৩০. সকালে ঘুম ভাঙার পর

৩০.

সকালে ঘুম ভাঙার পর আবার প্রেম করলাম আমরা।

উত্তেজনা প্রশমিত হওয়ার পর মোরাকে বুকে নিয়ে শুয়ে আছি, এমন। সময় ভাইব্রেট করে উঠল আমার মোবাইল।

 এস.এম.এস. পাঠিয়েছেন মিউস: ঠিক নটায়। মনে করিয়ে দিলাম।

ওটা দেখালাম মোরাকে। আমার বস।

 এটা হয়তো তোমাকে জালে আটকানোর কোনো ফন্দি।

মাথা নাড়লাম। রিভসের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগেই আজকের একই সাক্ষাতের কথা জানিয়ে রেখেছিলেন মিউস।

আমার বুকের উপর খুঁতনি রাখল মোরা। কী মনে হয় তোমার-অ্যান্ডি রিভসকে খুঁজে পেয়েছে ওরা?

আমিও ভাবছি কথাটা।

হলুদ মাস্ট্যাংটা খেয়াল করবে কেউ-না-কেউ, মালিকবিহীন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে খবর দেবে পুলিশে। অথবা পুলিশ নিজে থেকেই করতে পারে কাজটা। যেটাই হোক, পুলিশ খুঁজে পাবে মৃতদেহটা। রিভসের সঙ্গে কি আইডি ছিল? হয়তো। না থাকলেও ওর পরিচয় জানতে বেগ পেতে হবে না পুলিশকে। ওর গাড়ির লাইসেন্স প্লেটের সূত্র ধরে ওর পরিচয় জেনে নেয়া যাবে। খোঁজ পাওয়া যাবে দ্য আদার পিয়ানোম্যান-এরও। আমি যেভাবে দেখেছি, একইভাবে রিভসের শিডিউল দেখবে পুলিশ। জানতে পারবে, যে-রাতে মারা গেছে লোকটা, সে-রাতে হাঙ্ক-আ-হাঙ্ক-আ ক্লাবে শেষবারের মতো পিয়ানো বাজিয়েছে। ওই ক্লাবের সিসিটিভি ফুটেজ দেখা হবে।

এবং পার্কিংলটের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যাবে আমাকে।

হয়তো দেখা যাবে আমার গাড়িও।

হয়তো দেখা যাবে, রিভসের সঙ্গে হেঁটে গিয়ে ওর হলুদ মাস্ট্যাং-এ উঠছি আমি।

তারপর আমার কাছে হাজির হবে পুলিশ। বলবে, মিস্টার রিভসকে আপনিই শেষবারের মতো জীবিত অবস্থায় দেখেছেন।

 অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, তাকালাম মোরার দিকে। ঘটনাস্থলে যেতে হবে আমাদেরকে। রিভসের ব্যাপারে পুলিশ কিছু করেছে কি না, জানতে হবে।

একটা গড়ান খেয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল মোরা। তোমার বস হঠাৎ মিটিং ডাকলেন কেন?

জানি না। তবে আমার মনে হয় কোথাও কোনো একটা ঘাপলা হয়েছে।

তা হলে যেয়ো না।

বলো কী! আমার বস যেতে বলেছেন, আর আমি যাবো না?

চলো আমরা দুজনে কোথাও পালিয়ে যাই।

দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, নামলাম বিছানা থেকে, মোরার দিকে এগিয়ে গিয়ে আলতো করে চুমু খেলাম ওর ঠোঁটে। বিশ্বাস করো, আজকের আগে এত চমৎকার কোনো পরামর্শ দেয়নি কেউ আমাকে কখনও। তারপরও করতে পারবো না কাজটা। আমি তোমাকে যেমন মনেপ্রাণে ভালোবাসি, ঠিক তেমন জানি, চাকরিসূত্রে কিছু-না-কিছু দায়িত্ব আছে আমার কাঁধে। কাজেই শেষপর্যন্ত যা ঘটবে, সেটার মুখোমুখি হতে হবে আমাকে।

জবাব না দিয়ে কাপড় পরতে শুরু করল মোরা।

আমিও তা-ই করলাম।

বাইরে বেরিয়ে এলাম দুজনে। পার্কিংলটটা একঝলক দেখল মোরা, দেখল রাস্তাটা। নিশ্চিত হলো, আমাদের অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে নেই কেউ আশপাশে কোথাও। একটা ঝুঁকি নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা। দুজনই উঠে পড়লাম একই গাড়িতে। রওয়ানা হলাম রুট টু হানড্রেড এইটির দিকে।

 জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে ঠিক কোন্ জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল রিভস, মনে আছে তোমার?

মাথা ঝাঁকাল মোরা। গুদামটা আর্ভিংটনে…ওখানকার কবরস্থানটা ছাড়িয়ে কিছুদূর গেলেই। হলুদ মাস্ট্যাংটা ছাড়িয়ে আরও কিছুদূর গেল মোরা, তারপর নিরিবিলি একজায়গায় গাড়ি থামাল।

এদিকওদিক তাকাচ্ছি আমি। পুরো এলাকা নির্জন। একটা মানুষ বা পথচারীও নজরে পড়ছে না। ওই গুদামের আশপাশে ধ্বংসপ্রাপ্ত কয়েকটা বাড়ি ছাড়া আর কিছু নেই।

তারমানে, ধরে নেয়া যায়, গতর তে মোরার উদ্ধার-অভিযানের পর কেউ আসেনি এখানে এখনও।

ধরে নেয়া যায়, আমরা এখন পর্যন্ত নিরাপদ।

 তোমার মিটিং কোথায় হবে? জিজ্ঞেস করল মোরা।

নিউআর্কে। তবে সেখানে যাওয়ার আগে আমাকে গোসল করতে হবে, জামাকাপড় বদল করতে হবে।

দুষ্টু হাসি হাসল মোরা। কেন…বিনা সাজেই তো তুমি আমার মনের মতো?

 প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার আগে শেভ না করলে, ইস্ত্রি-করা কাপড় না পরলে কেমন কেমন যেন লাগে আমার।

আজ শেভ না করেও সুন্দর দেখাচ্ছে তোমাকে। …আমি বলছি কথাটা, তারপরও বিশ্বাস হচ্ছে না?

হেসে ফেললাম।

হাসল মোরাও। ঠিক আছে। যাও, শেভ করো, ইস্ত্রি-করা কাপড় পরো…যেভাবে খুশি লাগে তোমার সেভাবে সাজো।

ওর একটা হাত ধরলাম। রাগ করলে নাকি?

না, ন্যাপ। কোথায় যাবে আগে?

হাঙ্ক-আ-হাঙ্ক-আ ক্লাবে। আমার গাড়িটা নেবো। তারপর আমার বাসায় ফিরে যাবো।

ঠিক আছে।

হাত ধরাধরি করে বসে আছি আমরা। একজন আরেকজনকে অনুভব করার চেষ্টা করছি।

একটা কথা বলি? নরম আর নিচু গলায় বলল মোরা।

হু।

এই পনেরো বছরে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য আমি যে কত হাজারবার ফোন নিয়েছি হাতে, নিজেও জানি না।

ফোন করলে না কেন?

ফোন করলে কী ঘটবে, তা জানা ছিল না বলে। আমি সবসময় চেয়েছি, তুমি যাতে বেঁচে থাকো, নিরাপদে থাকো। ন্যাপ, আজ অথবা আগামীকাল অথবা পরশু কী ঘটবে জানি না আমি; যদি খারাপ কিছু ঘটে, আর যদি মারা যাই আমি, আমাকে ছাড়া বেঁচে থাকতে পারবে না?

আমার বুকের ভিতর যেন হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মারল কেউ। টের পাচ্ছি, অদৃশ্য একটা হাত যেন শক্ত করে চেপে ধরতে চাইছে আমার গলা। জবাব দিলাম না প্রশ্নটার। শুধু বললাম, তোমার কিছু হবে না। চলো রওনা দিই।

মোরাও বোধহয় আবেগতাড়িত হতে চাইছে না, তাই গাড়ি চালাতে শুরু করল।

আমাকে ছাড়া কীভাবে ছিল সে, আর ওকে ছাড়া কীভাবে ছিলাম আমি, সেসব নিয়ে কথা বলতে বলতে হাঙ্ক-আ-হাঙ্ক-আ ক্লাবের কাছকাছি হাজির হয়ে গেলাম আমরা। ক্লাব থেকে দুই ব্লক দূরে গাড়ি থামাতে বললাম মোরাকে। আমি চাই না, ক্লাবের সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়ক, একসঙ্গে আছি আমরা।

গাড়ি থেমে নামতে যাবো, এমন সময় মোরা বলল, তোমার মোবাইলে। নতুন একটা অ্যাপ ইন্সটল করে দিয়েছি আমি।

একটু আশ্চর্য হলাম। কখন?

তুমি যখন ঘুমিয়ে ছিলে, তখন। ওটা ব্যবহার করে যোগাযোগ করতে পারবে আমার সঙ্গে। যতদূর জানি, এই অ্যাপ ট্রেস করার মতো কোনো প্রযুক্তি আবিস্কৃত হয়নি এখনও। কোনো মেসেজ আসার অথবা পাঠানোর পাঁচ মিনিটের মধ্যে সেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে ডিলিট হয়ে যায়।

বলতে ইচ্ছা করল, যা-ই ঘটুক না কেন, কথা দাও, আবার পালিয়ে যাবে না। কিন্তু বললাম না সেটা বলতে পারলাম না কেন যেন। তার বদলে ঝুঁকে পড়ে আলতো করে এবং সময় নিয়ে চুমু খেলাম ওকে।

মোরাও চুমু খেল আমাকে, তারপর একসময় আলতো ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল আমাকে। বলল, নিউআর্কের সেই অফিসের বাইরে তোমার জন্য অপেক্ষা করবো আমি।

নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে।

 চলে গেল মোরা।

এদিকওদিক তাকালাম। যেখানে রেখেছিলাম, সেখানেই আছে আমার গাড়িটা।

হাঙ্ক-আ-হাঙ্ক-আ ক্লাবটা এখন, স্বাভাবিকভাবেই, বন্ধ। পার্কিংলটে আরও দুটো গাড়ি দেখা যাচ্ছে।

চারপাশে সতর্ক নজর রেখে গিয়ে উঠলাম আমার গাড়িতে। একটুও দেরি না করে ওয়েস্টব্রিজে ফেরার পথ ধরলাম।

 গাড়ি চালাতে চালাতেই ফোন করলাম অগিকে। মোরার ফিরে আসা এবং রিভসের মৃত্যুর খবরটা জানানো দরকার তাঁকে।

অগি ফোন ধরার পর বললাম, আজ সকাল নটার সময় আমার সঙ্গে দেখা করতে চান মিউস।

কোন ব্যাপারে?

 বলেননি। …আপনাকে কয়েকটা কথা বলতে চাই।

শুনছি।

কাউন্টি প্রসিকিউটরের অফিসের বাইরে মাইকস নামে একটা কফিশপ আছে। পৌনে নটার সময় সেখানে দেখা করতে পারবেন আমার সঙ্গে?

পারবো।

 লাইন কেটে দিলেন অগি।

বাসায় পৌঁছে গেলাম আমি। ড্রাইভওয়েতে গাড়ি রাখলাম, নামলাম। এদিকওদিক তাকাচ্ছি।

আমার প্রতিবেশী ট্যামি ওয়ালশ কিছু একটা করছে ওদের লনে। আমাকে তাকাতে দেখে হাত নাড়ল। জবাবে হাত নাড়লাম আমিও।

সবকিছু স্বাভাবিক মনে হচ্ছে।

শত্রুপক্ষের কেউ কি আমার অপেক্ষায় ঢুকে বসে আছে বাসার ভিতরে? ওঁৎ পেতে আছে আমার জন্য?

ড্রাইভওয়েতে দাঁড়িয়ে ভালোমতো দেখলাম বাড়ির প্রতিটা জানালা।

 কোথাও কোনো নড়াচড়া নেই।

সবকিছু বড় বেশি স্বাভাবিক।

ঝুঁকি নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

 ঢুকে পড়লাম বাসায়।

না, কোথাও কেউ নেই।

 হাতে বেশি সময় নেই, তাই যত দ্রুত সম্ভব এবং যত ভালোভাবে সম্ভব চেক করলাম একতলাটা। কেউ নেই। দোতলা এবং তারপর চিলেকুঠুরিটাও দেখলাম। কেউ নেই।

আনমনে মাথা ঝাঁকিয়ে গিয়ে ঢুকলাম আমার ঘরে। কাপড় ছেড়ে বাথরুমে গেলাম, শাওয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম সেটার নিচে।

জলধারা আস্তে আস্তে যেন ঠাণ্ডা করছে আমার মাথাটা। আস্তে আস্তে যেন খেলায় ফিরে আসছি আমি আবার। সত্যি কথাটা অনেকখানি জানা হয়ে গেছে আমার। আর কিছু কি জানতে বাকি আছে? মনে হচ্ছে আছে। কেন যেন মনে হচ্ছে, কোথাও কিছু একটা মিস করছি আমি। নাকি এটা আমার অতিকল্পনা?

পরিত্যক্ত ওই সামরিক ঘাঁটি কোনোকালেই কৃষি-গবেষণাকেন্দ্র ছিল না, ছিল একটা ব্ল্যাক সাইট-কুখ্যাত এবং মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসীদের জন্য। গোপন কথাটা গোপন রাখার জন্য সরকারি লোকজন কি খুন করতেও পিছ পা হতো না? মোরা যেমনটা বলেছে…নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল ওরা সে রাতে; ও-রকম কাজ করার অনুমতি কে দিল ওদেরকে?

 সে-রাতে মোরাকে দৌড়াতে দেখেই গুলি করতে শুরু করে দিল ওরা? নাকি অন্য কিছু একটা ঘটেছিল যা এখনও জানি না আমি?

কী ঘটেছিল? ঘাঁটির লোকগুলো কি কোনো কারণে ঘাবড়ে গিয়েছিল?

যা-ই ঘটে থাকুক, গুলি চালানো হয়েছিল এবং মারা পড়েছিল লিও আর ডায়ানা। যা-ই ঘটে থাকুক, পুলিশে খবর দেয়নি অথবা দেয়ার সাহস পায়নি রিভস আর ওর সাঙ্গোপাঙ্গরা। কেন করেনি ওরা কাজটা? উত্তরটা সহজ। পুলিশ যদি একটাবার ঢুকত ওই ঘাঁটিতে, কৃষি-গবেষণাকেন্দ্রের নামে কী চলছিল সেখানে তা জেনে যেত সারা দেশ।

আরেকটা কথা। ওই ঘাঁটির লোকেরা ইচ্ছা করলেই গুম করে ফেলতে পারত লিও আর ডায়ানার লাশ। কিন্তু কাজটা করেনি তারা। কেন করেনি, তা-ও বোঝা যাচ্ছে। জলজ্যান্ত দুটো মানুষ হারিয়ে গেলে তদন্ত হতোই। বিশেষ করে ডায়ানার খোঁজে পুরো ওয়েস্টব্রিজ তন্নতন্ন করে ফেলতেন অগি। সে-ঝুঁকি নেয়াটা সম্ভব ছিল না রিভস আর ওর চামচাঁদের পক্ষে।

আমার অনুমান, লিও আর ডায়ানার মৃতদেহ থেকে সব বুলেট বের করে নিয়েছিল ঘাঁটির ওই লোকগুলো। তারপর ওদেরকে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেয় চলন্ত ট্রেনের সামনে। ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় ওদের শরীর, ফলে ওদের মৃত্যুর আসল কারণ বুঝতে পারা তো পরের কথা, অনুমান করাও সম্ভব ছিল না মেডিকেল একযামিনারের পক্ষে।

তারমানে এখন কি আমার সেই ঘাতক প্রশ্নগুলোর সব কটার জবাব পেয়ে গেছি?

নাকি কোনো কোনো প্রশ্নের জবাব এখনও জানা বাকি আছে আমার?

যেমন, পনেরো বছর কেন আবার হাত বাড়ানো হলো কন্সপাইরেসি ক্লাবের সদস্যদের দিকে? কেন খুন করা হলো রেক্স আর হ্যাঙ্ককে?

ওই ক্লাবের মাত্র দুজন সদস্য বেঁচে আছে এখনও।

 এক, বেথ। লুকিয়ে আছে সে।

এবং দুই, মোরা।

মানে কি এসবের? ধাঁধাটা কি এখনও ধাঁধাই রয়ে গেছে আমার জন্য? অগির সঙ্গে যখন দেখা হবে, তিনি কি কোনো সদুত্তর দিতে পারবেন?

তিনি কি কোনো সদুত্তর দেবেন আসলে?

.

মাইকস কফি শপে শুধু কফিই পাওয়া যায় না, পিটজাও পাওয়া যায়। অথচ দোকানটা দেখতে কফি শপের মতোও না, পিটজার দোকানের মতোও না। নিউআর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে, ব্রড অ্যান্ড উইলিয়ামের এককোনায় অবস্থিত ওটা। দোকানের সামনে বড় একটা লাল ক্যানভাসের আচ্ছাদন আছে।

একদিকের জানালার পাশে বসে আছেন অগি। সকাল নটা বাজার আগেই পিটজা খেতে শুরু করে দিয়েছে এক লোক, তার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। আমাকে দেখতে পেলেন তিনি, দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন ওই লোকের উপর থেকে।

বসে পড়লাম তার মুখোমুখি।

কী হয়েছে? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

লিও আর ডায়ানা ট্রেনের-নিচে কাটা পড়ে মরেনি। ওদেরকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।

 কী! অথবা কী বলছ আবোলতাবোল! অথবা বুলেটের কোনো নমুনাই পাওয়া যায়নি ওই দুজনের লাশে, জাতীয় কোনো কথা বললেন না অগি। বরং বললেন, খুলে বলো।

 যা-যা ঘটেছে এবং যা-যা জানতে পেরেছি, বললাম তাকে। শুধু চেপে গেলাম রিভসের মৃত্যুর ব্যাপারটা-মানে, মোরা যে গুলি করেছে লোকটাকে, বললাম না সেটা।

অগিকে বিশ্বাস করি আমি। কিন্তু এটাও জানি, কর্তব্যের খাতিরে আমাকেও ফাঁসিতে ঝোলাতে পারেন তিনি–তার মতো মানুষদের কাছে নীতির কোনো বিকল্প নেই। তাঁকে যদি বলে দিই কে গুলি চালিয়েছে রিভসের উপর, আদালতে যখন সত্যি বলার জন্য শপথ নেবেন তিনি, হয়তো অবলীলায় বলে দেবেন মোরার নাম।

 খেয়াল করলাম, আমার কথা শোনার সময় বার বার কুঁচকে যাচ্ছে অগির চোখমুখ। মনে হচ্ছে, বুকে-পেটে একের পর এক ঘুসি হজম করতে বাধ্য হচ্ছেন তিনি। তাঁর অবস্থা দেখে বিরতি দিতে চাইলাম, কিন্তু বুঝতে পারলাম, পরে যখনই বলবো কথাগুলো, একই প্রতিক্রিয়া হবে।

আমার কথা শেষ হওয়ার পর চেয়ারে হেলান দিলেন অগি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন।

এদিকওদিক তাকাচ্ছি আমি।

ওই লোক এখনও পিটজা খাচ্ছে। ব্রড স্ট্রীট ধরে সাঁই সাঁই করে চলে যাচ্ছে একের পর এক গাড়ি। পায়ে হেঁটে কাজে যাচ্ছে অনেক মানুষ। পনেরো বছর আগের একরাতের একটা ঘটনা আমার আর অগির…দুজন মানুষের…জীবন থেকে জীবন কেড়ে নিয়েছে, অথচ তাতে কোনো পরিবর্তন হয়নি পৃথিবীর। পৃথিবীটা আগের মতোই আছে, থাকবে।

 আমার দিকে মুখ ফেরালেন অগি। আর কিছু বলার আছে তোমার? নাকি যা বলার ছিল, বলে ফেলেছ?

আমার মনে হয় আরও কিছু বলার আছে।

যেমন?

ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার আছে লিও আর ডায়ানার।

 মরা মানুষের বিচার করে না পৃথিবীর কোনো আদালত।

 মানে?

তুমিই তো বললে মারা গেছে রিভস।

ওই লোকের সাঙ্গোপাঙ্গরা ছিল ঘাঁটিতে সে-রাতে।

তুমি কি তাদের সবাইকে ধরতে চাও? তাদের সবার বিচারের ব্যবস্থা করতে চাও?

আপনি চান না?

 মুখ ঘুরিয়ে নিলেন অগি। জবাব দিলেন না।

কেউ একজন গুলি করেছে আমার ভাই আর আপনার মেয়েকে। কেউ একজন তাদের মৃতদেহ থেকে বুলেট বের করেছে। কেউ একজন আপনার মেয়ের লাশটা ছুঁড়ে মেরেছে চলন্ত ট্রেনের সামনে…

আর বলতে হলো না, চেহারা কুঁচকে গেল অগির। চোখ বন্ধ করে ফেলেছেন তিনি।

অগি, সারাটা জীবন অন্যায় আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। আপনি। অন্যায় আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রেরণা জুগিয়েছেন আমাকে, কীভাবে সে-লড়াই করতে হয় তা হাতে-ধরে শিখিয়েছেন। যখনই কোনো কেসে হতোদ্যম হয়ে পড়েছি আমি, আপনিই আমাকে বলেছেন, তুমি যদি হ্যাল ছেড়ে দাও তা হলে খারাপ লোকগুলোকে শাস্তি দেবে কে? আমার ভাইয়ের কথা না-হয় বাদ দিলাম, আপনার মেয়ের সঙ্গে যা ঘটেছে তা কি ঠিক হয়েছে? যারা কাজটা করেছে, তাদের কি শাস্তি হওয়া উচিত না?

শাস্তি তো হয়েছে। তুমি শাস্তি দিয়েছ রিভসকে।

আমি যদি তা করেও থাকি, যথেষ্ট হয়নি। সামনের দিকে ঝুঁকলাম আমি, এক ধরনের নিষ্ঠুরতা পেয়ে বসেছে আমাকে। আপনি কিছু একটা লুকিয়েছেন এবং আজও লুকাচ্ছেন আমার কাছে। কী সেটা?

দুহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরলেন অগিযেন হঠাৎ প্রচণ্ড মাথাব্যথা শুরু হয়েছে তার।

অগি?

হাত দিয়ে চেহারা মুছলেন অগিযেন পানি লেগে ছিল সেখানে। আবার যখন তাকালেন আমার দিকে, দেখতে পেলাম, তার দুই চোখ লাল হয়ে গেছে। তুমি বলেছ, সে-রাতে ঘটনাটার জন্য নিজেকে দোষী করেছে মোরা।

 হ্যাঁ। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে ওর কোনো দোষ ছিল না। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় আমি যদি দৌড়াতে শুরু করি আর আপনার হাতে তখন যদি পিস্তল থাকে, আমাকে গুলি করতে পারেন না আপনি।

 কিন্তু আমি যদি বলি সব দোষ মোরার, তুমি কি ওকে শাস্তি দেবে?

থমকে গেছি আমি। কথা সরছে না আমার মুখে। তাকিয়ে আছি অগির দিকে।

 উজ্জ্বল আলোর কথা বলেছে মোরা, বলছেন অগি। অনেক লোকের চেঁচামেচির কথা বলেছে।

বলেছে, মাথা ঝাঁকালাম আমি। তো?

আজ থেকে পনেরো বছর আগে ওই ঘাঁটির কাছেপিঠে হাতেগোনা কয়েকজন সাধারণ নাগরিক বাস করত। যেমন ডোডি মেয়ার, কার্লিনো পরিবার, দ্য ব্রানুস। সে-রাতে ডোডি মেয়ার ফোন করেছিল আমাকে। আমি তখন অফিসেই ছিলাম। বলল, কিছু একটা ঘটছে ওই ঘাঁটিতে। বলল, সে-ও নাকি উজ্জ্বল আলো দেখেছে সেখানে। বলল, ওর ধারণা উচ্ছঙ্খল ছেলেছোকরার দল ঢুকে পড়েছে ওই জায়গায়, ফ্লাডলাইট জ্বালিয়ে দিয়েছে, সমানে পটকা ফাটাচ্ছে।

কী করলেন আপনি তখন?

গেলাম ওই ঘাঁটিতে। কিন্তু যতক্ষণে পৌঁছালাম, ফ্লাডলাইট বা স্পটলাইট যা-ই বলল, নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। দেখলাম, তারকাঁটার বেড়ার সঙ্গে যে-গেট ছিল, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা পিকআপ ট্রাক। বুঝতে পারলাম, আর কিছুক্ষণের মধ্যে রওনা দেবে সেটা। ট্রাকে ওঠানো হয়েছে কিছু একটা, তেরপল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। আগন্তুকদের জন্য ঘণ্টার ব্যবস্থা ছিল, বাজালাম ওটা। বেরিয়ে এল অ্যান্ডি রিভস। ততক্ষণে অনেক রাত হয়েছে; ডিপার্টমেন্ট অভ অ্যাগ্রিকালচারের কম্পাউন্ডে অত রাতে কী করছিল এত লোক, জিজ্ঞেস করলাম না রিভসকে। সরকারের উপর অগাধ আস্থা ছিল আমার তখন, আস্থা ছিল সরকারি লোকদের উপরও। তাই রিভসকে বললাম, একটা ডিসটার্বেন্স কল পেয়েছি আমি।

সে কী বলল?

বলল, একটা হরিণ নাকি লাফিয়ে ঢুকে পড়েছিল তারকাঁটার বেড়ার ভিতরে। ফলে অ্যালার্ম বাজতে শুরু করে, আর আলো জ্বলে ওঠে। নতুন নিয়োগ-পাওয়া একজন গার্ড নাকি ঘাবড়ে যায়, গুলি করতে শুরু করে। ফলে মারা যায় হরিণটা। ইশারায় আমাকে তেরপলটা দেখিয়ে দেয় রিভস।

বিশ্বাস করেছিলেন ওর কথা?

আসলে…ওর বক্তব্য ঠিক মেনে নিতে পারিনি আমি। কিন্তু কিছু বলিনি ওকে। কারণ, একটু আগেই বললাম, ওদেরকে সন্দেহ করার মতো কিছু জানতে পারিনি আমি তখনও।

কী করলেন তারপর?

বাসায় ফিরে এলাম। আমার শিফট ততক্ষণে শেষ হয়ে গেছে। অপেক্ষা করতে লাগলাম ডায়ানার জন্য। সে-অপেক্ষা আর ফুরাল না। কয়েক ঘণ্টা পর… কথা শেষ না করে কাঁধ ঝাঁকালেন অগি, দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

লিও আর ডায়ানার মরদেহ পাওয়ার খবরটা জানিয়ে কেউ একজন ফোন করল আপনাকে, তা-ই না?

হু, ছলছল করছে অগির চোখ।

তারপরও আপনি ওই ঘাঁটির সঙ্গে লিও আর ডায়ানার মৃত্যুর কোনো যোগসূত্র পাননি?

 না, পাইনি। হয়তো…আমি কোনো যোগসূত্র পেতে চাইনি। হয়তো আমি কল্পনাই করিনি, ও-রকম কোনো যোগসূত্র থাকতে পারে।

ভাইব্রেট করে উঠল আমার মোবাইল। পকেট থেকে ওটা বের করে সময় দেখলাম। নটা দশ।

 মোরা মেসেজ পাঠিয়েছে: তুমি কোথায়?

ফিরতি মেসেজ পাঠালাম আমি: এক মিনিটের মধ্যে আসছি।

উঠে দাঁড়ালাম আমি।

মেঝের দিকে তাকিয়ে আছেন অগি। মুখ না তুলেই বললেন, তোমার দেরি হয়ে গেছে। যাও।

 ইতস্তত করছি। অগিকে এভাবে বিধ্বস্ত অবস্থায় রেখে যেতে ইচ্ছা করছে না, কিন্তু আমাকে যেতে হবে। টের পাচ্ছি, অসহ্য একটা মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন অগি…গত পনেরোটা বছর ধরে ভুগছেন।

তেরপলটা যদি একটাবার সরিয়ে দেখতেন তিনি..

 আমার ফোন বেজে উঠল।

 মিউস।

 কল রিসিভ করলাম। চলে এসেছি।

কী করেছ তুমি এটা?

 কেন, কী হয়েছে?

এই মুহূর্তে হাজির হও আমার সামনে।

.

৩১.

আমি যেখানে কাজ করি, অর্থাৎ এসেক্স কাউন্টি প্রসিকিউটরের অফিসটা মার্কেট স্ট্রীটে। জায়গাটা সবসময়ই গমগম করতে থাকে। পুরো রাজ্যের এক-তৃতীয়াংশের বেশি ক্রিমিনাল কেস নিয়ে কাজ করা হয় এখানে।

 ওই অফিসে ঢুকছি, এমন সময় অপরিচিত একটা ডিং-ডিং আওয়াজ করে উঠল আমার মোবাইল ফোন। বুঝলাম, মোরার ইন্সটল-করা সেই অ্যাপ করেছে শব্দটা।

ওর পাঠানো মেসেজ পড়লাম: হলুদ মাস্ট্যাংটা পেয়ে গেছে পুলিশ।

খারাপ খবর। তারপরও সময় ও সুযোগ দুটোই আছে আমার হাতে। পাল্টা মেসেজ পাঠালাম: ঠিক আছে। মিটিং-এ যাচ্ছি।

মিটিংরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন মিউস, আমাকে দেখতে পাওয়ামাত্র খঞ্জরদৃষ্টি দেখা দিল তাঁর চোখে। আগেও হয়তো বলেছি, তিনি বেঁটেখাটো একজন মানুষ। তার পাশে সবসময় স্যুট-পরিহিত এক বা একাধিক দীর্ঘদেহী লোক থাকে। ফলে তাকে আরও বেঁটে দেখায়। এখন তার দুপাশে দুজনকে দেখা যাচ্ছে। ওই দুজনের মধ্যে যার বয়স কম, তার হ্যালকাঁপাতলা শরীরটা তারের মতো পাকানো। দৃষ্টি কঠোর। আর যার বয়স বেশি, তার টেকো মাথায় বলয়ের মতো আটকে রয়েছে কয়েকগাছি চুল। লোকটার পেট এত মোটা যে, আমার মনে হচ্ছে তার শার্টের কয়েকটা বোতাম সুতোর-বাঁধন-ছিড়ে খসে পড়বে এখনই।

মিউসের অফিসে যখন ঢুকলাম আমরা, বয়স্ক ওই লোক বলল, আমি স্পেশাল এজেন্ট রকডেল। ইঙ্গিতে দেখাল হ্যালকাঁপাতলা লোকটাকে। আর সে স্পেশাল এজেন্ট গার।

এফবিআই।

হাত মেলালাম আমরা।

মিউসের দিকে তাকাল রকডেল। আপনার সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ, ম্যাম। আমাদেরকে এখানে রেখে কিছু সময়ের জন্য যদি বাইরে যান আপনি, কৃতজ্ঞ থাকবো।

কথাটা পছন্দ হলো না মিউসের। বাইরে যাবো?

 জী, ম্যাম।

কিন্তু এই অফিস আমার।

আপনি যদি কাজটা করেন, আপনার সহযোগিতার প্রশংসা করবে ব্যুরো। ডিটেক্টিভ ডুমাসের সঙ্গে একা কথা বলতে চাই আমরা।

না, বললাম আমি।

আমার দিকে তাকাল মোটু-পাতলু।

জী? বলল মোটু।

যা-ই জিজ্ঞেস করেন না কেন আপনারা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় এখানে উপস্থিত থাকবেন প্রসিকিউটর মিউস।

আমরা কিন্তু আপনাকে সন্দেহ করছি না, বলল মোটু।

তারপরও আমি চাই, এখানে থাকবেন মিউস।

 মিউসের দিকে তাকাল রকডেল।

 দুমা কী বলেছে, শুনেছেন আপনারা, বললেন মিউস।

 ম্যাম,..

থামুন! ঢং করবেন না আমার সঙ্গে। ম্যাম বলে ডাকবেন না। আমাকে। আপনার ঢং দেখে মনে হচ্ছে ওয়েস্টার্ন কোনো সিনেমার শুটিং। চলছে এখানে।

সরি, প্রসিকিউটর মিউস। তবে…উপর থেকে ফোন এসেছে আপনার কাছে, ঠিক না?

হ্যাঁ, এসেছে।

উপর থেকে মানে কী? কাজের দিক দিয়ে মিউসের উপরওয়ালা হচ্ছেন নিউ জার্সির গভর্নর। তিনি ফোন করেছেন মিউসকে আমার ব্যাপারে?

নিশ্চয়ই তিনি সহযোগিতা করতে বলেছেন আপনাকে বলছে রকডেল। নিশ্চয়ই তিনি বলেছেন, জাতীয় নিরাপত্তার এই ইস্যুতে ব্যুরোর আইনগত-অধিকারের একটা ব্যাপার আছে?

ভাইব্রেট করে উঠল আমার মোবাইল। ওটা পকেট থেকে বের করে আড়চোখে তাকালাম।

আশ্চর্য! এস.এম.এম. পাঠিয়েছে আমার প্রতিবেশী ট্যামি ওয়ালশ:

ভ্যানে করে একদল লোক এসেছে তোমার বাসায়।
সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে কী যেন খুঁজছে ওরা।
 ওদের সবার পরনে এফবিআই-এর উইন্ডব্রেকার।

.

ট্যামি আমাকে এস.এম.এস পাঠানোয় আশ্চর্য হয়েছি, কিন্তু সেটা পড়ে আশ্চর্য হলাম না। এফবিআই-এর লোকেরা তন্নতন্ন করে কী খুঁজছে, জানি।

 হ্যাঙ্কের সেই ভিডিওটেপ।

 কিন্তু ওরা সেটা খুঁজে পাবে না আমার বাসায়। কারণ আমি সেটা দাফন করে রেখেছি এমন এক জায়গায়, যা হয়তো কল্পনাও করতে পারবে না কেউ-পুরনো সেই ঘাটি-সংলগ্ন জঙ্গলে।

কাজেই বুঝতেই পারছেন, যেন তর্কে জিতে গেছে এমন ভঙ্গিতে বলল রকডেল, ডিটেক্টিভ ডুমাসের সঙ্গে যা কথা হবে আমাদের, তা খুবই গোপনীয়।

আমার দিকে তাকালেন মিউস। ন্যাপ?

অসহ্য একটা রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে আমার ভিতরে। পুরো ঘটনাটা…পনেরো বছর আগে যা শুরু হয়েছিল এবং যা এখনও চলছে…যেন অসহ্য কোনো আন্দোলন জাগিয়ে তুলেছে আমার ভিতরে। মনে পড়ে যাচ্ছে, অগি বলেছিলেন, এই গোপন ব্যাপারটা গোপন রাখাই উচিত। মনে পড়ে যাচ্ছে, তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, লিও-ডায়ানা-রেক্স হ্যাঙ্কের ভাগ্যে যা ঘটেছে, তার জন্য আসলে কাকে দোষ দেয়া উচিত।

এদিকওদিক তাকালাম আমি। মিউসের অফিসে ঢুকেছি আমরা, কিন্তু দরজার কাছ থেকে বেশি দূরে যাইনি। চারজন সাপোর্ট স্টাফ আছে মিউসের, চারজনই দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাইরে; এমন ভান করছে যেন আমাদের কথাবার্তার কিছুই শুনছে না, কিন্তু আমি জানি আসলে ওদের কান খাড়া আছে। তাকালাম দুই স্পেশাল এজেন্টের দিকে। নিস্পৃহ দৃষ্টিতে আমাকেই দেখছে রকডেল। আর ক্রুগার বার বার হাত মুঠ করছে ও খুলছে; এমনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে যে, ওর দৃষ্টি লক্ষ করে আমার মনে হচ্ছে, আমি যেন এইমাত্র বের হয়েছি কোনো কুকুরের মলদ্বার দিয়ে।

আর সামলাতে পারলাম না আমি রাগটা।

ঘুরলাম মিউসের দিকে, প্রায় চেঁচিয়ে বলে উঠলাম, পনেরো বছর আগে ওয়েস্টব্রিজের ওই পরিত্যক্ত সামরিক ঘাঁটি ব্যবহৃত হচ্ছিল আইনবিরোধী একটা ব্ল্যাক সাইট হিসেবে। যেসব আমেরিকান জড়িয়ে পড়েছিল সন্ত্রাসের সঙ্গে, তাদেরকে পাকড়াও করতে পারলে গোপনে নিয়ে যাওয়া হতো ওই ঘাঁটিতে, জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো। ওসব সাইট পরিচালনা করাই হচ্ছিল যাতে ওই সন্ত্রাসীরা আইনের কোনো সাহায্য পেতে না পারে। …আমার যমজ ভাই তখন পড়ত হাইস্কুলে; একরাতে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে যায় সে ওই ঘাঁটির কাছে, সেখানে একটা ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টারের অবতরণ-দৃশ্য ভিডিও করে। এই লোকগুলো, ইঙ্গিতে দেখালাম দুই স্পেশাল এজেন্টকে, ওই ভিডিওটেপটা চায় আমার কাছ থেকে। এবং এই মুহূর্তে ওই টেপের খোঁজে আমার বাড়ি তছনছ করে ফেলছে এদের দুজনের সহকর্মীরা।

বড় বড় হয়ে গেছে ক্রুগারের দুই চোখ, রেগে গেছে সে। লাফিয়ে আগে বাড়ল, আমার গলা চেপে ধরতে চায়। কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টাও হয়নি দম-বন্ধ-হয়ে-যাওয়ার অনুভূতির বিরুদ্ধে জীবন-মরণ লড়াই করেছি আমি, কাজেই আমার ভিতরে কিছু একটা…আদিম কিছু একটা জেগে উঠল মুহূর্তের মধ্যে, হুঙ্কার দিয়ে উঠলাম আমি। লাফিয়ে আগে-বাড়া ক্রুগারের সোলার প্লেব্লাসে প্রচণ্ড একটা লাথি মারলাম। লাথিটা খেয়ে বসে পড়তে বাধ্য হলো গার, সব বাতাস বেরিয়ে গেছে ওর ফুসফুস থেকে। এবার লাফিয়ে আগে বাড়লাম আমি, হাত মুঠ করে আছি, রকডেল যদি বীরোচিত কিছু করতে চায় তা হলে সমুচিত জবাব দেবে।

কিন্তু সে-রকম কিছু করল না রকডেল। আহত দষ্টিতে তাকিয়ে আছে ক্রগারের দিকে। কিছুক্ষণ পর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি এইমাত্র একজন ফেডেরাল অফিসারের গায়ে হাত তুললেন।

ন্যাপ যা করেছে, আত্মরক্ষার খাতিরে করেছে! চিৎকার করে উঠলেন মিউস। শুরুটা করেছেন আপনারা! কী পেয়েছেন আপনারা? এফবিআই হয়েছেন বলেই কি যেখানে-খুশি-সেখানে মারামারি শুরু করে দেবেন?

মিউসের দিকে তাকাল রকডেল। আপনার লোক একটা গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে। এটা একটা অপরাধ। বিশেষ করে কথাটা যখন মিথ্যা, তখন।

কথাটা মিথ্যা হলে ওটাকে গোপন তথ্য বলছেন কেন? খেঁকিয়ে উঠলেন মিউস।

আবারও ভাইব্রেট করে উঠল আমার মোবাইল।

এবার মেসেজ পাঠিয়েছে এলি।

 এবং সেটা পড়ামাত্র বুঝতে পারলাম, এই মুহূর্তে এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া উচিত আমার: বেথকে খুঁজে পেয়েছি।

মুহূর্তের মধ্যে শান্তিপ্রিয়-মানুষের একটা অদৃশ্য মুখোশ পরে ফেললাম আমি নিজের চেহারায়। সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম ক্রুগারের দিকে। সরি। 

ধাক্কা মেরে আমার হাত সরিয়ে দিল গার।

নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলেন মিউস। তার মুখোমুখি তিনটা চেয়ারে বসলাম আমি, রকডেল আর কুগার।

আমি যদি দুটো মিনিট চেয়ে নিই আপনাদের কাছে, বিনয়ের অবতার সাজার চেষ্টা করছি আমি, তা হলে কি কিছু মনে করবেন আপনারা?

কী সমস্যা? ভ্রূ কুঁচকে গেছে মিউসের।

বাথরুমে যাবো। কাজ সেরেই চলে আসবো।

কারও অনুমতির তোয়াক্কা না করে বেরিয়ে এলাম মিউসের অফিস থেকে। করিডর ধরে হাঁটছি, কেউ অনুসরণ করছে না আমাকে। সোজা গিয়ে হাজির হলাম পুরুষ টয়লেটের দরজায়। এদিকওদিক তাকিয়ে পাশ কাটলাম ওটা, এগিয়ে যাচ্ছি সিঁড়ির দিকে। তারপর একছুটে নেমে এলাম একতলায়, দৌড়াতে শুরু করলাম।

রকডেল আর ক্রুগারের সঙ্গে আসমান-জমিনের সমান দূরত্ব তৈরি করতে চাই আমি এখন।

ফোন করলাম এলিকে। বেথ কোথায়?

ফার হিলসে, ওর বাবা-মার সেই ফার্মে। ওখানে একটা মেয়েকে দেখেছি আমি, ওকে বেথের মতোই লেগেছে আমার কাছে। তুমি কোথায়?

নিউআর্কে।

বেথের ঠিকানাটা মেসেজ করে দিচ্ছি তোমার কাছে। এখনই যদি রওনা হও, ওখানে পৌঁছাতে বড়জোর এক ঘণ্টা লাগবে তোমার।

লাইন কেটে দিলাম। মার্কেট স্ট্রীট ধরে দৌড়াচ্ছি এখন। বেশ কিছুদূর এগিয়ে মোড় নিলাম ইউনিভার্সিটি অ্যাভিনিউর দিকে। থামলাম একজায়গায়। মোরা যে-অ্যাপ ইন্সটল করে দিয়েছে আমার মোবাইলে, চালু করলাম সেটা।

 ধুকপুক করছে আমার বুকের ভিতরে-না, দৌড়ানোর কারণে না, মোরা হয়তো আবার গায়েব হয়ে গেছে ভেবে। আশঙ্কা হচ্ছে, আমি যদি যোগাযোগ করি ওর সঙ্গে তা হলে জবাব দেবে না সে।

কিন্তু নিজের মোবাইল বোধহয় হাতেই নিয়ে বসে ছিল মোরা।

কী হয়েছে? জিজ্ঞেস করল সে।

তুমি কোথায়? পাল্টা প্রশ্ন করলাম আমি।

যেখানে থাকার কথা ছিল। মার্কেট স্ট্রীটে, প্রসিকিউটরের অফিসের সামনে।

তা হলে এই মুহূর্তে চলে এসো ইউনিভার্সিটি অ্যাভিনিউতে।

কেন? কী হয়েছে?

পুরনো একজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে হবে আমাদের।

.

৩২.

মোরা আমাকে ওর গাড়িতে তুলে নেয়ামাত্র মেসেজ পাঠালাম মিউসের মোবাইলে:  সরি। পরে সব বলবো আপনাকে।

কোথায় যাচ্ছি আমরা? জিজ্ঞেস করল মোরা।

বেথের সঙ্গে দেখা করতে।

 ওকে খুঁজে পেয়েছ তুমি?

এলি করেছে কাজটা।

আমার মোবাইলে একটা নেভিগেশন অ্যাপ আছে; এলি আমাকে যে মেসেজ পাঠিয়েছে, সেটা কপি-পেস্ট করে দিলাম ওই অ্যাপের নির্দিষ্ট একটা জায়গায়। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই জানিয়ে দিল অ্যাপ, জায়গামতো যেতে আটত্রিশ মিনিট লাগবে আমাদের।

 শহর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছি আমরা, এগোচ্ছি পশ্চিমদিকে-রুট সেভেনটি এইট অভিমুখে।

এসবের সঙ্গে বেথ জড়িয়ে গেল কেন? জানতে চাইল মোরা।

তোমার মনে নেই? সে-রাতে যখন ভিডিও করছিলে তোমরা, তোমাদের সঙ্গে ছিল বেথ, রেক্স আর হ্যাঙ্ক।

 মাথা ঝাঁকাল মোরা। কাজেই পালিয়ে বেড়ানোর যথেষ্ট কারণ আছে আমাদের সবার।

 বেথ আর রেক্স পালিয়ে যায়নি, শুধু ওয়েস্টব্রিজ ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আর হ্যাঙ্ক…ওর কথা আলাদা। এখন আমি বুঝতে পারছি কেন সে প্রতিদিন হাঁটতে হাঁটতে চলে যেত ওই ঘাঁটির কাছে। কেন সে গিয়ে হাজির হতে রেলরোড ট্রাকে। ওর অসুস্থ মনে অসহনীয় বোঝা হয়ে চেপে বসেছিল সে রাতের স্মৃতি। সে-রাতে, খুব সম্ভব, ওই ঘাঁটির কাছে ছিল সে-ও; লিও আর ডায়ানাকে গুলি খেয়ে মরতে দেখেছে তোমার মতোই।

আমি কিন্তু গুলি খেয়ে মরতে দেখিনি লিও আর ডায়ানাকে।

জানি। কিন্তু যদি ধরে নিই সে-রাতে তুমি বাদে কন্সপাইরেসি ক্লাবের সবাই, মানে লিও-ডায়ানা-হ্যাঙ্ক-বেথ-রেক্স উপস্থিত ছিল ওই ঘাঁটির কাছে? যদি ধরে নিই ওরাও দেখেছে ওই স্পটলাইট, গুলির শব্দ শুনেছে, তারপর প্রাণভয়ে পালিয়েছে? কিন্তু হ্যাঙ্ক-বেথ-রেক্স পরদিন যখন জানতে পেরেছে ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মরেছে লিও আর ডায়ানা, পুরো ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর কিছু-একটা হয়ে গেছে ওদের কাছে।

মাথা ঝাঁকাল ডায়ানা। দুইয়ে দুইয়ে যোগ করে ওরা হয়তো বুঝে গিয়েছিল, ঘাঁটির ওই লোকগুলোই লিও আর ডায়ানার লাশ ফেলে দিয়েছিল চলন্ত ট্রেনের নিচে।

ঠিক।

হাইওয়েতে গাড়ি তুলল মোরা। কিন্তু ওরা শহরেই রয়ে গিয়েছিল। কাজেই আমরা ধারণা করে নিতে পারি, ঘাঁটির ওই লোকগুলো হ্যাঙ্ক, রেক্স আর বেথের ব্যাপারে কিছু জানত না। ওই লোকগুলো সে-রাতে হয়তো শুধু লিও আর ডায়ানাকে দেখে ফেলেছিল।

 রিভসের প্রতিক্রিয়া দেখে আমার মনে হয়েছে, ভিডিওটেপটার ব্যাপারেও কিছু জানত না সে।

কাজেই সে এবং ওর চামচারা ধরে নেয়, ঘাঁটিতে সে-রাতে যা ঘটেছিল, সেটার একমাত্র জীবিত প্রত্যক্ষদর্শী আমি।

খুব সম্ভবত।

কিন্তু কন্সপাইরেসি ক্লাবের পেছনে পনেরো বছর পর লাগল কেন। লোকগুলো?

উইন্ডশিল্ড দিয়ে তাকিয়ে আছি রাস্তার দিকে, ভাবছি মোরার কথাটা। কিছুক্ষণ পর, স্বগতোক্তির ঢঙে বললাম, ভাইরাল ভিডিও।

কী?

হ্যাঙ্কের সেই ভাইরাল ভিডিও এবং ওর হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম মোরাকে।

মোরা বলল, তারমানে, তোমার ধারণা, ওই ঘাঁটির কেউ-না-কেউ সম্প্রতি দেখেছে ভিডিওটা এবং চিনতে পেরেছে হ্যাঙ্ককে?

হতে পারে।

ভাইরাল ভিডিওতে হ্যাঙ্ককে দেখামাত্র চিনতে পারল, অথচ হ্যাঙ্ক গত পনেরোটা বছর ঘুরে বেড়াল ওদের চোখের সামনে দিয়ে, তখন চিনতে পারল না? না, ন্যাপ, আমার মনে হয় এখনও কিছু-একটা মিস করছি আমরা।

প্রতিবাদ করলাম না। ভাবছি কথাটা।

গত পনেরোটা বছর নিরাপদে ছিল হ্যাঙ্ক, রেক্স আর বেথ। তারপর ইন্টারনেটে ভাইরাল হলো এমন একটা ভিডিও যেটাতে স্পষ্ট দেখা গেছে হ্যাঙ্ককে। আর তারপরই…

মাথা নাড়লাম আনমনে। কোথাও-না-কোথাও কোনো-না-কোনো যোগসূত্র আছেই।

হাইওয়ের একধারে একটা সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে: ওয়েলকাম টু ফার হিলস।

ফার্ম কান্ট্রি বলতে যা বোঝায়, ফার হিলস আসলে সে-রকম কোনো জায়গা না। আসলে এই জায়গায় হচ্ছে ওই সব পয়সাওয়ালার জন্য, যারা নিরিবিলি কোনো জায়গায় বিশাল প্লট কিনতে চায় এবং যারা তাদের প্লটের আশপাশে কোনো প্রতিবেশী চায় না। এখানকার এক লোককে চিনি আমি, যার পুট এতই বড় যে, একটা থ্রি-হোল গল্ফ কোর্স অনায়াসে বানানো যাবে তার জমিতে। এখানকার আরেক লোক তার জমিতে ঘোড়া লালনপালন করেন। আরেকজন আপেলের চাষ করেন। মোদ্দাকথা, ফার হিলস আসলে সৌখিন মানুষদের খেয়ালি চাষবাসের জায়গা।

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম মোরার চেহারার দিকে। অভিভূত হওয়ার মতো কোনো একটা অনুভূতি যেন ছেকে ধরল আমাকে। হাত বাড়িয়ে ধরলাম মোরার একটা হাত। আমার দিকে তাকিয়ে হাসল সে। সেই পাগলকরা হাসি…যা দেখার জন্য ছটফট করেছি আমি গত পনেরো বছরের প্রতিটা দিন। ওর সেই হাসি যেন আমার অস্থিমজ্জায় আঘাত হানে।

একহাতে স্টিয়ারিং ধরে রেখে আরেক হাতে ধরল সে আমার হাতটা, তুলে নিল ওটা, ঠোঁটের কাছে টেনে নিয়ে চুমু খেল।

মোরা?

বলো।

আবার যদি পালিয়ে যেতে হয় তোমাকে, আমাকে সঙ্গে নিয়ে।

আমার হাতটা নিজের একদিকের গালে ঠেকাল সে। এবার আর তোমাকে ছেড়ে যাবে না, ন্যাপ। এবার যা-ই ঘটুক-বাঁচি বা মরি, তোমাকে আর কাছছাড়া করবো না।

আর কিছু বললাম না।

এই ব্যাপারে আর কিছু বলারও নেই।

আমরা টিনএজার প্রেমিক-প্রেমিকা না। আমাদের কাছে আবেগটা বড় না। আমরা একজন আরেকজনকে অনুভব করি, এবং সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কোনো ভনিতা নেই আমাদের মাঝখানে, আমরা শুধু সময় কাটিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে ভালোবাসছি না একজন আরেকজনকে।

গত পনেরো বছরে ইচ্ছা করলেই এক বা একাধিক সঙ্গিনী জুটিয়ে নিতে পারতাম আমি, কিন্তু ইচ্ছাটা করেনি। ইচ্ছা করলেই হয়তো এক বা একাধিক বয়ফ্রেন্ড জুটিয়ে নিতে পারত মোরা, কিন্তু সে-ও করেনি ওই কাজ। আমাদের ভালোবাসা অতুলনীয় কিছু না, জানি আমি; তবে এ-ও জানি, যে-ভালোবাসায় অনুভব থাকে, তা কখনও ফুরায় না।

.

বেথদের সেই ফার্ম হাউসের বাইরে একজায়গায় পার্ক করেছে এলি, গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর গাড়ির পেছনে নিজের গাড়ি থামাল মোরা। নামলাম আমরা দুজন।

কোনো কথা হলো না এলি আর মোরার মধ্যে, ওরা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে থাকল না অনেকক্ষণ। ওরা শুধু এগিয়ে গেল একজন আরেকজনের দিকে। একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে থাকল অনেকক্ষণ।

অনুভব।

কেউ বলে দিচ্ছে না আমাদেরকে, অথচ আমরা তিনজনই জানি, হাতে সময় খুব কম। কাঠের-তক্তার বেড়া দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বেথদের ফার্ম হাউসের সীমানাপ্রাচীর, এগিয়ে গেলাম সেদিকে। একদিকে একটা দরজা আছে। সেখানে কলিংবেল আছে।

বেল বাজাল এলি।

 কাউকে দেখা গেল না।

দরজার ফাঁক দিয়ে দূরে একটা সাদা ফার্মহাউস দেখতে পাচ্ছি আমি। এ-পর্যন্ত যতগুলো ফার্মহাউস দেখেছি, সবগুলোই সাদা রঙের, সবগুলোই কেন যেন স্মৃতিকাতর করে তোলে আমাকে। মনে হয়, ও-রকম কোনো বাড়ির ছাদের নিচে যদি কাটিয়ে দিতে পারতাম বাকি জীবন, সুখে থাকতে পারতাম।

দরজায় ঠেলা দিলাম আমি। ভিতর থেকে আটকানো ওটা।

এখন করার মতো একটা কাজই আছে, এবং সেটাই করলাম আমি। বেড়া টপকে ঢুকে পড়লাম ভিতরে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে এলি আর মোরাকে বললাম, ওরা যেন দরজার কাছাকাছি থাকে।

ড্রাইভওয়ে ধরে দুশ গজ এগোলে ফার্মহাউসটা। বেড়া আর ফার্মহাউসের মাঝখানে কোথাও কোনো গাছ নেই, লুকানোর মতো কোনো আড়াল নেই। কাজেই চুপিসারে এগিয়ে যাওয়ার মতো কোনো সুযোগও নেই আমার। মাথা ঘামালাম না ওই ব্যাপারে, পা বাড়ালাম ফার্মহাউসের দিকে। বাড়ির ভিতর থেকে এখন যে-কেউ দেখতে পাবে আমাকে।

কাছাকাছি পৌঁছে গেছি ওই বাড়ির, এমন সময় দেখতে পেলাম, গ্যারেজে রাখা আছে একটা ভলভো স্টেশন ওয়্যাগন। লাইসেন্স প্লেট বলছে, গাড়িটা মিশিগানের। বেথ থাকে অ্যান আবারে। সুতরাং ধরে নেয়া যায়, ওটা ওরই গাড়ি।

সদর-দরজায় পৌঁছে গেলাম, কিন্তু বেল বাজালাম না। বরং সরে এলাম দরজার কাছ থেকে। বেথ যদি বাড়ির ভিতরে থেকে থাকে, ইতোমধ্যে জেনে গেছে আমি এসেছি। হয়তো ইতোমধ্যে দেখেছেও আমাকে। বাড়িটা ঘিরে চক্কর দিতে শুরু করলাম। এগিয়ে যাচ্ছি বাড়ির পেছনদিকের উদ্দেশে।

কিচেন উইন্ডোতে হাজির হওয়ামাত্র দেখতে পেলাম বেথকে। বন্ধ জানালার কাঁচ ভেদ করে দেখা যাচ্ছে ওকে।

 কিচেন টেবিলের একপাশে বসে আছে সে। টেবিলের উপর একটা প্রায়-খালি মদের-বোতল আর একটা আধ-খালি গ্লাস দেখা যাচ্ছে।

এবং একটা রাইফেল দেখা যাচ্ছে বেথের কোলের উপর।

দেখতে পেলাম, কাঁপা কাঁপা হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা তুলল বেথ, একচুমুকে খেয়ে নিল সবটুকু মদ।

 তারমানে, অনুমান করলাম, অনেকক্ষণ ধরে মদ খাচ্ছে বেথ। ইতোমধ্যে হয়তো মাতলামি পেয়ে বসেছে ওকে। মাতাল একটা মানুষ…রাইফেল নিয়ে বসে আছে…কীভাবে কথা বলবো ওর সঙ্গে?

 কিন্তু খালি হাতে ফিরে যাওয়ার জন্য আসিনি আমি।

বেথ? ডাক দিলাম। আমি ন্যাপ। কথা বলতে চাই তোমার সঙ্গে।

হাত থেকে গ্লাস রেখে দিল বেথ। রাইফেলটা তুলছে কাঁধে।

আমি ন্যাপ…তোমার হাইস্কুলের বন্ধু। শুধু কথা বলতে চাই তোমার সঙ্গে।

স্থির হয়ে গেল বেথ। অবিশ্বাস দেখা দিয়েছে ওর দৃষ্টিতে।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, এগিয়ে আসছে জানালার দিকে। প্রস্তুত অবস্থায় আছে ওর রাইফেল।

আমি ন্যাপ, বেথ, তৃতীয়বারের মতো পরিচয় দিলাম নিজের। তোমার মনে আছে কি না জানি না, হাইস্কুলে একসঙ্গে পড়তাম আমরা। তোমার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলতে চাই আমি। তোমার কোনো ক্ষতি হবে না।

জানালায় এসে দাঁড়িয়েছে বেথ। তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

 আমিও তাকিয়ে আছি ওর দিকে।

কিছুক্ষণ পর খুলল সে জানালাটা। হ্যালো, ন্যাপ।

হ্যালো, বেথ।

.

৩৩.

কিচেন-ডোর খুলে দিয়ে আমাকে বাড়ির ভিতরে ঢোকাল বেথ। কিচেন টেবিলেই বসলাম আমরা। মোরার সেই অ্যাপ ব্যবহার করে ওকে জানিয়ে দিলাম নিরাপদেই আছি আমি, দেখা হয়েছে বেথের সঙ্গে, ওকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করছি।

অনেক বছর পর দেখা, তাই তাকিয়ে আছি বেথের দিকে। হাইস্কুলের বেথের সঙ্গে আজকের বেথের তেমন কোনো পার্থক্য নেই…অন্তত চেহারায়। খুব একটা বদলায়নি সে। আকর্ষণ-জাগানিয়া কিছু একটা আছে ওর মধ্যে…কিশোরীদের চেয়ে মাঝ-ত্রিশের মেয়েরা বেশি আবেদনময়ী সম্ভবত।

মনে পড়ে যাচ্ছে হাইস্কুলের সেই দিনগুলোর কথা। স্কুল অর্কেস্ট্রায় বেহালা বাজাত বেথ। মনে পড়ে যাচ্ছে, সিনিয়র অ্যাওয়ার্ড নাইটে বায়োলোজি-স্কলারশিপ জিতে নিয়েছিল সে।

কেন এসেছ আমার কাছে, ন্যাপ? আমাকে খুন করতে?

কেন খুন করতে চাইব আমি তোমাকে?

বদলা নেয়ার জন্য।

কীসের বদলা?

 তুমি হয়তো জেনে গেছ সবকিছু। এতদিন কেন চুপ করে ছিলাম আমি, কেন কিছু বলিনি কাউকে, সেজন্য হয়তো প্রতিশোধপরায়ণ হয়েছ আমার উপর।

বেথের কথা বুঝতে পারছি না। ওকে কি মাতলামি পেয়ে বসেছে?

ওকে কি শান্ত হতে বলবো? ওকে কি বলবো, ওর কোনো ক্ষতি করার জন্য আসিনি আমি? আমার কথা শুনে কি আদৌ শান্ত হবে সে? অবিশ্বাসের দৃষ্টিটা এখনও বিদায় নেয়নি ওর চোখ থেকে। কেন সে বিশ্বাস করতে পারছে না আমাকে? কেন সে বসে ছিল রাইফেল নিয়ে?

তোমার ছেলে-মেয়ে আছে? জিজ্ঞেস করলাম আমি।

আছে। দুটো ছেলে। একজনের বয়স আট, অন্যজনের ছয়।

আমার দিকে তাকাল বেথ। নগ্ন ভয় দেখা দিয়েছে ওর দৃষ্টিতে। একবার বোধহয় একটুখানি ফুঁপিয়ে উঠল।

বেথ, আমি শুধু জানতে চাই সে-রাতে কী ঘটেছিল।

 তুমি কি আসলেই জানো না?

না।

লিও কিছু বলেনি তোমাকে?

 মানে?

সে-রাতে তোমার একটা হকি-ম্যাচ ছিল, ঠিক?

 ঠিক।

ম্যাচ খেলতে যখন বের হবে বাসা থেকে, তখন কিছু বলেনি তোমাকে লিও?

থমকে গেলাম আমি। একরকমের আচ্ছন্নতা অনুভব করছি। স্মৃতির কোনো জলাশয়ে পড়ে গেছি যেন। ডুবে যাচ্ছি অতীতে। ফিরে যাচ্ছি বিশেষ সে-রাতে।

ওয়েস্টব্রিজ। আমাদের সেই বাসা। প্যাক করা হয়ে গেছে আমার হকিব্যাগ। স্কেট, স্টিক, এলবো প্যাড, শিন গার্ড, শোল্ডার প্যাড, গ্লাভস, চেস্ট প্রোটেক্টর, নেক গার্ড, হেলমেট-বলতে গেলে কিছুই বাদ দিইনি। যা-যা নিয়েছি আমি, সেগুলোর একটা চেকলিস্ট বানিয়ে দিয়েছেন বাবা।

লিও কোথায়?

আমাদের সঙ্গে…আমার আর বাবার সঙ্গে নেই সে।

কিন্তু থাকার কথা ছিল। সাধারণত তা-ই করে সে। আমার যেদিন হকিম্যাচ থাকে, গাড়ি ড্রাইভ করে স্কুল পর্যন্ত দিয়ে আসে আমাকে। সেখান থেকে বাস ধরি আমি। এটা একটা অলিখিত রুটিন।

বাবা আর আমি চেকলিস্ট দেখছি। আমাকে স্কুল পর্যন্ত দিয়ে আসার কথা লিওর। কিন্তু সে-রাতে কাজটা করেনি সে।

কেন করেনি?

 মনে পড়ছে না।

 চেকলিস্ট দেখা শেষ হলো আমাদের।

 বাবা জিজ্ঞেস করলেন, লিও কোথায়?

কী বলেছিলাম আমি জবাবে? জানি না…মনে পড়ছে না।

আমাদের ঘরে…আমি আর লিও যে-ঘরে থাকতাম, সেখানে গেলাম আমি। ঘরের বাতি নেভানো। দোতলা খাটের উপরের বাঙ্কে শুয়ে আছে লিও।

যাবে না? জিজ্ঞেস করলাম লিওকে।

আজ একটু বাবাকে বলো না তোমাকে স্কুল পর্যন্ত দিয়ে আসতে। আমি কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে চাই।

আমাকে নিয়ে রওয়ানা হলে গেলেন বাবা।

আর কিছু না।

লিও’র ব্যাপারে অন্য কোনো শেষস্মৃতি নেই আমার। আমার উদ্দেশে বলা ওর শেষ কথা হচ্ছে: আমি কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে চাই।

অতীতের সেই জলাশয়ের তীরে উঠে পড়লাম আমি। ফিরে এলাম বাস্ত বে।

না, বললাম বেথকে, লিও কিছু বলেনি আমাকে।

ডায়ানার ব্যাপারে কিছু বলেনি? সে-রাতে একটা পরিকল্পনা করেছিল সে, কিছু বলেনি ওটার ব্যাপারে?

না…কিছু না।

নিজের গ্লাসে আরও হুইস্কি ঢালল বেথ। এত বছর আগের একটা ঘটনা হঠাৎ এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল কেন?

কারণ এটার সঙ্গে একাধিক মানুষের বাঁচা-মরা নির্ভর করেছে এবং করছে।

সত্যি কথাটা জানতে পারলে তোমার কি কোনো উপকার হবে আসলেই? তুমি কি কিছু করতে পারবে?

মনে হয় পারবো।

কী পারবে?

রেক্স আর হ্যাঙ্কের খুনিকে ধরতে পারবো। তুমি বলো।

হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিল বেথ! দোষ আসলে আমাদের সবার। কিন্তু কথা হচ্ছে, ভালো-মন্দ সব কাজে প্রতিটা দলের একজন নেতা থাকে। লিও ছিল আমাদের সেই নেতা। আর আমরা ছিলাম ওর অনুসারী। যা-হোক, লিও যেন কীভাবে জানতে পারে, ওর সঙ্গে ব্রেকআপ ঘটাতে চলেছে ডায়ানা। জানতে পেরেছিল, স্কুলের ফল ড্যান্স পার্টি অনুষ্ঠিত হওয়ার পর নাকি কাজটা করবে ডায়ানা। প্রথমে ভীষণ মুষড়ে পড়ে লিও। তারপর ভয়ঙ্কর ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। রেগে গেলে সে কী-রকম হয়ে যেত, মনে আছে নিশ্চয়ই?

মাথা ঝাঁকালাম আমি।

ছটফট করছিল লিও। কুত্তী বলে গালি দিচ্ছিল ডায়ানাকে। বলছিল, ডায়ানার বাবা পুলিশের চাকরি করে বলে নাকি দেমাগে মাটিতে পা পড়ে না মেয়েটার। বলছিল, আমরা যা-ই করতে চাই তাতেই বাগড়া দিয়ে বসে মেয়েটা। …এখন বুঝতে পারি কথাটা কত হাস্যকর, কিন্তু আজ থেকে পনেরো বছর আগে…জীবন যখন একটা আবেগ ছাড়া আর কিছু ছিল না আমাদের কাছে…সত্যি বলে মনে হয়েছিল লিও’র সব কথা। কারণ ওর ভালো-মন্দ বিচার না-করে ওকে অন্ধের মতো অনুসরণ করতাম আমরা। আরেক চুমুক হুইস্কি খেল বেথ।

 কিছু বললাম না আমি। আমার যমজ ভাইয়ের নতুন একটা চেহারা উন্মোচিত হচ্ছে আমার সামনে।

কন্সপাইরেসি ক্লাব সম্পর্কে কিছু জানো?

 মাথা ঝাঁকালাম আমি।

আমি, লিও, রেক্স, হ্যাঙ্ক আর মোরা। লিও বলল, আমাদের এই ক্লাব ডায়ানার উপর শোধ নেবে। আমরা শুধু হা-হুঁ করলাম, কিন্তু তেমন কোনো গুরুত্ব দিইনি। কথা ছিল, রেক্সের বাসায় জমায়েত হবো আমরা। কিন্তু মোরা এল না। ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগল আমাদের কাছে।

লিও’র প্ল্যানটা কী ছিল?

ডায়ানাকে এল,এস,ডি, খাইয়ে দেয়া।

মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেলাম আমি। তোমরা এল.এস.ডি.-ও খেতে?

 না…মানে, সে-রাতের আগে কখনও খাইনি।

সে-রাতে খাওয়া বা খাওয়ানোর দরকার হলো কেন?

প্রশ্নটার জবাব আমার চেয়ে ভালো দিতে পারত তোমার ভাই। ডায়ানার প্রতি কোন্ আক্রোশ জন্মেছিল ওর মনে, তা সে-ই বলতে পারত। …আমার প্রেমিকা আমাকে ছেড়ে চলে যাবে, সে-কারণে আমি ওকে এল,এস,ডি, খাইয়ে দেবো–কোনো মানে হয় না এটার। কিন্তু আজ থেকে পনেরো বছর আগে…যখন আমাদের সবার বয়স ছিল আঠারো, যখন বিবেচনাশক্তি বলতে তেমন কিছু ছিল না আমাদের, যখন আমরা সবাই অন্ধভাবে অনুসরণ করছিলাম লিও নামের একজন খেয়ালি নেতাকে, যখন আমরা বিশ্বাস করে নিয়েছিলাম ডায়ানা আসলেই দেমাগী এবং ওর একটা শিক্ষা হওয়া উচিত…কথাটা বুঝতে পারিনি।

আমি কিছু বলছি না। বলতে পারছি না আসলে। আমার ভাই লিও করেছে এত জঘন্য একটা কাজ? লিও?

কেমিস্ট্রি ক্লাসের একজনের সঙ্গে খাতির ছিল হ্যাঙ্কের, বলছে বেথ। ওই ছেলে এল,এস.ডি.র একটা লিকুইড ভার্সন বানিয়ে দেয় হ্যাঙ্ককে। এরপর রেক্স তার ভূমিকা পালন করে-ওদের বাসার বেইজমেন্টে রাত কাটানোর সুযোগ করে দেয় আমাদের সবাইকে। আর আমার দায়িত্ব ছিল, ডায়ানার ড্রিঙ্কে এল.এস.ডি, মিশিয়ে দেয়া।

ঘৃণায় গা রি রি করে উঠল আমার।

ডায়ানার ড্রিঙ্কে এল.এস.ডি. মিশিয়ে দেয়ার দরকার ছিল, কারণ সে নিজে থেকে ওই জিনিস খেতে রাজি হতো না কখনও। সে ছিল ডায়েট কোকের বড় ফ্যান। কাজেই আমার দায়িত্ব ছিল, ওর কোকের গ্লাসে এল.এস.ডি. মিশিয়ে দেয়া। থামল বেথ, একটু দম নিল। রেক্সদের বেইজমেন্টে অপেক্ষা করছিলাম আমরা–ডায়ানাকে নিয়ে আসবে লিওঁ, পার্টি শুরু হবে আমাদের।

মনে পড়ে গেল অগির-বলা একটা কথা।

 ডায়ানাকে নেয়ার জন্য সে-রাতে অগির বাসায় গিয়েছিল লিও।

ডায়ানাকে নিয়ে লিও যখন এল রেক্সদের বেইজমেন্টে, কেমন যেন ক্লান্ত দেখাচ্ছিল মেয়েটাকে। আমরা সবাই আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কেউ মদ খাবো না সে-রাতে। যা-হোক, পিং-পং খেলতে শুরু করি আমরা। কী একটা মুভিও যেন দেখেছিলাম এবং সেটার ফাঁকে ফাঁকে কোক খাচ্ছিলাম। আমাদের কোকে মেশানো ছিল ভদকা। আর ডায়ানার কোকে, সুযোগ পাওয়ামাত্র, এল.এস.ডি. মিশিয়ে দিয়েছিলাম আমি।

আমার সামনে যদি বেথের বদলে অন্য কেউ বসে থাকত, ছি ছি করতাম তাকে।

আমার মনে আছে, মুভিটা যখন শেষপর্যায়ে, তখন তাকিয়েছিলাম ডায়ানার দিকে। ওর তখন মূৰ্ছা যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে। ভাবলাম, এল.এস.ডি.র ডোয বেশি হয়ে গেল নাকি? সম্ভবত…কারণ ওই জিনিস কতখানি সহ্য করতে একটা মানুষ, জানা ছিল না আমার। যা-হোক, আমি ভাবলাম, মিশন শেষ, সব চুকেবুকে গেছে।

আবারও বিরতি দিল বেথ। তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কিন্তু আমি নিশ্চিত, আমাকে দেখছে না। ওর দৃষ্টির শূন্যতা বলে দিচ্ছে, অতীতে হারিয়ে গেছে সে।

কিন্তু সব তখনও চুকেবুকে যায়নি? বেথকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলাম আমি।

 না। লিও হঠাৎ করেই বলে বসল, চলো, আমরা সবাই ডায়ানাকে ওই ঘাঁটি-সংলগ্ন জঙ্গলে নিয়ে যাই।?

না…না…আমার ভাই ওই কাজ করতে পারে না…

সুতরাং আমরা…লিও’র অন্ধ অনুসারীরা…তা-ই করলাম। আমার মনে আছে, রাতটা ছিল ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। ডায়ানাকে একরকম টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছি আমরা ওই জঙ্গলে। একটা মেয়ে হয়ে ওই কাজে কিছুতেই সায় দিচ্ছে না আমার মন, তারপরও কটুকথা-শোনার-ভয়ে কিছু বলতে পারছি না। হ্যাঙ্ক বা রেক্সও কিছু বলছে না।

আমিও কিছু বললাম না। আমার মুখে কথা সরছে না।

জঙ্গলের একজায়গায় হাজির হয়ে থামতে বলল লিও। জায়গাটা ভালোমতোই চিনি, কারণ ওখানে ডায়ানার সঙ্গে অনেকবার ডেটিং করেছে লিও-আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখেছি। যা-হোক, কোনো কুলি যেভাবে বোঝা নামায়, বলতে গেলে সেভাবে ফেলে দিলাম আমরা ডায়ানাকে ওই জায়গায়। লিও বলল, ডেটিং করা পর্যন্তই, তার বেশি কিছু করতে দেয়নি আমাকে ডায়ানা কখনোই। আজ মজা দেখাবো। মেয়েটার দিকে এমন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সে যে, আঁতকে উঠল আমার ভিতরটা; ঝোঁকের মাথায় এবং নেশার ঘোরে কত জঘন্য একটা কাজ করে ফেলেছি বুঝতে পেরে কুঁকড়ে গেলাম ভিতরে ভিতরে। আমার তখন মনে হচ্ছিল, ডায়ানাকে ধর্ষণ করবে লিও, আর সেজন্যই আমাদেরকে ফুসলিয়ে এল.এস.ডি. খাইয়ে দিয়েছে মেয়েটাকে।

লিওকে একজন ভালোমানুষ হিসেবে জানতাম আমি, অথচ…

তোমার ভাই শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত বদল করল কি না, বুঝতে পারলাম না। বলল, চলো আমরা কাছেপিঠে কোথাও লুকিয়ে থাকি, দেখি কী হয়। সেটাই করলাম আমরা সবাই। রেক্স আর হ্যাঙ্ক তখন ফিকফিক করে হাসছে। কিন্তু আমার ধারণা আসলে নার্ভাস হয়ে পড়েছিল ওরা। নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম আমিও। এল.এস.ডি.র প্রভাবে কী কাণ্ড ঘটিয়ে বসবে ডায়ানা, বুঝতে পারছিলাম না। আমি চাইছিলাম, কেউ একজন বলুক, অনেক হয়েছে, এবার চল বাসায় ফিরে যাই। কিন্তু কথাটা বলল না কেউ। বাধ্য হয়ে লিওকে বললাম, বাদ দাও, ছেড়ে দাও ডায়ানাকে। তোমার ভাইয়ের চেহারা তখন থমথম করছে। বোধশক্তি বলতে কিছু একটা কাজ করতে শুরু করেছে ওর ভিতরে সম্ভবত। দেখলাম, হঠাৎ করেই টপটপ করে পানি পড়তে শুরু করল ওর চোখ দিয়ে। মাথা ঝাঁকিয়ে আমার প্রস্তাবে সায় জানাল সে। হাসাহাসি থামাতে বলল রেক্স আর হ্যাঙ্ককে। উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেল ডায়ানার দিকে। ঠিক তখনই… টপটপ করে পানি পড়ছে বেথের চোখ দিয়ে, অশ্রু মোছার চেষ্টাই করছে না সে, …নরক গুলজার হয়ে গেল ওই ঘাঁটির ভিতরে। অতি-উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠল সেখানে। আমাদের…বলা ভালো, ডায়ানা আর লিও’র গায়ে এসে পড়ল ওই আলো। ঠিক সে-মুহূর্তে হুশ ফিরে পেল ডায়ানা, চমকে উঠল। ওকে দেখে আমার মনে হলো, কেউ যেন এক বালতি বরফ ঢেলে দিয়েছে ওর উপর। চিৎকার করে উঠল সে, লাফিয়ে দাঁড়িয়ে গেল, দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়াতে শুরু করল। ওকে থামানোর জন্য ওর পিছন-পিছন দৌড় দিল লিও। আমি, রেক্স আর হ্যাঙ্ক ততক্ষণে জমে গেছি বরফের মতো, যে জায়গায় ছিলাম সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি। মনে আছে, উজ্জ্বল আলোর বিপরীতে কেমন ভুতুড়ে দেখাচ্ছিল ডায়ানার ছায়ামৰ্তিটা। তখনও চেঁচাচ্ছে সে…আগের চেয়েও জোরে। বলছে, লিও! বাঁচাও আমাকে! দৌড়াতে দৌড়াতেই একে একে খুলে ফেলছে ওর সব কাপড়। তারপর…হঠাৎ করেই শুরু হলো বুলেটবৃষ্টি। ডায়ানাকে পড়ে যেতে দেখলাম আমি। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল লিও, ঘুরে তাকাল আমাদের দিকে। চিৎকার করে বলল, পালাও! কথাটা দ্বিতীয়বার বলতে হয়নি ওকে, কারণ ওর সেই চিৎকার শেষ হওয়ার আগেই ছুটতে আরম্ভ করেছি আমি, রেক্স আর হ্যাঙ্ক। একছুটে হাজির হলাম আমরা রেক্সদের সেই বেইজমেন্টে। সারাটা রাত অপেক্ষা করলাম লিও’র জন্য, কিন্তু এল না সে। তখন আমরা তিনজন প্রতিজ্ঞা করলাম, ওই রাতের কথা কখনও বলবো না কারও কাছে। রাত ভোর হলো, সকালে যার যার বাসায় ফিরে গেলাম আমি আর হ্যাঙ্ক। আমরা তিনজন তখনও জানতাম না কী হয়েছে লিও বা ডায়ানার। পরে জানতে পারি, রেলরোড ট্র্যাকে পাওয়া গেছে ওদের দুজনের লাশ। বুঝতে পারি, ঘাঁটির ওই কুত্তার-বাচ্চারা গুলি করে মেরেছে ওদের দুজনকে, তারপর নিজেদের মতো করে সাজিয়েছে পুরো ঘটনা। …হ্যাঙ্ক উত্তেজিত হয়ে ওঠে, পুলিশের কাছে যেতে চায়। কিন্তু আমি আর রেক্স থামাই ওকে। কারণ, বুঝতে পারছিলাম, আসল ঘটনা জানাজানি হলে আমরাই আগে ফাসবো। তাই নিজেদের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করি আমরা, কাউকে কিছু বলিনি কোনোদিন। তারপর একসময় হাইস্কুলের পাট চুকিয়ে যার-যার সুবিধামতো কেটে পড়লাম শহর থেকে।

আমি কি শুনছি বেথের কথা? সে যা-যা বলেছে, সব কি বোধগম্য হয়েছে আমার? অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে চলে গেছি আমি। নিকট অতীতে ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে-যে-রাতে আমার বাসায় হাজির হয়েছিলেন রেনল্ডস আর বেটস। তখন যদি তাদেরকে আমি কিছু জানি না এবং জানতে চাই না বলে বিদায় করে দিতাম, তা হলেই ভালো হতো।

কারণ, সত্যি…কখনও কখনও…বীভৎস। সত্যি, কখনও কখনও, সাংঘাতিক অপ্রত্যাশিত। এবং আমি জানি…টের পাচ্ছি, আরও কিছু অপ্রত্যাশিত সত্যি অপেক্ষা করছে আমার জন্য।

তাকালাম বেথের দিকে। তুমি লুকিয়ে পড়লে কেন?

বেশ কিছুদিন আগে কেউ একজন ফোন করেছিল অ্যান আর্বার হাসপাতালে…

.

৩৪.

পকেট থেকে বের করলাম আমার মোবাইল।

 ইতোমধ্যে কয়েক ডজন মিস কল এসেছে। মিউস, অগি, এলি, এবং সম্ভবত এফবিআই। এসেছে অনেক মেসেজও। ভিডিওটেপটার জন্য আমাকে খুঁজছে এফবিআই। আর পুলিশ হয়তো এতক্ষণে দেখে ফেলেছে হাঙ্ক-আ-হাঙ্ক-আ ক্লাবের সিসিটিভি ফুটেজ।

 যার যা খুশি করুক, এখন আর কিছু যায়-আসে না আমার। অপ্রত্যাশিত একটা সত্যি এবং ভয়ঙ্কর একটা অনুমান এখন অন্য একটা মানুষে পরিণত করেছে আমাকে।

 লেফটেন্যান্ট স্টেসি রেনল্ডকে ফোন করলাম। কিছুক্ষণ কথা বললাম তার সঙ্গে। রেক্স যে-রাতে খুন হলো, সে-রাতে ওই বারের ভিডিওফুটেজের কপি চাইলাম।

রাজি হলেন তিনি। ঠিক আছে, ভিডিওটা পাঠিয়ে দেবো আপনার কাছে। …রেক্সকে খুন করার জন্য হিটম্যান ভাড়া করেছিল কে, জানতে পেরেছেন?

না।

কথাটা…আসলে…ঠিক না। আবার হয়তো ঠিক–আমার সন্দেহ ভুল হতে পারে।

লাইন কেটে দিয়ে ফোন করলাম অগিকে।

কল রিসিভ করেই তিনি বললেন, এফবিআই হয়তো আমার ফোন মনিটরিং করছে।

করুক। আমি এমনিতেও ফিরে আসছি কিছুক্ষণের মধ্যে। তখন কথা বলবো ওদের সঙ্গে।

ন্যাপ, কী ঘটছে আসলে বলো তো?

কী বলবো, বুঝতে পারছি না। শুধু সত্যি কথাটাই বলা উচিত অগিকে। তা না হলে খাতা-কলম নিয়ে বসতে হবে আমাকে, সে-রাতের সেই ঘটনা গোঁজামিল দিয়ে সাজানোর জন্য লিখতে হবে কোনো গল্প।

বেথ ল্যাশলিকে খুঁজে পেয়েছি, বললাম আমি।

 কোথায়?

ফার হিলসে, ওর বাবা-মার ফার্ম হাউসে।

কী বলল সে?

 ডায়ানা… কথা শেষ করতে পারলাম না, আমার বুকের ভিতরটা মোচড়াচ্ছে। সন্তান-হারানো একজন বাবাকে কীভাবে বলতে পারি, তার মেয়ের উপর শোধ নিতে গিয়ে মেয়েটাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে আমার ভাই?

ডায়ানা কী?

সামনাসামনি বলবো।

 তারমানে খবর খারাপ।…বাসায় থাকবো আমি। চলে এসো।

 হ্যাঁ, এখনই রওনা হচ্ছি।

 লাইন কেটে দিলেন অগি।

এবার ফোন করলাম সাইমন ফ্রেজারকে। প্রথম সাক্ষাতের খারাপ ব্যবহারের জন্য প্রথমেই ক্ষমাপ্রার্থনা করলাম তার কাছে, তারপর তাঁকে বুঝিয়ে বললাম আমার অনুমানের ব্যাপারটা। বললাম, তিনি যদি সহযোগিতা করেন তা হলে রেক্সের খুনিকে পাকড়াও করাটা অসম্ভব কিছু না।

 এবার সহযোগিতা করলেন তিনি।

গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য জেনে নিয়ে লাইন কেটে দিলাম, মোবাইল পকেট ঢুকিয়ে রেখে তাকালাম বেথের দিকে। বিড়বিড় করে নিজের সঙ্গে কথা বলছে সে।

বললাম, তোমার ল্যাপটপ আছে?

মাথা ঝাঁকাল সে।

.

আমি বেথের মতো না। রাইফেল কোলে নিয়ে জানালার পাশে বসে থাকাটা আমাকে মানায় না। আমি বসে আছি ফার্মহাউসের লিভিংরুমের এককোনায়। আমার দুপাশে এবং পেছনে দেয়াল। চুপিসারে কেউ হাজির হতে পারবে না আমার কাছে। আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে কেউ ঢুকতে পারবে না এই বাড়িতে।

গত প্রায় এক ঘণ্টা ধরে বিশেষ একজনের জন্য অপেক্ষা করছি আমি।

অস্পষ্টভাবে শুনতে পেলাম, ফার্মহাউস থেকে দূরে একটা গাড়ি থামল।

কল্পনার চোখে দেখতে পেলাম, গাড়ি থেকে নামল কেউ একজন। আমি জানি, কলিংবেল বাজাবে না সে…আমার মতোই বেড়া টপকে ঢুকে পড়বে ভিতরে। আমার মতোই প্রথমে এসে দাঁড়াবে বাড়ির সদর-দরজায়, যদি ওটা খোলা না-পায় তা হলে আমার মতোই…।

আমি জানি, খুব তাড়াহুড়ো করে কাজ সারতে চাইবে লোকটা। কাজ সারা মানে বেথকে খুন করা। লোকটা তাড়াহুড়ো করতে চাইবে, কারণ আজ সময়ের খুব অভাব তার। তাই, হয়তো, সদর-দরজাটা কেন লক করে রাখা হয়নি তা নিয়ে মাথা ঘামাবে না সে।

মোট তিনটা গাড়ি ছিল এই ফার্ম হাউসে এবং এটার বাইরে-বেথের একটা, এলির একটা, মোরার একটা। ওরা তিনজন ওই তিন গাড়িতে করে ফার্ম হাউস থেকে মাইলখানেক দূরের নির্জন একটা জায়গায় গিয়েছিল অনেকক্ষণ আগে। সুবিধামতো একজায়গায় এলি আর মোরার গাড়ি পার্ক করে বেথের গাড়িতে চড়ে ফার্মহাউসে ফিরে এসেছে এলি আর মোরা। আমি ততক্ষণে ইন্টারনেট ঘেঁটে আবিষ্কার করেছি আরও কিছু তথ্য, আরেকটু পাকাঁপোক্ত হয়েছে আমার সন্দেহটা।

বেথের গাড়িটা এখন গ্যারেজেই আছে, আর বেথ আছে এলি আর মোরার গাড়ির কাছে। আমি জানি, রেক্স আর হ্যাঙ্কের খুনি যাবে না গ্যারেজে, হাত দিয়ে ছোঁবে না বেথের গাড়ির বনেট-পরখ করে দেখবে না ইঞ্জিন ঠাণ্ডা নাকি গরম। বেথকে লোকটা নিজের শেষ ও সহজতম শিকার হিসেবে ধরে নিয়েছে। কাজেই, আমার ধারণা, লোকটা কল্পনাও করতে পারবে না, তার জন্য কোন ফাঁদ পেতেছি আমি এই ফার্ম হাউসে।

আজ সময়ের খুব অভাব লোকটার।

.

লিভিংরুমের দরজায় এসে দাঁড়ালেন অগি।

আমার হাতেধরা পিস্তলটা তার দিকে তাক করলাম আমি।

আমার সন্দেহ ভুল হতে পারে। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে, ভুল করিনি আমি। আমি একজন ভালো গোয়েন্দা। দেশের সেরা প্রশিক্ষণকেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছি আমি।

আমার বুকের ভিতরটা এখনও মোচড়াচ্ছে।

মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেছেন অগি, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। তার সেই চেহারা দেখামাত্র কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে নামল আমার গাল বেয়ে।

বললাম, আপনি আমার শিক্ষক। আপনি আমার বাবার মতো। আমার বাবা মারা যাওয়ার পর আপনিই বাবার মতো দেখভাল করেছেন আমার। আপনিই আমাকে গড়ে তুলেছেন একজন হোমিসাইড ইনভেস্টিগেটর হিসেবে। এবং আপনি জানেন, আমি যখন গুলি করি, আমার হাত কাঁপে না, নিশানা ফস্কায় না। …একটা পিস্তল আছে আপনার কাছেও অনুরোধ করছি, হাত বাড়াবেন না ওটার দিকে।

অগি বুঝতে পারছেন, তার খেলা শেষ।

বেথের কাছে একটা ল্যাপটপ ছিল, বললাম আমি। ওটা কাজে লাগিয়ে আপনার ডেটিং-সাইটে লগইন করেছি।

ইউজার আইডি পেলে কোথায়?

আমার অনুমান কাজে লেগে গেছে। আপনার ই-মেইল আপনার ইউজার আইডি।

আমার ই-মেইল পেলে কোথায়?

কেন, মনে নেই? হ্যাঙ্কের সেই ভিডিও পাওয়ার জন্য আপনিই ওই আইডি দিয়েছিলেন আমাকে। আমার ধারণা, ওটা আর কারও সঙ্গে শেয়ার করেননি আপনি কখনও।

অগি চুপ করে আছেন।

 খুনি যত চালাকই হোক, বলছি আমি, একটা-না-একটা ভুল সে করবেই–আপনিই শিখিয়েছিলেন আমাকে, মনে পড়ে?

মাথা ঝাঁকালেন অগি। পাসওয়ার্ড জানলে কীভাবে?

সহজ। এগারো…চৌদ্দ…চুরাশি-ডায়ানার জন্মতারিখ। মেয়েকে পাগলের মতো ভালোবাসতেন আপনি, তা-ই না?

কিছু বললেন না অগি।

আপনার ওই সাইট তন্নতন্ন করে ঘেঁটেছি আমি। কার কার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, দেখিছি। শুধু একটা নাম পাওয়া গেছে–যোভন। যোভন শিফিন। তাঁর ফোন নম্বরটাও পেয়েছি ওখান থেকে।

ফোন করেছ ওকে?

করেছি। তার সঙ্গে মাত্র একবার ডেটিং-এ গিয়েছিলেন আপনি। মাত্র একবার একসঙ্গে লাঞ্চ করেছেন আপনারা দুজন। যোভন বললেন, তাঁর সঙ্গে নাকি খুব ভালো ব্যবহার করেছেন আপনি। আপনার পুরো চেহারায় আর চোখে তখন নাকি দুঃখের ছাপ ছিল।

য়োভনও খুব ভালো।

হিলটন হেডের সী পাইন রিসোর্টে ওঠার কথা ছিল আপনার। সেখানে ফোন করেছি আমি। …নিজের নামে সেখানে রুম বুকিং দেননি আপনি।

 হোটেলটা ভালো লাগেনি আমার, আত্মপক্ষ সমর্থন করার চেষ্টা করছেন অগি।

 তা হলে হিলটন হেডে বেড়ানোর নাম করে আসলে কোথায় গিয়েছিলেন আপনি? রেক্সকে খুন করতে?

জবাব দিলেন না অগি।

আপনার-বলা একটা কথা কেন যেন আটকে গিয়েছিল আমার মাথায়, কিন্তু তখন আপনাকে সন্দেহ করিনি বলে মাথা ঘামাইনি কথাটা নিয়ে। আপনি বলেছিলেন, আমি যদি অনুমান করি, রেক্সের হত্যাকাণ্ডকে লিও আর ডায়ানার মৃত্যুর সঙ্গে জোড়া দিতে চাইছ তুমি, তা হলে কি ভুল হবে? …ওই ব্যাপারে আমি কিছুই বলিনি আপনাকে, যা বলার আপনিই আগ বাড়িয়ে বলেছেন। কেন, চোরের মন পুলিশ পুলিশ?

মুখে তালা মেরেছেন অগি।

সম্প্রতি আমার আগে আরেকজন অ্যান আর্বার হাসপাতালে ফোন, করে খোঁজ করেছে বেথকে। সেটা নিশ্চয়ই আপনি?

অগির মৌনতা বলে দিল, আমার প্রশ্নটার জবাব হ্যাঁ।

কিন্তু তারপর আর কোনো খোঁজ পাচ্ছিলেন না আপনি বেথের। তাই আজ আমার কাছ থেকে ওর ঠিকানা জানতে পারামাত্র তড়িঘড়ি করে…। সবচেয়ে বড় কথা, কিছুক্ষণ আগে সাইমন ফ্রেজারের সঙ্গে কথা বলেছি। যোভন শিফিনের প্রতিনিধি সেজে তাঁর কাছে গিয়েছিল যে-লোক, তার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। সে-বর্ণনার সঙ্গে অনেকখানি মিলে গেছে আপনার শারীরিক গঠনকাঠামো।

নিজের এক ঠোঁটের সঙ্গে আরেক ঠোঁট চেপে রেখেছেন অগি, কোন একটা আবেগ সামলানোর চেষ্টা করছেন সম্ভবত।

হ্যাঙ্কের বাবা মিস্টার টম স্ট্রাউডের উপর শুধু শুধু দোষ চাপানোর চেষ্টা করছিলেন আপনি। আপনার আসল উদ্দেশ্য ছিল, আপনাকে যাতে কখনোই সন্দেহ না হয় আমার। কাজটা করতে গিয়ে হিতে বিপরীত হয়েছে আপনার, অগি। রিভস যে-রাতে গিয়েছিল আপনার কাছে, সে-রাতে ওর দাবি আমাকে মনে করিয়ে দিয়ে, অর্থাৎ ভিডিওটেপটা…কাউকে দেখিও না– বলে নিজের অজান্তে প্রমাণ করেছেন, ওর সঙ্গে তলে তলে খাতির ছিল আপনার। ঠিক না?

 আস্তে আস্তে মাথা ঝাঁকালেন অগি। বেথ তা হলে তোমাকে সবকিছু। বলে দিয়েছে? তুমি নিশ্চয়ই এতক্ষণে জেনে গেছ, সে-রাতে ওরা কী করেছিল আমার মেয়েটার সঙ্গে?

হ্যাঁ।

তা হলে তো বুঝেই গেছ সব।

আপনি কি আমার ভাইকে খুন করেছেন, অগি?

 আমি শুধু আমার মেয়েটাকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছি।

আপনি লিওকে খুন করেছেন?

সে-রাতে খুব অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল ডায়ানাকে। বুঝতে পারছিলাম, কিছু একটা হয়েছে এবং সেটা ছোটখাটো কোনো ঘটনা না। একসঙ্গে খেতে বসেছিলাম আমরা, কিন্তু বলতে গেলে কিছু মুখে দিচ্ছিল না সে। মুরগির একটা আইটেম ছিল, ওটার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছিল না সে, অথচ ওই আইটেম খুব পছন্দ করত। জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? সে বলল, লিও’র সঙ্গে ব্রেকআপ করে ফেলবো। জানতে চাইলাম, কবে? সে বলল, স্কুলের ড্যান্স পার্টির পর। …ডিনারের পর ওকে নিতে এল লিও। তারপর…তার পরের ঘটনা আগেও বলেছি তোমাকে।

বলেছেন, কিন্তু পুরোটা না। ডিনারের পর নাইট শিফটে কাজ করার জন্য অফিসে গিয়েছিলেন আপনি। তারপর ডিসটার্বেন্স কল পেয়ে ওই ঘাঁটিতে গেলেন। তারপর কী হয়েছিল?

 আমাকে ভিতরে নিয়ে যায় রিভস, ওর চেহারা দেখেই বুঝতে পারছিলাম সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটে গেছে। পিকআপ ট্রাকের তেরপল সরিয়ে ভিতরে-রাখা লাশটা দেখায় সে। একজন পূর্ণবয়স্ক আমেরিকান পুরুষ-পালাতে চেয়েছিল ওই ঘাঁটি থেকে, হাজির হয়ে গিয়েছিল তারকাঁটার বেড়ার কাছে। রিভস আর ওর সহকর্মীরা ঝুঁকি নিতে চায়নি। ওরা এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে শুরু করে ওই লোকের উপর। রিভস আমাকে বলে, এই ঘটনার সঙ্গে আমাদের দেশের নিরাপত্তার ব্যাপার, জড়িত, এটা খুবই গোপনীয়, আপনি প্লিজ কাউকে কিছু বলবেন না। আমরা সব সামলে নেবো। বুঝতে পারি আমি। রিভস বলে, আমি কি আপনাকে বিশ্বাস করতে পারি? আমি বলি, পারেন। তখন সে বলে, আরেকটা– জিনিস দেখানোর আছে আপনাকে…

স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, যন্ত্রণায় কুঁচকে যাচ্ছে অগির চোখমুখ।

আমাকে জঙ্গলে নিয়ে যায় রিভস। ওর দুজন লোক ছিল আমাদের সঙ্গে। আরও দুজন আগে থেকেই ছিল ওই জায়গায়। কে বা কারা যেন ফ্ল্যাশলাইট জ্বালায়। দেখতে পাই, লাশ হয়ে মাটিতে পড়ে আছে আমার মেয়েটা…পুরো নগ্ন…

কাঁদছেন অগি, কিন্তু তাঁর দুই চোখ ঠিকরে বের হচ্ছে ক্রোধের আগুন।

ডায়ানার একটা হাত ধরে তখন মাটিতে বসে আছে লিওহিস্টিরিয়া রোগীর মতো কাঁদছে আর মৃগীরোগীর মতো কাঁপছে। ভূতগ্রস্তের মতো তাকিয়ে আছি আমি, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছি।

তারপর?

 পুরো ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে শুরু করল রিভস। দরকার ছিল না। ঘটে গেছে তা এমনিতেই বুঝতে পারছিলাম আমি। অতি শোকে আমি তখন পাথর হয়ে গেছি।

কিছু বললাম না।

কীভাবে মারা গেছে ডায়ানা, জিজ্ঞেস করলাম লিওকে। সে বলল, ওরা নাকি সেক্স করার জন্য এসেছিল জঙ্গলে। ডায়ানার সব কাপড় খুলেছে সে, এমন সময় জ্বলে ওঠে ফ্লাডলাইট, ঘাবড়ে যায় ডায়ানা, পালানোর উদ্দেশ্যে দৌড়াতে শুরু করে। আর তখনই…। যা-হোক, লিও’র একটা কথাও বিশ্বাস করিনি আমি, কারণ ওর চেহারা দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, মিথ্যা বলছে সে। রিভস তখন…নিজেদেরকে বাঁচানোর জন্যই কি না কে জানে…আমার কানে ফিসফিস করে বলল, ভিডিওফুটেজ আছে আমাদের কাছে।

নড়েচড়ে বসলাম আমি।

হাত ধরে দাঁড় করালাম লিওকে, ওকে নিয়ে গেলাম ওই ঘাঁটির ভিতরে। চালু করা হলো সারভেইলেন্স ভিডিও। প্রথমে দেখা গেল তোমার বান্ধবী মোরাকে। রিভস জানতে চাইল, মেয়েটাকে চিনি কি না আমি। কিছু না ভেবেই বলে দিলাম মোরার নাম-পরিচয়। তখন মাথা ঝাঁকাল রিভস, আরেকটা ভিডিও দেখাল। ডায়ানাকে দেখা গেল। চিৎকার করতে করতে দৌড়াচ্ছে সে। দুই চোখ বড় বড় হয়ে আছে–যেন প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে। দৌড়াতে দৌড়াতেই একটা একটা করে খুলছে ওর কাপড়-যেন অস্থির হয়ে গেছে প্রচণ্ড গরমে। দেখতে পেলাম, একটা বুলেট এফোঁড়ওফেঁড় করে দিল ওর বুক। লুটিয়ে পড়ল সে। আর তারপর দেখা গেল লিওকে নিজের একটা কাপড়ও খোলেনি; তারমানে, ওর সঙ্গে মোটেও সেক্স করছিল না ডায়ানা।

কিছু বললাম না। বুঝতে পারছি, অগির কথা শেষ হয়নি।

ভিডিও বন্ধ করে দিল রিভস। তাকালাম লিও’র দিকে। নিজে থেকেই গল্প বানাতে শুরু করল সে তখন। কিন্তু আমি পুলিশকে সত্যি বলছে আর কে মিথ্যা বলছে তা আমাকে শিখিয়ে দিতে হয় না। বললাম, লিও, আমাকে শুধু সত্যি কথাটা বলো। কারণ আগামীকাল সকালেই ময়নাতদন্ত হবে ডায়ানার। বলল, কী ড্রাগ খাইয়েছ তুমি আমার মেয়েকে? জেরার মুখে ভেঙে পড়তে বেশি সময় লাগল না লিওর। বলে দিল, কী করেছে সে আমার মেয়েটার সঙ্গে।

তখন কী করলেন আপনি?

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম রিভসের দিকে। এমন এক ভঙ্গিতে মাথা ঝকাল সে, যেন আমরা দুজনই বুঝতে পেরেছি আমাদের মনের কথা। ওই ঘাঁটি ছিল একটা ব্ল্যাক সাইট। সেখানে যা ঘটেছিল এবং ঘটছিল, তা কিছুতেই প্রকাশিত হতে দিতে চাইবে না সরকার-যদি ওসব গোপন রাখার জন্য হাতেগোনা কয়েকজন সাধারণ-মানুষের মৃত্যু হয়, তবুও। কাজেই, যে-ঘরে ছিলাম আমরা, সেখান থেকে বাইরে চলে গেল রিভস। লিও তখন কাঁদছে…ওকে সান্ত্বনা দিলাম আমি। বললাম, সব ঠিক হয়ে যাবে। তারপর, যখন খেয়াল করলাম অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে সে, আমার পিস্তলটা বের করে গুলি করলাম ওর মাথায়।

কুঁচকে গেল আমার চোখমুখ। হাতেধরা পিস্তলটা অনেক ভারী বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, আমি উপস্থিত আছি ঘটনাস্থলে, দাঁড়িয়ে আছি অগির পাশে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি, আমার ভাইকে খুন করছেন তিনি ঠাণ্ডা মাথায়।

ঘরে এসে ঢুকল রিভস। আমাকে বাসায় যেতে বলল। বলল, পরিস্থিতি সামাল দেবে সে। আরও বলল, ডায়ানা কেন ও কীভাবে মারা গেছে তা যদি গোপন রাখি আমি, তা হলে লিও কেন ও কীভাবে মারা গেল সেটা গোপন রাখবে সে। অলিখিত চুক্তি হয়ে গেল আমাদের মধ্যে। তারপরও বাসায় ফিরে গেলাম না আমি, রয়ে গেলাম রিভসের সঙ্গে। খুঁজে বের করলাম ডায়ানার সব কাপড়, পরিয়ে দিলাম ওকে-আমি চাইনি, নগ্ন অবস্থায় আবিস্কৃত হোক ওর লাশ। যা-হোক, ওর আর লিও’র লাশ দুটো তোলা হলো পিকআপ ট্রাকে। শহরের ভিতর দিয়ে গভীর রাতে রওনা হলাম আমরা রেলরোড ট্রাকের উদ্দেশে। ট্রেন কখন আসবে জানতাম, তাই প্রস্তুত হয়ে থাকলাম। তারপর একসময় আমি…হ্যাঁ, আমি…নিজহাতে ডায়ানার লাশটা ছুঁড়ে দিলাম চলন্ত ট্রেনের সামনে। চোখের সামনে দেখতে পেলাম, আমার ফুটফুটে মেয়েটাকে পিষ্ট করে দিয়ে চলে গেল দানব ট্রেনটা। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম…স্পষ্ট মনে আছে, আমার চোখের পলক পড়েনি, চোখমুখ কুঁচকে যায়নি। কারণ ডায়ানার মৃত্যু মেনে নেয়ার জন্য, ওর মৃত্যু নতুনভাবে সাজানোর জন্য, এবং ওর মৃত্যুর বদলা নেয়ার জন্য ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করার দরকার ছিল আমার।

তারপর?

তারপর আর কী? বাসায় ফিরে গেলাম, অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন ফোন আসবে…আমাকে বলা হবে, আপনার মেয়ের লাশ খুঁজে পাওয়া গেছে…

অগিকে গালি দিতে ইচ্ছা করছে আমার। তাঁকে গুলি করতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু করতে পারছি না কাজটা। আমার ভিতরের কিছু একটা…আমার কোনো একটা আবেগ কাজটা করতে দিচ্ছে না আমাকে।

 অপরাধীদের জিজ্ঞাসাবাদ করার ব্যাপারে জুড়ি নেই আপনার, বললাম আমি। তারপরও আমার মনে হয় না, সে-রাতে আপনাকে সব কথা বলেছিল লিও। ঠিক না?

হ্যাঁ, ঠিক। ডায়ানাকে এলএসডি খাইয়ে দেয়ার কাজে কে কে সাহায্য করেছিল ওকে, তা চেপে গিয়েছিল সে।

মাথা ঝাঁকালাম। ওয়েস্টব্রিজ পুলিশ স্টেশনে ফোন করেছিলাম আমি। জিল স্টিভেনসের সঙ্গে কথা হয়েছে। হ্যাঙ্কের বিরুদ্ধে প্রায়ই অভিযোগ করত শহরের কেউ-না-কেউ। অভিযোগের পর অভিযোগ জমা হচ্ছিল ওর নামে-খোলা ফাইলে। আর সে-ফাইল সবসময় রাখা থাকত আপনার ডেস্কে, দেখেছি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, নিতান্ত অবহেলায় পড়ে আছে ফাইলটা, কেউ খুলেও দেখছে না। যদি তা-ই হতো, আপনার ডেস্কের অন্য ফাইলগুলোর মতো ধুলো জমে যেত ওটার গায়ে। কিন্তু তা হয়নি। তারমানে ফাইলটা নিয়মিত দেখতেন আপনি।

হ্যাঁ, দেখতাম। যতক্ষণ পর্যন্ত আমি জানতে পারিনি ডায়ানার মৃত্যুর সঙ্গে ওই ছেলেও জড়িত, ততক্ষণ ওর প্রতি একরকমের মায়া ছিল আমার মনে। একইসঙ্গে সন্দেহও ছিল~-ডায়ানার সঙ্গে একই স্কুলে পড়ত সে, এবং লিওকে গুলি করার আগেই জানতাম, আরও এক বা একাধিক বন্ধু ছিল ওর সঙ্গে সে-রাতে। রিভস বলেছিল, ঘাড় ঘুরিয়ে চেঁচিয়ে পালাও শব্দটা বলেছিল লিও। যা-হোক, হ্যাঙ্ক যেদিন পুলিশ স্টেশনে এসেছিল, মানে যেদিন জিলের সঙ্গে কথা হয়েছিল ওর, সেদিন রাতে ওর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল বাস্কেটবল কোর্টে। ওকে নিয়ে গেলাম আমার বাসায়। এককথা দুকথায়, অনেকটা অবচেতনভাবেই, ডায়ানার মৃত্যুর প্রসঙ্গ তুললাম। খেয়াল করলাম, সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে পড়ল হ্যাঙ্ক। গত পনেরোটা বছর যাকে মায়া করেছি, তার বিরুদ্ধে সন্দেহের একটা তীর যেন মুহূর্তের মধ্যে বিদ্ধ হলো আমার মনে। ডায়ানার ঘরে নিয়ে গেলাম ওকে। সে-ঘরে ডায়ানার অনেক স্মৃতি আছে, জানো তুমি। ওসব দেখে আরও ভেঙে পড়ল হ্যাঙ্ক, আক্রান্ত হলো অদ্ভুত কোনো আবেগে, কাঁদতে শুরু করল। বার বার ক্ষমা চাইছিল আমার কাছে। ভিতরে ভিতরে আরও তীব্র হচ্ছিল আমার সন্দেহ, অথচ বাবার মতো সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম ওকে তখন। বললাম, যা ঘটে গেছে। তা ভুলে গেছি আমি, ডায়ানার মৃত্যুর জন্য যদি কেউ দায়ী হয়ে থাকে তা হলে তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি অনেক আগেই। আমার মিষ্টি কথায় গলে গেল হ্যাঙ্কের মন, গড়গড় করে বলে দিল সে-রাতের কথা। আমারও জানা হয়ে গেল, সে-রাতে কে কে সাহায্য করেছিল লিওকে।

কিছু বললাম না।

ন্যাপ, তুমি এখনও বাবা হওনি; একমাত্র সন্তানকে হারানোর বেদনা যে কী পরিমাণ কষ্টদায়ক, জানো না তুমি। ডায়ানা শুধু আমার একমাত্র সন্ত নিই ছিল না, সে ছিল আমার পৃথিবী…আমার সব। যারা পরোক্ষভাবে খুন করেছে ওকে, তাদের নাম পনেরো বছর কেন, পঞ্চাশ বছর পরও যদি জানতে পারতাম, আমি কি কিছু করতাম না? আমার মোটিভটা কি বুঝতে পারছ এখন?

পারছি। এবং মোটিভটা বুঝতে পারামাত্র একমাত্র সন্দেহভাজন হিসেবে আপনার নামটা চলে এসেছে আমার সামনে। …আজ আর অস্তিত্ব নেই যে-ঘাঁটির, সেটার গোপন খবর ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে পনেরো বছর পর খুঁজে খুঁজে হত্যা করার কোনো দরকার নেই কন্সপাইরেসি ক্লাবের সদস্যদের, তারপরও করা হচ্ছে কাজটা। বেথের সঙ্গে কথা বলার পর আমার মনে হলো, আমার মতো অন্য কেউ কি সম্প্রতি জানতে পেরেছে কন্সপাইরেসি ক্লাবের শেষ-শয়তানির কথাটা? উত্তরটা যদি হ্যাঁ হয়, তা হলে সে কে? এবং কেন সে খুন করতে চাইবে রেক্স, হ্যাঙ্ক আর বেথকে? কেন ওই লোক হাতের-নাগালে পেয়েও খুন করল না মোরাকে? …রেক্সকে যখন দ্বিতীয়বার গুলি করলেন আপনি, সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল মোরা, যত দ্রুত সম্ভব গাড়ি চালিয়ে আত্মরক্ষা করল–ব্যাপারটা খাপছাড়া মনে হলো আমার কাছে। একজন মানুষের রিফ্লেক্স নিশ্চয়ই বুলেটের গতির চেয়ে বেশি না? আপনি আসলে খুন করতে চাননি মারাকে, আপনি চেয়েছিলেন সে যেন পালিয়ে যায়। তাই ওর দিকে পিস্তল তাক করেও ট্রিগারে টান দেননি। এবং আমার ধারণা, আপনি চেয়েছিলেন মোরা পালিয়ে যাক। কারণ ওকে খুন করা হলে রিভস জানতে পারত ঘটনাটা, তখন দুইয়ে দুইয়ে যোগ করে সে বুঝে ফেলত, কে করেছে খুনটা। লিওকে খুন করেছেন আপনি-সহ্য করেছে সে। কিন্তু সে যদি বুঝতে পারত আপনি একে একে শেষ করে দিচ্ছেন লিও’র বন্ধুদেরকেও, চুপ করে থাকত কি?

মাথা ঝাঁকালেন অগি। ঠিক। …হ্যাঙ্কের কাছ থেকে নামগুলো জানার পর প্রথমেই খুন করে ফেললাম হ্যাঙ্ককে। ওই কাজে কোনোরকম প্রস্তুতি ছিল না আমার, তাই লুকিয়ে রাখতে হয়েছিল লাশটা। তারপর কাজে লেগে গেলাম। পুলিশে চাকরি করি আমি, রেক্স কোথায় আছে আর কী করছে তা জানতে সময় লাগল না। সে-ও পুলিশ অফিসার জেনে একটু দমে গিয়েছিলাম। তখন আরও ভালোমতো খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলাম ওর গোপন পেশার খবর। জানতে পারলাম কোন উকিল আছে ওর পেছনে। ডেটিং সাইটে নিজের নামে অ্যাকাউন্ট খুললাম। পরিচয় হলো যোভনের সঙ্গে। ওর প্রতিনিধি সেজে যোগাযোগ করলাম ওই উকিলের সঙ্গে। মোটা টাকায় গোপনীয়তার চুক্তি হলো আমাদের মধ্যে। তারপর…হিলটন হেডে ছুটি কাটানোর নাম করে,..একরাতে ছদ্মবেশ ধারণ করে গেলাম পেনসিলভানিয়ায়। য়োভন যার সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ চায় তাকে কোথায় পাওয়া যাবে, আগেই বলে দিয়েছিলাম উকিলকে; আর উকিল আমাকে জানিয়ে দিয়েছিল রেক্সের শিকার ধরার কায়দা। তবে…মোরা যখন ফষ্টিনষ্টি শুরু করেছিল আমার সঙ্গে, চমকে গিয়েছিলাম কিছুটা-ভাবতেও পারিনি ওভাবে দেখা হয়ে যাবে ওর সঙ্গে। শেষপর্যন্ত সে পালিয়ে যাওয়ায় ভালোই হয়েছিল।

বারটেন্ডারের বর্ণনা শুনে আমারও মনে হয়েছিল, ছদ্মবেশ ধারণ করেছে তথাকথিত ডেইল মিলার। মোরা চিনতে পারেনি আপনাকে, তবে ভিডিওফুটেজে আপনার হাঁটাচলা ঠিকই পরিচিত মনে হয়েছে আমার। আপনাকে না-চিনতে পারার আরও একটা কারণ আছে মোরার: মাত্র একবার দেখেছে সে আপনাকে-ডায়ানার শেষ বার্থ ডে পার্টিতে। যা হোক, যেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করেছিলেন আপনি, সেখানকার ভিডিওফুটেজ যখন দেখলাম, আপনার উচ্চতা আর দেহকাঠামো পরিষ্কার বোঝা গেল। আরও একটা মিল আছে: আপনার কণ্ঠ।

আমার কণ্ঠ?

রান্নাঘরের দরজাটা খুলে গেল এমন সময়, ভিতর থেকে বেরিয়ে এল এলি আর মোরা।

আমি চাইনি ওরা থাকুক আমার সঙ্গে, কিন্তু এলিকে রাজি করাতে পারিনি। সে বলেছিল, ওরা যদি মেয়ে না হয়ে ছেলে হতো, তা হলে কি ওদেরকে রাখতাম না আমার সঙ্গে?

আমার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল মোরা। একই কণ্ঠ–ঠিক যেমনটা শুনেছিলাম রেক্স যে-রাতে খুন হলো সে-রাতে।

অগির উপর থেকে দৃষ্টি সরাইনি আমি। মোরা বলেছিল, রেক্সকে যে লোক খুন করেছে সে প্রফেশনাল। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে, খুনি যদি আসলেই প্রফেশনাল হবে, কিছুতেই পালিয়ে যেতে দিত না মোরাকে। কাজেই খুনি এমন কেউ, পিস্তলে যার হাত পাকা, কিন্তু খুন করাটা যার পেশা না। যা-হোক, হ্যাঙ্কের লাশ গাছের ডালে ঝোলাতে গেলেন কেন?

যখন দেখা হলো হ্যাঙ্কের বাবার সঙ্গে, মনে পড়ে গেল সন্তান হারানোর কষ্ট কী। মনে পড়ে গেল, টম যদি ছেলের লাশ দেখতে না-পায়, অন্যায় করা হবে ওর উপর। ভাগ্য সহায় হলো–ততদিনে ভাইরাল হয়ে গেছে হ্যাঙ্কের সেই ভিডিও। ব্যস, আর কী…ওর লাশের বিশেষ একজায়গায় ছুরি চালিয়ে লাশটা ঝুলিয়ে দিলাম জঙ্গলের এক গাছে।

এবং আরও একটা ভুল করলেন। হ্যাঙ্কের লাশ আর ওর বিশেষ ক্ষতস্থান ভালোমতো দেখলে যে-কেউ বুঝবে, খুন করে প্রথমে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল ওকে, তারপর দায়টা ভাইরাল ভিডিওর উপর চাপিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে কেটে নেয়া হয়েছে ওর পুরুষাঙ্গ।

মাথা ঝাঁকালেন অগি। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে কিছু ভুল হয়ে গেল। …এখন কী করবে?

সাবধানে উঠে দাঁড়ালাম আমি। খুন করতে এসেছেন বেথকে, নিশ্চয়ই খালি-হাতে আসেননি?

ঠিকানাটা তুমিই দিয়েছ আমাকে। তুমি আসলে ফাঁদ পেতেছ আমার জন্য।

কারণ আমি জানতাম, যারা আপনার মেয়ের ক্ষতি করেছে, তাদের কাউকে ছাড়বেন না আপনি এবং প্রথম সুযোগেই শেষ করে দিতে চাইবেন বেথকে। জানতাম, খুব তাড়াহুড়ো করে হাজির হবেন এখানে, কারণ আমাকে আজই দেখা করতে বলেছিলেন আপনার বাসায়। বেথকে খুন করে আবার ওয়েস্টব্রিজের উদ্দেশে রওনা দেয়ার পরিকল্পনা ছিল আপনার, তা-ই না?

ন্যাপ, আমি যা করেছি, সন্তান হারানোর বদলা নেয়ার জন্য করেছি। তোমার বিরুদ্ধে অথবা তোমার বাবার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই আমার। তোমাকে ভালোবাসি আমি।

কথাটা শুনে যেন দুমড়েমুচড়ে গেল আমার বুকের ভিতরটা। আমিও ভালোবাসি আপনাকে।

প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিলেন অগি।

 না! বললাম আমি।

 আমি তোমাকে গুলি করবো না।

 জানি। তারপরও পিস্তল বের করবেন না আপনি।

কাজটা শেষ করতে দাও আমাকে, ন্যাপ।

না।

পিস্তল উঁচিয়ে এগিয়ে গেলাম অগির দিকে, তাঁর পকেট থেকে বের করে নিলাম তার পিস্তল। সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম দূরে।

আমার মনের একটা অংশ বলছে, অগি যদি আত্মহত্যা করেন, তা হলে সবদিক দিয়ে ভালো হয়। আরেকটা অংশ বলছে, ট্রে-কে নিজহাতে শাস্তি দিয়ে আমি যেমন অন্যায় করেছি, অগিও তেমন লিও-রেক্স-হ্যাঙ্ককে খুন করে অন্যায় করেছেন। অগির আত্মহত্যা সে-অন্যায়ের পরিসমাপ্তি হতে পারে না।

আমি পুলিশের একজন হোমিসাইড ইনভেস্টিগেটর। ব্যক্তিগত আবেগের চেয়ে আমার দায়িত্ব-কর্তব্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত আমার কাছে।

হ্যান্ডকাফ আছে অগির সঙ্গে, ওটা তাঁর হাতেই পরিয়ে দিলাম আমি।

দূরে সাইরেনের আওয়াজ শোনা গেল। পুলিশের গাড়ি আসছে।

অগিকে আমি পাকড়াও করামাত্র রান্নাঘর থেকে বেথকে মিস কল দিয়েছে মোরা আমাদের-পরিকল্পনা-অনুযায়ী। তখন পুলিশে ফোন করেছে বেথ।

হাঙ্ক-আ-হাঙ্ক-আ ক্লাবে সিসি ক্যামেরা নেই, বললেন অগি।

 মানে?

মানে রিভসের মৃত্যুর সঙ্গে তোমাকে অথবা মোরাকে জড়াতে পারবে না পুলিশ।

মানে?

জবানবন্দি দেবো আমি। রিভসকে খুন করার দায় তুলে নেবো নিজের ঘাড়ে।

কীভাবে?

সহজ। বলবো, যে-কারণে লিও, রেক্স আর হ্যাঙ্ককে খুন করেছি এবং বেথকে খুন করতে চেয়েছি, একই কারণে শেষ করে দিয়েছি রিভসকে। বলবো, ইচ্ছা করলে ছাড় দিতে পারতাম ওকে, কিন্তু পনেরো বছর পর আমার মেয়ের ঘাতকদের যখন একে-একে শেষ করে দেয়ার কাজটা শুরু করেছি, তখন ওকে বাঁচিয়ে রাখার কোনো মানে হয় না। কারণ, যত যা-ই হোক, ওর অথবা ওর সাঙ্গোপাঙ্গদের বুলেটেই মারা পড়েছে ডায়ানা। কাজেই যাদের কারণে আমার মেয়েকে হারিয়েছি, সে তাদের মধ্যে একজন। সুতরাং ওর উপর কি বদলা নেয়া উচিত না আমার?

চুপ করে আছি আমি, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি অগির দিকে।

এ-ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটে থাকবে তুমি সারাজীবন, বলছেন তিনি, মোরাকেও তা-ই করতে বলবে। তোমাদের দুজনকে বাঁচানোর জন্য যে ব্যাখ্যা তৈরি করেছি আমি, আশা করছি তাতে কোনো গলদ খুঁজে পাবে না পুলিশ।

হতভম্ব হয়ে গেছি আমি।

বাড়ির ভিতরে হাজির হলো পুলিশের অফিসাররা। ওদের সঙ্গে যখন চলে যাচ্ছেন অগি, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন আমার দিকে।

 তিনি হয়তো কিছু বলতে চান আমাকে। কিন্তু আমি শুনতে চাই না সেটা। আমার মনে হয় তাঁর সে-কথা সহ্য করতে পারবো না আমি। যে মানুষটা আমার হাহাকারের-জীবনে বাবার মতো ছিলেন আমার পাশে, আজ তাঁকে হারালাম আমি। আজ আমি নিজহাতে তাঁকে হাতকড়া পরিয়ে সোপর্দ করলাম আইনের কাছে। অথচ, তিনি বলে গেছেন, আমাকে আর মোরাকে রক্ষা করবেন তিনি পুলিশের হাত থেকে।

.

পুলিশের অফিসাররা চলে গেছেন।

এলি আর মোরাকে নিয়ে বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ালাম আমি।

আরেকটা কথা বলা বাকি রয়ে গেছে, বলল মোরা।

 কিছু বললাম না। উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি দূর দিগন্তের দিকে।

যেদিন মারা গেল লিও আর ডায়ানা, বলছে মোরা, সেদিন স্কুলের লাইব্রেরিতে এলি আর ডায়ানার সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার।

জানি আমি কথাটা। এলি বলেছে।

কথাটা গোপন রাখা উচিত ছিল আমার। কিন্তু আমি তা করিনি।

সেটাও জানি আমি। ডায়ানা যে ব্রেকআপ করতে চায় লিও’র সঙ্গে, তা চট করে কীভাবে জানতে পারল আমার ভাই? নিশ্চয়ই হয় এলি নয়তো মোরা বলেছিল ওকে। এলি যদি বলত, যে-রাতে মুখ খুলেছে সে আমার কাছে সে-রাতেই জানিয়ে দিত। কিন্তু যেহেতু বলেনি, সেহেতু…

 শুনে খুব রেগে গিয়েছিল লিও। যেভাবেই হোক ডায়ানাকে কজায় রাখতে চাইছিল সে। সে-রাতে ডায়ানাকে জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে কিছু একটা করে ফেলার কথা বলছিল। আমি সায় দিইনি।

আবার দূরেও থাকতে পারেনি। তাই সে-রাতে একা একা গিয়েছিলে জঙ্গলে।

আমি যদি লিওকে কিছু না বলতাম…। সব দোষ আমার।

না। সব দোষ…সম্ভবত…আমাদের নিয়তির। সব দোষ…আমাদের সবার। আমার দোষ–আমি কেন হকি আর তোমাকে নিয়ে মত্ত ছিলাম? কেন আমি খেয়াল রাখিনি আমার ভাইয়ের? দোষ আছে অগি, হ্যাঙ্ক, রেক্স, আর বেথেরও। দোষ আছে লিওর। এবং দোষ আছে আমেরিকার প্রেসিডেন্টেরও-কেন তিনি ও-রকম একটা ব্ল্যাক সাইটের অনুমোদন দিলেন?

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল মোরা। তারপর বলল, এবার?

তাকালাম মোরার দিকে। ফিরে যাবো ওয়েস্টব্রিজে, মুখোমুখি হবে এফবিআই-এর। আশা করছি মিটমাট করে নিতে পারবো ওদের সঙ্গে।

আর?

লিওকে এখনও ভালোবাসি আমি, সবসময় বাসবো। কিন্তু সে মরে গেছে, কখনও ফিরে আসবে না, কিছু ঘাতক প্রশ্ন নিয়ে আর দিন কাটাতে হবে না আমাকে। আমি এখন জীবনের বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দিতে চাই রক্তমাংসের একজন মানুষের সঙ্গে। তুমি কি রাজি আছ?

 কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল মোরা, চুমু খেল আমার ঠোঁটে। নিচু গলায় বলল, অবশ্যই।

বাহুবাঁধনে জড়িয়ে-ধরা সুন্দরী মেয়েটার দিকে তাকালাম আমি।

 সত্যি, শেষপর্যন্ত, মুক্তি দিয়েছে আমাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *