৬. কোরাল রীপের ভেতর

ব্যারনেসের কাছ থেকে দিকনির্দেশনা পেয়ে কোরাল রীপের ভেতর সরু একটা প্যাসেজ ধরে ক্রীশ-ক্রাফট চালাল পিটার, রীফটা ঘিরে আছে ইল দ্র ইউসিউ-কে। পাখিদের পাখা ঝাপটানোর আওয়াজে কান পাতা দায় হলো, ঝাঁক বেঁধে মেঘের মতো ওদের মাথার ওপর আকাশ ঢেকে দিল ওগুলো। দ্বীপটার যেদিকে টানা বাতাস লাগছে তার উল্টো দিকে পাঁচ ফ্যাদম গভীরতায় নোঙর ফেলল পিটার, তারপর ভি.এইচ.এফ, রেডিওর সাহায্যে প্রধান দ্বীপটার সাথে যোগাযোগ করল, কথা বলল হেড, বোটম্যানের সাথে। ব্যারনেস সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রাতটা তিনি বোটে কাটাবেন, ব্যাখ্যা করল ও। দুশ্চিন্তা কোরো না।

 সেলুনে ছিল পিটার, ইতোমধ্যে নিজের চেষ্টায় ওঠা বসার মতো সুস্থতা ফিরে এসেছে ব্যারনেস ম্যাগডার। লকার থেকে টাওয়েলিং ট্র্যাক স্যুট বের করে পরেছে। সে, কুৎসিত দাগটা ঢাকার জন্যে গলায় একটা ভোয়ালে জড়িয়েছে। লকার খুলে মেডিসিন বক্স বের করল পিটার, আপত্তি সত্ত্বেও দুটো ক্যাপসুল আর দুটো ট্যাবলেট গিলতে করতে হলে ম্যাগডাকে। তারপর তার গলা থেকে তোয়ালে নামাল পিটার, আঙুলের ডগা দিয়ে আন্টিসেপটিক মলম মাখিয়ে দিল কালচে দাগের ওপর।

এখন আর জ্বালা করছে না, আরাম লাগছে, অস্ফুট বলল ম্যাগডা, চিচি করে আওয়াজ বেরুল। একটা শব্দও পরিষ্কার করে উচ্চারণ করতে পারছে না সে, ভেঙ্গে গেছে গলা।

 এবার দেখি পেটের কি অবস্থা। প্যাড লাগানো বেঞ্চে ধীরে ধীরে ম্যাগডাকে শুইয়ে দিল পিটার, টাউয়েলিং স্যুটের চেইন খুলল কোমর পর্যন্ত। ওর জোড়া পায়ের লাথিটা ম্যাগডার শুধু পেটে নয়, বুকেও লেগেছিল–স্তনের ঠিক নিচ থেকে নাভি পর্যন্ত লম্বা লালচে দাগ ফুটে আছে, ফুলে আছে মাংস। চামড়ায় মলমের প্রলেপ পড়তেই চোখ বুজল ব্যারনেস, আরাম পেয়ে অকুট-উ-আহ করতে লাগল। পিটারের কাজ শেষ হতে ধীরে ধীরে দাঁড়াল সে, একটু কুঁজো হয়ে পনেরো মিনিটের জন্যে বাথরুমে ঢুকল। এই ফাঁকে নিজের ক্ষতগুলোর যত্ন নিল পিটার। মুখ ধুয়ে, চুলে চিরুনি চালিয়ে বেরিয়ে এল ম্যাগডা, দেখল তার জন্যে গ্লাসে হুইস্কি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পিটার। বেঞ্চের ওপর পাশাপাশি বসল ওরা।

তুমি, পিটার? হঠাৎ উদ্বেগে অধীর দেখাল ম্যাগডাকে। তোমার কি অবস্থা?

 মাত্র একটা কথা বলার আছে আমার। আগাম নোটিস দিয়ে দেখবে, যাতে পালিয়ে বাঁচার একটা সুযোগ পাই। ওরে বাপরে বাপ!

হঠাৎ হাসতে গিয়ে গলায় ব্যথা পেল ম্যাগডা, পিটারকে ধরে ঝুলে পড়ল, বার কয়েক কাশল খক খক করে।

ম্যাগডা শান্ত হতে নরম গলায় জিজ্ঞেস করল পিটার, কথা হবে কখন? হওয়া দরকার, তাই না?

হ্যাঁ, জানি, কিন্তু এখন নয়, পিটার। আরো কিছুক্ষণ আমাকে ধরে থাকো। এবং আজ যেন নতুন করে উপলব্ধি করল পিটার প্রিয় নারীদেহ শরীরের সাথে সেঁটে থাকলে ব্যথা-বেদনা কোথায় যেন হারিয়ে যায়। ওর গলায় নাক ঘষল ম্যাগডা, আর ম্যাগডার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল পিটার। বললে, কিছুক্ষণ পর মুখ খুলল ম্যাগডা, আমাকে তুমি ভালোবাস। প্রশ্নের সুরে কথাটা বলা হলো, নতুন করে আশ্বস্ত হতে চাইছে, যা প্রতিটি প্রেমিক-প্রেমিকারই হতে চাওয়া একান্ত উচিত।

হ্যাঁ, ভালোবাসি তোমাকে। প্রথম থেকেই ব্যাপারটা জানতাম, কিন্তু যখন বুঝলাম তুমি খলিফা, মনের অনেক গভীরে মাটি চাপা দিয়েছিলাম ওটাকে-কিন্তু ছিল।

আমি খুশি, সাদামাঠা স্বীকারোক্তি ম্যাগডার। কারণ তুমি দেখেছ আমিও তোমাকে ভালোবাসি। ধরে নিয়েছিলাম, ও জিনিস কখনো আমার জীবনে আসবে না। নিজেকেই দোষ দিতাম, আমি ভালোবাসতে জানি না। তারপর তোমাকে দেখলাম, পিটার। থেমে গেল সে, যেন তোমাকে দেখলাম আর তোমাকে ভালোবাসলাম সমার্থক। কিন্তু তারপরই ওরা আমাকে বলল তুমি নাকি আমাকে খুন করবে। বলল, তুমি খলিফা। ইস, মনে হচ্ছিল আমি মারা যাব। তোমাকে পেলাম কিন্তু হারাতে হবে। নিয়তির এই নিষ্ঠুরতা আমার সহ্য হচ্ছিল না, পিটার। ব্যাপারটা যে মিথ্যে সেটা প্রমাণ করার একটা সুযোগ তোমাকে না দিয়ে আমার উপায় ছিল না।

কথা বোল না, ম্যাগডাকে কোলের আরো ভেতরে টেনে নিয়ে প্রায় শুইয়ে দিল পিটার। আমার গলা ভাঙেনি, কাজেই প্রথমে আমি বলি–কি জানি, কিভাবে জানলাম তুমি খলিফা।

এমন মারই মেরেছ, গালে একটা চুমো খাওয়ার জায়গা পর্যন্ত রাখনি?

ঝুঁকে ম্যাগডার ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াল পিটার, কিন্তু হাসল না। মেলিসা কিডন্যাপ হওয়ার আগের সব ঘটনা তুমি জানো। সব আমি তোমাকে বলেছিলাম, কিছুই বাদ দিইনি, একটা মিথ্যে কথা বলিনি, একবারও…, শুরু করল পিটার, মেলিসাকে কিভাবে উদ্ধার করা হলো তার বিশদ বর্ণনা দিল। তখন আমার মানসিক অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, যে যা বলে সব বিশ্বাস করতে রাজি, মেলিসাকে উদ্ধার করার জন্যে যে কোনো কাজ করতে পারি। বলল ডক্টর কিংস্টোন পার্কারকে নিজের অজান্তেই খুন করার প্ল্যান করে ও। লারাগের পোডড়াবাড়ির ঠিকানা কিভাবে পেল তাও বলল। কে যে টেলিফোনে খবরটা দিয়েছিল আর জানা যায়নি। তারপর ওরা আমাকে জানাল, তুমি খলিফা।

কে? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল ম্যাগডা।

অ্যাটলাসের প্রেসিডেন্ট।

পার্কার?

 হ্যাঁ, তিনি আর কলিন নোবলস্।

 কি বলল ওরা?

তুমি তখন খুব ছোট, বাবা তোমাকে প্যারিসে নিয়ে আসেন। তখনই নাকি তোমার মেধার কথা জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। তারপর বাবা অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেলেন। বাবার বন্ধুরা তোমাকে নিয়ে গেল। তোমার প্রতিভা দেখে কারা যেন তোমাকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করল। একজন লোককে কাকা বানিয়ে পাঠাল তারা…।

 দশ বছর ধরে বিশ্বাস করেছি সত্যি সে আমার কাকা ছিল…, অনেক কষ্টে নিজেকে থামাল ম্যাগডা, তারপর নিস্তেজ, বিষণ্ণ গলায় আবার বলল, বাবা মারা যাবার পর জানলাম সেই একমাত্র আমার আপনজন…।

তোমাকে ওডেসায় পাঠানোর জন্যে নির্বাচিত করা হলো…

আড়ষ্ট হয়ে গেল ম্যাগডা। তুমি… তুমি ওডেসার ব্যাপারটাও জানো, পিটার?

 ওখানে তোমাকে ট্রেনিং দেয়া হয় অনেক বিষয়ে।

হ্যাঁ।

যেমন, খালি হাতে কিভাবে একজন মানুষকে খুন করতে হয়।

পিটার, চেষ্টা করলেও শেষপর্যন্ত আমি তোমাকে খুন করতে পারতাম বলে বিশ্বাস করি না। অন্তত আমার অবচেতন মন থেকে প্রবল একটা বাধা নিশ্চয় আসত। ঘটেছেও ঠিক তাই। আমার যা ট্রেনিং, তোমার বাঁচার কথা ছিল না। বেঈমানী করেছ বলে ঘৃণা হয়েছিল, কিন্তু ভালোবাসার অস্তিত্ব ছিল…

 আবার তুমি কথা বলছ।

তারপর যখন জানলাম, তুমি আমাকে খুন করতে যাচ্ছ, প্রায় অবাস্তব মতো লাগল ব্যাপারটা। মৃত্যুকে মেনে নিতে তখন আর খারাপ লাগল না, কারণ ভালবাসা পেয়ে আবার হারানোর ব্যথা…

চুপ করবে?

মুখে একটা কিছু দাও-না, ঠোঁটে।

ম্যাগডাকে চুমো খেয়ে আবার শুরু করল পিটার, ওডেসায় ট্রেনিং নিলে তুমি। রাশিয়ার হয়ে কাজ করার জন্যে তৈরি করা হলো তোমাকে। সব সত্যি, তাই না?

 সব। আরো একটু জোরে পিটারের পিঠ জড়িয়ে ধরল ম্যাগডা। তোমাকে আর কখনো মিথ্যে কথা বলব না, পিটার।

 তারপর ওরা তোমাকে প্যারিসে পাঠাল? জিজ্ঞেস করল পিটার, উত্তরে মাথা ঝকাল ম্যাগডা। এসেই প্যারিসকে তুমি জয় করে নিলে। কোনো পুরুষের সাধ্য ছিল না তোমাকে এড়িয়ে যায়…।

কোনো মন্তব্য বা প্রতিবাদ করল না ম্যাগডা, তবে চোখ থেকে চোখ সরাল না।

আর তারা সবাই সুদর্শন, শক্তিশালী, ক্ষমতাবান পুরুষ ছিল। সংখ্যায় অনেক, কতজন কেউ বলতে পারে না। তাদের সবার কাছ থেকে রাশিয়ার জন্যে তথ্য সংগ্রহ করতে তুমি…

বেচারা, ফিসফিস করে বলল ম্যাগডা। এ-সব কথা ভেবে নিজেকে তুমি কষ্ট দিচ্ছো?

 তোমার ওপর ঘৃণা আরো বেড়ে যায় আমার।

 হ্যাঁ, বুঝতে পারি। কিন্তু তোমার অশান্তি দূর করার জন্যে কিছুই বলার নেই আমার শুধু এইটা বাদে! তোমার সাথে পরিচয় হবার আগে কাউকে আমি ভালোবাসিনি।

কথা রাখছে ম্যাগডা। এখন থেকে আর সে মিথ্যে বলবে না, ছলনার আশ্রয় নেবে না। পিটার নিশ্চিতভাবে জানে।

তারপর ওরা তোমাকে নির্দেশ দিল ব্যারন অল্টম্যানের বিশ্বাস অর্জন কর, তার শিল্প সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নাও…

না, নিচু গলায় কথাটা বলে মাথা নাড়ল ম্যাগডা। সিদ্ধান্তটা আমার ছিল। আমার জীবনে সেই একমাত্র পুরুষ ছিল যাকে আমি…, মাথার পিছনে হাত নিয়ে গিয়ে হুইস্কির গ্লাসটা বেঞ্চ থেকে তুলল সে, এক চুমুক খেয়ে গলা ভেজাল,… যে আমাকে জাদু করেছিল। এরকম মানুষ কোথাও আমি দেখিনি। তার গায়ের জোর সম্পর্কে বললে তুমি বিশ্বাস করবে না। আর ছিল ক্ষমতা-টাকার ক্ষমতা, রাজনৈতিক ক্ষমতা, যোগাযোগের ক্ষমতা, প্ল্যানিংয়ের ক্ষমতা। ওহ পিটার, মস্ত একটা আগ্নেয়গিরি মনে হত তাকে আমার।

ইতোমধ্যে একই ধরনের কাজ করে তুমি বোধ হয় একঘেয়েমিতে ভুগছিলে…।

বিভিন্ন লোকের সাথে প্রেমের অভিনয় করা, তারপর সবাইকে ফাঁকি দেয়া, কি যে কঠিন কাজ… এই প্রথম ক্ষীণ একটু হাসল ম্যাগডা, যেন নিজেকে ব্যঙ্গ করল।

অল্টম্যানের বিশ্বাস অর্জন করলে তুমি অসুস্থ ছিল সে, যোগ্য একজন কাউকে হয়তো মনে মনে খুঁজছিল, তোমাকে পেয়ে হাতে যেন স্বর্গ পেয়ে গেল। সে তোমাকে বিশ্বাস করায় তার ব্যবসার গোপন তথ্য জানার সুযোগ হলো তোমার, সব তুমি রাশিয়ায় পাচার করতে লাগলে। ওদের কাছে তোমার দাম একশ গুণ বেড়ে গেল।

কথা বলছে ওরা, আর ওদিকে ধীরে ধীরে রঙ বদলে ফুরিয়ে যাচ্ছে দিনের মেয়াদ, পোর্টহোলের বাইরে গোলাপ রাঙা মেঘ একটু একটু করে ফ্যাকাসে হয়ে এল। কেবিনের ভেতর ম্লান হতে থাকল আলো, এক সময় শুধু ব্যারনেস ম্যাগডার মুখটা কোমল আলো হয়ে ফুটে থাকল পিটারের চোখের নিচে। সুরটা অভিযোগের নয়, মৃদুকণ্ঠে বলে চলেছে পিটার। ম্যাগডা শুধু মাঝেমধ্যে দু-একবার প্রতিবাদের ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল, অথবা আঙুল দিয়ে জোরে হঠাৎ দু-একবার চেপে ধরল পিটারের বাহু। কখনো চোখ বুঝল সে, তিক্ত ঘটনাগুলো স্মরণ করতে চায় না।

তারপর এক সময় রুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠল, ওহ গড! সব সত্যি!

পিটার বলল, অল্টম্যান স্ত্রী হিসেবে কিভাবে ম্যাগডা বিপুল প্রভাব আর ক্ষমতার অংশীদার হলো। ব্যারনের শক্তি যত কমল ততই বাড়ল তার প্রতিপত্তি। ক্ষমতা কি জিনিস, উপলব্ধি করল ব্যারনেস। আরো ক্ষমতার জন্যে লালায়িত হয়ে উঠল সে। এমন একটা পর্যায় আসল, অনেক ব্যাপারে ব্যারনের সাথে দ্বিমত পোষণ করল সে। যেমন, দক্ষিণ আফ্রিকায় অস্ত্র বিক্রি! তুমি ব্যাপারটা পছন্দ করনি।

হ্যাঁ। আমরা তর্ক করেছি। মৃদু হাসল ম্যাগডা, কিন্তু হাসির কারণটা ব্যাখ্যা করল না–যেন এটা তার ব্যক্তিগত সেই সব স্মৃতির একটা, যা কাউকে বলা যায় না।

তারপর পিটার বলল, বিপুল ক্ষমা হাতে পেয়ে ব্যক্তিগত উচ্চাশা চরিতার্থের স্বপ্ন দেখতে শুরু করল ব্যারনেস। মহৎ বা অমর হওয়ার সাধ জাগল মনে। রাশিয়া বুঝতে পারল, ব্যারনেসের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে তারা। হুমকি দিল, চাপ সৃষ্টি করল, কিন্তু ততদিনে ব্যারনেস তাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। অল্টম্যানের মোসাড কানেকসন আবিষ্কার করে ফেলেছে সে, স্বামীর সাথে তাল মিলিয়ে ইসরায়েলি ইন্টেলিজেন্স মোসাডের সাথে সহযোগিতা করছে–অর্থাৎ রাশিয়ার জন্যে তার হাতে একটা অস্ত্র চলে এসেছ।

 অবিশ্বাস্য, পিটার! ফিসফিস করে বলল পিটার। আসল ঘটনার এত কাছাকাছি, প্রায় সত্যি বলা যায়। চিবুক নেরে পিটারকে আবার শুরু করার ইঙ্গিত করল সে।

 রাশিয়া হুমকি দিল তোমার পরিচয় ব্যারনকে জানিয়ে দেবে। তোমার কোনো উপায় ছিল না, ব্যারনকে খুন করার সিদ্ধান্ত নিলে তুমি। প্ল্যানটা সুন্দর ছিল, ব্যারন নিহত হলো, কেউ তোমাকে সন্দেহ করল না। অল্টম্যান গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রির একমাত্র মালিক বনে গেলে তুমি। মুক্তিপণের টাকাও নিলে, সে টাকা জমা পড়ল সুইজারল্যান্ডের একটা গোপন অ্যাকাউন্টে…

হায় ঈশ্বর!

 সত্যি নয়? নিশ্চিত হতে চাইল পিটার।

 ভীতিকর, পিটার! থামলে কেন, বল।

স্বামীকে হত্যা করার প্ল্যানটা নিখুঁতভাবে সফল হলো, সেই সাথে নতুন একটা সম্ভাবনাময় জগৎ তোমার সামনে উন্মোচিত হয়ে গেল। ঠিক এই সময় সত্যিকার খলিফা হয়ে উঠলে তুমি। অল্টম্যানকে খুন করার পর জিরো-সেভেন-জিরো হাইজ্যাক করার প্ল্যান কর তুমি, নাকি মাঝখানে আরো অপারেশন চালিয়েছে, আমার জানা নেই। ভিয়েনায় ওপেক মন্ত্রীদের ওপর হামলা চলে, কাজটা তোমার বলেই অনেকের ধারণা। রোমে রেড ব্রিগেড় পাইকারিভাবে খুন করল বাসভর্তি একদল স্কুলের ছেলেমেয়েকে, সম্ভবত ওখানেও তোমার হাত ছিল। তবে জিরো সেভেন-জিরো হাইজ্যাক করার সময়ই প্রথম খলিফা নামটা ব্যবহার করলে তুমি। এই অপারেশনও সফল হতে যাচ্ছিল, কিন্তু বাদ সাধল একজন কমান্ড। নিজের প্রতি ইঙ্গিত করল পিটার। এই ঘটনার পরই আমার ওপর চোখ পড়ল তোমার।

পিটারের কোল থেকে মাথা তুলে রিডিং লাইটের সুইজ অফ করল ম্যাগডা। সোনালি আলোয় ভরে উঠল কেবিন। পিটারের মুখ চোখ রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল সে। ইতোমধ্যে তুমি জেনে ফেলেছ, খলিফার পেছনে লোক লেগেছে। মোসাড, ফ্রেঞ্চ ইন্টেলিজেন্স ছাড়াও তথ্য পাবার ব্যক্তিগত উৎস ছিল তোমার। তুমি জানতে পারলে, লোকটা হলো ডক্টর কিংস্টোন পাকার। তিনিই যে শিকারি, সেটা আমার কাছ থেকে নিশ্চিতভাবে জানতে পার তুমি। তাকে খুন করার জন্যে আমাকে তোমার আদর্শ লোক বলে মনে হলো। স্পেশাল ট্রেনিং আছে আমার, সন্দেহ না জাগিয়ে তার কাছাকছি যেতে পারব। কিন্তু আমাকে দিয়ে কাজটা করাতে হলে শক্তিশালী একটা লিভার দরকার হবে।

না! বিড়বিড় করল ম্যাগডা, পিটারের মুখ থেকে চোখ সরাতে পারল না।

খাপে খাপে মিলে যায়, বলল পিটার। পুরোটাই। এবার ম্যাগডার মুখে কোনো কথা নেই।

মেলিসার আঙুল পাবার পর…

আমি অসুস্থবোধ করেছি…

 দুঃখিত। হুইস্কির গ্লাসটা বেঞ্চ থেকে তুলে ম্যাগডার মুখের সামনে ধরল পিটার। এক চুমুক হুইস্কি খেয়ে পিটারের কোল থেকে মাথা তুলল ম্যাগডা, আহত গলায় হাত রেখে চোখ বুজে বসে থাকল কয়েক সেকেন্ড।

 এখন ভালো? অবশেষে জিজ্ঞেস করল পিটার।

 হ্যাঁ। বল।

 সবই মিলে যায়, শুধু অজ্ঞাতনামার টেলিফোন কলটা বাদে। মেলিসা কোথায় আছে আমাদেরকে জানিয়ে দেয়া হলো। তবে ব্যাপারটা কো-ইন্সিডেন্স হতে পারে, খলিফার হিসেবের মধ্যে ছিল না।

কিন্তু প্রমাণ আছে বৈকি, শান্তভাবে বলল পিটার। জিলি ও’ শওনেসি, লারাগের হাইড-আউটে যে আটকে রেখেছিল মেলিসাকে, ওখান থেকে দুটো ফোন করে সে। দুটো ফোনই করা হয়েছিল রবুইলে, তোমার নম্বরে।

 নির্বাক তাকিয়ে থাকল ম্যাগডা।

জিলি ও’ শওনেসি তার স্যার খলিফাকে রিপোর্ট করেছিল, বলে উত্তরের অপেক্ষায় বসে থাকল পিটার। কিন্তু কোনো উত্তর আসছে না দেখে আবার শুরু করল। খলিফাকে খুন করার সিদ্ধান্ত নেয় ও, সম্ভাব্য জায়গাও ঠিক করে ফেলে, কিন্তু তার আগেই ব্যারনেস ওকে নিজের আস্তানা, এখানে ডেকে পাঠায়। ওটা ছিল মৃত্যুকে বরণ করে নেয়ার আমন্ত্রণ। ইতোমধ্যে ব্যারনেস জেনে ফেলেছে, তার পরিচয় ফাঁস হয়ে গেছে ওর কাছে।

বলে যাও।

আমি এলাম। তোমার নিদের্শে কাস্টমস অফিসাররা আমাকে সার্চ করল…

 মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল ম্যাগডা।

কাল রাতে তুমি তোমার লোকদের নিয়ে আমার কামরা সার্চ করিয়েছ। বুঝলাম, আজ তুমি খুন করতে চাও। জানতাম, বাঁচতে হলে প্রথমে আমাকে হানতে হবে। হানলামও তাই…

হ্যাঁ। গলায় হাত বুলাল ম্যাগডা। তুমিই প্রথমে।

উঠে গিয়ে বাল্কহেডের পেছন থেকে গ্লাস ভরে নিয়ে এল পিটার। ফিরে এসে দেখল ম্যাগডার চোখ আধবোজা হয়ে আছে, একটু একটু টলসে সে। দুঢেকে হুইস্কি খাওয়াল তাকে, তারপর গ্লাস রেখে দিয়ে দুহাতের উপর তুলে নিল শরীরটা। পিটারের বুকের সাথে লেপটে থাকল ব্যারনেস। তাকে নিয়ে মাস্টার কেবিনে ঢুকল পিটার, শুইয়ে দিল বাল্কে। নিচের লকারে বালিশ আর চাদর পাওয়া গেল, একই চাদরের তলায় ম্যাগডার পাশে লম্বা হলো পিটার। কুঁকড়ে ওর দিকে পিছলে এল ম্যাগডা, ওর শরীরের ভাঁজে ঢুকে পড়ল। পিটারের বুকে ম্যাগডার পিঠ, ওর শক্ত ঊরুতে তার গোল নিতম্ব, ওর ভাঁজ করা কনুইয়ের ওপর তার মাথা। পিটারের ওপর তার হাতটা তার পাঁজরের ওপর দিয়ে বুকের ওপর স্থির হয়ে থাকল। এই অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়ল ওরা। তারপর পিটার যখন চোখ মেলে পাশ ফিরল, অস্কুট গোঙানির মতো শব্দ করলেও ম্যাগডার ঘুম ভাঙল না। আবার ঘুমিয়ে পড়ল পিটার। দ্বিতীয়বার চোখ মেলে দেখল, ম্যাগডা নেই। এত চমকে উঠল, নিজেই অবাক হয়ে গেল। পলকের মধ্যে কত রকম সন্দেহ খেলে গেল মনে, তারপর বাথরুম থেকে পানির আওয়াজ পেয়ে ঢিল পড়ল পেশিতে। একটু পর বাথরুম থেকে ফিরল ম্যাগডা, টাওয়েলিং ট্রাক স্যুট খুলে ফেলেছে, বাহুর ভেতর তার নগ্ন শরীর অরক্ষিত অমূল্য সম্পদ বলে মনে হলো পিটারের।

 আবার ওদের ঘুম ভাঙল একসাথে, পোর্টহোল থেকে তখন রোদ ঢুকছে কেবিনের মেঝেতে।

 মাইগড, নির্ঘাত দুপুর হয়ে গেছে। বিছানায় উঠে বসল ব্যারনেস, মাথা ঝাঁকিয়ে চকচকে কালো চুল উদোম পিঠে ছড়িয়ে দিল।

কিন্তু পিটার উঠে বসতে গিয়ে গুঙিয়ে উঠল।

 কোথায় লাগল, শেরিং।

নিশ্চয়ই আমি ট্রাকের নিচে চাপা পড়েছিলাম। কাতরাতে লাগল পিটার। শুকাতে শুরু করায় ক্ষতগুলোয় টান ধরেছে, ছেঁড়া পেশি আর ছড়ে যাওয়া চামড়া সামান্য নড়াচড়াতেই প্রতিবাদ করে উঠল।

 দুজনের জন্যে একটাই মাত্র চিকিৎসা আছে, পিটারকে জানাল ব্যারনেস। সেটাকে আমরা তিন পর্যায়ে ভাগ করে নিতে পারি।

 পিটারকে বাল্ক থেকে নামতে সযত্নে সাহায্য করল সে, ও যেন থুড়থুড়ে একটা বুড়ো। আরো বেশি আদর আর সহানুভূতি আদায়ের জন্যে গোঙানির মাত্রা বাড়িয়ে দিল পিটার, ওরে দুষ্টু, বলে হেসে উঠল ম্যাগডা। একটু বেসুরো শোনালেও, এখন সে হাসতে পারছে।

 ক্রীশ-ক্রাফটের ডাইভিং প্ল্যাটফর্ম থেকে শান্তভাবে পানিতে নামল ওরা, পরস্পরকে ছুঁয়ে থেকে সাঁতার কাটল কিছুক্ষণ।

 কাজ হচ্ছে, স্বীকার করল পিটার, উষ্ণ লোনা পানিতে আরাম পেল থেঁতলানো শরীরটা।

পাশাপাশি থেকে সাঁতার কাটল ওরা, দুজনেই বিবস্ত্র-প্রথমে ধীরে ধীরে, তারপর দ্রুত, একেবারে সেই রীফ পর্যন্ত পিছিয়ে এল। হাপরের মতো হাঁপাচ্ছে ওরা।

এখন ভালো? চোখ থেকে চুল সরিয়ে জিজ্ঞেস করল ব্যারনেস।

আগের চেয়ে। চলো একদমে ফিরে যাই।

একসাথে ক্ৰীশ ক্রাফটে ফিরল ওরা, হাঁপাতে হাঁপাতে ককপিটে উঠল, পানি আর হাসি ছড়াচ্ছে চারদিকে। কিন্তু কু-উদ্দেশ্য নিয়ে পিটার হাত বাড়াতে, বাতাসের মতো মোলায়েম একটু আদর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল ম্যাগডা।

চিকিৎসার প্রথম পর্যায়ে শেষ হলো।

কোমরে শুধু একটা অ্যাপ্রন জড়িয়ে গ্যালিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ব্যারনেস, অ্যাপ্রনে তার পেটের লম্বা দাগটা ঢাকা পড়ল।

নতুন অভিজ্ঞতা! বিস্ময় প্রকাশ করল পিটার। অ্যাপ্রন যে কোনো পুরুষকে প্ররোচিত করতে পারে জানা ছিল না।

 তোমার না কফি বানাবার কথা? কৃত্রিম ঝঝের সাথে মনে করিয়ে দিল ম্যাগডা। কিন্তু পিটার নড়ছে বা চোখ ফেরাচ্ছে না দেখে নিতম্ব দিয়ে ধাক্কা দিল সে।

মোটা, ফোলা, আর সোনালি ওমলেটের দিক থেকে চোখ তুলে ম্যাগডার বুকের দিকে তাকাল পিটার। খেতে শুরু করে মন্তব্য করল, অদ্ভুত মিল আছে।

 হাভাতে, জবাব দিল ব্যারনেস, হঠাৎ লালচে হয়ে ওঠা চেহারাটা লুকাতে চেষ্টা করল না।

প্রচুর খেল ওরা, ঝলমলে নতুন সকাল কাল রাতের সমস্ত উদ্বেগ, উত্তেজনা, আর দ্বন্দ মন থেকে মুছে নিয়ে সুন্দর মেজাজ দান করেছে ওদেরকে। আকাশে পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘ যেন ভেড়ার পাল, মন্থরগতিতে চলছে, আর ফাঁকগুলোর ভেতর আকাশ অদ্ভুত সুন্দর উজ্জ্বল নীল। কেউই ওরা এই খোশ মেজাজ হারাতে চায় না, অর্থহীন আর অপ্রাসঙ্গিক প্রলাপ বকে চলেছে। সীগালদের লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারছে রুটির টুকরো, প্রশংসা করছে আবহাওয়া–যেন পিকনিকে বেরিয়েছে দুটো বাচ্চা।

তারপর ম্যাগডা দাঁড়াল, হঠাৎ ঘাড় ফিরিয়ে লক্ষ্য করল তার নিতম্বের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে পিটার। চোখে রাগ নিয়ে হেঁটে এল ব্যারনেস, ধপ করে বসে পড়ল পিটারের কোলে। দেখ এবার! তারপর পিটারের একটা হাতের কবজি ধরল। পালস্ দেখার ভান করছে।

রোগীর অবস্থা আগের চেয়ে ভালো, ঘোষণা করল সে। তৃতীয় পর্যায়ের চিকিৎসা বোধ হয় শুরু করা যেতে পারে।

সেটা কি?

পিটার, মাই লাভ, কোনো ভয় নেই তোমার, অভয় দিল ব্যারনেস, পিটারের কোলের ওপর নিতম্ব ঘষল সে। যদি ভুলেও গিয়ে থাকো, সব তোমাকে আমি শিখিয়ে নেব।

তুমি নদীর মতো ডাগর একটা মেয়ে, ঢোক গিয়ে বলল পিটার।

গরম রোদে মিলিত হলো ওরা, নরম বালি আর ফেনা ওদের বিছানা হলো, টানা বাতাস অদৃশ্য আঙ্গুলের মতো সোহাগের স্পর্শ দিয়ে গেল শরীরে।

ব্যাপারটা শুরু হলো খুনসুটি আর হাসাহাসি দিয়ে। নতুন করে পরস্পরকে আবিষ্কারের আনন্দে আঁতকে ওঠার মতো শব্দ করল ওরা, বিড়বিড় করে আমন্ত্রণ জানাল, উৎসাহ দিল, তারপর হঠাৎ করে বদলে গেল পরিস্থিতি। আবেগের প্রচণ্ড ঝড়ে সমস্ত দ্বিধা, ঘৃণা, সন্দেহ, আর নোংরামি ভেসে গেল।

ভালোবাসি, আমি তোমাকে ভালোবাসি, তুমুল ঝড়কে ছাপিয়ে উঠল ব্যারনেসের চিৎকার, যেন এর আগে যা সে করতে বাধ্য হয়েছে সব অস্বীকার করতে চায়। জীবনে এই প্রথম এবং শুধু তোমাকে। পিটারের মনে হলো ম্যাগডার আত্মার গভীর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসা কান্নারই একটা অংশ তার এই চিৎকার।

 ঝড়ের কবলে যেখানে ওরা গিয়ে পড়েছিল সেখান থেকে আবার ফিরে আসতে অনেক সময় লাগল ওদের, এক সময় আবার ওরা আলাদা দুটো অস্তিত্ব লাভ করল। আর দুজনেই উপলব্ধি করল, জীবনে আর কখোনোই ওরা সম্পূর্ণভাবে আলাদা হতে পারবে না। আজকের এই মিলন ওদেরকে শুধু দৈহিক বন্ধনেই জড়ায়নি।

.

স্টার্নের কিনারা থেকে পানিতে অ্যাভন এস ডিঙ্গি নামাল পিটার, তীরে পৌঁছে পাম গাছের সাথে বেঁধে রাখল সেটা।

দ্বীপের ভেতর দিকে হাঁটা ধরল ওরা, পরস্পরের হাত ধরে আছে, পথ করে নিল সামুদ্রিক পাখিদের তৈরি বাসাগুলোর মাঝখান দিয়ে। ছয় কি সাত প্রজাতির পাখি বিশ একর দ্বীপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ডিম পাড়ছে–কোনোটা ম্লান নীল, হাঁসের ডিমের মতো বড়; কোনোটার গায়ে রঙচটে ফোঁটা, লিচুর দানার মতো আকার। গোটা দ্বীপ পাখা ঝাপটানো আর তীক্ষ্ণ কর্কশ আওয়াজে মুখর।

প্রতিটি প্রজাতির জুয়োজিক্যাল নাম জানা আছে ব্যারনেসের, কার কি অভ্যেস বা দোষ সব তার নখদর্পণে। সহিষ্ণু কান পেতে তার কথা শুনে গেল পিটার, বুঝতে অসুবিধে হলো না এই আলাপচারিতার সুযোগ ম্যাগডা আসলে ওর দায়ের করার অভিযোগের উত্তর তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

 দ্বীপের শেষপ্রান্তে নিসঙ্গ একটা বিশাল টাকামাকা গাছ রয়েছে, সবুজ পাতাসহ বিশাল ডালগুলো ছায়া ফেলেছে সাদা বালিতে। ইতোমধ্যে তেতে উঠেছে রোদ, যেন গরম পানিতে ভেজানো উলের কম্বল গায়ে জড়িয়ে রেখেছে ওদেরকে।

কৃতজ্ঞচিত্তে টাকামাকার চায়ার আশ্রয় নিল ওরা, পাশাপাশি বসে চোখ মেলে দিল লেগুনের শান্ত স্থির পানিতে। প্রধান দ্বীপটা অনেক, প্রায় পাঁচ মাইল দূরে। এত দূর থেকে বাড়ি বা জেটি কিছুই দেখা গেল না। প্রাগৈতিহাসিক যুগের তাজা আর নির্দোষ পৃথিবীর প্রথম পুরুষ আর প্রথম নারী বলে মনে হলো নিজেদেরকে পিটারের।

জেগে জেগে স্বপ্ন দেখায় বাধা দিল ব্যারনেস, তার একটা প্রশ্ন ধপ্ করে কঠিন বাস্তবে ফিরে এল ও।

কে আমাকে খুন করার নির্দেশ দিয়েছিল, পিটার?

ঘার ফিরিয়ে তাকাল পিটার।

কিভাবে দেয়া হয় নির্দেশটা? আবার জিজ্ঞেস করল ব্যারনেস। নিজের সম্পর্কে বলার আগে এসব আমার জানতে হবে।

কেউ না, বলল পিটার।

কেউ না? পার্কারকে খুন করার নির্দেশসহ একটা চিরকুট পেয়েছিলে তুমি, সে ধরনের চিরকুট পাওনি?

না।

পার্কার, বা কলিনের কাছ থেকে? তারা তোমাকে কাজটা করার অনুরোধ করেনি-বা পরামর্শ দেয়নি?

 ডক্টর পার্কার বিশেষভাবে নিষেধ করে দিয়েছিল কাজটা করতে। তোমাকে স্পর্শ করার চলবে না-যতক্ষণ না তুমি হাতেনাতে ধরা পড়ো।

ব্যাপারটা তাহলে তোমার নিজের সিদ্ধান্ত ছিল? ওটা আমার দায়িত্ব ছিল।

মেয়ের ওপর নির্যাতনের প্রতিশোধ?

হ্যাঁ, সেটা একটা কারণ ছিল, বলল পিটার। কিন্তু তার আগে অন্য কারণও তৈরি হয়েছিল। জিরো-সেভেন-জিরো হাইজ্যাক করার পর রক্তপাত ঘটে, যারা দায়ী তাদেরকে শাস্তি দেয়া আমার কর্তব্য বলে মনে করেছিলাম আমি। পরে আরো কারণ যোগ হয়–ব্যারন অল্টম্যান হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ। তাছাড়া, খলিফা অশুভ একটা শক্তি, দুনিয়াকে নিজেদের জন্যে স্বর্গ বানাতে চায়। একজন সৈনিক হিসেবে আমার দায়িত্ব তাকে খতম করা।

খলিফা আমাদের সম্পর্কে জানে। নিজেদের আমরা যতটা বুঝি, আমাদেরকে তারচেয়ে ভালো জানে সে। আমি কাওয়ার্ড নই, পিটার, কিন্তু এখন আমি সত্যি ভয় পাচ্ছি।

 তার ব্যবসার মূলধনই তো ভয়, বলল পিটার। লক্ষ্য করল একটু কাছ ঘেঁষে এল ম্যাগডা-শারীরিক সংস্পর্শের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। তার নগ্ন কাঁধে একটা হাত রাখল ও, ওর গায়ের ওপর হালকাভাবে ঢলে পড়ল ব্যারনেস।

 কাল রাতে তুমি যা বলেছ সব সত্যি, শুধু অনুমান আর কল্পনাগুলো মিথ্যে। বাবার মৃত্যু, তারপর তার বাড়িতে নিঃসঙ্গ সময় কাটানো-চাদরের তলায় মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার ইতিহাস। পোল্যান্ড ফিরলাম, ওখান থেকে আমাকে ওডেসায় নিয়ে যাওয়া হলো–সবই সত্যি, এবং তিক্ত অভিজ্ঞতা। ওডেসা কলেজে কিভাবে ট্রেনিং দেয়া হয় তুমি জানো, শিউরে উঠল ব্যারনেস। একদিন তোমাকে ওডেসার গল্প শোনাব।

আমার আগ্রহ নেই।

বলতে না হলে বেঁচে যাই। প্যারিসে আসার পর কি ঘটল শুনবে?

শুধু যেটুকু প্রয়োজন।

হ্যাঁ, পিটার, পুরুষমানুষ ছিল। মুগ্ধ করার ট্রেনিংই তো দেয়া হয়েছিল আমাকে। হ্যাঁ, ওদের সাথে মিশেছি বৈকি…থেমে গিয়ে দুহাতে পিটারের গাল ধরল ব্যারনেস, নিজের দিকে ফেরাল মুখটা যাতে ওর চোখ দেখতে পায়। তাতে কি আমাদের সম্পর্কে বদলে যাবে, পিটার?

আমি তোমাকে ভালোবাসি, দৃঢ় কণ্ঠে বলল পিটার।

চাতুর্য বা ছলনার সন্ধানে অনেকক্ষণ পিটারের চোখে তাকিয়ে থাকল ব্যারনেস, কিন্তু কিছুই না পেয়ে বিড়বিড় করে বলল, হ্যাঁ। ব্যাপারটা তাই। মনের কথাই বলেছ। স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলে পিটারের কাঁধে মাথা ঠেকাল সে, মৃদু কণ্ঠে কথা বলে গেল, যেন গুনগুন করছে।

কিন্তু ওদের কাউকে আমি পছন্দ করতাম না পিটার। সেজন্যেই আমি অল্টম্যানকে বেছে নেই। অনেক পুরুষের সাথে মিশছি, কিন্তু কারো কাছ থেকে না। কিছু পাচ্ছি, না কাউকে কিছু দিতে পারছি–তারচেয়ে একজন লোককে যদি বেছে নিতে পারি, নিজের ওপর শ্রদ্ধা ফিরে আসবে। মৃদু কাঁধ ঝাঁকাল ব্যারনেস। অল্টম্যানকে বেছে নিলাম, মস্কো আমাকে সমর্থন করল। কাজটা ভারী জটিল ছিল। প্রথমে আমাকে তার শ্রদ্ধা অর্জন করতে হয়েছে। অল্টম্যান আগে কখনো কোনো মেয়েকে শ্রদ্ধা করেনি। ধীরে ধীরে আমি প্রমাণ করলাম, সম্ভাব্য যে-কোনো কাজে পুরুষের মতোই যোগ্য আমি, আমাকে দিয়ে সব কাজ করাতে পারে সে, তা যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক। তার শ্রদ্ধা অর্জনের পর বাকি সব পানির মতো সহজ হয়ে গেল।

নিয়তি কাকে যে কিভাবে নিয়ে খেলে। প্রথম আবিষ্কার করলাম, লোকটাকে আমি পছন্দ করি। তারপর দেখলাম, তার প্রতি আমারো শ্রদ্ধা জন্মাচ্ছে। কুৎসিতদর্শন একটা ষাঁড়, গায়ে হারকিউলিসের মতো জোর, আর ব্যক্তিত্বের শক্তি ছিল কসমিক পাওয়ারের সমান। তার এই শক্তি, প্রভাব, আর ক্ষমতাকে আমি পুজো করতে শুরু করি। মুখ তুলে পিটারের চোয়ালে আঙুল বুলাল ব্যারনেস, তারপর মাথাটা আরো একটু তুলে ওর ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াল। না, পিটার, তার প্রতি আমার ভালোবাসা জন্মায়নি। তোমার আগে কাউকে আমি ভালোবাসিনি। অল্টম্যানকে আমার জাদুকর বলে মনে হত, ভয় মেশানো শ্রদ্ধা ছিল তার প্রতি। বর্বর আদিবাসী যেমন বজ্রপাত আর বিদ্যুৎচমকের দিকে সভয়ে তাকিয়ে ভাবে ঈশ্বরের লীলা, আমিও ঠিক তেমনি অল্টম্যানের দিকে তাকিয়ে ভাবতাম লোকটার ক্ষমতার কি কোনো শেষ-সীমা নেই? সে আমার অস্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। একজন বাবা, একজন শিক্ষক, একজন গুরুর মতো, প্রায় একজন ঈশ্বরের মতো। কিন্তু কখনোই একজন প্রেমিকের মতো নয়।

অল্টম্যান শক্তিশালী ছিল, কিন্তু তার শক্তি সে ক্ষয় করতে জানত না–এরকম একটা মানুষ কাউকে ভালোবাসবে কিভাবে! নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গম্ভীরভাবে পিটারের দিকে তাকাল ব্যারনেস। কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছ কি, পিটার? নাকি ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারলাম না?

 না, আশ্বস্ত করল পিটার, ভালোই বলতে পেরেছ।

শারীরিকভাবে সে আমাকে টানতে পারত না—তার গন্ধ বা গা ভরা লোম। বিশাল ভুঁড়ি ছিল, লোহার মতো শক্ত, মুহূর্তের জন্যে শিউড়ে উঠল ব্যারনেস। তবে এসব অগ্রাহ্য করার ট্রেনিং নেয়া ছিল আমার। কিন্তু সে আমাকে আলাদা একটা জগৎ দেখবার সুযোগ করে দেয়। সেটা ক্ষমতা আর টাকার জগৎ। স্বীকার করছি, পিটার এই দুটো জিনিস পছন্দ করি আমি। অল্টম্যান আমাকে শেখাল, কিভাবে টাকা থেকে ফায়দা লুটতে হয়। শেখাল, বিলাসিতা কাকে বলে। সুন্দর জিনিস কিভাবে অর্জন করতে হয়, কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, কিভাবে অন্য সবার চেয়ে সুন্দর আর ভালোভাবে বাঁচতে হয়। প্রায়ই সে আমাকে হাসতে হাসতে বলত, আমার প্রিয় কমিউনিস্ট লেডি।

 হ্যাঁ, পিটার, আমি নই, সেই আমাকে বোকা বানায়। আমি কে, প্রথম থেকেই জানত সে। জানত, ওডেসায় ট্রেনিং দেয়া হয়েছে আমাকে। আমাকে সে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিল। অবশ্যই ভালোবাসত–অন্তত এ কথা বলা যায়, সে তার মতো করে ভালোবাসত। কিন্তু জেনেশুনেই তার সাম্রাজ্যের ভেতরে আমাকে ঢুকতে দিয়েছিল সে, চেয়েছিল আমার আদর্শ আর রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণায় ফাটল ধরাবে। শুধু তখনই জানতে পারলাম, মস্কোয় পাঠানো আমার প্রতিটি তথ্যের ওপর চোখ বুলিয়েছে অল্টম্যান, নিজে সেন্সর করেছে। অল্টম্যান মোসাড ছিল, তাও তুমি জানো। জানো, সে ইহুদি ছিল। এবং আমাকে সে ভাবতে শেখাল আমিও একজন ইহুদি।

অল্টম্যান যত দিন বেঁচে ছিল, তার শিক্ষা আমি ভুলিনি–একজন ইহুদি হয়েই তার সাথে ছিলাম। ইউনিভার্সাল কমিউনিজমের গুরুতর গলদগুলো আমার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সে, পরিচয় করিয়ে দেয় গণতন্ত্র তো আর পশ্চিমা জগতের ক্যাপিটালিস্টিক সিস্টেমের সাথে। আর তারপর ইসরায়েলি ইন্টেলিজেন্স মোসাডের একজন এজেন্ট বানাল আমাকে… আবার থামল ব্যারনেস, ঘন ঘন মাথা নাড়ল।

 তার কাছে আমি চিরঋণী হয়ে আছি, পিটার। কি করে তাকে আমি ধ্বংস করার কথা ভাবতে পারি। আমি তাকে কিডন্যাপ করব কি করে। শেষ দিকে, যখন তার আয়ু ফুরিয়ে আসছে, লোকটা ভারী দুর্বল হয়ে পড়েছিল-প্রচণ্ড ব্যথা হত, চাইত সারাক্ষণ আমি তার পাশে থাকি। তখন, পিটার, বলতে পার প্রায় ভালোবেসে ফেলেছিলাম–মা যেমন তার সন্তানকে ভালোবাসে। বেচারা এমন নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল আমার ওপর, দেখে মায়া হত-সে বলত, শুধু আমার স্পর্শ পেলে তবু কিছুটা ব্যথা কমে তার।

তার সেই লোমে ঢাকা পেটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাত বুলাতাম, অনুভব করতাম কুৎসিত জিনিসটা তার ভেতর প্রতিদিনই একটু একটু করে বড় হচ্ছে। কাটাছেঁড়া করতে রাজি করানো যায়নি। ওদেরকে সে দুচোখে দেখতে পারত না, বলত ব্যাটারা সব কসাই।

 না তাকিয়েও, শুধু ব্যারনেসের ধরা গলা শুনে পিটার বুঝতে পারল, তার চোখ পানিতে ভরে উঠেছে। আরো দৃঢ়ভাবে তাকে আলিঙ্গন করল ও, অপেক্ষা করে থাকল কখন নিজেকে সামলে নেবে।

নিশ্চয় ওই সময়টাতেই তার সাথে যোগাযোগ করেছিল খলিফা। এখন স্মরণ করতে গিয়ে মনে পড়ছে, তখন হঠাৎ করে দুশ্চিন্তায় ভুগতে শুরু করে অল্টম্যান। ব্যাপারটা আমার বোধগম্য হয়নি। ইন্টারন্যাশনাল টেরোরিজম সম্পর্কে কথা বলত, এত রেগে যেত যে ভয় পেয়ে যেতাম আমি। শত্রু তখন বোধ হয় খলিফা নামটা ব্যবহার করেনি। বেঁচে থাকলে অল্টম্যান আমাকে যোগাযোগের ব্যাপারটা জানাত, আমি জানি। কিন্তু সে সুযোগ খলিফা তাকে দেয়নি।

মুখ দেখার জন্যে পিটারের আলিঙ্গন থেকে বেরিয়ে চোখ তুলল ব্যারনেস।

তোমাকে বুঝতে হবে, শেরি, এসব আমি ইদানিং জেনেছি–গত কয়েক সপ্তাহ হয়। বিচ্ছিন্নভাবে জেনেছি, এখন জোড়া লাগাচ্ছি–তবে ঘটেছিল ঠিক এরকমই। একটা প্রস্তাব নিয়ে অল্টম্যানের সাথে যোগাযোগ করে খলিফা। সহজ একটা প্রস্তাব-খলিফার পার্টনার হতে পারে অল্টম্যান। খলিফার যুদ্ধ-খাতে অল্টম্যানকে মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে হবে, আর তার প্রভাব, প্রতিপত্তি, যোগাযোগ এবং তথ্য সংগ্রহের উৎস ব্যবহার করতে হবে খলিফার স্বার্থে। বদলে খলিফার স্বপ্ন নতুন জগৎটাকে গড়ার কাজে পরামর্শ দিতে পারবে অল্টম্যান, জগৎটার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে খলিফার পাশাপাশি তার নামও স্থান পাবে।

 হিসেবে ভুল করেছিল খলিফা, সম্ভবত এখন পর্যন্ত এটাই তার একমাত্র ভুল। অল্টম্যান তাকে প্রত্যাখ্যান করে। সাথে সাথে বিপদটা দেখতে পেল খলিফা। অল্টম্যানকে কনভিন্স করানোর জন্যে নিজের আসল পরিচয় প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছিল সে। কারণ ছদ্মনাম, গোপন পরিচয় ইত্যাদি ছেলেমানুষি ব্যাপার সহ্য করার লোক অল্টম্যান ছিল না। কাজেই অল্টম্যানের সামনে সশরীরে আসতে হয়েছিল তাকে। কিন্তু আলোচনায় কোনো ফল হলো না, ফিরে গেল খলিফা। এরপর অল্টম্যানকে দুনিয়ার বুক থেকে সরিয়ে না দিয়ে তার কোনো উপায় ছিল না।

তাকে টরচার করা হয় গোপন তথ্য সংগ্রহের জন্যে, আমার ধারণা। সম্ভবত মোসাড সম্পর্কে সব কথা জানতে চায় খলিফা। স্বামীকে ফেরত পাবার জন্যে মুক্তিপণের টাকা নিয়ে একাই গেলাম আমি, আর কারও ওপর আমার বিশ্বাস ছিল না। এক ঢিলে দুটো পাখি মারল খলিফা–অল্টম্যানকে সরাল, যুদ্ধ খাতের জন্যে পঁচিশ মিলিয়ন ডলারও হাতিয়ে নিল।

এসব তুমি জানলে কিভাবে? আরো আগে যদি জানাতে আমাকে,-তিক্ত কণ্ঠে শুরু করল পিটার।

 আমাদের যখন প্রথম দেখা হলো, এ-সব কিছুই আমি জানতাম না, শেরিকসম! কিভাবে জানলাম বলব, কিন্তু প্লিজ, তাড়া দিয়ো না। যেভাবে ঘটেছে। সেভাবে বলতে দাও আমাকে।

আমি দুঃখিত, মৃদু কণ্ঠে বলল পিটার।

মুক্তিপণের টাকা দিতে গিয়ে প্রথম আমি খলিফা নামটা শুনলাম। আগেই তোমাকে জানিয়েছি, তাই না?

হ্যাঁ।

এবার তাহলে তোমার প্রসঙ্গে আসা যাক। জিরো-সেভেন-জিরো হাইজ্যাক হওয়ার পর প্রথম শুনলাম নামটা। এই দেখ, রিয়্যাকশনটা স্মরণ করে আবার আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে। পিটারের চোখের সামনে একটা হাত তুলল ব্যারনেস, পিটার দেখল লোমকূপের গোড়া থেকে সূক্ষ্ম সুঁচের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওগুলো।

প্রচণ্ড আকর্ষণ বোধ করেছিলাম তোমার প্রতি। তারপর তোমার পেশা আর গুণেরও পরিচয় পেলাম। তখনই চিন্তাটা এল মাথায়–খলিফাকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে তুমি আমাকে সাহায্য করতে পার। তোমার সম্পর্কে আরো খোঁজ-খবর নিতে শুরু করলাম। এমনকি একটা কম্পিউটার প্রিন্ট-আউটও জোগাড় করে ফেলি। থামল ব্যারনেস, চোখের তারায় দুষ্টামির ঝিলিক খেলে গেল। তোমার বান্ধবীর সংখ্যা আর তাদের স্ট্যাটাস সত্যি আমাকে মুগ্ধ করেছিল…

এ প্রসঙ্গ থাক…

হাত তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গি করল পিটার। যা হবার হয়েছে, আর হবে না। এ প্রসঙ্গে আর একটাও কথা নয়–রাজি?

রাজি। হি হি করে হেসে উঠল ব্যারনেস। বকবক করে ব্যথা এনে ফেলেছি গলায়। খিদেও পেয়েছে ভীষণ…

আবার ওরা হাত ধরাধরি করে দ্বীপের আরেক প্রান্তে চলে এল, ডিঙ্গিতে চড়ে ফিরে এল ক্রীশ-ক্রাফটে। শেফ দুনিয়ার উপাদেয় খাবার দিয়ে ভরে দিয়েছে রেফ্রিজারেটর, নিজের হাতে ভিউভ ক্লিকোৎ শ্যাম্পেনের একটা বোতল খুলল ব্যারনেস।

তোমার রুচি ভীষণ খরুচে, মন্তব্য করল পিটার। আমার যা বেতন তাতে তোমাকে পুষতে পারব কিনা সন্দেহ হয়।

 দুজন মিলে তোমার বসকে বেতন বাড়াবার জন্যে চাপ দেব, চোখে কৌতুকের ঝিলিক নিয়ে বলল ব্যারনেস, বস বলতে নিজেকেই বোঝাল সে। অলিখিত চুক্তির মতো খাবার সময়টা ভুলেও কেউ ওরা খলিফার নাম উচ্চারণ করল না।

অবশেষে আবার ওরা পাশাপাশি বসল, বাল্কহেড়ে হেলান দিল পিটার, ওর কাঁধে মাথা ঠেকাল ব্যারনেস। একটা সিগারেট ধরিয়ে নিজে দুটান দিল, তারপর পিটারের ঠোঁটে গুঁজে দিল সেটা।

আরেকটা ব্যাপার তোমাকে বুঝতে হবে, পিটার। আমি মোসাডের একজন, কিন্তু ওদের আমি নিয়ন্ত্রণ করি না। ওরা আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে। অল্টম্যানের ব্যাপারটাও তাই ছিল। দুজনেই আমরা অত্যন্ত মূল্যবান এজেন্ট ছিলাম, আমি এখনো আছি, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আমার নেই, ওদের সমস্ত গোপন তথ্য জানার সুযোগ আমি পাই না।

 আর সব ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির মতো মোসাড়ের কাজও স্বদেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আমি নিশ্চিতভাবে জানতাম, খলিফার পরিচয় সম্পর্কে মোসাড়ে রিপোর্ট করে অল্টম্যান, তার প্রস্তাব সম্পর্কেও বিস্তারিত জানায় ওদেরকে। সন্দেহ করি, খলিফার সাথে সহযোগিতা করার জন্যে অল্টম্যানকে হুকুম করে মোসাড।

কেন? তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জানতে চাইল পিটার।

সঠিক জানি না–তবে দুটো কারণ আন্দাজ করতে পারি। খলিফা নিশ্চয়ই অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি যার সাহায্য মোসাডের জন্যে মূল্যবান। আমার মনে হয়েছে, ইসরায়েলের প্রতি একটু সহানুভূতি আছে খলিফার। আগেই বলেছি, প্রয়োজনে শয়তানের সাথেও বন্ধুত্ব করতে পারে মোসাড, তাদের নীতির কোনো বালাই নেই। তারা খলিফার সাথে হাত মেলাবার জন্যে হুকুম করল অল্টম্যানকে…কিন্তু…।

কিন্তু

অল্টম্যানের মতো একজন মানুষকে দিয়ে তার আদর্শের বিরুদ্ধে কেউ কিছু করিয়ে নিতে পারে না। সম্পূর্ণ অন্য ধাতুতে গড়া ছিল সে। তাকে তুমি পুঁজিপতি বলতে পার, ইহুদি বলে নিন্দা করতে পার, ক্ষমতালিপসু বলতে পার, কিন্তু আমি তো জানি অন্তরে লোকটা ছিল একজন গ্রেট হিউম্যানিস্ট। তখনকার তার সেই দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগের কারণ আজ আমি বুঝতে পারি। মোসাডের নির্দেশ সে মেনে নিতে পারছিল না। খলিফাকে ধ্বংস করার চিন্তা পেয়ে বসেছিল তাকে। এ ধরনের একটা অশুভ শক্তিকে ধ্বংস করা তার দায়িত্ব বলে মনে করেছিল সে…

গ্লাসসহ হাতটা ম্যাগডার মুখের সামনে ধরল পিটার, শ্যাম্পেনে মৃদু একটা চুমুক দিয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল ব্যারনেস।

তারপর আবার শুরু করল, খলিফা যেভাবে হোক জেনে যায়, আমি একজন বিপজ্জনক মিত্র পেয়েছি। বঁবুইলের সেই রাতে সে তোমাকে খুন করার জন্যে অ্যামবুশ পাঠাল…

ওরা তোমাকে খুন করতে চেয়েছিল, ম্যাগডা, বাধা দিয়ে বলল পিটার।

 কারা, পিটার? কারা আমাকে খুন করতে চেয়েছিল?

রাশানরা। ওরা তোমার কথা ভোলেনি।

 ভোলেনি, হ্যাঁ। মাথা একদিকে একটু কাত করে চোখ ছোট করে চিন্তামগ্ন। হল ব্যারনেস। কথাটা আমিও ভেবেছি, আগেও দুবার আমার ওপর হামলা করা হয়েছিল। কিন্তু বুইলে রোডে ওটা রাশানদের অ্যামবুশ ছিল না, পিটার।

ঠিক আছে, তাহলে খলিফাই-কিন্তু তোমাকে, আমাকে নয়।

হয়তো, তবে তাও আমি মনে করি না। আমার মন বলে, টার্গেট করা হয়েছিল। তোমাকেই।

 মেনে নিতে হয় আমাকে, বলল পিটার। তোমাকে বলা হয়নি–সেদিন প্যারিস থেকে আমাকে অনুসরণ করা হয়েছিল। স্ট্রিনের কথাটা বিশদ ব্যাখ্যা করল ও। ওরা জানত মাসেরাতিতে আমি একা আছি।

 তাহলে আর কোনো সন্দেহ থাকল না-খলিফারই কীর্তি ছিল ওটা, এবং টার্গেট ছিলে তুমি।

 কিংবা মোসাড, বিড়বিড় করে বলল পিটার, সেই সাথে ধীরে ধীরে বিস্ফারিত হয়ে উঠল ব্যারনেসের চোখজোড়া। তাদের সেরা স্টার এজেন্টের পাশে মোসাড একজন অ্যাটলাস সৈনিককে দেখতে চাইবে না। মোসাড চাইবে না তুমি খলিফাকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে আমার সাহায্য পাও।

পিটার, এখানে পানি খুব গভীর…।

 আর ঝাঁক ঝাঁক হাঙরও ঘুরে বেড়াচ্ছে।

রঁবুইলে রোডের ঘটনাটা আপাতত বাদ দাও, বলল ব্যারনেস। আমি যে গল্প তোমাকে শোনাতে চাইছি, তাতে ওটা জটিলটা সৃষ্টি করছে।

বেশ, রাজি হলো না পিটার। দরকার হলে আবার ফেরা যাবে।

পরবর্তী গুরুতর তৎপরতা ছিল মেলিসাকে কিডন্যাপ করা, বলল ব্যারনেস, সেই সাথে বদলে গিয়ে পাথরে হয়ে উঠল পিটারের চেহারা। খলিফা যেই হোক, তোমার সম্পর্কে বিস্তারিত সমস্ত খবর তার জানা ছিল, বলে চলল ব্যারনেস। মেলিসা তোমার একমাত্র মেয়ে, এটা কোনো গোপন কথা নয়। তাকে বাঁচানোর জন্যে তুমি অন্যায় অপরাধ করার কথাও ভাবতে পারো, তা সে জানত। ইতোমধ্যে নিজের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছি আমি, তোমাকে ভালোবাসি-উপহারটা তারই স্বীকৃতি ছিল।

বইটা, স্মরণ করে বলে পিটার। কর্নওয়ালিস হ্যারিস–প্রথম সংস্করণ।

ওটাই ছিল আমার জীবনে কাউকে দেয়া প্রথম লাভ গিফট, কিশোরী মেয়ের মতো লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল ব্যারনেস। নিজের কাছে যেদিন স্বীকার করলাম– আমি তোমাকে ভালোবাসি, সেদিন ওটা কিনেছিলাম। কিন্তু আমি অনেকটা সেকেলে–ছেলেরাই তো ভালোবাসার কথা আগে বলে।

বলেছি আমি। তাই না? পিটার জানতে চায়।

কোনোদিন ভুলব না, কখনো না। গতকালের উন্মত্ত আক্রমণের কথা মনে করতে চাইছে না ওরা কেউই।

আমি চেয়েছি একটু বুঝে নিতে, বিড়বিড় করে বলে পিটার।

মেলিসা এত সুন্দর একটা মেয়ে। প্রথম দেখাতেই ওকে আমার দারুণ ভালো লেগেছে। নিজেকেই দায়ী মনে হচ্ছিল আমার, ওর ঘটনায়। আমার কারণেই খলিফার সাথে লড়তে গেলে তুমি, এই দশা হলো ওর।

 নিজের অজান্তেই নিচু হয়ে এল পিটারের মাথা, মনে পড়ে গেছে ব্যারনেসকে দায়ী বলে ভেবেছিল ও।

 হ্যাঁ, পিটারের মনের ভাব বুঝতে পেরে বলল ম্যাগডা, কঠিন একটা আঘাত পাই আমি। তুমি ভাবতে পারলে কিভাবে এ ধরনের কাজ আমার দ্বারা হতে পারে। মেলিসাকে ফিরিয়ে আনার জন্যে নরকে পর্যন্ত যেতে রাজি ছিলাম আমি, কিন্তু চারদিকে শুধু অন্ধকার দেখতে লাগলাম, কিছুই করার ছিল না আমার। ফ্রেঞ্চ ইন্টেলিজেন্স বলল, তারা কিছু জানে না। আর মোসাডে আমার কন্ট্রোল রহস্যময় আচরণ শুরু করল, কোথাও তাকে পাওয়াই গেল না। কেন যেন আমার মনে হয়েছিল, কিডন্যাপিংয়ের সাথে মোসাডের সম্পর্ক থাকতে পারে, তারা যদি সরাসরি জড়িত নাও হয়, ব্যাপারটা সম্পর্কে আর সবার চেয়ে বেশি জানে তারা।

 তোমাকে আমি আগেই বলেছি, খলিফার পরিচয় মোসাডকে জানিয়ে দিয়েছিল অল্টম্যান। ভাবলাম তাহলে মোসাড নিশ্চয়ই এমন কিছু জানে যা মেলিসাকে উদ্ধারে তোমার সাহায্যে লাগবে। কিন্তু প্যারিসে বসে তথ্য সংগ্রহ করা সহজ ছিল না। বাধ্য হয়ে ইসরায়েলে যেতে হলো আমাকে, উদ্দেশ্য আমার কন্ট্রোলারের সাথে সামনা-সামনি কথা বলব…

তুমি ইসরায়েলে গিয়েছিল…

যেতে হয়েছিল, আর কোনো উপায় ছিল না–তোমাকে সাহায্য করার জন্যে আমি তখন মরিয়া হয়ে উঠেছি। আমি জানতাম, মোসাড আমাকে সাহায্য করতে চাইবে না। আমি খালি হাতে যাইনি, সাথে অস্ত্র ছিল। মেলিসাকে ফিরে পেতে ওরা সাহায্য না করলে কি করতে হবে জানা ছিল আমার…।

তুমি–তুমি মোসাড থেকে পদত্যাগ করার হুমকি দিয়েছিলে?

দেব না? তা না হলে ওরা সাহায্য করতে রাজি হবে না জানতাম…

আমার জন্যে তুমি এতটা…

ধোৎ, তুমি বুঝবে না। আমি ভালোবাসি, আর ভালোবাসার জন্যে মানুষ কি না। করতে পারে!

আমি কৃতজ্ঞ বোধ করছি।

উত্তর না দিয়ে আবার প্রসঙ্গে ফিরে এল ব্যারনেস, সব কিছু আমি প্যারিসে রেখে গিয়েছিলাম। প্রয়োজনে অদৃশ্য হবার পরীক্ষিত একটা কৌশল আছে আমার। লীয়ারে করে রোমে নিয়ে গেল আমাকে পিয়েরে, ওখান থকে তোমাকে আমি ফোন করলাম। কিন্তু কি করতে যাচ্ছি তোমাকে বলার উপায় ছিল না। তারপর আমি পরিচয় বদলে একটা কমার্শিয়াল ফ্লাইটে চড়ে তেল আবিবে চলে গেলাম।

 ইসরায়েলে আমার কাজটা ছিল কঠিন, যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক কঠিন। আমার সাথে দেখা করতে পাঁচ দিন সময় নিল কন্ট্রোল। তার সাথে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক, অনেক দিনের। না, হয়তো বন্ধুত্বের সম্পর্ক নয়, তবে পরস্পরকে আমরা অনেক বছর ধরে চিনি। মোসাডের একজন ডেপুটি ডিরেক্টর সে। এরকম একজন গুরুত্বপূর্ণ কন্ট্রোলারের অধীনে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে ওরা আমাকে, এ থেকেই বোঝা যায় ওদের কাছে কতটা মূল্যবান আমি। অথচ তবু পাঁচ দিন বসিয়ে রেখে আমাকে কাজ করতে দেয়া হলো। দেখলাম, কন্ট্রোল ঝিম মেরে আছে, ঠাণ্ডা। বলল, তারা কোনো সাহায্য করতে পারবে না। কারণ, তারা নাকি কিছু জানে না।

আমি যখন সত্যি মরিয়া হয়ে কিছু চাই, আমার তখনকার চেহারা তুমি দেখনি, পিটার। ইসরায়েলের মাটিতে বসে মোসাডের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করলাম আমি। আহ্, কি একখানা যুদ্ধ! মোসাডের এমন অনেক ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে জানি আমি, যা প্রকাশ হয়ে পড়লে ইসরায়েলের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো হাইড্রোজেন বোমার মতো বিস্ফোরিত হবে–যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স। হুমকি দিয়ে বললাম, সোজা নিউ ইয়র্কে গিয়ে প্রেস কনফারেন্স ডাকব। আমার কন্ট্রোল আরো নির্লিপ্ত হয়ে গেল। বলল, কারও ব্যক্তিগত অনুভূতির চেয়ে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এরপর আমি শেষ অস্ত্রটা ছাড়লাম, অসম্ভব কিছু কাজ দেয়া হয়েছে আমাকে, সেগুলোর হাত দিয়েছি, কিন্তু ওগুলো চিরকাল অসম্ভবই থেকে যাবে। একটু গরম হলো কন্ট্রোল।

 কিন্তু এসবের পিছনে সময় নষ্ট হচ্ছিল–দিনের পর দিন পেরিয়ে গেল, আর আমি ছটফট করতে লাগলাম। মেলিসাকে যাতে তুমি উদ্ধার করতে পার তার জন্যে অনেক প্রার্থনা করেছি আমি, প্রতিটি মুহূর্ত চেয়েছি এই বিপদের সময় তোমার পাশে থাকি। মনে হত শুধু যদি একবার অন্তত তোমার গলা শুনতে পেতাম। কিন্তু তেল আবিব থেকে ফোন করা সম্ভব ছিল না, আমার কাভার ফাঁস হয়ে যেত। কি দুঃসহ সময় যে কাটছিল ওখানে…।

অবশেষে মোসাড আমাকে দু-একটা তথ্য দিতে রাজি হলো। প্রথমে কন্ট্রোল স্বীকারই করল না যে তারা খলিফার নাম শুনেছে। কিন্তু আমি একটা ঝুঁকি নিয়ে মিথ্যে কথা বললাম তাকে। বললাম, অল্টম্যান আমাকে বলে গেছে খলিফার পরিচয় মোসাডকে জানানো হয়েছে। এবার একটু নরম হলো সে। হ্যাঁ, স্বীকার গেল-খলিফা সম্পর্কে তারা জানে, কিন্তু তার পরিচয় জানে না। কিন্তু আমার হাতুড়ি থেমে নেই, জেদ ধরলাম প্রতিদিন কন্ট্রোলকে আমার সাথে দেখা করতে হবে। এক সময় রেগে গেল সে, ভয় দেখাল ইসরায়েল থেকে বের করে দেয়া হবে আমাকে। তবে যত বার দেখা হলো, প্রতিবার এক-আধটা তথ্য তার কাছ থেকে বের করতে পারলাম আমি।

 শেষে পরাজয় মানল সে, বলল হ্যাঁ, খলিফাকে তারা চেনে, কিন্তু সে খুব বিপজ্জনক, সাংঘাতিক ক্ষমতাবান…ঈশ্বর চাইলে আরো ক্ষমতা আসতে যাচ্ছে তার হাতে, এককভাবে দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে সে এবং লোকটা ইসরায়েলের একজন বন্ধু। অন্তত মোসাড তাই বিশ্বাস করে।

 আমি জোকের মতো তাকে ধরে ঝুলে থাকলাম। এরপর সে জানাল, খলিফার কাছাকাছি একজন এজেন্টকে পাঠিয়েছে তারা। এজেন্ট লোকটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু খলিফা তার পরিচয় জেনে ফেললে স্রেফ মারা পড়বে সে। এই পরিস্থিতিতে মোসাড যদি আমাকে কোনো তথ্য দেয়, তথ্যটা কোত্থেকে ফাঁস হলো জানতে চেষ্টা করবে খলিফা এবং স্বভাবতই মোসাডের সেই এজেন্টের পরিচয় ফাঁস হয়ে যাবে। অর্থাৎ মোসাড নিজের এজেন্টকে রক্ষার জন্যে এ ধরনের কোনো ঝুঁকি নেবে না।

আবার আমি তাকে হুমকি দিলাম। এবার সে এজেন্টের কোড নেম জানাল আমাকে। তার সাথে যদি কখনো আমি যোগাযোগ করি, কোড নেমটা ব্যবহার করব, তাহলে দুজনেরই নিরাপত্তা অটুট থাকবে। কোড নেমটা হলো–ক্যাকটাস ফ্লাওয়ার।

ব্যস, এইটুকু মাত্র? হতাশ ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল পিটার।

না, আমার কন্ট্রোল আরো দুটো নাম জানাল—সান্ত্বনা হিসেবে। বলল, এদের কাজ থেকে দূরে এবং সাবধানে থাকতে হবে। এই নামের লোক দুজন নাকি খলিফার এত কাছাকাছি, আসলে এদেরকেই খলিফা বলা যেতে পারে। নামগুলো বলার আগে আবার সে স্মরণ করিয়ে দিল, দিচ্ছে শুধু আমার প্রোটেকশনের কথা ভেবে।

নামগুলো…

 তোমার নাম, নরম গলায় বলল ব্যারনেস। স্ট্রাইড।

বিরক্তিসূচক শব্দ করে পিটার বলল, সেফ ধোঁকা দিয়েছে তোমাকে। আমি কেন মেলিসাকে কিডন্যাপ করতে যাব? আর, ক্যাকটাস ফ্লাওয়ার-ছদ্মনাম জানা না জানা সমান কথা।

এবার আমার বলার পালা–দুঃখিত।

চিন্তার লাগাম টেনে ধরল পিটার, হঠাৎ খেয়াল হলো ভালোভাবে বিবেচনা না করেই তথ্যগুলো বাতিল করে দিচ্ছে ও। উঠে দাঁড়িয়ে ক্রীশ-ক্রাফটের ডেকে পায়ে ঝাঁকুনি তুলে পায়চারি করতে শুরু করল, কপালে চিন্তার রেখা। ক্যাকটাস ফ্লাওয়ার, ক্যাকটাস ফ্লাওয়ার, বার কয়েক উচ্চারণ করে ব্যারনেসের দিকে তাকাল। আগে কখনো নামটা শুনেছ তুমি?

মাথা নাড়ল ব্যারনেস। না।

তোমাকে জানাবার পর?

আবার, না।

স্মৃতির মাঠ চষে ফেলল পিটার, কিন্তু নামটা আগে কখনো কোথাও শুনেছে বলে মনে পড়ল না। ঠিক আছে। এই মুহূর্তে নামটা অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয় বলে ধরে নিল ও। এবার এসো আমার প্রসঙ্গে কন্ট্রোলের মুখে শোনার পর কি মনে হলো তোমার?

প্রথমে অর্থহীন মনে হলো, শুধু প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম। প্রশ্নটা আমার মনেও আসে–পিটার স্ট্রাইড কেন মেলিসাকে কিডন্যাপ করতে যাবে।

 শুধু আমার নামটাই বলল তোমাকে, আর কিছু না?

একবার নয়, দুবার–কন্ট্রোল আমাকে তোমার সম্পর্কে দুবার সাবধান করে দেয়, বলল ব্যারনেস।

দুবার? পায়চারি থামিয়ে ব্যারনেসের দিকে ঝুঁকে পড়ল পিটার। দ্বিতীয়বার কখন?

মেলিসাকে উদ্ধার করা হয়েছে এই খবর পাবার পর। সেই মুহূর্তে প্যারিসে ফিরতে চেয়েছিলাম আমি, তোমার পাশে থাকতে হবে আমাকে। খবরটা শোনার ছঘণ্টা পর বেন-গারিয় এয়ারপোর্টে পৌঁছে একটা ফ্লাইট ধরতে পারি আমি। আমার হৃৎপিণ্ড গান গাইছিল, পিটার। মেলিসা সুস্থ আর নিরাপদ, অ্যান্ড আই ওয়াজ ইন লাভ। দেরি নেই, আবার তোমার সাথে থাকব আমি। প্লেনে উঠতে যাচ্ছি, সিকিউরিটি চেকিং চলছে, একজন মহিলা পুলিশ ডেকে নিয়ে গেল আমাকে- সিকিউরিটি অফিসে। আমার কন্ট্রোল ওখানে আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল। আমাকে ধরার জন্যে তেল আবিব থেকে নিজেই ছুটে এসেছে, চেহারা দেখে মনে হলো সাংঘাতিক উদ্বেগের মধ্যে আছে বলল, ক্যাকটাস ফ্লাওয়ারের কাছে থেকে জরুরি একটা মেসেজ পেয়েছে সে। মেসেজটা নাকি হুবহু এই রকম : জেনারেল স্ট্রাইড পিটার এই মুহূর্তে অবশ্যই খলিফা কর্তৃক অনুপ্রাণিত।

কন্ট্রোল আমাকে বলল, পিটার তোমাকে প্রথম সুযোগেই খুন করবে। তার মুখে হাসলাম আমি। কিন্তু তাকে সাংঘাতিক সিরিয়াস দেখল, বলল, মাইডিয়ার ব্যারনেস, ক্যাকটাস ফ্লাওয়ার প্রথম শ্রেণির একজন এজেন্ট। তার ওয়ার্নিং তোমাকে সিরিয়াসলি নিতে হবে। এক কথা বারবার বলল সে।

তবু আমার বিশ্বাস হয়নি, পিটার। অসম্ভব একটা ব্যাপার। আমি তোমাকে ভালোবাসি, জানি তুমিও আমাকে ভালোবাস-যদিও হয়তো তুমি নিজেও সেটা ভালো করে উপলব্ধি করোনি। স্রেফ পাগলামি মনে হচ্ছিল। কিন্তু প্লেনে চড়ার পর চিন্তা করার অবসর পেলাম আমি আমার কন্ট্রোল এর আগে কখনো ভুল করেনি। পিটার, আমার তখনকার মানসিক অবস্থা তুমি কল্পনা করতে পার? আমার সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে আমি চাইছি তোমার কাছে পৌঁছুতে, অথচ ভূতের মতো ভয় লাগছে তোমাকে। আমাকে তুমি খুন করে ফেলবে সে ভয় নয়-ওটা আমার কাছে কোনো গুরুত্ব পায়নি। ভয় হচ্ছিল সত্যি না তুমি খলিফা হিসেবে আত্মপ্রকাশ কর। এই চিন্তাটাই আমাকে আতঙ্কিত করে তোলে। বুঝতে পারছ তো, তোমার আগে কাউকে আমি ভালোবাসিনি।

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকল ব্যারনেস; দ্বিধা, সংশয়, আর ব্যথার কথা মনে পড়ে গেছে। তারপর সে মাথা নাড়ল, ঘন কালো চুল ঢেউ তুলল কাঁধে।

 প্যারিস পৌঁছে আমার প্রথম কাজ ছিল মেলিসা আর তুমি কেমন আছো খবর নেয়া। তারপর জানতে চেষ্টা করব, ক্যাকটাস ফ্লাওয়ারের ওয়ার্নিঙে কতটা শাঁস আছে। খবর পেলাম, স্যার স্টিভেনের বাড়িতে তোমরা। কিন্তু কতটা নিরাপদ যতবার তুমি আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে আমি এড়িয়ে গেলাম–আর প্রতিবার এড়িয়ে যাবার সময় মনে হতে লাগল আমার ছোট একটা করে অংশ মরে যাচ্ছে।

পিটারের দিকে ঝুঁকে ওর একটা হাত তুলে নিল ব্যারনেস, আঙুলগুলো খুলল, মাথা নিচু করে চুমো খেল তালুতে, তারপর হাতটা তুলে নিজের গালে চেপে রাখল।

কয়েক হাজার বার নিজেকে বুঝিয়েছি, এ অভিযোগ সত্যি নয়। দিনের মধ্যে পাঁচ-সাতবার ঝোঁক চেপেছে, বেরিয়ে পড়ি, যাই তোমার কাছে। ওহ্ পিটার, এক সময় অসহ্য হয়ে উঠল ব্যাপারটা। সিদ্ধান্ত নিলাম ওরলিতে তোমার সাথে দেখা করব, কারণ সত্যটা আমাকে জানতেই হবে। তোমার মনে আছে, সেদিন আমার সাথে নেকড়েগুলো ছিল, ওদেরকে বলা ছিল বিপদ হতে পারে। তবে বলিনি, বিপদটা তোমার দিক থেকে আসতে পারে।

 ওরলির প্রাইভেট লাউঞ্জে তুমি পা রাখতেই আমি বুঝতে পারলাম, কথাটা সত্যি। ব্যাপারটা অনুভব করতে পারছিলাম, মৃত্যুর গন্ধ ছড়াচ্ছিলে তুমি, তোমাকে ঘিরে ছিল অস্বাভাবিক উজ্জ্বল একটা প্রভাব। শুধু ভীতিকর নয়, আমার জীবনের সবচেয়ে ঘৃণ্য মুহূর্তে ছিল সেটা। তোমাকে অন্য এক লোক বলে মনে হচ্ছিল, সম্পূর্ণ অচেনা। তোমাকে চুমো খেয়ে বিদায় জানালাম, কারণ বুঝতে পারছিলাম, জীবনে আর আমাদের দেখা হবে না। এমনকি এই চিন্তাটাও আমার মাথায় খেলে যায় যে তুমি আমাকে খুন করার আগে নিজেকে বাঁচানোর জন্যে আমিই তো প্রথম আঘাত… কথাটা শেষ করল না ব্যারনেস। তোমাকে আমি খলিফা বা খলিফার অংশ বলে মনে করছিলাম বুঝতেই পারছ, তাই সেটাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হচ্ছিল। স্বীকার করছি, পিটার, চিন্তাটা মাথায় এসেছিল। আমাকে খুন করার আগে তুমি মারা যাও–কিন্তু ওটা শুধুই একটা সাময়িক চিন্তা ছিল মাত্র। সেটাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে আমি আমার কাজে ফিরে গেলাম। কাজ, ব্যবসা, চিরকালই টনিক হিসেবে উপকার করেছে আমার। কাজের ভেতর ডুবে যেতে পারলে প্রায় সব কিছু ভুলে যেতে পারি আমি। কিন্তু এবার তা হলো না। কথাটা বারবার বলছি, কারণ কথাটায় এত বেশি ব্যাখ্যা পাওয়া যায় যে ঘন ঘন না বলে পারা যায় না–তোমার আগে আমার জীবনে ভালোবাসা আসেনি, পিটার এবং সেই ভালোবাসাকে অস্বীকার করার সাধ্য আমার ছিল না।

কাজে মন বসল না। আবার আমি নিজেকে বোঝাতে লাগলাম, ক্যাকটাস ফ্লাওয়ার ভুল তথ্য দিয়েছে। তুমি আমাকে খুন করার ষড়যন্ত্র করতে পার না।

এখানে এলাম, শুধু তোমার কাছে হুট করে চলে যাবার ঝোঁকটা কমাবার জন্যে। কিন্তু না, তাতেও কাজ হলো না। অবস্থা আরো খারাপের দিকে গেল। এখানে কাজ নেই, চিন্তা করার জন্যে অঢেল সময় পেলাম হাতে। প্রতিটি মুহূর্ত নির্যাতন করলাম নিজেকে। উদ্ভট সব চিন্তা-ভাবনা পেয়ে বসল আমাকে। বুঝলাম, গোটা ব্যাপারটার একটা সমাপ্তি হওয়া দরকার। কোনো না কোনো উপায় নিশ্চয়ই আছে। তারপর হঠাৎ করেই উপায়টা দেখতে পেলাম।

 তোমাকে আমি এখানে ডেকে আনব, সুযোগ দেব আমাকে খুন করার। হেসে উঠল ব্যারনেস, এ ধরনের পাগলামি জীবনে এটাই প্রথম আমার। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, পাগলামিটা করার সুবুদ্ধি দিয়েছিলেন, তিনি আমাকে।

হ্যাঁ, একটুর জন্যে বেঁচে গেছি আমরা, স্বীকার করল পিটার।

পিটার, তুমি আমাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করনি কেন আমি খলিফা কিনা? প্রশ্ন করল ব্যারনেস।

যে কারণে তুমি আমাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করনি আমি তোমাকে খুন করার প্ল্যান করছি কিনা।

হ্যাঁ, একমত হলো ব্যারনেস। খলিফার পাতা জালে দুজনেই আমরা আটকা পড়েছিলাম। আমার আর শুধু একটা প্রশ্ন আছে, পিটার, শেরি। আমি যদি সত্যি খলিফা হতাম, তোমার বিশ্বাস হয় আমি এতই বোকা যে যাদেরকে দিয়ে মেলিসাকে কিডন্যাপ করিয়েছি তাদের একজনকে বঁবুইলের টেলিফোন নম্বর দেব, যাতে সে আমার সাথে খোশ-গল্প করার জন্যে যখন খুশি ডায়াল করতে পারে?

থতমত খেয়ে গেল পিটার। আমি ভেবেছিলাম, শুরু করল ও, তারপর থেমে গেল। না, ভাবিনি। মাথা ঠিক ছিল না, ম্যাগডা। কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। সত্যিই তো, তুমি খলিফা হলে এরকম একটা সূত্র কেন কাউকে দিতে যাবে। তবে মহা ধুরন্ধর ক্রিমিনালরাও এ ধরনের স্থূল ভুল করে, তার রেকর্ড আছে।

 ওডেসা থেকে ট্রেনিং পাওয়া ক্রিমিনালরা করে না, পিটার, তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গটা থেকে সরে এল ব্যারনেস। সে যাক, আমার তরফের গল্প তুমি শুনলে। হয়তো কিছু বাদ দিয়ে গেছি, তুমি প্রশ্ন করে জেনে নিতে পার।

আবার ওরা প্রথম থেকে গল্পটা নিয়ে আলোচনা শুরু করল। প্রতিটি ঘটনা বারবার বিশ্লেষণ করল, প্রতিটি সম্ভাবনা নিয়ে বিনিময় হলো মতামত। অবশেষে পিটার মন্তব্য করল, একটা কথা আমাদের ভুললে চলবে না–প্রতিপক্ষের কোয়ালিটি। পশ্চিম আকাশে তখন ঢলে পড়েছে সূর্য, ব্যাঙের ছাতা আকৃতির বিশাল মেঘ গায়ে গোলাপি রঙ মেখে স্থির হয়ে আছে শূন্যে। রহস্যের ভেতর রহস্য আছে, ম্যাগডা। আমাকে দিয়ে ডক্টর পার্কারকে খুন করাবার জন্যেই যে শুধু মেলিসাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল তা নয়। চেষ্টা করা হয়েছিল আমি যাতে তোমাকেও খুন করি। অর্থাৎ এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছিল খলিফা। আমি যদি সফল হতাম, তাহলে আরো একটা পাখি মারা পড়ত, তাই না? চিরকালের জন্যে খলিফার জালে আটকা পড়তাম আমি।

 এখান থেকে আমরা এখন কোথায় যাব, পিটার? জিজ্ঞেস করল ব্যারনেস, কৌশলে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকারটুকু তুলে দিল সে পিটারের হাতে।

 বাড়ি ফিরলে কেমন হয়, এখুনি? পরামর্শ দিল পিটার অবশ্য যদি না তুমি আরো এক রাত এখানে কাটাতে চাও।

.

পিটার আবিষ্কার করল ওর সমস্ত জিনিসপত্র চুপিসারে বাংলো থেকে সরিয়ে দ্বীপের উত্তর প্রান্তে ব্যারনেসের প্রাসাদতুল্য বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। টয়লেটে ব্যবহার যোগ্য প্রতিটি জিনিস আয়না মোড়া মাস্টার বাথরুমে সাজানো পেল ও। পাশের– বাথরুমটাই ব্যারনেসের।

পিটারের জন্যে ড্রেসিংরুমও আলাদা, এখানে ওর সবগুলো কাপড় নতুন করে ধোয়া আর ইস্ত্রি করা অবস্থায় পাওয়া গেল। হ্যাঙ্গারে ঝোলাবার জন্যে ফাঁকা জায়গাটা ধরে দুবার হটল পিটার, হিসাবে কষে বের কলল, তিনশ স্যুট অনায়াসে রাখা যাবে। বিশেষভাবে তৈরি, বোতাম টিপে খোলা বা বন্ধ করা যায়, পালিশ ট্রাউজার এবং র‍্যাকে তিনশ জোড়া জুতো রাখা যাবে। যদিও সবগুলো খালি।

 পিটারের হালকা রঙের সুতি স্যুটটাকে বিশাল সাহারায় নিঃসঙ্গ উটের মতো লাগল।

 ওর সুইটের সিটিংরুমটা তিন প্রস্থে ভাগ করা, একটার চেয়ে অপরটার মেঝে ছয় ফিট করে উঁচু। বাঁশের তৈরি ফার্নিচার, দুর্লভ প্রজাতির পাতা-গাছ, ফুলগাছ, বিভিন্ন জাতের কোরান, আর অ্যাকুয়ারিয়াম দিয়ে সাজানো। তিনটে ভাগকে পরস্পরের কাছ থেকে আড়াল করেছে কাপড়ের কোনো পর্দা নয়, লতানো গাছের পাতা।

সোনালি বরণ এক পলিনেশিয়ান যুবতী, কিশোরীই বলা চলে, দুহাতে ধরে একটা ট্রে নিয়ে এল পিটারের সামনে। ট্রেতে চারটে গ্লাস, ঠাণ্ডায় ঘেমে গেছে কাঁচ। সবগুলোতেই বিপন্ন ফলের রস, তবে পিটারের নাকে রামের গন্ধও ঢুকল। মনে হলো বেশ কড়াই হবে, তাই বলল, হুইস্কি হলে ভালো হতো।

হতাশার ম্লান ছায়া পড়ল মেয়েটার মুখে। আমি নিজের হাতে তৈরি করেছিলাম, স্যার!

 তাহলে তো দেখতে হয়…, পিটার চুমুক দিচ্ছে, ওর দিকে সাগ্রহে তাকিয়ে থাকল মেয়েটা। মাত্র একপ্রস্থ কাপড়ে বুক আর কোমর ঢাকা তার, কাপড়ের ভেতর থেকে উঁচু হয়ে আছে যৌবন, কিন্তু সে দিকে তাকাবার কোনো আগ্রহ হলো না পিটারের। বাহ্ ভারী সুন্দর, দারুণ স্বাদ হয়েছে!

 শিশুর মতো আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল সোনালি বরণ মেয়েটা। আমি আছি, ডাকলেই আমাকে পাবেন, বলে লতানো গাছের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল সে।

 ব্যারনেস ম্যাগডা এল শিফনের এত পাতলা একটা পোশাক পরে, মনে হলো সবুজ সামদ্রিক কুয়াশা তার চারপাশে টগবগ করে ফুটছে, যদিও আলো পড়লে মাখন যেমন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তেমনি উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার হাত মুখসহ অনাবৃত অংশগুলো। পিটারের হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে চেখে দেখল সে।

 গুড, মন্তব্য করল ব্যারনেস, ফিরিয়ে দিল গ্লাসটা। কিন্তু কিশোরী মেয়েটা পর্দার আড়াল থেকে তার সামনে ট্রে ধরতে মাথা নেড়ে তাকে বিদায় করে দিল সে।

পিটারকে বাহুবন্ধনে জড়িয়ে নিয়ে সিটিংরুমের এদিক-সেদিক ঘুরতে লাগল ব্যারনেস, দুর্লভ প্রজাতির গাছ আর মাছের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল পিটারের। বলল, এদিকটা আমি তৈরি করেছি অল্টম্যান মারা যাবার পর। পিটার উপলব্ধি করল, ম্যাগডা ওকে জানতে চায় এই স্যুইটের সাথে অন্য কোনো পুরুষমানুষের স্মৃতি জড়িয়ে নেই। জানানোটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে ম্যাগডা, এভাবে ভেবে কৌতুক বোধ করল পিটার।

বারোজন চাকর এল ডিনার নিয়ে। টেবিল সাজিয়ে অপেক্ষা করার ভঙ্গিতে দূরে দাঁড়িয়ে থাকল তারা, কিন্তু ব্যারনেস তাদেরকে হাত নেড়ে বিদায় করে দিল। সবাই চলে যাবার পর পিটারকে জিজ্ঞেস করল সে, নিজে খেতে পারবে, নাকি হাতে তুলে খাওয়াতে হবে?

হেসে ফেলল পিটার। হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?

কিন্তু ব্যারনেস হাসল না। ছোটবেলায় আমার কোনো পুতুল ছিল না, পিটার। ডিশ থেকে এটা-সেটা অনেক খাবার নিজের হাতে পিটারের প্লেটে তুলে দিল সে। এটা লে নিউফ পোজাইটির একটা স্পেশালিটি, দুনিয়ার আর কোথাও পাবে না, বলল সে, ধূমায়িত ক্ৰীয়োল সস থেকে ছোট ছোট আনাজের টুকরো তুলল পিটারের প্লেটে, গভীর সমুদ্রের তলদেশ থেকে বহু কষ্টে উদ্ধার করা হয়েছে। নারকেল দুধের সর আর বিভিন্ন জাতের ঝাঁঝালো মশলা দিয়ে তৈরি সস।

ডিনারের পর লম্বা নখ দিয়ে বরফ-ঠাণ্ডা অস্ট্রেলিয়ার আঙুরের খোসা ছাড়াল ব্যারনেস, একটা একটা করে তুলে দিল পিটারের মুখে।

তুমি দেখছি আমাকে নষ্ট করে ফেলবে, হাসতে লাগল পিটার।

বৃত্তাকার পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে ডাইনিংরুম থেকে পঞ্চাশ ফিট নিচে সৈকতে নেমে এল ওরা, শেষ ধাপে জুতো খুলে মসৃণ, ভেজা ভেজা কংক্রিটের মতো শক্ত বালিতে খালি পায়ে হাঁটল। কদিন আগে পূর্ণিমা ছিল, আজও বেশ বড়সড় আকার নিয়ে উদয় হয়েছে চাঁদ, হলদেটে আলো দিগন্তরেখা পর্যন্ত বিস্তৃত।

পরস্পরের গা ছুঁয়ে হাঁটছে ওরা।

খলিফাকে বুঝতে দিতে হবে তার উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে, হঠাৎ করে বলল পিটার, অনুভব করল সামান্য একটু শিউরে উঠল ব্যারনেস।

অন্তত আজ রাতটা তার কথা আমরা ভুলে থাকতে পারি, পিটার।

উচিত নয়। এক মুহূর্তের জন্যেও উচিত হবে না।

না, তা ঠিক। কিন্তু কিভাবে তাকে বিশ্বাস করাবে? জিজ্ঞেস করল ব্যারনেস। অন্তত সবাই জানবে তুমি মরে গেছ। দেখে মনে হবে আমি তোমাকে খুন করেছি।

প্ল্যানটা বল।

 তুমি বলেছ, প্রয়োজন অদৃশ্য হবার সেট করার একটা কায়দা আছে তোমার।

 হ্যাঁ, আছে।

এখান থেকে অদৃশ্য হবার দরকার হলে কি করবে তুমি? জানতে চাইল পিটার।

মাত্র কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করল ব্যারনেস। পিয়েরে আমাকে বোরা-বোরা নিয়ে যাবে, ওখানে আমার বন্ধুরা আছে। বিশ্বস্ত। দ্বীপের নিজস্ব এয়ারলাইন ফ্লাইট করে আরেক পাসপোর্ট নিয়ে তাহিতি-ফায়া চলে যাব। সেই একই পাসপোর্ট দেখিয়ে কোনো শিডিউলড় এয়ারলাইন ফ্লাইট ধরে ক্যালিফোর্নিয়া বা নিউজিল্যান্ড চলে যেতে পারি আমি।

তোমার একাধিক কাগজপত্র আছে?

কেন, থাকবে না কেন! এত অবাক হলো ব্যারনেস, পিটারের মনে হলো এবার না জিজ্ঞেস করে বসে, সবারই কি থাকে না?

গুড, বলল পিটার। এখানে একটা দুর্ঘটনা সাজাতে হবে আমাদের। স্কুবা ডাইভিং অ্যাক্সিডেন্ট হলেই চলবে, গভীর পানিতে হাঙর হামলা করেছিল, লাশ পাওয়া যাইনি।

কিন্তু এ সবের অর্থ কি, পিটার?

মরা মানুষকে খুন করার জন্যে কেউ মানুষ পাঠায় না, বলল পিটার।

 ও, হ্যাঁ, তাই তো!

তাহলে এই ঠিক হলো। খলিফা সমস্যার একটা বিহিত না করা পর্যন্ত অফিসিয়ালি তুমি মরে থাকবে, ব্যারনেসকে বলল পিটার, অনেকটা যেন হুকুমের সুরে। খলিফার ইচ্ছায় তোমাকে আমি খুন করায় তার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান একটা সম্পদ হয়ে উঠব আমি। তার কাছে আমার যোগ্যতা প্রমাণ হয়ে যাবে, আমাকে দিয়ে আরো বড় কাজ করাবার কথা ভাবতে পারে সে। আবার একবার তার কাছাকাছি যাবার সুযোগ পেয়ে যাব আমি। অন্তত উদ্ভট কিছু সন্দেহ যাচাই করার সুযোগ আমি পাবই।

আমার মৃত্যুটা খুব বেশি বিশ্বাসযোগ্য করার চেষ্টা কর না, শেরি, মাই লাভ। তাহিতি পুলিশ আমার সাংঘাতিক ভক্ত, বিড়বিড় করে বলল ব্যারনেস ম্যাগডা। চোয়ারু-র গিলোটিনে তুমি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ কর তা আমি চাই না।

.

ব্যারনেসের আগে ঘুম ভাঙল পিটারের, কনুইয়ের ওপর উঁচু হয়ে তার অনাবৃত কাঁধ আর মুখের দিকে ঝুঁকে তাকিয়ে থাকল ও। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যতই দেখল, আনন্দদায়ক ফলুধারায় আপ্লুত হয়ে উঠল সারা শরীর। নারীসুলভ সৌন্দর্য আর অভিজাত ব্যক্তিত্বের এমন সংমিশ্রণ আগে আর কোনো মেয়ের মধ্যে লক্ষ্য করেনি পিটার। ঘুমন্ত ব্যারনেসের চওড়া চোয়ালেও দৃঢ় মানসিকতার ছাপ সুস্পষ্ট, কিন্তু বন্ধ চোখ আর ঠোঁটের চারপাশে কোমল ভাবের মোলায়েম প্রলেপ লেগে রয়েছে। চামড়া এত মসৃণ আর লালিত্যে ভরপুর যে কয়েক ইঞ্চি দূর থেকে লোমকূপের গোড়া দেখা যায় না। পিটার গ্রোগ্রাসে গিলছে, কিভাবে যেন টের পেয়ে গেল ব্যারনেস, চোখে ঘুম নিয়ে পাতা খুলল সে। এই প্রথম লক্ষ্য করল পিটার, ম্যাগডার চোখ কেবল সুবজ নয়, সবুজের সাথে ক্ষীণ সোনালি আর বেগুনী আভা লেগে আছে। বার কয়েক চোখ পিট পিট করল ব্যারনেস, পিটারকে তার ওপর ঝুঁকে থাকতে দেখে ধীরে ধীরে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল চেহারা, হাত দুটো মাথার পিছনে নিয়ে গিয়ে পরম পুলকে পিঠ বাকা করল যেন অলস একটা অজগর আড়মোড়া ভাঙার ভঙ্গিটা প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশি সময় ধরে রাখল সে, ইচ্ছে করে দেখতে দিল শরীরটা, কাঙালের মতো তাকিয়ে থাকল পিটারের চোখ।

 চোখ মেলে তোমাকে পাশে না পেলে দিনটাই আমার মাটি হয়ে যায়, বলে হাত দুটো পিটারের দিকে সবটুকু বাড়িয়ে দিল ব্যারনেস, পিটারের ঘাড়ের চারপাশে ভাঁজ করল, এখনো পিঠটা একটু উঁচু করে আছে। এসো ভান করি এই সুখ যেন চিরস্থায়ী হয়, শরীরে মেয়ে-মেয়ে গন্ধের সাথে মিশে আছে গোলাপের মৃদু সুবাস। ধীরে ধীরে খুলে গেল তার ঠোঁট মুখের ভেতর পিটারের জিভ টেনে নিল সে, চাহিদা পুরোপুরি মিটছে না বলে নাক-মুখ দিয়ে গোঙানির আওয়াজ বেরিয়ে আসছে। এত তাড়াতাড়ি উত্তেজিত হয়ে উঠল পিটার, এত শক্ত আর পাশবিক যে, আবার গুঙিয়ে উঠল ব্যারনেস, শরীরের সমস্ত আড়ষ্ট ভাব দূর হয়ে দিয়েছিল, পড়ল পেশিতে, যেন আগুনের খুব কাছাকাছি ধরায় গলে যাচ্ছে মোমের পুতুল। কাঁপতে কাঁপতে বন্ধ হয়ে গেল তার চোখের পাতা, ভাজ খুলে বিছানায় লম্বা হলো হাঁটু আর পা। পিটার, মাই লাভ! শেরি, মাই লাভ! যেন তীব্র জ্বরের মধ্যে প্রলাপ বকে চলেছে ব্যারনেস।

তারপর পাশাপাশি বহুক্ষণ নিথর হয়ে পড়ে থাকল ওরা, দুজনেই চিৎ হয়ে রয়েছে। শুধু দুজনের একটা করে আঙুল পরস্পরকে আঁকড়ে আছে, একটু আগে ওদের শরীর যেভাবে পরস্পরকে আঁকড়ে ছিল।

 যেতে যখন হবেই, যাব, ফিসফিস করে বলল ব্যারনেস, কিন্তু এখন নয়, এখনই নয়।

পিটার কোনো কথা বলল না।

এসো দর কষি। আমাকে তুমি তিনদিন সময় দাও। শুধু তিনটে দিন, আজকের মতো এভাবে সুখী হবার জন্যে। আমার জন্যে প্রথমবার ছিল ব্যাপারটা, এ জিনিসের সাথে আগে কখনো পরিচয় হয়নি-জানি না হয়তো এটাই শেষবার…

 প্রতিবাদ করার জন্যে মাথা তুলতে গেল পিটার, কিন্তু ওর আঙুলে চাপ দিয়ে চুপ থাকতে অনুরোধ করল ব্যারনেস। এটাই হয়তো শেষবার, আবার বলল সে। তাই প্রাণভরে উপভোগ করতে দাও আমাকে। এই তিনদিন আমরা খলিফার নামটা পর্যন্ত মুখে আনব না। এটা যদি দান কর আমাকে, তোমার যে কোনো আদেশ আমি বিনা শর্তে পালন করব। দেবে, পিটার? বল তুমি রাজি।

 বেশ তো, নাহয় আরো তিন দিন মহাসুখে থাকলাম আমরা, আপত্তি কিসের।

তাহলে বল, স্পষ্ট করে বল, তুমি আমাকে ভালোবাস। কথাটা খুব বেশি বার তোমার মুখে শুনেছি বলে মনে পড়ে না।

ওই তিন দিন প্রায়ই কথাটা ব্যারনেসের কানে কানে বলার সুযোগ পেল পিটার। যতবারই শুনল ব্যারনেস, অপার আনন্দে ভাঙায় ভোলা মাছের মতো খাবি খেল সে, যেন উচ্চারণটা কানে ঢুকলেই তার দম আটকে আসে। তখন ওরা পরস্পরকে না ছুঁয়ে পারে না।

এই তিনটে দিন অমর স্মৃতি হয়ে থাকবে ওদের জীবনে। নিঃসঙ্গ চাঁদের হলদেটে আলো গায়ে মেখে লেগুনের শান্ত স্বচ্ছ পানিতে গভীর রাতে সাঁতার কাটল ওরা, নির্জন দুপুরে দোলনায় পাশাপাশি বসে গাছের ছায়ার নিচে বাতাস খেল, সূর্য ওঠার আগে ছোট একটা দ্বীপের উন্মুক্ত সৈকতে হাত ধরাধরি করে হাঁটল-বিবস্ত্র, সব সময় বিবস্ত্র। পালা করে নয়টা দ্বীপেই সময় কাটাল ওরা। কলোনিতে মিলিত হতে দেখল পাখিদের, দেখল কিভাবে ডিম পাড়ে। আমাকে একটা বাচ্চা দেবে তুমি, হুকুমের সুরে পিটারকে বলল ব্যারনেস। খোলা সাগরে বেরিয়ে এসে একটা রাত কাটাল ওরা, ভেলার ওপর, তারাজ্বলা গোটা আকাশ চোখের ভেতর নিয়ে ভালোবাসার গান গাইল ব্যারনেস–বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ছারখার হয়ে যাবার পরও ওদের নাকি বিচ্ছিন্ন করা যাবে না, ধূলিকণার ভেতর বা অগ্নিকণার সাথে ওদের শরীর আর আত্মার অংশবিশেষ অবশিষ্ট থেকে যাবে অনন্তকাল। তারপর আবার যখন নতুন বিশ্ব তৈরি হবে, তেত্রিশ কোটি আলোকবর্ষ দূরত্ব পেরিয়ে খুঁজতে এসে প্রথম পুরুষ পিটার বিশাল এক পদ্মফুলের ভেতর দেখতে পাবে প্রথম নারী ম্যাগডাকে। দুজনেই একযোগে বলে উঠবে, এতদিন কোথায় ছিলে? তারপর আবার মৃত্যু, এবং পুনর্জন্ম, এভাবেই চলতে থাকবে–অবিনাশী অস্তিত্ব, পরমায়ু, অনন্ত ভবিষ্যৎ অমর প্রেম। কী সুন্দর গান, মুগ্ধ হয়ে শুনল পিটার এবং বিশ্বাস করতে প্ররোচিত হলো।

চারদিনের দিন সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখল, ম্যাগডা নেই। রাজ্যহারা সম্রাটের মতো লাগল নিজেকে, অসহায় এবং দিকভ্রান্ত। ব্যারনেস ফিরে আসতে তাকে প্রথমে চিনতেই পারল না ও।

তারপর খেয়াল হলো, চুল প্রায় সবই কেটে ফেলেছে ব্যারনেস খুলি কামড়ে কালো গোলাপের মতো যেটুকু আছে সেটুকু না থাকলে ন্যাড়া মনে হত। এভাবে চুল কাটায় লম্বা ব্যারনেসকে আরো লম্বা দেখাচ্ছে। দীর্ঘ গলা যেন ফুলের ডাটা, হাঁসের মতো একটু বাঁকানো। পিটারের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে ক্ষীণ একটু হাসল ব্যারনেস, মৃদুকণ্ঠে বলল, ভাবলাম চেহারা একটু বদলানো দরকার। নতুন পরিচয় নিয়ে যাচ্ছি যখন। আবার গজাবে, আগের মতো যদি লম্বাই পছন্দ কর তুমি।

 ব্রেকফাস্টে বসে নিজের প্ল্যান ব্যাখ্যা করল ব্যারনেস। তার সেক্রেটারি মোটা একটা এনভেলাপ রেখে গেছে প্লেটের পাশে, কাগজপত্র দেখতে দেখতে কথা বলল সে। রুথ লেভি নামটা ব্যবহার করব, এনভেলাপ থেকে প্লেনের একাধিক টিকেট বের করল সে। ঠিক করেছি, জেরুজালেম যাব। ওখানে আমার একটা বাড়ি আছে। আমার নামে নয়, তাছাড়া মোসাড় ছাড়া ওটার কথা আর কেউ জানে বলেও মনে করি না। আমার জন্যে ভালো একটা সেন্টার হতে পারে, আমার মোসাড কন্ট্রোলের কাছাকাছি। ওখান থেকে যতটা সম্ভব তোমাকে আমি সাহায্য করার চেষ্টা করব। এমন কিছু তথ্য হয়তো দিতে পারব, খলিফাকে খুঁজে বের করতে সাহায্য হবে তোমার।

লাল রঙের ইসরায়েলি ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্টটা এনভেলাপে ভরে রাখল ব্যারনেস। টাইপ করা একটা কাগজ বাড়িয়ে দিল পিটারের দিকে। এটায় মোসাডের টেলিফোন নম্বর থাকল, আমাকে মেসেজ পাঠাতে পারবে-রুথ লেভি নামটা ব্যবহার কোরো।

নম্বরটা মুখস্ত করে নিল পিটার, ওর কাছ থেকে নিয়ে কাগজটা ছিঁড়ে ফেলল ব্যারনেস।

আমার যাবার ব্যাপারটা একটু বদলেছে, বলল ব্যারনেস ক্রীশ-ক্রাফট নিয়ে বোরা-বোরা যাব আমরা। মাত্র একশ মাইল। আগেই রেডিওতে খবর পাঠাব। রাতের অন্ধকারে সৈকত থেকে বেশ খানিক দূরে বন্ধুরা অপেক্ষা করবে আমার জন্যে।

কোরালের মাঝখানে সরু প্যাসেজ, সাবধানে এগোল ক্রীশ-ক্রাফট, সব আলো নিভিয়ে রাখা হয়েছে। ক্ষয়িষ্ণু চাঁদের মৃদু আলোয় পথ দেখে বোট চালাচ্ছে ব্যারনেসের বোটম্যান, এদিকের জলপথ হাতের তালুর মতোই পরিচিত তার।

আমি চাই হাপিতি আমাকে জ্যান্ত চলে যেতে দেখুক, পিটারের গায়ে হেলান দিয়ে ফিসফিস করে বলল ব্যারনেস, শেষ কটা মুহূর্ত থেকে যতটুকু পারে আদায় করে নিতে চাইছে। আমি চাই না আমাকে তুমি মেরে ফেলেছ ধরে নিয়ে স্থানীয় লোকজন খেপে উঠুক। হাপিতি মুখ বন্ধ রাখবে, পিটারকে আশ্বাস দিল সে। তবে তুমি হুকুম করলে মুখ খুলবে।

ভাবতে দেখছি কিছু বাকি রাখনি।

মশিয়ে, এইমাত্র আবিষ্কার করেছি তোমাকে, আনন্দঘন সুরে বলল ব্যারনেস। এখুনি তোমাকে হারাতে আমি রাজি নই। এমন কি তাহিতির পুলিশ প্রধানের সাথেও কথা বলব বলে ঠিক করেছি। তিনি আমার পুরানো বন্ধু। লে নিউফ পোইজোতে ফিরে এসে আমার সেক্রেটারিকে দিয়ে রেডিও মেসেজ পাঠাবে তুমি…

শান্তভাবে বলল ব্যারনেস, আয়োজন করা ব্যবস্থাপনার প্রতিটি খুঁটিনাটির দিকে নজর দেয়া হয়েছে। কোথাও কোনো ফাঁক দেখল না পিটার। অন্ধকার সাগর থেকে ভৌতিক কণ্ঠস্বরের মতো একটা হাঁক-ডাকের আওয়াজ পাওয়া গেল, চোখ খোলা রেখে পিটারের ঠোঁটে চুমো খেল ব্যারনেস। ক্রীশ-ক্রাফটের গতি কমিয়ে দিল। হাপিতি, তারপর এক সময় থামাল। দূরে একটা দ্বীপের কালো কাঠামো ফুটে আছে তারাজ্বলা আকাশের গায়ে। ক্ৰীশ-ক্রাফটের পাশে ধাক্কা খেল একটা ভেলা। পিটারের বাহুবন্ধনের ভেতর দ্রুত ঘুরে গেল ব্যারনেস ম্যাগডা, দুটো মুখ এক হলো।

 প্লিজ বী কেয়ারফুল, পিটার, শুধু এই একটা কথা বলে আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হলো ব্যারনেস, মই বেয়ে নেমে গেল ভেলায়। হাপিতি হাত বাড়িয়ে একমাত্র হ্যান্ডব্যাগটা ধরিয়ে দিল তাকে। সাথে সাথে রওনা হলো ভেলা। হারিয়ে গেল অন্ধকারে। চ্যানেলে ঢোকার জন্যে ফিরতি পথ ধরল ক্রীশ-ক্রাফট, স্টার্নে দাঁড়িয়ে অন্ধকারের দিকে চোখ মেলে থাকল পিটার। পাঁজরের নিচে শূন্য একটা অনুভূতি, যেন ওর নিজেরই একটা অংশ হারিয়ে গেছে। ব্যারনেসের স্মৃতি দিয়ে সেই শূন্যতা ভরাট করার চেষ্টা করল পিটার। ক্ষীণ কৌতুকের হাসি ফুটল ওর ঠোঁটে।

 তোমার মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর, আজ সকালে আলোচনায় বসে হঠাৎ প্রসঙ্গটা মনে পড়ে গিয়েছিল পিটারের, শেয়ার মার্কেটে কি প্রতিক্রিয়া হবে ভেবে দেখেছে? আর অল্টম্যানের স্টক ঝপ করে নেমে যাবে।

জানি। সহাস্যে বলেছিল ব্যারনেস। খবর ছড়াবার পর প্রথম সপ্তাহ হয়তো প্রতিটি শেয়ারের দাম একশো ফ্রাঙ্ক করে কমে যাবে।

তোমার চিন্তা হচ্ছে না।

হচ্ছে না। হঠাৎ ব্যারনেসের চোখ দুষ্টামির ঝিলিক খেলে গেল। একটু আগে জুরিখে টেলেক্স পাঠিয়ে শেয়ার কেনার অর্ডার দিয়েছি। আবার যখন স্টক তুঙ্গে উঠে আসবে, আশা করছি একশ মিলিয়ন ফ্রাঙ্ক লাভ করব আমি। এত দৌড়-ঝাঁপ, তোমার কাছ থেকে দূরে সরে থাকা, এসবের জন্যে ক্ষতিপূরণ নেব না?

ঘটনাটা মনে পড়তে আসল বটে পিটার, কিন্তু বুকের ভেতর শূন্য ভাবটা থেকেই গেল।

.

ট্রীই-আইল্যান্ডারে করে তাহিতিয়ান পুলিশকে লে নিউফ পোইজোতে নিয়ে এল পিয়েরে, তারপর দুদিন ধরে চলল জবানবন্দী আর বিবৃতি দেয়ার পালা। দ্বীপবাসীদের প্রায় সবাই একটা করে বিবৃতি দিতে চায়, এ ধরনের উত্তেজনাকর ঘটনা এদিকের দ্বীপগুলোয় বড় একটা ঘটে না। তাছাড়া, সবাই ওরা ব্যারনেস অল্টম্যানকে ভালোবাসত, তাদের কাছে সে ছিল মহীয়সী সম্রাজ্ঞীর মতে, প্রায় দেবীর সমতুল্য। কেঁদে বুক ভাসাল সবাই তারা।

হাপিতি তার ভূমিকায় একটু বেশি অভিনয় করে ফেলল। ডেড হোয়াইট হাঙরের বিশদ বর্ণনা পর্যন্ত দিয়ে ফেলল সে, ব্যারনেসকে যখন ওগুলো আক্রমণ করে সে নাকি একেবারে কাছ থেকে নিজের চোখে দেখেছে।

দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায় ব্যারনেসের পুণ্য স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার জন্যে সৈকতে একটা ভোজের আয়োজন করা হলো। দ্বীপবাসিনী যুবতী মেয়েরা শোকগাথা গাইতে গাইতে পানিতে ভাসাল তাজা ফুলের মালা, গানের সুরের সাথে একযোগে আগুপিছু দুলতে লাগল তাদের প্রায় নগ্ন শরীর।

পরদিন সকালে পুলিশের সাথে তাহিতি-ফায়া এল পিটার। সবার অলক্ষ্যে ওর আশপাশে থাকল পুলিশ বাহিনির কয়েকজন সাদা পোশাক পরা সদস্য, পথ দেখিয়ে ওকে নিয়ে আসা হলো শহরের পুলিশ হেডকোয়ার্টারে। পুলিশ প্রধানের সাথে ওর সাক্ষাৎকারটা সৌজন্যমূলক এবং সংক্ষিপ্ত হলো, বোঝাই যায় ওর আগে এখান থেকে হয়ে গেছে ব্যারনেস ম্যাগডা। চোখ টিপে ইঙ্গিত প্রধান বা সবজান্তার হাসি যদি বিনিময় নাও হয়ে থাকে, পুলিশ প্রধানের বন্ধুত্বপূর্ণ করমর্দন থেকে প্রকৃত পরিস্থিতির আঁচ পাওয়া যায়। মহীয়সী ব্যারনেসের যে-কোনো বন্ধু আমাদেরও বন্ধু। ভদ্রলোক প্রেজেন্ট টেন্স ব্যবহার করলেন, তারপর এয়ারপোর্টে ফিরে যাবার জন্যে অফিসের একটা গাড়ি দিলেন পিটারকে।

ইউটিএ ফ্লাইট ধরে ক্যালিফোর্নিয়া চলে এল পিটার। সাথে সাথে এয়ারপোর্ট থেকে না বেরিয়ে টয়লেটে ঢুকে দাড়ি কামিয়ে শার্ট বদলাল ও, তারপর ফার্স্ট ক্লাস প্যান অ্যাম লাউঞ্জে বসে এক কাপ কফি খেল। টেবিল থেকে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালটা তুলে নিয়ে দেখল, কালকের। ব্যারনেস অল্টম্যানের মৃত্যু সংবাদ ছাপা হয়েছে তৃতীয় পৃষ্ঠায়, পুরো এক কলাম জুড়ে। এই প্রথম উপলব্ধি করল পিটার, স্টিল আর অল্টম্যান গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রি মার্কিন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কি গভীরভাবে জড়িত। ব্যবসার বিভিন্ন শাখার একটা তালিকা দেয়া হয়েছে, তারপর ছাপা হয়েছে ব্যারন অল্টম্যানের সাফল্য আর উত্থানের চমকপ্রদ ইতিহাস, সবশেষে ব্যারনেস ম্যাগডার ভূয়সী প্রশংসা আর গুণকীর্তন! মৃত্যুর বিবরণ দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর সাথে স্কুবা ডাইভিং-এ গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েন ব্যারনেস। বন্ধুর পরিচয়, জেনারেল পিটার স্ট্রাইড।

ওর নামটা উল্লেখ করায় খুশি হলো পিটার। যেখানেই থাকুক, রিপোর্টটা পড়বে খলিফা, এবং যা তাকে ভাবতে চাওয়ানো হচ্ছে তাই সে ভাববে। এবার কিছু একটা ঘটবে বলে ধারণা করল পিটার। কি ঘটবে ঠিক জানা নেই, কিন্তু অনুভব করছে চুম্বক ওকে লোহার টুকরোর মতো টানছে।

 বড়সড় একট আর্মচেয়ারে লম্বা হয়ে ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে নেয়া গেল। বলে রাখা ছিল, একজন হোস্টেস ঘুম ভাঙিয়ে জানাল, প্যান অ্যামের পোলার ফ্লাইট ছাড়ার সময় হয়েছে।

লন্ডনের হিথরো এয়ারপোর্টে নেমে প্রথমেই স্টিভেনের বাড়ি, অ্যাবোটস ইউ তে ফোন করল পিটার। ওর গলা পেয়ে পাখির মতো আনন্দে কিচিরমিচির শুরু করে দিল প্যাট্রিসিয়া।

স্টিভেন দারুণ খুশি হবে শুনলে।

এয়াপোর্টের অ্যাভিস ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে ফাইন্যানশিয়াল টাইমসের ভাঁজ খুলল পিটার, একটা গাড়ি চেয়ে অপেক্ষা করছে ও। আজকের পত্রিকা, ব্যারনেস ম্যাগডা সম্পর্কে ফলো-আপ খবর বেশ বড় করে ছাপা হয়েছে। যা মনে করা গিয়েছিল, লন্ডন আর ইউরোপিয়ান স্টকে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। শেয়ারের পতন ব্যারনেসের হিসেবকে ছাড়িয়ে অনেক বেশি নেমে গেছে। দুর্ঘটনাটা সম্পর্কে বলতে গিয়ে আবার উল্লেখ করা হয়েছে ওর নাম। দুটো ব্যাপারই আনন্দ বয়ে আনল পিটারের জন্যে। অনেক সস্তার শেয়ার কিনতে পারছে ব্যারনেসের লোকজন, তারমানে একশো মিলিয়ন নয়, দেড়শো মিলিয়ন ফ্রাঙ্ক লাভ হবে তার। আর ওর নামটা প্রচার হচ্ছে দেখে সন্তুষ্ট বোধ করল।

অ্যাবোটস ইউ-এর গেস্টরুমে ঢুকে বিছানার পাশের টেবিলে এনভেলাপটা পেল পিটার। বেন গারিয় এয়ারপোর্ট, তেল আবিব থেকে পাঠানো হয়েছে। ভেতরের কাগজে একটা মাত্র শব্দ টাইপ করা। পিটার জানল, নিরাপদে আর নিঝঞ্জটে গন্তব্যে পৌঁছেছে ম্যাগডা। গরম পানি ভরা বাথটাবে লম্বা হয়ে তার কথা ভাবতে লাগল ও। আবার কবে দেখা হবে কে জানে! আর কোনোদিন দেখা হবে কিনা তাই বা কে বলতে পারে!

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *