৫০. মুখোশ পরা সুলেমান

৫০.

মুখোশ পরা সুলেমান আজিজের চোখ দুটোর ওপর দৃষ্টি স্থির রাখলেন ক্যাপটেন কলিন্স। সন্ত্রাসবাদীদের নেতা লোকটার চোখে পশুসুলভ কি যেন একটা আছে। আকৃতিটা মানুষেরই বটে, কিন্তু যার চোখ থেকে অশুভ আভা বেরোয় তার ভেতর মানবিক কোনো গুণ থাকতে পারে না।

আমাকে জানতে হবে, আপনি কখন আমার জাহাজ ছেড়ে যাবেন? তীক্ষ্ণ কণ্ঠে দাবি জানালেন তিনি।

পিরিচ চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখল সুলেমান আজিজ, আলতোভাবে ঠোঁটে ন্যাপকিন ছোঁয়াল, তারপর নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকাল ক্যাপটেনের দিকে। আপনাকে চা পান করার পর কথা বলতে পারি?

 প্রথমে আমার প্যাসেঞ্জার আর ক্রুদের অফার করতে হবে, শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন কলিন্স। সাদা ইউনিফর্ম পরে আছেন তিনি, শিরদাঁড়া টান টান, প্রচণ্ড শীত বা ঠাণ্ডা হিম বাতাস তাঁকে কাবু করতে পারেনি।

ঠিক একই উত্তরই আমি আপনার কাছ থেকে আশা করেছিলাম। খালি কাপটা উল্টো করে রাখল সুলেমান আজিজ। আপনি একজন দরদি ক্যাপটেন। শুনে খুশি হবেন, কাল সন্ধ্যের দিকে কোনো একসময় আমরা চলে যাব। যদি কথা দেন, আমরা বিদায় নেয়ার আগে আপনারা কোনো রকম বোকামি করবেন না, মানে জাহাজ দখলের চেষ্টা করবেন না বা পালিয়ে কাছাকাছি তীরে যাবেন না, তাহলে আমিও কথা দেব, আপনাদের কারও কোনো ক্ষতি করা হবে।

 আমি চাই এই মুহূর্তে জাহাজে হিটিং সিস্টেম চালু করা হোক, খেতে দেয়া হোক সবাইকে। গরম কাপড়ের অভাবে কষ্ট পাচ্ছে আমার লোকজন। কয়েক দিন ধরে কেউ কিছু খায়নি। পাইপে জমে গেছে পানি। স্যানিটেশনের কথা নাই বা বললাম।

হাসল সুলেমান আজিজ। কষ্ট করলে আত্মা বিশুদ্ধ হয়।

 ক্যাপটেনের দৃষ্টিতে আগুন ঝরল। আবর্জনা।

অসহায় ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল সুলেমান আজিজ। দৃষ্টিভঙ্গির তফাত।

গুড গড, ম্যান, বিনা দোষে নিরীহ মানুষজন মারা যেতে বসেছে এখানে!

আরে, দূর! আপনি বাড়িয়ে বলছেন। দুচার দিন খেতে না পেলে মানুষ বুঝি মারা যায়? তাছাড়া, ঠাণ্ডা দেশের মানুষ আপনারা, শীতে মারা যাবেন, তা কি হয়। আমরা তো চলেই যাব কাল, খুব বেশি হলে আরও ত্রিশ ঘণ্টা একটু কষ্ট করতে হবে আপনাদের।

তার আগে যদি গ্লেসিয়ারটা ভেঙে পড়ে?

 ভেঙে পড়বে কেন? দেখে তো নিরেট বলেই মনে হচ্ছে।

বিপদটা বুঝতে চেষ্টা করুন, আবেদনের সুরে বললেন ক্যাপটেন। যেকোনো মুহূর্তে বড় একটা অংশ ধসে পড়তে পারে। দশতলা ভবন একটা গাড়ির ওপর ভেঙে পড়লে যা হয়, লেডি ফ্ল্যামবোরোর সেই অবস্থা হবে। আপনারাও কেউ রক্ষা পাবেন না। প্লিজ-জাহাজটা সরিয়ে নিন।

ঝুঁকি আছে, মানলাম, কিন্তু ঝুঁকিটা এড়াবার কোনো উপায় নেই আমার। জাহাজ সরাতে গেলেই প্লাস্টিকের ওপর জমা বরফের প্রলেপ গলে যাবে, ফাঁস হয়ে যাবে আমাদের লোকেশন-স্যাটেলাইটের ইনফ্রারেড ক্যামেরায় ধরা পড়ে যাবে আমাদের বিকিরিত তাপ।

হয় আপনি একটা গর্দভ, নয়তো উন্মাদ। রাগে চেঁচিয়ে উঠলেন কলিন্স। এতগুলো মানুষের প্রাণের ওপর ঝুঁকি নিয়ে কী আপনি অর্জন করতে চান? জিম্মিদের ছেড়ে দেয়ার বিনিময়ে টাকা চান? তাহলে সে-কথা জানাচ্ছে না কেন? স্বদেশি আতঙ্কবাদীদের কোথাও থেকে মুক্ত করতে চান? তা-ও তো বলছেন না। আমাদের ছেড়ে দিয়ে চলে যাবেন, তাহলে লাভটা কী হলো আপনার?

 আপনার কৌতূহল ভারি অস্বস্তিকর, ক্যাপটেন। তবে, জাহাজটা হাইজ্যাক করার কারণ একটা অবশ্যই আছে, সময়মতো সেটা আপনি জানতেও পারবেন। ক্যাপটেনের পেছনে দাঁড়ানো গার্ডকে ইঙ্গিত করল সে। ক্যাপটেনকে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখো।

 নিজের জায়গা ছেড়ে নড়লেন না কলিন্স! কেন আপনি গরম কফি, স্যুপ, চা। ইত্যাদিদিতে চাইছেন না?

 আগেই পেছন ফিরেছে সুলেমান আজিজ, ডাইনিং সেলুন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। সে। বিদায়, ক্যাপটেন। আমাদের আর দেখা হবে না।

সরাসরি কমিউনিকেশন রুমে চলে এল সুলেমান আজিজ। যান্ত্রিক গুঞ্জনের সাথে একটা টেলিটাইপ থেকে সর্বশেষ অয়্যার-সার্ভিস নিউজ বেরিয়ে আসছে, পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে ইবনে। সামনে রেডিও নিয়ে বসে রয়েছে অপারেটর, ইনকামিং ট্রান্সমিশন শুনছে, একটা ভয়েস রেকর্ডার কাগজে কপি করছে সেটা। রেডিও আর টেলিটাইপে শক্তি জোগাচ্ছে একটা পোর্টেবল জেনারেটর।

পায়ের আওয়াজ পেয়ে ঘাড় ফেরাল ইবনে, সুলেমান আজিজকে দেখে শ্ৰদ্ধার সাথে সালাম দিল, টেলিটাইপ থেকে খুলে নিল লম্বা একটা কাগজ।

মিসরের খবর কী?

খুশি হবার মতো কিছু নয়। হাসানের মন্ত্রিসভা এখনও সরকার পরিচালনা করছে। গোঁয়ারের মতো এখনও ক্ষমতা আঁকড়ে রয়েছে তারা। দাঙ্গা থামাবার জন্য রাস্তায় সেনাবাহিনী না নামিয়ে সাংঘাতিক বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে তারা। বড় ধরনের রক্তপাত ঘটেছে মাত্র এক জায়গায়। মোল্লারা ভুল করে একটা বাসে বোমা ছোড়ে, চল্লিশজন আলজেরিয়ান মারা গেছে, কায়রোয়। সবাই তারা ফায়ার সার্ভিসের লোক, একটা কনভেনশনে যোগ দিতে এসেছিল। মোল্লারা সন্দেহ করেছিল, বাসে পুলিশ আছে। এই ঘটনার পর কায়রো রেডিও থেকে প্রচার করা হয়েছে, ইয়াজিদের আন্দোলন দেশকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে। আমাদের সাধারণ সমর্থকরাও ব্যাপারটাকে মেনে নিতে পারছে না। বিক্ষোভ মিছিলের সংখ্যা কমে যাবার সেটাও একটা কারণ। মন্ত্রিসভা বাতিল করার জন্য জনসাধারণের তরফ থেকে তেমন কোনো চাপ নেই।

বাসে বোমা মারার জন্য নিশ্চয়ই গর্দভ খালেদ ফৌজি দায়ী, খেঁকিয়ে উঠল সুলেমান আজিজ। সামরিক বাহিনী, তারা কী করতে চাইছে?

প্রেসিডেন্ট হাসান আর হে’লা কামিল মারা গেছেন বিশ্বাস করাতে হলে তাদের লাশ দেখাতে হবে প্রতিরক্ষামন্ত্রী আবু হামিদকে, বলল ইবনে। তার আগে পর্যন্ত নিজের কোনো মতামত দিতে সে রাজি নয়।

 তার মানে বিজয়ীর বেশে আবির্ভূত হতে এখনও দেরি আছে আখমত ইয়াজিদের।

মাথা ঝাঁকাল ইবনে তার চেহারা অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে উঠল। খবর আরও একটা আছে, জনাব। আখমত ইয়াজিদ ঘোষণা করেছে, প্রমোদতরী ধ্বংস হয়নি, প্যাসেঞ্জার ও ক্রুরাও বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে। সে প্রস্তাব দিয়েছে, আতঙ্কবাদীদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে সবাইকে মুক্ত করার চেষ্টা করবে। এতদূর গেছে সে, বলেছে, সিনেটর জর্জ পিটকে বাঁচাবার জন্য দরকার হলে নিজের জান পর্যন্ত কোরবান করতে দ্বিধা করবে না।

প্রথমে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারল না সুলেমান আজিজ। তরপর প্রচণ্ড রাগে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ল সে। তার শরীর কাঁপতে লাগল। অবস্থা দেখে এক পা পিছিয়ে গেল ইবনে।

 আল্লাহ আমাকে দিয়ে পাইকারি হত্যাকাণ্ড ঘটাতে চান। বিড়বিড় করে বলল সুলেমান আজিজ। ইবনের দিকে তাকাল সে। বুঝতে পারছ তো, আখমত ইয়াজিদ সরাসরি বেঈমানি করছে আমাদের সাথে।

 সায় দিয়ে মাথা ঝাঁকাল ইবনে। আপনাকে ব্যবহার করেছে, উদ্দেশ্য হাসিল হবার পর এখন আপনাকে শেষ করার চেষ্টা করছে।

 তাইতো বলি হাসান আর হে’লা কামিলকে খুন করার নির্দেশ দিতে এত কেন দেরি করছে সে! তোমাকে, আমাকে, আমাদের দলকে ম্যাকাডো খুন করবে, এই আশায় অপেক্ষা করছে আখমত ইয়াজিদ।

 কিন্তু জনাব, জিম্মিদের বাঁচিয়ে রেখে আখমত ইয়াজিদ আর টপিটজিনের লাভ কী? অবাক হয়ে প্রশ্ন করল ইবনে।

 দু’জন প্রেসিডেন্ট আর জাতিসংঘের মহাসচিবের ত্রাণকর্তা সেজে জগৎজোড়া সম্মান কুড়াতে চায় আখমত ইয়াজিদ। মৌলবাদী বলে, সন্ত্রাসের উৎস বলে তার যত দুর্নাম আছে, এই একটা চালাকি দিয়ে সব মুছে ফেলতে চায় সে। দেশে ও দেশের বাইরে তার জনপ্রিয়তা বেড়ে গেলে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা দখল তখন। তাই আমাদের শকুনের খাবার বানাবার প্ল্যান করা হয়েছে।

এটা আখমত ইয়াজিদের অনেক পুরনো একটা প্ল্যান, বলল সুলেমান আজিজ। শুধু এটা নয়; আরও অনেক কুকাজ আমাদেরকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছে সে। আমরা বেঁচে থাকলে সব ফাস হয়ে যেতে পারে।

 আর ক্যাপটেন ম্যাকাডো ও তার মেক্সিকান ক্রুদের কপালে কী ঘটবে? আমাদের তারা খুন করল, তারপর?

 ওদের ব্যাপারটা সামলাবে সম্ভত টপিটজিন। মেক্সিকোয় ফেরার পর স্রেফ গায়েব হয়ে যাবে তারা।

তার আগে আরও বিপদ আছে ওদের কপালে, মৃদুকণ্ঠে বলল ইবনে। মেক্সিকোয় ফেরার আগে জাহাজ থেকে পালাতে হবে ওদের।

হ্যাঁ। চিন্তিত দেখার সুলেমান আজিজকে। রাগের সাথের কমিউনিকেশন রুমে পায়চারি শুরু করল সে। আখমত ইয়াজিদকে আমি ছোট করে দেখেছি। তার চালাকি আমি আগে ভালো করে বুঝিনি। ম্যাকাডোকে আমি গ্রাহ্য করিনি, কারণ ধরে নিয়েছিলাম আজেন্টিনার নিরাপদ একটা এয়ারপোর্টে আমাদের পালাবার আয়োজন সম্পর্কে তার কিছু জানা নেই। এখন বুঝতে পারছি, আখমত ইয়াজিদকে ধন্যবাদ, মেক্সিকান আতঙ্কবাদী লিডারের নিজস্ব একটা প্ল্যান আছে কেটে পড়ার।

তাহলে এখনও সে আমাদেরকে খুন করেনি কেন?

জিম্মিদের মুক্ত করার ব্যাপারে আলোচনার ভান করছে আখমত ইয়াজিদ আর টপিটজিন, ওদিকটা পুরোপুরি না গুছিয়ে ম্যাকাডোকে তারা কাজ শেষ করার নির্দেশ দেবে না।

হঠাৎ ঘুরে গিয়ে রেডিওম্যানের কাঁধ খামচে ধরল সুলেমান আজিজ। আতঙ্কিত লোকটা তাড়াতাড়ি হেড ফোন খুলে ফেলল। লেডি ফ্ল্যামবোরোকে উদ্দেশ্য করে পাঠানো কোনো মেসেজ পেয়েছো তুমি?

 আশ্চর্য! ঢোক গিলে বলল রেডিওম্যান। দশ মিনিট পর পর এসে একই প্রশ্ন করছে আমাদের ল্যাটিন বন্ধুরা। ওদের আমি গবেট ভাবছিলাম। যেকোন ডাইরেক্ট ট্রান্সমিশন ধরা পড়ে যাবে আমেরিকান-ইউরোপিয়ান ইন্টেলিজেন্স লিসনিং স্টেশনে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আমাদের পজিশন বের করে ফেলবে তারা।

রেডিও বন্ধ করে দাও, নির্দেশ দিল সুলেমান আজিজ। মেক্সিকানরা যেন দেখতে পায় তুমি তোমার শোনার কাজ ঠিকমতো করে যাচ্ছ। যখনই কোনো মেসেজ এসেছে কি না জিজ্ঞেস করবে, বলবে আসেনি।

 আগ্রহের সাথে সুলেমান আজিজের দিকে গলাটা লম্বা করল ইবনে। আমাকে কি নির্দেশ দেবেন, জনাব?

 মেক্সিকান ক্রুদের ওপর কড়া নজর রাখো। বন্ধুর মতো আচরণ করে অবাক করে দাও ওদের। লাউঞ্জ বার খুলে মদ খাবার জন্য ডাকো। কঠিন কাজগুলো আমাদের লোককে দাও, মেক্সিকানরা যাতে বিশ্রাম নিতে পারে। আমি চাই ওরা অসতর্ক অবস্থায় থাকুক।

ওরা আমাদের খুন করার আগে আমরা ওদেরকে খুন করব, চকচকে চোখে প্রত্যাশা নিয়ে জিজ্ঞেস করল ইবনে, জনাব?

 না, বলল সুলেমান আজিজ, তার চেহারায় হিংস্র হাসি ফুটে উঠল। কাজটা আমরা ছেড়ে দেব গ্লেসিয়ারের ওপর।

.

৫১.

আইসবার্গের সংখ্যা ওখানে এক মিলিয়নের কম নয়, হতাশ সুরে বলল জিওর্দিনো। নির্দিষ্ট একটাকে খুঁজে বের করতে কয়েক মাস লেগে যেতে পারে।

কর্নেল মরটন হোলিস বলল, লেডি ফ্ল্যামবোরার আকৃতির সাথে মিল পাওয়া যাবে। খুঁজতে থাকুন।

মনে রেখো, বলল রুডি, অ্যান্টার্কটিকের আইসবার্গ সাধারণত সমতল হয়। সুপারস্ট্রাকচারের ওপর প্লাস্টিক থাকলেও, জাহাজটা দেখতে হবে গা-ঘেঁষা কয়েকটা ছোট-বড় পিরামিডের সমষ্টি।

 ম্যাগনিফাইং গ্লাসের ভেতর মেজর ডিলিঞ্জারের চোখ চারগুণ বড় দেখল। মেঘ না থাকলে ভালো হতো, বিড়বিড় করল সে।

সাউন্ডারের কমিউনিকেশন কমপার্টমেন্টে রয়েছে ওরা, ঘিরে দাঁড়িয়েছে ছোট্ট একটা টেবিলকে, ক্যাসপার থেকে তোলা বিশাল কালার ফটোটা পরীক্ষা করছে সবাই। প্লেনটা ল্যান্ড করার চল্লিশ মিনিট পর সার্ভে জাহাজের লেয়ার রিসিভারের মাধ্যমে এরিয়াল রিকাইসন্স ফিল্ম প্রসেস করে পাঠানো হয়েছে।

 বিশদ বিবরণসহ ফটোয় দেখা যাচ্ছে পেনিনসুলার পূর্ণ দিক, লারসেন আইস শেলফ ভেঙে বেরিয়ে এসেছে আইসবার্গের একটা সাগর। পশ্চিম দিকেও কয়েকমা আইসবার্গ দেখা যাচ্ছে, গ্লেসিয়ারের কাছাকাছি, গ্রাহাম ল্যান্ডের খানিক সামনে।

পিটের ধ্যান অন্যদিকে। একধারে,সবার কাছ থেকে দূরে বসে আছে ও, কোলের ওপর বড় একটা নটিক্যাল চার্ট! মাঝেমধ্যে চোখ তুলে ওদের দিকে তাকাচ্ছে, শুনছে, কিন্তু আলোচনার যোগ দিচ্ছে না।

স্কিপার ফ্রাঙ্ক স্টুয়ার্টের দিকে তাকাল কর্নেল হোলিস, মাইক্রোফোনের সাথে জোড়া লাগানো একটা হেডসেট পরে রিসিভারের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। ক্যাসপারের ইনফ্রারেড ফটো কখন আমরা পেতে পারি?

 হাত তুলে চুপ থাকার অনুরোধ জানাল ফ্রাঙ্ক স্টুয়ার্ট, হেডসেট আরও জোরে চেপে ধরল কানের সাথে, সি.আই.এ. হেডকোয়ার্টার ওয়াশিংটন থেকে ভেসে আসা ভারী একটা কণ্ঠস্বর মনোযোগ দিয়ে শুনতে চেষ্টা করছে। কয়েক সেকেন্ড পর জবাব দিল সে, ল্যাংলি ফটো ল্যাব জানাল, আধ মিনিটের মধ্যে ট্রান্সমিশন শুরু করবে ওরা।

অস্থিরভাবে পায়চারি আরম্ভ করল কর্নেল। পিটের দিকে তাকাল একবার, একজোড়া ডিভাইডার নিয়ে দূরত্ব মাপছে ও।

 জাহাজের আর সব লোকের কাছ থেকে গত কয়েক ঘণ্টায় পিটের কথা অনেক কিছু জানতে পেরেছে কর্নেল। লোকজন ওর সম্পর্কে এমন সুরে কথা বলে, ও যেন একটা বিশেষ কিছু।

আসছে, জানাল স্কিপার। হেডসেট খুলে ধৈর্যের সাথে অপেক্ষায় থাকল সে, খবরের কাগজ আকারের একটা ফটো বেরিয়ে এল রিসিভার থেকে।

সাথে সাথে টেবিলে বিছানো হলো সেটা। সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল, চোখ পেনিনসুলার ওপর দিকে, তীররেখা বরাবর।

 কালো শীতলতম আবহাওয়ার প্রতিনিধিত্ব করছে, ব্যাখ্যা করল স্কিপার। গাঢ় নীল, হালকা নীল, সবুজ, হলুদ আর লাল ক্রমশ বেশি উত্তাপের লক্ষণ প্রকাশ করছে। সাদা মানে ওখানে তাপের মাত্রা সবচেয়ে বেশি।

লেডি ফ্ল্যামবোরো থেকে কি রিডিং আশা করতে পারি আমরা? ডিলিঞ্জারের প্রশ্ন।

 ওপরের দিকে কোথাও, হলুদ আর লালের মাঝখানে কিছু হবে।

গাঢ় নীলের কাছাকাছি, মৌত ভাঙল পিট।

সবাই ওর দিকে এমনভাবে তাকাল, ও যেন দাবা প্রতিযোগিতার উত্তেজনাকর মুহূর্তে হাঁচি দিয়েছে।

 তা যদি হয়, ফটোয় আমরা জাহাজটাকে দেখতেই পাব না, প্রতিবাদের সুরে বলল কর্নেল।

রেডক্লিফ তর্ক করল, ইঞ্জিন আর জেনারেটর থেকে হিট র‍্যাডিয়েশন ধরা পড়তে বাধ্য, সবুজ মাঠে গলফ বলের মতো পরিষ্কার দেখতে পাবার কথা জাহাজটাকে।

ইঞ্জিন বন্ধ থাকলে?

চেহারায় অবিশ্বাস নিয়ে জন ডিলিঞ্জার জিজ্ঞেস করল, আপনি নিশ্চয়ই একটা মরা-জাহাজ-এর কথা বলছেন না?

 নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকাল পিট। সবার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকাল ও, ওদেরকে ভিজে চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেও এমন অস্বস্থি বোধ করত কি না সন্দেহ। তারপর বলল, সন্ত্রাসবাদীদের নেতাকে ছোট করে দেখলে ভুল করব আমরা।

ওরা পাঁচজন পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল, তারপর একযোগে ফিরল পিটের দিকে ব্যাখ্যা পাবার আশায়।

নটিক্যাল চার্ট এক পাশে সরিয়ে রেখে চেয়ার ছাড়ল পিট। হেঁটে চলে এল টেবিলের কাছে, ইনফ্রারেড ফটোটা নিয়ে দুই ভাঁজ করল, এখন সেটায় শুধু চিলির নিচের অংশটা দেখা যাচ্ছে। কেউ লক্ষ করেনি, জিজ্ঞেস করল ও, যখনই জাহাজটা কোর্স বদলেছে বা চেহারা পাল্টেছে, তার মাত্র খানিক আগে কোনো না কোনো একটা স্যাটেলাইট চলে গেছে মাথার ওপর দিয়ে?

এ থেকে বোঝা যায়, সন্ত্রাসবাদীদের প্ল্যানে কোনো ফাঁক নেই, বলল রুডি। সায়েন্টিফিক তথ্য সংগ্রহকারী স্যাটেলাইটগুলোর কক্ষপথ সম্পর্কে অর্ধেক দুনিয়া জানে। ওরাও তথ্যটা জোগাড় করেছে।

বেশ হাইজ্যাকাররা জানল, কখন তাদের দিকে স্যাটেলাইট ক্যামেরা তাক করা হবে, অস্থির গলায় বলল কর্নেল। তাতে কী?

তাতে করে ইনফ্রারেড ফটো তোলার সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে সে, পাওয়ার সাপ্লাই স্থগিত রেখে। প্লাস্টিকের ওপর বরফের স্তর জমেছে, পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ থাকায় তা-ও গলছে না।

পাঁচজনের মধ্যে চারজনের মনে হলো পিটের যুক্তি মেনে নেয়া যায়। মানল না। একা শুধু রুডি। আর কারও আগে তার চোখেই ত্রুটিগুলো ধরা পড়ল। তুমি পেনিনসুলার চারদিকে হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রার কথা ভুলে যাচ্ছ, পিট। নো পাওয়ার, নো হিট। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জাহাজের সবাই নিরেট বরফে পরিণত হবে। তোমার কথা সত্যি হলে, ধরে নিতে হবে হাইজ্যাকাররা জিম্মিদের খুন করার সাথে সাথে নিজেরাও আত্মহত্যা করছে।

 রুডির কথায় যুক্তি আছে, বলল জিওর্দিনো। উপযুক্ত কাপড়-চোপড় আর অন্তত খানিকটা উত্তাপ না পেলে কেউ ওরা বাঁচবে না।

 পিটের হাসি দেখে মনে হলো, যেন মোটা টাকার লটারির জিতেছে। রুডির সাথে শতকরা একশো ভাগ একমত আমি।

হেয়ালি আমার একদম পছন্দ নয়, চটে উঠে বলল কর্নেল হোলিস। সহজ ভাষায় কেউ ব্যাখ্যা করবেন, প্লিজ?

এর মধ্যে জটিল কিছু নেই-লেডি ফ্ল্যামবোরা অ্যান্টার্কটিকায় ঢোকেনি।

অ্যান্টার্কটিকায় ঢোকেনি, যন্ত্রচালিতের মতো পুনরাবৃত্তি করল কর্নেল। তথ্য প্রমাণ তত তা-ই বলে। স্যাটেলাইটের শেষ ফটোতে দেখা গেছে, পেনিনসুলার ডগা আর কেপ হর্নের মাঝখানে রয়েছে লেডি ফ্ল্যামবোরো, ছুটছে দক্ষিণ দিকে। আর আপনি বলছেন…

 আর কোনো দিকে যাবার জায়গাও তো নেই জাহাজটার, ডিলিঞ্জারের গলাতেও প্রতিবাদের সুর।

 ম্যাগেলান প্রণালীর চারদিকে ছড়িয়ে থাকা দ্বীপগুলোর ওপর একটা আঙুল বুলালো পিট! বাজি ধরতে চান?

 ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে থাকল কর্নেল হোলিস, মুহূর্তের জন্য হতভম্ব। তারপর সে উপলব্ধি করল। ওহ, গড! বুঝেছি! ফেরত এসেছে লেডি ফ্ল্যামবোয়রা!

রুডির কথাই ঠিক, স্বীকার করল পিট। হাইজ্যাকাররা আত্মহত্যা করবে না, ইনফ্রারেড ফটোয় ধরা পড়ার ঝুঁকি নিতেও তারা রাজি নয়। আইসপ্যাকে ঢোকার কোনো ইচ্ছেই তাদের ছিল না। তার বদলে তারা উত্তর-পশ্চিম দিকে গেছে, ব্যারেন আইল্যান্ড ঘুরে…

স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলে রুডি বলল, টিয়েরা ডেল ফুগোর চারদিকে তাপমাত্রা ভয়াবহ কিছু নয়। উত্তাপের ব্যবস্থা না থাকায় জাহাজের সবাই ভুগবে, তবে কেউ মারা যাবে না।

আইসবার্গ আইসবার্গ খেলাটা তাহলে কী জন্য? জানতে চাইল জিওর্দিনো।

 নিজেদেরকে গ্লেসিয়ার থেকে বিচ্ছিন্ন একটা অংশ বলে চালাবার জন্য।

ইনফ্রারেড ফটোর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকল জিওর্দিনো। এত দক্ষিণে গ্লেসিয়ার?

আমরা পাল্টা অ্যারেনাসের যেখানে নোঙর ফেলেছি, সেখান থেকে আটশো কিলোমিটার দূরে কয়েকটা প্রবাহ পাহাড় থেকে নেমে সাগরে পড়েছে, জানাল পিট।

 লেডি ফ্ল্যামবোরো কোথায় আছে বলে আপনার ধারণা? জিজ্ঞেস করল কর্নেল।

টেবিল থেকে একটা চার্ট তুলে নিল পিট, টিয়েরা ডেল ফুগোর পশ্চিমে নিঃসঙ্গ কয়েকটা দ্বীপ দেখানো হয়েছে ওটায়। দুটো সম্ভাবনার কথা ভাবছি আমি, বলল ও। স্যাটেলাইট ফটোয় জাহাজটাকে শেষবার কোথায় দেখা গেছে আমরা জানি, তার সাথে পাল-তোলা দূরত্বের হিসাব ধরলে…, চার্টের গায়ে দুটো নামের পাশে ক্রস চিহ্ন আঁকার জন্য থামল ও। …এখান থেকে সরাসরি দক্ষিণে, মাউন্টস ইটালিয়া ও সারমিন্টো গ্লেসিয়ার প্রবাহ।

তার মানে প্রচলিত পানিপথ থেকে দূরে…, বলল কর্নেল, তার কথা শেষ হবার আগেই পিট কথা বলল।

তবে তেল খনিগুলোর কাছাকাছি। কোম্পানির সার্ভে প্লেনগুলো বরফের ছদ্ম আবরণ দেখে ফেললে অবাক হবার কিছু নেই। আমি যদি সন্ত্রাসবাদীদের নেতা হতাম, আরও একশো ষাট কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে সরে যেতাম। তাহলে সান্টা ইনেজ দ্বীপে একটা গ্লেসিয়ারের কাছে থাকত ওরা।

 চার্টটা টেনে নিল জন ডিলিঞ্জার। দ্বীপটা ছোট, আঁকাবাঁকা তীররেখার ওপর চোখ বুলালো সে। তারপর কালার ফটোটার দিকে তাকাল, চিলির দক্ষিণ প্রান্তের নিচের অংশ ঢাকা পড়ে আছে মেঘে। সেটা সরিয়ে রেখে ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে পরীক্ষা করল ইনফ্রারেড ইমেজের ওপরের অংশটুকু, ইমেজটা ভাঁজ করে তল্লাশি এলাকা আগেই ছোট করে দিয়েছে পিট।

কয়েক সেকেন্ড পর চেহারায় মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে চোখ তুলল সে। প্রকৃতি দেবী যদি চোখা বো আর গোল পাছাসহ আইসবার্গ তৈরি করে না থাকে, তাহলে ধারণা করি, আমরা আমাদের ছলনাময়ী লেডি ফ্ল্যামবোরোকে খুঁজে পেয়েছি।

মেজরের হাত থেকে গ্লাসটা নিল কর্নেল, আয়ত আকৃতিটা পরীক্ষা করল খুঁটিয়ে। নকশাটা যে মিলছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর. মি. পিট যেমন বলেছেন, র‍্যাডিয়েশনের কোনো আভাসও দেখছি না। রিডিংয়ে দেখা যাচ্ছে গ্লেসিয়ারের মতোই ঠাণ্ডা ওটা। একেবারে নিখুঁত কালো না হলেও, অত্যন্ত গাঢ় নীল।

আরও একটু ঝুঁকল রুডি। হ্যাঁ, আমিও দেখতে পাচ্ছি। দুএকটা মাঝারি আকৃতির আইসবার্গ দেখা যাচ্ছে, ভেঙে বেরিয়ে এসেছে গ্লেসিয়ার দেয়াল থেকে। গ্লাসের ভেতর চোখে বিস্ময়ে ফুটে উঠল। আশ্চর্য, লেডি ফ্ল্যামবোরোকে গ্লেসিয়ারের সামনের পাঁচিলের সরাসরি নিচে কেন রেখেছে ওরা?

ছোট হয়ে গেল পিটের চোখ। সরো, দেখতে আমাকে। জন ডিলিঞ্জার, রুডির মাঝখানে ঢুকে পড়ল ও, সামনের দিকে ঝুঁকল, চোখ রাখল গ্লাসে। খানিক পর সিধে হলো, সমস্ত রক্ত যেন এক নিমেষে মুখে উঠে এল।

কী দেখলেন? জানতে চাইল স্কিপার।

 সাইকে ওরা মেরে ফেলার বুদ্ধি করেছে।

বাকি সবার দিকে তাকাল স্কিপার, হতভম্ব। উনি জানলেন কীভাবে?

গ্লেসিয়ারের একটা টুকরো ভেঙে যদি জাহাজের ওপর পড়ে, শুকনো গলায় ব্যাখ্যা করল জিওর্দিনো, ওটার চাপে তালিয়ে যাবে লেডি ফ্ল্যামবোরো, তলার সাথে বাড়ি খেয়ে খুঁড়িয়ে যাবে। কোনো দিনই ওটার আর হদিশ পাওয়া যাবে না।

 পিটের দিকে কঠিন চোখে তাকাল জন ডিলিঞ্জার। এত দিন সুযোগ পেল, প্যাসেঞ্জার বা ক্রুদের খুন করল না, আর আপনি বলছেন এখন তারা সবাইকে মেরে ফেলবে?

হ্যাঁ, ফেলবে।

তাহলে আগে কেন ফেলেনি?

ওদের পালিয়ে বেড়ানোর একটাই কারণ, সময় নষ্ট করা। হাইজ্যাকিং-এর নির্দেশ যেই দিয়ে থাকুক, প্রেসিডেন্ট দু’জনকে বাঁচিয়ে রাখার দরকার ছিল তার। দরকারটা কী, তা বলতে পারব না….।

 আমি পারব, পিটকে বাধা দিল কর্নেল হোলিস। ভিআইপি প্যাসেঞ্জারদের হাইজ্যাক করার নির্দেশ দিয়েছে মিসরের ধর্মীয় নেতা আখমত ইয়াজিদ। সেই আবার ঘোষণা করেছে, নিজের প্রাণ দিয়ে হলেও প্রেসিডেন্ট হাসান, মহাসচিব হে’লা কামিল, সিনেটর পিট ও বাকি সবাইকে সন্ত্রাসবাদীদের কবল থেকে রক্ষা করবে। সন্ত্রাসবাদীদের সাথে যোগাযোগ, আলোচনা ইত্যাদি অজুহাত দেখিয়ে সময় নিচ্ছে সে, এই সুযোগে সেনাবাহিনীর সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে, গুছিয়ে নিচ্ছে নিজের ক্ষমতা, উন্মাদ ভক্তদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে দিচ্ছে, যাতে সময় সময় হলেই সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করতে পারে। হঠাৎ সে ঘোষণা করবে, জাহাজটার নিয়ন্ত্রণ এখন তার হাতে, তার লোকেরা উদ্ধার করছে প্যাসেঞ্জার আর ক্রুদের।

 চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে তার প্রশংসা, রুডি বলল। সবাই জানবে আখমত ইয়াজিদ একজন মহৎপ্রাণ মানুষ।

 মিসরে ফেরার পথে প্রেসিডেন্ট হাসান ও হে’লা কামিল যাতে একটা দুর্ঘটনায় পড়ে মারা যান, সে ব্যবস্থাও করবে আখমত ইয়াজিদ।

 বাহ্ কী চমৎকার! দাঁতে দাঁত চাপল জিওর্দিনো। সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না।

 প্ল্যানটা সত্যি ভালো, বলল পিট! তবে, সামরিক বাহিনী এখনও নিরপেক্ষ ভূমিকা থেকে নড়েনি। মন্ত্রিসভাও পদত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

মাথা ঝাঁকাল কর্নেল। হ্যাঁ, ইয়াজিদের এত সাধের প্ল্যান ব্যর্থ করে দিচ্ছে ওরা। কাজেই, প্ল্যানটা যাওয়ায়, কোণঠাসা হয়ে পড়েছে আখমত ইয়াজিদ। সময়ক্ষেপণের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে সে, পরিচয় গোপন রাখা অসম্ভব হয়ে উঠেছে, এবার তাতে সত্যি সত্যি লেডি ফ্ল্যামবোরোকে গায়েব করে দিতে হবে, তার না হলে ইন্টেলিজেন্স সোসগুলো জেনে ফেলবে হাইজ্যাকিংয়ের পেছনের লোকটি কে।

তার মানে আমরা এখানে কথার মালা তৈরি করছি, আর সন্ত্রাসবাদীদের নেতা গ্লেসিয়ারের সাথে রাশিয়ান রুলে খেলছে, তিক্ত গলায় বলল জিওর্দিনো। কে জানে, ইতিমধ্যে হয়তো সে তার লোকদের নিয়ে জাহাজ ত্যাগ করেছে বোট বা হেলিকপ্টরে চড়ে। অসহায় প্যাসেঞ্জার আর কুরা বন্দি হয়ে আছে জাহাজের ভেতর।

 হতে পারে, অসম্ভব নয়, স্নান গলায় বলল জন ডিলিঞ্জার। বোটটাকে আমরা হয়তো দেখতে পাইনি।

কর্নেল ব্যাপারটাকে আরেক দৃষ্টিতে দেখছে। কাগজে একটা নম্বর লিখে স্কিপারের হাতে গুঁজে দিল সে। ক্যাপটেন, এই ফ্রিকোয়েন্সিতে আমার কমিউনিকেশন অফিসারের সাথে যোগাযোগ করুন, প্লিজ। বলুন, আমি আর আমার মেজর এয়ারফিল্ডে ফিরে যাচ্ছি। সবাইকে জড় করতে বলুন, আমি ফিরেই ব্রিফিং করব ওদেরকে।

আমরাও আপনার সাথে যাচ্ছি, শান্ত প্রত্যয়ের সাথে বলল পিট।

মাথা নাড়ল কর্নেল মরটন হোলিস। সম্ভব নয়। আপনারা অ্যাসল্ট ট্রেনিং পান নি। সিভিলিয়ান। এ ধরনের অনুরোধ করাই আপনার বোকামি হয়ে গেছে।

লেডি ফ্ল্যামবোরোয় আমার বাবা রয়েছেন।

আমি দুঃখিত, বলল কর্নেল।

ঠাণ্ডা চোখে কর্নেল হোলিসের দিকে তাকাল পিট। ওয়াশিংটনে স্রেফ একটা ফোন করে আপনার পুরো ক্যারিয়ারের বারোটা বাজিয়ে দিতে পারি আমি।

 কর্নেলের চেহারা শক্ত হলো। আপনি আমাকে হুমকি দিতে সাহস করেন, মি, পিট? পিটের দিকে এক পা সামনে বাড়ল সে। এই অপারেশনে আগামী বারো ঘণ্টার মধ্যে চল্লিশটা লাশ পড়তে যাচ্ছে। আমি আর আমার লোকজন যেভাবে ট্রেনিং পেয়েছি, কাজটা যদি সেভাবে করি, হোয়াইট হাউস বা কংগ্রেসে এক হাজার টেলিফোন করলেও আমার কিছু হবে না। পিটের দিকে আরও এক পা এগোল সে। সারাজীবনে আপনি যত চালাকি শিখবেন, তার চেয়ে অনেক বেশি শেখা আছে আমার। ইচ্ছে করলে এই মুহূর্তে আপনাকে আমি খালি হাতে ছিঁড়ে টুকরো টুকরা করে ফেলতে পারি।

আলোর একটা ঝলকের মতো বিদ্যুৎ খেলে গেল পিটের শরীরে।

নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে পিট, হাতে একটা কোল্ট ফরটি ফাইভ অটোমেটিক, কর্নেলের দুই উরুর মাঝখানে তাক করা। শুধু যে উঠতে চেষ্টা করলে তা নয়, বলল ও, সম্পূর্ণ শান্ত ভঙ্গিতে আমার প্রস্তাব না মানলেও গুলি করব।

সামনের দিকে ঝুঁকে লাফ দেয়ার ভঙ্গিতে স্থির হয়ে রয়েছে জন ডিলিঞ্জার, লাফ দেয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে তার ঘাড়ের ওপর পিস্তল চেপে ধরেছে জিওর্দিনো।

 বেশি কথা বলে সময় নষ্ট করব না, বলল পিট। শুধু জেনে রাখুন, আমরা তিনজন বন্দুকযুদ্ধে নিজেদের রক্ষা করতে জানি। কথা দিচ্ছি, আপনাদের কাজে আমরা নাক গলাব না। আপনারা সম্ভবত লেডি ফ্ল্যামবোরোর ওপর হামলা করবেন আকাশ ও সাগর থেকে। দুটোই এড়িয়ে যাব আমরা, জাহাজে পৌঁছাব জমিন ধরে।

চোখ পিটপিট করল কর্নেল।

ডার্ক আসলে খুব কম চাইছে আপনার কাছে, রুডির বলার সুরে সহিষ্ণুতা প্রকাশ পেল। আমার পরামর্শ যদি গ্রহণ করেন, ওর প্রস্তাবটা মেনে নিয়ে বাকি সম্মানটুকু বাঁচান।

মুখ খুলল কর্নেল, আমাকে আপনি গুলি করে মারবেন, এ আমি বিশ্বাস করি না।

না, তা মারব না, বলল পিট। তবে কথা দিতে পারি, দুই উরুর মাঝখানে তাক করা অটোমেটিক এক চুল নড়ল না, যৌন জীবন বলতে কিছু থাকবে না আপনার।

আসলে আপনার আসল পরিচয়টা কী বলুন তো? কোন কোম্পানি? সিআইএ

সিআইএ? হাসল জিওর্দিনো। উঁহু, পছন্দ করতে পারিনি। আমরা নুমার সদস্য।

মাথা নাড়ল কর্নেল। এ সবের আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

 দরকার ও তো নেই, বলল পিট। রাজি কি না বলুন।

একটা প্লেন আপনাদেরকে জাহাজ থেকে দশ কিলোমিটারে মধ্যে পৌঁছে দেবে। দশ কিলোমিটারের বেশি নয়, কারণ তাহলে সন্ত্রাসবাদীদের আমরা বিস্ময়ের ধাক্কা দিতে পারব না। ওখান থেকে আপনাদেরকে পায়ে হেঁটে যেতে হবে। ভাগ্য আমাকে সহায়তা করলে, পৌঁছে দেখবেন নাটক শেষ হয়ে গেছে।

রাজি, বলল পিট।

পিছিয়ে গেল কর্নেল, ঝট করে দিকে তাকাল। আমার সেকেন্ড ইন কমান্ডকে মুক্তি দিলে কৃতজ্ঞ বোধ করব। তরপর আবার সে পিটের দিকে ফিরল। আমরা রওনা হচ্ছি, এখনই। জেনে রাখুন, আমাদের সাথে রওনা না হলে, আপনাদের যাওয়া হচ্ছে না। কারণ, আমি কমান্ড এয়ারক্রাফটে চড়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে গোটা অ্যাসল্ট দল আকাশে উঠে যাবে।

আমি আপনার পেছনে থাকছি, অটোমেটিকটা হোলস্টারে রেখে বলল পিট।

আমিও থাকছি মেজরের পেছনে, বলল জিওর্দিনো, ডিলিঞ্জারের পিঠ চাপড়ে দিল সে। বুদ্ধিমান লোক এক রাস্তায় চলে।

তার দিকে অগ্নিদৃষ্টি হানল জন ডিলিঞ্জার। তোমার বুদ্ধি নর্দমায় পচে মরুক!

পনেরো সেকেন্ডের মধ্যে খালি হয়ে গেল কামরাটা। নিজের কেবিনে ফিরে গিয়ে একটা ব্যাগ নিল পিট, ব্রিজে এসে কথা বলল স্কিপারের সাথে। সান্তা ইনেজে পৌঁছাতে কতক্ষণ লাগবে সাউন্ডারের?

চার্টরুমে ঢুকে দ্রুত একট হিসেবে করল স্কিপার। গ্লেসিয়ারে কাছাকাছি পৌঁছাতে সময় নেব আমরা নয় কী দশ ঘণ্টা।

তাহলে পৌঁছান, নির্দেশ দিল পিট। ভোরের দিকে আমরা আপনাকে খুঁজব।

পিটের সাথে করমর্দন করল স্কিপার। সাবধানে থাকবেন।

রাইট।

ব্রিজ কাউন্টার টপকে ওদের সামনে এসে দাঁড়াল জাহাজের একজন বিজ্ঞানী। লোকটা কালো, মাঝারি আকৃতি, থমথমে গম্ভীর ভাবটুকু মুখে যেন খোদাই করা। লোকটার নাম ক্লেইটন ফিনলে, কথা বলল স্বভাবসুলভ কর্কশ সুরে, আড়াল থেকে শোনার জন্য দুঃখিত। তবে শুনতে আমি ভুল করিনি, আপনারা সান্তা ইনেজ দ্বীপের কথা বলছিলেন।

হ্যাঁ, তো কী হয়েছে?

গ্লেসিয়ারের কাছে পুরনো একটা দস্তার খনি আছে। খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হওয়ায় চিলি সরকার বন্ধ করে দিয়েছে খনিটা।

আগ্রহ প্রকাশ করল পিট, দ্বীপটা সম্পর্কে আপনি জানেন?

মাথা ঝাঁকাল ক্লেইটন।

আরিজোনা মাইনিং কোম্পানির চিফ জিওলজিস্ট ছিলাম না আমি। ওরা ভেবেছিল, কম খরচে সারাতে পারলে খনিটা থেকে লাভ করা যায়। দু’জন ইঞ্জিনিয়ারের সাথে সার্ভে করতে পাঠানো হয় আমাকে। নরকটায় তিন মাস ছিলাম। দস্তার মান ভালো নয়। আমরা নিরাশ হয়ে চলে আসার পর খনিটা পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়।

রাইফেলে হাত কেমন?

শিকারে গিয়ে একেবারে খালি হাতে কখনও ফিরিনি।

তার বাহু চেপে ধরল পিট। ফিনলে, বন্ধু, তোমাকেই আমি খুঁজছিলাম।

.

৫২.

নিজের গুরুত্ব প্রমাণ করে দেখল কেইটন ফিনলে।

 খালি একটা অয়্যার হাউসে অ্যাসল্ট দলকে ব্রিফ করছে হোলিস, আরেক দিকে বাকি তিনজন ফিনলেকে সাহায্য করছে সান্তা ইনেজ দ্বীপের একটা মডেল তৈরি কাজে। এয়ারপোর্ট রানওয়ের পাশের মাছ থেকে কাদা সংগ্রহ করা হয়েছে, রং যোগাড় করেছে কর্নেলের একজন লোক। পুরনো একটা পিং-পিং টেবিলের ওপর তৈরি হলো মডেলটা। পিটের নটিক্যাল চার্ট দেখে দ্বীপটার ভুলে যাওয়া অংশগুলো চিনে নিল ফিনলে।

পোর্টেবল একটা হিটারের সাহায্যে মডেলটা শুকিয়ে শক্ত করে নেয়া হলো, তারপর রং চড়াল ফিনলে-পাথুরে এলাকায় দেয়া হলো বাদামি, গ্লেসিয়ারের বরফ আর তুষার বোঝবার জন্য ব্যবহার করা হলো সাদা। গ্লেসিয়ারের গোড়ায় এমনকি লেডি ফ্ল্যামবোরোও তৈরি করল সে। কাজ শেষ করে এক পা পিছাল, তাকিয়ে থাকল একদৃষ্টে।

দল নিয়ে টেবিলে সামনে চলে এল কর্নেল হোলিস। এক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলল না।

দ্বীপটার হাতা-মাথা ঠাওর করা মুশকিল। তীররেখা অসম্ভব উঁচু-নিচু, আঁকাবাঁকা চার চোখা। খাড়িগুলো দুর্গম, মুখ ব্যাদান সেগুলো। দ্বীপটা পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা, পশ্চিম দিকে প্রশান্ত মহাসাগর। অনুর্বর, মৃত একটা দ্বীপ। পঁচানব্বই কিলোমিটার লম্বা, চওড়ায় পঁয়ষট্টি কিলোমিটার, মাউন্ট হোয়ার্টন পর্বত এক হাজার তিনশো বিশ মিটার উঁচু।

সৈকত বা সমতল ভূমি নেই বললেই চলে। নিচু পাহাড়গুলো পাথুরে জাহজের মতো দেখতে, খাড়া চালগুলো যেন আহত কুমিরের পিঠ, যন্ত্রণাকাতর অস্থিরতার সাথে ঠাণ্ডা সাগরে নামছে।

দ্বীপটা যেন গোড়া, আর প্রাচীন গ্লেসিয়ারটা যেন ঘোড়ার পিঠে জিন। গরমের দিনে আকাশে মেঘ থাকায় আবহাওয়া ছিল ঠাণ্ডা, বরফ গলেনি, তাই এ রকম দেখাচ্ছে। জমাট বরফের দুদিকে মরিয়া হয়ে মাথাচাড়া দিয়েছে কঠিন পাথর, মাঝখান দিয়ে সাগরের দিকে পথ করে নিয়েছে গ্লেসিয়ার, পানিতে নামার আগে আকৃতি পেয়েছে ফালি করা মাংসের লম্বা টুকরোর মতো।

এমন ভয়াল দর্শন এলাকা খুব কমই আছে পৃথিবীতে। গোটা ম্যাগেলান দ্বীপপুঞ্জে স্থায়ীভাবে কোনো মানুষ বাস করে না। কয়েকশো বছর ধরে বহুজন দ্বীপটায় এসেছে, ফিরে গেছে তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে, পেছনে রেখে গেছে নিন্দাসূচক সব নাম-ঘাড় ভাঙা পেনিনসুলা, প্রতারক দ্বীপ, দুর্যোগ বে, জনশূন্য আইল, দুর্ভিক্ষের বন্দর। বরফ আর পাথর ছাড়া কিছুই নেই দ্বীপটায়, সবুজের চিহ্ন বলতে কোনো রকমে টিকে যাওয়া কুৎসিত দর্শন কিছু ঝোঁপ।

মডেলটার ওপর একটা হাত বুলালো ক্লেইটন ফিনলে। পাথুরে একটা এলাকার কথা কল্পনা করুন, উঁচু অংশগুলোর বরফ ঢাকা, আসল ছবিটা পেয়ে যাবেন।

ধন্যবাদ, মি. ফিনলে, বলল কর্নেল হোলিস। আমরা সবাই আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ।

 ঠিক আছে, কাজে নামা যাক। এয়ার-ড্রপ ফোর্সের নেতৃত্ব দেবে। জন ডিলিঞ্জারের ডাইভ টীমের কমান্ডে থাকব আমি। সদস্যদের চেহারায় চোখ বুলানোর জন্য থামল হোলিস। সবাই একহারা গড়নের, মেদ নেই এক ছটাক, লোহার মতো শক্ত পেশি। সবার পরনে কালো পোশাক। ওরা যে ট্রেনিং পেয়েছে, এত কঠিন ট্রেনিং আর কোনো দল পায়নি পৃথিবীর কোথাও। এদের প্রত্যেককে নিয়ে গর্বিত কর্নেল। রাতের অন্ধকারে কীভাবে একটা জাহাজ দখল করতে হয়, সে ট্রেনিং নেয়া আছে আমাদের। তবে, আলোচ্যক্ষেত্রে শত্রুরা অনেক সুবিধা ভোগ করছে। ক্রিটিক্যাল ইন্টেলিজেন্স ইনফরমেশনের অভাব রয়েছে আমাদের, আবহাওয়া অনুকূল নয়, এমন একটা গ্লেসিয়ারের সামনে দাঁড়াতে হবে যেটা যেকোনো মুহূর্তে বসে পড়তে পারে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হামলা শুরু করব আমরা, তার আগে কিছু প্রশ্নের উত্তর পেলে ভালো হয়। জন ডিলিঞ্জার, শুরু করো।

সাথে সাথে ফিনলের দিকে ফিরে প্রশ্ন করল জন ডিলিঞ্জার, দ্বীপে লোকবসতি?

খনি বন্ধ ঘোষণার পর একজনও নেই।

আবহাওয়ার অবস্থা?

প্রায় সারাক্ষণ বৃষ্টি পড়ছে। সূর্য দেখতে পাওয়া ভাগ্যের কথা। বছরের এই সময়টায় তাপমাত্রা হিমাঙ্কের কয়েক ডিগ্রী নিচে। তীব্র বাতাস বইছে প্রতি মুহূর্তে, মাঝেমধ্যে ঝড়কেও হার মানায়।

কর্নেলের দিকে গম্ভীর চেহারা নিয়ে তাকাল জন ডিলিঞ্জার। নির্দিষ্ট জায়গায় রাতের বেলা এয়ার-ড্রপ সম্ভব নয়।

মিনি কপ্টার নিয়ে যাব আমরা, রশি বেয়ে নামব।

আপনারা হেলিকপ্টার নিয়ে এসেছেন? সবিস্ময়ে জানতে চাইল রুডি। কিন্তু স্পিড আর রেঞ্জ কি নাগাল পাবে?

ওগুলোর সামরিক নাম এত বড় যে মুখস্ত করা ভারি কঠিন, বলল কর্নেল আমরা বলি, ক্যারিয়ার পিজিয়ন। ছোট একটা খাঁচা, পাইলট ছাড়া খুব বেশি হলে আরও দু’জনকে বহন করা যায়। সাথে ইনফ্রাবেড় গম্বুজ আছে, আর আছে সাইলেন্সড টেইল রোটরস। খুলে আবার জোড়া লাগাতে মাত্র পনেরো মিনিট লাগে-হ্যাঁ, আমি একটা পোর্টেবল হেলিকপ্টারের কথাই বলছি। আমাদের সি-১৪০ ছটা বইতে পারে।

আপনাদের আরও একটা সমস্যা আছে, বলল পিট।

বলুন।

এয়ারক্রাফট আসছে কি না দেখার জন্য লেডি ফ্ল্যামবোরোর রাডার চালু রাখতে পারে হাইজ্যাকাররা। আপার ক্যারিয়ার পিজিয়ন নিচু দিয়ে উড়তে পারে জানি, তবু স্ক্রিনে ওগুলোকে দেখার পর আন্তরিক অভ্যর্থনা জানাবার জন্য যথেষ্ট সময় পাবে তারা প্রস্তুতির।

হেলিকপ্টার বাদ, হতাশ গলায় বলল জন ডিলিঞ্জার।

খাড়ি থেকে যদি হামলা করি অসুবিধা কী? ফিনলেকে জিজ্ঞেস করল কর্নেল।

অসুবিধা নয়, সুবিধা-ফ্রস্ট স্মোক।

 ফ্রস্ট স্মোক?

কুয়াশার মতো মেঘ। গ্লেসিয়ার ওয়ালের কাছে পানি তত ঠাণ্ডা নয়, হিম বাতাস ওই পানির সংস্পর্শে এল জিনিসটা উঠে আসে। দুই থেকে দশ মিটার পর্যন্ত ওঠে। তার সাথে থাকে বৃষ্টি, ফলে আপনার ডাইভ দল রওনা হবার মুহূর্ত থেকে আড়াল পাবে, ডেকে পৌঁছুনো পর্যন্ত।

চিন্তিতভাবে গাল চুলকাল কর্নেল। এযার-ড্রপ ফাঁস হয়ে গেলে মারা পড়বে সবাই। বিস্ময়ের ধাক্কা দিতে না পারলে বিশজন লোকের ডাইভ টিমের পক্ষে কোন রকম ব্যাকআপ ছাড়া চল্লিশজন আতঙ্কবাদীদের সাথে পেরে ওঠা কঠিন হবে।

 প্যারাস্যুট নিয়ে জাহাজে নামতে যাওয়া যদি আত্মহত্যা হয়, বলল পিট, আপনারা গ্লেসিয়ারের আরও ওপরে কোথাও নামছেন না কেন? ওখান থেকে কিনারায় চলে আসবেন, তারপর রশি ধরে নামবেন মেইন ডেকে।

 চিন্তাটা আমার মাথায় এসেছে, বলল কর্নেল। মি. পিটের প্রস্তাবে কেউ কোনো বাধা দেখতে পাচ্ছেন?

 গ্লেসিয়ারটাই আপনাদের সবচেয়ে বড় বিপদ, বলল রুডি। ওটার গায়ে বরফ চাকা অসংখ্য ফাটল বা গর্ত থাকতে পারে, থাকতে পারে নরম তুষার, পা ফেললেই নেমে যাবেন গভীরে। অন্ধকার, কাজেই সাবধানে এগোতে হবে।

আর কেউ কিছু বলবেন? কেউ কিছু বলল না। মেজের ডিলিঞ্জারের দিকে ফিরল কর্নেল। এয়ার-ড্রপের হামলা করতে কতক্ষণ সময় নেবে তোমরা?

বাতাসের তীব্রতা আর কোনো দিকে বইছে জানতে পারলে হিসাবে করতে সুবিধা হতো।

 দশ দিনের মধ্যে নয় দিনই দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে আসে বাতাস, জবাব দিল ফিনলে। বোজা চোখে রাতের দৃশ্য কল্পনা করার চেষ্টা করল সে।

গ্লেসিয়ারের পেছনে খাড়া হয়ে থাকা ছোট পাহাড়গুলোর দিকে তাকাল জন ডিলিঞ্জার। আধবোজা চোখে রাতের দৃশ্য কল্পনা করার চেষ্টা করল সে, আন্দাজ করল বাতাসের তীব্রতা। কর্নেলের দিকে তাকাল সে, বলল, এয়ার-ড্রপের পর চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় নেব হামলা করতে।

ভাববেন না আপনাকে কাজ শেখাচ্ছি, বলল পিট। তবে, সময়টা আপনি খুব কমিয়ে ধরছেন।

 আমি একমত, সায় দিল ফিনলে। গ্লেসিয়ারটার ওপর কয়েকবার হেঁটেছি আমি। আইস রিজ থাকায় এগোনো খুব কঠিন।

চোখের পলকে কোমরের খাপ থেকে লম্বা একটা ছুরি বের করল জন ডিলিঞ্জার, ফলাটা বাঁকা, মাথার দিকটা সরু। মডেলের ওপর সেটাকে পয়েন্টার হিসেবে ব্যবহার করল সে। গ্লেসিয়ারের ডানে, পাহাড়ের পেছন দিকে নামব আমরা। তাহলে আমাদের সি-১৪০ জাহাজের রাডারে ধরা পড়বে না। ধরে নিচ্ছি বাতাসের সাধারণ প্যাটার্ন বদলাবে না, প্যারাস্যুট নিয়ে পাহাড় ঘুরে উড়ে যাব সাত কিলোমিটার, গ্লেসিয়ারের সামনের পাঁচিল থেকে খুব বেশি হলে এক কিলোমিটার দূরে নামবো। জাম্প করার পর নিচে নেমে একত্রিত হওয়া পর্যন্ত আঠারো মিনিট ধরেছি আমি। গ্লেসিয়ারের কিনারা পর্যন্ত হাঁটব, আরও বিশ মিনিট। হামলা করার জন্য প্রস্তুতি নিতে আরও ছয় মিনিট। সব মিলিয়ে চুয়াল্লিশ মিনিট।

আমি হলে সময়টা দ্বিগুণ করে নিতাম, বলল জিওর্দিনো। দলের কেউ একজন কোনো ফাটলে পড়লে, দ্বিতীয় দলটার সাথে নির্দিষ্ট সময়ে মিলিত হতে পারবেন না। আপনাদের পৌঁছুতে দেরি হবে, ডাইভ দল তা জানতে পারবে না।

চেহারার বিরক্তি নিয়ে দিকে তাকাল কর্নেল। আমরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছি না, মি. জিওর্দিনো। ইউনিফর্মের সাথে প্রত্যেকের কাছে একটা করে ছোট্ট রেডিও আছে, কানের সাথে ফিট করা, আর স্কি মাস্কের সাথে আছে মাইক্রোফোন। প্রতি মুহূর্তে যোগাযোগ থাকবে আমাদের মধ্যে।

আরেকটা কথা, বলল পিট। আশা করি আপনাদের আগ্নেয়াস্ত্রে সাইলেন্সার লাগানো আছে?

আছে, বলল কর্নেল। কেন?

সাইলেন্সার না থাকলে মেশিনগানের একটা বিস্ফোরণেই গ্লেসিয়ারের পাঁচিলটা ভেঙে পড়বে।

হাইজ্যাকাররা কী করবে আমি জানি না।

তাহলে যত তাড়াতাড়ি পারেন, খুন করবেন ওদের, নিচু গলায় বলল জিওর্দিনো।

সন্ত্রাসবাদীদের বন্দি করার ট্রেনিং আমাদেরকে দেয়া হয়নি, নিষ্ঠুর ঠাণ্ডা হাসির সাথে বলল কর্নেল। এবার আমাদের অতিথিদের সমালোচনা যদি শেষ হয়ে থাকে, কারও কোনো প্রশ্ন আছে?

ডাইভ টিমের রিচার্ড বেনিং হাত তুলল। স্যার?

 বেনিং?

জাহাজে পৌঁছাব আমরা কি পানির ওপর দিয়ে, নাকি তলা দিয়ে?

পয়েন্টার হিসেবে একটা বল পয়েন্ট পেন ব্যবহার করল কর্নেল। খাড়ির ছোট্ট একটা দ্বীপেরর ওপর টোকা দিল সে, জাহাজ থেকে দ্বীপটা দেখা যায় না। পিজিয়ন ক্যরিয়ার, এই দ্বীপে পৌঁছে দেবে আমাদেরকে। ওখান থেকে লেডি ফ্ল্যামবোরো তিন কিলোমিটার দূরে। পানি এত ঠাণ্ডা যে সাঁতার কাটা যাবে না, আমরা রাবার বোটে করে রওনা হব। ফ্রস্ট স্মোক যদি সত্যি থাকে,, সন্ত্রাসবাদীদের চোখে ধরা পড়ে পৌঁছাতে পারব, আর যদি না থাকে, জাহাজ দুশো মিটার দূরে থাকতে পানিতে নামতে হবে, সাঁতরে পৌঁছাতে হবে খোলের গায়ে।

 অনেকেরই, মানে, বেশ কয়েক জোড়া বিচি বরফ হয়ে যাবে-প্রথম পার্টির জন্য খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলে।

অয়্যার হাউসে প্রায় আশি জন লোক জড় হয়েছে, সবাই হেসে ফেলল।

মুখে চওড়া হাসি নিয়ে কর্নেল হোলিস বলল, কাজেই সাবধান হওয়া দরকার মেজর ডিলিঞ্জার তার দল নিয়ে আগেই রওনা হয়ে যাবে।

একটা হাত তুলল রুডি।

ইয়েস, মি. রুডি, হালকা ব্যঙ্গের সুরে বলল কর্নেল। আপনি আবার কী বলতে চান? আমার কোথাও ভুল হয়েছে?

কৌতূহলের শিকার, কর্নেল। হামলা সম্পর্কে আগে-ভাগে যদি টের পেয়ে যায়, আমাদের জন্য যদি ফাঁদ পেতে অপেক্ষা করে-আপনি জানবেন কীভাবে?

আমাদের একটা এয়ারক্রাফটে অ্যাডভান্সড ইলেকট্রনিক সার্ভেইল্যান্স ইকু্যইমেন্ট আছে, লেডি ফ্ল্যামবোরোর সাত মাইল ওপরে চক্কর দেবে ওটা, এলাকার বাইরে সহযোগীদের কাছে সন্ত্রাসবাদীদের পাঠানো যেকোনো ট্রান্সমিশন ধরে ফেলবে। স্পেশাল অপারেশন ফোর্সের একটা দল জাল ছোট করে আনছে টের পেলে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীর মতো চেঁচাবে ওরা।

একটা আঙুল খাড়া করে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল পিট।

 ইয়েস, মি. পিট, বাঁকা হাসি নিয়ে তাকাল কর্নেল।

আশা করি আমাদের কথা, মানে নুমা পার্টির কথা আপনি ভুলে যাননি।

একটা ভ্রু উঁচু কল কর্নেল। না, ভুলিনি।

 জিওলজিস্টের দিকে ফিরল সে। মি. ফিনলে, পুরনো খনিটা যেন কোথায়?

মডেলে ওটাকে আমি দেখাইনি, শান্ত গলায় বলল ফিনলে। তবে আপনার যখন জানার আগ্রহ…, থেকে ছোটো একটা পাথুর উত্থানের পাশে দিয়াশলাইয়ের একটা বাক্স রাখল সে, ওখান থেকে গ্লেসিয়ার আর খাড়ি দেখতে পাওয়া যায়। এখানে খনিটা, গ্লেসিয়ারের সামনের কিনারা আর জাহাজ থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে।

পিটের দিকে ফিরল কর্নেল। ওটাই আপনাদের উপযুক্ত জায়গা। আপনারা অবজারভেশন পোস্ট হিসেবে ভূমিকা পালন করবেন।

 আহা, কী আমার অবজারভেশন পোস্ট রে। গোমড়া মুখে বলল জিওর্দিনো। অন্ধকার, বৃষ্টি, ফ্রস্ট স্মোক-বিপদ থেকে দূরে, সান্ত্বনা দিয়ে বলল পিট। ইচ্ছে করলে ওখানে আমরা আগুন জ্বেলে পিকনিক করতে পারি।

 আপনাদের জন্য সেটাই ভালো হবে, চেহারায় খানিকটা তপ্তি নিয়ে বলল কর্নেল। লোকজনদের ওপর চোখ বুলালো একবার। কথা বলে আর সময় নষ্ট করব না, চলো এবার, কিছু লোকের প্রাণ বাঁচানো যাক।

হ্যাঁ, বিশেষ করে প্রাণ বাঁচানোর একক এজেন্সি যখন পেয়ে গেছেন, বিড়বিড় করল জিওর্দিনো।

কী বললেন?

জিওর্দিনো বলছে, এলাইড ফোর্সের একজন হতে পারা ভারি সৌভাগ্যের ব্যাপার, বলল পিট।

জিওর্দিনোর দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকাল কর্নেল, দু’জন যেন জন্মশত্রু। স্পেশাল অপারেশন ফোর্স কাউকে অনারারি সদস্যপদ দেয় না। আপনারা সিভিলিয়ানা, আমাদের থেকে দূরে সরে থাকবেন। ঝট করে ডিলিঞ্জারের দিকে ফিরল মরটন হোলিস। আমার অনুমতি না পেয়ে মার কোনো লোক যদি লেডি ফ্ল্যামবোরোর পা ফেলতে চেষ্টা করে, গুলি করবে। দ্যাটস অ্যান অর্ডার।

আ প্লেজার! ক্ষুধার্ত হাঙরের মতো হাসল জন ডিলিঞ্জার।

কাঁধ ঝাঁকাল জিওর্দিনো। ঘৃণা ছড়াতে এরা দেখছি সাংঘাতিক পটু।

পিট কিন্তু জিওর্দিনোর মতো মেজাজ গরম করল না। কর্নেল হোলিসের মনোভাব পরিষ্কার উপলব্ধি করল ও। কর্নেলের লোকেরা প্রফেশনাল, একটা দল। আরেকবার সবার ওপর চোখ বুলালো ও। একহারা গড়নের দীর্ঘদেহী যুবক তারা, কারও বয়স পঁচিশের বেশি নয়, প্রত্যেকের চেহারায় দৃঢ়প্রত্যয় আর সংকল্পের ছাপ। একটা প্রশ্ন নাছোড়বান্দার মতো বারবার উদয় হলো পিটের মনে, আগামী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এদের মধ্যে কে কে মারা পড়বে।

.

৫৩.

আর কত দেরি? জানতে চাইল ম্যাকাডো, গা ছেড়ে দিয়ে ক্যাপটেন কলিন্সের সোফায় বসে রয়েছে।

পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ থাকায় ক্যাপটেনের কেবিনের টর্চলাইট জ্বালানো হয়েছে। সিলিংয়ের চারটে কোণ থেকে ঝুলছে সেগুলো।

কোরআন পড়ছে সুলেমান আজিজ, মুখ না তুলে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল। কমিউনিকেশন রুমে আমার চেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছেন আপনি, আপনিই বলুন।

 পোয়াতি হাঁসের মতো অপেক্ষা করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছি আমি। আসুন, সবাইকে গুলি করে এই নরক থেকে কেটে পড়ি।

হত্যা ষড়যন্ত্রের দোসর ম্যাকাডোর দিকে তাকাল সুলেমান আজিজ। মেক্সিকান লোকটা নোংরা। তার চুল তেল-চিটচিটে ময়লা, নখের ভেতর ধুলোবালি। দুহাত দূর থেকে নাক টানলে দুর্গন্ধে ভূতও পালাবে। বিপজ্জনক হুমকি হিসেবে ম্যাকাডোকে শ্রদ্ধা করে সুলেমান আজিজ, তার বাকি সব কিছু ঘৃণার উদ্রেক করে।

সোফা ছেড়ে পায়চারি শুরু করল ম্যাকাডো, মনটাকে শান্ত করতে না পেরে একটা চেয়ারে বসল। চব্বিশ ঘণ্টা আগেই নির্দেশ আসা উচিত ছিল, বলল সে। টপিটজিন দ্বিধায় ডোগার মানুষ নন।

 আখমত ইয়াজিদও নন, পবিত্র পুস্তকে চোখ রেখে বলল সুলেমান আজিজ। তার আর পরম করুণাময় আল্লাহর ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস আছে। তারা আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ঠিকই করবেন।

 কী ব্যবস্থা করবেন? প্রায় চেঁচিয়ে উঠে জানতে চাইল ম্যাকাডো। হেলিকপ্টার, জাহাজ, নাকি সাবমেরিন? আমাদের পরিচয় ফাস হবার আগে, না পরে? আপনি জবাবটা জানেন, মিসরীয় বন্ধু, তবু নিষ্প্রাণ মূর্তির ভূমিকা নিয়ে আছেন।

চোখ না তুলে একটা পাতা ওল্টাল সুলেমান আজিজ। কাল এই সময় আপনি আর আপনার দল নিরাপদে পৌঁছে যাবে মেক্সিকোয়।

 আদর্শের জন্য, বৃহত্তর স্বার্থে, আমাদেরকে বলি দেয়া হবে না, সে নিশ্চয়তা আপনি দিতে পারেন?

 আমরা ধরা পড়া মানে আখমত ইয়াজিদ ও টপিটজিনের বিপদ, বলল সুলেমান আজিজ। কারণ শারীরিক নির্যাতন করা হলে আমরা মুখ খুলতে পারি। হাইজ্যাকিংয়ের সাথে তারা জড়িত, এ কথা আমরা যদি ফাঁস করে দিই, তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বপ্ন ভেঙে খান খান হয়ে যাবে। আমার ওপর বিশ্বাস রাখুন, আমাদের পালানোর ব্যবস্থা করা হবে। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন।

কী ব্যবস্থা?

প্ল্যানের ওই অংশটুকু আপনাকে জানো হবে জিম্মিদের সম্পর্কে নির্দেশ আসার পর।

অতিরঞ্জিত গল্পে ফাঁক-ফোকর দেখা দিতে শুরু করেছে। যেকোনো মুহূর্তে সত্যের আভাস পেয়ে যাবে ম্যাকাডো। যতক্ষণ সুলেমান আজিজের নিজস্ব লোক জাহাজের কমিউনিকেশন, নেটওয়ার্ক অপারেট করবে, রেডিও সেট ভুল ফ্রিকোয়েন্সিতে থাকায় কোনো সঙ্কেত রিসিভ করা যাবে না। আখমত ইয়াজিদ এবং সম্ভবত টপিটজিন, নির্ঘাত ঘেমে সারা হচ্ছে, যদি তারা ভেবে থাকে তাদের নির্দেশ অমান্য করে জিম্মিদেরকে খুন করে ফেলেছে সে। প্রচারণার স্বার্থে জিম্মিদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছে ওরা।

নির্দেশের অপেক্ষায় থাকার দরকার কী। সবাইকে নিচে নিয়ে গিয়ে জাহাজটা ডুবিয়ে দিলেই তো হয়!

কাজটা নেহাৎই বোকামি হয়ে যাবে। ক্রুরা বেশির ভাগ ব্রিটিশ, সিনেটের একজন কর্মকর্তাও রয়েছেন। রয়েছে মিসরীয় ও মেক্সিকান নাগরিকরা। এতগুলো মানুষকে খুন করলে পরিণতি কী ঘটতে পারে ভেবে দেখেছেন? আমাদের খোঁজে সারা দুনিয়া চষে ফেলা হবে।

তাছাড়া উপায়ই বা কী! সাক্ষী রেখে খুন করার মধ্যে আমি নেই।

খাঁটি কথা, ভাবল সুলেমান আজিজ, আমিও নেই।

হ্যাঁচকা টানে খুলে ফেলল দরজা। নির্দেশ তাড়াতাড়ি এলে ভালো, প্রায় হুমকির সুরে বলল ম্যাকাডো। তা না হলে, আগেই বলে রাখছি, আমার লোকদের সামলে রাখা কঠিন হবে। এরই মধ্যে তারা মিশনের দায়িত্ব আমাকে নেওয়ার জন্য চাপ দিতে শুরু করেছে।

তাকে সমর্থন দিয়ে হাসল সুলেমান আজিজ। দুপুরের মধ্যে… আমাদের নেতারা যদি দুপুরের মধ্যে কোনো নির্দেশ না পাঠান, মিশনের কমান্ড আমি আপনার হাতে তুলে দেব।

সবেগে ঘুরে দাঁড়লো ম্যাকাডো। সন্দেহ আর অবিশ্বাসে বিস্ফারিত হয়ে উঠল তার চোখ। আমাকে কর্তৃত্ব দিয়ে আপনি সরে দাঁড়াবেন?

 অসুবিধা কি? যে কাজে পাঠানো হয়েছে তা আমি শেষ করেছি। বাকি আছে শুধু ছোট্ট একটা কাজ-প্রেসিডেন্ট হাসান আর হে’লা কামিলের ব্যবস্থা করা। সর্বশেষ ঝামেলাটা খুশি মনে আপনার কাঁধে তুলে দিতে পারি আমি।

হঠাৎ করে খোদ শয়তানের হাসিতে কদাকার হয়ে উঠল ম্যাকাডোর চেহারা। এই প্রতিশ্রুতি আপনাকে আমি রক্ষা করতে বাধ্য করব, মিসরীর বন্ধু। তখন সম্ভবত মুখোশের আড়ালে মুখটা দেখার সুযোগ হবে আমার।

কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল সে।

দরজাটা ক্লিক শব্দে বন্ধ হবার সাথে সাথে কোটের ভেতর থেকে মিনিয়েচর রেডিওটা বের করল সুলেমান আজিজ। সুইচ অন করে বলল, ইবনে?

ইয়েস, সুলেমান আজিজ, হযরত।

 তোমার লোকেশন?

 জাহাজের পেছন দিকে আছি, জনাব।

 তীরে কজন?

পুরনো খনির জেটিতে ছজনকে পাঠিয়েছি। জাহাজে আছি পনেরোজন, আপনাকে নিয়ে, হযরত। যেতে সময় লাগছে। বোটে একেক বারে তিনজন যেতে পারে। আটজনের রাবারের নৌকাটা এমনভাবে চেরা হয়েছে, মেরামত করা যাবে না।

স্যাবোটাজ?

অবশই, হযরত ম্যাকাডো বাহিনীর কাজ।

আরো কোনো সমস্যা?

এখনও দেখছি না। ঠাণ্ডার ভয়ে বাইরের ডেকে ওরা কেউ বেরোচ্ছে না। বেশির ভাগ লাউঞ্জে বসে হুইস্কি খাচ্ছে। বাকিরা ঘুমিয়ে। বন্ধু হতে বলে কাজের কাজ করেছেন, জনাব। শৃঙ্খলা বলতে কিছুই নেই ওদের মধ্যে।

বিস্ফোরক চার্জ?

গ্লেসিয়ারের মুখের সাথে একই রেখায় লম্বা একটা ফাটল আছে, সবগুলো এক্সপ্লোসিভ খানিক পরপর বসানো হয়েছে। বিস্ফোরণ ঘটলে গোটা সামনের পাঁচিল ধসে পড়বে জাহাজের ওপর।

জাহাজ ছাড়তে কতক্ষণ সময় লাগবে আমাদের?

স্রোত বেশ জোরাল, বৈঠা চালাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে আমাদের লোকেরা। আওয়াজের ভয়ে বোটের মোটর চালু করা যাচ্ছে না। স্যার, জাহাজ ছাড়তে সময় লাগবে আরও পঁয়তাল্লিশ মিনিট।

দিনের আলো ফোটার আগে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে হবে আমাদের।

সবাই জান-প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করে যাবে, হযরত।

তোমাকে ছাড়া ফেরি অপারেশন চালাতে পারবে ওরা? জানতে চাইল সুলেমান আজিজ

পারবে।

 একজন লোককে সাথে নিয়ে হাসানের কেবিনে আমার সাথে দেখা কোরো।

তার মানে কী, হযরত, ওদেরকে খতম করার সময় হয়েছে? চাপা উত্তেজনার সাথে প্রশ্ন করল ইবনে।

না। ওদেরকে আমরা সাথে নিচ্ছি।

 রেডিওর সুইচ অফ করে পবিত্র কোরানে পকেটে ভরল সুলেমান আজিজ। তার সাথে বেঈমানি করা হয়েছে, কাজেই প্রতিশোধ নিতে হবে তাকে। ইয়াজিদের এত সাধের প্ল্যানটা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে সে। কাজের বিনিময়ে মূল্য বা পুরস্কার তো দূরের কথা, তার বদলে ম্যাকাডোকে দিয়ে তাকে আর তার হাইজ্যাক পার্টিকে খুন করার মতলব করেছে আখমত ইয়াজিদ। কেউ পিঠে ছুরি মারার চেষ্টা করলে সুলেমান আজিজ তাকে ক্ষমা করে না।

 প্রেসিডেন্ট হাসান আর হে’লা কামিলকে বাঁচিয়ে রাখবে সুলেমান আজিজ। হ্যাঁ, বাঁচিয়ে রাখকে প্রেসিডেন্ট দো লরেঞ্জোকেও। অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও। দর কষাকষিতে কাজে লাগবে। টেবিল উল্টে ফেলে দৃশ্যপট বদলে দেবে সে, সমস্ত দায় আর অভিযোগ চাপারে আখমত ইয়াজিদ ও টপিটজিনের ঘাড়ে। দুনিয়ার সামনে খুলে ধরবে তাদের মুখোশ।

নতুন একটা প্ল্যান তৈরি করার জন্য সময় দরকার তার। তবে আগের কাজ আগে।

নিজের লোকদের নিয়ে জাহাজ থেকে সরে যেতে হবে তাকে। মেক্সিকান খুনিরা কিছু টের পাবার আগেই।

.

দরজা খোলার শব্দে মুখ তুলে তাকালেন হে’লা কামিল, সন্ত্রাসবাদীদের নেতাকে ভেতরে ঢুকতে দেখে ছাৎ করে উঠল বুক। অদ্ভুত মুখোশটার দিকে তাকিয়ে তার শুধু চোখ জোড়া দেখতে পেলেন তিনি, অনায়াস ভঙ্গিতে মেশিনগান ধরে আছে একহাতে। মেয়েলি কৌতূহলবশত তিনি ভাবলেন, অন্য কোনো পরিস্থিতিতে লোকটা কেমন কে জানে!

কেবিন স্যুইটের ভেতর ঢুকে কঠিন সুরে বলল সুলেমান আজিজ, আপনারা সবাই আসুন আমার সাথে।

খারাপ কথাটাই আগে মনে আসে। এবার বোধ হয় গুলি করা হবে ওদেরকে। ভয়ে কেঁপে উঠলেন হে’লা কামিল, চোখ নামিয়ে ডেকের দিকে তাকালেন, ভয় প্রকাশ করে ফেলায় রেগে উঠলেন নিজের ওপর।

উদ্বেগ বা দ্বিধা কোনোটাই প্রকাশ পেল না, প্রায় লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন সিনেটর পিট। দৃঢ়, দীর্ঘ পদক্ষেপে এগোলেন তিনি, সরাসরি সুলেমান আজিজের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, দুজোড়া জুতোর ডগা ছোয় ছোয় অবস্থা। কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমাদের, এবং কেন? তীক্ষ্ণ কণ্ঠে উত্তর দাবি করলেন তিনি।

 ভুলে গেছেন আপনি আমার বন্দি? ঠাণ্ডা স্বরে বলল সুলেমান আজিজ। যদি বলি, গুলি করার জন্য নিয়ে যাচ্ছি, কী করার আছে আপনার? বিদ্রুপের হাসি হাসল সে। আর কখনও জেরা করবেন না আমাকে।

 তোমার কথায় এত গর্ব আর ধমক কেন? আরও তীক্ষ্ণ হলো সিনেটরের কণ্ঠস্বর। এভাবে কাউকে বন্দি করা কাপুরুষের কাজ, জানো না? আর বন্দিদের যারা গুলি করতে নিয়ে যায়, তারা নিশ্চয়ই অন্য কারো কেনা গোলাম।

বাজে কথা বলবেন না! সিনেটরকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে কয়েক পা সামনে বাড়লো সুলেমান আজিজ, ম্লান চেহারাগুলোর দিকে এক এক করে তাকাল। বোটে চড়ে সবাই একটু বেড়াবেন আর কী? খানিকক্ষণ ট্রেন ভ্রমণের সুযযোগও পাবেন। আমার লোকেরা কম্বল দেবে একটা করে, সময়টা বেশ ভালোই উপভোগ করবেন।

কেউ কোনো কথা বলল না, শুধু তাকিয়ে থাকল।

অসুস্থ, অসহায় অনুভূতি নিয়ে প্রেসিডেন্ট নাদাভ হাসানকে দাঁড়াতে সাহায্য করলেন হে’লা কামিল। একটানা কয়েকটা দিন মৃত্যুর হুমকির মধ্যে বাস করে জীবনের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছেন ভদ্রমহিলা। তাঁর এখন মনে হচ্ছে কিছুতেই কিছু এসে যায় না। অথচ অন্তরের গভীরে কোথাও আগুনের একটা ফুলকি ছোটোছুটি করছে, ইচ্ছাশক্তি একত্রিত করে বিদ্রোহ করার উৎসাহ দিচ্ছে তাকে। ধীরে ধীরে একজন যোদ্ধা অনুপ্রবেশ করল তার মধ্যে। যে জানে যুদ্ধে যাচ্ছে, জানে মৃত্যু অনিবার্য, সেই সাথে জানে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যুদ্ধ করবে সে।

.

ভেতরে ঢুকে কমিউনিকেশন রুম খালি দেখল ম্যাকাডো। প্রথমে তার মনে হলো, সুলেমান আজিজের রেডিও অপারেটর সম্ভবত প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেছে। ব্যাথরুমটা পরীক্ষা করার পর তার ভুল ভাঙল।

রেডিও প্যানেলের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল ম্যাকাডো। ঘুম না হওয়ায় লাল হয়ে আছে চোখ। চেহারায় সংশয়। ধীর পায়ে ব্রিজে চলে এল সে, রাডার স্কোপের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নিজের একজন লোকের দিকে এগোল। রেডিও অপারেটর কোথায়? প্রশ্ন করল সে।

ঘুরে দাঁড়াল রাডার অবজারভার, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, তাকে তো আমি দেখিনি, ক্যাপটেন কমিউনিকেশন নিমে নেই সে?

না, ঘরটা খালি।

 ওদের লিডারকে জিজ্ঞেস করে দেখব? ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল ম্যাকাডো, মিসরীয় রেডিও অপারেটরের নিখোঁজ হওয়ার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে বুঝতে পারছে না। জর্জ দেলগাদোকে ডেকে আনো এখানে। রেডিও বোঝে সে। আরবরা নয়, এখন থেকে কমিউনিকেশন রুমের দায়িত্বে থাকব আমরা।

ওরা কথা বলছে, দু’জনের কেউই খেয়াল করল না, রাডারস্কোপে একটা জোরাল ব্লিপ উদয় হয়েছে। দ্বীপের মাঝখান দিয়ে উড়ে যাচ্ছে একটা আকাশ যান।

ব্লিপটা দেখে সতর্ক যদি হতোও ওরা, মেজর ডিলিঞ্জারের এয়ার অ্যাসল্ট টিমের অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছুই জানতে পারত না শত্রুপক্ষ। স্পেশাল অপারেশন ফোর্সের সদস্যরা বিশেষ ধরনের চোরাগুপ্তা প্যারাসুট ব্যবহার করছে, রাডারে তা ধরা পড়বে না। এরই মধ্যে খুলে গিয়ে গ্লেসিয়ারে দিকে ভেসে যাচ্ছে সেগুলো।

.

৫৪.

টিল্ট-রোটর অসপ্রে বিমানে বসে আছে পিট। ওঠানামা করে হেলিকপ্টারের মতো, ঘণ্টায় ছয়শো কিলোমিটার গতিতে ওড়ে বাহনটা। খোলো আনা জেগে আছে ও, অবিশ্বাস্য পাতলা প্যাড লাগানো অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি সিটে বসে, কানে ইঞ্জিনের শব্দ নিয়ে শুধু বোধ হয় একটা লাশের পক্ষেই ঘুমানো সম্ভব। শুধু একটা লাশের পক্ষে, তবে অ্যাল জিওর্দিনো বাদে। চুপসে আছে সে, মনুষ্য আকৃতির একটা বেলুন যেন। কয়েক মিনিট পর পর, যেন নির্দেশ দেয়া আছে মগজকে, চোখ না মেলে বা নিঃশ্বাসের ছন্দপতন না ঘটিয়ে পাশ ফিরে শুইছে।

এটা কীভাবে সম্ভব? সবিস্ময়ে জানতে চাইল কেইটন ফিনলে।

 ওর জিনে আছে ব্যাপারটা, জবাব দিল পিট।

 এর চেয়েও ভয়ংকর পরিস্থিতিতে ওকে আমি ঘুমাতে দেখেছি, বলল রুডি।

 কো-পাইলট ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকাল, ঠিক জানেন, উনি জ্ঞান হারাননি?

সবাই ওরা হাসল। তারপর নিস্তব্ধতা নেমে এল অসপ্রের ভেতর, সবারই একটা চিন্তা, বাইরের হিম নরকে বেরোতে না হলে কি ভালোই না হতো। যতটা সম্ভব নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে পিট। খানিকটা তুপ্তিও বোধ করছে ও। অ্যাসল্ট টিমে ওকে নেয়া হয়নি বটে, তবে কর্নেল হোলিস আর ডিলিঞ্জারের কাছাকাছি থাকার সুযোগ আদায় করা গেছে। জিম্মি উদ্ধারে ট্রেনিং পাওয়া প্রফেশনালরা দায়িত্ব পালন করুক। ওদের পিছু পিছু সমস্ত অ্যাকশন পর্যবেক্ষণে যাওয়ার অভিপ্রায় ওর।

বাবার ব্যাপারে তেমন কোনো দুশ্চিন্তা নেই ওর। সিনেটর পিট যে বেঁচে আছেন, এ ব্যাপারে মুহূর্তের জন্য ওর মনে কোনো সংশয় জাগেনি। ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে পারবে না, এমনকি নিজের কাছেও নয়, তবু কথাটা সত্যি-বাপের উপস্থিতি অনুভব করতে পারছে ও। বছরের পর বছর ধরে দু’জনের মধ্যে একটা মানসিক যোগাযোগ রয়েছে, অদৃশ্য বন্ধন বলা যেতে পারে, পরস্পরের মন ভোলা বইয়ের মতো পড়তে পারে ওরা।

ছমিনিটের মধ্যে ল্যান্ডিং পয়েন্টে পৌঁছে যাব, ঘোষণা করল পাইলট।

বরফ ঢাকা চূড়াগুলোর ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে অসপ্রে, তুমুল তুষার বৃষ্টির আড়ালে সেগুলো দেখা যাচ্ছে না, তবু চেহারায় কোনো উদ্বেগ নেই পাইলটের।

আপনি জানছেন কীভাবে আমরা কোথায়? জিজ্ঞেস করল পিট।

অলসভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল পাইলট। সব আমার কবজিতে।

সামনের দিকে ঝুঁকে পাইলটের কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল পিট। কন্ট্রোলে কোনো হাত নেই। হাত দুটো বুকে ভাজ করে রেখেছে পাইলট, ছোট্ট একটা স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে। জিনিসটা ভিডিও গেমের মতো দেখতে। গ্রাফিকস ডিসপ্লের নিচের দিকে অসপ্রের নাকটা শুধু দেখা যাচ্ছে। সচল ছবিতে রয়েছে পাহাড়, উপত্যকা-অসপ্রের নিচ দিয়ে পেছন দিকে ছুটে যাচ্ছে সেগুলো। স্ক্রিনের ওপর দিকে, এক কোণে, দূরত্ব আর উচ্চতা লাল ডিজিটাল সংখ্যায় দেখা যাচ্ছে।

সমস্ত কিছুর বিকল্প হয়ে উঠছে কম্পিউটর, মন্তব্য করল পিট।

ভাগ্য ভালো, যে এখনও ওরা এমন কোনো কম্পিউটর বানাতে পারেনি যেটা যৌবনের চাহিদা মেটাতে পারে, বলে হো হো করে হেসে উঠল রুডি।

কীভাবে কাজ করে, বলবেন? পাইলটকে জিজ্ঞেস করল পিট।

ইনফ্রারেড আর রাডার স্ক্যানারে নিচের গ্রাউন্ড স্টাডি করে, ত্রিমাত্রিক ডিসপ্লেতে স্টাডির রেজাল্ট রূপান্তর করে পাঠায় কম্পিউটর।

মাথা ঝাঁকাল পিট।

ছোট্ট এই ইলেকট্রনিক গাইড যদি না থাকতো, বলে চলল পাইলট, পান্টা অ্যারেনাসে এখনও বসে থাকতাম আমরা দিনের আলো আর ভালো আবহাওয়ার অপেক্ষায়। অদ্ভুত একটা শব্দ বেরিয়ে এল ডিসপ্লে স্ক্রিন থেকে, আড়ষ্ট হলো পাইলট। সামনে আমাদের ল্যান্ড করার নির্ধারিত জায়গা। নামার জন্য আপনার লোকদের প্রস্তুতি নিতে বলুন।

আপনাকে ঠিক কী নির্দেশ দিয়েছেন, কর্নেল হোলিস?

পাহাড় চূড়ার পেছনে মাইনের ওপর দিকে কোথাও আপনাদের নামিয়ে দিতে হবে, জাহাজের রাডারে যাতে অসপ্রে ধরা না পড়ে। বাকি পথ আপনাদেরকে হেঁটে পেরুতে হবে।

ফিনলের দিকে ফিরল পিট। তোমার দিক থেকে কোনো সমস্যা?

হাসল ফিনলে। পাহাড়টা আমার স্ত্রীর পশ্চাৎদেশের মতোই চেনা-ঢাল, খাদ, চড়াই, উতরাই ইত্যাদিসহ। খনির প্রবেশমুখ থেকে চূড়াটা তিন কিলোমিটার দূরে। ঢাল বেয়ে সহজেই নামা যায়। চোখ বুজে নামতে পারব।

আবহাওয়ার যা অবস্থা, ম্লান সুরে বলল পিট, ধরে নাও, ঠিক তাই তোমাকে করতে হবে।

.

অসপ্রে ইঞ্জিনের গর্জন থামল, শুরু হলো তীব্রগতি বাতাসের একটানা আহাজারি। কার্গো হ্যাঁচ গলে বাইরে বেরিয়ে এসে শীতে ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগল নুমার সদস্যরা। নষ্ট করার সময় নেই, কোনো কথা হলো না, শুধু হাত নেড়ে বিদায় জানাল ওরা পাইলটদের। এক মিনিটের মধ্যে বাতাসের গায়ে হেলান দিয়ে রওনা হয়ে গেল চারজন লোক, সাথে দুটো ব্যাগ। পাথুরে ঢাল বেয়ে চূড়ার দিকে উঠে যাচ্ছে দলটা।

নিঃশব্দে সবার সামনে চলে গেল ফিনলে। আকাশে থাকতে যেমন দেখেছে ওরা, নিচে নামার পরও তাই দেখছে, তুষার বৃষ্টিতে খুব বেশি দূর দৃষ্টি চলে। ফিনলের হাতের টর্চটা প্রায় কোনো কাজেই আসছে না। টর্চের আলোয় বৃষ্টির ফোঁটা চেনা যায়, এক কি দুমিটার সামনের এবড়োখেবড়ো পাথুরে জমি দেখা যায় কি যায় না।

 একটা অ্যাসল্ট টিমের সাথে ওদের কোনো মিল নেই। দৃশ্যত কোনো অস্ত্র নেই। ঠাণ্ডা থেকে বাঁচার জন্য চারজনের কাপড় চার রকম। পিট পরেছে ধূসর স্কি টগসটা গাঢ় নীল। রুডি পরেছে কমলা রঙের সারভাইভাল স্যুট, মাপ দুই সাইজ বড়। ফিনলের পরনে গলা-ঢাকা ওভারকোট, মাথায় কান-ঢাকা ক্যাপ। শুধু একটা জিনিস চারজনই ব্যবহার করছে, হলুদ লেন্স লাগানো স্কি গগলস।

বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় বিশ কিলোমিটার। ভিজে পিচ্ছিল হয়ে আছে পাথর। পা হড়কে পিছলে গেল ওরা, আছাড় খেল। তবে কারো কোনো অভিযোগ নেই। না চাইলে কেউ কাউকে সাহায্যও করছে না।

মাঝেমধ্যে গগলস থেকে তুষার পরিষ্কার করতে হলো। খানিক পর সামনে থেকে ওরা দেখতে পেল ঠিক যেন তুষার মানব, অথচ পেছন দিকটা রীতিমতো শুকনো।

 হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল ফিনলে। টর্চের আলো ফেলে বরফ-মুক্ত বোল্ডারগুলো পরীক্ষা করল সে। বাতাসের গতি বেড়ে গেছে অনুভব করে বুঝতে পারল, চূড়ার কাছাকাছি উঠে এসেছে ওরা। আর বেশি দেরি নেই, বাতাসের গর্জনকে ছাপিয়ে উঠল তার গলা। এরপর শুধুই ঢাল বেয়ে নেমে যাওয়া।

 দুর্ভাগ্য এখানে কোনো স্নেজগাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় না। ঘোৎ ঘোঁৎ করে উঠল জিওর্দিনো।

 দস্তানা সরিয়ে ঢোকা ড্রাইভ ওয়াচের ডায়ালে চোখ রাখল পিট। হামলার সময় নির্ধারিত হয়েছে সকাল পাঁচটা। আর আটাশ মিনিট পর। নাহ্, ওরা অনেক দেরি করে ফেলছে। চলো, তাড়াতাড়ি নামি। অনুষ্ঠানটা মিস করতে চাই না।

পনেরো মিনিট দ্রুত নামল ওরা। পাহাড়ের পা ক্রমশ চালু হয়ে নেমে গেছে। আঁকাবাঁকা একটা পথ খুঁজে পেল ফিনলে, খনির দিকে চলে গেছে। আরও নিচে নামার পর কুৎসিকদর্শন ঝোঁপের সংখ্যা কমে এল, পাথরগুলো এদিকে আগের চেয়ে ছোট, আলগা। পাথুরে মাটিতে কাঁকর বেশি, পিছলে যাওয়ার আশঙ্কা কম। ভাগ্য ভালোই বলতে হবে, বাতাসের গতিবেগ কমে এল, ধরে এল তুষার বৃষ্টি। মেঘের নিরেট পর্দায় ফাঁক-ফোকর দেখা দিল, উঁকি দিল দুচারটে করে তারা। চোখে গগলস না থাকলেও সামনেটা এখন ওরা দেখতে পাচ্ছে।

অন্ধকারের ভেতর উঁচু হয়ে থাকা আকরিক আবর্জনার একটা সুপ চিনতে পেরে আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল ফিনলের। পটাকে ঘুরে ছোট, ন্যারোগেজ রেলরোড-এর পাশে পৌঁছুল দলটা, অন্ধকারের ভেতর অনুসরণ করল সেটাকে।

 ঘাড় ফিরিয়ে আমরা পৌঁছে গেছি বলতে যাবে ফিনলে, কিন্তু বাধা দেয়া হলো তাকে। হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে, ঝট করে হাত বাড়িয়ে ফিনলের ওভারকোট খামচে ধরে হ্যাঁচকা টান দিল পিট, অপর হাত দিয়ে চেপে ধরল তার মুখ।

চুপ! চাপা গলায় বলল পিট, ফিনলের মুখ থেকে হাত সরিয়ে টর্চটা ছে দিয়ে কেড়ে নিয়ে বন্ধ করল।

কী… শুরু করল ফিনলে।

 চোপ! ফিসফিস করল পিট।

নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল রুডি, কিছু শুনেছ?

 না, পরিচিতি একটা গন্ধ।

পরিচিত গন্ধ?

বাচ্চা-ভেড়ার একটা পা, বলল পিট। আগুনে ঝলসানো হচ্ছে।

 পেছন দিকে মাথা কাত করে নাকে বাতাস টানল ওরা।

ঈশ্বর, তুমি ঠিক ধরেছ, বিড়বিড় করল জিওর্দিনো। গন্ধটা আমিও পাচ্ছি।

ফিনলেকে এতক্ষণে ছেড়ে দিল পিট। কী হে ফিনলে, তোমার আগেই দেখছি। আরেকজন এসে দখল করে নিয়েছে খনিটা।

নিশ্চয়ই একদল গাধা। যদি ভেবে থাকে খনি থেকে দস্তা তুলতে পারবে…

একবারও ভাবছ না, ওরা দস্তা তুলতে না-ও এসে থাকতে পারে?

একপাশে সরে গেল রুডি। তুমি টর্চ নেভানোর আগে এদিকে কোথাও আমি কী যেন একটা চকচক করতে দেখেছি। ছোট একটা বৃত্ত রচনা করে ঘুরতে শুরু করল সে। বুটে লেগে কী যেন একটা গড়িয়ে গেল। সেটা তুলে আলোয় সামনে ধরল সে। একটা স্কচ হুইস্কির খালি বোতল।

 অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে এখানে, বলতেই হবে, বিস্ময় প্রকাশ করল ফিনলে। মাইনাররা এত দামি মদ খায়, আমার জানা ছিল না।

রুডি বলল, হুইস্কি আর ভেড়ার পা, ধরে নেয়া চলে লেডি ফ্ল্যামবোরো থেকে এসেছে।

গ্লেসিয়ার যেখানে খাড়ির সাথে মিশেছে, সেখান থেকে কতটা দূরে আমরা? জানতে চাইল পিট।

গ্লেসিয়ার উত্তর দিকে মাত্র পাঁচশো মিটার গেছে। খাড়ির দিকে মুখ করা পাঁচিলটা পশ্চিম দিকে দুকিলোমিটারের কম।

 ওর কীভাবে সরানো হয়?

হাত তুলে খড়ির দিকটা দেখাল ফিনলে। ন্যারোগেজ রেলরোড রয়েছে না! খনির প্রবেশ মুখ থেকে ওর-ক্রাশার পর্যন্ত লম্বা লাইনটা, তারপর গেছে ডক পর্যন্ত, ওখানে জাহাজে ভোলা হয় ওর।

কিন্তু তুমি কোনো ডকের কথা আগে বলেনি।

কেউ জিজ্ঞেস করলে তো বলব, কাঁধ ঝাঁকাল ফিনলে। ছোট একটা লোডিং জেটি।

জাহাজ থেকে আনুমানিক দূরত্ব?

 হাতে জোর থাকলে, ডক থেকে একটা বল ছুঁড়ে জাহাজের খোলে লাগানো যায়।

দেখতে পাওয়া উচিত ছিল, তিক্ত কণ্ঠে বিড়বিড় করল পিট। কেউ আমরা দেখতে পাইনি।

কী বলছেন বুঝতে পারছি না! ফিনলে অবাক।

 সন্ত্রাসবাদীদের সাপোর্ট দল, বলল পিট। জাহাজে যারা আছে, পালানোর জন্য ওদের একটা অ্যাডভান্সড বেস দরকার। সাবমেরিনের ব্যবস্থা না থাকলে সাগরে নেমে ধরা পড়ার ঝুঁকি ওরা নেবে কেন? আর সাবমেরিন জোগাড় করতে হলে বৈধ সরকারি সহযোগিতা লাগবে।

তাহলে সাপোর্ট দল, না অ্যাডভান্স বেস…, জিওর্দিনো শুরু করল।

পরিত্যক্ত খনিটা হেলিকপ্টার লুকিয়ে রাখার জন্য আদর্শ জায়গা হতে পারে না? তাকে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করল পিট। খাড়ি থেকে আসা-যাওয়া করার জন্য এই রেইলরোডটাও ওরা ব্যবহার করতে পারবে।

কর্নেল হোলিস, দ্রুত, চাপা সুরে বলল জিওর্দিনো। তাকে ব্যাপারটা জানানো দরকার।

সম্ভব নয়, বলল রুডি। আমাদের প্রতিবেশী কর্নেল যোগাযোগ রাখার জন্য একটা রেডিও দিয়ে যেতে ভুলে গেছেন।

তাহলে কীভাবে তাকে জানানো যায়?

উপায় নেই, শ্রাগ করল পিট। তবে, আতঙ্কবাদীদের হেলিকপ্টারগুলো অকেজো করে দিতে পারি আমরা। পারি খনিতে যারা আছে তাদের কোণঠাসা করে রাখতে।

সংখ্যায় ওরা পঞ্চাশজনও হতে পারে, প্রতিবাদ করল ফিনলে। আমরা মাত্র চারজন।

রুডি বলল, ওরা সতর্ক অবস্থায় নেই। নিশ্চয়ই ঝড়ের মধ্যে নির্জন একটা দ্বীপে ওদের ওপর হামলা চালানো হবে বলে আশঙ্কা করছে না।

রুডি ঠিক বলেছে, সায় দিল জিওর্দিনো। ওরা সতর্ক থাকলে এতক্ষণে আমাদের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ত। চলো, আমরাই ওদের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ি।

বিস্ময়ের ধাক্কা জিনিসটা আমারও খুব প্রিয়, বলল পিট। অন্ধকার আমাদেরকে সাহায্য করবে।

ওরা যদি টের পেয়ে যায়, ধাওয়া করে, আমরা কি পাথর ছুঁড়ব? জিজ্ঞেস করল ফিনলে।

আমি বয় স্কাউটদের আদর্শে বিশ্বাসী, মুচকি হেসে বলল পিট।

পিটের সাথে একযোগে জিওর্দিনোও ঝুঁকে পড়ল, খুলে ফেলল ব্যাগ দুটো। জিওর্দিনো সবাইকে একটা করে বুলেটপ্রুফ ভেস্ট বিলি করল, আর পিট বিলি করল আগ্নেয়াস্ত্র। ফিনলের দিতে বাড়িয়ে ধরল একটা সেমি অটোমেটিক শটগান। বলল, বলছে, মাঝেমধ্যে শিকারে গেছ, তাই না? ধার করা জিনিস, তোমাকেও ধার দিলাম-টুয়েলভ-বোর বেনেলি সুপার নাইনটি।

চকচক করে উঠল ফিনলের চোখ। পছন্দ হয়েছে। স্টকের ওপর এমন আলতোভাবে হাত বুলালো সে, ওটা যেন কোনো কুমারীর গাল। এই সময় সে লক্ষ্য করল, রুডি আর হাতে একটা করে হেকলার কোচ মেশিন গান রয়েছে, সাইলেন্সারসহ। এসব তো মোড়ের কোনো মনিহারি দোকানে কিনতে পাওয়া যায় না।

স্পেশাল অপারেশনস ফোর্স-এর সম্পত্তি, বলল জিওর্দিনো৷ ধার করা হয়েছে, মরটন হোলিস আর জন ডিলিঞ্জার যখন অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল।

আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল ফিনলের জন্য, পিটকে একটা থম্পসন সাবমেশিন গানে গোল ড্রাম ঢোকাতে দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল তার।

 হাতঘড়ি দেখল পিট। মাত্র ছমিনিট পর জাহাজে হামলা চালাবে হোলিস আর ডিলিঞ্জার। আমি না বলা পর্যন্ত কোনো গোলাগুলি নয়। আমরা চাই না স্পেশাল ফোর্সের হামলাটা কেঁচে যাক। আতঙ্কবাদীদের ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে দিতে পারলে ওরাই জিম্মিদের উদ্ধার করতে পারবে।

কিন্তু গ্লেসিয়ারের ব্যাপারটা? জিজ্ঞেস করল ফিনলে। আমরা গুলি ছুড়লে শক ওয়েভ বরফের সামনের পাঁচিলে ফাটল তৈরি করবে না?

এই রেঞ্জ থেকে করবে না, তাকে আশ্বস্ত করল রুডি। সবাই আমরা একসাথে গুলি করলেও দূর থেকে মনে হবে আত্তসবাজি পোড়ানো হচ্ছে।

মনে রেখো, বলল পিট। বন্দুকযুদ্ধ যতক্ষণ পারা যায় এড়িয়ে থাকতে চাই। আমরা। আমাদের প্রথম কাজ হেলিকপ্টারগুলোকে খুঁজে বের করা।

সাথে কিছু বিস্ফোরক থাকলে ভালো হতো, খেদ প্রকাশ করল জিওর্দিনো।

 চাইলেই কি সব পাওয়া যায়?

আশপাশই ভালো করে চিনে নেয়ার জন্য ফিনলেকে কয়েক সেকেন্ড সময় দিল পিট। তারপর মাথা ঝাঁকাল জিওলজিস্ট, ওদেরকে নিয়ে রওনা হয়ে গেল। পুরনো, পড়ো পড়ো ভবনগুলোর পেছন দিয়ে এগোল ওরা, ছায়ার ভেতর থাকল, পা ফেলছে যতটা সম্ভব নিঃশব্দে।

খনির চারপাশে ভবনগুলো বেশির ভাগই কাঠের মোটা পিলারের ওপর তৈরি করা হয়েছে, মাথার করোগেটেড টিনে মরচে ধরে গেছে। কোনোটা ঘোট দোচালা, কোনোটা তিন বা চারতলা উঁচু, দেয়ালগুলো অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। মাংস ঝলসানোর গন্ধ বাদ দিলে, পরিত্যক্ত ওয়েস্টার্ন শহরের মতো জায়গাটা।

হঠাৎ করে লম্বা একটা শেডের পেছনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ফিনলে, একটা হাত তুলল, বাকি তিনজন তার কাছাকাছি আসার অপেক্ষায় থাকল। কোণ থেকে উঁকি দিয়ে একবার তাকাল সে, তারপর আরেকবার, সবশেষে ফিরল পিটের দিকে। আমার ডান দিকে, কাছেই রিক্রিয়েশন আর ডাইনিং হল ভবন, ফিসফিস করে বলল সে। ভারী পর্দার ভেতর থেকে আলোর ফালি বেরিয়ে আসছে, দেখতে পাচ্ছি আমি।

নাক টেনে বাতাসের গন্ধ নিল জিওর্দিনো। পা-টা ওরা খুব ভালোভাবে ঝলসাচ্ছে।

গার্ডদের দেখতে পাচ্ছ? জিজ্ঞেস করল পিট।

না, কেউ কোথাও নেই।

হেলিকপ্টারগুলো কোথায় লুকাতে পারে?

মেইন মাইন হলো খাড়া একটা শ্যাফট, সিক্স লেভেল পর্যন্ত নেমে গেছে। কাজেই পার্কিং গ্যারেজ হিসেবে ওটা কোনো কাজে লাগবে না।

তাহলে কোথায়?

ভোর-রাতের অন্ধকারে একটা হাত তুলল ফিনলে। সবচেয়ে বড় খোলা জায়গা ওর-ক্রাশিং মিল। হেভি ইকুইপমেন্ট রাখার জন্য ওখানে একটা স্লাইডিং দরজাও আছে। কপ্টারের বোটর ব্লেড যদি ভাঁজ করা যায়, ভেতরে অন্তত তিনটে ঢোকানো সম্ভব।

চলো তাহলে দেখানেই আগে দেখি, বলল পিট।

নষ্ট করার মতো সময় নেই। এখন থেকে যেকোনো মুহূর্তে অ্যাসল্ট দল হামলা শুরু করবে। ডাইনিং হল পেরিয়ে সামান্য একটু এগিয়েছে ওরা, অকস্মাৎ দড়াম করে একটা দরজা খুলে গেল, বৃষ্টির ভেতর দিয়ে ছুটে এল উজ্জ্বল আলোর একটা লম্বা কালি, হাঁটুর নিচে থেকে ওদের পাগুলো আলোকিত করল। স্থির মূর্তি হয়ে গেল চারজনই, অস্ত্রগুলো ফায়ারিং পজিশনে চলে এসেছে।

 ভেতরের আলোয় একটা মূর্তিকে দেখা গেল কয়েক সেকেন্ডের জন্য। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে একটা প্লেট থেকে অভুক্ত খাবার ছুঁড়ে বাইরে ফেলল সে। পিছিয়ে বন্ধ করল দরজা। আরও দুসেকেন্ড পর সিধে হয়ে ক্রাশিং মিলের দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল ওরা।

ঘাড় ফিরিয়ে ফিনলের কানে ঠোঁট ঠেকাল পিট। ভেতরে ঢুকব কীভাবে?

কনভেয়র বেল্ট আছে, ভবন থেকে ক্রাশারে আসে ওর, ক্রাশার থেকে পাঠানো হয় ট্রেনে। সমস্যা হলো, সবই আমাদের মাথার অনেকটা ওপরে।

নিচের দরজা?

ইকুইপমেন্ট-স্টোরেজ-এর দরজাটা বড়, বলল ফিনলে, তার গলাও পিটের মতো নিচু। আর আছে সদর দরজা। যতদূর মনে পড়ে, একটা সিঁড়িও আছে পাশের অফিসে যাবার জন্য….

সন্দেহ নেই তালা মারা, বলল জিওর্দিনো।

সামনের দরজা, বলল পিট। ভেতরে যারা আছে তারা সম্পূর্ণ অচেনা কাউকে আশা করছে না। শান্ত, স্বাভাবিকভাবে যাব আমরা, যেন দলেরই লোক। তিনজন বন্ধু ডাইনিং হল থেকে বেরিয়ে আসব।

বিড়বিড় করে অ্যাল বলল, আমি একশো ডলার বাজি রাখতে পারি, কাঁচ ক্যাচ করবে দরজা।

ক্রাশিং মিলের একটা কোণ ধীর পায়ে ঘুরল ওরা, কোনো বাধা না পেয়ে ভেতরে ঢুকল উঁচু একটা দরজা দিয়ে, কজাগুলো কোনো প্রতিবাদ করল না।

দরজা আওয়াজ না করুক, নির্ঘাত মাথার ওপর ছাদ ভেঙে পড়বে। দুসারি দাঁতের ফাঁক দিয়ে হিসহিস করে উঠল জিওর্দিনো।

বিল্ডিংয়ের ভেতরটা বিশাল। হওয়ারই কথা। দানবাকৃতি একটা অক্টোপাসের মতো মাঝখানে রয়েছে মেকানিকাল মেশিনটা, সাথে কনভেয়র বেল্ট, ওয়াটার হোস আর ইলেকট্রিকাল ওয়্যারিংগুলো যেন গুড়। ওর-ক্রাশারে রয়েছে বিভিন্ন মাপের ইস্পাতের বলসহ লম্বা সিলিন্ডার।

একদিকের দেয়াল বরাবর বসানো রয়েছে প্রকাণ্ড আকারের ট্যাংকগুলো। মাথার ওপরে ক্যাটওয়াক, ইস্পাতের মই বেয়ে উঠতে হয়। ক্যাটওয়াক রেইলিং থেকে কর্ডের ডগায় ঝুলছে আলোর মালা, বিদ্যুৎ সরবরাহ হয় পোর্টেবল জেনারেটর থেকে, সেটার এগজস্ট এককোণে বেরিয়ে আছে।

 আন্দাজ করতে ভুল হয়েছে পিটের। দুটো, এমনকি তিনটে হেলিকপ্টার থাকবে বলে আশা করেছিল ও। রয়েছে মাত্র একটা-বড়সড় ব্রিটিশ ওয়েস্টল্যান্ড কমান্ডো, পুরনো হলেও বিশ্বস্ত বাহন, সাধারণত টুপস ট্রান্সপোর্টের কাজেই ব্যবহার করা হয়। ত্রিশজন বা আরও বেশি লোকের জায়গা হবে ভেতরে। উঁচু মেকানিক স্ট্যান্ডে কমব্যাট ফেটিগ পরা দু’জন তোক দাঁড়িয়ে রয়েছে, ইঞ্জিনের পাশে অ্যাকসেস প্যানেলের ভেতর দিয়ে কী যেন দেখছে তারা। নিজেদের কাজে এতই মগ্ন, ভোর রাতের আগন্তুকদের দিকে তাকালই না।

ধীরে ধীরে, সতর্কতার সাথে, খোলা ক্রাশিং রুমের ভেতর ঢুকল পিট। ওর ডানদিকে ফিনলে, বাঁ দিকটা কাভার দিচ্ছে জিওর্দিনো, পেছনে রয়েছে রুডি। হেলিকপ্টারের ক্রু দু’জন এখনও ঘাড় ফিরিয়ে ওদের দিকে তাকাচ্ছে না। তৃতীয় লোকটাকে হঠাৎ করে দেখতে পেল ওরা, চমকে উঠল যেন ভূত দেখেছে। দরজার দিকে পেছন ফিরে, ওল্টানো একটা বাক্সের ওপর বসে আছে সে, একটা সাপোর্ট বিম এর পেছনে।

ইঙ্গিতে নির্দেশ দিল পিট। ফিনলে আর জিওর্দিনোকে ছায়ার ভেতর দিয়ে হেলিকপ্টার ঘুরে উল্টোদিকে যেতে হবে, ওদিকে আর কোনো আছে কি না দেখার জন্য। ওরা অদৃশ্য হয়ে যেতেই ঘাড় ফিরিয়ে পিটের দিকে তাকাল গার্ড, খোলা দরজা দিয়ে আসা ঠাণ্ডা বাতাস সতর্ক করে দিয়েছে তাকে।

তাড়াহুড়ো করল না পিট, ইতিস্ততও করল না। শান্তভাবে এগোল গার্ডের দিকে। লোকটা কালো কমব্যট ফেটিগ পরে আছে, মাথায় স্কি মাস্ক। দুমিটার দূরে তাকতে মৃদু হাসল পিট, হাতটা সামান্য একটু তুলে নাড়ল।

নিস্পলক তাকিয়ে থেকে আরবিতে কি যেন বলল লোকটা।

হাসিটা আরও বড় হলো পিটের মুখে, কাঁধ ঝাঁকালো। বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল, জেনারেটরের আওয়াজে শুনতে পাওয়া গেল না।

হঠাৎ করেই ওর হাতের থম্পসন মেশিন গানের ওপর চোখ পড়ল গার্ডের। বিস্ময় কাটিয়ে উঠে হাতের আগ্নেয়াস্ত্র পিটের দিকে তাক করতে দুসেকেন্ড দেরি করে ফেলল সে, দিতে হলো কঠিন মূল্য। থম্পসনের বাটটা সবেগে তার মাথায় নামিয়ে আনল পিট।

 সাপোর্ট বিমের আড়ালে কাত হয়ে পড়ে গেল গার্ড, তার হাতের অস্ত্রটা মেঝেতে খসে পড়ার আগেই ধরে ফেলল পিট। অজ্ঞান দেহটাকে আগের ভঙ্গিতে বসাল সে, দেখে মনে হবে ঝিমুচ্ছে। হেলিকপ্টারের ফরওয়ার্ড ফিউজিলাজের তলা দিয়ে এগোল ও। মেকানিক দু’জন ইঞ্জিনে কাজ করছে এখনও। মইটা ধরে হ্যাঁচকা টান দিল ও, মইয়ের মাথায় স্ট্যান্ডে দাঁড়ানো লোক দু’জন শূন্যে ছিটকে পড়ল, এতই চমকে গেছে যে, চিৎকার করতে ভুলে গেল। কঠিন মেঝেতে বস্তার মতো পড়ল তারা, একজন মাথায় আঘাত পেয়ে সাথে সাথে জ্ঞান হারাল, আরেকজন কাত হয়ে পড়ায় তার একটা হাত ভেঙে গেল। ব্যথায় গুঙিয়ে উঠল লোকটা, খুলিতে থম্পসনের বাড়ি খেয়ে থামল।

 চমৎকার রিফ্লেক্স, নিস্তব্ধতা ভাঙল ফিনলে। প্রতিটি নড়াচড়ার ছবি বাঁধাই করে রাখার মতো।

ক্যামেরা আনিনি, সেজন্য তুমি আমাদেরকে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করাতে পারো, বলে হাসল রুডি।

সবগুলোকে অচল করা গেছে, ঠিক? দ্রুত জিজ্ঞেস করল পিট।

আরে না। হেলিকপ্টারের পেছনে চলুন, দেখতে পাবেন।

সাবধানে হেলিকপ্টারের তলা দিয়ে এগোল ফিনলে, তাকে অনুসরণ করল পিট। পেছন দিকে এসে হেসে ফেলল ও। একটা ফোল্ডিং চেয়ারে বসে রয়েছে জিওর্দিনো, তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে চারজন বন্দি, প্রত্যেকের মাথায় একটা করে স্লীপিং ব্যাগ গলানো।

নিখুঁত প্যাকেট তৈরিতে তোমার জুড়ি মেলা ভার, প্রশংসা করল পিট।

বন্দিদের ওপর চোখ রেখে জিওর্দিনো বলল, আর তোমার স্বভাব হলো, শব্দ করা। এত কিসের আওয়াজ, শুনি?

মেইন্টেন্যান্স স্ট্যান্ড থেকে দু’জন মেকানিক পড়ে গেছে, আমার কী দোষ!

সব মিলিয়ে কজনের উপকার করলাম আমরা? জানতে চাইল জিওর্দিনো।

সাতজনের।

 চারজন নিশ্চয়ই ফ্লাইট ক্রুদের অংশবিশেষ।

মেকানিকদের একজনের দিকে ইঙ্গিত করল ফিনলে। একটার জ্ঞান ফিরছে।

থম্পসনটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিল পিট। ফিনলে, মুখে কাপড় খুঁজে হাত-পা বাঁধো ওদের। কপ্টারের ভেতর কাপড় পাবে। জিওর্দিনো, সব কটার ওপর নজর রাখো। রুডিকে নিয়ে বাইরেটা দেখে আসি আমি।

নো প্রবলেম! আশ্বস্ত করল জিওর্দিনো।

সাবধান, সুযোগ পেলেই ওরা তোমাকে খুন করবে।

দু’জন বন্দির কাপড় খুলে নিয়ে পরল ওরা। পিট পড়ল গার্ডের কালো ফেটিগ আর স্কি মাস্ক। দরজার দিকে হেঁটে গেল ওরা, গা ঢাকা দেয়ার কোনো চেষ্টা করল না। রাস্ত রি মাঝখান দিয়ে দৃঢ় পায়ে এগোল, দুপাশের ভবনগুলোর ওপর চোখ বুলালো। ডাইনিং হলের কাছে এসে ছায়ার ভেতর আশ্রয় নিল ওরা, উঁকি দিয়ে একটা জানালার ভেতর তাকাল।

 পর্দার ফাঁক দিয়ে রুডিও তাকাল, সব মিলিয়ে বারোজনের মতো মনে হচ্ছে। সবাই সশস্ত্র। যেন চলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে না?

 কর্নেলের নিকুচি করি, ফিসফিস করে বলল পিট। একটা রেডিও দিয়ে গেলে….

এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।

 দেরি হয়ে গেছে মানে?

সময়ের হিসাব রাখছ না? পাঁচটা। সময়মতো হামলা হয়ে থাকলে, কর্নেলের সাপোর্ট ফোর্স আর মেডিকের দল এই মুহূর্তে জাহাজের পথে আকাশে থাকার কথা।

ঠিক ধরেছে রুডি। স্পেশাল ফোর্সের হেলিকপ্টার আকাশে উঠলে আওয়াজ পেত ওরা।

চলো ওর ট্রেনটা খুঁজি, বলল পিট। ওটাকে অচল করে দিতে হবে। খনি আর জাহাজের মাঝখানে কিছুই যেন চলাচল করতে না পারে।

ডাইনিং হলের দেয়াল বরাবর নিঃশব্দে এগোল ওরা। প্রতিটি জানালার সামনে নিচু হলো, বাঁক ঘোরার আগে উঁকি দিয়ে দেখে নিল সামনেটা। ছায়া থেকে খোলা জায়গায় বেরিয়ে এল স্বাভাবিকভাবে, যেন কোনো কাজে যাচ্ছে। রেইলরোডে পৌঁছুল ওরা, লাইন ধরে ছুটল। বৃষ্টি আর বাতাস থেমেছে, পূর্ব আকাশের তারাগুলো ম্লান হতে শুরু করেছে এরই মধ্যে। থম্পসনটাকে দুহাতে শক্ত করে বুকের কাছে ধরে ছুটছে পিট, অশুভ আশঙ্কায় কুঁকড়ে আছে মন।

নিশ্চয়ই খুব খারাপ কিছু একটা ঘটেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *