৭০. বিস্ফোরণ ঘটতে বাকি

৭০.

সবার মনেই কি হয় না হয় ভাব। বিস্ফোরণ ঘটতে বাকি আছে আর প্রায় দুঘণ্টা, ম্যানিপুলেটলের লম্বা বাহুতে অ্যাটম বোমটাকে আটকে নিয়ে সাগরের মেঝে ধরে এগিয়ে চলেছে বিগ বেন। যতোই ঘনিয়ে আসছে সময় সি-ফাইভ গ্যালাক্সি ও হোয়াইট হাউসের ভেতর উত্তেজনায় ধনুকের ছিলার মতো টান টান হয়ে উঠছে পরিবেশ।

শিডিউলের চেয়ে আঠারো মিনিট এগিয়ে আছে ও, নরম সুরে বলল অ্যাল। এখনও কোন বিপদে পড়ে নি।

মনে মনে ওর জন্যে প্রার্থনা করো, নির্দেশ দিলেন অ্যাডমিরাল স্যানডেকার। গভীর সাগরের তলায় কয়েক লক্ষ মানুষের প্রাণ একা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে কাঁধে করে। যে-কোন মুহূর্তে ছাই হয়ে যেতে পারে ও, মৃত্যু মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার দূরে।

ওর সাথে থাকা উচিত ছিল আমার, তিক্ত কণ্ঠে বলল অ্যাল।

সবাই আমরা জানি, চিন্তাটা তোমার মাথায় প্রথম এল। তুমিও ওকে আটকে রেখে একা যেতে চেষ্টা করতে।

হয়তো, বিড়বিড় করল অ্যাল। কি জানি, অত সাহস আমার আছে কিনা। তবে পিট সাথে থাকলে মৃত্যুকে আমি পরোয়া করি না।

চার্টের দিকে তাকালেন অ্যাডমিরাল। লাল একটা রেখা চলে গেছে বি টোয়েনটিনাইনের দিকে, সেখান থেকে ডিটোনেশন সাইটে পিটের কোর্স। দায়িত্ব নিয়ে আজ পর্যন্ত পিট আমাদেরকে কখনো হতাশ করে নি। কাজটা ঠিকই করবে ও, প্রাণ নিয়ে ফিরেও আসবে। মৃত্যুকে ফাঁকি দেওয়া অভ্যেস হয়ে গেছে ওর।

.

মাসুজি কোয়োমা, ডিফেন্স ডিটেকশন সম্পর্কে সুমার এক্সপার্ট টেকনিশিয়ান, সার্ভেইল্যান্স রাডার ডিসপ্লে অপারেটরের পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে, হাত তুলে একটা টার্গেট দেখালো তার চারপাশে দাঁড়ানো দলটাকে। দলে রয়েছে কোরোরি ইয়োশিশু, ইচিরো সুবোই ও তাকেদা কোরোজিমা।

অত্যন্ত বড় আকারের আমেরিকান এয়ার ফোর্স ট্রান্সপোর্ট ওটা, ব্যাখ্যা করল সে। সি-ফাইভ গ্যালাক্সি, বিরাট ভার নিয়ে অনেক দূরে যেতে পারে।

তুমি বলছ প্লেনটা অদ্ভুত আচরণ করছে? জানতে চাইল ইচিরো সুবোই।

মাথা ঝাঁকাল মাসুজি কোয়োমা। আমরা লক্ষ রাখছিলাম, হঠাৎ দেখি কি একটা জিনিস খসে পড়ল প্লেনটা থেকে।

কী হতে পারে জিনিসটা?

মাথা নাড়ল মাসুজি কোয়োমা। শুধু এটুকু বলতে পারি, জিনিসটা ধীর ধীরে পড়েছে, যেন একটা প্যারাসুট ছিল।

আন্ডারওয়াটার সেনসিং ডিভাইস হতে পারে? কেদা কোরোজিমা জিজ্ঞেস করল।

হতে পারে, তবে সোনিক সেনসরের তুলনায় জিনিসটা অনেক বড় ছিল।

অদ্ভুত ব্যাপার, মন্তব্য করল ইচিরো সুবোই।

তারপর থেকে, বলল মাসুজি কোয়োমা, এলাকায় চক্কর মারছে প্লেনটা।

ঝট করে তার দিকে তাকাল ইচিরো সুবোই। কতক্ষণ হলো?

 প্রায় চার ঘণ্টা।

ভয়েস ট্রান্সমিশন শোনার চেষ্টা করেছ?

সংক্ষিপ্ত কিছু সিগন্যাল পেয়েছি, তবে ইলেকট্রনিক্যাল শব্দজট বাধা দেয়ার অর্থ উদ্ধার করতে পারি নি।

স্পটার প্লেন! হঠাৎ একটা ঝাঁকি খেল মাসুজি কোয়োমা।

স্পটার প্লেন মানে? ভুরু দুটো কুঁচকে আছে ইচিরো সুবোইর।

সফিসটিকেটেড ডিটেকশন ও কমিউনিকেশন ইকুইপমেন্ট আছে প্লেনটায়, ব্যাখ্যা করল মাসুজি কোয়োমা। সামরিক অভিযান চালাবার সময় কমান্ড স্টোপর হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

ওদের প্রেসিডেন্ট এক নম্বর মিথ্যেবাদী। হিস হিস করে বলল ইচিরো সুবোই। আমাকে ধোঁকা দিয়েছেন। বোঝা যাচ্ছে, সোসেকি দ্বীপে হামলা চালাবার পাঁয়তারা কষছেন উনি।

কিন্তু এতোটা প্রকাশ্যে কেন? জানতে চাইলেন কোরোরি ইয়োশিশু। ওই রেঞ্জে টার্গেট ডিটেক্ট করার যোগ্যতা আমরা রাখি, এ তথ্য মার্কিন ইন্টেলিজেন্স জানে।

রাডার ডিসপ্লেতে প্লেটাকে দেখছে কোয়োমা। ওরা কি ইলেকট্রনিক্যালি আমাদের ডিফেন্স ধ্বংস করতে চায়?

রাগে থরথর করে কাঁপছে ইচিরো সুবোই, টকটকে লাল হয়ে উঠছে চেহারা। এখুনি আমি ওদের প্রেসিডেন্টের সাথে যোগাযোগ করব, বলব আমাদের পানি থেকে ওটাকে সরিয়ে নিতে হবে।

না, আমার কাছে আরো ভালো একটা বুদ্ধি আছে, বললেন কোরোরি ইয়োশিশু। এমন একটা মেসেজ পাঠাব, প্রেসিডেন্ট সেটার মর্ম অনায়াসে উপলব্ধি করতে পারবেন।

 কী বুদ্ধি? জানতে চাইল ইচিরো সুবোই।

সহজ বুদ্ধি, কোরোরি ইয়োশিশু জবাব দিলেন। প্লেনটাকে আমরা উড়িয়ে দেব।

.

ছ মিনিটের মাথায় এক জোড়া ইনফ্রায়েরড সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল সি-ফাইভের দিকে ছুটলো, প্লেনের আরোহীরা কিছুই জানলো না, কারণ অ্যাটাক ওয়ার্নিং সিস্টেম বলে কিছু নেই ওটায়। আগের মতোই বিগ বেন-এর গতিবিধি মনিটর করছে ওরা চক্কর দিচ্ছে আকাশে।

হোয়াইট হাউসে স্ট্যাটাস রিপোর্ট পাঠানোর জন্যে কমিউনিকেশন কমপার্টমেন্টে ঢুকলেন অ্যাডমিরাল স্যানডেকার। অ্যাল ওদের অফিসে রয়েছে, ডেস্কের পিছনে দাঁড়িয়ে মেরিন জিওলজিস্টের রিপোর্টে চোখ বুলাচ্ছে সে, রিপোর্টে দেখানো হয়েছে কোন পথে আন্ডারসী ট্রেঞ্চ পেরিয়ে নিরাপদ জাপানি উপকূলে পৌঁছুবে পিট। দূরত্বটা মাপার চেষ্টা করছে অ্যাল, এ সময় প্রথম মিসাইলটা আঘাত হানল। শক ও প্রেসার ওয়েভ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল তাকে ডেকে! হতভম্ব অ্যাল কয়েক সেকেন্ড স্থির পড়ে থাকল, তারপর কনুইয়ে ভর দিয়ে ওঠার চেষ্টা করল, এ সময় আঘাত হানল দ্বিতীয় মিসাইল। লোয়ার কার্গো হোড চুরমার হয়ে গেল, ফিউজিলাজে তৈরি হলো বিরাট একটা গর্ত।

সমাপ্তটা হত দ্রুত ও দর্শনীয়, কিন্তু প্রথম মিসাইলটা সঙ্গে সঙ্গে ফাটে নি প্লেনের ওপরের কোমর পেরিয়ে একজোড়া বাল্কহেডের মাঝখান দিয়ে ছুটে গেল সেটা, উল্টোদিকের এয়ারফ্রেমের পাঁচরে লেগে বিস্ফোরিত হলো। বিস্ফোরণের বেশির ভাগ ধাক্কা লাগল রাতের বাতাসে, ফলে ছিন্নভিন্ন হওয়া থেকে রক্ষা পেল প্লেন।

ধাক্কাটা সামলে ওঠার চেষ্টা করছে অ্যাল, ভাবছে প্লেনটা যে-কোনো মুহূর্তে বিস্ফোরিত হবে অথবা ঝাঁপ দেবে সাগরে। পর পর দুটো মিসাইলের আঘাত খেযে বাতাসে ভেসে থাকা সম্ভব নয়। তবে ওর হিসেবে ভুল হয়েছে। প্রকাণ্ড গ্যালাক্সি সহজে বরণ করবে না মৃত্যুকে। প্লেনটায় এখনো আগুন লাগে নি, আর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মাত্র একটা ফ্লাইট কন্ট্রোল সিস্টেম। বড় একটা গর্ত তৈরি হওয়া সত্ত্বেও দিব্যি ভেসে থাকল বাতাসে।

পঙ্গু প্লেনটাকে নিয়ে ডাইভ দিল পাইলট। সাগর যখন আর মাত্র ত্রিশ মিটার নিচে, প্লেন সিধে করল সে, সোসেকি দ্বীপকে পেছনে রেখে দক্ষিণ দিকের কোর্স ধরল। এঞ্জিনগুলো স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে, তবে গর্ত দিয়ে বাতাস ঢোকায় থরথর করে কাঁপছে প্লেনের গোটা কাঠামো।

ফ্লাইট এঞ্জিনিয়ারকে নিয়ে সামনের দিকে এগোলেন অ্যাডমিরাল ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানার জন্যে। কার্গো বে-তে দেখতে পেলেন অ্যালকে, হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসছে, হাঁ করে তাকিয়ে আছে গর্তটার দিকে।

 নিচে লাফ দিলে নির্ঘাত মারা যাব, বাতাসের গর্জনকে ছাপিয়ে উঠল তার কণ্ঠস্বর।

আমারও লাফ দেয়ার কোনো ইচ্ছে নেই, পাল্টা চিৎকার করলেন স্যানডেকার।

 ক্ষয়ক্ষতি দেখে বিস্ফোরিত হয়ে গেল ফ্লাইট এঞ্জিনিয়ারের চোখ। মাই গড! কী ঘটল কী!

এক জোড়া গ্রাউন্ড-টু-এয়ার মিসাইল চুমো খেয়েছে, জবাব দিল অ্যাল।

হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এলো সে, অ্যাডমিরাল কে নিয়ে ককপিটের দিকে এগোল। প্লেনের নিচের পেটে কী ক্ষতি হয়েছে দেখার জন্যে চলে গেল ফ্লাইট এঞ্জিনিয়ার।

 ক্যাপটেন সম্পূর্ণ শান্ত, গভীর মনোযোগ দিয়ে কন্ট্রোল সামলাতে ব্যস্ত। ককপিটের মেঝেতে নেতিয়ে পড়ল অ্যাল, বেঁচে আছে বলে ভাগ্যের প্রতি কৃতজ্ঞ। প্লেনটা এখনো উড়ছে, এ আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল সে। ডিজাইনারকে চুমো খাবার কথা মনে করিয়ে দেবেন।

 দুই পাইলটের মাঝখানে মাথা গলিয়ে দিয়ে কনসোলের দিকে তাকালেন জেমস হ্যামলটন, ক্ষয়ক্ষতির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়ার পর জানতে চাইলেন, বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু?

 ইলেকট্রিকাল ও খানিকটা হাইড্রোলিক পাওয়ার এখনো আছে আমাদের, চীফ পাইলট জবাব দিল। তবে মেইন ফুয়েল ট্যাংক থেকে বেরিয়ে আসা লাইন বোধহয় কেটে গেছে। মিনিট দুই আগে গজের কাঁটা নেমে এসেছে।

মিসাইল রেঞ্জের বাইরে থাকলাম, তবে এলাকা ছেড়ে নড়লাম না, সম্ভব?

অসম্ভব।

আমি যদি অসম্ভবকে সম্ভব করার নির্দেশ দিই? কঠিন সুরে বললেন অ্যাডমিরাল।

মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাল পাইলট। আপনার অসম্মান করছি না, অ্যাডমিরাল, তবে জেনে রাখুন যে-কোনো মুহূর্তে আমাদের এই প্লেন টুকরো টুকরো হয়ে যেতে পারে। আপনার যদি মরার ইচ্ছে জাগে, সেটা আপনার ব্যাপার। তবে আমার দায়িত্ব প্লেন ও আরোহীদের রক্ষা করা। আপনি একজন পেশাদার নৌ-অফিসার, কাজেই আমি কি বলছি আশা করি আপনি তা বুঝতে পারছেন।

 আপনার প্রতি আমার সহানুভূতি আছে, তবে নির্দেশটা বহাল থাকল।

প্লেনটা যদি ভেঙে না পড়ে, আর যদি ফুয়েলে কুলায়, চীফ পাইলট বলল, তাহলে আমরা হয়তো ওকিনাওয়ার নাহা এয়ারফিল্ডে পৌঁছুতে পারব। ওটাই সবচেয়ে কাছের বড় একটা রানওয়ে।

ওকিনাওয়া বাদ, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন অ্যাডমিরাল। দ্বীপটার ডিফেন্স সিস্টেম থেকে নিরাপদ দূরে থাকব আমরা, থাকব আমার প্রজেক্ট ডিরেক্টর ডার্ক পিটের অবস্থা জানার জন্যে কমিউনিকেশন রেঞ্জের ভেতর। গোটা দুনিয়াকে রক্ষা করার জন্যে কাজ করছে ও, ওকে আমরা একা ফেলে চলে যেতে পারি না। যতক্ষণ পারেন আকাশে ভাসিয়ে রাখুন আপনি আমাদের। অবস্থা যদি আরো খারাপের দিকে যায়, প্লেনটাকে সাগরে নামিয়ে দেবেন।

 চীফ পাইলটের চেহারা লাল হয়ে উঠেছে, কপালে বিন্দু ঘাম। ঠিক আছে, অ্যাডমিরাল। তবে তীরে পৌঁছুনোর জন্যে লম্বা একটা সাঁতার দেওয়ার প্রস্তুতি নিন আপনি।

 অ্যাডমিরাল হাসতে যাবেন, তাঁর কাঁধে একট হাত পড়ল। আমি দুঃখিত, অ্যাডমিরাল, বলল কমিউনিকেশন অপারেটর। রেডিও গুঁড়িয়ে গেছে। কিছু ট্রান্সমিট বা রিসিভ করা সম্ভব নয়।

 বোবা রেডিও নিয়ে এলাকায় থেকে লাভ কী? জিজ্ঞেস করল চীফ পাইলট।

সিধে হয়ে দাঁড়ালেন অ্যাডমিরাল, তাকালেন অ্যালের দিকে, দৃষ্টিতে হতাশা। পিট কিছু জানবে না। ও ভাববে, ওকে একা ফেলে চলে গেছি আমরা।

উইন্ডস্ক্রীন দিয়ে কালো আকাশ ও কালো সাগরে মাঝখানে তাকাল অ্যাল। অসুস্থবোধ করল সে। চোখের পানি আটকে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করে বলল, আমাদেরকে পিটের দরকার নেই। কেউ যদি বোমাটা ফাটাতে পারে তো সে পিট। কেউ যদি এ ধরনের বিপদ থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারে তো সে আমার ওই হিরো।

ওর ওপর আমারও বিশ্বাস আছে, দৃঢ়কণ্ঠে বললেন অ্যাডমিরাল।

ওকিনাওয়া? ঘাড় ফিরিয়ে জানতে চাইল চীফ পাইলট।

ধীরে ধীরে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও, তার দিকে তাকালেন স্যানডেকার, বিড়বিড় করে বললেন, ওকিনাওয়া।

প্রকাণ্ড প্লেনটা অন্ধকারে ঘুরে গেল। কয়েক মুহূর্ত পর অস্পষ্ট হয়ে এলো এঞ্জিনের আওয়াজ। পেছনে পড়ে থাকল নিশুপ সাগর, একজন মানুষ বাদে সম্পূর্ণ। নির্জন।  

.

৭১.

ম্যানিপুলেটরে ঝুলছে বোমাটা। বিশাল সাবমেরিন ট্রেঞ্চের কিনারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে বিগ বেন্। ট্রেঞ্চটা দশ কিলোমিটার চওড়া, দুই কিলোমিটার গভীর।

জিওফিজিসিষ্টরা ট্রেঞ্চের কিনারা থেকে বারোশো মিটার নিচের একটা ঢালকে বোমা ফাটাবার পজিশন হিসেবে নির্বাচন করেছে। বিস্ফোরণের ফলে সুনামি সৃষ্টি হবে, তারপর সিসমিক সী ওয়েভ। তবে স্যাটেলাইট ফটো দেখে যা ধারণা করা হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি খাড়া ঢালটা। আরো খারাপ লক্ষণ হলো, ট্রেঞ্চের পাশের পলিমাটি তেলতেলা কাদার মতো হয়ে আছে। কী ধরনের বিপদে পড়তে যাচ্ছে, বুঝতে পেরে ভয়ই পেল পিট। পিচ্ছিল কাদায় একবার যদি হড়কাতে শুরু করে ভারী বাহনটা ট্রেঞ্চের একেবারে তলায় গিয়ে থামতে হবে। এমনকি কাদায় না পিছলালেও বিপদের মাত্রা কমছে না, কারণ, আঠার মতো কাদা বেয়ে কোনভাবেই আবার ওপরে উঠে আসা সম্ভব নয়। পিট সিদ্ধান্ত নিল, বোমাটা বিস্ফোরণের জন্যে তৈরি করার পর ওপরে ওঠার কোনো চেষ্টাই ও করবে না। ঢালের একটা পাশ ধরে আরো নিচে নামবে। নামতে হবে দ্রুত, যাতে ভুমিধসে চাপা না পড়ে। একবার চাপা পড়লে আগামি এক কোটি বছরে বেরুতে হবে না।

জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে রেখাটা কি সাংঘাতিক সরু, ভাবতে গিয়ে রোমাঞ্চিত হলো পিট। পাশে অ্যাল নেই বলে মনটা খারাপ। সি-ফাইভ গ্যালাক্সি যোগাযোগ রাখছে না, কারণটা বুঝতে পারল না ও। নিশ্চয় সঙ্গত কোন কারণ আছে। কারণ ছাড়া অ্যাল বা অ্যাডমিরাল ওকে ত্যাগ করবেন না।

উৎসাহ যোগানোর জন্যে কেউ ওর সঙ্গে কথা বলছে না, নিঃসঙ্গ পরিবেশটা ভৌতিক লাগছে। অবসাদ ও ক্লান্তি দুর্বল করে তুলছে ওকে। সীটের ওপর বেনিয়ে রয়েছে, যেন কোন আশা নেই মনে। হাতঘড়ি দেখল একবার।– খানিক পর বিগ বেন-এর ম্যানুয়াল কন্ট্রোল হাতে নিল পিট। সি-বাইভ থেকে ওরা যোগাযোগ করছে না, কাজেই পরামর্শ পাবার আশা নেই। ডিটোনেশন সেন্টারে পৌঁছুতেই হবে ওকে, আর দেরি করার কোনো মানে হয় না।

ফরওয়ার্ড ডাইভ এনগেজ করল পিট, প্রকাণ্ড ট্রাক্টর ভেহিকেল ডাল বেয়ে নামতে শুরু করল।

প্রথম একশো মিটারের পর অধোগতি বাড়তে শুরু করল। পিটের ভয় হলো, ডার্লিংকে বোধহয় আর থামাতেই পারবে না, সরাসরি ট্রেঞ্চের তলায় পৌঁছে যাবে। ব্রেক করল, কিন্তু বিগ বেন-এর গতি তাতে কমল না। পিচ্ছিল কাদার ওপর দিয়ে হড়কে নেমে যাচ্ছে প্রকাণ্ড যান্ত্রিক দানবটা।

ম্যানিপুলেটরের গ্রিপ-এর গোল বোমাটা মারাত্মক ভঙ্গিতে দুলছে। সরাসরি ওর সামনে রয়েছে ওটা, না তাকিয়ে পারছে না পিট। আর তাকালেই যেন নিজের ভবিষ্যৎ মৃত্যু প্রত্যক্ষ করছে ও।

হঠাৎ করে আরেকটা ভয়ঙ্কর চিন্তা খেলে গেল মাথায়। বোমাটা যদি গ্রিপ থেকে ছিটকে পড়ে, নেমে যায় ঢাল বেয়ে, ওটাকে উদ্ধার করা সম্ভব হবে না। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল শরীর। মৃত্যু ভয় নয়, ব্যর্থতার ভয়। জীবন দিয়ে হলেও এই অপারেশনে সফল হতে হবে ওকে।

 সীটের ওপর সিধে হলো পিট, দ্রুত নড়ে উঠল হাত দুটো। এমন একটা ঝুঁকি নিচ্ছে, কোনো সুস্থ লোক ভাবতেই পারবে না। রিভার্স ড্রাইভ দিয়ে অতিরিক্ত পাওয়ার অ্যাপ্লাই করল। ক্লিট বা গোঁজগুলো পেছন দিকে গতি পেল, ধীরে ধীরে মন্থর হলো বিগ বেন-এর গতি।

দাঁড়িয়ে পড়ল বিগ বেন। ঘোলা পানি ঢেকে ফেলল ওটাকে। ধীরে ধীরে পঞ্চাশ মিটার এগোল পিট, পানি খানিকটা পরিষ্কার হতে আবার রিভার্স এনগেজ করল, দাঁড় করাল বিগ বেনকে। এভাবেই এগোল পিট, খানিক দূর এগিয়ে থামে, তারপর আবার এগোয়। নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছে ও, ফিরে পেয়েছে আত্মবিশ্বাস।

 আধ ঘণ্টা পর নেভিগেশনাল কমপিউটার সঙ্কেত দিল, গন্তব্যে পৌঁছে গেছে ও। ঢালের মেঝে থেকে বেরিয়ে রয়েছে ছোট ও সমতল একটা শেলফ, পাওয়ার সিস্টেম ডিজএনগেজ করে পার্ক করল ও। ডিটোনেশন সাইটে পৌঁছেছি আমি, কমিউনিকেশন ফোনে বলল পিট, ওপরে কোথাও থেকে এখনো হয়তো শুনছেন জেমস স্যানডেকার, এ আশায়।

ম্যানিপুলেটরের বাহু নিচু করে বোমাটাকে নরম পলিতে নামাল পিট, রিলিজ করল গ্রিপার। ম্যানিপুলেটরের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে তুলে নিল, শিট-মেটাল দিয়ে তৈরি কঁটি দিয়ে বোমার টেইল প্যানেল কাটতে হবে, মেইন ফিউজিং কমপার্টমেন্টটাকে ঢেকে রেখেছে ওটা।

ভেতরে রয়েছে চারটে রাডার ইউনিট ও একটা ব্যারোমেট্রিক প্রেশার সুইচ। বোমাটা যদি পরিকল্পনা অনুসারে ফেলা হতো, গ্রাউন্ড টার্গেট এগিয়ে আসছে দেখলে প্রতি সঙ্কেত পাঠাতে রাডারগুলো। তারপর, আগেই নির্ধারিত নির্দিষ্ট অলটিচ্যুডে পৌঁছে, রাডারের দুটো ইউনিট ফিউজিং সিস্টেমকে ফায়ারিং সঙ্কেত পাঠাতো। ব্যারোমেট্রিক সুইচটা হলো দ্বিতীয় আর্মিং সিস্টেম, ওটাও নির্দিষ্ট অলটিচ্যুডে ফায়ারিং সার্কিট বন্ধ করার জন্যে সেট করা আছে।

তবে প্লেন সচল থাকা অবস্থায় ফায়ারিং সিগন্যাল সার্কিটগুলো বন্ধ করা যাবে না। ওগুলো বন্ধ করতে হবে। ক্লক-অপারেটেড সুইচ ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু সুইচগুলোর নাগাল পেতে হলে বম্ব-বে থেকে বোমাটাকে যথেষ্ট দূরে সরিয়ে আনতে হবে। তা না হলে কেউ ফাটাবার আগেই ফেটে যাবে বোমাটা।

প্যানেল সরাবার পর বাম দিকের ম্যানিপুলেটরের শেষ মাথায় একটা মিনিয়েচার ভিডিও ক্যামেরা বসাল পিট। ব্যারোমেট্রিক আর্মিং সুইচ খুঁজে নিয়ে দ্রুত ওটার ওপর ফোকাস করল। পিতল, তামা ও ইস্পাত দিয়ে তৈরি খানিকটা মরচে ধরলেও এখনও অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। এরপর ম্যানিপুলেটরের অপর বাহুতে সরু একটা সাড়াশি জোড়া লাগালো ও, সাঁড়াশিটা একটা হাতের মতো, ভাজ হয়ে ফিরে এসেছে বিগ বেন-এর সামনের দিকে। ভারী টুল বক্স থেকে অদ্ভুত দর্শন একটা সিরামিক বস্তু তুলে নিল হাতটা, বাতাসবিহীন ছোট ফুটবলের মতো দেখতে। চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই জিনিসটা কি। ওটা আসলে প্রেশারাইজড কন্টেইনার, ভেতরে আছে পুটিং-এর মতো দেখতে মিশ্র পদার্থ, প্লাস্টিক ও অ্যানিড দিয়ে তৈরি। ব্যারোমেট্রিক ফায়ারিং সুইচে নিখুঁতভাবে ফিট করবে সেরামিক কন্টেইনার। ফলে ওটা একটা ওয়াটার টাইট সীর-এর পরিণত হবে।

ম্যানিপুলেটরের হাত সচল করল পিট, সুইচের চারধারে কন্টেইনারটা আটকাল, তারপর সাবধানে খুলে নিল একটা পাগ। এবার ধীরে ধীরে পানি চুঁইয়ে ভেতরে ঢুকলে কন্টেইনারে। লবণ পানির সংস্পর্শে ভেতরের নিষ্ক্রিয় কমপাউন্ড সক্রিয় হয়ে উঠবে, হয়ে উঠবে জোরালো ক্ষার। তামার প্লেট খেয়ে ফেলার পর ব্যারোমেট্রিক সুইচের তামার ওপর হামলা চালাবে অ্যাসিড কম্পাউন্ড, ফলে এক সময় একটা, ইলেকট্রিক্যাল চার্জ তৈরি হবে। ওই ইলেকট্রিক্যাল চার্জই ফায়ারিং সিগন্যাল পাঠাতে ও বোমাটা বিস্ফোরণ ঘটাতে সাহায্য করবে। তামার প্লেট এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, অ্যাসিড কম্পাউন্ড ওটাকে এক ঘণ্টার আগে খেয়ে ফেলতে পারবে না।

ম্যানিপুলেটরের বাহুগুলো সরিয়ে আনল পিট। ধীরে ধীরে পিছিয়ে আনছে বিগ বেনকে। কাদার ওপর ভীতিকর ও ভৌতিক একটা আকৃতি নিয়ে পড়ে রয়েছে। বোমাটা। চট করে একবার ইনস্টমেন্ট কনসোলে তাকাল ও, ডিজিটাল ঘডিতে সময় দেখল।

শুরু হলো প্রাণ বাঁচানোর প্রতিযোগিতা। ফাটতে সাতচল্লিশ বছর দেরি করলেও, এবার নির্দিষ্ট একটা সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে, বোমাটাকে আজ ফাটতেই হবে।

.

কোনো খবর পেলে? ওভাল অফিস থেকে উদ্বিগ্ন প্রেসিডেন্ট জানতে চাইলেন।

যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে গেছে। কেন, তার কোনো ব্যাখ্যা পাই নি, সিচুয়েশন রূম থেকে ডরিপোর্ট করলেন রেইমন্ড জর্ডান।

অ্যাডমিরাল স্যানডেকারকে তুমি হারিয়েছে?

সে রকমই ভয় করছি, মি. প্রেসিডেন্ট। সম্ভাব সব রকম চেষ্টা করেও তার প্লেনের সাথে যোগাযোগ করতে পারি নি আমরা।

এক মুহূর্ত কথা বললেন না প্রেসিডেন্ট। আশঙ্কায় অস্থির মনটাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। কোথায় কী ভুল হলো?

আমরা শুধু অনুমান করতে পারি। সর্বশেষে স্যাটেলাইট রিপোর্ট হলো, বিগ বেন-এর সাথে যোগাযোগ কেটে দিয়ে ওকিনাওয়া দ্বীপের দিকে যাচ্ছে সি-ফাইভ।

এর কোনো অর্থ হয় না। ডেনিংস ডেমনস থেকে বোমাটা নামিয়ে আনতে সফল হয়েছে ডার্ক পিট, এরপর কেন ওকে ত্যাগ করবেন অ্যাডমিরাল?

ত্যাগ করার তো করা নয়, যদি না ডার্ক পিট গুরুতর কোনো দুর্ঘটনায় পড়ে। এমন হতে পারে অ্যাডমিরাল নিশ্চিতভাবে বুঝেছেন যে বোমাটা ফাটানো ওর দ্বারা সম্ভব নয়।

তার মানে সব শেষ হয়ে গেল, হতাশ গলায় বললেন প্রেসিডেন্ট।

এক সেকেন্ড দেরি করে, ভারী গলায় জবাব দিলেন রেইমন্ড জর্ডান, অ্যাডমিরাল আবার যোগাযোগ না করা পর্যন্ত কিছুই বলা যাচ্ছে না।

গাড়ি-বোমাগুলোর শেষ খবর?

আরো তিনটে গাড়ি-বোমা নিউট্রালাইজ করেছে এফবিআই টাস্ক ফোর্স, সবগুলোই মেট্রোপলিটান শহরে।

ড্রাইভাররা?

সবাই তারা সুমা ও ড্রাগনের অন্ধভক্ত, স্বেচ্ছায় প্রাণ দিতে রাজি অথচ গ্রেফতার হবার সময় কেউ তারা বাধা দেয় নি বা গাড়ি-বোমা ফাটিয়ে দেয়ার কোনো চেষ্টা করে নি।

এতোটা নিরীহ সাজার কারণ?

 ওদের ওপর নির্দেশ আছে, ড্রাগন সেন্টার থেকে কোডেড সিগন্যাল পাবার। পরই শুধু বোমাগুলো ফাটাবে ওরা।

আমাদের শহরগুলোয় আর কটা গাড়ি-বোমা লুকানো আছে?

উত্তেজনাকর বিরতি, তারপর ধীরে ধীরে রেইমন্ড জর্ডান বললেন, অনেক, দশটার কম নয়।

 গুড গড! অবিশ্বাস ও বিস্ময়ের ধাক্কার সঙ্গে ভয়ের একটা শিহরণও অনুভব করলেন প্রেসিডেন্ট।

 এখনো আমি ডার্ক পিটের ওপর আস্থা হারাই নি, রেইমন্ড জর্ডান শান্তকণ্ঠে বললেন। বোমার ফায়ারিং সিস্টেম প্রাইম করতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি, এর কোনো প্রমাণ এখনো আমি পাই নি।

প্রেসিডেন্টের চোখে ক্ষীণ আশার আলো জ্বলে উঠল। কখন জানতে পারব আমরা?

 ডার্ক যদি সময়সূচি রক্ষা করতে পারেন, বাবো মিনিটের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটার কথা।

চেহারায় কোনো ভাব নেই, ডেস্কের ওপর তাকালেন প্রেসিডেন্ট। তারপর যখন কথা বললেন, কোনো রকমে শুনতে পেলেন রেইমন্ড জর্ডান।

 ডার্ক পিটের জন্যে প্রার্থনা করো, রেই। ঈশ্বরের কাছে ওর সাফল্যের জন্যে কান্নাকাটি করো।

.

৭২.

 টাইমিং প্লেটটা ধীরে ধীরে খেয়ে ফেলল অ্যাসিড কম্পাউন্ড, তারপর হামলা চালার ব্যারোমেট্রিক প্রেশার সুইচে। একটু পরই একটা ইলেকট্রিকাল চার্জ তৈরি হলো, বন্ধ হয়ে গেল ফায়ারিং সার্কিট।

প্রায় পাঁচ দশক অপেক্ষা করার পর, মূল বোমার চারধারে বত্রিশটা ডিটোনেটর জ্যান্ত হয়ে উঠল, আগুন জ্বালিয়ে দিল অবিশ্বাস্য জটিল ডিটোনেশন সিস্টেমে, যার ফলে চেইন রিঅ্যাকশন শুরু করার জন্যে চারপাশের প্রটোনিয়ামে ঢুকে পড়ল নিউট্রন। এরপর শুরু হলো ফিশন বিস্ফোরণ, পরমাণু বিভাজন সৃষ্টি হলো শত সহস্র মিলিয়ন ডিগ্রি ও কিলোগ্রাম চাপ আর শক্তি। পানির তলায় গ্যাস ভরা অগ্নিগোলক মাথাচাড়া দিল, ছুটল ওপর দিকে, ছিন্ন করল সাগরের পিঠ। আকাশের দিকে উঁচু হলো বিশাল এলাকা জুড়ে বিপুল পানি, শক ওয়েভের ধাক্কা খেয়ে ছড়িয়ে পড়ল রাতের বাতাসে।

যেহেতু চাপ দিয়ে সংকুচিত করা যায় না, তুই শক ওয়েভ পাঠানোর জন্যে পানি হয়ে উঠল প্রায় নিখুঁত একটা মাধ্যম। প্রতি সেকেন্ড কম-বেশি দুই কিলোমিটার গতি, শক ওয়েভের সামনের অংশ মাত্র আট কিলোমিটার দুরে ট্রেঞ্চের ভেতর নাগাল পেয়ে গেল বিগ বেন-এর। ট্রেঞ্চের চাল বেয়ে মন্তরবেগে নেমে যাচ্ছে বিগ বেন, বারো মাইল অর্থাৎ নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে পারে নি। প্রকাণ্ড একটা হাতুড়ির মতো আঘাত করল শক ওয়েভ।

প্রচণ্ড ঝাঁকি খেল বিগ বেন, নরম পলিমাটির সচল পাঁচিল গ্রাস করল ওটাকে, কোনো দিকে দৃষ্টি চলে পিট, তবু পিট শুধু উল্লাসই বোধ করল। বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে ব্যর্থতার সমস্ত ভয় উবে গেছে মন থেকে। সোনার প্রোব-এর ওপর অন্ধবিশ্বাস। রেখে ঘোলা পানি ও কাদার ভেতর দিয়ে বিগ বেনকে নিয়ে এগোচ্ছে অজানা পথে। লম্বা একটা কার্নিসে রয়েছে, দীর্ঘ ঢালের মাঝখান দিয়ে নেমে গেছে সেটা। ঢালের চেয়ে কার্নিসটা কম ঢালু, ফলে গতি আগের চেয়ে সামান্য হলেও বেড়েছে, কারণ রির্ভাস এনগেজ করার দরকার হচ্ছে না। কার্নিসেও কাদা আছে, তবে কাদার নিচে রয়েছে পাথর, ফলে ট্র্যাক্টর রেস্ট অল্প হলেও কাজে লাগছে। যদিও যান্ত্রিক দানবটাকে সোজা পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব একটা ব্যাপার, কাদার ওপর বারবার হড়কে যাচ্ছে বিগ বেন।

 নিয়তি সম্পর্কে পিটের মনে কোনো ভুল ধারণা নেই। প্রাণ বাঁচানোর প্রতিযোগিতায় হেরে যাচ্ছে ও। ধেয়ে আসছে পাহাড়ের মত উঁচু ভুমিধস। ওটার পথ থেকে সরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। ঢালের কোথায় লুকাবে পিট? পুরো ট্রেঞ্চটাই তো ভূমিধসে ভরাট হয়ে যাবে।

তবু, গোঁয়ারের মতো একটা জেদ কাজ করছে ওর ভেতর। যেভাবে হোক, বেঁচে থাকতে হবে ওকে।

সাগরের ওপর, অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না, বিশাল এলাকার বিপুল পানি দুশো মিটার পর্যন্ত উঁচু হলো, তারপর ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। কিন্তু ফল্ট জোনের গভীরে কী ঘটছে? ট্রেঞ্চের মেঝের নিচে শক ওয়েভের অবিশ্বাস্য শক্তি পৃথিবীর শক্ত ছালে একটা খাড়া ফাটল তৈরি করল। একের পর এক ধাক্কা লাগায় ফাটলটা চওড়া হচ্ছে, সৃষ্টি করছে উঁচু মাত্রার ভূমিকম্প।

লক্ষ বছর স্থির হয়ে থাকা পলিমাটির অসংখ্যা স্তর আগে পিছে জায়গা বদল শুরু করল, টেনে নিচে নামাচ্ছে সোসেকি দ্বীপের ভারীলাভা, দ্বীপটা হয়ে উঠল চোরাবালিতে পড়া এক টুকরো পাথরের মত। মাটিতে গাঁথা বিশাল পাথরে দ্বীপ শক ওয়েভের প্রাথমিক ধাক্কা সহজেই হজম করতে পারল, ভুমিকম্পে কোনো ক্ষতিই হলো না কয়েক মিনিট। কিন্তু তারপরই সাগরে ভেবে যেতে শুরু করল, বাধের গা বেয়ে ওপরে উঠছে পানি।

নিচের স্তরে পলিমাটি জমাট না বাধা পর্যন্ত ডেবে যেতে থাকল দ্বীপটা, তারপর ভাসমান পাথরের বিস্তার ধীরে ধীরে নিচ হলো, এক সময় স্থির হলো নতুন একটা স্তরে। কিন্তু এখন সাগরের ঢেউগুলো পাহাড়-প্রাচীরের গোড়ায় আঘাত করছে না, বাঁধের মাথা টপকে উঠে আসছে দ্বীপের ওপর, লাফ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে সামনের সারি সারি গাছপালার দিকে।

বিস্ফোরণের কয়েক সেকেন্ড পর ট্রেঞ্চের পুব পাঁচিলের বিশাল একটা অংশ কেঁপে উঠল, অবিশ্বাস্য দ্রুতবেগে ফুলে উঠল বাইরের দিকে। তারপর বজ্রপাতের মতো বিকট শব্দে কয়েক শো মিলিয়ন টন কাদা বিস্ফোরিত হয়ে লাফ দিল ট্রেঞ্চের তলা লক্ষ করে। কল্পনার অতীত আলোড়ন সৃষ্টি হলো পানিতে। শুরু হলো সুনামি।

সাগরের একটা অংশ যেন বিদ্রোহী হয়ে উঠল। সারফেসের নিচে মাত্র এক মিটার উঁচু, নিচে হিমালয়ের আকৃতি পাওয়া পানির পাহাড় ঘণ্টায় পাঁচশো কিলোমিটার গতিতে ছুটল পশ্চিম দিকে ধেয়ে আসা এ পানির সঙ্গে দুনিয়ার অন্য কোনো শক্তির তুলনা চলে না, অপর কোন শক্তির এখোটা ধ্বংসকারী ক্ষমতা নেই। ওটার পথে, মাত্র বিশ কিলোমিটার সরাসরি সামনে রয়েছে সোসেকি দ্বীপ।

.

কোরোরি ইয়োশিশু, ইচিরো সুবোই ও তাদের লোকজন এখনো ডিফেন্স কন্ট্রোল রূমে রয়েছে, পঙ্গু সি-ফাইবের পলায়ন দেখছে রাডারে।

দু-দুটো মিসাইল লাগল অথচ এখনো ওটা উড়ছে, সবিস্ময়ে নিস্তব্ধতা ভাঙল ইচিরো সুবোই।

 এখনো ওটা পড়ে যেতে পারে, হঠাৎ থামলেন কোরোরি ইয়োশিশু। বিস্ফোরণের শব্দ ঠিক কতটা শুনতে পেরেছেন বলা কঠিন, তবে তার চেয়ে বেশি অনুভব করতে পেরেছেন। শুনলে?

 হ্যাঁ, অনেক দূরে বোধহয় কোথাও বাজ পড়ল, রাডার ডিসপ্লে থেকে চোখ না সরিয়েই বলল মাসুজি কোয়োমা।

তুমি অনুভব করোনি? জানতে চাইলেন কোরোরি ইয়োশিশু।

পায়ের তলাটা সামান্য যেন কাপল, বলল ইচিরো সুবোই।

কোয়োমা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল। মাটির কম্পন জাপানিদের জন্যে নতুন কিছু নয়। প্রতি বছর মেইন আইল্যান্ডে এক হাজার বার ভুমিকম্প হয়, প্রতি সপ্তায় কয়েক বার জাপানিদের পায়ের নিচে মাটি কেঁপে ওঠে। সিসমিক কম্পন, বলল সে। আমরা একটা সিসমিক ফল্টের কাছে রয়েছি। ভয় পাবার কিছু নেই, এ ধরনের কাঁপুনি প্রায়ই অনুভব করি আমরা। দ্বীপটা নিরেট পাথর, ড্রাগন সেন্টারও এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে ভুমিকম্পে কোনো ক্ষতি হবে না।

কামরার আলগা জিনিসপত্র সামান্য নড়ে উঠল, রোমাটার মন্থর হয়ে আসা এনার্জি ড্রাগন সেন্টারের ভেতর দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। তারপরই সাবওশন ফল্টের ধস থেকে তৈরি শক ওয়েভ দ্বীপের ওপর আছড়ে পড়ল প্রচণ্ড শক্তিতে। মনে হলো যেন গোটা ড্রাগন সেন্টার প্রতি মুহূর্তে চারদিকে টলছে আর ঝাঁকি খাচ্ছে। সবার চেহারায় বিস্ময়, তারপর বিস্ময়ের জায়গায় ফুটে উঠল উদ্বেগ, সবশেষে ভয়।

 খুব জোরাল মনে হচ্ছে, বলল ইচিরো সুবোই, নার্ভাস।

হ্যাঁ, এ ধরনের ভুমিকম্প আগে কখনো অনুভব করি নি আমরা, তাল সামলাবার জন্যে একটা দেয়ালে হাত রাখল কোয়োমা।

 কোরোরি ইয়োশিশু স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছেন, চেহারা দেখে বোঝা গেল খুব রাগ হয়েছে তাঁর। এখান থেকে আমাকে তোমরা বের করো, নির্দেশ দিলেন তিনি।

টানেলের চেয়ে এখানেই বরং আমরা বেশি নিরাপদ, চিৎকার করল মাসুজি কোয়োমা। ড্রাগন সেন্টার এখনও প্রবল ভাবে ঝাঁকি খাচ্ছে, কর্কশ ও বিচিত্র সব শব্দে কান পাতা দায়।

দ্বীপের নিচে রয়েছে লাভা রক, সেটাকে ভেদ করে ছুটে গেল শক ওয়েভ। ড্রাগন সেন্টারে যারা কিছু না ধরে দাঁড়িয়ে ছিল, ছিটকে পড়ে গেল মেঝেতে। লাভা রক-এর নিচে রয়েছে নরম পলিমাটির স্তর, ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল সেটা। কন্ট্রোল সেন্টার এবার আরো তীব্রগতিতে টলতে শুরু করল, প্রতি মুহূর্তে এদিক ওদিক কাত হচ্ছে গোটা দ্বীপ। ড্রাগন সেন্টারের প্রতিটি জিনিস, যেগুলো আটকানো নয়, উল্টে পড়ল।

 হামাগুড়ি দিয়ে কামরার এক কোণে সরে গেল ইচিরো সুবোই। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে কোয়োমার দিকে। মনে হচ্ছে আমরা যেন নিচের দিকে ডেবে যাচ্ছি।

কোয়োমা গুঙিয়ে উঠল, দ্বীপ ডুবে যাচ্ছে।

ড্রাগন সেন্টারের আতঙ্কিত লোকেরা জানে না অতিকায় সুনামি শক ওয়েভের ঠিক দুমিনিট পেছনে রয়েছে।

কাদার ভেতর দিয়ে পথ করে নিয়ে হেলে-দুলে এগোচ্ছে বিগ বেন, হডকে নেমে যাচ্ছে ট্রেঞ্চের তলার দিকে। প্রতি মুহূর্তে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে ট্রাক্টর বেল্ট, আড়াআড়ি হয়ে যাচ্ছে বিগ বেন। তারপর আবার বেল্টটা ঢুকে পড়ছে শক্ত মাটিতে, ফিরে পাচ্ছে নিয়ন্ত্রণ।

একটা কালার স্ক্রীন কয়েকটা ডায়াল ও গজ গাইড করছে পিটকে। সোনার লেয়ার স্ক্যানার বাইরের দৃশ্য তুলে ধরছে ওর চোখের সামনে, সেগুলো পরীক্ষা করে নিজের নিয়তি বোঝার চেষ্টা করছে ও।

এখনো যে বেঁচে আছে, এটা একটা বিস্ময় বলে মনে হলো ওর। কারণটাও বোঝা গেল। এদিকে শুধুই নরম মাটির আর কাদা, শক্ত পাথরের কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে, জিওফিজিসিন্টদের হিসাব অনুসারে যথেষ্ট দূরে সরে আসতে ব্যর্থ হওয়ায় ভূমিধস ওর নাগাল পেয়ে যাবে।

ভূমিধসে চাপা পড়বে, কিছুই করার থাকবে না ওর। তবে তার আগে ওকে চেষ্টা করতে হবে প্রথম ধাক্কাটা লাগার সময় ট্রেঞ্চের পাচিল থেকে বিগ বেন যেন ছিটকে না পড়ে। এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে হলে শক্ত মাটির পাঁচিল বা নিরেট পাথরের আড়াল পেতে হবে ওকে।

ভূমিধস নাগাল পেয়ে গেল অন্য কথা, ওর সবচেয়ে বড় বাধা এখনো ট্রেঞ্চটাই। উল্টোদিকে রয়েছে ও। জাপানি উপকূলে পৌঁছুতে হলে প্রথমে ট্রেঞ্চের তলায় নামতে হবে ওকে, তারপর অপর দিকে ঢাল বেয়ে উঠতে হবে।

 পিট জানে না, স্ক্যানার ওকে জানাতে পারেনি, উল্টোদিকের ঢাল বেয়ে ওটা ওর পক্ষে সম্ভব হবে না। একটা কারণ, ঢালটা অসম্ভব খাড়া। আরেকটা কারণ, চালটা শক্ত মাটি দিয়ে তৈরি নয়। তাছাড়া, সাগরের তলায় ঠাটলটা আরো চওড়া ও গম্ভীর হচ্ছে, ঘুরে যাচ্ছে দক্ষিণ-পুবে, অর্থাৎ আটশো কিলোমিটারের মধ্যে পালানোর কোনো সুযোগ দেবে না। স্ক্যানার অবশ্য ওকে জানালো, মহাশক্তিধর সিসমিক ভূমিধস ট্রেঞ্চের পুব পাড় ধরে ছুটে আসছে অবিশ্বাস্য দ্রুতবেগে, কিন্তু জানালো অনেক দেরিতে।

নরম কাদার সঙ্গে সংগ্রাম করছে বিগ বেন, এ সময় ধসটা আঘাত করল। পিট অনুভব করল ওর বাহনের নিচ থেকে সরে গেল মাটি। সে মুহূর্তে নিজের নিয়তি সম্পর্কে নিশ্চিত হলো ও। বুঝল, হেরে গেছে। এ ধরনের বিকট গর্জন কেউ কোনোদিন শুনেছে বলে মনে হয় না, অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল পিটের। দেখতে পেল মৃত্যুর থাবা ওকে ছুঁয়ে দেওয়ার জন্যে লম্বা হয়েছে। পিট শুধু শরীরটাকে শক্ত করে নেওয়ার সময় পেল, চোখের পলকে সুনামির কাদার পাঁচিল গ্রাস করল বিগ বেনকে, সঙ্গে করে ছুটিয়ে নিয়ে চলল কালো গভীর পাতালে।

.

সাগর যেন পাগলা ঘোড়া হয়ে উঠেছে। রাতের আকাশে মাথাচাড়া দিল সুনামি, দ্বীপের কাছাকাছি মগ্ন চড়ায় বাধা পেয়ে আরো উঁচু হলো, প্রায় আশি ফুট। মাতাল সাগর গর্জন করছে, আওয়াজগুলো সোনিক বুম-এর মতো। এরই মধ্যে দ্বীপটার উঁচু বাঁধ ডুবে গেছে, পাহাড় চূড়ার আকৃতি পেয়ে সেটার ওপর আছড়ে পড়ল জলোচ্ছ্বাস।

সমস্ত গাছপালা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। দ্বীপের প্রতিটি দালান মিশে গেল মাটির সঙ্গে, খড়কুটোর মতো ভেসে গেল প্রবল স্রোতে। প্রকৃতির বা মানুষের তৈরি কোনো কিছুই সুনামির তুলনা রহিত শক্তিকে এক পলকের বেশি ঠেকাতে পারল না। সহস্র কোটি টন পানি পথের সামনে যা পেল সবই ধ্বংস করে দিল। দ্বীপটাকে যেন একা দানবের হাত চাপ দিয়ে আরো নামিয়ে দিল নিচের দিকে।

তারপর ধীরে ধীরে পানির নিচে তলিয়ে গেল আজিমা দ্বীপ, আর কোনোদিন মাথা তুলবে না।

 মাত্র আট মিনিট হলো পানির নিচের পরমাণু বোমা, মায়ের নিঃশ্বাস বিস্ফোরিত হয়েছে। শেষ হয়ে গেছে ড্রাগন সেন্টার। কেইটেন প্রজেক্টের কোনো অস্তিত্ব নেই আর।

.

৭৩.

সোসেকি দ্বীপ নেই, ড্রাগন সেন্টার ধ্বংস হয়েছে, খবরটা শুনে ক্লান্ত হাসি হাসলেন ওঁরা।

প্রেসিডেন্ট সিচুয়েশন রুমে নেমে এলেন রেইমন্ড জর্ডান ও ডোনাল্ড কানকে অভিনন্দন জানাবার জন্যে। ভারি খুশি তিনি, সদ্য তৈরি সোনার মেডেলের মতো চকচক করছে মুখ।

 তোমার লোকজন অসম্ভবকে সম্ভব করেছে, বললেন তিনি, জর্ডানের হাতটা নির্মমভাবে পিষছেন। জাতি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ।

 মেইট দলের কৃতিত্ব, সমস্ত প্রশংসা তাদেরই প্রাপ্য, বললেন ডোনাল্ড কার্ন। সত্যি, অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন ওঁরা।

 সে জন্যে মূল্যও কম দিতে হয় নি, নরম সুরে বিড়বিড় করলেন রেইমন্ড জর্ডান। জিম হানামুরা, মার্ভিন শওয়াল্টার এবং ডার্ক পিট। আমি বলব, বিশেষ করে মি. ডার্ক পিটের কথা স্মরণ করে, অনেক চড়া মুল্যই দিতে হয়েছে।

ডার্ক পিটের কোনো খবর নেই? জানতে চাইলেন প্রেসিডেন্ট।

 মাথা নাড়লেন ডোনাল্ড কার্ন।

তার ও বিগ বেন-এর পরিণতি সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। সিসমিক ভূমিধসে চাপা পড়ে গেছে। চাপা পরে গেছে চিরকালের জন্যে।

স্যাটেলাইটও তাঁর বা বিগ বেন-এর কোনো চিহ্ন খুঁজে পায় নি?

বিস্ফোরণের পর প্রথমবার যখন স্যাটেলাইট ওদিক দিয়ে গেল, পানিতে এতো আলোড়ন ছিল যে ডীগ সী মাইনিং ভেহিকেলের কোন ছবি তুলতে পারে নি ক্যামেরা।

 হয়তো পরের বার ওদিক দিয়ে যাবার সময় ছবি পাওয়া যাবে, বললেন প্রেসিডেন্ট। ডার্কের বেঁচে থাকার সামান্যতম সম্ভাবনাও যদি দেখা যায়, আমি চাই তাঁকে উদ্ধারের জন্যে ফুল-স্কেল রেসকিউ মিশন পাঠানো হোক। আমরা বেঁচে আছি এখনো, দুনিয়াটা রক্ষা পেয়েছে, সেটা তার কৃতিত্ব, কাজেই আমরা তাঁকে পিঠ দেখাতে পারি না।

এদিকটা আমি দেখব, প্রতিশ্রুতি দিলেন রেইমন্ড জর্ডান, তবে এরই মধ্যে অন্যান্য প্রজেক্ট নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেছেন তিনি।

অ্যাডমিরাল জেমস স্যানডেকারের খবর কী?

 ড্রাগস সেন্টার থেকে মিসাইল ছোঁড়া হয়েছিল, পাইলট হুইল-আপ ল্যান্ডিং করতে সমর্থ হয়েছেন ওকিনাওয়ার নাহা এয়রফিল্ডে।

হতাহতের রিপোর্ট পাও নি?

 কেউ নিহত বা আহত হয় নি। দু একজন সামান্য ব্যথা পেয়েছে।

সন্তুষ্টচিত্তে মাথা ঝাঁকালেন প্রেসিডেন্ট। জানা গেল কেন ওরা যোগাযোগ রাখতে পারে নি।

সেক্রেটারি অভ স্টেটস, ডগলাস ওটস্ সামনে এগিয়ে এলেন। আরো সুখবর আছে, মি, প্রেসিডেন্ট। রুশ ও ইউরোপিয়ান সার্চ টিম নিজেদের এলাকার প্রায় সবগুলো গাড়ি-বোমার হদিস বের করে ফেলেছে।

 আরও ছটা গাড়ি বোমা পাওয়া গেছে। নিঃশব্দে হাসলেন জাতীয় নিরাপত্তা কমিশন ডিরেক্টর। এখন যেহেতু নিঃশ্বাস ফেলার সময় পেয়েছি, জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত না করে ধীরে সুস্থে বাকিগুলোও খুঁজে বের করা হবে।

কোরোরি ইয়োশিশু ও ইচিরো সুবোই?

ধারণা করা হচ্ছে, ডুবে গেছে তারা।

সবাইকে ধন্যবাদ, বললেন প্রেসিডেন্ট।

বিপদ কেটে গেছে, কিন্তু এরইমধ্যে অন্য আরো অনেক বিপদ মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে। সেদিন বিকেলেই জানা গেল, তুরস্ক ও ইরানের মধ্যে তুমুল গোলাগুলি বিনিময় হয়েছে। এক ঘণ্টা পর রিপোর্ট এলো, একটা মার্কিন কমাসিয়াল এয়াররাইনকে গুলি করে নামিয়েছে কিউবার একটা মিগ-টোয়েনটিফাইভ।

নানা ঝামেলা ও ব্যস্ততার মধ্যে একজন লোককে খুঁজে বের করার পরিকল্পনা ধামাচাপা পড়ে গেল। স্যাটেলাইটের ইমেজ টেকনলজি তার চেয়ে অনেক গুরুত্বপুর্ণ ছবি তুলতে ব্যস্ত। জাপান সাগরের দিকে আসতে আরো প্রায় চার সপ্তাহ সময় লাগল পিরামিডার স্যাটেলাইটের।

তবে বিগ বেন-এর কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেল না।

.

পঞ্চম পর্ব

শোক সংবাদ

১৯ নভেম্বর, ১৯৯৩ দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট

৭৪.

 নুমা অর্থাৎ ন্যাশনাল আন্ডার ওয়াটার অ্যান্ড মেরিন এজেন্সির হেডঅফিস থেকে আজ ঘোষণা করা হয়েছে ডার্ক পিট, স্পেশাল প্রজেক্ট ডিরেক্টর, জাপান সাগরে নিখোঁজ হয়েছেন। ধারণা করা হয়েছে, একটা দুর্ঘটনায় মারা গেছেন তিনি।

তিনি একজন দুঃসাহসিক অভিযাত্রী ছিলেন। বিশেষ করে সাগরের তলা থেকে প্রাচীন জাহাজ উদ্ধারে অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় দেন তিনি। গুপ্তধন আবিষ্কারে তার সাফল্যও বিস্ময়কর। তিনি সেরাপিস নামে প্রি-কলাম্বিয়ান বাইজেন্টিন জাহাজের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন গ্রীনল্যান্ড থেকে; আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারের অবশিষ্টাংশও উদ্ধার করেন তিনি। এছাড়াও, কিউবার লা ডোরান্ডা গুপ্তধন, এবং টাইটানিক জাহাজ উত্তোলনের পেছনেও তার অবদান ছিল।

ক্যালিফোর্নিয়ার সিনেটর জর্জ পিট এবং সুসান পিটের সন্তান ডার্ক, ক্যালিফোর্নিয়ার নিউপোর্ট বীচে জন্মগ্রহণ করেন। এয়ারফোর্সে নাম লেখান এবং বারোতম স্থান অধিকার করে গ্রাজুয়েশন করেন। পাইলট হিসেবে একটানা দশ বছর চাকরিতে ছিলেন তিনি, মেজর পদে উন্নিত হন পরে। পরবর্তীতে অ্যাডমিরাল জেমস স্যানডেকারের অনুরোধে নুমার সঙ্গে পাকাপাকিভাবে যুক্ত হয়ে পরেন।

অ্যাডমিরাল জানিয়েছেন, ডার্ক পিট ছিলেন অত্যন্ত সফল এবং গর্বিত মানুষ। তিনি তাঁর জীবনে বহু মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অ্যাডমিরাল নিজেও আছেন, আছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট মেক্সিকো উপকূলের একটা ঘটনা ছিলো সেটা। তার দৃষ্টিতে, ডার্ক পিটের বৈশিষ্ট্য ছিল ক্রিয়েটিভিটি। কোনো কাজকেই তিনি অসম্ভব বা কঠিন বলে মনে করতেন না।

তিনি এমন একজন মানুষ যাকে ভোলা যায় না।

পিটের হ্যাঙ্গারে রয়েছেন অ্যাডমিরাল স্যানডেকার, একটা প্রাচীন গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টের লেখাটা পড়লেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন তিনি, পিটের জীবনে সাফল্যের পরিমাণ এতো বেশি যে এই অল্প কটা কথায় ওর জীবনী তুলে ধরার চেষ্টাটাকে অন্যায় ও অবিচার বলে মনে হয়।

তাঁর সামনে পায়চারি করছে অ্যাল, চেহারায় কোনো ভাব নেই। পিট নেই, এ আমি ভাবতে পারছি না। কথাটা শান্ত সুরে বলা হলেও, শোনাল হুমকির মতো।

কারো ধারণা ছিল না, এ-ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে। অ্যাডমিরালের মনে হচ্ছে তিনি তার সন্তানকে হারিয়েছেন। আর অ্যালের মনে হচ্ছে সে তার ভাইকে।

বিগ বেন-এ ওর সাথে আমারও থাকা উচিত ছিল, আবার বলল অ্যাল।

মুখ তুলে তাকালেন অ্যাডমিরাল। তাহলে তোমারও কোনো খোঁজ পাওয়া যেত না। তুমিও মারা যেতে।

ওর সাথে আমার না থাকতে পারাটা একটা অপরাধ, নিজেকে আমি কোনোদিন ক্ষমতা করতে পারব না।

পিট সাগরে মারা গেছে। সবসময় তাই চাইতো সে সাগরে মৃত্যু।

আজ এ মুহূর্তে এখানে দাঁড়িয়ে থাকত পিট, বিগ বেন-এর ম্যানিপুলেটরে যদি কাটিং টুল-এর বদলে স্কুপ ফিট করা থাকত, আবার হুমকির মতো শোনাল অ্যালের কণ্ঠস্বর।

উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে অ্যালের দিকে তাকিয়ে ক্লান্তভাবে মাথা নাড়লেন অ্যাডমিরাল। তোমার উদ্ভট কল্পনা পিটকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না।

মুখ তুলে পিটের অ্যাপার্টমেন্টের দিকে তাকালো অ্যাল। আমার মনে হচ্ছে, শুধু নাম ধরে চিৎকার করলেই হবে, সিঁড়ি বেয়ে তর তর করে নেমে আসবে পিট।

অ্যাডমিরাল স্বীকার করলেন, সে-কথা আমারও মনে হয়েছে, কেন জানি না।

হঠাৎ করে খুলে গেল অ্যাপার্টমেন্টের দরজা, মুহূর্তের জন্যে আড়ষ্ট হয়ে গেল ওরা, তারপরই ঢিল পড়ল পেশীতে। খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো তোশি কুদো, হাতের ট্রেতে কাপ ও টিপট। সাবলীল ভঙ্গিতে পাচানো লোহার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো সে, আল আর জেমস স্যানডেকারের দিকে যেন উড়ে এলো।

 ভুরু কুঁচকে অ্যালের দিকে তাকালেন অ্যাডমিরাল আমার কাছে এটা একটা বিস্ময়, তোশিকে নিজের কাছে রাখার অনুমতি কীভাবে তুমি জর্ডানের কাছ থেকে আদায় করলে?

 এর মধ্যে কোনো রহস্য নেই, নিঃশব্দে হেসে বলল অ্যাল। এ ধরনের চুক্তিকে বলা হয়, বিনিময় ব্যবসা। ওকে আমি উপহার হিসেবে পেয়েছি, বদলে কেইটন প্রজেক্ট সম্পর্কে চুপ থাকতে হবে আমাকে।

তোমার ভাগ্য ভালো যে ড্রামে ভরে নদীতে ফেলে দেয় নি।

সব কথা রিপোর্টারদের বলে দেব, এই এক লাইনের একটা হুমকি। দিয়েছিলাম। হুমকি না বলে বলা উচিত ধোকা।

রেইমন্ড জর্ডান ডামি নন, বললেন অ্যাডমিরাল। তিনি তা জানেন।

ঠিক আছে, তাহলে ধরে নিতে হবে আমার কাজে খুশি হয়ে উনি আমাকে উপহারটা দিয়েছেন।

অ্যাডমিরালের পাশে, গাড়ির বনেটে ট্রেটা নামিয়ে রাখল তোশি কুদো। চা, জেন্টেলমেন?

হ্যাঁ, ধন্যবাদ, বললেন অ্যাডমিরাল।

অ্যাল বলল, ওর গাড়িগুলো আমি নিজে দেখাশোনা করব। যততদিন বেঁচে। আছি, হ্যাঙ্গারের ভেতরটা ঠিক এরকমই থাকবে। পিট জানবে, ওর একটা উপকার করছি আমি।

 তুমি এমনভাবে কথা বলছ পিটের যেন পুনর্জন্ম ঘটবে, খসখসে গলায় বললেন স্যানডেকার।

ও মরে নি, বিড়বিড় করল অ্যাল। তার মন পাথরের মতো শক্ত, তবু চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠছে।

.

ওয়াশিংটনে এটা খুব নাম করা একটা রেস্তোরাঁ। টুয়েন্টি ওয়ান ফেডারেল। ভিড়ের মধ্যে স্টেসি ফক্সকে দেখতে পেয়ে টেবিল থেকে হাত নাড়ল কংগ্রেস সদস্য লরেন স্মিথ। মাথার পিছনে চুলগুলো শক্ত করে বেঁধেছে স্টেসি, তার ওপর জড়িয়েছে একটা বড় স্কার্ফ। পরনের পোশাক আনুষ্ঠানিক বলা যাবে না প্যান্টের সঙ্গে ম্যাচ করা কাশ্মিরী টার্টলনেক সোয়েটার, নিচে গ্রে উলের শার্ট।

উলের তৈরি একটা চেক জ্যাকেট লরেনের গায়ে, ব্লাউজটা খাকি, স্কাটটাও উল। চেয়ার ছেড়ে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিল স্টেসির দিকে, শুধু স্টেসি বলেই। তুমি আসতে পারায় সত্যি আমি খুশি হয়েছি।

আন্তরিক হেসে লরেনের হাতটা ধরল স্টেসি। এখানে খাওয়ার খুব শখ ছিল আমার সুযোগ পেয়ে সত্যি আমি কৃতজ্ঞ।

তোমার জন্যে কী বলব? স্টেসি বসার পর জানতে চাইল লরেন।

বাইরে যে ঠাণ্ডা, মার্টিনি হলে মন্দ হয় না।

ওদের ওয়েটার অপেক্ষা করছিল, অর্ডার নিয়ে চলে গেল সে। ন্যাপকিন নিয়ে কোলের ওপর রাখল লরেন। ওয়েক দ্বীপে তোমাকে ধন্যবাদ জানানোর তেমন সুযোগ পাই নি আমি। সবাই আমরা খুব ব্যস্ত ছিলাম।

আমরা সবাই আসলে ডার্কের প্রতি ঋণী।

মুখটা অন্য দিকে ফিরিয়ে নিল লরেন। তার ধারনা ছিল, পিটের মৃত্যু সংবাদ পাবার পর পুরো দুটো দিন এতো কান্নাই কেঁদেছে যে চোখের পানি বলতে আর কিছু অবশিষ্ট নেই, কিন্তু হঠাৎ শুধু নামটা শুনেই আবার ভিজে উঠল চোখ দুটো।

মুখের হাসি নিভে গেল স্টেসির, লরেনের দিকে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো সে। ভাবল কিছু বলবে না। কিন্তু চুপ করে থাকাও সম্ভব হলো না। নিচু স্বরে বলল, পিট আমাকে বলেছে, তোমরা খুব ঘনিষ্ঠ ছিলে।

আমাদের সম্পর্কে উত্থান-পতন ছিল কিন্তু কখনোই একে অপরের থেকে খুব বেশি দূরে ছিলাম না।

কখনো বিয়ের জন্যে ভেবেছিলে? স্টেসি জানতে চায়।

মাথা নাড়লো লরেন। ডার্ক এমন এক মানুষ যাকে বেঁধে রাখা যায় না। সাগর ছিল ওর প্রেমিকা; আর তাছাড়া আমার ক্যারিয়ার নিয়ে আমি ভীষণ ব্যস্ত।

তুমি সত্যিই ভাগ্যবতী মেয়ে। ওর হাসিটা ছিল অসাধারণ, আর ওই সবুজ চোখ যে কোনো মেয়েকে বশ করে ফেলতে পারে। স্টেসি বলে।

হঠাৎ নার্ভাস দেখাল লরেনকে। কী যেন বলতে চায়, কিন্তু বলতে পারছে না।

কী ব্যাপার? জিজ্ঞেস করল স্টেসি।

আমাকে তোমার ক্ষমা করতে হবে। কী যে হয়েছে আমার। কিন্তু আমাকে জানতে হবে। হাতের তালু দুটো পরস্পরের সঙ্গে ঘষছে সে, ইতস্তত ভাবটা কাটিয়ে উঠতে সময় নিচ্ছে।

লরেনের চোখে সরাসরি তাকাল স্টেসি। কি জানতে চাইছে অনুমান করতে পারছি। উত্তরটা হলো, না। মিথ্যে বলছে স্টেসি। একরাতে তার ডেরায় যেতে হয়েছিল আমাকে। কিন্তু সেটা রেইমন্ড জর্ডানের নির্দেশ নিয়ে যাওয়ার জন্যে। বিশ মিনিট পর চলে আসি আমি। কখনোই কাজ ছাড়া কোনো কিছু হয় নি ওর সাথে।

জানি, অদ্ভুত লাগবে শুনতে। লরেন বলে চলে, কিন্তু আমি আর ডার্ক অনেক সময়ই অন্যান্যদের নিয়ে সময় কাটিয়েছি। সবসময় জানতাম, শেষমেষ আমার কাছেই ফিরে আসবে ও।

নিজেও জানো না, কতোটা ভালোবাসো ওকে। তাই না?

হালকা করে মাথা নেড়ে সায় দেয় লরেন। হ্যাঁ। অনেক দেরি হয়ে গেল। বুঝতে বুঝতে।

অন্য কেউ আসবে তোমার জীবনে, স্টেসি একটু তরল গলায় বলে।

জানি, কিন্তু ডার্কের মতো কেউ নয়।

ওদের ড্রিঙ্ক নিয়ে ফিরে এলো ওয়েটার। নিজের গ্লাসটা উঁচু করে ধরল স্টেসি। ডার্ক পিট– একজন অসামান্য মানুষের স্মরণে।

দুটো গ্লাস পরস্পরকে চুল।

চোখ ভরা পানি, লরেন বলল, হ্যাঁ, সত্যি একজন অসামান্য মানুষ… ছিল। ডার্ক।

.

৭৫.

মেরিল্যান্ড, শহরের বাইরে একটা সেফ হাউস। হিদেকি সুমার সঙ্গে লাঞ্চ সারছেন রেইমন্ড জর্ডান। আর কিছু করার আছে আমার, যে কদিন আছেন এখানে দিনগুলো যাতে আরো আরামে কাটে? জানতে চাইলেন তিনি।

কয়েক চামচ নুডল সুপ খেয়ে হাঁসের মাংসে কামড় বসাল হিদেকি সুমা, তাকিয়ে আছে সোনালি ক্যাভিয়ারের দিকে।

হ্যাঁ, একটা উপকার করতে পারেন, বলল সে।

 বলুন, কী উপকার?

দরজায় দাঁড়ানো সিকিউরিটি গার্ড আর তার সঙ্গীর দিকে ইঙ্গিত করল হিদেকি সুমা, দ্বিতীয় লোকটা ওদেরকে পরিবেশন করছে। আপনার লোকেরা শেফ-এর সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে না। তার রান্নার হাত খুব ভালো, আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে অভিনন্দন জানাতে চাই।

 নিউ ইয়র্কের নামকরা সব জাপানি রেস্তোরাঁয় কাজ শিখেছে মেয়েটা। ওর নাম নাটালি, সরকারের বিশেষ দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু না, দুঃখিত, আপনার সাথে তার পরিচয় করিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়।

রেইমন্ড জর্ডান সুমার মুখভাব পরীক্ষা করলেন, সেখানে রাগ বা শত্রুতার চিহ্নমাত্র নেই, কড়া পাহারায় বন্দী করে রাখা হয়েছে বলে হতাশ নয় সে। যে কোনো পরিতৃপ্ত একজন মানুষের সঙ্গে বদলে নেওয়া যাবে তার চেহারা। অল্প মাত্রার ড্রাগ দেওয়া হয়েছে তাকে, চার সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন বারো ঘন্টা করে ইন্টারোগেট করা হয়েছে, তবে চেহারায় তার কোন ছাপ নেই। এরকমই হবার কথা কারণ জর্ডানের এক্সপার্ট ইন্টারোগেটররা পোস্টহিপনোটিক সাজেশন দেয়ায় জেরার কথা কিছুই মনে নেই তার, জানে না নিজের অজান্তে কৌতূহলী একদল বিজ্ঞানী ও এঞ্জিনিয়ারকে যে-সব টেকনিক্যাল ডাটা দান করেছে তার দাম হবে কয়েকশো কোটি ডলার। পেশাদার চোরের মতো সিঁধ কেটে তার মাথা থেকে বের করে নেওয়া হয়েছে মুল্যবান সমস্ত তথ্য।

 সত্যি দুঃখ পেলাম, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল সুমা। ভেবেছিলাম ফেরার সময় ওকে আমি সাথে করে নিয়ে যাব।

তা সম্ভব হবে না, বললেন রেইমন্ড জর্ডান। সুপ শেষ করে আবার মাংসে কামড় দিল সুমা। সাধারণ একজন ক্রিমিন্যালের মতো বেশিদিন আমাকে আপনারা আটকে রাখতে পারনে না। আমি একজন চাষা নই, যাকে নর্দমা থেকে গ্রেফতার করে আনা হয়েছে। আর দেরি না করে আমাকে মুক্তি দিলে নিজেদেরই উপকার করবেন আপনারা।

জোরাল কোনো দাবি নয়, প্রচ্ছন্ন হুমকি। সুমা জানে না তার মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতা বলতে যা ছিল সবই হারিয়েছে সে। জাপানে তার আত্মার শান্তির জন্যে অনুষ্ঠান করা হয়েছে। কোরোরি ইয়োশিশু ও ইচিরো সুবোইর মৃত্যু সংবাদও শোনানো হয় নি তাকে। ড্রাগ সেন্টার যে নেই, তা-ও তাকে বলা হয় নি। তার জানা মতে, কেইটেন প্রজেক্টের গাড়ি-বোমাগুলো এখনো বিভিন্ন দেশে নিরাপদ জায়গায় লুকানো আছে।

যে অপচেষ্টা চালিয়েছিলেন, ঠাণ্ডা সুরে বললেন রেইমন্ড জর্ডান, উচিত ছিল আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল গঠন করে মানব সভ্যতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার দায়ে আপনার বিচার করা। আপনি আসলে ভাগ্যবান।

জাপানকে রক্ষা করা আমার পবিত্র দায়িত্ব, ভারী গলায় বলল সুমা।

নিজেদের রক্ষা করার জন্যে আপনারা অন্যের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলবেন, এ কেমন কথা? আপনার সঙ্গী ব্যবসায়ীদের মধ্যে নীতির কোনো বালাই নেই।

 জাপানি সমাজ অন্য যে-কোনো সমাজের চেয়ে সেরা। আমাদের শক্তিকেও খাটো করে দেখবেন না। সামরিক যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক যুদ্ধের মধ্যে আমি কোনো পার্থক্য দেখি না। যুদ্ধে আবার নীতি কী?

মনে মনে হাল ছেড়ে দিলেন রেই জর্ডান, হিদেকি সুমাকে যুক্তি দিয়ে বোঝানো তার কর্ম নয়। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেন তিনি, বললেন, এবার আমাকে যেতে হয়।

মুখ তুলে তাকাল সুমা। এডো সিটিতে কখন ফিরছি আমি? জানতে চাইল সে।

এক মুহূর্ত তার দিকে চিন্তিতভাবে তাকিয়ে থেকে রেইমন্ড জর্ডান বললেন, কাল।

ধন্যবাদ, স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল সুমা। প্লীজ, লক্ষ রাখবেন এয়ারপোর্টে যেন আমার প্রাইভেট একটা প্লেন অপেক্ষা করে।

ঠিক আছে।

গুড ডে, মি. জর্ডান।

গড ডে, মি. সুমা। আশা করি কোনো রকম কষ্ট পেয়ে থাকলে আমাকে আপনি ক্ষমা করবেন।

 সুমার ঠোঁট দুটো পরস্পরকে চেপে ধরল। আধবোজা চোখে রেইমন্ড জর্ডানকে দেখল সে। না, মি. জর্ডান, আপনাকে ক্ষমা করতে পারব না। এ-ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই, আমাকে বন্দী করার জন্যে চড়া মূল্য দিতে হবে আপনাদেরকে। হাত নেড়ে প্রতিপক্ষকে বিদায় করে দিল সে, ন্যাপকিনে মুখ মুছে কাপে চা ঢালল।

সেফ হাউসের আরেক কামরায় অপেক্ষা করছিলেন কার্ন। রেইমন্ড জর্ডানকে ভেতরে ঢুকতে দেখে জানতে চাইলেন, কেমন হলো লাঞ্চ?

খাবারগুলো ভালই ছিল, সঙ্গীটি ছিল উন্মাদ। তোমার লাঞ্চ?

কিচেনে বসে খাবার সময় সুমার বক্তব্য শুনলাম। নাটালি আমাকে হ্যামবার্গার খাইয়েছে।

ভাগ্যবান।

সুমাকে দেখে কী মনে হলো?

 ওকে বলেছি কাল ছেড়ে দেব।

 শুনেছি। সুটকেস গোছানোর কথা মনে থাকবে তার?

হাসলেন রেইমন্ড জর্ডান। আজ রাতের ইন্টারোগেশন সেশনে চিন্তাটা ওর মাথা থেকে মুছে ফেলা হবে।

ধীরে ধীরে মাথা ঝাঁকালেন ডোনাল্ড কার্ন। আর কতদিন ইন্টাররোগেট করা হবে ওকে?

যতদিন না সে যা জানে আমরাও তা জানতে পারি।

 তাতে এক বছর সময় লেগে যেতে পারে।

লাগল।

তাকে ছিবড়ে বানাবার পর?

 মানে?

চিরকাল তাকে আমরা লুকিয়ে রাখতে পারি না। আবার ছেড়ে দিয়ে যদি জাপানে চলে যেতে দিই, নিজেদের পায়ে কুড়াল মারা হবে।

চেহারায় কোনো পরিবর্তন নেই, তোনান্ডের দিকে তাকিয়ে থাকলেন রেইমন্ড জর্ডান। সুমার যখন আর নতুন কিছু বলার থাকবে না, নাটালি তার নুডল সুপে কিছু একটা মেশাবে।

.

আমি দুঃখিত, মি. প্রেসিডেন্ট। আমার হাত-পা বাঁধা।

কনফারেন্স রুমে রয়েছেন ওঁরা, টেবিলের উল্টো দিকে বসা শক্ত-সমর্থ মানুষটার দিকে ঠাণ্ডা চোখে তাকালেন প্রেসিডেন্ট। শক্ত-সমর্থ ও বেঁটে, সফল রাজনৈতিক নেতা হলেও দেখে মনে হবে সামরিক কর্মকর্তা।

জাপানের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রীয় সফরে ওয়াশিংটনে এসেছেন। সফরসঙ্গী হিসেবে এসেছেন দুজন মন্ত্রী, পাঁচজন উপদেষ্টা। তার দুপাশে বসেছেন তাঁরা।

দুঃখিত আমিও, মি. প্রাইম মিনিস্টার, বললেন প্রেসিডেন্ট। তবে যদি ভেবে থাকেন গত কয়েক হপ্তার ঘটনা ধামাচাপা দেয়া সম্ভব, মারাত্মক ভুল করবেন। আপনি। ইচ্ছে করেই কুটনৈতিক ভাষা পরিহার করেছেন তিনি।

হিদেকি সুমা, ইচিরো সুবোই ও কোরোরি ইয়োশিশু যদি অন্যায় কিছু করে থাকে, সেজন্যে শুধু তারাই দায়ী। ওদের সাথে জাপান সরকার বা জনসাধারণের কোনো সম্পর্ক নেই বা ছিল না। আপনি বলছেন যুক্তরাষ্ট্রের ও গভীর সাগরে নিউক্লিয়ার বোমা ফাটিয়েছে ওরা। সে রকম যদি কিছু ঘটে তাকে, আমি বলব, গোপনে নিজেদের সর্বনাশ করেছে ওরা। জাপান সরকার সে জন্যে দায়ী নয়।

মিটিংটা জটিল হয়ে উঠছে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী ও তার উপদেষ্টারা নিরেট পাঁচিলের ভূমিকা নিয়েছিলেন। প্রথমে তারা অভিযোগগুলোকে অবাস্তব ও বানোয়াট বলে অভিহিত করেছিলেন। আধ ঘণ্টা আলোচনার পর খানিকটা নরম হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তবে যা ঘটেছে তার দায়-দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে নিতে রাজি নন।

আপনার সাথে একা কথা বলতে চাই আমি, বললেন প্রেসিডেন্ট। মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের বলুন তারা যেন পাশের কামরায় অপেক্ষা করেন। শুধু আপনার ইন্টারপ্রেটার থাকুক।

অনুরোধটা অনুবাদ করার পর প্রধানমন্ত্রীর চেহারা লালচে হয়ে উঠল। ব্যাপারটা তার পছন্দ হয় নি। প্রেসিডেন্ট হাসছেন, তবে তাঁর চোখে হাসি নেই। আপনার অনুরোধ আরেকবার বিবেচনা করুন, বললেন প্রধানমন্ত্রী। উপদেষ্টারা উপস্থিত থাকলে আমাদের দুপক্ষেরই সুবিধে।

দেখতেই পাচ্ছেন, ইঙ্গিতে কিডনি আকৃতির টেবিলটা দেখালেন প্রেসিডেন্ট, আমার সঙ্গে কেউ নেই।

উপদেষ্টা ও মন্ত্রীদের সঙ্গে নিচু স্বরে কিছুক্ষণ আলাপ করলেন প্রধানমন্ত্রী, তারপর প্রেসিডেন্টের দিকে ফিরে বললেন, আপনার অনুরোধ স্বাভাবিক প্রোটোকল ক্ষুণ্ণ করছে। আমি প্রতিবাদ জানাচ্ছি।

 অনুবাদ শোনার পর প্রেসিডেন্ট স্পষ্ট কণ্ঠে জানিয়ে দিলেন, এখানে আমরা খেলা করতে বসি নি, মি. প্রাইম মিনিস্টার। হয় আপনার লোকজন কামরা থেকে বেরিয়ে যাবেন, নয়তো আমি।

ঝাড়া তিন সেকেন্ড চিন্তা করার পর প্রধানমন্ত্রী ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকালেন। বেশ। আবার তিনি কথা বললেন উপদেষ্টাদের সঙ্গে।

কামরা থেকে বেরিয়ে গেলেন তারা। নিজের ইন্টারপ্রেটারের দিকে তাকালেন প্রেসিডেন্ট, বললেন, আমি যা বলব ঠিক তাই অনুবাদ করবে, কড়া ভাষার ওপর মধুর প্রলেপ লাগাবার দরকার নেই।

বুঝেছি, সার।

 প্রধানমন্ত্রীর দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকালেন প্রেসিডেন্ট। আমাদের কাছে ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট আছে, কাজেই এসব তথ্য আপনি অস্বীকার করতে পারবেন।, মি. প্রাইম মিনিস্টার। সুমা ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা কী করতে যাচ্ছে, প্রথম থেকেই সব আপনি ও আপনার মন্ত্রিসভার অনেক সদস্য জানতেন। অ্যাটম বোমা তৈরির ওদের চেষ্টাকে আপনি নীরবে সমর্থন করেছেন। গোল্ডেন ড্রাগন নামে একটা আন্ডারওয়ার্ল্ড সংগঠন ভয়ঙ্কর একটা প্রজেক্টে অর্থ যোগান দিচ্ছে, তা-ও আপনি ও আপনার সহকারীরা জানতেন। কেইটেন প্রজেক্টের আসল উদ্দেশ্য, জাপানকে ব্ল্যাকমেলারের ভূমিকায় দাঁড় করানো। সমস্ত কিছু গোপনে করা হয়, এখন আবার এড়িয়ে যাবার যাবার চেষ্টা করছেন কিছুই না জানার ভান করে। সব জেনেশুনেও চুপ করে থেকে ওদেরকে আপনি সমর্থন যুগিয়েছেন।

অনুবাদ শোনার পর টেবিলে ঘুষি মারলেন প্রধানমন্ত্রী। এ সব অভিযোগ ভিত্তিহীন।

আমাদের ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট মিথ্যে হতে পারে না। আন্ডারওয়ার্ল্ডের পরিচিত অপরাধীরা নতুন সাম্রাজ্য গড়ে তোলার জন্যে কাজ করছিল, এ খবর একজন প্রধানমন্ত্রী হয়ে আপনি রাখেন নি, এটা কি বিশ্বাস করা যায়? আপনি সব জেনেও চুপ করে ছিলেন, সেটাই ওদেরকে উৎসাহ যুগিয়েছে। আপনারও ইচ্ছে ছিল, জাপান অ্যাটম বোমার মালিক হোক, সারা দুনিয়ায় অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলুক।

 চেহারা রক্তশূন্য হয়ে গেল, কথা বলতে পারলেন না প্রধানমন্ত্রী। দেয়ালের লিখন তিনি পড়তে পারছেন। মুখে চুনকালি মাখানো হবে, এ ভয়ে অস্থির হয়ে উঠলেন তিনি।

তাঁর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন প্রেসিডেন্ট। এখানে আমরা কারো ব্যক্তিগত আত্মমর্যাদা নিয়ে আলোচনা করতে বসি নি। কিছু কিছু ব্যাপার নিয়ে আমেরিকা ও জাপানের মধ্যে চিরকালই মন কষাকষি হবে। তবে পরস্পরকে ছাড়া আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা অসম্ভব।

প্রধানমন্ত্রী উপলব্ধি করলেন, বাঁচার জন্যে তাঁর দিকে একটা রশি ছুঁড়ে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট। খপ করে সেটা ধরে ফেললেন তিনি।

আপনার প্রস্তাবটা বলুন।

জাতি ও রাষ্ট্রকে কেলেঙ্কারি থেকে বাঁচানোর জন্যে পদত্যাগ করবেন আপনি। আপনার ও আমার সরকারের মধ্যে যে পারস্পরিক বিশ্বাস ছিল তা নষ্ট হয়ে গেছে। এ ক্ষতি পুরণ করা সম্ভব হবে না। শুধু নুতন একজন প্রাইম মিনিস্টার এবং সৎ ও রুচিশীল সদস্যদের নিয়ে গঠিত একটা নতুন মন্ত্রিসভার পক্ষে দুদেশের মধ্যে সুসম্পর্ক ফিরিয়ে আনা সম্ভব। আশা করা যায়, তখন আমরা আমাদের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যাগুলো নিয়ে ফলপ্রসু আলোচনা বসতে পারব।

ঘটনাটা তাহলে গোপনই থাকবে?

 আমি কথা দিচ্ছি, ড্রাগন সেন্টার এবং কেইটেন প্রজেক্ট সম্পর্কে সমস্ত তথ্য এদিক থেকে গোপন থাকবে।

কিন্তু আমি যদি পদত্যাগ না করি?

চেয়ারে হেলান দিয়ে হাত দুটো মেলে ধরলেন প্রেসিডেন্ট। সেক্ষেত্রে আমাকে ভবিষ্যদ্বাণী করতে হবে যে জাপানি ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা বিষম একটা ধাক্কা খেতে যাচ্ছে।

চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন প্রধানমন্ত্রী। আমাকে তাহলে বুঝতে হবে, মি. প্রেসিডেন্ট, আমেরিকায় জাপানি পণ্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করার হুমকি দিচ্ছেন আপনি?

হুমকি দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, ঘোষণা করারও, বললেন প্রেসিডেন্ট। কারণ, আমেরিকানরা যদি জানে যে জাপানে তৈরি অনেকগুলো অ্যাটম বোমা তাদের দেশে পাঠানো হয়েছিল, তার মধ্যে একটা ফাটানোও হয়েছে, জীবনে কখনো তারা কেউ আপনাদের পণ্য কিনবে বলে মনে হয় না আমার।

.

২১ নভেম্বর, ১৯৯৩, মার্কাস দ্বীপ

.

৭৬.

জাপানের দক্ষিণ পূর্ব থেকে এক হাজার একশো পঁচিশ কিলোমিটার দূরে মার্কাস আইল্যান্ড। সেই আদিকাল থেকে নিঃসঙ্গ, আশপাশে আর কোনো দ্বীপ নেই। দ্বীপটা প্রবালপ্রাচীরে ঘেরা, তীরগুলো নিখুঁত একটা ত্রিভুজ তৈরি করেছে, ত্রিভুজের প্রতিটি বাহু দৈর্ঘ্যে প্রায় দেড় কিলোমিটার।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকানরা মার্কাস দ্বীপে শুধু শুধু কয়েকটা বোমা ফেলেছিল, তখনই দ্বীপটার নাম কিছু কিছু মানুষ শুনেছে। তারপর ওটার কথা আর কেউ মনে রাখে নি। বছর চার-পাঁচ আগে হঠাৎ এক জাপানি ব্যবসায়ী দ্বীপটার নির্জন সৈকতে হাজির হন, তার ধারনা হয় টুরিস্টদের জন্যে জায়গাটা স্বর্গ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তার অক্লান্ত পরিশ্রম ও উৎসাহেই মার্কাস দ্বীপ একটা বিলাসবহুল রিসর্ট হিসেবে গড়ে উঠেছে।

ছবির মতো সুন্দর একটা গ্রাম তৈরি করেছেন ভদ্রলোক। একটা গলফ কোর্স আছে, আছে একটা ক্যাসিনো ও তিনটে রেস্তোরাঁ, ককটেল লাউঞ্জ, ড্যান্স ফ্লোর, একটা থিয়েটার, বিরাট পদ্ম আকৃতির সুইমিং পুল, ছটা টেনিস কোর্ট। ছোট একা এয়ারফিল্ডও আছে, ফলে দ্বীপে আর কোনো জায়গা খালি পড়ে নেই।

 রিসর্টের কাজ শেষ হবার পর দেখাবার জন্যে সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়, ফিরে গিয়ে যার যার কাগজে প্রতিবেদন লেখেন তাঁরা। অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় টুরিস্টদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে মার্কাস দ্বীপ। তবে জাপানি ট্যুরিস্টদের চেয়ে বিদেশি টুরিস্টরাই বেশি আসে এখানে, বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, তাইওয়ান ও কোরিয়ান ট্যুরিস্টরা।

মধুচন্দ্রিমার জন্যে মার্কাস দ্বীপ আদর্শ জায়গা। পাম গাছের ছায়ায় বাংলোগুলোর সদ্য বিবাহিত দম্পতিরা হেসে-খেলে অলস সময় কাটায়।

ব্রিসবেনের বাসিন্দা, ব্রয়ান ফস্টার পানি থেকে সৈকতে উঠে এলো। শেষ বিকেলেও গরম হয়ে আছে সাদা বালি, ভেজা গা নিয়ে সে তার নতুন বউয়ের দিকে হাঁটছে। একটা লাউঞ্জ চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে ঢুলছে শেলি। স্ত্রীর দিকে এগোবার সময় ঘাড় ফিরিয়ে পানির দিকে একবার তাকালো ফস্টার।

 ওরা কোরিয়ান দম্পতি, কিম ও লি সাং, ওদের পাশের বাংলোতেই থাকে। রিসর্টের একজন উৎসাহী ইনস্ট্রকটরের কাছে উইন্ডসার্ফিং-এর কলা কৌশল শিখছে দুজনে। ওদেরও খানিক সামনে, নিউজিল্যান্ডার এডওয়ার্ড কেইন স্নরকেল-এ চড়ে ছুটছে, পেছনে একটা ম্যাট-এর ওপর ভেসে রয়েছে তার স্ত্রী ময়রা। ওরাও সদ্য বিবাহিত।

স্ত্রীকে হালকা চুমো খেয়ে উদোম পিঠে একবার হাত বুলার ফস্টার। শেলির পাশে বালির ওপর শুয়ে পড়ল সে, চোখে সানগ্লাস তুলে অলস দৃষ্টিতে আবার তাকাল পানির দিকে।

কিম ও লি সাং উইন্ডসার্ফিং শিখতে হিমশিম খাচ্ছে। পাল তোলার আগেই ভারসাম্য হারিয়ে বারবার পড়ে যাচ্ছে পানিতে।

 এডওয়ার্ড কেইন ও ময়রার দিকে তাকাল ফস্টার। পানিতে না পড়ে ম্যাটের ওপর পাশ ফিরল ময়রা, তারপর চিৎ হলো। এক প্রস্থে তৈরি সোনালি বেদিং স্যুট পরেছে সে, শরীরের বিশেষ কিছু ঢাকা পড়ে নি। তাকিয়ে থাকার মতো একটা ফিগার, মনে মনে প্রশংসা করল ফস্টার। তার স্বামীরকেল নিয়ে পানির নিচে রয়েছে।

হঠাৎ কি যেন একটা ধরা পড়ল ফস্টারের চোখে। প্রবাল রীফ কেটে চ্যানেলের ঠিক মুখে, পানির তলায়, কি যেন একটা ঘটছে। ফস্টারের মনে হলো, সম্ভবত কোনো সামুদ্রিক প্রাণি পানির তলায় আলোড়ন তুলছে। জিনিসটা কি দেখতে না পেলেও, বোঝা গেল রীফের ভেতর দিয়ে খাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে ওটা।

 সাবধান! চিৎকার করল ফস্টার, লাফ দিয়ে দাঁড়ালো। স্ত্রীকে বলল, ওখানে ওটা কী বলল তো? উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে সৈকত ধরে ছুটলো সে, হাত তুলে আলোড়িত পানির দিকটা দেখাচ্ছে আর চিৎকার করছে, সাবধান! বিপদ! সাবধান!

 তার চিৎকার শুনে সুইজিং পুল ও রেস্তোরাঁ থেকে ছুটে এলো অনেক লোক, পানির কিনারায় ভিড় করল সবাই।

কিম ও লি সাঙের ইন্সট্রাকটর ফস্টারের চিৎকার শুনতে পেল। তার হাত অনুসরণ করে তাকাতেই পানির নিচে আলোড়ন দেখতে পেল সে, এদিকেই এগিয়ে আসছে। কিম ও লি সাঙকে তীরে ফেলার জন্যে তাগাদা দিল সে। লাফ দিয়ে সেইলবোর্ডে চড়ে এডওয়ার্ড কেইন আর তার স্ত্রীকে সাবধান করার জন্যে ছুটলো। পানির তলায় অলস ভঙ্গিতে ভেসে যাচ্ছে এডওয়ার্ড কেইন, জানে না রহস্যময় একটা প্রাণি বা অন্য কিছু সরাসরি এগিয়ে আসছে ওদের দিকেই।

একটা গুঞ্জন ঢুকল কেইনের কানে। আন্দাজ করল, কেউ বোধহয় পানিতে স্কি করছে। তারপর হঠাৎ সে দেখল, আশপাশের সমস্ত মাছ একযোগে ছুটে পালালো। ভয়ে শরীরটা শিরশির করে উঠল তার। ধারণা করল, খাঁড়িতে নিশ্চয়ই হাঙর ঢুকে পড়েছে।

পানির ওপর মাথা তুলল কেইন, চারদিকে তাকিয়ে হাঙরের ফিন খুঁজলো। নেই দেখে খানিকটা স্বস্তিবোধ করল সে। দেখল একটা সেনইলবোর্ড এগিয়ে আসছে, আর তার স্ত্রী ফ্লোটিং প্যাডে ঝিমাচ্ছে, এ সময় চিৎকার শুনে সৈকতের দিকে তাকালো সে। রিসর্টের প্রায় সব লোকই ভিড় করেছে ওখানে, উন্মেত্তের মতো হাত নেড়ে চ্যানেলের প্রবেশপথটা দেখাচ্ছে তারা। সেদিকে তাকিয়ে তুমুল আলোড়নটা সেও এবার দেখতে পেল।

 পানি থেকে একটা কাঁপুনি উঠছে, অনুভব করে আবার ডুব দিল কেইন। ভাবছে, কী হতে পারে জিনিসটা? স্বচ্ছ পানি, মাত্র পঞ্চাশ মিটার দুরে, কি ওটা? সবুজ ও খয়েরি মাটিতে ঢাকা বিশাল একটা আকৃতিবিহীন কাঠামো ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো তার চোখের সামনে।

স্ত্রীর ফ্লোটিং ম্যাট খপ করে ধরে দ্রুত সাঁতার কেটে এগোল কেইন। কাছেই প্রবালের একটা ঢাল পানির ওপর মাথা তুলেছে, নিরাপদ ভেবে সেদিকেই যাচ্ছে সে।

পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল কিমুতকিমাকার কাঠামোটা, ওদের কোনো ক্ষতি না করেই সরাসরি সৈকতের দিকে এগোচ্ছে।

অচেনা ও রহস্যময় একটা সামুদ্রিক দানবের মতো খাড়ির তলা থেকে মাথা তুলল ওটা। দেখে সভয়ে পিছিয়ে গেল রিসর্টের অতিথি ও কর্মীরা। কাঠামোটার চারদিকে থেকে হড়হড় করে পানি গড়াচ্ছে, ওটার নিচে থরথর করে কাঁপছে বালির জমিন, সৈকত ধরে উঠে এসে একজোড়া পাম গাছের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ল।

 জমাট বাঁধা নিস্তব্ধতার ভেতর স্থির দাঁড়িয়ে আছে সবাই, পায়ে যেন শিকড় গজিয়েছে, কারো চোখে পলক নেই। এখন ওরা দেখতে পাচ্ছে, জিনিসটা আসলে প্রকাণ্ড একটা মেকানিকাল ভেহিকেল, ওপর দিকে চুরুট আকৃতির চূড়া। দুটো যান্ত্রিক বাহু শূন্যে উঠল। সামুদ্রিক আগাছা ও শ্যাওলা ঝুলে রয়েছে বাহনটার গায়ে। ধাতব একটা শব্দ হলো, সেই সঙ্গে খুলে গেল চূড়ান্ত হ্যাঁচ। এলোমেলো কালো চুলসহ একটা মুখ উঁকি দিল বাইরে, দৃষ্টিতে সরল কৌতুক। ভিড়টার ওপর চোখ বুলালো আগন্তুক, সবুজ চোখের দৃষ্টি স্থির হলো সাদা অ্যাপ্রাণ পরা এক যুবকের ওপর। তারপর হঠাৎ ঠোঁট ফাঁক করে হাসল সে, জানতে চাইল, ভুল হলে ক্ষমা চাই, তুমি আসলে একজন ওয়েটার?

ইয়েস…স্যার।

খুশির খবর। একমাস ধরে শুধু বোলোঙা স্যান্ডউইচ আর কফি খেয়ে ঘেন্না ঘরে গেছে আমার। এখন আমি এক প্লেট গলদা চিংড়ি স্যালাড আর কড়া টেকুইলা পেতে পারি কি?

চার ঘণ্টা পর, ইতোমধ্যে সুস্বাদু খাবারে পেট ভরে নিয়েছে, জীবনের সবচেয়ে উপভোগ্য ও আরামপ্রদ ঘুমে তলিয়ে গেল ডার্ক পিট।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *