২০. ভিডিওটেপ কপি

২০.

ভিডিওটেপটা যত-জলদি-সম্ভব কপি করে নিলাম আমি।

 ওই কাজে ব্যবহার করেছি আমার স্মার্টফোন। ভিডিওক্যামেরায় চালিয়েছি টেপটা, স্ক্রীনের দিকে তাক করে আমার ফোনের ক্যামেরা চালু করে রেখেছিলাম তখন। ভেবেছিলাম ভিডিও-কোয়ালিটি খুবই খারাপ হবে, কিন্তু কাজ শেষ হওয়ার পর যখন মোবাইলে চালিয়ে দেখলাম ভিডিওটা, পুরোপুরি নিরাশ হতে হলো না আমাকে। নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম এই বলে, আমি তো আর কোনো সিনেমাটোগ্রাফি প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে যাচ্ছি না…কাজেই অসুবিধা কী? আমি শুধু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার আশা নিয়ে নিজের কাছে রেখে দিলাম রহস্যময় ওই ভিডিওর একটা কপি।

মোবাইলের মাধ্যমে সংযুক্ত হলাম ক্লাউড সার্ভারে, সেখানে পোস্ট করে দিলাম ভিডিওটা। শুধু তা-ই না, নিজের ই-মেইল অ্যাড্রেসেও পাঠিয়ে দিলাম ওটা।

নিরাপত্তার খাতিরে একটা কপি কি পাঠিয়ে রাখা উচিত অন্য কারও কাছে?

হ্যাঁ।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কার কাছে পাঠাবো?

ডেভিড রেইনিভ? কিন্তু…আসলে ওকে বিপদে ফেলতে চাইছি না আমি। তা হলে কার কাছে পাঠাবো? এলি? কিন্তু ওই ভিডিও পাওয়ার কারণে ডেভিডের যদি কোনো বিপদ হয়, তা হলে এলিরও হতে পারে। তা ছাড়া এলির সঙ্গে মন কষাকষি হয়েছে আমার, এই রহস্যের ব্যাপারে ওর কাছ থেকে আর কোনো সাহায্য চাইবো কি না, সে-ব্যাপারে সন্দেহ আছে। আমার মনে।

মনে পড়ল অগির কথা। কিন্তু তাকে আগে থেকে কিছু না-জানিয়ে হুট করে ভিডিও পাঠিয়ে দেয়াটা কি উচিত হবে তার কম্পিউটারে?

ফোন করলাম অগিকে।

পৌঁছে গেছ রাস্টি নেইলে? কল রিসিভ করেই জানতে চাইলেন তিনি। এত জলদি গেলে কী করে?

যাচ্ছি। ফোন করেছি অন্য একটা কাজে।

কী কাজ?

ডেভিড রেইনেভের বাসায় যাওয়া এবং ওর কাছ থেকে পাওয়া ভিডিও : টেপটার কথা বললাম অগিকে।

চুপ করে আছেন তিনি।

লাইনে আছেন? জিজ্ঞেস করলাম আমি।

আছি। …শোনো, আমার অফিসের মেইল-অ্যাড্রেসে পাঠিয়ো না ভিডিওটা। বরং আমার ব্যক্তিগত যে-অ্যাড্রেস আছে, সেটাতে পাঠাও। ওটা জানা আছে তোমার?

আছে।

 ঠিক আছে, পাঠিয়ে দিয়ে তা হলে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন অগি, তারপর খাকারি দিয়ে পরিষ্কার করলেন গলা। ডায়ানা…তুমি বললে, ভিডিওতে দেখা যায়নি ওকে।

 দেখা যায়নি মানে…আমি দেখতে পাইনি। ওর কণ্ঠও শুনতে পেয়েছি কি না, সন্দেহ আছে। আপনি দেখুন ভিডিওটা, কিছু বুঝতে পারলে জানাবেন।

জানাবো। কিন্তু…আমার এখনও মনে হচ্ছে, ভুল পথে যাচ্ছ তুমি।

আমারও সে-রকমই মনে হচ্ছে। তারপরও ওই পথেই যেতে হবে আমাকে, কারণ অন্য কোনো পথ নেই আমার জন্য। আমি দেখতে চাই, এই পথ আমাকে শেষপর্যন্ত কোথায় নিয়ে যায়।

তোমার মাথায় কোনো প্ল্যান আছে মনে হয়?

 আছে। তবে সেটা শেষপর্যন্ত কাজে লাগবে কি না, জানি না।

না লাগুক, অসুবিধা নেই। পরিকল্পনাহীন অবস্থায় থাকার চেয়ে বাজে পরিকল্পনা নিয়ে থাকা ভালো।

অ্যান্ডি রিভসকে কী বলেছেন?

 তোমার ব্যাপারে?

হ্যাঁ।

কিছুই বলিনি। ওকে কী-বা বলার আছে আমার? …ভিডিওটা পাঠাও। কিছু জানতে পারলে জানাবো তোমাকে।

.

রাস্টি নেইল এককালে কারও বাসা ছিল। যিনি বা যারা থাকতেন এখানে, দুটো পয়সার আশায় পুরো বাড়ি ভাড়া দিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছেন তারা। বাড়ির ভিতরের-বাইরের ডিজাইনে পরিবর্তন ঘটিয়ে এখানে একটা বার চালু করেছেন ভাড়াটে ভদ্রলোক।

 পার্কিং লটে একটা হলুদ ফোর্ড মাস্ট্যাং-এর পাশে পার্ক করলাম আমি নিজের গাড়িটা। হেঁটে গিয়ে দাঁড়ালাম পোর্চে, একবার দেখে নিলাম এদিকওদিক। তারপর ভিনাইল কাঠের স্লাইডিং দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লাম বারের ভিতরে।

খদ্দেরদের বেশিরভাগই বুড়ো। এককোনায় একটা সাদা পিয়ানো দেখা যাচ্ছে। বাদক সেটাতে মূৰ্ছনা তুলেছেন সুইট ক্যারোলিন গানটার।

যারা উপস্থিত আছে এখানে, তাদের মধ্যে অ্যান্ডি রিভস কে, জানি না। জেনে আসা উচিত ছিল আমার। এদিকওদিক তাকাচ্ছি। আমার ধারণা, রিভসের বয়স ষাট-পঁয়ষট্টি হবে। যারা সেনাবাহিনিতে চাকরি করে, তারা অবসর নেয়ার পরও সেনাবাহিনির চালচলন ছাড়তে পারে না। কাজেই আমার আরও ধারণা, কু-কাট চুল থাকবে রিভসের মাথায়, সেনাবাহিনির হাবভাবও থাকবে। আমার অনুমানের সঙ্গে মেলে, এ-রকম দু-চারজন বুড়োর দেখাও মিলল। আবার শক্তপোক্ত গোছের কয়েকজন মাঝবয়সী লোককেও দেখতে পেলাম, যাদের চোখে ক্লান্ত সিকিউরিটি গার্ডদের মতো দৃষ্টি।

আমার উপস্থিতি টের পেয়ে মুখ তুলে তাকালেন পিয়ানোবাদক, মাথা আঁকালেন আমার উদ্দেশে। তাঁর মাথায় কু-কাট চুল নেই, চেহারায় মিলিটারি ভাবও নেই। তাঁর হ্যালকা খয়েরি চুলগুলো দেখলে পাখির পালকের কথা মনে পড়ে যায়। ইশারায় কাছে ডাকলেন তিনি আমাকে। গেলাম। পাশের একটা টুল দেখিয়ে দিলেন তিনি ইশারায়। বসলাম সেটাতে।

বাদক লোকটা ভালোই বাজাচ্ছেন সুইট ক্যারোলিন। শ্রোতারা প্রশংসা করছেন। বাজানো শেষ হলো একসময়, হাততালি দিলেন শ্রোতারা। কেউ কেউ অন্য কোনো জনপ্রিয় গানের নাম বলছেন, সেগুলোর সুর বাজানোর অনুরোধ করছেন। কিন্তু তাদের সবার উদ্দেশে পিয়ানোবাদক বললেন, পাঁচ মিনিটের একটা ব্রেক দরকার আমার। ততক্ষণে আপনারা ভাবতে থাকুন আর কী কী গানের সুর শুনবেন।

আমার দিকে তাকালেন তিনি, নিচু গলায় বললেন, অফিসার ডুমাস?

 মাথা ঝাঁকালাম।

আমি অ্যান্ডি রিভস।

 খেয়াল করলাম, লোকটার কণ্ঠ ফ্যাসফ্যাসে।

আমাকে নিয়ে বারের এককোনায় সরে এলেন তিনি। নিজে বসলেন একটা চেয়ারে, আমাকে বসতে বললেন আরেকটাতে।

 তাঁর বয়স অনুমান করার চেষ্টা করছি। চেহারা চকচকে রাখার জন্য যা-ই ব্যবহার করে থাকুন না কেন তিনি, পঞ্চান্নর কম হবে না তার বয়স। মিলিটারি ঘাঁটিটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল পনেরো বছর আগে। তারমানে, তখন রিভসের বয়স ছিল চল্লিশ।

 এই জায়গার সঙ্গে, মুখ খুললাম আমি, ডিপার্টমেন্ট অভ অ্যাগ্রিকালচারের কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না।

জানি। কিন্তু…আসলে একটা পরিবর্তন দরকার ছিল আমার।

তারমানে আপনি এখন আর সরকারের পক্ষে কাজ করেন না?

না। অবসর নিয়েছি বছর সাতেক আগে। ইউ.এস.ডি.এ.র হয়ে পঁচিশ বছর কাজ করেছি। এখন পেনশন পাই, আর যা একসময় ছিল আমার নেশা, তা-ই করি। মানে, পিয়ানো বাজাই।

তাকিয়ে আছি রিভসের চেহারার দিকে। তার গায়ের রঙ কিছুটা বাদামি, তবে সেটা রোদে পোড়ার কারণে হয়নি। হেয়ারলাইনের নিচের চামড়া কেমন পাণ্ডুর বর্ণ ধারণ করেছে।

 আমাদের ওয়েস্টব্রিজের অফিসে একটা পিয়ানো ছিল, বললেন তিনি। আমিই বাজাতাম ওটা সবসময়। কাজের চাপ যখন সাংঘাতিক বেড়ে যেত, পিয়ানো বাজিয়ে দূর করতাম নিজের আর সহকর্মীদের ক্লান্তি। একটু নড়েচড়ে বসলেন তিনি। কী করতে পারি আপনার জন্য?

ওই মিলিটারি ঘাঁটিতে আসলে কী কাজ করতেন আপনারা?

 মিলিটারি ঘাটি?

মাথা ঝাঁকালাম আমি। এককালে আপনাদের অফিস একটা মিলিটারি ঘাঁটি ছিল। আরও পরিষ্কার করে বললে, দূরপাল্লার একজাতের মিসাইলের কন্ট্রোল সেন্টার ছিল।

ও…মনে পড়েছে। ঐতিহাসিক একটা জায়গা, না?

মন্তব্য করলাম না।

তবে আমার মনে হয় আমরা সেখানে যাওয়ার বেশ কয়েক বছরর আগের ঘটনা সেটা। আসলে…সেখানে আমরা একটা অফিস কমপ্লেক্স গড়ে তুলেছিলাম, কোনো সামরিক ঘাঁটি না।

ইউ.এস.ডি.এ.র জন্য অফিস কমপ্লেক্স, শুধরে দেয়ার কায়দায় বললাম আমি।

হ্যাঁ। আমাদের গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল: খাদ্যশস্য, কৃষি, প্রাকৃতিক সম্পদ, গ্রামীণ উন্নয়ন, পুষ্টি এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে আমেরিকাকে বিশ্ব নেতৃত্ব পাইয়ে দেয়া। জনগণের উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি আর দক্ষ লোকবলের মাধ্যমে কাজ করতাম আমরা।

কথাটা শুনে মনে হলো, বার বার চর্চা করার মাধ্যমে মুখস্ত কোনো বুলি আউড়াচ্ছেন রিভস।

বুঝতে পারার ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালাম। কিন্তু সেখানে কেন?

জী?

ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অভ অ্যাগ্রিকালচারের একটা অফিস আছে ওয়াশিংটন ডি.সি.র ইনডিপেন্ডেন্স অ্যাভিনিউতে।

 আছে। ওটা হেডকোয়ার্টার। আর আমরা ছিলাম…যাকে বলে স্যাটেলাইট অফিস।

 আমার কথাটা বোঝাতে পারিনি। স্যাটেলাইট অথবা অন্য যা-ই হোক না কেন আপনাদের অফিস, সেটা একটা জঙ্গলে চালু করতে হলো কেন?

 কেন, অসুবিধা কী? জায়গাটা ছিল এককথায় চমৎকার–আমাদের কাজের জন্য। ঠিক কী কাজ করতাম আমরা তা জানতে চাইবেন না দয়া করে, ওগুলো এখনও টপ সিক্রেট হয়ে আছে। সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকলেন রিভস। ট্রেডিং প্লেসেস নামের সিনেমাটা দেখেছেন?

এডি মারফি, ড্যান অ্যাকরযেড, জেমি লি কার্টিস।

ওই সিনেমার প্রধান চরিত্রদের নাম বলে দিয়েছি, তাই সন্তুষ্ট দেখাচ্ছে রিভসকে। আপনার কি মনে আছে, ডিউকরা দুই ভাই মিলে কী করেছিল ওই সিনেমায়?

কমলার জুসের মার্কেট দখল করতে চাইছিল।

একদম ঠিক। কীভাবে করতে চেয়েছিল ওরা কাজটা, মনে আছে?

আছে। সরকারি একজন কর্মকর্তাকে ঘুষ দেয়ার চেষ্টা করেছিল ওরা। বিনিময়ে ওদের হাতে একটা গোপন নথি তুলে দেয়ার কথা ছিল ওই কর্মকর্তার।

এবং সেই গোপন নথি আর কিছুই না, ইউ,এস.ডি.এ.র মাসিক ক্রপ রিপোর্ট তো?

বুঝতে পারেননি? আমাদের কাজকর্ম ঠাঁই পেয়ে গেছে ফিকশনে। আমাদের গোপন রিপোর্ট নিয়ে হলিউডে সিনেমা বানানো হয়েছে। অর্থাৎ, কেউ-না-কেউ ঠিকই বুঝতে পেরেছে, আমাদের কোনো গোপন দলিল যদি হস্তগত করা যায়, তা হলে কোনো-না-কোনোভাবে লাভবান হওয়া যাবে।

তা-ই?

হ্যাঁ, তা-ই। এবং ঠিক সে-কারণেই নিরাপত্তা আর গোপনীয়তার দরকার ছিল আমাদের।

এবং ঠিক সে-কারণেই কাঁটাতারের বেড়া আর প্রবেশ নিষেধ জাতীয় সাইনবোর্ড দিয়ে ঘিরে ফেলেছিলেন পুরো এলাকা?

হ্যাঁ।

কেউ কখনও ওই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেনি?

 মানে?

 কোনো অনুপ্রবেশকারীকে কখনও পাকড়াও করেননি আপনারা?

করেছি…দু-একবার। ছেলেছোকরারা মাঝেমধ্যেই ঘুরঘুর করত ওই ঘাঁটির আশপাশে। সিগারেট আর মদ খাওয়ার জন্য যেত ওরা ওখানে।

তারপর?

তারপর মানে?

সিগারেট আর মদ খাওয়ার জন্য যারা যেত, তারা কি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ঢুকে পড়ত আপনাদের এলাকায়?

উ…হা…মাঝেমধ্যে।

 আপনারা কী করতেন তখন?

কিছুই না। কারণ আমাদের কোনো ক্ষতি করার উদ্দেশ্য ছিল না ওই ছেলেছোকরাদের। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করার পর নিজে থেকেই চলে যেত ওরা।

আপনারা কিছু বলতেন না ওদেরকে?

 বলতাম মনে হয়।

মনে হয়? যেমন?

 যেমন…এটা ব্যক্তিগত এলাকা, এখানে ইচ্ছা হলেই ঢোকা যাবে না…ইত্যাদি ইত্যাদি।

বলার কাজটা কীভাবে করতেন?

জী?

ধরুন আপনি এখন ওই ঘাঁটিতে আছেন। একটা ছেলে হুট করে ঢুকে। পড়ল আপনাদের এলাকায়। কী করবেন?

কেন জানতে চাইছেন?

জবাব দিন, প্লিজ।

ছেলেটাকে চলে যেতে বলবো। ওকে মনে করিয়ে দেবো, বিনা অনুমতিতে আমাদের এলাকায় ঢুকে পড়ে আইনবিরোধী কাজ করেছে সে।

ও আচ্ছা। মনে করিয়ে দেয়ার কাজটা কি আপনিই করতেন?

 না…অবশ্যই না।

 তা হলে কে করত?

আমাদের সিকিউরিটি গার্ড ছিল।

 জঙ্গলেও পাহারা দিত ওরা?

কি?

যে-জায়গায় কাঁটাতারের বেড়া বসিয়েছিলেন আপনারা, সেখান থেকে কমপক্ষে পঞ্চাশ গজ বাইরের অনেকগুলো গাছের গায়ে লটকানো হয়েছিল প্রবেশ নিষেধ জাতীয় সাইনবোর্ড।

আমাদের গার্ডরা অত দূরে যেত না।

তারমানে কোনো অনুপ্রবেশকারী যতক্ষণ পর্যন্ত আপনাদের বেড়ার কাছে হাজির না হতো, ততক্ষণ পর্যন্ত তার উপস্থিতি টের পেতেন না আপনারা?

আমি আসলে ঠিক বুঝতে পারছি না…

আমি জানতে চাইছি, কেউ অনুপ্রবেশ করেছে–কীভাবে বুঝতে পারতেন আপনারা? গার্ডদের সতর্ক দৃষ্টির উপরই কি ভরসা করতেন? নাকি ক্যামেরাও বসিয়েছিলেন?

উ…মনে হয় দু-একটা ক্যামেরা ছিল…

মনে হয়? কেন, আপনার স্পষ্ট মনে নেই?

আমি আসলে রিভসের সঙ্গে ধৈর্যের খেলা খেলছি। আমি আসলে দেখতে চাইছি, অধৈর্য হয়ে উঠলে কী করবেন তিনি। এই মুহূর্তে আঙুলের নখ দিয়ে টেবিলের উপর টোকা দিচ্ছেন তিনি সমানে। তাঁর নখগুলো দেখামাত্র গা ঘিন ঘিন করে উঠল আমার। পুরুষমানুষের হাতে এত বড় নখ দেখলে ঘেন্না হয়।

টের পেলাম, আমার দিকে তাকিয়ে আছেন রিভস, ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসছেন। ফিসফিসে কণ্ঠে বললেন, আপনি আমাকে অনর্থক প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছেন, ডিটেক্টিভ ডুমাস।

ঠিক আছে, তা হলে যে-প্রশ্নের মানে আছে আপনার কাছে সেটা জিজ্ঞেস করা যাক। লম্বা করে দম নিলাম আমি। আপনাদের তথাকথিত স্যাটেলাইট অফিসে সিককি ব্ল্যাক হক স্টিল্থ-এর মতো হেলিকপ্টারের নামার দরকার হলো কেন? তা-ও আবার রাতের বেলায়?

প্রশ্নটা আশা করেননি অ্যান্ডি রিভস। হাঁ হয়ে গেছে তাঁর মুখ। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সামলে নিলেন তিনি নিজেকে। কঠোর হয়ে গেছে তাঁর দৃষ্টি। উধাও হয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগের সেই হাসি। এখন তাকে দেখে নিষ্প্রাণ চেহারার কোনো সরীসৃপ বলে মনে হচ্ছে আমার।

 আপনি যা বলছেন, স্বভাবসুলভ ফিসফিসে গলায় বললেন তিনি, সে ব্যাপারে কোনো ধারণা নেই আমার।

তাঁর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি আমি। তিনিও তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। ওভাবে তাকিয়ে থাকতে তার কোনো সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হয় না।

পনেরো বছর খুব দীর্ঘ কোনো সময় না, মনে করিয়ে দেয়ার ভঙ্গিতে বললাম। এত তাড়াতাড়ি এত বড় কোনো ঘটনা ভুলে যাওয়ার কথা না।

অ্যান্ডি রিভস নিরুত্তর। তিনি এখনও তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।

আপনারা কী নিয়ে গবেষণা করছিলেন সেখানে, সে-ব্যাপারে কোনো মাথাব্যথা নেই আমার। আমি শুধু জানতে চাই, আমার ভাইয়ের ভাগ্যে কী ঘটেছে।

আপনি যা বলছেন, আবারও ফাঁসাসে কণ্ঠে বললেন রিভস, সে ব্যাপারে কোনো ধারণা নেই আমার।

আমার ভাইয়ের নাম লিও দুমা।

 চিন্তার ভাঁজ ফুটল রিভসের কপালে-চিন্তা করার ভান করছেন তিনি। খুব সম্ভব।

চলন্ত ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মারা গেছে আমার ভাইটা। ওর সঙ্গে তখন ডায়ানা স্টাইলস নামের একটা মেয়ে ছিল।

 ডায়ানা স্টাইলস? এতক্ষণে কথা ফুটল রিভসের মুখে। মানে পুলিশ ক্যাপ্টেন অগির মেয়ে? মাথা নাড়ছেন তিনি-দুঃখজনক ঘটনাটার কথা মনে পড়ে যাওয়ায় মানসিকভাবে চোট পেয়েছেন যেন। আপনার ভাই তা হলে মারা গেছে ওই মেয়ের সঙ্গে? কথাটা শুনে খারাপ লাগল…দুঃখিত।

আমার ভাইকে যদি আপনারাই খুন করে থাকেন, তা হলে দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই।

টোপ গিললেন না রিভস। হাতঘড়ি দেখলেন, তারপর তাকালেন তার জন্য-অপেক্ষমান বুড়ো লোকগুলোর দিকে। পাঁচ মিনিটের ব্রেক নিয়েছিলাম, বললেন আমাকে, সেটা শেষ হয়ে গেছে। উঠে দাঁড়ালেন।

যাওয়ার আগে… কথা শেষ না করে থেমে গেলাম আমি। পকেট থেকে বের করলাম আমার মোবাইল ফোন।

রিভস আমার সঙ্গে কেমন আচরণ করবেন তা অনুমান করেছিলাম আগেই, তাই হ্যাঙ্কের সেই ভিডিওর বিশেষ একটা জায়গায় এসে থামিয়ে রেখেছিলাম ওটা। এবার চালু করে দিলাম ভিডিওটা, এমনভাবে ধরে রেখেছি আমার-ফোন যাতে স্ক্রীনে যা দেখা যাচ্ছে তা দেখতে কোনো অসুবিধা না হয় রিভসের।

হেলিকপ্টারটা নামছে ওই ঘাঁটিতে।

ভিডিওটা দেখলেন রিভস, তারপর ঢোক গিললেন। আমি…আমি আসলে বুঝতে পারলাম না কীসের ভিডিও দেখালেন আমাকে।

তা-ই? আমার কিন্তু মনে হয় বুঝতে পেরেছেন। যে- হেলিকপ্টারটা দেখলেন, এটা একটা সিকরসৃকি ব্ল্যাক হক স্টিলথ হেলিকপ্টার। আর যে জায়গায় নামল ওটা, সেটা আপনাদের সেই কৃষি-গবেষণাকেন্দ্র। নিশ্চয়ই দেখেছেন, হেলিকপ্টারটা ল্যান্ড করার পর ওটার ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেছে কয়েদিদের-মতো কমলা রঙের পোশাক-পরা একটা লোক?

আপনি দেখছি সাংঘাতিক কল্পনাবিলাসী মানুষ, ডিটেকটিভ ডুমাস!

ভিডিওতে একটা তারিখ আছে…সেটা নিশ্চয়ই হাতে বসিয়ে দিইনি আমি? আর যে-জায়গায় নেমেছে হেলিকপ্টারটা, সেখানকার বিল্ডিং আর ল্যান্ডস্কেপ যাচাই করাও তেমন কঠিন কোনো কাজ না। আরও বড় কথা হচ্ছে, ভলিউম কমিয়ে রেখেছি আমি, ওটা বাড়িয়ে রাখলেই বুঝতে পারতেন, যে বা যারা ভিডিওটা করেছিল, তারা কী নিয়ে কথা বলছিল।

চেহারা কালো হয়ে গেছে রিভসের, জবান বন্ধ হয়ে গেছে।

আরেকটা কথা, বললাম আমি। ভলিউম বাড়িয়ে যদি এই ভিডিও দেখেন আপনি, তিনজন টিনএজার ছেলের কণ্ঠ আলাদাভাবে সনাক্ত করতে পারবেন। আলাদা তিনটা রহস্যময় ঘটনায় মারা গেছে তিনজনই।

অ্যান্ডি, চিৎকার করে উঠলেন এক বুড়ো লোক, লিভিং অন আ প্রেয়ার-টা বাজাবেন নাকি?

ছি, ম্যাডোনার গান ঘেন্না করি আমি, চেঁচিয়ে বললেন আরেকজন।

ম্যাডোনার গানটার নাম লাইক আ প্রেয়ার, ছাগল কোথাকার! লিভিং অন আ প্রেয়ার বন জভির।

এত বড় সাহস! আমাকে ছাগল বলে! তুই কোন্ জায়গার পণ্ডিত?

 হট্টগোল শুরু হয়ে গেল বারের আরেক কোনায়।

ব্যাপারটা পাত্তা না দিয়ে আমার দিকে তাকালেন রিভস। মুখোশ খুলে গেছে তার চেহারা থেকে। যখন কথা বললেন, তার ফিসফিসে কণ্ঠ শুনে মনে হলো সাপের হিসহিস শুনছি। ভিডিওটার এই একটা কপিই কি বানিয়েছেন?

 হ্যাঁ, কোনো বোকা যে-ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকায়, সেভাবে মাথা ঝাঁকালাম আমি। আমি তো পৃথিবীর সেরা গর্দভ, তাই আসল ভিডিওটার কোনো কপি না বানিয়েই এবং সেগুলো জায়গামতে না পাঠিয়েই চলে এসেছি আপনার সঙ্গে দেখা করতে।

 আপনি কি জানেন, এই ভিডিওর খবর যদি জানাজানি হয়, তা হলে আইনের দৃষ্টিতে অপরাধী সাব্যস্ত হবেন আপনি? জানেন, সেক্ষেত্রে জেল হতে পারে আপনার?

 আপনি কি আমাকে আইন শেখাচ্ছেন? যদি প্রশ্নটার জবাব হ্যা হয়, তা হলে স্পষ্ট জানিয়ে দিতে চাই, আপনার হুমকিতে তিল পরিমাণ ভয়ও লাগছে না আমার।

হুমকি? হ্যাঁ, আমি আপনাকে সাবধান করে দিতে চাই। এই ভিডিও যদি অন্য কাউকে দেখান আপনি…

বাধা দেয়ার ভঙ্গিতে হাত তুললাম। আমি যা জানতে চাইছি তা যদি ঠিকমতো না বলেন আমাকে, তা হলে অবশ্যই এই ভিডিও আমি অন্য একাধিক লোককে দেখাবো। কীভাবে দেখাবো, তা-ও বলে দিই। ফেসবুক অথবা টুইটারে পোস্ট করে দেবো আমি এই ভিডিও। এবং সেটার নিচে লিখে দেবো আপনার নাম। নিজের নোটপ্যাড আর কলম বের করলাম আমি। রিভস শব্দটার বানান বলুন। ওটা কি দুটো ই দিয়ে লেখেন আপনি, নাকি একটা ই ব্যবহার করেন?

 আপনার ভাইয়ের ব্যাপারে আমার কিছু করার ছিল না, এবং এখন কিছু বলারও নেই।

 তা হলে আমার গার্লফ্রেন্ডের ব্যাপারে কিছু বলুন। ওর নাম মোরা ওয়েলস। মনে পড়েছে তো? নাকি এবারও বলবেন, মোরার ব্যাপারে কিছু করার ছিল না আপনার, এবং এখন কিছু বলার নেই?

বিষদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন রিভস। ডিটেকটিভ ডুমাস, ভিডিও টেপটা যদি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেন আপনি, আপনাকে নিজের হাতে খুন করবো আমি। খুন করবো যারা আপনার ঘনিষ্ঠ, তাদেরকেও। বোঝাতে পেরেছি কথাটা?

 অবশ্যই, মাথা ঝাঁকালাম আমি। সবকিছু পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে আমার কাছে। উঠে দাঁড়ালাম, এগিয়ে যাচ্ছি রিভসের দিকে।

 মাথায় রক্ত উঠে গেছে আমার। স্থান-কাল-পাত্র ভুলে গেছি। মোবাইলটা ঢোকালাম পকেটে।

 রিভসের কাছে গিয়ে প্রচণ্ড একটা লাথি মারলাম তাঁর নাকেমুখে। চেয়ার-সহ উল্টে পড়ে গেলেন তিনি। আরও দুপা আগে বাড়লাম আমি। পরের লাথিটা মারলাম রিভসের অণ্ডকোষে।

তার চিৎকারে খানখান হয়ে গেল রাতের নীরবতা।

 চমকে গেছেন রিভসের ভক্তরা। লাফিয়ে আগে বাড়ল মাঝবয়সী এক লোক। আমাকে কোনো-একটা শিক্ষা দেয়ার আগে তাকিয়ে নিল রিভসের দিকে।

বারের মেঝেতে এখনও পড়ে আছেন রিভস, ডাঙায়-তোলা মাছের মতো ছটফট করছেন।

 যেখানে আছেন সেখানেই থাকুন, হুমকি দেয়ার কায়দায় বললাম আমার-দিকে-এগিয়ে-লোকটাকে, মুহূর্তের মধ্যে বের করে ফেলেছি নিজের ব্যাজ। পুলিশ কেস।

জবাবে শার্টের হাতা গোটাল লোকটা। শালা …

 যে-গালিটা দিল সে আমাকে, তা ছাপার অযোগ্য।

আরও একবার রক্ত চড়ে গেল আমার মাথায়। গত পনেরো বছরের বঞ্চনা মেশিনগানের বুলেটের মতো ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে আমাকে, আজ আমার শোধ নেয়ার পালা।

আমার দিকে দৌড়ে আসছিল লোকটা, লাফিয়ে আগে বাড়লাম আমি। বুটের সোল কাজে লাগিয়ে নিখুঁত একটা সাইডকিক মারলাম ওই লোকের একদিকের কানে। দৌড়াতে দৌড়াতে যেন কোনো অদৃশ্য দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেল সে হঠাৎ, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল একটা মুহূর্ত, তারপরই আছড়ে পড়ল মেঝেতে।

পেছন থেকে আমাকে সর্বশক্তিতে জড়িয়ে ধরল কে যেন। একটুও দেরি করলাম না আমি, বুটের সোলটা সজোরে বসিয়ে দিলাম ওই লোকের পায়ে। ব্যথায় চিৎকার করে উঠল সে, আলগা হয়ে গেল ওর বাহুবাধন। ওর উচ্চতা অনুমান করে নিয়েছিলাম আগেই, এবার নিজের ডান কনুইটা চালালাম পেছনের দিকে। লোকটার নাকেমুখে আছড়ে পড়ল আমার কনুই, ওর ঠোঁট থেঁতলে যাওয়ার স্পষ্ট শব্দ শুনতে পেলাম। এক পায়ে ভর দিয়ে পাঁই করে ঘুরলাম আমি, একটা আপারকাট চালালাম আমার-প্রতিপক্ষের খুঁতনিতে। দু-চার পা পিছিয়ে গিয়ে হুড়মুড় করে পড়ে গেল লোকটা।

বোতল ভাঙার আওয়াজ পাওয়া গেল। একটা টেবিলের সঙ্গে বাড়ি মেরে মদের-বোতল ভেঙেছে রিভসের আরেক ভক্ত, বোতলের ভাঙা অংশটা বাগিয়ে ধরে ছুটে আসছে আমার দিকে। ওই লোকের দিকে ছুট লাগালাম আমিও, কাছাকাছি পৌঁছে একটা ফ্লাইংকিক মারলাম ওকে। ওর ডান চোখের উপর আছড়ে পড়ল আমার বুটের সোল, হাত থেকে ভাঙা বোতল ছেড়ে দিয়ে দুহাতে চোখ ধরে পড়ে গেল সে।

পা দিয়ে তেলাপোকা মারার কায়দায় ওই লোকের নাকেমুখে আরও দুবার লাথি মারলাম আমি, রক্তাক্ত করে দিলাম ওকে। দেরি করলাম না একমুহূর্ত, হিপ-হোলস্টারে রাখা পিস্তলটা টেনে বের করলাম। মুখোমুখি হলাম রিভসের বাকি ভক্তদের।

তাঁরা সবাই থমকে গেছেন। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে যা ঘটে গেছে, তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তাদের।

আপনার নামে রিপোর্ট করবো আমরা, আমাকে হুমকি দিলেন এক বৃদ্ধ।

অবশ্যই…যত জলদি সম্ভব করবেন কাজটা, মোবাইলটা বের করলাম। আমাকে যে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়েছিল, তা ইতোমধ্যে রেকর্ড করা হয়ে গেছে আমার। কাজেই আদালতে আমার প্রমাণ করতে কষ্ট হবে না, আমি যা করেছি আত্মরক্ষার খাতিরে করেছি।

চলে যান আমাদের বার থেকে! বললেন আরেকজন।

তা-ই করলাম আমি।

তবে বেরিয়ে আসার আগে মেঝেতে-পড়ে-থাকা রিভসের একটা ছবি তুললাম আমার মোবাইল দিয়ে।

.

২১.

আমি জানি, অ্যান্ডি রিভসের অণ্ডকোষের-ব্যথা সেরে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যে। আমি আরও জানি, যা করেছি, তা পুলিশে রিপোর্ট করবেন না তিনি, অন্য কাউকেও করতে দেবেন না হয়তো। কারণ তিনি চাইবেন না, কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপের সন্ধান পেয়ে যাক পুলিশ। তিনি হচ্ছেন সবকিছু ধামাচাপা দেয়া স্বভাবের মানুষ। এ-রকম লোকেরা পুলিশের সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলে সবসময়।

কাজেই আগেও যেমন একা ছিলাম আমি, এখনও তা-ই আছি। নিজের পিঠ নিজেকে বাঁচিয়ে কাজ করে যেতে হবে।

 তবে রিভসের হুমকিটা কিছুটা হলেও চিন্তিত করে তুলেছে আমাকে। ওটা ফাঁপা হুমকি ছিল না। খুন করা হয়েছে কন্সপাইরেসি ক্লাবের চার সদস্যকে–লিও, ডায়ানা, রেক্স আর হ্যাঙ্ক। হ্যাঁ, এখন থেকে ওই চারজনের বেলায় খুন শব্দটাই ব্যবহার করবো। কারণ কেউ আমাকে বলে না দিলেও আমি নিশ্চিতভাবে জানি, ওদের কেউ দুর্ঘটনায় মরেনি অথবা আত্মহত্যা করেনি। দুই বন্ধু অথবা অগির মেয়ের হত্যাকাণ্ডের বদলা নিতে পারবো কি না জানি না, তবে ভাই-হত্যার শোধ আমাকে নিতেই হবে। হত্যাকারীদের ছেড়ে দিতে পারি না আমি।

ভেবেছিলাম এই কেসের ব্যাপারে আর যোগাযোগ করবে না এলির সঙ্গে, কিন্তু ওর কথাই মাথায় এল প্রথমে। ফোন করলাম ওকে। কল রিসিভ করল না সে। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল আমার। বিরক্ত হলাম নিজের উপর।

 রিভসের যে-ছবি তুলেছি, সেটা চেক করলাম মোবাইলে। ব্যথায় বিকৃত হয়ে আছে চেহারাটা, তারপরও বোঝা যাচ্ছে চেহারার আদল।

 মেসেজ অপশনে গিয়ে ছবিটা অ্যাটাচ করে একটা এস.এম.এস. পাঠালাম এলিকে। টেক্সট-এ লিখে দিলাম:

মোরার মাকে এই ছবি দেখিয়ো। তিনি চিনতে পারেন কি না লোকটাকে, জানিয়ো।

.

গাড়ি চালাচ্ছি আমি, ফিরে যাচ্ছি বাসায়। হঠাৎ টের পেলাম, অনেকক্ষণ কিছু খাইনি। দিক বদল করে রওয়ানা হলাম আর্মস্ট্রং ডিনারের উদ্দেশে। চব্বিশ ঘণ্টাই খোলা থাকে ওটা।

রেস্টুরেন্টটার পার্কিংলটে যখন নামছি গাড়ি থেকে, বেজে উঠল আমার মোবাইল ফোন।

এলি ফোন করেছে।

 কল রিসিভ করলাম। হ্যালো?

 তুমি কোথায়?

 আর্মস্ট্রং-এ।

থাকো ওখানেই। আধ ঘণ্টার মধ্যে আসছি। লাইন কেটে দিল সে।

রেস্টুরেন্টের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকতে যাবো, হঠাৎ নজর পড়ল অপরিচিত দুটো মেয়ের উপর।

দুজনেরই বয়স উনিশ কি বেশি হলে বিশ। পাখির মতো কিচিরমিচির করে কথা বলছে দুজনই, আর সমানে সিগারেট টানছে। গিয়ে দাঁড়ালাম ওদের কাছে।

কিচিরমিচির থামিয়ে আমার দিকে তাকাল একটা মেয়ে। কোনো সমস্যা?

এতক্ষণে রেস্টুরেন্টের ভিতরে ঢুকে যাওয়া উচিত ছিল আমার, বললাম আমি। এবং এটাও ভালোমতো জানি, নিজের চরকায় তেল দেয়াটাই ভালো। তারপরও একটা কথা না বলে পারছি না।

মুখ চাওয়াচাওয়ি করল মেয়ে দুটো। তারপর দুজনই একসঙ্গে তাকাল আমার দিকে। ওদের দৃষ্টি বলে দিচ্ছে, চোখের সামনে জলজ্যান্ত একটা পাগল দেখছে ওরা।

দয়া করে সিগারেট খাবেন না, বললাম আমি।

ঝগড়া করার কায়দায় কোমরে হাত রাখল একটা মেয়ে। আপনাকে কি চিনি আমরা?

না। আসল কথা হচ্ছে, আমার বাবা ফুসফুসের ক্যান্সারে মারা গেছেন। প্রচুর সিগারেট খেতেন তিনি। সাংঘাতিক কষ্ট পেয়ে মরতে দেখেছি আমি তাঁকে। তাই যখনই কাউকে সিগারেট খেতে দেখি, নিষেধ না করে পারি না। আবারও বলছি, দয়া করে সিগারেট খাবেন না।

 মেয়ে দুটোকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঢুকে পড়লাম রেস্টুরেন্টে, বসে পড়লাম একদিকের একটা জানালার কাছে। খাবারের অর্ডার দিলাম, সেগুলো হাজির হওয়ামাত্র ঝাঁপিয়ে পড়লাম কাঁটা-চামচ নিয়ে।

 আমার খাওয়া যখন শেষপর্যায়ে, তখন রেস্টুরেন্টে ঢুকল এলি। এদিকওদিক তাকিয়ে খুঁজে নিল আমাকে, তারপর হেঁটে এসে বসে পড়ল আমার মুখোমুখি।

মোরার মাকে দেখিয়েছ ছবিটা? জিজ্ঞেস করলাম আমি।

মাথা ঝাঁকাল এলি। এখনও জবাব দেননি তিনি।

খেয়াল করলাম, কেমন ভেজা ভেজা দেখাচ্ছে এলির চোখ দুটো। সে যে কাঁদছে তা আমার থেকে লুকানোর জন্য চোখ পিটপিট করছে।

এলি?

 আমি আরও কিছু-একটা লুকিয়েছি তোমার কাছে।

কী?

 দুবছর আগের কথা। খেয়াল আছে, তখন একবার একমাসের জন্য ওয়াশিংটন গিয়েছিলাম আমি?

আছে। গৃহহীনদের জন্য একটা কনফারেন্সে যোগ দেয়ার কথা ছিল তোমার।

এবং যোগ দিয়েছিলামও, টেবিল থেকে ন্যাপকিন তুলে নিল এলি, চোখ মুছছে। একমাস।

কিছু বললাম না। প্রসঙ্গটা কোনদিকে যাচ্ছে, বুঝতে পারছি না।

আগেই বলে রাখি, মোরার সঙ্গে এই ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই। তারপরও…

হাত বাড়িয়ে এলির একটা হাত ধরলাম, আলতো করে চাপ দিলাম। কী হয়েছিল তখন?

তুমি আমার-দেখা সেরা মানুষ, ন্যাপ। আমি আমার নিজের চেয়েও বেশি বিশ্বাস করি তোমাকে। তারপরও এতদিন বলিনি কথাটা।

কী বলোনি?

 বব…

 মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেছি আমি।

একটা মাস আমাকে পায়নি বব। সেটা সহ্য করতে পারেনি সে। ফেরার সময় ভাবলাম, না জানিয়ে বাসায় হাজির হয়ে চমকে দেবো ওকে। কিন্তু বাসায় গিয়ে চমকে উঠতে হলো আমাকেই। বাচ্চা দুটো ঘুমিয়ে গেছে, ওদিকে আমার বেডরুম থেকে নারীকণ্ঠের চাপা শীৎকারের আওয়াজ ভেসে আছে। দরজা লক করেনি বব-প্রয়োজন বোধ করেনি অথবা খুব তাড়াহুড়ো ছিল। দোরগোড়ায় গিয়ে দাঁড়ানোমাত্র দেখলাম, বব আর ওই মেয়েটা…আমার বিছানায়… কথা শেষ করল না এলি, ভেঙে পড়েছে নিঃশব্দ কান্নায়।

জবান বন্ধ হয়ে গেছে আমার। কী বলবো, ভেবে পাচ্ছি না। এলি আমার কাছ থেকে সান্ত্বনামূলক কিছু শুনতে চাইছে বলেও মনে হচ্ছে না।

 মাত্র একমাসের বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারল না বব? যে-মানুষটাকে আমি এত ভালো বলে জানি, সে মাত্র একমাসের জন্য এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করল তার স্ত্রীর সঙ্গে?

গত দুটো বছর ধরে আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু তার বুকের ভিতরে সাংঘাতিক একটা কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছে, অথচ আমি কিছুই টের পাইনি!

চোখ মোছা শেষ করল এলি, জোর করে হাসি ফুটিয়ে তুলল চেহারায়। ওই ঘটনার পর পুরুষমানুষদের উপর বিশ্বাস উঠে গেছে আমার। তারপরও আমি ববের সঙ্গে শুয়েছি। কারণ যদি তা না করি, আবারও একই কাজ করবে সে। সে-রাতে সে ধরা পড়েছিল আমার কাছে, ওকে যদি অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে বিছানায় দেখে ফেলে লিয়া বা কেলসি, তা হলে কী হবে? …ইচ্ছা করলে ওকে ডিভোর্স দিতে পারতাম। কিন্তু দিইনি-লিয়া আর কেলসির কী হবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে।

তুমি কি এই ব্যাপার নিয়েই কথা বলতে চাও?

না। আজ কেন যেন কথাটা বলতে ইচ্ছা করল তোমাকে, তাই বলে ফেললাম। গত দুটো বছর ধরে বহন করছিলাম আমি এত বড় একটা দুঃখ, আর পারছিলাম না আসলে। বাদ দাও। মোরার ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি আমি। ওর কাছে যে-প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, কথা বলতে এসেছি সেটার ব্যাপারেও।

কবে করেছিলে প্রতিজ্ঞাটা?

যে-রাতে লিও আর ডায়ানা মারা গেল।

আমার মনে হলো, হেভিওয়েট কোনো বক্সারের পাঞ্চ খেয়েছি নাকেমুখে।

বানি এগিয়ে এল আমাদের দিকে। এলির কিছু লাগবে কি না, জানতে চাইল। ক্যাফিনমুক্ত কফির অর্ডার দিল এলি। আমার খাওয়া হয়ে গেছে, তাই শুধু পুদিনা-চা চাইলাম।

স্পেশার একটা মেন্যু আছে, জানাল বানি-কলা দিয়ে বানানো পুডিং। একবার খেলে সেটার স্বাদ নাকি অনেকদিন লেগে থাকবে মুখে। কিন্তু মানা করে দিলাম আমি, মানা করে দিল এলিও। চলে গেল বানি।

 সে-রাতে মোরার সঙ্গে কখন দেখা হয়েছিল তোমার? জিজ্ঞেস করলাম এলিকে। লিও আর ডায়না মারা যাওয়ার আগে নাকি পরে?

ওরা মারা যাওয়ার আগেও, পরেও।

কী বলবো বুঝতে পারছি না। অথবা, যা বলতে চাইছি তা বলতে ভয় লাগছে আমার।

জানালা দিয়ে বাইরে, পার্কিংলটের দিকে তাকিয়ে আছে এলি।

এলি?

মোরার কাছে করা প্রতিজ্ঞাটা ভাঙতে চলেছি আমি, মুখ না ঘুরিয়েই বলল এলি। কিন্তু…

কী?

পুরোটা শোনার পর তোমার আদৌ ভালো লাগবে কি না, জানি না।

.

লিও আর ডায়ানা মারা যাওয়ার পর আমাদের বাসায় গিয়েছিল মোরা।

কটার দিকে?

রাত তিনটায়। বাবা আর মার ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল…জানো তুমি…আমি তখন থাকতাম বাবার কাছে। তাকে পছন্দ করতাম, আবার মাকে তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন বলে ঘেন্নাও করতাম। আমার পক্ষে যদি সম্ভব হতো, অন্য কোথাও চলে যেতাম, কিন্তু সেটা সম্ভব ছিল না। ওদিকে বাবার সঙ্গে একই ছাদের নিচে থাকতেও ইচ্ছা করত না। তাই তাকে বলেছিলাম, গ্যারেজটা আমার জন্য ছেড়ে দিতে। অনুরোধটা রেখেছিলেন। তিনি। গ্যারেজটা বেডরুমের মতো করে সাজিয়ে দিয়েছিলেন আমার জন্য।

তারপর?

ওখানে থাকতে কষ্ট হতো আমার, তবে বন্ধুরা যখন-খুশি-তখন দেখা করতে পারত আমার সঙ্গে। কারণ আমার সঙ্গে দেখা করতে হলে বাবার ঘুম ভাঙানোর দরকার হতো না ওদের কারও।

আজ থেকে পনেরো বছর আগে শুনেছিলাম, এলির সেই গ্যারেজ হোমের দরজা নাকি দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে। কথাটা বিশ্বাস করিনি তখন। আজ করছি।

যা-হোক, বলছে এলি, অত রাতে দরজায় টোকার শব্দ শুনতে পেয়ে প্রথমে পাত্তা দিইনি আমি। ভবঘুরে অনেক মাতাল রাতটা কাটিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে ওই কাজ করেছে আগে অনেকবার। কেউ কেউ আবার জোর করে ঢুকে পড়তে চেয়েছে গ্যারেজের ভিতরে।

মোরা কি সে-রাতের আগে কখনও গিয়েছিল তোমার ওখানে?

না। কথাটা বোধহয় আগেও বলেছি তোমাকে, তোমার মনে নেই। আসলে…মোরাকে…কী বলবো…আমাদের সবার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমতী আর পরিপক্ক বলে মনে হতো আমার কাছে। মনে হতো, ওর বাস্তবজ্ঞান আমাদের সবার চেয়ে বেশি।

তোমার কাছে গেল কেন সে?

 আমিও জানতে চেয়েছিলাম কথাটা। কিন্তু মোরা প্রথমে খুব কাঁদছিল। ওকে দেখতে হিস্টিরিয়া রোগীর মতো লাগছিল। মনে হচ্ছিল, সে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত লাগে আমার কাছে। কারণ আমি সবসময় মনে করতাম, আবেগ কখনও স্পর্শ করতে পারে না মোরার মতো মেয়েদেরকে–আবেগ হচ্ছে আমার মতো সহজসরল আর নির্বোধ মেয়েদের জিনিস। যা-হোক, ওকে সামলাতে মিনিট পাঁচেক লাগে আমার। ধুলোয় মাখামাখি হয়ে ছিল ওর কাপড়। ভেবেছিলাম, হামলা করা হয়েছে ওর উপর…মানে, কেউ ওকে ধর্ষণ করেছে অথবা করার চেষ্টা করেছে। ওর কাপড় কোথাও ছিঁড়ে গেছে কি না দেখার জন্য বার বার তাকাচ্ছিলাম ওর দিকে।

তারপর?

 হঠাৎ করেই নিজেকে সামলে নিল সে। এবং সেটা দেখেও আশ্চর্য হয়ে গেলাম আমি। মনে হলো, কেউ যেন হঠাৎ একটা চড় মেরেছে ওর গালে, চেঁচিয়ে বলেছে, কান্না থামাও! 

 কী করলে তুমি তখন?

আমার বিছানার নিচে লুকিয়ে রেখেছিলাম ফায়ারবল হুইস্কির একটা বোতল, ওটা বের করলাম।

 তুমিও মদ খেতে?

হ্যাঁ। যা-হোক, মদ খেতে রাজি হয়নি মোরা। বলে, ওর নাকি মাথা। ঠাণ্ডা রাখাটা জরুরি। জানতে চায়, আমার সঙ্গে যদি কিছুক্ষণ থাকে তা হলে কোনো অসুবিধা হবে কি না। আমি বলি, কোনো সমস্যা নেই, তোমার যতক্ষণ খুশি থাকো। আসলে আমি তখন হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলাম। মোরার মতো একটা মেয়ে রাত তিনটায় আমার গ্যারেজ-হোমে হাজির হয়ে বলছে আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ থাকতে পারবে কি না…আমার মাথা কাজ করছিল না আসলে।

তুমি নিশ্চিত, রাত তিনটায় গিয়েছিল সে তোমার ওখানে?

হু।

তখনও লিও আর ডায়ানার মৃত্যুর খবর পাওনি তুমি?

না।

ওই ব্যাপারে তোমাকে কিছু বলেছিল মোরা?

না। সে তখন বলল, লুকিয়ে থাকার জন্য একটা জায়গা দরকার আমার। তারপর আমার চোখে চোখে তাকাল, আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞাটা করিয়ে নিল।

কী প্রতিজ্ঞা?

 সে যে এসেছে আমার কাছে, তা বলতে পারবো না কারও কাছে। এমনকী তোমাকেও না।

আমার কথা কি আলাদাভাবে বলেছিল সে?

মাথা ঝাঁকাল এলি। তখন আমি ভাবছিলাম, তোমাদের দুজনের সাংঘাতিক কোনো ঝগড়া হয়েছে, তাই তোমার কাছ থেকে আলাদা হয়ে যেতে চাইছে মোরা। কিন্তু খেয়াল করে দেখলাম, ভয়ের ছাপ স্পষ্ট ফুটে আছে ওর চোখেমুখে। বোঝার চেষ্টা করলাম, আমার কাছে কেন হাজির হয়েছে সে। উত্তরটা নিজেই দিলাম নিজেকে হয়তো আমার চেয়ে নির্ভরযোগ্য কাউকে পায়নি। কিন্তু অনেক পরে বুঝতে পেরেছিলাম, আসল কারণ ভিন্ন।

কী সেটা?

 মোরার মা বলেছিলেন, তখন নাকি সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজা হচ্ছিল তাঁর মেয়েকে। আমার সঙ্গে তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল না মোরার, তাই যে বা যারা খুঁজছিল ওকে, তারা হয়তো কল্পনাও করেনি, আমার গ্যারেজ-হোমে যেতে পারে সে।

মাথা ঝাঁকালাম। সে-কারণেই বাসায় ফিরতে পারেনি সে।

ঠিক। এবং একই কারণে যোগাযোগ করেনি তোমার সঙ্গে। কারণ সে বুঝতে পেরেছিল, শত্রুপক্ষ নজর রেখেছে এবং রাখবে তোমার উপর, তারা এমনকী ছাড় দেবে না তোমার বাবাকেও। যাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল মোরার, তাদের কাউকেই ছাড় দেয়ার কথা না ওই লোকগুলোর।

ব্যাপারটা অনেকখানি পরিষ্কার হয়ে এসেছে আমার কাছে। এবং আমরা সবাই জানতাম, তোমার সঙ্গে তেমন কোনো খাতিরই ছিল না মোরার।

হু।

কিন্তু ওই লোকগুলো কারা? আর…ওরা কেন খুঁজছিল মোরাকে?

জানি না।

 জিজ্ঞেস করোনি মোরাকে?

করেছিলাম। জবাব দেয়নি সে।

জোরাজুরি করোনি?

হাসতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল এলি। মোরার মত মেয়ের সঙ্গে জোরাজুরি করে লাভ আছে? সে নিজে থেকে কিছু না-বললে ওর পেট থেকে কথা বের করা যেত কখনও?

হ্যাঁ, মোরা চাপা স্বভাবের ছিল। সে নিজে থেকে কিছু বলতে না-চাইলে ওর পেট থেকে কথাটা বের করে নিয়ে আসা প্রায়-অসম্ভব একটা কাজ ছিল।

আরও পরে জানতে পারি, বলছে এলি, যে-কারণে মোরা তার মাকে কিছু বলেনি সে-রাতের ব্যাপারে, একই কারণে আমাকেও কিছু বলেনি। সে চেয়েছিল, আমাদের যেন কোনো ক্ষতি না হয়।

সে রক্ষা করতে চেয়েছিল তোমাদেরকে।

 হ্যাঁ।

স্বাভাবিক। তোমরা যদি কিছু না-ই জানবে, যে বা যারা জিজ্ঞাসাবাদ করবে তোমাদেরকে, তাদেরকে কিছু বলবে কী করে?

মাথা ঝাঁকাল এলি। মোরা আমাকে দিয়ে আরও প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিল, সে যতক্ষণ পর্যন্ত নিজে থেকে ফিরে না আসে, ততক্ষণ কাউকে কিছু বলতে পারবো না আমি। প্রতিজ্ঞাটা রক্ষা করার চেষ্টা করেছি আমি গত পনেরো বছর। জানি, হয়তো আমার উপর রাগ হবে বা হচ্ছে তোমার; কিন্তু…একটা মানুষ সাহায্য চেয়েছে আমার কাছে, তাকে কথা দিয়েছি আমি এবং বুঝতে পেরেছি তার হারিয়ে যাওয়াটা আমাদের সবার জন্য ভালো, তাই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিনি। এই যে এখন বসে আছি তোমার মুখোমুখি, সে-রাতের ঘটনাটা বলে দিলাম তোমাকে, আমার কিন্তু এখনও মনে হচ্ছে, কাজটা ঠিক করিনি। এখনও মনে হচ্ছে, মুখ বন্ধ রাখলেই বোধহয় ভালো হতো।

সিদ্ধান্ত বদল করলে কেন?

কারণ আমাদের হাইস্কুলের বন্ধুরা মারা পড়ছে একের-পর-এক। মোরাও মরে গেছে কি না, জানি না আমরা কেউই।

তোমার ধারণা খুন করা হয়েছে ওকেও?

আসলে…মোরা চলে যাওয়ার পর ওর মার সঙ্গে অদ্ভুত এক সম্পর্ক ওঠে আমার। তোমাকে হয়তো ইতোমধ্যে বলেছেন তিনি, বেনিগানস এ তাকে ফোন করেছিল মোরা? আমিই ঠিকঠাক করে দিয়েছিলাম সব। কথাটা তোমাকে বলার সময় আমার প্রসঙ্গ চেপে গেছেন তিনি।

মোরার কথা বলো। কী হলো তারপর?

তারপর… কাঁধ ঝাঁকাল এলি, একটা কাজে বাইরে গিয়েছিলাম, ফিরে এসে দেখি, চলে গেছে মোরা।

চিরকুট জাতীয় কিছু লিখে রেখে যায়নি তোমার জন্য?

না।

 তারপর?

 তারপর আর কখনও দেখা হয়নি ওর সঙ্গে। কথাও হয়নি।

লিও আর ডায়ানার মৃত্যুর ব্যাপারটা জানতে পারলে কখন?

ওরা মারা যাওয়ার একদিন পর।

কীভাবে?

 ডায়ানার সঙ্গে কথা বলার জন্য ওদের বাসায় ফোন করেছিলাম। তখনও ছাড়াছাড়ি হয়নি ডায়ানার বাবা-মার। ফোনটা ধরেন ওর মা।

তিনি ফোনেই সব জানিয়ে দিলেন তোমাকে?

না। আমাকে তাদের বাসায় যেতে বললেন। ফোনে আহাজারির মতো শোনাচ্ছিল তার কণ্ঠ। দৌড়াতে দৌড়াতে গেলাম তাদের বাসায়। জানতে পারলাম সবকিছু। সঙ্গে সঙ্গে মোরার কথা মনে পড়ে গেল আমার। আবার ছুট লাগালাম। কিন্তু গ্যারেজ-হোমে ফিরে আর পাইনি ওকে।

 তোমার কি তখন মনে হয়নি, লিও আর ডায়ানার মৃত্যুর সঙ্গে মোরার গায়েব হয়ে যাওয়ার সম্পর্ক আছে?

কিছু বলল না এলি।

যে-রাতে লিও আর ডায়ানা মারা গেল, সে-রাতেই তোমার গ্যারেজ হোমে গিয়ে হাজির হলো মোরা। তোমার কি পরে একবারও মনে হয়নি, কোনো-না-কোনো সম্পর্ক আছে ঘটনা দুটোর মধ্যে?

আস্তে আস্তে মাথা ঝাঁকাল এলি। মনে হয়েছিল, ব্যাপারটা কাকতালীয়।

এবং তুমি কাউকে কিছু বলেনি?

আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ন্যাপ।

তোমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু তখন মারা গেছে। তারপরও প্রতিজ্ঞা রক্ষা করলে তুমি?

মাথা নিচু করে ফেলল এলি।

 থমকে গেলাম আমি।

স্কুলে থাকতে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বাসী ও নির্ভরযোগ্য মেয়ে ছিলে তুমি। কাজেই তুমি যে অক্ষরে অক্ষরে প্রতিজ্ঞা পালন করবে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু আমার কাছে আশ্চর্য লাগছে অন্য একটা ব্যাপার। ডায়ানা মরে গেল, অথচ তুমি কাউকে কিছু…

 আসলে আমরা সবাই তখন ভেবেছিলাম, ওটা একটা দুর্ঘটনা। অথবা…একসঙ্গে আত্মহত্যা করেছে লিও আর ডায়ানা, যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে কখনোই বিশ্বাস করিনি সেটা। তবে আমার কিন্তু তখন একবারও মনে হয়নি, পুরো ব্যাপারটার সঙ্গে মোরা কোনোভাবে জড়িত।

এলি, কিছু মনে কোরো না, একটা কথা না বলে পারছি না। যতটা সহজভাবে বলছ তুমি কথাগুলো, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, পুরো ব্যাপারটা তত সহজ না। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, আবারও কিছু একটা গোপন করছ তুমি আমার কাছে।

আবারও মাথা নিচু হয়ে গেল এলির।

দেখতে না পেলেও বুঝতে পারলাম, চেহারা কালো হয়ে গেছে আমার। কারণ আমি বুঝতে পেরেছি, আমার সঙ্গে মিথ্যা বলেছে এলি।

এলি?

আমি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছিলাম, ন্যাপ।

চুপ করে আছি আমি। বিশ্বাসভঙ্গের একটা বেদনা চুরমার করে দিচ্ছে আমার বুকের ভিতরটা।

আমি…সব কথা বলে দিয়েছিলাম, এখনও মাথা নিচু হয়ে আছে এলির।

কার কাছে?

 ডায়ানার বাবা-মার কাছে।

 স্থির হয়ে গেলাম মূর্তির মতো। অগি আর অড্রের কাছে?

 হ্যাঁ।

অগি… যা বলতে চেয়েছিলাম তা মরে গেল আমার মুখের ভিতরে, তিতা একটা স্বাদ অনুভব করছি। অগি জানতেন তোমার গ্যারেজ-হোমে ছিল মোরা?

মাথা ঝাঁকাল এলি।

মুখ ঘুরিয়ে নিলাম এলির উপর থেকে। তাকিয়ে আছি রেস্টুরেন্টের কিচেনের দিকে।

এই পৃথিবীতে কি বিশ্বাস বলে কিছু নেই? এই পৃথিবীতে কি এমন একজন মানুষও নেই যাকে বিশ্বাস করা যায়? এলি আমার কাছে মিথ্যা কথা বলেছে। অগি মিথ্যা কথা বলেছেন। আর কে কে করেছে কাজটা? মা করেছেন। লিও’র মারা যাওয়ার খবর শুনে তিনি বলেছিলেন দেখতে আসবেন, কিন্তু আসেননি।

বাবাও কি কখনও মিথ্যা কথা বলেছেন আমার সঙ্গে?

 লিও-ও কি কখনও করেছে কাজটা?

মুখ ফেরালাম এলির দিকে। তোমার কাছ থেকে মোরার খবর শুনে অগি কী বললেন?

 ধন্যবাদ দিলেন আমাকে। মনে করিয়ে দিলেন, প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা উচিত আমার।

অগির সঙ্গে দেখা করতে হবে আমাকে, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করতে হবে, এত বড় একটা খবর কেন এতগুলো বছর লুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি আমার কাছে।

আরেকটা কথা মনে পড়ে গেল। তুমি বলেছ, যেদিন মারা গেল লিও আর ডায়ানা, সেদিন, ওরা মারা যাওয়ার আগে এবং পরে, অর্থাৎ কমপক্ষে দুবার, মোরার সঙ্গে দেখা হয়েছিল তোমার।

আবারও আস্তে আস্তে মাথা ঝাঁকাল এলি।

লিও আর ডায়ানা মারা যাওয়ার পরে কী হয়েছিল তা তো বললে। এবার বলো আগে কী হয়েছিল।

আরেক দিকে তাকাল এলি।

কী ব্যাপার? জিজ্ঞেস করলাম আমি।

বলতে কোনো সমস্যা নেই আমার।

তা হলে?

তোমার ভালো লাগবে কি না, তা-ই ভাবছি।

.

২২.

আর্মস্ট্রং ডিনারের ঠিক উল্টোদিকে, রাস্তার আরেক কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। তাকিয়ে আছে ওই রেস্টুরেন্টের বিশেষ একটা জানালার দিকে।

পনেরো বছর আগের বিশেষ একটা রাতের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে ওর। সে-রাতে বুলেটের আওয়াজে চুরমার হয়ে গিয়েছিল নীরবতা। দৌড়ে পালিয়ে যায় মেয়েটা, লুকিয়ে থাকে দুঘণ্টা। আড়াল ছেড়ে বের হয়েছিল সে একসময়, দেখতে পায় পাক-করে-রাখা কয়েকটা গাড়ি। দেখতে পায়, গাড়িগুলোর ভিতরে বসে আছে বিশেষ কয়েকজন লোক। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারে, কী করতে হবে ওকে। চুপিসারে গিয়ে হাজির হয় বাস স্টপে। কোন্ বাসে উঠবে তা জানা ছিল না, কিন্তু তখন ওর জন্য ওয়েস্টব্রিজ ছেড়ে চলে যাওয়াটাই ছিল বড় কথা, বাস কোনো ব্যাপার না। ওয়েস্টব্রিজ থেকে যত দূরে সম্ভব চলে যেতে চাইছিল সে তখন।

যেসব বাস ওয়েস্টব্রিজ ছাড়ে, সেগুলো হয় নিউআর্ক নয়তো নিউ ইয়র্কে যায়। যেখানেই যাক ওগুলো, মেয়েটা জানত, পরিচিত লোক অথবা কোনো বন্ধুর সাহায্য পাবে সে। কিন্তু মেয়েটা যখন হাজির হয়েছিল বাস স্টপে, ততক্ষণে রাত গম্ভীর হয়েছে, বেশিরভাগ বাস সার্ভিস বন্ধ হয়ে গেছে। আরও খারাপ কথা: গাড়ি নিয়ে শত্রুপক্ষের কয়েকজন লোক চলে এসেছিল সেখানে, যেসব বাস তখনও ছেড়ে যায়নি সেগুলোর ড্রাইভারদের সঙ্গে কথা বলছিল। কাজেই সে-রাতে ওয়েস্টব্রিজ ছেড়ে আর যাওয়া হলো না মেয়েটার। বাস স্টপ থেকে আবার পালাতে হলো ওকে।

এলির কাছে চলে আসে সে। দুটো রাত থাকে ওই মেয়ের সঙ্গে। তারপর আবার পালিয়ে যায়। এবারের ঠিকানা ওর আর্ট-শিক্ষক হুগ ওয়ার্নারের আর্ট স্টুডিয়োর বেইজমেন্ট। মিস্টার ওয়ার্নার তখনও বিয়ে করেননি। ঘুমানোর সময় বাদে সারাদিন পনিটেইল করে বেঁধে রাখেন চুল। সবসময় মদের গন্ধ আসে তাঁর মুখ থেকে।

কাজেই ওই বেইজমেন্টে কিছুদিন থাকার পর আবার পালাতে হয় মেয়েটাকে। অ্যালফাবেট সিটিতে মিস্টার ওয়ার্নারের একজন বন্ধু ছিলেন, তাঁর বাসায় গিয়ে ওঠে মেয়েটা। সেখানে দুটো দিন ছিল সে। ওখানেই কাটিয়ে ছোট করে নেয় নিজের চুল, রঙ করিয়ে নেয় চুলে।

এরপর সে ভিড়ে যায় একদল বিদেশি টুরিস্টের সঙ্গে। ওদের একজনের কাছ থেকে একরাতে বেশ কিছু টাকা চুরি করে। পুলিশের হাতে ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে যায়। পরিচয় হয় রাস্তার এক ভিক্ষুকের সঙ্গে, লোকটা ব্রুকলিনের এক বাটপারের সন্ধান দেয় মেয়েটাকে। ওই লোক নাকি জাল আই.ডি, বানানোয় ওস্তাদ।

বাটপার লোকটার কাছে যায় মেয়েটা, চারটা নকল আই.ডি. খরিদ করে নিজের জন্য। একটা আইডি, র বদৌলতে অস্থায়ী একটা চাকরিও পেয়ে যায়।

পরের তিনটা বছর যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়াতে থাকে মেয়েটা। সিনসিনাটিতে একটা রেস্টুরেন্টে, ওয়েইট্রেসের কাজ পেয়ে যায়। বার্মিংহ্যামে পিগলি-উইগলি নামের আরেকটা রেস্টুরেন্টে ক্যাশ রেজিস্টার সামলানোর দায়িত্ব পায়। ডেটোনা বীচে বিকিনির মডেল হয়। পেট চালানোর মতো কোনো কাজ যখন জুটত না ওর, তখন সে রাত কাটাত ফুটপাতে, কখনও পাবলিক পার্কে। আবার কখনও কোনো চেইন মোটেলে।

মোদ্দা কথা, মেয়েটা জানত, এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে পারবে না সে, পেটের তাগিদে এখানে-সেখানে ঘুরে ঘুরে কাজ করতে হবে। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, ঠিকানা বদল করে যেতে হবে ওকে নিরন্তর। বেঁচে থাকতে হলে অন্য কোনো উপায় ছিল না ওর। শত্রুপক্ষের লোকগুলোকে সামান্য সুযোগও দিতে চায়নি সে।

ওকে খুঁজছিল লোকগুলো, কিন্তু ওর নামে কখনও কোনো ওয়ান্টেড পোস্টার ছাপায়নি। ওই লোকগুলো খুঁজছিল মেয়েটাকে, কিন্তু বিশেষ একটা কারণে সীমিত পরিসরে ছিল ওদের সে-খোঁজ। সাধারণ জনগণের সাহায্য চাওয়ার কোনো উপায় ছিল না লোকগুলোর।

 সুযোগটা কাজে লাগায় মেয়েটা। ঢুকে পড়ে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দলে, নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দেয় বেশ কিছুদিন। তারপর যোগ দেয় একটা ক্লাবে, নর্তকী হিসেবে। ঘুণেধরা এই সমাজের চোখে যারা দিনের বেলায় ভদ্রলোক, তারাই রাতের আঁধারে একেকজন রিপুরাক্ষস; তথাকথিত ওই ভদ্রলোকগুলোর সামনে স্বল্পবসনে নাচত সে। তবে কখনও কোন পরপুরুষকে নিজের গায়ে হাত দিতে দেয়নি।

 ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছে সে মোট দুবার। একবার মারও খেয়েছে ওদের হাতে। তারপর থেকে একটা ছুরি রাখে সে নিজের কাছে। ডেনভারের একটা পার্কিংলটে একরাতে ধর্ষণ করার উদ্দেশ্যে দুজন লোক ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ওর উপর। ওদের একজনের পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দেয় মেয়েটা। রাগের মাথায় ওই লোকের বুকেও বোধহয় ছুরি মেরেছিল সে, কারণ ওর খেয়াল আছে, রক্ত বেরিয়ে এসেছিল লোকটার মুখ দিয়ে।

দেরি করেনি সে, পালায় আবার।

ছুরি-খাওয়া লোকটা মরে গিয়েছিল কি না, জানে না মেয়েটা, জানতে চায়ও না। তবে সে বিশ্বাস করে, আত্মরক্ষার তাগিদে যা করেছে, ঠিকই করেছে।

কখনও কখনও রাত কাটিয়েছে সে কিছু কমিউনিটি কলেজে। ওসব জায়গায় নিরাপত্তার কড়াকড়ি থাকে না কখনোই। কখনও আবার স্রেফ সময় কাটানোর উদ্দেশ্যে যোগ দিয়েছে ওসব কলেজের কোনো-না-কোনো ক্লাসে।

মিলওয়াকিতে যখন ছিল সে, একবার ভেবেছিল থিতু হবে সেখানে। রিয়েল এস্টেটের লাইসেন্সও জোগাড় করে ফেলেছিল। কিন্তু উকিল কীভাবে যেন বুঝে গেলেন, ওর আই.ডি. নকল।

ডালাসে থাকতে তিন সপ্তাহের একটা প্রশিক্ষণ নিয়েছিল ইনকাম-ট্যাক্স রিটার্নের উপর, টুকটাক কাজও পাচ্ছিল। পরে নিজের ছাদবিহীন ছোট্ট অস্থায়ী অফিস খুলে নিয়ে বসে একটা দোকানে সামনে। তবে তার আগে ওই দোকানের মালিককে বখরার অধের্ক টাকা দিতে রাজি হতে হয়েছিল ওকে।

ওই সময় একাকিত্ব পেয়ে বসে মেয়েটাকে। তাই অ্যান হ্যাঁনোন নামের একটা মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে সে। পেট চালানোর তাগিদে মামুলি একটা কাজ করত অ্যান, বেতনের টাকায় ঘরভাড়া দিয়ে চলতে কষ্ট হতো তার, তাই একজন রুমমেট খুঁজছিল। ওরা দুজনে তখন ভাড়া থাকতে শুরু করে একই ঘরে। স্বাভাবিকভাবেই অন্তরঙ্গতা বাড়ে ওদের। একসঙ্গে সিনেমা দেখতে যেত ওরা নিয়মিত। সপ্তাহান্তে অথবা ছুটিছাটায় কখনও কখনও বেড়াতে যেত স্যান অ্যান্টোনিয়োয়।

বিশ্বাস করার মতো একজন মানুষ ছিল অ্যান। ওকে ইচ্ছা করলে নিজের সব কথা বলতে পারত মেয়েটা। কিন্তু বলেনি। কারণ নিজেদের নিরাপত্তার কথাটা সবসময় ঘুরপাক খেয়েছে ওর মাথায়।

যে-ছাপড়াঘরে থাকত ওরা, একদিন সন্ধ্যায় কাজ সেরে ওই এলাকায় ফিরে মেয়েটা দেখে, স্যুট-পরিহিত দুজন লোক রাস্তার একধারে বসে অলস ভঙ্গিতে পত্রিকা পড়ছে। স্যুট-পরিহিত কেউ কখনও যেত না ওই এলাকায়, তাই ওই লোক দুজনকে দেখামাত্র ঘাপলা টের পায় মেয়েটা। ঘরের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল অ্যানকে। সদা-হাস্যোজ্জ্বল মানুষটার চেহারায় হাসির ছিটেফোঁটাও ছিল না।

 কাজেই আবার পালাতে হয় মেয়েটাকে। অ্যানকে বিদায় বলার সুযোগটা পর্যন্ত পায়নি সে।

আলাস্কায় গিয়ে হাজির হয় সে, টিনজাত খাবারের একটা কারখানায় কাজ নেয়। কিছুদিন সেখানে থাকার পর কাজ পেয়ে যায় স্ক্যাগওয়ে-থেকে সিয়াটলে যাতায়াতকারী একটা প্রমোদ-জাহাজে। সে-জাহাজের যাত্রীদের মধ্যে হাতেগোনা কেউ কেউ ভালো ব্যবহার করেছে মেয়েটার সঙ্গে। কিন্তু বেশিরভাগ যাত্রীই তা করেনি। বেশিরভাগ যাত্রী যা করেছে মেয়েটার সঙ্গে ওই জাহাজে, তা ভালো ব্যবহারের পর্যায়ে পড়ে না। প্রমোদ-জাহাজের যাত্রীরা ভালো ব্যবহার করার জন্য পয়সা খরচ করে না। তারা প্রমোদ কেনার জন্য পয়সা খরচ করে।

এভাবে পালিয়ে বেড়াতে বেড়াতে বছরের-পর-বছর কেটে গেছে মেয়েটার। পলাতক জীবনে এমন কিছু মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে ওর, যারা বুঝে গিয়েছিল সে আর কেউ না, মোরা ওয়েলস। সে-রকম ঘটনা ঘটেছিল দুবার-লস অ্যাঞ্জেলস আর ইন্ডিয়ানাপোলিসে। দুবারই পালাতে বাধ্য হয় মেয়েটা।

তেত্রিশ বছরের জীবনে পনেরোটা বছরই এভাবে পালিয়ে-পালিয়ে কেটে গেছে মেয়েটার।

তারপর একদিন দেখা হয়ে গেল রেক্সের সঙ্গে।

তারপর একদিন বুলেটের আওয়াজ আবার খান খান করে দিল রাতের নীরবতা।

তারপর একদিন…ধরা পড়লে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও…ভালোবাসার মানুষটাকে একনজর দেখার একটা দুর্দমনীয় বাসনা জেগে উঠল ওর মনে।

জানালা দিয়ে ন্যাপের চেহারাটা দেখতে পাচ্ছে মেয়েটা এখন। দেখতে পাচ্ছে, বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে ওর এককালের প্রেমিককে। গত পনেরো বছরের মধ্যে এই প্রথম দেখছে সে লোকটাকে। অদ্ভুত কোনো আবেগ বার বার ফিরে আসছে মেয়েটার মনে। এবং সে-আবেগ ঠেকানোর কোনো চেষ্টাই করছে না সে।

এতক্ষণ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছিল মেয়েটা, এবার এসে দাঁড়াল পার্কিংলটের আলোয়। মনে মনে প্রার্থনা করছে, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাক ন্যাপ, অন্তত একবারের জন্য হলেও দেখুক ওকে। তারপর বেরিয়ে আসুক পার্কিংলটে। তারপর…

ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল মেয়েটা টানা দশ সেকেন্ড।

ন্যাপ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল না।

আরও দশ সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকল মেয়েটা।

তাকাল না ন্যাপ।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরল মোরা, অদৃশ্য হয়ে গেল রাতের অন্ধকারে।

.

২৩.

যেদিনের কথা বলছি সেদিন স্কুলের লাইব্রেরিতে ছিলাম আমি আর ডায়ানা, শুরু করল এলি। পরের সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ফল ড্যান্স, ওটা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। প্ল্যানিং কমিটির হেড ছিল ডায়ানা। আর আমি ছিলাম ওর ডেপুটি।

স্মৃতি ঘাঁটছি আমি। না, ওই ফল ড্যান্সের কথা মনে নেই আমার। তবে এটা মনে আছে, ওই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে চাইছিল না মোরা। আর আমারও তেমন মাথাব্যথা ছিল না অনুষ্ঠানটার ব্যাপারে।

 ওই অনুষ্ঠান ডায়ানার জন্য ছিল বড় কিছু একটা। এক মাস আগে থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছিল সে ওটার জন্য। দুটো থিম ছিল অনুষ্ঠানটাতে ভিন্টেজ বোর্ডওয়াক এবং ওয়ান্স আপন আ স্টোরিবুক, কোনটাতে অংশ নেবে সে তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল। দুটোতেই অংশ নেয়ার কথা বলছিল সে, কিন্তু আমি রাজি ছিলাম না ওর প্রস্তাবে। ওই ব্যাপারেই কথা বলছিলাম আমরা। আলোচনাটা কথা কাটাকাটির পর্যায়ে চলে গেছে, এমন সময় আমাদের সামনে হাজির হয় মোরা। দম নেয়ার জন্য থামল এলি।

অপেক্ষা করছি আমি।

 ডায়ানার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে মোরা। কী নিয়ে কথা বলছিল ওরা তা খেয়াল করিনি প্রথমে, কারণ আমার মাথায় তখনও ঘুরপাক খাচ্ছে ফল ড্যান্সের ব্যাপারটা। তবে পরে শুনলাম, সে-রাতে ডায়ানাকে নিজের সঙ্গে কোনো এক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে চাপাচাপি করছে মোরা। রাজি হচ্ছিল না ডায়ানা, মানা করে দিচ্ছিল বার বার। তারপর একসময় হুট করে বলে বসে, দলের সবাই যদি যায়, তা হলে আমিও যাবো।

দলের সবাই মানে? কোন্ দল? কন্সপাইরেসি ক্লাব?

দেখো, ন্যাপ, যে-সময়ের কথা বলছি, তখন ওই ক্লাবের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল না আমার। কাজেই সে-রাতে ওরা কোথায় যেতে চায়, কেন যেতে চায়–আগ্রহ ছিল না সে-সব নিয়েও। তবে…তোমাকে ইয়ারবুকটা দেখানোর পর থেকে আমারও মনে হচ্ছে, সেদিন দল বলতে কন্সপাইরেসি ক্লাবের কথাই বুঝিয়েছিল মোরা।

তারপর?

সেদিন, যে-কোনো কারণেই হোক, ডায়ানার মেজাজটা বোধহয় খারাপ ছিল। মোরার সঙ্গেও কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে যায় ওর। একপর্যায়ে ডায়ানা বলে বসে, লিও আর ওর বন্ধুদের ব্যাপারে মন ভরে গেছে আমার। একটা কথা বলি তোমাদের দুজনকে, কাউকে বোলো না–আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি লিও’র সঙ্গে ব্রেকআপ করে ফেলবো।

বলো কী! অথচ…আমি ভাবতাম…।

তোমার ভাইটা বদলে গিয়েছিল, ন্যাপ, খেয়াল করোনি তুমি

অথচ মরার আগের দিন পর্যন্ত আমার সঙ্গে একই ঘরে থেকেছে সে।

 তারপরও কিছু টের পাওনি তুমি। কারণ তোমার ছিল মোরা। তোমার ছিল হকি। এবং তখন তোমার বয়স ছিল আঠারো।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা ঝাঁকালাম। তারপর?

না, তারপর আর কিছু না। ডায়ানার সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে চলে যায় মোরা একসময়। এবং পরে রাত তিনটায় আবার দেখা হয় ওর সঙ্গে। মাঝখানের সময়টা বড় একটা রহস্য হয়ে আছে আমার কাছে।

আমার কাছেও, মনে মনে বললাম আমি।

.

আর্মস্ট্রং ডিনারের পার্কিংলটে এসে দাঁড়ালাম আমরা। চুমু খেলাম এলির গালে। গাড়িতে উঠে পড়ল সে। আমাকে বিদায় না বলে, এমনকী আমার উদ্দেশে হাত না নাড়িয়ে চলে গেল।

তাকিয়ে আছি ওর গাড়ির দিকে। রাস্তায় বাঁক নিয়ে একসময় অদৃশ্য হয়ে গেল গাড়িটার টেললাইট।

দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। পনেরোটা বছর ধরে আমার কাছ থেকে কত বড় একটা ঘটনা গোপন করে রেখেছিল সে।

যে-দুটো মেয়ে সিগারেট খাচ্ছিল তাদের খোঁজে এদিকওদিক তাকালাম। নেই ওরা, অনেকক্ষণ আগেই চলে গেছে।

অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে আমার।

মনে হচ্ছে, কেউ একজন আড়ালে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

আবারও এদিকওদিক তাকালাম।

না, সে-রকম কাউকে দেখতে পেলাম না।

আমার কি আসলে হ্যাল ছেড়ে দেয়া উচিত? মনে মনে জিজ্ঞেস করলাম নিজেকে। মারা কি চায় না ওকে খুঁজে পাক কেউ? সে কি আর ফিরে আসতে চায় না?

আচ্ছা, এত রাতে এই পার্কিংলটে আসলে কী করছি আমি?

আমি যদি হ্যাল ছেড়ে দিই, যদি পিছিয়ে যাই, আবারও কি বীভৎস মৃত্যুকে বরণ করে নিতে বাধ্য হবে কেউ-না-কেউ? হারিয়ে-যাওয়া মোরাকে যদি ফিরিয়ে আনি আমি, ওকে এবং ওর সঙ্গে অন্য কাউকে কি বিপদে ফেলে দেবো?

একগুঁয়েমি আছে আমার মধ্যে। কোনোকিছু যদি একবার পেয়ে বসে আমাকে, সেটা সহজে ছেড়ে দিতে পারি না আমি। কোনো কাজের ব্যাপারে দৃঢ়-সংকল্প হয়েছি, অথচ সেটা শেষ করিনি, এমন ঘটনা কমই আছে আমার জীবনে। তারপরও আমি বেপরোয়া না। আত্মঘাতী না।

তা হলে কী করা উচিত আমার এখন?

 ছেড়ে দেবো সব? পিছিয়ে আসবো?

মোরা…অনেক বছর আগে তারাজ্বলা এক রাতে আমার বুকের উপর শুয়ে ফিসফিস করে বলেছিল…যেতে দিয়ো না আমাকে। অথচ সে নিজে থেকেই চলে গেছে।

কী করবো তা হলে? যে চলে গেছে তাকে হারিয়ে যেতে দেবো?

আবারও আমার মনে হচ্ছে, কেউ একজন আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখছে আমাকে।

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম।

জার্সি মাইকস সাব শপের সঙ্গে একটা গাছ আছে, ওটার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে কেউ একজন; তাকিয়ে আছে খুব-সম্ভব এদিকেই।

শত্রুপক্ষের কেউ? আমি কি ভয় পাচ্ছি ওদেরকে?

আজ থেকে পনেরো বছর আগে টিনএজার ছিল লিও আর ডায়ানা, কাজেই একঅর্থে অসহায় বলা যায় ওদেরকে। যখন গুলি চালানো হয় রেক্সের উপর, তখন অপ্রস্তুত অবস্থায় ছিল সে; কাজেই একঅর্থে অসহায় ছিল সে-ও। আর হ্যাঙ্ক…সে তো জীবনের প্রথম দিন থেকে শুরু করে শেষদিন পর্যন্ত ছিল অসহায়। কিন্তু আমি?

আমি পুলিশের একজন হোমিসাইড ইনভেস্টিগেটর। দিনের বেশিরভাগ সময় আমার সঙ্গে একটা আগ্নেয়াস্ত্র থাকে।

পা বাড়ালাম ওই গাছের দিকে। হাত বাড়িয়ে আঁকড়ে ধরেছি হিপ হোলস্টারে রাখা পিস্তলের বাঁট, তবে পিস্তলটা বের করিনি এখনও। যতক্ষণ পর্যন্ত ওটা আমার সঙ্গে আছে, ততক্ষণ পর্যন্ত লিও-ডায়ানা, অথবা রেক্স, অথবা হ্যাঙ্কের পরিণতি বরণ করতে হবে না আমাকে।

মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল এমন সময়।

প্যান্টের বা পকেটে রাখি আমি আমার ফোন, কাজেই ডান হাতে পিস্তলের বাট ধরে রেখেও ফোনটা বের করতে পারলাম।

অপরিচিত নম্বর।

কল রিসিভ করলাম। হ্যালো?

ডিটেকটিভ ডুমাস?

যে-লোক ফোন করেছে, বেশিরভাগ মানুষের মতো সে-ও আমার নামের উচ্চারণ ভুল করেছে।

হ্যাঁ। কে বলছেন?

কার্ল লেগ…অ্যান আবার পুলিশ ডিপার্টমেন্ট। ডক্টর ফ্লেচার নামের একজন কার্ডিয়োনলজিস্টের খোঁজ করছিলেন আপনি।

খোঁজ পাওয়া গেছে?

 না। তবে…

তবে?

 আপনাকে কয়েকটা কথা জানানো দরকার। …লাইনে আছেন?

মনের অজান্তেই দিক বদল করে এগিয়ে গেলাম আমার গাড়ির দিকে, গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে-থাকা মানুষটা গুরুত্ব হারিয়েছে হঠাৎ করেই। আছি। বলুন।

দুঃখিত, কোনো আওয়াজ না পেয়ে ভেবেছিলাম আপনি বোধহয় লাইন কেটে দিয়েছেন। …ডক্টর ফ্লেচারের অফিসে গিয়েছিলাম আমি। অফিস ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলেছি।

ম্যানেজারের নাম কেসি।

হ্যাঁ। চেনেন তাকে?

 চিনি মানে ফোনে কথা হয়েছে। তাঁর কথা শুনে মনে হয়েছে, ঠেকায় পড়ে কথা বলছিলেন আমার সঙ্গে। ডক্টর ফ্লেচারের ব্যাপারে আমাকে তেমন কোনো সাহায্য করেননি তিনি।

অন্যকে সাহায্য করার মনোভাব এমনিতেও নেই তাঁর। তবে… আমাকে একটু চাপাচাপি করতে হয়েছে।

ভালো করেছেন।

যা-হোক, ডক্টর ফ্লেচারের ব্যাপারে যা জানা গেছে তা হচ্ছে, বিশেষ একটা কারণ দেখিয়ে বেশ কিছুদিনের জন্য ছুটি নিয়েছেন তিনি হাসপাতাল থেকে।

গাড়িতে উঠে বসলাম আমি। তা-ই?

হু। নিজের সব অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল করে দিয়েছেন তিনি, এবং বেশিরভাগ অ্যাপয়েন্টমেন্ট ট্রান্সফার করেছেন ডক্টর পল সিম্পসন নামের আরেক ডাক্তারের কাছে। ডক্টর সিম্পসন, ডক্টর ফ্লেচারের পার্টনার।

 ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম গাছটার দিকে। কোনো নড়াচড়া চোখে পড়ছে না। ও-রকম কাজ কি আগেও করেছে ডক্টর ফ্লেচার?

না। কেসির কথা অনুযায়ী, ডক্টর ফ্লেচার খুবই অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষ, কিন্তু তাঁর রোগীদের প্রতি আবার দারুণ যত্নশীল। কাজেই এভাবে হুট করে তাঁর গায়েব হয়ে যাওয়াটা অদ্ভুতই লাগছে আমার কাছে।

আমারও অদ্ভুত লাগছে।

ডক্টর ফ্লেচারের স্বামীর সঙ্গেও কথা বলেছি আমি।

 কী বলেছেন তিনি?

বলেছেন, অনেক আগেই ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে তাদের। এবং ডক্টর ফ্লেচার এখন কোথায় আছেন, সে-ব্যাপারে কোনো ধারণা নেই তাঁর। …তিনি যখন আমার-কাছথেকে শুনলেন লম্বা ছুটি নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন তার এককালের স্ত্রী, তখন আমাদের মতোই আশ্চর্য হলেন। ভদ্রলোক আরও একটা কথা বলেছেন, এবং সেটা বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে আমার কাছে।

কী কথা?

তিনি যেভাবে বলেছেন সেভাবেই বলি…ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর থেকে অনেক বদলে গেছে সে।

গাড়ি চালু করলাম আমি, আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছি পার্কিংলট থেকে। ঠিক আছে, কার্ল, ধন্যবাদ।

আমার মনে হয় এই ব্যাপারটা আরেকটু খতিয়ে দেখা উচিত। ডক্টর ফ্লেচারের ফোন রেকর্ড, ক্রেডিট কার্ড স্টেটমেন্ট…এসবের কথা বলছি আর কী।

ঠিক আছে, দেখবো। আপনাকে আবারও ধন্যবাদ।

লাইন কেটে দিলাম।

বেথের ফোন রেকর্ড, ক্রেডিট কার্ড স্টেটমেন্ট ইত্যাদি চেক করতে হলে ওয়ার্যান্ট ইস্যু করাতে হবে আমাকে। অতদূর যাবো কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে আমার নিজেরই। কারণ এখন পর্যন্ত নিছক একটা ধারণার বশবর্তী হয়ে কাজ করে চলেছি আমি। কোথাও কোনো প্রমাণ নেই। কাজেই আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বদনামের ভাগীদার হতে চাইবে না-আমার মুখের-কথায় ওয়ার্যান্ট ইস্যু করবে না।

রওয়ানা হলাম অগির অ্যাপার্টমেন্টের উদ্দেশে। রাস্তা বলতে-গেলে ফাঁকা, তারপরও মাঝারি গতিতে গাড়ি চালাচ্ছি, কারণ অগির কাছে হাজির হওয়ার আগে কিছুক্ষণ ভাবতে চাই পুরো ব্যাপারটা।

অগি জানতেন, এলির কাছে দুটো রাত লুকিয়ে ছিল মোরা।

কথাটার মানে কী? আমি আসলে নিশ্চিত না। অগি কি পরে অনুসরণ করেছিলেন মোরাকে? কাজটা করার কোনো দরকার ছিল তার? সবচেয়ে বড় কথা, তথ্যটা আমার কাছে চেপে গেলেন কেন তিনি?

আবারও বেজে উঠল আমার মোবাইল ফোন।

এবার কল করেছেন আমার বস লরেন মিউস।

 আগামীকাল সকালে ঠিক নটায় চলে আসবে আমার অফিসে, বললেন তিনি।

কী ব্যাপার?

 নটার সময়, লাইন কেটে দিলেন তিনি।

অ্যান্ডি রিভসের অণ্ডকোষে লাথি মেরেছি আমি, তারপর মারামারি করেছি ওই লোকের কয়েকজন ভক্তের সঙ্গে কেউ কি আমার নামে নালিশ জানিয়ে দিয়েছে ঊধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে?

থাক, চিন্তিত হয়ে লাভ নেই–যা হওয়ার, হয়ে গেছে; অতীত বদলে দেয়ার ক্ষমতা নেই পৃথিবীর কোনো মানুষের।

হাতেই আছে মোবাইলটা, ওটার স্পিড ডায়াল থেকে ফোন করলাম। অগির নম্বরে।

কোনো জবাব নেই।

আশ্চর্য লাগল আমার।

সাধারণত এ-রকম হয় না। সাধারণত ফোন করামাত্র রিসিভ করেন অগি। তা ছাড়া, তার কাছে হ্যাঙ্কের সেই ভিডিও পাঠিয়েছি অনেকক্ষণ আগে, আমার সঙ্গে নিজে থেকেই যোগাযোগ করার কথা তার।

পৌঁছে গেছি অগির অ্যাপার্টমেন্টের কাছে। সুবিধাজনক একজায়গায় গাড়ি পার্ক করলাম। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। সবকিছু কেমন নিথর মনে হচ্ছে আমার কাছে। দূরে বিশাল একটা কুকুর নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন এক বুড়ি। ধোঁয়া উড়ছে তার এক হাত থেকে। অর্থাৎ, সিগারেট। দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়েও সামলে নিলাম~-আমি সমাজসংস্কারক না। বুড়ির আরেক হাতে একটা প্লাস্টিক-ব্যাগ। ওটা বোধহয় ডাস্টবিনে ফেলতে যাচ্ছেন তিনি।

কিছু একটা নজর কাড়ল আমার।

একটা হলুদ গাড়ি।

অথবা, গাড়িটা হলুদ দেখাচ্ছে। আমি জানি, রাতের বেলায় স্ট্রীট লাইটের হলুদাভ বাদামি আলোয় সাদা অথবা ক্রীম রঙের গাড়ি হলুদ দেখায়।

কাল্পনিক একটা বাতি যেন জ্বলতে-নিভতে শুরু করেছে আমার মনের ভিতরে। আজ কোনো এক জায়গায় একটা হলুদ গাড়ি দেখেছি আমি।

 কোথায়?

ঝট করে নামলাম গাড়ি থেকে, একদৌড়ে হাজির হলাম গাড়িটার কাছে।

হ্যাঁ, আসলেই হলুদ ওটা। একটা ফোর্ড মাসট্যাং।

রাস্টি নেইল বারের পার্কিংলটে আজ দেখেছি আমি এ-রকম একটা গাড়ি।

তারমানে…এই গাড়ি কি অ্যান্ডি রিভসের?

ইউ.এস.ডি.এ.র একটা কৃষি-গবেষণাকেন্দ্রের সাবেক কমান্ডার এত রাতে কী করছেন ওয়েস্টব্রিজের পুলিশ-চীফের অ্যাপার্টমেন্টে?

আনমনে আবার স্পর্শ করলাম পিস্তলের বাঁট…জানি না কেন।

অগির অ্যাপার্টমেন্টটা-বিল্ডিং এর ক্রমিক জি, অ্যাপার্টমেন্টের নম্বর ২। ছুট লাগালাম সেদিকে।

কাছাকাছি পৌঁছে গেছি, এমন সময় দেখতে পেলাম, ওই বিল্ডিং-এর ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছেন রিভস।

চট করে দিক বদল করলাম আমি, নেমে পড়লাম ফুটপাত থেকে, লুকিয়ে পড়লাম একটা ঝোঁপের আড়ালে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম পেছনে। বিল্ডিং ই দেখতে পাচ্ছি। ওটার অ্যাপার্টমেন্ট ১-এর একটা জানালা দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন বড় বড় চুলের এক কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা। তাঁকে আশ্বস্ত করার উদ্দেশ্যে একটুখানি হাসলাম। কাজ হয়েছে বলে মনে হলো না।

একটু আগে দাঁড়িয়ে ছিলাম যে-জায়গায়, ফুটপাত ধরে সেদিকে এগিয়ে আসছেন অ্যান্ডি রিভস। ডানদিকে তাকিয়ে কী যেন দেখছেন তিনি, বাঁ দিকে ঘাড় ঘোরালেই দেখতে পাবেন আমাকে…অন্তত আমার উপস্থিতি টের পেয়ে যাবেন। তবে আমার সবচেয়ে কাছের ল্যাম্পপোস্টে বাতি জ্বলছে না, এবং ওটাই এখন একমাত্র সুবিধা আমার জন্য।

রিভস কেন এসেছিলেন অগির কাছে?

তিনি কি অগিকে চিরনিদ্রায় শুইয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছেন?

তা হলে এখন কী করা উচিত আমার?

করার মতো কাজ আছে দুটো; যে-কোনো একটা করতে হবে আমাকে-হয় যেতে হবে অগির অ্যাপার্টমেন্টে, দেখতে হবে আসলেই কিছু হয়েছে কি না তাঁর, নয়তো পাকড়াও করতে হবে রিভসকে।

 সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম আমি, ছুট লাগালাম অগির অ্যাপার্টমেন্টের উদ্দেশে। রিভসকে যদি পাকড়াও করতে হয়, পরেও করা যাবে কাজটা।

.

অন্ধকারে ডুবে আছে অগির পুরো অ্যাপার্টমেন্ট।

ব্যাপারটা ভালো লাগল না আমার। পর পর কয়েকটা কিল মারলাম অগির সদর-দরজায়।

খোলা আছে।

 অগির গলা।

তারমানে বেঁচে আছেন তিনি।

নব ঘুরিয়ে খুললাম দরজাটা। অ্যাপার্টমেন্টের কোথাও কোনো আলো জ্বলছে না। আমার দিকে পেছন ফিরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে বসে আছেন অগি।

হাতড়ে হাতড়ে সুইচ খুঁজে বের করলাম, জ্বালিয়ে দিলাম লাইট।

 তুমি নাকি রিভসের উপর হামলা করেছ? বললেন অগি।

 ভিতরে ঢুকলাম আমি। লোকটার অণ্ডকোষে লাথি মেরেছি।

 ঈশ্বর! তুমি পাগল হয়ে গেছ নাকি?

তিনি আমাকে খুন করে ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন।

বসো

বসলাম অগির মুখোমুখি।

 হাত বাড়িয়ে একটা টেবিলল্যাম্প জ্বালিয়ে দিলেন অগি।

রিভসের উপর যে হামলা করেছি আমি, আপনি জানলেন কীভাবে? কিছু না জানার ভান করলাম।

রিভস একটু আগে এসেছিল এখানে।

খেয়াল করলাম, অগির হাতে মদের গ্লাস।

যদি মদ খেতে চাও, আমাকে বললেন তিনি, বানিয়ে নিতে পারো।

 লাগবে না। ওসব জিনিসে অরুচি এসে গেছে আমার।

ভিডিওটেপটা…কাউকে দেখিয়ো না।

 দেখেছেন ওটা?

 হ্যাঁ।

কী বুঝলেন?

 বুঝলাম, একদল টিনএজার ঢুকে পড়েছে সরকারি একটা এলাকায়। ওই এলাকায় তখন ল্যান্ড করছিল সরকারি একটা হেলিকপ্টার, সে-দৃশ্য ধারণ করেছে ক্যামেরায়।

কারা কারা কথা বলছিল তখন, বুঝতে পেরেছেন?

বুঝতে পেরেছি, আবার পারিনি।

 মানে?

মানে একমাত্র যার কণ্ঠের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পেরেছি, সে তোমার ভাই।

আর ডায়ানা?

মাথা নাড়লেন অগি। আমার মনে হয় না ভিডিও করার সময় ওখানে ছিল ডায়ানা।

এত নিশ্চিত হচ্ছেন কীভাবে?

জবাব দিলেন না অগি। মদ গেলার জন্য গ্লাস ছোঁয়ালেন ঠোঁটে, কিন্তু কী ভেবে নামিয়ে রাখলেন ওটা। তাকিয়ে আছেন সামনের দিকে, কিন্তু তার দৃষ্টিতে শূন্যতা। অর্থাৎ, বর্তমান দেখছেন না তিনি, হারিয়ে গেছেন অতীতে।

অগি, পুরনো সেই সামরিক ঘাঁটিতে কিছু একটা লুকানো ছিল।

ভেবেছিলাম অস্বীকার করবেন অগি কথাটা, কিন্তু মাথা কঁকালেন তিনি। তা-ই মনে হয়।

 আপনি আশ্চর্য হননি?

না।

অ্যান্ডি রিভস কি ওই ভিডিওটেপের ব্যাপারে কিছু বলেছেন আপনাকে?

হ্যাঁ। বলেছে, ওই ভিডিও যাতে ছড়িয়ে না দাও তুমি, সে-ব্যাপারে যাতে নজর রাখি আমি। বলেছে, যদি ওই কাজ করো তুমি, তা হলে সেটা নাকি দেশদ্রোহিতার সামিল হবে। কারণ ব্যাপারটা জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত।

এবং ব্যাপারটা আমার ভাই আর আপনার মেয়ের মৃত্যুর সঙ্গেও জড়িত। ব্যাপারটা আমাদের হাইস্কুলের দুজন বন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেও জড়িত। যে-মেয়েকে মনেপ্রাণে ভালোবাসতাম আমি এবং আজও বাসি, তার হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গেও জড়িত।

চোখ বন্ধ করে ফেললেন অগি, কোনো এক অসহ্য বেদনায় মাথা নাড়ছেন।

 আপনি চাইলেই কি অস্বীকার করতে পারবেন? গোপন কথাটা জেনে ফেলেছিল লিও আর ডায়ানা, এবং এক সপ্তাহ পরই পাওয়া গেল ওদের দুজনের লাশ।

 না। ওই ঘাঁটির সঙ্গে লিও আর ডায়ানার মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক নেই। অন্তত তুমি যেভাবে বলছ, সেভাবে না।

 তা-ই? তা হলে পুরো ব্যাপারটা কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন আপনি? পৃথিবীর সর্বকালের সর্ববৃহৎ কাকতালীয় ঘটনা?

চোখ খুললেন অগি, মুখ নামিয়ে তাকালেন হাতের মদের-গ্লাসের দিকে। তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে, গ্লাসের তলানিতে আমার প্রশ্নটার জবাব আছে।

 তুমি একজন ভালো গোয়েন্দা, ন্যাপ। আমি তোমাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি বলে বলছি না কথাটা। তুমি এমন কিছু দেখতে পাও, যা অন্য অনেকে পায় না। তারপরও, কখনও কখনও বেসিক্স ঠিক রাখা উচিত। কখনও কখনও, একজন তদন্তকারী অফিসারের, যা নিশ্চিত সত্যি, তা নিয়েই কাজ করা উচিত।

মন্তব্য করলাম না। অপেক্ষা করছি।

এক নম্বর কথা, ওই ঘাঁটি থেকে মাইলখানেক দূরের রেলরোড ট্র্যাকে পাওয়া গেছে লিও আর ডায়ানার লাশ।

ওটার ব্যাখ্যা আছে আমার কাছে।

বাধা দেয়ার ভঙ্গিতে হাত তুললেন অগি। আছে…হয়তো। হয়তো তুমি বলবে, ওদেরকে খুন করার পর ওখানে নিয়ে গিয়ে ফেলা রাখা হয়েছিল। কিন্তু এইমাত্র বললাম, নিশ্চিত সত্যি নিয়ে কাজ করতে হয় কখনও কখনও…সুতরাং হয়তো-জাতীয় কথাগুলো আপাতত বাদ। লম্বা একটা চুমুক দিলেন মদের গ্লাসে। দুই, মেডিকেল একামিনার স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে লিখিতভাবে জানিয়েছেন, চলন্ত ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মারা গেছে ওই দুজন, অন্য কিছু না। …বাকি কথা বলার আগে জানতে চাই, যা বললাম তা কি পরিষ্কার তোমার কাছে?

 মাথা ঝাঁকালাম। কিন্তু আসলে আমি একমত না অগির সঙ্গে, একমত না ওই মেডিকেল এক্যামিনারের সঙ্গেও। আমি আসলে শুনতে চাইছি অগির বাকি কথা।

 এবার এসো ওই ভিডিওটেপের প্রসঙ্গে। ধরে নিলাম, ওটাতে ভেজাল কোনোকিছু নেই। ভেজাল বলতে কী বুঝিয়েছি, নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ। …লিও আর ডায়ানা মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে ধারণ করা হয়েছে ওই ভিডিও। তো, লিও, এবং ওর সঙ্গীরা কী দেখতে পেয়েছে ভিডিওতে? ওই ঘাঁটিতে অবতরণ করছে একটা হেলিকপ্টার। তোমার থিউরি অনুযায়ী, ওই হেলিকপ্টার দেখে ফেলাটাই কাল হয়েছে লিও আর ওর সঙ্গীদের জন্য। কিন্তু তুমি বোধহয় ভুলে গেছ, ভিডিওটা যখন ধারণ করা হচ্ছিল, তখন ডায়ানা ছিল না ওদের সঙ্গে।

লিও হয়তো ডায়ানাকে বলে দিয়েছিল কথাটা।

না।

না?

 এই ব্যাপারটা জানত না ডায়ানা।

নিশ্চিত হচ্ছেন কীভাবে?

সহজ। লিও কি তোমাকে কখনও কিছু বলেছিল ওই হেলিকপ্টারের ব্যাপারে?

কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুললাম, কিন্তু বললাম না। বুঝতে পারছি কী বলতে চাইছেন অথবা বলতে যাচ্ছেন অগি।

 আমার যদি ভুল না হয়, তোমার প্রেমিকা মোরাকে দেখা গেছে। ভিডিওতে, ঠিক না?

ঠিক।

মোরা কখনও কিছু বলেছে তোমাকে ওই হেলিকপ্টারের ব্যাপারে?

না।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন অগি। তারপর বললেন, টক্সিকোলোজি রিপোর্ট।

লিও আর ডায়ানার টক্সিকোলোজি রিপোর্টে কী বলা হয়েছিল, মনে আছে আমার-হ্যালুসিনোজেনিক্স, মদ আর গাঁজার উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল ওদের মৃতদেহে।

কী হয়েছে ওই রিপোর্টে? জিজ্ঞেস করলাম।

 ডায়ানা প্রতি বছর শরৎকালে ফুটবল খেলত। শীতকালে পালন করত একজন চিয়ারলিডারের ভূমিকা। কমপক্ষে একডজন এক্সট্রাকারিকুলার অ্যাক্টিভিটির নেতত্ব ছিল ওর কাঁধে। .. আমি জানি, পড়াশোনার পাশাপাশি অত কাজ করার পরও কোনো ছেলে বা মেয়ের পক্ষে নেশাখোর হওয়া সম্ভব। তারপরও আমি বলবো, নিজের মেয়েকে ভালোমতোই চিনতাম আমি। তুমিও তো চিনতে ওকে। বলো তো, ওকে কি দেখতে নেশাখোরদের মতো মনে হতো?

না।

ইচ্ছা হলে এলিকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো সে-রাতের আগে কখনও গাঁজা বা মদ খেয়েছে কি না ডায়ানা। তা ছাড়া…

তা ছাড়া?

সে-রাতের কথা স্পষ্ট মনে আছে আমার। তোমার ভাই নিতে এল ডায়ানাকে। ডোরবেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুলেছিলাম আমি। হাতও মিলিয়েছিলাম লিও’র সঙ্গে। দৃশ্যটা আজও যেন ভাসে আমার চোখের সামনে। লিওকে দেখতে তখন…

কী?

পাথরে-বানানো একটা মূর্তির মতো মনে হচ্ছিল আমার কাছে। কিছু একটা বলতে চেয়েছিলাম ওকে। বাড়ির বাইরে যেতে বাধা দিতে চেয়েছিলাম ডায়ানাকে। কিন্তু আমার দিকে এমন এক দৃষ্টিতে তাকাল মেয়েটা যে…মনে হলো, যেন নিঃশব্দে বলছে, কোনো সিন ক্রিয়েট কোরো না, বাবা। বাধ্য হয়ে যেতে দিতে হলো ওকে। সে-রাত থেকে শুরু করে আজপর্যন্ত অনেকবার বুঝতে পেরেছি, মেয়েটাকে যেতে না দিলেই ভালো করতাম।

চুপ করে আছি আমি।

ন্যাপ, তুমি বোধহয় ধরেই নিয়েছ, একদল কৃষি-গবেষকের ছদ্মবেশে সিআইএ এজেন্টরা লুকিয়ে ছিল ওই ঘাঁটিতে। তোমার কথা অনুযায়ী, মরার একসপ্তাহ আগে একটা হেলিকপ্টার অবতরণের ভিডিও করল লিও আর ওর বন্ধুরা, আর সেটাই কাল হলো ওদের জন্য। এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে, তথাকথিত সিআইএ এজেন্টরাই যদি খুন করে থাকবে লিও আর ডায়ানাকে, সাতটা দিন অপেক্ষা করার দরকার হলো কেন ওদের? আমার প্রশ্ন হচ্ছে, তথাকথিত সিআইএ এজেন্টরাই কি লিও-ডায়ানাকে মদ আর ড্রাগ খাইয়ে ফেলে দিয়েছে চলন্ত ট্রেনের সামনে? নাকি বেলেল্লাপনা এত বেশি পেয়ে বসেছিল ওদের দুজনকে যে, নেশার ঘোরে দুঃসাহসিক কিছু একটা করতে গিয়ে প্রাণ খুইয়েছে ওরা? কোন্ সম্ভাবনাটা স্বাভাবিক বলে মনে হয় তোমার কাছে?

জবাব দিলাম না।

আমার দিকে তাকিয়ে আছেন অগি, অপেক্ষা করছেন।

কিন্তু মারা গেছে রেক্সও, একসময় বললাম আমি। মারা গেছে হ্যাঙ্ক। এবং দুজনই শিকার হয়েছে হত্যাকাণ্ডের।

হ্যাঁ, তবে সেটা লিও আর ডায়ানা মারা যাওয়ার পনেরো বছর পর।

এবং যে-রাতে মারা গেছে আমার ভাই আর আপনার মেয়ে, সে-রাতে প্রাণে বাঁচতে লুকিয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছিল মোরা। কোথায় লুকিয়েছিল সে, তা-ও জানেন আপনি।…কথাটা বলেননি কেন আমাকে?

কারণ কথাটা বলার মতো উপযুক্ত বলে মনে করিনি তোমাকে। তুমি তখন আঠারো বছরের এক ছোকরা ছিলো যখন তোমার বয়স ছিল উনিশ, তখন বললে কী লাভ হতো তোমার? যখন তুমি পুলিশ অ্যাকাডেমি থেকে গ্র্যাজুয়েশন করলে, তখন বললে কী লাভ হতো? যখন কাউন্টির একজন হোমিসাইড ইনভেস্টিগেটর হিসেবে পদোন্নতি পেলে, তখন বললে কী লাভ হতো? …তোমার প্রেমিকা একরাতে বাসায় না ফিরে তার এক বান্ধবীর কাছে থেকেছে, তারপর গায়েব হয়ে গেছে–গত পনেরো বছরের যে কোনো সময়ে কথাটা যদি বলতাম তোমাকে, কার কী লাভ হতো?

সাংঘাতিক ভয় পেয়ে লুকিয়ে পড়েছিল মোরা, চিৎকার করে উঠতে গিয়েও সামলে নিলাম নিজেকে। এবং ভয়টা সে পেয়েছিল সে-রাতে, যে রাতে মারা গেছে লিও আর ডায়ানা।

মাথা নাড়লেন অগি। জোর করে তদন্ত হয় না, ন্যাপ। এসব বাদ দাও। তাতে সবারই মঙ্গল।

ওই ঘাঁটি, কয়েকজন টিনএজারের একটা ক্লাব আর রহস্যময় একাধিক মৃত্যুর ব্যাপারে গত পনেরোটা বছর কিছুই করিনি আমরা। তাতে কার কোন্ মঙ্গলটা হয়েছে?

হেলান দিলেন অগি। গ্লাসে চুমুক দিতে গিয়ে খেয়াল করলেন, মদ ফুরিয়ে গেছে। গ্লাসটা নামিয়ে রাখলেন তার সামনের টেবিলে। হয়তো তোমার ভাইকে হারিয়েছ বলে, হয়তো মোরাকে হারিয়েছ বলে, একরোখামি পেয়ে বসেছে তোমাকে। কিন্তু মনে রেখো, কতগুলো প্রশ্নের জবাব পাওয়ার জন্য যাদের পেছনে লেগেছ, তারা খুবই বিপজ্জনক লোক। তারা তোমাকে শেষ করে দেবে। শেষ করে দেবে আমাকে। রিভস কী বলেছে, মনে আছে নিশ্চয়ই? …ধরে নাও, তোমার ধারণাই ঠিক, আর আমার যুক্তি ভুল। ধরে নাও, সে-রাতে আসলেই কিছু একটা দেখে ফেলেছিল লিও আর ওর বন্ধুরা, এবং সে-কারণে চিরতরে চুপ করিয়ে দেয়া হয়েছে ওদেরকে। ধরে নাও, একজন পেশাদার খুনি ভাড়া করে রেক্সের মাথায় দুটো বুলেট ঢুকিয়ে দিয়েছে ওরা। ধরে নাও, একটা ভাইরাল ভিডিওর বাহানায় ওরাই নৃশংসভাবে খুন করেছে হ্যাঙ্ককে। এবং আরও ধরে নাও, রিভস আর ওর সাঙ্গোপাঙ্গরাই করেছে ওসব।

মাথা ঝাঁকালাম আমি। কিছু বললাম না-কথা শেষ হয়নি অগির।

এবার কল্পনা করার চেষ্টা করো, তোমাকে থামানোর জন্য রিভস আর ওর সাঙ্গোপাঙ্গরা উঠেপড়ে লেগেছে। রেক্স একজন পুলিশ অফিসার ছিল, ওকে খতম করে দিয়েছে ওরা, তোমার জন্যও হয়তো কোনো হিটম্যান ভাড়া করবে ওরা। শেষ করে দিতে পারে আমাকেও। অথবা এলিকে…ওর বাচ্চা দুটোকে।

লিয়া আর কেলসির চেহারা ভেসে উঠল আমার চোখের সামনে।

টের পেলাম, আমার ভিতরটা নিথর হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। অগির কথাগুলো যেন লাগাম হয়ে টেনে ধরেছে আমাকে।

রিভসকে ওই ভিডিও দেখিয়ে, বলছেন অগি, এবং ওকে ধোলাই দিয়ে মৌচাকে ঢিল মেরেছ তুমি, ন্যাপ। মৌমাছিগুলো এখন কাকে কামড় দেয়, সেটাই ভাবছি।

কিছু বললাম না আমি, উঠে দাঁড়ালাম। রাত বাড়ছে, বাসায় ফেরা দরকার।

যাও, বললেন অগি, বাসায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আগামীকাল সকালে না-হয় আবার কথা বলা যাবে এ-ব্যাপারে।

.

২৪.

বিছানায় শুয়ে আছি, কিন্তু ঘুম আসছে না আমার।

ভাবছি অগির কথাগুলো। ভাবছি, আসলেই কোনো বিপদে পড়তে যাচ্ছে কি না এলি অথবা ওর মেয়েরা। এবং যত ভাবছি এসব, আমার ভিতরটা তত নিথর হয়ে যাচ্ছে। আমার সমস্ত উত্তেজনা তত স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে। যত ভাবছি ওসব কথা, আমি যেন তত দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ছি।

আমি কি শেষপর্যন্ত সমাধান করতে পারবো এই কেস?

ধরে নিলাম, ঘাতক প্রশ্নগুলোর জবাব শেষপর্যন্ত পেয়ে গেলাম আমি, কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণসহ অভিযুক্ত করতে পারবো কি কাউকে? সিআইএর মতো কোনো প্রতিষ্ঠান যদি জড়িত থাকে এসবের সঙ্গে, আদালতে কি যথোপযুক্ত বিচার হবে অভিযুক্ত লোকটার? সিআইএ কি ওই লোকের বিচার হতে দেবে আদৌ?

এই কেস সমাধান করার কোনো ক্লু পাচ্ছি না আমি কোথাও, তাই বলা যেতে পারে নিজেই নিজের উপর এক অসম্ভব মিশন চাপিয়ে দিয়েছি; আমার অন্ধ-স্পৃহা শেষপর্যন্ত কী পরিণতি ডেকে আনবে? আমার মৃত্যু? আমার কাছের লোকদের ধ্বংস?

আর মোরা? ওর কী হবে? ওর কী হয়েছে আসলে?

এই জীবনে কি আর কখনও দেখা হবে না ওর সঙ্গে?

কোনোদিন কি ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলতে পারবো না, তোমাকে যেতে দিতে চাইনি আমি? তুমি হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে প্রতিটা দিন খুঁজেছি তোমাকে?

কোনোদিন কি ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলতে পারবো না, আমি আজও ভালোবাসি তোমাকে?

অস্থির লাগছে।

উঠে বসলাম বিছানায়।

আমার আহত…বলা ভালো, নিথরতা-নামের-খাঁচায় বন্দি প্রবৃত্তি যেন বুনো পশুর মতো গর্জন করছে আমার ভিতরে: ডোন্ট লেট গো।

যেতে দিয়ো না।

কিন্তু, যদি যেতে না দিই…এখনও যেভাবে আঁকড়ে ধরে আছি এই কেস, সেভাবেই যদি ধরে রাখি, কী ঘটবে? আমার দিকে উল্টো ঘুরে আছে একটা ভালুক, ওটার গায়ে খোঁচা মারা হবে? তাতে লাভ হবে কোনো?

 লিও মরে গেছে। এখন আমি যা-ই করি না কেন…যত ভয়ঙ্কর আর অপ্রত্যাশিত সত্যি খুঁড়ে বের করে আনি না কেন, না-ফেরার দেশ থেকে ফিরে আসবে না সে।

মোরা হারিয়ে গেছে। হয়তো আজও…এখনও বেঁচে আছে সে। আমার সেই অপ্রত্যাশিত সত্যি কি শেষপর্যন্ত বেঁচে থাকতে দেবে ওকে? আমার কাছে ফিরে আসার বদলে ওকেও কি পাড়ি জমাতে হবে না ফেরার দেশে?

নেমে পড়লাম বিছানা থেকে। গিয়ে দাঁড়ালাম জানালার পাশে।

কেউ যেন আমার সামনে বিছিয়ে রেখেছে নিথর একটা রাত। কিন্তু আমি জানি…নিশ্চিতভাবে জানি…কর্মচঞ্চল একটা দিন শুরু হয়ে যাবে রাত শেষ হলেই।

আমি জানি, যখন কোথাও কোনো ক্ল থাকে না, তখন সেটা খুঁজে নিতে হয়।

বসে গেলাম আমার ল্যাপটপটা নিয়ে। ইন্টারনেট ব্রাউযার চালু করলাম। অ্যান্ডি রিভসের নাম, নিউ জার্সি স্টেট আর পিয়ানো শব্দ তিনটা দিয়ে সার্চ দিলাম।

একটা হিট পাওয়া গেলঃ

Welcome to the Fan Page for Piano ManAndy.

ফ্যানপেজ।

লিঙ্কটাতে ক্লিক করলাম।

হ্যাঁ, অন্য অনেক বাদকের মতো অ্যান্ডি রিভসেরও নিজস্ব একটা ওয়েবসাইট আছে। লোকটার একটা ছবি দেখা যাচ্ছে। পরনে চুমকি-মাখা একটা ব্লেযার।

World-renowned pianist Andy Reeves is a gifted vocalist, a comedian, and the all-around entertainer nicknamed by those who love him the Other Piano Man…

লোকটা নিজেই নিজেকে পৃথিবীখ্যাত বলে দাবি করছেন? নিজেই দাবি করছেন, ঈশ্বর-প্রদত্ত কণ্ঠের গায়ক তিনি? আরও দাবি করছেন, তিনি একজন কমেডিয়ান। যারা তাকে ভালোবাসে, তারা নাকি আদর করে দ্য আদার পিয়ানোম্যান বলে ডাকে তাঁকে।

আচ্ছা।

নিচে নামলাম ওই ওয়েবসাইটের।

অ্যান্ডি নাকি বিয়ে, কর্পোরেট ইভেন্ট, জন্মদিন অথবা বারের কোনো কোনো প্রাইভেট পার্টিতে অংশ নেন মাঝেমধ্যে।

পেইজের মাঝামাঝি এক জায়গায় লেখা আছে:

Want to join the Other Piano Man fan club?
Stay in touch via our newsletter!

কথাটার নিচে একজায়গায় একটা বক্সে ভিজিটরের ই-মেইল টাইপ করার ব্যবস্থা আছে।

নিজের ই-মেইল টাইপ করলাম আমি সেখানে।

আদৌ কিছু হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে আমার মনে।

পেইজের বাঁ দিকে হোম, বায়ো, ফটো, সং লিস্টস, শিডিউল জাতীয় কিছু বাটন আছে।

শিডিউল-এ ক্লিক করলাম আমি। খুঁজতে খুঁজতে বের করলাম, আজ কোথায় কোন প্রোগ্রাম আছে রিভসের।

আজ সন্ধ্যা ছটার সময় রাস্টি নেইলে গিয়েছিলেন লোকটা।

মাথা ঝাঁকালাম আনমনে দেখা হয়েছিল তখন আমাদের।

নিচে দেখা যাচ্ছে, রাত দশটা থেকে বারোটা পর্যন্ত হাঙ্ক-আ-হাঙ্ক আ ক্লাবে পিয়ানো বাজাবেন তিনি।

টুং করে একটা শব্দ হলো আমার মোবাইলে।

তাকালাম ওটার দিকে।

 মেসেঞ্জারে মেসেজ পাঠিয়েছে এলি :

জেগে আছো?

মোবাইলটা নিলাম হাতে। পাল্টা মেসেজ পাঠালাম:

হ্যাঁ। মাত্র দশটা বাজে।

এলি লিখল:

একটু বাইরে আসবে নাকি? তোমাকে নিয়ে হাঁটবো।

আমি লিখলাম:

অবশ্যই। কোথায় আসতে হবে?

ক্ষুদ্রাকৃতির কয়েকটা ডট ওঠানামা করছে। তারমানে কিছু একটা লিখছে এলি।

আমি ইতোমধ্যেই হাঁটছি। স্কুলের সামনে দেখা করো।

মিনিট পাঁচেক পর হাজির হলাম স্কুলের সামনে। এলি আর ববের বাসা এখান থেকে দূরে না।

খাঁ খাঁ করছে চারদিক। বেশিরভাগ স্কুলের মতো এই স্কুলের আশপাশও আলোকিত হয়ে আছে উজ্জ্বল আলোয়, কিন্তু কোথাও দেখা যাচ্ছে না এলিকে। গাড়ি থামালাম একদিকে, নামলাম।

এই যে, এদিকে, শোনা গেল এলির কণ্ঠ।

আমার হাতের বাঁ দিকে একটা প্লে-গ্রাউন্ড আছে। দোলনা, স্লাইড, ক্লাইম্বিং ওয়াল, নেট, মই, মাঙ্কি বার-বলতে গেলে সবরকমের ক্রীড়া উপকরণের ব্যবস্থা করে রেখেছে স্কুল-কর্তৃপক্ষ। বাচ্চারা পড়ে গেলে যাতে ব্যথা না পায় সেজন্য কৃত্রিম-মাটির মোলায়েম আবরণ বিছিয়ে রাখা হয়েছে পুরো জায়গায়।

একদিকের একটা দোলনায় বসে আছে এলি। এক পায়ের সাহায্যে অল্প অল্প দোল খাচ্ছে। কৃত্রিম-মাটির আবরণ থেকে সিডার গাছের মতো গন্ধ আসছে।

এগিয়ে গেলাম এলির দিকে। ঠিক আছ তো?

 কেন যেন বাসায় ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে না।

কী বলবো, বুঝতে পারলাম না।

একজন বিশ্বাসঘাতক লোকের স্ত্রী আর দুটো ফুটফুটে মেয়ের মা বলছে, বাসায় ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে না তার। জবাবে কী বলার থাকতে পারে আমার?

মাথা ঝাঁকালাম শুধু।

যখন ছোট ছিলাম, বলল এলি, প্লে-গ্রাউন্ড খুব ভালো লাগত আমার। এখনও মাঝেমধ্যে একা চলে আসি এখানে। রাতের বেলায়।

কেন?

 জানি না। হয়তো…ভালো লাগে, তাই।

 জানতাম না কথাটা।

নিজেদের ব্যাপারে আস্তে আস্তে অনেককিছু জানতে পারছি আমরা।

হু।

ববের বিশ্বাসঘাতকতার কথাটা বোধহয় বলা উচিত হয়নি তোমাকে। তোমার ভালো বন্ধু ছিল সে। কথাটা শোনার পর থেকে হয়তো ওকে সে দৃষ্টিতে দেখছ না তুমি। হয়তো…ওকে ইতোমধ্যেই ঘৃণা করতে শুরু করে দিয়েছ। হয়তো…ট্রের মতো পেটানোর চিন্তা করছ ওকেও।

 হু…কিছুটা।

মুচকি হাসল এলি। ও-রকম কিছু কোরো না, প্লিজ। বব আগে যেমন ছিল, এখনও তেমনই আছে। শুধু…একবার একটা ভুল করে ফেলেছিল…আর কিছু না। মুখ তুলে রাতের আকাশের দিকে তাকাল সে।

আমিও তাকালাম।

অনেক তারা দেখা যাচ্ছে। তারপরও মনে হচ্ছে, আরও তারা থাকলে ভালো হতো।

মোরার মার সঙ্গে কথা হয়েছে, বলল এলি।

 মুখ নামিয়ে তাকালাম ওর দিকে। এখনও তারা দেখছে সে।

যে-লোকের ছবি পাঠিয়েছ আমার কাছে, তিনিই নাকি জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন মোরার-মাকে। তার কথা অনুযায়ী…সেই পাণ্ডুর চেহারা, সেই ফিসফিসে কণ্ঠ।

আশ্চর্য হলাম না। ওই লোকের সঙ্গে আজ দেখা হয়েছে আমার।

কে তিনি?

তার নাম অ্যান্ডি রিভস। লিও আর ডায়ানা যখন মারা যায়, তখন ওই সামরিক ঘাঁটির কমান্ডার ছিলেন তিনি।

তার সঙ্গে কথা হয়েছে তোমার?

মাথা ঝাঁকালাম।

 কিছু বলেছেন তিনি?

আমাকে এবং যারা আমার ঘনিষ্ঠ তাদেরকে খুন করে ফেলার হুমকি দিয়েছেন তিনি।

তোমার সিদ্ধান্ত কী? কেসটা চালিয়ে যাবে? নাকি ছেড়ে দেবে?

 ছেড়ে দেবো।

 মুখ নামিয়ে আমার দিকে তাকাল এলি। কেন?

তোমার জন্য। তোমার দুই মেয়ের জন্য। ওরা তোমাদের ক্ষতি করতে পারে।

কথাটা ভুল হয়ে গেল না?

মানে?

তুমি যদি এমনি এমনি ছেড়ে দাও সব, যদি কিছুই না করো অ্যান্ডি রিভস নামের লোকটাকে, তা হলেও আমার এবং আমার দুই মেয়ের পেছনে লাগতে পারেন তিনি।

কেন করবেন তিনি কাজটা?

তোমাকে তার ক্ষমতা দেখিয়ে দেয়ার জন্য।

আমি হাত গুটিয়ে নিলে কিছু করার কথা না তাঁর।

 হাত গুটিয়ে নিয়েছিল রেক্স আর হ্যাঙ্কও। ওদের পরিণতি কী হয়েছে?

ইচ্ছা হলো, বলি, রহস্যময় ওই ঘাঁটিতে যখন একটা হেলিকপ্টার নামছিল, তখন যে বা যারা সে-দৃশ্য ভিডিও করছিল, তাদের সঙ্গে ছিল রেক্স আর হ্যাঙ্ক। কিন্তু বললাম না। তর্ক করতে ইচ্ছা করছে না আসলে। এলি যা বলতে চাইছে, তা বুঝতে পেরেছি। ভয় বা আতঙ্ক নিয়ে বেঁচে থাকতে চায় না সে। সে চায়, আমি যেন মীমাংসা করি এই কেসের-যেভাবেই হোক।

বললাম, তোমার অথবা তোমার মেয়েদের কোনো ক্ষতি হতে দেবো না আমি।

জানি।

অ্যান্ডি দ্য আদার পিয়ানোম্যান ওয়েবসাইটে যে-শিডিউল দেখেছি একটু আগে, সেটার কথা মনে পড়ে গেল আমার। লোকটা আজ রাতে হাক্ক-আ-হাঙ্ক-আ ক্লাবে থাকবেন। সিদ্ধান্ত নিলাম, সেখানে যাবো আমি।

আরেকটা কথা, বলল এলি।

কী?

 আমি খুব সম্ভব জানি কোথায় আছে বেথ ল্যাশলি।

একটুখানি চমকালাম। কোথায়?

ফার হিলস-এ।

ফার হিলস?

মাথা ঝাঁকাল এলি। আমরা যখন হাইস্কুলে পড়তাম, বেথের বাবা-মা ওই জায়গায় একটা ছোট অর্গানিক ফার্ম কেনেন। ওই ফার্মের কাছাকাছি থাকে মার্লি নামের আমার-এক-কাযিন। ওকে ফোন করে যেতে বলেছিলাম ওই ফার্মে, দেখতে বলেছিলাম বেথ সেখানে আছে কি না।

কিছু জানিয়েছে মার্লি?

মাথা ঝাঁকাল এলি। ফার্মের চারদিকে বেড়া আছে. বেড়ার সঙ্গে যে দরজা আছে সেটায় তালা-মারা। ভিতরে কাউকে দেখতে পায়নি মার্লি। …চিন্তা কোরো না, আমি আগামীকাল গাড়ি নিয়ে যাবো ওখানে, নিজে দিয়ে দেখে আসবো বেথ সেখানে আছে কি না।

ধন্যবাদ।…চলো, তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।

 লাগবে না। আমি হেঁটে যেতে পারবো।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *