৩. দৃঢ়পায়ে হাঁটছে পিটার

আশ্চর্য ঋজু ভঙ্গিতে, দৃঢ়পায়ে হাঁটছে পিটার। উঁচু হয়ে আছে শির, চোখ জোড়া ধকধক করে জ্বলছে। এয়ারপোর্টের প্রতিধ্বনিবহুল ডোমেস্টিক ডিপারচার হলে বহু লোকের ভিড়, থোর কমান্ডের সদস্যরা ওকে দেখে হাতের কাজ ফেলে সিধে হয়ে দাঁড়াল।

ওয়েল ডান, স্যার।

 গ্রেট স্টাফ, জেনারেল।

অ্যাই, পথ ছাড়ো, আমাদের কমান্ডার আসছেন…

মুক্ত আরোহীদের সেবা করছে ওরা সবাই, তাদের জিনিসপত্র গোছগাছ করে দিচ্ছে, সেই সাথে নিজেদের সিকিউরিটি আর কমিউনিকেশন ইকুইপমেন্ট খুলে বাক্সে ভরছে। এই মুহূর্তে যে-যার কাজ ফেলে পিটারকে ঘিরে ধরল, কে তার আগে হ্যান্ডশেক করতে পারে তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। শুধু থোর কমান্ডের সদস্যরাই নয়, আরোহীদের অনেকেই চিনতে পারল পিটারকে। পিটার তাদের পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় অভিনন্দন জানাল সবাই। বৃদ্ধা এক মহিলা ওর পথরোধ করে দাঁড়াল, হাত দুটো দুপাশে মেলে দিয়েছে। পিটার তার কুশল জিজ্ঞেস করল। দুহাত দিয়ে ওকে আলিঙ্গন করল বৃদ্ধা। বেঁচে থাকো বাবা, শত বর্ষ আয়ু হোক তোমার। গড ব্লেস ইউ!

এখনো কালো অ্যাসল্ট স্যুট পরে রয়েছে কলিন নোবলস, কোমরে ঝুলছে পয়েন্ট ফরটি ফাইভ। এটা একবার দেখ, স্যার, পিটারকে ডেকে বলল সে। তার সামনে একটা ডেস্ক, তাতে বিস্ফোরক আর আগ্নেয়াস্ত্র। বেশিরভাগই রাশিয়ান, কিন্তু ওদের হাতে এল কিভাবে একমাত্র ঈশ্বরই জানে। জোড়া ব্যারেলসহ শট পিস্তলের দিকে আঙুল তাক করল সে। এগুলো হাতে তৈরি, সাংঘাতিক দামি। এত টাকা ওরা পেল কোথায়?

প্রচুর টাকা ওদের, শুকনো গলায় বলল পিটার। এই তো মাত্র কয়েক মাস আগের কথা মনে নেই, দেড় মিলিয়ন ডলার দিয়ে ওপেক মন্ত্রীদের ওদের হাত থেকে ছাড়ানো হলো? ব্রাউন ভাইদের জন্যে ২৫ মিলিয়ন ডলার; ব্যারন অল্টম্যানের জন্যে আরো বিশ মিলিয়ন–একটা সরকারের মোট প্রতিরক্ষা ব্যয় ওটা। ডেস্ক থেকে একটা শট পিস্তল তুলে নিল পিটার, ব্রিচ খুলল। ভেতরে গুলি নেই। মেয়েটা কি এটা দিয়েই জিম্মিদের খুন করেছিল?

ঠোঁটের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে চুরুটটা চালান করে দিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল কলিন। সম্ভবত। দুটো ব্যারেল থেকেই গুলি করা হয়েছে।

শট পিস্তলটা লোড করল পিটার, লম্বা পা ফেলে অফিসের ভেতর দিয়ে আবার এগোল। আশপাশের সমস্ত ডেস্ক খালি, শুধু ফাইল আর টাইপরাইটার রয়েছে। এক দিকের দেয়াল ঘেষে পাশাপাশি পড়ে রয়েছে তিন হাইজ্যাকারের মৃতদেহ, প্রতিটি লাশ স্বচ্ছ প্লাস্টিকের মোড়কে ঢাকা। আরেক দেয়াল ঘেঁষে পড়ে রয়েছে পিটারের সহকারীর লাশ, একবার থেমে লাশটার দিকে ঝুঁকল পিটার। মিশরীয় সেনা বাহিনির একজন ক্যাপটেন ছিল লোকটা। এখনো তার চোখ জোড়া বিস্ফারিত হয়ে আছে, মুখ হাঁ করা। মৃত্যু মানুষের মর্যাদা কেড়ে নেয়, ভাবল পিটার। ধীরে ধীরে সিধে হলো ও।

শট পিস্তল হাতে ইনার অফিসে ঢুকল পিটার, পিছু পিছু কলিন আসছে।

মেয়েটাকে ওরা একটা স্ট্রেচারে শুইয়ে রেখেছে, একজন ডাক্তার আর দুজন পুরুষ নার্স নিঃশব্দে সেবা করছে তার। স্যালাইন আর রক্ত, দুটো একসাথে দেয়া হচ্ছে ইনগ্রিডকে। দরজা খোলার আওয়াজে বিরক্ত হলো ডাক্তার, কিন্তু ঘাড় ফিরিয়ে পিটারকে দেখে মুখের ভাব বদলে গেল। জেনারেল, ওর হাতটা যদি রাখতে চাই, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যেতে হবে। শোল্ডারের জয়েন্ট চুরমার হয়ে গেছে…

 অপরূপ সোনালি মাথাটা ঘুরিয়ে পিটারের দিকে তাকাল মেয়েটা। তার চলে আর মুখে রক্ত লেগে রয়েছে। চেহারা ম্লান হয়ে গেছে, কিন্তু চোখ দুটো আগের মতোই জ্বলজ্বলে।

এখানকার কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলেছি আমি, বলে চলেছে ডাক্তার। দুজন অর্থোপেডিক সার্জেন এখুনি চলে আসছেন, সেন্ট্রাল হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্যে একটা হেলিকপ্টারও পাওয়া যাবে…

বেরিয়ে যান, ডাক্তারকে বলল পিটার।

 জ্বী? হতভম্ব হয়ে গেল তরুণ ডাক্তার।

গেট আউট, আবার বলল পিটার। আপনারা সবাই। দরজা বন্ধ না হওয়া মেয়েটাকে বলল, মানুষ হিসেবে আমার একটা নীতি আছে, তুমি আমাকে বাধ্য করেছে সেই নীতি বিসর্জন দিতে। তার মানে আমার অধঃপতন ঘটেছে, তোমার লেভেলে নেমে এসেছি আমি।

চোখে অনিশ্চিত দৃষ্টি নিয়ে পিটারের দিকে তাকিয়ে থাকল ইনগ্রিড। আড়চোখে একবার দেখে নিল পিটারের হাতের শট পিস্তলটা। পিটারের ডান হাতে ঝুলছে ওটা।

 অবোধ শিশু আর নিরীহ মেয়েদের খুন করে তুমি আমাকে এমন একটা পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিলে, আমার ঊর্ধ্বতন অফিসারের নির্দেশ অমান্য করে তার বিশ্বাস আর আস্থা হারালাম। এক সেকেন্ড থামল পিটার, তারপর আবার বলল, আমি একজন গর্বিত মানুষ, কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর না পেলে এখন যে কাজটা করব তা করার পর গর্ব করার মতো আর কিছু আমার থাকবে না।

মার্কিন অ্যামব্যাসাডরের সাথে আমাকে দেখা করতে দেয়া হোক, দাবির সুরে বলল ইনগ্রিড, আরেকবার পিটারের হাতে ধরা শট পিস্তলের দিকে তাকাল। আমি আমেরিকান সিটিজেন। আই ডিমান্ড প্রোটেকশন…

পিটার থাকে থামিয়ে দিল, আগের মতো স্পষ্ট, শান্ত সুরে কথা বলছে, ভেবো না এটা প্রতিশোধ। অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি, মানুষের যত খারাপ গুণ আছে তার মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হলো প্রতিশোধ…

অসম্ভব, এ কাজ তুমি করতে পার না! ইনগ্রিডের গলা চড়ল, ভয় পেয়ে গেছে সে। পিটার চাইছেও তাই, প্রথম মেয়েটাকে ভয় পাইয়ে দেবে, তারপর প্রশ্ন করবে। প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতেই হবে ওকে। আমার গায়ে হাত দিলে নিজের পায়ে নিজে কুড়োল মারবে তুমি। ওরা তোমাকে ছিঁড়ে খাবে…

কিন্তু পিটার এমনভাবে বলে গেল যেন তার কথা শুনতেই পায়নি, সত্যি এটা প্রতিশোধ নয়। কারণটা তুমি নিজে তৈরি করেছ। তুমি বেঁচে থাকলে ওরা তোমাকে উদ্ধার করার জন্যে আসবে, আমি জানি। তোমার বেঁচে থাকার অর্থই হবে অন্য আরো নিরীহ মানুষের অকাল মৃত্যু।

আমি একজন মেয়েমানুষ। আমি আহত। আমি একজন যুদ্ধবন্দী। আর্তনাদ, করে উঠল ইনগ্রিড, হাত-পা ছুঁড়ে স্ট্র্যাপ ঢিলে করার চেষ্টা করছে।

উত্তর দেবে কিনা বলো। মেয়েমানুষ, আহত, যুদ্ধবন্দী–এসব পুরানো সেন্টিমেন্ট। ওসব বাতিল হয়ে গেছে। বইটা ছিঁড়ে ফেলেছ তুমি, লিখেছ নতুন একটা–আমি এখন তোমার নিয়মে খেলছি। মর্যাদা আর গর্ব হারিয়ে তোমার লেভেলে নেমে আসতে যাচ্ছি আমি…

কলিনের দিকে তাকাল ইনগ্রিড। ও পাগল হয়ে গেছে! ওর হাত থেকে আমাকে বাঁচাও! আমি প্রোটেকশন চাই! আমি মার্কিন অ্যামব্যাসাডরের সাথে দেখা করতে চাই…

পাগলটাকে বোঝাও! ওকে সরিয়ে নিয়ে যাও এখান থেকে! ওকে আমার অসহ্য লাগছে।

কলিন, ডাকল পিটার, কিন্তু তাকাল না তার দিকে। এবার তুমিও বেরিয়ে যেতে পার।

আতঙ্ক আবার গ্রাস করল ইনগ্রিডকে। না! অসম্ভব না! ওকে থামাও! ওকে বাধা দাও! কে কোথায় আছ, আমাকে বাঁচাও! পাগলটা আমাকে খুন করতে চাইছে…

স্যার, বলল কলিন।

হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ তুমি কলিন, বাচ্চা মেয়েটা দেখতে অনেকটা মেলিসা জেইনের মতো ছিল।

ঠাণ্ডা স্বরে বলল পিটার।

নিজের পিস্তলের কাছ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে দরজার উদ্দেশে হেঁটে চলল কলিন। গালিগালাজের ঝড় বইছে যেন ইনগ্রিডের মুখ থেকে।

নিজের পিছনে দরজাটা বন্ধ করে দিল কলিন। ক্লিক শব্দে লেগে গেল পাল্লা দুটো। তবু নিশ্চল পাঁচ সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইল সে, কিছু একটার জন্যে অপেক্ষা করছে। দরজা খুলে ওর পাশে এসে দাঁড়াল পিটার, কলিনের হাতে ধরিয়ে দিল ওর পিস্তলটা। একটা ব্যারেল খালি ওটার।

জেনারেল স্ট্রাইডের দশাশয়ী আকৃতি যেন শুকিয়ে গেছে এক লহমায়। সৈনিকের মতোই দৃঢ় পদক্ষেপে কাঁচের দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেল সে।

কলিন নোবলস একবারও পিছনে ফিরে চাইল না খোলা দরজা দিয়ে।

ঠিক আছে, ডাক্তারের উদ্দেশে বলল কলিন। এখন মেয়েটা শুধুই আপনার।

.

ছুটন্ত ঘোড়র জোরালো পদশব্দ শোনা গেল রিজের ওপারে। চাচা স্টিভেনের দেয়া যে ঘোড়াটার পিঠে বসে মেলিসা জেইন, জানোয়ারটা ওর ক্রিসমাসের উপহার। বয়ঃসন্ধিকালের সমস্ত মেয়েদের মতো ও–ও ঘোড়ার প্রেমে পড়ে গেছে। চকচকে স্ট্যালিয়নের পিঠে দারুণ সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। শেষবার পিটার যখন ওকে দেখেছিল, তার চাইতেও এখন বেড়ে গেছে মেলিসা–বিকশিত হয়েছে তার সৌন্দর্য। নিজের ভিতরে গর্ব অনুভব করে পাষাণ হৃদয় জেনারেল স্ট্রাইড–ওর মেয়ে দারুণ সুন্দরী হয়ে উঠছে।

স্টিভেনের একটা হান্টারের পিঠে চড়ে আছে পিটার। গেল্ডিংটা প্রকাণ্ড–কিন্তু সামনের ছুটন্ত জোড়ার সঙ্গে তাল মিলাতে হিমশিম খাচ্ছে।

সামনেই, ছোট্ট একটা টিলার উপর দিয়ে সাবলীল ভঙ্গিতে ঘোড়া নিয়ে লাফিয়ে পেরিয়ে গেল মেলিসা জেইন; অসাধারণ দক্ষতায় রাশ টেনে সামলালো জানোয়ারটাকে। ওর সুন্দর পিছনটা একটু উঁচু হয়ে গেল ঘোড়ার জিনের উপর, পাদানীর উপর দাঁড়িয়ে ওজন হালকা করল। ঘোড়া খুঁড়ের ঘায়ে গোলা পাকিয়ে উঠছে ধুলো।

এবারে পিটারের পালা। নিজের ভিতরে চ্যালেঞ্জ অনুভব করল সে। সামনের টিলাটাকে আচমকা মাথার সমান উঁচু মনে হচ্ছে। দুই বছর হতে চলল ঘোড়ার পিঠে চড়েনি পিটার, গেল্ডিং-এর পিছনে এই প্রথম; নিশ্চিন্তে লাফ দিল জানোয়ারটা। পায়ে ঘষা খেয়ে কোনো মতে মাটিতে নেমে এল টিলা পেরিয়ে। ঘোড়ার পিঠের উপর ঘাড় ল্যাগব্যাগিয়ে উঠল পিটারের। পরক্ষণেই মেয়ের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে রাশ টেনে সামলে নিল নিজেকে।

 সুপার-স্টার! একটা গাছের নিচে ঘোড়া থেকে নামল মেলিসা। নিচু একটা ডালে লাগামটা দুপ্যাঁচ জড়িয়ে ছুটে এসে হাত ধরল পিটারের।

এক সময় ওই গির্জাটা পর্যন্ত সমস্ত জায়গা আমাদেরই ছিল–দিগন্তের একটা পাথরখণ্ড দেখাল পিটার। আর ওখান থেকে সেই ঢাল পর্যন্ত। এবারে বিপরীত দিকে দেখাল ও।

 জানি, এক হাতে বাপকে জড়িয়ে ধরে মেলিসা জেইন। দাদা মারা যাওয়ার পর এটা বিক্রি করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না তোমাদের। তুমি বলেছ আমাকে। সেটা ঠিক আছে। এতকিছু দিয়ে আমরা কি করব?

অবাক বিস্ময়ে ওর দিকে তাকায় পিটার। ঈশ্বর! এ যে দেখছি কমিউনিস্ট মতবাদ!

 ওর হাতে মৃদু চাপ দেয় মেলিসা। চিন্তা কর না। এইসব আঙ্কল স্টিভেনের কাজ। তুমি আর ক্যাপিটালিস্ট নও-এখন আর চাকরিতে নেই তুমি-বলতে বলতেই নিজের ভুল বুঝতে পারে মেলিসা। ওহ, হো। এই কথাটা ঠিক বলতে চাইনি আমি।

প্রায় এক মাস হয়ে এল থোর কমান্ড থেকে পদত্যাগ করেছে পিটার, কিন্তু কাগজগুলো এখনো ওর কাহিনি প্রায় নিয়মিত ছেপে যাচ্ছে। দুদলে ভাগ হয়ে গেছে রিপোর্টাররা, এক দল নিন্দা করছে, আরেক দল প্রশংসা। তবে দুটোর কোনোটাই এখন আর স্পর্শ করছে না পিটারকে, গোটা ব্যাপারটা ভুলে থাকতে চায় ও।

 দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকার অবশ্য আক্রমণের আগেই নেতাদের মুক্তি দিয়েছিল। একজন হাইজ্যাকার জীবিত অবস্থায় হাসপাতালে নেয়ার পথে গুলির আঘাতে নিহত হয়। একজন মুক্তিপ্রাপ্ত জিম্মি, যে নিজে একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, মৌরিতাস থেকে মেডিকেল কনফারেন্স কভার করে ফিরছিল, পুরো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বিবরণ দেয়। অন্যান্য যাত্রীরাও জানিয়েছে, চতুর্থ হাইজ্যাকারের অনুনয়, প্রাণভিক্ষার আওয়াজ তারা শুনেছে।

চরম বামপন্থি ব্রিটিশ নেতারা পার্লামেন্টে নিন্দার ঝড় বইয়ে দেয়, এমনকি আমেরিকার ডেমোক্রেটদের সমর্থন পায় তারা। থোর কমান্ডের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ফ্রান্স এবং ইতালির কমিউনিস্ট দল এগিয়ে আসে। আমেরিকান বেস থেকে বাদার-মেইনহফের চুরি করা এম ২৬ হ্যান্ড গ্রেনেড বিস্ফোরণে প্যারিসে ফুটবল ম্যাচ চলাকালে একশ তেইশ জন প্রাণ হারায়। ফ্রেঞ্চ পত্রিকায় ফোন করে অজ্ঞাতনামা আততায়ী জানায়, চার হাইজ্যাকারের মৃত্যুর বদলা এটা।

প্রথমত, পেন্টাগন থেকেই পিটারের পদত্যাগের দাবি আসে, যদিও এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ডক্টর কিংস্টোন পার্কার অভিযুক্ত করেন ওকে। পর্দার অন্তরালেই থেকে যান তিনি। মিডিয়ার জোর দাবি, সুষ্ঠু তদন্ত হোক ঘটনার। এতে কোনো সন্দেহ নেই, থোর কমান্ডের ঘটনায় অপরাধমূলক কাজের আলামত আছে। সিভিল কোর্টে হোক, বা মিলিটারি–ঘটনার জন্যে দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের শাস্তি হওয়া উচিত তাদের দাবি। অ্যাটলাস কমান্ডের পুরো ঘটনা তাদের অজ্ঞাত ছিল। মারকারী বা ডায়ানা কমান্ডের কথা তাদের জানা ছিল না।

যদিও আমেরিকা এবং ব্রিটেনের সরকার যথেষ্ট সহানুভূতি জানিয়েছে পিটার স্ট্রাইডকে–কিন্তু নিজেই সরে দাঁড়ানোর সিন্ধান্ত নেয় সে। ওর পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়েছে। কিন্তু বামপন্থীরা রক্ত চায়। পিটার স্ট্রাইডের রক্ত।

আর এখন, মেলিসার গভীর নীল চোখে টলমল করছে জল। ওটা আমি বুঝে বলিনি, ড্যাডি।

ভালো হয়েছে–আমি চাকরিতে নেই। আমার মেয়ের সাথে আরো বেশি সময় কাটাতে পারছি এ জন্যে। মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসে পিটার।

 সবাই কি যাচ্ছেতাই বলছে তোমাকে নিয়ে, ড্যাডি। আমি বিশ্বাস করি না।

ধন্যবাদ। কিছুসময় চুপ রইল ওরা দুজন।

 পিটারই নীরবতা ভাঙে।

তুমি নাকি একজন প্যালিয়েন্টোলজিস্ট হবে–সে বলে।

না। সেটা গতমাসের সিদ্ধান্ত। এখন আর মাটি থেকে খুঁড়ে আনা হাড় নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই আমার। আমি ডাক্তার হব। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ।

 দারুণ! সায় দেয় পিটার। কিন্তু এখন যাওয়া উচিত। এখানে আর বেশিক্ষণ থাকলে ঠাণ্ডায় জমে যাব যে! পাশাপাশি ঘোড়া চালিয়ে ফিরে চলল ওরা দুজন। পিটারের মাত্র তিন ঘণ্টার বড় ভাই স্টিভেন সমস্ত রক্ষণাবেক্ষণ করে এখানকার।

একটু পরই লাল ইটের বাড়িটা দেখা গেল, তিন একর জায়গা নিয়ে বিশাল ছাদ। বাড়ির সামনে পাথুরে উঠান, পশ্চিম প্রান্তে আস্তাবল। ঘোড়া থেকে নেমে ঘাড় ফেরাতেই খোলা গ্যারেজগুলোর দিকে চোখ পড়ল পিটারের। নতুন মডেলের দুটো গাড়ি রয়েছে বাড়ির সামনে, তার মধ্যে একটা মার্সিডিজ সিক্স হানড্রেড, চকচকে রুপালি লিমোজিন। পপ স্টার, আরব শেখ কিংবা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রিরা ব্যবহার করে এমন জিনিস। আরেকটা আকৃতিতে অপেক্ষাকৃত ছোট্ট। গাড়ির পাশে বনেদি পোশাকের দুজন লোক টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কঠিন চেহারা। দেহরক্ষী।

গাড়িগুলো দেখতে পেয়ে চোখ উল্টাল মেলিসা। আবারো সেই অপদার্থ পয়সা-অলা লোজন। মেয়েকে ঘোড়া থেকে নামতে সাহায্য করল পিটার। হাত ধরাধরি করে গোলাপের বাগানের ভিতর দিয়ে এগিয়ে গেল ওরা দুজন। প্রধান ড্রইংরুমে প্রবেশ করল।

 পিটার, ওল্ড বয়! অতিথিদের ফেলে লম্বা পায়ে এগিয়ে এল স্টিভেন। প্রায় পিটারের সমান লম্বা সে, একসময় বেশ পাতলা ছিল কিন্তু আরাম-আয়েশ তার মধ্যে ঢিলেঢালা ভাব এনে দিয়েছে। ব্যবসায়ীর পরিচয় পাওয়া যায় রুপালি চুলের গাছি আর পেকে যাওয়া গোঁফে। অবশ্য, পিটারের জমজ ভাই হিসেবে এখনো মিল পাওয়া যায়। এই মুহূর্তে আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে আছে তার চেহারা।

এবারে ভাতিঝির দিকে ফিরে আলিঙ্গন করল স্টিভেন।

কি খবর, আমার ফ্লোরেন্স নাইটঙ্গেলকে মনে ধরেছে? জানতে চাইল সে।

দারুণ, আঙ্কল স্টিভ! খুব ভালো ঘোড়া ওটা। মেলিসা নিজের মতামত জানায়।

পিটার, এসো, তোমার সাথে এক বিশিষ্ট ভদ্রমহিলার পরিচয় করিয়ে দিই।

স্টিভেনের স্ত্রী, প্যাট্রিসিয়া স্ট্রাইডের সাথে আলাপ করছিল মেয়েটা। ঘুরে তাকাতেই জানালা দিয়ে আসা নরম রোদ উজ্জ্বল হয়ে জ্বলল অবয়বে।

পিটারের মনে হলো পায়ের তলায় ধরণী কাত হয়ে পড়ছে, দুপাশের পাজরে কিসের একটা তীব্র চাপ অনুভব করে দম আটকে এল ওর।

দেখামাত্র তাকে চিনতে পারল পিটার। কিডন্যাপাররা অনেক দিন ধরে আটকে রেখেছিল ওর স্বামীকে, তারপর খুন করে। অফিশিয়াল ফাইলে স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই অনেক ফটো ছিল। একটা পর্যায়ে বিশ্বাস করার কারণ ঘটেছিল কিডন্যাপাররা ব্যারন ভদ্রলোককে নিয়ে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে, প্রায় এক সপ্তা কন্ডিশন আলফাতে ছিল থোর কমান্ড। ছবিগুলোর মধ্যে কয়েকটা ছিল ভোগ পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করা, দক্ষ পেশাদার ক্যামেরাম্যানের নিপুণ শিল্পকর্ম, বহু রঙা ঝলমলে ছবি। কিন্তু সে সব পেশাদার ছবিও, রূপবতীর প্রতি অবিচার করা হয়েছে, রূপের মহিমা বা ব্যক্তিত্বের আকর্ষণীয় দিকগুলো সিকিভাগও ফোটেনি।

সামান্য অবাক এবং অকারণ পুলকের সাথে পিটার লক্ষ্য করল, ওকেও চিনতে পেরেছে সে। মেয়েটার মুখের ভাব বদলাল না, শুধু গাঢ়-সবুজ পান্নার মতো পলকের জন্য দীপ্তি ছড়াল চোখ জোড়া। এখনো তার দিকে হাঁটছে পিটার, কাছাকাছি হয়ে বুঝতে পারল মেয়েটা বেশ লম্বা, কিন্তু দেহ-সৌধে কোনো খুঁত না থাকায় সাথে সাথে তা বোঝা যায় না। সূক্ষ্ম উলের তৈরি একটা স্কার্ট পরে আছে সে, নর্তকীর মতো লম্বা পা দুটো বেশিরভাগই অনাবৃত।

ব্যারনেস, মে আই প্রেজেন্ট মাই ব্রাদার-জেনারেল স্ট্রাইড।

হাউ ডু ইউ ডু, জেনারেল। প্রায় নিখুঁত ইংরেজি বলতে পারে সে, শ্রুতিমধুর কণ্ঠস্বর, ইংরেজি তার জন্যে বিদেশি ভাষা বলেই সম্ভবত সুর একটু প্রলম্বিত, পিটারের পদটা সে উচ্চারণ করল তিন ভাগে—জেনারেল।

পিটার, দিস ইজ ব্যারনেস অল্টম্যান।

চকচকে কালো চুল এমনভাবে ব্যাকব্রাশ করা, টান টান হয়ে আছে কপালের চামড়া। পিছন দিকে নিয়ে গিয়ে লম্বা চুলগুলো বিনুনি করা হয়েছে, তারপর কান জোড়ার ওপর মাথার দুপাশে উঁচু করে বাঁধা হয়েছে দুটো খোঁপা। উঁচু চোয়ালের স্লাভিক গড় সহজেই টের পাওয়া যায়, চেহারায় দৃঢ় মানসিকতার একটা ভাব এনে দিয়েছে। চোখ জুড়িয়ে যায় গায়ের রঙ দেখলে, নির্মল হালকা গোলাপি কিন্তু তার থুতনি সামান্য চৌকো এবং একটু যেন শক্ত, সৌন্দর্য নিখুঁত হবার পথে ছোটখাটো হলেও একটা বাধা বটে। কমনীয় চেহারা, কিন্তু কোমলতার চেয়ে কাঠিন্যই যেন বেশি। মেয়েটা বিশ্বসুন্দরী হতে পারবে না, কিন্তু প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করলে কেউ তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়েও থাকতে পারবে না। যা সাধারণত হয় না, প্রচণ্ড আকর্ষণ বোধ করল পিটার। কয়েক মুহূর্তে নিজের অস্তিত্ব ভুলে গিয়ে রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে থাকল ও। একটা মেয়ের মধ্যে যা কিছু থাকা সম্ভব, থাকলে সন্তুষ্ট আর পুলকিত হয় হৃদয়, তার মধ্যে যেন সব কিছুই অঢেল রয়েছে।

মুগ্ধ বিস্ময়ে পিটারের অভিভূত হবার আরো অনেক কারণ আছে। ও জানে, ব্যারনেস অল্টম্যান তার এই অল্প বয়েসেই অসামান্য সাফল্য অর্জন করেছে। বিশাল এক শক্তিশালী সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী সে। আধুনিক দুনিয়ার যার ভাগ্যনিয়ন্তা, যারা পৃথিবীখ্যাত ব্যক্তিত্ব, তারাও তার সঙ্গ পেলে কৃতাৰ্থ বোধ করেন। সরাসরি পিটারের ওপর চোখ বুলিয়ে সে যেন ওর পৌরুষদীপ্ত অস্তিত্বকে ক্ষীণ একটু বিদ্রূপ করছে কিংবা কৌতুক বোধ করছে। চেহারায় রানী বা দেবীসুলভ নির্লিপ্ত ভাব যেন তার ন্যায্য পাওনা।

তার সম্পর্কে যা যা জানে এক মুহূর্তে সব মনে পড়ে গেল পিটারের।

প্রথমে ব্যারনের প্রাইভেট সেক্রেটারি ছিল ম্যাগডা, পাঁচ বছর কাজ করার পর ব্যারনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠে সে। তার নিপুণ কর্মকুশলতা, দক্ষতা, নিষ্ঠা, অধ্যবসায়, আর আন্তরিকতা লক্ষ্য করে ব্যারন তাকে ধাপে ধাপে তুলে আনেন, ডিরেক্টরদের একজন বানানো হয় তাকে। প্রথমে তিন-চারটে ছোটখাটো গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রি পরিচালনার দায়িত্ব, তারপর সেন্ট্রাল হোল্ডিং কোম্পানির অসীম ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া হয় তার হাতে। দুরারোগ্য ক্যানসারে দীর্ঘদিন ভুগেছেন ব্যারন, সে সময় তিনি আরো বেশি করে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন ম্যাগডার ওপর। দেখা গেল, তিনি তার বিশ্বাস অপাত্রে ঢালেননি। একাধিক হেভি ইন্ডাস্ট্রি, ইলেকট্রনিক্স আর আর্মামেন্টস করপোরেশন, ব্যাঙ্কিং, শিপিং, প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট–সবগুলো জটিল ব্যবসা নিপুণ দক্ষতার সাথে চালিয়ে গেল সে। আটান্ন বছর বয়সে বিয়ে করলেন তিনি, ম্যাগডার নতুন পরিচয় হলো ব্যারনেস অল্টম্যান।

তার বয়স তখন উনত্রিশ। দেখা গেল শুধু ব্যবসায়ী হিসেবে নয়, স্ত্রী হিসেবেও ম্যাগডার জুড়ি পাওয়া ভার।

মুক্তিপণের বিশাল অঙ্কের টাকা কিডন্যাপারদের হাতে তুলে দেয়ার জন্যে একাই গিয়েছিল ব্যারনেস অল্টম্যান, ফ্রেঞ্চ পুলিশের বারণ কানে তোলেনি। কিডন্যাপাররা ছিল নির্মম খুনি–কিন্তু স্বামীকে ফিরে পাবার জন্যে নিজের জীবনের ওপর ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করেনি সে। মুক্তিপণের বিনিময়ে স্বামীকে নয়, তার ক্ষতবিক্ষত লাশ নিয়ে ফিরে আসে সে। শোকে অস্থির হলেও, কর্তব্য-কর্ম থেকে সরে দাঁড়ায়নি সে, স্বামীকে সমাধিস্থ করার সমস্ত আয়োজন নিজে দেখাশোনা করেছে। তারপর নিহত স্বামীর শিল্প-সাম্রাজ্যের হাল ধরেছে আগের চেয়ে আরো দক্ষ এবং শক্ত হাতে।

ম্যাগডা অল্টম্যানের হাতের ওপর ঝুঁকে পড়ল পিটার, পলকের জন্যে তার মসৃণ, ঠাণ্ডা আঙুলে ঠোঁট ছোঁয়াল। এখন ওর বয়স একত্রিশ হবে। অনামিকায় হীরে বসানো একটা আংটি পরেছে সে, সাদা পাথরটা থেকে রঙহীন আগুনের মতো দ্যুতি ছড়াচ্ছে। শুধু বিত্ত-বৈভব নয়, এই নারীর মধ্যে উন্নত রুচি আর সৌন্দর্যবোধেরও বিকাশ ঘটেছে। সিধে হবার সময় উপলব্ধি করল পিটার, ম্যাগডা অল্টম্যানও সতর্কতার সাথে ওর সবকিছু খুঁটিয়ে লক্ষ্য করছে। পান্নার ছড়ানোর বড় বড় চোখ, কিছুই যেন তার দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।

ইদানীং খুব নাম শোনা যাচ্ছে আপনার, বলল ম্যাগডা, যেন কৌতূহলী দৃষ্টির ব্যাখ্যা দিল।

লাঞ্চের আয়োজন মোলোজনের জন্যে। স্টিভেন আর প্যাটের তিন ছেলেমেয়ে; মেলিসা রয়েছে। হাসিখুশি পরিবেশ, সবার সামনে সুস্বাদু খাবারের ছোটখাটো পাহাড় কিন্তু ব্যারনেস এমন একটা সীটে বসেছে যে সরাসরি তার সাথে কথা বলার সুযোগ হলো না পিটারের। তার কথা শোনার জন্যে সারাক্ষণ কান খাড়া করে রাখলেও, অত্যন্ত নিচু গলায় স্টিভেন আর একটা জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকের সাথে দু-চারটে কথা বলল সে, ওরা দুজন তাকে মাঝখানে নিয়ে বসে। বাঁ দিকে বসেছে সোনালি চুলো এক সুন্দরী–বিয়ে করা, ডিভোর্সে তার কোনো জুড়ি নেই। চোখ ধাঁধানো রূপ দিয়ে পিটারকে মুগ্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছে বেচারি। এটা নিঃসন্দেহে প্যাট্রিসিয়ার কাজ। বারো বছর হলো পিটারের বিয়ে ভেঙেছে–কিন্তু হাল ছাড়েনি সে।

চোরাচোখে ব্যারনেসকে বারবার লক্ষ্য করছে পিটার। বেশ কয়েকবার ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিল ম্যাগডা, কিন্তু ওয়াইনের লেভেল যেমন ছিল তেমনি থাকল, নিচে নামল না। প্লেটের খাবারও খুঁটে খুঁটে অতি সামান্যই খেল সে। পিটার চুপিচুপি তাকালেও, ব্যারনেস ভুলেও একবার পিটারের দিকে তাকাল না। একেবারে শেষ সময়, যখন ওরা কফি খাচ্ছে, হঠাৎ ওর পাশে চলে এসে বলল সে, স্যার স্টিভেন আমাকে বলছিলেন, এস্টেটে নাকি রোমান ধ্বংসাবশেষ আছে?

বনের ভেতর দিয়ে হেঁটে অনেকটা দূর যেতে হয়, বলল পিটার। আমি আপনাকে নিয়ে যেতে পারি।

ধন্যবাদ। কিন্তু তার আগে স্যার স্টিভেনের সাথে কিছু ব্যবসার কথা আছে আমার। আমরা কি তিনটের সময় রওনা হতে পারি?

কাপড় পাল্টে টুইডের ঢোলা স্কার্ট আর জ্যাকেট পরে এল ব্যারনেস, খাটো কেউ পরলে তাকে মোটা দেখাত। কাপড়ের মতো হাই বুট জোড়াও ব্রাউন। জ্যাকেটের নিচে পরেছে গোল গলা কাশ্মীরী জার্সি, একই সূক্ষ্ম উলের তৈরি স্কার্ফটা পিঠে ঝুলে আছে। চওড়া কানিসসহ হ্যাঁটের ব্যান্ডে উজ্জ্বল পালক, চোখ প্রায় ঢেকে রেখেছে।

 নিঃশব্দে হাঁটছে সে, হাত দুটো জ্যাকেট-পকেটের গভীরে ঢোকানো, কাদা বা ভেজা পাতা থেকে বুট জোড়া বাঁচানোর কোনো চেষ্টা নেই। লম্বা পা ফেলে হাঁটার মধ্যে বাতাস কেটে ভেসে চলার একটা ভাব আছে, নিতম্বের কাছ থেকে ওপরের অংশটুকু অদ্ভুত এক ছন্দে দোল খায়, এবং তার ফলে পিটারের মতো হতে লাগল ওর পাশে ব্যারনেসের মাথাটা যেন ভাসছে। ফাইন্যান্স আর ইন্ডাস্ট্রির জগতে মেয়েটা যদি সম্রাজ্ঞী নাও হতো, কোনো সন্দেহ নেই, সাড়া জাগানো মডেল হতে পারত অনায়াসে। কাপড় দিয়ে সাজিয়ে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা এবং চেহারায় দুর্লভ আভিজাত্য ফুটিয়ে তোলায় ভারি দক্ষ, সেই সাথে পরিচ্ছদের প্রতি নির্লিপ্ত অবহেলা অকৃত্রিম একটা সারল্য ফুটিয়ে তুলেছে।

 সমীহের একটা ভাব নিয়ে নৈঃশব্দ্য উপভোগ করছে পিটার, ব্যারনেসের সাথে সমান তালে পা ফেলে পাশাপাশি হাঁটতে পারায় খুশি। কাল রাতে বোধ হয় বৃষ্টি হয়েছে এদিকে, সবুজ পাতার ছুঁচালো ডগায় চিকচিক করছে পানি। ছাল ওঠা নগ্ন ওক গাছের কাণ্ডগুলোকে নির্লজ্জ পুরুষ-মূর্তির মতো লাগছে। এখান থেকে ক্রমশ উঁচু হতে শুরু করেছে মাটি। কোথাও না থেমে খোলা একটা ঢালের মাথায় বেরিয়ে এল ওরা। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে একটু হাঁপাচ্ছে ব্যারনেস, আরো গোলাপি হয়ে গেছে মুখের চেহারা। কিন্তু ক্লান্ত নয় মোটেও। প্রায় হনহন করে সোয়া ঘণ্টা হাঁটার পর এই প্রথম থামল ওরা। কোনো সন্দেহ নেই, ভাবল পিটার, শরীরটাকে ফিট রেখেছে।

 ওই দেখুন। পাহাড়ের মাথা ঘিরে থাকা ঘাস মোড়া বৃত্ত আকারের গর্তের দিকে হাত তুলল পিটার। তেমন আহামরি কিছু নয়, হতাশ হতে পারেন ভেবে ইচ্ছে করেই আগে আপনাকে সাবধান করিনি।

এই প্রথম হাসল ব্যারনেস। এখানে আমি আগেও এসেছি, সেই প্রলম্বিত, শ্রুতিমধুর কণ্ঠস্বর।

তার মানে প্রথম সাক্ষাতেই পরস্পরকে আমরা ধোঁকা দিলাম। মৃদুশব্দে হেসে উঠল পিটার।

প্যারিস থেকে এত দূর এলাম, অকারণে নয়, অনেকটা যেন ব্যাখ্যা দেয়ার সুরে বলল ব্যারনেস। স্যার স্টিভেনের সাথে ব্যবসা নিয়ে টেলিফোনেও কথা বলতে পারতাম। কিন্তু বুঝলাম, আপনার সাথে আমাকে মুখোমুখি কথা বলতে হবে। স্যার স্টিভেনকে অনুরোধ করলাম, বললেন সম্ভব-তার কথা আপনি নাকি ফেলতে পারবেন না।

আপনার মতো সুন্দরী ভদ্রমহিলা আমার ব্যাপারে আগ্রহী…

ভ্রু কুঁচকে উঠল সামান্য, সাথে সাথে পিটারকে থামিয়ে দিল ব্যারনেস। এমন খোলামেলা প্রশংসা শুনতে অভ্যস্ত নয় সে। নার্সকোর শাখা, সেডলার স্টিল কোম্পানির একটা প্রস্তাব আপনি প্রত্যাখ্যান করেছেন, স্টিলের সেলস ডিভিশনের হেড। মাথা ঝাঁকাল পিটার। থোর কমান্ড থেকে পদত্যাগের পর এ ধরনের অনেক প্রস্তাবই দেয়া হয়েছে ওকে। প্রস্তাবগুলোয় আপনাকে সন্তুষ্ট করার সব রকম সুযোগ-সুবিধে ছিল বলেই আমার ধারণা।

সেটা সত্যি।

সম্ভবত, একাডেমিক জীবন পছন্দ করেন আপনি, নাকি? জানতে চাইল ব্যারনেস। যদিও পিটারের মুখাবয়ব পাল্টাল না, কিন্তু ও অত্যন্ত অবাক হলো। কেমন করে আমেরিকার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক সামরিক ইতিহাস বিষয়ক বিষয়ের লেকচারারের অফারটা এই মেয়ে জানলো?

আমি কিছু বই পড়তে ও লিখতে চাই। অবশেষে জানাল পিটার।

বই। আপনার দারুণ সংগ্রহ আছে, আমি জানি। আপনার লেখা বই আমি পড়েছি। বেশ পরস্পরবিরোধী মানুষ আপনি, জেনারেল স্ট্রাইড-একদিকে সোজাসুজি অ্যাকশন; আবার গভীর রাজনৈতিক জ্ঞান রাখেন।

আমি নিজেও মাঝেমধ্যে বিভ্রান্ত হয়ে যাই, পিটার হাসে। তাহলে বলুন, কেমন করে আপনি আমাকে বুঝবেন?

ম্যাগডা কিন্তু হাসল না। আপনার লেখার অনেক চিন্তাধারা আমার সাথে মিলে যায়। আর অ্যাকশনের কথা যদি বলেন–আপনার অবস্থানে থাকলে আমিও এই করতাম।

একটু শক্ত হয়ে যায় পিটার। আবারো সেই বোয়িং ০৭০-র ঘটনা। ওর অস্বস্তি টের পায় ম্যাগডা।

আমি আপনার পুরো ক্যারিয়ারের কথাই বলছি। জোহানেসবার্গ থেকে সাইপ্রাস এবং আয়ারল্যান্ড। এবারে একটু শিথিল হলো পিটার।

নার্সকোর প্রস্তাব আপনি ফিরিয়ে দিলেন কেন?

 প্রস্তাবের লোভনীয় দিকগুলো এমনভাবে ব্যাখ্যা করা হয়, ভাবটা যেন লুফে না নিয়ে উপায় থাকবে না আমার, বলল পিটার। আরো একটা কারণ আছে। মনে হচ্ছিল, বোয়িং ঘটনার মতো কিছু আমার থেকে আশা করে বলেই অমন একটা প্রস্তাব করা হয়েছিল আমাকে।

বোয়িং ঘটনার মতো—কি? একটু ঝুঁকে আসে ম্যাগডা। অদ্ভুত একটা সুগন্ধি পায় পিটার। চমৎকার স্বাস্থ্যের অধিকারিণী একজন নারী ওর সামনে। যেন সতেজ একটা লেবু। পিটার টের পায়, একটু একটু করে শারীরিক আকর্ষণ বোধ করছে সে। সম্ভবত, এমন কোনো দায়িত্ব যাতে জোরজারি করে পথ তৈরির ব্যাপার আছে। পিটার জবাব দেয়।

 কি মনে হয়, কি করতে বলা হবে আপনাকে?

এবারে কাঁধ ঝাঁকায় পিটার। জানি না। হতে পারে, ন্যাটোতে আমার কলিগদের কাছে ঘুষের প্রস্তাব, যাতে করে নামকোর প্রডাক্ট কিনতে রাজি হয়। তারা।

কেন এমন মনে হলো?

 একটা কমান্ডের প্রধান ছিলাম আমি।

 শীতের মাঠের দিকের তাকিয়ে থাকে ম্যাগডা।

আপনি কি জানেন, অল্টম্যান ইন্ডাস্ট্রির মাধ্যমে সেডলার স্টিল কোম্পানির একটা বড় শেয়ার আমি নিয়ন্ত্রণ করি এবং নার্মকোর, অবশ্যই?

না, পিটার স্বীকার করে। কিন্তু মোটেও অবাক হচ্ছি না।

 জানেন কি, নার্মকোর অফারটা ব্যক্তিগতভাবে আমি পাঠিয়েছিলাম?

 এবারে পিটার কোনো কথা বলল না।

একটা কথা ঠিক, ন্যাটো এবং ব্রিটিশ হাইকমান্ডে আপনার বন্ধু-বান্ধব আছে বলেই আপনাকে অবিশ্বাস্য রকম মোটা বেতন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। হঠাৎ ঠোঁট টিপে হাসল ব্যারনেস, সাথে সাথে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তার গোলাপি চেহারা। আমরা একটা ক্যাপিটালিস্টিক সোসাইটিতে বাস করছি, জেনারেল স্ট্রাইড। এমনকি বেতনভুক কর্মচারীকেও আমরা কমিশন আর ইনট্রডিউসার ফিস দিয়ে থাকি।

ওগুলোর জন্যে নয়, হাসিটা সংক্রামক বলে পিটারেরও হাসি পেল।

 তবে লকহীড কেলেঙ্কারির পর আমরা আর কাউকে টাকা বহন করতে দেই না, কমিশন দেয়ার সিস্টেমও তুলে দিয়েছি। কেউ আপনাকে সনাক্ত করতে পারত না।

এ সব এখন কথা, বলল পিটার। আমি প্রস্তাবগুলো ফিরিয়ে দিয়েছি।

 আমি তা মানি না, জেনারেল স্ট্রাইড, মাথা নিচু করে নিয়ে এমনভাবে চুপ করে থাকল ব্যারনেস, যেন কথাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে। হ্যাঁটের কার্নিসে ঢাকা পড়ে আছে মুখ। আবার যখন চোখ তুলল, সাথে সাথে হাতটাও উঠে এল পিটারের গায়ে। পিটারের কনুই ধরে স্মিত হাসল। আমার স্বামী ছিলেন অসাধারণ একজন মানুষ। তার মতো হিতাকাঙ্ক্ষী, শক্তিশালী আর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ আমি আর দেখিনি। সেজন্যেই ওকে তারা খুন করে–ফিসফিস করে কথা বলছে সে,–খুন করার আগে তারা ওর উপর অমানসিক নির্যাতন চালায়। থামল সে কিন্তু মুখ ঘোরাল না। কেঁদে ফেলেছে সেজন্য লজ্জিত নয়। চোখ দুটো ভরে উঠেছে পানিতে, তবু নিজের পাতার কিনারা উপচে পানি ঝরে পড়ল না, এমনকি পাতা দুটো একবার কাঁপল না পর্যন্ত। অন্য দিকে তাকাতে হলো পিটারকেই। এবার ওর কনুই ছেড়ে দিল ব্যারনেস, ওর পাজর আর কনুই এর মাঝখানে হাত গলিয়ে আরো কাছে সরে এল, কেন কে জানে শিউরে উঠল একবার, দুটো মুখ একেবারে কাছে চলে এসেছে। বৃষ্টি হবে এখনি বলল সে, শান্ত গলা। আমাদের বোধ হয় ফেরা উচিত।

ফেরার পথে মৃদুকণ্ঠে কথা বলে গেল ব্যারনেস। অল্টম্যান খুন হয়ে গেল, কিন্তু খুনিদের কোনো সাজা হলো না, নপুংষক সমাজ তাদের শাস্তি দেয়ার কোনো ব্যবস্থা করতে পারল না। অ্যাটলাসের ধারণাটা প্রথম থেকেই আমার ভাল লেগেছিল। কিন্তু থোর আমাকে হতাশ করল। একটু থেমে পিটারের হাতে মৃদু চাপ দিল সে। হ্যাঁ, জেনারেল স্ট্রাইড-থোরের কথা আমার জানা ছিল। কিভাবে জেনেছি জিজ্ঞেস করবেন না প্লিজ।

খোলা ঢালের মাথা থেকে নেমে আবার বনভূমিতে ঢুকল ওরা। শুনে যাচ্ছে পিটার, কিছুই বলছে না।

বুঝলাম শক্তি দিয়ে কেউ বাধা না দিলে কিছুদিনের মাঝে সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যবে টেরোরিস্টদের হাতে। রাতদিন চিন্তা করতে লাগলাম আইনের ভিতরে থেকে কিভাবে ওদের ধংস করা যায়। অল্টম্যান ইন্ডাস্ট্রির উত্তরাধিকারী হিসেবে আন্তর্জাতিক তথ্য সংগ্রহের বা সিস্টেমের মালিকও আমি…, ধীরে ধীরে ব্যাখ্যা করল ব্যারনেস, বিভিন্ন সীমান্তের ওপার থেকে কিভাবে সে সন্ত্রাসবাদী খবরাখবর দিতে শুরু করে প্রথমে খবর দিলাম ইন্টারপোলকে, কিন্তু ওরা বলল অপরাধ সংগঠিত হওয়ার আগে ওদের কিছুই করার নেই। এভাবে আত্মহত্যাকারী একটা প্রবণতা চলতে থাকে নিরাপত্তা সংস্থাগুলোতে। অপরাধীকে ধরার এবং শাস্তি দেবার ব্যাপারে তারা খুব একটা সচেতন নয়।

আমি অপেক্ষা করছি আসল কথাটা কখন আপনি বলবেন।

তারপর আমি প্রাইভেট ইনভেস্টিগেশন ফার্মগুলো সম্পর্কে খবর নিতে শুরু করি, বলল ব্যারনেস। কিন্তু জেনারেল স্ট্রাইড, আমরা বাড়ির কাছে এসে পড়েছি…

আসুন বলে পথ দেখিয়ে এগোল পিটার, আস্তাবল পাস কাটিয়ে চলে এল সুইমিং পুল প্যাভিলিয়নে। পুলের গরম পানি থেকে বাষ্প উঠছে। ওদের পাশের কাঁচ মোড়া ঘরে ফুলে ভরে আছে গাছ। একটা দোলনায় বসলো ওরা, পাশাপাশি, এত কাছাকাছি যে নিচু গলায় কথা বললেও শোনা যাবে। হ্যাট, স্কার্ফ আর জ্যাকেট খুলে পাশের একটা বেতের চেয়ারে ছুঁড়ে দিল ব্যারনেস। তারপর সকৌতুকে বলল, কেন যেন মনে হচ্ছে স্যার স্টিভেন আপনাকে ব্যাঙ্কের চাকরিতে নিতে পারলে বর্তে যান!

স্টিভেনের মতো টাকার পিছনে অতটা ছোটার ইচ্ছে আমার কখনো ছিল না।

এই সময় মেলিসা এবং স্যার স্টিভেনের ছোট ছেলে হাত ধরাধরি করে হেঁটে এলো ওখানটায়, হাসিতে ফেটে পড়ছে দুজন।

ওদের দুষ্টামি দেখে হাসে ব্যারনেস। আপনার মেয়ে দারুণ মিষ্টি! উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে আরেকটা প্রশ্ন করল সে। মাথার ওপর দিয়ে ঝকঝাক পাখি কিচিরমিচির করতে করতে উড়ে গেল। পিটারের মনে হলো শব্দটা ভুল শুনেছে।

কি বললেন? সাবধানে জিজ্ঞেস করল ও। নির্লিপ্ত চেহারা, কিছুই প্রকাশ পাচ্ছে না।

খলিফা। নামটার তাৎপর্য জানা আছে আপনার?

ভ্রু কোঁচকাল পিটার, স্মরণ করার ভান করছে। বোয়িংয়ের ভেতর যা যা ঘটেছে সব একপলকে ভেসে উঠল চোখের সামনে। বিস্ফোরণ, ধোয়া, শিখা, পিস্তলের আওয়াজ, লাল শার্ট পরা কালো চুলের মেয়েটা উন্মাদিনীর মতো ছুটে আসতে আসতে বলেছে, আমাদের মেরো না! খলিফা বলেছে আমাদের মরতে হবে না। খলিফা…

 খলিফা? জিজ্ঞেস করল পিটার, নিজেও জানে না কেন অস্বীকার করছে ও। শব্দটা মুসলমানদের একটা টাইটেল। আক্ষরিক অর্থ হল পয়গম্বরের উত্তরাধিকারী।

 হ্যাঁ, একটু অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল ব্যারনেস। সিভিল আর রিলিজিয়াস লিডারের টাইটেল–কিন্তু কোডনেম হিসেবে নামটা কখনো কোথাও ব্যবহার করতে শুনেছেন?

না, দুঃখিত। তাৎপর্যটা কি?

নামটা আমি কয়েক মাস আগে প্রথম শুনি, জীবনে ভোলার নয় এমন একটা পরিস্থিতিতে, কয়েক সেকেন্ড ইতস্তত করল ব্যারনেস। আমার স্বামী কিডন্যাপ হলেন, তারপর কিভাবে তাকে খুন করা হলো, সমস্ত ঘটনা জানেন আপনি? দরকার না হলে সব আবার নতুন করে মনে করতে চাই না।

আমি জানি।

 জানেন, মুক্তিপণের টাকা আমি নিজে গিয়ে দিয়ে আসি?

হ্যাঁ।

রঁদেভো ছিল ঈস্ট জার্মান বর্ডারের কাছে পরিত্যক্ত এয়ারফিল্ড। হালকা দুই ইঞ্জিনের একটা রাশিয়ান প্লেন নিয়ে অপেক্ষা করছিল ওরা, রঙ প্রে করে মার্কিংগুলো মুছে ফেলা ছিল। বুক ভরে বাতাস নিলেন ব্যারনেস। পিটারের মনে পড়ল, বোয়িং সেভেন-জিরো-সেভেন হাইজ্যাক করার প্ল্যানেও কোনো খুঁত ছিল না এবং হাইজ্যাকাররা স্পেশাল টাইপের ইকুপমেন্ট ব্যবহার করেছে। অল্টম্যানকে যারা কিডন্যাপ করেছিল তাদের সাথে হাইজ্যাকারদের অনেক মিল আছে, চারজন ছিল ওরা, আবার শুরু করল ব্যারনেস। সবাই মুখোশ পরা ছিল। রুশ ভাষায় কথা বলছিল দুজন। বাকি দুজন কোনো কথাই বলেনি। পিটারের মনে পড়ল, রুশ ছাড়াও আরো পাঁচটা ভাষায় ভালো দখল আছে ব্যারনেসের। তার জন্ম পোল্যান্ডে, খুব ছোট থাকতে বাবা তাকে নিয়ে পালিয়ে আসেন। বেশ কিছুসময় ওদের সাথে ছিলাম আমি। রাশিয়ার প্লেন, ভাষা, এ সব নিজেদের আসল পরিচয় গোপন করার জন্যে ব্যবহার করছিল ওরা। অল্প কিছুক্ষণ ছিলাম ওদের সাথে, পঁয়তাল্লিশ মিলিয়ন সুইস ফ্রাঙ্ক নিয়ে গিয়েছিলাম। কয়েক মিনিট পর ওরা যখন বুঝতে পারল আমার সাথে বা পিছনে পুলিশ নেই, ওরা হাসাহাসি আর ঠাট্টা-তামাশা করতে লাগল। রুশ ভাষায় কথা বললেও ইংরেজি টোনে খলিফা শব্দটা শুনলাম ওদের মুখে। বাক্যটা মনে আছে আমার খলিফা কখনো ভুল করেন না।

 পুলিশকে জানিয়েছিলেন?

কেন জানাইনি বলতে পারব না। তখন ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়নি। মনের অবস্থাও ভালো ছিল না যে খতিয়ে সব কিছু দেখব। তাছাড়া প্রথম থেকেই আমার জেদ ছিল ওদের আমি নিজের চেষ্টায় খুঁজে বের করব।

ওই একবারই নামটা শোনেন?

অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল ব্যারনেস, যেন পিটারের প্রশ্ন শুনতেই পায়নি। আমেরিকানরা কিউবার সাথে আপোষ করে কিছুটা সামাল দিয়েছে। আপনাদের দেশেও আইআরএ-এর বিরুদ্ধে ভালো সাফল্য অর্জিত হয়েছে। জার্মানিতেও একই কথা। নিজেদের মধ্যেকার লড়াই নিয়ে লেবাননে আরবরা ব্যস্ত। সারা দুনিয়া জুড়ে টেরোরিজম একটা লাভজনক ব্যবসা হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রমাণিত হিসেব-সফল হবার সম্ভবনা শতকরা সত্তর ভাগ! পুঁজি খুব কম লাগে। নগদ প্রাপ্তির সাথে উপরি পাওনা পাবলিসিটি। প্রভাব বা ত্রাস সষ্টি হয়, অসামান্য রাজনৈতিক ক্ষমতা হাতে চলে আসে। এমনকি ব্যর্থ হলেও শতকরা পঞ্চাশ ভাগ সম্ভাবনা থাকে প্রাণে বাঁচার। হাসল সে, কিন্তু এখন আর মাধুরী বা উষ্ণতা নেই হাসিতে। একজন ব্যবসায়ী হিসেবে বলতে পারি, এর চেয়ে ভালো ব্যবসা আর হতে পারে না।

কিন্তু ব্যবসাটা অ্যামেচাররা করছে, বলল পিটার।  কিংবা এভাবে বলা যায়, প্রফেশলনাল যারা জড়িত তাদের উদ্দেশ্য সীমিত, সমাজের অব্যবস্থা আর অন্যায় অবিচার সহ্য করতে না পেরে ঘৃণায় আর আক্রোশে অন্ধ হয়ে এ পথে নেমেছে। এদের দ্বারা মহৎ কোনো উদ্দেশ্য পূরণ হবে না।

দুঃখিত, আমি শুধু একা একা বকবক করে যাচ্ছি। আসলে কি জানেন, আপনাকে আমার পুরানো বন্ধুর মতো লাগছে। ভালো কথা, আমি ম্যাগডা।

ধন্যবাদ, ম্যাগডা।

হ্যাঁ, আপনার কথা ঠিক, আগের সূত্র ধরে আবার শুরু করল ব্যারনেস ম্যাগডা। এতদিন অ্যামেচারই জড়িত ছিল। কিন্তু কথাটি এখন আর সত্যি নয়।

আপনি বলতে চাইছেন মাঠে খলিফা নেমেছে।

ফিসফিস গুঞ্জন যা শুনেছি আর কি। কোনো নাম নয়, শুধু ওই একটা রহস্যময় শব্দ। এথেন্সে হয়তো একটি মিটিং হয়ে গেছে, কিংবা আমস্টারডাম, ইস্ট বালিনে, বা এডেনে। খলিফা কে জানি না, নামটা একজনের নাকি কয়েকজনের তাও বলতে পারব না। তবে সত্যি যদি তার অস্তিত্ব থাকে, নিশ্চয়ই সে ধনকুবেরদের একজন হবে। এবং খুব তাড়াতাড়ি প্রচণ্ড ক্ষমতা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করবে।

একজন বা একদল মানুষ? কোনো সংগঠন নয়?

হতে পারে, জানি না। হয়তো কোনো সরকার। রাশিয়া, কিউবা, লিবিয়া কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের অন্য কোনো দেশ।

কিন্তু উদ্দেশ্য?

টাকা। রাজনৈতিক মতলব হাসিলের জন্য ফান্ড। তারপর, ক্ষমতা অসহায় ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল ব্যারনেস ম্যাগডা। এও স্রেফ কল্পনা। তবে টাকা ওরা যথেষ্ট কামিয়েছে–ওপেক আর আমার কাছ থেকে তো বটেই, আন্যান্য আরো অনেকের কাছ থেকে। এবারে চাই রাজনৈতিক ক্ষমতা। প্রথমে নরম একটা টার্গেট। আফ্রিকার একটা ব্যর্থ সরকার–এক ডজন প্রাণের বিনিময়ে খনিজ পদার্থে ভরা একটা দেশ। এমনকি মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হলেও তারা যে সান্ত্বনা পুরস্কার পেত, তাও কম নয়–প্রচুর সোনা। ওটাই ব্যবসা, পিটার। সফল হওয়ারই কথা ছিল। এবং হয়েছেও। পশ্চিমা দেশগুলো ভিকটিমদের চাপ দিয়েছে, চাপ দিয়ে হাইজ্যাকারদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য করেছে। সবকিছু চলছিল ঠিক মতো-গোল বাঁধাল একজন মাত্র মানুষ।

ভয় পেলাম, মৃদু স্বরে বলল পিটার। জীবনে প্রথমবারের মতো চরম ভীত আমি।

 আমিও তাই, পিটার, ব্যারনেস বলে। অ্যারনকে অপহরণ করে যেদিন ওরা। ফোন করল, সেদিন থেকে। আরো বেশি করে ভয় পাই আজকাল।

এরপর কি ঘটল?

জানি না। যে নামটা ওরা ব্যবহার করল, তার মধ্যে কেমন একটা ধর্মীয় উন্মাদনা ছিল। এমন একজন মানুষ রয়েছে এর পিছনে খোদার মতো ক্ষমতার ব্যারনেসের হাতের ডায়মন্ড ঝিকিয়ে উঠল। এমন একজন মানুষের মনের গভীরতা আচ করা সম্ভব নয়। সে হয়তো ভাবছে, মানবতার উন্নতির জন্যে এসব করছে সে। হয়তো ভাবছে, ধনীদের আক্রমণ করে, আতঙ্কবাদ দ্বারা শোষিতের মুক্তি আনবে। সম্ভবত অন্যায় দিয়ে সমস্ত ভুল সঠিক করতে চাইছে খলিফা।

আবারো, পিটারের হাত ধরল ম্যাগডা, তার হাতের শক্তিতে চমকে একটু চমকাল পিটার। তাকে খুঁজে বের করতে আমাকে সাহায্য কর, পিটার। সমস্ত কিছু দিয়ে আমি এর শেষ চাই, কোনো পরোয়া করি না। সমস্ত যোগাযোগ, অর্থ আমি ঢালব এই যুদ্ধে।

এজন্যে যে, আহত মেয়েটাকে আমি মেরেছি বলে বিশ্বাস কর তুমি? পিটার জানতে চায়। এটাই কি আমার যোগ্যতা? একটু শিউরে উঠে সরে যায় ম্যাগডা। তেরছা মঙ্গোলীয় চোখে তাকায় ওর দিকে। ঠিক আছে, স্বীকার করি, এটাও একটা কারণ। কিন্তু পুরোটা নয়। তুমি তো জানেনা, তোমার লেখা আমি পড়েছি। তোমাকে আমি ভালোভাবে স্টাডি করেছি। এই কাজের জন্যে তুমি সেরা। শেষপর্যন্ত তুমি নিজে তা প্রমাণ করেছ। আমি জানি, খলিফাকে খুঁজে বের করার জন্যে যতটুকু সামর্থ আর যোগ্যতা দরকার–তা তোমার আছে। সে আমাদেরকে, এই দুনিয়াকে ধ্বংস করে দেওয়ার আগে তাকে ধ্বংস কর।

নিচু হয়ে তাকিয়ে ছিল পিটার। ওর ধারণা ছিল, শয়তানটার বহু মাথা, একটা কাটলে আরো একটা গজাবে। কিন্তু এখন সে জানে, জন্তুটার আকার কেমন। এখনো সে আড়ালে আছে, কিন্তু মাথা তার একটা–এটা নিশ্চিত। হতে পারে, সে হয়তো মরণশীল।

সাহায্য করবে আমাকে, পিটার? ম্যাগডার কণ্ঠে অনুনয়।

তুমি জানো, করব। শান্ত স্বরে বলে পিটার। এছাড়া আমার আর কোনো পথ খোলা নেই।

.

অ্যাবোটস্ ইউতে সেই সাক্ষাতের পরবর্তী ছয় সপ্তাহে আর মাত্র তিনবার ম্যাগডার দেখা পেল পিটার। খুবই সংক্ষিপ্ত–পিটারের জন্যে খুব অতৃপ্ত–তিনটি সাক্ষাত।

খলিফাকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে এখনো কোনো অগ্রগতি হয় নি। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পিটার। তৃতীয় সাক্ষাতের সময়ে ম্যাগডার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ব্যবস্থায় পরিবর্তনের কথা বলেছে সে।

প্রথমে নিরাপত্তার ব্যবস্থা বদল করতে রাজি হয়নি ম্যাগডা, শেষপর্যন্ত পিটারের যুক্তির কাছে হার মানতে হয় তাকে। তারপর পিটার চাপ দেয়, তাকে তার নিয়মিত আচরণের প্যাটার্ন বদলাতে হবে।

কিন্তু সমস্যা কি জানো, বলল ম্যাগডা, হাসছে বটে, কিন্তু হাসির নিচে লুকিয়ে রয়েছে বিষণ্ণ একটা ভাব। আমার স্বামী আমাকে একটা ট্রাস্টের দায়িত্ব দিয়ে গেছে। দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হবে। আমি ভাবছি, একদিন সব তোমাকে আমি ব্যাখ্যা করে শোনাব।

মৃদু তুষার পড়ছে। তুষার মেঘ, আর পাথুরে পাহাড়ের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেছে সূর্য। গ্রামের ভেতর দিয়ে ফিরে আসছে ওরা। সুইটজারল্যান্ডের প্রত্যন্ত অঞ্চল এখানকার গ্রামও সার সার ডিপার্টমেন্টাল স্টোর উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করছে। ইউরোপে সম্পদের অভাব নেই, আর শীতপ্রধান আবহাওয়া বলে পরিশ্রমও করতে পারে এরা, ফলে সম্পদ বৃদ্ধি ঠেকানো মুশকিল হয়ে পড়েছে।

গরম পানিতে শাওয়ার সেরে স্ন্যাকস, ব্লেজার আর সিল্ক রোলনেক পরল পিটার, এখনো নিচের তলায় অফিস কামরা থেকে টেলেক্স মেশিনের আওয়াজ পাচ্ছে ও। আরো এক ঘণ্টা পর হাউজ ফোনে ওকে ডাকল ব্যারনেস।

 গোটা একটা ফ্লোর একা ব্যবহার করে সে। জানালার বাইরে বেশ গাঢ় হয়ে নেমেছে অন্ধকার, তবে তুষারের সাদায় গোটা উপত্যকা অবছায়া আলোকিত। স্কি বুটের ভেতর গোঁজা সবুজ স্ন্যাকস পরেছে সে। একই রঙের ব্লাউজ, চোখের সাথে ম্যাচ করা। পিছনে পিটারের পায়ের আওয়াজ পেয়েই পর্দার আড়ালে হাত ঢুকিয়ে একটা বোতাম চাপ দিল সে, কোনো শব্দ না করে জানালায় পর্দা পড়ল তারপর পিটারের দিকে ঘুরে দাঁড়াল সে।

ড্রিঙ্ক, পিটার?

আগে কাজের কথা শেষ হোক।

 হোক।

হাত তুলে ফায়ারপ্লেসের কাছাকাছি চৌকো, নরম লেদার আর্মচেয়ার দেখাল ব্যারনেস ম্যাগডা, তারপর হঠাৎ হাসল সে। নার্মকোর সেলস ডিরেক্টর হিসেবে এমন একটা জাদুকরকে পেয়ে যাব ভাবতেও পারিনি। এই অল্প কদিন তুমি যা করেছ আমি অবাক হয়ে গেছি।

তুমি জানো, পুরো ব্যাপারটা একটা কাভার, প্রশংসাটা উড়িয়ে দিল পিটার। কাভারটা জেনুইন প্রমাণ করতে হবে না। তাছাড়া আমি এখনো নিজেকে একজন সৈনিক বলে মনে করি। কাজটা ইন্টারেস্টিং লাগছে।

 ইংরেজরা কি সবাই তোমার মতো বিনয়ী! কৃত্রিম অসহায় একটা ভঙ্গি করে হাসল ব্যারনেস ম্যাগডা। পিটারের সামনে হাঁটাহাঁটি করছে, ঠিক অস্থির নয় তবে কি এক পুলক যেন তাকে চঞ্চল করে তুলেছে। আমাকে জানানো হয়েছে ন্যাটো নাকি কেসট্রেল টেস্ট করতে যাচ্ছে, একটানা প্রায় দুবছর টালবাহানা করার পর।

 কেসট্রেল হলো নার্মকোর তৈরি মাটি থেকে মাটিতে নিক্ষেপযোগ্য পোর্টেবল মিসাইল।

আরো খবর পেলাম পুরানো কজন কলিগের সাথে তুমি কথা বলার পর সিদ্ধান্তটা নিয়েছ ওর।

দুনিয়াটা তো চলছে বন্ধুত্বের খাতিরে, মৃদু হাসল পিটার।

ইরানেও তাহলে তোমার বন্ধু আছে? মাথা একটু কাত করে উত্তরের অপেক্ষায় পিটারের দিকে তাকিয়ে থাকল ব্যারনেস ম্যাগডা।

শুধু বন্ধুত্ব নয়, ভাগ্যও সহায়তা করছে, বলল পিটার। নতুন সামরিক উপদেষ্টার সাথে এক সময় একই ট্রেনিং কোর্স-এ ছিলাম।

.

পরের সপ্তাহে ব্যারনেসের লিয়ার জেট বিমান নিয়ে প্যারিসের ওরলি বিমানবন্দরে এল ওরা দুজন। ব্যারনেসের লাল ডিপ্লোমেটিক পাসপোর্ট দেখে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেয়া হলো।

পিটারের কানের কাছে ঠোঁট রেখে ব্যারনেস ম্যাগডা ফিসফিস করে বলল, আমার মতো তোমারও একটা লাল বই দরকার। তারপর, অফিসারদের বলল, কেউ বলতে পারবে না সকালটা আজ ঠাণ্ডা নয়, কাজেই আপনাদের হাতে গ্লাস থাকা দরকার।

আগেই অবশ্য সাদা জ্যাকেট পরা স্টুয়ার্ড ড্রিঙ্ক পরিবেশনের আয়োজন শুরু করেছে। আরাম করে বসার জন্যে হ্যাট আর পিস্তল বেল্ট খুলে ফেলল অফিসাররা, আয়েশ করে হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে।

ওদের ওখানে রেখেই প্লেন থেকে নেমে পড়ল ব্যারনেস, পিটারকে নিয়ে। হ্যাঙ্গারের পিছনে ড্রাইভার আর গার্ডসহ তিনটে গাড়ি অপেক্ষা করছিল। তিনটের মধ্যে একটা মাসেরাতি, দেখেই পিটারের ঠোঁটের কোণ বাঁকা হয়ে গেল।

ওটা চালাতে তোমাকে আমি নিষেধ করেছি, গম্ভীর সুরে বলল ও। নিজের বিপদ ডেকে আনতে চাও নাকি?

 নিরাপত্তা ব্যবস্থা নতুন করে সাজানোর সময় গাড়িটা নিয়ে তর্ক করেছে ওরা। মাসেরাতির রঙ ইলেকট্রিক সিলভার গ্রে, ব্যারনেসের প্রিয় রঙগুলোর একটা। ঝকঝকে গাড়িটা, সবাই জানে ব্যারনেস অল্টম্যান ওটায় চড়তে ভালোবাসে। সকৌতুক একটা আওয়াজ করে পিটারের কাছে সরে এল ব্যারনেস ম্যাগডা, কি ভালোই না লাগছে, কোনো পুরুষ আবার কর্তৃত্ব ফলাচ্ছে আমার ওপর। অনেক দিন পর আবার অনুভব করতে পারছি, আমি আসলে মেয়ে।

সেটা অনুভব করাবার আরো অনেক উপায় জানা আছে আমার।

 জানি, বলে চকিতে একবার পিটারের সর্বাঙ্গে দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে হাসল। ব্যারনেস, চোখে ঝিক করে উঠল দুষ্টামি। এবং ভারি পছন্দও করি। কিন্তু এখন নয়, প্লিজ। আমার স্টাফরা কি ভাববে। পরমুহূর্তে সিরিয়াস হয়ে উঠল সে। মাসেরাতিতে তুমি ওঠো, তোমার জন্যেই আনিয়েছি। কেউ একজন উপভোগ করুক ওটা। আর শোন, আজ সন্ধ্যায় আবার দেরি করে ফেল না। অনেক বুদ্ধি খরচ করে সময় বের করেছি। লা পিয়েরে বেনিতে তোমাকে আমি আটটার সময় চাই।

মূল শহর প্যারিসে ঢোকার মুখে ট্রাফিক জ্যামের কারণে মাসেরাতির গতি কমাতে হলো পিটারকে, ইতোমধ্যে গাড়িটার আসুরিক শক্তি সম্পর্কে ধারণা পেয়ে গেছে ও। ম্যাগডা ঠিকই বলেছে, উপভোগ করার মতোই একটা ব্যাপার বটে। সামনে হাজার হাজার গাড়ি, সামান্য একটু ফাঁক-ফোকর পেলেই সেখানে বুলেটের মতো মাসেরাতিকে নিয়ে ঢুকছে পিটার, দুপাশের দ্রুতগতি গাড়িগুলোকে ওভারটেক করার অদ্ভুত এক পাগলামি পেয়ে বসেছে ওকে। ম্যাগডা কেন যে এটাকে এত ভালোবাসে, বোঝা গেল। মাসেরাতি যেন কোনো মেশিন নয়, জ্যান্ত একটা ব্যাপার-ড্রাইভারের মনে পুলক জাগাবার জন্যে প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে অপেক্ষ করছে।

এলিসি প্রাসাদের কাছাকাছি একটা আন্ডারগ্রাউন্ড গ্যারেজে ঢুকে গাড়ি থামাল পিটার, রিয়ার ভিউ মিররে তাকিয়ে সহাস্যে বলল, ব্লাডি কাউবয় রোলেক্সের দিকে তাকাল, অ্যাপয়েন্টমেন্টর চেয়ে এক ঘণ্টা আগে পৌঁছে গেছে। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ায় কোবরা পিস্তলসহ শোল্ডার হোলস্টার খুলল ও। মাসেরাতির গ্লাভ কম্পার্টমেন্ট রেখে তালা লাগিয়ে দিল। নিঃশব্দে আবার হাসল—সশস্ত্র অবস্থায় ফ্রেঞ্চ ন্যাভাল হেডকোয়ার্টারে ঢুকতে চেষ্টা করলে একটা সিন ক্রিয়েট করা হবে। তুষারপাত বন্ধ হয়েছে, এলিসি প্রাসাদের ফুল বাগানে কুঁড়িগুলো পাপড়ি মেলছে। কনকর্ড মেট্রো স্টেশনে ঢুকে পাবলিক বুথ থেকে ব্রিটিশ দূতাবাসে ফোন করল পিটার। দুমিনিট কথা বলল মিলিটারি অ্যাটাশের সাথে, রিসিভার রেখে দিয়ে ভাবল, বল ছোঁড়া হয়ে গেছে, এবার অ্যাকশন শুরু হতে যতক্ষণ লাগে। খলিফা যদি অ্যাটলাসের ভেতর ঢুকে থোর কমান্ড সম্পর্কে জানার ক্ষমতা রাখে তাহলে থোর কমান্ডের প্রাক্তন কমান্ডার যে তার পিছনে লেগেছে এ খবরও পেয়ে যাবে খুব তাড়াতাড়ি। প্যারিসের ব্রিটিশ মিলিটারি অ্যাটাশে শুধু পার্টি দেয় আর ভদ্রমহিলাদের হাতে চুমো খায় না; তার আরো গোপন দায়িত্ব আছে।

হাতে ক মিনিট সময় নিয়ে রু রয়্যালের কোণে, মেরিন হেডকোয়ার্টারের প্রধান ফটকে উপস্থিত হলো পিটার। তবে আগে থেকেই ওখানে একজন সেক্রেটারি অপেক্ষা করছিল ওর জন্য। ভেতরে ঢোকার পথটুক নিষ্কণ্টক করে তুলল সে, সেন্ট্রিদের পাশ কাটিয়ে হনহন করে এগোল ওরা। চারতলার আমামেন্ট কমিটি রুমে উঠে এল পিটার। নার্মকো থেকে আগেই পৌঁছেছে পিটারের দুজন সহকারী। এরই মধ্যে ব্রীফকেস খুলে টেবিলের ওপর কাগজপত্র সাজিয়ে বসেছে তারা। গত সপ্তাহয় ফ্রেঞ্চ নেভী নার্মকোর কেসট্রেল রকেট মটর পেতে কতটুকু আগ্রহী।

দুপুরের পর একজন অ্যাডমিরাল তার ব্যক্তিগত অফিসে আমন্ত্রণ জানালেন পিটারকে। সেখানে দুঘণ্টা কাটাল ওরা, লাঞ্চ সারল, তারপর সদলবলে চলে এল মিনিস্ট্রি অভ মেরিনের অফিসে। ছটার দিকে মেজাজ বিগড়ে গেল পিটারের। প্রতিপক্ষের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে বিদায় নিল ও। ঠিক হলো দিন কয়েক পর আবার আলোচনা করা যাবে। এই সময়, একেবারে শেষ মুহূর্তে অ্যাডমিরালরা জানালেন, নার্মকোর কেসট্রেল রকেট মটর পাবার জন্যে অধীর হয়ে আছেন তারা। বিস্ময়ের বিষম একটা ধাক্কা খেল পিটার। কি আশ্চর্য, সারাটা দিন ধরে পিটারকে তারা বোঝাবার চেষ্টা করেছেন ওগুলো তাদের না হলেও চলে।

খুশির কথা, বলে চলে এল পিটার। এবং রাস্তায় বেরিয়ে এসেই ভুলে গেল সব, মন জুড়ে ফিরে এল ব্যারনেস ম্যাগডা। ওর জন্যে অপেক্ষা করছে সে।

মাসেরাতি নিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড গ্যারেজ থেকে বেরুবার মুখে সামনে গাড়ি থাকায় একবার থামতে হলো পিটারকে। রিয়ার ভিউ মিররে তাকাল ও অনেক দিনের পুরানো অভ্যেস। মাসেরাতির পিছনে অনেকগুলো গাড়ি সবগুলো বেরুবার জন্যে লাইন দিয়েছে। কিন্তু মনে দাগ ফেলল শুধু স্ট্রিনটা। মাসেরাতির পিছনে তিন নম্বর গাড়ি ওটা, চোখে পড়ার কারণ ওটার উইন্ডশিল্ডের কাঁচ চিড় ধরা। আরো ভাল করে তাকাতে পিটার দেখল, ট্রিনের মাডগার্ড বেড়ানো, কিছুর সাথে ধাক্কা খেয়ে রঙ চটে গেছে।

এলিসি প্রাসাদ ছাড়িয়ে এসে বাঁক নেয়ার সময়ও কালো ট্রিনটাকে পিছনে দেখল পিটার। মাথা নিচু করে ড্রাইভারকে দেখার চেষ্টা করল ও, কিন্তু সাথে সাথে ট্রিনের হেড লাইট জ্বলে উঠল। পরবর্তী কয়েক মাইল একই রাস্তায় থাকল গাড়ি দুটো। তবে দুটোর মাঝখানে অন্যান্য আরো কয়েকটা গাড়ি রয়েছে। এভিনিউতে লা গ্র্যান্ড আরমিতে ঢুকে বারবার পিছনে তাকিয়ে ট্রিনটাকে খুঁজল পিটার। দেখতে না পেয়ে ভাবল, আশপাশের কোনো গলিতে ঢুকে পড়েছে। ট্রিন পিছনে থাকায় যেন একটা কাজে ব্যস্ত ছিল পিটার, এখন নিজেকে বেকার মনে হতে লাগল। স্বস্তি বোধ করার কথা কিন্তু ঘটছে উল্টোটা, খুঁতখুঁত করছে মন। একটু পর অবশ্য ঠিক হয়ে গেল সব, আবার মন ঘুরেফিরে এল ব্যারনেস ম্যাগডা। মাসেরাতির গতি বেড়ে গেল, গাড়ি এবং ড্রাইভার দুজনেই রোমাঞ্চপ্রিয় হয়ে উঠল যেন। যানবাহনের প্রচুর ভিড় রাস্তায় পিছনে সিট্রন থাকলেও এখন আর সেটাকে দেখতে পাবার কথা নয় পিটারের।

ভার্সেই ছড়িয়ে রবুইলে রোডের উপর বেশ অনেকক্ষণ পর এই প্রথম পিছনটা অনেক দূর পর্যন্ত পরিষ্কার দেখতে পেল পিটার। রাস্তার দুপাশে গাছের সারি, মাঝখানে অন্য কোনো গাড়ি নেই। খুঁতখুঁতে ভাবটা আর থাকল না। শেষ বাঁকটা আর বেশি দূরে নয়, তারপরই লা পিয়েরি বেনিতে পৌঁছে যাবে প্রেমিক প্রবর।

ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হলো। বাঁক নেয়ার সাথে সাথে পিটারের সামনে ভিজে কুণ্ডলী ছড়ালো কালো অজগরের মতো রাস্তাটা, বহুদূরে এক জায়গায় ফুলে ফেটে উঁচু হয়ে আছে। তীরবেগে গাড়ি ছোটবার আনন্দে বিভোর হয়ে আছে ও। ঢালের মাথায় উঠে এর ঘণ্টায় দেড়শ কিলোমিটার স্পীড, ক্লাচ, ব্রেক আর হুইল নিয়ে মহানন্দে রয়েছে ও। ওর সামনে চকচকে সাদা ক্যাপ মাথায় একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে, বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ভিজছে লোকটা, হাতের লাল আলোসহ ল্যাম্পটা ঘন ঘন মুখের সামনে তুলে দোলাচ্ছে। রাস্তার পাশে খাদে পড়ে আছে একটা পুজোট গাড়ি, হেডলাইটের আলো আকাশের দিকে তাক করা। গাঢ় নীল পুলিশের ভ্যানটা রাস্তা প্রায় বন্ধ করে রেখেছে, ভ্যানের আলোয় আলোকিত হয়ে রয়েছে রাস্তার ওপর হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে থাকা স্থির দেহ। অত্যন্ত স্বাভাবিক অক্সিডেন্ট পরবর্তী দৃশ্য, পরিবেশে নাটকীয়তা এনে দিয়েছে ঝিরঝির বৃষ্টি।

সময় মতোই মাসেরাতির স্পীড কমাল পিটার, গুটি গুটি এগোচ্ছে গাড়ি। ইলেকট্রিক মটরের মৃদু গুঞ্জনের সাথে যোগ হলো বৃষ্টির কোমল শব্দ, পাশের জানালার কাঁচ নামিয়ে দিল পিটার। ঠাণ্ডা বাতাস ঝাপটা মারল চোখেমুখে। ইউনিফর্ম পরা পুলিশ ল্যাম্প নেড়ে একটা বিশেষ জায়গায় দিকে ইঙ্গিত করল পিটারকে, ঝোঁপ আর কোম্বি ভ্যানের মাঝখানে মাসেরাতিকে থামাতে বলছে।

অদ্ভুত একটা নড়াচড়া লক্ষ্য করল পিটার। হেডলাইটের আলোয় শুয়ে থাকা একটা দেহ। সামান্য একটু নড়ে আবার স্থির হয়ে গেছে। শুধু পিঠটা একটু ফুলে। মতে উঠেছিল, শোয়া অবস্থা থেকে কেউ উঠতে চাইলে প্রথমে তো পিঠটাই উঁচু হয়।

লোকটাকে হাত তুলতে দেখল পিটার, মাত্র কয়েক ইঞ্চি। উরুর পিছনে কি যেন লুকিয়ে রেখেছে লোকটা। তারপরই জিনিসটা চিনতে পারল পিটার। ভাজ করা মেশিন পিস্তল। ফুটোওয়ালা ছোট ব্যারেল।

সেই মুহূর্তে এত দ্রুত কাজ শুরু করল মাথা, পিটারের মনে হলো যা কিছু ঘটছে সবই স্বপ্নের মধ্যে বড় বেশি ধীরগতিতে ঘটছে। মাসেরাতি, ভাবল ও। ম্যাগডার জন্যে ফাঁদ পেতেছে ওরা।

মাসেরাতি যেখানে থামবে আন্দাজ করে নিয়ে একপাশে সরে দাঁড়াল পুলিশ, যাতে ড্রাইভারের পাশে থাকতে পারে সে। তার ডান হাত সাদা রেনকোটের ভেতর, পিস্তল বেল্টের কাছাকাছি।

গ্যাস পেডাল গাড়ির মেঝের সাথে চেপে ধরল পিটার, বুকে গুলি খাওয়া গণ্ডারের মতো গর্জে উঠে সাথে সাথে লাফ দিল মাসেরাতি। সামনের চাকা ভিজে রাস্তা ছেড়ে উঠে পড়ল, মৃদু স্পর্শ করে হইল একটু ঘোরাল পিটার। পুলিশ লোকটা ভারি সতর্ক, বিপদ দেখতে পাবার আগেই কিভাবে যেন টের পেয়ে গেছে, লাফ দিয়ে জায়গা বদল করল সে। ঝোঁপের দিকে ডাইভ দিল, হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করছে। মাসেরাতির একটা পাশ ঝোঁপ স্পর্শ করল, ঝড় ওঠার শব্দের সাথে ভেঙে পড়ল শুকনো ডালপালা। ডান পা তুলে মাসেরাতির বিদ্যুৎগতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করল পিটার, গাড়ির নাক আরেক দিকে ঘুরিয়ে নিতে হবে। মাসেরাতি সিধে হতেই আবার গ্যাস পেড়ালে চাপ দিল ও নতুন শক্তি পেয়ে আবার গর্জে উঠল ইঞ্জিন, এবার পিছনের চাকা থেকে নীল ধোয়া বেরিয়ে এল।

পুলিশ কোম্বিতে একজন ড্রাইভার রয়েছে, ভ্যানটা আগে বাড়িতে দিয়ে রাস্তাটা পুরোপুরি বন্ধ করার চেষ্টা করল সে। রাস্তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এই সময় অবশিষ্ট ফাঁকের মধ্যে চলে এল মাসেরাতি। দুটো গাড়ি স্পর্শ করল পরস্পরকে, ধাতব কর্কশ সংঘর্ষে পিটারের মাথার ভেতরটা এক সেকেন্ডের জন্যে ভোতা হয়ে গেল, দুসারি দাঁত ঠকাঠক বাড়ি খেল। দেহ দুটো এখন আর রাস্তায় পড়ে নেই। কাছের লোকটা এক হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে বেটপ মেশিন পিস্তলটা কাঁধের কাছে তুলছে-দেখে মনে হলো অস্ত্রটা স্টার্লিং বা সাইডওয়াইন্ডার হতে পারে। ভাজ করা ওয়ায়্যার বাঁট ব্যবহার করছে, কাঁধের কাছে তুলে ফায়ার করার জন্য একপলক বেশি সময় লাগছে তার, দ্বিতীয় লোকটার সামনে একটা বাধাও হয়ে সে। পিছনে তার সঙ্গীর হাতেও একটা মেশিন পিস্তল, প্রফেশনালদের মতো কোমরের কাছ থেকে গুলি করার জন্যে শিরদাঁড়া ধনুকের মতো বাঁকা করে সুযোগের অপেক্ষায় আছে।

কোম্বি ভ্যানের নাক বিধ্বস্ত করে দিয়ে কামানের গোলার মতো বেরিয়ে এল মাসেরাতি। গ্যাস পেডাল থেকে ডান পা তুলে পিছনের চাকার বিদ্যুৎগতি কমিয়ে আনল পিটার, একই সাথে বনবন করে ডান দিকে ঘুরিয়ে স্টিয়ারিং হুইল লক করে দিল। কংক্রিটের সাথে তীব্র শব্দে পিষে গেল রাবার, মাসেরাতি তার লেজের ঝাপটা দিল বাঁ দিকে, পিছলে রাস্তার লোক দুজনের দিকে ছুটল। দরজার নিচে মাথা নামিয়ে নিল পিটার। গাড়িটাকে বাঁ দিকে ইচ্ছে করে পিছলে যেতে দিয়েছে। যাতে অন্তত সামান্য হলেও ইঞ্জিন কমপার্টমেন্ট আর ধাতব কাঠামোর আড়াল পাওয়া যায়। নিচু হবার সময় পরিচিত আওয়াজটা কানে এল, এক দৈত্য যেন পুরু ক্যানভাস টেনে ছিঁড়ছে—অটোমেটিক আগ্নেয়াস্ত্রের উকিারণ, প্রতিটি মিনিটে প্রায় দু হাজার বুলেট। ইস্পাত ছিঁড়ে মাসেরাতির গায়ে ঢুকতে লাগল বুলেটগুলো কর্কশ আওয়াজে ভোতা আর অসাড় হয়ে গেল কান। কাঁচের গুড়ো ঝরঝর করে ঝরে পড়ল পিটারের গায়ে। কাঁচের টুকরো পিটারের পিঠে খোলা ঘাড়ে আর মুখে আটকে থাকল। গড়িয়ে বা খসে পড়ল না। মাথা ভর্তি কালো চুলে হীরের মতো আলো ছড়াচ্ছে।

ম্যাগাজিন শেষ হতেই গুলির আওয়াজ থেমে গেল। সীটে উঁচু হলে, পিটার পাপড়িতে কাঁচের কণা নিয়ে চোখ পিটপিট করে সামনে তাকাল। গাছ আর ঝোঁপ কালো মেঘের মতো ঝুলে রয়েছে মাথার ওপর, শিউরে উঠে মাসেরাতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করল ও। উল্টে যেতে শুরু করল গাড়ি কিন্তু সেদিকে খেয়াল না দিয়ে পিটার দেখল আততায়ীরা দ্রুত গড়াতে গড়াতে অগভীর খাদে নেমে যাচ্ছে।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে খাদের ঠোঁট পেরোল মাসেরাতির পিছনের একটা চাকা।

সামনের দিকে ছিটকে পড়ল পিটার, সীট বেল্টের চাপে হুস করে খালি হয়ে গেল ফুসফুস। আতঙ্কিত ঘোড়ার মতো পিছিয়ে এল মাসেরাতি, পারলে লেজের ওপর, সটান দাঁড়িয়ে পড়ে। খাদের ঠোঁট পেরিয়ে একবার নামছে মাসেরাতি আবার ওঠার চেষ্টা করছে। এভাবেই চলল কিছুক্ষণ।

নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবার জন্য গিয়ার, ব্রেক আর হইলের সাথে যুদ্ধ করছে পিটার। পরবর্তী দু সেকেন্ডের কোনো বর্ণনা দিতে পারবে না ও, তবে নিশ্চয়ই পুরো এক পাক ঘুরে গেছে মাসেরাতি–একঝলক আলো লাগল চোখে একজনকে গড়াতে দেখল, আরেকজনকে ছুটতে—সবই বৃষ্টির মধ্যে ঝাপসা আর অস্পষ্ট।

সবশেষে আবার সামনে খোলা রাস্তা ছেড়ে দিয়ে হুইল আপনাআপনি ঘুরে যাচ্ছে, তীরবেগে নাক বরাবর লাফ দিল গাড়ি। একই সময়ে মুখ তুলে রিয়ার ভিউ মিররে।

একচোখ জ্বলছে কোম্বি ভ্যানের। সেটার আলোর নীল ধোয়া আর বাষ্পের মেঘ দেখল পিটার।

টায়ার জ্বলছে। ধোয়া আর বাস্পের ভেতর দিয়ে খাদে দাঁড়ানো দ্বিতীয় লোকটাকে আবছামূর্তির মতো লাগল, তার কোমরের কাছ থেকে মেশিন পিস্তলের মাজল ঝলসে উঠল। মাসেরাতির গায়ে প্রথম দফা বিস্ফোরণের আওয়াজ পেল পিটার কিন্তু নিচু হয়ে মাথাটা আড়াল করার উপায় নেই, বৃষ্টির মধ্যে সামনেই একটা বাঁকাচোখ ধাঁধানো গতিতে কাছে চলে আসছে। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। মুখের ভেতর হাড়গোড় সব যেন ভেঙে চুড়িয়ে যাবে। পরবর্তী বিস্ফোরণও মাসেরাতির গায়ে লাগল, মনে হলো ঝমঝম বৃষ্টি পড়ল টিনের ছাদের। পিঠের ওপরের অংশে একটা ধাক্কা খেল পিটার। বুলেট আটকে গেছে নিঃসন্দেহে, অনুভব করল সে। হতে পার রিকোশো নয়তো পিছনের উইন্ডশীল্ড আর সীটের ভেদ করে আসা গতি হারানো বুলেট।

 নিখুঁতভাবে বাঁক নিল গাড়ি, আর তার পরই খকখক করে উঠল ইঞ্জিন। একবার গতি হারায়, আবার ছোটে, তারপর আবার গতি হারায়। প্রায় সাথে সাথেই গ্যাসোলিনের গন্ধে ভরে উঠল গাড়ির ভেতরটা। ফুয়েল লাইন ফুটো হয়ে গেছে কোথাও, বুঝতে পেরে ভাগ্যকে অভিশাপ দিল পিটার। পিঠ আর পাঁজর বেয়ে রক্তের ধারা নেমে যাচ্ছে। বাম কাঁধের নিচে কোথাও আঘাত পেয়েছে। আরো একটু ভেতরে ঢুকলে ফুটো হয়ে যেত ফুসফুস। ফুটো হয়েছে কিনা, তা এখনো বলা যাচ্ছে না। গলা দিয়ে রক্ত ওঠার অপেক্ষায় থাকল ও।

আবার সচল হলো ইঞ্জিন, ফুয়েলের অভাবে মারা যাচ্ছে। মেশিন পিস্তলের প্রথম দফা বিস্ফোরণেই সম্ভবত ইঞ্জিন কমপার্টমেন্ট আঘাত করেছিল। সিনেমা হলে এতক্ষণে খুদে ভিসুভিয়াসের মতো অগ্নিকুণ্ড হয়ে উঠত মাসেরাতি, বাস্তবে অবশ্য তেমন ঘটে না। ছেঁড়া লিড থেকে এখনো প্রাগ আর পয়েন্টগুলোর গ্যাসেলিন সাপ্লাই হচ্ছে।

বাঁক নেয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে পিছন দিকটা চট করে একবার দেখে নিয়েছে পিটার।

 আহত মাসেরাতি আরেকটা লাফ দিল। ধুঁকতে ধুঁকতে আরো পাঁচশ গজ নিয়ে এল পিটারকে, তারপর শেষবারের মতো থেমে গলে। ওর সামনে, হেডলাইটের আলোর শেষ প্রান্তে, লা পিয়ের বেনিতে সাদা গেট দেখা যাচ্ছে। ফাঁদটা এমন এক জায়গায় পেতেছে ওরা যেখানে অন্যান্য যানবাহন থেকে দৃষ্টি পড়ার আশঙ্কা কম। জালের ভেতর শুধু যাতে মাসেরাতিকে আটকানো যায়।

মনটাকে কাজের মধ্যে ফিরিয়ে আনল পিটার। মেইন গেটের সামনে এস্টেটের লে আউট স্মরণ করল ও। মাত্র একবার এখানে এসেছিল, সেবারেও অন্ধকার। তবে সৈনিকের চোখ, মনে আছে রাস্তার দুধারে গভীর জঙ্গল, রাস্তার আরো খানিক সামনে নিচু একটা ব্রিজ, নিচে খাড়া পাড়সহ খরস্রোতা পাহাড়ি নদী। ব্রিজের পর খাড়াভাবে উঠে গেছে রাস্তা সরাসরি বাড়িতে। গেট থেকে বাড়িটা আধমাইল দূরে, পিছনে চারজন সশস্ত্র আততায়ী আর শরীরে বুলেট থাকলে এই আধমাইলই অনেক দূরের পথ। তাছাড়া, বাড়িতে পৌঁছুতে পারলেও নিরাপত্তা পাওয়া যাবে কিনা তার কোনো গ্যারান্টি নেই। ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেলেও মাসেরাতি এখনো গেটের দিকে এগোচ্ছে, ধীর ধীরে কমে আসছে গতি। গরম তেল আর পোড়া রাবারের গন্ধ পাচ্ছে পিটার। ইঞ্জিন হুডের রঙ বদলে যেতে দেখল ও। ইলেকট্রিক পাম্প থেকে গরম ইঞ্জিনে আরো তেল ছড়াচ্ছে, ইগনিশন অফ করে বন্ধ করল সেটা। জ্যাকেটের ভেতর হাত ভরে যেখানে পাবে বলে আশা করেছিল সেখানেই পেল ক্ষতটা, বাম দিকে আর নিচে। এতক্ষণে দপদপ করতে শুরু করেছে, চটচট আর পিচ্ছিল হয়ে উঠল হাত। বের করে উরুতে মুছল।

ওর পিছন দিকে বৃষ্টির মধ্যে প্রতিফলিত আলোর আভা, প্রতি মুহূর্তে জোরাল হচ্ছে। যে কোনো মুহূর্তে বাঁক নিয়ে চলে আসবে ওরা। গ্লাভ কর্মপার্টমেন্ট খুলে নাইন এম এম কোবরাটা বের করে হোলস্টারে ভরল। টেনে বেল্টের সমনে নিয়ে এল সেটাকে। স্পেয়ার ম্যাগাজিনের ব্রীচও খালি। ম্যাগাজিনে শুধু নয় রাউন্ড গুলি আছে। ইঞ্জিন কম পার্টমেন্টের বনেটের ভেতর থেকে ফাটল আর ফুটো দিয়ে। আগুনের খুদে শিখা বেরিয়ে আসছে। সীট বেল্ট খুলে ফেলল পিটার। দরজাটা আধখোলা অবস্থায় রাখল, একহাতে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে মাসেরাতিকে রাস্তার কিনারায় নিয়ে যাচ্ছে। এখান থেকে হঠাৎ করে নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে রাস্তা। এক ঝটকায় স্টিয়ারিং হুইল উল্টে একটা ঝাঁকি মতো খেল পিটার। সেই ঝকির সাথে ছোট একটা লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল গাড়ির বাইরে। গড়িয়ে রাস্তার মাঝেখানে ফিরে গেল। মাসেরাতি থেমে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

প্যারাসুট ডুপের ভঙ্গিতে মাটি স্পর্শ করল পিটার। পা আর হাঁটুতে ধাক্কা খেল, তার পর গড়িয়ে দিল শরীরটা কাধ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল ব্যথাটা ক্ষতের ভেতর। কি যেন ছিঁড়ে যাওয়ায় অন্ধকার দেখল চোখে।

লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে টলতে লাগল ও। এক সেকেন্ড পর একটু কমল ব্যথা, জঙ্গলের কিনারা লক্ষ্য করে ছুটল ও কমলা রঙের কাঁপা আলো আসছে আগুন ধরা গাড়িটা থেকে। কোবরার চেম্বারে এক রাউন্ড গুলি ভরল পিটার। বাঁ হাতের আঙুলগুলো ফোলা ফোলা আর অসাড় লাগল।

ঠিক তখুনি বাঁকের সামনের রাস্তা বিমূঢ় করা উজ্জ্বল আলোয় ঝলসে উঠল। ছাৎ করে উঠল পিটারের সামনের বুক। যেন নধর, মধ্যিখানে কেউ ওর কাপড় খুলে নিয়েছে। বৃষ্টিভেজা নরম রাস্তায় ডাইভ দিয়ে পড়ল ও শর্ষেফুল দেখল চোখ।

হামাগুড়ি দিয়ে গাছগুলোর দিকে এগোচ্ছে ফোলা দেখল নাক। শর্টের ভেতর আবার শুরু হয়েছে রক্তপাত। রাস্তার বিস্তৃতিটুকু সগর্জনে পেরিয়ে গেল পুলিশ ভ্যান। কাদা মাটি আর ঘাসের সাথে মুখ সেটে পড়ে থাকল পিটার। তিনশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে পড়েছে মাসেরাতি। দুটো চাকা এখনো রাস্তায়। বাকি দুটো রাস্তার পাশে মাটিতে। সর্বাঙ্গে আগুন নিয়ে ভালোভাবেই জ্বলছে সেটা। কোম্বি ভ্যান থামল মাসেরাতির কাছ থেকে সশ্রদ্ধ একটা দূরত্ব রেখে। যে কোনো মুহূর্তে বিস্ফোরিত হতে পারে গাড়িটা। সাদা ক্যাপ আর কোট পরা পুলিশটা ভ্যান থেকে নেমে সামনের দিকে ছুটল। মাসেরাতির ক্যাবের ভেতর একবার উঁকি দিয়েই চিৎকার করে কিছু বলল সে, মনে হলো ভাষাটা ফরাসি কিন্তু এত দূর থেকে পরিষ্কার শোনা গেল না।

দ্রুত একটা ইউ টান নিল কোম্বি; মাটিতে ঝাঁকি খেল, তারপর ফিরে যেতে শুরু করল বাকের দিকে, ধীর গতিতে। ভ্যানের সামনে মেশিন পিস্তল হাতে সেই দুজন লোক রয়েছে। চেইনের সাথে বাধা হাউন্ডের মতো ছুটছে তারা দুজন রাস্তার দুই কিনারা ধরে, রাস্তার নরম কাঁধে পিটারকে খুঁজছে তারা। সাদা ক্যাপ মাথায় পুলিশটা দাঁড়িয়ে রয়েছে ভ্যানের রানিংবোর্ডে, শিকারিদের নির্দেশ এবং উৎসাহ দিচ্ছে।

আবার দাঁড়াল পিটার কোমর ভাঁজ করে নিচু হয়ে দৌড়াল। যেমন করে হোক জঙ্গলের ভেতর ঢুকতে হবে ওকে। কাটাতারের বেড়ায় গোটা শরীর আছাড় খেল, স্প্রিং-এর মতো আরেক ধাক্কা দিয়ে পিছন দিকে ছুঁড়ে দিল ওকে বেড়াটা, ধড়াম করে চিত হয়ে পড়ে গেল পিটার।

 কাঁটাতারে ছিঁড়ে গেছে ট্রাউজার, আওয়াজ শুনেছে ও। দুইশ সত্তর ডলার দিয়ে স্যাভিল রো থেকে তৈরি করা স্যুট বরবাদ হয়ে গেল, দুঃখের মধ্যেও মৃদু হেসে ভাবল। বিশ্রাম নিল না সে। হামাগুড়ি দিয়ে কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক গলে ভেতরে ঢুকল পিছন থেকে। একটা চিৎকার ভেসে এল, যাস্ শালা, মাটিতে পায়ের দাগ দেখে ফেলেছে। তার পর আরেকটা আওয়াজ হলো আগের চেয়ে জোরালো উল্লাসে ভরপুর। মাসেরাতির আলোয় ধরা পড়ে গেছে পিটার। চিৎকারের পরপরই অটোমেটিক ফায়ারের শব্দ হলো কিন্তু শর্ট ব্যারেল আর লো ভেলোসিটি অ্যামুনিশনের জন্যে রেঞ্জটা খুব বেশি। বাদুড়ের ডানা ঝাপটানোর মতো মৃদু আওয়াজ পেল পিটার মাথার দিকে অনেক ওপর থেকে। এতক্ষণে প্রথম সারির গাছগুলোর কাছে পৌঁছুল ও, একটার পিছনে দাঁড়িয়ে আড়াল নিল।

হাঁপাছে বটে, কিন্তু নিঃশ্বাস ফেলতে কোনো কষ্ট হচ্ছে না। ক্ষতটা মারাত্মক নয়, হলে এতক্ষণে দুর্বল হয়ে পড়ত শরীর। এখান থেকে কাঁটাতারের বেড়া পঞ্চাশ মিটার, আন্দাজ করল পিটার। কোবরার বাট ধরেছে দুহাতে, অপেক্ষা করছে ওর মতো একই দুর্দশায় পড়ে লোকগুলো। বেড়ার সাথে ধাক্কা খেয়ে দুজন ধরাশায়ী হলো, ব্যথা পেয়ে গালিগালাজ বেরিয়ে এল মুখ থেকে। নিঃসন্দেহ হওয়া গেল ভাষাটা ফরাসি। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। আগুনের আভায় দেহ-কাঠামোর কিনারা গোলাপী দেখাল। একজন মেশিন গানারের পেট লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ল পিটার।

তিনশ পঁচাশি ফুট পাউন্ড এনার্জি নিয়ে ছুটে গেল বুলেট। থ্যা করে একটা আওয়াজের সাথে ঢুকে গেল মাংস আর হাড়ের ভেতর। মাটি থেকে শূন্যে উঠে পড়ল লোকটা, ছিটকে পড়ল পিছন দিক। পরবর্তী টার্গেটের দিকে কোবরার ব্যারেল ঘোরাল পিটার, কিন্তু বাকিগুলো অপ্রত্যাশিত আক্রমণের মুখেও হতভম্ব হয়ে পড়েনি। সাথে সাথে অন্ধকার মাটিতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে। দেখতে না পেলে গুলি করবে না পিটার, অ্যামুনিশন কম। ওদের একজন একপশলা ব্রাশ ফায়ার করল, সামনের কয়েকটা গাছ থেকে ঝরে পড়ল ডাল আর পাতা। এক কি দুই মিনিট লাগবে ওদের, এই সুযোগে খানিক দূর সরে যাওয়া দরকার। জঙ্গলের মাথা আর মাসেরাতির মাঝখানে কোনো আড়াল নেই। আগুনের ক্ষীণ আভায় অন্ধকার দূর না হলেও কোন দিকে যাচ্ছে বুঝতে পারল পিটার। নাক বরাবর গেলেই নদী পড়বে কিন্তু দু-তিন গজ এগোবার পরই কাঁপতে শুরু করল ও। বৃষ্টিতে আর ভেজা ঝোপেঝাড়ে ঘষা খেয়ে স্যুটটা সপসপ করছে। জুতোর ভেতর কাদা-পানি ঢুকছে, ঠাণ্ডায় হি হি করতে করতে এই প্রথম বমি পেল পিটারের। পঞ্চাশ গজের মতো এগিয়ে একবার করে থামল ও, পিছনে পায়ের আওয়াজ শোনার জন্যে। রাস্তার দিক থেকে একবার ইঞ্জিনের আওয়াজ পেল, মনে হলো ফুল স্পীডে কোনো প্রাইভেট কার ছুটে গেল। রাস্তার পাশে পরিত্যক্ত পুলিশ ভ্যান আর জ্বলন্ত মাসেরাতি দেখে কি মনে করবে আরোহীরা? আসল পুলিশকে খবর দিয়ে হলেও তারা এসে পৌঁছুবার আগে যা ঘটার ঘটে যাবে।

এমন সময়, নদীর পানিতে একজনের অস্তিত্ব টের পেল সে। ম্যাগডার দুজন বডিগার্ডও চলে এসেছে, নদীর পাড়ে তাদের আওয়াজ পাচ্ছে পিটার। একজনকে আটকে ফেলেছে প্রধান দেহরক্ষী, কার্ল। ক্লান্ত, অবসন্ন লোকটা হাঁটু পানিতে হাঁটছে, চুলে ঢাকা পড়ে আছে তার মুখ। নাভির কাছে দুহাতে পিস্তল ধরে তাকে দেখছে কার্ল।

আচমকা পিটার টের পেল কি ঘটতে যাচ্ছে। বমির ভাবটা চেপে চেঁচিয়ে উঠল ও, না! কার্ল, না! ওকে জ্যান্ত ধরো! মেরো না, কার্ল!

 দেহরক্ষী শুনতে পেল না বা ওর কথা বুঝল না। মাজল থেকে বেরিয়ে আসা আগুনের ঝলক কার্ল আর আততায়ীর মাঝখানে যে একটা রক্ত-গোলাপি রশি টেনে দিল। বজ্রপাতের মতো আওয়াজ হলো বিস্ফোরণের। আততায়ীর বুক আর পেটে বুলেট তো নয় যেন কাঠুরের কুঠার ঢুকল।

না! অসহায়ভাবে চিৎকার করছে পিটার। ওহ খোদা না! হাতের ব্যথা ভুলে দ্রুত সাঁতার দিয়ে এগিয়ে এল ও, জড়িয়ে ধরল একটা লাশকে। এক হাতে টেনে লাশটাকে পাড়ে তুলে আনল ও দেহরক্ষীরা সাহায্য করল ওকে।

দুবার দাঁড়াবার চেষ্টা করে শক্তি পেল না পিটার। কার্ল ওর বগলের নিচে হাত দিয়ে খাড়া করল। কোমর ভাজ করে গলগল করে বমি করল পিটার।

পিটার! ব্রিজের ওপর থেকে উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর ভেসে এল।

ডান হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুখ মুছে চোখ তুলল পিটার, নেশাখোর মাতালের মতো লাগছে ওকে। ব্রিজ ধরে ছুটে আসছে ব্যারনেস ম্যাগডা। লম্বা পায়ে কালো বুট আর স্কি প্যান্ট পরে আছে। সন্ত্রস্ত চেহারা সাদা হয়ে আছে।

কোমর সিধে করে টলতে লাগল পিটার। ছুটে এসে ওকে জড়িয়ে ধরল ব্যারনেস, সিধে হয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করল।

পিটার, ওহ গড! ডার্লিং কি হয়েছে…!

লাশটাকে দেখাল পিটার। কয়েকজন তোক নিয়ে তোমাকে কিডন্যাপ করতে চেয়েছিল ও, কিন্তু তোক চিনতে ভুল করে ফেলে।

লাশের দিকে তাকিয়ে থাকে ওরা। পয়েন্ট তিনশ সাতান্ন মাগনাম ব্যবহার করেছে কার্ল, বুক আর পেট ধসে গেছে। মুখ ঘুরিয়ে নিল ব্যারনেস।

ভালো দেখিয়েছ, কার্লকে বলল পিটার। ও আর মুখ খুলবে না।

আপনি তো, স্যার ওকে থামাতে বললেন, পিস্তল রিলোড করতে করতে গম্ভীর সুরে বলল কার্ল।

ভাবছি যদি মারতে বলতাম তাহলে কি করতে তুমি। রাগে, দুঃখে, অন্য দিকে তাকাল পিটার। ক্ষতটা ব্যথা করে উঠল। বিকৃত হয়ে গেল চেহারা।

 আহত হয়েছ হঠাৎ বুঝতে পেরে আতকে উঠল ব্যারনেস ম্যাগডা। ওর ওদিকের হাতটা ধরো, কার্লকে হুকুম করল সে। দুজনের সাহায্যে ব্রিজের গোড়ায়, সেখান থেকে গাড়িতে উঠে এল পিটার।

 ভিজে আর ছেঁড়া কাপড় খুলে ফেলল ও, ক্যাবের আলোয় ক্ষতটা পরীক্ষা করে নিজের গায়ের উলেন শাল দিয়ে পিটারকে ঢেকে দিল ব্যারনেস। ক্ষতটা থেকে এখন আর রক্ত পড়ছে না।

বুলেটের গর্তটা নীল হয়ে গেছে, শক্ত পেশি আর পাঁজরের মাঝখানে আটকে আছে বুলেট, বাইরে থেকে দেখা গেল। থ্যাংকস গড! ফিসফিস করে বলল ব্যারনেস। এখুনি তোমাকে আমরা হাসপাতালে নিয়ে যাব। কার্ল, যত জোরে পারে চালাও। পাশের ককটেল কেবিনেট খুলল সে, ক্রিস্টাল একটা টাম্বলার বের করে হুইস্কি ঢালল তাতে।

 মুখে হুইস্কি নিয়ে কুলি করল পিটার, তারপর দু-ঢোক গিলে ফেলল। একটু পরেই গরম হয়ে উঠল শরীর।

কিভাবে আসা হলো তোমার? জিজ্ঞস করল ও।

রবুইলে পুলিশকে কেউ একটা গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টের খবর দেয়। মাসেরাতি ওদের চেনা গাড়ি, ইন্সপেক্টর লা পিয়েরে বেনিতে ফোন করে। আমি ধরে নিলাম…

 গেটের কাছে পৌঁছুল গাড়ি, সামনে মেইন রোড। রাস্তার ধারে মাসেরাতির অবশিষ্ট দুমড়েমুচড়ে পড়ে আছে, সেটাকে ঘিরে পাঁচ-সাত জন পুলিশ অস্থিরভাবে ঘোরাফেরা করছে, যেন এরপর কি করতে হবে জানা নেই তাদের। গাড়ির গতি শ্লথ হলো, জানালা দিয়ে মুখ বের করে একজন সার্জেন্টের সাথে কথা বলল ব্যারনেস। সার্জেন্ট সমীহের সাথে ঘন ঘন মাথা ঝাঁকাল। পুলিশরা সবাই স্যালুট করল ব্যারনেসকে। আবার স্পীড তুলল কার্ল।

শুধু ব্রিজের কাছে নয়, বলল পিটার, সম্ভবত জঙ্গলের কিনারাতেও একটা লাশ পাবে ওরা।

 সত্যি তুমি যোগ্য লোক, তাই না? পটলচেরা চোখ সরু করে ওর দিকে তাকাল ব্যারনেস।

 সত্যিকার যোগ্য লোকেরা আহত হয় না। হাসল পিটার, বেঁচে থাকার আনন্দ ফিরে পাচ্ছে আবার।

মাসেরাতির ব্যাপারে তুমি তাহলে ঠিকই বলেছিলে–ওরা আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল।

সেজন্যেই তো ওটাকে পুড়িয়ে ফেললাম, বলল পিটার, কিন্তু ওর হাসির কোনো উত্তর দিল না ব্যারনেস।

পিটারের হাত চেপে ধরে, ওর অক্ষত কাঁধে মাথা রাখল ব্যারনেস। ওহ পিটার, কি রকম লাগছিল আমার সে তুমি বুঝবে না। পুলিশ জানাল, ড্রাইভার বেরোতে পারেনি, গাড়ির সাথে পুড়ে গেছে। মনে হলো…মনে হলো, আমার একটা অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। কি যেন একটা মরে গেল আমার ভেতরে। আমি আসতে চাইনি কিন্তু ভাবলাম নিজের চোখে না দেখে বিশ্বাস করব না। ব্রিজে ওঠার পর কার্ল বলল, নদীতে তোমাকে সে চিনতে পারছে… থরথরে করে কেঁপে উঠল সে। সব আমাকে বল, কি ঘটেছে বল আমাকে সব। পিটারের টামব্লারে আরো হুইস্কি ঢালল ম্যাগডা।

কি কারণে পিটার নিজেও ভালো জানে না সিট্রনের কথাটা চেপে গেল ও। নিজেকে যুক্তি দিল সিট্রনের সাথে ফাঁদের কোনো সম্পর্ক নাও থাকতে পারে কারণ স্ট্রিনের ড্রাইভার ফোন করে ভুয়া পুলিশকে জানিয়ে দিতে পারত মাসেরাতিতে ব্যারনেস অল্টম্যান নেই। তারমানে স্ট্রিনের সাথে ফাঁদের সম্পর্ক থাকলে বিশ্বাস করে নিতে হয় তারা ব্যারনেসকে নয়, ওকেই খুন বা কিডনাপ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তা বিশ্বাস করার, কোনো কারণ নেই। মাত্র আজ সকালে নিজেকে টোপ হিসেবে বাজারে ছেড়েছে পিটার, এত তাড়াতাড়ি সেটা গিলতে পারে না প্রতিপক্ষ। মাথাটা ঝিমঝিম করছে, এসব নিয়ে পরে চিন্তাভাবনা করা যাবে। তার আগে পর্যন্ত ওকে বিশ্বাস করতে হবে, ফাঁদটা ব্যারনেসের জন্যেই পাতা হয়েছিল, কিন্তু জালে ধরা পড়ে যাচ্ছিল ও।

 মন দিয়ে পিটারের কথাগুলো শুনল ব্যারনেস ম্যাগডা। পিটারের মাথায়, মুখে আর বুকে হাত বুলিয়ে দিল সে।

রেডিওতে আগেই খবর পাঠিয়েছিল পুলিশ, হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে ঢোকার আগে, দরজায় হাত রেখে বাধা দিল ব্যারনেস। পিটারের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ল সে, চুমো খেল ঠোঁটে। আমার জীবনে এখনো তুমি আছ, ঈশ্বরের প্রতি সেজন্যে আমি কৃতজ্ঞ, পিটার। পিটারের কানের লতিতে ঠোঁট ছোঁয়াল সে।

আবার খলিফা, তাই না?

কাঁধ ঝাঁকাল পিটার। এ ধরনের প্রফেশনাল কাজ আর কার দ্বারা সম্ভব জানি না।

অপারেশন থিয়েটারের দরজা পর্যন্ত ট্রলির সাথে হেঁটে এল ব্যারনেস, তারপর আবার একবার পিটারের কপালে চুমো খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

.

জ্ঞান ফিরে পাচ্ছে পিটার, ওর মুখের ওপর ঝুঁকে পাশে দাঁড়িয়ে আছে ব্যারনেস, বেডের আরেক পাশে ডাক্তার। কেবিনে দুজন নার্সও রয়েছে, দরজার কাছে।

জাদু দেখবার ভঙ্গিতে মুঠো খুলল ডাক্তার। কাটাছেঁড়া করতে হয়নি, খুঁচিয়েই বের করে এনেছি। পিটারকে বুলেটাটা দেখিয়ে বলল সে। আপনি খুব ভাগ্যবান মানুষ। রেসের ঘোড়ার মতো পেশি বেশি ভেতরে ঢুকতে দেয়নি বুলেটাকে। খুব তাড়াতড়ি সেরে উঠবেন।

কথা দিয়েছি আমি তোমার দেখাশোনা করব, কাজেই তোমাকে উনি ছেড়ে দেবেন, ব্যারনেস ম্যাগডা বলল। কি, দেবেন না, ডাক্তার?

 আপনার কপালে জুটল দুনিয়ার সেরা সুন্দরী নার্সদের একজন, পিটারকে কথাটা বলে, ভক্তির সাথে ব্যারনেসের উদ্দেশে বাউ করল ডাক্তার। ডাক্তারের কথাই ঠিক, বুলেটের ক্ষতের চেয়ে কাঁটাতারে ছোঁড়া উরুর ক্ষতটা বেশি ভোগাল পিটারকে, কিন্তু ব্যারনেস ম্যাগডা এমন আচরণ করতে লাগল পিটার যেন দুরারোগ্য কোনো ব্যাধিতে ভুগছে, যমে মানুষ টানাটানি হচ্ছে। ওকে ফেলে পরদিন বুলেভার্ড দে কাপুসিন, অফিস হেডকোয়ার্টারে জরুরি কাজে যেতে হলো তাকে, সেখানে থেকে ফোন করল সাত বার, শুধু পিটার ঠিক আছে কিনা জানার জন্যে। ওর জুতো ও কাপড়ের মাপও অবশ্য জেনে নিল। দিনের আলো ফুরাল না, তার আগেই লা পিয়ের বেনিতে ফিরে এল সে।

মেইন গেস্ট স্যুইটে বসে ছিল পিটার, এখন থেকে টেরেসসহ লন আর কৃত্রিম হ্রদটা দেখা যায়। এত তাড়াতাড়ি ফিরলে যে?

তুমি খুশি হওনি? বলেই চোখে দুষ্ট ভাব নিয়ে হাসল ব্যারনেস। নিষ্ঠুর বা অন্য কিছু ভেবে না, ঘটনাটা ঘটার দরকার ছিল। তোমার কাছে থাকার, আরো ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ পেয়ে গেছি আমি। কাল আমি সারাদিন তোমার সাথে থাকব।

 সেবা যত্নে ভাটা পড়লে কি চাইতে হবে জানা হয়ে যাচ্ছে আমার, বলল পিটার। খলিফা আবার একটা গুলি ছুঁড়লে যত্ন বেড়ে যাবে, তাই না?

প্রায় ছুটে এসে পিটারের ঠোঁটে একটা আঙুল রাখল ব্যারনেস। শেরি, অমন অলক্ষুণে কথা ভুলেও মুখে আনবে না। শুধু ভয় নয়, বিষাদের কালো ছায়া পড়ল তার চেহারায়। তারপরই তার মুখে ধীরে ধীরে ফুটে উঠল ফুলের মতো হাসি। দেখো কি এনেছি তোমার জন্যে।

পিটারের ব্রিফকেসটা মাসেরাতির ট্রাঙ্কে রয়ে গিয়েছিল, সেটার বদলে কুমিরের কালো চামড়া দিয়ে তৈরি একটা ব্যাগ নিয়ে এসেছে ব্যারনেস। প্যারিসের অভিজাত অনেকগুলো দোকানে ঢু মেরে এটা সেটা কিনে ভরেছে ওটায়। ভুলেই গিয়েছিলাম প্রিয় কারও জন্যে উপহার কিনতে কি মজা লাগে, কথা শেষ না করে হাত দিয়ে তুলে সিল্ক ব্রোকেডের একটা ড্রেসিং গাউন দেখাল পিটারকে। এটা বাছার সময় সেন্ট লরেন্টের সবাই বুঝে নিয়েছে কি ভাবছিলাম আমি…

কিছুই ভোলেনি ব্যারনেস। শেভিং গিয়ার, সিল্কের রুমাল আর আন্ডারঅয়্যার, নীল একটা ব্লেজার, স্ন্যাকস আর জুতো, এমন কি সোনার কাফলিঙ্ক পর্যন্ত বাদ যায়নি। তোমার চোখে ও কিসের হাসি? উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে আবার বলল, ডিনারের জন্যে রেসপেক্টেবল হয়ে আসি। রবার্টোকে বলেছি, এখানেই খাব আমরা।

আজ অন্য কোনো গেস্ট নেই। গানমেটাল বিজনেস স্যুট আর সিল্কের পাগড়ি পরে ফিরে এল ব্যারনেস। চুল কোমর ছাড়িয়ে নেমে এসেছে, পোশাকের চেয়ে বেশি চকচকে।

শ্যাম্পেনের বোতল কিন্তু আমি খুলব, বলল সে। দুহাত দরকার সেজন্যে।

পিটার পরেছে ব্রোকেডসহ গাউনটা, বা হাত এখনো স্লিংয়ের সাথে ঝুলছে। শ্যাম্পেন ভরা গ্লাসের কিনারা দিয়ে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ভাবল ওরা।

আমার ধারণাই ঠিক, তোমার রঙ ব্ল। নীল তোমার বেশি বেশি পরা উচিত। পিটারের গ্লাসের সাথে নিজের গ্লাসটা ছোঁয়াল সে, মাত্র একবার চুমুক নিয়ে নামিয়ে রাখল। ভাবগম্ভীর হয়ে উঠল চেহারা।

 সুরেত-এ আমার বন্ধু আছে, ওদের সাথে কথা বলেছি আমি। ওদেরও ধারণা, আমাকে কিডন্যাপ করার চেষ্টাই ছিল ওদের। তুমি সুস্থ হও, তারপর একটা স্টেটমেন্ট দেবে। আমার অনুরোধে অপেক্ষা করতে রাজি হয়েছে ওরা। কাল ওরা একজন লোক পাঠাবে। জঙ্গলের কিনারায় দ্বিতীয় লোককে ওরা পায়নি। হয়তো হেঁটে চলে গেছে, নয়তো তার লোকেরা গাড়িতে তুলে নিয়ে গেছে।

অপর লোকটা? জিজ্ঞেস করল পিটার। যে মারা গেছে?

তাকে ওরা ভালো করে চেনে, জঘন্য একটা লোক। আলজেরিয়ান, প্রফেশনাল কিডন্যাপার এবং মার্ডারার চেষ্টা করেও সে তোমাকে মারতে পারেনি, সুরেত-এর ওরা বিশ্বাস করতে পারছে না। আমি ওদেরকে তোমার আসল পরিচয় জানাইনি। ভাল করেছি, তাই না?

 হ্যাঁ।

তোমার সাথে যখন এভাবে থাকি, ভুলে যাই যে তুমিও বিপজ্জনক একটা মানুষ। পিটারের চেহারায় কি যেন খুঁজল ব্যারনেস। তুমি বিপজ্জনক সেজন্যেই কি তোমার প্রতি এতটা আকর্ষণ আমার? তুমি কাছে না থাকলে কেন আমি কাতর হয়ে পড়ি? অসহায় ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল সে। তুমি দ্র, তোমার ব্যবহার কি সুন্দর। কিন্তু কখনো কখনো তোমার হাসির মধ্যে কি যেন একটা থাকে, কখনো কখনো তোমার চোখে জ্বলে ওঠে ঠাণ্ডা একটা আলো, কঠিন আর নিষ্ঠুর। তখন আমার মনে পড়ে অনেক, অনেক লোককে খুন করেছ তুমি। তোমার কি মনে হয় এর জন্যেই তোমাকে এত ভালো লাগে আমার? সেজনেই কি এই টান?

অন্য কোনো কারণ থাকলে ভালো হয়।

রক্ত আর জখম ধ্বংস আর বিপর্যয় দেখে উত্তেজিত বোধ করে অনেক লোক। যারা বুল ফাইট আর বক্সিং দেখতে যায় তাদের চেহারা লক্ষ্য করেছি আমি। নিজের কথা ভেবেছি, আমি কি তাদের একজন? জানি না, পিটার। শুধু জানি শক্তিশালী আর কঠিন পুরুষ আমাকে টানে। অল্টম্যান সেরকম একজন লোক ছিল। সে চলে যাবার পর আমার জীবনে আর একজন সেরকম লোক তুমি। আজ পর্যন্ত আর কাউকে দেখিনি।

নিষ্ঠুরতা শক্তি নয়, ব্যারনেসকে বলল পিটার।

না, সত্যিকার একজন শক্তিশালী মানুষের মধ্যে কোমলতা আর আবেগ থাকবে। তুমি শক্ত, অথচ যখন ভালোবাস এত নরম হতে পারো। কিন্তু নরম হলেও তোমার ভেতর কাঠিন্য আর নিষ্ঠুরতা আছে, টের পাই আমি। পিটারের পাশ থেকে সরে গিয়ে সোনালি আর ক্রীম কালারে সাজানো ঘরের চারদিকে হাঁটতে লাগল সে। একবার থেমে দেয়ালের পর্দা সরিয়ে বেল বাজাল।

ডিনার ট্রলি নিয়ে ভেতরে ঢুকল লোকজন, নেতৃত্ব দিচ্ছে রবার্টো। সে নিজের হাতে ওয়াইন গ্লাসে ঢালছে। তরল সাদা গ্লাভস পরনে। তার লোকেরা চলে যাবার পর দরজার পাশে দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল, নিজের হাতে পরিবেশন করতে চায়। কিন্তু হাত নেড়ে তাকে বিদায় করে দিল ব্যারনেস।

মোটা প্যাড আকৃতির একটা উপহার রয়েছে টেবিলে, লাল আর সোনালি কাগজে মোড়া।

 উপহার একবার কেনা শুরু করলে আমার আর হুশ থাকে না, বলল ব্যারনেস। কিন্তু এবার আমি ভাবলাম, ওটা তুমি খুলবে!

সাবধানে খুলল পিটার, তারপর স্থির হয়ে গেল।

ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে আছে ব্যারনেস। কি যেন খুঁজছে পিটারের চোখে। তুমি খুশি হওনি?

বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল পিটার। ওটা কোথায় পেলে তুমি? সোথবিতে ১৯৭১-এ ছিল বইটা, তখন একবার অকশন করেছিলাম। পাঁচ হাজার পাউন্ডের পর ছেড়ে দিয়েছিল সে।

তোমার কাছে কর্নওয়ালিস হ্যারিসের প্রথম এডিশন নেই তাহলে? মাথা নাড়ে পিটার। আফ্রিকার বিগ গেমের দুপ্রাপ্য সোনালি কালার প্লেট রয়েছে বইটায়।

না, নেই। কিন্তু তুমি জানলে কি করে?

 তোমার কি মনে হয় না, তোমার নিজের চেয়ে তোমার সম্পর্কে বেশি জানি আমি? রহস্য করে জানতে চায় ম্যাগডা।

অসাধারণ একটা বই! তাও প্রথম এডিশন! বিশ্বাস করতে পারছি না।

মুখ নিচু করে খেতে শুরু করল ব্যারনেস, খাওয়ার সময় কেউ আর কোনে কথা বলল না। রবার্টো এসে টেবিল পরিষ্কার করল, ট্রলি নিয়ে বেরিয়ে গেল নিঃশব্দে। ফায়ার প্রেসের সামনে পাশাপশি সোফায় বসল ওরা, হাতে কফির কাপ

পিটার, ব্যারনেস ম্যাগডাই প্রথম নিস্তব্ধতা ভাঙল। আজ আমি তিনজনের কথা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না। তুমি, আমি আর খলিফা। তুমি পাশে আছ, কাজেই আমার ভয় পাবার কোনো কারণ নেই তবু আমি ভয় পাচ্ছি। অল্টম্যানের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। হিংস্র পশুর ওপরও মানুষ ওরকম নির্যাতন চালায় না…

ব্যারনেস ম্যাগডার হাতে হাত রেখে মৃদু চাপ দিল।

আমার একটা দ্বীপ আছে, হঠাৎ অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল ব্যারনেস। একটা নয় অনেকগুলো ছোট ছোট নয়টা। ওগুলোর মাঝখানে আছে নয় কিলোমিটার চওড়া একটা লেগুন। এত স্বচ্ছ তার পানি পঞ্চাশ ফিট নিচেও মাছ দেখতে পাবে তুমি। বড় দ্বীপটায় আছে এয়ারস্ট্রিপ, তাহিতি থেকে প্লেনে মাত্র দুঘণ্টার পথ। ওখানে আমরা আছি কেউ জানতে পারবে না। সারাদিন আমরা সাঁতার কাটতে পারি, হাত ধরাধরি করে হাঁটতে পারি বালির ওপর, আকাশ ভরা মিটিমিট তারার নিচে ভালোবাসতে পারি। আমার মতো বা আমার চেয়ে ভালো কাউকে ব্যবসায় দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়তে পারি আমরা। ওখানে শান্তির নীড় বাঁধতে পারি। কোনো বিপদ নেই। ভয় নেই। খলিফা নেই–হঠাৎ থেমে গেলে সে, যেন শেষ কথাটা ভুল করে বলে ফেলছিল। যাবে, পিটার? পালাবে আমার সাথে?

স্বপ্নটা লোভনীয়, বিষণ্ণ সুরে বলল পিটার।

কথা না বলে ব্যারনেসের চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকল পিটার, যতক্ষণ না ব্যারনেস দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ নিচু করল।

 উঁহু, না, পিটারের মনের ভাব বুঝতে পেরে সমর্থন করল ব্যারনেস। তা হবার নয়। এই জীবনযাপন কেউই আমরা ছাড়তে পারব না। কিন্তু পিটার, আমার বড় ভয় হয়–ভয় হয় তোমার সম্পর্কে আমি কি জানি, আর কি কি জানি না। একইরমভাবে, আমার সম্পর্কে তুমি তো সব জানো না। অনেক কিছু আছে যেগুলো বলতে পারি না। কিন্তু তুমি ঠিক বলেছ। খলিফাকে খুঁজে পেতে হবে আমাদের। ধ্বংস করতে হবে তাকে। কিন্তু ওহ গড–এই করতে গিয়ে নিজেদেরকেই না ধ্বংস করে ফেলি আমরা।

যে কোনো সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যায়।

ঠিক আছে। তার চেয়ে চল, ধাঁধার খেলা খেলি। প্রথমে আমার পালা। একজন নারীর জন্যে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক অভিজ্ঞতা কি হতে পারে?

পারলাম না। পিটার বলে।

 শীতের রাতে একা ঘুমানো।

 পরিত্রাণ যে হাতের নাগালে, হেসে বলে এবারে পিটার

কিন্তু বেচারা আহত কাধ?

নিজেদের বিশাল প্রতিভা আর প্রজ্ঞা কাজে লাগালে আমার মনে হয়, এটা কোনো সমস্যা হয়ে দেখা দেবে না!

মনে হয়, ঠিক বলেছ, বলে, ধূর্ত বিড়ালির মতো পিটারের গায়ে সেঁটে আসে ম্যাগডা।

.

সুন্দরী একজন নারীর জন্যে অন্তর্বাস কেনাটা একটা আনন্দময় অভিজ্ঞতা। মধ্যবয়স্কা সেলস্ লেডির চেহারায় প্রজ্ঞার ছাপ লক্ষ্য করল পিটার। এক ট্রে ভর্তি লেস দেয়া দারুণ সুন্দর অন্তর্বাস বের করে টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখল সে। দারুণ দামি ওগুলো।

হ্যাঁ, ব্যথভাবে সমর্থন জানায় মেলিসা–জেইন, ওগুলো ঠিক

 সামনের কাঁচে তাকিয়ে পিটার নিশ্চিত হয়, ওর পিছনে লেজ লেগেছে।

গ্রে ওভারকোটে মোড়া এক লোক খুব নিবিষ্ট মনে ডিসপ্লেতে সাজানো ব্রেসিয়ার পর্যবেক্ষণ করছে।

ডার্লিং, আমার মনে হয় তোমার মা ওগুলো পরার অনুমতি দেবে না, মেয়েকে বলে পিটার। সেলস ওম্যান চমকিত হয় এমন কথায়।

ওহ, প্লিজ, ড্যাডি! আগামী মাসে আমার বয়স চৌদ্দ হতে যাচ্ছে।

হিথ্রোতে নামার পর থেকে পিটারের পিছনে লেগেছে এই ফেউ। গতকাল বিকেল থেকে। কিন্তু কে বা কারা–বুঝে উঠছে না সে। নদীতে সেদিন কোবরা পিস্তলটা যে কেন হারাল-এখন আফসোস হচ্ছে পিটারের।

আমার মনে হয়, এসো একটু সতর্ক হই, মেয়েকে বোঝায় সে।

না, না! প্রতিবাদ করে মেলিসা।

 হাতঘড়ি দেখল পিটার। পালা বদলের সময় হয়ে এসেছে। নতুন লোক আসবে এখন।

প্রতি পাঁচ ঘণ্টা পরপর পালা বদল করে ওর পাহারাদারেরা। দাম দেয়ার সময় আয়নায় দেখল স্টোর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে গ্রে-কোট। নতুন লোকটাকে চিনতে পারল পিটার। পরনে টুইডের স্পোর্টস জ্যাকেট। বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসছে।

সান অভ এ গান। দিস ইজ এ সারপ্রাইজ। পিটারের সামনে এসে বাউ করল কলিন নোবলস।

ক্ষীণ একটু স্বস্তি বোধ করল পিটার, শেষপর্যন্ত জানা গেল কারা ওরা। সারপ্রাইজই বটে। তোমার গরিলাদের সাথে কাল বিকেল থেকে ধাক্কা খাচ্ছি আমি।

আরে ছাড়ো ওদের কথা। সব কটা ছাগল।

 মেলিসার দিকে ফিরে চুমো খায় গালে।

আঙ্কল কলিন! একেবারে আকাশ থেকে পরলে যে! আলিঙ্গন ভেঙে স্বচ্ছ প্যান্টিগুলো কলিনকে দেখাল সে।

কি মনে হয় ওগুলো দেখে?

ওগুলো তোমারই জন্য তৈরি-মাই লেডি।

খালি আমার বাপকে একটু বোঝাও কথাটা!

.

ডরচেস্টারে পিটারের স্যুইটে ঢুকে চারদিকে তাকাল কলিন। একেই বলে বেঁচে থাকা। সত্যি খুব সুখে আছ। পিটারের হাত থেকে হুইস্কির গ্লাস নিল সে। আমাকে অভিনন্দন জানাবে না?

সানন্দে। নিজের গ্লাস নিয়ে জানালার সামনে চলে এল পিটার। জানালা দিয়ে হাইড পার্কের কুয়াশা ঢাকা বিষণ্ণ আকাশ দেখল। কি করছ তুমি?

ভান কর না তো, পিটার। থোর কমান্ড-তুমি চলে আসার পর ওরা আমাকে তোমার কাজটা দিয়েছে।

ওরা আমাকে বিদায় করে দেয়ার পর।

তুমি চলে আসার পর, জোর দিয়ে আবার বলল কলিন। ঢকঢক করে দুচেক হুইস্কি খেল সে। এ কথা ঠিক যে অনেক জিনিসই আমরা বুঝি না। আওয়ারস নট টু রিজন হোয়াই, আওয়ারস বাট টু ডু অ্যান্ড ডাই। শেক্সপীয়র।

পিটারের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলেও পিছন থেকে কলিন তা দেখতে পেল না।

এখন এখানে তুমি অনেক ভালো আছ। সবাই জানে থোর-এ তোমার মেধা অপচয় হচ্ছিল। তাছাড়া দুহাতে টাকা কামানো চাই, তবে না পুরুষমানুষ।

তুমি খুব ভালো করেই জানো নার্সকোতে চাকরি করছি আমি।

 নার্সকোতে, পিট? তুমি নার্সকোতে আছ? সত্যি, জানতাম না!

হাসল পিটার। কলিনের সামনে এসে বসল ও কে তোমাকে পাঠিয়েছে, কলিন?

 কেন কেউ আমাকে পাঠাতে যাবে? দোস্তের সাথে আমি দেখা করতে পারি না?

উনি বোধ হয় ভয় করছেন আবার আমি কার না কার চোয়াল ভাঙি, তাই না?

সবাই জানে, তোমাকে আমি পছন্দ করি, পিট। মনের টান আছে বলেই না চলে এলাম …

মেসেজটা কি, কলিন?

কংগ্রাচুলেশন্স, পিটার বেইবি। তুমি একটা রিটার্ন টিকেট জিতেছ। হৃৎপিণ্ডের ওপর একটা হাত রেখে উদার কণ্ঠে গেয়ে উঠল কলিন, নিউ ইয়র্ক নিউ ইয়র্ক ইট স আ ওয়ান্ডারফুল টাউন।

অধৈর্যের মতো কলিনের দিকে চেয়ে থাকে পিটার। কোথায় যেতে হবে, আন্দাজ করতে পারল ও। মনের কাছ থেকে সায় পাওয়া যাচ্ছে, যাওয়া দরকার।

কাদা আর ঘোলা পানি নিচ থেকে কি যেন একটা উঠে আসতে চাইছে, সুতোর অদৃশ্য প্রান্তটা এবার বোধ হয় পাওয়া যাবে। শিকারে নেমেছে ও, এই খবরটা বাতাসে ছড়িয়ে দেয়ার পর এ ধরনের কিছু একটা ঘটবে বলেই আশা করছিল।

কখন?

কেন বলিনি, এই মুহূর্তে ক্রয়ডনে একটা এয়ারফোর্স জেট অপেক্ষা করছে তোমার জন্যে?

কিন্তু, মেলিসা?

নিচে একটা গাড়ি অপেক্ষা করছে ওর জন্যে।

 ও কিন্তু তোমার উপর ক্ষেপে যাবে।

এটাই আমার জীবনের গল্প, দোস্ত, কলিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কেবল কুকুরগুলো আমাকে ভালোবাসে হে!

.

জিন-রামি খেলে আটলান্টিক পাড়ি দিল ওরা। ঠোঁটের কোণে চুরুট রেখে সারাক্ষণ বক বক করে গেল কলিন। নতুন দায়িত্ব কেমন লাগছে, ট্রেনিং এর সময় মজার কি কি ঘটেছে, দুজনেই যাদের চেনে তাদের এখনকার খবর, সবাই জানাল সে। তবে পিটারের নতুন চাকরি বা নার্সকো সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করল না। কথার ফাঁকে এক সময় শুধু বলল, আগামী সোমবারে পিটারকে লন্ডনে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে সে, তার জানা আছে নার্মকোর প্রতিনিধি হিসেবে কয়েকটা মিটিং-এ বসতে হবে পিটারকে। কথাটা ইচ্ছা করেই বলল কলিন, বোঝাতে চাইল ওরা পিটার এবং তার বর্তমান তৎপরতা সম্পর্কে কতটুকু কি জানে।

মাঝরাতের খানিক পর কেনেডি এয়ারপোর্টে নামল ওরা, একজন আর্মি ড্রাইভার অপেক্ষা করছিল ওদের জন্যে, হাওয়ার্ড জনসনে এয়ারফোর্সের একটা অফিসে ছয় ঘণ্টা ঘুমাবে ওরা।

সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাস্ট সারার পরও চোখ থেকে ঘুম ঘুম ভাবটা যেতে চায় না, তাই আরেক কাপ কফি খেল পিটার। নিজে একটা চুরুট ধরিয়ে পিটারকে সাধল কলিন, মাথা নাড়ল পিটার। বাইরে এসে আবার ক্যাডিলাকে চড়ল ওরা, কালকের সেই ড্রাইভার নিয়ে যাচ্ছে ওদের। ফিফথ আর ওয়ান হানড্রেড ইলেবেন্থ স্ট্রীটের চৌরাস্তা হয়ে দক্ষিণ দিকে এগোল। ডক্টর কিংস্টোন পার্কারের বাসায় যাচ্ছে ওরা। কলিনের অ্যাটলাস পাস দেখে ওকে ছেড়ে দিল সদর দরজার নিরাপত্তা রক্ষীরা।

অ্যাকুস্টিক টাইলে ঢাকা সিলিংসমেত একটা লম্বা ঘরে নিয়ে চলল কলিন, পিটারকে। বিশাল কনসার্ট পিয়ানো আর সারি সারি বইয়ের ভারে ন্যজ শেলফ রয়েছে একটা। রেকর্ডিং স্টুডিওর মতো বিশাল স্পিকার রয়েছে দেয়ালে।

কিংস্টোন পার্কার দাঁড়িয়ে আছেন পিয়ানোর পাশে, বীরপুরুষের চেহারা নিয়ে। প্রায় ছফিট লম্বা তিনি, শরীরের তুলনায় কাঁধে দুটো একটু যেন বেশি গলায় বসানো প্রকণ্ড মাথাটা সামনের দিকে একটু ঝুঁকে আছে। তার চেহারায় পবিত্র একটা আলো ফুটে আছে, চোখ দুটো আধবোজা যেন ধ্যানমগ্ন। যন্ত্রসঙ্গীতের সুর মূর্ঘনার ঘোর ভেঙে গেল ওদের দুজনের আগমনে।

ঘরের ভেতর নিস্তব্দতা নেমে এল। জেনারেল স্ট্রাইড, পার্কার অভ্যর্থনা জানালেন ওকে। নাকি আমি তোমাকে পিটার বলে ডাকব?

মি. স্ট্রাইড উইল ডু ভেরি নাইসলি, বলল পিটার।

হাত না মিলিয়ে অনুতাপের ভঙ্গি করে ওকে বসতে বললেন পার্কার।

 তাও তো এসেছো, পিটার বসতে, মাথা নেড়ে বললেন।

সবসময়ই আমার কৌতূহল একটু বেশি।

আমিও ওটা ভেবেই তোমাকে ডেকেছিলাম, হেসে বললেন পার্কার। ব্রেকফাস্ট করেছো?

আমরা দুজনে স্ন্যাক নিয়েছি, চট করে বলে কলিন, পিটার মাথা নেড়ে সায় দেয়।

তাহলে কফি, বললেন ডক্টর পার্কার, ইন্টারকমের সুইচ অন করে অর্ডার দিলেন তিনি। তারপর পিছন দিকে ফিরলেন। কোত্থেকে শুরু করা যায়! দুহাতের আঙুল চালালেন চুলে।

শুরু করুন শুরু থেকে, বলল পিটার। অ্যালিসকে তাই তো বলেছিল কিং অভ হার্টস।

শুরু থেকে কোমল হাসি দেখা গেল ডক্টর পার্কারের মুখে। —বেশ, শুরুতে আমি তোমাকে অ্যাটলাসে চাইনি।

আমি জানি।

আমার ধারণা ছিল থোর কমান্ডের কমান্ডারের পদটা তুমি প্রত্যাখ্যান করবে, কারণ তোমার যোগ্যতা আরো অনেক বেশি ছিল। কিন্তু পদটা গ্রহণ করে তুমি আমাকে অবাক করে দাও, যদিও এই প্রথমবার নয়।

 সাদা জ্যাকেট পরা একজন চীনা বাটলার ঢুকল ভেতরে, পিতলের চকচকে ট্রেতে কফির সরঞ্জাম নিয়ে। কফিতে ক্রীম আর রঙিন চিনি মিশিয়ে পরিবেশন করল সে। তারপর চলে গেল।

 নিস্তব্ধতা ভাঙলেন ডক্টর পার্কার, কেন তোমাকে চাইনি আমি? চাইনি এজন্যে যে তোমার রেকর্ড আর অ্যাচিভমেন্ট চমৎকার হলেও, আমার ধারণা ছিল পুরানো আর রদ্দি ধ্যান-ধারণা থেকে তুমি কখনো বেরিয়ে আসতে পারবে না। আমি এমন একজন লোক খুঁজছিলাম যে শুধু ব্রিলিয়ান্ট নয়, যার স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার এবং প্রচলিত নিয়ম-কানুন ভাঙার ক্ষমতা আছে। এ সব গুণ তোমার মধ্যে আছে তা আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। তবু তুমি থোরের কমান্ডার হওয়ার প্রস্তাব মেনে নেয়ায় এক রকম বাধ্য হয়েই তোমাকে আমার নিতে হলো। আমরা একসাথে কাজ শুরু করলাম, কিন্তু আমি তোমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস অর্জন করতে পারলাম না।

 কথা বলার সময় পিয়ানোর কী বোর্ডে হাত বুলালেন ডক্টর পার্কার, তারপর পিয়ানোর দিকে পিছন ফিরে টুলে বসলেন।

 তা যদি পারতাম, জিরো-সেভেন-জিরো অপারেশনটা অন্যভাবে শেষ হতো। এই ঘটনাটা ঘটে যাবার পর তোমার সম্পর্কে আমার ধারণা বদলে গেল। আমাকে খুব কষ্ট পেতে হলো। তোমার ভেতর যা ছিল না বলে জানতাম, চোখে আঙুল দিয়ে তুমি দেখিয়ে দিলে সেগুলো সবই তোমার ভেতর আছে, নিজের বুদ্ধিবৃত্তির ওপর আমার আস্থা কমে গেল। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার জন্যে সময় দরকার ছিল আমার, কিন্তু সে সময় তুমি আমাকে দিলে না, তার আগেই পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিলে।

এবং আপনি সেটা গ্রহণ করলেন, ডক্টর পার্কার।

 হ্যাঁ, তাই।

তাহলে বোঝা যাচ্ছে, এখানে অযথা আমরা সময় নষ্ট করছি। পিটারের চোখে ঠাণ্ডা দৃষ্টি, চেহারা কঠোর।

প্লিজ, জেনারেল স্ট্রাইড, আগে আমাকে সবটা ব্যাখ্যা করতে দাও। একটা হাত এমনভাবে বাড়িয়ে দিলেন ডক্টর পার্কার, যেন পিটারকে চেয়ার ছাড়তে বাধা দিতে চাইছেন। গোটা ব্যাপারটাকে অর্থবহ করতে হলে একটু পিছন থেকে শুরু করতে হবে।

তোমার সেই চুরুটটা, নিচু গলায় বলল পিটার।

পকেট থেকে চুরুট আর লাইটার বের করে পিটারের হাতে নিঃশব্দে ধরিয়ে দিল কলিন, দুজন পাশাপাশি বসেছে ওরা।

টুল ছেড়ে কার্পেটের ওপর দিয়ে হেঁটে এলেন ডক্টর পার্কার, সরাসরি পিটারের সামনে এসে থামলেন। জিরো-সেভেন-জিরো হাইজ্যাক হবার কয়েক মাস আগের ঘটনা। নানা সূত্র থেকে আমি আভাস পেলাম, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ নতুন একটা চেহারা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। প্রথম শুধু আভাস, তারপর কিছু কিছু প্রমাণ। ধীরে ধীরে পরিষ্কার হতে থাকল, দুনিয়া জুড়ে যে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা চলছে সেগুলোকে নির্দিষ্ট একটা কেন্দ্র বা সেন্টার থেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

দুহাত বুকের ওপর ভাজ করে এক পা থেকে আরেক পায়ে দেহের ভার চাপালেন ডক্টর পার্কার। সেন্টারটা কি ধরনের বা কোথায়, কে বা কারা গোটা দুনিয়ার টেরোরিস্টদের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে, এ সব কিছুই তখন আমরা জানতে পারিনি, এখনো জানি না। বিচ্ছিন্ন সব খবর আসতে লাগল- টেরোরিস্টদের পরিচিত লীডাররা কোথায় যেন মিটিং করেছে, সন্দেহজনক বা রহস্যময় চরিত্রের কিছু লোক কোথাও এক জায়গায় জড়ো হয়েছিল, মধ্যপ্রাচ্যের বা পুব ইউরোপের রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে কে বা কারা যেন গোপনে সাক্ষাৎ করেছে, এই সব। তারপর হঠাৎ করেই সন্ত্রাসবাদীদের আচরণ বলতে গেলে রাতারাতি বদলে গেল।

প্রথমে ধনী হিসেবে দুনিয়া জোড়া যাদের খ্যাতি আছে তাদের কিডন্যাপ করা শুরু হলো। মুক্তিপণ হিসেবে শত শত মিলিয়ন ডলার চলে গেল টেরোরিস্টদের হাতে বা সেন্টারে। ওপেক মন্ত্রীরা কিডন্যাপ হলো। তারপর সৌদি বাদশার আত্মীয়রা। সবশেষে হাইজ্যাক করা হলো জিরো-সেভেন-জিরো।

 সব কথা খুলে ব্যাখ্যা করার সময় ছিল না, আমি তোমাকে কঠোর নির্দেশ দিলাম-হাইজ্যাকারদের বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশন নেয়া চলবে না। টেরোরিজমের এই নতুন ঢেউ সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য দরকার ছিল আমার। আমি চেয়েছিলাম ক্ষতির ঝুঁকি নিয়ে হলেও হাইজ্যাকারদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু আমি যা বিশ্বাস করতাম না, তাই করে বসলে তুমি।

 স্বীকার করি, জেনারেল স্ট্রাইড, প্রথমে আমি ভয়ানক রেগে গিয়েছিলাম। পারলে তোমাকে আমি কড়া শাস্তি দিতাম। কিন্তু মাথা ঠাণ্ডা হবার পর হঠাৎ আমি উপলব্ধি করলাম, শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ার জন্যে যেমন লোক আমার দরকার তুমি নিজেকে ঠিক সেই লোক হিসেবে প্রমাণিত করেছে। জানলাম জেনারেল স্ট্রাইড নিয়ম ভাঙতে পারে, এবং স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

সেই সাথে আরো একটা ব্যাপার উপলব্ধি করলাম। তোমার ভেতর যে গুণ আমি আবিষ্কার করেছি, প্রতিপক্ষরাও সেই গুণটা দেখে আমার প্রতি আকৃষ্ট হবে। আতঙ্কবাদীরা বুঝবে, ওদের জন্যে চমৎকার একটা হাতিয়ার হতে পারো তুমি। কাজেই, আমি তোমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করলাম। অর্থাৎ তুমি আমার এজেন্ট থাকলে, কিন্তু তুমি নিজেও জানলে না। নিখুঁত, তাই না? জানো তুমি আমাদের কেউ নাও, তাই অভিনয় করার দরকার পড়ল না। সবাই জানল থোর কমান্ড থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে তোমাকে, অর্থাৎ যে কেউ তোমাকে কাজের অফার দিতে পারে, দিলে তুমি নেবেও। এবং ঘটলও ঠিক তাই। টোপ ফেলা হলো, এবং তুমি গিললে।

 আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না, মৃদুকণ্ঠে বলল পিটার। হাতের চুরুটটা নিভে গেছে।

ব্যাঙ্কে খবর নিলে বিশ্বাস হত, বললেন ডক্টর পার্কার মিটিমিটি হাসছেন তিনি। পিছিয়ে এসে ডেস্কের দেরাজ থেকে একটা এনভেলাপ বের করলেন, আবার পিটারের সামনে ফিরে এসে বাড়িয়ে দিলেন সেটা। এনভেলাপ খুলে সুইস ব্যাঙ্কের স্টেটমেন্টের ওপর চোখ বুলাল পিটার। থোর কমান্ড থেকে পদত্যাগ করার পরও প্রতি মাসের বেতন জমা হয়েছে ওর অ্যাকাউন্টে, কোনো টাকা তোলা হয়নি। দেখতেই পাচ্ছ, পিটার, এখনো তুমি আমাদের সাথে আছ। তোমাকে আমি শুধু এইটুকু বলতে পারি, ভান করার জন্যে দুঃখিত। কিন্তু ভান করায় লাভ যে হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

মুখ তুলে তাকাল পিটার, এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না। কথাগুলো, কিন্তু চেহারায় আগের সেই কাঠিন্য আর নেই।

কি বলতে চাইছেন, ডক্টর পার্কার?

বলতে চাইছি, শত্রুর বিরুদ্ধে আবার তুমি তৎপর হয়ে উঠেছে।

কিন্তু আমি তো শুধু নর্দান আর্মামেন্ট কোম্পানির একজন সেলস ডিরেক্টর মাত্র।

 হ্যাঁ, এবং নার্মকো হলো অল্টম্যান গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রির একটা অংশ। ব্যারন অল্টম্যান আর তার স্ত্রী ব্যারনেস ম্যাগডা অল্টম্যান, অদ্ভুত একটা জোড়া–মানে ছিল আর কি। এই যেমন ধরো, তুমি কি জানো, অল্টম্যান ইসরায়েলি ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি মোসাডের একজন এজেন্ট ছিল?

অসম্ভব! দ্রুত, অস্বস্তির সাথে মাথা নাড়ল পিটার। অল্টম্যান ছিল রোমান ক্যাথলিক। ইসরায়েলিরা ক্যাথলিকদের দুচোখে দেখতে পারে না।

উনবিংশ শতাব্দীর ফ্রান্সে ইহুদি হয়ে থাকা বিড়ম্বনা ছিল মাত্র, তাই অল্টম্যানের দাদা ধর্ম বদলে ক্যাথলিক হয়। কিন্তু যুবক অল্টম্যান তার মা আর দাদীর ভক্ত ছিল, তাদের মতো সেও তার ধর্ম বদলায়নি। খুন হবার আগপর্যন্ত ইহুদি ধর্মের প্রতিই তার টান ছিল।

দ্রুত চিন্তা করছে পিটার। এ-সব যদি সত্যি হয়, তাহলে গোটা ব্যাপারটা আবার আকৃতি বদলাচ্ছে। ব্যারনের মৃত্যুর সাথে নিশ্চয়ই এই ব্যাপারটার সম্পর্ক আছে। ওর জীবনে ব্যারনেস ম্যাগডার ভূমিকাও তাহলে অন্য রকম হতে বাধ্য।

ব্যারনেস? সে কি জানত?

ডেস্কের কাছে ফিরে গেলেন ডক্টর পার্কার পাইপে টোবাকো ভরে অগ্নিসংযোগ করলেন। তাঁর চেহারায় প্রশংসার ভাব ফুটে উঠল। সুন্দরী মহিলা, গুণী মহিলা কিন্তু তার সম্পর্কে আর কি জানি আমরা? পোল্যান্ডে জন্ম, বাবা ছিল ডাক্তার। ম্যাগডা যখন ছোট, তাকে নিয়ে পশ্চিমে পালিয়ে আসে। কয়েক বছর পর প্যারিস খুন হয়ে যায় সে, রোড় অ্যাক্সিডেন্ট। ঘাতক ট্রাকের ড্রাইভার পালিয়ে যায়। মৃত্যুটাকে ঘিরে আজও খানিকটা রহস্য রয়ে গেছে।

 এক পরিবার থেকে আরেক পরিবারে হাত বদল হতে লাগল বাচ্চাটা। কিছুদিন থাকল আত্মীয়-স্বজনদের কাছে, কিছুদিন বাবার বন্ধুদের বাড়ি। ইতোমধ্যে তার প্রতিভার কথা জানাজানি হয়ে গেছে। চমৎকার দাবা খেলে, ভাল গাইতে আর বাজাতে পারে, তেরো বছর বয়সেই তিনটে ভাষা শিখে ফেলল। এরপর বেশ লম্বা একটা সময় তার সম্পর্কে আর কোনো রেকর্ড পাওয়া যায় না। ম্যাগডা যেন সম্পূর্ণ। হারিয়ে গেল। একটু যা আভাস পাওয়া যায় তার ফস্টার মাদারের কাছ থেকে, ছোটবেলায় যে তাকে মানুষ করেছিল। সে এখন অথর্ব, আশির ওপর বয়স, সবকথা ভালো করে মনে করতে পারে না।

ম্যাগডা নাকি তাকে বলেছিল, আমি দেশে যাচ্ছি। দেশ? এর অর্থ আমাদের জানা নেই। দেশ মানে কি ওয়ারসও? ইসরায়েল? পূর্বের কোনো দেশ? পাইপে টান দিয়ে ধোয়া ছাড়লেন ডক্টর পার্কার।

আপনি তার সম্পর্কে খোঁজ-খবর করেছেন, বলল পিটার। যা শুনেছে তাতেই অস্বস্তি বোধ করছে ও, আরো কি শুনতে হবে কে জানে।

থোর কমান্ড ছেড়ে চলে যাবার পর তুমি যাদের সাথে যোগাযোগ করেছ তাদের সবার ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছি। তবে ব্যারনেসের ব্যাপারে বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলাম আমরা।

মাথা ঝাঁকিয়ে অপেক্ষা করে থাকল পিটার, খুঁটিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে ব্যারনেসকে যেন অপমান করা হবে।

অজ্ঞাতবাস থেকে আবার একদিন প্যারিস ফিরে এল ম্যাগডা, উনিশ বছর বয়সে। পাঁচটা ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে, অত্যন্ত যোগ্য প্রাইভেট সেক্রেটারি। শুধু মার্জিত আর সুন্দরী নয়, পশ্চিমা ফ্যাশন সম্পর্কে ভারি সচেতন। দেখতে দেখতে প্রভাবশালী মহল তার ভক্ত হয়ে পড়ল। পরিচয় হলো ব্যারন অ্যারন অল্টম্যানের সাথে।

ব্যারনেসও কি মোসাডের এজেন্ট? রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করল পিটার।

আমরা জানি না। তবে সম্ভাবনা খুব বেশি। হয়তো তার কাভার কোনো খুঁত নেই। সেজন্যেই তো তোমার ওপর ভরসা করছি আমরা, ব্যারনেস অল্টম্যান ইসরায়েলি এজেন্ট কিনা জানতে হবে তোমাকে।

আই সি! বিড়বিড় করে বলল পিটার।

ব্যারনেস নিশ্চয়ই জানত তার স্বামী একজন ইহুদি। স্বামীর মৃত্যুর সাথে এই ব্যাপারটার একটা যোগসূত্র আছে, বুঝতে পারার কথা তার। তাছাড়া, সে নিজেও ছয় বছর নিখোঁজ ছিল–তেরো থেকে উনিশ। এই ছয় বছর কোথায় ছিল সে?

ম্যাগডা কি ইহুদি? জিজ্ঞেস করল পিটার। তার বাবা কি ইহুদি ছিল?

আমাদের তাই বিশ্বাস, কিন্তু ধর্মের ব্যাপারে লোকটা কখনো আগ্রহ দেখায়নি। তার মেয়েও ধর্মকে গুরুত্বের সাথে নেয়নি। ব্যারনের সাথে তার বিয়ে হয় ক্যাথলিক ধর্মমতে, কিন্তু সেটা স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা বজায় রাখার জন্যে।

শান্ত গলায় পিটার বলল, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি আমরা।

মাথা নাড়লেন ডক্টর পার্কার। আমার তা মনে হয় না। ব্যারন অল্টম্যান তো এই সন্ত্রাসবাদেরই শিকার। ব্যারনেসও শিকার হতে যাচ্ছিল–সন্ত্রাসবাদবিরোধী একজন এজেন্ট তার সাথে মেলামেশা শুরু করার পরপরই। তাৎপর্য একটা আছে। বলে মনে হচ্ছে না তোমার, পিটার?

চুপ করে থাকল পিটার।

সেদিন রাতে লা পিয়েরে বেনিতে যা ঘটল, সে সম্পর্কে তোমার কি ধারণা? প্যারিস থেকে সিট্রন অনুসরণ করেছিল পিটারকে। বলল, আমাকে নয়, ওরা ব্যারনেসকে খুন বা কিডন্যাপ করার চেষ্টা করেছিল।

তুমি তার গাড়ি চালাচ্ছিলে, তাই না?

হ্যাঁ।

আর ওই রাস্তা দিয়েই আসা-যাওয়া করত ব্যারনেস।

 হ্যাঁ।

 ওখানে তোমাকে যেতে বলেছিল কেউ! কে?

গাড়িটা আমি ব্যারনেসকে ব্যবহার করতে নিষেধ করি…

তার মানে কি তুমি স্বইচ্ছায় মাসেরাতি নিয়ে ওখানে যাচ্ছিলে?

 হ্যাঁ, নিজেও জানে না পিটার কেন মিথ্যে বলছে।

ব্যারনেস আর পিটার সুইটজারল্যান্ড থেকে ফেরার পর ওদের সাথে দেখা হয় দুজন দেহরক্ষী আর দুজন ড্রাইভারের তারা জানত।

তুমি ঠিক জানো?

হ্যাঁ, জানি, বলল পিটার। আমি ছাড়া আর কেউ জানত না। কিন্তু ব্যারনেস ম্যাগডা জানত। রাগের সাথে চিন্তাটা মাথা থেকে বের করে দিতে চেষ্টা করল পিটার।

 ঠিক আছে, তাহলে আমাদের ধরে নিতে হবে যে ব্যারনেসের ওপরই হামলা করা হয়েছিল। কিন্তু হামলাটা কি ছিল–খুনের চেষ্টা, নাকি কিডন্যাপিংয়ের? যদি খুনের চেষ্টা হয়ে থাকে, আমরা ধনে নিতে পারি প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো এজেন্টের কাজ ছিল ওটা, ধরে নিতে পারি ব্যারনেসও মোসাডের এজেন্ট। কিন্তু যদি কিডন্যাপিংয়ের চেষ্টা হয়ে থাকে তাহলে মনে করতে হবে আতঙ্কবাদীরা দায়ী, উদ্দেশ্য ছিল মোটা টাকা কামানো। তোমার কি মনে হয়, পিটার?

রাস্তা বন্ধ করে রেখেছিল ওরা, বলল পিটার, কিন্তু পুরোপুরি নয়, মনে আছে ওর। ভুয়া পুলিশটা আমাকে থামার ইঙ্গিত দিল—কিংবা গাড়ির গতি কমাবার ইঙ্গিত ছিল ওটা, হয়তো গুলি শুরু করার আগে সহজ একটা টার্গেট পেতে চাইছিল ওরা। আমি থামব না বুঝতে পারার পরই কেবল গুলি শুরু করল ওরা। কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়। আমার ধারণা ব্যারনেসকে ওরা জীবিত ধরতে চেয়েছিল।

 ঠিক আছে, মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন ডক্টর পার্কার। আপাতত এটাই মেনে নেব আমরা। কলিনের দিকে তাকালেন তিনি। তোমার কোনো প্রশ্ন আছে নাকি?

ধন্যবাদ, স্যার। আমরা এখনো জানি না আর অফারটা কিভাবে পেল পিটার। প্রথমে কে যোগাযোগ করেছিল?

 লন্ডনের একটা এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সি প্রথমে যোগাযোগ করে আমার সাথে, বলল পিটার। তারপর ব্যারনেস ম্যাগডা সরাসরি…।

তোমাকে শুধু সেলস ডিপার্টমেন্টের দায়িত্ব নেয়ার কথা বলা হয়? অন্য কোনো দায়িত্বের কথা বলা হয়নি? সিকিউরিটি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইন্টেলিজেন্স…?

না। তবে ব্যারনেসের সাথে ঘনিষ্ঠ হবার পর আমি তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলি। সিকিউরিটি সিস্টেমে কিছু রদবদল করা হয়।

তার স্বামীর মৃত্যু নিয়ে তোমাদের মধ্যে কথা হয়নি?।

হয়েছে, বলল পিটার, যথাসম্ভব কম মিথ্যে বলে পার পেতে চাইছে পিটার।

ব্যারনেস তোমাকে বলেনি যে সে তার স্বামীর খুনিকে খুঁজছে বা খুনিকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে তোমার সাহায্য পেলে ভালো হতো?

দ্রুত চিন্তা করল পিটার। প্যারিসের ব্রিটিশ দূতাবাসের মিলিটারি অ্যাটাশের সাথে যোগাযোগ করেছিল পিটার, খলিফাকে আকৃষ্ট করার জন্যে ওটা একটা টোপ ছিল ওর। যোগাযোগের খবরটা হয় পেয়ে গেছেন ডক্টর পার্কার, নয়তো পেয়ে যাবেন। অ্যাটলাসের কম্পিউটার ব্যবহার করা তার জন্যে কোনো সমস্যা নয়। না, অস্বীকার করে লাভ হবে না।

হ্যাঁ, এ ধরনের একটা অনুরোধ সে আমাকে করেছে। প্যারিসে খোঁজখবর করেছি আমি, কেউ কিছু বলতে পারে নি।

ডেস্কের ওপর ঝুঁকে নোটবুকে খসখস করে কি যেন লিখলেন ডক্টর পার্কার। অল্টম্যানের সাথে বিয়ের আগে আটজন লোকের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক ছিল ব্যারনেস ম্যাগডার, আমরা জানি। প্রত্যেকেই তারা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং ধনী। তাদের মধ্যে ছয়জন বিবাহিত…।

রেগে গিয়ে ভেতর ভেতর এমন কাঁপতে লাগল পিটার, নিজেই অবাক হয়ে গেল। ব্যারনেস ম্যাগডাকে অমার্জিতভাবে কলঙ্কিত করায় ডক্টর পার্কারকে ঘৃণ্য বলে মনে হলো। প্রাণপণ চেষ্টা করে চেহারা শান্ত রাখল ও, হাত দুটো কোলের ওপর শিথিলভাবে পড়ে আছে।

 …এসব সম্পর্ক অত্যন্ত সাবধানে লুকিয়ে রাখত সে, বলে চলেছেন ডক্টর পার্কার। তবে বিয়ের কাছাকাছি সময়ে অন্য কোন পুরুষের সাথে মেলামেশা করেনি। বিয়ের পরও তার জীবনে অন্য কোনো পুরুষ ছিল না। কিন্তু স্বামী মারা যাবার পর আবার বিছানার সঙ্গী হিসেবে তিনজনকে জুটিয়ে নেয় ব্যারনেস। একজন ফ্রেঞ্চ সরকারের মন্ত্রী, একজন আমেরিকান ব্যবসায়ী, ঝট করে নোটবুকের দিকে একবার ঝুঁকেই মাথা তুললেন তিনি। অতি সম্প্রতি আরেকজনের সাথে তার অ্যাফেয়ার চলছে।

ঠাণ্ডা, অন্তর্ভেদী চোখে সরাসরি পিটারের চোখে তাকিয়ে আছে পার্কার।

মহিলা ব্যবসার সাথে ব্যক্তিগত সুখ মেলাতে ভালোবাসে। তার সাম্প্রতিক সেক্সয়াল পার্টনারের ক্ষেত্রেও বোধ হয় কথাটা খাটে।

কলিন নোবলস অস্বস্তিভাবে কেশে ওঠে, কিন্তু তার দিকে না তাকিয়ে সোজা পার্কারের দিকে তাকিয়ে থাকল পিটার। ওর আর ম্যাগডার সম্পর্কের কোথাও লুকোচুরি ছিল না–কিন্তু এই সব ব্যাপার নিয়ে আলোচনা দারুণ তিক্ত লাগছে ওর কাছে।

আমার ধারণা, তুমি খুব ভালো পজিশনে আছে, পিটার। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অনায়াসে বের করে আনতে পারবে। তোমার আশপাশেই রয়েছে শত্রু, চোখ খোলা রাখলেই চিনতে পারবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ভাবাবেগের বা দুর্বলতার বশে দায়িত্বের কথা ভুলে যাবে কিনা।

আমাকে দুর্বল বা ভাবাবেগে আপ্লুত ভাবার কোনো কারণ নেই, ডক্টর পার্কার, বলল পিটার। আমার দায়িত্ববোধ সম্পর্কে আপনার ভালো ধারণা থাকার কথা।

আছেও, আর সেজন্যেই তোমার ওপরই সম্পূর্ণ নির্ভর করছি আমরা। ব্যারনেস ম্যাগডা সম্পর্কে এখন অনেক বেশি জানো তুমি। কাজেই বুঝতে পারছ, কেন আমরা ভদ্রমহিলা সম্পর্কে এত বেশি আগ্রহী।

পারছি, শান্ত সুরে বলল পিটার। চেহারায় রাগের কোনো চিহ্নমাত্র নেই। আপনি চাইছেন সম্পর্কের সুযোগটা নিয়ে আমি তার ভেতরের খবর সংগ্রহ করি, তাই না?

 তাই। কিন্তু মনে রাখতে হবে উল্টোটাও সত্যি-ব্যারনেস ম্যাগডাও সম্পর্কটার সুযোগ নিয়ে তোমার কাছ থেকে আমার সম্বন্ধে খবর নেয়ার চেষ্টা করছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ডক্টর পার্কার। আমাকে হয়তো একটু অমার্জিত মনে হয়েছে, পিটার। সেজন্যে আমি দুঃখিত। আমি হয়তো তোমার রঙিন একটা স্বপ্নে কাদা ছিটালাম, সেজন্যেও দুঃখিত।

হাত নেড়ে ইঙ্গিত করলে পার্কার। অর্থাৎ, মিটিং শেষ।

আমার বয়সে ভাবালুতা একটা অবাস্তব ব্যাপার, ডক্টর। উঠে দাঁড়ায় পিটার। আমি কি সরাসরি আপনার কাছে রিপোর্ট করব?

সমস্ত যোগাযোগের ব্যবস্থা কলিন করবে। এগিয়ে এসে পিটারের কাঁধে একটা হাত রাখলেন ডক্টর পার্কার। অন্য কোনো উপায় থাকলে কাজটা তোমাকে দিতাম না, পিটার।

 অস্বস্তি না করে পার্কারের হাত নিজের হাতে নিয়ে নিল পিটার। দারুণ ঠাণ্ডা, শুষ্ক ওটা। যদিও বোঝা যায় না, কিন্তু পিয়ানো বাজিয়ে ওই হাতে দারুণ শক্তি ধরেন কিংস্টোন পার্কার-অনুভব করল সে।

 আমি বুঝতে পারছি, স্যার, পিটার বলে। যাই হোক, সত্যটা সে উদঘাটন করেই ছাড়বে।

.

ক্লান্তির অজুহাত দেখিয়ে জিন-রামি খেলার প্রস্তাব এড়িয়ে গেল পিটার, দীর্ঘ ট্রান্স আটলান্টিক ফ্লাইটের বেশিরভাগ সময় ঘুমের ভান করে কাটাল। চোখ বন্ধ, মন জুড়ে থাকা সমস্ত চিন্তা-ভাবনা গোছগাছ করে গোটা ব্যাপারটার একটা আকার পাবার চেষ্টা করল ও। কিন্তু লাভ হলো না, বারবার তালগোল পাকিয়ে গেল সব। ব্যারনেস ম্যাগডার প্রতি ওর অনুভূতি এবং বিশ্বস্ততা সম্পর্কেও নিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারল না। দৈহিক সম্পর্ক–ডক্টর পার্কার ব্যারনেস সম্পর্কে আপত্তিকর শব্দ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তথ্যটা সত্যি হয়? বিয়ের আগে আটজনের সাথে দৈহিক সম্পর্ক ছিল ব্যারনেসের, ছয়জন তার মধ্যে বিবাহিত পুরুষ বিয়ের পর আরো দুজনের সাথে, দুজনই ধনী বা প্রভাবশালী লোক। ব্যারনেস ম্যাগডার বিবস্ত্র শরীর চোখের পর্দায় ফুটে উঠল। শুধু সুন্দর নয়, পবিত্র বলে মনে হয়েছিল পিটারের। ওর মনে হলো, ওর সাথে বেঈমানী করা হয়েছে। পরমুহূর্তে নিজেকে তিরস্কার করল পিটার–কিশোরসুলভ ভাবাবেগে ভোগার কোনো মানে হয় না।

 আরো অস্বস্তিকর প্রশ্ন তুলেছেন ডক্টর পার্কার। মোসাডের সাথে ব্যারনেসের যোগাযোগ। হারিয়ে যাওয়া ছয়টি বছর। দুজন একান্তে, নিভৃতে যে সময়গুলো কাটিয়েছে তার কথা মনে পড়ে গেল পিটারের। এমন সুন্দর যার মন, এমন মার্জিত যার রুচি, তার দ্বারা কি এত নোংরা ছলনা সম্ভব? সত্যি কি ওকে খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করছে ব্যারনেস, আর সব পুরুষকে যেমন ব্যবহার করেছে? তারপর কাজ ফুরিয়ে গেলে আবর্জনার মতো ফেলে দেবে, আর সবাইকে যেমন দিয়েছে?

একটা ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর পেতে হবে পিটারকে। ব্যারনেস ম্যাগডার সাথে কতটুকু জড়িয়ে পড়েছে ও? তার প্রতি কতটুকু দুর্বল ও? কিন্তু হিথরোতে নামার পরও নিজের মন বুঝতে পারল না পিটার, চুলচেরা হিসেব করে ভালোবাসার গভীরতা মাপা সম্ভব হলো না। হঠাৎ করে ব্যারনেসের একটা প্রস্তাবের কথা মনে পড়ে গেল। মাঝখানে একটা লেগুন নিয়ে নয়টা দ্বীপ, যেখানে ওরা পালাতে পারে। সন্দেহ নেই, ব্যারনেস ম্যাগডার জীবনও সঙ্কট আছে, সেজন্যেই জীবন থেকে পালাতে চায় সে। কিন্তু ওকে নিয়ে কেন? ভালোবেসে ফেলেছে, তাই? তাহলে কি তার ভালোবাসা অকৃত্রিম?

কে জানে, শেষ পরিণতি কি লেখা আছে দুজনের কপালে। এমন তো নয় যে দুজনের পরিচয়ই হয়েছে পরস্পরকে ওরা ধ্বংস করবে বলে?

হোটেল ডরচেস্টারে ব্যারনেস ম্যাগডার তিনটে আলাদা আলাদা মেসেজ পেল পিটার। প্রতিটি মেসেজে রবুইলের টেলিফোন নম্বর দিয়েছে। কাপড়চোপড় না ছেড়েই ডায়াল করল পিটার।

পিটার ডার্লিং! কি দুশ্চিন্তায় ছিলাম! কোথায় ছিলে তুমি? বিশ্বাস করা কঠিন ব্যারনেস ম্যাগডা ভান করছে। এবং গা শিরশির করা পুলক পিটারের সারা শরীরে, ছড়িয়ে পড়ল। পরদিন দুপুরে, ড্রাইভারকে না পাঠিয়ে চার্লস দ্য গল এয়ারপোর্টে নিজেই চলে এল ব্যারনেস।

আমার তর সইছিল না, বলল সে, পিটারের কনুইয়ের ভাঁজে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে গা ঘেঁষে এল। তোমাকে এক ঘণ্টা আগে দেখতে পাব বলে নিজেই চলে এলাম। মানে হলো, জেনারেল স্ট্রাইড পিটার, নির্লজ্জের মতো আচরণ করছি আমি! জানো, তুমি আমাকে আমার কৈশোর ফিরিয়ে দিয়েছ!

সন্ধ্যা আটটায় একটা পার্টিতে থাকল ওরা, ডিনার খেল লিমেরী রোদায়, থিয়েটার দেখল পাপেতি-তে। যেখানেই গেল ওরা, প্রতি মুহূর্ত পিটারের স্পর্শ নিল ব্যারনেস, যেন ওকে হারাবার ভয়ে অবচেতনভাবে শঙ্কিত হয়ে আছে। মাঝরাতে লা পিয়েরে বেনিতে ফেরার সময়ও নিজের কোলের ওপর পিটারের হাতটা ধরে থাকল সে।

 টেলিফোনে বলতে পারিনি তোমাকে, শুরু করল পিটার। অ্যাটলাস থেকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে আমাকে। ওদের প্রেসিডেন্ট আমাকে নিউ ইয়র্কে ডেকেছিলেন। ওরাও খলিফার পিছনে লেগে আছে।

পিটারের হাতের ওপর ব্যারনেসের আঙুলগুলো নড়ল না। একটা দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ পেল পিটার। কখন বলবে তার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম আমি, পিটার। জানতাম তুমি আমেরিকায় গেছ। কেন যেন মনে হয়েছিল, তুমি মিথ্যে কথা বলতে পার আমাকে। তা যদি বলতে, কি করতাম জানি না।

ব্যারনেস জানে নিউ ইয়র্কে গিয়েছিল ও? কিন্তু কিভাবে? তারপর পিটারের মনে পড়ল, তথ্য পাবার নিজস্ব উৎস আছে তার।

সব আমাকে বল, পিটার।

প্রায় সব কথাই বলল পিটার, শুধু ব্যারনেস সম্পর্কে ডক্টর পার্কারের অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলো বাদ দিয়ে গেল-বাদ দিয়ে গেল ব্যারনের মোসাড কানেকশন, ব্যারনেসের হারানো ছয়টা বছর, আর দশজন নামহীন পুরুষ প্রেমিকের প্রসঙ্গ।

 শত্রু খলিফা নামটা ব্যবহার করছে ওরা তা জানে না, বলল পিটার। তবে ওরা আন্দাজ করে নিয়েছে, তুমি তাকে খুঁজছ। ওদের ধারণা, আমার কাছ থেকে সাহায্য চাও তুমি।

লা পিয়েরে বেনিতে পৌঁছেও আলোচনা থামল না, একটা সোফায় পাশাপাশি গা ছুঁয়ে বসে ফিসফিস করে কথা বলল ওরা। নিজের ভাবসাব লক্ষ্য করে নিজেই অবাক হয়ে গেল পিটার, মন থেকে প্রায় সমস্ত সন্দেহ আর অবিশ্বাস বেমালুম উবে গেছে বলে মনে হতে লাগল। ব্যারনেসের মধ্যে কি যেন একটা জাদু আছে, কাছে এলে মুগ্ধ করে ফেলে।

 অর্গানাইজেশনের একজন হিসেবে এখনো আমাকে রেখেছেন ডক্টর পার্কার, ব্যাখ্যা করল পিটার। প্রত্যাখ্যান বা আপত্তি করিনি আমি। কারণ খলিফাকে খুঁজে বের করতে হবে, অর্গানাইজেশনে আমার একটা পজিশন থাকলে খোঁজার কাজটা সহজ হবে।

 আমি একমত। হ্যাঁ, আমাদের সাহায্য হবে, বিশেষ করে এখন যখন ওরাও জানে যে খলিফার অস্তিত্ব আছে।

গভীর রাতে ঘনিষ্ঠ হয়ে এল ম্যাগডা। এ শুধু দুটো দেহ এক হওয়া নয়, কোমল সমস্ত ভাব নিয়ে দুটো কাতর মনের ব্যাকুল মিলন। গোপনীয়তার স্বার্থে দিনের আলো ফোঁটার আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ব্যারনেস ম্যাগডা, কিন্তু এক ঘণ্টা পর ব্রেকফাস্টের জন্যে আবার ওরা মিলিত হলো গার্ডেন রুমে।

পিটারের কাপে কফি ঢালল ব্যারনেস, ইঙ্গিতে প্লেটের পাশে ছোট্ট পার্সেলটা দেখাল পিটারকে। যতটুকু সাবধান হওয়া দরকার ততটা আমরা হতে পারছি না, শেরি। রাঙা ঠোঁট টিপে হাসল সে। কে যেন জানে কোথায় তুমি রাত কাটাও।

ডান হাতের তালুতে নিয়ে পার্সেলটার, ওজন নিলো পিটার। বাদামি কাগজে মোড়া, লাল মোম দিয়ে সীল করা।

কাল-সন্ধ্যায় স্পেশাল ডেলিভারি এজেন্সির লোক পৌঁছে দিয়ে গেছে, কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল ব্যারনেস, তার পটল চেরা সবুজ চোখে কৌতূহল।

 পার্সেলের গায়ে একটা চৌকো কাগজ সাঁটা রয়েছে, ঠিকানাটা তাতে টাইপ করা। স্ট্যাম্পগুলো ব্রিটিশ। পার্সেলটা নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে অকারণেই কেমন যেন ভয় পেয়ে গেল পিটার। দামী আসবাবে সাজানো গার্ডেন রুমে কোথাও যেন ও পেতে আছে কি একটা বিপদ।

কি হলো পিটার? পিটারের চেহারা দেখে থতমত খেয়ে গেছে ব্যারনেস।

না, কই, বলল পিটার। কিছু না।

হঠাৎ তুমি সাদা হয়ে গেলে কেন? অসুস্থ বোধ করছ, ডার্লিং?

না-না। এমনি, মানে… কথা শেষ না করে টেবিল থেকে ছোট একটা ছুরি তুলে পার্সেলের গা থেকে খুঁচিয়ে মোম তুলতে শুরু করল পিটার। তারপর বাদামি কাগজের মোড়ক খুলল। সাদা, স্বচ্ছ কাঁচের তৈরি একটা বোতল, মাথাটা প্যাঁচ বিশিষ্ট ছিপি দিয়ে আটকানো। ভেতরের তরল পদার্থটুকুও স্বচ্ছ-এক ধরনের প্রিজারভেটিভ, সাথে সাথে বুঝল পিটার। স্পিরিট বা ফরমাল ডিহাইড।

তরল পদার্থের মাঝখানে ভাসছে সাদাটে একটা জিনিস।

কি ওটা? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল ব্যারনেস।

পেটে একটা আলোড়ন উঠল পিটারের, গলার কাছে উঠে আসতে চাইল বমি বমি ভাব।

বোতলের ভেতর জিনিসটা ধীরে ধীরে ঘুরছে। হঠাৎ গোড়ার দিকটা লালচে আলোর মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। লালের মাঝখানে সাদা হাড়।

 তোমার মা আজকাল নখে রঙ করতে দেয় তোমাকে, মেলিসা? নিজের স্বরণে প্রশ্নটা যেন বেজে ওঠে পিটারের। ওর মেয়ে সাথে সাথে আঙুলগুলো মেলে ধরে দেখিয়েছিল, লাল রঙে রাঙানো। ঠিক ওই লাল টুকরোর মতো।

ওই, হ্যাঁ, ড্যাডি! বলেছিল মেলিসা। তুমি তো জানো না? ভুলেই যাও, আমার বয়স প্রায় চৌদ্দ এখন!

কোনো মানুষের কাটা আঙুল ওটা। গোড়া থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। বোতলটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে উঠল পিটারের চোখ জোড়া।

 বমি উঠে এল পেটের গভীর থেকে।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *