৫. চুরুট ফুঁকছে কলিন

চুরুট ফুঁকছে কলিন, তার সামনে বসে পাইপ টানছেন ডক্টর পার্কার, যেন প্রতিযোগিতা চলছে কার আগে কে ঘরটা ভরে তুলতে পারে ধোঁয়ায়। থোর কমান্ডের অস্থায়ী হেডকোয়ার্টারে এখনো শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা হয়নি। ওদের কীর্তিকলাপ দেখে নিজে আর ধূমপান করতে সাহস পেল না পিটার। অস্বস্তি বোধ করলেও, এমন সব কথা শুনতে হলো ওকে যে খানিক পর ধোঁয়ার অস্তিত্ব চোখে বা নাকে আর ধরাই পড়ল না।

আইরিশ অপারেশন সম্পর্কে রিপোর্ট দিচ্ছে কলিন। লারাগের পোড়াবাড়ি সম্পূর্ণ ছাই হয়ে গেছে, কিছুই উদ্ধার করা যায়নি। অস্টিনটা চুরি করা হয় ডাবলিন থেকে, নতুন রঙ আর রুফ ক্যারিয়ার পরে লাগানো হয়। গাড়িতেও কিছু পাওয়া যায়নি। বাড়ি বা গাড়ি, দুটোই এক্সপার্টরা পরীক্ষা করে দেখেছে।

লোকগুলো সম্পর্কে বল। নড়েচড়ে বসল পিটার।

ইয়েস, স্যার। প্রথমে যারা মারা গেছে। জিলি ও’ শওনেসি, উনিশশো আটান্ন সালে বেলফাস্টে জন্ম,সামনের টেবিল থেকে একটা ফাইল তুলে খুলল কলিন, পাঁচ ইঞ্চি মোটা। সব পড়ার দরকার আছে কি? মনে হয় না। লোকটা পরিচিত টেরোরিস্ট, বহুবার জেল ভেঙে পালিয়েছে। এই কেসটার সাথে কিভাবে সে জড়াল জানা যায়নি। এবার, তার পকেটে যা পাওয়া গেছে। ফাইল বন্ধ করল সে। তেমন কিছু নয়, অন্তত আমাদের কাজে আসার মতো কিছু নয়। পনেরোশ পাউন্ড ট্রাভেলার্স চেক, পয়েন্ট থারটি-এইট অ্যামুনিশন আটত্রিশ রাউন্ড। কাগজপত্র পাওয়া গেছে এডওয়ার্ড এবং হেলেন ব্যারি নামে। এবারে, অপরজন। মরিসন ক্লউদ মরিসন, কুখ্যাত অ্যাবরশনিস্ট এবং মদ্যপ। কম করে হলেও পনোরো বছরের জেল হবে তার। গুরুত্বপূর্ণ একটাই তথ্য পেয়েছি তার কাছ থেকে। দলটা ছিল দুজনের, লীডার ছিল জিলি ও’ শওনেসি। যা কিছু করেছে সে জিলির নির্দেশে করেছে, আর জিলি ও’ শওনেসি অন্য একজনের কাছ থেকে নির্দেশ পেত। এই অন্য একজনের নাম আমরা আগেই শুনেছি। খলিফা।

 এখানে একটা পয়েন্ট রয়েছে, বাধা দিয়ে বললেন ডক্টর পার্কার। খলিফা তার নাম ব্যবহার করতে পছন্দ করে। পিটারকে লেখা চিঠিতেও সে তার নিজের নাম সই করেছিল। এখন দেখা যাচ্ছে খুব নিচুস্তরের শিষ্যদেরও নিজের নাম জানতে দিয়েছে সে। কেন?

উত্তরটা আমি দিতে পারব। মাথা তুলল পিটার। সে চায় আমরা জানি তার অস্তিত্ব আছে। ভয় আর ঘৃণা কাকে করব? একজন থাকতে হবে তো? নামটা প্রচার করছে সে, আর কাজের মধ্যে দিয়ে অবয়বের একটা ধারণা দিচ্ছে, আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি ভীতিকর সে।

 তোমার সাথে আমি একমত। প্রকাণ্ড মাথাটা গম্ভীরভাবে ঝাঁকালেন ডক্টর পার্কার। নিজের নাম ব্যবহার করে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করছে সে, এক সময় এটা থেকে অনায়াসে ফায়দা লুটবে। ভবিষ্যতে খলিফা যখন খুন করার বা ক্ষতি করার হুমকি দেবে আমরা ধরে নেব সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠেছে এবং আপোষের কোনো প্রশ্ন থাকবে না। অর্থাৎ প্রতিটি ক্ষেত্রে সে তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করবে। সে বা তারা, চতুর সাইকোলজিস্ট।

আইরিশ অপারেশনের একটা দিক নিয়ে একটু মাথা ঘামানো দরকার,বলল পিটার। কে আমাদের খবরটা দিল, তার টেলিফোন করার পিছনে কারণ কি? পুরস্কার দাবি করল না কেন?

সবাই ওরা চুপ করে থাকল, অবশেষে কলিনের দিকে ফিরল পিটার। তোমার কি ধারণা?

পুলিশের সাথে এ বিষয়ে কথা বলেছি আমি। ওদের কাছেও ব্যাপারটা রহস্যময়। ইন্সপেক্টর অ্যালান রিচার্ডসের বিশ্বাস, আয়ারল্যান্ডকে বেছে নেয়ার কারণ জায়গাটা শওনেসির পরিচিত, ওখানে তার পুরানো বন্ধুরা আছে। এক সময় ওখানে থাকত সে। এখানে সে যত সহজে গাড়ি এবং জিনিসপত্র জোগাড় করেছে, লন্ডন বা এডিনবার্গে ব্যাপারটা তত সহজ নয়।

পিটারের নির্লিপ্ত চেহারা দেখে কলিন বুঝল, ব্যাখ্যাটা ওর মনে ধরছে না।

 বন্ধু যেমন ছিল, তেমনি ওখানে শত্রুও ছিল জিলির, আবার শুরু করল কলিন। আয়ারল্যান্ড ত্যাগ করার পর অনেকেই তার ওপর খেপে ছিল। পুলিশের মতো আমারও ধারণা, তার পুরানো বন্ধুদেরই কেউ প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে আমাদের টেলিফোন করে। রেকর্ড করা ফোন কলটা ভাষা বিশেষজ্ঞকে দিয়ে পরীক্ষা করানো হয়েছে, কম্পিউটারে নেই, আবার থাকতেও পারে। কথা বলার সময় ইচ্ছে করে কণ্ঠস্বর বিকৃত করা হয়, নোজ প্লাগ ব্যবহার করা হয়েছিল, অথবা মুখে রুমাল ধরা ছিল। ভাষা বিশেষজ্ঞের ধারণা, কোনো আইরিশ লোক ফোনে কথা বলেছে। টেলিফোন ডিপার্টমেন্ট থেকে জানা গেছে, কলটা করা হয় দেশের বাইরে থেকে বেশিরভাগ সম্ভাবনা আয়ারল্যান্ড থেকে, কিন্তু নিশ্চতভাবে কিছু বলা যায় না।

 তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে বলছ, গোটা ব্যাপারটাই কোইন্সিডেন্স। জিলির দুর্ভাগ্য, পুরানো এক শত্রুর সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিল। আমাদের সৌভাগ্য, জিলির শত্রু আমাদেরকে খবরটা জানাবার সিদ্ধান্ত নেয়। মেলিসার ভাগ্য, তার হাত কাটার চব্বিশ ঘণ্টা আগেই খবরটা পেয়ে যাই আমরা। থোর কমান্ডের সৌভাগ্য, ঠিক যখন জিলি ও’ শওনেসি পালাচ্ছে তখন সেখানে পৌঁছুতে পারি আমরা। এই ব্যাখ্যাই তো দিতে চাইছ, তাই না?

অনেকটা তাই, স্বীকার করল কলিন।

 দুঃখিত, কলিন। পরপর এতগুলো দৈব-ঘটনা আমি বিশ্বাস করি না।

ঝেড়ে কাশো, আমন্ত্রণ জানাল কলিন। শোনা যাক আসলে ঠিক কি ঘটেছে।

কি ঘটেছে আমি জানি না। তিক্ত একটু হাসল পিটার। কিন্তু আমার শুধু মনে হচ্ছে, খলিফা যেখানে জড়িত সেখানে এতগুলো কেন, কোনো দৈব-ঘটনাই ঘটতে পারে না। আমার বিশ্বাস, খলিফাও কো-ইন্সিডেন্স বিশ্বাস করেন না।

ঠিক কি বলতে চাও?

 জিলির ব্যাপারে এইটুকু যে, প্রথম থেকেই তার কপালে মৃত্যু-চিহ্ন এঁকে দেয়া হয়েছিল। গোটা প্ল্যানেরই একটা অংশ-জিলির এই মৃত্যু।

তোমার মনে হওয়াটা খুব মজার, একটু যেন রেগে উঠল কলিন। কিন্তু মনে হওয়ার ভেতর যুক্তি আর প্রমাণ না থাকলে তার দাম কি?

আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে হাত তুলল পিটার। ঠিক আছে, শান্ত হও। ধরা যাক, তোমার ব্যাখ্যাটাই ঠিক। তাহলে…

কিন্তু?

কোনো কিন্তু না। অন্তত যতক্ষণ অকাট্য প্রমাণ না পাওয়া যায়।

নিঃশব্দে কাঁধ ঝাঁকাল কলিন, তার চেহারা গম্ভীর। অকাট্য প্রমাণ, তাই না? ট্রাই দিস ওয়ান ফর সাইজ

থামো, কলিন, দ্রুত, কর্তৃত্বের সুরে বাধা দিলেন ডক্টর পার্কার। এ প্রসঙ্গে কিছু বলার আগে আরো কথা আছে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিল কলিন, ধীরে ধীরে শান্ত হলো তার চেহারা, ডক্টর পার্কারের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে পরিচিত হাসি হাসল একটু।

একটু পিছিয়ে যাই আমরা, কেমন? কথা বলছেন ডক্টর পার্কার। পিটার এল খলিফার নাম নিয়ে। তারও আগে এই একই নাম শুনেছি আমরা, কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য এক উৎস থেকে। পিটারকে আমি কথা দিয়েছি, আমাদের উৎস সম্পর্কে বলব ওকে। বলব, কারণ, গোটা ব্যাপারটা তাহলে সম্পূর্ণ নতুন এক আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে।

এমন একটা দিক থেকে খবরটা এল, রীতিমতো তাজ্জব ব্যাপার। তবে নামের ধরনটা বিবেচনা করলে আশ্চর্য হওয়া চলে না। পুব দিক, পিটার। পরিষ্কার করে বলি, রিয়াদ। সৌদি আরবের রাজধানী, তেল সাম্রাজ্যের বাদশার প্রাসাদ। কেসটার কথা নিশ্চয় তোমার মনে আছে। বাদশার উনিশ বছরের নাতি, প্রিন্স। সে খুন হয়ে যাবার পর বাদশা সি.আই. এর সাহায্যে চান। পিটারের মনে পড়ল, ব্যারনেস ম্যাগডার সাথে এ প্রসঙ্গে আলোচনা হয়েছে ওর, মাত্র তিন সপ্তাহ আগে। প্রিন্সের চেয়ে অনেক বেশি ভালোবাসেন বাদশার এমন নিকট আত্মীয়ের সংখ্যা সাতশর মতো, আরো আছে-এদের সবাইকে নিখুঁতভাবে প্রোটেকশন দেয়া সম্ভব নয়, কাজেই যে কেউ খলিফার শিকারে পরিণত হতে পারে।

বাদশার কাছে ওদের দাবিটা কি ছিল? জিজ্ঞেস করল পিটার।

দাবি একটা জানানো হয়েছিল শুধু এটুকুই জানি আমরা। নিজের এবং পরিবারের নিরাপত্তার দিকটা দেখার জন্যে সি.আই. এ-র সহযোগিতা চান বাদশা। দাবিটা জানানো হয়েছিল খলিফা নামে কোনো লোক বা এজেন্সির পক্ষ থেকে। দাবিটা কি ছিল তা না জানলেও, খবর পেয়েছি যে ইরানের সাথে সুর মিলিয়ে সৌদি আরবও ঘোষণা করেছে ওপেকের পরবর্তী বৈঠকে ক্রুড অয়েলের দাম বাড়াবার প্রস্তাব তারা সমর্থন করবে না। তারা বরং আরো পাঁচ পার্সেন্ট কমাবার জন্যে চেষ্টা করবে।

তার মানে খলিফার চাপের মুখে নতি স্বীকার করছে দেশগুলো! বিড়বিড় করে বলল পিটার।

অন্তত দেখে তো তাই ভাবতে হয়। পাইপে আগুন ধরালেন ডক্টর পার্কার। তার মানে আমরা যা ভয় করেছিলাম সেটা সত্যি–খলিফার অস্তিত্ব একটা বাস্তব ঘটনা।

 শুধু যে অস্তিত্ব আছে তাই নয়, দিনে দিনে তার সাহসও বাড়ছে।

 সত্যি কথা বলতে কি, আমরা আসলে ঘাস কাটছি, ঝঝের সাথে বলল, কলিন। জোহানেসবার্গে সেই জিতল। রিয়াদেও সেই জিতছে। এরপর কোথায় হাত বাড়াবে সে? পশ্চিম জার্মানির শ্রমিক সংগঠনে? গ্রেট ব্রিটেনের ট্রেড ইউনিয়নে? লোকটা এরকম একটা হুমকি হয়ে থাকবে আর আমরা বসে বসে দেখব? একে একে পিটার আর ডক্টর পার্কারের দিকে তাকাল সে, তারপর আবার বলল, আমাদের বোঝা উচিত, এককভাবে কোনো গ্রুপ যদি যথেষ্ট ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে সে গ্রুপের পক্ষে যে কোনো দেশের ভাগ্য বদলে দেয়া সম্ভব।

 গোটা পৃথিবীর জন্যেই ব্যাপারটা ভীতিকর। দুনিয়ার বড় বড় সিদ্ধান্ত যারা নেন তাদের সংখ্যাও কম নয়, তাদের সবাইকে ব্যক্তিগতভাবে রক্ষা করা অসম্ভব একটা ব্যাপার। এক সেকেন্ড চিন্তা করল পিটার। আমরা একটা বুদ্ধিমান শত্রুর পিছনে লাগতে যাচ্ছি। প্রথম দুটো টার্গেটের কথা ভেবে দেখ। দক্ষিণ আফ্রিকা আর সৌদি আরব। একটা দেশ কালোদের নির্যাতন করছে, আরেকটা দেশ তেলকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে–এদের প্রতি সাধারণ মানুষের কোনো সমর্থন বা সহানুভূতি নেই। তার মানে সাধারণ মানুষের মনে একটা ধারণা জন্ম নিচ্ছে, খলিফা আসলে মানবসভ্যতার মঙ্গল চায়। এভাবে জনপ্রিয়তা অর্জনের পিছনে নিশ্চয়ই তার কোনো উদ্দেশ্য আছে। সে কি নিজেকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি ভাবছে, নাকি রবিন হুড? দুনিয়ার বুক থেকে দুর্নীতি আর অবিচার মুছে ফেলে বাসযোগ্য একটা স্বর্গ গড়ে তুলতে চায়?

তুমি আমাকে অকাট্য প্রমাণের কথা বলছিলে, স্যার, স্মরণ করিয়ে দিল কলিন। এখুনি শুনতে চাও?

 সোফা ছেড়ে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল পিটার। অপেক্ষা করে আছে।

আইটেম ওয়ান। মেলিসাকে আটকে রাখার সময় পোড়োবাড়ি থেকে দুটো টেলিফোন কল করা হয়। দুটোই ইন্টারন্যাশনাল কল। চলতি মাসের পয়লা তারিখে প্রথমটা, তার মানে যেদিন ওরা বাড়িটায় আশ্রয় নিয়েছিল। আমরা ধরে নিতে পারি, মেসেজের মূল কথা ছিল, এদিকে সব ঠিক আছে। অল্প সময়ের কল ছিল ওগুলো, আগে থেকে ঠিক করা এক বাক্যের একটা মেসেজ পাঠাতে যতক্ষণ লাগে। থেমে ডক্টর পার্কারের দিকে তাকাল কলিন।

বল, অনুমতি দিলেন ডক্টর পার্কার।

 কলগুলো একটা ফ্রেঞ্চ নাম্বারে করা হয়েছিল বঁধুইলে ৪৭-৮৭-৯৭।

তলপেটে বেমক্কা একটা ঘুসি খেল যেন পিটার। ঝাঁকি খেয়ে একটু কুঁজো হয়ে গেল ও। মুহূর্তের জন্যে বন্ধ হয়ে গেল চোখ। এই নম্বরে কত বার ফোন করেছে ও। তারপর চোখ খুলে দ্রুত ঘন ঘন মাথা নাড়ল। না! এ আমি বিশ্বাস করি না!

কথাটা সত্যি, পিটার, নরম সুরে বললেন ডক্টর পার্কার।

 ধীরে ধীরে জানালার দিকে পিছন ফিরল পিটার, ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে এসে নিজের সোফায় বসে পড়ল।

কামরার ভেতর জমাট বেঁধে থাকল নিস্তব্ধতা। বাকি দুজনের কেউই সরাসরি পিটারের দিকে তাকাল না।

কলিনের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে ইঙ্গিত করলেন ডক্টর পার্কার। লাল রঙের একটা বক্স ফাইল, টেবিলের ওপর দিয়ে ডক্টর পার্কারের দিকে ঠেলে দিল কলিন।

ফাইলটা খুললেন ডক্টর পার্কার। ডবল স্পেস দিয়ে টাইপ করা পাতা, এক সেকেন্ড করে চোখ বুলিয়েই উল্টে গেলেন। নির্দিষ্ট পাতায় চোখ রেখে অপেক্ষা করে থাকলেন, পিটারকে শান্ত হবার সময় দিচ্ছেন।

 শিরদাঁড়া খাড়া করে বসে আছে পিটার, সরাসরি সামনের দেয়ালে স্থির হয়ে আছে ঠাণ্ডা দৃষ্টি। ওর সারা শরীরে অসাড় একটা ভাব এবং গলার কাছে বিষমিশা। আবার চোখ বুজল পিটার, থই থই যৌবন নিয়ে একহারা নারীদেহ ভেসে উঠল মনের পর্দায়, চেহারায় হৃদয়ের সমস্ত ব্যাকুলতা ফুটিয়ে আত্মসমর্পণ করছে ওর কাছে। মার্জিত এবং অভিজাত, সুন্দরী এবং বিদুষী। বিশ্বাসঘাতিনী? ওকে ব্যবহার করেছে?

চোখ খুলে আরো একটু সিধে হলো পিটার এবং মুহূর্তটি চিনতে পেরে পিটারের দিকে ফাইলটা উল্টো করে ধরলেন ডক্টর পার্কার।

ফাইলের কাভারে লেখা রয়েছে, টপ সিক্রেট। তার নিচে নামটা টাইপ করা : অল্টম্যান ম্যাগডা আইরিন। জন্ম : কুচিনস্কি।

 ফাইলটা সিধে করলেন ডক্টর পার্কার, তারপর শুরু করলেন। তোমাকে আমি আগেই বলেছি, মেয়েটার প্রতি আমাদের বিশেষ কৌতূহল আছে। নিউ ইয়র্কে তুমি আমার সাথে দেখা করার পর তার সম্পর্কে কৌতূহলের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। তথ্য সংগ্রহ করার বেশিরভাগ কৃতিত্ব কলিনের বিভিন্ন ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিতে ধরনা দিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। সি. আই. সি, ব্রিটিশ সিক্রেটি সার্ভিস, ফ্রেঞ্চ ইন্টেলিজেন্স এবং এমনকি কে.জি.বি-র কাছ থেকেও সহযোগিতা আদায় করেছে ও।

নারী রহস্যময়ী। নারী ছলনাময়ী। পুরানো হলেও, কথাগুলো আজও কারও কারও বেলায় সত্যি। মেয়েটা…এক কথায় অঘটনঘটনপটিয়সী। তার কৃতিত্ব রীতিমতো অবিশ্বাস্য। সুপুরুষ বাছাইয়ে তার রুচি আর দক্ষতা স্বীকার করে নিতে হয়। কি রকম কষ্ট পাচ্ছ তা আমি বুঝি, পিটার। কিন্তু দুঃখিত, তোমার ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে কৌশলে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করার সময় আমাদের হাতে নেই। স্পষ্ট ভাষায় তিক্ত কত কথা বলব আমি।

আমরা জানি, ব্যারনেস ম্যাগডা অল্টম্যান তোমাকে একজন লাভার হিসেবে গ্রহণ করেছে। বুঝতে পারছ কি, বাক্যটা আমি নির্বাচিত শব্দ দিয়ে সাবধানে সাজিয়েছি? ব্যারনেস ম্যাগডা লাভার গ্রহণ করে, উল্টোটা ঘটে না। সে লাভার বাছাই করে ভবিষ্যতের কথা ভেবে, নিজের স্বার্থে, এবং নিখুঁত পরিকল্পনার সাহায্যে। নিছক ভাবাবেগের কোনো মূল্যই দেয় না সে।

পিটারের মনে পড়ল ব্যারনেস ম্যাগডা ওকে বলেছিল, মন দেয়া-নেয়ার ব্যাপারে আমি একদম কাঁচা, পিটার, কোনো অভিজ্ঞতা নেই। শুধু যেন, তোমাকে আমি সুখী করতে চাই, সেই সাথে তোমাকে নিয়ে সুখী হতে চাই।

লাভ-মেকিং-এ ট্রেনিং পাওয়া মেয়ে, এ বিষয়ে তার জুড়ি গোটা পশ্চিম জগতে আর হয়তো দু-একজন থাকতে পারে। আর এই ট্রেনিং সে প্যারিস, লন্ডন, বা নিউ ইয়র্কে পায়িনি। ক্রু কুঁচকে পিটারের দিকে তাকালেন ডক্টর পার্কার। এসবই গুজব, পিটার। তুমিই ভালো বলতে পারবে কতটা কি সত্যি বা মিথ্যে।

 পিটারের নির্লিপ্ত চোখে অনুসন্ধানী দৃষ্টি। ব্যারনেস ম্যাগডা কৌশলে ওকে প্রেমের জালে আটকেছে, এ কথা এখনো বিশ্বাস করতে চায় না। ম্যাগডার সাথে থাকার সময় মধুর একটা আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে ওর গোটা অস্তিত্ব, তনু-মন ছেয়ে থাকে পরম পুলকে। মিষ্টি ভুবনভোলানো হাসি, মৃদু কোমল স্পর্শ, কিংবা কোনো দুর্লভ উপহার দিয়ে ওকে সম্মোহিত করে ফেলে। ডক্টর পার্কারের প্রশ্নের উত্তর দিল না পিটার। বিড়বিড় করে বলল, আপনি বলে যান, প্লিজ। নিজেকে সামলে নিতে পেরেছে ও, ওর ডান হাত কোলের ওপর শিথিল ভঙ্গিতে পড়ে আছে, আঙুলগুলো ছড়ানো।

ভাষা আর অঙ্কে ছোটবেলা থেকেই অসম্ভব ভালো সে। তার বাবা সৌখিন অঙ্কবিদ ছিলেন, দাবাতেও খুব ভালো ছিলেন। তাঁর মেয়ে ম্যাগডা সবার দৃষ্টি কাড়ে, কারণ তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। দুঃখিত, পিটার-এটা একটা নতুন তথ্য তাই তোমাকে আগে জানানো সম্ভব হয়নি। ফ্রেঞ্চদের কাছ থেকে পেয়েছি তথ্যটা, রাশিয়ানরা কনফার্ম করেছে। পার্টি মিটিংয়ে মেয়েকে সাথে করে নিয়ে যেতেন বাবা এবং দেখা গেল রাজনীতির প্রতি দারুণ আগ্রহ আছে মেয়ের।

 বাবার মৃত্যু বেশ একটু রহস্যময়। কিন্তু ফ্রেঞ্চ বা রাশানরা এ ব্যাপারে মুখ খুলতে রাজি নয়। বাবার বন্ধুরা প্রায় সবাই পার্টি মেম্বার ছিল, তারাই এতিম ম্যাগডার দায়িত্ব নিল। এক পরিবার থেকে আরেক পরিবারের ঘুরে বেড়াতে লাগল ম্যাগডা। ডক্টর পার্কার পোস্টকার্ড সাইজের একটা ফটোগ্রাফ রাখলেন পিটারের সামনে নিচু টেবিলে। তার তখনকার ছবি।

বুকের দুপাশে বেণী করা চুল, ছোট স্কার্ট পরা একজন স্কুলছাত্রী, দুহাতে বুকের সাথে একটা কালো বিড়ালকে ধরে আছে। বিকেলবেলা ফরাসি কোনো পার্কে দাঁড়িয়ে তোলা হয়েছে ছবিটা।

এরপর তার কাকা তাকে চিঠি লেখে দেশ থেকে। চিঠির সাথে তার মা-বাবার কম বয়েসের ফটো ছিল। কিশোরী মেয়েটা মুগ্ধ হয়ে যায়। বাবা-মা যেখানে শৈশব কাটিয়েছে সে জায়গাটা না জানি কেমন! সে জানত না তার একজন কাকা আছে। বাবা কখনো আত্মীয়স্বজনদের প্রসঙ্গে কথা বলেননি। বেচারি এতিম মেয়েটা এই প্রথম জানল, তার একটা পরিবার আছে। আরো কয়েকটা চিঠি আদান-প্রদান হলো, বিনিময় হলো আনন্দ আর স্নেহ, তারপরই সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন হয়ে গেল। কাকা নিজে এল ভাইঝিকে নিয়ে যেতে, তার সাথে জন্মস্থান পোল্যান্ডে ফিরে গেল ম্যাগডা কুটচিনস্কি। পার্কার তার হাত দুটো মেলে দিলেন। গোটা ব্যাপারটা এই, পানির মতো সোজা।

 হারানো বছরগুলো, বলল পিটার, নিজের কানেই অদ্ভুত শোনাল কণ্ঠস্বর। একটু কেশে গলা পরিষ্কার করল ও, ডক্টর পার্কারের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে অস্বস্তি নিয়ে নড়েচড়ে বসল।

এখন আর বছরগুলোকে হারানো বলা যাবে না, পিটার। তেরো থেকে উনিশ, এই ছয়টা বছর নিরুদ্দেশ ছিল ম্যাগডা, তাই না? কোথায় তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল জানার পর আমরা জানতে চেষ্টা করি কারা এবং কেন নিয়ে গিয়েছিল। সংশ্লিষ্ট পক্ষ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিল…

রাশিয়ানরা? জিজ্ঞেস করল পিটার, চেহারায় অবিশ্বাস। ওরা এভাবে সহযোগিতা করছে, ব্যাপারটা সন্দেহজনক নয়? আপনাদেরকে মূল্যবান তথ্য দেয়ার লোক তো নয় ওরা।

এই কেসটায় দিয়েছে, তার কারণও আছে—সময় হলে বলব।

বেশ।

কাকার সাথে পোল্যান্ড, ওয়ারশে ফিরে এল ম্যাগডা। পরিবারটা আসল, নাকি ষড়যন্ত্রের অংশ আমরা জানতে পারিনি। কাকার ইচ্ছায় পরীক্ষা দিল ম্যাগডা, খুব ভালো রেজাল্ট করল, চেষ্টা-তদবির করায় সোভিয়েত ইউনিয়নের একটা এলিট কলেজে পড়ার স্কলারশিপ-ও পেয়ে গেল সে।

কলেজটা ছিল কৃষ্ণসাগরের কাছে ওডেসায়। নাম নেই এমন একটা কলেজ, মেধাবীদের মধ্যে থেকে শুধু সেরা ছেলেমেয়েদের বাছাই করে আনা হয় এখানে। ম্যাগডাকে বিশেষ করে তালিম দেয়া হলো ভাষা, রাজনীতি, ফাইন্যান্স আর অঙ্কে। সতেরো বছর বয়সে একটা পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে পাস করল সে, কলেজের আরো স্পেশালাইজড ব্রাঞ্চে ভর্তি হলো। এখানে তাকে শেখানো হলো স্মরণশক্তি বাড়াবার কৌশল। ওডেসা কলেজের মান অনুসারে সহজ একটা পরীক্ষা নমুনা হলো-একশটা বিষয়ে চল্লিশটা লাইন লেখা থাকে একটা কাগজে, কাগজটা ষাট সেকেন্ড দেখতে দেয়া হয়। ষাট সেকেন্ড পর অন্য একটা কাগজে না দেখে লেখাগুলো লিখতে হয়, চব্বিশ ঘণ্টার পর। প্রশংসাসূচক ভঙ্গিতে আবার মাথা নাড়লেন ডক্টর পার্কার।

একই সাথে তাকে পাশ্চাত্যের অভিজাত শ্রেণির জীবনধারা শেখানো হলো। সাজ-সজ্জা, আহারাদি, পানীয়, প্রসাধন, আদব-কায়দা, জনপ্রিয় সঙ্গীত আর সাহিত্য, সিনেমা-থিয়েটার, গণতান্ত্রিক রাজনীতি, বাণিজ্য কৌশল, স্টক মার্কেট পণ্য বণ্টন, সেক্রেটারিয়াল কোর্স, আধুনিক নাচ, বশীকরণ মন্ত্র, সম্মোহন–এরকম আরো অনেক কিছু, সবই বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে–ফ্লাইং, স্কিইং, মার্ডারিং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অর্থাৎ একজন প্রথম সারির এসপিওনাজ এজেন্টকে যা শেখানো দরকার।

ব্যাচে সেই ছিল মক্ষিরানি, মেধা এবং মননে সবার সেরা, এবং তোমার চোখে সে ধরা দেয় দুর্লভ একটা উপহার সামগ্রীর আদলে। অভিজাত কামিনীসুলভ কোমল, ঐশ্বর্যময়ী, দক্ষ, উদ্যোগী এবং বিপজ্জনক।

উনিশ বছর বয়সে, বয়সের দ্বিগুণ অভিজ্ঞতা আর জ্ঞান-বুদ্ধি অর্জন করে সে। তার ট্রেনিংয়ে একটাই মাত্র ছোট্ট খুঁত থেকে গিয়েছিল, সেটা প্রকাশ পায় পরে। বড় বেশি বুদ্ধিমতী সে, এবং বড় বেশি অ্যামবিশাস। বিশ মিনিটে এই প্রথম হাসলেন ডক্টর পার্কার। অ্যামবিশন, যার অপর নাম লোভ। তার প্রভুরা এই দোষটা লক্ষ্য করেনি।

 কলিনের দিকে না তাকিয়ে একটা হাত পাতল পিটার। ওর হাতে চুরুট আর লাইটার ধরিয়ে দিল কলিন।

লোভ সে তো অযোগ্য আর নির্বোধ লোকের মধ্যেও থাকে, আবার শুরু করলেন ডক্টর পার্কার। শুধু অত্যন্ত উন্নতমানের মেধা যার, সেই টাকার লোভ আর ক্ষমতার লোভ এক করে দেখে। পিটারের চোখে প্রতিবাদ লক্ষ্য করে তাড়াতাড়ি মাথা নাড়লেন তিনি। না, না–আমি সাধারণ ক্ষমতার কথা বলছি না। নাগালের মধ্যে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা, সে জিনিস নয়। আমি সত্যিকার ক্ষমতার কথা বলছি। একটা রাষ্ট্র বা জাতির ভাগ্য বদলে দেয়ার ক্ষমতা। যে ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন সিজার বা নেপোলিয়ান। যে ক্ষমতার অধিকারী যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। ব্যারনেস ম্যাগডার এই ক্ষমতাটা দরকার পিটার। মহান হবার লোভে ক্ষমতাটা দরকার তার।

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকলেন ডক্টর পার্কার, তারপর কলিনের দিকে ফিরে অনুরোধ করলেন, তুমি কি বল, কলিন, একটু কফি হলে ভালো হতো না?

কফি মেশিনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল কলিন।

বিরতি পেয়ে চিন্তা করার সুযোগ হলো পিটারের। ডক্টর পার্কারের কাহিনিতে খুঁত খুঁজল, কিন্তু পেল না। ব্যারনেস ম্যাগডার সাথে কাটানো সময়গুলোর কথা মনে পড়ে গেল। তার স্পর্শ, মধুর সংলাপ, কোমল কটাক্ষ, ব্যাকুল উদ্বেগ-মনে পড়লেই পুলকে শিরশির করে ওঠে শরীর। কোনো মেয়েকে ট্রেনিং দিয়ে এতটা ঝানু নিখুঁত করা সম্ভব কি?

নিচু টেবিলে সবার সামনে কফির কাপ রাখল কলিন। আবার শুরু করলেন ডক্টর পার্কার।

তারপর সে প্যারিসে ফিরে এল এবং তার পায়ে লুটিয়ে পড়ল প্যারিস। এল, এবং জয় করল ম্যাগডা। ফাইল থেকে ম্যাগডার কয়েকটা ছবি বের করলেন তিনি। এলিসি প্রাসাদে নাচছে ম্যাগডা, ব্লু রয়্যালের সামনে একটা রোলস-রয়েসে চড়ছে, সফররত মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাথে করমর্দন করছে, বরফ ঢাকা নিরিবিলি প্রান্তরে স্কি করছে, ঘোড়ার পিঠে বসে তীরবেগে মাঠ পেরোচ্ছে। অভিজাত ভঙ্গি, হাসিখুশি, গর্বিত। প্রতি ছবিতে তার সঙ্গে পুরুষ আছেই। ধনী, সুদর্শন, ক্ষমতাবান পুরুষ।

তোমাকে আমি আগেই জানিয়েছি, ছয়জনের সাথে যৌন সম্পর্ক ছিল তার, চেহারায় অস্বস্তি এবং তিক্ত ভাব নিয়ে বললেন ডক্টর পার্কার। সংখ্যাটা বদলাবার কারণ ঘটেছে। ফ্রেঞ্চরা এ সব ব্যাপারে খুঁটিয়ে জানতে পছন্দ করে, তালিকাটা আরো লম্বা করে দিয়েছে তারা। পিয়েরে হ্যামন্ড, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি মিনিস্টার এবং মার্ক ভিনসেন্ট, আমেরিকান কনসুলেটে হেড অভ দি মিশন। ফটোগুলো পিটারের দিকে বাড়িয়ে দিলেন তিনি।

একবার চোখ বুলিয়ে মাথা ঝাঁকাল পিটার। বলে যান। না দেখেই ম্যাগডার পুরুষ সঙ্গীদের চেহারা-আকার সম্বন্ধে সঠিক অনুমান করেছিল সে।

তার প্রভুরা কি রকম খুশি হয়েছিল বুঝতেই পারছ। একজন পুরুষ এজেন্টকে দিয়ে কাজ পেতে হলে অনেক সময় দশ-বারো বছর অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু ম্যাগডা সাথে সাথে ডিম পাড়তে শুরু করল। তার সাফল্য সম্পর্কে বিশদ আমরা জানতে পারিনি, রাশিয়ানরা সব কথা বলেনি আমাদের। তবে তারা বুঝতে পারে ম্যাগডা তাদের একটা অমূল্য সম্পদ। কিন্তু সেই সাথে এও তারা উপলব্ধি করে, ম্যাগডার রূপ-যৌবন একদিন শেষ হয়ে যাবে। আমরা ঠিক জানি না, ম্যাগডার প্রভুরাই ব্যারন অ্যারন অল্টম্যানকে নির্বাচন করেছিল কিনা। সম্ভবত তাই। পশ্চিম ইউরোপের অন্যতম একজন ধনী ব্যক্তি, যিনি স্টিল আর ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবসার বেশিরভাগটাই নিয়ন্ত্রণ করেন, যার রয়েছে এককভাবে সেরা আর্মামেন্ট কমপ্লেক্স, ইলেকট্রনিক্স সাম্রাজ্য, টার্গেট হিসেবে আদর্শ নয়? ব্যারনের স্ত্রী গত হয়েছে, কোনো সন্তানাদি নেই, কাজেই আবার তিনি বিয়ে করলে তার দ্বিতীয় স্ত্রীই হবে বিপুল সম্পত্তি আর বিত্ত-বৈভবের একমাত্র উত্তরাধিকারী। ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ধীরে ধীরে হারছেন ভদ্রলোক, অর্থাৎ তার আয়ু বেশিদিন নেই। তিনিও একজন ইহুদি এবং মোসাডের পুরানো ও বিশ্বস্ত এজেন্ট। ভেবে দেখো, পিটার, এ ধরনের একজন লোকের সাথে নিজেদের এজেন্টকে ভিড়িয়ে দিতে পারলে কি লাভ।

 ব্যারন সম্পর্কে বিস্তারিত সব জানা আছে আমার। আরেকজন অসাধারণ মানুষ। সিংহের মত দুর্জয় সাহস, সমস্ত বিষয়ে সেরা জিনিসটির ভক্ত। কৌশলে এবং ধীরে ধীরে তার কাছাকাছি হলো ম্যাগডা। এবং নিজ গুণে জয় করল তার মন। দুবছর কাটল, ম্যাগডা প্রমাণ করল তাকে ছাড়া ব্যারনের চলে না। কিন্তু নিজেকে সস্তা হতে দেয়নি ম্যাগডা, ব্যারনের যৌন-ক্ষুধার খোরাক হতে দেয়নি শরীরটাকে।

ব্যারনের নারী-প্রীতি ছিল কিংবদন্তীর মতে, ইউরোপের যে কোনো সুন্দরীকে চাইলেই পেত সে এবং চাইতেও দ্বিধা করত না। সন্তানাদি না হওয়ার অবশ্য একটা কারণ ছিল–যুবা বয়সের পদ্মস্থলন দায়ী। হ্যাঁ, যৌনরোগ। রোগটা অবশ্য পরে সম্পূর্ণ সেরে যায়, কিন্তু ক্ষতিটা পূরণ করা যায়নি। ব্যারন সন্তানোৎপাদনে অক্ষম হয়ে পড়েন।

ভক্টর পার্কার আরেকটা ফটো উল্টো করে ধরলেন পিটারের দিকে। গভীর মনোযোগর সাথে ব্যারন অল্টম্যানকে দেখল পিটার। শালপ্রাংশু শরীর, ষাড়ের মতো চওড়া কাঁধ, ইস্পাত-কঠিন নিরেট চোয়াল। যৌন-কাতর এবং কামুক অনেক লোকের মতোই তার মাথায় চুল নেই, কামানোর গোলা আকৃতির খুলির কিনারায় কাঁচাপাকা কয়েক গাছি ফিতের মতো সেঁটে আছে শুধু। হাসছে না, কিন্তু ঠোঁটের বঙ্কিম রেখা, আর সূতীক্ষ দৃষ্টির ভেতর থেকে ফুটে বেরুচ্ছে নির্দয় কৌতুকের ভাব। ক্ষমতার প্রতিমূর্তি ভাবল পিটার।

অবশেষে যখন ব্যারনকে শরীর জয় করার অধিকার দিল ম্যাগডা, নিশ্চয়ই বজ্রপাত সহ তুমুল ঝড়-ঝঞ্জর মতো ছিল ব্যাপারটা। ডক্টর পার্কার ম্যাগডা অল্ট ম্যানের যৌন-জীবন নিয়ে বেশি কথা বলছেন, যে তথ্যগুলো পাচ্ছে পিটার সেগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে আপত্তি করতে গিয়েও নিজেকে সামলে রাখল ও। দুজনেই সব দিক থেকে অসাধারণ, পরস্পরের উপযুক্ত। এক কোটি মানুষের মধ্যে ব্যতিক্রম একজোড়া নর-নারী। ওদের একটা বাচ্চা হতে পারলে কি ঘটত, গবেষণার বিষয় বৈকি। আমার ধারণা, বাচ্চাটা হতো মঙ্গোলিয়ান গর্দভ। ঠোঁট টিপে একটু হাসলেন তিনি। লাইফ ইজ লাইক দ্যাট।

অস্বস্তির সাথে নড়েচড়ে বসল পিটার, আলোচনার এই পর্যায়টাকে ঘৃণা করছে ও।

ওদের বিয়ে হয়ে গেল। পশ্চিমা ইন্ডাস্ট্রি জগতে নিজের একজন এজেন্টকে সাফল্যের সাথে বসাতে পারল এনকেভিডি। স্টিল আর অল্টম্যান আর্মামেন্টস কমপ্লেক্সে তৈরি হচ্ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স, আর আমেরিকার জন্যে মিসাইল। নতুন ব্যারনেস স্টিলের ডেপুটি চেয়ারম্যান হলো। আমরা ধরে নিতে পারি, মিসাইল ব্লু প্রিন্ট ব্রিফকেসে করে নয়, ট্রাকে করে পাচার করা হয়। প্রায় রোজ রাতেই পশ্চিমা জগতের রাজনীতির আর ভাগ্য বিধাতারা নতুন ব্যারনেসের সাথে মিটিংয়ে বসতেন, ব্যারনেস তাদেরকে মদ খাইয়ে খুশি করত আর তথ্য সংগ্রহ করত। প্রতিটি তথ্য মনে গেথে নিত ব্যারনেস, একবার কিছু শুনলে জীবনে কখনো ভোলে না। ধীরে ধীরে ব্যারনের ক্ষমতা কমতে লাগল, প্রতিদিন আরো বেশি করে স্ত্রীর ওপর নির্ভর করতে শুরু করলেন তিনি। ঠিক কখন থেকে ম্যাগডা ব্যারনের মোসাড তৎপরতায় সহযোগিতা করতে শুরু করে আমরা জানি না, তবে ব্যাপারটা ঘটতে শুরু করার সাথে সাথে রাশিয়ানদের প্ল্যান পরিপূর্ণ সাফল্য লাভ করে। ম্যাগডার মাধ্যমে ব্যারন অল্টম্যান হয়ে উঠল কে.জি.বি.-র ডান হাত। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, পশ্চিমা জগতের হেভি ইন্ডাস্ট্রির সিংহভাগের নিয়ন্ত্রণ চলে এল রাশিয়ার হাতে।

গোটা ব্যাপারটা চমৎকার শৃঙ্খলার সাথে চলছিল, কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে শুরু করল ব্যারনেসের আসল চেহারা। এক সময় কে.জি.বি. টের পেয়ে গেল, ব্যারনেস নিজের জন্যে কাজ করছে। ম্যাগডাকে যারা নিয়ন্ত্রণ করত, তাদের চেয়ে অনেক উন্নত ব্রেনের অধিকারিণী সে এবং প্রকৃত ক্ষমতার স্বাদ পেতে শুরু করেছে।

জাত গল্প বলিয়ের মতো ডক্টর পার্কার জানেন শ্রোতাদের কিভাবে উত্তেজিত করে তুলতে হয়। মাথা নিচু করে কফির কাপে চুমুক দিলেন তিনি। বিরতির সুযোগে উঠল বরসন, সবার কাপ ভরে দিল আবার।

 স্বভাবতই শেষ অস্ত্রটা ব্যবহার করল কে.জি.বি.-ভয় দেখাল ম্যাগডার কাভার ফাঁস করে দেবে তারা। অল্টম্যানের মতো ব্যক্তি যদি জানতে পানে তাকে বোকা বানানো হয়েছে, গুজব নেমে আসবে। সন্দেহ নেই, সাথে সাথে ম্যাগডাকে ডিভোর্স করবেন তিনি। ফ্রান্সে কাউকে ডিভোর্স দেয়া কঠিন, কিন্তু অল্টম্যানের জন্যে কিছুই কঠিন নয়। তার প্রোটেকশন ছাড়া ম্যাগডা মূল্যহীন-কারণ রাশিয়ানদের কাছে তার আর কোনো গুরুত্বই থাকবে না। অল্টম্যানকে হারালে ম্যাগডার ব্যক্তিগত স্বপ্নও ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। তাই বলতে হয়, কে.জি.বি-র হুমকিটা কাজের জিনিসই ছিল। কিন্তু এ ধরনের হুমকিতে কাজ হয় শুধু সাধারণ মানুষের বেলায়। কিন্তু আমরা এখানে একজন অসাধারণ মানুষকে নিয়ে আলোচনা করছি।

নিভে যাওয়া চুরুটটা আবার ধরাল পিটার। ওর সমস্ত নড়াচড়া নির্লিপ্ত লক্ষ্য করলেন ডক্টর পার্কার। তারপর ক্ষীণ একটু হাসলেন।

কথা একা শুধু বলছি। এবার তোমাকে একটা সুযোগ দিতে চাই, পিটার। সামান্য হলেও তুমি তাকে চিনো এবং গত এক ঘণ্টায় তার সম্পর্কে অনেক কিছু জানলে–ধারণা করতে পারো, এরপর কি করল সে?

মাথা নাড়তে শুরু করে হঠাৎ থেমে গেল পিটার, যেন প্রচণ্ড শক্তিতে কেউ ওকে ঘুসি মেরে বসেছে। ঠোঁট দুটো একটু ফাঁক হলো, বিস্ফারিত চোখে ডক্টর পার্কারের দিকে তাকিয়ে থাকল ও।

তুমি আন্দাজ করতে পেরেছ, মাথা ঝাঁকালেন ডক্টর পার্কার। হ্যাঁ, আমরা ধরে নিতে পারি, এ পর্যায়ে এসে ম্যাগডা নিজেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিল। পটল তুলতে বড় বেশি দেরি করছিল ব্যারন।

ক্রাইস্ট, ইটস হরিবল! যেন ব্যথা পেয়ে গুঙ্গিয়ে উঠল পিটার।

একদিক থেকে কথাটা ঠিক, পিটারকে সমর্থন করলেন ডক্টর পার্কার। কিন্তু

একজন দাবা খেলোয়াড়ের দৃষ্টিতে যদি তাকাও? অপূর্ব একটা চাল ছিল ওটা, পিটার। ম্যাগডা ব্যবস্থা করল, মনে হলো অল্টম্যানকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। সেদিন ব্যারনের সাথে যাবার জন্যে জেদ ধরে সে, সাক্ষী আছে। ব্যারনের শরীর ভালো ছিল না, নৌবিহারে যেতেই চাননি তিনি। কিন্তু ম্যাগডা তাকে জোর করে নিয়ে যায়, তাজা বাতাস আর রোদ দরকার স্বামীর। নৌ বিহারে যাবার সময় কখনোই দেহরক্ষী নিতেন না ব্যারন। তীর থেকে খানিক দূরে দ্রুগ্রামী একটা ক্রুজার অপেক্ষা করছিল–হাত দুটো দুদিকে মেলে দিলেন তিনি। খুঁটিনাটি সবই তো তোমরা জানো, তাই না?

না, অস্বীকার করল পিটার।

ক্রুজারটা সরাসরি ছুটে এসে ধাক্কা মারে ইয়টকে। পানি থেকে ব্যারনেসকে তোলা হয়, কিন্তু ব্যারন হাবুডুবু খেতে থাকে। এক ঘণ্টার পর একটা রেডিও মেসেজ রিসিড় করে স্কোস্টগার্ড, তারা গিয়ে উদ্ধার করে ব্যারনসেকে–তখনো বিধ্বস্ত ইয়টের ভাসমান টুকরো ধরে বসে ছিল সে। ব্যারনেস যাতে বেঁচে থাকে তার ব্যবস্থা কিডন্যাপাররাই করে রেখে গিয়েছিল।

তারা হয়তো চেয়েছিল দর কষাকষি করতে হলে স্বামী-ভক্ত স্ত্রীকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার।

তা সম্ভব। এবং তার পর আদর্শ স্ত্রীর ভূমিকাই পালন করে সে। মুক্তিপণ চাওয়া হলো, ব্যারনেস ম্যাগডা অল্টম্যান ইন্ডাস্ট্রির বোর্ড অভ ডাইরেক্টরদের বাধ্য করল পঁচিশ মিলিয়ন ডলার হাতছাড়া করতে। সে একা মুক্তিপণের টাকা কিডন্যাপারদের দিয়ে আসতে গেল–সম্পূর্ণ একা।

কিন্তু টাকার তার দরকার ছিল না।

কেন ছিল না? নিশ্চয়ই ছিল! দ্বিমত পোষণ করলেন ডক্টর পার্কার। ব্যারনেসের ওপর যতই নির্ভর করুন অল্টম্যান, স্বভাবে তিনি কড়া হিসেবী ছিলেন। চেক বই কখনো তিনি হাতছাড়া করেননি। ধনী একজন লোকের স্ত্রী হিসেবে ম্যাগডা যা খুশি তাই চাইতে পারত, চেয়ে পেতে পারত–ফার, অলঙ্কার, চাকর-বাকর, গাড়ি, কাপড়চোপড়, দ্বীপ বা বাড়ি, ঘোড়া বা ইয়ট, হাতখরচা-বছরে দুলাখ ডলার, বেতন হিসেবে। সাধারণ একজন স্ত্রী এতেই সন্তুষ্ট থাকত, কিন্তু ম্যাগডা তা ছিল না। বিপুল ক্ষমতার অধিকারিণী হবার জন্যে বিপুল টাকার দরকার ছিল তার। পঁচিশ মিলিয়ন ডলার পুঁজি হিসেবে খুব কম নয়, পরে মূল তহবিলে তো হাত পড়বেই। গাড়িতে করে টাকা নিয়ে রওনা হয়ে গেল সে-প্রতিটি এক হাজার সুইস-ফ্রাঙ্কের নোট ছিল ওগুলো আমার ধারণা। পরিত্যক্ত একটা এয়ারফিল্ডে পৌঁছায় সে, একটা প্লেন এসে টাকাগুলো তুলে নিয়ে যায় সুইটজারল্যান্ডে। নিখুঁত, তাই না?

 কিন্তু,–প্রতিবাদ করার জন্যে উপযুক্ত শব্দ খুঁজল পিটার। কিন্তু ব্যারনকে নির্যাতন করা হয়। ম্যাগডা কিভাবে…?

 মৃত্যু মৃত্যই, নির্যাতন হয়তো অন্য কোনো উদ্দেশ্য পূরণ করে থাকবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, আমরা একটা ইস্টার্ন বেন নিয়ে আলোচনা করছি। হতে পারে ব্যারনকে নির্যাতন করা হয় স্ত্রীর ওপর থেকে সন্দেহ দূর করার জন্যেই। দেখ না, নির্যাতনের প্রসঙ্গ তুলে তুমিও ম্যাগডাকে নির্দোষ বলে ভাবতে চাইছ।

কথাটা সত্যি, ভাবল পিটার। স্বামীকে কেউ যদি খুন করতে পারে, নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্যে তাকে ক্ষত-বিক্ষত করা তার জন্যে অসম্ভব কি। না, প্রতিবাদ করার আর কিছু নেই ওর।

এবার এসো, দেখা যাক এ পর্যন্ত কি পেল ম্যাগডা। বিপুল ক্ষমতা অর্জনের পথে ব্যারন একটা বাধা ছিল, বাধাটা আর থাকল না। ম্যাগডার অনেক ইচ্ছায় বাদ সাধতেন তিনি, সে সব সমস্যাও দূর হলো–যেমন, ম্যাগডা চাইত দক্ষিণ আফ্রিকায় অস্ত্র বিক্রি করবে না, কিন্তু ব্যারন বাজার হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ভারি পছন্দ করতেন এবং জাতিসংঘ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার আগে পর্যন্ত স্ত্রীর আপত্তি কানে না তুলে দক্ষিণ আফ্রিকার এয়ারক্রাফট, মিসাইল, আর লাইট আর্মামেন্টস বিক্রি করেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতি সহানুভূতি ছিল ব্যারনের, অবশ্যই তার একটা কারণ এই যে সে দেশের শ্বেতাঙ্গ সরকার ইহুদিদের প্রতি সহানুভূতিশীল। ব্যারনেস ম্যাগডার দক্ষিণ আফ্রিকা বিরোধী মনোভাবের কথা ভুলে যেয়ো না, এ প্রসঙ্গে পরে আমরা ফিরে আসব।

দুনম্বর বাধা ছিল রাশিয়ান নিয়ন্ত্রণ, তাদের সাথে সম্পর্কের ইতি ঘটিয়ে সে বাধাও দূর করল ম্যাগডা। নিজেকে রক্ষার জন্যে প্রাইভেট একটা বাহিনি মোতায়েন করল সে। অল্টম্যান মারা যাবার পর তার সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী হলো ম্যাগডা, সে তখন ফরাসি সরকারের মর্যাদার অন্যতম প্রতীক, প্রাক্তন প্রভুরা তাকে স্পর্শ করার সাহস পেল না। পুঁজি হিসেবে তার হাতে এসেছে পঁচিশ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, এই টাকার হিসাব কাউকে তার দিতে হবে না। ইন্ডাস্ট্রিগুলোর রয়েছে তথ্য সংগ্রহের বিপুল আয়োজন, ফলে ফরাসি সরকার পর্যন্ত সমীহ করতে শুরু করল তাকে। ম্যাগডা ফ্রেঞ্চ ইন্টেলিজেন্সকেও যতদূর পারে নিজের কাজে ব্যবহার করার সুযোগ তৈরি করে নিল। তারপর, মোসাড কানেকশন তো ছিলই…

হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেল পিটারের, ম্যাগডা প্রায়ই ওকে তার তথ্য সংগ্রহের উৎসের কথা বলেছে, কিন্তু উৎসগুলোর পরিচয় প্রকাশ করেনি কখনো ম্যাগডা কি নিজের প্রাইভেট এজেন্সির মতো একইভাবে ফ্রেঞ্চ আর ইসরায়েলি ইন্টেলিজেন্সকে ব্যবহার করার যোগ্যতা রাখে? অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার। কিন্তু ব্যারনেস ম্যাগডার পক্ষে সব কিছুই সম্ভব…।

এরপর আরেক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ম্যাগডা। কোম্পানি থেকে স্বামীর ভক্ত আর বন্ধুদের কৌশলে সরাতে লাগল সে, যারা তার কাজে বাধা দিতে পারে। কাজটা কৌশলে আর সময় নিয়ে করল সে। কৌশলে আর সময় নিয়ে এবার আসল কাজেও হাত দিল ম্যাগডা। গোটা মানবজাতির নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে তুলে নিতে হলে প্রথমে দরকার নিজের অপছন্দের রাষ্ট্রগুলোকে টার্গেট করা। তাই করেছে ম্যাগডা। কেন সে খলিফা নামটা বেছে নিল তা অবশ্য বলতে পারব না…

আপনি বোধ হয় ভুল করছেন, ডক্টর পার্কার। আঙুল দিয়ে চোখের কোণ টিপে ধরল পিটার। ব্যারনেস ম্যাগডাকে আপনি ঠিক চিনতে পেরেছেন বলে মনে হয় না…।

 আমি কেন, কেউ তাকে চেনে বলে বিশ্বাস করি না, পিটার, বিড়বিড় করে বললেন ডক্টর পার্কার, পাইপের তামাক ঝাড়লেন অ্যাশট্রেতে। দুঃখিত, খুব তাড়াতাড়ি কথা বলছি আমি। কোনো প্রশ্ন করার জন্যে আরেকটু পেছনে যেতে চাও তুমি, পিটার?

না, ঠিক আছে। চোখ মেলল পিটার! আপনি বলে যান, প্লিজ।

খুব চালাকির সাথে প্ল্যানটা করে ম্যাগডা। দক্ষিণ আফ্রিকার কালোদের পক্ষে কেউ যদি কিছু করতে চায়, গোটা দুনিয়ার সমর্থন পেয়ে যাবে তারা, এই কথাটা মনে রেখে জিরো-সেভেন-জিরোকে ওখানে নিয়ে যায় সে। শর্ত দেয় কালোদের নেতাদের মুক্তি দিতে হবে, সাথে দিতে হবে চল্লিশ টন সোনা। আর চল্লিশ টন সোনা আর দক্ষিণ আফ্রিকা–সবই থাকত খলিফার হাতের মুঠোয়।

 প্ল্যানটা প্রায় সফল হতে যাচ্ছিল, তাই না? শুধু একজন লোক বাদ সাধে তুমি, পিটার। তবু বলতে হবে, ম্যাগডার হার হয়নি। তার অনেকগুলো ধারণা সত্যি প্রমাণিত হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকার দুর্বল, এটা প্রমাণিত হয়। বিপদের সময় এই সরকারকে আমেরিকা বা ব্রিটেন সাহায্য করবে না। কাজে হাত দেয়ার আগে প্রচুর টপ সিক্রেট ইনফরমেশন জোগাড় করেছিল সে, জানা গেল প্রতিটি তথ্য ছিল নির্ভুল। অপারেশনের জন্যে যে সব লোকদের বাছাই করেছিল সে, দুনিয়ার সেরা ছিল তারা। এমনকি এই তথ্যও জানা ছিল তার যে নেগোশিয়েটর হিসেবে তোমাকে পাঠানো হবে। চারজন জিম্মিকে হত্যা করায় তার প্রতিপক্ষরা হতভম্ব হয়ে যায়, অসহায় বোধ করে—কিন্তু তার মুখের গ্রাস কেড়ে নেয় একজন মাত্র লোক। স্বভাবতই সেই লোকের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে সে। মেয়েলি ইনটিউশনের সাহায্যে যে বুঝতে পারে লোকটার মধ্যে উন্নতমানের কিছু গুণ রয়েছে যা নিজের কাজে ব্যবহার করতে পারলে সোনায় সোহাগা।

 গল্পের এই অংশে নিজেকে আনতে হয়। আমাকে আভাস দেয়া হয়েছিল, খলিফার অস্তিত্ব আছে। অল্টম্যানকে খুন করার পর দক্ষিণ আফ্রিকা দখলের প্ল্যান করেছিল ম্যাগডা, তা নাও হতে পারে। মাঝখানে আরো কিছু দুষ্কর্ম করে থাকতে পারে সে। দুটো কিডন্যাপিংয়ের ঘটনা তার স্টাইলের সাথে মেলে। একটা হলো, ভিয়েনা থেকে ওপেক তেল মন্ত্রীদের কিডন্যাপিং। তবে আমরা নিশ্চিত নই। আমাকে সাবধান করা হয়, খলিফা আবার কখন মাথাচাড়া দেবে তার অপেক্ষায় ওত পেতে ছিলাম আমি। প্লেন হাইজ্যাকারদের জেরা করার সুযোগ পেয়েও হারালাম…।

ওরা আপনাকে কিছু বলতে পারত না, বাধা দিল পিটার। ওরা স্রেফ খুঁটি ছিল, আয়ারল্যান্ডের সেই ডাক্তারের মতো।

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডক্টর পার্কার। হয়তো তোমার কথাই ঠিক, পিটার। কিন্তু তখন আমার বিশ্বাস ছিল হাইজ্যাকাররা মারা যাওয়ায় একমাত্র সূত্রটা হারালাম, খলিফাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। আঘাতটা সামলে ওঠার পর হঠাৎ আমার মনে হলো, সূত্র হারায়নি, আছে। তুমি, পিটার, তোমাকে আমি সূত্র হিসেবে চিনতে পারলাম। সেজন্যেই থোর কমান্ড থেকে তোমার পদত্যাগ মেনে নিলাম আমি, অর্থাৎ মেনে নেয়ার ভান করলাম। তুমি পদত্যাগ না করলে তোমাকে আমি বরখান্ত করতাম, বুঝলে। কিন্তু তার দরকার হলো না, আমার মনের আশা পূরণ করে তুমিই পদত্যাগ করলে। সেজন্যে তোমার ধন্যবাদ পাওনা হয়েছে, দেয়ার কথা মনে ছিল না…

ধন্যবাদ দেয়ার কোনো দরকার নেই, গম্ভীর সুরে বলল পিটার। থোর কমান্ডে কাজ করার সুযোগ পেয়ে আমি খুশি।

সবাই জানল, থোর কমান্ডে নেই তুমি। ম্যাগডা সময় নষ্ট করেনি, তোমার জন্যে টোপ ফেলল সে। প্রথমে তোমার সম্পর্কে সম্ভাব্য সব জানার চেষ্টা করল-প্রমাণ আছে আমার কাছে। তুমি পদত্যাগ করার চারদিন পর অ্যাটলাসের কম্পিউটার অনুমতি ছাড়াই ব্যবহার করা হয়। সব জানার পর তোমাকে তার মনে ধরে। কনভেনশনাল চ্যানেলের মাধ্যমে তোমাকে তো যোগ দেয়ার প্রস্তাব পাঠানো হলো। তুমি প্রত্যাখ্যান করায় আগ্রহ আরো বেড়ে গেল ম্যাগডার। স্যার স্টিভেনের সাথে যোগাযোগ ছিল তার, তোমাকে নিমন্ত্রণ করার জন্যে তাকে ব্যবহার করল সে। তোমাদের দেখা হলো এবং তুমি মুগ্ধ হলে-ব্যারনেস ম্যাগডা সুন্দরী, অভিজাত, বিদুষী, সত্যিকার একজন পুরুষ তার প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে পারে না। আমি তোমাকে দোষ দিচ্ছি না, পিটার। তার জানা ছিল ঠিক কোন্ ধরনের মেয়ে তুমি পছন্দ কর। কোন কোন শারীরিক বৈশিষ্ট্য তোমার প্রিয়—-

কি সেগুলো? পিটার জানতে চায়। তার জানা ছিল না, নির্দিষ্ট কোনো শারীরিক বৈশিষ্ট্য তার পছন্দের তালিকায় পড়ে।

লম্বা, স্লিম, গাঢ় বাদামি চুল, সাথে সাথেই জবাব দিলেন পার্কার। চিন্তা করেই দেখ। তোমার সমস্ত বান্ধবীরাই কিন্তু তাই।

ঠিকই বলেছে—-মনে মনে স্বীকার করে পিটার। এই উনচল্লিশ বছর বয়সেও নিজের সম্পর্কে অনেক কিছু জানার বাকি আছে তাহলে!

আপনি একটা যাচ্ছেতাই—ঠাণ্ডা মাথার বাস্টার্ড–কিংস্টোন। আগে কেউ বলেছে কথাটা?

মাঝেমধ্যেই, কিংস্টোন হাসেন। কিন্তু কথাটা সত্যি নয়। ব্যারনেস অল্টম্যানের তুলনায় আমি তো ফাদার ক্রিস্টমাস! আবারো সিরিয়াস প্রসঙ্গে ফিরে গেলেন তিনি।

 ম্যাগডা জানতে চাইছিল অ্যাটলাস অর্থাৎ আমরা তার সম্পর্কে কতটুকু কি জানি। ইতোমধ্যে সে জেনেছে, তাকে আমরা সন্দেহ করি। তোমাকে পেয়ে আসলে আমাদের অর্গানাইজেশনের ভেতর নিজের একটা কান পেয়ে গেল সে। তুমি থোরের বাইরে থাকায় তার কাছে তোমার দাম কমেনি, কারণ অন্যান্য আরো বহু জায়গায় তোমাকে দিয়ে তার কাজ হবার কথা। বোনাস হিসেবে পাওয়া যাবে তো তোমার সার্ভিস। তার সব আশাই পূরণ হলো। তুমি এমনকি তার জীবনের ওপর একটা হামলাও বানচাল করে দিলে…

ভ্রু কুঁচকে তাকাল পিটার।

রঁবুইলেতে সে রাতে কি ঘটেছিল? এখানে আমরা শুধু আন্দাজ করতে পারি, তবে আন্দাজটাকে বিশ্বাস্য করার মতো যথেষ্ট তথ্যও আমাদের হাতে এসেছে। ফ্রান্সের সাথে সম্পর্ক করতে চাইনি রাশানরা, তাই ম্যাগডার উপর প্রতিশোধ নেয়নি তারা, কিন্তু তাই বলে ক্ষমাও করেনি। তারা আসলে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। ম্যাগডাই যে খলিফা, এ সন্দেহ তাদের মনেও দেখা দিয়ে থাকবে, ঠিক জানি না, এনকেভিডি হয়তো সরাসরি ম্যাগডাকে খুন করার প্ল্যানটা করেনি, ভাড়াটে খুনি নিয়োগ করে, কিংবা মোসাড় তার এজেন্ট পাঠায়–বঁবুইলে রোডে পাতা হয় একটা অ্যামবুশ। কিন্তু সে অ্যামবুশে গিয়ে পড়ো তুমি। আমি জানি, পিটার, কো-ইন্সিডেন্স তুমি বিশ্বাস কর না কিন্তু মাসেরাতি চালাচ্ছিলে এবং ব্যাপারটা কো-ইন্সিডেন্স ছাড়া অন্য কিছু নয়।

 বেশ, বিড়বিড় করে বলল, পিটার। বাকি সব যদি গিলতে পারি, এটা হজম করা কি আর এমন কঠিন।

 ওই হামলাটা সতর্ক করে দেয় ম্যাগডাকে। কারা দায়ী, সে জানত না। তার সন্দেহ হয়, এর পিছনে আমাদের হাত আছে। এই ঘটনার পরপরই তুমি জানাও, আমাদের সন্দেহ মিথ্যে নয়, খলিফা নামে সত্যি একজন কেউ আছে। তোমাকে আমি আমেরিকায় ডেকে পাঠাই, কলিন তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসে, তারপর ফিরে গিয়ে ম্যাগডার সাথে কথা বল তুমি। হয় তুমি নিজেই সব বলেছ তাকে, নয়তো তোমার সাথে কথা বলে সে বুঝে নেয় আমাদের অর্গানাইজেশন এবং বিশেষ করে ডক্টর পার্কার তার পিছনে লেগেছে। এখানেও আমি কল্পনার আশ্রয় নিচ্ছি, পিটার। তুমিই ভালো বলতে পারবে কতটুকু কি সত্যি। বি অনেস্ট।

পিটার তার দিকে তাকিয়ে থাকল, চেষ্টা করছে চেহারায় যাতে কোনো ভাব না ফোটে। ঝড় বয়ে তুলেছে মনের ভেতর। ডক্টর পার্কার যা কল্পনা করেছেন ঠিক তাই ঘটেছে।

আমরা সবাই খলিফাকে খুঁজছিলাম। এ প্রসঙ্গে ম্যাগডার সাথে আলোচনা করাটা বিপজ্জনক বলে মনে করোনি তুমি। স্বীকার করার জন্যে পিটারকে প্ররোচিত করলেন ডক্টর পার্কার। ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকাল পিটার।

 তুমি বিশ্বাস করেছিলে আমাদের এবং ম্যাগডার উদ্দেশ্য আলাদা নয়, নরম সুরে বললেন ডক্টর পার্কার, তুমি ভেবেছিলে আমরা সবাই খলিফাকে ধ্বংস করতে চাই।

ম্যাগডা জানত আমেরিকায় আপনার সাথে দেখা করতে গিয়েছি আমি। কিভাবে জানতে পারে বলতে পারব না, কিন্তু জানত। আড়ষ্ট বোধ করল পিটার, নিজেকে বিশ্বাসঘাতকের মতো লাগল।

 তাই বুঝি, পিটার। কারও প্রতি দুর্বলতা জন্মালে এ ধরনের ভুল মানুষ করে, সেজন্য আমি তোমাকে দোষ দেই না। তোমার সাথে কথা বলার পর ম্যাগডা জেনে গেল, কে তাকে শিকার করতে চায়। জেনে গেল, তার জন্য আমি একটা ভয়ঙ্কর বিপদ। একমাত্র তুমিই কোনো রকম সন্দেহ সৃষ্টি না করে আমার কাছে পৌঁছুতে পারো। কিন্তু তোমাকে বললে কাজটা করতে তুমি রাজি হবে না। ম্যাগডা জানত, তুমি খুনি নও। সে তোমার দুর্বলতা খুঁজতে লাগল। পেতে বেশি দেরি হলো না। এমন একজনকে খুঁজে বের করল সে, যার জন্যে নিজের জীবন দিতে পার তুমি–মেলিসা জেইন। এক ঢিলে দুটো পাখি মারার প্ল্যান করল ম্যাগডা। মেয়েকে বাঁচাবার জন্যে আমাকে তুমি খুন করলে দুটি কাজ হতো তার। এক, শত্রু নিপাত যেত। দুই, চিরকালের জন্যে তার ফাঁদে আটকে পড়তে তুমি। কাজটা করার পর খলিফার মুঠো থেকে বেরুতে পারতে না কোনোদিন। একের পর এক তোমাকে দিয়ে খুন করাত সে। খুন করাত, আর তোমার শরীরটাকে ব্যবহার করত। তার যৌন ক্ষুধা সম্পর্কে তোমাকে তো আমি আগেই বলেছি।

পিটারের শক্ত চোয়াল আর ঠোঁটের কোণে কুঞ্চন পার্কারের চোখ এড়াল না। চোখে আগুন।

তুমি খুবই সুপুরুষ। আর ব্যারনেস চাইছিল কাজের ফাঁকে ফাঁকে উপরি নেবে তোমার কাছ থেকে।

পিটারের ইচ্ছে হলো, এক ঘুষিতে সামনের ভদ্রলোকের চোয়াল ভেঙে দেয়।

 তবে শুধু যৌন সুখ দিয়ে তোমাকে ভেড়া বানানো সম্ভব নয় এটুকু বুঝতে পেরেছিল ম্যাগডা। সেজন্যই মেলিসাকে কিডন্যাপ করল সে। কিডন্যাপ করার পরপরই তার একটা আঙ্গুল কেটে ফেলল, তার স্টাইলের সাথে মিলে যায়, তাই না? জোহানেসবার্গের কথা স্বরণ কর। কোনো রকম দ্বিধা না করেই জিম্মিদের হত্যা করে সে। দুনিয়ার লোককে তো বুঝতে হবে খলিফাকে ভয় পাওয়া দরকার।

নির্দিষ্ট সময়ের আগে তুমি আমাকে খুন না করলে কি হতো, পিটার? মেলিসাকে খুন করত সে। কিন্তু আমরা বেঁচে গেলাম শওনেসির একজন শত্রু দয়া করে ফোন করায়। এই সময় রাশিয়ানরাও আমাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিল। নিজেদের সমস্যা আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার সুবর্ণ একটা সুযোগ ছিল তাদের ওটা। ম্যাগডার প্রায় সম্পূর্ণ ইতিহাস আমাদের জানিয়ে দিল তারা।

কিন্তু এখন আমাদের করণীয় কি? জিজ্ঞেস করল কলিন। আমাদের হাত তো বাধা। আমরা কি অপেক্ষা করব আবার কখন আঘাত হানবে খলিফা সেই আশায়? একটু থেমে আবার বলল, এরপর হয়তো খবর আসবে সৌদি বাদশার কোনো ছেলেকে খুন করেছে খলিফা। কিংবা মেশিনগান দিয়ে ঝাঁঝরা করেছে ইরানের শাহ-এর বোনকে?

ওপেক তেলের দাম বাড়ালে সে ধরনের ঘটনা ঘটবে। অবশ্যই ঘটবে, বললেন ডক্টর পার্কার। তেলের দাম কমলে এককভাবে আর কেউ তার মতো উপকৃত হবে না। ম্যাগডা অতুলনীয়-ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক স্বার্থ কি সুন্দরভাবে মেলাতে পেরেছে।

ধরুন এই কাজে সফল হবে সে, ওপেক সদস্যরা তার ভয়ে তেলের দাম বাড়াবে না, বলল কলিন। কিন্তু তারপর? খলিফার পরবর্তী টার্গেট কি হবে?

এ ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়, নিচু গলায় বললেন ডক্টর পার্কার, তার সাথে কলিন পিটারের দিকে তাকাল।

ক্লান্ত এবং বিধ্বস্ত দেখল ওরা পিটারকে। শুধু চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে।

আমি চাই তুমি আমার এই কথাগুলো বিশ্বাস কর, পিটার। এতক্ষণ বকবক করছি তোমার উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য নয়। ধীরেসুস্থে পাইপে তামাক ভরলেন ডক্টর পার্কার। সব কথা তোমাকে আমি বলিনি, যতটুকু প্রয়োজন বলে মনে করেছি ততটুকু বলেছি। বলেছি এজন্য মায়াবিনীর পাতালপুরীতে যদি ঢোকার সিদ্ধান্ত নাও, আমি চাই তুমি সতর্ক অবস্থায় থাকবে। না, পিটার, আমি তোমাকে তার কাছে ফিরে যাবার অর্ডার করছি না। ঝুঁকিটা খাটো করে দেখার উপায় নেই। তোমার বদলে অন্য কেউ যেতে চাইলে ব্যাপারটাকে আমি সুইসাইডাল বলে ধরে নিতাম। তবে তোমার কথা আলাদা। যেহেতু তোমাকে সতর্ক করা হয়েছে, একমাত্র তোমার পক্ষেই তার নিজের জায়গায় তাকে ধ্বংস করা সম্ভব। এই কথাটার ভুল অর্থ করবে না, প্লিজ। আমি খুন করার পরামর্শ দিচ্ছি না। আমি বরং তোমাকে এ লাইনে চিন্তা করতে নিষেধ করছি। তবু যদি তুমি এ ধরনের কিছু করে বসো, আমি সেটা অনুমোদন করব না, তোমাকে আমি বিচারকের সামনে কাঠগড়ায় দাঁড় করাব।

আমি শুধু চাই, খলিফার কাছাকাছি থাকো তুমি, বুদ্ধি দিয়ে তাকে হারাও। তার কুকীর্তি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ কর, সাক্ষি হও আর প্রমাণ জোগাড় কর, আমরা তাকে আইনের সাহায্যে কাবু করব। আমি চাই ইমোশন্যাল ইস্যুগুলো ভুলে থাকো তুমি জিরো-সেভেন-জিরোর জিম্মিদের কথা মুছে ফেল মন থেকে, ভুলে যাও মেলিসার কথা। আমরা বিচারক নই, পিটার। আমরা জল্লাদও নই।

 পিটার ভাবছে, খলিফাকে ঠেকাবার একটাই রাস্তা আছে। ব্যারসেন ম্যাগডা অল্টম্যানের মতো ব্যক্তিত্বকে ফরাসি কোর্টে দাঁড় করানোর আশা হাস্যকর। ডক্টর পার্কার যাই বলুন, ওর সিদ্ধান্ত তাতে বদলাবে না।

 পিটার ভাবতে চেষ্টা করল, ওর সিদ্ধান্তে প্রতিশোধের কোনো ভূমিকা নেই। কিন্তু উপলব্ধি করল, নিজেকে বোকা বানাতে চেষ্টা করছে সে। হ্যাঁ, প্রতিশোধ নিতে চায় বলেই এই সিদ্ধান্তে আসতে হয়েছে ওকে। ব্যক্তিগতভাবে অপমান করা হয়েছে ওকে।

জার্মান মেয়ে ইনগ্রিডকে খুন করেছে পিটার। খুন করেছে জিলি ও। শওনেসিকে। ওদের খুন করার সময় অপরাধবোধে ভোগেনি বা সিদ্ধান্তগুলোর জন্যে নিজেকে ঘৃণা করেনি। ওদের খুন করা যদি উচিত কাজ হয়ে থাকে, তাহলে খলিফাকে খুন করা আরো কয়েক হাজার গুণ বেশি উচিত কাজ হবে।

সেই উচিত কাজটা করার মতো লোক একজনই মাত্র আছে।

.

পরিচিত সুর-মাধুর্য সারা শরীরে শিরশিরে একটা শীতল ভাব এনে দিল। হালকা, প্রলম্বিত কণ্ঠস্বর, আন্তরিক এবং উদ্বিগ্ন। শুনে হাঁপ করে গেল পিটারের, যেন অনেকটা পথ দৌড়ে এসেছে।

 ওহ পিটার! শুধু তোমার এই গলা পেয়েই আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি! কি রকম উদ্বেগে ছিলাম জানো না! আমার টেলিগ্রাম পেয়েছ?

না, কিসের টেলিগ্রাম?

 মেলিসাকে মুক্ত শোনার পর রোম থেকে তোমাকে একটা টেলিগ্রাম পাঠাই..

পাইনি, কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না…

ভায়া নার্মকো, ব্রাসেলসে পাঠিয়েছিলাম ওটা…

হয়তো ওখানে আমার টেবিলে পড়ে আছে। সময়ের অভাবে খবর নেয়া হয়নি।

কেমন আছে ও, পিটার?

ভালো। ম্যাগডার নাম উচ্চারণ বা অন্য কোনোভাবে সম্বোধন করছে না পিটার, ভয় হতে লাগল গলার আওয়াজ থেকেই না টের পেয়ে যায় মনের ভাবটুকু।

নতুন করে কেউ ওকে স্পর্শ করতে পারবে না, নিরাপদ জায়গায় পজিশন নিয়ে আছে, সম্পূর্ণ তৈরি। ওর ধারণা হলো, ম্যাগডা হয়তো জানতে চাইবে কোথায় আছে মেলিসা।

তুমি কেমন আছ, শেরি, মাই লাভ?

 আছি একরকম। খুব ধকল গেছে, বুঝতেই পার।

জানি, পিটার, জানি। কি রকম অসহায় বোধ করছিলাম সে তোমাকে বোঝাতে পারব না। খবর সংগ্রহের জন্য কি না করেছি, কোথায় না গেছি–সেজন্যেই তোমার সাথে যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু দিনের পর দিন কোনো খবরই আসেনি…

এখন সব মিটে গেছে, শুকনো গলায় বলল পিটার।

আমার তা মনে হয় না, দ্রুত বলল ব্যারনেস ম্যাগডা। কোত্থেকে বলছ তুমি?

লন্ডন।

 তুমি ফিরবে কখন?

এক ঘণ্টা আগে ব্রাসেলসে ফোন করেছিলাম। জরুরি ব্যাপার, নার্সকোতে আমাকে দরকার। আজ বিকেলে ফ্লাইট ধরব।

 অপরপ্রান্ত থেকে কয়েক সেকেন্ড শুধু ঘন ঘন নিঃশ্বাস পতনের আওয়াজ শুনল পিটার। তারপর ম্যাগডা বলল, পিটার, তোমার সাথে আমার দেখা হওয়া দরকার। অনেক দিন তোমাকে কাছে পাই না। কিন্তু, হায় ঈশ্বর, আজ রাতে আমাকে ভিয়েনায় থাকতে হবে। দাঁড়াও, একটু ভাবতে দাও–এই, শোনো, পেয়েছি! এখুনি যদি তোমাকে আনার জন্যে লিয়ারটা পাঠিয়ে দেই আমাদের দেখা হতে পারে, অন্তত এক ঘণ্টার জন্যে হলেও তুমি রাত করে ওরলি থেকে ব্রাসেলসের ফ্লাইট ধরতে পারো আর আমি লিয়ার নিয়ে ভিয়েনায় চলে যেতে পারি। প্লিজ, পিটার। তোমার অভাব আমাকে…প্লিজ, চলে এসো, একটা ঘণ্টা একসাথে কাটাই আমরা!

.

লিয়ার থেকে পিটার নামতেই এয়ারপোর্টের একজন সহকারী ম্যানেজার অভ্যর্থনা জানাল, পথ দেখিয়ে নিয়ে এল ভি.আই.পি, লাউঞ্জে।

লাউঞ্জে ঢুকেই পিটার দেখল লম্বা পা ফেলে ওর দিকে দ্রুত হেঁটে আসছে ব্যারনেস ম্যাগডা। ও ভুলে গিয়েছিল ব্যারনেসের উপস্থিতি কিভাবে একটা কামরাকে সৌন্দর্য মণ্ডিত করে তোলে।

হাতে সেলাই করা জ্যাকেটের সাথে ম্যাচ করা স্কার্ট পরেছে সে, গান মেটাল গ্রে তার রঙ। হাঁটা নয় যেন নাচ, লম্বা পায়ে মন কাঁপানো ছন্দ যেন সরু কোমর থেকে উৎসারিত হচ্ছে। আড়ষ্ট হয়ে গেল পিটার, পা দুটো বিষম ভারী, কারণ শত্রু আর অমঙ্গলের উপস্থিতি সম্পর্কে ওর গোটা অস্তিত্ব সচেতন।

 পিটার, মাই লাভ! ওরা তোমার একি অবস্থা করেছে! মায়াভরা কোমল চোখ উদ্বেগে ভরাট হয়ে উঠল ম্যাগডার, হাত তুলে পিটারের মুখ স্পর্শ করল সে।

গত কয়েক দিন তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়েছে পিটার, লাবণ্য হারিয়েছে চেহারা। দাড়ি-গোঁফ কামায়নি, মাথায় এলোমেলো হয়ে আছে লম্বা চুল। চোখ দুটো প্রায় লাল।

আগেই ভেবে রেখেছে পিটার, ওকে সাবধান থাকতে হবে। ও যা জানে সেটা গোপন করে রাখাটা কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ বোঝে। ম্যাগডাকে কোনোভাবেই জানতে দেয়া চলবে না যে তার পরিচয় ফাঁস হয়ে গেছে। ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক হবে সেটা। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক আচরণ করতে হবে ওকে। সতর্কই ছিল, তবু মুহূর্তের জন্যে চোখের সামনে ভেসে উঠল মেলিসার ব্যান্ডেজ বাধা হাতটা। টান পড়ল পেশিতে, সেটা গোপন করার জন্যে তাড়াতাড়ি একটু ঝুঁকে এগিয়ে দিল মুখটা। দুজোড়া ঠোঁট এক হলো।

ঠোঁট দুটো ম্যাগডার মতো করতে চাইল পিটার-কোমল, উষ্ণ, ভেজা। যে নারীদেহ পাকা টসটসে ফলের মতে, এ ঠোঁট তার; যেন থেঁতলানো পাপড়ি। শরীরটাকে আদরের কাঙাল, ভালোবাসায় থরথর করে তুলতে চেষ্টা করল পিটার, ঠিক ম্যাগডা যেমন ওর আলিঙ্গনের ভেতর তাপ দগ্ধ মোমের মতো গলে যাচ্ছে, চাপ দিয়ে সেঁধিয়ে যেতে চাইছে শরীরের ভেতর। মনে হলো পাকা অভিনেতার মতো উৎরে গেছে ও, আর ঠিক তখুনি মৃদু ধাক্কা দিয়ে ওকে সরিয়ে দিল ম্যাগডা, আলিঙ্গনমুক্ত করল নিজেকে। দ্রুত, অনুসন্ধানী দৃষ্টি বুলিয়ে পিটারের মুখে কি যেন খুঁজল ম্যাগডা। গাঢ় সবুজ চোখে আলো ছিল, ধীরে ধীরে নিভে গেল সেটা।

কিছু একটা দেখে ফেলেছে ম্যাগডা। কিন্তু দেখার তো কিছুই ছিল না। দেখেনি, অনুভব করেছে। পিটারের সতর্কতা তার মনের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি। কোনো সন্দেহ নেই এ ধরনের একটা প্রতিক্রিয়া পিটারের মধ্যে খুঁজছিল সে। শুধু একটা আভাস পাওয়ার দরকার ছিল–প্রয়োজনের চেয়ে জোরে চুমো। খাওয়া, স্থির অপলক দৃষ্টি, ক্ষীণ একটু আড়ষ্ট ভাব।

বুকটা দুরুদুরু করে উঠল পিটারের। তবে কি ধরা পড়ে গেলাম।

পিটারের নীল কাশ্মীরী জ্যাকেটের কিনারা চুল ম্যাগডা। বলেছিলাম, একটাই তোমার রঙ। আমার কথা মনে করে কিনেছ?

 কেনার সময় খলিফার পরিচয় জানত না পিটার, ম্যাগডার কথা ভেবেই কিনেছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে ম্যাগডার আচরণ কেমন যেন ভঙ্গুর মনে হলো। দুজনের মাঝখানে অদৃশ্য একটা পাঁচিল তৈরি হচ্ছে।

এসো, বলেই পিটারের দিকে পিছন ফিরল ম্যাগডা, যেন মুখ লুকাল। পথ। দেখিয়ে পিটারকে পিকচার উইন্ডোর নিচে নরম সোফার কাছে নিয়ে এল। এয়ারপোর্ট অফিসারদের কেউ একজন কিছু তাজা ফুলের ব্যবস্থা করতে পেরেছে-হলুদ টিউলিপ, বসন্তের প্রথম উপহার। এক পাশে বার এবং কফি মেশিন।

সোফায় পিটারের পাশেই বসল ম্যাগডা, কিন্তু গা ছুঁয়ে নয়। মাথা ঝাঁকিয়ে সেক্রেটারিকে বিদায় করে দিল সে। লোকটা দূরে সরে গিয়ে দেহরক্ষীদের সাথে দাঁড়াল ওদের কথা শুনতে পাবে না।

কি হয়েছে আমাকে সব বল, পিটার, প্লিজ। আবার পিটারের দিকে অনুসন্ধানী চোখ মেলে তাকাল ম্যাগডা, কিন্তু চোখের সেই কোমল আলো আর জ্বলল না। প্রথম থেকে শুরু করল পিটার, কিভাবে কিডন্যাপ করা হয় মেলিসাকে। মনোযোগ আর আন্তরিকতার সাথে শুনছে ম্যাগডা, চেহারায় সহানুভূতি আর উদ্বেগ। তবে দৃষ্টিতে আগের সেই প্রেমের ঘোর একেবারেই অনুপস্থিত।

ম্যাগডা সম্ভবত বিশদ বিবরণ পেয়ে গেছে বা পেয়ে যাবে, কাজেই রাখ-ঢাক না করে পিটার জানাল, খলিফা পার্কারের জীবন চেয়েছিল। সেই সাথে ওর প্রতিক্রিয়াটাও ব্যাখ্যা করল। কাজটা আমি করতাম, ম্যাগডা।

শিউরে উঠে দুহাত দিয়ে নিজেকে আলিঙ্গন করল ম্যাগডা। গড নো!

অজ্ঞাতনামার ফোন কল সম্পর্কে বলল পিটার, তার দয়াতেই উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে মেলিসাকে। কিভাবে আঙুলটা কাটা হয়, সংক্রমণের ফলে হাতটার কি অবস্থা হয়েছিল, বিস্তারিত বর্ণনা দিল ও। সারাক্ষণ সতর্কতার সাথে ম্যাগডার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। কোনো অপরাধবোধ দেখতে না পেয়ে নিজেকে বোকা বলে তিরস্কার করল মনে মনে-পাকা অভিনেত্রী ম্যাগডা, মনের ভাব চেহারায় ফুটতে দেবে কেন! ম্যাগডাকে ম্যাগডা হিসেবে নয়, এখন থেকে খলিফা হিসেবে দেখতে হবে।

 কয়েকটা দিন ওর সাথে থাকতে হয়েছে আমাকে, বলল পিটার। ওকে নিরাপদ জায়গায় পাঠিয়ে দিয়ে স্বস্তি বোধ করছি।

কব্জি তুলে হাতঘড়ি দেখল ম্যাগডা। সেরেছে, আর বেশি সময় নেই! মুখ তুলল সে। এসো, এক ঢোক শ্যাম্পেন খাই। ধরো আমরা উৎসব পালন করছি। মেলিসা জেইন বেঁচে আছেন।

 বোতল খুলে প্লসে শ্যাম্পেন চালল পিটার। দুজনের হাতে দুটো গ্লাস, পরস্পরকে স্যালুট করল ওরা।

 তুমি কাছে থাকলে আনন্দে হাবুডুবু খাই, গ্লাসের কিনারার একটু ওপরে ম্যাগডার চোখ, চোখে সেই অনুসন্ধানী দৃষ্টি। কি যে এর পরিণতি জানি না। তুমি না শেষপর্যন্ত আমাকে মেরেই ফেল!

কি দারুণ অভিনয়, প্রশংসা না করে পারল না পিটার। তোমার প্রেমে উন্মাদিনী হয়ে গেছি, এই ভাবটা এমন নিখুঁতভাবে ফুটল ম্যাগডার চেহারায়, মুহূর্তের জন্যে হতভম্ব হয়ে গেল পিটার। কেন, এ কথা বলছ কেন?

হঠাৎ পিটার উপলব্ধি করল, এখানে এবং এখনই ম্যাগডাকে খুন করতে পারে ও। কোনো অস্ত্রের দরকার নেই। খালি হাতেই কাজটা করতে পারবে, যদিও লেদার জ্যাকেটের ভেতর কোবরা পিস্তলটা রাখা আছে। ম্যাগডাকে খুন করা সম্ভব, কিন্তু পর মুহূর্তে দেহরক্ষীরা ওকে ঝাঁঝরা করে ফেলবে। ম্যাগডার সাথে ওদের একজনকে হয়তো মারা যাবে, কিন্তু দ্বিতীয় লোকটা খুন করবে ওকে। সেরা প্রফেশনাল ওরা, ওর নিজের বাছাই করা লোক।

সময়ের এত অভাব আমাদের, খেদ প্রকাশ করল পিটার। মিটিমিটি হাসি ধরে রেখেছে মুখে। ভালো লাগে না।

ভালো কি আমারও লাগে, ডার্লিং? পিটারের কনুই ধরল ম্যাগডা। কিন্তু ভুললে চলবে না সামনে আমাদের অনেক কাজ। তুমিও ব্যস্ত থাকবে, আমিও–পরস্পরকে আমরা ক্ষমা করতে পারি।

কথাগুলোর হয়তো বিশেষ কোনো অর্থ আছে। ম্যাগডার চোখে মুহূর্তের জন্যে আবার সেই কোমল সবুজ আলো জ্বলে উঠতে দেখল পিটার। ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ, নিশ্চয়ই প্রেমের নয়। ধীরে ধীরে প্রথমবার শ্যাম্পেনের গ্লাসে চুমুক দিল ম্যাগডা, চোখের পাতা নামল, যেন পিটারের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থেকে চোখ দুটোকে বাঁচাল।

ক্ষমা, ম্যাগডা? ভয়ঙ্কর এমন কিছু কি আমাদের জীবনে ঘটবে যা ক্ষমা করার যোগ্য নয়?

ঘটবে না, পিটার, আমি ঘটতে দেব না!

 ঘটতে দেবে না? তার মানে কি ওকে ঠেকাবে ম্যাগডা? হুমকি দিচ্ছে?

চোখ তুলে মুহূর্তের জন্যে তাকাল ম্যাগডা, তার চোখে চোখ রেখে মনে মনে নিজেকে শোনাল পিটার, পারি-এ খুনি এই অপরূপ সৌন্দর্য আমি ধ্বংস করে দিতে পারি। কিন্তু ম্যাগডার চোখে নতুন একটা ভাষা, চিন্তায় বাধা পেল পিটার। ম্যাগডার দৃষ্টিতে কিসের যেন আবেদন-সম্ভবত করুণা প্রার্থনা করছে। পিস্তল, নাকি খালি হাত? দুহাত দিয়ে গলা টিপে ধরতে পারলে ভালো হয়, ব্যক্তিগত আক্রোশ চরিতার্থ হয়! ওর বুক আর উরুর নিচে মোচড় খাবে থরথর যৌবন, কয়েক ইঞ্চি দূর থেকে দেখতে পাবে পিটার, প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাচ্ছে।

কোণের একটা ডেস্কে ঝনঝন করে উঠল টেলিফোন। দ্বিতীয়বার বেল বাজতে সহকারী ম্যানেজার রিসিভার তুলল, তারপর ধরিয়ে দিল সেক্রেটারির হাতে। দুএকটা কথা বলে রিসিভার নামিয়ে রাখল সে, ওদের দিকে কয়েক পা এগিয়ে এসে দাঁড়াল।

মাই ব্যারনেস, প্লেন রেডি।

এখুনি রওনা হব, সেক্রেটারিকে বলল ম্যাগডা, তারপর পিটারের দিকে ফিরল আমি দুঃখিত, পিটার।

আবার কখন দেখা হবে আমাদের?

কাঁধ ঝাঁকাল ম্যাগডা, সামান্য ছায়ায় ঢাকা পড়ল চোখ জোড়া। বলা কঠিন ঠিক জানি না… তোমাকে আমি টেলিফোন করব। কিন্তু এখন আমাকে যেতে হয় পিটার। গেলাম প্রিয়তম।

ম্যাগডা চলে যাবার পর জানালার সামনে দাঁড়িয়ে এয়ারফিল্ডের দিকে তাকাল পিটার। বাইরে সোনালি আলো ঝরা বসন্তের বিকেল। টারমাকের কিনারায় ছোট ছোট বাগানে রঙচঙে ফুল ফুটেছে। ফুলগুলোকে ঘিরে উড়ে বেড়াচ্ছে ফড়িং আর মৌমাছি। রঙিন ডানা ঝাঁপটে একঝাক পাখি উড়ে গেল। লিয়ার জেটের বিকট আওয়াজ ওগুলোকে যেন স্পর্শই করছে না।

 সাক্ষাৎকারের প্রতিটি মুহূর্ত স্মরণ করল পিটার। ম্যাগডার চেহারা কতবার কখন কখন বদলেছে, সব মনে আছে ওর। ঠিক কোনো সময়টা খোলস ঝেড়ে ফেলে বেরিয়ে এসেছিল খলিফা।

সন্দেহের আর কোনো অবকাশ নেই। আগেও ছিল কি? ও আসলে মনে মনে, হয়তো অবচেতনভাবে চাইছিল এমন কিছু ঘটুক যাতে প্রমাণিত হয় ম্যাগডা খলিফা নয়। কিন্তু না, তেমন কিছু ঘটেনি, ঘটার নয়।

এখন কাজটা করার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করা দরকার ওর। তোমাকে আরো কঠিন হতে হবে, পিটার। আগে যেমন সহজ ভেবেছিলে, কাজটা তারচেয়ে অনেক শক্ত। মুহূর্তের জন্যেও একা ছিল না ওরা, সারাক্ষণ দেহরক্ষীরা নজর রাখছিল ওদের ওপর। এও আরেকটা লক্ষণ, ম্যাগডা সতর্ক হয়ে আছে। নিরিবিলিতে কোথাও দুজন একা হবে, সে সুযোগ আর আসবে বলে মনে হয় না। তারপর পিটারের মনে পড়ল, যাবার সময় গেলাম, প্রিয়তম বলে গেল ম্যাগডা।

 গেলাম মানে কি? আর কখনো দেখা হবে না চলে গেল চিরতরে? ডক্টর পার্কার পিটারকে বলেছিলেন, প্রয়োজন ফুরালে আর সব পুরুষ প্রেমিকের মতো পিটারকেও বাতিল কাগজের মতো ফেলে দেবে ব্যারনেস। নাকি কথাটার মধ্যে প্রচ্ছন্ন হুমকি লুকিয়ে আছে?

 আশ্চর্য, মন এত খারাপ কেন? এরপর শুধু গানসাইটে চোখ রেখে ম্যাগডাকে দেখতে হবে, তাই?

 এয়ারফিল্ডে তাকিয়ে আছে পিটার, কিন্তু কিছুই দেখছে না। মনে পড়ল প্রথমবার খলিফা নামটা শোনার পর কিভাবে ওর ক্যারিয়ার আর জীবন ভেঙে পড়তে শুরু করে।

কাঁধের পিছন থেকে নরম একটা কণ্ঠস্বর ওর সংবিৎ ফিরিয়ে আনল। সহকারী ম্যানেজার জানল, কে এলএম-এর ব্রাসেলস ফ্লাইট রেডি, জেনারেল।

ওভারকোট আর ব্রিফকেসটা তুলে নিয়ে এগোল পিটার। ব্রিফকেসটা উপহার পেয়েছে ও। মেয়েটা বলতে চায়, সে নাকি ওকে প্রাণ মন দিয়ে ভালোবাসে। তাকেই খুন করতে হবে পিটারের।

.

পিটারের নতুন অফিসের ডেস্কে গাদা গাদা চিঠি আর ফাইল জমা হয়ে আছে, কাজে ডুবে যেতে হলো ওকে। নিজের অজান্তেই স্বস্তি বোধ করল ও। খলিফার বিরুদ্ধে প্ল্যানটা আপাতত স্থগিত রাখার একটা অজুহাত পাওয়া গেছে।

একটু অবাক হয়ে উপলব্ধি করল পিটার, অস্ত্র বিক্রি করার নতুন এই দায়িত্ব উপভোগ করছে সে। ক্রেতা দেশের প্রতিনিধিরা সবাই প্রথম শ্রেণির ব্রেন, শাণিত বুদ্ধির অধিকারী, যে-কোনো পণ্ডিত অধ্যাপককেও বুদ্ধির প্রতিযোগিতায় হারিয়ে দিতে পারে। ভবিষ্যৎ যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তাদের মন-মানসিকতা বোঝার একটা সুযোগও পেয়ে গেল পিটার। কিভাবে সময় কাটতে লাগল নিজেও টের পেল না।

ডেস্কে ফিরে আসার তিনদিন পর ইরানি এয়ারফোর্সের সাথে একটা চুক্তিতে পৌঁছল পিটার। এই প্রথম কেসট্রেল মিসাইলের অর্ডার দিল ওরা। একশ বিশ ইউনিট, দাম পড়ল দেড়শ মিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। চুক্তিপত্র সই করার পর অদ্ভুত একটা আনন্দঘন অনুভূতি হলো পিটারের, সেই সাথে একটা মোহ স্পর্শ করল ওকে। এই মোহ আরো শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে, এক সময় অ্যাডিক্টেড হয়ে ওঠাও বিচিত্র নয়।

এর আগে পর্যন্ত টাকাকে একটা ঝামেলা বা বিড়ম্বনা বলে মনে করে এসেছে পিটার, কিন্তু এখন উপলব্ধি করতে পারল এ আরেক ধরনের টাকা। খলিফা যে জগতে বাস করে তার ছবি একপলক দেখার সুযোগ ঘটেছে ওর, জেনে ফেলেছে এ ধরনের টাকা কোনো মানুষ যখন একবার নাড়াচাড়া করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে তখন ঈশ্বরতুল্য ক্ষমতার স্বপ্ন দেখে তার জন্যে অবাস্তব বলে মনে হয় না।

মানুষের স্বপ্ন এবং উচ্চাশা কখন আর কেন সীমা ছাড়ায় বোঝে পিটার, কিন্তু ক্ষমা করতে রাজি নয় ও। আর তার ব্রাসেলসে ফিরে আসার সাতদিন পর কর্তব্যের দিকে মুখ ফেরাতে নিজেকে বাধ্য করল।

ব্যারনেস ম্যাগডা অল্টম্যান নির্লিপ্ত আচরণ করছে। শেষবার ওরলি এয়ারপোর্টে অল্প সময় কথা হওয়ার পর পিটারের সাথে আর যোগাযোগ করেনি সে। পিটার বুঝতে পারল, ওকেই তার কাছে যেতে হবে।

খুন করার জন্যে যথেষ্ট কাছে পৌঁছুনো এখনো সম্ভব ওর পক্ষে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত পিটার। ওরলিতে যে ধরনের সুযোগ পেয়েছিল, সে ধরনের সুযোগ আবার তৈরি করে নেয়া কঠিন হবে না। তবে ওখানে যদি কাজটা করত, আত্মহত্যা করারই নামান্তর হতো সেটা। দেহরক্ষীদের দ্রুত পাল্টা আঘাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারলেও, আইনের যন্ত্রণাকর প্যাঁচ থেকে নিজেকে ছাড়ানো সম্ভব নাও হতে পারত। খুব গভীরভাবে চিন্তা না করেই ধরে নিল, খলিফার গল্পটাকে আত্মরক্ষার জন্যে ব্যবহার করতে পারবে না সে। দুনিয়ার কোনো কোর্ট ওর কথা বিশ্বাস করবে না। অ্যাটলাস বা ব্রিটিশ ও মাকিন ইন্টেলিজেন্সের সমর্থনহীন স্ট্রাইড পিটারকে ম্যানিয়াক বলে চিত্রায়িত করা হবে। ওরা যে সমর্থন করবে না, এ ব্যাপারেও পিটার নিশ্চিত। খলিফাকেও খুন করলে ওরা খুশি হবে, কিন্তু ওর সমর্থনে টু-শব্দটিও না করে ওর কল্লা নেবে।

তার মানে সম্পূর্ণ একা পিটার। অ্যাটলাস যে সাহায্য করবে না, ডক্টর পার্কার সেটা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন। এবং অকালে প্রাণ হারানোর কোনো ইচ্ছে পিটারের নেই। খলিফাকে থামানোর জন্যে নিজেকে বলি দিতে প্রস্তুত নয় সে অন্তত অন্য কোনো উপায় থাকা পর্যন্ত। এক-আধটা উপায় নিশ্চয় আছে।

প্ল্যান করার সময় শিকারকে শুধু খলিফা হিসেবে কল্পনা করল পিটার, একবারও ম্যাগডা অল্টম্যান হিসেবে নয়। তাতে সমস্যাটা নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করা সহজ হলো। ওর সামনে তিনটে প্রশ্ন–কোথায় খুন করা যায়, কখন, কিভাবে।

খলিফার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ব্যবস্থা নতুন করে সাজিয়ে ব্যাপারটাকে নিজেই জটিল করে তুলেছে ও। এমন একটা সিস্টেম করে দিয়েছে, খলিফা কোথায় কখন থাকবে বা যাবে আগে থেকে জানার কোনো উপায় নেই। রাষ্ট্রীয় গোপন দলিল যেভাবে পাহারা দেয়া হয়, খলিফার সফরসূচি লেখা খাতাটা তার চেয়েও নিখুঁতভাবে পাহারা দেয়া হয়। খলিফা কোথাও যাবার পর খবরটা প্রকাশ পায়, যাবার আগে কিছুই জানানো হয় না প্রেসকে।

তাকে যদি এলিসি প্রাসাদে ডিনার খাওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়, খবরটা প্রেসে যায় পরদিন, আগের দিন নয়। তবে বাৎসরিক কিছু উপলক্ষ্য বা অনুষ্ঠান আছে বটে, ভুলেও অনুপস্থিত থাকে না খলিফা। তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিষয়ে আলাপ করার সময় এই দুর্বলতাগুলো সম্পর্কে জেনেছিল পিটার। তখন ম্যাগডার আসল পরিচয় জানত না ও, দুর্বলতাগুলো দূর করার জন্যে কিছু পরামর্শ দিয়েছিল। মনে আছে, হাসতে হাসতে প্রতিবাদ করেছিল ম্যাগডা।

 তুমি চাওটা কি, শুনি—আমাকে কয়েদি বানাবে? এগুলো আমার জীবনের সত্যিকার আনন্দ, আমি বিশ্বাস করি না এ-সব তুমি কেড়ে দিতে পার!

বছরের প্রথমবার যখন উভস সেন্ট লরেতের কালেকশন দেখানো হয়, প্রথম দিনই সেখানে যাওয়া চাই খলিফার। লংচ্যাম্পে অনুষ্ঠিত হয় গ্র্যান্ড প্রি ডি প্যারিস, ওখানেও যাবে সে আইস লেপার্ড নামে তার একটা বিখ্যাত ঘোড়া আছে, বছরে মাত্র দুবার দৌড়ায়, প্রতিটি রেষে উপস্থিত থাকবে সে।

সম্ভাব্য বধ্যভূমির তালিকা তৈরি করল পিটার। তারপর এক এক করে বাতিল করে ছোট করল তালিকাটা। যেমন, লা পিয়েরে বেনিত। এর একটা সুবিধে হলো বাড়িসহ বিশাল এস্টেটটা পিটারের পরিচিত। সৈনিকের চোখ দিয়ে লক্ষ্য করেছে ও, টেরেসগুলোর সামনে লনগুলো লেকের দিকে নেমে যাওয়ায়, লেকের কিনারা থেকে জঙ্গলের ভেতর দাঁড়িয়ে গুলি করা সম্ভব। আর বাড়ির পিছনে রয়েছে মাটির ঢিবি, ঢিবির মাথা থেকে আস্তাবল আর প্রশস্ত উঠান পরিষ্কার দেখা যায়, দূরত্বও খুব বেশি নয়। কিন্তু গোটা এস্টেটে পাহারার ব্যবস্থা নিখুঁত। তাছাড়া শিকারের গতিবিধি সম্পর্কে আগাম কিছু জানা প্রায় অসম্ভব। সে যখন রোম বা নিউ ইয়র্কে থাকবে, সাতদিনের জন্যে বাড়ির কাছাকাছি কোনো জঙ্গলে অ্যামবুশ পেতে বসে থাকতে পারে পিটার। আরেকটা চিন্তার বিষয় হলো, পালানোর পথ ঝুঁকিবহুল। গোটা এস্টেটে লোকবসতি কম হলেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, সবগুলোই পথের ধারেকাছে, আর পথও মাত্র দুটো। দ্রুত এবং সহজেই সেগুলো বন্ধ করে দিতে পারে পুলিশ। না, লা পিয়েরে বেনিত তালিকা থেকে বাদ দেয়াই ভালো।

শেষপর্যন্ত তালিকায় মাত্র দুটো জায়গার নাম থাকল। লংচ্যাম্প, আর ইভস সেন্ট লরেত মিউজিয়াম–ছেচল্লিশ নম্বর এভিনিউ ভিক্টর হুগো।

আশেপাশের কোনো বিল্ডিংয়ে অফিস ঘর ভাড়া করা যেতে পারে। ভুয়া পরিচয় দেবে পিটার। তবে দুটোর মধ্যে কোন জায়গাটা, পরে ঠিক করবে ও। তার আগে দেখে আসবে।

খলিফাকে এই দুজায়গায় মারতে চাইলে একটা বিশেষ সুবিধে পাবে পিটার। দূর থেকে গুলি করতে হবে ওকে। কাছ থেকে হলে ছুরি, পিস্তল বা হাত ব্যবহার করতে হত। না, কাছ থেকে তাকে মারতে চায় না পিটার।

এই কাজের জন্যে থোরের পয়েন্ট টু-টু-টু স্নাইপার রাইফেল সবচেয়ে উপযোগী। এক্সট্রা লং ব্যারেল, ম্যাচ গ্রেড অ্যামুনিশন ব্যবহার করার জন্যে তৈরি করা হয়েছে, সাথে রয়েছে নতুন লেয়ার সাইট-সাতশ গজ দূর থেকে অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ সম্ভব।

স্নাইপারকে শুধু বা হাত দিয়ে স্টকের মাথায় বোতামটা টিপতে হবে, সাথে সাথে রওনা হয়ে যাবে লেজার রশ্মিরশ্মি যে পথে গেছে সেই একই পথ ধরে যাবে বুলেটও। সিকি আকৃতির উজ্জ্বল সাদা মুদ্রার মতো দেখাবে ওটাকে, সাইটের টেলিস্কোপিক লেন্সে চোখ রেখে সাদা আলোটাকে পরিষ্কার দেখতে পাবে স্নাইপার। টার্গেটের ঠিক জায়গায় ওটাকে দেখতে পাবার সাথে সাথে ট্রিগার টানবে সে। এমনকি অদক্ষ একজন মার্কসম্যানের ব্যর্থ হবার কোনো আশঙ্কা নেই।

চাইলে কলিন নোবলস্ ওকে একটা না দিয়ে পারবে না। থোর কমান্ডের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে এমন ব্যবস্থাও তার পক্ষে করা সম্ভব, প্যারিসের মার্কিন দূতাবাস থেকে নিজে এসে সিনিয়র একজন মিলিটারি অ্যাটাশে পিটারকে উপহার দিয়ে যাবে রাইফেলটা।

অথচ সে উপলব্ধি করল প্ল্যানটা নিয়ে অযথা সময় নষ্ট করছে সে, কাজে নেমে পড়ার কোনো তাগাদা অনুভব করছে না।

 ব্রাসেলসে ফেরার পর মোল দিন পেরিয়ে যাচ্ছে, আজ শুক্রবার। সকালটা শহরের উত্তরে ন্যাটো রেঞ্জে কাটাল পিটার। শর্টরেঞ্জ অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইলে যে রাডার গাইডেন্স থাকে সেটাকে ফাঁকি দেয়ার জন্যে নতুন একটা ইলেকট্রনিক শীল্ড বানিয়েছে, পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছিল সেটা। তারপর ইরানিয়ান অফিসারদের সাথে হেলিকপ্টার যোগে শহরে ফিরে এল ও, ওদেরকে নিয়ে লাঞ্চ খেল উপাউলে দে মুর্ত এ। লাউঞ্চে বসে গল্পগুজব চলল অনেকক্ষণ, তিনটে ঘণ্টা অপব্যয় হওয়ায় অপরাধবোধ দূর করার জন্যে রাত আটটা পর্যন্ত কাজ করল অফিসে।

চারদিকে অনেক আগেই অন্ধকার নেমে এসেছে, পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল পিটার। জানে অন্ধকার রাস্তায় খলিফার লোক ওত পেতে থাকতে পারে, সেজন্যে সম্ভাব্য সতর্কতা অবলম্বনে অবহেলা করেনি। কবে কোন দরজা দিয়ে বেয়োয় কেউ বলতে পারবে না, কখন বেরোয় তারও কোনো ঠিক নেই। প্রতিদিনই আলাদা রাস্তা ব্যবহার করে। গ্র্যান্ড প্যালেস থেকে আজ কয়েকটা সান্ধ্য পত্রিকা কিনল ও, চৌরাস্তায় প্রায় সবটুকু দেখা যায় এমন একটা কফি শপে বসে প্রথমে ইংরেজি পত্রিকাটা পড়ল।

হেডিংটা লাফ দিয়ে উঠে এল চোখে।

‘অপরিশোধিত তেলের দাম কমল।‘

কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে রিপোর্টটা পড়ল পিটার, দ্রুর ওপর কুঁচকে থাকল চামড়া। পড়া শেষ করে মুখ তুলল ও। রাস্তা দিয়ে ট্যুরিস্টরা দল বেঁধে হাঁটছে, হাসি-আনন্দে মুখর সবাই।

ব্যাপারটা ব্ল্যাকমেইল। প্রাণ হরণের হুমকিতে কাজ হয় কিনা তার পরীক্ষা। আন্তর্জাতিক বাজার নিয়ন্ত্রণ করার প্রথম প্রচেষ্টা খলিফার। পুরোপুরি সফল হয়েছে সে।

তার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাবে। ক্ষমতার লোভে সীমা ছাড়িয়ে নির্দয় হয়ে উঠবে সে। হত্যাযজ্ঞের নায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে এবার।

পিটার জানে আর তার দেরি করা উচিত নয়। দ্রুত কয়েকটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ও। মিথ্যে একটা অজুহাত তৈরি করে সোমবার সকলে লন্ডনে যাবে ও, আগেই ব্যবস্থা করবে এয়ারপোর্টে যাতে দেখা হয় কলিনের সাথে। তাকে সব কথা জানানোর দরকার আছে। পিটার জানে, তার কাছ থেকে পূর্ণ সমর্থন পাবে বলে আশা করতে পারে ও। তারপর ফিরে আসবে প্যারিসে, শেষবার ভেবে নেবে বধ্যভূমি। কালেকশনের প্রদর্শনী শুরু হতে এখনো দুসপ্তাহ বাকি। আরো ভালোভাবে প্ল্যান করার জন্যে যথেষ্ট সময় থাকবে হাতে।

হঠাৎ করেই ক্লান্তি অনুভব করল পিটার, যেন সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে শরীরের অতিরিক্ত শক্তি ক্ষয় হয়ে গেছে। এতই ক্লান্ত, হোটেল পর্যন্ত সামান্য পথ হেঁটে আসতে দম ফুরিয়ে গেল ওর। হুইস্কির অর্ডার দিল ও, গ্লাসে ধীরে ধীরে চুমুক দিয়ে চাঙা হতে চেষ্টা করল।

নার্মকোর তরফ থেকে হিলটনের দুটো স্যুইট সারা বছর সিনিয়র একজিকিউটিভ আর গুরুত্বপূর্ণ ভিজিটরদের জন্যে রিজার্ভ রাখা হয়, তারই একটায় থাকছে পিটার। গ্লাস হাতে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে হাঁটাহাঁটি করল কিছুক্ষণ, কিন্তু নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা থেকে নিস্কৃতি পাওয়া গেল না।

নিঃসঙ্গতা অনেক দিন থেকেই কুরে কুরে খাচ্ছে ওকে। ব্যারনেস ম্যাগডাকে চোখে দেখার আগেই ওর মনে হয়েছিল, একটা মেয়ে ওর জীবনে আসছে, ওর নিঃসঙ্গতা দূর করে দেবে সে, অর্থবহ করে তুলবে জীবনটাকে। ম্যাগডাকে দেখার পর মনে হলো, এই তো সেই মেয়ে।

তারপর সব ওলটপালট হয়ে গেল। জানা গেল খলিফার আসল পরিচয়।

 শ্বেতাঙ্গদের জন্যে পরিচ্ছন্ন, নিরাপদ একটা বিশ্ব গড়ে তুলতে চায় সে। শ্বেতাঙ্গরা ছাড়া বাকি সব নোংরা আবর্জনা, কাজেই তাদেরকে সমূলে ধ্বংস করতে হবে।

তাকে খুন না করে উপায় কি? এবং করলে তাড়াতাড়ি করতে হবে, তা না হলে উন্নত বিশ্ব বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপ, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া অর্থাৎ শ্বেতাঙ্গ-প্রধান দেশগুলোর কাছে থেকে উৎসাহ এবং সহযোগিতা পেতে শুরু করবে খলিফা, তখন তাকে ঠেকানোর সাধ্য কারো থাকবে না। খলিফার আদর্শ, স্বপ্ন, পরিকল্পনা সম্পর্কে এখনো ভালো ধারণা নেই কারো, সেটাই রক্ষা। জার্মানরা এত উন্নত জাত, অথচ তারাই হিটলারকে সমর্থন করেছিল। স্বজাতির একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তারের সুযোগ আছে দেখলে শ্বেতাঙ্গ কোনো সরকারই সেটা হাতছাড়া করতে চাইবে না।

 হঠাৎ আবিষ্কার করল পিটার, খালি গ্লাস নিয়ে হাঁটাহাঁটি করছে সে। দাঁড়িয়ে পড়ল খোলা জানালার সামনে, নিঃসঙ্গতা আবার ওকে পেয়ে বসল। অকস্মাৎ সুরেলা প্রলম্বিত কণ্ঠস্বর বাজল কানে, মনে পড়ে গেছে কথাগুলো।

আমি একা। কতদিন ধরে। নিঃসঙ্গতা আমাকে মেরে ফেলছে, পিটার। এই অভিশাপ থেকে আমি মুক্তি চাই। তুমি আমাকে উদ্ধার করতে পার না?

স্মৃতি বড় বেদনাদায়ক। খলিফার কথা আলাদা, কিন্তু ম্যাগডার কথা মুছে ফেলতে হবে মন থেকে। প্রায় ছিটকে জানালার সামনে থেকে সরে এল পিটার, বেরিয়ে এল কামরা থেকে। নিচের লবিতে এক মিনিট দাঁড়াল, প্রায় অন্ধকার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ব্যস্ত হাতে সিগারেট ধরাল একটা। মাথা ধরেছে, কিছুক্ষণ ঠাণ্ডা বাতাস পাওয়া দরকার।

লম্বা-চওড়া এক মেয়ে রাস্তা পেরিয়ে ফুটপাথে উঠে এল। ঠোঁটে লাল টকটকে লিপস্টিক মেখেছে। পিটারের পথ আগলে দাঁড়াল সে, ফিসফিস করে প্রস্তাব দিয়ে রূঢ় বাস্তবে ফিরিয়ে আনল পিটারকে।

মার্সি। দ্রুত মাথা নেড়ে তাকে পাশ কাটাল পিটার, হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল। দুমাইল হেঁটে আবার হিলটন হোটেলে সামনে চলে এল ও, নেড়েচেড়ে দেখল কয়েকটা। একটা ভোগ-এর পাতা ওল্টাচ্ছে, ইভস সেন্ট লরেত প্রদর্শনী সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায় কিনা খুঁজছে। তার বদলে একটা মেয়ের ছবি লাফ দিয়ে উঠে এল চোখে।

 চকচকে গাঢ় চুল এমনভাবে ব্যাকব্রাশ করা, টান টান হয়ে আছে কপালের চামড়া। পিছন দিকে নিয়ে গিয়ে লম্বা চুলগুলো বিনুনি করা হয়েছে, তারপর কান জোড়ার ওপর মাথার দুপাশ উঁচু করে বাঁধা হয়েছে দুটো খোঁপা। উঁচু চোয়ালের স্লাভিক গড়ন সহজেই টের পাওয়া যায়, চেহারায় দৃঢ় মানসিকতার একটা ভাব এনে দিয়েছে। চোখ জুড়ানো রঙ গায়ের, হালকা গোলাপি। থুতনি সামান্য চৌকো, একটু যেন শক্ত, সৌন্দর্য নিখুঁত হবার পথে ছোটখাটো হলেও একটা বাধা। রমণীয় চেহারা, কিন্তু কোমলতার চেয়ে কাঠিন্যই যেন বেশি। মেয়েটা হয়তো বিশ্ব সুন্দরী হতে পারবে না, কিন্তু একবার তাকালে চোখ ফেরানোও সম্ভব নয়।

চারজনের একটা গ্রুপ ফটোর মধ্যে সেও একজন। দ্বিতীয় মহিলাটি বিখ্যাত এক পপ গায়কের স্ত্রী, তীক্ষ্ণ চেহারা, ঠিক মেয়েলি নয়। তার পাশে কিশোর-সুলভ চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আমেরিকান এক অভিনেতা, লোকটা অভিনয়ের জন্যে যতটা না তার চেয়ে মেয়ে-পটানোর জন্যে বেশি নাম কিনেছে। সাধারণত এ ধরনের লোকদের সাথে চলাফেরা বা ওঠাবসা করে না ব্যারনেস ম্যাগডা। তবে তার পাশে দাঁড়ানো লোকটা অভিজাত এবং সুপুরুষ, ব্যারনেস ম্যাগডার কাঁধে হাত দিয়ে আছে। ক্ষমতা আর কর্তৃত্ব ফুটে আছে লোকটার চেহারায়। ক্যাপশন না দেখেই তাকে চিনতে পারল পিটার-বৃহত্তম জার্মান অটোমোবাইল ম্যানুফ্যাকচারিং কমপ্লেক্সের চেয়ারম্যান। ক্যাপশনে লেখা রয়েছে, একটা ফ্যাশন-শো উদ্বোধন হতে যাচ্ছে, প্রধান অতিথি ব্যারনেস ম্যাগডা।

চেয়ারম্যানের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পাঁজরের ভেতর চিনচিনে একটা অনুভূতি হলো পিটারের। ঘৃণা নাকি ঈর্ষা, ঠিক জানে না। ম্যাগাজিনটা র‍্যাকে রেখে দিয়ে হনহন করে হোটেলে ফিরে এল ও।

স্যুইটে ফিরে শাওয়ার সারল পিটার, আবার হুইস্কি নিয়ে খোলা জানালার সামনে একটা চেয়ার টেনে বসল। মেলিসা কিডন্যাপ হবার পর থেকে মদ খাবার পরিমাণ বেড়ে গেছে ওর। গুরুতর সন্দেহে ভুগতে থাকলে বা নিঃসঙ্গতা দূর করা না গেলে এর মাত্রা দিনে দিনে বাড়তেই থাকবে। এখন থেকেই ওর সাবধান হওয়া উচিত। গ্লাসটা হাতে নিয়ে চেয়ার ছাড়ল পিটার, আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

ব্রাসেলসে ফেরার পর থেকে ন্যাটোর অফিসার্স ক্লাবের জিমনেশিয়ামে রোজই যাচ্ছে পিটার। শরীরটাকে আগের মতোই একহারা আর শক্ত রাখতে পারছে সে, তলপেট হয়ে উঠছে গ্ৰেহাউন্ডের মতো। শুধু শ্ৰী হারিয়েছে মুখটা। ঘৃণাও মানুষের চেহারা বদলে দিতে পারে।

আয়নার দিকে পেছন ফিরতেই ফোন বেজে উঠল।

স্ট্রাইড, রিসিভারে বলল ও, বাথরুম থেকে বেরিয়ে এখন কাপড় পরেনি, ডান হাতে হুইস্কির গ্লাস।

প্লিজ হোল্ড অন, জেনারেল স্ট্রাইড। ইন্টারন্যাশনাল কল।

যান্ত্রিক শব্দজট ভেসে এল কানে। অনবরত ক্লিক ক্লিকের সাথে অন্যান্য অপারেটরদের আধা ইংরেজি আধা ফরাসি কথা অস্পষ্টভাবে শোনা গেল।

তারপর হঠাৎ করে কণ্ঠস্বর। সেই প্রলম্বিত সুর। এতই অস্পষ্ট, যেন বিশাল হলঘরে ফিসফিস করছে কেউ।

পিটার, তুমি?

ম্যাগডা? বিস্ময়ের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে সময় নিচ্ছে পিটার, রিসিভার থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে কানে ফিরে এল নিজের কণ্ঠস্বর। ম্যাগডা আবার কথা বলার আগে ক্লিক করে আওয়াজ হলো একটা, তার মানে যোগাযোগটা এখন রেডিও টেলিফোন লিঙ্কের মাধ্যমে চালু হলো।

তোমার সাথে আমার দেখা করতে হবে, পিটার। এভাবে দিন কাটানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি আমার কাছে আসবে, পিটার, প্লিজ?

কোথায় তুমি?

 লে নিউফ পোইজোঁ। শব্দগুলো একেবারেই অস্পষ্ট আর ভাঙাচোরা, এবার

শুনতে চাইল পিটার।

লে নিউফ পোইজোঁ-দি নাইন ফিশ, পুনরাবৃত্তি করল ম্যাগডা। আসবে, পিটার, আসবে আমার কাছে?

তুমি কাঁদছ? জিজ্ঞেস করল পিটার। শব্দজট তুঙ্গে উঠল, হাজার হাজার যান্ত্রিক আওয়াজ ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। পিটারের মনে হলো, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। হতাশায় চিৎকার করে উঠল সে, কাঁদছ নাকি?

হ্যাঁ, নিঃশ্বাসের আওয়াজ, উত্তরটা ওর কল্পনাও হতে পারে।

কেন?

কারণ আমি ভয়ে মরে যাচ্ছি। কারণ আমি দুঃখিত। একা। তুমি আসবে?

 আসব, বলল পিটার। কিভাবে যাব বলে দাও।

লা পিয়েরে বেনিতে ফোন করে জেমের সাথে কথা বল, সেই সব ব্যবস্থা করবে। কিন্তু তাড়াতাড়ি আসবে, পিটার? যত তাড়াতাড়ি পার।

হ্যাঁ, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, কিন্তু জায়গাটা কোথায়?

উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করে থাকল পিটার, কিন্তু শব্দজট ছাড়া কিছুই শোনা গেল না।

 ম্যাগডা? ম্যাগডা? গলা ফাটিয়েও কোনো লাভ হলো না, যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে গেছে। আঙ্গুলের ডগা দিয়ে ক্রেলে চাপ দিল পিটার।

 লে নিউফ পোইজোঁ, বিড়বিড় করে বলল ও, আঙুলটা তুলে নিল। অপারেটর, একটু দম নিয়ে শুরু করল, ফ্রান্সের বঁবুইলের ৪৭-৮৭-৪৭ নম্বরটা দিন আমাকে, প্লিজ। অপেক্ষা করার সময়টুকু দ্রুত চিন্তার মধ্যে কেটে গেল।

যেন ঠিক এই ঘটনার জন্যেই অপেক্ষা করছিল ও, অবচেতনভাবে। মনে হলো একমাত্র এটাই ঘটার ছিল–চাকা শুধু ঘুরতে পারে, দুপাশের কোনো দিকে গড়াতে পারে না।

 খলিফার সামনে কোনো বিকল্প ছিল না। ইতি টানার জন্যে এই ডাক। অবাক হয়েছে পিটার শুধু একটা কারণে, ডাকটা আরো আগে আসেনি ভেবে। আরো কয়েকটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গেল ওর কাছে। লন্ডন বা ইউরোপের কোনো শহরে ওকে মারতে চাইছে না খলিফা। সে ধরনের একটা প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল বুইলেতে, কিন্তু সফল হয়নি। সতর্ক হয়ে গেছে খলিফা, বঁবুইলের ঘটনার পর তার জানা হয়ে গেছে শিকার দুর্বল নয়, পাল্টা আঘাত হানার শক্তি আর বুদ্ধি রাখে সে।

পিটারের কয়েকটা সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। কোথাও আর কখন, এই দুই প্রশ্নের উত্তর খলিফার কাছ থেকে আসছে। বাকি থাকল কিভাবে। সেটা জায়গামতো পৌঁছে ঠিক করতে পারবে পিটার।

ঝানু অভিনেত্রী। সামান্য একটু শব্দ করেছে, পিটার যাতে শুধু চিনতে পারে ওটা কান্না।

ব্যারনেস অল্টম্যানের রেসিডেন্স থেকে বলছি।

গ্যাসটন?

 স্পিকিং, স্যার।

 জেনারেল স্ট্রাইড।

গুড ইভনিং, জেনারেল। আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। ব্যারনেসের সাথে আগেই কথা হয়েছে আমার। লে নিউফ পেইজেতে আপনার যাবার ব্যবস্থা করতে বলেছেন তিনি। ব্যবস্থা হয়েছে, স্যার!

জায়গাটা কোথায়, গ্যাসটন?

 লে নিউফ পোইজোঁ-ইল সুলে ভঁৎ এ ব্যারনেসের হলিডে আইল্যান্ড, স্যার। ইউ.টি.এ ফ্লাইট ধরে তাহিতির পাপেটি ফায়াতে পৌঁছতে হবে, ওখানে ব্যারনেসের পাইলট অপেক্ষা করবে আপনার জন্যে। ওখান থেকে আরো একশ মাইল দূরে লে নিউফ পোইজো, দুর্ভাগ্য যে এয়ারস্ট্রিপ খুব ছোট বলে লিয়ার ল্যান্ড করতে পারে না, আরো ছোট প্লেন ব্যবহার করতে হয়।

ব্যারনেস কখন পৌঁছবেন লে নিউফ পোইজোঁতে?

তিনি তো সাতদিন হলো চলে গেছেন, স্যার। তারপরই ইউ.টি.আই, ফ্লাইট সম্পর্কে বিশদ বলতে শুরু করল গ্যাসটন। ইউ.টি.আই. টিকেট কাউন্টারে আপনার জন্যে টিকেট থাকবে, স্যার-নন-স্মোকিং একটা সীট বুক করেছি। জানালার ধারে।

সব তোমার মনে থাকে। ধন্যবাদ, গ্যাসটন।

রিসিভার নামিয়ে রাখল পিটার, অনুভব করল সমস্ত বোধ দূর হয়ে গেছে। কোথা থেকে যেন বিপুল শক্তি এসে ভর করল শরীরে। এ শক্তি কি ট্রেনিং পাওয়া একজন সৈনিকের প্রাণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা থেকে আসছে, নাকি সিদ্ধান্তহীনতা আর অজানা ভীতির অবসান ঘটার আশা থেকে?

দুজনের উদ্দেশ্যই এক। বলা কঠিন কে জিতবে কে হারবে। তবে বেশি দেরি নেই, অচিরেই সব জানা যাবে।

বাথরুমে ঢুকে বেসিন থেকে অবশিষ্ট হুইস্কি ভরা গ্লাসটা নিয়ে এল ও।

.

তাহিতি-ফায়া-য় ল্যান্ড করল ডিসি টেন। একটু গরম আবহাওয়া, ফুলের গন্ধে ভারী আছে বাতাস। রানওয়ে থেকে সাগর আর শহর দেখা যায়; নিতম্বিনী নধর যুবতীদের বোটে, সৈকত, বা ফুটপাতে যেখানেই দেখা গেল মনে হলো অফুরন্ত আনন্দ পুলকে সারাক্ষণ নাচছে। চারদিকে ভালো করে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে লাগেজ হোন্ডের দিকে এগোল পিটার।

কাস্টমস চেকিঙের পর আরেক দিকের গেট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ও, এই সময় অস্বাভাবিক এক ঘটনা ঘটল। গেটের পাশে দুজন সশস্ত্র কাস্টমস অফিসার দাঁড়িয়ে রয়েছে, দূর থেকে পিটারকে দেখে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কি যেন আলাপ করল তারা। তারপর দুজনই পিটারের পথ আগলে দাঁড়াল।

গুড আফটারনুন, স্যার, বলল একজন, অমায়িক হাসছে, কিন্তু হাসিটুকু চোখ ছোঁয়নি। আমাদের সাথে এদিকে একটু আসবেন, প্লিজ? পিটারকে পথ দেখিয়ে পর্দা ঘেরা একটা অফিস ঘরে নিয়ে আসা হলো।

 দয়া করে আপনার ব্যাগগুলো খুলুন, স্যার। হ্যান্ডব্যাগ আর ব্রিফকেস, দুটোই তন্নতন্ন করে খুঁজল ওরা, গোপন পকেট আছে কিনা তাও পরীক্ষা করল একজন।

 আপনাদের প্রশংসা করতে হয়, বলল পিটার, ওদের মতোই হাসছে ও, কিন্তু কণ্ঠস্বর টান টান আর নিচু।

 অনিয়মিত চেক, স্যার, সিনিওর লোকটা বলল ওকে। দশ হাজার লোকের মধ্যে আপনি আনলাকি একজন। আবার, স্যার, আশা করি দেহ-তল্লাশিতে আপত্তি করবেন না?

দেহ তল্লাশি করবেন? চটে গেল পিটার, কিন্তু কি মনে করে তর্ক করল না; কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাত দুটো মাথার ওপর তুলল। করুন।

 জানা গেল, ফ্রান্সের মতো এখানেও ম্যাগডা অল্টম্যান একজন মহীয়সী নারী। একগুচ্ছ দ্বীপের মালিক সে, তার অঙ্গুলি হেলনে ভালো-মন্দ অনেক কিছুই ঘটতে পারে। নবাগত একজন বিদেশি অস্ত্র বহন করছে কিনা সেটা জানতে চাওয়া তার জন্যে স্বাভাবিক।

এ ধরনের দেহ-তল্লাশির অভিজ্ঞতা আগে কখোনো হয়নি পিটারের। একজন ওর পিঠ, পাঁজর, বুক, আর পেট করল। অপর জন পেট থেকে শরীরের নিচের অংশ-ঊরুসন্ধি, হাঁটুর পিছনটা, নিতম্বের খাজ, পায়ের পাতা, কিছুই বাদ দিল না।

ব্রাসেলের হিলটনে কোবরাটা রেখে এসেছে পিটার, আগেই আন্দাজ করছিল এ ধরনের একটা পদক্ষেপ নিতে পারে খলিফা।

সন্তুষ্ট? জিজ্ঞেস করল ও।

 সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ, স্যার। হ্যাড এ লাভলি স্টে অন আওয়ার আইল্যান্ড।

মেইন কনকোর্সে ম্যাগডার ব্যক্তিগত পাইলট অপেক্ষা করছিল ওর জন্যে করমর্দনের জন্যে শশব্যস্ত হয়ে ছুটে এল সে। আমি তো ভাবলাম এই ফ্লাইটে আপনি বোধ হয় আসেননি, স্যার!

কাস্টমসে একটু দেরি হয়ে গেল, ব্যাখ্যা করল পিটার।

এখুনি আমাদের রওনা হতে হয়, মানে লে নিউফ পোইজোতে যদি অন্ধকারে ল্যান্ড করতে না চাই। একেবারে যা তা অবস্থা স্ট্রিপের।

সার্ভিস এরিয়ার কাছাকাছি পার্ক করা হয়েছে লিয়ার জেট, সেটার পাশে নরম্যান ব্রিটেন ট্রাই-আইল্যান্ডারকে ছোট্ট আর কুৎসিত দেখাল। প্লেনটার বৈশিষ্ট্য হলো অল্প জায়গায় ওঠা-নামা করতে পারে।

এরই মধ্যে অনেকগুলো কাঠের বাক্স আর প্যাকেট তোলা হয়েছে প্লেনে, টয়লেট রোলস থেকে শুরু করে ভিউট ক্লিকোৎ শ্যাম্পেন, কিছুই বাদ পড়েনি। সবগুলো বাক্স আর প্যাকেট একটা জালের ভেতর আটকানো।

ডান দিকের সিটে বসল পিটার। স্টার্ট দিয়ে টাওয়ারের অনুমতি নিল পাইলট, তারপর পিটারকে বলল, এক ঘণ্টার পথ, স্যার। দেখতে দেখতে কেটে যাবে।

অস্তগামী সূর্য ওদের পিছনে, পশ্চিম দিক থেকে পৌঁছল ওরা। নীল মখমলের মতো সাগরে লে নিউফ পোইজো যেন পান্না বসানো অমূল্য নেকলেস।

নয়টা দ্বীপ একটা বৃত্ত রচনা করেছে, মাঝখানে আটকে থাকা লেগুনের পানি এত স্বচ্ছ যে কোরালের প্রতিটি শাখা স্রোতের সাথে সাথে কিভাবে মোচড় খাচ্ছে। পরিষ্কার দেখা যায়, যেন পানির ওপর রয়েছে।

ব্যারন পঁচাত্তর সালে দ্বীপগুলো কেনার সময়, বলল পাইলট, ওগুলোর একটা পলিনেশিয়ান নাম ছিল। পুরানো এক রাজার কাছ থেকে একজন মিশনারী উপহার পেয়েছিল, তার বিধবা স্ত্রীর কাছ থেকে কিনে নেন ব্যারন। তিনি পলিনেশিয়ান নামটা উচ্চারণ করতে পারতেন না, তাই বদলে ফেলেন। শ্রদ্ধাভরে হাসল পাইলট।

 সাতটা দ্বীপ স্রেফ বালির বিস্তৃতি, এখানে সেখানে সার সার পাম গাছ। বাকি দুটো আকাড়ে বড়, জমাট বাঁধার নিরেট লাভায় মোড়া, নিস্তেজ রোদে চকচক করছে।

নিচের দিকে নামতে শুরু করল প্লেন। জানালা দিয়ে একটা বাড়ি দেখতে পেল পিটার, পাম গাছের পাতা দিয়ে ঢাকা ছাদ। বাড়িটার চারপাশে ফুলবহুল বাগানের আড়ালে অন্যান্য আরো কয়েকটি ছোট বাংলো দেখা গেল। পরমুহূর্তে লেগুনের উপর চলে এল প্লেন, লম্বা জেটির দুপাশে অনেকগুলো ছোট ছোট জলযান রয়েছে। জেটিটা সুরক্ষিত জল সীমা পর্যন্ত লম্বা। নগ্ন মাস্তুল সহ সাধারণ বোট রয়েছে একটা, পাশেই বড় একটা পাওয়ার স্কুনার—-ওটা বোধ হয় পাপেটি থেকে ভারী জিনিসপত্র আনার কাজে ব্যবহার করা হয়–যেমন, ডিজেল। স্কিইং, ডাইভিং, আর ফিশিং এর জন্যে রয়েছে বেশ কয়েকটা পাওয়ার বোট। ওগুলোর একটাকে লেগুনের মাঝখানে দেখা গেল, তীরবেগে ছুটছে আর পিছনে রেখে যাচ্ছে অস্ট্রিচ পাখির পালকের মতো তুষার ধবল দুসারি পানির উত্থান, আরো পিছনে স্কির উপর খুদে একটা মনুষ্য আকৃতি আকাশের দিকে মুখ তুলে ওদের উদ্দেশে অভ্যর্থনাসূচক হাত নাড়াল। মুহূর্তের জন্যে পিটারের মনে হলো, ম্যাগডা হতে পারে কিন্তু হঠাৎ বাক নিল ট্রাই-আইল্যান্ডার, চোখের সামনে হরেক রকম লাল আর গোলাপি মেঘমালা ও দিগন্ত ছোঁয়া সূর্য ছাড়া আর কিছু থাকল না।

রানওয়েটা ছোট আর সরু, সৈকত আর পাহাড়ের মাঝখানে সমতল জমি থেকে পাম গাছের সারি কেটে তৈরি করা হয়েছে। স্ট্রিপের মেঝে বানানো হয়েছে কোরালের টুকরো দিয়ে। একঝাঁক পাম গাছের দিকে নামল ওরা, দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে ধেয়ে আসা বাতাসের তীব্রগতি প্রতি মুহূর্তে ঝাঁকি দিয়ে গেল প্লেনটাকে। পাম গাছগুলোকে পিছনে রেখে রানওয়ে স্পর্শ করল চাকা।

স্ট্রিপের কিনারায় ইলেকট্রিক গলফকার্ট নিয়ে অপেক্ষা করছিল একটা পলেশিয়ান যুবতী, পাম গাছের ছায়া আর রোদ পড়েছে তার গায়ে। পরনে এক প্রস্থ কাপড়, বগলের নিচ থেকে উরুর মাঝামাঝি পর্যন্ত ঢাকা। পা খালি, কিন্তু মাথায় পরেছে তাজা ফুলের তৈরি মুকুট–এ দিকের সব মেয়েই পরে।

 সরু মেঠোপথ, আঁকাবাঁকা, দুপাশে বাগান। পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা বাগান কিনা বলতে পারবে না পিটার, তবে বৈচিত্র্যের দিক থেকে বিশেষ একটা স্থান পেয়ে যেতে পারে। প্রতিটা বাকের পর আলাদা আলাদা ফুল বা গাছ, বেশিরভাগই দুর্বল প্রজাতির। প্রতিটি বাকেই অপেক্ষা করছে বিস্ময় আর চমক।

বারান্দার নিচে সাদা বালি নিয়ে পিটারের বাংলো সৈকতের বেশ খানিক ওপরে, বারান্দা থেকে অবাধ দৃষ্টি চলে দিগন্তরেখায় বিলীন সাগর-সীমা। পর্যন্ত, চারপাশে এমন ভাবে গাছপালা সাজানো হয়েছে, মনে হয় গোটা দ্বীপে এটাই বুঝি একমাত্র বাড়ি। বাঁকের পর বাক পেরিয়ে বেপরোয়া বেগে গাড়ি চালিয়ে এল মেয়েটা, ব্রেক কষে লাফ দিয়ে নিচে নামল, তারপর নিরীহ খুকির মতো সাদরে হাত ধরে নামাল পিটারকে।

 হাত না ছেড়েই বাংলোর ভেতর নিয়ে এল ওকে। এক এক করে এয়ারকন্ডিশন, সুইচবোর্ড, ভিডিও স্ক্রীন, বাথরুম, ইত্যাদি দেখাল সে। ঘোট ঘোট ফরাসি শব্দ উচ্চারণ করে কথা বলল পিটারের সাথে, যেন সমবয়েসী ভাই অনেক দিন পর বাড়ি ফিরেছে। পিটারের হাবভাব লক্ষ্য করে হেসে কুটিকুটি হলো বারবার।

বার আর কিচেন যা কিছু দরকার সব আছে, লাইব্রেরিতে রয়েছে সবগুলো সাম্প্রতিক বেস্টসেলার–শুধু ম্যাগাজিন আর দৈনিক পত্রিকাগুলো দিন কয়েকের পুরানো। ভিডিও ক্যাসেট পাওয়া গেল গোটা বিশেক, প্রতিটি ছবিতে অস্কার বিজয়ীরা অভিনয় করেছে।

রবিনসন ক্রুসোর নাম শুনেছ? তার একবার এখানে আসা উচিত ছিল। পিটারকে হাসতে দেখে মেয়েটাও খিলখিল করে হেসে উঠল।

 দুঘণ্টা পর আবার পিটারকে নিতে এল সে। ইতোমধ্যে শাওয়ার সেরে দাড়ি কামিয়েছে পিটার, খানিক বিশ্রাম নিয়ে কাপড় পাল্টেছে। হালকা সুতি ট্রপিকাল স্যুট পরেছ ও, বুকে খোলা শার্ট, পায়ে স্যান্ডেল।

আবার ওর হাত ধরল মেয়েটা। পিটার বুঝল, এই অভ্যেসটাকে কেউ যদি অবাধ লাইসেন্স বলে মনে করে মেয়েটা আহত হবে, হতভম্ব হয়ে পড়বে বেচারি। সরু আর লম্বা পথ ধরে ওকে নিয়ে চলল সে, শুধু দুপাশের ঝোঁপঝাড়গুলো আলোকিত। ঝোঁপের ভেতর এমনভাবে লুকানো আছে আলোর ব্যবস্থা, টিউব বা বালব নজরে আসে না। সাগরের কলকল ছলছল শব্দে ভরাট হয়ে আছে রাত, আর একেবারে কানের কাছে পাম গাছের পাতার সাথে বাতাসের খসখস খুনসুটি।

বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল ওরা, প্লেন থেকে এটাকে দেখছিল পিটার। মৃদু সুর-ঝংকার আর হাসির আওয়াজ কানে এল, তবে আলোর মধ্যে পিটার এসে দাঁড়াতে হাসির শব্দ থেমে গেল। পাঁচ-সাতজন মানুষ চোখে প্রত্যাশা নিয়ে ঘাড় ফেরাল ওর দিকে।

 পিটারের ঠিক জানা ছিল না কি আশা করবে সে, কিন্তু আর যাই হোক এই ধরনের আনন্দমুখর সামাজিক সমাবেশ আশা করেনি ও রোদে পোড়া সুঠামদেহী নারী-পুরুষ রুচিসম্মত মূল্যবান কাপড় পরে আছে, বরফ আর ফলের রস ভরা লম্বা গ্লাস হাতে, গ্লাসগুলো ঘেমে ঝাপসা হয়ে গেছে।

 পিটার! দল ভেঙে বেরিয়ে এল ব্যারনেস ম্যাগডা, নিতম্বে ঢেউ তুলে যেন উড়ে চলে এল পিটারের সামনে।

ঝলমলে, নরম সোনালি একটা ড্রেস পরেছে সে, গলার কাছে সরু সোনালি চের দিয়ে আটকানো, কিন্তু কাঁধ থেকে গোটা পিঠ একেবারে নিতম্বের এক ইঞ্চি উপর পর্যন্ত সম্পূর্ণ নগ্ন। দৃশ্যটা শ্বাসরুদ্ধকর, কারণ তার শরীর গোলাপ পাপড়ির মতে, আর পরিমিত রোদ পোহানো চামড়ার রঙ চাকভাঙা নতুন মধুর মতো। ঘন কালো চুল মুচড়ে কবজি সমান মোটা রশি পাকানো হয়েছে, তারপর মাথার মাঝখানে স্তূপ করা হয়েছে সযত্নে। প্রসাধন ব্যবহার করেছে সে, হালকা ছায়া পড়েছে যেন, ফলে চোখজোড়া চিকন, সবুজ আর রহস্যময় লাগছে।

 পিটার, আবার বলল ম্যাগডা অল্টম্যান, পায়ের পাতায় ভর দিয়ে আলতোভাবে চুমো খেল ঠোঁটে, প্রজাপতি পাখনা ছোঁয়াল যেন। অস্পষ্টভাবে পারফিউমের গন্ধ পেল পিটার, মন মাতানো, মিষ্টি।

বোধশক্তি লোপ না পেলেও টলে গেল পিটারের। ম্যাগডা সম্পর্কে কিছুই তার অজানা নেই, অথচ তাকে দেখে টান পড়েনি পেশিতে।

ম্যাগডা সম্পূর্ণ শান্ত, নিরুদ্বিগ্ন এবং সপ্রতিভ। সদ্য ফোঁটা ফুলের মতো তাজা। নিদারুণ হতাশা বা ভীতিকর নিঃসঙ্গতা, এই মুহূর্তে কিছুই তাকে স্পর্শ করেনি। এই মেয়ে কেঁদেছে বা কাঁদতে পারে বলে বিশ্বাস হয় না।

 মাথাটা একপাশে কাত করার জন্যে এক পা পিছিয়ে গেল ম্যাগডা, দ্রুত চোখ বুলিয়ে দেখে নিল পিটারকে, মৃদু হাসল্ ওহ্, শেরি, আগের চেয়ে কত ভালো দেখাচ্ছে তোমাকে। শেষবার যেদিন দেখলাম, ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে আমাকে।

এতক্ষণে উপলব্ধি করল পিটার, শান্ত সপ্রতিভ ভাবটুকু পুরোটাই কৃত্রিম, হালকা ছায়া থাকায় চোখ ভরা বিষাদ সহজে নজরে পড়ছিল না। ঠোঁটের দুই কোণও টান টান হয়ে আছে।

আর তোমাকেও যে এত সুন্দর দেখেছি, আমার মনে পড়ে না।

কথাটা সত্যি, কাজেই কোনো সংকোচ ছাড়াই বলতে পারা গেল। শুনে হেসে উঠল ম্যাগডা, ক্ষণস্থায়ী কোমল একটু আনন্দ-উচ্ছ্বাস।

আগে কখনো কথাটা বলোনি, মনে করিয়ে দিল ম্যাগডা, কিন্তু এখনো তার আচরণ মৃদু হলেও ভঙ্গুর। তার স্নেহ আর বন্ধুত্বের ভাব আরেক সময়ের কথা মনে করিয়ে দিলেও, এখন আর কোনো গুরুত্ব নেই ওগুলোর। সত্যি আমি কৃতজ্ঞ।

আপন করে কাছে টানল ম্যাগডা, পাজর আর বগলের মাঝখানে পিটারের একটা হাত আটকাল, পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল জোট বাধা অতিথিদের দিকে, যেন একবার যখন পেয়েছে তখন এই অমূল্য সম্পদ আর সে হাতছাড়া করতে রাজি নয়।

তিনজন পুরুষ আর তাদের স্ত্রীরা রয়েছে দলটায়। একজন মার্কিন ডেমোক্র্যাট সিনেটর, বেশ ভালো রাজনৈতিক প্রভাব আছে। তার মাথায় প্রচুর চুল, সব সাদা। চোখ জোড়া পাকা লিচুর মতো। পাশে বসা স্ত্রীর বয়স তার চেয়ে অন্তত ত্রিশ বছর কম হবে, খুবই সুন্দরী। লোকটা পিটারের দিকে তাকাল–ঠিক সিংহ যেভাবে হরিণের দিকে তাকায়। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি চাপ দিয়ে এক সেকেন্ড অতিরিক্ত ধরে থাকল সে পিটারের হাত।

একজন অস্ট্রেলিয়ান রয়েছে, বিশাল কাঁধ, প্রকাণ্ড হুঁড়ি। তার চোখের চারপাশে স্থায়ীভাবে কুঁচকে আছে মোটা চামড়া, গায়ের রঙ জন্ডিস রোগীর মতো হলদেটে। দৃষ্টি দেখে মনে হবে অনেক দূরে তাকিয়ে আছে। দেখেই চিনেছে পিটার, সারা দুনিয়ায় জানা মতে যত ইউরেনিয়াম আছে তার সিকি ভাগের মালিক সে, আর আছে অসংখ্য ক্যাটল স্টেশন, সবগুলো এক করলে আকারে ব্রিটিশ আইলসের দ্বিগুণ হবে। স্ত্রীটি স্বামীর মতোই রোদে পোড়া তামাটে, দুজনে সমান জোর দিয়ে করমর্দন করল।

 তৃতীয়জন স্প্যানিয়ার্ড, পৃথিবী বিখ্যাত একটা শেরির সাথে তার পরিবারের নাম জড়িয়ে আছে। চশমা পরা অধ্যাপকের চেহারা, রোগা-পাতলা, ভঙ্গুর। কোথায় যেন পড়েছে পিটার, এই লোকের সেলারে পাঁচশ মিলিয়ন ডলারের শেরি আর কনিয়্যাক, মজুদ থাকে, অঙ্কটা নাকি তাদের পরিবারের মোট বিনিয়োগের ক্ষুদ্র একটা ভগ্নাংশ মাত্র। সুন্দরী বউ, তবে মোটা আরেকটু কম হলে পিটার বোধহয় নিজের অজান্তেই আরো দু-একবার তার দিকে তাকাত।

পরিচয় এবং কুশল বিনিময়ের পর দলটা আজকের মাছ ধরা নিয়ে আলোচনা শুরু করল। অস্ট্রেলিয়ান লোকটা সকালে প্রকাণ্ড একটা মারলিন তুলেছে বোটে, হাজার পাউন্ডের বেশি তার ওজন, মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত পনেরো ফিট লম্বা। বর্ণনা শুনে সবাই, বিশেষ করে মেয়েরা রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল।

আলোচনায় যোগ দিলেও খুব কম কথা বলল পিটার, তবে চোরাচোখে সারাক্ষণ লক্ষ্য রাখল ম্যাগডার ওপর। সব কথা আর কারও জানা নেই, কাজেই ওদের চোখে তার মানসিক উত্তেজনা ধরা পড়ছে না। প্রয়োজনের সময় সহজভাবেই হাসছে সে, পিটারের দিকেও দু-একবার তাকাল, প্রতিবার হাসিমুখে-শুধু চোখের তারায় ম্লান ছায়া।

 অবশেষে হাততালি দিল সে। এসো সবাই, মাটি খুঁড়ে গুপ্তভোজ বের করি। দুহাতের ভঁজে সিনেটর আর অস্ট্রেলিয়ান লোকটাকে বন্দী করল সে, সবাইকে নিয়ে নেমে এল সৈকতে। ওদের তিনজনের পিছনে পিটারের ঘাড়ে চাপল সিনেটরের স্ত্রী, সে ওর বাহুর সাথে বুক ঘষল, তারপর আঁকড়ে ধরে প্রায় ঝুলে পড়ার সময় ঠোঁটের ওপর হালকাভাবে জিভ বুলিয়ে দিল দুবার।

লম্বা একটা বালির স্তূপের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুজন পলিনেশিয়ান ভূত্য, ম্যাগডার সঙ্কেত পেয়ে কোদাল নিয়ে পটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল তারা! বালির নিচ থেকে বেরুল সীউইড আর কলাপাতার মোটা স্তর, ওগুলোর ভেতর থেকে সাদাটে ধোঁয়া উঠতে লাগল। পরের স্তরে রয়েছে ফালি করা কাঠ আর পাম গাছের শুকনো ডাল, শেষ স্তরে আরেক প্রস্থ সীউইড আর জ্বলন্ত কয়লা।

মুরগি, মাছ আর খাসির মাংসের সাথে মিশে থাকা ব্রেড-ফ্রট, কলা আর মশলার গন্ধ উঠে এল নাকে, উল্লাসে হাততালি দিল সবাই।

কার ভাগ্যে কে জানে, সমস্ত আয়োজন সফল হয়েছে, ঘোষণা করল ব্যারনেস ম্যাগডা। খাবারের ভেতর একটু যদি বাতাস ঢুকত, পুড়ে কয়লা হয়ে যেত সব।

শুরু হলো ভোজ, হাসি-আনন্দে মুখর সবাই, দামি শ্যাম্পেন আর হুইস্কি গ্লাসের পর গ্লাস ধরেছে, তাও সবটুকু হুইস্কি শেষ করেনি। শান্তভাবে অপেক্ষা করছে ও, আলোচনায় যোগ দিচ্ছে না। বার কয়েক কটাক্ষ হানলেও, সিনেটরের বউকে হতাশ করল ও, কোনো রকম উৎসাহ দিল না।

আঘাতটা আসবে, জানে পিটার। কখন, কোন দিক থেকে আসবে জানে না। আভাস আর লক্ষণের খোঁজে রয়েছে ও। এখানে নয়, জানে, লোকজনের সামনে কিছু ঘটবে না। আঘাতটা যখন আসবে, খলিফার আর সব কাজের মতো সেটাও হবে দ্রুতগতি এবং মোক্ষম। হঠাৎ নিজের অহমবোধ উপলব্ধি করে বিস্মিত হলো পিটার–নিজেকে নিয়ে অহঙ্কার না থাকলে এভাবে কেউ শত্রুর ফাঁদে নিরস্ত্র অবস্থায় পা দেয়? এটা শুধু বধ্যভূমি নয়, শত্রুর নির্বাচিত নিজস্ব বধ্যভূমি। ও জানে, আত্মরক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায় প্রথমে আঘাত হানা, সুযোগ পাওয়া গেলে আজ রাতেই। যত তাড়াতাড়ি হয় ততই নিরাপদ, উপলব্ধি করল ও এবং ঠিক তখনই দেখল পাম গাছের নিচে ফেলা টেবিলের ওদিক থেকে ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে ম্যাগডা অল্টম্যান, সামনে সুস্বাদু খাদ্যবস্তুর বিপুল সমারোহ। উত্তরে পিটারও মৃদু হাসল, ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকিয়ে সাড়া দিল ম্যাগডা।

নারী-পুরুষ সবাই কথা বলছে, বিড়বিড় করে ক্ষমা প্রার্থনা করল ব্যারনেস, বিশেষভাবে কারও দৃষ্টি আকর্ষণ না করে আলো থেকে ছায়ায় গিয়ে দাঁড়াল।

পঞ্চাশ পর্যন্ত গুনল পিটার, তারপর পিছু নিল।

সৈকতে অপেক্ষা করছিল সে। চাঁদের আলোয় তার নগ্ন পিঠ আলোকিত হয়ে আছে, দূর থেকে দেখতে পেল পিটার। সৈকতের কিনারায় দাঁড়িয়ে লেগুনের পানির দিকে তাকিয়ে আছে ব্যারনেস। পিছনে পায়ের আওয়াজ পেল, কিন্তু ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল না। তার কণ্ঠস্বর অস্পষ্ট শোনাল।

তুমি আসায় আমি খুব খুশি হয়েছি, পিটার।

আমি খুশি হয়েছি, তুমি আসতে বলায়।

ব্যারনেসের গলার পিছনে আস্তে করে হাত রাখল পিটার, খুলির নিচে চুলগুলো আঙুলের ডগায় সিল্কের মতো লাগল। এখুনি ইচ্ছে করলে অ্যাকসিসটা খুঁজে নিতে পারে পিটার। খুলির গোড়ায় ওটা একটা হালকা হাড়, ফাঁসির রশিতে কাউকে ঝুলিয়ে দেয়ার সময় জল্লাদ আশা করে মট করে ভেঙে যাবে ওটা। আঙুলের চাপ দিয়ে কাজটা করতে পারে পিটার, ফাসের মতোই দ্রুত হবে।

ওরা থাকায় সত্যি আমি দুঃখিত, বলল ব্যারনেস। তবে ওদের আমি বিদায় করে দিচ্ছি–হোক একটু দৃষ্টিকটু। হাতটা নিজের কাঁধে তুলল সে, পিটারের হাত আস্তে করে ঘাড় থেকে নামাল। ছাড়ল না, আঙুলগুলো সমান করে নিজের গালে চেপে ধরল তালুটা। কাল খুব সকালে চলে যাবে ওরা, পিয়েরে ওদের পাপেটেতি পৌঁছে দিয়ে আসবে। তারপর… তারপর গোটা লে নিউফ পোইজে আমাদের একার হয়ে যাবে-শুধু তোমার আর আমার হাসি নাকি কান্না চাপল ম্যাগডা ঠিক বোঝা গেল না, গলার আওয়াজ খসখসে, অস্কুট শোনাল, অবশ্য ত্রিশ-বত্রিশ জন চাকর-বাকর থাকবে।

তার মানে, আন্দাজ করে নিল পিটার, সম্ভবত একটা দুর্ঘটনায় পড়ে প্রাণ হারাতে হবে ওকে। সাক্ষী থাকবে শুধু বেতনভুক বিশ্বস্ত কর্মচারীরা।

 এবার আমাদের ফিরতে হবে। দুর্ভাগ্য, আমার অতিথিরা সবাই প্রভাবশালী, বেশিক্ষণ ওদের এড়িয়ে থাকতে পারি না–কিন্তু রাত পোহাবে। রাতটা আমার জন্যে খুব দীর্ঘ হবে, পিটার–তবে পোহাবে। পিটারের বাহু-বন্ধনের ভেতর ঘুরল ম্যাগডা, আকস্মিক উন্মাদনার সাথে চুমো খেল, দাঁতের সাথে পিষে গেল পিটারের ঠোঁট। নিজেকে ছাড়িয়ে নিল ম্যাগডা, পিটারের কানের কাছে ফিসফিস করে, যা ঘটার তা তো ঘটবেই, পিটার–কিন্তু ভুলো না মনের গহীনে পরস্পরের জন্যে অমূল্য কিছু অনুভূতি ছিল আমাদের। সারা জীবনে এত মূল্যবান কিছু জোটেনি আমার কপালে। মনে হলো ফুঁপিয়ে উঠল সে, কিন্তু আওয়াজটা এত তাড়াতাড়ি চাপা দিতে পারল যে সন্দেহ হলো শোনার ভুল। সেটা ওরা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না।

পরমুহূর্তে প্রায় বিদ্যুৎবেগে পিটারের নাগালের বাইরে চলে গেল ম্যাগডা, সৈকত ধরে আলোকিত সরু পথের দিকে ছুটছে। ধীরপায়ে তাকে অনুসরণ করল পিটার, চিন্তায় নুয়ে আছে মাথাটা। ম্যাগডার শেষ কথাগুলো বিমূঢ় করে তুলেছে ওকে, ঠিক কি বোঝাতে চাইল ধরতে পারছে না। হঠাৎ ধারণা হলো, ঠিক এটাই চায় ম্যাগডা–ওকে বিমুঢ় আর দ্বিধাগ্রস্ত করাই তার উদ্দেশ্য ছিল। শব্দটা ঠিক শোনেনি পিটার, অনুভূতি দিয়ে টের পেল–পিছনে কিসের একটা নড়াচড়া। চোখের পলকে পাঁই করে আধপাক ঘুরে গেল ও, কোমর বাঁকা করে ঝাঁপ দেয়ার ভঙ্গি করল।

লোকটা ওর দশ কদম পিছনে, বিড়ালের মতো নিঃশব্দে এগিয়ে এল। পথের পাশে ঝোঁপের ডাল দুলছে দেখে পিটার বুঝতে পারল ওখানে গা ঢাকা দিয়ে ছিল সে।

গুড ইভনিং, জেনারেল স্ট্রাইড।

ডাইভ দিতে যাচ্ছিল পিটার, গলার আওয়াজ চিনতে পেরে সামলে নিল নিজেকে। ধীরে ধীরে সিধে হলো ও, যদিও হাত দুটো শরীরের দুপাশে বাঁকা হয়ে থাকল।

কার্ল! তার মানে নেকড়েগুলো ওদের কাছাকাছিই ছিল, মাত্র কয়েক ফিট দূরে–পাহারা দিচ্ছিল বিবি সাহেবাকে।

 আমি কি আপনাকে চমকে দিলাম? দেহরক্ষীর মুখ দেখতে না পেলেও তার কণ্ঠস্বরে ক্ষীণ একটু ব্যঙ্গ রয়েছে টের পেল পিটার। সন্দেহ যদিও একটু থেকেও থাকে, এখন তা সম্পূর্ণ দূর হয়ে গেল। রোমান্টিক কোনো মুহূর্তে শুধু খলিফারই দরকার হতে পারে বডিগার্ড।

নিঃসন্দেহ হলো পিটার, কাল সূর্য ডোবার আগে হয় সে, না হয় ম্যাগডা অল্টম্যান, দুজনের একজন মারা যাবে।

.

বাংলোয় ফেরার আগে আশপাশের ঝোঁপ আর গাছগুলো পরীক্ষা করল পিটার, সন্দেহজনক কিছুই পাওয়া গেল না। ঘরে ফিরে দেখল, বিছানাটা তৈরি করা হয়েছে, পরিষ্কার করা হয়েছে শেভিং গিয়্যার, টুকিটাকি জিনিসগুলো সুন্দরভাবে গুছিয়ে রাখা হয়েছে টেবিলে। ছেড়ে যাওয়া কাপড়গুলো পাওয়া গেল না, সম্ভবত ধোয়ার জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। নতুন কিছু শার্ট আর ট্রাউজার পেল পিটার, সদ্য ইস্ত্রি করা। কাজেই জোর করে বলা যায় না, ওর অন্যান্য জিনিসে হাত দেয়া হয়নি। ধরে নিতে হবে বেশ ভালোভাবেই সার্চ করা হয়েছে গোটা বাংলো।

 দরজা-জানালার তালাগুলো যথেষ্ট মজবুত নয়, সম্ভবত অনেক দিন ব্যবহার না করায় মরচে ধরে গেছে। ব্যবহার করার দরকার পড়েনি, কারণ দ্বীপে চোর-ডাকাত বা সাপ-বিছে আছে বলে শোনা যায়নি–এখনকার কথা অবশ্য আলাদা। কাজেই চেয়ার টেবিলগুলো দরজার সামনে মেঝেতে এমনভাবে সাজাল পিটার, ঘরে কেউ ঢুকলে অন্ধকারে যাতে ধাক্কা খেতে হয়। বিছানাটা খানিক এলোমেলো করল ও, চাদর ঢাকা বালিশগুলো এমনভাবে সাজাল দেখে মনে হবে কেউ ঘুমাচ্ছে। একটা কম্বল নিয়ে প্রাইভেট লাউঞ্জে চলে এল ও, সোকায় শোবে।

 অতিথিরা দ্বীপ ছেড়ে চলে যাবার আগে আক্রমণ আসবে বলে মনে হয় না, তবে সাবধানের মার নেই।

 ভালো ঘুম হলো না। একবার ঘুম ভাঙল পাম গাছের মরা ডাল খসে পড়ার শব্দে। আরেক বার মুখে চাঁদের আলো পড়ায়। ঠিক ভোরের আগে আবার ঘুম পেল ওর, অর্থহীন আর উদ্ভট স্বপ্ন দেখল, চোখ মেলার পর আতঙ্কে বিকৃত ম্যাগডার মুখ ছাড়া আর কিছুই মনে করতে পারল না।

 সূর্য তখনো ওঠেনি, সৈকতে চলে এল পিটার। রীফ ছাড়িয়ে এক মাইল পর্যন্ত সাঁতার কাটল, স্রোতের সাথে লড়াই করে ফিরে এল তীরে। সম্পূর্ণ সতর্ক আর প্রস্তুত মনে হলো নিজেকে ওর। কোনো দিক থেকে কি আসবে আসুক, সেও তৈরি।

বিদায়ী অতিথিদের জন্যে ফেয়ারওয়েল ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাতের জোয়ারে সৈকতের বারি মসৃণ হয়ে উঠেছে, রঙিন ছাতার নিচে বসে লরেত পেরিয়ার শ্যাম্পেনের বোতল ভোলা হলো, নিউজিল্যান্ড থেকে এসেছে হট-হাউস স্ট্রবেরি। ব্যারনেস ম্যাগডার পরনে ছোট্ট সবুজ প্যান্ট, সুগঠিত পা আর হাঁটু সহ প্রায় সবটুকু ঊরু দেখা গেল, ঊর্ধ্বাঙ্গে ম্যাচ করা টিউব আকৃতির বক্ষবন্ধনী–তবে তলপেট, কাঁধ আর পিঠ উদোম। সযত্নলালিত একজন অ্যাথলেটের শরীর, মহান কোনো শিল্পীর অবদান।

আজ একটু যেন বেশি হাসাহাসি করছে ম্যাগডা এবং কয়েকবার সময়ের আগেই হেসে ফেলল, যেন আগে থেকেই ভেবে রেখেছিল হাসতে হবে। পিটারের দিকে যতবার তাকাল, প্রতিবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল চেহারা। তার হাবভাব দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক, কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিতে পেরে উল্লাস বোধ করছে সে, এখন শুধু কাজটা করার জন্যে পুলকের সাথে অপেক্ষা করছে।

কাঠের চাকা লাগানো গাড়ি করে এয়ারপোর্টে এল ওরা। গরু না থাকায় ওটাকে গরুর গাড়ি বলা যাবে না, গরুর বদলে ছোট একটা ইঞ্জিন চালাচ্ছে ওটাকে। সিনেটর লোকটা প্রচুর শ্যাম্পেন খেয়ে মহা ফুর্তিতে আছে, বিদায়ের মুহূর্তে আদর করে আলিঙ্গন করার চেষ্টা করল, কিন্তু কৌশলে তাকে ফাঁকি দিয়ে সরে দাঁড়াল ম্যাগডা অল্টম্যান, পিঠে ধাক্কা দিয়ে অন্যান্য আরোহীদের সাথে তুলে দিল ট্রাই-আইল্যান্ডারে।

প্লেনটা আকাশে অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত সেদিকে তাকিয়ে থাকল ম্যাগডা, তারপর ফিরল পিটারের দিকে। কাল রাতে ভালো ঘুমাতে পারিনি আমি, কথাটা বলে চুমো খেল সে।

 আমিও, মুখে বলল পিটার, মনে মনে বলল, বাজি ধরে বলতে পারি, একই কারণে।

বিশেষ একটা প্রোগ্রাম করেছি, বলল ম্যাগডা। শুধু তোমার আর আমার জন্যে। এসো, এসো-আমি আর এক মিনিটও দেরি করতে রাজি নই।

জেটির মাথায় ম্যাগডার পঁয়তাল্লিশ ফুট লম্বা ক্রীশ-ক্রাফট ফিশারম্যান নিয়ে অপেক্ষা করছিল হেড বোটম্যান। অদ্ভুত সুন্দর একটা বোট, রঙে কোথাও এক বিন্দু ময়লা নেই, স্টেনলেস স্টিলের ফিটিংস পালিশ করে ঝকঝকে আয়না করে তোলা হয়েছে।

 ব্যারনেসকে দেখে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসল বোটম্যান। সব ট্যাংক ভর্তি, মাই ব্যারনেস। স্কুবা বটল চার্জ করা হয়েছে, লাইট রডগুলোও টোপসহ তৈরি। ওয়াটার স্কি পাবেন মেইন র‍্যাকে। শেফ নিজে এসে আইস বক্স চেক করে গেছে।

কিন্তু তার গাল ভরা হাসি মিলিয়ে গেল যখন শুনল ব্যারনেস একাই বোট নিয়ে রওনা হবে।

কি, আমার উপর তোমার বিশ্বাস নেই? হেসে উঠল ম্যাগডা।

না-না, তা কেন, মাই ব্যারনেস… অপ্রতিভ বোধ করল বোটম্যান। রশিগুলো নিজের হাতে খুলল সে, জেটি আর বোটের মাঝখানে ফাঁকটা বড় হতে শুরু করল, শেষবারের মতো চেঁচিয়ে কিছু উপদেশ দিল ব্যারনেসকে।

ভেব না, বহাল তবিয়তে ফিরে আসব, পিটারের দিকে না তাকিয়ে জেটিতে দাঁড়ানো বোটম্যানকে বলল ম্যাগডা, সকৌতুকে হাসছে। তারপর দুটো ডিজেল ইঞ্জিনই চালু করল সে, ধীরে ধীরে থ্রটল খুলল। প্লেনের মতো ছুটল ক্রীশ-ক্রাফট, পানির গা ছুঁলো কি ছুঁলো না। বাঁক নিয়ে চ্যানেল মার্কারগুলোর মাঝখানে ঢুকল বোট, রীফের ভেতর দিয়ে প্যাসেজ তৈরি করে এগোবে। তারপরই খোলা প্যাসিফিক।

 কোথায় যাচ্ছি আমরা?

রীফের পিছনে আশ্চর্য একটা জিনিস আছে। একশ ফিট পানির নিচে পুরানো একটা জাপানি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার। চুয়াল্লিশ সালে আমেরিকানরা ডুবিয়ে দিয়েছিল। স্কুবা ডাইভিংয়ের জন্যে ভারি সুন্দর স্পট। প্রথমে আমরা ওখানে যাব…

কিভাবে? আন্দাজ করার চেষ্টা করল পিটার। হয়তো একটা স্কুবা বলে খানিকটা কার্বন মনোঅক্সাইড গ্যাস ভরা আছে। ডিজেল জেনারেটরের এগজস্টে একটা হোস লাগিয়ে সহজেই কাজটা করা যায়-একটা চারকোল ফিল্টারের ভেতর দিয়ে এগজস্ট গ্যাসকে আসতে দিলে অব্যবহৃত হাইড্রোকার্বনের স্বাদ আর গন্ধ দূর হয়ে যাবে, বাকি কার্বন মনোঅক্সাইড গ্যাস যেটা থেকে যাবে তার অস্তিত্ব ফাঁস হবে না। প্রথমে এই গ্যাস ত্রিশ অ্যাটমোসফেয়ার প্রেশার দিয়ে ভরতে হবে বোতলে, তারপর অপারেটিং প্রেশার একশ দশ অ্যাটমোসফেয়ারের সাহায্যে ক্লিয়ার অক্সিজেন ভরতে হবে। কিছু টের পাবে না ভিকটিম, ঘুমিয়ে পড়বে সে। তারপর মুখ থেকে মাউথপীস খসে পড়ার পর বাকি গ্যাস আপনা থেকেই বেরিয়ে যাবে বোতল থেকে, কোনো প্রমাণই থাকবে না।

 তারপর আমরা ইল দে উইসিউ যাব। আমার স্বামী অল্টম্যান কড়া নির্দেশ দিয়েছিল, দ্বীপবাসীরা কেউ ডিম চুরি করতে পারবে না–তার নির্দেশ এখনো বহাল আছে, সবাই মেনেও চলে। ফলে সাউদার্ন প্যাসিফিকের সবচেয়ে বড় পাখির কলোনি পেয়ে গেছি আমরা। টার্ন, নডি, ফ্রিগেট–কত রকমের যে পাখি।

 সম্ভবত একটা স্পিয়ার গান। সরাসরি, অব্যর্থ এবং নিশ্চিত। অল্প রেঞ্জে, এই ফিট দুই-এক দূর থেকে, এমনকি পানির তলাতে থাকলেও স্পিয়ার অ্যারো মানুষের ধড় ভেদ করে যাবে–শোল্ডার ব্লেডের মাঝখান দিয়ে ঢুকে বেরুবে বুকের পাজর ভেঙে।

পরে আমরা ওয়াটার-স্কির জন্যে তৈরি হব…

স্কি নিয়ে পানিতে থাকবে পিটার, অপেক্ষা করবে কখন টান পড়ে লাইনে, এই সময় শক্তিশালী জোড়া ইঞ্জিন নিয়ে যদি ওর দিকে তেড়ে আসে বোট, কি করার থাকবে ওর? স্টিল বডি যদি বা ওকে থেঁতলাতে নাও পারে, ছুরি দিয়ে রুটি কাটার মতো নিখুঁতভাবে ফালি করবে জোড়া স্কু, প্রতি মিনিটে পাঁচশ বার ঘুরবে ওগুলো।

এসব আন্দাজ করতে করতে নিজের ওপর বিরক্ত হয়ে উঠল পিটার, বুঝল আসলে কি করবে খলিফা সেটা জানার কোনো উপায় নেই। জানবে, কিন্তু তখন হয়তো অনেক দেরি হয়ে গেছে ক্ৰীশ-ক্রাফটের লম্বা ফ্লাইং ব্রিজে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে ওরা, ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাল পিটার। প্রধান দ্বীপটা এরই মধ্যে অনেক নিচু হয়ে গেছে, তার মানে অনেক দূর চলে এসেছে ওরা। বিনকিউলার না থাকলে কেউ ওদেরকে দেখতে পাচ্ছে না।

পাশে দাঁড়িয়ে চুল থেকে একটা রিবন খুলল ম্যাগডা, কালো স্কার্ফটা ঢিল করে দিল একটু, তার মাথার পিছনে পতাকার মতো উড়তে লাগল সেটা। এসো, সারা জীবন ধরে এই করি আমরা, তীব্র বাতাস আর কর্কশ ইঞ্জিনের আওয়াজকে ছাপিয়ে উঠল তার গলা।

 মায়াবতী রমণীর মুঠোয় বন্দী ক্রীতদাস, পাল্টা চিৎকার করে জবাব দিল পিটার, পরমুহূর্তে নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিল খুন করার কঠিন ট্রেনিং দেয়া হয়েছে খলিফাকে, তার হাসি আর সৌন্দর্য দেখে মুহূর্তের জন্যেও অসতর্ক হওয়া চলবে না। কোনো অবস্থাতেই খলিফাকে প্রথম আঘাত হানার সুযোগ দেবে না ও।

 আবার ঘাড় ফিরিয়ে তীরের দিকে তাকাল পিটার। এখন থেকে যে কোনো মুহূর্তে ব্যাপারটা ঘটতে পারে, ভাবল ও। এমনভাবে নড়ল, যেন কিনারা দিয়ে নিচে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। ম্যাগডার দৃষ্টিসীমার ভেতরই থাকল, কিন্তু সরে এল একটু পিছনে। বাধ্য হয়ে ওর দিকে শরীরটা একটু ঘোরাতে হলো ম্যাগডাকে, এখনো হাসছে সে।

ঠিক এ ধরনের স্রোতেই অ্যামবারজ্যাক পাওয়া যায় চ্যানেলে। শেফকে কথা দিয়েছি, তার জন্যে জ্যান্ত একজোড়া মাছ সাথে করে নিয়ে যাব, ব্যাখ্যা দেয়ার সুরে বলল ব্যারনেস ম্যাগডা যাবে না, শেরি, নিচে গিয়ে রডগুলো রেডি করবে না? টোপগুলো পাবে তুমি ফরওয়ার্ড স্টারবোর্ড লকারে।

মাথা ঝাঁকার পিটার। ঠিক আছে।

বাঁক নিয়ে চ্যানেলে ঢোকার সময় স্পীড একেবারে কমিয়ে দেব, ঠিক তখন লাইন ফেলবে তুমি, কেমন?

 জো হুকুম। তারপর কিছু না ভেবেই বলে বসল পিটার, কিন্তু তার আগে চুমো খাও আমাকে।

পরিবেশনের ভঙ্গিতে পিটারের ঠোঁটের সামনে মুখ তুলে ধরল ব্যারনেস ম্যাগডা, আর পিটার ভাবল কেন বললাম আমি কথাটা? ম্যাগডার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার জন্যে নয়। সম্ভবত অভয় দেয়ার জন্যে, বুঝতে দিতে চায় না, সে তাকে খুন করার আগে ওই তাকে খুন করতে যাচ্ছে। অথচ তবু দুজোড়া ঠোঁট এক হতে গভীর একটা বেদনা অনুভব করল পিটার, এই কদিন যেটাকে মাথাচাড়া দিতে দেয়নি। ওর মুখের নিচে ধীরে ধীরে উন্মুক্ত হলো ব্যারনেসের মুখ-ভেজা ভেজা, উষ্ণ, কোমল-পিটারের মনে হলো এখনই বোধ হয় ভেঙে যাবে বুকটা। নিমেষের জন্যে একটা সন্দেহ দেখা দিল, কাজটা করার আগে নিজেই না মারা যায়।

 ম্যাগডার কাঁধের ওপর দিয়ে হাত বাড়াল পিটার, তার ঘাড় স্পর্শ করল। ম্যাগডার শরীর ওর শরীরে বাধা পেয়ে সমতল হলো। খুলির নিচে জায়গামতো পৌঁছুল পিটারের আঙুল। দুটো মুখ এক হয়ে আছে। এক সেকেন্ড পেরোল। আরেক সেকেন্ড কাটল। তারপরই নরমভাবে পিছিয়ে এসে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল ম্যাগডা। আরে, কি করতে চাও তুমি? উত্তেজিত, অস্কুট কণ্ঠস্বর। একটু একটু হাঁপাচ্ছে তোমার আদরে নেশা হয়ে যাক আমার, আর রীকে ধাক্কা খেয়ে গুঁড়ো হয়ে যাক বোট?

 খালি হাতে কাজটা করতে পারেনি পিটার। না, এভাবে পারবে না ও। ঝট করে সারতে হবে, চোখের পলকে। যত দেরি করবে ও, ততই ওর জন্যে ব্যাপারটা বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াবে। মনে দ্বিধা এসে গেছে, জীবনে এই বোধ হয় প্রথম।

কি হলো, যাও। ঠাট্টাচ্ছলে পিটারের বুকে মৃদু ঘুসি মারল ম্যাগডা। এ সবের জন্যে অনেক সময় পাব আমরা-প্রতিটি মুহূর্ত তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করব…

দুর্বল মনে হলো নিজেকে, খালি হাতে পারেনি, ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল পিটার। ইস্পাতের মই বেয়ে ককপিটে নামার সময় চমকে উঠল ও, অকস্মাৎ ধরা পড়েছে ব্যাপারটা। দীর্ঘ চুম্বনের সময়টাতে ম্যাগডার ডান হাতটা আদর করার ছলে ওর ঠিক চিবুকের নিচে গলা আঁকড়ে ছিল। ওর হাত ম্যাগডার খুলির নিচে চাপ দিতে শুরু করলেই ম্যাগডা এক ঝটকায় ওর ল্যারিংস ভেঙে দিতে পারত।

ককপিটে নেমে এল পিটার, আরেকটা চিন্তা খেলে গেল মাথায়। ম্যাগডার অপর হাতটা ওর গায়ের সাথে সেঁটে ছিল, পাঁজরের নিচে মৃদু চাপড় দিয়ে আদর করছিল। ওই হাতটা বিদ্যুৎবেগে ওপর আর ভেতর দিকে আঘাত করতে পারত, সাথে সাথে ছিঁড়ে যেত পেটের ভেতর ডায়াফ্রাম। তার মানে সারাক্ষণ তৈরির ছিল খলিফা, ছিল ওর চেয়ে অনেক বেশি সর্তক। ওর আলিঙ্গনের ভেতর ছিল সে, প্রতিরক্ষা ব্যুহের ভেতর ঢুকে পড়েছিল, অপেক্ষা করছিল ওর জন্যে। মৃত্যুর কতটা কাছাকাছি চলে গিয়েছিল উপলব্ধি করে শিউরে উঠল পিটার।

পরের বার ইতস্তত করা চলবে না।

কাজ করছে পিটার, সেই সাথে দ্রুত মাথা ঘামাচ্ছে। সীট লকারের ঢাকনি তুলল ও। ভেতরের ট্রে-তে ফিশিং গিয়ার রয়েছে। তামা আর ইস্পাতের সুইভেল, বিভিন্ন আকারের পঞ্চাশটা। সব ধরনের সিঙ্কার রয়েছে, পানিতে বা তলায় ব্যবহারযোগ্য। প্লাস্টিক, পালক, আর উজ্জ্বল ধাতুর তৈরি ফাতনা রয়েছে প্রচুর। আছে দৈত্যকার বিল ফিশের জন্যে হুক, আর আছে আলাদা কমপার্টমেন্টের সাইড ট্রে-তে একটা বেইট নাইফ।

 পঞ্চাশ ডলারের নিনজা ছুরি, চৌকো ঘর আঁকা বহুঙা হাতল। সাত ইঞ্চি লম্বা ইস্পাতের ব্লেড়, বাঁটের কাছে তিন ইঞ্চি চওড়া, ক্রমশ সরু হতে হতে সূঁচ হয়ে গেছে ডগাটা। এটা নির্দয় লোকের অস্ত্র। বিজ্ঞাপনের বলা হয় এই ছুরি দিয়ে আপনি ওক গাছের শুকনো কাণ্ডও টুকরো করতে পারবেন। মাখনের ভেতর যেমন অনায়াসে ছুরি ঢোকে, একটাও তেমনি মানুষের মাংসে ঢুকে হাড় ভেদ করে যাবে অনায়াসে।

 হাতলটা বাগিয়ে ধরে কোপ মারল পিটার, তারপর স্যাৎ করে ওপর দিকে তুলল, বাতাসে হিস করে উঠল ফলা। চিরে গিয়ে সূক্ষ্ম একটা রেখা ফুটল আঙুলের ডগায়, ব্যস্তভাবে ধার পরীক্ষা করতে যাওয়ার খেসারত।

 ক্যানভাস স্বীকার খুলে ফেলল ও, ডেকে যাতে রাবার সোল কোনো শব্দ না করে। পরনে এখন শুধু গেঞ্জি আর বক্সার-টাইপ সুইমিং ট্রাঙ্কস।

খালি পায়ে মইয়ের তিনটে ধাপ টপকে থামল পিটার, ধীরে ধীরে ফ্লাইং ব্রিজের লেভেলের ওপর চোখ তুলল।

 ক্রীশ-ক্রাফটের কেন্ট্রাল সামনে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ম্যাগডা অল্টম্যান, বিরাট বোটটাকে চ্যানেলের মুখে নিয়ে আসছে সে, গভীর মনোযোগের সাথে তাকিয়ে আছে সামনে।

 স্কার্ফ খুলে ফেলেছে ম্যাগডা, চুল উড়ছে বাতাসে। তার উদোম পিছনটা পিটারের দিকে ফেরানো–গভীর একটা খাদের ভেতর শিরদাঁড়া, খাদের দুপাশে উঁচু হয়ে আছে মসৃণ শক্ত পেশি।

প্যান্টির একটা পায়া সামান্য একটু উঁচু হয়ে থাকায় আধখানা চাঁদের মতো বেরিয়ে আছে সাদা সুডৌল নিতম্বের নিচের অংশ। নৃত্যপটিয়সীর মতো সুঠাম পা সম্পূর্ণ অনাবৃত, পাতার ওপর ভর দিয়ে সামনের দিকে একটা ঝুঁকে আছে সে, বোর। ওপর নিয়ে সামনেটা দেখার চেষ্টা করছে।

 ব্রিজ থেকে চলে গিয়েছিল পিটার বারো সেকেন্ডও হয়নি, এরই মধ্যে সম্পূর্ণ অসতর্ক হয়ে উঠেছে ব্যারনেস ম্যাগডা।

একই ভুল পিটার দ্বিতীয়বার করল না। ক্ষিপ্র একটু ঝাঁকির সাথে ধাপ থেকে ব্রিজে উঠে এল ও, কোনো শব্দ যদি হয়েও থাকে, ইঞ্জিনের গর্জনে তা চাপা পড়ে গেছে।

সুযোগ থাকলে হাড় এড়িয়ে লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হয়, কারণ হাড়ে লেগে ছুরির ডগা দিকভ্রান্ত হতে পারে।

লক্ষ্যস্থল ঠিক করল পিটার, পিঠটা যেখানে সবচেয়ে সরু-কিডনির লেভেলে, পাঁজরের খাঁচার ভেতর গহ্বরটাকে আড়াল করার জন্যে ওখানে কোনো গাড়ি নেই। সম্ভাব্য সবটুকু শক্তি দিয়ে ঘ্যাঁচ করে এক ধাক্কায় ভেতরে ঢুকিয়ে দিতে হবে ছুরি, একেবারে হাতলের কিনারা পর্যন্ত, তা নাহলে ভেতরে ঢোকার পরও একপাশে সরে যেতে পারে ফলা।

তাই করল পিটার, সর্ব শক্তি দিয়ে চালাল ছুরিটা।

ঢিল ছোঁড়া হয়ে গেছে, ঠাণ্ডা মাথায় খুন করার জন্যে ছুরি চালিয়ে বসার পর, উপলব্ধি করল পিটার ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে প্রতিপক্ষ। ক্রীশ-ক্রাফটের আয়নার মতো ঝকঝকে কন্ট্রোল প্যানেলে পরিষ্কার ফুটে আছে পিটারের প্রতিচ্ছবি। ও ব্রিজে ওঠার পর থেকেই ওর দিকে একইভাবে তাকিয়ে আছে ম্যাগডা।

কন্ট্রোল প্যানেলে ম্যাগডার মুখ সবটুকু নয়, শুধু তার বিস্ফারিত চোখজোড়া দেখতে পেল পিটার। ছুরির ফলা মাংসের ভেতর ঢুকতে যাচ্ছে তখন। মনোযোগ নষ্ট হয়ে গেল পিটারের। ম্যাগডার নড়ে ওঠা দেখতেই পেল না।

হাতসহ ডান পাশ বেয়ে নেমে এল তীব্র ব্যথাটা, অসাড় একটা অনুভূতির সাথে চোখে অন্ধকার দেখল পিটার। ব্যথার উৎস ওর কলার বোন যেখানে বাহু ছুঁয়েছে তার পাশের গর্তটা। একই সময়ে ওর ডান হাতের কনুইয়ের নিচে কিসের যেন একটা প্রচণ্ড বাড়ি পড়ল, দিক বদলাল ছুরির ফলা, ম্যাগডার নিতম্ব থেকে এক ইঞ্চি দূর দিয়ে চলে গেল সেটা।

ম্যাগডার সামনে কন্ট্রোল পানেল, ছুঁচালো ফলার ডগা কয়েকটা নব আর ডায়াল চুরমার করে দিল। পিটারের অসাড় আঙুল হাতলটা ধরে রাখতে পারল না, লাফ দিয়ে মুঠো থেকে বেরিয়ে এসে টং করে স্টীল হ্যান্ড-রেইলে ধাক্কা খেল, ব্রিজের কিনারা ঘেঁষে ফিরতি পথে ছিটকে পড়ল সেটা, পিটারের পিছনে ককপিটের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ওর দিকে না ফিরেই আঘাত করেছে ম্যাগডা, কন্ট্রোল প্যানেলে ওর প্রতিচ্ছবি দেখে কাঁধের প্রেশার পয়েন্টে লক্ষ্যস্থির করেছিল।

ব্যথায় পঙ্গু হয়ে গেছে পিটার, অপর হাতটা ব্যথার উৎস খামছে ধরতে চাইল। কিন্তু না, বাঁচার স্বতঃস্ফুর্ত প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করল বা হাতটাকে–আড়াল করার ভঙ্গিতে ঘাড়ের পাশে উঠে এল সেটা।

আবার পিছন দিকে আঘাত করল ব্যারনেস, সাদা হাত আলোর একটা প্রবাহের মতো ঝলসে উঠল চোখের সামনে, ঘাড়ের কাছে ভোলা বাঁ হাতের কবজির একটু নিচে লাগল, মনে হলো গায়ের সবটুকু জোর দিয়ে ক্রিকেটের ব্যাট চালিয়েছে।

যেখানে লক্ষ্যস্থির করা হয়েছিল, ঘাড়ে, লাগলে সাথে সাথে মারা যেত পিটার। পরিবর্তে অপর হাতটাও অবশ্য হয়ে গেল, এখন অনায়াসে ঘুরে গিয়ে ওর দিকে ফিরছে ম্যাগডা-পিটারের মতো সেও আশুরিক শক্তির অধিকারিণী, সমান ক্ষিপ্র, ভারসাম্য রক্ষায় কেউ কারোও চেয়ে কম নয়।

 পিটার জানে, ম্যাগডার কাছাকাছি থাকতে হবে ওকে—-ভার, আকার আর শক্তি দিয়ে পরাস্ত করতে হবে শত্রুকে। কাঁধ থেকে কনুই পর্যন্ত অবশ্য ডান হাতের আঙুল বাঁকা করে ম্যাগডার মুখ খামছে ধরতে গেল ও, ইতোমধ্যে ঘুরে গেছে ম্যাগডা। অনায়াসে হাতটাকে বাধা দিল সে, কয়েক সেকেন্ড হাতাহাতি হলো, তারপর ঝাঁকি দিয়ে ছাড়িয়ে নিল নিজেকে। তার বুকের কাছ থেকে খানিকটা কাপড় ছিঁড়ে নিয়েছে পিটার।

পরস্পরের দিকে তাকাল ওরা।

হাড়ের মতো সাদা হয়ে গেছে ম্যাগডার মুখ। দাঁতের সাথে সেঁটে আছে ঠোঁট, নাকের ফুটো কাঁপছে। মেয়ে বা মানুষ বলে মনে হলো না, যেন হিংস্র একটা বাঘিনী। আবারও সে প্রথম আঘাত হানল। লম্বা চুল পিটারের মুখের সামনে ঘুরপাক খেল, চাবুকের মতো বাড়ি মারল চোখে। পিটারের নাক, কানের নিচে, চোয়ালে, কপালের পাশে অবিরাম ঘুষি চালার সে, হাতের কিনারা দিয়ে ঘাড় লক্ষ্য করে কোপ মারল–মেরেই প্রতিবার লাফ দিয়ে সরে গেল, পরমুহূর্তে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল বারবার ঝাঁকি খেল উন্মুক্ত স্তন জোড়া।

বিস্ময়ের সাথে উপলব্ধি করল পিটার, একাই পেটাচ্ছে ম্যাগডা। এ পর্যন্ত শুধু ঘুষিগুলো ঠেকাতে পেরেছে ও, কখনো হাত তুলে থামিয়েছে, কখনো শক্ত কাঁধটাকে তাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। কিন্তু খালি পায়ের লাথিগুলো প্রত্যেকটা ওর উরু আর পেটে লেগেছে, ভাজ করা হাটুর গুতো একটাও লক্ষ্যচ্যুত হয়নি, বারবার প্রচণ্ড ঝাঁকি খেয়ে পেলভিসের হাড়ে চিড় ধরার কথা।

ধীরে ধীরে শক্তি ক্ষয় হচ্ছে, একটু একটু করে দুর্বল হয়ে পড়ছে পিটার। ভাগ্য, উপস্থিত বুদ্ধি, আর বাঁচার সহজাত প্রবৃত্তির সাহায্যে এতক্ষণ বাধ্য দিয়েছে ও, এখন থেকে যেকোনো মুহূর্তে নির্ঘাত ওকে ঘাতক ট্রাকের মতো চাপা দেবে ম্যাগডা। একটা মুহূর্ত স্থির থাকছে না সে হাত আর পা সামনে চালাচ্ছে দুটো, ভারসাম্য ফিরে পাবার কোনো সুযোগই দেবে না পিটারকে।

এখন পর্যন্ত পিটার তাকে আঘাত করতে পারেনি, কনুই আর আঙুল দিয়ে দুএকবার চেষ্টা করলেও স্পর্শ করা সম্ভব হয়নি। গায়ে জোর থাকলে কি হবে, জোর খাটাবার অস্ত্র হাত দুটো এখনো প্রায় অসাড় হয়ে আছে। একটা অস্ত্র দরকার ওর, একটু দম ফেলার ফুরসত দরকার। পিছনে ককপিটে পড়েছে ছুরিটা, বারবার সেটার কথা ভাবছে পিটার।

আবার হামলা করল ম্যাগডা, পিছিয়ে এসে তাকে সামনে বাড়তে দিল পিটার। কোমরে ব্রিজ রেইল ঠেকল। একটা ঘুষি আসছিল, গলার নরম অংশে লক্ষ্যস্থির করা হয়েছে-হাতের কিনারায় লেগে আরেক দিকে সরে গেল, থেতলে গেল নাকটা। চোখ থেকে হড়হড় করে পানি বেরিয়ে এল, সেই সাথে রক্ত। ঠোঁটের ভেতর দিকে দাঁত বসে গিয়ে কেটে গেছে, গলার ভেতর উষ্ণ, লোনা স্বাদ পেল পিটার। নাকে ঘুষি খেয়ে, ঘুষির ধাক্কার সাথেই, পিছন দিতে হেলে পড়ল ও, কোমরে ঠেকে থাকা রেইলটা পিছন দিকে ডিগবাজি খেতে সাহায্য করল ওকে। শূন্যে মাত্র একবার ডিগবাজি খেল ও, পরমুহূর্তে ককপিটের ডেকে দুপা দিয়ে পড়ল, ব্রিজ থেকে দশ ফিট নিচে। চোখ পিটপিট করে পানি সরাল ও, রক্ত চলাচল চালু করার জন্যে ঝাঁকাতে লাগল হাত দুটো। তারপর পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে গিয়ে দেখতে পেল ছুরিটা। ককপিট থেকে ছিটকে স্টার্নের একটা নর্দমায় পড়েছে ওটা। সেদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল পিটার।

ওকে ডাইভ দিতে দেখে বিস্মিত হলো ম্যাগডা, ওর নগ্ন ঘাড়ে মরণ আঘাত হানার প্রস্তুতি শেষ করেছিল মাত্র। লম্বা দুটো লাফ দিয়ে মইয়ের মাথায় পৌঁছে গেল সে, নিচে ঝাঁপ দেয়ার জন্যে টান পড়ল পেশিতে, ঠিক তখন তার দশ ফিট নিচে কুৎসিত নিনজা ছুরির নাগাল পাবার চেষ্টা করছে পিটার।

অতটা ওপর থেকে খালি পায়ে পিটারের পিঠের ওপর পড়ল ম্যাগডা, সামনের দিকে প্রচণ্ড ঝাঁকি খেল পিটার, বাল্কহেডের সাথে ধাক্কা খেয়ে খুলিটা যেন খুঁড়িয়ে গেল ওর। চোখের সামনে অন্ধকার ছেয়ে এল, অনুভূতি হারিয়ে ফেলছে। আর কোনো আশা নেই জানে পিটার, তবু শেষ চেষ্টা হিসেবে সবটুকু শক্তি এক করে গড়ান দিল একটা, ভাজ করে বুকের ওপর তুলল হাঁটু জোড়া। ম্যাগডা যে মরণ আঘাত হানতে চাইছে, টের পেয়ে গেছে ও।

পরবর্তী লাথিটা হাঁটুর নিচে লম্বা হাড়ে লাগল, তার আগেই হাত চলে গেছে ওর। হাতটা অবশ বলেই চুরির হাতল অসম্ভব মোটা আর কর্কশ ঠেকল আঙুলে, খপ করে সেটা মুঠোর মধ্যে নিয়েই ছেড়ে দেয়া প্রিঙের মতো ভাঁজ খুলে ডেকের ওপর লম্বা হয়ে গেল শরীরটা। জোড়া পা এক করে বিদ্যুৎবেগে লাথি চালিয়েছে পিটার। লক্ষ্যস্থির করে মারেনি, বেপরোয়া অন্ধের মতো মেরেছে।

এই প্রথম একটা আঘাত করতে পারল পিটার। আঘাতটা লাগল ঠিক যখন আবার ওর দিকে লাফ দিয়ে বসেছে ম্যাগডা। তার পাঁজরের নিচে পেটে লাগল জোড়া পা। ওখানে তার মাংস যদি নরম হতো, বোটে পিটারের প্রতিপক্ষ কেউ থাকত না। কিন্তু সমতল শক্ত পেশি ধাক্কাটা সামলে নিল। তবে পিছন দিকে ছিটকে পড়ল ব্যারনেস, হুস করে বেরিয়ে এল ফুসফুসের বাতাস, অসহ্য ব্যথায় ভাজ হয়ে গেল শরীরটা।

 পিটার বুঝল, এই ওর শেষ সুযোগ। কিন্তু শরীরটা কাতর হয়ে পড়েছে, চোখের সামনে থেকে অন্ধকার দূর হয়নি এখনো, কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে মাথা তোলার শক্তিও যেন অবশিষ্ট নেই। মুখের ভেতর রক্ত, চোখের কোণ গড়িয়ে আবার পানি নামছে।

 কিভাবে সম্ভব হলো বলতে পারবে না পিটার, সম্ভবত প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তির কল্যাণে, দুপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারল ও, হাতে ছুরি। ফলাটা ডান উরুর পিছনে আড়াল করে রেখেছে, ব্যবহার করার আগ পর্যন্ত সংরক্ষিত অবস্থায় রাখতে চায়। বাঁ হাতটাকে ঢালের মতো তুলল সামনে, তারপর সামনের দিকে ঝুঁকে এগোল। জানে, খুব তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে কাজটা। বেশিক্ষণ দম পাবে না ও। এটাই হবে ওর শেষ চেষ্টা।

কিন্তু ম্যাগডার হাতেও একটা অস্ত্র চলে এল। যন্ত্রণার বিকৃত চেহারা নিয়ে ঝড়ের বেগে নড়ে উঠল ব্যারনেস, কেবিনে ঢোকার মুখে একটা র‍্যাকে ক্লিপ দিয়ে আটকানো বোর্ট হুক ছিল, খুলে হাতে নিল সেটা। অ্যাশ কাঠের আট ফিট লম্বা ভারী লগি, কুৎসিতদর্শন মাথাটা তামার পাত দিয়ে মোড়া। শূন্যে তুলে পিটারের মাথার দিকে নামিয়ে আনল ম্যাগডা সেটা, খুব দ্রুত নয় ওকে শুধু দূরে ঠেকিয়ে রাখতে চাইছে সে আপাতত, এই সুযোগে বাতাস ভরে নিচ্ছে খালি ফুসফুসে।

দ্রুত শক্তি ফিরে পাচ্ছে ম্যাগডা, পিটারের চেয়ে অনেক দ্রুত। তার চোখে নতুন করে ঠাণ্ডা খুনের আলো জ্বলে উঠতে দেখল পিটার। আবার লড়াই বেধে গেলে বেশিক্ষণ টিকতে পারবে না জানে ও, সমস্ত ঝুঁকি আর শক্তি নিয়ে শেষ চেষ্টা এখুনি করতে হবে ওকে।

ছুরিটা ছুঁড়ল পিটার, ম্যাগডার মাথা লক্ষ্য করে। নিক্ষেপযোগ্য অস্ত্র হিসেবে তৈরি করা হয়নি নিনজাটাকে, নির্দিষ্ট পথে না থেকে ডিগবাজি খেয়ে ছুটল সেটা, বোঝাই গেল ম্যাগডার মাথার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাবে। তবে আত্মরক্ষার জন্যে বোট হুকসহ হাত দুটো মাথার ওপর তুলে সরে যাবার চেষ্টা করল ম্যাগডা। মুহূর্তের জন্যে তার মনোযোগ অন্য দিকে সরে গেল, আর সেটাই দরকার ছিল পিটারের। ছুরি ছোঁড়ার পর শরীরের ঝাঁকিটা কাজে লাগাল পিটার, স্যাৎ করে বোট-হুঁকের তলায় চলে এল ও, কাঁধ দিয়ে আঘাত করল ম্যাগডাকে, তার হাত দুটো যখন মাথার ওপর তোলা।

দুজনেই কেবিন বাল্কহেডের ওপর ছিটকে গিয়ে পড়ল, মরিয়া হয়ে মুঠোর ভেতর ম্যাগডার কিছু একটা ধরতে চেষ্টা করল পিটার। মখমলের মতো পিচ্ছিল এক গোছা চুল পেয়ে ভেতরে আঙুল ঢোকাল ও।

আহত পশুর মতো বেপরোয়া শক্তিতে ধস্তাধস্তি শুরু করল ম্যাগডা। শরীরের সমস্ত জোর দিয়েও তাকে নিচে চেপে রাখা অসম্ভব বলে মনে হলো। এলোপাতাড়ি ঘুষি খেল পিটার, থেঁতলে গেল সারা মুখ, নখের আঁচড়ে ছিঁড়ে গেল গলার চামড়া। তবু মাথাটা ম্যাগডাকে তুলতে দিল না ও, হাতে পেঁচানো চুলের গোছা ছাড়ল না। শুধু শরীরের ভার চাপিয়ে তাকে এই প্রথম কোণঠাসা করে ফেলেছে পিটার।

 বুকের নিচে ম্যাগডাকে সিধে করল ও, দুটো শরীরের মাঝখানে একটা হাত ঢুকিয়ে রেখেছে। অপর হাতটা এখনো চুলের গোছা ধরে আছে, অদ্ভুতভাবে বেঁকে আছে মাথাটা, সাদা গলা সম্পূর্ণ উন্মুক্ত এবং অরক্ষিত। থেকে থেকে নিঃশ্বাস ফেলছে ম্যাগডা, ঠোঁটের কোণে ফেনা। কাঠের লগিটাও জোড়া লেগে থাকা দুটো শরীরের মাঝখানে আড়াআড়িভাবে আটকে আছে।

তার এই মৃত্যু চাক্ষুষ করা পিটারের জীবনের কঠিন অভিজ্ঞতার মধ্যে সবচেয়ে ভীতিকর।

 দুজনের কেইই কথা বলছে না, ফেস ফস শব্দের সাথে নিঃশ্বাস ফেলছে শুধু, পরস্পরের দিকে তকিয়ে আছে চোখে খুনের নেশা আর ঘৃণা নিয়ে। ইতোমধ্যে গোটা শরীর ম্যাগডার ওপর তুলে ফেলেছে পিটার, হঠাৎ একটু উঁচু হয়ে বোট হুকটাকে সামান্য সরাল ও, বুক থেকে গলায় নেমে গেল সেটা। মাথাসহ গলাটা সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলেও দেরি করে ফেলল ম্যাগডা, এটা সে আশা করেনি। বা হাতে এখনো ম্যাগডার চুল ধরে আছে পিটার, দুজোড়া চোখের মাঝখানে ছয় ইঞ্চি ব্যবধান, ওর নাক আর মুখ থেকে রক্তের ফোঁটা চিবুক গড়িয়ে ম্যাগডার গলায় আর স্তনে পড়ছে।

ম্যাগডার চুল ধরা হাতটা ব্যবহার করল পিটার, কনুই দিয়ে বোট-হুঁকের গায়ে চাপ দিতে লাগল। ধীরে ধীরে গলায় চেপে বসল সেটা।

হেরে যাচ্ছে বুঝতে পারলেও হাল ছাড়ল না ব্যারনেস। কিন্তু যতই সে ধস্তাধস্তি করল ততই ক্ষয় হতে লাগল শক্তি। বোট-হুঁকের ওপর আরো বেশি চাপ দিতে পারল পিটার। ম্যাগডার মুখে আটকা পড়ছে রক্ত, প্রথমে লাল তারপর কালচে হয়ে গেল চামড়া। ঠোঁট দুটো থরথর করে কাঁপছে।

অত্যন্ত সতর্কতার সাথে শরীরটা আবার একটু নাড়ল পিটার, জানে একটু ঢিল দিলেই মোচড় খেয়ে বেরিয়ে যাবে ম্যাগডা তলা থেকে। পিটারের এই নড়াচড়ার তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারল ব্যারনেস। বোট-হুঁকটা আর যদি এক ইঞ্চির আট ভাগের এক ভাগ গলার ভেতর দেবে যায়, চিরকালের জন্যে নিঃশ্বাস ফেলা বন্ধ হয়ে যাবে তার। পিটারের চোখে তাকাল ম্যাগডা, সেখানেও দেখতে পেল নিজের মৃত্যু।

এই প্রথম কথা বলল সে। শুধু ঠোঁট নড়ল, আওয়াজ যেটা বেরুল তার কোনো অর্থ পিটারের কানে ধরা পড়ল না। তারপর আবার শব্দগুলো উচ্চারণ করল সে, পিটারের মনে হলো ভুল শুনছে ও।

ওরা আমাকে সাবধান করে দিয়েছিল।

প্রবল একটা ঝাঁকির সাথে ঝামেলা শেষ করতে যাচ্ছে পিটার। কানে এল, কিন্তু আমি ওদের কথা বিশ্বাস করিনি, অস্কুট ধ্বনি, কোনো রকমে শোনা গেল। নট ইউ।

তারপরই বাধা দেয়ার শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেল ম্যাগডার, তার শরীর সম্পূর্ণ নেতিয়ে গেল। অবশেষে মৃত্যুকে চরম নিয়তি বলে মেনে নিয়েছে সে। তার সেই মায়াভরা চোখ থেকে নিভে গেল সবুজ আলো, একেবারে শেষ মুহূর্তে তার বদলে এমন গাঢ় বিষণ্ণতা ফুটল যেন গোটা দুনিয়া তার সাথে বেঈমানী করেছে, কেউ তার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখেনি।

 পিটারকে এখন কেউ বাধা দিচ্ছে না, শেষ একটা ধাক্কার সাথে বোট-হুঁকটা গলায় আরেকটু দাবিয়ে দিলেই কাজ ফুরোয়। কিন্তু পারল না ও। একটা গড়ান দিয়ে ডেকে নামল, বোট-হুঁকটা তুলে ছুঁড়ে দিল ককপিটের দিকে। বাল্কহেডে গিয়ে বাড়ি খেল সেটা। ম্যাগডার দিকে সম্পূর্ণ পিছন ফিরে ক্রল করে এগোল পিটার, জানে এখনো বেঁচে আছে ম্যাগডা, গোক্ষুরের মতোই বিপজ্জনক-অথচ কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে না। রেইলের নিচে পৌঁছে সিধে হলো ও। ধীরে ধীরে ঘুরল ম্যাগডার দিকে। থরথর করে কাঁপছে পিটার, খটাখট বাড়ি খাচ্ছে দুসারি দাঁত। রেইল ধরে টলতে লাগল। ঝাপসা চোখে দেখল, ক্রল করে এগোচ্ছে ম্যাগডা! প্রতিবার এক ইঞ্চি এগোতে পারছে সে। তার একটা হাত গলায়, তাকিয়ে আছে ওর দিকেই।

ম্যাগডার নগ্ন ধড় পিটারের রক্তে পিচ্ছিল হয়ে আছে। আগের চেয়ে বড় দেখাল মুখটা, ফুলে গেছে। মাথার বিশৃঙ্খল চুলে প্রায় ঢাকা পড়ে আছে মুখ। ককপিটের মাঝখানে যেন একটা জটাবুড়ি হামাগুড়ি দিচ্ছে। বোট-হুঁকের দাগ লাল আর কালচে হয়ে ফুটে আছে গলার ওপর, নিঃশ্বাসের সাথে স্তন জোড়া উঁচু আর নিচু হচ্ছে ঘন ঘন।

পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে ওরা, কথা বলার শক্তি নেই, দুজনেই ক্লান্তির শেষ ধাপে পৌঁছে গেছে।

মাথা ঝাঁকি দিল ম্যাগডা, যেন গোটা ব্যাপারটা অস্বীকার করার চেষ্টা করল। তারপর মুখ খোলার জন্যে হাঁ করল সে। জিভ আর ঠোঁট নড়ল, আওয়াজ বেরুল না। মুখের ভেতর পুরে ঠোঁট চুষল সে, গলায় আবার একটা হাত রেখে ব্যথাটা যেন কমাবার চেষ্টা করল।

আবার মুখ খুলল সে, এবার একটা মাত্র শব্দ বেরুল। কেন?

পুরো ত্রিশ সেকেন্ড জবাব দিতে পারল না পিটার, ওর নিজের গলাও বুজে গেছে। ও জানে দায়িত্ব পালন করতে পারেনি, কিন্তু সেজন্যে নিজের ওপর কোনো রাগ নেই। দ্বিতীয়বার চেষ্টা করার পর গলায় স্বর ফুটল, কর্কশ আর ভারী। তোমাকে খুন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

আবার মাথা ঝাঁকাল ম্যাগডা, চেহারা দেখে মনে হলো পরবর্তী প্রশ্ন কি করবে ভাবছে। কিন্তু আবার সেই একটাই শব্দ বেরুল মুখ থেকে। কেন?

এই কেনর কোনো উত্তর দিতে পারল না পিটার।

তারপর কতটা সময় বয়ে গেল ওরা বলতে পারবে না। পিটারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ম্যাগডার দুচোখ ভরে উঠল পানিতে। চোখ উপচে শিশিরের মতো স্বচ্ছ ফোঁটাগুলো গড়াতে শুরু করল। চিবুক থেকে ঝরে পড়ল ডেকের ওপর। আবার সে ক্রল করে এগোবার চেষ্টা করল, কিন্তু ফোঁপাতে শুরু করায় জোর পেল না গায়ে। ডেকের ওপর মুখ থুবড়ে নেতিয়ে পড়ল সে। চাইছে, কিন্তু পিটারও শক্তি পাচ্ছে না তার দিকে এগোয়। পেশিগুলোকে নিজের নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে আনতে বেশ অনেকগুলো সেকেন্ড লেগে গেল, হাড়হীন কাঠামো নিয়ে একটা বস্তা যেন ঢলে পড়ল ডেকের ওপর, ম্যাগডার পাশে স্থির হয়ে গেল পিটার। স্থির হয়ে গেছে ম্যাগডাও। যাক তাহলে সফল হওয়া গেছে ভেবে খুশি হবার চেষ্টা করল পিটার, কিন্তু তার বদলে আতঙ্ক গ্রাস করল ওকে। হঠাৎ কোত্থেকে যেন শক্তি ফিরে এল, ব্যস্ত হাত বাড়িয়ে ম্যাগডার মাথাটা তুলে নিল কোলের ওপর।

 মৃদু ঝাঁকি দিল পিটার, ম্যাগডার মাথা ওর কোলের ওপর অবলম্বনহীন নারকেলের মতো দোল খেল। এতক্ষণে কথাগুলো আবার স্মরণ হলো ওর।

ওরা আমাকে সাবধান করে দিয়েছিল।

তারপর, কিন্তু আমি ওদের কথা বিশ্বাস করিনি।

 সবশেষে, তুমি নও।

কথাগুলো মনে পড়ল, সেই সাথে নিজের ব্যর্থতার কারণও আবিষ্কার করল পিটার। অর্থ না বুঝলেও, কথাগুলো ম্যাগডা বলেছিল বলেই তাকে খুন করতে পারেনি ও। খুন করার দৃঢ় সিদ্ধান্তে চিড় ধরেছিল।

ম্যাগডাকে বুকের সাথে শক্ত করে চেপে রেখেছে পিটার, অসাড় শরীরটা নড়ে উঠল একটু। ঘাড়টা এখনো নড়বড় করছে, যেন কোনো হাড় নেই। মনে হলো বিড়বিড় করে ওর নাম উচ্চারণ করল ম্যাগডা। শব্দটা বাস্তবে ফিরিয়ে আনল ওকে। বিরাট ক্রীশ-ক্রাফট এখনো সগর্জনে ছুটে চলেছে। খোলা সাগরে আগেই বেরিয়ে এসেছে ওরা।

আস্তে করে শরীরটা ডেকে নামিয়ে রাখল পিটার, টলতে টলতে মই বেয়ে উঠল। প্রথমবার পিটার ছুরি চালাবার পর থেকে ম্যাগডার হাল ছেড়ে দেয়া পর্যন্ত গোটা ব্যাপারটা দুই মিনিটও স্থায়ী হয়নি।

কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে এসে পিটার দেখল, ক্রীশ-ক্রাফট অটোমেটিক পাইলটে চলছে। তার মানে বোট নিয়ন্ত্রণ করার ভান করছিল ম্যাগডা, আসলে ও আক্রমণের অপেক্ষায় তৈরি হয়ে ছিল।

গোটা ব্যাপারটার অর্থ এখনো পরিষ্কার নয়। পিটার শুধু বুঝল, হিসেবে কোথাও একটা মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে ওর। অটোমেটিক স্টিয়ারিংয়ের সুইচ অফ করে দুটো থ্রটলই বন্ধ করে দিল ও, ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে এল ইঞ্জিনের আওয়াজ। গতি স্থির হবার পর বাতাস আর স্রোতের মধ্যে পড়ে ধীরে ধীরে ঘুরতে শুরু করল বোট।

স্টার্নের ওপর দিয়ে পিছন দিকে একবার তাকাল পিটার। দিগন্তরেখার কাছে দ্বীপটা মোটা একটা রেখার মতো লাগল। আবার টলতে টলতে মই বেয়ে নেমে এল

মাথা তুলেছে ম্যাগডা, আধশোয়া অবস্থায় উঁচু হয়ে রয়েছে ডেকে। কিন্তু পিটারকে দেখেই কুঁকড়ে গেল, এবং এই প্রথমবার তার চোখে আতঙ্ক বাসা বাঁধতে দেখল পিটার।

ভয় পেয়ো না, বলর পিটার, নিজের কানেই কর্কশ শোনাল। ম্যাগডা ওকে ভয় পাচ্ছে দেখে নিজের ওপর ঘৃণা বোধ করল ও। চায় না ম্যাগডা আর কখনো ভয় পাক ওকে।

পাশে বসে ম্যাগডাকে দুহাতের ওপর তুলে নিল পিটার, ওর হাত আর বুকের ওপর আড়ষ্ট হয়ে থাকল ব্যারনেস–এখন কি ঘটবে জানা নেই তার। তৃতীয়বারের চেষ্টায় ম্যাগডাকে বুকে নিয়ে সিধে হয়ে দাঁড়াতে পারল পিটার। ভয় পেয়ো না, আবার বলল কথাটা, তাকে নিয়ে ক্রীশ-ক্রাফটের সেলুনে ঢুকল। ওর নিজের শরীরও দুমড়েমুচড়ে কাহিল হয়ে পড়েছে, যেন কোনো একটা হাড়ও আগের মতো শক্ত নেই। ম্যাগডাকে এত যত্নের সাথে আর আলতোভাবে বয়ে নিয়ে এল যে ধীরে ধীরে তার পেশিতে ঢিল পড়ল, ওর শরীরের সাথে মোমের মতো গলে গেল সে।

লেদারের প্যাড লাগানো বেঞ্চে তাতে শুইয়ে দিল পিটার। সিধে হতে যাবে, এক হাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলে পড়ল ম্যাগডা, সরতে দেবে না।

ছুরিটা আমিই ওখানে রেখেছিলাম, খসখসে গলায় বলল ম্যাগডা। পরীক্ষা করার জন্যে।

মেডিকেল চেষ্টটা খুলতে দাও, নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করল পিটার।

না। মাথা নাড়াল ম্যাগডা, অমনি চোখ কুঁচকে মুখ বিকৃত করল গলায় ব্যথা পেয়ে। কোথাও যেয়ো না, পিটার। থাকো আমার সাথে, প্লিজ। কি রকম হচ্ছে আমার বুঝতে পারছি না। ছুরিটা নিয়ে ডেকে তুমি উঠে এলে, তোমাকে আমি খুন করব-বুঝতে পারছ কি বলছি? প্রায় ঘটে গিয়েছিল ব্যাপারটা, ওহ গড়! কি হয়েছে আমাদের, পিটার। আমরা এমন করছি কেন? দুজনেই কি পাগল হয়ে গেছি?

 মরিয়া হয়ে পিটারকে জড়িয়ে রাখল ম্যাগডা, ডেকে হাটু গেড়ে তার মুখের দিকে ঝুঁকে পড়ল পিটার। বোধ হয় তাই। গোটা ব্যাপারটা আমার কাছেও দুর্বোধ্য, নিজেকেও বুঝতে পারছি না।

কেন, পিটার–কেন ছুরিটা নিতে গেলে তুমি? প্লিজ, বল আমাকে। মিথ্যে বোল না, সত্যি কথা বল। আমাকে জানতে হবে কেন।

কারণ মেলিসাকে তুমি নির্যাতন করেছ, কারণ…

বাধা দিয়ে কিছু বলতে গিয়েও পারল না ম্যাগডা, তার গলা বুজে এল।

আরেকটু ব্যাখ্যা করল পিটার, কারণ আমি যখন জানলাম তুমিই খলিফা তখন তোমাকে খুন না করে আমার কোনো উপায় ছিল না…

মনে হলো প্রাণপণ চেষ্টা করে শক্তি সঞ্চয় করছে ম্যাগডা, যেন কি একটা জরুরি কথা তাকে বলতে হবে। গলায় আওয়াজ ফুটল, কিন্তু অস্পষ্ট। কিন্তু করলে না কেন, পিটার? মেরেই তো ফেলেছিলে, শেষ মুহূর্তে বাঁচালে কেন?

কারণ…. কারণটা হঠাৎ করেই উপলব্ধি করল পিটার, কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর কিছু কোনো ব্যাপার নয়।

ডুকরে উঠল ম্যাগডা, ত্রিশ সেকেন্ড ঘনঘন হাঁপাল। তারপর জিজ্ঞেস করল সে, এখনো তুমি মনে কর আমি খলিফা?

জানি না। না জানায় এই মুহূর্তে কিছু এসেও যায় না। শুধু জানি তোমাকে আমি ভালোবাসি।

 কেন এমন হলো, পিটার? বিড়বিড় করে উঠল ম্যাগডা। ঈশ্বর, এমন হলো কেন?

তুমি খলিফা, ম্যাগডা?

কিন্তু পিটার, তুমি আমাকে খুন করতে যাচ্ছিলে! ছুরিটা তো সেই পরীক্ষাই ছিল। খলিফা তো তুমি!

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *