এরপর আমরা লাইব্রেরি ঘরে পৌঁছলাম। আধো অন্ধকার ঘর। ঘরটাতে বেশ বড় বড় ওয়ালনাট টেবিল। বেশ খানিকক্ষণ সময় গেল এই ঘরটাতে খুঁজতে। কারণ পুরো ঘরটা চূড়ান্ত অগোছাল অবস্থা। নানারকম বিল ও রিমিট, জমা দেওয়া টাকার রসিদ মিলে মিশে একাকার। বহু পুরনো চিঠি, আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের, স্কুপ হয়ে রয়েছে নানা জায়গায়। প্রায় আধঘণ্টা পরে পোয়ারো একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বলল, সবই আমার মোটামুটি যাচাই করে দেখেছি। কিছু বাদ যায় নি। হঠাৎ পোয়ারো আমার দিকে একটা গোটা কাগজ ছুঁড়ে দেয়। একটা চিঠি। বেশ বড় বড় অক্ষরে হাতের লেখা।

প্রিয়তম,
পার্টি সত্যি সত্যি চমৎকার হয়েছে। আজকের দিনটা বেশ উষ্ণ। আশাকরি তুমি ওই জিনিসটা স্পর্শ করবে না। আবার শুরু কর না, প্রিয়তম। অবশ্য, ছেড়ে দেওয়াটা সত্যি সত্যি বড্ড কঠিন। আমার বয়ফ্রেণ্ডটিকে লিখছি দ্রুত সরবরাহ করতে। জীবন কি নরক সমতুল্য।
—তোমার, ফ্রেডি।

গত ফ্রেব্রুয়ারির তারিখ দেওয়া দেখছি। চিন্তিত গলায় পোয়ারো বলে। উনি যে ড্রাগ নেন তা অবশ্য প্রথমবার ওর দিকে তাকিয়েই আমি বুঝতে পেরেছিলাম।

সত্যি আশ্চর্য, আমি কখনও ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি। অবাক গলায় আমি বলি।

সেটা খুবই স্বাভাবিক। তুমি শুধু ওনার চোখ দেখতে, সৌন্দর্য উপভোগ করতে কিন্তু কোনদিনই ওনার মুড বোঝবার চেষ্টা করনি। কখনও সেটা প্রবলভাবে প্রাণোচ্ছল, আবার কখনও চরমভাবে প্রাণহীন, বিষাদগ্রস্থ। অবসন্নতায় আক্রান্ত। যা কখনও খুব স্বাভাবিক নয়।

মাদক গ্রহণ তো মরাল-সেন্সকে অ্যাটাক করে তাই না?

অবশ্যই, তবে মাদাম জোয়েল রাইস সেভাবে মাদকাগ্রস্থ নন। সবে হয়ত শুরু করেছেন।

আর নিক?

নাহ, মাদাম জোয়েলকে দেখে মনে হয় না উনি মাদকে অভ্যস্থ। হয়তো নেহাত মজা বা অ্যাডভেঞ্চারের জন্য মাঝে মাঝে ভোপ পার্টিতে যান। তবে, সেভাবে মাদক নেন না। আমি কথাটা শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, এবং মুখে সেটা প্রকাশও করে ফেললাম। যাক, বাঁচা গেল। পোয়ারো হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়, যাক, চল এবার মাদাম জোয়েলের-ঘরটা একটু খুঁজে দেখা যাক।নিকের ঘরে এসে হাজির হলাম আমরা। এই ঘরেও একটা বেশ বড়সড় ডেস্ক রয়েছে। তন্নতন্ন করে খুঁজেও সেখানে উইলটার চেহারা দেখা গেল না। শুধুমাত্র নিকের গাড়ির রেজিস্ট্রি সংক্রান্ত কাগজপত্র ছাড়া আর কোনওরকম গুরুত্বপূর্ণ কাগজই সেখানে পাওয়া গেল না।

পোয়ারো একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, এইসব অল্পবয়সী মেয়েরা, এদের ঠিকঠাকভাবে মানুষই করা হয়না বুঝলে হে। শৃঙ্খলা, গোছানো পদ্ধতি, এসব এদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। একটা ঘোট, চেষ্ট ড্রয়ার ঘাঁটাঘাঁটি করতে শুরু করে এরপর। ঠিকই চলছে। বেশ খানিকটা লজ্জিত ভাবেই তাকিয়ে থাকার পর, ওকে না বলে পারি না। পোয়ারো, কি হচ্ছে? মহিলাদের অন্তর্বাস রয়েছে দেখছ না ওখানে? নিজের কাজ চালিয়ে যেতে যেতে পোয়ারো ছোট্ট মন্তব্য করে, তাতে কি? আমি বিস্ময়ের গলায় প্রশ্ন করি, তুমি কি আশা করছ ওখানে……. হো হো করে প্রবল হাসির গমকে ফেটে পড়ে সে, হেস্টিংস, তুমি তখনও সেই ভিকটোরিয়ান যুগেই পড়ে রয়েছ। আরে আজকের আধুনিক যুবতীরা আর তাদের অন্তর্বাস নিয়ে লজ্জিত হয় না। তবুও আমার মনে হয় এটা আমরা পারি না।

না, বন্ধু, আমার মনে হয় না মাদাম জোয়েল নিক এসব ব্যাপারে খুব রক্ষণশীল। লুকোচুরি পছন্দ করেন না। তাহলে তো ড্রয়ারটাকে তিনি বন্ধ করেই রাখতেন। তাই না? পোয়ারোর যুক্তিগুলো আমাকে মোটেই কাবু করতে পারে না। বেশ দৃঢ় গলায় আমি প্রশ্ন করি, তবু এসবের কি প্রয়োজন আছে খুব?

এবার, এতক্ষণে পোয়ারো আমার দিকে ফিরে তাকায়, সে কথা যদি বল বন্ধু, কোথায়-কখন-কিভাবে যে প্রয়োজন তাকে কেউ বলতে পারে না। পোয়ারো এবার অন্তর্বাসের স্তূপের নীচ থেকে তার হাত বের করে আনে।

বাদামী একটা মোটা খাম, গোলাপী রিবন জড়িয়ে বাঁধা। সম্ভবত, মাইকেল সেটনের প্রেমপত্রের গোছা। শান্ত গলায় বলে সে। ততোধিক শান্তভঙ্গিতে সে গোছা খুলে ফেলে রিবনের বাঁধন থেকে, তারপর চিঠিগুলো বের করে পড়তে আমি আর্তচিৎকার করে উঠি স্ক্যানডালাইজড হয়ে গিয়ে। তুমি কিন্তু এটা কিছুতেই করতে পার না। খুব বেশি রকম বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। কোন ছেলেখেলা নয় মোটেই এটা।

আমি মোটেই ছেলেখেলা করছি না বন্ধু। আচমকাই ওর মন তীক্ষ্ণ, তীব্র হয়ে ওঠে। আমি একজন, খুনিকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।

হ্যাঁ, কিন্তু ব্যক্তিগত চিঠিপত্র……

এগুলো হয়ত কিছুই বলবে না, আবার হতে পারে অনেক কিছুই বলে দেবে। আমাকে সব প্রত্যেকটি সুযোগই নিতে হবে বন্ধু। এস, তোমাকেও চিঠিগুলো আমার সাথে পড়তে হবে। একজোড়া চোখের চেয়ে দুজোড়া চোখ অনেক বেশি কার্যকরী হতে পারে। যদিও ব্যাপারটা আমার একেবারেই পছন্দ হচ্ছিল না। যদিও, আমি বুঝতে পারছিলাম পোয়ারোর পক্ষে সব দিকগুলো, সম্ভাব্য সবকটি পথ হাতড়ে দেখাই উচিত, সঠিক কাজ। পোয়ারো আমাকে অবাক করে হঠাৎ বলে মনকে সান্ত্বনা দিতে চাইলে, ভেবে নাও, তোমার আমার অনেক আগেই নিশ্চিতভাবেই এলিন এগুলো সবকটাই পড়ে ফেলেছে। যদিও আমি মনের বিরুদ্ধে গিয়েও কাজটা করতে সান্ত্বনা খুঁজে নিলাম নিকের বলা কয়েকটা শব্দ, শেষ কথাগুলো, যা ইচ্ছে হয়, যেখানে খুশি খুঁজে দেখতে আপনারা যা ইচ্ছে করতে পারেন।

পোয়ারো ততক্ষণে একটা চিঠি খুলে পড়তে শুরু করেছে।

 নববর্ষ প্রিয়তমা,
শুভ নববর্ষ। আমার নতুন বছরের রিজিলিউশন একটা মিষ্টি ব্যাপার। তোমাকে আরও-আরও ভালোবাসা। আমার জীবনটাতে তুমি এসে একেবারে অন্য চেহারা দিয়েছ। প্রথম দর্শন থেকেই আমরা দুজনেই জানতাম–যা ঘটেছে সেটাই আমাদের জীবনের একমাত্র গন্তব্য ছিল। হ্যাপি নিউ ইয়ার, আমার মিষ্টি সোনা।
—তোমার চিরদিনের মাইকেল।

ফ্রেব্রুয়ারী ৪
 প্রিয়তমা,

আমাদের মধ্যে কি আরও ঘনঘন দেখা হতে পারে না? সত্যি বড় বিশ্রী ব্যাপার। এমন একটা ব্যস্ততার মধ্যে জড়িয়ে গিয়েছি। তোমাকে তো সব কথাই বলেছি। আবার আমাদের সম্পর্কটাকে নিয়েও এমন ছলনার আশ্রয় নিতে হচ্ছে। আমি জানি তুমি মিথ্যে এবং ছলনা কতটা ঘৃণা কর। আমিও করি। তবু এছাড়া কোন উপায় নেই। এই মুহূর্তে ম্যাথু কাকাকে সব কথা জানানোর অর্থই হচ্ছে পুরো দুধের গামলাটায় কয়েক ফোঁটা চোনা ফেলে দেওয়া। বিয়ে, নারী এসব উনি কতটা ঘৃণা করেন তুমি কল্পনাও করতে পার না।

মন খারাপ কর না সোনা। সব খুব তাড়াতাড়িই ঠিক হয়ে যাবে।
তোমার-তোমারই–মাইকেল।

 মার্চ–২
প্রিয়তমা,
আগামীকাল আবার স্কারবরোঘ. যাচ্ছি। সেই স্কারবরোঘ। আমার জীবনটাকে ভগবানের আশীর্বাদধন্য করে তুলেছে যে জায়গা। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর এই জায়গাটা তাই আমার কাছে। আজ সকালে উঠেই তাই তোমার কথা মনে পড়ল।

প্রিয়তমা, তুমি জান না, আমি তোমায় কতখানি–কতটা ভালবাসি।
—তোমারই মাইকেল।

এপ্রিল–১৮
প্রিয়তমা,
সব সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। নিশ্চিতভাবেই এই সময়টা সফলভাবে করে ফিরতে পারি (এবং আমি জানি সফল হয়েই ফিরব)। আমি ম্যাথু কাকার সঙ্গে কথা বলব। পুরো ব্যাপারটা ওনাকে জানাব। উনি যদি খুশি না হন, তোমাকে মেনে নিতে না পারেন, আমার তাহলে আর কিছু করার নেই। ওনাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেব আমি তোমাকে বিয়ে করছি। আশা করছি, এই বিশ্ব সফরটাতে সফল হলে অর্থনৈতিকভাবে আমাকে আর ওনার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না। সুতরাং, এসব ব্যাপার নিয়ে আর দুশ্চিন্তা কর না।

এদিকের আর সব খবর ভাল। আলবাট্রাস পুরোপুরি তৈরি। এবার শুধু আমার ওড়বার অপেক্ষা। আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না। ভগবানের কৃপায় সব ঠিকঠাক চলবে।

ভাল থেকো সুইটহার্ট
— তোমার–মাইকেল এপ্রিল ২০ প্রিয়তমা,

আমার দেবীপ্রতিমা, আমার পরী, গত চিঠির উত্তরে তুমি যা-যা বলেছ সবই সত্যি। এই চিঠিটা আমার জীবনের একটা সম্পদ হয়ে সযত্নে রক্ষিত থাকবে। আমি তোমার জন্যে অর্ধেকও উপযুক্ত নই। অন্য সবার থেকে তুমি এতো আলাদা, অন্যরকমের। আমি তোমাকে শ্রদ্ধাবশত ভালবাসি। আমার কাছে তুমি এক অতি মহার্ঘতম বস্তু।
—তোমার—মাইকেল

 শেষ চিঠিটা আশ্চর্যজনক ভাবে তারিখ বিহীন।

প্রিয়তমাসু,
আমি আগামীকাল উড়ছি। অত্যন্ত উৎসাহী এবং উত্তেজিত বোধ করছি। সাফল্য সম্বন্ধে অবশ্য পুরোপুরি নিশ্চিত। আলবাট্রাসও পুরোপুরি প্রস্তুত। আমি জানি সে আমাকে কোন ভাবেই হতাশ করবে না। চিয়ার আপ সুইটহার্ট। আর কোনরকম চিন্তা কর না। হ্যাঁ, ঝুঁকি তো এই কাজটাতে আছেই। কিন্তু জীবনের কোন ক্ষেত্রে ঝুঁকি নেই?

ভাল কথা, শুভানুধ্যায়ীরা অনেকে পরামর্শ দিল, আমার একটা উইল করে ফেলা উচিত। এরা খুবই বাস্তববাদী নিঃসন্দেহে। তবে এদের পরামর্শটা আমি গ্রহণ করেছি। ক্ষতি কি? ভাগ্যের কথা কে বলতে পারে? সুতরাং, আমি আধপাতার একটা নোট আমার আইনবিদ উইলফ্রেড অ্যান্ড কোম্পানী–তে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। গতকাল উইলটা তৈরি হয়ে এসেছে। কারও মুখে যেন একবার শুনেছিলাম, তিন শব্দের উইল–সব কিছু মায়ের। আমারটাও অনেকটা সেইরকম হয়েছে। তোমার ভাল নাম যে ম্যাগডালা, আমার খেয়াল আছে, চিন্তা কর না। আর হ্যাঁ, উইলকে জড়িয়ে সামান্য বিষাদময় প্রসঙ্গটায় মনে আঘাত পেও না, দুঃখবোধ কর না। করবে না তো, আমার সোনামনি? আমি ঠিক থাকব, ঠিক থাকব। অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতে পৌঁছে তোমাকে টেলিগ্রাম করব। তারপর থেকে যে-যে দেশে পৌঁছব সেখান থেকেও টেলিগ্রাম করব। ভাল থেকো। চিন্তা কর না আমাকে নিয়ে। দেখো, আমি ভালো থাকব। শুভরাত্রি। ভগবান তোমায় ভালো রাখুন —মাইকেল।

পোয়ারো চিঠিগুলোকে আবার ভাঁজ করে রাখে। দেখেছ হেস্টিংস। আমি চিঠিগুলোকে পড়লাম নিশ্চিত হয়ে আর তোমাকে যা বলেছিলাম তাই ঘটল।

তুমি কি সেরকম কোন সূত্র খুঁজে পেয়েছ?

না, না। সেরকমভাবে না হলেও, অন্যভাবে আমি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও প্রমাণ পেয়েছি।

অন্যভাবে? যেমন?

যেমন? যেমন আমরা জানতে পারলাম মাইকেল সেটন আমাদের মাদাম জোয়েলের নামে যে উইলটি করেছেন সেটা একেবারে আইনসিদ্ধ ভাবেই তৈরি করা হয়েছে। যদি অন্য আর কেউ এই চিঠিগুলো পড়ে থাকেন, তিনিও আমাদের মতোই নিশ্চিতভাবে সেই ব্যাপারটা জেনেছেন। আর যেভাবে অত্যন্ত দায়সারা, অসুরক্ষিত অবস্থায় চিঠিগুলো ফেলে রাখা, তাতে যে কেউই সহজে এগুলো পড়ে ফেলতে পারে।

এলিন? এলিন। প্রায় নিশ্চিতভাবে আমরা একটা ছোট পরীক্ষা করব পুরোপুরি নিশ্চিত হতে।

কিন্তু উইলটার তো কোন চিহ্নমাত্র দেখা গেল না? পোয়ারো মাথা নাড়ে। চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে, সেটাই তো আমাকে অবাক করছে। তবে, যতদূর মনে হচ্ছে, অন্যমনস্কভাবে উনি জিনিসটাকে কোন আলমারির মাথায় ছুঁড়ে দিয়েছেন, অথবা হয়ত কোন চিনামাটির ফুলদানির মধ্যে ঢুকিয়ে রেখেছেন। মাদাম জোয়েলের স্মৃতিকে উসকে দিয়ে তার মুখ থেকে উইলটার খোঁজ জানতে পারবে অপেক্ষায় থাকা ছাড়া, আপাতত এই ব্যাপারে কিছুই করবার নেই।

আমরা বাইরের ঘরে এসে দেখলাম এলিন ঘরের ধুলো ঝাড়ছে আসবাবের থেকে। পোয়ারো ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার ভান করে বিদায় জানায়। দরজার হাতল টেনে বের হয়ে যেতে গিয়েও ঘুরে দাঁড়িয়ে আচমকা সে বলে, এলিন, মিস বার্কলি যে বিমান অভিযাত্রী মাইকেল সেটনের বাগদত্তা ছিলেন, এ কথাটাতো বলনি আমাদের? এলিন বাঁকা চোখে তাকায়। কি? কাগজে যাকে নিয়ে খুব লেখালেখি হচ্ছে? আমি ব্যাপারটা একেবারেই জানতাম না। মিস নিকের বাগদত্তা, হে ভগবান।

বাড়ির বাইরে বের হয়ে এসে আমি বললাম, দারুণ অভিনয়। না জানবার, আকাশ থেকে পড়বার ভানটা খুব বিশ্বাসযোগ্য ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছ। হ্যাঁ, ব্যাপারটা তো একেবারে আসলের মতোই লাগল।

হয়ত ও সত্যি কথাই বলেছে।

হুম। আর ওই চিঠির তোড়া নামের পর মাস ওই অন্তর্বাসগুলোর নীচে অনাবিষ্কৃত থেকে গেছে।

তাহলে ঠিক কি দাঁড়াচ্ছে ব্যাপারটা? আমি নিজের মনকে প্রশ্ন করি। আমরা সবাই তো এরকুল পোয়ারো নই। আমরা অপরাধের জগৎ কে এগোবার ক্ষমতাধারী নই। আমরা অপরাধের গন্ধ শুঁকে এগোবার ক্ষমতাধারী নই। এই এলিন… এক রহস্যময় নারী।

পোয়ারো বলে, গভীর চিন্তান্বিত মুখে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলে, নাহ, আমার ব্যাপারটা একদম ভাল লাগছে না। একটা হেঁয়ালি যেন। কোথায় যেন কিছু একটা রয়েছে। যা কিছুতেই আমি বুঝতে পারছি না।এক হাত মুঠো করে সখেদে অন্য হাতের তালুতে ঘুষি মারে সে।

.

১৪.

হারিয়ে যাওয়া উইলের রহস্য

আমরা আবার ফিরে গেলাম সোজা নার্সিংহোমে। নিক যথারীতি বেশ অবাক হল আমাদের দেখে।

হ্যাঁ, মাদাম জোয়েল। নিকের সপ্রশ্ন কৌতূহলী দৃষ্টির উত্তর দিয়ে পোয়ারো বলে, আমি এখনও এই কেসের তলদেশটাতে পা রাখতে পারি নি। কিছু কৌতূহলের এখনও, কোন সদুত্তর খুঁজে পাইনি। নিক বার্কলির চোখের কৌতূহলী দৃষ্টি আরও ঘন হয়ে উঠল। সে যেন সুতীব্র দৃষ্টিতে পোয়ারোর মুখে কি খুঁজতে লাগল। সিরিয়াস কথাগুলো সেরে নিই। আমি এসেছি। আপনার সেই, বস্তুটি আমি খুঁজে পাইনি।

ওহ্,নিকের বাঁকা ভুরু এবার সহজ হয়, ওটা নিয়ে আর মাথা ঘামানোর প্রয়োজন আছে কি? আমি তো মরিনি। আর আমি যতদূর জানি, কোন মানুষ যতক্ষণ না মারা যাচ্ছে তার উইলের কোন দাম বা গুরুত্বই নেই।

যেটা ঠিকই। তবে আমার নিজস্ব একটা অন্য কৌতূহল আছে আপনার এই উইলের ব্যাপারে।

পোয়ারো থামে। এক ঝলকে নিকের মুখটা চকিতে নিরীক্ষণ করে নিয়ে আবার বলে, ভাল করে চিন্তা করুন উইলটাকে ঠিক কোথায় রেখেছেন। মনে করবার আন্তরিক চেষ্টা করুন মাদাম।

নাহ, সেরকম সঠিকভাবে কিছু মনে করতে পারছি না। তবে যতটা মনে করতে পারছি কোন একটা ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রেখেছিলাম ওটাকে।

আপনি কোনভাবেই কোন সিক্রেট প্যানেলে রাখেননি তো এটাকে?

সিক্রেট কি? চরম বিস্ময়ের গলায় প্রশ্ন করে নিক।

আপনার পরিচারিকা এলিন আমাকে বলেছে আপনার বাড়ির লাইব্রেরিতে একটা গোপন চেম্বার রয়েছে।

ননসেন্স। আমি কোন দিন এরকম কিছুর কথা শুনিওনি, দেখিওনি কখনও। এলিন আপনাদের এই আষাঢ়ে গল্পটা বলেছে?

আশ্চর্য তো? তাহলে হয়ত অল্পবয়সে সে যখন রান্না ঘরের পরিচারিকা হিসাবে এন্ড হাউসে কাজ করত সে সময় দেখে থাকবে। হয়ত, হতে পারে রাঁধুনিটিই ওকে সেসময় এটা দেখিয়েছিল।

এই প্রথম আমি ব্যাপারটা শুনছি। সেরকম কিছু যদি থাকত ঠাকুরদা নিশ্চয়ই জানতেন। আর সেক্ষেত্রে, তিনি আমাকে অবশ্যই বলতেন। নিশ্চিতভাবেই। মিঃ পোয়ারো আপনি নিশ্চিত এলিন এসব বানিয়ে বলছে না তো?

না মাদাম জোয়েল, আমি এ বিষয়ে একেবারেই নিশ্চিত নই। আপনার এই এলিনের মধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে। কিছু একটা অস্বাভাবিক…….. গণ্ডগোল……. কোথায় যেন…….. পোয়ারোর কথায় নিক কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বলে, আমার অবশ্য সেরকম কিছু কখনও মনে হয়নি। বেশ দায়িত্বশীলই মনে হয়েছে ওকে সবসময়।

পোয়ারোর সে কথা কানে গেল কিনা বুঝলাম না। হাতের পাতা উল্টে নখের দিকে তাকিয়ে এক মনে কি যেন চিন্তা করে যাচ্ছিল। হঠাৎ চোখ তোলে সে।

আচ্ছা মাদাম, আপনি ওকে বাগানে গিয়ে বাজি পোড়ানো দেখবার ছুটি দিয়েছিলেন?

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, প্রতিবারেই সবাইকে ছুটি দেওয়া হয়।

 তবু সেই রাতে বাজি পোড়ানো দেখতে বের হয় নি সে।

হ্যাঁ, অবশ্যই গিয়েছিল, নিক জোর গলায় দাবি করে।

 আপনি কি করে জানলেন মাদাম?

না, মানে ঠিক জানি না। প্রতিবছরই তো ওদের সবাইকে ছুটি দেওয়া হয়। ওরা বাইরে বাজি পোড়ানো দেখতে যায়। সেই হিসাবে বলছি। এবারও নিশ্চয়ই এসেছিল।

না, মাদাম জোয়েল। পোয়ারো মৃদু হেসে মাথা নাড়ে, বরং উল্টোটাই ঘটেছিল। এলিন বাড়ির ভেতরেই ছিল।

কিন্তু কেন? ভারি আশ্চর্য তো? নিকের গলায় বিস্ময়ের পরিবর্তে স্পষ্ট সংশয়।

মাদাম, আপনার এটা আশ্চর্য মনে হচ্ছে?

হ্যাঁ, অবশ্যই। আমি নিশ্চিত এর আগে কখনও সে এরকম করেনি।

সে কি বলেছে কেন বাইরে যায়নি?

নাহ, সেরকম কিছু নিশ্চিত ভাবে বলেনি। কাজ সারছিল–এইটুকুই।

আশ্চর্য। গোটা ব্যাপারটাই আমার কেমন যেন গোলমেলে লাগছে। আচ্ছা, লুকানো প্যানেলটা ঠিক কোথায় আছে ও আপনাদের দেখিয়েছে?

ও বলেছে এখন মনে করতে পারছে না।

 এরকম কিছু আছে, থাকতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি না।

ও এটাও বলেছে বাড়িটা নাকি বাস করবার পক্ষে ঠিক নয়। ওর অস্বস্তি হয় থাকতে।

নিমেষে নিকের মুখ-চোখ বদলে যায়। দু চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে। চোখের তারায় আতঙ্কের কালো ছায়া পড়ে, হ্যাঁ, এই কথাটা ও ভুল বলেনি। ইদানিং আমারও কেমন মেনে লাগত এই বাড়িটাতে থাকতে। মাঝে মাঝেই শরীর কেমন ছমছম করে উঠত। আর তাছাড়া………

মৃদু কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়ে শরীরে। পোয়ালরা ওকে কথা শেষ করতে না দিয়ে দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে।

মাদাম, আমরা মূল প্রসঙ্গ থেকে ক্রমশই সরে যাচ্ছি। উইল। ম্যাগি বার্কলির উইল। শেষ কোথায় আপনি দেখেছিলেন সেটাকে?

আমি ঠিক মনে করতে পারছি না। আসলে মিঃ ক্রফট বলেছিলেন উইল বানানোটা খুব কঠিন ব্যাপার। তাই আমি পরপর বেশ কয়কটা খসড়া করেছিলাম। নতুন খসড়া করা হলেই পুরনোটা নষ্ট করে ফেলতাম।

পোয়ারো কৌতূহলী গলায় বলে, মিঃ ক্রফট? তিনি উইলের ব্যাপারটা জানতেন?

হ্যাঁ, উনিই তো প্রথম ব্যাপারটা আমার মাথায় ঢোকান। উনি বলেছিলেন তুমি যদি সম্পত্তির ভাগ না করা অবস্থায় মারা যাও তাহলে সরকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেবে। তাই উনি আমাকে উইল করে রাখবার কথা বলেছিলেন।

বাহ্। বেশ উপকারী তো ভদ্রলোক পোয়ারো কথায় সায় দেয়।

হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে, উনি তো…….. আহ আমার মনে পড়েছে। উনি এলিন আর ওর স্বামীকে সাক্ষী হিসাবে সই করানোর জন্যেও নিয়ে এসেছিলেন।

কথাটা শোনামাত্র পোয়ারো অর্থপূর্ণ চোখে আমার দিকে তাকায়।

আহ-হ। সত্যি আমি একটা নির্বোধ। আমার মনে পড়েছে ওটা তো চার্লসের কাছে। রয়েছে।

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। মিঃ ক্রফট বলেছিলেন একজন আইনবিদই ব্যাপারটার সঠিক দায়িত্ব। নিতে পারবেন।

হুম। মিঃ ক্রফট অবশ্যই ঠিক কথাই বলেছিলেন।

সুতরাং, আমরা ওটাকে একটা খামে বন্ধ করে সোজা চার্লসের কাছে পাঠিয়ে দিই।

তাহলে এই ব্যাপার। পোয়ারো ঠাণ্ডা গলায় কেটে কেটে বলেন।

নিক বালিশে হেলান দিয়ে বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।আমি সত্যিই অত্যন্ত দুঃখিত। আসলে গত কয়েকদিন ধরে যা চলেছে, মাথা কাজ করছে না।

আপনি যদি সত্যিই ওটা দেখতে চান আপনাকে চার্লসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।

আপনার একটা লিখিত অনুমতিপত্র ছাড়া সেটা বোধহয় সম্ভব নয়।

 নিক বিস্ময়ের চরমে ওঠা গলায় বলে, আরে না না, তার কোন দরকার নেই।

না, মাদাম জোয়েল, আমার বিনীত অনুরোধ সব কিছুরই একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতি থাকে। সবারই সেটা মেনে চলা উচিত।

বেশ। নিক পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাশে মুখে মৃদু হাসে। বিছানার পাশ থেকে কাগজের প্যাড, কলম টেনে নেয়।

পোয়ারো চিঠিটা হাতে নিয়ে বের হবার উদ্যোগ করে। ধন্যবাদ। আমি সত্যিই ভীষণভাবে দুঃখিত। আপনাকে অনেক সমস্যায় ফেলেছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করুন। আমার একেবারেই মনে ছিল না। পোয়ারো মৃদু হাসে। ঘরের চারপাশে তাকিয়ে হাসি মুখেই বলে, বাহ, চমৎকার ফুলগুলো।

নিক উচ্ছ্বাসের গলায় বলে, চমৎকার, তাই না? এই কারনেশানগুলো ফ্রেডির পাঠান। গোলাপগুলো জর্জের, আর জিম লাজারুম পাঠিয়েছে লিলিগুলো।

একটু থেমে সে আরও বেশি উচ্ছ্বাসের গলায় বলে, তার এটা দেখুন না।

কাপড়ের ঢাকনা সরাতেই একটা বেতের ফলের টুকরি বের হয়। তাতে দুর্দান্ত পাকা, রসালো, কালো আঙুরের থোকা। নিমেষে পোয়ারোর মুখটা পরিবর্তিত হয়ে ওঠে। দ্রুত, ক্ষিপ্র পায়ে সে সামনে এগিয়ে যায়। আপনি কি এখান থেকে ফল খেয়েছেন?

পোয়ারোর তীব্র প্রতিক্রিয়ায় নিক একটু ঘাবড়ে যায়, না, এখনও পর্যন্ত খাইনি।

খাবেন না। মাদাম হাসপাতালের খাবার ছাড়া অন্য কিছু বাইরের কোন খাবার ভুল করেও মুখে তুলবেন না। বুঝেছেন?

পোয়ারোর প্রতিক্রিয়া দেখে নিকের মুখের বিবর্ণতা আরও প্রগাঢ় হল, বুঝেছি। আপনি মনে করছেন সব এখনও শেষ হয়ে যায়নি–না, শেষ হয়নি। তাই না? খুনি এখনও চেষ্টা করে যাবে–যাচ্ছে, তাই না? ফিস্ ফিস্ করে বলে সে।

পোয়ারো নিকের হাতদুটো নিজের হাতের মধ্যে তুলে নেয়। চেপে ধরে, ওসব নিয়ে একদম চিন্তা করবেন না। আপনি এখানে পুরোপুরি নিরাপদ। শুধু একটা কথা মনে রাখবেন, বাইরে থেকে আসা কোন জিনিস ছুঁয়েও দেখবেন না, খাবেন না, এমন কি কিছু ব্যবহারও করবেন না।

আমার ঘর ছেড়ে বের হয়ে আসবার পরও, বিছানার বালিশে হেলান দিয়ে এলিয়ে থাকা, মৃতবৎ নিকের ফ্যাকাশে মুখটা আমার চোখের সামনে ভাসছিল। পোয়ারো ঘড়ির দিকে তাকায়। চলো হে, তাড়াতাড়ি যেতে পারলে মিঃ ভ্যাইস দুপুরের খাবার খেতে বের হয়ে যাবার আগে ধরতে পারব।

আমাদের মিঃ ভ্যাইসের ঘরে পৌঁছে দেওয়া হল। উনি সাদরে আমাদের অভ্যর্থনা করলেন।

আসুন মিঃ পোয়ারো। বলুন আপনার জন্য কি করতে পারি?

পোয়ারো মৃদু হেসে নিকের চিঠিটা ওর হাতে তুলে দেয়। সেটা পড়বার পর মিঃ ভ্যাইস বিমূঢ় চোখে আমাদের দিকে তাকালেন।

মাফ করবেন, কিন্তু আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

 পোয়ারো ভুরু কুঁচকে তাকায়, চিঠিটা কি যথেষ্ট সহজ ভাষায় লেখা নয়?

এই চিঠিতে……. বিহ্বলভাবে ভ্যাইস বলে, আমাকে বলা হয়েছে ফেব্রুয়ারি মাসে নিক যে উইলটা আমায় করতে এবং গচ্ছিত রাখতে দিয়েছে, সেটা আপনার হাতে তুলে দিতে। চিঠিটার উপর আঙুল বোলাতে বোলাতে উনি বলেন।

হ্যাঁ, মঁসিয়ে।

 কিন্তু, মহাশয়, আমাকে তো কোন উইল করতে বা রাখতে দেওয়া হয়নি।

 মানে? পোয়ারোর দুচোখ এবার ছানাবড়া হয়ে যায়।

আমি যতদূর জানি, আমার তুতো বোন কোন উইল করে নি। আমি সেরকম কিছুই কখনও ওর জন্যে বানাইনি।

পোয়ারো কয়েক মুহূর্ত নিশব্দে বসে থাকে। বোধহয় বিস্ময়ের অভিঘাতটা সামলাতে। তারপর উঠে দাঁড়ায়, মিঃ ভ্যাইস, সেক্ষেত্রে আমার কিছু বলার নেই। কোথাও একটা ভুল হচ্ছে।

নিশ্চিত ভাবেই মিঃ পোয়ারো ভুল হচ্ছে একটা।

 ঠিক আছে। আজ তাহলে চলি। আবার দেখা হবে।

বাইরে বের হয়ে এসে আমি প্রথম কথা বলি, ব্যাপারটা কি হল? তোমার কি মনে হয়? লোকটা মিথ্যে বলল?

কিছু বলা যাচ্ছে না।

তাহলে? এখন আমাদের কর্তব্য?

খুব জটিল হয়ে উঠল। একমাত্র মিঃ ক্রফটই আমাদের এ ব্যাপারে আলো দেখাতে পারেন।

ওনার তো এখানে কোন লোভ করার ব্যাপার নেই?

না, না, আমি সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাপারটা দেখছি না। ভদ্রলোক বোধহয় প্রতিবেশীদের ব্যাপারে অহেতুক নাক গলানো, এবং গায়ে পড়ে তাদের সাহায্য করা ধরনের চরিত্রের মানুষ। কিছু লাভের আশায় কোন কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন না।

আমরা যখন মিঃ ক্রফটের বাড়ি গিয়ে পৌঁছলাম উনি রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিলেন। আমাদের দেখেই উনি নিকের বিষয়ে জানতে চাইলেন। সে ভাল আছে, পোয়ারো জানাল। ভদ্রলোক তাতে বেশ নিশ্চিন্ত হলেন মনে হল। কিন্তু মিঃ ক্রফট এতো কথা বলছিলেন, প্রশ্ন করছিলেন, যে পোয়ারো আমাদের এখানে আসবার আসল প্রসঙ্গটাই তুলতে পারছিল না। নিহত মেয়েটির ময়না তদন্ত হয়েছে কি? তার আত্মীয় পরিজনরা কখন এসে পৌঁছবেন? শেষকৃত্য কবে, কখন হবে? পুলিশ কি খুনের ব্যাপারে কোন সূত্র পেয়েছে? শেষ পর্যন্ত, সামান্য একটা বিরতি, ক্রফটের সামান্য থামার সুযোগে পোয়ারো প্রশ্নটাকে বলা ভাল একরকম ছুঁড়েই দেয়। এতক্ষণ যে কথাটা সে বলবার জন্যে প্রবল, অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল।

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, আমার স্পষ্টই মনে আছে। পোয়ারোর প্রশ্নের উত্তরে উনি বললেন।

আসলে, কিছুটা মজা করেই আমি ওনাকে বলেছিলাম, প্রশ্ন করেছিলাম, উনি কোন উইল করেছেন কিনা?

মিঃ ক্রফট একটু থামলেন, কিন্তু উনি ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নিয়ে নিলেন, সঙ্গে সঙ্গেই একটা উইল বানাবার কাজ শুরু করে দিলেন। আমি ওনাকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করি, ব্যাপারটা খুব সহজ কাজ নয়, অনেক ঝামেলা আছে। কিন্তু উনি বলেন কোন সমস্যা হবে না, ওনার এক তুতো ভাই উকিল। তিনিই সবকিছু করে দেবেন। সব ব্যবস্থা করবেন। পোয়ারো মাথা নেড়ে অনুমোদনের ভঙ্গিতে সায় দেয়, এবং তারপর? আমরা ওটা ডাক যোগে মিঃ ভ্যাইসকে পাঠিয়ে দিই। নিকের সেই তুতো ভাই উকিলকে।

আপনি নিশ্চিত, ওটা মিঃ ভ্যাইসকে পাঠান হয়েছিল? পোয়ারোর কথায় মিঃ ক্রফট ক্ষুণ্ণ গলায় বলেন, মিঃ পোয়ারো, আমি নিজের হাতে ডাকাযোগে ওটা মিঃ ভ্যাইসকে পাঠিয়েছিলাম।

কিন্তু মিঃ ভ্যাইস যে বলছেন তিনি ওটা আদৌ পাননি? মিঃ ক্রফট বিস্ময়ের চোখে তাকালেন। তার মানে? উনি কি বলতে চাইছেন? উইলটা ডাক পথে খোয়া গেছে? কিন্তু তা অসম্ভব নয় কি? পোয়ারো মাথা নাড়ে, যাইহোক, ব্যাপারটা আর এখন তত গুরুত্বপূর্ণ নয়। মাদাম জোয়েল মোটেই মারা যাচ্ছে না। কথাটা শেষ করে পোয়ারো উদ্দেশ্যপূর্ণ হাসে।

El Voila, আমরা বাড়ির বাইরে বের হয়ে আসবার পর পোয়ারো বলে। কে তাহলে মিথ্যে কথা বলছে? মিঃ ক্রফট? না মিঃ ভ্যাইস? সত্যি কথা বলতে কি আমি কিন্তু মিঃ ক্রফটের মিথ্যে কথা বলবার কোন কারণ দেখতে পাচ্ছি না। প্রথমত ওনার উইল থেকে কোন লাভই হবার নেই। দ্বিতীয় কথা, উইলটা বানাতে উনি সাহায্য করেছিলেন। আমার তো মনে হয়……

মি ক্রফটকে রান্না করতে দেখে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। আরও খুশি হয়েছিলাম যখন দেখলাম টেবিলে রাখা খবরের কাগজে উনি সেই হাত চেপে ধরলেন। ওনার অলক্ষ্যে আমি সেই কাগজের থেকে অংশটুকু ছিঁড়ে এনেছি। আমাদের প্রিয় বন্ধু ইন্সপেক্টর জাপের কাছে আজই আঙুলের ছাপটা পাঠিয়ে দিতে হবে। দেখা যাক উনি আমাদের কোন তথ্য দিতে পারেন কি না।

আমি বিস্ময়ে হতবাক চোখে পোয়ারোর দিকে তাকাতে সে হাসে, হেস্টিংস, আমাদের সেই ক্রফট ভদ্রলোক, একটু বাড়াবাড়ি রকম ভদ্রলোক। আর সেখানেই কেমন যেন একটা প্রবল খটকা। কোথায় যেন……..