১০. শনিবারের অপরাহ্ন

১০. শনিবারের অপরাহ্ন

মিসেস লিডনার এক শুক্রবার তার জীবনের কাহিনী আমাকে শোনালেন। পরদিন শনিবার সকালে বাতাসে যে সুর ভেসে আসে, বুঝি তার কাহিনীর সঙ্গে কোথায় যেন একটা অমিল থেকে যায়। বিশেষ করে আমি লক্ষ্য করেছি, আমার উপর প্রভুত্ব করার একটা ঝোঁক আছে। আমি ওঁর সেবিকা হিসাবে এখানে কাজে এসেছি, সে কথা আমি অস্বীকার করছি। না, কিন্তু তাই বলে আমাকে ভুল বোঝানো হবে, বিশেষ, করে তার মানসিক রোগ উপশমের ভারটা যখন আমার উপরে ন্যস্ত, সেই দাবীতে আমি অন্তত ওঁর কাছ থেকে প্রকৃত সত্য ঘটনাটা আশা করতে পারি, পারি কি না? ঠিক আছে, তার জন্য আমি অবশ্য বিন্দুমাত্র বিস্মিত নই। এ রকম ঘটনা বার বার আমার জীবনে ঘটছে এবং ঘটবে, এর মধ্যে অবাক হবার কী আছে? মেয়েরা সাধারণতঃ আবেগের মাথায় নিজেদের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে থাকে। পরে ঠাণ্ডা মাথায় নিজের ভুল বুঝতে পেরে সত্য ঘটনাটা তখন বেমালুম চেপে যায়। এই হল মানুষের স্বভাব। আমরা সবাই স্বভাবের দাস, এ কথা অস্বীকার করা যায় না, তা না হলে সত্যকে অস্বীকার করা হয়।

তারপর থেকে আমি খুব সতর্ক হলাম, মিসেস লিডনার যে কাহিনী আমাকে শুনিয়েছিলেন, সে নিয়ে তার কাছে ফিরে আর আমি উচ্চবাচ্য করলাম না ভুলেও। ওদিকে সকালেই মিঃ কোলম্যান হাসানিয়ের পথে যাত্রা করেছে। সঙ্গে চিঠিগুলো নিতে সে ভোলেনি। শ্রমিকদের বেতন দিবস আজ, ব্যাঙ্ক থেকে খুচরো মুদ্রা আনতে হবে তাকে। বিকেলের আগে ফিরতে পারছে না সে। আমার অনুমান শীলা রেলির সঙ্গে অপরাহ্নের ভোজ সারবে সে। সাড়ে তিনটার পর খোঁড়া খুঁড়ির কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়, কারণ একটু পরেই বেতন দেওয়া শুরু করা হবে।

ছোকরা আবদুল্লার কাজ হল মাটির পাত্রগুলো বোয়া মোছা করা। কোটইয়ার্ডের ঠিক মাঝখানে বসে সে তার কাজ করছিল এবং মাঝে মাঝে কেমন যেন সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছিল চারিদিকে। মিঃ কোলম্যান ফিরে না আসা পর্যন্ত ডঃ লিডনার এবং মিঃ এমাট তাদের নির্দিষ্ট কাজে ব্যস্ত রইলেন। আর মিঃ ক্যারি খনন কার্যের তদারকি করতে থাকলেন।

ওদিকে মিসেস লিডনার তার শয়নকক্ষে বিশ্রাম নিচ্ছেন। তাঁর আরামের যথাযথ ব্যবস্থা করে আমি আমার ঘরে ফিরে আসি। ঘুম আসছিল না, বই খুলে পড়তে বসলাম। তখন পৌনে একটা হবে, হাতে যথেষ্ট সময় ছিল। নার্সিংহোমে মৃত্যু–রীতিমতো রোমাঞ্চকর কাহিনী। যদিও লেখকের লেখার ধরণ দেখে আমি মনে করি নার্সিংহোম পরিচালনার ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতা কম, এ ব্যাপারে তিনি আর একটু যত্ন নিলে বোধহয় ভালো হত। যাইহোক, এ ব্যাপারে লেখককে দু-একটা কথা লেখার কথা আমি ভাবছিলাম। অবশেষে বই বন্ধ করে (কাহিনীর বিবরণ মত ভোজ টেবিলের পরিচারিকাকে অভিযুক্ত করা হয়, কিন্তু একবারও তাকে আমার সন্দেহ হয়নি) ঘড়ির দিকে তাকালাম, তিনটে বেজে কুড়ি! সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়লাম এবং গায়ে ইউনিফর্ম চাপিয়ে কোর্ট ইয়ার্ডের সামনে এসে দাঁড়ালাম।

আবদুল্লা তখন তার কাজে ব্যস্ত এবং তার সেই বিষণ্ণ গানের সুরটা ঠোঁটে লেগেছিল। ডেভিড এমাট তার পাশে দাঁড়িয়ে ব্রুশ দিয়ে ধোয়া মাটির পাত্র গুলো আলাদা করে রাখছিলেন। আমার দৃষ্টিটা সেদিক থেকে ফিরিয়ে নিতে হল কারণ ডঃ লিডনারকে ছাদ থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসতে দেখলাম তখন।

অপরাহ্নটা খুব একটা খারাপ নয়, ডঃ লিডনার উৎফুল্ল হয়ে বললেন, ছাদটা পরিষ্কার করে এলাম। কদিন থেকে লুসিও অভিযোগ করছিল, ছাদে বেড়াবার জন্য এতটুকু জায়গা নেই। লুসি এবার খুশি হবে। এই খবরটা আমি এক্ষুনি তাকে দিতে যাচ্ছি।

মনে হয় মিনিট দেড়েকও হয় নি ডঃ লিডনার তাঁর স্ত্রীর শয়নকক্ষে গিয়ে প্রবেশ করেছিলেন, সেটুকু সময়ের মধ্যেই তিনি আবার ফিরে এলেন। তার দিকে এই মুহূর্তে তাকালে মনে হয় আমি যেন রাতের বিভীষিকা দেখছি। আমার স্পষ্ট মনে আছে ঘরে ঢোকার সময় তাকে বেশ হাসি-খুশি দেখেছিলাম। কিন্তু তিনি ফিরে এলেন। ঠিক মাতাল অবস্থায়, পা টলছে, মুখে আতঙ্কের ছাপ।

নার্স–ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর, বিচিত্র চাহনি, নার্স সঙ্গে সঙ্গে আমার কেন জানি না মনে হল, একটা কোন অঘটন ঘটেছে নিশ্চয়ই। ডঃ লিডনারের ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর অন্তত যে কথাই বলে দিচ্ছে যেন। তাই আমি তাড়াতাড়ি তার কাছে ছুটে এলাম। আমার দিকে তাকিয়েছিলেন তিনি, ভয়ঙ্কর বীভৎস সেই চাহনি। টান-টান ধূসর রঙের মুখ। তার অবস্থা দেখে মনে হল, যে কোন মুহূর্তে তার দেহটা অবশ হয়ে পড়ে যেতে পারে।

আমার স্ত্রী… কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল তার, আমার স্ত্রী ……… ওঃ হায় ঈশ্বর……

তার অসমাপ্ত কথাটা শোনবার জন্য আমার বুঝি আর তর সইছিল না। ডঃ লিডনারের পাশ কাটিয়ে তার স্ত্রীর শয়নকক্ষে ছুটে গেলাম। ঘরে ঢোকা মাত্র আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হল যেন।

বিছানার উপরে মিসেস লিডনারের দেহটা দলাপাকানো অবস্থায় পড়ে রয়েছে।

আমি তার উপরে ঝুঁকে পড়লাম। তার দেহে প্রাণের কোন সাড়া নেই। স্পন্দনহীন দেহটা দেখে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না, তিনি মৃত। মৃত্যু ঘটেছে অন্তত ঘণ্টাখানেক আগে। মৃত্যুর কারণটা অনুমান করা খুবই সহজ ডানদিক ঘেঁষে মাথার উপর প্রচণ্ড আঘাত করার ফলেই তার মৃত্যুটা ঘটে থাকবে। মনে হয়, মৃত্যুর পূর্বে তিনি একবার বিছানার উপর উঠে বসবার চেষ্টা করে থাকবেন, তারপর যেভাবে যে অবস্থায় ছিলেন ঠিক সেখানেই পড়ে থাকেন। বিশেষ কারণেই আমি তার মৃতদেহ স্পর্শ করলাম না।

ক্লু খোঁজার জন্য চকিতে ঘরের চারিদিকে একবার তাকিয়ে দেখে নিলাম, কিন্তু উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু চোখে পড়ল না। জানালাগুলো সব বন্ধ এবং ছিটকিনি লাগানো। খুনের চিহ্ন লুকিয়ে রাখার মতো জায়গাও তেমন চোখে পড়ল না। মনে হয় খুনী অনেক আগে নির্বিবাদে তার কাজ হাসিল করে কেটে পড়েছে।

ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমি দরজা বন্ধ করে দিলাম।

বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি ডঃ লিডনার তখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। ডেভিড এমোট তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, ফ্যাকাশে মুখে আমার দিকে তাকালেন তিনি। তার চোখে অনেক প্রশ্ন।

আমি তার প্রশ্নের উত্তর দিলাম এক এক করে। গলা থেকে কিছুতেই স্বর বেরুতে চাইছিল না, তবু কোন রকমে নিচু গলায় বললাম সমস্ত ঘটনা, সংক্ষেপে।

ডেভিডের উপর আমার বরাবর আস্থা ছিল। শান্ত প্রকৃতির মানুষ। যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই, তিনি আমার খবরটা উপলব্ধি করে নীল চোখে বড় বড় করে তাকালেন। কম কথার মানুষ তিনি, তার ওই চোখের চাহনিতে তিনি বুঝিয়ে দিলেন যে, ঘটনাটা সাধারণ নয়, তার জটিলতা ভয়ানক রূপ নিতে বাধ্য।

একটু সময় চুপ করে থেকে তিনি বললেন, আমার মনে হয় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পুলিশে একবার আমাদের খবর দেওয়া উচিত। যেকোন মুহূর্তে বিল ফিরে আসতে পারে। এখন লিডনারকে নিয়ে কি করব, সেটাই এখন বিরাট সমস্যা আমাদের কাছে যেন।

ওঁকে ওঁর ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্য আসুন আমায় একটু সাহায্য করুন।

মাথা নাড়ল সে।

মনে হয় দরজায় সর্বপ্রথম একটা তালা লাগান দরকার। ডেভিড বলে। তারপর তিনি দরজায় তালা লাগিয়ে চাবিটা আমার হাতে দিয়ে বলেন, চাবিটা তোমার কাছে থাকাই ভাল। যখন-তখন

দুজনে ধরাধরি করে তার ঘরে তাকে বহন করে এনে বিছানায় শুইয়ে দিলাম আমরা। তারপর ব্রান্ডির খোঁজে বেরিয়ে গেলেন মিঃ এমোট। একটু পরে মিস জনসনকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলেন তিনি। মিস জনসনকে কেমন চিন্তিত এবং তার মুখটা থমথমে দেখাচ্ছিল, তবে তাকে বেশ শান্ত এবং নির্ভরযোগ্য বলেই মনে হচ্ছিল। তার উপর ডঃ লিডনারকে ভার দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম কোর্টইয়ার্ডে দ্রুত পায়ে।

ঠিক সেই সময় ধনুকাকৃতি খিলান পথ দিয়ে স্টেশন ওয়াগনটা কোর্ট ইয়ার্ডে এসে প্রবেশ করল। বিলকে হাসি মুখে নামতে দেখে আমরা সবাই বিচলিত এ সময়।

হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো, খুশিতে উপচে পড়ে সে আবার বলে ওঠে, হাইওয়ের কোন ডাকাতির নামগন্ধ নেই আর–

কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ সে চুপ করে গেল। আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকে সে বলে, কি ব্যাপার? আপনারা সব চুপ কেন, কথা বলছেন না কেন? আপনাদের দেখে মনে হচ্ছে, আপনাদের প্রিয় পোষা পাখিটাকে দুষ্টু বেড়ালটা মেরে ফেলেছে।

মিসেস লিডনার মৃত, মিঃ এমাট সংক্ষেপে বললেন, তাকে খুন করা হয়েছে।

কি বললে? বিলের ফর্সা মুখটা হঠাৎ অবিশ্বাস্য ভাবে বদলে যায়। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে সে, মিসেস লিডনার মৃত!

মৃত? কান্না-জড়ানো কণ্ঠস্বর। পিছন ফিরে তাকাতে গিয়ে দেখি মিসেস মারকাডো দাঁড়িয়ে আছেন। তুমি কি বলতে চাও মিসেস লিডনার নিহত?

হ্যাঁ, আমি প্রত্যুত্তরে বললাম, খুন হয়েছেন তিনি।

না! আর্ত চিৎকার। ওঃ না! এ আমি বিশ্বাস করি না। সম্ভবতঃ তিনি আত্মহত্যা করেছেন।

আত্মহত্যা? নিজের মাথায় কেউ অমন মারাত্মক ভাবে আঘাত করে আত্মহত্যা করতে পারে? আমি শুকনো গলায় বলি, তিনি খুন হয়েছেন মিসেস মারকাডো।

হঠাৎ শব্দ করে একটা কাঠের প্যাকিংবাক্সের উপর তিনি বসে পড়লেন। উঃ, এ যে ভয়ঙ্কর, বীভৎস–

ভয়ঙ্কর, বীভৎস এ ঘটনা, একথা এখন আর অজানা নয় আমাদের কাছে। এ সব কথা ওঁর মুখ থেকে শুনতে আমাদের মন সায় দিচ্ছিল না। আমার আশঙ্কা ভদ্রমহিলা বোধহয় লিডনারের প্রতি হিংসার মনোভাব প্রদর্শনের জন্য এখন অনুতপ্ত, বিবেকের দংশনে ক্ষত-বিক্ষত।

মিনিট পনেরো পরে একরকম এক নিঃশ্বাসে তিনি জিজ্ঞেস করে ফেললেন, তা এখন তোমরা কী করতে যাচ্ছো!

ওঁর কথার উত্তর আমরা কেউ দিলাম না। চুপ করে যে যার কাজে লেগে পড়লাম তারপর।

মিঃ এমোট শান্তভাবে তার কাজ বুঝে নিলেন।

শোন বিল, তুমি বরং আবার হাসানিয়েয় ফিরে যাও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। এখানকার নিয়ম কানুন আমি ঠিক জানি না। ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড এখানকার পুলিশের বড় কর্তা, তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে মনে হয় ঠিক হবে। তবে তার আগে ডঃ রেলিকে খবর দিতে হবে। তিনি জানেন, এরপর আমাদের কি করতে হবে। কি করা উচিত।

মিঃ কোলম্যান মাথা নাড়লেন। তার মাথায় তখন একরাশ প্রশ্ন গিজগিজ করছিল। তার মুখ দেখে মনে হয়, খুব ভয় পেয়ে গেছে। নিঃশব্দে সে অপেক্ষামান স্টেশন ওয়াগনে উঠে বসে। একটু পরেই গাড়ি চালিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায় সে।

তারপর মিঃ এমোট কতকটা অনিশ্চিত ভাবে বলে, আমার মনে হয় প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদটা এখন সেরে নিলে ভাল হয়। বলেই সে গলা চড়িয়ে হাঁক দেন, ইব্রাহিম!

হুজুর।

পরিচারক ইব্রাহিম ডাক শুনে ছুটে আসে। মিঃ এমাট তার সঙ্গে আরবি ভাষায় কথা বলতে থাকেন! মিঃ এমাটের অভিব্যক্তি দেখে মনে হয় তার প্রশ্নগুলো খুব কঠিন এবং চোখা চোখা হচ্ছিল। ছেলেটার মুখ নাড়ার ভঙ্গি দেখে মনে হয়, সব কথাতেই সে না বলছিল, অস্বীকার করছিল।

অবশেষে মিঃ এমাট কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বলে, ইব্রাহিমের বক্তব্য হল, আজ অপরাহ্নে কোন আগন্তুক কিংবা অপরিচিত কোন লোক এখানে আসেনি, এবং যেই আসুক না কেন নিঃশব্দে সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে সে তার কাজ হাসিল করে পালিয়েছে।

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই সে তাই করেছে। মিসেস মারকাডোই প্রথম মুখ খুললেন, পরিচারকরা যখন অন্য কাজে ব্যস্ত ছিল, তখনই আততায়ী মিসেস লিডনারকে খুন করে পালায়। 

হ্যাঁ, মিঃ এমাটের কথায় অনিশ্চয়তার সুর আমার কানে বাজে, বোধহয় তাই।

তারপর সে বাচ্চা পট-বয় আবদুল্লার দিকে ফিরে আরবি ভাষায় কতকগুলো প্রশ্ন করে তাকে। প্রত্যুত্তরে ছেলেটি উত্তেজিত হয়ে আরবি ভাষায় কি যেন বলল তাকে।

মিঃ এমাট হতভম্বের মত ভ্রু কুঁচকায়, এ আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না, নিজের মনে বিড়বিড় করে সে বলতে থাকে, এ আমি আদৌ বুঝতে পারি না।

কিন্তু সে আমাকে বলল না, কি সে বুঝতে পারছে না।

.

১১.

বিচিত্র ঘটনা

এখানে আমার ব্যক্তিগত ভূমিকার কথা যতটা সম্ভব সবিস্তারে বর্ণনা দেবার চেষ্টা করব। পরবর্তী দু’ঘণ্টা আমাকে নীরবে কাটাতে হল ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড, পুলিশ এবং ডঃ রেলির আগমনের অপেক্ষায়। তখন অপরাহ্নের শেষ আলো এসে পড়েছিল কোর্টইয়ার্ডের পশ্চিম প্রান্তে, সময় পাঁচটা। ডঃ রেলি তার অফিস ঘরে যেতে বললেন আমাকে। ডঃ লিডনারের চেয়ারে বসে তিনি আমাকে তার বিপরীত আসনে বসতে বললেন।

আচ্ছা নার্স, এবার শুরু থেকে আরম্ভ করা যাক, কি বলো? নোটবুক তার হাতের কাছেই ছিল। এ আমার নিজের সন্তুষ্টির জন্য, বুঝলে? এখন বল তো ঠিক কখন ডঃ লিডনার তার স্ত্রীর মৃতদেহ দেখতে পান?

তা তখন তিনটে বাজতে পনেরো হবে।

ঠিক আছে, ডঃ রেলি নোটবুক থেকে মুখ তুলে তার পরবর্তী প্রশ্নের জন্য তৈরি হলেন, আচ্ছা, মিসেস লিডনারের ঠিক কখন মৃত্যু হয়, এ ব্যাপারে তোমার কী অনুমান?

ওঃ ডক্টর আমি অত্যন্ত দুঃখিত, গলার স্বরটা যতটা সম্ভব পরিষ্কার করে বললাম, আমার বলা উচিত নয়।

অমন পেশাদারী কথা বলো না। আমি দেখতে চাই আমার সঙ্গে তোমার অনুমান মিলে যায় কি না!

ঠিক আছে, তাহলে বলি, আমার অনুমান এক ঘন্টা আগে ওঁর মৃত্যু ঘটে থাকবে।

তা হতে পারে। সাড়ে চারটের সময় আমি মৃতদেহ পরীক্ষা করে দেখেছি, এবং নোটবুকে মৃত্যুর সময় উল্লেখ করেছি একটা পনেরো থেকে পঁয়তাল্লিশ। মৃত্যুর সময় মোটামুটি দেড়টা হিসাবে ধরে নেওয়া যায়, কি বল?।

আমি চুপ করে ওঁর কথাগুলো শুনে গেলাম। কোন মন্তব্য নয়।

এই খুন-খারাবি ব্যাপারটা বড় অদ্ভুত, ডঃ রেলি নিজের থেকেই আবার বলেন, আচ্ছা, আপনি বলেছেন, তখন আপনি নাকি বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। ভাল কথা, কোন শব্দ শুনতে পাননি।

দেড়টার সময় ?না ডক্টর। দেড়টা কেন, তার আগে কিম্বা পরে কোন সময়েই আওয়াজ বলতে কিছু আমার কানে আসেনি। পৌনে একটা থেকে তিনটে কুড়ি পর্যন্ত আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তাই কোন শব্দ আমি শুনতে পাইনি, কেবল ওই আরবী ছেলেটির গুন গুন আওয়াজ ছাড়া এবং ঘুমের ঘোরে মাঝে মাঝে ছাদ থেকে ডঃ লিডনারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মিঃ এমাটের চিৎকারধ্বনি আমার কানে আসা ছাড়া অন্য আর কোন শব্দ আমি শুনতে পাইনি।

হ্যাঁ, সেই আরবী ছেলেটি

 ডঃ রেলির চোখে ভ্রুকুটি।

ঠিক সেই সময় ঘরের দরজাটা খুলে যায়, ডঃ লিডনার এবং ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড প্রবেশ করলেন। ব্যস্তবাগীশ মানুষ এই কাপ্টেন মেটল্যান্ড, ধূসর চোখে ক্রুর চাহনি।

ডঃ রেলি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ডঃ লিডনারকে আসন ছেড়ে দিলেন। বসুন আপনি। আপনি যে আসতে পেরেছেন, তাতেই আমি খুব খুশি। আপনাকে আমাদের প্রয়োজন হবে। বড় বিচিত্র এই কেস।

ডঃ লিডনার মাথা নিচু করে বসে রইলেন।

আমি জানি। ডঃ লিডনার এবার আমার দিকে তাকালেন। নার্স লিথেরানের কাছে আমার স্ত্রী সব সত্য কথা প্রকাশ করে গেছেন। এই সময় কোন কিছু গোপন করা উচিত হবে না আমাদের। নার্স, তাই বলছি, গতকাল আমার স্ত্রীর সঙ্গে তোমার যে সব কথাবার্তা হয়, সব তুমি খুলে বল ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড এবং ডঃ রেলিকে, কোন কিছু গোপন করো না।

আমাদের কথাবার্তা যতটা সম্ভব অক্ষরে অক্ষরে আমি বলে গেলাম।

ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড আকস্মিক ভাবে কখন কখন কথা বলছিলেন। আমার বলা শেষ হতেই তিনি ফিরে তাকালেন ডঃ লিডনারের দিকে।

আর এ সব কথা সবই সত্য, তাই না লিডনার।

নার্স লিথেরানের প্রতিটি কথা সত্য।

কি বিচিত্র কাহিনী! ডঃ রেলির সরস মন্তব্য এবং জিজ্ঞাসা সেই চিঠিগুলো আপনি দেখাতে পারেন?

তিনি তার এ্যাটাচি কেস থেকে বার করে চিঠিগুলো আমাকে দেখান। তারপর সেগুলো তিনি টেবিলের উপরে রেখে দেন।

তাহলে সেগুলো সেখানে পড়ে আছে নিশ্চয়ই।

এ কাহিনীর ব্যপারে চুপ করে বসে থাকা ঠিক হবে না ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড, ডঃ রেলি এবার ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ডের দিকে ফিরে বলেন, এখন এই পত্রলেখককে খুঁজে বার করে শাস্তি দিতে হবে।

আচ্ছা এ কাজ কী মিসেস লিডনারের প্রাক্তন স্বামীর বলে আপনারা বিশ্বাস করেন? আমি আমার কৌতূহল আর চাপতে পারলাম না।

কেন, তুমি কী তা মনে করো না? ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড পাল্টা প্রশ্ন করলেন।

হ্যাঁ, একটু দ্বিধার সঙ্গে আমাকে বলতে হল, এর মধ্যে একটু সন্দেহ থেকে যায় বৈকি।

সে যাই হোক, এবার ডঃ লিডনার বলেন, লোকটা অবশ্যই খুনি এবং আমি এ কথাও বলব, মারাত্মক বিপদজ্জনক উন্মাদ লোক সে। তাকে আমাদের খুঁজে বার করতেই হবে ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড, আর সে কাজটা খুব কঠিন বলে মনে হয় না আমার।

আপনি যা ভাবছেন ব্যাপারটা তার থেকেও অনেক কঠিন, কাপ্টেন মেটল্যান্ডের দিকে ফিরে ডঃ রেলি বলেন, তাই না মেটল্যান্ড?

ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড উত্তর না দিয়ে গোঁফে তা দিতে থাকেন।

হঠাৎ সেই সময় আমার মুখ থেকে কথাটা ফসকে গেল, আমাকে মাফ করবেন, এ ব্যাপারে একটা কথা না বলে আমি থাকতে পারছি না।

তারপর আমি সেই ইরাকি লোকটার কথা বললাম। দুদিন আগে নোকটা ফাদার ল্যাভিগনির ঘরের কাছে ঘোরাফেরা করছিল, সে কথাও বললাম ওঁদের।

ভাল কথা, ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড সব শুনে বলেন, খবরটা আমরা নোট করে রাখলাম। খবরটা পুলিশের পক্ষে বিশেষ সহায়ক হবে বলে মনে হয়। এ কেসের ব্যাপারে লোকটা জড়িত থাকলেও থাকতে পারে।

মনে হয়, লোকটা গুপ্তচরের কাজ করছিল, আমি ওঁদের বললাম, পথ পরিষ্কার হয়ে গেলে লোকটার সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিতে হবে।

ডঃ রেলি ভ্রু কুঁচকে বলেন, মনে কর পথ আদৌ পরিষ্কার হল না, তখন, তখন কী করবে?

হতভম্বের মত তার দিকে আমি তাকিয়ে থাকলাম। অতঃপর ডঃ লিডনারের দিকে ফিরে তাকালেন ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড।

খুব মনোযোগ দিয়ে আমার কথাগুলো শুনুন ডঃ লিডনার, এখন পর্যন্ত যে সব তথ্য আমরা পেয়েছি, এ হল তার সারমর্ম। মধ্যাহ্নভোজের পর, তখন পৌনে একটা হবে, নার্স লিথেরানকে সঙ্গে নিয়ে আপনার স্ত্রী তার শয়নকক্ষে চলে যান। আর আপনি নিজে তখন ছাদে চলে যান, সেখানে ঘণ্টা দুই কাটান, ঠিক?

হুঁ।

এই সময়ের মধ্যে আপনি কী একবারও নিচে নেমে আসেন নি?

কেউ আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য ছাদে উঠে আসেনি?

হ্যাঁ, এমোট ঘন ঘন এসেছিল। তার কাজই হল আমার সঙ্গে আলোচনা করার ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে নিচে নেমে গিয়ে মাটির পাত্র বোয়ার কাজে নিযুক্ত ছোকরাটার কাজ তদারক করা।

আচ্ছা ডঃ লিডনার এবার খুব ভাল করে মনে করে দেখুন, সব চেয়ে দীর্ঘ সময় কখন তিনি আপনার কাছে ছিলেন, আর সবচেয়ে কত বেশি সময় তিনি কোর্ট ইয়ার্ডে অনুপস্থিত ছিলেন? কোর্ট লিডনার মনে করার চেষ্টা করেন।

বলা মুশকিল, সম্ভবত দশ মিনিট। ব্যক্তিগতভাবে আমি বলব দুই কি তিন মিনিট, কারণ আমি যখন কোন কাজে ব্যস্ত থাকি তখন সময়ের জ্ঞান বলতে আমার কিছু থাকে না।

চকিতে একবার ডঃ লিডনারের দিকে তাকালেন ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড। তারপর নোটবুকের পাতা উল্টাতে গিয়ে তিনি বলেন, এবার শুরু থেকে পড়ে শোনানো যাক। একটু থেমে তিনি আবার বলেন, দেখুন মিঃ লিডনার দুপুর একটা থেকে দুটোর মধ্যে আপনার এক্সপিডিসনের সদস্যরা কে কি করছিল, তার একটা সঠিক বিবরণ দেবার চেষ্টা আমি করছি।

একটু অপেক্ষা করুন। আমার বক্তব্যটা পুরোপুরি শুনলে বুঝতে পারবেন, আমি কি বলতে চাইছি। প্রথমে মিঃ ব্যান্ড মিসেস মারকাডো তার জবানবন্দীতে বলেছেন, তিনি তখন তার শয়নকক্ষে শ্যাম্পু করা অবিন্যস্ত চুল বিন্যস্ত করতে ব্যস্ত ছিলেন। মিস জনসন বলেছেন, তিনি নাকি তখন বসবার ঘরে বসে সিলেন্ডার সীলের ছাপ নিচ্ছিলেন। মিঃ রেইটারের জবানবন্দীতে দেখা যাচ্ছে, তিনি তখন ডার্করুমে ফটো ডেভেলপিং’র কাজে ব্যস্ত ছিলেন। ওদিকে ফাদার ল্যাভিগনি বলেছেন, দুর্ঘটনার সময় তিনি তার শয়নকক্ষে কাজ করছিলেন। অপর দুজন সদস্য ক্যারি এবং কোলম্যানের প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, ক্যারি তখন খনন কাজে ব্যস্ত ছিল, আর কোলম্যান তখন হাসানিয়ায়। এরপর এখন পরিচারকদের প্রসঙ্গে আসা যাক– বলে ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড এখানে একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন?

আপনাদের ভারতীয় পাঁচকটি তখন প্রবেশ পথে প্রহরীর সামনে বসে একটা একটা করে পাখি শিকার করছিল। দুপুর একটা পনেরো নাগাদ হাউসবয় ইব্রাহিম এবং মনসুর তার সঙ্গে মিলিত হয়। আড়াইটে পর্যন্ত তারা সেখানে হাসি-ঠাট্টা এবং গল্প-গুজব করে কাটিয়ে দেয়। আর সেই সময়ের মধ্যেই আপনার স্ত্রীর মৃত্যু ঘটে।

ডঃ লিডনার সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না, আপনি আমাকে ধাঁধায় ফেলে দিলেন যেন। বলুন, আপনি কী ইঙ্গিত করতে চাইছেন?

তার আগে বলুন, কোর্ট ইয়ার্ডের দিকে দরজা ছাড়া আপনার স্ত্রীর ঘরে প্রবেশ করার অন্য আর কোন পথ আছে কি না!

না, থাকার মধ্যে দুটি জানালা, কিন্তু সেগুলো শক্ত রেলিং দিয়ে ঘেরা, তাছাড়া, আমার ধারণা, জানালা দুটি বন্ধ ছিল।

সপ্রশ্ন চোখে আমার দিকে তাকালেন ডঃ লিডনার, আমার সম্মতি পাওয়ার জন্য।

হ্যাঁ, জানালা দুটি ভেতর থেকে ছিটকিনি দেওয়া ছিল, সঙ্গে সঙ্গে আমি জবাব দিলাম।

সে যাই হোক, জানালা দুটি ভোলা থাকলেও ঘন লোহার রেলিং-এর ফাঁক দিয়ে মাথা গলিয়ে কেউ তার ঘরে ঢুকতে পারে না, কিম্বা সেই পথ দিয়ে বেরিয়ে আসতেও পারে না। ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড বলতে থাকেন, সে কথা আমি এবং আমার অনুগামীরাও ভেবে দেখেছি, কোন মতেই জানালা পথ দিয়ে আততায়ীরা আসতে পারে না। তাই আমার যতদূর মনে হয়, আপনার স্ত্রীর শয়নকক্ষে প্রবেশের জন্য আততায়ী নিশ্চয়ই খিলান পথের দরজা দিয়ে কোর্টইয়ার্ডে ঢুকে থাকবে। তবে সেই সঙ্গে প্রহরী, এবং সেই দুজন হাইসবয়দের কথা ধরে নিলে বলতে হয়, সে পথ দিয়ে তৃতীয় কোন ব্যক্তি প্রবেশ করতে পারে না।

সঙ্গে সঙ্গে ডঃ লিডনার লাফিয়ে উঠলেন।

তার মানে কী, কী বলতে চান আপনি?

শান্ত হয়ে আপনি বসুন ডঃ লিডনার, আমাদের কথা এখনও শেষ হয়ে যায়নি, ডঃ রেলি শান্তভাবে বললেন, আমি আপনার মনের অবস্থা জানি, স্ত্রী বিয়োগে আপনি এখন শোকাভূত, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, বাস্তবের মুখোমুখি আপনাকে হতেই হবে। হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম, আপনার স্ত্রীর খুনী বাইরে থেকে আসেনি, অতএব সে নিশ্চয়ই ভেতরের কেউ। মনে হয়, আপনাদের এক্সপিডিসনের কোন সদস্য মিসেস লিডনারের খুনের জন্য দায়ী।

.

১২.

আমি বিশ্বাস করি না….

না, না!

ডঃ লিডনার লাফিয়ে উঠে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে থাকেন পাগলের মতন।

এ একেবারে অসম্ভব, আপনি কি যেন বললেন ডঃ রেলি? অসম্ভব। আমাদের মধ্যে কেউ একজন? এ আপনি কী বলছেন? লুসিকে এখানকার প্রতিটি সদস্য ভালবাসত, ওর প্রতি সবাই অনুগত ছিল।

ডঃ রেলি স্তম্ভিত। এ অবস্থায় কিই বা তিনি বলতে পারেন? নীরব থাকা মানেই যে সম্মতির লক্ষণ, তার ক্ষেত্রে অন্তত এ কথাটা খাটে না।

অসম্ভব! ডঃ রেলিকে চুপ করে থাকতে দেখে ডঃ লিডনার নিজের থেকেই আবার বলতে থাকেন, তারা সবাই লুসির প্রতি অনুগত। সবাই ওকে খুব পছন্দ করত। লুসিকে-

মাফ করবেন ডঃ লিডনার, ডঃ রেলি তাঁর কথায় বাধা দিয়ে বলে, এ আপনার ব্যক্তিগত অভিমত। ধরুন, আপনার এক্সপিডিসনের কেউ যদি একান্তই আপনার স্ত্রীকে অপছন্দ করে থাকে, এত বোকা সে নয় যে, তার মনের কথাটা সে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে আপনাকে শোনাতে যাবে!

ডঃ লিডনারকে কেমন অসহায় দেখায়।

সত্যি, খুবই সত্যি কথা। কিন্তু রেলি, তবু আমি বলব, এ আপনার ভুল ধারণা। এখানকার সবাই যে লুসির অনুগত, এ কথা আমি হলফ করে বলতে পারি।

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ডঃ লিডনার এক সময় ফেটে পড়লেন।

আপনার ধারণা আজগুবি, অবিশ্বাস্য।

কিন্তু সত্যকে আপনি অস্বীকার করতে পারেন না ডঃ লিডনার, ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড বলেন, পারেন অস্বীকার করতে অকাট্য কোন প্রমাণকে?

অকাট্য প্রমাণ? ভারতীয় পাঁচক, আরব হাউস-বয়, এরা কী সবাই মিথ্যে বলছে? এদেরকে আমি আপনি সবাই বেশ ভাল করে জানি। আপনারা যা জানতে চেয়েছেন, ওরা তো তাই বলেছেন।

এক্ষেত্রে, ডঃ রেলির গলা শুকিয়ে আসছিল। সেই অবস্থায় তিনি বললেন, ওরা এমন সব কথাবার্তা বলতে শুরু করে, যা আমরা শুনতে চাই না। তাছাড়া, আপনার এক্সপিডিসনের সদস্যদের স্বভাব আমার বেশ ভাল করেই জানা আছে। গেটের বাইরে ওদের একটা সমিতি ধরনের আড্ডাস্থল আছে। দুপুরে যখনই এখানে এসেছি, আমি লক্ষ্য করেছি, আপনার বেশির ভাগ কর্মচারী সেখানে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। জায়গাটা তাদের পক্ষে আদর্শ তাই না ডঃ লিডনার?

আসলে কথাটা কি জানেন, আপনার কথা শুনে মনে হল, আপনি ভীষণ ভাবপ্রবণ ব্যক্তি। ডঃ লিডনার তাকে মনে করিয়ে দেয়, আচ্ছা এমন তো হতে পারে, আততায়ী অনেক আগে মিসেস লিডনারের শয়নকক্ষে প্রবেশ করে কোথাও লুকিয়েছিল?

একেবারে অসম্ভব নয়, এ কথা আমি মানতে পারছি না, ডঃ লিডনার ঠাণ্ডা মাথায় বলতে থাকেন, ধরে নেওয়া যাক, আগন্তুক নিঃশব্দে কারোর চোখে না পড়ে মিসেস লিডনারের শয়ন কক্ষে গিয়ে ঢুকেছিল, নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাকে সেখানে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল আবার সঙ্গে সঙ্গে আর একটা কথাও ভাবতে হবে, মিসেস লিডনারের ঘরে লুকোবার মত তেমন কোন সুযোগ ছিল না আদৌ। অতএব এ ক্ষেত্রে সেই আরবী ছোকরার দৃষ্টি এড়িয়ে তাকে একটা বিরাট ঝুঁকি নিতে হয় সেখানে প্রবেশ এবং প্রস্থান করতে গিয়ে।

সেই ছেলেটি, হ্যাঁ সেই ছেলেটির কথা আমি বলতে একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম, ডঃ লিডনার একটু ব্যস্ত ভাবে বললেন, ছেলেটি খুব চতুর। তবে, ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড, আমার বিশ্বাস সে নিশ্চয়ই খুনীকে আমার স্ত্রীর শয়নকক্ষে প্রবেশ করতে দেখে থাকবে।

হ্যাঁ, তার ব্যাখ্যাও আমরা করেছি। ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড সেই ছোকরার প্রসঙ্গে এসে যা বলল তা এই রকম : ছোকরাটা নাকি প্রায় সর্বক্ষণ মাটির বাসন ধোয়ার কাজে ব্যস্ত ছিল, মিনিট দশেক কোর্টইয়ার্ডে তার অনুপস্থিত থাকতে দেখা যায়, তখন প্রায় দেড়টা হবে।

হ্যাঁ ডঃ লিডনার বলেন, সঠিক সময়টা আমি বলতে পারছি না, তবে ওই রকমই হবে।

খুব ভাল কথা, তাহলে মনে হয়, এই দশ মিনিট ছোকরাটা নিশ্চয়ই গেটের বাইরে আড্ডায় জমে গিয়েছিল। এমাট ফিরে এসে দেখেন ছোকরা সেখানে নেই, এবং একটু রেগে গিয়ে ছোকরাটিকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন, না বলে কয়ে হঠাৎ তার এই কাজ ছেড়ে যাওয়ার মানে কি থাকতে পারে? আমার অনুমান যদি সত্যি হয়, তাহলে অবশ্যই ধরে নিতে হয় যে, এই দশ মিনিট সময়ের মধ্যেই আপনার স্ত্রী খুন হয়ে থাকবে।

আঁতকে উঠে ডঃ লিডনার বসে পড়লেন মাথা গুঁজে।

ডঃ রেলির কাহিনী সমাপ্তির পথে। শান্ত সংযত কণ্ঠস্বর।

যে সব তথ্য আমার হাতে এসেছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করে আমি বলতে পারি, তিনি বলেন, আমি তাকে পরীক্ষা করে দেখবার ঘন্টা তিনেক আগে তাঁর মৃত্যু ঘটে থাকবে হয়তো। এখন কেবল একটাই প্রশ্ন–কে, কে এই নিষ্ঠুর কাজটা করল?

সেই মুহূর্তে ঘরের মধ্যে শ্মশানের নিস্তব্ধতা নেমে এল। তাপর এক সময় বুকফাটা চিৎকার করে দাঁড়িয়ে উঠলেন ডঃ লিডনার, হাতটা তার যথারীতি কপালে।

আপনার সব যুক্তি আমি মেনে নিচ্ছি ডঃ রেলি,, শান্ত স্থির ভাবে ডঃ লিডনার বলতে থাকেন, আমি স্বীকার করছি এ কাজ আমাদের ভেতরের লোকেরই। কিন্তু তবু আমার কেন জানি না মনে হয়, কোথায় যেন একটা ভুল থেকে যায়। আপাত দৃষ্টিতে এটা ন্যায় সঙ্গত হলেও, কোথাও না কোথাও একটা ত্রুটি থেকে যায়।

আপনার মত বিচক্ষণ ব্যক্তির কাছ থেকে এমন কথা শুনতে হবে, আশা করিনি। ডঃ লিডনার বলতে থাকেন, আমার স্ত্রীকে হুমকি দিয়ে চিঠি লেখা হচ্ছিল। কোন এক ব্যক্তিকে আমার স্ত্রীর হত্যাকারী সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ থাকতে পারে। তারপর আজ তিনি খুন হলেন। আর আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে বলেন সেই লোকটার দ্বারা তিনি খুন হননি, খুন হয়েছেন সম্পূর্ণ এক ভিন্ন প্রকৃতির লোকের দ্বারা। তাই আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, এ এক আশ্চর্য ব্যাপার, অদ্ভুত অনুমান।

হ্যাঁ, ডঃ রেলি গম্ভীর ভাবে চিন্তা করে বলেন, তাই মনে হয় বৈকি।

তারপর তিনি ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ডের দিকে ফিরে তাকালেন, আঃ অদ্ভুত অনুমান? মেটল্যান্ড, আপনি কী বলেন? আপনি কী ওঁর সঙ্গে একমত? নাকি লিডনারের উপরে কেসটা ছেড়ে দেব?’

ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড মাথা নাড়লেন এবং সংক্ষেপে বললেন, এগিয়ে যান।

ডঃ লিডনার, আপনি এরকুল পোয়ারোর নাম শুনেছেন।

বিহ্বল বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন ডঃ লিডনার। তারপর বিস্ময়ের ঘোরটা কাটিয়ে উঠে তিনি বলেন, হ্যাঁ, মনে হচ্ছে নামটা যেন শুনেছি। তার কথায় দ্বিধাগ্রস্থ ভাব। মনে পড়ছে, একদিন মিঃ ভান আলাদিনকে ওঁর সম্বন্ধে খুব উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে শুনেছিলাম। উনি একজন প্রাইভেট ডিকেটটিভ, তাই না?

হ্যাঁ, তিনি সেই লোক।

কিন্তু তিনি নিশ্চয়ই লন্ডনে থাকেন, তাহলে কীভাবে তিনি আমাদের সাহায্য করতে পারেন?

তিনি যে লন্ডনে বাস করেন, সে কথা ঠিক, ডঃ রেলি বলেন, তবে ঘটনাচক্রে তিনি এখন লন্ডনে নেই, এখন তিনি সিরিয়ায়। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, বাগদাদ যাবার পথে আগামীকাল তিনি হাসানিয়ে হয়ে যাবেন।

এ খবর কে আপনাকে দিল?

জীন বেরাট, ফ্রেঞ্চ কনসাল। কাল আমাদের সঙ্গে নৈশভোজের সময় ওঁর কথা বলছিলেন তিনি। মনে হয় সিরিয়ায় মিলিটারি স্ক্যান্ডালের ব্যাপারে তদন্ত করতে এসেছেন তিনি। বাগদাদ যাবার পথে তিনি এখানে এসেছেন। তারপর লণ্ডনে ফেরার পথে আবার সিরিয়া হয়ে যাবেন। কি অদ্ভুত যোগাযোগ বলুন!

ডঃ লিডনার একটু ইতস্ততঃ করে কাপ্টেন মেটল্যান্ডের দিকে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে তাকালেন, এ ব্যাপারে আপনি কী ভাবছেন? ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড প্রত্যুত্তরে বলেন, আমার ছেলেরা আরবদের বহুদিনের দ্বন্দ্বের ব্যাপারে তদন্ত করতে গিয়ে হাত পাকিয়ে ফেলেছে, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি ডঃ লিডনার, আপনার স্ত্রীর কেসটা একেবারে ভিন্ন ধরনের, আমার বুদ্ধির বাইরে। সমস্ত ব্যাপারটা যেন সন্দেহজনক। এই সব কথা ভেবেই এরকুল পোয়ারোর হাতে আপনার স্ত্রীর কেসটা আমি তুলে দিতে চাই। আর সেইজন্য আপনাকে–

তার মানে আপনি বলতে চান যে, পোয়ারোকে আমি যেন অনুরোধ করি কেসটা হাতে নেবার জন্য। ডঃ লিডনার একটু থেমে প্রশ্ন চোখে তাকালেন, আর ধরুন, উনি যদি আমার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন?

কোন মতেই তিনি প্রত্যাখ্যান করতে পারেন না। ডঃ রেলি দৃঢ়স্বরে বললেন।

আপনি কী করে জানলেন?

কারণ, আমিও একজন পেশাদার লোক, ডঃ রেলি নিজের সমর্থনে বলতে থাকেন, সাধারণ কিন্তু জটিল কোন কেস হলে আমাদের না বলার কোন অধিকার নেই, আমরা কেসটা ফিরিয়ে দিতে পারি না। কিন্তু এ কেসটা সাধারণ অপরাধের পর্যায় পড়ে না লিডনার।

না, ডঃ লিডনার অস্ফুটে বললেন দাঁতে দাঁত ঘষে। ফলে দংশন যন্ত্রণায় তার মুখটা ঈষৎ কম্পিত হল। তাহলে ডঃ রেলি, আমার হয়ে আপনারা এরকুল পোয়ারোকে অনুরোধ করছেন তো?

চেষ্টা করে দেখব।

ডঃ লিডনার তাকে ধন্যবাদ জানালেন।

বিশ্বাস করুন, ধীরে ধীরে বললেন তিনি, এখানো আমি ভাবতেই পারছি না, সত্যি লুসি মৃত!

আমি আর বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারলাম না।

ওঃ উঃ লিডনার, এবার ফেটে পড়লাম, আমার যে কি খারাপ লাগছে। আমি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। আমি আমার কর্তব্যে অবহেলার জন্য সত্যি খুব মর্মাহত। মিসেস লিডনারের যাতে কোন ক্ষতি না হয়, সে দেখার ভার ছিল আমার উপরে। সেই আমি-

ডঃ লিডনার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে ওঠেন, না নার্স, তোমাকে অত অনুশোচনা করতে হবে না। ভাঙা গলায় তিনি বলেন, দোষ যদি দিতে হয় তো আমাকে দাও। ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করুন। আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না, এমন কি আমি কখন স্বপ্নেও ভাবিনি যে, সত্যিকার কোন বিপদ ঘটতে পারে।

উঠে দাঁড়ালেন তিনি, তার মুখটা কেমন ফ্যাকাশে, বিবর্ণ হয়ে গেছে এই কয়েক মিনিটে।

আমি, হ্যাঁ আমি বোধ হয় ওকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছি… হ্যাঁ, ঠিক তাই, কিন্তু কথাটা কেমন অবিশ্বাস্য ঠেকছে, তাই না?

তিনি আর ঘরে থাকতে পারলেন না। ডঃ রেলি অপসৃয়মান ডঃ লিডনারের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন।

আমিও নিজেকে ঠিক, ত্রুটিমুক্ত ভাবতে পারি না, আক্ষেপ করে বললেন তিনি।

কোন ক্ষেত্রেই ব্যাপারটাকে আমি খুব বেশি গুরুত্ব দিইনি। অকপটে আমি আমার দোষ ত্রুটির কথা স্বীকার করলাম।

আমরা তিনজনেই, বোধহয় একই ভুল করছি, ডঃ রেলি গম্ভীর ভাবে কথাটা বললেন।

অতএব, এবার কাপ্টেন মেটল্যান্ড মন্তব্য করলেন, আপাত দৃষ্টিতে তাই মনে হয় 

.

১৩.

এরকুল পোয়ারোর আবির্ভাব

মনে হয় এরকুল পোয়ারোর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাতের কথা আমি কোন দিন ভুলতে পারব না। অবশ্য পরবর্তী কালে ওঁর সঙ্গে আমার বহুবার সাক্ষাত হয়েছে, তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে, প্রথম সাক্ষাতের রোমান্সই বলুন, আর ট্রাজেডিই বলুন, আর মূল্যায়ন অন্য এক নিরীখে হওয়া উচিত। যাইহোক, যে কথাটা আমি বলতে গিয়েও মনের দিক থেকে, সামাজিক দিক থেকে, সব শেষে শালীনতার দিক থেকে বাধা পাচ্ছিলাম, সেটা এবার বলেই ফেলি, পোয়ারোর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে আমি তো রীতিমত শক্ পাই। আমার বিশ্বাস, প্রত্যেকের মনে এই একই ধারণা হয়ে থাকে।

ঠিক জানি না, পোয়ারোর সম্বন্ধে আমার কিরকম উচ্চাশা ছিল, শার্লক হোমস এর মতন? পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন লম্বাটে মুখ। অবশ্য আমি জানি, তিনি একজন বিদেশী। তবে তাকে ঠিক যতটা বিদেশী বলে মনে করা উচিত উনি ঠিক ততটা নন, আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, আমি কি বলতে চাইছি।

ওঁকে প্রথমে দেখা মাত্রই আপনাদের হাসির উদ্রেক হবে। মনে হবে রঙ্গমঞ্চে কিম্বা ছায়াচিত্রের সঙ্গে তিনি যেন জড়িত আছেন। প্রথম থেকে শুরু করা যাক, পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চির বেশি লম্বা তিনি নন। একটু বেঁটেই বলতে হয় বুঝি বা একটু বয়স হয়েছে, প্রকাণ্ড দেহ, ডিম্বাকৃতি মুখ। কতকটা কৌতুক নাটকে নরসুন্দরের মত দেখতে তাকে।

হ্যাঁ, এই লোকই মিসেস লিডনারের খুনীর সন্ধান করতে যাচ্ছেন।

 মনে হয় আমার মুখের উপর বিরক্তির ছায়া পড়ে থাকবে এবং সেটা পোয়ারোর চোখে ধরা পড়ে গেছে। তা না হলে সরাসরি কি করে তিনি বললেন, আমাকে কী তোমার পছন্দ হয়নি ম্যাডাম? মনে রেখো, পুডিং খেতে কেমন কেবল মুখে দিলেই বোঝা যায়।

উপমাটা মন্দ নয়। কিন্তু নিজের মধ্যে তেমন আস্থা অনুভব করতে পারলাম না।

রবিবার, মধ্যাহ্নভোজের পর ডঃ রেলি তাঁর গাড়িতে চড়িয়ে এরকুল পোয়ারোকে নিয়ে এলেন। পোয়ারোর পরবর্তী কাজ হল আমাদের এক সঙ্গে জড়ো করে এক এক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা। তার সুবিধার জন্য আমরা সবাই ডাইনিংরুমে সমবেত হলাম। ডাইনিং টেবিলের সামনে এরকুল পোয়ারো বসেছিলেন, তার একপাশে ডঃ লিডনার, অন্য দিকে ডঃ রেলি তার সঙ্গে নিচু গলায় কি যেন আলোচনা করছিলেন তখন, হয়তো নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করছিলেন, কি ভাবে জিজ্ঞাসাবাদের পালাটা শুরু করা যায়।

আমাদের সবাইকে সমবেত হতে দেখে ডঃ লিডনার গলা পরিষ্কার করেও দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বললেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনারা সবাই নিশ্চয়ই এরকুল পোয়ারোর নাম শুনেছেন। আজ তিনি হাসানিয়ে হয়ে বাগদাদে ফিরে যাচ্ছিলেন। দয়া করে তিনি তার যাত্রাপথে বিরতি ঘটিয়ে আমাদের সাহায্য করতে রাজী হয়েছেন। ইরাকের পুলিশ এবং ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড তাদের সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কিন্তু এ এক বিচিত্র কেস, ডঃ রেলির দিকে ফিরে তিনি আবার বলতে থাকেন, মনে হয় তাদের পক্ষে এই জটিল কেসের সঠিক সমাধানে পৌঁছুতে অসুবিধা হবে।

সব দিক থেকে তারা তেমন দক্ষ নন, তাই কী? টেবিলের মধ্যমণি সেই ছোট বেঁটে খাটো লোকটি মন্তব্য করে তাকান চারদিকে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজী, ভাল করে ভাষাটা রপ্ত করতে পারেন নি কেন, কে জানে?

ওহো, যে ভাবেই হোক তাকে ধরতেই হবে। মিসেস মারকাডো চিৎকার করে উঠলেন, সে যদি পালিয়ে যায়, তাহলে সেটা আমাদের কাছে অসহ্য হবে।

দেখলাম মিসেস মারকাডোর কথাটা অনুধাবন করবার চেষ্টা করছেন পোয়ারো। তার চোখের চাহনিতে অন্তত সেই কথা মনে হল আমার।

কে, কে সে ম্যাডাম?

কেন, সেই খুনী ছাড়া আর কার কথা বলতে পারি?

খুনী? ও, হ্যাঁ

কথাটা এমন হাল্কা ভাবে বললেন এরকুল পোয়ারো যে খুনীর ব্যাপারটা যেন কিছুই নয়।

আমাদের সবার অবাক চোখ তার দিকে। এবং তার সন্ধানী চোখ এক এক করে আমাদের মুখের উপর পরিক্রমারত।

আপনাদের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, পোয়ারো বলেন, আপনারা কেউই এর আগে কোন খুনের মুখোমুখি হননি।

একটা সমবেত আক্ষেপধ্বনি বেরিয়ে এল। এরকুল পোয়ারো হাসলেন।

তাহলে এর থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, আপনাদের কারোরই খুনের অ, আ, ক, খ সম্বন্ধে জ্ঞান নেই। অপ্রীতিকর, হা এখানে অনেক অপ্রীতিকর ব্যাপার রয়েছে। যেমন প্রথমেই ধরা যাক, এ ব্যাপারে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ আছে।

সন্দেহ?

মিস জনসন এই প্রথম মুখ খুলল। মিঃ পোয়ারো চিন্তিত ভাবে তাকালেন তার দিকে। আমার ধারণা, মিস জনসনের কথায় তার সায় আছে। সেই মনোভাব তার কথায় প্রকাশ পেল। দেখছি এখানে একজন সমঝদার বুদ্ধিমতী মহিলা আছেন। একটু থেমে তিনি আবার বলেন, হ্যাঁ, ম্যাডাম, সন্দেহজনকই বটে! এ বাড়িতে এখন আপনারা সবাই সন্দেহজনক ব্যক্তি। পাঁচক, হাউস-বয়, পরিচারক, পট বয়, হা, সবাই, এমন কি আপনাদের এক্সপিডিসনের প্রতিটি সদস্যই পুলিশের চোখে এখন সন্দেহজনক ব্যক্তি।

মিসেস মারকাডো সঙ্গে সঙ্গে ফুঁসে উঠলেন, আপনার সাহস তো কম নয়? এ কথা বলার স্পর্ধা হল কী করে আপনার? এ উক্তি জঘন্য এবং অসহনীয়। ডঃ লিডনার আপনি চুপ করে বসে থাকবেন না। এই লোকটাকে –হ্যাঁ এখুনি এই লোকটাকে আপনি

ডঃ লিডনার ফলাত ভাবে বলেন, একটু শান্ত হবার চেষ্টা কর মেরী।

 মিঃ মারকাডোও উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। কাঁপা কাঁপা হাত, রক্তবর্ণ চোখ। এ অন্যায় অপমান, আমাদের সম্মানের পক্ষে হানিকর।

না, না, মিঃ পোয়ারো সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, আমি আপনাদের অপমান করতে চাই না। আমি আপনাদের সবাইকে এক অপ্রীতিকর ঘটনার মুখোমুখি হতে বলেছি মাত্র। যে বাড়িতে কেউ খুন হয়, সেই বাড়ির প্রতিটি বাসিন্দাই সন্দেহের ভাগীদার হয়ে থাকে, এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। তারপর আমি যদি জিজ্ঞাসা করি, খুনি যে বাইরে থেকে এসেছিল তার প্রমাণই বা কোথায়?

মিসেস মারকাডো গর্জে উঠলেন, হ্যাঁ, অবশ্যই সে বাইরে থেকে এসেছে।

একথা ভাববার যথেষ্ট কারণ আছে! কেন জানেন? একটু থেমে গলার স্বর একেবারে খাদে নামিয়ে এনে তিনি বললেন, এ ছাড়া অন্য সব কিছুই অবিশ্বাস্য।

ম্যাডাম, এ ব্যাপারে আপনি নিঃসন্দেহ, অস্বীকার করছি না, পোয়ারো মাথা নিচু করে বলেন, আমি তো আপনাদের আগেই বলেছি, এই পরিস্থিতিতে প্রথমে আমি আপনাদের সবাইকে নিরপরাধ ভেবে প্রকৃত অপরাধীর খোঁজ করব। আর সেই সময়টুকু, শুধু সেই সময়টুকুর জন্য আমরা এখন আপনার হাতের মুঠোয়, ফাদার ল্যাভিগনি বিরক্তি ভাব দেখিয়ে বলেন, আমরা যে নির্দোষ, এ ব্যাপারে নিজেকে সন্তুষ্ট করবার ব্যবস্থা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করুন, যাতে করে আমরা এই অস্বস্তিকর অবস্থার হাত থেকে রেহাই পেতে পারি।

প্রয়োজনীয় সময়ের অতিরিক্ত খরচ করব না। আসলে ব্যাপারটা আপনাদের কাছে পরিষ্কার করার দরকার বলে মনে করেছিলাম। কারণ আচমকা প্রশ্ন করলে আপনারা যাতে ঘাবড়ে না যান।

বেশ তো প্রশ্ন করুন না আমি প্রস্তুত, ফাদার ল্যাভিগনি সাহসের সঙ্গে কথাটা বলেন।

এটাই কী আপনার প্রথম বছর এখানে?

হুঁ।

আর এখানে কবে এসেছেন?

 প্রায় সপ্তাহ তিনেক আগে। সাতাশে ফেব্রুয়ারি।

ধন্যবাদ মঁসিয়ে। আর একটা কথা, এখানে আসার আগে মিসেস লিডনারের সঙ্গে আপনার কি কোন পরিচয় ছিল?

না, এখানে এসেই ওঁর সঙ্গে প্রথম আলাপ-আমার।

এবার বলুন মিসেস লিডনার খুন হওয়ার সময় আপনি কোথায় ছিলেন?

আমার ঘরে বসে পারস্য দেশের শিলালিপিতে আবিষ্কার করা বর্ণমালাগুলো পাঠোদ্ধার করার চেষ্টা করছিলাম।

পোয়ারোর কুনুইয়ের নিচে বিল্ডিংয়ের একটা খসড়া প্ল্যান পড়ে থাকতে দেখলাম।

দক্ষিণ-পশ্চিম কোণায় এই ঘরটা আপনার, আর আপনার ঘরের ঠিক বিপরীত দিকে মিসেস লিডনারের শয়নকক্ষ, ঠিক বলেছি না?

হুঁ।

তা কখন আপনি আপনার ঘরে যান ফাদার ল্যাভিগনি?

মধ্যাহ্নভোজের ঠিক পরেই, তা তখন একটা চল্লিশ হবে।

আর সেখানে আপনি ঠিক কতক্ষণ ছিলেন বলতে পারেন?

ঠিক তিনটের আগে পর্যন্ত। স্টেশন ওয়াগান ফিরে আসার শব্দ পেলাম। তারপর সেটা আবার ফিরে যাওয়ার আওয়াজ শুনে আমি একটু অবাক হলাম এবং ব্যাপারটা জানবার জন্য বাইরে বেরিয়ে এলাম।

ঘরে থাকার সময় কোন অস্বাভাবিক শব্দ কিংবা এমন কিছু আপনার চোখে পড়েনি যার সঙ্গে এই বিয়োগান্ত নাটকের সম্পর্ক থাকতে পারে বলে আপনার মনে হয়?

না।

কোর্টইয়ার্ডের দিকে আপনার ঘরের কোন জানালা নেই?

না, দুটো জানালাই রাস্তার দিকে।

কোর্ট ইয়ার্ড থেকে সাড়া শব্দ পাননি?

খুব বেশি নয়, তবে আমার ঘরের পাস দিয়ে মিঃ এমাটের বার বার ছাদে যাতায়াত করার শব্দ আমি শুনতে পেয়েছি।

কোন্ সময়, মনে আছে আপনার?

না, বলতে পারব না। কারণ তখন আমি আমার কাজে ডুবেছিলাম।

কয়েক মুহূর্তের জন্য একটা স্তব্ধতা নেমে আসে। মনে হয় পোয়ারো তখন চিন্তা করার সুযোগ নিচ্ছিলেন। তিনিই সেই নীরবতা ভঙ্গ করে বললেন, এ কেসের ব্যাপারে আপনার কিছু বলার নেই? মানে খুন হওয়ার আগে অস্বাভাবিক কিছু আপনার চোখে পড়েনি?

ফাদার ল্যাভিগনিকে একটু অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দেওয়া হল যেন। জিজ্ঞাসু নেত্রে ডঃ লিডনারের পানে তাকালেন তিনি।

এটা একটা খুব কঠিন প্রশ্ন মঁসিয়ে, ফাদার ল্যাভিগনি উত্তরে বলেন,তাহলে খোলাখুলি ভাবেই বলি, আমার মতে মিসেস লিডনার বলতে গেলে এক রকম সব সময় মৃত্যু ভয়ে দিন গুণছিলেন। আগন্তুক খুনীর আসন্ন আবির্ভাবের কথা ভেবে দারুণ হতাশ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। আমি তার নার্ভাস হওয়ার মানে বুঝি, কিন্তু কারণটা জানি না। আর মিসেস লিডনার বিশ্বাস করে কখনো তার গোপন কথা আমার কাছে খুলেও বলেন নি।

পোয়ারোর হাতে খুদে খুদে অক্ষরে লেখা নোট। গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলেন সেই নোটটা। তারপর সেদিন থেকে চোখ তুলে তাকালেন ফাদার ল্যাভিগনির দিকে।

আমার কাছে খবর আছে, দু-তিন দিন আগে এখানে চুরির ভয় দেখান হয়েছিল।

ফাদার ল্যাভিগনি দৃঢ়স্বরে যা বললেন তা ঠিক এই রকম : অ্যান্টিকরুম থেকে চুঁইয়ে পড়া আলো নাকি তিনি দেখতে পান। কিন্তু সেই আলো আলেয়ার মতই রহস্যই রয়ে গেছে এখন। ব্যর্থ অনুসন্ধান বলা যেতে পারে।

আপনি বিশ্বাস করবেন কি করবেন না জানি না, তবে শুনে রাখুন, একজন অচেনা অজানা লোক সেই সময় প্রবেশ করেছিল এখানে।

আমি জানি না, এর পরেও কি ভাববার থাকতে পারে, ফাদার ল্যাভিগনি খোলাখুলি ভাবে বলেন, কারোর কিছু চুরি গেল না, কিংবা কাউকে উত্তক্তও করা হল না। তাই মনে হয় হাউস বয়দের কেউ একজনকে–

নাকি এক্সপিডিসনের কেউ?

এক্সপিডিসনের কেউ যদি হয় তাহলে সেক্ষেত্রে কারোর স্বীকার না করার কোন অর্থ তো দেখা যাচ্ছে না।

কিন্তু বাইরের কোন আগন্তুক হলে?

আমি তাই মনে করি।

আচ্ছা ধরা যাক, বাইরের কোন লোক যদি আগের দিন গোপনে প্রবেশ করে থাকে এখানে, এখন কথা হচ্ছে, সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে পরদিন, মানে দুর্ঘটনার দিন অপরাহ্ন পর্যন্ত তার পক্ষে আত্মগোপন করে থাকাটা সম্ভবপর কিনা?

প্রশ্নটা ফাদার ল্যাভিগনি এবং ডঃ লিডনারকে উদ্দেশ্য করে বললেন পোয়ারো। তারা দুজনেই প্রশ্নটা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ভেবে দেখলেন।

আমার মনে হয় না সেটা সম্ভব,অবশেষে ডঃ লিডনার একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, কোথায় যে সে লুকোতে পারে, আমি তো দেখতেই পাচ্ছি না। ফাদার ল্যাভিগনি, আপনার কি মনে হয়, কেউ এখানে লুকিয়ে থাকতে পারে?

না, না, আমি তা আদৌ মনে করতে পারি না।

এবার পোয়ারো মিস জনসনের দিকে ফিরলেন।

আর মাদাম আপনি? আমার ধারণাটা আপনার কী সম্ভবপর বলে মনে হয় না?

না, প্রত্যুত্তরে মিস জনসন বলে, আমি মনে করি না, এখানে কোথায় কে লুকোতে পারে? শয়নকক্ষ সব সময়ই ব্যবহার করা হচ্ছে। অন্য ঘরগুলো, যেমন ডার্ক-রুম, ড্রইং-অফিস, ল্যাবরেটরি, সেগুলো সব হয় সেদিন, নয় পরদিন ব্যবহার করা হয়েছে, কেউ সেখানে লুকিয়ে থাকলে নিশ্চয়ই কারোর না কারোর ঠিক নজরে পড়তোই। তবে চাকর-বাকররা যদি কোন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে

হ্যাঁ, সেটা হতে পারে, পোয়ারো তাকে সমর্থন করে বললেন, আবার অসম্ভবও বলা যেতে পারে।

ফাদার লাভিগনির দিকে আবার ফিরে তাকালেন পোয়ারো।

আর একটা কথা, নার্স লিথেরান বলছিলেন, (আপনি নাকি একদিন বাইরের লোকের সঙ্গে কথা বলছিলেন) সেই লোকটাকেই তিনি জানালায় উঁকি মারতে দেখেছিলেন। এর থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, কোন একটা উদ্দেশ্য নিয়ে লোকটা ঘোরা-ফেরা করছিল।

হ্যাঁ সে কথা আমি অস্বীকার করছি না, ফাদার ল্যাভিগনি অনেক চিন্তা করে কথাটা বললেন যেন।

লোকটার সঙ্গে আপনি প্রথম কথা বললেন, নাকি সে আপনার সঙ্গে প্রথম কথা বলেছিল?

ফাদার ল্যভিগনি কয়েক মুহূর্ত কি যেন ভাবলেন।

 হ্যাঁ, আমার মনে পড়েছে, সে-ই প্রথম আমার সঙ্গে কথা বলে।

 তা কী বলেছিল সে?

ফাদার ল্যাভিগনি আবার মনে করার চেষ্টা করলেন।

আমার যতদূর মনে পড়ছে, এই আমেরিকান এক্সপিডিসন হাউসের ব্যাপারে কথাবার্তা বলছিল সে। তারপর এই এক্সপিডিসনে কতজন আমেরিকান কাজ করছে ইত্যাদি। সত্যি কথা বলতে কি লোকটাকে আমি ভাল করে বুঝতেই পারিনি। তবে আরবী ভাষাটা রপ্ত করার জন্য আমি তার সঙ্গে কথা চালিয়ে যাই।

আপনি কী বিশেষ কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছিলেন?

আমার যতদূর মনে পড়ে, কথা প্রসঙ্গে আমি তাকে বলেছিলাম, হাসানিয়ে একটা বড় শহর। তারপরে আমরা দুজনেই স্বীকার করলাম, বাগদাদ শহরটা সব থেকে বড়। এরপর বোধহয় সে জানতে চেয়েছিল, আমি আমেরিকান, নাকি সিরীয় ক্যাথেলিক।

তার চেহারার বিবরণ দিতে পারেন?

আর এক দারুণ ভাবনায় পড়লেন ফাদার ল্যাভিগনি।

ছোট-খাট বেঁটে লোক, অবশেষে তিনি বললেন, তবে চেহারা বেশ গাঁট্টাগোট্টা এবং টেরা। গায়ের রং ফর্সা।

মিঃ পোয়ারো এবার আমার দিকে তাকালেন।

 ফাদার ল্যাভিগনির দেওয়া লোকটার বর্ণনার সাথে আপনি কী একমত?

না, ঠিক তা নয়, একটু ইতস্তত করে আমি বললাম, বেঁটে নয় বরং তাকে বেশ লম্বাই বলা যায় এবং গায়ের রং অত্যন্ত কালো। রোগাটে চেহারা, আর তাকে টেরা বলে আমার মোটেই মনে হয়নি।

মিঃ পোয়ারোর মুখে চোখে হতাশার ছায়া।

এ কী করে সম্ভব? একই লোকের বর্ণনা দুজন লোকের কাছে দুরকম কী করে হতে পারে? পোয়ারো ফাদার ল্যাভিগনির দিকে ফিরে বলেন, আপনি যদি পুলিশ হতেন, কী চোখে দেখতেন ব্যাপারটা?

লোকটা যে টেরা ছিল, এ ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত। ফাদার ল্যাভিগনির কথায় দৃঢ়তার সুর, নার্স লিথেরান হয়তো অন্য বিষয়গুলি ঠিক ঠিক বলে থাকবে। যেমন ধরা যাক, আমি বলেছি লোকটার গায়ের রং মোটামুটি ফর্সা। তার মানে আমি বলতে চেয়েছিলাম, ইরাকীদের মধ্যে তাকে বেশ ফর্সা বলা যেতে পারে। আমার ধারণা, নার্স তাকে কালো বলেই বর্ণনা দেবে।

শুধু কালো নয়, অত্যন্ত কালো, আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, কালচে হলুদ রঙের চেহারা।

আমার কি মনে হল, ডঃ রেলির দিকে তাকাতেই দেখলাম, ঠোঁট টিপে তিনি হাসছেন।

 হঠাৎ পোয়ারো হাত নেড়ে মৃদু চিৎকার করে বলে উঠলেন, সেই লোকটা, হা সেই আগন্তুক হয়তো সে এ কেসের ব্যাপারে একটা উল্লেখযোগ্য নোক হয়ে উঠতে পারে, আবার নাও হতে পারে। সে যাই হোক, যে ভাবেই হোক, তাকে আমাদের খুঁজে বার করতেই হবে। সেই সঙ্গে আসুন তদন্ত চালিয়ে যাওয়া যাক।

পোয়ারোর দ্বিধাজড়িত চোখের দৃষ্টি এখন অশান্ত, ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ দ্রুত স্থির নিবদ্ধ হয় মিঃ রেইটারের মুখের উপরে।

আমার শুভাকাঙ্খী, আসুন। গতকাল অপরাহ্নের ঘটনা সম্পর্কে আপনি যা যা জানেন বলুন।

মিঃ রেইটারের লাল গোলগাল মুখটা হঠাৎ কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল।

আ–আমাকে বলছেন?

হ্যাঁ, হ্যাঁ আপনাকেই। শুরু করার আগে আপনার নাম এবং বয়স দয়া করে বলুন।

 কার্ল রেইটার, আঠাশ।

আমেরিকান নিশ্চয়ই?

 হু, শিকাগো থেকে আসছি।

এটাই কী আপনার প্রথম বছর এখানে?

 হু, ফটোগ্রাফির ব্যাপারে আমি ভারপ্রাপ্ত।

বেশ, বেশ। পোয়ারো এবার কাজের কথায় ফিরে আসে, এবার বলুন গতকাল অপরাহ্নে আপনি কী করছিলেন মিঃ রেইটার।

তা বেশিরভাগ সময় ডার্ক রুমে ছিলাম।

 বেশির ভাগ সময়?

হ্যাঁ, বললাম তো, কতকগুলো প্লেট ডেভেলপের কাজে ব্যস্ত ছিলাম তখন। মাঝে মাঝে ফটোগ্রাফির-রুমেও আসতে হয়েছিল।

বাইরে?

না, না বাইরে যেতে হবে কেন? ডার্করুম এবং ফটোগ্রাফি রুম পাশাপাশি।

তার মানে ফটোগ্রাফি রুম থেকে আপনি কোন সময়ই বাইরে আসেননি, বলছেন?

 হ্যাঁ, ঠিক তাই।

 সেই সময় কোর্টইয়ার্ডে অস্বাভাবিক কিছু ঘটতে দেখেননি?

 মিঃ রেইটার মাথা ঘাড় নাড়লেন।

না, আমি এখন কাজে খুব ব্যস্ত ছিলাম। তবে গাড়ির শব্দ হতেই বেরিয়ে আসি, আমার কোন চিঠি পত্র এসেছে কিনা দেখবার জন্য। কিন্তু বাইরে এসেই দেখি–।

তা কখন আপনি আপনার কাজ শুরু করেন মিঃ রেইটার?

 তখন একটা বাজতে দশ হবে।

এই এক্সপিডিসনে যোগ দেবার আগে মিসেস লিডনারের সঙ্গে আপনার কী কখন পরিচয় হয়েছিল?

না স্যার। এখানে আসার আগে আমি তাকে কখনো দেখিনি।

আপনার কী অনুমান? এটা কী কোন একটা দুর্ঘটনা।

কার্ল রেইটার মাথা নাড়লেন। হতাশ ভাবে বললেন, না, স্যার আমি দুঃখিত এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।

মিঃ এমাট?

আমেরিকানদের মতো পরিষ্কার কণ্ঠস্বর ডেভিড এমাটের এবং একটু সতর্কতার সঙ্গেই তিনি বললেন, পৌনে একটা থেকে পৌনে তিনটে পর্যন্ত আমি পটারির কাজে ব্যস্ত ছিলাম। আবদুল্লার কাজের উপর নজর রাখাই আমার উদ্দেশ্য ছিল। মাঝে মাঝে ডঃ লিডনারকে সাহায্য করার জন্য ছাদে উঠতে হয়েছিল।

তা কতবার এরকম যেতে হয়েছিল?

চারবার মনে হয়।

কতক্ষণ?

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কয়েক মিনিটের জন্য। তবে একবার দশ মিনিটেরও বেশি সময় আমাকে থাকতে হয়। আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল, কোন্ কোন্ মাটির পাত্রগুলো রেখে দেব, আবার কোনগুলো ফেলে দেব।

আমি শুনেছি, তখন ফিরে এসে আপনি দেখেন, ছেলেটি সেখান থেকে কেটে পড়েছে?

হ্যাঁ, আমার চেঁচামেচিতে সে ফিরে আসে। গেটের বাইরে অন্যদের সঙ্গে খোশগল্পে মেতেছিল।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, এই একটি মাত্র ক্ষেত্রে ছেলেটি স্থান ত্যাগ করে।

না ঠিক তা নয়, বারকয়েক আমি তাকে ছাদে পাঠিয়েছিলাম পটারির কাজে।

আচ্ছা মিঃ এমাট, ভাল করে ভেবে দেখুন তো, সেই সময়ে মিসেস লিডনারের ঘরে কাউকে ঢুকতে কিংবা বেরিয়ে আসতে দেখেছিলেন কি না?

না, সেরকম কাউকে আমার চোখে পড়েনি, মিঃ এমাট সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেন, এমন কি সেই দু’ঘণ্টা সময় আমি কাউকেই কোর্টইয়ার্ডে প্রবেশ করতে দেখিনি।

আর আপনার স্মরণশক্তি মত আপনি বলেছেন, ঠিক দেড়টার পর কিছু সময় আপনি এবং সেই ছেলেটি কোর্টইয়ার্ডে অনুপস্থিত ছিলেন, এই তো?

ঠিক দেড়টা কিনা বলতে পারি না, মিঃ এমাট বললেন, তবে কাছাকাছি ওই সময়টা ধরে নেওয়া যেতে পারে।

ডঃ রেলির দিকে ফিরলেন পোয়ারো।

 ডক্টর, আপনার অনুমানই ঠিক। মৃত্যুর সময় বেলা দেড়টার কিছু পরে।

হ্যাঁ, তা না হয়ে যেতেই পারে না।

মিঃ পোয়ারো তার লম্বা গোঁফে তা দিতে থাকেন। তার কণ্ঠে গভীরতার ছোঁয়া। আমার মনে হয়, মিসেস লিডনারের মৃত্যু ঘটে সেই দশ মিনিট সময়ের মধ্যে। সেটাই আমরা মৃত্যুর সময় বলে ধরে নিতে পারি। না ডক্টর?

.

১৪.

 আমাদের মধ্যে একজন?

খানিক স্তব্ধতা নেমে এল ঘরের মধ্যে। আর সেই স্তব্ধতা একটা ভয়ঙ্কর বিভীষিকা ছড়িয়ে দিল যেন সারা ঘরময়। ওঁরা কথা বলছিলেন, তবু ভাল ছিল বোধ হয়। কিন্তু নীরবতা যেন অসহ্য।

ডঃ রেলির অনুমান আক্ষরিক ভাবে যে সত্য, সেই প্রথম আমি উপলব্ধি করলাম, সেই প্রথম আমি বিশ্বাস করলাম।

আমি তখন বেশ বুঝতে পারছিলাম, মিসেস লিডনারের খুনী ঘরের ভিতরেই আছে, আমাদের মধ্যে বসে থেকে সব কথাই শুনছে সে। অর্থাৎ আমাদের মধ্যেই কেউ একজন…..

সম্ভবতঃ মিসেস মারকাভোও কথাটা অনুভব করে থাকবেন আমার মতন। তা না হলে সহসা তিনি অমন করে কাতরে উঠবেন কেন?

এ আমি কিছুতেই ভাবতে পারছি না,কান্না জড়ানো কণ্ঠস্বর তার, উঃ! কি ভয়ঙ্কর। আমি, আমি–

অমন করে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না মেরী, সাহস সঞ্চয় করো। মিসেস মারকাভোর স্বামী তাকে সান্ত্বনা দিলেন।

তারপর তিনি আমাদের দিকে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে তাকালেন।

আমার স্ত্রী বড় ভাবপ্রবণ। আপনারা যেন কিছু মনে করবেন না। একটুতেই বড্ড বেশি চিন্তা করে ও।

আমি, আমি লুসির কি যে ভক্ত ছিলাম- কান্নায় কথা জড়িয়ে আসে মিসেস মারকাডোর।

আমি জানি না, আমার মুখের হাবভাবে কি ছিল, তবে হঠাৎ আমি লক্ষ্য করলাম মিঃ পোয়ারো আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার ঠোঁটে মৃদু হাসি।

আমি আমার শান্ত চোখ দুটি তুলে তাকালাম এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন।

বলুন ম্যাডাম পোয়ারো মুখ খুললেন, গতকাল অপরাহ্ন বেলাটা আপনি কী ভাবে খরচ করলেন?

চুলে শ্যাম্পু দিচ্ছিলাম, মিসেস মারকাডো আগের মতোই কান্না চোখে তাকালেন, আমি তখন আমার চুলের পরিচর্যা করতে এতই ব্যস্ত ছিলাম যে, অন্য কিছু আমার কাছে তখন অতি নগন্য বলে মনে হয়েছে।

আপনি কী তখন ঘরের ভিতরেই ছিলেন?

হুঁ। গাড়ির শব্দ না শোনা পর্যন্ত আমি ঘরের ভিতরে ছিলাম। তারপর গাড়ির শব্দ শুনে বাইরে বেরিয়ে এসে ঘটনার কথা আমি জানতে পারি। ডঃ কি ভয়ঙ্কর সেই ঘটনা।

ঘটনাটা কী আপনাকে বিস্মিত করেছিল?

 মিসেস মারকাডো কান্না থামিয়ে বড় বড় চোখ করে তাকালেন।

 আপনি কী বলতে চান মিঃ পোয়ারো? আপনি কী পরামর্শ দিচ্ছেন?

আমি আর কী বলতে চাইব ম্যাডাম? একটু আগে আপনিই তো বললেন মিসেস লিডনারের খুব ভক্ত ছিলেন আপনি। সম্ভবতঃ আপনার প্রতি তাঁর গভীর আস্থা ছিল। তিনি আপনাকে সময় সময় তার গোপন কথা প্রকাশ করে থাকবেন নিশ্চয়ই। বলুন ঠিক বলেছি কিনা?

ওহো, না, না প্রিয় লুসি আমাকে তার কোন গোপন কথাই বলেননি। তবে তাকে সব সময় ভীষণ চিন্তিত দেখাত, নার্ভাস বলে মনে হতো। তারপর সেই অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনাগুলো ঘটে, জানালায় ধাক্কা মারা, ইত্যাদি।

আমার মনে আছে, আপনি বলেছিলেন, আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। তাকে যে একটু উত্তেজিত করতে পেরেছি, তাতেই আমার আনন্দ। মিঃ পোয়ারো আর একবার আমার দিকে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম।

ম্যাডাম, আপনার কথা মত তাহলে ধরে নেওয়া যায়, আপনি তখন আপনার চুলের পরিচর্যার ব্যস্ত ছিলেন, আপনি কিছুই শোনেননি, কিছুই দেখেননি। এছাড়া আপনার কি অন্য আর কিছুই মনে হয় না, যা এই কেসের ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে?

চিন্তা করবার প্রয়োজন মনে করলেন না মিসেস মারকাডো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন না, সে রকম তো কিছুই মনে পড়ছে না। আর সেটাই সব থেকে বেশি বিস্ময়কর। তবে আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি, খুনী বাইরে থেকেই এসেছিল। এর পিছনে যথেষ্ট কারও আছে।

পোয়ারো এবার তাঁর স্বামীর দিকে ফিরলেন।

আর মঁসিয়ে আপনি, আপনার কিছু বলার নেই?

 মিঃ মারকাডো ভয়ে ভয়ে তাকান।

হ্যাঁ, তাই হবে, তাই হবে। তার কণ্ঠস্বরে ভয়ের ছোঁয়া। কিন্তু তার এমন ক্ষতি কে করতে পারে? তিনি ছিলেন অত্যন্ত ভদ্র দয়ালু তারপর তিনি আপন মনে মাথা নেড়ে বলতে থাকেন, তাকে যেই খুন করে থাকুক না কেন, শয়তান ছাড়া আর কিছু নয় সে।

মঁসিয়ে আপনি নিজে গতকাল অপরাহ্ন কী ভাবে কাটালেন বলুন?

 আমি? তার চোখে অনিশ্চিত ভাব।

জোসেফ, তুমি খেয়াল করতে পারছো না? তাঁর হয়ে মিসেস মারকাডো উত্তরটা বলে দেন, কেন, তুমি তো তখন লাবোরেটরিতে ছিলে, মনে পড়ছে না?

ও হ্যাঁ, তাই তো ল্যাবোরেটরিতে তো ছিলাম। এ আমার নিত্য কাজ।

কখন গিয়েছিলেন?

 তিনি আবার অসহায় ভাবে তার স্ত্রীর দিকে তাকালেন, উদ্দেশ্যে, কি হবে তুমি বলে দাও।

একটা বাজতে দশ তখন, জোসেফ।

 হ্যাঁ, হ্যাঁ তখন দশ মিনিট বাকি ছিল একটা বাজতে।

 দুর্ঘটনার কথাটা আপনি কখন জানতে পারলেন?

আমার স্ত্রী এসেই খবর দেয়। ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ সেটা। বিশ্বাস করা যায় না। এমন কি এখনো আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, সত্যি কী তিনি খুন হয়েছেন?

হঠাৎ তিনি কঁপতে শুরু করে দিলেন।

 উঃ কি ভয়ঙ্কর! কি ভয়ঙ্কর

মিসেস মারকাডো দ্রুত তার পাশে এসে দাঁড়ালেন।

হ্যাঁ, হ্যাঁ জোসেফ, আমরাও সেটা অনুভব করি। কিন্তু এভাবে ভেঙ্গে পড়লে তো চলবে না। বেচারা, উঃ লিডনারের কথাও ভাবতে হবে আমাদের।

ডঃ লিডনারের মুখে একটা অব্যক্ত যন্ত্রণার ছাপ আমি দেখতে পেলাম। আমার মনে হয় স্ত্রী বিয়োগের প্রসঙ্গটা তিনি খুব সহজে মেনে নিতে পারছিলেন না এবং এ প্রসঙ্গে বাড়তি আলোচনাও যেন তার কাছে অসহ্য বলে মনে হচ্ছিল। পোয়ারোর দিকে তাকালেন তিনি, চোখে করুণ আবেদন। পোয়ারো সঙ্গে সঙ্গে তার আবেদনে সাড়া দিলেন।

মিস জনসন?

আমার আশঙ্কা, আমি বোধহয় খুব বেশি খবর আপনাকে দিতে পারব না। মিস জনসন একবার মিসেস মারকাডোর দিকে তাকিয়ে দেখে নিয়ে বললেন, বসার ঘরে আমি তখন কাজ করছিলাম।

অস্বাভাবিক কিছু আপনি দেখেননি? কিংবা আপনার চোখে পড়েনি?

না।

আপনি কী একেবারে নিশ্চিত এ ব্যাপারে? কোন অস্পষ্ট শব্দ—

 না, আমি ঠিকই বলছি।

যদি বলি আপনার চোখ বলছে, কিছু একটা আপনি দেখেছেন নিশ্চয়ই।

 না, না আমি ঠিক বলছি কিছুই দেখেনি।

তাহলে কোন শব্দ শুনে থাকবেন — পোয়ারো একটু জোর দিয়েই বলেন, যা আপনি খেয়াল করতে পারছেন না।

মিস জনসন অবজ্ঞার হাসি হাসলেন।

আপনি আমাকে যে ভাবে চাপ দিচ্ছেন মিঃ পোয়ারো, তাতে মনে হয়, আমি যা কল্পনা করছি তা আমাকে বলতে হবে।

তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি, আপনি কিছু একটা অনুমান বা কল্পনা করছেন।

মিস জনসন কি যেন ভাবলেন, তারপর থেমে থেমে বলতে শুরু করলেন, আমার যতদূর মনে পড়ছে, গতকাল দুপুরের সময় একটা অস্পষ্ট আওয়াজ আমার কানে আসে। আওয়াজটা মানুষের কান্নার মতো মনে হয়।

তারপর?

সব থেকে দুঃখের ব্যাপার কি জানেন, যথা সময়ে কান্নার আওয়াজ আমি ঠিকই শুনতে পাই। আমার বসবার ঘরের সব জানালাগুলো ভোলাই ছিল। আর কান্নার আওয়াজটা যে মিসেস লিডনারের, সেটা বুঝতে একটু সময় লেগেছিল। সেটাই আমার দুঃখের কারণ। তা সত্ত্বেও আমি যদি তখন তার ঘরে ছুটে যেতাম, কে জানে, হয়তো আমি আততায়ীকে—

ডঃ রেলি তার কথার মাঝে বাধা দিলেন।

ওই চিন্তাটা তখন আর মাথায় আনতে হবে না। ডঃ রেলি তার কথার জের টেনে বলেন, আমার কোন সন্দেহ নেই, মিসেস লিডনার (আমাকে ক্ষমা করবেন লিডনার) বলতে গেলে একরকম আততায়ী তার ঘরে প্রবেশ করা মাত্র আঘাত পান, মাত্র একটি ঘুষির আঘাতই যথেষ্ট ছিল। দ্বিতীয়বার আততায়ীকে ঘুষি ব্যবহার করতে হয় নি। কারণ তা হলে, তার দেহে প্রাণ থাকলে তিনি নিশ্চয়ই সাহায্যের জন্য আবার চিৎকার করতেন নিশ্চয়ই।

তবু মনে হয় আততায়ীকে আমি বোধহয় ধরতে পারতাম একটু তৎপর হলে। মিস জনসন আক্ষেপ করে বললেন।

তা তখন সময়টা কত ছিল মাদাম মঁসিয়ে? পোয়ারো জিজ্ঞাসা করলেন, দেড়টার কাছাকাছি?

হ্যাঁ, সময়টা ওই রকমই হবে।

ভাল কথা। পোয়ারোর কথায় চিন্তার ছোঁয়া, এ ছাড়া আর কোন শব্দ আপনি কী শুনতে পাননি? এই ধরুন দরজা জানালা খোলা কিংবা বন্ধ করার শব্দ?

মিস জনসন মাথা নাড়েন, না, সেরকম কিছু তো মনে পড়ছে না।

আমার ধারণা আপনি সেই সময় টেবিলে বসেছিলেন। তা কোন্ দিকে মুখ করে বসেছিলেন বলুন তো? কোর্টইয়ার্ডের দিকে? অ্যান্টিকরুমের দিকে? বারান্দার দিকে? কিম্বা শহরের উন্মুক্ত পথের দিকে?

কোর্টইয়ার্ডের দিকে।

 সেখান থেকে আপনি বয় আবদুল্লাকে দেখতে পাচ্ছিলেন?

ও হ্যাঁ, চোখ তুলতে দেখতে পেতাম বৈকি! কিন্তু তখন আমি নিজের কাজে দারুণ ব্যস্ত ছিলাম, মুখ তুলে তাকাবার মত অবসর আমার ছিল না।

চোখ না তুলেও অনুভবে তো বোঝা যায়, পোয়ারোর সুচিন্তিত প্রশ্ন, কোর্টইয়ার্ডের দিকে জানালার পাশ দিয়ে কেউ হেঁটে গেছে বলে আপনার মনে হয়নি?

না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।

কিন্তু কেউ যদি কোর্টইয়ার্ডের মাঝখানে দিয়ে চলে গিয়ে থাকে, সেটা কী আপনার নজরে পড়েছে?

সম্ভব নয়। তার কারণ তো আমি আগেই বলেছি, চোখ তুলে তাকাবার মত ফুরসত আমার ছিল না তখন।

বয় আবদুল্লাকে কাজ ছেড়ে বাইরে সহকর্মী অন্য পরিচারকদের সঙ্গে আড্ডা মারার জন্য চলে যেতে দেখেননি আপনি?

না।

দশ মিনিট, ধ্যান মগ্ন সন্ন্যাসীর মত আপন মনে চোখ বন্ধ করে ভাবলেন পোয়ারো, সেই সর্বনাশা দশ মিনিট।

সেই সময় একটা অদ্ভুত নীরবতা নেমে আসে তাদের আলোচনার মাঝে।

হঠাৎ, হা হঠাই মিস জনসন মাথা তুলে বললেন, জানেন মঁসিয়ে পোয়ারো, আমার । মনে হয় অনিচ্ছাকৃত ভাবে আমি আপনাকে ভুল বুঝিয়েছি। ভাল করে ভেবে দেখে আমার মনে হচ্ছে, আমার বিশ্বাস হয় না, আমার ঘরের অবস্থান যা, যেখান থেকে মিসেস লিডনারের চিৎকার আমি শুনতে পেয়েছিলাম। মাঝখানে এ্যান্টিক রুম। তাছাড়া আমি শুনেছি, ওঁর ঘরের জানালাগুলো বন্ধ অবস্থায় দেখা গিয়েছিল সেই সময়।

সে যাই হোক, নিজের উপর অমন করে আস্থা হারাবেন না মাদাম। বিনয়ের সঙ্গে বললেন পোয়ারো। এটা খুব একটা জরুরী ব্যাপার নয়।

না, অবশ্যই নয়, সে কথা আমি জানি। কিন্তু দেখুন, আমার কাছে সেটা খুবই প্রয়োজনীয়। কারণ আমি মনে করি, একটু সজাগ থাকলে হয়তো কিছু একটা আমি করতে পারতাম।

প্রিয় অ্যানি, ওভাবে নিজের উপর আস্থা হারিও না। ডঃ লিডনারের কণ্ঠে আন্তরিকতার সুর ধ্বনিত হয়, সমস্ত ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করো। এমনও হতে পারে, যে শব্দটা তুমি শুনেছিলে সেটা কোর্টইয়ার্ডের বাইরে কোথাও দূর থেকে এসে থাকবে।

ডঃ লিডনারের সান্ত্বনায় মিস জনসনের মুখ থেকে আংশিক মেঘ সরলেও আমি লক্ষ্য করলাম, দীর্ঘ সময় ধরে চোখের জল কষ্ট করে ধরে রাখার সেই ধৈর্য্যের বাঁধটা হঠাৎ ভেঙ্গে রেণু রেণু হয়ে খুঁড়িয়ে পড়ল। মুখ ফিরিয়ে নিল ও, হয়তো চোখের জল ঢাকবার জন্য এবং কথা হল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত, প্রসঙ্গ বিক্ষিপ্ত।

মিস জনসনের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিয়োগান্ত নাটকের শেষ অঙ্কে মাঝে মাঝে কল্পনার প্রভাব পড়ে থাকাটাই স্বাভাবিক।

পোয়ারো আর একবার তার নোটবুকের উপরে চোখ বুলিয়ে নিলেন। তারপর মিঃ রিচার্ড ক্যারির দিকে ফিরলেন তিনি।

মিঃ ক্যারি, আমার ধারণা, এর পরেও আপনাকে বেশি কিছু বলতে হবে।

দম দেওয়া পুতুলের মত ধীরে ধীরে কথা বলতে শুরু করলেন রিচার্ড ক্যারি।

আমার আশঙ্কা, এ ব্যাপারে আমি আপনাদের খুব বেশি সাহায্য করতে পারব না। দুর্ঘটনার সময় আমি খনন কার্যে ব্যস্ত ছিলাম, খবরটা আমাকে সেখানেই দেওয়া হয়।

খুন হওয়ার আগে এমন কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা আপনার মনে পড়ে না যা এ কেসের ব্যাপারে সাহায্যে আসতে পারে?

না, তেমন কিছুই তো মনে পড়ছে না।

 মিঃ কোলম্যান?

সমস্ত ব্যাপারটাই আমার অনুপস্থিতিতে ঘটেছে?মিঃ কোলম্যানের কথা বলার ধরণ দেখে মনে হয়, সে যেন বলতে চাইছে, আমাকে এ ব্যাপারে আর জড়ানো কেন।এখানে সবাই জানে শ্রমিকদের বেতনের টাকা অনার জন্য গতকাল সকালেই আমি চলে যাই হাসানিয়েয়। ফিরে এসে মিঃ এমাটের কাছ থেকে দুর্ঘটনার কথা শুনতে পাই। পরমুহূর্তে আমি গাড়ি ঘোরাই, গন্তব্যস্থল পুলিশ স্টেশন এবং ডঃ রেলিকে দুঃসংবাদটা পরিবেশন করার কথাটাও আমার মনে পড়ে যায় তখন।

আর তার আগে?

বলছি স্যার, মিঃ কোলম্যানের চোখে মুখে আতঙ্কের ছায়া কাপে, আপনি নিশ্চয়ই এখানকার অ্যান্টিক-রুমের কথা শুনেছেন। বুঝলেন, সেই ঘরের জানালার সামনে অপরিচিত মুখ দুর্ঘটনার দিন কয়েক আগে দেখা সেই অদ্ভুত দৃশ্য। সেই দৃশ্যপটের আড়ালে যে-ই কলকাঠি নাড়ুক না কেন, আজও সে পলাতক। আপনার মনে আছে? ডঃ লিডনারের দিকে তাকালেন তার সমর্থন পাবার জন্য, তিনি মাথা দুলিয়ে সমর্থন জানালেন।

আমার ধারণা, মিঃ কোলম্যান বললেন, হয়তো তদন্ত করতে গিয়ে আপনি জনি নামে এক ভিখারীকে আবিষ্কার করবেন, যে লোকটা সেদিন কোর্টইয়ার্ডে প্রবেশ করে থাকবে।

দু-এক মিনিট নীরবে তার দিকে তাকিয়ে থাকলেন পোয়ারো, তাকে বোঝবার জন্য।

মিঃ কোলম্যান, আপনি কী ইংলিশম্যান? অবশেষে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন পোয়ারো তার দিকে।

হ্যাঁ, আপনার অনুমানই ঠিক স্যার, খাঁটি ব্রিটিশ।

 এ বছরই কী আপনার প্রথম এখানে আসা?

হুঁ।

আপনি কী আন্তরিকভাবে প্রত্মতত্ত্বে আগ্রহী?

এই একটা প্রশ্নে মিঃ কোলম্যানকে একটু দ্বিধাগ্রস্থ বলে মনে হল। অপরাধী ছাত্রের মত  তাকাল সে ডঃ লিডনারের দিকে। তারপর কি ভেবে সে বলে, নিশ্চয়ই, আমার আগ্রহ আছে বৈকি। আমতা আমতা করে সে, না-মানে আমি খুব একটা মেধাবী ছাত্র নই।

অসমাপ্ত তার বক্তব্য। তবু পোয়ারো তার কাছ থেকে বাকী কথা আদায় করার তেমন কোন আগ্রহ দেখালেন না। তাকে এখন ঠিক ধ্যানমগ্ন যোগীর মত দেখাচ্ছিল। টেবিলের উপর পেন্সিলের দাগ কাটা, সেকি অন্যমনস্কতার দরুন, নাকি তিনি সময় নিচ্ছিলেন নিজেকে তৈরি করতে পরবর্তী লড়াইয়ের প্রস্তুতি হিসাবে।

তাহলে এর থেকে মনে হচ্ছে, পোয়ারো ধীরে ধীরে বললেন, যে কোন মুহূর্তে আমরা অন্ধকার থেকে আলোয় ফিরে আসতে পারি। আপনাদের মধ্যে যদি কারোর মনে হয় যে, আপনারা এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা জানেন, যা আপনারা মনে করার চেষ্টা করেও সফল হতে পারছেন না ঠিক এই মুহূর্তে, আমি তাদের কাছে বিনীত ভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি, সেই কথাটা আপনাদের স্মরণ-বীণায় যে মুহূর্তে ঝঙ্কার তুলবে আমার কাছে আসতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবেন না। এখন আপনারা যে যার কাজে ফিরে যেতে পারেন। আমি এখন ডঃ লিডনার এবং ডঃ রেলির সঙ্গে কয়েকটা জরুরি আলোচনা করতে চাই।

সভা ভাঙ্গার সংকেত জানিয়ে দিলেন পোয়ারো। আমরা সবাই যে যার আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম এবং একে একে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার উদ্যোগ করলাম। ওদের অনুসরণ করতে গিয়ে আমি প্রায় দরজার ওপারে পা রাখতে যাব, মঁসিয়ে পোয়ারোর ডাকে ফিরে আসতে হল।

সম্ভবত মঁসিয়ে পোয়ারো আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, নার্স লিথেরান দয়া করে থেকে যাবেন। আমার অনুমান, আপনার সহযোগিতা আমাদের কাছে খুব মূল্যবান হয়ে উঠতে পারে।

তাই আমাকে ফিরে আসতে হল। আমি আমার আগের আসন দখল নিলাম আবার।