০৩. ছুটির দিন

০৩.

পরের দিনটা ছুটির দিন।

ত্রিপুরারির সঙ্গে বেড়াতে বেরুব আগেই স্থির ছিল। ও একটা গাড়ির ব্যবস্থাও করে রেখেছে।

কিন্তু মিথ্যের খেসারত এত সহজে মেটে না। ত্রিপুরারির বেরুবার কোনো উদ্যোগ বা লক্ষণ নেই। জিজ্ঞাসা করতে রায় দিল, এই শরীর নিয়ে বেরিয়ে কাজ নেই, আরো দু’চারদিন বিশ্রাম করে নাও। আছ তো এখন, তাড়া কি–

বিরক্তিকর। গত দু-দিনের অচলাবস্থা কোনরকমে বরদাস্ত করা গেছে, তার ওপর আজও এই কথা। প্রবল প্রতিবাদের আশ্রয় গ্রহণ ছাড়া গতি নেই। বললাম, যথেষ্ট বিশ্রাম নেওয়া হয়েছে, আর বিশ্রামে কাজ নেই। আর বিশ্রাম করতে বললে আমি একাই বেরিয়ে পড়ব বলে দিলাম। তাছাড়া খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপার তো নেই, মোটরে ঘুরব–কিছু ক্ষতি হবে না। তোমার ছুটি তো আবার সেই সাত দিন পরে।

ত্রিপুরারি অনিচ্ছার কারণ দর্শালো, কিন্তু বউ যে বারণ করে দিল, অসুস্থ মানুষকে নিয়ে বেরুতে হবে না, বন্ধুকে শুয়ে ঘুমুতে বলল।

অগত্যা ওর সুপারিশ না করে ত্রিপুরারি-গৃহিণী সকাশে উপস্থিত আমি। যুক্ত হস্তে নিবেদন করলাম, বাংলা দেশের মেয়ে স্বামীর বন্ধুর প্রতি অকরুণ হয়েছে এমন নজির বড় চোখে পড়েনি, বন্ধুটি আপনাকে যত নিরীহ মনে করে ঠিক ততটাই আপনি নন বলে আমার ধারণা। দয়া করে আপনি ওর মাথায় কিছু ঢোকাবেন না, আর আরো একটু দয়া করে তরতাজা সুস্থ মানুষ দুটোকে একটু চরে বেড়াবার অনুমতি দেবেন, এই প্রার্থনা।

লজ্জা পেয়ে ত্রিপুরারি-গিন্নি হাসতে লাগল। আমি সেটাই ছাড়পত্র ধরে নিয়ে ফিরে এলাম। আর তারপর সন্দেহের উদ্রেক না করে ওকেও রাজি করানো গেল। যদিই দরকার হয় এজন্যে সঙ্গে দরকারী ওষুধ-পত্র নিতে পরামর্শ দিল ত্রিপুরারি।

সম্মেলনের অতিথিদের কাছের বা দূরের দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখবার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু সেই আনুষ্ঠানিক দেখার মধ্যে নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়া আদৌ সম্ভব হয় না। দেখার তাড়াতেই সেই দেখার পর্ব শেষ হয়ে থাকে। ওই আনুষ্ঠানিক দেখার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করিনি। কারণ আমার এখানে থেকে যাওয়ার বা এখানকার এই দেখার পিছনে উদ্দেশ্য কিছু আছেই। এই দেখার সঙ্গে একটা মানসিক যোগ স্থাপন করাই বিশেষ উদ্দেশ্য।

প্রথম দর্শনে জায়গাটা যে ভালো লেগেছিল তার প্রধান কারণ সম্ভবত সাবরমতী। সাবরমতীর নীলাভ জল। শহরের মাঝখান দিয়ে সাবরমতীর ধারা দেখতে দেখতে মনটা কখনো সুদূর অতীতে উধাও হয়েছে, কখনো বা সদ্য বর্তমানে ঘোরা-ফেরা করেছে। আর ছোট বড় এত সেতু-বন্ধ দেখে দেখে ভিতরে ভিতরে কি এক সেতু রচনার প্রচ্ছন্ন উদ্দীপনা উঁকি-ঝুঁকি দিয়েছে।

লিখব কিছু। কিন্তু কি লিখব সেটা নিজের কাছেও স্পষ্ট নয়। একটুও। ঘুরতে ঘুরতে কখনো ইতিহাস চোখ টেনেছে, কখনো বা সদ্যগত অতীত। এই দেখার মধ্যে আজকের বর্তমানটি শুধু একপাশে সরে দাঁড়িয়ে আছে। এই বর্তমানটাকে সাবরমতী যেন আমারই মতো দেখছে চেয়ে চেয়ে। না, আমার মতও নয়, আমার থেকেও শান্ত নির্লিপ্ত।

সাবরমতীর দু-ধারের এই জন-জীবনের কূল স্থাপন সুদূর অতীতের কাহিনী। প্রায় সাড়ে বারশ’ বছর আগের এই অরণ্য অঞ্চল ছিল। ভীলদের দখলে। ভীলপ্রধান আসা ভাল–তার নামে জায়গার নাম আসাওয়ল। তখন থেকে সারবতী এখানকার মানুষদের কৃষি বাণিজ্য শিখিয়েছে–সমৃদ্ধির আসন বিছিয়ে বসতে শিখিয়েছে!

এর পর মুসলমান কালের ইতিহাস। স্মরণীয় ইতিহাস নয়, কিছুটা রক্তপাতের ইতিহাস, কিছুটা বা ভাস্কর্য-শিল্পের ইতিহাস। গুজরাট-শাসক মজফফরের বিদ্রোহী পুত্র দুর্ধর্ষ তাতার খা পিতাকে বন্দী করেছিল এই আসাওয়লে। তারপর দোর্দণ্ডপ্রতাপে রাজ সিংহাসনে বসেছিল তাতার খাঁ।

কিন্তু ক্ষমতা-অন্ধ নবীন বিদ্রোহী জানত না, মৃত্যু হাসছিল তার পিছনে দাঁড়িয়ে। তার হিসেবের সঙ্গে ওপরঅলার হিসেব মেলেনি। ওই সিংহাসন তখন আসলে প্রস্তুত মজফফর-পৌত্র আহমদ শাহকে গ্রহণ করার জন্য। তারই কাছে রক্তের বিনিময়ে নতিস্বীকার করবে প্রতিবেশী রাজপুত আর মালবরাজ–আহমদ শাহ প্রতিষ্ঠিত করবে স্বাধীন গুজরাট–পরের ইতিহাসের এই বিধিলিপি।

কিন্তু বিধিলিপিরও পরমায়ু আছে। ষোল শতকে গুজরাটের ভাগ্যবিধাতা বদলেছে। মোগল-রাজ আকবরের ভ্রূকুটি-শাসনগত হয়েছে এই দেশ। আর জাহাঙ্গীরের সময়ে গুজরাটের এই অঞ্চল দেখেছে রমণীর শাসন। ভাবতে ভালো লাগছে, একটি নয়, এই শহরের ওপর দিয়ে দুটি প্রতিস্পর্ধী রমণীর লীলাধারা উচ্ছল হয়ে উঠেছিল সেদিন। এক রমণী নদী সাবরমতী–দ্বিতীয় রমণী জাহাঙ্গীর মহিষী নূরজাহান ….লিখতে বসে হঠাৎ প্রতিস্পর্ধী শব্দটাই কলমে এলো কেন জানি না। এই দুই রমণীর যৌবনধারায় কতটা মিল ছিল সেদিন আর কতটা অমিল, কল্পনা করতে ইচ্ছে করে।

আঠারো শতকের মাঝামাঝি আবার ক্ষমতা-বদলের পালা। সমগ্র গুজরাট নয়, গুজরাটের এই অঞ্চলটি তখন মারাঠা-শক্তি করতলগত। আর উনিশ শতকের গোড়ায় ইংরেজের।

ইংরেজের!

 যে ইংরেজ এখান থেকে নড়বে বলে কেউ ভাবেনি।

কিন্তু ঠিক একশো বছর বাদে এই ইংরেজের পাকা ভিত ভাঙার সাধনায় এখানে আসন পেতে বসল আর একজন। দেশ তার কানে। মন্ত্র দিল, তুমি জাতির জনক, জাতিকে বাঁচাও।

মহাত্মা গান্ধী। সাবরমতীর কূলে একদিন দেখা দিল তার আশ্রম। জাতীয় আন্দোলনের পীঠস্থান।

এই ইতিহাস আর এই অতীতের মধ্যে গত কদিন ধরেই বিচরণ করছিলাম আমি। আজও।

মন্দির-মসজিদের রাজ্য থেকে যখন শাহীবাগে এলাম, তখনো বিকেল ঘন হয়নি। মেঘলা দিন, খাওয়া-দাওয়ার খানিক পরেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম।

সম্রাট শাহাজানের শাহীবাস। একান্ত নিরিবিলি জায়গা। আগে আরো নিরিবিলি ছিল শুনলাম। শাহীবাগের নামোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে দুটো প্রাসাদ ভেসে উঠবে চোখের সামনে। প্রবাদ অনুযায়ী এক প্রাসাদের সঙ্গে আর এক প্রাসাদের যোগ দুইয়ের মাঝের ভূগর্ভের সুড়ঙ্গপথে। এই নির্জনে এসে দাঁড়ালে দু-কান আপনা থেকে উৎকর্ণ হতে চায় কেন?

পাগলা মেহের আলীর গর্জন কানে আসবে–তফাৎ যাও, সব ঝুট হ্যায়?

ইংরেজ আমলে এখানে চাকরি করতে আসে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তখন এই শাহীবাগ ছিল তার বাসভবন। বিলেত যাবার পথে সে সময়ে এই প্রাসাদে অবস্থান করেছিল রবীন্দ্রনাথ। ক্ষুধিত পাষাণের পটভূমি সেই শাহীবাগ প্রাসাদ!

আশ্চর্য! সে কোন্ যুগের কথা। সাতাশিটা বছর পার হয়েছে মাঝে। মাত্র আঠারো বছর বয়স তখন রবি ঠাকুরের। তার চিন্তার রাজ্যে সেই তখন জন্মগ্রহণ করেছে পাগল মেহের আলীর কণ্ঠস্বর। আজও সেটা তেমনি অটুট তাজা।

তফাৎ যাও! সব ঝুট হায়!

নিবিষ্ট মনে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। মন দিয়ে দেখছিলাম, চোখ দিয়ে দেখছিলাম, কান দিয়ে দেখছিলাম। এই তন্ময়তার ফাঁকে ত্রিপুরারি কখন সরে গিয়ে কোন্ জায়গায় বসে গেছে, খেয়াল করিনি। হঠাৎ সব কটা ধমনীর সবটুকু রক্ত একসঙ্গে নাড়া খেল বুঝি। বিষম চমকে ঘুরে দাঁড়ালাম।

–তফাৎ যাও! সব ঝুট হায়!

না, পাগলা মেহের আলীর বুক-কাঁপানো গলা নয়। রমণীর কণ্ঠস্বর।

হঠাৎ এমন এক অকল্পিত বৈচিত্র্যের ধাক্কায় আমার মুখে কথা সরল না খানিকক্ষণ। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছি। রমণীর কণ্ঠস্বর না, রমণীই বটে।

দু’হাতের মধ্যে দাঁড়িয়ে হাসছে মুখ টিপে।

যশোমতী পাঠক। সহাস্যে যুক্তকরে নমস্কার জানালো।

আমার অবস্থা দেখে মহিলা আরো একটু জোরে হাসতে হুশ ফিরল যেন। ওদিক থেকে হন্তদন্ত হয়ে ত্রিপুরারি ছুটে এলো। অদূরে আমাদের গাড়িটার পাশে মস্ত আর একখানা ঝকঝকে গাড়ি দাঁড়িয়ে।

ত্রিপুরারিকে দেখে হোক, অথবা প্রায়-অপরিচিত একজনের কাছে এই লঘু বিস্ময় সৃষ্টির দরুন হোক, উৎফুল্ল হাসিটুকু মহিলা আর বাড়তে দিল না। ফলে, সপ্রতিভ হাসির আভাসটুকু সমস্ত মুখময় ছড়িয়ে থাকল। সবিনয়ে বলল, আপনি খুব মন দিয়ে দেখছিলেন। চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটালাম বোধহয়।

ত্রিপুরারি খুব হাসি-হাসি মুখে আমার দিকে চেয়ে আছে। পারলে আমার হয়ে সে-ই মাথা নেড়ে দেয়। চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটুক না ঘটুক, মহিলার এই অপ্রত্যাশিত আবির্ভাবে বিব্রত বোধ করছি। কেন, সে শুধু আমিই জানি। যুক্তকরে আনত হলাম, এবং ততোধিক বিনয়ে জবাব দিলাম, ব্যাঘাত কিছু ঘটাননি।….আপনিও বেড়াতে বেরিয়েছিলেন নাকি?

হাসিমুখে মাথা নাড়ল। আমার মুখের ওপর দু’চোখ নড়াচড়া করল একটু। হাসিটুকু হালকা গাম্ভীর্যের পর্দায় ঢাকতে চেষ্টা করে বলল, আমি এসেছিলাম রোগী দেখতে। এসে শুনলাম, রোগী ভর দুপুরেই বেড়াতে বেরিয়ে পড়েছেন। তারপর সাবরমতীর ধারেও তাকে না দেখে ভাবলাম এখানেই আছেন।

ত্রিপুরারি হেসে মাথা নাড়ল, অর্থাৎ তার কত্রীর নির্ভুল ভাবনার তারিফ করল। আমার প্রচ্ছন্ন শঙ্কা ঠিক-ঠিক হাসি-চাপা দেওয়া গেছে কিনা বলতে পারব না। মহিলার পরের স্বাভাবিক প্রশ্নটা আরো অস্বস্তিকর। দু’চোখ তেমনি মুখের ওপর রেখেই জিজ্ঞাসা করল, এখন কেমন আছেন?

জবাব দেবার আগেই বিপাকে পড়ার ভয়ে ত্রিপুরারি ফস ফস করে বলে উঠল, খুব ভালো না, তবু কিছুতে বাড়িতে রাখা গেল না, বেরিয়ে তবে ছাড়ল।

যশোমতী বলল, ভালো করেছেন, আমি তো ভালই দেখছি এখন, কাল আপনি ঘাবড়ে দিয়েছিলেন প্রায়। এই উক্তি ত্রিপুরারির উদ্দেশে। তারপর আমার দিকে ফিরে আবার বলল, ডাক্তারবাবু অবশ্য দেখে গিয়ে জানিয়েছেন তেমন কিছু হয়নি, তবু কালই আসা উচিত ছিল আমার, গেস্টরা ছিলেন বলে হয়ে উঠল না। আজ চারটের গাড়িতে শেষ গেস্ট বিদায় নেবার পর কর্তব্য করতে বেরিয়েছিলাম। আপনি এত ভালো আছেন দেখে অবশ্যই আরো বেশি খুশি হয়েছি।

হাসিমুখের এই আন্তরিক কথাগুলো কানে কেন যেন খুব সরল ঠেকল না। কেবলই মনে হল, মহিলা বুদ্ধিমতী, এই সাদাসিধে উক্তির পিছনে কিছু একটা কৌতুক প্রচ্ছন্ন। অবশ্য, শারীরিক অসুস্থতার মিথ্যাচার প্রসঙ্গে নিজে আমি সচেতন বলেও এ-রকম মনে হতে পারে।

দু’চার কথার ফাঁকে আরো খানিকক্ষণ শাহীবাগ দেখা হল! যশোমতী জিজ্ঞাসা করল, এর ওপর লিখবেন নাকি?

–ভাবিনি কিছু….

ঠোঁটের ফাঁকে সকৌতুক হাসি দেখা গেল আবার। বলল, এখানে এসে সব লেখকই খুব ইন্সপায়ার্ড হয়ে শাহবাগ দেখেন, দিনের পর দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটান এখানে, মনে হয় ফিরে গিয়েই বড় গোছের কিছু একটা লিখে ফেলবেন। কিন্তু শেষে ক্ষুধিত পাষাণের ভয়েই আর কিছু লেখেন না বোধহয়।

অযোগ্যতার খোঁচা কিনা বোঝা গেল না। মন্তব্য করলাম, ক্ষুধিত পাষাণের পর লেখা তত খুব সহজ নয়।

স্বীকার করে নিয়ে তক্ষুনি মাথা নাড়ল।–তা বটে।

ফেরার সময় মহিলা তার গাড়িতে ওঠার জন্য আপ্যায়ন করল। কোনরকম আপত্তি করার অবকাশ না দিয়ে ত্রিপুরারিকে লল, আপনি আপনার গাড়ি নিয়ে চলে যান, আপাতত একে আমার বাড়িতে ধরে নিয়ে যাচ্ছি।

নিজে বাড়ি বয়ে দেখতে এসেছিল, তারপরে সাবরমতীর ধারে খোঁজাখুজি করে এই পর্যন্ত এসেছে–আমার আপত্তির যথার্থ কোনো কারণ নেই আর। তাছাড়া এই রমণীসঙ্গ অবাঞ্ছিত নয়। কিন্তু ত্রিপুরারিও আপত্তি করল না দেখে ভিতরে ভিতরে অস্বস্তি বোধ করলাম একটু। অসুখের ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ক ক্ষতি নেই, কিন্তু তার গুরুত্বও না এরপর ফিকে হয়ে যায়।

তাই মৃদু দ্বিধা প্রকাশ করলাম, আজ থাক না, আর একটু তাজা হয়ে পরে না হয় একদিন যাব’খন। আছি তো এখন দিন কতক।

মুখের দিকে দুই এক পলক চেয়ে থেকে যশোমতী জিজ্ঞাসা করল, কেন, শরীরটা এখনো তেমন ভালো লাগছে না?

প্রশ্নটা নয়, চোখের চাপা হাসিটা আমাকে বিব্রত করেছে। তাড়াতাড়ি জবাব দিয়ে বাঁচার চেষ্টা, বললাম, না, শরীর এখন ভালই আছে।

–তবে আর কি, আসুন। আর কথা না বাড়িয়ে নিজের হাতে গাড়ির দরজা খুলে দিল।

অতঃপর বিনা বাধায় আমাকে উঠে বসতে দেখে ত্রিপুরারিরই দায় বাচল যেন। গাড়ি ছাড়তে ও-পাশের দরজার কোণে ঠেস দিয়ে মহিলা হাসিমুখে বলল, আপিন এখানে আসছেন শোনার পর থেকেই আপনার সঙ্গে আলাপ করার বিশেষ ইচ্ছে ছিল। এ ক’দিনের মধ্যে হয়েই উঠল না….কিন্তু সেজন্যে আমার থেকেও ঘোষবাবু বেশি দায়ী–তিনি আমাকে বললেন, বন্ধু আমার ঘরের লোক, তার জন্য আপনাকে একটুও ব্যস্ত হতে হবে না, আপনি এদিকের অভ্যাগতদের দিকে মন দিন।

এ আবার কোন ধরনের উক্তি! মহিলার ঠোঁটের ফাঁকে সহজ মিষ্টি হাসিটুকু লেগে আছে। কিন্তু আমার ঘেমে ওঠার দাখিল। একটু আগে ত্রিপুরারির সামনে মহিলার আচরণে বা মুখের সামান্য। হাসিতে যে কৌতুক প্রচ্ছন্ন মনে হয়েছিল, এখন সেটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠার আশঙ্কা। জবাব না দিয়ে বোকার মতো আমি তার কথার অর্থ বুঝতে চেষ্টা করলাম যেন।

গাড়িতে বসার শিথিল ভঙ্গিটুকুও চুরি করে দেখার মতই লোভনীয়। কিন্তু এর পরের উক্তি কোনদিকে গড়াবে আপাতত সেই সশঙ্ক প্রতীক্ষা আমার। যশোমতী বলল, গান শুনে সেদিন আপনি প্রশংসা করে গেলেন, কি লজ্জা, এত লোকের মধ্যে আমি ঠিক। খেয়ালই করতে পারলাম না–একদিন তো মাত্র দেখেছিলাম। পরে মনে হয়েছে। তার ওপর আবার ঘোষবাবুর কথায় পড়ে নিজে গিয়ে নেমন্তন্ন করলাম না, আমার ভদ্ৰতাজ্ঞান আর অতিথিপরায়ণতার বহর দেখে আপনি তো একেবারে অসুখই বাঁধিয়ে বসলেন। খুব লজ্জা পেয়েছি।

সুবিনয়িণী যথার্থই লজ্জা কতটুকু পেয়েছে জানি না, কিন্তু গাড়ি থামালে আমি বোধহয় পালিয়ে বাঁচতুম। যে মহিলা কোটি কোটি টাকার ব্যবসা চালাচ্ছে, কটন চেম্বারের প্রেসিডেন্ট হয়েছে তার বুদ্ধির প্রতি আমার খুব যে অনাস্থা ছিল তা নয়। শুধু এমন এক রমণীর এই সুচারু হৃদয়ের দিকটাই আমি হিসেবের মধ্যে আনিনি। অসুখ শুনে ব্যস্ত হয়ে বাড়িতে ডাক্তার পাঠাবে, আর তারপর ফাঁক পেয়েই স্বয়ং রোগী দেখতে চলে আসবে–এ সম্ভাবনার কথা কে ভেবেছিল।

এই পরিস্থিতিতে যে কাজ সব থেকে সহজ এবং শোভন আমি তাই করলাম। আরো আগেই যা করা উচিত ছিল। হাসতে চেষ্টা করলাম আর তারপরে হাতজোড় করে বললাম, আমি একটি মূখের মতো কাজ করেছি, অপরাধ নেবেন না।

–কি আশ্চর্য, মহিলা হেসে উঠল, অপরাধ তো আমার, আপনার রাগ করাই তো স্বাভাবিক–কি ভেবেছিলেন বলুন তো, এ রকম অভ্যর্থনা জুটবে জানলে কলকাতা ছেড়ে আসতেন না বোধহয়?

এমন সঙ্কটে এই মুখের দিকে চেয়ে এই চোখে চোখ রেখে জবাব দেওয়া যে কত কঠিন, তা মর্মে মর্মে অনুভব করেছি। মিথ্যার খোলস আগেই ছেড়েছি, এবারে গোটাগুটি সমর্পণ ভিন্ন গতি নেই। বললাম, দেখুন, এখানে আসার সঙ্গে সঙ্গে ত্রিপুরারির মুখে, আর আরো দু চারজন বাঙালীর মুখে আপনার এতবড় পরিচয় পেয়েছি যে মনে মনে বোধহয় হিংসেই হয়েছিল। আর সেজন্যেই হয়তো নিজের ঠুনকো আত্মসম্মানের দিকটা মাথা উঁচিয়ে উঠেছিল। ভেবেছিলাম, ত্রিপুরারি আপনার কর্মচারী বলেই তার অন্তরঙ্গ বন্ধুকে আপনি অবহেলার চোখে দেখলেন।

মহিলার সমস্ত মুখখানাই কমনীয় হাসিতে ভরে উঠছিল এবার। কিন্তু শেষের কথায় লজ্জা পেয়ে বলে উঠল, ছি, ছি, ঘোষবাবু আমাদের আপনার লোক, তাকে আমি বন্ধু মনে করি। কিন্তু আপনার একটুও অন্যায় হয়নি, আপনি উচিত শিক্ষাই দিয়েছেন। আপনার বই টইগুলো আমার পড়া আছে যখন এ-রকম ভুল করা আমার উচিত হয়নি। বলতে বলতে আবারও হেসে উঠল।

যুক্ত করে করে বললাম, আর লজ্জা দেবেন না।

তক্ষুনি তরল জবাব দিল, দেব, যদি না আপনি আমার ভুল সংশোধন করার সুযোগ দেন। দিন সাতেক অন্তত এখন আপনি খুব লক্ষ্মী ছেলের মতো আমার গেস্ট হয়ে থাকুন তো। চিন্তা নেই, বাড়ি গিয়েই আমি টেলিফোনে ঘোষবাবুকে জানিয়ে দিচ্ছি আপনি দিনকতক এখন ফিরছেন না।

অস্বীকার করব না, এই নতুন জায়গা, নতুন জায়গার মানুষেরা, এই সাবরমতী গত কদিন ধরে আমাকে যত না আকৃষ্ট করেছে, স্বল্প আলাপে সূচ্যগ্রবুদ্ধি এই সুদর্শন মহিলা আমাকে তার থেকে অনেক বেশি টেনেছে। অন্তরঙ্গ আমন্ত্রণও লোভনীয় মনে হয়েছে তাই। কোনো অবিবাহিত রমণীর পক্ষে এ-ধরনের দ্বিধাশূন্য আমন্ত্রণ সঙ্গত কিনা, সে সমস্যা মনে কোণেও উঁকিঝুঁকি দেয় নি।

তবু অভ্যাসগত ভব্যতার দিক আছে একটা। বললাম, এতখানি অপরাধের পরেও আমার ভাগ্য প্রসন্নই ধরে নিলাম।….কিন্তু আজ থাক, পরে আপনার আতিথ্য সানন্দে মাথা পেতে নেব।

মহিলা সহজ আন্তরিকতায় মাথা নাড়ল। বলল, উহ, আজই, মানে আজকের থেকেই। আসলে আপনি লজ্জা পাচ্ছেন। রাজি না হলে আমার হাতে অস্ত্র আছে–ঘোষবাবুর কাছে আপনার অসুখের কথা ফাঁস করে দেব। তাঁর এখনো ধারণা আর একটু হলেই অসুখটা আপনার বেশ খারাপের দিকে গড়াতে। কালও বলছিলেন সে কথা।

এরপর সানন্দে এবং শশব্যস্তে বশ্যতা স্বীকার। বললাম, ওর স্ত্রীর হাতে প্রায় ধরা পড়েছি, তার ওপর আপনার এই অস্ত্র ঘাড়ে পড়লে এ-জায়গা ছেড়েই পালাতে হবে আমাকে।

যশোমতী পাঠক খুশি হয়ে হাসতে লাগল। আলাপ আরো সহজতর করার চেষ্টা আমার। বললাম, খুব খুশি-চিত্তে আপনাকে ইচ্ছেমত অতিথি-সৎকারের সুযোগ দিতে রাজি, কিন্তু আমার দিক থেকেও সামান্য একটুখানি শর্ত থাকবে।

রমণীমুখের চকিত কারুকার্য নয়নাভিরাম। সভয়ে বলে উঠল, কি শর্ত, আপনার গল্পের মেটিরিয়াল জোগাতে হবে না তো?–এমনিতেই তো আমাকে নিয়ে শহরে টি-টি।

ঠিক এই মুহূর্তেই, অর্থাৎ, এই উক্তির পরেই কি নিয়ে লিখব সে-চিন্তাটা আমার অবচেতন মন থেকে ঘুচে গেছল কিনা সঠিক বলতে পারব না। হয়তো তাই। কিন্তু মহিলার ওই কথা আর ওই হাসির সঙ্গে সঙ্গে নিজের মনের ভিতরটা তলিয়ে দেখার অবকাশ তখন ছিল না। হেসে জবাব দিলাম, এইটুকুর মধ্যে অত বড় লাভের দিকে হাত বাড়াতে সঙ্কোচ–আমি গান শোনার বায়না পেশ করতে যাচ্ছিলাম।

প্রসন্নবয়ানে মহিল। তৎক্ষণাৎ রাজি। বলল, এ আবার একটা শর্ত নাকি! সাহিত্যিককে গান শোনাব এ তো ভাগ্যের কথা, ভালো লাগলে যত খুশি শুনবেন।

মস্ত ফটকের ভিতর দিয়ে গাড়ি ঢুকে গেল। চারিদিকে পাঁচিল ঘেরা। সামনে লন্, পিছনে বাগান। বাড়ি না বলে প্রাসাদ বলা যেতে পারে। দূর থেকে আগেও একবার দেখেছিলাম। কিন্তু দূর থেকে ঠাওর হয় না।

না, এ-হেন আবাসে অতিথিকে ডেকে আনার ব্যাপারে রমণীরও সঙ্কোচের কারণ না থাকাই স্বাভাবিক। মহিলা সংসারী নয় বটে, কিন্তু তাকে কেন্দ্র করে এখানে অনেকগুলো সংসারের অস্তিত্ব অনুভব করা যায়। প্রাসাদ-সংলগ্ন হাল-ফ্যাশানের গেস্ট হাউস। ম্যানেজার, সেক্রেটারী, কেয়ারটেকার আর দাস-দাসী–সব মিলিয়ে এখানকার বাসিন্দার সংখ্যা কত, আজও সঠিক বলতে পারব না। বাড়ির পিছনদিকে একসারি পাকা সারভ্যান্টস্ লজ। সামনের দিকে গেস্ট হাউস, সার ওধারের একপাশ জুড়ে ম্যানেজার, সেক্রেটারী আর কেয়ারটেকারের আলাদা আলাদা কোয়ার্টার্স।

এরকম এক জায়গায় এসে পড়ে আমার প্রতি মুহূর্তে বিব্রত বোধ করার কথা। ত্রিপুরারির বউয়ের নীরব তদারকেই কত সময় বিব্রত বোধ করেছি। এখানে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালে দু’জন করে লোক দৌড়ে আসে–কিছু চাই কি না। অথচ চাওয়ার অপেক্ষায় যে এখানে থাকতে হয় না, সে বোধহয় ওরাও জানে। যে ব্যবস্থা তার ওপরেও কিছু চাইতে হলে গবেষণা করে বার করতে হবে। প্রথম আধঘণ্টা একঘণ্টা এই পরিবেশে নিজেকে ভয়ানক বেখাপ্পা লাগছিল বটে। কিন্তু আশ্চর্য, তারপরে সেভাবটা কেটে যেতে সময় লাগেনি।

ঐশ্বর্যপুরীই বটে, তবু অতটা সহজ নিঃসঙ্কোচ হতে পেরেছিলাম কি করে ভাবলে অবাক লাগে। পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে তো সাত দিন থাকতে হবে ভেবে উতলা হয়ে পড়েছিলাম। মনে হয়, ঐশ্বর্য এখানে সীমিত নয় বলেই সঙ্কোচ আপনই সরে গেছে। কৃত্রিম হ্রদকে বহু রকমে সাজিয়ে গুছিয়ে চোখ ঠিকরে দেওয়া যায়। কিন্তু সমুদ্রের আর এক রূপ। সমস্ত উচ্ছলতা নিয়েই সমাহিত রূপ তার। এও যেন অনেকটা তাই। প্রথমে তাক লাগে বটে, পরে মনে হয় ঐশ্বর্য এখানে ধ্যানে বসেছে। কোন রকম হঠাৎ-চমক নেই, দৃষ্টিকে পীড়া দিয়ে ঈর্ষা জাগানোর ঠমক নেই। যা আছে, তা থাকলেই যেন মানায়।

নিজস্ব ঐশ্বর্য বলতে যশোমতী সাগ্রহে প্রথমে আমাকে যে জিনিসটি দেখাল, সেটা তার লাইব্রেরি। লাইব্রেরি অনেক দেখেছি, কিন্তু এত বড় অথচ এমন সুচারুশৃঙ্খলাবদ্ধ নিজস্ব পাঠাগার কমই চোখে পড়েছে। শুনলাম এটি তদারক করার জন্য একজন এক্সপার্ট লাইব্রেরিয়ানও আছে। বাংলা ছেড়ে বিশাল ইংরেজি সাহিত্যের ধারা নিয়েও কেউ যদি গবেষণা করতে চান, মনে হয় এখানে বসেই তিনি মোটামুটি রসদ পেয়ে যেতে পারেন।

লজ্জা পেলাম, যখন আধুনিক লেখকদের সারি থেকে যশোমতী হাসিমুখে আমার লেখা প্রতিটি বই টেনে টেনে দেখাতে লাগল কিন্তু প্রশংসার বদলে অনুযোগের সুরটাই স্পষ্ট করে তুলতে চেষ্টা করল। বলল, আপনার কোনো কোনো লেখা, বিশেষ করে ট্র্যাজেডি গুলো এত বেশি আপত্তিকর যে পড়তে পড়তে মনে হত আপনাকে সামনে পেলে তর্ক তো করবই, ঝগড়াও হয়ে যেতে পারে। অথচ এখন দেখুন কিছুই মনে পড়ছে না।

লেখক মাত্রেই প্রীত হবার কথা, আমিও ব্যতিক্রম নই। তবু বললাম, আমার লেখার ওইটেই বোধহয় বড় গুণ, পড়ার পর আর মনে রাখার বালাই থাকে না।

যশোমতী হেসে ফেলেও একটু জোর দিয়েই বলল, না, অতটা নিন্দে অবশ্য করছি না, কিন্তু বেশিরভাগই ট্র্যাজেডি লেখার দিকে আপনার অত ঝোঁক কেন? আর ট্রাজেডি নয় যেগুলো, তারও তলায় তলায় কিছু-না-কিছু ট্র্যাজিক এলিমেন্ট থাকবেই।

হেসে সমালোচনা যথার্থ মেনে নিয়েই জবাব দিলাম, আচ্ছা, আপনার খাতিরে একটা বই অন্তত পরের সংস্করণে অন্যরকম করে দিতে রাজি আছি–যে-কোনো একটা বইয়ের নাম করুন, বদলে স্ট্রেইট কমেডি করে দেব।

বিপদাপন্ন মুখশ্রী যশোমতীর। প্রায় হার মেনে মন্তব্য করল, আপনি আচ্ছা জব্দ করতে পারেন।

খুশি মুখে প্রসঙ্গ বদল করলাম, জিজ্ঞাসা করলাম, এত বই আপনি পড়ার সময় পান কখন?

–কেন, বই পড়েই তো সময় কাটাই কোন রকমে। আর কি কাজ?

–এত বড় একটা ব্যবসা চালাচ্ছেন–ত্রিপুরারিতে বলে আপনার মতো এতবড় ব্যবসা এখানে আর কারো নেই।

হেসে জবাব দিল, নিজের জিনিস সবাই বড় দেখে, ঘোষবাবুর তো কথাই নেই। তা ছাড়া ব্যবসা খুব বড় হয়ে গেলে আপনিই চলে। চালানোর একটা শো রাখতে হয় বটে, কিন্তু আসলে তেমন কিছু করতে হয় না।

ভালো লাগছিল। প্রতিটি কথা ভালো লাগছিল। হাসি ভালো লাগছিল। হাসির আভাসটুকুও ভালো লাগছিল।

শহর দেখার জন্য আর লেখার রসদ সংগ্রহের জন্য পরদিন থেকে ঝকঝকে একটা গাড়ি আমার হেপাজতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সাত দিন ছেড়ে বাকি পনেরো দিনই এখানে আমি অতিথি হয়ে ছিলাম। যশোমতী অনুরোধ করেছে। আমার যেটুকু সঙ্কোচ তা ত্রিপুরারির জন্য। ওর বউও ভাবতে পারে বড়লোকের আতিথ্য পেয়ে ওদের ভুলেছি। কিন্তু আপত্তি করা দূরে থাকুক, বরং সাগ্রহে সায় দিয়েছে। আড়ালে উৎসাহ দিয়েছে। ওখানেই থেকে যাও বন্ধু, অনেক মনের মতো মালমশলা পেয়ে যাবে–তাছাড়া আমার সঙ্গে দেখা তো রোজই হচ্ছে, বললে দু’বেলাই আসতে রাজি আছি। সাহিত্যিকের বন্ধু হলেও যে এত খাতির মেলে এ বাপু এই প্রথম জানলাম। গলা খাটো করে আর সেই সঙ্গে কনুইয়ের একটা গুতো দিয়ে আবার বলল, একটুও ঘাবড়াবার দরকার নেই, যা জানার ইচ্ছে শপাং করে মুখের ওপর জিজ্ঞাসা করে বসবে। তোমাকে দেখার আগে থেকেই তোমাকে পছন্দ যে হে, নইলে অত করে বলত না।

সকালের দিকে আমার হোস্টেসের অবকাশ কম। চায়ের টেবিলে দেখা হয়। তখনই যেটুকু কথাবার্তা হয়। তারপর সে কাজ নিয়ে বসে, আমি হয় গাড়ি নিয়ে বেরোই নয়তো লাইব্রেরিতে থাকি। এরপর দেখা হয় দুপুরে খাবার সময়। ফ্যাক্টরী থেকে এই সময় ঠিক ঘড়ি ধরে ফিরে আসে। আমার ধারণা ছিল এই রীতিতেই বুঝি অভ্যস্ত কত্রীটি। কিন্তু পরে একজন পরিচারকের মুখে শুনলাম তা নয়, বাড়িতে অতিথি আছে বলেই ফিরে আসে, নইলে তার দুপুরের খাবার ফ্যাক্টরীতেই নিয়ে যেতে হয়।

শুনে খুশি হয়েছি আবার সঙ্কোচও বোধ করছি। একটু এদিক ও-দিক হলেই অতিথি বিগড়ায় ভেবেই ভদ্রমহিলা কষ্ট করে আসে কিনা কে জানে। সেদিন বললাম, আপনি তো ফ্যাক্টরীতেই লাঞ্চ করেন শুনেছি, আমার জন্যেই কষ্ট করে আসতে হচ্ছে আপনাকে–এর কিছু দরকার নেই, যারা ছে তারা আদর যত্ন কম করছে না।

যশোমতী তক্ষুনি বলল, আপনি আমার ঘরের খবর নিতে গেছেন কেন? তরল কৌতুক-ভরা প্রসন্ন মুখ, আমার বার কতক শরত্যাবু পড়া আছে মশাই–সামনে বসে না খাওয়ালে আপনাদের মেজাজ ঠিক থাকে না।

দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে জবাব দিলাম, শরৎবাবুর যুগ গেছে, মেয়ের। বসে এখন শুধু বিষম খাওয়ায়।

চোখ পাকালো, মিথ্যে কথা, শরৎবাবুর যুগ যে একেবারে যায়নি সেটা আপনারও দুই একখানা বই থেকে প্রমাণ করে দিতে পারি।

গল্প জমে বিকেলে বা সন্ধ্যার পর। আমি সেই প্রতীক্ষায় থাকি। সেদিন গাড়ি নিয়ে বহুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ফেরার পর প্রথম সাক্ষাতে মহিলা জিজ্ঞাসা করল, আজ কি দেখলেন?

–বিশেষ কিছু না। ঘুরলাম শুধু।

 ঈষৎ কৌতুকে আবার প্রশ্ন করল, আপনি এখানকার কি নিয়ে লেখার কথা ভাবছেন?

–লিখবই যে এ আপনাকে কে বললে?

একটু অপ্রস্তুত হয়ে জবাব দিল, ঘোষবাবু বলছিলেন লেখার জন্যেই নাকি আপনি থেকে গেলেন এখানে, নইলে সাহিত্য অধিবেশন শেষ হলেই পালাতেন।

স্বীকার করলাম, বললাম, বাসনা সেই রকমই ছিল বটে। কিন্তু কি লিখব এখনো ঠিক করা হয়ে ওঠেনি। কখনো পুরাণ হাতড়ে বেড়াচ্ছি, কখনো ইতিহাস, কখনো বা এখানকার বিগত রাজনীতি। লেখা হয়তো শেষ পর্যন্ত হবেই না, কারণ ওগুলোর একটার ওপরেও নির্ভরযোগ্য দখল নেই।

মুখের দিকে চেয়ে থেকে যশোমতী হাসল মুখ টিপে-কেন বর্তমান পছন্দ হচ্ছে না?

আশায় আশায় বড় লোভনীয় বাসনার দিকেই বেপরোয়া হাত বাড়িয়ে ফেললাম। কনুইয়ে গুতো দিয়ে ত্রিপুরারি শপাং করে বলে বসার পরামর্শই দিয়েছিল। ওর কল্যাণে আর এখানকার প্রবাসী বাঙালী আলাপীদের সঙ্গে একটু অন্তরঙ্গ হয়ে ওঠার ফলে গল্পে গল্পে যে রসদের সন্ধান পেয়েছি, সেটা সত্যিই আরো কতগুণ লোভনীয় হয়ে উঠেছে এই ক’দিনে তা আর কে জানে?

বক্তব্যের ভূমিকাস্বরূপ ঘটা করে বড় নিঃশ্বাস ফেলতে হল একটা, বললাম, বর্তমান বড় কৃপণ, নিজেকে কেবল আগলে রাখে। ফলে কেউ তার সম্পর্কে বাড়িয়ে বলে কেউ কমিয়ে। সঠিক হদিস কেউ দিতে পারে না, লিখি কি করে বলুন?

মহিলা যথার্থ অবাক। আপনি কার কথা বলছেন?

আমি হাসতে লাগলাম। সেই হাসি থেকেই তক্ষুনি বুঝে নিল। আর সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত মুখে রক্ত-কণা ছোটাছুটি করতে লাগল যেন। তারপর সামলে নিয়ে দু’চোখ কপালে তুলে মুখের দিকে চেয়ে রইল খানিক। এই মতলব আপনার, অ্যাঁ? আপনি কোথায় কি শুনেছেন শুনি?

সরলতার একটা সহজ ফল আছেই। সবিনয়ে জানালাম, শোনার ব্যাপারে প্রথম সহায়তা আপনার কাছ থেকেই পেয়েছি, শাহীবাগ থেকে ফেরার পথে সেদিন আপনিই বলছিলেন, আপনাকে নিয়ে শহরে টি-টি।

মুখ থেকে লজ্জার আভা মিলাতে সময় লাগল। জিজ্ঞাসা করল, আর সেই শুনেই আপনি কি নিয়ে ঢি-ঢি খোঁজ-খবর করতে লেগে গেলেন?

মাথা নাড়লাম। তাই।

ঠোঁটের ফাঁকে হাসি চেপে চুপচাপ চেয়ে রইল একটু।–আমি এই শহরের একজন মহা গণ্যমান্য ব্যক্তি বেস কিছু লিখে ধরা পড়েছেন কি মানহানির কেস করব, খুব সাবধান।

আমি বিনয়াবনত আরো নির্দ্বিধায় আর এক ধাপ এগোলাম। –সেই জন্যেই তো আপনার সাহায্যপ্রার্থী।

লজ্জাগোপনের সুচারু প্রয়াস আবারও।– আপনি ভয়ানক লোক, আমি খাল কেটে কুমীর এনেছি।

কি একটা অছিলায় তখনকার মতো উঠে গেছে। খানিক বাদে গানের বায়না পেশ করতে সহজ আন্তরিকতায় সম্মতি-জ্ঞাপন করেছে। গান আগেও দু-তিন সন্ধ্যায় শুনেছি। কিন্তু এই দিনে সর্বরকমে ভাগ্য প্রসন্ন মনে হল। কারণ, মুখ বুজে বসে এই দিন গান আমাকে একা শুনতে হয়নি। দোসর পেয়েছিলাম। সব থেকে সুবাঞ্ছিত দোসর বোধ হয়….

বাইরে থেকে, অর্থাৎ ত্রিপুরারির মুখে এবং বাঙালী ভদ্রলোকদের রসালো জটলা থেকে যে রিপোর্ট পেয়েছিলাম, তাতে মনে মনে প্রতিদিনই এখানে আমি একজনকে আশা করেছি।

কিন্তু আমার আসার সঙ্গে তার আসাটা এ-পর্যন্ত বড় বেখাপ্পা রকমের অমিল হচ্ছিল।

সে শঙ্কর সারাভাই।

এই রাত্রিতেই তার সাক্ষাৎ মিলল।

যশোমতী পাঠক দু’চোখ বুজে গানে তন্ময় তখন। মেঝেতে পুরু গালচে, কারো আসা-যাওয়া টের পাবার কথা নয়, পেলও না। ভদ্রলোক এলো। আমার তন্ময়তার ছেদ পড়ল, নিভৃতের একটা অনুভূতি আনন্দে চঞ্চল হল। শঙ্কর সারাভাই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে গায়িকাকে দেখল একটু। তারপর দু’হাত জোড় করে আমার উদ্দেশে নমস্কার জানালো। তারপর তেমনি নিঃশব্দে পাশের আসনে বসল। সপ্রতিভ মুখের অল্প অল্প হাসিটুকু আজ আরো অনেক বেশি ভালো লাগল আমার।

গানের মাঝেই একটু বাদে চোখ মেলে তাকালো যশোমতী পাঠক। আমার পাশে দ্বিতীয় আগন্তুক দেখার ফলে গানের তাল কাটল না বটে, কিন্তু মুখে পলকের লালিমার ছোপ স্পষ্টতর হল বোধ করি। আমার দিকে তাকালো একবার। দু’চোখ বুজেই গাইতে লাগল আবার। শঙ্কর সারাভাই গান শুনছে কি তন্ময় হয়ে কিছু চিন্তা করছে বোঝা ভার। তার দু’চোখ অদূরের দেয়ালের ছবিটার দিকে। আমার ধারণা, যে সময়ে গান শেষ হতে পারত, তার থেকে কিছু’দেরিই হল।

তবু শেষ খানিক বাদে হলই। এরপরেও চোখ বুজে থাকা সম্ভব নয়। যশোমতী তাকালো। হাসল। নিজেই আগে কথা বলে প্রশংসা এবং আবার গানের অনুরোধ একসঙ্গে বাতিল করল হয়তো। আমাকে ইঙ্গিতে দেখিয়ে শঙ্কর সারাভাইয়ের উদ্দেশে প্রশ্ন করল, আলাপ আছে?

আমার দিকে চেয়ে শঙ্কর সারাভাই আর একদফা পরিচয়সূচক মাথা ঝাঁকালো। কিন্তু যশোমতী আমার নাম বলেনি বা পরিচয় দেয়নি। হাসিমুখে ভদ্রলোক সম্মুখবর্তিনীর দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করল তারপর। নিজেদের ভাষায় বলল, আলাপ হয়েছিল বোধহয়, তাছাড়া মাননীয় অতিথিকে নিয়ে তুমি খুব ব্যস্ত সেটা আগেই শুনেছি।

কেন জানি না, তাড়াতাড়ি নিজেকে নিরপরাধ প্রতিপন্ন করার চেষ্টা আমার। বললাম, ওনার ব্যস্ততার জন্য আমি নিজেই খুব লজ্জিত।

ঝুঁকে চলা আর মাথা ঝাঁকিয়ে কথা বলা ভদ্রলোকের স্বভাব বোধহয়। সানন্দে মাথা ঝাঁকালো। আপনার লজ্জার কিছুমাত্র কারণ নেই, ওঁর কাছে আপনারা প্রিভিলেজড, ক্লাস, লেখকদের সাত খুনও উনি মাপ করে দিতে পারেন–এ তো মাত্র একটা খুন।

ঘুরিয়ে বললে দাঁড়ায়, মহিলাকে ব্যস্ত রাখার দরুন সেই একটা মাত্র খুন যাকে করা হয়েছে সেই ব্যক্তিটি উনি। এত বড় ঘরটাকে সচকিত করে হা-হা শব্দে হেসে উঠল। জোরালো পুরুষ, জোরালো হাসি। এ-রকম এক হাসিতে স্বল্প পরিচয়ের সমস্ত সঙ্কোচ ধুয়ে মুছে যাবার মতা। হাসি মিলাতে সাগ্রহে মহিলাকে লক্ষ্য করছি আমি। সেই মুখে ছদ্ম ভ্রুকুটি।অত হাসার কি হল?

মুখখানা কঁচুমাচু করে ভদ্রলোক আমার দিকে ফিরল।-হাসি পেলে মেপে হাসা যায়, আপনি বলুন?

আমি মাথা নাড়লাম। যায় না।

যশোমতী পাঠক নিজেই হাসতে লাগল এবার। বলল, লেখককে আমি তোমার কাছে পাঠাব ভাবছিলাম, ভদ্রলোক বেশ মুশকিলে পড়েছেন। গল্পের প্লট খুজছেন–পাচ্ছেন না। হতাশ হয়ে দেশে ফেরার মতলব করছেন, তুমি দাও না কিছু ব্যবস্থা করে।

চোখ দিয়ে, কান দিয়ে, মন দিয়ে রসদ আমি নিজেই সংগ্রহ করেছি। শঙ্কর সারাভাইয়ের পরিচয় যশোমতী আমাকে দেয়নি। এটা যে ভুল তা আমার মনে হয়নি। কিন্তু ভদ্রলোককে যে আমি চিনি সেটা সে বুঝেছে। তবু কোনো রকম বিড়ম্বনা বা সঙ্কোচ দেখিনি। অতিথির হয়ে এই সুপারিশও খুব সাদাসিধেভাবেই করল। এর আড়ালে যে কৌতুক প্রচ্ছন্ন সে শুধু উপলব্ধির বস্তু। নির্লিপ্ত চোখে মুখে ওই কৌতুক চিকচিক করছে কিনা দেখার জন্য আমার অবাধ্য দৃষ্টি ওই মুখখানাকেই চড়াও করেছিল।

দু’চোখ বড় বড় করে প্রায় আমার মুখোমুখি ঘুরে বসল শঙ্কর সারাভাই।

–আপনার নামটা কি মিস্টার….?

 নাম যশোমতীই বলে দিল।

আরো একটু সহানুভূতি নিয়েই যেন শঙ্কর সারাভাই আমাকে নিরীক্ষণ করল। তারপর বলল, মহিলার অনুরোধ আমি সচরাচর রক্ষা করে থাকি। আমাদের দেশে এসে আপনি এরকম সমস্যায় পড়েছেন সাহায্য তো করাই উচিত। কিন্তু–আমি জমিজমার প্লট বুঝি, গল্পের প্লট—সে আবার কি?

জবাব দিলাম, খুব তফাৎ নেই, গল্পেরও তো কিছু জমি-জমা দরকার, নয়তো দাঁড়াবে কার ওপর?

হাসিমুখে যশোমতী পাঠক সেতারে রিন-রিন শব্দ করতে লাগল। ছদ্ম বিরক্ত মুখ করে শঙ্কর সারাভাই বাধা দিল, আঃ, ব্যাপারটা বুঝতে দাও ভালো করে। আবার আমার দিকে ফিরল, তা আপনার কি রকম প্লট চাই, নরম মাটির না শক্ত মাটির? আই মিন, ঠিক কোন্ রকম প্লটে কি ফসল ফলাতে চান না বুঝলে ব্যবস্থা করি কি করে?

জবাব দেওয়ার ফুরসৎ মিলল না। বেগতিক দেখে যশোমতী ধমকে উঠল তাকে, তোমাকে আর ব্যবস্থা করতে হবে না, থামো।

–দেখলেন? একেই বলে অস্থিরমতি রমণী-চিত্ত। শঙ্কর সারাভাইয়ের আর এক দফা সেই জোরালো হাসি।

গল্পে গল্পে রাত মন্দ হল না। আর রাত হওয়ার দরুন এক সময় এই আসর ভাঙল বলে ঘড়ি বস্তুটার ওপরেই রাগ হতে লাগল আমার। যাবার আগে আন্তরিক সৌজন্যে শঙ্কর সারাভাই তার বাড়িতে চায়ের নেমন্তন্ন করল আমাকে। যার খাতিরে এই আমন্ত্রণ তাকে কিছু বলল না দেখে ঈষৎ বিব্রত বোধ করেছি।

.

কিন্তু মহিলা নেমন্তন্নের ধার ধারে বলে মনে হল না। যথা দিনের যথাসময়ে যশোমতীই আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেল। শঙ্কর সারাভাই বাংলা বোঝে, বলতে পারে না। আমিও হিন্দী বুঝতে পারি, প্রকাশে বিভ্রাট। কিন্তু তা সত্ত্বেও হাসি-খুশির মধ্যেই সময়। কেটেছে। মনে হয়েছে, শঙ্কর সারাভাই তেমনি এক পুরুষ, অনায়াসে যে সমস্ত বাধা ডিঙিয়ে যেতে পারে। ভাষার অন্তরায় সেখানে তুচ্ছ।

লেখার প্রসঙ্গে মহিলাকে শুনিয়ে শুনিয়ে আমার হাত ঝাঁকুনি দিয়ে বলেছে, লিখুন তত মশাই, দুনিয়ার সব থেকে সেরা অকরুণ কোনো মহিলার গল্প লিখুন দেখি। সে-রকম গল্প দুনিয়ায় কেউ লিখেছে কিনা জানি না। যদি পারেন একটা মস্ত কাজ হবে, ব্যই বি কেয়ারফুল, পাথরের থেকেও শক্ত নারী-চরিত্র চাই- যে নিজের প্রতি অকরুণ, অন্যের প্রতি অকরুণ, অথচ সক্কলে তাকে করুণাময়ী ভাবছে।

রমণীর ভুরুর শাসন সত্ত্বেও হা-হা শব্দে সেই হাসিই হেসে উঠেছে শঙ্কর সারাভাই।

নিচের পাথরের ওপর উঁচু পাহাড়ী জলপ্রপাত ভেঙে পড়তে দেখেছি আমি। সেই আঘাতে পড়ন্ত জলের বেগকে ভীমগর্জনে শতধা হয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে একলক্ষ মুক্তার হাসির মত ছড়িয়ে পড়তে দেখেছি। কিন্তু সেদিন এই সরব হাসি দেখে মনে হয়েছিল, জলপ্রপাতের সেই দৃশ্যের সবটুকুই কি হাসি? সবটুকুই সুমহান বিশাল বটে, নিছক হাসি কি সবটুকু?

আরো দু’চার দিন এসে গল্প-গুজব করে গেছি ভদ্রলোকের সঙ্গে বসে। কি পেয়েছি বা কতটুকু পেয়েছি, সেটা সে-সময় খেয়াল করিনি। এদিকে অবকাশ সময়ে যশোমতীর সঙ্গে বসে গল্প তো করেইছি। আমাকে রসদ জোগানোর আগ্রহে সে একটা কথাও বলেনি কখনো। সহজ অন্তরঙ্গতায় সে তার বাবা, মা আর বড় দাদার গল্প করেছে, ব্যবসার গল্প করেছে, এমন কি কৌতূহল প্রকাশ করলে শঙ্কর সারাভাইয়ের বেপরোয়া স্বভাবের গল্পও করেছে। সেই গল্প করার মধ্যে কোন উচ্ছ্বাস ছিল না, কোনরকম আবেগের আতিশয্যও না। কিন্তু তবু আমি যেন কিছু একটা উদ্দেশ্যের মোহনার দিকে এগিয়ে যেতে পেরেছি। পেরেছি যে, সেটা পরের অনুভূতি। তখন উদ্দেশ্য ভুলে কান পেতে শুনেছি শুধু। ঐশ্বর্য-বিলাসে মগ্ন হয়েও সহজতার এই রূপ কোনদিন ভোলবার নয়।

সম্ভাব্য কাহিনীর উচ্ছ্বাস এবং রোমাঞ্চের দিকটা ভরাট করে তোলার লোকের অভাব নেই। ত্রিপুরারি আছে। আর প্রবাসী বাঙালী বন্ধুরা তো আছেই। তাদের কাছে তিল কিছু নেই, সব তাল।

মনে মনে নিজেকে ধন্যবাদ দিয়েছি। দিয়েছি এই জন্যে যে বোকার মতো অসুখের সেই মিথ্যে আশ্রয় না নিলে, আর ঠিক তেমনি অসহায়ভাবে ধরা না পড়ে গেলে মহিলার মনটিকে ঠিক এমন করে এমন সুরে ধরার সুযোগ পেতাম কিনা জানি না। আর আরো একটা কথা মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, প্রায় জ্ঞাতসারেই যশোমতী পাঠক আমাকে কিছুটা প্রশ্রয় দিয়েছে, অর্থাৎ নিজেকে প্রচ্ছন্ন রাখার তাগিদ ভুলেছে। গোচরে হোক বা অগোচরে থোক, সমস্ত পরিপূর্ণতারই একধরনের বেদনাভার আছে। সেটা হয়তো আপনিই প্রকাশের পথ খোঁজে। প্রশ্রয় হয়তো এই কারণে।

আজকের যশোমতী পাঠকের পরিপূর্ণতার আড়ালে এই বেদনার দান কতটুকু, সেটা শুধু কল্পনাসাপেক্ষ কিনা বলতে পারব না। মোট কথা, যে দুটি নারী-পুরুষের হৃদয়চিত্র আমি আঁকতে চলেছি, তাতে কতখানি রঙ ফলানো হয়েছে, সে-সম্বন্ধে আমার নিজেরই কোনো ধারণা নেই। যদি হয়েও থাকে রঙ ফলানো, সে রঙ আমার নিজস্ব নয়। সেই রঙের জন্য আমি ঋণী ত্রিপুরারির কাছে আর প্রবাসী বাঙালী বন্ধুদের কাছে তো বটেই, হয়তো শঙ্কর সারাভাই আর যশোমতী পাঠকের কাছেও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *