৬০. প্লেনটা কয়েক মিটার দূরে

৬০.

সি-২০ জেটে সুমা, তোশি ও সিনেটর ডিয়াজ ওঠার পর লরেনকে নিয়ে সেদিকে এগোল পিট। প্লেনটা কয়েক মিটার দূরে থাকতে দাঁড়িয়ে পড়ল লরেন। আবার কবে দেখা হবে? নরম সুরে জানতে চাইল সে।

দুজনেই আমরা ব্যস্ত জীবন-যাপন করি, বলল পিট। আমাদের শিডিউল কখনো ম্যাচ করে না।

কি জানি, হয়তো কোনোদিন  ধীরে, মিইয়ে যায় লরেনের গলা।

হ্যাঁ। কোনোদিন। সমর্থন জোগায় ডার্ক।

তুমি ফিরে যাচ্ছ না আমেরিকায়? অস্বস্তি ভরে জানতে চাইলো লরেন।

কাঁধ ঝাঁকাল পিট। জানি না। অ্যাল আর আমাকে এখান থেকে যেতে বলা হয়েছে।

 এখন ওরা তোমাকে আবারো ওই দ্বীপে ফিরে যেতে বলতে পারে না। অন্তত এ মুহূর্তে নয়।

 আমি একজন মেরিন এঞ্জিনিয়ার ভুলে গেলে? ড্রাগন সেন্টার আক্রমণ করতে হলে ওরা আমার সাহায্য চাইতেই পারে।

 তুমি যদি বলো তো আমি প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলতে পারি। তুমি আর অ্যাল যাতে ছুটি পাও, তার ব্যবস্থা করা আমার পক্ষে সম্ভব।

এর মধ্যে তুমি আবার নাক গলিয়ো না। হেসে উঠল পিট।

পায়ের পাতার উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ডার্কের ঠোঁটে চুমো খেলো লরেন।

সবকিছুর জন্যে ধন্যবাদ।

পিট হাসে। সুন্দরী মেয়েদের জন্যে আমি সবকিছু করতে রাজী!

ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকল পিট, লরেনের দিকে তাকিয়ে আছে। সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছে সে। জানালায় তার মুখ দেখা গেল। পরস্পরের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ল ওরা।

প্লেন আকাশে উঠে পরার পর নিচে তাকিয়ে পিটকে দেখতে পেলো না লরেন।

.

৬১.

ইচিরো সুবোইর মাথায় যেন আগুন ধরে গেল। ব্যাপারটা তার বিশ্বাস হতে চাইল না। টোকিও থেকে প্রথমে এড়ো সিটিতে, তারপর ড্রাগন সেন্টারে এসেছে সে ব্যক্তিগতভাবে কেইটেন প্রজেক্টের কমান্ড নিজের হাতে তুলে নেয়ার জন্যে। এ মুহূর্তে কন্ট্রোল রুমে দাঁড়িয়ে রাগে কাঁপছে। কী বলছ বুঝতে পারছি না! কেন বলছ কোনো গাড়ি-বোমাই তোমাদের পক্ষে ফাটানো সম্ভব নয়?

তাকেদা কোরোজিমা, ড্রাগন সেন্টারের চীফ ডিরেক্টর, আড়ক্ট ও দিশেহারা বোধ করছে। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা এঞ্জিনিয়ার ও বিজ্ঞানীদের দিকে অসহায়ভাবে তাকাল সে সমর্থনের আশায়। কিন্তু সবাই তারা মেঝের দিকে তাকিয়ে, যেন আশা করছে ধরণী তাদেরকে গিলে নেবে। কোড জানেন একা শুধু মি, সুমা, অবশেষে বলল সে। প্রাইম ও ডিটোনেট সিগন্যাল পাঠানোর জন্যে কোড সিস্টেমটা উনি ব্যক্তিগতভাবে নিজে প্রোগ্রাম করেছেন।

কোড রিপ্রোগ্রাম করতে কতক্ষণ লাগবে?

আবার স্টাফদের দিকে তাকালো তাকেদা কোরোজিমা। নিজেদের মধ্যে বিড়বিড় করছে তারা। তারপর, নিজেরা একমত হয়ে, এক পা সামনে বাড়ল সবাই ফিসফিস করে কী বলল কিছুই বোঝা গেল না।

কি…কি বললে তোমরা?

 দুমিনিট পর ইচিরো সুবোইর দিকে তাকাল তাকেদা কোরোজিমা। সময় লাগবে তিন দিন। মি. সুমার কমান্ড কোড মুছে সিস্টেমটা রিপ্রোগ্রাম করতে।

নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করল সবুই ইচিয়োর তিন দিন?

কাজটা সহজ নয়।

দুদিন আটচল্লিশ ঘণ্টা। এর মধ্যে কেইটেন প্রজেক্টকে পুরোপুরি অপারেশন্যাল করতে হবে আপনাদের। দাঁতে দাঁত চাপল ইচিরো সুবোই, ড্রাগন সেন্টারের কন্ট্রোল রুমে পায়চারি শুরু করল। হিদেকি সুমাকে তার শিয়ালের মতো চতুর বলে মনে হলো। লোকটা কাউকে বিশ্বাস করে নি, এমন কি ঘনিষ্ঠ ও প্রাচীন বন্ধু বৃদ্ধ কোরোরি ইয়োশিশুকেও নয়।

এ সময় টোকিও থেকে ফোন এলো। কোরোরি ইয়োশিশু, ইচিরো সুবোইকে চাইলেন।

জ্বী, মি. ইয়োশিশু, আমি ইচিরো বলছি।

মার্কিন জাহাজ থেকে একটা মেসেজ পাঠানো হয়েছে, আমাদের ইন্টেলিজেন্স আড়িপাতা যন্ত্রে ধরে ফেলেছে সেটা, বললেন বৃদ্ধ কোরোরি ইয়োশিশু। মেসেজটা হলো, সুমার প্লেনটাকে গুলি করে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আমাদের পাইলটরা কি সুমার প্লেনটাকে সত্যি সাগরে পড়তে দেখেছে?

ফিরে এসেছে মাত্র একজন। শুনলাম সে তার রিপোর্টে বলেছে, জাহাজের গোলা এড়াতেই ব্যস্ত ছিল, তার মিসাইল টার্গেটে লেগেছে কিনা বলতে পারবে না।

আমেরিকানদের এটা একটা চাল হতে পারে।

আমাদের একটা অবজারভার স্যাটেলাইটকে জাহাজটার ওপর দিয়ে যাবার জন্যে প্রোগ্রাম করতে পারলে জানা যাবে।

জাহাজে যদি প্লেনটাকে দেখা যায়? কোরোরি ইয়োশিশু জানতে চাইলেন।

জানা গেলেও তখন অনেক দেরি হয়ে যাবে, বলল ইচিরো সুবোই। মার্কিন ইন্টেলিজেন্স ফোর্সের হাত থেকে সুমাকে ছিনিয়ে আনার ক্ষমতা আমাদের নেই।

কথা বলাবার জন্যে তার ওপর ড্রাগ ব্যবহার করবে ওরা। গাড়ি-বোমাগুলো কোথায় আছে জানতে খুব বেশি সময় নেবে না। পরিস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বর, ইচিরো সুবোই। কেইটেন প্রজেক্ট সফল করতে হলে আমাদের আর সময় নষ্ট করা চলে না।

এদিকে অন্য এক সমস্যা দেখা দিয়েছে, বলল ইচিরো। প্রাইম ও ডিটোনেট সিগন্যাল অ্যাকটিভ করার অপারেশন্যাল কোড একা শুধু সুমা জানতো।

অপরপ্রান্তে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকার পর কোরোরি ইয়োশিশু বলেন, আমরা তো আগে থেকে জানি। তার বুদ্ধিতে খুব ধার।

একটু বেশি ধার।

সমস্যা সমাধানের জন্যে তোমার ওপর নির্ভর করছি আমি, ভারী গলায় বললেন কোরোরি ইয়োশিশু।

আপনার বিশ্বাসের মর্যাদা অবশ্যই রাখব আমি। রিসিভার রেখে দিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেল ইচিরো সুবোই। যুক্তরাষ্ট্র আঘাত হানবে, জানা কথা। আঘাতটা যাতে এখুনি না আসে, তার ব্যবস্থা করা দরকার। ঝাড়া এক মিনিট চিন্তা করার পর তার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। কন্ট্রোল রুমের সবাই তার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছে। তাদের দিকে ফিরে সে জানতে চাইল, ম্যানুয়ালি একটা গাড়িবোমা ফাটানো খুব কি কঠিন?

তাকেদা কোরোজিমার একটা ভুরু প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে উঠল। কোডেড সিগন্যাল ছাড়া?

হ্যাঁ।

তাকেদা কোরোজিমা একবার মাথা নোয়াল, তারপর কঠিন সব শব্দ সহযোগে ব্যাখ্যা শুরু করল।

রেগে গিয়ে ইচিরো সুবোই বলল, আপনার লেকচার কে শুনতে চায়? সহজ ভাষায় বলুন একটা গাড়ি-বোমা কীভাবে ফাটানো যায়।

ভেলোসিটির সাহায্যে ফাটানো সম্ভব। কমপ্রেসর শেল-এর ভেতর একটা হাই-ভেলোসিটি বুলেট লাগবে।

কটমট করে তাকাল ইচিরো সুবোই। আপনি বলতে চাইছেন রাইফেলের গুলি ছুঁড়ে ফাটাতে হবে ওগুলো?

ম্যানুয়ালি, হ্যাঁ। একেবার কাছ থেকে ছুঁড়তে হবে।

অবিশ্বাসের শেষ সীমায় পৌঁছে গেল ইচিরো সুবোই। তাহলে একটা রোবটকে প্রোগ্রাম করা হয় নি কেন, রাইফেল দিয়ে এয়ারকন্ডিশনারে গুলি করার জন্যে?

এখানেও সময়ের প্রশ্ন এসে যায়, তাকেদা কোরোজিমা বলল। ডিটোনেশন সাইটে গাড়ি নিয়ে যাবার প্রোগ্রাম করা হয়েছে রোবটকে, তাকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে অন্য কোনো কাজে লাগবে না। আপনি জানেন, আমাদের সব কাজই জরুরি ভিত্তিতে তাড়াহুড়োর সাথে সারা হয়েছে।

একটা রোবো গার্ডকে মডিফাই করা যায় না?

সিকিউরিটি রোবটের ডিজাইন করা হয়েছে চলাফেরা ও গুলি ছোঁড়ার জন্যে ওগুলো গাড়ি চালাতে পারবে না।

কাজটা করতে পারবে এ রকম একটা রোবট তৈরি করতে অসুবিধে কী? কী রকম সময় লাগবে?

কয়েক সপ্তাহ, এক মাসের কম নয়।

পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে একটা গাড়ি-বোমা অবশ্যই ফাটাতে হবে। আমরা আঘাত হানতে পারি, এটা প্রমাণ করতে না পারলে ড্রাগন সেন্টার ধ্বংস করে দেবে আমেরিকা।

সেক্ষেত্রে, মি. ইচিরো সুবোই, একজন লোক দরকার আমাদের। একেবারে কাছ থেকে গুলি করে বোমাটা ফাটাতে হবে তাকে। সমস্যা হলো, ওটা একটা অ্যাটম বোমা।

.

৬২.

 বৈঠক করছেন মেল পেনার। ইঙ্গিতে দুই ভদ্রলোককে দেখালেন তিনি, একজন বসে আছেন, অপরজন পেছনের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে।

প্রথমে আপনাদেরকে ব্রিফ করবেন কাইড ইনগ্রাম। ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির বিজ্ঞান ও কারিগরি তথ্য বিভাগের পরিচালক উনি। একটা জিনিস আবিষ্কার করেছেন, আপনাদেরকে ব্যাখ্যা করে শোনাবেন। তারপর কার্টিস মিকার বলবেন তার উর্বর মস্তিষ্কে কি সব উঁকি দিচ্ছে। অ্যাডভান্সড টেকনিক্রাল অপারেশনস-এর ডেপুটি ডিরেক্টর উনি।

কাপড় ঢাকা একটা ইজেলের সামনে এসে দাঁড়ালেন কাইড ইনগ্রাম। কাপড়টা সরিয়ে ফেলতেই বড় একটা ফটোগ্রাফ দেখা গেল, দেখে মনে হলো পুরানো একটা প্লেন। এখানে আপনারা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়কার একটা বি-টোয়েনটিনাইন সুপার ফোরট্রেস দেখতে পাচ্ছেন, পড়ে আছে সোসেকি দ্বীপ থেকে ছত্রিশ মাইল দূরে সাগরের তলায়, সারফেস থেকে প্রায় এক হাজার ফুট নিচে।

 ছবিটা অত্যন্ত পরিষ্কার, বলল স্টেসি। নিশ্চয়ই কোন সাবমারসিবল থেকে ভোলা হয়েছে?

 না। আমাদের পিরামিডর ইলেভেন রিকনিসনস স্যাটেলাইট আবিষ্কার করেছে। প্লেনটাকে, সোসেকি দ্বীপের উপর দিয়ে যাবার সময়।

একটা অরবিটিং স্যাটেলাইট সাগরের তলার ছবি এত পরিষ্কার ভোলে কিভাবে?

 কিভাবে তোলে ব্যাখ্যা করতে গেলে চার-পাঁচ ঘন্টা সময় লাগবে, বললেন কাইড ইনগ্রাম। কাজেই সে ঝামেলায় আমি যাচ্ছি না।

ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো তার চেয়ারে নড়েচড়ে বসলেন। পুরানো একটা বম্বারের তাৎপর্যটুকু ব্যাখ্যা করলেই হবে। কেইটেন প্রজেক্টের সাথে ওটার সম্ভাব্য সম্পর্ক কী হতে পারে?

ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসের দিকে দিকে একবার তাকিয়ে ফটোর গায়ে পেন্সিল দিয়ে টোকা দিলেন কাইড ইনগ্রাম। এই প্লেনটা সোসেকি দ্বীপ ও ড্রাগন সেন্টার ধ্বংস করতে যাচ্ছে।

স্বভাবতই মুহূর্তের জন্যেও কেউ তার কথা বিশ্বাস করল না। নিস্তব্ধতা ভাঙল অ্যাল, ওটাকে উদ্ধারের পর মেরামত করতেই তো কয়েক মাস সময় লাগবে।

প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরানো একটা প্লেন ড্রাগ সেন্টারের গায়ে একটা আঁচড়ও কাটতে পারবে না, ডাক্তার জশ নগামি মন্তব্য করল।

ইনগ্রাম হাসলেন। প্লেনটা সোসেকি দ্বীপ ধ্বংস করবে, এ কথা বলে আমি আসলে বোঝাতে চেয়েছি পেনের ভেতর যে বোমাটা আছে ওটাকে আমরা কাজে লাগাব। একটা মাত্র বোমা, তবে একটাই যথেষ্ট, আমার ধারণা।

ধীরে ধীরে খোলা হচ্ছে রহস্যের জট, মন্তব্য করল পিট। আমি একটা ষড়যন্ত্রের গন্ধও যেন পাচ্ছি।

এড়িয়ে না গিয়ে কাইড ইনগ্রাম বললেন, এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা দেবেন কার্টিস মেকার।

ইনগ্রামের দিকে থেকে কার্টিসের দিকে তাকাল পিট, চোখে বাঁকা দৃষ্টি। এই ষড়যন্ত্রে আপনরা দুজন বাদে রেইমন্ড জর্ডান ও ডোনাল্ড কার্নও আছেন বলে আমার ধারনা।

ইজেলে নতুন একটা ফটোগ্রাফ আটকালেন কাইড ইনগ্রাম। প্লেনটার বো-র একপাশে আঁকা খুদে শয়তানের ক্লোজ আপ। ডেনিংস ডেমনস বললেন তিনি, শয়তানের নিচে ঝাপসা হরফগুলোর ওপর পেন্সিল ঠুকলেন। প্লেনটার কমান্ডার ছিলেন মেজর চার্লস ডেনিংস। বর্তমানে এটার অস্তিত্ব সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না, বেমালুম ভুলে যাওয়া হয়েছে। মাত্র কয়েক দিন আগে আমি আর কার্টিস মিকার ল্যাংলির গোপন ফাইল থেকে কিছু তথ্য উদ্ধার করেছি। ডেনিংস ডেমনস বলা হতো মেজর ডেনিংস ও তার ক্রুদের। জাপানের ওপর বোমা ফেলার দায়িত্ব ছিল ওদের ওপর।

 হোয়াই! অবিশ্বাসে চিৎকার করলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো, বাকি সবাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকল।

 ইতিহাসের বই থেকে আমরা জানি জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে একটা করে অ্যাটম বোমা ফেলি আমরা, বললেন কাইড ইনগ্রাম। কিন্তু কেউ জানি না যে তৃতীয় আরেকটা বোমা ফেলার চেষ্টাও হয়েছিল। যে-কোনো কারণেই হোক, প্লেনটা জাপানে পৌঁছুতে পারে নি, সাগরে পড়ে তলিয়ে যায়।

এতো বছর ওটার কথা চেপে রাখা হয়েছে কেন? জানতে চাইল পিট

ক্ষমা প্রার্থনার সুরে কাইড ইনগ্রাম বললেন, সে-প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন রাজনীতিকরা। আমাকে বলা হয়েছে, এটা একটা টপ সিক্রেট ইনফরমেশন, তাই চেপে যাওয়া হয়েছে।

বেশ। কিন্তু আমাদের সাথে ডেনিংস ডেমন-এর সম্পর্ক কী?

এবার আপনারা বরং কার্টিস মিকারকে প্রশ্ন করুন।

চেয়ার ছেড়ে একটা ব্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়ালেন কার্টিস মিকার, প্রথমে তিনি চক দিয়ে বি-টোয়েনটিনাইন ও সোসেকি দ্বীপের ছবি আঁকলেন, তারপর সাগরের তলার কয়েকটা বৈশিষ্ট্য। আমার বক্তব্য শুরু করার আগে আপনাদেরকে আমি একটা দুঃসংবাদ শোনাতে চাই, হাসিমুখে বললেন তিনি। ড্রাগন সেন্টারের ইলেকট্রিকাল নেটওয়ার্কে আপনারা যে বিস্ফোরক ব্যবহার করেছেন তাতে কোনো কাজ হয় নি।

 আমার রেখে আসা বিস্ফোরক বিস্ফোরিত হয় নি, এমন ঘটনা কখনো ঘটে নি, জোর দিয়ে বললেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো।

আপনার চার্জ ফেটেছে ঠিকই, বললেন কার্টিস শিকার, তবে যেখানে রেখে এসেছেন সেখানে নয়। মি. জশ নগামি এখনো যদি কমান্ড কমপ্লেক্সে ডীপ কাভর এজেন্ট হিসেবে উপস্থিত থাকতেন উনি আপনাকে বলতে পারতেন যে ওটা ফেটেছে ইলেকট্রিক নেটওয়ার্ক সেন্টার থেকে পঞ্চাশ মিটার দুরে।

 তা কি করে সম্ভব! বিস্ময় প্রকাশ করল স্টেসি। আমি নিজের চোখে এক বান্ডিল অপটিক ফাইবারের গায়ে বিস্ফোরক বসাতে দেখেছি ওঁকে।

ওটা সরিয়ে ফেলা হয়, চিন্তিত সুরে বলল ডাক্তার নগামি।

কীভাবে?

সম্ভবত কোনো রোবট ইন্সপেক্টর দায়ী। পাওয়ার পালস রেটে তারতম্য ঘটায় সন্দেহ হয় তার, খোঁজ নিতে গিয়ে বিস্ফোরক দেখে ফেলে। রোবোটিক কন্ট্রোলকে জিজ্ঞেস করে ওটা সরিয়ে ফেলে সে।

তার মানে ড্রাগন সেন্টারের কোনো ক্ষতিই হয় নি? চেহারা ম্লান হয়ে গেল ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসোর।

ড্রাগন সেন্টার যদি অক্ষত থাকে, এরপর শুনব এখানে সেখানে ফাটতে শুরু করেছে গাড়ি-বোমাগুলো, উদ্বিগ্ন সুরে বলল স্টেসি।

ঠিক তাই, একমত হলেন কার্টিস মিকার।

টিমোথি ওয়েদারহিল হতাশায় মাথা নাড়লেন। ছি-ছি, আসল কাজটাই করতে পারি নি আমরা।

 কার্টিস মিকার একটা হাত তুলে ওদেরকে থামিয়ে দিলেন, বললেন, যথেষ্ট করেছেন আপনারা। সুমাকে ধরে এনেছেন এবং তাকে ছাড়া গাড়ি-বোমা ডিটোনেট করা যাবে না।

তার মানে? বিস্মিত হলো স্টেসি।

সকৌতুকে ডাক্তার নগামির দিকে তাকাল পিট, বলল, আমার ধারণা, এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন সুচিকিৎসক ড. নগামি।

সবিনয়ে মাথা ঝাঁকাল ডাক্তার। কমপিউটার টেকনিশিয়ানদের সাথে বন্ধুত্ব হবার পর কিছু কিছু ইনফরমেশন পাই আমি, বলল সে, মুখে চওড়া হাসি। ওদের সেন্টারে অবাধ যাতায়াত ছিল আমার। একবার এক প্রোগ্রামার-এর পেছনে দাঁড়িয়ে দেখি, কেইটেন প্রজেক্ট সংক্রান্ত ডাটা কমপিউটারে ঢোকাচ্ছে। এন্ট্রি কোড মুখস্ত করে নিই আমি। তারপর প্রথম সুযোগেই সিস্টেমটা পরীক্ষা করি। গাড়ি-বোমার লোকেশন জেনে ফেলি আমি, তা অবশ্য আপনারাও জেনে ফেলেছেন। কিন্তু ডিটোনেশন সিস্টেমে ভাইরাস ঢোকাতে ব্যর্থ হই। কারণ পরে জানতে পারি ডিটোনেশন কোড জানে একমাত্র সুমা।

তার মানে সুমাকে ছাড়া ওদের কেইটেন প্রজেক্ট সফল হচ্ছে না। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল স্টেসি।

ওদের জন্যে এটা একটা সমস্যা, তবে কাটিয়ে ওঠার জন্যে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে, বললেন মিকার। ওরা ওদের প্রাইম ও ডিটোনেট সিস্টেম রিপ্রোগ্রাম করার আগেই চরম আঘাত হানতে হবে আমাদের। টিম স্টাজকে ধন্যবাদ, আপনারা সুমাকে নিয়ে আসায় প্ল্যান-প্রোগ্রাম করার জন্যে হাতে খানিকটা সময় পেয়েছি আমরা।

আর প্ল্যান-প্রোগ্রামের অন্যতম উপাদান হলো ডেনিংস ডেমনস, ঠিক বলি নি? জিজ্ঞেস করল পিট।

একটা ডেস্কের পেছনে শিরদাঁড়া খাড়া করে বসলেন কার্টিস মিকার। নিজের রাজনৈতিক জীবন ধ্বংস করার ঝুঁকি নিয়ে প্রেসিডেন্ট সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ড্রাগন সেন্টারে পারমাণবিক আঘাত হানবেন। আপনারা পালাতে পেরেছেন, এ কথা শুনে নির্দেশটা বাতিল করে দেন তিনি। নতুন নির্দেশে বলেছেন, তিনি দেখতে চান যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ড্রাগন সেন্টারের কোনো অস্তিত্ব নেই।

বি-টোয়েনটিনাইনে, একটা অ্যাটম বোমা আছে, আপনারা ওটাকে ফাটিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন, বলল পিট, ক্লান্তিতে আধবোজা হয়ে আছে ওর চোখ।

না, বললেন কার্টিস মিকার। ফাটাবার আগে খানিক দূরে সরাতে হবে ওটাকে।

কিন্তু প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে সোসেকি দ্বীপ, বোমাটা ফাটালে কি এমন ক্ষতি হবে ওটার? জানতে চাইল অ্যাল।

একদল ওশেনোগ্রাফার ও একদল জিয়োফিজিসিস্ট জানিয়েছেন, আন্ডারওয়াটার অ্যাটমিক বিস্ফোরণে ড্রাগ সেন্টার ধ্বংস হয়ে যাবে।

আমি জানতে চাই, কিভাবে? প্রশ্নটা করার সময় একটা ঝাঁকি খেল স্টেসির শরীর, যেন হঠাৎ সে তার নগ্ন হাঁটুতে মশার কামড় খেয়েছে।

চেয়ার ছেড়ে ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দিয়ে দাঁড়ালেন কার্টিস মিকার। প্লেন ও সোসেকি দ্বীপের মাঝখানে, সাগরের মেঝেতে, একটা আঁকাবাঁকা রেখা আঁকলেন তিনি। এটা হলো বড় ধরনের একটা প্যাসিফিক সিসমিক ফল্ট সিস্টেমের একটা অংশ, প্রায় সরাসরি ড্রাগন সেন্টারের তলা দিয়ে এগিয়ে গেছে। প্লেন ওখানেই পড়েছে।

ইতস্তত করল ডাক্তার জশ নগামি, এদিক ওদিক মাথা নাড়ল তারপর বলল, সেন্টারটা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে বড় ধরনের ভূমিকম্প ও নিউক্লিয়ার অ্যাটাক হজম করতে পারে। এতো বছর ধরে লোনা পানিতে পড়ে থাকার পর বোমাটা আদৌ ফাটে কিনা সন্দেহ, আর যদি ফাটেও, ফল্টটা হয়তো আকারে বড় হবে, কিন্তু দ্বীপটার তেমন কোনো ক্ষতি হবে বলে মনে হয় না।

 ডাক্তারের সাথে আমি একমত, বলল পিট। দ্বীপটা প্রায় নিরেট পাথর। শুধু শক ওয়েভে ওটা টলমল করবে, তারপর কাত হয়ে পড়ে যাবে বলে মনে হয় না।

এক মুহূর্ত কথা না বলে হাসলেন কার্টিস মিকার। না, অবশেষে বললেন তিনি। কাত হয়ে পড়বে না। তবে ডুবে যাবে।

.

৬৩.

শেরিডান থেকে প্রায় পঁচিশ মাইল-পুর্বে, মন্টানা সীমান্তের ঠিক দক্ষিণে, ঘোড়ার পিঠে বসে চারদিকে দৃষ্টি বুলাচ্ছে ড্যান কিগান। কিছু দিন হলো এদিকটায় অবৈধ শিকারীদের উপদ্রব বেড়ে গেছে, মাসখানেক আগে এক শিকারীর লক্ষ্য ব্যর্থ হওয়ায় হরিণের বদলে মারা গেছে তার একটা বাছুর। বিকেলের নাস্তার জন্যে হাত-মুখ ধোবার সময় হয়েছে, হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এল দুটো গুলির শব্দ। স্ত্রীকে অপেক্ষা করতে বলে মাউজার বোল্ট-অ্যাকশন রাইফেলটা নিল সে, প্রিয় ঘোড়ার পিঠে চড়ে রওনা হয়ে গেল।

দুই পাহাড়ের মাঝখানের ট্রেইল ধরে ছুটলো ড্যান, এক সময় বেরিয়ে এলো খোলা প্রান্তরে। চারপাশে খুঁটিয়ে তাকাতেই টায়ারের ছাপ পেয়ে গেল সে। চাকার দাগ ধরে খানিক দূর যেতেই খরচ করা শেল কেসিং, বুটের ছাপ, বালুবহুল মাটিতে রক্ত দেখতে পেল। শিকারী তার ধরাশায়ী শিকার নিয়ে চলে গেছে।

দেরি হয়ে যাওয়ায় নিজের ওপর রেগে গেল ড্যান। তার রেঞ্জে কেউ গাড়ি নিয়ে ঢুকেছিল, তার মানে হয় বেড়া ভেঙেছে নয়তো গেট। গেটের সামনে প্রাইভেট রোড, চলে গেছে তাইওয়েতে। একটু পরই সন্ধ্যে হবে, কাজেই কতটা কি ক্ষতি হয়েছে দেখার জন্যে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে তাকে। ঘোড়ায় চড়ে বাড়ির পথ ধরল সে।

খানিক দূর এসে লাগাম টেনে ধরল ড্যান। বাতাসে ভেসে আসছে এঞ্জিনের অস্পষ্ট আওয়াজ। এক হাত দিয়ে কানের পেছনটা আড়াল করে মনোযোগ দিয়ে শুনল সে। শব্দটা বাড়ছে। একটা ঢাল বেয়ে মাথায় উঠে এলো ড্যান, নিচের সমতল প্রান্তরে চোখ বুলাল। রাস্তা ধরে দ্রুত বেগে ছুটে আসছে একটা গাড়ি, পেছনে ধুলোর মেঘ তুলে।

ট্রাক বা জীপ হবে বলে আশা করলেও, চেনার মতো কাছাকাছি আসার পর ড্যান দেখল ওটা একটা সাধারণ গাড়ি, খয়েরি রঙের ফর-ডোর সিডান, জাপানি।

একটু পরই ব্রেক করল ড্রাইভার, খোলা রাস্তায় দাঁড়াল। ধীরে ধীরে গাড়ির ছাদে ও রাস্তার পাশে ঘাসের ওপর নেমে এলো ধুলোর মেঘ। গাড়ি থেকে নামল ড্রাইভার, হুডটা খুলল, ঝুঁকে থাকল কয়েক সেকেন্ড। এরপর গাড়ির পেছনে চলে এল সে, ট্রাঙ্ক-এর ঢাকনি তুলল, বের করল সার্ভেয়ারের একটা ট্রানজিট। রাগ নয়, কৌতূহল বোধ করলো ড্যান। তেপায়ার ওপর ট্রানজিটটা বসিয়ে কয়েকটা ল্যান্ডমার্কের দিকে লেন্স তাক করল ড্রাইভার, ক্লিপবোর্ডে আটকানো কাগজে রিডিং লিখল, রাস্তার উপর মেলা জিওলজিক্যাল ম্যাপের সাথে মিলিয়ে দেখল।

ট্রানজিট ব্যবহার করার অভিজ্ঞতা ড্যানের আছে, কিন্তু এভাবে কাউকে সার্ভের কাজ করতে দেখে নি কোনোদিন। বেসলাইন সম্পর্কে ধারণা পাবার বদলে লোকটা যেন নিজের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চাইছে। হাঁ হয়ে গেল ড্যান, কারণ হাতের ক্লিপবোর্ডটা ছুঁড়ে রাস্তার পাশে ঝোঁপের ভেতর ফেলে দিল ড্রাইভার।

গাড়ির সামনে হেঁটে এসে আবার এঞ্জিনের দিকে তাকিয়ে থাকল সে, ওটা যেন তাকে সম্মোহিত করে ফেলেছে।

বেশ কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে ধ্যান করার পর একটা ঝাঁকি খেয়ে সচল হলো লোটা, গাড়ির ভেতর হাত গলিয়ে বের করে আলন একটা রাইফেল।

ব্যাপারটা মেলাতে পারছে না ড্যান। টাই বিজনেস স্যুট পরা সার্ভেয়ার জীবনে কখনো দেখে নি সে। অচেনা এলাকায় সার্ভে করতে এসে অন্যায় জেনেও শিকার করবে, এ-ও বিশ্বাস্য বলে মনে হয় না।

 ঘোড়া নিয়ে আরও কাছাকাছি চলে এলো সে, আগুন্তুকের পেছন দিকে থেকে এগোচ্ছে। রাইফেলে একটা শেল ঢোকাবার চেষ্টা করছে লোকটা, জানে না তার পেছনে চলে এসেছে সে। লোকটার ভাব দেখে মনে হলো, রাইফেলে শেল ঢোকানোয় অভ্যস্ত নয়। আট মিটার দূরে থাকতে লাগাম টানল ড্যান, লেদার কেস থেকে মাউজারটা বের করে হাতে নিল।

আপনি অনধিকার প্রবেশ করেছেন, জানেন কি?

 লাফ দিল ড্রাইভার, দ্রুত ঘুরলো তার দিকে। হাত থেকে পড়ে গেল একটা শেল, রাইফেলের ব্যারেলটা ধাক্কা খেল গাড়ির সঙ্গে। এতোক্ষণে তাকে এশিয়ান বলে চিনতে পারল ড্যান।

কী চান আপনি? হতভম্ব লোকটা জানতে চাইল।

আপনি আমার জমিনে দাঁড়িয়ে আছেন। ঢুকলেন কীভাবে?

 গেটটা ভালো ছিল।

ড্যান যা ভেবেছিল তাই। শিকারীদের কাণ্ড, যাদেরকে ধরতে পারে নি সে। সার্ভেয়ারের ট্রানজিট নিয়ে কী করছেন আপনি?

আপনি কি সরকারের লোক?

না… আমি মিয়াটা কমিউনিকেশন-এর এঞ্জিনিয়ার।

লোকটা ইংরেজিতে জবাব দিচ্ছে, তবে উচ্চারণে জাপানি প্রভাব স্পষ্ট। একটা রিলে স্টেশন বসানোর জন্যে আশপাশটা ঘুরে ফিরে দেখছি।

কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে ঢোকার আগে অনুমতি লাগে, জানেন না? কী করে ধরে নিলেন রিলে স্টেশন বসানোর অনুমতি দেব আমি?

আপনার সাথে যোগাযোগ করা উচিত ছিল আসলে আমার বসের।

ছিল বৈকি, বলল ড্যান। খিদে পেয়েছে তার, দিনের আলো থাকতে ঘরে ফিরতে চায়। এবার দয়া করে বিদায় হোন। আবার যদি কখনো আসতে চান, প্রথমে আমার অনুমতি নেবেন।

আপনার অসুবিধের জন্যে সত্যি আমি দুঃখিত।

মুখে যা-ই বলুক, আসলে লোকটা মোটেও দুঃখিত নয়, মনে হলো ড্যানের। তার হাতের রাইফেলের দিকে সতর্ক নজর রাখছে সে। চেহারায় উদ্বেগ ও অস্থিরতা চাপা থাকছে না। শিকার করারও ইচ্ছে ছিল নাকি? জানতে চাইল সে।

না, মানে স্রেফ টার্গেট শূটিং।

কিন্তু আমার অনুমতি নেই। এদিকে আমার গরু-বাছুররা ঘুরে বেড়ায়। জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে চলে যান এবার।

মাথা ঝাঁকিয়ে রাজি হলো লোকটা। সার্ভেয়ারের ট্রানজিট ও তেপায়া ভরল ট্রাঙ্কে, রাইফেলটা রাখল গাড়ির ব্যাকসীটে। আবার গাড়ির সামনে এসে খোলা হুডের ভেতর উঁকি দিল। এঞ্জিনটা ঠিকমতো কাজ করছে না।

স্টার্ট নেবে তো? জানতে চাইল ড্যান।

মনে হয় নেবে, বলে জানালা দিয়ে গাড়ির ভেতর মাথা গলাল লোকটা, ইগনিশন কী ঘোরাল। প্রথমবারেই স্টার্ট নিল গাড়ি। গেলাম, বলল সে।

ড্যান লক্ষ করল না, হুডটা নামানো হলেও তালা দেয়া হয় নি। পারেন যদি গেটটা বন্ধ করে দেবেন, বলল সে।

অবশ্যই।

মাউজারটা কেসে ভরে বাড়ির পথ ধরল ড্যান। চার কিলোমিটার ছুটতে হবে তাকে।

 গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে রওনা হলো সুবুরু মিয়া, গেটের দিকে যাচ্ছে। এ ধরনের নির্জন, প্রায় পরিত্যক্ত এলাকায় একজন রেঞ্জারের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে, ভাবতে পারে নি সে। তবে এতে করে তার মিশন ব্যর্থ হবে না। দুশো মিটার এগিয়ে এসে হঠাৎ করে ব্রেক করল মিয়া, লাফ দিয়ে নিচে নামল, ব্যাকসিট থেকে ছোঁ দিয়ে তুলে নিল রাইফেলটা, তারপর হুডটা তুলল আবার।

এঞ্জিনের আওয়াজ থেকে গেছে শুনে কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল ড্যান।

 ঘামে ভেজা হাতে রাইফেল তুলে লক্ষ স্থির করল মিওয়া, এয়ারকন্ডিশনারের কমপ্রেসর প্রায় ছুঁয়ে আছে মাজল। আত্মহুতি দেয়ার এই মিশনে স্বেচ্ছায় রাজি হয়েছে সে, প্রস্তাব পাবার সঙ্গে সঙ্গে, কারণ নতুন সাম্রাজ্যের জন্যে জীবনদান করা তার দৃষ্টিতে অত্যন্ত সম্মানজনক। রাজি হবার পেছনে আরো কয়েকটা বিবেচনা গুরুত্ব পেয়েছে। গোল্ড ড্রাগন-এর প্রতি অনুগত সে। তাছাড়া, কোরোরি ইয়োশিশু স্বয়ং তাকে আশ্বাস দিয়েছেন, সে মারা গেলেও তার স্ত্রী সারা জীবন আর্থিক সচ্ছলতার মধ্যে দিন কাটাবে, তার তিন ছেলেমেয়েকে নিজেদের পছন্দ মতো ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের পথে টোকিও ত্যাগ করার সময় কোরোরি ইয়োশিশু তাকে কী বলেছেন মনে পড়ে গেল তার। কোটি কোটি স্বদেশবাসীর উন্নত ভবিষ্যতের স্বার্থে আত্মত্যাগ করছ তুমি। শত শত বছর তোমার এ আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করবে জাপানিরা।

ট্রিগার টেনে দিল মিওয়া।

.

৬৪.

এক মিলি সেকেন্ডে মিওয়া, ড্যান, গাড়ি ও ঘোড়াটা বাষ্প হয়ে গেল। ঝলসে উঠল বিশাল একটা অত্যুজ্জ্বল হলুদ আলো, তারপর বিস্ফোরিত হয়ে সাদা হয়ে গেল সেটা। অদৃশ্য শক ওয়েভ ছুটে গেল চারদিকে। বিস্তৃত হলো ফায়ারবল, দিগন্ত থেকে বেরিয়ে আসা সূর্যের মতো বাড়ছে, ওপরে উঠছে।

 মাটি ছেড়ে আকাশে উঠে পড়ল ফায়ারবল, মেঘের মাঝখানে পড়ে ম্লান হয়ে গেল সেটা, জ্বলজ্বলে রেডিয়েশন ওটাকে রক্তবর্ণ করে তুলল। পিছু পিছু টেনে নিল ঘূর্ণি আকৃতির মাটি ও আবর্জনার একটা প্রকাণ্ড স্বম্ভকে, দ্রুত ত্রিশ কিলোমিটার পর্যন্ত খাড়া হলে সেটা।

মানুষ বলতে মারা গেল শুধু ড্যান ও মিওয়া। বেশ কিছু খরগোশ, বুনো কুকুর, সাপ ও ড্যানের বিশটা গরু-বাছুর মারা গেল, বেশির ভাগই শক ওয়েভে। চার কিলোমিটার দুরে মিসেস কিগান আর তিনজন শ্রমিক ছুটে আসা ভাঙা কাঁচ লেগে সামান্য আহত হলে শুধু। বিস্ফোরণের বেশিরভাগ ধাক্কা থেকে দালানটাকে আড়াল করল পাহাড়। জানালার কাঁচ ভাঙা ছাড়া দালানের তেমন কোনো ক্ষতি হল না।

আগুনে বিস্ফোরণ একশো মিটার চওড়া ও ত্রিশ মিটার গভীর একটা গর্ত তৈরি করল। শুকনো ঝোঁপ আর ঘাসে আগুন ধরে গেল, দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, খয়েরি ধুলোর মেঘের সঙ্গে মিশে গেল কালো ধোঁয়া।

নিস্তেজ হয়ে আসা শক ওয়েভ বাড়ি খেল পাহাড়ে। ঘর-বাড়ি কাঁপিয়ে দিল, ঝাঁকি দিল গাছপালায়, তারপর পৌঁছুল একশো বারো কিলোমিটার উত্তরে লিটল বিগহর্নে।

 শেরিডান শহরের বাইরে, একটা ট্রাক স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক জাপানি লোক, পাশে বাড়া করা কার। চারদিকে মানুষের ভিড় ও শোরগোল, সবাই উত্তেজিতভাবে হাত তুলছে দূর আকাশে উঠে আসা ব্যাঙের ছাতা আকৃতির মেঘটার দিকে। তাদের দিকে খেয়াল নেই জাপানি লোকটার, চোখে দূরবীন তুলে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সে। এক সময় চোখ থেকে দূরবীন নামিয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে এল ট্রাক স্ট্যান্ড থেকে, ঢুকল একটা টেলিফোন বুদে। খুচরো পয়সা বের করে ডায়াল করল সে, কয়েকটা কথা বলল জাপানি ভাষায়, তারপর নামিয়ে রাখল রিসিভার। গাড়িতে ফিরে এসে স্টার্ট দিল সে, মেঘটার দিকে একবারও না তাকিয়ে চলে গেল।

দুনিয়ার অনেকগুলো সিসমোগ্রাফ স্টেশনে রেকর্ড হয়ে গেল বিস্ফোরণটা। কলোরাডোর স্কুল অব মাইনস-এর, ন্যাশনাল আর্থকোয়েক সেন্টারের স্টেশনটাই সবচেয়ে কাছে, গ্রাফ রেকর্ডারে সিসমোগ্রাফিক ট্রেসিং সামনে পেছনে ছুটোছুটি করছে দেখে সতর্ক হয়ে উঠল জিওফিজিসিস্ট ক্লেইটন সোর্স। ভুরু কুঁচকে কমপিউটারে ডাটা যোগান দিল সে, তারপর ফোন করল সেন্টারের ডিরেক্টর রজার স্টিভেনসনকে। বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত, স্যার। এইমাত্র একটা আঘাত রেকর্ড করেছি আমরা।

ক্যালিফোর্নিয়া?

না, মন্টানা সীমান্তের কাছাকাছি।

কয়েক মুহূর্ত বিরতি, তারপর ডিরেক্টর রজার স্টিভেনসন বললেন, আশ্চর্য! ওদিকটা তো অ্যাকটিভ কোয়েক জোন-এর মধ্যে পড়ে না।

এটা কৃত্রিম, স্যার।

 বিস্ফোরণ?

বড় ধরনের। ইনটেনসিটি স্কেল দেখে যতটুকু বুঝতে পারছি, নিউক্লিয়ার বলেই মনে হচ্ছে।

গড, বিড় বিড় করলেন ডিরেক্টর। তুমি নিশ্চিত?

 এ-সব ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া কি সম্ভব, স্যার?

 কিন্তু ওদিকটায় তো কখনোই টেস্ট করে নি পেন্টাগন।

না, আমাদেরকে সতর্ক করা হয় নি।

 তাহলে ওরা নয়।

কী করব বলুন তো। নিউক্লিয়ার রেগুলেটরি কমিশনের সাথে যোগাযোগ করব?

ডিরেকটর স্টিভেনসন কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বললেন লাফ দিয়ে ওদেরকে টপকাও, কথা বলল, ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির হাঙ্ক-এর সাথে। জিজ্ঞেস করো, আসলে কী ঘটছে।

কিন্তু হাঙ্ক সয়ের যদি কিছু না বলেন?

কার কি আসে যায়? রহস্যটা ওদের কোলে ফেলে দিয়ে খালাস হতে চাই আমরা। ক্যালিফোর্নিয়ায় বড় একটা ভূমিকম্প হতে যাচ্ছে, ওদিকটায় মনোযোগ দিতে হবে আমাদের।

যা জানেন না তা বলবেন কীভাবে হাঙ্ক সয়ের? তবে কোনোটা জাতীয় সংকট কোনোটা নয়, এটুকু উপলব্ধি করার বুদ্ধি তার আছে। সোর্সের কাছে আরও তথ্য চাইলেন তিনি, দেরি না করে খবরটা পাঠিয়ে দিলেন জাতীয় নিরাপত্তা কমিশন–এর ডিরেক্টরের কাছে।

রাজনৈতিক বৈঠকে যোগ দেয়ার জন্যে সানফ্রানসিসকোয় যাবেন প্রেসিডেন্ট, এয়ারফোর্স ওয়ান-এ রয়েছেন তিনি, এ সময় জর্ডানের ফোন পেলেন। পরিস্থিতি ভালো, রেই? জানতে চাইলেন তিনি।

 মন্টানা সীমান্তের কাছে পারমাণবিক বিস্ফোরণের খবর পেয়েছি আমরা, জবাব দিলেন রেইমন্ড জর্ডান।

ড্যাম! নিঃশ্বাসের সঙ্গে বিড় বিড় করলেন প্রেসিডেন্ট। আমাদের না ওদের?

 অবশ্যই আমাদের নয়। এ সম্ভবত গাড়ি বোমাগুলোর একটা।

 হতাহতের খবর?

নগণ্য। ফাঁকা ল্যাঞ্চল্যান্ডে বিস্ফেরণ ঘটেছে, লোকবসতি নেই বললেই চলে।

পরবর্তী প্রশ্নটা ভয়ে ভয়ে করলেন প্রেসিডেন্ট, আরো বিস্ফোরণের কোনো খবর বা লক্ষণ?

না, স্যার। আপাতত ওই একটার কথাই জানি আমরা।

আমাকে বলা হয়েছিল কেইটেন প্রজেক্ট আটচল্লিশ ঘণ্টা পিছিয়ে গেছে।

গেছে, রেইমন্ড জর্ডান জোর দিয়ে বললেন। কোড রিপ্রোগ্রাম করার মতো যথেষ্ট সময় এখনো ওরা পায় নি।

তাহলে ব্যাখ্যা করো।

পার্সিভাল ন্যাশর সাথে কথা বলেছি আমি। তার ধারনা, একেবারে কাজ থেকে হাই-পাওয়ারড রাইফেল দিয়ে ডিটোনেট করা হয়েছে বোমাটা।

রোবটের সাহায্যে?

না গুলি ছুঁড়েছে একজন লোক।

 তার মানে আত্মহত্যার প্রবণতা ওদের মধ্যে এখনো আছে?

তাই তো মনে হচ্ছে।

কেন রেই? এভাবে কাউকে আত্মহত্যা করানোর পেছনে ওদের উদ্দেশ্যে কী?

সম্ভবত আমাদেরকে সাবধান করে দেওয়াই উদ্দেশ্য। সুমা যে আমাদের কাছে, এটা ওরা যুক্তি দিয়ে বুঝে নিয়েছে। আমরা পারমাণবিক আঘাত হেনে ড্রাগন সেন্টার ধ্বংস করে দিতে পারি, ওরা জানে। গাড়ি-বোমা ফাটাবার যোগ্যতা ওদের আছে, ওরা ধরে নিয়েছে এটা প্রমাণ করতে পারলে আমরা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগব, এ সুযোগে ডিটোনেশন কোড রিপোগ্রাম করে নেবে ওরা। সবগুলো বোমা যাতে একসাথে ফাটাতে পারে।

হুম।

সমস্ত যুক্তি ও অজুহাত আমাদের পক্ষে, স্যার, রেই জর্ডান বললেন।

পারমাণবিক আক্রমণে কোন বাধা নেই।

ঠিক, কিন্তু নিরেট প্রমাণ কি আছে আমাদের হাতে, কী করে বুঝব কেইটেন। প্রজেক্ট অপারেশন্যাল নয়? এমন হতে পারে না অসম্ভবকে সম্ভব করেছে জাপানিরা, এরই মধ্যে তৈরি করে নিয়েছে কোড? এমন যদি হয়, ওরা ধোকা দিচ্ছে না?

না, নিরেট কোন প্রমাণ আমাদের হাতে নেই, রেইমন্ড জর্ডান স্বীকার করলেন।

 সোসেকি দ্বীপের দিকে একটা ওয়ারহেড মিসাইল ছুটে আসছে, টের পেয়ে গেল ড্রাগন সেন্টারের কন্ট্রোলাররা, তখন ওদের একমাত্র কাজ হবে সেই মুহূর্তে গাড়ি বোমাগুলো একসাথে ফাটিয়ে দেয়া। রোবট ওগুলোকে টার্গেট এলাকায় নিয়ে যাবার আগেই, যেখানে যে অবস্থায় আছে।

সেটা হবে ভয়ঙ্কর একটা ব্যাপার, মি. প্রেসিডেন্ট। বেশিরভাগ গাড়ি লুকানো আছে মেট্রোপলিটান শহরগুলোর মাঝখানে।

গাড়িগুলোকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খুঁজে বের করে বোমাগুলো অকেজো করতে হবে, রেই। এই আতঙ্কের কথা পাবলিককে আমরা জানাতে পারি না, অন্তত এখন আর তা সম্ভব নয়।

এফবিআই এজেন্টদের একটা বিরাট বাহিনী কাজে নেমে পড়েছে।

 তারা কি জানে বোমাগুলো কীভাবে অকেজো করতে হবে?

প্রতিটি টীমে একজন করে নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট আছেন।

রেইমন্ড জর্ডান প্রেসিডেন্টের চেহারায় ফুটে ওঠা উদ্বেগের রেখাগুলো দেখতে পেলেন না। এটাই আমাদের শেষ সুযোগ, রেই, বললেন প্রেসিডেন্ট।

 আমি জানি, মি. প্রেসিডেন্ট। কাল এ সময় আমরা জানব দুনিয়ার মানুষ জাপানিদের ক্রীতদাসে পরিণত হতে যাচ্ছে কিনা।

.

এফবিআই টিমটা লাস ভেগাসে পৌঁছুল। নির্দিষ্ট এক হোটেলের আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং এরিয়ার ভল্টে একটা গাড়ি-বোমা আছে, জানে তারা। টিমের নেতৃত্ব দিচ্ছে বিল ফ্রিক।

কোথাও কোনো গার্ড নেই, ইস্পাতের দরজাটাও ভোলা। লক্ষণ সুবিধের নয়, ভাবল ফ্রিক। সিকিউরিটি সিস্টেম অফ করে রাখা হয়েছে, ইলেকট্রনিক্স এক্সপার্ট জানালোর আরো উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল ফ্রিক।

সাবধানে কয়েকটা দরজা পেরিয়ে একটা আউটার সাপ্লাই রুমে চলে এল টিমটা। দূর প্রান্তে বড় একটা ধাতব দরজা দেখা যাচ্ছে, গুটিয়ে তুলে ফেলা হয়েছে সিলিঙের কাছে। দরজা দিয়ে একটা হাইওয়ে সেমিট্রেইলন অনায়াসে ঢুকতে পারবে।

ভল্টের ভেতর ঢুকল তারা। ভেতরটা সম্পূর্ণ খালি।

ড্রাগন আমরা হয়তো ভুল জায়গায় এসেছি, বিল ফ্রিকের একজন এজেন্ট মন্তব্য করল।

 কংক্রিটের দেয়ালগুলোর দিকে তাকাল ফ্রিক, তাকালো ভেন্টিলেটরের দিকে, যে-পথে ভেতরে ঢুকেছিল ওয়েদারহিল। মেঝের দিকে তাকিয়ে টায়ারের অস্পষ্ট দাগ দেখল সে। অবশেষে মাথা নেড়ে বলল, না, এখানেই ছিল গাড়িটা। সেন্ট্রাল এজেন্সির বর্ণনার সাথে মিলে যাচ্ছে।

 ফ্ৰিককে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকলেন নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট ভদ্রলোক। খালি ভল্টের চারদিকে চোখ বুলিয়ে হাত বুলালেন কাঁচা-পাকা দাড়িতে, গলায় ঝাঁঝ এনে বললেন, বোমাই যেখানে নেই সেখানে আমি ওটাকে অকেজো করব কীভাবে? ভাবটা যেন, গাড়ি বোমা না থাকার জন্যে ফ্রিকই দায়ী।

 জবাব না দিয়ে ভল্ট থেকে দ্রুত বেরিয়ে এসে কমান্ড ট্রাকে উঠল বিল ফ্রিক। কাপে কপি ঢেলে চুমুক দিল সে, তারপর অন করল রেডিও। ব্ল্যাক হর্স, দিস ইজ রেড হর্স, ক্লান্ত সুরে বলল সে।

গো অ্যাহেড, রেঙ হর্স, এফবিআই ফিল্ড অপারেশনস-এর ডিরেক্টর জবাব দিলেন।

আমরা অচল হয়ে পড়েছি। আমাদের আগেই পৌঁছেছিল ওরা, বাছুর নিয়ে কেটে পড়েছে।

তোমরা একা নও, অচল হয়ে পড়েছে আরো অনেকে। শুধু নিউ জার্সিতে ব্লু হর্স আর মিনেসোটাতে গ্রে হর্স তাদের বাছুর খুঁজে পেয়েছে।

আমরা কি অপারেশনের মধ্যে থাকব?

অবশ্যই। তোমাদের হাতে সময় আছে বারো ঘণ্টা। রিপিট, বারো ঘণ্টা। নতুন অবস্থান থেকে তোমাদের বাছুর এ সময়ের মধ্যে খুঁজে বের করতে হবে। অতিরিক্ত ডাটা পাঠানো হচ্ছে। পুলিশ, শেরিফ ও হাইওয়ে পেট্রল ইউনিটকে নিদের্শ দেওয়া হয়েছে যে-কোনো ট্রাক ও সেমিট্রেইলর দেখলেই থামিয়ে চেক করতে হবে।

আমার একটা হেলিকপ্টার দরকার।

দরকার হলে একটা কেন, পুরো এক ঝাঁক পেতে পারো। কিন্তু বারো ঘণ্টার মধ্যে ওগুলোকে খুঁজে বের করা চাই।

.

এডো সিটি থেকে ট্রেনটা এসে থামল টানেলের শেষ মাথায়। কোরোরি ইয়োশিশুকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে অপেক্ষা করছে ইচিরো সুবোই। আপনি এসেছেন, প্রাচীন বন্ধু, সেজন্যে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই।

 দুনিয়াই জাপানিরা দখল করতে যাচ্ছে, এ সময় তোমার পাশে থাকতে চাই আমি, অশীতিপর বৃদ্ধ কোরোরি ইয়োশিশু এক গাল হাসলেন। ইচিরো সুবোই লক্ষ করল, ভদ্রলোকের হাঁটাচলায় অদ্ভুত একটা প্রাণচাঞ্চল্য রয়েছে আগে যা তার চোখে পড়ে নি।

গ্ল্যান অনুসারে মিডওয়েস্ট স্টেটে একটা গাড়ি-বোমা ফাটানো হয়েছে।

 গুড, ভেরি গুড। হোয়াইট হাউসের প্রতিক্রিয়া?

চেহারায় উদ্বেগ, ইচিরো সুবোই বলল, কোন প্রতিক্রিয়াই নেই। যেন মনে হচ্ছে ওরা ব্যাপারটা চেপে রাখতে চাইছে।

কোরোরি ইয়োশিশু গম্ভীর হলেন। তারপর উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার চোখ দুটো। প্রেসিডেন্ট যদি আমাদের বিরুদ্ধে পারমাণবিক আক্রমণের নির্দেশ না দিয়ে থাকেন, ধরে নিতে হবে ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়ে ভয় পেয়ে গেছেন তিনি।

সে ক্ষেত্রে বলা চলে জুয়ায় আমরা জিতেছি।

সম্ভবত, তবু কেইটেন প্রজেক্ট সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা উৎসব করতে পারি না।

তাকেদা কোরোজিমা কথা দিয়েছে, কাল সন্ধ্যের দিকে কোনো এক সময় নতুন কোড প্রোগ্রাম করা হয়ে যাবে।

ইচিরো সুবোইর কাঁধে একটা হাত রাখলেন বৃদ্ধ কোরোরি ইয়োশিশু। আমার মনে হয় এখুনি প্রেসিডেন্টের সাথে সরাসরি লাইনে কথা বলা দরকার। আমাদের নতুন জাপানের শর্তগুলো তাকে জানাতে হবে।

নতুন জাপান ও নতুন আমেরিকা, গর্বের সুরে বলল ইচিরো সুবোই।

 হ্যাঁ, ঠিক তাই।কোরোরি ইয়োশিশু তার নতুন শিষ্যের দিকে স্নেহের দৃষ্টিতে তাকালেন। নতুন একটা জাপানিজ আমেরিকা।

.

৬৫.

লকহীড সি-ফাইভ গ্যালাক্সি, দুনিয়ার সবচেয়ে বড় কার্গো প্লেন, ওয়েক দ্বীপের এয়ারট্রিপে ল্যান্ড করল। প্লেনটা থামার পর এগিয়ে এলো একটা কার, ব্রেক করে দাঁড়িয়ে পড়ল ডান ডানার ছায়ায়। গাড়ি থেকে নেমে প্লেনের সামনের দিকের একটা হ্যাঁচ গলে ভেতরে ঢুকল পিট ও অ্যাল।

ভেতরে ওদের জন্যে অপেক্ষা করছেন অ্যাডমিরাল স্যানডেকার। ওদের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন তিনি, পথ দেখিয়ে কার্গো বে-তে নিয়ে এলেন এখানে ছটা হাইওয়ে বাস রাখার পরও একশো জন আরোহীর বসার সিট ফেলা যাবে। নুমার একটা ডীপ সী মাইনিং ভেহিকেলকে পাশ কাটাল ওরা। হাঁটার গতি কমিয়ে বিশাল মেশিনটায় গায়ে হাত বুলাল পিট, মনে পড়ে গেল বিগ জনে চড়ে প্রশান্ত মহাসাগরের তলা থেকে কীভাবে কোনো রকমে প্রাণ বাঁচিয়েছিল। সেই বিগ জনেরই উন্নত সংস্করণ এটা, নাম দেয়া হয়েছে বিগ বেন্।

 ডীপ সী ভেহিকেলে সাধারণত কাদা সরানোর জন্যে প্রকাণ্ড হাতা ও থাবা থাকে যান্ত্রিক বাহুতে, তার বদলে এটায় বাহুর বর্ধিত অংশে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের রিমোট ম্যানিপুলেটর, আঁকড়ে ধরে ধাতুব বস্তু কাটার জন্যে। নতুন আরেকটা জিনিস লক্ষ করল পিট, মেশিনটার ওপরের অংশ ও কন্ট্রোল কেবিনের মাথায় প্রকাণ্ড একটা নাইলন প্যাক। ওটা থেকে ভারী লাইন নেমে এসেছে, সংযুক্ত হয়েছে ভেহিকেলের বিভিন্ন পয়েন্টের সঙ্গে।

চেহারায় বিষণ্ণতা ফুটিয়ে পড়েছে দেখে স্যানডেকার বললেন, সময় নষ্ট করা উচিত হচ্ছে না। টেক-অফ করার জন্যে তৈরি হয়ে রয়েছে ওরা।

অ্যাডমিরালের পিছু পিছু অফিসের মতো দেখতে একটা কমপার্টমেন্টে ঢুকল ওরা। সিটবেল্ট বাঁধছে, এ সময় সচল হলো দৈত্যাকার বিমান। আটাশটা চাকা ঘুরতে শুরু করল, ঘোর গতি ক্রমশ দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। তারপর এক সময় আকাশে উঠে এলো ওরা।

হাতঘড়ির ওপর চোখ বুলিয়ে অ্যাল বলল, ছো দিয়ে আমাদের তুলতে মাত্র তিন মিনিট সময় নিল পাইলট।

গম্ভীর সুরে অ্যাডমিরাল বললেন, হাতে নষ্ট করার মতো সময় সত্যি নেই।

 পেশীতে দিল দিল পিট, লম্বা করল পা দুটো। ধরেই নিচ্ছি আপনার একটা প্ল্যান আছে।

কাইড ইনগ্রাম আর কার্টিস মিকার কতটুকু বলেছেন তোমাদের? অ্যাডমিরাল জানতে চাইলেন।

বলেছেন একটা বি-টোয়েনটিনাইন সাগরের তলায় পড়ে আছে, বলল পিট। তারপর সোসেকি দ্বীপের চারধারের জিওলজি ও সিসমিক ফল্ট সিস্টেম সম্পর্কে লেকচার দিলেন। কার্টিসের ধারণা, প্লেটার ভেতর যে অ্যাটকি বোমাটা আছে তা ফাটিয়ে দিতে পারলে শক ওয়েভের কারণে দ্বীপটা সাগরের নিচে ডুবে যাবে।

আমার বিশ্বাস, এটা একটা ফালতু ধারণা।

মাথা ঝাঁকিয়ে পিট বলল, তারপর মেল পেনার আমাদেরকে ছুটি দিয়ে ওয়েক আইল্যান্ডের সৈকতে ফুর্তি করতে বললেন। ইতোমধ্যে টিমের বাকি সবাই প্লেনে চড়ে আমেরিকায় চলে গেছে। আমি জানতে চাইলাম, আমাদেরকে আটকে রাখা হয়েছে কেন। উত্তরে তিনি বললেন, আপনি এসে সব কিছু ব্যাখ্যা করবেন।

মেল পেনার উত্তর এড়িয়ে গেছে, কারণ উত্তরগুলো তার জানা নেই, বললেন স্যানডেকার। এমনকি কাইড ইনগ্রাম ও কার্টিন্স মিকারও অ্যারিজোনা সম্পর্কে কিছু জানেন না।

অ্যারিজোনা মানে? পিট কৌতূহলী।

আমাদের অপারেশনের কোড নেম।

আমাদের অপারেশন? সতর্ক প্রশ্ন অ্যালের।

আশা করি বিগ বেন-এর সাথে কোনো সম্পর্ক নেই? কিংবা পার্ল হারবারে ওই নামে যে যুদ্ধজাহাজটা আছে, তার সাথে?

থাকতে পারে আবার না-ও থাকতে পারে। কোড নেম সাধারণত অর্থবহ হয় না। পিট ও অ্যালের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন অ্যাডমিরাল। পুরো একটা দিন বিশ্রাম নেয়ায় উপকার হলেও, এখনো অত্যন্ত ক্লান্ত ওরা। অপরাধবোধের একটা অস্বস্তিকর খোঁচা অনুভব করলেন তিনি। ওদেরকে এতটা ধকল সইতে হয়েছে, সেজন্যে তিনিই দায়ী। এখন আবার প্রেসিডেন্ট ও রেইমন্ড জর্ডানকে ওদের সার্ভিস নেওয়ার জন্যে পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ জানেন মহাসাগরের অতল পরিবেশ সম্পর্কে ওদের দুজনের মতো অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান জীবিত আর কোনো লোকের মধ্যে নেই। আবার একটা ঘূর্ণি বহুল বিপদের মুখে ওদেরকে ঠেলে দেওয়াটা সত্যি নিষ্ঠুরতারই নামান্তর, কিন্তু তাঁর সামনে দ্বিতীয় কোনো বিকল্প ছিল না।

টেবিলে রেখে একটা জিওলজিকাল চার্টের ভাঁজ খুললেন তিনি, সোসেকি দ্বীপের চারদিকে পঞ্চাশ কিলোমিটার সাগরের মেঝে দেখা যাচ্ছে। ড্রাগন সেন্টার ধ্বংস করার মতো যোগ্য লোক কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় নি, কাজেই আবার তোমাদেরকেই নির্বাচন করা হয়েছে। ডীপ সী মাইনিং ভেহিকেল সম্পর্কে একমাত্র তোমরাই অভিজ্ঞ।

ভাবতে ভাল লাগছে মানুষের উপকারে লাগি আমরা, বিড়বিড় করে বলল অ্যাল।

কী বললে?

অ্যাল জিজ্ঞেস করছে, ঠিক কী করতে হবে আমাদের, বলে চার্টের ওপর ঝুঁকল পিট, তাকালো একটা ক্রস চিহ্নের দিকে নিচে লেখা রয়েছে ডেনিংস ডেমনস। বোমাটা ফাটাবার জন্যে ডিএসএমভি ব্যবহার করতে হবে আমাদের, তাই না?

 হ্যাঁ, বললেন অ্যাডমিরাল। আমরা টার্গেট সাইটে পৌঁছুনোর পর তোমাদেরকে ও বিগ বেকে প্যারাসুটের সাহায্যে পানিতে নামিয়ে দেওয়া হবে।

তারপর? জানতে চাইল অ্যাল।

সাগরে নামার পর নিচে, তলায় চলে যাবে তোমরা-প্যারাসুট থাকায় গতি দ্রুত হবে না। তারপর ওটাকে চালিয়ে নিয়ে যাবে বি-টোয়েনটিনাইনের কাছে। ফিউজিল্যাজে আছে অ্যাটমিক বোমাটা, বের করে আনবে। নির্দিষ্ট একটা জায়গায় বয়ে আনতে হবে ওটাকে, ফাটাবার জন্যে।

আড়ষ্ট হয়ে গেল অ্যাল, যেন হঠাৎ ভূত দেখেছে। ওহ্ গড! যা ভয় করেছিলাম তার চেয়ে মারাত্মক।

 ঠাণ্ডা চোখে অ্যাডমিরালের দিকে তাকিয়ে আছে পিট। পাশে দাঁড়িয়ে একটা অ্যাটম বোমা ফাটাতে বলছেন, একটু বেশি আশা করা হয়ে যাচ্ছে না কি?

 ইউনিভার্সিটির পঞ্চাশজন বিজ্ঞানী ও এঞ্জিনিয়ার একসাথে বসে অপারেশন অ্যারিজোনার প্রোগ্রাম ফাইনাল করেছেন। আমার কথায় বিশ্বাস রাখো, সফল হবার নিখুঁত একটা ডায়াগ্রাম তৈরি করেছেন তারা।

 এতটা নিশ্চিত তাঁরা হন কীভাবে? জানতে চাইল অ্যাল। এর আগে একটা প্লেন থেকে পঁয়ত্রিশ টন ডীপ সী ভেহিকেল সমুদ্রে নামায় নি কেউ।

 সমস্ত দিক অঙ্ক কষে বিবেচনা করা হয়েছে, ব্যর্থতার সমস্ত সম্ভাবনা বাতিল করা হয়েছে এক এক করে। তোমরা পানিতে নামবে খসে পড়া একটা পাতার মতো হালকাভাবে।

 নরকের পথে প্রথম পদক্ষেপ, কৌতুক করল অ্যাল, যদিও আওয়াজটা ভাল করে ফুটল না।

বিপদ সম্পর্কে আমরা সচেতন, মারাত্মক ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছি বলে তোমাদের ওপর আমাদের সহানুভূতিও আছে, কিন্তু তোমার আচরণ কোনো উপকারে আসবে না।

প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে পিটের দিকে তাকাল অ্যাল। কী আচরণ?

 অশুভ ভবিষ্যদ্বাণী করার প্রবণতা, ব্যাখ্যা করল পিট।

খোশ মেজাজে কাঁধ ঝাঁকাল অ্যাল। আমি শুধু নির্ভেজাল অনুভূতি প্রকাশ করার চেষ্টা করছিলাম।

বিধ্বস্ত একটা প্লেন থেকে কীভাবে বোমাটাকে বের করব আমরা? জানতে চাইল পিট। ফাটাবোই বা কীভাবে?

 দুজনের হাতেই একটা করে ফোল্ডার ধরিয়ে দিলেন অ্যাডমিরাল স্যানডেকার। ফটো, ডায়াগ্রাম ও নির্দেশ, সব মিলিয়ে প্রতিটি ফোল্ডারে চল্লিশটা করে পাতা। ওগুলোর ভেতর সব দেওয়া আছে। এখান থেকে ড্রপ জোনে পৌঁছুতে সময় লাগবে, সেই ফাঁকে পড়ে নিতে পারবে।

প্রায় পঞ্চাশ বছর পানিতে পড়ে রয়েছে বোমাটা, দোমড়ানো মোচড়ানো একটা প্লেনের ভেতর। কীভাবে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব, এখনো ওটা ফাটবে?

পিরামিড়ার স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ফটোতে দেখা গেছে, ফিউজিলাজটা সম্পূর্ণ অক্ষত। তার মানে বোমাটারও কোনো ক্ষতি হয় নি। প্রয়োজনে দীর্ঘদিন পানিতে ফেলে রেখে, ব্যবহার করার সময় ভোলা হবে, এ কথা ভেবেই বোমাটার ডিজাইন করা হয়েছিল। ওটার ব্যালিস্টিক কেসিং-এর আর্মারড উপাদানগুলো এমনভাবে বাছাই করা হয়েছে, ভেতরে যাতে পানি ঢুকতে না পারে। ওটা যারা তৈরি করেছিল, তাদের মধ্যে দু একজন আজও বেঁচে আছে, তারা কসম খেয়ে বলছে, সাগরের তলায় আরও পাঁচশো বছর থাকলেও ফাটবে ওটা।

মুখ হাঁড়ি করে জানতে চাইল অ্যাল, একটা টাইমার থাকবে, আশা করি?।

 বিস্ফোরণের আগে এক ঘণ্টা সময় পাবে তোমরা, জবাব দিলেন স্যানডেকার। বিগ জনের চেয়ে বিগ বেন-এর গতি বাড়ানো হয়েছে। বিস্ফোরণের ধাক্কা এড়ানোর জন্যে যথেষ্ট দূরে আসতে পারবে তোমরা।

যথেষ্ট দূরে মানে কত দূরে? জানতে চাইল পিট।

বারো কিলোমিটার।

শেষ ফলাফল কী?

ধারণাটা হলো, সাগরের তলায় পুরানো অ্যাটমিক বোমাটার সাহায্যে একটা কৃত্রিম ভূমিকম্প সৃষ্টি করা। ভূমিকম্পের ফলে সাগরের তলায় কিছু ঘটনা বা বিপর্যয় ঘটবে, ঠিক যে ধরনের ঘটনা বা বিপর্যয় উইনাকে ধ্বংস করেছিল।

তাতে সোসেকি দ্বীপের কি এমন ক্ষতি হবে? জানতে চাইল পিট।

কয়েক মিলিয়ন বছর আগে সোসেকি দ্বীপ তৈরি হয়েছে একটা আগ্নেয়গিরির লাভা থেকে। আগ্নেয়গিরিটা বিস্ফোরিত হয়েছিল জাপানের উপকুল ঘেঁষে, লাভা বিস্তৃত হয় সাগরের অনেক দূর পর্যন্ত। এক সময় এই বিশাল লাভা জাপানের মেইনল্যান্ডের একটা বাহু ছিল, পানির ওপর দুশো মিটার পর্যন্ত জেগে ছিল। তবে লাভার নিচে রয়েছে প্রাচীন নরম পলি নরম পলিতে ডেবে যেতে শুরু করে লাভার বিস্তৃতি, এক সময় শুধু চুড়াটা ছাড়া বাকিটুকু তলিয়ে যায় পানির তলায়।

সেই চুড়াই আজ সোসেকি দ্বীপ?

হ্যাঁ।

তার মানে আমরা ধরে নিচ্ছি, শক ওয়েভ ও ভুমিকম্প দ্বীপের নিচের পলিমাটিকে দুর্বল করে তুলবে, দ্বীপটা বসে যাবে আরো নিচের দিকে?

হ্যাঁ।

কিন্তু ব্যাপারটা অতিরিক্ত সহজ বলে মনে হচ্ছে।

মাথা নাড়লেন স্যানডেকার। আরো ব্যাপার আছে। শুধু শক ওয়েভে কাজ হবে না। সে জন্যেই ফাটাবার আগে প্লেন থেকে খানিক দূর সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে বোমাটাকে।

সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে কোথায়?

দ্বীপের সাথে সমান্তরালভাবে এগিয়েছে একটা গভীর ট্রেঞ্চ, সেই ট্রেঞ্চের চালে। সাবওশেন শক সৃষ্টি করা ছাড়াও, আমরা আশা করছি অ্যাটমিক বিস্ফোরণের ফলে ট্রেঞ্চের পাঁচিলও বেশ খানিকটা ভেঙে পড়বে। কয়েক মিলিয়ন টন পলিমাটির ধস আর শক ওয়েভ, দুটো মিলে প্রচণ্ড একটা ধ্বংসাত্মক শক্তি তৈরি করবে।

অর্থাৎ একটা সিসমিক সী ওয়েভ তৈরি হবে, বলল পিট।

সিসমিক শকে দ্বীপটা ডুবতে শুরু করবে, বলে চলছেন অ্যাডমিরাল, তারা ওটাকে ধাক্কা দেবে জলোচ্ছ্বাস। কমপিউটার থেকে জানা গেছে, দশ মিটার উঁচু হবে ওটা, গতি হবে ঘণ্টায় চারশো কিলোমিটার। সোসেকি দ্বীপের সারফেসে যা কিছু অবশিষ্ট থাকবে, সব ডুবে যাবে ড্রাগন সেন্টার সহ।

দৈত্যটাকে মুক্ত করব আমরা? জানতে চাইল অ্যাল। আমরা দুজন?

তোমরা দুজন আর বিগ বেন। ওটাকে মডিফাই করা হয়েছে।

চার্টের দিকে তাকিয়ে দূরত্বটুকু আন্দাজ করার চেষ্টা করল পিট। আন্ডারওয়াটার ট্রেঞ্চের ঢাল, যেখানে বোমাটা ফাটানো হবে বলে চিহ্ন এঁকে রাখা হয়েছে, সেখান থেকে বম্বারটার দূরত্ব হবে আটাশ কিলোমিটার। প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছরের পুরানো একটা অ্যাটম বোমাকে অচেনা ও দুর্গম সাগরের তলা দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া সহজ বা ঝুঁকিবিহীন কাজ হবে না।

বোমাটা ফাটল, তারপর কী হবে? জানতে চাইল পিট।

বিগ বেনকে নিয়ে কাছাকাছি তীরে চলে আসবে তোমরা, ওখানে একটা। স্পেশ্যাল ফোর্স টিম তোমাদেরকে উদ্ধার করার জন্যে অপেক্ষা করবে।

বড় করে শ্বাস নিল পিট।

আর কোনো প্রশ্ন, পিট? জানতে চাইলেন অ্যাডমিরাল।

পিটের চোখে সংশয় ও সন্দেহ। এরকম উদ্ভট অপারেশনের কথা জীবনে কখনো শুনি নি আমি। এ যেন স্বেচ্ছায় মরতে চাওয়া।

.

৬৬.

সি-ফাইভ গ্যালাক্সি প্রতি ঘণ্টায় চারশো ষাট কিলোমিটার বেগে ছুটছে। উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে সন্ধ্যে নেমে এলো। কার্গো বে-তে বিগ বেন-এর ইলেকট্রনিক ও পাওয়ার সিস্টেম চেক করছে অ্যাল। স্যানডেকার কাজ করছেন অফিস কমপার্টমেন্টে, সর্বশেষ তথ্য সংগ্রহ করছেন, সেই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ও জর্ডানের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন রেডিওতে। হোয়াইট হাউসের সিচুয়েশন রুমে গলদঘর্ম হচ্ছেন তাঁরা। সী ফ্লোর জিওলজি সম্পর্কে নতুন তথ্য পাবার জন্যে জিওফিজিসিস্টদের সঙ্গে সারাক্ষণ যোগাযোগ রাখছেন অ্যাডমিরাল। ওদের সঙ্গে পার্সিভাল ন্যাশও আছেন। প্লেনটা থেকে বোমাটা কীভাবে সরাবে, তারপর কীভাবে ফাটাবে, সে সম্পর্কে পিটের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন ভদ্রলোক।

আকাশে আর মাত্র এক ঘণ্টা আছে পিট, উচিত ছিল অ্যালের পাশে দাঁড়িয়ে বিগ বেন-এর সঙ্গে পরিচয়টা ভার করে ঝালাই করে নেয়া। তা না করে ও যা করছে, অদ্ভুতই বলতে হবে। ক্রুদের কাছ থেকে যতগুলো পারে লাঞ্চ বক্স সংগ্রহ করছেও, কিছু চেয়ে নিল, কিছু কিনে। খাবার পানি সংগ্রহ করল ৩০ লিটার। এমনকি কফিও সংগ্রহ করল। সবই যত্ন করে তুলে রাখল বিগ বেন-এ। এয়ার ফোর্স ফ্লাইট এঞ্জিনিয়ারের কাছ থেকে খানিকটা কেবল ধার করল ও, ধার করল একটা ছোট ইলেকট্রিক উইঞ্চ। সবশেষে বিগ বেন-এর অপারেটরস চেয়ারে বসল, ভাবছে মিশনটা সফল হবে কিনা। বি-টোয়েনটিনাইন থেকে বোমা বের করা অত্যন্ত জটিল একটা কাজ, তারপর অচেনা সাগরের মেঝের ওপর দিয়ে বারো কিলোমিটার সরে আসতে হবে প্রাণ নিয়ে, তা না হলে বিস্ফোরিত আটক বোমা ভস্ম করে দেবে ওকে।

ফিফটিন মিনিটস টু ড্রপ, জেন্টেলমেন, কার্গো বে-র স্পীকার থেকে ভেসে এলো পাইরটের যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর।

 তোমাদের তৈরি হবার সময় হয়েছে, স্যানডেকার বললেন, মুখের চামড়া টান টান হয়ে আছে।

অ্যালের কাঁধে একটা হাত রাখল পিট। রওনা হবার আগে চলো বাথরুম ব্যবহার করি।

অবাক হয়ে তাকাল অ্যাল। কেন? বিগ বেন-এ তো ওয়েস্ট সিস্টেম আছেই।

সাবধানের মার নেই। কেউ জানি না পানিতে কত জোরে পড়ব আমরা। অ্যাক্সিডেন্টের সময় শরীরের ভেতরটা যাতে নষ্ট না হয় সেজন্যে রেস কারের ড্রাইভাররা প্রতিযোগিতা শুরুর এগ সব সময় ব্লাডার খালি করে নেয়।

কাঁধ ঝাঁকাল অ্যাল। বেশ। টয়লেটের দিকে এগিয়ে গেল সে।

টয়লেটে ঢুকছে অ্যাল, বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিল পিট। ফ্লাইট এঞ্জিনিয়ারের দিকে ফিরে ইঙ্গিত করল, উত্তরে ছোট করে মাথা ঝাঁকাল ফ্লাইট এঞ্জিনিয়ার, কয়েকটা মোটা তার দিয়ে ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকাল ফ্লাইট এঞ্জিনিয়ার, কয়েকটা মোটা তার দিয়ে ছোট্ট টয়লেট বেঁধে ফেলল সে।

কী ঘটছে বুঝতে পেরে ভেতর থেকে চিৎকার জুড়ে দিল অ্যাল। পিট, না! গড, নো! পিট, প্লীজ।

কী ঘটছে স্যানডেকারও তা বুঝতে পারলেন। তুমি একা পারবে না। পিটের একটা বাহু আঁকড়ে ধরলেন তিনি। তোমরা দুজন, এর-কথা মনে রেখে প্ল্যানটা তৈরি করা হয়েছে।

বিগ বেকে চালাবার জন্যে একজনই যথেষ্ট। দুজনকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেয়া বোকামি, টয়লেটের দরজায় ঘন ঘন লাথি পড়ছে, ইস্পাতের কেবল জড়ানো থাকায় খুলছে না ওটা। অ্যালকে বলবেন, সত্যি আমি দুঃখিত। যদি বেঁচে ফিরে আসি, ওর সমস্ত গালমন্দ আমি হাসিমুখে হজম করব।

আমি নির্দেশ দিলেই ক্রুরা ওকে বের করে আনবে।

রাবারের মতো প্রসারিত হলো পিটের ঠোঁট। তা পারেন, কিন্তু কাজটা করতে হলে আমার সাথে লড়তে হবে ওদের।

তুমি কিন্তু অপারেশনটা নষ্ট করছ। পানিতে নামার সময় যদি আহত হও, তখন কী হবে?

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত অ্যাডমিরালের দিকে তাকিয়ে থাকল পিট। তারপর বলল, একজন বন্ধুকে হারাতে হবে, এই ভয় নিয়ে কোনো কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

 স্যানডেকার জানেন, তাঁর স্পেশাল প্রজেক্ট ডিরেক্টরকে টলানো সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে পিটের একটা হাত নিজের দুটো দিয়ে ধরলেন তিনি। ফিরে এসে কী দেখতে চাও তুমি, পিট, মাই সান?

উষ্ণ হাসি ফুটল পিটের মুখে। এক প্লেট গলদা চিংড়ি আর কড়া টেকুইলা!

 ঘুরল পিট, বিগ বেন-এ চড়ল, ভেতর থেকে সীল করে দিল হ্যাঁচ।

সি-ফাইড গ্যালাক্সিতে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। ইট্রুমেন্ট প্যানেলের পাশের হাতলটা ধরে টান দিল কো-পাইলট, ইলেকট্রিক মটরের গুঞ্জন শোনা গেল, সেই সঙ্গে কার্গো ডেকের মেঝে এক পাশে সরে যাওয়ায় বিরাট একটা ফাঁক দেখা গেল। অ্যাডমিরাল স্যানডেকার ও দুজন ক্রুর শরীর সেফটি স্ট্যাপ দিয়ে বাধা, বিগ বেন এর সামনে দাঁড়িয়ে ওঁরা। বিরাট ফাঁকটা দিয়ে তীব্র বাতাস আসছে। বিগ বেন-এ বসে রয়েছে পিট।

ড্রপ জোনে পৌঁছুতে আর ষাট সেকেন্ড, পাইলটের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো ওদের হেডসেটে। বাতাসের গতিপাঁচ নট। আকাশে মেঘ নেই। বাঁকা চাঁদ। সাগরে চার ফুট ঢেউ। রাডারে কোনো সারফেস শিপ দেখা যাচ্ছে না।

পরিবেশ গ্রহণযোগ্য, নিশ্চিত করলেন অ্যাডমিরাল।

বিগ বেন-এর সামনে দাঁড়িয়ে অ্যাডমিরাল শুধু দেখতে পাচ্ছেন কার্গো ডেকের বিরাট হা। এক হাজার মিটার নিচে সাগর চকচকে রূপো।

আর বিশ সেকেন্ড, বলে কাউন্ট ডাউন শুরু করল পাইলট।

বিশাল বাহনের স্বচ্ছ বো থেকে হাত নাড়ল পিট। মনে যদি কোনো ভয় বা উদ্বেগ থাকেও, চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে না। টয়লেটের দরজায় এখনো পদাঘাত করছে অ্যাল, তবে বাতাসের গর্জনে আওয়াজটা চাপা পড়ে যাচ্ছে।

ফাইড, ফোর, থ্রী, টু, ওয়ান, ড্রপ!

হাইড্রলিক পাম্পের সাহায্যে অকস্মাৎ তুলে ফেলা হলো সামনের রেইল, পেছন দিকে পিছলে গেল বিগ বেন, ফাঁকের কিনারা দিয়ে খসে পড়ল প্লেন থেকে অন্ধকার শূন্যে। ত্রিশ টন ওজনের বিগ বেনকে চোখের পলকে ও সাবলীল ভঙ্গিতে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখলেন অ্যাডমিরাল, সতর্কভাবে ডেকের কিনারার দিকে এগোলেন তিনি, নিচের দিকে ঝুঁকে তাকালেন।

চাঁদের আলোয় ছুটন্ত একটা উল্কার মতো দেখা গেল প্রকাণ্ড ডীপ সী মাইনিং ভেসেল বিগ বেনকে।

.

৬৭.

প্রথমে তীরবেগে নামতে শুরু করল বিগ বেন, তারপর প্রকাণ্ড আকৃতির তিনটা ছাতা অর্থাৎ প্যারাসুট খুলে যেতেই নামার গতি মন্তর হয়ে পড়ল। ওপরদিকে তাকিয়ে স্বস্তিবোধ করল পিট, শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এলো। প্রথম বাধাটা পেছনে ফেলে এসেছেও। এবার নিরাপদে পানিতে পড়তে হবে, নেমে যেতে হবে তিনশো বিশ মিটার গভীর সাগরের তলায়, অখণ্ড ও অক্ষত অবস্থায়। অপারেশনের এ পর্যায়ে কিছুই ওর করার নেই, কাজেই যাত্রা উপভোগ করা যেতে পারে।

চাঁদের আলোয় সি-ফাইভ গ্যালাক্সিকে পরিষ্কার চিনতে পারল ও, বিগ বেনকে ঘিরে চক্কর দিচ্ছে। অ্যাডমিরাল টয়লেট থেকে অ্যালকে বের করেছেন কিনা ভাবল। মনে মনে হাসল ও, অসহায় বোদ করা ছাড়া আর কিছু করার নেই অালের।

আকাশ থেকে পানির দূরত্ব মাপা দিনের বেলা অত্যন্ত কঠিন, রাতে প্রায় অসম্ভব। তবে ঢেউয়ের মাথার চাঁদের আলো প্রতিফলিত হতে দেখে পিট আন্দাজ করল আর পনেরো সেকেন্ডের মধ্যে পানিতে পড়বে ও। সিটটা কাত করে নিল, অতিরিক্ত প্যাডের ওপর স্থির হলো সেটা। সি-ফাইভের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ল একবার, যদিও জানে প্লেন থেকে কেউ ওকে দেখতে পাচ্ছে না।

অকস্মাৎ ঝাঁকি খেল বিগ বেন, জোড়া ঢেউয়ের মাঝখানে পড়ল। সাগরের পানিতে বেশ বড় একটা গর্ত তৈরি হলো, পাঁচিলগুলো গোলাকার। তারপরই পানির নিচে ডুব দিল বিগ বেন।

প্যারাসুট থাকায় আশঙ্কার চেয়ে কমই লাগল ধাক্কাটা, পিটের কোনো হাড় ভাঙল না বা কোথাও সরেও গেল না। সিটটাকে খাড়া করে নিল ও, প্রতিটি পাওয়ার সিস্টেম চেক করল। ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেলে সবুজ আলো জ্বলছে দেখে খুশি হয়ে উঠল মন। কমপিউটার মনিটর জানিয়ে দিল, কোথাও কোনো যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দেয় নি। বাইরের আলো জ্বালাল, আলোটাকে তাক করল ওপর দিকে। দুটো প্যারাসুট মেলা অবস্থায় রয়েছে, তৃতীয়টা মোচড় খেয়ে জড়িয়ে গেছে লাইনের সঙ্গে।

কমপিউটর স্ক্রীনের ওপর চোখ, নির্দিষ্ট বোতামে চাপ দিয়ে নামার গতি জেনে নিল পিট। স্ক্রীনের ওপর দিয়ে মিছিল করে এগিয়ে গেল সংখ্যাগুলো, জ্বলে উঠল লাল ওয়ার্নিং সিগন্যাল। প্রতি মিনিটে একষট্টি মিটার নামছে বিগ বেন। কিন্তু নামার গতি হিসেবে করা হয়েছিল, খুব বেশি হলে বিয়াল্লিশ ছাড়াবে না। প্রতি মিনিটে উনিশ মিটার দ্রুত নামতে বিগ বেন।

এতে ব্যস্ত যে কথা বলতে পারবে না? পিটের এয়ারফোনে অ্যাডমিরালের যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর।

ছোট্ট একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে, জবাব দিল পিট।

প্যারাসুট? জানতে চাইলেন অ্যাডমিরাল, কী শুনতে হবে ভেবে উদ্বেগ বোধ করলেন।

একটা লাইনের সাথে জড়িয়ে গেছে, ফলে নামার গতি বেড়ে গেছে আমার।

স্পীড?

 একষট্টি।

 নট গুড।

সব কথা শুনতে চাই আমি।

ল্যান্ডিং সাইটটা বেছে নেওয়া হয়েছে জায়গাটা সমতল এবং নরম পলিমাটি দিয়ে তৈরি বলে। তোমার গতি বেশি হলেও, পানিতে নামার সময় যেরকম ধাক্কা খেয়েছ তারচেয়ে কমই লাগবে।

 ধাক্কার কথা ভাবছি না, বলল পিট, তাকিয়ে আছে কমপিউটার মনিটরে। ভাবছি ত্রিশ টন বিগ বেন দশ মিটার নরম কাদায় না ডুবে যায়। বিগ জনের মতো এটার স্কুপ নেই যে মাটি খুঁড়তে পারবে।

আমরা তোমাকে মাটি খুঁড়ে বের করে আনব, প্রতিশ্রুতি দিলেন অ্যাডমিরাল।

কিন্তু অপারেশনের কী হবে?

এতো নিচু গলায় কথা বললেন অ্যাডমিরাল, কোনো রকমে শুনতে পেল পিট, অপারেশন বাতিল করা হবে।

হোল্ড অন! অকস্মাৎ বাধা দিল পিট। মনিটরে সাগরের তলা দেখতে পাচ্ছি।

 অন্ধকার থেকে কালো কুৎসিত তলদেশ দ্রুতবেগে উঠে আসছে। স্পঞ্জ থেকে একটা আঙুলের মতো করে ডুবে গেল বিগ বেন। ঠাণ্ডা কালো পানিতে ফুলে-ফেঁপে উঠল একটা বিশাল মেঘ, অন্ধকার হয়ে গেল চারদিক।

 সি-ফাইভে কালো হয়ে গেল অ্যাডমিরাল ও অ্যালের চেহারা, ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করছে ওরা পিটের গলা শোনার জন্যে।

বিগ বেন কাদার ভেতর পুরোপুরি চাপা পড়ে গেছে কিনা বুঝতে পারল না পিট। ও শুধু দৃঢ় একটা চাপ অনুভব কর। চারদিকের সমস্ত দৃশ্য অদৃশ্য হয়েছে। ক্যামেরা ও বাইরের আলোয় শুধু বাদামি ও খয়েরি কাদা দেখা গেল। ভাগ্য ভালো যে প্যারাসুটগুলো স্রোতের টানে বিগ বেন-এর একপাশে সরে গেছে। বোতাম টিপে শুটের লাইনে আটকানো হুকগুলো খুলে নিল পিট। তারপর নিউক্লিয়ার পাওয়ার সিস্টেম চালু করল, যাতে সিধে হয়ে সামনে এগোতে পারে বিগ বেন। কাপুনিটা অনুভব করল ও, বিশাল ট্রাক্টর বেল্ট মাটি কামড়ে ঘুরতে শুরু করেছে। বেল্ট ঘুরছে, তবে বিগ বেন সামনে বাড়ছে বলে মনে হলো না।

কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল। তারপর হঠাৎ ঝাঁকি খেল বিগ বেন, কাত হয়ে পড়ল ডান দিকে। কন্ট্রোল অ্যাডজাস্ট করে বাহনটাকে সিধে করে নিল পিট। অনুভব করল, একটু একটু করে সামনে এগোচ্ছে। ক্রমশ বাড়ছে গতি।

হঠাৎ করেই কাদার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে দ্রুত বেগে ছুটল বিগ বেন। চারপাশের পানি খোলা। আরো পঞ্চাশ মিটার এগোবার পর দৃষ্টিসীমা বাড়তে শুরু করল, ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসছে পানি।

পেশী ঢিল করে দিয়ে বসে আছে পিট, আপন গতিতে এগিয়ে চলছে বিগ বেন। খানিক পর অ্যাডমিরাল ও অ্যালের সঙ্গে যোগাযোগ করল ও। জানাল, ডেনিংস ডেমনস-এর দিকে রওনা হয়ে গেছে।

.

৬৮.

 সকাল দশটার দিকে জেমস স্যানডেকারের মেসেজ নিয়ে হোয়াইট হাউসে ঢুকলেন রেইমন্ড জর্ডান। শাওয়ার সেরে কাপড় পাল্টে এইমাত্র বেডরুমে ঢুকেছেন প্রেসিডেন্ট। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাইয়ের নট বাঁধছেন, সিচুয়েশন রুম থেকে খবর এল।

 বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত, মি. প্রেসিডেন্ট, সবিনয়ে বললেন রেইমন্ড জর্ডান। ভাবলাম শুনে খুশি হবেন যে অপারেশনটা সুন্দরভাবে শুরু হয়েছে। বিগ বেনকে নিয়ে ডেনিংস ডেমনস-এর দিকে রওনা হয়ে গেছেন ডার্ক পিট।

ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, ভালো একটা খবর দিয়ে শুরু হলো দিনটা। বম্বারের কাছে পৌঁছুতে কতক্ষণ সময় নেবেন উনি?

এক ঘণ্টা। আরো কম লাগবে যদি সাগরের তলা সমতল হয়।

আর বিস্ফোরণ?

দুঘণ্টা লাগবে বোমাটা সরাতে। আরো তিন ঘণ্টা এক্সপ্লেশন সাইটে পৌঁছে ডিটোনেটর সেট করতে, নিরাপদ দুরত্বে সরে আসতে।

কোন সমস্যা হয়নি তো?

তেমন কোনো সমস্যা হয় নি। অ্যাডমিরাল স্যানডেকার ভয় করেছিলেন, পতনের ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে বিগ বেন, তবে সেরকম কিছু ঘটে নি। আরেকটা বিষয় হলো, মি. ডার্ক পিট মি, অ্যাল জিওর্দিনোকে যেভাবেই হোক ফাঁকি দিয়েছেন। কাজটা তিনি একা করছেন।

মনে মনে খুশি হলেন প্রেসিডেন্ট। আমি অবাক হচ্ছি না। ভদ্রলোকের বিবেচনাবোধ অত্যন্ত প্রখর একজন বন্ধুকে বিপদে ফেলার আগে নিজেই বরং প্রাণদান করবেন। গাড়ি-বোমা সম্পর্কে নতুন কিছু খবর পেলে?

টাস্ক ফোর্স এ পর্যন্ত সাতাশটা গাড়ি-বোমা খুঁজে বের করেছে।

কোরোরি ইয়োশিশু ও ইচিরো সুবোই এতোক্ষণে বুঝতে পারছে, তাদের ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছি আমরা। বোমা ফাটাবার কোড যদি ওদের কাছে থাকতো, এতোক্ষণে আওয়াজ পেতাম।

প্রতিযোগিতায় আমরা জিতেছি কিনা শিগগিরই জানতে পারব, শান্ত সুরে বললেন রেইমন্ড জর্ডান।

 প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী ডেইল নিকোলাস হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এলেন। এলিভেটর থেকে নামতেই তাকে দেখতে পেলেন প্রেসিডেন্ট।তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, বললেন তিনি, খালি পায়ে বিষ-পিঁপড়েদের কলোনিতে দাঁড়িয়ে আছ। কী ব্যাপার, ডেইল?

 কমিউনিকেশন লাউঞ্জে আসুন, প্লীজ, মি. প্রেসিডেন্ট। কীভাবে যেন আমাদের সেফ, কমিউনিকেশন সিস্টেমে ঢুকে পড়েছে ইচিরো সুবোই, ভিডিওতে আপনাকে চাইছে সে।

স্ক্রীনে রয়েছে সে?

এখনো আসেনি, তবে বলছে আপনার সাথে কথা বলতে চায়।

সিচুয়েশন রুমকে সতর্ক করো, আলোচনাটা যাতে শুনতে পায় ওরা।

কমিউনিকেশন রুমে ঢুকে একটা লেদার চেয়ারে বসলেন প্রেসিডেন্ট, তার সামনের দেয়ালে বিশাল ও চারকোণা একটা স্ক্রীন দেখা যাচ্ছে। চেয়ারের হাতলে বোতাম, সেটা টিপতেই স্ক্রীনে ফুটে উঠল ইচিরো সুবোইর জ্যান্ত ছবি।

মাদুরের ওপর পদ্মাসনে বসে রয়েছে ইচিরো সুবোই, হাত দুটো দুই হাঁটুর ওপর। দামী বিজনেস স্যুট পরে আছে সে, পায়ে জুতো নেই, তবে মোজা আছে। তার প্রান্তের স্ক্রীণে প্রেসিডেন্টের ছবি ফুটে উঠতেই সামান্য মাথা ঝাঁকাল সে।

আপনি আমার সাথে আলোচনা শুরু করতে চান, মি. ইচিরো?

হ্যাঁ, চাই, অবশ্যই, বলল ইচিরো সুবোই, সম্মানসূচক কোনো রকম সম্বোধন এড়িয়ে গেল।

প্রথমেই আক্রমণাত্মক ভুমিকা নিলেন প্রেসিডেন্ট। মন্টানা সীমান্তে নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আপনি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছেন, মানতে হবে। বিস্ফোরণটা আসলে একটা মেসেজ ছিল, তাই না?

ইচিরো সুবোইর চোখের পাতা ঘন ঘন ওঠা-নামা করল দেখে প্রেসিডেন্ট ধরে নিলেন, লোকটা নার্ভাস বোধ করছে, যদিও তার চেহারা সম্পূর্ণ নিলিপ্ত। আমাদের আলোচনা সংক্ষিপ্ত হওয়া দরকার, বলল ইচিরো সুবোই। সোসেকি দ্বীপে আমাদের কী ধরনের ফ্যাসিলিটি রয়েছে, আশা করি ইতোমধ্যেই আপনি তা মিস লরেল ও মি. ডিয়াজের কাছ থেকে জেনে নিয়েছেন। মার্কিন ইন্টেলিজেন্সও নিশ্চয়ই আপনাকে অন্ধকারে রাখে নি…।

তাকে থামিয়ে দিয়ে প্রেসিডেন্ট বললেন, আমি আপনাদের ড্রাগন সেন্টার ও কেইটেন প্রজেক্ট সব কথাই জানি। লক্ষ করছেন, ইচিরো সুবোই হিদেকি সুমার কথা তোলে নি। যদি ভেবে থাকেন আরেকটা গাড়িবোমা ফাটলে আমি পাল্টা আঘাত হানার নির্দেশ দেব না, মারাত্মক ভুল করবেন আপনি।

লক্ষ লক্ষ মানুষকে মেরে ফেলা আমাদের উদ্দেশ্য নয়, শুরু করল ইচিরো সুবোই, এবারও তাকে বাধা দিলেন প্রেসিডেন্ট।

আপনারা কী চান তা-ও আমরা জানি, বললেন তিনি। পাবার চেষ্টা করে দেখুন, পরিণতির জন্যে আপনারাই দায়ী থাকবেন। পিঁপড়ের পাখা গজায় মরার জন্যে। বোধ হয় কিছু একটা বলতে চান আপনি, তা না হলে আমার সাথে যোগাযোগ করবেন কেন?

আমার কয়েকটা নির্দিষ্ট প্রস্তাব আছে।

শুনতে কোনো আপত্তি নেই আমার।

গাড়ি-বোমার তল্লাশি বন্ধ করার নির্দেশ দিন। আর যদি একটাও আটক করা হয়, ডিটোনেটের জন্যে সিগন্যাল পাঠানো হবে। মনে আছে, আপনারাই প্রথমে অ্যাটম বোমা ফেলেছিলেন আমাদের ওপর? কাজেই আপনাদের মেট্রোপলিটান শহরগুলোয় বোমা ফাটাতে ইতস্তত করব না আমরা।

অনেক কষ্টে রাগ চেপে রাখলেন প্রেসিডেন্ট। আমাদের কয়েক মিলিয়ন লোককে মারুন আপনারা, আমরা আপনাদের সবাইকে মেরে সাফ করে দেব। গোটা জাপানে প্রাণের কোনো অস্তিত্বই থাকবে না।

 না, আপনি তা করবেন না। আপনাকে সবাই কসাই বলবে। আমেরিকানদের ঘৃণা করবে সবাই। তবু বলে রাখি, নতুন সাম্রাজ্যের স্বার্থে আত্মদান করতে এক পায়ে খাড়া হয়ে আছে জাপানিরা।

মিথ্যে কথা, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন প্রেসিডেন্ট। এখনো আপনি, সুমা ও আপনাদের সঙ্গী আন্ডারগ্রাউন্ড ক্রিমিনালরা সবকিছু গোপনে করছেন। আপনাদের জঘন্য ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জাপানের সাধারণ মানুষ কিছুই জানে না। আপনারা তাদের প্রতিনিধিত্ব করেন না, জাপান সরকারের সাথেও আপনাদের কোনো সম্পর্ক নেই।

ঠোঁট বাঁকা করে হাসল ইচিরো সুবোই। আপনি আমার প্রস্তাব মেনে নিয়ে দুদেশের বিপর্যয় এড়াতে পারেন।

আমি শুনছি, বললেন প্রেসিডেন্ট, গলার স্বরে চাপা উত্তেজনা।

জাপানী মালিকানাধীন কোনো কোম্পানি আপনারা জাতীয়করণ করতে পারবেন না। যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় কোনো রকম বাধা দেওয়া যাবে না।

কোনো বিদেশি কোম্পানি জাতীয়করণ করা হচ্ছে না। রিয়েল এস্টেট ব্যবসা ও অবাধে চলছে, কোন রকম বাধা দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না।

 আপনি ঘোষণা করবেন, যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার সময় জাপানিদের পাসপোর্ট লাগবে না।

 এ ব্যাপারে কংগ্রেসের সাথে লড়তে হবে আপনাদের।

ঠাণ্ডা সুরে বলে চলছে ইচিরো সুবোই, জাপানি পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করা যাবে না, শুল্ক বাড়ানোর যাবে না।

আর আপনারা?

আমরা কী করব সেটা আমাদের ব্যাপার, বলল ইচিরো। এ ব্যাপারে আপনাদের সাথে আমরা কোনো আলোচনায় বসব না। যথেষ্ট সঙ্গত কারণেই আপনাদের পণ্য জাপানিরা পছন্দ করে না।

বলে যান, নির্দেশ দিলেন প্রেসিডেন্ট।

হাওয়াই রাজ্য জাপানের হাতে ছেড়ে দিতে হবে।

 প্রেসিডেন্টকে আগেই সাবধান করা হয়েছে, এ ধরনের দাবি করা হতে পারে। আপনি একটা পাগল।

শুধু হাওয়াই নয়, ক্যালিফোর্নিয়াও।

মৃদু হাসলেন প্রেসিডেন্ট। নিজেকে আপনি বোকা প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন কেন বুঝলাম না।

যেহেতু আমাদের টাকায় আপনাদের অর্থনীতি চাঙা রয়েছে, তাই মন্ত্রিপরিষদের আমাদের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে স্টেট, ট্রেজারি ও কমার্স ডিপার্টমেন্টে।

প্রতিনিধি নির্বাচন করবে কে? আপনি, কোরোরি ইয়োশিশু, নাকি জাপান সরকার?

মি. কোরারি ও আমি।

 আপনার দাবি বা প্রস্তাব হজম করতে খানিকটা সময় দিন আমাকে, বলে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকলেন প্রেসিডেন্ট। তারপর বললেন, না, বড় বেশি গুরুপাক। দুঃখিত, মি. ইচিরো। জাতি হিসেবে আমরা কারো কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারি না। আপনার দাবি মেনে নিলে আমেরিকানরা হবে ক্রীতদাস। এ ধরনের অন্যায় ও উদ্ভট দাবি মেনে নেয়ার জন্যে ভোট দিয়ে আমাকে প্রেসিডেন্ট বানানো হয় নি।

ঊনিশশো পঁয়তাল্লিশে আপনারা যে সব শর্ত দিয়েছিলেন আমাদেরকে, সেগুলোর তুলনায় আমাদের দাবি অনেক নরম। তবে মানা না মানা আপনার ব্যাপার। আজ বিকেল তিনটে পর্যন্ত সময় হয়ে হলো আপনাকে। উপদেষ্টা ও কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করুন। ওদেরকে জানান, আলোচনার মুহূর্তে ওয়াশিংটনের জনবহুল এলাকায় দুটো গাড়ি বোমা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কথাও শেষ হলো, সেই সঙ্গে স্ক্রীন থেকে মুছে গেল ইচিরো সুবোইর ছবি।

দেয়াল-ঘড়ির দিকে তাকালেন প্রেসিডেন্ট। নটা বাজে। বাকি আছে আর ছঘণ্টা। ঠিক ছঘণ্টা পর ডার্ক পিটও পুরানো অ্যাটম বোমাটা ফাটিয়ে সাগরের তলায় একটা সুনামি ঘটাবে।

 হায় ঈশ্বর, খালি কামরার ভেতর আপন মনে বিড়বিড় করলেন তিনি। পিট যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে কী হবে?

.

৬৯.

উনসত্তর ঘণ্টায় পনেরো কিলোমিটার গতিতে এগোচ্ছে বিগ বেন, পেছনে মাথাচাড়া দিচ্ছে কাদার বিশাল একটা মেঘ। ভিউয়িং স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে আছে পিট, লেয়ার সোনার ইউনিটের সঙ্গে সংযুক্ত ওটা। সাগরের তলায় মরুভূমিতে রয়েছে ও, তেমন কোনো বিস্ময় ওর জন্যে অপেক্ষা করছে না।

 সাতচল্লিশ মিনিট পর বি-টোয়েনটিনাইনের কাঠামোটা দেখতে পেল পিট। ধীরে ধীরে আকারে বড় হলো ওটা, এক সময় পুরো মনিটর দখল করে ফেলল। বিগ বেন-এর গতি কমিয়ে ভাঙাচোরা প্লেনটাকে ঘিরে চক্কর দিতে শুরু করল ও। ডেনিংস ডেমনস এক মিটারের কিছু বেশি কাদায় ডুবে আছে। একটা এঞ্জিন নিখোঁজ, মোচড় খেয়ে পেছন দিকে ভাজ খেয়ে রয়েছে স্টারবোর্ড উইং। তিনটে অবশিষ্ট প্রপেলারের বেড়গুলো ও ভাঁজ খেয়ে গেছে।

তিনতলা উঁচু টেইল সেকশনে শেল ফায়ারের চিহ্ন দেখা গেল। গানারস ডুবিয়ে দিয়েছে কাদায়। ত্রিশ মিটার লম্বা অ্যালুমিনিয়াম ফিউজিলাজে শ্যাওলা ও কাদা জমেছে, তবে বো কে ঘিরে থাকা জানালার কাঁচ এখনো পরিষ্কার।

টার্গেট দেখতে পাচ্ছি, সি-ফাইভে খবর পাঠাল পিট।

কী অবস্থা ওটার? সঙ্গে সঙ্গে জানতে চাইলেন জেমস স্যানডেকার।

একটা ডানার মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। টেইল সেকশনও ভেঙে গেছে। তবে ফিউজিলাজ অক্ষত।

বোমাটা আছে ফরওয়ার্ড বম্ব বে-তে। বিগ বেন-কে এমন পজিশনে নিয়ে যেতে হবে, তুমি যাতে প্লেনের ছাদ কেটে ভেতরে ঢুকতে পারো।

ভাগ্য আজ লক্ষ্মী মেয়ে, বলল পিট। স্টারবোর্ড উইং ভেঙে যাওয়ায় পজিশন নেওয়ার জায়গা পাব। পাশ থেকে বাল্কহেড কাটব।

বিগ বেন-এর মেটাল কাটিং মেশিনকে কাজে লাগালো পিট। মেশিনটার একটা বাহুর সঙ্গে ক্যামেরা আছে, কি কাটা হচ্ছে না হচ্ছে সবই পিট দূর থেকে স্ক্রীনে দেখতে পারবে। মেশিনটার ধারালো হুইলগুলো যান্ত্রিক গুঞ্জন তুলে ঘুরতে শুরু করল, এয়ারফ্রেমের অ্যালুমিনিয়াম কাটা চলছে।

 চার মিটার লম্বা, তিন মিটার চওড়া হলো ফাঁকটা। ভেতরে বোমাটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। একটা বড় জিঞ্জিরের সঙ্গে ঝুলছে। বোমাটা নয় ফুট লম্বা, ডায়ামিটারে পাঁচ ফুট। ওটা আনতে যাচ্ছি, রিপোর্ট করল পিট।

 তুলে আনতে দুটো ম্যানিপুলেটরই লাগবে তোমার, বললেন অ্যাডমিরাল। ওটার ওজন পাঁচ টন।

জিঞ্জির ও ব্রাকেট কাটতে একটা ম্যানিপুলেটর আর্ম লাগবে আমার।

কিন্তু একটা আর্ম বোমটার ভার সহ্য করতে পারবে বলে মনে হয় না।

জানি, বলল পিট। সে জন্যেই তো জিঞ্জির ও ব্রাকেট কাটার পর ওটাকে তুলব ভেবেছি।

একটু অপেক্ষা করো, বললেন অ্যাডমিরাল। আমি চেক করে দেখে বলছি তোমাকে।

ঠিক আছে।, পাট মিনিট পর অ্যাডমিরাল আবার যোগাযোগ করলেন, পিট?

বলুন।

বোমাটাকে খসে পড়তে দাও।

আবার বলুন।

জিঞ্জির ও ব্রাকেট কাটো, বোমাটা নিচে পড়ে যাক। বড় ধরনের ধাক্কা হজম করার ক্ষমতা আছে ওটার।

 ডকুমেন্টারি ফিল্মে দেখা অ্যাটম বোমা বিস্ফোরণের প্রতিক্রিয়া ভেসে উঠল পিটের চোখের সামনে। ওর মাত্র কয়েক ফুট দূরে সে ধরনের একটা বোমা রয়েছে। ওটা যদি জিঞ্জির মুক্ত হয়ে নিচে পড়ে, তারপর ফেটে যায়?

লাইনে আছ তুমি, পিট? জানতে চাইলেন অ্যাডমিরাল, গলার আওয়াজে চাপা উত্তেজনা।

যা বলছেন তা কি ফ্যাক্ট, নাকি গুজব?

 হিস্টোরিক্যাল ফ্যাক্ট।

বোমাটা যদি ফাটে, আমার আজকের দিনটাই মাটি হবে, কৌতুক করল পিট। তারপর বড় করে শ্বাস নিল, ছাড়ল, বন্ধ করল চোখ, সবিশেষে কাটিং ডিস্কটাকে জিঞ্জির কাটার কাজে লাগিয়ে দিল। এতো বছর পানির তলায় থাকায় শিকলে মরচে ধরে গেছে, বিচ্ছিন্ন হতে বেশি সময় নিল না। প্রকাণ্ড বোমাটাবন্ধ বম্ব বে-র দরজার ওপর পড়ল। বিস্ফোরণ ঘটলো শুধু কাদায়।

নিঃসঙ্গ কয়েকটা মুহূর্ত কেটে গেল। বোধহীন, অসাড় লাগছে নিজেকে পিটের। গোলা পানি ধীরে ধীরে স্বচ্ছ হলো আবার, আবার দেখা গেল বোমাটাকে।

আমি তো কোনো বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনলাম না, অদ্ভুত শান্ত গলায় বললেন অ্যাডমিরাল।

পাবেন, বলল পিট, দ্রুত সামলে নিচ্ছে নিজেকে। অবশ্যই শুনতে পাবেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *