২৫. আনঅফিশিয়াল ভিজিট

২৫.

আমার এটা আনঅফিশিয়াল ভিজিট, হে’লা কামিলকে বললেন জুলিয়াস শিলার, সিনেটর পিটের স্কি লজের সিটিংরুমে ঢুকলেন ওঁরা। সবাই জানে এই মুহূর্তে কী ওয়েস্টে মাছ ধরছি আমি।

বুঝতে পারছি, হে’লা কামিল বললেন। কুক আর সিকিউরিটি গার্ডদের সাথে কত আর কথা বলা যায়, আপনি আসায় আমি খুশি হয়েছি। আইসল্যান্ডে তৈরি খয়েরি রঙের সোয়েটার জ্যাকেট আর ম্যাচ করা প্যান্ট পরে জুলিয়াস শিলারকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন তিনি, জুলিয়াস শিলার যেমন স্মরণ করতে পারেন তার চেয়ে অনেক কম লাগল বয়স।

পরনে বিজনেস স্যুট, তার সাথে পায়ে ছুঁচাল উগার জুতো আর হাতে অ্যাটাচি কেস থাকায়, স্কি রিসর্ট-এ কেমন যে বেমানান লাগছে ভদ্রলোককে। আপনার নিরাপদ সময়টা আরও সহনীয় করার জন্য আমার যদি কিছু করার থাকে, মিস কামিল…

না, ধন্যবাদ। কোনো কাজে হাত দিতে পারছি না, এটাই অস্থির করে তুলেছে আমাকে।

আর তো মাত্র কয়টা দিন।

আপনাকে কিন্তু মোটেও আশা করিনি, দাঁড়িয়ে পড়লেন হে’লা কামিল, সরাসরি তাকালেন শিলারের দিকে।

মিসরের স্বার্থ আছে এমন একটা ব্যাপারে কথা বলতে চাই আপনার সাথে। আমাদের প্রেসিডেন্ট ভাবছেন, সব কথা আপনাকে জানানো দরকার।

ইঙ্গিতে একটা সোফা দেখিয়ে বসলেন হে’লা কামিল। চোখে প্রশ্ন, নির্লিপ্ত চেহারা।

আপনার সহযোগিতা পেলে তিনি ভারি কৃতজ্ঞ বোধ করবেন।

কোন ব্যাপারে?

সোফায় বসে হাঁটুর ওপর রেখে অ্যাটাচি কেসটা খুললেন জুলিয়াস শিলার, ভেতর থেকে একটা ফোল্ডার বের করে বাড়িয়ে দিলেন হে’লা কামিলের দিকে। বেয়ারা চা দিয়ে গেল।

ফোল্ডারের শেষ পাতাটি পড়া শেষ করে মুখ তুললেন হে’লা কামিল। তার চোখে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। এটা কি এখন পাবলিক নিউজ?

 মাথা ঝাঁকালেন জুলিয়াস শিলার। আজ বিকেলে ঘোষণা করা হবে যে, জাহাজটা পাওয়া গেছে। তবে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির কথাটা গোপন রাখা হচ্ছে।

জানালা দিয়ে বাইরে, দূরে তাকালেন হে’লা কামিল। ষোলোশো বছর আগে আমাদের লাইব্রেরি হারানো আর আজ আপনাদের ওয়াশিংটন আর্কাইভ ও ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারি পুড়িয়ে দেয়া দুটো প্রায় সমর্থক, তাই না?

মাথা ঝাঁকালেন জুলিয়াস শিলার। সমার্থক।

 প্রাচীন বইগুলো উদ্ধার পাবার কোনো আশা আছে?

এখনও আমরা জানি না। মোম ট্যাবলেগুলো অস্পষ্ট কিছু সূত্র দিতে পারছে। মাত্র। আইসল্যান্ড আর দক্ষিণ আফ্রিকার মাঝখানে যেকোনো জায়গায় লাইব্রেরিটা থাকতে পারে।

 তবে আপনারা খুঁজে দেখতে চাইছেন, বললেন হে’লা কামিল, আগ্রহের সাথে সিধে হয়ে বসলেন তিনি।

হ্যাঁ, একটা দল গঠন করা হয়েছে, কাজও শুরু করেছে তারা।

আর কে জানে?

 প্রেসিডেন্ট, আমি, টিমের লোকজন, সরকারি দুচারজন কর্মকর্তা, আমাদের এক কী দু’জন বিশ্বস্ত বন্ধু।

আমাদের প্রেসিডেন্টকে না জানিয়ে আমাকে জানানোর কথা ভাবলেন কেন?

সোফা ছেড়ে কার্পেটের ওপর দিয়ে হেঁটে গেলেন জুলিয়াস শিলার, তারপর হে’লা কামিলের দিকে ফিরলেন। প্রেসিডেন্ট হাসান অদূর ভবিষ্যতে ক্ষমতায় না-ও থাকতে পারেন। তাকে জানানোর চেষ্টা করা হলে তথ্যটা ভুল লোকের হাতে পৌঁছে যেতে পারে।

আখমত ইয়াজিদ।

সত্যি কথা বলতে কি, হ্যাঁ।

কিম্ভ পর হলেও আখমত ইয়াজিদকে তথ্যটা আপনারা জানাবেন। লাইব্রেরির খোঁজ পাওয়া গেলে সেটা মিসরকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানাবে সে। প্রতিটি মিসরবাসীর দাবি হবে সেটা। আমিও তাই চাইব।

ব্যাপারটা আমরা বুঝি, বললেন জুলিয়াস শিলার। সে ব্যাপারে কথা বলার জন্যই আপনার কাছে আমার আসা। আমাদের প্রেসিডেন্ট চান, আপনার ভাষণে আবিষ্কারের কথাটা আপনি ঘোষণা করুন।

কঠোর হলো হে’লা কামিলের দৃষ্টি। তাতে কী লাভ?

 আমরা চাইছি আবিষ্কারটা যেন আপানাদের বর্তমান প্রেসিডেন্টের পক্ষে জনমত তৈরিতে সাহায্য করে। মিসরকে কয়েকশো বিলিয়ন ডলারের খনিজ সম্পদের নকশা উপহার দিতে পারে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি।

রাগে লালচে হলো হে’লা কামিলের চেহারা। খোঁজ পেতে যেখানে কয়েক বছর লাগতে পারে, সেখানে কি করে আপনারা আশা করেন দেশবাসীকে আমি বলব, দাঁড়াও, তোমাদের সুদিন এসে গেছে, আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির বদৌলতে আমরা ধনী হয়ে গেছ? মি. শিলার, মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে অনেক বাজে খেলা খেলেছেন আপনারা, এটাও সে রকম একটা নোংরা খেলা। মিসরবাসীকে মিথ্যে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য আমাকে আপনারা খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন, এতটা আশা করে বসে আছেন?

 ধীরে ধীরে ফিরে এসে সোফায় আবার বসলেন জুলিয়াস শিলার। কোনো প্রতিবাদ করলেন না।

 আপনি ভুল করেছেন, মি, শিলার। আমি আমার সরকারের পতন দেখব, মোস্তাফা ইয়াজিদের পাঠানো খুনিদের হাতে মারা যাবার ঝুঁকি নেব, কিন্তু দেশবাসীকে মিথ্যে তথ্য সরবরাহ করতে পারব না।

মহৎ ভাবাবেগ, শান্তকণ্ঠে বললেন জুলিয়াস শিলার। আপনার নীতির প্রতি আমার শ্রদ্ধা প্রকাশ করছি। তবে, এখনও আমার বিশ্বাস, প্ল্যানটা সব দিক থেকে ভালো।

দেশের কাছে আমি মিথ্যেবাদিনী হয়ে যাব, বুঝতে পারছেন না? শেষ পর্যন্ত যদি লাইব্রেরিটার সন্ধান পাওয়া না যায়? পাওয়া না গেলে আপনারাও দুর্নামের ভাগীদার হবেন। এমনিতেও আপনাদের মধ্যপ্রাচ্য নীতি।

একটা হাত তুলে বাধা দিলেন জুলিয়াস শিলার। হ্যাঁ, কিছু ভুল আমরা করেছি। কিন্তু, মিস কামিল, এখানে আমি আপনার সাথে মধ্যপ্রাচ্য নীতি নিয়ে কথা বলতে আসিনি।

দুঃখিত। আপনাকে আমি কোনো সাহায্য করতে পারলাম না।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে জুলিয়াস শিলার বললেন, বেশ। প্রেসিডেন্টকে আপনার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানাব আমি। তিনি যে ভীষণ হতাশ হবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অ্যাটাচি কেস হাতে নিয়ে সোফা ছাড়লেন তিনি, দরজার দিকে পা বাড়ালেন।

দাঁড়ান! তীক্ষ্ণ আদেশের সুরে বললেন জাতিসংঘ মহাসচিব।

দাঁড়ালেন জুলিয়াস শিলার, ধীরে ধীরে ঘুরলেন। প্লিজ?

সোফা ছেড়ে দাঁড়ালেন হে’লা কামিল, কিন্তু এগিয়ে এলেন না। প্রমাণ করুন, লাইব্রেরির সন্ধান পাবার মতো পজিটিভ সূত্র আপনাদের হাতে আছে, হোয়াইট হাউসের অনুরোধ রক্ষা করব আমি। সূত্রগুলো নির্ভেজাল কি না সেটা আমি নিজে বুঝব।

ভাষণে উল্লেখ করবেন?

 হ্যাঁ।

 কিন্তু ভাষণের আর মাত্র চারদিন বাকি। এত অল্প সময়ে…

ওটাই আমার শর্ত।

গম্ভীরভাবে মাথা ঝাঁকালেন জুলিয়াস শিলার। ঠিক আছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে হন হন। করে এগোলেন তিনি।

.

শিলারের গাড়িটা প্রাইভেট রোড থেকে হাইওয়ে নাইনে বেরিয়ে এল। গাড়ি বা আরোহীকে চিনতে না পারলেও, এই প্রাইভেট রোড ধরে খানিক দূর গেলেই যে সিনেটর পিটের লজ দেখা যাবে তা ভালো করেই জানে মোহাম্মদ ইসমাইল। মার্সিডিটা চলে গেল স্কি শহর ব্রেকেনরিজ-এর দিকে।

মার্সিডিজটা যে সরকারি গাড়ি, বুঝতে পারল মোহাম্মদ ইসমাইল। প্রাইভেট রোডের ওপর সশস্ত্র লোকজন হাঁটাচলা করছে, মাঝেমধ্যে কথা বলছে, রেডিও ট্রান্সমিটারে, রাস্তার মুখেই দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা ডজ ভ্যান। এসব দেখে মোহাম্মদ ইসমাইলের বুঝতে বাকি থাকল না, ওয়াশিংটন থেকে ইয়াজিদের এজেন্টরা যে তথ্য সংগ্রহ করেছে তা মিথ্যে নয়।

 একটা মার্সিডিজ-বেঞ্জ ডিলে সিডানের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মোহাম্মদ ইসমাইল, গাড়ির ভেতর বসা লোকটাকে আড়াল করে রেখেছে সে, চোখে বাইনোকুলার নিয়ে খোলা জানালা দিয়ে প্রাইভেট রোডটার দিকে তাকিয়ে লোকটা। গাড়ির ছাদে একটা ব্ল্যাক, তাতে কয়েক সেট স্কি। মোহাম্মদ ইসমাইলের পরনে সাদা স্কি স্যুট, মুখেও সে একটা স্কি মাস্ক পরেছে। স্কি র‍্যাক অ্যাডজাস্ট করার ছলে আরেক দিকে মুখ ফেরাল সে, জিজ্ঞেস করল, দেখা হলো?

 আর এক মিনিট, বলল লোকটা। লজটা দেখছে সে, গাছের ফাঁক দিয়ে কোনো রকমে দেখা যাচ্ছে। লোকটার মুখ ভর্তি দাড়ি, মাথায় ঝাকড়া চুল।

তাড়াতাড়ি করো ঠাণ্ডায় কাপ ধরে যাচ্ছে। কী রকম বুঝছ?

সব মিলিয়ে মাত্র পাঁচজন গার্ড। তিনজন বাড়ির ভেতর, দু’জন গাড়িতে। মাত্র একজন লোক বাড়িটাকে ঘিরে চক্কর দিয়ে আসছে ত্রিশ মিনিট পরপর। ঠাণ্ডা বলে কেউই বেশিক্ষণ বাইরে থাকছে না। তুষারের ওপর দিয়ে প্রতিবার একই পথ ধরে টহল দিচ্ছে ওরা। টিভি ক্যামেরার কোনো চিহ্ন দেখছি না। তবে, ভ্যানের ভেতর থাকতে পারে একটা, বাড়ির ভেতর নজর রাখছে।

হামলাটা করা হবে দুদিক থেকে, মোহাম্মদ ইসমাইল প্ল্যান দিল। একদল বাড়িটা দখল করবে, দ্বিতীয় দলটা টহল গার্ড আর ভ্যানটাকে সামলাবে-হামলা হবে পেছন থেকে, যেদিক থেকে বিপদের সবচেয়ে কম সম্ভাবনা।

আপনি কি আজ রাতেই হামলা করার চিন্তা করছেন? চোখ থেকে বাইনোকুলার নামিয়ে জিজ্ঞেস করল লোকটা।

না, কাল। সকালে যখন আমেরিকান শুয়োরগুলো নাস্তা খাবে।

কিন্তু দিনের বেলা…বিপদ হতে পারে।

আমরা কাপুরুষ নই যে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে কাজ সারব, রেগে গেল মোহাম্মদ ইসমাইল।

কিন্তু এয়ারপোর্টে ফেরার সময় শহরের মাঝখান দিয়ে যেতে হবে, প্রতিবাদ জানাল লোকটা। ট্রাফিক আর কয়েকশো স্কিয়ার থাকবে রাস্তায়। এ ধরনের অহেতুক ঝুঁকি নিতে রাজি হবেন না সুলেমান আজিজ।

 চরকির মতো আধপাক ঘুরে ঠাস করে লোকটার গালে চড় কষাল মোহাম্মদ ইসমাইল। এখানে নেতৃত্ব দিচ্ছি আমি! চাপা গলায় গর্জে উঠল সে। আমার সামনে ফের যদি তার নাম মুখে এনেছ তো খুন করে ফেলব! তার মাতব্বরি করার দিন শেষ হয়ে গেছে!

লোকটা ভয়ও পেল না, নতও হলো না। তার কালো চোখে ঘৃণা ফুটে উঠল। আপনি আমাদের সবাইকে খুন করবেন! শান্তভাবে বলল সে।

বিনিময়ে যদি হে’লা কামিল খুন হয়, তাতেও আমার আপত্তি নেই! হিস হিস করে বলল মোহাম্মদ ইসমাইল।

.

২৬.

অসাধারণ! পিট বলে।

অভিজাত, সত্যি অভিজাত, বিড়বিড় করে বলে লিলি।

মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় জিওর্দিনো, একটা জিনিস!

 দুর্লভ গাড়ির একটা রিস্টোরেশন শপে দাঁড়িয়ে ওরা।

গাড়িটা দর্শনীয় বটে। উনিশশো ত্রিশ সালে তৈরি, এল-টোয়েনটি নাইন কর্ড টাউন করে শোফারের জন্য গাড়ির সামনের অংশটা খোলা। রক্তবর্ণ শরীর, ফেন্ডার হালকা হলুদ, প্যাসেঞ্জার কমপার্টমেন্টের ওপর চামড়ার তৈরি ছাদও তাই। গাড়িটা লম্বা, সুন্দর অভিজত চেহারা ফ্রন্ট হুইল ড্রাইভ। আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ মিটার লম্বা পিটের কার্ড। প্রায় অর্ধেকটাই হুড দিয়ে ঢাকা, শুরু হয়েছে রেস-কার-টাইপ গ্রিল দিয়ে আর শেষ হয়েছে সরু উইন্ডশিল্ড দিয়ে।

ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে কর্ডে চেপে বসল ওরা তিনজন। পিট ড্রাইভিং সিটে, ছাদের নিচে প্যাসেঞ্জার কমপার্টমেন্টে লিলিকে নিয়ে জিওর্দিনো। ইন্টারস্টেট সেভেনটিতে বেরিয়ে এল অ্যান্টিক কার কর্ড। তুষার ঢাকা রকি পাহাড়ের দিকে যাচ্ছে ওরা। হুড ফেলে নিজেকে ঢাকল না পিট, মুখে ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাঁপটা ভালো লাগছে। আট সিলিন্ডার ইঞ্জিনের আওয়াজ শুনছে ও, শুনছে এগজস্টের শব্দ। মেরামত করার পর কোথাও কোনো ত্রুটি নেই। মনটা খুশি হয়ে উঠল ওর। জানে না অদূর ভবিষ্যতে কি অপেক্ষা করছে ওদের জন্য। জানলে, সোজা গাড়ি ঘুরিয়ে ডেনভারের পথ ধরত।

.

হোটেলে পৌঁছে রিসেপশন থেকে দুটো মেসেজ পেল পিট। পড়ে পকেটে রেখে দিল।

 ড. রোথবার্গ তার বাড়িতে ডিনার খাবার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। রাস্তার ওপারেই তার বাড়ি।

কখন? পেটে হাত বুলিয়ে আগ্রহের সাথে জানতে চাইল জিওর্দিনো।

সাড়ে সাতটায়।

হাত ঘড়িতে চোখ বুলালো লিলি। শাওয়ার নিয়ে চুল ঠিক করতে মাত্র চল্লিশ মিনিট সময় পাচ্ছি, আমি বরং কামরায় ঢুকি।

পোর্টারের পিছু নিয়ে লিলি চলে যাবার সাথে সাথে জিওর্দিনোকে সাথে আসার ইঙ্গিত দিয়ে ককটেল লাউঞ্জে চলে এল পিট। বারমেইড অর্ডার নিয়ে সরে যাবার পর পকেট থেকে দ্বিতীয় মেসেজটা বের করে হাত ধরিয়ে দিল।

জিওর্দিনো নিচু গলায় পড়ল, তোমাদের লাইব্রেরি প্রজেক্ট টপ প্রায়োরিটি পেয়ে গেছে। আগামী চার দিনের মধ্যে আলেকজান্দ্রিয়ার ঠিকানা খুঁজে বের করাটা অত্যন্ত জরুরি। লাক, ড্যাডি। মুখ তুলে পিটের দিকে তাকাল সে। পড়তে ভুল করিনি তো? মাত্র চারদিনের মধ্যে? স্কি করার কথা ভুলে যাও।

 ব্যস্ত হয়ে কী লাভ? বলল পিট। ইয়েজারের ভাগ্যে শিকে না ছেঁড়া পর্যন্ত আমাদের কিছু করার নেই। চেয়ার ছাড়াল ও তার একটা খবর নেয়া দরকার।

হোটেলের লবি থেকে ফোন করল পিট। ইয়েজার, পিট বলছি। কতদূর এগোবে?

এগোচ্ছি।

কিছু পেলে?

কয়েকটা কম্পিউটর কাজ করছে, ব্যাংকগুলোর জিওলজিকাল ডাকা, ক্যাসাব্লাঙ্কা থেকে জাঞ্জিবার পর্যন্ত, তন্নতন্ন করে যাচাই করা হচ্ছে। আফ্রিকা উপকূলে এমন কোনো স্পট নেই, যা তোমার নকশার সাথে মেলে। তিনটে অস্পষ্ট বা ক্ষীণ সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু পরে আমি সেগুলোও বাতিল করে দিয়েছি। ষোলোশো বছরে ল্যান্ডমাস ট্রান্সফরমেশন অবশ্যই ঘটেছে, সম্ভাবনাগুলোর সাথে তার হিসাব ধরলে কোনো মিলই আর পাওয়া যায় না।

তোমার পরবর্তী পদক্ষেপ?

উত্তর দিকে সার্চ করব। সময় আরও বেশি লাগবে। কারণ ব্রিটিশ দ্বীপগুলো ছাড়াও বাল্টিক সী আর সাইবেরিয়া স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর উপকূল রেখা ধরে কাজ করতে হবে আমাকে।

চার দিনের মধ্যে শেষ করতে পারবে?

 তুমি তাগাদা দিলে ভাড়াটে কর্মীদের সংখ্যা বাড়াতে পারি।

তাগাদা খুব জোরাল বলে ধরে নাও। আর্জেন্ট প্রায়োরিটি।

 ঠিক আছে, সাধ্যমতো চেষ্টা করব।

ব্রেকেনরিজ, কলোরাভোয় রয়েছি আমরা। যদি কিছু পাও, ব্রেকেনরিজ হোটেলে খবর দেবে। ইয়েজারকে রুম আর ফোন নম্বর দিল পিট। ভালো কথা, তোমাকে এত খুশি লাগছে কেন?

নদীটা কোথায় এখনও তা আমি জানি না, জবাব দিল হিরাম ইয়েজার, কিন্তু জানি কোথায় সেটা নেই।

.

হোটেল থেকে বেরিয়ে রাস্তা পেরোল ওরা, সাদা পাউডারের মতো তুষারে ঢাকা পড়ে গেল জামা-কাপড়। অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের ২২ বি নম্বরে থাকেন ড. বেরট্রাম রোথবার্গ। দরজা খুলে দিয়ে এমন আন্তরিকতার সাথে ওদেরকে তিনি অভ্যর্থনা জানালেন যেন কত বছরের পরিচয়। সিটিংরুমে, আগুনের চারপাশে বসালেন ওদেরকে। নিজে রান্না করতে শিখিনি, রেস্তোরাঁ থেকে দিয়ে যায়-আজ আটটার সময় দেবে। তার আগে একটু গরম হয়ে না, বাছারা! তিনি নিজেই সবার হাতে হুইস্কির গ্লাস ধরিয়ে দিলেন। পিট নিজেদের পরিচয় দিল না। সন্দেহ নেই, সিনেটর পিট আগেই ওদের সবার বর্ণনা পাঠিয়ে দিয়েছেন।

 বাবা বলছিলেন আপনি নাকি সারা জীবন ধরে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির ওপর গবেষণা করছেন।

ছোটখাট মানুষটা, মোটা সোয়েটার আর ট্রাউজার পরে আছেন, দাড়ি আর গোঁফে ঢাকা পড়ে আছ ছোট্ট মুখটা। সলজ্জভাবে একটু হাসলেন তিনি। বত্রিশ বছর। ধুলো ঢাকা বুকশেলফ আর প্রাচীন পাণ্ডুলিপি ঘেঁটে শুধু চোখ নষ্ট করেছি, বোধ হয় বিয়ে করে সংসারী হলেই ভালো করতাম। তবে সাবজেক্টটা আমার কাছে রক্ষিতার মতো কখনও কিছু চায় না, শুধু দেয়। আমি যে তার প্রেমে পড়ে গেছি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। গলা ছেড়ে হেসে উঠলেন প্রৌঢ় ইতিহাসবেত্তা। তারপর লিলির দিকে ফিরে বললেন, একজন আর্কিওলজিস্ট হিসেবে তুমি আমার অনুভূতি বুঝতে পারবে।

লাইব্রেরিটা সম্পর্কে বলবেন আমাদের, প্লিজ? অনুবোধ জানাল জিওর্দিনো।

ফায়ারপ্লেসের আগুনটা উসকে দিয়ে এলেন ড. রোথবার্গ। প্রাচীন দুনিয়ার একটা বিস্ময় ছিল আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি। গোটা সভ্যতার সমস্ত দলিলপত্র আর নমুনা ওখানে সংগ্রহ করে রাখা হয়েছিল। আধবোজা চোখে বলে গেলেন তিনি, যেন তাকে সমাহিত করা হয়েছে।

 গ্রিক ঈজিপশিয়ান আর রোমানদের মহৎ শিল্প আর সাহিত্য ইহুদিদের পবিত্র বাণী, প্রাচীন দুনিয়ার সেরা মেধাসম্পন্ন মনীষীদের জ্ঞান আর কীর্তি, দর্শনের বিস্ময়কর তত্ত্ব, সুর আর সঙ্গীতের অপূর্ব সব আবিষ্কার, প্রাচীন বেস্টসেলার, বিজ্ঞান আর মেডিসিনের যুগান্তকারী সব কৃতিত্ব, কী না জমা ছিল লাইব্রেরিটায়!

ওটা কি সাধারণ মানুষের জন্য খোলা থাকত?

মুর্খ বা ভিখিরীদের অবশ্যই প্রবেশাধিকার ছিল না, বললেন ড. রোথবার্গ। তবে গবেষক আর পণ্ডিতরা নিয়মিত যেতেন লাইব্রেরিতে-পরীক্ষা, যাচাই, অনুবাদ, সংশোধন করতেন তারা; ক্যাটালগ তৈরি করতেন। শুধু সংগ্রহশালা বললে ভুল হবে, ওটা ছিল দুনিয়ার প্রথম রেফারেন্স লাইব্রেরি। প্রতিটি আইটেম ক্যাটালগে ভোলা ছিল, সুন্দরভাবে সাজানো-গোছানো রাখা হতো।

পরবর্তী সম্রাটরা এবং বহু জাতি আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির ঋণ মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছে। প্রাচীন যুগে আর কোনো প্রতিষ্ঠানে এত জ্ঞান-সম্পদ ছিল না। প্লিনী, প্রখ্যাত রোমান পণ্ডিত, প্রথম খ্রিস্টাব্দে এনসাইক্লোপিডিয়া রচনা করেন। অ্যারিসটোফানেস, খ্রিস্টের জন্মের দুশো বছর আগে লাইব্রেরির প্রধান ছিলেন-তোমরা জানো, তিনিই প্রথম অভিধান রচনা করেন। ক্যালিম্যাচাস গ্রিক ট্র্যাজেডির বিখ্যাত লেখক, সবার আগে রচনা করেন হুজ হু! পণ্ডিত, অঙ্কশাস্ত্রবিদ ইউক্লিড জ্যামিতির ওপর প্রথম টেক্সটবুক লেখেন। সুষ্ঠুভাবে সাজিয়ে ব্যাকরণের নিয়মকানুন প্রথম প্রকাশ করেন। ডাইয়োনাইসিয়াস। আর্ট অব গ্রামার তার একটা মহৎ সৃষ্টি, প্রায় সব ভাষার জন্য ওটা একটা মডেল হয়ে ওঠে। এই সব মনীষীরা, আরও হাজার হাজার পণ্ডিতদের সাথে বসে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন।

আপনি যেন একটা ইউনিভার্সিটির বর্ণনা দিচ্ছেন, মন্তব্য করল পিট।

ইউনিভার্সিটিই তো ছিল সেটা। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানভাণ্ডার। তখনকার দিনে লাইব্রেরি আর মিউজিয়ামটাকে এক করে বলাও হত তাই-হেলেনিস্টিক দুনিয়ার ইউনিভার্সিটি। সাদা মার্বেল পাথরের তৈরি বিশাল সব কাঠামোর মধ্যে পিকচার গ্যালারি ছিল, মূর্তিগুলোর জন্য ছিল আলাদা হলঘর, কবিতা পাঠের আসর বসত থিয়েটার হলে, পণ্ডিতরা জ্ঞানগর্ভ লেকচার দিতেন মঞ্চে দাঁড়িয়ে। লাইব্রেরির সাথে ডরমিটরি, ডাইনিং হল, চিড়িয়াখানা আর বোটনিক্যাল গার্ডেনও ছিল। প্রকাণ্ড আকারের দশটা হলঘরে রাখা হতো বই আর পাণ্ডুলিপি। সেগুলোর কয়েক হাজার ছিল হাতে লেখা, হয় প্যাপিরাসে নয়তো পার্চমেন্ট। লেখার পর সেগুলো গুটিয়ে ব্রোঞ্জ টিউবে ঢুকিয়ে রাখা হতো।

দুটোর মধ্যে পার্থক্য কী? প্রশ্ন করল অ্যাল।

প্যাপিরাস ট্রপিকাল প্লান্ট। মিসরীয়রা ওটার কাণ্ড থেকে লেখার জন্য কাগজের মতো এক ধরনের জিনিস তৈরি করত। পার্চমেন্ট, ভেল্যাম-ও বলা হয়, তৈরি হতো পশুর চামড়া থেকে-হাতি গরু ছাগল বা ভেড়ার বাচ্চার চামড়াই ব্যবহার করা হতো সাধারণত।

এত দিনে ওগুলো নষ্ট হয়ে যাবার কথা নয়? জিজ্ঞেস করল পিট।

প্যাপিরাসের চেয়ে বেশি দিন টেকার কথা পার্চমেন্টের, বললেন ড. রোথবার্গ। পিটের দিকে তাকালেন তিনি। মোলোশো বছর পর ওগুলোর অবস্থা কী হয়েছে নির্ভর করে কোথায় রাখা হয়েছে তার ওপর। মিসরীয় সমাধি থেকে পাওয়া তিন হাজার বছরের পুরনো প্যাপিরাসের লেখাও তো পড়া গেছে।

গরম আর শুকনো আবহাওয়া।

ধরুন, সুইডেন বা রাশিয়ার উত্তর উপকূল কোথাও আছে ওগুলো।

চিন্তিতভাবে মাথা নিচু করলেন ড. নোথবার্গ। শীত ওগুলোকে সংরক্ষণ করবে, কিন্তু গরমের দিনে পচে যেতে পারে।

লাইব্রেরিটাকে অক্ষত খুঁজে পাবার সম্ভাবনা ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসছে বুঝতে পেরে মন খারাপ হয়ে গেল পিটের। কিন্তু লিলি ওর মতো হাতাশ নয়। সে কণ্ঠস্বরে উত্তেজনা নিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি যদি জুনিয়াস ভেনাটর হতেন, ড. রোথবার্গ, কী ধরনের বই আপনি রক্ষা করতে চাইতেন?

কঠিন প্রশ্ন, চোখ পিট পিট করে লিলির দিকে ফিরলেন ড. রোথবার্গ। আমি শুধু আন্দাজ করতে পারি। সোফোক্লিস, ইউরিপেডিস, অ্যারিস্টটল আর প্লেটোর সমগ্র রচনা তো থাকবেই। আরও থাকবে, অবশ্যই, হোমার। তিনি বই লিখেছেন চব্বিশটা, কিন্তু অল্প দুচারটে হাতে পেয়েছি আমরা। আমরা ধারণা, গ্রিক, এট্রাসক্যান, রোমান ও ঈজিপশিয়ান মিলিয়ে পঞ্চাশ হার ভলিউম ইতিহাস অবশ্যই সাথে নিয়েছিলেন ভেনাটর, কারণ জাহাজের সংখ্যা তো আর কম ছিল না। ঈজিপশিয়ান বইগুলো অত্যন্ত মূল্যবান হবে, কারণ ওগুলো শুধু আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিতে ছিল বলে প্রাচীন মিসরে জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্প, ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ে কিছুই আমরা আনতে পারিনি। এট্রাসক্যান সভ্যতা সম্পর্কেও প্রায় কিছুই আমরা জানি না অথচ ক্লডিয়াস তাদেরকে নিয়ে বড়সড় একটা ইতিহাস লিখেছিলেন-সেটাও নিশ্চয়ই লাইব্রেরির কোনো শেলফে আছে। ভেনাটরের জায়গায় আমি হলে হিব্রু আর খ্রিস্টান আইন ও ঐতিহ্য সম্পর্কে লেখাগুলোও সাথে নিতাম। ওগুলোয় হয়তো এমন সব তথ্য ও উপাদান আছে, যা আজকের খ্রিস্টান ধর্মের পণ্ডিতদের বেকায়দায় ফেলে দিত।

বিজ্ঞান?

বিজ্ঞানের ওপর অসংখ্য বই লেখা হয়েছে সে যুগে। ভেনাটর সেগুলো না নিয়ে পারেন না।

রান্নার বইয়ের কথা ভুলে যাবেন না, লিলি বলে।

হেসে উঠলেন ড. রোথবার্গ। ভেনাটর অত্যন্ত বিবেচক ও বুদ্ধিমান মানুষ ছিলেন, জ্ঞানের কোনো শাখাই তার চোখ এড়িয়ে যায়নি। শুধু রান্নাবান্না কেন, দৈনন্দিন প্রয়োজনের ওপর বা ঘর-গেরস্থালির ওপর লেখা বইও তিনি জাহাজে তুলেছিলেন বলে ধরে নেয়া যায়। সবার জন্যই কিছু না কিছু নিয়েছিলেন তিনি।

বিশেষ করে প্রাচীন জিওলজিকাল ডাটা, বলল পিট।

 হ্যাঁ।

আচ্ছা, এ কথা কি জানা গেছে, মানুষটা কেমন ছিলেন তিনি? লিলির প্রশ্ন।

ভেনাটর?

হ্যাঁ।

 তার যুগে তিনি সেরা বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম ছিলেন। এথেন্সে পণ্ডিত বলে খ্যাতি ছিল তার, সেখানে তিনি শিক্ষকতা করতেন। আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি ও মিউজিয়ামের কিউরেটর হিসেবে ভাড়া করে নিয়ে আসা হয় তাকে। আমরা জানি, রাজনীতি আর সামাজিক বিষয় নিয়ে একশোর ওপর বই লিখেছেন তিনি, আজ থেকে চার হাজার বছরের পুরনো পটভূমি সন্ধানও সেসব বইতে পাওয়া যায়। কিন্তু তার কোনো বই-ই রক্ষা পায়নি।

তাঁর সম্পর্কে আর কী জানেন আপনি? পিটের প্রশ্ন।

খুব বেশি না। ভেনাটরের অনেক মেধাবী ছাত্র ছিলেন, যারা পরে বিখ্যাত হয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন অ্যানটিওক-এর ডায়োক্রেস। ডায়োক্লেস তার একটা রচনায় ভেনাটরের কথা উল্লেখ করেছেন-তার শিক্ষক নতুন কিছু প্রবর্তন বা আবিষ্কারের প্রতি নিবেদিত ছিলেন, এমন সব বিষয়ে গবেষণা চালাতেন তিনি, অন্যান্য পণ্ডিতরা সেসব বিষয়ে গবেষণা করতে ভয় পেতেন। যদিও খ্রিস্টান ছিলেন, তবে ধর্মকে তিনি সমাজবিজ্ঞান হিসেবে দেখতেন। আলেকজান্দ্রিয়ার বিশপ থিয়োফিলোস এর সাথে এই নিয়েই তার বিরোধ দেখা দেয়। ভেনাটরের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগেন থিয়োফিলোস, রায় দিয়ে বসেন লাইব্রেরি আর মিউজিয়াম পৌত্তলিক ধ্যান-ধারণার ভাণ্ডার হিসেবে কাজ করছে। শেষ পর্যন্ত তিনি সম্রাট থিয়োডোসিয়াসকে লাইব্রেরি আর মিউজিয়াম পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিতে রাজি করান। সম্রাট ছিলেন গোড়া খ্রিস্টান। পোড়ানোর সময় খ্রিস্টান আর অখ্রিস্টানদের মধ্যে তুমুল মারামারি শুরু হয়ে যায়। ধরে নেয়া হয়েছিল, থিয়োফিলোস-এর ফ্যানাটিকাল অনুসারীদের হাতে নিহত হন ভেনাটর।

কিন্তু এখন আমরা জানি সংগ্রহের ভালো একটা অংশ নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি, বলল লিলি।

রাস্তার ঝাড়ুদার লটারিতে এক মিলিয়ন ডলার পেলে যেমন খুশি হয়, সিনেটর পিটের মুখে গ্রিনল্যান্ডে তোমরা কী আবিষ্কার করেছ শুনে আমিও ঠিক সে রকম খুশি হয়েছি।

 ভেনাটর ওগুলো কোথায় রাখত পারেন, আপনি কোনো ধারণা দিতে পারেন? জিজ্ঞেস করল পিট।

দীর্ঘ এক মিনিট চুপ করে থাকলেন ড. রোথবার্গ। তারপর শান্ত গলায় তিনি বললেন, জুনিয়াস ভেনাটর সাধারণ একজন মানুষ ছিলেন না। তিনি তার নিজের পথ অনুসরণ করছিলেন। জ্ঞানের পাহাড় ছিল তাঁর হাতে। বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তি, অমূল্য সম্পদ ভাবী বংশধরদের জন্য সংরক্ষণের ব্যাপারে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি তিনি ব্যবহার করেছেন। ষোলোশো বছর পেরিয়ে যেতে চলল অথচ আজও লাইব্রেরিটার কোনো সন্ধান আমরা পাইনি, এ থেকেই কি প্রমাণ হয় না যে লুকিয়ে রাখার ব্যাপারে অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি? পরাজয় স্বীকার করার ভঙ্গিতে হাত দুটো মাথার ওপর তুললেন তিনি। আমি কোনো সূত্র দিতে অপরাগ। ভেনাটরের বুদ্ধির নাগাল পাওয়া আমার সাধ্যের অতীত।

কিন্তু আন্দাজ করতে অসুবিধা কী? জিজ্ঞেস করল পিট।

 ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে, নৃত্যরত শিখাগুলোর দিকে দীর্ঘ কয়েক সেকেন্ড একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলেন ড. রোথবার্গ। আমরা ধারণা, ভেনাটর ওগুলো এমন এক জায়গায় রেখেছেন, যেখানে খোঁজার কথা ভাববে না কেউ।

.

২৭.

মোহাম্মদ ইসমাইলের হাতঘড়িতে সাতটা আটান্ন মিনিট। একটা ঝোঁপের আড়ালে শুয়ে, পাতার ফাঁক-ফোকর দিয়ে লজটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে। দুটো চিমনির একটা থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। হে’লা কামিল, সে জানে, সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠেন, রাঁধতেও জানেন ভালো। তার অনুমানটাই ঠিক, গার্ডদের জন্য ব্রেকফাস্ট তৈরি করছেন তিনি।

মরুর মানুষ, হিম শীতল ঠাণ্ডা তার সহ্য হচ্ছে না। গোড়ালি ব্যথা করছে, হাত পায়ের আঙুল দস্তানার ভেতর অসাড় হয়ে যাচ্ছে। হাটচলা করা সুযোগ থাকলে খুশি হতো সে। ধীরে ধীরে ভয়টা বাড়ছে তার, এভাবে তুষারের ওপর পড়ে থাকলে ক্ষিপ্রতা হারাবে সে। অপারেশনটা ভেস্তে যেতে পারে, কোনো উদ্দেশ্য পূরণ না করেই খুন হয়ে যেতে পারে প্রতিপক্ষের হাতে।

এ সবই আসলে অনভিজ্ঞতার ফল। মিশনের সংকটময় মুহূর্তে অস্থির হয়ে উঠছে সে। হঠাৎ তার সন্দেহ হলো, আমেরিকান গার্ডরা তার উপস্থিতির কথা জেনে ফেলেনি তো? নার্ভাস হয়ে পড়ায় দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার বা উপস্থিত বুদ্ধি খাটাবার ক্ষমতা হারাচ্ছে মোহাম্মদ ইসমাইল।

 সাতটা উনষাট মিনিট। প্রাইভেট রোডে ঢোকার মুখে চট করে একবার তাকাল সে। ভ্যানটা সেই আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। চার ঘণ্টা পর পর পালা বদল, লজ থেকে ভ্যানে আসে দু’জন, ভ্যান থেকে লজে ফিরে যায় অপর দু’জন। সময় ঘনিয়ে এসেছে, লজ থেকে দু’জন, যেকোনো মুহূর্তে বেরিয়ে আসবে। লজ থেকে ভ্যানটা একশো মিটার দূরে।

বাড়ির পাশ ঘেঁষে একজন গার্ড টহল দিচ্ছে। বরফের ওপর দিয়ে ধীর পায়ে হাঁটছে সে। মোহাম্মদ ইসমাইলের দিকে আসছে লোকটা। নিঃশ্বাস বাস্প হয়ে যাচ্ছে বেরিয়েই। সতর্ক দৃষ্টি বেমানান কিছু দেখার জন্য ছটফট করছে।

চারপাশের বৈচিত্র্যহীন দৃশ্য বা হাড় কাঁপানো শীত সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টকে নিস্তেজ করতে পারেনি। দৃষ্টিপথের প্রতিটি জিনিস খুঁটিয়ে দেখে নিয়ে এগোচ্ছে সে। ডানে-বায়ে তাকাচ্ছে। আর এক মিনিটও নেই, তুষারের ওপর মোহাম্মদ ইসমাইলের পায়ের দাগ দেখতে পাবে সে।

ভাগ্যকে অভিশাপ দিল মোহাম্মদ ইসমাইল, নড়েচড়ে তুষারের ভেতর আরও সেঁধিয়ে যাবার চেষ্টা করল। ঝোঁপের আড়ালে থাকলে কী হবে, সরু পাতা আর চিকন ডালের ফাঁক দিয়ে অবশ্যই তাকে দেখতে পাবে লোকটা। ওগুলো বুলেটও ঠেকাতে পারবে না।

 কাঁটায় কাঁটায় আটটা বাজল। সেই সাথে লজের সামনের দরজা খুলে বেরিয়ে এল দু’জন লোক। তাদের মাথায় ক্যাপ, গায়ে স্কি কোট। রাস্তা ধরে হেঁটে আসছে তারা, শান্তভাবে কথা বলছে, চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিচ্ছে তুষার ঢাকা আশপাশ।

পালাবদলের মুহূর্তে ভ্যানে লোক থাকবে চারজন, ইসমাইলের প্ল্যান ছিল ঠিক তখনই হামলা করবে তারা। হিসেবে ভুল হয়েছে তার, পজিশনে পৌঁছে গেছে সময়ের আগে। প্রাইভেট রোড ধরে পঞ্চাশ মিটারের মতো এগিয়েছে লোক দু’জন, এই সময় টহলরত গার্ড ইসমাইলের পায়ের ছাপ দেখতে পেল।

দাঁড়িয়ে পড়ল সে, ট্রান্সমিটার ধরা হাতটা উঠে গেল ঠোঁটের কাছে। ঠোঁট ফাঁকই হলো শুধু, কোনো আওয়াজ বেরোল না, তার আগেই ইসমাইলের হেকলার অ্যান্ড কোচ এমপি-ফাইভ সাবমেশিন গানের গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল তার গলা।

অনভিজ্ঞ ইসমাইল অসময়ে অ্যাকশন শুরু করতে বাধ্য হলো। পেশাদার কেউ হলে সাইলেন্সর লাগানো সেমিঅটোমেটিক ব্যবহার করত, গুলি করত মাত্র একটা, সেটা লাগত গার্ডের দুই চোখের ঠিক মাঝখানে। দশ রাউন্ড গুলি করে গার্ডের গলা আর বুক ঝাঁঝরা করে দিয়েছে সে, আরও বিশ রাউন্ডের মতো ছড়িয়ে পড়েছে সামনের বনভূমিতে। তার সঙ্গীদের একজন ব্যস্ততার সাথে ভ্যান লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুড়ল একের পর এক, আরেকজন ভ্যানের দুপাশে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ল। একটা গ্রেনেড উইন্ডশিল্ড দিয়ে ভেতরে ঢুকল, জোরাল আওয়াজের সাথে বিস্ফোরিত হলো সেটা। সিনেমায় যেমন দেখা যায় তেমন কিছু ঘটলো না, আগুনের কুন্ডলী নিয়ে বিস্ফোরিত হলো না গ্যাস ট্যাংক। ভ্যানের শরীর ফুলে উঠল, ফেটে গেল, যেন পাকা একটা ফল।

আরোহীদের দু’জনেই সাথে সাথে মারা গেছে।

রক্ততৃষ্ণায় অধীরে দুই খুনি, কারও বয়সই বিশের বেশি নয়, বিধ্বস্ত ভ্যানের ওপর বার বার আঘাত হানল, রাস্তার ওপর যে আরও দু’জন সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট রয়েছে তাদের কথা ভুলে গেছে। ইতোমধ্যে গাছের আড়ালে গা ঢাকা দিয়েছে তারা, কাঁধ থেকে উজি নামিয়ে অব্যর্থ নিশানায় ঘায়েল করল আনাড়ি দুই আতঙ্কবাদীকে। ভ্যানের ভেতর সঙ্গী যারা রয়েছে তাদের আর সাহায্য দরকার নেই, বুঝতে পেরে লজের দিকে দ্রুত পিছু হটতে শুরু করল তারা, একজন ইসমাইলের সাথে গুলি বিনিময় করছে। কাছেপিঠে একটা বড় পাথর পেয়ে তার আড়ালে কাভার নিয়েছে ইসমাইল।

ইসমাইলের প্ল্যানটা মার খেল আরও একটা কারণে। কথা ছিল, গুলির শব্দ হবার সাথে সাথে দশজন আতঙ্কবাদী লজের পেছনের দরজার দিকে ছুটবে। হাঁটু সমান উঁচু, আলগা তুষার বাধা দিল তাদেরকে। অনেক দেরি করে ফেলল তারা, লজের ভেতর থেকে সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টরা ঝাঁক ঝাক গুলি ছুঁড়ে ঠেকিয়ে দিল তাদের।

সন্ত্রাসবাদীদের একজন লজের উত্তর দেয়ালের নিচে অল্প সময়ের জন্য আশ্রয় পেল। গ্রেনেডের পিন খুলে জানালা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিল সে। জানালার কাঁচ কতটা পুরু ধারণা করতে পারেনি, ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল গ্রেনেড়। বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হবার আগে আতঙ্কে শুধু চেহারাটা বিকৃত করার সময় পেল সে।

লাফ দিয়ে ধাপ পেরোল এজেন্ট দু’জন, সদর দরজা স্যাৎ করে ঢুকে পড়ল ভেতরে। বিরামহীন গুলি করছে সন্ত্রাসবাদীরা, একজনের পিঠে একটা বুলেট ঢুকল। পড়ে গেল লোকটা, তার শুধু পা দুটো দোরগোড়ায় দেখা গেল। এক সেকেন্ড পর টেনে ভেতরে ঢোকানো হলো তাকে, দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল দরজা।

 অবিরাম গুলিবর্ষণের সব কয়টা জানালার কাঁচ ভেঙে পড়ল, কিন্তু শক্ত কাঠের দেয়ালগুলোর তেমন কোনো ক্ষতিই হলো না। এজেন্টরা ইসমাইলের আরও দু’জন লোককে ফেলে দিল, তবে বাকি সবাই আড়াল নিয়ে এগিয়ে এল লজের আরও কাছাকাছি। এরপর তারা বিশ্ব মিটার দূর থেকে একের পর এক গ্রেনেড ছুঁড়তে শুরু করল জানালা লক্ষ্য করে।

লজের ভেতর কারও মুখে কথা নেই। একজন এজেন্ট নির্দয় ধাক্কা দিয়ে আনছে সে, ইচ্ছে ফায়ারপ্লেসের মুখটা আড়াল করবে, এই সময় এক ঝাঁক বুলেট ঢুকল ঘরের ভেতর। দেয়ালে পিছলে তিনটে বুলেট ছুটে এল, লোকটার শিরদাঁড়া ভেঙে ভেতরে ঢুকল একটা, বাকি দুটো হৃৎপিণ্ড ফুটো করল। ডেস্কের আড়ালে বলে কিছুই দেখতে পেলেন না হে’লা কামিল, তবে কাঠের মেঝেতে পতনের শব্দটা তিনি শুনতে পেলেন।

গ্রেনেডগুলো বিপজ্জনক করে তুলল পরিস্থিতি। কাছ থেকে গ্রেনেডের টুকরো রাইফেল বুলেটের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিকর। এজেন্টরা অভিজ্ঞ, নিশানাভেদে অব্যর্থ, কিন্তু এ ধরনের ব্যাপক হামলার জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না। অ্যামুনিশন শেষ হয়ে এসেছে, হাতে আর মাত্র কয়েকটা ক্লিপ।

ইসমাইল প্রথম গুলি করার সাথে সাথে ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সাহায্য চাওয়া হয়েছে, কিন্তু জরুরি আবেদনটা ডেনভার সিক্রেট সার্ভিস অফিস হয়ে স্থানীয় শেরিফের কাছে পৌঁছতে মাঝখানে অপচয় হয়েছে মূল্যবান কয়েকটা মিনিট।

স্টোররুমে বিস্ফোরিত হলো একটা গ্রেনেড, রং ভর্তি বড় একটা টিনের পাত্রে আগুন ধরে গেল। স্লেব্লোয়ারে ভরার জন্য যে গ্যাস ক্যানটা ছিল, বিস্ফোরিত হলো সেটা। দেখতে দেখতে লজের এক দিকের পুরোটা দেয়ালে আগুন ধরে গেল।

আগুন ভালো করে ছড়াবার সাথে সাথে গোলাগুলি বন্ধ হয়ে গেল। চারদিক থেকে বৃত্তটাকে ছোটো করে আনল সন্ত্রাসবাদীরা। তাদের অটোমেটিক রাইফেল প্রতিটি জানালা আর দরজার দিকে তাক করা। আগুনের পুড়ে মরার ভয়ে লজের বাসিন্দারা বেরিয়ে আসতে বাধ্য হবে, ধৈর্যের সাথে সেই আশায় অপেক্ষা করছে।

 এজেন্টদের মাত্র দু’জন এখনও নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভাঙাচোরা, উল্টে পড়া ফার্নিচারের সাথে রক্তাক্ত স্তূপের মতো পড়ে আছে বাকি সবাই। আগুনের শিখা সগর্জনে কিচেন হয়ে পেছন দিককার সিঁড়ি লক্ষ্য করে ছুটল, ছড়িয়ে পড়ল ওপরতলার বেডরুমগুলোয়। এরই মধ্যে আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে, ফায়ারব্রিগেড় ছাড়া আর কারও নেভাবার সাধ্য নেই। নিচের তলায় যারা রয়েছে, মৃত্যুর প্রহর গুনছে সবাই। আর বেশিক্ষণ এখানে তারা টিকতে পারবে না।

শহরের দিক থেকে ভেসে আসা সাইরেনের আওয়াজ উপত্যকায় প্রতিধ্বনি তুলল।

এজেন্টদের একজন ফায়ারপ্লেসের সামনে থেকে উল্টে পড়া ডেস্কটা সরাল। হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এলেন হে’লা কামিল। এজেন্টের সাথে ক্রল করে নিচু একটা জানালার দিকে এগোলেন তিনি।

লোকাল শেরিফের ডেপুটিরা আসছেন, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল এজেন্ট। সন্ত্রাসবাদীরা ওদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়বে। সেই সুযোগে লজ থেকে বেরোব আমরা। তা না হলে পুড়ে মরতে হবে।

 হে’লা কামিল শুধু নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকাতে পারলেন। কানেও তিনি ভালো শুনতে পাচ্ছেন না। গ্রেনেডগুলোর বিস্ফোরণ তার কানে তালা লাগিয়ে দিয়েছে। তবে চেহারায় ভয় বা হতাশার চিহ্ন মাত্র নেই, শুধু চোখ দুটো ভিজে রয়েছে। তাকে রক্ষার জন্য এজেন্টদের অকাতরে প্রাণ দিতে দেখেছেন তিনি, তাদের জন্য প্রার্থনা ছাড়া আর কিছু করতে পারেননি। একটা রুমাল দিয়ে চোখ দুটো চেপে ধরলেন, ধোঁয়ায় ভরে আছে ঘরের ভেতরটা।

বাইরে তুষারের ওপর শুষে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে মোহাম্মদ ইসমাইল। গোটা লজ দেখতে দেখতে অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হলো। জানালা দিয়ে ধোঁয়া আর শিখা বেরিয়ে আসছে। কেউ যদি এখনও বেঁচে থাকে, এক্ষুনি বেরিয়ে না এলে পুড়ে মরতে হবে তাকে।

কিন্তু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার সময় নেই, বুঝতে পারল ইসমাইল। লাল আর নীল আলোর ঝলক দেখে টের পেয়ে গেছে সে, পুলিশের গাড়ির হাইওয়েতে পৌঁছে গেছে।

টিমে ছিল বাবোজন, তাকে নিয়ে সাতজন বেঁচে আছে। কেউ আহত হলে তাকে মেরে ফেলতে হবে, আমেরিকান ইন্টেলিজেন্স অফিসাররা যেন ইন্টারোগেট করতে না পারে। সাংকেতিক ভাষায় নিজের লোকদের নির্দেশ দিল সে। বৃত্ত ভেঙে পিছিয়ে এল লোকগুলো, তারপর এন্ট্রান্স রোডের দিকে ছুটল।

 ডেপুটিদের প্রথম দলটা পৌঁছেই লজে ঢোকার রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করর। একজন রেডিও যোগে রিপোর্ট অপরজন সতর্কতার সাথে জ্বলন্ত লজটার দিকে তাকাল, শক্ত করে ধরে রিভলভারটা ওদের কাজ হলো দেখা রিপোর্ট করা, ব্যাকআপ টিমের জন্য অপেক্ষায় থাকা।

সশস্ত্র ক্রিমিনালদের বিরুদ্ধে কৌশলটা ভালো। কিন্তু অদৃশ্য আতঙ্কবাদীদের একটা বাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো কাজে লাগল না, কারণ তারা হঠাৎ করে গুলি ছুঁড়তে শুরু করল। পাল্টা আঘাতে হানার সুযোগ দেয়া হলো না, তার আগেই ডেপুটি দু’জন গুলি খেয়ে মারা পড়ল।

এজেন্টদের একজন জানালা পথে উঁকি দিয়ে বাইরেটা দেখছে, তার ইঙ্গিতে হে’লা কামিল নিচু জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে বাইরের তুষারের ওপর পড়লেন। তিনি দাঁড়াবার আগেই এজেন্টরা লাফ দিল। দু’জন তার দুপাশে পাঁচিল তৈরি করল, তাঁর দুটো হাত ধরে ছুটিয়ে নিয়ে চলল কোনাকুনি পথ ধরে হাইওয়ের দিকে।

মাত্র ত্রিশ পা এগিয়েছে ওরা, ইসমাইলের একজন তোক দেখতে পেয়ে চিৎকার করে উঠল। ছুটন্ত, পলায়নরত মানুষগুলোর চারদিকে বুলেট-বৃষ্টি শুরু হলো। এজেন্টদের একজন আচমকা মাথার ওপর খাড়া করল হাত দুটো, যেন আকাশটাকে খামচে চাইছে। হোঁচট খেয়ে তিন পা এগোল সে। আছাড় খেল সটান। সাদা তুষার টকটকে লাল হয়ে উঠল।

ওরা চেষ্টা করছে আমরা যেন হাইওয়ের দিকে যেতে না পারি। হাঁপাতে হাঁপাতে, ধমকের সুরে কথা বলছে সে, আমি আপনাকে কাভার দেব, ওদেরকে ঠেকাব। আপনি একা হাইওয়েতে পৌঁছতে চেষ্টা করবেন।

এজেন্টের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করলেন হে’লা কামিল, কিন্তু লোকটা তার কাধ ধরে ঘুরিয়ে দিল, তারপর পিঠে হাত রেখে ঠেলে দিল সামনের দিকে। দৌড়ান, ফর গডস সেক, দৌড়ান! আর্তনাদ করে উঠল সে।

কিন্তু এজেন্ট দেখল, এরই মধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। নিজেদের অজান্তেই হাইওয়েতে পৌঁছানোর জন্য ভুল একটা পথ বেছে নিয়েছে তারা। পথের শেষে, রাস্তার কাছাকাছি, জঙ্গলের ভেতর দাঁড়িয়ে রয়েছে দুটো মার্সিডিজ বেঞ্চ সেডান। উদ্ভ্রান্ত এজেন্ট উপলব্ধি করল, গাড়ি দুটো আতঙ্কবাদীদের। দিশেহারা বোধ করলেও, লোকটা তার কত ভুলল না। সন্ত্রাসবাদীরা হে’লা কামিলকে বাধা দেয়ার জন্য কোনাকুনি একটা পথ ধরে ছুটে আসছে। ওদেরকে সে ঠেকাতে পারবে না, জানে। নিজের প্রাণের মায়া ত্যাগ করতে পারলে দেরি করিয়ে দিতে পারবে। সেই সুযোগে, ভাগ্য যদি সহায়তা করে, হে’লা কামিল রাস্তায় উঠে যেতে পারবেন। ভাগ্য যদি আরেকটু সহায়তা করে, হাইওয়ের কোনো গাড়ি হয়তো তাকে দেখে দাঁড়াতে পারে।

 মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করে আতঙ্কবাদীদের দিকে সরাসরি ছুটল এজেন্ট, উজির ট্রিগারে আঙুল, কামানের গোলার মতো মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে অশ্রাব্য খিস্তি।

মুহূর্তের জন্য ইসমাইল আর তার দল থমকে গেল, কারণ তাদের মনে হলো খোদ শয়তান ওদেরকে লক্ষ্য করে ছুটে আসছে। অবিশ্বাস্য দুটো সেকেন্ড পেরিয়ে গেল। তারপর তারা সবাই একেযোগে গুলি ছুড়ল। অকুতোভয় সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট বুলেটের আঘাতে ছিটকে পড়ল তুষারের ওপর। তবে তার আগে তিনজন শত্রুকে ধরাশায়ী করতে পেরেছে সে।

গাড়ি দুটোকে হে’লা কামিলও দেখলেন। আরও দেখলেন, সন্ত্রাসবাদীরা তার দিকে ছুটে আসছে। পেছন থেকে কান ফাটানো গুলিবর্ষণের আওয়াজ পেলেন তিনি। লম্বা পা ফেলে ছুটছেন, হাঁপাচ্ছেন, হোঁচট খেয়ে ছোট একটা গর্তের ভেতর আছাড় খেলেন। জগিং করা অনেক দিনের অভ্যেস, লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে আবার ছুটলেন তিনি। দেখলেন সামনেই কালো অ্যাসফল্ট। ছোটার গতি কমালেন না, যদিও জানেন অবধারিত মৃত্যুকে তিনি শুধু দেরি করাতে পারছেন, এড়াতে পারছেন না। নিশ্চিতভাবে জানেন, দুচার মিনিটের মধ্যে তারও লাশ পড়ে থাকবে।

.

২৮.

ব্রেকেনরিজ থেকে হাইওয়ে ধরে রওনা হলো কর্ড। পুরনো গাড়ি হলে কী হবে, নতুন রং করা হয়েছে, সকালের রোদ লেগে চকমক করছে গা। লিফটের দিকে হেঁটে যাচ্ছে স্কিয়ারা, ষাট বছরের পুরনো গাড়িটাকে দেখে সহাস্যে হাত নাড়ল তারা। ঘেরা অংশে, পেছনের সিটে বসে ঝিমুচ্ছে অ্যাল জিওর্দিনো। লিলি বসেছে। পিটের সাথে বাইরে।

 ভোরে ঘুম ভেঙেছে পিটের ইতস্তত একটা ভাব নিয়ে। ব্রেকেনরিজে এসেছে অথচ স্কি করবে না, তা কি হয়? এর আগে যতবার এখানে এসেছে ও, তুষার ঢাকা পাহাড় আর প্রান্তরের ওপর ছোটছুটি করে পাঁচ বা সাতটা করে দিন মহা আনন্দে কাটিয়েছে। এবারের আসাটা অবশ্য কাজ নিয়ে, ড. ফোরম্যানের পরামর্শ দরকার ছিল। তাগাদা দেয়া হয়েছে, দুচারদিনের ভেতরে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির হদিশ বের করতে হবে। কিন্তু হিরাম ইয়েজার কোনো সূত্র না দেয়া পর্যন্ত পিটের কিছু করার নেই। করার যখন কিছু নেই, স্কি করার সুযোগটা গ্রহণ করা উচিত নয়?

ঘুম থেকে তুলে প্রস্তাবটা দিতে যা দেরি, লিলি আর জিওর্দিনো লাফিয়ে উঠল। কোনো রকমে শাওয়ার সেরে, নাকেমুখে ব্রেকফাস্ট গুঁজে বেরিয়ে পড়েছে ওরা, যাচ্ছে স্কি সরঞ্জাম ভাড়া করার জন্য পরিচিত একটা দোকানে।

এত সকালে আতশবাজি পোড়ায় কে? হঠাৎ অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল লিলি।

আতশবাজি নয়, বলল পিট, গুলিবর্ষণের তীক্ষ্ণ শব্দ আর গ্রেনেড বিস্ফোরণের ভোঁতা প্রতিধ্বনি আগেই ওর কানে গেছে। মনে হচ্ছে যেন পদাতিকে বাহিনী যুদ্ধে নেমেছে।

আওয়াজটা আসছে ওদিকের জঙ্গল থেকে, একটা হাত তুলে দেখল লিলি। রাস্তার ডান দিক থেকে।

কর্ডের গতি বাড়িয়ে দিল পিট, ডিভাইডার উইন্ডোর গায়ে নক করল। তন্দ্রা ছুটে গেল, সিটের ওপর সিধে হয়ে বসে জানালার কাঁচ সরাল সে। শোনো, বলল পিট।

মুখে ঠাণ্ডা বাতাস লাগায় চোখ কোঁকাল জিওর্দিনো। কানের পেছনে হাত রাখল একটা। ধীরে ধীরে বিস্ময় ফুটে উঠল চেহারায় রাশিয়া ছত্রীসেনা পাঠিয়েছে?

দেখো, দেখো–ওহে, গড! চেঁচিয়ে উঠল লিলি। জঙ্গলে আগুন ধরে গেছে?

গাছপালার মাথার ওপর হঠাৎ ভাসতে দেঘা গেল কালো ধোয়া; ধোয়ার নিচে কমলা রঙের লকলকে শিখা। বড় বেশি ঘন, তাই না, ধোয়াটা? মন্তব্য করল জিওর্দিনো, আমি বলব, গাছপালা নয়, নিরেট কোনো কাঠামোয় আগুন ধরেছে-হয় কোনো বাড়ি, নয়তো দোচালায়।

 হ্যাঁ, শান্ত সুরে বলল পিট। কী ঘটছে না বুঝে নামা উচিত হবে না। প্রথমে পাশ কাটিয়ে যাব আমরা। অ্যাল, সামনে চলে এসো। লিলি, পেছনে বসো, মাথা নিচু করে থাকবে।

কেন, আমাকে সামনে বসতে হবে কেন?

তোমার প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে কাভার দেয়ার জন্য, বলল পিট। তাড়াতাড়ি করো! ধমক লাগল ও। আমি সন্দেহ করছি, গোলাগুলি আর আগুন ধরাবার সাথে সন্ত্রাসবাদীরা জড়িত থাকতে পারে।

সন্ত্রাসবাদী! কী বলছ! পিট, তুমি কি দুঃস্বপ্ন দেখছ?

পিট জবাব দিল না। তাতেই যা বোঝার বুঝে নিল জিওর্দিনো। লিলিকে পেছনে আসতে সাহায্য করল সে, নিজে সামনে গিয়ে বসল।

 প্রাইভেট রোডের মুখ থেকে আধ মাইল দূরে, হাইওয়ের পাশে থেমে আরোহীরা যার যার গাড়ির আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে উঁকি মারছে, কালো ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে অটোমেটিক রাইফেলের আওয়াজ শুনছে। শেরিফের অফিস থেকে এখনও কেউ পৌঁছায়নি দেখে অবাক হলো পিট। তার পরই ওর চোখ পড়ল বুলেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত ভ্যানটার ওপর। প্রাইভেট রোডের মুখে একটা বাধা হয়ে রয়েছে ভ্যানটা।

ডান দিকে তাকাল পিট, ধোঁয়া আর আগুন ছাড়িয়ে আরও সামনে কিছু দেখার চেষ্টা করল। এমন সময় হঠাৎ জঙ্গলের কিনারা থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল একটা মূর্তি, সরাসরি কর্ডের দিকে ছুটে এল সে।

ব্রেকের ওপর দাঁড়িয়ে পড়ল পিট, ডান দিকে স্টিয়ারিং হুইল ঘোরাল। নব্বই ডিগ্রি বাক নিয়ে রাস্তার ওপর আড়াআড়ি ঘুরে গেল কর্ড। পেভমেন্টের সাথে ঘষা খেল টায়ার। অবধারিত দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়ে স্থির পাথর হয়ে গেছে মূর্তিটা, ড্রাইভারের কাছ থেকে মাত্র এক মিটার দূরে।

পিটের হার্টবিট বেড়ে গেল। সিট থেকে ঝুঁকে নারীমূর্তির দিকে ভালো করে তাকাল ও, চোখে ফুটে উঠল সমীহ আর অকৃত্রিম বিস্ময়।

আ-আপনি। হে’লা কামিল হাঁপিয়ে উঠলেন। সত্যিই কি আপনি?

মিস কামিল? শূন্য চোখে চেয়ে আছে পিট।

ওহ্, থ্যাঙ্ক গড! ফিসফিস করে বললেন হে’লা কামিল। প্লিজ, সাহায্য করুন আমাকে! সবাইকে ওরা মেরে ফেলেছ! ওরা আ-আমাকে খুন করতে আসছে!

 পিট হুইলের পেছন থেকে, আর লিলি প্যাসেঞ্জার কম্পার্টমেন্ট থেকে নেমে পড়ল। পেছনের সিটে উঠতে হে’লা কামিলকে সাহায্য করল ওরা। কারা? জিজ্ঞেস করল পিট।

 আখমত ইয়াজিদের ভাড়াটে লোক। সিক্রেট সার্ভিসের সব কয়জন এজেন্টকে মেরে ফেলেছে। গাড়ি ছাড়ন, প্লিজ। এক্ষুনি এসে পড়বে ওরা!

শান্ত হোন, তার একটা হাত ধরে মৃদু চাপ দিল লিলি, এই প্রথম লক্ষ করল মহাসচিবের কাপড়চোপড় ধোয়া লেগে কালো হয়ে আছে, চুল এলোমেলো। আপনাকে আমরা সরাসরি একটা হাসপাতালে নিয়ে যাব।

তাড়াতাড়ি! জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রুদ্ধশ্বাসে বললেন হে’লা কামিল। দেরি করলে আপনারাও মারা পড়বেন।

হে’লা কামিলের দৃষ্টি অনুসরণ করে ঘাড় ফেরাল পিট, আর ঠিক সেই সময় ঝোঁপ-ঝাড় ফুড়ে হাইওয়েতে বেরিয়ে এল মার্সিডিজ দুটো। এর সেকেন্ডের বেশি দেখল না ও, লাফ দিয়ে উঠে পড়ল ড্রাইভিং সিটে। ফার্স্ট গিয়ার দিয়েই মেঝের সাথে চেপে ধরল অ্যাকসিলারেটর, কর্ড ঘোরাল ওর জন্য খোলা একমাত্র দিকটায় ব্রেকেনরিজ-এর ফিরতি পথ ধরে ছুটল গাড়ি।

স্পেয়ার টায়ারের মাথায় একটা আচ্ছাদন রয়েছে, সেটার ওপর বসানো রিয়ার ভিউ মিররে তাকাল পিট। মার্সিডিজ দুটো পিছু নিয়েছে, মাত্র তিনশো মিটার দূরে ওগুলো। পরমুহূর্তে দৃশ্যটা চুরমার হয়ে গেল একঝাঁক বুলেট ছুটে এসে আয়নার কাঁচ গুঁড়িয়ে দেয়ায়।

মেঝের সাথে সেঁটে থাকুন! চিৎকার করল পিট।

পেছনের অংশে ড্রাইভ শ্যাফট না থাকায় মেঝেতে প্রচুর জায়গা, হে’লা কামিলকে নিয়ে সেখানে কুণ্ডলী পাকাল লিলি।

চিন্তা করবেন না, অভয় দিয়ে বলল ও। একবার শহরে পৌঁছতে পারলে আমরা নিরাপদ।

মাথা নাড়লেন হে’লা কামিল। এ যাত্রা আমাদের কেউ বাঁচতে পারবে না। আমরা ফ্যানাটিকাল আতঙ্কবাদীদের পাল্লায় পড়েছি।

সামনের সিটে কুঁকড়ে যতটা সম্ভব ছোট হয়ে গেছে অ্যাল জিওর্দিনো। এটার টপ স্পিড কত? তুমি জানো, এখনও আমি বিয়ে করিনি!

 এল-টোয়েনটি নাইনের টপ স্পিড রেকর্ড করা হয়েছে সাতাত্তর, জবাব দিল পিট, ওগুলো কী?

ঝট করে ঘুরল জিওর্দিনো, দরজার ওপর ঝুঁকে উঁকি দিল পেছনে। সামনে থেকে দেখে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না কোনো মডেলেরর মার্সিডিজ, তবে সম্ভবত থ্রি হানড্রেড এস.ডি.এল.।

ডিজেল?

টার্বো চার্জড ডিজেল, ঘণ্টায় দুশো বিশ কিলোমিটার ছুটতে পারে।

 দূরত্ব কমছে?

ছারপোকাকে বানর তাড়া করলে দূরত্ব কমে না বাড়ে? ঝাঁঝের সাথে পাল্টা প্রশ্ন করল জিওর্দিনো। শেরিফের অফিস অনেক দূরে থাকতেই ওরা আমাদেরকে ধরে ফেলবে।

পায়ের চাপ দিয়ে মেঝের সাথে সেঁটে ধরল পিট ক্লাচ। গিয়ার বদলে থার্ডে দিল। কোথাও না থেমে নাগালের বাইরে থাকার চেষ্টা করব। থামতে যাচ্ছি দেখলেই এলোপাতাড়ি গুলি করবে ওরা, তাতে বহু নিরীহ মানুষ মারা পড়তে পারে। খুন করা ওদের এক ধরনের নেশা।

আবার একবার পেছন দিকে তাকাল জিওর্দিনো। ওদের চোখের সাদা অংশটুকুও আমি দেখতে পাচ্ছি।

.

হাতের অস্ত্র জ্যাম হতেই ভাগ্যকে গালি দিল মোহাম্মদ ইসমাইল, মার্সিডিজ থেকে হাইওয়ের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিল সেটা। পেছনে বসা এক সঙ্গীর হাত থেকে আরেকটা অস্ত্র ছিনিয়ে নিল সে, জানালার দিকে ঝুঁকে এক ঝাঁক গুলি ছুড়ল কর্ড লক্ষ্য করে। মাজল থেকে মাত্র পাঁচটা শেল বেরোল, অ্যামুশিন ক্লিপ খালি হয়ে গেছে। আরেকটা ক্লিপের সন্ধানে পকেট হাতড়াতে শুরু করে আবার গাল দিল সে, ক্লিপটা বের করে স্লটে ঢোকাল।

উত্তেজিত হয়ো না, শান্তভাবে বলল ড্রাইভার। সামনের এক কিলোমিটারের মধ্যেই ওদেরকে ধরে ফেলব। কর্ডের বাঁ দিকে থাকব আমরা, দ্বিতীয় মার্সিডিজ নিয়ে সাদ্দাম থাকবে ডান দিকে। দুদিক থেকে গুলি করে সব কটাকে পাঠিয়ে দেব জাহান্নামে।

মাঝখানে যারা বাদ সেধেছে তাদের আমি নিজের হাতে মারতে চাই! গর্জে উঠল ইসমাইল।

সুযোগ তুমি পারে। ধৈর্য ধরো।

বলা যায়, বায়না ধরা শিশুর মতো, যার আবদার রক্ষা করা হয়নি, হাঁড়িপানা মুখ নিয়ে ধপাস করে সিটের ওপর বসে পড়ল ইসমাইল, চোখ পিট পিট করে তাকিয়ে থাকল সামনের গাড়িটার দিকে।

মোহাম্মদ ইসমাইল নিকৃষ্টতম খুনিদের একজন। অপরাধবোধের সাথে তার পরিচয় নেই। হাসতে হাসতে একটা মাতৃসদন উড়িয়ে দিতেও তার বাধবে না। প্রথমশ্রেণীর খুনিরা তাদের কাজের ধরন-ধারণ নিয়ে মাথা ঘামায়, কাজটা সারার পর ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে চিন্তা করে, আরও নিখুঁত হবার চেষ্টা করে পরবর্তী কাজটায়। মোহাম্মদ ইসমাইলের কাছে এ সবের কোনো গুরুত্ব নেই। যথেষ্ট সময় আর মেধা খরচ না করায় তার প্ল্যানে স্কুল সব ভুল থেকে যায়, সেজন্য অঘটনও কম ঘটে না। ইতিমধ্যে দুবার দু’জন মানুষকে মারতে গিয়ে তাদের বদলে অন্য দু’জনকে মেরে এসেছে সে। এ ধরনের ঘটনা ইসমাইলের মতো খুনীদের আরও বিপজ্জনক করে তোলে। উত্তেজিত হাঙরের মতো অস্থিরমতি, কখন কী করবে ধারণা করা যায় না, ঘটনাচক্রে বাধা হয়ে দাঁড়ালে পাইকারি হারে নিরীহ মানুষজনকে খুন করবে। তার প্রেরণার উৎস হলো ধর্ম। তার ধারণা, ধর্মের নামে কাফেরদের খুন করে বিপুল সওয়াব হাসিল করছে সে। খুন করে ভারি মজা পায় মোহাম্মদ ইসমাইল, আরও খুন করা প্রেরণা অনুভব করে, ধরে নেয় আল্লাহ তার প্রতি বিশেষভাবে সন্তুষ্ট বলেই তাকে এত আনন্দ দান করছেন।

 গাড়ি আরও জোরে চালাও! ড্রাইভারকে তাগাদা দিল সে। মনে থাকে যেন, সব কয়টার মাথায় গুলি করতে চাই আমি! বেজন্মাদের আমি দেখিয়ে দেব!

.

ওরা বোধ হয় অ্যামুনিশন বাঁচাচ্ছে, কৃতজ্ঞচিত্তে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল জিওর্দিনো।

 আমাদেরকে মাঝখানে রেখে স্যান্ডউইচ তৈরি করতে চাইছি, বলল পিট। যাতে মিস না করে। রাস্তার দিকে চোখ, তবে মাথার ভেতর পালানোর পথ খোঁজার কাজ চলছে দ্রুত।

একটা রকেট লঞ্চার পেলে আমি আমার রাজ্য হারাতেও রাজি আছি।

ভালো কথা মনে করেছ। সকালে গাড়িতে ওঠার সময় কী যেন একটা ঠেকেছিল পায়ে, ঠেলে সিটের তলায় পাঠিয়ে দিই, বলল পিট।

মেঝের দিকে ঝুঁকে পিটের সিটের নিচেটা হাতড়াল জিওর্দিনো। ঠাণ্ডা, শক্ত কী। যেন একটা ঠেকল হাতে। চেহারা ব্যাজার হয়ে উঠল তার। স্রেফ একটা সকেট রেঞ্চ, এ দিয়ে কিছুই হবে না।

সামনে একটা জিপ ট্রেইল, স্কি রান-এর চূড়ায় উঠে গেছে। সাপ্লাই আর ইকুইপমেন্ট নিয়ে দুচারটে গাড়ি মাঝেমধ্যে যায় ওদিকে। জঙ্গল বা নালায় গা ঢাকা দেয়ার সুযোগ এনে দিতে পারে। হাইওয়েতে থাকলে বাঁচার কোনো আশা নেই।

সামনে কতদূর?

পরবর্তী বাঁকের কছাকাছি।

কিন্তু হাইওয়ে ছাড়লে আমাদের স্পিড আরও কমবে, বলল জিওর্দিনো। ব্যাপারটা ফাঁদ হয়ে উঠবে না তো?

তুমিই বলো।

তৃতীয়বার পেছন দিকে তাকাল জিওর্দিনো। পঁচাত্তর মিটার দূরে ওরা, দূরত্ব প্রতি মুহূর্তে কমছে।

ওদের গতি মন্থর করতে হবে।

তুমি অনুমতি দিলে আমি আমার কুৎসিত চেহারাটা ওদেরকে দেখাতে পারি, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করতেও আপত্তি নাই, শুকনো গলায় প্রস্তাব রাখল জিওর্দিনো।

 তাতে কাজের কাজ কিছুই হবে না, ওরা আরও বরং খেপে উঠবে। না হে, তার চেয়ে এক নম্বর কাজে লাগাও।

ব্রিফিংটা আমি মিস করেছি, ব্যাঙ্গের সুরে বলল জিওর্দিনো।

ছোঁড়াছুড়িতে তোমার হাত কেমন?

বুঝতে পেরে মাথা আঁকাল জিওর্দিনো। বাহনটাকে একটা সরলরেখায় ধরে রাখো, অ্যাল জিওর্দিনো-বম্ব এখন প্রতিপক্ষের ওপর নিক্ষিপ্ত হবে।

খোলা টাউন কার আদর্শ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে চমৎকার উতরে গেলে। পেছন দিকে মুখ করে সিটে হাঁটু সাঁটিয়ে সিধে হলো জিওর্দিনো, ছাদের ওপর উঁচু হলো তার কাঁধ আর মাথা। লক্ষ্যস্থির করল সে, হাত তুলল, ছুঁড়ে দিল রেঞ্চটা। ধনুকের মতো বাঁকা একটা পথ তৈরি করে ছুটল হাতিয়ার, সামনের মার্সিডিজটাকে লক্ষ্য করে।

পলকের জন্য থেমে গেল হৃৎপিণ্ড। রেঞ্চ টার্গেটে পৌঁছনোর আগেই বড় বেশি নিচে নেমে যাচ্ছে। টার্গেটে নয়, পড়ল হুডের ওপর। তবে পড়ে ছিটকে গেল, উইন্ডশিল্ডটা নিখুঁতভাবে চুরমার করে ঢুকে পড়ল ভেতরে।

আতঙ্কবাদী ড্রাইভার জিওর্দিনোকে জিনিসটা ছুঁড়তে দেখেছিল। তার ক্ষিপ্রতা ভালো হলেও প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট ভালো নয়। ব্রেকে চাপ দিল সে, বন বন করে হুইল ঘোরাল রেঞ্চের পথ থেকে সরে যাবার জন্য, ঠিক তখনই হাজারটা টুকরো হয়ে গেল উইন্ডশিল্ডের কাঁচ, ছড়িয়ে পড়ল তার মুখে। স্টিয়ারিং হুইলের গায়ে বাড়ি খেয়ে মোহাম্মদ ইসমাইলের কোলের ওপর পড়ল রেঞ্চটা।

দ্বিতীয় মার্সিডিজের ড্রাইভার ইসমাইলের ঠিক পেছনেই ছিল, সে দেখতেই পায়নি বাতাস চিরে একটা মিসাইল ছুটে আসছে। সামনের হেডলাইট হঠাৎ করে লাল হয়ে উঠতে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল সে। পেছনে থেকে প্রথম মার্সিডিজকে ধাক্কা দেয়ার সময় অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল, দেখল ধাক্কা খেয়ে ঘুরে যাচ্ছে গাড়িটা, চোখের পলকে উল্টো দিকে অর্থাৎ তার দিকে মুখ করল সেটা।

তুমি কি ঠিক এটাই চাইছিলে? ফুর্তির সাথে জিজ্ঞেস করল জিওর্দিনো।

 অক্ষরে অক্ষরে। শক্ত হও, অ্যাল, বাঁকের কাছে এসে পড়েছি। স্পিড কমাল পিট, সরু একটা তুষার ঢাকা পথে ঘুরিয়ে নিল কর্ডকে। পথটা আঁকাবাঁকা, কোনো কোনো বাকের পর উল্টো দিকে বিস্তৃত হয়েছে, তবে শেষ পর্যন্ত পৌঁছেছে পাহাড়ের চূড়ায়।

পিচ্ছিল, অমসৃণ পথ। ভারী গাড়িটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে একশো পনেরো ঘোড়ার স্ট্রেইট-এইট ইঞ্জিনের ওপর খুব ধকল যাচ্ছে। স্প্রিংবহুল চেসিস সবাইকে নিয়ে টেনিস বলের মতো খেলতে লাগল।

 মেঝে থেকে তুলে নিজেদেরকে সিটের ওপর বসিয়েছে মহিলা আরোহীরা, দুজোড়া পা ডিভাইডার পার্টিশনটাকে পেঁচিয়ে রেখেছে, সিলিংয়ের স্ট্র্যাপ ধরে ঝুলে আছে।

 ছয় মিনিট পর জঙ্গলটাকে পেছনে ফেলে এল ওরা। রাস্তার দুধারে এখন বড়বড় বোল্ডার আর গভীর তুষার। পিটের প্রথম ইচ্ছে ছিল কর্ড ফেলে পালাবে ওরা, পাথর আর জঙ্গলে গা ঢাকা দিয়ে কেটে পড়বে। কিন্তু ইচ্ছেটা বাতিল করে দিতে হলো পাউডার-মিহি তুষার দেখে, পা ফেলামাত্র হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যাবে। বিকল্প উপায় একটাই আছে, চূড়ায় উঠে যাওয়া, তারপর একটা চেয়ার লিফট নিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে শহরে নামা, হারিয়ে যাওয়া ভিড়ের মধ্যে।

আমরা ফুটছি, ঘোষণা করল জিওর্দিনো।

র‍্যাডিয়েটর ক্যাপের চারদিকে থেকে বাষ্প উঠছে, আগেই দেখেছে পিট। টেমপারেচার গজের কাঁটাও উঠে গেছে হট লেখা ঘরে। এভাবে দৌড় খাটানো হবে ভেবে তৈরি করা হয়নি গাড়িটা, বলল ও। এখনও যে ভেঙে চারখানা হয়ে যায়নি সেটাই আশ্চর্য।

রাস্তা শেষ হয়ে গেলে? কী করব আমরা?

দুনম্বর প্ল্যানটা কাজে লাগাব। চেয়ার লিফটে চড়ে ধীরেসুস্থে নেমে যাব কাছাকাছি একটা সেলুনে।

 তোমার স্টাইলটা পছন্দ হলেও, না বলে পারছি না যে যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি, পেছন দিকে ইঙ্গিত করল জিওর্দিনো। বন্ধুরা ফিরে এসেছে।

এত ব্যস্ত ছিল পিট, অনুসরণকারীদের খবর রাখার সময় পায়নি। দুর্ঘটনা সামলে নিয়ে দুটো মার্সিডিজই আবার নতুন উদ্যমে কর্ডটাকে ধাওয়া শুরু করেছে। ঘাড় ফিরিয়ে পেছন দিকে তাকাবারও অবসর পেল না ও পেছনের জানালার কাঁচ, হে’লা কামিল আর লিলির মাথার মাঝখানে, এক ঝাঁক বুলেটের আঘাতে গুঁড়িয়ে গেল, সামনের উইন্ডশিল্ড ফুটো করে বেরিয়ে গেল ঝাকটা। চোখের সামনে তিনটে ফুটো দেখতে পেল পিট, কিনারাগুলো এবড়োখেবড়ো। মহিলা আরোহীদের কিছু বলতে হলো না, আবার তারা আশ্রয় নিল গাড়ির মেঝেতে। এবার তারা চেষ্টা করল মেঝে ফুটো করে ভেতরে সেঁধোবার।

 আমরা সন্দেহ হচ্ছে, রেঞ্চটা ছুঁড়ে দেয়ায় ওদের খুব রাগ হয়েছে, আঁচ করল জিওর্দিনো।

 আমরা গাড়িটাকে যেভাবে ঠেলছে ওরা, আমারও খুব রাগ হচ্ছে!

 চুলের কাটার মতো তীক্ষ্ণ একটা বাঁক নিল পিট, গাড়ি সিধে করার সময় চুরি করে তাকাল ধাওয়ারত মার্সিডিজগুলোর দিকে। দৃশ্যটার মধ্যে বিপদের উপাদান যথেষ্ট পরিমাণেই রয়েছে।

সামনের মার্সিডিজ এঁকেবেঁকে ছুটে আসছে। কর্ডের চাকা তুষারের ওপর গভীর গর্ত তৈরি করেছে, সেই গর্তের ফাঁদে পড়ার কোনো ইচ্ছে নেই ড্রাইভারের, উন্মত্ততার সাথে সারাক্ষণ হুইল ঘোরাচ্ছে সে। প্রতিটি বাকে পিছলে রাস্তা থেকে সরে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করছে না। প্রায়ই তুষারের স্তূপে আটকা পড়ছে চাকা। মার্সিডিজে স্লে টায়ার লাগানো নেই দেখে অবাক হলো পিট। ওর জানা নেই, নিজেদের পরিচয় গোপন রাখার জন্য গাড়িগুলো মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে চালিয়ে এনেছে সন্ত্রাসবাদীরা। অস্তিত্বহীন একটা টেক্সাটাইল কোম্পানির নামে রেজিস্ট্রি করা ওগুলো, হে’লা কামিলের জান কবচ করার পর দুটোকেই ফেলে যাওয়া হবে ব্রেকেনরিজ এয়ারপোর্টে।

যা দেখল, মোটেও, খুশি হতে পারল না পিট। মাঝখানের দূরত্ব দ্রুত কমছে। ওরা মাত্র পঞ্চাশ মিটার পেছনে। পছন্দ হলো না অটোমেটিক রাইফেল হাতে লোকটাকেও, সামনের মার্সিডিজের ভাঙা উইন্ডশিল্ডের ফাঁক দিয়ে ব্যারেল বের করে ওদের দিকে লক্ষ্যস্থির করার চেষ্টা করছে সে।

 ভগ্নদূতেরা আসছে! চেঁচাল পিট, হুইলের নিচে মাথা লুকাল, ড্যাশবোর্ডের কিনারা দিয়ে কোনো রকমে দেখতে পাচ্ছে সামনের রাস্তা। সবাই নিচু হও!

কথাগুলো মুখ থেকে বেরোতে যা দেরি, কর্ডের গায়ে আঘাত করল এক ঝাঁক বুলেট। প্রথম বিস্ফোরণে ডান দিকের ফেন্ডার মাউন্টিংয়ের ওপর শাখা স্পেয়ার টায়ার আর হুইল ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল। পরের ঝক ছাদটাকে ফুটো করল। নিজের অজান্তেই মাথাটা আরও নামিয়ে নিল পিট। পেছনের দরজা থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল কজাগুলো, দরজাটাও উড়ে গেল বাতাসে ডানা মেলে। একটা গাছের সাথে ঘষা খেল কর্ড। বৃষ্টির মতো ঝরল কাঁচের টুকরো। মহিলা আরোহীদের একজন আর্তনাদ করে উঠল, দু’জনের মধ্যে কে বোঝা গেল না। ড্যাশবোর্ডে গাঢ় রক্তের পোচ দেখতে পেল পিট। পরমুহূর্তে উপলব্ধি করল, একটা কান এ-ফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে বুলেট। কী আশ্চর্য, কৌতুকপ্রবণ ইটালিয়ান যুবক টু-শব্দটিও করল না।

নির্লিপ্তভাবে ক্ষতটা স্পর্শ করল জিওর্দিনো, ভাবটা যেন ওটা অন্য কারও কান। তারপর মাথা কাত করে পিটের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসল। আমার সন্দেহ হচ্ছে, কাল রাতে খাওয়া মদটুকু ফুটো দিয়ে বেরিয়ে আসছে।

সিরিয়াস?

দুহাজার ডলার লাগবে প্লাস্টিক সার্জারি করাতে, ফুটো হয়েছিল কিনা টেরও পাবে না। মহিলাদের কোনো খবর জানো?

না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করল পিট, লিলি, তোমরা ঠিক আছে তো?

 কাঁচের টুকরো চামড়ায় দুএকটা দাগ কেটেছে, প্রায় সাথে সাথে, উঁচু গলায় জবাব দিল লিলি। তাছাড়া আমরা অক্ষতই আছি।

কর্ডের র‍্যাডিয়েটর থেকে বাষ্প এবার সশব্দ প্রতিবাদের সাথে বেরোচ্ছে। ইঞ্জিনের শক্তি কমছে, টের পেল পিট। সামনে শেষ বাক, তারপর চুড়া। গাড়িটাকে ঘোরানোয় মন দিল ও। পেছনের বাম্পারে প্রায় সেঁটে আছে প্রতিপক্ষরা।

 অতিরিক্ত উত্তাপে ইঞ্জিনের বেয়ারিংগুলো প্রতিবাদ জানাচ্ছে। আরও এক ঝাঁক বুলেট বামদিকের পেছনের ফেন্ডার গুঁড়িয়ে দিল, চ্যাপ্টা করে দিল টায়ারটাকে। কর্ডের পেছনের অংশ রাস্তা থেকে নেমে যেতে চাইছে, ধরে রাখার জন্য হুইলের সাথে যুদ্ধ করছে পিট। রাস্তার পাশে অসংখ্য বোল্ডার, গাড়ি ধাক্কা খেলে ছাতু হয়ে যাবে আরোহীরা।

হুডের নিচ থেকে নীল ধোয়া বেরোতে দেখে পিট বুঝল, মারা যাচ্ছে কর্ড। রাস্তার কিনারায় পড়ে থাকা একটা পাথরকে এড়াতে পারেনি ও, অয়েল প্যানে খোঁচা লাগায় গর্ত তৈরি হয়েছে, ইঞ্জিনের নিচ থেকে ঝরে পড়ছে তেল। অয়েল প্রেশার গজ দ্রুত শূন্যের ঘরে নেমে এল। পাহাড় চূড়ায় পৌঁছানোর আশা ত্যাগ করাই ভালো।

 পিছলানো চাকা নিয়ে সামনের মার্সিডিজ শেষ বাকটা ঘুরতে শুরু করল। কর্ডের হুইল শক্ত করে ধরে অনবরত ঘোরাচ্ছে পিট। ধাওয়ারত শত্রুদের চেহারায় উল্লাস কল্পনা করতে পারল ও, তারা বুঝে ফেলেছে পালানোর কোনো উপায় নেই শিকারের।

চারদিকে উদ্ভ্রান্তের মতো তাকিয়ে আশ্রয়ের কোনো সন্ধান দেখল না পিট। পা সম্বল কোথাও বেশিদূর যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। রাস্তার একদিকে তুষার আর বোল্ডার, আরেকদিকে ঝপ করে নেমে গেছে গভীর খাদ, মাঝখানের সরু রাস্তায় আটকা পড়েছে ওরা। ইঞ্জিন অচল হয়ে পড়েছে, একেবারে দাঁড়িয়ে পড়ার আগেই ঘটে যাবে যা ঘটার।

মরিয়া হয়ে উঠল পিট, মেঝের সাথে চেপে ধরল অ্যাকসিলারেটর-পেড়াল গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে, সেই সাথে বিধাতা সাহায্য চেয়ে আবেদন জানাল ওপর মহলে।

আশ্চর্যে, যুদ্ধবিধ্বস্ত প্রাচীন বাহনের এখনও কিছু দেয়ার আছে। জ্যান্ত একটা প্রাণীর মতো, লোহা আর ইস্পাতসহ কুঁকড়ে গেল কর্ড। ইঞ্জিনের আওয়াজ বদলে গেল, সামনের চাকাগুলো দেবে গেল তুষারের ভেতর, পরমুহূর্তে ছেড়ে দেয়া স্প্রিংয়ের মতো সামনে লাফ দিল কর্ড, একবারের চেষ্টাতেই উঠে এল চূড়ায়।

পেছনে নীল ধোয়া আর সাদা বাষ্পের মেঘ উঠল, খোলা স্কি রান-এর মাথায় পৌঁছে গেল ওরা। ট্রিপল-চেয়ার স্কি লিফট ওদের একশো মিটার দূরেও নয়। কর্ডের সরাসরি নিচের ঢালে কেউ স্কি করছে না দেখে প্রথমে ভারি অবাক হলো পিট। লোকজন চেয়ার থেকে নেমে পড়ছে, ঘুরে যাচ্ছে লিফটের উল্টোদিকে, তারপর ছুটছে সমান্তরাল স্কি ট্রেইল ধরে।

তারপর লক্ষ করল ও, ওর দিকের ঢালটা রশি দিয়ে আলাদা করে রাখা হয়েছে। বিপজ্জনক বলে এদিকে কাউকে কি করতে নিষেধ করা হয়েছে, রশির সাথে ঝুলে থাকা রঙিন বোর্ডগুলোয় তাই লেখা।

রাস্তার এটাই শেষ মাথা, হতাশ কণ্ঠে বলল জিওনিনা।

তার সাথে একমত হয়ে পিট বলল, লিফটের দিকে যাব, তা সম্ভব নয়। দশ মিটার পেরোবার আগেই গুলি করে আমাদের সব কয়টাকে ফেলে দেবে ওরা।

তুষারের বল তৈরি করে ছুঁড়ে মারা যায়। নাকি আত্মসমর্পণ করার কথা ভাবছ?

 তিন নম্বর প্ল্যানের কথাটা ভুলে গেছ? তিরস্কার করল পিট।

কৌতূহল নিয়ে পিটকে দেখল জিওর্দিনো। প্রথম দুটোর চেয়েও খারাপ হবে সেটা, এ আমি বিশ্বাস করি না। তার পরই তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল। তুমি কী ভাবছ…ওহ, গড়, নো!

মার্সিডিজ দুটো পৌঁছে গেল, প্রতিপক্ষ থুথু ছুড়লেও ওদের গায়ে লাগবে। কর্ডের দুপাশে চলে এসেছে প্রায়। হুইল মোচড় দিল পিট, গাড়িটাকে নামিয়ে দিল স্কি রান এ, অর্থাৎ বিপজ্জনক ঢালে।

.

২৯.

আল্লাহ সহায় হোন! উন্মাদ! ওরা উন্মাদ! বিড়বিড় করে বলল ইসমাইলের ড্রাইভার। ওদেরকে ধরা সম্ভব নয়।

তাড়া করো! হুঙ্কার ছাড়ল ইসমাইল। যদি পালায়, তোমাকে আমি খুন করব!

পালিয়ে যাবে কোথায়! হিসহিস করে বলল ড্রাইভার। দেখছ না, আত্মহত্যা করছে ওরা? পাহাড়ের মাথা থেকে সচল গাড়ি নিয়ে নামতে চেষ্টা করলে কেউ বাঁচে?।

 অটোমেটিক রাইফেলের ব্যারেলটা স্যাঁৎ করে ঘোরালো ইসমাইল, ড্রাইভারের কানে মাজল চেপে ধরল। বেজন্মা শুয়োর, ওদের ধর, নয়তো আল্লাহর কাছে পাঠিয়ে দেব তোকে!

ইতস্তত করল ড্রাইভার, বুঝতে পারছে ধাওয়া করলেও, মৃত্যুর ঝুঁকি নিতে হবে, না করলেও। হাল ছেড়ে দিয়ে কর্ডের পিছু নিল সে, কিনারা থেকে ঢালে নামিয়ে আনল মার্সিডিজকে। আল্লাহ, অন্তত আমাকে তুমি রক্ষা করো!

ভাঙা উইন্ডশিল্ডের ভেতর রাইফেলের ব্যারেল লম্বা করে ইসমাইল বলল, গাড়ি সিধে করে রাখো। দ্বিতীয় গাড়ির ড্রাইভার ইতস্তত করেনি, প্রথমটার পিছু পিছু নেমে এসেছে ঢালে।

.

জমাট বাঁধা শক্ত বরফের ওপর দিয়ে তীরবেগে নামছে কর্ড, প্রতি মুহূর্তে আরও বাড়ছে গতি। হুইলটা আলতোভাবে ছুঁয়ে আছে পিট, প্রায় ঘোরাচ্ছেই না। ব্রেকের ওপরও কোনো চাপ দিচ্ছে না। একটু এদিক-ওদিক হলেই চরকির মতো ঘুরতে শুরু করবে কর্ড। যদি আড়াআড়িভাবে পিছলাতে শুরু করে, অবধারিত পরিণতি হবে ঘন ঘন ডিগবাজি খাওয়া, পাহাড়ের গোড়ায় পৌঁছবে কিছু ভাঙা হাড় আর লোহালক্কড়।

 সিট বেল্টের প্রশ্ন তোলার জন্য এটা কি আদর্শ সময় নয়? জিজ্ঞেস করল জিওর্দিনো।

মাথা নাড়ল পিট। উনিশশো ত্রিশে সে ধরনের কিছু ছিল না।

বুলেটে ঝাঁঝরা পেছনের চাকার রাবার খসে যাওয়ায় ভাগ্যকে ছোট্ট একটা ধন্যবাদ দিল ও। চুপসে যাওয়া টায়ার থেকে মুক্ত হয়ে কাঠামোর জোড়া কিনারা বরফের গায়ে ভালোভাবে কামড় বসাতে পারছে, ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য পাচ্ছে পিট।

স্পিডমিটারের কাঁটা ষাটের ঘরে উঠে গেল, এই সময় এক ঝাঁক মুঘলকে ছুটে আসতে দেখল ও তুষারের অতিকায় স্তূপ, দক্ষ স্কিয়াররা এ ধরনের বাধা পেরোতে ভালোবাসে। স্কি নিয়ে ঢাল পেরোবার সময় বাধাগুলো পিটেরও খুব প্রিয়। কিন্তু দুহাজার একশো বিশ কিলোগ্রাম ওজনের গাড়ি নিয়ে মুঘলদের মাঝখান দিয়ে পথ করে নেয়ার কথা ভাবতে পারে শুধু পাগলরা। অ্যাল ধারণা, পিট বর্তমানে তাদের ভূমিকাতেই অভিনয় করছে।

আলতো স্পর্শে ট্রেইল থেকে সামান্য সরিয়ে দিল পিট গাড়িটাকে, চলে এল মসৃণ বরফে। সামনের পরীক্ষাটা সূচের ফুটোয় অলিম্পিক মশাল ঢোকানোর সাথে তুলনা করা যায়। আপনা থেকেই শরীরের পেশি শক্ত হয়ে গেল, ঝাঁকি খাবার জন্য তৈরি। এক চুল এদিক ওদিক হলে ছাতু হয়ে যাবে সবাই ওরা।

একপাশে অনেকগুলো তুষার স্তূপ, আরেক পাশে সারি সারি গাছ, মাঝখান দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ। কোনোটার সাথে ঘষা লাগল না, সরু পথ ধরে পরিষ্কার বেরিয়ে এল কর্ড। চওড়া, বাধাহীন ঢালে বেরিয়ে এসেই ঝট করে পেছন দিকে তাকাল পিট।

প্রথম মার্সিডিজের ড্রাইভার কাণ্ডজ্ঞানের চমৎকার পরিচয় দিল। মুঘলদের এড়াবার জন্য কর্ডের ফেলে আসা চাকার দাগ অনুসরণ করল সে। দ্বিতীয় মার্সিডিজের ড্রাইভার হয় মুঘলদের দেখেনি বা বিপজ্জনক বলে মনে করেনি। নিজের ভুল বুঝতে পারল অনেক দেরিতে, ব্যস্ততার সাথে সংশোধনের জন্য গাড়িটাকে ঘন ঘন ডানে বায়ে ঘোরাল সে। এভাবে তিন কী চারটে মুঘলকে এড়াতে সফল হলো লোকা, তারপর একটার সাথে মুখোমুখি ধাক্কা খেল। গাড়ির সামনের অংশ তুষারের ভেতরে ঢুকে গেল, উঁচু হলো পেছনটা। নব্বই ডিগ্রি কোণ সৃষ্টি করে বুঝলে থাকল সেটা। তারপর শুরু হলো ডিগবাজি খাওয়া। নিরেট বরফে পড়ল, খাড়া হলো, আবার পড়ল, আবার খাড়া হলো-প্রতিবার গাড়ি থেকে কিছু না কিছু ছিটকে পড়ছে, শুধু আরোহীরা বাদে, কারণ ডিগবাজি খাওয়ায় চ্যাপ্টা হয়ে গেছে বডি, জ্যাম হয়ে গেছে দরজা। গাড়ি থেকে ছিটকে পড়লে আরোহীরা হয়তো প্রাণে বেঁচে যেত।

মাউন্টিং থেকে ছিঁড়ে বেরিয়ে গেল ইঞ্জিন, ছিটকে জঙ্গলের দিকে চলে গেল। চাকা, ফ্রন্ট সাসপেনশন, রিয়ার-ড্রাইভ ট্রেন, এক এক সবগুলো চেসিস থেকে বেরিয়ে ঢাল বেয়ে সবেগে নামতে শুরু করল।

যদি বলি একটা খতম, ব্যাকরণ সম্মত হবে কি? প্রশ্ন করল জিওর্দিনো।

খুশি হবার কিছু নেই, দাঁতে দাঁত চেপে বলল পিট। সামনে তাকাও।

সামনে তাকিয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠল জিওর্দিনো। সামনে নতুন একটা ট্রেইল শুরু হতে যাচ্ছে, সেখানে উজ্জ্বল রঙের স্কি সুট পরা অনেক লোকের ভিড়। উইন্ডশিল্ড ফ্রেমের কিনারা ধরে সটান খাড়া হলো সে, উন্মত্তের মতো হাত নেড়ে চিৎকার জুড়ে দিল। কর্ডের জোড়া হর্ন বাজাচ্ছে পিট।

চমকে উঠে ওদের দিকে ফিরল স্কিয়াররা। দেখল, দুটো ছুটন্ত গাড়ি প্রায় তাদের ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে। মাত্র কয়েক সেকেন্ড সময় আছে, ছিটকে একপাশে সরে গেল সবাই, কর্ডটাকে পাশ কাটাতে দেখল, দেখল তীরবেগে সেটাকে ধাওয়া করছে একটা মার্সিডিজ।

ট্রেইলে উঁচু হয়েছে একটা স্কি জাম্প, নেমেছে একশো মিটার দূরে। তুষার ঢাকা র‍্যাম্প ঠিক কোথায় পাহাড়ের গায়ে মিশেছে, দেখার অবসর নেই পিটের। কোনো রকম ইতস্তত না করে স্টাটিং ড্রপ-অফ-এর দিকের র‍্যাডিয়েটর অর্নামেন্ট তাক করল

লাফ দেবে, না? তাজ্জব জিওর্দিনো প্রশ্ন করল।

চার নম্বর প্ল্যান, তাকে আশ্বস্ত করল পিট। শক্ত হও। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে পারি।

আছে নাকি যে হারাবে?

অলিম্পিক কমপিটিশনের জন্য যে ধরনের কাঠামো তৈরি করা হয়, এটা তার চেয়ে অনেক ছোট। এটা শুধু অ্যাবেটিক আর হটডগ প্রদর্শনীর জন্য ব্যবহার করা হয়। তবে র‍্যাম্পটা কর্ডকে ধারণ করার জন্য যথেষ্ট চওড়া, খানিকটা জায়গা পড়েও থাকবে। ক্রমশ উঁচু হয়েছে ঢালটা, তারপর সমতল খানিকটা বিস্তৃতি, সবশেষে দেবে গেছে র‍্যাম্প, ত্রিশ মিটার এগিয়ে গ্রাউন্ড-এর বিশ মিটার ওপরে হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেছে।

স্টার্টিং গেটের দিকে গাড়ি তাক করল পিট, কর্ডের চওড়া বডির আড়ালে লুকিয়ে রাখল স্কি জাম্প। সাফল্য নির্ভর করছে সময়জ্ঞান আর প্রয়োজনমতো স্টিয়ারিং হুইল ঘোরানোনার ওপর।

একেবারে শেষ মুহূর্তে, সামনের চাকা স্টার্টিং লাইন পেরোবার আগেই, স্টিয়ারিং হুইল ঘোরানোর ওপর।

একেবারে শেষ মুহূর্তে, সামনের চাকা স্টার্টিং লাইন পেরোবার আগেই, স্টিয়ারিং হুইলে মোচড় দিল পিট। কর্ডের পেছনটা ঘুরে গেল, চরকির মতো পাক খেতে শুরু করে র‍্যাম্পটাকে এড়িয়ে গেল গাড়ি। কর্ডের আকস্মিক অস্থিরতা লক্ষ করে ঘাবড়ে গেল ইসমাইলের ড্রাইভার, সংঘর্ষ এড়াবার জন্য সরলরেখা থেকে সরিয়ে নিল মার্সিডিজকে, স্টার্টিং গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল নিখুঁতুভাবে।

কর্ডকে সোজা পথে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে পিট, ঘাড় ফিরিয়ে মার্সিডিজের দিকে তাকিয়ে আছে জিওর্দিনো। সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কিনারা থেকে নেমে গেল গাড়িটা। মুহূর্তের জন্য সেটাকে আকাশের গায়ে ডানাবিহীন মোটাসোটা একটা পাখির মতো লাগল। র‍্যাম্পের কিনারা ছাড়ার মুহূর্তে ঘণ্টায় একশো বিশ কিলোমিটার বেগে ছুটছিল ওটা। নিচে পড়ে প্রথমে ওটা চ্যাপ্টা হলো, তারপর গড়িয়ে নামার সময় খুলে খুলে পড়ল একেকটা পার্ট। পাইনগাছের সারিতে ধাক্কা খাওয়ার আগেই আরোহীরা সবাই দলা পাকিয়ে গেছে।

আরেকটু হলে আমরাও আকাশে উড়তাম! ঢাক গিলে পিটকে তিরস্কার করল জিওর্দিনো।

 তার বদলে সম্ভবত পাতালে নামতে যাচ্ছি! সতর্ক করল পিট। গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে ফিরতি পথ ধরতে গিয়ে সফল হলেও, কর্ডের চাকা ঢালে নেমে এসে পিছলাতে শুরু করেছিল। স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে পিছলানো সামলে নিয়েছে পিট, কিন্তু ঢাল বেয়ে পতনের গতি কমাতে পারছে না। ঢালের অর্ধেকটা পেরিয়ে আসতেই ব্রেকের শূন্য পুড়ে গেল, স্টিয়ারিং টাই রঙ বেঁকে গেছে, সেটাও একটা থ্রেড-এর মাথায় ঝুলছে। কর্ড ছুটে চলেছে তার অবধারিত পথে, সরাসরি একটা স্কি ফ্যাসিলিটি আর রেস্তোরাঁ বিল্ডিংয়ের দিকে, চেয়ার লিফটের গোড়ায়। একটা কাজই করার আছে রানর, করছেও তাই, বাচ্চাদের মতো অনবরত হর্ন বাজাচ্ছে।

 মহিলা আরোহীরা দ্বিতীয় মার্সিডিজের ধ্বংস চাক্ষুষ করেছে নির্দয় কৌতুল আর বিশাল স্বস্তিকর অনুভূতি নিয়ে। স্বস্তিটুকু ক্ষণস্থায়ী। ভবনটা সবেগে ছুটে আসছে দেখে আঁতকে উঠল তারা।

মি. পিট, কিছুই কি আমাদের করার নেই? পেছন থেকে জিজ্ঞেস করলেন হেলা কামিল। প্রশ্নটা প্রায় বুলেটের মতো ছুটে এল।

পরামর্শ দেয়ার অধিকার ইচ্ছে করলেই আপনি প্রয়োগ করতে পারেন, পাল্টা গুলি ছুড়ল পিট। পরমুহূর্তে ব্যস্ত হয়ে উঠল বাচ্চাদের তৈরি খেলাঘর এড়বার জন্য, খেলাঘরের চারপাশে তারা স্কি নিয়ে ছোটাছুটি করছে।

স্কিয়ারদের প্রধান অংশটা মার্সিডিজের পতন দেখেছে, কর্ডের আওয়াজও তাদের কানে গেছে। ট্রেইলের একপাশে দ্রুত সরে গেল তারা, হাঁ করে পাশ কাটাতে দেখল গাড়িটাকে।

চেয়ার লিফটের উঁচু প্রান্তটা থেকে ফোনে একাধিক গাড়ির দৌড় প্রতিযোগিতা সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে, বেস এরিয়া থেকে লোকজনকে সরিয়ে রয়েছে, স্কি ইনস্ট্রাকটররা। স্কি সেন্টারের ডান দিকে অগভীর একটা পুকুর রয়েছে, বরফে জমাট বাঁধা! পিটের ইচ্ছে, ওই পুকুরের ওপর পৌঁছানো। জমাট বাঁধা বরফ ভেঙে গেলে কর্ডের রানিং বোর্ড পর্যন্ত ডুবে যাবে, স্থির হবে গাড়ি। কিন্তু সমস্যা হলো, লোকজন কি ঘটে দেখার লোভে এমনভাবে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছে যে তাদের মাঝখানে রেস্তোরাঁ ভবন পর্যন্ত একটা করিডর তৈরি হয়েছে, পুকুরের দিকে যাবার কোনো পথ খোলা রাখেনি।

 আশা করতে পারি, গম্ভীর সুরে জিজ্ঞেস করল জিওর্দিনো, এবার তুমি ঝোলা থেকে পাঁচ নম্বর প্ল্যানটা বের করবে?

প্ল্যান সব শেষ, বলল পিট। দুঃখিত।

 হে’লা কামিল গলা লম্বা করে তাকিয়ে আছেন সামনের দিকে। তাঁকে মিথ্যে অভয় দেবে, সে উৎসাহও পাচ্ছে না লিলি। সংঘর্ষ অনিবার্য, আর দেরিও নেই, বুঝতে পেরে পরস্পরকে তারা জড়িয়ে ধরল, তারপর একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ল ড্রাইভিং সিটের পেছনে।

 স্কি আর পোল রাখা হয় র‍্যাকগুলোয়, কয়েকটার সাথে ধাক্কা খেল কর্ড। টুথপিকের মতো চারদিকে উড়ে গেল স্কি আর পোলগুলো। মুহূর্তের জন্য মনে হলো তুষারের ভেতর চাপা পড়েছে গাড়ি, তারপর বিস্ফোরণের মতো বেরিয়ে এসে আবার ছুটল সেটা, কংক্রিটের সিঁড়ি বেয়ে সরাসরি উঠে পড়ল বারান্দায়, কাঠের দেয়াল ভেঙে ঢুকে পড়ল ককটেল লাউঞ্জে।

 রুমটা খালি করা হয়েছে, রয়ে গেছে শুধু পিয়ানো বাদক। সে তার কি-বোর্ডের সামনে বসে আছে, বিস্ময়ে পঙ্গু। এক সেকেন্ড পর দেখা গেল আরও একজন রয়ে গেছে। বার-এর নিচ থেকে ধীরে ধীরে মাথা তুলল বারটেন্ডার, কর্ডটা ভেতরে ঢুকছে দেখে আবার ঝপ করে বসে পড়ল সে। চেয়ার-টেবিল খুঁড়িয়ে উন্মত্ত হাতির মতো ছুটে এল কর্ড, উল্টোদিকের দেয়াল ভেঙে নিচে লাফ দেয়ার পাঁয়তারা করল। দেয়ালের বিশ ফুট নিচে শক্ত বরফ।

আশ্চর্যই বটে, দেয়াল ভাঙার পর গর্তের ভেতর খানিকটা নাক গলিয়ে দিয়ে স্থির হয়ে গেল কর্ড, বোঝা গেল লাফ দেয়ার কোনো ইচ্ছে ওটার নেই।

র‍্যাডিয়েটরের হিসহিস শব্দ ছাড়া কামরার ভেতর ভৌতিক নিস্তব্ধতা নেমে এল। উইন্ডশিল্ড ফ্রেমের সাথে মাথাটা ঠুকে গেছে পিটের, চুলের আড়ালে সদ্য তৈরি ক্ষত থেকে গাল বেয়ে নেমে আসছে রক্ত। দেয়ালের দিকে ফিরল ও। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে এমন স্থিরভাবে বসে আছে সে, যেন পাথরের মূর্তিতে পরিণত হয়েছে। ঘাড় ফিরিয়ে পেছন দিকে তাকাল পিট। মহিলা আরোহীদের দু’জনের চেহারাতেই প্রশ্নসূচক এখনও আমরা বেঁচে আছি! ভাব।

 বারটেন্ডার এখনও লুকিয়ে আছে, কাজেই পিয়ানো বাদকের দিকে ফিরল পিট। তিন পায়াওলা একটা টুলে হতভম্ব চেহারা নিয়ে বসে আছে সে। তার মাথায় কাত হয়ে রয়েছে ডার্বি হ্যাট, ঠোঁটের কোণে ঝুলে রয়েছে আধপোড়া সিগারেট, ছাইটুকু এখনও ঝরে পড়েনি। কি-র ওপর তাক করা রয়েছে তার হাত দুটো, গোটা শরীর আড়ষ্ট। রক্তাক্ত আগন্তুকের দিকে তাকাল সে, আগন্তুক হাসল।

 ক্ষমা করবেন, ভাই, সবিনয়ে বলল পিট। একটু বাজিয়ে শোনাবেন নাকি–ফ্লাই মি টু দ্য মুন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *