১০. শ্ৰীমতী অলিভার

১০.

শ্ৰীমতী অলিভার তার ছোট টু-সিটার গাড়ি থেকে অনেক কষ্টে রাস্তায় অবতরণ করলেন। কেন যে এরা এমন গাড়ি তৈরি করে। এরা কি ভাবে যে ফুরফুরে ক্ষীণকটি তন্বী ছাড়া আর কেউ গাড়ি চালায় না? একজন মাঝ বয়সি স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের মহিলার পক্ষে এই অপরিসর জায়গায় বসে গাড়ি চালানো যে কত কষ্টকর সে বিষয়ে কোম্পানির কোনো গ্রাহ্য নেই তাছাড়া দরজাগুলোও এত ছোট যে ভেতরে প্রবেশ করা বা বাইরে অবতরণ করা দুইই খুব পরিশ্রম সাপেক্ষ। ভাবতে ভাবতে তার মনটা বিরক্তিতে ব্যাজার হয়ে উঠল। পাশের সীটে একটা হাতব্যাগের মধ্যে গুটিকতক ম্যাপ গোটাতিনেক রহস্য উপন্যাস এবং দু’পাউন্ড আন্দাজ আপেল ভরা আছে। এই আপেল তাঁর খুবই প্রিয় সঙ্গী। মাথার মধ্যে কোনো জটিল প্লট পাক দিয়ে উঠলে তিনি আপেল চিবোতে শুরু করেন। ‘ড্রেন পাইপে মৃত্যু নামে’ বিখ্যাত উপন্যাসটির পরিকল্পনার প্রাক্কালে তিনি নাকি একনাগাড়ে পাঁচ পাউন্ড আপেল খেয়ে ফেলেছিলেন। আধ ঘন্টা বাদে তারই সম্মানে এক ভোজ আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানেও হাজির হয়েছিলেন যথা সময়ে।

গাড়ি থেকে নেমে তিনি ধীরে ধীরে ওয়েডেন কুটিরের দিকে এগোলেন। এক হাতে হ্যান্ডব্যাগ, অন্য হাতে ধরা একটি রক্তিম আপেল। যেতে যেতে মাঝে মাঝে কামড় বসাচ্ছিলেন তার ওপর। গন্তব্যস্থলের কাছাকাছি এসে তিনি বাকি অংশটুকু ছুঁড়ে ফেলে দিলেন একটা ঝোঁপের মধ্যে। অবিন্যস্ত কেশবেশ যতটা সম্ভব গোছগাছ করে নিলেন। পায়ে দৃষ্টি পড়তেই তার দু কুঁচকে উঠল। নতুন কেশ বাহারি জুতোটাই পরে আসবেন বলে ভেবেছিলেন কিন্তু মনের ভুলে সাদামাটা হাই-হীল জুতোটাই পায়ে গলিয়ে চলে এসেছেন। তার ওপর বুরুশটাও একবার বোলানো হয়নি। একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে শ্রীমতী অলিভার গেট পেরিয়ে ভেতরের দিকে এগোলেন। সামনের কিছুটা জায়গা তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। পেছনে বাংলো প্যাটানের দুকামরার কুটির। কামরার লাগোয়া চওড়া কলিং বেলটাও নজরে পড়ল। বেল টিপে দু-চার মুহূর্ত অপেক্ষা করলেন। কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি আবার বেল টিপলেন। এবার বেশ জোরে। কিন্তু ভেতরে কেউ আছে বলে মনে হল না।

অগত্যা নিরূপায় হয়ে শ্রীমতী অলিভার বাগানের মধ্যে খানিক পায়চারি করার জন্য চিন্তা করলেন।হয়তো বাড়ির লোকেরা আশে-পাশেই কোথাও গেছে। এক্ষুণি ফিরে আসবে।

বাগানটা সাবেকি ধাঁচের। ইতস্তত সূর্যমুখী আর গোলাপ ফুটে আছে। বাগানের পরেই একটা ফাঁকা মাঠ। মাঠের ওপারে ছোট্ট শান্ত নদী উত্তর দক্ষিণে বয়ে যাচ্ছে।

দুটি অল্পবয়সি তরুণীকে সেদিক থেকে মাঠ পেরিয়ে আসতে দেখা গেল। কাছাকাছি আসতেই একজন দাঁড়িয়ে পড়ল স্থির হয়ে।

শ্রীমতী অলিভার নিজে এগিয়ে গেলেন।

 ভাল আছেন তো, মিস মেরিডিথ? আমাকে চিনতে পারছেন নিশ্চয়?

 নিশ্চয় পারছি। অ্যানা মেরিডিথ করমর্দনের জন্য দ্রুত হাত বাড়িয়ে দিলেন। সুপ্রভাত? কিন্তু তার চোখের তারায় পলকের জন্য একটা আতঙ্ক ফুটে উঠল। নিজেকে সংযত করতে কিছুটা সময় লাগল তার।

এই হচ্ছে আমার বন্ধু মিস দোয়াস। আমরা দুজনে একসঙ্গেই থাকি।.. রোডা, ইনি মিসেস অলিভার।

মিস দোয়াস মেরিডিথের চেয়ে মাথায় ঈষৎ লম্বা। দেখতে ও বেশ সুন্দরী। তিনি এবার উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন আপনিই বিখ্যাত লেখিকা, মিসেস অলিভার।

মিসেস অলিভার মুখে কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়লেন। তারপর মেরিডিথের দিকে ফিরে বললেন, আমার অনেক কথা আছে। কোনোখানে বসতে পারলে ভালো হত।

নিশ্চয় নিশ্চয়। এবং চা….চায়ের জন্য অত তাড়া নেই। সেটা পরে হলেও চলবে।

মেরিডিথ তাকে পথ দেখিয়ে ড্রয়িংরুমে নিয়ে গেলেন। গোলটেবিলের চারপাশে হাকা সৌখিন বেতের চেয়ার। তার মধ্যে যেটাকে সবচেয়ে মজবুত বলে মনে হল শ্রীমতী অলিভার তার ওপর উপবেশন করলেন। আধুনিক ধাঁচের অপলকা এই চেয়ার সম্বন্ধে তাঁর বেশ দু-চারবার শোচনীয় অভিজ্ঞতা হয়েছে। তাই আজকাল উপবেশনের আগে সভয়ে সেগুলোর ধারণ ক্ষমতা সম্যকভাবে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন।

শ্রীমতী অলিভার গা এলিয়ে আরাম করে বসতে বললেন, বাজে ভূমিকার কোনো প্রয়োজন বোধ করছি না। গত দিনের সেই নৃশংস খুনটার সম্পর্কে আমাদের কিছু করা উচিত।

কিছু করা উচিত? মেরিডিথের কণ্ঠে শঙ্কা ও বিস্ময়ের যুগল সমন্বয়।

অবশ্যই। দৃঢ়স্বরে ঘোষণা করলেন শ্রীমতী অলিভার আপনার কি মনে হয় আমি জানি না, কিন্তু এটা কার কীর্তি সে সম্বন্ধে আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। ওই ডাক্তার, কি যেন নাম?..রবার্টস, হ্যাঁ, সেইই আসল অপরাধী। ভদ্রলোক নিশ্চয় ওয়েলসের অধিবাসী। ওদের আমি জীবনে বিশ্বাস করি না। একবার আমার অসুখের সময় একজন মহিলা নার্স রেখেছিলাম। সেও জাতে ওয়েলস। একদিন কি করল জানেন।নিরকমের তিনটে মিটার একঘন্টা অন্তর অন্তর পর পর তিনটে খাবার কথা। কিন্তু মনের ভুলে একই মিলার পর পর তিনবার খাইয়ে দিল। দায়িত্ব জ্ঞান বলতে যদি কিছু থাকে ওদের। আমি নিশ্চিত জানি এ-কাজটা রবার্টস ছাড়া আর কারো নয়। এখন শুধু মাথা ঠাণ্ডা রেখে প্রমাণ খুঁজে বার করতে হবে।

মিস দোয়াস আচমকা খিলখিল করে হেসে উঠলেন। পরতেই সামলে নিলেন নিজেকে। বললেন, মাফ করবেন, হাসির বেগটা সামলাতে পারলাম না।…আমি কিন্তু আপনাকে মনে মনে যেমন ভাবে কল্পনা করেছিলাম আসলে তার সঙ্গে বিন্দুমাত্র সাদৃশ্য নেই।

খুব হতাশ হয়েছে তাই তো? তাতে আমার কিছু যায় আসে না। এই ধরনের কথা শুনে আমি অভ্যস্থ হয়ে গেছি। কিন্তু আমাদের এখন প্রধান কর্তব্য ডাক্তার রসের বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহ করা।

কিন্তু সেটা কি উপায়ে? সংশয়ের সুরে মনের ভাব ব্যক্ত করলেন মেরিডিথ।

প্রথমে এতটা হতাশ হয়ে পড়িসনি অ্যানা। মিস দোয়াস চেঁচিয়ে উঠলেন। এ সমস্ত বিষয়ে মিসেস অলিভারের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে।

তাঁর ফিনিশীয় গোয়েন্দার মতোই তিনি রহস্যভেদ করবেন।

শ্ৰীমতী অলিভার তার সৃষ্ট গোয়েন্দার নাম শুনে ঈষৎ পুলকিত হলেন। তাছাড়া এ কাজ আমাদের করতেই হবে। আর কেনই বা করতে হবে তাও বলছি। আপনি নিশ্চয় চান না লোকে আপনাকে খুনি বলে সন্দেহ করুক।

কেন? খামোক এমন সন্দেহই বা কেন তারা করতে যাবে? মিস মেরিডিথের মুখচোখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে উঠল।

সাধারণ লোকের মনের গড়ন এই রকমই। যে তিনজন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নন তাদেরও তারা সমানভাবে সন্দেহ করবে।

অ্যানা মেরিডিথ ধীর শান্ত কণ্ঠে বললেন, আমি কিন্তু এখনও ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছি না, বিশেষভাবে আমার কাছেই বা আপনি কেন এসেছেন?

তার কারণ আমার মতে অন্য দুজনের সম্বন্ধে কোনো প্রশ্নই ওঠে না। মিসেস শরিমার সারাদিন ক্লাবে বসে ব্রিজ খেলেন। তার সামথ্যও আছে যথেষ্ট। তিনি নিজেকে এই জাতীয় বিপদ আপদ থেকে বাঁচাতে পারবেন। তাছাড়া তার বয়সও হয়েছে অনেক। লোকে তাঁকে কি ভাবল বা না ভাবল তাতে এমন কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না। কিন্তু একজন সুন্দরী তরুণীর কথা সম্পূর্ণ আলাদা, সারাটা ভবিষ্যই তার সামনে পড়ে আছে। তার নামে কোনো বাজে অপবাদ রটলে অনেক খেসারত দিতে হবে।

আর মেজর ডেসপার্ড।

ডেসপার্ড তো পুরুষমানুষ। আমি কখনো পুরুষদের জন্য মাথা ঘামাই না। আত্মরক্ষায় তারা যথেষ্ট সক্ষম। তার ওপর মেজর ডেসপার্ড জীবনভর উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যেই কাটিয়ে এসেছেন। এতেই তিনি অভ্যস্ত। এখন এই অবাছিত ঘটনার সম্মুখীন হয়ে হয়তো মনে মনে এক ধরনের মজা পাচ্ছেন তিনি। সেইজন্য ও দুইজনের সম্পর্কে আমার কোনো চিন্তা নেই। যত চিন্তা কেবল আপনাকে ঘিরে।

আপনি সত্যিই দয়াল। স্নান কঠে-বিড় বিড় করলেন মেরিডিথ।

ব্যাপারটা খুবই সঙ্কটময়। রোড মন্তব্য করলেন। এই ঘটনায় অ্যানা একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে। ও কি রকম স্পর্শকাতর তা আপনি জানেন তো? তাই বলছি, চুপ-চাপ বসে থেকে কিছু একটা করা বরং শতগুণে শ্রেয়। নিশ্চয় সে কথা আর বলতে। শ্রীমতী অলিভার উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। এইরকম প্রত্যক্ষ খুনের সংস্পর্শে ইতিপূর্বে আমি কোনদিন আসিনি। আর এটাও বলতে বাধা নেই, কল্পনার দৌড়ে আমি অনেক দূর যেতে পারি কিন্তু প্রকৃত গোয়েন্দাগিরি আমার ধাতে সইবে না। তবে এই ব্যাপারটা যখন একেবারে ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে তখন একটা হেস্তনেস্ত না করে ছাড়ছি না। এরকুল পোয়ারো সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল আর কর্নেল রেসই যে সমস্ত মজাটা উপভোগ করবেন সেটাই বা ঠান্ডা মাথায় সহ্য করব কেমন করে? আমি অনেকদিন আগেই বলেছি যদি কোনো মহিলার হাতে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের কর্তৃত্ব দেওয়া থাকত..

মিস দোয়াস কৌতূহলী হয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন। বাধা দিয়ে বললেন, আচ্ছা আপনি এই কর্তৃত্বে থাকলে কি করতেন?

আমি সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার রবার্টসকে গ্রেপ্তার করতাম, তারপর স্বর পালটে বললেন অবশ্য সে ভার যখন আমার ওপর নেই….আমি হলাম অতি সাধারণ একজন মহিলা মাত্র……

কিন্তু আপনি মোটেই সাধারণ মহিলা নন। মিস দোয়াসের কণ্ঠে প্রশংসার সুর ধ্বনিত হল।

এখন আমরা তিনজন। শ্রীমতী অলিভার নিজের কথার খেই ধরে শুরু করলেন, তিনজনেই সাধারণ নারী মাত্র, দেখা যাক আমাদের সমবেত প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত কিছু একটা হয় কিনা।

অ্যানা মেরিডিথ চিন্তান্বিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। ডাক্তার রবার্টসই যে খুনি একথা আপনার মনে উদয় হল লে?

কারণ তিনিই এই ধরনের কাজের সবচেয়ে উপযুক্ত, নির্বিকার চিত্তে উত্তর দিলেন শ্রীমতী অলিভার।

কিন্তু আপনার কি মনে হয় না, অল্প ইতস্তত করলেন মেরিডিথ, একজন ডাক্তার হত্যার উপায় হিসেবে বিষটাকেই আগে বেছে নেবে? সেইটাই তার পক্ষে সহজতম পদ্ধতি।

মোটই তা নয়। এটা মন্তু ভুল ধারণা বিষের ক্রিয়ায় মৃত্যু ঘটলে স্বাভাবিকভাবেই সকলে আগে ডাক্তারকে সন্দেহ করবে। তিনি কি অত কাঁচা নাকি? সবদিক ভেবে চিন্তে কাজে নেমেছেন।

তা ঠিক। মেরিডিথের কণ্ঠে সংশয়ের দোলা। আচ্ছা কেনই বা ডাক্তার বরাটস মিঃ শ্যাতানাকে খুন করতে যাবনে? এ-বিষয়ে আপনার কি ধারণা?

ধারণা?…একটা কেন অসংখ্য ধারণা আমার মাথার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর সে জন্যই তো অন্য মুশকিল। গল্পের প্লটের বেলাতেও আমাকে এই ঝামেলায় পড়তে হয়। এক সঙ্গে পাঁচ-সাতটা আইডিয়া মাথায় এসে ভিড় করে। তাদের মধ্যে কোনটা ধরি কোনটা ছাড়ি সেই মহা সমস্যা। এই খুনের পেছনে আমি ছটা সম্ভাব্য কারণ নির্দেশ করতে পারি এবং তার প্রত্যেকটিই যুক্তিপূর্ণ। কিন্তু এক্ষেত্রে তার মধ্যে কোনটা প্রকৃত সত্য সেটা খুঁজে বার করতে হবে। ব্যাপারটা এমন হতে পারে যে মিঃ শ্যাতানা হয়তো ডাক্তার রবার্টসকে অনেক টাকা ধার দিয়েছিলেন। এখন তিনি সেটা পরিশোধ করে দিতে বলছিলেন সেইজন্যে ডাক্তার রবার্টস তাকে খুন করেছেন। কিংবা শ্যাতানা হয়তো রবার্টসের কোনো না কোনো আত্মীয়াকে পথে বসিয়েছিলেন, রবার্টস তার প্রতিশোধ নিলেন। অথবা রবার্টস হয়তো গোপনে দুটো বিয়ে করে থাকেন। শ্যাতানা কোন রকমে জানতে পেরেছিলেন। কিংবা হয়তো রবার্টস শ্যাতানার কোনো নিকট আত্মীয়কে বিয়ে করেছেন। শ্যতানার মৃত্যুর পর সেই আত্মীয়াই তার বিপুল সম্পত্তি পাকেন, রবার্টসও বউ-এর টাকায় মনের সুখে দিন কাটাতে পারবেন।কটা কারণের কথা এখন বললাম? চারটে তৎপর ভাবে উত্তর দিলেন রোডা।

আবার এমনও হতে পারে রবার্টসের অতীত জীবনের কোন গোপন ঘটনা শ্যাতানা জেনে ফেলেছিলেন। সেদিন সন্ধ্যায় ভোজের আসরে এ-ধরনের একটা মন্তব্যও করেছিলেন তিনি। নিশ্চয় তা আপনার নজরে পড়েছে?

আমার মুখ যেন রক্তশূন্য হয়ে গেল। আমতা আমতা করে বললেন, কই আমার তো কিছু মনে পড়ছে না।

কেন তিনি কি বলেছিলেন? রোডার কণ্ঠে কৌতূহল।

ভ্রমক্রমে রুগিকে বিষাক্ত ওষুধ খাইয়ে দেওয়া বা ওই ধরনের একটা কিছু আপনার কি তা মনে পড়ছে না মিস মেরিডিথ?

অ্যানা বাঁ হাত দিয়ে শক্তভাবে চেয়ারের হাতলটা চেপে ধরলেন। হা কি যেন একটা বলেছিলেন। তবে সঠিক স্মরণ নেই।

রোডা হঠাৎ কথার মাঝখানে বলে উঠলেন, এটা গরমকাল নয়। তোর অন্তত একটা কোট গায়ে দিয়ে থাকা উচিত।

অ্যানা বিরক্তির দৃষ্টিতে বন্ধুর দিকে ফিরে তাকালেন। তারপর মাথা নাড়লেন না আমার বেশ গরমই বোধ হচ্ছে।

আমার থিওরিটা নিশ্চয় আপনাদের বোধগম্য হয়েছে? শ্রীমতী অলিভার শুরু করলেন, হয়তো লোকে জানে ডাক্তার রবার্টসের কোনো পেশেন্ট ভুল করে ওষুধের বদলে বিষ খেয়ে ফেলেছেন। তার ফলেই হতভাগ্যের মৃত্যু ঘটেছে। এদিকে সমস্ত ব্যাপারটাই হয়তো সাজানো। রবার্টসই চক্রান্ত করে তাকে হত্যা করেছেন। এমনভাবে অন্য অনেক পেশেন্টকেও হত্যা করতে পারেন।

আমার চিবুকে আবার রক্তের রঙ ফিরে এলো। বললেন এইভাবে পেশেন্টদের খুন করলে ডাক্তারের পশারের ক্ষতি হবে না?

নিশ্চয় খুনের পেছনে কোনো নিগুঢ় কারণ আছে।

কিন্তু আমার মনে হয় এটা একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। সমস্ত আইডিয়াটাই অবাস্তব।

ওঃ অ্যানা। ধমকের সুরে চেঁচিয়ে উঠলেন রোডা। তারপর বন্ধুর হয়ে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে ফিরে তাকালেন শ্রীমতী অলিভারের দিকে আমার তো মনে হয় সমস্তু আইডিয়াটা খুবই চমৎকার। রোডার কণ্ঠে গভীর বিশ্বরে সুর। একজন ডাক্তারের পক্ষে এমনভাবে একটা খুন করার অনেক সুযোগ সুবিধে আছে। ( কথার মাঝখানে আনা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন …হ্যাঁ….এবার আমার মনে পড়েছে। মিঃ শ্যাতানা একবার কথা প্রসঙ্গে ডাক্তারদের ল্যাবরেটারির বিষয়ে কি একটা মন্তব্য করেছিলেন। খুনের সম্বন্ধেই কথা হচ্ছিল তখন। বলছিলেন এক ধরনের বিষ আছে যা নাকি ডাক্তারি পরীক্ষাতেও ধরা পড়ে না।

একথা শ্যাতানা বলেননি, শ্রীমতী অলিভার তার ভুল সংশোধন করে দিলেন, বলেছিলেন মেজর ডেসপার্ড।

বাইরের বাগানে কার পদশব্দ পাওয়া গেল। শ্রীমতী অলিভার ঘাড় ফিরিয়ে সেদিকে তাকালেন, আরে নাম করতে না করতেই ভদ্রলোক স্বয়ং এসে হাজির।

দেখা গেল বাগানের পথ ধরে মেজর ডেসপার্ড মন্থর পদক্ষেপে বাড়ির দিকেই এগিয়ে আসছেন।

.

১১.

 শ্ৰীমতী অলিভারকে দেখে মেজর ডেসপার্ড কেশ মুষড়ে পড়েছেন বোঝা গেল। একটু লাজুক ভঙ্গিতে বললেন, অসময়ে আপনাকে বিরক্ত করবার জন্যে আমি খুবই দুঃখিত মিস মেরিডিথ। এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম, তাই ভাবলাম আপনার সঙ্গে একবার দেখা করে যাই।

না, না আপনার বিচলিত বোধ করবার কোনো কারণ নেই। অ্যানার কঠে মি উচ্ছ্বাস। এই আমার বন্ধু রোডা।

রোডা হাসিমুখে মেজর ডেসপার্ডের সঙ্গে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি বরং চায়ের ব্যবস্থা করি। আজ বেশ শীত শীত ভাব আছে। আনারা না হয় ভেতরের ঘরে এসে বসুন। সকলে একসঙ্গে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলেন। রোডা চায়ের জোগাড় দেখতে রান্না ঘরের দিকে এগোলেন।

শ্ৰীমতী অলিভার মন্তব্য করলেন, কি আচ যোগাযোগ আবার, আমাদের দেখা হয়ে গেল।

ডেসপার্ড ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন, যা, তার কঠে চিন্তার হোওয়া অতি সহজেই কানে বাজে। তিনি তখন গভীর দৃষ্টি মেলে শ্রীমতী অলিভারকে জরিপ করবার চেষ্টায় মগ্ন।

শ্রীমতী অলিভারও যেন সমস্ত ব্যাপারটায় মনে মনে খুব মজা পাচ্ছেন। রহস্যময় কণ্ঠে বললেন, মিস মেরিডিথকে বলছিলাম আমাদের কিছুকরা উচিত। প্রসঙ্গটা যে শ্যাতানার খুনের বিষয়েই সেটা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। আমার বিশ্বাস ডাক্তার রবার্টসই খুন করেছেন আপনার কি তাই মনে হয় না?

আমার সঠিক কোনো ধারণা নেই। বড়ই জটিল ব্যাপার।

শ্ৰীমতী অলিভারের চোখে মুখে বিরক্তির ভাব ফুটে উঠল। তিনজনই চুপচাপ, ঘরের মধ্যে একটা মোট থমথমে আবহাওয়া। শ্রীমতী অলিভার সেটা উপলব্ধি করতে পারলেন। ইতিমধ্যে চায়ের ট্রে হাতে ধরে ভেতরে ঢুকলেন রোভা। কিন্তু তিনি আর চায়ের জন্য অপেক্ষা করলেন না। চোখে মুখে ব্যস্ততা ফুটিয়ে বললেন একটা বিশেষ কাজে আজ আমাকে একনি উঠতে হচ্ছে। আর দাঁড়াবার উপায় নেই। তোমাদের আতিথেয়তার জন্যে অশেষ ধন্যবাদ। আমার কার্ড রইল। লন্ডনে গেলে অবশ্যই আমার সঙ্গে দেখা করবে। তখনই না হয় ভেবেচিন্তে সমাধানের পথ খোঁজা যাবে।

রোডা বললেন, চলুন, আপনাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।

শ্রীমতী অলিভার রোডার সঙ্গে গল্প করতে করতে কিছুটা পথ এগিয়েছেন এমন সময় পেছন থেকে দৌড়ে এসে অ্যানা তাদের ধরে ফেললেন। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছি।

 হ্যাঁ, এটা তো মস্ত ভাবনারই কথা। শ্রীমতী অলিভারের কঠে সহানুভূতির সুর।

আপনি যে কষ্ট স্বীকার করে এতটা পথ এসেছেন সেজন্যে সত্যিই আমি খুব কৃতজ্ঞ। কিন্তু এর মধ্যে জড়িয়ে পড়তে আমি বিন্দুমাত্র আগ্রহী নই। কি বীভৎস ব্যাপার বলুন তো….সমস্ত ঘটনাটা আমি মন থেকে মুছে ফেলতে চাই।

বোকা মেয়ে কোথাকার। মেহমাখা ভর্ৎসনার সুরে বললেন শ্রীমতী অলিভার, তুমি ভুলে থাকতে চাইলেই কি তোমাকে ভুলে থাকতে দেওয়া হবে মনে করছ?

এই প্রথম তিনি অ্যানাকে আপনির বদলে তুমি বলে সম্বোধন করলেন।

 অবশ্য পুলিশ আমাকে ছেড়ে কথা বলবে না তা জানি। খুব সম্ভবত তারা এখানে আসবে এবং জেরায় জেরায় আমাকে নাজেহাল করে দেবে। তার জন্যে আমি প্রস্তুত হয়েই আছি। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি এটা ভুলে থাকতে চাই। কেউ এসে আমায় তা মনে করিয়ে দিক সেটা আমার অভিপ্রেত নয়। অবশ্য আমি ভীরু বা কাপুরুষ, তাহলেও এটাই আমার মনের কথা।

ওঃ অ্যানা। অসহিষ্ণু কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন রোডা।

তোমার কথা আমি উপলব্ধি করতে পারছি কিন্তু কাজটা ঠিক বুদ্ধিমানের মতো হবে না। শ্রীমতী অলিভার তাকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন। পুলিশের হাতে সবকিছু ছেড়ে দেবার অর্থই হল প্রকৃত সত্যের আশা চিরতরে জলাঞ্জলি দেওয়া।

নির্বিকার চিত্তে প্রশ্ন করলেন অ্যানা তাতে কিই বা যাবে আসবে?

বাঃ, যাবে আসবে না। এবার চেঁচিয়ে উঠলেন রোডা আপনিই বলুন মিসেস অলিভার এর ফলে কি কিছু ক্ষতির সম্ভাবনা নেই?

অবশ্যই আছে। দৃঢ়কঠে ঘোষণা করলেন শ্রীমতী অলিভার।

আমি তোমাদের সঙ্গে একমত নই। অ্যানা তার জেদ বজায় রাখলেন, আমাকে চেনে বা জানে এমন কোনো লোকেই মনে করবে না যে এটা আমার কাজ। সেইজন্যে আমি ওর মধ্যে মাথা গলাবার কোনো প্রয়োজন অনুভব করি না। আসল সত্য খুঁজে বার করা পুলিশেরই কর্তব্য অতএব এটা তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভালো।

ওঃ, অ্যানা, তুই যে এত ভীতু আমি আগে জানতাম না। রীতিমতো ক্ষুব্ধ হলেন রোড।

কিন্তু এই আমার স্পষ্ট কথা।

অ্যানা হাত জড়িয়ে শ্রীমতী অলিভারের সঙ্গে করমর্দন করলেন। আপনি যে আমার কথা এত চিন্তা করেছেন তার জন্য আমি যে কি পরিমাণ কৃতজ্ঞ….

না না এর জন্যে এত কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কোনো প্রয়োজন নেই। শ্রীমতী অলিভার তার স্বাভাবিক মধুর কণ্ঠে বললেন তাছাড়া তোমার মনের কথা যদি এই হয় তাহলে আর কি করা যাবে। আমি কিন্তু আমার পায়ের নীচে ঘাস বাড়তে দিতে রাজি নই। আচ্ছা, আজ তাহলে চলি ইতিমধ্যে যদি তোমার মরে কোনো পরিবর্তন হয় তবে আমার সঙ্গে লন্ডনে দেখা সভার তার গাড়িতে অভিবাদন জান

শ্ৰীমতী অলিভার তার গাড়িতে উঠে স্টার্ট দেবার উপক্রমে করলেন। অ্যানা এবং রোডা হসিমুখে হাত নেড়ে তাকে অভিবাদন জানালেন।

গাড়িতে স্টার্ট দেবার পূর্বমুহূর্তে নোড়া হঠাৎ তার দিকে দৌড়ে গেলেন।

 আপনি যে লন্ডনে দেখা করতে বললেন সে কি শুধু অ্যানাকেই?

শ্রীমতী অলিভার ব্রেক কষে গাড়ির গতি রোধ করলেন। বললেন দুজনকে উদ্দেশ্য করেই বলেছি।

ধন্যবাদ। অ্যানা না গেলেও আমি কিন্তু আপনার সঙ্গে দেখা করব। এ-বিষয়ে আমার দু-একটা কথা আছে।…আচ্ছা আজ তাহলে আপনার আর সময় নষ্ট করব না।…

রোডা ফিরে আসতেই অ্যানা জিজ্ঞাসা করলেন কি ব্যাপার হঠাৎ অমন করে দৌড়ে গেলি কেন?

সে কথার কোনো উত্তর দিলে না রোডা। প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন ভদ্রমহিলা খুব মজার। তাই না? আমার খুব ভালো লাগল আলাপ করে। লক্ষ্য করে দেখেছিলি দু’পায়ে দু রকম মোজা পড়ে এসেছেন? তবে উনি যে মাথায় খুব বুদ্ধি ধরেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। তা নাহলে অত সমস্ত জটিল প্লট খুঁজে পাবেন কোথা থেকে। সত্যিই যদি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে বোকা বানিয়ে উনি এর প্রকৃত রহস্য আবিষ্কার করেন তখন কি অবাক কান্ডই না হবে।

কিন্তু উনি কি উদ্দেশ্যে এখানে এসেছিলেন? অ্যানার কণ্ঠে চিন্তার সুর কানে বাজে।

রোডা বিস্মিত দৃষ্টিতে বন্ধুর দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, কোন উদ্দেশ্যের কথা তা স্পষ্টভাবেই ব্যক্ত করলেন।

অ্যানার মুখ থেকে সন্দেহের ছায়া গেল না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন চল ভেতরে যাওয়া যাক। ভদ্রলোকের কথা ভুলেই গিয়েছিলেন। অনেকক্ষণ একলা অপেক্ষা করছেন।

ভদ্রলোককে ভারী সুন্দর দেখতে তাই না অ্যানা?

অ্যানা অন্যমনস্ক ভাবে কি যেন ভাবছিলেন। ঘাড় নেড়ে বন্ধুর কথায় সায় দিলেন। হ্যাঁ ভালো চেহারা।

দুজনে পাশাপাশি বাগানের পথ ধরে ধীরে হেঁটে চললেন। মেজর বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন। চায়ের কাপটা তখনও তার হাতের মধ্যে ধরা।

অহেতুক দেরির জন্য অ্যানা ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে কিছু বলতেই তিনি তাকে থামিয়ে দিলেন।

মিন মেরিডিথ এখন এত লৌকিকতার অবসর নেই। আমার আগমনের উদ্দেশ্যটা আগেই আপনাকে বুঝিয়ে বলি।

কিন্তু আপনি……

হ্যাঁ, যদিও আগে জানিয়ে দিলাম যে এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম বলেই এখানে একবার ঘুরে গেলাম কিন্তু কথাটা সত্যি নয়। একটা উদ্দেশ্য নিয়েই আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।

আপনি আমার ঠিকানা জানলেন কেমন করে?

সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেলের কাছ থেকে শুনেছি।

ব্যাটেলের নাম কানে যেতেই অ্যানা কেমন কুঁকড়ে উঠলেন।

মেজর ডেসপার্ড সেদিকে তেমন লক্ষ্য করলেন না। নিজের কথার খেই ধরে বলতে লাগলেন, ব্যাটেলও এখানেই আসছেন। আমি তাকে প্যাডিংটা স্টেশনে অপেক্ষা করতে দেখেছি। তিনি আমায় দেখতে পাননি। তাড়াতাড়ি গাড়ি হাঁকিয়ে চলে এলাম। জানতাম, ট্রেন এসে পৌঁছবার আগেই আমি এখানে হাজির হতে পারব।

কথাটা বলা হয়তো আমার পক্ষে একটু অশোভন হবে, মেজর ডেসপার্ড অল্প ইতস্তুত করলেন, কিন্তু আমার কেমন মনে হল, পৃথিবীতে আপনি ভীষণ একলা। আপনাকে সাহায্য করার কেউ নেই।

তা কেন? আমি তো আছি। মাঝপথে ফোঁস করে উঠলেন রোডা।

মেজর ডেসপার্ড তির্যক দৃষ্টিতে তার দিকে ফিরে তাকালেন। রোডার ঋজু পুরুষালি চেহারার মধ্যে যে এক ধরনের সৌন্দর্য আছে সেটা তার চোখে পড়ল। কণ্ঠস্বরে সুগভীর সরলতার ঝঙ্কার। এই দুই বন্ধুর জুটি সত্যিই অদ্ভুত ভালো মানিয়ে গেছে।

আমি জানি মিস দোয়াস আপনার মতো বন্ধু দুনিয়ায় দুর্লভ। স্পষ্টতা সহকারে বললেন মেজর ডেসপার্ড কিন্তু আমার মনে হল এই সংকটের দিনে এমন কার পরামর্শের প্রয়োজন, বাস্তব পৃথিবী সম্বন্ধে যার অভিজ্ঞতা বিপুল ও ব্যাপক। প্রকৃতপক্ষে পরিস্থিতিটা এখন এই রকম মিস মেরিডিথকে পুলিশ সন্দেহ করে। অবশ্য আমার ক্ষেত্রেও সেটা প্রযোজ্য। এবং খুনের সময় ঘরের মধ্যে বাকি যে দুজন ছিলেন তারাও পুলিশের চোখে সন্দেহভাজন ব্যক্তি। অবস্থাটা নিশ্চয় খুব প্রীতিকর নয়। তবে আপনার মতো যার বয়স এবং অভিজ্ঞতা দুই-ই কম তার পক্ষে এই বিপদের গুরুত্বটা উপলব্ধি করা কষ্টসাধ্য। আমার মতো আপনার উচিত কোন অভিজ্ঞ সলিসিটরের হাতে নিজেকে সঁপে দেওয়া। হয়তো ইতিমধ্যেই তা আপনি করেছেন?

অ্যানা মেরিডিথ মাথা নেড়ে বললেন না, কথাটা আগে আমার মনে উদয় হয়নি।

তাহলে আমি ঠিকই সন্দেহ করেছিলাম। চেনা জানা কোনো ভালো সলিসিটর কি আপনার হাতে আছে?

এবার উপযাচক হয়ে রোডাই কথা বললেন, মিঃ বারী বলে এক পরিচিত ভদ্রলোক আছেন, তবে তার বয়স প্রায় একশোর কাছাকাছি এখন আর তেমন বলতে টলতে পারেন না।

যদি আপত্তি না থাকে তবে আমার সলিসিটার মিঃ মেহর্নের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারেন। তার ফার্মের নাম হচ্ছে, জ্যাকোব অ্যান্ড জ্যাকোব। এ ধরনের কাজে তাদের বিশেষ অভিজ্ঞতা আছে।

আমার মুখ চোখ বিবর্ণ হয়ে উঠল। সত্যিই এর কি কানো প্রয়োজন আছে?

আমি তো জোর গলায় বলব, নিশ্চয় আছে। কত রকমের সাইনের মারপ্যাঁচ থাকতে পারে তা জানেন?

এঁদের চার্জ কি খুব বেশি? টাকার জন্য চিন্তা করবার কোনো কারণ নেই, মেজর ডেসপার্ড। অ্যানাকে বাধা দিয়ে রোডা বলে উঠলেন, সে ব্যবস্থা এক রকম হয়ে যাবে। আমার মনে হয় আপনার উপদেশই ঠিক। অ্যানার জন্যে এক্ষুনি কোনো অভিজ্ঞ সলিসিটরের কাছে যাওয়া প্রয়োজন। তাদের ফি খুব একটা বেশি নয়। তাছাড়া এই সঙ্কটময় মুহূর্তে এটাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা।

বেশ। ম্লান সুরে জবাব দিলেন অ্যানা, যদি ভালো মনে করেন তো আমি তাদের কাছেই যাব।

এই তো লক্ষী মেয়ের মতো কথা। যোডাও উফুন্ন হলেন। এবং এর জন্যে মেজর কৃতজ্ঞ। সত্যিই আমাদের খুব উপকার করলেন আপনি।

অ্যানাও মেজর ডেসপার্ডকে কৃতজ্ঞচিত্তে ধন্যবাদ জানালেন। তারপর অল্প ইতস্তৃত করে জিজ্ঞেস করলেন সুপারিটেনডেন্ট ব্যাটেল কি এই দিকেই আসছেন?

হ্যাঁ, তবে এতে ভয় পাবার কিছু নেই। তাদের কাজ তো তারা করবেই।

 সে আমি জানি। সত্যি বলতে কি, আমিও মনে মনে যে কোনো মুহর্তের প্রতীক্ষা করছি।

আহা বেচারি, সমবেদনায় মুখর হলেন রোডা। এই নোংরা ঘটনাটা অ্যানাকে বুঝি শেষ করে দেবে। কী ঘৃণ্য লজ্জাকর ব্যাপার।

মেজর ডেসপার্ড ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন। সত্যিই পাশবিক কান্ড। বিশেষ করে অল্পবয়সি রুণীকে এর মধ্যে টেনে আনা খুবই খারাপ। মিঃ শ্যাতানাকে কেউ খুন করতে চাইলে তার উচিত ছিল। অন্য কোনো স্থানে কাজটা সমাধান করা।

রোডা আচমকা প্রশ্ন করলেন, আপনার কাকে সন্দেহ হয়? ডাক্তার রবার্টস না মিসেস পরিমার?

ডেসপার্ডের ঠোঁটের কোনো ম্লান আলতো হাসি ফুটো উঠল। খুনটাতো আমার দ্বারাও সম্ভব হতে পারে?

অসম্ভব। যোডার কণ্ঠে তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনিত হল। অ্যানা আর আমি দুজনেই জানি যে এমন কাজ আপনি করতে পারেন না।

মেজর ডেসপার্ড সহৃদয় দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন, দু’জনেই খুব ছেলে মানুষ। কী সরল গভীর বিশ্বাস। মিস মেরিডিথ তো খুবই অসহায়। মেহ্ন নিশ্চয় তাকে রক্ষা করতে সমর্থ হবেন। যোডা অবশ্য অতটা অসহায় নয়। তার মধ্যে একটা রণংদেহি ভাব আত্মগোপন করে আছে। অ্যানার মতে এই ধরনের কোনো বিপদের মধ্যে জড়িয়ে পড়লে সে নিশ্চয় এতটা ঘাবড়ে যেত না। মেয়ে দুটি সত্যিই ভালো। তিনি এদের সঙ্গে আরও বেশি অন্তরঙ্গ হয়ে উঠলেন।

ডেসপার্ডের মাথার মধ্যে এই ধরনের অনেক চিন্তার উদয় হল। মুখে বললেন, প্রমাণ না পেয়ে কোনো কিছুকেই ধ্রুব সত্য বলে বিশ্বাস করবেন না, মিস দোয়াস। মানুষের জীবনের মূল্য আমার কাছে খুব বেশি নয়। মানুষ তো প্রতিনিয়তই বিপদের মধ্যে ডুবে আছে। পথ দুর্ঘটনা, সংক্রামক রোগ ইত্যাদি কত অসংখ্য বিপদ আপদই যে আছে তার ইয়ত্তা নেই, চেষ্টা করলেও আপনি তাদের এড়িয়ে চলতে পারবেন না।

আপনার কথা অস্বীকার করব না, রোডা সায় দিলেন তবে ভয়ে ভয়ে বেঁচে না থেকে সাহসের সঙ্গে সবকিছুর সম্মুখীন হওয়াই বাঞ্চনীয় তা নাহলে জীবনটাকে বড় বেশি একঘেয়ে ক্লান্তিকর বলে মনে হয়।

কিন্তু এর মধ্যেও উত্তেজনার খোরাক আছে।

সে কেবল আপনাদের জন্য। আপনারা, যাঁরা দুর্গম স্থানে ঘুরে বেড়ান, বনে জঙ্গলে বাঘ বা জাগুয়ারে শিকার করেন তাদের জীবনে উত্তেজনার কোনো অভাব হয় না।

উত্তেজনার খোরাক কেবল বনে জঙ্গলেই আছে, এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। মিস মেরিডিথ তো চার দেওয়ালের আবদ্ধ ঘরের মধ্যে বসেই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার আস্বাদ লাভ করেছেন। চোখের সামনে এমন নৃশংস হত্যার দৃশ্য ক’জনের আর দেখার সৌভাগ্য ঘটে?

অ্যানা ভয়ার্ত স্বরে চিৎকার করে উঠলেন না, না পুরনো স্মৃতি আবার নতুন করে মনে করিয়ে দেবেন না।

আমি খুবই দুঃখিত। বিব্রতভাবে থেমে গেলেন মেজর ডেসপার্ড। রোডা অত সহজে থামবার পাত্রীনন। ব্যাপারটা অবশ্যই খুবই দুঃখের সন্দেহ নেই, কিন্তু এর মধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ রহস্যের মাদকতাও আছে। এই দিকটা অ্যানা কিছুতেই মানতে চায় না। মিসেস অলিভার তো সে রাতের ঘটনাটা বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছেন।

মিসেস অলিভার?…ওই সুলাঙ্গিনী ভদ্রমহিলা গোয়েন্দা গল্প লিখে থাকেন? তিনি কি এবার বাস্তব খুন নিয়েও গোয়েন্দাগিরির মতলব ভাঁজছেন?

হ্যাঁ, সেইরকম।

ভালো। আমরা তার সৌভাগ্য কামনা করি। সত্যিই যদি তিনি সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেলকে এই ব্যাপারে টেক্কা দিতে পারেন তাহলে খুব মজার জিনিস হবে। সংবাদপত্রের রিপোর্টাররাও বেশ কিছুদিন হৈ চৈ করবার একটা সুযোগ পানে।

সুপারিটেনডেন্ট ব্যাটেল লোক কি রকম? রোভার কঠে কৌতূহলের স্পর্শ।

তিনি খুব বিচক্ষণ ব্যক্তি, কর্মদক্ষতাও অসাধারণ।

 তাই বুঝি। কিন্তু অ্যানা যে বলল কেমন বোকা বোকা গোঁয়ারগোবিন্দ টাইপের চেহারা।

মনে হয় ওটা তার একটা ছক্স মুখোশ। কিন্তু আমাদের কোনো ভুল করা উচিত হবে না। ব্যাটেল বোকা নন, খুবই চর। ডেসপার্ড উঠে দাঁড়ালেন এবার আমি বিদায় নেব। যাবার আগে একটা কথা বলে যাই।

অ্যানাও আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে করমনের জন্য হাত বাড়ালেন। যা বলুন?

ডেসপার্ড ক্ষণকাল চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। কি বলবেন ভেবে নিলেন মনে মনে। তার সবল পেল হাতের মুঠোয় আনার হাতটা ভীরু অগাতীর মতো ঠাপছে। তিনি অ্যানার বিষাদমাখা বিশাল আয়ত চোখ জোড়ার দিকে ফিরে তাকালেন। আমাকে যেন ভুল বুঝবেন না। আমি বলতে চাই, মিঃ শ্যাতানার সঙ্গে হয়তো আপনার এমন কোনো যোগাযোগ থাকতে পারে যেটা অন্য কারো কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ক আপনি তা চান …..। মিস মেরিডিথ ডেসপার্ডের হাতের মুঠো থেকে নিজের হাতটা টেনে নেবার জন্য অল্প চেষ্টা করলেন, ডেসপার্ড হাতটা ধরে রেখেই বললেন, আমার ওপর রাগ করবেন না। যদি সেইরকম কিছু থেকে থাকে তবে আপনার সলিসিটরের উপস্থিতি ছাড়া সুপারিটেনডেন্ট ব্যাটেলের এধরনের কোন প্রশ্নের জবাবদিহি করতে আপনি বাধ্য নন। মনে রাখবেন এটা আপনার আইনসঙ্গত, নাগরিক অধিকার।

অ্যানা জোর করে হাতটা ছাড়িয়ে নিলেন। তার চোখে ক্রোধের রক্তিম আভা। বললেন, আমার সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। ওই পশুস্বভাবের মানুষটাকে আমি চিনতামই না বলা চলে। মাপ করবেন মৃদুস্বরে বললেন মেজর ডেসপার্ড, আমি বেল সমগ্ৰ পরিস্থিতিটা ভালোভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছি।

রোডাও অ্যানার কথায় সায় দিলেন। মিঃ শ্যাতানার সঙ্গে যে ওর বিশেষ সম্পর্ক ছিল না, সে কথা সত্যি। এমনকি ভদ্রলোকটিকে অ্যানা তেমন পছন্দও করত না তবে ভদ্রলোক মাঝে মধ্যে বেশ জমকালো পার্টি দিতেন।

হ্যাঁ মিঃ শ্যাতানার বেঁচে থাকার সপক্ষে এই একটি মাত্র যুক্তিই খাড়া করা যায়। অ্যানা মৃদুস্বরে বিড়বিড় করলেন। সুপারিটেনডেন্ট ব্যাটেলের যে কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিতে আমি রাজি আছি। আমার লুকোবার কিছু নেই…কিছুই নেই…..

ডেসপার্ড নম্র স্বরে বললেন, আমাকে ক্ষমা করবেন।

অ্যানা ডেসপার্ডের দিকে ফিরে তাকালেন, তার চোখে ক্রোঁধের রক্তিমাভা আর নেই। তার বদলে মধুর হাসির মৃদু সৌরভ। বললেন আপনি কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে একথা বলেননি তা আমি জানি।

যা বলেছেন তা আমার মঙ্গলের কথা চিন্তা করেই।

আবার তার হাত বাড়িয়ে দিলেন অ্যানা। ডেসপার্ড পরম আগ্রহে অ্যানার হাতটা নিজের হারে মধ্যে তুলে নিয়ে বললেন, আমাদের সামনে এখন বিপদ সঙ্কুল অথৈ সাগর। আমরা দুজন একই নৌকোর যাত্রী। অতএব আজ থেকেই আমরা পরস্পরের বন্ধু।

এবার অ্যানা একা মেজর ডেসপার্ডকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেলেন। যখন ফিরে এলেন রোডা তখন খোলা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃদু সুরে শিস দিচ্ছেন। অ্যানা ঘরে ঢুকতেই রোভা ঘুরে দাঁড়ালেন।

ভদ্রলোকে সত্যিই দেখতে খুব সুন্দর।

হ্যাঁ আচার ব্যবহারও খুব চমৎকার।

শুধু চমৎকার বললেই সবটা বলা হল না।…আমার তো ভদ্রলোককে খুব ভালো লেগে গেছে। সেদিন সাক্ষ্য ভোজের আসরে তোর বদলে যদি আমি উপস্থিত থাকতাম এই উত্তেজনাটাও তাহলে রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করা যেত।

কেমনভাবে বিপদের জাল চারদিক থেকে ঘিরে আসছে..চোখের সামনে ঝুলছে ফাঁসির দড়ি।

 জিনিসটা এত মজার নয়; বোকার মত আবোল তাবোল কথা বলিস না রোডা। অ্যানার কণ্ঠস্বর তী, তারপরই সুর নামিয়ে বললেন, কিন্তু ভলোক প্রকৃই খুব ভালো। আমাদের কাছে তো একজন অপরিচিত আগকে ছাড়া আর কিছু নয়। সেদিন স্যায় একবার মাত্র দেখা।তর মধ্যে কতটুকুইবা পরিচয়।তবু তিনি এতটা পথ ভেঙেঅযাচিতভাবে আমার উপকার করতে এলেন।

তোকে দেখে মজে গেছেন, বুঝতে পারছিস না? এ আমি বাজি ধরে বলতে পারি। পুরুষ মানুষ কখনো নিঃস্বার্থে এতটা দয়ালু হয়ে ওঠে না। তোর মুখে যদি কাটাছেঁড়া বা ডুমো ডুবো ব্রণর দাগ থাকত তবে দেখতাম তিনি কোন উপকার করতে এতটা ছুটে আসনে।

তাহলে ভদ্রলোক আসতেন না বলে মনে করিস?

হ্যাঁ করি–বুদ্ধ কোথাকার। তবে মিসেস অলিভারের কথা আলাদা। এব্যাপারে সত্যিই তার কোনো স্বার্থ নেই।

কিন্তু এই ভদ্রমহিলাকে আমার একদম পছন্দ হয় না। ওঁকে দেখলে পরেই মনে কেমন খটকা লেগেছে। গোপন কি উদ্দেশ্য নিয়ে যে উনি এখানে এসেছিলেন…?

মেয়েরা তো মেয়েদের সন্দেহ করবেই, এ তো চিরকালের প্রথা। মেজর ডেসপার্ডও তো মাথায় কোনো মতলব নিয়ে আজ এখানে আসতে পারেন, নিশ্চয় না; তিনি সে ধরনের মতলাজ লোকই নন। ক্রুদ্ধ কণ্ঠে প্রতিবাদ করলেন অ্যানা। কিন্তু তার পরেই রোডাকে আচমকা খিলখিল করে হেসে উঠতে দেখে লজ্জায় লাল হয়ে উঠল তার চোখ মুখ।

.

১২.

সুপারিটেনডেন্ট ব্যাটেল যখন ওয়েনডন কুটিরে হাজির হলেন তখন বেলা পড়ে এসেছে। মিস মেরিডিথের সঙ্গে দেখা করবার আগে তিনি এই অঞ্চলের আরও বিভিন্ন লোকের সঙ্গে দেখা করেছেন।

তার মূল অভিপ্রায় এখানে আসার আগে অ্যানার সম্বন্ধে যেসব গল্পগুজব প্রচলিত আছে সেগুলো সংগ্রহ করা।

কাজটা তার মতো অভিজ্ঞ লোকের পক্ষে এমন কিছু কষ্টসাধ্য নয়। বিভিন্ন লোকের কাছে তিনি বিভিন্ন পরিচয়ে উপস্থিত হয়ে নানারকমের খবরাখবর সংগ্রহ করলেন। নিজের প্রকৃত পরিচয় অবশ্য সর্বদা গোপন করে গেছেন। দুজন লোকের কাছে তিনি নিজেকে একজন বিল্ডিং কনস্ট্রাকসান কোম্পানির লোক বলে পরিচয় দিয়েছেন। তার আগমনের একমাত্র কারণ ওয়েনডন কুটিরকে ভেঙুেরে নতুন ধাঁচে তৈরি করা। অপর একজন লোক তাকে ভ্রমণকারী হিসেবেই জানে। এক সপ্তাহের ছুটি কাটাতে সম্প্রতি এখানে এসেছেন। সেই জন্যেই ওয়েনডন কুটির সম্বন্ধে খোঁজখবর সংগ্রহ করছেন। ওখানে কোনো ঘর ভাড়া পাওয়া যেতে পারে কিনা সেটাই তার প্রকৃত উদ্দেশ্য।

খবর যা সংগ্রহ করলেন তাও বেশ আশাপ্রদ।

ওয়েনডন কুটিরের কথা বলছেন-হ্যাঁ ঠিকই সালবারি রোডের ওপর। গেলেই আপনার নজরে পড়বে। আর চোখে পড়বার মতোই। হা দু’জন অল্পবয়স্কা তরুণী ওই কুটিরে বাস করেন। একজনের নাম মিস দোয়াস, অপর জন মিস মেরিডিথ। দুজনেই খুব ভালো মেয়ে। বেশ শান্তশিষ্ট।

অনেক বছর ধরে এখানে আছেন কিনা জিজ্ঞেস করছেন?…না না, খুব বেশি দিন নয়। বছর দুয়েকের অল্প কিছু ওপর হবে। মিঃ পিকার গিলের কাছ থেকে ওঁরা ওটা কিনে নেন। সে ভদ্রলোকও অবশ্য এখানে বেশিদিন বাস করেননি। তার স্ত্রী মারা যাবার পরই এটা বিক্রি করে দেন।

না মিস দোয়াস বা মিস মেরিডিথ নর্দারল্যান্ড থেকে এসেছেন কিনা সঠিক বলতে পারি না। আমার ধারণা ওরা লন্ডনের মেয়ে। প্রতিবেশীরা সকলেই ওঁদের খুব পছন্দ করেন। তবে কোনো কোনো পুরানো আমলের বৃদ্ধ অবশ্য দু’জন অবিবাহিতা তরুণীর এমনভাবে এক একা বাস করাটা তেমন সুনজরে দেখেন না। কিন্তু মেয়ে দুটি খুবই ভদ্র এবং সভ্য।

আজকালকার মেয়েদের মতো মোটেই চটকবাজ নয় মিস দোয়াস, একটু বলিয়ে কইয়ে চটপটে স্বভাবের, মিস মেরিডিথ আবার ঠিক তার বিপরীত। মিস দোয়াসের কিছু টাকাকড়ি আছে বলে মনে হয়। মোটের ওপর সব খরচ-খরচা তিনিই চালান।

কথা, প্রসঙ্গে সুপারিটেনডেন্ট ব্যাটেল অবশেষে মিসেস অস্টওয়েলের সন্ধান পেলেন। অষ্টওয়েল ওয়েনডন কুটিরে ঠিকের কাজ করেন মাঝ বয়সি বাকপটু মহিলা।

না মশাই, ওরা ওয়েনডন কুটির বিক্রি করবে বলে আমার মনে হয় না। আর কেনই বা করবে? এই তো সবে দুবছর হল ওখানে এসেছে। আমি সকালে গিয়ে ওদের কাজকর্ম করে দিয়ে আসি। ওরা এখানে আসার পর থেকেই আমি কাজে লেগেছি। সকাল আটটা থেকে বারোটা পর্যন্ত আমার ডিউটি। মেয়ে দুটির স্বভাব চরিত্র খুব ভালো। সব সময় নিজেদের মধ্যে হাসি ঠাট্টায় মেতে আছে। ওদের কাউকে কখনো চড়া গলায় কথা বলতে পর্যন্ত শোনা যায়নি।

আপনি যে মিস দোয়াসের কথা বলছেন, ইনিই সেই কিনা তা খুব জোর করে বলতে পারব না। আমার বিশ্বাস মিস দোয়াসের আদি নিবাস ডেভনশায়ারে। কথাবার্তা শুনে তাই মনে হয়।

হ্যাঁ তা যা বলেছেন, আজকাল অনেক অল্পবয়সি মেয়েকেই জীবিকা নির্বাহের জন্যে বাধ্য হয়ে চাকরি বাকরি করতে হচ্ছে। খুবই দুঃখের কথা। এই মেয়ে দুটি খুব ধনী না হলেও মোটামুটিভাবে বেশ সুখেই জীবন যাপন করছে। তবে মিস দোয়াসের কিছু টাকাকড়ি আছে বলে মনে হয়। সেই-ই কুটিরের মালিক অপর মেয়েটি তার বন্ধু।

না, মিস মেরিডিথ কোথাকার বাসিন্দা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। সে তাকে উইট দ্বীপের নাম করতে শুনেছি এবং মেয়েটি যে ইংলন্ডের উত্তরাঞ্চল বিশেষ পছন্দ করে না, তাও আমি জানি। ওরা দুজন নিশ্চয় কোনো এক সময় ডেভনশায়ারে বাস করতো। কারণ ওরা প্রায়ই সেখানকার পাহাড় পর্বত সমুদ্র নদীর কথা নিয়ে স্মৃতিচারণ করে।

সম্ভাব্য সমস্ত স্থানেই ঘুরে বেড়ালেন সুপারিটেনডেন্ট ব্যাটেল। এদিক ওদিক থেকে খবর যা সংগ্রহ করলেন তাও খুব নিরাশা হবার মতো নয়। সমস্তই তিনি মনের মধ্যে গেঁথে রাখলেন। মাঝে মধ্যে দু-একটা রহস্যময় কথাও টুকে নিলেন তার ডায়েরিতে। অবশেষে সন্ধ্যে আটটা নাগাদ ওয়েনডন কুটিরে হাজির হলেন।

বেল টিপতেই একটি দীর্ঘাকৃতি মেয়ে এসে দরজা খুলে দাঁড়াল। পরনে কমলা রঙের ফ্রক। তন্বী এবং সুন্দরী।

মিস মেরিডিথ কি এখানে থাকেন? প্রশ্ন করলেন ব্যাটেল। তাকে বেশ কঠোর আর গম্ভীর বলে মনে হল।

হ্যাঁ, আপনি?…

দয়া করে তাঁকে গিয়ে বলুন সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল একবার দেখা করতে চান।

আসুন ভেতরে আসুন। দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে মিস দোয়াস ব্যাটেলকে সসম্ভ্রমে আহ্বান জানালেন।

মিস দোয়াসের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাটেল ভেতরে প্রবেশ করলেন। ড্রয়িংরুমে একটা বেতের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন অ্যানা। তার পাশে জ্বলন্ত আগুনের চুল্লি। অ্যানার পরনে বাহারি ডোরাকাটা পাজামা। আগুনের পাশে বসে তিনি তখন উষ্ণ আরামে কফি পান করছিলেন।

সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল তোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে অ্যানাকে ডেকে জানিয়ে দিলেন রোডা। অ্যানা এগিয়ে এসে করমর্দন করলেন।

এখন অবশ্য কারো সঙ্গে দেখা করার পক্ষে খুবই অসময়। ব্যাটেল নম্রভাবে কথা শুরু করলেন, তবে ইচ্ছা করেই একটু দেরিতে এলাম। আগে এলে যদি আপনাকে বাড়িতে না পাই, সেই ভেবে।

অ্যানা মৃদু হাসলেন। এক কাপ কফি পান করতে নিশ্চয় আপনার কোনো আপত্তি হবে না?…রোডা, সুপারিনটেনডেন্টের জন্যে এক কাপ কফি নিয়ে আয়।

ব্যাটেল একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বললেন, আপনার আতিথেয়তার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ মিস মেরিডিথ।

রোডা রান্নাঘর থেকে এক পেয়ালা গরম কফি নিয়ে এসে ব্যাটেলের সামনে রাখলেন।

ঘরের মধ্যে একটা সুন্দর আরামদায়ক আবহাওয়া। অ্যানাকেও বেশ সহজ স্বচ্ছন্দ মনে হল। রোডা একদৃষ্টে সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার দুই চোখের গভীর কৌতূহলের চিহ্ন চক্‌চক্‌ করছে।

আমরা এতদিন আপনাকেই আশা করছিলাম। এমন সুরে কথাটা বললেন অ্যানা যাতে মনে হয় ব্যাটেল তার কাছে আগে না আসার জন্যে তিনি খুব ক্ষুব্ধ। এর মানে তাঁর প্রতি যেন অবহেলা দেখানো হয়েছে।

দুঃখিত। আমি আগেই আসব ভেবেছিলাম। কিন্তু নানা কাজের ঝামেলায় সময় করে উঠতে পারিনি।

তদন্তের কাজ কতদূর এগিয়েছে? তেমন আশাপ্রদ কিছু জানতে পারলেন?

খুব আশাপ্রদ বলা যায় না তবে এগোচ্ছে, এই পর্যন্ত। ইতিমধ্যে আমরা ডাক্তার বরাক্টসের চেম্বারে গিয়ে তার যাবতীয় কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখেছি। মিসেস লরিমারের সঙ্গে-ও কথাবার্তা হয়েছে। এখন শুধু আপনি আর মেজর ডেসপার্ড বাকি আছেন।

আপনার সঙ্গে কাজ মিটে যাবার পরেই আমি ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করবার জন্য তৈরি হব।

অ্যানার ঠোঁটের ফাঁকে আবার ক্ষীণ হাসির রেখা ফুটে উঠল। কি জানতে চান বলুন? আমি প্রস্তুত।

কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল খালি কাপটা টেবিলের উপর নামিয়ে রাখলেন। অ্যানা নিজের চেয়ারে সোজা হয়ে বসে আছেন।

এই আপনার সম্বন্ধে দু-চার কথা, আর কি। সোজা ভাষায় যাকে আত্মপরিচয় বলে। আমি নিজেকে তো ভদ্র সভ্য মেয়ে বলেই জানি। অ্যানার মুখে তখনও হাসির আভাস লেগে আছে।

ওর সম্বন্ধে কখনো কোনো দুর্নাম শুনতে পাবেন না, এ গ্যারান্টি আমি দিতে পারি। বেশ দৃঢ় কণ্ঠে অ্যানার কথায় যায় দিলেন রোডা।

সে তো খুব ভালো কথা। সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেলও বেশ হাসিখুশি। তিনি এবার রোডার দিকে ফিরে তাকালেন। আপনার সঙ্গে নিশ্চয় মিস মেরিডিথের অনেক দিনের আলাপ?

হ্যাঁ, ছেলেবেলায় স্কুল জীবন থেকেই আমাদের দুজনের বন্ধুত্ব। রোডা উত্তর দিলেন। এখন মনে হয় যে যেন কত যুগ আগের ঘটনা, তাই না অ্যানা?

সুপারিনটেনডেন্ট হেসে বললেন, এত দিন আগের কথা যে আর মনে পড়তে চাইছে না!…মিস মেরিডিথ, এবার আপনার নিজের জীবনবৃত্তান্ত কিছু বলুন।

আমার জন্ম হয়েছিল অ্যানা বলতে শুরু করলেন।

গরিব, কিন্তু ভদ্ৰপরিবারে। রোডা শেষ করলেন কথাটা। তার কণ্ঠস্বরে ঠাট্টার আমেজ।

সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল তাকে হাত তুলে বাধা দিলেন। বললেন, দয়া করে আপনার বন্ধুকেই বলতে দিন। অ্যানা ক্ষুব্ধ হলেন। রোডা, এটা কিন্তু খুব সিরিয়াস ব্যাপার।

দুঃখিত। ক্ষমা প্রার্থনা করলেন রোডা।

হ্যাঁ, তারপর আপনার জন্ম হয়েছিল কোথায়?

ভারতবর্ষের এক শহরে, কোয়েটায়।

ও, আপনার বাবা বুঝি মিলিটারিতে চাকরি করতেন?

হ্যাঁ, আমার বাবা মেজর জন মেরিডিথ। আমার এগারো বছর বয়সের সময় মা গত হলেন। বাবা যখন চাকরি থেকে অবসর নিলেন আমার বয়স তখন পনেরো বাকি জীবনটা তিনি কেপ্টেনহ্যামে বাস করেন। আমার বয়স যখন আঠারো তখন এক রকম প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় বাবা মারা যান।

ব্যাটেল সহানুভূতির সুরে মাথা নাড়লেন। আপনি নিশ্চয় তখন মনে খুব আঘাত পেয়েছিলেন?

আমি তো প্রথমে চোখে কানে অন্ধকার দেখতে শুরু করলাম। আমরা ধনী ছিলাম না তা আমি জানতাম কিন্তু তাই বলে যে একেবারে পথের ভিখিরি এতটা কোনোদিন বুঝতে পারিনি।

তারপর আপনি কি করলেন?

একটা চাকরি নিতে বাধ্য হলাম, লেখাপড়া বেশিদূর এগোয়নি, খুব চালাক চটপটেও নই। শর্টহ্যান্ড টাইপ বা ওই ধরনের কিছুও জানতাম না এমন মেয়ের চাকরি হওয়া খুব সহজসাধ্য নয়। কেপ্টেনহ্যামে আমার এক বন্ধুই তার আত্মীয়ের বাড়িতে একটা চাকরি দেখে দিলো। দুটো ছোট ছোট ছেলে মেয়েকে দেখাশোনার দায়িত্ব, তার সঙ্গে সংসারের খুঁটিনাটি কাজে সাহায্য করা।

সেখানকার ঠিকানা?

কর্ত্রীর নাম মিসেস এল্ডন। লার্চ শহরের ভেন্টর অঞ্চলে বাড়ি। সেখানে আমি প্রায় দু’বছর ছিলাম। তারপর তিনি তার স্বামীর সঙ্গে বিদেশে চলে যান। তখন আমি মিসেস ডিয়ারিং-এর বাড়িতে একটা কাজ পেলাম।

ডিয়ারিং আমার কাকিমা। রোডাই কথাটা প্রকাশ করলেন।

হ্যাঁ, রোডা আমাকে এই কাজটার ব্যবস্থা করে দেয়। আমিও সেখানে খুব সুখে ছিলাম। রোডা মাঝে মধ্যে আসতো। দু-চার দিন থেকেও যেত কখনো সখনো। সে দিনগুলো বেশ হাসিতে গল্পেতে কেটে যেত।

সেখানে আপনি কি কাজ করতেন?

বাগান তদারকির কাজ বলতে পারেন। অ্যানার হয়ে উত্তর দিলেন রোডা। আমার কাকির খুব বাগানের সখ ছিল। যদিও কাকিকে সেবা শুশ্রূষা করবার জন্যেই অ্যানাকে নিযুক্ত করা হয়েছিল কিন্তু তার বাগানের কাজে সাহায্য করতেই অ্যানার সময় কেটে যেত।

সে চাকরিতে আপনি কবে ইস্তফা দিলেন?

মিসেস ডিয়ারিংয়ের স্বাস্থ্য ক্রমশ আরও ভেঙ্গে পড়ল। শেষকালে একজন পাসকরা নার্সের সাহায্য নেওয়া ছাড়া উপায় রইল না।

তার ক্যান্সার হয়েছে। রোডা বললেন শেষ বয়সটা খুব যন্ত্রণায় ভুগছেন! যন্ত্রণার জ্বালা জুড়োতে আজকাল জাঁকিয়ে নিয়ে থাকেন।

কিন্তু আমার প্রতি খুব সদয় ছিলেন। তার বর্তমান অবস্থার জন্যে আমি খুবই দুঃখিত। অ্যানার কণ্ঠে গভীর বেদনা ধ্বনিত হল।

সেই সময় গ্রামাঞ্চলে আমি একটা বাসার খোঁজে ছিলাম। ইচ্ছে ছিল আর কাউকে সঙ্গী হিসেবে সঙ্গে নিই। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা আবার বিয়ে করলেন। আমার কেমন ভালো লাগল না ব্যাপারটা। তাই আলাদা হয়ে চলে এলাম। অ্যানাকে বলতেই ও রাজি হয়ে গেল। তারপর থেকেই আমরা দুজনে এখানে বাস করছি-রোডা যযাগ করলেন।

তাহলে তো নির্দোষ সাদামাটা জীবনযাপন করছেন বোঝা গেল। এর মধ্যে দুর্নাম রটবার কোনো অবকাশ নেই। খুব ভালো কথা। এবার তারিখগুলো সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করা যাক। মিসেস এল্ডনের কাছে দু’বছর ছিলেন বললেন না? তার বর্তমান ঠিকানা?

ভদ্রমহিলা এখন প্যালেস্টাইনে আছেন। সরকারি কাজেই তাঁর স্বামীকে ওখানে যেতে হয়েছে। তবে কাজটা কি, সে সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণা নেই।

ঠিক আছে, ঠিক আছে তা আমার জেনে নিতে পারব।…তারপর আপনি মিসেস ডিয়ারিংয়ের কাছে যান।

আমি সেখানে তিন বছর ছিলাম। চটপট জবাব দিলেন অ্যানা। তার ঠিকানা মার্শভেন, হেম্বারী, ডের্ভনে।

হুঁ, তাহলে আপনার বর্তমান বয়স হল পঁচিশ? আর একটা প্রশ্ন, কেপ্টেনহ্যাম শহরের এমন দুজন সম্ভ্রান্ত লোকের নাম বলুন, যাঁরা আপনাকে এবং আপনার পিতাকে চিনতেন।

অ্যানা দু’জন লোকের নাম, ঠিকানা দিলেন।

মিঃ শ্যাতানার সঙ্গে সুইজারল্যান্ডে আপনার প্রথম পরিচয় হয় বলে জানিয়েছিলেন, সেখানে আপনি কি একলাই গিয়েছিলেন না আপনার বন্ধুও সঙ্গে ছিলেন?

আমরা দুজনেই গিয়েছিলাম, হোটেলে আরও কয়েকজন ভদ্রলোকের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। বোধহয় সব মিলিয়ে জনা আষ্টেক হবে।

মিঃ শ্যাতানার সঙ্গে কিভাবে আপনার পরিচয় হল?

অ্যানা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বলার মতো বিশেষ কিছু নেই। হোটেলের অন্যান্য ট্যুরিস্টদের সঙ্গে যেভাবে আলাপ হয় সেই রকমই। আমরা সকলেই সকলের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছিলাম। সে সময় সমস্ত বোর্ডার মিলে একটা ফ্যান্সি ড্রেসের আয়োজন করা হয়েছিল। মিঃ শ্যাতানা প্রথম পুরস্কার পান। তিনি শয়তানের পোশাক পরে হেঁটে গিয়েছিলেন।

ব্যাটেল মাথা দোলালেন। বললেন, ওটাই ভদ্রলোকের প্রিয় কাজ।

শয়তানের ভূমিকায় ভদ্রলোককে খুব ভালোই মানাতো। রোডাও কথার মাঝখানে সায় দিলেন। বিশেষ কোনো মেক-আপের প্রয়োজন হত না।

ব্যাটেল এবার দু’জনের চোখের দিকেই ফিরে তাকালেন। কার সঙ্গে তাঁর আলাপ বেশি ছিল?

অ্যানাকে ইতস্তত করতে দেখে রোডা উত্তর দিলেন। তার কণ্ঠে অকপটে সরলতা। দু’জনের সঙ্গেই সমান। বলতে গেলে আলাপও খুব যৎসামান্য। বুঝতেই পারছেন, আমরা সকলেই ছিলাম ট্যুরিস্ট। শ্বেতশুভ্র বরফের ওপর স্কি করা ছিল আমাদের একটা আনন্দ। সন্ধেবেলা সকলে মিলে লনে বসে গল্প গুজব করতাম। সেখানেই মিঃ শ্যাতানার সঙ্গে আলাপ কিন্তু তিনি কেন যেন একটু বেশি করে অ্যানার দিকেই ঝুঁকে ছিলেন। সেজন্যে মাঝে-মধ্যে অ্যানাকে ঠাট্টাও করতাম।

আমার মনে হয় তিনি আমাকে বিরক্ত করবার জন্যই এমন ব্যবহার করতেন, অ্যানা উত্তর দিলেন, ভদ্রলোক জানতেন আমি তাকে পছন্দ করি না দেখলে অস্বস্তি বোধ করি আর আমি অস্বস্তি বোধ করায় তিনি যেন খুব মজা পেতেন।

রোডা হেসে বললেন, আমরা ঠাট্টা করে অ্যানাকে বলেছিলাম শ্যাতানাকে বিয়ে করতে। এমন ধনবান স্বামী পাওয়া ভাগ্যের কথা।

কিন্তু কথা শুনে ও আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বার উপক্রম করেছিল।

আচ্ছা হোটেলে অন্য ট্যুরিস্ট যাঁরা ছিলেন তাদের নাম ঠিকানা নিশ্চয় মনে আছে?

মানুষের কথার ওপর আপনার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই দেখছি। রোডার কণ্ঠে ব্যঙ্গের সুর। আপনি কি মনে করেন আমরা আপনাকে আগাগোড়া মিথ্যে বলছি?

ব্যাটেল চোখ মিটমিট করলেন। কিন্তু আমাকে তো সব দিক পরীক্ষা করে দেখে নিতে হবে। এমন একটা মারাত্মক খুনের তদন্তে…..

তবুও বলব, আপনি সন্দেহবাতিক মানুষ। মৃদু হাসলেন রোডা। তারপর একটা কাগজ টেনে নিয়ে খসখস করে কতকগুলো নাম ঠিকানা লিখে দিলেন।

ব্যাটেল উঠে দাঁড়ালেন। অনেক ধন্যবাদ মিস মেরিডিথ। আপনার বন্ধু যখন বললেন আপনি নির্দোষ জীবনযাপন করেন তখন আর কথা কি?

খামোক ভয় পাবেন না। তবে একটা ব্যাপার বড় বিচিত্র ঠেকছে। আপনার প্রতি মিঃ শ্যাতানার এই অদ্ভুত আচরনের কারণ কি! তদন্তের খাতিরে প্রশ্নটা করতে হচ্ছে? তার জন্যে আগে থেকেই ক্ষমা চেয়ে রাখছি। আপনাকে কি মিঃ শ্যাতানা কখনো বিয়ের কথা বলেছিলেন বা এই ধরনের অন্য কিছু?

না, ভদ্রলোকের সঙ্গে অ্যানার কোনোরকম অবৈধ সম্পর্ক ছিল না। উত্তর দিলেন রোডা। অবশ্য এই প্রশ্নই যদি আপনার জিজ্ঞাসা হয়ে থাকে।

লজ্জায় অপমানে অ্যানা লাল হয়ে উঠলেন। না, ও রকম কিছুই তিনি বলেননি, আমার প্রতি সব সময় খুব ভদ্র ব্যবহার করতেন আর এই মাত্রাতিরিক্ত ভদ্রতাই আমার অস্বস্তির কারণ হত।

উনি কি বিশেষ কোনো বিষয়ের প্রতি কখনো কোনো ইঙ্গিত দিয়েছিলেন?

হ্যাঁ…না, সে রকম কিছু নয়। আমার সঙ্গে কোনো বিষয়ের আলোচনাই হয়নি। হু, আচ্ছা শুভরাত্রি। আপনার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ, মিস মেরিডিথ।

সুপারিনটেনডেন্ট বিদায় নেবার পরে গেট বন্ধ করে রোডা আবার ড্রয়িংরুমে ফিরে এলেন। যাক, ভালোয় ভালোয় ঝামেলাটা মিটে গেল। ভদ্রলোককে যতটা ভয়ঙ্কর মনে হয়েছিল। মোটেই ততটা নন। কথাবার্তা তো আমার বেশ ভালোই লাগল। পিতার মতো স্নেহমাখা কণ্ঠস্বর তাছাড়া কোনো মানুষকে খুন করা যে তোর পক্ষে সাধ্যাতীত সে কথা নিশ্চয় উনি ভালো করেই জানেন।

চেয়ারে বসে অ্যানা অলসভাবে হাই তুললেন। হ্যাঁ ব্যাপারটা বেশ সহজেই মিটে গেছে। এতদিন অযথা ভেবে মরছিলাম। আমার ধারণা ছিল হয়তো আমায় জেরায় জেরায় নাজেহাল করে ছাড়বেন।

রোডা অল্প ইতস্তত করলেন। অ্যানা, তুই তো প্রফটওয়েতে থাকার কথা কিছু বললি, না? ভুলে গিয়েছিলি নাকি?

না, ভুলিনি, ধীর স্বরে জবাব দিলেন অ্যানা, মাত্র সামান্য ক’দিনের জন্য সেখানে ছিলাম, তাই ভাবলাম এ কথাটা এমন কিছু প্রয়োজনীয় নয়। তাছাড়া সেখানকার কোনো লোকও আমায় বিশেষ চেনে না। তবে তুই যদি এটা দরকারি মনে করিস, আমি ব্যাটেলের কাছে চিঠি লিখে জানিয়ে দিতে পারি। যদিও আমার বিশ্বাস এর ফলে এমন কিছু ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না তাই আর নতুন করে ঘাঁটাঘাঁটি না করাই ভালো।

না, দরকার আর কি। মনে এলো তাই বললাম। রোডা উঠে গিয়ে রেডিওর নব ঘোরালেন।

 ঘোষকের গম্ভীর গলা ভেসে এলো তার মধ্যে থেকে।

এইমাত্র যে নাটকটি অভিনীত হল তার নাম-কেন মিছে বলছো খুকু! বেতারের জন্যে বিশেষভাবে এই নাটকটি রচনা করেছেন মিঃ ব্ল্যাক নিউরিয়াস।

.

১৩.

মেজর ডেসপার্ড অ্যালবানি হোটেল থেকে বেরিয়ে রিজেন্ট স্ট্রিটের বাস স্টপেজে এসে দাঁড়ালেন। তারপর প্রায় লাফ দিয়ে একটা চলন্ত বাসে উঠে পড়লেন।

দুপুর বেলা বাসে তেমন ভিড় নেই। ওপর তলার বসবার আসনগুলো অধিকাংশই খালি পড়ে আছে। তিনি এগিয়ে গিয়ে সামনের দিকের জানলার ধারে একটা সীট দখল করলেন।

পরের স্টপেজে আর এক ভদ্রলোক বাসে উঠলেন। তিনিও উঠে মেজর ডেসপার্ডের বিপরীত দিকের সীটে গিয়ে বসলেন, ডেসপার্ড ভদ্রলোককে লক্ষ্য করেননি। একটু পরেই পাশের সীট থেকে মৃদু কণ্ঠের আওয়াজ ভেসে এলোদোতলা বাসের ওপর থেকে এই শহরটা বেশ ভালোই দেখায় তাই না?

ডেসপার্ড মাথা ঘোরালেন। কয়েক মুহূর্তের জন্য তাঁর চোখে একটা বিহ্বল হতচকিত ভাব ফুটে উঠল। যেন ঠিক চিনতে পারছেন না ভদ্রলোককে। তারপরেই মনে পড়ল। মাফ করবেন, মঁসিয়ে পোয়ারো। আপনি পাশে বসে আছেন খেয়াল করিনি। তাঁ, যা বলেছেন; পাখিরা যেমন ওপর থেকে নীচের পৃথিবীকে নিরীক্ষণ করে, দোতলা বাসের ওপর থেকে সেইভাবেই শহরটিকে দেখা যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই যন্ত্র সভ্যতার দৌলতে কাঁচের খাঁচায় বসে শহর দেখার চেয়ে আগেকার দিনই অনেক ভালো ছিল।

পোয়ারো গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বাস না থাকলেও কি ভীষণ অসুবিধার ব্যাপার হত ভেবে দেখুন। বৃষ্টির দিনে ভরা পেটে হাঁসফাস করতে করতে পায়ে হেঁটে অফিস বেরোতে হত। আর আপনাদের এই লন্ডনে বৃষ্টি তো অনবরত লেগেই আছে।

বৃষ্টি? বৃষ্টি কখনো কোনো ক্ষতি করে না।

ভুল করছেন। প্রতিবাদ করলেন পোয়ারো। বৃষ্টিতে ভিজে নিউমোনিয়া হতে পারে।

ডেসপার্ড উজ্জ্বল দাঁত বার করে হাসলেন। আপনি দেখছি এখন সেই পুরোনো আমলেই রয়ে গেছেন যাঁরা সব সময় নিজেদের ঢেকেঢুকে রাখাই পছন্দ করেন।

পোয়ারো অস্বীকার করলেন না। ঠান্ডা লাগবার ভয়ে তিনি শরৎকালেও গায়ে গরমের কোট চাপিয়েছেন। গলায় পুরু মাফলার জড়ানো।

ডেসপার্ড বললেন, আপনার সঙ্গে এইভাবে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়াটা খুব আশ্চর্যের।

পোয়ারোর গোঁফের ফাঁকে মৃদু হাসির রেখা তাঁর মাফলারের গলায় চাপা পড়ে গেল। এই দেখা হয়ে যাওয়াটার মধ্যে আশ্চর্যের কিছুই নেই। ডেসপার্ড কখন তাঁর হোটেল থেকে বেরোবেন পোয়ারো পূর্বাহ্নেই সেটা অনুমান করে রেখেছিলেন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষাও করছিলেন তাঁর জন্যে। দূর থেকে ভদ্রলোককে বেরোতে দেখে তিনি এগিয়ে গিয়ে পরের বাস স্টপেজে দাঁড়ান। তিনি অবশ্য ডেসপার্ডের মতো ঝুঁকি নিয়ে ছুটন্ত বাসে ওঠেননি। বাস থামবার পর বেশ ধীরে সুস্থে আরোহন করেছেন। বললেন, তা বটে। মিঃ শ্যাতানার ফ্ল্যাটে সেই সন্ধ্যায় প্রথম পরিচয়ের পর আর আমাদের দেখাসাক্ষাৎ ঘটেনি।

আপনি কি এই ব্যাপারে কিছু চেষ্টা চরিত্র করছেন?

পোয়ারো ভদ্রভাবে কান চুলকালেন। দেখুন আমি চিন্তা করি, অনেক সময় একলা বসে ভাবি। এদিক ওদিক ঘুরে বেড়িয়ে তদন্ত করা আমার ধাতে পোষায় না। আর এত চললে শরীররও সে ধকল সহ্য করতে নারাজ। মেজর ডেসপার্ড উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। চিন্তা করেন বলছেন? সেটা তো খুবই কার্যকর পদ্ধতি। আজকাল লোকে অনর্থক ছোটাছুটি করে মরে। তার বদলে, কোনো কাজে অগ্রসর হবার আগে যদি শান্ত হয়ে বসে বিষয়টা সম্বন্ধে ভালো করে ভেবে নেওয়া যায় তবে পরিশেষে পন্ডশ্রমের আশঙ্কা খুবই কম থাকে।

জীবন সম্বন্ধে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কি তাই, মেজর ডেসপার্ড?

প্রায় ক্ষেত্রেই তাই। সহজ মনে উত্তর দিলেন ডেসপার্ড। আগে সমস্ত জিনিসটা তলিয়ে বুঝে নেবার চেষ্টা করি কি ভাবে অগ্রসর হব সেটা ঠান্ডা মাথায় ভেবে নিই। তারপর কাজে হাত দিই।

পোয়ারো গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, এরপর কি আপনার সিদ্ধান্তের আর নড়চড় হয় না? কোনো প্রতিবন্ধকই কি আপনার সামনে পথ আগলে দাঁড়াতে পারে না?

না না, এমন কথা আমি বলছি না। একগুঁয়েমি মূর্খতার নামান্তর। ভুল হলে নিশ্চয় তা, স্বীকার করে নেব। সেই মতো শোধরাবার চেষ্টা করব।

তবে আমার বিশ্বাস, ভুল বড় একটা আপনি করেননি।

সকলেই আমরা কমবেশি ভুল করে থাকি, তাই না মঁসিয়ে পোয়ারো?

অনেকে কিন্তু-শীতল স্বরে বললেন পোয়ারো–অন্যদের চেয়ে অনেক কম ভুল করে।

ডেসপার্ড পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। বললেন আপনি কি জীবনে কখনো ভুল করেননি?

শেষ ভুলটা হয়েছিল আঠাশ বছর আগে। পোয়ারোর কণ্ঠে অহমিকার গাম্ভীর্য। তারপর অবশ্য দু-একবার ভুলের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু ভুল হয়নি।

আপনার রেকর্ড তো মারাত্মক রকমের ভালো। সোৎসাহে বললেন মেজর ডেসপার্ড আচ্ছা, মিঃ শ্যাতানার খুনের বিষয়ও কি আপনি তদন্ত করছেন? অবশ্য আমি যতদূর জানি সরকারিভাবে এই তদন্তের ভার আপনার ওপর দেওয়া হয়নি।

না, সরকারিভাবে কেউ আমাকে নিয়োগ করেনি। কিন্তু তাহলেও খুনির গগনচুম্বী স্পর্ধা আমার অহমিকায় আঘাত করেছে। কেসটা আমি নিজে থেকে হাতে নিতে বাধ্য হয়েছি। আমার নাকের ডগায় বসে কেউ একজনকে খুন করে যাবে এতখানি বেয়াদবি আমি বরদাস্ত করতে পারব না। হত্যাকারী যে আমার ক্ষমতাকে ব্যঙ্গ করে এই ঘটনার মধ্যে তারই প্রকাশ ফুঠে উঠেছে।

কেবল আপনার সামনেই নয়–শুস্বরে বললেন ইয়ার্ডের চোখের সামনেই এই অপকীর্তি সাধিত হয়েছে।

ওটাই বোধহয়–হত্যাকারীর সবচেয়ে মারাত্মক ভুল। পোয়ারো একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেলকে বাইরে থেকে দেখে বোকা মনে হলেও আসলে তিনি বোকা নন। খুবই চালাক চতুর। মাথায় যথেষ্ট বুদ্ধি ধরেন।

আমি জানি। ডেসপার্ড সায় দিলেন। আসলে ও বোকামির ভাব একটা মুখোশ মাত্রই। তিনি খুবই দক্ষ ধুরন্ধর পুলিশ অফিসার।

এবং ব্যাপারটা নিয়েও তিনি খুব উঠে পড়ে লেগেছেন।

তা আর বলতে! পেছনের সীটে ওই শক্ত সমর্থ লোকটার দিকে তাকিয়ে দেখুন।

পোয়ারো ফিরে তাকালেন। কই, কাউকেই তো দেখা যাচ্ছে না।

তাহলে নিশ্চয় বাসের মধ্যে অন্য কোথাও বসে আছে। কখনো আমার কাছছাড়া হয় না। সব সময় পেছন পেছন ঘুরছে। ছদ্মবেশ ধারণ করতেও পয়লা নম্বরের ওস্তাদ।

হুঁ; কিন্তু ছদ্মবেশের ভাওতাও আপনাকে ভোলাতে পারেনি বোঝা যাচ্ছে। আপনার দৃষ্টিশক্তি খুব নিখুঁত আর প্রখর।

কোনো মুখ একবার দেখলে আমি জীবনে ভুলি না। এমন কি সে কালো নিগ্রো হলেও আমি তাকে দেখা মাত্রই চিনতে পারি। এ ক্ষমতা খুব কম লোকেরই থাকে।

ঠিক আপনার মতো একজনকেই আমি খুঁজছিলাম। পোয়ারোর কণ্ঠস্বরে খুশির আমেজ। এমনভাবে আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়াটা সত্যিই খুব সৌভাগ্যের কথা। আমি এমন একজনকে চাই যার নজর তীক্ষ্ণ এবং স্মৃতিশক্তিও প্রখর, দুর্ভাগ্যবশত একজনের মধ্যে এই দ্বিবিধ গুণের সমন্বয় কদাচিৎ দৃষ্ট হয়। ডাক্তার রবার্টসকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, কোনো ফল পাইনি। মিসেস লরিমারও আমায় হতাশ করেছেন। এবার তাহলে আপনার কাছেই আর একবার চেষ্টা করে দেখি অভীষ্ট ফলোভে সক্ষম হই কিনা। সেদিন সন্ধ্যায় মিঃ শ্যাতানা খুন হবার প্রাক্কালে যে ঘরে বসে আপনারা তাস খেলছিলেন সেই ঘরটার কথা স্মরণ করুন। সেই ঘরের মধ্যে কি কি জিনিস আপনি দেখেছিলেন?

ডেসপার্ড অবাক হয়ে তাকালেন। আপনার কথার তাৎপর্য ঠিক হৃদয়ঙ্গম করতে পারছি না।

আমাকে সেই ঘরের একটা যথাযথ বিবরণ দিন কি কি জিনিস আপনার নজরে পড়েছিল আসবাবপত্র বা কি কি ছিল, এই আর কি!

এ ধরনের ব্যাপারে আমি খুব সাহায্য করতে পারব কিনা সন্দেহ! ডেসপার্ড মৃদু কণ্ঠে জানালেন। যতদূর মনে পড়ছে ঘরটায় জিনিসপত্র ঠাসা ছিল। কোনো মানুষের বাসঘর বলে মনে হয় না। অনেকগুলো আলনা, সিল্কের জামা কাপড় আরও কত কি ছিল তার ইয়ত্তা নেই। ঘরটার চরিত্র যেন অনেকটা মিঃ শ্যাতানার চরিত্রের অনুকূল।

কিন্তু ঠিক কি কি জিনিস ছিল?

ডেসপার্ড হতাশভাবে মাথা নাড়লেন। বিশেষ নজর দিয়ে দেখিনি।…গোটা কতক ভালো জাতের কম্বল পারস্য ওইসব দেশ থেকে আমদানি করা নানা ধরনের কতকগুলো মূর্তি, দেওয়ালে টাঙানো কিছু ছবি, দক্ষিণ আফ্রিকার একটা বড় সাইজের কৃষ্ণসার হরিণের মাথা, না না ওটা বোধহয় পাশের হলঘরটার মধ্যে ছিল। আমার বিশ্বাস রোল্যান্ড ওয়ার্ডের দোকান থেকে কেনা।

মিঃ শ্যাতানার বনে জঙ্গলে গিয়ে শিকারের নেশা ছিল বলে আপনার নিশ্চয় মনে হয় না?

তিনি সে রকম পাত্ৰই নন। ঘরে বসে তাস, দাবা খেলা ছাড়া তার যে আর কোন কাজ নেই এ আমি বাজি ধরে বলতে পারি। তবে ঘরের মধ্যে আর কি কি দেখেছিলাম, বা আদৌ নজর দিয়ে দেখেছিলাম কিনা সেকথা এখন মনে করতে পারছি না। আপনাকে বোধহয় নিরাশ করলাম। আমি খুবই দুঃখিত। টেবিলের ওপর একটা পালিশ করা কাঠের মূর্তির কথা আমার বেশ মনে পড়ছে। জিনিসটা খুব ভালো লেগেছিল।

পোয়ারো ঈষৎ গম্ভীর হলেন। বললেন যাকগে মনে না পড়লে আর কি করা যাবে।….মিসেস লরিমারের স্মৃতিশক্তি কিন্তু আশ্চর্য রকমের ভালো। প্রত্যেকটা তাস এবং কোন সে কি ডাক হয়েছিল, কি খেলা হয়েছিল সবকিছু গড়গড় করে বলে গেলেন। সত্যিই অদ্ভুত ক্ষমতা।

ডেসপার্ড তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। অনেক বয়স্কা মহিলাই এটা মনে রাখতে পারে। সারাদিন তারা শুধু ক্লাবে বা পার্টিতে তাস খেলে বেড়ায়। তাসই তাদের একমাত্র ধ্যান জ্ঞান চিন্তা।

আপনার নিশ্চয় সমস্ত তাসের কথা মনে নেই?

না। ডেসপার্ড স্বীকার করলেন। দু-একটা তাসের কথা শুধু মনে আছে। একবার রবার্টসের ভাওতায় ভড়কে গিয়ে পাঁচটা ডায়মন্ডের গেমটা ডাকতে পারিনি। অবশ্য ভদ্রলোক গোটা দু তিন শর্ট দিয়েছিলেন কিন্তু আমরা ডবল দিইনি বলে মোটের ওপরে লোকানই হল। একটা নেট্রাম্প গেমের কথা মনে পড়ে। বেশ শক্ত খেলা। তাসটাও চার হাতে খুব বিশ্রি ভাবে ভাগ হয়েছিল। আমি খেলতে পারলাম না। দুটো শর্ট দিলাম। আর বেশি দিতে হয়নি এই আমার ভাগ্য।

ব্রিজ কি আপনি বেশি খেলেন, মেজর ডেসপার্ড?

না, ক্কচিৎ খেলি। তবে এটা যথেষ্ট বুদ্ধির খেলা তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

 পোকারই বোধহয় আপনার বেশি পছন্দ? হা সে কথা অকপটেই স্বীকার করছি। কারণ এতে জুয়ার গন্ধ খুব বেশি।

পোয়ারো চিন্তামগ্ন কণ্ঠে বললেন, মিঃ শ্যাতানা তাসে তেমন আসক্ত ছিলেন বলে আমার মনে হয় না।

একটা খেলায় কিন্তু তার অফুরন্ত উৎসাহ ছিল!

কি খেলা?

অপরকে ভয় দেখানো খেলা। পোয়ারো মিনিটখানেক নীরব রইলেন। তারপর প্রশ্ন করলেন, একথা কি আপনি আগেই জানতেন না এখন হঠাৎ মনে হল?

ডেসপার্ড ঈষৎ বিব্রত হয়ে পড়লেন। পরক্ষণেই সামলে নিলেন নিজেকে। তার মানে আমার বক্তব্যের সপ্রসঙ্গ ব্যাখ্যা শুনতে চাইছেন? অবশ্য চাওয়াটা খুব দোষের নয়। যদি জানতে চান তো বলি, এ হল আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা। এর বেশি ব্যাখ্যা দিতে আমি রাজি নই। যে সমস্ত কথা আমার কানে এসেছে তা খুব গোপন সূত্রেই এসেছে।

আপনি কি নারীঘটিত কোনো বিষয়ের ইঙ্গিত করছেন?

তাছাড়া আর কি। শ্যাতানার মতোন নোংরা স্বভাবের লোক তো মেয়েদের ভয় দেখিয়েই আনন্দ পাবে।

ভদ্রলোককে কি আপনার ব্ল্যাকমেলার বলে মনে হয়? ভারী আশ্চর্যের ব্যাপার তো?

ডেসপার্ড মাথা নাড়লেন। আপনি আমার কথা ঠিক বুঝতে পারছেন না। এক হিসেবে। তাকে ব্ল্যাকমেলার বলাই যুক্তিসঙ্গত। তবে প্রচলিত অর্থে নয়। অর্থের লালসায় তিনি একাজ করতেন না। অপরে যাতে তাকে দেখলে ভয় পায়, কুঁকড়ে ওঠে এর জন্য তিনি তাঁদের ব্যক্তিগতভাবে গোপনে খবরাখবর সংগ্রহ করতেন। এবং তিনি যে সমস্তই জানেন আভাসে ইঙ্গিতে সেটা তাদের বুঝিয়ে দিতেও ছাড়তেন না। অপরকে ভয় দেখিয়ে তিনি নিজের মনে এক ধরনের কলুষিত আনন্দ উপভোগ করতেন।

তার ফল কি হল? প্রতিফলে প্রচন্ড একটা লাথি খেলেন। এর বেশি ভালো কথা আমার মুখে আসছে না। অন্যকে ভয় দেখিয়ে যন্ত্রণা দিয়ে তিনি মজা পেলে। এমন লোককে মনুষ্যপদবাচ্য মনে করতে আমার ঘৃণা হয়। মেয়েদের পেট থেকে কথা বার করতে তিনি ছিলেন খুব পটু। কোনোরকমে যদি তাদের মাথায় একবার ঢুকিয়ে দিতে পারেন যে ব্যাপারটা আপনি জানেন তাহলে বাকি যে অংশটা আপনি জানেন না সেটাও তারা অকপটে বলে যাবে। এর ফলে তিনি নিজেকে খুব চালাক বলে ভাবতেন। শয়তানের চালচলন নকল করে উদ্ধত ভঙ্গিতে জনসাধারণের মধ্যে ঘুরে বেড়াতেন। ঠোঁটের কোণে সূক্ষ ব্যঙ্গের হাসি। যেন সকলকে ডেকে বলছেন, জানো হে আমি সকলের সব কিছুই জানি। আমি শয়তানের প্রতিভূ মিঃ শ্যাতানা। আমার কাছে কোনো জারিজুরি চলবে না।….ঠিক যেন একটা শিম্পাঞ্জি।

 আপনি কি সন্দেহ করেন, তিনি মিস মেরিডিথকেও সেই রকম ভয় দেখিয়েছিলেন, ধীর শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন পোয়ারো। দু’চোখে সন্ধানী দৃষ্টি ডেসপার্ডের মুখের ওপর নিবদ্ধ। মিস মেরিডিথ! ডেসপার্ড বিস্মিত হলেন। তাঁর কথা আমি ভাবছি না। আর শ্যাতানার মতো জঘন্য চরিত্রের লোককে উনি কি দুঃখেই বা ভয় পেতে যাবেন।

মাফ করবেন। আপনি কি মিসেস লরিমারের কথা বলতে চাইছেন?

আরে না, না। আপনি ভুল বুঝছেন। বিশেষ কাউকে উদ্দেশ্য করে না, আমি সাধারণভাবে তার চরিত্রের কথা ব্যক্ত করছি। মিসেস লরিমারকে ভয় দেখানো সহজসাধ্য নয়। আর তিনি সে ধরনের মহিলাও নন যার অতীত জীবনে কোনো অপরাধ থাকতে পারে।

আপনি শুধু একটা সাধারণ পদ্ধতির কথা বলছেন?

 হ্যাঁ তাই।

তিনি যে মেয়েদের মনের গতি প্রকৃতি ভালো ভাবেই বুঝতেন তাতে কোনো দ্বিমত নেই।

পোয়ারো শান্তস্বরে তার অভিমত ব্যক্ত করলেন। কেমনভাবে তাদের কাছ থেকে কথা আদায় করা যায় তিনি জানতেন। তিনি তাদের গোপন কথা ব্যক্ত করবার জন্যে কৌশলে প্ররোচিত করতেন।

পোয়ারো মাঝপথে থেমে গেলেন। ডেসপার্ডের কণ্ঠে অধৈর্যের ছোঁওয়া। সত্যিই অবিশ্বাস্য। লোকটা ছিল পর্বতপ্রমাণ নির্বোধ। এমন কিছু বিপজ্জনকও নয়। তা সত্ত্বেও মেয়েরা তাকে কেন যে এত ভয় পেত।…..ভাবলে এখন হাসি পায়।

কথা বলতে বলতে অকস্মাৎ উঠে দাঁড়ালেন ডেসপার্ড। আরে আরে মনের ভুলে যখন আমার স্টপেজ পেরিয়ে চলে এসেছি। আচ্ছা, এখন উঠি পরে আবার দেখা হবে মঁসিয়ে পোয়ারো। জানালা দিয়ে লক্ষ্য করলেও দেখতে পাবেন আমার অনুসরণকারীও আমার সঙ্গে সঙ্গেই বাস থেকে অবতরণ করবেন।

দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেলেন ভদ্রলোক। তারপর ছুটন্ত বাস থেকেই রাস্তায় লাফিয়ে পড়লেন। পোয়ারো জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলেন মেজর ডেসপার্ড লম্বা লম্বা পা ফেলে ফুটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। অবশ্য তিনি তার অনুসরণকারীকে খুঁজে দেখবার কোনো চেষ্টা করলেন না। কেউ একজন হয়তো হবে!

তাঁর মাথার মধ্যে তখন অন্য চিন্তা পাক খাচ্ছে। বিশেষ কাউকে উদ্দেশ্য করে নয়।….মৃদুস্বরে কথাটা বিড়বিড় করলেন তিনি। সত্যিই খুব আশ্চর্যের।

.

১৪.

 সার্জেন্ট ওকোনারের একটা বিশেষ ক্ষমতার জন্যে তার অন্যান্য সহকর্মী তাকে হিংসে করত। গৃহস্থবাড়ির মেয়েও ঝি-দাসীদের মন ভোলাতে ওকোনারের জুড়ি নেই।

ওকোনার দেখতে শুনতে খুবই সুদর্শন। নরম কচি মুখ তারুণ্যের আভায় উজ্জ্বল। চওড়া কাঁধ, দীর্ঘ দেহ। কথাবার্তার মধ্যে একটা সাবলীল উদ্ধত ভঙ্গি। দু’চোখে হাসির উচ্ছ্বাস। মেয়েরা তাকে দেখা মাত্র একটা অদম্য আকর্ষণ অনুভব করত। তার ফলে ওকোনার তার কাজ উদ্ধার করতে পারতেন বেশ ভালো এবং দ্রুতগতিতে।

মিঃ শ্যাতানার খুনের চারদিন পরেই তাকে একটা সস্তা দরের রেস্তোরাঁয় মিস এলিনা ব্যাটেল-এর পাশের চেয়ারে বসে থাকতে দেখা গেল। মিস এলিনা বেশ কিছুদিন মিসেস ক্র্যাডকের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেছিল। ওকোনার সেই দিকেই কথার মোড় ঘোরালেন।

এই মাত্র রাস্তা দিয়ে এক ভদ্রলোককে হেঁটে যেতে দেখলাম। তাকে দেখে আমার এক পুরানো মনিব মিঃ ক্র্যাডকের কথা মনে পড়ে গেল, ভদ্রলোককে অবিকল তাঁর মতো দেখতে।

ক্র্যাডক! এলিনাও কৌতূহলী হয়ে উঠল। আমিও তো অনেক দিন আগে এক ক্র্যাডক দম্পতির বাড়ির কাজ করেছিলাম।

ব্যাপারটা ভারী আশ্চর্যের তো। আমরা দুজনেই কি তাহলে একই ভদ্রলোকের বাড়ি চাকরি করতাম?

আমার ক্র্যাডক তো নর্থ অডলে স্ট্রিটে থাকতেন, পরে সেখান থেকে কোথায় যেন চলে যান।

আমার ভদ্রলোকও ওই রাস্তাতেই থাকতেন। নম্বরটা সঠিক মনে আসছে না। ভদ্রলোকের স্ত্রীর জ্বালায় একদিনের জন্যও স্বস্তিতে কাজ করতে পারেনি।

তাহলে আর কোনো ভুল নেই। ভাগ্যচক্রে আমরা দুজনে একই বাড়িতে চাকরি করে এসেছি। মিসেস ক্র্যাডক আমাকেও সারাক্ষণ জ্বালিয়ে পুরিয়ে মারতেন। সব সময় সন্দেহ অবিশ্বাস আর খিটিমিটি। শক্ত সমর্থ পুরুষ দেখলে তো তার মুখ দিয়ে লালা ঝড়তে শুরু করত।

ভদ্রমহিলার আচার ব্যবহারের জন্যে তার স্বামীকেও খুব ঝামেলা পোহাতে হত। মিসেস ক্র্যাডক। সর্বদাই অভিযোগ করে বেড়াতেন, তাঁর স্বামী একবারেই তার দিকে নজর দিচ্ছেন না। দিন দিন তার শরীর ভেঙে পড়ছে। আর সব হাজার রকমের উপসর্গের ফিরিস্তি। আমার মনে হয় সমস্ত বাজে কথা। ভদ্রমহিলা দিব্যি সুস্থ ছিলেন।

থাকগে।….একবার এক ডাক্তারের সঙ্গে ভদ্রমহিলার নাম জড়িয়ে কি যেন একটা কথা উঠেছিল। খুব রসালো ধরনের কিছু, তাই না?

ডাক্তার রবার্টসের কথা বলছ তো, কিন্তু তিনি অতিশয় ভদ্রলোক।

রেখে দাও তোমার ভদ্রলোক, সকৌতুকে বলে উঠলেন ওকোনার। মেয়েদের কথা আমার জানা আছে। কোনো লোকের খারাপ নাম ছড়ালেই মেয়েরা তার কাছে বেশি ভিড় করতে ভালোবাসে, তাছাড়া ওই ধরনের ভদ্রলোকের স্বভাব-চরিত্রের সঙ্গেও আমি খুব পরিচিত।

না না, তুমি তাহলে ভদ্র লোককে চিনতে ভুল করেছ। ওঁর কোনো দোষ নেই। মিসেস ক্র্যাডক সব সময় তাকে ডেকে পাঠাতেন। ডাক্তারের আর করবার কি আছে বলো। তিনি ভদ্রমহিলাকে তার একজন পেশেন্ট হিসেবেই দেখতেন, সেই রকম ভাবেই ব্যবহার করতেন। মিসেস ক্র্যাডক কিন্তু তাকে ছাড়তে চাইতেন না।

ছেড়ে দাও। আমাদের আর পরের কথা আলোচনা করে লাভ কি এলিনা। তোমার নাম ধরে ডাকছি বলে কিছু মনে করো না। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে তোমার সঙ্গে যেন আমার কত যুগ যুগান্তের পরিচয়।

এলিসা ছোট্ট মেয়ের মতো মাথা ঝকাল। না না, আমি কিছু মনে করছি না, তোমার মুখে আমার নাম খুব ভালো লাগছে।

ওকোনোর একবার তির্যক দৃষ্টিতে এলিনাকে দেখে নিলেন। আমি যতদূর জানি শেষকালে মিঃ ক্র্যাডক তার বউ-এর ওপর ক্ষেপে গিয়েছিলেন। এ বিষয়ে তোমার কি ধারণা?

হ্যাঁ, একদিন ভদ্রলোক রেগেমেগে ডাক্তারের সামনেই খুব চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন। কিন্তু তখন তিনি অসুস্থ ছিলেন। মারাও গেলেন তার দু-চার দিনের মধ্যে।

হ্যাঁ হ্যাঁ, তাঁর মৃত্যুটাও কেমন অদ্ভুত। কিসে যেন মারা গেলেন শেষ কালে।

এক ধরনের সস্তা দামের জাপানি সেভিং ব্রাশ। ব্রাশগুলোই দূষিত ছিল। কোম্পানির লোকেরা কেন যে তাদের জিনিসপত্র একটু সাবধানে তৈরি করে না। তার পর থেকে যতই সস্তা হোক জাপানি জিনিস ব্যবহার করা আমি একেবারেই ছেড়ে দিয়েছি।

কিনতে হলে ব্রিটেনের তৈরি জিনিসই কেনা ভালো। আমিও সকলকে সেই রকম পরামর্শ দিই।

তাহলে ডাক্তারের সঙ্গেও ভদ্রলোকের কথা কাটাকাটি হয়েছিল?

এলিনা ঘাড় নাড়ল। পুরানো কাসুন্দি ঘাঁটবার সুযোগ পেয়ে মুখর হয়ে উঠল তার রসনা। মিঃ ক্র্যাডকই ঝগড়াটা বাঁধাবার চেষ্টায় ছিলেন। তবে ডাক্তার রবার্টস তেমন মুখ খোলেননি। বিব্রতভাবে শুধু বলেছিলেন, কি আবোল তাবোল বকছেন। আপনার মাথা কি একদম খারাপ হয়ে গেছে!

ব্যাপারটা নিশ্চয় বাড়ির মধ্যেই ঘটেছিল?

হ্যাঁ, একদিন মিসেস ক্র্যাডক ফোনে ডাক্তার রবার্টসকে ডেকে পাঠালেন। তার স্বামী তখন ঘরের মধ্যেই ছিলেন। তিনি খুব চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন। তাদের দু’জনের ঝগড়ার মাঝখানে ডাক্তার এসে হাজির। তখন ভদ্রলোক বউকে ছেড়ে দিয়ে ডাক্তারের ওপরেই চোটপাট করতে লাগলেন।

কি বললেন তিনি ডাক্তারকে? এসব যদিও আমার শোনবার কথা নয়, কারণ খোদ মনিব গিন্নির শোয়ার ঘরেই সমস্ত নাটকটা জমে উঠেছিল। তবে ভাবলাম ওপর তলায় কিছু একটা ঘটছে। তাই আমি ধুলো ঝাড়বার ডাস্টারটা হাতে নিয়ে সিঁড়ি পরিষ্কারের কাজে মন দিলাম। ব্যাপারটা কি আমার জেনে রাখা উচিত!

সার্জেন্ট ওকোনার নিজের প্রেমিক-প্রবরের ছদ্মবেশটিকে মনে মনে অভিনন্দন জানালেন। সে যদি আজ পুলিশের পোশাকে আসত তবে এই আড়ি পেতে শোনবার কথা এলিনা নিশ্চয় অস্বীকার করতো।

আমি শুনতে পেলাম, আমার মনিব যাচ্ছেতাই ভাষায় ডাক্তারকে বকে চলেছেন। ডাক্তার রবার্টস চুপ করে আছে।

কি বলছিলেন তিনি?

এই নিয়ে দ্বিতীয়বার প্রশ্নটা উত্থাপন করলেন ওকোনার। উত্তরটা তাঁর পক্ষে খুব জরুরি।

মনের সুখে আশ মিটিয়ে গালাগাল দিচ্ছিলেন। এলিনার কণ্ঠে পরম তৃপ্তির সুর। সঠিক উত্তরটা কি মেয়েটার মুখ থেকে বার করে আনা যাবে না? মনে মনে শঙ্কিত হলেন ওকোনার। মুখের ভাবে কিন্তু কোনো পরিবর্তন ঘটল না। কি বলে গালাগাল দিচ্ছিলেন?

সে অনেক কথা। সবটার অর্থ আমি বুঝতেও পারিনি। অকপটে ব্যক্ত করল এলিনা। একবার বলছিলেন অপেশাদারী ব্যবহার, আর একবার বললেন আপনি আমার ভদ্ৰব্যবহারের সুযোগ নিয়ে এই সমস্ত অপকীর্তি চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি এ-বিষয়ে আদালতে মামলা আনবেন বলেও শাসালেন। মেডিক্যাল রেজিস্টার না কোথায় ডাক্তারের নামে অভিযোগ লিখে পাঠাবেন।

হুঁ, মেডিক্যাল কাউন্সিলে।

অবে তাই হয়তো। এদিকের এইসব শুনে ভদ্রমহিলা তো খুব খাপ্পা। তিনি হিস্টিরিয়া রুগির মতো হাত পা ছুঁড়তে লাগলেন। যা মুখে আসে তাই বলে স্বামীকে গালাগাল দিলেন। বললেন তুমি আমার দিকে একেবারে নজর দাও না। সব সময় আমাকে অবহেলা করো। ডাক্তার রবার্টস অতিশয় সজ্জন ব্যক্তি, আমার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেন। 

এইসব গন্ডগোলের মধ্যে ডাক্তার রবার্টস ভদ্রলোককে পাশের ঘরে ডেকে এনে দরজা ভেজিয়ে দেন। তিনি বেশ শান্ত কণ্ঠেই ভদ্রলোককে বোঝালেন। আপনার স্ত্রীর যে হিস্টিরিয়া রোগ আছে তা কি আপনি জানেন না।

ভদ্রমহিলা অনেক সময় কিছু না ভেবেই নাম ধরে কথাবার্তা বলে থাকেন। এই কেসটা খুব জটিল এবং আমার পক্ষেও অত্যধিক ক্লান্তিকর। অনেকদিন আগেই এখান থেকে জবাব দিয়ে চলে যাব বলে ভেবেছিলাম, কিন্তু বিবেকে বাধল। এমন ভাবে কোনো পেশেন্টকে ছেড়ে যাওয়া উচিত নয়। ডাক্তারের কথায় মিঃ ক্র্যাডক কিছুটা শান্ত হলেন। ডাক্তার তাকে বললেন, আপনার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিন। তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে অযথা মাথা গরম করবেন না। সমস্তটাই অলীক কল্পনাপ্রসূত। আপনার রুগ্ন স্ত্রীর স্বপ্ন বিলাস। আমিও সম্ভবত এ বাড়িতে আর কোনোদিন পদার্পণ করব না। প্রয়োজন বোধ করলে কোনো বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে পারেন।

এরপর ডাক্তার রবার্টস ও মিঃ ক্র্যাডক দুজনেই বাইরে বেরিয়ে এলেন। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে সিঁড়ি পরিষ্কার করতে লাগলাম। কিন্তু তিনি তেমন লক্ষ্য করলেন না। তাঁকে তখন খুব অসুস্থ বলে মনে হচ্ছিল। ডাক্তার রবার্টসকে দেখলাম বেশ হাসিখুশি। তিনি শিষ দিতে দিতে বাথরুমে গিয়ে সাবান দিয়ে হাত ধুলেন। তারপর ছোট এটার্চি কেসটা হাতে ধরে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলেন। যাবার সময় হাসি মুখে আমার সঙ্গে কথা বললেন। তাঁকে তখন বেশ প্রাণোচ্ছল মনে হল…তাহলে বুঝতেই পারছেন ভদ্রলোক সত্যিই খুব ভালো তার কোনো দোষ নেই। কেবল ভদ্রমহিলার জন্যেই তাকে এই বদনামের ভাগীদার হতে হল।

এর পরেই কি ভদ্রলোক অ্যানথ্রক্স রোগে আক্রান্ত হলেন?

হ্যাঁ, তবে আমার মনে হয় ভদ্রলোক আগে থেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। মিসেস ক্র্যাডক কিন্তু সে সময় প্রাণ দিয়ে স্বামীর সেবা করেছিলেন। বাঁচাতে পারলেন না।

ভদ্রলোকের মৃত্যুর পর কি ডাক্তার রবার্টস আবার হাজির হয়েছিলেন?

না, তিনি আর আসেননি। তোমার নিশ্চয় ডাক্তারের ওপর কোনো আক্রোশ আছে। আমি তো বললাম, তাঁদের মধ্যে সেরকম কোনো সম্পর্ক ছিল না। তাহলে তো তারা অনায়াসে আবার বিয়ে করতে পারতেন। কিন্তু রবার্টস বোকা নন। মিসেস ক্র্যাডক অবশ্য মাঝে মধ্যে তাঁকে দু-চারবার ফোন করেছিলেন। তার কাছ থেকে তেমন সাড়া পাননি। এরপর ভদ্রমহিলা হঠাৎ সমস্ত কিছু বিক্রি করে দিয়ে মিশরে চলে যান। যাবার আগে টাইফয়েড রোগের প্রতিষেধক টীকা নেবার জন্য তিনি একবার রবার্টসের চেম্বারে গিয়েছিলেন। যখন ফিরে এলেন সারা হাতে আড়ষ্ট ব্যথা। সময়টা ছিল শীতকাল, তবু তিনি হাল্কা ধরনের পোশাক পরিচ্ছদ নিয়ে গেলেন। বললেন, মিশরে নাকি এখন খুব গরম।

তা ঠিক। ওকোনার ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন। মিশরে মাঝে-মধ্যে অত্যধিক গরম পড়ে। ভদ্রমহিলা বোধহয় সেখানেই মারা যান?

সে খবর সঠিক আমি জানি না। এলিনা একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অমন ভালো পোশাক-পরিচ্ছদগুলো তিনি বোধহয় আর গায়ে দিতে পারেননি।

সেগুলোর ওপর তোমার যেন খুব লোভ ছিল মনে হচ্ছে? সকৌতুকে প্রশ্ন করলেন ওকোনার।

যা, অসভ্য কোথাকার। এলিনা কৃত্রিম ক্ষোভে ফুঁসে উঠল।

তাহলে এখন উঠি। ফার্মের কাজে আমাকে হয়তো দু-চার দিনের জন্যে বাইরে যেতে হবে।

ক’দিনের জন্যে যাবে? তার কোনো ঠিক নেই। সবই মালিকের ইচ্ছে আমরা তো সামান্য কর্মচারী মাত্র। যদ্দিনের আদেশ হবে তদ্দিনই থাকতে হবে বাইরে।

এলিনা বিমর্ষ হল। মনে মনে ভাবল। এই সমস্ত সুন্দর সুখী যুবকরা দু-চার দিনের জন্য ধরা দিয়েই আবার কোথায় অদৃশ্য হয়ে যায়। এদের চেয়ে ফ্রেডই শতগুণে ভালো। সে কোনোদিন কোথাও উড়ে যাবে না। এলিসার সামান্য অনুকম্পা লাভের জন্যে বেচারির কি আকুল প্রচেষ্টা।

সার্জেন্ট ওকোনার যে দুদিনের জন্যে এসে এলিনার মনে বরাবরের মতো কোনো গভীর দাগ কেটে যেতে পারেনি সেইটুকুই যা বাঁচোয়া।