১০. দুই ঢেউয়ের মাঝখানে

১০.

দুই ঢেউয়ের মাঝখানে, পানি ফুঁড়ে বেরিয়ে এল প্রথম সাবমারসিবল। আকাশ স্বচ্ছ নীল, সাগর প্রায় শান্ত। ঢেউগুলো খুব বেশি হলে এক মিটারের মত উঁচু। হ্যাঁচ খুলে গোলকার টাওয়ারের উঠল অ্যাল। ভেবেছিল খালি সাগর দেখতে পাবে কিন্তু চারদিকে তাকাতে গিয়ে বিস্ময় ও আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে গেল তার চোখ।

চল্লিশ মিটার দূরে একটা জাহাজ, সরাসরি ভাসমান সাবমারসিবলের দিকে এগিয়ে আসছে। বো-র ওপর চারকোণা ডেক, পিছনটা গোল মতো ও উঁচু, দেখেই বোঝা যায় ওটা একটা চাইনিজ জাহাজ। বো-তে একটা চোখ আঁকা, অ্যালের দিকে নিস্পলকে তাকিয়ে আছে।

টাওয়ারের উপর থেকে নিচের দিকে তাকাল অ্যাল, চিৎকার করল, এভরিবডি আউট! জলদি, জলদি।

 ঢেউয়ের মাথায় উঠল খুদে সাবমারসিবল, জাহাজের দুজন ক্রু দেখতে পেল ওটাকে। চিৎকার জুড়ে দিল তারা, হেলমসম্যানকে স্টারবোর্ডের দিকে গুঁড়িয়ে নিতে বলছে জাহাজ। কিন্তু মাঝখানের ব্যবধান কমে গেছে। চকচকে খোল সদ্য পানিতে লাফিয়ে পড়া প্যাসেঞ্জারদের ওপর চড়াও হলো। জাহাজের ক্রুরা রেইলিঙে দাঁড়িয়ে আছে, যেন পাথরের মূর্তি। কারও মনে কোন সন্দেহ নেই, জাহাজের বো ধাক্কা দিয়ে সাবমারসিবলটাকে ডুবিয়ে দেবে এখুনি।

 শেষ লোকটা লাফ দিয়ে পানিতে পড়ল, এবার অ্যালের পালা। ঢেউয়ের মাথায় চড়ে জাহাজের বো ওপরে উঠল, তারপর নেমে এল সরাসরি সাবের গায়ে। সংঘর্ষের ফলে যে প্রচণ্ড কোন আওয়াজ হলো, তা নয়। প্রায় কোন শব্দই হলো না। সাবটা এই ছিল, এখন নেই। দেরিতে হলেও, জাহাজের হেলমসম্যান ক্রুদের চিৎকার শুনতে পেয়েছে। সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব নয়, বুঝতে পেরে জাহাজ থামাবার চেষ্টা করছে সে। ক্রুরাও বসে নেই, পালগুলো নামিয়ে ফেলছে তারা। আবার চালু হলো জাহাজের এঞ্জিন, রেইলিং থেকে পানিতে ফেলা হলো লাইফ রিঙ।

 অল্পের জন্যে রক্ষা পেল অ্যাল, ছিটকে দূরে না পড়লে জাহাজের খোলে বাড়ি খেত। নাক দিয়ে নোনা পানি ঢুকল, খক খক করে কাশছে সে। কয়েকটা মাথা ঢেউয়ের মাথায় ডুবছে আর ভাসছে। গুণে দেখল, ছয়টা। আশ্চর্য, জাহাজ চড়াও হলেও, কেউ তেমন মারাত্মকভাবে আহত হয়নি। সবাই লাইফ রিঙ ধরার জন্যে সাঁতার দিচ্ছে।

পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে চাইনিজ জাহাজ। নামটা পড়ল অ্যাল, সাংহাই শেলি। ভাগ্যকে ধিক্কার দিল সে বন্ধুকে ফিরিয়ে আনার কোন সুযোগই আর থাকল না।

না, একটা উপায় আছে। দ্বিতীয় সাবটা নিয়ে নামতে হবে তাকে।

তবে আগের কাজ আগে। চারদিকে তাকাল সে, চিৎকার করল, কেউ আহত হলে হাত তোলো!

তরুণ এক জিওলজিস্ট একা হাত তুলল। আমার একটা গোড়ালি মচকে গেছে।

ধীর ধীরে ঘুরে ফিরে এল জাহাজ, স্থির হলো ওদের দশ মিটার দূরে। রেইলিং থেকে নিচের দিকে ঝুঁকে পড়লেন পৌঢ় এক ভদ্রলোক।

কেউ আহত হয়েছেন? চিৎকার করলেন। আমরা কি বোট নামাব?

গ্যাংওয়ে নামান, নির্দেশ দিল অ্যাল। আপনাদের জাহাজে চড়ব আমরা। তারপর বলল, চারদিকে নজর রাখুন। নিচে থেকে আমাদের আরও একটা সাব উঠে আসছে।

শুনতে পেয়েছি।

পাঁচ মিনিট পর, একজন বাদে প্রথম সাবের সব কয়জন ক্রু সাংহাই শেলির ডেকে দাঁড়িয়ে আছে, একা শুধু তরুণ জিওলজিস্টকে জালে আটকে জাহাজে তোলার পর সিক-বেতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পৌঢ় লোকটা এগিয়ে এসে অ্যালের সামনে দাঁড়ারেন। গড, সত্যি আমরা দুঃখিত। একেবারে শেষ মুহূর্তে আপনাদের আমরা দেখতে পাই।

আপনাদের দোষ নয়। আমরা আপনাদের খোলের নিচে পড়ে গিয়েছিলাম।

কেউ নিখোঁজ হয়েছে?

ভাগ্যকে ধন্যবাদ, না।

ঈশ্বর মহান। তবে আজকের দিনটাই বিদঘুটে। এখান থেকে আঠারো-বিশ কিলোমিটার দূরে আরেক ভদ্রলোককে জাহাজে তুলেছি আমরা। তাঁর অবস্থা ভাল নয়। নাম বলছেন জিমি নক্স। উনি আপনাদের কেউ?

না, বলল অ্যাল। আপনাদের বাকি সবাই দ্বিতীয় একটা সাবমারসিবলে রয়েছে।

ক্রুদের নির্দেশ দিয়েছি, তারা যেন চোখ মেলে থাকে। খোলা সাগরের উপর চোখ বুলালেন পৌঢ়। আপনারা এলেন কোত্থেকে?

পরে ব্যাখ্যা করব। আপনাদের রেডিওটা কি ব্যবহার করতে পারি?

অবশ্যই। ভাল কথা, আমি ওয়েন মারফি।

অ্যাল জিওর্দিনো।

কোয়ার্টার ডেকের একটা বড় কেবিন দেখিয়ে পৌঢ় বললেন, ওদিকে চলে যান মি. জিওর্দিনো। আপনি রেডিওতে কথা বলুন, ইতোমধ্যে আপনার লোকদের শুকনো কাপড়ের ব্যবস্থা করি আমি।

 অসংখ্য ধন্যবাদ, তাড়াতাড়ি কেবিনটার দিকে এগোল অ্যাল। সাগরের তলায় আটকা পড়ে আছে পিট ও মি, প্লাঙ্কেট, দৃশ্যটা কল্পনা করে শিউরে উঠল সে।

নুমার দ্বিতীয় সাবমারসিবল সাংহাই শেলির আধ কিলোমিটার দূরে ভেসে উঠল। পানিতে না ভিজে জাহাজে উঠতে পারল ক্রুরা।

পরিস্থিতি সম্পর্কে অ্যাডমিরাল স্যানডেকারকে একটা ধারণা দিয়ে আগেই ডেকে বেরিয়ে এসেছে অ্যাল, ফ্লাইং বোটে চড়ে রওনা হয়ে গেল সাবমারসিবলের উদ্দেশ্যে। সাব থেকে অর্ধেকটা বেরিয়ে আছে ডেভ, তার উদ্দেশ্যে চিৎকার করল অ্যাল, স্ট্যান্ড বাই! ওটাকে আমি নিচে নিয়ে যেতে চাই।

মাথা নাড়ল ডেভ। সম্ভব নয়। ব্যাটারি কেসিং-এর লিক দেখা দিয়েছে। চারটে ব্যাটারি শেষ। আরেকটা ডাইভ দেয়ার মত শক্তি নেই।

হতাশায় মুষড়ে পড়ল অ্যাল, রেইলিং ঘুসি মারল সে। নুমার বিজ্ঞানী ও এঞ্জিনিয়ার, স্টেসি ও ড. স্যালাজার, এমন কি সাংহাই শেলির ক্রুরাও বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল তার দিকে।

নট ফেয়ার, বিড়বিড় করছে অ্যাল। নট ফেয়ার।

অনেকক্ষণ ওখানেই, একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকল অ্যাল, তাকিয়ে আছে সাগরের দিকে, যেন পানির তলায় কি ঘটছে দেখার চেষ্টা করছে। আকাশে অ্যাডমিরাল স্যানডেকারের এয়ারক্রাফট উদয় হলো, চক্কর দিচ্ছে সাংহাই শেলিকে ঘিরে, তখনও রেইলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে অ্যাল।

.

কোন রকম জ্ঞান আছে জিমি নক্সে, কেবিনে ঢুকল ড. স্যালাজার ও স্টেসি। বেডের পাশে এক ভদ্রলোক বসে আছেন চেয়ারে, ওদেরকে দেখে দাঁড়ালেন তিনি। হ্যালো, আমি হ্যারি ডিয়ারফিল্ড। আপনারা কি মি. জিমি নক্সেকে চেনেন?

আমরা বন্ধু, একই ব্রিটিশ সার্ভে শিপের সহকর্মী, জবাব দিলেন ড. স্যালাজার। কেমন আছেন উনি?

সুস্থ হতে সময় নেবেন, বললেন হ্যারি ডিয়ারফিল্ড। এখন বিশ্রাম নিচ্ছেন।

আপনি কি ডাক্তার।

পিডিঅ্যাট্রিকস, আসলে। ছয় সপ্তার ছুটি নিয়ে ওয়েনকে সাহায্য করছি এই ভয়েজে। জিমি নক্সের দিকে ফিরলেন তিনি। মি. নক্স, আপনার বন্ধুরা আপনাকে দেখতে এসেছেন।

চোখ না খুলে একটা হাত তুলে একবার আঙুল নাড়লেন জিমি নক্স। তার মুখ ফুলে আছে, কয়েক জায়গায় আঁচড়ের দাগ। ধীরে ধীরে চোখ মেললেন তিনি। ড. স্যালাজার ও স্টেসিকে চিনতে পেরে উজ্জ্বল হয়ে উঠল চোখ দুটো। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আপনারা নিরাপদে আছেন। ভাবিনি আবার আপনাদের দেখতে পাব। সেই উন্মাদ ভদ্রলোক…মি. প্লাঙ্কেট কোথায়?

 তিনি একটু পরই আসছেন, বলল স্টেসি, ড. স্যালাজারকে চুপ থাকার ইঙ্গিত করল। কি ঘটেছিল, জিমি? আমাদের ইনভিনসিবল কোথায়?

 দুর্বল ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন জিমি নক্স। জানি না। কোন এক ধরনের বিস্ফোরণ ঘটেছিল। আপনাদের সাথে আন্ডারওয়াটার ফোনে কথা বলছিলাম, হঠাৎ ভেঙে চুরমার হয়ে গেল গোটা জাহাজ, আগুন ধরে গেল চারদিকে। কোন রকমে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ি, চোখের সামনে ডুবে গেল জাহাজ…।

ডুবে গেল? বিড়বিড় করল স্টেসি, মেনে নিতে পারছে না। ইনভিনসিবল ডুবে গেছে, আমাদের ক্রুরা সবাই মারা গেছে?

কতক্ষণ ভেসে ছিলাম বলতে পারব না, ওয়েন মারফির ক্রুরা আমাকে দেখতে পেয়ে তুলে আনে। আশপাশে সার্চ করে ওরা, কিন্তু আর কাউকে পায়নি।

কিন্তু আমরা যখন ডাইভ দেই, কাছাকাছি আরও দুটো জাহাজ ছিল! বলল স্টেসি। সেগুলো গেল কোথায়?

 কোথাও দেখিনি। বোধহয় ওগুলোও তলিয়ে গেছে, ফিসফিস করে বললেন জিমি নক্স, মনে হলো যে-কোন মুহূর্তে আবার জ্ঞান হারাবেন। ইচ্ছাশক্তি আছে, কিন্তু শরীরে বল নেই। চোখ বন্ধ করলেন তিনি, মাথাটা এদিকে কাত হয়ে পড়ল।

ডাক্তার হ্যারি ডিয়ারফিল্ড ইঙ্গিতে দরজাটা দেখিয়ে দিলেন ওদেরকে। আপনারা পরে কথা বলবেন, ওঁর এখন বিশ্রাম দরকার।

 ওর সমস্যাটা কি? জানতে চাইলেন ড. স্যালাজার।

এক্স-রে ছাড়াই বলছি, পাঁজরের দুতিনটে হাড় ভেঙেছে। এ ধরনের আঘাতের চিকিৎসা আমার জানা আছে। কিন্তু…,

কিন্তু?

কিন্তু বাকি সব লক্ষণগুলো অদ্ভুত, জাহাজডুবি থেকে বাঁচা কোন মানুষের মধ্যে দেখা যায় না।

কি বলছেন, কিছুই তো বুঝতে পারছি না! তীক্ষ্ণকণ্ঠে বললেন ড. স্যালাজার।

 জ্বর, লো ব্লাড প্রেশার, ইরাইথেমা, স্টমাক ক্র্যাম্প, অদ্ভুত ধরনের ফোঁসকা।

কারণ?

কাঁধ ঝাঁকালেন ডাক্তার হ্যারি ডিয়ারফিল্ড। আমার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার বাইরে। এ বিষয়ে মেডিকেল জার্নালে দু একটা আর্টিকেল পড়েছি শুধু। তবে একথা বললে ভুল হবে না যে মি. জিমি নক্সের সিরিয়াস লক্ষণগুলোর কারণ হলো রেডিয়েশন।

এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল স্টেসি, তারপর জানতে চাইল, নিউক্লিয়ার রেডিয়েশন?

মাথা ঝাঁকালেন ডাক্তার হ্যারি ডিয়ারফিল্ড। আমার তাই বিশ্বাস।

তাহলে ওঁকে বাঁচার উপায়?

এখানে চিকিৎসার সুবিধে নেই বললেই চলে। আমি এসেছি ডেক হ্যান্ড হিসেবে। আমার ব্যাগে শুধু ট্যাবলেট, অ্যান্টিসেপটিক ও ব্যান্ডেজ আছে। একটু থেমে আবার বললেন, আমরা তীরের আরও কাছাকাছি না পৌঁছলে ওঁকে হেলিকপ্টারে ভোলাও সম্ভব নয়। তারপরও আমার সন্দেহ আছে, থেরাপিউটিক ট্রিটমেন্টের সাহায্যে ওঁকে বাঁচানো যাবে কিনা।

 শালাদের ফাঁসি দাও! হঠাৎ গর্জে উঠলেন জিমি নক্স, চমকে উঠে সবাই তাঁর দিকে তাকাল। ভদ্রলোকের চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে আছে, সামনে দাঁড়ানো লোকজনকে ভেদ করে দৃষ্টি চলে গেছে বাঙ্কহেড ফুড়ে দূরে কোথাও। শালাদের ফাঁসিতে ঝোলাও।

তাঁকে অমন করতে দেখে ভয় পেল স্টেসি। নিজের জায়গা ছেড়ে নড়তে পারল না। বিছানার দিকে ছুটে এলেন ড. স্যালাজার ও হ্যারি ডিয়ারফিল্ড। বিছানার উপর ছটফট করছেন জিমি নক্স, ব্যর্থ চেষ্টা করছেন উঠে বসার।

 বেজন্মা কুত্তাগুলোকে খতম করো! হিংস্র আক্রোশে বারবার গর্জন করছেন। তিনি, কাদের যেন অভিশাপ দিচ্ছেন। আবার ওরা খুন করবে! শালাদের ফাঁসি দাও।

 একটা ইঞ্জেকশন দেয়ার চেষ্টা করলেন হ্যারি ডিয়ারফিল্ড, কিন্তু তার আগেই জিমি নক্সের শরীর আড়ষ্ট হয়ে গেল। মুহূর্তের জন্যে চকচকে হয়ে উঠল চোখ দুটো, তারপর কুয়াশার মত মিহি একটা পর্দা পড়ল। বিছানার উপর নেতিয়ে পড়লেন তিনি। অসাড় হয়ে গেল শরীর।

 বুকে চাপ দিয়ে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের সাহায্যে জিমি নষ্মে দম ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হলো। কিন্তু কোন লাভ হলো না। এক সময় ঘর্মাক্ত হ্যারি ডিয়ারফিল্ড জানালেন, ভদ্রলোক মারা গেছেন।

যেন সম্মোহিত, কেবিন থেকে বেরিয়ে এল ওরা। স্টেসি নিঃশব্দে কাঁদছে, ড. স্যালাজার গম্ভীর ও বিষণ্ণ।

কিছু সময় পর, চোখ মুছে স্টেসি বললো, উনি কিছু একটা দেখেছিলেন।

তার দিকে তাকায় স্যালাজার। কি দেখেছিলেন?

কোনো এক অসাধারণ উপায়ে তিনি জানতেন, খোলা দরোজা দিয়ে নিথর দেহটার দিকে তাকিয়ে থাকে স্টেসি। মৃত্যুর কিছুসময় আগে জিমি বুঝতে পেরেছিলো এই ধ্বংসলীলা আর মৃত্যুর জন্যে কারা দায়ী।

.

১১.

 লাল চুল খুলি কামড়ে আছে, তার ওপর পানামা স্ট্র, হ্যাঁ। নীল গলফ শার্ট, তার সাথে ম্যাচ করা প্যান্ট পরেছেন ভদ্রলোক। একহারা গড়ন, তলোয়ারের মত খাড়া ও ঋজু। বয়েস হয়েছে, বৃদ্ধই বলা যায়, তবে আসলে তিনি চির তরুণ। সাংহাই শেলির গ্যাংওয়ের ওপর দিয়ে একটা দমকা বাতাসের মত উঠে এলেন, মুখের চুরুটটা থেকে আগুনের ফুলকি ছুটছে চারদিকে। নাটকীয় উদয় বা আবির্ভাবের জন্যে অস্কার দেয়ার প্রচলন থাকলে, কোন সন্দেহ নেই, ন্যাশনাল আন্ডারওয়াটার অ্যান্ড মেরিন এজেন্সির ডিরেক্টর অ্যাডমিরাল স্যানডেকার প্রথম পুরস্কারটি ঠিকই ছিনিয়ে নিতেন। প্লেনে থাকতেই অ্যালের কাছ থেকে দুঃসংবাদটা পেয়েছেন তিনি, কাজেই থমথম করছে তার চেহারা। সাংহাই শেলির ডেকে পা দিয়েই ফ্লাইং বোট এর পাইলটের উদ্দেশ্যে একটা হাত তুললেন, পাইলটও সাড়া দিয়ে হাত নাড়ল। বাতাসের দিকে ঘুরে ছুটল এয়ারক্রাফট, ঢেউয়ের মাথায় বাড়ি খেল বার কয়েক, তারপর শূন্যে উঠে পড়ল। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে হাওয়াইয়ান দ্বীপগুলোর দিকে চলে যাচ্ছে।

 অ্যাল সামনে বাড়ল, সাথে ওয়েন মারফি অর্থাৎ সাংহাই শেলির মালিকও। রয়েছেন। মালিকের দিকেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন অ্যাডমিরাল। হ্যালো, ওয়েন। ভাবিনি এখানে তোমার সাথে দেখা হবে আমার।

ঠোঁটে মৃদু হাসি, অ্যাডমিরালের সাথে করমর্দন করলেন ওয়েন মারফি। আমারও তো সেই কথা, জেমস। তোমাকে দেখে ভারি খুশি লাগছে আমার। ইঙ্গিতে নুমার টিমটাকে দেখালেন তিনি, ওদেরকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে সবাই, এবার হয়তো কেউ আমাকে জানাবে কাল আলো ও বজ্রপাতের যে প্রদর্শনীটা দেখলাম, আসলে সেটা কি ছিল কারাই বা দায়ী। আরও জানতে পারব, এরা সবাই সাগরের মাঝখানে হাবুডুবু খাচ্ছিল কেন।

সরাসরি জবাব দিলেন না, অ্যাডমিরাল। ডেকের চারদিকে তাক আনা পালগুলো দেখলেন। এটা আসলে কি দেখছি আমরা?

এটা একটা চাইনিজ জাংক, শখ করে বানিয়েছি। হংকং থেকে হনলুলু যাচ্ছি আমরা, ওখান থেকে যাব সান ডিয়াগো।

 পরস্পরকে আপনারা চেনেন? অবশেষে জানতে চাইল অ্যাল।

মাথা ঝাঁকালেন অ্যাডমিরাল স্যানডেকার। নেভিতে একই সাথে নাম লেখাই আমরা, কিন্তু পরে রিজাইন করে ও। ইলেকট্রনিকস্-এর ব্যবসা করে প্রচুর কামিয়েছে, ইউএস ট্রেজারিতে যত টাকা আছে, তারচেয়ে বেশি আছে ওয়েন মারফির কাছে।

বাড়িয়ে বলার দোষটা তোমার এখনও তাহলে আছে! লাজুক হাসি দেখা গেল ওয়েন মারফির ঠোঁটে।

হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠলেন অ্যাডমিরাল। বেস-এর শেষ খবর কি, অ্যাল?

 ওটা বোধহয় হারিয়েছি আমরা, শান্তস্বরে জবাব দিল অ্যাল। আমাদের অবশিষ্ট সাব থেকে আন্ডারওয়াটার টেলিফোনে সাড়া পাবার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিছু শোনা যায়নি। হ্যারিসের ধারণা, বেস থেকে আমরা বেরিয়ে আসার একটু পরই প্রচণ্ড শক ওয়েভ আঘাত করেছিল। আপনাকে আমি আগেই জানিয়েছি, সাব দুটোয় আমাদের সবার জায়গা হয়নি। পিট ও ব্রিটিশ মেরিন সায়েন্টিস্ট ভদ্রলোক স্বেচ্ছায় নিচে থাকার সিদ্ধান্ত নেন।

ওদেরকে বাঁচানোর জন্যে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে?

 মাথা নিচু করল অ্যাল। দুঃখিত, অ্যাডমিরাল করার মত কিছু নেই আমাদের।

 কে আমার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে? অ্যাল? অ্যাল জিওর্দিনো? ডার্ক পিটের ঘনিষ্ঠ বন্ধু? প্রচন্ড গর্জে উঠলেন অ্যাডমিরাল, অ্যাল? সে-ই তুমি ওকে সাগরের সাড়ে পাঁচ হাজার মিটার নিচে রেখে এসে বলছ, ওকে উদ্ধার করার জন্যে কিছুই তোমার করার নেই? কেন, তুমি না বললে ব্যাকআপ সাবমারসিবল নিয়ে ফিরে যাবে?

বলেছিলাম ডেভ বাতিল ব্যাটারি নিয়ে উঠে আসার আগে। প্রথমটা ডুবে গেছে, দ্বিতীয়টা অচল, এখন আপনিই বলুন কি করার আছে আমাদের।

 অ্যাডমিরাল চেহারা নরম হলো। মাথা থেকে পানামা স্ট্র হ্যাঁ নামিয়ে পায়চারি শুরু করলেন তিনি। পিটকে তিনি আপন সন্তানের মত ভালবাসেন। অ্যালের সামনে দাঁড়ালেন একবার। ব্যাটারি মেরামত করা যায় না?

ইঙ্গিতে সাবমারসিবলটা দেখার অ্যাল, বিশ মিটার দূরে ঢেউয়ের মাথায় দুলছে।চেষ্টার কোন ত্রুটি করছে না ডেভ, তবে আশা না করাই ভাল।

 কেউ যদি দায়ী হয় তো আমি, মন খারাপ করে বললেন ওয়েন মারফি।

 অ্যাাল বলল, আমার ধারণা, এখনও বেঁচে আছে পিট। সহজে মরার লোক নয় সে।

 তার দিকে কটমট করে তাকালেন অ্যাডমিরাল, মাথার চুলে আঙুল চালাচ্ছেন।

অ্যাল বলল, এখানে যদি আমরা আরেকটা সাব আনতে পারি…।

ডীপ কোয়েস্ট দশ হাজার মিটার নিচে নামতে পারে, বললেন অ্যাডমিরাল, রেইলিঙের সামনে চলে এলেন। লস অ্যাঞ্জেলস হারবারে আমাদের ডকে রয়েছে ওটা। হাতঘড়ির ওপর চোখ বুলালেন। নিয়ে আসতে আট ঘণ্টার মত লাগবে।

কিভাবে আনবে? জানতে চাইলেন ওয়েন মারফি।

এয়ার ফোর্স সি-ফাইভে করে।

তুমি বলছ, একটা বারো টন সাবমারসিবলকে এরোপ্লেন বা হেলিকপ্টার থেকে পানিতে নামাবে?

তাছাড়া উপায় কি! বোটে করে আনতে এক সপ্তাহ লেগে যাবে।

তবু তোমাদের একটা সাপোর্ট শিপ লাগবে বলে মনে হয়, বললেন ওয়েন। তুমি চাইলে আমাদের সাংহাই শেলিকে কাজে লাগাতে পারো।

বন্ধুর কাঁধে একটা হাত রাখলেন অ্যাডমিরাল। তোমার জাহাজটাকে যদি ফ্লিট কমান্ড শিপ হিসেবে কাজে লাগানো যায়, ভারি উপকার হবে। নুমার তরফ থেকে অসংখ্য ধন্যবাদ, ওয়েন।

ফ্লিট? তার মানে?

কেন, জানো না ইউএস নেভির অর্ধেক জাহাজ চারদিক থেকে ছুটে আসছে এদিকে? জানতে চাইলেন অ্যাডমিরাল, যেন ধরেই নিয়েছেন, রেইমন্ড জর্ডান গোপনে তাঁকে যে ব্রিফ করেছেন সে কথা কারও অজানা নেই। এই মুহূর্তে যদি এখানে ওদের একটা নিউক্লিয়ার সাবমেরিন মাথা তোলে, একটুও অবাক হব না। বিশ কিলোমিটার দূরে রয়েছে অ্যাটাক সাবমেরিন টাকসন। পানির চারশো মিটার নিচে দিয়ে ছুটে আসছে সাংহাই শেলির দিকে। সাবমেরিনের কমান্ডার, বিউ মরটন পার্ল হারবারে থাকার সময় নির্দেশ পেয়েছেন, বিস্ফোরণ এলাকায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছতে হবে তাকে। ওখানে পৌঁছে আন্ডারওয়াটার রেডিওলজিক্যাল কনটামিনেশন সম্পর্কে পরীক্ষা চালাতে হবে, ভাসমান কোন আবর্জনা থাকলে নিরাপদে তুলে নিতে হবে সাবমেরিনে। একটা বাল্কহেডের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন বিউ মরটন, এক হাতে খালি একটা কাপ, তাকিয়ে আছেন ন্যাভাল রেডিওলজিক্যাল ডিফেন্স ল্যাবরেটরির কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার স্যাম হাউজারের দিকে। নেভির বিজ্ঞানী ভদ্রলোকে বিউ মরটনের উপস্থিত সম্পর্কে সচেতন বলে মনে হল না। নিজের কাজে মগ্ন তিনি। সাবমেরিনের পিছনে লেজের মত লম্বা হয়ে আছে যন্ত্রপাতি ঠাসা একাধিক প্রোব, রেডিও-কেমিক্যাল ইনস্ট্রমেন্ট ও কমপিউটারের সাহায্যে ছবিটা ও গামা-র মাত্রা ও ঘনত্ব মনিটর করছেন তিনি।

আমরা কি এখনও অন্ধকারে? জানতে চাইলেন বিউ মরটন।

রেডিওঅ্যাকটিভিটি কোথাও বেশি, কোথাও কম ডিসট্রিবিউট করা হয়েছে, বললেন স্যাম হাউজার। তবে ম্যাক্সিমাম পারমিসিবল এক্সপোজার এর যথেষ্ট নিচে। হেভিয়েস্ট কনসেনট্রেশন উপর দিকে।

সারফেস ডিটোনেশন?

 হ্যাঁ-জাহাজ, সাবমেরিন নয়। বাতাসই বেশিরভাগ দূষিত হয়েছে।

আমাদের উত্তরে যে চীনা জাহাজটা রয়েছে, ওটার কোন ক্ষতি হবে না তো?

মাথা নাড়লেন স্যাম হাউজার। অনেকটা দূরে রয়েছে ওরা, বাতাসের উল্টোদিকে। সামান্য একটু ছোঁয়া পাবে মাত্র।

কিন্তু এই মুহূর্তে বিস্ফোরণ এলাকার দিকে ভেসে আসছে যে?

 বিস্ফোরণের আগে ও পরে প্রবল বাতাস ছিল, সাগরও ছিল অশান্ত, বললেন হাউজার। বেশিরভাগ রেডিয়েশন পূর্ব দিকে আকাশে উঠে গেছে। কমপার্টমেন্টের ফোনটা পিপ-পিপ করে উঠল। রিসিভার তুলে কানে ঠেকালেন তিনি। ইয়েস?

ক্যাপটেন কি ওখানে আছেন, স্যার?

রিসিভারটা বিউ মরটনের হাতে ধরিয়ে দিলেন হাউজার।

দিস ইজ দ্যা ক্যাপটেন।

স্যার, সোনারম্যান কাইজার। অদ্ভুত একটা কনট্যাক্ট, স্যার। আপনার শোনা উচিত।

 এখুনি আসছি, বলে রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন বিউ মরটন।

 সোনারম্যানকে পাওয়া গেল তার কনসোলের কাছে, কানে এয়ারফোন আটকে কি যেন শুনছে, কুঁচকে আছে ভুরু জোড়া। বিউ মরটনের এক্সিকিউটিভ অফিসার, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার তার দিকে একজোড়া স্পেয়ার ফোন বাড়িয়ে ধরলেন। তাড়াতাড়ি সেটা কানে আটকালেন তিনি। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করলেন, কিন্তু কিছুই শুনতে পেলেন না। কোথায় কন্ট্রাক্ট?

সাথে সাথে জবাব না দিয়ে আরও কয়েক সেকেন্ড শোনার চেষ্টা করল সোনারম্যান কাইজার, তারপর বাম কান থেকে এয়ারফোন নামিয়ে বলল, আশ্চর্য ব্যাপার।

আশ্চর্য? কি আশ্চর্য?

 দাঁড়ান, স্যার প্লীজ! স্পিকারটা অন করি।

অদ্ভুত যোগাযোগের কথা এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে সাবমেরিনের সবখানে, সোনার এনক্লোজারের ভেতর অফিসারদের ভিড় কমে গেল। স্পিকার অন করা হতেই শোনা গেল আওয়াজটা। অস্পষ্ট, তবে দুর্বোধ নয়। কারা যেন কোরাস গাইছে।

অ্যান্ড এভরি নাইট হোয়েন দ্য স্টারফিশ কেইম আউট,
আই উড হাগ অ্যান্ড কিস হার সো।
 ওহ, হোয়াট আ টাইম আই হ্যাড উইথ মিনি দ্য মারমেইড
ডাউন ইন হার সীমী বাংলো।

 নিশ্চয় সাংহাই শেলি থেকে আসছে। বললেন বিউ মরটন।

না, স্যার। কোন জাহাজ বা কোন সারফেস ভেসেল থেকে আসছে না।

আরেকটা সাবমেরিন থেকে? রাশিয়ান নাকি?

 মাথা নাড়লেন ফাৎসিও। না। এদিকে রাশিয়ানদের কোন সাবমেরিন নেই।

 রেঞ্জ? বিয়ারিং? জানতে চাইলেন বিউ মরটন।

 ইতস্তত করছে সোনারম্যান কাইজার। যেন বাচ্চা একটা ছেলে বিপদে পড়েছে, ভয় পাচ্ছে সত্যি কথা বলতে। হরাইজেন্টাল কমপাস বিয়ারিং নেই, স্যার। কোরাসটা ভেসে আসছে সাগরের তলা থেকে, সোজা পাঁচ হাজার মিটার নিচ থেকে।

.

১২.

 গিরিখাদের তলায়, যেখানে একসময় নুমার মাইনিং স্টেশন ছিল, পলি ও পাথর ধসে ঢাকা পড়ে গেছে। এবড়োখেড়ড়া, উঁচু-নিচু একটা প্রান্তরে পরিণত হয়েছে। জায়গাটা, বোল্ডার স্তূপগুলোকে ঘিরে ভেসে বেড়াচ্ছে মিহি পলির মেঘ। ভূমিকম্পের কাঁপন ও গর্জন থেকে যাবার পর মৃত্যুপুরীর নিস্তব্ধতা নেমে আসার কথা, কিন্তু তা নামেনি, সাগরের অতল গহবরে ভেসে বেড়াচ্ছে একটা গানের আওয়াজ।

শব্দের উৎস সন্ধানে কেউ যদি জঞ্জাল ভর্তি প্রান্তরের ওপর দিয়ে এই মুহূর্তে হাঁটে, নিঃসঙ্গ একটি অ্যান্টেনা শ্রাফট দেখতে পারে বসে বাঁকা ও মোচড়ানো, মাথাচাড়া দিয়ে আছে কাদার ওপর। একটা লালচে-খয়েরি র‍্যাটফিশ দুএক মুহূর্তের জন্যে পরীক্ষা করল অ্যান্টেনাটা, তারপর উৎসাহ হারিয়ে চোখা লেজ নেড়ে দূরে সরে গেল।

একটু পর অ্যান্টেনা থেকে কয়েক মিটার দূরে নড়ে উঠল পলিমাটির স্তূপ, শুরু হলো একটা ঘূর্ণি, ক্রমশ আকারে বড় হচ্ছে, ভেতর থেকে ছড়িয়ে পড়ছে একা আলো। আলোর ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে এল একটা যান্ত্রিক হাত, চ্যাপ্টা কোদাল আকৃতির, হাতলের কাছটা গিটসর্বস্ব। যান্ত্রিক হাতটা শিকারী কুকুরের মত সিধে হলো, তারপর যেন শিকারের সন্ধানে বাতাস শুঁকতে শুঁকতে চারদিকে তাকাল।

 তারপর কোদালটা বাঁকা হয়ে নিচের দিকে ঝুঁকল, গভীর একটা ট্রেঞ্চ কুঁড়ছে। ট্রেঞ্চের গা ঢালু হয়ে নেমে গেছে নিচের দিকে। খোঁড়ার কাজ তখনও শেষ হয়নি, বড় একটা বোল্ডার বাধা হয়ে দাঁড়াল কোদালের তুলনায় বোল্ডারটা বড়। কোদালের পাশে চলে এল বিশাল একটা ধাতব থাবা। থাবার আঙ্কটাগুলো মোন পাখির বাঁকা নখের মত, চারদিক থেকে আঁকড়ে ধরল বোল্ডারটাকে, কাদা থেকে তুলে ফেলল টান দিয়ে, ফেলে দিল ট্রেঞ্চের বাইরে অনেকটা দূরে। আবার নিজের জায়গায় সরে গেল থাবা, নিজের কাজ শুরু করল কোদাল।

নাইস ওঅর্ক, ডার্ক, চীফ এঞ্জিনিয়ার প্লাঙ্কেট বললেন, পরম স্তস্তিতে নিঃশব্দে হাসছেন। লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে বিকেলের চা খাওয়ার আগেই বাড়িতে পৌঁছে যাব।

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রযেছে পিট, গভীর মনোযোগের সাথে তাকিয়ে আছে টিভি মনিটরের দিকে।এখনও আমরা রাস্তায় পড়িনি।

আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, কার কতিত্ব? ভাগ্যের, নাকি প্রতিভার? আমি বলব, প্রতিভার। ভূমিকম্পের মূল ধাক্কাটা লাগার আগেই আমরা আপনার একটা ডীপ সী মাইনিং ভেসেলে ঢুকে পড়ি, তারপর টুকি এয়ার প্রেশার লকে। মাত্র কয়েক সেকেন্ড দেরি করলে এ যাত্রা আর বাঁচতে হত না।

ভাগ্যের কৃতিত্ব হচ্ছে, এয়ার-লকের দেয়াল টিকে গেছে, ভেঙে পড়েনি, বিড়বিড় করে বলল পিট, ভেহিকেলের কমপিউটারকে নির্দেশ দিচ্ছে কোদালটাকে আরও একটু বাঁকা করতে।

ডিএসএমভি-র চারদিকে তাকালেন প্লাঙ্কেট। সত্যি, অদ্ভুত একটা মেশিন। এর শক্তির উৎসটা কি?

ছোট একটা নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর।

 নিউক্লিয়ার? মাই গড! আমার ধারণা, সাগরের তলা দিয়ে ইচ্ছে করলে আমরা এটা নিয়ে ওয়াইকিকি সৈকতে পৌঁছে যেতে পারি, কি বলেন?

 বিগ জনের রিয়্যাক্টর ও লাইফ-সাপোর্ট সিস্টেম সাহায্য করবে আমাদের, তবে এটার গতি খুব কম, ঘণ্টায় মাত্র পাঁচ মাইল। পৌঁছবার আগে না খেতে পেয়ে মারা যাব আমরা।

এখানে কোন খাবার নেই, বলতে চাইছেন?

 একটা আপেলও না।

না খেয়ে মরি, তাতে আফসোস নেই, বললেন প্লাঙ্কেট। মরার সময় গান শুনতে পারব, এটাই বা কম কিসে!

 টেলিফোন হাউজিং চুরমার হয়ে গেছে, কাজেই সারফেসের সাথে যোগাযোগ করার একমাত্র মাধ্যম জলো অ্যাকুসটিক রেডিও ট্রান্সমিটার। আলাপ করার জন্যে রেঞ্জ অবশ্য যথেষ্ট নয়, তবে এটা ছাড়া আর কিছু নেই আমাদের। কোরাসটা কেউ যদি শুনতে পায়, বুঝতে পারবে এখানে কেউ বেঁচে আছে।

 তাতে যে কতটুকু উপকার হবে, বলা মুশকিল, ম্লান কণ্ঠে বললেন প্লাঙ্কেট। ধরুন, একটা রেসকিউ মিশন পাঠানো হলো, কিন্তু প্রেশার-লক না থাকায় এই ভেহিকেল থেকে একটা সাবমারসিবলে আমরা ঢুকব কিভাবে? পকেট থেকে একটা ফাস্ক বের করে পিটের দিকে বাড়িয়ে ধরলেন তিনি। নিন, আর চার পাঁচ ঢোক অবশিষ্ট আছে।

ডিগিং অপারেশন শুরু করার পর পাঁচ ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। এতক্ষণে টিভির পর্দার সরু তবে প্রায় পরিচ্ছন্ন একটা করিডর দেখতে পেল পিট, ক্রমশ উঁচু হয়ে উঠে গেছে মেঝেটা। কমপিউটারকে দায়িত্ব থেকে আপাতত অব্যাহতি দিয়ে ম্যানুয়াল কন্ট্রোল চালু করল ও।

 থ্রটল কন্ট্রোল ধীরে ধীরে সামনের দিকে ঠেলল পিট। বিগ জনের দুধারের চওড়া ট্র্যাক ঘুরতে শুরু করল। গতি ধীরে ধীরে বাড়াল পিট। এ ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে এগাল বিগ জন। তারপর কাদায় আটকে গেল একটা চাকা।

কাদা সরাতে হবে, বলল পিট।

তারপর আবার ওই কাদাতেই আটকা পড়বে, মন্তব্য করলেন প্লাঙ্কেট, হতাশা চেপে রাখতে পারছে না।

 আমাদের গোটা প্রজেক্ট ভেস্তে গেছে, গম্ভীর সুরে বলল পিট। আপনারা আপনাদের সাবমারসিবল, সাপোর্ট শিপ ও ক্রুদের হারিয়েছেন। এ-সবের জন্যে কেউ না কেউ দায়ী।

বেশ, দায়ী! তো কি হলো?

 কি হল মানে? যদি বাঁচি তো দেখতে পাবেন! ব্যাটাদের ঠিকই আমি খুঁজে বের করব! অদ্ভুতদর্শন যান্ত্রিক হাতটার সাহায্যে কাদা সরাবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল পিট। ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলেন ব্রিটিশ সার্ভে টিমের চীফ এঞ্জিনিয়ার প্লাঙ্কেট।

.

০৮.

হাজার কিলোমিটার দূরে, ম্যানিলা বে-র মুখের কাছে একটা পাথুরে দ্বীপ। পাহাড়ের ঢালে পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে খাড়া একটা সুড়ঙ্গ, বাঁকা হয়ে নেমে গেছে নিচে। বিশজন শ্রমিক নিচে দাঁড়িয়ে পাথর ও মাটি কেটে একটা গর্ত তৈরি করছে, দুজন ভদ্রলোককে এগিয়ে আসতে দেখে সরে দাঁড়াল তারা। ফ্লাডলাইটের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে আছে সুড়ঙ্গের ভেতরটা। খানিক সামনে একটা টানেল দেখা গেল, ভেতরে একটা পুরানো ও মরচে ধরা ট্রাক দাঁড়িয়ে রয়েছে। পাহাড়ের গভীর গহরে নামার জন্যে এক সময় আঁকাবাঁকা টানেল ব্যবহার করা হত, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষ দিকে ডিনামাইট ফাটিয়ে টানেলগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

 ইয়ামাশিটার গুপ্তধন-এর সন্ধানে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে এখানে। ১৯৪৪ সালের অক্টোবরের পর জাপানি সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন জেনারেল ইয়ামাশিটা। যুদ্ধের সময় চীন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটা দেশ, ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ ও ডেইলপইন থেকে বিপুল সোনা, মূল্যবান পাথর, অলঙ্কার, রূপো, প্রাচীন মূর্তি ইত্যাদি লুট করা হয়। শুধু সোনাই লুট করা হয় কয়েক হাজার মেট্রিক টন। ম্যানিলা ছিল কালেকশন পয়েন্ট, ওখানে সংগ্রহ করে রাখার পর জাপানে সরিয়ে নিয়ে যাবার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে আমেরিকান সাবমেরিনগুলো আক্রমণ শুরু করায় শতকরা বিশ ভাগের বেশি টোকিয়োতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। কাজেই জাপানি তস্কররা লুজান দ্বীপের চারদিকে অন্তত একশো জায়গায় ওগুলো লুকিয়ে রাখার প্ল্যান করে, আশা ছিল পরে এক সময় ফিরে এসে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে।

কয়েক বছর গবেষণা করে সেই গুপ্তধন কোথায় আছে জানতে পেরেছেন ওঁরা। চলতি বাজারে ওগুলোর দাম আন্দাজ করা হয়েছে, সাড়ে চারশো থেকে পাঁচশো বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

 আজ চার মাস ধরে চলছে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। সিআইন এ হেডকোয়ার্টার ল্যাংলিতে পুরানো যে ও এস এস ম্যাপগুলো পাওয়া গেছে, সেগুলোর সাহায্য নিয়ে গুপ্তধনের সন্ধান করছে মার্কিন ও ডেইলাইন ইন্টেলিজেন্স-এর এজেন্টরা। ম্যাপে জাপানের একটা আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, প্রচুর সময় ও ধৈর্য লেগেছে অনুবাদ করতে। পাহাড়ের নিচে সরাসরি পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। ডিনামাইট ফাটিয়ে ধসিয়ে দেয়া হয়েছে টানেলগুলো। প্রথমে পাথর কেটে একটা খাড়া শ্যাফট তৈরি করতে হয়েছে, নিচে টানেল পাবার পর কাটতে হয়েছে মাটি, পাথর ও কংক্রিটের পাঁচিল। অবশেষে গভীর একটা গর্তের ভেতর চওড়া একটু টানেলের মুখ দেখা গেল। টানেলের মুখ থেকে ভেতর দিকে ছড়িয়ে রয়েছে নিচু ঝোঁপ। সেদিকে আলো ফেলার পর দুই ভদ্রলোকের একজন, যিনি একটু বেশি লম্বা, ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো, হঠাৎ আঁতকে উঠলেন। নিচু ঝোঁপগুলো আসলে কি, বুঝতে পেরেছেন তিনি।

তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন রিকো একোস্টা, ডেইলাইন সিকিউরিটি ফোর্স-রে একজন মাইনিং এঞ্জিনিয়ার। মাইনিং দেখছ, ফ্রাঙ্ক? জানতে চাইলেন তিনি।

হাড়, ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো বললেন ফিসফিস করে। কঙ্কাল। গড, কম করেও কয়েকশো হবে! পিছিয়ে এসে জায়গা করে দিলেন রিকো একোস্টাকে।

ছোটখাট ভদ্রলোক শ্রমিকদের নির্দেশ দিলেন, গর্তটা আরও চড়া করো।

গর্ত বড় করার পর নিচে মানুষ নামার সুযোগ হলো। টানেলের গা সস্তা সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করা হয়েছে, দেখে মনে হলো যে-কোন মুহূর্তে ভেঙে পড়বে। টানেলের মুখের কাছে থামলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো, পকেট থেকে পাইপ বের করে তামাক ভরলেন।

 কলোরাডো স্কুল অভ মাইনস থেকে গ্রাজুয়েট ডিগ্রি অর্জন করার পর কর্মজীবনের শুরুতে দীর্ঘ কয়েক বছর মূল্যবান পাথরের খোঁজে দুনিয়ার প্রায় সমস্ত এলাকার খনিতে কাজ করেছেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। অস্ট্রেলিয়ায় ওপাল, কলম্বিয়ায় এমারেল্ড, তাঞ্জানিয়ায় রুবি আবিষ্কার করেছেন। সিআইএ তাঁকে বিশেষ একটা এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ করে ফিলিপাইনে পাঠায় ইয়ামাশিটা গুপ্তধনের সন্ধান! অত্যন্ত কড়া গোপনীয়তার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। আগেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, গুপ্তধন পাওয়া গেলে ফিলিপাইনের বিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে তা ব্যবহার করা হবে।

 গল্পটা তাহলে সত্যি! তার পাশ থেকে বিড়বিড় করে বললেন রিকো একোস্টা।

মুখ তুলে তাকালেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। গল্প?

 মিত্র বাহিনীর বন্দী সদস্যদেরকে দিয়ে তৈরি করানো হয় এই টানেলগুলো, টালে তৈরি হবার পর তাদের সবাইকে মেরে ফেলে জাপানিরা, কেউ যাতে এগুলোর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে না পারে।

 সেরকমই মনে হচ্ছে। ভেতরে ঢোকার পর নিশ্চিত হতে পারব।

আমার কাছে আশ্চর্য লাগছে, জাপানিরা আবার ফিরে আসেনি কেন? গুপ্তধন উদ্ধার করার জন্যে?

 চেষ্টা করেনি, একথা বলা যাবে না, জবাব দিলেন ম্যানকিউসো। যুদ্ধের পর নির্মাণ কাজে সহায়তার নাম করে অনেক জাপানি ঠিকাদারি কোম্পানি ফিলিপাইনে ঢুকতে চেয়েছিল। তাদের ধারণা ছিল, একবার ঢুকতে পারলে গোপনে সব সরিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু মার্কোস গুপ্তধনের কথা জানার পর জাপানিদের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেন, নিজেই খুঁজতে শুরু করেন।

মার্কোস সব না হলেও অংশবিশেষ উদ্ধার করেন। উৎখাত হবার আগে কয়েক দফায় যে ত্রিশ বিলিয়ন ডলার দেশের বাইরে পাচার করেন তিনি, বলা হয় তার বেশিরভাগটাই গুপ্তধন বেচা টাকা। ঘৃণায় মুখ কুঁচকে থুথু ফেললেন রিকো একোস্টা। মার্কোস আর তাঁর স্ত্রীর লোভ আমাদের যে ক্ষতি করেছে, তা পূরণ করতে একশো বছর লাগবে আমাদের।

 নাকে-মুখে কাপড় বড়িয়ে নিয়ে সামনে বাড়লেন ওঁরা, তা না হলে দুর্গন্ধে জ্ঞান হারাবেন। টানেলের ভেতর কোথাও কোথা পানি জমে রয়েছে। একবার দাঁড়ালেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো, লক্ষ করলেন সিলিং থেকে পানির ধারা গড়িয়ে নিচে নামছে। হাতের টর্চটা জ্বাললেন, আলো ফেললেন নিচের দিকে।

 একটা কঙ্কাল পড়ে রয়েছে সামনে, কঙ্কালের একটা হাতের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি। কঙ্কাল, তবে পরনের ইউনিফর্মটা চেনা গেল। গলায় একটা চেইন, চকচক করছে টর্চের আলোয়। লকেটের ওপর আলো ফেললেন ম্যানকিউসো, তারপর ঝুঁকে ভাল করে তাকালেন। লুকেটে নাম লেখা রয়েছে, উইলিয়াম মিলার। নামের নিচে লেখা রয়েছে আর্মি সিরিয়াল নম্বর। সিধে হলেন ম্যানকিউসো, আলোটা চারদিকে ঘোরালেন। টানেলের চারদিকে শুধু কঙ্কাল আর কঙ্কাল। কোথাও কোথাও অনেকগুলো কঙ্কাল স্তূপ হয়ে আছে।

মিত্র বাহিনীর সদ্য ছিল এরা সবাই, বিড়বিড় করলেন রিকো একোস্টা। আমেরিকান, ফিলিপিনো, ব্রিটিশ, অস্ট্রেলিয়ান। দেখে মনে হচ্ছে অন্যান্য যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকেও বন্দীদের ধরে এনেছিল জাপানিরা কাজ করানোর জন্যে। কিন্তু একসাথে এতগুলো মানুষকে খুন করা হলো কিভাবে?

 বুলেটের কোন চিহ্ন নেই। টানেল বিধ্বস্ত হওয়ায় ওরা বোধহয় দম বন্ধ হয়ে মারা যায়। প্রথম ট্রাকটাকে পাশ কাটিয়ে সামনে বাড়লেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। এক সারিতে অনেকগুলো ট্রাক দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রতিটি ট্রাকের চাকা বসে গেছে, পচে গেছে প্রতিটি ক্যানভাস টপ। একটা ট্রাকের ভেতর টর্চের আলো ফেললেন তিনি। ভাঙা কাঠের বাক্স ছাড়া আর কিছু নেই। এভাবে কয়েকটা ট্রাক পরীক্ষা করা হলো। সবগুলোই খালি।

দুশো মিটার এগিয়ে বাধা পেলেন ওঁরা। দেখেই বোঝা যায়, বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধসিয়ে দেয়া হয়েছ টানেল। বাধার সামনে ছোট একটা অটো হাউজ টেইলার দেখা গেল, অ্যালুমিনিয়ামের গা এখনও চকচক করছে। ১৯৪০ সালে এধরনের অটো ট্রেইলার ছিল না। গাড়িটার পাশে কোন মার্কা নেই, তবে টায়ারের গায়ে লেখাগুলো পড়া গেল।

ধাতব ধাপ বেয়ে ওপরে উঠলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো, দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ভেতরে টর্চের আলো ফেললেন। ভেতরটা দেখে অফিস বলে মনে হলো। ঠিকাদাররা এধরনের সচল অফিস ব্যবহার করে।

চারজন লোককে নিয়ে গাড়িটার কাছে এসে দাঁড়ালেন রিকো একোস্টা। ফ্লাডলাইটের তার বহন করছে লোকগুলো উজ্জ্বল আলোয় ভেসে গেল চারদিক। এটা আবার এল কোত্থেকে! বিস্ময়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন তিনি।

আলোটা ভেতরে আনতে বলো, নির্দেশ দিলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো।

আলো ফেলার পর দেখা গেল ট্রেইলারের ভেতরে কিছুই নেই। ডেস্ক থেকে সমস্ত কাগজপত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে। দেরাজগুলো খালি, খালি ওয়েস্টপেপার বাস্কেট। কোথাও কোন ছাইদানী নেই। দেয়ালে হুকের সঙ্গে ঝুলছে শুধু একটা হ্যাঁ। আরেক দিকের দেয়ালে একটা ব্যাকবোর্ড দেখা গেল। আরবিতে লেখা কয়েকটা সংখ্যা দেখলেন ওঁরা, শিপটম লেখার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে কাতাকানা সঙ্কেত।

কি ওগুলো?

 গুপ্তধনের তালিকা বলে মনে হচ্ছে।

ডেস্কের পিছনে, একটা চেয়ারের ওপর ধপ করে বসে পড়লেন রিকো একোস্টা। কিছুই নেই, সব নিয়ে চলে গেছে।

প্রায় পঁচিশ বছর আগে, বোর্ডে লেখা তারিখ দেখে অন্তত তাই মনে হচ্ছে।

 মার্কোস? জানতে চাইলেন একোস্টা।

না, মার্কোস নন, বললেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। জাপানিরা। ওরা ফিরে এসেছিল। আমাদের জন্যে শুধু হাড়গুলো রেখে গেছে।

.

১৪.

 ওয়াশিংটনের ফোর্ডস থিয়েটারে বসে অনুষ্ঠান দেখছেন রেইমন্ড জর্ডান, পাশে স্ত্রী। হঠাৎ তার হাতঘড়ির অ্যালার্ম পিপ পিপ করে উঠল। স্ত্রীকে বললেন, আসছি। থিয়েটার থেকে শান্তভাবে বেরিয়ে এলেন তিনি। লবিতে পৌঁছে দেখলেন কার্টিস মিকার একা তার জন্যে অপেক্ষা করছেন।

কার্টিস মিকার হলেন অ্যাডভান্সড টেকনিক্যাল অপারেশনস-এর ডেপুটি ডিরেক্টর। নিজের অফিস ছেড়ে বড় একটা বেরোন না তিনি, ওখানে বসেই সারাদিন স্যাটেলাইট ইন্টেলিজেন্স ফটো পরীক্ষা করেন।

কি খরব? কোন ভূমিকা না করেই জানতে চাইলেন রেইমন্ড জর্ডান।

 কোন জাহাজে বোমাটা ছিল, আমরা জানি, কার্টিস মিকার জবাব দিলেন।

 কিন্তু এখানে তো কথা বলা সম্ভব নয়।

ম্যানেজারের সাথে আলাপ করেছি, তার অফিসটা ব্যবহার করতে পারি আমরা।

 কামরাটা চেনেন রেইমন্ড জর্ডান। ভেতরে ঢুকে ম্যানেজারের চেয়ারে বসলেন তিনি। তুমি নিশ্চিত? কোন ভুল হচ্ছে না?

 শান্তভাবে মাথা নাড়লেন কার্টিস মিকার। একটা আবহাওয়া পাখি থেকে তোলা ফটোতে দেখা যাচ্ছে এলাকায় তিনটে জাহাজ ছিল। বিস্ফোরণের পর ওই এলাকার উপর দিয়ে যাবার সময় আমরা আমাদের পুরানো স্কাই কিং ইন্টেলিজেন্স স্যাটেলাইট অ্যাকটিভেট করি। ওটা থেকে পাওয়া ফটোতে আমরা দুটো জাহাজ দেখত পাচ্ছি।

 কিভাবে?

রাডার-সোনার সিস্টেমের কার্যকারিতা কমপিউটারের সাহায্যে অনেক বাড়িয়ে নেওয়ার ফলে পানির নিচেটা আমরা পরিষ্কার দেখতে পাই, দেখে মনে হয় স্বচ্ছ কাঁচ।

তুমি তোমার লোকদের ব্রিফ করেছিলে?

হ্যাঁ।

কার্টিসের চোখে চোখে রাখলেন রেই জর্ডান। তুমি সন্তুষ্ট? কোথাও কোন খুঁত নেই?

কোন খুঁত নেই, দৃঢ়কণ্ঠে বললেন কার্টিস মিকার।

 হ্যাঁ।

 জানো তো যে ভুল করলে তোমাকেও দায়ী হতে হবে?

তোমাকে রিপোর্ট করার পর বাড়িতে ফিরে নাক ডেকে ঘুমাব আমি।

বেশ, এবার বলো।

পকেট থেকে একটা ফোল্ডার বের করে টেবিলের ওপর রাখলেন কার্টিস মিকার।

রেইমন্ড জর্ডান হাসলেন। তুমি দেখছি ব্রিফকেসের ভক্ত নও।

 হাত দুটো মুক্ত রাখতে চাই, বলে ফোল্ডারটা খুললেন কার্টিস মিকার। ভেতর থেকে পাঁচটা ফটোগ্রাফ বেরুলো। প্রথম তিনটেতে জাহাজগুলোকে পানির ওপর অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে। এখানে তুমি দেখতে পাচ্ছ জাপানি অটো ক্যারিয়ারটাকে ঘিরে চক্কর মারছে নরওয়জিয়ান প্যাসেঞ্জার কার্গো লাইনার-স্রোতে ভেসে যাচ্ছে অটো ক্যারিয়ার বারো কিলোমিটার দূরে, পানিতে একটা সাবমারসিবল নামাচ্ছে ব্রিটিশ সার্ভে শিপ।

বিস্ফোরণ ঘটার আগের পরিস্থিতি, মন্তব্য করলেন রেইমন্ড জর্ডান।

মাথা ঝাঁকালেন কার্টিস মিকার। পরের ছবি দুটো বিস্ফোরিণের পর স্কাই কিং থেকে তোলা, সাগরের তলায় ভাঙাচোরা দুটো খোল দেখা যাচ্ছে। তৃতীয় জাহাজটা গায়েব হয়ে গেছে। সাগরের মেঝেতে ওটার এঞ্জিনের কিছু টুকরো-টাকরা ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না।

তিনটের মধ্যে কোনটি সেটা? ধীরে ধীরে জানতে চাইলেন রেইমন্ড জর্ডান।

যে দুটো ডুবে গেছে ওগুলোর পরিচয় পেয়েছি আমরা। বোমাটা ছিল জাপানি অটো ক্যারিয়ারে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দিলেন রেইমন্ড জর্ডান। জাপানের কাছে অ্যাটম বোমা আছে, খবরটা আমার জন্যে বড় কোন বিস্ময় নয়। কারণ বহু বছর ধরেই বোমা বানাবার টেকনলজি ওদের হাতে রয়েছে।

প্রথম আভাস পাওয়া যায় ওরা যখন একটা নিকুইড মেটাল ফাস্ট-ব্রীডার রিয়্যাক্টর বানায়। ফিশনিং উইথ ফাস্ট নিউট্রনস, দ্য ব্রীডার ক্রিয়েটস মোর পুটোনিয়াম ফুয়েল দ্যাট ইট বার্নস। পারমাণবিক অস্ত্র বানাবার প্রথম পদক্ষেপ।

এবার মরীচিৎকার পিছনে ছোটো-কুঁজে বার করো কোথায় আছে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কারখানা! তিক্তকণ্ঠে বললেন রেইমন্ড জর্ডান।

জাপানিরা আমাদেরকে বোকা বানিয়েছে, মন্তব্য করলেন কার্টিস মিকার।

আমার কেন যেন মনে হয় জাপানের সরকারি নেতারাও এ ব্যাপারে কিছু জানেন না।

ওদের প্রোডাকশন ফ্যাসিলিটি মাটির ওপর হলে আমাদের নতুন স্যাটেলাইট ডিটেকশন ইকুইপমেন্ট ওগুলোর খবর ঠিকই পেয়ে যেত।

অদ্ভুত ব্যাপার, ওদের কোন এলাকাতেই অস্বাভাবিক রেডিও অ্যাকটিভিটি ধরা পড়েনি।

আমরা শুধু ওদের ইলেকট্রিক্যাল পাওয়ার রিয়্যাক্টরগুলোর কথা জানি, আর জানি একটা নিউক্লিয়ার ওয়েস্ট ডাম্প সম্পর্কে উপকূল শহর রোকোটার কাছে।

 রিপোর্টগুলো আমি দেখেছি, বললেন রেইমন্ড জর্ডান। পারমাণবিক বর্জ্য ফেলার জন্যে চার হাজার মিটার গভীর একটা শ্যাফট বানিয়েছে ওরা। এমন হতে পারে, কিছু একটা দেখার কথা ছিল, কিন্তু দেখতে পাইন আমরা?

চুপ কর থাকলেন কার্টিস মিকার।

কি সর্বনাশ! হঠাৎ বিস্ফোরিত হলেন রেইমন্ড জর্ডান। জাপান বিনা বাধায় জাহাজে করে আমেরিকায় অ্যাটম বোমা পাঠাচ্ছে অথচ আমরা কিছুই জানি না। বোমা কোথায় পেল ওরা, কিভাবে বানাল, কেন পাঠাচ্ছে, ঠিক কোথায় পাঠাচ্ছে…ওহ গড, আমরা তো কিছুই জানি না।

তুমি বলছ বোমাগুলো? বহুবচন? জিজ্ঞেস করলেন কার্টিস মিকার।

কলোরাডোর সিসমোগ্রাফিক সেন্টার-এর রিডিং অনুযায়ী প্রথম বিস্ফোরণের এক মিলিসেকেন্ড পর দ্বিতীয় একটা বিস্ফোরণ ঘটেছে।

এক সেকেন্ড চুপ করে থাকলেন কার্টিস মিকার, তারপর বললেন, খুবই খারাপ। কথা, দশ বছর আগেই সতর্ক হওনি তোমরা।

কিসের ভিত্তিতে দশ বছর আগে সতর্ক হব? রাজনীতিকরা তো শুধু রাশিয়া আর মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল। প্রতি বছর ইন্ট্রেলিজেন্স বাজেটও কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া জাপান হলো আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। ওখানে আমরা শুধু অবসরপ্রাপ্ত দুজন এজেন্টকে ভাড়ায় রেখেছি। একই কথা ইসরায়েল সম্পর্কে। আমরা জানি যে-কোন দিন অ্যাটম বোমা বানিয়ে ফেলবে ওরা, কিন্তু যেহেতু ওরা আমাদের বন্ধু, তেমন গুরুত্ব দিই না।

 গাফলতির খেসারত দিতে হবে এখন, মন্তব্য করলেন কার্টিস মিকার। দেখো, প্রেসিডেন্ট কি বলেন। ফোল্ডার থেকে আরেকটা ছবি বের করলেন তিনি। দেখো তো, কি এটা?

 ফটোর দিতে ঝুঁকে তাকালেন রেইমন্ড জর্ডান। দেশে মনে হচ্ছে বড় একটা ফার্ম ট্র্যাক্টর।

 ওটা অচেনা একটা ডীপ সী মাইনিয়ং ভেসেল। পানির পাঁচ হাজার মিটার নিচে রয়েছে। বিস্ফোরণ এলাকা থেকে খুব বেশি হলে বিশ কিলোমিটার দূরে। তুমি জানো, কাদের এটা? বা ওই সময় ওখানে কি করছিল ওরা?

 হ্যা… ধীরে ধীরে বললেন রেইমন্ড জর্ডান। আগে জানতাম না, এখন জানি। ধন্যবাদ, কার্টিস।

ফটোগুলো পকেটে ভরে কামরা থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি, পিছন থেকে তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন কার্টিস মিকার।

.

১৫.

 কাদা সরিয়ে, ঢাল বেয়ে ট্রেঞ্চের ওপর উঠে এল বিগ জন্।

চীফ এঞ্জিনিয়ার প্লাঙ্কেট জানতে চাইলেন, ল্যান্ডস্লাইড থেকে তো রক্ষা পেলাম, এবার আপনার প্ল্যানটা কি, ডার্ক? চায়ের কাপে চুমুক দিলেন তিনি।

প্ল্যান হলো ওপরে ওঠা। হাত তুলে বিগ জনের ছাদটা দেখিয়ে দিল পিট।

আপনার বিগ জন ভাসতে পারে না, আর আমাদের মাথার ওপর রয়েছে পাঁচ কিলোমিটার সাগর, ওপরে ওঠার মত অসম্ভব একটা কাজ কিভাবে আপনি করতে চান?

নিঃশব্দে হাসল পিট। তারপর বলল, স্রেফ বসে থাকুন, উপভোগ করুন চারদিকের দৃশ্য। আপনাকে আমি পাহাড়ের মাথায় তুলে নিয়ে যাব।

.

ওয়েলকাম আবোর্ড, অ্যাডমিরাল! অ্যাটাক সাবমেরিন সাইন্ডারের কমান্ডার বিউ মরটন বললেন, তাকিয়ে আছেন অ্যাডমিরাল জেমস স্যানডেকারের দিকে। মুখে হাসি ধরে রাখলেও, মনে মনে খুশি নন তিনি। এধরনের ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। আমরা একটা অভিযানে রয়েছি, হঠাৎ নির্দেশ এল সারফেসে উঠে একজন ভিজিটরকে তুলে নিতে হবে। আপনাকে জানাতে আপত্তি নেই, ব্যাপারটা আমার পছন্দ হয়নি।

সাংহাই শেলির লঞ্চ থেকে সাউন্ডারের আংশিক ভাসমান সেইল টাওয়ারে পা দিলেন অ্যাডমিরাল স্যানডেকার, বিউ মরটনের বাড়িয়ে দেয়া হাতটা ধরে এমনভাবে ঝাঁকালেন যেন কতদিন ধরে চেনেন আঁকে, চেহারায় হাসিখুশি ভাব। আপনার সাবমেরিনে চা খেতে আসার জন্যে আমি কোন কলকাঠি নাড়িনি, কমান্ডার। আমাকে আসতে হয়েছে সরাসরি প্রেসিডেনশিয়াল নির্দেশে। আপনার যদি অসুবিধে হয় বলুন, এখুনি আমি চাইনিজ জাঙ্কে ফিরে যাই।

চেহারায় আহত একটা ভাব ফুটিয়ে বিউ মরটন বললেন, নো অফেন্স, অ্যাডমিরাল। কিন্তু রুশ স্যাটেলাইট…।

 আমাদের ছবি তুলবে, এই তো? তুলবে, সে ব্যাপারে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। টাওয়ারে উঠে এল অ্যাল, তার দিকে তাকালেন স্যানডেকার। অ্যাল জিওর্দিনো, আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রজেক্ট ডিরেক্টর।

 কুশলাদি বিনিময়ের পর পথ দেখিয়ে ওদেরকে সাবমেরিনের কন্ট্রোল সেন্টারে নিয়ে এলেন বিউ মরটন। কমান্ডারের পিছু পিছু ট্রান্সপারেন্ট প্লটিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন অ্যাডমিরাল। ডিসপ্লেতে সাগরের নিচেটা দেখা যাচ্ছে। থ্রী ডাইমেনশন্যাল সোনার ভিউ।

লেফটেন্যান্ট ডেভিড ডিলুসা, সাউন্ডারের নেভিগেশন অফিসার, টেবিলের ওপর ঝকে রয়েছেন। পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময় উষ্ণ হাসি ছড়িয়ে পড়ল মুখে।

অ্যাডমিরাল স্যানডেকার, দিস ইজ অ্যান অনার। অ্যাকাডেমিতে আপনার একটা লেকচারও আমি মিস করতাম না!

ঠোঁট টিপে হাসলেন অ্যাডমিরাল। যদি বলেন আমার লেকচার শুনে আপনার ঘুম পেত, ভারি লজ্জা পাব।

 কি যে বলেন, স্যার! নুমা প্রজেক্ট সম্পর্কে আপনার লেকচার শুনে মুগ্ধ হয়ে গেছি আমি।

 ডিলুসার দিকে চট করে একবার তাকিয়ে টেবিলের দিকে ইঙ্গিত করলেন বিউ মরটন। তোমার আবিষ্কার সম্পর্কে অ্যাডমিরাল জানতে চান, ডেভিড ডিলুসা।

 ডিলুসার কাঁধে একটা হাত রাখলেন স্যানডেকার। কি আবিষ্কার করেছেন, মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড?

ভাবাবেগে সামান্য কেঁপে গেল ডি লুসার গলা, সাগরের তলা থেকে অদ্ভুত একটা মিউজিকের আওয়াজ পাচ্ছি আমরা…।

মিনি দ্য মারমেইড? জানতে চাইল অ্যাল।

 হ্যাঁ…।

আপনারা জানলেন কিভাবে? তীক্ষ্ণকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন বিউ মরটন।

পিট, জোর গলায় বলল বি। এখনও বেঁচে আছে ও।

অ্যাডমিরাল স্যানডেকার, তাকালেন ডিলুসার দিকে। এখনও কি শুনতে পাচ্ছেন কোরাসটা?

ইয়েস, স্যার। একটা ফিক্স পাবার পর উৎসটারও সন্ধান পেয়েছি।

সচল?

সাগরের তলায়, ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার।

পিট আর মি. প্লাঙ্কেট ভূমিকম্পের ধাক্কা সামলে নিয়েছে, আশ্রয় নিয়েছে বিগ জন্-এ, বলল অ্যাল।

যোগাযোগের চেষ্টা করেছেন? বিউ মরটনকে জিজ্ঞেস করল অ্যাডমিরাল।

চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু এক হাজার মিটারের চেয়ে বেশি গভীরে ট্রান্সমিট করা আমাদের সিস্টেমের পক্ষে সম্ভব নয়।

শুনতে পাবেন কি, ওরা যদি কোন সারফেস ভেসেলের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে?

ওদের কোরাস যদি শুনতে পাই, ভয়েস ট্রান্সমিশনও শুনতে পারব।

সে ধরনের কোন শব্দ রিসিভ করেছেন?

তার মানে ওদের ফোন সিস্টেম নষ্ট হয়ে গেছে, মন্তব্য করলেন স্যানডেকার।

কিন্তু তাহলে মিউজিক ট্রান্সমিট করছেন কিভাবে ওঁরা?

বিগ জন-এ একটা ইমার্জেন্সি অ্যামপ্লিফাইং সিস্টেম আছে, জবাব দিল জিওর্দিনো। সেটার শব্দ পেয়ে রেসকিউ ভেহিকেল যাতে পৌঁছাতে পারে। তবে ওটা ভয়েস ট্রান্সমিট বা রিসিভ করতে পারে না।

বিউ মরটন তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জানতে চাইলেন, আপনাদের বিগ জন্-এ ওঁরা কারা, জানতে পারি? প্রশান্ত মহাসাগরে তলায় কি করছেন ওরা?

সবিনয়ে হাসলেন অ্যাডমিরাল। দুঃখিত, কমান্ডার! এটা আমাদের একটা টপ সিক্রেট প্রজেক্ট। ডিলুসার দিকে ফিরলেন তিনি। আপনি বলছিলেন, ওটা সচল।

 ইয়েস, স্যার! কয়েকটা বোতামে চাপ দিলেন ডিলুসা। টেবিলের ডিসপ্লেতে থ্রী-ডাইমেনশন্যাল হলোগ্রাফ ফুঠে উঠল।

 লেটেস্ট আন্ডারওয়াটার ভিজুয়াল টেকনলজি, বললেন বিউ মরটন, গলায় গর্বের সুর। আমাদের সাবমেরিনেই প্রথম ফিট করা হয়েছে।

 লাল হয়ে উঠল বিউ মরটনের চেহারা। চাপাস্বরে তিনি বললেন, অ্যাডমিরালকে দেখাও তার খেলনা কি রকম কাজ করে।

লাঠি আকৃতির একটা প্রোব হাতে নিয়ে ডিসপ্লের মেঝেতে একটা লাইট ছোট গিরিখাদ থেকে এখানটায় উঠে আসে, মেইন ফ্র্যাকচার জোন থেকে খানিকটা দূরে। এই মুহূর্তে আঁকাবাঁকা একটা পথ ধরে ঢাল বেয়ে উঠছে ওটা। কিছু বলতে হল না, ডিসপ্লেটা আকারে বড় করে তুলল সে। খাড়া ঢালের গায়ে বিগ জনকে দেখা গেল।

এর চেয়ে বেশি পরিষ্কারভাবে দেখানো সম্ভব নয়।

স্রেফ একটা বিন্দু, তার বেশি কিছু না। বিশ্বাস করা কঠিন যে ওই বিন্দুটার ভেতর দুজন মানুষ বাঁচার জন্যে প্রাণপণ সংগ্রাম করছে।

 মরটন জানতে চাইলেন, আপনাদের সাবমারসিবলের সাহায্যে ভদ্রলোকদের বাঁচাতে পারেন না?

ডিসপ্লে টেবিলের রেইল শক্ত করে চেপে ধরে আছে অ্যাল, আঙুলের গিটগুলো সাদা হয়ে গেছে। কাছে যেতে পারি, কিন্তু দুটো ভেহিকেলের কোনটাতেই এয়ার লক নেই, ফলে ওদেরকে ট্রান্সফার করা সম্ভব নয়।

কেবল দিয়ে আটকে তুলে আনা যায় না?

ছয় কিলোমিটার কেবল কোন জাহাজে থাকে বলে তো শুনিনি। ভুলে গেলে চলবে না যে যথেষ্ট মোটা হতে হবে কেবলটাকে।

কাঁধ ঝাঁকালেন বিউ মরটন। আমরা কিছু করতে পারছি না বলে সত্যি দুঃখিত।

ধন্যবাদ, কমান্ডার।

প্রায় এক মিনিট চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেন ওঁরা, তাকিয়ে আছেন ডিসপ্লের দিকে।

আচ্ছা, ওঁরা যাচ্ছেন কোথায়? অবশেষে নিস্তব্ধতা ভাঙলেন ডিলুসা।

কি বললেন? হঠাৎ যেন ঘুম থেকে জাগলেন অ্যাডমিরাল।

ওটার ওপর যখন থেকে নজর রাখছি আমি, বললেন ডেভিড ডিলুসা, মনে হচ্ছে নির্দিষ্ট একটা লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছে। বাধা পেলে এদিক ওদিক ঘোরে, তারপর আবার আগের কোর্সে ফিরে আসে।

পিট উঁচু জায়গায় উঠে আসছে, মাই গড!

কোর্স দেখে সম্ভাব্য একটা গন্তব্য ডিলুসা, বললেন বিউ মরটন। হিসেবে করে বের করো।

 নেভিগেশন্যাল কমপিউটারের বোতামে চাপ দিলেন ডেভিড ডিলুসা। তারপর মনিটরের দিকে তাকালেন, অপেক্ষা করছেন কমপাস প্রজেকশনের জন্যে। প্রায় সাথে সাথে সংখ্যাগুলো ফুটে উঠল মনিটরের স্ক্রীনে। আপনার লোক, অ্যাডমিরাল, থ্রী থ্রী, ফোর ধরে এগোচ্ছে।

থ্রী-থ্রী-ফোর, বিড়বিড় করলেন বিউ মরটন। তার মানে সামনে কিছুই নেই!

ওটার সামনের জায়গা এনলার্জ করুন, প্লীজ, ডেভিড ডিলুসাকে অনুরোধ করল অ্যাল।

করা হলো এনলার্জ। দেখা যাচ্ছে কয়েকটা পাহাড়ের মাথা ছাড়া আর কিছু নেই।

পিট কনরো গাইঅট-এর দিকে যাচ্ছে, বলল অ্যাল।

 গাইঅট? ডেভিড ডিলুসা জানতে চাইলেন।

সমতল চূড়াসহ একটা সী মাউন্ট, ব্যাখ্যা করলেন স্যানডেকার।

চূড়ার ডেপথ কত? ডিলুসাকে প্রশ্ন করল অ্যাল।

টেবিলের নিচের কেবিনেট থেকে একটা চার্ট বের করে ভাঁজ খুললেন ডেভিড ডিলুসা। ডেপথ তিনশো দশ মিটার।

বিগ জন্ থেকে কত দূরে? প্রশ্নটা এল মরটনের তরফ থেকে।

মাপজোক করে ডেভিড ডিলুসা বললেন, প্রায় ছিয়ানব্বই কিলোমিটার।

প্রতি ঘণ্টা আট কিলোমিটার, হিসেব করল অ্যাল, পথে বাধা পাওয়ায় দূরত্বটাকে দ্বিগুণ ধরতে হবে ভাগ্য ভাল হলে কাল এই সময় চূড়ান্ত পৌঁছাবে ওঁরা।

 চূড়ায় উঠতে পারলে সারফেসের খানিকটা কাছে আসবেন ওঁরা, তা ঠিক। কিন্তু তারপরও তিনশো মিটার বা প্রায় এক হাজার ফুট নিচে থাকবেন সারফেস থেকে। আপনাদের এই লোক কিভাবে…?

ওর নাম ডার্ক পিট, বলল অ্যাল।

বেশ, ডার্ক পিট। তো উনি কিভাবে পানির ওপর আসতে চান, সাঁতার দিয়ে?

অন্তত ওই গভীরতা থেকে সম্ভব নয় সেটা।

 তাহলে এই পিট কি করতে চাইছে?

কেউ কোন কথা বলল না। বিউ মরটনের প্রশ্নের উত্তর ওদের কারও জানা নেই।

.

১৬.

 আমরা দুহাজার মিটার পেরিয়ে এসেছি, রিপোর্ট করল পিট।

 ভেরি গুড, মন্তব্য করলেন ক্লোভার প্লাঙ্কেট। চূড়া আর বেশি দূরে নয়।

এখুনি হবার কোন কারণ নেই, বলল পিট। ঢালটা ক্রমশ আরও খাড়া হচ্ছে। আর যদি পাঁচ ডিগ্রি বেশি খাড়া হয়, আমাদের ট্র্যাক মাটি কামড়াতে পারবে না।

ব্যর্থতার কথা এখন আর চিন্তা করছেন না প্লাঙ্কেট। পিটের ওপর তার আস্থা প্রায় সীমাহীন হয়ে উঠেছে। তবে ঢালের মেঝে তো দেখছি সমতল উঠে যেতে অসুবিধে হবে বলে মনে হয় না।

দেখা যাক, বলে চোখ বুজল পিট, দেখে মনে হলো ঘুমিয়ে পড়েছে।

.

দুঘণ্টা পর গুলির মত একটা আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল ওর। চোখ মেলে কনসোলের দিকে তাকাল ও। লাল একটা আলো জ্বলছে আর নিভছে।

 যান্ত্রিক কোন ত্রুটি? জিজ্ঞেস করল ও।

একটা লিক দেখা দিয়েছে, বললেন প্লাঙ্কেট। আওয়াটার সাথে সাথে ওয়ার্নিং লাইট জ্বলে উঠল।

ড্যামেজ ও লোকশান সম্পর্কে কমপিউটার কি বলছে?

 দুঃখিত, আপনি আমাকে প্রোগ্রাম ক্যাকটিভেট করার জন্যে কোড় শোনেননি।

কীবোর্ডের নির্দিষ্ট একটা বোতামে চাপ দিল পিট। ডিসপ্লে মনিটরে ফুটে উঠল রিডআউট। আমরা ভাগ্যবান, বলল ও। লাইফ সাপোর্ট ও ইলেকট্রনিক ইকুইপমেন্ট চেম্বার অক্ষতই আছে। লিকটা নিচে কোথাও, এঞ্জিনের পাশপাশে বা জেনারেটর কমপার্টমেন্টে।

 তারপরও বলছেন আমরা ভাগ্যবান?

ওদিকে নড়াচড়া করার জায়গা আছে। চেয়ার থেকে নেমে ক্রল করে কন্ট্রোল কেবিনের দিকে এগোল পিট, একটা ট্র্যাপ ডোর খুলে ভেতরে ঢুকল। আলো জ্বেলে এনি কম্পার্টমেন্টের চারদিকে তাকাল ও। হিসহিস আওয়াজ হচ্ছে, কিন্তু উ+সটা দেখা গেল না। এরইমধ্যে খানিকটা পানি জমেছে ভেতরে।

লিকটা পেলেন? চিৎকার করে জানতে চাইলেন প্লাঙ্কেট।

না।

বিগ জনকে থামাব!

না, চূড়ার দিকে উঠতে থাকুন। দ্রুত চিন্তা করছে পিট। ঘন ঘন বাড়ি খেয়ে বিগ জনের বাইরের দেয়াল তুবড়ে গেছে। হিসহিস আওয়াজ শুনে ও পানি দেখে বোঝা যাচ্ছে, সূচের মত সরু একটা ফুটো তৈরি হয়েছে কোথাও। সরু একটা ফুটো দিয়ে ধীরে ধীরে পানি ঢুকলে এঞ্জিন কমপার্টমেন্ট ভরতে দুঘন্টা লাগবে। কিন্তু যদি ফুটোটা বড় হয়, কামানের মত বিস্ফোরিত হবে পানি, ভেতরের দেয়াল এক পলকে চুরমার হয়ে যাবে। প্রশ্ন হলো, সরু ফুটোটা কি এরই মধ্যে গুরুত্ত্বপূর্ণ কোন ইকুইপমেন্টের ক্ষতি করেছে? ফুটোটা কি এত বড় যে বন্ধ করা সম্ভব নয়? ক্রল করে আরও একটু এগোল পিট। আওয়াজটা কাছাকাছি কোথাও থেকে আসছে। ভেতরে মিহি পানির কণা ভাসছে, কুয়াশার মতো, ঝাপসা লাগছে সব কিছু। কুয়াশার ভেতর দিয়ে আরও একটু এগাল পিট। তারপর মাথায় একটা বুদ্ধি এল। পায়ের এক পাটি জুতো খুলে মুখের সামনে নাড়ল ও, একজন অন্ধ যেভাবে তার ছড়ি নাড়ে। এক মুহূর্ত পর প্রায় ছো দিয়ে জুতোটা কেড়ে নেয়ার চেষ্টা হল। এতক্ষণে ফুটোটা দেখতে পেল ও। ওর সামনে, ডান দিকে, উজ্জ্বল একটা চকচকে ভাব।

সুচের মত সরু একটা ফুটো, কমপ্যাক্ট স্টীম টারবাইনের গায়ে। পিছিয়ে এসে স্পেয়ার পার্টস কেবিনেটটা খুলল পিট। ভেতর থেকে বের করল এক প্রস্থ হাই প্রেশার রিপ্লেসমেন্ট পাইপ ও একটা ভারী জে-টাইপ হ্যাঁমার।

ইতোমধ্যে মেঝেতে আধ মিটার পানি জমে গেছে। টেপ বা অন্য কিছু দিয়ে ফুটোটা বন্ধ করা সম্ভব নয়। একটাই উপায় আছে, সেটা যদি ব্যর্থ হয়, নির্ঘাৎ ডুবে মরতে হবে ওদের। পাইপের একটা প্রান্ত ফুটোর ওপর ঠেকাল ও, অপর প্রান্তটা মোটা বাল্কহেড শীল্ডের ঢালু গায়ে চেপে ধরল। হাতুড়ি দিয়ে পাইপের নিচের দিকটায় ঘা মারল ও, ফুটো আর বাল্কহে শীল্ডের গায়ে শক্তভাবে আটকে গেল সেটা।

 পানি ঢোকা বন্ধ হলো, তবে পুরোপুরি নয়। কোনমতেই এটাকে স্থায়ী সমাধান বলা যাবে না। ধীরে ধীরে বড় হবে ফুটোটা, ছিটকে পড়বে পাইপ। পানিতে বসে থাকল পিট। এক মিনিট পর ভাবল, ব্যাপারটা অদ্ভুত নয়? বরফের মতো ঠাণ্ডা পানিতে বসে ঘামছি?

কনরো গাইওটে উঠে এল বিগ জন্। ডিজিটাল ডেপথ রিডিং-এর দিকে তাকাল পিট। তিনশো বাইশ মিটার ওপরে সারেফস।

 আপনার লোকদের কাউকে দেখতে পাচ্ছেন? জানতে চাইলেন প্লাঙ্কেট।

সোনার-রাডার প্রোবে হাত ছোঁয়াল পিট। ডিসপ্লেতে দশ বর্গ কিলোমিটার চুড়া সম্পূর্ণ খালি দেখা গেল। পিট আশা করেছিল, একটা রেসকিউ ভেহিকেল আসবে। কিন্তু আসেনি। না।

 উপর থেকে ওরা আমাদের মিউজিক শুনতে পায়নি, এ স্রেফ বিশ্বাস করা যায় না।

 রেসকিউ অপারেশন শুরু করতে প্রস্তুতির জন্যে সময় লাগে, বিড়বিড় করল পিট। ও জানে, অ্যাডমিরাল স্যানডেকার ও অ্যাল ওদের খোঁজে স্বর্গ-মর্ত্য তোলপাড় করে ফেলবেন। ওর প্ল্যানটা ওরা বুঝতে পারেনি, এটা মেনে নিতে মন চাইছে না। নিঃশব্দে চেয়ার ছাড়ল ও, এঞ্জিন কমপার্টমেন্টের দরজা তুলে ভেতরে তাকাল। ফুটোটা বড় হয়েছে, মেঝেতে পানি এখন এক মিটারের মতো। আর চল্লিশ মিনিটের মধ্যে টারবাইন ডুবে যাবে। টারবাইন ডুবলে জেনারেটরও ডুববে। লাইফ-সাপোর্ট সিস্টেম কাজ না করলে ওরাও বাঁচবে না।

ওরা আসবে, বিড়বিড় করল পিট। আমি জানি, আসবে ওঁরা।

.

১৭.

 দশ মিনিট পেরিয়ে গেল। তারপর বিশ মিনিট। ভীতিকর একটা নিঃসঙ্গতা ঘিরে। ধরল ওদেরকে।

এখন কি হবে? জানতে চাইলেন প্লাঙ্কেট। ওরা তো আসছে না।

আমরা উদ্ধার পাব কি পাব না, নির্ভর করে অ্যালের ওপর, বলল পিট। সে যদি ধরতে পারে আমি কি ভাবছি, তাহলে একটা সাবমারসিবল নিয়ে নিচে নামবে সে, ইকুইপমেন্ট থাকবে…

কিন্তু আপনার বন্ধু ইতোমধ্যে আপনাকে একবার হতাশ করেছেন।

নিশ্চয়ই কোন বিপদে পড়ে আসতে পারেনি সে। নিজের চেয়ারে ফিরে এসে বসল পিট। বিগ জনের আলো পড়েছে বাইরে, আলোয় আকৃষ্ট হয়ে এক ঝাক মাছ কাছাকাছি চলে এসেছে। সেদিকে তাকিয়ে ভুরু কোঁচকাল ও।

কি ব্যাপার?

 যেন মনে হলো একটা শব্দ শুনলাম!

মনের ভুল, বললেন প্লাঙ্কেট। ধীরে ধীরে মরার চেয়ে হঠাৎ প্রাণ হারানোই ভাল বলে মনে করি, ডার্ক। কেবিনটা পানিতে ডুবিয়ে দিয়ে, আসুন, ঝামেলা সেরে ফেলি।

হঠাৎ নিঃশব্দে হাসল পিট। চেয়ারে নড়ে বসল, তাকাল আপার ভিউইং উইন্ডোয়। বিগ জনের পিছনে, সামান্য ওপরে, ভাসছে নুমার একটা সাবমারসিবল? ভেতরে বসে রয়েছে অ্যাল, বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসছে সে। বড়, গোল পোর্টে অ্যাডমিরাল স্যানডেকারকেও দেখা গেল।

পিটকে প্রচণ্ড শক্তিতে আলিঙ্গন করলেন প্লাঙ্কেট, দম আটকে মারা যাবার অবস্থা হলো পিটের। নিজেকে ছাড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে ও, প্লাঙ্কেট ওকে চুমো খেলেন।

আপনি আমার আপন ভাই!

ছাড়া পেয়ে দম নিচ্ছে পিট, স্পীকারের ভেতর থেকে বেরিয়ে অ্যালের গলা ভেসে এল, আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?

কানে মধু বর্ষণ করছে হে!

দেরি করার জন্যে দুঃখিত, পিট। প্রথম সাবটা সারফেসে ওঠার পর ডুবে গেছে। এটার ব্যাটারি শেষ হয়ে গিয়েছিল, মেরামত করতে দেরি হয়ে গেল।

তোমার সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। গুড টু সী ইউ, অ্যাডমিরাল।

ড্রাগন তোমার স্ট্যাটাস জানাও, নির্দেশ দিলেন অ্যাডমিরাল।

একটা ফুটো তৈরি হয়েছে, আর কয়েক মিনিটের মধ্যে পাওয়ার সোর্স বন্ধ। করে দেবে। কাবি সব ঠিক আছে।

তাহলে আর কোন কথা নয়, আমরা কাজ শুরু করছি।

অ্যাটাক সাবমেরিন টাকসন থেকে অক্সিজেন ক্যাটিং ইকুইপমেন্ট নিয়ে এসেছে অ্যাল, সাবমারসিবলের যান্ত্রিক বাহুতে জোড়া লাগানো হয়েছে সেটা। সেই কাটিং ইকুইপমেন্টের সাহায্যে বিগ জনের সমস্ত মাউন্ট, ড্রাইভ শ্রাফট ইত্যাদি কেটে আলাদা করা হবে, উদ্দেশ্য মেইন ফ্রেমও ট্র্যাক মেকানিজম থেকে কন্ট্রোল হাউজিং বিচ্ছিন্ন করা।

পঁয়ত্রিশ মিনিট পর বিগ জনের শুধু কন্ট্রোল হাউজিংটা হুক দিয়ে আটকে পানির ওপর তোলা হল। পানিতে ভেসে অবাক হয়ে বিশাল সাবমেরিনের লেজের দিকে চেয়ে থাকে পিট। প্লাঙ্কেটকে ওদিকে টেনে তোলা হলো সাবমেরিনের উপরে। ইউএস নেভীর লোকেরা ঘিরে রেখেছে ব্রিটিশ ভদ্রলোককে।

নুমা সাবমারসিবল থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো অ্যাল। দুই কান বিস্তৃত হাসি হাসছে।

দেখলে তো, তোমার জন্যে এত্তো ঝামেলা! চারপাশের ব্যস্ততার দিকে ইঙ্গিত করলো সে। এর জন্যে বহু টাকা গচ্চা যাচ্ছে হে!

কিন্তু বেঁচে থাকার আনন্দ নয়, পিটের চেহারায় নির্দয় হিংস্রতা। টানটান, অস্বাভাবিক স্বরে সে বলে উঠলো, যেই দায়ী থাকুক এর জন্যে, চরম মূল্যই দিতে হবে তাকে।

.

দ্বিতীয় পর্ব

দ্য কেইটেন মিনেস

৬ অক্টোবর, ১৯৯৩, টোকিও, জাপান।

১৮.

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সুইসাইড স্কোয়াডের- জাপানি পাইলটরা প্লেনে ওঠার আগের মুহূর্তে পরস্পরকে বিদায় জানাবার সময় বলতে, আবার দেখা হবে ইয়াসুকুনিতে।

ইয়াসুকুনি হলো পবিত্র তীর্থ মন্দির। সেই ১৮৬৮ সাল থেকে সম্রাটের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে যারা মারা গেছে তাদের পবিত্র স্মৃতিতে উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয় মন্দিরটা। একটা ঢালের মাথায় বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে তীর্থভূমি, টোকিওর মাঝখানে। ঢালটার নাম কুড়ান হিল। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আচার অনুষ্ঠানের জন্যে মূল হলটা তৈরি করা হয়েছে শিন্টো স্থাপত্য রীতি অনুসারে। ওখানে কোন রকম ফার্নিচার রাখা হয়নি।

প্রাচীন ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা শিন্টো আসলে জাপানিদের একটা সাংস্কৃতিক ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি, খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। শিন্টো আজ বহু শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত, দল-উপদলের সংখ্যা-সীমা নেই। অবশেষে শিন্টো বলতে মানুষ বোঝে, বিভিন্ন দেবতা বা ঈশ্বরের মাধ্যমে ঐশ্বরিক ক্ষমতা অর্জনের উপায় বিশেষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দেখা গেল, শিন্টো হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রীয় পূজা পদ্ধতি বা রাষ্ট্রীয় ধর্মবিশ্বাস ও নৈতিক দর্শন; প্রচলিত অন্যান্য ধর্মের সাথে কোন মিলই নেই। আমেরিকানদের দখলে থাকার সময় শিন্টো তীর্থভূমি ও মন্দিরগুলো সরকারি সমর্থন হারায়, তবে পরে ওগুলোকে জাতীয় জাদুঘর, ধনভাণ্ডার ও পবিত্র সাংস্কৃতিক স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়।

সমস্ত শিন্টো মন্দিরের ভেতরে, মূল উপসানালয়ে, প্রধান পুরোহিত ছাড়া আর কারও প্রবেশ নিষেধ। প্রতিটি উপাসনালয়ের ভেতরে একটা বস্তু থাকে, ঐশ্বরিক আত্মা বা ক্ষমতার প্রতীক বলে মনে করা হয় সেটাকে যা কিনা মহা-পবিত্র হিসেবে মর্যাদা পায়-ইয়াসুকুনিতে মহা-পবিত্র ঐশ্বরিক ক্ষমতার প্রতীক চিহ্ন হলো একটা আয়না।

ব্রোঞ্জের তৈরি বিশাল তোরণ পেরিয়ে যুদ্ধে নিহত বীরদের সমাধি-মন্দিরে কোন বিদেশী ঢুকতে পারে না। বীর যোদ্ধারা যেখানেই মারা গিয়ে থাকুক, মনে করা হয় তাদের সবার আত্মা এই মন্দিরে অবস্থান করছে। সংখ্যায় তারা আড়াই লাখের কম নয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইয়াসুকুনি স্রেফ সামরিক স্মৃতিমন্দির থাকল না। রক্ষণশীল ডানপন্থী রাজনীতিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের গোপন মিটিং বসতে শুরু করল এখানে। এখনও তারা স্বপ্ন দেখেন, গুণে মানে শ্রেষ্ঠ জাপানি কালচার পৃথিবীর বুকে বিশংশাল এক সাম্রাজ্যের জন্ম দিতে পারে, সে সাম্রাজ্যে শুধু জাপানিরাই কর্তত্ব করবে। প্রতি বছর একবার অন্তত জাপানের প্রধানমন্ত্রি তাঁর মন্ত্রীসভার সদস্য ও পার্টি নেতাদের নিয়ে ইয়াসুকুনিতে আসেন, ১৯৪৫ সালে জাপানের পরাজয় বার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে। তাঁর এই আগমন টিভি ও রেডিওতে ফলাও করে প্রচার করা হয়। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণত তীব্র প্রতিবাদ জানায়, তাদের সাথে যোগ দেয় বামপন্থী ও মধ্যপন্থী রাজনীতির সমর্থকরা, শিন্টো-বিরোধী ধর্মীয় দল-উপদল এবং প্রতিবেশী দেশগুলো, যুদ্ধের সময় জাপানিদের দ্বারা যারা নির্যাতিত হয়েছে।

সমালোচনা এড়াতে উগ্র মৌলবাদী ও ডানপন্থী রাজনীতিক ও সামরিক কর্মকর্তারা ইয়াসুকুনিতে আসেন রাতের অন্ধকারে, সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে। ভূত বা চোরের মত আসা-যাওয়া করেন তারা, যদিও কেউই তারা সমাজের সাধারণ মানুষ নন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন জাপানের শিল্পপতি, ব্যাংকার, ক্ষমতাধর রাজনৈতিক নেতা ও সরকারি কর্মকর্তা।

এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি হলো হিদেকি সুমা।

.

ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে, ব্রোঞ্জ তোরণ পেরিয়ে ইয়াসুকুনি উপাসনালয়ের দিকে ধীরে পায়ে হাঁটছে হিদেকি সুমা। মাঝরাত পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই, চারদিকে অন্ধকার, শুধু টোকিওর উজ্জ্বল আলো মেঘে প্রতিফলিত হয়ে স্নানআভা ছড়িয়ে রেখেছে কুড়ান হিলের ওপর। অবশ্য অন্ধকারেও ইয়াসুকুনির পথ চিনতে হিদেকি সুমার কোন অসুবিধে হয় না, পবিত্র মন্দিরের প্রতিটি ইঞ্চি তার চেনা। বড় একটা গাছের নিচে দাঁড়াল সে, উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বিশাল উঠানের চারদিকে চোখ বুলাল। কোথাও কিছু নড়ছে না।

কেউ লক্ষ করছে না, বুঝতে পেরে স্বস্তিবোধ করল সুমা। আরও খানিক এগোল সে, একটা পাথুরে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে রীতি অনুসারে হাত ধুলো, তারপর কাঠের হাতা দিয়ে পানি তুলে মুখে পুরল, কুলকুল শব্দ করে মুখের ভেতরটাও ধুলো। মন্দিরের ভেতর ঢুকে থামল না সে, করিডর ধরে হনহন করে এগোল। প্রধান পুরোহিত অপেক্ষা করছেন তার জন্যে। উপাসনালয়ে পৌঁছে পুরোহিতের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করল সে। দুজনের মধ্যে কোন বাক্যবিনিময় হলো না, মাথা নত করে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র উচ্চারণ করল হিদেকি সুমা, রেনকোটের পকেট থেকে টিস্যু পেপারে মোড়া এক তোড়া নোট বের করে পুরোহিতের হাতে ধরিয়ে দিল। প্যাকেটটা বেদির ওপর রাখলেন পুরোহিত।

মন্দিরের ভেতর ঢং ঢং করে ঘণ্টা বেজে উঠল, হিদেকি সুমার নির্দিষ্ট ঈশ্বরকে আহ্বান করা হচ্ছে। এরপর দুইজোড়া হাত এক হলো। সুমার নিজের আত্মশুদ্ধির জন্যে পুরোহিত সুমার সাফল্যের জন্যে প্রার্থনা করলেন।

প্রার্থনা শেষে পুরোহিতের সাথে এক মিনিট আলাপ করল সুমা, নিচুস্বরে। টিস্যু পেপাটা পুরোহিতের হাত থেকে নিয়ে পকেটে ভরল, তারপর বেরিয়ে এল মন্দির থেকে।

গত তিনদিনের মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পেল হিদেকি সুমা। প্রার্থনা শেষ হতেই নতুন শক্তি ও অনুপ্রেরণা লাভ করেছে সে। তার ঈশ্বর তাকে ঐশ্বরিক ক্ষমতা দান করেছেন, অন্তরে জ্বেলে দিয়েছেন আশার আলো। হিদেকি সুমার গোটা জীবনটাই একটা ধর্মযুদ্ধে নিবেদিত। দুটো যুদ্ধক্ষেত্রে লড়ছে সে। পশ্চিমা বিষাক্ত প্রভাব থেকে জাপানি সংস্কৃতিকে মুক্ত করতে হবে। এবং জাপান যে অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে, সেটাকে গোটা দুনিয়ার বুকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে হবে। হিদেকি সুমা বিশ্বাস করে, এই যুদ্ধে তাকে সাহায্য করছে ঐশ্বরিক একটা ক্ষমতা।

ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে এখন যদি কেউ দেখে ফেলে হিদেকি সুমাকে, কোন গুরুত্ব দেবে বলে মনে হয় না। পরনে শ্রমিকদের ওভারাল, রঙচটা সস্তাদরের নেরকোট, মাথায় কোট হ্যাট নেই, দেখে মনে হবে নিতান্তই সাধারণ একজন লোক। খুবই লম্বা তার চুল, খুলির পিছনে ইচ্ছে করলে একটা খোঁপা বাধা যায়। ঊনপঞ্চশ বছর বয়েস, তবে কালো চুলের জন্যে আরও অনেক কম বয়েসী বলে মনে হয় তাকে। জাপানিদের তুলনায় একটু বেশি লম্বা সে, একশো সত্তর সেন্টিমিটার।

শুধু তার চোখের দিকে তাকালে বোঝা যায়, এই লোক সাধারণ কেউ নয়। নীল চোখ জোড়ায় অদ্ভুত এক সম্মোহনী শক্তি, যেন একবার তাকালেই বশ্যতা স্বীকার না করে উপায় নেই। চিরকালই রোগা-পাতলা সে, তবে পনেরো বছর বয়েস থেকে ওয়েট লিফটিং চর্চা করছে। অমানুষিক পরিশ্রম ও দৃঢ় প্রত্যয়ে সে তার শরীরটাকে পরিণত করেছে পেশীসর্বস্ত একটা কঠিন পাথুরে মূর্তিতে।

মাথা নত করে শ্রদ্ধা জানাবার পর হিদেকির দেহরক্ষী তথা শোফার তোরণের গেটটা বন্ধ করে দিল। মুরো কামাতোরি, সুমার পুরানো বন্ধু ও প্রধান সহকারী, তোশি কুদো, সুমার সেক্রেটারি, তোরণের দিকে পিছন ফেরা একটা কালো মুরমটো লিমুজিনে বসে আছে। গাড়িটাকে চালায় বারো সিলিন্ডারের, ছয়শো ঘোড়ার একটা এঞ্জিন। ধীর পায়ে হেঁটে এসে পিছনের সীটে বসল হিদেকি সুমা।

সাধারণ জাপানি মেয়েদের চেয়ে অন্তত দুইঞ্চি বেশি লম্বা তোশি কুদো। দীর্ঘ, সুগঠিত পা; ঘন কালো লম্বা চুল, কোমর পর্যন্ত বিস্তৃত, ত্রুটিহীন হালকা হলুদ রঙা ত্বক, চোখ যেন দুফোঁটা কফি, দেখে মনে হবে জেমস বন্ড সিনেমার একজন নায়িকা। শুধু দেখতেই সুন্দরী বা সেক্সি নয়, তোশির বুদ্ধিও খুব ধারাল। তার আইকিউ একশো পঁয়ষট্টি।

হিদেকি সুমা গাড়িতে উঠল, কিন্তু তার দিকে তাকাল না তোশি কুদো। তার মন ও চোখ আটকে আছে কোলের ওপর রাখা একটা কমপ্যাক্ট কমপিউটারের স্ক্রীনে।

 মুরো কামাতোরি একটা টেলিফোনে কথা বলছে। তার বুদ্ধি তোশি কুদোর সমতুল্য না হতে পারে, তবে সুমার গোপন পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত করার জন্যে যে নিষ্ঠুরতা, শয়তানি ও নোংরা চাতুর্য দরকার তা তার মধ্যে প্রচুর পরিমাণেই আছে। সমস্ত দুনম্বর কাজ তাকে দিয়েই করায় সুমা।

লালমুখো, রাগী বাঁদরের মত চেহারা মুরো কামাতোরির। তার ভুরু অত্যন্ত ঘন ও কালো, নিচে প্রাণহীন একজোড়া চোখ, চোখে মোটা লেন্সের বিমলেস চশমা। ঠোঁট দুটো পরস্পরের সাথে শক্তভাবে সেঁটে থাকে, মুরো কামাতোরিকে কেউ কখনও হাসতে দেখেনি। দয়া বা ভাবাবেগ বলে কিছু নেই তার ভেতর। একটা বিশেষ খেলার ভক্ত সে, খেলেও খুব ভাল, এ ব্যাপারে তাকে একটা প্রতিভাই বলা যায়। খেলাটার নাম, মানুষ শিকার।

দুনিয়ায় এক শুধু হিদেকি সুমার প্রতি অনুগত মুরো কামাতোরি। কেউ যদি হিদেকি সুমার কাছে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তা সে যতই ধনী ব্যবসায়ী বা প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তা হোক, যে কোন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাতে হবে তাকে, দোষ চাপবে ব্যক্তিগত কোন শত্রু অথবা বিরুদ্ধ রাজনৈতিক দলের ওপর।

খুনী মুরো কামাতোরির একটা বৈশিষ্ট্য হলো, প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিশদ বিবরণ একটা খাতায় লিখে রাখে সে। গত পঁচিশ বছরে দুশো সাঁইত্রিশটা খুনের বিবরণ লিখেছে।

 টেলিফোনে কথা শেষ করে রিসিভারটা আর্মরেস্ট ক্রেডলে রেখে দিল সে, তাকাল সুমার দিকে। অ্যাডমিরাল ইতাকুরা কথা বললেন। অ্যাডমিরাল ইতাকুরা ওয়াশিংটনে রয়েছেন, জাপানি দূতাবাসে। তিনি তার সূত্র থেকে জানতে পেরেছেন, হোয়াইট হাউস নিশ্চিত যে বিস্ফোরণটা নিউক্লিয়ার এবং দায়ী হলো ডিভাইন স্টার।

মৃদু কাঁধ ঝাঁকাল হিদেকি সুমা। ওদের প্রেসিডেন্ট কি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কাছে কোন আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানিয়েছে।

 মার্কিন সরকার অদ্ভুত আচরণ করছে, বলল মুরো কামাতোরি। প্রতিবাদ তো দূরের কথা, টু-শব্দটিও করছে না। তবে নরওয়ে আর ব্রিটেন খুব চেঁচামেচি করছে, জাহাজ হারিয়েছে বলে।

মার্কিন নিউজ মিডিয়া?

অস্পষ্ট রিপোর্ট ছাপছে কাগজগুলো। টিভি নেটওঅর্কও পরিষ্কার কিছু বলছে না।

সামনের দিকে ঝুঁকল সুমা, তোশি কুদোর নাইলন ঢাকা হাঁটুতে টোকা দিল। এক্সপ্লোসন সাইটের ছবিটা দেখাও তো, প্লীজ।

 সমীহের সাথে মাথা ঝাঁকাল তোশি, চাপ দিল কমপিউটারের বোম। ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে ডিভাইডার ওয়াল-এর ফিট করা ফ্যাক্স মেশিন থেকে রঙিন একটা ফটো বেরিয়ে এল। ডিভাইডার ওয়ালটা ড্রাইভার ও প্যাসেঞ্জার কমপার্টমেন্টের মাঝখানে। ফটোটা সুমার হাতে ধরিয়ে দিল তোশি, সুমা ভেতরের একটা আলো জ্বালাল, তারপর মুরো কামাতোরির বাড়িয়ে দেয়া হাত থেকে ম্যাগরিফাইং গ্লাসটা নিল।

 ইনফ্রারেড ফটোটা দেড় ঘণ্টা আগে আমাদের আগাগি স্পাই স্যাটেলাইট থেকে, চোখে প্রশ্ন। একটা নিউক্লিয়ার হান্টার কিলার অ্যাটাক সাবমেরিন, আর একটা চাইনিজ জাংক? আমি যেমন আশা করেছিলাম, আমেরিকা তো সেরকম আচরণ করছে না। অদ্ভুত, ওরা ওদের প্যাসিফিক ফ্লিটের অন্তত অর্ধেকটা তো পাঠাবে।

 এক্সপ্লোসন এরিয়ার দিকে কয়েকটা ন্যাভাল শিপ যাচ্ছে, বলল মুরো কামাতোরি। ওদিকে একটা ওশেন সার্ভে বেসেলও আছে, নুমার।

হোয়াই অ্যাবাউট স্পেস সার্ভেইল্যান্স?

মাকিনীরা তাদের পিরামিড়ার স্পাই স্যাটেলাইট ও এস আর-নাইনটি এয়ার ক্রাফটের সাহায্যে এই মধ্যে যথেষ্ট ডাটা সংগ্রহ করেছে।

ফটোয় গায়ে ছোট একটা বিন্দুর ওপর আঙুলের টোকা দিল সুমা। দুটো ভেসেলের মাঝখানে একটা সাবমারসিবল ভাসছে। কোত্থেকে এল ওটা?

ফটোর দিকে ঝুঁকে পড়ল মুরো কামাতোরি। জাংক থেকে অবশ্যই আসেনি। নিশ্চয়ই সাবমেরিনটা থেকে এসেছে।

 যত চেষ্টাই করুক, ডিভাইন স্টারের কিছুই ওরা খুঁজে পাবে না, বিড় বিড় করে বলল হিদেকি সুমা। বিস্ফোরণে নিশ্চয়ই ওটা অণুতে পরিণত হয়েছে। ফটোটা তোশির দিকে ছুঁড়ে দিল সে। আরেকটা রিড আউট, প্লীজ যেসব ক্যারিয়ার আমাদের তৈরি গাড়ি বহন করছে, ওগুলোর বর্তমান স্ট্যাটাস ও গন্তব্য।

মুখ তুলে তার দিকে তাকাল তোশি, সমস্ত তথ্য আমার কাছে আছে, মি. সুমা।

ইয়েস?

কাল রাতে বোস্টনে অটো কার্গো খালাস করেছে ডিভাইন মুন, রিপোর্ট করল তোশি, ডিসপ্লে স্ক্রীনের জাপানি লেখাগুলোর ওপর চোখ। ডিভাইন ওয়াটার…আট ঘন্টা আগে লস অ্যাঞ্জেলেস পোর্টে ভিড়েছে ওটা, এই মুহূর্তে কার্গো খালাস করছে।

বাকিগুলো?

আর দুটো। ডিভাইন স্কাই নিউ অরলিয়নস-এর ভিড়বে আঠারো ঘণ্টার মধ্যে। লস অ্যাঞ্জেলেসে ডিভাইন লেক পৌঁছাবে পাঁচ দিন পর।

 আমাদের বোধহয় জাহাজগুলোকে জরুরি নির্দেশ পাঠানো উচিত, বলল মুরো কামাতোরি। আমেরিকার দিকে না গিয়ে অন্য কোন দিকে চলে যাক। মার্কিন কাস্টমসকে হয়তো সতর্ক করে দেয়া হয়েছে, রেডিয়েশন আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখবে ওরা।

লস অ্যাঞ্জেলেসে আমাদের আন্ডারকভার এজেন্ট কে? জানতে চাইল হিদেকি সুমা।

 দক্ষিণ-পশ্চিম রাজ্যগুলোর আমাদের গোপন ব্যাপারগুলো দেখাশোনা করেন জর্জ ফুরোকাওয়া।

সীটে হেলান, দিল সুমা। ফুরোকাওয়া অত্যন্ত যোগ্য মানুষ। মার্কিন কাস্টমস কড়াকড়ি করলে আগাম খবর পাবে সে। কামাতোরির দিকে তাকাল, দেখল টেলিফোনে কথা বলছে তার সহকারী। আরও তথ্য না পাওয়ার আগে ডিভাইন স্কাইকে জ্যামাইকার দিকে ঘুরে যেতে বললো। তবে ডিভাইন লেক লস অ্যাঞ্জেলেসে যেমন যাচ্ছে যাক।

ফোনে কথা শেষ করে মাথা আঁকাল কামাতোরি, তারপর আবার ডায়াল করল।

আমরা কি ধরা পড়ার ঝুঁকি নিচ্ছি না, মি. সুমা? নরম সুরে জিজ্ঞেস করল তোশি।

ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মাথা নাড়ল সুমা। মার্কিন ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস জাহাজগুলো সার্চ করবে, করুক। বোমাগুলো কোনদিন খুঁজে পাবে না ওরা। আমাদের টেকনলজির কাছে হার মানতে হবে ওদের।

ডিভাইন স্টারে বিস্ফোরণটা হলো খারাপ একটা সময়ে, বলল তোশি। ভাবছি কারণটা কোনদিন আমরা জানতে পারব কিনা।

ও-সব নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না, ঠাণ্ডা সুরে বলল সুমা। অ্যাকসিডেন্টটা দুর্ভাগ্যজনক, তবে সেটা আমাদের কেইটেন প্রজেক্ট শেষ করতে কোন বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। তার চেহারায় হিংস্র একটা ভাব ফুটে উঠল। আমাদের নতুন। সাম্রাজ্যের জন্যে হুমকি হয়ে দাঁড়ালে যেকোন রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দেয়ার মত খুঁটি ইতোমধ্যেই সাজিয়ে ফেলেছি আমরা।

.

১৯.

 নামকরা প্রতিষ্ঠান স্যামুয়েল জে, ভিনসেন্ট ল্যাবরেটরিজ-এর অফিসে বসে ভাইস প্রেসিডেন্ট জর্জ ফুরোকাওয়া টেলিফোনে তার স্ত্রীর সাথে কথা বলছে। দাঁতের ডাক্তারের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, একথা মনে করিয়ে দেয়ায় স্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাল সে, দুএকটা ভালবাসার কথা বলল, তারপর রেখে দিল রিসিভার।

অপরপ্রান্তের মহিলাটি তার স্ত্রী নয়, হিদেকি সুমার একজন এজেন্ট, মিসেস ফুরোকাওয়ার গলা হুবহু নকল করতে পারে। ডেন্টাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট আসলে একটা সঙ্কেত, এর আগে পাঁচবার পেয়েছে সে। এর অর্থ হলো, মুরমটো গাড়ি দিয়ে একটা জাহাজ ভিড়েছে বন্দরে, কার্গো খালাসের প্রস্তুতি চলছে।

বিকেলের বাকি সময়টা দাঁতের ডাক্তারের কাছে থাকতে হবে, একথা সেক্রেটারিকে বলে এলিভেটরে চড়ল জর্জ ফুরোকাওয়া, নেমে এল আন্ডারগ্রাউন্ড গ্যারেজে। কয়েক পা হেঁটে একটা মুরমটো স্পোর্টস কারে উঠে বসল সে।

 সীটের তলাটা হাতড়াল জর্জ ফুরোকাওয়া। হ্যাঁ, একটা এনভেলাপ রয়েছে। প্রতিবারের মত এবারও এটা রেখে গেছে সুমার কোন লোক। ডক এরিয়া থেকে তিনটে গাড়ি ছাড়াবার জন্যে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট যা লাগবে, সবই রয়েছে এনভেলাপের ভেতর। পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হলো সে, কাগজগুলোয় কোন খুঁত নেই।

 গাড়িতে স্টার্ট দিল ফুরোকাওয়া। ইস্পাতের উঁচু গেটের কাছে এসে দাঁড়াল গাড়ি। গেটহাউস থেকে হাসিমুখে বেরিয়ে এল গার্ড।

আজ আপনি এত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছেন, মি. ফুরোকাওয়া?

আমার একটা ডেন্টাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।

 আপনার দাঁতের চিকিৎসা করে ডাক্তার নিশ্চয়ই একটা ইয়ট কিনে ফেলেছে।

শুধু ইয়ট, ফ্রান্সে একটা ভিলাও নয় কেন? পাল্টা কৌতুক করল জর্জ ফুরোকাওয়া।

 হেসে উঠল গার্ড, তারপর রুটিন প্রশ্ন করল, আজ রাতের জন্যে কোন ক্লাসিফায়েড কাজ বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন?

 না। অ্যাটাচী কেসটা অফিসে ফেলে এসেছি।

 দেয়ালের দিকে পিছু হটল গার্ড, একটা বোতামে চাপ দিতেই ইস্পাতের গেট ধীরে ধীরে খুলে গেল, গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে এল জর্জ ফুরোকাওয়া।

লম্বা একটা কাঁচ মোড়া বিল্ডিঙের দুটো ফ্লোর নিয়ে ভিনসেন্ট ল্যাব, পাঁচিলের ভেতর সার সার ইউক্যালিপটাস থাকায় রাস্তা থেকে ভাল দেখা যায় না। ভিনসেন্ট ল্যাব একটা মিলিটারি রিসার্চ ও ডিজাইন সেন্টার, মালিক হলো একাধিক স্পেস ও অ্যাভিয়েশন কোম্পানির একটা কনসোটিংয়াম। এখানের কাজগুলো অত্যন্ত গোপনীয়, ফলাফল কড়া পাহারায় রাখা হয়। কাজগুলো বেশিরভাগই আসে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে, এখানের আবিষ্কারগুলো একা শুধু সামরিক বাহিনী ব্যবহার করতে পারে।

 এসপিওনাজ জগতে যাদেরকে স্লীপার বলা হয়, জর্জ ফুরোকাওয়া তাদেরই একজন। তার মা-বাবা যুদ্ধের পরপরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসে, হাজার হাজার জাপানিদের সাথে। ফুরোকাওয়া দম্পতি আমেরিকায় আসে ঠিকই, কিন্তু আমেরিকাকে ভালবেসে নয়। চিরকালই তারা শুধু জাপানের প্রতি অনুগত ছিল, আমেরিকাকে জাপানের প্রধান শত্রু বলে মনে করেছে।

ফুরোকাওয়া দম্পতি তাদের একমাত্র সন্তানকে মার্কিন ব্যবসা জগতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে সম্ভাব্য সবকিছু করেছে। আমেরিকার সবচেয়ে নামী-দামী স্কুলে পড়িয়েছে ছেলেকে। টাকা তাদের জন্যে কোন সমস্যা হয়নি, জাপানি ব্যাঙ্ক থেকে টাকা এসেছে পারিবারিক অ্যাকাউন্টে। অবশেষে অ্যারোডাইনামিক ফিজিক্সে পিএইচডি করল জর্জ ফুরোকাওয়া, অর্জন করল ভিনসেন্ট ল্যাবে সম্মানজনক ও উঁচু মানের পদ। অ্যাভিয়েশন ডিজাইনারদের চোখে অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র, জর্জ ফুরোকাওয়া এখন আমেরিকার সর্বশেষ অ্যারোস্পেস টেকনলজি সংক্রান্ত মহামূল্য ও টপ সিক্রেট তথ্যাদি গোপনে পাচার করছে জাপানে, সরাসরি সুমার কাছে।

জাপানে কখনও যায়নি ফুরোকাওয়া, তবে তার পাঠানো ইনফরমেশন পাওয়ায় কয়েক বিলিয়ন মার্কিন ডলার বেঁচে গেছে জাপানের, গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে প্রায় কিছুই ব্যয় করতে হয়নি। আমেরিকার সাথে তার বিশ্বাসঘাতকতার ফলে পাঁচ বছর এগিয়ে এসেছে জাপান, অ্যারোস্পেস মার্কেটে দখল করেছে শীর্ষ স্থান।

হাওয়াই-এ হিদেকি সুমার সাথে একবারই মাত্র দেখা হয় তার। তখনই তাকে কেইটেন প্রজেক্টে রিট করা হয়। জাপানের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা পবিত্র একটি দায়িত্ব দিয়ে সম্মানিত করে তাকে। তার কাজ হলো, বিশেষ একটা রঙের গাড়ি ডক থেকে গোপনে সংগ্রহ করে অজানা গন্তব্যে পাঠিয়ে দেয়া। ফুরোকাওয়া কোন প্রশ্ন করে না। অপারেশনের সবটুকু তাকে জানানো হবে না, একথা শুনে সে বরং খুশিই হয়। এসব ব্যাপারে যত কম জানা যায় ততই ভাল। গভীরভাবে জড়িয়ে পড়লে মার্কিন টেকনলজি চুরির কাজটায় বরং বিঘ্ন সৃষ্টি হবে।

সান্তা মোনিকা বুলেবার্ডে চলে এল গাড়ি। এদিকটায় যানবাহনের সংখ্যা কমই। আরও কয়েক কিলোমিটার এগিয়ে দক্ষিণ দিকে বাঁক নিল সে উঠে এল সান। ডিয়াগো ফ্রিওয়েতে। আরেকবার ডান দিকে বাঁক ঘুরল সে, চলে এল হারবার ফ্রিওয়েতে। দশ মিনিট পর পৌঁছে গেল শিপিং টার্মিনাল এরিয়ায়। গাড়ি নিয়ে একটা গলির ভেতর ঢুকল ফুরোকাওয়া। খালি একটা ওয়ারহাউসের পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিরাট একটা ট্রাক ও একটা সেমিস্ট্রেইলার। ট্রাক ও ট্রেইলারের গায়ে নামকরা একটা স্টোরেজ কোম্পানির লোগো আঁকা রয়েছে। গাড়ি দুটোকে পাশ কাটিয়ে এসে থামল সে, হর্ন বাজাল দুবার। ট্রেইলারের ড্রাইভার সাড়া দিল তিন বার হর্ন বাজিয়ে, এগিয়ে এসে থামল স্পোর্টস কারের পিছনে।

 দশ মিনিট পর লোর্ডি ডক-এর সামনে দেখা গেল ফুরোকাওয়াকে। অসংখ্য ট্রাক ঢুকছে ও বেরিয়ে আসছে, কোনরকমে গা বাঁচিয়ে একটা পাঁচিল ঘেরা উঠানের গেটে এসে থামল সে। বিদেশ থেকে আমদানি করা গাড়িগুলো রাখা হয় এখানে। এনভেলাপ থেকে বের করে ডকুমেন্টগুলো গার্ডের হাতে ধরিয়ে দিল ফুরোকাওয়া, তাকিয়ে দেখল ডিভাইন ওয়াটার থেকে আনলোড করা গাড়িতে ভরে গেছে বিশাল উঠানটা। আশপাশের প্রতিটি উঠানের একই অবস্থা কোনটায় আছে টয়োটা, কোনটায় হোন্ডা বা মাজদা। ফুরোকাওয়ার সামনের উঠানে আরেকটা গেট দিয়ে এখনও ভেতরে ঢুকছে গাড়ি, প্রতি মিনিটে আঠারোটা করে।

কাগজগুলো ফিরিয়ে দিল গার্ড, বলল, সব ঠিক আছে, স্যার। তিনটে এসপি ফাইভ হানড্রেড স্পোর্ট সেডান। প্লীজ, রাস্তার ওপারে চলে যান, কাগজগুলো ডেসপ্যাচারকে দেখালে সেই সব ব্যবস্থা করবে।

ধূমপানরত ডেসপ্যার ফুরোকাওয়াকে চিনতে পারল। আবার সেই পচা ব্রাউন রঙের গাড়িগুলো দিতে এসেছেন, স্যার? সকৌতুকে জানতে চাইল সে।

কাঁধ ঝাঁকাল ফুরোকাওয়া। আমার এক মক্কেল এগুলো তার সেলস ফ্লিট-এর জন্যে কেনে। বিশ্বাস করো বা না করো, ব্রাউন ছাড়া আর কোন রঙ পছন্দ নয় তার।

কি বেচে লোকটা, কুমীরের লেজ?

না, বিদেশী কফি।

 নামটা জানতে চাই না, আমার কোন আগ্রহ নেই।

ডেসপাচারের হাতে একশো ডলারের একটা নোট গুঁজে দিল ফুরোকাওয়া। কত তাড়াতাড়ি আমি ডেলিভারি পেতে পারি? জানতে চাইল সে।

নিঃশব্দ হাসল ডেসপাচার। কার্গো হোল্ডে আপনার গাড়ি খুঁজে পাওয়া পানির মত সহজ। বিশ মিনিটের মধ্যে হাজির করছি আপনার সামনে।

এক ঘণ্টার মধ্যে সেমিট্রেইলারে ভোলা হলো গাড়ি তিনটে। উঠান থেকে রওনা হয়ে গেল ট্রেইলার। ড্রাইভারের সাথে একবারও কথা বলেনি ফুরোকাওয়া। এমনকি দুজন ভুলেও একবার পরস্পরের দিকে তাকায়নি।

গেটের বাইরে বেরিয়ে এসে রাস্তার পাশে গাড়ি থামাল ফুরোকাওয়া, ধীরে সুস্থে একটা সিগারেট ধরাল। তাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল সেমি ট্রেইলার, বাঁক নিয়ে চলে যাচ্ছে হারবার ফ্রিওয়ের দিকে। ট্রেইলারের নাম্বার প্লেটে ক্যালিফোর্নিয়া লেখা রয়েছে, তবে রাস্তায় কোথাও বদলে ফেলা হবে ওটা।

 কৌতূহলটা তীব্র নয়, তবু ফুরোকাওয়া একবার ভাবল, ব্রাউন গাড়িগুলোর রহস্যটা কি? কি আছে ওগুলোয়? এগুলোর গন্তব্য এভাবে গোপন রাখা হয় কেন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *