২০. সাফবোর্ডে দাঁড়িয়ে

২০.

প্রথমে আমরা সাফবোর্ডে দাঁড়িয়ে ম্যাকাপু পয়েন্টে সূর্যোদয় দেখব, বলল পিট, স্টেসির একটা হাত ধরে আছে। পরে, হানাউমা বে-তে চড়ব ডলফিনের পিঠে। তারপর সৈকতে শুয়ে গায়ে রোদ মাখব, যতক্ষণ না আপনার চামড়া থেকে সানট্যান তেল শুকায়। দুপুরে আমরা ছাতার নিচে বসে লাঞ্চ খাব, বিকেলটা গাছের নিচে শুয়ে। আর রাতে… রাতে, ছোট্ট একটা নির্জন রেস্তোরাঁয় নিয়ে যাব আপনাকে, ম্যানোয়া ভ্যালিতে ওটা…।

ভারি মজা পাচ্ছে স্টেসি, কথাবলার সময় কৌতুকে চিকচিক করে উঠল চোখ দুটো। একটা এসকর্ট সার্ভিস খোলার কথা ভেবেছেন কখনও?

 মেয়েদের কাছ থেকে কিছু খসাবার প্রবণতা আমার ভেতর একেবারেই নেই, বলল পিট। সেজন্যেই পকেট সব সময় খালি থাকে।

এয়ার ফোর্স হেলিকপ্টারের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল পিট। বাইরে অন্ধকার, দূরে অস্পষ্ট একটা আলো দেখা গেল।

পিট ও প্লাঙ্কেটকে উদ্ধার করা হয় সন্ধ্যার দিকে, তার একটা পরই সবাইকে তুলে দেয়া হয় এই হেলিকপ্টারে। সবাই মানে সগি একর-এর মাইনিং টিম, ওল্ড গার্ট-এর ত্রু। সাংহাই শেলি ত্যাগ করার আগে ওয়েন মারফি ও তাঁর ক্রুদের অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়েছে ওরা। হেলিকপ্টারে সবার শেষে ভোলা হয় জিমি নষ্পে লাশ, ক্যানভাসে মুড়ে। চাইনিজ জাংক ও মার্কিন অ্যাটাক সাবমেরিনকে ওখানে রেখে হেলিকপ্টার রওনা হয়ে গেল হাওয়াই-এর উদ্দেশে।

অ্যাডমিরাল স্যানডেকার সীটে বসে ঘুমাচ্ছেন। তার পাশের সীটে অ্যালও। সম্ভবত বাকি সবাইও জেগে নেই। স্টেসিও ঘুমিয়ে পড়ত, শুধু পিটের সঙ্গ দারুন। ভাল লাগছে বলে জেগে আছে সে।

 কিছু দেখতে পেলেন? জানতে চাইল স্টেসি।

দিগন্তের কাছে একটা দ্বীপ, নাম জানি না, বলল পিট। তবে বোধহয় পনেরো মিনিটের মধ্যে হনলুলুকে পাশ কাটাব।

চোখে ক্ষীণ বিদ্রূপ, স্টেসি বলল, আপনি বরং আগামীকাল সম্পর্কে আরও কিছু বলুন। ইতোমধ্যে বুঝে ফেলেছি, আপনি মানুষকে ভাল ভাল স্বপ্ন দেখাতে পারেন।

আগামীকাল সম্পর্কে আপনি ঠিক কি জনতে চান বলুন তো?

 বিশেষ করে ডিনার পরবর্তী প্রোগ্রাম সম্পর্কে বলুন।

কিন্তু আমি তো ডিনার সম্পর্কে এখনও কিছু বলিনি আপনাকে।

বলেননি, এখন বলুন।

ঠিক আছে। ওখানে, মানে সাদা বালির ওপর, সরি সরি অনেকগুলো নারকেল ও সুপারি গাছ আছে…।

আনন্দে চিকচিক করে উঠল স্টেসির চোখ দুটো। নারকেল ও সুপারি গাছ? বাহ্ দারুণ! তারপর?

 গাছগুলোর মাঝখানে ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর আছে, গাছের পাতা দিয়ে তৈরি। ঘরটা এত ছোট যে কোনরকমে দুজনের জায়গা হতে পারে।

.

হিকাম ফিল্ডের একধারে ল্যান্ড করল হেলিকপ্টার। অন্ধকারে দেখা যায় না, তবে চারদিকে পাহারা দিচ্ছে আর্মির একটা বিশেষ কমব্যাট প্ল্যাটুন। একটা বাস ছুটে এল, পিছনে একটা কালো ফোর্ড সিডান ও আর্মি অ্যাম্বুলেন্স। কার থেকে নামল সাদা পোশাক পরা চারজন লোক, হেলিকপ্টারের দরজার দুপাশে দাঁড়াল তারা। পোস্টমর্টেম করার জন্যে জিমি নক্সের লাশ সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে।

নুমার লোকজনকে বাসে উঠতে বলা হলো। হেলিকপ্টার থেকে সবার শেষে নামল পিট ও স্টেসি বাসের দিকে এগোচ্ছে, ওদের পথরোধ করে দাঁড়াল একজন গার্ড, ইঙ্গিতে আরেক দিকে যেতে বলছে সে, যেখানে অ্যাডমিরাল স্যানডেকার দাঁড়িয়ে আছেন, পাশে অ্যাল। গার্ডের লম্বা করা হাতটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল পিট, এগিয়ে এসে দাঁড়াল বাসের পাশে। গুডবাই, প্লাঙ্কেটকে বলল ও। পা দুটো শুকনো রাখার চেষ্টা করবেন।

পিটের হাতটা মুচড়ে দিলেন প্লাঙ্কেট। আপনার জন্যে লাইফ পেয়েছি, সেজন্যে ধন্যবাদ, ডার্ক। আবার দেখা হলে বোতলের খরচ আমি দেব।

মনে থাকবে আমার। আপনার জন্যে শ্যাম্পেন, আমার জন্যে বিয়ার।

গড ব্লেস।

কালো গাড়িটার দিকে হেঁটে আসছে পিট, দেখল দুজন লোক তাদের সোনালি আইডি কার্ড অ্যাডমিরালের মুখের সামনে ধরে আছে, নিজেদের পরিচয় দিচ্ছে ফেডারেল গভর্মেন্টের এজেন্ট বলে। তাদের একজন বলল, আমি প্রেসিডেনশিয়াল নির্দেশে কাজ করছি, অ্যাডমিরাল। আমার ওপর নির্দেশ আছে আপনাদের চারজনকে সরাসরি ওয়াশিংটনে নিয়ে যেতে হবে। আপনি, মি. ডার্ক পিট, মি. অ্যাল জিওর্দিনো ও মিস স্টেসি ফক্স।

বুঝলাম না, বললেন অ্যাডমিরাল স্যানডেকার, চেহারায় অস্বস্তি। এত তাড়া কিসের?

 তা আমার জানা নেই, স্যার।

কিন্তু আমার নুমার অফিসাররা দুমাসের ওপর পানির নিচে কাজ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, ওদের বিশ্রাম দরকার, প্রতিবাদের সুরে বললেন অ্যাডমিরাল।

নিউজ ব্ল্যাকআউট, প্রেসিডেন্টের নির্দেশ, স্যার। আপনার নুমার লোকজন, প্লাঙ্কেট ও ড. স্যালাজার সহ, দ্বীপের নিরাপদ একা কম্পাউন্ডে থাকবেন, যতদিন না নিউজ ব্ল্যাকআউট তুলে নেয়া হয়। তারপর সরকারি খরচে ওরা যে যেখানে যেতে চান পৌঁছে দেয়া হবে।

যতদিন মানে?

 তিন কি চার দিন, স্যার।

অন্যান্যদের সাথে মিস স্টেসিও যেতে পারবেন না?

না, স্যার। আমার ওপর নির্দেশ আছে, তাকেও আপনার সাথে থাকতে হবে।

স্টেসির দিকে তাকাল পিট, ঠোঁট বাঁকা করে বলল, কি যেন গোপন করে গেছেন আপনি, লেডি!

অদ্ভুত রহস্যময় এক টুকরো হাসি ফুটল স্টেসির ঠোঁটে। হাওয়াই-এর আমাদের আগামীকালটা ভেস্তে গেল!

কেন বলতে পারব না, আমার তা মনে হচ্ছে না।

স্টেসির চোখ দুটো সামান্য একটু বড় হলো। অন্য এক সময় পুষিয়ে নেয়া যাবে, সম্ভবত ওয়াশিংটনে।

 আপনি আমাকে বোকা বানিয়েছেন। এখন সন্দেহ হচ্ছে ওল্ড গার্টে যে সাহায্য চেয়েছিলেন, সেটাও আপনার ছিল কিনা।

মুখ তুলে তাকাল স্টেসি, চেহারায় রাগ ও অভিমানের অদ্ভুত সংমিশ্রণ। সময়মত আপনারা না পৌঁছালে সবাই আমরা মারা যেতাম।

তাছাড়া, রহস্যময় বিস্ফোরণটা? ওটা কি আপনাদেরই কীর্তি?

কে দায়ী সে সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নেই, আন্তরিক সুরে বলল স্টেসি। আমাকে ব্রিফ করা হয়নি।

ব্রিফ, মৃদুকণ্ঠে পুনরাবৃত্তি করল পিট। একজন ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার এ ধরনের একটা শব্দ ব্যবহার করবে কেন? আসলে কাদের হয়ে কাজ করছেন আপনি?

হঠাৎ যেন কঠিন হয়ে উঠল স্টেসির সুর। শিগগিরই জানতে পারবেন। পিটের দিকে পিছন ফিরল সে, গাড়িতে উঠে পড়ল।

.

ওয়াশিংটনে যাবার পথে, প্লেনে মাত্র তিন ঘণ্টা ঘুমাল পিট। গালফস্ট্রীম সরকারি জেটের পিছন দিকে, সবার কাছ থেকে দূরে একা বসে আছে ও, কোলের ওপর পড়ে রয়েছে ইউএসএ টুডে। কাগজটার দিকে তাকিয়ে আছে, তবে পড়ছে না।

 রেগে আছে পিট। রাগ হচ্ছে একাধিক কারণে। বিস্ফোরণের কারণে যে ভূমিকম্প হলো, সে-ব্যাপারে একের পর এক অনেক প্রশ্ন করেছে ও, কিন্তু ওর প্রতিটি প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন অ্যাডমিরাল স্যানডেকার। বুঝতে অসুবিধে হয়নি, মুখ খুলতে রাজি নন তিনি। রাগ স্টেসির ওপরও, কারণ এখন ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে ব্রিটিশদের ডীপ-ওয়াটার অপারেশনের উদ্দেশ্য ছিল নুমার সগি একর প্রজেক্টের ওপর নজর রাখা। একই লোকেশনে ওল্ড গার্টের ডাইভ দেয়াটা কাকতালীয় ব্যাপার হতে পারে না। ফটোগ্রাফার না ঘোড়ার ডিম, ওটা আসলে স্টেসির কাভার। মেয়েটা আসলে স্পাই, কোন সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হলো, কোন এজেন্সির প্রতিনিধিত্ব করছে সে?

 চিন্তার মগ্ন পিট, প্লেনের পিছন দিকে চলে এসে পিটের পাশে বসল অ্যাল। তোমাকে পরাস্ত বলে মনে হচ্ছে, দোস্ত।

আড়মোড়া ভাঙল পিট। ভাবছি, বাড়ি ফিরতে পারলে ভালো হতো।

অ্যান্টিক ও ক্লাসিক গাড়ির একটা বিরাট সংগ্রহ আছে পিটের, অ্যাল তা জানে।

নতুন কোন গাড়ির ওপর কাজ করবে? জানতে চাইল সে।

 কোনটা?

 জিওর্দিনো মাথা ঝাঁকায়। প্যাকার্ড না মারমন?

কোনোটাই না, পিট বলে। প্যাসিফিকে যাওয়ার আগে স্টাজে লাগানোর জন্যে একটা এঞ্জিন তৈরি করেছি নতুন করে।

সেই যে, ১৯৩২ সালের সবুজ গাড়িটা?

হ্যাঁ।

.

ক্লাসিক গাড়ির রেস হবে রিচমন্ডে, থাকতে চাও ওখানে?

রেস তো আর মাত্র দুদিন পর, চিন্তিত ভাবে বলল পিট। এত তাড়াতাড়ি গাড়িটা খাড়া করাতে পারব না।

দুজন মিলে চেষ্টা করলে পারব, উৎসাহ দিয়ে বলল অ্যাল। অন্তত চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি?

 বোধহয় সুযোগ পাব না, অ্যাল, বলল পিট। শুধু নিউজ ব্ল্যাকআউট নয়। ব্যাপারটা আরো সিরিয়াস তে পারে। অ্যাডমিরালের হাবভাব আমার ভাল ঠেকছে না।

আমি তার মুখ খোলাবার কম চেষ্টা করিনি, হতাশ কণ্ঠে বলল অ্যাল।

কিন্তু?

তার চেয়ে একটা লাইটপোস্টের সাথে কথা বললেও হয়তো কিছু আদায় করা যেত।

মাত্র একটা তথ্য আদায় করতে পেরেছি আমি, বলল পিট। ল্যান্ড করার পর সরাসরি আমাদেরকে ফেডারেল হেডকোয়ার্টার বিল্ডিঙে নিয়ে যাওয়া হবে।

হতভম্ব দেখায় অ্যালকে। ওয়াশিংটনে কোন ফেডারেল হেডকোয়ার্টার বিল্ডিং আছে বলে তো কখনও শুনিনি।

আমিও, বলল পিট।সেজন্যেই মনে হচ্ছে, আমাদের আটকে রাখা হয়েছে।

.

২১.

 ভ্যানটায় কোন চিহ্ন নেই, পাশে কোন জানালাও নেই। এ এয়ারফোর্স বেস থেকে বেরিয়ে কনস্টিটিউশন অ্যাভিনিউ ধরে ছুটল সেটা। বেশ কিছুক্ষণ পর নির্জন একটা গলির ভেতর ঢুকল। থামল পার্কিং লটের পিছনে, একটা পুরানো ছতলা ভবনের সিঁড়ির গোড়ায়। ভবনের গায়ে প্লাস্টার প্রায় নেই বললেই চলে, দেখে মনে হলো যেকোন মুহূর্তে ধসে পড়তে পারে। বাইরের দিকের সবগুলো জানালা ভেতর থেকে বন্ধ, সম্ভবত বছরের পর বছর খোলা হয় না। কয়েকটা ঝুল-বারান্দার রেইল ভেঙে গেছে, পরে আর মেরামত করা হয়নি। যেন পরিত্যক্ত একটা ভবন।

ওদের সাথে দুজন ফেডারেল এজেন্ট রয়েছে, তারাই পথ দেখাল। কয়েকটা ধাপ টপকে লবিতে ঢুকল ওরা। লবিতে ফার্নিচার বলতে তেমন কিছু নেই, যা-ও বা আছে, সব ভাঙাচোরা ও মান্ধাতা আমলের। মেঝেতে বসে আছে ছেঁড়া কম্বল জড়ানো এক প্রৌঢ়, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, দেখে মনে হলো আশ্রয়হীন। তার দিকে চোখ পড়তে দ্রুত মুখ ফিরিয়ে নিলেন অ্যাডমিরাল। লোকটার গায়ে নির্ঘাত ছারপোকা আর উৎকট দুর্গন্ধ আছে, যেকোন মেয়ের মনে ঘৃণার উদ্রেক করবে, কিন্তু লোকটার দিকে চোখ পড়তে সামান্য হাসল স্টেসি।

কৌতূহল বোধ করল পিট, দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, রোদ পোহাবার জন্যে দিনটা ভাল।

প্রৌঢ় লোকটা নিগ্রো, জট করে মুখ তুলে তাকাল। আপনি অন্ধ নাকি, মিস্টার? রোদ আমার কি উপকারে আসবে?

 লোকটার চোখে প্রফেশন্যাল অবজারভার-এর দৃষ্টি, লক্ষ করল পিট। ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুঁটিয়ে পরীক্ষা করল সে। এ চোখ আশ্রয়হীন কোন দুর্ভাগার হতে পারে না।

কি জানি, প্রতিবেশীসুলভ সৌহার্দ্য প্রকাশ পেল ওর গলার সুরে। তবে পেনশন পাবার পর আপনি যখন বারমুডায় সময় কাটাতে যাবেন, রোদে তো আপনাকে বেরুতেই হবে, তাই না?

সর্বহারা লোকটি হাসল, মুক্তার মত ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে। হ্যাভ আ সেফ স্টে, মাই ম্যান, বলল সে।

চেষ্টা করব, বলল পিট। অদ্ভুত উত্তর শুনে কৌতুক বোধ করল। সামনে এই প্রথম এক সারিতে কয়েকজন সশস্ত্র সেন্ট্রিকে দেখতে পেল ও। তাদেরকে পাশ কাটিয়ে ঢুকে পড়ল মেইন হলরুমে।

প্রথমেই ডিজাইনফেকট্যান্ট-এর গন্ধ ঢুকল নাকে। হলরুমের মেঝেতে চাল বলে কিছু নেই, কোথাও গর্তও সৃষ্ট হয়েছে। দেয়ালে অনেক কাল আগে রঙিন কাগজ সাঁটা হয়েছিল, বেশিরভাগ ছিঁড়ে গেছে। একপাশে একটা অ্যান্টিক পোস্টবক্স দেখল ও, গায়ে লেখা রয়েছে ইউএস মেইল।

নিঃশব্দে খুলে গেল একটা এলিভেটরের দরজা। ভেতরটা চকচকে ক্রোম, দেখে অবাক হয়ে গেল সবাই। সদ্য ভাজ খোলা ইউনিফর্ম পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইউএস মেরিন-এর একজন সদস্য, সেই অপারেটর। কোন রকম জড়তা নেই, সরাসরি এলিভেটরে উঠে পড়ল স্টেসি। পিটের মনে হলে, এখানে সম্ভবত আগেও এসেছে সে।

 ওপরে নয়, এলিভেটর নামতে শুরু করল নিচের দিকে। এক সময় থামল সেটা। বাইরে বেরিয়ে এসে পিট দেখল, করিডরের মোজাইক করা মেঝে ঝকঝক করছে, দেয়ালগুলো এত সাদা যেন গতকালই চুনকাম করা হয়েছে। ফেডারেল এজেন্টরা ওদেরকে একটা দরজার সামনে এসে দাঁড় করাল। দেখেই বোঝা গেল, দরজাটা সাউন্ডপ্রুফ। সবার সাথে ভেতরে ঢুকল পিট।

এটা একটা কনফারেন্স রুম। নিচু সিলিং, সিলিঙের আড়ালে আলো। কামরার মাঝখানে বিরাট একটা লাইব্রেরি টেবিল, টেবিলটা প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট হোয়াইট হাউসের জন্যে কিনেছিলেন। টেবিলের ওপর একটা বেতের ঝুড়িতে এক গাদা আপেল রয়েছে, পাশেই একটা কনসোল। নিচে রক্তলাল পারশিয়ান কার্পেট।

 টেবিলের উল্টোদিকে গিয়ে দাঁড়াল স্টেসি। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে তার মুখের পাশে আলতোভাবে চুমো খেলেন এক ভদ্রলোক, অভ্যর্থনা জানালেন নিচু স্বরে, উচ্চারণ ভঙ্গিতে টেক্সাসের সুর স্পষ্ট। দেখে মনে হলো, স্টেসির সাথে আগে থেকেই পরিচয় আছে তার। যদিও স্টেসি ওদের কারও সাথে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিল না। হাওয়াই-এ প্লেনে চড়ার পর থেকে পিট ও স্টেসি পরস্পরের সাথে কথা বলেনি। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে ভান করার চেষ্টা করছে স্টেসি, দিকে পিছন ফিরে থাকছে সে।

স্টেসির পরিচিতি ভদ্রলোকের দুপাশে আরও দুজন বসে রয়েছেন, চেহারাই বলে দেয় এশিয়ান, তাদেরকেও পিট চেনে না। নিজেদের মধ্যে চাপাস্বরে কথা বলছেন সবাই, পিট ও অ্যাল ঘরে ঢুকতেও মুখ তুলে তাকালেন না। টেবিলের মাথার কাছে একটা চেয়ার রয়েছে, সেটার পাশের একটা চেয়ারে বসলেন অ্যাডমিরাল স্যানডেকার, শান্তভাবে একটা হাভানা চুরুট ধরালেন। টেবিলে আরও এক ভদ্রলোক বসে আছেন, একটা ফাইল খুলে কি যেন পড়ছেন তিনি।

রোগা-পাতলা, স্যুটপরা এক ভদ্রলোক, চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে এলেন, হাতে একটা পাইপ। জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের মধ্যে ডার্ক পিট কে?

আমি, বলল পিট।

 ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো, ভদ্রলোক বললেন, পিটের দিকে বাড়িয়ে দিলেন ডান হাতটা। আমাকে বলা হয়েছে, আমরা একসাথে কাজ করব।

কাজটা কি না জেনে উৎসাহ বোধ করছি না, করমর্দন করে বলল পিট। আমার বন্ধু, অ্যাল জিওর্দিনো ও আমি, দুজনেই আমরা অন্ধকারে।

আমরা সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়েছি একটা এমএআইটি তৈরি করব বলে।

এম এআইটি মানে?

মাল্টি এজেন্সি ইনভেস্টিগেটিভ টিম।

ও আচ্ছা, গম্ভীর সুরে বলল পিট। বেশ ভাল, খুশির খবর। টিম গঠন করুন, আমার তাতে কোন আপত্তি নেই। শুধু যদি ক্ষমা করেন, এই মুহূর্তে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে চাই আমি। আমার ঘুম পেয়েছে।

 পিটেরও কথা শেষ হলো, রেইমন্ড জর্ডানও দুই ভদ্রলোককে নিয়ে কনফারেন্স রুমে ঢুকলেন। তিনজনের চেহারাই থমথম করছে। রেইমন্ড জর্ডান সরাসরি জেমস স্যানডেকারের দিকে এগিয়ে এলেন। তোমাকে দেখে খুশি লাগছে, জেমস, বললেন তিনি। এই বিপদে তোমার সহযোগিতা পেয়ে সত্যি মুগ্ধ হয়েছি আমি। জানি প্রজেক্টটা নষ্ট হওয়ার তোমাদের কারও মনই ভাল নেই।

নুমা আরেকটা প্রজেক্ট তৈরি করবে, গমগম করে উঠল অ্যাডমিরালের গলা।

টেবিলের মাথায় বসলেন রেইমন্ড জর্ডান। সহকারীরা পাশেই থাকলেন, কয়েকটা ফাইল রাখলেন তার সামনে। বসার পরও শিথিল হলো না তার পেশী। ভঙ্গিটা আড়ষ্ট, শিরদাঁড়া চেয়ারের পিছনটাকে স্পর্শ করছে না। একে একে সবার দিকে তাকালেন তিনি, দৃষ্টি দেখে বোঝা যায় মনের কথা পড়ার চেষ্টা করছেন। তারপর তিনি তিনজনকে উদ্দেশ্য করে আলাপ শুধু করছেন। ওরা তিনজন এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে পিট, অ্যাল ও ম্যানকিউসো। আপনারা বসবেন, প্লীজ?

বসল ওরা। সামনের ফাইলগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন রেইমন্ড জর্ডান। পরিবেশ উত্তেজনা ও উদ্বেগে ভারী হয়ে আছে।

চুপচাপ বসে আছে পিট, নির্লিপ্ত। লেকচার বা ভাষণ শোনার মত মন নেই ওর। গত দুদিন সাঙ্ঘাতিক ধকল গেছে ওর ওপর দিয়ে, ক্লান্তি বোধ করছে। ইচ্ছে গোসল করে আট ঘণ্টা ঘুমাবে। কারও বাধা মানত না, শুধু অ্যাডমিরালের প্রতি শ্রদ্ধাবশত এখনও এখানে নিজেকে ধরে রেখেছে।

আপনাদের কারও যদি কোন অসুবিধে করে থাকি, সেজন্যে আমি ক্ষমাপ্রার্থী, শুরু করলেন রেইমন্ড জর্ডান। তবে এ-ও সত্যি যে আমরা একটা মহাসঙ্কটে পড়ে দিশেহারা বোধ করছি। সঙ্কট বা বিপদ যে শুধু আমেরিকার, তা নয়। আমাদের ধারণা, গোটা বিশ্বই মারাত্মক একটা সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে। সেজন্যেই এখানে আজ বসে আমরা যে ইনভেস্টিগেটিভ টিম তৈরি করব তাতে আমেরিকান ছাড়াও জাতিসংঘ ও অন্যান্য দেশের প্রতিনিধি থাকবেন। থামলেন তিনি, একটা ফাইলে চোখ বুলালেন। আপনাদের সম্পর্কে জানি আমি।

এতটা নিশ্চিত না হওয়াই ভাল, মন্তব্য করল অ্যাল, অ্যাডমিরাল কঠিন দৃষ্টি এড়িয়ে গেল।

 দুঃখিত, বললেন জর্ডান। আমার নাম রেইমন্ড জর্ডান। জাতীয় ও আন্ত র্জাতিক নিরাপত্তার স্বার্থে প্রেসিডেন্ট আমাকে ইনভেস্টিগেটিভ টিম গঠন করার অনুমতি ও নির্দেশ দিয়েছেন। পরিস্থিতি এবং আপনাদের উপস্থিতি ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব আমি ছেড়ে দিচ্ছি আমার ডেপুটি ডিরেক্টর অপারেশনস, মি. ডোনাল্ড কার্নকে।

 ডোনাল্ড কার্ন হাড়সর্বস্ব ব্যক্তি, ঠাণ্ডা নীল চোখ দিয়ে সবার অন্তর পর্যন্ত দেখে নিচ্ছেন। সবার, শুধু পিটের বাদে। দুজনকে দেখে মনে হলো, মাঝপথে দুটো বুলেট এক হয়েছে, কেউ কাউকে পথ ছাড়বে না।

 প্রথমে, শুরু করলেন ডোনাল্ড কার্ন, এখনও পিটের মন বোঝার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন, টিমের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করব আমি। প্রতিটি টীমে দুজন করে সদস্য থাকবেন। নেতৃত্ব দেবেন একজন। টিম লীডার যদি চান, সদস্য সংখ্যা বাড়াতে পারবেন। তবে তাদের তালিকা আগেই পৌঁছে দিতে হবে আমার কাছে। প্রতিটি টিমের কমান্ড সেন্টার ওয়াশিংটন, এই টিমের কমান্ড সেন্টার ওয়াশিংটন, এই ফেডারেল হেডকোয়ার্টার বিল্ডিং। শাখা অফিস থাকবে প্রশান্ত মহাসাগরের একটা দ্বীপে, পালাও রিপাবলিকের কাছাকাছি। ওটা হবে আমাদের ইনফরমেশন গ্যাদারিং ও কালেকশন পয়েন্ট। আমাদের ডিরেক্টর অভ ফিল্ড অপারেশনস নিয়োগ করা হয়েছে মি. মেল পেনারকে। পেনারের দিকে তাকলেন তিনি, তাঁর ও জর্ডানের সাথেই কনফারেন্স রুমে ঢুকেছেন ভদ্রলোক।

অলসভঙ্গিতে একটা হাত তুললেন পেনার। কারও দিকে তাকালেন না, হাসলেনও না।

 আমাদের টিমগুলোর কোডের ভেতরে থাকবে, বললেন ডোনাল্ড কার্ন। সেন্ট্রাল কমান্ডকে বলা হবে টিম লিঙ্কন। মেল পেনার হলেন টিম ক্রাইসলার। মি. মার্ভিন শওয়াল্টার, ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের আসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর অভ সিকিউরিটি, টোকিওর ইউএস দূতাবাসে দায়িত্ব পালন করবেন। তার টিম কোড হলো ক্যাডিলাক।

মার্ভিন শওয়াল্টার দাঁড়ালেন, মাথা নত করে সবিনয়ে জানালেন, আপনাদের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়ে নিজেকে আমি ধন্য মনে করছি।

 ডোনাল্ড কার্ন এরপর ফিরলেন স্টেসি ও তার পাশে বসা দাড়িঅলা ভদ্রলোকের দিকে। মিস স্টেসি ও মি. টিমোথি ওয়েদারহিল, আপনারা দুজন দেশের ভেতর তদন্ত চালাবেন। আপনাদের কাভার, ডেনভার ট্রিউবুন-এর জার্নালিস্ট ও ফটোগ্রাফার। টিমের কোডনেম, টিম বুইক। এরপর তিনি এশিয়ান ভদ্রলোকের। দিকে তাকালেন। টিম হোন্ডা হলো মি. রয় ওরশিয়া ও জেমস হানামুরা। আপনারাই সবচেয়ে বিপজ্জনক অ্যাসাইনমেন্ট পেয়েছেন জাপানে।

মি. ডোনাল্ড ব্রিফ শেষ করার আগে কারও কোন প্রশ্ন আছে? জানতে চাইলেন রেইমন্ড জর্ডান।

আমরা যোগাযোগ করব কিভাবে? জানতে চাইলেন ওয়েদারহিল।

জবাব দিলেন ডোনাল্ড কান, ফোনে। টেবিলের ওপর একটা কনসোল রয়েছে, অনেকগুলো বোতামের একটায় চাপ দিলেন তিনি, তাকালেন দেয়ালের দিকে দেয়ালে সাঁটা একটা কালো স্ক্রীন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আরও কয়েকটা বোতামে চাপ দিলেন তিনি, কয়েকটা সংখ্যা ফুটে উঠল স্ক্রীনে। টেলিফোন নম্বরটা মুখস্থ করে নিন সবাই। এই নম্বরে চব্বিশ ঘণ্টা একজন অপারেটর থাকবে, নিরাপদ লাইন, তার জানা থাকবে কে কোথায় আছি আমরা।

 খুক করে কেশে রেইমন্ড জর্ডান বললেন, প্রতি বাহাত্তর ঘণ্টায় একবার যোগাযোগ করবেন টিম লীডার। যদি না করেন, আপনাদের খোঁজে এখান থেকে কাউকে আমরা পাঠাব।

নিজের চেয়ারের পিছনের পায়া দুটোর ওপর ভর চাপিয়ে দোল খাচ্ছে পিট, দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে একটা হাত তুলল। আমার একটা প্রশ্ন আছে।

ইয়েস, ডার্ক?

কৃতজ্ঞবোধ করব, দয়া করে কেউ যদি বলে দেন এখানে ঠিক কি ঘটছে।

 অস্বস্তিতে ভরপুর নিস্তব্ধতা নামল কনফারেন্স রুমে। অ্যাল ছাড়া সবাই ভুরু কুঁচকে তাকাল পিটের দিকে, দৃষ্টিতে অসন্তোষ।

জেমস স্যানডেকারের দিকে তাকালেন রেইমন্ড জর্ডান, অ্যাডমিরাল মাথা নেড়ে বললেন, তুমি যেমন অনুরোধ করেছিলে, পিট বা অ্যালকে আমি পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছুই জানাইনি।

 মাথা ঝাঁকালেন রেইমন্ড জর্ডান। দ্রমহোদয়গণ, আপনাদেরকে ব্রিফ করা হয়নি, এটা সম্পূর্ণ আমার ব্যর্থতা। আপনাদের ওপর দিয়ে যে ধরনের ধকল গেছে, তারপর যদি অমর্যাদাকর আচরণ করা হয়ে থাকে, সেজন্যে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

 জর্ডানের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে আছে পিট। নুমার মাইনিং অপারেশনে অবৈধভাবে নজর রাখার জন্যে একটা ষড়যন্ত্র করা হয়। আমি জানতে চাই, ষড়যন্ত্রের পিছনের ব্যক্তিটি কি আপনি?

এক মুহূর্ত ইতস্তত করলেন রেইমন্ড জর্ডান, তারপর বললেন, আমরা কখনও অবৈধভাবে নজর রাখি না, ডার্ক। আমরা পর্যবেক্ষণ করি। হ্যাঁ, নির্দেশটা আমিই দেই। উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে একটা ব্রিটিশ সার্ভে টিম আগে থেকেই কাজ করছিল, আপনাদের এলাকায় সরে গিয়ে তারা আমার সাথে সহযোগিতা করে।

আর পানির ওপর যে বিস্ফোরণটা হলো, যে বিস্ফোরণে ডুবে গেল ক্রু সহ ব্রিটিশ জাহাজটা, ভূমিকম্পের কারণ সৃষ্টি করল, আট বছরে গবেষণা ও পরিশ্রম ব্যর্থ হয়ে গেল নুমার, সেটাও কি আপনার নির্দেশে?

না, ওটা ছিল একটা আকস্মিক ট্রাজেডি। কেউ জানত না এধরনের কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।

 ভাবতে আশ্চর্য লাগছে আমার, নুমার পিছনে আপনি স্পাই লাগালেন!

 পিটের দিকে নয়, তাকালেন জেমস স্যানডেকারের দিকে, বললেন, তোমার ফ্যাসিলিটি, যেটাকে তোমরা সগি একর বলছ, এমন কড়া গোপনীয়তার মধ্যে তৈরি করা হয় যে আমাদের কোন ইন্টেলিজেন্স এজিন্সি জানেই না তোমরা কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে কাজ করছ কিনা।

কাজেই প্রজেক্টের কথা জানতে পারার সাথে সাথে গলাবার জন্যে লম্বা হয়ে গেল আপনার নাকটা? জিজ্ঞেস করল পিট।

 রেইমন্ড জর্ডান এত বড় পদের অধিকারী, এত বেশি তার দক্ষতা, কেইউ কখনও তাঁকে ব্যঙ্গ করার স্পর্ধা দেখায়নি। তাঁর আচরণে কখনোই আত্মরক্ষার ভঙ্গি থাকে না। অথচ পিটের চোখের দিকে তাকালেন না তিনি। যা হবার হয়ে গেছে, বললেন তিনি। এতগুলো মানুষ মারা যাওয়ায় সত্যি আমি দুঃখিত। কিন্তু ভুল একটা সময়ে দুর্ভাগ্যজনক একটা পজিশনে অপারেটরদের পাঠানোর জন্যে পুরোপুরি আমাদেরকে দায়ী করা যায় না। কেউ আমাদেরকে জানায়নি যে একটা জাপানি অটো ক্যারিয়ার সাগরের ওপর দিয়ে অ্যাটম বোমা বয়ে আনছে। ওগুলো। যে দুর্ঘটনাবশত প্রায় আপনাদের মাথার ওপর ফেটে যেতে পারে, তা-ও আমরা জানতাম না।

মুহূর্তের জন্যে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে তাকল পিট। প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেয়েছে সত্যি, তবে ধাক্কাটা দুসেকেন্ডেই সামলে নিল ও। ধাঁধার উত্তরগুলো ধীরে ধীরে মিলে যাচ্ছে। কথা বলার সময় তাকিয়ে থাকল জেমস স্যানডেকারের দিকে, অনুভব করল আহত বোধ করছে। আপনি জানতেন, অ্যাডমিরাল, অথচ কিছুই আমাকে বলেননি। আপনি ওয়াশিংটন ত্যাগ করার আগেই জানতেন। অ্যাটাক সাবমেরিন টাকসন মি. প্লাঙ্কেট ও আমাকে উদ্ধার করতে আসেনি, এসেছিল রেডিওঅ্যাকটিভিটি রেকর্ড ও আবর্জনার সন্ধানে।

কেউ জ্বালাতন করায় এই প্রথম লাল হয়ে উঠল অ্যাডমিরালের চেহারা। প্রেসিডেন্ট আমাকে দিয়ে কথা আদায় করিয়ে নেন, আমি গোপনীয়তা রক্ষা করব, ধীরে ধীরে বললেন তিনি। এর আগে কখনও তোমাকে আমি মিথ্যে কথা বলিনি, পিট। কিন্তু এক্ষেত্রে যোবা না থেকে আমার উপায় ছিল না।

মনে মনে অ্যাডমিরালকে ক্ষমা করে দিল পিট, তবে জর্ডানের ওপর রাগটা এখনও আছে। জানতে চাইল, বলুন, মি. জর্ডান, আমরা এখানে কেন?

 প্রতিটি টিমের সদস্যকে প্রেসিডেন্ট স্বয়ং বাছাই করেছেন, বললেন জর্ডান। আপনাদের সবার ব্যাকগ্রাউন্ড, রেকর্ড, ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি তিনি জানেন। আপনারা সবাই যে বিশ্বস্ত, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হবার পরই তৈরি করা হয়েছে তালিকাটা।

আবার শুরু করলেন রেইমন্ড জর্ডান, অ্যাডমিরাল এবং মি. জিওর্দিনো দুজন মিলে একটা টিম। কোডনেম মার্সিডিজ। ওঁরা সাগরের নিচে কাজ করবেন।

আমার প্রশ্নের মাত্র অর্ধেকটার উত্তর দিচ্ছেন আপনি, মি. জর্ডান, মনে করিয়ে দিল পিট।

 বাকি অর্ধেককটাও বলতে যাচ্ছি, জানালেন রেইমন্ড জর্ডান। আপনি এবং মি. ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো, আপনারা দুজন একটা সাপোর্ট টিম হিসেবে কাজ করবেন।

কিসের সাপোর্ট?

প্রতিটি টিমকে সহযোগিতা দেবেন আপনারা। এটা একটা বিশাল অপারেশন, কাজেই সাপোর্ট টিমের দায়িত্বই সবচেয়ে বেশি। কোন টিম বিপদে পড়লে, তাদেরকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার দায়িত্ব আপনাদের।

আমাদের কোডনেম?

 ডোনাল্ডের দিকে তাকালেন রেইমন্ড জর্ডান, ভদ্রলোক বলেন, সাপোর্ট টিমের কোডনেম…টিম স্টাজ।

বেশ, বলল পিট। নামকরণ যখন হয়ে গেল, এখানে আমার আর থাকার দরকার আছে বলে মনে হয় না। হাতঘড়ির ওপর চোখ বুলাল ও। এখানে আমাকে আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে টেনে আনা হয়েছে। গত আটচল্লিশ ঘণ্টায় মাত্র তিন ঘণ্টা ঘুমিয়েছি আমি, খেয়েছি মাত্র একবার। আমাকে একবার বাথরুমেও যেতে হবে। অথচ এখনও আমাকে জানানো হয়নি আসলে ঠিক কি ঘটছে। আপনাদের সেন্ট্রিরা বা মেরিনরা আমাকে বাধা দিতে পারে, জানি। কিন্তু সেক্ষেত্রে আমি আহত হব, আর আহত হলে সাপোর্ট টিমে থাকতে পারব না।

এক সাথেই বেরোই, বলে পিটের আগে চেয়ার ছাড়ল অ্যাল। পিটের মত আমাকেও জিজ্ঞেস করা হয়নি, টীমে থাকতে আমি রাজি আছি কিনা।

অসম্ভব! গম্ভীর সুরে বললেন ডোনাল্ড কার্ন। এভাবে আপনারা চলে যেতে পারেন না। ইউ আর আন্ডার কন্ট্রাক্ট টু দ্য গভর্নমেন্ট।

সিক্রেট এজেন্টের ভূমিকায় কাজ করার জন্যে কারও সাথে আমার কোন চুক্তি হয়নি, শান্ত গলায় বলল পিট। সাগরের তলা থেকে আমরা ফিরে আসার পর যদি আমেরিকায় সামরিক অভ্যুত্থান না ঘটে থাকে, এদেশে কারও স্বাধীন ইচ্ছায় হস্তক্ষেপ করার অধিকার কেউ আপনারা রাখেন না।

রেগেমেগে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন ডোনাল্ড কার্ন, তাঁকে থামিয়ে দিয়ে কথা বললেন রেইমন্ড জর্ডান। ডার্ক, আপনার অসন্তুষ্ট হবার কারণ আমি বুঝতে পারছ। আপনি যদি দয়া করে আর একটু ধৈর্য ধরেন, তাহলে সব কথা আপনাকে জানাবার একটা সুযোগ পাই আমরা। প্রথমেই বলে রাখছি, কিছু কিছু ব্যাপার ক্লাসিফায়েড থাকবে। পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা আপনাদের কারও না থাকাই ভাল বলে মনে করি আমি। সেটা আপনাদের নিরাপত্তার স্বার্থেই। বুঝতে পারছেন তো?

আমি শুনছি, বলল পিট।

জাপানের কাছে অ্যাটম বোমা আছে, তথ্যটা ফাঁস করলেন জাতীয় নিরাপত্তা কমিশন চীফ। কতদিন থেকে আছে বা কতগুলো আছে তা এখনও আমরা জানি না। অ্যাডভান্স নিউক্লিয়ার টেকনলজিতে জাপানের যে উন্নতি, ওঅরহেড তৈরি করার ক্ষমতা দশ বছর আগেই অর্জন করেছে ওরা। পরমাণু অস্ত্র-বিরোধী চুক্তিতে সই করলেও, ওদের ক্ষমতা-বলয়ের মধ্যে কেউ বা কোন একটি গ্রুপ সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রয়োজনে অন্তত ব্যাকমেইল করার জন্যে অমোঘ একটা অস্ত্র তাদের দরকার।

খুব সামান্যই জানি আমরা, তা-ও জেনেছি বিস্ফোরণের পর। জাপানের একটা অটো ক্যারিয়ার মুরমটো অটোমোবাইল বহন করছিল, প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে এক কি দুটো বোমা বিস্ফোরিত হয় ওটার সাথে ধ্বংস হয়ে যায় নরওয়ের একটা প্যাসেঞ্জার-কাগো লাইনার ও একটা ব্রিটিশ সার্ভে শিপ, ক্রু সহ। জাপানের একটা জাহাজে অ্যাটম বোমা কেন? ওরা ওগুলো গোপনে যুক্তরাষ্ট্রের বন্দরে আনছিল। শুধুই কি যুক্তরাষ্ট্রের পাঠাচ্ছে ওরা? বোধহয় না। ওদের উদ্দেশ্যটা কি? সম্ভবত নিউক্লিয়ার হুমকি সৃষ্টি।

 জাপানের কাছে নিউক্লিয়ার বোমা থাকতে পারে, কিন্তু ওটা ফেলার জন্যে দূর পাল্লার যে মিসাইল বা বহুবার দরকার তা ওদের নেই। ওরা কি ভাবছে, আমরা আন্দাজ করে নিতে পারি। জাপান একটা অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে, দুনিয়ায় এমন কোন লোক নেই যে জাপানি পণ্য ব্যবহার করছে না। এই সাম্রাজ্যটাকে রক্ষার জন্যে, আকারে আরও বড় করার জন্যে, পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে গোপনে অ্যাটম বোমা পাঠাচ্ছে ওরা, লুকিয়ে রাখছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়, প্রয়োজন হলে যাতে অল্প সময়ের নোটিশে ব্যবহার করতে পারে। কখন প্রয়োজন হবে?

ধরুন, জাপানের ব্যবসায়িক নীতি আমেরিকার পছন্দ হলো না। কিংবা ধরুন, কোন কারণে জাপানের ওপর আমেরিকা খুব রেগে গেল। আপনারা জানেন, জাপানি ব্যাংকগুলো আমেরিকারকে কয়েকশো বিলিয়ন মার্কিন ডলার ধার দিয়েছে। রেগে গিয়ে আমেরিকা জানিয়ে দিল, ধারের টাকা জাপানকে তারা ফেরত দেবে না। আরও জানাল, জাপানি পণ্য বয়কট করা হবে। এই মুহূর্তে, আপনাদের সাথে আমি যখন কথা বলছি, প্রেসিডেন্টের কাছে ঠিক এই প্রস্তাবই তুলছেন সিনেটর মাইক ডিয়াজ ও কংগ্রেস সদস্য লরেন স্মিথ। শুধু তাই নয়, এমন হতে পারে প্রেসিডেন্ট হয়তো সুপিরিয়র মিলিটারি ফোর্সকে নির্দেশ দেবেন, জাপানকে যেন অবরোধ করা হয়, আমাদের তেল ও কোন কাঁচামাল তারা যেন না পায়। আপনি শুনছেন তো, ডার্ক?

শুনেছি।

আমরা জাপানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে পারি, এ সম্ভাবনা নিয়ে কথাবার্তা অনেক দিন ধরেই চলছে। কাজেই ওরাও সতর্ক হয়েছে। তার নমুনা, এই বোমা। কাজেই আমরা ধরে নিতে পারি, আমেরিকা বা আর কারও ভয়ে জাপানিরা ভীত নয় আমরা বেশি বাড়াবাড়ি করলে বোতাম টিপে ওগুলো ফাটিয়ে দেবে তারা, বা ফাটিয়ে দেয়ার হুমকি দেবে। পরবর্তী প্রশ্ন, আমরা এখানে কেন? বোমাগুলো কোন দেশে কোথায় আছে, জানতে হবে আমাদের। জাপানিদের ঠেকানোর এটাই একমাত্র উপায়। বোমাগুলো খুঁজে বের করতে হবে, আমরা কাজ শুরু করেছি এ কথা ওরা জানতে পারার আগেই। এখানেই টিম বুইকের প্রসঙ্গ এসে পড়ে। স্টেসি ফক্স আসলে ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির একজন অপারেটর। টিমোথি ওয়েদারহিল একজন নিউক্লিয়ার সায়েন্টিস্ট, রেডিও অ্যাকটিভিটি ডিটেকশনে বিশেষজ্ঞ। টিম হোন্ডা, জিম হানামুরা ও রয় ওরশিয়া, সিআইএ এজেন্ট। ওদের কাজ, বোমার উৎস, কমান্ড সেন্টার, কন্ট্রোল ও ডিটোনেশন সম্পর্কে অনুসন্ধান ও তথ্য সংগ্রহ। আমরা কি একটা দুঃস্বপ্নের ভেতর রয়েছি? নিঃসন্দেহে। আমার ধারণা, একটা হিংস্র ড্রাগন গোটা পৃথিবীকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে, আগামী দুএক হপ্তার ভেতর ওটাকে বাধা দেয়া না গেলে কেউ আমরা বাঁচব না। বিশ্বাস করুন বা না করুন, ডার্ক, এমএআইটি অপারেশন হলো দুনিয়াটাকে বাঁচানোর শেষ উপায়। ছবিটা পরিষ্কার হয়েছে?

হ্যা…, ধীরে ধীরে বলল পিট। ধন্যবাদ, মি. জর্ডান। ছবিটা পরিষ্কার।

এবার অফিশিয়ালি আমাদের সাথে যোগ দিতে আপনার আপত্তি নেই তো?

চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াল পিট, অ্যাল ও অ্যাডমিরালকে ছাড়া বাকি সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলল, প্রস্তাবটা বিবেচনা করে দেখব আমি।

কথা শেষ করে কনফারেন্স রুম থেকে বেরিয়ে এল ও।

.

২২.

 পিটের কার মিউজিয়াম ওয়াশিংটন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের একেবারে গা ঘেষে, একটা পুরানো এয়ারক্রাফট হ্যাঙ্গারের ভেতর। তবে ফেডারেল হেডকোয়ার্টার বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে সেদিকে গেল না ও। প্রথমে অ্যালকে কয়েকটা নির্দেশ দিয়ে একটা ট্যাক্সিতে তুলে দিল, তারপর কনস্টিটিউশন অ্যাভিনিউ ধরে হাঁটতে লাগল যতক্ষণ না একটা জাপানি রেস্তোরাঁ পায়।

হেড ওয়েটারকে ডেকে এক কোণার একটা বুঁদ চাইল পিট। বসার পর অর্ডার দিল, সবই জাপানি খাবার। স্বচ্ছ চিংড়ি সুপ আর চুনো মাছের খিচুড়ি খেয়ে টেবিল ত্যাগ করল, ঢুকল রেস্ট রুমের পাশে একটা ফোন বুদে।

মানি ব্যাগ থেকে ছোট্ট একটা অ্যাড্রেস বুক বের করে পাতা ওল্টাল পিট। ফোন নম্বরটা পেয়ে ডায়াল করল। ভদ্রলোকের নাম ড. পার্সিভাল ন্যাশ। মেরিল্যান্ডে থাকেন। ডার্কের মায়ের দিকের চাচা হন স্থানীয় পার্সিভাল ন্যাশ। পিটকে অত্যন্ত হে করেন। পরপর ছয়বার রিং হলো তবু কেউ রিসিভার তুলছে না। যোগাযোগ কেটে দিতে যাচ্ছে পিট, এই সময় অপরপ্রান্ত থেকে সাড়া পাওয়া গেল।

 ড. ন্যাশ বলছি, তারুণ্যে ভরপুর একটা কণ্ঠস্বর, যদিও ভদ্রলোক চলতি বছর বিরাশিতে পড়েছেন।

কাকা, আমি পিট।

ও মাই গুডনেস, ডার্ক! বুড়ো কাকাকে মনে পড়ল? সানন্দে হাসলেন পার্সিভাল ন্যাশ। পাঁচ মাস হয়ে গেল একবারও ফোন করোনি।

চার মাস, শুধরে দিল পিট। সাগরমন্থন করছিলাম কিনা।

আমার বোনের খবর কী? আর যে নোংরা বুড়ো পলিটেশিয়ানটাকে বিয়ে করেছে। তারই বা কী খবর?।

এখনো বাড়ি যাইনি আমি, বলল পিট। তবে মা আর সিনেটর ভাল আছেন বলেই জানি।

তারপর বলো। তুমি ভাল আছ তো?

আছি ভালই, তবে একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। আপনার সাহায্য দরকার।

বাকি দিনগুলো তো স্রেফ অবসর, বলল না কি কাজ।

ফোনে বলা যাবে না, কাকা। যদি সম্ভব হয় নুমা বিল্ডিঙে চলে আসুন।

 কি আশ্চর্য, কাজটা সম্পর্কে একটা ধারণা তো দেবে! শুনলে হয়তো বলতে পারব, তোমার কোন উপকারে আসব কিনা।

বলছি। ধরুন, রেস কারে নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর লাগাতে চাই আমি।

পার্সিভাল ন্যাশ সাথে সাথে বুঝতে পারলেন, টেলিফোনে আলাপ করতে রাজি নয় পিট। জানতে চাইলেন, কখন?

যত তাড়াতাড়ি আপনার পক্ষে সম্ভব, কাকা।

 এক ঘণ্টা পর?

 ঠিক আছে, বলল পিট।

তুমি এখন কোথায় ডার্ক?

জাপানি ডিনার খাচ্ছি।

সুস্বাদু, তবে দেখতে ভাল না, বলে যোগাযোগ কেটে দিলেন ভদ্রলোক।

টেবিলে ফিরে এসে কফি খেল পিট, একটা সিগারেট ধরাল। রেস্তোরাঁয় ঢোকার পর থেকেই কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করছিল, এতক্ষণে কারণটা বুঝতে পারল। ভয় হচ্ছে রেস্তোরাঁয় ভেতর কোথাও পাচার করা কোন বোমা আছে কিনা। তাড়াতাড়ি ওখান থেকে বেরিয়ে এল ও।

একটা ট্যাক্সি নিয়ে দশতলা নুমা বিল্ডিঙে চলে এল পিট। পান্না-সবুজ সোলার গ্লাসে গোটা বিল্ডিংটা মোড়া, মাথার অংশটা পিরামিড আকৃতির গম্বুজ। লবিতে রয়েছে অসংখ্য জলপ্রপাত ও অ্যাকুয়ারিয়াম, সামুদ্রিক মাছ ও উদ্ভিদে সাজানো। সবুজ মার্বেল পাথরের মেঝেতে, মাঝখানে, প্রকাণ্ড একটা গ্লোব। পৃথিবীর প্রতিটি পাহাড়, সাগর, বড় লেক ও প্রধান নদীগুলো দেখানো হয়েছে তাতে। এলিভেটরে চড়ে ১০ লেখা বোতামে চাপ দিল পিট। পাঁচতলার অফিস এগিয়ে ওপরতলার কমিউনিকেশন ও ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক-এ উঠে এল ও। এখানেই রয়েছে নুমার মস্তিষ্ক। সমুদ্র সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য এখানে জমা আছে, তা সে বৈজ্ঞানিক হোক বা ঐতিহাসিক, ফিকশন হোক বা নন-ফিকশন। নুমার বাজেটের বেশিরভাগ টাকাই এখানে ব্যয় করেন স্যানডেকার।

নুমার এই ডাটা সুপার মার্কেটের অধিপতি হলো হিরাম ইয়েজার। ঝোড়ো কাকের মতো চেহারা, কমপিউটার জগতে জাদুকর হিসেবে নাম কিনেছে। কমপিউটার ডিজাইনে লেগে থাকলে এতদিনে নিজেই একটা বিশাল কোম্পানির মালিক হতে পারত সে, কিন্তু নিজে থেকে কিছু করার উৎসাহ তার কোনকালেই ছিল না, আজও নেই। একটু ঘর-কুনো টাইপের লোক, অফিস আর বাড়ি ছাড়া কিছু চেনে না। পিটের অত্যন্ত ঘনিষ্ট বন্ধু সে।

ডেস্কেই পাওয়া গেল তাকে। ডেস্কটা একটা উঁচু মঞ্চের ওপর, বিশাল কামরার মাঝখানে। মঞ্চটা গোল, চারদিক ঘোরে। বিলিয়ন ডলার মূল্যের রাজত্বের প্রতিটি কোণায় চোখ রাখতে চায়, সেজন্যে নিজেই অর্ডার দিয়ে মঞ্চটা বানিয়েছে হিরাম ইয়েজার। পিটকে দেখে চওড়া হাসি ফুটল তার মুখে। আরে, ডার্ক! তুমি ফিরে এসেছ?

কয়েকটা ধাপ টপকে মঞ্চে উঠল পিট, বন্ধুর সাথে হ্যান্ডশেক করল। কেমন আছ, হিরাম?

সগি একর ভেস্তে গেছে শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল, বলল হিরাম। তবে এখনও জীবিতদের মধ্যে তুমি আছ দেখে সত্যি ভাল লাগছে। দোস্ত, তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। বসো, আরাম করো।

তোমার মত বন্ধু হারালে বাঁচার আনন্দটাই মাটি হয়ে যাবে। কিন্তু দোস্ত, শুধু আমার পিৎসা খাবার জন্যে আমার কাছে আসো নি তুমি। কি চাও, বলে ফেলো।

আমার আত্মীয় এক ভদ্রলোককে আশা করছি আমি, বলল পিট। ড. পার্সিভাল ন্যাশ, কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যাবেন। কাজ করেছেন অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনে, এখন অবসর জীবনযাপন করছেন। তোমার আছে সুপারকমপিউটার ইন্টেলিজেন্স, আর পার্সিভাল ন্যাশর আছে নিউক্লিয়ার অস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান। আমি চাই তোমরা দুজন মিলে একটা সিনারিও তৈরি করবে।

কিসের দৃশ্যপট?

 একটা স্মাগলিং অপারেশন-এর।

 কি স্মাগল করব আমরা?

পার্সিভাল ন্যাশ আসুন, তখন বলব।

হিরাম ইয়েজার হাসল। নিরেট কোন বস্তু? এই ধরো, একটা নিউক্লিয়ার ও অরহেউ?

বন্ধুর দিকে তাকাল পিট। হতে পারে।

ভদ্রলোকের জন্যে অপেক্ষা করো তুমি, ইতোমধ্যে আমি আমার সিএডি/ সিএএম গরম করি, বলে চেয়ার ছাড়ল হিরাম ইয়েজার। পিট কিছু বলার আগেই মঞ্চ থেকে নেমে গেল সে।

.

২৩.

 ধবধবে সাদা দাড়ি, নেকটাই ছাড়িয়ে নিচে নেমে এসেছে। মোটাসোটা মানুষ, নাভির নিচে পরা ট্রাউজারটা বেল্ট দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। বিরাশি পেরোলেও, পার্সিভাল ন্যাশর চেহারায় হাসিখুশি ভাব ও লাবণ্য আজও অম্লান। নীল স্যুট পরেছেন তিনি, লাল টাই। পায়ে গলিয়েছেন সারার্ড-স্কীন কাউবয় বুট। চিরকুমার তিনি, তবে এই বয়েসেও তার মেয়ে-বন্ধুর তালিকাটা ছোট নয়। তাঁর চরিত্রের গুরুতর বৈশিষ্ট্য একটাই, সেটা হলো পারমাণবিক মারণাস্ত্র সম্পর্কে বিপুল জ্ঞান। তৃতীয় বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রনায়ক তাঁদের সারা জীবনের সঞ্চয় তার মেধার বিনিময়ে হাতবদল করতে রাজি আছেন। পার্সিভাল ন্যাশ সম্পর্কে বলা হয়, উনি ওঁর গ্যারেজে বসেও অ্যাটম বোমা বানাতে পারেন, দাম পড়বে একটা রিকন্ডিশন গাড়ির চেয়ে বেশি নয়।

ডার্ক, মাই বয়, পিটকে দেখে উদ্ভাসিত হলো তার চেহারা। তোমাকে এত ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন!

আপনাকে দেখে এখন আর ক্লান্তি বোধ করছি না, পরস্পরকে আলিঙ্গন করার সময় বলল পিট।

 মোটর ভেহিকেল ডিপার্টমেন্ট আমার মটরসাইকেলের লাইসেন্সটা কেড়ে নিয়েছে, জানো! তবে জাগুয়ার জেডকে ওয়ান-টোয়েনটিটা এখনও আমি চালাতে পারি। ট্যাক্সি ভাড়া নয়, পেট্রলের খরচটা দিতে হবে তোমাকে।

আপনি আমাকে সময় দিচ্ছেন বলে আমি কৃতজ্ঞ, কাকা, বলল পিট।

চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা আমার বেঁচে থাকার প্রধান উপকরণ, বলে হাসলেন বৃদ্ধ।

হিরাম ইয়েজারের সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিল পিট। পরিচয় পর্বের পর একটা কমপিউটার স্ক্রীনের সামনে দুটো অতিরিক্ত চেয়ার টেনে আনল হিরাম ইয়েজার। যে-কোন ডেস্ক মেডেলের চেয়ে তিনগুণ বড় স্ক্রীনটা। পিট ও পার্সিভাল ন্যাশ বসার পর হাত নেড়ে শুরু করল সে।

কমপিউটার শিল্পের সর্বশেষ আবিষ্কার হলো সিএডি/সিএএম-কমপিউটর এইডেড ডিজাইন/কমপিউটর-এইডেড ম্যানুফাঁকচারিং। আসলে এগুলো কমপিউটার গ্রাফিক সিস্টেম, তবে সেই সাথে সুপার-সফিসটিকেটেড ডিজুয়াল মেশিনও বটে, যার সাহায্যে ড্রাফটসম্যান ও এঞ্জিনিয়াররা কল্পনাযোগ্য যে-কোন বস্তুর অপূর্ব সুন্দর বিশদ ড্রইং তৈরি করতে পারে। কোন ভিভাইডার, কমপাস বা টি স্কয়ার লাগছে ন। প্রোগ্রাম সেট করে আপনি শুধু স্ক্রীনে ইলেকট্রনিক পেন দিয়ে রাফ একটা আউটলাইন আঁকবেন, ব্যস। এরপর কমপিউটার নিজেই ওটাকে নিখ নিরেট করে তুলবে, কিংবা থ্রী ডাইমেনশন-এর প্রদর্শন করবে।

বিস্ময়কর, বিড়বিড় করলেন পার্সিভাল ন্যাশ। ড্রইং-এর বিভিন্ন অংশ কি আলাদাভাবে দেখানো সম্ভব, কিংবা আকারে বড় করা?

হ্যাঁ, অনায়াসে সম্ভব। আপনি রং লাগাতে পারেন, আকৃতি বদলাতে পারেন, পরিবর্তন এডিট করতে পারেন, তারপর ফলাফলটা মেমোরিতে জমাও রাখতে পারেন, ঠিক একটা ওয়ার্ড প্রসেসর-এর মত।

নিজের চেয়ারটায় উল্টো করে বসেছে পিট, ব্যাকরেস্টে চিবুক ঠেকাল। দেখা যাক, আমাদের সমস্যার কোন সুরাহা করতে পারে কিনা।

এবার বল, কি খুঁজছ তুমি, ডার্ক? জানতে চাইলেন পার্সিভাল ন্যাশ।

খুঁজছি একটা নিউক্লিয়ার বোমা, বলল পিট।

 কোথায়?

একটা গাড়িতে।

গাড়িটা কি সীমান্তে দিয়ে পাচার করা হবে? জানতে চাইলেন বৃদ্ধ বিজ্ঞানী।

 ধরে নিন তাই।

সীমান্তটা কি? সাগর, নাকি মাটি?

 সাগর।

দুদিন আগে প্রশান্ত মহাসাগরে যে বিস্ফোরণ ঘটল, তার সাথে কোন সম্পর্ক। আছে নাকি?

বলতে পারব না।

আরে ডার্ক, কার কাছে তুমি লুকাচ্ছ? এদেশের প্রেসিডেন্ট বাদে, আমারই রয়েছে হাইয়েস্ট সিকিউরিটি ক্লিয়ারান্স, তা জানো?

আপনি যেন আমাকে কিছু বলতে চাইছেন, কাকা?

জাতিসংঘের পারমাণবিক অনুসন্ধান কমিটিতে আছি আমি, কাজেই আমার সাথেই প্রথম প্যাসিফিক ডিটোনেশন সম্পর্কে আলোচনা করেছেন রেইমন্ড জর্ডান।

চুপসে গেল পিট। তাহলে তো আপনি আমার চেয়ে বেশি জানেন।

অন্তত একটুকু জানি যে জাপান আমেরিকায় গাড়ি-বোমা লুকিয়ে রাখছে। তবে বুড়ো মানুষ বলে জর্ডান আমাকে তার টিমে জায়গা দেয়নি।

ধরে নিন আপনাকে আমার টিমে জায়গা দেয়া হয়েছে, বলল পিট। এইমাত্র আমার টিম, স্টাজ-এ আপনি যোগ দিলেন। তুমিও, হিরাম।

 মি. জর্ডান জানতে পারলে খেপে যাবে তোমার ওপর, সাবধান করলেন পার্সিভাল ন্যাশ।

 আপনাদের দুজনের নাম জানিয়ে দেব ওদের, বলল পিট। টিমের সদস্য বারাবার অনুমতি আছে।

 গাড়িতে জাপানি বোমা, ব্যাপারটা কি? প্রশ্ন করল হিরাম ইয়েজার, গলায় অবিশ্বাস।

তার কাঁধে একটা হাত রাখলেন ডক্টর ন্যাশ। এখানে যে কাজটা করব আমরা, হিরাম, যেকোন মূল্যে গোপন রাখতে হবে।

হিরামের বিটা-কিউ ক্লিয়ারান্স রয়েছে, বলল পিট।

তাহলে আর দেরি কিসের, আমরা কাজ শুরু করছি না কেন?

শুরু করার আগে ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পেতে চাই আমি, বৃদ্ধের চোখে চোখ রেখে বলল ল্যারি কিং।

অ্যাটমিক এক্সপার্ট বৃদ্ধ একটা দীর্ঘশ্বাস চাপলেন, তারপর শুরু করলেন, ত্রিশের দশকে জাপান যুদ্ধ শুরু করেছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ একটা অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে তোলার মানসে। আজ, পঞ্চাশ বছর পর, আবার একটা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা, এবার সাম্রাজ্যটাকে রক্ষা করার জন্যে। কেউ কিছু সন্দেহ করার আগে, অত্যন্ত কড়া গোপনীয়তার মধ্যে, নিজেদের নিউক্লিয়ার অস্ত্র বানিয়ে ফেলেছে তারা। সিভিলিয়ান নিউক্লিয়ার ফ্যাসিলিটি থেকে উইপনস-গ্রেড প্রটোনিয়াম ও ইউরেনিয়াম সংগ্রহ করা হয়েছে। ওদের কাছে বোমা থাকতে পারে, এটা আরও একটা কারণে সন্দেহ করা হয় নি কারণটা হলো, ওদের ডেলিভারি সিস্টেম নেই। ডেলিভারি সিস্টেম মানে লং রেঞ্জ মিসাইল, বহুবার বা মিসাইল-বহনযোগ্য সাবমেরিন।

 কিন্তু আমি তো জানি পারমাণবিক নিষিদ্ধকরণ চুক্তিতে সই করেছে জাপান, বলল হিরাম ইয়েজার।

 করেছে, সত্যি। এ-ও সত্যি যে বেশিরভাগ জাপানি পারমাণবিক মারণাস্ত্রের ঘোরতর বিরোধী। কিন্তু ওদের বুরোক্র্যাসীর মূলধারার গভীরে একটা গ্রুপ আছে যারা অত্যন্ত প্রভাবশালী, তারা দেখতে চায় জাপান অ্যাটম বোমার অধিকারী হয়েছে। এসব মারণাস্ত্র ঠিক সামরিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার জন্যে তৈরি করা হয় নি, তৈরি করা হয়েছে অর্থনৈতিক হুমকি প্রতিরোধ করার জন্যে। জাপানের কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী মহলে একটা আতঙ্ক আছে, ইউরোপ ও আমেরিকায় তাদের পণ্য বয়কট করা হতে পারে। যদি হয়, তখন এই মারণাস্ত্র ব্যবহার করার হুমকি দিয়ে পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে আনার চেষ্টা করবে তারা।

শুধু যে অস্বস্তিবোধ করছে হিরাম ইয়েজার, তা নয়। তার ভয়ও লাগছে। আপনি বলতে চাইছেন, এমন হতে পারে এই মুহূর্তে আমরা একটা নিউক্লিয়ার বোমার ওপর বসে আছি?

জবাব দিল পিট, বোমাটা হয়তো পাঁচ-সাতশো গজের ভেতর কোথাও আছে।

 এ অচিন্তনীয়! রাগে কেঁপে উঠল হিরাম ইয়েজারের নিচু গলা। কটা বোমা পাঠিয়েছে ওরা?

এখনও আমরা জানি না, বলল পিট। একশো হতে পারে, দুশো হওয়াও বিচিত্র নয়। আর শুধু আমেরিকায় পাঠিয়েছে কি না, তা-ও আমরা জানি না। সম্ভবত দুনিয়ার আরও অনেক দেশে পাঠিয়েছে।

পরিস্থিতি কতটা খারাপ, কল্পনা করতে ভয় লাগে, বললেন পার্সিভাল ন্যাশ। বোমাগুলো সত্যি যদি বিভিন্ন দেশের বড় বড় সবগুলো শহরে পাঠিয়ে থাকে ওরা, পৃথিবীটাকে নিশ্চিতভাবে ধ্বংস করার মারাক্কা ক্ষমতা পেয়ে গেছে জাপান। ইটস অ্যান এফিশিয়েন্ট সেট-আপ। বোমাগুলো একবার জায়গামত পৌঁছবার পর, ওগুলোর বিরুদ্ধে কারও কিছু করার থাকবে না। দেয়ার ইজ নো ডিফেন্স এগেইনস্ট দেম, নো টাইম টু রিয়্যাক্ট, নো অ্যালার্ট, নো সেকেণ্ড স্ট্রাইক। ওরা শুধু বোম টিপবে, পরমুহূর্তে শুরু হয়ে যাবে ধ্বংসযজ্ঞ।

গুড গড! আমরা তাহলে করবটা কি?

খুঁজে বার করব ওগুলো, বলল পিট। ধারণা করা হচ্ছে, অটো শিপ ক্যারিয়ারে করে বোমাগুলো আনা হয়েছে। আমার সন্দেহ, লুকানো আছে আমদানি করা গাড়িতে। কম্পিউটারের সাহায্যে জানতে হবে গাড়ির কোন জায়গায় লুকানো আছে ওগুলো।

গাড়ি করে আনা হলে, হিরাম ইয়েজার বলল, কাস্টমস অফিসাররা দেখতে পাবে, কারণ তারা ড্রাগস আছে কিনা সার্চ করে দেখবে।

মাথা নাড়ল পিট। এটা একটা সফিসটিকেটেড অপারেশন, হাই-টেক প্রফেশন্যালদের দ্বারা পরিচালিত। তারা তাদের কাজ বোঝে। বোমাটার ডিজাইন এমনভাবেই করবে তারা, যাতে মনে হয় গাড়িরই একটা অংশ ওটা, ফলে সার্চ করলেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। কাস্টমস অফিসাররা সার্চ করবে টায়ার, গ্যাস ট্যাংক, সিট যেখানে ফাঁকা জায়গা আছে। কাজেই এমন জায়গায় বোমাটা লুকাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে, বুদ্ধিমান কোন কাস্টমস অফিসারও যাতে খুঁজে না পায়।

হুম! গম্ভীর আওয়াজ করল হিরাম ইয়েজার।

মেঝের দিকে চিন্তিতভাবে তাকিয়ে রয়েছেন পার্সিভাল ন্যাশ, বললেন, ঠিক আছে, এবার আকার-আকৃতি নিয়ে আলোচনা করা যাক।

ওটা আপনার ডিপার্টমেন্ট, কাকা, বলল পিট।

আমাকে কিছু তথ্য দাও, ডার্ক। অন্তত গাড়ির মডেলটা আমাকে জানতে হবে, আমি আবার জাপানি মেশিনারি সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না।

ওটা যদি একটা মুরমটো হয়, স্পোর্ট সিডান হওয়ারই বেশি সম্ভাবনা।

পার্সিভাল ন্যাশর হাসিখুশি চেহারা থমথমে হয়ে উঠল। তার মানে আমরা একটা কমপ্যাক্ট নিউক্লিয়ার ডিভাইস খুঁজছি, দশ কিলোগ্রাম-এর কাছাকাছি যেটা কিনা মাঝারি সাইজের একটা সিডানে আছে, অথচ খুঁজে পাওয়া সহজ নয়।

ডিভাইসটা যথেষ্ট দূর থেকে ফাটিয়ে দেয়া যায়, যোগ করল পিট।

 বলাই বাহুল্য, ড্রাইভার যদি আত্মহত্যা করতে না চায়।

বোমার আকৃতি কি হবে বলে ভাবছি আমরা? জানতে চাইল হিরাম ইয়েজার।

তেলের একটা ব্যারেল ও একটা বেসবল, এ-দুটোর মাঝখানে যে-কোন সাইজের হতে পারে, জবাব দিলেন পার্সিভাল ন্যাশ।

 বেসবল, বিড়বিড় করল হিরাম ইয়েজার, যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। কিন্তু অত ছোট একটা জিনিস কি যথেষ্ট ক্ষতি করতে পারবে?

সিলিংয়ের দিকে তাকালেন বৃদ্ধ বিজ্ঞানী, যেন ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করছেন। ওঅরহেডটার মান যদি তিন কিলোটন-এর কাছাকাছি হয় তাহলে ডেনভার, কলোরাডোর মাঝখানটা মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে পারে, আর বিস্ফোরণের ফলে যে আগুন ধরবে তাতে শহরের আশপাশ বলে কিছু অবশিষ্ট থাকবে না।

শিউরে উঠল হিরাম ইয়েজার।

ব্যবচ্ছেদ করার জন্যে একটা মডেল দরকার আমাদের। কি ব্যবহার করছি আমরা?

 আমাদের পারিবারিক ফোর্ড টরাস, বলল হিরাম ইয়েজার। এক্সপেরিমেন্ট হিসেবে আমি ওটার সমস্ত পার্টস ম্যানুয়াল কম্পিউটারে ঢুকিয়ে দিয়েছি। গোটা কাঠামোটা বা প্রতিটি পার্ট আলাদাভাবে দেখাতে পারব। কীবোর্ডের ওপর কয়েক সেকেন্ড প্রজাপতির মত লাফালাফি করল তার আঙুলগুলো, তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে হাত দুটো কোলের ওপর ফিরিয়ে আনল। একটা ছবি ফুটে উঠল স্ক্রীনে, বহুরঙা, থ্রী ডাইমেনশনাল। আবার একটা বোতামে চাপ দিল সে। লাল ফোর্ড, চার দরজা, স্ক্রীনে বিভিন্ন ভঙ্গিতে ঘুরতে মুখ করল, ওটা যেন একটা সফল মঞ্চের ওপর রয়েছে।

 তুমি কি আমাদেরকে গাড়িটার ভেতর নিয়ে যেতে পারো? জানতে চাইল পিট।

 ঢুকছি, বলল হিরাম ইয়েজার। বোতামে চাপ দেয়ামাত্র মনে হলো, নিরেট ধাতব পার্টস-এর ভেতর নিয়ে উড়ে যাচ্ছে ওরা, আশপাশে দেখতে পাচ্ছে চেসিস ও বডির অভ্যন্তর-ভাগ। ভূতের মত, যেন দেয়াল ফুড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ওরা। গাড়ির প্রতিটি নাট-বল্ট পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। অবশেষে ওদেরকে নিয়ে এঞ্জিনের ভেতর ঢুকে পড়ল হিরাম ইয়েজার।

ইন্টারেস্টিং কিছু দেখতে পাচ্ছেন, কাকা? জানতে চাইল পিট।

সাদা দাড়িতে হাত বুলালেন পার্সিভাল ন্যাশ। ট্রান্সমিশন কেসিং ভাল একটা কন্টেইনার হতে পারে।

 নো গুড। এঞ্জিন বা ড্রাইভট্রেনেরও কিছু থাকতে পারে না। স্বাভাবিকভাবে চলার সুবিধে থাকতে হবে গাড়িটায়।

বাদ পড়ছে ব্যাটারি কেসিং রেডিয়েটরও, বলল হিরাম ইয়েজার। শক অ্যাবজরবার?

মাথা নাড়লেন ডক্টর ন্যাশ। প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ পাইপ-বোমার জায়গা হতে পারে, নিউক্লিয়ার ডিভাইসের জন্যে বড় সরু হয়ে যায়।

স্ক্রীনের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকল ওরা, হিরাম ইয়েজার ওদেরকে অ্যাক্সেল ও বিয়ারিং অ্যাসেম্বল, ব্রেক সিস্টেম, স্টার্টার মটর ও অলটার-নেটর-এর ভেতর দিয়ে নিয়ে গেল। প্রতিটি খুঁটিয়ে পরীক্ষা করার পর বাতিলও করে দেয়া হলো।

হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙল পিট। উৎসাহ ও উত্তেজনা বোধ করলেও, ঘুমে জড়িয়ে আসছে ওর চোখ। হিটিং ইউনিটে থাকতে পারে?

নকশার সাথে মেলে না, বললেন পার্সিভাল ন্যাশ। উইশীল্ড বা ওয়াশার বটল?

মাথা নাড়ল হিরাম ইয়েজার। সহজেই চোখে পড়ে যাবে।

 হঠাৎ প্রায় একটা ঝাঁকি খেয়ে, আড়ষ্ট হয়ে গেল পিটের পেশী। এয়ার কন্ডিশনার! শব্দ দুটো বিস্ফোরিত হয়ে বেরিয়ে এল গলা থেকে। এয়ার কন্ডিশনারের ভেতর কমপ্রেসার!

 বোতাম টিপে স্ক্রীনে ভেতরের দৃশ্য ফুটিয়ে তুলল হিরাম। এয়ার কন্ডিশনারের সাথে গাড়ি চলার বা না চলার কোন সম্পর্ক নেই। কমপ্রেসার ঠাণ্ডা বাতাস ছাড়ছে না কেন, জানার জন্যে দুঘণ্টা ব্যয় করে ওটা খুলতে যাবে না কোন কাস্টমস অফিসার।

কমপ্রেসারের ভেতরের সবকিছু বের করে নাও, বোমা রাখার একটা জায়গা পেয়ে যাবে তুমি, বলল পিট, তাকিয়ে আছে কমপিউটার ইমেজ-এর দিকে।

আপনি কি বলেন, কাকা?

কনডেনসর কয়েলকে ডিটোনেট-এর রিসিভিং ইউনিটে রূপান্তর করা যেতে পারে, বললেন পার্সিভাল ন্যাশ। বেশ অনেকটা জায়গা পাওয়া যাবে। নাইস ওঅর্ক, জেন্টলমেন! আমার ধারণা, রহস্যের সমাধান হয়ে গেছে।

 খালি একটা ডেস্কের দিকে এগোল পিট, তুলে নিল ফোনের রিসিভার। ডোনাল্ডের দেয়া নম্বরে ডায়াল করল। অপরপ্রান্ত থেকে সাড়া দিল এক লোক। ও বলল, দিস ইজ স্টাজ। টিম লিঙ্কনকে বলুন তার গাড়ির এয়ার কন্ডিশনারের ত্রুটি রয়েছে। গুড বাই।

ডিসপ্লে স্ক্রীনে কমপ্রেসার-এর ভেতর দিকটা আকারে বড় করেছে হিরাম ইয়েজার, সেদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে সে বলল, চায়ের কাপে আমি একটা মাছ দেখতে পাচ্ছি।

মানে? দাড়িতে হাত বুলাচ্ছিলেন পার্সিভাল ন্যাশ, হাতটা স্থির হয়ে গেল। কি বলছেন?

জাপানের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো, ফলে জাপান আমাদের জীবন-প্রদীপ নিভিয়ে দিল, এরকম একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে,– তাই না? কিন্তু ওরা আমাদের সমস্ত ডিফেন্স ধ্বংস করে দিতে পারবে না, বিশেষ করে আমাদের নিউক্লিয়ার সাবমেরিনগুলো অক্ষতই থাকবে। আমাদের রিট্যালিয়েশেন ফোর্সদের গোটা আইল্যান্ড চেইন ছিন্নভিন্ন করে দেবে। আমার দৃষ্টিতে গোটা ব্যাপারটাই অসম্ভব ও সুইসাইডাল। বিরাট একটা ব্লাফ।

আপনার ধারণার মধ্যে ছোট্ট একটা ত্রুটি আছে, বললেন পার্সিভাল ন্যাশ, হাসছেন। দুনিয়ার সেরা ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসগুলোকে বোকা বানিয়েছে জাপান, দুনিয়ার মুরুব্বিরা অপ্রস্তুত অবস্থায় ধরা খেয়েছে। তাদের দৃষ্টিতে পরিণতি অতটা ধ্বংসাত্মক হতে যাচ্ছে না। জাপান আমেরিকাকে একটা প্রস্তাব দিয়েছিল, আমেরিকা তা গ্রহণ করে নি। ইনকামিং মিসাইল ও অরহেড ধ্বংস করার জন্যে স্ট্রাটেজিক ডিফেন্স সিস্টেম গড়ে তুলতে গোপনে একটা কাজ শুরু করে জাপান। আমাদের নেতারা অত্যন্ত খরচবহুল ও অকার্ডকর বলে বাতিল করে দেয় গবেষণা। আমার ধারণা, জাপান একটা সিস্টেম খাড়া করেছে, আমাদেরকে ঠেকাতে পারবে।

তার মানে কি জাপান অজেয় হয়ে উঠেছে? জিজ্ঞেস করল হিরাম ইয়েজার, চোখ দুটো কুঁচকে আছে।

মাথা নাড়লেন পার্সিভাল ন্যাশ। এখনও নয়। কিন্তু আরও দুবছর সময় দিন ওদেরকে, ওদের হাতে থাকবে স্বয়ংসম্পূর্ণ স্টার ওঅরস সিস্টেম। কিন্তু আমাদের বা আর কারও হাতে থাকবে না।

.

২৪.

 ক্যাপিটল বিল্ডিং-এর একটি রুদ্ধদ্বার কক্ষে মিটিং বসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওপর জাপানের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব তদন্ত ও মূল্যায়ন করাই মিটিংয়ের উদ্দেশ্য। কংগ্রেসের কয়েকজন সদস্য রাগে কাঁপছেন, কারণ তাঁদের ধারণা জাপানের পুঁজি ও ব্যবসায়িক নীতির কাছে এমন মার খাচ্ছে আমেরিকা, বলা যায় ওদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছেন তারা।

ইচিরো সুবোই, দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সিকিউরিটি কোম্পানি কানোইয়া সিকিউরিটিজ-এর চীফ ডিরেক্টর, একটা টেবিলে বসে আছে। তার সামনে কাউন্টার আকৃতির একটা ডেস্কে বসেছেন কংগ্রেশন্যাল সাব-কমিটির সদস্যরা। ইচিরো সুবোইর দুদিকে রয়েছে চারজন উপদেষ্টা। ইচিরো প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে নিজেদের মধ্যে চাপাস্বরে কিচিরমিচির করছে তারা, ফলে কমিটির সদস্যরা ভারী অস্বস্তিবোধ করছেন।

ইচিরো সুবোইকে দেখে মনে হবে না যে সে একজন ধনকুবের। আমেরিকার প্রথম সারির পাঁচজন ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসায় যে পরিমাণ পুঁজি খাটান, সে তার কানোইয়া সিকিউরিটিজ-এর একটি তারচেয়ে অনেক বেশি পুঁজি ঢেলেছে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, প্রথম সারির অন্তত দশজন ব্যবসায়ীর বিভিন্ন কোম্পানিতে তারও মোটা শেয়ার আছে। বেঁটেখাট, রোগা মানুষ। সব সময় হাসিখুশি থাকে।

তার হাসিখুশি ভাবটা আসলে কৃত্রিম আবরণ। ভদ্রবেশী এই টাকার কুমীর যেমন হিংস্র তেমনি প্রতিশোধপরায়ণ। জাপানে ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাকে যমের মত ভয় ও ঘৃণা করে, অতীত অভিজ্ঞতার কারণে। অন্যান্য জাপানি ব্যবসায়ীদের সাথে ইচিরো সুবোইর পার্থক্য হলো, আমেরিকা ও ইউরোপ সম্পর্কে তার রাগ ও বিদ্বেষ সে গোপন করে না।

সিলেক্ট সাব-কমিটির সামনে বসে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে সে, সারাক্ষণ সবিনয়ে হাসছে, হাবভাবে উত্তেজনার লেশমাত্র নেই।

কংগ্রেস যে প্রস্তাব করতে যাচ্ছে তার সারমর্ম হলো, যে-সব জাপানি কোম্পানি আমেরিকায় ব্যবসা করছে তাদেরকে বেশিরভাগ শেয়ার সংশ্লিষ্ট আমেরিকান কোম্পানিগুলোকে নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দিতে হবে। এ সেফ জাতীয়করণ ছাড়া কিছু নয়। আমেরিকার ব্যবসা-নীতি বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে, কোন সন্দেহ নেই। ইন্টারন্যাশনাল কারেন্সির সাথে ব্যাংকিং সিস্টেম ধসে পড়বে। শিল্প-সমৃদ্ধ দেশগুলো দেউলিয়া হয়ে যাবে। কিন্তু কেন এই সর্বনাশা আঘাত? আমি সবিনয় বলতে চাই, আমেরিকানদের জীবনে ভাল যা কিছু ঘটেছে সেগুলোর মধ্যে সেরা হলো জাপানি পুঁজিপতিদের এ-দেশে আগমন।

আপনি যে আইনের কথা বললেন, কংগ্রেস সে-ধরনের কোন আইন এখুনি প্রয়োগ করতে বলছে না, কঠিন স্বরে জানালেন সিনেটর মাইক ডিয়াজ। আমি শুধু বলেছি, আমেরিকার মাটিতে আপনাদের যে কোম্পানিগুলো ব্যবসা করে প্রফিট করছে, সে-সব কোম্পানির জন্যেও আমাদের শুল্ক ও ইনকাম ট্যাক্স নীতি প্রযোজ্য হবে। আপনাদের দেশে আমেরিকানরা রিয়েল এস্টেট কিনতে পারে না, পারে না ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের একচ্ছত্র মালিক হতে, অথচ আমাদের দেশে ব্যবসা করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার নিয়ে কেটে পড়ছেন আপনারা, মি. ইচিরো সুবোই…।

অন্তত একজন মানুষ ইচিরো সুবোইকে চিনতে ভুল করেন নি, তিনি হলেন সাব-কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর মাইক ডিয়াজ। জাপানিদের ব্যবসায়িক নীতির সবচেয়ে কড়া সমালোচক তিনি, পারলে আজই আইন করে জাপানি পন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

 মি. চেয়ারম্যান? সাব-কমিটির মহিলা সদস্য মাত্র একজন, কথা বলার জন্যে হাত তুলল সে। ইয়েস, মিস স্মিথ, বলুন।

মি. ইচিরো, শুরু করল লরেন, এর আগে আপনি উল্লেখ করেছেন, ডলারকে সরে গিয়ে জায়গা করে দিতে হবে ইয়েনকে। আপনার মনে হয় না, এখানে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলছেন আপনি?

আমার তা মনে হয় না। আপনারও তা মনে হবে না, যদি স্মরণ রাখেন যে আপনাদের বাজেট ঘাটতির শতকরা পঞ্চাশ ভাগ যোগান দিচ্ছে জাপানি পুঁজিপতিরা, উদার ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলল ইচিরো সুবোই। আপনাদের কারেন্সির জায়গা দখল করবে আমাদের কারেন্সি, এটা তো স্রেফ সময়ের ব্যাপার মাত্র।

আপনি বোধহয় বলতে চাইছেন, মি. ইচিরো, আমেরিকা ও জাপান আরও ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তুললে ডলারের জায়গা এমনিতেই দখল করে নেবে ইয়েন। কিন্তু আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কিভাবে হতে পারে, বলবেন কি? আমেরিকায় জাপানের যে-সব শাখা ব্যাংক কাজ করছে, সমস্ত আমেরিকান ব্যাংকের সর্বমোট অ্যাসেট-এর চেয়ে ওগুলোর অ্যাসেট অনেক বেশি। এ-দেশে জাপানি মালিকদের অধীনে এক মিলিয়ন আমেরিকান চাকরি করছে। আপনাদের লবিস্টরা পারলে আমাদের সরকারকে কিনে ফেলেন। জাপানিরা চল্লিশ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ইউএস রিয়েল এস্টেটের মালিক হয়েছে। এরপর আরও ঘনিষ্ঠ কিভাবে আমরা হতে পারি, বলবেন কি, মি. ইচিরো?

অমায়িক হাসি ফুটল ইচিরো সুবোইর মুখে। আপনাদের প্রেসিডেন্ট ও কংগ্রেস আমাদেরকে আশ্বাস দিয়ে আরও ঘনিষ্ঠ হবার পথ খুলে দিতে পারেন–কথা দিতে পারেন, আমাদের পুঁজি ও পণ্য আপনাদের বাজারে কখনোই নিষিদ্ধ করা হবে না। আমরা আরও একটা ব্যাপারে নিশ্চয়তা চাই, বিনা ভিসায় জাপানিদেরকে আমেরিকায় ঢুকতে দিতে হবে।

কিন্তু যদি এ-ধরনের চিন্তাকে আমরা প্রশ্রয় না দিই?

কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিষ্ঠুর হাসি হাসল ইচিরো সুবোই। আমরা পাওনাদার জাতি। আপনারা দেনাদার, গোটা দুনিয়ায় আপনারাই সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছেন জাপানের কাছ থেকে। কাজেই, তখন বাধ্য হয়ে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে আমাদেরকে। আমার ভয় হচ্ছে, সেটা আপনাদের জন্যে প্রীতিকর হবে না।

তার মানে আমেরিকা জাপানিদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে, আপনি বলতে চাইছেন?

এ-পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাবার রাস্তা আপনাদের জন্যে আমরা ভোলা রেখেছি, বলল ইচিরো সুবোই। আপনাদের এখন পতনের সময়। আর জাপানের সময় উত্থানের। কাজেই বাঁচতে হলে নিজেদের মেথড পরিহার করে আমাদের মেথড গ্রহণ করুন। আপনাদের নাগরিকদের উচিত আমাদের সংস্কৃতি আরও ভালভাবে বোঝার চেষ্টা করা। তাহলে কিছু একটা শিখতেও পারে তারা।

সেজন্যেই কি নিজের দেশের বাইরেও জাপানি কোম্পানিগুলো শুধু জাপানিদের চাকরি দিচ্ছে?

টপ পজিশনে নয়। শুধু নিস্তরের ম্যানেজার, সেক্রেটারি, ক্লার্ক আর পিয়নদের চাকরি দেন। তা-ও শুধু পুরুষদের, মহিলারা বাদ পড়ে যাচ্ছে। আরেকটা কথা বলা দরকার, জাপানি কোম্পানিগুলো শ্রমিক ইউনিয়নকে কোন পাত্তাই দিতে চায় না।

উত্তর দেয়ার আগে উপদেষ্টাদের সাথে পরামর্শ করল ইচিরো সুবোই। অবশেষে বলল, আপনাকে বুঝতে হবে যে আমরা সংস্কারকে প্রশ্রয় দিই না। পশ্চিমারা আমাদের পদ্ধতির ভক্ত নয়, কাজেই তাদেরকে টপ পজিশনে বসিয়ে নিজেদের ব্যবসায়িক ক্ষতি করতে রাজি নই আমরা। এ-কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে পশ্চিমারা আমাদের কালচারকে ভাল চোখে দেখে না। আপনিই বলুন, আমাদের কালচারের ওপর যাদের ভক্তি নেই, তাদেরকে আমরা কিভাবে টপ পজিশনে বসাই?

 আমাদের দেশে বসে ব্যবসা করতে এসে আমাদেরকেই আপনারা অবজার্ভ করবেন, এমন আচরণ করবেন যেন আমরাই বিদেশী, এটা কি মেনে নেয়ার মত একটা ব্যাপার, মি. ইচিরো?

এটা দুর্ভাগ্যজনক, মিস লরেন। আমরা আপনাদের অবজ্ঞা করি, এটা ঠিক নয়। আমরা ব্যবসায়ী, বোকার মত কোন ঝুঁকি না নিয়ে লাভ করতে ভালবাসি।

হ্যাঁ, জাপানি ব্যবসায়ীদের স্বার্থপরতা সম্পর্কে আমরা সচেতন। ব্যবসা করার নামে আপনারা সাপের গালেও চুমো খান, ব্যাঙের গালেও। পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়ান ব্লকে আপনারা স্ট্রাটেজিক মিলিটারি কমপিউটার টেকনলজি বিক্রি করছেন। আপনার মত করপোটে এক্সিকিউটিভের কাছে রাশিয়া, জার্মানি, কিউবা, ইরান, লিবিয়া, স্রেফ খদ্দের।

আন্তর্জাতিক রাজনীতি বা মতাদর্শ আমাদের মাথাব্যথা নয়। ব্যবসায়িক স্বার্থেই ও-সব আমরা তুচ্ছ জ্ঞান করি।

 আর একটা প্রশ্ন, বলল লরেন স্মিথ। এ-কথা কি সত্যি, আপনাদের সরকার গোটা হাওয়াই রাজ্য কিনে নেয়ার প্রস্তাব দিতে চাইছেন, জাপানের সাথে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি ব্যালান্স করার জন্যে?

উপদেষ্টাদের সাথে পরামর্শ না করে সাথে সাথে জবাব দিলেন ইচিরো সুবোই, হ্যাঁ, সরকারকে প্রস্তাবটা বিবেচনা করার প্রস্তাব দিয়েছি আমি। হাওয়াই-এ জাপানিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। ওখানে রিয়েল এস্টেট ব্যবসার শতকরা বাষট্টি ভাগ আমরা নিয়ন্ত্রণ করছি। আমি আরও প্রস্তাব দিয়েছি, ক্যালিফোর্নিয়াকে আমাদের দুদেশের কম্বাইন্ড ইকোনমিক কমিউনিটিতে পরিণত করা হোক। আমরা জাপানি লোকদের ওখানে পাঠাব, সবাই তারা দক্ষ। কয়েকশো ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানী গড়ে তোলার মত পুঁজি দেব আমরা।

 আপনার প্রস্তাব অত্যন্ত তিক্ত লাগছে আমার, বলল লরেন স্মিথ। জাপানি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের দ্বারা ক্যালিফোর্নিয়াকে রেপ করার দুরাশা কোনদিনই সফল হবে না। এ সত্যি দুর্ভাগ্যজনক যে হাওয়াই-এর কোন কোন এলাকা শুধু জাপানিদের জন্যে সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। শুনতে পাই, অনেক ক্লাব ও-রেস্তোরাঁয় শুধু জাপানিরা ঢুকতে পারে, আমেরিকানদের ঢোকা নিষেধ করা হয়েছে। জাপানিদের এই আচরণ কোন আমেরিকান মেনে নিতে পারে না। অন্তত আমি মেনে নিতে পারি না। দরকার হলে আমি একাই লড়ে যাব, যাতে…।

সাব-কমিটির সদস্যরা প্রশংসা-মুখর হয়ে উঠলেন। ডেস্কের ওপর হা সবাইকে থামতে বললেন সিনেটর মাইক ডিয়াজ।

ভবিষ্যতে কি ঘটতে যাচ্ছে কে বলবে, নরম হাসি দেখা গেল ইচিরো সুবোইর ঠোঁটে। আপনাদের সরকারকে উৎখাত করার কোন গোপন প্ল্যান আমাদের নেই। তবে এ-কথা ঠিক যে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় আপনারা হেরে গেছেন। আর কে না জানে যে হারু পার্টিকে অনেক নিষ্ঠুর শর্তও মেনে নিতে হয়।

 আমরা যদি হেরে থাকি, হেরেছি জাপানি ব্যবসায়ীদের অন্যায় ব্যবসায়িক নীতির কাছে, কঠিন সুরে বলল লরেন স্মিথ।

আপনারা, আমেরিকানরা, বাস্তবতা মেনে নিন। আমরা যদি আমেরিকাকে কিনিনি, কিনছি শুধু আপনারা বিক্রি করে দিচ্ছেন বলে।

সাব-কমিটির সদস্য ছাড়াও কনফারেন্স রুমে রয়েছেন তাদের উপদেষ্টা ও বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের অসংখ্য পর্যবেক্ষক। ইচিরো সুবোইর প্রচ্ছন্ন হুমকি সবাইকে যেমন বিস্মিত করল তেমনি খেপিয়েও তুলল। জাপানি বিলিওনিয়ার সবার মনে। একটা ভয় ধরিয়ে দিয়েছে।

 ডেস্কের ওপর ঝুঁকে পড়লেন সিনেটর মাইক ডিয়াজ, তাঁর চোখে কঠিন দৃষ্টি। পরিবেশটাকে আপনারা তিক্ত করে তুলেছেন, কোন সন্দেহ নেই, বললেন তিনি। তবু অন্তত দুটো সুবিধে পাচ্ছি আমরা।

এই প্রথম ইচিরো সুবোইকে খানিকটা বিচলিত হতে দেখা গেল। কি ধরনের সুবিধের কথা বলছেন আপনি, সিনেটর?

এক, আপনারা যদি বেশি বাড়াবাড়ি করেন, আপনাদের পাওনা টাকার হিসেব মুছে ফেলতে পারব আমরা। কিভাবে শুনবেন? টাকা তো আপনারা কাগজে পত্রে পাবেন, তাই না? হিসাবটা আছে কাগজে আর কমপিউটার মনিটরে। ওগুলো মুছে ফেলতে মাত্র কয়েক সেকেন্ড লাগবে আমাদের। দুই, আজ আর আগলি আমেরিকান-এর কোন অস্তিত্ব নেই। তার জায়গা দখল করেছে আগলি জাপানিজ।

.

২৫.

 কি করতে হবে বলে দিল পিট, ফেডারেল হেডকোয়ার্টার বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে ডিপার্টমেন্ট অভ কমার্স-এর চলে এল অ্যাল। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ব্যবসার উপ-পরিচালক ভদ্রলোক তার আত্মীয়, মুরমটো মোটর গাড়ি আমদানি সম্পর্কিত ফাইলটা তার কাছ থেকে চেয়ে নিল। এরপর ট্যাক্সি নিয়ে আলেকজান্দ্রিয়া, ভার্জিনিয়ায় চলে এল সে। একটু খুঁজতেই পাওয়া গেল বিল্ডিংটা, মুরমটো, মোটর করপোরেশন এখান থেকে পাঁচটা রাজ্যে তাদের আমদানি করা গাড়ি বিলিবণ্টন করে।

ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে বিল্ডিংয়ের সামনে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকল অ্যাল। লাল ইটের আধুনিক ভবন, জানালাগুলো কাঁচ আর ব্রোঞ্চ দিয়ে মোড়া। পার্কিং লটে অনেক গাড়ি রয়েছে, সবগুলোই মুরমটো কোন আমেরিকান বা ইউরোপিয়ান গাড়ি চোখে পড়ল না। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল অ্যাল, এক জাপানি রিসেপশনিস্টের সামনে দাঁড়াল।

বলুন, আপনার জন্যে কি করতে পারি? জানতে চাইল মেয়েটা।

অ্যাল জিওর্দিনো, কমার্স ডিপার্টমেন্ট। নতুন গাড়ি আমদানি সম্পর্কে কার সাথে কথা বলব?

 এক সেকেন্ড চিন্তা করল মেয়েটা, তারপর একটা নোটবুক খুলে কর্মকর্তাদের নামগুলোর ওপর চোখ বুলাল। আমাদের ট্রান্সপোর্টেশন ডিরেক্টর ডেনিশ সুহাকার সাথে। আমি তাঁকে জানাচ্ছি, মি. অ্যাল জিওর্দিনো দেখা করতে এসেছেন।

অ্যাল জিওর্দিনো।

 সরি। অ্যাল জিওর্দিনো।

খানিক পর এক জাপানি সেক্রেটারি ডেনিশ সুহাকার অফিসে নিয়ে এল অ্যালকে। হলওয়েতে দামী কার্পেট, দুপাশের দরজায় লেখাগুলো দেখে কৌতুক বোধ করল সে। কেউ এখানে ম্যানেজার, সুপারিনটেনডেন্ট বা ভাইস-প্রেসিডেন্ট নয়, সবাই ডিরেক্টর।

ডেনিশ সুহাকা, গোলগাল আকৃতির হাসিখুশি মানুষ। ডেস্কের পিছন থেকে উঠে এসে অ্যালের সাথে করমর্দন করলেন। ডেনিশ সুহাকা, মি. জিওর্দিনো। বলুন কমার্স ডিপার্টমেন্টের জন্যে কি করতে পারি আমি।

 স্বস্তিবোধ করল অ্যাল, ডেনিশ সুহাকা ওর বিধ্বস্ত ও দাড়ি-না-কামানো চেহারা দেখে কোন প্রশ্ন তোলেন নি বা পরিচয়পত্রও দেখতে চান নি। তেমন জরুরি কোন ব্যাপার না। রেকর্ড ঠিকঠাক রাখার জন্যে স্বাভাবিক আমলাতান্ত্রিক ছুটোছুটি।

সুপারভাইজার বললেন, বাড়ি ফেরার পথে আমি যেন একবার এখান থেকে তথ্যটা সংগ্রহ করি।

কি তথ্য, মি. অ্যাল জিওর্দিনো?

 আপনারা যে-কটা গাড়ি আমাদনি করে ডিলারদের কাছে পাঠিয়েছেন, তার সংখ্যাটা আমাকে জানতে হবে। আপনাদের টোকিও হেডকোয়ার্টার থেকে একটা সংখ্যা আমরা পেয়েছি, ওটার সঙ্গে মিলিয়ে দেখব।

কতদিনের হিসেব চান আপনি? আমরা তো প্রচুর গাড়ি আনাই।

 গত নব্বই দিনের হিসেব পেলেই বলবে।

কোন সমস্যা নয়, বললেন ডেনিশ সুহাকা। আমাদের শিপমেন্ট লিস্ট পুরোটাই কমপিউটারাইজড, দশ মিনিটের মধ্যে পেয়ে যাবেন। সংখ্যাগুলো মিলবে। টোকিও প্রায় কোন ভুল করে না বললেই চলে। অপেক্ষা করার সময়টা আপনি এক কাপ কফি খান, প্লীজ?

 সাজানো ছোট্ট একটা অফিসে নিয়ে আসা হল অ্যালকে, সুন্দরী সেক্রেটারি কফি পরিবেশন করল। কাপে চুমুক দিচ্ছে অ্যাল, একগাদা কাগজ-পত্র দিয়ে গেল মেয়েটা।

 যে জিনিসের খোঁজে পাঠিয়েছে পিট, আধ ঘণ্টার মধ্যে পেয়ে গেল অ্যাল। চেয়ারে হেলান নিয়ে চোখ বুজল সে, একটু ঝিমিয়ে নিচ্ছে। ঠিক পাঁচটার সময় কামরায় ঢুকলেন ডেনিশ সহাকা। স্টাফরা বাড়ি ফিরে যাচ্ছে, তবে আমি আরও বেশ কিছুক্ষণ আছি। আপনার আর কিছু লাগবে?

 না, বলল অ্যাল, কাগজগুলো ফাইলে ভরে ফেলল। আমিও বাড়ি ফিরতে চাই, সাত ঘণ্টার বেশি ডিউটি করতে রাজি নই। সহযোগিতা করার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। আপনাদের ইমপোর্ট ইউনিট ফিগারস সরকারী কমপিউটারে প্রোগ্রামের জন্যে ঢোকানো হবে। কি উদ্দেশ্যে? বেসমেন্ট অফিসে এক হতাশ কেরানি ছাড়া আর বোধহয় কেউ জানে না। কমার্স ডিপার্টমেন্টের ফাইলটা টেবিল থেকে তুলে নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল সে। দরজার কাছে পৌঁছে ঘুরল সে, হঠাৎ যেন কিছু মনে পড়ে গেছে। একটা কথা।

বলুন?

 ছোট্ট একটা খুঁত, উল্লেখ করার মত নয় অবশ্য।

ইয়েস?

আপনাদের ইনকামিং ইনভেনটরি লিস্টে ছটা গাড়ি দেখলাম, দুটো আলাদা জাহাজ থেকে বাল্টিমোর-এর খালাস করা হয়েছে, কিন্তু ওগুলো আপনাদের টোকিওর এক্সপোর্ট লিস্টে নেই।

বিস্মিত হলেন ডেনিশ সুহাকা, তার বিস্ময় নির্ভেজাল বলেই মনে হল। কই, আমার চোখে তো পড়ে নি। আপনার তালিকার সাথে মিলিয়ে দেখতে পারি?

ডিপার্টমেন্ট অভ কমার্স থেকে ধার করে আনা অ্যাকাউন্টিং শীটটা টেবিলের ওপর মেলে ধরল অ্যাল, পাশেই রয়েছে সুহাকার সেক্রেটারির দিয়ে যাওয়া তালিকাটা। তার নিজের তালিকায় ছটা গাড়ির নামের নিচে দাগ দিল অ্যাল, দেখা গেল টোকিও থেকে পাঠানো তালিকায় নেই ওগুলো। ছটাই এসপি-৫০০ স্পোর্ট সেডান।

 অফিশিয়াল নিয়মের কথা যদি বলেন, এ-ধরনের গরমিল আমাদের কোন মাথাব্যথা নয়, বলল অ্যাল। এ-দেশে ওগুলো আমদানি করা সংক্রান্ত তথ্য আপনারা খাতায় লিখে রাখলে সরকারের সাথে আপনাদের কোম্পানির কোন ঝামেলা হবার কথা নয়। আমার ধারণা, এটা আপনাদের টোকিও অ্যাকাউন্টিং ডিপার্টমেন্টের গাফলতি ছাড়া কিছু নয়।

নিজেকে আমার অপরাধী মনে হচ্ছে। এ-ধরনের অক্ষমনীয় অবহেলা আমার দ্বারা কি করে যে হলো। ডেনিশ সুহাকাকে দেখে অ্যালের মনে হলো, নর্দমায় রাজমুকুট ফেলে দিয়ে হতভম্ব হয়ে পড়েছেন ভদ্রলোক। হোম অফিসের ওপর খুব বেশি ভরসা করেছিলাম। আমার চোখে না হয় পড়ল না, আমার স্টাফদের কারও চোখেও পড়ল না।

 স্রেফ কৌতূহল, ওই গাড়িগুলো কারা রিসিভ করেছেন? মানে ডিলারদের নাম কি?

 এক মিনিট, বলে অ্যালকে নিয়ে নিজের অফিসে চলে এলেন ডেনিশ সুহাকা। ডেস্কের পিছনে বসে কমপিউটারের চাবি টিপলেন। তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে অপেক্ষায় থাকলেন। একটু পরই স্ক্রীনে ছড়িয়ে পড়ল এক গাদা তথ্য। ধীরে ধীরে তার মুখের হাসি নিভে গেল। ছটা গাড়িই ছয়জন ডিলারের কাছে পাঠানো হয়েছে। কে কোথায় রয়েছে, খুঁজে বের করতে হলে কয়েক ঘণ্টা লেগে যাবে। দয়া করে কাল যদি একবার যোগাযোগ করেন আমার সাথে, ডিলারদের নামগুলো আপনাকে আমি জানাতে পারব।

কোন প্রয়োজন নেই, ভুলে যান। আপনিও ব্যস্ত মানুষ, আর আমারও কাল বিবাহ-বার্ষিকী।

কংগ্রাচুলেয়শন্স, বললেন ডেনিশ সুহাকা, চেহারায় স্বস্তি ফুটে উঠল।

 সহযোগিতা করার জন্যে ধন্যবাদ।

মুখের হাসি ফিরে পেলেন ডেনিশ সুহাকা। অলওয়েজ গ্ল্যাড টু হেলপ! গুড বাই।

বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে এসে দুশো গজ হাঁটল অ্যাল, একটা গ্যাস স্টেশন থেকে ফোন করল। শুধু হ্যালো বলে সাড়া দিল একটি পুরুষ কণ্ঠ।

আমি আপনার কার সেলসম্যান বন্ধু। নতুন একটা মডেল এসেছে হাতে, আপনার পছন্দ হতে পারে।

আপনি আসলে নিজের এলাকার বাইরে ব্যবসা করার চেষ্টা করছেন, স্যার। আপনার উচিত পানির কিনারায় খদ্দের ধরার চেষ্টা করা। আরও ভাল হয় যদি প্রশান্ত মহাসাগরে ডুব দেন।

ভাল একটা জার্মান গাড়ি যদি খুব বেশি দামী মনে হয়, মুরমটো কিনতে পারেন। আমার কাছে ছটা এসপি-৫০০ স্পোর্ট সেডান-এর খবর আছে, যেগুলোর কোন হিসেব নেই।

এক মিনিট।

এরপর অপরপ্রান্ত থেকে অন্য একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল। ডেপুটি ডিরেক্টর অভ অপারেশন, ডোনাল্ডের গলা, চিনতে পারল অ্যাল। বেশ, বেশ। সস্তায় গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে, এরচেয়ে সুখবর আর কিছু হতে পারে না। বলুন, হিসেবের বাইরে আপনার গাড়িগুলো কোথায় পেতে পারি।

 সে তথ্য আপনাকে উদ্ধার করতে হবে মুরমটো ডিসট্রিবিউটর-এর কাছ থেকে। ওটা আলেকজান্দ্রিয়ায়। ওদের কমপিউটার রেকর্ড বলছে, ছটা গাড়ি এ দেশে এসেছে, কিন্তু কারখানা থেকে বের হয় নি। কথাটা জানাজানি হয়ে যাবার আগেই ওখানে আপনার পৌঁছানো উচিত। তিনটে গাড়ি বাল্টিমোর-এ খালাস করা হয়েছে, চার তারিখ অগাস্টের। বাকি তিনটে এসেছে সেপ্টেম্বরের দশ তারিখে।

 হোল্ড অন, নির্দেশ দিলেন ডোনাল্ড কার্ন, কথা বললেন তাঁর সহকারীর সাথে। এখুনি হাত লাগাও কাজে। মুরমটো কমপিউটার সিস্টেমে নাক গলাও, তাড়াতাড়ি বের করে আনো ওদের শিপিং রেকর্ড। দেরি করলে সমস্ত ডাটা মুছে ফেলবে ওরা। আবার অ্যালের সাথে কথা বললেন তিনি। নাইস ওঅর্ক। আপনার সমস্ত বাড়াবাড়ি ক্ষমা করা হলো। ভাল কথা, এ-ধরনের একটা ব্যবসা আপনি হঠাৎ পেলেন কিভাবে?

আইডিয়াটা আমার বন্ধুর। ওর কোন খবর পেয়েছেন?

পেয়েছি, আধ ঘণ্টা আগে ফোন করেছিলেন, বললেন ডোনাল্ড। সমস্যার উৎসটা তিনি আবিষ্কার করেছেন।

আমি জানতাম, রহস্যের সমাধান ওর দ্বারাই সম্ভব, বলল অ্যাল। ওর সাফল্যে আমি গর্ব বোধ করছি।

.

২৬.

 ওয়াশিংটনের ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের এক কোণে পুরানো ও পরিত্যক্ত একটা হ্যাঁঙ্গার আছে, উনিশশো ছত্রিশ সালে তৈরি। পুরানো গাড়ি সংগ্রহ করা ওর একটা হবি, হ্যাঁঙ্গারটাকে ওর ব্যক্তিগত কার মিউজিয়াম বলা যেতে পারে। ওর বন্ধু হিরাম ইয়েজার, সন্ধ্যের পর পৌঁছে দিল ওকে। ভেতরে একটা চক্কর দিয়ে সে বলল, তোমার কার কালেকশন আরেকদিন ভাল করে দেখে যাব, আজ আমাকে বিদায় দাও। কাজ আছে, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে।

 হিরাম ইয়েজারের গাড়ি হ্যাঙ্গারের বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, হেডলাইটের আলো পড়েছে ওদের গায়ে। পটোম্যাক নদীর ওপার থেকে আলোকিত শহরের আভাও এসে পড়েছে এ দিকটায়। আর মাত্র একটি আলোর উৎস চোখে পড়ে দুশো মিটার উত্তরে জ্বলছে নিঃসঙ্গ একটি রোড ল্যাম্প। আশপাশে লোকবসতি নেই, রাস্ত টাও নির্জন।

 লিফট দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ, বলল পিট। ধন্যবাদ সমস্যা সমাধানে সাহায্য করার জন্যে। সেই কবে শেষবার ঘুমিয়েছি মনে করতে পারছি না, আমাকেও বিছানায় উঠতে হবে।

গাড়িতে চড়ে হিরাম ইয়েজার বলল, তুমি কোন সমস্যা নিয়ে এলে তবেই আমার মাথা খোলে। যদি কোনদিন বিশ্ব সৃষ্টির রহস্য ভেদ করতে চাও, আমার কাছে চলে এসো। জানালা দিয়ে হাত বের করে নাড়ল সে, গাড়ি ছেড়ে দিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।

হিরাম ইয়েজার চলে যাবার পর পকেট থেকে একটা স্পেয়ার ট্রান্সমিটার বের করল পিট। এটা নুমা অফিসে রাখে ও। কয়েকটা বোতামে চাপ দিয়ে হ্যাঙ্গারের সিকিউরিটি সিস্টেম বন্ধ করে দিল, তারপর ভেতরের আলো জ্বালাল। পাশের একটা দরজা খুলে হ্যাঙ্গারে ঢুকল, ঘুমে বুজে আসছে চোখ। ভেতরে মেঝেটা চকচক করছে, একটু ময়লা নেই কোথাও। কার মিউজিয়াম না বলে, এটাকে আসলে বলা উচিত ট্র্যান্সপোর্ট মিউজিয়াম। এক কোণে মান্ধাতা আমলের একটা রেলরোড পুলম্যান কার-এর পাশে দেখা যাচ্ছে। পুরানো ফোর্ড ট্রাইমোটর এরোপ্লেন। বাকি দশ হাজার বর্গ মিটার দখল করে রেখেছে পঞ্চাশটার ওপর মোটর গাড়ি। ব্রিটিশ গাড়ির মধ্যে রয়েছে দুর্লভ একটা হিসপানো-সুইজা। একটা মার্সিডিজ-বেঞ্জ রয়েছে ফিফটিফোর ওকে, আর একটা জর্ডান-লাগো। ওগুলোর পাশেই জায়গা করে নিয়েছে কয়েকটা আমেরিকান ক্লাসিক কার-একটা কর্ড এল টোয়েটিনাইন, একটা পীয়ার্স-অ্যারো ও পান্না সবুজ স্টাজ টাউন কার। পরিবেশের সাথে একেবারেই বেমানান এমন জিনিস একটাই দেখা গেল হ্যাঙ্গারে, তা হলো ঢালাই করা লোহার একটা বাথটাব, ব্যাকরেস্টে জোড়া লাগানো রয়েছে আউটবোর্ড মোটর।

 প্যাঁচানো লোহার সিঁড়ি বেয়ে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে উঠে এল পিট, এখান থেকে ওর কালেকশনগুলো পরিষ্কার দেখা যায়। এককালে যেটা অফিস ছিল, নতুন করে সাজিয়ে সেটাকেই আরামদায়ক এক রূপের অ্যাপার্টমেন্টে বানিয়ে নিয়েছে ও, সাথে আছে বড় একটা লিভিং রুম সেটাকে স্টাডি হিসেবেও ব্যবহার করা চলে। শেলফে প্রচুর বই আছে, আর আছে জাহাজের অনেকগুলো মডেল।

কিচেন থেকে সুন্দর একটা গন্ধ ভেসে আসছে, জিভে পানি বেরিয়ে এল পিটের। ডাইনিং টেবিলের ওপর একটা ফুলদানিতে একগাদা গোলাপ রয়েছে, মাঝখানে একটা কাগজ। ভাজ খুলে লেখাটা পড়ার সময় আপন মনে হাসল পিট।

শুনলাম শহরে তোমার শুভাগমন ঘটেছে। রেফ্রিজারেটরে কয়েক মাস আগে রাখা সমস্ত তরিতরকারি পচে গিয়েছিল, কাজেই সব ফেলে দিলাম। ভাবলাম তোমার খিদে পাবে, তাই এক প্লেট সালাড বানিয়ে রেখে গেলাম। স্টোভে গরম হচ্ছে কচি বাছুরের নরম কাঁধ। তোমাকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্যে থাকতে পারছি না বলে দুঃখিত, হোয়াইট হাউসের ডিনারে উপস্থিত না থাকলেই নয়।
লাভ,
এল।

ওখানে দাঁড়িয়ে ঘুমে আচ্ছন্ন মনটাকে একটা সিদ্ধান্তে আসার তাগাদা দিচ্ছে ডার্ক। আগে খাবে, তারপর শাওয়ার সারবে কিনা? নাকি প্রথমে ভিজবে? সিদ্ধান্ত নিল, পেটখালি রাখতে নেই। ঢোলা একটা আলখেল্লা পরল ও, তারপর টেবিলে বসে সালাদ ও ভরপেট মাংস খেল। বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে প্লেটগুলো ধুচ্ছে, এই সময় ফোন এল।

হ্যালো? ^

মি. ডার্ক পিট?

হ্যাঁ, মি. রেইমন্ড জর্ডান, ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের ডিরেক্টর-এর গলাটা চিনতে পেরে বলল পিট। আপনার জন্যে কি করতে পারি আমি?

আশা করি আপনার ঘুমে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছি না।

আর দশ মিনিট পর শুতে যাব।

মি. অ্যাল জিওর্দিনের সাথে আপনার কথা হয়েছে কিনা জানার জন্যে ফোন করছি আমি।

হ্যাঁ, আপনার সাথে কথা হবার পরই ফোন করে সে আমাকে।

আমার অনুমতি ছাড়াই অন্যান্য লোকদের সাহায্য নিয়েছেন আপনি, তবু আবিষ্কারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার ওপর আমি অসন্তুষ্ট নই, বললেন রেইমন্ড জর্ডান। অন্যান্য লোক বলতে নুমার কমপিউটার বিজ্ঞানী হিরাম ইয়েজার ও পরমাণু বিজ্ঞানী ডক্টর ন্যাশের কথা বলছেন তিনি। ওদের দুজনেরই এ-প্লাস সিকিউরিটি ক্লিয়ার্যান্স আছে। একটা গাড়ির ঠিক কোথায় অ্যাটম বোমা লুকিয়ে রাখা যেতে পারে, জানার জন্যে ওদের সাহায্য নিয়েছে পিট।

আমাকে একটা দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, সেটা আমি নিজস্ব পদ্ধতিতে পালন করব। আপনি অসন্তুষ্ট হলেও আমার কিছু করার ছিল না, বলল পিট।

হ্যাঁ, বুঝতে পারছি একা কাজ করতে পছন্দ করেন আপনি।

আর কি জানতে চান, মি. রেইমন্ড জর্ডান? বিছানায় ওঠার জন্যে অস্থির হয়ে আছে পিট।

ভাবলাম আপনি জেনে খুশি হবেন যে বম্ব ক্যারিয়ারগুলো পেয়েছি আমরা।

 ছটা গাড়িই? জিজ্ঞেস করল পিট, অবাক হয়ে গেছে। এত তাড়াতাড়ি?

 হ্যাঁ। ওয়াশিংটনে, একটা জাপানি ব্যাংক বিল্ডিংয়ে লুকানো রয়েছে। আন্ডারগ্রাউন্ড বেসমেন্টে সীল করে রাখা হয়েছে। প্রয়োজনের সময় ধুলো ঝেড়ে নির্দিষ্ট টার্গেটে নিয়ে যাওয়া হবে, তারপর ডিটোনেট করা হবে।

খুব দেখিয়েছেন।

নিজস্ব পদ্ধতি আমাদেরও আছে, মি. ডার্ক পিট। মৃদু শব্দে হাসলেন রেইমন্ড জর্ডান।

ওগুলোর ওপর নজর রাখা হচ্ছে তো? জানতে চাইল পিট।

তা তো হচ্ছেই। তবে খুব সাবধানে নড়াচড়া করছি আমরা। আমরা যে জানি, এটা শত্রুদেরকে বুঝতে দিচ্ছি না। এই আতঙ্ক সৃষ্টির জন্যে যারা দায়ী, প্রথমে তাদেরকে খুঁজে বের করব আমরা। ওদের কমান্ড সেন্টারটাও ধ্বংস করতে হবে। মি, অ্যাল জিওর্দিনো নিজের অজান্তেই একটা বিপদ ডেকে এনেছিলেন, আপনি কি তা জানেন?

কি রকম?

 মুরমটো ডিসট্রিবিউটরস-এর কেউ একজন ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ওদের ইমপোটেড শিপিং ডাটা কমপিউটার থেকে মুছে ফেলতে যাবে, এই সময় নাক গলাই আমরা। আর দশ মিনিট দেরি করলে সর্বনাশ হয়ে যেত।

ওই ডাটাই আপনাদেরকে গাড়িগুলো খুঁজে বের করতে সাহায্য করে? জানতে চাইল পিট।

 আমরা একটা ফ্রেইট কোম্পানীর সন্ধান পাই, মালিক জাপানি। ওই কোম্পানীর ট্রাকেই গাড়িগুলো বহন করা হয়। ওদের রেকর্ডে গন্তব্য সম্পর্কে কোন তথ্য নেই, তবে ড্রাইভারের ডেলিভারি লগ ধার করি আমরা। ডকইয়ার্ড থেকে রওনা হবার পর কত কিলোমিটার ছুটেছে ট্রাক, লেখা আছে তাতে। এরপর নিরেট তদন্ত ও সামান্য কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়েছে।

মানুষ অ্যাটম বোমার ওপর বসে আছে, খবরটা ফাঁস হয়ে গেলে আপনাদের গোটা দৈশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে, বলল পিট। বোমাগুলো জাপানি, জানাজানি হয়ে গেলে ব্যাপক দাঙ্গাও বেধে যেতে পারে। আমেরিকায় জাপানিদের সংখ্যা কম নয়।

হ্যাঁ, পরিস্থিতি ভাল নয়। সাধারণ আমেরিকানরা পাল্টা ব্যবস্থা অর্থাৎ প্রতিশোধ নেয়ার দাবি জানাবে। তাতে ভয় পেয়ে জাপানিরা গাড়িগুলোকে স্ট্র্যাটেজিক পজিশনে নিয়ে গিয়ে ফায়ার বাটনে চাপ দিতে পারে, আমরা ওগুলো খুঁজে বের করি অকেজো করার আগেই।

সবগুলো বোমা খুঁজে বের করতে হলে গোটা দেশে তল্লাশি চালাতে হবে, বলল পিট। তাতে সময় লাগবে, আমার ধারণা, বিশ বছর।

আমার তা মনে হয় না, বললেন রেইমন্ড জর্ডান। আমরা জানি কিভাবে কি করে ওরা। কি খুঁজছে আমরা তা-ও জানি, মি. অ্যাল জিওর্দিনো ও আপনাকে সেজন্যে ধন্যবাদ। এসপিওনাজ জগতে আমরা যতটা দক্ষ, জাপানিরা তার অর্ধেকও নয়। আমি বাজি ধরে বলতে পারি, বোমাসহ প্রতিটি মুরমটো এক মাসের মধ্যে খুঁজে বের করে ফেলব আমরা।

 আমি নিজেও একজন আশাবাদী, তবে বাস্তব সমস্যার কথা ভুলে থাকতে পারি না, বলল পিট। ভাল কথা, আপনাদের বন্ধুও রাশিয়ার কথা কিছু ভাবছেন? জাপানিরা ওদের ঘরেও বোমা লুকিয়ে রাখতে পারে। আপনাদের প্রেসিডেন্ট কি ওদেরকে সতর্ক করে দেবেন?

এখনই নয়। এ-ধরনের মারাত্মক একটা গোপন তথ্য ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোকেও এখুনি আমরা জানাতে চাইছি না। বিশ্বাস করা যায় না, কোন ফুটো দিয়ে বেরিয়ে যায়। তবে কোন কোন দেশকে ইচ্ছে করলে জানাতেও পারেন প্রেসিডেন্ট, কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও মজবুত করার জন্যে।

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকার পর রেইমন্ড জর্ডান বললেন, কাজটা আপনি ভাল করেন নি, মি. ডার্ক পিট। ইনফরমেশনটা লিক হয়ে গেলে গোটা দুনিয়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে।

আরেকটা হুমকির কথা আপনি ভেবেছেন কি?

 আরেকটা হুমকি?

ধরুন যুক্তরাষ্ট্রে বা রাশিয়ায় দুএকটা গাড়ি-বোমা ফাটিয়ে দিল জাপান। দুপক্ষই ভাববে, হামলার জন্যে প্রতিপক্ষ দায়ী। আপনারা, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া, পরস্পরের সাথে যুদ্ধ বাধিয়ে দিলেন।

 এ-ধরনের দুশ্চিন্তা নিয়ে বিছানায় যাওয়ার কোন মানে হয় না, ঘুম আসবে না, বললেন রেইমন্ড জর্ডান, অস্বস্তিবোধ করছেন। যখন যা ঘটে তাই নিয়ে চিন্তা করুন। আমাদের অপারেশন যদি সফল হয়, তারপর গোটা ব্যাপারটা চলে যাবে রাজনীতিকদের হাতে।

আপনার এ-কথা শোনার পর ঘুমাতে পারব বলে মনে হয় না, বলল পিট।

.

ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যাচ্ছে পিট, হঠাৎ সিকিউরিটি অ্যালার্ম বেজে উঠল। কেউ একজন হ্যাঙ্গারে ঢোকার চেষ্টা করছে।

বিছানা থেকে নেমে স্টাডিতে বেরিয়ে এল পিট, বোতাম টিপে ছোট একটা টিভি মনিটরিং সিস্টেম চালু করল। হ্যাঙ্গারের সাইড ডোর-এর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে স্টেসি ফক্স, মুখ তুলে সিকিউরিটি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

একটা বোতামে চাপ দিল পিট, সাইড ডোর খুলে গেল। স্টাডি থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির মাথায়, ঝুল-বারান্দায় এসে দাঁড়াল ও। খোলা দরজা দিয়ে হ্যাঁঙ্গার ঢুকল কেটা সেক্স বম্ব। কলারবিহীন নীল জ্যাকেট পরে আছে স্টেসি, সঙ্গে ম্যাচ করা স্কার্ট ও জুয়েলনেক সাদা ব্লাউজ। মুগ্ধ বিস্ময়ে গাড়িগুলোর ভেতর দিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে এল সে। মেটালিক বু জর্ডান-লাগো গ্রান্ড স্পোর্ট-এর পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল, আলতোভাবে আঙুল ছোঁয়াল ফেন্ডারে।

স্টেসিই প্রথম নয়। পিটের এই অদ্ভুত বাসস্থানে আরও অনেক মেয়েই এসেছে, তাদের প্রায় সবইকে আকৃষ্ট করেছে জর্ডান। গাড়িটাকে মেকানিক্যাল আর্ট-এর উৎকৃষ্ট একটা নমুনা বলে মনে করে পিট, তবে মেয়েরা ওটার দিকে তাকালে পুলক ও শিহরণ অনুভব করে। গাড়িটার চকচকে পিচ্ছিল গা, আকৃতির মধ্যে বিড়ালসুলভ ছন্দ, শক্তিশালী এঞ্জিনের উপস্থিতি, ভেতরে দামী চামড়ার গন্ধ প্রায় এক ধরনের যৌনবেদনা সৃষ্টি করে।

আপনি আমাকে খুঁজে পেলেন কিভাবে? জানতে চাইল পিট, বিশাল হ্যাঙ্গারের ভেতর প্রতিধ্বনি তুলল আওয়াজটা।

মুখ তুলে তাকাল স্টেসি। ইনভিনসিবলে চড়ার আছে, আমি আপনার ফাইলে চোখ বুলিয়ে নিই।

ইন্টারেস্টিং কিছু পেলেন?

আপনি তো সাহেব ভয়াবহ রকম সফল একজন মানুষ।

 ফ্ল্যাটারি ইনডীড।

আপনার গাড়ির সংগ্রহ বিস্ময়কর।

তার মানে সত্যিকার ভাল কালেকশন আপনি দেখেন নি।

জর্ডান লাগোর দিকে আবার তাকাল স্টেসি। আই লাভ দিস ওয়ান।

আমার পছন্দ ওটার পাশের সবুজ টাউন কার।

ঘাড় ফিরিয়ে স্টাজ-এর দিকে তাকাল স্টেসি। মাথা নাড়ল সে। সুন্দর, তবে বিশাল ও গম্ভীর দর্শন; বড় বেশি পুরুষালি ভাব, প্রায় কর্কশই বলা যায়। মুখ তুলে তাকাল সে। আমরা কথা বলতে পারি? জানতে চাইল হঠাৎ।

যদি জেগে থাকতে পারি। উঠে আসুন।

প্যাঁচানো সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল স্টেসি, অ্যাপার্টমেন্টটা তাকে ঘুরিয়ে দেখাল পিট। তারপর জিজ্ঞেস করল, কফি চলবে?

না, ধন্যবাদ, পিটের দিকে তাকিয়ে আছে স্টেসি, ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে গেল চেহারা। আমার আসা উচিত হয় নি। দেখে মনে হচ্ছে যে-কোন মুহূর্তে জ্ঞান হারাবেন আপনি।

এক রাত ঘুমাতে দিন, দেখে মনে হবে আবার আমি সমুদ্র মন্থন করতে পারব।

ডলাই-মলাই পছন্দ করেন না? হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে জানতে চাইল স্টেসি। ঘুমের জন্যেও ওটা একটা মহৌষধ।

আমি ভেবেছিলাম আপনি কথা বলতে এসেছেন। একটা ঢোক গিলল পিট।

 আমি একই সময়ে একাধিক কাজ করতে পারি, বলল স্টেসি। ম্যাসেজও করলাম, আবার কথাও বললাম। কোনটা আপনার পছন্দ-সুইডিস নাকি শিয়াৎসু?

হোয়াট দ্য হেল, ডু বোথ।

হেসে উঠল স্টেসি। ঠিক আছে। পিটের হাত ধরল সে, বেডরুমে নিয়ে এল, মৃদু ধাক্কা দিয়ে শুইয়ে দিল ওকে বিছানায়, উপুড় করে।

আলখেল্লাটা খুলে ফেলুন, প্লীজ।

পর্দা হিসেবে গায়ে একটা চাদর রাখতে পারি?

আমি দেখি নি, এমন কিছু আছে আপনার? আলখেল্লাটা পিটের গা থেকে খুলে নিল স্টেসি।

হেসে উঠল পিট। আমাকে চিৎ হতে বলবেন না।

আসলে টিমোথি আর আমি ওয়েস্ট কোস্টে চলে যাচ্ছি, যাবার আগে ক্ষমা চাইতে এসেছি, গম্ভীর সুরে বলল স্টেসি।

টিমোথি?

 ড. টিমোথি ওয়েদারহিল।

আপনারা আগেও একসাথে কাজ করেছেন, ধরে নিতে পারি?

 হ্যাঁ।

আবার আপনার সাথে আমার দেখা হবে?

বলতে পারছি না। আমাদের মিশন দুজনকে দুদিকে নিয়ে যেতে পারে। এক সেকেন্ড ইতস্তত করল স্টেসি। আপনাকে আমি জানাতে চাই, আমার দ্বারা যে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছিল সেজন্যে সত্যি আমি দুঃখিত। আপনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন, সে-কথা কোন দিন আমি ভুলব না।

শরীরটা ভাল করে ডলে নিতে পারলে দেনা-পাওনা শোধবোধ হয়ে যাবে। ক্লান্ত, আড়ষ্ট হাসি পিটের মুখে।

পিটের লম্বা শরীরের ওপর চোখ বুলাল স্টেসি। পানির নিচে এত দিন ছিলেন, কিন্তু গায়ের রঙটা এমন রোদে পোড়া সোনালি থাকল কিভাবে?

 জিপসি রক্ত, ঘুমজড়ানো গলায় বিড়বিড় করল পিট।

শিয়াৎসু পদ্ধতি অনুসারে পিটের নগ্ন পায়ের স্পর্শকাতর জায়গায় আঙুলের ছাপ দিল স্টেসি।

 দারুণ লাগছে, বিড়বিড় করল পিট। রেইমন্ড জর্ডান আপনাকে জানিয়েছেন, ওঅরহেড সম্পর্কে কি জানত পেরেছি আমরা?

হ্যাঁ, বলেছেন। তার সাথে ঝগড়া করে ফেডারেল হেডকোয়ার্টার বিল্ডিং থেকে যেভাবে বেরিয়ে গেলেন আপনি, উনি ধরে নিয়েছিলেন, আপনি বোধহয় টীমে থাকবেন না। আমি আর টিমোথি এখন জানি কোথায় তদন্ত হবে, গাড়ি-বোমাগুলো খুঁজে বের করা অনেক সহজ হয়ে গেল।

তার মানে ওয়েস্ট কোস্ট থেকে তদন্ত শুরু করেছেন আপনারা?

সীয়াটল, সানফ্রান্সিকো আর লস অ্যাঞ্জেলস পোর্টগুলোতেই মুরমটো ক্যারিয়ার নোঙর ফেলে।

 পিটের হাত, পিঠ ও ঘাড় ডলে দিচ্ছে স্টেসি। তারপর কোমরে একটা চাপড় মেরে চিৎ হতে বলল সে, কিন্তু কোন সাড়া পেল না। ঘুমিয়ে পড়েছে পিট।

 ভোরের দিকে কোন এক সময় ঘুম ভাঙল পিটের, অনুভব করল স্টেসির নরম শরীরের সাথে ওর শরীরটা বিদঘুটে ভঙ্গিতে জড়িয়ে আছে। পরবর্তী নড়াচড়া, তৃপ্তিকর অনুভূতি, স্টেসির অস্ফুট একটা-দুটো শব্দ, সবই যেন স্বপ্নের ভেতর ঘটল। তারপর আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল পিট।

কুম্ভকর্ণ, জাগো! কংগ্রস সদস্য লরেন স্মিথ পিটের উদোম পিঠে একটা চাদর বিছিয়ে দিল। চাদরটা বুকের কাছে খামচে ধরল পিট, ধড়মড় করে উঠে বসল বিছানায়, ঘাড় কাত করে নিজের পাশে তাকাল। বিছানার একটা পাশ খালি পড়ে আছে, কিনারায় বসে রয়েছে লরেন স্মিথ। স্টেসি ফক্স চলে গেছে দেখে বিরাট একটা স্বস্তিবোধ করল ও। মুখে আড়ষ্ট হাসি, তাকাল কংগ্রেস সদস্যের দিকে। ফুল আর পাতা বহুল ছিট কাপড়ের শার্ট পরে আছে সে, প্রিন্টের কাপড়টা মনে হলো। ক্যানভাস, পকেট আর বোম গিজগিজ করছে। তোমার না কংগ্রেসে বসে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্যে গরম বক্তৃতা দেয়ার কথা?

অধিবেশন মূলতবী ঘোষণা করা হয়েছে। কফির কাপটা বাড়াল লরেন, তারপরও সেটা পিটের নাগালের বাইরে থাকল, ওকে প্ররোচিত করতে চাইছে।

কাপটা পেতে হলে কি করতে হবে আমাকে?

একটা চুমো, ব্যস।

বেশ দামী জিনিস, কিন্তু পাবে।

আর একটা সত্যি কথা।

আমি কখনও মিথ্যে বলি না, অন্তত তোমাকে।

রাতটা তুমি কার সাথে কাটালে?

আমি একটা মেয়ের সাথে রাত কাটিয়েছি? পিটের চেহারা নির্লিপ্ত।

কাল রাতে এই বিছানায় তুমি একা শোওনি। আরেকজনকে নিয়ে শুয়েছিলে।

এখানে তুমি কোন মেয়েকে দেখেছ নাকি?

দেখার দরকার নেই, বলল লরেন। আমি তার গন্ধ পেয়েছি।

 বললে বিশ্বাস করবে, সে আমার ম্যাসাঞ্জার ছিল?

কফির কাপটা পিটের নাগালের মধ্যে বাড়িয়ে ধরল লরেন। মন্দ নয়। তোমার উদ্ভাবনী শক্তি এ-প্লস।

আমাকে ঠকানো হয়েছে, অভিযোগ করল পিট। কাপটা মাত্র অর্ধেক ভর্তি।

 নিশ্চয় তুমি চাওনি গোটা চাদরে ছলকে পড়ক কফি? হেসে উঠল লরেন। চাদরটা কোমরে জড়িয়ে যাও, বাথরুমে গিয়ে ঢোকো, গোসল করে গা থেকে ধয়ে ফেলো সমস্ত পারফিউম। গন্ধটা খারাপ নয়, স্বীকার করছি। বেশ দামী। ইতোমধ্যে আমি ব্রেকফাস্ট তৈরি করে ফেলি।

 আট ঘণ্টায় দ্বিতীয়বার শাওয়ার সেরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে পিট দেখল, রুটিতে মাখন লাগাচ্ছে লরেন। কোমরে মুদু তোয়ালে, তাড়াতাড়ি বেডরুমে ঢুকে কাপড় পরে নিল ও। কিচেন থেকে ডাক দিল লরেন, এত দেরি করছ কেন?

অনেকদিন পর দেখা হলো, কিচেনে ঢুকে লরেনের মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসল পিট। কেমন আছ তুমি, লরেন?

ভাল। অ্যাডমিরাল স্যানডেকার আমাকে বললেন, তোমার একটা প্রজেক্ট নাকি ভেস্তে গেছে। মারাই যেতে, একটুর জন্যে বেঁচে গেছ।

ব্যাপারটা গোপন থাকার কথা, বলল পিট।

গোপন তথ্য জানার বিশেষ অধিকার আছে কংগ্রেস সদস্যদের। মুখে এক টুকরো আপেল ফেলল লরেন। প্রজেক্টটা নষ্ট হওয়ায় সত্যি আমি দুঃখিত। তোমাকে হারাতে হয়নি, তাতেই আমি খুশি।

প্রজেক্ট নষ্ট হলেও, সবগুলো টেস্টের রেজাল্ট রক্ষা করা গেছে।

লরেনের নিয়ে আসা দৈনিক পত্রিকাটা তুলে নিয়ে চোখ বুলাল পিট। এক মিনিট পর বলল, জাপানি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আবার দেখছি বিবৃতি দিচ্ছে তুমি। মুখ তুলে হাসল ও।

 কফির কাপে চুমুক দিল লরেন। আমাদের ব্যবসার মালিকানা এক তৃতীয়াংশ চলে গেছে টোকিয়োতে। তারই সাথে চলে গেছে জাতির গর্ব, সমৃদ্ধি ও স্বাধীনতা। আমেরিকা এখন আর আমেরিকানদের নেই। আমরা এখন জাপানের অর্থনৈতিক উপনিবেশ।

 সত্যি এতটা খারাপ?

কতটা খারাপ সাধারণ মানুষের ধারণা নেই, বলল লরেন, পিটের জন্যে কফি ঢালল কাপে। বাজেটে বিপুল ঘাটতি আমাদের অর্থনীতিতে প্রকাণ্ড একটা গর্তের সৃষ্টি করেছে, সেটা দিয়ে হু হু করে ঢুকে পড়েছে জাপানি টাকা।

 কফির কাপটা তুলে নিয়ে পিট বলল, সেজন্যে আমরাই দায়ী। আমরা বেশি ভোগ করি, ওরা কম ভোগ করে, ফলে দিনে দিনে ঋণের পরিমাণ বাড়ছে তোমাদের। টেকনলজির যে-সব শাখায় আমরা এগিয়ে আছি, ফমূলাগুলো হয় চুরি যায়, না হয় আমরা ওদের কাছে বিক্রি করে দিই।

কী ব্যাপার? এতো বড় ভাষণ? সিনেটে যোগ দেবে নাকি?

দুদিন গাড়িগুলোর একটা যত্ন নেব, বলল পিট। স্টাজটাকে ঘষেমেজে ঠিক করে নিতে পারলে ক্লাসিক কার রেসে অংশগ্রহণও করতে পারি।

 গায়ে-হাতে গ্রীজ লাগানোর চেয়ে অনেক ভালো একটা কাজ আমার জানা আছে, আচমকা খসখসে গলায় বলে লরেন।

 দারুণ একটা আকর্ষণ বোধ করছে পিট। ধীরে, মন্ত্রমুগ্ধের মতো উঠে দাঁড়ায় সে। এগিয়ে যায় লরেনের দিকে।

বিছানায় নয়, রুদ্ধস্বরে লরেন বলে। অন্তত, চাদরটা না পাল্টালে নয়!

.

২৭.

 মুরমটো টিল্ট-রোটর এক্সিকিউটিভ জোন থেকে নেমে এল হিদেকি সুমা, তার ঠিক পিছনেই হয়েছে মুরো কামাতেরি। প্লাস্টিকের প্রকাণ্ড একটা গম্বুজের পাশে হেলিপোর্টে ল্যান্ড করল প্লেন। ঘন গাছপালায় ঢাকা পার্কের মাঝখানে পঞ্চাশ মিটার। উঁচু গম্বুজটা আসলে মাটির নিচে এড়ো সিটি-তে নামার একটা প্রবেশ পথ।

এডো সিটিকে জাপানের নতুন আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্রন্টিয়ার বিবেচনা করা হয়, বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও যুদ্ধ পরিচালনার মূল ঘাঁটি হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। এডো সিটির ধারণা হিদেকি সুমার মাথা থেকে বেরোয়, নকশা ও নির্মাণও তার নির্দেশে সম্পন্ন হয়েছে। প্রায় ষাট হাজার লোক কাজ করছে এখানে। মাটির নিচে প্রকাণ্ড সিলিন্ডার আকৃতির, বিশতলা বিল্ডিংটায় বিজ্ঞানীরা সপরিবারে বাস করেন। এক হাজার সদস্যের একটা সিকিউরিটি ফোর্সও আছে শহরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যে।

মাটির নিচে একই আকৃতির আরও কয়েকটা সিলিন্ডার আছে, প্রধান সিলিন্ডারের সাথে সেগুলোর যোগাযোগ রক্ষা করা হয় টানেলের মাধ্যমে। কমিউনিকেশন ইকুইপমেন্ট, হিটিং ও কুলিং সিস্টেম, টেমপারেচার ও তিউমিডিটি নিয়ন্ত্রণ, ইলেকট্রিক্যাল পাওয়ার প্ল্যান্ট এবং ওয়েস্ট প্রসেসিং মেশিনারির জন্যে আলাদা আলাদা বিল্ডিং। গোটা এভো সিটি সিরামিক কংক্রিট দিয়ে তৈরি, মাটির নিচে একশো পঞ্চাশ মিটার পর্যন্ত গভীর।

সরকারী কোন সাহায্য ছাড়াই প্রজেক্টের কাজ শেষ করেছে হিদেকি সুমা। আইনগত বাধা বা অন্যান্য ঝামেলার কারণে নির্মাণ কাজে যে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয় নি তা নয়, তবে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক প্রভাব খাঁটিয়ে সে সব সমস্যা দূর করেছে সে। টোকিওর কুখ্যাত ক্রিমিন্যালরা তাকে গুরু হিসেবে মান্য করে। স্মাগলার ও হেরোইন ব্যবসায়ীদের পুঁজি সরবরাহ করে সে। ঘুষখোর সরকারী কর্মকর্তারা তার ভক্ত। দুর্নীতিপরায়ণ অসৎ রাজনীতিকরা তার কাছ থেকে সাহায্য ও নিরাপত্তা পেয়ে অভ্যস্ত। তাছাড়া, জাপানি কালচারের প্রতি অন্ধ ভক্ত ও জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ ফ্যানাটিকরা তো আছেই। হিদেকি সুমা নিজেই একটা সরকার, তার কাজে বাধা দেয় এমন শক্তি জাপানে নেই।

মুরো কামাতোরিকে নিয়ে গোপন একটা এলিভেটরে চড়ল সে, নেমে এল মূল সিলিন্ডারের পাঁচতলায়। পাঁচতলার পুরোটা জুড়ে তার করপোরেট অফিস। প্রাইভেট অফিস ও অ্যাপার্টমেন্টের সামনে সশস্ত্র প্রহরীরা সারাক্ষণ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। দরজা খুলে গেল, ভেতরে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার সেক্রেটারি তোশি কুদো।

কামরাগুলোর জানালা-দরজা ও দেয়াল ঢাকা হয়েছে ব্রোকেড, সাটিন ও ক্রেপ দিয়ে। দেয়ালের ওপরের অংশে অনেকগুলো পেইন্টিং, বেশিরভাগই প্রাকৃতিক দৃশ্য। তবে ড্রাগন চিতা, হরিণ ও ঈগলও আছে।

মি. আশিকাগা ইনশু অপেক্ষা করছেন, সবিনয়ে জানাল মুশি ততশি।

নামটা তো আমার মনে পড়ছে না।

মি. ইনশু একজন ইনভেস্টিগেটর। দুর্লভ শিল্প খুঁজে বের করা ভদ্রলোকের পেশা, এ-ব্যাপারে তাকে একজন বিশেষজ্ঞ বলা যেতে পারে। শুধু খুঁজে বের করাই নয়, নিজের ক্লায়েন্টকে কিনে দেয়ার জন্যে মধ্যস্থতাও করেন, ব্যাখ্যা করল তোশি কুদো। আমাকে ফোন করে জানিয়েছিলেন, এমন একটা পেইন্টিং আবিষ্কার করেছেন তিনি, যেটা আপনার কালেকশনে নতুন একটা মাত্রা যোগ করবে। আপনার সাথে আলোচনা না করেই একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করেছি আমি, ভদ্রলোক যাতে পেইন্টিংটা আপনাকে দেখানে পারেন।

কিন্তু আমার হাতে সময় খুব কম, বলে হাতঘড়ি দেখল হিদেকি সুমা।

কাঁধ ঝাঁকাল মুরো কামাতোরি। কি এনেছে দেখই না একবার, সুমা। এমন হতে পারে তুমি হয়তো এই পেইন্টিংটাই খুঁজছ।

ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও যাবতীয় অপকর্মের সহযোগীর দিকে একবার তাকাল সুমা, তারপর সেক্রেটারিকে বলল, ঠিক আছে, ডেকে পাঠাও তাকে।

 আর্টডিলার কামরায় ঢুকতে তার উদ্দেশ্যে মাথা নত করে বাউ করল সুমা। মি. ইনশু, শুনলাম আপনি নাকি আমার জন্যে দুর্লভ একটা জিনিস যোগাড় করেছেন?

 জী, আমার তাই ধারণা। আপনার জন্যে কি যোগাড় করেছি, দেখলে আমার ওপর ভারি খুশি হবেন আপনি। আশিকাগা ইনশুর মাথায় রূপালি কেশর, তার গোঁফ জোড়া অস্বাভাবিক চওড়া, ঘন ভুরু। সুমার চোখে চোখ রেখে হাসছে সে।

 আলোয়, স্ট্যান্ডে রাখুন এটা, প্লীজ, বলল সুমা, হাত তুলে বড় একটা জানালার সামনে ইজেলটা দেখিয়ে দিল।

জানালার পর্দা আরেকটু তুলে দিতে পারি?

 প্লীজ ডু সো।

জানালার পর্দা সামান্য সরিয়ে ইজেলে পেইন্টিংটা চড়াল আশিকাগা ইনশু, তবে সিল্কের আবরণটা সরাল না। ষোড়শ শতাব্দীর একটা মাসাকি শিমজু।

শ্রদ্ধেয় সীস্কেপ আর্টিস্ট, বলল কামাতোরি, গলার স্বরে চাপা উত্তেজনা। তোমার প্রিয় আর্টিস্টদের একজন, সুমা।

আপনি জানেন আমি শিমজুর একজন ভক্ত? আশিকাগ ইনশুকে জিজ্ঞেস করল সুমা।

আপনি যে তার কাজ সংগ্রহ করেন, শিল্প জগতের সবাই তা জানে। বিশেষ করে আমাদের চারপাশের দ্বীপগুলোর যে ছবি তিনি এঁকেছেন।

তোশি কুদোর দিকে ফিরল সুমা। তার ছবি কটা যেন আছে আমার কালেকশনে?

তার আকা দ্বীপের ছবি মোট তেরোটা, তার মধ্যে এগারোটা আছে আমাদের সংগ্রহে। আরও আছে হাইড়া পাহাড়ের ওপর করা চারটে ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টি।

আর একটা যোগ হলে দ্বীপের ছবি হবে মোট বারোটা?

জী।

শিমজুর আঁকা কোন দ্বীপের ছবি এনেছেন আপনি আমার জন্যে, মি. ইনশু? জিজ্ঞেস করল সুমা, আগ্রহে চকচক করছে তার চোখ জোড়া। আজিমা?

না, কেচি।

হতাশায় মগ্ন হয়ে গেল সুমার চেহারা। আমি আশা করেছিলাম ওটা আজিমা হবে।

 সত্যি আমি দুঃখিত, বলল আশিকাগা ইনশু, আজিমা সংগ্রহ করতে না পারাটা যেন তার ব্যক্তিগত পরাজয়। সভ্যতার দুর্ভাগ্য, জার্মানির পতনের সময় আজিমা হারিয়ে গেছে। ওটাকে শেষবার দেখা গেছে আমাদের বার্লিন দূতাবাসে, অ্যামব্যাসাডরের অফিসের দেয়ালে, উনিশশো পঁয়তাল্লিশ সালের মে মাসে।

আপনি খোঁজ করতে রাজি হলে সমস্ত খরচ আমি বহন করব।

 ধন্যবাদ, বলল আশিকাগা ইনশু, সুমার উদ্দেশ্যে মাথা নত করল। ইউরোপ ও আমেরিকায় আমার লোকজন অনেক আগে থেকেই ওটা খুঁজছে।

গুড। এবার কেচি আইল্যান্ড দেখান আমাদের।

নাটকীয় ভঙ্গিতে সিল্ক আবরণটা সরাল আশিকাগা ইনশু পাখির চোখ দিয়ে দেখা একটা দ্বীপের ছবি, উজ্জ্বল রঙের বিপুল সমাহার চোখ ধাঁধিয়ে দিল।

শ্বাসরুদ্ধকর, বিড় বিড় করল তোশি কুদো, মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে।

একমত হয়ে মাথা ঝাঁকাল ইনশু। শিমজুর এত ভাল কাজ আমি আর দেখি নি।

 তোমার কি মনে হয়, সুমা? জানতে চাইল কামাতোরি।

হা মাস্টারওয়ার্ক, বলল সুমা, শিল্পীর প্রতিভা প্রায় বিহ্বল করে তুলেছে তাকে। এ স্রেফ অবিশ্বাস্য! ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে আকাশের অত ওপর থেকে দেখা এ রকম একটা দৃশ্য তিনি আঁকলেন কিভাবে। ছবির প্রতিটি বিবরণ কি নিখুঁত, লক্ষ করেছ? যেন মনে হয় একটা বেলুনে ভাসমান অবস্থায় এঁকেছেন।

 কিংবদন্তী আছে, উনি নাকি একটা ঘুড়ির ওপর বসে এটা এঁকেছিলেন, বলল মুশি তোশি।

ঘুড়িতে বসে সম্ভবত স্কেচ করেছিলেন, শুধরে দেয়ার সুরে বলল আশিকাগা ইনশু। দৃশ্যটা আসলে আঁকা হয়েছে মাটিতে দাঁড়িয়েই।

অবাক হবার কিছু নেই। মুহূর্তের জন্যেও পেইন্টিং থেকে নড়ছে না সুমার চোখ। বিশাল আকৃতির ঘুড়ি তৈরি করার হাজার বছরের ঐতিহ্য রয়েছে আমাদের। অবশেষে ঘাড় ফিরিয়ে আশিকাগা ইনশুর দিকে তাকাল সে। সত্যি একটা কাজের কাজ করছেন আপনি, মি. ইনশু। এটা আপনি পেলেন কোথায়?

 হংকং-এ, এক ব্যাংকারের বাড়িতে, জবাব দিল ইনশু। চীনারা দখলে যাবার আগে ভদ্রলোক তার সম্পদ বেঁচে দিয়ে মালয়েশিয়ায় সরে যাচ্ছেন। বছরখানেক সময় লাগলেও, শেষ পর্যন্ত তাকে আমি বেঁচতে রাজি করিয়ে ফেলি টেলিফোনে। দেরি না করে সাথে সাথে হংকং-এ চলে যাই, দর দাম করে জিনিসটা নিয়ে ফিরে আমি। এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি আপনার অফিসে চলে এসেছি।

কত?

একশো পঁয়তাল্লিশ মিলিয়ন ইয়েন।

সন্তুষ্টচিত্তে দুহাতের তালু এক করে ঘষল সুমা। ভাল দামই বলব আমি। ধরে নিন, কিনলাম।

ধন্যবাদ, মি. সুমা। আপনি সত্যি উদার। শুধু আপনার কথা ভেবে আজিমার খোঁজে আরও লোক লাগাব আমি। পরস্পরকে বাউ করল ওরা, তারপর তোশি কুদোর পিছু পিছু কামরা থেকে বেরিয়ে গেল আশিকাগা ইনশু।

 পেইন্টিংয়ের ওপর ফিরে এল সুমার দৃষ্টি। সৈকতে কালো পাথর ছড়িয়ে রয়েছে, জেলেদের ছোট একটা গ্রামও দেখা যাচ্ছে, একধারে কয়েকটা মাছ ধরার বোট। প্রতিটি জিনিসের আকার-আকৃতি দেখে মনে হয় যেন আকাশ থেকে ভোলা একটা ফটো। কি আশ্চর্য শান্ত গলায় বলল সে। দ্বীপের যে ছবিটা আমি সবচেয়ে ভালবাসি শুধু সেটাই আমার কাছে নেই।

আজও যদি ওটার অস্তিত্ব থাকে, ইনশু ঠিকই খুঁজে বের করে ফেলবে, বন্ধুকে সান্ত্বনা দিল কামাতোরি। লোকটাকে দেখে নাছোড়বান্দা বলে মনে হলো আমার।

 আজিমার জন্যে কেচির চেয়ে দশ গুণ বেশি দাম দেব আমি।

একটা চেয়ারে বসে পা দুটো লম্বা করল কামাতোরি। আজিমা আঁকার সময় শিমজুর কোন ধারণা ছিল না, দ্বীপটা কিসের প্রতীক হতে যাচ্ছে।

কামরায় ফিরে এসে তোশি কুদো সুমাকে মনে করিয়ে দিল, দশ মিনিট পর আপনার সাথে মি. ইয়োশিশুর মিটিং।

প্রাচীন কাণ্ড চোর এবং গোল্ড ড্রাগনস-এর লীডার, বলল কামাতোরি, ঠোঁটে ব্যঙ্গাত্মক হাসি। তোমার অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যে নিজের শেয়ার হিসেব নিতে এসেছেন।

ধনুক আকৃতির বিশাল জানালা দিয়ে পার্কের দিকে তাকাল সুমা। যুদ্ধের সময় ও পরে কোরোরি ইয়োশিশু আর আমার বাবা সে সংগঠনটা গড়ে তোলেন, তারই নিরেট ফল হলো আজকের এই প্রজেক্ট।

আগামী শতাব্দীর নিপ্পন-এর গোল্ড ড্রাগনস বা অন্যান্য গুপ্ত সংগঠনগুলোর কোন ভূমিকা থাকবে না, বলল কামাতোরি। নিপ্পন একটি প্রাচীন শব্দ, অর্থ হলো সূর্যের উৎস।

 আমাদের আধুনিক টেকনলজির পাশে ওদেরকে বেমানান লাগে, স্বীকার করল হিদেকি সুমা, কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে এখনও ওরা আমাদের কালচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ওদের সাথে আমার অনেক বছরের সম্পর্ক, তা থেকে আমি লাভবানই হয়েছি।

 এ-সব ফ্যানাটিক্যাল গুপ্ত সংগঠন বা আন্ডারওয়ার্ল্ড ক্রাইম সিন্ডিকেটগুলোর সাহায্য না নিলেও চলে তোমার, ব্যাকুলস্বরে বলল কামাতোরি। মন্ত্রিসভায় তোমার পুতুলের সংখ্যা কম নয়, তোমার হুকুম পালন, করার জন্যে এক পায়ে খাড়া হয়ে আছে সবাই। তারপরও কেন যে তুমি…, কথা শেষ না করে কাঁধ ঝকাল সে, বলল, যদি কোন দিন ফাঁস হয়ে যায় যে তুমি দুনম্বর ড্রাগন, বড় ধরনের খেসারত দিতে হবে তোমাকে।

 কারও কাছে আমি বাঁধা পড়ি নি, শান্তভাবে ব্যাখ্যা করল সুমা। আইন যেটাকে ক্রিমিন্যাল অ্যাকটিভিটি বলে, তার সাথে আমার পরিবার দুই শতাব্দী ধরে জড়িয়ে আছে। পূর্ব-পুরুষদের পায়ের ছাপ ধরে এগোচ্ছি আমি, তাদের রেখে যাওয়া ভিতের ওপর গড়ে তুলছি একটা সংগঠন। আমি গর্বিত, কারণ এ-ধরনের শক্তিশালী সংগঠন দুনিয়ার খুব কম দেশেই আছে। আন্ডারওয়ার্ল্ডের বন্ধুদের জন্যেও আমি গর্বিত, লজ্জিত নই।

আমি আরও খুশি হতাম তুমি যদি সম্রাটের প্রতি সম্মান দেখাতে, গুরুত্ব দিতে পুরানো নৈতিক মূল্যবোধকে।

 দুঃখিত, কামাতোরি। তীর্থ মন্দিরে গিয়ে বাবার জন্যে প্রার্থনা করি বটে, তবে পৌরাণিক কাহিনীর ঈশ্বরতুল্য সম্রাটের ওপর আমার কোন শ্রদ্ধা নেই। চা পান অনুষ্ঠানে গিয়ে গেইসাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া, কাবুকি খেলায় অংশগ্রহণ করা, কানোইয়া কুস্তি দেখা, কিংবা জাতীয় কালচারকে শ্রেষ্ঠ বলে গর্ব বোধ করা, কোনটাই আমার দ্বারা সম্ভব নয়। নতুন যে থিওরিটা আজকাল শোনা যাচ্ছে ঐতিহ্য, ইন্টেলিজেন্স, আবেগ, ভাসা, ইত্যাদি ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের তুলনায় আমরা শ্রেষ্ঠ, এর সঙ্গেও আমি একমত নই। এই সব আইডিয়া বা মতবাদ আমি সমর্থন করি নিজের স্বার্থের কথা ভেবে, কিন্তু এ সবে আমার বিশ্বাস নেই। সত্যি কথা বলতে কি, আমি আমার প্রতিদ্বন্দ্বীদের ছোট করে দেখতে রাজি নই। আমিই আমার ঈশ্বর, বিশ্বাস করি টাকা আর ক্ষমতায়। তুমি কি রেগে যাচ্ছ, মুরো?

কোলের ওপর পড়ে থাকা হাত দুটোর দিকে তাকাল কামাতোরি। চুপচাপ বসে থাকল সে, চোখে বিষাদের ছায়া। অবশেষে সে বলল, না, মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমি সম্রাটকে শ্রদ্ধা করি, ভালবাসি আমাদের ঐতিহ্যবাহী কালচারকে। তার পরিবারের উৎস বা রুটস যে পবিত্র স্বর্গ, এ আমি বিশ্বাস করি, বিশ্বাস করি আমাদের এই দ্বীপগুলোর ওপর ঈশ্বরের বিশেষ দৃষ্টি ও ভালবাসা আছে। আমাদের রক্তে কোন ভেজাল নেই, আমাদের গোটা জাতির আত্মা এক সুতোয় গাঁথা। তবে আমি তোমাকেও অনুসরণ করি, হিদেকি। কারণ আমরা পুরোনো বন্ধু। কারণ, তোমারে আন্ডারগ্রাউন্ড কানেকশন আমার পছন্দ না হলেও, জাপানকে দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী দেশে পরিণত করার জন্যে বিরাট অবদান রয়েছে তোমার।

 তোমাকে আমি ভালবাসি, কারণ তুমি আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু, মুরো, সত্যি কথাই বলল সুমা। সামুরাই বংশের লোক তুমি, জন্মসূত্রেই যোদ্ধা, হাতে কাতানা থাকলে একাই তুমি একশো।

কাতানা শুধুই একটা তলোয়ার নয়, তারচেয়ে বেশি কিছু সামুরাইদের সতেজ আত্মা, বলল কামাতোরি, গলার সুরে প্রগাঢ় শ্রদ্ধা। কাতানায় দক্ষ হওয়া মানে স্বর্গীয় পবিত্রতা অর্জন করা। সম্রাটের মর্যাদা ও নিরাপত্তার জন্যে কাতানা ব্যবহার করতে পারলে আমার আত্মা শান্তিময় আশ্রয় পাবে পবিত্র তীর্থ মন্দিরে।

 অথচ আমি বললে আমার জন্যেও হাতে কাতানা তুলে নেবে তুমি।

বন্ধুর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে মুরো কামাতোরি। তোমার নির্দেশে যে কোন লোককে আমি খুন করব, কারণ তুমি স্বজাতির জন্যে অনেক কিছু করেছ।

 ভাড়াটে খুনীর নিষ্প্রাণ চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকল সুমা। প্রাচীন সামন্ত প্রভুদের নির্দেশে হত্যাকাণ্ড ঘটানো ছিল সামুরাই যোদ্ধাদের পেশা, বিনিময়ে সামান্য কিছু সুবিধে ও নিরাপত্তা পেলেই খুশি থাকত। সুমা জানে, রাতারাতি আনুগত্য প্রত্যাহার করে নেয়াও সামুরাইদের একটা বৈশিষ্ট্য। কথা বলার সময় অস্বাভাবিক শান্ত শোনাল তার গলা, কিছু লোক শিকার করে তীর-ধনুক দিয়ে, বেশিরভাগই ব্যবহার করে আগ্নেয়াস্ত্র। একা শুধু তোমাকে আমি চিনি, মুরো, মানুষ শিকার করার খেলায় তুমি তলোয়ার ব্যবহার করো।

.

আপনাকে সুস্থ ও সতেজ দেখাচ্ছে, প্রাচীন বন্ধু, বলল সুমা, তোশি কুদোর পিছু পিছু কোরোরি ইয়োশিশুকে কামরায় ঢুকতে দেখেই। কোরারি ইয়োশিশুর সাথে ইচিরো সুবোইও রয়েছে, কংগ্রেশন্যাল সিলেক্ট সাব-কমিটির সাথে বিতর্কে অংশগ্রহণের পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে এসেছে সে।

 বৃদ্ধ ভদ্রলোক মৃদু হাসলেন। বাইরে থেকে সুস্থ ও সতেজ বলে মনে হলেও, আরও বুড়ো হয়ে গেছি আমি। আর খুব বেশি নতুন চাঁদ দেখার সুযোগ পাব না। শ্রদ্ধেয় পূর্ব-পুরুষদের সাথে মিলিত হবার একটা আকুলতাও অনুভব করছি।

কিন্তু আমরা জানি আরও একশো নতুন চাঁদ দেখার সুযোগ আপনি পাবেন।

 দাঁতহীন মাড়ি বের করে হাসলেন কোরোরি ইয়োশিশু। কামরা থেকে বেরিয়ে গিয়ে বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিল তোশি কুদো। ইচিরো সুবোইর সামনে দাঁড়িয়ে মাথা নত করল সুমা। তোমাকে দেখে আনন্দ লাগছে আমার, ইচিরো। শুনলাম আমেরিকানদের তুমি নাকি বিষম একটা ধাক্কা দিয়েছ।

তেমন নাটকীয় কিছু নয়, বলল ইচিরো সুবোই। তবে ওদের ক্যাপিটল বিল্ডিংয়ে দুএকটা ফাইল বোধহয় ধরাতে পেরেছি।

খুব কম লোকই জানে যে মাত্র চোদ্দ বছর বয়েসে গোল্ড ড্রাগন-এর সদস্য হয় ইচিরো সুবোই। কিশোর বালকটির ওপর নজর পড়ে কোরোরি ইয়োশিশুর, গুপ্ত সংগঠনের নীতিমালা মেনে চলার ব্যাপারে তার নিষ্ঠা ও আগ্রহ দেখে মুগ্ধ হন তিনি। ইয়োশিশু নিজে তাকে অর্থনীতি ও ব্যবসা শেখান। আজ কানোইয়া সিকিউরিটিজ-এর চীফ ডিরেক্টর হিসেবে ইচিরো সুবোই, সুমাও ইয়োশিশুর ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য পাহারা দেয়, পরামর্শ দেয় গোপন লেনদেন সম্পর্কে।

আমার বিশ্বস্ত বন্ধু, মুরো কামাতোরি, আশা করি নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার দরকার নেই, বলল সুমা।

যুবা বয়েসে আমি যেমন নাম করেছিলাম, তলোয়ার যুদ্ধে সে-ও তেমনি নাম করেছে, আমি জানি, বললেন কোরোরি ইয়োশিশু।

মাথা নত করার সময় কামাতোরির কোমর ভাঁজ হয়ে গেল। আমি জানি, কাতানায় আজও আপনি আমার চেয়ে ভাল।

 তোমার বাবাকে আমি চিনতাম, ভার্সিটিতে উনি তখন ফেনসিং মাস্টার ছিলেন, বললেন ইয়োশিশু। আমি ছিলাম তার সবচেয়ে বাজে ছাত্র। আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, একটা কামান কিনে আমি যেন জঙ্গলে হাতি মারতে যাই।

 বৃদ্ধ ইয়োশিশুর একটা হাত ধরল সুমা, চেয়ারগুলোর দিকে এগোল দুজন। জাপানের সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যক্তি ধীরপায়ে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে হাঁটছেন, তবে তাঁর মুখে স্থির হয়ে আছে পাথুরে হাসি, আর চোখ দুটোকে কিছুই ফাঁকি দিতে পারছে না।

পিঠ উঁচু একটা চেয়ারে বসলেন তিনি, মুখ তুলে সুমার দিকে তাকালেন, কোন ভূমিকায় না গিয়ে সরাসরি প্রসঙ্গে চলে এলেন। কেইটেন প্রজেক্টের কি অবস্থা?

খোলা সাগরে আঠারোটা বম্ব ভেহিকেল রয়েছে আমাদের। ওগুলোই শেষ। চারটের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। পাঁচটা যাবে রাশিয়ায়। বাকিগুলো ইউরোপ আর প্যাসিফিক রাষ্ট্রগুলোয়।

টার্গেটের কাছাকাছি কোন সময় পৌঁছুবে ওগুলো?

কমবেশি তিন হপ্তার মধ্যে। ইতোমধ্যে আমাদের কমান্ড সেন্টারের কমপিউটারের সাথে ডিফেন্স-ডিটেকশন ও ডিটোনেশন সিস্টেম সংযুক্ত করার কাজ শেষ হয়ে যাবে।

সুমার দিকে অবাক হয়ে তাকালেন ইয়োশিশু। ডিভাইন স্টারে সময়ের আগে বিস্ফোরণ ঘটায় প্রজেক্টের কোন ক্ষতি হয় নি? প্রজেক্টটা পিছিয়েও যায় নি?

ভাগ্য ভাল যে ঝড়ে, সংঘর্ষে বা অন্য কোন দুর্ঘটনায় একটা জাহাজ হারাতে হতে পারে, এ আমি ধরেই রেখেছিলাম। ছটা অতিরিক্ত ওয়ারহেড সরানো ছিল। বিস্ফোরণে যে তিনটে হারিয়েছি সেগুলো আবার জায়গা মত পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। গাড়িতে করে মেক্সিকোয় পাঠিয়ে দিয়েছি। ওখান থেকে টেক্সাস সীমান্ত পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকবে, পৌঁছে যাবে টার্গেট এরিয়ায়।

 বাকি তিনটে নিরাপদে রাখা হয়েছে, ধরে নিতে পারি?

একটা সারপ্লাস ট্যাংকারে। হোক্কাইডোর এক নির্জন সৈকত থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে নোঙর ফেলে আছে ওটা।

আমরা কি জানি, কি কারণে ডিভাইনস্টারে বিস্ফোরণ ঘটল?

সময়ের আগে এই বিস্ফোরণ কেন ঘটল, ব্যাখ্যা দেয়া সত্যি কঠিন, বলল সুমা। প্রতিটি ক্ষেত্রে সেফগার্ড-এর ব্যবস্থা ছিল। আমরা জানি, ঝড়ের মুখে পড়েছিল জাহাজটা। নিশ্চয়ই একটা গাড়ি প্রচণ্ড ঝাঁকি খায়, ফলে ক্ষতি হয় ওঅরহেড কন্টেইনারের। রেডিয়েশন লিক করে, ছড়িয়ে পড়ে কার্গো ডেকে। ক্রুরা আতঙ্কিত হয়ে জাহাজ ছেড়ে পালায়। পরিত্যক্ত ডিভাইন স্টারকে দেখতে পায় নরওয়ের একটা জাহাজ, তারা একটা বোর্ডিং পার্টি পাঠায়। এর কিছু পর ডিভাইন স্টার বিস্ফোরিত হয়।

আর ক্রুরা? জানতে চাইলেন ইয়োশিশু। ডিভাইন স্টার ছেড়ে যারা পালাল?

তাদের কোন হদিস পাওয়া যায় নি। ঝড়ের মধ্যে গায়েব হয়ে গেছে।

গোটা সিস্টেমে গাড়ির সংখ্যা মোট কত? বৃদ্ধ জানতে চাইলেন।

ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়াল সুমা। হাতে ধরা ছোট একটা কন্ট্রোল বক্স-এর বোতামে চাপ দিল। কামরার একদিকের দেয়াল সিলিংয়ের দিকে উঠে গেল, বেরিয়ে পড়ল বড় একটা ট্রান্সপারেন্ট স্ক্রীন। বক্সের আরেকটা বোতামে চাপ দিল সে, গোল পৃথিবীর হলোগ্রাফিক ইমেজ ফুটে উঠল, নিওনের মত রঙিন আলো মিটমিট করছে গায়ে। এরপর ডিটোনেশন সাইটগুলো দেখাবার জন্যে আরেকটা বোতাম টিপল সে, প্রায় বিশটা দেশের গায়ে সোনালি আলো জ্বলে উঠল। এরপর কোরোরি ইয়োশিশুর প্রশ্নের জবাব দিল সুমা। পনেরোটা দেশে একশো ত্রিশটা গাড়ি বোমা।

কোরোরি ইয়োশিশু কুদে আলোগুলোর দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে থাকলেন। গ্লোবটা ঘুরছে, তার সাথে ঘুরছে আলোগুলো। অন্য যে-কোন দেশের চেয়ে আলোর সংখ্যা রাশিয়ায় বেশি। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র জাপানের ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী, কিন্তু রাশিয়াকে ওরা জাপানের পরম শত্রু বলে মনে করে। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, কোন সামরিক স্থাপনা বা বড় কোন শহরকে টার্গেট করা হয় নি। আলো দেখা যাচ্ছে শুধু ফাঁকা ও কম জনবহুল এলাকাগুলোয়।

তোমার বাবার আত্মা তোমাকে নিয়ে গর্ব অনুভব করছেন, বললেন কোরোরি ইয়োশিশু, আবেগে কেঁপে গেল তাঁর গলা। তোমার প্রতিভাকে নমস্কার, দুনিয়ার বুকে অন্যতম সুপার পাওয়ার হতে যাচ্ছে জাপান। একবিংশ শতাব্দীতে দুনিয়া শাসন করবে নিপ্পন। আমেরিকা ও রাশিয়ার দিন শেষ।

সুমা খুশি। আপনার সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়া কোনদিনই কেইটেন প্রজেক্ট সফল হত না, প্রিয় প্রাচীন বন্ধু। টাকা বানানোর কারিগর বা জাদুকর ইচিরো সুবোইর অবদানও কম নয়।

গোপন নিউক্লিয়ার অস্ত্র বানাবার জন্যে ফান্ড সংগ্রহ করা, সত্যি বিরাট একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেয়, বলল ইচিরো সুবোই। তবে যার কাছে গেছি সে-ই আমাকে সাহায্য করেছে।

রুশ ও ওয়েস্টার্ন ইন্টেলিজেন্স জানে যে অ্যাটম বোমা বানাবার ক্যাপাসিটি আমাদের আছে, বলল মুরো কামাতোরি, আলোচনায় বাস্তবতার ছোঁয়া আনতে চাইছে সে।

 বিস্ফোরণের আগে যদি না-ও জানত, বলল সুমা, এখন তারা জানে। আমেরিকানরা তো কয়েক বছর ধরেই সন্দেহ করছে আমাদের। তবে আমাদের সিকিউরিটি রিঙ পেনিট্রেট করতে পারে নি ওরা, আমাদের ফ্যাসিলিটির সঠিক অবস্থান খুঁজে পায় নি।

তবে আমাদের ভুলে থাকা উচিত নয় যে রাশিয়া বা আমেরিকার চোখে এক সময় আমরা ঠিকই ধরা পড়ে যাব, গম্ভীর সুরে বললেন কোরোরি ইয়োশিশু।

আমাদের একজন এজেন্ট আমাকে জানিয়েছে, বলল কামাতোরি, ডিভাইন স্টারে বিস্ফোরণ ঘটার পর আমরা জড়িত কিনা জানার জন্যে গোপন তদন্ত শুরু করেছে আমেরিকানরা। গন্ধ শুঁকে এরই মধ্যে মুরমটো অটো ডিসট্রিবিউটরস-এ গিয়েছিল ওরা।

কোবোরি ইয়োশিশুর কপালের বলিরেখাগুলো কুঁচকে উঠল। আমেরিকান ইন্টেলিজেন্সকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। আমার ভয় হচ্ছে কেইটেন প্রজেক্ট না বানচাল হয়ে যায়।

আজকালকের মধ্যেই খবর পাব আমরা, কতটা কি জানে ওরা, বলল কামাতোরি। আমাদের এজেন্ট ওয়াশিংটন থেকে ফিরে এসেছে, তার সঙ্গে আমার দেখা হবে। সে দাবি করছে, তার কাছে লেটেস্ট ইনফরমেশন আছে।

ইয়োশিশুর কপালে দুশ্চিন্তার রেখাগুলো আরও গম্ভীর হলো। কমান্ড সেন্টার স্বংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠার আগে প্রজেক্টটা যদি কোন বিপদের মধ্যে পড়ে, আমাদের নতুন সাম্রাজ্যের স্বপ্ন চুরমার হয়ে যাবে।

আমি একমত, বলল ইচিরো সুবোই। আগামী তিন হপ্তা অরক্ষিত অবস্থায় থাকব আমরা। ওঅরহেডগুলো কোন কাজে আসবে না। কিছু যদি ফাঁস হয়ে যায়, পশ্চিমা দেশগুলো একযোগে চারদিক থেকে হামলা শুরু করবে অর্থনৈতিক, সামরিক, দুধরনেরই।

 অত চিন্তার কিছু নেই, আশ্বাস দিল সুমা। ওদের এজেন্ট আমাদের নিউক্লিয়ার উইপনস্ ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্ট যদি খুঁজে বের করেও ফেলে, কেইটেন প্রজেক্টের ব্রেন সেন্টার কোনদিনই খুঁজে পাবে না। একশো বছরেও নয়, তিন হপ্তার মধ্যে তো প্রশ্নই ওঠে না।

তাছাড়া, ওদের ভাগ্য যদি সুপ্রসন্নও হয়, বলল কামাতেরি, সময়মত ওটাকে নিউট্রালাইজ করা সম্ভব হবে না। ভেতরে ঢোকার পথ তো একটাই, সেটাকে স্টীল ব্যারিয়ার দিয়ে দুর্ভেদ্য দুর্গ বানিয়ে রাখা হয়েছে, পাহারায় আছে দক্ষ একদল সশস্ত্র সিকিউরিটি গার্ড। ওটাকে আমরা এমনভাবেই তৈরি করেছি, অ্যাটম বোমা আঘাত করলেও চালু রাখতে পারব।

সুমার ঠোঁটে টান টান হাসি ফুটল। সব কিছুই আমাদের অনুকূলে রয়েছে। সামান্য একটু বিপদের আঁচ পেয়ে বা যদি বুঝি যে শত্রুপক্ষ হামলা করতে যাচ্ছে, দুএটা গাড়ি-বোমা ফাটিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া যাবে।

ইচিরো সুবোই সন্তুষ্ট হতে পারল না। মিথ্যে হুমকি দিয়ে কি লাভ?

সুমার কথায় যুক্তি আছে, বলল কামাতোরি। শুধু আমরা এই কজন আর কমান্ড সেন্টারের এঞ্জিনিয়াররা জানি যে আমাদের সিস্টেমটা স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে তিন হপ্তা সময় লাগবে। পশ্চিমা নেতৃত্বকে সহজেই ধোঁকা দেয়া যাবে, ওরা জানবে সিস্টেমটা পুরাপুরি কাজ করছে।

কোরোরি ইয়োশিশু সন্তুষ্টচিত্তে মাথা ঝাঁকালেন। তাহলে ভয় পাবার কিছু নেই। আমাদের।

প্রায় এক মিনিট আর কেউ কিছু বলল না। তারপর ডেস্কের ইন্টারঅফিস ফোনটা বেজে উঠল। রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল সুমা। কথা না বলে শুনল শুধু, তারপর ক্রেডলে নামিয়ে রাখল রিসিভার। সেক্রেটারি জানাল, আমার প্রাইভেট ডাইনিংরুমে ডিনার দেয়া হচ্ছে। নিজেকে আমি অত্যন্ত সম্মানিত মনে করব, শ্রদ্ধেয় অতিথিরা যদি আমার সাথে খেতে বসেন।

ধীরে ধীরে দাঁড়ালেন কোরোরি ইয়োশিশু। আমি আনন্দের সাথে তোমার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম। তোমার শেফকে আমি চিনি, জাপানের সেরা শেফদের একজন। আমি আশা করছিলাম, তুমি আমাকে খেতে বলবে।

 আলোচনা শেষ করার আগে, বলল ইচিরো সুবোই, আমি একটা সমস্যার কথা বলতে চাই।

মাথা ঝাঁকাল সুমা। তোমাকে ফ্লোর দেয়া হলো, ইচিরো।

এ তো জানা কথা যে বৈরী কোন সরকার আমাদের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক বাধা সৃষ্টি করলে বা আমদানি শুল্ক বাড়ালে প্রতিশোধ হিসেবে প্রতিবার আমরা অ্যাটম বোমা ফাটাবার হুমকি দিতে পারব না। আরও হালকা কোন বিকল্প আমাদের থাকা উচিত বলে মনে করি আমি।

কামাতোরি ও সুমা দৃষ্টি বিনিময় করল। এ-ব্যাপারে যথেষ্ট চিন্তা ভাবনা করেছি আমরা, বলল সুমা, সমস্যার চমৎকার সমাধান হলো, কিডন্যাপিং। শত্রুদের কাউকে অপহরণ।

সন্ত্রাস আমাদের কালচারের একমাত্র বৈশিষ্ট্য নয়, প্রতিবাদের সুরে বলল ইচিরো সুবোই।

ব্লাড রেড ব্রাদারহুডকে কি বলো তুমি, বৎস? জানতে চাইলেন কোরোরি ইয়োশিশু।

উন্মাদ ফ্যানাটিকাল কসাই। ওরা নিরীহ মেয়ে মানুষ ও বাচ্চাদের কোন কারণ ছাড়াই খুন করে। যে আদর্শের কথা বলে, সাধারণ লোকের কাছে তার কোন অর্থ। নেই।

কিন্তু তারা জাপানি।

অল্প কিছু বেশিরভাগই জার্মানির লোক, কেজিবি ট্রেনিং দিয়েছে।

ওদেরকে ব্যবহার করা যেতে পারে, বলল সুমা, উৎসাহে চকচক করছে চোখ দুটো।

 আমি সাবধান করে দিচ্ছি, ওদের সাথে কোন রকম সম্পর্ক রাখা উচিত হবে না। ওদের সাথে সম্পর্ক আছে, এটা যদি কেউ সন্দেহও করে, বাইরে থেকে এমন সব নাজুক জায়গায় হামলা আসবে যে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা হবে আমাদের।

সুমা খুন-খারাবির কথা বলছে না, ব্যাখ্যা করল কামাতোরি। ওর প্রস্তাব হলো, অপহরণের পর জিম্মিকে আমরা অক্ষত ও সুস্থাবস্থায় রাখব, তবে অপহরণের জন্যে দায়ী করব ব্লড রেড ব্রাদারহুডকে।

 এতক্ষণে ব্যাপারটার তাৎপর্য ধরা পড়ল, হেসে উঠে বললেন বৃদ্ধ ইয়োশিশু। তোমরা আসলে সিল্কেন প্রিজন এর কথা বলছ।

মাথা নাড়ল ইচিরো সুবোই। জীবনে কখনও শুনি নি।

এটা আসলে আমাদের কালচারের পুরানো একটা ঐতিহ্য, বললেন ইয়োশিশু। যখন একজন শোগুন তার কোন শত্রুকে খুন করতে চাইছে না, তখন সে কি করে? শত্রুকে অপহরণ করে সে, গোপনে বন্দী করে রাখে বিলাসবহুল জীবনযাপন করতে দেয় শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে। তারপর অপহরণের জন্যে দায়ী করে বন্দীর ঈর্ষাকাতর কোন প্রতিদ্বন্দ্বীকে।

 ঠিক তাই, বলল সুমা। আজিমা দ্বীপে এ-ধরনের ফ্যাসিলিটি তৈরি করেছি আমি। ছোট, তবে আধুনিক একটা এস্টেট।

এর মধ্যে সামান্য ঝুঁকি রয়েছে না? জানতে চাইল সবুই ইচিরো।

 দ্য অবভিয়াস ইজ নেভার সাসপেক্টেড।

হাসিমুখে ইচিরোর দিকে তাকার কামাতোরি। কাকে বা কাদেরকে অপরহণ করা যেতে পারে, তুমি শুধু তাদের নামগুলো আমাকে জানালেই চলবে।

মাথা নিচু করে চিন্তা করল সবুই ইচিরো। তারপর মাথা উঁচু করে তাকাল সে। যুক্তরাষ্ট্রে দুজন মানুষ বড় বেশি বিরক্ত করছে আমাদের। কিন্তু অত্যন্ত সাবধানে কাজ করতে হবে তোমাকে। দুজনেই তারা কংগ্রেসের সদস্য। ওদেরকে কিডন্যাপ করা হলে মার্কিন মুলুকে বিরাট আলোড়ন উঠবে।

 দায়ী করা হবে ব্ল্যাড রেড ব্রাদারহুডকে। মোটা টাকা মুক্তিপণও চাইবে ওরা, বলল সুমা, যেন আবহাওয়ার সংবাদ দিচ্ছে।

আপনি ঠিক কাদের কথা বলছেন, ইচিরো সুবোই? জানতে চাইল কামাতোরি।

কংগ্রেস সদস্য লরেন স্মিথ আর সিনেটর মাইকেল ডিয়াজ।

মাথা ঝাঁকালেন কোরোরি ইয়োশিশু। ও, হ্যাঁ, ওরাই তো জাপানের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক অবরোধ সৃষ্টির সুপারিশ করছে।

আমাদের লবি যথেষ্ট শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও, সিনেট ও কংগ্রেসে আইন পাস করাবার মত ভোট ওরা পেয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। ওদের দুজনকে সরিয়ে আনতে পারলে এই উদ্যোগে ভাটা পড়বে।

 যুক্তরাষ্ট্র সরকার খেপে যাবে, সাবধান করল সুমা। হিতে বিপরীত হবে না তো?

কংগ্রেসে আমাদের লবির প্রভাব আছে, টেরোরিস্টদের ষড়যন্ত্র বলে সরকারের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানো কঠিন হবে না। সিলেক্ট সাব-কমিটি যে আচরণ করেছে তার সাথে, সে-কথা ভুলেনি ইচিরো সুবোই। মার্কিন রাজনীতিকদের দ্বারা কম অপমানিত হই নি আমরা। এবার এই শিক্ষাটা দেয়া উচিত যে নিজেদের শক্তি ওদেরকে রক্ষা করার জন্যে যথেষ্ট নয়।

 জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন কোরোরি ইয়োশিশু, কিন্তু কিছু দেখছেন বলে মনে হলো না। এক সময় মাথা নাড়লেন তিনি। করুণা হয়।

তার দিকে তাকাল সুমা। কার ওপর করুণা হয়, প্রাচীন বন্ধু?

ইউনাইটেড স্টেটস অভ আমেরিকার ওপর, নরম গলায় বললেন ইয়োশিশু। দেশটা সুন্দরী রমণীর মত, যে মারা যাচ্ছে ক্যান্সারে।

.

২৮.

মার্ভিন শওয়াল্টার নিজেদের দূতাবাস থেকে ট্রেনে চড়ে বাড়ি ফিরছেন। রোজকার মত আজও দুজন জাপানি এজেন্ট নজর রাখছে তার ওপর। সিট ছেড়ে দরজার দিকে এগোলেন তিনি, তারপর দরজা খোলার অপেক্ষায় আরোহীদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকলেন।

 দরজা খুলে গেল, আরোহীদের স্রোতটা নেমে এল প্ল্যাটফর্মে। নিচে নেমে দাঁড়িয়ে থাকলেন মার্ভিন শওয়াল্টার, এক দুই করে গুনতে শুরু করেছেন মনে মনে। পাশের একটা কমপার্টমেন্ট থেকে এজেন্ট দুজনও নেমেছে, ভিড়ের ভেতর দিয়ে এগিয়ে আসছে তারা। পঁচিশ পর্যন্ত গুনে হঠাৎ চরকির মত আধপাক ঘুরেই লাফ দিয়ে আবার ট্রেনে চড়লেন তিনি। দুসেকেন্ড পর বন্ধ হয়ে গেল দরজা, সেই সাথে চলতে শুরু করল ট্রেন। দেরি হয়ে গেছে, এজেন্ট দুজন আবার ট্রেনে ওঠার চেষ্টা করেও সফল হলো না। গতি বাড়ল ট্রেনের, ঢুকে পড়ল টানেলে।

পরবর্তী স্টেশনে ট্রেন বদল করলেন মার্ভিন শওয়াল্টার। এরপর নামলেন টোকিওর উত্তরপুর এলাকায়। জায়গাটার নাম শিটামাচি। শিটামাচি পুরানো টোকিওর অংশ, প্রাচীন অনেক নিদর্শন এখনও এদিকটায় দেখতে পাওয়া যায়।

 প্যাটফর্ম থেকে কাঁপাবাসি স্ট্রীটে বেরিয়ে এলেন মার্ভিন। ট্যাক্সি নিয়ে চলে এলেন শহরের মাঝখানে, নামলেন একটা জাপানি সরাইখানার সামনে। সরাইখানার নাম রায়ওকন।

বাইরে থেকে দেখে স্নান ও বিধ্বস্ত মনে হলেও, সরাইখানার ভেতরটা পরিচ্ছন্ন ও ছিমছাম। দোরগোড়াতেই একজন স্টাফের সঙ্গে দেখা হলো, মাথা নত করে বলল সে, রিজ-এর স্বাগত, পেশীবহুল দৈত্যই বলা যায় নোকটাকে।

আমার ধারণা ছিল এটা একটা গেইস্ট হাউস।

কথা না বলে পথ ছেড়ে দিল ডোরম্যান, রিসেপশনে ঢুকলেন মার্ভিন। ওক। কাঠের পালিশ করা মেঝে। দেয়াল ঘেঁষে সৌখিন বেতের চেয়ার। জুতো খুলে প্লাস্টিকের স্লিপার পরার অনুরোধ করা হলো তাকে। জাপানিদের পা ছোট, তাদের স্লিপারও ছোট, তবে এগুলো এমারসনের বড় আকারের পায়ে ঠিকমতই ফিট করল। তার ধারণা হলো, স্লিপারগুলো আমেরিকা থেকে আমদানি করা হয়েছে। তিনি জানেন, রায়ওকন-এর মালিক আসলে একটা মার্কিন ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি। এদের কাজ হলো, এজেন্টরা অন্যায় কিছু করে ধরা পড়তে যাচ্ছে দেখলে গোপনে ও নিরাপদে জাপান থেকে পালিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে দেয়া।

সরাইখানার ভেতরের একটা কামরায় নিয়ে আসা হলো মার্ভিনকে। ঘরের সাথে বারান্দা আছে, বারান্দার নিচে বাগান। কোন চেয়ার বা ফার্নিচার নেই, কার্পেটের ওপর আছে শুধু কুশন। একটা বিছানাও আছে একপাশে, বালিশবহুল। কামরার মাঝখানে একটা গর্তের ভেতর আগুন জ্বলছে, টকটকে লাল হয়ে আছে কয়লাগুলো। কাপড়চোপড় খুলে খাটো একটা আলখেল্লা পরলেন মার্ভিন। এরপর কিমানো পরা এক পরিচালিকা এসে সরাইখানার বারোয়ারি গোসলখানায় নিয়ে গেল তাকে। আলখেল্লা ও হাতঘড়ি খুলে একটা বেতের ঝুড়িতে রাখলেন মার্ভিন, কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে ঢুকে পড়লেন ঘেরা গোসলখানায়। প্রথমে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে ভিজলেন কিছুক্ষণ, তারপর ধূমায়িত বাথটাবে নামলেন। বাথটাব তো নয়, ছোটখাট একটা সুইমিং পুল বললেই চলে।

 একটা ছায়ামূর্তিকে আগেই দেখেছেন তিনি, বুক সমান পানিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মার্ভিনই প্রথম কথা বললেন, টিম হোন্ডা, ধরে নিচ্ছি।

মাত্র অর্ধেকটা, জবাব দিল রয় ওরশিয়া। জিম হানামুরা যে-কোন মুহূর্তে এসে পড়বে বলে আশা করছি। সাকি চলবে?

অপারেশনে রয়েছি, তবে ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছি। দিন।

পুলের কিনারা থেকে বোতলটা তুলে নিয়ে গ্লাসে সাকি ঢালল রয় ওরশিয়া। দূতাবাসের খবর কি?

ঠিকই আছে সব। গ্লাসটা নিয়ে চুমুক দিলেন মার্ভিন। ইনভেস্টিগেশন কেমন চলছে? টিম লিঙ্কনের কাছ থেকে যে সূত্র পাওয়া গিয়েছিল, সেটা কোন কাজে লাগল?

মুরমটো কোম্পানি ম্যানেজমেন্ট চেক করেছি আমি। করপরেট এক্সিকিউটিভ অফিসারদের সাথে ও অরহেডের সরাসরি কোন যোগাযোগ আছে বলে মনে হয় না। আমার ধারণা, ওরা কিছু জানে না।

কেউ না কেউ নিশ্চয়ই জানে।

নিঃশব্দে হাসল রয় ওরশিয়া। অ্যাসেম্বলি লাইন ওয়ার্কারদের মধ্যে মাত্র দুজনের জানার কথা।

মাত্র দুজন কেন?

 অ্যাসেম্বলি লাইন ওয়ার্কারদের মধ্যে একজন গাড়িতে এয়ারকন্ডিশনার বসানোর কাজ তদারক করে। তার যা পজিশন, ওয়ারহেড বসানোর জন্যে নির্দিষ্ট একটা গাড়ি বাছাই করার সুযোগ একমাত্র তারই আছে। দ্বিতীয় লোকটা হল ইন্সপেক্টর, যার কাজ ডিলারের কাছে গাড়িগুলো পাঠানোর আগে চেক করে দেখা ইউনিটটা ঠিকমত কাজ করছে কিনা। এয়ারকন্ডিশনার কাজ করছে না জানা সত্ত্বেও রিপোর্ট দেয়, সব ঠিক আছে।

তৃতীয় একজনও থাকার কথা, বললেন মার্ভিন শওয়াল্টার। কারখানার কমপিউটারাইজড শিপিং ডিপার্টমেন্টে। সে গাড়ি-বোমার সমস্ত চিহ্ন মুছে ফেলে। শুধু বিল অভ লেডিং ছাড়া, কারণ বিদেশী কাস্টমস অফিসারদের ওটা দেখাতে হবে।

সুতোটা ধরে এগোতে পেরেছেন কারখানা থেকে এয়ারকন্ডিশনার সাপ্লায়ার্স, ওখান থেকে বোমা তৈরির প্ল্যান্ট পর্যন্ত?

 সাপ্লয়ার্স পর্যন্ত এগোতে পেরেছি, তারপর সব চিহ্ন মুছে গেছে। তবে আশা করছি দুএকদিনের মধ্যে নতুন একটা সূত্র পাব।

 কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল ওরশিয়া, ড্রেসিং রুম থেকে এক লোককে বেরিয়ে আসতে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল সে। লোকটা মাঝারি আকৃতির, মাথায় রূপালি চুল, কোমরে শুধু একটা তোয়ালে।

হু দ্য হেল আর ইউ? জিজ্ঞেস করলেন মার্ভিন, ভয়ে নীল হয়ে গেছে চেহারা। তার ধারণা, রায়ওকনের সিকিউরিটি ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়েছে আগন্তুক।

আমার নাম আশিকাগা ইনশু।

কে?

কথা না বলে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকল লোকটা। দিশেহারা বোধ করলেন মার্ভিন, উদভ্রান্তের মত এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন, ভাবছেন আশপাশে সেন্ট্রিরা নেই কেন।

তারপর হাসতে শুরু করল ওরশিয়া। অদ্ভুত ছদ্মবেশ, জিম। দুজনকেই বোকা বানিয়েছ তুমি।

মাথা থেকে রূপালি উইগ নামাল জিম হানামুরা, নকল গোঁফটাও খুলে ফেলল। শুধু তোমাদেরকেই নয়, হিদেকি সুমা আর তার সেক্রেটারিকেও বোকা বানিয়েছি।

বড় করে শ্বাস নিয়ে গলা পর্যন্ত পানির তলায় নেমে গেলেন মার্ভিন। জেসাস, যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন না।

সাকির গন্ধটা দারুণ। আমার জন্যে খানিকটা আছে নাকি?

একটা গ্লাসে খানিকটা সাকি ঢালল ওরশিয়া। কিচেনে পুরো এক বাক্স আছে। পরমুহূর্তে তার চেহারায় বিস্ময় ফুটে উঠল। কি যেন বললেন, এই মাত্র?

কই?

 হিদেকি সুমা।

মুরমটো অটোমোটিভ, মুরমটো এয়ারক্রাফট করপোরেশন ইত্যাদি অনেকগুলো কোম্পানির আসল মালিক কে, আমি জানতে পেরেছি। সবই ধনকুবের হিদেকি সুমার। এ-সব কোম্পানির এক বালতি পানিতে কয়েকটা ফোঁটা মাত্র। গোটা ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্য, নেভাড়া ও আরিজোনা বিক্রি করলে যে টাকা পাওয়া যাবে তারচেয়ে অনেক বেশি টাকার মালিক এই লোক।

 তার মানে কি ডিভাইন স্টার, যে জাহাজটা বিস্ফোরিত হয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরে, ওটার মালিক সুমা?

অবশ্যই।

সুমা অত্যন্ত প্রভাবশালী লোক, বললেন মার্ভিন। বলা হয়, সে যদি জাপানের প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রিসভার কোন সদস্যকে বাহুতে ডানা লাগিয়ে বিশতলা বিল্ডিংয়ের মাথা থেকে লাফ দিতে বলে, কে কার আগে লাফ দেবে তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।

তুমি সত্যি সুমার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলে? হানামুরাককে প্রশ্ন করল ওরশিয়া।

কোন সমস্যাই হয় নি। অফিস আর তার সেক্রেটারি, দুটোই ভারি সুন্দর।

ছদ্মবেশ কেন?

টিম লিঙ্কনের আইডিয়া। ষোড়শ শতাব্দীর এক জাপানি আর্টিস্ট, নাম মাসাকি শিমজু, তাঁর পেইন্টিং সংগ্রহ করে সুমা। হোয়াইট হাউসের রেইমন্ড জর্ডান এক ওস্ত দি জালিয়াতকে ভাড়া করেন, নির্দেশ দেন শিমজুর অনাবিস্কৃত একটা পেইন্টিং আঁকতে, যেটা সুমার কালেকশনে নেই। আশিকাগা ইনশু হলেন দুর্লভ ও হারানো শিল্প খুঁজে বের করায় অভিজ্ঞ এক লোক। তাঁর ছদ্মবেশ নিয়ে যাই আমি, সুমার কাছে বিক্রি করি ছবিটা।

মাথা ঝাঁকালেন মার্ভিন। দারুণ। সত্যি দারুণ। জাপানি আর্ট সম্পর্কে নিশ্চয়ই আপনাকে পড়াশোনা করতে হয়েছে?

 সংক্ষিপ্ত। হেসে উঠল হানামুরা। সুমা আমাকে ব্যাখ্যা করল, শিমজু কিভাবে বেলুনে চড়ে দ্বীপের ছবি আঁকলেন। যদি জানত যে স্যাটেলাইট ফটো দেখে আমার ছবিটা আঁকা হয়েছে, নিশ্চয়ই পানিতে চুবিয়ে মারত আমাকে।

কিন্তু লাভটা কি হলো? জিজ্ঞেস করল ওরশিয়া, টান টান হয়ে আছে মুখের চামড়া।

তার অফিসে এখন ছারপোকা আছে।

কিন্তু এ-সব আমি কেন জানি না?

একজন কি করছে অপরজন তা জানতে পারবে না, এটা আমার সিদ্ধান্ত, বললেন শাভিন। ফলে কেউ ধরা পড়লে খুব বেশি তথ্য ফাস করতে পারবে না।

ছারপোকা কোথায় রেখে এসেছ? হানামুরাকে জিজ্ঞেস করল ওরশিয়া।

পেইন্টিংয়ের ফ্রেমে দুটো। জানালার সামনে দাঁড় করানো ইজেলে একটা। আরেকটা পর্দার হাতলে। শেষ দুটো একটা রিলে ট্রান্সমিটারের সাথে সম্পর্ক রাখবে, গম্বুজের বাইরে একটা গাছের ডালে বেঁধে রেখে এসেছি ওটাকে।

কিন্তু যদি ছারপাকা ধরার গোপন যন্ত্র থাকে সুমার?

 তার ফ্লোরের ইলেকট্রিক্যাল ব্লুপ্রিন্ট জোড়াড় করেছি আমি। ডিটেকশন ইকুইপমেন্টগুলো প্রথম শ্রেণীর, তবু আমাদের ছারপোকার অস্তিত্ব খুঁজে বের করতে পারবে না।

কেন পারবে না?

আমাদের মিনিয়েচার রিসিভিং ও সেণ্ডিং ইউনিট দেখতে খুদে ইলেকট্রনিক বস্তুর মত নয়, ওগুলো জ্যান্ত পিঁপড়ের মত দেখতে। চোখে পড়লে হয় অগ্রাহ্য করা হবে, নয়তো পিষে মেরে ফেলা হবে।

মাথা ঝাঁকালেন মার্ভিন। বাহ।

রিলে ট্রান্সমিটারটা গলফ বল আকৃতির। সমস্ত আলোচনা রিলে করবে ওটা। টেলিফোন বা ইন্টারকমে যা বলা হবে, তা-ও আমরা শুনতে পাব, আমাদের একা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। স্যাটেলাইট থেকে আওয়াজগুলো সরাসরি চলে যাবে মেল পেনারের কাছে অর্থাৎ টিম ক্রাইসলারের কাছে। ওরা পালাউ-এ আছে।

 আমরা নিশ্চিতভাবে জানি, সুমার কথাবার্তা ওরা শুনতে পাচ্ছে কিনা? পানির ওপর চোখ রেখে জানতে চাইল ওরশিয়া।

 সিস্টেমটা চমৎকার কাজ করছে, মার্ভিন আশ্বাস দিয়ে বললেন। এখানে আমার আগে মেল পেনারের সাথে কথা হয়েছে আমার। পরিষ্কার সিগন্যাল পাচ্ছেন তিনি। পাচ্ছি আমরাও আমার টিমের এক লোক ছারপোকার দিকে কান পেতে আছে।

কোন তথ্য যদি আমাদের তদন্তে কাজে লাগে, জানাতে দেরি করবেন না।

অবশ্যই দেরি করব না, বললেন মার্ভিন। দুঃখের বিষয় হলো, সুমা আর কোরোরি ইয়োশিশুর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটা আলোচনা হচ্ছিল, এই সময় দূতাবাস থেকে বেরিয়ে আমি আমি। মাত্র দুমিনিট শোনার সুযোগ হয়েছে আমার।

 ইয়োশিশু, কোরোরি ইয়োশিশু, বিড়বিড় করল রয় ওরশিয়া। গুড গড, বুড়ো শয়তানটা আজও তাহলে বেঁচে আছে।

.

ভোর হতে আর ঘণ্টাখানেক বাকি, একটা মুরমটো লিমোজিন এসে থামল গাঢ় ছায়ার ভেতর। আসাকুসার সরু রাস্তা ধরে ধীরগতিতে আবার এগোল গাড়িটা।

 মি. সুমার অফিসে আড়িপাতা যন্ত্র ফিট করা হয়েছে, বলল রয় ওরশিয়া। আমাদের একজন এজেন্ট আর্ট ডিলারের ছদ্মবেশে ভেতরে ঢুকেছিল। একটা পেইন্টিংয়ের ফ্রেমে, ইজেলে আর পর্দার হাতলে আছে ওগুলো।

 তুমি ঠিক জানো? জানতে চাইল মুরো কামাতোরি, হতভম্ব হয়ে গেছে সে। ডিলার লোকটা আসল একটা শিমজু নিয়ে এসেছিল।

আসল নয়। স্যাটেলাইট ফটো দেখে নকল করা হয়েছে।

হিস হিস করে উঠল কামাতোরি, আমাকে আরও আগে জানানো উচিত ছিল তোমার।

 আমি নিজেই জানতে পেরেছি মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে।

কথা না বলে আধো ছায়া আধো অন্ধকারে রয় ওরশিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল কামাতোরি, যেন তার ওপর বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে।

রয় ওরশিয়া একজন ইন্টেলিজেন্স স্লিপার, জাপানি মা-বাবার ঘরে আমেরিকায় জন্ম, সিআইএ-তে চাকরি পাবার জন্যে ছোটবেলা থেকে ট্রেনিং দেয়া হয়েছে। তাকে।

অবশেষে কামাতোরি বলল, আজ বিকেলে অনেক কথাই আলোচনা হয়েছে, সে-সব জানাজানি হয়ে গেলে মি. সুমার বিরাট ক্ষতি হবে। তুমি নিশ্চিত, কোথাও কোন ভুল হচ্ছে না?

আর্ট ডিলার কি নাম বলল তার? আশিকাগা ইনশু?

শিউরে উঠল কামাতোরি, নিজেকে অপরাধী মনে হলো তার। সুমার অর্গানাইজেশনে কেউ যাতে নাক গলাতে না পারে সেটা সেটাই তার কাজ। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে সে। হ্যাঁ, ইনশু।

তার আসল নাম জিম হানামুরা। আমার টিমের দ্বিতীয় লোক সে। তার কাজ নিউক্লিয়ার গাড়িবোমার উৎস খুঁজে বের করা।

গাড়ির সাথে ও অরহেডের সম্পর্ক আছে, এই রহস্য ভেদ করল কে?

 ডার্ক পিট নামের এক অ্যামেচার। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল আন্ডারওয়াটার অ্যান্ড মেরিন এজেন্সির লোক সে।

সে কি আমাদের জন্যে বিপজ্জনক?

আমি নিশ্চিত নই। সে এখনো অফিশিয়ালি আমাদের পিছনে নেই। কিন্তু উদ্ভট প্রচুর জিনিস আবিষ্কার করেছে সে।

সীটে হেলান দিল কামাতোরি, জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। কিছুক্ষণ পর ওরশিয়ারের দিকে ফিরল সে। তুমি যে-সব এজেন্টদের সাথে কাজ করছ তাদের নামের একটা তালিকা দিতে পারো আমাকে? কে কি করছে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ সহ?

মাথা ঝাঁকাল ওরশিয়া। নামগুলো দেয়া যাবে। তৎপরতা, সম্ভব নয়। সবাই আমরা আলাদাভাবে কাজ করছি। কেউ কারও সম্পর্কে কিছু জানি না।

ঠিক আছে, যখন যতটা পারো জানিয়ে আমাকে।

 পিটের ব্যাপারে কি করবে বলে ভাবছ?

ওরশিয়ার দিকে ঠাণ্ডা চোখে তাকাল কামাতোরি। প্রথম সুযোগেই মেরে ফেলতে হবে।

.

২৯.

 সবগুলোই ক্লাসিক অ্যান্টিকস কার, কোনটার বয়সই ষাট-সত্তরের কম নয়। লক্ষ্য করার মত বিষয় হলো, গাড়িগুলোর মালিকরাও প্রায় সবাই পৌঢ় বা বৃদ্ধ, যুবকদের সংখ্যা খুবই কম। পুরানো গাড়ি সংগ্রহ খরচবহুল হবি, এ ধরনের শখ মেটাবার সামর্থ্য যুবক বয়সে খুব কম লোকেরই হয়। সব মিলিয়ে প্রায় একশোর মতো গাড়ি এসেছে মাঠে, দর্শকের সংখ্যা কয়েক হাজার। পিটের স্টাজকে দাঁড় করানো হয়েছে উনিশশো ছাব্বিশ সালে ফ্রান্সে তৈরি একটা হিসপানো-সুইজার পাশে। প্রতিবার দুটো করে গাড়ি প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে। বিচার করে পরীক্ষা করে ঠিক করবেন কোন দুটো গাড়ি পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতা করবে।

পিটের দুপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে লরেন স্মিথ ও অ্যাল জিওর্দিনো। মাথা চুলকে অ্যাল বলল, রেস শুরু হতে মনে হচ্ছে দেরি আছে, কিন্তু আমার যে খিদে পেয়েছে।

হেসে উঠে স্টাজের ব্যাক সিট থেকে পিকনিক বাস্কেটটা নামাল লরেন।

ঘাসের ওপরই বসে পড়ল তিনজন। ওরা খাচ্ছে, দুজন বিচারক এসে পিটের স্টাজ ও পাশের গাড়িটা পরীক্ষা করলেন। স্টাজের সিগারেট লাইটার ঠিকমত কাজ করছে না, এগজস্ট সিস্টেম মূল ডিজাইনের সাথে মিলছে না, এসব কারণে তিন পয়েন্ট কাটা গেল। পয়েন্ট কাটা যাবার অর্থ হলো, প্রতিযোগিতায় জিতলেও টাকা কিছু কম পাবে বিজয়ী। হিসপানো-সুইজার সাথেই প্রতিযোগিতা করতে হবে স্টাজকে, সিদ্ধান্ত দিলেন বিচারকরা।

জিতবে তো? জানতে চাইল অ্যাল।

বলা কঠিন, জবাব দিল পিট। ওটার চেয়ে আমার গাড়ির বয়স ছয় বছর কম, তবে হিসপানোর এঞ্জিনটা বড়, শরীরটা হালকা। কি হয় বলা যায় না।

আপনিই জিতবেন, ওদের কাছে এসে দাঁড়ালেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো।

মাইনিং এঞ্জিনিয়ারের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল পিট। হঠাৎ কোত্থেকে উদয় হলেন আপনি? জানতে চাইল ও।

কানে এল, এখানে আপনাকে পাওয়া যাবে, সহাস্যে বললেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। ভাবলাম আপনার গাড়িটাও দেখা হবে, মি. অ্যাল জিওর্দিনোর সাথে কথাও বলা যাবে, তাই চলে এলাম?

কোথাও ডাক পড়েছে নাকি? জানতে চাইল পিট।

এখুনি নয়।

লরেন স্মিথের সাথে ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসোর পরিচয় করিয়ে দিল পিট। হাসিমুখে ম্যানকিউসোর হাতে এক গ্লাস বিয়ার ধরিয়ে দিল লরেন। ইতোমধ্যে খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়েছে ওদের, লরেনের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে মাঠের ওপর হাঁটতে শুরু করল তিনজন। কি ঘটছে? ধৈর্য হারিয়ে জিজ্ঞেস করল অ্যাল।

 অ্যাডমিরাল স্যানডেকার সম্ভবত আপনাদেরকে জানাবেন। টিম মার্সিডিজকে কে আপাতত কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গাড়ি-বোমা বহন করছিল যে জাহাজটা, সেটার অবশিষ্ট কিছু পাওয়া যায় কিনা খোঁজ করার কাজটা ও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

কারণ?

প্রেসিডেন্ট ভাবছেন, আপাতত ব্যাপারটা বেশি নাড়াচাড়া না করাই ভাল। চারদিকে নানান সমস্যা। রুশ রাজনীতিকরা এরই মধ্যে অভিযোগ করছেন, বিস্ফোরণের জন্যে আমেরিকাই দায়ী। আন্ডার কবার স্যালভেজ অপারেশন চালু রাখা হলে, রাশিয়াকে একটা ব্যাখ্যা দিতে হবে, প্রেসিডেন্ট সে ধরনের ঝামেলায় যেতে চাইছেন না। তাছাড়া, প্রশান্ত মহাসাগরের তলায় নুমা কি করছিল, এটা তিনি গোপন রাখতে চান। সাগরের মেঝেতে মাইনিং অপারেশন পরিচালনা করা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।

হুম। ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসোর দিকে তাকাল পিট। ওয়ারহেডসহ কয়টা গাড়ি পাওয়া গেছে?

এখন পর্যন্ত শুধু আপনার ছয়টা। ওয়েস্ট কোস্টে স্টেসি ফক্স ও ড. টিমোথি ওয়েদারহিল কতদূর কি করতে পেরেছেন এখনও কোন রিপোর্ট আসেনি।

জাপানিরা নিশ্চয়ই গোটা আমেরিকার সবখানে ছড়িয়ে রেখেছে ওগুলো, বলল পিট। সবগুলো খুঁজে বের করতে হলে রেই হবে।

 লোকবল কোন সমস্যা নয়। সমস্যা হলো, জাপানিদের কোণঠাসা না করে কাজটা সারতে হবে। তারা যদি দেখে তাদের নিউক্লিয়ার প্রজেক্ট হুমকির মুখে পড়ছে, অস্থির হয়ে দুএকটা ম্যানুয়ালি ফাটিয়ে দিতে পারে।

 খুব ভাল হত যদি চীম টিম হোন্ডা লোকেশন-এর একটা ম্যাপ যোগাড় করতে পারত, শান্ত গলায় বলল অ্যাল।

সে চেষ্টাই করছে ওরা, জানালেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো।

 আপাতত আমরা তাহলে কানে আঙুল ঢুকিয়ে বসে থাকব? পিট গম্ভীর।

এত হতাশ হবার কিছু নেই, ডার্ক। সবগুলো টিম মিলে গত আটচল্লিশ ঘণ্টায় যা করেছে, আপনারা প্রথম চার ঘণ্টায় তার চেয়ে অনেক বেশি করেছেন। সময় হলে আপনাদের ডাকা হবে।

কিছু ঘটার অপেক্ষায় অন্ধকারে বসে থাকতে আমার ভাল লাগে না, বলল পিট।

ভিড়ের মধ্যে চারজনের দলটাকে সম্পূর্ণ বেমানান লাগল। ক্লাসিক গাড়ির মালিক বা দর্শকরা সাধারণ শাট ট্রাউজার পরে এসেছে, তাদের মধ্যে গাঢ় রঙের স্যুট পরা একদল বেঁটেখাটো শক্ত-সমর্থ জাপানিকে হাতে অ্যাটাচি কেস নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে দেখলে অবাক হবারই কথা। লোকের গাড়িগুলো খুঁটিয়ে দেখছে, খসখস করে নিজেদের ভাষায় কি যেন লিখছে নোটবুকে, ভাবটা যেন টোকিওর গাড়ি সংগ্রাহকদের প্রতিনিধি তারা। যতটা না বিস্মিত হচ্ছে লোকজন, তারচেয়ে বেশি কৌতুক বোধ করছে। ওরা যে আসলে ভাড়াটে টেরোরিস্ট, বুঝতে পারছে না কেউ। চারটে অ্যাটাচি কেসে ঠাসা রয়েছে গ্যাস গ্রেনেড ও অ্যাসল্ট উইপনস। ক্লাসিক গাড়ির রেস দেখতে নয়, তারা এসেছে লরেন স্মিথকে অপহরণ করতে।

 সশস্ত্র সিকিউরিটি গার্ডরা কে কোথায় আছে, ভাল করে দেখে নিল ওদের লীডার। আগেই লক্ষ্য করেছে, পিটের স্টাজ মাঠের প্রায় মাঝখানে দাঁড়িয়ে। ভিড়ের মধ্যে থেকে লরেন স্মিথকে কিডন্যাপ করা সম্ভব নয়, ধরা পড়ে যেতে হবে। কাজেই অনুকূল পরিবেশের জন্যে অপেক্ষায় থাকতে হবে ওদেরকে। রাস্তার কিনারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ওদের লিমুসিন, তিনজনকে গাড়িতে ফিরে যেতে বলল লীডার। ভিড়ের মধ্যে একা থাকল সে, লরেনের ওপর নজর রাখছে। দূর থেকে পিট, অ্যাল ও ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসোর দিকেও নজর রাখছে সে। তার মনে হলো, তিনজনের একজনের কাছেও কোন আগ্নেয়াস্ত্র নেই।

একজন রেস স্টুয়ার্ড এসে জানাল, স্টাজ নিয়ে স্টাটিং লাইনে দাঁড়াতে হবে পিটকে। দল বেঁধে, হৈ-চৈ করতে করতে এগোল ওদের পুরো দলটা। গাড়ির হুড তুলে শেষবারের মত এঞ্জিনটা চেক করে নিল অ্যাল, পাশে দাঁড়িয়ে ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো সাহায্য করলেন তাকে। পিটকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে শুভ কামনার চিহ্নস্বরূপ চুমো খেল লরেন, তারপর ছুটে চলে এল ট্র্যাক-এর পাশে, নিচু একটা পাঁচিলের উপর বসল পা ঝুলিয়ে। ইতোমধ্যে হিসপানো-সুইজার মালিক ক্লাইভ কিউমন্ট-এর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে পিটের। করমর্দন করে যে যার গাড়িতে উঠে বসল ওরা।

 স্টিয়ারিং হুইলের পিছনে বসে ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেল ও ড্যাশবোর্ডের ওপর চোখ বুলাল পিট, তারপর মুখ তুলে তাকাল অফিশিয়াল স্টার্টার-এর দিকে। লোকটা ধীরে ধীরে সবুজ পতাকাটার ভাঁজ খুলছে। কংক্রিটের সেফটি ওয়াল-এর কাছাকাছি, লরেনের ঠিক সামনে, একটা নিমুসিন এসে দাঁড়িয়েছে, দেখতে পেল না ও। দেখতে পেল না এক লোক গাড়িটা থেকে নেমে এগিয়ে এল, কথা বলছে লরেনের সাথে।

এখনও স্টাজ-এর এঞ্জিন পরীক্ষা করছে অ্যাল। একা শুধু ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো দেখলেন, জাপানি লোকটার উদ্দেশ্যে ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকাল লরেন, পাঁচিল থেকে নেমে তার সাথে হেঁটে গেল লিমুসিনের দিকে, উঠে বসল গাড়িতে।

হুডটা নামাল অ্যাল, পিটের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলল, নো অয়েল অর ওয়াটার রিকস। তবে খুব বেশি খাঁটিও না বেচারিকে। এঞ্জিনকে আমরা নতুন করে তৈরি করলেও, বুড়ির বয়েস ষাট বছরের ওপর।

ঠিক আছে, ঠিক আছে, বলল পিট, হঠাৎ খেয়াল করল আশপাশে কোথাও লরেনকে দেখা যাচ্ছে না। লরেন কোথায়? জানতে চাইল ও।

দরজার দিকে ঝুঁকে ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো হাত তুলে সাদা লিংকনটাকে দেখালেন। ওই লিমোর এক জাপানি ভদ্রলোক তার সাথে কথা বলছেন। সম্ভবত কোন লবিষ্ট হবেন।

রেস বাদ দিয়ে কথা বলতে চলে গেল?

আমি তার ওপর নজর রাখছি, বললেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো।

স্টার্টার দুই গাড়ির মাঝখানে দাঁড়িয়ে পতাকাটা মাথার উপর তুলল। অ্যাল আর ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো সরে এলেন তাড়াতাড়ি। পতাকা নেমে এল, সেই সাথে ছুটল গাড়ি দুটো।

প্রথমেই হিসপানো-সুইজাকে পিছনে ফেলে দিল স্টাজ। রাস্তাটা সোজা প্রায় এক হাজার গজ লম্বা, তারপর বাঁক নিয়ে চলে গেছে উত্তর দিকে। গাছপালা বা বাড়িঘর নেই, মাঠ থেকে উত্তর দিকের দুমাইল রাস্তা পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। আবার বাঁক নিয়ে তির্যকভাবে স্টার্টিং পয়েন্টে ফিরে এসেছে রাস্তাটা। পুরোটা রাস্তার দুপাশে হালকা ভিড়, হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে ড্রাইভারদের। উত্তরের রাস্তায় একবার সামনে থাকল স্টাজ, একবার হিসপানো। রাস্তাটার শেষ অংশে দুটো গাড়ি একই সাথে, পাশাপাশি ছুটল। তির্যক রাস্তায় ওঠার পর, মাঝামাঝি জায়গায়, স্টাজকে ছাড়িয়ে কয়েক হাত সামনে চলে এল হিসপানো। স্টাটিং পয়েন্ট আর মাত্র কয়েক শো গজ দূরে, এখনও এগিয়ে আছেন ক্লাইভ বিউমন্ট। বোঝাই যাচ্ছে ফলাফল কি হবে। স্টাজের চেয়ে এক কি দেড় সেকেন্ড আগে ফিনিশিং লাইন স্পর্শ করবে হিসপানো।

আর মাত্র পঞ্চাশ গজ বাকি, এই সময় একটা ঝাঁকি খেয়ে বেড়ে গেল স্টাজের গতি। হিসপানো ছুটছে ফুল স্পীডে, স্পীড আর বাড়ানোর কোন সুযোগ নেই। শেষ মুহূর্তের জন্যে এঞ্জিনের খানিকটা শক্তি রিজার্ভ রেখেছিল পিট, এবার সেটা কজে লাগাচ্ছে। ঘণ্টায় আশি মাইল স্পীডে ছুটছিল ওর গাড়ি, সেটা বেড়ে নব্বইয়ে উঠে গেল।

ফিনিশিং লাইন স্পর্শ করল দুটো গাড়ি, মনে হলো একসাথে। কিন্তু না, আধ হাত এগিয়ে ছিল স্টাজ, টিভির বিরাট স্ক্রীনে তাই দেখা গেল। নিয়ম হলো, বিজয়ী ড্রাইভার মাঠটাকে এক চক্কর ঘুরে স্টার্টিং লাইনে ফিরে, কিন্তু অ্যাল আর ম্যানকিউসো পিটকে সে সুযোগ দিল না। স্টাজের সামনে দাঁড়িয়ে উন্মাদের মত হাত নাড়ছে তারা, অগত্যা বাধ্য হয়ে ব্রেক কষতে হলো পিটকে। ও লক্ষ্য করছে, হাত বাড়িয়ে সাদা লিমুসিনটাকে দেখাচ্ছেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো।

গাড়ি থামিয়ে জানালা দিয়ে মাথা বের করল পিট। লরেন?

স্টাজও চলছে, লাফ দিয়ে রানিং বোর্ডে উঠে পড়ল অ্যাল। হা! আমার ধারণা, লিমুসিনের জাপানিরা তাকে কিডন্যাপ করেছে।

ছুটে এলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো, হাঁপাচ্ছেন। গাড়ি নিয়ে চলে গেল ওরা, বুঝতে পারিনি মিস লরেন ওটায় আছেন।

আপনার কাছে অস্ত্র আছে? জানতে চাইল পিট।

হোলস্টারে একটা কোল্ট অটো আছে, পঁচিশ ক্যালিবারের।

উঠে পড়ুন। নির্দেশ দিল পিট, তাকাল অ্যালের দিকে। তুমি একজন গার্ডের রেডিও চেয়ে নিয়ে পুলিশে খবর দাও। আমরা ধাওয়া করছি।

মাথা ঝাঁকিয়ে গার্ডের খোঁজে ছুটল অ্যাল। স্পীড বাড়িয়ে মাঠ থেকে পূর্ব দিকের রাস্তায় উঠে এল পিট। মান্ধাতা আমলের একটা গাড়ি নিয়ে আধুনিক মডেলের একটা লিমুসিনকে ধাওয়া করে কোন লাভ নেই, জানে ও। তবু চেষ্টা করে দেখতে হবে ওকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *