৩০. দ্য লেডি ফ্ল্যামবোরো

তৃতীয় পর্ব দ্য লেডি ফ্ল্যামবোরো

১৯ অক্টোবর, ১৯৯১ উক্সমাল, ইউকাটান

৩০.

চারদিকে বহুবর্ণ ফ্লাডলাইটের ছড়াছড়ি। অতিকায় কাঠামোর প্রতিটি পাথর শিল্পকর্ম, সেগুলোয় প্রতিফলিত হয়ে উজ্জ্বল আলো অতিপ্রাকৃত একটা আভা বিকিরণ করছে। প্রকাণ্ড পিরামিডের দেয়ালগুলো নীল করা হয়েছে, পিরামিডের মাথার ওপর জাদুকরের মন্দির গোলাপি আভায় উদ্ভাসিত। লাল স্পটলাইট দ্রুত ওঠানামা করছে সিঁড়ি বেয়ে, প্রতিবার রক্ত ঢেলে দেয়ার একটা ছবি ফুটে উঠছে ধাপগুলোর ওপর। উপরে, মন্দিরের ছাদে, সাদা কাপড়ে মোড়া একটা মূর্তি।

 নিজের দুদিকে হাত দুটো মেলে দিল টপিটজিন, মুঠো খুলল- তার এই ভঙ্গি পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে অনেক আগেই। সামনের দিকে সামান্য একটু ঝুঁকে নিচে তাকাল সে।

ইউকাটান পেনিনসুলায় প্রাচীন মায়ান শহর উক্সমাল, মন্দির আর পিরামিডের চারদিকে গিজগিজ করছে মানুষ, হাজার হাজার ভক্ত মুখ তুলে তাকিয়ে আছে তার দিকে। টপিটজিন তার ভাষণ শেষ করল প্রতিবারের মতোই কীর্তন গাওয়ার সুরে আযটেক গান গেয়ে। সুরটা ধরতে পারল বিশাল জনতা, একযোগে গেয়ে উঠল তারাও।

 এই জাতির শক্তি, সাহস আর সাফল্য নিহিত রয়েছে আমাদের মধ্যে, আমরা যারা কখনোই অভিজাত বা ধনী হব না। আমরা অভুক্ত থাকি, মেহনত করি সেই সব নেতাদের জন্য যারা আমাদের চেয়ে কোনো অর্থেই বড় বা সৎ নয়। অবৈধ সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত কোনো রকম মহত্ত্ব বা গৌরবের অস্তিত্ব মেক্সিকোয় থাকবে না। আর নয় দাসত্ব। আর নয় মুখ বুজে শোষণ আর অত্যাচার সহ্য করা। ভদ্রবেশী অভিজাত আর ধনীদের শায়েস্তা করার জন্য, তাদের দুর্নীতি থেকে জাতিকে চিরকালের জন্য উদ্ধার করার জন্য, আবার একজোট হয়েছেন দেবতারা। তারা আমাদের জন্য নতুন এক সভ্যতা উপহার হিসেবে নিয়ে এসেছেন। সেটা আমাদেরকে গ্রহণ করতে হবে।

ভাষণ শেষ হবার সাথে সাথে বহুরঙা আলো ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে এল, শুধু উজ্জ্বল সাদা আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে থাকল একা টপিটজিন। তারপর অকস্মাৎ সাদা স্পটলাইটও নিভে গেল, সেই সাথে অদৃশ্য হলো মূর্তিটা।

 খোলা প্রান্তরে বহূৎসব জ্বলে উঠল ট্রাক বহর থেকে হাজার হাজার কৃতজ্ঞ ভক্তদের মধ্যে বিলি করা হলো বক্স ভর্তি খাবার। প্রতিটি বাক্সে নরম, সুস্বাদু রুটি আর মাংস আছে, আর আছে একটা করে পুস্তিকা। পুস্তিকাটা কার্টুন পত্রিকার মতো, প্রচুর ছবি, ক্যাপশন কম। ছবিতে দেখানো হয়েছে দৈত্য-দানবের চেহারা নিয়ে মেক্সিকো ছেড়ে পালাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট দো লরেঞ্জো আর তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা, সীমান্তের ওপারে শয়তানরূপী আংকল স্যাম দুবাহু বাড়িয়ে তাদেরকে আলিঙ্গন করার জন্য তৈরি হয়ে আছে। প্রেসিডেন্ট আর তার সঙ্গীদের তাড়া করছে দেবতার চেহারা নিয়ে টপিটজিন, তার সাথে রয়েছে আরও চারজন আযটেক দেবতা।

পুস্তিকায় নির্দেশের একটা তালিকাও স্থান পেয়েছে, বুদ্ধি দেয়া হয়েছে শান্তিপূর্ণ উপায়ে কিন্তু কার্যকরীভাবে সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করার।

 খাবার বাক্স বিলি করার সময় স্বেচ্ছাসেবক যুবক-যুবতীরা টপিটজিনের নতুন শিষ্য সংগ্রহ ও তাদেরকে তালিকাভুক্ত করার দায়িত্বও পালন করল। গোটা ব্যাপারটার আয়োজন করা হয়েছে পেশাদারি দক্ষতার সাথে। মেক্সিকো সিটি দখল করে সরকারকে উৎখাত করার জন্য এক পা এক পা করে এগোচ্ছে টপিটজিন। শুধু উক্সমালে নয়, আরও বহু প্রাচীন আযটেক শহরে ভাষণ দিয়েছে সে। নিজের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে তার প্রতিটি ভাষণ অবিশ্বাস্য অবদান রাখছে। তবে আজ পর্যন্ত আধুনিক কোনো শহরে সমাবেশের আয়োজন করেনি সে।

 সন্ত্রষ্ট জনতা টপিটজিনের নামে জয়ধ্বনি দিতে শুরু করল। কিন্তু তাদের সে জয়ধ্বনি তার কানে গেল না স্পটলাইট নেভার সাথে সাথে দেহরক্ষীরা তাকে নিয়ে পিরামিডের পেছন দিকের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসেছে বড়সড় একটা ট্রাক তথা সেমিট্রেইলর-এর পাশে। তাড়াহুড়ো করে ট্রাকে উঠে পড়ল টপিটজিন। স্টার্ট নিল ইঞ্জিন। ট্রাকের সামনে একটা প্রাইভেট কার থাকল, পেছনে থাকল আরেকটা। জনতার ভিড়ের মাঝখান দিয়ে ধীরগতিতে এগোল গাড়িগুলো, উঠে এল হাইওয়েত, বাঁক নিয়ে রওনা হলো ইয়ুক্যাটান রাজ্যের রাজধানী মারিডার দিকে।

ট্রেইলরের ভেতরে দামি ফার্নিচার; একপাশে কনফারেন্স রুম, পার্টিশনের অপর দিকে টপিটজিনের লিভিং কোয়ার্টার।

ঘনিষ্ঠ ভক্তদের সাথে আগামীকালের শিডিউল নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করল টপিটজিন। বৈঠক শেষ হলো, এই সময় দাঁড়িয়ে পড়ল ট্রাক, শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নিল সবাই। প্রাইভেট কারে উঠে মারিডার একটা হোটেলে চলে গেল তারা।

দরজা বন্ধ করে দিয়ে লিভিং কোয়ার্টার ঢুকল টপিটজিন। মাথা থেকে পালকের মুকুট খুলল সে, খুলল সাদা আলখেল্লা, পরনে থাকল একজোড়া স্ন্যাকস আর একটা স্পোর্টস শার্ট। কেবিনেট থেকে দামি এক বোতল হুইস্কি বের করল। প্রথম দুবার তাড়াতাড়ি গলায় ঢালল তৃষ্ণা নিবারণের জন্য, তারপর আয়েশ করে ছোট ঘোট চুমুক দিল গ্লাসে।

পেশিতে ঢিল পড়ার পর ছোট্ট একটা খুপরিতে ঢুকল টপিটজিন, ভেতরে নানা ধরনের কমিউনিকেশন ইকুইপমেন্ট রয়েছে। একটা হোলোগ্রাফিক টেলিফোনের কোড করা নাম্বারে চাপ দিয়ে ঘুরল সে, খুপরির ঠিক মাঝখানে মুখ করল হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিয়ে অপেক্ষায় আছে। ধীরে ধীরে অস্পষ্ট একটা ত্রিমাত্রিক মূর্তি ফুটে উঠতে শুরু করল। একই ভাবে হাজার মাইল দূরে টপিটজিনকেও দেখা যাচ্ছে।

 একসময় পরিষ্কার হলো ছবিটা। আরেকজন তোক একটা আরাম কেদারায় বসে তাকিয়ে রয়েছে টপিটজিনের দিকে। তার গায়ের রং গাঢ়, ব্যাকব্রাশ করা চুলে চকচক করছে তেল। শক্ত, দামি পাথরের মতো ঝলমলে তার চোখ জোড়া। পাজামার ওপর আলখেল্লা পরেছে সে। টপিটজিনের স্ন্যাকস আর শার্ট প্রু কুঁচকে লক্ষ করল লোকটা, লক্ষ করল হাতে মদের গ্লাসটাও। বিপদের ঝুঁকি নিচ্ছ তুমি। এতটা বেপরোয়া হওয়া কি উচিত? ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল সে, বাচনভঙ্গি আমেরিকান। এরপর মেয়েমানুষের দিকে ঝুঁকবে, কী বলো?

হেসে উঠল টপিটজিন। শোনো ভাই, আমাকে লোভ দেখিয়ে না! বিজাতীয় কাপড়ে চব্বিশ ঘণ্টা নিজেকে ঢেকে রাখা, পোপের মতো আচরণ করা, তার ওপর কৌমার্য অক্ষুণ্ণ রাখা, প্রায় অসম্ভব একটা কাজ।

কেন, একই কাজ তো আমাকেও করতে হচ্ছে।

হ্যাঁ, তা হচ্ছে। কিন্তু আর যে পারি না!

 সাফল্য নাগালের মধ্যে চলে এসেছে, এখন তোমার অসতর্ক হওয়া সাজে না।

হতে চাই না, হচ্ছিও না। আমার প্রাইভেসিতে নাক গলাবে এমন সাহস কারও নেই। যখন একা থাকি, ভক্তরা ধরে নেয় ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ করছি আমি।

দ্বিতীয় লোকটা নিঃশব্দে হাসল। ব্যাপারটার সাথে আমিও পরিচিত।

কাজের কথা শুরু করবে? জিজ্ঞেস করল টপিটজিন।

 ঠিক আছে। বলো কি ব্যবস্থা করেছ?

সংশ্লিষ্ট লোকজন ছাড়া কাকপক্ষীও আয়োজনটার কথা জানে না। নির্দিষ্ট সময়ে সবাই যে যার জায়গায় উপস্থিত থাকবে। সমাবেশের জায়গাটা কোথায় জানার জন্য দশ মিলিয়ন পেসো ঘুস দিয়েছি আমি। বোকার দল তাদের কাজ শেষ করবে, তারপর তাদের বলি দেওয়া হবে। শুধু যে তাদের মুখ বন্ধ করাই উদ্দেশ্য তা নয়, আমাদের নির্দেশ পালনের জন্য যারা অপেক্ষা করছে তাদেরকে সতর্কও করা হবে।

আমার অভিনন্দন গ্রহণ করো। তোমার কাজ অত্যন্ত নিখুঁত।

কৌশল আর বুদ্ধিমত্তা দেখানোর সুযোগ তোমাকে ছেড়ে দিয়েছি আমি।

টপিটজিনের মন্তব্যের পর কয়েকটা মুহূর্তে নিস্তব্ধতার ভেতর কাটল, দু’জনেই যে যার চিন্তায় মগ্ন। অবশেষে নড়ে উঠল দ্বিতীয় লোকটা, গাউনের ভেতর থেকে ব্র্যান্ডির একটা বোতল বের করল, উঁচু করে দেখল টপিটজিনকে। তোমার স্বাস্থ্য।

হেসে উঠে হুইস্কির গ্লাসটা টপিটজিনও উঁচু করল। যৌথ অভিযানের সাফল্য কামনায়।

আমি দেখার অপেক্ষায় আছি, আমাদের মেধা আর পরিশ্রমের ফল ভবিষ্যৎকে কীভাবে বদলে দেয়।

.

৩১.

ডেনভারের অদূরে বাকলি এয়ারফিল্ড থেকে আকাশে উঠে পড়ল চিহ্নবিহীন বিচক্রাফট জেট বিমানটা। ইঞ্জিনের গর্জন কমেছে কিছুটা। তুষার ঢাকা রকি পর্বতমালার চূড়াগুলো পিছিয়ে পড়ল, বিচক্রাফট জেট আকাশের আরও ওপরে উঠে এল।

 প্রেসিডেন্ট শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, আপনি যাতে তাড়াতাড়ি সেরে ওঠেন, ডেইল নিকোলাস বললেন। ঘটনার বর্ণনা শোনার পর ভয়ানক অসন্তুষ্ট হয়েছেন তিনি…

 তিনি উপলব্ধি করেছেন আপনার ওপর দিয়ে কী রকম বিশ্রী একটা ধকল গেছে, মন্তব্য করলেন জুলিয়াস শিলার।

এবং তিনি আমাদের সবার পক্ষ থেকে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন। বলেছেন, আপনার নিরাপত্তার জন্য সম্ভাব্য যেকোনো ব্যবস্থা নিতে তৈরি আছে মার্কিন প্রশাসন।

তাঁকে বললেন, আমি কৃতজ্ঞ, হে’লা কামিল উত্তর দিলেন। আমার তরফ থেকে তাঁর প্রতি একটাই অনুরোধ, আমার প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে যারা মারা পড়েছে তাদের পরিবারকে যেন উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

জুলিয়াস শিলার নিশ্চয়ই দিয়ে বললেন, সে ব্যাপারে অবহেলা করা হবে না।

একটা বিছানায় শুয়ে আছেন হে’লা কামিল, পরনে সাদা সুইট-স্যুট। তার ডান গোড়ালি প্লাস্টার করা হয়েছে। এক এক করে জুলিয়াস শিলার, ডেইল নিকোলাস ও সিনেটর পিটের দিকে তাকালেন তিনি। আমি সম্মানিত বোধ করছি, আপনাদের মতো ব্যক্তিত্ব নিউ ইয়র্কের পথে আমাকে সঙ্গদান করছেন।

আপনি কিন্তু বিড়ালকেও হার মানিয়েছেন, মুচকি হেসে এই প্রথম কথা বললেন সিনেটর।

 হে’লা কামিলের ঠোঁট জোড়া সামান্য ফাঁক হলো। দ্বিতীয় ও তৃতীয় জীবন দান করার জন্য আপনার ছেলের কাছে আমি ঋণী। অদ্ভুত সময়ে হাজির হওয়ার বিরল ক্ষমতা আছে ওর।

ডার্কের পুরনো গাড়িটার অবস্থা দেখেছি স্বচক্ষে। কেমন করে বেঁচেছেন সবাই, কে জানে। সিনেটর পিট বললেন।

 অত্যন্ত সুন্দর একটা বাহন ছিল, আফসোসের সুর ধ্বনিত হলো হেলার কণ্ঠে। নষ্ট হয়ে গেল।

কাশি দিয়ে ডেইল নিকোলাস বললেন, জাতিসংঘে আপনার ভাষণ প্রসঙ্গে কথা বলতে পারি, মিস কামিল?

আপনার লোকেরা আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি সম্পর্কে নিরেট তথ্য প্রমাণ কিছু কি সংগ্রহ করতে পেরেছে? হেলার কণ্ঠে তীক্ষ্ণতা।

চট করে জুলিয়াস শিলার আর জর্জ পিটের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করলেন ডেইল নিকোলাস। জবাব দিলেন সিনেটর, ভালো করে সার্চ করার সময় পাইনি আমরা। চারদিন আগে যেখানে ছিলাম, আজও প্রায় সেখানে…

ডেইল নিকোলাস ইতস্তত ভাব নিয়ে শুরু করলেন, প্রেসিডেন্ট বলেছেন,…তিনি আশা প্রকাশ করেছেন…

সময় নষ্ট করার দরকার নেই, মি. নিকোলাস, হে’লা কামিল বাধা দিয়ে বললেন। আপনারা শান্ত হোন। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ভাষণে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির কথা বলব।

আপনি মত পাল্টেছেন জেনে আমি আনন্দিত।

যা ঘটে গেল, আমি আপনাদের কাছে অন্তত এইটুকু ঋণী।

ডেইল নিকোলাস স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আপনার ঘোষণা প্রেসিডেন্ট নাদাভ হাসানকে কিছু রাজনৈতিক সুবিধা এনে দেবে, অর্থাৎ আখমত ইয়াজিদ বেশ খানিকটা বেকায়দায় পড়বে। আমার তো ধারণা, ধর্মীয় মৌলবাদের বদলে জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রসার ঘটবে মিসরে।

 খুব বেশি কিছু আশা করো না, সতর্ক করলেন সিনেটর। দুৰ্গটা ধসে পড়ছে, আমরা শুধু ফাঁক-ফোকরগুলো ভরার চেষ্টা করছি।

জুলিয়াস শিলার আশঙ্কা প্রকাশ করে বললেন, আমার ভয়, আখমত ইয়াজিদ মিস হে’লা কামিলের বিরুদ্ধে আরও মরিয়া হয়ে লাগবে।

আমি তা মনে করি না, দ্বিমত পোষণ করলেন ডেইল নিকোলাস। নিহত আতঙ্কবাদীদের সাথে ইয়াজিদের যোগাযোগ যদি এফ.বি.আই, আবিষ্কার করতে পারে, আর যদি ষাট জন প্লেন আরোহীর মৃত্যুর জন্য তাকে দায়ী করা সম্ভব হয়, সাধারণ মিসরীয়রা তার ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেবে। সারা দুনিয়া যদি তার সন্ত্রাসী তৎপরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে, মিস হে’লা কামিলের ওপর আবার আঘাত হানতে সাহস পাবে না সে।

 একটা কথা ঠিক, মিসরীয়রা সুন্নি মুসলমান, শিয়া ইরানিদের মতো রক্তপিপাসু নয়-আমরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে ধীরে ধীরে নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে চাইব। তবে আপনার দ্বিতীয় ধারণাটি ঠিক নয়। আমি বেঁচে থাকা পর্যন্ত আখমভ ইয়াজিদ ক্ষান্ত হবে না। একের পর এক চেষ্টা করে যাবে সে, তাকে আমি সেধরনের ফ্যানাটিক হিসেবেই চিনি। হয়তো এই মুহূর্তেও আমাকে খুন করার প্ল্যান করছে সে।

উনি ঠিক বলেছেন, সিনেটর একমত হলেন। আখমত ইয়াজিদের ওপর আমাদের কড়া নজর রাখা দরকার।

 জাতিসংঘে ভাষণ দেয়ার পর আপনার প্ল্যান কী? জিজ্ঞেস করলেন জুলিয়াস শিলার।

আজ সকালে, হাসপাতাল ছাড়ার আগে, প্রেসিডেন্ট হাসানের একটা মেসেজ পেয়েছি আমি, বললেন হে’লা কামিল। তিনি আমার সাথে দেখা করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন।

ডেইল নিকোলাস সাবধান করে দিয়ে বললেন, আমাদের চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে গেলে আমরা কিন্তু আপনার নিরাপত্তার ব্যাপারে কোনো রকম গ্যারান্টি দিতে পারব না, মিস কামিল।

আপনাদের উদ্বেগের কোনো কারণ নেই, মৃদু হেসে হে’লা কামিল বললেন, প্রেসিডেন্ট সাদাত আততায়ীদের হাতে নিহত হবার পরে আমার দেশের সিকিউরিটি সিস্টেম বেশ সজাগ।

জানতে পারি, মিস কামিল, সাক্ষাৎকারটি কোথায় অনুষ্ঠিত হবে? খোঁজ নিলেন। জুলিয়াস শিলার। নাকি অনধিকার চর্চা হয়ে গেল?

গোপন কোনো ব্যাপার নয়। দুনিয়ার সবাই জানবে। উরুগুয়ের পান্টা ডেল এসটে-তে মিলিত হব আমরা, আমি এবং প্রেসিডেন্ট নাদাভ হাসান।

তোবড়ানো, বুলেটে ঝাঁঝরা কর্ডটাকে গ্যারেজে নিয়ে আসা হয়েছে। চোখে অবিশ্বাস নিয়ে গাড়িটার চারদিকে ঘুরল একবার এসবেনসন। গাড়ির অবস্থা যদি এই হয়, আপনারা বেঁচে আছেন কীভাবে?

 গাড়ির মালিককে জিজ্ঞেস করো, পরামর্শ দিল অ্যাল জিওর্দিনো। তার একটা হাত স্লিংয়ে ঝুলছে, গলায় একটা পট্টি বাঁধা হয়েছে, ব্যান্ডেজ বাধা হয়েছে কানে।

ছয়টা সেলাই পড়েছে, তবে সবগুলো চুলের ভেতর আড়ালে, তাছাড়া অক্ষতই বলা যায় পিটকে। গাড়ির নাকে হাত বুলাচ্ছে ও, ওটা যেন একটা পোষা প্রাণী।

অফিসঘর থেকে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বেরিয়ে এল লিলি। তার বাম গালে আঁচড়ের দাগ, ডান চোখে নিচটা ফুলে আছে।

টেলিফোনে হিরাম ইয়েজার।

মাথা ঝাঁকিয়ে এগিয়ে এল পিট। এসবেনসনের কাঁধে এক হাত রেখে বলল, আমার গাড়িটাকে আগের চেয়ে সুন্দর করে দাও।

কমপক্ষে ছয় মাস, সঙ্গে প্রচুর টাকা লাগবে। জানাল এসবেনসন।

 সময়, টাকা কোনোটাই সমস্যা নয়, পিট বলে, সরকার দেবে বিল।

ঘুরে দাঁড়িয়ে, অফিস ঘরে ঢুকে টেলিফোন উঠালো সে, হিরাম, আমার জন্য কোনো খবর আছে?

বাল্টিক সাগর আর নরওয়ে উপকূল বাদ দিয়েছে আমি।

 কারণ?

সেরাপিস লগ যে জিওলজিকাল বর্ণনা দিয়েছে তার সাথে ওই এলাকার বৈশিষ্ট্য মেলে না। রাফিনাস যে অসভ্যদের বর্ণনা দিয়েছে তার সাথে প্রথম দিককার ভাইকিংদেরও কোনো মিল নেই। সে যাদের কথা লিখেছে, তাদের সাথে বরং বেশ খানিকটা সিদিয়ানদের মিল খুঁজে পাওয়া যায়, তবে গায়ের রং আরও গাঢ়।

কিন্তু সিদিয়ানরা এসেছিল সেন্ট্রাল এশিয়া থেকে, বলল পিট। সোনালি চুল বা ফর্সা চামড়া কোত্থেকে পাবে তারা এক সেকেন্ড চিন্তা করল ও। আচ্ছা, আইসল্যান্ডের কথা ভেবেছ? আরও প্রায় পাঁচশো বছর ভাইকিংরা ওখানে বসবাস করেনি। রাফিনাস হয়তো এস্কিমোদের কথা বলে থাকতে পারে।

সম্ভব নয়, বলল ইয়েজার। চেক করে দেখেছি। এস্কিমোরা কখনোই আইসল্যান্ডে মাইগ্রেট করেনি। রাফিনাস পাইন বনের বর্ণনা দিয়েছে, আইসল্যান্ডে পাচ্ছ না। তাছাড়া, ভুলো না, ছয়শো মাইল লম্বা সাগর পাড়ি নিয়ে কথা বলছি আমরা, তার মধ্যে কয়েকটা সাগর সাংঘাতিক অশান্ত। ঐতিহাসিক মেরিন রেকর্ড বলছে, রোমান জাহাজের ক্যাপটেনরা তীরভূমিকে সাধারণত দুদিনের বেশি চোখের আড়াল করত না।

এখন তাহলে কোথায় খোঁজ করব আমরা?

ভাবছি আবার একবার পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলে তল্লাশি চালাব। কিছু হয়তো চোখ এড়িয়ে গেছে।

অসভ্যদের সন্ধান পেতে চাইছ তুমি, বলল পিট। কিন্তু সেরাপিস গ্রিনল্যান্ডে এল কী করে, এলে কি ব্যাখ্যা দেবে?

কম্পিউটর আমাদের বাতাস স্রোতের হিসেবে দিলে বলতে পারব।

আজ রাতে আমি ওয়াশিংটন যাচ্ছি, বলল পিট। কাল তোমার সাথে দেখা করব।

ঠিক আছে, ম্লান কণ্ঠে বলল ইয়েজার।

ফোন রেখে অফিস থেকে বেরিয়ে এল পিট। ওর চেহারা দেখে লিলি বুঝল, আশাজাগানিয়া কিছু ঘটেনি।

ভালো কোনো খবর নেই, তাই না? পিটের পেছন থেকে জিজ্ঞেস করল সে।

তার দিকে ফিরে কাঁধ ঝাঁকাল পিট। যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, আবার সেখানেই ফিরে এসেছি।

পিটের বাহু ধরে মৃদু চাপ দিল লিলি। হতাশ হয়ো না তো। ইয়েজার পারবে, তুমি দেখো।

 কিন্তু সে তো আর জাদুকর নয়!

অফিসঘরে উঁকি দিল জিওর্দিনো। প্লেন ধরতে হলে এক্ষুনি বেরিয়ে পড়তে হয়, পিট।

হেঁটে এসে এসবেনসনের উদ্দেশে মৃদু হাসল পিট। ওকে ভালো করে দাও, আমাদের সবার জীবন বাঁচিয়েছে গাড়িটা।

তা করব, এসবেনসন বলে, কিন্তু কথা দিতে হবে বুলেট আর স্কি ঢালের থেকে দূরে থাকবে?

ঠিক হ্যায়!

.

৩২.

পাবলিক গ্যালারিতে প্রশংসা আর হাততালির ঝড়; প্রধান ফ্লোরে বসে থাকা কূটনৈতিক নেতাদের সামনে কোনো রকম সাহায্য ছাড়াই মঞ্চে উঠে এলেন হে’লা কামিল। ক্রাচের সাহায্য নিয়ে হাঁটছেন তিনি। মাইকের সামনে একটু থেমে, জোরাল গলায় ভাষণ শুরু করলেন। স্পষ্ট, কাটা কাটা শব্দে। ধর্মের নামে নিরীহ লোকজনকে হত্যা থেকে বিরত থাকতে সবাইকে অনুরোধ জানালেন প্রথমে।

আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি আবিষ্কারের সমূহ সম্ভাবনা ঘোষণা করার পর গুঞ্জন উঠল পুরো হলজুড়ে। তাকে হত্যা-প্রচেষ্টার জন্য সরাসরি আখমত ইয়াজিদকে দায়ী করলেন হেলা।

এরপর, দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে তিনি বললেন, যেকোনো ভয়-ভীতি দেখিয়ে তাকে জাতিসংঘের মহাসচিবের পদ থেকে সরানো যাবে না।

মঞ্চ থেকে হেলা নেমে যাওয়ার বহুক্ষণ পরেও চলতে থাকল হাততালি।

.

দারুণ এক মহিলা, প্রশংসা করে বললেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। তার মতো কাউকে পেলে মন্ত্রিসভায় থাকার জন্য অনুরোধ জানাতাম আমি। রিমোট কন্ট্রোলের বোতাম টিপে টিভি সেট বন্ধ করে দিলেন প্রেসিডেন্ট।

চমৎক্তার বললেন মহিলা, সিনেটর পিট সায় দিলেন। শব্দচয়ন তুলনাহীন। আখমত ইয়াজিদকে একেবারে ধুয়ে দিয়েছেন।

হ্যাঁ, প্রেসিডেন্ট বললেন, আমাদের জন্য সেরা একটা ভাষণ।

সিনেটর জিজ্ঞেস করলেন, আপনি জানেন নিশ্চয়ই, মিস কামিল প্রেসিডেন্ট হাসানের সাথে আলোচনা করার জন্য উরুগুয়ে যাচ্ছে?

ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকালেন প্রেসিডেন্ট। ডেইল নিকোলাস জানিয়েছে আমাকে। সার্চ কেমন এগোচ্ছে, সিনেটর?

লোকেশন খুঁজে বের করার জন্য নুমার কম্পিউটর ফ্যাসিলিটি কাজ করছে।

 এগিয়েছে কত দূর?

চার দিন আগে যেখানে ছিলাম সেখানেই আছি আমরা।

পেন ইউনিভার্সিটির একজনকে চিনি আমি, ট্রিপল-এ রিসার্চার বলা হয় তাকে, যদি মনে করেন তার সাহায্য নিতে পারেন আপনারা, পরামর্শ দিলেন প্রেসিডেন্ট।

 আজই যোগাযোগ করব আমি, বললেন সিনেটর।

ধীর ভঙ্গিতে প্রেসিডেন্ট বললেন, প্রেসিডেন্ট নাদাভ হাসানের কাছে আর্টিফ্যাক্ট দেয়ার সময় ধীরে আখমতকে সরিয়ে দিলে কেমন হয়?

আমিও তাই মনে করি। কিন্তু ইয়াজিদ যেন তেন লোক নয়।

নিশ্চই নিখুঁতও নয়।

 তা বটে। কিন্তু আয়াতুল্লাহ খোমেনির মতো উন্মাদ নয় সে। চালাক লোক।

সিনেটরের দিকে ফিরলেন প্রেসিডেন্ট। তার সম্পর্কে খুব কম জানি আমরা।

সে দাবি করে, জীবনের প্রথম ত্রিশ বছর সিনাই মরুতে একা একা ঘুরে বেড়িয়েছে, আলাপ করেছে আল্লাহর সাথে।

 লোকটার উচ্চাশা আছে, মানতে হবে, তিক্ত হাসি ফুটল প্রেসিডেন্টের মুখে। পয়গম্বর হতে চায়। তার সম্পর্কে একটা রিপোর্ট তৈরি করতে বলেছিলাম সিআইএ চিফকে। বিশেষ করে ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে। দেখা যাক, কতদূর কী করল ওরা। ইন্টারকমে কথা বললেন তিনি, ডেইল, একটু আসবে?

পনেরো সেকেন্ডের মধ্যে ওভাল অফিসে চলে এলেন ডেইল নিকোলাস।

আমরা আখমত ইয়াজিদকে নিয়ে আলাপ করছিলাম, তাকে জানালেন প্রেসিডেন্ট। সিআইএ কি ওর জীবনবৃন্তান্ত পেয়েছে?

 ঘণ্টাখানেক আগে মার্টিন ব্রোগানের সাথে আমরা কথা হয়েছে। গবেষকরা এক কি দুদিনের মধ্যে ফাইল তৈরির কাজটা শেষ করতে পারবে বলে জানিয়েছে।

শেষ হলেই সেটা আমি দেখতে চাই। সোফা ছেড়ে উঠলেন প্রেসিডেন্ট।

ধরুন, বললেন সিনেটর, আগামী কয়েক সপ্তাহর মধ্যে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির অস্তিত্ব আবিষ্কার হলো। আমরা সম্ভবত লাইব্রেরির শিল্পকর্ম আর নবশাগুলো মিসরকে ফিরিয়ে দেব। কিন্তু তার আগে, আনঅফিশিয়ালি, গোটা ব্যাপারটা সম্পর্কে আগেই যদি একটা আভাস দিয়ে রাখি প্রেসিডেন্ট নাদাভ হাসানকে, কেমন হয় সেটা?

হ্যাঁ, তার জানা দরকার। আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে আমার পক্ষ থেকে ব্যাপারটা তাকে জানান আপনি, সিনেটর।

 কাঁধ ঝাঁকালেন সিনেটর পিট। সরকারি বিমান পেলে মঙ্গলবার আমেরিকা ছেড়ে মিসরে উড়ে যেতে পারি আমি। প্রেসিডেন্ট হাসানকে গোটা ব্যাপারটা জানিয়ে আবার ফিরে আসব ওইদিন বিকেলেই।

 প্রেসিডেন্ট হাসানকে ব্যক্তিগতভাবে বলবেন, ইয়াজিদের বিরুদ্ধে তিনি যদি কোনো অ্যাকশন নিতে চান, আমি তাকে সর্বাত্মক সাহায্য করতে প্রস্তুত।

বাজে আইডিয়া, সিনেটর পিট বললেন, এই প্রস্তাব ফাস হলে আপনার সরকার টলে যাবে।

 আপনার সতোর প্রতি আমার আস্থা আছে।

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সিনেটর। লাইব্রেরির বই-পুস্তক, শিল্পকর্ম বিষয়ক কথাবার্তা আমি বলব। কিন্তু ইয়াজিদকে দুনিয়ার বুক থেকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে আমার পক্ষে কিছু বলা সম্ভব নয়।

নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন প্রেসিডেন্ট। সিনেটরের সঙ্গে হাত মেলালেন।

 আমি কৃতজ্ঞ, বন্ধু। বুধবার আপনার রিপোর্টের আশায় থাকব।

 বিদায়, প্রেসিডেন্ট।

ওভাল অফিস ছেড়ে বেরোনোর সময় সিনেটর পিটের মনে হলো, বুধবার সন্ধ্যেয় নির্ঘাত একা একা ডিনার করবেন প্রেসিডেন্ট।

.

৩৩.

আর মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে মূল ভূখণ্ডের পশ্চিমে ডুব দেবে সূর্য, এই সময় পাল্টা ডেল এসটের ছোট্ট বন্দরে সাবলীল ভঙ্গিতে ঢুকে পড়ল প্রমোদতরী লেডি ফ্ল্যামবোরো। মৃদুমন্দ দেখিনা বাতাসে উড়ছে ব্রিটেনের পতাকা।

সুশোভিত, সুদর্শন একটা জাহাজ, দেখামাত্র চোখ জুড়িয়ে যায়। কখনোই একশোর বেশি আরোহী ভোলা হয় না। তাদের সেবা করার জন্য রয়েছে সমান সংখ্যক ক্রু সদস্য। সান হুয়ান থেকে আসার সময় এবার অবশ্য কোনো আরোহী নিয়ে আসেনি লেডি ফ্ল্যামবোরো।

টু ডিগ্রিজ পোর্ট, কৃষ্ণাঙ্গ পাইলট বলল।

 টু ডিগ্রিজ পোর্ট, সাড়া দিল হেলমসম্যান।

খাকি শর্টস আর শার্ট পরে আঙুলের মতো লম্বা মাটির বাড়তি অংশটির ওপর হিসেবি চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকল পাইলট, মাটির বাড়তি এই অংশটাই আড়াল করে রেখেছে বে-কে। ধীরে ধীরে সেটাকে ছাড়িয়ে এল লেডি ফ্ল্যামবোরো।

স্টারবোর্ডের দিকে ঘুরতে শুরু করো-হোল্ড স্টেডি অ্যাট জিরো এইট জিরো।

নির্দেশ পুনরাবৃত্তি করল হেলমসম্যান, অত্যন্ত ধীরগতিতে নতুন কোর্স ধরল জাহাজ।

আরও অনেক রংচঙে প্রমোদতরী ও ইয়ট রয়েছে বন্দরে। অর্থনৈতিক শীর্ষ সম্মেলন উপলক্ষ্যে ভাড়া করা হয়েছে অনেক জাহাজ, বাকিগুলো তাদের আরোহীদের নামাচ্ছে।

নোঙর করার স্থান থেকে আধ কিলোমিটার দূরে থাকতে পাইলট নির্দেশ দিল ডেড স্টপ! 

 শান্ত পানি কেটে আপন গতিতে এগোল লেডি ফ্ল্যামবোরো, দূরত্ব কমিয়ে এনে ধীরে ধীরে থামছে। সন্তুষ্ট হয়ে পোর্টেবল ট্রান্সমিটারে পাইলট জানাল, পজিশনে পৌঁছেছি আমরা। হুক ফেলল।

নির্দেশটা বো-র দিকে পাঠানো হলো, সাথে সাথে পানিতে ফেলা হলো নোঙর। এতক্ষণে ইঞ্জিন বন্ধ করার নির্দেশ দিল পাইলট।

সাদা ইউনিফর্ম পরা এক ভদ্রলোক ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, সহাস্য বদনে করমর্দনের জন্য পাইলটের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিলেন তিনি। প্রতিবারের মতই নিখুঁত, মি. ক্যাম্পোস। ক্যাপটেন অলিভার কলিন্স বিশ বছর ধরে পাইলট হ্যারি ক্যাম্পোসকে চেনেন।

আর যদি ত্রিশ মিটার লম্বা হতে জাহাজটা, কোনোমতেই বন্দরে ঢোকাতে পারতাম না। তামাকের দাগে কালো দাঁত বের করে হাসল ক্যাম্পোস। তবে আমরা ওপর নির্দেশ আছে, বন্দরেই নোঙর ফেলতে হবে, জেটিতে ভিড়তে পারব না।

অবশ্যই নিরাপত্তার কারণে, আন্দাজ করা যায়, ক্যাপটেন বললেন।

আধপোড়া একটা চুরুট ধরাল পাইলট। শীর্ষ সম্মেলনের প্রস্তুতি গোটা দ্বীপটাকে ওলটপালট করে ছেড়েছে। সিকিউরিটি পুলিশের হাবভাব দেখে মনে হয় প্রতিটি পাম গাছের আড়ালে একজন করে স্নাইপার লুকিয়ে আছে।

 ব্রিজের জানালা দিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার জনপ্রিয় খেলার মাঠের দিকে তাকালেন ক্যাপটেন। আশ্চর্য হবার কিছু নেই। সম্মেলন চলার সময় এই জাহাজে মেক্সিকো আর মিসরের প্রেসিডেন্ট থাকবেন।

তাই? বিড়বিড় করে বিস্ময় প্রকাশ করল পাইলট। তাহলে সেজন্যই তীর থেকে দূরে রাখতে বলা হয়েছে আপনাকে।

আসুন না, আমার কেবিনে বসে গলাটা ভিজিয়ে নেবেন, আমন্ত্রণ জানালেন ক্যাপটেন কলিন্স।

 অসংখ্য ধন্যবাদ, মাথা নেড়ে বলল ক্যাম্পোস। বন্দরের জাহাজগুলোর দিকে একটা হাত তুলল সে। আজ অনেক কাজ, আরেক দিন হবে।

কাগজপত্র সেই করিয়ে নিয়ে বন্দর পাইলট ক্যাম্পোস নিজের বোটে নেমে গেল। হাত নাড়ল সে, তাকে নিয়ে চলে গেল বোট।

 এত আনন্দ আর কখনও পাইনি, কলিন্সের ফাস্ট অফিসার মাইকেল ফিনি বলল। এরা সবাই হাজির, কিন্তু আরোহী বলতে কেউ নেই। ছয় দিন ধরে আমার মনে হচ্ছে, মারা যাবার পর স্বর্গে পাঠানো হয়েছে আমাকে।

কোম্পানির নির্দেশ, ক্রুরা যতটা সময় জাহাজ চালানোয় ব্যয় করবে, সেই একই পরিমাণ সময় ব্যয় করতে হবে আরোহীদের মনোরঞ্জনের জন্য। এই দায়িত্ব পছন্দ নয় মাইকেল ফিনির। অত্যন্ত দক্ষ একজন নাবিক সে, মেইন ডাইনিং সেলুনের কাছ থেকে যতটা সম্ভব দূরে সরে থাকে, খাওয়া-দাওয়া সারে সঙ্গী অফিসারদের সাথে, সারাক্ষণ জাহাজের খবরদারিতে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করে। শরীরটা তার প্রকাণ্ড, ড্রাম আকৃতির ধড়, আঁটসাট ইউনিফর্ম ছিঁড়ে সেটা যেন প্রতি মুহূর্তে বিস্ফোরিত হতে চাইছে।

 নেতাদের গালগল্প নিশ্চয়ই তুমি শুনতে চাইবে, কৌতুক করে বললেন ক্যাপটেন।

চেহারায় অসন্তোষ নিয়ে মাইকেল ফিনি বলল, ভিআইপি প্যাসেঞ্জারদের সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। একই প্রশ্ন বারবার করা তাদের একটা বদঅভ্যেস।

 কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে আরোহী মাত্রেই শ্রদ্ধেয়, মাইক। আগামী কয়েকটা দিন নিজের আচরণের প্রতি লক্ষ রেখো, প্লিজ। অতিথি হিসেবে এবার আমরা বিদেশি নেতা আর রাষ্ট্রপ্রধানদের পাচ্ছি।

জবাব দিল না মাইকেল ফিনি, সৈকতের দিকে তাকিয়ে আকাশছোঁয়া ভবনগুলো দেখছে। পুরনো শহরটায় যখনই আসি, প্রতিবার নতুন একটা হোটেল দেখতে পাই।

হ্যাঁ, তুমি তো উরুগুয়েরই লোক।

মন্টিভিডিয়োর সামান্য পশ্চিমে জন্ম আমার।

বাড়ি ফেরার আনন্দটুকু উপভোগ করছো না?

 এ শহরে, শুধু শহরে কেন, এ দেশে আপন বলতে কেউ নেই আমরা। ষোলো বছর বয়স থেকে জাহাজে চাকরি নিয়ে সাগরে ঘুরে বেড়াচ্ছি, সাগরই আমার আসল ঠিকানা। মাইকেল ফিনি-র চেহারা হঠাৎ বিরূপ হয়ে উঠল। জানালার দিকে একটা হাত তুলে দেখল সে। ওই যে, ব্যাটারা আসছে-কাস্টমস আর ইমিগ্রেশন ইন্সপেক্টরের দল।

প্যাসেঞ্জার নেই, ক্রুরাও কেউ তীরে নামছে না, রাবার স্ট্যাম্প মেরেই চলে যাবে ওরা।

হেলথ ইন্সপেক্টরকে বিশ্বাস নেই, প্যাঁচ কষলেই হলো!

পারসারকে জানাও, মাইক। তারপর ওদেরকে নিয়ে আমার কেবিনে চলো এসো।

মাফ করবেন, স্যার, একটু বেশি খাতির করা হয়ে যাবে না? স্রেফ কাস্টমস ইন্সপেক্টরদের ক্যাপটেনের কেবিনে ডাকা কি উচিত?

 হয়তো একটু বেশি হচ্ছে, তবে বন্দরে থাকার সময় বিশেষ করে ওদের সাথে সদ্ভাভ রাখতে চাই আমি, ক্যাপটেন বললেন। বলা তো যায় না কখন আমাদের উপকার দরকার হয়।

ইয়েস স্যার!

লেডি ফ্ল্যামবোয়রার গায়ে বোট ভিড়ল, মই বেয়ে উঠে এল অফিসাররা। ইতোমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। হঠাৎ করে জাহাজের আলো জ্বলে উঠে ঝলমলে করে তুলল আপার ডেক আর সুপারস্ট্রাকচার। শহর আর অন্যান্য জাহাজের আলোকমালার মাঝখানে নোঙর করা লেডি ফ্ল্যামবোরোকে গহনার বাক্সে হীরের একটা টুকরো মনে হলো।

উরুগুয়ের সরকারি অফিসারদের নিয়ে পাইলটের কেবিনের দিকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল ফাস্ট অফিসার মাইকেল ফিনিকে। তাকে অনুসরণরত পাঁচজন লোককে খুঁটিয়ে লক্ষ করলেন ক্যাপটেন। অভিজ্ঞ মানুষ, তার চোখকে ফাঁকি দেয়া সহজ নয়। প্রায় সাথে সাথেই বুঝলেন তিনি, কোথায় কী যেন একটা মিলছে না। অন্তত পাঁচজনের মধ্যে একজনকে অদ্ভুত লাগল তাঁর। লোকটার মাথায় স্ট্র হ্যাট, এত চওড়া আর নিচে নেমে আছে যে তার চোখ দুটো দেখা গেল না। পরে আছে একটা জাম্পস্যুট। বাকি সবার পরনে স্বাভাবিক ইউনিফর্ম। ক্যারিবিয়ান দ্বীপগুলোর বেশির ভাগ অফিসারই এই ইউনিফর্ম পরে।

অদ্ভুত লোকটা তার সঙ্গীদের পিছু পিছু আসছে মাথা নিচু করে। সবাইকে নিয়ে দোরগোড়ায় পৌঁছল মাইকেল ফিনি, একপাশে সরে দাঁড়িয়ে অফিসারদের আগে ঢোকার সুযোগ করে দিল।

সামনে বাড়লেন ক্যাপটেন কলিন্স। গুড ইভনিং, জেন্টলমেন। লেডি ফ্ল্যামবোরোয় আপনাদের স্বাগত জানাই। আমি ক্যাপটেন অলিভার কলিন্স।

কি ব্যাপার, অফিসাররা কেউ নড়ছে না বা কথা বলছে না কেন? মাইকেল ফিনির সাথে দৃষ্টি বিনিময় করলেন ক্যাপটেন। এই সময় জাম্পস্যুট পরা লোকটা এক পা সামনে বাড়লো। পা থেকে ধীরে ধীরে জাম্পস্যুটটা খুলে ফেলল সে, ভেতরে দেখা গেল সোনার কাজ করা সাদা ইউনিফর্ম, হুবহু ক্যাপটেন কলিন্স যেমন পরে আছেন মাথা থেকে স্ট্র হ্যাটটা নামাল সে, পরল একটা ক্যাপ, ইউনিফর্মের সাথে মানানসই।

সাধারণত কোনো ব্যাপারেই দিশেহারা হন না ক্যাপটেন, কিন্তু আজ চোখের সামনে এ ধরনের একটা ঘটনা ঘটতে দেখে হতবাক হয়ে গেলেন। তাঁর মনে হলো, তিনি যেন একটা আয়নায় তাকিয়ে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখছেন। আগন্তুককে তার যমজ ভাই বলে অনায়াসে চালিয়ে দেয়া যায়।

কে আপনি? বাকশক্তি ফিরে পেয়ে কঠিন সুরে জিজ্ঞেস করলেন ক্যাপটেন। কী ঘটছে এখানে?

নাম জেনে আপনার কাজ নেই, সবিনয় হাসির সাথে বলল সুলেমান আজিজ। আপনার জাহাজের দায়িত্ব এখন থেকে আমি নিলাম।

.

৩৪.

চোরাগোপ্তা হামলার সাফল্য নির্ভর করে হতচকিত করে দেয়ার ওপর। সুলেমান আজিজ আর তার অনুচররা কাজটা এমন নিখুঁতভাবে সারল যে ক্যাপটেন, ফাস্ট অফিসার আর পারসার ছাড়া জাহাজের আর কেউ জানতেই পারল না তাদের জাহাজে বেদখল হয়ে গেছে। ওদের তিনজনকে ফাস্ট অফিসার মাইকেল ফিনি-র কেবিনে নিয়ে যাওয়া হলো, বাঁধা হলো হাত-পা, মুখে টেপ লাগানো হলো, বন্ধ দরজার ভেতর পাহারায় থাকল সশস্ত্র একজন লোক।

সুলেমান আজিজের সময়ের হিসাবটাও নিখুঁত। উরুগুয়ের নির্ভেজাল কাস্টমস অফিসাররা মাত্র বারো মিনিট পর হাজির হলো জাহাজে। মাইকেল কলিগের প্রায় নিখুঁত ছদ্মবেশ নিয়েছে সে, অফিসারদের অভ্যর্থনা জানাল এমনভাবে যেন তাদের সাথে তার কতকালের পরিচয়। মাইকেল ফিনি আর পারসারের ভূমিকায় যে দু’জনকে বেছে নিয়েছে, বেশির ভাগ সময় ছায়ায় ভেতর থাকল তারা। দু’জনেই তারা অভিজ্ঞ নাবিক, যাদের ভূমিকায় নামানো হয়েছে তাদের সাথে চেহারার মিলও যথেষ্ট। তিন মিটারের বেশি দূর থেকে খুব কম লোকই তাদের চেহারার পার্থক্য ধরতে পারবে।

 অনুসন্ধান শেষ করে কাস্টমস অফিসাররা বিদায় নিল। কলিন্সের সেকেন্ড আর থার্ড অফিসারকে ক্যাপটেনের কেবিনে ডেকে পাঠাল সুলেমান আজিজ। এটাই হবে তার প্রথম ও কঠিনতম পরীক্ষা। এই দুই অফিসারের চোখকে যদি ফাঁকি দিতে পারা যায়, নিরীহ ও অজ্ঞ সহযোগী হিসেবে তার স্বার্থে আগামী চব্বিশ ঘণ্টা অমূল্য অবদান রাখবে তারা।

 প্লেন হাইজ্যাক করার আগে, ক্যাপটেন ডেইল লেমকের ভূমিকা গ্রহণের সময়, ছদ্মবেশ নেয়ার পদ্ধতিটা ছিল অন্যরকম। ডেইল লেমকেকে খুন করার পর অনায়াসে তার মুখের একটা প্লাস্টিক ছাঁচ তৈরি করে নিয়েছিল সে। লেডি ফ্ল্যামবোরোর ক্যাপটেন অলিভার কলিন্সকে খুন করার সুযোগ হয়নি তার, কাজেই তার ছদ্মবেশ নিতে গিয়ে মাইকেল কলিন্সের আটটা ফটো সংগ্রহ করে সে। কণ্ঠস্বর কলিন্সের সমান পর্দায় তোলার জন্য বিশেষ এক ধরনের মেডিসিন ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে শরীরে গ্রহণ করতে হয়েছে তাকে।

দক্ষ একজন শিল্পীকে ভাড়া করে সুলেমান আজিজ, কলিন্সের ফটোগুলো দেখে লোকটা তাকে বানিয়ে দেয় একটা মূর্তি। ভাস্কর্যটি থেকে নারী ও পুরুষ, দুধরনের ছাঁচ তৈরি করা হয়। সেই ছাঁচ মুখোশ হিসেবে কাজে লাগায় সুলেমান আজিজ। কলিন্সের মুখের রং আনার জন্য মুখোশে ব্যবহার করা হয় গাছের দুধসাদা নির্যাস। ফোমের তৈরি কান লাগিয়েছে সুলেমান আজিজ। কলিন্সের চোখের রং পাবার জন্য কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহার করেছে। দাঁতে পরেছে টুথক্যাপ।

ক্ষমা করবেন, জেন্টলমেন, ঠাণ্ডা লেগে গলাটা বসে গেছে।

জাহাজের ডাক্তারকে খবর দেব? সেকেন্ড অফিসার হারবার্ট পারকার জিজ্ঞেস করল। দীর্ঘদেহী সে, রোদে পোড়া তামাটে রং গায়ের, শিশুসুলভ নিরীহ চেহারা।

ভুল হয়ে গেছে, ভাবল সুলেমান আজিজ। ক্যাপটেন কলিন্সকে চেনে ডাক্তার, কাছ থেকে পরীক্ষা করলেই মুখোশটা চিনে ফেলতে পারে। এর মধ্যে তিনি আমাকে এক গাদা ট্যাবলেট দিয়েছেন, এখন ভালোর দিকে।

থার্ড অফিসার, স্কটল্যান্ডের অধিবাসী, নাম আইজ্যাক জোন্স, কপাল থেকে লাল চুল সরিযে গলাটা সামনের দিকে লম্বা করল। আমাদের কিছু করার আছে, স্যার?

 হ্যাঁ, আছে বৈকি, মি. জোন্স! অফিসারদের ফটো দেখা আছে, নাম-ধামও জানা কাজেই আলাপ চালিয়ে যেতে সুলেমান আজিজের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। আমাদের ভিআইপি প্যাসেঞ্জাররা কাল বিকেলে আসছেন। অভ্যর্থনা কমিটির নেতৃত্ব দেবে তুমি। একসাথে দু’জন প্রেসিডেন্টকে অতিথি হিসেবে পাওয়া দুর্লভ একটা সম্মান, স্বভাবতই কোম্পানি আশা করবে প্রথম শ্রেণীর আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন করব আমরা।

ইয়েস স্যার, দৃঢ়কণ্ঠে বলল জোন্স। ভরসা রাখতে পারেন।

মি. পারকার।

ক্যাপটেন।

এক ঘণ্টার মধ্যে একটা বোট আসছে, কোম্পানির কার্গো নিয়ে। তুমি লোডিং অপারেশনের চার্জে থাকবে। আজ সন্ধ্যায় সিকিউরিটি অফিসারদের একটা দলও আসছে। তাদের থাকার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা করবে, প্লিজ।

কার্গো নিতে হবে? নোটিশটা আরও আগে পেলে ভালো হতো না, স্যার? আর, আমি ভেবেছিলাম, মিসরীয় ও মেক্সিকোর সিকিউরিটি অফিসাররা আসবেন কাল সকালে।

আমাদের কোম্পানির ডিরেক্টররা চিরকাল রহস্যময় আচরণ করেন, খানিকটা অভিযোগের সুরে বলল সুলেমান আজিজ। সশস্ত্র অতিথিদের কথা যদি বলেন, এ ক্ষেত্রেও কোম্পানির আদেশ কাজ করছে। সাবধানের মার নেই ভেবে তারা নিজেদের লোক রাখতে চাইছে।

তার মানে একদল সিকিউরিটি অফিসার আরেকদল সিকিউরিটি অফিসারের ওপর নজর রাখবে?

 অনেকটা তাই। আমার ধারণা, লয়েডস ব্যাঙ্ক অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করা দাবি জানিয়েছে, তা না হলে বীমার রেট বাড়িয়ে দেবে।

বুঝতে পারছি।

 কোনো প্রশ্ন, জেন্টলমেন?

কারও কোনো প্রশ্ন নেই, অফিসাররা চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াল।

হারবার্ট, আরেকটা কথা, বলল সুলেমান আজিজ। কার্গো লোড করবে যতটা সম্ভব চুপচাপ আর তাড়াতাড়ি, প্লিজ।

ঠিক আছে, স্যার।

ডেকে বেরিয়ে গিয়ে হারবার্ট পারকার, আইজ্যাক জোন্সের দিকে তাকাল। শুনলে? উনি আমার নামের প্রথম অংশ ধরে ডাকলেন। ব্যাপারটা অদ্ভুত নয়?

জোন্স নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কাধ ঝাঁকাল। উনি বোধহয় সত্যি খুব অসুস্থ।

ঠিক এক ঘণ্টা পরই লেডি ফ্ল্যামবোরার পাশে এসে থামল লোডিং ক্রাফট, সাথে সাথে একটা সেতুবন্ধ রচনা করা হলো। কার্গো লোড করার সময় কোনো বিঘ্ন ঘটল না। সুলেমান আজিজের বাকি লোকরাও, সবার পরনে বিজনেস স্যুট, পৌঁছল জাহাজে। চারটে খালি স্যুইট ছেড়ে দেয়া হলো তাদেরকে

মাঝরাতের দিকে মাল খালাস করে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল ল্যান্ডিং ক্রাফট। লেডি ফ্ল্যামবোরোর সেতু তুলে নেয়া হলো। হোল্ডের ভেতর ঠাই পেয়েছে কার্গো, হোন্ডের বিশাল ডাবল ডোর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

মাইকেল ফিনি-র দরজায় তিনবার টোকা দিল সুলেমান আজিজ। সামান্য ফাঁক হলো কবাট, ভেতর থেকে উঁকি দিল সশস্ত্র গার্ড। কার্পেট মোড়া প্যাসেজওয়ের দুদিকে চট করে একবার তাকাল সুলেমান আজিজ, কেউ কোথাও নেই। তাড়াতাড়ি কেবিনের ভেতর ঢুকে পড়ল সে।

গার্ডের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করল সে। নিঃশব্দে এগিয়ে গেল গার্ড। ক্যাপটেন মাইকেল কলিঙ্গের মুখ থেকে টেপটা খুলে দিল সে।

কষ্ট দিতে হচ্ছে, সেজন্য সত্যি আমি দুঃখিত, ক্যাপটেন, বলল সুলেমান আজিজ। কিন্তু ধরুন, যদি আপনাকে আটকে না রেখে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে দিতাম, আপনি পালাতে চেষ্টা করতেন না? বা ক্রুদের সাবধান করতেন না?

একটা চেয়ার আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বসে আছেন ক্যাপটেন, হাত আর পা চেয়ারের সাথে বাঁধা, চোখে আগুন ঝরা দৃষ্টি। তুমি একটা নর্দমার কীট!

 তোমরা ব্রিটিশরা, জুতসই গাল দিতেও জানো না! হেসে উঠল সুলেমান আজিজ। আমেরিকানরা এ ব্যাপারে ওস্তাদ। তারা চার অক্ষরের শব্দ ব্যবহার করে যা বলে তারচেয়ে খারাপ খিস্তি আর হয় না।

তুমি আমার ক্রুদের কোনো সাহায্য পাবে না।

কিন্তু আমি যদি আমার লোকদের অর্ডার দিই, আপনার মহিলা ক্রুদের গলা কেটে সাগরে ফেলে দিতে? এদিকের পানিতে হাঙর আছে তা তো আপনি জানেনই।

হাত-পা বাঁধা থাকলেও, রাগের মাথায় সুলেমান আজিজের দিকে লাফিয়ে পড়তে চাইল মাইকেল ফিনি। তার তলপেটে রাইফেলের মাজল চেপে ধরে বাঁধা দিল গার্ড চেয়ারে পিছিয়ে গেল ওয়েট, ব্যথায় কুঁচকে উঠল তার চেহারা।

ক্যাপটেন একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন সুলেমান আজিজের দিকে। যা খুশি করতে পারো তুমি, টেরোসিস্টদের সাথে কোনো সহযোগিতার প্রশ্ন ওঠে না, দৃঢ়কণ্ঠে বললেন তিনি।

 সন্ত্রাসবাদী বলুন আর যাই বলুন, প্রথম শ্রেণীর প্রফেশনাল আমরা, শান্তভাবে ব্যাখ্যা করল সুলেমান আজিজ। কাউকে খুন করার কোনো ইচ্ছেই আমাদের নেই। টাকা চাই, আর তাই আমরা প্রেসিডেন্ট হাসান ও প্রেসিডেন্ট দো লরেঞ্জোকে আটক করব। আপনারা যদি বাধা হয়ে না দাঁড়ান, দুই সরকারের সাথে একটা সমঝোতায় আসব আমরা, টাকা নিয়ে চলে যাব।

 সুলেমান আজিজের মুখোশ আঁটা চেহারা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলেন ক্যাপটেন কলিন্স, লোকটা মিথ্যে বলছে কিনা বুঝতে চাইছেন। তার মনে হলো, লোকটা সত্যি কথাই বলছে। ভদ্রলোকের জানা নেই, সুলেমান আজিজের রয়েছে দুর্লভ অভিনয় প্রতিভা।

তা না হলে তুমি আমার ক্রুদের খুন করবে?

তাদের সাথে আপনাকেও।

কী চাও তুমি?

প্রায় কিছুই না। মি. পারকার আর মি. জোন্স আমাকে ক্যাপটেন কলিন্স বলে বিশ্বাস করে নিয়েছেন। কিন্তু আমার দরকার ফাস্ট অফিসারের সার্ভিস। আপনি তাকে আমার নির্দেশ মানার হুকুম দিন।

কেন, মি, ফিনির সার্ভিস কেন দরকার তোমার?।

আপনার কেবিনে ডেস্ক ড্রয়ারটা খুলে অফিসারদের পার্সোনাল রেকর্ড পড়েছি আমি, বলল সুলেমান আজিজ। মি. মাইকেল ফিনি এদিকের পানি সম্পর্কে জানেন।

ঠিক কী চাইছ?

একজন পাইলটকে জাহাজে ডাকার ঝুঁকি আমরা নিতে পারি না, ব্যাখ্যা করল সুলেমান আজিজ। কাল সন্ধের পর হেলম-এর দায়িত্ব ফিনিকে নিতে হবে, জাহাজটাকে চালিয়ে চ্যানেল থেকে বের করে নিয়ে যাবেন উনি খোলা সাগরে।

 শান্তভাবে প্রস্তাবটি বিবেচনা করলেন ক্যাপটেন। খানিক পর ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন তিনি। বন্দর কর্তৃপক্ষ খবর পাওয়ামাত্র প্রবেশপথ বন্ধ করে দেবে, ক্রুদের তোমরা খুন করার ভয় দেখাও আর নাই দেখাও।

 টের পাবে না। কালো রং করা একটা জাহাজ কালো রাতে অনায়াসে কর্তৃপক্ষের চোখকে ফাঁকি দিতে পারে।

কতদূর যেতে পারবে বলে মনে করো? দিনের আলো ফোঁটার সাথে সাথে লেডি ফ্ল্যামবোরোর একশো মাইল ঘিরে চারদিকে গিজগিজ করবে পেট্রল বোট।

তারা আমাদের খুঁজে পাবে না, আশ্বস্ত করার সুরে বলল সুলেমান আজিজ।

সামান্য অস্থির দেখাল ক্যাপটেনকে। বললেই তো হবে না! লেডি ফ্ল্যামবোয়রার মতো একটা জাহাজকে কেউ লুকিয়ে ফেলতে পারে না।

সত্যি কথা, বলল সুলেমান আজিজ, সবজান্তর হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে। অন্যের বেলায় সত্যি। কিন্তু আমি এটাকে গায়েব করে দিতে পারি।

কাল সকালে অভ্যর্থনা অনুষ্ঠান, নিজের কেবিনে বসে নোট লিখছে আইজ্যাক জোন্স। দরজায় নক করে ভেতরে ঢুকল হারবার্ট পারকার। ক্লান্ত সে, ইউনিফর্ম ঘামে ভিজে আছে।

ঘাড় ফিরিয়ে তার দিকে তাকাল জোন্স। লোডিং ডিউটি শেষ হলো?

 হ্যাঁ, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।

ঘুমোবার আগে এক ঢোক চলবে নাকি?

তোমার স্কটিশ মল্ট হুইস্কি?

ডেস্ক ছেড়ে উঠল আইজ্যাক জোন্স, ড্রেসারের দেরাজ থেকে একটা বোতল বের করল। দুটে গ্লাসে হুইস্কি ভরে ফিরে এল সে। ব্যাপারটাকে এভাবে দেখো-ভোররাতে নোঙর পাহারা দেয়ার দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছ।

কার্গো লোডিংয়ের চেয়ে সেটাই ভালো ছিল, ক্লান্ত সুরে বলল মার্টিন। তোমার কি খবর?

এই মাত্র ডিউটি শেষ হলো।

তোমার পোর্টে আলো না দেখলে ভেতরে ঢুকতাম না।

সকালের অনুষ্ঠানটা সুন্দর হওয়া চাই, তাই খুঁটিনাটি বিষয়গুলো লিখে রাখছিলাম।

ফিনিকে কোথাও দেখতে পেলাম না, তাই ভাবলাম তোমার সাথেই কথা বলি।

এই প্রথম জোন্স লক্ষ করল পারকারের চেহারায় কেমন যেন একটা দিশেহারা ভাব। কী ব্যাপার, কী হয়েছে তোমার?

গলায় হুইস্কি ঢেলে খালি গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে থাকল পারকার। এ ধরনের কার্গো আগে কখনও তুলিনি আমরা। এটা একটা প্রমোদতরী, তাই না?

 এ ধরনের কার্গো মানে? কী তুলেছ তোমরা? কৌতূহলী হয়ে উঠল জোন্স। চুপচাপ বসে থাকল পারকার, শুধু এদিক ওদিক মাথা নাড়ল। তারপর মুখ তুলে তাকাল সে, বলল, পেইন্টিং গিয়ার। এয়ার কমপ্রেসার, ব্রাশ, রোলার আর পঞ্চাশটা ড্রাম-বোধ হয় রং ভর্তি।

রং? জোন্স দ্রুত জিজ্ঞেস করল। কী রং?

 মাথা নাড়ল পারকার। তা বলতে পারব না। ড্রামের লেখাগুলো স্প্যানিশ।

এর মধ্যে আশ্চর্য হবার কী আছে? রিফিটের সময় লাগবে মনে করে কোম্পানি ওগুলো হাতের কাছে রাখতে চাইতে পারে।

আহা, সবটুকু আগে শোনোই না। শুধু ওগুলো নয়, প্লাস্টিকের বিশাল আকারের অনেকগুলো রোলও আমরা তুলেছি।

প্লাস্টিক?

প্লাস্টিক আর প্রকাণ্ড আকারের অনেকগুলো ফাইবারবোর্ড, বলল পারকার। অন্ত ত কয়েক কিলোমিটার তো হবেই। লোডিং ডোর দিয়ে বহু কষ্টে ঢোকানো গেছে। ভেতরে গুজতেই বেরিয়ে গেছে তিন ঘণ্টা।

 জোন্স তার খালি গ্লাসের দিকে আধবোজা চোখে তাকিয়ে থাকল। তোমার কি ধারণা, কোম্পানি ওগুলো নিয়ে কী করবে?

 চোখে বিস্ময় নিয়ে তার দিকে তাকাল পারকার, কপাল কুঁচকে উঠল। কী জানি! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *