০৪. সাত, আট, সাজানোর পাট

০৪. সাত, আট, সাজানোর পাট

মিঃ মর্লের মৃত্যুর পর একমাস কেটে গেছে। আর মিস সেইনসবরি সীল? সে আজও পলাতক। তার খোঁজ এখনও চলছে।

চিফ ইন্সপেক্টর জ্যাপ বিষয়টি নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন! একদিন তিনি বিরক্ত হয়ে এরকুল পোয়ারোকে বললেন–মহিলাটি যদি জীবিত থাকেন, তাহলে কোথায় থাকতে পারেন বলে আপনার মনে হয়। আর যদি মারা যায় তাহলে তার লাশ কে গায়েব করল? আর যদি আত্মহত্যা করে থাকেন তাহলে?

পোয়ারো তার মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নিয়ে বললেন–আবার একটা আত্মহত্যার কেস সাজাচ্ছেন, বন্ধু।

–এটা ঠিক বললেন না। আপনার বিশ্বাস মর্লেকে হত্যা করা হয়েছে। আর আমি প্রমাণ করেছি তিনি আত্মহত্যাই করেছেন।

–আপনারা পিস্তলটার মালিকের খোঁজ পেয়েছেন?

–না, ওটা বিদেশী জিনিস।

তা আমি অস্বীকার করছি না। আমার বক্তব্য ওটা এল কোথা থেকে? ওটার মালিক কে?

–ওটার মালিক মর্লে নিজে। তিনি ওটা বিদেশ থেকে কিনেছিলেন হয়তো। জাহাজে চড়ে তিনি ও তার বোন বহুবার বিদেশে বেড়াতে গিয়েছিলেন। বিদেশে গেলে বহু লোকই এরকম পিস্তল কেনেন। বিদেশী জিনিস কেনা মর্লের একটা নেশাও হতে পারে।

জ্যাপ দম নেবার জন্যে থামলেন। আবার বলা শুরু করলেন–আমি নিশ্চতভাবে কিছু বলিনি। আমি যদির ওপর জোড় দিয়ে বলছি। ধরুন যদি মিস সীল নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে থাকেন অথবা কেউ তাকে নদীতে ফেলে দিয়ে খুন করে থাকেন তাহলে তার দেহ জলে ভেসে উঠবে।

পোয়ারো তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন–যদি না তার দেহে ভারী কিছু বেঁধে টেমসের জলে ফেলে দেওয়া হয়।

জ্যাপ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–আপনি এটাও বলবেন, কোনো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদীরা খুন করেছে নিশ্চয়ই?

পোয়ারো বললেন–এরকম কিছু ঘটনা খবরের কাগজে ছাপাও হয়। লোকমুখে তা প্রচারও পায়।

কার কাছে আপনি শুনেছেন?

 –মি-রেজিনাল্ড বার্নেসের মুখে শুনেছি। ক্যানেল গার্ডেন রোড, ইলিংসে তার বাড়ি।

জ্যাপ সন্দিগ্ধ মনে বললেন তিনি জানাতে পারেন। যখন তিনি স্বরাষ্ট্র দপ্তরের সচিব ছিলেন, তখন তিনি এদের খুব কাছ থেকে দেখেছেন।

–আপনি মানতে পারছেন না।

এসব আমার ডিপার্টমেন্টের আওতায় পড়ে না। এসব থাকতে পারে। কিন্তু তারা সব ক্ষেত্রে সফল হতে পারে না।

পোয়ারো একথার কোনো জবাব দিলেন না। বেশ কিছুটা সময় কেটে গেছে। হঠাৎ জ্যাপ বললেন–আমাদের হাতে আরও কিছু তথ্য এসেছে। ওই মহিলার সঙ্গে আগে থেকেই মি. অ্যামবেরিওটিসের পরিচয় ছিল। তারা দুজনে একই দিনে একই জাহাজে ভারত থেকে এসেছিলেন। তবে অ্যামবেরিওটিস ফার্স্ট ক্লাসের যাত্রী ছিলেন। আর উনি ছিলেন সেকেণ্ড ক্লাসের। এতে সন্দেহ করার মতো কিছু নেই। তবে ওই মহিলার সঙ্গে লোকটির দেখা হয়েছিল তার মৃত্যুর কয়েকদিন আগে। এক মধ্যাহ্নভোজের আসরে। সম্ভবত সেটাই ছিল তাদের শেষ দেখা।

–তাহলে বলছেন দু’জনের মধ্যে একটা যোগসূত্র ছিল?

–হয়তো ছিল–তবে আমার ধারণা অন্য। কোনো মিশনারী এরকম জঘন্য ব্যাপারে জড়িত থাকতে পারেন না।

আপনার মতে অ্যামবেরিওটিস ওই ব্যাপারে জড়িত?

— হ্যাঁ, ঠিক তাই। মধ্য ইউরোপে তার কিছু বন্ধু ছিল। তাদের সঙ্গে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। ভুলে যাবেন না গুপ্তচর বৃত্তি তার পেশা ছিল।

–এ বিষয়ে আপনি নিশ্চিত?

–অবশ্যই। তিনি নিজে কোনো নোংরা কাজে লিপ্ত ছিলেন না। তার কাজ ছিল খবর দেওয়া নেওয়া। কিন্তু তাকে প্রমাণের অভাবে ধরা যেত না। কিন্তু এই চক্রের সঙ্গে মিস সীল যুক্ত ছিলেন না।

পোয়ারো তীব্রস্বরে বললেন ভুলে যাবেন না, মিস সীল বহু বছর ভারতে বসবাস করেছিলেন।

জ্যাপ বললেন–আমি ভাবতে পারছি না অ্যামবেরিওটিস ও মিস সীল একসঙ্গে থাকতে পারেন?

পোয়ারো বললেন–আপনি নিশ্চয় জানেন না, মিস সীল ও মৃতা মিসেস অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল। তারা দুজনে খুব ভালো বন্ধু ছিলেন।

জ্যাপ বললেন–আমি বিশ্বাস করি না তারা দুজনে দুই মেরুর বাসিন্দা। আপনি বিশ্বাস না করতে পারেন। তবে মি. ব্লাস্ট নিজের মুখে একথা বলেছেন আমাকে।

জ্যাপ বললেন–ওহ, মি. ব্লাস্ট বলেছেন? তা উনি এসব জানতে পারেন। সত্যিই যদি মিস সীল মারা যান অথবা জীবিত থাকেন তাহলে কোথায় আছেন তিনি? গত মাসে কাগজে ছাপা হয়েছে তার ছবি ও বিবরণ।

–আপনার লোকেরাও তার সন্ধান করতে পারেনি? অনেক জায়গায় খোঁজ করেছে। ইংল্যাণ্ডের প্রতিটি লোককে ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছে, মাঝবয়সি জলপাই রঙের কার্ডিগান পরা কোনো মহিলাকে দেখলে ছুটে গেছে তার কাছে। ছবির সঙ্গে ওই মহিলার মিল খোঁজার চেষ্টা করেছে। যেখানে যেখানে মিস সীলের যাওয়ার সম্ভাবনা সেখানে সেখানে আমার লোক গেছে। ইয়র্কসায়ার থেকে লিভারপুল, কোথাও বাদ রাখেনি। ওই মহিলার বিবরণ অনুযায়ী কেউ কোনো খবর দিলেই আমার লোকেরা সেখানে গিয়ে হাজির। তল্লাসি চালিয়েছে কিন্তু সব পরিশ্রম বিফল হয়েছে।

পোয়ারো সহানুভূতি জানালেন। জ্যাপ আবার বলতে শুরু করলেন ভদ্রমহিলা খুব ভালো মানুষ ছিলেন। আমার কাছে খবর আছে তার অতীত জীবনেও কোনো কলঙ্ক ছিল না। অথচ তিনি বেপাত্তা।

পোয়ারো বললেন–অবশ্যই এর পেছনে কোন চাল আছে।

জ্যাপ বললেন–আপনি বলতে চাইছেন উনি মি. মর্লেকে গুলি ক. পাকতে পারেন। অথচ আপনি জানেন উনি চলে যাওয়ার পরেও অ্যামবেরিওটিস মর্লেকে জীবিত দেখেছেন।

পোয়ারো তীব্র প্রতিবাদ করে বললেন–আমি একথা বলিনি।

জ্যাপ বললেন–তাহলে আপনি বলতে চাইছেন মর্লের ব্যাপারে অ্যামবেরিওটিস মিস সীলকে কিছু বলেছেন। সে যাতে বাইরের কাউকে জানাতে না পারে তাই তাকে সরিয়ে দেওয়া হল। পোয়ারো বললেন–এসব কোনো পাকা খেলোয়ারের কাজ। আর এর সঙ্গে অনেকেই জড়িত আছে। তা না-হলে এক নিরীহ সহজ সরল দাঁতের ডাক্তারকে বেঘোরে প্রাণ দিতে হত না।

জ্যাপ বললেন–রেজিনান্ড বার্নেসকে একদম পাত্তা দেবেন না। উনি আজেবাজে খবর সংগ্রহ করেন। উনি লোককে ঠকিয়ে আনন্দ পান। গুপ্তচরগিরি ও রাজনীতির বুলি আওড়ানো ছাড়া ওনার কাছে আর কিছু পাবেন না। জ্যাপ এবার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–চলি বন্ধু, ও নিয়ে আর বৃথা চিন্তা করবেন না। যথাসময়ে সব জানতে পারবেন। জ্যাপ বিদায় নিলেন। পোয়ারোর চোখ গেল সামনের টেবিলের দিকে। ভ্রু কুঁচকে তিনি সেদিকেই তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তিনি ভাবছেন, অনেকগুলো নাম সংগ্রহ করা হয়েছে। তাদের সম্পর্কে বহু তথ্যও এসেছে হাতের মুঠোয়। তবুও বার বার মনে হচ্ছে কি যেন একটা বাদ যাচ্ছে। ঠিক মতো সাজাতে পারছেন না কেসটা। এরপরের কাজটাইবা কি হবে? কিছুই বুঝতে পারছেন না। চিন্তারা সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে তাঁর মাথার ভেতর।

সন্ধ্যার একটু পরেই পোয়ারো একটি দুঃসংবাদ পেলেন। জ্যাপ টেলিফোনে সেই সংবাদ দিয়েছেন। মিস সেইনসবারি সীলের খোঁজ পাওয়া গেছে। তবে তিনি মৃত। এখুনি তাকে কিং লিওপোল্ড ম্যানসনস, ব্যটারসি পার্ক, পঁয়তাল্লিশ নম্বর ফ্ল্যাটে হাজির হতে হবে। মিনিট পনেরোর মধ্যে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লেন এরকুল পোয়ারো। কিং লিওগোল্ড ম্যানসানসের সামনে এসে দাঁড়ালেন।

বহুতল বাড়িটিতে অনেকগুলো ফ্ল্যাট। তিনতলায় রয়েছে পঁয়তাল্লিশ নম্বর ফ্ল্যাটটি। ফ্ল্যাটের কলিং বেল বাজাতেই জ্যাপ দরজাটা খুলে দিলেন। তার মুখে বিষণ্ণতার ছাপ। তিনি বললেন–আসুন পোয়ারো। যেটা দেখাবার জন্য আপনাকে ডেকে এনেছি সেটা ঠিক আশা করিনি আমি। তবে আপনার একবার দেখা উচিত। পোয়ারো গম্ভীর মুখে বললেন–কিরকম অবস্থায় আছেন?

-একদম মরে কাঠ। মনে হয় একমাস আগেই তার মৃত্যু হয়েছে।

পোরারো তার ডানদিকে পরিচিত একটা শব্দ শুনতে পেলেন। তিনি শব্দ অনুসরণ করে সেদিকে চোখ রাখলেন।

জ্যাপ বললেন–এখানকার পোর্টার। সে অসুস্থ। রান্নাঘরের পাশের ঘরে সে শুয়েছিল। মৃতদেহ সনাক্তকরণের কাজটা ওকে দিয়েই সারলাম।

তারা বারান্দা দিয়ে এগিয়ে চললেন। পোয়ারোর নাকে একটা দুর্গন্ধ এল। তিনি রুমাল দিয়ে নাক চেপে ধরলেন।

তাঁরা ছোট একটা ঘরে এসে ঢুকলেন। সেই ঘরে রয়েছে ডালা খোলা একটি সিন্দুক।

জ্যাপের ইশারায় পোয়ারো সিন্দুকের দিকে এগিয়ে গেলেন। তার ভেতরে চোখ রাখলেন। প্রথমেই তার চোখে পড়ল পা ও ছাতার বকলস। তখন সেদিনের কথা তার মনে পড়ে গেল। যেদিন মি. মর্লে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। সেদিনও তিনি মিস সেইনসবারি সীলের এই বকলসই দেখেছিলেন। একে একে তার নজরে এল সবুজ পশমি কোর্ট, স্কার্ট ও মাথা। দৃশ্যটা দেখে তিনি আঁতকে উঠলেন। তার মুখ দিয়ে অস্ফুট একটা শব্দ বের হল।

মৃতার মুখ শক্ত ও ভারী কোনো বস্তুর আঘাতে থেতলে গিয়েছিল। তাতে পচন ধরায় আরও বীভৎস রূপ নিয়েছিল। দুজনেই ওই দৃশ্যটা সহ্য করতে না পেরে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।

জ্যাপ বললেন, আজ সারাদিন ব্যস্ত ছিলাম এই নিয়ে। আমরা এসবে অভ্যস্ত। বেশ বুঝতে পারছি আপনার কষ্ট হচ্ছে। সত্যিই দৃশ্যটা বেদনাদায়ক। পাশের ঘরে বসবেন চলুন। ওঘরে ব্র্যান্ডি রাখা আছে। একটু খেয়ে নেবেন।

পাশের ঘরটা বসবার ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ঘরটা সুন্দরভাবে সাজানো, বড় বড় কয়েকটি সোফা ও জ্যামিতিক আকারের আসবাবপত্রে ঠাসা ঘরটি।

পোয়ারো বোতল থেকে কিছুটা ব্র্যান্ডি একটি গ্লাসে ঢাললেন। খানিকটা গলায় ঢেলে তিনি বললেন, এবার বলুন বন্ধু, আমি প্রস্তুত।

জ্যাপ বলতে শুরু করলেন, এই ফ্ল্যাটের মালিক মিসেস অ্যালবার্ট চ্যাপম্যান। বছর চল্লিশের মহিলা। মাথা ভর্তি সোনালি চুল। উদার হাতে টাকা খরচ করেন। ব্রিজ খেলতে ভালোবাসেন, তিনি নিঃসন্তান। তাই একাকীত্ব তার সয়ে গেছে। তিনি একজন বানিজ্যিক পর্যটক। যেদিন আমরা মিস সীলের সঙ্গে দেখা করে কথা বলেছিলাম, সেই দিন সন্ধ্যায় তিনি এখানে এসেছিলেন। পোর্টার তাকে পথ দেখিয়ে ওই ফ্ল্যট নিয়ে গিয়েছিল, তখনই পোর্টারের সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল। পোয়ারো প্রশ্ন করলেন, তার সময়টা মনে আছে তো?

তার অসুখ করেছিল। তাকে বেশ কিছুদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। মাত্র এক সপ্তাহ আগের কথা। সে একটি কাগজের নিরুদ্দেশ কলামে বিজ্ঞাপন দেখে। নিরুদ্দিষ্টার ছবি দেখে ও বিবরণ পড়ে সে মিস সীলকে চিনতে পারে। সে তার স্ত্রীকে বলেছিল, যে মহিলা দোতলায় মিসেস চ্যাপমানের ফ্ল্যাটে রয়েছেন ইনিই সে। এই কাগজের বর্ণনার সঙ্গে ওই মহিলার ছবি, পোশাক একেবারে মিলে যাচ্ছে। এমনকি ওই জুতোর বকলসটা হুবহু এক। মহিলার নামও তখন তার মনে পড়েছিল।

জ্যাপ জোরে শ্বাস নিলেন। আবার শুরু করলেন বলা, পোর্টার লোকটি প্রথমে বুঝতে পারেনি কি করবে? পুলিশে খরব দেবে না গোপন রাখবে। শেষে মনস্থির করে সে পুলিশে জানায়। সত্যিই এখানে একটা চমক লুকিয়ে আছে তা আমি ভাবিনি। আমারতো কর্তব্যে অবহেলা করলে হবে না। তাই সেই লোকটির কথামতো আমি বেড়োর্জকে এখানে পাঠাই। সে খুব ভালো মানুষ। কাজে কর্মে মন আছে। বেডোর্জও অনুমান করেছিল এবার নিশ্চয় কোনো সূত্র পাওয়া যাবে। কেন না আমরা জানতে পেরেছি মিসেস চ্যাপম্যান একমাস ধরে ওই ফ্ল্যাটে আসছেন না। তিনি কোনো ঠিকানাও রেখে যাননি, তার দরজার সামনে বড় বড় করে লেখা : নেমি, একটা বিশেষ কাজে আমাকে হঠাৎ যেতে হচ্ছে। তুমি গোয়ালাকে বলে দিও আর দুধ লাগবে না। আশ্চর্য বিষয় হল তিনি মালপত্র বয়ে দেওয়ার জন্য পোর্টারকে ডাকেননি অথবা ট্যাক্সি ডাকার কথাও বলেননি।

এদিকে মিস সেইনসবারি সীলকে কেউ ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেনি। তবে কি তিনি সকলের চোখের আড়ালে সিঁড়ি দিয়ে নেমেছেন? এটাও অবান্তর প্রশ্ন নয়।

নেমি মিসেস চ্যাপম্যানের পরিচারিকা। সে রোজকার মতো সেদিনও এসেছিল। সে নোটিশ বোর্ডটা দেখেছিল। কিন্তু তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর ঘটেনি। সে জানত মিসেস চ্যাপম্যাম এভাবে বহুবার চলে গেছেন। তাই সে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। সার্জেন্ট বেডোর্জের ইচ্ছে ছিল ফ্ল্যাটে ঢুকে তল্লাশি করার। আমরা একটা সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে গিয়েছিলাম। সেটা ম্যানেজারকে দেখাই এবং ডুপ্লিকেট চাবি চাই। চাবি দিয়ে ঘর খুলে আমরা ভেতরে ঢুকলাম। ঘরের এক কোণে একটা সিন্দুক ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না। তবে বাথরুমে লিনোলিয়ামের উপর সামান্য রক্তের দাগ দেখতে পেলাম। তখন আমাদের সন্দেহ আরও বেড়ে গেল। বেডোর্জ বলল, স্যার, আমি নিশ্চিত দেহটা এখানেই আছে। দেহ খোঁজার পালা এবার। বেডোর্জ সিন্দুকের চাবি আবিষ্কার করল। সেই চাবি দিয়ে তালা খোলা হয়। তালা খুলতেই হারিয়ে যাওয়া মিস সীলের দেহ সকলের দৃষ্টিগোচর হল।

পোয়ারো জানতে চাইলেন, মিসেস চ্যাপম্যান কোথায় যেতে পারেন বলে আপনার মনে হয়, বন্ধু? হয়তো এই মৃতদেহ মিসেস চ্যাপম্যানের। তাকে কেউ খুন করে বাক্সে ঢুকিয়ে রেখেছে। আর আমরা মিস সীল বলে মনে করছি।

পোয়ারো সম্মতি জানিয়ে বললেন–মুখ বিকৃত করার অর্থ কি?

–সঠিক বলতে পারব না। তবে অনুমানের ভিত্তিতে বলতে পারি, নিছক বিকৃত ঈর্ষা বা লালসা মেটানোর জন্য। আর একটি সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না, সেটা হল মহিলার পরিচয় গোপন রাখার জন্যই এরকম করা হয়েছে। এতে তার পরিচয় গোপন রয়েছে কি?

–না, কারণ আমরা জেনেছি মিস ম্যাবেল সেইনসবারি সীল কি পোশাক পড়ে বাইরে বেরিয়েছিলেন। তার হাতে একটি ব্যাগ ছিল। সেই ব্যাগ থেকে একটি পুরোনো চিঠি পাওয়া গেছে। যেটা রাসেল স্কোয়ার থেকে পাঠানো হয়েছিল।

–এর থেকে কি প্রমাণিত হয়?

–কিছুই না। হয়তো এটাও মস্তবড় একটা ভুল। পোয়ারো উঠে দাঁড়ালেন, বললেন ভুল? হয়তো তাই। আপনারা ফ্ল্যাটের সব কিছু নিখুঁত ভাবে দেখেছেন? হ্যাঁ, বন্ধু, গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই। আমি মিসেস চ্যাপম্যানের শোবার ঘরটা দেখব।

জ্যাপ ও পোয়ারো শোবার ঘরে এলেন। ঘরটি নিপুণ হাতে সাজানো। পরিপাটি করে বিছানা পাতা। বোঝা যাচ্ছে এখানে অনেকদিন কেউ ঘুমোননি। চারদিকে শুধু ধুলো আর ধুলো।

জ্যাপ বললেন–আমরা খুব ভালোভাবে দেখেছি। কোথাও হাতের ছাপের চিহ্নমাত্র নেই। বাসনপত্রের গায়ে কিছু হাতের ছাপ রয়েছে। তবে তা হয়তো ওই পরিচারিকা নেমির হবে।

অর্থাৎ খুনের পর সব প্রমাণ মুছে লোপাট করে দিয়েছে। হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন।

পোয়ারো মিসেস চ্যাপম্যানের ফ্ল্যাটটা ঘুরে ঘুরে দেখলেন, বসার ঘর সাজানোতে আধুনিকতার ছোঁয়া আছে। আসবাবপত্রের দাম খুব কম হলেও দেখতে খুব সুন্দর, একটা দেয়াল আলমারি রয়েছে। সেটা কম দামি পোশাকে ভরা। তবে প্রত্যেকটি অতি মনোরম। সুর্যাকে কয়েকজোড়া জুতো রয়েছে। পোয়ারো একটা জুতো তুলে নিয়ে দেখলেন। সেটির নম্বর পাঁচ। দেয়ালের এককোণে একটি লোমের কোটের ওপর তার নজর আটকে গেল। এছাড়া ড্রেসিং টেবিলে বেশ কিছু দামি প্রসাধনী রয়েছে। রুজ, পাউডার, ভ্যানিসিং ক্রিম, শ্যাম্পু, লিপস্টিক, নেলপালিশ সবই আছে।

পোয়ারো মজার সুরে বললেন–ভদ্রমহিলা চল্লিশটি বসন্ত পাড় করেছেন। চুলে রূপালির আভাস। তবুও তিনি প্রকৃতির নিয়ম মানতে রাজি নন। জ্যাপ প্রশ্ন করলেন, আপনি কি কিছু আন্দাজ করতে পারছেন? না, না, কোথা থেকে শুরু করব বুঝতে পারছি না। কথা বলতে বলতে তিনি এগিয়ে গেলেন সিন্দুকটার দিকে। মৃতার পায়ের জুতো খুলে নিলেন। বকলসটা হাতে নিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলেন। বকলসটা খুলে গিয়েছিল, আবার সেটাকে সেলাই করা হয়েছিল। দেখে মনে হচ্ছে হাতে সেলাই করা হয়েছে।

পোয়ারো জোরে শ্বাস ফেললেন। পরে বললেন আমার কাছে এসব ধাঁধাঁর মতো লাগছে। জ্যাপ বিরক্ত হয়ে বললেন–আপনার মতলব কি বলুন তো? সামান্য একটা বকলস নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি করতে চাইছেন? পোয়ারো হেসে বললেন, ঠিক তাই। জ্যাপ বললেন–এতে গণ্ডগোলের কি আছে? পোয়ারো বললেন–সেটাই আমি বোঝার চেষ্টা করছি।

এরকুল পোয়ারো পোর্টারের কাছে জেনেছেন মিসেস চ্যাপম্যানের প্রিয় বান্ধবী হলেন মিসেস মারটন। তিনি থাকেন ৮২, কিং লিওপোল্ড ম্যানসনসে। জ্যাপ ও পোয়ারো সেখানে উপস্থিত হলেন।

মিসেস মারটন কথা বলায় পটু। কালো দুটি গভীর চোখ। সুবিন্যস্ত এক মাথা চুল। তার মুখ দিয়ে কথা বার করার জন্য কোনো কসরতের প্রয়োজন হল না। কোনোরকম ভূমিকা ছাড়াই জ্যাপ সরাসরি তাকে প্রশ্ন করলেন মিসেস সিলভিয়া চ্যাপম্যান কি আপনার পরিচিত?

সিলভিয়া চ্যাপম্যান? ভদ্রমহিলা একটু ভাবলেন। তারপর বললেন হ্যাঁ, তাকে চিনি। মাঝে মধ্যে সন্ধ্যেবেলায় ব্রিজ খেলতাম আমরা, একসঙ্গে আমরা দু’জনে ছবিও দেখেছি কতবার, কেনাকাটাও করেছি দু’জনে। কিন্তু, বলুন তো কি হয়েছে? তার কোনো অঘটন ঘটেনি তো? জ্যাপ তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, না, না ওসব কিছু হয়নি। আপনি বিচলিত হবেন না।–যাক শুনে আশ্বস্ত হলাম। সত্যি কথা বলতে কি, কিছুক্ষণ আগে একটা খবর আমার কানে এল। এক ডাকপিওন বলছিল কোনো ফ্ল্যাট থেকে একটা মৃতদেহ পাওয়া গেছে। তবে নোকমুখে শুনেছি তাই বিশ্বাস করতে পারছি না। জ্যাপ বললেন মিসেস চ্যাপম্যান সম্পর্কে আপনি কি জানেন? বিশেষ কিছুই না। তিনি চলে যাবার পরও কিছু শুনিনি। তিনি হঠাৎ চলে যান, তাই বোধহয় আমাকে বলার সুযোগ পাননি। এছাড়া আমাদের রোজার্সে যাবার কথা ছিল। মিসেস চ্যাপম্যান মিস সেইনসবারি সীল সম্পর্কিত কোন কথা আপনাদের কাছে বলেছেন?

-নামটা যেন চেনা চেনা লাগছে। কোথায় মনে হয় শুনেছি। জ্যাপ রুক্ষস্বরে বললেন কাগজে দেখতে পারেন। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে এই খবরটি কাগজে ছাপা হচ্ছে। হা, হা মনে পড়েছে। নিরুদ্দেশের কলামে দেখেছি। তবে আপনি বলছেন চ্যাপম্যান ওই মহিলাকে চেনেন। অসম্ভব কথা, সিলভিয়া কখনো ওই নাম আমাদের কাছে বলেননি, অফিসার। মিসেস মারটন, মি. চ্যাপম্যান সম্পর্কে কিছু জানেন? মিসেস মারটনের মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। কোনোরকমে ঢোক গিলে তিনি বললেন, মিসেস চ্যাপম্যান একবার বলেছিলেন তার স্বামীকে ব্যবসার খাতিরে দেশের বাইরে প্রায়ই যেতে হয়। তিনি যে সংস্থায় চাকরি করতেন, সেই সংস্থার তৈরি অস্ত্র সারা ইউরোপের বাজারে চড়া দামে বিক্রি হত। তাই মি. চ্যাপম্যানকে বেশির ভাগ সময় ইউরোপে থাকতে হত।

তার সঙ্গে আপনার আলাপ আছে? না, কখনো না। বাড়িতে তিনি খুব কম আসতেন। তাছাড়া স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই প্রতিবেশীদের নিয়ে মাথা ব্যথা ছিল না। মিসেস চ্যাপম্যানের অন্তরঙ্গ কেউ আছে কি? অন্তরঙ্গ বলতে কোনো বন্ধু বান্ধব বা নিকট আত্মীয় কেউ ছিলেন?–না। অন্তত সিলভিয়া কখনো বলেননি।

সিলভিয়া কখনো এদের সম্পর্কে কিছু বলেনি। সুতরাং আমিও জানি না।

-উনি কি কখনো ভারতে গিয়েছিলেন?

দুঃখিত, আমি এতসব জানি না। মিসেস মারটনের চোখ মুখের ভাব বদলে গেল। তিনি সন্ধিগ্ধ স্বরে বললেন আপনারা কে? আপনারা কি স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড থেকে এসেছেন। আর আমাকেই বা এত জেরা করছেন কেন? নিশ্চয় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে?

জ্যাপ বললেন, হ্যাঁ আপনার অনুমানই ঠিক, মিসেস মারটন। চ্যাপম্যানের ফ্ল্যাটে একটি মৃতদেহ পেয়েছি আমরা।

মিসেস মারটন বিস্ফারিত নেত্রে বললেন–ওহ গড! মৃতদেহ! কার হতে পারে? কোনো পুরুষের কি? জ্যাপ বললেন–না, এটি একটি স্ত্রীলোকের দেহ, পুরুষের নয়!

 মিসেস মারটন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন–আশ্চর্য, স্ত্রীলোক?

এবার পোয়ারো শান্ত স্বরে বললেন–দেহটা কোনো পুরুষের হবে ভাবলেন কেন?

–সেটাই স্বাভাবিক।

-কিন্তু কেন? মিসেস চ্যাপম্যান কি কোনো পুরুষ ভদ্রলোকদের তার ফ্ল্যাটে আপ্যায়ন করতেন?

মিসেস মারটন রুষ্ট হয়ে বললেন–আপনি ভুল করছেন। আমি এমন কথা বলিনি। সিলভিয়া নোংরা চরিত্রের মহিলা নয়। পোয়ারো বললেন মিসেস মারটন, আপনি আমাদের অনেক কিছুই গোপন করছেন।

মিসেস মারটন একটু অসন্তুষ্ট হলেন। কি করব বলুন তো। যে আমাকে বিশ্বাস করে তার অমর্যাদা করা উচিত হবে কি। তার কাছে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, ঘনিষ্ঠ দু-একজন ছাড়া অন্যদের বলা নিষেধ।

জ্যাপ বললেন–কি এমন কথা তিনি আপনাকে বলেছেন যা আমাদের বলতে দ্বিধা করছেন মিসেস মারটন?

মিসেস মারটন নিচু স্বরে বলতে লাগলেন–একদিন কথা প্রসঙ্গে তার মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে যে তার স্বামী মি. চ্যাপম্যান সিক্রেট সার্ভিসে রয়েছেন। এইজন্য তাকে বিদেশে থাকতে হত বেশি। তিনি মিথ্যে করে বলতেন অস্ত্র বিক্রি করেন। এই কাজটা মিসেস চ্যাপম্যানের পছন্দ নয়। সরাসরি স্বামীকে চিঠি লিখতে পারতেন না বলে তিনি রাগ করতেন। মি. চ্যাপম্যানের কাজটা নাকি খুব বিপজ্জনক। তাই তিনি আমাকে শপথ করিয়ে নেন কথাটা কাউকে না বলার জন্য।

এরকুল পোয়ারা ও চিফ ইন্সপেক্টর জ্যাপ বেরিয়ে এলেন মিসেস মারটনের ফ্ল্যাট থেকে। মিসেস মারটনের জবাবদিহি জ্যাপকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তিনি সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললেন নাঃ কোনো সুরাহা হল না। এবার আমার মাথাটাই খারাপ হবে দেখছি। তারা দু’জনে মিসেস চ্যাপম্যানের ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়ালেন। সেখানে তরুণ অফিসার বেডোর্জ অপেক্ষা করছিল। সে সম্ভ্রমে বলল–স্যার, নেমি স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেনি। মিসেস চ্যাপম্যান কাজের লোককে বেশিদিন রাখতে পছন্দ করতেন না। ঘন ঘন বদলাতেন। দুতিন মাস ধরে মেয়েটি কাজ করছে এখানে। ওর বয়ান অনুযায়ী মিসেস চ্যাপম্যান সরল সাদাসিধে মানুষ। সর্বক্ষণ রেডিও শুনে কাটিয়ে দিতেন। ওর স্বামী ধাপ্পাবাজ লোক। অহরহ মিথ্যে বলতেন। কিন্তু তিনি রাগ বা অভিমান করতেন না। জার্মানি, রাশিয়া, আমেরিকা থেকে প্রচুর চিঠি আসত তার কাছে।

মিসেস চ্যাপম্যানের চিঠিপত্রের মধ্যে সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেছে। সাধারণ কিছু কাগজপত্র পাওয়া গেছে। তার মধ্যে কয়েকটা বিল; কিছু রসিদ, পুরোনো নাটকের বিজ্ঞাপন জেনানা মিশনের হ্যাঁণ্ডবিল। এছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছুই পাওয়া যায়নি।

সেগুলো কার মারফত আসছে কিংবা নিজেই আনছেন, তা কিছু বোঝা গেল? অচেনা কোনো লোককে আশে পাশে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে?

না, স্যার, পোর্টার কিছু বলতে পারেনি বলাও সম্ভব না, বাড়িটা এত বড় আর এত লোক যাতায়াত করছে, বোঝা মুশকিল কে কোন মতলবে আসছে বা যাচ্ছে।

অন্যান্য ফ্ল্যাটের কেউ কিছু বলেছে?

–না, স্যার। এমন সময় ডিভিশনাল সার্জেন বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলেন। তার নাক চাপা রুমালে। তিনি তিক্ত স্বরে বললেন,

–কি বিশ্রী গন্ধ। গা গুলিয়ে উঠছে। তাড়াতাড়ি দেহটা মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। 

মৃত্যুর কারণ বোঝা গেল, ডাক্তার?

 আগে ময়না তদন্ত হোক, তারপর যা বলার বলব। তবে এই মুহূর্তে বলতে পারি, খুনের পর মুখে আঘাত করা হয়েছে। শরীরের অন্য কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন আছে কিনা দেখতে হবে। নিরুদ্দিষ্ট এক মহিলার কথা শুনেছি। ইনিই যে তিনি সেটা প্রমাণ সাপেক্ষ। ডাক্তার চলে গেলেন।

পোয়ারো ডেস্কের কাছে গেলেন। তাতে কিছু কাগজ-পত্র ছিল। তার মধ্যে থেকে তিনি একটি ছোট্ট বই তুলে নিলেন। বইটিতে বাদামী রঙের মলাট দেওয়া। বইটির ওপর একটা ঠিকানা লেখা ছিল। বেডোর্জ হেসে বলল, ওটা কোনো উপকারে লাগবে না। ওতে কয়েকটি দর্জির দোকানের নাম ও ঠিকানা আছে।

পোয়ারো ইংরেজি ডি নম্বর দেওয়া পাতাটি খুললেন।

তিনি পড়তে শুরু করলেন–ডঃ ডেভিস, ১৭ প্রিন্স অ্যালবার্ট রোড, ড্রেক ও পমপনেটি, মাছ বিক্রেতা। তার নিচে দু’লাইন ছেড়ে লেখা দাঁতের ডাক্তার মি. মর্লে, ৫৮ কুইন শার্ট স্ট্রিট।

পোয়ারেরে চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। তিনি বললেন-মৃতদেহ সনাক্ত করতে কোনো বেগ পেতে হবে না। জ্যাপ ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন পোয়ারের দিকে। বললেন–আপনি সত্যিই কিছু ভাবছেন?

পোয়ারো তীব্র স্বরে বললেন–অবশ্যই। আমি নিশ্চিত লক্ষ্যে পৌঁছতে চাইছি।

মিস জর্জিনা মর্লে ভাইয়ের মৃত্যুর পর তাঁর গ্রাম হার্টকোর্ডে ফিরে যান। সেখানে তার একটি ছোট্ট কুঁড়ে আছে।

একদিন এরকুল পোয়ারো তাঁর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তিনি পোয়ারোকে খুশি মনে স্বাগত জানালেন। তার চেহারার মধ্যে রুক্ষতা ফুটে উঠেছে। আগের থেকে তিনি আরও কঠিন হয়েছেন। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা জেগেছে তাঁর। ভাইয়ের পেশাদারি জীবনে কলঙ্ক লাগায় তিনি খুবই দুঃখ পেয়েছেন।

তিনি বিশ্বাস করেন বিচারকের রায় অসত্য। তিনি এও মনে করেন পোয়ারোও এই বিচারের রায়ে খুশি হননি। তাই তিনি পোয়ারোর প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দিলেন হাসি মুখে। পোয়ারো প্রশ্ন করলেন মি. মর্লের কাগজপত্র কি আপনার কাছে আছে?

না, ওগুলো সব গ্ল্যাডিসের হেফাজতে আছে। সে যত্ন করে সেগুলি গুছিয়ে রেখেছে।

–মি. মর্লের রোগীদের খরব রাখেন?

না, তেমনভাবে না, গোড়াতে শুনেছিলাম কিছু রোগী মি. রেইলিকে দেখান। আবার কেউ কেউ অন্য ডাক্তারের কাছে গিয়েছেন।

আপনি নিশ্চয় জানেন, মিস সেইনসবারি সীল কিছুদিন ধরে নিরুদ্দেশ। তার খোঁজ আমরা পেয়েছি।

–শেষ পর্যন্ত তাকে খুঁজে বের করলেন আপনারা। সে এখন কি অবস্থায় আছে?

–তাকে খুন করা হয়েছে?

–তাকেও খুন করা হয়েছে! তাকেও কথাটার ওপর বেশ জোর দিলেন তিনি। পোয়ারো বললেন মি. মর্লে তার কথা আলাদাভাবে কিছু বলেছে আপনাকে?

আমি মনে করতে পারছি না। নিশ্চয় সে শান্তশিষ্ট ভদ্র রোগী ছিল, তা না-হলে আমায় বলত।-আচ্ছা, আপনার কি মনে আছে, মি. মর্লের মুখে চ্যাপম্যান নামে কোনো রোগীর কথা শুনেছেন?–চ্যাপম্যান? না, না, এমন নাম তার কাছে কখনো শুনিনি। এ বিষয়ে আপনি গ্ল্যাডিসকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। হয়তো ও আপনাকে সাহায্য করতে পারে।

তার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে আমার আছে। তাকে এখন কোথায় পাব?–সে একটা চাকরি জোগাড় করেছে। র‍্যামসগেটে এক দন্তচিকিৎসকের চেম্বারে।

ফ্র্যাঙ্ক কার্টারের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে গেছে?

–না, আমার মনে হয় না সে তাকে কোনোদিন বিয়ে করবে। ওই ছোকরাকে কেউ পছন্দ করে না। একটা লম্পট। ও ন্যায়নীতির ধার ধারে না। ও নিশ্চয় কোনো দুষ্ট চক্রের হাতে পড়েছে।

–আপনি কি ভাবছেন সে আপনার ভাইকে গুলি করেছে?

মিস মর্লে তিক্ত স্বরে বললেন আমার ভাইয়ের ওপর একাজ করলেও করতে পারে। তবে এটা আসল কারণ নয়। হেনরি ওদের আসল কারণ নয়। হেনরি ওদের মধ্যে বিচ্ছেদ চাইলেও গ্ল্যাডিস ওকে ভীষণ ভালোবাসত। ফ্র্যাঙ্ককে কেউ প্ররোচিত করতে পারে। অথবা মোটা অঙ্কের টাকা পাবার লোভ দেখাতে পারে?

টাকার লোভ? তার মানে আপনি বলছেন ঘুষ নিয়ে ফ্র্যাঙ্ক আমার ভাইকে খুন করেছে? অবাস্তব চিন্তা-ধারা! ও একাজ করতে পারে না। এমন সময় সুন্দরী একটি মেয়ে ঘরে এসে ঢুকল। তার হাতে একটি ট্রে, সে ট্রে নামিয়ে দরজা বন্ধ করে চলে গেল। পোয়ারো জানতে চাইলেন, এই মেয়েটিকে আপনার লন্ডনের বাড়িতে দেখেছি মনে হয়?

হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। ও অ্যাগনেস। আমার কাছেই থাকে। আমার সব কাজ করে, খুব ভালো রাঁধুনি। তাই আসার সময় সঙ্গে এনেছি।

পোয়ারো মাথা নাড়লেন। তখন তার মানসপটে ভেসে উঠেছে মি. মর্লের ৫৮ কুইন শার্লট স্ট্রিটের বাড়ির ছবি। দুই ভাই-বোন দোতলায় বাস করনে। একতলার ঘরগুলি বন্ধ থাকত। বাড়িতে ঢোকার একমাত্র পথে পাহারায় থাকত অ্যালফ্রেড। তাই তার অলক্ষ্যে ওই বাড়িতে প্রবেশ করা কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না।

রাঁধুনি ও পরিচারিকা বহুদিনের পুরোনো কাজের লোক। এবং বিশ্বস্তও বটে। তারা পুলিশের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সাহায্য করেছে। কোনোরকম বিরক্ত বোধ করেনি।

পোয়ারো বিদায় নিয়ে ঘরের বাইরে এলেন। অ্যাগনেস পোয়ারোর টুপি ও ছড়ি এগিয়ে দিল। সে ভীত সন্ত্রস্ত ভঙ্গীতে জানতে চাইল, স্যার, কর্তার মৃত্যুর কারণ জানতে পেরেছেন?

পোয়ারো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,নতুন কিছু জানা যায়নি।

কর্তা তাহলে ভুল করে ওষুধ দিয়েছিলেন। এবং তার গুরুত্ব বুঝতে পেরে নিজেই গুলি করে আত্মহত্যা করেছেন, তাই না, স্যার?

–হ্যাঁ। এসব জেনে তোমার কি লাভ হবে?

অ্যাগনেস নিচু স্বরে বলল–আমার কত্ৰী এই যুক্তি মানতে রাজি নন। পোয়ারো উদগ্রীব হয়ে বললেন–তোমারও একমত?–আমি! না, না, আমি আর কি বলব। আমি শুধু নিশ্চিন্ত হতে চাইছিলাম। এরকুল পোয়ারো শান্ত স্বরে বললেন–আত্মহত্যা শুনলে তুমি কি চিন্তামুক্ত হতে? অ্যাগনেস চটপট উত্তর দিল–হ্যাঁ, স্যার।

এরকুল পোয়ারো ওর চোখে চোখ রাখলেন। দেখলেন, চোখ দুটো আনন্দে চিক চিক করছে। এরকুল পোয়ারো আর প্রশ্ন না করে রাস্তায় নেমে এলেন। হাঁটতে হাঁটতে তিনি ভাবলেন, অ্যাগনেসের করা ওই প্রশ্নের আড়ালে কোনো গুঢ়ই তথ্য আছে কি? তিনি নিশ্চিত, এই প্রশ্নের একটা উত্তর আছে। তবে সেটা সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল নন। তবে এটা ভেবে তিনি আশ্বস্ত হলেন যে মি. মর্লের খুনের একটা ধাপ এগোতে পেরেছেন।

পোয়ারো বাড়ি ফিরে এলেন। তার জন্য চমক অপেক্ষায় আছে, যা তিনি কল্পনাও করেননি। তিনি দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন। দেখতে পেলেন বিরল কেশ ছোটোখাটো চেহারার এক ভদ্রলোককে। তার সঙ্গে পোয়োজরার আগেই আলাপ হয়েছিল। তিনি হলেন মি. বার্নেস। বার্নেসও পোয়ারোকে দেখে সসম্ভ্রমে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তার চোখে মিষ্টি হাসির ইশারা। তিনি বললেন–মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি আমার বাড়ি গিয়েছিলেন তাই আমি কৃতজ্ঞতাবশত এসেছি।

পোয়ারো বললেন মি. বার্নেস, আপনার পদার্পণে আমি ভীষণ আনন্দিত। তিনি এবার জর্জকে হুকুম করলেন, দুকাপ কফি দিয়ে যেতে। কিন্তু বার্নেস কফির থেকে চা হুইস্কি ও সোডা বেশি পছন্দ করেন।

ইতিমধ্যে জর্জ কফি দিয়ে গেছে। কফি পান করার ফাঁকে মি. বার্নেস বললেন আপনার কাছে আমার কিছু জানবার আছে, মঁসিয়ে পোয়ারো এই ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর রাখেন আপনি, কাগজে বেরিয়েছে নিরুদ্দিষ্ট, মিস সেইনসবারি সীলকে খুঁজে পাওয়া গেছে। অবশ্য এই কৃতিত্ব পুলিশের। তাই আরও প্রমাণের আশায় বিচার থমকে রয়েছে। অতিরিক্ত মাত্রায় মেডিনাল প্রয়োগের ফলে তার মৃত্যু হয়েছে। পোয়ারো বললেন হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন। আচ্ছা, মি. বার্নেস, আপনি অ্যালবার্ট চ্যাপম্যানকে চেনেন?

–ওহ, যে মহিলার ফ্ল্যাটে মিস সীলের লাশ পাওয়া গেছে। সম্পূর্ণ অন্য ধরনের মানুষ তিনি। তিনি কে, মি. বার্নেস? ইনকোয়েস্টে এর উত্তর কেউ দিতে পারবে না। হয়তো তারা জানেন না। তারা ওই অস্ত্র কোম্পানির বিক্রেতার গল্প শোনাবে।

–তাহলে সত্যিই তিনি সিক্রেট সার্ভিসে ছিলেন?

–অবশ্যই। তবে মিসেস চ্যাপম্যানকে সত্যি কথা না বললেই ভালো করতেন তিনি। আসলে বিয়ের পর কাউকে এ কাজে রাখা হয় না। তাহলে অ্যালবার্ট চ্যাপমান ছিলেন, পোয়ারোর কথাটা লুফে নিয়ে মি. বার্নেস বললেন–কিউ. এক্স ৯১২। এটাই তার চিহ্নিতকরণ নম্বর। নাম ব্যবহার করার বিষয় নেই। সে বার্তাবাহকের কাজ করতো। ইউরোপের নানা রাষ্ট্রে পাঠানো হত। অনুল্লেখ্য চেহারা হওয়ায় তাকে নিয়ে বিপদের সম্ভাবনা ছিল না। সুবিধাই হতো বেশি। তবে আজ তার অস্তিত্ব আর নেই। তাহলে তিনি প্রচুর গোপণ খবর রাখতেন?

একদম না!

–আপনি বলছেন তিনি বেঁচে নেই?–তাই তো জানি। তবে এ সবই গুজব। বার্নেসের চোখে চোখ রেখে পোয়ারো বললেন তার স্ত্রী এখন কোথায় জানেন? মি. বার্নেস হেসে বললেন আমার ধারণার অতীত। তবে আশা করেছিলাম ওই মহিলার খবর আপনার মুখেই শুনব। পোয়ারো বললেন–আমার ধারণা ছিল । কথা শেষ না করে মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন। মি. বার্নেস সহানুভূতির সুরে বললেন–বিশেষ কিছু ভাবিয়ে তুলেছে বোধহয় আপনাকে? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পোয়ারো বললেন–হ্যাঁ। আমার চোখের সামনে জীবন্ত প্রমাণ হাজির। ইতিমধ্যে জ্যাপ পোয়ারোর বসবার ঘরে ঢুকে পড়েছেন। টুপিটা তিনি সজোরে ছুঁড়ে ফেললেন টেবিলের ওপরে। তিনি রাগে ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন–এটা কিভাবে বুঝলেন বলুন তো? পোয়ারো ধীরে ধীরে বললেন আপনার একথা বলার অর্থ কি বন্ধু? জ্যাপ চিৎকার করে বললেন–কিসের ভিত্তিতে দেহটা মিস সীলের নয় বলে সনাক্ত করলেন?

প্রশ্নটা পোয়ারোকে চিন্তায় ফেলেছে।–মুখটাই আমার সব গোলমাল করে দিয়েছিল। একজন মৃত মহিলার মুখ এভাবে বিকৃত করার কারণ কি?

 জ্যাপ মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন আমার বিশ্বাস সাক্ষ্য প্রমাণ লোপাটের জন্য তাকে খুন করা হয়েছে। হেনরি মর্লে বেঁচে থাকলে তিনিই রহস্য ভেদ করতে পারতেন।

লেদারেণ মি. মর্লের উত্তরাধিকারী। যথেষ্ট যোগ্য লোকও বটে সে। তার সাক্ষ্য আমাদের পথের সন্ধান দিতে পারত।

সংবাদপত্রগুলোর সান্ধ্য সংস্করণে উত্তেজক খবর প্রকাশিত হল। কিং লিওগোল্ড ম্যানসনসের ৪৫ নম্বর ফ্ল্যাটে যে মহিলার মৃতদেহ পাওয়া যায় সেটা মিস সেইনসবারি সীলের নয়। যদিও পুলিশ ভেবেছিল ইনিই মিস সীল যাকে একমাস ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে ময়না তদন্তে প্রমাণিত হয় ওই দেহটি মিসেস অ্যালবার্ট চ্যাপম্যানের।