২০. মিস জনসন, মিসেস মারকাডো, মিঃ রেইটার

২০. মিস জনসন, মিসেস মারকাডো, মিঃ রেইটার

আমি ভাবতেই পারিনি, সেই বেনামা চিঠিগুলোর সঙ্গে মিস জনসন জড়িয়ে পড়বে। সম্ভাব্য নাম মিসেস মারকাডো। কিন্তু মিস জনসনের মতো আত্মবিশ্বাসে ভরপুর, সমঝদার এবং খাঁটি মহিলা নয়। এ যেন অবিশ্বাস্য একটি নাম।

কিন্তু এ প্রসঙ্গে আজ সন্ধ্যায় পোয়ারো এবং ডঃ রেলির সন্দেহের কথা মনে পড়ে যেতেই নিজেকে আমি প্রশ্ন করি, কেন, কেন সে এ কাজ করতে গেল? মিস জনসন এই খুনের ব্যাপারে জড়িত, এক মুহূর্তের জন্যও সে কথা অস্বীকার করা যায় না, মিসেস লিডনারকে সে অপছন্দ করত, কেন? এমনও তো হতে পারে, মিসেস জনসনের প্রতি তার সেই বিরূপ মনোভাব তাকে এ কাজে প্রলোভিত করে থাকবে।

তবে মিসেস লিডনারের খুন হওয়ার পর তার মনে অনুশোচনা জেগে থাকবে, হ্যাঁ, ঠিক অনুশোচনা নয়, ভয় বলা যেতে পারে। সেই ভীতির কারণ দুটি প্রথমতঃ তার সেই নিষ্ঠুর চতুর খেলার জন্য দ্বিতীয়ত খুনের পর সে বুঝতে পারে, সেই চিঠিগুলো প্রকৃত খুনীর স্বপক্ষে একটা উল্লেখযোগ্য প্রমাণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই সে ওভাবে ভেঙ্গে পড়ে থাকবে হয়তো। কিন্তু এখনো আমি বিশ্বাস করি, তার মত কোমল নারী সচরাচর খুব কম দেখা যায়। এর প্রমাণ আমি তার কথায় প্রতিফলিত হতে দেখেছি। তা না হলে আমি যখন তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বললাম, যা ঘটার ঘটে গেছে, সে ভুলের সংশোধন আর হতে পারে না, কেন মিস জনসন সে কথায় আগ্রহ দেখাতে গেল?

এবং তারপরে নিজের যথার্থতা প্রমাণ করার জন্য তার সেই রহস্যময় উক্তি, তিনি কখনোই ভাল মহিলা ছিলেন না।

প্রশ্ন হল, আমার এখন কী করা উচিত? অনেক ভাবনা-চিন্তার পর আমি ঠিক করলাম, প্রথম সুযোগেই খবরটা দিতে হবে মিঃ পোয়ারোকে।

পরদিন তিনি আবার এলেন, কিন্তু বলার সুযোগ বলতে যা বোঝায়, মানে সেই গোপন পরিবেশটা আমি পেলাম না। সুযোগ এসেছিল মাত্র এক মিনিট, সেই এক মিনিট সময়ে যখন আমি ভাবছি, কি করে প্রসঙ্গটা শুরু করব ঠিক সেই সময় তিনি আমার কাছে এসে কানে কানে মন্ত্র দেওয়ার মতো করে বললেন।

মিস জনসন এবং আরও কয়েকজনের সঙ্গে আমি আলোচনা করব বসবার ঘরে সম্ভবত। আপনার কাছে মিসেস লিডনারের ঘরের চাবি আছে না?

হ্যাঁ, আছে বৈকি!

তাহলে মিস লিডনারের ঘরে ঢুকে অতি সন্তর্পনে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করবেন। তারপর কান্নার মতো করে চেঁচাবেন, তবে ঠিক আর্তচিৎকার নয়, আমি কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই। স্রেফ বাইরের লোকদের সতর্ক করে দেওয়া আর কি!

এরপর ওঁর সঙ্গে কথা আর এগোয়নি, কারণ মিস জনসনের হঠাৎ কোর্টইয়ার্ডে সেই সময় আবির্ভাব হবার জন্য।

আমি জানি, মিঃ পোয়ারোর উদ্দেশ্যটা কি। মিস জনসনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি বসবার ঘরে প্রবেশ করা মাত্র আমি মিসেস লিডনারের ঘরের তালা খুলে চকিতে ঢুকে পড়লাম। পিছন ফিরে একবার তাকালাম, না, কেউ আমাকে অনুসরণ করছে না।

বন্ধ ঘরের ভিতরে আমি একা। পোয়ারোর নির্দেশ মতো আমি মৃদু চিৎকার করে উঠলাম ওঃ! খুব জোরেও নয়, আবার খুব আস্তেও নয়। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম পা টিপেটিপে।

তবে অতো সাবধান হবার কোন দরকার ছিল না। পোয়ারো এবং মিস জনসন গভীর মনোযোগ দিয়ে দুজনে আলোচনা করছিল এবং কোন ব্যাঘাত ঘটল না তাদের সেই আলোচনায়। ঘরের ভিতরে গিয়ে তাদের আলোচনায় আমি ব্যাঘাত ঘটাতে চাইলাম না। বারান্দায় একটা খালি চেয়ারে বসলাম। সেখান থেকে তাদের কথাগুলো বেশ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল।

কেসটা অত্যন্ত জটিল, বুঝতে পারছেন, পোয়ারো তখন তাকে বোঝাচ্ছিলেন, ডঃ লিডনার নিশ্চয়ই তাঁর স্ত্রীকে আদরযত্ন করতেন–

তিনি তাকে পুজোও করতেন, জনসন তাকে কথাটা স্মরণ করিয়ে দেয়।

ডঃ লিডনার বলেছেন, তার কর্মচারীরাও খুব শ্রদ্ধাশীল ছিল তার স্ত্রীর প্রতি। খুবই স্বাভাবিক, প্রভুপত্নীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করাটাই ভদ্রতা। তাদের সেই ব্যবহারে হয়তো আন্তরিকতা থাকতে পারে, সততা থাকতে পারে। আবার নাও থাকতে পারে। মাদমোয়াজেল, আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, এই প্রহেলিকার চাবিকাঠি মিসেস লিডনারের চরিত্রে নিহিত আছে। তাই বলছি, আমি যদি এখানকার প্রতিটি সদস্যদের কাছ থেকে সৎ পরামর্শ পেতাম, তাহলে ওই ব্যাপারে একটা সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারতাম। সত্যি কথা বলতে কি এই কারণেই আজ আমি এখানে এসেছি। আর আমি এও জানি, ডঃ লিডনার এখন হাসানিয়েয় থাকবেন। ওঁর অনুপস্থিতিতে আপনাদের জিজ্ঞাসাবাদ করার কাজটা একটু সহজ হবে বলেই মনে হয়। আমি আপনাদের সাহায্য প্রার্থী।

ঠিক আছে, মিস জনসন বলতে গিয়ে চুপ করে যায়।

পোয়ারোর দৃষ্টি পড়েছিল তার উপরে। কি ভেবে তিনি বললেন–তবে আনুগত্যের খাতিরে সময় সময় অনেক অপ্রিয় কথা চেপে যেতে হয়। অপরাধ জগতে এই আনুগত্যের ভাবটা একটা মস্তবড় অপরাধ। সেটা বার বার সত্যকে গোপন করে।

এ ব্যাপারে আপনি নিঃসন্দেহে থাকতে পারেন,মিস জনসনের ঠোঁটে শুকনো হাসি, মিসেস লিডনারের প্রতি আমার কোন বিশেষ আনুগত্য নেই। মিসেস লিডনারের প্রসঙ্গে তার কথার মধ্যে কিসের একটা জ্বালা অনুভূত হয় যেন। ডঃ লিডনারের ব্যাপার আলাদা। যাইহোক, তিনি ছিলেন তার স্ত্রী।

তা অবশ্য ঠিক, তা অবশ্য ঠিক। আমি বেশ বুঝতে পারছি, আপনি আপনার চীফের স্ত্রীর বিরুদ্ধে কিছু বলতে চান না। কিন্তু এটা কোন সাক্ষ্য প্রমাণের প্রশ্ন নয়। এ প্রশ্ন হঠাৎ এবং রহস্যজনক একটি মৃত্যুকে ঘিরে। মিসেস লিডনার ছিলেন দেবদূত, নিহত হয়ে আজ তিনি শহীদ হয়েছেন, আমার এই বিশ্বাস তবু কাজটা খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না।

আমি অবশ্যই তাকে দেবদূত আখ্যায় ভূষিত করব না। মিস জনসনের কথায় আগের থেকে বেশি উত্মা প্রকাশ হতে দেখা যায়।

একজন নারী হিসাবে লিডনারের সম্বন্ধে আপনার মতামত কী পরিষ্কার করে বলুন তো?

হুঁ বলছি। তবে শুরুতেই আপনাকে বলে রাখি আঁসিয়ে পোয়ারো, আমি পক্ষপাত দুষ্ট। আমি, শুধু আমি কেন বলছি, আমরা সবাই ডঃ লিডনারের এখানে আসায় শুরুতে আমরা ঈর্ষান্বিত ছিলাম তার প্রতি। আমরা চাইতাম না বাড়তি সময় খরচ করুন, আদর যত্ন করুক। মিসেস লিডনারের এখানে আসাতে আমরা বিরক্তবোধ করেছিলাম। তবে এ কথা ঠিক যে, মিস জনসন তার কথার জের টেনে বলে–আমার মনের ভাবটা আমি কখনো বাইরে প্রকাশ করতাম না। অন্য সবার থেকে আমাদের তফাত হল এইখানে, বুঝলেন?

আমাদের? আমাদের কেন বলছেন আপনি?

মিঃ ক্যারি এবং আমি। কারণ কি জানেন, দুজনই কেবল বহুদিনের পুরনো কর্মচারী এখানকার। তাই আমরা কোন পরিবর্তন বরদাস্ত করতে পারতাম না। সেটাই তো স্বাভাবিক, কি বলেন মঁসিয়ে পোয়ারো?

কেন, পরিবর্তনটা কিসের বলুন তো?

ওঃ! পরিবর্তন তো সবেতেই। আগে আমরা এখানে কতই না সুখে ছিলাম। ডঃ লিডনার খুব আমুদে লোক ছিলেন, তাঁকে নিয়ে আমরা কতই না ঠাট্টা তামাশা করতাম। আমাদের সঙ্গে মিশতে গিয়ে তিনি একেবারে বাচ্চা ছেলে হয়ে যেতেন।

আর মিসেস লিডনার আসার পর তিনি বদলে যান, এই তো?

সে যাইহোক আমি কিন্তু মনে করি না, এর জন্য মিসেস লিডনার দায়ী। বিশ্বাস করুন মঁসিয়ে পোয়ারো, গত বছরটা আমাদের খুব একটা খারাপ যায়নি, আর আমাদের বিরক্তিকর কোন কাজ তিনি করেননি। আমার কাছে তিনি সব সময় চমৎকার মহিলা বলেই মনে হত। তাঁর মতো অমন ভাল মহিলা কেউ আর হতে পারে না।

সে যাইহোক– পোয়ারো স্মরণ করিয়ে দেন, পরিবর্তনটা কিন্তু এ বছরই লক্ষ্য করা যায়। আবহাওয়াটা কেমন বদলে যায় এখানকার তাই না?

হ্যাঁ, সত্যি সম্পূর্ণ আবহাওয়াটাই কেমন বদলে যায়। মিস জনসন ভাবতে থাকে, কেন, কেন এই পরিবর্তন? সবেতেই কেমন ভুল-ভ্রান্তি, অবশ্য তাদের কাজকর্মে নয়। ভুল-ভ্রান্তি তাদের মেজাজে, তাদের স্বভাবে।

আর তার জন্য সব দোষ আপনারা চাপাতে চান মিসেস লিডনারের ঘাড়ে?

 তিনি এখানে আসার আগে তেমনটি তো ছিল না? পাল্টা প্রশ্ন করে তাকালো মিস জনসন।

আমার প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এখনো পেলাম না। পোয়ারো তাকে মনে করিয়ে দেয়, মিসেস লিডনারের স্বভাব-চরিত্র কিম্বা তার মেজাজ সম্বন্ধে আপনার কি মতামত তা তো জানালেন না?

মিস জনসন পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে একবার নিরীক্ষণ করে নিল পোয়ারোকে, সেই ফাঁকে হয়তো ভেবে নিল তার বক্তব্য। তারপর ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল সে, হ্যাঁ, দারুণ মেজাজী ছিলেন তিনি। এই রোদ, এই বৃষ্টি যেন। আজ যার সঙ্গে খুব মেজাজে কথা বলছেন, কালই দেখাচ্ছেন তাকে রুক্ষ মেজাজ। তবু বলব, মানুষ হিসাবে ভাল ছিলেন তিনি, আমার অন্তত তাই মনে হয়। তবে অন্যদের কাছে তিনি ছিলেন বহু বিতর্কিত মহিলা। এক এক সময় আমার মনে হয়েছে, তিনি তার সারাজীবনটা নষ্ট করে ফেলেছেন। তবে একটা ব্যাপারে আমি তাকে কিছুতেই সমর্থন করতে পারি না। তার স্বামী ডঃ লিডনার অমন বিখ্যাত একজন মানুষ, অথচ তার প্রশংসা করা দূরে থাক, কচ্চিৎ ভুলেও কখনো তার নাম উল্লেখ করতে শুনিনি ভদ্রমহিলার মুখে। এই ব্যাপারটা আমাকে মাঝে মাঝে আজও ভীষণ পীড়া দেয়। অবশ্য তাকে আমি লক্ষ্য করেছি, সব সময় তিনি কেমন চিন্তিত, বুঝি বা ভীতগ্রস্থ। স্নায়ুরোগে ভুগছিলেন তিনি ইদানীং। তার দেখাশোনার জন্য নার্স লিথেরানকে আনার জন্য ধন্যবাদ ডঃ লিডনারকে।

ভালো কথা, পোয়ারো জিজ্ঞেস করলেন, তার পাওয়া সেই বেনামা চিঠিগুলোর ব্যাপারে আপনার কী অভিমত?

বারান্দা থেকে মিস জনসনের মুখ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। পোয়ারোর প্রশ্ন শুনে তার মুখের প্রোফাইল কেমন বদলে যেতে দেখলাম। পোয়ারোর পিঙ্গল চোখের দৃষ্টি পলকের জন্য মিস জনসনের মুখের উপরে নিবদ্ধ হল। সে মুখে এখন একটা ধূসর পান্ডুর ছায়া। দু’চোখের গভীরে পুঞ্জীভূত ভয় ও হতাশা।

আমার মনে হয় আমেরিকায় তার উপরে কোন লোকের আক্রোশ আছে, এবং সেই লোকই সেখান থেকে তাকে চিঠিতে ভয় দেখাচ্ছে, কিম্বা তাকে বিরক্ত করছে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ, আমার তাই ধারণা। শুনেছেন তো ভদ্রমহিলা খুব সুন্দরী ছিলেন। সুন্দরী মেয়েদের অনেক শত্রু থাকাটা স্বাভাবিক। আমার মনে হয়, সেই চিঠিগুলো কোন মহিলা লিখে থাকবে। মিসেস লিডনার ছিলেন একটু ভীতু সম্প্রদায়ের–তাই সেই চিঠিগুলো পেয়ে তিনি দারুণ ভয় পেয়ে যান, নার্ভাস হয়ে পড়েন।

সব মানলাম, থেমে থেমে পোয়ারো তাঁর কথাটার শেষ প্রশ্ন করলেন–কিন্তু মনে রাখবেন মাদমোয়াজেল শেষ চিঠিটা ডাকে আসেনি, প্রেরক নিজের হাতে কিম্বা তার দূত মারফত তার ঘরে ফেলে গিয়ে থাকবে সেটা।

মেয়েরা তাদের আক্রোশ চরিতার্থ করার জন্য সবরকম বিপদের ঝুঁকি নিতে পিছপা হয় না।

হ্যাঁ, তারা সব পারে, কথাটা আমিও ভেবেছি বৈকি।

হয়তো আপনার কথাই ঠিক মাদমোয়াজেল। আপনার কথা মতো সুন্দরী মিসেস লিডনারের শত্রু থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। পোয়ারো এখানে একটু থেমে আবার বললেন, ভাল কথা, মিস রেলিকে আপনি চেনেন? ডঃ রেলির কন্যা?

শীলা রেলির কথা বলছেন! হ্যাঁ, চিনি বৈকি!

পোয়ারো চালাকি করে একটা বেশ রসালো গল্পের অবতারণা করল।

আমি একটা গুজব শুনেছি (স্বাভাবিক কারণেই ডঃ রেলিকে জিজ্ঞেস করতে পারিনি), ডঃ লিডনারের একজন কর্মচারীর সঙ্গে মিস রেলির নাকি অন্তরঙ্গতা আছে। কথাটা কী সত্যি? আপনার কী মনে হয় মিস জনসন?

ওহো, এই কথা? মিস জনসন হাসতে হাসতে বলেন–তা কোলম্যান এবং ডেভিড এমোট দু’জনেই শীলার নাচের সঙ্গী। আমার মনে হয়, তাদের দু’জনের মধ্যে কে শীলার জীবনসঙ্গী হবে, এ নিয়ে তাদের মধ্যে মন কষাকষি হতে পারে, তবে এ ব্যাপারে শীলার কোন ভূমিকা নেই, কোন আগ্রহ নেই। তাছাড়া আর একটা কথা বলে রাখি, বিমান বাহিনীর কর্মচারীদের নাচের আসরে অনেক যুবক কর্মচারীর নাচের সঙ্গিনী হয়ে থাকে শীলা।

অতএব আপনি বলতে চাইছেন, সেরকম কিছু ঘটেনি শীলার জীবনে। গুজবটা সত্যি সত্যি গুজবই বটে!

না, আমি ঠিক সে কথা বলতে চাইছি না। মিস জনসনকে এবার একটু যেন চিন্তিত বলে মনে হল। এ কথা ঠিক যে, মেয়েটি প্রায়ই বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়। প্রকৃতপক্ষে মিসেস লিডনার একদিন কথার ছলে ডেভিড এমাটকে ঠাট্টা করে বলছিলেন, তোমার পিছনে পিছনে মেয়েরা কেন ছুটে বেড়ায় বল তো! আমার মনে হয় না, কথাটা ডেভিডের পছন্দ হয়েছিল। সত্যি কথা বলতে এ ধরনের পরনিন্দা-পরচর্চা কারই বা ভাল লাগে বলুন? হ্যাঁ, শীলাও তাতে কান দেয়নি। দুর্ঘটনার দিন অপরাহ্নে আমি তাকে ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে দেখেছি। মিস জনসন খোলা জানালা পথে দৃষ্টি প্রসারিত করে বলতে থাকে তবে ডেভিড, এমাট কিম্বা কোলম্যান, কেউই সেদিন তাদের কাজে যায়নি। রিচার্ড ক্যারি ছিল ইনচার্জ। হ্যাঁ, সম্ভবতঃ এদেরই মধ্যে একজন তার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে থাকবে। তবে তাদের মধ্যে কে, কে তাকে পছন্দ করত, সেটা আমি বলতে পারব না। বিল ছেলেটি চমৎকার, যে যতই বোকা হওয়ার ভান করুক না কেন, আসলে তার মত চালাক ছেলে খুব কম আছে। শান্ত প্রকৃতির ডেভিড এমাটের মধ্যে গভীরতা আছে।

তারপর সে কৌতূহলী চোখ নিয়ে পোয়ারোর দিকে তাকাল, কিন্তু এটা কী কোন অপরাধের তালিকায় পড়ে মঁসিয়ে পোয়ারো?

আপনি আমাকে লজ্জায় ফেলে দিলেন মাদমোয়াজেল, ফরাসী কায়দায় হাত নেড়ে পোয়ারো বলেন যুবক-যুবতীদের প্রেমের ক্ষেত্রে আমি অত্যন্ত আগ্রহী। আমার পূর্ণ সমর্থন আছে তাদের উপরে।

বড় বিচিত্র চরিত্রের মেয়ে এই শীলা রেলি,মিস জনসন আরো বলে–কাঁচা বয়স, তবে বেসামাল নয় অবশ্যই।

পোয়ারো উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন–আপনাদের স্টাফদের মধ্যে আর কোন সদস্য বাকি আছে?

মেরী মারকাডোকে দেখতে পাচ্ছি না। বোধহয় খনন কার্য দেখতে গেছেন। সবাই তখন এখানেই আছে। মিস জনসন কথা বলতে বলতে বাইরে বারান্দায় বেরিয়ে আসে, আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে সে বলে নার্স লিথেরান আপনাকে সেখানে নিয়ে যেতে আপত্তি করবেন না বলেই আমার মনে হয়।

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই মিস জনসন, আমি তাকে আশ্বস্ত করতে বললাম আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, তারপর পোয়ারোর দিকে ফিরে বললাম, মিসেস মারকাডো এখন ছাদে আছেন। আপনি কী প্রথমে তার সঙ্গে দেখা করতে চান?

হ্যাঁ, সেই ভাল–চলুন উপরে যাওয়া যাক।

 সিঁড়ি পথে উঠতে গিয়ে পোয়ারোকে আমি বললাম, আপনার কথা মতো, আমি তো কাজ করলাম। তা আপনি আমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিলেন?

না–কোন শব্দই কানে আসেনি।

মিস জনসনকে তাহলে নতুন করে তার জবানবন্দীর কথা আবার ভেবে দেখতে হবে।

পোয়ারো আমার কথাগুলো খুব মনযোগ সহকারে শুনলেন কিন্তু হা-না কিছুই বললেন না।

প্যারাপেটের উপরে বসেছিলেন মিসেস মারকাডো। নিচের দিকে মুখ, গভীর চিন্তায় এমনি মগ্ন যে পোয়ারো তার সামনে গিয়ে সুপ্রভাত না জানানো পর্যন্ত তার হুঁশ ছিল না। তাকে খুব অসুস্থ বলে মনে হচ্ছিল। চোখের কোলে গভীর কালো আস্তরণ, বিমর্ষ মুখ।

আমি একটা বিশেষ কাজ নিয়ে এখানে এসেছি, বলে পোয়ারো অতঃপর কাজের প্রসঙ্গে চলে গেলেন কোন ভূমিকা না করে। সেই একই প্রশ্ন যা তিনি একটু আগে মিস জনসনের সামনে রেখেছিলেন। অর্থাৎ মিসেস লিডনার সম্বন্ধে প্রকৃত তথ্য তিনি জানতে ভীষণ আগ্রহী।

আমি বেশ ভাল করেই জানতাম যে, মিস জনসনের মতো সত্য কথা কিছুতেই বলতে পারে না মিসেস মারকাডো! মুখে একরকম আর কাজে আর একরকম। মুখে তিনি অবশ্য মিসেস লিডনার সম্বন্ধে ভূয়সী প্রশংসা করলেন পোয়ারোর কাছে, কিন্তু আমি হাল্কা করে বলতে পারি যে, মনে মনে তিনি অকথ্য ভাষায় তার নিন্দা করতে কসুর করেন না।

ওঃ আমাদের প্রিয় লুসি। যারা তাঁকে চাক্ষুস করেনি, কিম্বা তার সংস্পর্শে আসেনি, আমি মনে করি তাদের কাছে তার গুণাবলির ব্যাপারে যত কিছুই বলি না কেন, তবু যেন আক্ষেপ থেকে যায়, হায় কিছুই বুঝি বলা হল না আমার। তার মতো অমন দরদী, পরোপকারী মিষ্টি মহিলা আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি। প্রত্নতত্ত্বের ব্যাপারে তার কোন জ্ঞান না থাকলেও, অবাক লাগে সে ব্যাপারে তার সেই অদম্য কৌতূহলের কথা ভাবতে। হ্যাঁ, শুধু এই জন্যই বোধহয় আমরা তার ব্যবহারে সবাই প্রীত ও মুগ্ধ।

ম্যাডাম, তাহলে আমি যা শুনেছি সত্যি নয়? এখানে কিছুদিন আগে যে একটা খারাপ আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, সত্যি নয়?

মিসেস মারকাডো বড় বড় চোখ করে তাকালেন, কে, কে এ কথা বলেছে? নার্স? না কি ডঃ লিডনার? বেচারা ডক্টর! আমার মনে হয় না, আজকাল তিনি ঠিক দেখার মতো করে দেখেন না।

মিসেস মারকাডোর কথায় অবজ্ঞার ভাব। জানেন মঁসিয়ে পোয়ারো, মিসেস লিডনারের মৃত্যুর পর এখন এখানকার সবাই ভান করতে চাইছে, তারা বুঝি অনেক কিছু জানে, কিন্তু আসলে তারা কিছুই জানে না। তারা অনেক ঘটনার কথা বলে, যা আদৌ ঘটেনি। জানেন, অস্বাভাবিক আবহাওয়া, উত্তেজনা, এ সব কী ঘটছে আসলে? না, আমার তা মনে হয় না। এসব হল লোকের গল্প কথা।

তারা অনেক ঘটনার কথা বলে, এর মানে আপনি কী বলতে চান ম্যাডাম? পোয়ারো জিজ্ঞাসা করলেন।

ওসব বাজে কথা ছেড়ে দিন। ওদের কথার মধ্যে বাস্তবতার বড় অভাব। এখানে আমরা সুখী পরিবার ছিলাম।

মিসেস লিডনারের উপর আমার দারুণ ঘৃণা হচ্ছিল। এক্সপিডিসন হাউস থেকে বেরিয়ে এসে পথে পোয়ারোকে বললাম, ওই মহিলার মত ডাহা মিথ্যুক আমি এর আগে কখনো দেখিনি। আমার দৃঢ় ধারণা, সত্যি সত্যি মিসেস লিডনারকে তিনি ঘৃণা করতেন। যাইহোক, ওঁর কথা ছেড়ে দিন। সত্যি কথা ওঁর কাছ থেকে আশা করা বৃথা। মিথ্যে সময় নষ্ট।

তা ঠিক। তা ঠিক। তবে বারবার তিনি মুখে মিথ্যে কথা বললেও একদিন না একদিন তাঁর চোখের তারায় সত্যের ছবি প্রতিবিম্বিত হবে। আচ্ছা তার অতো ভয় কিসের জন্য? ছোট-ম্যাডাম–মারকাডোর জন্য? পোয়ারো তার ধারণার কথা বললেন–আমি তার চোখে ভয়ের ছায়া দেখতে পেয়েছি। হ্যাঁ, তিনি নিশ্চয়ই কোন কিছুর ভয়ে আতঙ্কগ্রস্থ। দারুণ কৌতূহলের ব্যাপার এটা।

আমার না বলা কথাগুলি আমাকে বারবার তাগিদ দিচ্ছিল, সব না বলতে পারলেও কিছু অন্তত বলব। শেষপর্যন্ত বলেই ফেললাম,–মঁসিয়ে পোয়ারো?

কিছু বলবেন আমাকে?

 হ্যাঁ, আপনাকে আমার কিছু বলার ছিল।

তারপর আমি আগের দিনের ঘটনার কথা সব খুলে বললাম। আর এও বললাম যে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সেই সব বেনামা চিঠিগুলোর লেখিকা হলেন মিস জনসন।

মিস জনসন মিথ্যুক। আমি তাকে বললাম, আজ সকালে ঠাণ্ডা মাথায় তিনি আপনাকে যেমন গুছিয়ে মিথ্যে কথাগুলো বলে গেলেন, একটার পর একটা।

হ্যাঁ, যথেষ্ট কৌতূহল আছে তার কথার মধ্যে, পোয়ারো আমার কথা সমর্থন করে বলেন, তবে এমনও হতে পারে, গতকাল ডঃ লিডনার তাকে চিঠিগুলোর কথা বলাটা স্বাভাবিক, কারণ তারা পরস্পর দুজনের অনেকদিনের বন্ধু। আর তা যদি না হয়, তাহলে ভাববার কথা। মিস জনসন জানলেন কী করে চিঠিগুলোর কথা?

পোয়ারো কৌশলে যে ভাবে চিঠিগুলোর কথা উত্থাপন করলেন, তাতে তার উপরে আমার আরও শ্রদ্ধা বেড়ে গেল।

মাটি খোঁড়ার কাজে ব্যস্ত ছিল সবাই তখন। ঘটনাস্থলে পৌঁছে প্রথমেই দেখা হল মিঃ রেইটারের সঙ্গে, দেওয়ালের ছবি তুলছিলেন তিনি তখন। ছবি নেওয়ার পর রেইটার তার ক্যামেরা এবং প্লেট সহ বয়ের হাতে তুলে দেন। ছবি তোলার ব্যাপারে তাকে কতকগুলো প্রশ্ন করলেন পোয়ারো। উত্তরগুলো যে তৈরি ছিল, চটপট জবাব দিলেন তিনি। তার কাজের সম্বন্ধে প্রশ্ন করাতে তাকে যেন একটু খুশি বলে মনে হল।

মিঃ রেইটার দুঃখ প্রকাশ করলেন আমাদের তিনি বেশিক্ষণ সঙ্গ দিতে পারছেন না বলে। তারই মাঝে পোয়ারো থেমে থেকে টুকরো টুকরো কয়েকটা কথা বললেন বিক্ষিপ্তভাবে। এ ধরনের কথা বলা পোয়ারোর একটা কৌশল। সরাসরি প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার আগে অন্য কথার মাধ্যমে লোকটাকে বাজিয়ে নেন একবার। যাইহোক, শেষপর্যন্ত কাজের কথাটা তিনি বলেই ফেললেন।

বুঝেছি, বুঝেছি আপনি কি বলতে চাইছেন, মিঃ রেইটার ব্যস্ততার মধ্যেও প্রয়োজনীয় উত্তরটা ঠিক ঠিক দেবার চেষ্টা করে বললেন,–কিন্তু আমার তো মনে হয় না, আপনার কোন সাহায্যে আমি আসতে পারি। সত্যি কথা বলতে কি, কেবল এ বছরই আমি এখানে এসেছি। তাছাড়া মিসেস লিডনারের সঙ্গে বড় একটা কথাবার্তা আমার তখনও হত না। তাই আমি অত্যন্ত দুঃখিত মঁসিয়ে পোয়ারো, এ ব্যাপারে আমি আপনাকে কিছুই বলতে পারছি না।

বেশ তো, পোয়ারো শান্তস্বরে বলেন–আপনি তাকে পছন্দ করতেন কি করতেন না, এর জবাব তো আপনি দিতে পারেন, কেন পারেন না?

মিঃ রেইটারের মুখটা হঠাৎ কেমন লাল হয়ে গেল, কথায় জড়তা প্রকাশ পেল। ও হ্যাঁ, লোককে আকর্ষণ করার মতো বিশেষ গুণ তার অবশ্যই ছিল, এবং বুদ্ধিমতী ছিলেন।

আপনি তাকে পছন্দ করতেন? আর তিনি আপনাকে পছন্দ করতেন?

তখনও লাল দেখাচ্ছিল রেইটারের মুখ।

আ-আমি সেটা লক্ষ্য করিনি। দু’একবার আমি তার সান্নিধ্যে আসার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, আমার আড়ষ্টতা আমাকে তার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। আমার এই জড়তাই বলুন কিম্বা আড়ষ্টতাই বলুন, এর জন্য আমি তার বিরক্তির কারণ নিশ্চয়ই হয়েছিলাম। কিন্তু আজ অকপটে স্বীকার করছি, সেটা আমার ইচ্ছাকৃত ছিল না।

পোয়ারো তার কথায় করুণাবোধ করলেন।

 ঠিক তা ঠিক। এবার অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। আচ্ছা, এখানকার আবহাওয়ার কী তেমন সুখপ্রদ ছিল?

অনুগ্রহ করে–

আর একটা প্রশ্ন করব, অতঃপর পোয়ারো জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা সবাই এখানে সুখে-শান্তিতে ছিলেন তো? মানে আপনারা সবাই প্রাণ খুলে হাসতে পারতেন, কথা বলতে পারতেন তো?

না, না, ঠিক তা নয়। একটু অসুবিধা ছিল– রেইটার এখানে একটু থেমে নিজের মনের সঙ্গে বোঝাঁপড়ার চেষ্টা করলেন বোধহয়। তারপর আবার মুখ খুললেন, দেখুন আমি খুব একটা মিশুকে নই। কেমন একটা সংকোচবোধ সব সময় আমাকে ঘিরে রাখে। ডঃ লিডনার আমার প্রতি সদাশয় সব সময়। অথচ আমি কি বোকা দেখুন, আমার এই জড়তা কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারি না। সব সময় কেমন ভুল হয়ে যায়। এ আমার দুর্ভাগ্য।

সত্যি সত্যি তাকে কেমন অসহায় শিশুর মতোন দেখাচ্ছিল।

আমরা সবাই ছেলেবেলায় এরকম করে থাকি, পোয়ারো হাসতে হাসতে বললেন পরে নিজেকে বিচার করে থাকি। তারপর বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে পোয়ারো স্থান ত্যাগ করলেন ধীরে ধীরে।

হয় নোকটা অত্যন্ত সরল প্রকৃতির মানুষ, পোয়ারো মন্তব্য করলেন ফিরে আসার পথে, নয় তত তিনি একজন অভিজ্ঞ অভিনেতা। তাই না?

আমি কোন উত্তর দিলাম না। তার কারণ আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এ ধরনের মানুষ দারুণ বিপজ্জনক হয়ে থাকে, এরা ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে পিছপা হয় না। তবে যে কারণেই হোক, এমন সুন্দর সূর্যস্নাত প্রভাতে সেটা অসম্ভব বলেই মনে হল আমার কাছে।

.

২১.

মিঃ মারকাডো এবং রিচার্ড ক্যারি

দেখছি ওঁরা দুজন আলাদা আলাদা জায়গায় কাজ করেন। এক জায়গায় একটু থেমে, কথাটা বললেন পোয়ারো।

ঝুড়ি মাথায় শ্রমিকরা মাটির নিচ থেকে উঠে আসছিল সারিবদ্ধ ভাবে, কণ্ঠে তাদের কোরাস গান, ভাষা আরবি। তেমনি দল বেঁধে কিছু শ্রমিক ঝুড়ি মাথায় ফিরে যাচ্ছিল মাটির নিচে। টুকরো টুকরো মৃত্তিকার বাসনপত্র হলেও ডঃ লিডনার বেশ আগ্রহ নিয়েই সেগুলো মাটি খুঁড়ে তুলে আনার ব্যবস্থা করছিলেন।

চলুন, ওখানে যাওয়া যাক, পোয়ারোর আগ্রহও কম নয়।

সূর্যের তাপ বাড়ছিল, আমাদের চলার গতি তাই শ্লথ হল।

দূর থেকে মিঃ মারকাড়োকে একজন ফোরম্যানের সঙ্গে আলাপরত দেখা গেল। ফোরম্যানের পরনে টুইড কোট, ডোরাকাটা মূর্তির গাউন, কচ্ছপের মতো কতকটা।

সরু পিচ্ছিল মেটো পথ। তবু শ্রমিকরা কেমন অনায়াসে বুড়ি মাথায় ওঠা-নামা করছিল। দূর থেকে তাদের ঝুলন্ত বাদুড়ের মতো দেখাচ্ছিল। কিন্তু আমাদের পক্ষে সেই পথে নামাটা বেশ কষ্টসাধ্য বলে মনে হল।

পোয়ারোকে অনুসরণ করছিলাম হঠাৎ তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্নটা আমার দিকে ছুঁড়ে দিলেন, আচ্ছা মিঃ মারকাডো ন্যাটা নাকি আর পাঁচজনের মতো ডান হাতেই সব কাজ করেন?

এ যেন এক অদ্ভুত ধরনের প্রশ্ন। বাজে কথা বলার লোক নন পোয়ারো। তাই অনেক ভাবনা-চিন্তার পর নিশ্চিন্ত হয়ে বললাম, ডান হাতই ব্যবহার করে থাকেন উনি।

মিঃ পোয়ারো প্রত্নতত্ত্বের ব্যাপারে বেশ আগ্রহ দেখালেন, কিন্তু আমি হলপ করে বলতে পারি, বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তার এ ব্যাপারে। তবে মিঃ মারকাডো সঙ্গে সঙ্গে তার প্রশ্নের জবাব দিয়ে যেতে থাকলেন।

তারপর নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ে মাটির একটা পাত্র থেকে চকমকি পাথরের ছুড়িটা তুলে নিতে গেলে মিঃ মারকাডো হঠাৎ শূন্যে লাফ দিয়ে চিৎকার করে উঠলেন। আমার দিকে করুণ চোখে তাকালেন তিনি। আর পোয়ারো অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলেন তার দিকে। বাঁ হাত দিয়ে তিনি তার হাতটা আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন।

আগুনে পোড়া লাল ছুঁচের মত কি যেন বিধলো আমার হাতে।

সঙ্গে সঙ্গে তৎপর হলেন পোয়ারো।

আসুন নার্স লিথেরান, পোয়ারো ব্যস্ত হয়ে বললেন, দেখা যাক ওঁর কি হল?

 আমি এগিয়ে গেলাম।

পোয়ারো তার জামার হাতাটা গুটিয়ে কাঁধের উপরে তুলে ধরলেন ক্ষত স্থানটা নিরীক্ষণ করার জন্য।

ওই যে ওখানে–মিঃ মারকাডো অপর হাত দিয়ে নিজের ক্ষতস্থান দেখান।

কাঁধ থেকে প্রায় ইঞ্চি তিনেক নিচে এক জায়গায় রক্তের দাগ লক্ষ্য করা গেল।

আশ্চর্য! তাঁর হাতের সেই রক্তের দাগটার উপরে স্থির দৃষ্টি রেখে অস্ফুটে বললেন–কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না, তবে মনে হয় পিঁপড়ে কেটে থাকবে।

একটু আইডিন লাগিয়ে দিলে ভাল হয়, আমি বললাম।

আইডিন পেন্সিল আমার সঙ্গেই ছিল। মিঃ মারকাভোর ক্ষতস্থানে আইডিন লাগাতে গিয়ে আমি একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখে বুঝিবা একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। তার কুনুই থেকে কব্জি পর্যন্ত হাতের উপরে ছোট ছোট ফুটোর দাগ। আমি বেশ ভালো করেই জানি, ওইগুলো কিসের দাগ হতে পারে। অধস্থকে প্রদেয় ইনজেকসনের ছুঁচের দাগ!

মিঃ মারকাডো জামার হাতটা নিচে নামিয়ে দিতে গিয়ে একটু আগের ঘটনাটা পুনরায় ব্যাখ্যা করলেন। মিঃ পোয়ারো তার কথাগুলো শুনলেন বটে, কিন্তু এর মধ্যে লিডনারদের প্রসঙ্গ টানতে কোন চেষ্টাই করলেন না তিনি। সত্যি কথা বলতে কি, কোন প্রশ্নই তিনি করলেন না মিঃ মারকাডোকে।

আপাততঃ মিঃ মারকাডোকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে আমরা আবার উপরে উঠে এলাম।

কাজটা খুব নির্ঝঞ্ঝাটে সারা গেল, তাই না?

কলারের ভাজ থেকে একটা জিনিস টেনে বার করে অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে নিরীক্ষণ করছিলেন পোয়ারো। তার হাতে রিপু করার সুঁচ জাতীয় জিনিস, মোমের আড়ালে ঢাকা, একটা পিনের মতো দেখাচ্ছিল।

মিঃ পোয়ারো? আমি চিৎকার করে উঠলাম, ওটা আপনি সঙ্গে নিয়ে এসেছেন?

হ্যাঁ, তাই তো বললাম, কাজটা বেশ নিঝঞ্ঝাটে সারা গেল। কেন আপনি লক্ষ্য করেননি?

হ্যা, আমি অকপটে স্বীকার করলাম, আমার নজর এড়িয়ে গেছে এক্ষেত্রে। শুধু আমারই বা কেন বলছি, আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, বিন্দুমাত্র সন্দেহ হয়নি মিঃ মারকাভোর। মনে হয়, কাজটা খুব তড়িৎগতিতে

কিন্তু কেন মঁসিয়ে পোয়ারো?

পাল্টা প্রশ্ন করলেন তিনি আমাকে, আপনি কোন কিছু লক্ষ্য করেছেন মিস্টার?

মাথাটা আমি নাড়লাম ধীরে ধীরে।

অধঃস্থকে প্রদেয় ইনজেকসন-এর সঁচের দাগ?

হ্যাঁ, ঠিক তাই, পোয়ারো আমাকে সমর্থন করে বললেন, তাহলে এর থেকে বোঝ যাচ্ছে, মিঃ মারকাভোর সম্পর্কে কিছু আমরা জানতে পেরেছি অন্তত। আমার সন্দেহটা যে ঠিক তা অনুমান করতে পারছি না। তবে জানাটা দরকার।

হঠাৎ পোয়ারো পকেটে হাত ঢোকালেন।

এই যা! রুমালটা আমি ফেলে এসেছি সেখানে। সেই রুমাল দিয়ে আপনি ঢেকে নিন পিনটা।

ঠিক এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিল, এই কেসের ব্যাপারে মিঃ পোয়ারো এবং আমি যথাক্রমে ডাক্তার এবং নার্স হিসাবে নিযুক্ত হয়েছি। অন্তত এক্ষেত্রে মানে, এই অপারেশনের ক্ষেত্রে মিঃ পোয়ারো একজন বিরাট শল্য চিকিৎসকের ভূমিকা নিলেন যেন। সমস্ত ব্যাপারটা আমি বেশ কৌতুকের সঙ্গে উপভোগ করছিলাম। আমি তাকে আশ্বাস দিয়ে বললাম রুমালটা আমি খুঁজে নিয়ে আসছি।

নার্সের ট্রেনিং লাভের পর আমি আমার কর্ম জীবনের রুগীদের অপারেশনের সময় সার্জেনদের সাহায্য করেছি প্রয়োজনীয় মুহূর্তে দরকারী জিনিসগুলোর যোগান দিয়ে কখনও ফরসেপ, কখনও বা ছুরি-কাঁচি। আর এই মুহূর্তে ঠিক সেই রকম একটা পরিবেশের কথা আমার মনে পড়ে গেল। সেই রকম একজন সার্জেনের কথা আমাকে মনে করিয়ে দিলেন পোয়ারো যেন। ঠিক সেই রকম ছোট বেঁটে-খাটো নোক, দেখতে কুৎসিত, বাঁদরের মতো মুখের অবয়ব, কিন্তু সার্জেন হিসাবে অপূর্ব। কখন কি ভাবে কাজে এগুতে হয়, সেটা তিনি বেশ ভাল করেই জানেন। বহু সার্জেনের সান্নিধ্যে আমি এসেছি, এবং তাদের মধ্যে প্রভেদটা যে কোথায়, সেটা আমার বেশ ভাল করেই জানা আছে। কে শ্রেষ্ঠ সার্জেন আমি তাদের কাজ দেখলেই বুঝতে পারি। সেই রকম পোয়ারোর মধ্যে তীক্ষ্ণ মেধার পরিচয় পেয়েই বোধহয় তার উপরে আস্থা আমার আরও বেড়ে গেল।

রুমাল হাতে ফিরে এসে প্রথমে আমি তাকে দেখতে পাই না। তবে শেষপর্যন্ত তাকে দেখতে পেলাম, তখন তিনি কথা বলছিলেন মিঃ ক্যারির সঙ্গে। আর মিঃ ক্যারির লোক তার কাছে দাঁড়িয়েছিল, তাঁর হাতে সেই বিরাট রড, যার উপরে মিটারের দাগ দেওয়া। তবে সেই সময় তিনি সেই লোকটাকে কি যেন বললেন–পর মুহূর্তেই চলে গেল সে। মনে হয়, আপাততঃ সেই রডটার কাজ তাঁর শেষ হয়ে গেছে।

পোয়ারোকে এখন ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আমাকে তিনি তার রুমাল খুঁজে আনতে পাঠালেন কেন? তবে কি তিনি আমাকে রুমাল খুঁজে আনার অছিলায় দূরে সরিয়ে রাখলেন? আর আমার অনুপস্থিতিতে তিনি তার প্রয়োজনীয় কাজটুকু সেরে নিলেন?

এও যেন সেই অপারেশনের ব্যাপার। বড় বড় সার্জেনরা তাদের কাজের সুবিধার জন্য চরম মুহূর্তে নবাগত নার্সদের মামুলি কাজের অছিলায় অপারেশন থিয়েটার থেকে সরিয়ে দেয়, পাছে তারা ভুল করে বসে, কিন্তু আমার সৌভাগ্য যে, এখনও পর্যন্ত আমার কাজে কোন ভুল হয়নি। অবশ্য আমি মনে করি না, মিঃ ক্যারির সঙ্গে তার কথা আমাকে শুনতে দিতে তিনি নারাজ। মনে হয় আমার অনুপস্থিতিতে মিঃ ক্যারির সঙ্গে বেশ খোলাখুলিভাবে তার আলোচনা করতে সুবিধা হবে বলেই তিনি আমাকে বুদ্ধি করে সরিয়ে দিয়েছিলেন।

কারোর ব্যক্তিগত ব্যাপারে মাথা ঘামানো আমার স্বভাব নয়। তবে এ কথাও ঠিক যে, মিঃ পোয়ারো একান্তই যদি তার ব্যক্তিগত কোন ব্যাপারে মিঃ ক্যারির সঙ্গে আলাপ করে থাকতেন তাহলে আমি অমন আগ্রহ নিয়ে তাদের কথায় কান রাখতাম না। একটা সুবিধাজনক স্থানে আমি দাঁড়িয়েছিলাম। যাইহোক, অনুভূতিশূন্য রুগীর (অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগে) কাজ থেকে অনেক কিছু শুনতে পাবেন। তবে রুগী চাইবে না, আপনি শুনুন সব কথা শুনলেও সে কিছু টের পাবে না। এক্ষেত্রে মিঃ ক্যারিকে আমি রুগী হিসাবে ধরে নিয়েছি।

বিরাট আবর্জনা স্তূপের পিছনে আমি দাঁড়িয়েছিলাম বলে ওরা আমাকে দেখতে পাচ্ছিলেন না। লুকিয়ে এভাবে আড়ি পেতে অপরের কথা শোনা যদি নিয়ম-বহির্ভূত হয়, সে কথা মানতে আমি রাজী নই। কোন কেসের ভারপ্রাপ্ত নার্সের কাছে কিছুই গোপন করা উচিত নয়। অবশ্য এক্ষেত্রে ডাক্তারের কর্তব্য হল কি করা উচিত, সে কথা বলে দেওয়া।

পোয়ারোর মনে কি আছে, তখনও আমি জানি না। তবে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই আমার প্রথমে নজর পড়ল তার চোখের উপরে। তার সন্ধানী চোখ দুটি যেন কি খুঁজছিল তখন।

ডঃ লিডনার যে তার স্ত্রীর প্রতি অনুগত ছিলেন, সেটা এখানকার কেউই পছন্দ করতেন না, তিনি তখন বলছিলেন–তাই এর থেকে অনুমান করা যায়, একজনের সম্বন্ধে জানতে গেলে তার বন্ধুদের চেয়ে শত্রুর কাছ থেকে বেশি তথ্য সংগ্রহ করা যায়।

তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, তাদের সতোর থেকেই দোষ-ত্রুটির বেশি গুরুত্বপূর্ণ? প্রশ্ন করলেন মিঃ ক্যারি। তাঁর কথায় বিদ্রুপের ছোঁয়া ছিল।

নিঃসন্দেহে তাই বিশেষ করে খুন সংক্রান্ত কেস হলে তো কোন কথাই নেই।

আমার আশঙ্কা, এ ব্যাপারে আমি বোধহয় আপনাকে কোন সাহায্য করতে পারব না, মিঃ ক্যারি বলেন। সত্যি কথা বলতে কি মিসেস লিডনারের সঙ্গে আমার শত্রুতা থাকা দূরে থাক কোন ব্যাপারে তার সাথে আমার কথা কাটাকাটি পর্যন্ত হয়নি। যদিও আমরা কেউ কারোর শত্রু ছিলাম না, তবে ঠিক বন্ধু যে ছিলাম একথাও আবার বলা যায় না। মিসেস লিডনারের স্বামীর পুরানো বন্ধু আমি, সম্ভবত এই সত্যটা স্বীকার করে নিতে তার বোধহয় ঘোরতর আপত্তি ছিল। আমরা স্বীকার করছি, সবাইকে আকর্ষণ করার মতো রূপ, মাধুর্য সবই ছিল, তবু বলব–ডঃ লিডনারের উপরে তাঁর জোর খাটানো, তাকে তার প্রতি একান্ত অনুগত করে তোলার বিরুদ্ধে আমাদের বিরক্তি, ক্ষোভ যথেষ্ট। যার ফলে তার সঙ্গে মিশতে গিয়ে আমরা সবাই নম্রতা, ভদ্রতার একটা মুখোস পরে থাকতাম, কোনদিন তার একান্ত কাছে যাইনি, তাঁর সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠিনি আমরা।

তাহলে আপনার কথামত ধরে নেওয়া যায় যে, মিসেস লিডনারকে আপনি সত্যি-সত্যি পছন্দ করতেন না।

মিঃ ক্যারি নিজের কথায় নিজেই হেসে উঠলেন। পোয়ারোর সজাগ দৃষ্টি তার উপরে নিবদ্ধ।

মিস জনসনের সঙ্গেও আমার কথা হয়েছে। ডঃ লিডনারের স্ত্রীর বিরুদ্ধে কোন মন্তব্য করতে তিনি নারাজ। তবে তার কথাবার্তা শুনে মনে হয় মিসেস লিডনারকে তিনি খুব শ্রদ্ধা করতেন। মিসেস মারকাডোর অভিমতও ঠিক তাই। তাঁর মতে মিসেস লিডনারের মতো অমন চমৎকার মহিলা আর কেউ হতে পারে না। তাই না?

হ্যাঁ, না কোন উত্তর দিলেন না মিঃ ক্যারি। পোয়ারো মিনিট দুই তার মুখের দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করলেন এবার–কিন্তু আমি তা বিশ্বাস করি না বলেই আপনার কাছে ছুটে এলাম। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি আপনার কথা শুনেও আমার মন ভরল না। অর্থাৎ আপনার কথাও আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না মিঃ ক্যারি।

ক্যারির চোয়াল দুটো কেমন কঠিন হয়ে উঠল। বেশ বুঝতে পারছিলাম একটু একটু করে তিনি রেগে যাচ্ছেন, তাঁর কথায় সেই রাগটা প্রকাশ পেল।

মিঃ পোয়ারো, একটা কথা আপনাকে বলে রাখি আপনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন কি না, তাতে আমার কিছু এসে যায় না। যা সত্যি তাই বললাম, এখন সেটা গ্রহণ করা না করা আপনার ব্যাপার। এর বেশি কিছু আমি বলতে চাই না।

পোয়ারোর মুখ দেখে মনে হল, ক্যারির কথায় একটু ক্ষুণ্ণ হলেন বটে, কিন্তু রাগের কোন লক্ষণ প্রকাশ করলেন না তিনি। কেমন শান্ত এবং সংযত স্বরে তিনি বললেন–এ আমার অপরাধ, হয়তো বিশ্বাস করতে পারি না বলে। কিন্তু আমিও মানুষ। মনে রাখবেন মিঃ ক্যারি–বুঝতে পারবেন, এখন এখানে নানান গুজবের গল্প আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। তার কিছু কাহিনী আছে যা শুনে সত্যি সত্যি উপলব্ধি করতে হয়। উপলব্ধি করার মতো সেই সব কাহিনীর কথা আমি এখানে বলতে চাইছি, বুঝলেন?

আমি স্পষ্ট দেখলাম, পোয়ারোর কথায় হয়তো সামান্য একটু বিচলিত হলেন মিঃ ক্যারি, তবে তাতে তার মুখটা আগের চেয়ে আরও সুন্দর হয়ে উঠল। আমি বেশ বুঝতে পারছি, এই কারণেই মেয়েরা বোধহয় তার প্রেমে পড়ে যায়।

তা সেসব কাহিনী কিসের শুনতে পারি?

মিঃ ক্যারির দিকে আড়চোখে তাকালেন পোয়ারো–আপনি হয়তো অনুমান করতে পারেন, সেই চিরন্তন কাহিনী মিসেস লিডনার এবং আপনাকে কেন্দ্র করে সেই সব কাহিনী।

ছিঃ ছিঃ মানুষের মন কত হীন! বিরক্তির ছোঁয়া মিঃ ক্যারির কথায় প্রকাশ পায়। আর আপনি সেই সব কাহিনী বিশ্বাস করেন?

আমি সত্যের প্রকাশ দেখতে চাই মিঃ ক্যারি! আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে কথাটা বললেন পোয়ারো।

আমার সন্দেহ হয়, প্রকৃত সত্য ঘটনা আপনি শুনেছেন কি না?

বেশ তো, আপনি শোনান না সেই সত্য ঘটনার কথা। পাল্টা প্রশ্ন করলেন পোয়ারো।

তাহলে সত্যি কথাটা শুনবেন? মিঃ ক্যারির কথায় ঘৃণা, বিরক্তি ঝরে পড়ে, লুসি লিডনারকে আমি ঘৃণা করতাম। আমি তাকে ঘৃণার চোখে দেখতাম, এখনও দেখি–বুঝলেন?

.

২২.

এমোট ল্যাভিগনি এবং নতুন আবিষ্কার

দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে ক্যারিকে চলে যেতে দেখা যায়। রাগে গজরাচ্ছিল সে তখন। তার দিকে তাকিয়ে পোয়ারো ফিসফিসিয়ে বললেন–হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারছি।

তারপর মাথা না ঘুরিয়ে তাকে এবার একটু জোরে বলতে শোনা গেল, এখানে মিনিট খানিকের জন্য এসো না নার্স। আমার রুমালটা আপনি পেয়েছেন? অজস্র ধন্যবাদ।

একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম এই ভেবে আমি এতক্ষণ তাঁদের আলোচনার কথা শুনছিলাম, সে ব্যাপারে কোন উল্লেখই তিনি করলেন না। যাক একটা জবাবদিহির হাত থেকে রেহাই পাওয়া গেল।

মিঃ পোয়ারো, মিসেস লিডনারকে উনি ঘৃণা করতেন, এ কথাটা সত্যি কী আপনার বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়? থাকতে না পেরে আমি জিজ্ঞেস করে ফেললাম শেষপর্যন্ত।

আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন পোয়ারো, কৌতূহলী চোখ। হ্যা। ঠোঁটটা তার নড়ে উঠল, আমার মনে হয়, সত্যি-সত্যি তিনি তাকে ঘৃণা করতেন।

তারপর তিনি দ্রুত পায়ে উপরে উঠে এসে হাঁটতে শুরু করে দিলেন কাছেই মাটির  ঢিবিটার দিকে। দু’একজন আরব দেশীয় লোক ছাড়া অন্য কারোর মুখ আমাদের চোখে পড়ল না। অবশেষে ঢিবির সামনে গিয়ে উপস্থিত হতেই চোখে পড়ল ডেভিড এমোটকে। মুখ তার নিচের দিকে। চোখের সামনে একটা কঙ্কাল ঝাড়পোঁছ করেছিলেন, সবেমাত্র সেই কঙ্কালটা মাটির নিচ থেকে তুলে আনা হয়েছিল।

আমাদের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হতেই একটা মিষ্টি হাসি তার ঠোঁটে ফুটে উঠতে দেখা গেল।

কি ব্যাপার, জায়গাটা ঘুরে দেখতে চান? জানতে চাইলেন এমোট, এক মিনিট, হাতের কাজটা সেরে নিয়েই আপনাদের সঙ্গে কথা বলব, কেমন?

এমোট আবার তার কাজে মন দিলেন। ছুরি দিয়ে সেই কঙ্কালটার উপর থেকে মাটি চেঁছে পরিষ্কার করলেন খুব যত্ন নিয়ে, মাঝে মাঝে কঙ্কালটার উপরে মুখ নামিয়ে ঠু দিচ্ছিলেন ধুলো ঝাড়বার জন্য।

এটা ভাল নয় মিঃ এমোট। ওই কঙ্কালটার মধ্যে কত বিষাক্ত বীজাণু থাকতে পারে। আপনার মুখে বীজাণু যদি–।

ওই সব বিষাক্ত বীজাণু আমার নিত্য খাদ্য নার্স, আমাকে বাধা দিয়ে তিনি আরও বলেন–কোন বীজাণুই প্রত্নতত্ত্ববিদদের কাছে ক্ষতিকারক হতে পারে না বুঝলেন!

কঙ্কালটার আকৃতি দেখে মনে হয় কোন মহিলার। ছুরি দিয়ে দাগ কাটছিলেন কঙ্কালটার উপরে। মিঃ রেইটার সেই সব চিহ্নিত অংশের ফটো তুলবে মধ্যাহ্ন ভোজের পরে।

কে, কে এই মহিলা?? পোয়ারোই প্রথম সেই কঙ্কালের প্রসঙ্গে গেলেন।

প্রথম হাজার বছরের কোন এক সময়ের মহিলা হবেন হয়তো। করোটিটা একটু অস্বাভাবিক বলে মনে হয়। মারকাডোকে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখতে বলব। দেখে মনে হয় মহিলার মৃত্যুটা স্বাভাবিক ছিল না।

তবে কি ধরে নিতে পারি, হাজার হাজার বছর আগে আর এক মিসেস লিডনারের মতো?

সম্ভবত, সংক্ষিপ্ত উত্তর মিঃ এমোটের।

বিল কোলম্যান একটা পাথরের টুকরো নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। এমোট তাকে ডেকে সংক্ষেপে কি যেন বলবেন, ঠিক বোঝা গেল না। তারপর এক সময় কব্জি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে এমোট ফিরে তাকালেন পোয়ারোর দিকে।

এবার কী বাড়ি ফিরে যাবেন?

গেলে মন্দ হয় না! পোয়ারো এমনভাবে বললেন–যেন এমনটিই চাইছিলেন তিনি।

আস্তে আস্তে হাটছিলাম আমরা। পোয়ারোই প্রথম মুখ খুললেন–আমার বিশ্বাস, পুনরায় কাজে ফিরে এসে আপনারা সবাই বেশ খুশি, তাই না?

হ্যাঁ, ভালই তো, এমোট গর্বভরে জবাব দেন, বাড়িতে বসে খোশ-গল্প করার থেকে এ অনেক ভাল।

আপনাদের মধ্যেই কেউ একজন খুনীর এ কথা জেনেও পোয়ারো প্রশ্নটা করে স্থির চোখে তাকালেন এমোটের দিকে।

এমোট কোন উত্তর দিলেন না, কিম্বা ভিন্নমতও পোষণ করলেন না। এখন আমি বেশ বুঝতে পারছি যে–হাউসবয়দের ডেকে মিঃ পোয়ারো জিজ্ঞাসাবাদ করার পরেই এমোট জেনে গেছেন, তাঁরা সবাই এখন তার চোখে সন্দেহভাজন ব্যক্তি। যে-কোন মুহূর্তে যে-কোন লোককে তিনি খুনী বলে ঘোষণা করতে পারেন–বলতে পারেন, আপনাকে গ্রেপ্তার করা হল, ইত্যাদি—

মিঃ পোয়ারো? শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন মিঃ এমোট–আপনি কোন সূত্রের সন্ধান পাচ্ছেন বলে মনে হয়?

যে-কোন মুহূর্তে পাবার আশা রাখি বৈকি! পোয়ারো বেশ গর্বের সঙ্গেই কথাটা বললেন–তবে সেটা নির্ভর করছে, আপনারা কতটুকু সাহায্য আমাকে করবেন তার উপরে।

বেশ তো, আমি আপনার কী সাহায্যে লাগতে পারি বলুন?

আগের মতই এমোটের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে পোয়ারো বলেন–এই কেসের কেন্দ্র-ব্যক্তি হলেন মিসেস লিডনার। আমি তার সম্বন্ধে কিছু জানতে চাই মিঃ এমোট।

তা আপনি তার সম্বন্ধে কী জানতে চান বলুন তো?

কোথা থেকে তিনি এসেছেন? কুমারী বেলায় কি তার পদবী ছিল, কি রকম দেখতে ছিলেন, তার চোখের রং কি ছিল, এসব আমি জানতে চাই না। মানে আমি কেবল তার সম্বন্ধে জানতে চাই। আমি কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই!

আপনি কী মনে করেন এই কেসের ব্যাপারে সেটা খুব প্রয়োজনীয়?

হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত। পোয়ারো বলেন, আর এ ব্যাপারে আপনিই আমাকে সাহায্য করতে পারেন। আপনি বলতে পারেন, ঠিক কি ধরনের মহিলা ছিলেন তিনি।

আমি কী পারব?

কেন, এর আগে আপনি কী কখনও ভেবে দেখেননি?

মিঃ এমোট কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। মনে হয় কিভাবে শুরু করা যায়, সেই কথাটা তিনি ভাবছিলেন। ভাববার পর তিনি বললেন, তার সম্বন্ধে নার্স কি ভাবেন সেটা আমাদের আগে জানা দরকার। একজন মহিলা অন্য আর এক মহিলাকে খুব তাড়াতাড়ি চিনে নিতে পারে। আর নার্স হিসাবে ওঁর অভিজ্ঞতা প্রচুর।

আমার বলার ইচ্ছা থাকলেও পোয়ারো আমাকে বলার সুযোগ একেবারে দিলেন না। আমার হয়ে তিনি দ্রুত বললেন–তার সম্বন্ধে একজন পুরুষের কি চিন্তাধারা সেটা জানাই আমার উদ্দেশ্য। এমোটের ঠোঁটে সূক্ষ্ম হাসির রেখা।

আমার মনে হয় চিন্তাধারা একই হবে, একটু থেমে তিনি আবার বলেন, বয়স তার যথেষ্ট হয়েছিল, তবে আমি হলপ করে বলতে পারি যে, এই বয়সেও তার মত অমন রূপসী মহিলার সংস্পর্শে আমি এর আগে কখনও এসেছি বলে মনে হয় না।

এ তমামুলি উত্তর মিঃ এমোট, এমোটের কথায় পোয়ারোর মনপুতঃ হল না, আমি আপনার কাছ থেকে আরও কিছু আশা করি।

মিনিট দুই চুপ করে থেকে এমোট আবার বলতে শুরু করলেন–ছেলেবেলায় আমি এক রূপকথার কাহিনী শুনেছিলাম। তুষার রানী এবং খুদে কে। আমার ধারণা, মিসেস লিডনারকে সেই তুষার রানীর সঙ্গে তুলনা করলে অত্যুক্তি হবে না।

ও, হ্যাঁ, হানস্ এন্ডারসনের গল্প তাই না? আর হ্যাঁ, সেই কাহিনীতে একটি ছোট্ট মেয়ের ভূমিকা ছিল। কি যেন মেয়েটির নাম? জেরদা না?

হতে পারে। তবে আমার খুব বেশি মনে নেই।

ওঁর সম্বন্ধে আর একটু আলোকপাত করতে পারেন না, মিঃ এমোট?

ডেভিড এমোট মাথা নাড়লেন।

আপনি তো জানেন মঁসিয়ে পোয়ারো, বড় দুরূহ নারী চরিত্র। দেবতারা যেখানে তাদের চরিত্র ঠিক ভাবে নিরুপণ করতে পারেন না, আমি মানুষ। তাদের থেকে বেশি কি আর জানতে পারি বলুন? সত্যি বড় বিচিত্র ছিল মিসেস লিডনারের চরিত্র। তার চেয়েও বিচিত্র ছিল তার মন। এই রোদ, এই বৃষ্টির মতন। তার মনের হদিশ পাওয়া বড় মুশকিল ছিল। আজ হয়তো তাকে খুব রূঢ় বলে মনে হল, আবার কাল সকালে তার ব্যবহার হয়তো অতি মনোরম বলে মনে হবে। তবে ওঁর সম্বন্ধে মুখে আমরা যাই বলি না কেন আপনি ঠিকই বলেছেন এ কেসের কেন্দ্রবিন্দু হলেন তিনি। আর তিনিও তো নিজেকে ঠিক এই রকমই চাইতেন সকলের মধ্যমণি হয়ে বসে থাকতে। সবাই তাকে মান্য করুক, খাতির করুক আর তিনি তাদের উপরে খবরদারি করুন। এই ছিল তাঁর কাম্য।

আর কেউ যদি তাকে সেই ভাবে সন্তুষ্ট করতে অপারগ হয়ে থাকেন? পোয়ারো জিজ্ঞাসা করলেন–তার সম্ভাব্য পরিণাম কী ঘটতে পারত অনুমান করেছেন?

সেক্ষেত্রে তার রূপ হত অতি কদাকার।

এই কথার পর আমি লক্ষ্য করলাম মিঃ এমোটের চোয়াল দুটো কেমন শক্ত হয়ে উঠল, দাঁতে দাঁতে ঘষছিলেন কথা বলতে গিয়ে। এই পরিবর্তনটাই কী আশা করছিলেন মিঃ পোয়ারো?

আমার অনুমান মিঃ এমোট, বেসরকারিভাবে আপনি আপনার মতামত, জানাতে কুণ্ঠাবোধ করবেন না, পোয়ারো আর কোন ভূমিকা না করেই জিজ্ঞাসা করে বসলেন, মিসেস লিডনারের সম্ভাব্য খুনী কে হতে পারে মিঃ এমোট?

জানি না। মিঃ এমোট সরাসরি অস্বীকার করে বসলেন–সত্যি কথা বলতে কি, এ ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। এক এক সময় আমি ভাবি, আমি যদি কার্ল রেইটার হতাম, তাহলে আমি হয়তো তার সম্ভাব্য খুনী হতে পারতাম। কার্লের কাছে তিনি ছিলেন শয়তান। তবে তার সেই ভূমিকায় কার্লের সমর্থন ছিল বোধহয়। সে নিশ্চয়ই চাইতো, তাঁর কাছে তিনি শয়তানের রূপ নিয়ে দেখা দিন, তাকে তিনি লাথি মেরে বিদেয় করুন।

তা মিসেস লিডনার কি তাকে সত্যি সত্যি লাথি মেরেছিলেন?

না। ঠিক তা নয়। তবে এমব্রয়ড্রারির সুঁচ দিয়ে খোঁচা মারার মতোন আর কি। কাউকে পিছন থেকে লাথি মারার পদ্ধতিই ছিল তার ঠিক এই রকম।

আড়চোখে পোয়ারোর দিকে তাকালাম তার ঠোঁট জোড়া ভয়ে কেঁপে উঠতে দেখলাম।

কিন্তু, পোয়ারো জিজ্ঞাসা করলেন–কিন্তু কার্ল রেইটার যে তাকে খুন করতে পারেন, এ ধারণা আপনার নেই নিশ্চয়ই!

না নেই। আমার মনে হয় না, কোন নারী আপনাকে বার বার বোকা বানালেও আপনি এমন কোন অস্বাভাবিক আচরণ করবেন না, যাতে করে সেটা খুনের পর্যায়ে নেমে আসে।

পোয়ারো মাথা নাড়তে নাড়তে কি যেন ভাবছিলেন।

মিসেস লিডনারকে অমানুষের পর্যায় ফেলতে চান ডেভিড এমোট। সেই সঙ্গে আবার বিপরীত দিকটার কথা চিন্তা করতে গেলে অন্য কিছুও ভাবতে হবে বৈকি। ওদিকে মিঃ রেইটারের আচরণ অত্যন্ত রিক্তিকর এবং অসহ্য।

আমি একবার ভাবলাম–মিঃ পোয়ারোকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলব। কিন্তু আসন্ন মধ্যাহ্ন ভোজের প্রস্তুতির জন্য সুযোগ পাওয়া গেল না তখন।

ডাইনিং রুম। মিঃ এমোটের আসতে একটু দেরি হল। আমি এবং তিনি প্রায় এক সঙ্গে ডাইনিং রুমে প্রবেশ করলাম। মিস জনসন এবং মিসেস মারকাডো আগেই উপস্থিত ছিলেন সেখানে এবং তারপর মিনিট কয়েক পরে মিঃ মারকাডো, মিঃ রেইটার এবং বিল কোলম্যান আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন।

ওদিকে ফাদার ল্যাভিগনির ডাকে পোয়ারো তার ঘরে প্রবেশ করেছিলেন।

আমরা সবাই যে যার আসনে বসে। আবার বয়কে দিয়ে মারকাডো খবর পাঠিয়েছেন। ফাদার ল্যাভিগনির কাছে, মধ্যাহ্নভোজ প্রস্তুত, আর ঠিক সেই মুহূর্তে একটা অস্পষ্ট কান্নার আওয়াজ শুনে আমরা সবাই চমকে উঠলাম। আমাদের মধ্যে মিস জনসনকে একটু বেশি ভেঙ্গে পড়তে দেখলাম। তার মুখটা ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর তার, কী ব্যাপার? আবার কী ঘটল?

সেই মুহূর্তে পোয়ারো এবং ফাদার ল্যাভিগনি এসে উপস্থিত হলেন সেখানে।

 আমরা ভাবলাম, কেউ বোধহয় আহত হল, বললেন মিস জনসন।

আমি হাজার বার ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি মাদমোয়াজেল, পোয়ারো দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, দোষটা আমার। ফাদার ল্যাভিগনির ঘর থেকে চিৎকারটা আমি করেছিলাম। আপনারা হয়তো সেই চিৎকার শুনেই পোয়ারো কিন্তু তার সেই চিৎকারের কারণটা খুলে বললেন না।

আমরা ভাবলাম, মিসেস মারকাডো হাসতে হাসতে বললেন–আর একজন খুন হলেন বুঝি। তাঁর কথা শুনে দমফাটা হাসির ফোয়ারায় ফেটে পড়ল সবাই।

মেরী? মারকাডোর কথায় ধমকের সুর। ছোট্ট কথায় যেন অনেক কিছু বলা হয়ে গেল। স্ত্রীকে সতর্ক করে দিলেন তিনি–অবুঝের মত হেসো না, এখন হাসবার সময় না।

ওদিকে মিস জনসন তখন কান খাড়া করে শুনছিলেন, তাঁদের আলোচনার বিষয়বস্তু। সীমাবদ্ধ ছিল বেশির ভাগ প্রত্মতত্ত্ব সম্বন্ধে।

পোয়ারোকে সঙ্গে নিয়ে ফাদার ল্যাভিগনি প্রবেশ করলেন সেই এ্যান্টিক রুমে। আমিও অনুসরণ করলাম তাদের। সব কিছু খুঁটিয়ে জানার প্রবণতাটা আমার মনের মধ্যে দারুণভাবে একটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল তখন। ফাদার ল্যাভিগনি তখন একটা সোনার কাপ দেখাচ্ছিলেন পোয়ারোকে, পোয়ারোর মুখ থেকে সেই জিনিসটার ভূয়সী প্রশংসা শুনলাম।

আঃ! কি চমৎকার! কি অদ্ভুত কারুকার্য!

মধ্যরাত্রে অতিথিদের কাছে এটা একটা বিরাট আকর্ষণ। আমার উপস্থিতির কথা খেয়াল না করেই তারা ফরাসী ভাষায় নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে থাকেন।

ওদিকে মিসেস মারকাডো তার স্বামীর জন্য মোজা বুনতে ব্যস্ত, মিস জনসনের চোখ বইয়ের পাতায় নিবদ্ধ। মিস জনসন সাধারণতঃ নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তাই তাকে এ সময় বই পড়তে দেখে অবাক লাগল।

পোয়ারো সবার অজান্তে তার পর্যবেক্ষণের কাজটা ঠিক চালিয়ে যাচ্ছিলেন এবং মাঝে মাঝে আমাদের সঙ্গে আলোচনায় যোগ দিচ্ছিলেন। লক্ষ্য করলাম, মিস জনসনই তার বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তরগুলো দিচ্ছিলেন।

কার্ডবোর্ডের সামনে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন পোয়ারো। সেফের ভিতরে ঘরে ঘরে সাজানো রয়েছে প্ল্যাস্টিসিন, ডিউরেফিক্স, ফটোগ্রাফিক পেস্ট এবং অন্য আর কিছু টুকিটাকি জিনিস। ভাল করে নিরীক্ষণ করতে গিয়ে হঠাৎ একটা অদ্ভুত জিনিস নজরে পড়ল পোয়ারোর। কার্ডবোর্ডের ভিতরের লুকনো রয়েছে কোঁচকানো একটা জিনিস।

 ওটা, ওটা কী মাদমোয়াজেল? কথা বলতে বলতেই একটা হাত ঢুকিয়ে দেন পোয়ারো সেই কার্ডবোর্ডের পিছনে। এবং একটু পরেই তাঁকে দেখা যায়, একটি ধুলো মলিন কোঁচকানো জিনিস হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসছেন। একটা বোবা বিস্ময় ছড়িয়ে ছিল তার সারা চোখেমুখে।

এক সময়, পোয়ারো সোজা হয়ে দাঁড়াতেই তার হাতের সেই জিনিসটা স্পষ্ট হল আমাদের কাছে। যার নাম মুখোশ। ভারতীয় কালি দিয়ে আঁকা মুখ চোখ। রঙটা যেন একটু কাঁচা। সমস্ত জিনিসটার উপরে প্লাস্টিসিন (প্লাস্টিক জাতীয় তরল পদার্থ) প্রলেপ দেওয়া হয়েছিল বলে মনে হয়।

সত্যি কি অস্বাভাবিক জিনিস এটা। মিস জনসন বিস্মিত। কিন্তু ওটা তো আমি এর আগে কখনও দেখিনি ওখানে, ওটা এল কী করে? আর ওটা কিই বা?

লুকিয়ে রাখার জায়গা হিসাবে কাপবোর্ডটা হয়তো আদর্শ। আমার অনুমান এই সিজন কাপবোর্ডটা কখনও ঘোরানো হয়নি। ওটা কি, এবং ওটার প্রয়োজনই বা কি, মনে হয় উত্তরটা পেতে খুব একটা কষ্ট করতে হবে না। আপনাদের স্মরণ থাকতে পারে, মৃত্যুর আগে মিসেস লিডনার তার ঘরের জানালার সামনে হঠাৎ একটি ভুতুড়ে মুখের আবির্ভাব। ঘটতে দেখেছিলেন, দেহবিহীন মুখ।

হঠাৎ মিসেস মারকাডো চিৎকার করে উঠলেন।

 মিস জনসনের মুখটা সাদা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। বিড়বিড় করে তিনি বলতে থাকেন, তাহলে এখন মিসেস লিডনারের মৃত্যুটাকে আর স্বাভাবিক ভাবা যায় না কিছুতেই। মৃত্যু নিয়ে মারাত্মক খেলা। কিন্তু কে তার মৃত্যু নিয়ে এমন নিষ্ঠুর খেলা খেলতে পারে?

হ্যাঁ, আমারও সেই প্রশ্ন, মিসেস মারকাডোও চিৎকার করে উঠলেন–কে, কে এমন নিষ্ঠুর কাজ করতে পারে বলে মনে হয়?

উত্তর দেবার কোন চেষ্টা করলেন না পোয়ারো। তাঁর মুখটা ক্রমশঃ কঠিন হয়ে উঠছিল। একটা কার্ডবোর্ড বক্সের ভিতরে সেই কোঁচকানো মুখোশটা রাখলেন।

এটা পুলিশকে অবশ্যই দেখানো দরকার। তাহলে আপনি কী মনে করেন, সব কিছু এখানে লুকিয়ে রাখা হয়েছে? মিসেস মারকাডো তীক্ষ্ণ স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, মানে সম্ভাব্য অস্ত্র বলতে, গদা, মুগুর জাতীয় রক্ত মাখা কোন অস্ত্র যা দিয়ে মিসেস লিডনারকে হত্যা করা হয়–ওঃ! আমার ভীষণ ভয় করছে।

আর একটু হলে তিনি পড়ে যাচ্ছিলেন, মিস জনসন ঠিক সময়ে ধরে ফেললেন তাকে।

শান্ত হন। ধমকের সুরে মিস জনসন তাকে বলেন–ডঃ লিডনার রয়েছেন, আমরা ভেঙ্গে পড়লে তার মানসিক বিপর্যয় ঘটতে পারে; তাই এভাবে আমাদের ভেঙ্গে পড়া উচিত নয়।

বস্তুতপক্ষে সেই মুহূর্তে গাড়ি থেকে নেমে সোজা বসবার ঘরে এসে প্রবেশ করলেন ডঃ লিডনার। বিবর্ণ মুখ। চোখের কোলে কালো আস্তরণ পড়ে গেছে। এই তিন দিনে তার বয়স যেন দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

শান্ত গলায় ধীরে ধীরে তিনি খবরটা দিলেন–কাল সকাল এগারোটায় অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে। মেজর ডীন অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া পরিচালনা করবেন।

মিসেস মারকাডো আমতা আমতা করে কি যেন বলতে গেলেন, কিন্তু কিছু না বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন দ্রুত পায়ে।

অ্যানি, তুমি আসছো তো? মিস জনসনের উদ্দেশ্যে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন ডঃ লিডনার।

হ্যাঁ প্রিয়, নিশ্চয়ই আসব। কথাটা বলতে গিয়ে আবেগে গলা কেঁপে উঠল মিস জনসনের।

প্রিয় অ্যানি, ডঃ লিডনারের কণ্ঠস্বরে অন্তরঙ্গতার ছোঁয়া। তুমি আমার পুরানো বান্ধবী, আমার দুঃসময়ের সঙ্গিনী। তোমার কাছে এলে আমার সব দুঃখ জ্বালা যেন নিমেষে জুড়িয়ে যায়।

ডঃ লিডনার কাছে গিয়ে মিস জনসনের হাতে হাত রাখেন। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম–মিস জনসনের দেহটা ঈষৎ কেঁপে উঠল, মুখের রঙ লাল হল। সেই মুহূর্তে কেন জানি না আমার মনে হল, মিস জনসনের মতো সুখী মহিলা আর কেউ সেখানে ছিল বলে মনে হয় না।

আর একটা সম্ভাবনার কথা হঠাৎ আমার মনে উদয় হল। সম্ভবত পরে কোন এক সময় পুরানো বন্ধুত্বের সুবাদে ওঁরা পরস্পরের কাছে আসার চেষ্টা করবেন এবং এক নতুন সুখী জীবন হয়তো গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন। অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়ার আগে এসব কথা আমার চিন্তা করা উচিত নয়, তবু মনে হয় ওঁদের বন্ধুত্বের পরিণতি এভাবেই হওয়া উচিত। বিশেষ করে মিস জনসন যখন মনে-প্রাণে তাঁর প্রতি অনুরক্ত বাকি জীবনটা মিলন সুখে গা ভাসিয়ে দেওয়া উচিত। আর আমি তো জানি, মেয়েরা যে জিনিসটা চাইব মনে করে, না পাওয়া পর্যন্ত থেমে থাকতে পারে না।

তারপর ডঃ লিডনার ফিরে তাকালেন পোয়ারোর দিকে, জানতে চাইলেন কেসের ব্যাপারে কোন অগ্রগতি হল কিনা।

ডঃ লিডনারের ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন মিস জনসন। তার দৃষ্টি পড়েছিল পোয়ারোর হাতের কার্ডবোর্ডের বক্সের উপরে। চোখে করুণ মিনতি পোয়ারোর প্রতি। তিনি যেন ওই বাক্সবন্দি মুখোশের কথাটা এই মুহূর্তে ডঃ লিডনারকে না বলেন। অন্তত আর একটা দিন তিনি যেন চুপ করে থাকেন এ ব্যাপারে।

পোয়ারো তার অনুরোধ রাখলেন। ধীরে ধীরে ডঃ লিডনারের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বললেন–এসব কেসের কাজে অগ্রগতি হয় অতি ধীরে ধীরে মঁসিয়ে।

তারপর দু’একটা দরকারি কথাবার্তা সেরে ডঃ লিডনার স্থান ত্যাগ করে চলে যান।

মিঃ পোয়ারোকে একা পেয়ে আমার তখন ইচ্ছা হচ্ছিল ডজন খানেক প্রশ্ন করি তাঁকে। কিন্তু কিছুই বলা হল না। সার্জেনের সামনে সহকারী নার্স যেমন অসহায় বোধ করে, আমার অবস্থাও ঠিক তাই। ডাক্তারের নির্দেশের অপেক্ষায় থাকা ছাড়া নিজস্ব বক্তব্য বলতে কিছু থাকতে যে পারে না, এই মুহূর্তে সেই সত্যটা বার বার আমি উপলব্ধি করলাম।

কিন্তু মিঃ পোয়ারো আমার সব ধ্যান-ধারণা পাল্টে দিয়ে বললেন, খুকুমণি, এখন থেকে আপনি আপনার নিজের যত্ন নেবেন। তারপর একটু থেমে তিনি আবার বলেন, আমার আশঙ্কা এ জায়গাটা আপনার পক্ষে নিরাপদ নয়। যত তাড়াতাড়ি পারেন এখান থেকে চলে যান।

হ্যাঁ, এ ব্যাপারে ডঃ লিডনারের সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই, আমি তাকে বললাম। কিন্তু অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার কাজ সমাধা না হওয়া পর্যন্ত তো আমি এখান থেকে কোথাও যেতে পারছি না আঁসিয়ে!

পোয়ারো মাথা নাড়লেন। তারপর মৃদু হেসে বললেন, সেই সময়টুকু অযথা কোন বাড়তি উৎসাহ দেখাবার চেষ্টা করবেন না। আপনার কাজ হল আমাকে ছুরি কঁচি এগিয়ে দেওয়া আর আমার কাজ হল রুগীর অপারেশন করা বুঝলেন?

 ধীরে ধীরে মাথা নাড়লাম আমি। আমি তখন বেশ বুঝে গেছি, এরপর আমার কৌতূহল দমন করতে হলে কি করা উচিত।

পোয়ারো নিজে থেকেই আবার বললেন–ফাদার ল্যাভিগনি বড় অদ্ভুত মানুষ।

একজন সন্ন্যাসীর প্রত্নতত্ত্ববিদ হওয়াটা আমার কাছে কেমন যেন বেমানান বলে মনে হয়। কথাটা না বলে থাকতে পারলাম না আমি।

আমি প্রোটেস্ট্যান্ট, আমি কিন্তু একজন গোঁড়া ক্যাথলিক। পুরোহিত এবং সন্ন্যাসীদের সম্বন্ধে আমার বেশ ভাল ধারণা আছে। তারপর তিনি চোখে ভ্রুকুটি টেনে বলেন মনে রাখবেন, ফাদার ল্যাভিগনি আপনার থেকে অনেক বেশি চতুর। যে-কোন মুহূর্তে তিনি আপনার সর্বনাশ করতে পারেন।

আমার তখন মনে হল–গল্পকথা শুনে তিনি যদি আমাকে সতর্ক করে থাকেন, সে সতর্কতায় কোন গুরুত্ব দেওয়া উচিত নয়। আমার অন্তত তাই মনে হল।

.

২৩.

মনোবিশ্লেষণের পালা

মিসেস লিডনারের অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ায় তার শত্ৰুমিত্র নির্বিশেষে সবাই যোগ দিলেন। এমনকি শীলা রেলি পর্যন্ত। তার পরনে ছিল কালো রঙের কোট এবং স্কার্ট। তাকে খুব শান্ত এবং বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল।

বাড়ি ফিরে এসে ডঃ লিডনারকে অনুসরণ করলাম এবং আমার প্রত্যাবর্তনের প্রসঙ্গটা তুললাম। সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাজী হয়ে গেলেন। প্রশংসা করে বললেন, আমি নাকি আমার কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেছি। আমাকে তিনি বাড়তি এক সপ্তাহের বেতন দিতে চাইলেন। প্রত্যুত্তরে আমি বললাম–আমার তো একদিনেরও বেতন পাওয়া উচিৎ নয় ডঃ লিডনার। আপনি বরং আমাকে বাড়ি ফিরে যাবার খরচটা দিন, তাতেই যথেষ্ট বলে মনে করব আমি।

তুমি অহেতুক কিন্তু উতলা হচ্ছ। ওসব কথা মাথায় এনো না। আমি তো আর তোমাকে মহিলা গোয়েন্দা হিসাবে নিযুক্ত করিনি। তাছাড়া আমার স্ত্রীর এমন আসন্ন বিপদের কথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। ভেবেছিলাম, স্নায়ুর চাপে ভুগছে, সাময়িক, কিছুদিন পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আর শেষ দু’তিন দিন ওকে আমি বেশ খুশিই বলে মনে করেছিলাম। তোমাকে বিশ্বাস করে নিয়েছিল ও। অতএব তোমার অনুতাপ করার কিছু নেই এই ব্যাপারে।

কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বর তাঁর। আমি জানি কি ভাবছেন তিনি। মিসেস লিডনারের ভয়কে তেমন কোন গুরুত্ব না দেওয়ার জন্য একমাত্র তাকেই দোষী সাব্যস্ত করা যায়। ডঃ লিডনার, আমার কেমন কৌতূহল হল, জিজ্ঞাসা করলাম–সেই বেনামা চিঠিগুলোর ব্যাপারে আপনি কী কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পেরেছেন?

কোনটা যে বিশ্বাস করব, ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। আচ্ছা, মিঃ পোয়ারো কি কোন নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন?

আমি জানি গতকাল পর্যন্ত কোন খবর নেই। তবে একবার ভাবলাম মিস জনসনের নামটা উল্লেখ করে দেখি তার মনে কি রকম প্রতিক্রিয়া হয়। চিঠিগুলোর কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু গত পরশু ডঃ লিডনার এবং মিস জনসনের মধ্যে যে অন্তরঙ্গভাব আমি দেখেছি, তাতে আমার আগ্রহটা নতুন করে আবার জেগে উঠল। তবে মিস জনসন যদি একান্তই চিঠিগুলো লিখে থাকেন তাহলে এ কথা ঠিক যে, মিসেস লিডনারের মৃত্যুর পরে তার সময়টা সত্যি ভাল যাচ্ছে বলে মনে হয় না।

সেই বেনামা চিঠিগুলো কোন এক মহিলার লেখা বলেই সন্দেহ হয়।

হয়তো বা, দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন–কিন্তু নার্স, তুমি ভুলে যাচ্ছ, চিঠিগুলো প্রকৃতপক্ষে ফ্রেডরিক বনসারেরই লেখা। ওর মতো পাগল ছাড়া অন্য আর কে এ কাজ করতে পারে? দুর্ঘটনার দিন যেভাবেই হোক (হয়তো চাকরদের ঘুষ দিয়ে থাকবে সে) আমার স্ত্রীর ঘরে প্রবেশ করে থাকবে সে। আমিও তাই বিশ্বাস করি।

ডঃ লিডনার আমার দিকে তাকালেন, আমি তার কথা মন দিয়ে শুনছি কি না দেখার জন্য বোধহয়, কিন্তু মিঃ পোয়ারো সে কথা বিশ্বাস করেন না। তার ধারণা চিঠিগুলো—

হয়তো আপনার অনুমানই ঠিক,আমার কথায় সন্দেহের অবকাশ রেখেই আমি তার কথায় সায় দিলাম।

ডঃ লিডনার তখন উত্তেজিত অবস্থায় বলতে থাকেন, মিঃ পোয়ারো আমার এক্সপিডিসনের লোকেদের সন্দেহ করছেন, খুব ভাল কথা। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তারা কেউই এমন জঘন্য কাজ করতে পারেন না। আমি তাদের সবাইকে খুব ভাল করে চিনি।

কিন্তু পত্র লেখকের হাতের লেখায় যে মেয়েলী টান আছে ডঃ লিডনার!

আমার অনুমান, মিসেস মারকাডোকে তুমি সন্দেহ করছে। কিন্তু তাই বা কি করে হয়? না, না এ কাজ তিনি করতে পারেন না।

তাহলে, তাকে বাদ দিলে বাকি থাকেন কেবল মিস জনসন, কথাটা বলে আমি তার ভাবান্তর লক্ষ্য করলাম।

সে চিন্তা তো আরও অবিশ্বাস্য!

তার স্বল্প হাসির মধ্যে একটা কিছু গোপন করার ভাব যেন লুকিয়ে ছিল। আমার দৃষ্টি এড়ালো না। মিস জনসন যে চিঠিগুলো লিখতে পারেন, এ কথাটা তিনি কিছুতেই মাথায় আনতে চান না। কিন্তু আমি কোন কথা বললাম না। আমি তো জানি, আমি নিজের চোখে মিস জনসনকে অনুতাপ করতে দেখেছি। ডঃ লিডনার তাকে যত আড়ালই করুন না কেন, আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবেন না।

যাইহোক, ঠিক হল পরদিন আমি ইংলন্ডে ফিরে যাব। ডঃ রেলির মাধ্যমে ব্যবস্থা করলাম, হসপিটালে মেট্রনের সঙ্গে দু-একদিন আমি থাকব। তারপর ইংলন্ডে ফিরে যাব –গাড়ি এবং ট্রেন পথে বাগদাদ কিম্বা সরাসরি লিসবন হয়ে।

ডঃ লিডনার অনুগ্রহ দেখালেন আমাকে, তার একান্ত ইচ্ছা মিসেস লিডনারের স্মৃতি হিসাবে আমি যেন তার স্ত্রীর ব্যবহৃত দামী কচ্ছপের খোলে তৈরি টয়লেট সেটটা সঙ্গে নিয়ে যাই।

না, না ডঃ লিডনার এ অনুরোধ আমাকে করবেন না, সঙ্গে সঙ্গে আমি আপত্তি জানালাম, অত দামী সেট আমি নিতে পারব না।

জানো, আমার স্ত্রীর কোন বোন নেই, আর এ জিনিস অন্য কাউকে দেওয়াও যায় না।

তার কথা শুনে মনে হল, ওই দামী টয়লেট সেটটা তিনি লোভী মিসেস মারকাভোকে দিতে চান না। আর আমার মনে হয় না, সেটা তিনি মিস জনসনকে উপহার হিসাবে দিতে চাইবেন।

একটু ভেবে দ্যাখো, ডঃ লিডনার তার স্ত্রীর আলমারির চাবি আমার হাতে দিয়ে বললেন–আলমারির মধ্যে লুসির অলঙ্কার আছে, তোমার পছন্দ মত একটা বেছে নিও। আর একটা কথা, ওর সব পোষাকগুলো সঙ্গে নিয়ে যেও। ডঃ রেলি হাসানিয়ের গরীব খ্রিশ্চিয়ান পরিবারদের মধ্যে ওর সেই পোষাকগুলো বিতরণ করার ব্যবস্থা করবেন।

ওঁর অমন সৎ প্রস্তাব শুনে আমি খুব খুশি হলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে ওঁর কথায় রাজি হয়ে গেলাম।

মিসেস লিডনারের ঘর। আমার কাজ সেরে তার আলমারিতে চাবি দিয়ে ফিরে আসার আগে ঘরের চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিতে ভুললাম না। ওই সেই খাট, ওই খাটের পাশে দুর্ঘটনার দিন আমি একটা চেয়ারে বসে তার সঙ্গে গল্প করছিলাম। তিনি বই পড়তে পড়তে আমার কথার জবাব দিচ্ছিলেন। তারপর ওঁর ঘর থেকে চলে আসার পর কি যে হল

আমি কুসংস্কারাচ্ছন্ন নই। তবু কেন জানি না আমার মনে হল, মিসেস লিডনারের আত্মা বোধহয় এই ঘরের ভিতরে বিচরণ করছে নিশ্চয়ই। হাসপাতালে মেয়েদের সেই প্ল্যানচেট করার কথা আমার মনে পড়ে গেল। অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য সেই প্ল্যানচেটে লেখা হয়েছিল। কথাটা ভাবতে ভাবতে আমি নিজেই যেন নিজেকে সম্মোহিত করে ফেললাম। আমি আর তখন আমি নই। আমি তখন মিসেস লিডনারে রূপান্তরিত হয়ে গেছি। সময় সেদিনকার সেই দুপুরবেলা। আমি মিসেস লিডনার! নিজের মনেই আমি নিজেকে মিসেস লিডনার হিসাবে জাহির করতে থাকলাম। তার বিছানায় চোখ বন্ধ করে আধো ঘুমে ঘুমিয়ে আছি আমি।

ঠিক বেলা দেড়টার সময় ভেজানো দরজার পাল্লাটা একটু করে খুলে যেতে থাকে।

এবার আমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রসারিত হল দরজার উপরে। সেই সময় অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা আমি দেখতে চাই, দরজা ঠেলে কে ঘরে ঢোকে?

ধীরে ধীরে দরজার ফাঁক বড় হতে থাকল। দরজাটা সম্পূর্ণ খুলে যেতেই দেখলাম দরজার ওপরে বিল কোলম্যান দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে তার এক গুচ্ছ লাল টকটকে ফুল।

আমি দুঃখিত নার্স অপরাধীর মতো তিনি কৈফিয়ত দিতে চাইলেন, আমার বড় ভুল হয়ে গেছে, আগে থেকে আপনাকে খবর না দিয়ে ঘরে ঢোকাটা আমার অন্যায় হয়ে গেছে।

কি সরল যুবক। মায়া হল তার জন্য। হাসতে হাসতে বললাম–আপনি মিঃ কোলম্যান, দেখুন তো কি ভয় না আমাকে পাইয়ে দিয়েছিলেন।

কোলম্যান আর একদফা ক্ষমা চেয়ে নিয়ে তার এখানে আসার উদ্দেশ্যর কথা জানালেন। মিসেস লিডনারের ছবির সামনে ওই লাল ফুলগুলো তিনি নাকি রোজ রেখে যান তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য।

সত্যি তাকে শ্রদ্ধা জানানোর এ এক মহৎ প্রচেষ্টা মিঃ কোলম্যান। আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম স্বাভাবিক, আপনি ছিলেন তাঁর সত্যিকারের একজন গুণগ্রাহী। আপনার আচরণে খাঁটি ইংরেজ বনেদিয়ানা পুরোপুরি বর্তমান।

আমি যাচ্ছি শুনে ফাদার ল্যাভিগনি দুঃখ প্রকাশ করলেন। কথায় কথায় তিনি জিজ্ঞাসা করলেন–মিঃ পোয়ারোকে আজ দেখতে পাচ্ছি না, কোথায় তিনি?

আমি তাকে বললাম আজ সারাদিন তিনি টেলিগ্রাম পাঠানোর কাজে ব্যস্ত থাকবেন।

ফাদার ল্যাভিগনি ভ্রু কোঁচকালেন।

টেলিগ্রাম? আমেরিকায়?

হ্যাঁ, সেই রকমই তো মনে হয়।

তারপর তিনি জানতে চাইলেন মিসেস লিডনার এবং আমি কখন কোথায় কিভাবে জানালার সামনে সেই আগন্তুককে মিসেস লিডনারের ঘরে উঁকি মারতে দেখেছি, তার একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ আমি দিতে পারি কি না। শেষে তিনি তার মতামত জানিয়ে বললেন, আমার সন্দেহ হয়, নোকটা ইউরোপীয় কি না, কারণ এখানে ইরাকি ছাড়া ওভাবে কেউ উঁকি দিতে পারে না।

ফাদার ল্যাভিগনির ধারণাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। হয়তো তার কথাই ঠিক, এ কাজ স্থানীয় লোকেরাই করে থাকবে।

তাছাড়া, খুনী নিশ্চয়ই একটা না একটা জিনিস ঘটনাস্থলে ফেলে গিয়ে থাকবে। ফাদার ল্যাভিগনি বাড়ির বাইরেটা ঘুরে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করে বলেন–গোয়েন্দা গল্পে অপরাধীরা সব সময় এরকম ভুল করে থাকে।

কিন্তু বাস্তব জীবনে অপরাধীরা দারুণ চালাক। আমি তাকে কথাটা মনে করিয়ে দিলাম।

ফাদার ল্যাভিগনি চলে যাবার পর আমি আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে এলাম। মিস জনসনকে ছাদের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম, তার দৃষ্টি সামনের দিকে। স্থির চোখে কি যেন লক্ষ্য করছিলেন তিনি। কাছে গিয়ে তার পিঠে আলতো করে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করলাম–অমন নিবিষ্ট মনে কী দেখছেন মিস জনসন?

তাঁর চোখে আতঙ্কের ছায়া থিরথির করে কাঁপতে থাকে–কেমন করে বাইরে থেকে কোন লোক নিঃশব্দে সবার দৃষ্টি এড়িয়ে এ বাড়িতে প্রবেশ করতে পারে, আমি সেটা খুঁটিয়ে দেখছি।

মিস জনসনকে অনুসরণ করে আমিও তাকালাম সামনের দিকে। দেখলাম, মিঃ রেইটার ফটোগ্রাফিক রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং ফাদার ল্যাভিগনি কোর্টইয়ার্ড পার হচ্ছিলেন।

সত্যি? কিন্তু আমি তো তেমন কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। একটু খুলে বলবেন মিস জনসন?

মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালেন মিস জনসন, এখন নয়, এখন নয়, পরে। আরও ভাল করে আমাদের দেখতে হবে। আমাকে প্রথমে ভাবতে হবে, তারপর–

কথাটা অসমাপ্ত রেখে নিচে নেমে যান মিস জনসন। আমাকে আহ্বান না জানিয়েই। বেশ বুঝতে পারি, এই মুহূর্তে উনি আমার সঙ্গ চান না। অতঃপর আমি আবার দূরে দৃষ্টি প্রসারিত করে দিলাম। প্রধান প্রবেশ পথের সামনে ওয়াটার বয় এবং ভারতীয় রাঁধুনি আলাপরত। আমার ধারণা, ওদের দৃষ্টি এড়িয়ে কেউ এ বাড়িতে প্রবেশ করতে পারে না।

.

২৪.

খুন একটা অভ্যাস

সেদিন রাত্রে আমরা একটু সকাল সকাল ঘুমোতে গেলাম। নৈশভোজের সময় মিস জনসনের আচরণ আগের থেকে একটু স্বাভাবিক বলেই মনে হল। তবে সব সময় চুপচাপ ছিল সে। স্তব্ধ, হতবাক। মনে হয়, মনের সঙ্গে প্রচণ্ড লড়াই চালাচ্ছিল সে ভিতরে ভিতরে। মাঝরাতে একটা চাপা গোঙানির আওয়াজে আমার ঘুম হঠাৎ ভেঙ্গে যায়। কান পেতে শুনি আওয়াজটা কোন দিক থেকে আসছে। দরজার বাইরে এসে টের পেলাম শব্দটা আসছে মিস জনসনের ঘর থেকে। তাড়াতাড়ি তার ঘরে ছুটে যাই। আমার ঘরের পাশেই তার ঘর।

বিছানায় মিস জনসনের দেহটা থরথর করে কাঁপছিল। আমার হাতের মোমবাতিটা তার মুখের কাছে নিয়ে যেতেই কথা বলার জন্য চেষ্টা করলেন তিনি, কিন্তু তার ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর ফিস্ ফিস্ শব্দের মত শোনাল। বোঝা গেল না একবর্ণও। ভাল করে তাকাতে গিয়ে আমি দেখলাম মিস জনসনের ঠোঁট দুটি এবং চিবুকের একটা অংশ পুড়ে গেছে।

মিস জনসন তার দৃষ্টি আমার দিক থেকে সরিয়ে নিয়ে মেঝেয় পড়ে থাকা একটি গ্লাসের উপরে ফেললেন, যেটা তার হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল। আমি সেটা হাতে তুলে নিয়ে তার ভিতরে একটা আঙুল রাখতে গিয়ে অস্ফুটে চিৎকার করে উঠলাম। আমার আঙুলটা তখন জ্বলে যাচ্ছিল যেন। পরক্ষণে আমি মিস জনসনের মুখের দিকে তাকালাম।

ঘটনাটা যে কি, বুঝতে আমার একটুও অসুবিধে হল না। যেভাবেই হোক, ইচ্ছাকৃত কিম্বা জোর করেই হোক, কিছু পরিমাণ, অক্সালিক কিম্বা হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড তাকে গলাধঃকরণ করতে হয়েছে। আমার তাই সন্দেহ।

আমি তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে ডঃ লিডনারকে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম এবং পরে তিনি সবার ঘুম ভাঙ্গালেন হৈ-চৈ করে। ডেভিড এয়োটকে পাঠানো হল হাসানিয়ের ডঃ রেলিকে ডেকে আনার জন্য।

মিস জনসনকে যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই দেবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা আমরা করলাম। ঝুঁকে পড়ে আমি তাকে মরফিয়া ইনজেকসন দিতে গেলে অস্ফুটে কি যেন বলতে গেলেন তিনি। কোন কথাই স্পষ্ট নয়, শ্বাসরোধ করা কণ্ঠস্বর।

এই জানালা…… কোন রকমে তিনি বলেন, নার্স, ওই জানালা…..

সেই শেষ কথা তাঁর, সেই শেষ তার চোখ মেলে তাকানো। তারপরেই তার দেহের স্পন্দন স্তব্ধ হয়ে গেল, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন মিস জনসন। সেই ভয়ঙ্কর বিভীষিকাময় রাত্রির কথা আমি কোনদিনও ভুলতে পারব না। তারপর একে একে এলেন ডঃ রেলি, ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড, এবং সব শেষে এলেন এরকুল পোয়ারো।

পোয়ারোকে দেখে আমি চোখে জল রাখতে পারলাম না। উঃ কি ভয়ঙ্কর সেই দৃশ্য মঁসিয়ে পোয়ারো। সান্ত্বনার সুরে বললেন–হ্যাঁ, অত উতলা হবেন না। আমি জানি, আপনার সাধ্যমতো চেষ্টা আপনি করেছেন। আমার মনে হয়, সম্ভবতঃ মিস জনসন ঘুম থেকে সম্পূর্ণ জেগে ওঠার আগে ওই অ্যাসিডের কিছু অংশ গলাধঃকরণ করে থাকবেন। তা আপনার কী ধারণা নার্স?

না, আমার তা বিশ্বাস হয় না। একটু ইতস্ততঃ করে আমি বললাম আমার বিশ্বাস, গতকাল অপরাহ্নে অস্বাভাবিক কিছু একটা তিনি নিশ্চয়ই দেখে থাকবেন।

আপনি কী বলতে চাইছেন? তবে কি তিনি কিছু দেখেছেন?

তারপর পোয়ারোকে আমি আমাদের গতকালের সেই কথাবার্তা হুবহু পুনরাবৃত্তি করে শোনালাম। সব শোনার পর একটা অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে। সেই শব্দ আক্ষেপের, দীর্ঘশ্বাসের।

তারপর তাকে সঙ্গে নিয়ে আমি ছাদে উঠে এলাম জায়গাটা দেখানোর জন্য। যেখান। থেকে গতকাল অপরাহ্নে মিস জনসন হয়তো কাউকে দেখে থাকবেন, যে তার ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছিল পরবর্তীকালে।

ফটোগ্রাফিক রুমের দরজার সামনে মিঃ রেইটারকে তখন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখার কথা এবং ফাদার ল্যাভিগনি কোর্টইয়ার্ড পেরিয়ে যাওয়ার কথা, সব আমি খুলে বললাম, কোন কথাই গোপন করলাম না কিন্তু আমরা তো তখন অস্বাভাবিক কিছুই দেখতে পাইনি। কিন্তু তিনি দেখেছিলেন।

পোয়ারো মাথা নেড়ে বললেন–কী তিনি দেখেছিলেন?

ঠিক সেই সময় ভোর হয়ে আসছিল। সারা পূর্ব আকাশে রক্তিমাভা ছড়িয়ে পড়ছিল একটু একটু করে।

আঃ কি চমৎকার সূর্যোদয়! শান্তভাবে বললেন পোয়ারো। তাঁর দৃষ্টি প্রসারিত হল পূর্ব থেকে পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণে।

তারপর আমি তার দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেলাম।

সত্যি আমি কি বোকা, বিড়বিড় করে আপন মনে তিনি বলে চলেন, সত্যি যেখানে এত স্পষ্ট, এত স্পষ্ট–