প্লাবন

প্লাবন – ৮১

ভোর হলো।

আজানের ধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে ফিরে গেলো গ্রামবাসী যে যার ঘরে। কদিন আগেই ডাকাত পড়েছিলো ইকরাম আলী সাহেবের বাড়িতে, পুনরায় আজও সেই ডাকাতের আবির্ভাব সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে।

ভোর হবার সঙ্গেই ইকরাম আলীর রূপ পাল্টে গেলো। সে তার সমকক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে বেশ করে আবার গোপন আলোচনায় মেতে উঠলো, রাতে ডাকাত এসে তাকে এবং নৌকার মহাজনকে শাসিয়ে যে কথা বলে গেছে সে কথা সম্পূর্ণ গোপন করে গেলো সে।

মহাজনরা নৌকা বোঝাই চালের বস্তা নিয়ে ইরামতিতে নৌকা ভাসালো।

ইকরাম আলী তার চালের মূল্য বুঝে নিয়ে লোহার সিন্দুকে তুলে রাখলো এবং বাড়িতে দু’জন চৌকিদারের পাহারার ব্যবস্থা করলো। সে মালেক মিয়াকে ডেকে কঠিন কণ্ঠে বলে দিলো, এরপর যদি সে নাকে তেল দিয়ে ঘুমায় তাহলে তাকে সেদিনই বিদায় করে দেওয়া হবে।

মালেক মিয়া মাথা নেড়ে বললো–আর এমন হবে না মালিক, এবারের মত মাফ করে দিন।

 নানারকম গালমন্দ করার পর ইকরাম আলী ও ইকরাম গৃহিনী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

গোলাপীর মনটা ব্যথায় জর্জরিত হলো, কারণ মালেক মিয়া বুড়োমানুষ, তাকে এমনভাবে গালমন্দ করাটা যেন বড় অশোভন লাগছিলো তার কাছে।

রাতে আঁচলের নিচে ভাতের থালা লুকিয়ে এনে হাজির হলো গোলাপী। মুখোভাব তার মলিন বিষণ্ণ। ভাতের থালা নামিয়ে রেখে বললো–মালেক ভাই, এই নাও। সারাদিন কত বকুনি খেয়েছো, সব আমি শুনেছি।

হাসে মালেক মিয়া, তারপর খেতে বসে সে নিশ্চিন্ত মনে।

বাইরে কারও পদশব্দ শোনা গেলো।

গোলাপী বেরিয়ে গেলো আলগোছে। সে যখন বেরিয়ে যায় তখন ইকরাম আলী তাকে দেখে ফেলে। অবাক হয়ে বলে সেহাবলু বৌ, তুমি এখানে কেন?

হাবলুর বৌ কিছু না বলে চলে যায়।

ইকরাম আলী কক্ষমধ্য প্রবেশ করে রাগে ফেটে পড়ে–বুঝেছি লুকিয়ে লুকিয়ে ভাত দিয়ে যাওয়া হয়েছে……একগাদা ভাত নষ্ট করবে অথচ ঠিকমত পাহারা দিতে পারবে না। এক্ষুণি খেয়ে নিয়ে লাঠি হাতে দরজায় বসে যাও।

মালেক মিয়ার ততক্ষণে খাওয়া হয়ে গিয়েছিলো, সে হাত মুখ ধুয়ে লাঠি হাতে বেরিয়ে আসে, তারপর দরজার একপাশে বসে পড়ে দক্ষ প্রহরীর মত।

একসময় বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, এমন কি ইকরাম আলীও। আলগোছে সরে পড়ে মালেক মিয়া। সে জানতে পাড়ার হবি মোল্লার একটি ঘোড়া ছিলো। মাঝে মাঝে হবি মোল্লা তার ঘোড়া নিয়ে ইকরাম আলীর বাড়িতে আসতো, তখন মালেক মিয়া কখনও কখনও ঘোড়াটার পাশে গিয়ে দাঁড়াত এবং ওর শরীরে হাত বুলিয়ে দিতো। ঘোড়াটা বেশ বড়সড় ছিলো। মালেক মিয়া ভালবাসতো ঘোড়াটাকে। একদিন মালেক মিয়া হবি মোল্লাকে জিজ্ঞাসা করেছিলো, এ ঘোড়ায় তুমি কি করো?

হৰি মোল্লা জবাব দিয়েছিলো–ঘোড়াটা আমার বড় প্রিয়। ওর পিঠে চড়ে আমি দূরে শহরে বন্দরে যাই। ওতে চড়ে আমি মাঠে দৌড়াই তাতে আমি আনন্দ পাই। মালেক মিয়া নিজ হাতে কয়েকদিন ছোলাও খাইয়ে দিয়েছিলো ঘোড়াটাকে।

রাত বেড়ে আসছে।

মালেক মিয়া কক্ষমধ্যে প্রবেশ করে পাল্টে নেয় তার ড্রেস। জমকালো পোশাকে সজ্জিত হয়ে বেরিয়ে আসে সে বাইরে।

ইকরাম আলীর বাড়ি হতে সামান্য দুরে ছিলো হবি মোল্লার বাড়ি। বাড়ির উঠানের একপাশেই ছিলো তার ঘোড়াশালা। নিকষ অন্ধকারে ঘোড়াশালা থেকে হবি মোল্লার ঘোড়াটা বের করে আনলো মালেক মিয়া, তারপর পিঠে হাত বুলিয়ে চেপে বসলো। উল্কাবেগে ছুটে চললো এবার হবি মোল্লার ঘোড়াটা।

ইরামতির তীর ধরে ছুটলো মালেক মিয়া।

সমস্ত দিনে ইকরাম আলীর চালের বস্তাসহ মহাজনের নৌকা সবেমাত্র হাজরার বাঁক ঘুরে এসেছে। হাজরা বাক অনেক বড়, এই বাঁক ঘুরে আসতে প্রায় একদিন সময় লেগে যায়। সমস্ত দিন ধরে যে পথ এগিয়ে এসেছিলো নৌকাখানা, মালেক মিয়া সেই পথ মাত্র দেড় ঘন্টায় অতিক্রম করে পৌঁছে গেলো নৌকাখানার পাশে।

তীর ছেড়ে মাত্র কয়েক হাত দূরে নদীবক্ষে নৌকাখানা এগিয়ে চলেছে।

 মালেক মিয়া তীর থেকে কঠিন কণ্ঠে বললো–মাঝি, নৌকা ভিড়াও…নৌকা ভিড়াও……

মাঝিরা নিশ্চিন্ত মনে দাঁড় টেনে এগিয়ে যাচ্ছিলো। গভীর নিস্তব্ধ রাতের অন্ধকারে বনহুরের কণ্ঠস্বর স্পষ্ট এবং গুরুগম্ভীর শোনা গেলো। মাঝিরা সচকিত হয়ে উঠলো, ভয়ও হলো তাদের মনে। একজন বললো–হুজুর, হুজুর, তীর থেকে কে যেন নৌকা ভিড়ানোর জন্য হুকুম করছে।

মহাজনদ্বয় নৌকার মধ্যে শুয়েছিলো নরম গদি বিছানো বিছানায়। যদিও তারা নিদ্রায় মগ্ন ছিলো তবু তাদের সুখনিদ্রা ছুটে গিয়েছিলো, এতরাতে নির্জন হাজরা বকে কে তাদের নৌকা ভিড়ানোর জন্য নির্দেশ দিচ্ছে। তারা কান পেতে শুনতে চেষ্টা করছিলো।

এমন সময় মাঝিদের ভয়বিহ্বল কণ্ঠস্বর শোনা গেলো–হুজুর, কি করবো?

 প্রথম মহাজন চাপাকণ্ঠে বললো–তোমরা দাঁড় টেনে যাও।

ততক্ষণে পুনরায় শোনা গেলো–মাঝি, যদি বাঁচতে চাও নৌকা ভিড়াও……

দ্বিতীয় মহাজন তখন প্রায় কেঁদে ফেলেছে। সে বললো–নৌকা ভিড়াতে বলল, নইলে হয়তো কোনো বিপদে পড়বে।

প্রথম মহাজন বললো কিছুতেই নৌকা ভিড়ানো চলবে না। মাঝি, তোমরা জোরে জোরে দাঁড় টেনে চলো।

মাঝিরা কার কথা শুনবে, তারা মহাজনের কথামত দাঁড় টেনে চললো।

নৌকার মধ্যে বসে মহাজনদ্বয় তখন এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। হঠাৎ একটা গুলী তাদের মাথার পাশ কেটে চলে গেলো।

আঁতকে উঠলো মহাজনদ্বয়, ভয়ে তারা কাঁপতে শুরু করলো। হাজরা বাকে নদীর প্রশস্ততা অত্যন্ত সংকীর্ণ ছিলো, তাই নৌকা মাঝনদীতে চলেও রক্ষা পেলো না বনহুরের শক্তিশালী রিভলভারের গুলী থেকে।

সা করে আরও একটা গুলী নৌকার ছৈ ভেদ করে বেরিয়ে গেলো ওপাশে।

দ্বিতীয় মহাজন জড়িয়ে ধরলো প্রথম মহাজনকে, তারপর দুজনে গড়াগড়ি দিতে শুরু করলো। শুধু প্রাণের ভয় নয়, ভয় এক লক্ষ টাকার চালের বস্তাগুলোর জন্যও।

অবিরত গুলী ছুটে আসছে।

মাঝিরা ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো, তারা বললো–হুজুর, আমাদের প্রাণ যাবে–আপনারাও মরবেন, তার চেয়ে নৌকা তীরে ভিড়ানো ভাল।

প্রথম মহাজন বললো–তাই করো, তাই করো, নাহলে রক্ষা নেই। গুলী তো নয় যেন বৃষ্টি।

নৌকা নিয়ে মাঝিরা তীরের দিকে এগুতে লাগলো।

এবার বন্ধ হয়ে গেলো গুলী বর্ষণের পালা।

বনহুর কিন্তু তখনও অশ্বপৃষ্ঠে বসে আছে। অশ্বপৃষ্ঠে থেকেই সে অবিরত গুলী বর্ষণ করে চলেছিলো।

নৌকা তীরে ভিড়তেই মহাজনদ্বয় নৌকার ফাঁক দিয়ে তীরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। ভয়ে হৃদকম্প শুরু হলো তাদের। তারা দেখলো, তীরে অশ্বপৃষ্ঠে বসে আছে সেই জমকালো মূর্তি যে বলেছিলো–তোমরা এ চাল ক্রয় করো না। তোমাদের অর্থগুলো বিলিয়ে দাও হাজরার দুঃস্থ অসহায় জনগণের মধ্যে, কারণ তোমাদের এ অর্থ সদুপায়ে উপার্জিত অর্থ নয়……কিন্তু মহাজনদ্বয় তার কোনো কথা শোনোনি। তারা ইকরাম আলীর গুদামের সব চাল কিনে নিয়েছিলো যা চালের মূল্য তার পাঁচগুণ বেশি মূল্যে। ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছে তারা।

মাঝিরা নৌকার ভিতরে প্রবেশ করতে যাচ্ছিলো, তারাও ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে। গরিব মানুষ তারা, দুটো পয়সার জন্য নৌকা বায়, এবার তাদের মৃত্যু সুনিশ্চিত।

বনহুর অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নেমে পড়লো, তারপর নৌকার ধারে গিয়ে গম্ভীর এবং দৃঢ়কণ্ঠে বললো—বেরিয়ে এসো, বেরিয়ে এসো বলছি……

মহাজনদ্বয় বলির পাঠার মত কাঁপছিলো, এবার বেরিয়ে এলো ছৈয়ের বাইরে।

 বনহুর বললো–নেমে এসো নিচে।

 অগত্যা মহাজনদ্বয় নেমে এলো নৌকা থেকে। মাঝিরাও নেমে আসতে বাধ্য হলো।

বনহুর এগিয়ে এলো মহাজনদ্বয়ের পাশে।

রিভলভারটা প্রথম মহাজনের বুকে চেপে ধরে বললো–কি ব্যাপার, আমার কথা অবহেলা করে নিশ্চিন্ত মনে চালের বস্তাগুলো নিয়ে নিজেরা পাচার হয়ে যাচ্ছিলে দেখছি? সুন্দর বন্দোবস্ত, তাই না?

নীরব হয়ে গেছে মহাজনদ্বয়। তাঁদের দাঁতগুলো ঠক্ ঠক্ শব্দ শুরু করে দিয়েছিলো। চোয়ালটা অবাধ্যের মত খুব জোরে জোরে কাঁপছিলো কিনা, তাই দাঁতগুলো লাঠিবাড়ি খেলছিলো যেন।

বনহুর বললো–গাদা গাদা কাগজের বিনিময়ে এ দেশ থেকে তোমরা অসহায় মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে যাচ্ছো, জানো এর শাস্তি কি?

প্রথম মহাজন ঢোক গিলে বললো–কাগজের বিনিময়ে এসব নেবো কেন? আমরা নগদ টাকার বিনিময়ে এসব নিয়েছি…

বনহুর অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। হাজরা বাকের নির্জন প্রান্তর কেঁপে উঠলো সে হাসির শব্দে। মহাজনদ্বয়ের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার উপক্রম হলো। মাঝিরা তো তখন ভয়ে আতঙ্কে ঠক্ ঠক করে কাঁপছে। তারা বহু হাসি দেখেছে কিন্তু এমন হাসি তারা দেখেনি কোনোদিন। হাসির প্রতিধ্বনি যেন কেঁপে কেঁপে ভেসে বেড়াছে। হাসির রেশ মুখে যেতে না যেতেই বললো বনহুর–নগদ টাকা! কোনগুলো তোমাদের নগদ টাকা। এ কাগজের বান্ডিলগুলো? হাঁ, এ দেশে ওগুলো টাকাই বটে তবে তোমাদের দেশে ওগুলো টাকা নয়–ওগুলো টাকার আকারে তৈরি কাগজের স্তূপ। নরপশুর দল, তোমরা তোমাদের দেশে তৈরি টাকার আকারে কাগজের বান্ডিলগুলো এনে আমাদের দেশের অর্থ লেভী জানোয়ারদের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে তাদের মাথায় ঘোল ঢেলে তাদেরই সর্বনাশ করে যাচ্ছো? জিনিসের যা মূল্য তার দশগুণ বেশি দিলেও লোকসান হচ্ছে না, কারণ তোমরা তো তোমাদের কোনো বস্তু দিচ্ছে না, দিচ্ছো গাদা কাগজ–যার মূল্য নেই এক পয়সা। সেই কাগজের বিনিময়ে পাচ্ছো মূল্যবান সামগ্রী, লুটে নিচ্ছে এ দেশের হাজার হাজার অসহায় মানুষের গ্রাস। শুধু তোমরাই নও, তোমাদের মত বহু নরপশুর দল সাধারণ জনগণ সেজে গোপনে এ দেশের কিছু সংখ্যক স্বার্থান্ধদের উদর পূরণ করার সুযোগ করে দিচ্ছে।

না না, আমরা নই…..আমরা নই……হাত জুড়ে বলে মহাজনদ্বয়ের প্রথম জন।

বনহুর বললো–জানি, আমি একা তোমাদের সবাইকে শায়েস্তা করতে পারবো না কিন্তু মনে রেখো শয়তান, দেশের লাখো লাখো মানুষ তোমাদের ক্ষমা করবে না। তোমাদের মাংস তারা জীবন্ত অবস্থায় টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে শিয়াল কুকুরকে দিয়ে ভক্ষণ করাবে…যাও, নৌকা নিয়ে তোমরা হাজরা গ্রামে ফিরে যাও। সমস্ত চাল হাজরা গ্রামের দুঃস্থ মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দাও, নইলে হাজরা বাক তোমরা অতিক্রম করতে পারবে না। যাও, নৌকা নিয়ে তোমরা হাজরা গ্রামে ফিরে যাও……

বাধ্য সন্তানের মত নৌকায় উঠে বসলো মহাজনদ্বয়। তারা মনে মনে আল্লাহর নাম জপতে শুরু করে দিয়েছে।

মাঝিরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছিলো, বনহুর তাদের ধমক দিতেই তারাও নৌকায় উঠে পড়লো।

নৌকার মুখ হাজরা গ্রাম অভিমুখে ফিরিয়ে নিতেই বনহুর ঘোড়ার পিঠে চেপে বসলো।

*

লাঠি হাতে মালেক মিয়া টুলটার উপরে বসে বসে ঘুমাচ্ছিলো। তার অদূরে দু’জন চৌকিদার তারা চট বিছিয়ে নাক ডাকছিলো।

ওদিকে বেলা উঠে গেছে কখন।

ইকরাম আলী শয্যা ত্যাগ করে আনন্দ বিগলিতভাবে হাই তুলে শুভ রাত্রিকে অভিনন্দন জানালো। তারপর বেরিয়ে এলো বাইরে, খুশিতে উচ্ছল তার মুখমন্ডল, কারণ সে গোটারাত নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়েছে।

বাইরে এসে দেখে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে মালেক মিয়া আর চৌকিদারদ্বয়। রাগে ফেটে পড়লেন–এটাই বুঝি তোমাদের পাহারা দেবার ঢং, তাইনা?

ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ায় মালেক মিয়া।

চৌকিদারদ্বয় গোটারাত নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়েছে, কাজেই তারা আরামে গা মোড়া দিয়ে উঠে বসলো। মালেক মিয়া সন্ধ্যা রাতে দুটো বিড়ি দিয়েছিলো তার পুঁটলি থেকে বের করে ওদের হাতে। ওরা বিড়ি দুটো খেয়ে আরামে ঘুমিয়ে পড়েছিলো, ঘুম ভাঙলো সবেমাত্র।

ইকরাম আলী বললো–এমন করে রোজ পাহারা দিবি যাতে কোনো ডাকাত বা ডাকাতের বেটা আমার বাড়ির আশেপাশে আসতে না পারে। কথা শেষ করে যেমনি ইকরাম আলী উঠানের দিকে পা বাড়াতে যাচ্ছিলো, ঠিক ঐ মুহূর্তে মহাজনদ্বয় এলোমেলো ছন্নছাড়া অবস্থায় এসে দাঁড়ালো।

চমকে ফিরে তাকালো ইকরাম আলী, অবাক কণ্ঠে বললো–আপনারা?

উভয় মহাজনের মুখমন্ডল বিবর্ণ ফ্যাকাশে। তাদের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে তারা এইমাত্র কোনো মৃতদেহ অগ্নিদগ্ধ করে শুশান থেকে ফিরে আসছে।

ইকরাম আলী বললো–কি ব্যাপার, আপনারা?

প্রায় কেঁদে ফেললো মহাজনদ্বয়।

মালেক মিয়াও কম অবাক হয়নি, সে বলে উঠলো–আপনারা ফিরে এলেন কেন? চালগুলো কি মালিক সাহেবকে ফেরত দিতে এসেছেন?

মহাজনদ্বয়ের মুখে কথা বের হচ্ছে না যেন, ঢোক গিলে বললো প্রথমজন–সর্বনাশ হয়েছে……সর্বনাশ হয়েছে…….

সর্বনাশ? কি সর্বনাশ হয়েছে আপনাদের মহাজন সাহেব? বললো মালেক মিয়া।

ততক্ষণে আরও লোকজন জুটে গেছে সেখানে, কারণ মহাজনদ্বয় কাল সকালে বিদায় নিয়ে চলে গেছেন। তারা সীমান্তের ওপারের লোক এসেছিলেন গোপনে, চলে গেছেন সাবধানে অথচ আবার তারা কেন ফিরে এলেন ভাববার বিষয়।

মালেক মিয়ার কথায় বললেন ইকরাম আলী–তুই চুপ কর মালেক, আমাকে বলতে দে।

হাঁ, বলুন মালিক বলুন–আমরা তো ঘোটলোক, কি বুঝবো এ সবের, কিন্তু……

বল কিন্তু কি, থামলি কেন?

আপনি যে চুপ করতে বললেন তাই…

যা, তুই এখান থেকে যা দিকি।

আমাকে শুনতে দিবেন না মালিক, যদি আমার দরকার হয়, কারণ লাঠিতে আমার হাতে।

হ, তুই থাক। আচ্ছা বলুন কি সর্বনাশ হয়েছে? নৌকা ডুবে গেছে বুঝি? বললো ইকরাম আলী মিয়া।

না, নৌকা ডোবেনি।

 তবে চুরি হয়েছে, না কেউ লুট করে নিয়েছে?

না।

তবে কি হয়েছে?

 ঘরের ভিতরে চলুন, সব বলছি।

ইকরাম আলী সহ মহাজনদ্বয় ইকরাম আলীর বৈঠকখানায় প্রবেশ করলেন।

রাতের ঘটনা তারা সব বললে ইকরাম আলীর কাছে। তারা চাল দুঃস্থ জনগণের মধ্যে বিতরণ করে না দিয়ে হাজরা বাঁক তাদের নৌকা পার হতে পারবে না। আরও বললো–ডাকাত তাদের ঐ মুহূর্তে হত্যা করতে পারতো শুধু তা করেনি চালগুলোর জন্য……।

 ইকরাম আলী আকাশ থেকে পড়ার ভান করলেও একেবারে হকচকিয়ে গেলো না, কারণ টাকাপয়সা তার নেওয়া হয়ে গেছে, এখন মহাজনদের চাল তারা যা খুশি করতে পারে। নদীর পানিতে ফেলুক আর দুঃস্থ জনগণের মধ্যে বিলিয়ে দিক, ক্ষতি নেই কিছু তার।

মহাজনদ্বয় এবার গ্রামের দুঃস্থ লোকদের জানাবার জন্য ইকরাম আলীকে অনুরোধ করলেন। ইকরাম আলী আদেশ দিলেন মালেক মিয়ার উপর–যাও মালেক মিয়া, তুমি গ্রামের দুঃস্থ লোকদের সংবাদ দাওগে, তারা যেন নদীর ঘাটে সমবেত হয়। আর শোনো, সবাইকে যেন বলোনা, কিছু চাল বিতরণ করবে আর কিছু গোপনে আমার গুদামে এনে রাখবে।

মালেক মিয়া বললো–আচ্ছা মালিক, তাই করবো……চলে গেলো মালেক মিয়া।

ইকরাম আলী এবার মহাজনদ্বয়কে বললো–আপনারা সামান্য কিছু চাল বিতরণ করে সব চাল আমার গুদামে রেখে যান, ডাকাত বেটা টেরও পাবে না।

মহাজনদ্বয়ের পিলে কেঁপে উঠলো, তারা ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলো তাই রাজি হলো না কিছুতেই।

মালেক মিয়া প্রথমেই হবি মোল্লার কাছে গেলো, বললো– আমাকে তোমার ঘোড়াটা। কিছুক্ষণের জন্য দাও, আমি গ্রামের দুঃস্থ জনগণকে খবর দিয়ে আসি তারা যেন ইরামতির তীরে যায়। সেখানে দু’জন হৃদয়বান মহৎ মহাজন এসেছেন, তারা তাদের চালগুলো বিতরণ করে দেবেন দুঃস্থ জনগণের মধ্যে।

হবি মোল্লা কিছুতেই ঘোড়া দেবে না।

হাসলো মালেক মিয়া, বললো–রাতে তোমার ঘোড়া কোথায় ছিলো ভাই, মাঠে ছুটে গিয়েছিলো, আমি তো এনে বেঁধে রেখে গেছি।

হবি মোল্লা ওর কথা বিশ্বাস না করে পারলো না, সে ঘোড়াটা ছেড়ে দিলো মালেক মিয়ার হাতে। মালেক মিয়া ঘোড়া পেয়ে খুব খুশি হয়ে গ্রামের দুঃস্থ অসহায় যারা, তাদের সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করে জানিয়ে দিলো ইমতি তীরে যাওয়ার কথা।

দুঃস্থ জনগণ খুশি হয়ে ছুটলো মালেক মিয়ার কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে।

অল্পক্ষণেই ইরামতি তীরে মহাজনের নৌকার পাশে অগণিত দুঃস্থ অসহায় জনগণের ভিড় জমে গেলো।

মহাজনদ্বয়ের মুখ মড়ার মুখের মত ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে, তারা মনের ব্যথা মনে চেপে নৌকার পাশে দন্ডায়মান রইলো। মালেক মিয়ার কিন্তু আনন্দ আজ ধরছে না, সে নৌকার মধ্য থেকে মাঝিদের সহায়তায় চালের বস্তা বের করে এনে নিজের হাতে চাল মেপে দিতে শুরু করে দিলো।

দুঃস্থ জনগণ যারা ইকরাম আলীর কাছে টাকা এনেও চাল পায়নি, তারা বিনা পয়সায় তাদের প্রয়োজন মত চাল পেয়ে হাসিতে ভরে উঠলো তাদের মুখ। তারা মহাজনদ্বয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠলো।

মালেক মিয়া চাল মেপে দিচ্ছে আর গলা ফাটিয়ে মহাজনদ্বয়ের মহৎ হৃদয়ের কথা শোনাচ্ছে। সে বলছে–ভাই সকল, তোমরা খোদাতালার কাছে মোনাজাত করো তোমাদের পরম বন্ধু বিদেশী মহাজনদ্বয় যেন দীর্ঘজীবি হোন, তারা যেন বারবার এদেশে আসেন এবং তোমাদের মধ্যে এভাবে খাদ্যদ্রব্য বিতরণ করেন।

মালেক মিয়ার কথায় মহাজনদ্বয়ের মুখ আরও কালো হয়ে উঠছে, তারা শুধু অধর দংশন করছে কিন্তু কোনো উক্তি উচ্চারণ করতে সক্ষম হচ্ছে না। তাদের গলা যেন শুকিয়ে গেছে, চোখ দুটো দু’আংগুল বসে গেছে, চুলগুলো রুক্ষ–শ্রীহীন চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে, যেন এক একটি কাঠের পুতুল।

 মালেক মিয়া তার সঙ্গী–সাথীদের নিয়ে এক এক বস্তা চাল নৌকার খোল থেকে বের করে আনছে আর বস্তার মুখ খুলে নিয়ে তুলে দিচ্ছে গরিবদের থলেতে।

থলে ভর্তি হলে তারা সরে যাচ্ছে।

হাজরার মেঠো পথে লাইন ধরে এগিয়ে যাচ্ছে একদল খালি থলে হাতে নৌকার দিকে, আর একদল পূর্ণ থলে হাতে বাড়ির পথে ফিরে যাচ্ছে। সবার চোখে আনন্দের উচ্ছলতা, কতদিন পর তারা পেট পুরে দুটি খেতে পাবে!

ইকরাম আলীও মহাজনদ্বয়ের পাশে দাঁড়িয়েছিলো, এত চাল বিনা পয়সায় লোককে দিতে হচ্ছে, এটা কম যন্ত্রণাদায়ক দৃশ্য নয়। তবু তিনি নীরব দর্শক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছেন থ’ হয়ে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বিরাট নৌকাখানার খোল শূন্য হয়ে গেলো, পড়ে রইলো শুধু খালি বস্তাগুলো।

মহাজনদ্বয় মাথায় হাত দিয়ে নদীতীরে ধুলোবালির মধ্যে বসে পড়লো, তাদের মুখে কোনো কথা নেই।

মালেক মিয়া চাল বিতরণ শেষ করে নেমে পড়লো নৌকা থেকে। হাতের মধ্যে হাত কচলে বললো–হুজুর, আপনারা যে মহৎ কাজ করলেন তার তুলনা হয় না। হাজরা গ্রামের দুঃস্থ জনগণ ক্ষুধার জ্বালায় মরিয়া হয়ে উঠেছিলো, তারা আপনাদের আশীর্বাদ করছে। আপনারা এবার ফিরে যান। যেখান থেকে এসেছিলেন সেখানে।

ইকরাম আলী বললো–আপনারা দুঃখ করবেন না। যতদিন আমরা জীবিত আছি ব্যবসা আমাদের চলবেই, নদী পথে না হয় স্থলপথে–তাও যদি না হয় আকাশপথে……হেঁ হেঁ হেঁ, একটু হেসে বললো–ডাকাত কেন, ডাকাতের বাবা পুলিশ মহল আমাদের কাজে বাধা দিতে পারেনি, পারবেও না। কি বলিস্ মালেক, তাই না?

হাঁ হাঁ মালিক, ঠিক বলেছেন, কারও বাবার সাধ্য নেই আপনাদের মত জীবন্ত শয়তানদের……

কি, কি বললি?

না না……জিভ কামড়ে বলে মালেক মিয়া–আপনাদের মত জীবন্ত ফেরেস্তাদের কাজে কেউ কোনোদিন বাধা দিতে পারবে না। আপনারা হলেন কিনা দেশ ও দশের জনদরদী বন্ধু–শুধু বন্ধু নন, আপনারা দেশের হিতাকাঙ্খী। আপনারা সদাসর্বদা দেশ ও দশের মঙ্গল নিয়ে ভাবছেন।

হাঁ, ঠিক বলছিস মালেক, আমরা যত দেশ ও দশের জন্য ভাবি এমন আর কে আছে যারা দেশের জন্য ভাবে? হাঁ, অচিরেই একটা জনসভা দেবো–দুঃস্থ জনগণকে এতগুলো চাল দেওয়া হলো বিনা পয়সায়, কাজেই এ সময়ে তারা সবাই খুশি আছে আমাদের উপর।

মালেক মিয়া বলে উঠে–মালিক, অচিরে কেন, আজই একটা সভা দিন, সে সভায় থাকবেন বিদেশী মহাজনদ্বয়। তারা নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করে হাজার হাজার টাকার চাল জনগণের মধ্যে বিতরণ করে দিলেন, আর জনগণ তাদের ধন্যবাদ জানাবার সুযোগ পাবে না?

ঠিক কথা। মালেক,. তুই দেখছি বেশ বুদ্ধি নিয়ে কথা বার্তা বলিস। হাঁ, মহাজনদ্বয় থাকতেই আমি গ্রামে জনসভা করবো, তবে আজ নয় দু’একদিন যাক।

কিন্তু মহাজনরা কি থাকবেন?

বলল না থেকে পারবেন না। তা ছাড়া মহাজনরা তো আমাদেরই পরম বন্ধু, তবে আমাদের ছোঁয়া খান না, এই যা অসুবিধা…

হাঁ, ওটুকুই অসুবিধা উনাদের, আমাদের ছোঁয়া কিছু খান না…..মালিক, তাহলে কি উপায় হবে? হাঁ, একটা বুদ্ধি আমার মাথায় এসেছে। উনারা সেদ্ধ খান না কাঁচা খান? কাঁচা চাল ডাল মাছ মাংস ডিম দুধ সব দিলেই উনারা নৌকায় পাক করে খাবেন। মালেক মিয়া এবার মহাজনদ্বয়ের পাশে গিয়ে বললো–একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেছেন কেন–কথা বলুন, কাঁচা মাল খাবেন তো?

মহাজনদ্বয়ের মুখে কে যেন কালি মাখিয়ে দিয়েছিলো, তারা বলির পাঠার মত মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়েছিলো এতক্ষণ, এবার বললো–না খেয়ে উপায় কি?

তা ঠিক, স্থান–কাল–পাত্র বিশেষ কাঁচা–পাকা সবই চলে, তাই না হুজুর……বললো মালেক।

ইকরাম আলী ধমকে উঠেন–মালেক, তুই দেখেছি বড় বড় বুলি আওড়াতে শিখছিস! পাকা পাকা কথা শিখলি কোথায়?

মালিক, শিখতে হয় না, আজকাল হা করলেই গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে।

তাই বলে যা খুশি বলবি?

না না, তা কি আর বলা যায়, যা দেখবো যা শুনবো নীরবে হজম করতে হবে। হঠাৎ দু’একটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় এই যা……।

যখন এসব আলোচনা চলছিলো, ঠিক ঐ সময় একটা জীপগাড়ি এসে দাঁড়ালো ইকরাম আলীর বৈঠকখানার সম্মুখে। গাড়ি থেকে নামলেন দু’জন সরকারি পোশাকধারী লোক।

ইকরাম আলী তাঁদের দেখামাত্র আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো, তাড়াতাড়ি অভিনন্দন জানিয়ে তাদের বৈঠকখানায় নিয়ে গিয়ে বসালো। মহাজনদ্বয় তখন সরে পড়তে যাচ্ছিলো, ইকরাম আলী তাদেরও ডেকে বসালো এবং পরিচয় করে দিলো সরকারি ভদ্রলোক দু’জনার সঙ্গে।

মালেক মিয়াও ওদের সঙ্গে প্রবেশ করেছিলো বৈঠকখানায়, তার কানে এলো ইকরাম আলীর কণ্ঠস্বর–স্যার, হঠাৎ সংবাদ না দিয়ে কেন এসেছেন জানতে পারি কি?

প্রথম ব্যক্তি সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে বললেন–যে কারণে এসেছি তা শুনলে আপনি দুঃখ পাবেন ইকরাম আলী সাহেব, তবু না বলে পারছি না, কারণ আমরা আপনার সম্বন্ধে রিপোর্ট পেয়েছি যে, আপনি দেশের পণ্যদ্রব্য পাচার করে যাচ্ছেন……প্রথম ব্যক্তি পরিস্কার বাংলায় কথা বললেন। বহুদিন যাবৎ এদেশে চাকরি করেন, তাই ভাল বাংলা বলতে পারেন।

দ্বিতীয় ব্যক্তি বললেন–ভয় পাবার কিছু নেই জনাবা, কারণ অমন রিপোর্ট আমরা পেয়েই থাকি কিন্তু আসলে আপনাদের কাজে সহায়তা করাই আমাদের উদ্দেশ্য।

 ইকরাম আলীর মুখে এবার হাসি ফুটলো, সে হাত বাড়িয়ে সরকারি ব্যক্তিদ্বয়ের সঙ্গে করমর্দন করলো। হঠাৎ তার দৃষ্টি চলে গেলো দরজার দিকে, দেখলো সেখানে দাঁড়িয়ে আছে মালেক মিয়া।

ইকরাম আলী বললো–কিরে, এখানে কি করতে এলি?

মালেক মিয়া হাতের মধ্যে হাত কচলে বললো–মালিক, মেহমান এসেছে কখন কি দরকার তাই এখানে দাঁড়িয়ে আছি। তামাক আনবো কি?

তামাক তোকে আনতে হবে না, দেখছিস না সিগারেট পান করছেন ইনারা?

মালিক আপনি সিগারেট পান করেন না কিনা তাই…..

কে বললো সিগারেট পান করি না? যা, এখান থেকে চলে যা বলছি।

আচ্ছা যাচ্ছি। বেরিয়ে যায় মালেক মিয়া।

বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে আসতেই নজরে পড়লো হাবলু মোটরখানার দিকে হা করে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

মালেক মিয়া গিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখলো–হাবলু ভাই কি দেখছো?

 হাবলু ইশারা করে দেখিয়ে দিলো গাড়িখানা।

 মালেক মিয়া বললো–গাড়িতে চড়বে?

হাবলু মাথা নেড়ে সায় দিলো সে চড়বে। আধপাগলা হাবলুর চোখমুখে ফুটে উঠেছে আনন্দোচ্ছাস। গাড়িখানা নেড়েচেড়ে দেখছে সে ব্যাকুল আগ্রহ নিয়ে।

এমন সময় ভিতর থেকে ডাক এলো, ইকরাম আলীর গালা–মালেক, আমার জন্য তামাক নিয়ে আয়।

মালেক খুশি হয়ে বললো–আসছি মালিক। সে ঐ কক্ষে প্রবেশের জন্যই উৎসুক ছিলো। তাড়াতাড়ি তামাক আনার জন্য ভিতরে প্রবেশ করলো। একটু পরেই তামাক হাতে প্রবেশ করলো বৈঠকখানায়।

এখন ওরা তিনজন নিজেদের আলাপ–আলোচনায় গভীরভাবে তলিয়ে গেছে। একপাশে বসেছিলো মহাজনদ্বয়, তারা একেবারে নিশ্চুপ কোনো কথা বলছে না।

মালেক মিয়া তামাক হাতে একপাশে এসে দাঁড়ায়। তাকে ওরা লক্ষ্য করে না, যেমন কথাবার্তা বলছিলো তেমনি বলতে থাকে।

ইকরাম আলী বলে–দেখুন মিঃ বার্নার, আপনারা যদি সহায় থাকেন এবং সাহায্য করেন তবে কোনো অসুবিধা হবে না। দেশে এবার যা খাদ্যশস্য ফলেছে তা প্রচুর। প্রতি হাটে আমি দুশ’ মণ থেকে পাঁচ শমণ চাল খরিদ করি এবং তা…মহাজনদ্বয়কে দেখিয়ে বলে–এদের হাতে তুলে দেই! থামলো ইকরাম আলী।

মিঃ বার্নার বললেন–আপনার সহায়তা আমাদের কাম্য মিঃ আলী, কারণ আপনি যে খাদ্যশস্য সংগ্রহ করেন এর জন্য আপনি নিজেও মোটা অংক লাভে লাভবান হন, আর ইনারাও লাভবান হন। মাঝখানে বকশিস স্বরূপ আমরা সামান্য দু’চার হাজার পাই এই যা। মিঃ ইকরাম আলী, আমি কেন এসেছি এবার আসল কথাটা বলি? আমাদের কর্মকর্তা মহল এবার সজাগ হয়েছেন, তারা প্রকাশ্যে আপনাদের সহায়তা করতে পারবেন না, তারা গোপনে কাজ করবেন যেন একটি পিঁপড়াও জানতে না পারে।

হাঁ, আমরাও তাই চাই। দেশের যে শোচনীয় অবস্থা তাতে মানুষগুলো যেন উন্মাদ হয়ে উঠেছে। হা খাদ্য খাদ্য করে মরছে। আমাকে কত সাবধানে যে কাজ করতে হচ্ছে তা কি বলবো…

ইকরাম আলীর কথা শেষ হয় না, পিছন থেকে মালেক মিয়া বলে উঠে–মালিক, তবু তো রেহাই পেলেন না। সেই উন্মাদ মানুষগুলোর হাতে তুলে দিতে হলো হাজার হাজার মণ চাল……

কে মালেক–তুই কখন এলি এখানে?

মালিক, যখন আপনি তামাক চেয়েছিলেন তখন। এই নিন তামাক……

ইকরাম আলী বহুক্ষণ তামাক সেবন না করায় বেশ হাঁপিয়ে উঠেছিলো, সে হাত বাড়িয়ে হুঁকোটা মালেকের হাত থেকে নিয়ে বললো– এখান থেকে, আর যেন আসবি না।

আচ্ছা মালেক। কথাটা বলে মালেক মিয়া বেরিয়ে যায় কিন্তু সে একেবারে চলে যায় না, দরজার আড়ালে আত্মগোপন করে।

মহাজনদ্বয় এতক্ষণ নিশ্চুপ বসেছিলো, তাদের মুখে কোনো কথা ছিলো না, এবার তারা যেন মুখর হয়ে উঠে।

প্রথম ব্যক্তি বললো–ইকরাম আলী সাহেব, সাবধানে কাজ করেও তো রেহাই পেলাম না। আমাদের সমস্ত খরিদ করা মাল ডাকুর ভয়ে দুঃস্থ জনগণের মধ্যে বিলিয়ে দিতে বাধ্য হলাম।

আগন্তুকদ্বয় বিস্ময় নিয়ে তাকালেন মহাজনটির মুখের দিকে এবং পরক্ষণে ইকরাম আলীকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন করলেন–ব্যাপার কি মিঃ আলী, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না?

ইকরাম আলী এক নিঃশ্বাসে কিছুক্ষণ হুঁকো থেকে নির্গত করে বললো–মিঃ বার্নার, বড় দুঃখের কথা ইদানীং নতুন এক বিপদ দেখা দিয়েছে।

কি রকম? অবাক কণ্ঠে বললেন মিঃ বার্নার। আগন্তুকদ্বয়ের মধ্যে তিনিই বেশি বুদ্ধিমান বলে মনে হচ্ছিলো।

মিঃ বার্নারের কথায় বললে ইকরাম আলী–বহুদিন ধরে আমি ব্যবসা করে আসছি কিন্তু কোনোদিন এমন বিপদে পড়িনি। এবার নতুন এক বিপদ দেখা দিয়েছে–সে হলো এক অদ্ভুত ধরনের ডাকাত।

ডাকাত!

হাঁ, বড় দুর্ধর্ষ সে ডাকাত।

 হাজরা গ্রামে ডাকাত এ কথা তত আমরা কোনোদিন শুনিনি?

শোনেননি এবার শুনুন এবং এই ভয়ঙ্কর ডাকাতের আতঙ্কে আতঙ্কিত হয়ে আমরা দিশেহারা হয়ে পড়েছি……থামলো ইকরাম আলী, তারপর আবার বলতে শুরু করলো, প্রায় রাতেই এই দুর্ধর্ষ ডাকাতের আবির্ভাব ঘটে এবং সে গতরাতে মহাজনদ্বয়ের নৌকায় হানা দিয়ে সর চাল….বেশ কয়েক হাজার টাকা মূল্যের চাল……

কি বললেন, বেশ কয়েক হাজার মূল্যের চাল সে ছিনিয়ে নিয়েছে।

ঠিক ছিনিয়ে না নিলেও সর্বনাশ সে করেছে। বিস্ময়কর তার কার্যকলাপ। সে নৌকায় হানা দিয়ে মহাজনদ্বয়কে সাবধান করে দিয়ে বলেছে, যদি নৌকার সমস্ত চাল হাজরার দুঃস্থ জনগণের মধ্যে বিলিয়ে না দেয় তাহলে হাজরার বাঁকে তাদের হত্যা করা হবে…….

হো হো করে হেসে উঠে বললেন মিঃ বার্নার–আর সেই হত্যার ভয়ে আপনারা নৌকার সমস্ত চাল দুঃস্থ জনগণের মধ্যে বিলিয়ে দিলেন, তাই না?

এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলোনা মিঃ বার্নার।

কেন আপনারা শহরে সংবাদ পাঠাননি? কেন আপনারা নীরবে ডাকুর আদেশ পালন করেছেন? শহরে সংবাদ পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ফোর্স চলে আসতো এবং আপনাদের বিপদমুক্ত করতো।

কিন্তু ডাকু রিভলবারের মুখে আমাদের শাসিয়ে দিয়েছিলো যদি আমরা পুলিশের সাহায্য গ্রহণ করি তাহলে হাজরা বাঁক কোনোদিনের জন্য অতিক্রম করতে পারবে না, তাই আমরা……কথাটা বলতে গিয়ে থেমে পড়লেন মহাজনদ্বয়ের প্রথম জন।

সরকারি লোক মিঃ বার্নার এবং মিঃ হার্ডিং–তারা ডাকুর স্পর্ধার কথা শুনে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন–কে সে ডাকু যার দৌরাত্ন এমনভাবে বেড়ে গেছে? বললেন মিঃ হার্ডিং।

ইকরাম আলী হুঁকোটা দেয়ালে ঠেশ দিয়ে রেখে বললো–সে এক অদ্ভুত ডাকু….দেখতেও যেমন ভয়ঙকর তেমনি দুধর্ষ…একবার নয়,,,কয়েকবার সে আমার বাড়িতে হানা দিয়েছে কিন্তু সে কিছু নিতে বা করতে সাহস পায়নি। জানে আমার ক্ষতি করলে সে রেহাই পাবে না, তাই তো যেমন এসেছে তেমনি পালাতে বাধ্য হয়েছে……একটু থেমে বললো–শেষ পর্যন্ত মহৎ ব্যক্তি মহাজনদ্বয়কে সে কাবু করতে সক্ষম হয়েছে…এবার হাসলো ইকরাম আলী–আপনারা ঘাবড়াবেন না, শয়তান ডাকাতটাকে এবার পেলে আমি নিজে তাকে হত্যা করবো। সুযোগ পেয়েও আমি তাকে ক্ষমা করেছি কয়েকবার কিন্তু আর নয়……যাক, ওসব কথা, মিঃ বার্নার আপনি যে কারণে এসেছেন এবার তা নিয়ে আলোচনা করতে চাই।

মিঃ বার্নার বললেন–হাঁ, তবে শুনুন। এবার হাজরার দুঃস্থ জনগণের জন্য আসছে হাজার হাজার বাক্স রিলিফদ্রব্য। যা শুধু আপনার সৌভাগ্যই খুলে দেবে না, খুলে দেবে আমাদের সকলের অদৃষ্ট। কিন্তু অতি সাবধানে কাজ করতে হবে।

হাঁ, আপনি যা বলেছেন সত্য, সাবধানতা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু…

বলুন কিন্তু কি?

যে রিলিফদ্রব্য হাজরার দুঃস্থ জনগণের জন্য এসেছে তা যদি সেই দুঃস্থরা জানতে পারে?

যাতে জানতে না পারে সেই ব্যবস্থাই করতে হবে মিঃ ইকরাম।

ইকরাম আলী বললো–আচ্ছা মিঃ বার্নার আমি যথাসম্ভব আপনার আদেশ এবং নির্দেশ মেনে। চলতে চেষ্টা করবো। কবে পর্যন্ত মাল এসে পৌঁছবে মিঃ বার্নার?

আপনি প্রস্তুত থাকবেন, কেননা মাল রাজধানীতে পৌঁছে গেছে, এখন দেশের বিভিন্ন এলাকার জন্য বরাদ্দ করা বাকি। তবে কর্মকর্তারা হাজরার দুঃস্থদের জন্য সব জায়গার চেয়ে বেশি রিলিফদ্রব্য বরাদ্দ করেছেন…..গলার স্বর খাটো করে নিয়ে বললেন মিঃ বার্নার–শুধু বরাদ্দ নয়, হাজরার মাল পাঠানো ব্যাপারে সব ঠিক হয়ে গেছে। কৌশলে কাজ করতে হবে–হুঁশিয়ার, যেন কেউ টের না পায়। যদি আপনি ঠিকমত কাজ সমাধা করতে পারেন তাহলে পাবেন মোটা অঙ্ক।

ইকরাম আলী বললো–সে ব্যাপারে কোনো ত্রুটি হবে না মিঃ বার্নার।

জানি আপনি কাজের লোক এবং সে কারণেই আপনাকে আমাদের এত প্রয়োজন।

ইকরাম আলীর মুখখানা যেন খুশিতে ঝলমল করে উঠলো, হাতের মধ্যে হাত কচলে বললো–সবই আপনাদের অনুগ্রহ…হেঁ হেঁ হেঁ, হাসলো ইকরাম আলী, তারপর বললো–এতদিন ধরে ইরামতি নদীপথে আমার কারবার বেশ চলছিলো, এ ছাড়াও সীমান্তের ওপার থেকে বহু কারবারী মহাজন গোপনে আসা–যাওয়া করতেন। এখন নতুন এক বিপদ দেখা দিয়েছে…

মিঃ বার্নার বললেন–কিন্তু সে বিপদ দেখে ভয়ে কুঁকড়ে গেলে চলবে না।

ঠিক বলেছেন মিঃ বার্নার, যত বিপদ আসুক উপড়ে ফেলতেই হবে। ডাকাতের ভয়ে ব্যবসা ছেড়ে দেবো, এমন বান্দা ইকরাম আলী মিয়া নয়। মহাজনদ্বয়কে লক্ষ্য করে বলে সে–এমন কৌশলে কাজ করবো ডাকাত বেটা টেরই পাবে না।

আমরা জানি মিঃ ইকরাম, আপনি কাজের লোক, তাইতো আপনার এত কদর আমাদের কাছে। যে রিলিফ দ্রব্যগুলো ইদানীং এসে পৌঁছেছে, এগুলো ছাড়াও আরও বহু মালামাল বিদেশ থেকে আসছে। মিঃ ইকরাম আলী, আপনি শুনে খুশি হবেন ইদানীং বহু চাল, গম ও বস্ত্র আসছে আমাদের দেশের দুঃস্থ জনগণের জন্য……

বলেন কি স্যার?

 হাঁ মিঃ ইকরাম এবং সে মালামাল অচিরেই এসে পৌঁছবে।

এত সাহায্য হঠাৎ কেন বিদেশ দিচ্ছে?

আপনি এ সংবাদ জানেন না বুঝি?

না তো?

এবারের প্লাবন, সে এক মহাপ্লাবন মিঃ ইকরাম, হাজরা এবং কয়েকটা জায়গা ছাড়া এবার যে ভয়ংকর প্লাবন দেখা দিয়েছে তাতে হাজার হাজার গ্রাম ভেসে গেছে। আমি অবাক হচ্ছি আপনি এ সংবাদ এখনও জানেন না।

মিঃ বার্নার আমার নিজের কাজ আর নিজের গ্রাম ছাড়া আমার কিছু জানার নেই তবে এখন জানার জন্য আগ্রহী হলাম, কারণ প্লাবন আমার গ্রামে আসবে না তো?

অসম্ভব কিছু নেই মিঃ ইকরাম যে প্লাবন আসছে তাতে এ দেশের কোনো জায়গা রেহাই পাবে না। জলপ্লাবনে না হোক দ্রব্যমূলের অগ্নিপ্লাবনে মানুষ মরণমুখী হয়ে উঠবে……

মিঃ হার্ডিং এবার কথা বললেন–উঠবে নয়, হয়ে উঠেছে…

ইকরাম আলী বলে উঠে–দ্রব্যমূল্য যত অগ্নিমূল্য হবে তাতে আমাদের মঙ্গল সাধনই হবে– তাই নয় কি মিঃ বার্নার?

ঠিক বলেছেন, প্রাবন না হলে এসব রিলিফদ্রব্য আসতো না, আমাদের বরাৎ খুলে যেতো না। শুনুন মিঃ ইকরাম, শুধু রিফিদ্রব্য নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যে মোটা অঙ্ক সাহায্য সংগ্রহ হয়েছে, তা শুধু লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকা! জানেন মিঃ ইকরাম……

ঐ সময় মালেক মিয়া তামাক হাতে এসে দাঁড়ায়, বলে উঠে সে মিঃ বার্নারের কথার মাঝখানে কোটি কোটি টাকা যখন সাহায্য সহ হয়েছে তাহলে আমাদের মত গরিব–দুঃখীর বরাৎ খুলে যাবে এবার।

সবাই যেন চমকে উঠলো মালেক মিয়ার কথায়। বলে উঠেন মিঃ বার্নার–তুমি কোন্ সাহসে আবার এসেছে এখানে।

হুজুর সাহস নয়, দয়ায়…

কি বললি, দয়ায়? কিসের দয়া, কার জন্য দয়া, রাগত কণ্ঠে বললে ইকরাম আলী।

মালেক মিয়া মুখ কাচুমাচু করে বললো–মালিক, আপনি অনেকক্ষণ থেকে তামাক পান করেন না কিনা, তাই গলাটা হয়তো শুকিয়ে গেছে, এই ভেবে…..

তামাক নিয়ে এলি, তাই না?

হাঁ মালিক।

মিঃ হার্ডিং বললেন–পুরোন ভূত্য কিনা তাই।

এবার ইকরাম আলী হাত বাড়িয়ে তামাকের কলকেটা নিয়ে হুঁকোর উপর বসালো। সত্যিই সে বহুক্ষণ তামাক পান না করে হাঁপিয়ে উঠেছিলো। মনে মনে মালেক মিয়ার তারিফ না করে পারে না।

ঘরটায় বেশ গরম বোধ হচ্ছিলো।

মালেক মিয়া বললো–মালিক, যদি বলেন হাতপাখা নিয়ে বাতাস করি, যা গরম পড়েছে।

 খুশিভরা কণ্ঠে বললেন মিঃ বার্ণার নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, করো বখশীস দেবো।

ইকরাম আলী কিছু বলবার পূর্বেই মালেক মিয়া দ্রুত বেরিয়ে গেলো এবং পাখা হাতে ফিরে এসে শুনতে পেলো ইকরাম আলী বলছে–এটা তো শহর নয় যে, বৈদ্যুতিক পাখা আর আলো থাকবে, তাই আপনাদের কষ্ট হচ্ছে, তাই না?

না না, কষ্ট কি, এসব আমাদের অভ্যাস আছে। মহাজনদ্বয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন মিঃ বার্ণার।

মহাজনদ্বয়ের মনের অবস্থা ভাল ছিলো না, তারা মনমরা হয়ে বসেছিলো, শুধু মাথা নেড়ে একটু সম্মতি জানালো।

মালেক মিয়া সবাইকে পাখা দিয়ে বাতাস করতে লাগলো, কান কিন্তু রইলো আলাপ আলোচনার দিকে।

মিঃ হার্ডিং বললেন–মিঃ ইকরাম, লোকটা তো বিশ্বাসী?

হাঁ স্যার খুব বিশ্বাসী, ও আছে বলেই তো ডাকাত বেটা এত ভয় পায়। বলুন, আপনারা নিঃসন্দেহে কথাবার্তা বলুন? কথাগুলো বলে থামলো ইকরাম আলী।

বাতাস করতে করতেই বলে মালেক মিয়া–আমরা বড় গরিব মানুষ, যদি কিছু সাহায্য পাই……

চুপ, কথা বলবি না। বললো ইকরাম আলী।

মিঃ বার্নার বললেন–ঠিক বলেছিস, তোকে আমরা মোটা বখশিস্ দেবো, তুই হাওয়া কর বেটা।

করছি মালিক।

মালেক কিরে; উনাদের স্যার বলতে পারি না? বললো ইকরাম আলী।

 মিঃ বার্ণার বললেন–ওরা বলতে চাইলেও মুখে আসবে না…

ঠিক বলেছেন মালিক, ওসব সাহেবী বুলি আমাদের এই নোংরা মুখে আসবে না। মালেক মিয়া বাতাস করতে করতেই কথাটা বললো।

মিঃ হার্ডিং বললেন–স্যার বলতে শেষে ষাঁড় না বলে ফেলে! বলে তিনি সশব্দে হেসে উঠলেন।

যাক এবার কাজের কথায় আসা যাক। শুনুন মিঃ ইকরাম, বন্যা বা প্লাবনে ভেসে যাওয়া মানুষগুলোর জন্য যে সাহায্য অর্থ সরকারের তহবিলে জমা হয়েছে তার কিছু কিছু অর্থ বন্যা প্লাবিত অঞ্চলগুলোতে প্রেরণ করা হয়েছে..

মালেক মিয়া বলে উঠে–বলেন কি মালিক, তবুও শহরের পথেঘাটে এত বন্যাপীড়িত দুঃস্থ মানুষগুলোর কঙ্কাল সার দেহগুলো পড়ে থাকতে দেখা যায় কেন?

ইকরাম আলী বলে উঠে–চুপ,তুই এসব বুঝবি না।

বুঝবো না কেন মালিক সব বুঝি, গরিব বলে আমরা কি মানুষ নই যে, বুঝবো না? এই তো কিছুদিন আগে রাজধানীতে গিয়েছিলাম, যে দৃশ্য দেখলাম কি করে আপনাদের বুঝিয়ে বলবো।

তুই চুপ কর তোকে কিছু বুঝিয়ে বলতে হবে না।

একটু বলতে দেন মালিক, দেখলাম রাজধানীর পথেঘাটে পড়ে আছে কত মানুষ…হাড় বের করা কঙ্কালসার শরীর। লজ্জাস্থানে এক টুকরা কাপড় আছে কিনা সন্দেহ, কথা বলার শক্তিটুকু নেই তাদের। জানেন মালিক, এরা কিছু চেয়ে নেবে তাও পারে না, গলা দিয়ে কথা বের হয় না। কেউ কেউ হা করে পড়ে আছে, তাদের মুখের মধ্যে মাছি ঢুকছে, আবার বের হয়ে আসছে। আমি মনে করেছিলাম বুঝি মরে গেছে কিন্তু আসলে তারা মরেনি মালিক, জীবিত আছে। শুনলাম, প্লাবনে যে সব জায়গা বা অঞ্চল তলিয়ে গেছে যে সব জায়গা থেকে এরা পালিয়ে এসেছে বাঁচবে বলে, কিন্তু…বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে মালেক মিয়ার গলা।

ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলে ইকরাম আলী–ওসব কথা তোর কাছে কে শুনতে চাইছে বল তো?

গামছায় চোখ মুছে বলে মালেক মিয়া–কেউ আপনারা শুনতে চাইবেন না জানি, তবু আমাকে বলতে হবে মালিক……কারণ আমিও তো ওদেরই একজন কিনা।

মিঃ বার্নার বললেন–বলুক, মুখ দিয়ে ও বলবে তাতে আমাদের কি?

মালেক মিয়া খুশি হয়ে বলতে শুরু করে–শুধু একজন দু’জন নয় মালিক, অমন কত মানুষ রাজধানীর রাজপথে পড়ে আছে তার হিসাব কে রাখে বলুন? আমি দেখেছি ফুটপাথের ধারে, দেখেছি গাছের তলায়, দেখেছি আবর্জনার স্কুপের পাশে, দেখেছি নর্দমার ধারে। নর্দমায় গড়িয়ে পড়া পচা ফেন তুলে নিয়ে তারা খাচ্ছে। আবর্জনার মধ্যে হাতড়াচ্ছে এক টুকরো রুটি মালিক, এরা সেই প্লাবনে ভেসে যাওয়া অঞ্চলের মানুষ কিন্তু কই, আপনারা যে কোটি কোটি টাকা এদের দুর্দশা দূর করবার জন্য জনসাধারণের কাছ থেকে সাহায্য হিসেবে পেয়েছেন বলেছেন, কই সে টাকা? কি করছেন সেই টাকা?

দেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে বললেন মিঃ বার্নার।

মালেক মিয়া বলে উঠে–তাহলে হাজার হাজার লোক ফুটপাথের ধারে ধুকে ধুকে মরতো না।

ফুটপাতের ধারে ওরা তো ভিখারী। বললেন পুনরায় বার্নার।

মালেক মিয়াও চুপ রইলো না, বললো সেভিখারী কারা, তারা কি মানুষ নয় মালিক? আর ভিখারী তারা হলো কেমন করে? ঐ প্লাবনে ভেসে যাওয়া অঞ্চল থেকেই তারা এসেছিলো শহরে কাজ করে খাবে বলে, কিন্তু কাজ তারা পায়নি আর কেই বা তাদের কাজ দেবে, তাই তো তারা ভিক্ষার জন্য হাত পেতেছিলো……থামলো মালেক মিয়া।

ইকরাম আলী বললো–মালেক, তোর স্পর্ধা দেখে আমি অবাক হচ্ছি, কে এসব শুনতে চাচ্ছে হোর কাছে।

আপনারা কেউ না শুনলেও আমি বলবো, কারণ বলেছিতো আমিও তাদেরই একজন। আমি মানুষ, তাই মানুষের দুঃখ আমাকে বড় কষ্ট দেয় মালিক। আপনারা বড়লোক কিনা, তাই গরিবদের কথা শুনতে আপনাদের ভাল লাগে না–কেমন যেন ঘেনর ঘেনর মনে হয়, তাই না মালিক?

চুপ কর অমন অনেক দেখেছি, অনেক শুনেছি। গরিব আর দুঃস্থ লোকদের নাকিকান্না শুনে শুনে জানটা যেন যাই যাই করছে। রেখে দে তোর কাহিনী।

না, আজ আমি আরও কিছু বলবো আপনাকে শোনার জন্য নয়, ঐ যে যারা শহর থেকে এসেছেন, শুনেছি উনারা নাকি সরকারের লোক, উনাদের কাছে বললে যদি একটু দেশের উপকার হয়……।

তার মানে?

মানে দেশের জনগণের যদি একটু মঙ্গল হয়।

তুই উপদেশ দিবি সরকারের লোককে? মালেক, তোর ছোট মুখে বড় কথা! ইকরাম আলীর চোখ যেন আগুন ঠিকরে বের হয়।

মালেক মিয়া নরম গলায় বলে–মালিক, এক সিংহ একবার ফাঁদে পড়েছিলো, তখন একটা ইঁদুর তার ফাঁদের দড়ি দাতে কেটে কেটে সিংহকে উদ্ধার করেছিলো। দেখুন ইঁদুর একটি ক্ষুদ্র জীব তবু সে পশুরাজ সিংহের কতবড় উপকার করলো। তেমনি আমি নগণ্য এক চাকর যদি একটু উপকার করতে পারি আপনাদের…কাজ না পেয়ে ভিক্ষার জন্য হাত পেতেছিলো ওরা, কিন্তু দেশের যে অবস্থা তাতে জনসাধারণের জীবন যাপন দুর্বিসহ–নিজেদের পেট চালাবে কি করে, কি করে নিজের জীবন রক্ষা করবে, তাই ভেবে তারা অস্থির ভিখারীকে ভিক্ষা দেবে তারা কোথা থেকে? তবে হাঁ, যাদের দেবার মত ক্ষমতা আছে তাদের কাছে এরা ভিড়তেও পারবে না, কারণ লোহার ফটক পেরিয়ে কোনো রকমেই তারা ঢুকতে পারবে না ভিতরে, তা ছাড়া আছে বন্দুক ধারী পাহারাদার। একটু থেমে বললো মালেক মিয়া–কাজেই যারা ভিক্ষা দিতে সমর্থ তারা দুঃস্থ জনগণ থেকে অনেক দুরের মানুষ যেমন ধরুন আপনারা মালিক, আপনাদের নাগাল যেমন আমরা সহজে পাই না। একটু থেমে আবার বললো মালেক মিয়া–মালিক আমি আরও দেখেছি পথের ধারে অর্ধউলঙ্গ মেয়েমানুষ, কোলে তার কঙ্কালসার ছেলে ক্ষুধার জ্বালায় মায়ের শুকনো চুপষে যাওয়া স্তন কামড়াচ্ছে…..মাথার চুল জটা ধরে গেছে, কত যুগ সে মাথায় তেল পড়েনি। একটুকরো কাপড়ে লজ্জা ঢাকবার চেষ্টা করছে বটে কিন্তু তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না, সমস্ত লজ্জা তার ঢাকা পড়ে গেছে যেন ক্ষুধার কাছে। জানেন মালিক, এরা কোথাকার মানুষঐ প্লাবনে ভেসে যাওয়া অঞ্চলের। একটু আগে বললেন, আপনাদের তহবিলে প্রচুর অর্থসগ্রহ রয়েছে এদের জন্য। লক্ষ লক্ষ নয়, কোটি কোটি……মালিক, তবু কেন এদের এমন অবস্থা? বলুন জবাব দিন?

মিঃ বার্নার রাগত কণ্ঠে বললেন–তুই চাকর হয়ে এসেছিস আমাদের কাছে কৈফিয়ত তলব করতে?

ইকরাম আলীও বোমার মত ফেটে পড়লো বেরিয়ে যা, বেরিয়ে যা এখান থেকে। শয়তান, বেঈমান কোথাকার……।

হাঁ, আমরা বেঈমানই বটে, আর আপনারা ঈমানদার ব্যক্তি…

আবার মুখের উপর কথা বলছিস?

না বলে পারছি না মালিক, কারণ আপনারা সৎ মহৎ ঈমানদার মানুষ আর আমরা যারা সাতদিন পর একদিন পেট পুরে খেতে পাই না, আমরা বেঈমান। কিন্তু মালিক, প্লাবন দুর্গত মানুষের জন্য যে অর্থ আপনাদের তহবিলে জমা হয়েছে, আর বিদেশ থেকে যে সাহায্যদ্রব্য আসছে তা যদি ঠিক ঠিক মত জায়গায় গিয়ে না পৌঁছে তাহলে বেঈমান জানোয়ারগুলো আপনাদের মত ঈমানদার মানুষগুলোকে রক্ষা করবে না। ক্ষুধার জ্বালায় তারা এমন হিংস্র হয়ে উঠেছে, তারা এখন মানুষের কাঁচামাংস খেতেও দ্বিধা বোধ করবে না। সাবধান মালিক সাবধান, যত গোপনেই আপনারা কাজ করুন দেয়ালের কান আছে, চোখও আছে মালিক, কাজেই রেহাই আপনারা কেউ পাবেন না……

মালেক, তুই…তুই…ইকরাম আলী রাগে ক্রোধে বাকশক্তি যেন হারিয়ে ফেলে।

মিঃ বার্নারও ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন, তিনি বললেন–প্রচুর সাহায্যদ্রব্য প্লাবিত অঞ্চলে দেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। বহু অর্থ ওদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। জানিস বেটা, ওরা যতই পাক তবুও ওদের ঐ স্বভাব যাবে না। শহরে যাদের কথা বললি তারা তো এক নম্বর বদমাইশ, রিলিফের দ্রব্য দিলে ওরা বিক্রি করে দেয়,

তা সত্য কিন্তু কেন তারা ঐসব দ্রব্য বিক্রি করে মালিক।

 তা অতো কে খোঁজ রাখে!

হাসে মালেক মিয়া–তা ঠিক, কে অতো খোঁজ রাখে আর ওসব শয়তান লোকগুলোর খোঁজ রেখেই বা কি হবে–ওরা তো মানুষ নয়, পশু, তাই না মালিক?

হাঁ, ঠিক বলেছিস তুই, ওরা মানুষ নয়, পশুই বটে, না হলে যা তা খেতে পারে। ঐ তো তুই বললি ডাস্টবিনের মধ্য থেকে খাবার খুঁজে নিচ্ছে। বললি না নর্দমা থেকে পচা ফেন তুলে নিয়ে আরামে খাচ্ছে?

হাঁ, বলেছি মালিক, আরামে ওরা ঐ পচা আর নোংরা জিনিস খাচ্ছে কিন্তু কেন খাচ্ছে বলুন তো? দু’দিন না খেয়ে দেখুন কেন ওরা ঐ পচা জিনিস খায়। পারবেন মালিক দুদিন অনাহারে থাকতে? জানি পারবেন না—সময় মত স্নানাহার না করলে আপনাদের শরীর খারাপ হবে, অসুস্থ হয়ে পড়বেন, কাজেই অনাহারের কথা আপনারা চিন্তাই করতে পারেন না।

মিঃ বার্নারের সুর একটু নরম হয়ে এলো, তিনি বললেন–দেশের জনগণকে বাঁচানোর জন্যই তো আমাদের এত প্রচেষ্টা। প্লাবিত অঞ্চলের দুঃস্থ জনগণের সাহায্যার্থে আমরা শহরে ত্রাণশিবির স্থাপন করেছি এবং সেইসব ত্রাণশিবিরে তাদের থাকা–খাওয়া আর ওষুধদির ব্যবস্থা করেছি। তা ছাড়াও যে অর্থ আমাদের ত্রাণ তহবিলে জমা হয়েছে, ঐ অর্থ আর রিলিফদ্রব্য প্লাবিত অঞ্চলগুলোতে পাঠানো হচ্ছে……কথাগুলো বলতে বলতে বারবার মিঃ বার্নার তাকান ইকরাম আলীর মুখের দিকে।

ইকরাম আলী এবার তার কথার রেশ টেনে বলেন–দেশ রক্ষা অভিযানে আমরা আত্মত্যাগ করেছি। তুই মুখ, তাই এসেছিস আমাদের কথার বাদ সাধতে। বেরিয়ে যা এখান থেকে…….

বলতে যখন সুযোগ দিয়েছেন মালিক তখন আর একটু বলতে দেন। আপনারা দেশ আর দেশবাসীকে রক্ষার জন্য অভিযান চালিয়েছেন সত্য কিন্তু দেশ আর দেশবাসী যে গেলো মালিক? এত সাহায্যদ্রব্য দিচ্ছে, এত অর্থ দিচ্ছে তবু পথেঘাটে, গ্রামে গ্রামে হাজার হাজার উলঙ্গ কঙ্কালসার মানুষ ক্ষুধার জ্বালায় ধুকে ধুকে মরছে কেন বুঝতে পারি না। কই মালিক, একটি অসহায় পরিবারকেও তো দেখলাম না তারা সুখে–স্বাচ্ছন্দে কাটাচ্ছে?

ঐ তো বলেছি তোরা বেঈমান, হাজার দিলেও তোদের মন পাওয়া যায় না। এত দেওয়া হচ্ছে তবু তোদের মুখে হা হা রব।

তা সত্যি হুজুর, এত দিচ্ছেন তবু আমাদের মুখে হা হা রব। এত পেয়েওে আমরা উলঙ্গ হয়ে থাকি, এত পেয়েও আমরা না খেয়ে মরি, তাই না?……

হাঁ, তোদের উদর পূরণ করার সাধ্য কারও নেই।

আর আপনাদের উদর সামান্যতেই বুঝি পূর্ণ হয় হুজুর?

ভীষণভাবে রেগে উঠেন মিঃ বার্নার, তিনি ইকরাম আলীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন– আপনার চাকরের স্পর্ধা দেখে আমি বিস্মিত হচ্ছি মিঃ ইকরাম, এমন চাকরকে আপনি বাড়িতে স্থান দিয়েছেন?

ইকরাম আলী কঠিন কণ্ঠে বলে উঠে–বেরিয়ে যা এই মুহূর্তে বেরিয়ে যা বলছি…..যা, এক মুহূর্ত আর তোকে রাখতে চাই না।

মালেক মিয়া এবার পাখা রেখে বলে–বেশ, আমি চলে যাচ্ছি কিন্তু মনে রাখবেন রাত কাল ভীষণ কাল, তখন যেন আমাকে ডাকবেন না মালিক।

না, তোর আর দরকার হবে না, তুই চলে যা।

 মালেক মিয়া বেরিয়ে যায়।

মিঃ বার্নারের সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ গোপনে আলোচনা চলে, তারপর সেদিনের মত, বিদায় নেন তারা।

*

মালেক মিয়া পুঁটলি বাঁধছিলো। সে আজই চলে যাবে, কারণ মালিক তাকে বিদায় দিয়েছেন।

এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করে গোলাপী। আঁচলের নিচে লুকিয়ে এনেছে সে কয়েকটা পাকা পেয়ারা। মালেক মিয়াকে পুটলি বাধতে দেখে গোলাপী অবাক হয়ে যায়, বলে সে–একি মালেক ভাই, তুমি ওসব গুছিয়ে নিচ্ছো কেন?

চলে যাবো বলে।

 সেকি!

 হাঁ, মালিক আমাকে বিদায় করে দিয়েছেন।

মালেক ভাই, তুমি চলে যাবে? বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে গোলাপীর গলা। চোখ দুটো তার জলে ভরে আসে।

মালেক মিয়া পুঁটলি বাঁধা শেষ করে সরে আসে, গোলাপীর কাঁধে হাত রেখে বলে–গোলাপী, তুমি মিছামিছি দুঃখ করছো, আমি তো চিরকাল এখানে থাকতে আসিনি।

তবে কেন এসেছিলে? বলল মালেক ভাই, তবে কেন এসেছিলে সেদিন তুমি? জানো মালেক ভাই, এ পৃথিবীতে আমার কেউ নেই………কিছু নেই……মেয়েদের স্বামী বড় আপন জন, আমার তাও নেই। মালেক ভাই, তুমি এ বাড়িতে আসার পর জানি না, কেন তোমাকে আমার এত ভাল লাগে–তোমার স্নেহ, তোমার ভালবাসা আমার শূন্য হৃদয়ে এনে দিয়েছে এক অফুরন্ত আনন্দ। মালেক ভাই, তুমি চলে যেও না, আমি তোমাকে চলে যেতে দেবো না।

গোলাপী মালেকের হাতখানা মুঠায় চেপে ধরে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে কথাগুলো বললো। তার কথাগুলো বড় করুণ ব্যথাভরা ছিলো, মালেকের চোখ দুটো ছল ছল করে উঠলো।

ঐ সময় বাইরে শোনা গেলো ইকরাম আলীর গলা–মালেক, মালেক কোথায় তুই?

গোলাপী বেরিয়ে গেলো পিছন দরজা দিয়ে।

মালেক মিয়া জবাব দিলো–এখানে আমি।

ইকরাম আলী কক্ষমধ্যে প্রবেশ করতেই বলে উঠে মালেক মিয়া–চলে যাচ্ছি মালিক…তবে একটা চিঠি পেলাম এই ঘরের মেঝেতে, দেখুন তো মালিক এতে কি লেখা আছে।

মালেক মিয়া একখানা ভাঁজকরা কাগজ তার বালিশের তলা থেকে বের করে ইকরাম আলীর দিকে বাড়িয়ে ধরে বলে—এই দেখুন মালিক?

ইকরাম আলী চিঠিখানা নিয়ে দ্রুত পড়তে শুরু করলো–

মালেক মিয়া, তুমি চলে যাও, তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি আর যেন ফিরে এসো না। আমি গভীর রাতে আসবো, ইকরাম আলীর সঙ্গে প্রয়োজন আছে।
–ডাকাত

ডাকাত! ডাকাতের চিঠি এটা? অস্ফুট কণ্ঠে বলেন ইকরাম আলী।

 মালেক মিয়া ভীতকণ্ঠে বললো–কি বললেন মালিক, ডাকাতের চিঠি ওটা?

 হাঁ হরে–না না, ডাকাতের নয়, ও আমার এক বন্ধুর চিঠি।

কি লিখেছেন বন্ধু ওতে?

 লিখেছেন মালেক মিয়াকে যেন বিদায় না করি। মানে তুই যেন না যাস, বুঝলি?

বুঝেছি, কিন্তু আপনি ডাকাতের চিঠি বললেন আমি যেন তাই শুনলাম।

 ও কিছু না, আমার মুখ দিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে এসেছে ডাকাত শব্দটা।

কিন্তু মালিক, আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে আপনি ভীষণ ভয় পেয়ে গেছেন একেবারে?

না না, ভয় পাবো কেন, ভয় পাবো কেন? মালেক মিয়া, একটা কথা বলবো তোকে?

বলুন মালিক? কথা

রাখবি তো?

 রাখবো।

তোকে আমি তখন মিছামিছি তাড়িয়ে দেবার ভান করেছিলাম। জানিস তো ওরা সাহেব সুবার দল কিনা?

কিন্তু আমি যে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিয়েছি মালিক?

না, যাওয়া তোর হবে না। শোন মালেক, এক্ষুণি শহরে রওয়ানা দেবো। আমাদের গরু গাড়িখানা বের করে নেতো?

হঠাৎ শহরে যাবেন কেন মালিক? বন্ধু বুঝি শহরে যাওয়ার জন্য চিঠিখানা দিয়েছেন?

হাঁ–হাঁরে, তাই লিখা আছে, আজই–এক্ষুণি শহরে রওয়ানা দেবো। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে ইকরাম আলী–ব্যাঙ্ক বন্ধ হবার আগেই আমাকে শহরে পৌঁছতে হবে।

ব্যাঙ্কে বুঝি কাজ করেন আপনার বন্ধু?

হাঁ, তুই যা গাড়ি বের কর, ওসব শুনে তোর কোনো লাভ হবে না।

মালেক মিয়া বেরিয়ে যায়।

গরু দুটোকে ভাল করে খাইয়ে নিয়ে গাড়ি জুড়ে নেয় মালেক মিয়া।

ততক্ষণে ইকরাম আলী খেয়েদেয়ে ব্যাগ হাতে গাড়ির পাশে এসে দাঁড়ায়। বারবার সে হাতঘড়িটা দেখছে। আপন মনেই বলে ইকরাম আলী কাল যদি ও চিঠিটা পেতাম তা হলে মিঃ বার্নারের মোটরেই চলে যেতাম শহরে। আজ গরুগাড়িতে পৌঁছে বেলা গড়িয়ে যায় কিনা কে জানে।

মালেক মিয়া বললো–উঠেন মালিক, বেলা তো এখানেই গড়িয়ে এলো।

 ইকরাম আলী গাড়িতে চেপে বসলো, ব্যাগটা কিন্তু সে সব সময় কোলের মধ্যে রেখে দিয়েছে।

গাড়ি চলেছে।

নিজের গরুগাড়ি, কাজেই কোনো অসুবিধা নেই ইকরাম আলীর। গাড়ির মধ্যে নরম গদি আছে, আর আছে দুটো বালিশ। তাকে প্রায়ই শহরে যেতে হয় কিনা, তাই গাড়িতে কোনো অসুবিধা না হয়, সে জন্য সব আছে তার। পানি খাবার জগ গেলাস ইত্যাদি অনেক কিছু।

আজ কিন্তু ইকরাম আলী বালিশে মাথা রাখলো না, সে ব্যাগটা বুকে আঁকড়ে ধরে বসে রইলো। গাড়ি চলেছে।

গ্রাম্য মেঠো পথ। গাছ–গাছড়ার ভিড় দু’পাশে, মাঝে মাঝে পথে দু’একটা লোক চলছিলো। গাড়ি দেখেই তারা চিনতে পারে এ গাড়ি কার। গাড়িখানা যেমন বড় তেমনি উঁচু। গরু গলায় ঘন্টা বাধা আছে এক সারি নয়, দু’ সারি ঘন্টা–তাই গরু দুটো যখন গাড়ি টানছিলো তখন অনেক দূর থেকে শোনা যাচ্ছিলো সেই ঘন্টাগুলোর আওয়াজ।

এ গ্রাম সে গ্রাম ছেড়ে নদীতীর ধরে গাড়ি চললো কিছুদূর গিয়ে বেশ জঙ্গল। এ পথটা বেশ নির্জন তাই ইকরাম আলী বললো মালেক, বাবা তুই গরু দুটোকে তাড়া করে নিয়ে চল।

কেন মালিক?

দেখছিস না সামনে জঙ্গলের পথ, তাছাড়া এ পথে তেমন লোকজন নেই কিনা।

 কিন্তু আমার যে পায়খানা চাপলে মালিক।

 এই সেরেছিস তুই।

বড় পেট ব্যথা করছে মালিক, দেরী করলে কাপড় চোপড় নষ্ট হতে পারে। একটুখানি গাড়িতে বসুন, আমি জঙ্গলের মধ্যে পায়খানা করেই চলে আসবে।

একটু কষ্ট করে থাক্ বাবা।

না মালিক, পারছি না…..মালেক মিয়া জঙ্গলের মাঝা মাঝি এসে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো, বললো–গরু দুটোর দড়ি ধরে একটু বসুন আমি এক্ষুণি আসছি……পিছন থেকে ছোটো পুঁটলিটা বগলে নিয়ে নেমে যায় মালেক মিয়া।

মালেক জঙ্গলে প্রবেশ করলে ইকরাম আলী মনে মনে খোদাকে স্মরণ করতে থাকে। ডান হাতে শুরুর দড়ি, বাম হাতের মুঠায় ব্যাগটা এটে ধরে তাকায় এদিক ওদিকে।

হঠাৎ পিছনে ঠান্ডা কি যেন ঠেকলো।

আঁতকে উঠে ফিরে তাকাতেই জমে গেলো তার শরীরের রক্ত, অস্ফুট কণ্ঠে বললো–এ্যা, ডাকাত!

হাঁ, চিনতে পেরেছেন তাহলে? কোথায় যাবে গাড়ি নিয়ে মৌলবী সাহেব?

শহরে।

কেন?

এমনি বেড়াতে।

হঠাৎ বেড়াতে যাবার এত আগ্রহ কেন?

 তোমাকে সবকিছু জানতে হবে নাকি? এক বন্ধুর চিঠি পেয়ে আমি শহরে যাচ্ছি…..

সেই বন্ধু আমি, ইকরাম আলী সাহেব। যে কারণে আপনি শহরে যাচ্ছেন তা আর প্রয়োজন হবে না। আমি সে ব্যবস্থা করছি। দিন, আপনার এটাচ ব্যাগটা আমার হাতে দিন–আমি শহরে যাচ্ছি, আপনার কাজটা আমিই সেরে আসবো।

না না……মালেক……মালেক……ডাকাত……ডাকাত এসেছে……চিৎকার শুরু করে দেন। ইকরাম আলী। গলা ফাটিয়ে তিনি চেঁচাল কিন্তু কোথায় মালেক মিয়া।

অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে ডাকাত, বলে সে–মালেক মিয়া আসবে না, জানে এখানে আমি আছি–কাজেই চুপচাপ বসে থাকুন। দিন ব্যাগটা…..ডান হাতে পিস্তল ঠিক রেখে বাম হস্ত বাড়িয়ে ধরে ডাকাত তার দিকে।

ইকরাম আলী ঢোক গিলে বললো–না না, এ ব্যাগ আমি দিতে পারি না। এ ব্যাগে কিছু নেই, শুধু আমার জামা কাপড় রয়েছে……

জামাকাপড় থাকুক আর যাই থাকুক ব্যাগ দিতেই হবে আমাকে, নইলে এক্ষুণি আপনার রক্তাক্ত দেহ এই গাড়িতে লুটোপুটি খাবে।

সত্যি তুমি আমাকে হত্যা করবে?

 যদি ব্যাগ না দেন করতে বাধ্য হবো।

ইকরাম আলীর মুখ মড়ার মুখের মত হয়ে উঠলো, সে শুষ্ক গলায় বললো–ব্যাগে আমার তিন লক্ষ টাকা আছে,

এই তো একটু পূর্বে বললেন ব্যাগে শুধু আপনার জামা কাপড় আছে? তিন লক্ষ টাকা আপনি পেলেন কোথায় শুনি?

না, আমি বলবো না।

না বললেও আমি জানি ইকরাম আলী, ও টাকা আপনি কোথায় পেয়েছেন। হাজার হাজার মানুষের মুখের আহার কেড়ে নিয়ে আপনি বিদেশী মহাজনদের কাছে বিক্রি করে টাকা সংগ্রহ করেছেন……

কি করে…কি করে জানলে তুমি?

সব জানি, আরও জানি আপনি কি করে কোটি কোটি টাকার মালিক হলেন। দিন, ব্যাগ দিন আমার হাতে, নইলে মালেক এসে যেতে পারে এবং সে এসে গেলে আমাকে দ্রুত কাজ করতে হবে। তখন আপনাকে হত্যা করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। তাছাড়া আপনার প্রিয় চাকরটিও হয়তো প্রাণ হারাবে…….

ইকরাম আলী এবার বাধ্য হলো তার টাকা সহ ব্যাগটা ডাকাতের হাতে তুলে দিতে, কারণ না দিয়ে কোনো উপায় ছিলো না। ডাকাতের অর্ধ আচ্ছাদিত মুখমন্ডল আর ঐ পিস্তলখানা তাকে ভীষণ ভীত করে তুলেছিলো।

ব্যাগ নিয়ে নির্বিঘ্নে চলে যায় ডাকাত।

ইকরাম আলী প্রাণহীনের মত নিস্পন্দ হয়ে গেছে, শুষ্ক হতাশ গলায় ডাকে–মালেক, ওরে মালেক…ফিরে আয়, ডাকাত চলে গেছে……

ভীত–কম্পিত পদক্ষেপে মালেক মিয়া ফিরে এলো, আলগোছে বগলের পুঁটলিখানা লুকিয়ে রাখলো গরুগাড়ির পিছন দিকে, তারপর সম্মুখে এসে বললো–মালিক,

এসেছিস ওরে হতভাগা, সব গেছে আমার….সব গেছে আমার……মাথায় করাঘাত করে ইকরাম আলী।

মালেক কাঁদে কাঁদো সুরে বলে–মালিক, আমি আড়াল থেকে সব দেখেছি। কি সাংঘাতিক ডাকাত…….

আর এক মুহূর্ত বিলম্ব নায়, গাড়ি নিয়ে চল….

 কোন দিকে যাবো মালিক?

বাড়ির দিকে গাড়ির মযুখ ফিরিয়ে নে।

 কেন মালিক, শহরে যাবেন না?

 গিয়ে আর কি হবে, সব গেছে আমার।

কি গেছে মালিক….কি সব গেছে বলছেন? ঐ ব্যাগের মধ্যে কি ছিলো?

টাকা, টাকা ছিলো। আমি মহাজনের কাছে ওযে চাল বিক্রি করে টাকা পেয়েছিলাম, সেই টাকা ছিলো ব্যাগের মধ্যে। মালেক, তুই জানিস্ না ঐ টাকা রাখতেই আমি ব্যাঙ্কে যাচ্ছিলাম।

তাহলে তো বড় ভয়ঙ্কর কথা মালিক। মহাজন বেচারীদের চালও গেলো আপনার টাকাও গেলো। সব যে শূন্য হয়ে গেলো! তবু গাড়ি নিয়ে ফিরে যাবেন মালিক

না গিয়ে কি করবো?

 ঐ যে পচা পুকুর আছে, আমি হলে ঐ পুকুরে ডুবে আত্মহত্যা করতাম মালিক…….

কি বললি?

মালিক এতগুলো টাকা হারিয়ে জীবনে বেঁচে থাকতে পারতাম না। জানেন তো দুটো টাকাই আমাদের কাছে কত মূল্যবান। আর আপনি কত লক্ষ মণ চাল বিক্রি করেছেন–এ টাকা যে জীবনের চেয়ে দামী……

চল অত কথা তোকে বলতে হবে না।

মালে গাড়িতে উঠে বসে গরুকে লক্ষ্য করে বললো–চল বাবা চল ফিরে চল বাড়ির দিকে…….

*

দু’দিন পরের কথা।

মালেক মিয়া গরু নিয়ে বাইরে যাচ্ছিলো, হঠাৎ তার কানে ভেসে আসে ইকরাম আলীর পরম কোনো আত্মীয়ের গলার আওয়াজ–যা গেছে তা নিয়ে ভেবে কোনো লাভ হবে না আলী সাহেব, প্লাবিত অঞ্চলের জন্য যেসব সাহায্যদ্রব্য আসছে তা থেকেই আপনার এ ক্ষুতিপূরণ হয়ে যাবে দেখবেন।

ইকরাম আলীর গলা–আমার অঞ্চলে তো আর প্লাবন আসেনি, কি করে আমি প্লাবিত অঞ্চলের সাহায্যদ্রব্য পেতে পারি বলুন চাচাজান?

পাবেন, পাবেন, হাজরার এ অঞ্চলে বন্যা আসেনি। কিন্তু হাজরার আশেপাশের গ্রামগুলো তো বন্যায় ভেসে গেছে। আপনি হলেন কিনা এ গ্রামের হর্তাকর্তা, আপনি যা করবেন তাই হবে। মিছামিছি সামান্য কটা টাকার জন্য এত হা–হুঁতাশ করবেন না…

মালেক মিয়া গরু নিয়ে চলে গেলো মাঠে, আর কোনো কথা তার কানে এলো না।

মাঠে গেলে এবং নির্জন জায়গা পেলে মালেক মিয়া তার দাড়িগোঁফ খুলে ফেলে, নাহলে বড় অসহ্য লাগে তার কাছে। গরুগুলো মাঠে চরছে। বনহুর ভাবছে তার আস্তানার কথা, ভাবছে দিপালীর কথা, স্বর্ণগুহায় বন্দী কান্দাই রিলিফ প্রধানের কথা। এ ছাড়াও ভাবছে নূরের কথা, এ মাসেই নূর বিলেত যাবে। যদিও নূরের তেমন বয়স হয়নি তবু তাকে বিদেশ পাঠাতে হচ্ছে, নাহলে অসুবিধা আছে–হঠাৎ একদিন জেনে ফেলতে পারে তার পিতা একজন দস্যু…..না না, তা হয় না। নূর লেখাপড়া শিখে মানুষ হবে, এটাই তার এবং মনিরার বাসনা। কাজেই নূর বিলেত যাবার পূর্বে তাকে একবার যেতে হবে কান্দাই। নূরকে বিলেতে পাঠাতে মন তার ব্যথাকাতর হবে সত্য। কিন্তু উপায় নেই। নূরী আর জাবেদ–তারা আস্তানায় রয়েছে, যদিও তাদের জন্য ভাবনার কিছু নেই, কারণ রহমান কায়েস এরা আছে। রহমান জম্বু থেকে ফিরে এসেছে, জম্বুর সমস্ত দায়িত্বভার রয়েছে এখন রাম সিং আর সাধন সিংয়ের উপর। হাঁ, তার একটা বিরাট কাজ আছে–জম্বুর রত্নাগারে আটক আছে কয়েকজন জম্বু নেতা। তাদের জীবিত রাখার জন্য রামসিংয়ের উপর নির্দেশ আছে তারা যেন প্রাণত্যাগ না করে–দিনান্তে একটি রুটি আর এক কাপ পানি তাদের জন্য বরাদ্দ করে এসেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের মুখের গ্রাস নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলে তাদের হত্যা করা মোটেই উচিত নয়। মৃত্যু মানুষের জীবনে পরম এক পরিত্রাণ। মহাবিপদ থেকে মানুষ পরিত্রাণ পায় কখন। যখন তাদের মৃত্যু হয়, কাজেই হত্যা করে ঐসব নরপশুকে পরিত্রাণ দেওয়া উচিত নয়। দেশের সর্বনাশের মূলে যারা তাদের উপুক্ত সাজা হওয়া দরকার। দুঃস্থ মানুষের কি অবস্থা তা অনুধাবান করার জন্য তাদের ব্যবস্থা হওয়া প্রয়োজন, হত্যা নয়……..

হঠাৎ বনহুরের চিন্তাধারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছে গোলাপী।

লজ্জাজড়িত চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে—আপনি আবার এসেছেন, কই, গেলেন নাতো আমাদের বাড়িতে?

বনহুর দ্রুত নিজকে সংযত করে নিয়ে বলে–ও, তুমি…

 হাঁ আমি, আমার নাম গোলাপী।

সুন্দর নাম তোমার।

কই, যাবেন বলেছিলেন, গেলেন নাতো?

 শুনলাম ওটা তোমার শ্বশুরবাড়ি। আমি অচেনা অজানা মানুষ, হঠাৎ করে যদি সেখানে যাই তাহলে নিশ্চয়ই তোমার শ্বশুর তোমার স্বামী ক্রুদ্ধ হবেন।

গোলাপী বললো–শশুর হয়তো কিছু মনে করতে পারেন কিন্তু আমার স্বামী…….একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বলে–আমার স্বামী, সে পাগল বোবা……আমি তার স্ত্রী সে হয়তো জানেই না। গলাটা ধরে আসে গোলাপীর।

বনহুর বললো–হাঁ, মালেক মিয়া একদিন তোমার সম্বন্ধে সব কথা বলেছিলো।

তাহলে আপনি সব জানেন?

হাঁ, সত্যি তোমার জন্য আমার দুঃখ হয়। এত সুন্দর তুমি আর তোমার পাশে একটি বোজা কালো পাগল ছেলে…….না না, বড় বেখাপ্পা এটা।

আপনি শুধু একদিন আমাকে দেখেছিলেন, আর আজ আমাকে দেখলেন তাতেই আপনি আমার জন্য দুঃখ করেন। জানেন আর একজন আমার দুঃখ দেখে দেখে দুঃখ পায়, সে হলো আমাদের বাড়ির চাকর মালেক ভাই।

হাঁ, তাও আমি জানি, মালেক মিয়া আমাকে বলেছিলো গোলাপীর দুঃখ আমাকে খুব ব্যথা দেয়, কিন্তু তার কোনো উপকার আমি করতে পারি না।

আপনার বাড়ি কতদূর?

বলেছিতো অনেক দূরে।

আপনি বুঝি এই পথে ফিরে যাচ্ছেন নিজের দেশে।

হাঁ, ফিরবার পথে এখানে বিশ্রাম করছি, ভেবেছিলাম, যদি মালেক মিয়ার সঙ্গে দেখা হয়। গোলাপী, একটু ডেকে দেবে তাকে?

গোলাপী এদিক ওদিক ভালভাবে লক্ষ্য করে বলে–মালেক ভাই তো এদিকেই এসেছিলো গরু নিয়ে। গরুগুলো তো মাঠেই চরছে কিন্তদু মালেক ভাইকে দেখছিনা কেন?

হয়তো আবার সে বাড়ি ফিরে গেছে, তুমি বাড়ি গিয়ে তাকে পাঠিয়ে দাওগে।

আপনি যাবেন না?

না। আচ্ছা গোলাপী, একটা কথা সত্যি করে বলবে আমাকে?

বলুন বলবো?

এ দু’দিনেই আমি তোমাকে যতটুকু বুঝেছি তাতে বুঝতে পেরেছি তুমি সুখী নও। আচ্ছা গোলাপী, তুমি কি কাউকে ভালবাসতে কোনোদিন?

না, তবে এখন বাসি।

বলো তুমি কাকে ভালবাসো, আমি চেষ্টা করবো তোমাকে যেন তার হাতে তুলে দিতে পারি।

লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠে গোলাপীর মুখখানা। না করে বলে–বলবো কিন্তু এখন না। আমি মালেক ভাইকে বলবো, সে আপনাকে বলবে। কিন্তু……না থাক, আমি যাই, মালেক ভাইকে পাঠিয়ে দিইগে। আপনি যেন চলে যাবেন না।

আচ্ছা।

গোলাপী কলসী কাখে চলে যায়।

বনহুর দ্রুত তার গোঁফদাড়ি লাগিয়ে দিব্যি মালেক মিয়া বনে যায়।

 প্রায় অর্ধঘন্টা পর ফিরে আসে গোলাপী।

 মালেক তখন গরুগুলো এ মাঠ থেকে পাশের মাঠে তাড়া করে নিচ্ছে।

গোলাপী গাছটার দিকে তাকিয়ে বিমর্ষ মুখে দাঁড়িয়ে থাকো, চোখ দুটো তার ছলছল করছে। চারদিকে তাকিয়ে ব্যাকুলভাবে কাকে যেন খুঁজছে সে।

মালেক মিয়া গরুগুলো পাশের মাঠে দিয়ে এসে দাঁড়ায় গোলাপীর কাছে, বলে–এখানে কেন গোলাপী, কাকে খুঁজছো তুমি?

মালেক ভাই, তোমাকে খুঁজতে গিয়ে তাকে হারিয়ে ফেলেছি আমি।

কাকে, কাকে হারিয়ে ফেলেছো?

ঐ সেদিন যে এসেছিলো। তোমার সঙ্গে নাকি অনেক কথা হয়েছিলো। যাকে আমি দাওয়াত করেছিলাম আমাদের বাড়িতে, কিন্তু সে যায়নি। কেন যায়নি জানো মালেক ভাই–বাড়িতে আমার শ্বশুর আছে, আমার স্বামী আছে, তাই যায়নি, যদি তারা কিছু বলে। মনে পড়েছে এবার তোমার?

খুব একটা মনে পড়ছে না।

 শোনো কথা! সেই সুন্দর সুপুরুষ লোকটি, যাকে তুমি তোমার সব বলেছিলে…….

ও মনে পড়েছে, সেই ভদ্রলোকটি আজ আবার এসেছিলো নাকি?

হাঁ, এই গাছটার নিচে বসেছিলো।

তাই নাকি?

আমাকে সে বললো, মালেক ভাইকে ডেকে আনোগে, আমি তার জন্য অপেক্ষা করবো। কিন্তু হঠাৎ কিছু না বলে চলে গেলো…….গোলাপীর চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে।

মালেক মিয়া বলে—একটা অজানা অচেনা লোকের জন্য এত ভাবো কেন বলো তোর চলে গেছে, আবার যদি কোনোদিন আসতে মন চায় আসবে।

মালেক ভাই, তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে, শুনবে?

বেশ বলো?

এই মাঠে দাঁড়িয়ে কথা বলতে গেলে কেউ যদি দেখে ফেলে?

চলো তবে ঐ গাছটার আড়ালে গিয়ে বসি।

তাই চলো।

মালেক মিয়া আর গোলাপী বটগাছটার নিচে এসে বসলো। মালেকের কাছে গোলাপীর কোনো দ্বিধা বা সঙ্কোচ ছিলো না, সে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো।

মালেক মিয়া বললো–বলো?

গোলাপীর মুখখানা আপনা আপনি রক্তাভ হয়ে উঠলো, উদাস চোখে তাকালো সামনের দিকে, তারপর বললো–মালেক ভাই, সে জিজ্ঞাসা করেছিলো আমি কাউকে ভালবাসতাম কি না?

তুমি কি জবাব দিয়েছিলে তার কথায়?

জবাব দিয়েছিলাম, আমি আগে কোনোদিন কাউকে ভাল বাসিনি তবে এখন বাসি। জানো মালেক ভাই, সে কি বলেছিলো?

কি বলেছিলো সে?

বলছিলো, বলো তুমি কাকে ভালবাসো, আমি চেষ্টা করবো তোমাকে যেন তার হাতে তুলে দিতে পারি…. থামলো গোলাপী। লজ্জাভরা কণ্ঠে বললো আবার–আমি বলেছিলাম, বলবো কিন্তু এখন নয়। আমি মালেক ভাইকে বলবো, সে আপনাকে বলবে……তারপর আমি চলে গিয়েছিলাম তোমার খোঁজে। হয়তো ফিরতে আমার দেরী দেখে সে চলে গেছে মারেক ভাই। গলাটা ধরে আসে

মালেক মিয়া বলে–হয়তো আবার আসবে, তাই আজ চলে গেছে। কিন্তু তুমি যা আমাকে বলতে চেয়েছিলে বলো? তুমি কাকে ভালবাসো যদি তাকে বললে সে কোনো উপকার করতে পারে। ভদ্রলোককে দেখে মনে হয়েছিলো সে তোমার কোনো অসুবিধা হলে দূর করতে পারবে।

কিন্তু আমরা যে বিয়ে হয়েছে মালেক ভাই, আমি কি করে বলবো সে কোথা?

কোনো সঙ্কোচ করো না, আমার কাছে বলে ফেলো দেখি যদি পারি আমিও সহায়তা করবো তুমি যাকে ভালবাসো তাকে পাইয়ে দিতে।

এটা তো শহর নয়–গ্রাম, একবার বিয়ে হলে তার আর বিয়ে হয় না।

তোমার বিয়ে সে তো বিয়েই নয়। একটা পাগল বোবা কালা তোমার স্বামী হতেই পারে না। তা ছাড়া তুমি কোনোদিন তার সংস্পর্শেই যাওনি। কি করে তোমার স্বামী হয়? না না, ও বিয়ে তোমার বিয়ে নয়, বলো কাকে তুমি ভালবাসো–কে সে?

মালেক ভাই, আমি তোমাকে সেদিন বলেছিলাম মনে নেই তোমার? আমি ওকে ভালবেসে ফেলেছি।

ওকে……

হাঁ, সেই অচেনা অজানা বন্ধুটিকে।

 গোলাপী! অস্ফুট ধ্বনি করে উঠে মালেক মিয়া।

হাঁ মালেক ভাই তুমি বিশ্বাস করো। বিশ্বাস করো মালেক ভাই, আমি যে কিছুতেই তাকে ভুলতে পারছি না।

কিন্তু জানোনা গোলাপী সে কে, কি তার পরিচয়, কেমন ধরনের লোক সে–সে কোনো অসৎ ব্যক্তি কিনা কিছুই তুমি জানো না, এমন লোককে বিশ্বাস করতে নেই কিছুতেই।

না না মালেক ভাই, আমি যে তাকে কিছুতেই ভুলতে পারছি না। তার সঙ্গে দেখা হলে বলো আমার কথা–যদি সে আমার মঙ্গল চায় তাহলে সে যেন আমাকে গ্রহণ করে…মালেক ভাই, তুমি অমন নিশ্চুপ হয়ে গেলে কেন? কথা বলোকথা বলো মালেক ভাই? জানো মালেক ভাই, এ পৃথিবীতে আমার কেউ নেই। শুধু তুমি যা আমাকে ভালবাসো, আমার ভাল চাও? সব জানো তুমি, আমার আর এ বাড়িতে একটুও ভাল লাগেনা, মনে হয় চলে যাই যেদিকে দু’চোখ যায়। আবার ভাবি কোথায় যাবো–কে দেবে আমাকে আশ্রয়, কে দেবে আমাকে খেতে……ফুঁপিয়ে কাঁদে গোলাপী। ওর গন্ড দুটি আপেলের মত লাল হয়ে উঠে।

বড় মায়া হয় মালেক মিয়ার, কেন সে এমন ভুল করেছিলো? কেন সে নিজের ছদ্মবেশ পরিত্যাগ করেছিলো। গোলাপী যদি তার আসল চেহারা না দেখতো তাহলে তো তার মনে এমন প্রতিক্রিয়া হতো না। নিজের উপর রাগ হয় মালেক মিয়ার।

গোলাপী আঁচলে চোখ মুছে বলে–মালেক ভাই, তুমি অমন নীরব হয়ে গেলে কেন? গোলাপী মালেক মিয়ার বুকে মাথা রেখে আকুলভাবে কেঁদে উঠে–পারবে না তুমি এই সামান্য কাজটুকু করতে? তুমি যদি আমার মঙ্গল কামনা করো তাহলে আমাকে নিয়ে চলো তার কাছে…….

সে কোথায় থাকে আমি কেমন করে বলবো। আমি কেমন করে জানাবো গোলাপী, সে কোথায় থাকে।

নিশ্চয়ই সে আবার আসবে, নিশ্চয়ই সে আবার আসবে–আমার মন বলছে সে আসবে। আমি বোজ ঠিক এমনি সময় এখানে আসবো যেন সে ফিরে না যায়। গোলাপী আঁচলে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়।

চলে যায় গোলাপী।

মালেক মিয়া নিশ্চল পাথরের মূর্তির মত ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। গোলাপীর কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হতে থাকে তার কানের কাছে…..জানো মালেক ভাই, এ পৃথিবীতে আমার কেউ নেই, শুধু তুমি যা আমাকে ভালবাসো, আমার ভাল চাও…..সব জানো তুমি, আমার এ বাড়িতে একটুও ভাল লাগে না…মনে হয় চলে যাই, যে দিকে চোখ যায়……পারবে না তুমি এই সামান্য কাজটুকু করতে……তুমি যদি আমার মঙ্গল কামনা করো, তাহলে আমাকে নিয়ে চলো তার কাছে……নিয়ে চলো তার কাছে…….

মালেক মিয়ার মন ব্যথাকাতর হয়ে উঠে অসহায় গোলাপীর কথা ভেবে। কিন্তু কি করবে সে? গোলাপী যদি হাজরার যে কোনো একজনকে ভালবাসতো, সে যেমন করেই হোক তার সঙ্গে ওর মিলন ঘটিয়ে দিতো। বড় অনাথা, বড় হতভাগিনী মেয়ে সে। সারাটা দিন ও বাড়িতে সে ঝি– চাকরাণীর চেয়ে বেশি কাজ করে তবু তাকে চারটি পেট পুরে খেতে দেয় না। তাকে ভাল জামাকাপড় দেয় না, চুলে তেল দেয় না, মাথাটা সব সময় রুক্ষ শুষ্ক যেন শ্যাম্পু করা চুল, ওকেআরও সুন্দর লাগে ওর এলোমেলো চুলগুলো যখন ছড়িয়ে থাকে ওর চোখেমুখে। বেচারী সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে তবু প্রায়ই ইকরাম গৃহিণীর গালমন্দ তাকে খেতে হয়। শুধু কি গালমন্দ, মাঝে মাঝেই মারধর চলে তার উপর, সেকি নির্মম অত্যাচার…….ভাবতে বড় কষ্ট হয় মালেক মিয়ার কিন্তু কি করবে, কোনো উপায় খুঁজে পায় না যেন সে ঐ মুহূর্তে।

এমন সময় কয়েকটা ছেলে একটি নৌকার মাঝিকে ধরে বেদম প্রহার করছে দেখতে পায় সে। কিছু বুঝতে না পেরে উঠে দাঁড়ায়, গোলাপীর কথা ঐ সময় সম্পূর্ণরূপে ভুলে যায় মালেক মিয়া, এগিয়ে যায় সে ঐদিকে।

নৌকার নিকটবর্তী হতেই নজরে পড়ে নৌকার ছৈয়ের মধ্যে বস্তা বোঝাই কিছু রয়েছে। ছেলেগুলোর বয়স বেশি নয়, কিশোর তারা; তবু তাদের দেখে মনে হচ্ছে এক একজন তেজোদ্দীপ্ত আর অসীম সাহসী।

মালেক মিয়া নদীতীরে পৌঁছে তাদের জিজ্ঞাসা করলো কি হয়েছে ভাইরা, তোমরা, কেন ওকে মারছো?

মালেক মিয়ার কথা কেউ প্রথমে কানেই নিতে চায় না, রাগে ক্ষোভে তাদের শরীর যেন কাঁপছে। ক্রুদ্ধভাবে সবাই লোকটাকে ঘিরে ধরে আছে। একজন তখনও তাকে কিল–ঘুসি মেরে চলেছে।

মালেক মিয়া দুতিনবার জিজ্ঞাসা করায় একজন বললো–এ বেটা মাঝি নয়, চোরাচালানী। মাঝির বেশ ধরে চাল বোঝাই নৌকা নিয়ে পালাচ্ছিলো…..

মালেক মিয়া এতক্ষণে বুঝতে পারে ব্যাপারখানা–সে বলে, ওভাবে মেরে কোনো ফল হবে না, ওকে বেঁধে নিয়ে যাও…

একজন বলে উঠে–কোথায় নিয়ে যাবে, থানায় থানায় নিয়ে গেলে এক্ষুণি ছাড়া পেয়ে যাবে।

এক ছেলে, নাম তার ঠান্ডা সে এগিয়ে এসে বললো–কে, মালেক ভাই?

হাঁ দাদু, তোমরা এসব কি করছো?

করবো না? দেশটাকে এরা ধ্বংস করে দিলো–বেটা এক নম্বর চোরাচালানী, এর নাম ইউনুছ ব্যাপারী। পাটের ব্যবসা করতো, ঐ দেখছে না পাটের গাইটের তলায় চালের বস্তা লুকিয়ে সীমান্তের ওপারে নিয়ে যাচ্ছিলো। মালেক ভাই, তুমি ওকে থানায় দিতে বলছো, কিন্তু কিছু হবে না। থানায় দিলে এর কোনো শাস্তি হবে না, ছাড়া পেয়ে যাবে এক্ষুণি। জানো তো পুলিশ এদের হাতের মুঠায়……

জানি ঠান্ডা ভাই জানি, আমি ওকে থানায় দিতে বলছি না, বলছি তোমরা ওকে ধরে নিয়ে যাও, তারপর,….

কি বলছো মালেক ভাই তারপর গ্রামের মাতাব্বরের কাছে বিচার দাও, এই বলছো তো? জানো গ্রামের মাতাব্বর ইকরাম আলী সাহেব নিজেই একজন বড় চোর……তুমি তার বাড়ির চাকর বলে আমরা তোমাকে ভয় করবো না। এভাবে দেশে অন্যায় হবে, সহ্য করব না আমরা বুঝলে?

মালেক মিয়া বললো–আমি তা বলছি না, বলছি ওকে ধরে নিয়ে যাও, তারপর তোমরা নিজেরাই ওর বিচার করো–হত্যা না করে হাতের আংগুলগুলো কেটে দাও, তারপর মাথা নেড়ে করে মুখে চুনকালি মাখিয়ে সমস্ত গ্রামে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াও। তাতে ওর শাস্তিও হবে এবং যারা অসৎ ব্যবসায়ী–এই ধরো চোরাকারবারী, মুনাফাখোর, এরাও কিছুটা ভড়কে যাবে।

মালেক মিয়ার কথা শুনে সবাই প্রহার থেকে ক্ষান্ত হলো এবং মাঝিবেশী চোরাচালানীকে দড়ি দিয়ে মজবুত করে বেঁধে ফেললো।

ঠান্ডা ডাকলো–মখলেছুর ভাই, মালেক ভাই কি বলছে শোনো। এই সেই মালেক ভাইয়ার কথা বলেছিলাম।

মখলেছুর নিজে চোরাচালানীকে বাঁধছিলো, এবার সে সরে এলো মালেক মিয়ার পাশে, রাগে তার মুখমন্ডল কঠিন হয়ে উঠেছে।

মখলেছুরকে সরে আসতে দেখে তার সঙ্গীরা চোরাচালানীসহ এসে দাঁড়ালো মালেক মিয়ার চারপাশে।

এ গ্রামে যদিও মালেক মিয়া বেশীদিন হলো আসেনি তবু সবাই তাকে ভালবাসতো, সমীহ করতো। মালেক মিয়ার প্রতি সবার ছিলো গভীর একটা আকর্ষণ। সে যে কথাগুলো বলে তা অতি গুরুত্বপূর্ণ, তাই কেউ ফেলতে পারতো না তার কথা। অবশ্য একদল ছিলো যারা মালেক মিয়াকে ভাল নজরে দেখতো না। তারা হলো ইকরাম আলীর সহকারী এবং বন্ধু–বান্ধবের দল কারণ মালেক মিয়া মাঝে মাঝে তাদের লক্ষ্য করে এমন কথা বলতে যা কোনোদিন কোনো চাকর তাদের মুখের উপর বলতে সাহস হয়নি বলতেও পারেনি।

মালেক মিয়া এদের শুনিয়ে শুনিয়ে কথা বলতে, যেন ওদের দিব্যদৃষ্টি খুলে যায়। কিন্তু চোর নাহি শোনে ধর্মের কাহিনী’ মালেক মিয়ার কথায় তাদের কোনো চেতনা হতো না।

মখলেছুর, ঠান্ডা, শাহীনুর, সুজা, ইকবাল আর জোবায়েদ এরা কয়েকজন বড় ভাল ছেলে। দেশের যখন চরম অবস্থা, দিন দিন দ্রব্যমূল্য যখন ঘোড়ার মত লাফিয়ে লাফিয়ে উপরে উঠছে তখন এরা চুপ থাকতে পারলো না। এরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে দেশরক্ষা বা দেশগড়ার ব্যাপারে। শুধু এই ক’জনাই নয় এদের সঙ্গে আরএকজন মহৎ ছেলে এবং মেয়ে যোগ দিয়েছে কাজে। যদি তাদের প্রচেষ্টা সার্থক হয় তবু কিছুটা দেশগড়ার কাজে সহায়তা হবে।

একদিন দেখা হয়েছিলো মালেক মিয়ার সঙ্গে ঠান্ডার, তখন অনেক কথা হয়েছিলো। বলেছিলো মালেক মিয়া, তোমরা যখন দেশের দুঃস্থ জনগণের মঙ্গল চাও, তোমরা দেশকে সুষ্ঠু সুন্দর করে গড়ে তুলতে চাও, দেশের জনগণকে বাঁচাতে চাও, তাহলে তোমরা খুঁজে বের করো কারা তারা, যারা দেশের এ অবস্থার জন্য দায়ী। প্রথমে চোরাচালানী এবং অসৎ উপায়ে যারা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের খুঁজে বের করো। দেশের সর্বনাশের মূলে রয়েছে তারা, তাদের শায়েস্তা করতে না পারলে দেশে শান্তি কোনোদিন আসবে না।

মালেক মিয়ার কথাগুলো মনে দাগ কেটেছিলো সেদিন। সে ঐ কথাগুলো বলেছিলো নিজেদের দলের মধ্যে গিয়ে।

ঠান্ডার কথায় তাদের দল সজাগ হয়ে উঠেছিলো। ভেবেছিলো, তাই তো, তারা যদি নিজেরাই গ্রামকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে চায়, তাহলে গ্রামে যারা অসৎ ব্যক্তি আছে তাদের শায়েস্তা করতে হবে। তাই ওরা নেমে গেছে কাজে এবং চোরাকারবারী ইউনুস আলীকে ধরে ফেলেছে হাতেনাতে। মালেক মিয়ার কথায় সবাই খুশি হলো।

মখলেছুর বললো–মালেক ভাই, তুমি যা বলেছো সত্য। ইউনুস আলীকে আমরা আমাদের সমিতি কক্ষে প্রথমে আটক করে রাখবো, তারপর হবে তার বিচার। কিন্তু তোমাকে আসতে হবে, আমাদের বিচারে অংশ নেবে তুমি।

হাসলো মালেক মিয়া, তারপর বললো–আমি চাকর মানুষ তোমাদের বিচারে আমার যাওয়া উচিত হবে না ভাই। তোমরা কাজ করো, যদি কোনো দরকার মনে করো আমার কাছে এসো।

ইকবাল ইউনুস আলীর কোমরে বাধা রশিটা ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো, সে বললো–আচ্ছা মালেক ভাই, তুমিও এসো না আমাদের দলে। তোমাকে পেলে আমরা আরও শক্তিশালী হবো।

একসঙ্গে বলে উঠে ঠান্ডা, জোবায়েদ, সুজা–হা, আমরা সবাই মিলে তোমাকে চাই।

তৃপ্তি আর আনন্দের হাসি হাসে মালেক মিয়া, বলে সে–বেশ, আমিও আছি তোমাদের দলে, কিন্তু সব সময় যেতে পারবো না হয়তো, পরের বাড়ি কাজ করি কিনা……

আচ্ছা তাই হবে, যখন সময় পাও এসো আমাদের সমিতিতে, কেমন? বললো মখলেছুর।

মালেক মিয়া চলে যাচ্ছিলো; শাহীনুর বললো–আচ্ছা মালেক ভাই, এই নৌকার চালগুলো এখন কি করবো বলতে পারো?

হেসে বলে মালেক মিয়া –আমার চেয়ে তোমরা কত জ্ঞানবান, বুদ্ধিমান–আমি তো মুর্খ মানুষ।

তবু তুমি অনেক বুদ্ধিমান, তাছাড়া তুমিও যখন আমাদের দলে যোগ দিলে তখন তোমাকে জিজ্ঞাসা করা দরকার। কথাটা বললো ঠান্ডা।

মালেক মিয়া বললো–যদি আমার কাছে শুনতেই চাও তবে শোনো, যে চাল তোমরা আজ আটক করেছে এ চাউল হাজরার হাটে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করো এবং এ চাল সেখানে নিয়ে গিয়ে তোমরা সবাই মিলে উচিৎ মূল্যে, মানে যা সম্ভব আর যে মূল্যে হলে জনগণের কোনো অসুবিধা হবে না সেই মূল্যে বিক্রি করে দাও। টাকাগুলো তোমাদের সমিতিতে জমা রাখো। যখন দেখবে কেউ অনাহারে মরছে বা কেউ ভীষণ অসুখে পড়েছে কিংবা কোনো পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মারা গেছে, তখন ঐ টাকা দিয়ে তোমরা সেই সব পরিবারকে সাহায্য করবে।

মারহাবা, মারহাবা, মালেক ভাই জিন্দাবাদ। সবাই মিলে মালেকের জয়ধ্বনি করে উঠলো, তারপর চোরাচালানী ইউনুস আলীকে বেঁধে নিয়ে চললো।

এসব কান্ড দূর থেকে দেখছিলো হবি মোল্লা। সে ইকরাম আলীর একজন মঙ্গলকামী বন্ধু। সংবাদটা সে সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে জানালো ইকরাম আলীকে।

ইকরাম আলীর সহকারী হলো ইউনুস ব্যাপারী। বহুকাল ধরে সে পাটের ব্যবসা করে। পাটের ব্যবসার সঙ্গে চলে তার চোরাকারবার। ইদানীং তার চোরাকারবারী ভীষণভাবে কেঁপে উঠেছে। ইকরাম আলী ও গ্রামের আরও কয়েকজনের সহায়তায় তার সাহস বেড়ে গেছে ভীষণভাবে।

তবে ইকরাম আলী যেমন প্রকাশ্যে চোরা কারবার চালিয়ে যায়, কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বলতে পারে না–ইউনুস ব্যাপারী ঠিক তা নয়, সে গোপনে তার পাট ব্যবসার আড়ালে করে চোরাকারবার।

হাজরার মানুষের মুখের গ্রাস গোপনে নিয়ে যায় সে পাটের গাইটের তলায় করে সীমান্তের ওপারে, নিয়ে আসে গাদা গাদা টাকার আকারে ছাপানো কাগজে স্তূপ আর সেই মূল্যহীন কাগজের স্তূপগুলো দিয়ে খরিদ করে সে একখন্ড মূল্যের দ্রব্য দশগুণ মূল্য দিয়ে। দেশের সম্পদে আগুন ধরে যায়। যারা কালোবাজারী মুনাফাঁকারী, তারা এক টাকার জিনিস দশ টাকায় খরিদ করে, আর যারা সভ্য শান্ত সব মানুষ তারা দিশে হারার মত তাকিয়ে দেখে, ভাবে কি ভাবে বাঁচাবো বাচবো সন্তানদের।

ইকরাম আলী প্রকাশ্য চোরাকারবারি করতে ভয় পায় না, তার কারণ আছে। কারণ হলো সে নিজেই গ্রামের মাতব্বর তাছাড়া সরকারের লোক সবাই তার বন্ধু স্থানীয় এবং তাদের সহায়তা লাভ করে থাকে। কাজেই ইকরাম আলীর দুর্জয় সাহস, কেউ তার কোনো ক্ষতি সাধন করতে সাহস পাবে না।

মালেক মিয়া সবে ভাত খেতে বসেছে, এমন সময় ইকরাম আলী এসে দাঁড়ায় তার সম্মুখে। গম্ভীর কণ্ঠে বলে–মালেক; শুনলাম তুই নাকি গ্রামের যুবক ছেলেদের উৎসাহ দিয়েছিস্ ইউনুস ব্যাপারীকে শায়েস্তা করতে? দিন দিন তোর স্পর্ধা বেড়ে যাচ্ছে, জানিস ইউনুস ব্যাপারী কার লোক?

নাতো মালিক আমি কিছু জানিনা।

জানি না। প্রচন্ডভাবে ধমকে উঠে ইকরাম আলী। ওর সম্মুখে থেকে ভাতের থালা নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় উঠানে—যা, তোকে আজ খেতে দেবো না। গ্রামের ছেলেদেরকে তুই নষ্ট করে দিচ্ছিস। খবরদার, আর কোনোদিন অমন কাজ করবি না!

মালেক মিয়ার মনে পড়ে একটু আগেই উঠান থেকে বেরিয়ে গেছে হবি মোল্লা। বুঝতে পারে সে–ই সব কথা বলে দিয়েছে।

ইকরাম আলী চলে যায় সেখান থেকে।

মালেক মিয়া গেলাসের পানিটুকু এক নিঃশ্বাসে পান করে উঠে দাঁড়ায়। হঠাৎ মালেক মিয়ার দৃষ্টি চলে যায় উঠানের একপাশে। গোলাপী দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা।

মালেক মিয়া ঘরে গিয়ে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো। ভাবছে সে অনেক কথা–যদিও ক্ষুধায় পেট চো চো করছে, তবু তার কষ্ট হচ্ছে না, কারণ ক্ষুধা সহ্য করার অভ্যাস তার আছে। ভাবছে, গতদিন ইকরাম আলীর কাছ থেকে নেওয়া টাকাগুলো পুঁটলিটার মধ্যে আছে। ঐ টাকাগুলো তার বিলিয়ে দিতে হবে দুঃস্থ গ্রামবাসীদের মধ্যে। কিভাবে ঐ টাকা সে সং কাজে লাগাবে, এই চিন্তাই করছিলো মালেক মিয়া।

হঠাৎ চুড়ির রিমঝিম শব্দ কানে গেলো তার।

বুঝতে পারলো গোলাপী এসেছে, তাই চুপচাপ শুয়ে রইলো সে।

গোলাপী ছাড়া কেউ নয়, সে এসে দাঁড়ালো ওর শিয়রে, কোমলকণ্ঠে ডাকলোমালেক ভাই, মালেক ভাই,….আমি সব শুনেছি, সব দেখেছি। আমার শ্বশুর মানুষ নয়, পশু…….তোমার মুখের খাবার ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। কি অন্যায় তুমি করেছো মালেক ভাই?

এবার মালেক মিয়া উঠে বসলো, ম্লান মুখে বললো–আমি নাকি হাজরার যুবক ছেলেদেরকে নষ্ট করে দিচ্ছি!

কি করেছিলে তুমি তাদের কি করে নষ্ট করে দিয়েছো তুমি মালেক ভাই?

সৎপরামর্শ দিয়ে…….

 সৎপরামর্শ দিলে মানুষ নষ্ট হয়, এটা তো আমি কোনোদিন শুনিনি মালেক ভাই?

হাঁ, যারা অসৎ ব্যক্তি তারা তাই মনে করে। সৎ কাজ বা সৎ কথা তাদের কাছে মন্দ, বুঝলে?

আমি জানি মালেক ভাই, তুমি কোনোদিন মানুষকে নষ্ট করতে পারো না। তুমি নিজে একজন মহৎ লোক।

তা বলুক, তুমি তাতে রাগ করো না। এই দেখো আমি তোমার খাবার এনেছি। আঁচলের তলা থেকে খাবারের থালা বের করে সম্মুখে রাখে গোলাপী।

মালেক মিয়া বলে উঠে–একি করেছে, তোমার সব খাবার নিয়ে এসেছে আমার জন্য?

খাও মালেক ভাই, তুমি খাও। সারাদিন কত পরিশ্রম করো, নাও, দেরী করো না।

আর তুমি?

আমার খাবার আছে।

 তা হয় না, কিছুটা তুমি খাও, তারপর আমি খাবো।

না, তুমি আগে খাও, আমি পরে খাবো।

 অগত্যা মালেক মিয়া খেলো, বাকিটুকু আঁচলে ঢেকে নিয়ে গেলো গোলাপী অন্তঃপুরে।

মালেক মিয়া ভাবে, কত মহৎ নারী এই গোলাপী। প্রাণ ভরা দয়ামায়া মেহ। প্রাণভরা প্রেম ভালবাসা কিন্তু সে আজ অসহায়। স্বামীর প্রেম সে কোনোদিন পায়নি, পাবেও না। একটি জীবন এমনি করে নিঃশেষ হয়ে যাবে। যদি সে এই হাজরা গ্রামে না আসতো, না পরিচয় হতো ওর সঙ্গে তাহলে হয়তো ওর জন্য আজ তার কোনো কিছু ভাবতে হতো না। আজ তার মস্তবড় চিন্তা, গোলাপীকে রাহুমুক্ত করা।

সন্ধ্যায় নদীতীরে বসেছিলো মালেক মিয়া, হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন ডাকলোমালেক ভাই!

ফিরে তাকালো মালেক মিয়া, সে দেখতে পেলো মখলেছুর আর ঠান্ডা এগিয়ে আসছে তার দিকে। ওদের সঙ্গে একটি মেয়েও আছে।

ওরা মালেকের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো।

মখলেছুর বললো–মালেক ভাই, তুমি এখানে বসে আছে আর আমরা তোমাকে আলী সাহেবের বাড়িতে খুঁজতে গিয়েছিলাম।

মালেক মিয়া মৃদু হেসে বললো–সন্ধ্যাবেলায় কোনো কাজ হাতে ছিলো না, তাই নদীতীরে এসে বসেছি। তোমরাও বসো আমার পাশে।

ঠান্ডা বললো–আমরা তোমার কাছে এলাম কয়েকটা কথা বলতে।

বেশ বলো।

ওরা তিনজন বসলো মালেক মিয়ার পাশে ঘাসের উপর।

ঠান্ডা বললো–মালেক ভাই এ আমার বোন, এর নাম শিরীন।

 বেশ নামতো তোমার বোনের! তুমিও বুঝি কাজ করছো ভাইদের সঙ্গে?

শিরীন লজ্জাভরা অথচ দীপ্তকণ্ঠে বললো–হা মালেক ভাই, আমি ওদের সঙ্গে কাজ করছি। আমি ছাড়া আরও কয়েকটি মেয়ে আছে। তুমি একদিন আমাদের সমিতি কক্ষে এসো, আমি ওদের সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দেব।

নিশ্চয়ই যাবো বোন। শুনে খুশি হলাম তোমরা সবাই মিলে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করছে জেনে। আচ্ছা এবার বলো দেখি, কি কথা আছে তোমাদের

মখলেছুর বললো সেদিন আমরা নৌকার সমস্ত চাল হাজরার হাটে তুলেছিলাম। যা মানুষের কিনবার ক্ষমতার মধ্যে, সেই দলে আমরা সব চাল বিক্রি করে দিয়েছি।

বেশ করেছে, শুনে খুশি হলাম।

টাকাগুলো সমিতির ফান্ডে জমা রেখেছি। মালেক ভাই–টাকাটা কি করা যায়, এ নিয়েই। তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চাই।

মালেক মিয়া তাকিয়ে আছে সম্মুখে ইরামতী নদীর বুকে। কল কল, ছল ছল করে ইরামতীর পানি ছুটে চলেছে। বন্যায় ভরে উঠেছে নদীর পানি, ভেসে গেছে একূল ওকূল। হাজরা গ্রামটা বেশ উঁচু জায়গায়, তাই গ্রামে বন্যার পানি প্রবেশ করেনি। নদীর আশেপাশে প্রচুর শস্যক্ষেত। যদিও এখন মাঠে তেমন কোনো শস্য নেই তবু মাঝে মাঝে দেখা যায় সবুজ রংয়ের গালিচার মত ধানের ছোট চারা গাছ।

নদীর বুকে কচুরিপানাগুলো তীরবেগে ছুটে চলেছে কোন অজানার পথে কে জানে।

মালেক মিয়া সেইদিকে তাকিয়ে বললো শোনো ভাইরা–যে টাকা তোমরা মজুত রেখেছে ঐ টাকা দেশগড়ার কাজে ব্যয় করো।

হাঁ, আমরা তাই করতে চাই। আমাদের উদ্দেশ্য দেশের দুঃস্থ অসহায় জনগণকে রক্ষা করা। এমন অনেক পরিবার আছে যাদের সংসার চালানো দূর্বিষহ হয়ে উঠেছে।

আমি তোমাদের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছি ভাই। এ টাকা যদি তোমরা দুঃস্থ জনগণের মধ্যে বিলিয়ে দাও, তাহলে তারা হয়তো দু’চারদিন পেট পুরে খেতে পারবে তারপর আবার তাদের অবস্থা সঙ্কটময় হয়ে পড়বে।

মালেক ভাই, এমন একটা বুদ্ধি দাও যাতে আমরা দেশের জনগণকে বাঁচাবার মত কিছু করতে পারি।

হাঁ, তাই করতে হবে যাতে দেশবাসী বাঁচতে পারে। তোমাদের যা টাকা মজুত আছে তা দিয়ে তোমাদের সমিতি প্রাঙ্গণে বা কোনো উপযুক্ত জায়গায় একটি কারখানা খুলে দাও যেখানে তৈরি হবে। কাঠের জিনিস, তৈরি হবে বেতের জিনিস, তৈরি হবে বাঁশের জিনিস। সেই কারখানায় কাজ করবে দেশের জনগণ–যারা কোথাও চাকরি পায়নি বা কাজ পায়নি তারা কাজ পাবে এই কারখানায়…….

মারহাবা মালেক ভাই…চমৎকার এক বুদ্ধি বাতলে দিয়েছে। এই সামান্য বুদ্ধিটুকু আমাদের মাথায় আসছিলো না। কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বললো মখলেছুর।

ঠান্ডাও করতালি দিয়ে উঠলো–ঠিক বলেছো মালেক ভাই, এইতো কাজের কথা। শিরীনের চোখ দুটো খুশিতে দীপ্ত হয়ে উঠলো, সে বললো–আমরা নিজেরা তো কাজ শিখতে পারবো সেখানে?

হাঁ বোন, তোমরা সবাই কাজ শিখতে পারবে। শহর থেকে বা দূরে কোনো জায়গা থেকে এসব যারা জানেন, সেই সব শিক্ষক জোগাড় করে আনতে হবে। মাইনে দিতে হবে, অবশ্য তোমাদের কারখানা থেকেই এসব শিক্ষকের মাইনে হয়ে যাবে। জানো, আজকাল কাঠের জিনিসের কত প্রয়োজন, বেতের তৈরি বহু জিনিস আজ শহরের ঘরে ঘরে শোভা পাচ্ছে, বাঁশের তৈরি জিনিসের তো কথাই নেই। বাঁশ তো আমাদের দেশেই প্রচুর জন্মে, কোনো অভাব হবে না, বাঁশ, কাঠ, বেত সংগ্রহ করতে। বাঁশের তৈরি ফুলদানী, এসট্রে, নানাবিধ খেলনা এবং মেয়েদের হাতের চুড়িও তৈরি হয়। দেশে তোমাদের কত সম্পদ, শুধু পরিশ্রম করে তা থেকে পয়সা উপার্জন করা।

সত্যি মালেক ভাই, তুমি যে কি বুঝিয়ে বলতে পারবো না। আমাদের গ্রামে–গঞ্জে এ ধরণের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সবার জন্য কর্তব্য। দেশের হাজার হাজার মানুষ না খেয়ে মরছে–তারা খেটে খাবে তাও কোনো উপায় নেই। কারণ কাজ কোথায় পাবে, কে দেবে কাজ।

সেজন্যই তো আমাদের এভাবে দেশকে গড়ে তুলতে হবে, যেন দেশের মানুষ অনাহারে না। মরে। তারা যেন খেটে খেতে পারে।

এখন থেকে তোমরা সতর্ক এবং সজাগ হয়ে যাও, কোনোক্রমে কোন ব্যক্তি যেন দেশের সম্পদ বাইরে পাচার করতে না পারে। আর কোনো মাল যেন বেশি মুনাফার লোভে গুদামজাত করতে না সক্ষম হয়, দেখবে ধীরে ধীরে দেশে শান্তি ফিরে আসছে।

ঠিক তোমার কথা মতই কাজ করবো আমরা মালেক ভাই।

আমি মূর্খ মানুষ, আর তোমরা জ্ঞানী বুদ্ধিমান। একটু থেমে বললো মালেক মিয়া সরকারের ত্রাণ তহবিলে প্লাবন দুর্গতদের সাহায্যার্থে যে লক্ষ লক্ষ টাকা জমা হয়েছে, ঐ টাকা কিছু কিছু দুর্গতদের খাবারের জন্য দান করার পর সরকার যদি ঐ টাকায় গ্রামে–গঞ্জে, শহরে–বন্দরে এক একটি সাধারণ কল–কারখানা কিংবা কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তাহলে ঐ সব অসহায় মানুষ হয়তো বাঁচার আশ্বাস পেতো।

মালেক ভাই তুমি যা বলছো খাঁটি সত্য। নাহলে লক্ষ লক্ষ কেন, কোটি কোটি টাকা দিয়েও ঐ সব দুঃস্থ অসহায় মানুষকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। আমার মনে হয়, সরকারের ত্রাণ তহবিল থেকে টাকাগুলো যখন বেরিয়ে আসবে তখন শুরু হবে লুকোচুরি অভিযান। প্রথম স্তরে যাবে কিছু, তারপর দ্বিতীয় স্তর, দ্বিতীয় স্তর থেকে তৃতীয় স্তর এমনি করে লুকোচুরি খেলা চলবে পঞ্চম স্তর পর্যন্ত। তারপর ষষ্ঠ স্তরে গিয়ে যখন সেই দুর্গত মানুষদের হাতে পৌঁছবে তখন দেখা যাবে এক সন্ধ্যার মত খাবার বা পয়সা তাদের ভাগ্য জুটেছে, হয়তো বা তাও কারও হাতে গিয়ে পৌঁছায়নি।

মালেক মিয়া অস্ফুটধ্বনি করে উঠে–মখলেছুর ভাই, তুমি ঠিক বলেছো। সরকারের ত্রাণ তহবিলে যে সাহায্য অর্থ সংগ্রহ হয়েছে, ঐ অর্থে দেশের দুঃস্থ জনগণের জন্য মহান মহৎ কাজ করা যায়, ইচ্ছা করলে সরকার এইসব অসহায় মানুষগুলোকে বাঁচাতে পারেন কিন্তু সরকারকে অত্যন্ত সজাগভাবে কাজ করতে হবে। ঐ অর্থের একটি কানাকড়িও যদি কোনো মহান নেতার পকেটে হঠাৎ প্রবেশ করে তাহলে তাকে হয় চাকরি থেকে বরখাস্ত, নয় চুল, কান কেটে শহর প্রদক্ষিণ করানো……কিন্তু কে করবে ভাই, সরকার যে তারাই যাদের পকেটে লাফিয়ে প্রবেশ করে কানাকড়িগুলো……একটা ব্যথা–করুণ হাসি ফুটে উঠে মালেক মিয়ার মুখমন্ডলে।

ঠান্ডা বলে উঠলো–সরকার যদি নিজেদের লোকজনকে শায়েস্তা করতে না পারে তাহলে জনগণ আছে। মালেক ভাই, জনগণ ক্ষুধার জ্বালায় শুধু উন্মাদ হয়নি, তারা প্রতিদিন হাজার হাজার মরছে কিন্তু মরলেও সবাই মরবে না–যারা তাদের এই মৃত্যু যজ্ঞ সৃষ্টি করার মূলে তাদের রক্ত শুষে নেবে, সেদিন বেশি দূরে নেই…

বললো মালেক মিয়া–শুনলাম বিদেশ থেকে আমাদের দেশের সাহায্যার্থে প্রচুর পরিমাণ চাল এবং অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য এসেছে। তোমাদের এই হাজরা গ্রামের জন্যও আসবে কিন্তু তোমরা সাবধানে সজাগ দৃষ্টি নিয়ে লক্ষ্য রাখবে এই সাহায্যদ্রব্য বা চালের এক ছটাক যেন কেউ আত্মসাৎ করতে না পারে।

হাঁ, আমরা যুব সমাজ শপথ গ্রহণ করেছি–আবার করলাম, দেশের এই অনাচার আর দুর্নীতি কিছুতেই বরদাস্ত করবো না। বরদাস্ত করবো না চোরাচালানি, মজুতদারি। দেশের হাজার হাজার জনগণের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে আমরা আর ইমারত গড়তে দেবে না। দাঁতে দাঁত পিষে কথাগুলো বললো মুখলেছুর।

দীপ্ত উজ্জ্বল হয়ে উঠলো মালেক মিয়ার চোখ দুটো, বললো সে–উদ্দেশ্য যাদের মহৎ খোদা তাদের সহায়। তোমরা প্রতিটি যুবক প্রতিটি গ্রামে গঞ্জে শহরে বন্দরে দেশগড়ার শপথ নিয়ে কাজে আঁপিয়ে পড়ো। খুঁজে বের করো কার ঘরে মজুত আছে খাদ্যশস্য। কে বা কারা অসৎ ব্যবসায়ে লিপ্ত আছে কিংবা চোরাচনা করে যাচ্ছে। তাদের খুঁজে বের করে প্রকাশ্য দিনের আলোতে শায়েস্তা করো। যদি কেউ প্রতিবাদ করে বা পুলিশের সহায়তা গ্রহণ করে তাহলে……

বলল মালেক ভাই, থামলে কেন?

হয়তো তোমাদের উপর আসবে অত্যাচার, হয়তো নির্মমভাবে হত্যা করবে সৈন্যবাহিনী বা পুলিশের লোক কিংবা ধরে নিয়ে যাবে কারাগারে…….

আমরা ভয় করি না আর! মালেক ভাই, কতজনকে ওরা হত্যা করবে, কতজনকে ওরা বন্দী করবে, আমরা কোটি কোটি যুবসমাজ দেশগড়ার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। মৃত্যুকে আমরা ভয় করি না, মৃত্যুকে জয় করতে শিখেছি আমরা…মখলেছুর কথাগুলো বলে থামলো।

মালেক মিয়া উচ্চসিত আনন্দে বললো–সাবাস!

আজ তাহলে চলি মালেক ভাই

ঠান্ডা এবং শিরীনও বলে উঠে–মালেক ভাই, দোয়া করো আমরা যেন কাজে সফলতা লাভ করি।

নিশ্চয়ই তোমরা জয়ী হবে, অন্যায় কোনোদিন চিরস্থায়ী হয় না। তোমাদের অভিযান অন্যায় অনাচারের বিরুদ্ধে, কাজেই জয় তোমাদের সুনিশ্চিত।

ওরা চলে গেলো।

উঠে দাঁড়ালো মালেক মিয়া।

বাড়ির দরজায় পা দিতেই কানে এলো কান্নার শব্দ, তার সঙ্গে গালমন্দের ঝঙ্কার। গোলাপীর কান্নার শব্দ বেশ বুঝতে পারলো মালেক মিয়া। বোবা হাবলুর হাউমাউ করে গলার আওয়াজও শোনা যাচ্ছে।

ইকরাম গৃহিণীর গলা–আমরা দয়া করে তোমার মত অলক্ষুণে মেয়েকে ঘরে স্থান দিয়েছি, না হলে কবে ঝেটিয়ে বের করে দিতাম। এত বড় স্পর্ধা। তুমি স্বামীর অবাধ্য হয়েছে। ও যা বলবে তাই শুনতে হবে তোমাকে। যদি আমার ছেলের কথা না শোনো তাহলে তোমার এ বাড়িতে স্থান নেই মনে রেখো……

গোলাপীর গলা–আমি পারবো না, ওর পায়ে তেল মাখতে আমি পারবো না।

সমস্ত রাত বসে বসে আমার ছেলের পায়ে তেল মাখতে হবে তোমাকে, নইলে আরও মারবে ও…….

না, পারবো না।

সঙ্গে সঙ্গে ধুপধাপ শব্দ। ইকরাম গৃহিণীর ইঙ্গিতে বোঝা কালা হাবলু বেদম প্রহার শুরু করে দেয় গোলাপীকে।

মালেক মিয়া সহ্য করতে পারে না, সে উঠানে প্রবেশ করে সোজা বারান্দায় উঠে যায় এবং প্রচন্ড এক ধাক্কায় হাবলুকে সরিয়ে দিয়ে বলে–এসব কি করছেন বেগম সাহেবা, এমনভাবে প্রহার করতে দিচ্ছে আপনার ছেলেকে?

দেবো না মানে একশ’ বারও মারবে। ওর বৌও যা ইচ্ছা করবে, তোমার তাতে কি? যাও তুমি বেরিয়ে যাও উঠান থেকে, নইলে সাহেবকে ডাকবো। যাও বলছি…

যাচ্ছি কিন্তু মনে রাখবেন এরপর যেমন আর একটা আঘাতও না পড়ে গোলাপীর উপর।

কি, কি বললে…এতবড় সাহস তোমার! আমরা যা খুশি করিনা কেন, তাতে তোমার কি? একবার নয়, হাজারবার হাবলু ওর বৌয়ের উপর আঘাত করবে তাতে তোমার কি বেরিয়ে যাও উঠান থেকে যদি ভাল চাও।

মালেক মিয়া ধীর মন্থর পদক্ষেপে বেরিয়ে গেলো তখনকার মত। নিজের ঘরে গিয়ে জামাটা খুলে শুয়ে পড়লো বিছানায়……ভাবছে, সারাটা দিন গোলাপী কত না পরিশ্রম করে, হাড় ভাঙা খাটুনি করে সে, তবু তার উপর চলে অকথ্য অত্যাচার….ওকে এ বাড়ি থেকে সরানো ছাড়া উপায় নেই। একটি সুন্দর ফুলের মত জীবন এভাবে বিনষ্ট হতে দেবে না সে। গোলাপীর উপযোগি একটি ছেলে তাকে খুঁজে বের করতে হবে। যতদিন না গোলাপীর একটা ব্যবস্থা হয়েছে ততদিন সে নিশ্চিন্ত হতে পারবে না।

*

আরও কিছুদিন কেটে গেলো।

মখলেছুর ও তার সঙ্গীরা সমিতি প্রাঙ্গণে বড় বড় তিনটি কক্ষ তৈরি করে নিয়েছে; এক একটি কক্ষে এক এক রকম জিনিস তৈরির সরঞ্জাম রাখা হয়েছে। প্রাঙ্গণে কাজ হয় সকাল থেকে বেলা দুটো পর্যন্ত কাজ চলে।

মখলেছুর একদিন নিজে গিয়ে হাজির হলো। মালেক মিয়া তখন মাঠে কাজ করছিলো। এসে দাঁড়ালো মখলেছুর মালেক ভাই, তোমাকে যেতে হবে।

কোথায়?

আমাদের সমিতি প্রাঙ্গণে। দেখবে চলো আমরা কিভাবে কাজ করছি।

 হাঁ, চলো যাই।

মালেক মিয়া মখলেছুরের সঙ্গে চলে এলো সমিতি প্রাঙ্গণে, সে দেখতে পেলো বিরাট আকারের লম্বা ঘর, তাতে নানারকম যন্ত্রপাতি আর বিভিন্ন জিনিস তৈরির সরঞ্জাম সুন্দরভাবে স্থান লাভ করেছে। বহু দুঃস্থ লোক সমিতি প্রাঙ্গণে জমায়েত হয়ে যে যার কাজ করে চলেছে। একদিকে চলছে বেতের কাজ, একদিকে বাঁশের, অপর দিকে চলছে কাঠের কাজ। অনেক পঙ্গু লোককেও কাজ করতে দেখা যাচ্ছে।

মালেক মিয়ার দু’চোখ আনন্দে ভরে উঠলো, একজন শিক্ষক এক এক দলকে কাজ শেখাচ্ছে।

মখলেছুর বললো–মালেক ভাই, এরা যখন নিজেরা কাজ শিখে নেবে তখন আর শিক্ষকের প্রয়োজন হবে না। এই দেখো এরা কেউ কেউ অন্ধ, কেউ কেউ পঙ্গু খোঁড়া, তবু এরা কাজ করছে বেতের কাজ।

হাঁ, খুব সুন্দর হচ্ছে। এই তো কদিন আগেও এরা কাজ না পেয়ে পথে পথে হাত পেতে বেড়াতো, অনাহারে–উপবাসে ধুকে ধুকে মরতো, আর আজ ওরা কাজ পেয়েছে–আর ওরা ক্ষুধায় মারবে না।

এই দেখো মালেক ভাই, এরা বাশের কাজ করছে। এগুলো ফুলদানি, এ্যাসট্রে…..

চার, পাঁচজন মেয়ে একপাশে বসে বাঁশের ফুলদানি আর অ্যাসট্রেগুলোতে নানারকম রঙের আঁচড় টেনে চলেছে।

মালেক মিয়া একটা ফুলদানি হাতে নিয়ে নেড়চেড়ে দেখে বললো–ভারী সুন্দর হচ্ছে।

জানো মালেক ভাই, এরা কারা? এরা আমাদেরই বোন–লাকী, লেবু, শিরীন, সাহরাবানু, পারভীন, লায়লা, পারুল। এদের সহযোগিতায় আমরা যথেষ্ট উপকার পাচ্ছি।

মালেক মিয়া বললো–খুব আনন্দ লাগছে বোন, তোমরাও এসেছে দেশগড়ার কাজে সহায়তা করতে। নিশ্চয়ই দেশের সব পরিস্থিতি মঙ্গলময় হয়ে উঠবে। তোমাদের দেখে পাশের গ্রাম শিখবে, তারপর শিখবে অপর গ্রাম, এমনি করে সমস্ত দেশে শুরু হবে দেশগড়ার কাজ। আমি বলছি তোমাদের সমিতি কক্ষগুলো অচিরে দালানে পরিণত হবে।

সত্যি হবে মালেক ভাই? বললো শিরীন।

 মালেক মিয়া বললো–হবেই।

পরদিন দেখা গেলো গাড়ি ইট আর সিমেন্ট আসছে। এলো মিস্ত্রি, পুরাদমে কাজ শুরু হলো।

বহু টাকা খরচ হতে লাগলো সমিতির কাজে। অবাক হয়ে গেলো মখলেছুর ও তার দলবল। তারা ভেবে পাচ্ছে না কে এসব দিচ্ছে।

ছেলেদের উৎসাহ ধরে না, তারা উচ্ছ্বসিতভাবে কাজ করতে লাগলো।

ইকরাম আলীর কানে গিয়ে পৌঁছলো এ সংবাদ। সে রাগে জ্বলে উঠলোকার এমন সাহস, আমার বিনা হুকুমে সমিতি প্রাঙ্গনে ইটের দালান তৈরি করে, তারপর দেশের মানুষদের কাজে লাগিয়ে দেশটাকে রসাতলে দিচ্ছে।

সমস্ত ছেলেদের ডেকে পাঠালো ইকরাম আলী।

ছেলেরা এলে তাদের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো এবং ভীষণভাবে রেগে বললো–কার আদেশে তোমরা সমিতি করেছে এবং সেখানে দুঃস্থ জনগণকে কাজ দিয়েছ।

একসঙ্গে এসেছিলো সমিতি কয়েকজন ছেলে–শাহীনুর, ঠান্ডা, ইকবাল, সুজা, জোবায়েদ আর মখলেছুর। সবার সামনে এগিয়ে এলো মখলেছুর, দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দিলো জনহিতকর কাজে কারও মতামতের প্রয়োজন আমরা বোধ করিনি, তাই……

তোমাদের সমিতি আমি বন্ধ করে দেবো।

না, পারবেন না, ও সমিতি আমরা নষ্ট করতে দেবো না। ঐ সমিতিতে প্রতিদিন শত শত দুঃস্থ। গ্রামবাসী কাজ করে আহারের সংস্থান করছে। ঐ সমিতিতে ওরা কাজ না করলে মারা পড়বে।

মারা পড়ুক। ওদের বেঁচে কোনো ফল হবে না, ওরা দেশের জঞ্জাল।

আর আপনারা যারা দেশকে রসাতলে নিয়ে যাচ্ছেন আপনারা বুঝি দেশের সম্পদ।

কি, আমার মুখের উপর এতবড় কথা বলতে সাহস পেলে? শুনেছি সেদিন তোমরা ইউনুস আলী ব্যাপারীকে অপমান করেছে, তার চুল কেটে মুখে চুনকালি মাখিয়ে তাকে নিয়ে গ্রামময় ঘুরিয়ে বেড়িয়েছো?

হাঁ, তবু তাকে ক্ষমা করেছি, তার হাতের সবগুলো আঙ্গুল কেটে দেওয়ার কথা ছিলো, তা করিনি আমরা।

একজন সম্মানিত ব্যক্তির সম্মানহানি করার কি অধিকার আছে তোমাদের? জানো আমি পুলিশকে সংবাদ দিয়েছি।

হেসে উঠলো মখলেছুর–পুলিশ। পুলিশ এসে কি করবে? আমরা চোরাচালানী হিসেবে তাকে আটক করেছিলাম, তার সমস্ত মাল আমরা আটক করেছি এবং তা বিক্রি করে সমিতির কাজ করছি। আমরা এমন কোনো দোষ বা অপরাধ করিনি যে পুলিশ আমাদের গ্রেপ্তার করতে পারে।

তোমাদের কোনো কথা আমি শুনব না বা শুনতে চাই না। পুলিশ এলে তাদের সম্মুখে জবাবদিহি করতে হবে তোমাদের।

সে দেখা যাবে। রাগতভাবে কথাটা বলে দলবল নিয়ে চলে গেলো মখলেছুর।

ইকরাম আলী রাগে ক্ষোভে বোমার মত ফেটে পড়লো। হবি মোল্লাকে ঘোড়া দিয়ে শহরে পাঠিয়েছে সে পুলিশকে সংবাদ দিতে।

গ্রামের ছেলেদের এমন দুর্জয় সাহস হলো কি করে। তারা সম্মানী লোকের সম্মানহানি করতে পিছপা হচ্ছে না,…রাগে দুঃখে পায়চারী করে চলে ইকরাম আলী।

বেলা গড়িয়ে যেতে না যেতেই হাজরা থানার পুলিশ অফিসার সহ কয়েকজন পুলিশ এলো। গাড়ি এসে থামতেই ইকরাম আলী শশব্যস্ত গাড়ির পাশে এসে পুলিশ অফিসারকে অভ্যর্থনা জানালো।

ইকরাম আলীকে লক্ষ্য করে বললেন পুলিশ অফিসার–কোথায় সেই দুস্কৃতিকারী দল, যারা দিনদুপুরে গ্রামের লোকদের উপর হামলা চালিয়ে সব লুটপাট করে নিচ্ছে? চলুন দেখিয়ে দিন।

না স্যার, যেতে হবে না, আমি তাদের ডেকে পাঠাচ্ছি।

 সেকি, যারা দিনদুপুরে লুটপাট করে, লোকের সর্বনাশ করে, তারা ডাকলে আসবে তো?

 আসতে বাধ্য স্যার।

 বেশ, ডেকে পাঠান।

 চলুন, বৈঠকখানায় গিয়ে আমরা বসি।

চলুন।

হবি মোল্লা সেখানেই ছিলো, তাকেই পাঠালেন ইকরাম আলী সাহেব মখলেছুরের দলকে ডাকতে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো হবি মোল্লা, বললো–তারা কেউ নেই বাড়িতে।

কোথায় গেছে?

তাদের বাবা বললো তারা নাকি কাজে বেরিয়ে গেছে।

দেখলেন স্যার, এক মুহূর্ত তারা বাড়িতে থাকে না, সব সময় কার সর্বনাশ করবে এজন্য ঘুরে বেড়ায়। স্যার, এখন কি করা যায় বলুন?

যতক্ষণ তারা ফিরে না আসে ততক্ষণ বিশ্রাম করুন স্যার বললো হবি মোল্লা।

পুলিশ অফিসার ধমক দিয়ে বললেন–আপনারা সঠিক কোনো কিছু না করে কেন আমাদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন? তবে যে হবি মোল্লা বললো এলেই তাদের হাতেনাতে পাকড়াও করতে পারবো আমরা?

হবি মোল্লা হাতের মধ্যের হাত কচলে বললো–স্যার, ভেবেছিলাম এলেই পাবেন কিন্তু দেখছি। ওরা কিছুই নয় পাকাল মাছ, ধরতে গেলেই পিছলে পালায়।

ইকরাম আলী বলে–যাও, পাকাল মাছদের না পেলে তাদের বাপদের ডেকে আনে। স্যার, দু’জন পুলিশ দিয়ে দেননা, নাহলে হয়তো সহজে আসতে চাইবে না।

চলে যায় হবি মোল্লা দু’জন পুলিশ সহ।

কিছু পরে মখলেছুরের বাবাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে তারা। বেচারী হাসান সাহেব সাদাসিদা মানুষ, তিনি কিছু বুঝতে না পেরে হতাশ হয়ে গেছেন।

ইকরাম আলী বৈঠকখানায় প্রবেশ করবার পূর্বেই বুঝতে পারেন, সব ইকরাম আলীর চক্রান্ত। ভিতরে প্রবেশ করে দেখতে পান চেয়ারে বসে আছেন পুলিশ অফিসার এবং ইকরাম আলী।

হাসান সাহেব ছালাম দিতেই বলে উঠে ইকরাম আলী–আপনার ছেলে মখলেছুরকে কোথায় সরিয়ে দিয়েছেন? বলুন, জবাব দিন?

অবাক কণ্ঠে বলেন হাসান সাহেব–আমার ছেলে মখলেছুরের কথা বলছেন?

 হাঁ, কোথায় সে? এবার কঠিন এবং গম্ভীর কণ্ঠে বললেন পুলিশ অফিসারটি।

 হাসান সাহেব বললেন–সে সমিতির কাজে বাইরে কোথাও গেছে।

 বিস্ময় নিয়ে বললেন পুলিশ অফিসারটি সমিতির কাজে! কিসের সমিতি?

ইকরাম আলী হাসান সাহেবকে কোনোরকম জবাব দিতে না দিয়ে বলে উঠে–সমিতির নামে ওরা ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে। লুট করা টাকা–পয়সা দিয়ে…….

হাসান সাহেব রাগত কণ্ঠে বলে উঠেন–লুট করা মানে আমার ছেলেরা লুট করেছে, বলেন কি ইকরাম আলী সাহেব?

তা নয় তো কি, ইউনুস ব্যাপারীর একনৌকা চাল ওরা লুটে নেয়নি? ঐ চাল লুট এবং আরও অনেক কিছু দুস্কর্ম ব্যাপারে আপনার ছেলে এবং তার সঙ্গীদের গ্রেপ্তার করতেই ইনারা এসেছে।

কি আশ্চর্য, ইউনুস আলী পাটের গাইটের তলায় হাজার হাজার মন চাল পাচার করতে যাচ্ছিলো তখন তারা তার নৌকা আটক করে……

স্যার, দেখুন সত্যি কিনা। ওরা দিনের বেলায় লুটতরাজ শুরু করে দিয়েছে। বলে কি জানেন স্যার, আমরা দুঃস্থ জনগণের সেবা করছি। তার মানে দেশবাসীকে লুটতরাজ করা শিক্ষা দিচ্ছে ওরা এবং লুটতরাজ শিখবার জন্যই সমিতি খুলেছে। হাসান সাহেব ছেলের অপরাধ ঢাকবার চেষ্টা করছেন। আপনি কোনো কথা শুনবেন না যেন।

পুলিশ অফিসারটি বলে উঠেন–না, আমি কারও কথাই শুনবো না। আমি নিজে গিয়ে দেখতে চাই সমিতিটিতে সত্যি লুটতরাজ শেখানো হচ্ছে কিনা। উঠে দাঁড়ান পুলিশ অফিসার–চলুন এখনই যাবো।

হাসান সাহেব খুশিভরা কণ্ঠে বলেন—হা স্যার, চলুন।

মখলেছুর রহমান তার সঙ্গীদের নিয়ে সমিতির কাজে শহরে গিয়েছিলো, সমিতি কক্ষে ছিলো মেয়েরা। শিরীন, লায়লা, সাহেরানু, পারুল, লাকী, রেবু আর পারভীন–এরা সমিতি প্রাঙ্গণে যারা যারা কাজ করে চলেছে, তাদেরকে সহযোগিতা করছিলো।

এমন সময় এসে হাজির হলো ইকরাম আলী ও পুলিশ অফিসারটি এবং পুলিশদ্বয়।

ইকরাম আলীর সঙ্গে পুলিশের পোশাকপরা লোকদের দেখে মেয়েরা বেশ চিন্তিত হলো, কারণ তারা জানে এই মাতব্বর কতখানি বদ এবং শয়তান। মনে মনে ভড়কে গেলেও মুখে সাহস টেনে উঠে দাঁড়ালো শিরীন।

অন্যান্য মেয়ে কাজ করে চললো আপন মনে।

শিরীনকে উঠে দাঁড়াতে দেখে এগিয়ে এলেন পুলিশ অফিসারটি, তার মুখোভাব দেখে মনে হচ্ছিলো তিনি সমিতি এবং সমিতির কাজ দেখে খুশি হয়েছেন। পুলিশ অফিসার শিরীনকে লক্ষ্য করে বললেন–আপনি বুঝি এ সমিতির কর্মী?

জী হাঁ, আমিও এ সমিতির একজন।

 শুনুন, আমি আপনাকে কয়েকটি প্রশ্ন করবো?

বেশ করুন। সচ্ছভাবে জবাব দিলো শিরীন।

পুলিশ অফিসার কিছু জিজ্ঞাসা করবার পূর্বেই বলে উঠে ইকরাম আলী–স্যার, ওকে আবার কি জিজ্ঞাসা করবেন, ও তো মেয়েমানুষ।

হোক, তবুও জবাব দিতে পারবে বলে মনে করি। আচ্ছা বলুন, আপনাদের এ সমিতির উদ্দেশ্য কি সংক্ষেপে জবাব দিন।

তাই দেব। শিরীন একটু চুপ করে থেকে বললো–গ্রামের দুঃস্থ জনগণকে সাহায্য করা আমার সমিতির উদ্দেশ্য।

কিভাবে এবং কি ধরনের দুঃস্থ জনগণকে আপনারা সাহায্য করছেন?

ধরুন আমাদের গ্রামে যেসব গরিব অসহায় মানুষ আছে এবং যারা পঙ্গু–কোনো কিছু করতে পারে না, তাদের আমরা আমাদের সমিতিতে নানাভাবে, নানা কাজে সুযোগ দিয়ে থাকি। আসুন আমার সঙ্গে, আপনাকে দেখাচ্ছি।

ইকরাম আলী বলে উঠেনা না, ওসব আবার ঘুরেফিরে কি দেখবেন, যা বলেছি তাই সত্য……

পুলিশ অফিসার কান দিলেন না, তিনি শিরীনের সঙ্গে এগিয়ে চললেন।

শিরীন নিয়ে গেলো যেখানে বেতের কাজ হচ্ছিলো সেখানে। পুলিশ অফিসার অবাক হয়ে দেখছেন ভারী সুন্দর সুন্দর ঝুরি ফুলের সারি, চেয়ার, টেবিল, বেতের বাক্স আরও বহু জিনিস তৈরি হচ্ছে।

শিরীন বললো–এরা সবাই পঙ্গু কারও পা খোঁড়া, কারও হাত ছোটো বা খোঁড়া, কারও চোখ নেই অন্ধ, এমনি নানা ধরনের পঙ্গু লোক এখানে আছে। এরা পূর্বে ভিক্ষা করতো। দেশে যে অবস্থা ভিক্ষাও পেতো না, তখন না খেয়ে সবাই মরতে বসেছিলো। এদের মধ্যে অনেকেই আছে বন্যা প্লবিত অঞ্চলের লোক। বাড়িঘর সব বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়ায় যারা দিশেহারা হয়ে শহরে গ্রামে বন্দরে ছড়িয়ে পড়েছিলো, ক্ষুধার জ্বালায় পথে পথে ধুকে মরছিলো আমরা তাদের এনে এখানে খেতে দিয়েছি। প্রথমে কদিন শুধু খেতে দিয়ে দুর্বল মানুষগুলোকে কিছুটা সবল করে তুলেছি, তারপর কাজ দিয়েছি। এখন যেসব বেতের কাজ হচ্ছে তা বিক্রি করেই এই অসহায়দের ভরণ পোষণ চলছে। স্যার, আপনি কিছু কিনলে খুশি হবো।

ইকরাম আলীর দু’চোখে আগুন ঠিকরে বের হতে লাগলো, সে বলে উঠলোনা, উনি এসব কিনবেন কোন দুঃখে, জানো উনারা কেন এসেছেন?

অফিসার শান্ত গলায় বললেন–আপনি চুপ করুন ইকরাম আলী সাহেব। যা প্রশ্ন করার আমাকে করতে দিন। চলুন ওদিকে দেখি?

চলুন।

যেখানে বাঁশের কাজ হচ্ছিলো সেখানেও নারীপুরুষ সবাই মিলে কাজ করছে। সুন্দর সুন্দর ডালা, ঝুড়ি, ফুলদানি, এ্যাসট্রে অনেক কিছু। পুলিশ অফিসার ভদ্রলোক হাতে তুলে নিয়ে দেখতে লাগলেন। বললেন তিনি—ভারী সুন্দর……এবার পুলিশ অফিসারটি দুঃস্থ জনগণ যারা বাশের কাজ করছিলো তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন–তোমরা এর পূর্বে কি করতে?

একজন জবাব দিলো–হুজুর ভিক্ষা করতাম কিন্তু দ্যাশের অবস্থা খারাব, ভিক্ষা আর দেয় না কেউ, তাই না খাইয়্যা মরতি বস্যাছিনু–ভাগ্যিস এই কাজ পাইছি, তা না অইলে ছ্যালা মাইয়া নিয়া এতদিন কবরখানায় যাওন লাগতো।

অপর একজনকে জিজ্ঞাসা করলেন পুলিশ অফিসার–তুমি কি করতে?

আমি, আমি ভিক্ষা করতে পারিনা হুজুর। আগে জমি জায়গা ছিলো চাষ আবাদ করেছি কিন্তু দ্যাশ ডুইব্যা যাওয়ায় কাজের লাইগ্যা আইস্যা ছিলাম কিন্তু দ্যাশে কাম কই হুজুর, কত জায়গায় কাম খুঁজলাম কোথাও কাম পাইল্যাম না। পাঁচটি ছ্যালা মাইয়া নিয়া মরতে বইস্যাছিনু শুনতি পাইল্যাছিনু শুনতি পাইলাম হাজরা গায়ে একটা সমিতি খুলছে দ্যাশের ছেলে, তাই শুইন্যা আইস্যা ছিলাম। হুজুর আপনারে কি কমু, এহন খাইতে পাই বৌ ছ্যালেরে খাইতে দিতে পারি। ঐতো আমার বৌ হুজুর এহানে আমার বৌও কাম করে।

একটা রুগ্ন মেয়েমানুষ ঘোমটা টেনে দিয়ে ছালাম করে পুলিশ অফিসারটিকে।

 তারপর শিরীন পুলিশ অফিসারটিকে নিয়ে যায় যে কক্ষে কাঠের কাজ হচ্ছিলো সেখানে।

বহুলোক কাঠের জিনিস তৈরি করছে। কেউ আর বসে নেই। বহু চেয়ার টেবিল বেঞ্চ ইত্যাদি সুন্দর সুন্দর কাঠের জিনিস থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। পুলিশ অফিসার সব দেখে সন্তুষ্ট হলেন এবং বললেন—দুঃস্থ জনগণকে এভাবে কাজে লাগিয়ে আপনারা যে মহত্ত্বের পরিচয় দিয়েছেন সেজন্য আমি আপনাদেরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

পুলিশ অফিসারের কথা শুনে ইকরাম আলীর দু’চোখ আগুন ঠিকরে বের হতে লাগলো। সে পুলিশ অফিসারকে নিয়ে এসেছে গ্রামের কয়েকজন ছেলেকে শায়েস্তা করার জন্য কিন্তু পুলিশ অফিসার স্বয়ং সমিতির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠলেন, এটা একেবারে অসহ্য ব্যাপার।

ইকরাম আলী রাগেক্ষোভে ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো।

পুলিশ অফিসার বললেন–আপনারা সমিতি প্রতিষ্ঠা করে খুব ভাল কাজ করেছে। এমন প্রতিষ্ঠান আমাদের গ্রামে গ্রামে, শহরে বন্দরে হওয়া উচিত। সত্যি আপনারা প্রশংসার যোগ্য।

শিরীন বললো–স্যার, আসলে মখলেছুর ভাই ও তার সঙ্গীরা এই সমিতি গড়ে তুলেছে। আমরা মেয়েরাও তাদের সহযোগিতা করেছি মাত্র। আর একজন আর একজন আমাদের বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে উৎসাহিত করেছে, সে হলো….ইকরাম আলীকে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। উনার বাড়ির চাকর মালেক মিয়া।

বিস্ময়ে দু’চোখ কপালে তুলে বলেন পুলিশ অফিসার ভদ্রলোক–ইকরাম আলী সাহেব, আপনার বাড়ির চাকর সে পর্যন্ত এই সমিতির কাজে সহায়তা করেছে, অথচ আপনি কিনা সমিতির বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়েছেন। বুঝতে পারছি না একটা সৎ মহৎ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আনপরা এত অভিযোগ কেন?

পুলিশ অফিসার সমিতি থেকে কিছু বেতের এবং বাঁশের সুন্দর সুন্দর জিনিস কিনে নিয়ে বিদায় গ্রহণ করলেন। তিনি বিদায়কালে ইকরাম আলীকে সালামটাও করলেন না।

*

ইকরাম আলীর ধমনিতে যেন আগুন জ্বলে উঠলো, সে বাড়ি ফিরেই ডেকে পাঠালো মালেক মিয়াকে।

মালেক মিয়া কিন্তু সমিতির পাশে পাশেই ছিলো এতক্ষণ। সে সবকিছু লক্ষ্য করছিলো দূর থেকে। পুলিশ অফিসার চলে যেতেই শিরীনের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো এবং এতক্ষণ তাদের মধ্যে কি কথাবার্তা হচ্ছিলো সব শুনে নিয়েছিলো।

বাড়ির উঠানে পা দিতেই হাঁকালো ইকরাম আলী–মালেক শোন।

 আসছি মালিক। বলে এসে দাঁড়ালো মালেক মিয়া।

ইকরাম আলী ক্রুদ্ধভাবে হুঙ্কার ছাড়লো–তুই নিজে বলেছিলি ওদের কোনো সহযোগিতা করছিস না, তবে যে বললোর।

কে কি বললো মালিক, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

তা পারবি কেন? শয়তানি করার জায়গা পাচ্ছনা–ঐ সমিতি নাকি তোমার পরামর্শেই ওরা করেছে?

সে কি মালিক, আমি হলাম মূর্খ মানুষ, আমি পরামর্শ দেবো সমিতি করার–বলেন কি মালিক!

তবে যে সমিতির একটি মেয়ে বললো?

বললো, হয়তো পুলিশ দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে মালিক। ভেবেছিলো আপনার বাড়ির চাকরের কথা বললে……

চুপ কর, বল্ কি পরামর্শ তুই দিয়েছিলি?

পরামর্শ আমি নিজেই জানি না, পরামর্শ দেবো এখনকার শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের মালিক, ওদের কারও কথা শুনবেন না। ওরা যা ভাল মনে করেছে তাই করুক, আপনি নিজের চিন্তা করেন।

জানিস তোকে কেন বের করে দেই না?

জানি মালিক, ডাকাতের ভয়ে।

হাঁ, শুধু ঐ ডাকাতের উপদ্রবে আমি তোক তাড়াতে পারছি না, নাহলে কবে বের করে দিতাম..

মালিক, তাহলে থাকবো না চলে যাবো?

থাকবি নাতো যাবি কোথায়? শোন, ভাল করে পাহারা দিবি যেন রাতে ডাকাত বেটা সোজা এসে হাজির না হয়। তোরা কেউ জানিস না সে আমার কি সর্বনাশটাই না করেছে আমাকে সে ফকির বানিয়ে ছেড়েছে।

মালেক বলে উঠে–একবার যদি ওকে পাই আমি, মাথাটা ওর নিয়ে তবে ছাড়বো।

হাঁ, প্রস্তুত থাকবি? আচ্ছা মালেক বলতে পারি, ঐ মখলেছুরের দল সমিতি করার জন্য এত টাকা পেলো কোথায়?

টাকা। মালিক, লোকে বলে উদ্দেশ্য যার মহৎ খোদা তার সহায়। হয়তো তাই কোনো অভাব হচ্ছে না…

কিন্তু আসলে তা নয়।

 তবে কি মালিক?

 ওরা গোপনে লুটতরাজ করছে।

না মালিক, লুটতরাজ করতে পারে না।

সেদিন ইউনুস ব্যাপারীর একনৌকা চাল লুট করে নিলো আর তুই বলছি কিনা তারা লুট করে না।

ওটা ঠিক লুট নয় মালিক, মানুষ লুট করে গোড়পনে আর তারা সবার সামনে নৌকা আটক করেছিলো, তারপর নৌকার চাল তারা নিজেরা একমুঠো কেউ নেয়নি, গরিব–দুঃখীদের মধ্যে বিতরণ করে দিয়েছে, আর বাকিটা হাটে বিক্রি করে সেই টাকায় সমিতি খুলেছে। মালিক, আপনি কিছু সাহায্য করুন, নামও হবে নেকিও হবে।

অমন নাম আমি চাই না, তুই যা, এখন বকবক করিস না।

আচ্ছা যাচ্ছি মালিক।

শোন, হবি মোল্লাকে একটু সন্ধ্যার পর ডেকে আনবি, বুঝলি?

আচ্ছা।

চলে যায় মালেক মিয়া নিজের ঘরে। সন্ধ্যার অন্ধকার এখনও ঘনীভূত হয়ে আসেনি, মালেক মিয়া ঘরে প্রবেশ করে দাড়িগোঁফ খুলে ফেলে, জানে সে এখন কেউ আসবে না সেখানে।

হঠাৎ দরজায় মৃদু পদশব্দ শোনা গেলো।

মালেক দ্রুত চাদরখানা টেনে নিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। পাশে এসে দাঁড়ালো গোলাপী, চাপাকণ্ঠে ডাকলোমালেক ভাই!

বল। চাদরের তলা থেকে জবাব দিলো মালেক মিয়া। ভাবছে হঠাৎ যদি গোলাপী চাদর সরিয়ে ফেলে তাহলে কোনোরকমে আত্মগোপন করা সহজ হবে না। চাদরখানা সে আরও এটে ধরে রাখলো।

গোলাপী বললো–মালেক ভাই, আমি আর পারছি না। আমাকে নিয়ে চলো সেখানে, যেখানে সে আছে।

তার তো আমি ঠিকানা জানি না, তোমাকে কোথায় নিয়ে যাবো?

মালেক ভাই, সে বলেছিলো আমি আবার আসবো। কই, এলোনা তো? আমি যে তার প্রতীক্ষায় প্রহর গুণছি। মালেক ভাই, উঠো, ভাল করে কথা বলল আমার সঙ্গে।

বড় অসুস্থ লাগছে আমার। তুমি এখন যাও…আমি একটু ঘুমাবো……

 তোমার কি মাথা ধরেছে, আমি একটু হাত বুলিয়ে দিই।

না, দরকার হবে না গোলাপী।

যেতে বললেও আমি যাবো না, কারণ জানো ঐ পাগলটা আমার পিছু নিয়েছে। আমি আর পারছি না……বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এলো গোলাপীর গলা।

মালেক মিয়া ভীষণ বিপদে পড়লো–এ মুহূর্তে তার মুখে দাড়িগোঁফ কিছু নেই–হঠাৎ যদি তার আসল রূপ ধরা পড়ে যায় তাহলে গোলাপীর কাছ থেকে নিজকে সে কিছুতেই সরিয়ে নিতে পারবে না…না, তা হয় না, গোলাপীর কাছে সে কিছুতেই ধরা দেবে না। বললো–গোলাপী, আমার বড্ড ঘুম পাচ্ছে–তুমি যাও, কেমন?

গোলাপী তবু মালেকের মাথায় হাত স্পর্শ করে বললো–দেখি তোমার জ্বর আসেনি তো?

না। মালেক মিয়ার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠলো, কত দয়া গোলাপীর, এতটুকু স্নেহ ভালবাসার কাঙ্গাল সে।

গোলাপী বেরিয়ে গেলো, একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো মালেক মিয়া।

*

অনেক রাত।

সমিতির কক্ষে বসে বসে আলোচনা চলছিলো–মখলেছুর, ঠান্ডা, শাহীনুর, সুজা, জোবায়েদ ও আরও দু’তিনজন ছেলে। সেদিন শহর থেকে ইকরাম আলী হবি মোল্লাকে পাঠিয়ে পুলিশ অফিসার ও দুজন পুলিশ আনিয়েছিলো, যেন পুলিশ এসে তাদের সমিতি নষ্ট করে দেয় এবং তাদেরকে লুটতরাজের নাম করে গ্রেপ্তার করে, কিন্তু পুলিশ মহলের লোক সমিতি দর্শন করে খুশি হয়েছেন।

এসব নিয়েই আলোচনা চলছিলো, এমন সময় হঠাৎ দরজা খুলে যায়, সমিতি কক্ষে প্রবেশ করে এক জমকালো মূর্তি, হাতে তার পিস্তল।

মখলেছুর ও তার সঙ্গীরা ভীতভাবে উঠে দাঁড়ায়, বলে উঠে মখলেছুর কে তুমি, কি চাও?

জমকালো মূর্তির মুখের অর্ধেক ঢাকা ছিলো কালো রুমালে, বললো সে গম্ভীর কণ্ঠে–আমি ডাকাত।

ডাকাত! কম্পিত গলায় উচ্চারণ করলো ঠান্ডা। তার দলবলও ভয়বিহ্বল গলায় বললো– ডাকাত

ডাকাত তখন শান্তকণ্ঠে বললো–ভয় নেই, আমি তোমাদের কাছে কিছু নিতে আসিনি, দিতে এসেছি,

দিতে এসেছো? বললো মখলেছুর।

ডাকাত বললো–হাঁ, আজ তোমরা কেন শাহানশা গ্রামে গিয়েছিলে অর্থের প্রয়োজনে নয় কি?

হাঁ, তুমি সেকথা জানলে কি করে? বললো ইকবাল।

ডাকাত বললো–জানি, আমি সব খবর জানি। যাক, বেশিক্ষণ দেরী করতে পারবো না। এই নাও টাকা কাল ব্যাঙ্কে গিয়ে সমিতির ফান্ডে রেখে আসবে। প্রয়োজনমত খরচ করবে, কোনোদিন সমিতি নষ্ট করো না। শোনো, যখনই সমিতির জন্য অর্থের প্রয়োজন মনে করবে তখনই পাবে……টাকার বান্ডিলগুলো পকেট থেকে বের করে টেবিলে রাখলো।

মখলেছুর ও তার দলবলের দু’চোখে বিস্ময়, এত টাকা তারা একযোগে কোনোদিন দেখেনি। তাছাড়া ডাকাত সে নিজে এসেছে তাদের সমিতির জন্য টাকা দিতে, কি অদ্ভুত কান্ড!

মখলেছুরের দলের কারও মুখে কোনো কথা নেই, সবাই যেন আড়ষ্ট হয়ে গেছে।

ততক্ষণে বেরিয়ে গেছে জমকালো মূর্তি।

মখলেছুর বেরিয়ে আসে পিছনে পিছনে, কিন্তু জমাট অন্ধকারে কাউকে সে দেখতে পায় না।

মখলেছুর ফিরে আসতেই ঠান্ডা বলে উঠলো–আশ্চর্য মখলেছুর ভাই, ডাকাত নিজে এসে সমিতির জন্য এত টাকা দিয়ে গেলো।

শুধু আশ্চর্য নয়, বিস্ময়ভরা কান্ড–ডাকাত টাকা দিয়ে গেলো, এটা স্বপ্ন নয় তো? কথাটা বললো সুজা।

জোবায়েদ বললো–নিশ্চয় এই ডাকাতই আমাদের সমিতি দালানে পরিণত করার জন্য গোপনে চুন, সিমেন্ট, ইট, বালি দিয়েছে।

ঠিক বলেছিস শাহীনুর, এবার আমরা বুঝতে পেরেছি কে ঐ সব জিনিস আমাদের সমিতির জন্য পাঠাতো। কথাটা বললো ইকবাল।

ঠান্ডা বললো–আর বিলম্ব করা উচিত নয়। টাকাগুলো তাড়াতাড়ি ভালভাবে উঠিয়ে রাখা দরকার। টাকাগুলো আমাদের সমিতির দুঃস্থ জনগণের ভাগ্যেই এসেছে, কাজেই বলতে হবে খোদার রহমত।

হাঁ, ঠিক, তা না হলে ডাকাত আসে কেড়ে নিতে, ডাকাত যে দিয়ে যায় তাতো জানতাম না। নে, তাড়াতাড়ি টাকাগুলো উঠিয়ে রাখা হক, নাহলে ডাকাতের উপর ডাকাত আছে ইকরাম আলী, সে যদি জানতে পারে তাহলে সর্বনাশ হবে। কথাগুলো বলে মখলেছুর টাকাগুলো তুলে রাখার জন্য প্রস্তুত হলো।

*

পরদিন ভোর বেলা মখলেছুর এসে হাজির হলো মালেক মিয়ার কাছে। মালেক মিয়া তখন গরুগুলোকে গোয়াল থেকে বের করে ঘাস খেতে দিচ্ছিলো।

মখলেছুরকে দেখে বললো মালেক মিয়া–মখলেছুর ভাই যে, কি খবর?

এসো কথা আছে তোমার সঙ্গে। বললো মখলেছুর।

মালেক মিয়া গরুকে ঘাস খেতে দিয়ে বললো– চলো।

ইকরাম আলীর বাড়ির অদূরে একটা গাছের নিচে এসে দাঁড়ালো মালেক মিয়া আর মখলেছুর। ততক্ষণে আরও কয়েকজন যুবক এসে পড়েছে তারা হলো ঠান্ডা, শাহীনুর, জোবায়েদ। মখলেছুরকে লক্ষ করে বললোমালেক মিয়া বলো কি খবর?

খবর অতি শুভ মালেক ভাই। আমাদের আর কোনো চিন্তা নেই। সমিতি আমরা দালানে পরিণত করতে পারবো এবং আমাদের সমিতির কাজে যেসব জিনিসপত্রের অভাব ছিলো তা এবার পূরণ হবে।

এসব কি বলছো মখলেছুর, হঠাৎ যে একেবারে…..

 হাঁ, একেবারে মূলধন পেয়ে গেছি।

 ব্যাপার কি বল?

 ডাকাত……

 ডাকাত, বলো কি মখলেছুর ভাই!

হাঁ, ডাকাত এসেছিলো গত রাতে……

 সর্বনাশ, তাহলে সব নিয়ে গেছে……

 নিয়ে না, দিয়ে গেছে।

এ তুমি কি বলছো?

হাঁ, সত্যি ডাকাত আমাদের সমিতিতে এসে বহু টাকা সমিতির জন্য দিয়ে গেছে।

 একি অদ্ভুত কথা বলছো মখলেছুর ভাই?

অদ্ভুত হলেও সত্য। এত টাকা সমিতিকক্ষে রাখা ঠিক নয়, তাই আমরা তোমার কাছে এসেছি পরামর্শ নিতে।

মালেক মিয়া চিন্তিতভাবে মাথা চুলকে বলে–হাঁ, ও টাকা সমিতিকক্ষে রাখা মোটেই উচিত হবে না। তোমরা বেশি জানাজানি না করে শহরে গিয়ে ব্যাঙ্কে রেখে এসো এবং যখন যা সমিতির কাজে প্রয়োজন ব্যাঙ্ক থেকে তুলে এনে খরচ করো।

ঠান্ডা বলে উঠলো–ডাকাত টাকা দিয়ে গেছে, আবার আজ রাতে হানা দিয়ে নিয়ে যাবে না তাই বা কেমন করে বলবে। হয়তো আজ রাতে এসে টাকা ফেরতও চাইতে পারে।

হেসে বললো মালেক মিয়া–যা দিয়ে গেছে তা ফেরত নিতে আসবে কে তোমাদের এমন কথা বললো? জানোনা, ডাকাত হলেও তার মন প্রাণ হৃদয় আছে–সেও মানুষ, কাজেই মানুষ হয়ে অমানুষী কাজ সে করবে না।

কি জানি ভয় হচ্ছে, যদি কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে সে টাকাগুলো দিয়ে গিয়ে থাকে? বললো শাহীনুর।

না, ভয়ের কোনো কারণ নেই, বরং সে তোমাদের সমিতিকে সাহায্য করতে পেরে নিজকে ধন্য মনে করেছে……কথাগুলো বলে মালেক মিয়া বললো–যাই, এখন অনেক কাজ আছে। হাঁ, আর একটা কথা শোনো। তোমরা গ্রামে যমন কাজ করছে তেমনি শহরেও করতে হবে। শহরের পথেঘাটে অগণিত মানুষকে আমি উলঙ্গ দেখেছি–দেখেছি জীবন্ত কঙ্কালের মত এক একটা মানুষ, যারা ক্ষুধার জ্বালায় ধুকে ধুকে মরছে।

মালেক ভাই, শহরে যারা আছে তারাই শহরে দুর্গত মানুষদের জন্য ভাববে, আমরা গ্রাম থেকে গিয়ে কতটুকু করতে পারবো, বলো?

করতে হবে মখলেছুর ভাই, তোমরা যেমন গ্রামাঞ্চলে দেশ গড়ার কাজে এগিয়ে এসেছে, তেমনি শহরে–বন্দরে সব জায়গায় এগিয়ে যেতে হবে। দেশ তোমাদের শুধু এই হাজরা গ্রামটিই নয়, সমস্ত পৃথিবী তোমাদের দেশ। মখলেছুর ভাই, মনে করো শহরের দুঃস্থ অসহায় মানুষগুলোকে বাঁচানোর দায়িত্বও তোমাদের কাছে। অবশ্য শহরের যুবসমাজের কর্তব্য এটা, তবু যদি তোমরা গিয়ে কাজ করো। তোমাদের দেখেই শিখবে তারা। জানো, শহরে কত মানুষ আজ খেতে না পেয়ে পথের ধারে পড়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে–অচিরে এদের বাঁচাবার জন্য সচেষ্ট হওয়া দরকার, কিন্তু……না, এখন থাক, পরে বলবো।

চলে যায় মালেক মিয়া।

মখলেছুর নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে মালেকের চলে যাওয়া পথের দিকে। অস্ফুট কণ্ঠে বলে–একটা মূর্খ মানুষ মালেক ভাই, তার মধ্যে কত জ্ঞান।

ওরা সেখান থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। আজই তাদের শহরে যেতে হবে।

মালেক ফিরে আসে, নিজের কাজে মনোযোগ দেয় সে। কাজ শেষ করে ফিরে আসে ঘরে। বৈঠকখানার পাশেই তার ঘরখানা। বিছানায় বসে গামছায় হাওয়া খেতে থাকে। হঠাৎ তার কানে ভেসে আসে পাশের ঘর যেটা ইকরাম আলীর বৈঠকখানা, সেইঘর থেকে হবিমোল্লার গলা।

হবিমোল্লা বলে আপনি নিজে যান আলী সাহেব, কাজ ভাল হবে। আপনি যেখানে যেতে পারবেন আমি কি পারবে সেখানে যেতে? তাছাড়া আপনি এ গ্রামের হর্তা–কর্তা–বিধাতা, আপনি গিয়ে সব বুঝিয়ে বলুন।

আমিই যাবো, তাহলে তোমাকে ডাকলাম কেন? তুমি বড্ড অকেজো।

যা বলেন আলী সাহেব। জানেন তো লেখাপড়া বেশি জানি না, কার সঙ্গে কেমন করে কথা বলতে হয় তেমন করে বলতে পারি না। হর্তাকর্তারা যদি ইংরেজি বলে তখন আমি সম্পূর্ণ হাবা বনে যাই……তাই বলছিলাম কি, যদি পারেন তবে আপনি নিজে চলে যান। গিয়ে বলুন সব কথা। কয়েকটি ছেলে মিলে গ্রামে যা–তা শুরু করে দিয়েছে……।

তোমাকে আর শেখাতে হবে না, আমি যদি যাই তবে কি বলতে হয় জানি। হাঁ, দেখে নেবো ছোকরার দল আমাকে কি করে। শয়তানরা পুলিশকে হাত করে নিলো, আমাকে অপমান করলো।

শুধু ছেলেরাই নয়, আপনার বাড়ির চাকর বেটাও আছে ওদের দলে। প্রায়ই দেখি ওদের সঙ্গে মালেক মিয়া কথা বলছে।

কি করবো বলো তো? ওর উপর আমার কম রাগ নেই। মনে হয় এক্ষুণি তাড়িয়ে দেই, কিন্তু তাড়াতে পারছি না। বুড়ো হলেও ওকে দেখলে কেউ বুড়ো বলতে পারবে না। যা দরাজ চেহারা, মনে হয় ও একাই সাত জোয়ানের বল রাখে। যা ডাকাতের উপদ্রব শুরু হয়েছে, মালেককে দেখলে সাহস হয়……

আপনি শুধু শুধু ওর প্রশংসা করছেন সেদিন ও সঙ্গে ছিলো, তবু তো ডাকাত আপনার সর্বস্ব নিয়ে গেলো?

তা সহ্য হবি তা সত্য কিন্তু কেন যেন ওকে তাড়াতে পারছি না। হবি, টাকাগুলো হারিয়ে আমি দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম, ঐ মালেক আমার মনে সান্ত্বনা যুগিয়েছে। মূর্খ হলেও ওর মাথায় বুদ্ধি আছে। আমাকে ও বলেছিলো, মালিক, টাকার জন্য ভাববেন না। টাকা তো হাতের ময়লা, এই গেলো আর এই আসবে। ধরুন যে মাল আবার আসছে ঐ মাল দেশের বাইরে পাচার করলেই পেয়ে যাচ্ছেন যা হারিয়েছেন তার দ্বিগুণ…… ভাবলাম, তাইতো, যা গিয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি উপার্জন করতে পারবো যদি সুযোগ আসে। হবি, ভাই আমি আফসোস করি না।

তাহলে চলে যান, শুধু সমিতি সম্বন্ধেই বলবেন না, বললেন আমাদের গ্রামে মোটা রিলিফ দরকার। তারপর……হা বুঝলেন কিনা।

ঠিক বুঝেছি।

আচ্ছা তাহলে আসি?

এসো।

মালেক মিয়া কান পেতে শুনছিলো কথাগুলো, এমন সময় গোলাপী এসে দাঁড়ায়–মালেক ভাই, তুমি এখানে আর আমি তোমাকে গোয়ালে খুঁজছিলাম! শোনো মালেক ভাই, কথা আছে তোমার সঙ্গে?

কথা, বেশ বলো?

 এখানে নয়।

 তবে কোথায়?

নদীর ধারে চলো।

কিন্তু এই অসময়ে?

চল, আমি কলসী নিয়ে পানি আনতে যাবো আর তুমি যাবে মাঠে গরু আনতে।

চলো।

 মালেক মিয়া উঠে দাঁড়ালো।

 বেরিয়ে গেলো গোলাপী।

নদীর তীরে এসে মিলিত হলো ওরা দু’জন। এখনও বেলা ডুবে যায়নি, সন্ধ্যার অন্ধকার ধীরে ধীরে পৃথিবীর বুকে নেমে আসছে। ঝাঁকে ঝাকে বুনো হাঁস উড়ে যাচ্ছে মাথার উপর দিয়ে।

ইরামতি নদী ভরে উঠেছে কানায় কানায়। কচুরিপানাগুলো তীরবেগে ছুটে চলেছে যেন দিশেহারা অজানার পথে।

বললো মালেক মিয়া বলো কেন ডেকেছিলে?

হাঁ বললো…শোনো মালেক ভাই, আজ অনেক কথা আছে তোমার সঙ্গে। আমি আর বাঁচতে চাই না, আমার জীবন আর রাখবো না, তোমাকে বলে রাখলাম যদি সে আসে বলো গোলাপী তোমাকেই ভালবেসেছিলো, তোমাকে কোনোদিন সে পাবে না জেনে মৃত্যুবরণ করেছে। বলল, বলো মালেক ভাই, বলবে আমার শেষ কথাগুলো তাকে।

গোলাপীর কথাগুলো মালেক মিয়ার হৃদয় সংস্পর্শ করে। সে নিশ্চুপ শুনে যাচ্ছিলো তার কথাগুলো। কি জবাব দেবে ভেবে পাচ্ছিলো না, এবার সে বললো–এ তুমি কি বলছো গোলাপী?

হাঁ, যা সত্যি তাই বলছি। মালেক ভাই, আমি জানি সে আর কোনোদিন আসবে না। আজ কতদিন হলো নিশ্চয় সে আসতো কিন্তু……না না পুরুষ মানুষ বড় নিষ্ঠুর, বড় হৃদয়হীন। জানো মালেক ভাই, আমি তাকে আমার সব কথা বলেছিলাম, তবু কই, তার তত এতটুকু দয়া হলো না? সে কি ইচ্ছা করলে আমার মত একজন অসহায়া মেয়েকে রক্ষা করতে পারতো না? বলল, বলল মালেক ভাই? অমন নিশ্চুপ থেকো না, কথা বলো?

গোলাপীর কোমল মুখখানা তার হৃদয়ে দারুণভাবে আঘাত করলো, বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললো– গোলাপী তুমি তাকে ভুল বুঝছে, হয়তো তার কোনো বাধা আছে তাই সে তোমাকে গ্রহণ করতে পারেনি বা পারছে না।

না না, সে কথা সত্য নয়, আমি জানি আমার মন বলছে তার কোনো বাধা নেই। যাক, শোনো মালেক ভাই, আজ আমার এই শেষ কথা। যদি কোনোদিন সে আসে তবে দেখা হলে বলো আমার কথাগুলো……গোলাপী কলসী কাখে তুলে নিয়ে দ্রুত বাড়ির দিকে চলে যায়।

মালেক মিয়া কিছুক্ষণ আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর গরু নিয়ে ফিরে আসে বাড়িতে। বাড়ি ফিরে এলেও মনের মধ্যে তার ঝড় বইছে। গোলাপী কি সত্যিই কোনো অঘটন ঘটিয়ে বসবে? না না, তা হতে দেবে না মালেক মিয়া। একটা সুন্দর নিষ্পাপ জীবন এভাবে বিনষ্ট হতে দেবে না সে, কিন্তু কি করে ওকে বাঁচানো যায়?

*

গভীর রাত।

বাড়ির দরজার আড়ালে বসে লক্ষ্য রেখেছিলো মালেক মিয়া কেউ যদি রাতে এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে, তাহলে তার দৃষ্টি যেন এড়াতে না পারে। বসে বসে ভাবছিলো মালেক মিয়া, আপাততঃ যেমন করে থোক বাঁচাতে হবে গোলাপীকে। হঠাৎ যদি সে আত্মহত্যা করে বসে তাহলে তার জন্য দায়ী হবে সে, কারণ সে জানে গোলাপী নিজের অজান্তে কাকে ভালবেসেছে, কাকে সে চায়…

হঠাৎ দরজার ওপাশে শব্দ হলো, দরজা খুলে বেরিয়ে এলো ঘোমটায় আবৃত এক নারীমূর্তি।

 মালেক মিয়া সরে দাঁড়ালো।

জমাট অন্ধকারে এদিক ওদিক তাকিয়ে দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে চললো নারীমূর্তি সোজা নদীর দিকে।

মালেক মিয়াও পিছু অনুসরণ করলো।

আকাশে মেঘ করে এসেছে।

মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। নারীমূর্তি অন্য কেউ নয় গোলাপী বুঝতে বাকি রইলো না মালেক মিয়ার। সেও আত্মগোপন করে দ্রুত এগিয়ে চললো।

ক্ষেতের মধ্য দিয়ে, আইলের উপর দিয়ে চলেছে গোলাপী, কখনও হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছে আইলের ধারে।

দূর থেকে মালেক মিয়া ওকে অনুসরণ করে চলেছে।

বৃষ্টি না থাকলেও মেঘের গর্জনের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিলো। সেই আলোতে স্পষ্ট সব দেখতে পাচ্ছিলো গোলাপী। সে জানে না একজন তাকে অনুসরণ করছে। গোলাপী আজ ভুলে গেছে তার অভিশপ্ত জীবনের কথা ভুলে গেলো তার শ্বশুর–শাশুড়ি আর বোবা–কাল–পাগল স্বামীর কথা, ভুলে গেছে বৃদ্ধ মালেক ভাইয়ের কথা। এ মুহূর্তে সে শুধু ভাবছে ঐ একটি মানুষের কথা, সেই একটি মুখ ভাসছে তার চোখের সামনে। সেই শান্ত গম্ভীর স্থির কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি। গোলাপী তাকে ভালবেসে ফেলেছিলো মনপ্রাণ দিয়ে, কিন্তু সে বুঝতে পেরেছে ও কোনোদিন আর আসবে না, তাই সে আত্মহত্যা করবে তার প্রতিচ্ছবি বুকে নিয়ে……

নদীর তীরে এসে দাঁড়ালো গোলাপী।

শান্ত ইরামতি আজ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। মেঘের গর্জনের সঙ্গে গর্জন করে চলেছে। ইরামতীর পানি। অন্ধকারে কচুরিপানাগুলোকে ইরামতির বুকে ভয়ংকর লাগছে।

গোলাপী নদীর কিনারে এসে দাঁড়ায়। এখন তার মাথায় ঘোমটা নেই। চুলগুলো ছড়িয়ে আছে পিঠে কাঁধে। আঁচলখানা বাতাসে পত পত করে উড়ছে। বিদ্যুতের আলোতে তাকে অদ্ভুত এক নারী বলে মনে হচ্ছে।

ঠিক তার পিছনে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে বনহুর। এ মুহূর্তে তার মুখে দাড়িগোঁফ কিছু নেই। বলিষ্ঠ বাহু দুটি বাড়িয়ে আছে সে গোলাপীর দিকে।

গোলাপী দু’হাতে মুখ ঢেকে ঝাঁপিয়ে পড়লো ইরামতির বুকে, কিন্তু নদী বক্ষে পড়ে যাবার পূর্বেই দুটি বাহু তাকে ধরে ফেললো।

গোলাপী চমকে উঠলো, বললো–কে? কে তুমি আমাকে ধরলে? মালেক ভাই…….ফিরে তাকাতেই বিদ্যুৎ চমকে উঠলো, সঙ্গে সঙ্গে গোলাপী অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলো–তুমি….তুমি এসেছে।

হাঁ হাঁ গোলাপী, আমি এসেছি……কিন্তু কেন তুমি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলে, বলো তো?

 গোলাপী বনহুরের বুকে মুখ গুঁজে বলে–শুধু তোমাকে না পেয়ে।

ছিঃ ছিঃ তুমি যা করতে যাচ্ছিলে তা বড় মন্দ কাজ গোলাপী……

জানি, কিন্তু এ ছাড়া আমার কোনো উপায় ছিলো না। জানো তো আমার জীবন কত বিপন্ন। কিসের জন্য আমি বাঁচবো, কোন্ আশা নিয়ে আমি বাঁচবো বলো?

কিন্তু আত্মহত্যা করা যে মহাপাপ তা তো জানো?

জানি।

তবু তুমি……

হাঁ, তোমাকে না পেলে আমি কিছুতেই বাঁচবো না। বলল কি করে তুমি বুঝতে পারলে, আর কেমন করেই বা তুমি এলে?

মালেক মিয়ার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, সেই বলেছে তোমার কথা। সে–ই তো দেখিয়ে দিলো নদীর পথ।

আশ্চর্য, মালেক ভাই তাহলে জানতো আমি নদীর দিকে এসেছি?

হয়তো জানতো, নাহলে সে কি করে বললো তুমি নদীর দিকে এসেছে।

কিন্তু এত রাতে তুমি কোথা থেকে এলে?

সে অনেক কথা…পরে বলব, চলো তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।

 আর তুমি?

 চলে যাবো।

না, তা হয় না, তুমি আমাকে নিয়ে চলো।

 কোথায়?

যেখানে তুমি থাকো।

তাকি সম্ভব গোলাপী?

 কেন সম্ভব নয়?

জানো বাড়িতে আমার কে কে আছে, জানলে তুমি এ কথা বলতে না।

আমি তোমার কোনো কথা শুনতে চাই না। তবে কেন আমাকে মরতে দিলে না?

 বসো, শান্ত হও, আমি কয়েকটা কথা বলবো তোমাকে।

কিন্তু আমাকে তুমি ছেড়ে চলে যেতে পারবে না। তুমি একদিন বলেছিলে আমি যাকে চাইবো তাকেই তুমি এনে দেবে কিংবা আমাকে তুলে দেবে তার হাতে?

হাঁ, বলেছিলাম।

যদি তুমি সত্যি করে বলে থাকো, তবে শোনো আমি তোমাকে পাবো বলে বেঁচে আছি আর বেঁচে থাকবো।

গোলাপী শোনো আমি যা বলি……

গোলাপী ওর নরম হাতখানা তুলে চাপা দেয় বনহুরের মুখে–না না, কোনো কথা আমি শুনতে চাই না। আমার এ পৃথিবীতে কেউ নেই–কেউ নেই…..

বনহুরের বলা হয় না কোনো কথা, সে নিশ্চুপ ভেবে চলে, এ মুহূর্তে গোলাপী, কোনো কথা না বলাই ভাল। হয়তো হিতে বিপরীত হবে। এখন সে সম্পূর্ণ উন্মাদিনীর মত হয়ে উঠেছে। প্রাণের উপর তার কোনো মায়া–মমতা, নেই। এখন সে যে কোনো সময় আত্মহত্যা করতে পারে। সব সময় তো ওকে পাহারা দিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। ওকে রক্ষা করা তার কর্তব্য আর রক্ষা করতে হলে চাই ধৈর্য। অসীম ধৈর্য সহকারে গোলাপীর সঙ্গে তাকে অভিনয় করে যেতে হবে, যতদিন না তার মন সংযত হয়।

মনকে স্থির করে নিলো বনহুর। এখনও তার বুকে মুখ লুকিয়ে রেখেছে গোলাপী বিদ্যুত চমকাচ্ছে। সেই আলোতে দেখলো বনহুর গোলাপীর অশ্রুসিক্ত মুখখানা, বললো–বেশ, তুমি যা চাও পাবে–চলো এবার..

বনহুর গোলাপীসহ পা বাড়ায় বাড়ির দিকে। বলে গোলাপী–আবার কখন কবে দেখা হবে তোমার সঙ্গে?

যখন তুমি মনে করবে আমার কথা।

সত্যি বলছো?

কিন্তু…

হাঁ।

কোনো কিন্তু নেই, যখন আমাকে দেখতে ইচ্ছে করবে তখন তোমার মালেক ভাইকে বলে সে আমাকে জানাবে।

উঃ! কি আনন্দ হচ্ছে আমার! সত্যি আমি তোমাকে পাবো?

বনহুর নীরব।

আরও কিছুক্ষণ চলার পর বললো বনহুর–এবার যাও।

আর তুমি?

আমিও ফিরে যাবো আমার গন্তব্যস্থানে। যাও গোলাপী

 গোলাপী কম্পিত পায়ে অন্তঃপুরের দিকে পা বাড়ায়।

*

মালেক, তুই যাবি আমার সঙ্গে?

কোথায়?

শহরে।

আমি চাকর আর আপনি মালিক, কেন যাবো না?

 তবে তৈরি হয়ে নে।

 কিন্তু আজ যদি আবার ডাকাত হামলা চালায়?

না চালাবে না।

আপনি জানেন মালিক? তবে সেদিন কেন জানলেন না ডাকাত আসবে?

সে তুই বুঝবি না, যা গাড়ি বের করগে।

মালেক মিয়া চলে যায়।

গাড়ি বের করে নিয়ে গরুর গলায় দড়ি পরাচ্ছিলো, ঠিক ঐ সময় গোলাপী এসে দাঁড়ায়, এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নিয়ে বলে–মালেক ভাই….

কে গোলাপী? ফিরে তাকায় মালেক মিয়া। হাসিখুশিভরা একখানা মুখ, আনন্দ উজ্জ্বল দুটি চোখ। বলে সে–মালেক ভাই, তুমি শহরে যাচ্ছো?

হ। কথাটা বলে মালেক মিয়া সোজা হয়ে দাঁড়ায়, এ বাড়িতে আসার পর গোলাপীর এমন হাসিভরা মুখ মালেক মিয়া কোনোদিন দেখেনি। আজ নতুন একরূপে দেখলো সে ওকে। বললো মালেক মিয়া–কিছু আনতে হবে নাকি তোমার জন্য?

ব্যথারুণ হয়ে উঠলো গোলাপীর মুখখানা, বললো সে–পয়সা কোথায় পাবো যে তোমাকে কিছু আনতে দেবো?

তা পয়সার জন্য ভাবতে হবে না, বলো কি দরকার তোমার?

চাপা গলায় বললো গোলাপী–এক শিশি আলতা আনবে আমার জন্য, পরে তোমাকে পয়সা। দিয়ে দেবো।

তা হবে আর কি নেবে বলো?

 আর কিছু না, শুধু এক শিশি আলতা।

 বেশ আনবো।

গোলাপী চলে যায়, হাসে মালেক মিয়া–ম্লান–করুণ সে হাসি।

এমন সময় ইকরাম আলী এসে দাঁড়ায়–কি মালেক, হলো?

 হাঁ, হয়েছে আমার।

গাড়িতে তোষক তুলেছিস?

সব তুলেছি মালিক, এবার আপনি উঠুন।

ইকরাম আলী গাড়িতে উঠে বসলো।

মালেক মিয়া গাড়িতে গরু জুড়ে গিলো, তারপর সেও উঠে বসলো গাড়ির সম্মুখভাগে।

শহরের পথ ধরে এগিয়ে চললো গাড়িখানা। আজ মালেকের বুকটা অনেকখানি হালকা মনে হচ্ছে, কারণ গোলাপীর মুখে সে হাসি দেখতে পেয়েছে। আহা বেচারী গোলাপী কত অসহায়, কিন্তু…….

হঠাৎ মালেকের চিন্তাজাল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো, বললো ইকরাম আলী–মালেক দেশে প্লাবন এসেছে জানিস?

জানি মালিক, প্লাবন শুধু নদী-নালা-গ্রামে-গঞ্জে নয়, প্লাবন এসেছে সমস্ত দেশে। কিসের প্লাবন জানেন মালিক–অন্যায় অনাচার আর দুর্নীতির প্লাবন……

[পরবর্তী বই জীবন্ত কঙ্কাল]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *