২. একজোড়া বাথিং ট্রাঙ্ক

সব কাপড়চোপড় খুলে শুধু একজোড়া বাথিং ট্রাঙ্ক পরেছে পিটার, পায়ে ক্যানভাস চপ্পল। সামনাসামনি দেখা করার জন্যে নির্দেশ দিয়েছে ইনগ্রিড, মেয়েটাকে কাছ থেকে মাপজোক করার সুযোগ পেয়ে খুশি হয়েছে ও।

প্রতিটি মুহূর্ত তোমাকে আমরা কাভার দেব, পিটারকে বলল কলিন নোবলস্, ঘণ্টা বাজার আগে বক্সারকে ঘিরে কোচ যেমন ব্যস্ত থাকে তেমন আচরণ করছে সে। গানারদের সরাসরি নির্দেশ দেব আমি—পার্সোনালি।

বিশেষভাবে হাতে তৈরি পয়েন্ট টু-টু-টু ম্যাগনাম দেয়া হয়েছে স্নাইপারদের, প্রচণ্ড ভেলোসিটি আর স্ট্রাইকিং পাওয়ার নিয়ে ব্যারেল থেকে বেরিয়ে আসবে ছোট হালকা বুলেট। ম্যাচ-গ্রেড অ্যামুনিশন, প্রতিটি রাউন্ড হাতের সযত্ন পরশ দিয়ে পালিশ করা হয়েছে। ইনফ্রারেড টেলিস্কোপিক সাইট তো আছেই, একপলকের ব্যবধানে লেজার সাইটও ব্যবহার করা যাবে, ফলে কি দিনে কি রাতে অস্ত্রটা হয়ে উঠেছে লক্ষ্যভেদে ভীতিকর রকম অব্যর্থ। প্রায় একই সমতল সরলরেখা ধরে সাতশ গজ পর্যন্ত ছুটবে বুলেট। সন্দেহ নেই, মানুষ খুন করার জন্যেই তৈরি করা হয়েছে ওগুলো। যাকে লক্ষ্য করে গুলি করা হবে তাকেই লাগবে শুধু, পাশে দাঁড়ানো কাউকে বা আরোহীদের গায়ে আঁচড়টিও কাটবে না। বুলেট হালকা হলেও, তেড়ে আসা যাড়ের মতো ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে টার্গেট করা লোকটাকে। শরীরের ভেতর ঢুকে বিস্ফোরিত হবে বুলেট, ফলে টার্গেটের পিছনে কেউ থাকলেও তার কোনো ক্ষতি হবে না।

তুমিও যেমন! হাসল পিটার। কথা বলতে চায় ওরা, গুলি করবে না–অন্তত এখুনি করবে না।

তবু মেয়ে মানুষ তো, সাবধান করে দিল কলিন। কি করতে কি করে বসে। আর একটা তো স্রেফ প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছে।

বন্দুকের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্যামেরা আর সাউন্ড ইকুইপমেন্ট।

কয়েকজনের কান মুচড়ে দিয়ে এসেছি, ছবি যা তুলবে অস্কার না পেয়ে যায়! হাতঘড়ি দেখল কলিন। যাবার সময় হলো। মহারানীকে অপেক্ষা করিয়ে রাখা ঠিক হবে না। হালকাভাবে পিটারের কাঁধ চাপড়ে দিল সে। দেরি কোরো না, স্যার, একসাথে কফি খাব। শান্তভাবে রোদে বেরিয়ে এল পিটার, হাত দুটো কাঁধের ওপর তুলল-তালু খোলা, আঙুলগুলো ছড়ানো।

 নিজের পায়ের আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই–শান্ত, নিঃসংকোচ, দৃঢ় ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে পিটার। তবু মনে হলো ওর জীবনের দীর্ঘতম পদযাত্রা এটা। বোয়িংয়ের যত কাছে চলে এল ততই সেটা টাওয়ারের মতো উঁচু হতে থাকল, চোখের দৃষ্টি ক্রমশ উঠে গেল আরো ওপরে। ইনগ্রিড ওকে প্রায় বিবস্ত্র অবস্থায় আসতে বলেছে, কারণটা শুধু এই নয় যে সাথে অস্ত্র রাখতে পারবে না, মুখপাত্রকে আড়ষ্ট এবং অসহায় অবস্থায় পেতে চায় সে। গেস্টাপো কৌশল, জেরা করার সময় তারাও উলঙ্গ করে নিত বন্দীদের। কিন্তু পিটারের বেলায় ইনগ্রিডকে নিরাশ হতে হবে। ওর মধ্যে কোনো আড়ষ্ট ভাব নেই, বুকের ভেতরটা ধুকধুক করলেও চেহারায় তার কোনো ছাপ নেই-বুক টান করে হাঁটছে ও, নিজের মেদহীন পেটা শরীর নিয়ে গর্বিত। চর্বিবহুল, ভুড়ি বিশিষ্ট একটা স্কুল শরীর এই চারশো গজ বয়ে নিয়ে আসতে হলে লজ্জায় মরে যেত পিটার।

 অর্ধেক দূরত্ব পেরিয়ে এসেছে, এই সময় সামনের দরজা, ককপিটের ঠিক পিছনে, খুলে গেল। চৌকো ফাঁকাটায় একজন নয়, একটা দলকে দেখা গেল। চারপাশ কুঁচকে চোখ ছোট করল পিটার, ইউনিফর্ম পরা তিনটে মূর্তি-না, চারটে-ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ইউনিফর্ম। দুজন পাইলট, ওদের মাঝখানে একটা নারীমূর্তি। স্টুয়ার্ডেস।

কাঁধে কাঁধে ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরা, ওদের পিছনে আরো একটা মাথা, মনে হলো সোনালি চুল। বাইরে প্রখর রোদ, প্লেনের ভেতর আলো কম, ভালো করে দেখা গেল না।

আরো কাছে এসে দেখল ডানদিকে দাঁড়ানো পাইলটের বেশি, ছোট করে ছাঁটা কাঁচা-পাকা চুল মাথায়, মুখটা গোল। তার মানে কমান্ডার ওয়াটকিংস হবে। যোগ্য লোক, তার সার্ভিস রেকর্ড পড়েছে পিটার। কো-পাইলট আর স্টুয়ার্ডেসের দিকে না তাকিয়ে তাদের পিছন দিকে মনোযোগ দিল ও। কিন্তু খোলা হ্যাচের ঠিক নিচে না দাঁড়াবার আগে মেয়েটা ওকে তার চেহারা দেখার সুযোগ দিল না।

চুল নয় যেন সোনালি, কোমল আগুন। মুখ নয় যেন সূর্যমুখী ফুল। মুগ্ধ বিস্ময়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকল পিটার। কমলা রঙের মুখে রোদের পালিশ, সবুজ চোখে কি গভীর সরলতা, পিটারের মনে হলো সে বুঝি স্বপ্ন দেখছে। বিশ্বাসই হতে চায় না মেয়েটা টেরোরিস্টদের একজন।

কথা বলল মেয়েটা, আমি ইনগ্রিড। পিটার ভাবল, কিছু বিষাক্ত ফুল খুব সুন্দর হয়।

আমি ব্রিটিশ আর মার্কিন সরকারের নির্বাচিত নেগোশিয়েটর, বলল পিটার, পাইলটের মাংসল মুখের দিকে তাকাল। তোমার কমান্ডোদের কজন রয়েছে প্লেনে?

কোনো প্রশ্ন নয়! কঠিন সুরে চিৎকার করল ইনগ্রিড, আর ঊরুর সাথে সেঁটে থাকা ডান হাতের চারটে আঙুল সিধে করল সিরিল ওয়াটকিংস, চেহারায় কোনো ভাব ফুটল না।

সংখ্যাটা আগেই আন্দাজ করা হয়েছিল, তবে নিশ্চিতভাবে জানাটা জরুরি ছিল। পাইলটের প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করল পিটার। শর্ত নিয়ে আলোচনা করার আগে, বললও, এবং মানবিক কারণে, তোমার জিম্মিদের সুস্থতা আর আরামের জন্যে কিছু করার আছে কিনা ভাবতে পারি আমরা।

সবাইকে যত্নে রাখা হয়েছে।

খাবার বা পানির দরকার?

মাথাটা পেছনদিকে একটু হেলিয়ে মনের আনন্দে প্রাণ খুলে হাসল ইনগ্রিড। পানির সাথে ল্যাক্সাটিভ মিশিয়ে দেয়ার মতলব, তাই না? তরল ময়লায় যাতে আমাদের হাঁটু ডুবে যায়? গন্ধে পাগল হয়ে বেরিয়ে যাব?।

 প্রসঙ্গটা নিয়ে আর আগে বাড়ল না পিটার, অবশ্য ড্রাগ মেশানো খাবার অনেক আগেই তৈরি করে রেখেছে থোর কমান্ডের ডাক্তার। প্লেনে গুলিতে আহত লোক আছে কেউ?

 কেউ আহত হয়নি, হাসি থামিয়ে সরাসরি অস্বীকার করল ইনগ্রিড, কিন্তু দুটো আঙুল দিয়ে গোল একটা আকৃতি তৈরি করল ওয়াটকিংস, হা-সূচক ইঙ্গিত। তার সাদা শার্টের আস্তিনে রক্তের শুকনো দাগও দেখতে পেল পিটার। যথেষ্ট হয়েছে, পিটারকে সাবধান করে দিল ইনগ্রিড। আরেকটা প্রশ্ন কর, আলোচনা বাতিল করে দেয়া হবে…

 ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি মেনে নিল পিটার। আর কোনো প্রশ্ন নয়।

পরমুহূর্তে ঝড়ের বেগে কঠিন কঠিন শব্দের বৃষ্টি শুরু হলো, এই কমান্ডোর চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো নিষ্ঠুর, চণ্ডাল, অমানবিক, নব্য-সাম্রাজ্যবাদী, বর্ণ-বৈষম্যবাদী, বিবেকহীন শোষক, অবৈধ স্বৈরাচারী সরকারকে সমূলে উৎখাত করা, যারা এই সম্পদশালী দেশের বৈধ সন্তানদের দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দী করে রেখেছে, সংখ্যাগুরু কালো শ্রমিকদের ন্যায্য পারিশ্রমিক থেকে বঞ্চিত করছে এবং সর্বহারা শ্রেণির মৌলিক মানবাধিকার অস্বীকার করছে।

জনপ্রিয় কথাবার্তা, সন্দেহ নেই, ভাবল পিটার। কে বলবে ওদের উদ্দেশ্য মহৎ নয়? সবার সহানুভূতি আদায়ের জন্যে ভালো একটা ভূমিকা বাছাই করেছে আতঙ্কবাদীরা। দক্ষিণ আফ্রিকা টার্গেট হিসেবে আদর্শ।

পিটার উপলব্ধি করল, দায়িত্ব পালন ওর জন্যে খুব কঠিন হবে।

বিরতিহীন একনাগাড়ে বলে চলেছে মেয়েটা। দীর্ঘ বাক্য, আবেগ ঢালা কাঁপা কাঁপা গলা, সযত্নে চয়ন করা শব্দমালা। তার বলার ভঙ্গিতে ধর্মীয় উন্মাদনার সব রকম লক্ষণ পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠল। কোনো সন্দেহ নেই মেয়েটা ফ্যানাটিক। ধীরে ধীরে গলা চড়ছে, কর্কশ আর তীক্ষ্ণ। সুন্দর মুখাবয়ব বিকৃত হয়ে উঠল, চোখ থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে ঘৃণা আর আক্রোশ। মেয়েটা থামার পর পিটার বুঝল, এই মেয়ের পক্ষে অসম্ভব বলে কিছু নেই। উদ্দেশ্য পূরণের জন্যে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতে পারে, নিজের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে ঘটিয়ে বসতে পারে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড। শিউরে উঠল ও।

কেউ ওরা কথা বলছে না তবে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে পরস্পরের দিকে। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এল মেয়েটার নিঃশ্বাস। তাকে শান্ত হবার জন্যে সময় দিয়ে অপেক্ষা করছে পিটার।

আমাদের প্রথম দাবি, আবার শান্ত গলায় বলল ইনগ্রিড, কড়া চোখে লক্ষ্য করছে সে পিটারকে, আমাদের প্রথম দাবি, এইমাত্র আমি যে বিবৃতিটা দিলাম সেটা ব্রিটিশ, মার্কিন এবং দক্ষিণ আফ্রিকান টেলিভিশন নেটওয়ার্কে পড়ে শোনাতে হবে। স্থানীয় সন্ধ্যা সাতটায় পড়তে হবে-লস অ্যাঞ্জেলস্, নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, আর জোহানেসবার্গ টিভিতে। পিটার জানে, সাংবাদিকদের কল্যাণে রাতারাতি গোটা দুনিয়ায় প্রচার হয়ে যাবে বিবৃতিটা।

খোলা হ্যাচের সামনে ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইনগ্রিড, তার হাতে মোটা একটা এনভেলাপ দেখা গেল। এতে বিবৃতির একটা কপি আছে, আরো আছে নামের একটা তালিকা। একশ উনত্রিশটা নাম, সবাই এই দেশের অবৈধ সরকারের কারাগারে বন্দী। ওরা সবাই এই দেশের সুযোগ্য সন্তান, মহান নেতা। এনভেলাপটা বাতাসে ছুঁড়ে দিল সে, পিটারের পায়ের কাছে পড়ল সেটা।

 আমাদের দ্বিতীয় দাবি, আবার বলল ইনগ্রিড। তালিকায় যাদের নাম আছে তাদের সবাইকে একটা প্লেনে সুস্থ অবস্থায় তুলে দিতে হবে। প্লেনের ব্যবস্থা করবে স্বৈরাচারী সরকার। ওই একই প্লেনে থাকতে হবে এক মিলিয়ন গোল্ড ক্রুগার র‍্যান্ড কয়েন, তাও এই সরকারকে জোগাড় করতে হবে। মুক্ত রাজনৈতিক নেতারা যেখানে, যে দেশে যেতে চাইবেন সেখানে, সে দেশে তাদের পৌঁছে দিতে হবে। সোনাগুলো তারা ব্যবহার করবে প্রবাসী সরকার গঠনের তহবিল হিসেবে…

 ঝুঁকে এনভেলাপটা তুলল পিটার। দ্রুত হিসেব করছে ও। একটা কুগার র‍্যান্ড মুদ্রার দাম হবে কম করেও একশ সত্তর মার্কিন ডলার। তার মানে আতঙ্কবাদীরা একশ সত্তর মিলিয়ন মার্কিন ডলার দাবি করছে। আরো একটা হিসেব আছে। এক মিলিয়ন ক্রুগারের ওজন হবে চল্লিশ টনের বেশি, ইনগ্রিডকে বলল ও। একটা প্লেনে কিভাবে ভোলা হবে সব?

মেয়েটা ইতস্তত করতে লাগল। সব কিছু ওরা নিখুঁতভাবে প্ল্যান করেনি বুঝতে পেরে মনে মনে খুশি হলো পিটার। ছোট হলেও, একটা ভুল যদি করে থাকে, আরো ভুল করতে থাকতে পারে।

 ট্র্যান্সপোর্টের উপযুক্ত ব্যবস্থা অবৈধ সরকারকেই করতে হবে, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল ইনগ্রিড়, মাত্র এক সেকেন্ডের মধ্যে ইতস্তত ভাবটা কাটিয়ে উঠেছে সে।

 আর কিছু? জিজ্ঞেস করল পিটার। ওর ভোলা কাঁধে গরম ছ্যাকা দিচ্ছে রোদ, পাঁজর বেয়ে ঘামের ধারা নামছে।

মুক্ত নেতাদের আর সোনা নিয়ে কাল দুপুরের আগে রওনা হবে প্লেন, তা না হলে আমরা জিম্মিদের খুন করতে শুরু করব।

গলা শুকিয়ে গেল পিটারের। যে মেয়ে এত সহজে খুন করব উচ্চারণ করতে পারে তার পক্ষে সবই সম্ভব।

 নেতাদের নির্বাচিত গন্তব্যে প্লেনটা পৌঁছুলে, আমাদের কাছে আগে থেকে ঠিক করা একটা কোড মেসেজ পাঠানো হবে। তারপর আমরা বোয়িংয়ের শিশু আর মেয়েদের মুক্ত করে দেব।

 আর পুরুষদের?

সোমবার, ছয় তারিখে, আজ থেকে তিন দিন পর, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে একটা প্রস্তাব তুলতে হবে। প্রস্তাবটা তোলাতে হবে সিরিয়া বা ইরানকে দিয়ে। প্রস্তাবে দাবি করা হবে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারকে সব রকম আর্থিক সাহায্য দেয়া বন্ধ করা হোক। আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থা বা কোনো রাষ্ট্র দক্ষিণ আফ্রিকার বর্তমান অবৈধ সরকারকে কোনো রকম আর্থিক সহায়তা দিতে পারবে না। ইতোমধ্যে যে-সব আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তাও বাতিল করতে হবে। সমস্ত বিদেশী পুঁজি প্রত্যাহার করে নিতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকায় তেল রফতানি এবং সবরকম ব্যবসার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে। ট্রান্সপোর্ট এবং কমিউনিকেশন লিঙ্ক কেটে দিতে হবে। জাতিসংঘের শান্তি বাহিনি মোতায়েন করে সবগুলো এয়ারপোর্ট আর বন্দরের তৎপরতা থামিয়ে দিতে হবে। এবং জাতিংসংঘের ইন্সপেক্টরদের তত্ত্বাবধানে স্থগিত করা সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে।

কি ঘটতে পারে কল্পনা করার চেষ্টা করল পিটার। শ্রীলঙ্কা এবং তাঞ্জানিয়াকে দিয়ে সাধারণ পরিষদে তোলা যেতে পারে প্রস্তাবটা।

যেন পিটারের মনের কথা বুঝতে পেরেই আবার মুখ খুলল ইনগ্রিড, নিরাপত্তা পরিষদের কোনো সদস্য–আমেরিকা, ব্রিটেন, বা ফ্রান্স-যদি প্রস্তাবটার বিরুদ্ধে ভেটো দেয়, বোয়িং জিরো-সেভেন-জিরো হাই এক্সপ্লোসিভ দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হবে।

বোকা আর বোবা হয়ে গেল পিটার। হাঁ করে তাকিয়ে থাকল ফুলের মতো সুন্দর কচি মেয়েটার দিকে। এত তাজা আর পবিত্র লাগছে দেখে, বাচ্চা একটা মেয়ে বলেই মনে হলো তাকে ওর। আবার যখন কথা বলার শক্তি ফিরে পেল, গলার কর্কশ আওয়াজ শুনে নিজেই অবাক হয়ে গেল ও, তোমাদের সাথে হাই এক্সপ্লোসিভ আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না!

ধরো! চিৎকার করে বলল ইনগ্রিড, জিনিসটার ওজন অনুভব করে অবাক হয়ে গেল পিটার। ধরার পরপরই চিনতে পারল ও। ইলেকট্রনিক্যালি ফিউজড। হাসছে মেয়েটা। এত আছে যে তোমাকে একটা নমুনা হিসেবে দিতে পারলাম!

 নিজের বুকে হাত রেখে কে কি যেন বলার চেষ্টা করছে সিরিল ওয়াটকিংস, কিন্তু পিটারের মনোযোগ রয়েছে হাতের গ্রেনেডটার দিকে। ও জানে এ ধরনের একটা গ্রেনেডই বোয়িং আর তার চারশ আরোহীকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট।

 পাইলট ওকে কি বলতে চাইছিল? আবার বুকে হাত দিয়েছে সে, কি বলতে চায়? মেয়েটার গলার দিকে তাকাল পিটার। গলা জড়িয়ে থাকা স্ট্র্যাপে ছোট একটা ক্যামেরা ঝুলছে। গ্রেনেড আর ক্যামেরার সাথে কোনো সম্পর্ক আছে? পাইলট কি সে কথাই বলার চেষ্টা করছে ওকে?

আবার কথা বলছে মেয়েটা, তোমার মনিবদের কাছে নিয়ে যাও ওটা, ঘেমে গোসল হোক তারা। সারা দুনিয়ার সর্বহারা মানুষের অভিশাপ রয়েছে তাদের ওপর। বিপ্লব আজ এবং এখানেই। হ্যাচের দরজার সৎ করে বন্ধ হয়ে গেল, ক্লিক করে তালা লাগার আওয়াজ পেল পিটার।

দীর্ঘ পথ ধরে আবার ফিরে আসছে ও, এক হাতে গ্রেনেড আরেক হাতে এনভেলাপ। ভয় আর দুশ্চিন্তায় শুকিয়ে গেছে মুখ।

.

হকারের হ্যাচওয়ে থেকে সরে গিয়ে পিটারকে পথ করে দিল কলিন, চেহারা থেকে উধাও হয়েছে হাসি। ওভারঅলের বোতাম লাগাচ্ছে পিটার। কলিন বলল, ডক্টর পার্কার স্ক্রীনে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছেন, স্যার। তোমাদের প্রত্যেকটা কথা কপি করেছি আমরা, টেলিপ্রিন্টারে ওনাকেও কপি পাঠানো শুরু হয়েছে।

পরিস্থিতি খারাপ, কলিন।

আরো খারাপ খবর তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে, স্যার, বলল কলিন। ডক্টর পার্কারের সাথে আগে কথা বলে নাও।

 কলিনকে এক রকম ধাক্কা দিয়ে কমান্ড কেবিনে ঢুকল পিটার, কমান্ড চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়ল। স্ক্রীনে দেখা গেল ডেস্কের ওপর ঝুঁকে বসে আছেন ডক্টর পার্কার, টেলিপ্রিন্টার শীটের ওপর চোখ বুলাচ্ছেন, ঠাণ্ডা খালি পাইপটা দুসারি দাঁতের মাঝখানে।

স্ক্রীনের বাইরে দাঁড়ানো কমিউনিকেশন ডিরেক্টরের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, জেনারেল স্ট্রাইড পিটার, স্যার।

মুখ তুলে তাকালেন ডক্টর পার্কার। পিটার। এই মুহূর্তে আমরা একা–তুমি আর আমি! সার্কিট বন্ধ করে দিয়েছি আমি, মাত্র একটা টেপ রেকর্ড চালু আছে। আমি তোমার প্রথম প্রতিক্রিয়া জানতে চাই, তারপর আমি রিপোর্ট করব স্যার উইলিয়াম আর কনস্টেবলের কাছে। স্যার উইলিয়াম আর কেলি কনস্টেবল দক্ষিণ আফ্রিকায় যথাক্রমে ব্রিটিশ আর আমেরিকান অ্যামব্যাসাডর।

একটু অধৈর্যের সাথে আবার বললেন ডক্টর পার্কার, আমি তোমার প্রথম প্রতিক্রিয়া জানতে চাই।

উই আর ইন সিরিয়াস ট্রাবল, ডক্টর পার্কার, বলল পিটার, মস্ত মাথাটা সায় দেয়ার ভঙ্গিতে ঝাঁকালেন ডক্টর পার্কার।

টেরোরিস্টদের সামর্থ, কতটুকু?

আমার এক্সপ্লোসিভ এক্সপার্টরা গ্রেনেডটা পরীক্ষা করছে। তবে কোনো সন্দেহ নেই যে জিরো-সেভেন-জিরোকে ধ্বংস করতে পারবে ওরা। আরোহীদের সহ।

তার মানে সাইকোলজিকাল কেপ্যাবিলিটিও আছে?

প্রচুর। ওরা বিশ্বাস করে ডেস্ট্রাকশনই একমাত্র ক্রিয়েটিভ অ্যাক্ট। বিশ্বাস করে ভায়োলেন্সই মানুষকে নবজন্ম দেয়। সাত্রে কি বলেছেন আপনি জানেন–বিপ্লবী যখন কাউকে খুন করে তখন একজন অত্যাচারী মারা যায় এবং একজন মুক্ত মানুষের আবির্ভাব ঘটে।

মেয়েটা কি সবটুকু পথ যাবে?

যাবে। ইতস্তত না করে বলল পিটার। তাকে বাধ্য করা হলে অবশ্যই যাবে।

অ্যাশট্রেতে পাইপের ঠাণ্ডা ছাই ঝাড়লেন ডক্টর পার্কার। হ্যাঁ, ওর সম্পর্কে এখানে যা জানা যাচ্ছে তার সাথে তোমার কথা মিলে যায়।

ওর সম্পর্কে জানতে পেরেছেন? আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করল পিটার।

ওর ভয়েস প্রিন্ট পাওয়া গেছে, আর ক্রস-ম্যাচের সাহায্যে ওর ফেশিয়াল স্ট্রাকচার প্রিন্ট তৈরি করে ফেলেছে কম্পিউটার।

কে ও?

জন্মের পর ওর নাম রাখা হয় হিল্ডা বেকার, জার্মানি থেকে আসা থার্ড জেনারেশন আমেরিকান পরিবারের মেয়ে। বাবা সফল একজন ডেন্টিস্ট ছিল, মা মারা যায় ১৯৫৯-এ। মেয়েটার বয়স একত্রিশ। আশ্চর্য হয়ে গেল পিটার, এত বেশি! আই.কিউ. একশ আটত্রিশ, কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে মডার্ন পলিটিক্যাল হিস্টরী নিয়ে পড়াশোনা করেছে ১৯৬৫-৬৮ সালে। এসডিএস-এর মেম্বার। এসডিএস মানে- স্টুডেন্টস ফর ডেমোক্র্যাটিক সোসাইটি…

হ্যাঁ, অধৈর্য হয়ে উঠল পিটার।

পারমাণবিক যুদ্ধ-বিরোধী বিক্ষোভে নিয়মিত অংশ নিয়ে, আর মারিজুয়ানা পাচার করার অভিযোগে গ্রেফতার হয় ১৯৬৭ সালে। কিন্তু সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দেয়া হয়। তৃতীয়বার গ্রেফতার হয় ১৯৬৮-তে, বাটলার ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে বোমাবাজি করার অভিযোগে কিন্তু আবারও প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যায়। সত্তর সালে আমেরিকা ছেড়ে চলে যায়, আরো পড়াশোনা করার জন্যে ভর্তি হয় জার্মানির ডুসেলডর্ফ ইউনিভার্সিটিতে। ১৯৭২ সালে পলিটিক্যাল ইকোনমিক্সে মাস্টার ডিগ্রী নেয়। এই সময়ে বাদের-মেইনহফের প্রথম সারির নেতাদের সংস্পর্শে আসে। পশ্চিম জার্মানির নামকরা ব্যবসায়ী ম্যানডেল বটারকে যারা খুন করে তাদের মধ্যে সেও ছিল বলে সন্দেহ করা হয় ১৯৭৬ সালে। তারপর অনেক দিন তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। শোনা যায়, সিরিয়া, তারপর লিবিয়ায় কমান্ডো ট্রেনিং নেয় সে…

 হ্যাঁ, ডক্টর পার্কার থামার আগেই আবার বলল পিটার, সবটুকু পথ যাবে সে।

আর কি মনে হয়েছে তোমার?

খুব উঁচু মহল থেকে প্ল্যানটা করা হয়েছে, কোনো সরকার জড়িত থাকলেও আশ্চর্য হবে না…

তোমার এরকম মনে হবার কারণ? তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন ডক্টর পার্কার।

জাতিসংঘে কোন্ রাষ্ট্রকে দিয়ে প্রস্তাবটা তুলতে হবে তাও ওরা বলে দিচ্ছে…

ঠিক আছে, বলে যাও।

এমন একটা দেশ বেছে নিয়েছে ওরা যেখানে সত্যি সত্যি মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, বলল পিটার। ব্রিটেন আর আমেরিকার সচেতন মানুষ ওদের দাবি শুনে বলবে, অযৌক্তিক নয়। আতঙ্কবাদীরা জানে, তাদের দাবি আদায়ের শতকরা আশি ভাগ সম্ভাবনা রয়েছে। জিম্মিরা বেশিরভাগ আমেরিকান আর ব্রিটিশ, এই দুদেশের লোক তাদের চারশ ভাই-বেরাদারকে হারাতে চাইবে না, ফলে টেরোরিস্টদের দাবি মেনে নেয়ার জন্যে চাপ সৃষ্টি করবে সরকারের ওপর…।

তোমার কি মনে হয় আতঙ্কবাদীরা কোনো আপোষ রফায় আসবে?

আসতে পারে, এক সেকেন্ড চিন্তা করে বলল পিটার। কিন্তু আপনি জানেন, এ-ধরনের লোকদের সাথে আপোষ করার বিরোধী আমি।

এমনকি এই গুরুতর পরিস্থিতিতেও, পিটার?

বিশেষ করে এই গুরুতর পরিস্থিতিতেই, ডক্টর পার্কার। টেরোরিস্টদের দাবি সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে আমরা কতটুকু সহানুভূতিশীল সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। ওরা হয়তো ন্যায্য দাবিই করছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কাজ করছি। ওরা যদি জেতে, জিতটা হবে বন্দুকের! এবং ওদের জিততে দিলে মানবসভ্যতার ক্ষতি করা হবে।

কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে পাইপে তামাক ভরলেন ডক্টর পার্কার, অগ্নিসংযোগ করলেন, তারপর জানতে চাইলেন, পাল্টা আঘাত হানলে সাফল্যের সম্ভাবনা কতটুকু?

পিটার জানত, প্রশ্নটা আসবে, তবু কিছুক্ষণ ইতস্তত করল ও। তারপর বলল, আধঘন্টা আগে হলে আমি বলতাম, শতকরা নব্বই ভাগ সম্ভাবনা, হতাহত হবে শুধু আতঙ্কবাদীরা।

কিন্তু এখন?

এখন আমি জানি, ওরা আবেগতাড়িত আমেচার নয়। আমাদের মতোই ট্রেনিং পাওয়া লোক ওরা, ইকুইপমেন্টও আছে। কয়েক মাস প্রস্তুতি নেয়ার পর হাত দিয়েছে কাজে…

কিন্তু এখন? আবার উত্তর চাইলেন ডক্টর পার্কার।

ডেল্টা কন্ডিশনে শতকরা ষাট ভাগ সম্ভাবনা আছে সফল হবার–দুপক্ষের মিলে অন্তত দশজন হতাহত হবে।

বিকল্প উপায়?

নেই, ডক্টর পার্কার। আমরা ব্যর্থ হলে কেউ বাঁচবে না– প্লেনটা ধ্বংস হবে, আরোহীরা সবাই মারা পড়বে, থোর কমান্ডের অপারেটররা খুন হয়ে যাবে।

ঠিক আছে, পিটার, বলে চেয়ারে হেলান দিলেন ডক্টর পার্কার। লাইনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অপেক্ষা করছেন, ওদের সাথে কথা বলব এখন। অ্যামব্যাসাডরদের ব্রিফিং করার পর আবার ফিরে আসব তোমার কাছে এক ঘণ্টার মধ্যে।

পিটারও হেলান দিল চেয়ারে, উপলব্ধি করল কাজে নেমে পড়ার জন্যে মনটা ছটফট করছে ওর। কলিং বেল বাজাল ও, কমান্ড কেবিনের সাউন্ড-প্রুফ দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল কলিন।

গ্রেনেড খুলে পরীক্ষা করা হয়েছে, বলল সে। এক্সপ্লোসিভ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে সোভিয়েত সি, জে, কমপোজিশন, ফিউজিংটা কোনো ফ্যাকটরির তৈরি। প্রফেশনাল স্টাফ, কাজের জিনিস।

পিটারের ধারণাই ঠিক, মেয়েটা মিথ্যে বলেনি–একটা দিয়েই উড়িয়ে দেয়া যাবে প্লেন।

 নামের তালিকা আর বিবৃতি ওয়াশিংটন পাঠানোর জন্যে টেলিপ্রিন্টারে দেয়া হয়েছে, সামনের দিকে ঝুঁকে কেবিন ইন্টারকমের সুইচ অন করল কলিন, মাউথপীসে বলল, লুপটা চালাও-প্রথমে সাউন্ড ছাড়া। তারপর পিটারের দিকে ফিরল। খারাপ খবর আছে, বলেছিলাম না?

ভিডিও করা ছবি মাঝখানের স্ক্রীনে ফুটে উঠল। অবজার্ভেশন পোস্ট থেকে পরিষ্কারভাবে তোলা হয়েছে। শুরু হলো পিটারকে দিয়ে, নগ্ন পিঠ আর কাঁধে উজ্জ্বল রোদ নিয়ে বোয়িংয়ের দিকে দৃঢ় পায়ে হেঁটে যাচ্ছে ও। হঠাৎ করে বোয়িংয়ের দরজা খুলে গেল, কাছ থেকে ছবি নেয়ার জন্যে ক্যামেরাম্যান তার ক্যামেরা জুম করল।

দুজন পাইলট আর এয়ার হোস্টেস দাঁড়িয়ে রয়েছে দোরগোড়ায়, এ স্থির থেকে আবার জুম করল ক্যামেরা। লেন্সের অ্যাপারচার দ্রুত অ্যাডজাস্ট করা হলো, একপলকের জন্যে মেয়েটার সোনালি মাথা পরিষ্কার দেখা গেল, কিন্তু তারপরই একটু ঘুরে গেল মুখটা, তার কমলা কোষের মতো সুন্দর ঠোঁট জোড়া নড়ে উঠল। কাকে যেন কি বলল ইনগ্রিড, মনে হলো তিনটে শব্দ উচ্চারণ করল সে। তারপর ঘাড় সোজা করে ক্যামেরার দিকে ফিরল।

ওকে, বলল কলিন। আবার চালাও, এবার সাউন্ডে নিউট্রাল ব্যালান্স দিয়ে।

গোটা লুপট আবার চালানো হলো। কেবিনের দরজা খুলল, তিনজন জিম্মিকে দেখা গেল, সোনালি চুল নিয়ে মাথাটা ঘুরল, আর তারপরই ইনগ্রিডের গলা শোনা গেল, লেটস স্লাইড। কিন্তু ব্যাকগ্রাউন্ডে হিস-হিস আর শোঁ-শোঁ আওয়াজ হচ্ছে।

লেটস স্লাইড? জিজ্ঞেস করল পিটার।

আবার চালাও, এবার ডেনসিটি ফিলটার ব্যবহার কর, নির্দেশ দিল কলিন।

সেই একই দৃশ্য ফুটে উঠল স্ক্রীনে, লম্বা ঘাড়ের ওপর সোনালি মাথা ঘুরল।

লেটস স্লাইড। কিন্তু পিটারের মনে হলো পরিষ্কার শুনতে পায়নি ও।

ওকে, টেকনিশিয়ানকে বলল কলিন, এবার ফুল ফিল্টার দাও, ফুল ভলিউমে প্রতিধ্বনি হোক।

একই দৃশ্য, মেয়েটার মাথা সরু ঠোঁট ফাঁক হলো, স্ক্রীনের বাইরে দাঁড়ানো কাউকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলল।

 এবার শুনতে ভুল হলো না। পরিষ্কার গলায় ইনগ্রিড বলল, ইটস স্ট্রাইড। শোনার সাথে সাথে অদৃশ্য হাতের প্রচণ্ড একটা ঘুসি খেল পিটার তলপেটে।

 মেয়েটা তোমাকে চেনে, বলল কলিন। উঁহু, শুধু চেনে বলছি কেন-তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিল!

 দুজন ওরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকল, পিটারের প্রশস্ত কপালে দুশ্চিন্তার রেখা। অ্যাটলাসের কথা অনেকেই জানে, কিন্তু থোর কমান্ডের অস্তিত্ব হাতে গোণা মাত্র কয়েকজন লোক ছাড়া কেউ জানে না–একেবারেই টপ সিক্রেট। অ্যাটলাসের তিন-চারজন বাদে বাইরের আরো হয়তো পাঁচ-ছয়জন জানতে পারে, তাদের মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট একজন। অথচ ইনগ্রিডের কথাগুলো শুনতে ওরা ভুল করেনি।

শান্ত, ঠাণ্ডা গলায় নির্দেশ দিল পিটার, আবার চালাও।

দুটো শব্দের জন্যে উত্তেজনার সাথে অপেক্ষা করে থাকল ওরা, ইনগ্রিডের প্রাণবন্ত কণ্ঠস্বর আবার শোন গেল। ইটস স্ট্রাইড, বলল ইনগ্রিড, তারপর খালি হয়ে গেল স্ক্রীন।

 পাতা বন্ধ করে একটা আঙুল দিয়ে চোখ রগড়াল পিটার। মনে পড়তে একটু অবাক হলো হয়তো প্রায় আটচল্লিশ ঘণ্টা ঘুমায়নি ও। কিন্তু শারীরিক ক্লান্তি নয়, কেউ বেঈমানী করেছে উপলব্ধি করে বিধ্বস্ত লাগছে নিজেকে।

 কেউ থোর কমান্ডের অস্তিত্ব ফাঁস করে দিয়েছে, নরম গলায় বলল কলিন। বোঝাই যাচ্ছে, শক্তিশালী কোনো একটা মহল থেকে মদদ পাচ্ছে আতঙ্কবাদীরা।

হাত নামিয়ে চোখ খুলল পিটার। ডক্টর পার্কারের সাথে এখুনি কথা বলতে হবে, বলল ও। স্ক্রীনে ডক্টর পার্কারের ছবি আসার পর দেখা গেল বেশ বিরক্ত হয়েছেন তিনি।

আমি প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলছিলাম, পিটার!

ডক্টর পার্কার, দ্রুত বলল পিটার, পরিস্থিতি বদলে গেছে। কন্ডিশন ডেল্টাতে পাল্টা আঘাত হানলে আমাদের সফল হবার সম্ভাবনা কমে গেছে। ফিফটি ফিফটি চান্স, তার বেশি নয়।

আই সী, গভীর সুরে বললেন, ডক্টর পার্কার। ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক আছে, প্রেসিডেন্টকে আমি জানাচ্ছি।

.

ইতোমধ্যে ল্যাভেটরির ধারণ ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে গেছে, এয়ারকন্ডিশনিং চালু থাকা সত্ত্বেও প্রতিটি কেবিনে ছড়িয়ে পড়েছে দুর্গন্ধ। খাবার আর পানির বরাদ্দ খুব কম, ক্ষুৎপিপাসায় কাহিল হয়ে পড়েছে আরোহীরা। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বাচ্চাদের, কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে উঠেছে তাদের, বেশিরভাগই ঝিমাচ্ছে। উত্তেজিত হাইজ্যাকারদের চেহারাতেও ক্লান্তির ছাপ ফুটতে শুরু করেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সতর্ক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে তাদের, বিশ্রামের চার ঘণ্টা সময়ের সবটুকু ঘুমাতে পারে না। লাল সুতি শার্টের ভাজ নষ্ট হয়ে গেছ, বগলের কাছে ঘামে ভেজা। চোখগুলো লালচে, অনিশ্চিত মেজাজ।

 সন্ধ্যা লাগার পরপরই কালো-চুল ক্যারেন, বয়স্ক একজন আরোহীর ওপর খেপে গেল। টয়লেট থেকে বেরিয়ে নিজের সীটে ফিরতে দেরি করছিল লোকটা। হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রুগিণীর মতো তারস্বরে চেঁচাতে লাগল ক্যারেন, শট পিস্তলের ব্যারেল দিয়ে বুড়ো মানুষটার মুখে বারবার আঘাত করল, চোয়াল কেটে বেরিয়ে পড়ল সাদা হাড়। শুধু ইনগ্রিড শান্ত করতে পারল ক্যারেনকে, হাত ধরে পর্দা ঘেরা টুরিস্ট গ্যালিতে নিয়ে চলে গেল তাকে। ওখানে তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করল। ইনগ্রিড। এমন করে না, সোনা, আর মাত্র অল্প কিছুক্ষণ, ক্যারেনকে বলল সে, আমরা এতটা সময় পর্যন্ত ঠিক আছি, এই তো আর কিছুক্ষণ পর পিল খেয়ে নিব। কিছুসময়ের মধ্যেই নিজেকে সামলে নেয় ক্যারেন। আবারো, নিজের অবস্থান নেয় প্লেনের পিছনে।

ইনগ্রিডের সামর্থের যেন কোনো শেষ নেই। রাতেরবেলায় যাত্রীদের আসনের মাঝের আইল ধরে হেঁটে চলে সে, দু-একটা নরম কথা বলে সান্ত্বনা দেয় রাতজাগা যাত্রীদের।

আগামীকাল সকালে আমাদের দাবির একটা উত্তর পাব, সমস্ত নারী এবং শিশুদের মুক্তি দেয়া হবে। সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে-কোনো চিন্তা করবেন না।

মধ্যরাতের কিছু পরে, ককপিটে তাকে ডেকে নিল ডাক্তার ভদ্রলোক।

নেভিগেটর বেচারার অবস্থা মারাত্মক, জানাল সে, এখনই ওকে কোনো হাসপাতালে নিতে না পারলে বাঁচানো যাবে না।

এক পা পিছিয়ে ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল ইনগ্রিড। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে বেচারা, দ্রুত শ্বাস পড়ছে।

কিডনি অকেজো হয়ে গেছে, জানাল ডাক্তার, শ পেয়ে দুটো কিডনিই। বিকল হয়ে গেছে। এখানে কোনো চিকিৎসা করা সম্ভব না, হাসাপাতাল ছাড়া উপায় নেই।

অর্ধ-সচেতন ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের একটা হাত তুলে নেয় ইনগ্রিড; দুঃখিত। সেটা সম্ভব নয়।

আরো কিছুক্ষণ আহতের হাত ধরে বসে রইল সে।

তোমার কি অনুভূতি বলে কিছু নেই? তিক্ত স্বরে জানতে চায় ডাক্তার।

মানবজাতীর প্রতি যেমন অনুভব করি–ওর প্রতিও আমার দরদ আছে, ইনগ্রিড বলে। কিন্তু ও তো কেবল একটা প্রাণ। এরকম আরো কত প্রাণ রয়েছে বাইরে।

.

দক্ষিণ আফ্রিকার রাজধানীতে প্রায় সারা রাত ধরে কেবিনেট মিটিং চলল। বুল-ডগ আকৃতির মাথা আর দানব আকৃতির দেহ নিয়ে টেবিলের এক মাথায় বেশিরভাগ সময় নিঃশব্দে বসে থাকলেন প্রাইম মিনিস্টার, মাঝেমধ্যে শুধু ঘেৎ ঘোৎ করে অসম্মতি বা অসন্তোষ প্রকাশ করলেন। তার দুপাশে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বসেছেন, কথা যা বলার তারাই বললেন। টেবিলের আরেক প্রান্তে বসেছেন ব্রিটেন আর আমেরিকার অ্যামব্যাসাডর, তাদের সামনে রাখা টেলিফোন প্রায়ই বেজে উঠছে, দূতাবাস থেকে সর্বশেষ খবর বা স্ব-স্ব সরকারের কাছ থেকে জরুরি নির্দেশ পাচ্ছেন তারা।

আপনার নিজের সরকার এতদিন টেরোরিস্টদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার কথা বলে এসেছে, অন্যান্য সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে ওদের সাথে আপোষ করা একদম উচিত হবে না, অথচ আজ আপনারা চাইছেন ওদের সাথে আমরা যেন নরম ব্যবহার করি…।

আমরা জোর করছি না, দক্ষিণ আফ্রিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে থামিয়ে দিয়ে মার্কিন অ্যামব্যাসাডর কেলি কনস্ট্যাবল বললেন। আমরা শুধু পাবলিক সেন্টিমেন্টের কথা ভেবে একটা আপোষ রফার পরামর্শ দিচ্ছি।

স্পট থেকে অ্যাটলাস জানিয়েছে পাল্টা আঘাত হানলে সাফল্যের সম্ভাবনা আধাআধি, বললেন ব্রিটিশ অ্যামব্যাসাডর স্যার উইলিয়াম। আমার সরকার মনে করে এই ঝুঁকি নেয়া সম্ভব নয়।

সুযোগ পেয়ে আবার মুখ খুললেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিরক্ষামন্ত্রী, আমাদের সেনা বাহিনির গেরিলা ইউনিট মনে করে তারা আরো সাফল্যের সাথে পাল্টা আঘাত করতে পারবে…

কিন্তু অ্যাটলাসের আন্ডারে যে কমান্ডো টিম দায়িত্বে রয়েছে তারা সম্ভবত দুনিয়ার সেরা ট্রেনিং পাওয়া অ্যান্টি-টেরোরিস্ট গ্রুপ, কেনি কনস্টেবল বললেন, তাকে বাধা দিলেন প্রাইম মিনিস্টার।

 এই পর্যায়ে, জেন্টলমেন, আসুন আমরা বরং শান্তিপূর্ণ একটা উপায় খুঁজে বের করি।

আমি একমত, মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার। স্যার উইলিয়াম মাথা ঝাঁকালেন।

একটা ব্যাপার পরিষ্কার, কনস্টেবল বললেন, টেরোরিস্টদের দাবির সাথে মার্কিন দাবির মিল আছে।

 স্যার, আপনি কি টেরোরিস্টদের দাবি সম্পর্কে সহানুভূতি প্রকাশ করছেন? সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন প্রাইম মিনিস্টার।

 আমি পাবলিক সেন্টিমেন্টের দিকে লক্ষ্য করতে বলি, মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার ইউনাইটেড স্টেটস অভ আমেরিকা মানুষের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। আপনারা যদি টেরোরিস্টদের কিছু কিছু দাবি মেনে নেন তাহলে আগামী সোমবার জাতিসংঘের প্রস্তাবে ভেটো দেয়া আমাদের জন্য সহজ হবে।

এটা কি একটা হুমকি, স্যার? আবারও সরাসরি জানতে চাইলেন প্রাইম মিনিস্টার।

না, মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার, স্রেফ কমনসেন্স। প্রস্তাবটা যদি পাস হয়ে যায়, আপনার দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে। সারা দেশে সন্ত্রাসবাদীরা তৎপর হয়ে উঠবে, শুরু হবে রাজনৈতিক হাঙ্গামা-দেশটা সেভিয়েত ইউনিয়নের জন্যে হয়ে উঠবে পাকা ফল। আমার সরকার সেটা হতে দিতে চায় না, চায় না চারশ নিরীহ মানুষকে টেরোরিস্টদের হাতে খুন হতে দিতে। ক্ষীণ একটু হাসলেন কেনি কনস্টেবল।

শান্তিপূর্ণ সমাধান ছাড়া আর বোধহয় কোনো পথ খোলা নেই।

কিন্তু আমার প্রতিরক্ষামন্ত্রী একটা উপায়ের কথা এর মধ্যে ব্যাখ্যা করেছেন!

মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার, ব্রিটিশ আর আমেরিকান সরকারকে আগে থেকে না জানিয়ে টেরোরিস্টদের বিরুদ্ধে যদি কোনো সামরিক ব্যবস্থা নেয়া হয়, তাহলে ভেটো দেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না–আমরা বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের রায়কে শ্রদ্ধা জানাব।

এমনকি অ্যাটাক যদি সফল হয় তবুও?

এমনকি অ্যাটাক সফল হলেও। একটা ব্যাপারে আমরা অটল, পাল্টা আঘাত হানতে হলে একমাত্র অ্যাটলাসের নির্দেশেই তা হানা যেতে পারে। কথা না বাড়িয়ে আসুন না ভেবেচিন্তে দেখি টেরোরিস্টদের কোন দাবিটা মেনে নেয়া যায়।

.

ব্রেকফাস্ট পরিবেশনের সময় নিজে উপস্থিত থাকল ইনগ্রিড। মাথাপিছু এক স্লাইস রুটি, একটা বিস্কিট, মধুর মতো মিষ্টি এক কাপ কফি বরাদ্দ করা হলো। খিদের জ্বালায় নিস্তেজ হয়ে পড়েছে আরোহীরা।

হাঁটতে হাঁটতে আরোহীদের মধ্যে সিগারেট বিলি করল ইনগ্রিড-বাচ্চা ছেলেমেয়েদের গাল টিপে দিয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করল, সান্ত্বনা আর অভয় দিল কোনো মাকে-শান্ত এবং হাসিখুশি। এরই মধ্যে আরোহীরা তাকে সবার চেয়ে ভালো, লক্ষ্মী মেয়ে বলে চিহ্নিত করেছে।

ফার্স্ট ক্লাস গ্যালিতে ফিরে এসে এক এক করে সহকর্মীদের ডেকে খেতে দিল ইনগ্রিড। এক-একজন তিন-চারটে করে সেদ্ধ ডিম, মাখন দেয়া রুটি, যত খুশি বিস্কিট, পেস্ট্রি, আর স্যান্ডউইট পেল। দুর্বল হওয়া চলবে না, বলল ইনগ্রিড। পিল ওরা খাবে, কিন্তু দুপুরের আগে নয়। ড্রাগের প্রভাব থাকবে বেশি হলে বাহাত্তর ঘণ্টা, তারপর সাবজেক্টের শারীরিক বা মানসিক অবস্থা সম্পর্কে জোর করে কিছু বলা সম্ভব নয়–হয়তো অলস হয়ে উঠবে, ইতস্তত করবে সিদ্ধান্ত নিতে। প্রস্তাবটা অনুমোদনের জন্যে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাঠানো হবে নিউ ইয়র্ক-সময় আগামী সোমবার দুপুরে, তারমানে স্থানীয় সময় সোমবার সন্ধ্যে সাতটায়। ওই সময় পর্যন্ত নিজের দলকে সম্পূর্ণ সতর্ক এবং তৎপর রাখতে চায় ইনগ্রিড, কাজেই সময়ের আগে ড্রাগ ব্যবহার করে ঝুঁকি নিতে রাজি নয় সে।

তবে ক্লান্তি তাকেও কাবু করে ফেলছে। ইতোমধ্যে চুপিচুপি বাথরুমের আয়নায় নিজের চেহারা দেখে এসেছে সে বেশ কয়েকবার। চোখ এমন লাল হয়ে উঠেছে যে রীতিমতো ভয় ধরে গেছে তার। হাঁটাচলার মধ্যে একটা অনিচ্ছাকৃত আঁকি এসে যাচ্ছে, সামান্য কারণে ঘেমে যাচ্ছে হাতের তালু, অকারণে চমকাচ্ছে-নার্ভাস হয়ে পড়ার লক্ষণ।

 জার্মান যুবক, কার্ট, পাইলটের সীটে নেতিয়ে আছে। কোলের ওপর পিস্তল মৃদু নাক ডাকছে, লাল শার্টের বোতাম নাভি পর্যন্ত খোলা। শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে ঘন লোমে ভরা চওড়া ছাতিটা উঠছে আর নামছে। কার্ট দাড়ি কামায়নি, লম্বা মাথার চুলে ঢাকা পড়ে রয়েছে মুখের একটা অংশ। তার ঘামের গন্ধ নাকে পেয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠল ইনগ্রিড, একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল। কার্টের চেহারায় অদ্ভুত একটা বুনো, নিষ্ঠুর ভাব আছে। হঠাৎ করে কার্টকে তার এই মুহূর্তে পেতে ইচ্ছে করল।

কিন্তু অনেক চেষ্টা করে কার্টের ঘুম ভাঙিয়েও কোনো লাভ হলো না। রক্তবর্ণ ঢুলু ঢুলু চোখে তাকাল সে, উত্তেজিত হবার কোনো লক্ষণ নেই। শেষ পর্যন্ত পরাজয় স্বীকার করে ককপিট থেকে বেরিয়ে গেল ইনগ্রিড।

পরমুহূর্তে কি মনে করে আবার ককপিটে ঢুকল সে, প্রায় ছোঁ দিয়ে হাতে নিল মাইক্রোফোনটা, প্যাসেঞ্জার কেবিনের লাউডস্পীকারের সুইচ অন করল।

সবাইকে বলছি, গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘোষণা। বিনা প্ররোচনায় সবার ওপর প্রবল আক্রোশ অনুভব করল সে। সুখে-শান্তিতে জীবনযাপনে অভ্যস্ত এই লোকগুলোই তো বুর্জোয়া, ভাবল সে, তার বাপের মতো এরাও সবাই সুবিধাভোগী। গাল দিয়ে ভূত ছাড়াল ইনগ্রিড। নিজের কণ্ঠস্বর নিজেই সে চিনতে পারল না, লোকগুলোর প্রতি ঘৃণায় তার শরীর রী রী করতে লাগল।

একটানা দশ মিনিট অনলবর্ষী বক্তৃতা দেয়ার পর থামল সে। তারপর আবার তিন ঘণ্টার মধ্যে অত্যাচারী প্রতিপক্ষের তরফ থেকে সাড়া না পেলে আমরা জিম্মিদের খুন করতে শুরু করব, হুমকির সুরে পুনরাবৃত্তি করল সে, আর মাত্র তিন ঘণ্টা।

শিকারি নেকড়ের মতো প্যাসেজে পায়চারি শুরু করল ইনগ্রিড।

দুঘণ্টা, আরোহীদের বলল সে। তাকে এগিয়ে আসতে দেখে কুঁকড়ে সরে যাবার চেষ্টা করল লোকজন।

এক ঘণ্টা, উল্লাসে ফেটে পড়ল তার কণ্ঠস্বর। এখুনি জিম্মিদের মধ্যে থেকে লোক বাছাই করা হবে।

 কিন্তু আপনি কথা দিয়েছিলেন, করুণ মিনতি ভরা গলায় আবেদন জানাল ছোটখাট ডাক্তার। ইনগ্রিড তার স্ত্রীর হাত ধরে সীট থেকে তুলল। ফ্রেঞ্চ যুবক, হেনরির দায়িত্বে ছেড়ে দেয়া হলো মহিলাকে। মহিলাকে নিয়ে ফ্লাইট ডেকের দিকে চলে গেল হেনরি।

ডাক্তারের দিকে না তাকিয়ে ক্যারেনের দিকে ফিরল ইনগ্রিড। বাচ্চাদের বাছাই কর-একটা ছেলে আর একটা মেয়ে, নির্দেশ দিল সে। আর হ্যাঁ, গর্ভবতী মেয়েলোকটাকেও। ওর অত বড় পেটটা দেখুক ওরা।

দুর্ভাগা জিম্মিদের খেদিয় ফরওয়ার্ড গ্যালিতে নিয়ে গেল ক্যারেন, পিস্তলের মুখে বসিয়ে রাখল ভাজ করা এয়ার-ক্রুদের চেয়ারে। ফ্লাইট ডেকের দরজা খোলা, গ্যালি থেকে ইনগ্রিডের গলা পরিষ্কার শুনতে পাওয়া গেল, হেনরিকে বলছে, ডেডলাইন পেরোবার সাথে সাথে আমাদের নিষ্ঠুরতার নমুনা দেখানোটা ভয়ানক জরুরি। দেখাতে যদি আমরা ব্যর্থ হই, ওরা আমাদের টোড়া সাপ ধরে নেবে। আমরা বিশ্বাসযোগ্যতা হারাব। অন্তত একবার ওদেরকে দেখাতে হবে আমরা কতদূর যেতে পারি।

 বাচ্চা মেয়েটা কাঁদতে শুরু করল। তেরো বছর বয়স, বিপদটা বুঝতে পারছে। সুলদেহী ডাক্তারের স্ত্রী মেয়েটার কাঁধে হাত রাখল, আদর করে কাছে টানল।

স্পীডবার্ড জিরো-সেভেন-জিরো…, হঠাৎ জ্যান্ত হয়ে উঠল রেডিও, ইনগ্রিডের জন্যে আমাদের একটা মেসেজ আছে।

গো অ্যাহেড, টাওয়ার, দিস ইজ ইনগ্রিড। লাফ দিয়ে মাইক্রোফোন ধরেছে সে, পা লম্বা করে দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে ফ্লাইট ডেকের দরজা।

নেগোশিয়েটর তোমার বিবেচনার জন্যে প্রস্তাব দিতে চায়। কপি করার জন্যে তৈরি হও।

নেগেটিভ, ঠাণ্ডা, নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলল ইনগ্রিড। আবার বলছি, নেগেটিভ। নেগোশিয়েটরকে আমার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হবে। আর তাকে বল চল্লিশ মিনিট পর ডেডলাইন। তাড়াতাড়ি এখানে চলে এলে ভালো করবে। মাইক্রোফোনটা হুকে ঝুলিয়ে হেনরির দিকে ফিরল সে। শেষপর্যন্ত ব্যাপারটা শুরু হয়েছে-এবার আমরা পিল নিতে পারি।

.

আজও আকাশে কোনো মেঘ নেই, খালি গায়ে চামড়া পোড়ানো রোদে টারমাকের ওপর দিয়ে হাঁটছে পিটার। আগের মতোই অর্ধেক দূরত্ব পেরিয়েছে, বোয়িংয়ের ফরওয়ার্ড হ্যাচ খুলে গেল।

এবার জিম্মিদের কাউকে দেখা গেল না, প্রায় অন্ধকার খালি একটা চৌকো আকৃতির মতো লাগল দোরগোড়াটাকে। দ্রুত হাঁটার একটা ঝোঁক অনুভব করলেও দৃঢ় ভঙ্গিতে শান্তভাবে এগোল পিটার, মাথাটা উঁচু হয়ে আছে, চোয়াল শক্ত। প্লেন থেকে যখন পঞ্চাশ গজ দূরে ও, চৌকো জায়গাটায় এসে দাঁড়াল মেয়েটা। দাঁড়াবার ভঙ্গির মধ্যে রাজকীয় গরিমা। এক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে, অপর পা সামান্য একটু বেঁকে আছে। তার নিতম্বের কাছে ঝুলে আছে বড়সড় শট পিস্তল, কাটিজ বেল্টটা সরু কোমরে জড়ানো। মুখে আরো হাসি নিয়ে পিটারের এগিয়ে আসা দেখছে।

হঠাৎ ইনগ্রিডের বুকে উজ্জ্বল একটা আলোক বিন্দু দেখা গেল। চোখে ঘৃণা নিয়ে সেটার দিকে তাকাল সে।

 আমাকে উত্তেজিত করা হচ্ছে। জানে, আলোক বিন্দুটার উৎস এয়ারপোর্ট বিল্ডিংয়ে দাঁড়ানো একজন মার্কসম্যানের লেজার সাইট। ট্রিগারে আর কয়েক আউন্স চাপ বাড়লেই পয়েন্ট টু-টু-টু বুলেট ঠিক ওই আলোক বিন্দুর জায়গায় লাগবে, চোখের পলকে রক্তাক্ত কাদা বানিয়ে দেবে হৃৎপিণ্ডটাকে।

 নির্দেশ ছাড়া লেজার সাইট চালু করায় স্নাইপারের ওপর রেগে গেল পিটার, তবে রাগের চেয়েও বেশি অবাক হয়ে গেল মেয়েটার সাহস লক্ষ্য করে। বুকের ওপর সুনিশ্চিত মৃত্যুর ওই চিহ্ন দেখেও এক বিন্দু ঘাবড়ায়নি। ডান হাত দিয়ে দ্রুত বাতিল করার একটা ভঙ্গি করল পিটার, প্রায় সাথে সাথে গানার তার লেজার সাইট অফ করে দেয়ায় আলোর বিন্দুটা ইনগ্রিডের বুক থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ধন্যবাদ, বলল ইনগ্রিড, হাসল সে, পিটারের শরীরের ওপর সপ্রশংস বুলাল। তোমার আকৃতিটা পয়সার মাল, বেইবী।

পিটার নিরুত্তর।

সমতল পাথুরে পেট, বলে চলেছে ইনগ্রিড, লম্বা, পেশিবহুল পা। ডেস্কে বসে কলম পিষে খাও না, বোঝা যায়। ঠোঁট কামড়ে চিন্তা করার ভান করল সে। আমার ধারণা, তুমি পুলিশ বা আর্মি অফিসার, বেইবী। আমার ধারণা তুমি একটা শুয়োর। কণ্ঠস্বর বদলে গিয়ে কেমন বেসুরো হয়ে উঠল তার।

আরো কাছে এসে পিটারের সন্দেহ হলো, মেয়েটা সুস্থ নয়। চোখ জোড়া অস্বাভাবিক চকচক করছে। হাত নাড়ছে এলোমেলোভাবে। নিশ্চয় উত্তেজক কোনো ড্রাগস নিয়েছে।

হ্যাচের নিচে পৌঁছে থামল পিটার, উত্তর দিল না। ওষুধের প্রভাবে স্থির থাকতে পারছে না, ইনগ্রিড, নিতম্বের কাছে অস্ত্রটা নাড়াচাড়া করছে, আরেক হাতে আঙুলগুলো কিলবিল করছে গলা থেকে ঝুলতে থাকা ক্যামেরার গায়ে। পিটারের মনে পড়ল, সিরিল ওয়াটকিংস ওকে কিছু একটা বলতে চাইছিল ক্যামেরার সম্পর্কে-হঠাৎ ব্যাপারটা বুঝে ফেলল ও। ফিউজের ট্রিগার, তা না হয়েই যায় না! সেজন্যে সারাক্ষণ নিজের সাথে রাখছে ওটা ইনগ্রিড। পিটারের চোখের দৃষ্টি কোথায় লক্ষ্য করে ক্যামেরা থেকে হাত সরিয়ে নিল ইনগ্রিড, পিটারের আর কোনো সন্দেহ থাকল না।

বন্দীদের মুক্তি দেয়া হয়েছে? জানতে চাইল ইনগ্রিড। প্যাক করা হয়েছে সোনা? বিবৃতি ট্রান্সমিট করার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে?

ব্রিটেন আর আমেরিকার প্রতিনিধিদের পরামর্শ মতো কাজ করতে রাজি হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার…।

গুড, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল ইনগ্রিড।

মানবিক কারণে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার তোমার দেয়া তালিকার সব বন্দীদের মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে…

গুড।

বন্দীদের নির্বাচিত যে কোনো দেশে চলে যেতে দেয়া হবে,..

 কিন্তু সোনা? তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল ইনগ্রিড।

দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার অসাংবিধানিক দাবির কাছে নতি স্বীকার করবে না অর্থাৎ সোনা দিতে রাজি নয়…

আর টেলিভিশন ট্রান্সমিশন?

দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার বিবৃতিটাকে সত্যের অপলাপ বলে বিবেচনা করছে…

তার মানে ওরা শুধু আমাদের একটা দাবি মেনে নিয়েছে! চেহারায় অবিশ্বাস নিয়ে বলল ইনগ্রিড। পিটার লক্ষ্য করল, তার কাধ দুটো আড়ষ্ট হয়ে গেল।

বন্দী মুক্তির ব্যাপারে একটা শর্ত আছে, নরম গলায় বলল পিটার।

কি সেটা?  ইনগ্রিডের গোলাপি মুখে রক্ত উঠে এল।

বন্দীদের মুক্তির বিনিময়ে ওরা সব কজন জিম্মির মুক্তি চায়-শুধু বাচ্চার আর মেয়েদের নয়। এবং জিম্মিদের মুক্তি দেয়া হলে ওরা তোমাদের নিরাপদে এই দেশ থেকে বেরিয়ে যেতে দেবে, মুক্ত বন্দীদের সাথে।

হো হো করে পাগলের মতো হেসে উঠল ইনগ্রিড, হাসির সাথে ইন্মাদিনীর মতো মাথা ঝাঁকাতে লাগল। তারপর হঠাৎ করেই থামল সে। ঠাণ্ডা, প্রায় শান্ত গলায় বলল, ওরা ভাবছে, ওরাও শর্ত দিতে পারে, তাই না? জিম্মিদের ছেড়ে দিই আমরা, তাহলে ব্রিটেন আর আমেরিকার জন্যে আমাদের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো দেয়া খুব সহজ হয়ে যায়, তাই না?

পিটার কথা বলল না।

জবাব দাও, সাম্রাজ্যবাদের পা চাটা কুকুর! তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল ইনগ্রিড। ওরা। ভেবেছে আমরা সিরিয়াস নই, তাই না?

আমি শুধু একজন মেসেঞ্জার,  বলল পিটার।

তুমি একটা শুয়োর! তুমি একটা ট্রেনিং পাওয়া খুনি। এক ঝটকায় হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করে পিটারের দিকে তাক করল ইনগ্রিড।

 ওদের আমি কি বলব? জিজ্ঞেস করল পিটার, যেন লক্ষ্যই করেনি ওর দিকে পিস্তল তাক করা হয়েছে।

 কি বলবে, না? আবার ইনগ্রিডের কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক হয়ে এল। হ্যাঁ, একটা উত্তর পাওনা হয়েছে ওদের।  পিস্তল নিচু করে কবজিতে বাধা জাপানি হাতঘড়ির ওপর চোখ বুলাল। তিন মিনিট হলো ডেডলাইন পেরিয়ে গেছ, উত্তর তো একটা পেতেই হবে ওদের। নিজের চারদিকে এমনভাবে তাকাল সে, যেন বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েছে।

ওষুধটার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে, ভাবল পিটার। হয়তো বেশি হয়ে গেছে ডোজ। কিংবা যে প্রেসক্রাইব করেছে তার জানা ছিল না উত্তেজিত অবস্থায় আটচল্লিশ ঘণ্টা জেগে থাকার পর খাওয়া হবে ওষুধটা।

আমি অপেক্ষা করছি, শান্তভাবে বলল পিটার।

হ্যাঁ, দাঁড়াও। প্লেনের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল ইনগ্রিড।

.

দুর্ভাগা চারজন জিম্মির দিকে পিস্তল তাক করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ক্যারেন, ঘাড় ফিরিয়ে ঢুলু ঢুলু চোখে ইনগ্রিডের দিকে তাকাল সে। ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকাল ইনগ্রিড, আবার বন্দীদের দিকে ফিরল ক্যারেন। এসো, কোমল গলায় বলল সে। তোমাদের মুক্তি দেয়া হচ্ছে। প্রায় আদর করে গর্ভবতী মহিলাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করল সে।

ক্যারেনকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত পিছনের কেবিনে চলে গেল ইনগ্রিড। কার্টের সাথে চোখাচোখি হতে ছোট্ট করে আবার মাথা ঝাঁকাল সে। মাথা ঝাঁকি দিয়ে চুলগুলো মুখ থেকে সরাল কার্ট, পিস্তলটা বেল্টে গুঁজে নিল। মাথার ওপর লকার থেকে একজোড়া প্রাস্টি গ্রেনেড বের করল সে, এক এক করে দুটোরই পিন খুলল, রিঙ দুটো জড়িয়ে নিল দুহাতের কাড়ে আঙুলে। ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মতো হাত দুটো ভাজ আর উঁচু করে প্যাসেজ ধরে হালকা পায়ে ছুটল সে। গ্রেনেডগুলো এখন জ্যান্ত, হাত থেকে পড়ে গেলেই বিস্ফোরিত হবে। কেউ নড়বে না, কেউ নিজের সীট ছেড়ে উঠবে না-যাই ঘটুক না কেন। যে যেখানে আছে সেখানেই থাকো!

হেনরি একই ভঙ্গিতে ছুটল,-তারও দুহাতে দুটো জ্যান্ত গ্রেনেড, সেও একই কথা বলে সাবধান করে দিল সবাইকে। কেউ নড়বে না। কোনো কথা নয়। সীট ছাড়বে না। সবাই চুপ! জার্মানি এবং ফরাসি ভাষায় পুনরাবৃত্তি করল সে। রক্তের নেশায় তার চোখ জোড়াও অস্বাভাবিক চকচক করছে।

ফ্লাইট ডেকের দিকে পিছন ফিরল ইনগ্রিড। এসো, লক্ষ্মীটি। ছোট্ট মেয়েটার কাঁধে একটা কোমল হাত রাখল সে, তাকে দাঁড় করিয়ে খোলা হ্যাচওয়ের দিকে নিয়ে চলল। কিন্তু দুপা এগিয়েই কুঁকড়ে পিছিয়ে আসার চেষ্টা করল মেয়েটা।

আমি তো কিছু করিনি, আমাকে ছেড়ে দাও, ফিসফিস করে বলল সে, তার চোখ জোড়া আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে। তোমার সব কথা শুনব আমি, প্লিজ। ঝাঁকি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল সে, পিছিয়ে গেল।

ছেলেটার বয়স আরো কম, বিপদের সত্যিকার চেহারা জানা নেই। বলতেই ইনগ্রিডের হাত ধরল সে। মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল তার, মুখে খয়েরি রঙের অনেক তিল, মধুরঙা চোখে একটু বিস্ময় এবং অনিশ্চিত ভাব। জিজ্ঞেস করল, ওখানে কি বাবা আমাকে নিতে এসেছে?

তবে আর বলছি কি! তোমার বাবা এসেছেন বলেই তো তোমাকে যেতে দিচ্ছি, এসো, এসো। একটু পরই তার সাথে দেখা হবে তোমার। খোলা হ্যাচওয়ের সামনে তাকে দাঁড় করিয়ে দিল ইনগ্রিড। লক্ষ্মী ছেলের মতো এখানে একটু দাঁড়িয়ে থাকো।

.

ছেলেটাকে খোলা হ্যাচের সামনে দাঁড়াতে দেখল পিটার, কি ঘটতে যাচ্ছে পরিষ্কার ধারণা নেই। ছেলেটার পাশে মোটাসোটা, মধ্যবয়স্কা এক মহিলা দাঁড়াল, পরনে খুব দামি সিল্ক ড্রেস, গলায় হীরে বসানো নেকলেস। মহিলার মাথায় চূড়া আকৃতির খোঁপা, খুচরো কিছু চুল কানের কাছে রিঙ তৈরি করেছে। চেহারায় কোমল, মাতসুলভ একটা ভাব, ছেলেটার কাঁধে আগলে রাখার ভঙ্গিতে একটা হাত রাখল সে।

তার পাশে এসে দাঁড়াল লম্বা, কম বয়েসী এক মহিলা। তার গায়ের সাদা রঙ কেমন যেন ফ্যাকাসে, কান্নাকাটি করায় নাকের ডগা আর চোখের পাতা ফুলে আছে। কনুইয়ের ওপর হাত আর গলায় অসংখ্য লাল লাল দাগ, সম্ভবত অ্যালার্জি। ঢিলেঢালা সুতী কাপড় পরে আছে সে, কাপড়ের নিচে থেকে বেঢপভাবে ফুলে আছে পেট। দাঁড়াবার ভঙ্গিটা আড়ষ্ট, রোদের দিকে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করতে লাগল।

আরো একজনকে খোলা হ্যাচের সামনে আসতে দেখল পিটার। কিশোরী একটা মেয়ে। আচমকা পাজরের ভেতরে চিনচিনে ব্যথা বোধ করল পিটার, মনে হলো মেয়েটা মেলিসা জেইন। কিন্তু সে যে মেলিসা নয়, এটা উপলব্ধি করতে বারো সেকেন্ড সময় লাগল পিটারের। তবে চেহারা অনেকটা মেলে–চোখ ভরা সরলতা, মুখে দেবীসুলভ পবিত্রতা। এমন একটা বয়স যখন সবেমাত্র লকলকিয়ে বেড়ে উঠতে শুরু করেছে শরীর। সরু, লম্বা পা, ছেলেদের মতো কোমর আর নিতম্ব।

তার বড় বড় চোখে নগ্ন ভীতি এবং পিটারকে দেখে একপলকেই বুঝে নিল একমাত্র ওই তাকে উদ্ধার করতে পারে। সংশয় আর আতঙ্ক মেশানো দৃষ্টিতে করুণ আবেদন ফুটে উঠল, সাথে যোগ হলো আশার আলো। প্লিজ, বিড়বিড় করে বলল সে। ওদের বারণ করুণ? এত আস্তে, কোনোরকমে শুনতে পেল পিটার। প্লিজ, স্যার! প্লিজ হেল্প আস!

কিন্তু ওখানে ইনগ্রিড রয়েছে, শান্ত গলাতেই কথা বলছে সে, কিন্তু পিটারের কানে তার কথাগুলো দ্রিম দ্রিম ঢাক পেটাবার মতো বাজল।

আমরা যা বলি তা করি। একটা করে ডেডলাইন পেরোবে আর একটা করে হত্যাকাণ্ড ঘটবে! আমাদের প্রমাণ করতে হবে বিপ্লবের প্রশ্নে আমরা দয়ামায়াহীন। আমরা চাই তোমরা জানো দাবির ব্যাপারে কোনো আপোষ নেই, দর কষাকষি চলবে না। একটু থেমে দম নিল সে। পরবর্তী ডেডলাইন আজ মাঝরাত। ওই সময়ের মধ্যে আমাদের সব দাবি মেনে নেয়া না হলে, আবার চরম মূল্য দিতে হবে। থামল সে, তারপর বাঘের তাড়া খাওয়া মানুষের মতো আর্তচিৎকার বেরিয়ে এল তার গলা থেকে, এই হলো চরম মূল্যের নমুনা! পরমুহূর্তে পিছিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল সে।

ভয়-ভাবনায় অস্থির এবং অসহায় পিটার কি করবে বুঝতে না পেরে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। কি ঘটতে যাচ্ছে জানে, কিন্তু ঠেকাবার কোনো উপায় দেখতে পাচ্ছে না।

জ্যাম্প! জোরে চিৎকার করল পিটার, মেয়েটার দিকে দুহাত তুলে দিল। লাফ দাও, তাড়াতাড়ি! আমি তোমাকে ধরব।

কিন্তু হ্যাচ থেকে টারমাক প্রায় ত্রিশ ফিট নিচে, মেয়েটা ইতস্তত করতে লাগল। একবার মনে হলো এই লাফ দিল, কিন্তু তাল সামনে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল নিজের জায়গায়। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে।

 মরে যেতে ইচ্ছে করল পিটারের। ওর এই অসহায় অবস্থার জন্যে নিয়তি নাকি স্রষ্টা কার ওপর জানে না, এমন প্রচণ্ড রাগ হলো, মনে হলো আত্মহত্যা করে।

মেয়েটার দশ কদম পিছনে, ক্যারেন আর ইনগ্রিড পাশাপাশি দাঁড়িয়েছে, একযোগে দুজনেই পিস্তল তুলল তারা। দুহাতে ধরে আছে পিস্তল, নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছে টার্গেট।

 লাফ দাও, ফর গডস সেক লাফ দিয়ে পড়! তোমার কোনো ভয় নেই! পিটারের কণ্ঠস্বর কেবিনের ভেতর থেকে পরিষ্কার শোনা গেল ক্ষীণ একটু বিদ্রুপের হাসি ফুটল ইনগ্রিডের ঠোঁটে।

 নাউ! বলল, সে এবং দুজন একসাথে গুলি করল। বিস্ফোরণের জোড়া শব্দ একটা শোনাল, হাঁ করা মাজল থেকে বেরোল নীলচে ধোয়া, বারুদের গন্ধে ভারী হয়ে উঠল বাতাস। কাঁচা মাংসের ভেতর বুলেট বিদ্ধ হবার আওয়াজগুলো অদ্ভুত কোমল শোনাল, কেউ যেন তরমুজের ফালি ছুঁড়েছে দেয়ালে।

ক্যারেনের চেয়ে একটু আগে দ্বিতীয় ব্যারেলটা ফায়ার করল ইনগ্রিড, এবার তাই জোড়া বিস্ফোরণের আওয়াজ আলাদা আলাদা ভাবে চেনা গেল। তারপরই সব নিস্তব্ধ, পিন-পতন স্তব্ধতা নেমে এল। মাত্র এক মুহূর্ত, আচমকা ওদের পুরুষ সঙ্গীরা গর্জে উঠল।

কেউ নড়বে না! এভরিবডি ফ্রিজ!

.

সেকেন্ডের ওই ভগ্নাংশগুলো দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা বলে মনে হলো পিটারের। থেমে যাওয়া সময় যেন ওর মাথায় বিচিত্র এক খেলায় মেতে থাকল, যেন কোনো ছায়াছবির কিম্ভুতকিমাকার একাধিক দৃশ্য স্থির হয়ে গেছে।

 প্রথম বিস্ফোরণের পুরো ধাক্কাটা খেল অন্তঃসত্ত্বা মহিলা। বেশি পেকে যাওয়া ফলের মতো ফেটে গেল সে, সীসাগুলো শিরদাঁড়া থেকে নাভি পর্যন্ত পথ করে নেয়ায় তার ফোলা শরীর আকৃতি বদল করল। সামনের দিকে ছিটকে পড়ল সে, শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে বস্তার মতো পড়ল টারমাকের ওপর, প্রাণবায়ু আগেই বেরিয়ে গেছে।

 মোটাসোটা মহিলা পাশে দাঁড়ানো ছেলেটাকে আঁকড়ে ধরেছিল, খোলা দোরগোড়ায় ঝুঁকে দেখতে লাগল দুজনেই, ঝাঁক ঝাঁক সীসা ওদের যেন নাচতে বাধ্য করেছে, মান নীলচে ধোয়া মোচড় খাচ্ছে ওদের ঘিরে। আঁটসাট সিল্ক ড্রেসে পনেরো-বিশটা ফুটো দেখা গেল, ধারালো কিছু দিয়ে কেউ যেন খোঁচা মেরেছে তাকে। ছেলেটার সাদা স্কুল-শার্ট ভেদ করেও ভেতরে ঢুকল অনেক গুলি, প্রতিটি ফুটোর কিনারা রঙিন হয়ে উঠল সাথে সাথে। কেউ ওরা কোনো শব্দ করেনি। দুজনের চেহারাতেই ঘোর বিস্ময় আর উদভ্রান্ত ভাব। পরের বিস্ফোরণটা কঠিন ধাক্কা মারল ওদেরকে, ছিটকে শূন্যে পড়ার সময় মনে হলো ওদের যেন কোনো হাড় নেই। তখন ও দুজন জড়াজড়ি অবস্থায় রয়েছে। পিটারের মনে হলো ওরা যেন অনন্তকাল ধরে পড়ছে আর পড়ছে।

কিশোরী মেয়েটা পড়ে যাচ্ছে দেখে ধরার জন্যে সামনের দিকে ছুটল পিটার, তার ভার সামলাতে না পেরে ভাজ হয়ে গিয়ে টারমাকে ঠেকে গেল পিটারের হাটু। দৌড়াতে শুরু করে সিধে হলো পিটার, ঘুমন্ত শিশুর মতো তাকে বয়ে নিচে চলেছে, একটা হাত তার হাঁটুর নিচে, আরেক হাত কাঁধ জড়িয়ে আছে। মেয়েটার ছোট্ট, সুন্দর মাথা ওর কাঁধে বাড়ি খেতে লাগল, মিহি চুলগুলো ওর চোখেমুখে সেঁটে গেল, প্রায় অন্ধ করে রাখল ওকে।

মরো না! নিঃশ্বাসের সাথে অস্ফুট শব্দগুলো বেরিয়ে এল, নিজের অজান্তেই মিনতি জানাচ্ছে পিটার। প্লিজ, ডোন্ট ডাই! তলপেটে গরম রক্তের স্রোত অনুভব করল ও, উরু বেয়ে নেমে যাচ্ছে পায়ের দিকে। অনেক রক্তপাত হচ্ছে। একসময় ভিজিয়ে দিল ওর পায়ের পাতা। টার্মিনাল বিল্ডিংয়ের প্রবেশপথ থেকে দশ কদম ছুটে এল কলিন নোবলস, চেষ্টা করল পিটারের হাত থেকে মেয়েটাকে তুলে নিতে। কিন্তু খ্যাপা পশুর মতো তাকে ঠেলে সরিয়ে দিল পিটার। থোর কমান্ডের ডাক্তার অপেক্ষা করছিল, কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে কিছু বলার ব্যর্থ চেষ্টা করে তার হাতে মেয়েটাকে তুলে দিল ও।

দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়েছে পিটার। সারা মুখে কঠিন রেখা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল ও।

একটু পরই মুখ তুলে তাকাল ডাক্তার। দুঃখিত, স্যার। শি ইজ ডেড।

এ যেন পিটারের ব্যক্তিগত পরাজয়। স্তম্ভিত চেহারা নিয়ে ডাক্তারের দিকে এক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকল ও, তারপর ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকিয়ে ঘুরে দাঁড়াল।

নির্জন টার্মিনাল ভবনের মার্বেল পাথরে পায়ের আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, একটু পিছনে ওকে অনুসরণ করছে কলিন। দুজনের চেহারাই নির্লিপ্ত। কমান্ড এয়ারক্রাফটে চড়ার সময়ও কেউ ওরা কথা বলল না।

.

স্যার উইলিয়াম, রাষ্ট্রদ্রোহীদের বিনা বিচারে আটক রেখেছি বলে আপনি আমাদের অভিযুক্ত করছেন, দক্ষিণ আফ্রিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রিটিশ অ্যামব্যাসাডরের দিকে তর্জনী তাক করলেন। কিন্তু আপনারা ব্রিটিশরা যখন প্রিভেনশন অভ টেরোরিস্ট অ্যাক্ট পার্লামেন্টে পাস করলেন তখন নাগরিকদের অধিকার হেবিয়াস কর্পাস প্রয়োগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। তারও আগে সাইপ্রাস, এবং প্যালেস্টাইনে এই আপনারাই তো বিনা বিচারে হাজার হাজার লোককে আটক রেখেছিলেন আজই বা আপনারা কি করছেন–আয়ারল্যান্ডে? ওখানে আপনারা মুক্তিকামী মানুষের নেতাদের বিনা বিচারে আটক রাখেননি?

 চেহারা অম্লান রেখে চুপ করে থাকলেন স্যার উইলিয়াম, ভাব দেখালেন জুৎসই একটা স্বভাবের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কৌশলে তাকে রক্ষা করলেন মার্কিন অ্যামব্যাসাডর। আমরা ঐকমত্যে পৌঁছুবার চেষ্টা করছি, জেন্টলমেন, বিতর্কে ইন্ধন জোগাতে চাইছি না। যেখানে কয়েকশ মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন জড়িত…

ঝনঝন শব্দে ফোন বেজে উঠল। শান্ত হাত বাড়িয়ে রিসিভার তুললেন স্যার উইলিয়াম। অপরপ্রান্তের কথা শোনার সময় তার মুখের রক্ত নেমে গেল। আই অ্যাম সরি, বলে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন তিনি, টেবিলের আরেক প্রান্তে সরাসরি প্রাইম মিনিস্টারের দিকে তাকালেন।

 আমি অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে আপনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে আতঙ্কবাদীরা, দশ মিনিট আগে চারজন জিম্মিকে খুন করেছে তারা।

অবিশ্বাস ভরা বিস্ময়সূচক আওয়াজ বেরিয়ে এল সবার গলা থেকে।

জিম্মিরা ছিল দুই মহিলা আর দুই বাচ্চা-একটা ছেলে আর একটা মেয়ে ওদেরকে পিছন থেকে গুলি করা হয়, তারপর ফেলে দেয়া হয় প্লেন থেকে। নতুন একটা ডেডলাইন দিয়েছে আতঙ্কবাদীরা—আজ মাঝরাত। এই সময়ের মধ্যে ওদের সব দাবি মেনে নিতে হবে। তা না হলে আবার খুন করবে ওরা। নিস্তব্ধতা জমাট বাঁধল। তারপর ধীরে ধীরে সবাই বুল-ডগ আকৃতির মাথার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল।

মানবতার নামে আমি আপনার কাছে আবেদন জানাচ্ছি, স্যার, কনস্টেবল নিস্তবদ্ধতা ভাঙলেন। আসুন, অন্তত মহিলা আর বাচ্চা-কাচ্চাদের বাঁচাই। ওরা খুন করবে আর আমরা বসে বসে দেখব সে অধিকার বা অনুমতি আমাদের নেই।

আর কোনো উপায় নেই, কমান্ডো পাঠিয়ে জিম্মিদের উদ্ধার করব আমরা।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাথা নাড়লেন। আমার সরকার অটল, স্যার এবং আমার বিশ্বাস ব্রিটিশ সরকারও। স্যার উইলিয়ামের দিকে তাকালেন তিনি, উইলিয়াম মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলেন। আমরা একটা হত্যাযজ্ঞের ঝুঁকি নিতে পারি না, নেব না। আপনারা যদি প্লেনে হামলা চালান, প্রস্তাবের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের কোনো চেষ্টাই আমরা করব না, নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দেয়ার কথাও ভাবব না।

অথচ আপনারা খুব ভালো করেই জানেন যে এই পশুগুলোর দাবি মেনে নিলে আমরা আমাদের দেশটাকে নরকের দিকে ঠেলে দেব!

 মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার, মাত্র অল্প কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সমাধান খুঁজে বের করতে হবে আমাদের–তা না হলে আরো কয়েকটা অমূল্য প্রাণ হারাব আমরা।

.

তুমি নিজেই বলেছ ডেল্টা অ্যাটাকে সাফল্যের সম্ভাবনা আধাআধি, গলার সুর স্বাভাবিক রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করলেন কিংস্টোন পার্কার।

 তোমাকে তো বললামই, দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে টেরোরিস্টদের দাবি মেনে নিয়ে মহিলা আর বাচ্চাদের মুক্ত করার জন্যে …

ওতে সমাধান হবে না। রেগে গেছে পিটার, গলার সুরে খানিকটা প্রকাশও পেয়ে গেল। আজ রাতেও সেই একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।

 বাচ্চা আর মহিলাদের ছাড়িয়ে আনতে পারলে, বিপদে থাকা মানুষের সংখ্যা কমে যাবে, তারপর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে—আমরা সময় কিনছি, পিটার, দাম যদি বেশি দিতে হয় কি আর করা।

কিন্তু যদি দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার না মানে? মাঝরাতের মধ্যে আমরা যদি হাইজ্যাকারদের সাথে কোনো সমঝোতায় না আসতে পারি? তখন কি ঘটবে, ডক্টর পার্কার?

 যা ঘটবে কল্পনা করতে কষ্ট হয়, পিটার, কিন্তু তা যদি ঘটে… অসহায় ভঙ্গিতে হাত দোলালেন ডক্টর পার্কার। … আমরা হয়তো আরো চারজনকে হারাব। কিন্তু পাইকারিভাবে চারশ লোককে খুন হতে দেয়ার চেয়ে সেটা তবু ভালো নয় কি? আরো চারজন লোক মারা গেলে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার জেদ ধরে বসে থাকতে পারবে না। বাচ্চা আর মহিলাদের ছাড়িয়ে আনতে রাজি হবে তারা যে কোনো মূল্যে।

পিটারের বিশ্বাসই হতে চায় না কথাগুলো ঠিক শুনেছে। জানে মেজাজের লাগাম টেনে না ধরলে বিচ্ছিরি একটা কাণ্ড ঘটে যাবে, নিজেকে শান্ত করার জন্যে কয়েক সেকেন্ড সময় নিল ও। ডেস্কের ওপর হাতের আঙ্গুলগুলো পরস্পরকে শক্তভাবে পেঁচিয়ে রেখেছে, মাথা নিচু করে সেদিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। ওর ডান হাতের নখগুলোর ভেতর কালচে দাগ দেখা গেল, আধখান চাঁদের মতো। কিশোরী মেয়েটার রক্ত শুকিয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি থোর ওভার-অলের পকেটে হাতটা ভরে ফেলল ও। বড় করে শ্বাস টেনে ধীরে ধীরে বলল, কল্পনা করতে কষ্ট হলে আগেই বলে নিজেকে সান্তনা দিতে পারেন, ঘটনাটা যে দেখবে তার কষ্ট আরো বেশি হবে।

তুমি কি ফিল করছ আমি বুঝি, পিটার।

আমার তা মনে হয় না, ডক্টর পার্কার, ধীরে ধীরে মাথা নাড়াল পিটার।

পিটার, তুমি একজন সৈনিক…

আর শুধু একজন সৈনিকই ভায়োলেন্সকে ঘৃণা করতে জানে, বলল পিটার।

আমাদের ব্যক্তিগত অনুভূতি কাজে বাধা সৃষ্টি করবে এটা আমার অভিপ্রেত নয়, এবার তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল ডক্টর পার্কারের গলা। তোমাকে আমি আবার একবার পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিচ্ছি, ডেল্টা কন্ডিশন ঘোষণার অনুমতি শুধু আমাকে দেয়া হয়েছে। আমার নির্দেশ ছাড়া পাল্টা আঘাত হানা যাবে না। বুঝতে পারছ তো, জেনারেল স্ট্রাইড?

পারছি, ডক্টর পার্কার, সাথে সাথে ঠাণ্ডা গলায় জবাব দিল পিটার। আমরা আশা করছি পরবর্তী হত্যাকাণ্ডের ভিডিও টেপ বেশ ভালোই হবে। আপনার ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখার জন্য একটি কপি আমার কাছ থেকে অবশ্যই পাবেন আপনি।

.

সার্ভিসিং-এর জন্যে ল্যান্ড করেছিল আরো একটা বোয়িং ৭৪৭, অ্যাসেম্বলি এলাকায় ওটা যেখানে পার্ক করা রয়েছে সেখান থেকে স্পীডবার্ড জিরো-সেভেন জিরো এক হাজার গজ দূরে, মেইন সার্ভিস হ্যাঙ্গার আর টার্মিনাল ভবনের একটা কোণ আড়াল তৈরি করায় হাইজ্যাকাররা ওটাকে দেখতে পাচ্ছে না। দুটো প্লেনের রঙ আলাদা, দ্বিতীয়টার গায়ে কমলা আর নীল রঙে লেখা রয়েছে সাউথ আফ্রিকান এয়ারওয়েজ, লেজে আঁকা ছুটন্ত হরিণের ছবি। তবে প্লেন দুটো একই মডেলের, এমন কি কেবিন প্ল্যানেও তেমন কোনো পার্থক্য নেই। স্পীডবার্ড জিরো-সেভেন জিরোর ভেতরের প্ল্যান হিথ্রোর ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ হেডকোয়ার্টার থেকে আগেই টেলিপ্রিন্টারের সাহায্যে পাঠিয়ে দেয় হয়েছে। দুটো প্লেন প্রায় একই রকমের হওয়ায় ওদের খুব সুবিধে হলো, সুযোগটা সাথে সাথে কাজে লাগাল কলিন নোবলস। এরই মধ্যে শূন্য খোলের ভেতর সাতবার ডেল্টা কন্ডিশনের মহড়া শেষ করেছে সে।

ঠিক আছে, এসো এবার এমনভাবে দৌড়াই যেন খোদ ডেভিল তাড়া করেছে আমাদের। গো থেকে পেনিট্রেশন পর্যন্ত চৌদ্দ সেকেন্ড বড় বেশি সময়, কলিনের স্ট্রাইক টীম টারমাকে অর্ধবৃত্ত তৈরি করে দাঁড়িয়ে রয়েছে, পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল তারা, কেউ কেউ নাটকীয় ভঙ্গিতে আকাশের দিকে মুখ তুলে চোখ ঘোরাল। গ্রাহ্য করল না কলিন।

এসো দেখি, নয় সেকেন্ডে পারা যায় কিনা।

অ্যাসল্ট গ্রুপে ওরা ষোলোজন রয়েছে। পিটার যোগ দিলে সতেরো জন হবে। থোর-কমান্ডে অন্যান্য সদস্যরা টেকনিকাল এক্সপার্ট-ইলেকট্রনিক্স আর কমিউনিকেশন্স চারজন মার্কর্সম্যান স্নাইপার, একজন উইপনস্ কোয়ার্টারমাস্টার, একজন বম ডিজগোজাল আর এক্সপ্লেসিভ সার্জেন্ট, ডাক্তার, কুক, একজন লেফটেন্যান্টের অধীনে তিনজন নন-কমিশনড ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট এবং অন্যান্য ত্রু, সব মিলিয়ে বড়সড় একটা দল, কিন্তু একজনকেও বাদ দেয়ার উপায় নেই।

 একপ্রস্থ কালো নাইলনের তৈরি ইউনিফর্ম পরে আছে অ্যাসল্ট গ্রুপের লোকজন, রাতেরবেলা সহজে কারও চোখে পড়বে না। প্রত্যেকের গলায় ঝুলছে গ্যাস মাস্ক। কালো বুটে নরম রাবার সোল। প্রত্যেকের সাথে রয়েছে যার যার অস্ত্র আর ইকুইপমেন্ট, হয়তো ব্যাক প্যাকে নয়তো কালো ওয়েবিং বেল্টে। কাউকে ভারী বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরতে দেয়া হয়নি, নড়তে চড়তে অসুবিধে হয়। নিরেট কোনো হেলমেটও ব্যবহার করা হচ্ছে না, অস্ত্রের সাথে ঘষা লেগে আওয়াজ হতে পারে ভেবে।

 গ্রুপের সবার বয়সই পঁচিশের মধ্যে, বিভিন্ন দেশের সেনা বাহিনি থেকে বাছাই করে আনা হয়েছে। প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে ট্রেনিং দিয়ে ওদেরকে ক্ষুরের মতো ধারালো করে তুলেছে পিটার।

 টারমাকের দুজায়গায় চক দিয়ে দুটো আঁক কেটেছে কলিন, একটা দাগ দিয়ে এয়ার টার্মিনালের প্রবেশমুখ বোঝানো হচ্ছে, আরেকটা দিয়ে বোঝানো হচ্ছে জিরো-সেভেন-জিরোর সবচেয়ে কাছের সার্ভিস হ্যাঙ্গারটাকে। অ্যাসল্ট গ্রুপ দাগের ওপর নিঃশব্দে দাঁড়াল, তীক্ষ্ণ চোখে ওদেরকে দেখছে কলিন। কোথাও কোনো ঢিলেঢালা ভাব নেই।

 ঠিক আছে, দশ সেকেন্ড পর ফ্লেয়ার! ডেল্টা কন্ডিশনে আক্রমণ শুরু করা হবে টার্গেট পৌঁছনের নাকের সামনে ফসফরাস ফ্লেয়ার জ্বালিয়ে। ফ্লেয়ারগুলো খুদে প্যারাস্যুটের শেষ মাথায় থাকবে। ডাইভারশন তৈরির জন্যে ভালো কাজ দেয় কৌশলটা। আলোর উৎস জানার জন্যে ফ্লাইট ডেকে জড়ো হবে আতঙ্কবাদীরা। ফ্লেয়ারগুলো এত উজ্জ্বল যে তাকাবার সাথে সাথে ধাধিয়ে যাবে চোখ, পরে বেশ কয়েক মিনিট রাতের অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাবে না আতঙ্কবাদীরা।

 ফ্লেয়ারস! গর্জে উঠল কলিন, সাথে সাথে তৎপর হয়ে উঠল অ্যাসল্ট গ্রুপ। দুজন লোককে স্টিক বলে ডাকা হয়, তারাই নেতৃত্ব দিচ্ছে ওদের। পরিত্যক্ত প্লেনের বিশাল লেজের দিকে সরাসরি ছুটল ওরা। লীডারদের প্রত্যেকের কাঁধে স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধা গ্যাস সিলিন্ডার রয়েছে, ফ্লেক্সিবল আমার কাপলিংয়ের সাথে সিলিন্ডারের সাথে আটকানো স্টেনলেস স্টিল প্রোব-সেজন্যেই এই নামকরণ ওদের। লীডারের পিঠের ট্যাংকে রয়েছে দুশ, পঞ্চাশ অ্যাটমসফেয়ার কমপ্রেসড এয়ার, আর বিশ ফিট পোবের ডগায় রয়েছে হীরে বসানো এয়ার-ড্রিলের পয়েন্ট ছোঁয়াবার জন্যে দুহাত উঁচু করে দিল। ম্যানুফ্যাকচারারের ড্রইং দেখে আগেই জেনে নিয়েছে স্পটটা কোথায়-প্লেনের এই অংশের প্রেশার হাল সবচেয়ে পাতলা, এখানে ফুটো করেই সরাসরি প্যাসেঞ্জার কেবিনে গ্যাস ঢোকানো হবে।

কাটিং ড্রিলের যান্ত্রিক গুঞ্জন চাপা দেয়া হবে দক্ষিণ টার্মিনাল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা প্লেনের জেট ইঞ্জিন চালু করে। বোয়িঙের খোল ফুটো করার জন্যে সময় বরাদ্দ করা হয়েছে তিন সেকেন্ড। দ্বিতীয় লীডার ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে তার প্রোবের ডগা সদ্য তৈরি ফুটোয় ঢোকার জন্যে।

 পাওয়ার অফ? নির্দেশ দিল কলিন। এই নির্দেশ পাবার সাথে সাথে মেইন্স থেকে সংযুক্ত প্লেনের ইলেকট্রিক পাওয়ার লাইন কেটে দেয়া হবে, বন্ধ হয়ে যাবে এয়ার-কন্ডিশনিং।

দ্বিতীয় লীডার তার ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে-পিঠে বাঁধা বোতলের গ্যাস প্রোবের মাধ্যমে প্লেনের ভেতরকার বাতাসে ছড়িয়ে দেয়ার মহড়া দিচ্ছে সে। ভিক্টর ফাইভ নামে পরিচিত এই গ্যাসের প্রায় কোনো গন্ধ নেই, নাকে ঢোকার পর দশ সেকেন্ডের মধ্যে একজন লোককে অসাড় করে দিতে পারে-পেশি অবশ হয়ে যাবে, নড়াচড়ায় নিয়ন্ত্রণ থাকবে না, মুখে কথা আটকে যাবে, দৃষ্টি হয়ে উঠবে ঝাপসা।

বিশ সেকেন্ড শ্বাস নিলে সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়বে। ত্রিশ সেকেন্ড পর জ্ঞান থাকবে না। দুমিনিটে মত্যু। রেহাই পাবার উপায় তাজা বাতাস। আরো ভালো হয় খাঁটি অক্সিজেন পাওয়া গেলে। দ্রুতই ফিরে আসে সুস্থতা, দীর্ঘমেয়াদী কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই।

অ্যাসল্ট গ্রুপের আর সবাই লীডারদের পিছু নিয়ে চার ভাগে ভাগ হয়ে পড়েছিল, ডানার নিচে তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছিল তারা–সবাই গ্যাস মাস্ক পরে আছে, হাতে বাগিয়ে ধরা অস্ত্র আর ইকুইপমেন্ট। স্টপওয়াচে চোখ রেখেছে কলিন, আরোহীদের দশ সেকেন্ডের বেশি গ্যাস সরবরাহ করবে না সে। বয়স্ক লোকজন আর বাচ্চারা রয়েছে, হাঁপানির রোগী থাকতে পারে।

পাওয়ার অন। এয়ার-কিন্ডিশনিং চালু হবার সাথে সাথে কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে শুরু করবে বিষাক্ত গ্যাস। তারপরই নির্দেশ এল, গো!

অ্যালুমিনিয়ামের মই বেয়ে তরতর করে ডানার সংযোগ পর্যন্ত উঠে গেল অ্যাসল্ট টিম, বাড়ি দিয়ে ইমার্জেন্সি উইন্ডো প্যানেল ভেঙে ফেলল তারা। বাকি দুদল উঠল প্রধান দুটো দরজার কাছে, কিন্তু ওরা শুধু স্ন্যাপ-হ্যামার দিয়ে ধাতব পাত ছিঁড়ে ভেতরের রকিং ডিভাইস বের করার ভান করল মাত্র। স্টান গ্রেনেড ডিটোনেট করারও সুযোগ নেই ওদের।

পেনিট্রেশন। লীডারদের একজন পিটারের ভূমিকায় অভিনয় করছে, কেবিনে ঢোকার সিগন্যাল দিল সে। সেই সাথে স্টপওয়াচ বন্ধ করল কলিন। কাজে এত মগ্ন ছিল যে জানেই না নিঃশব্দ পায়ে কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে পিটার।

এগারো সেকেন্ড, স্যার, বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসল কলিন। খারাপ নয়–তবে খুব একটা আহামরি কিছুও নয়। আবার মহড়া দেব আমরা।

একটু বিশ্রাম দাও, নির্দেশ দিল পিটার। কিছু কথাও হোক।

এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ারের দেয়াল জুড়ে পাশাপাশি দাঁড়াল সবাই, শুধু পিটার আর কলিন তাদের দিকে মুখ করে থাকল। বিকেলের তাপে টারমাকের দিকে তাকানো যায় না, তবে দূরাকাশের কোণে কালো আর ভারী মেঘ জমেছে।

আর ছয় ঘণ্টা পর ডেডলাইন, বলল কলিন। সরকারের তরফ থেকে কনসেশনের কোনো খবর এল?

না। ওরা রাজি হবে বলে মনে হয় না।

হয়তো হবে, তবে আরেকটা ডেডলাইন পেরোবার পর। দাঁত দিয়ে চুরুটের গোড়া ছিঁড়ল কলিন, ছোঁড়া অংশটুকু থু করে ফেলে দিল, যেন কারও ওপর রেগে গেছে। এতগুলো দিন গাধার খাটনি খেটে নিজেকে তৈরি করলাম, অথচ যখন কাজ করার সুযোগ এল পিছমোড়া করে বেঁধে রাখল হাতজোড়া।

সন্ধ্যার পরপরই, সাথে সাথে জবাব দিল কলিন।

না। ড্রাগের প্রভাব এখনো ওদের শরীরে বাড়ছে। প্রভাব কমতে শুরু করার খানিকক্ষণ পর আক্রমণ করব আমরা। আমার ধারণা দ্বিতীয় ডেডলাইনের একটু আগে আবার ওরা ড্রাগ নেবে, ঠিক তার আগে হামলা চালানো উচিত, হিসেবে করার জন্যে থামল পিটার, পৌনে এগারোটায়, ডেডলাইনের সোয়া একঘণ্টা আগে।

পিটারকে সমর্থন করে মাথা ঝাঁকাল কলিন। যদি ডেল্টা কন্ডিশন ঘোষণা করা হয়।

 হ্যাঁ, বলল পিটার, তারপর কিছুক্ষণ ওরা কেউ কথা বলল না।

নিস্তব্ধতা পিটারই ভাঙল, দেখ কলিন, ব্যাপারটা আমাকে ক্লান্ত করে তুলেছে। ওরা আমার নাম জানে, তাহলে থোর সম্পর্কে আরো কিছু না জানতে পারার কি কারণ থাকতে পারে? প্লেন দখল করার জন্যে আমাদের নির্দিষ্ট প্ল্যান আছে, সেটাও কি জানে ওরা?

 ঈশ্বর, আমি এত দূর ভাবিনি!

 তাই ভাবছি, প্ল্যান কিছুটা বদলানো দরকার। মডেল ঠিক রেখেই করতে হবে সেটা, কারণ এখন আর সবটা বদলানো সম্ভব নয়, কলিনকে সন্দিহান দেখাল।

ফ্লেয়ার, বলল পিটার। হামলা যদি করি, আমরা ফ্লেয়ার জ্বালব না।

কিন্তু তাহলে তো আতঙ্কবাদীরা প্যাসেঞ্জার কেবিনে ছড়িয়ে থাকবে…!

লক্ষ্য করেছ ইনগ্রিড লাল শার্ট পরে আছে?

তার মানে কি ওরা সবাই… হ্যাঁ, হতে পারে।

ভেতরে ঢুকে লাল কিছু দেখলেই ঝাঁঝরা করে দেব, বলল পিটার। কিন্তু ঢুকে যদি দেখি লাল শার্ট নেই, তাহলে ইসরায়েল স্টাইল ফলো করতে হবে।

ইসরায়েলি স্টাইল হলো, সবাইকে শুয়ে পড়ার নির্দেশ দেয়া, নির্দেশ অমান্য করলে সরাসরি খুন করার জন্যে গুলি করা। বিচ্ছু হচ্ছে ওই মেয়েটা। ক্যামেরাটা ওর কাছে রয়েছে। ওর ভিডিও টেপ দেখিয়েছ সবাইকে?

দেখিয়েছি, চিনতে পারবে। ডাইনিটা কিন্তু ভারি সুন্দরী। শুধু ইনগ্রিডের নয় লাশের ভিডিও দেখিয়েছি, আহত বাঘের মতো হয়ে আছে সবাই। কিন্তু লাভ কি, চেহারায় হতাশ ভাব এনে বলল কলিন, অ্যাটলাস ডেল্টা কন্ডিশন ঘোষণা করবে না। আমরা শুধু শুধু সময় নষ্টা করছি।

 ধরে নাও ডেল্টা কন্ডিশন ঘোষণা করা হয়েছে, অসুবিধে আছে কোনো? জিজ্ঞেস করল পিটার, কিন্তু উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে বলে চলল, আমি তোমাকে বললাম আজ রাত স্থানীয় সময় দশটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে হামলা করা হবে। কাজটা এমনভাবে করবে যেন মহড়া দিচ্ছ না, সত্যি হামলা করছ-খুঁটিনাটি কোনো কাজেই ভান করবে না…।

ধীরে ধীরে ঘাড় ফিরিয়ে কমান্ডারের চোখে তাকাল কলিন, দুজনের দৃষ্টি এক হলো। পিটারের চোখের পাতা, দ্রু, নাকের ফুটো, ঠোঁট, কিছুই নড়ছে না।

ধরে নেব, স্যার? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল কলিন।

 অবশ্যই, দৃঢ়কণ্ঠে বলল পিটার,-একটু যেন অসহিষ্ণু।

কাঁধ ঝাঁকাল কলিন। ধেত্তেরি, আমি তো এখানে শুধু কাজ করি, বলে ঘুরে দাঁড়াল সে।

চোখে বিনকিউলার তুলে বোয়িং জিরো-সেভেন-জিরোর লেজ থেকে নাক পর্যন্ত দেখল পিটার, কোথাও প্রাণের কোনো লক্ষণ নেই। প্রতিটি পোর্ট আর জানালা ভেতর থেকে বন্ধ। তারপর, অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিনকিউলার একটু নিচু করে প্লেনের পাশে টারমাকে তাকাল ও। লাশগুলো স্তূপ হয়ে এখনো পড়ে রয়েছে ওখানে।

বিনকিউলার নামাল পিটার, একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে উঠে এল এয়ার ট্রাফিক টাওয়ারে। সিনিয়র এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের পাশে দাঁড়াল ও। আমি আবার একবার চেষ্টা করে দেখতে চাই। সাথে সাথে ওর হাতে মাইক্রোফোন ধরিয়ে দেয়া হলো।

 স্পীডবার্ড জিরো-সেভেন-জিরো, দিস ইজ টাওয়ার। ইনগ্রিড, ডু ইউ রিড মি? কাম ইন, ইনগ্রিড।

গত কয়েক ঘণ্টায় দশ-এগারোবার যোগাযোগ করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে পিটার হাইজ্যাকাররা কোনো সাড়া দেয়নি।

ইনগ্রিড, কাম ইন, প্লিজ। হাল না ছেড়ে আবার ডাকল পিটার।

 হঠাৎ করেই প্রাণবন্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এল, দিস ইজ ইনগ্রিড। কি চাই তোমার?

ইনগ্রিড, অনুরোধ করছি অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে লাশগুলো সরিয়ে আনার অনুমতি দাও।

 নেগেটিভ, টাওয়ার। আই সে এগেন, নেগেটিভ। প্লেনের ধারেকাছে কেউ আসতে পারবে না। এক সেকেন্ড থামল সে। এত তাড়া কিসের, আরো বারোটা। লাশ এখানে জমুক না, তখন সব একসাথে সরিয়ে নিতে পারবে। খিলখিল করে হাসল সে। মাঝরাত পর্যন্ত সবুর কর, কথা দিচ্ছি মেওয়া ফলবে।

ক্লিক শব্দ করে স্তব্ধ হয়ে গেল রেডিও।

.

এখন আপনাদের ডিনার পরিবেশন করা হবে, সহাস্যে ঘোষণা করল ইনগ্রিড, এবং আশ্চর্য, এত আতঙ্ক আর দুর্ভাবনার মধ্যেও উৎসাহের সাথে নড়েচড়ে বসল আরোহীরা। আপনারা জেনে খুশি হবেন আজ আমার জন্মদিন। কাজেই ডিনারের পর সবাইকে শ্যাম্পেনও দেয়া হবে। কি মজা, তাই না?

কিন্তু ছোটখাটো, মোটাসোটা ইহুদি ডাক্তার হঠাৎ করে উঠে দাঁড়াল, তার মাথার কগাছি সাদা চুল খাড়া হয়ে থাকায় কৌতুককর লাগছে দেখতে। তারপর মুখ যেন ভেতর দিকে দেবে গেছে, মনে হলো গলতে শুরু করা মোমের তৈরি বিধ্বস্ত একজন মানুষ, শোকে কাতর-কি বলা হচ্ছে বা কি ঘটছে সে ব্যাপারে তার যেন কোনো হুঁশ নেই।

কেন, কেন? কোন অধিকারে? কি করেছিল সে তোমার? বুড়ো মানুষের মতো কেঁপে গেল তার গলা। ওর মতো মেয়ে হয় না, তাকে তুমি বিনা কারণে মেরে ফেললে! জীবনে কখনো কারো মনে দুঃখ দেয়নি…।

আপনার স্ত্রীর কথা বলছেন? তাকে থামিয়ে দিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জানতে চাইল ইনগ্রিড। ভালো ছিল? বিদ্রুপের হাসি হাসল সে। কেউ ভালো নয়, কেউ নিরীহ নয়, আপনারা সবাই আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদের নোংরা উপকরণ।

হঠাৎই থেমে গেল ইনগ্রিড, নিজেকে সামলে নিয়ে ডাক্তারের কাঁধে হাত রাখল একটা জোর করে হাসল একটু। বসুন, বলল সে প্রায় কোমল সুরে। আপনার কেমন লাগছে আমি জানি, প্লিজ বিশ্বাস করুন। অন্য কোনো উপায় থাকলে সত্যি ভালো হতো।

 ধপ করে বসে পড়ল ডাক্তার, চোখে শূন্য দৃষ্টি, এক হাতের আঙুল দিয়ে আরেক হাতের আঙুল অকারণেই নাড়াচাড়া করছে।

শান্ত হোন, শান্ত হয়ে বসে থাকুন, নরম সুরে বলল ইনগ্রিড। আমি নিজে আপনাকে এক গ্লাস শ্যাম্পেন এনে দিচ্ছি।

.

মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার,–প্রায় দুটো দিন আর দুটো রাত বিরতিহীন উদ্বেগের মধ্যে থেকে কেনি কনস্টেবলের কণ্ঠস্বর কর্কশ হয়ে গেছে,-দশটার বেশি বেজে গেছে। হাতে আর দুঘণ্টা সময়ও নেই, সিদ্ধান্ত যা নেয়ার এখনি নিতে হবে। তা না হলে কি ঘটবে সবাই আমরা জানি।

গুঞ্জন থামাবার জন্যে লোমশ একটা হতে তুললেন প্রাইম মিনিস্টার।

হাজার মাইল দূরবর্তী জোহানেসবার্গ থেকে ভিডিও টেপের একটা কপি আনানো হয়েছে প্লেনে করে, উপস্থিত সবাই চাক্ষুষ করেছেন জিম্মিদের হৃদয় বিদারক হত্যাকাণ্ড। টেবিলে এমন একজন লোক নেই যে নিঃসন্তান। ওদের মধ্যে যারা ডানপন্থী রাজনীতি করেন, চেহারায় অনিশ্চিত ভাব নিয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করেছেন তারা। এমনকি লৌহমানব বলে খ্যাত মিনিস্টার অভ পুলিস পর্যন্ত চোখ তুলে অ্যামব্যাসাডারদের দিকে তাকাতে পারেননি।

 এবং এও আমরা জানি টেরোস্টিদের সবগুলো দাবি পুরোপুরি মেনে না নিলে আপোষের কোনো সম্ভাবনা নেই…

আবার কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতার মধ্যে কাটল সময়, তারপর প্রাইম মিনিস্টার মুখ খুললেন, মি. অ্যামব্যাসাডর, আমরা যদি দাবিগুলো মেনে নিইও, মেনে নেব শুধু মানবিক কারণে। আরোহীরা আপনাদের নাগরিক, তাদের নিরাপত্তার জন্যে বড় বেশি চড়া মূল্য দিতে হবে আমাদের–কিন্তু যদি এই মূল্য দিই আমরা, কাল বাদে পরশু কি নিরাপত্তা পরিষদে ব্রিটেন আর আমেরিকার পূর্ণ সমর্থন পাব আমরা?

কেনি কনস্টেবল বললেন, আমার প্রেসিডেন্ট আমাকে ক্ষমতা দিয়েছেন, আমি যেন আপনার সহযোগিতার বিনিময়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে সম্ভাব্য সব রকম সাহায্যের প্রস্তাব দিই।

ওই একই ক্ষমতা হার ম্যাজেস্টিজ গভর্নমেন্ট আমাকেও দিয়েছে, তাল মেলালেন স্যার উইলিয়াম এবং আমার সরকার একশ সত্তর মিলিয়ন ডলারের মোট একটা অংশ জোগান দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে।

তবু আমি একা সিদ্ধান্ত নেয়ার কেউ নই। একজনের পক্ষে ব্যাপারটা বড় বেশি ভারী। প্রাইম মিনিস্টার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আমি আমার মন্ত্রীদের কাছে ভোট চাইব, কাজেই আপনারা কমিনিটের জন্যে, প্লিজ…

অ্যামব্যাসাডররা একযোগে চেয়ার ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।

.

কলিন নোবলস কোথায়? প্রশ্ন করলেন ডক্টর কিংস্টোন পার্কার।

 ওখানে অপেক্ষা করছে। মাথা ঝাঁকিয়ে কমান্ড কেবিনের সাউন্ডপ্রুফ দরজার দিকে ইঙ্গিত করল পিটার।

 এই আলোচনায় ওকেও আমাদের দরকার, প্লিজ, স্ক্রীন থেকে বললেন ডক্টর পার্কার, কলিং বেলের বোতামে চাপ দিল পিটার।

মাথা নিচু করে ভেতরে ঢুকল কলিন, ছাদ নিচু বলে একটু ঝুঁকে থাকল, থোর ক্যাপটা ত্রুর কাছে নেমে আছে। গুড ইভনিং, স্যার। স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে বলল সে, পিটারকে পাশ কাটিয়ে পাশের সীটে বসল।

কলিন এখানে থাকায় আমি খুশি, বলল পিটার। আশা করি, আমার প্ল্যানটা সমর্থন করবে ও। ডেল্টা কন্ডিশনে পাল্টা আঘাত যদি পৌনে এগারোটায় করা হয় তাহলে সাফল্যের সম্ভাবনা আগের চেয়ে অনেক বাড়বে বলে আমার ধারণা। আস্তিন সরিয়ে হাতঘড়ি দেখল ও। তার মানে আমরা আক্রমণ করব আর চল্লিশ মিনিট পর, ড্রাগসের প্রভাব তখন সবচেয়ে কম থাকবে। আমার ধারণা…।

ধন্যবাদ, জেনারেল স্ট্রাইড,–শান্তভাবে পিটারকে বাধা দিলেন ডক্টর পার্কার। কিন্তু আমি আসলে মেজর কলিনকে এখানে ডেকেছি যাতে আমার নির্দেশ নিয়ে কোনো ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ না থাকে। মেজর কলিন, থোর কমান্ডের কমান্ডার, জেনারেল স্ট্রাইড, এখুনি হাইজ্যাকারদের কাবু করে বোয়িং জিরো জেভেন-জিরো দখল করতে চায়। আমি, তোমার উপস্থিতিতে, তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলাম। কোনো অবস্থাতেই, প্রকাশ্যে বা গোপনে টেরোরিস্টাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র কোনো ব্যবস্থা আমার হুকুম ছাড়া নেয়া যাবে না। আমি কি আমার বক্তব্য পরিষ্কার ব্যাখ্যা করতে পেরেছি?

ইয়েস, স্যার। কলিনের চেহারায় পাথুরে একটা ভাব।

 মেজর জেনারেল পিটার?

ইয়েস, ডক্টর পার্কার।

ভেরি গুড। আমি চাই তোমরা আমার জন্যে তৈরি থাক, প্লিজ। অ্যামব্যাসাডরের সাথে কথা বলে আবার আমি ফিরে আসছি।

স্ক্রীন খালি হয়ে যেতে ধীরে ধীরে পিটারের দিকে ফিরল কলিন, যা দেখল তাতে তার চেহারা সামান্য বদলে গেল। তাড়াতাড়ি কমান্ড কনসোলের সেনসর বোতামে চাপ দিল সে, সাথে সাথে সমস্ত রেকর্ডিং টেপ অচল হয়ে গেল, বন্ধ হয়ে গেল সব কটা ভিডিও ক্যামেরা। যাই বলুক ওরা, তার কোনো রেকর্ড থাকবে না।

 চিন্তা কর, স্যার, ভালো করে ভেবে দেখ, আবার মুখ খুলল কলিন, জানে পিটার কি ভাবছে। আর কদিন পরেই তুমি ন্যাটোর চিফ হতে যাচ্ছো। আর, একবার ন্যাটোর কিছু হলে এরপর যে কোথায় পৌঁছুবে নিজেও জানো না।

নিঃশব্দে আরেকবার হাতঘড়ি দেখল পিটার। থমথম করছে চেহারা। দশটা বেজে সতেরো মিনিট।

ভাবছি, কলিন, শান্ত গলায় বলল পিটার,—ঘটনাটা ঘটার পর থেকে ভাবনা ছাড়া একটা মুহূর্ত কাটাইনি-প্রতিবার একই সিদ্ধান্তে এসেছি। ওদের যদি মরতে দিই, ওই মেয়েটার চেয়ে আমার অপরাধ কোনো অংশে কম হবে না।

কেন তুমি অপরাধী হতে যাবে? সিদ্ধান্তটা আরেকজনের…

এভাবে এড়িয়ে যাওয়া সহজ, বলল পিটার। কিন্তু এড়িয়ে গেলে কি চারশ লোক বাঁচবে?

 পিটারের কাঁধে একটা হাত রেখে মৃদু চাপ দিল কলিন। কিন্তু, তোমার ক্যারিয়ার, স্যার? ভবিষ্যৎ? আমি জানি–কত উপরে উঠতে পারো তুমি, বন্ধু।

ইচ্ছে করলে তুমি সরে দাঁড়াতে পারো, কলিন। আমি চাই না তোমার ক্যারিয়ার নষ্ট হোক।

সরে দাঁড়াতে তেমন পটু নই, স্যার।

আমি চাই তুমি একটা প্রতিবাদ রেকর্ড কর–সবাই একসাথে ডোবার কোনো মানে হয় না, বলল পিটার, রেকর্ডিং ইকুইপমেন্টের সুইচ অন করল ও–অডিও আর ভিডিও, দুটোই।

কলিন নোবলস্, স্পষ্ট উচ্চারণে বলল পিটার, আমি জেনারেল স্ট্রাড ডেল্টা কন্ডিশনে জিরো-সেভেন-জিরো এখুনি দখল করতে যাচ্ছি। সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন কর, প্লিজ।

ক্যামেরার দিকে মুখ ফেরাল কলিন। মেজর জেনারেল পিটার স্ট্রাইড, অ্যাটলাসের অনুমতি ছাড়া ডেল্টা কন্ডিশন ঘোষণা করছেন আপনি, আমি এর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানাচ্ছি।

 কলিন নোবলস্, তোমার প্রতিবাদ নোট করা হলো, গম্ভীরভাবে বলল পিটার, হাত ঝাপটা দিয়ে সেনসর বোতাম টিপল কলিন।

যথেষ্ট পাগলামি হয়েছে, সীট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে। চলো স্যার, ব্যাটাদের উচিত শিক্ষা দিয়ে আসি।

.

হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের সীটে বসে রয়েছে ইনগ্রিড, আরোহীদের পিলে চমকানো আরো একটা দুঃসংবাদ দেয়ার জন্যে মনে মনে তৈরি হচ্ছে সে। চোখের পিছনে বোধহয় কোনো শিরা লাফাচ্ছে তা না হলে ব্যথা হবে কেন! মাইক্রোফোন ধরা হাতটাও কাঁপছে একটু একটু। জানে, এ সবই ড্রাগের প্রতিক্রিয়া। মনে মনে স্বীকার করল সে, লিটারেচারে যা লেখা ছিল তার চেয়ে বেশি ডোজ বরাদ্দ করাটা বোকামি হয়ে গেছে। সেজন্যে মূল্য দিতে হচ্ছে চারজনকেই। তবে আর বিশ মিনিট পর আবার এক ভোজ ড্রাগ নেয়ার সময় হবে, তখন মাত্রা ঠিক রাখবে সে, কারও জন্যেই দুটোর বেশি ট্যাবলেট বরাদ্দ করবে না।

বন্ধুরা আমার, মাইক্রোফোনে কথা বলতে শুরু করল সে। অত্যাচারীরা আমাদের দাবির কাছে নতি স্বীকার করেনি। ফ্যাসিস্ট সাম্রাজ্যবাদীর এই হলো আসল চেহারা, আপনাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে মোটেও উদ্বিগ্ন নয় সে। অথচ আপনারা জানেন, এই অত্যাচারী লোকটার নেতৃত্বে একদল হায়েনা এ দেশের বৈধ সন্তানদের কিভাবে শোষণ করছে, কিভাবে তাদের স্বাধীনতার দাবি অস্বীকার করে আসছে।

 হাঁপিয়ে গেছে ইনগ্রিড, দম নিয়ে আবার শুরু করল, আমি দুঃখিত, কিন্তু নষ্ট করার মতো আর সময় নেই–আরো চারজন জিম্মিকে বেছে নিতে হবে আমাদের। কথা দিচ্ছি, বাছাইয়ের কাজে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা বজায় রাখা হবে। সেই সাথে আপনাদের আমি এই বলে কাতর হতে নিষেধ করি যে এখানে এই মুহূর্তে যে বিপ্লব ঘটছে আপনারা আমরা সবাই তাতে সামিল হতে পেরে গর্বিত। সবাই আমরা এই ভেবে অহঙ্কার করতে পারি যে…।

অকস্মাৎ বারকয়েক বিদ্যুৎ চমকাল, সেই সাথে শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। গুরু-গম্ভীর মেঘ ডাকছে। অর্থহীন পাগলের প্রলাপ বকে চলেছে ইনগ্রিড, দম ফুরিয়ে গেলে থামছে, তারপর আবার কঠিন শব্দ সাজিয়ে যা মনে আসছে তাই বলে যাচ্ছে।

 সীট নম্বর ধরে আপনাদের ডাকব আমি, আবার কাজের কথায় ফিরে এল সে। আমার অফিসাররা আপনাদের নিয়ে আসবে। দয়া করে তাড়াতাড়ি আপনারা চারজন ফার্স্ট ক্লাস গ্যালিতে চলে আসবেন। বিপ্লবী ভাই এবং বোনেরা, আপনাদের কাছ থেকে আমি পূর্ণ সহযোগিতা কামনা করি। তিন সেকেন্ডের বিরতি, তারপর আবার তার গলা শোনা গেল, সীট নম্বর নাইনটি/বি। দাঁড়ান, প্লিজ।

 কড়-কড়-কড়াৎ করে বাজ পড়ল কোথাও। লাফ দিয়ে ইনগ্রিডের পাশে চলে এল ক্যারেন, থরথর করে কাঁপছে সে। তার চোখ জবা ফুলের মতো লাল হয়ে উঠেছে, চোখের পাতা ভারী। চেহারায় উভ্রান্ত একটা ভাব নিয়ে কান পেতে থাকল সে, বজ্রপাতের আওয়াজকে তার ভারী ভয়। অন্যমনস্কভাবে পিঠে হাত বুলিয়ে অভয় দিল তাকে ইনগ্রিড।

লম্বা চুলে মুখ ঢাকা জার্মান যুবক কার্ট এগিয়ে গেল, নাইনটি-বি সীটের মধ্যে বয়স্ক আরোহীকে টেনে-হিঁচড়ে দাঁড় করাল সে। লোকটার একটা হাত ধরে মুচড়ে শিরদাঁড়ার কাছে নিয়ে এল।

 কিছু একটা করুন আপনারা! সহ-আরোহীদের দিকে তাকিয়ে করুণ আবেদন জানাল লোকটা। তার সাদা শার্ট ঘামে ভিজে আছে। ঢিলেঢালা ট্রাউজারের ভেতর বারবার ভাজ হয়ে যাচ্ছে হাঁটু, প্যাসেজ ধরে তাকে হটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাচ। ওরা আমাকে খুন করতে নিয়ে যাচ্ছে দেখেও কেউ আপনারা কিছু করবেন না? বিস্ময়ে বিপন্ন চোখে লোকজনদের দিকে তাকাল লোকটা। প্লিজ, আমাকে বাঁচতে দিন। আমি বাঁচতে চাই। কিন্তু সবাই ওরা যে যার কোলের দিকে তাকিয়ে থাকল। কেউ নড়ল না, কেউ মুখ খুলল না।

সীট নম্বর ফরটি-থ্রী/এফ।

পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের সুন্দরী এক মেয়ে, নিজের সীটের ওপর নম্বরটা দেখার সাথে সাথে তার চেহারা ধীরে ধীরে আঁচ লাগা মোমের মতো গলে যেতে শুরু করল। কান্নার আওয়াজ চাপা দেয়ার জন্যে মুখে একটা হাত তুলল সে। তার ঠিক উল্টোদিকের সীট থেকে ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন একজন, চটপটে এক বৃদ্ধ। মাথা ভর্তি প্রচুর চুল, সব সাদা হয়ে গেছে, ক্লিনশেভড। সপ্রতিভ ভাবে তিনি তার টাইটা ঠিক করলেন।

ফিসফিস করে তিনি বললেন, আমার সাথে সীট বদল করবে, ম্যাডাম, প্লিজ? বড় বেশি স্পষ্ট উচ্চারণ কণ্ঠস্বরে বিদেশি টান। কথা শেষ করে উত্তরের অপেক্ষায় থাকলেন না, প্যাসেজে বেরিয়ে সহজ ভঙ্গিতে হাঁটতে লাগলেন। হনহন করে এগিয়ে আসছিল ফরাসি যুবক হেনরি, বৃদ্ধের কনুই চেপে ধরল সে। আঁকি দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিলেন তিনি, দৃঢ়পায়ে একাই ফরওয়ার্ড গ্যালিতে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

.

বোয়িং জিরো-সেভেন-জিরোর সবচেয়ে দুর্বল জায়গা চিহ্নিত করা হলো। ফ্লাইট ডেকের পাশের জানালাগুলো থেকে বিশ ডিগ্রী কোণ সৃষ্টি করে পিছনের লেজ পর্যন্ত যে জায়গাটুকু রয়েছে সেখানে প্লেন থেকে কারও চোখ পড়বে না। হাউজ্যাকারদের সাথে অত্যাধুনিক ইকুইপমেন্ট রয়েছে, এবং তাদের আত্মবিশ্বাস আকাশচুম্বী, কাজেই দুর্বল জায়গাটার ওপর কড়া নজর রাখছে বলে মনে হয় না।

মেইন সার্ভিস হ্যাঙ্গারের চার্ট রয়েছে কলিনের, মন দিয়ে পিটারের কথা শুনছে সে। সরাসরি বোয়িংয়ের পিছনে রয়েছে ওরা, মাঝখানে চারশ গজের কিছু বেশি দূরতু, তার অর্ধেকটাই হাঁটু সমান উঁচু ঘাসে ঢাকা, বাকিটা টারমাক। টারমাক শুধু ট্যাক্সিওয়ের নীল আলোয় আর এয়ারপোর্ট বিল্ডিংয়ের সাদা আভায় আলোকিত হয়ে আছে। এয়ারপোর্টের সব আলো নিভিয়ে দেয়ার কথা ভেবেছিল পিটার, পরে বাতিল করে দিয়েছে চিন্তাটা। চারদিক অন্ধকার হয়ে গেলে হাইজ্যাকাররা বিপদ টের পেয়ে যাবে, বোয়িংয়ের কাছে পৌঁছুতে অ্যাসল্ট টিমেরও অসুবিধে হবে।

কই, কিছুই তো দেখছি না, চোখ থেকে নাইট গ্লাস নামিয়ে বলল কলিন। অনেক আগেই নিভে গেছে তার চুরুট, তবু ফেলছে না সেটা। ব্লাইন্ড স্পটে ওরা নজর রাখছে না।

 দুজনেই ওরা একজন এন.সি. ও-র হাতে নিজেদের নাইট গ্লাস ধরিয়ে দিল, ওগুলো আর দরকার হবে না। একান্ত প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট ছাড়া বাকি সব কিছু ফেলে রেখে যাচ্ছে অ্যাসল্ট টিম।

টার্মিনাল ভবনে নিজের লোকদের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্যে হালকা, এগারো আউন্সের একটা ভি, এইচ, এফ, ট্রানসিভার সেট নিয়েছে পিটার, আর শুধু একটা ওয়ালথার পি. কে, থারটি এইট অটোমেটিক পিস্তল। নিতম্বের কাছে কুইক রিলিজ হোলস্টারে রয়েছে ওটা। অ্যাসল্ট টিমের অন্যান্য সদস্যরা যে যার পছন্দ মতো অস্ত্র বেছে নিয়েছে। কলিন নিয়েছে ব্রাউনিং হাই-পাওয়ার পয়েন্ট ফরটিফাইভ, ম্যাগাজিনে চৌদ্দ রাউন্ড গুলি। সবাই ওরা সুপার ভেলেক্স এক্সপ্লোসিভ বুলেট ভরেছে যে যার অস্ত্রে-ধাক্কা লাগার সাথে সাথে ধরাশায়ী হবে টার্গেট, শরীরের ভেতর বিস্ফোরণ ঘটায় ভেদ করে বেরিয়ে আর কাউকে আহত করার আশঙ্কা নেই।

রোলেক্সের আলোকিত ডায়ালে চোখ রাখল পিটার। এগারোটা বাজতে ষোলো মিনিট বাকি। ঠিক এই মুহূর্তে জীবনের মোড় ঘুরে যেতে পারে এমন একটা কাজে হাত দিতে যাচ্ছে ও। এর পরিণতি কি হতে পারে ওর জানা নেই। কিন্তু সে ব্যাপারে চিন্তিত নয় ও। যাই ঘটুক, পরে দেখা যাবে।

মুঠো পাকানো ডান হাতটা মাথার ওপর তুলল পিটার, দুসেকেন্ড ওভাবে রাখল, তারপর নামিয়ে আনল ঝট করে। সিগন্যাল পেয়ে স্টিক দুজন দ্রুত সামনে বাড়ল, বুটে রাবার সোল থাকায় কোনো শব্দ হলো না, পিঠের সাথে স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধা গ্যাস সিলিন্ডার আর প্রোব।

ধীরে ধীরে পাঁচ পর্যন্ত গুনল পিটার, উত্তেজনায় টান টান হয়ে আছে শরীর। ডক্টর পার্কারের নির্দেশ এখনো পরিষ্কার বাজছে ওর কানে। সব ভুলে গিয়ে আবার সিগন্যাল দিল পিটার, ছায়া থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে রওনা হয়ে গেল অ্যাসল্ট টিম, ওদের তিনজন অ্যালুমিনিয়ামের একটা মই বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, চারজনের কাঁধ থেকে স্ট্র্যাপের সাথে ঝুলছে স্টার গ্রেনেড ভরা ব্যাগ, অন্যান্যদের হাতে স্ন্যাপ হ্যাঁমার–প্লেনের দরজায় লাগানো তালা ভাঙার কাজে দরকার হবে ওগুলো। প্রায় কোনো আওয়াজ না করে ছুটল ওরা, প্রত্যেকে শুধু তার নিঃশ্বাসের শব্দ পাচ্ছে।

টার্মিনাল বিল্ডিংয়ের আলোর আভায় স্টিক দুজনকে দেখতে পেল পিটার, নাক বরাবর সামনে, প্লেনের ফুলে থাকা রুপালি পেটের নিচে পজিশন নিয়েছে। ভিজে টারমাক চকচক করছে। বিস্ফোরণের আওয়াজ পেয়ে ছ্যাৎ করে উঠল পিটারের বুক, সেই সাথে চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল আলোর বন্যায় ভেসে গেল চারদিক। তারপরই অন্ধকার, কিন্তু আবার যে কোনো মুহূর্তে চমকাতে পারে বিদ্যুৎ। বিস্ফোরণের মতো শব্দ করে ডেকে ওঠার পর থামেনি মেঘ, গরগর করে গজরাচ্ছে। কালো আকাশটাকে চিরে আবার ছুটে গেল বিদ্যুৎরেখা। ঘাসের ওপর মাথা উঁচু করে ছুটছে অ্যাসল্ট টিম, সবাইকে পরিষ্কার দেখতে পেল পিটার। হাইজ্যাকাররাও কি দেখতে পেয়েছে?

মাটি ছেড়ে শক্ত টারমাকে উঠে এল ওরা। রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে পিটার যে কোনো মুহূর্তে একসাথে দশ-বারোটা গ্রেনেড ছুটে আসবে। কিন্তু এল না। তারপর অনেকটা যেন হঠাৎ করেই বোয়িংয়ের ফিউজিলাজের নিচে পৌঁছে গেল সব কজন, যেন বাচ্চারা মুরগির পেটের তলায় নিরাপদ আশ্রয়ে গা ঢাকা দিল। দুটো দল চার ভাগ হয়ে গেল, প্রত্যেকে তার বা হাঁটু ভাঁজ করে টারমাকে ঠেকাল, একসাথে ঢেকে ফেলল যে যার মুখ গ্যাস মাস্ক দিয়ে। সবাইকে চট করে একবার দেখে নিয়ে ট্র্যানসিভারের বোতামে চাপ দিল পিটার, গোটা ব্যাপারটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত মুখ খুলবে না ও। বলা যায় না, হয়তো একই ফ্রিকুয়েন্সি মনিটর করছে হাইজ্যাকাররা। বোতাম চাপ দেয়ার ফলে টার্মিনাল ভবনে অপেক্ষারত থোর কমান্ডের লোকজন শব্দটা শুনতে পেল-ক্লিক। এই সিগনালের জন্যেই অপেক্ষা করছিল ওরা। প্রায় সাথে সাথে দূরে গর্জে উঠল একটা জেটের একজোড়া ইঞ্জিন। উত্তর প্রান্ত ঘেঁষে ইন্টারন্যাশনাল ডিপারচার এরিয়ায় রয়েছে জেটটা, তবে জেটের এগজস্ট সার্ভিস এলাকার দিকে ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছে। এক এক করে আরো তিনটে জেটের তিন জোড়া ইঞ্জিন চালু হয়ে গেল। সবগুলোর একত্রিত আওয়াজে এত দূর থেকেও কানে তালা লাগার অবস্থা হলো। হাত তুলে সিগনাল দিল পিটার।

তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছিল একজন স্টিক, সিগনাল পেয়েই ড্রিলের ডগা ফিউজিলাজের গায়ে ছোঁয়াল সে। ড্রিলের আওয়াজ ওরাই কেউ শুনতে পেল না, হাইজ্যাকারদের তো আরো শুনতে না পাবার কথা। প্রেশার হাল ভেদ করে লম্বা প্রোব বোয়িংয়ের ভেতর সেঁধিয়ে গেল। সাথে সাথে দ্বিতীয় স্টিক তার প্রোব ডোকাল খুদে ফুটোর ভেতর, চট করে পিটারের দিকে একবার তাকাল সে। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে পিটার। সিগনাল দিল ও, প্লেনের ভেতর গ্যাস ঢুকতে শুরু করল।

ট্র্যানসিভারের বোতামে পরপর দুবার চাপ দিল পিটার, দুসেকেন্ড পর বোয়িংয়ের পর্দা ঢাকা আলোকিত পোর্টহোলগুলো অন্ধকার হয়ে গেল একযোগে মেইন্স থেকে পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

জেট ইঞ্জিনগুলোর আওয়াজ আরো কয়েক সেকেন্ড শোনা গেল। মইবাহী লোকদের সামনের দিকে এগোবার সিগনাল দিল পিটার। রাবার প্যাড লাগানো মইয়ের মাথা মসৃণ ডানার কিনারায় ঠেকাল, তরতর করে উপর দিকে উঠে গেল গ্যাস কমান্ডোরা। গ্যাস মাস্ক পরা কালো মূর্তিগুলো দ্রুতহাতে কাজ শুরু করল।

 বোয়িংয়ের কেবিনে গ্যাস ঢোকার পর দশ সেকেন্ড সময় নিল পিটার, তারপর তিনবার চাপ দিল বোতামে। সাথে সাথে মেইন্স থেকে আবার পাওয়ার সাপ্লাই শুরু হলো, প্লেনের ভেতর জ্বলে উঠল আলোগুলো। সেই সাথে এয়ারকন্ডিশনিংও চালু হলো আবার। কেবিন আর ফ্লাইট ডেক থেকে বিষাক্ত গ্যাস এবার বেরিয়ে যাবে।

কলিনের কাঁধে মৃদু টোকা দিল পিটার, বুক ভরে বাতাস টেনে ছুটল দুজন। দুই ডানার ওপর অপেক্ষা করছে দুটো দল, তাদের নেতৃত্ব দেবে ওরা।

.

এগারোটা বাজতে নয় মিনিট, ক্যারেনকে বলল ইনগ্রিড, বাইরে কোথাও জেট ইঞ্জিন চালু হওয়ায় গলা একটু চড়াতে হলো তাকে। ড্রাগের প্রভাব কমে আসায় জিভ আর গলা শুকিয়ে গেছে তার, চোখের কোণে একটা শিরা ঘন ঘন লাফাচ্ছে। মনে হলো পাকানো একটা রশি জড়ানো রয়েছে তার কপালে, কেউ সেটা ধীরে ধীরে চাপ দিয়ে আরো আঁটসাট করছে। মনে হচ্ছে হিসেবে ভুল করেছে খলিফা। দক্ষিণ আফ্রিকান সরকার হার মানতে রাজি নয়। ঠোঁট একটু বাঁকা করে ফ্লাইট ডেকের ভোলা দরজা দিয়ে ভাজ খোলা চেয়ারে বসা ক্রুদের দিকে তাকাল সে। পাকা চুল পাইলট ভার্জিনিয়া সিগারেট খাচ্ছে, নিস্তেজ চোখে ইনগ্রিডের দিকে তাকাল সে। কোনো কারণ ছাড়াই পিত্তি জ্বলে গেল ইনগ্রিডের, গলা চড়িয়ে বলল, এই দলটাকেও গুলি করতে হতে পারে।

প্রবল বেগে মাথা নাড়ল ক্যারেন। খলিফার কখনো ভুল হয় না। এখনো এক ঘণ্টা বাকি রয়েছে ডেডলাইনের।

এই সময় একবার কেঁপে উঠে নিভে গেল আলো। পোর্ট হোলে শেড থাকায় বোয়িংয়ের ভেতরটা গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেল, এয়ার-কন্ডিশনিংয়ের হিসহিস থেমে যাওয়ায় নেমে এল জমাট নিস্তব্ধতা।

অন্ধকারে বিস্ময়সূচক কিছু আওয়াজ হলো।

 কন্ট্রোল প্যানেল হাতড়াল ইনগ্রিড। বোতামটা পেয়ে চাপ দিল সে, প্লেনের নিজস্ব ব্যাটারিচালিত আলো জ্বলে উঠল-মান আর নিস্তেজ। নরম আলোর আভায় ইনগ্রিডকে উত্তেজিত দেখল ক্যারেন।

পাওয়ার সাপ্লাই বন্ধ করে দিয়েছে ওরা, হিসহিস করে বলল ইনগ্রিড। এয়ার-কন্ডিশনিং…হয়তো ডেল্টা কন্ডিশন ঘোষণা করা হয়েছে।

না, প্রায় চিৎকার করে বলল ক্যারেন। ফ্লেয়ার কোথায়?

কিন্তু…, মুখের ভেতর কথা জড়িয়ে যাচ্ছে ইনগ্রিডের, জিভটাকে অনেক বড় লাগছে। ক্যারেনের চেহারা তার চোখে ঝাপসা লাগল, মুখের কিনারাগুলো পরিষ্কার নয়। ক্যারেন,–শুরু করল আবার, কিন্তু নাকে কি যেন একটা গন্ধ পেয়ে ছ্যাৎ করে উঠল তার বুক। হঠাৎ বিস্ফারিত হয়ে উঠল চোখ জোড়া। গড, ওহ্ গড! আর্তচিৎকার বেরিয়ে এল তার গলা থেকে, ম্যানুয়েল অক্সিজেন রিলিজ করার জন্যে উন্মাদিনীর মতো লাফ দিল সামনের দিকে। প্রতিটি সীটের ওপরের প্যানেলে কোরাগেটেড হোস সহ অক্সিজেন মাস্ক রয়েছে।

 কার্ট! হেনরি! কেবিন ইন্টারকমের মাউথপীসে মুখ ঠেকিয়ে সে, ফোঁস ফোঁস আওয়াজ করে শ্বাস টানতে লাগল। ফার্স্ট ক্লাস গ্যালিতে ক্রুদের একজন নিঃশব্দে ঢলে পড়ল সামনের দিকে। আরেকজন ঘুমিয়ে পড়ল কাত হয়ে।

ঘনঘন অক্সিজেন টানতে টানতে গলা থেকে ক্যামেরাটা নামাল ইনগ্রিড, আতঙ্ক ভরা চোখে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে ক্যারেন।

তু-তুমি কি স-ব উড়িয়ে দিতে চা-চাও, ইনগ্রিড? অক্সিজেন মাস্ক খুলে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল ক্যারেন, মনে হলো কেঁদে ফেলবে, ধীরে ধীরে মাথা নাড়ছে। না, প্লিজ, না!

তাকে গ্রাহ্য না করে মাইক্রোফোনে চিৎকার করছে ইনগ্রিড, কার্ট! হেনরি! পাওয়ার সাপ্লাই আবার শুরু হবার সাথে সাথে চলে আসবে শক্ররা। চোখ আর কান ঢাকো, স্টান গ্রেনেড ব্যবহার করবে ওরা। ডানার দিকে জানালা আর দরজায় নজর রাখো। আবার অক্সিজেন মাস্ক পরে হাপরের মতো হাপাতে লাগল সে।

 মে-মেরো না, ইনগ্রিড! আবার মাস্ক খুলে ফেলেছে ক্যারেন। সারেন্ডার করলে খ-খলিফা আমাদের এ-এক মাসের এক মধ্যে ছা-ছাড়িয়ে আনবে! আমাদের ম-মরার কোনো দু-দরকার নেই! সে ঠিক তোতলাচ্ছে না, কথা আটকে যাচ্ছে মুখে। হঠাৎই আবার চোখ ধাঁধিয়ে ফিরে এল আলো, মৃদু হিস-হিস আওয়াজের সাথে চালু হয়ে গেল এয়ার-কন্ডিশনিং।

বুক ভরে অক্সিজেন নিয়ে ফার্স্ট ক্লাস কেবিনের দিকে ছুটল ইনগ্রিড, কয়েকজন জিম্মি আর দুজন এয়ার হোস্টেসের অজ্ঞান দেহ লাফ দিয়ে টপকাল, ঝুলন্ত আরেকটা অক্সিজেন মাস্ক খপ করে মুখে পরে গোটা কেবিনের ওপর চোখ বুলাল। কার্ট আর হেনরি ছাদের কাছাকাছি প্যানেল থেকে নেমে আসা অক্সিজেন মাস্ক ব্যবহার করছে। পোর্ট উইং প্যানেলের কাছে অস্ত্র হাতে তৈরি হয়ে আছে কার্ট, আর হেনরি দাঁড়িয়েছে পিছনের হ্যাচের পাশে, তার হাতেও পিস্তল। কিন্তু মাস্কে ঢাকা বলে তাদের মুখ দেখতে পেল না ইনগ্রিড।

 অল্প কয়েকজন আরোহী বুদ্ধি করে তাড়াতাড়ি অক্সিজেন মাস্ক টেনে নিয়ে মুখে লাগিয়েছিল, শুধু তারাই জ্ঞান হারায়নি। বাকি সবাই হয়তো সীটের ওপর ঢলে পড়েছে নয়তো কাত হয়ে পড়ে গেছে সীট থেকে।

 খালি হাতে ক্যামেরা ধরে আছে ইনগ্রিড। এখনো অক্সিজেন নিচ্ছে সে। জানে এয়ার-কন্ডিশনিং চালু হলেও গ্যাস বেরিয়ে যেতে আরো অনেক সময় লাগবে। যা ঘটার দু-এক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটবে, তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছে সে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ক্যারেন, মাস্কের ভেতর ঠোঁট নড়ছে তার, আপন মনে বিড়বিড় করে কি বলছে, শোনা যাচ্ছে না।

সঙের মতো দাঁড়িয়ে থেকো না, ধমকের সুরে বলল ইনগ্রিড। ফ্রন্ট হ্যাচটা কাভার কর, যাও।

ইনগ্রিড, আ-আমাদের মরার কোনো দরকার নেই… আবেদন জানাল ক্যারেন, এবং সাথে সাথে ভেঙে পড়ার শব্দ নিয়ে ভেতর দিকে বিস্ফোরিত হলো পোর্ট উইঙের ইমর্জেন্সী এগজিট প্যানেল। সদ্য তৈরি কালো গহ্বর থেকে আরো কালো একজোড়া গোল বস্তু উড়ে এল কেবিনের ভেতর।

স্টান গ্রেনেড! আর্তনাদ করে উঠল ইনগ্রিড। গেট ডাউন!

.

নীলিমায় ডানা মেলে দেয়া বাজপাখির মতো হালকা আর স্বচ্ছন্দ বোধ করল পিটার। শরীরে এমন একটা সর্বগ্রাসী ক্ষিপ্র ভাব এসে গেছে যে মনে হলো বেয়ে নয়, উড়ে এল ও-হাত আর পা যেন মইয়ের ধাপগুলো স্পর্শই করেনি। ছুঁড়ে দেয়া ঢিলের মতো লাগছে নিজেকে, মনে এখন আর কোনো রকম দ্বিধা নেই, জাতশত্রু টেরোরিস্টদের বিরুদ্ধে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পেরেছে বলে পরম স্বস্তি বোধ করছে। সারা জীবনের ট্রেনিং আর নীতিবোধ আজকের বিশেষ মুহূর্তটিতে আগুন ধরা বারুদের মতো করে তুলেছে ওকে।

মইয়ের শেষ ধাপ থেকে লাফ দিল পিটার, মসৃণ আর বাকনো ডানার কিনারা টপকে সারফেসের ওপর কাঁধ আর নিতম্ব দিয়ে পড়ল, উঠে দাঁড়াল একপলকে, চওড়া আর চকচকে ধাতব মেঝে পেরোল নিঃশব্দ পায়ে। ওর পায়ের চারপাশে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো মুক্তো দানার মতো ফেটে পড়ছে, ছোটার সময় ভেজা বাতাসে চুল উড়ছে ওর। মেইন খোলের সামনে পৌঁছুল ও, প্যানেলের একপাশে হাঁটু গেড়ে পজিশন নিল, কিলবিল করতে করতে আঙুলগুলো খুঁজে নিল জয়েন্টের সূক্ষ্ম রেখাটা। উল্টো দিক ঝট করে নিচু হলো ওর টিমের দুনম্বর লোকটা।

মনে মনে একটা হিসেব করল পিটার, গো থেকে এখানে আসতে ছয় সেকেন্ড লেগেছে, মহড়ায় এর চেয়ে বেশি লেগেছিল। বিপদ আর ঝুঁকির মধ্যে মানুষের ক্ষিপ্রতা অনেক বেড়ে যায়।

পিটার আর ওর দুনম্বর সমস্ত শক্তি এক করে ইমার্জেন্সী এস্কেপ হ্যাচের রিলিজে চাপ দিল, স্থানচ্যুত হয়ে ভেতর দিকে ছিটকে পড়ল সেটা। গ্রেনেড হাতে অপেক্ষা করছিল অন্য দুজন কমান্ডো, বিদ্যুৎ খেলে গেল তাদের শরীরে। তারপর চারজনই ওরা সেজদার ভঙ্গিতে বসে পড়ে যে যার চোখ আর কান ঢাকল।

কেবিনের বাইরে রয়েছে ওরা, তবু মনে হলো গজব পড়েছে মাথায়। বিস্ফোরণের শব্দের সাথে তীব্র আলোর ঝলকানি, বন্ধ চোখ হাত দিয়ে ঢাকা থাকা সত্ত্বেও এক্স-রে ছবির মতো লালচে আঙুলগুলো দেখতে পেল পিটার। পরমুহূর্তে গ্রেনেড টিমের লোকেরা কেবিনের দিকে মুখ করে গর্জে উঠল, শুয়ে পড়ুন! সবাই শুয়ে পড়ুন। এখন থেকে ওরা বিরতিহীন চিৎকার করতে থাকবে, যতক্ষণ প্রয়োজন মনে করে।

বিস্ফোরণের ধাক্কা খেয়ে গতি কমে গেল পিটারের, ওয়ালথারের বটে একবার পিছলে গেল হাত, ঝটকা মেরে হ্যাঁমার টেনে ভেতরে ঢুকলও। খোলা হ্যাচ দিয়ে প্রথমে ভেতরে ঢুকল জোড়া পা, যেন একজন দৌড়বিদ সর্বশেষ রেখা স্পর্শ করার জন্যে শরীরটাকে পিছলে দিয়েছে। শূন্যে থাকতেই ক্যামেরা হাতে লাল শার্ট পরা মেয়েটাকে ছুটে আসতে দেখল ও, কি যেন চিৎকার করে বলছে। ডেকে পা ঠেকতেই গুলি করেছে ও, গুলিটা তার মুখে লাগল। সাদা দুসারি দাঁতের মাঝখানে লাল একটা গর্ত তৈরি করল বুলেট, মাথাটা পিছন দিকে এত জোরে ঝাঁকি খেল যে ঘাড়ের ভঙ্গুর হাড়টা ভেঙে গেল, আওয়াজটা পরিষ্কার শুনতে পেল পিটার।

.

দুহাত দিয়ে কান আর চোখ ঢেকে রেখেছে ইনগ্রিড, ঝুঁকে আছে সামনের দিকে। লোক ঠাসা কেবিনের ভেতর আগুন আর আলোর তাণ্ডব বয়ে গেছে। তারপরও ধাক্কাটা সামলাবার জন্যে একটা সীটের পিঠ ধরে টলতে লাগল সে, হিসেব করার চেষ্টা করছে থোর কমান্ডের লোকেরা খোলর ভেতর কখন ঢুকবে।

খোলের বাইরে যারা থাকবে বিস্ফোরণে তাদের খুব একটা ক্ষতি হবে না, প্রাণে বেঁচে যাবে। ইনগ্রিড চাইছে গোটা অ্যাসল্ট টিম ভেতরে ঢুকলে গ্রেনেডগুলো ফাটাবে সে। যত বেশি সম্ভব লোককে নিজের সাথে নিয়ে যেতে চায়। ক্যামেরাটা দুহাতে ধরে হাত দুটো মাথার ওপর তুলল, অপেক্ষা করছে। এসো, চলে এসো!

গোটা কেবিন ধোয়ায় ভরে গেছে, বারুদের গন্ধে বন্ধ হয়ে আসছে দম। প্যানেল থেকে ঝুলে থাকা হোসগুলো দুলছে আর মোচড় খাচ্ছে। একটা শট পিস্তলের গুলি হলো, কেউ চিৎকার করে বলল, শুয়ে পড়ুন! সবাই শুয়ে পড়ুন! খোলা ইমার্জেন্সী হ্যাচওয়ের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে ইনগ্রিড, ডিটোনেটর বোতামে আঙুল। কোথা থেকে আচমকা কালো একটা মূর্তি ছুটে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল তার ওপর।

না, তুমি খুন করতে পারো না! এভাবে আমরা মরব না! ইনগ্রিডের উঁচু করা হাত ক্যারেনকে ফাঁকি দিতে সক্ষম হলো, কিন্তু মুঠোর মধ্যে ক্যামেরার স্ট্র্যাপটা পেয়ে হ্যাচকা টান দিল ক্যারেন। মেরো না, আমাদের মেরো না! খলিফা আমাদের ছাড়াবে, খলিফা বলেছে আমরা কেউ খুন হব না! ক্যামেরা নিয়ে সামনের দিকে ছুটল সে, হিতাহিত জ্ঞান নেই। খলিফা…

 খোলা হ্যাচ দিয়ে উড়ে এল পিটার, প্যাসেজের মাঝখানে পা দিয়েই গুলি করল। পরের গুলি দুটো এত দ্রুত বেরুল শব্দ শুনে মনে হলো একটাই গুলি হয়েছে, পেটে আর বুকের ভেতর বিস্ফোরিত হলেও শিরদাঁড়া আর শোল্ডার ব্লেড চুরমার করে দিল ক্যারেনের। ঝাঁকি লেগে তার হাত থেকে ছুটে গেল ক্যামেরাটা, ডিগবাজি খেতে খেতে অচেতন একজন আরোহীর কোলে পড়ল।

বুনো বিড়ালের মতো সাথে সাথে লাফ দিল ইনগ্রিড, প্যাসেজে পড়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে শুরু করল। ধোঁয়ায় কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু এভাবে এগোলে দেরি হয়ে যাবে। আরো বিশ ফিট দূরে রয়েছে ওটা। দাঁড়াতে হবে তাকে, চারটে অচেতন দেহ টপকে ক্যামেরার কাছে পৌঁছুতে হবে।

.

তিনটে গুলি করে নাচের ভঙ্গিতে জায়গা বদল করল পিটার, দুনম্বরের জন্যে ঠাই করে দিল। ঠিক পিটারের ফেলে আসা জায়গাতেই জোড়া পা দিয়ে নামল দুনম্বর, পিছনের গ্যালির আড়াল থেকে বেরিয়েই তাকে গুলি করল লাল শার্ট পরা কার্ট। ভারী বুলেটের ধাক্কায় পিটারের পায়ের কাছে আছাড় খেল দুনম্বর, ভাজ করা ছুরির মতো বাঁকা হয়ে গেছে শরীর, শরীরে প্রাণ নেই।

গুলির আওয়াজের দিকে পাঁই করে ঘুরল পিটার, ধোয়ার ভেতর দিয়ে এগিয়ে আসা ইনগ্রিডের দিকে পিছন ফিরল। গুলি করার পর পিস্তলের ব্যারেল সিলিঙের দিকে উঠে গেছে, প্রাণপণ চেষ্টায় সেটাকে নামিয়ে আনার চেষ্টা করছে কার্ট। তার লাল নাভি পর্যন্ত খোলা, শক্ত আর চকচকে পেশি কালো লোমে ঢাকা, ঝাঁকড়া চুল ভর্তি মাথার নিচে চোখ দুটো একজন উন্মত্ত খুনির। পিটারের গুলি তার লোমশ বুকে আঘাত করল, দ্বিতীয়টা চুরমার করে দিল কপালের হাড়। শক্তি মদমত্ত লোকটা এক নিমেষে রক্তাক্ত কাদার মতো হয়ে গেল, প্যাসেজে মুখ থুবড়ে পড়ে আর নড়ল না।

দুজন, বিড়বিড় করে বলল পিটার। সম্পূর্ণ শান্ত রয়েছে ও, দক্ষতার সাথে হাতের কাজ করে যাচ্ছে। হিসেবেও ভুল নেই, ওয়ালথারে এখনো চারটে বুলেট রয়েছে। আরো দুজন আছে। কিন্তু ধোয়ার জন্যে পনেরো ফিটের ওদিকে কিছু দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া দুলতে থাকা অক্সিজেন হোসগুলোও চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দিচ্ছে।

 দোমড়ানো মোচড়ানো দুনম্বরের লাশটা লাফ দিয়ে টপকাল পিটার, ওর বুট থেকে ঝরঝর করে ঝরে পড়ল তাজা রক্ত। হঠাৎ করেই কলিন নোবলসকে কেবিনের আরেক দিকে দেখতে পেল পিটার, স্টারবোর্ড উইং দিয়ে ঢুকেছে সে। পাক খাওয়া ধোঁয়ার ভেতর গ্যাস মাস্ক পরা কলিনকে পাতাল থেকে উঠে আসা দৈত্যের মতো লাগল, মাকর্সম্যানের প্রিয় ভঙ্গিতে হাঁটু গেড়ে বসল সে, দুহাতে শক্ত করে ধরল ব্রাউনিংটা।

 লাল শার্ট পরা আরেক লোককে গুলি করল কলিন। ধোয়া আর হোসের মাঝখানে অস্পষ্টভাবে তাকে দেখতে পেয়েছে সে। বাচ্চা ছেলের মতো মুখ লোকটার, চিবুক ছোঁয়া গোঁফ। গুলিটা যেন সেন্টার বাল্কহেডের সাথে গেঁথে ফেলল তাকে। কপালের ফুটো থেকে হলুদ মগজ আর বুক থেকে ফিনকি দিয়ে লাল রক্ত বেরিয়ে এল।

তিনজন, ভাবল পিটার। এবার ক্যামেরাটা খোঁজা দরকার। কিন্তু আরেকজন গেল কোথায়?

গুলি করার পর মেয়েটার হাত থেকে ক্যামেরাটা পড়ে যায়, দেখেছে পিটার। ডিটোনেটরটা উদ্ধার করা জরুরি, কারণ ওটা ইনগ্রিডের হাতে পড়ে গেলে সবাইকে মরতে হবে। কেবিনে ঢোকার পর মাত্র চার সেকেন্ড পেরিয়েছে অথচ মনে হচ্ছে চোখের পলক ফেলতে অনন্তকাল লাগছে। স্ন্যাপ-হ্যামার দিয়ে দরজার তালা ভাঙা হচ্ছে, সামনে পিছনে দুদিকে, আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে হুড়মুড় করে বোয়িংয়ের ভেতর ঢুকে পড়বে থোর অ্যাসল্ট টিম, অথচ এখনো পালের গোদাটাকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না ও।

 শুয়ে পড়ুন! সবাই শুয়ে পড়ুন! ইমার্জেন্সি এগজিটের বাইরে থেকে এখনো। একজন লোক নির্দেশ দিচ্ছে।

ফ্লাইট ডেকের দিকে ছুটল পিটার, ওর ধারণা এখানে ওত পেতে আছে ইনগ্রিড। সামনে পড়ল কালো চুল মেয়েটা, নিজের গাঢ় রক্তে ভাসছে। তালা ভেঙে পড়ার সাথে সাথে ফরওয়ার্ড হ্যাচ দড়াম করে খুলে গেল, কিন্তু ধোয়ার ভেতর সেদিকে কিছুই দেখতে পেল না পিটার। লাশটা টপকাবার জন্যে লাফ দিতে যাবে, এই সময় ধোয়ার ভেতর ভেতর থেকে ডেকের ওপর সিধে হতে শুরু করল ইনগ্রিড। সিধে হতে হতেই লাফ দিল সে।

ক্যামেরা থেকে দুহাত দূরে ডাইভ দিয়ে পড়ল ইনগ্রিড, হাত বাড়িয়ে অন্ধের মতো হাতড়াচ্ছে। একটু বেসামাল হয়ে পড়েছে পিটার, লাফ দিতে যাচ্ছিল, শেষ মুহূর্তে সামলে নিয়েছে নিজেকে, হাতটা ঘুরিয়ে এনে পিস্তলটা ইনগ্রিডের দিকে তোলার চেষ্টা করল।

ক্যামেরার স্ট্র্যাপ ধরে ফেলল ইনগ্রিড। এতক্ষণে দেখতে পেল পিটার ওটা। শিরশির করে উঠল শরীর। কিন্তু স্ট্র্যাপ ধরে টানলেও ক্যামেরাটা দুই সীটের মাঝখানে আটকে যাওয়ায় হাতে আনতে পারছে না ইনগ্রিড। পিটারের কাছ থেকে মাত্র বারো ফিট দূরে সে, কাজেই সরাসরি মাথায় গুলি করতে হবে। মাঝখানে ধোয়া থাকলেও ব্যর্থ হবার আশঙ্কা নেই।

আরোহীদের মধ্যে যারা জ্ঞান হারায়নি তাদের একজন ছিটকে এসে পড়ল পিটারের সামনে। লক্ষ্য স্থির করে ট্রিগার টানার মুহূর্তে হতভম্ব হয়ে গেল পিটার, জানে এখন আর সম্ভব নয়, তবু ব্যারেল উঁচু করার চেষ্টা করল ও। লোকটার কালো, ফোলা-ফাপা চুল দুফাঁক করে বেরিয়ে গেল বুলেট। দুহাত মাথার ওপর তুলে নাচছে লোকটা। গুলি করবেন না। প্লিজ, প্লিজ! আমাকে এখান থেকে বেরুতে দিন। চুল পোড়ার গন্ধ বাতাসে। এই মুহূর্তে ইনগ্রিড কি করছে দেখতেই পাচ্ছে না পিটার।

খালি হাতে লোকটাকে ঠেলে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল পিটার। পলকের জন্যে দেখতে পেল টানতে টানতে স্ট্র্যাপটা ছিঁড়ে ফেলেছে ইনগ্রিড, কয়েক ইঞ্চি এগিয়ে গিয়ে ক্যামেরাটা ধরে ফেলল।

পিটারের পিস্তল ধরা হাতটা ধরে ঝুলে পড়ল উভ্রান্ত লোকটা।

মাঝখানের কয়েক প্রস্থ সীটের ওদিক থেকে গুলি করল কলিন, একবার। এখনো সে স্টারবোর্ড প্যাসেজে রয়েছে, টার্গেট মিস করার সম্ভাবনা ষোলো আনা। পিটারের কাঁধের নয় ইঞ্চি দূর দিয়ে ছুটে যেতে হবে বুলেটটাকে, তা না হলে ইনগ্রিডের দেহ-কাঠামোর কিনারায়ও লাগবে না। ঝুলন্ত হোসগুলো আরেক বাধা।

কলিনের প্রথম গুলিটা লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হলো। তবে কানের ওপর চুল আর খুলি ছুঁয়ে গেছে বুলেট, একটা ঝাঁকি মতো খেল ইনগ্রিডের মাথা, ভারসাম্য হারিয়ে ধপ করে বসে পড়ল প্যাসেজে।

বসে বসে ক্যামেরার গায়ে ডিটোনেটর খুঁজছে।

উন্মাদ লোকটার গলায় ডান হাতের শক্ত আঙুল দিয়ে জোরে একটা খোঁচা মারল পিটার, ছিটকে নিজের সীটের ওপর গিয়ে পড়ল সে। প্রাণপণ চেষ্টা করে পিস্তল ধরা বাঁ হাতটা ইনগ্রিডের দিকে তুলে লক্ষ্যস্থির করল পিটার, জানে সরাসরি মাথায় লাগাতে হবে, যাতে আঘাতের সাথে সাথে অচল হয়ে যায় আঙুলগুলো।

 কলিন দ্বিতীয় গুলিটা ছুঁড়ল, প্রায় পিটারের সাথে একই সময়ে। কলিনের বুলেটের ধাক্কায় স্যাৎ করে দূরে সরে গেল ইনগ্রিড, তার খালি করা জায়গা দিয়ে বেরিয়ে গেল পিটারের বুলেট।

 ইনগ্রিডের ডান কাঁধে লেগেছে গুলি, ঝাঁকি খেয়ে তার একটা হাত স্যালুটের ভঙ্গিতে কপালের কাছে উঠে গেল। দাঁড়াবার চেষ্টা করছে ইনগ্রিড, তার মাথায় লক্ষ্যস্থির করল পিটার। কিন্তু আবারও ট্রিগার টানার আগে ধোঁয়ার ভেতর থেকে ছুটে এল কয়েকটা মর্তি। ইনগ্রিডকে তারা ঘিরে দাঁড়াল, লাথি মারছে, চল ধরে টানাটানি করছে। ফরওয়ার্ড হ্যাচ দিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল থোর অ্যাসল্ট টিমের লোকজন, খ্যাপা আরোহীদের ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ইনগ্রিডের প্রাণ বাঁচাল। হোলস্টারে ওয়ালথার রেখে ক্যামেরাটা ভোলার জন্যে ঝুঁকল পিটার। তুলে নিল ওটা, হাসল।

তারপর আরেক হাতে গ্যাস মাস্কটা মুখ থেকে নামাল ও। আর কেউ নেই। অপারেশন কমপ্লিট! চেঁচিয়ে বলল পিটার। মাইক্রোফোনের সুইচ অন করল ও। টাচ ডাউন! টাচ ডাউন! পরিপূর্ণ সাফল্যের কোড সিগনাল। থোর কমান্ডের তিনজন কমান্ডো ধরে রেখেছে ইনগ্রিডকে, আহত হয়েও কার্পেটের ওপর নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টায় ধস্তাধস্তি করছে সে খাঁচায় বন্দী হিংস্র নেকড়ের মতো।

 ইমার্জেন্সী প্লাস্টিক স্লাইড নামাও, নির্দেশ দিল পিটার, প্রতিটি খোলা প্রবেশপথ থেকে বাতাস ভরা লম্বা প্লাস্টিক স্লাইড নেমে গেল টারমাকে। থোর কমান্ডোর লোকেরা সাথে সাথে আরোহীদের পথ দেখিয়ে নামতে নিয়ে চলল।

 ওঁয়া ওঁয়া করতে করতে বারোটা অ্যাম্বুলেন্স ছুটে এল টার্মিনাল ভবন থেকে। থোর কমান্ডের ব্যাক-আপ টিম সদ্য জ্বলে ওঠা ফ্লাডলাইটের আলোয় ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে ছুটে আসছে বোয়িংয়ের দিকে। উল্লাসে ফেটে পড়ছে তাদের গলা, টাচ ডাউন! টাচ ডাউন!

 প্রাগৈতিহাসিক দানবের মতো উত্তরপ্রান্তের অ্যাপ্রন থেকে ছুটে এল প্রকাণ্ড যান্ত্রিক সিঁড়ি।

এক হাতে ক্যামেরা নিয়ে মেয়েটার দিকে ঝুঁকল পিটার। হাত-পা ছোঁড়া বন্ধ করে পিটারের দিকে তাকাল ইনগ্রিড। তার চোখ দুটো অঙ্গারের মতো জ্বলছে। কপালে ঘাম, হাঁপাচ্ছে সে। হঠাৎ মাথাটা একটু পিছিয়ে নিল, ছোবল মারার আগে সাপ যেমন পিছিয়ে নেয়। একদলা থুথু ছুঁড়ে দিল সে। পিটারের পায়ের ওপর ছড়িয়ে পড়ল সাদা ফেনা। পিটারের পাশে এসে দাঁড়াল কলিন। দুঃখিত, স্যার। চেয়েছিলাম, কিন্তু হার্টে লাগেনি।

আমাকে তোমরা আটকে রাখতে পারবে না, আচমকা চিৎকার জুড়ে দিল ইনগ্রিড়। তোমাদের মতো চুনোপুঁটির কাজ নয় আমাকে আটকে রাখে। বড়জোর দুমাস, হাসতে হাসতে বেরিয়ে যাব আমি!

 আমার লোকেরা আমাকে ছিনিয়ে নিতে আসবে! আবার থুথু ছুঁড়ল মেয়েটা, এবার তাকে যারা ধরে রেখেছে তাদের একজনের মুখে।

হয় ছিনিয়ে নেবে না হয় বাধ্য করবে আমাকে ছেড়ে দিতে…।

সত্যি! দুনিয়া জুড়ে অদ্ভুত এক অরাজকতা চলছে। বন্দী হাইজ্যাকার বা সন্ত্রাসবাদীদের মুক্ত করার জন্যে তাদের দলের সশস্ত্র লোকেরা জঙ্গী মিছিল করবে, রাস্তা-ঘাটে ভিড়ের মধ্যে বোমা ফাটাবে, নিরীহ শিশু আর মহিলাদের অপহরণ করে আটকে রাখবে। পিটারের মনে হলো, আজকের ওর এই সাফল্য আসলে সাময়িক একটা ব্যাপার মাত্র। অশুভ শক্তির গতি মন্থর করতে পেরেছে হয়তো, কিন্তু তাদের পরাজিত করতে পারেনি। আরো শক্তি সঞ্চয় করে, আরো ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে আবার ওরা ছোবল মারবে। কে জানে, এই মেয়েটাই হয়তো নেতৃত্ব দেবে তখনো।

আমরাই বিপ্লব! অক্ষত হাতটা কপালের কাছে তুলে স্যালুট করার ভঙ্গি করল ইনগ্রিড। আমরাই শক্তি। কেউ, দুনিয়ার কোনো শক্তি আমাদের রুখতে পারবে না।

 পিটারের চোখের সামনে অন্তঃসত্ত্বা মহিলার বিকৃত লাশটা ভেসে উঠল। পাকা ফলের মতো ফেটে গিয়েছিল তার ফোলা পেট।

ওর মুখের সামনে শক্ত মুঠো করা হাতটা নাড়ল ইনগ্রিড। এই তো সবে শুরু–শুভ সূচনা ঘটেছে নতুন যুগের…।

সিধে হলো পিটার। অস্থির বোধ করছে ও।

তোমরা জিততে পারবে না! বিজয় আমাদের অবশ্যম্ভাবী… তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চেঁচায় ইনগ্রিড।

.

সুধীবৃন্দ, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাইম মিনিস্টার বিচিত্তে ধীরে ধীরে কথা বলছেন, তার চেহারায় গাম্ভীর্য মেশানো অভিমান, কণ্ঠস্বরে পরাজয়ের সুর, আমি এবং আমার কেবিনেট দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে টেরোরিস্টদের দাবি মেনে নেয়ার অর্থ হচ্ছে হিংস্র একটা বাঘের পিঠে আশ্রয় নেয়া, যার পিঠ থেকে আর কখনোই আমরা নামতে পারব না। থেমে টেবিলের অপরপ্রান্তে পাশাপাশি বসা অ্যামবাসডরদের দিকে তাকালেন, তার কাঁধ ঝুলে পড়ল। কিন্তু মানবতার স্বার্থে অনেক সময় চরম ত্যাগ স্বীকার না করে উপায় থাকে না। তাছাড়া, বৃহৎ একাধিক দেশের চাপ সহ্য করার ক্ষমতা ছোট একটা দেশের না থাকারই কথা। এই সব বাস্তবতা উপলব্ধি করে আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে টেরোরিস্টদের দাবিগুলো মনে নিয়ে অন্তত শিশু আর মহিলাদের উদ্ধার করা যেতে পারে…

মার্কিন অ্যামব্যাসাডরের সামনে ঝনঝন শব্দে বেজে উঠল টেলিফোন। ভ্র কুঁচকে উঠল প্রাইম মিনিস্টারের, কিন্তু আবার তিনি শুরু করলেন, তবে দুনিয়ার অন্যতম মাতবর হিসেবে আপনাদের সরকারদ্বয় যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আমি আশা করি…. ফোনের বেল আবার বাজতে শুরু করায় তিনি অসহায় একটা ভাব করে থেমে গেলেন। তারপর বললেন, আপনি বরং কথা বলে নিন, স্যার…।

এক্সকিউজ মি, মি, প্রাইম মিনিস্টার, কেনি কনস্টেবল ফোনের রিসিভার তুললেন। ধীরে ধীরে তার চেহারায় বিস্ময় আর অবিশ্বাস ফুটে উঠল। এক মিনিট ধরুন, বলে প্রাইম মিনিস্টারের দিকে তাকালেন তিনি, হাত দিয়ে মাউথপীসটা চাপা দিলেন। মি. প্রাইম মিনিস্টার, আমি অতীব আনন্দের সাথে আপনাকে জানাচ্ছি যে তিন মিনিট আগে থোর কমান্ডের অ্যাসল্ট টীম কমান্ডো হামলা চালিয়ে বোয়িং জিরো-সেভেন-জিরো দখল করে নিয়েছে। তিনজন টেরোরিস্ট মারা গেছে, গুরুতরভাবে আহত অবস্থায় ধরা পড়েছে আরেকজন, কিন্তু আরোহীদের একজনও হতাহত হয়নি। ইতোমধ্যে তাদের সবাইকে প্লেন থেকে বের করা হয়েছে। সবাই সুস্থ এবং অক্ষত।

প্রকৃত বিজয়। প্রশ্রয় দেয়া পিতৃসুলভ হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তাঁর চেহারা। মার্কিন অ্যামব্যাসাডরের দিকে আবার তাকালেন তিনি। খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন, ধন্যবাদ, স্যার, অসংখ্য ধন্যবাদ।

.

তোমাকে আমি কর্তব্যে অবহেলার জন্যে অভিযুক্ত করছি, জেনারেল স্ট্রাইড, গমগম করে উঠল ডক্টর পার্কারের কণ্ঠস্বর।

চারশ লোকের জীবন রক্ষার জন্যে এছাড়া আর কোনো পথ ছিল না, সম্পূর্ণ শান্ত পিটার। চোখে প্রায়-নির্লিপ্ত, ঠাণ্ডা দৃষ্টি। নৈতিক আইন বলে একটা কথা আছে, সেটা আমাকে ব্যবহার করতে হয়েছে। হাইজ্যাকারদের কাবু করার পর পনেরো মিনিটও পেরোয়নি, চেহারা দেখে মনে না হলেও বমি বমি ভাব আর মানসিক অস্থিরতায় এখনো ভুগছে পিটার।

 তুমি ইচ্ছে করে আমার সুনির্দিষ্ট নির্দেশ অমান্য করেছ। উন্মত্ত সিংহের মতো ক্রোধে গরগর করছেন ডক্টর পার্কার, স্ক্রীন তার চেহারা লাল টকটকে দেখাচ্ছে, সাদা চুল এলোমেলো আর খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাথায়। তার সর্বগ্রাসী ব্যক্তিত্ব হকারের কমান্ড কেবিন ভরাট করে রেখেছে। তোমার ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস ছিল, তুমি সেই বিশ্বাসের অমর্যাদা করেছ…

আপনার এসব কথা থেকে বোঝা যাচ্ছে থোর কমান্ড থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে আমাকে, বাধা দিয়ে বলল পিটার, তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর। এতক্ষণে ওর চেহারায় রাগের ভাব দেখা গেল, একটু যেন থতমত খেয়ে গেলেন ডক্টর পার্কার। পিটার জানে, অ্যাটলাসের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডক্টর পার্কার সীমাহীন ক্ষমতার অধিকারী, কিন্তু তার পক্ষেও সদ্য অর্জিত বিজয়ের নায়ককে এত তাড়াতাড়ি তাড়িয়ে দেয়া সম্ভব নয়। পিটারকে বিদায় করতে সময় লাগবে, তবে ওর ভাগ্যলিপি নির্ধারিত হয়ে গেছে।

সরাসরি আমার নিয়ন্ত্রণে থাকছ তুমি। ব্যক্তিগতভাবে আমাকে জিজ্ঞেস না করে সিদ্ধান্ত তুমি নিতে পারবে না। আমি কি বোঝাতে চাইছি জানো, জেনারেল স্ট্রাইড?

উত্তর দেবে না বলে মনস্থির করল পিটার।

মৌনতা সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে বলে চললেন ডক্টর পার্কার, এখন তোমার প্রথম কর্তব্য, সব কটা গোর ইউনিটকে প্রত্যাহার করে নেয়া–যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। টেরোরিস্ট যে মেয়েটা ধরা পড়েছে তাকে লন্ডনে পাঠাতে হবে। ওখানেই তাকে জেরা করা হবে, ওখানেই তার বিচার করা হবে…

 মেয়েটা অপরাধ করেছে এখানে। খুনের অভিযোগে তার বিচার হওয়া উচিত এখানেই…

দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের সাথে কথা বলে এই সিদ্ধান্তে আসা হয়েছে। পিটার তর্ক করছে দেখে রাগ হলেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখলেন ডক্টর পার্কার। এবং এই সিদ্ধান্তের নড়চড় হবে না। তোমার কমান্ড প্লেনে করে লন্ডনে যাবে সে। থোর ডাক্তার তার দেখাশোনা করবে।

নিঃশব্দে কাঁধ ঝাঁকিয়ে চুপ করে থাকল পিটার।

চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে মেয়েটাকে লন্ডনে চাই আমি, আবার বললেন ডক্টর পার্কার। প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে কেউ যেন তার গায়ে হাত দিতে না পারে, সেক্ষেত্রে তোমাকে আমি সরাসরি দায়ী করব। এরইমধ্যে যথেষ্ট রক্তপাত ঘটিয়েছি আমরা, তোমার বোকামির জন্যে। আমি আর কোনো রক্তপাত চাই না।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *