১. সমুদ্রতীরবর্তী দেশ

ওয়াইল্ড জাস্টিস উইলবার স্মিথ
অনুবাদ : মখদুম আহমেদ

সমুদ্রতীরবর্তী দেশ সেইশেলযের মাহে দ্বীপের ভিক্টোরিয়া বিমানবন্দর ছেড়ে উড্ডয়নের প্রস্তুতি নিচ্ছে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইট। কেবল পনেরো জন আরোহী এখান থেকে ওঠার অপেক্ষায় আছে বিমানটায়।

দুই জোড়া কপোত-কপোতী বিমানে ওঠার আগের আনুষ্ঠানিকতা সেরে নেওয়ার উদ্দেশ্যে বহির্গমন বিভাগের দিকে এগোল। সবাই তারা বয়সে তরুণ; ট্যান করা উজ্জ্বল ত্বক, ভূ-স্বর্গের মতোন এই দ্বীপ-দেশে ছুটি কাটিয়ে সবাই দারুণ চনমনে, নিরুদ্বিগ্ন। দলটার মধ্যে একটি মেয়ের শারীরিক সৌন্দর্য অন্যদের ম্লান করে দিয়েছে যেন।

দারুণ লম্বা মেয়েটা, সুগঠিত দীর্ঘ হাত-পা, মরাল গ্রীবার উপর গর্বোদ্ধত মস্তক। মোটা, সোনালি চুলগুলো বেণী করে মাথার উপর চূড়া করে বাধা, ঝকঝকে সূর্যালোকে স্নান করছে অসামান্য রূপ-যৌবন-স্বাস্থ্য।

চিতার মতোই ছন্দোবদ্ধ রাজকীয় ঢঙে হেঁটে গেল ও, খোলা একজোড়া স্যান্ডেল পরনে; পাতলা সুতির তৈরি সোয়েটারের নিচে বুকের গড়ন আঁটসাট, খাটো জিন্সের পিছনে দোল-দোল-দুলনি খেলে যৌবনের অকৃপণ সুষমা।

 টি-শার্টের সামনে উজ্জ্বল হরফে লেখা রয়েছে আমি এক লাভ-নাট, নিচে সেই ফলেরই একটা ছবি। ফলটার নাম কোকো-ডি-মার। সেইশেলযের বিখ্যাত বাদাম।

ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার উদ্দেশে ঝকঝকে হাসিতে উদ্ভাসিত মুখে ইংরেজিতে কথা বলে নিজের আমেরিকান পাসপোর্ট বাড়িয়ে ধরল ও, কিন্তু নিজের ছেলে বন্ধুর সাথে কথা বলার সময়ে তার ভাষা হয়ে উঠল বিশুদ্ধ জার্মান। পাসপোর্ট ফিরে পেতে সঙ্গীদের নিয়ে নিরাপত্তা–এলাকার দিকে এগোল সুন্দরী। আগ্নেয়াস্ত্র আছে কিনা পরীক্ষা করার জন্যে দু’জন সেইশেল পুলিশ রয়েছে, তাদেরকেও মুক্তা ঝরা হাসি উপহার দিল সে। কাঁধ থেকে নেটের ব্যাগটা নামিয়ে দুষ্টামি করার ভঙ্গিতে দোলাতে লাগল। মদির কটাক্ষ হেনে জিজ্ঞেস করল, এগুলো আপনারা চেক করতে চান? তার কথা শুনে হেসে ফেলল সবাই। ব্যাগে একজোড়া কোকো-ডি-মার রয়েছে। ফলগুলো অদ্ভুত আকৃতির, আকারে মানুষের মাথার দ্বিগুণ হবে একেকটা। মাহে দ্বীপের অত্যন্ত জনপ্রিয় স্যুভেনির এই কোকো-ডি-মার, টুরিস্টরা প্রায় সবাই দু একটা করে নিয়ে যায়। মেয়েটার সঙ্গী-সাথীরা সবাই যার যার নেট ব্যাগে একটা দু’টো করে ভরে নিয়েছে। এ ধরনের পরিচিত জিনিস পরীক্ষা করে লাভ নেই মনে করে ওদের ক্যানভাস ফ্লাইট ব্যাগের দিকে নজর দিল অফিসাররা। প্রত্যেকের হাতেই একটা করে ক্যানভাস ব্যাগ রয়েছে। মেটাল ডিটেকটর দিয়ে পরীক্ষা করার সময় হঠাৎ করে কর্কশ যান্ত্রিক আওয়াজ শোনা গেল। মেয়েটার এক পুরুষ সঙ্গী লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করল, আড়ষ্ট ভঙ্গিতে ক্যানভাস ব্যাগ থেকে ছোট একটা নিকরম্যাট ক্যামেরা বের করল সে। আবার একবার হেসে উঠল সবাই, একজন পুলিশ অফিসার হাত নেড়ে এগিয়ে যেতে বলল দলটাকে। ডিপারচার লাউঞ্জে পৌঁছে গেল ওরা।

ট্রানজিট প্যাসেঞ্জারে এরই মধ্যে ভরে গেছে ডিপারচার লাউঞ্জ, এরা সবাই মৌরিশাস থেকে বিমানের আরোহী হয়ে এসেছে। লাউঞ্জের খোলা জানালার বাইরে, টারমাকের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রকাণ্ড বোয়িং সেভেন-জিরো-সেভেন জাম্বো। চোখ ধাঁধানো ফ্লাডলাইটের আলোয় আলোকিত হয়ে রয়েছে বিমানটা, সেটাকে ঘিরে এয়ারপোর্ট কর্মীরা রিফুয়েলিঙের কাজে ব্যস্ত।

লাউঞ্জে বসার জন্যে কোনো সীট খালি নেই, ঘুরতে থাকা একটা ফ্যানের তলায় গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল চারজন। রাতটা আজকের বেশ গরম, তার ওপর বন্ধ ঘরের ভেতর এতগুলো মানুষের নিঃশ্বাস আর তামাকের ধোয়ায় দম আটকে আসার জোগাড়।

হাসি-খুশি খোশগল্পে স্বর্ণকেশী মেয়েটাই সবাইকে মাতিয়ে রেখেছে, জলতরঙ্গের মতো তার হাসির শব্দ। ছেলে বন্ধুদের চেয়ে কয়েক ইঞ্চি, আর বান্ধবীর চেয়ে পুরো একমাথা লম্বা, কাজেই তার দিকেই তাকাচ্ছে সবাই। মেয়েটাও নিজের রূপ-লাবণ্য সম্পর্কে সচেতন। তবে দারুণ সপ্রতিভ সে, হাবভাবে কোন রকম জড়তা নেই। কয়েকশো আরোহীর কৌতূহলী দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সে তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে হাসি-তামাশায় মেতে আছে। লাউঞ্জে ঢোকার পর ওদের আচরণে সূক্ষ্ম একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে, চোখে-মুখে কি রকম যেন একটা স্বস্তির ভাব, যেন বড় ধরনের একটা বাঁধা পেরোনো গেছে। হাসির মধ্যেও কেমন একটা উল্লাসের বা উন্মাদনার চাপা সুর টের পাওয়া যায়। সবাই ওরা উত্তেজিত, মুহূর্তের জন্যেও স্থির থাকতে পারছে না। একবার এ পায়ে, আরেকবার ও পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াচ্ছে, হাত দিয়ে কাপড় বা চুল ঠিক করছে ঘন ঘন।

বোঝাই যাচ্ছে পরস্পরের সাথে ওদের নিবিড় বন্ধুত্বের সম্পর্ক, সেখানে আর কারও প্রবেশাধিকার নেই, তবু ট্রানজিট প্যাসেঞ্জারদের একজন কৌতূহল চেপে রাখতে পারল না। সে তার স্ত্রীকে বসে থাকতে বলে সীট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, লাউঞ্জের আরেক প্রান্ত থেকে এগিয়ে এল দলটার দিকে।

এই যে, তোমরা ইংরেজি জানো নাকি? কাছাকাছি এসে জিজ্ঞেস করল সে। বেশি হলে আটচল্লিশ হবে বয়স, গম্বুজ আকৃতির মাথায় চকচকে টাক, মোটাসোটা নিরেট শরীর, চোখে বাইফোকাল চশমা। চেহারায় আত্মবিশ্বাস আর তৃপ্ত একটা ভাব, বোঝা যায় জীবনে সাফল্য আর প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, বিপুল বিত্ত-বৈভবের অধিকারী।

অনিচ্ছার ভাব নিয়ে দলটা আকৃতি বদল করল, চারজনই তাকাল লোকটার দিকে, কিন্তু কথা বলল লম্বা মেয়েটা, একমাত্র যেন তারই অধিকার। অবশ্যই, আমিও একজন আমেরিকান।

কী আশ্চর্য, তাই না! বিস্ময়ে আর আনন্দে চোখ বড় বড় করল লোকটা। খোলাখুলি, সপ্রশংস দৃষ্টিতে মেয়েটাকে লক্ষ্য করছে সে। আমি আসলে জানতে চাইছিলাম, ওগুলো কি জিনিস। মেয়েটার পায়ের কাছে পড়ে থাকা নেট ব্যাগের দিকে আঙুল তুলল সে।

স্বর্ণকেশী জবাব দিল, ওগুলো কোকো-ডি-মার।

হ্যাঁ, নাম শুনেছি বটে…

এখানকার লোকেরা এগুলোকে লাভ নাটস্ বলে, বলে চলেছে মেয়েটা, ঝুঁকে নেট ব্যাগটা খুলল সে। ভালো করে দেখলেই বুঝবেন, কারণটা কি। দুহাতে ফলটা ধরে লোকটাকে দেখাল সে।

ফলে দুটো অংশ এমনভাবে জোড়া লেগে আছে, হুবহু মানুষের নিতম্বের মতো দেখতে! এটা পেছন দিকে, বলে হাসল সে, মুখের ভেতর নড়ে উঠল জিত, চীনামাটির মতো ঝকঝকে দাঁত বেরিয়ে পড়ল। ফলটা ঘুরিয়ে ধরল সে। সামনের দিক। লোকটা দেখল ফলের সামনের অংশটা কোমল রেশমের আঁশসহ অনেকটা যোনির মতো দেখতে। কী আশ্চর্য, তাই না? আবার হাসতে লাগল সে। দাঁড়াবার ভঙ্গি বদলে কোমরটা বাড়িয়ে দিল সামনের দিকে, একটা ঢেউ উঠল তলপেটে। নিজের অজান্তেই মেয়েটার আঁটসাঁট ডেনিমের দিকে তাকাল লোকটা। দম বন্ধ হয়ে এল তার। বুঝতে পেরেছে, মেয়েটা তাকে নিয়ে কৌতুক করছে। একটা ঢোক গিলল বেচারা। হতভম্ব হয়ে পড়েছে মেয়েটার শর্টসে দুটো বোম খোলা, ভেতরের বেশ কিছুদূর দেখা গেল।

 কী আশ্চর্য, তাই না? আবার বলল মেয়েটা, সকৌতুকে লক্ষ্য করছে। লোকটাকে।

 লজ্জায়, অপমানে লোকটার কান গরম হয়ে উঠল। মুখ বন্ধ, ঘাম ছুটছে। শরীরে।

 পুরুষ গাছটার যে কেশরে পরাগ থাকে, সেটা কত বড় হয় জানেন? জিজ্ঞেস করল স্বর্ণকেশী। আপনার হাতের মতো লম্বা আর মোটা, বিশ্বাস করুন আর নাই করুন! চোখ বড় বড় করল সে। লাউঞ্জের অপরপ্রান্তে সীট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল লোকটার স্ত্রী, মেয়েলি বুদ্ধি দিয়ে টের পেয়ে গেছে স্বামী বেচারা বিপদে পড়তে যাচ্ছে। স্বামীর চেয়ে তার বয়স অনেক কম, বাচ্চা কোলে সীট ছেড়ে উঠতে হিমশিম খেয়ে গেল সে।

এখানকার লোকদের মুখে শুনতে পাবেন, পূর্ণিমার রাতে পুরুষ গাছ তার শিকড়গুলো মাটির ওপর তুলে নিয়ে মেয়ে গাছের সাথে মিলিত হবার জন্যে সরসর করে হেঁটে যায়…

আপনার হাতের মতো লম্বা… স্বর্ণকেশীর পাশ থেকে তার এলোচুল বান্ধবী খিলখিল করে হেসে উঠল,…উই মা! তামাশায় সে-ও যোগ দিল। তারপর, দুজন একসাথে লোকটার তলপেটের নিচে তাকাল। পরিষ্কার দেখা গেল, কুঁকড়ে একটু ছোট হয়ে গেল লোকটা। তার এই দুর্দশা লক্ষ্য করে মেয়েগুলোর পুরুষ বন্ধুরা হাসতে লাগল, দুজন লোকটার দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে।

স্বামীর পাশে এসে দাঁড়াল স্ত্রী, কনুই ধরে টান দিল। মহিলার ঠোঁটের ওপর, নাকের নিচে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, চোখে কঠোর দৃষ্টি। হ্যারি, আমি অসুস্থ বোধ করছি, হিসহিস করে বলল সে।

আমাকে এখন যেতে হয়, পালাবার ছুতো পেয়ে পরম স্বস্তি বোধ করল লোকটা, তার আত্মবিশ্বাস চুরমার হয়ে গেছে। স্ত্রীর হাত ধরে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটা ধরল সে।

ওকে তোমরা কেউ চিনতে পেরেছ কি? এলোচুল মেয়েটা জার্মান ভাষায় জিজ্ঞেস করল, এখনো হাসছে সে।

 হ্যারল্ড ম্যাককেভিট, একই ভাষায় ফিসফিস করে উত্তর দিল স্বর্ণকেশী। ফোর্ট ওঅর্থের নিউরো-সার্জেন। শনিবার সকালে টিভিতে দেখনি, কনভেনশনের শেষ পেপারটা ও-ই তো পড়েছে। বড় মাছ খুব বড় মাছ। বিড়ালের মতো করে সে তার গোলাপি জিভের ডগা দিয়ে ঠোঁটের ওপরটা ভিজিয়ে নিল।

আজ এই সোমবার বিকেলে ডিপারচার লাউঞ্জের চারশ একজন আরোহীর মধ্যে তিনশ ষাট জনই হয় সার্জেন, না হয় তাদের স্ত্রী। সার্জেনদের মধ্যে কেউ কেউ ওষুধ বিজ্ঞানে অবদান রেখে দুনিয়া জোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্য, জাপান আর দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া আর অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছেন ওঁরা। চব্বিশ ঘণ্টা আগে মৌরিশাস দ্বীপে শেষ হয়েছে ওঁদের কনভেনশন, মাহে দ্বীপ থেকে পাঁচশো মাইল দক্ষিণে। কনভেনশন শেষ হবার পর এটাই দূর পাল্লার প্রথম ফ্লাইট, কাজেই বিমানের কোনো আসনই খালি নেই। অনেক আগে টিকেট কাটা ছিল বলে মাহে থেকে বিমানে ওঠার সুযোগ পাচ্ছে পনেরো জন জয়েনিং প্যাসেঞ্জার।

 ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ, নাইরোবি এবং লন্ডনের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া বিমানের গমনের আদেশ ঘোষণা করছে, আরোহীরা দয়া করে প্রধান গেট দিয়ে বিমানে উঠে আসুন। ঘোষণা শেষ হবার সাথে সাথে ভিড় করে দরজার দিকে এগোল লোকজন।

.

ভিক্টোরিয়া কন্ট্রোল, স্পিডবার্ড শূন্য সাত শূন্য থেকে উড্ডয়নের অনুমতি চাইছি। শূন্য-সাত-শূন্যকে অনুমতি দেয়া হলো। রানওয়ে নং এক থেকে চলতে শুরু করতে পারেন।

নাইরোবির উদ্দেশে আমাদের যাত্রাপথের বিবরণ পাঠিয়ে দিবেন দয়া করে। আমরা একেবারে ভর্তি।

রজার, স্পীডবার্ড, ইওর ফ্লাইট প্ল্যান ইজ অ্যামেন্ডেড।

.

নাক উঁচু করে এখনো আরো ওপর দিকে উঠে যাচ্ছে প্রকাণ্ড জিরো-সেভেন-জিরো। নো-স্মোকিং আর সীট-বেল্ট লাইট ফার্স্ট ক্লাস কেবিনের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। স্বর্ণকেশী মেয়েটা আর তার পুরুষ সঙ্গী পাশাপাশি বসে আছে প্রশস্ত ওয়ান-এ আর ওয়ান-বি সীটে। সীট দুটো ফরওয়ার্ড বাল্কহেডের ঠিক পিছনে, কমান্ড এরিয়া আর ফার্স্ট ক্লাস গ্যালির মাঝখানে একটা দেয়াল এই বাল্কহেড। তরুণ আর তরুণীর পাশাপাশি এই সীট জোড়া কয়েক মাস আগে রিজার্ভ করা হয়েছে।

যুবক সঙ্গী সামনের দিকে ঝুঁকল, প্যাসেজের ওপাশ থেকে কোনো আরোহী যাতে সঙ্গিনীকে দেখতে না পায়। আড়াল পেয়ে দ্রুত নেট ব্যাগের ভেতর হাত গলিয়ে দিয়ে একটা কোকো-ডি-মার বের করে নিজের কোলের ওপর তুলল মেয়েটা।

 ইলেকট্রিক করাত দিয়ে ফলটাকে দুভাগ করা হয়েছিল, পানি আর সাদা শাঁস বের করে নিয়ে আঠার সাহায্যে আবার জোড়া লাগানো হয়েছে, তবে দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই। জোড়া লাগা অংশে ছোট একটা সরু ধাতব ইন্সট্রুমেন্ট ঢুকিয়ে জোরে চাড় দিল মেয়েটা, দুটো ভাগ আলাদা হয়ে গেল সাথে সাথে। জোড়া খোলর ভেতর প্লাস্টিক ফোমের তোষক, তোষকের ওপর গ্রে রঙের মসৃণ গা একজোড়া গোল বস্তু-প্রতিটির আকার বেসবলের মতো।

 পূর্ব জার্মানিতে তৈরি গ্রেনেড। ওয়ারস প্যাক্ট কমান্ড নাম দিয়েছে, এম-কে আই-ভি (সি)। প্রতিটি গ্রেনেডের বাইরের আবরণ প্রতিরোধক প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি ল্যান্ডমাইনের আবরণে যে ধরনের প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়-ইলেকট্রনিক মেটাল ডিটেকটরকে ফাঁকি দেয়ার জন্যে। প্রতিটি গ্রেনেডের চারদিকে হলুদ ডোরা কাটা রয়েছে, তার মানে হলো এগুলো ফ্র্যাগমেন্টেশন টাইপ গ্রেনেড নয়, প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ক্ষমতা ভরে দিয়ে তৈরি করা হয়েছে।

 বাঁ হাতে একটা গ্রেনেড নিল মেয়েটা, সীট-বেল্ট খুলল, তারপর নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল সীট ছেড়ে। কোনো দিকে না তাকিয়ে পর্দা সরিয়ে গ্যালি এলাকার দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল সে, অন্যান্য আরোহীরা তাকে ঢুকতে দেখলেও কেউ কিছু মনে করল না।

 গ্যালির সার্ভিস সেকশনে তিনজন রয়েছে ওরা। একজন পার্সার, দুজন স্টুয়ার্ডেস। এখনো ফোল্ডিং চেয়ারে বসে আছে সবাই, চেয়ারের সাথে স্ট্র্যাপ দিয়ে আটকানো। স্বর্ণকেশী মেয়েটা ঢুকতেই ঝট করে ঘাড় ফেরাল ওরা।

দুঃখিত, ম্যাডাম—প্লিজ, নিজের সীটে ফিরে যান! ক্যাপটেন এখনো সীট বেল্ট লাইট অফ করতে বলেননি!

 বাঁ হাত তুলে পার্সারকে ভয়ঙ্কর ডিমটা দেখাল স্বর্ণকেশী। এটা একটা স্পেশাল গ্রেনেড, ব্যাটাল-ট্যাংকের ভেতর যারা থাকে তাদের মারার জন্যে তৈরি করা হয়েছে, শান্তভাবে বলল সে। প্লেনের ফিউজিলাজ এমনভাবে উড়িয়ে দেবে, মনে হবে ওটা কাগজের তৈরি–পঞ্চাশ গজের মধ্যে একজনও বাঁচবে না।

ওদের মুখ লক্ষ্য করছে মেয়েটা, ভয় আর আতঙ্ক অশুভ ফুলের মতো বিকশিত হচ্ছে।

আমার হাত থেকে পড়ার তিন সেকেন্ড পর ফাটবে এটা। একটু থেমে দম নিল মেয়েটা, চোখ দুটো উত্তেজনায় চকচক করছে। নিঃশ্বাস ফেলছে ছোট ছোট আর ঘন ঘন। তুমি পার্সারকে বেছে নিল সে, -ফ্লাইট ডেকে নিয়ে চলো আমাকে। স্টুয়ার্ডেসদের দিকে তাকাল। তোমরা এখানেই থাকবে। কিছু করবে না, কিছু বলবে না।

 ককপিটটা ছোট : থরে থরে সাজানো ইন্সট্রুমেন্ট, ইলেকট্রনিক ইকুইপমেন্ট আর ফ্লাইট ক্রুদের জায়গা হবার পর খালি মেঝে নেই বললেই চলে। স্বর্ণকেশী মেয়েটা ভেতরে ঢুকল, সামান্য অবাক হয়ে তিনজন লোকই ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল তার দিকে। বাঁ হাত তুলে গ্রে রঙের ডিমটা ওদের দেখাল সে।

সাথে সাথে বুঝল ওরা।

প্লেনের নিয়ন্ত্রণ আমি নিলাম। ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের দিকে তাকাল মেয়েটা। কমিউনিকেশন ইকুইপমেন্টের সুইচ অফ করে দাও।

ঝট করে ক্যাপটেনের দিকে তাকাল ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার। ছোট্ট করে মাথা ঝকাল ক্যাপটেন। ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার এক এক করে তার রেডিওগুলো বন্ধ করে দিতে শুরু করল প্রথমে ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সি সেটগুলো তারপর হাই ফ্রিকোয়েন্সি, আলট্টা হাই ফ্রিকোয়েন্সি।

এবং স্যাটেলাইট রিলে, নির্দেশ দিল মেয়েটা। মুখ তুলে তার দিকে তাকাল ফ্লাইট এঞ্জিনিয়ার, জ্ঞানের বহর দেখে বিস্মিত হয়েছে।

সাবধান, গোপন সুইচ-এ হাত দেবে না! হিসিহিস করে উঠল মেয়েটা।

চোখ পিটপিট করল ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার। কেউ জানে না, কোম্পানির কিছু লোক ছাড়া কারও জানার কথা নয় যে এই প্লেনে স্পেশাল রিলে সিস্টেম আছে! খুদে বোতামটা রয়েছে তার ডান হাঁটুর পাশেই, একবার শুধু টিপে দিলেই হিথরো এয়ারপোর্ট কন্ট্রোল জেনে যাবে হাইজ্যাকারদের পাল্লায় পড়েছে স্পীডবার্ড জিরো সেভেন-জিরো-ফ্লাইট ডেকের প্রতিটি শব্দ পরিষ্কার শুনতেও পাবে তারা। ধীরে ধীরে ডান হাঁটুর কাছ থেকে হাতটা সরিয়ে আনল সে।

 স্পেশাল রিলের সার্কিট থেকে ফিউজটা সরাও। ফ্লাইট, ইঞ্জিনিয়ারের মাথার ওপর অনেকগুলো বাক্স, সঠিক বাক্সটার দিকেই আঙুল তাক করল মেয়েটা। আবার একবার ক্যাপটেনের দিকে তাকাল ইঞ্জিনিয়ার, চাবুকের মতো শব্দ বেরুল মেয়েটার গলা থেকে। কারও দিকে তাকাতে হবে না, আমি যা বলছি কর!

সাবধানে ফিউজটা সরাল ইঞ্জিনিয়ার, সামান্য একটু শিথিল হলো মেয়েটার কাঁধের পেশি।

আবার নির্দেশ দিল সে, ডিপারচার ক্লিয়ারান্স পড়ে শোনাও।

রাডারের আওতা থেকে বেরিয়ে নাইরোবি যাবার অনুমতি পেয়েছি আমরা। ঊনচল্লিশ হাজার ফিট পর্যন্ত উঠতে পারব।

তোমার পরবর্তী অপারেশনস নরম্যাল-এর সময় বল। অপারেশনস নরম্যাল হলো রুটিন রিপোর্ট, নাইরোবি কন্ট্রোলকে জানাতে হবে প্ল্যান অনুসারেই এগোচ্ছে ফ্লাইট।

এগারো মিনিট পঁয়ত্রিশ সেকেন্ড পর। ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের বয়স বেশি হলে পঁয়ত্রিশ হবে, তার মাথাতেও সোনালি চুল। কপালটা চওড়া, এখন সেখানে ঘাম চিকচিক করছে। সপ্রতিভ চেহারা, বিপদের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ট্রেনিংও নেয়া আছে তার।

ক্যাপটেনের দিকে মুখ ফেরাল স্বর্ণকেশী, পরস্পরকে বোঝার চেষ্টায় দুজনের দৃষ্টি অনেকক্ষণ এক হয়ে থাকল। ক্যাপটেনের মাথায় কালোর চেয়ে সাদা চুলই বেশি, বড়সড় গোল খুলি কামড়ে রয়েছে। ষাড়ের মতো চওড়া ঘাড়, আর মাংসল মুখ দেখে তাকে কসাই বা চাষী বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক-কিন্তু তার চোখ জোড়া স্থির, আচরণ শান্ত এবং দৃঢ়। এই লোককে চোখে চোখে রাখতে হবে, সাথে সাথে উপলব্ধি করল মেয়েটা।

আমি চাই কথাগুলো আপনি বিশ্বাস করুন। মৃত্যু আমার কাছ থেকে ক ইঞ্চি দূরে, আমি জানি। আমার একটা আদর্শ আছে, আদর্শের জন্যে নিজের জীবন দিতে পারলে আমি ধন্য হব। মেয়েটার গভীর নীল চোখে ভয়ের লেশমাত্র নেই। ক্যাপটেনের বাদামী চোখ স্থির হয়ে আছে, সেখানেও ভয়ের কোনো ছাপ নেই, আছে সমীহের ক্ষীণ একটু আভাস। মনে মনে খুশি হলো মেয়েটা, ক্যাপটেন তাকে হালকাভাবে নিচ্ছে না। তার সতর্ক হিসেবে এই সমীহের ভাবটা আদায় করা গুরুত্বপূর্ণ, জরুরি ছিল।

আমি আমার অস্তিত্ব এই অপারেশনে উৎসর্গ করেছি।

 আমি বিশ্বাস করি, বলে একবার মাথা ঝাঁকাল পাইলট।

চারশ সতেরোটা প্রাণ, সবার দায়িত্ব আপনার কাঁধে, বলে চলেছে মেয়েটা। শুধু যদি আপনি আমার প্রতিটি নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন, ওরা সবাই নিরাপদে থাকবে। এই একটা কথা আপনাকে আমি দিতে পারি।

 বেশ।

এই নিন আমাদের নতুন গন্তব্য। ছোট একটা টাইপ করা কার্ড দিল মেয়েটা। নতুন একটা কোর্স চাই আমি, বাতাসের মতিগতি আর পৌঁছুবার সময় সহ। পরবর্তী অপারেশনস নরম্যাল রিপোর্ট পাঠাবার পরপরই নতুন কোর্স ধরবেন-, ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের দিকে তাকাল সে, সময় জানতে চায়।

নয় মিনিট আটান্ন সেকেন্ড, সাথে সাথে জানাল ইঞ্জিনিয়ার।

নতুন কোর্স ধরবেন খুব আস্তে-ধীরে, ব্যালেন্স থাকা চাই। আমরা চাইব না প্যাসেঞ্জারদের গ্লাস থেকে শ্যাম্পেন ছলকে পড়ক, চাইব কি?

বিষাক্ত কালনাগিনীর ভঙ্গি নিয়ে ফ্লাইট ডেকে দাঁড়িয়ে থাকল মেয়েটা। ক্যাপটেনের সাথে কথা বলার সময় তার কণ্ঠস্বর ছিল দৃঢ়, ভাবাবেগশূন্য, ঠাণ্ডা। যৌনাবেদন নিয়ে তার দাঁড়াবার ভঙ্গি, পরনের ন্যূনতম পোশাক, সুন্দর অবয়ব, সোনালি খোঁপা-সবকিছু মিলিয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও কেমন যেন একটা ভয় মেশানো শ্রদ্ধা এসে গেছে ওদের মনে। উত্তেজনায় তার শরীর শক্ত হয়ে গেছে, শ্লোগান লেখা পাতলা সুতী শার্টের ভেতর থেকে নিরেট গোল আকৃতি প্রকটভাবে চোখে লাগে। শরীরের মেয়ে-মেয়ে গন্ধ পাচ্ছে ওরা।

কয়েক মিনিট কেউ কোনো কথা বলল না। তারপর নিস্তব্ধতা ভাঙল ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার, ত্রিশ সেকেন্ড পর অপারেশন্ নরম্যাল।

ঠিক আছে, হাই ফ্রিকোয়েন্সি অন করে রিপোর্ট পাঠাও।

নাইরোবি, স্পীডবার্ড জিরো-সেভেন-জিরো থেকে বলছি।

 বলুন, স্পীডবার্ড জিরো-সেভেন-জিরো।

মাছে, হেডসেটে বলল ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার।

 রজার, জিরো-সেভেন-জিরো। চল্লিশ মিনিট পর আবার রিপোর্ট করুন।

জিরো-সেভেন-জিরো।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মেয়েটা। সেট অফ কর, বলে ক্যাপটেনের দিকে ফিরল সে। ফ্লাইট ডাইরেক্টর ডিজএনগেজ করুন, বাক নিয়ে নতুন কোর্স ধরুন হাত দিয়ে-দেখা যাক কতটা নরমভাবে কাজটা আপনি করতে পারেন।

প্লেন চালনা কৌশলের অপূর্ব প্রদর্শনী চাক্ষুষ করল মেয়েটা, মাত্র দুমিনিটে ছিয়াত্তর ডিগ্রী দিক্ বদল সহজ কথা না। টার্ন অ্যান্ড-ব্যালেন্স ইন্ডিকেটরের কাটা এক চুল এদিক ওদিক নড়ল না। বাক নেয়া শেষ হতে এই প্রথমবারের মতো হাসল স্বর্ণকেশী।

মুক্তার এক ঝলক দ্যুতি ছড়ানো চোখ ধাঁধানো হাসি।

 গুড, বলল সে, সরাসরি ক্যাপটেনের মুখের ওপর হাসছে। আপনার নাম কি?

 সিরিল, এক মুহূর্ত ইতস্তত করে বলল ক্যাপটেন।

আমাকে আপনি ইনগ্রিড বলে ডাকতে পারেন, আহ্বান জানাল সুন্দরী।

.

পিটার স্ট্রাইডের নতুন চাকরিতে বাঁধা-ধরা কোনো রুটিন নেই, তবে পিস্তল আর অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে প্র্যাকটিস করা বাধ্যতামূলক। থোর কমান্ডের সবাইকে, এমন কি টেকনিশিয়ানদেরও, দৈনিক এক ঘণ্টা রেঞ্জ প্র্যাকটিস করতেই হবে।

দিনের বাকি সময় বিরতিহীন ব্যস্ততার মধ্যে কাটে পিটারের। ওর কমান্ড এয়ারক্রাফটে নতুন ইলেকট্রনিক কমিউনিকেশন ইকুইপমেন্ট বসানো হয়েছে সেগুলোর নাড়ি-নক্ষত্র জানার জন্যে এক্সপার্টদের সাথে থাকতে হয় ওকে। সকালের অর্ধেক এই দুই কাজে বেরিয়ে যায়। তারপর তাড়াহুড়ো করে ছুটতে হয় স্ট্রাইকার ফোর্সের সাথে যোগ দেয়ার জন্যে। দিনের অনুশীলন শুরু করার জন্যে ওর অপেক্ষায় হারকিউলিস ট্রান্সপোর্ট প্লেনের মেইন কেবিনে বসে থাকে সবাই।

প্রথম দশজনের সাথেই জাম্প করে পিটার। পাঁচশো ফিট ওপর থেকে লাফ দেয়, হ্যাচকা টানের সাথে প্যারাসুট খোলে যেন মাটি স্পর্শ করার কয়েক সেকেন্ড আগে। তবে বিভিন্নমুখী জোরাল বাতাস থাকায় এত অল্প উঁচু থেকে লাফ দিলেও পরস্পরের কাছ থেকে বেশ একটু ছড়িয়ে পড়ে ওরা। আজকের প্রথম ল্যান্ডিংটা টার্গেট এরিয়ার যথেষ্ট কাছাকাছি না হওয়ায় অসন্তুষ্ট হলো পিটার। জাম্প করার পর থেকে পরিত্যক্ত অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিল্ডিংয়ে পেনিট্রেট করতে সময় লাগল দুমিনিট আটান্ন সেকেন্ড।

নির্জন স্যালিসবারি প্রান্তর, মিলিটারি জোন।

এখানে যদি আতঙ্কবাদীরা একদল লোককে জিম্মি করে রাখত, যে-সময়ে পৌঁছেছি তাতে বড়জোর মেঝে থেকে রক্ত মোছর সময় পেতাম। আবার আমরা প্র্যাকটিস করব!

 দ্বিতীয়বার ওরা এক মিনিট পঞ্চাশ সেকেন্ডের মাথায় ঢুকল বিল্ডিংয়ে, ঝকের প্রতিটি লোক আড়াল নিয়ে তৈরি হতে আরও দশ সেকেন্ড সময় নিল। কলিন নোবলসের দু-নম্বর স্ট্রাইকার টীমের চেয়ে পঁচিশ সেকেন্ড এগিয়ে থাকল ওরা।

 এরপর, সেলিব্রেট করার জন্যে দৌড়ে এয়ারস্ট্রিপে পৌঁছুল ওরা, প্রত্যেকে পুরোদস্তুর কমব্যাট কিট পরে আছে, ব্যবহার করা প্যারাস্যুট সিল্কের মস্ত বান্ডিলটাও বয়ে নিয়ে আসতে হলো।

হারকিউলিস বিমান ওদের পুরো দলটাকে হেডকোয়ার্টারে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে আসতে অন্ধকার ঘনিয়ে গেল।

কলিন নোবলসের কাছে ডি-ব্রিফিংয়ের থেকে পালাতে পারলে বাঁচে পিটার।

তার ধারণা, মেলিসা জেইন নিশ্চয়ই ইস্ট ক্রয়ডন স্টেশনে পৌঁছে গেছে এতক্ষণে। গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে পিটার, দশ মিনিটের মধ্যে ওকে নিয়ে নতুন ভাড়া করা কটেজে পৌঁছে যাবে ড্রাইভার। কটেজে একা একা অপেক্ষা করার সময় ওর ওপর রেগে যাবে মেলিসা। বেসের গেট থেকে কটেজটা মাত্র অর্ধেক মাইল দুরুত্বে।

 থোর কমান্ডের নেতৃত্ব নেয়ার পর থেকে, আজ ছয় সপ্তাহ, একদিনের জন্যেও ছুটি নেয়নি পিটার। অপরাধবোধের দংশন অনুভব করল ও, এমনটা আসলে করা উচিত হয় নি। দ্রুত, আজকের মতন কলিন নোবলের কাছে দায়িত্বভার হস্তান্তর করল।

উইকএন্ডে কোথায় যাচ্ছো হে? কলিন জানতে চাইল।

আগামীকাল রাতে একটা পপ গানের কনসার্টে নিয়ে যাচ্ছে মেলিসা আমাকে, মুচকি হাসে পিটার, কি যে গান শুনব—-ভালোই জানা আছে।

ঠিক আছে, মেলিসাকে আমার শুভেচ্ছা জানিয়ে, কলিন বিদায় দেয়।

নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপারে পিটার সাধারণত মুখ খোলে না অতটা। জীবনের বেশিরভাগ সময় মেসে না হয় ব্যারাকে কাটিয়ে এই গোপনীয়তা এখন উপভোগ করছে সে।

কম্পাউন্ড থেকে গাড়িতে মাত্র সাড়ে চার মিনিটের পথ হলেও নির্জন প্রান্তরে নিঃসঙ্গ একটা দ্বীপের মতো কটেজটা। ফার্নিশ বাড়ির এত কম ভাড়া- ভাবাই যায় না। উঁচু একটা মাটির পাহাড়ের পিছনে অযত্নে বেড়ে ওঠা বাগানের মাঝখানে তিন কামরার সাজানো-গোছানো শান্তি নীড়। গত ক-সপ্তা থেকে এটাই ওর বাড়ি। এখনো পর্যন্ত নিজের বইপত্রগুলো গোছগাছ করতে পারেনি পিটার। প্রায় বিশ বছরের সংগ্রহ- সাজিয়ে রাখা সহজ নয়। অবশ্য, নতুন এই চাকরিতে পড়াশোনা করার সুযোগ বলতে গেলে হয় না তার।

মেলিসা নির্ঘাত খোয়া বিছানো পথে ওর গাড়ির চাকার শব্দ পেয়েছিল, অপেক্ষায় থেকে বোধ হয় বোর হয়ে গেছে মেয়েটা। দৌড়ে, সদর দরজা ঠেলে ড্রাইভওয়েতে বেরিয়ে এল সে। সরাসরি পিটারের গাড়ির হেডলাইটের সামনে। ওর কমনীয় মুখটা দেখে বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে উঠল পিটারের।

 গাড়ি থেকে ও নামতে যত দেরি, ঝাঁপিয়ে পড়ে দুই হাতে ওকে জড়িয়ে ধরল মেয়েটা। বেশ অনেকক্ষণ ধরে ওকে ধরে রাখল পিটার, কেউ কোনো কথা বলছে না। জীবনীশক্তিতে ভরপুর, ওর আলিঙ্গনের ভিতর এক তরতাজা প্রাণ মেলিসা।

অবশেষে, চিবুক উঁচু করে ধরে তার মুখটা ভালো করে পরখ করে দেখল পিটার। বিশাল বড় বেগুনি চোখদুটোতে জল; নাক টানছে বেচারি। দাগহীন মুখটা অদ্ভুত মিষ্টি।

যত্ন করে কপালে চুমো খেল পিটার।

ওহ, ড্যাডি, তুমি এমন কেন? চোখে পানি নিয়েও পায়ের পাতার উপর দাঁড়িয়ে বাপের গালে চুমো খেল মেলিসা।

ক্রয়ডনের একটা ইতালিয় রেস্তোরাঁয় খাবার খেল ওরা দুজন। সারাক্ষণ বকবক করে গেল মেলিসা, চুপচাপ শুনল কেবল পিটার। বিশ্বাস করা কঠিন- ওর বয়স এখনো চোদ্দ পেরোয়নি। গায়ে-গতরে এখনই পূর্ণবয়স্কা হয়ে উঠেছে মেলিসা।

কটেজে ফিরে, ওদের দুজনের জন্যে ওভালটিন বানাল মেয়েটা; উইকএন্ডে কি কি করবে তাই নিয়ে দারুণ উত্তেজিত সে। মার কথা সচেতনভাবেই উচ্চারণ করল না দুজনের একজনও।

শোবার সময় হতে, বাপের কোলে মাথা রেখে মুখে আঙুল বোলাতে লাগল মেলিসা।

তুমি জানো, তোমাকে দেখে আমার কার কথা মনে পড়ে?

কার কথা? পিটার উৎসাহ দেয় মেয়েকে।

গ্যারি কুপার অবশ্য অনেক কম বয়স্ক সময়ের। দ্রুত যোগ করে মেলিসা।

বুঝলাম। কিন্তু গ্যারি কুপারের কথা তুমি শুনলে কোথায়?

ওই যে- গত শনিবারে টেলিভিশনে একটা মুভি দেখে!

নিচু হয়ে মেয়ের ঠোঁটে চুমা খেতে চিনি আর ওভালটিনের স্বাদ পেল পিটার; মিষ্টি সুবাস তার চুলে।

তোমার বয়স কত, ড্যাডি?

 ঊনচল্লিশ।

ওহ, ওটা খুব বেশি বয়স নয়। একটু যেন স্বস্তি মেলিসার গলায়।

কখনো ডাইনোসরদের কথা ভেবে দেখেছ- ঠিক ওই মুহূর্তে বেজে ওঠে কাপের পাশে রাখা খুদে এলার্ম। পেটে কিসের যেন একটা টান অনুভব করে পিটার।

ম্যাচ বক্সের মতো ছোট্ট ব্লিপারটা তুলে নিল পিটার। মিনিয়েচার টু-ওয়ে রেডিওটা অন করল খুদে একটা বোতামে চাপ দিয়ে, মেলিসা তখনো ওর কোলে।

থোর ওয়ান, শান্ত গলায় বলল ও।

যান্ত্রিক, অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর ভেসে এল, রেঞ্জের প্রায় শেষ সীমায় রয়েছে সেটটা। জেনারেল পিটার স্ট্রাইড, অ্যাটলাস কন্ডিশন আলফা ঘোষণা করেছে।

আরেকটা ফলস অ্যালার্ম, বিরক্ত হয়ে ভাবল পিটার। গতমাসে বারো বার কন্ডিশন আলফা ঘোষণা করা হয়, কিন্তু এত থাকতে আজ রাতে কেন! কন্ডিশন আলফা হলো সতর্কতার প্রথম পর্যায়, তৈরি হয়ে কন্ডিশন ব্রাভো-এর জন্যে অপেক্ষা করতে হবে কমান্ডোদের। কন্ডিশন ব্রাভো ঘোষণা করার সাথে সাথে রওনা হতে হবে সবাইকে।

আলফা-কে জানাও সাত মিনিটের মধ্যে কন্ডিশন ব্রাভোর জন্যে তৈরি হব। আমরা। সাড়ে চার মিনিট লাগবে কম্পাউন্ডে পৌঁছুতে। হঠাৎ করেই কটেজ ভাড়া করার সিদ্ধান্তটা ভুল হয়েছে বলে উপলব্ধি করল পিটার। এই কমিনিটে অনেক মানুষ মারা যেতে পারে।

ডার্লিং, আমি দুঃখিত, মেয়েকে আলিঙ্গনে বাধে পিটার।

ঠিক আছে, শক্তমুখে বসে রইল মেলিসা।

আগামীবার আমরা যাব- প্রমিস।

তুমি শুধু প্রমিস কর- ফিসফিস করে বলল ও, কিন্তু ওর বাবা শুনছে না ওর কথা। উঠে দাঁড়িয়ে মেয়ের দিকে একবার তাকাল পিটার। শক্ত মুখে চোয়ালের রেখা ফুটে আছে।

আমি চলে গেলে দরজার দিকে খেয়াল রেখ। ব্যাপারটা ব্রাভো হলে আমি তোমার জন্যে ড্রাইভার পাঠিয়ে দেব। সে তোমাকে ক্যামব্রিজে পৌঁছে দেবে। তোমার মাকে জানাব আমি।

খোয়া বিছানো পথে চাকার আওয়াজ তুলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল পিটার।

.

নাইরোবি টাওয়ারে কন্ট্রোলার অপেক্ষা করছে, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের সেইশেল্য ফ্লাইটের এখনই রিপোর্ট করার সময়। পনেরো সেকেন্ড অপেক্ষা করার পর একবার, দুবার, তিনবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করল সে। কোনো সাড়া নেই ইনফরমেশন, অ্যাপ্রোচ টাওয়ার এবং ইমার্জেন্সির জন্যে আলাদা আলাদা চ্যানেল আছে, বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সির সুইচ অন করে এক এক করে সবগুলো চ্যানেল জ্যান্ত করার চেষ্টা চলল। এগুলোর যে কোনো একটা খোলা রেখে বাইরের দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে হয় জিরো-সেভেন-জিরোকে। অথচ তবু কোনো সাড়াশব্দ নেই।

পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড পেরিয়ে গেছে স্পীডবার্ড জিরো-সেভেন-জিরো অপারেশনস নরমাল রিপোর্ট পাঠাচ্ছে না, অ্যাপ্রোচ ব্যাক থেকে হলুদ স্লিপ নামিয়ে ইমার্জেন্সি লস্ট কন্ট্যাক্ট স্লটে ঢোকাল কন্ট্রোলার, সাথে সাথে অনুসন্ধান ও উদ্ধার তৎপরতা শুরু হয়ে গেল।

দুমিনিট তেরো সেকেন্ড পেরিয়ে গেছে। স্পীডবার্ড জিরো-সেভেন-জিরো অপারেশনস নরমাল পাঠাচ্ছে না, হিথ্রো কন্ট্রোলের ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ ডেস্কে টেলেক্স শীটটা পৌঁছল। ষোলো সেকেন্ড পর অ্যাটলাসকে জানানো হলো তোর কমান্ড-কন্ডিশন আলফা ঘোষণা করা হয়েছে।

.

পূর্ণিমা হতে আর তিন দিন বাকি, পৃথিবীর ছায়া পড়ায় চাঁদের ওপর দিকের কিনারা সামান্য একটু চ্যাপটা। এত উঁচু আকাশ থেকে প্রায় সূর্যের মতোই বড় দেখাচ্ছে।

গ্রীষ্মের রাতকে অপরূপ সাজে সাজিয়ে রেখেছে রুপালি মেঘমালা, কোথাও কোথাও ব্যাঙের ছাতার মতো আকৃতি নিয়েছে, কিনারায় বজ্ৰবাহী বিশালকায় পাখনা, চাঁদের অঝোর আলোয় দীপ্তিময়।

 মেঘমালার সার সার চূড়ার মাঝখান দিয়ে দ্রুতবেগে ছুটে চলেছে স্পীডবার্ড জিরো-সেভেন-জিরো, যেন অশুভ একটা কালো বাদুড়। বিরতিহীন পশ্চিম দিকে তার এই যাত্রার যেন শেষ নেই।

 ওটা মাদাগাস্কার, কথা বলল ক্যাপটেন, নিস্তব্ধ ককপিটে তার শক্ত কণ্ঠস্বরও গমগম করে উঠল। ঠিক পথেই আছি আমরা। তার পিছনে নড়েচড়ে উঠল মেয়েটা, সাবধানে হাত বদল করল গ্রেনেড, আধঘণ্টার মধ্যে এই প্রথম মুখ খুলল সে।

আরোহীরা কেউ কেউ জেগে আছে, ওরাও লক্ষ্য করছে ব্যাপারটা। হাতঘড়ির দিকে একবার তাকাল সে। সবাইকে জাগাবার সময় হয়েছে। সুখবরটা এবার জানানো দরকার। ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের দিকে তাকাল সে। কেবিন আর সীট বেল্ট লাইট জ্বালো, প্লিজ। তারপর মাইক্রোফোনটা দাও আমাকে।

ক্যাপটেন সিরিল ওয়াটকিংসকে আবার মনে করিয়ে দেয়া হলো, গোটা অপারেশনটাই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে প্ল্যান করা। মেয়েটা এমন এক সময় আরোহীদের কাছে ব্যাপারটা প্রকাশ করতে যাচ্ছে যখন তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা সবচেয়ে দুর্বল স্তরে পৌঁছেছে, ইন্টারকন্টিনেন্টাল ফ্লাইটের বাধাপ্রাপ্ত অগভীর ঘুম রাত দুটোর সময় ভাঙিয়ে দিলে বেশিরভাগই তারা অসহায় বোধ করবে।

কেবিন আর সীট বেল্ট লাইট জেলে দেয়া হয়েছে, বলে মেয়েটার হাতে মাইক্রোফোন ধরিয়ে দিল ইঞ্জিনিয়ার।

গুড মর্নিং, লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন, সজীব, স্পষ্ট আর মিষ্টি কণ্ঠস্বর মেয়েটার। এই অসময়ে আপনাদের ঘুম ভাঙানোর জন্যে সত্যি আমি দুঃখিত। কিন্তু আমি যা ঘোষণা করতে যাচ্ছি সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আমি চাই সবাই আপনারা মন দিয়ে শুনুন কথাগুলো।

লোক ঠাসা বিশাল গুহার মতো কেবিনে কাপড়চোপড়ের খসখস আওয়াজ শোনা গেল, দু-একটা করে উঁচু হতে শুরু করল মাখা, কেউ হাই তুলল, কেউ চোখ রগড়াতে শুরু করল।

 সীট বেল্ট লাইট জ্বলছে, আপনার পাশের আরোহীর ঘুম ভেঙেছে কিনা দয়া করে দেখে নিন। আরো দেখুন, তার সীট বেল্ট বাঁধা রয়েছে তো। কেবিন স্টাফরা ব্যাপারটা চেক কর।

 সব মানুষ সমান নয়, অনেকে বিপদের প্রথম ধাক্কা খেয়েই অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়, সীট বেল্ট আটকানো থাকলে বাধা পাবে সে। কথা বলার মাঝখানে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বিরতি নিচ্ছে ইনগ্রিড, কাঁটায় কাঁটায় ষাট সেকেন্ড পর আবার মুখ খুলল সে, প্রথমে আমার পরিচয়। অ্যাকশন কমান্ডো ফর হিউম্যান রাইটসের আমি একজন সিনিয়র অফিসার, সামান্য বাঁকা ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের ভাব নিয়ে থাকল ক্যাপটেন, প্লেনের বাইরে, চন্দ্রালোকিত মহাশূন্যের দিকে তাকিয়ে আছে সে।

-এবং প্লেনটা এখন সম্পূর্ণ আমার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আমার অফিসারদের অনুমতি ছাড়া কোনো অবস্থাতেই কেউ নিজের সীট ছেড়ে উঠবেন না। কেউ যদি এই নির্দেশ অমান্য করেন, হাই এক্সপ্লোসিভ দিয়ে গোটা প্লেন উড়িয়ে দেয়া হবে।

 ঘোষণার পরপরই আবার সেটা সাবলীল জার্মান ভাষায় পুনরাবৃত্তি করা হলো। সবশেষে ফরাসি ভাষায়, তবে থেমে থেমে, বোঝা গেল মেয়েটা ভালো ফ্রেঞ্চ জানে না।

অ্যাকশন কমান্ডের অফিসাররা লাল শার্ট পরে থাকবে সহজেই যাতে আপনারা তাদের চিনতে পারেন।

 ওদিকে ইনগ্রিড ঘোষণা শুরু করার পরপরই তার তিন সঙ্গী, ফার্স্ট ক্লাস কেবিনের সামনের অংশে দাঁড়িয়ে যে যার ক্যানভাস ব্যাগের ফলস্ বটম্ খুলে ফেলেছে। ভেতরে জায়গা মাত্র দু-ইঞ্চি গভীর, চৌদ্দ ইঞ্চি লম্বা, আর আট ইঞ্চি চওড়া, তবে ভাঁজ করা বারে বোর পিস্তল আর দশ রাউন্ড কান্ট্রিজের জন্যে যথেষ্ট। পিস্তলগুলোর ব্যারেল চোদ্দ ইঞ্চি লম্বা, বোরগুলো মসৃণ, আর আরমার্ড প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি। নিচে একটা বুলেটের প্যাসেজ হিসেবে এই প্লাস্টিক টেকার কথা নয়, তাই বিশেষ ধরনের বুলেট ব্যবহার করছে ওরা। এই বুলেটের ভেলোসিটি আর প্রেশার খুব কম। করডাইটের মাত্রাও অল্প, পরপর বেশ কয়েকটা গুলি করায় কোনো অসুবিধে নেই। ব্রীচ আর ডাবল পিস্তল গ্রিপও প্লাস্টিকের, সহজেই জায়গা মতো জোড়া লেগে গেল। গোটা আগ্নেয়াস্ত্রে ধাতব পদার্থ বলতে শুধু কেস স্টিল ফায়ারিং পিন আর প্রীং, ক্যানভাস ফ্লাইট ব্যাগের ধাতব পায়ার চেয়ে বড় নয় আকারে, কাজেই মাহে এয়ারপোর্টে সিকিউরিটি চেকিঙের সময় মেটাল ডিটেকটরকে ফাঁকি দেয়া সম্ভব হয়েছে। প্রতিটি ব্যাগে দশটা করে কাট্রিজ রয়েছে, প্লাস্টিক কেসে মোড়া–এগুলোরও শুধু পারকাশন ক্যাপ অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল দিয়ে তৈরি, কোনো ইলেকট্রিক ফিল্ডকে উত্তেজিত করবে না। কার্ট্রিজগুলো লুপ করা বেল্টের ভেতর রয়েছে, বেল্টটা কোমরে জড়িয়ে দেয়া যাবে।

অস্ত্রগুলো ছোট, কালো আর কুৎসিত। সাধারণ শটগানের মতো করে লোড করতে হয়। ব্যবহৃত শেল নিজে থেকে ছিটকে পড়ে না, আর রিকয়েলের ধাক্কা এত প্রচণ্ড যে সবটুকু শক্তি দিয়ে পিস্তল গ্রিপ চেপে না ধরলে ব্যবহারকারীর কবজি নির্ঘাত ভেঙে যাবে। ত্রিশ ফিট দূর থেকে এর ধ্বংস-ক্ষমতা হতবাক করে দেয়। বারো ফিট দূর থেকে পেটে গুলি করলে নাড়িভুড়ি সব বেরিয়ে আসবে। আর ছয় ফিট দূর থেকে নিখুঁতভাবে আলাদা করে দিতে পারে মাথা। অথচ একটা ইন্টারকন্টিনেন্টাল এয়ারলাইনারের প্রেশার হাল (খোল) ফুটো করার ক্ষমতা নেই।

 ওদের হাতের এই কাজটার জন্যে আদর্শ একটা অস্ত্র। সংযোজনের পর লোড করা হলো, টি-শার্টের ওপর লাল শার্ট গায়ে চড়াল পুরুষ দুজন, তারপর যে যার পজিশনে গিয়ে দাঁড়াল–একজন ফার্স্ট ক্লাস কেবিনের পিছন দিকে, অপরজন টুরিস্ট কেবিনের পিছন দিকে। চেহারায় মারমুখো ভাব নিয়ে হাতের অস্ত্র তুলল তারা, সবাইকে দেখাল।

 সুন্দরী, একহারা, কালো চুল মেয়েটা আরো কিছুক্ষণ বসে থাকল নিজের সীটে। অবশিষ্ট কোকো-ডি-মার থেকে গ্রেনেড বের করে নেটিং ব্যাগে ভরল সে, ইনগ্রিডের হাতে যেটা রয়েছে সেটার সাথে এগুলোর এক জায়গাতেই পার্থক্য-মাঝখানে জোড়া লাল রেখা। তার মানের এগুলোর ফিউজ ইলেকট্রনিক নিয়ন্ত্রিত।

কেবিন অ্যাড্রেস সিস্টেমে প্রাণবন্ত একটা কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে এই মুহূর্তে, আবার কথা বলছে ইনগ্রিড। ইতোমধ্যে আরোহীরা সবাই সম্পূর্ণ জেগে গেছে সার সার লম্বা সীটে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বসে আছে প্রত্যেকে, চেহারায় হতচকিত বিপন্ন ভাব।

 ও কে, আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, অ্যাকশন কমান্ডোর একজন অফিসার কেবিনের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত হেঁটে আসছে, তাই না? ওর হাতে ওগুলো হাই এক্সপ্লোসিভ গ্রেনেড,-কালোকেশী জার্মান মেয়েটা প্যাসেজ ধরে হাঁটছে, পনেরোটা সীটের সারি পেরিয়ে একবার করে থামছে সে, ওভারহেড লকার খুলে ভেতরে একটা করে গ্রেনেড রাখছে, লকার বন্ধ করে আবার হাঁটছে। আরোহীদের মাথা একযোগে ঘুরতে শুরু করল, নিখাদ আতঙ্ক ভরা চোখে মেয়েটার কীর্তিকলাপ দেখছে তারা। গ্রেনেডগুলোর যে কোনো মাত্র একটারই প্লেনটাকে উড়িয়ে দেয়ার এক্সপ্লোসিভ পাওয়ার রয়েছে। একটা ব্যাটল ট্যাংকের গা তৈরি করা হয় ছয় ইঞ্চি মোটা ইস্পাত দিয়ে, অনেকেই জানেন আপনারা। এই গ্রেনেডের রয়েছে সেই ছয় ইঞ্চি মোটা ইস্পাতকে ভেঙে ভেতরের লোকগুলোকে মেরে ফেলার বিস্ফোরণ ক্ষমতা। আমার অফিসার প্লেনের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত মোট চৌদ্দটা গ্রেনেড রাখছে। আমার নিয়ন্ত্রণে ইলেকট্রনিক ট্রান্সমিটার রয়েছে, গ্রেনেডগুলো একসাথে ফাটিয়ে দেয়া যাবে। এরপর তার কণ্ঠস্বরে কিছুটা দুষ্টামির সুর পাওয়া গেল, সেই সাথে মৃদু হাসির আওয়াজ। আর যদি ফাটে, নর্থ পোল থেকেও শোনা যাবে আওয়াজটা।

মৃদুমন্দ বাতাসে গাছের পাতা যেমন কাপে তেমনি কাঁপতে লাগল আরোহীরা, কাছেপিঠে কোথাও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল একজন মহিলা। চাপা গলার কান্না, কেউ এমনকি তার দিকে তাকাল না পর্যন্ত।

তবে দয়া করে কেউ উদ্বিগ্ন হবেন না। সে ধরনের কিছু ঘটতে যাচ্ছে না। কারণ আমি জানি আপনারা সবাই আমার নির্দেশগুলো মেনে চলবেন। তারপর সব যখন ভালোয় ভালোয় শেষ হবে, যে যার ঠিকানায় ফিরে যাবার সময় এই অপারেশনে ভূমিকা রাখার জন্যে সবাই আপনারা গর্ব অনুভব করবেন। আমরা সবাই মহান এবং গৌরবময় একটা মিশনে অংশগ্রহণ করছি। মানবকল্যাণ এবং স্বাধীনতার পক্ষে আমরা সবাই এক-একজন অকুতোভয় যোদ্ধা, বঞ্চিত মানুষের প্রাপ্য আদায়ে বদ্ধপরিকর। নতুন এক জগৎ সৃষ্টির কাজে আজ আমরা বড় একটা পদক্ষেপ নিয়েছি। সবাই মিলে ঝেটিয়ে দূর করব সব রকম অত্যাচার, বৈষম্য, দুর্নীতি, শোষণ আর অবিচার। আসুন, আমরা শপথ নেই অবহেলিত মানুষের অধিকার আদায় এবং তাদের কল্যাণের জন্যে নিজেদের আমরা উৎসর্গ করব।

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে এখনো কাঁদছে মহিলা, তার সাথে পাল্লা দিতে শুরু করল ছোট একটা বাচ্চা।

 কালোকেশী জার্মান মেয়েটা নিজের সীটে ফিরে এল, ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করল সে। এই ক্যামেরাটাই মাহে এয়ারপোর্টে ধরা পড়েছিল মেটাল ডিটেকটরে। নাইলনের স্ট্র্যাপটা মাথায় গলাল সে, গলায় ঝুলিয়ে নিল ক্যামেরা, তারপর সামনের দিকে ঝুঁকে অবশিষ্ট পিস্তল দুটো জোড়া লাগাতে বসল।

দ্রুতহাতে কাজটা শেষ করে উঠে দাঁড়াল সে, পিস্তল দুটো ছাড়াও হাতে কার্টিজ বেল্ট রয়েছে। গ্যালি এলাকার ভেতর দিয়ে সোজা ফ্লাইট ডেকে চলে এল সে। নির্লজ্জের মতো তার ঠোঁটে চুমো খেল ইনগ্রিড।

ক্যারেন–আই লাভ ইউ! ক্যামেরাটা নিয়ে নিজের গলায় ঝোলাল স্বর্ণকেশী। এটা, ক্যাপটেনকে ব্যাখ্যা করল সে, যা দেখছেন তা নয়। এটা একটা রিমোট রেডিও ডিটোনেটর, কেবিনের গ্রেনেডগুলো ফাটিয়ে দেবে।

 কথা না বলে মাথা ঝাঁকাল ক্যাপটেন। চেহারায় প্রকাশ্যে স্বস্তির ভাব নিয়ে পিনটা আবার জায়গামতো ঢুকিয়ে দিয়ে গ্রেনেডটাকে ডিজআর্ম করল ইনগ্রিড, অনেকক্ষণ ধরে মুঠোর ভেতর রাখায় তালুর ঘামে ভিজে গেছে। বান্ধবীর হাতে গুঁজে দিল সেটা।

 উপকূলে পৌঁছুতে আর কতক্ষণ লাগবে? কোমরে কার্লিজ বেল্ট জড়াতে জড়াতে জিজ্ঞেস করল সে।

বত্রিশ মিনিট, ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার সাথে সাথে জবাব দিল।

পিস্তলের ব্রীজ খুলল ইনগ্রিড, লোড চেক করল, তারপর হাত-ঝাপটা দিয়ে বন্ধ করল আবার। তুমি আর হেনরি এবার বিশ্রাম নিতে পারো, ক্যারেনকে বলল সে। বিশ্রাম মানে ঘুমাতে হবে।

অপারেশনটা দীর্ঘ কয়েকদিন ধরে চলতে পারে, তখন ক্লান্তি ওদের সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে দেখা দেবে। সেজন্যেই ভেবেচিন্তে এত বড় করা হয়েছে দলটাকে। এখন থেকে, শুধু ইমার্জেন্সি ছাড়া, দুজন করে বিশ্রাম নেবে।

 গোটা ব্যাপারটা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সামলাচ্ছেন আপনারা, পাইলট সিরিল ওয়াটকিংস প্রশংসার সুরে বলল,-এখনো পর্যন্ত।

ধন্যবাদ, সুরেলা কণ্ঠে হেসে উঠল ইনগ্রিড, তার একটা হাত সীটের পিঠ ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল, ক্যাপটেনের কাঁধে মৃদু চাপ দিল সে। আজকের এই দিনটার জন্যে কঠোর পরিশ্রম করেছি আমরা।

.

সরু গলির শেষ মাথায় কম্পাউন্ডের গেট দেখা গেল, ল্যান্ড-রোভারের গতি না কমিয়ে পরপর তিনবার হেডলাইট জ্বালাল আর নেভাল পিটার। তাড়াহুড়ো করে ঠেলে গেট খুলে দিল সেন্ট্রি, পরমুহূর্তে সগর্জনে তাকে পাশ কাটাল গাড়ি।

কোথাও ফ্লাডলাইট জ্বলছে না, নেই কোনো ব্যস্ত ছুটোছুটি, প্রতিধ্বনিবহুল বিশাল গুহা আকৃতির হ্যাঙ্গারে শুধু পাশাপাশি একজোড়া প্লেন দাঁড়িয়ে রয়েছে।

গোটা হ্যাঙ্গার একা লকহীড হারকিউলিসটাই যেন দখল করে রেখেছে। হ্যাঙ্গারটা আসলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ছোট ছোট প্লেনের জন্যে তৈরি করা হয়েছিল। হারকিউলিসের লম্বা, খাড়া ফিন ছাদের কাছাকাছি মাচা প্রায় ছুঁইছুই করছে। তার পাশে হকার সিডলি এইচ-এস ওয়ান-টু-ফাইভ একজিকিউটিভ জেট খেলনার মতো লাগছে। থোর কমান্ড শুধু এই দু-দেশের বিমানই নয়, আরো কয়েকটা দেশের বিমান পেতে যাচ্ছে।

 ভালো রাত বলতে হয়, কলিন এগিয়ে আসে। ল্যান্ডরোভারের ইঞ্জিন বন্ধ হতেই পাশে এসে দাঁড়াল সে, কথার সুরে মধ্য-পশ্চিম আমেরিকান টান। ইউ. এস. মেরিনসের মেজর হলেও, চেহারা দেখে মনে হবে সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ির সেলসম্যান।

নীল ওভারঅক্স আর সুতি কাপড়ের ক্যাপ পরেছে কলিন, দুটোতেই লেখা রয়েছে–থোর কমিউনিকেশনস। সৈনিক নয়, বরং টেকনিশিয়ান বলে মনে হচ্ছে। ওকে।

পিটারের সেকেন্ড ইন কমান্ড কলিন, থোর-এর কমান্ডার হিসেবে পিটার ছয় সপ্তাহ আগে যোগ দেয়ার পর প্রথম পরিচয়। খুব একটা লম্বা নয় কলিন, তবে শরীরটা বেশ ভারী। প্রথম দর্শনে তাকে মোটা বলে মনে হতে পারে, কারণ চওড়ায় একটু যেন বেশি সে। কিন্তু শরীরের কোথাও অতিরিক্ত মেদ নেই, সবটুকুই হাড় আর পেশি। সেনা বাহিনিতে হেভিওয়েট বক্সার হিসেবে খ্যাতি আছে তার, চওড়া হাশিখুশি মুখের ওপর নাকটা ব্রিজের ঠিক নিচে ভাঙা-সামান্য ফুলে গিয়ে দু-এক সুতো বেকে আছে। সবচেয়ে আগে দৃষ্টি কাড়ে পোড়া চকলেট রঙের চোখজোড়া, বুদ্ধিদীপ্ত এবং সর্বভুক্ত। পিটারের প্রশংসা অর্জন করা সহজ কথা নয়, মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে সফল হয়েছে কলিন।

এই মুহূর্তে জোড়া প্লেনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সে, তার লোকেরা কন্ডিশন ব্রাভোর জন্যে ব্যস্ত দক্ষতার সাথে তৈরি করছে নিজেদের। দুটো প্লেনই কমার্শিয়াল এয়ারলাইন স্টাইলে রঙ করা হয়েছে, পেটের কাছে গায়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা, হোর কমিউনিকেশন। কোনো বাধা না পেয়ে পৃথিবীর যে কোনো এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করতে পারবে ওগুলো। থোর কমান্ডের কমান্ডোরা পাসপোর্ট ছাড়াই যে কোনো দেশে ভ্রমণ করতে পারবে, শুধু আইডেনটিটি কার্ডই যথেষ্ট। এ ব্যাপারে সদস্য দেশগুলো গঠনতন্ত্রে সই করার সময়ই অনুমতি দিয়ে রেখেছে।

 কোথায় কি ঘটতে যাচ্ছে শুনি? ল্যান্ড-রোভারের দরজা বন্ধ করে কলিনের পাশাপাশি হাঁটা ধরল পিটার।

নিখোঁজ প্লেন, স্যার। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ। ধেত্তেরি, খাবলা মেরে জান খারাপ করে দিল! প্রচণ্ড বাতাস কলিনের ওভারঅলের পায়া আর আস্তিন ধরে টান দিচ্ছে।

কোথায়?

ভারত মহাসাগরে।

কন্ডিশন ব্রাভোর জন্যে আমরা তৈরি? নিজের কমান্ড প্লেনে ওঠার সময় জিজ্ঞেস করল পিটার।

অল সেট, স্যার।

হেডকোয়ার্টার আর কমিউনিকেশন সেন্টারের উপযুক্ত করে নতুনভাবে সাজানো হয়েছে হকারের ভেতরটা। ফ্লাইট ডেকের ঠিক পিছনেই আরামদায়ক চারটে সীট চারজন অফিসারের জন্যে। পরের জায়গাটুকু দুজন ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার আর তাদের ইকুইপমেন্টের জন্যে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, সম্পূর্ণ আলাদা একটা কমপার্টমেন্ট। তারপর ছোট একটা টয়লেট, একেবারে পিছনে গ্যালি।

মাথা নিচু করে কেবিনে ঢুকতেই মাঝখানের দরজা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল একজন টেকনিশিয়ান। গুড ইভনিং, জেনারেল-অ্যাটলাসের সাথে ডাইরেক্ট লাইনে রয়েছি আমরা।

ভদ্রলোককে স্ক্রীনে আনো, নির্দেশ দিল পিটার, ছোট ওয়ার্কিং ডেস্কের পিছনে প্যাড লাগানো চেয়ারে বসল আরাম করে।

সরাসরি পিটারের দিকে মুখে করে রয়েছে চৌদ্দ ইঞ্চি টিভিটা, তার ঠিক ওপরেই কনফারেন্স কমিউনিকেশনের জন্যে রয়েছে ছয় ইঞ্চি স্ক্রীন সহ চারটে সেট। চৌদ্দ ইঞ্চিটা মেইন স্ক্রীন, সেটা সচল হয়ে উঠল, সাথে সাথে বড়সড় একটা মাথা পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠল স্ক্রীনে। প্রথম দর্শনেই শ্রদ্ধার ভাব জাগে মনে।

গুড আফটারনুন, পিটার। হাসিটা আন্তরিক, চুম্বকের মতো টানে।

গুড ইভনিং, স্যার।

ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকিয়ে ডক্টর পার্কার বোঝাতে চাইলেন পিটারের মতো তিনিও যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্যের সময়ের ব্যবধান সম্পর্কে সচেতন।

ঠিক এই মুহূর্তে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রয়েছি আমরা, পিটার। শুধু জানি, বি,এ, জিরো-সেভেন-জিরো চারশ একজন প্যাসেঞ্জার আর ষোলো জন ক্রু নিয়ে মাহে থেকে নাইরোবি আসছিল, বত্রিশ মিনিট হয়ে গেল ওটার কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না।

ইন্টেলিজেন্স ওভারসাইট বোর্ডের সভাপতি ছিলেন ডক্টর পার্কার, তিনি শুধু আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কাছে সরাসরি রিপোর্ট করে থাকেন। ব্যক্তিগতভাবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন ডক্টর পার্কার দুজন তারা এক স্কুল এবং একই কলেজ থেকে পড়াশোনা করেছেন।

ডক্টর পার্কার একজন শিল্পী, প্রতিভাবান সঙ্গীতজ্ঞ। দর্শন আর রাজনীতির ওপর সাড়া জাগানো চারটে বই আছে তাঁর। দাবায় তিনি গ্র্যান্ড মাস্টার। নানা বিষয়ে সুগভীর জ্ঞানের অধিকারী ভদ্রলোক, ভাবাবেগকে প্রশ্রয় না দিয়ে ক্ষুরধার বুদ্ধির সাহায্যে সমস্যা সমাধানে অভ্যস্ত, মানুষের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। অথচ তবু তাকে একজন রহস্যময় ব্যক্তি না বলে উপায় নেই, কারণ উৎসুক প্রচার মাধ্যমগুলোকে সব সময় এড়িয়ে থাকেন তিনি, গোপন করে রাখেন নিজের উচ্চাশা। অবশ্য তাঁর কোনো উচ্চাশা আছে কিনা বলা কঠিন। তাঁর মতো একজন মানুষের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হবার স্বপ্ন দেখা অসঙ্গত বা অসম্ভব নয়। প্রচার-বিমুখ এই জ্ঞানসাধক চুপচাপ শুধু দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন, কাঁধে যত বোঝাই চাপানো হোক প্রতিবাদ করতে জানেন না।

থোর কমান্ডের কমান্ডার হিসেবে পিটারের নাম প্রস্তাব করা হয় মাস কয়েক আগে, তারপর পাঁচ-ছয় মাস আগে ডক্টর পার্কারের সাথে দেখা হয়েছে ওর। ডক্টর পার্কারের নিউ ইয়র্কের বাড়িতে একবার পুরো একটা রোববার কাটিয়েছে পিটার। ভদ্রলোককে যতই দেখেছে পিটার, ততই শ্রদ্ধা জেগেছে মনে। কোনো সন্দেহ নেই অ্যাটলাসের প্রেসিডেন্ট হবার উপযুক্ততা একমাত্র তাঁরই আছে। ট্রেনিং পাওয়া একদল সৈনিকের ওপর একজন দার্শনিকের প্রভাব খুব কাজ দেবে। তার মতো একজন সফল কূটনীতিকের পক্ষে সরকার প্রধানদের সাথে যোগাযোগ রাখা খুব সহজ হবে। এবং সঙ্কটের সময় যখন শত শত নিরীহ মানুষের জীবন ধ্বংসের মুখোমুখি, রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার সৎসাহস এবং দৃঢ়তা শুধু তার কাছ থেকেই আশা করা যায়।

অল্প কথায় পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে পিটারকে তিনি বললেন, মনে হচ্ছে এটা একটা পারফেক্ট টার্গেট। দুনিয়ার নামকরা প্রায় সব কজন সার্জেন রয়েছে প্লেনটায়, আঠারো মাস আগেই কনভেনশনের জায়গা আর দিন-তারিখ সবার জানা ছিল। ডাক্তারদের একটা চমৎকার ভাবমূর্তি আছে, পাবলিক সেন্টিমেন্টে ঘা দেয়ার জন্যে সেটা ভালো কাজ দেবে। আমেরিকান, ব্রিটিশ, রাশিয়ান, ফ্রেঞ্চ, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান, জার্মান, ইটালিয়ান,সব দেশেরই লোক রয়েছে ওদের মধ্যে। চার-পাঁচটা দেশের আবার দুর্নাম রয়েছে, সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার বিরুদ্ধে তারা মোটেও কঠোর নয়। প্লেনটা ব্রিটিশ কিন্তু হাইজ্যাকাররা সম্ভবত এমন এক জায়গায় নিয়ে যাবে সেটাকে, গোটা ব্যাপারটা আরো জটিল হয়ে উঠবে-পলিটিক্যালি। দেখা যাবে, আমরা হয়তো পাল্টা আঘাত হানার কোনো সুযোগই পাব না।

তার কপালে উদ্বেগের একটা রেখা ফুটে উঠল, খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললেন, মারকারি কমান্ডের জন্যেও আমি কন্ডিশন আলফা ঘোষণা করেছি। ব্যাপারটা যদি হাইজ্যাক হয়, প্লেনটার শেষ অবস্থান জানার পর আমার মনে হচ্ছে হাইজ্যাকারদের গন্তব্য পূর্ব দিকে হওয়াও বিচিত্র নয়।

আলফার তিনটে হাতিয়ার বা বাহু রয়েছে, প্রত্যেকটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। হোর কমান্ড শুধু ইউরোপ আর আফ্রিকায় কাজ করতে পারবে। মারকারি কমান্ডের হেডকোয়ার্টার ইন্দোনেশিয়ায়, এশিয়া আর অস্ট্রেলিয়া কাভার করছে। ডায়ানারের হেডকোয়ার্টার ওয়াশিংটনে, উত্তর আর দক্ষিণ আমেরিকায় তৎপর।

আরেক রিলেতে মারকারির ট্যানার আমার সাথে কথা বলতে চাইছে। কয়েক সেকেন্ড পর আবার ফিরে আসবে, পিটার।

ঠিক আছে, ডক্টর পার্কার।

স্ক্রীন কালো হয়ে গেল, পিটারের পাশের চেয়ারে দামি ডাচ চুরুট ধরাল কলিন নোবলস্। নিজের ডেস্কের কিনারায় হাঁটু ঠেকিয়ে চেয়ারে হেলান দিল সে, হাতঘড়ি দেখল।

এটাও যদি ফলস অ্যালার্ম হয়, সংখ্যাটা হবে তেরো। মুখের সামনে হাত রেখে হাই তুলল একটা। শুধু অপেক্ষায় থাকা ছাড়া এই মুহূর্তে কারও কিছু করার নেই। এবং বারবার অপেক্ষা করতে করতে গোটা ব্যাপারটা একঘেয়ে হয়ে উঠেছে ওদের কাছে। একঘেয়ে হলেও, প্রস্তুতি নিতে অবহেলা করেনি ওরা। বিশাল হারকিউলিস ট্রান্সপোর্টে প্রতিটি অস্ত্র এবং ইকুইপমেন্ট তাৎক্ষণিক ব্যবহারের জন্যে তৈরি রাখা হয়েছে। উঁচু মানের ট্রেনিং পাওয়া ত্রিশজন সৈনিককে ভোলা হয়েছে। প্লেনে। দুটো প্লেনেরই ফ্লাইট ক্রুরা যার যার স্টেশনে অপেক্ষা করছে। স্যাটেলাইটের সাথে যোগাযোগ রাখছে কমিউনিকেশন টেকনিশিয়ানরা, প্রয়োজনে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ওয়াশিংটন আর লন্ডনের ইন্টেলিজেন্স কমপিউটারের সাহায্য চাইবে ওরা। বাকি শুধু অপেক্ষার অবসান। একজন সৈনিক জানে তার জীবনের বেশিরভাগ সময় শুধু অপেক্ষাতেই কেটে যায়। কিন্তু অপেক্ষা করতে হলেই ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় পিটারের। কলিনের সঙ্গ পেয়ে আজ তবু ব্যাপারটা সহনীয় লাগছে।

খানিক পর আবার স্ক্রীনে ফিরে এলেন ডক্টর পার্কার। জানালেন জিরো-সেভেন জিরোর সর্বশেষ পজিশনে একটা সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ প্লেন পাঠানো হয়েছিল, কিছুই জানতে পারেনি ক্রুরা। বিগ বার্ড নামে একটা রিকনিস্যান্স স্যাটেলাইট ওই একই পজিশনের ফটো তুলেছে, কিন্তু পরীক্ষা করার জন্যে ফিলা পাওয়া যাবে চৌদ্দ ঘণ্টা পর। এক ঘণ্টা ছয় মিনিট হলো জিরো-সেভেন-জিরো অপারেশনস নরমাল রিপোর্ট পাঠাচ্ছে না।

স্ক্রীন থেকে উধাও হলেন ডক্টর পার্কার, একটা সিগারেট ধরাল পিটার। হঠাৎ করেই মেলিসা জেইনের কথা মনে পড়ল তার। কটেজে ফোন করে দেখল কেউ ধরে না। তাহলে মনে হয় ড্রাইভার তাকে ইতোমধ্যেই তুলে নিয়েছে। কাজেই স্ত্রী, সিনথিয়ার নাম্বারে ডায়াল করল পিটার।

 গোল্লায় যাও তুমি, পিটার। এটা কোনো আচরণ করলে মেয়ের সাথে! ঘুমজড়িত কণ্ঠে বলল সিনথিয়া। বেচারি কতদিন ধরে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিল।

জানি। কিন্তু কি করব।

এদিকে জর্জ আর আমি ভেবেছিলাম জর্জ, অর্থাৎ, সিনথিয়ার নতুন স্বামী ছিল একজন বিরাট রাজনৈতিক নেতা। অবশ্য, পিটার ওকে অপছন্দ করে না। ভদ্রলোক মেলিসার সাথে বেশ ভালো ব্যবহার করে।

 চাকরির কারণে এই ত্যাগ, আর কিছু না, হালকা স্বরে বলে পিটার।

অনেকবার শুনেছি এই কথা, আর শুনতে ভালো লাগে না। এই শুরু হলো পিটার ভাবে। এই কারণেই ওদের বিয়েটা টিকেনি।

দেখ সিনথিয়া-মেলিসা তোমার ওখানেই আসছে

স্ক্রীনে ডক্টর পার্কারের ছবি ফুটে উঠল। সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল পিটার। পরে কথা বলব, বলে ফোনের লাইন কেটে দিল সে।

দক্ষিণ আফ্রিকার রাডারে অজ্ঞাত পরিচয় একটা প্লেন দেখা গেছে, ওদের এয়ারস্পেসের দিকে এগোচ্ছে, পিটারকে বললেন ডক্টর পার্কার। স্পীড আর পজিশন দেখে মনে হয় জিরো-সেভেন-জিরো হতে পারে। বাধা দেয়ার জন্যে একঝাক মিরেজ আকাশে তুলেছে ওরা। আমি ইতোমধ্যে ধরে নিচ্ছি প্লেন নিখোঁজ হওয়ার পিছনে সন্ত্রাসবাদীদের হাত আছে–কাজেই এই মুহূর্তে কন্ডিশন ব্রাভো ঘোষণা করছি, ইফ ইউ প্লিজ, পিটার।

রওনা হলাম আমরা, ডক্টর পার্কার।

ডেস্কের কিনারা থেকে হাঁটু নামিয়ে সটান দাঁড়িয়ে পড়ল কলিন নোবলস, দু সারি দাঁতের ফাঁকে এখনো আটকে রয়েছে চুরুটটা।

.

টার্গেট সচল এবং দৃশ্যমান-লিডিং মিরেজ এফ. আই. ইন্টারসেপটরের পাইলট বোতাম টিপে তার ফ্লাইট কমপিউটার চালু করল, সাথে সাথে জ্বলে উঠল লাল অক্ষরগুলো, অ্যাটাক। মিরেজের সবগুলো অস্ত্র-মিসাইল আর কামান-লোড করা অবস্থায় রয়েছে। কমপিউটার ইন্টারসেপটের সময় নির্ধারণ করে দিল-তেত্রিশ সেকেন্ড। দুশ দশ ডিগ্রী কোর্স ধরে এগোচ্ছে টার্গেট, গ্রাউন্ড স্পীড চারশ তিরাশি নট।

পাইলটের সামনে ভোরের প্রথম আলো নাটকীয় প্রদর্শনীর আদলে দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। গোটা আকাশ জুড়ে ঝুলে আছে রুপালি আর গোলাপি মেঘ, দিগন্তরেখার নিচে অদৃশ্য সূর্য তার সোনালি আলোর বিশালকায় ফলা হিমবাহ আকৃতির মেঘমালার ভেতর দিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে দূরদূরান্তে। সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ায় কাঁধের সাথে আটকানো স্ট্র্যাপে টান পড়ল, দস্তানা পরা হাত দিয়ে হেলমেটের পোলারয়েড ভাইজর তুলে নিল পাইলট। চোখ কুঁচকে তাকাল সে, আবার একবার দেখে নিল টার্গেটকে।

 তার অভিজ্ঞ বন্দুকবাজ চোখে কালো একটা বিন্দুর মতো ধরা পড়ল প্লেনটা। মেঘ আর রোদের মাঝখানে আবছা ধূসর পর্দার গায়ে খুদে একটা পোকা। নিজের অজান্তেই প্লেনের কন্ট্রোল প্যানেলে হাত চলে গেল তার–সরাসরি টার্গেটের দিকে এগোতে চায় না।

প্রতি ঘণ্টায় পনেরোশো মাইল ছুটছে মিরেজ, সামনের কালো বিন্দুটা আশঙ্কাজনক দ্রুতগতিতে বড় হচ্ছে আকারে। খানিক পর টার্গেটের পরিচয় সম্পর্কে আর কোনো সন্দেহ থাকল না। ছড়ানো পাঁচ আঙুলের আকৃতি নিয়ে উড়ছিল ঝাকটা, লীডারের দেখাদেখি বাকি চারটে প্লেনও ঘুড়ির মতো গোত্তা দিয়ে নিচে নামতে শুরু করল। টার্গেট প্লেনের পাঁচ হাজার ফিট ওপরে সিধে হলো মিরেজগুলো।

 চিতা, দিস ইজ ডায়মন্ড লিডার-উই আর ভিজুয়াল, অ্যান্ড টার্গেট ইজ এ বোয়িং সেভেন-ফোর-ফোর-সেভেন বেয়ারিং বিটিশ এয়ারওয়েজ মার্কিংস।

ডায়মন্ড লিডার, দিস ইজ চিতা, পাঁচ হাজার ফুট দুরুত্বে থেকে অনুসরণ করুন। রিপোর্ট এগেইন ইন সিক্সটি সেকেন্ডস।

.

মেজর জেনারেল পিটার স্ট্রাইডের একজিকিউটিভ জেট তীরবেগে ছুটে চলেছে দক্ষিণ দিকে, একই দিকে শ্লথগতিতে এগোচ্ছে পেটমোটা ট্রান্সপোর্টটা। প্রতি মুহূর্তে দুটো প্লেনের মাঝখানে দূরত্ব বাড়ছে–জেটটা যখন তার চূড়ান্ত গন্তব্যে। পৌঁছুবে, সম্ভবত এক হাজার মাইল পিছিয়ে থাকবে দ্বিতীয়টা। তবে স্পীড কম হলেও হারকিউলিসের বৈশিষ্ট্য অন্যখানে–পৃথিবীর যে কোনো দুর্গম প্রান্তে, এবড়োখেবড়ো। ছোট্ট স্ট্রিপে লোকজন আর ভারী ইকুইপমেন্ট নিয়ে ল্যান্ড করতে পারে ওটা। হকারের কাজ হলো সন্ত্রাসবাদীরা যেখানে তৎপর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পিটারকে সেখানে পৌঁছে দেয়া। আর আগেভাগে পৌঁছে পিটারের কাজ হলো কৌশলে সন্ত্রাসবাদীদের কাছ থেকে সময় আদায় করা, যতক্ষণ অ্যাসল্ট টীম নিয়ে কলিন নোবলস্ না পৌঁছায়।

 তবে যোগাযোগ রয়েছে দুজনের মধ্যে, পিটারের সামনে সেন্ট্রাল টেলিভিশনের ছোট স্ক্রীনটা সারাক্ষণ আলোকিত, হারকিউলিসের মেইন হোন্ডের ছবি দেখা যাচ্ছে। তাতে কাছ থেকে চোখ তুললেই নিজের লোকদের দেখতে পাবে পিটার, সবার পরনে থোর ওভারঅল। হাত-পা ছেড়ে দিয়ে শিথিল ভঙ্গিতে বসে আছে সবাই, কারও মধ্যেই আড়ষ্ট কোনো ভাব নেই। এরাও সবাই অপেক্ষার কঠিন পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে এসেছে বহুবার। সামনের দিকে ছোট একটা ডেস্কের পেছনে বসে রয়েছে কলিন নোবলস, কন্ডিশন চার্লি ঘোষণা করা হলে কি কি কাজ তাৎক্ষণিকভাবে সারতে হবে তার একটা দীর্ঘ তালিকা পরীক্ষা করছে সে। কন্ডিশন ব্রাভোর পর কন্ডিশন চার্লির জন্যে অপেক্ষা করছে ওরা, সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেলে ঘোষণাটা আসবে।

ক্লিক ক্লিক একজোড়া আওয়াজের সাথে সামান্য যান্ত্রিক শব্দ-গুঞ্জন শোনা গেল, পিটারের কমিউনিকেশন কনসোলের সেন্ট্রাল স্ক্রীনটা জ্যান্ত হয়ে উঠল, ডক্টর পার্কারের ছবি পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠার আগেই ভেসে এল তার ভারী, গমগমে কণ্ঠস্বর।

কন্ডিশন চার্লি, পিটার, বললেন তিনি। সম্পূর্ণ শান্ত দেখল তাকে পিটার, শিরায় শিরায় দ্রুতগতি পেল রক্তস্রোত, রোমাঞ্চকর শিহরণ বয়ে গেল সারা শরীরে। একজন সৈনিকের জন্যে ব্যাপারটা আনন্দের, এই মুহূর্তটির আশায় বছরের পর বছর অপেক্ষা করে থাকে তারা।

দক্ষিণ আফ্রিকানরা আইডেনটিফাই করেছে জিরো-সেভেন-জিরোকে, বলে চলেছেন ডক্টর পার্কার। প্লেনটা পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড হলো তাদের আকাশসীমায় ঢুকছে।

 রেডিও কন্ট্যাক্ট? জিজ্ঞেস করল পিটার।

না। বড়সড় মাথাটা নাড়লেন ডক্টর পার্কার। ডাকাডাকি করেও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ধরে নিতে হবে টেরোরিস্টদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে প্লেনটা-কাজেই এখন থেকে এই ডেস্কেই থাকছি আমি যতক্ষণ না একটা বিহিত করা যায়।

কি ধরনের সহযোগিতা আশা করতে পারি আমরা? জিজ্ঞেস করল পিটার।

ইতোমধ্যে বেশ কটা আফ্রিকান রাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ করেছি, সম্ভাব্য সব রকম সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছে তারা–ওভার-ফ্লাইট, ল্যান্ডিং, রিফুয়েলিং ফ্যাসিলিটি, কোনো সমস্যা হবে না। দক্ষিণ আফ্রিকাও সহযোগিতা করবে। ওদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর সাথে কথা বলেছি আমি।

বলেছি জিরো-সেভেন-জিরোকে যেন ওদের কোনো এয়াপোর্টে নামতে দেয়া না হয়, বললেন ডক্টর পার্কার। দক্ষিণ আফ্রিকায় ল্যান্ডিং ক্লিয়ার্যান্স না পেলে উত্তর দিকে অন্য কোনো দেশে সরে যাবে আতঙ্কবাদীরা, ওদের আসল প্ল্যানও হয়তো তাই। দক্ষিণ আফ্রিকা সম্পর্কে আমার ধারণা কি তুমি জানো, সবকিছুতে গোয়ার্তুমি করা স্বভাব ওদের-তবে এই ব্যাপারটায় ওরা বেশ ভালোই সহযোগিতা করছে।

দেরাজ থেকে কালো একটা ব্রায়ার পাইপ বের করলেন ডক্টর পার্কার, টোবাকো দিয়ে ভরলেন সেটা। শরীরের অন্যান্য অংশের মতে, তার হাত দুটোও মোটাসোটা, তবে আঙুলগুলো অস্বাভাবিক লম্বা আর চঞ্চল। তামাকের গন্ধটা কি রকম মিষ্টি মনে পড়ে গেল পিটারের।

 দুজনেই চুপ করে আছে, গভীর চিন্তায় মগ্ন। ডক্টর পার্কারের জোড়া সামান্য একটু কুঁচকে আছে একমনে পাইপ টানছেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার তিনি মুখ তুললেন। ঠিক আছে, পিটার–এবার শোনা যাক, তুমি কি ভাবছ?

সদ্য লেখা পয়েন্টগুলোর ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিল পিটার। টেরোরিস্টদের কাছ থেকে সম্ভাব্য চার রকম আচরণ আশা করছি আমরা, ডক্টর পার্কার। যে আচরণই করুক, কিভাবে ওদের আমরা কাবু করব তারও চারটে ছক তৈরি করেছি। আঘাতটা জার্মান নাকি ইটালিয়ান স্টাইলে করবে…।

আধবোজা চোখে শুনে যাচ্ছেন ডক্টর পার্কার, প্ল্যান-প্রোগ্রামের ওপর তার আস্থা প্রবল। আতঙ্কবাদীরা যদি ইটালিয়ান স্টাইলে আঘাত হানে, সেটা মোকাবিলা করা অপেক্ষাকৃত সহজ-সরাসরি নগদ টাকা চাইবে ওরা। আর জার্মান পদ্ধতি হলো, বন্দিমুক্তির দাবি জানাবে ওরা, রাজনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যার সমাধান চাইবে। নিজেদের মধ্যে প্রায় এক ঘণ্টা আলোচনা করল ওরা, তারপর বাধা পেল।

গুড গড! শুধু অতিমাত্রায় বিস্মিত হলে এ ধরনের ভাষা ব্যবহার করেন কিংস্টোন পার্কার। এখানে দেখছি আরেক দিক মোড় নিচ্ছে ঘটনা…

.

পূর্ব দিকের আকাশপথ বেছে নিল জিরো-সেভেন-জিরো, স্পীড কমল, অনেক নিচেও নেমে এল আগের চেয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকান এয়ারফোর্স কমান্ড হঠাৎ করেই উপলব্ধি করল কি ঘটতে চলেছে।

জরুরি নির্দেশে সমস্ত এভিয়েশন ফ্রিকোয়েন্সি নিস্তব্ধ করে দেয়া হলো, উপর্যুপরি হাতুড়ির বাড়ির মতো বারবার একই আদেশ করা হলো জিরো-সেভেন জিরোকে, জাতীয় আকাশ সীমা ছেড়ে বেরিয়ে যাও। কোনো সাড়া তো পাওয়া গেলই না, বরং জান সুট ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে দেড়শ নটিক্যাল মাইল দূরে বোয়িংটার স্পীড আরো কমল, আরো নিচে নেমে নিয়ন্ত্রিত আকাশ সীমার ভেতর চলে এল।

ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ জিরো-সেভেন-জিরো দিস ইজ জান স্মাট কন্ট্রোল, ইউ আর এক্সপ্রেসলি রিফিউজড় ক্লিয়ারান্স টু জয়েন দি সার্কিট। ডু ইউ রিড মি, জিরো সেভেন জিরো?

ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ জিরো-সেভেন-জিরো দিস ইজ এয়ারফোর্স কমান্ড। ইউ আর ওয়ানড় দ্যাট ইউ আর ইন ভায়োলেশন অভ ন্যাশনাল এয়ারস্পেস। ইউ আর অর্ডারড টু ক্লাইম্ব ইমিডিয়েটলি টু থারটি থাউজেন্ড ফিট অ্যান্ড টার্ন অন কোর্স ফর নাইরোবি।

বোয়িং ইতোমধ্যে একশ নাটিক্যাল মাইলের মধ্যে চলে এসেছে, পনেরো হাজার ফিট থেকে আরো নেমে আসছে নিচের দিকে।

ডায়মন্ড লিডার, দিস ইজ চিতা। টেক দি টার্গেট আন্ডার কমান্ড অ্যান্ড এনফোর্স ডিপারচার ক্লিয়ারান্স।

দেখার বিষয়, জোর করে জিরো-সেভেন-জিরাকে বিদায় করা যায় কিনা।

সবুজ আর খয়েরি রঙের লম্বা চকচকে মিরেজের দ্রুতগতি পতন শুরু হলো। কয়েক হাজার ফিট নেমে এসে বোয়িংয়ের লাল, সাদা, আর নীল নাকের সামনে সিধে হলো পাইলট, মাঝখানে দূরত্ব মাত্র একশ ফিট। পাইলট তার মিরেজের ডানা কাত করল, নির্দেশ দিচ্ছে-আমাকে অনুসরণ কর।

সেই একই কোর্সে, একই গতিতে এগোচ্ছে বোয়িং, পাইলট যেন কিছু দেখেনি বা বোঝেনি। থ্রটল একটু পিছিয়ে আনল মিরেজের পাইলট, মাঝখানের ব্যবধান কমে গিয়ে পঞ্চাশ ফিটে দাঁড়াল। আবার কাত হলো মিরেজের ডানা, রেট-ওয়ান টার্ন নিয়ে উত্তর দিকে এগোল পাইলট।

নিজের পথেই থাকল বোয়িং, জোহানেসবার্গের দিকে এগোচ্ছে।

দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে মাঝখানের ব্যবধান আরো কমিয়ে আনল মিরেজের পাইলট। বোয়িংয়ের সরাসরি পিছনে না থেকে একপাশে সরে এল একটু, পিছিয়ে এসে জিরো-সেভেন-জিরোর ককপিটের পাশে চলে এল। ঘাড় ফিরিয়ে পঁয়তাল্লিশ ফিট দূরে তাকাল সে। চিতা, দিস ইজ ডায়মন্ড লিডার ওয়ান। টার্গেটের ফ্লাইট ডেকের ভেতরটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। ককপিটে অতিরিক্ত একজন রয়েছে। একটা মেয়ে। মনে হচ্ছে তার হাতে একটা মেশিন পিস্তল।

ইন্টারসেপ্টর প্লেনটাকে দেখার জন্যে ঘাড় ফেরাল দুজন পাইলট, হাড়ের মতো সাদা হয়ে গেছে চেহারা। বাঁ দিকের সীটটার পিছন থেকে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল মেয়েটা, কুৎসিত দর্শন কালো অস্ত্রটা স্যালুটের ভঙ্গিতে কপালের কাছে। তুলল। মিরেজ পাইলটের চোখে রেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল সে, এত কাছ থেকে যে, তার ঝকঝকে সাদা দাঁত পরিষ্কার দেখতে পেল পাইলট।

 যুবতী একটা মেয়ে, সোনালি চুল, রিপোর্ট করল মিরেজ পাইলট। সুন্দরীখুবই সুন্দরী।

ডায়মন্ড ওয়ান, দিস ইজ চিতা। পজিশন ফর হেড-অন অ্যাটাক।

সাথে সাথে সগর্জনে সামনের দিকে ছুটল মিরেজ, চোখের পলকে উঠে গেল ওপর দিকে, বিশাল অর্ধবৃত্ত রচনা করে পাঁচ আঙুলের আকৃতি, নিল, গোটা ঝাঁক।

চিতা, উই আর ইন পজিশন ফর এ হেড-অন অ্যাটাক।

ডায়মন্ড লিডার ফ্লাইট। আক্রমণের ভান করুন। আবার বলছি, ভান করুন। সত্যি আক্রমণ নয়।।

ডায়মন্ড লিডার আন্ডারস্ট্যান্ডস সিমিউলেটেড অ্যাটাক।

মিরেজ এফ. আই. নাক ঘুরিয়ে নিয়ে ডাইভ দিল, স্কেলের কাঁটা নড়ে ওঠার সাথে সাথে বিদ্যুৎগতিতে ছুটল, সোনিক ব্যারিয়ার ভেঙে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠল তার মতিগতি।

সাত মাইল দূরে থাকতেই ওটাকে দেখতে পেল সিরিল ওয়াটকিংস। জেসাস, চেঁচিয়ে বলল সে। দিস ইজ রিয়েল! ঝট করে সামনের দিকে ঝুঁকল সে, বোয়িংয়ের ম্যানুয়েল কন্ট্রোল নিজের হাতে নেবে। এতক্ষণ ইলেকট্রনিক ফ্লাইট ডিরেক্টর প্লেন চালাচ্ছিল।

না, যেমন আছে তেমনি থাক! এই প্রথম গলা চড়াল ইনগ্রিড। হোল্ড ইট! হাঁ করা জোড়া মাজল সহ শট পিস্তলটা ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের দিকে তাক করল সে। এখন আমাদের কোনো নেভিগেটরের দরকার নেই।

 স্থির পাথর হয়ে গেল পাইলট, তীরবেগে সোজা ছুটে আসছে মিরেজ। প্রতি মুহূর্তে আকারে বড় হচ্ছে ওটা। এক সময় মনে হলো গোটা উইন্ডস্ক্রীন ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। সম্ভাব্য শেষ মুহূর্তে নাকটা সামান্য একটু উঁচু হলো, মাথার ওপর দিয়ে সৎ করে বেরিয়ে গেল মিরেজ, মনে হলো দুটো প্লেনের মাঝখানে বড়জোর এক ফিট ব্যবধান ছিল। মুখোমুখি সংঘর্ষ হলো না বটে, কিন্তু সুপারসোনিক আলোড়ন এত বড় বোয়িংটাকেও তীব্র একটা ঝাঁকি দিয়ে গেল।

আরো একটা আসছে! আর্তনাদ করে উঠল পাইলট।

আমিও এখানে আছি, হুমকির সুরে বলল ইনগ্রিড, ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের ঘাড়ে এত জোরে মাজল চেপে ধরেছে সে যে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে বেচারা, কপালটা ঠেকে রয়েছে কমপিউটার কনসোলের কিনারায়। কলারের ওপর নগ্ন ঘাড়ের মান চামড়া ছিলে গেছে, সরু একটা রক্তের ধারা শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যাচ্ছে পিঠের দিকে।

 মিরেজগুলো একটার পর একটা আক্রমণ চালাল, সুপারসোনিক আলোড়ন বারবার ঝাঁকি দিয়ে গেল জিরো-সেভেন-জিরোকে। গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে খালি হাতে একটা র‍্যাকের কিনারা ধরে নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করছে ইনগ্রিড, কিন্তু মুহূর্তের জন্যেও ইঞ্জিনিয়ারের ঘাড় থেকে জোড়া মাজ সরাল না। আমার কথার নড়চড় হবে না, বারবার বলল সে। ওকে আমি খুন করব, সত্যি খুন করব। সবাই ওরা আরোহীদের চিৎকার শুনতে পাচ্ছে, কেবিন আর ককপিটের মাঝখানে বাল্কহেড থাকায় ভোতা আর অস্পষ্ট শোনাল কান্নাগুলো।

এক সময় শেষ মিরেজটাও মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল।

চেষ্টা করে দেখল আর কি, ঠোঁট বাঁকা করে বিদ্রুপের হাসি হাসল ইনগ্রিড, পিছিয়ে ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের কাছ থেকে এক পা সরে গেল সে। আর আসবে না। ইঞ্জিনিয়ার বেচারা মাথাটা কাত করে শার্টের আস্তিন দিয়ে ঘাড়ের রক্ত মুছল। আসবে না, কারণ এখন আমরা ওদের নিয়ন্ত্রিত এয়ারস্পেসের অনেক ভেতরে ঢুকে পড়েছি। হাত লম্বা করে দিয়ে সামনের দিকটা দেখাল সে। দেখ!

মাটি থেকে মাত্র পাঁচ হাজার ফিট ওপরে রয়েছে জিরো-সেভেন-জিরো, কিন্তু হালকা কুয়াশা থাকায় দিগন্তরেখা তেমন স্পষ্ট নয়। ডানদিকে আবছাভাবে একটা টাওয়ার দেখা গেল–ওটা কেম্পটন পার্ক পাওয়ার স্টেশন, কুলিং টাওয়ার। আরো কাছাকাছি বিষাক্ত হলুদ প্রান্ত-সমতল আর নিষ্প্রাণ। খনির সমস্ত আবর্জনা এই প্রান্তরে নিয়ে এসে ফেলা হয়। এই বিশাল এলাকাটাকে বাদ দিয়ে চারধারে ঘন লোকবসতি গড়ে উঠেছে। হাজার হাজার জানালার কাঁচ সকালের রোদ লেগে ঝলসে উঠল।

আরো কাছে লম্বা, সরল, নীলচে বিস্তৃতি দেখা গেল-জান স্মট এয়াপোর্টের মেইন রানওয়ে।

সোজা একুশ নম্বর রানওয়েতে চলুন, নির্দেশ দিল ইনগ্রিড।

অসম্ভব…।

কথা নয়, ধমক দিল মেয়েটা। এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল নিশ্চয়ই পরিষ্কার করে রেখেছে সার্কিট। ওরা আমাদের থামাতে পারবে না জানে।

থামাতে পারবে এবং থামাতে যাচ্ছে, জবাব দিল ওয়াটকিংস। রানওয়ে অ্যাপ্রনের দিকে তাকান একবার।

এত কাছে চলে এসেছে ওরা, এক এক করে পাঁচটা ফুয়েল টেন্ডার গোণা গেল, প্রতিটি ট্যাংকে শেল কোম্পানীর প্রতীক চিহ্ন আঁকা রয়েছে।

রানওয়েতে ব্যারিকেড তৈরি করছে ওরা!

শুধু ট্যাংকার নয়, সাথে উজ্জ্বল লাল ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটা আর ধবধবে সাদা দুটো অ্যাম্বুলেন্সও রয়েছে। রানওয়ের কিনারা ধরে ছুটে আসছিল ওগুলো, তারপর মাঝখানের সাদা রেখায় কয়েকশ গজ পর পর দাঁড়িয়ে পড়ল একেকটা গাড়ি।

ল্যান্ড করা সম্ভব নয়, জানিয়ে দিল পাইলট।

অটোমেটিক বাদ দিয়ে হাতে চালান প্লেন, কঠিন আর নিষ্ঠুর হয়ে উঠল ইনগ্রিডের কণ্ঠস্বর। আমার নির্দেশ বদলায়নি। ল্যান্ড করার প্রস্তুতি নিন।

এক হাজার ফিটে নেমে এসেছে বোয়িং, আরো নামছে। একুশ নম্বর রানওয়ের দিকে ছুটছে ওরা। নাক বরাবর সোজা লাল আলোগুলো ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির মাথায় ঘুরছে।

 আমাকে মাফ করতে হবে, দৃঢ় কণ্ঠে বলল ওয়াটকিংস। নামতে চেষ্টা করলে সবাই আমরা যারা পড়ব। তার চেহারায় কোনো ভয় বা দ্বিধা নেই। ওগুলোর ওপর দিয়ে উড়ে এখান থেকে চলে যাব আমি।

 ঘাসের ওপর নামুন! মরিয়া হয়ে উঠল ইনগ্রিড। রানওয়ের ডান দিকে খোলা মাঠ, ওখানে নামব আমরা।

সিরিল যেন শুনতেই পায়নি, সামনের দিকে ঝুঁকে ঠেলে সামনে বাড়িতে দিল থ্রটল। আকস্মিক শক্তি পেয়ে গর্জে উঠল ইঞ্জিনগুলো, নাক উঁচু করে তীরবেগে ওপরে উঠতে শুরু করল জিরো-সেভেন-জিরো।

উইন্ডস্ক্রীন দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার, সারা শরীর উত্তেজনায় আড়ষ্ট। নগ্ন ঘাড়ের ওপর জোড়া মাজলের লালচে দাগ এখনো অম্লান। ডান হাত দিয়ে ডেস্কের কিনারা খামচে ধরল সে, আঙুলের ডগাগুলো সাদা হয়ে গেল।

 আড়ষ্ট সেই হাতটার কবজিতে পিস্তলের মাজল চেপে ধরল ইনগ্রিড। কখন সে নড়ল টের পায়নি কেউ। বন্ধ ককপিটের ভেতর প্রচণ্ড বিস্ফোরণের আওয়াজ হলো, মনে হলো কানের পর্দা ছিঁড়ে গেছে। লাফ দিয়ে ইনগ্রিডের মাথার প্রায় কাছাকাছি উঠে এল পিস্তলটা, পোড়া বারুদের গন্ধ ঢুকল নাকে।

 চোখ ভরা অবিশ্বাস নিয়ে ডেস্কের ওপর তাকিয়ে থাকল ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার।

ডেস্কের ধাতব মাথা ভেদ করে গর্ত তৈরি হয়েছে, চায়ের একটা কাপ গলে যাবে, গর্তের কিনারা এবড়োখেবড়ো আর সাদা জরির মতো চকমকে।

বিস্ফোরণে ইঞ্জিনিয়ারের কবজি নিখুঁতভাবে দু-টুকরো হয়ে গেছে, বিচ্ছিন্ন অংশটা সামনের দিকে ছিটকে গিয়ে পাইলটদের জোড়া সীটের মাঝখানে পড়েছে, থ্যাতলানো মাংসের ভেতর থেকে বেরিয়ে রয়েছে ভাঙাচোরা হাড়। পদদলিত, জ্যান্ত, বোবা পোকার মতো মোচড় খাচ্ছে সেটা।

ল্যান্ড! হিসহিস করে বলল মেয়েটা। তা না হলে পরের গুলিটা ওর মাথায় ঢুকবে।

ইউ ব্লাডি মনস্টার! আর্তনাদ করে উঠল সিরিল ওয়াটকিংস, আতঙ্কিত দৃষ্টিতে ইঞ্জিনিয়ারের বিচ্ছিন্ন হাতের দিকে তাকিয়ে আছে।

লোকটা যদি মারা যায় সম্পূর্ণ আপনার দোষে মারা যাবে।

আঙুল আর তালুহীন হাতটা যেন আপনা থেকে সেঁটে এল গায়ের সাথে ক্ষতটা পেটে ঠেকিয়ে সামনের দিকে যতটা সম্ভব ঝুঁকল ইঞ্জিনিয়ার, উরু আর পেটের মাঝখানে চাপা পড়ে গেল হাতটা। গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরুল না, দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখা দম ছাড়ার সময় কেঁপে কেঁপে উঠল সারা শরীর, কালচে আর বিকৃত হয়ে উঠেছে মুখ।

 বিচ্ছিন্ন হাতটা থেকে দৃষ্টি যেন ছিঁড়ে সরিয়ে আনল ক্যাপটেন ওয়াটকিংস, আবার সামনের দিকে তাকাল। সরু ট্যাক্সিওয়ে আর রানওয়ে মার্কারের মাঝখানে ঘাস মোড়া বিশাল খোলা মাঠ। হাঁটু সমান উঁচু হবে ঘাসগুলো, তবে আন্দাজ করা যায় ঘাসের নিচে মাটি কমবেশি সমতলই হবে।

 শান্তভাবে থ্রটল পিছিয়ে আনল ক্যাপটেন, ইঞ্জিনের গর্জন কমে এল, নিচু হলো প্লেনের নাক। মেইন রানওয়ের দিকে এগোচ্ছে বোয়িং, গাড়ির ড্রাইভারদের এখুনি বুঝতে দিতে চায় না তার উদ্দেশ্য। ডাইনী, নিঃশ্বাসের সাথে বিড়বিড় করে বলছে সে। উন্মত্ত কুত্তি!

একেবারে সম্ভাব্য শেষ মুহূর্তে সামান্য দিক বদল করল সে, খোলা মাঠের দিকে তাক করল প্লেনের নাক। একটু পর পিছিয়ে নিয়ে এসে লক করে দিল থ্রটল। ঝাপ্ করে নেমে এল বোয়িং। গতি এর চেয়ে কমে গেলে শূন্যে থেমে যাবে। ঈশ্বরের নাম জপতে জপতে ঘাসের দিকে নামাতে শুরু করল জিরো-সেভেন জিরোকে।

প্রথম ঝাঁকিটা তেমন জোরাল হলো না, কিন্তু তারপরই বিরতিহীন লাফ দিতে দিতে নিয়ন্ত্রণহীন ধেয়ে চলল জিরো-সেভেন-জিরো। শেষ রক্ষা বোধহয় সম্ভব হলো না, কাত হয়ে পড়ল বোয়িং, উল্টে যায় যায় অবস্থা। শক্ত করে ধরে নোজ হুইলটা এমনভাবে ঘোরাচ্ছে ক্যাপটেন, মনে হচ্ছে প্যানেল থেকে ওটাকে ভেঙে বের করে আনতে চাইছে। ওদিকে তার কো-পাইলট বোয়িংয়ের সবগুলো দৈত্যাকার ইঞ্জিন রিভার্স সুইচ টিপে চালিয়ে দিয়েছে, মেইন ল্যান্ডিং গিয়ার ব্রেকে পা চেপে ধরে প্রায় দাঁড়িয়ে পড়েছে সে।

স্টারবোর্ড ডানার ডগা থেকে অল্প দূরে দেখা গেল ফায়ার ইঞ্জিন আর ট্যাংকারগুলোকে, স্যাৎ করে পিছিয়ে গেল। ড্রাইভার আর সহকারীদের একেবারে কাছ থেকে এক পলকের জন্যে দেখা গেল, স্তম্ভিত বিস্ময়ে সবার চেহা সাদাটে হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে কমে এল গতি, নোজ হুইল মাটি স্পর্শ করল। আবার কয়েকটা ঝাঁকি খেল বোয়িং। ইট দিয়ে তৈরি একটা বিল্ডিংয়ের কাছাকাছি চলে এল সেটা, ওই বিল্ডিংয়ে অ্যাপ্রোচ আর ল্যান্ডিং বীকন বসানো হয়েছে, মেইন রাডার স্থাপনা সহ।

 সময় তখন সকাল সাতটা পঁচিশ মিনিট। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল স্পীডবার্ড জিরো-সেভেন-জিরো।

.

অবশেষে নামতে পারল ওরা, শান্ত কণ্ঠে বললেন ডক্টর পার্কার, নেমে পড়েছে। এ থেকে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেল, দক্ষিণ আফ্রিকাই ওদের ফাইনাল ডেসটিনেশন ছিল।

জার্মান স্টাইল, মাথা ঝাঁকাল পিটার। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে ওদের।

দুঃখও হয়, বুঝলে, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন ডক্টর পার্কার। কেন দুঃখ হয় তা ব্যাখ্যা করার আগে পাইপে দুবার টান দিলেন তিনি। ওরা সবাই একটা নীতিতে বিশ্বাসী-ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে। কোনো বিশেষ মহৎ উদ্দেশ্য সাধনে নিবেদিতপ্রাণ।

আমি মানি না, স্যার, পিটার দ্বিমত পোষণ করে।

ডক্টর পার্কারের চোখে আগ্রহের ঝিলিক, বিষয়টা নিয়ে পিটারের সাথে তর্ক করতে ভালো লাগছে তার। দাবি আদায়ের আরো অনেক পথ আছে বটে, কিন্তু সেগুলোয় কাজ কতটা হয় তাও ভেবে দেখতে হবে। কাজ হয় না বলেই তো আতঙ্কবাদীরা চরমপন্থা বেছে নিতে বাধ্য হয়। কোনটা সন্ত্রাসবাদ কোনটা নয়, পার্থক্য করা সত্যি খুব কঠিন, তাই না? প্যারিসের রাস্তায় জার্মান অফিসারদের কি হত্যা করা হয় নি?

সেটা যুদ্ধ ছিল। পিটার অটল।

জিরো-সেভেন-জিরো যারা হাইজ্যাক করেছে তারাও সম্ভবত মনে করছে তারা যুদ্ধের মধ্যে রয়েছে।

নিরীহ লোকদের সাথে?

যুদ্ধে জেতাটাই কি বড় কথা নয়? তাছাড়া, সমষ্টির স্বার্থে ব্যক্তির স্বার্থ যদি লঙ্তি হয়, ক্ষতি কি তাতে?

 ওদের বোঝা উচিত ভুল পথে রয়েছে ওরা, না বুঝলে তার খেসারত তো দিতেই হবে, বলল পিটার।

 কোনটা ভুল পথ, পিটার? হালকা সুরে জিজ্ঞেস করলেন ডক্টর পার্কার সর্বহারা মানুষের অধিকার আদায়ে যারা নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিতে চায়, তারা ভুল পথে রয়েছে? ধর্মের দোহাই পেড়ে যারা জেহাদ ঘোষণা করেছে অতীতে, তাহলে তাদের কি বলবে তুমি? কেনিয়ার মাও মাও আন্দোলনের কথা না হয় বাদ দাও, বাদ দাও ইদানীং আয়ারল্যান্ডে যা ঘটছে, কিন্তু ফ্রেঞ্চ বিপর্যয়ের সময় যা ঘটেছে তার কি ব্যাখ্যা? তুমি জানো ক্যাথলিক বিশ্বাস প্রচার করার সময় মানুষের ওপর কি নির্মম অত্যাচার চালানো হয়েছিল? নৈতিকতার বিচারের ওগুলোও কি সঠিক ছিল না?

 আমি বলব ওগুলো হয়তো যুক্তিগ্রাহ্য ছিল, কিন্তু নিন্দনীয়ও বটে। সন্ত্রাসবাদ নৈতিকতার বিচারে ন্যায্য হতে পারে না, তার ধরন যাই হোক।

অস্বস্তিবোধ করছে পিটার, চেয়ারে নড়েচড়ে বসল। আইনের বাইরে থেকে কোনো প্রতিবাদ হতে পারে না

মানলাম। কিন্তু যাবে না, তারও তো কোনো কথা নেই। আইন তো মানুষই তৈরি করে, নিজেদের সুবিধার খাতিরে। আমি দুঃখিত, পিটার, চেয়ারে হেলান দিয়ে হাসলেন ডক্টর পার্কার। মাঝেমধ্যে কনফিউজড় হয়ে পড়ি। কিন্তু বুঝতে পারি না যে টেরোরিস্ট হবার চেয়ে দয়াময় উদার হওয়া তোমার-আমার মতো লোকের জন্যে অনেক বেশি নিরাপদ আর সুবিধেজনক। আমাদের মতো নীতি নিয়ে আপোষ করে না ওরা, উদ্দেশ্য নিয়ে দ্বিধায় ভোগে না। থাক, এবার থামি। পাইপে ঘন ঘন টন দিলেন তিনি। দু-এক ঘণ্টা তোমাকে আর বিরক্ত করব না, নতুন মাত্রা যেটা যোগ হয়েছে সেটা মনে রেখে প্ল্যান তৈরি কর। শেষে শুধু একটা কথা বলি আমার মন বলছে, ব্যাপারটা মেটার আগে বিবেকের কাছে কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে আমাদের।

.

ডানদিকে, শান্তভাবে বলল ইনগ্রিড, পরমুহূর্তে ঘাস মোড়া মাটি ছেড়ে ট্যাক্সিওয়েতে উঠে পড়ল বোয়িং। প্লেনটার ল্যান্ডিং গিয়ার অক্ষত রয়েছে, সাবলীলভাবে ঘুরছে সবগুলো চাকা।

মাটিতে নামা কোনো জাম্বো জেটের ফ্লাইট ডেকে আগে কখনো থাকেনি মেয়েটা, ককপিট মাটি থেকে এতটা উঁচু দেখে বিস্মিত হলো সে, সেই সাথে অসহায় আর বিচ্ছিন্ন একটা অনুভূতি জাগল মনে। আবার বাঁ দিকে, নির্দেশ দিল সে। ঘুরে গিয়ে মেইন এয়ারপোর্ট বিল্ডিংয়ের দিকে পিছন ফিরল বোয়িং, দক্ষিণ প্রান্তে রানওয়ের শেষ মাথার দিকে এগোল। এয়ারপোর্ট বিল্ডিংয়ের সমতল ছাদে প্রান্তে রানওয়ের শেষ মাথার দিকে এগোল। এয়ারপোর্ট বিল্ডিংয়ের সমতল ছাদে অবজারভেশন ডেক, ইতোমধ্যে ডেকটা কৌতূহলী দর্শকে ভরে গেছে। তবে অ্যাপ্রনের সমস্ত তৎপরতা থামিয়ে দেয়া হয়েছে। টেন্ডার আর অ্যাম্বুলেন্স ছেড়ে চলে গেছে সবাই, গোটা রানওয়েতে একজন লোকও নেই।

ওখানে পার্ক করুন। হাত তুলে ফাঁকা একটা জায়গা দেখাল ইনগ্রিড, কাছে বিল্ডিংটা থেকে চারশ গজ দূরে, টার্মিনাল আর সার্ভিস হ্যাঙ্গারের মাঝখানের। হ্যাঙ্গারের পাশে মেইন ফুয়েল ডিপো রয়েছে। ইন্টারসেকশনে থামাবেন।

গম্ভীর এবং চুপচাপ, শুধু নির্দেশ মেনে যাচ্ছে ক্যাপটেন। হঠাৎ সীটের ওপর একটু ঘুরে বসল সে। ওকে এ অবস্থায় ফেলে রাখা যায় না, একটা অ্যাম্বুলেন্স ডেকে পাঠিয়ে দেয়া দরকার।

কো-পাইলট আর একজন স্টয়ার্ডেস ধরাধরি করে গ্যালির মেঝেতে শুইয়ে দিয়েছে ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারকে, ফ্লাইট ডেকের দরজার ঠিক সামনে। রক্ত বন্ধ করার জন্যে টেবিল ন্যাপকিন দিয়ে ক্ষতটা বেঁধেছে ওরা। তাজা রক্ত আর ঘামের সাথে বাতাসে এখনো মিশে রয়েছে বারুদের গন্ধ।

এই প্লেন থেকে কেউ কোথাও যাচ্ছে না। মাথা নাড়ল ইনগ্রিড। এরই মধ্যে আমাদের সম্পর্কে অনেক বেশি জেনে ফেলেছে ও।

এ কি শোনালে, ঈশ্বর! কিন্তু ওর চিকিৎসা দরকার।

চিকিৎসার অভাব হবে না, হেসে উঠে বলল ইনগ্রিডতিনশ ডাক্তার রয়েছে। প্লেনে। দুনিয়ার সেরা ওরা, তাই না? দুজন চলে আসতে পারে, দেখে যাক ওকে। ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের রক্তাক্ত ডেস্কের কিনারায় বসে পা ঝুলিয়ে দিল সে, হাত বাড়িয়ে এক ঝটকায় অন করল ইন্টারন্যাল মাইক্রোফোন। রাগের মধ্যেও ব্যাপারটা লক্ষ্য করল সিরিল ওয়াটকিংস, মেয়েটার দ্বিধাহীন আচরণ একটা জিনিসই প্রমাণ করে, জটিল কমিনিকেশন ইকুইপমেন্ট ব্যবহার করার অভিজ্ঞতা আছে তার। বুদ্ধি তো রাখেই, ভালো ট্রেনিংও পেয়েছে।

 লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন, আমরা জোহানেসবার্গ এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করেছি। এখানে আমরা অনেকক্ষণ থাকব-হতে পারে কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহ। সময় যত গড়াবে ততই আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ব এবং আমাদের ধৈর্য ফুরিয়ে আসবে, কাজেই আপনাদের আমি সতর্ক করে দিয়ে বলছি, যে কোনো রকম অবাধ্যতা কঠোরভাবে দমন করা হবে। এরই মধ্যে আমাদের কাজে একবার বাধা দেয়া হয়েছে, ফলে গুলি খেতে হয়েছে ক্রুদের একজনকে। আঘাত গুরুতর, মারা যেতে পারে। এ ধরনের ঘটনা আরো ঘটুক, আমরা তা চাই না। কিন্তু সেই সাথে আপনাদের জানা দরকার যে আমি বা আমার অফিসাররা গুলি করতে ইতস্তত করব না, এমনকি আপনাদের মাথার ওপর গ্রেনেডগুলোও ফাটিয়ে দিতে পারি–যদি প্রয়োজন হয়।

থামল ইনগ্রিড, নির্বাচিত দুজন ডাক্তারকে এগিয়ে আসতে দেখল সে। ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের দুপাশে হাঁটু গেড়ে বসল তারা। থরথর করে কাঁপছে ইঞ্জিনিয়ার, সাদা শার্ট তাজা রক্তে ভিজে জবজব করছে। ইনগ্রিডের চেহারায় কোনো দয়া বা সহানুভূতি নেই, আবার যখন কথা বলল কণ্ঠস্বর আগের মতোই শান্ত এবং হালকা শোনাল। আমার দুজন অফিসার প্যাসেজ ধরে এগোবে, আপনাদের পাসপোর্টগুলো সংগ্রহ করবে তারা। যে যার পাসপোর্ট বের করে রাখুন, প্লিজ।

ঝট করে আড়চোখে দূরে তাকাল সে, চোখের কোণে কি যেন নড়তে দেখেছে। সার্ভিস হ্যাঙ্গারগুলোর পিছন থেকে এক লাইনে চারটে আমার কার বেরিয়ে এল। ফ্রেঞ্চ প্যানহার্ড ওগুলো, এখানে সংযোজন করা হয়েছে। হিঁচড়ে টানার উপযোগী লম্বা টায়ার, গর্তের ভেতর সচল কামান বসানোর মঞ্চ, কামানের লম্বা ব্যারেল, সব পরিষ্কার দেখা গেল। ঠোঁটের কোণ বেঁকে গেল ইনগ্রিডের, ওদিকে সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। সাবধানে ঘুরল আর্মার ভেহিকেলগুলো, বোয়িং থেকে তিনশ গজ দূরে দাঁড়াল চারটে পয়েন্টে-প্লেনের ডানা বরাবর দুটো, একটা লেজের দিকে, অপরটা নাকের সামনে–ঘেরাও করে ফেলল জিরো সেভেন-জিরোকে, লম্বা কামানের ব্যারেলগুলো প্লেনের দিকে তাক করা।

সেদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ইনগ্রিড, তার দিকে এগিয়ে এল একজন ডাক্তার। ছোটখাটো মানুষটা, মাথায় উঁকি দিচ্ছে টাক, খুব সাহসী।

ওকে এই মুহূর্তে হাসপাতালে পাঠাতে হবে।

সে প্রশ্নই ওঠে না।

এটা একটা মানবিক প্রশ্ন, লোকটার জীবন বিপন্ন।

জীবন আমাদের সবার বিপন্ন, ডাক্তার। এক মুহূর্ত থেমে কথাটা হজম করার সময় দিল ইনগ্রিড। কি কি দরকার আপনার তার একটা তালিকা দিন আমাকে। চেষ্টা করে দেখতে পারি পান কিনা।

.

ল্যান্ড করার পর মোলো ঘণ্টা পেরিয়ে গেল, অথচ মাত্র একবার যোগাযোগ করেছে ওরা। জ্যাকেট খুলে ফেলেছেন ডক্টর পার্কার, ঢিল করেছেন টাইয়ের নট, বাকি আর কিছু দেখে বোঝার উপায় নেই রাত জাগার ক্লান্তি তাকে স্পর্শ করেছে। মাত্র একবার যোগাযোগ করে দুটো অনুরোধ করেছে সন্ত্রাসবাদীরা–ইলেকট্রিক মেইন্স-এর সাথে পাওয়ার লিঙ্ক-আপ আর মেডিকেল সাপ্লাই চেয়েছে।

টিভির পর্দায় ফুটে ওঠা ছবির দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল পিটার। সাপ্লাইয়ের ধরন দেখে আপনার ডাক্তাররা কি ভাবছেন?

মনে হচ্ছে গুলি খেয়ে আহত হয়েছে কেউ। এ-বি পজিটিভ রক্ত চেয়েছে ওরা, দুর্লভ একটা গ্রুপ। ক্রুদের সার্ভিস রেকর্ডে দেখা যাচ্ছে, অন্তত একজনের রক্তের গ্রুপ এ-বি পজিটিভ। দশ লিটার প্রাসমালাইট বি, রক্ত দেয়ার একটা সেট আর সিরিঞ্জ, মরফিন আর ইন্টারভেনাস পেনিসিলিন, টিটেনাস টক্সয়েড সবগুলোই গুরুতর আহত লোকের চিকিৎসায় লাগে।

মেইন পাওয়ারের সাথে বোয়িংয়ের সংযোগ দেয়া হয়েছে?

হ্যাঁ, এয়ারকন্ডিশনিং ছাড়া চারশ লোক এতক্ষণে দম আটকে মারা যেত। এয়ারপোর্ট কর্মীরা একটা কেবল টেনে নিয়ে গিয়ে এক্সটারনাল সকেটে প্লগ ঢুকিয়ে দিয়েছে। প্লেনের সবগুলো সাপোর্ট সিস্টেম-গ্যারিল হেটিংসহ পুরোপুরি চালু রয়েছে।

তার মানে যে কোনো সময় সুইচ অফ করে দিতে পারি আমরা। ডেস্কে রাখা প্যাডের ওপর পয়েন্টটা লিখল পিটার। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো দাবি জানানো হয়নি? নেগোশিয়েটর হিসেবে কারো নামও প্রস্তাব করেনি?

না। মনে হচ্ছে এ ধরনের পরিস্থিতিতে দর কষাকষির কৌশল ভালোই জানা আছে ওদের। এদিকে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের ভাবসাব ভালো ঠেকছে না।

কি রকম?

কমান্ডো পাঠিয়ে বোয়িংটাকে দখল করতে চাইছে ওরা। আমেরিকান আর ব্রিটিশ অ্যামব্যাসাডর চাপ সৃষ্টি করে কোনোমতে ঠেকিয়ে রেখেছেন ওদের।

পিটারের শিরদাঁড়া বেয়ে আতঙ্কের হিম একটা শিহরণ নেমে এল। সে ধরনের কিছু ঘটতে দিলে রক্তের বন্যা বয়ে যাবে, ডক্টর পার্কার, তাড়াতাড়ি বলল ও।

ভেবেছ আমি বুঝি না? জান সুটে উড়ে আসতে আর কতক্ষণ লাগবে তোমার?

সাত মিনিট আগে জাম্বেজি নদী পেরিয়ে এসেছি, উইন্ডস্ক্রীনের দিকে ঝুঁকে নিচে তাকাল পিটার, কিন্তু কুয়াশার জন্যে মাটি পর্যন্ত দৃষ্টি গেল না। দু-ঘণ্টা দশ মিনিট লাগবে, কিন্তু আমাদের সাপোর্ট সেকশন তিন ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট পিছিয়ে আছে।

ঠিক আছে, পিটার। দেখি ওদিকে ওরা কি করছে। দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার কেবিনেট মিটিং ডেকেছে, অ্যাটলাসের প্রতিনিধি হিসেবে আমারও যেতে হবে।

এক মুহূর্ত থেমে পার্কার বললেন, তোমাকে জানানোর দরকার, কন্ডিশন ডেল্টা ঘোষণা করার অনুমতি পেয়ে গেছি আমি।

কন্ডিশন ডেল্টা মানে কাজে বাধা পেলে খুন করার সিদ্ধান্ত, ঘোষণাটা সংগঠনের চেয়ারম্যান মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়। তবে, বলে চলেছেন ডক্টর পার্কার, কন্ডিশন ডেল্টা আমি সম্ভাব্য শেষ উপায় হিসেবে ব্যবহার করব। প্রথমে আমি ওদের দাবিগুলো শুনতে চাই, বিবেচনা করে দেখতে চাই–সেদিক থেকে ভাবলে, ওদের সাথে সহযোগিতা করার জন্যে সম্পূর্ণ তৈরি আমরা।

অনেক কথাই বলেছেন ডক্টর পার্কার, মন দিয়ে শুনছেও পিটার, কিন্তু প্রতিটি বক্তব্যের সাথে একমত হতে পারছে না। অস্বস্তি গোপন করার জন্যে মুখ নিচু করে হাতের তালুর দিকে তাকিয়ে থাকল ও। কথা বলল মৃদুকণ্ঠে, টেরোরিস্টদের বিনা শাস্তিতে ছেড়ে দেয়ার অর্থ হবে অন্যান্য গ্রুপগুলোকে আঘাত হানতে উৎসাহিত করা…

কন্ডিশন ডেল্টার অনুমতি আমার হাতে তো থাকছেই, একটু যেন তিক্ত শোনাল ডক্টর পার্কারের কণ্ঠস্বর। কিন্তু লাইসেন্স পেলেই মানুষ খুন করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আমরা খুনি নই, জেনারেল স্ট্রাইড। স্ক্রীনের বাইরে দাঁড়ানো কার উদ্দেশে যেন মাথা ঝাঁকালেন তিনি। অ্যাটলাসের উপস্থিতি সম্পর্কে ওদের আমি এখুনি জানাব। টিভির স্ক্রীন নিস্প্রভ হয়ে গেল।

লাফ দিয়ে উঠে প্যাসেজে পায়চারি শুরু করল পিটার, কিন্তু দুসারি সীটের মাঝখানে জায়গাটুকু খুব সরু, তাছাড়া সিলিং এত নিচু যে মাথা সোজা করা যায় না-রেগেমেগে আবার বসে পড়তে বাধ্য হলো ও।

.

পেন্টাগনের পশ্চিম উইংয়ের নিজের অফিসে কমিউনিকেশন ডেস্ক ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ডক্টর পার্কার। তার চলার পথ থেকে সমীহের সাথে সরে দাঁড়াল দুজন টেকনিশিয়ান, দ্রুতহাতে ইনার অফিসের দরজা খুলে দিল পার্সোনাল সেক্রেটারি। এরকম একটা বিশাল ধড় নিয়ে চমৎকার সুষম সাবলীল হাঁটা-চলা সহজে চোখে পড়ে না, কাঠামোয় কোথাও বেশি মেদ নেই, চওড়া হাড়গুলো মাংসের পাতলা ফালি দিয়ে মোড়া। তার পরনের কাপড়চোপড় খুব দামি, ফিফথ এভিনিউ-এর দর্জিরা এর চেয়ে ভালো তৈরি করতে পারে না। কিন্তু কাপড়গুলো সবই পুরানো হয়ে গেছে, আগের মতো আর ভাজ হয় না। জুতো জোড়া ইটালি থেকে আমদানি করা, কিন্তু অনেক দিন কালির মুখ দেখেনি। বেশভূষার ব্যাপারে অমনোযোগী, তা সত্ত্বেও আসল বয়সের চেয়ে দশ বছর কম, তেতাল্লিশ বলে মনে হয় তার। জুলফির কাছে অল্প দু-চারটে চুলে পাক ধরেছে।

ইনার অফিসে প্রচুর বই রেখেছেন ডক্টর পার্কার, পঠন-পাঠনে তড়িঘড়ি একটা সময় বেরিয়ে যায়। ফার্নিচারগুলো হালকা এবং আরামদায়ক, বই আর পিয়ানোটা তার নিজের। পাশ কাটাবার সময় পিয়ানোর কীবোর্ডে আঙুল ছোঁয়ালেন তিনি লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেলেন ডেস্কের দিকে।

সুইভেল চেয়ারে বসে ডেস্কে সাজিয়ে রাখা ইন্টেলিজেন্স ফোল্ডারগুলোয় হাত দিলেন ডক্টর পার্কার। প্রতিটি ফোল্ডারে লেটেস্ট কমপিউটার প্রিন্ট-আউট রয়েছে, তার অনুরোধে পাঠানো হয়েছে ওগুলো। স্পীডবার্ড জিরো-সেভেন-জিরো উদ্ধার করার ব্যাপারে যারা জড়িত হবে তাদের মধ্যে থেকে বাছাই করা গুরুত্বপূর্ণ কিছু লোক সম্পর্কে তথ্য রয়েছে ফোল্ডারগুলোয়। এক-একটা ফোল্ডার এক-একজনের নামে।

 প্রথম দুটো লাল রঙের ফোল্ডার দুজন অ্যামব্যাসাডরের। হাইয়েস্ট সিকিউরিটি রেটিং-এর জন্যে ওদের ফোল্ডারের রঙ লাল। ফাইল দুটোর গায়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে–হেডস অভ দি ডিপার্টমেন্টস ওনলি। পরের চারটে ফোল্ডার দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের কেবিনেট মন্ত্রীদের, ইমার্জেন্সির সময় চারজনই তারা সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা এবং অধিকার ভোগ করেন। চারটের মধ্যে সবচেয়ে মোটাটা প্রাইম মিনিস্টারের। ডক্টর পার্কার জানেন, এই ভদ্রলোক কালোদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল, তিনি তাদের অনেক ন্যায্য দাবিই মেনে নিতে চান, কিন্তু তার শ্বেতাঙ্গ মন্ত্রীদের প্রবল বিরোধিতার মুখে বেশিরভাগ সময় সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য হন। বাকি তিনটে ফোল্ডার বিচারমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, আর কমিশনার অভ পুলিশের।

একেবারে নিচের ফোল্ডারটার রঙও লাল। এত বেশি নাড়াচাড়া করা হয়েছে ওটা যে কার্ডবোর্ড কাভারের কোণগুলো নরম হয়ে গেছে। এই ফোল্ডারের অরিজিনাল প্রিন্ট-আউট চাওয়া হয়েছিল মাস কয়েক আগে, তার পর থেকে পনেরো দিন অন্তত অন্তর লেটেস্ট প্রিন্ট-আউট ভরা হয়েছে। ফোল্ডারের গায়ে লেখা রয়েছে—স্ট্রাইড পিটার চার্লস। তার ঠিক নিচেই ব্র্যাকেটের ভেতর লেখা—হেড অভ অ্যাটলাস অনলি।

 ফোল্ডারের লেখাগুলো মুখস্থ বলতে পারবেন ডক্টর পার্কার, তবু রিবন খুলে ফোল্ডারের পাতা ওল্টালেন। পড়তে পড়তেই পাইপে অগ্নিসংযোগ করলেন তিনি।

১৯৩৯ সালে জন্ম পিটারের, সামরিক পরিবারে। বাবা মারা যান ওর জন্মের ঠিক তিন বছরের মাথায়, উত্তর আফ্রিকায় জেনারেল রোমেলের বাহিনির সঙ্গে সংঘর্ষে। ওর জমজ ভাই উত্তরাধিকারসূত্রে ব্যারন হয়; পারিবারিক সুবাদে বহু দেশ ঘুরেছে সে। অন্য সবার সাথে পিটারের একমাত্র অমিল বলতে লেখাপড়ায় তার অসাধারণ মেধা। দলগত খেলাধুলোর চেয়ে একাই যেন থাকতে ভালোবাসে পিটার।

এক মুহূর্তের জন্যে চিন্তা করলেন কিংস্টোন পার্কার। পিটারের চরিত্রের এই ব্যাপারগুলোয় তাকে সবচেয়ে বেশি ভাবিয়েছে।

পিটার স্ট্রাইড যখন বাপের রেজিমেন্টে যোগ দেয়, ওর নিষ্ঠা এবং নিয়মানুবর্তিতায় দারুণ অবাক হয় নিকটজনেরা। পিটারের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা জলাঞ্জলি দিয়ে সেনাবাহিনীতে দারুণ সফল হয় সে। গোল বাধে যখন ওর বাহিনিকে সাইপ্রাসে প্রেরণ করা হয়। ওখানকার কমান্ডার তাকে সহ-নেতৃত্ব দিয়ে দেন পিটারের দ্রুত কর্মপদ্ধতির প্রেমে পড়ে। সম্ভবত, ওর মধ্যে তিনিই প্রথম অসাধারণ সম্ভাবনার আভাস পেয়েছিলেন।

অন্তত একবার হলেও যুক্তিযুক্ত সিন্ধান্ত নিয়েছিল সেনা বাহিনি। গত ষোলো বছরে একটি মাত্র ভুলও করেনি স্ট্রাইড; কেবল বিয়েটা ছাড়া–কেবল মাত্র দুই বছরই টিকেছিল ওটা। সাইপ্রাস সফরের পর থেকেই তরতর করে উঠে গেছে তার ক্যারিয়ার, যদিও স্বাভাবিক উপায়ে নয়।

প্রায় বারোটি অসম্ভব কঠিন এবং বিচিত্র অ্যাসাইনমেন্ট পেয়েছিল সে এর পরে; একের পর এক নিজের প্রতিভার প্রমাণ দিয়ে চলছিল সেগুলোতে। ব্রিটিশ রেজিমেন্টের ধারার বিপরীতে নিজের র‍্যাঙ্ক দ্রুত বাড়াতে সক্ষম হয় পিটার।

 ন্যাটোতে শক্তিশালী বন্ধু-বান্ধব আছে তার, আটলান্টিকের দুই পারেই রয়েছে সমর্থন। ব্রাসেলসে ত্রিশ বছর টার্ম শেষ হবার পর মেজর জেনারেল পদে প্রতিষ্ঠিত হয় পিটার স্ট্রাইড। আয়ারল্যান্ডে ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্সের প্রধান নিযুক্ত করা হয় তাকে।

ব্রিটেনে আইরিশ সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন হামলা কমিয়ে আনার পিছনে তার একক অবদান রয়েছে। অ্যাটলাস গঠন করা হবে, এই সিদ্ধান্ত নেয়ার পরপরই প্রজেক্টের প্রধান হিসেবে তার নাম ছিল তালিকায়। কমিটিতে মার্কিন এবং ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি ছিল, যে যার উৎস থেকে পিটার সম্পর্কে যা জানার সবই জানত তারা, নামটা প্রস্তাব করার ব্যাপারে যার যার সরকারের অনুমতিও পেয়েছিল।

প্রায় ঠিক হয়ে গিয়েছিল অ্যাটলাস কমিটির প্রেসিডেন্ট হবার প্রস্তাব দেয়া হবে পিটারকে, কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে তার সৈনিক পরিচয় এহেন নাজুক একটা সংস্থার সভাপতি হিসেবে সমস্যা তৈরি করে ফেলে।

 অ্যাশট্রেতে পাইপের তামাক ঝেড়ে ফোল্ডার হাতে চেয়ার ছাড়লেন ডক্টর পার্কার, পিয়ানোর দিকে হাঁটতে হাঁটতে গোটা ঘটনাটা স্মরণ করলেন তিনি। পিয়ানোর মিউজিক র‍্যাকে ফোল্ডারটা রাখলেন, ধীরেসুস্থে বসলেন কীবোর্ডের সামনে। খোলা ফোল্ডারে চোখ রেখে বাজানো শুরু করলেন তিনি।

ডক্টর পার্কার ব্যক্তিগতভাবে থোর কমান্ডেও চাননি পিটারকে, কারণ প্রথম থেকেই পিটারকে তার ভয়ানক বিপজ্জনক বলে মনে হয়েছিল। পিটার অতি মাত্রায় স্বাধীনচেতা, তাকে বশ করা বা বাধ্য করা কঠিন হবে। তার বিবেচনায় থোর কমান্ডের জন্যে আদর্শ কমান্ডার হতে পারত ট্যানার, এখন যে মারকারি কমান্ডের কমান্ডার। কিংবা কলিন নোবলস্ হলেও ভালো হতো।

 পিটার থোর কমান্ডের দায়িত্ব নিতে রাজি হলো। অগত্যা বাধ্য হয়ে ওকে মেনে নিলেন ডক্টর পার্কার। মেনে নিলেও, তার মনে খুঁতখুঁতে একটা ভাব থেকেই গেল। পিটারের অ্যামবিশন সম্পর্কে সন্দেহ জাগল তাঁর মনে। ওর ওপর তিনি তীক্ষ্ণ নজর রাখতে শুরু করলেন। পাঁচ পাঁচবার পিটারকে ওয়াশিংটনে ডেকে পাঠিয়েছেন তিনি, সঙ্গে রেখে বুঝতে চেষ্টা করেছেন ওকে। এমনকি তিনি তার নিউ ইয়র্কের বাড়িতেও পিটারকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, পুরো একটা রোববার কাটিয়েছেন ওর সাথে।

পিটারের ব্যক্তিত্ব লক্ষ্য করেছেন তিনি, লক্ষ্য করেছেন ওর জ্ঞানের পরিধি। মনে মনে স্বীকার করে নিয়েছেন, ওর মেধা। কিন্তু অ্যাটলাসে তার ভবিষ্যত সম্পর্কে তিনি সন্দিহান।

ফোল্ডারটা পড়া শেষ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডক্টর পার্কার। কোনো মানুষের দুর্বলতা খুঁজতে চাইলে তার উরুসন্ধির দিকে তাকানো হলো নিয়ম। কিন্তু পিটার স্ট্রাইডের মধ্যে কোনো অস্বাভাবিক যৌনতার দেখা নেই। হোমোসেক্সয়াল নয় সে, বরঞ্চ উল্টোটা সত্যি। ডিভোর্সের পর থেকে কম করে হলেও বারোজন মেয়ের সাথে ওর সম্পর্কের কথা প্রকাশ পেয়েছে। যদিও তাদের মধ্যে তিনজন বিবাহিতা-কিন্ত প্রত্যেকেই তারা উঁচু তলার নারী, বিদূষী এবং মাননীয়া—-কাজেই পিটারের ব্যক্তিগত জীবনে কোনো গুজব রটে নি।

লম্বা মেয়ের প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হয়, আকৃষ্ট হয় বুদ্ধিমতি এবং নিজের ক্ষেত্রে সফল নারীর প্রতি। একটা মেয়ে ছিল সাংবাদিক, নিজের লেখা সিন্ডিকেটেড কলাম ছিল তার; আরেকজন স্বনামখ্যাত মডেল যার লন্ডনে নিজের একটা ডিজাইন শপ আছে। রয়াল শেক্সপিয়র কোম্পানির এক অভিনেত্রীও রয়েছে পিটারের প্রেমিকার তালিকায়। ধৈর্য ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সমস্ত বিবরণ পড়ে চললেন পার্কার।

সামরিক বেতন ছাড়াও ব্যক্তিগত আয় আছে পিটার স্ট্রাইডের যা থেকে বইয়ের একটা সংগ্রহ গড়ে তুলেছে সে। তার প্রেমিকারদের মতোই-বইয়ের সংগ্রহও বেশ দুর্লভ। কোনো লুকোচুরির ব্যাপার নেই ওর জীবনে। সিগারেট খায় না। মদ খায় সে, বলা যেতে পারে ওয়াইন সম্পর্কে একজন বিশেষজ্ঞ। কিন্তু মদ্যপ নয়, সে ধারার মানুষ তো নয়ই। অবৈধ কোনো আয় নেই, সুইস ব্যাংকে নেই কোনো গোপন অ্যাকাউন্ট।

যদিও ইংরেজ আভিজাত্য অনুযায়ী কোনো ধরনের শিকার বা শুটিং সে করে না; তথাপি মিউনিখ অলিম্পিকে ইংল্যান্ডের পক্ষে পিস্টল শটে স্বর্ণপদক জিতেছিল একদা। এখনো নিয়মিত রেঞ্জে প্রাকটিস করে। শারীরিক ফিটনেস অতি অবশ্যই, অসাধারণ।

ডক্টর পার্কার, স্যার,–মৃদু নক করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল তার অ্যাসিস্ট্যান্ট। নতুন খবর এসেছে…।

দীর্ঘশ্বাস চেপে ডক্টর পার্কার বললেন, আসছি। ফোল্ডারটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।

.

বাতাস কেটে নিঃশব্দে নেমে এল হকার। মাটি থেকে পাঁচ হাজার ফিট উপরে থাকতেই পাওয়ার বন্ধ করে দিয়েছে পাইলট, থ্রটল আবার স্পর্শ না করেই ফাইনাল অ্যাপ্রোচের জন্যে প্রস্তুতি নিল সে। প্লেন সচল রাখার জন্যে যে ন্যূনতম গতি দরকার তার চেয়ে মাত্র দশ নট বেশি গতিতে কাঁটাতারের বেড়ার ওপর দিয়ে উড়ে এল সে, রানওয়ে ওয়ান ফাইভে নেমেই ম্যাক্সিমাম সেফ ব্রেকিং অ্যাপ্লাই করল। ওয়ান ফাইভ ছোট একটা বিকল্প রানওয়ে, হকারও অল্প একটু দূর ছুটে দাঁড়িয়ে পড়ল।

 তিনশো ষাট ডিগ্রী বাঁক নিয়ে হকারকে ঘোরাল পাইলট, চলে এল পনেরো নম্বর রানওয়েতে, শুধু চাকা ঘোরাবার মতো পাওয়ার ব্যবহার করছে।

ওয়েল ডান, ভারী গলায় বলল পিটার, ঝুঁকে ওত পাতার ভঙ্গিতে পাইলটের পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ও। প্রায় নিশ্চিতভাবে ধরে নেয়া চলে জিরো-সেভেন-জিরো থেকে কেউ ওদের ল্যান্ড করতে দেখেনি।

সামনেই অ্যাপ্রন মার্শালকে হাত নাড়তে দেখা গেল, মার্শালের পিছনে চারজন লোক গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিনজনের পরনে ক্যামোফ্লেজ ব্যাটলড্রেস অপরজনের পরনে নীল ইউনিফর্ম ক্যাপ আর গোল্ড ইনসিগনিয়া দেখে বোঝা গেল সাউথ আফ্রিকান পুলিশ অফিসার।

ভাঁজ খোলা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসতে ইউনিফর্ম পরা অফিসার প্রথম অভ্যর্থনা জানাল পিটারকে।

 প্রিন্সলু, পিটারের বাড়ানো হাতটা জোরে ঝাঁকিয়ে নিজের পরিচয় দিল সে, লেফটেন্যান্ট-জেনারেল।

 সেনা বাহিনির নয়, পুলিশের পদ। মোটাসোটা, শক্ত-সমর্থ কাঠামো, চোখে স্টিল রিমের চশমা, বয়স পঞ্চাশ। আসুন, জেনারেল স্ট্রাইড, আপনার সাথে কমান্ড্যান্ট বুনজেইয়ারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। এটা মিলিটারি র‍্যাঙ্ক, কর্নেলের সমপর্যায়। কমান্ড্যান্টের বয়স পীসমেকারের চেয়ে কম, বেশ লম্বা। শ্বেতাঙ্গ এই দুই অফিসারই দ্বিধা আর সন্দেহে ভুগছে, চেহারায় ম্রিয়মাণ ভাব। কারণটাও সাথে সাথে জানা গেল।

আমাকে বলা হয়েছে, আপনার পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে হবে, জেনারেল। লোকগুলোর পজিশন আলগোছে বদলে গেল, অফিসার দুজন আস্তে করে চলে এল পিটারের দুপাশে, দুজন মুখোমুখি দাঁড়াল। সাথে সাথে উপলব্ধি করল পিটার, রাগ আর বিদ্বেষ একা শুধু ওর ওপর বর্ষিত হচ্ছে না। পুলিশ আর মিলিটারির চিরন্তন রেষারেষি লেগে আছে এখানেও। অ্যাটলাসের মতো একটা সংগঠনের প্রয়োজন যে সত্যি ছিল, এই রেষারেষি লক্ষ্য করে নতুন করে আবার উপলব্ধি করল পিটার। আপনিই অর্ডার করবেন, আমরা আপনাকে সাহায্য করব।

ধন্যবাদ, শান্তভাবে কমান্ড গ্রহণ করল পিটার। ঠিক তিন ঘণ্টা পর আমার ব্যাক-আপ টীম ল্যান্ড করবে। একেবারে শেষ উপায় হিসেবে শক্তি ব্যবহার করব আমরা। যখন করব, শুধু থোর কমান্ডের কমান্ডোরা জড়িত হবে তাতে। ব্যাপারটা আপনাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাওয়া দরকার। পিটার দেখল, সামরিক অফিসারের চোয়াল কঠিন হয়ে গেল।

 কিন্তু আমার লোকেরা অত্যন্ত…

এটা একটা ব্রিটিশ এয়ারক্রাফট-আর প্লেনের যাত্রীরা সবাই হয় ব্রিটিশ না হয় আমেরিকান। এটা একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত–আমি নেতৃত্ব দেব। বলল পিটার। তবে অন্যান্য ব্যাপারে আপনাদের মূল্যবান পরামর্শ নিশ্চয়ই গ্রহণ করব আমি। হাতঘড়ি দেখল ও।

 এবার বলুন দেখি, আমার সার্ভেইল্যান্স ইকুইপমেন্টগুলো কোথায় রাখা যায়। তারপর চারদিকটা একবার ঘুরেফিরে দেখব, কেমন?

.

নজর রাখার জন্যে ভালো একটা জায়গা বাছাই করতে কোনো রকম সমস্যা হলো না পিটারের। সার্ভিস ম্যানেজারের কামরা টার্মিনাল ভবনের চারতলায় আকারে বেশ বড়, ওখান থেকে ট্যাক্সিওয়ের দক্ষিণ ভাগ সহ গোটা সার্ভিস এলাকা পরিষ্কার দেখা যায়। পাঁচতলায় ঝুল-বারান্দা থাকায় চারতলার এই কামরার জানালায় ঘন ছায়া পড়ে, পিটার যদি একেবারে জানালার কাছাকাছি না থাকে তাহলে চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল রোদে দাঁড়িয়ে এদিকে তাকালে ওকে দেখতে পাবে না কেউ, এমনকি শক্তিশালী লেন্স ব্যবহার করেও কোনো লাভ হবে না। তাছাড়া হাইজ্যাকাররা এদিকে তাকাবে বলেও মনে হয় না, আরো অনেক উঁচু কাঁচমোড়া কন্ট্রোল টাওয়ারে লোক থাকবে বলে ধারণা করবে ওরা।

 সার্ভেইল্যান্স ইকুইপমেন্টের মধ্যে কয়েকটা ক্যামেরা, একটা অডিও ইন্টেনসিফার। ক্যামেরাগুলোর কোনোটাই বাড়িতে ব্যবহারযোগ্য সুপার এইট এম.এম-এর চেয়ে বড় নয়, অ্যালুমিনিয়ামের ট্রাইপড়সহ একহাতেই বহন করা যায়। ওগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো, আটশ এম.এম, ফোকাল লেন্থ পর্যন্ত জুম করা যায়, প্রয়োজনে রিপিট করা যাবে হকারের কমান্ড কনসোলের স্ক্রীনে, একই সাথে ভিডিও টেপে ধরে রাখা সম্ভব। অডিও ইন্টেনসিফায়ার আকারে আরেকটু বড় হলেও ওজনে বেশি নয়। মাঝখানে সাউন্ড কালেক্টরসহ ওতে রয়েছে চার ফুটি ডিশ অ্যান্টেনা। একজন স্নাইপারের রাইফেল যতটুকু অব্যর্থ হতে পারে ততটুকু নিখুঁতভাবে ইন্টেনসিফায়ারকে লক্ষ্যস্থির করতে সাহায্য করবে টেলিস্কোপিক সাইট-ফোকাস করতে পারে আটশ গজ দূরে দাঁড়ানো একজন লোকের ঠোঁটে, একই দুরত্বের যে কোনো সাধারণ কথাবার্তা পরিষ্কার রেকর্ড করতে পারে, শব্দগুলো সরাসরি পাঠিয়ে দেবে কমান্ড কনসোলে, সেই সাথে ম্যাগনেটিক টেপ শুলে জমা হয়ে যাবে সব।

পিটারের কমিউনিকেশন টিমের দুজন টেকনিশিয়ানকে বসিয়ে দেয়া হলো কামরাটায়, প্রচুর স্যান্ডউইচ আর কফির ব্যবস্থা থাকল। আফ্রিকান কর্নেল আর তার লোকজনকে নিয়ে এলিভেটরে চড়ল পিটার, উঠে এল কাঁচমোড়া কন্ট্রোল টাওয়ারে।

.

এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে এয়ারফিল্ড, এয়ারফিল্ডের ওপাশে অ্যাপ্রন, এবং টার্মিনালকে ঘিরে থাকা সার্ভিস এলাকা অবাধে দেখা যায়। টাওয়ারের নিচে অবজার্ভেশন প্ল্যাটফর্ম খালি করা হয়েছে, শুধু সামরিক বাহিনির লোকজন পাহারায় আছে ওখানে।

এয়ারফিল্ডে ঢোকার সবগুলো পথ বন্ধ করে দিয়েছি। শুধু টিকেট সাথে থাকলে প্যাসেঞ্জারদের ঢুকতে দেয়া হবে। ট্রাফিকের জন্যে একটাই সেকশন খোলা রাখা হয়েছে, টার্মিনালের উত্তর প্রান্তে।

মাথা ঝাঁকিয়ে সিনিয়র কন্ট্রোলারদের দিকে ফিরল পিটার।

ডোমেস্টিক ট্রাফিক প্যাটার্নটা কি রকম?

প্রাইভেট কোনো ফ্লাইটকে ক্লিয়ার্যান্স দেয়া হচ্ছে না। ডোমেস্টিক নিয়মিত ফ্লাইটগুলোকে ল্যালেরিয়া আর জারমিসটনে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। আসা-যাওয়া করছে শুধু ইন্টারন্যাশনাল নিয়মিত ফ্লাইটগুলো।

জিরো-সেভেন-জিরো থেকে দেখতে পাচ্ছে ওরা?

না। প্লেনটা থেকে সবচেয়ে দূরে ইন্টারন্যাশনাল ডিপারচার টার্মিনাল, তাছাড়া দক্ষিণ দিকের ট্যাক্সিওয়ে আর অ্যাপ্রন আমরা ব্যবহারই করছি না। দেখতেই পাচ্ছেন, গোটা এলাকা খালি করে ফেলেছি–শুধু ওভারহল আর সার্ভিসিংয়ের কাজ চলছে বলে তিনটে এস-এ এয়ারওয়েজের প্লেন রয়ে গেছে। ওগুলো ছাড়া জিরো সেভেন-জিরোর এক হাজার গজের মধ্যে আর কোনো প্লেন নেই।

বোয়িংয়ে যদি উঠতে হয় সমস্ত ট্রাফিক বন্ধ করে দিতে হতে পারে…

আমাকে বললেই হবে, জেনারেল স্ট্রাইড।

 চোখে বিনকিউলার তুলে আবার অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বোয়িংটাকে দেখল পিটার। নিঃসঙ্গ, চুপচাপ, যেন পরিত্যক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে ওটা। উজ্জ্বল মার্কিংগুলো অলঙ্করণের মতো লাগছে। লাল, নীল, আর সাদা, তিনটে রঙই রোদ লেগে চোখ ধাধিয়ে দিচ্ছে। টাওয়ারের দিকে পুরোপুরি আড়াআড়িভাবে পার্ক করা রয়েছে, প্রতিটি হ্যাচ আর দরজা বন্ধ। সার সার জানালার ওপর এক এক করে দৃষ্টি ফেলল পিটার, ভেতর থেকে প্রতিটি সানশেড বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

ফ্লাইটডেকের উইশীল্ড আর সাইড প্যানেলের দিকে তাকাল পিটার। ভেতর থেকে কম্বল দিয়ে ডেকে গুলি করাও সম্ভব নয়। টার্মিনাল ভবনের সবচেয়ে কাছের কোণ থেকে প্লেনটার দূরত্ব চারশ গজের বেশি নয়, সুযোগ পেলে নতুন লেজার সাইটের সাহায্যে থোরের ট্রেনিং পাওয়া স্নাইপার একজন লোকের যে কোনো একটা চোখে অব্যর্থভাবে গুলি করতে পারত।

ট্যাক্সিওয়ের খোলা টারমাকের ওপর দিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে হেঁটে এলো কমান্ড্যান্ট বোনজেইয়ার, চোখ থেকে বিনকিউলার নামিয়ে ঠোঁট টিপে হাসল পিটার। সহিষ্ণু বন্ধুর মধুর হাসি, দেখে অবাক হয়ে গেল লোকটা।

পরিবেশ থেকে যতটা সম্ভব উত্তেজনা কমিয়ে ফেলতে চাই আমরা, সব ব্যাখ্যা করতে হওয়ায় বিরক্তবোধ করছে পিটার, তবু হাসিটা নিস্তেজ হতে দিল না। কারও দিকে চারটে কামান তাক করা থাকলে তার পক্ষে সঠিক সিন্ধান্ত নেয়া কঠিন, সে নিজেই ট্রিগার টেনে দিতে পারে। টার্মিনাল কার পার্কে রাখুন ওগুলো, প্লেন থেকে দেখা যাবে না। আর আপনার লোকদের বিশ্রাম নিতে বলুন।

লাল চেহারা আরো লাল করে ওয়াকিটকিতে নির্দেশ দিল কর্নেল, খানিক পর আর্মারড কারগুলো হ্যাঙ্গারের পিছনে অদৃশ্য হতেই আবার মুখ খুলল পিটার।

ওখানে কজন লোকের সময় নষ্ট করছেন আপনি? প্রথমে অবজার্ভেশন ব্যালকনির নিচে পাঁচিল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা সৈনিকদের দিকে, তারপর সার্ভিস হ্যাঙ্গারের পাশে সার বেঁধে থাকা ছোট ছোট কালো মাথা দিকে আঙুল তুলল ও।

দুশ তিরিশজন…

ডেকে নিন, নির্দেশ দিল পিটার। বোয়িংয়ের ওরা যেন লোকগুলোকে ফিরে আসতে দেখে।

সবাইকে? কর্নেলের চোখে অবিশ্বাস।

সবাইকে, হাসল পিটার! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, প্লিজ।

দ্রুত শিখছে লোকটা, ইতস্তত না করে ওয়াকিটকিটা মুখের সামনে তুলল আবার। প্রথমে দিশেহারা চঞ্চল একটা ভাব দেখা গেল সৈনিকদের মধ্যে, তারপর লাইনবন্দী হয়ে মার্চ শুরু করল সবাই। নিচু পাঁচিলের ওপর স্টিল হেলমেট আর অটোমেটিক রাইফেলের মাজল দেখা গেল।

কিন্তু একটা কথা আপনাকে মানতে হবে, জেনারেল। ওরা পশু, ওদের সাথে আপনি যদি নরম ব্যবহার করেন…।

আরো কি শুনতে হবে জানে পিটার, তাড়াতাড়ি বলল, কিন্তু বন্দুক তাক করে রাখলে ওরা সতর্ক থাকবে। একটু বিশ্রাম নিতে দিন, আত্মবিশ্বাস বাড়ক।

 ইতোমধ্যে চোখে আবার বিনকিউলার তুলেছে ও, একজন সৈনিকের দূর-দৃষ্টি নিয়ে থোরের চারজন স্নাইপারের জন্যে জায়গা খুঁজছে। ওদেরকে ব্যবহার করার সম্ভাবনা খুব কম-একই সময়ে শত্রুদের প্রত্যেককে খুন করত পারতে হবে। তবে দুর্লভ একটা সুযোগ এসেও যেতে পারে, এলে প্রস্তুতির অভাবে বিফল হতে চায় না পিটার। একটা রাইফেল রাখা যেতে পারে, ওখান থেকে বোয়িংয়ের পোর্ট ভেন্টিলেটর রয়েছে, ওটা ভেঙে ফেলা যেতে পারে, ওখান থেকে বোয়িংয়ের পোর্ট সাইডটা সম্পূর্ণ কাভার করা যাবে। দুদিক থেকে ফ্লাইট ডেক কাভার করার জন্যে দুটো রাইফেল দরকার হবে। মেইন রানওয়ের কিনারা ধরে গভীর ড্রেন চলে গেছে, সেটার ভেতর দিয়ে ছোট কামরাটায় একজন লোককে পাঠানো সম্ভব–ওই কামরাতেই রয়েছে অ্যাপ্রোচ রাডার আর আই,এল,এস, বীকন। কামরাটা শত্রুপক্ষের পিছন দিকে, ওদিক থেকে তারা গোলাগুলি আশা করবে বলে মনে হয় না।

এয়ারপোর্টের বড়সড় স্কেল ম্যাপের গায়ে ঘন ঘন চোখ বোলাচ্ছে পিটার, সিদ্ধান্তগুলো লিখে রাখছে নোটবুকে। প্রতিটি সিদ্ধান্তের পাশে আলাদা আলাদা স্কেচ এঁকে প্ল্যান তৈরি করল, প্রতিটি প্ল্যানের পাশে লেখা থাকল দুরত্বের চুলচেরা হিসেব, বরাদ্দ করা থাকল টার্গেটে পৌঁছুবার নির্দিষ্ট সময়। অচেনা শত্রু, ভয়হীন, তবু চিন্তা-ভাবনায় তাদের চেয়ে এগিয়ে থাকতে চায় পিটার।

একটানা একঘণ্টা কঠোর পরিশ্রম করার পর সন্তুষ্ট হলো পিটার। হারকিউলিস এখনো না এসে পৌঁছুলেও, সিদ্ধান্ত আর প্ল্যানগুলো টারমাক স্পর্শ করার চার মিনিটের মধ্যেই তার টিমের লোকজন পজিশন নিতে পারবে।

 ম্যাপ থেকে চোখ তুলে সোজা হলো পিটার, চামড়া মোড়া নোটবুকটা বোম খোলা বুক পকেটে ভরে রাখল। চোখে গ্লাস তুলে আরো একবার ধ্যানমগ্ন দৃষ্টিতে দেখল বোয়িংটাকে, চেহারা দেখে বোঝা না গেলেও অদ্ভুত একটা আক্রোশ অনুভব করল ও।

সারা দুনিয়া জুড়ে সন্ত্রাসবাদীদের আলাদা কোনো পরিচয় নেই—ওরা সবাই নিষ্ঠুর, নির্মম, আর বিবেকহীন। দাবি আদায়ের জন্যে নিরীহ মানুষ আর নারী শিশুদের যারা খুন করে পিটারের অভিধানে তারা অমানুষ।

.

মাথা নিচু করে হকারের কেবিনে ঢোকার সময় পিটার দেখল কমিউনিকেশন টেকনিশিয়ানরা টিভির বড় পর্দাটায় কলিন নোবলকে এনে ফেলেছে। সীটে বসে ওপর সারির ডান দিকে স্ক্রীনে তাকাল ও, দক্ষিণ টার্মিনালের প্রায় সবটুকু দেখা যাচ্ছে। স্ক্রীনের ঠিক মাঝখানে বিশাল ঈগলের মতো বসে রয়েছে জিরো-সেভেন জিরো। পাশের স্ক্রীনে আটশো এম.এম, জুম লেন্সের সাহায্যে বোয়িংয়ের ফ্লাইট ডেকের ব্লো আপ ধরে রাখা হয়েছে। খুঁটিনাটি সবকিছু এত পরিষ্কার যে উইন্ডশিল্ড ঢাকা কম্বলের গায়ে সেলাই করা ট্যাগটা পর্যন্ত দেখতে পেল। তৃতীয় ছোট স্ক্রীনে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ারের ভেতরটা ফুটে রয়েছে। আস্তিন গোটানো কন্ট্রোলারকে দেখা গেল, সামনে রাড়ার রিপিটার নিয়ে বসে আছে। আরো সামনে মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত লম্বা জানালা, জানালার বাইরে বোয়িং। ছবিগুলো তোলা হচ্ছে এক ঘণ্টা আগে টার্মিনাল বিল্ডিংয়ে বসানো ক্যামেরার সাহায্যে। অবশিষ্ট টিভির স্ক্রীনটা খালি। মেইন স্ক্রীনে হাসিখুশি কলিন নোবলস চুরুট ফুকছে।

চলে এসো হে, মুচকি হেসে বলল পিটার। এখানে তোমার অনেক কাজ।

এত তাড়া কিসের, স্যার? পার্টি তো এখনো শুরুই হয়নি। বেসবল ক্যাপটা ঠেলে মাথার পিছন দিকে সরিয়ে দিল কলিন।

 তা ঠিক, এমনকি পার্টিটা কে দিচ্ছে তাও এখনো জানি না আমরা। শেষ হিসেবটা বল, কখন পৌঁছাবে?

অনুকূল বাতাস পাওয়া গেছে–আর মাত্র এক ঘন্টা বিশ মিনিট উড়তে হবে।

 গুড, এবার তাহলে কাজ শুরু করা যাক। বুকপকেট থেকে নোটবুক বের করে ব্রিফিং শুরু করল পিটার। বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে মনে করলে ক্যামেরাম্যানকে নির্দেশ দিল ও, স্ক্রীনে বদলে যেতে লাগল দৃশ্যগুলো-কখনো জুম করল ক্যামেরা, কখনো প্যান। ছবিগুলো শুধু কমান্ড কনসোলে নয়, বহু দূর হারকিউলিসের স্ক্রীনেও ফুটল। টীমের লোকজন সবাই যে যার পজিশন আগেভাগে দেখে নিতে পারছে। একই ফটো মহাশূন্যে ঘুরতে থাকা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে, একটু ঝাপসা হয়ে, পৌঁছে যাচ্ছে অ্যাটলাস কমিটির স্ক্রীনে। বুড়ো সিংহের মতো জড়োসড়ো হয়ে ব্রিফিংয়ের প্রতিটি শব্দ গভীর মনোযোগের সাথে শুনছেন ডক্টর পার্কার, একবার শুধু তার অ্যাসিস্ট্যান্ট টেলেক্স মেসেজ নিয়ে এলে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। ব্রিফিং শেষ হবার আগেই পিটারের ছবির দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকালেন তিনি, নির্দেশ দিলেন তার নিজের ছবি যেন পিটারের কমান্ড কনসোলে ফুটে ওঠে।

বাধা দেয়ার জন্যে দুঃখিত, পিটার-কিন্তু এখানে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য পৌঁছেছে।

ইয়েস, ডক্টর পার্কার।

 টেরোরিস্টরা মাহে এয়ারপোর্ট থেকে প্লেনে উঠেছে ধরে নিয়ে সেইশেল পুলিশের কাছে জয়েনিং প্যাসেঞ্জারদের একটা তালিকা চেয়েছিলাম। পনেরো জন প্যাসেঞ্জার, দশজন স্থানীয় একজন ব্যবসায়ী আর তার স্ত্রী, আটটা বাচ্চা, বয়স আট থেকে চৌদ্দ, ওদের সাথে কোনো অভিভাবক নেই। ওদের মা-বাবা সেইশেলয়ে সরকারি চাকরি করে, ছেলেমেয়েগুলো লন্ডন স্কুলে ফিরে যাচ্ছে।

দুর্ভাবনা বাড়ল পিটারের। বাচ্চাদের জীবন যেমন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর মূল্যবান, তেমনি বড় বেশি অসহায় ওরা।

টেলেক্স মেসেজে চোখ রেখে কথা বলে চলেছেন ডক্টর পার্কার, পাইপের গোড়া দিয়ে ঘাড়ের পিছনটা চুলকাচ্ছেন। আরো রয়েছে একজন ব্রিটিশ ব্যবসায়ী, শেল অয়েল কোম্পানির একজন শেয়ার হোল্ডার, বাকি চারজন টুরিস্ট-একজন আমেরিকান, একজন ফ্রেঞ্চ, দুজন জার্মান। এই চারজন একসাথে ট্রাভেল করছে বলে মনে হয়েছে, ইমিগ্রেশন আর সিকিউরিটি অফিসাররা মনে রেখেছে ওদের। দুটো মেয়ে, দুটো ছেলে, সবাই তরুণ। নাম-স্যালি অ্যানি টেইলর, পঁচিশ বছর, আমেরিকান, হাইডি হটশওসার, চব্বিশ; জার্মান, শুভার রেইজ, পঁচিশ, জার্মান; হেনরি লারৌসে ছাব্বিশ, ফ্রেঞ্চ।

ওদের ব্যাকগ্রাউন্ড…

চেক করেছে পুলিশ। ভিক্টোরিয়ার কাছাকাছি রীফ হোটেলে দুসপ্তাহ ছিল ওরা, দুটো ডাবল রুমে মেয়েরা আর ছেলেরা আলাদাভাবে। ওদের সময় কাটে সাঁতার কেটে আর রোদ মেখে, প্যাটার্নটা বদলে যায় ভিক্টোরিয়ায় একটা সমুদ্রগামী ইয়ট ভেড়ার পর। পঁয়ত্রিশ ফুট লম্বা ইয়ট, স্কিপার একজন আমেরিকান। যে কদিন ওখানে ছিল, রোজই একবার করে ওটায় চড়েছে চারজনের দলটা। জিরো-সেভেন জিরো আকাশে ওড়ার চব্বিশ ঘন্টা আগে নোঙর তুলে চলে যায় ইয়ট।

 ধরে নিচ্ছি ইয়ট থেকে অস্ত্র সাপ্লাই পেয়েছে, বলল পিটার। তার মানে অনেক আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে কাজে নেমেছে ওরা। ধীরে ধীরে হলেও, শত্রুদের চেহারা প্রকাশ পাচ্ছে, ভাবল ও। জানে, নতুন সবগুলো তথ্যই ভীতিকর হবে, আস্তে আস্তে কুৎসিত হয়ে উঠবে চেহারাগুলো। নামগুলো কম্পিউটারে চেক করিয়েছেন?

 কোনো রেজাল্ট পাইনি, বললেন ডক্টর পার্কার। হয় ওদের সম্পর্কে কোনো ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট নেই, তা না হলে নাম আর পাসপোর্ট সব ভুয়া…।

একটা স্ক্রীনে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ারের ভেতরটা দেখা যাচ্ছিল, সেখানে অকস্মাৎ নতুন তৎপরতা শুরু হওয়ায় মাঝপথে থেমে গেলেন ডক্টর পার্কার। দ্বিতীয় একটা স্পীকারে অন্য একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল। ভলিউম খুব উঁচুতে দেয়া ছিল, কন্ট্রোল বোর্ডের টেকনিশিয়ান তাড়াতাড়ি অ্যাডজাস্ট করল কথা সুরে আমেরিকান পশ্চিম উপকূলের টান।

জান স্মুট টাওয়ার, দিস ইজ দি অফিসার কমান্ডিং দি টাস্ক ফোর্স অভ দি অ্যাকশন কমান্ডোর ফর হিউম্যান রাইটস দ্যাট হ্যাঁজ কন্ট্রোল অভ স্পীডবার্ড জিরো-সেভেন-জিরো। স্ট্যান্ড বাই টু কপি এ মেসেজ।

কন্ট্যাক্ট! চেপে রাখা নিঃশ্বাস ছাড়ল পিটার। শেষমেশ যোগাযোগ করল ওরা!

ছোট স্ক্রীনে নিঃশব্দে হাসছে কাল কলিন, কায়দা করে বারবার ঠোঁটের এক কোণ থেকে আরেক কোণে গড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে চুরুটটা। অনুষ্ঠান শুরু হলো, ঘোষণা করল সে, কণ্ঠস্বর থেকে চাপা উত্তেজনা লুকিয়ে রাখতে পারল না।

.

ক্রুদের তিনজনকে ফ্লাইট ডেক থেকে সরিয়ে হাইজ্যাকারদের খালি সীটে বসানো হয়েছে। বোয়িংয়ের ককপিটকে নিজের হেডকোয়ার্টার বানিয়েছে ইনগ্রিড, এই মুহূর্তে পাশে তূপ করা আরোহীদের পাসপোর্ট পরীক্ষা করছে সে, ভজ খোলা সিটিং প্ল্যানটা কোলের ওপর, তাতে প্রতিটি আরোহীর নাম আর জাতীয়তা লেখা রয়েছে।

গ্যালির দিকে দরজাটা খোলা, এয়ারকন্ডিশনিংয়ের মৃদু গুঞ্জন ছাড়া প্রকা প্লেনটা আশ্চর্য রকম নিস্তব্ধ। কেবিনে কথা বলা নিষেধ করে দেয়া হয়েছে, নিষেধ মানা হচ্ছে কিনা দেখার জন্যে লাল শার্ট পরা কমান্ডোরা টহল দিচ্ছে প্যাসেজে। টয়লেট ব্যবহার করার অনুমতি দেয়া হলেও, নিয়ম করে দেয়া হয়েছে একজন ফিরে এসে সীটে না বসা পর্যন্ত আরেকজন সীট ছেড়ে উঠতে পারবে না। ব্যবহার করার সময় খোলা রাখতে হবে টয়লেটের দরজা, কমান্ডোরা যাতে চট করে তাকিয়ে চেক করতে পারে।

 নিস্তব্ধ হলেও, গোটা কেবিন টান টান হয়ে আছে উত্তেজনায়। কিছু আরোহী ঘুমাচ্ছে, বেশিরভাগই শিশু, বাকি সবাই যে যার সীটে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বসে আছে, চেহারায় ক্লান্তি আর উদ্বেগ; ভয় আর ঘৃণা মেশানো দৃষ্টিতে দেখছে কমান্ডোদের।

হেনরি, ফরাসি, ককপিটে ঢুকল।

আর্মারড কারগুলো ফিরিয়ে নিচ্ছে ওরা, বলল সে। একহারা গড়ন তার, কবিসুলভ মায়াভরা চোখ, প্রায় চিবুক ছোঁয়া বাকানো গোফ জোড়া তাকে মানায়নি।

মুখ তুলে তার দিকে তাকাল ইনগ্রিড।

তুমি খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছ, ডিয়ার। মাথা নাড়ল সে। সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখ।

বাজে কথা, আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বলল হেনরি। নার্ভাস হব কেন?

মৃদু, মিষ্টি হেসে ভালোবাসার একটা হাত বাড়িয়ে হেনরির মুখ স্পর্শ করল ইনগ্রিড।

ভেব না তোমাকে আমি অপমান করছি। এবার দুহাত বাড়াল সে, হেনরির মাথা ধরে নিজের দিকে টানল, চুমো খেল তার ঠোঁটে। সাহসের পরিচয় আগেও দিয়েছ তুমি বহুবার, বিড়বিড় করে বলল সে।

 পিস্তলটা ডেস্কের দিকে ছুঁড়ে দিল হেনরি, দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল ইনগ্রিডকে। ইনগ্রিডের লাল সুতী শার্টের ওপরের তিনটে বোতাম খোলা, হেনরিকে ভেতরটা হাতড়াবার সুযোগ করে দিল সে। একটু পরই তার নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠল। কিন্তু হেনরি শার্টের বোতামে হাত দিতেই তাকে নির্মমভাবে ঠেলে সরিয়ে দিল সে।

পরে, শুকনো গলায় বলল ইনগ্রিড, আগে সব মিটে যাক। সামনের দিকে একটু ঝুঁকে কম্বলের একটা কোণ একটু সরাল সে, ককপিটের সাইড উইন্ডোর বাইরে চোখ ধাঁধানো রোদ। উজ্জ্বল আলোটা চোখে সয়ে এল। অবজার্ভেশন ডেকের নিচে পাঁচিল ছাড়িয়ে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে হেলমেট পরা সৈনিকদের মাথা, মার্চ করে চলে যাচ্ছে লোকগুলো। মনে মনে খুশি হলো ইনগ্রিড, ওরা তাহলে সৈনিকদেরও ফিরিয়ে নিচ্ছে। এবার কথা বলার সময় হয়েছে। না, আরো একটু ঘামুক ওরা। ইতোমধ্যে ধাতস্থ হয়ে গেছে হেনরি।

উঠে দাঁড়াল ইনগ্রিড, শার্টের বোতাম লাগাল, গলায় স্ট্র্যাপের সাথে ঝুলতে থাকা ক্যামেরাটা অ্যাডজাস্ট করল, তারপর গ্যালিতে একবার থেমে ঠিকঠাক করে নিল সোনালি চুলগুলো। মাঝখানের প্যাসেজ ধরে কেবিনের পুরো দৈর্ঘ্য হেঁটে এল ধীরপায়ে, একবার থেমে ঘুমন্ত একটা শিশুর গায়ে ঠিকমতো টেনে দিল কম্বলটা, আরেকবার থামল গর্ভবতী একজন আরোহীনির অভিযোগ শোনার জন্যে। মহিলার স্বামী টেক্সাসের একজন নিউরোসার্জেন।

বাচ্চারা আর আপনি সবার আগে প্লেন থেকে নামবেন–কথা দিলাম।

নিঃসাড় ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে ঝুঁকল সে। জানতে চাইল, এখন কেমন আছে ও?

 ঘুমোচ্ছে। মরফিন ইঞ্জেকশন দিয়েছি। মুখের ভেতর আরো কি যেন বিড়বিড় করে বলল মোটাসোটা ডাক্তার, ইনগ্রিডের দিকে একবারও তাকাল না। ইঞ্জিনিয়ারের আহত হাতটা উঁচু করে স্লিংয়ের সাথে বাঁধা হয়েছে, রক্ত বন্ধ করার জন্যে, ক্ষতের ওপর ব্যান্ডেজ তো আছেই।

ডাক্তারের কাঁধে নরম একটা হাত রাখল ইনগ্রিড।

অনেক করেছেন আপনি। ধন্যবাদ। অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল ডাক্তার। ইনগ্রিড হাসছে, কিন্তু ডাক্তারের চোখে ঘৃণার ভাবটুকু তার চোখ এড়ায়নি। নিচু গলায়, যেন আর কেউ শুনতে না পায়, জিজ্ঞেস করল সে, উনি আপনার স্ত্রী? দ্রুত মাথা ঝাঁকাল ডাক্তার, কাছাকাছি একটা সীটে বসা মোটাসোটা ইহুদি মহিলার দিকে একবার তাকাল। আমি দেখব উনি যাতে প্রথম দলটার সাথে নামতে পারেন, ফিসফিস করে বলল ইনগ্রিড। ডাক্তারের চেহারায় কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠল। সিধে হয়ে আবার হাঁটা ধরল ইনগ্রিড।

টুরিস্ট কেবিনের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল লাল শার্ট পরা জার্মান যুবক, দ্বিতীয় গ্যালির পর্দা ঢাকা দরজার পাশে। চেহারা দেখেই বোঝা যায়, ফ্যানাটিক। দুটুকরো আগুনের মতো জ্বলজ্বল করছে চোখ, লম্বা চুলে প্রায় ঢাকা পড়ে আছে কাঁধ, ওপরের ঠোঁটের এক কোণে সাদা একটা শুকনো ক্ষতচিহ্ন থাকায় মনে হয় সারাক্ষণ যেন ভেঙচাচ্ছে।

কার্ট, সব ঠিক আছে তো?

খাইখাই করছে সবাই।

আরো দুঘণ্টা পর খেতে দেয়া হবে, তবে পেট ভরে নয় ঘাড় ফিরিয়ে গোটা কেবিনটা ঘৃণাভরে একবার দেখে নিল ইনগ্রিড, চর্বি, হিসহিস করে বললে সে, চর্বিসর্বস্ব বুর্জোয়া শূকর একেকটা। পর্দা সরিয়ে গ্যালিতে ঢুকল সে, ঘাড় ফিরিয়ে কার্টের দিকে আমন্ত্রণ ভরা চোখে তাকাল। চকচকে চোখ নিয়ে তার পিছু নিল কার্ট, গ্যালিতে ঢুকে পর্দাটা টেনে দিল ভালো করে।

ক্যারেন কোথায়? কার্ট তার কোমরের বেল্ট খুলছে দেখে জিজ্ঞেস করল ইনগ্রিড। এখুনি এক দফা সুখ দরকার তার, সাদা ব্যান্ডেজের গায়ে লাল রঙ আর উত্তেজনা তার শরীরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে।

বিশ্রাম নিচ্ছে, কেবিনের পিছনে। কেউ ডিসটার্ব করবে না আমাদের।

শার্টের চেইনটা নিচের দিকে টেনে দিল ইনগ্রিড।

ঠিক আছে। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি, কার্ট, মনে থাকে যেন, চাপা রুদ্ধ গলায় বলল সে। ঝটপট।

.

ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের সীটে বসে আছে ইনগ্রিড, তার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে কালো চুল ক্যারেন। ওর পরনে উজ্জ্বল লাল স্কার্ট, কাঁধ থেকে ঝুলে আছে কান্ট্রিজ বেল্টটা। কোমরে জড়ানো হোলস্টারে কুৎসিত পিস্তল।

 ইনগ্রিডের হাতে ধরা মাইক্রোফোনটা ঠোঁটের কাছে ভোলা, অপর হাতের আঙুল দিয়ে সে তার সোনালি চুলে বিলি কাটছে। শান্ত গলায় কথা বলছে সে। একশো আটানব্বই জন ব্রিটিশ নাগরিক, একশ ছেচল্লিশ জন আমেরিকান, বন্দীদের তালিকা পড়ছে সে। একশ বাইশ জন মেয়ে, বাচ্চাকাচ্চা ছাব্বিশটা, ছয় থেকে দশ বছর বয়স। প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে কথা বলছে, সে এতক্ষণে নড়েচড়ে বসল সীটে। মুখ ফিরিয়ে ক্যারেনের দিকে তাকিয়ে হাসল, উত্তরে তার সোনালি চুলে হাত বুলিয়ে দিল ক্যারেন।

আমরা আপনার শেষ ট্রান্সমিশন কপি করেছি।

নাম ধরে ডাকো আমাকে। আমি ইনগ্রিড, বলিনি? যেন রসিকতা করছে, হাসিতে দুষ্টামির ভাব। অপরপ্রান্তে এক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা, ধাক্কাটা সামলাতে সময় নিল কন্ট্রোলার।

রজার, ইনগ্রিড। আমাদের জন্যে আর কোনো মেসেজ আছে আপনার?

একজন মুখপাত্র চাই, দুঘণ্টার মধ্যে। আরোহীদের মুক্তি দেয়ার ব্যাপারে আমার কিছু শর্ত আছে, তার কাজ হবে কথাগুলো মন দিয়ে শোনা।

স্ট্যান্ড বাই, ইনগ্রিড। অ্যামব্যাসাডরদের সাথে কথা বলার পরপরই আবার আমরা ফিরে আসব।

ন্যাকামি বাদ দাও, টাওয়ার, ঝাঁঝের সাথে বলল ইনগ্রিড। সবাই আমরা জানি, এই মুহূর্তে ব্রিটিশ আর মার্কিন অ্যামব্যাসাডর তোমাদের ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছেন। ওঁদের বল, দুঘণ্টার মধ্যে একজন লোক চাই–তা না হলে প্রথম জিম্মির লাশ দেখবে তোমরা।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *