১০. ঘাটাঘাটি শুরু

১০.

নিজের মতো করে ঘাটাঘাটি শুরু করে দিলাম আমি।

ফিরে এসেছি বাসায়। ফোন করলাম এসেক্স পাইন্স মেডিকেল সেন্টারে। যে-ডাক্তার নিয়মিত দেখছেন হ্যাঙ্ককে, নিজের পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলাম তার সঙ্গে।

লাইনটা ট্রান্সফার করা হলো ওই ভদ্রলোকের রুমে। আমি কে এবং কী জানতে চাই তা শোনামাত্র তিনি বললেন, আপনি পুলিশে চাকরি করেন? তা হলে তো একজন রোগীর গোপনীয়তার অধিকার সম্পর্কে যে-আইন চালু আছে আমাদের অঙ্গরাজ্যে, তা ভালোমতোই জানেন।

জানি।

সুতরাং মিস্টার হ্যাঙ্কের শারীরিক বা মানসিক অবস্থা সম্পর্কে কিছু বলতে পারছি না আপনাকে। দুঃখিত।

আমি যদি হ্যাঙ্কের সঙ্গে কথা বলতে চাই?

সেটাও সম্ভব হবে না মনে হয়। তিনি আপনাকে আদৌ কোনো সাহায্য করতে পারবেন কি না, সন্দেহ আছে আমার।

জানি।

সবচেয়ে বড় কথা, আপনি যেখানে ফোন করেছেন, সেখানে থাকেন না মিস্টার হ্যাঙ্ক।

আপনার নাম কী, ডক্টর?

বোয়া। কেন?

যে বা যারা মুলোমুলি করে আমার সঙ্গে, তাদের নামটা আগেই জেনে নিই আমি।

টেলিফোনের ও-প্রান্তে নীরবতা।

আগেও বলেছি, আবারও বলছি, আমি একজন পুলিশ অফিসার। হ্যাঙ্ককে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। ওকে কোথায় পাওয়া যেতে পারে, বলতে পারেন?

না, পারি না।

 ওর কোনো ঠিকানা আছে আপনার কাছে?

না।

আসলেই?

আবারও কিছুক্ষণের নীরবতা। তারপর বোয়া বললেন, আমাদেরকে ওয়েস্টব্রিজের একটা পোস্টঅফিস বক্সের নম্বর দিয়েছেন তিনি শুধু। আর…যেহেতু জানতে চাইবেন সেহেতু আগেই বলে দিচ্ছি…সপ্তাহে তিন থেকে পাঁচবার আসেন তিনি এই হাসপাতালে, কিন্তু গত দুসপ্তাহে একবারের জন্যও আসেননি।…এবার কি আমি লাইনটা কাটতে পারি?

লাইন কেটে দিলাম আমি নিজেই।

যে-লোক সপ্তাহে তিন থেকে পাঁচবার যেত এসেক্স পাইন্স-এ, সে গত দুসপ্তাহে একবারও যায়নি সেখানে।

চিন্তার কথা।

.

ওয়েস্টব্রিজ হাইস্কুলের সামনে একটা বাস্কেটবল কোর্ট আছে, সেখানে দাঁড়িয়ে আছি আমি। কোর্টের অ্যাসফল্ট-দিয়ে-বানানো মেঝেতে প্র্যাকটিস করছে একদল ছেলে-বুড়ো, সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারে সে-শব্দ বেশ মধুর বলে মনে হচ্ছে আমার।

ছেলে-বুড়ো টার্মটা ব্যবহার করার কারণ আছে। যারা প্র্যাকটিস করছে, তাদের বয়সের কোনো নির্দিষ্টতা নেই। তাদের কেউ কারও-না-কারও বন্ধু, কেউ আবার আগন্তুক। কেউ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করে, কেউ আবার ভবঘুরে। লম্বা, বেঁটে, মোটা, পাতলা, শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ-সব রকমের মানুষ আছে ওই কোর্টে। একজনের মাথায় উষ্ণীষ জাতীয় কিছু একটা আছে, কিন্তু ওই ব্যাপারে অন্য কারও তেমন কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।

হাইস্কুলে আমাদের সঙ্গে মাইরন বলিটার নামের একটা ছেলে পড়ত, দারুণ বাস্কেটবল খেলত সে। নিজের একটা ভুলের কারণে প্রফেশনাল লিগে খেলা হয়ে ওঠেনি ওর। বয়সে আমার সমান সে, অথচ এখনও প্র্যাকটিস করে। বাস্কেটবল-প্রিয় স্থানীয় ছেলেপেলেরা ওকে গুরু বলে মানে।

দেখা হয়ে গেল মাইনের সঙ্গে। আসলে আমার বলা উচিত ছিল, অনেকদিন পর দেখতে পেলাম পুরনো একজন বন্ধুকে। আমাকে দেখতে পেয়ে প্র্যাকটিস বাদ দিয়ে এগিয়ে এল সে।

কী খবর?

 হ্যাঙ্ককে খুঁজছিলাম।

 কেন, কিছু করেছে নাকি সে?

না। এমনি…ওর সঙ্গে একটু কথা বলার দরকার ছিল। শুনেছি, সে নাকি এই কোর্টে প্রতি সোমবার প্র্যাকটিস করতে আসে। কখনও কখনও নাকি ম্যাচ খেলে।

তোমার বলা উচিত ছিল আসত এবং খেলত। কারণ, গত কিছুদিন কোনো পাত্তা নেই ওর।

মানে?

 হ্যাঙ্কের আসলে…কী বলবো…মতিগতির কোনো ঠিক নেই।

মানসিক সমস্যা?

হতে পারে। আবার, যাকে বলে কেমিক্যাল ইমব্যালেন্স, সেটাও হতে পারে। আসলে…আমাকে প্রশ্ন করে সময় নষ্ট করছ তুমি। মাসখানেক শহরের বাইরে ছিলাম আমি।

তা হলে হ্যাঙ্কের ব্যাপারে কাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে ভালো হয়?

 ইশারায় সুদর্শন একটা লোককে দেখিয়ে দিল মাইরন। ডেভিড রেইনিভ।

ডেভিডকে ভালোমতোই চিনি আমি। হাইস্কুলে যখন পড়তাম, স্কুলের ন্যাশনাল অনার সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ছিল সে। আর এখন দেশের অন্যতম বড় একটা ইনভেস্টমেন্ট ফার্মের সি.ই.ও.। বছরখানেক আগে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হওয়ার চেষ্টা করছিল, তখন ওকে নিয়মিত দেখা যেত টিভিতে। ম্যানহাটনে একটা পেন্টহাউস আছে ওর। হাইস্কুলে থাকতে জিল নামের একটা মেয়ের সঙ্গে প্রেম করত সে, পরে বিয়ে করেছে মেয়েটাকে; সে আর ওই মেয়ে মিলে ওদের সন্তানদের বড় করছে এই ওয়েস্টব্রিজেই।

দেখা করলাম ওর সঙ্গে, কিছু সময় চাইলাম ওর কাছে। আমাকে নিয়ে কোর্টের একধারের একটা বেঞ্চে বসে পড়ল সে। আমি কী জানতে চাই তা শোনার পর বলল, গত কয়েকদিন হ্যাঙ্ককে দেখেছি বলে মনে হয় না।

ব্যাপারটা অস্বাভাবিক না?

একটু। কারণ নিয়ম করে প্রায় প্রতি সোমবার এবং বৃহস্পতিবার আসত সে।

শেষ যখন দেখা হয়েছিল ওর সঙ্গে, তখন কী মনে হয়েছিল ওকে দেখে?

ভালোই তো। আসলে…আর দশজনের মতো স্বাভাবিক না সে, কাজেই সে সত্যিই ভালো আছে কি না তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। ইঙ্গিতে বাস্কেটবল কোর্টটা দেখাল ডেভিড। ওখানকার কেউ কেউ চায় না, প্র্যাকটিস করতে অথবা খেলতে আসুক হ্যাঙ্ক। তারপরও আসে সে। বেশিরভাগ সময়ই খেলায় নেয়া হয় না ওকে। তখন সাইডলাইনে বসে থাকে সে। ভুল হলো…বসে থাকে না, সাইডলাইন ধরে পায়চারি করতে থাকে। আর চিৎকার করে ভাষণ দিতে থাকে।

কী-রকম ভাষণ?

 ওর ওসব আজেবাজে কথা খেয়াল করে শোনার মতো সময় আছে। নাকি আমাদের? তবে…একটা কথা প্রায়ই বলে সে…টুনা মাছ পছন্দ করে না হিমলার।

হিমলার? মানে নাৎসি বাহিনির সেই লোকটা?।

কাঁধ ঝাঁকাল ডেভিড। ঠিক কী বোঝাতে চাইল, বুঝতে পারলাম না। কোর্টের দিকে তাকিয়ে আছে, খেলা শুরু হয়েছে সেখানে, দেখছে। কিছুক্ষণ খেলা-দেখার পর বলল, ভাষণ দেয় সে, পায়চারি করে, কখনও কখনও ভয় দেখানোর চেষ্টা করে কাউকে কাউকে। কিন্তু যেইমাত্র ওর হাতে বল তুলে দেয়া হয়, অর্থাৎ যেইমাত্র খেলায় নেয়া হয় ওকে, সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে যায় সে। তখন পাগলামি বলতে কিছু থাকে না ওর মধ্যে। আমার দিকে তাকাল। হাইস্কুলে থাকতে যখন একসঙ্গে পড়তাম আমরা, তখন কী-রকম ছিল সে, মনে আছে?

মাথা ঝাঁকালাম আমি।

 তখন কিন্তু অনেকেই পছন্দ করত ওকে, বলল ডেভিড।

হ্যাঁ।

মাইরন বলিটার খেলছে। নিখুঁত ভঙ্গিতে লাফ দিল সে, অতুলনীয় কায়দায় বাস্কেট করল। আসলেই…দেখার মতো খেলা খেলে সে। ভাগ্য কেন যে এত বড় প্রতারণা করল ওর সঙ্গে। কেন যে প্রফেশনাল লিগে খেলার সুযোগ পেল না সে!

দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ভাগ্য আমাদের কার সঙ্গে প্রতারণা করেনি?

হ্যাঙ্ক আসলে ভালো নেই, ন্যাপ। কিন্তু সেটা ওর দোষ না। ওকে ওই কোর্টে যে বা যারা চায় না, তাদেরকে কয়েকবার বলেছি আমি কথাটা। মনে করো সে যদি ছিটপাগল না হয়ে ক্যান্সার রোগী হতো, তা হলেও কি ওর সঙ্গে ও-রকম ব্যবহার করত ওরা? ক্যান্সারে ভুগছে এ-রকম কেউ যদি এসে খেলতে চায় আমাদের সঙ্গে, আমরা কি বলবো, না…খেলতে দেয়া। যাবে না তোমাকে, কারণ তোমার ক্যান্সার হয়েছে?

ভালো বলেছ।

আবারও কিছুক্ষণ খেলা দেখল ডেভিড। তারপর বলল, হ্যাঙ্কের কাছে। আমি ঋণী।

কীভাবে?

 গ্র্যাজুয়েশন করার পর হ্যাঙ্ক এম.আই.টিতে গিয়েছিল। জানো?

জানি।

আর আমি ভর্তি হয়েছিলাম হার্ভার্ডে। এম.আই.টি, থেকে হার্ভার্ডের দূরত্ব বড়জোর এক মাইল। তখন পূর্বপরিচিত বলতে এক হ্যাঙ্ক ছাড়া আর কেউ নেই আমার। তাই ওর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। মাঝেমধ্যেই হার্ভার্ড থেকে এম.আই.টিতে চলে যেতাম আমি, তারপর হ্যাঙ্ককে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম কোথাও-না-কোথাও। দুজনে কখনও একসঙ্গে বার্গার খেতাম, কখনও আবার গিয়ে যোগ দিতাম কোনো পার্টিতে। কখনও ফুর্তি করতাম আমার ক্যাম্পাসে, কখনও আবার ওর ক্যাম্পাসে। সে-সময় মজার মজার কথা বলতে পারত হ্যাঙ্ক। ওর কথা শুনে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাওয়ার মতো অবস্থা হতো আমার। একচিলতে হাসি দেখা দিয়েছে ডেভিডের চেহারায়। মদ তেমন একটা খেত না সে। লোকের ভিড়ে যখন যেতাম ওকে নিয়ে, এককোনায় দাঁড়িয়ে পড়ত সে, তাকিয়ে তাকিয়ে কী যেন দেখত। দূরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকাটা পছন্দ করত সে। এবং…আশ্চর্য…মেয়েরাও কেন যেন পছন্দ করত ওকে।

একঝলক বাতাস বয়ে গেল। আমাদের আশপাশে কিছু গাছ আছে, সরসর করে উঠল সেগুলোর পাতা। বাস্কেটবল কোর্টে খেলোয়াড়দের কেডস ঘষা খাওয়ার বেসুরো আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি একটু পর পর।

কিন্তু হঠাৎ করেই যেন বদলে গেল হ্যাঙ্ক, হাসি মুছে গেছে ডেভিডের চেহারা থেকে। আসলে আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছিল সে। কিন্তু পরিবর্তনটা নজরে পড়েনি আমার।

কী-রকম পরিবর্তন?

যেমন ধরো, ওকে নিয়ে কোথাও বাইরে যাবো…গেলাম ওদের ডরমিটরিতে। কিন্তু কখনও কখনও হঠাৎ গোঁ ধরত সে-কোথাও যাবে না। কখনও আবার রুমের বাইরে বের হওয়ামাত্র ফিরে যেত দরজার কাছে, দু তিনবার করে চেক করত দরজায় ঠিকমতো তালা মেরেছে কি না। …আস্তে আস্তে আরও খারাপ হতে শুরু করে পরিস্থিতি।

যেমন?

ধরো গিয়ে বসে আছি ওর রুমে। কিন্তু ওর পরনে তখনও বাথরোব, শার্ট-প্যান্ট পরার কোনো লক্ষণ নেই। কখনও আবার ঘন্টার পর ঘন্টা গোসল করতে থাকত, শেষে বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে আসতে হতো আমাকে ওর রুম থেকে। কখনও আরও আজব এক কাজ করত। আমার সঙ্গে রুমের বাইরে বের হওয়ামাত্র তালা লাগাত দরজায়, সঙ্গে সঙ্গে খুলত, তারপর আবার লাগাত। দু-তিনবার না, বিশ-ত্রিশবার করত সে কাজটা। তখন আমি বুঝতে পারি, মাথায় গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে ওর। তারপর থেকে ওর সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে শুরু করে আমার।

তুমি কিছু বলতে না ওকে?

মাথা ঝাঁকাল ডেভিড। বলতাম। হ্যাঙ্ক, এসব পাগলামি বন্ধ করো। এমন কোনো হীরা-জহরত লুকিয়ে রাখোনি তুমি যে, ওসব নেয়ার জন্য তালা ভেঙে ঢুকবে কেউ তোমার ঘরে।

তারপর? একসময় তালার-সমস্যা কেটে গেল হ্যাঙ্কের। তখন দেখা দিল স্টোভের-সমস্যা।

স্টোভের সমস্যা?

 হ্যাঙ্কদের ডরমিটরির পাবলিক রুমে একটা ইলেকট্রিক স্টোভ ছিল। কীভাবে যেন দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যায় ওর মনে, একদিন বিস্ফোরিত হবে ওই স্টোভ, আগুন লেগে যাবে সারা ডরমিটরিতে। তারপর থেকে আমার সঙ্গে বাইরে বের হওয়ার সময় বার বার গিয়ে দাঁড়াত স্টোভটার সামনে, চেক করে দেখত ওটা নেভানো আছে কি না। …মোমাদ্দা কথা, সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার পর ওকে নিয়ে বাইরে বের হতে এক-দেড় ঘণ্টা লেগে যেত আমার।

থামল ডেভিড।

আমরা দুজনে এখন খেলা দেখছি। চাপাচাপি করলাম না ওকে। হ্যাঙ্কের মানসিক ভারসাম্যহীনতার বর্ণনা নিজের মতো করেই দিক সে।

 একরাতে, কোর্টের উপর থেকে চোখ না সরিয়ে বলল ডেভিড, আমার সঙ্গে কেমব্রিজের একটা দামি রেস্টুরেন্টে যাওয়ার কথা ছিল হ্যাঙ্কের। ফোন করে বলল সে, আমাকে নিতে আসার কোনো দরকার নেই। বাসে করে চলে যেতে পারবো জায়গামতো। আমি বললাম, ভালো। কিন্তু একা কোথাও ঘুরতে গেলে মজা পাওয়া যায় না, তাই কয়েকটা মেয়েকে জুটিয়ে নিলাম আমার সঙ্গে। তারপর গেলাম ওই রেস্টুরেন্টে। ওই মেয়েদের একজনের নাম ছিল ক্রিস্টেন মেগার্জি। মুখে কখনও কিছু বলেনি হ্যাঙ্ক, কিন্তু ওর ভাবভঙ্গি দেখে বুঝতে বাকি ছিল না আমার, মেয়েটাকে পাগলের মতো ভালোবাসে সে। আর ওই মেয়েও ছিল দেখতে-শুনতে চমৎকার। তার উপর অঙ্কে তুখোড়। কাজেই ওই মেয়েকে একঝলক দেখার জন্য, ওর সঙ্গে মেশার জন্য যদি উতলা হয়ে যায় হ্যাঙ্ক, ওকে দোষ দেয়া যাবে না। কিন্তু…শেষপর্যন্ত কী ঘটেছিল সে-রাতে, তা বোধহয় অনুমান করতে পারছ?

রেস্টুরেন্টে যায়নি হ্যাঙ্ক।

ঠিক। বাধ্য হয়ে সে-রাতের প্রোগ্রাম তাড়াহুড়ো করে শেষ করতে হলো আমাদেরকে, তারপর গাড়িতে করে ওই মেয়েগুলোকে যার-যার বাড়ি পৌঁছে দিলাম। এরপর গেলাম হ্যাঙ্কদের ডরমিটরিতে। দেখি, নিজের রুমের দরজায় বার বার তালা লাগাচ্ছে আর খুলছে সে, থামতে পারছে না কিছুতেই। আমাকে দেখামাত্র মেজাজ বিগড়ে গেল ওর, আমার বিরুদ্ধে আমার কাছেই নালিশ জানাতে শুরু করল।

কোনো মন্তব্য করলাম না।

আস্তে আস্তে দূরত্ব বাড়তে শুরু করল আমাদের। তখন মাঝেমধ্যে আমাকে এস.এম.এস. পাঠাত হ্যাঙ্ক, আমি জবাব দিতাম না। অথবা দিলেও দেরিতে দিতাম। এক মাস কেটে গেল। তারপর কেটে গেল এক সেমিস্টার। তারপর…

চুপ করে আছি আমি। টের পাচ্ছি, অপরাধবোধে ভুগছে ডেভিড।

কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করলাম, এখন কোথায় আছে সে, জানো?

না। …ওর সঙ্গে সেই যে দূরত্ব বেড়েছে আমার, তারপর আর কখনও কমেনি। এখানে যদি দেখা হয় ওর সঙ্গে, যদি একসঙ্গে খেলিও আমরা, তবুও তেমন একটা কথা বলি না। বুঝতে পারি খারাপ একটা কাজ করছি, তারপরও এড়িয়ে চলি ওকে। …খেলা শেষে পিত্যা খাওয়ার জন্য ম্যাকমারি দোকানে যাই আমরা অনেকেই, হ্যাঙ্ককেও দু-একবার বলেছি আমাদের সঙ্গে যেতে, কিন্তু প্রস্তাবটা শোনামাত্র দৌড়ে পালিয়েছে সে প্রতিবার। …এই শহরে ওকে কখনও হেঁটে বেড়াত দেখেছ?

দেখেছি।

একই পথ ধরে একই সময়ে হাঁটে সে প্রতিদিন। অভ্যাসের দাস। প্র্যাকটিস বা খেলা যা-ই করি না কেন আমরা এখানে, নটার সময় শেষ হয়ে যায় সব। তারপরও পাঁচ-দশ মিনিট গল্পগুজব করি। কিন্তু হ্যাঙ্ক যেদিন আসে, কাঁটায় কাঁটায় নটার সময় চলে যায়, এক সেকেন্ডও দেরি করে না। গুডবাই বলে না কাউকে…কিছুই বলে না। অ্যালার্মওয়ালা পুরনো-আমলের একটা হাতঘড়ি পরে থাকে সে, ওটাই সময় জানিয়ে দেয় ওকে। যেইমাত্র নটা বাজার সঙ্কেত দেয় ঘড়িটা, সঙ্গে সঙ্গে ছুট লাগাল হ্যাঙ্ক, ডানে-বাঁয়ে কোনোদিকে তাকায় না। এমনকী তখন যদি সে খেলতে থাকে, খেলা ফেলে ওভাবে চলে যেতে একটুও দ্বিধা বোধ করে না।

ওর পরিবারের কী খবর? পরিবারের সঙ্গেই কি থাকে সে?

ওর মা মারা গেছেন গত বছর। ওয়েস্ট অরেঞ্জ রোডের ক্রস ক্রীক পয়েন্টে পুরনো একটা বাড়িতে থাকতেন তিনি। হ্যাঙ্কের বাবা হয়তো এখনও আছেন সেখানে।

অথচ যখন আমরা ছোট ছিলাম, আমি ভাবতাম ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে হ্যাঙ্কের বাবা-মার মধ্যে।

 কোর্টে চেঁচিয়ে উঠল কেউ একজন, সেদিকে তাকিয়ে দেখি পড়ে গেছে সে। ফাউলের আবেদন জানাচ্ছে, কিম্ভ যার বিরুদ্ধে আবেদনা জানানো হচ্ছে, সে-ও চেঁচিয়ে বলছে, পড়ে-থাকা লোকটা অভিনয় করছে।

ছাড়াছাড়ি হয়েছিল, বলল ডেভিড, তবে সেটা ঠিক ডিভোর্স না। হ্যাঙ্কের বাবা তখন খুব-সম্ভব কলোরাভোয় চলে যান। পরে একসময় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন হ্যাঙ্কের মা, খবর পেয়ে ফিরে আসেন তিনি।

কার কাছ থেকে জেনেছ এই খবর?

 মনে নেই। উঠে দাঁড়াল ডেভিড। এবার যাই। পরের ম্যাচটা খেলতে হবে আমাকে।

কন্সপাইরেসি ক্লাবের ব্যাপারে কিছু জানো?

 না। ওটা আবার কী?

আমাদের ক্লাসের কয়েকজন মিলে গড়ে তুলেছিল ওই ক্লাব। হ্যাঙ্ক একজন সদস্য ছিল ক্লাবটার। আমার ভাই-ও ছিল।

বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ডেভিড। লিও ভালো একটা মানুষ ছিল।

ওই কথার জবাবে কিছু বললাম না। লিওকে নিয়ে আলোচনা করার জন্য এখানে আসিনি আমি। কন্সপাইরেসি ক্লাবের ব্যাপারে কখনও কিছু বলেছে তোমাকে হ্যাঙ্ক?

জানি না…মনে করতে পারছি না আসলে। আমি যখন থেকে বুঝতে পারি মাথায় গণ্ডগোল আছে ওর, তারপর থেকে ওর কোনো কথাতেই গুরুত্ব দিতাম না।

 জঙ্গলের ভিতরের সেই সামরিক ঘাঁটির ব্যাপারে কখনও কিছু বলেছে সে?

হাইস্কুলে যখন পড়তাম আমরা, ওই জায়গার প্রতি একরকমের মোহ ছিল হ্যাঙ্কের। আমার সঙ্গে বেশিরভাগ সময় ওই ঘাঁটি নিয়েই কথা বলত সে।

কী বলত?

পাগলের প্রলাপ…সরকার নাকি ওই জায়গায় এল.এস.ডি, টেস্ট করছে। কখনও আবার বলত, মিসাইল ঘাটির আড়ালে চলছে মাইন্ড-রিডিং এক্সপেরিমেন্ট।

ডেভিড! কোর্ট থেকে চিৎকার করে ডাক দিল একজন। আসছ না কেন? খেলা শুরু করতে যাচ্ছি আমরা।

আমার দিকে তাকাল ডেভিড-নীরবে অনুমতি চাইছে। মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালাম আমি। কিন্তু কোর্টের দিকে এগোতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল সে, ঘুরল। এখনও ওই ঘাঁটির উপর মোহ রয়ে গেছে হ্যাঙ্কের।

কেন?

ওই ঘাঁটির পাশে পুরনো একটা রাস্তা আছে না? প্রতিদিন সকালে সেখানে হাঁটে সে।

.

১১.

পরদিন সকালে আমাকে ফোন করলেন রেনল্ডস।

যে-ডিভোর্স অ্যাটর্নি ভাড়া করেছিলেন রেক্সকে, তার খোঁজ পাওয়া গেছে।

সুসংবাদ, বললাম আমি।

মোটেও না। লোকটার নাম সাইমন ফ্রেজার। আপনি জানেন কি না। জানি না, আমাদের এখানে বলতে-গেলে একনামে পরিচিত তিনি। এলবে, ব্যায়োশ অ্যান্ড ফ্রেজার নামের একটা ফার্মের পার্টনার।

যোগাযোগ করেছেন তাঁর সঙ্গে?

হ্যাঁ।

নিশ্চয়ই সহযোগিতা করেছেন তিনি?

মোটেও না। উকিল-মক্কেল সম্পর্কের দোহাই দিয়ে মুখে তালা মেরে রেখেছিলেন।

তাঁকে গ্রেপ্তার করা উচিত।

হ্যাঁ। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, আমি বা আপনি কেউই আইনপ্রণেতা না।

এখন কী করবেন?

তার মক্কেলদের সঙ্গে যোগাযোগ করবো।

 মানে যেসব ভদ্রমহিলা ডিভোর্স চাইছিলেন, তাঁদের সঙ্গে?

হ্যাঁ।

সময় নষ্ট করবেন শুধু শুধু। তাঁদের কেউ কিছু স্বীকার করবেন বলে মনে হয় না।

তা হলে?

 আমরা ব্যক্তিগতভাবে দেখা করতে পারি সাইমন ফ্রেজারের সঙ্গে।

 তাতেও কি সময়ের অপচয় হবে না?

হয়তো হবে। আবার হয়তো হবে না।

 আমার মনে হয় না কাজে লাগবে আপনার পরিকল্পনা।

দেখুন, রেক্স যে-এলাকায় খুন হয়েছে সেখানে তদন্ত চালানোর সম্পূর্ণ। এখতিয়ার আপনার। কাজেই আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য হিসেবে আপনি দেখা করতেই পারেন সাইমন ফ্রেজারের সঙ্গে।

সেক্ষেত্রে আপনার ভূমিকাটা কী হবে? অতি-আগ্রহী একজন সিভিলিয়ান?

 তা ছাড়া আর কী?

কখন আসতে চাইছেন?

 পথে দুজায়গায় থামতে হবে আমাকে, তারপরও আশা করছি লাঞ্চের আগে পৌঁছে যাবো।

কাছাকাছি আসার পর এস.এম.এস. করবেন আমাকে।

ঠিক আছে।

লাইন কেটে দিলাম আমি। গোসল করে কাপড় পরে নিলাম। হাতঘড়ির দিকে তাকালাম একনজর।

গতরাতে ডেভিড বলেছে, সামরিক ঘাঁটি-সংলগ্ন ওই পথ ধরে প্রতিদিন সকাল ঠিক সাড়ে আটটায় হাঁটাহাঁটি করে হ্যাঙ্ক। কাজেই নাকেমুখে কিছু খুঁজে বেরিয়ে পড়লাম গাড়ি নিয়ে।

শিক্ষকদের পার্কিংলটের কাছে পার্ক করলাম গাড়িটা। এখান থেকে সহজেই নজর রাখা যাবে ওই পথের উপর, মাঝখানে কোনো বাধা পড়বে না।

সোয়া আটটা বাজে।

চুপচাপ অপেক্ষা করায় তেমন একটা বিশ্বাসী না আমি, তাই রেডিও চালিয়ে দিলাম। হাওয়ার্ড স্টার্নের গান শুনলাম কিছুক্ষণ।

সাড়ে আটটা বাজে।

গান বন্ধ করে দিলাম। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি অনতিদূরের ওই পথের দিকে।

কাউকে দেখা যাচ্ছে না সেখানে।

অভ্যাসের দাস হ্যাঙ্ক তা হলে কোথায়?

নটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও যখন দেখা মিলল না ওর, হ্যাল ছেড়ে দিলাম। গিয়ে হাজির হলাম এলির সেই আশ্রয়কেন্দ্রে। জানতে চাইলাম বেথ ল্যাশলির ব্যাপারে।

এখন আর সে বেথ ল্যাশলি না, বলল এলি, বিয়ের পর স্বামীর নাম যুক্ত করে নিয়েছে নিজের নামের সঙ্গে। এখন সে ডক্টর বেথ ফ্লেচার। কার্ডিয়োলোজিস্ট হিসেবে কাজ করে অ্যান আবার-এ।

জানলে কীভাবে?

হাইস্কুলে যে-কজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল ওর, তাদের সবাইকে ফোন করেছি আমি। কারও সঙ্গেই নাকি বেথের কোনো যোগাযোগ নেই। আশ্চর্য লাগল কথাটা শুনে। কারণ স্কুলে পড়ার সময় হাসিখুশি মেয়ে ছিল বেথ, সবার সঙ্গে মিশত। বাধ্য হয়ে যোগাযোগ করতে হলো ওর বাবা-মার সঙ্গে। বললাম, অচিরেই রি-ইউনিয়ন করতে যাচ্ছি আমরা, কাজেই বেথের সঙ্গে যোগাযোগ করাটা জরুরি হয়ে পড়েছে।

তারা কী বললেন?

তেমন কিছু বললেন না, আবার বেথের নম্বর দিতেও রাজি হলেন না। জানালেন, আমি চাইলে রি-ইউনিয়ন সম্পর্কিত যে-কোনো তথ্য ই-মেইলে পাঠিয়ে দিতে পারি তাদের কাছে। তারা নাকি সেগুলো পরে জানিয়ে দেবেন বেথকে।

শেষপর্যন্ত বেথকে পেলে কী করে তা হলে?

এলেন মেগারের মাধ্যমে। মেয়েটার কথা মনে আছে তোমার?

মোটামুটি। আমাদের এক ক্লাস নিচে পড়ত। ওর সঙ্গে কখনও কখনও ম্যাথ ক্লাসে দেখা হতো আমার।

মাথা ঝাঁকাল এলি। পরে হিউস্টনের রাইস ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয় সে।

আচ্ছা।

বেথ ল্যাশলিও ভর্তি হয়েছিল ওখানে। যা-হোক, রাইস ইউনিভার্সিটির অ্যালামনাই অফিসে ফোন করার জন্য অনুরোধ করলাম এলেন মেগারকে। ওখানকার কেউ বেথের ব্যাপারে কোনো তথ্য জানাতে পারবে কি না, খোঁজ নিতে বললাম।

দারুণ কাজ দেখিয়েছ।

মুচকি হাসল এলি। ইউনিভার্সিটি অভ মিশিগান মেডিকেল সেন্টারে একজনের ই-মেইল অ্যাড্রেস পাওয়া গেল…নামের শেষে ফ্লেচার আছে। বাকিটা খুঁজে বের করার জন্য গুগলের সাহায্য নিতে হয়েছে আমাকে। আমার দিকে একটা চিরকুট বাড়িয়ে দিল সে। এই যে, ওর অফিসের নাম্বার।

এমনভাবে তাকালাম চিরকুটটার দিকে, যেন কোনো ক্লু পেয়েছি।

 হ্যাঙ্কের কোনো খোঁজ পাওয়া গেছে? জিজ্ঞেস করল এলি।

না।

সঙ্কট ঘনীভূত হচ্ছে।

হ্যাঁ। চুমু খেলাম এলির গালে, বাইরে বেরিয়ে আবার উঠলাম গাড়িতে। রওয়ানা দিলাম পশ্চিম দিকে, পেনসিলভানিয়া সীমান্তের উদ্দেশে।

যে-সময় নাগাদ পৌঁছাবো, ততক্ষণ অফিসে থাকার কথা না সাইমন ফ্রেজারের। সেক্ষেত্রে তার বাসায় যেতে হবে আমাকে অথবা অন্য কোনো পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। আবার, হয়তো দেখা যাবে, আমাদের দেখা হলো ঠিকই অথচ আমার সঙ্গে কথা বলতে রাজি না তিনি। আসলে গোয়েন্দাগিরির কাজটা এ-রকমই। এই কাজে সময় নষ্ট হয় প্রচুর, শারীরিক-মানসিক শক্তিও খরচ হয় অনেক।

লং ড্রাইভ সবসময়ই আত্মচিন্তায় বিভোর বানিয়ে দেয় আমাকে, এবারও সেটার ব্যতিক্রম হলো না। লিও’র কথা ভাবছি।

 জীবনের প্রথম আঠারোটা বছরের তেমন কোনো স্মৃতি নেই আমার। লিওকে নিয়ে তেমন বিশেষ কিছু মনে করতে পারি না আমি। তবে এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই, একই জরায়ু ভাগাভাগি করে নিয়েছিলাম আমরা, তারপর ভাগাভাগি করে নিয়েছিলাম একই ঘর। লিও’র সঙ্গে যে কোনোকিছু শেয়ার করতে কখনও কোনো আপত্তি ছিল না আমার। এমনকী আমার যত গোপন কথা ছিল, সব শেয়ার করেছি ওর সঙ্গে। ওসব কথা ওকে বলতে কখনও লজ্জিত হইনি, কুণ্ঠা বোধ করিনি। কারণ, আমি জানতাম, আমার গোপনতম কথাগুলো শোনার পরও আমাকে ভালোবাসবে লিও…মুখ ফিরিয়ে নেবে না আমার উপর থেকে। অন্য সবার জন্য কিছুটা হলেও ভনিতা ছিল লিও’র আচার-আচরণে। আমার জন্য ছিল না।

আসলেই?

যদি বলি, আমার কাছ থেকে জীবনের কোনো একটা বাস্তবতা লুকিয়ে রেখেছিল সে, ভুল হবে?

যদি বলি, আমার থেকে ভয়াবহ কিছু একটা গোপন করে রেখেছিল সে, ভুল হবে?

ঘণ্টাখানেক পর, তখনও ড্রাইভ করছি আমি, ফোন করলাম ডক্টর বেথ ফ্লেচারের অফিসে। নিজের নামটা বললাম রিসিপশনিস্টকে, কথা বলতে চাইলাম বেথের সঙ্গে। রিসিপশনিস্ট বলল, এই মুহূর্তে নেই ডক্টর। জানতে চাইল, কেন কথা বলতে চাই ডক্টরের সঙ্গে।

একসময় একই হাইস্কুলে পড়তাম আমরা, জবাবে বললাম আমি। সে-হিসেবে আমাকে ডক্টরের পুরনো একজন বন্ধু বলা চলে। …এক কাজ করুন। আমার নাম আর মোবাইল নম্বর লিখে রাখুন।

লিখল রিসিপশনিস্ট।

যদি কিছু মনে না করেন, কণ্ঠে জরুরি একটা ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলাম আমি, ডক্টরের সঙ্গে কথা বলাটা কিন্তু আসলেই দরকার আমার।

তাকে মেসেজটা জানিয়ে দেবো, যান্ত্রিক গলায় বলল রিসিপশনিস্ট।

আমি পুলিশে চাকরি করি।

জবাব পাওয়া গেল না ও-প্রান্ত থেকে।

দরকার হলে যোগাযোগ করুন ডক্টর ফ্লেচারের সঙ্গে। ওকে জানান, আমি জরুরি ভিত্তিতে কথা বলতে চাইছি ওর সঙ্গে।

আর কিছু না বলে লাইন কেটে দিল রিসিপশনিস্ট।

এবার ফোন করলাম অগিকে।

একবার রিং হওয়ামাত্র কল রিসিভ করলেন তিনি। বলো।

আমি জানি, আপনি এসব থেকে দূরে থাকতে চাইছেন।

জবাব পাওয়া গেল না।

শুধু একটা উপকার করতে পারবেন?

হা-না কিছুই বললেন না অগি।

 হ্যাঙ্ককে খুঁজে বের করতে বলবেন আপনার পেট্রোল অফিসারদেরকে? এমনভাবে বলছ, যেন হ্যাঙ্ককে খুঁজে বের করাটা সাংঘাতিক কঠিন কোনো কাজ। কিন্তু আসলে তা না। প্রতিদিন একই রাস্তা ধরে হাঁটাহাঁটি করে সে।

আজ করেনি।

 গত রাতে হ্যাঙ্কের ব্যাপারে ডেভিডের কাছ থেকে যা যা জানতে পেরেছি, সংক্ষেপে বললাম অগিকে। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে চুপ করে থেকে সব শুনলেন অগি।

তারপর বললেন, তুমি নিশ্চয়ই জানো, হ্যাঙ্ক পুরোপুরি সুস্থ না?

 আমরা কেউই পুরোপুরি সুস্থ না।

কথাটা শুনে একটু যেন থমকে গেলেন অগি। কী ভাবছ তুমি আসলে, বলো তো? কী জানতে পারবে হ্যাঙ্কের কাছ থেকে?

জানি না। আমি শুধু ওর মুখোমুখি হতে চাই।

ঠিক আছে। বলে দিচ্ছি আমার লোকদেরকে। ওরা যদি দেখতে পায় হ্যাঙ্ককে, রেডিওতে যোগাযোগ করবে আমার সঙ্গে।

ধন্যবাদ, বললাম আমি, কিন্তু ততক্ষণে লাইন কেটে দিয়েছেন অগি।

এলবে, ব্যায়োশ অ্যান্ড ফ্রেজার ফার্মটা, গ্লাস পার্টিশনে মোড়া উঁচু একটা ভবনে অবস্থিত। ওটার আশপাশে আরও কিছু গ্লাস-পার্টিশনে-মোড়া উঁচু ভবন আছে। পার্কিং লটে গাড়ি পার্ক করলাম আমি। লটটা তেমন একটা বড় না। এদিকওদিক তাকিয়ে দেখতে পেলাম, ওই ফার্ম যে-ভবনে। অবস্থিত, সেটার নিচতলার দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন রেনল্ডস। সবুজ একটা টার্টেলনেকের উপর ব্লেযার পরেছেন তিনি। তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

সাইমন ফ্রেজার আছেন অফিসে, বললেন তিনি।

জানলেন কীভাবে?

আপনি ফোন করার পর থেকেই এখানে ঘুরঘুর করছি আমি। আমার সামনে দিয়েই অফিসে ঢুকেছেন তিনি। আমাকে খেয়াল করেছেন কি না, জানি না। তবে এটা জানি, এখনও বেরিয়ে যাননি। তাঁর গাড়ি আছে পার্কিং লটে।

চলুন।

ভিতরে ঢুকলাম আমরা।

লবিটা কেমন যেন বর্ণহীন, ঠাণ্ডা। আরও কয়েকটা ল ফার্ম এবং অন্যান্য কিছু প্রতিষ্ঠানের অফিস আছে এই ভবনে। এলিভেটরে চেপে ছতলায় হাজির হলাম আমরা।

রিসিপশনে যে-লোক বসে আছে, তার চেহারা ছোকরাদের মতো। মাইক্রোফোন-সহ হেডসেট পরে আছে সে। চোখে ফ্যাশনেবল চশমা। আমাদেরকে দেখামাত্র একটা আঙুল তুলল-বুঝিয়ে দিল একটু সময় দরকার ওর।

কিছুক্ষণ পর বলল, আমি কী সাহায্য করতে পারি আপনাদেরকে?

নিজের ব্যাজ বের করে দেখালেন রেনল্ডস। সাইমন ফ্রেজারের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি আমরা।

অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে?

অবজ্ঞায় এমনভাবে বিকৃত হয়ে গেল রেনল্ডসের চেহারা যে, একটা মুহূর্তের জন্য মনে হলো আমার, থু করে থুতু ছিটানোর কায়দায় বলে বসবেন, এই ব্যাজই আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট।

কিন্তু সেটা বললেন না তিনি, বরং যথেষ্ট বিনয়ের সঙ্গে বললেন, না, নেই। তবে মিস্টার ফ্রেজার যদি তার মূল্যবান কিছু সময় দেন আমাদেরকে কৃতজ্ঞ থাকবো।

কী একটা বাটনে চাপ দিল ওই ছোকরা, ফিসফিস করে কী যেন বলছে। তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, একটু বসুযান আপনারা।

কথামতো কাজ করলাম আমরা।

কোথাও কোনো ম্যাগাজিন দেখতে পাচ্ছি না, কাজেই, অপেক্ষার মুহূর্তগুলো কীভাবে পার করবো, বুঝতে পারছি না। ল ফার্মের চকচকে কিছু ব্ৰশিয়ের দেখা যাচ্ছে। একটা তুলে নিলাম। পাতা উল্টাতেই দেখা গেল সাইমন ফ্রেজারের ফটোগ্রাফ আর জীবনবৃত্তান্ত।

 পেনসিলভানিয়ার সন্তান তিনি। পড়াশোনা করেছেন স্থানীয় একটা হাই স্কুলে। তারপর বি.এ. ডিগ্রি অর্জনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান পশ্চিমে, ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি অভ পিটসবার্গে। এরপর ফিলাডেলফিয়ার ইউনিভার্সিটি অভ পেনসিলভানিয়া থেকে আইনের উপর ডিগ্রি নেন। তাঁর জীবনবৃত্তান্তে বলা হচ্ছে, পারিবারিক আইনের উপর তিনি একজন দেশবরেণ্য উকিল।

 ধূসর স্কার্ট পরিহিতা লম্বা একজন মহিলা এসে দাঁড়ালেন আমাদের সামনে। আসুযান আমার সঙ্গে।

পিছু নিলাম তার। একটা করিডর ধরে হাজির হলাম কনফারেন্স রুমে। এই ঘরের যে-দেয়াল রাস্তার দিকে মুখ করে আছে, সেটা ইট দিয়ে বানানো না, বরং গ্লাস পার্টিশনে আবৃত। পার্কিং লটটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অলিভ গার্ডেন নামের একটা রেস্টুরেন্টও দেখা যাচ্ছে।

 দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম আমি। একটা লম্বা কনফারেন্স টেবিল আছে ঘরে। প্রতিটা চেয়ারের সামনে একটা করে মাইক্রোফোন বসানো।

আমাদেরকে বসতে বলার ইঙ্গিত করে কোথায় যেন চলে গেলেন লম্বা মহিলাটা। ফিরে এলেন মিনিট পনেরো পর। তাকালেন রেনল্ডসের দিকে। আপনি লেফটেন্যান্ট রেনল্ডস?

হ্যাঁ।

 তিন নম্বর লাইনে কল দেয়া হয়েছে আপনাকে। চলে গেলেন লম্বা মহিলা।

 আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কোঁচকালেন রেনল্ডস। ঠোঁটে আঙুল রেখে আমাকে চুপ করে থাকার ইশারা করলেন তিনি, তারপর এগিয়ে গিয়ে চাপ দিলেন তিন নম্বর স্পিকারফোনের রিসিভ বাটনে।

বললেন, রেনল্ডস।

 স্টেইসি? শোনা গেল একটা ভারী পুরুষকণ্ঠ।

 হ্যাঁ।

সাইমন ফ্রেজারের অফিসে কী করছ তুমি?

 একটা কেস নিয়ে কাজ করছি আমি, ক্যাপ্টেন।

কোন কেস?

 অফিসার রেক্স ক্যান্টনের হত্যাকাণ্ড।

এই কেস সামলানোর দায়িত্ব এখন আর আমাদের না। কারণ ওটা হস্তান্তর করা হয়েছে কাউন্টি অফিসের কাছে।

কথাটা জানা ছিল না আমার।

তারপরও কাজ করছি আমি। আসলে চেষ্টা করে দেখছি কোনো সূত্র পাওয়া যায় কি না।

না, স্টেইসি, তুমি আসলে কোনো সূত্র পাওয়ার চেষ্টা করছ না। তুমি আসলে দেশের বিশিষ্ট একজন নাগরিককে হয়রানি করছ। জানো কি না জানি না, স্থানীয় দুজন বিচারপতির সঙ্গে দহরম-মহরম আছে তার। তুমি তার অফিসে গেছ, দেখা করতে চেয়েছ তার সঙ্গে, ওদিকে তিনি ফোন করেছেন আমাকে, তোমার বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়ে বলছেন, আমার একজন লেফটেন্যান্ট নাকি বার বার বিরক্ত করছে তাকে। অথচ উকিল-মক্কেল সম্পর্কের দোহাই দিয়ে তিনি নাকি আগেই ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন তোমার কাছে, সাফ জানিয়ে দিয়েছেন এই কেসে সাহায্য করা সম্ভব না তার পক্ষে।

আমার দিকে তাকালেন রেনল্ডস। দেখলেন, কাদের সঙ্গে কাজ করি আমি? জাতীয় দৃষ্টি দেখা যাচ্ছে তার চোখে।

বুঝতে পারার ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালাম আমি।

 আমাকে কি আর কিছু বলতে হবে, স্টেইসি?

না, ক্যাপ্টেন। যা বুঝবার, বোঝা হয়ে গেছে আমার। মিস্টার ফ্রেজারের অফিস থেকে চলে আসছি আমি।

দাঁড়াও। আমাকে বলা হয়েছে, তোমার সঙ্গে নাকি আরও একজন আছে। কে সে?

এখন রাখি। পরে কথা বলবো।

লাইন কেটে দিলেন রেনল্ডস।

সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল কনফারেন্স রুমের দরজা, ভিতরে ঢুকলেন ওই লম্বা মহিলা। আমার মনে হলো, দরজার বাইরেই অপেক্ষা করছিলেন তিনি।

আমাদেরকে এলিভেটর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে চলে গেলেন তিনি, একটা কথাও বললেন না।

আমার দিকে তাকালেন রেনল্ডস। আমার কথামতো এত দূর থেকে এলেন আপনি, কিন্তু কোনো কাজ হলো না। দুঃখিত।

হু।

বাইরে বের হওয়ার পর রেনল্ডস বললেন, আমি বরং আমাদের স্টেশনে যাই। মানানোর চেষ্টা করি আমাদের ক্যাপ্টেনকে।

ভালো বুদ্ধি।

হ্যান্ডশেক করলাম তার সঙ্গে।

কী করবেন এখন? আমাকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি। ফিরে যাবেন ওয়েস্টব্রিজে?

কাঁধ ঝাঁকালাম। আগে লাঞ্চ করবো। অলিভ গার্ডেন রেস্টুরেন্টটা কেমন?

কেমন হতে পারে বলে ধারণা আপনার?

.

অলিভ গার্ডেনে গেলাম না আমি।

পার্কিং লটে রিযার্ভ পার্কিং-এর জন্য আলাদা জায়গা আছে। চকচকে একটা লাল টেসলার পেছনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে ছোট্ট একটা বোর্ড, তাতে লেখা আছে: রিভৃর্ড ফর সাইমন ফ্রেজার।

উঠে পড়লাম নিজের গাড়িতে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম এই ভবনের নিচতলার সদর-দরজার দিকে। সাইমন ফ্রেজারের কোনো পাত্তা নেই।

চালু করলাম নিজের গাড়ির ইঞ্জিন, গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে পার্ক করলাম সাইমন ফ্রেজারের গাড়ির ঠিক পাশে। এখন আমার প্যাসেঞ্জার সিটের পাশের-দরজা থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে আছে ফ্রেজারের ড্রাইভিং-সিটের পাশের-দরজা।

অপেক্ষা করতে লাগলাম।

সোয়া বারোটার দিকে বের হলেন ফ্রেজার। মোবাইল ফোনে কথা বলছেন তিনি। এগিয়ে আসছেন নিজের গাড়ির দিকে। একটা হাত ঢুকিয়ে দিলেন পকেটে। বের করে আনলেন কিছু একটা, আলতো চাপ দিলেন ওটাতে। মৃদু একটা বিপ-বিপ আওয়াজ শোনা গেল তার গাড়ির ভিতর থেকে।

পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করলাম আমি, কানে ঠেকালাম। কেউ কল দেয়নি আমাকে, আমিও কল দিইনি কাউকে। ফোনে কথা বলার অভিনয় করছি।

ফ্রেজার হঠাৎ করেই বুঝতে পারলেন, আমি গাড়ি না সরালে উঠতে পারবেন না তিনি নিজের ড্রাইভিং সিটে। রেগে গেলেন তিনি, শুনতে পেলাম উঁচু গলায় বললেন, এসব কী?

 নিজের মোবাইল ফোন হাতবদল করলাম আমি। খালি হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলাম আমার ঠিক পাশের ডোর-হ্যান্ডেল।

এই যে…শুনছেন?

শুনছি, কিন্তু তাকালাম না ফ্রেজারের দিকে। মোবাইল কানে ঠেকিয়ে বসে আছি।

 রাগ বাড়ল ফ্রেজারের। আমার গাড়ির পেছনটা ঘুরে এগিয়ে এলেন তিনি, থামলেন আমার ঠিক পাশেই। ঝুঁকে পড়ে উঁকি দিয়ে তাকালেন আমার দিকে। এভাবে গাড়ি পার্ক করতে পারেন না আপনি!

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম তাঁর দিকে, ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিলাম মোবাইল ফোনটা, বুঝিয়ে দিলাম ফোনে কথা বলছি।

রাগে লাল হয়ে গেল ফ্রেজারের চেহারা। জঘন্য একটা গালি দিয়ে বললেন, নামুন গাড়ি থেকে!

 সঙ্গে সঙ্গে টান দিলাম আমি ডোর-হ্যান্ডেলে, পরমুহূর্তেই সজোরে ধাক্কা দিলাম ওটাতে।

দরজাটা ছিটকে গিয়ে লাগল ফ্রেজারের নাকেমুখে। প্রচণ্ড ধাক্কায় উল্টে পড়ে গেলেন তিনি পার্কিং লটে। চটজলদি নামলাম আমি ড্রাইভিং সিট থেকে। ইতোমধ্যে মোবাইল ফোন চালান করে দিয়েছি প্যান্টের পকেটে।

আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম আমি, সাইমন ফ্রেজার।

নাকে-মুখে হাত বুলাচ্ছেন ফ্রেজার, দেখছেন কোথাও কেটে গেছে কি না, কোনো জায়গা থেকে রক্ত বের হচ্ছে কি না।

রক্ত বের হয়নি, বললাম আমি, এখনও।

হুমকি দিচ্ছেন নাকি? শুয়ে থেকেই জিজ্ঞেস করলেন ফ্রেজার।

হ্যাঁ। একটা হাত বাড়িয়ে দিলাম ফ্রেজারের দিকে। নিন, উঠে পড়ুন।

 কে আপনি?

 ন্যাপ দুমা।

পুলিশে খবর দিচ্ছি আমি।

কোনো দরকার নেই। আমিই পুলিশ। বলুন কী করতে পারি আপনার জন্য?

আপনি একজন পুলিশ অফিসার?

হ্যাঁ।

আপনার চাকরি খাবো আমি।

কেন? কী দোষ করেছি আমি?

আমার গায়ে হাত তুলেছেন।

কে বলল? আপনিই তো গাড়ি থেকে নামতে বললেন আমাকে। আপনার কথামতো তাড়াহুড়ো করে নামতেই গিয়েই তো ঘটল দুর্ঘটনাটা। …আপনার যদি আরও পুলিশের দরকার হয়, ডাকুন। তবে আগেই বলে রাখি, যা জানার জন্য এসেছি, তা যদি জানতে না পারি, এক ইঞ্চিও নড়বো আপনার সামনে থেকে।

যদি না বলি?

কাঁধ ঝাঁকালাম। আপনার সুখশান্তি সব হারাম করে দেবো।

উঠে দাঁড়ালেন ফ্রেজার। পারবেন?

পারবো কি না জানি না, তবে চেষ্টা অবশ্যই করবো। কারণ আমার হারানোর কিছু নেই। এবং আপনার কী হলো না-হলো তা নিয়ে কোনো পরোয়াও নেই। …আমি বিয়ে করিনি। সামাজিক প্রতিষ্ঠা নামের কুকুরের মলের জন্য আমি লালায়িতও না। কাজেই আবারও বলছি, হারানোর কিছু নেই আমার। আপনার যা-খুশি করতে পারেন আমার ব্যাপারে। তারপর আমিও আমার যা-খুশি-লাগে করবো। কসম।

আপনি এভাবে হুমকি দিতে পারেন না আমাকে!

দিচ্ছি তো!

রাগে জবান বন্ধ হয়ে গেল ফ্রেজারের। বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।

আমার ভাই মারা গেছে, সাইমন। আমার ধারণা, খুন করা হয়েছে। তাকে। কে বা কারা করেছে কাজটা, এবং কেন করেছে, জানতে চাই আমি। এখন আপনি যদি আমার সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের পথে প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ান, নিশ্চয়ই আশা করতে পারেন না আপনাকে সহ্য করবো আমি?

খাকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করলেন ফ্রেজার। রেক্স ক্যান্টনের কোনো ভাই ছিল বলে তো শুনিনি?

 রেক্স আমার ভাই না। আমার ভাইয়ের নাম লিও। আজ থেকে বছর পনেরো আগে রহস্যজনকভাবে মারা গেছে সে। আমার ধারণা, লিও’র হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কোনো-না-কোনো যোগসূত্র আছে রেক্সের হত্যাকাণ্ডের।

সেক্ষেত্রে কিছু করার নেই আমার। আপনাকে সাহায্য করতে পারবো না। মক্কেলদের টাকা খেয়ে তাদেরই গোপন কথা ফাস করতে পারবো না কারও কাছে।

আমিও আপনার মক্কেলদের গোপন কথা জানার জন্য চাপাচাপি করতাম না। কিন্তু, সাইমন ফ্রেজার, আপনি এমন একটা কাজ করেছেন, যা এ-দেশের দণ্ডবিধি অনুযায়ী একটা অপরাধ।

আবারও জবান বন্ধ হয়ে গেল ফ্রেজারের।

কিছু সংখ্যক লোকের অপ্রস্তুত অবস্থার সুযোগ নিয়ে তাদেরকে ফাঁদে ফেলেছেন আপনি এবং ফায়দা লুটেছেন। আমার কথা ঠিক নাকি বেঠিক?

আবারও গলা খাঁকারি দিলেন ফ্রেজার। এসব কী বলছেন আপনি?

আপনি সময়ে-সময়ে ভাড়া করেছেন অফিসার রেক্স ক্যান্টনকে। আপনার তথাকথিত মক্কেলরা ডিভোর্স চাইছিল তাদের স্বামীদের কাছ থেকে, রেক্সের সাহায্য নিয়ে আপনি আদালতে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, ওই লোকগুলো সংসার করার উপযুক্ত না।

আপনার কাছে কোনো প্রমাণ নেই, গলায় জোর নেই ফ্রেজারের।

কে বলল? তেজ দেখানোর চেষ্টা করলাম। পিট করউইক, র‍্যান্ডি ও টুল আর নিক ওয়েইস। নাম তিনটা পরিচিত মনে হয় আপনার?

তৃতীয়বারের মতো জবান বন্ধ হলো ফ্রেজারের।

ওই তিনজনকেই মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছিল রেক্স। এবং ওই তিনজনের কেসই হ্যান্ডেল করেছিল আপনার ফার্ম। বলুন, এর চেয়ে বড় কাকতালীয় ঘটনা কি আর ঘটেছে পৃথিবীতে?

তাতে কী? কেউ প্রমাণ করতে পারবে না, আমি কোনো অন্যায় করেছি।

আপনি বোকা নাকি? আমি প্রমাণ করার কথা বলিনি একবারও। আমি বলেছি আপনার সম্মানের কথা। আপনি দেশবরেণ্য একজন লোক, আপনার বিরুদ্ধে এত রসালো একটা অভিযোগ যদি মিডিয়ার কানে যায়… ইচ্ছাকৃতভাবে থেমে গেলাম আমি।

বিষদৃষ্টিটা আবারও ফিরে এসেছে ফ্রেজারের চোখে আমার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছেন তিনি।

 মাত্র দুটো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবো আপনাকে। যদি ঠিক ঠিক জবাব দেন, গাড়ি নিয়ে চলে যাবো। আর যদি না দেন, প্রথমে যাবো মিডিয়ার কাছে। তারপর আমেরিকান বার অ্যাসোসিয়েশনে। এমনকী টুইটার অথবা ফেইসবুকে ছড়িয়ে দেবো আপনার কুকীর্তির কথা। চলবে?

মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেছেন ফ্রেজার।

 বুঝতে পারলাম, আমার মাছ ধরা পড়েছে বঁড়শিতে। বললাম, প্রথম প্রশ্ন: মাতাল গাড়িচালকদের পাকড়াও করার কাজে একটা মেয়ে সাহায্য করত রেক্সকে; ওর ব্যাপারে কী জানেন আপনি?

কিছু না।

বেশি দ্রুত দিয়ে ফেলেছেন ফ্রেজার জবাবটা।

শিকারকে প্ররোচিত করে ফাঁদে ফেলার কাজে একটা মেয়েকে ব্যবহার করত রেক্স, জানেন নিশ্চয়ই?

মাতাল অবস্থায় কোন্ বারে কে-কার-সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করে, তা জানাটা নিশ্চয়ই আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না?

মেয়েটা কে?

কোনো ধারণা নেই আমার। রেক্সকে ভাড়া করার পর্যন্তই আমার কাজ শেষ, সে কাকে দিয়ে কী করত তা জানারও প্রয়োজন বোধ করতাম না।

মনে হলো, সত্যি কথাই বলছেন ফ্রেজার।

বললাম, এবার দ্বিতীয় প্রশ্ন।

এবং শেষ প্রশ্ন।

রেক্স ক্যান্টন যে-রাতে খুন হলো, সে-রাতে আপনার কোন্ মক্কেলকে সাহায্য করছিলেন আপনি?

ইতস্তত করছেন ফ্রেজার। কী বলবেন, অথবা আদৌ কিছু বলবেন কি না, ভাবছেন। দ্বিধা করার সুযোগ দিলাম আমি তাকে। লাল থেকে আরও লাল হয়ে যাচ্ছে তার চেহারা।

 আপনি কী জানতে চাইছেন, বললেন তিনি কিছুক্ষণ পর, বুঝতে পারছেন তো?

কী জানতে চাইছি?

আপনার প্রশ্নটার মানে হলো, আমার সে-রাতের মক্কেল, অফিসার ক্যান্টনের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।

এবং আপনার কথাটার মানে হলো, আপনার মক্কেল যদি আসলেই জড়িত থাকে হত্যাকাণ্ডটার সঙ্গে, তা হলে তাকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন আপনি।

আবারও সেই বিষদৃষ্টি, আবারও সেই নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকা।

 কিছুক্ষণ পর ফ্রেজার বললেন, আমার মক্কেলকে কেন সন্দেহ হলো আপনার, জানতে পারি?

অবশ্যই পারেন। টার্গেটের বেশে একজন খুনি গিয়ে বসল একটা। বারে। তার আগে চোরাই একটা আই.ডি. কার্ড দিয়ে ভাড়া নিল একটা গাড়ি। যে-মেয়েটা সাহায্য করছিল রেক্সকে, তার দ্বারা প্ররোচিত হওয়ার ভান করল, মাতাল হওয়ার ভান করল। আসলে সে অপেক্ষা করছিল কখন তার পিছু নেবে রেক্স, কখন ওর গাড়ি থামাবে কোনো নির্জন জায়গায়। তাই সুযোগ পাওয়ামাত্র গুলি করে খুন করল সে রেক্সকে।

চুপ করে আছেন ফ্রেজার, আমার কথা শুনে থতমত খেয়ে গেছেন সম্ভবত।

সাইমন, ঘটনার বর্ণনা শুনে আপনার কি মনে হয় না, ওটা একটা সেটআপ? ঠাণ্ডা মাথায় একটু ভাবুন, নিজেই বুঝতে পারবেন।

ঠিক আছে, হ্যাল ছেড়ে দেয়ার কায়দায় বললেন তিনি, নামটা বলবো আমি আপনাকে।

ভালো।

তবে ওটা এই মুহূর্তে মনে নেই আমার। কাগজপত্র ঘটতে হবে…লাঞ্চের পর বলি? হাতঘড়ি দেখে নিলেন ফ্রেজার একনজর। একজন মক্কেলের সঙ্গে দেখা করতে হবে আমাকে…দেরি হয়ে যাচ্ছে।

সাইমন?

ঘুরতে যাচ্ছিলেন তিনি, ডাক শুনে ফিরে তাকালেন।

লাঞ্চ, মক্কেল সব বাদ আপনার। ওই নাম এই মুহূর্তে বলতে হবে আপনাকে।

.

পনেরো বছরের দূরত্বটা কি একটু একটু করে কমছে? মোরা কি একটু একটু করে কাছিয়ে আসছে আমার?

স্মৃতি আর অতীত ভুলে গিয়ে আমার মনোনিবেশ করা উচিত এই কেসে। আবেগ কোনো কাজে লাগবে না আমার…আবেগ কখনোই কারও কাজে লাগে না। তারপরও আমরা আবেগাক্রান্ত হই। এবং ভুল করি।

 আমিও কি কোনো ভুল করছি? মোরাকে ফিরে পাওয়ার হাস্যকর একটা আশা নিয়ে অনাহূতের মতো জড়িয়ে গেছি এবং এখনও জড়িয়ে আছি এই কেসের সঙ্গে সময় যত গড়াচ্ছে, অদ্ভুত কোনো আবেগে আমার মন ও মস্তিষ্ক আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে তত…আচ্ছন্ন হয়ে আসছে চিন্তাশক্তি।

কাজটা কি উচিত হচ্ছে?

সাইমন ফ্রেজারের অফিসে, তার মুখোমুখি বসে আছি আমি। লম্বা সেই মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন ফ্রেজারের পাশে, একটা ফাইল খুলে কী-সব কাগজ বাড়িয়ে দিচ্ছেন ফ্রেজারের দিকে। সেগুলো একটা একটা করে হাতে নিচ্ছেন ফ্রেজার, উল্টেপাল্টে দেখছেন, তারপর ফিরিয়ে দিচ্ছেন ওই মহিলার হাতে। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি আমি তাঁদের কাজ, একইসঙ্গে বিভোর হয়ে পড়েছি আত্মচিন্তায়।

হঠাৎ বদলে গেল ফ্রেজারের মুখভাব।

কী? জানতে চাইলাম আমি, পিঠটা খাড়া হয়ে গেছে নিজের অজান্তে।

গত এক মাসে রেক্সকে ভাড়া করিনি আমি। অর্থাৎ, সে-রাতে আমার কোনো মক্কেলের হয়ে ভাড়া খাটেননি তিনি। কাজেই কে বা কারা ভাড়া করেছিলেন তাঁকে সে-রাতে, বলতে পারলাম না আপনাকে।

হয়তো…আপনার ফার্মের অন্য কেউ…

ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলেন ফ্রেজার। না…মনে হয় না।

রেক্স কি শুধু আপনার জন্যই কাজ করত?

জানি না। তবে এটা জানি, এই ফার্মে আমি ছাড়া আর কেউ কখনও ভাড়া করেনি তাঁকে। কারণ এখানে পারিবারিক আইন নিয়ে ওকালতি করি একমাত্র আমিই।

আমার মোবাইল ফোন বেজে উঠল।

কলার আইডি বলছে: ওয়েস্টব্রিজ পুলিশ ডিপার্টমেন্ট।

ভদ্রতা দেখিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিলাম ফ্রেজারের কাছে, উঠে চলে এলাম একটু দূরে। রিসিভ করলাম কলটা। হ্যালো?

হ্যাঙ্ককে কেন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, ও-প্রান্তে শোনা গেল অগির কণ্ঠ, তা জানতে পেরেছি।

.

১২.

পরদিন সকালে ওয়েস্টব্রিজ পুলিশ স্টেশনে পৌঁছে দেখি, জিল স্টিভেন্স নামের সম্প্রতি-নিয়োগপ্রাপ্ত এক মেয়ে-অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে অপেক্ষা করছেন অগি। আমাকে আর জিলকে নিয়ে সোজা উঠে গেলেন তিনি দোতলায়, বসলেন নিজের অফিস-কামরায়।

অগির পেছনের দেয়ালে কোনো আর্টওয়ার্ক নেই, পতাকা নেই, এমনকী কোনো পুরস্কার বা ডিগ্রি নেই। অগির ডেস্কের উপর কোনো ফটোও নেই। অথচ বাজি ধরে বলতে পারি, আমেরিকার অন্য যে-কোনো পুলিশ ক্যাপ্টেনের অফিসে ও-রকম কিছু-না-কিছু আছে। এই অবস্থা দেখলে বহিরাগত যে-কেউ বলবে, নিজের অবসরের কথা ভেবে অর্ধেক গোছগাছ সেরে ফেলেছেন অগি।

জিল বসেছে আমার ডান পাশে। ওর কোলে একটা ল্যাপটপ।

অগি বললেন, সপ্তাহ তিনেক আগে আমাদের এখানে এসেছিল হ্যাঙ্ক, একটা ব্যাপারে অভিযোগ করে গেছে। ওর বক্তব্য লিখে নিয়েছিল জিল।

তাকালাম জিলের দিকে।

খাঁকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করল সে, একটা ফাইল চালু করল ল্যাপটপে। মিস্টার হ্যাঙ্ক যখন ঢোকেন আমাদের অফিসে, খুবই উত্তেজিত দেখাচ্ছিল তাঁকে। তবে…তাঁকে আগেও দেখেছি আমি এই শহরে। তার অবস্থা সম্পর্কে মোটামুটি জানি। সেদিনের আগে আমাদের স্টেশনে আর কখনও আসেননি তিনি…মানে, স্বেচ্ছায় আসেননি। ছিটপাগলামির সমস্যাটা যখন বেশিমাত্রায় পেয়ে বসত তাকে, তখন কখনও কখনও তাঁকে তুলে আনতে বাধ্য হয়েছি আমরা, আটকে রেখেছি কয়েক ঘণ্টা। তারপর যখন বুঝতে পেরেছি তিনি ঠাণ্ডা হয়েছেন, ছেড়ে দিয়েছি। তবে তাঁকে কখনোই সেলে ঢোকানো হয়নি, প্রতিবারই জোরপূর্বক বসিয়ে রাখা হয়েছিল নিচতলার একটা চেয়ারে। …আমি আসলে বলতে চাই, সেদিনের আগে কোনো অভিযোগ লেখানোর জন্য কখনও আসেননি তিনি এখানে।

সে উত্তেজিত অবস্থায় ছিল? বললাম আমি।

আসলে…ও-রকম উত্তেজিত অবস্থায় ছিলেন তিনি প্রায় প্রতিবারই। তাই তেমন একটা পাত্তা দিইনি তখন। ভেবেছিলাম, তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করলে আপনাআপনি কেটে যাবে তার উত্তেজনা। কিন্তু সে-রকম হয়নি সেদিন শেষপর্যন্ত।

কী অভিযোগ ছিল হ্যাঙ্কের?

 বলছিলেন, কেউ কেউ নাকি তাকে হুমকি দিচ্ছে। আসলে…পাগলের প্রলাপ ভেবে খেয়াল করে শুনিনি তো, তাই সব কথা মনে নেই এখন। তবে এটা মনে আছে, সেদিন ভয়ের স্পষ্ট ছাপ দেখেছি তার চেহারায়। তিনি বলছিলেন, অনেকেই নাকি তাঁকে নিয়ে মিথ্যা কথা বলছে। মানহানির মামলা করা যায় কি না, তা নিয়েও আমার সঙ্গে আলোচনা করেছেন। এমনভাবে কথা বলছিলেন, যেন তিনি নিজেই নিজের উকিল। পুরো ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগছিল আমার কাছে। হঠাৎ করেই আমাকে একটা ভিডিও দেখান তিনি।

ল্যাপটপটা ডেস্কের উপর রাখল জিল, ঘুরিয়ে দিল আমার দিকে। প্লে বাটনে ক্লিক করে চালু করল ভিডিওটা।

কিছু একটা যেন হঠাৎ ঝাঁকুনি খেয়ে চলতে শুরু করে আরম্ভ করল আমার চোখের সামনে।

ইমেজ বলতে যা-কিছু আছে, সব কেমন যেন সঙ্কুচিত; স্ক্রীনের দুপাশ ঝাপসা। বুঝতে পারছি, স্মার্টফোন উল্লম্বভাবে ধরে ধারণ করা হয়েছে এই ভিডিও।

একটা বেসবল মাঠের এককোনায়, স্মার্টফোন থেকে দূরে দাঁড়িয়ে আছে একটা লোক।

স্লোন পার্ক, বলল জিল।

পার্কটা ইতোমধ্যে চিনতে পেরেছি আমি। ওটা বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন মিডল স্কুলের পাশে।

যুম করা হচ্ছে ভিডিও। ছবি কাঁপছে। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ওই লোক আর কেউ না…হ্যাঙ্ক। আশ্চর্য হলাম না। বাস্তুহারা বা ভবঘুরে বলতে যা বোঝায়, ওকে ঠিক তেমন দেখাচ্ছে। শেভ করেনি সে। পরনে রঙজ্বলা ঢলঢলে জিন্স আর ফ্ল্যানেলের শার্ট। জিন্সের কোনো কোনো জায়গার রঙ এতই জ্বলে গেছে যে, কেমন ফেকাসে সাদা দেখাচ্ছে। শার্টের সবগুলো বোতাম খোলা। ওটার নিচে আরেকটা শার্ট পরে আছে হ্যাঙ্ক। ভিতরের শার্টটার কোনো কোনো জায়গা পোকায়-কাটা।

দু-এক সেকেন্ড কিছুই হলো না। খুব সম্ভব কোনো কারণে ভয় পাচ্ছে। স্মার্ট ফোনওয়ালা মানুষটা, হাত কাঁপছে তার। বার বার ফোকাস করার চেষ্টা করছে হ্যাঙ্ককে, কিন্তু ঠিকমতো পারছে না।

 একটা মহিলার ফিসফিসানি শোনা গেল এমন সময়…খুব সম্ভব সে-ই ধরে রেখেছে স্মার্ট ফোনটা… বিকৃত রুচির ওই নোংরা লোকটা জামাকাপড় খুলে নিজের সবকিছু দেখাচ্ছে আমার মেয়েকে!

চট করে তাকালাম অগির দিকে। তার চেহারায় নির্বিকার ভাব।

আবার তাকালাম ভিডিওর দিকে।

এবার অনেক বেশি কাঁপছে ভিডিওটা, উপরে-নিচে দুলছে–খুব সম্ভব হ্যাঙ্কের দিকে হাঁটা ধরেছে ওই মহিলা।

এখানে কী করছ তুমি? চিৎকার করে বলল মহিলাটা।

মহিলাকে এতক্ষণে দেখতে পেল হ্যাঙ্ক। বড় বড় হয়ে গেছে ওর চোখ।

জামাকাপড় খুলে কেন নিজের সবকিছু দেখাচ্ছ ছোট ছোট বাচ্চাদের?

ভয়-পাওয়া পাখির মতো হয়ে গেছে হ্যাঙ্কের দৃষ্টি।

তোমার মতো বিকৃত-রুচির একটা লোককে ধরে কেন জেলে ঢোকাচ্ছে না পুলিশ?

মুখের সামনে হাত তুলল হ্যাঙ্ক-যেন অত্যুজ্জ্বল কোনো আলো থেকে বাঁচাতে চাইছে নিজের চোখ।

জবাব দাও!

 ছুট লাগাল হ্যাঙ্ক।

দৌড় দিল ওই মহিলাও।

নাচছে ক্যামেরা। নাচছে ভিডিও।

ওই অবস্থাতেই দেখা গেল, হ্যাঙ্কের কোমর থেকে পিছলে নেমে যাচ্ছে ওর প্যান্ট। এক হাত দিয়ে খামচে ধরে রেখেছে সে প্যান্টটা। দৌড়ে যাচ্ছে কাছের জঙ্গলের দিকে।

আপনারা যদি এই বিকৃত-রুচির লোকটার ব্যাপারে সাবধান থাকতে চান, এবার স্পষ্ট শোনা গেল মহিলার কণ্ঠ, তা হলে দয়া করে এই পোস্ট যত বেশি পারুন শেয়ার করুন। আমাদের বাচ্চাদের নিরাপদে রাখাটা আমাদের দায়িত্ব।

শেষ হয়ে গেল ভিডিও।

মুখ তুলে তাকালাম আমি। তারমানে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে এই। ভিডিও? নাকি বলবো ইউটিউবে?

জবাব দেয়ার দরকার মনে করলেন না অগি। জিলও কিছু বলল না।

তাকালাম অগির দিকে। হ্যাঙ্কের ব্যাপারে কেউ কোনো অভিযোগ করেছে আপনাদের কাছে?

ওর বিরুদ্ধে কেউ-না-কেউ কখনও-না-কখনও কিছু-না-কিছু বলেছে।

কী বলেছে? জামাকাপড় খুলে নিজের সবকিছু দেখিয়ে দেয় সে?

না…এখন পর্যন্ত ও-রকম কোনো অভিযোগ পাইনি হ্যাঙ্কের বিরুদ্ধে। সামনের দিকে ঝুঁকলেন অগি, ল্যাপটপের স্ক্রীনে আঙুল রেখে দেখিয়ে দিলেন কতবার দেখা হয়েছে ভিডিওটা।

হাঁ হয়ে গেলাম আমি।

 ৩৭,৮৯,৪৫২।

এই ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেছে, বলল জিল। এটা যেদিন আপলোড করা হয় ইন্টারনেটে, তার পরদিন আমাদের এখানে আসেন হ্যাঙ্ক। ততক্ষণে পাঁচ লক্ষবার দেখা হয়ে গেছে ভিডিওটা।

তোমাকে কী করতে বলেছিল সে ওই ব্যাপারে?

কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল জিল। তারপর বলল, শুধু বলেছিল, তার নাকি ভয় লাগছে।

সে কি ওকে বাঁচানোর আকুতি জানিয়েছিল তোমার কাছে?

হ্যা…মনে হয়।

তারপর তুমি কী করলে?

কী-ই বা করতে পারতাম? ..বলেছিলাম, কেউ যদি সরাসরি হুমকি দেয় তাকে, তা হলে যেন আবার চলে আসেন তিনি পুলিশ স্টেশনে।

ভিডিওটা কে পোস্ট করেছে, জানার চেষ্টা করেছ?

না। অগির দিকে তাকাল জিল। 

ঠিক আছে, জিল, যথেষ্ট করেছ তুমি। ল্যাপটপটা রেখে যাও আমার ডেস্কে। ধন্যবাদ।

উঠে দাঁড়াল জিল, তাকাল আমার দিকে।

কিছু বললাম না আমি। প্লে বাটনে চাপ দিয়ে পর পর দুবার দেখলাম ভিডিওটা।

 কে কী কমেন্ট করেছে, বললেন অগি, ইচ্ছা হলে পড়ে দেখতে পারো।

 পঞ্চাশ হাজারের বেশি কমেন্ট আছে। পড়তে শুরু করা মানে সময় নষ্ট করা। হঠাৎ একটা তাগাদা অনুভব করলাম আমি। হ্যাঙ্ককে খুঁজে বের করতে হবে আমাদের।

ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছি আমি। একটা বুলেটিন প্রচার করে দিয়েছি সারা রাজ্যে।

আমাদের বোধহয় ওর বাবার সঙ্গে দেখা করা উচিত।

হ্যাঙ্কের বাবা? মানে…টম? অনেক বছর আগেই শহর ছেড়ে চলে গেছে সে।

গিয়েছিলেন। তারপর ফিরে এসেছেন।

আসলেই?

একজনের কাছ থেকে শুনেছি, তিনি নাকি ক্রস ক্ৰীক পয়েন্টে থাকেন এখনও।

 ঠিক আছে, উঠে দাঁড়ালেন অগি। কিন্তু গাড়ি চালাতে হবে তোমাকে…আমি পারবো না।

.

১৩.

গাড়ি চালাচ্ছি আমি। চুপ করে আছি আমরা দুজনই।

 কিছু একটা বলতে চাইছি আমি অগিকে, কিন্তু বলতে পারছি না। আসলে…তাঁকে এসবের মধ্যে টেনে আনার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করতে চাইছি। বুকের ভিতরে অতি-গোপন কোনো জায়গায় এসব চাপা দেয়ার জোর চেষ্টা চালিয়েছিলেন এবং এখনও হয়তো চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তাই আমি তাকে বলতে চাইছি; গাড়িটা ঘুরিয়ে নিচ্ছি, আপনাকে পুলিশ স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে ফিরে আসবো, যা ঘটছে তা আমি একাই সামাল দিতে পারবো। বলতে ইচ্ছা করছে, আপনার মৃত মেয়ের ব্যাপারে যা-যা বলেছি, সব ভুলে যান।

কিন্তু সেসবের কিছুই বলতে পারছি না।

 উল্টো বলে ফেললাম, আমার থিউরি এখনও বলছে, যা ঘটছে, তার সঙ্গে কোনো-না-কোনো যোগসূত্র আছে লিও আর ডায়ানার মৃত্যুর।

চোখের কোনা দিয়ে দেখতে পেলাম, চেহারা কুঁচকে গেল অগির। তোমার থিউরিতে একটু গণ্ডগোল আছে।

যেমন?

তুমি ধরেই নিয়েছ, ডায়ানাও কন্সপাইরেসি ক্লাবের সদস্য ছিল। কিন্তু ইয়ারবুকে ওর যে-ফটো আছে, সেটাতে রুপার কোনো পিন নেই।

 আমি আসলে তদন্ত এগিয়ে নেয়ার স্বার্থে ধরে নিয়েছি সেটা। ডায়ানাকে আসলে…সম্ভাব্য একজন সদস্য হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

আচ্ছা।

আপনি যদি চান এসব নিয়ে কথা না-বলি আমি তা হলে বরং…

ন্যাকামি কোরো না, ন্যাপ। আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার দরকার নেই। তোমার থিউরি নিয়ে কথা বলো।

মাথা ঝাঁকালাম। কন্সপাইরেসি ক্লাব। ছজন সম্ভাব্য সদস্য। তাদের মধ্যে লিও আর ডায়ানা…

 মরে গেছে, আমার মুখের কথা কেড়ে নিলেন অগি। রেক্সকে খুন করা হয়েছে। বাকি আছে মোরা; যে, রেক্সকে যখন খুন করা হয় তখন ঘটনাস্থলে ছিল। বাকি আছে আরও একজন…সেই কার্ডিয়োলোজিস্ট মেয়েটা…

বেথ ফ্লেচার ওরফে ল্যাশলি।

এবং হ্যাঙ্ক।

 এবং ওকে নিয়েই যত সমস্যা।

কেন?

একটু খেয়াল করুন। তিন সপ্তাহ আগে…রেক্সকে তখনও খুন করা হয়নি…হ্যাঙ্কের সেই ভাইরাল ভিডিওটা ছড়িয়ে দেয়া হলো ইন্টারনেটে। তারপর থেকে হ্যাঙ্ক লাপাত্তা। তারপর খুন করা হলো রেক্সকে। কেন যেন মনে হচ্ছে আমার, এসবের মধ্যে কোনো একটা যোগসূত্র আছে। কিন্তু সেটা ঠিক কী, ধরতে পারছি না।

খুঁতনি চুলকালেন অগি। একটা কথা বলি?

বলুন।

 তুমি বেশি বেশি অনুমান করছ।

আর আপনি কিছুই অনুমান করতে চাইছেন না, ঢিলের বদলে পাটকেল মারলাম।

জবাবে আগের চেয়েও বড় ঢিল আশা করছিলাম, কিন্তু কেন যেন হেসে ফেললেন অগি। তোমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে তার মুখে ঘুসি মারতাম আমি।

কেন?

এসব নিয়ে যতবার আলোচনা করছ তুমি আমার সঙ্গে, লিও আর ডায়ানাকে দিয়ে কথা শুরু করছ। কিন্তু তুমি আসলে এই কেসের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছ শুধু মোরার জন্য। ঠিক না?

জবাব দিলাম না।

তুমি এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে চাইছ, কারণ তোমার কিছু একটা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। যদি সমাধান করতে পারো এই রহস্যের, যদি শেষপর্যন্ত খুঁজে বের করতে পারো মোরাকে, হয়তো পুনর্মিলন হবে তোমাদের। কিন্তু আমি কী পাবো? যে-কবরস্থানে পচে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে আমার মৃত-মেয়ে, সেখান থেকে কি জ্যান্ত বেরিয়ে আসবে সে?

জবাব দিলাম না, দিতে পারলাম না আসলে-কন্ডে ডেভেলপমেন্টের দরজায় পৌঁছে গেছি আমরা। আবেগ নামের জটিল সমস্যাটা দূরে সরিয়ে রাখতে হবে এখন। কাজে মনোযোগ দিতে হবে।

হাতে লাঠিজাতীয় কিছু একটা নিয়ে একজন গার্ড দাঁড়িয়ে আছে কন্ডো ডেভেলপমেন্টের দরজায়। আমার ব্যাজটা দেখালাম ওকে। মিস্টার টম স্ট্রাউডের সঙ্গে দেখা করতে চাই আমরা।

হাতে নিয়ে ব্যাজটা দেখল লোকটা কিছুক্ষণ, তারপর ফিরিয়ে দিল। মিস্টার স্ট্রাউডের সঙ্গে কি দেখা করার কথা আছে আপনাদের?

না।

তা হলে…কিছু মনে করবেন না…আমি বরং যোগাযোগ করি তাঁর। সঙ্গে। বুঝতেই পারছেন…নিয়ম আর কী।

অগির দিকে তাকালাম। মাথা ঝাঁকালেন তিনি।

সমস্যা নেই, বললাম আমি।

ইন্টারকমে কথা বলল গার্ড, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, টেনিসকোর্ট ছাড়িয়ে হাতের বাঁ দিকের দ্বিতীয় মোচড় ধরে এগোবেন। একটা পার্কিং-পাস লাগিয়ে দিল সে আমার গাড়ির উইন্ডশিল্ডে।

ওকে ধন্যবাদ দিয়ে গাড়ি আগে বাড়ালাম।

জায়গামতো যখন পার্ক করছি গাড়িটা, তখন দেখি নিজের বাড়ির খোলা-দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন টম স্ট্রাউড।

চেহারা দেখলেই বোঝা যায়, তিনি হ্যাঙ্কের বাবা। কিন্তু তিনি যে এত বুড়িয়ে গেছেন, ভাবতে পারিনি। তবে হ্যাঙ্কের চেয়ে অনেক ভালো তার পোশাক। নিখুঁতভাবে শেভও করেছেন। তার ছেলেকে দেখায় নোংরা, আর তাকে দেখাচ্ছে পরিপাটি। হ্যাঙ্কের চুল খাড়া খাড়া, ওদিকে চুল বলতে যা কিছু আছে ওর বাবার মাথায় সেগুলো সুন্দর করে আঁচড়িয়ে রেখেছেন তিনি।

গাড়ির দরজা খুলে যখন নামছি, দেখতে পেলাম, অস্থিরতার কারণে হাত মোচড়ামোচড়ি করছেন মিস্টার স্ট্রাউড, এবং তার শরীরটা অল্প অল্প কাঁপছে। অগির দিকে তাকালাম। তিনিও খেয়াল করেছেন ব্যাপারটা।

 আমাদের কাছ থেকে খারাপ কোনো খবর আশা করছেন মিস্টার স্ট্রাউড।

ওই জাতের খবর আগেও অনেকবার দিতে হয়েছে আমাকে। এবং পেতে হয়েছে।

টলমল ভঙ্গিতে এক পা আগে বাড়লেন টম স্ট্রাউড। অগি?

অগি আর মিস্টার স্ট্রাউডের মধ্যে একসময় গভীর-বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। ডায়ানার মৃত্যুর পর আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে আসে সেটা।

হ্যাঙ্ককে খুঁজছি আমরা, বললেন অগি, কিন্তু কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না ওকে। সেজন্যই এসেছি।

 স্বস্তির ছাপ দেখা গেল মিস্টার স্ট্রাউডের চেহারায়। ছেলে মারা গেছে। শোনার চেয়ে ছেলে-হারিয়ে-গেছে শোনাটা বোধহয় কম কষ্টের।

আমাকে পাত্তা না দিয়ে পুরনো বন্ধুর দিকে এগিয়ে এলেন মিস্টার স্ট্রাউড, দুহাত প্রসারিত করে দিয়েছেন দুদিকে। জড়িয়ে ধরলেন তিনি অগিকে। কুঁচকে উঠল অগির চোখমুখ-পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে গেছে হয়তো, কিন্তু সামলে নিলেন নিজেকে।

তোমাকে দেখে ভালো লাগল, অগি, বললেন মিস্টার স্ট্রাউড।

আমারও, টম। বন্ধুর বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলেন অগি। হ্যাঙ্ক কোথায়, জানো নাকি?

মাথা নাড়লেন মিস্টার স্ট্রাউড। ভিতরে এসো।

.

কফি বানিয়ে আমাদেরকে দিলেন টম স্ট্রাউড।

 চুমুক দিলাম কাপে। চমৎকার হয়েছে।

কিচেনেই বসেছি আমরা। একটা টুলে বসেছি আমি, অগিও তা-ই। দাঁড়িয়ে আছেন মিস্টার স্ট্রাউড, জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছেন বাইরে।

একসময় মুখ ঘুরালেন তিনি আমাদের দিকে। ডরিস…মানে হ্যাঙ্কের মার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল আমার। তখন হ্যাঙ্কের বয়স দশ। আমি আর ডরিস ছিলাম সমবয়সী। আমাদের বয়স যখন পনেরো, তখন থেকে ডেটিং শুরু করি আমরা। কলেজে পড়া অবস্থায় বিয়ে হয় আমাদের। যা-হোক, বাবার ব্যবসায় যোগ দিতে হয়েছিল বলে বেশিদূর পড়াশোনা করতে পারিনি আমি। পেরেক আর হুক বানানোর একটা কারখানা ছিল তার। তিন পুরুষ ধরে চলেছে ব্যবসাটা, আমার মাধ্যমে শেষ হয়েছে। কারখানাটা ছিল নিউআর্কে।

অগির দিকে তাকালাম আমি। চুপ করে আছেন তিনি, তাকিয়ে আছেন পুরনো বন্ধুর দিকে, মনোযোগী শ্রোতার ভূমিকা পালন করছেন। যেভাবে কথা বলছেন মিস্টার স্ট্রাউড, তাতে ব্যাঘাত ঘটাতে চাইছেন না।

আমিও কোনো ব্যাঘাত ঘটালাম না।

আমার বয়স যখন পঁয়ত্রিশ কি ছত্রিশ, ব্যবসার উপর থেকে মন উঠে গেল। কারণ কাজটা ভীষণ একঘেয়ে, তা ছাড়া টানা মন্দা চলছিল তখন। অথবা, হতে পারে, বুড়ো হওয়ার আগেই বুড়িয়ে গিয়েছিলাম আমি। সেটার প্রভাব পড়ল আমার বৈবাহিক জীবনে। ডরিসের সঙ্গে আমার তিক্ততা বাড়তে বাড়তে একসময় ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। হ্যাঙ্ক তখন অতশত বোঝে না, ওর চোখে আমার দোষটাই ধরা পড়ল বেশি, আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করল সে তাই। চলে গেলাম অনেক দূরে, নতুন একটা ব্যবসা শুরু করলাম। মাঝেমধ্যে আসতাম-হ্যাঙ্ককে দেখতে। কিন্তু আমাকে দেখামাত্র চেহারা গম্ভীর করে ফেলত সে।

একটু নড়েচড়ে বসলাম আমি।

গোদের উপর বিষফোঁড়া নিয়ে কে বেঁচে থাকতে চায়? তাই আবার বিয়ে করে ফেললাম। কিন্তু বেশিদিন টিকল না সেটাও। মেয়েটা আমাকে ছেড়ে চলে গেল। কোনো বাচ্চাকাচ্চা হয়নি ওই ঘরে, আমিও কোনো সন্তান চাইনি ওই মেয়ের গর্ভে।

ফিরে এলে কেন?

কারণ একদিন হঠাৎ করেই আমাকে ফোন করল ডরিস। বলল, ওর ক্যান্সার হয়েছে, দেখাশোনা করার মতো কেউ নেই। অশ্রু দেখা দিয়েছে মিস্টার স্ট্রাউডের চোখে।

ছলছল করছে অগির চোখও।

বিশ্বাস করো, বলছেন মিস্টার স্ট্রাউড, ফিরে আসার পর আর একদিনও ঝগড়া হয়নি আমার আর ডরিসের মধ্যে। ফেলে-আসা দিনগুলো নিয়ে কখনও কথা বলতাম না আমরা। কার দোষ ছিল, কী করলে ভালো হতো…কিছু না। শুধু একসঙ্গে থাকতাম। কোনো মানে নেই, তারপরও একসঙ্গে থাকতাম। …ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ একা থাকতে পারে না, কাজেই একজন ক্যান্সার রোগীর কথা বলা বাতুলতা।

অগি কোনো মন্তব্য করলেন না। চুপ করে আছি আমিও।

 ছয় মাস একসঙ্গে ছিলাম আমরা। কারণ ক্যান্সার ধরা পড়ার পর ওই ছটা মাসই বেঁচে ছিল ডরিস। যখন মারা যায় বেচারী, আমি আর হ্যাঙ্ক ওর পাশেই ছিলাম। …একদিক দিয়ে সৌভাগ্যবতী সে–শেষনিঃশ্বাসের সময় পাশে পেয়েছে ছাড়াছাড়ি-হয়ে-যাওয়া স্বামীকে, পাশে পেয়েছে একমাত্র সন্তানকে। ওই সৌভাগ্য কজনের হয়? এগিয়ে এসে আরেকটা টুলে বসে পড়লেন মিস্টার স্ট্রাউড। তোমাকে খবর দেয়া উচিত ছিল আমার, অগি। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক দিতে পারিনি।

খাঁকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করলেন অগি। ঠিক আছে।

ডরিস মারা যাওয়ার পর কখনও কখনও ভেবেছি, বিক্রি করে দেবো এই বাড়ি, একটা ট্রাস্ট গঠন করে টাকাটা রেখে দেবো হ্যাঙ্কের নামে। কিন্তু সেটাও আর করা হয়নি। কারণ, খেয়াল করে দেখেছি, যখনই কন্ডো ডেভেলপমেন্টের এই এলাকায় ঢোকে হ্যাঙ্ক, সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে যায়। ওকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি আমি অনেকবার। কখনও কখনও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক আচরণ করে সে। তখন বুঝে উঠতে পারি না, কোন্ ডাক্তারের কাছে যাবো, গিয়ে কী বলবো। প্রথমবারের মতো আমার দিকে তাকালেন মিস্টার স্ট্রাউড। তুমি কি হ্যাঙ্কের স্কুলজীবনের বন্ধু?

হ্যাঁ।

 তা হলে তো জানোই…হ্যাঙ্ক অসুস্থ।

ওর সঙ্গে শেষ কবে দেখা হয়েছে আপনার?

 কয়েক সপ্তাহ আগে।

কয়েক সপ্তাহ আগে? এই কদিন ওকে না দেখে দুশ্চিন্তা হয়নি আপনার?

হয়েছে, আবার হয়নি।

মানে?

মানে, আমি জানি না হ্যাঙ্ককে নিয়ে দুশ্চিন্তা হলে কী করতে হবে। পুলিশের কাছে যাবো? গিয়ে কী বলবো? নিখোঁজ হয়ে গেছে আমার ছেলে…মাথায় সমস্যা আছে ওর? ও-রকম কারও জন্য পুলিশই বা কী করতে পারবে? তা ছাড়া হঠাৎ-হঠাৎ লাপাত্তা আগেও হয়েছে হ্যাঙ্ক।

সে কি কোনো ভিডিও দেখিয়েছে আপনাকে?

কীসের ভিডিও?।

মোবাইল ফোন হাতে নিলাম আমি, ইন্টারনেটে ঢুকে বের করলাম ভিডিওটা। দেখালাম মিস্টার স্ট্রাউডকে।

পুরোটা দেখা শেষ করে দুহাত দিয়ে চেহারা ঢাকলেন তিনি। মাই গড়…ওটা কে পোস্ট করেছে?

জানি না।

 আমি কি…মিসিং পার্সন হিসেবে রিপোর্ট করতে পারি হ্যাঙ্কের নাম?

পারেন।

অগির দিকে তাকালেন মিস্টার স্ট্রাউড়। সাহায্য করো আমাকে খুঁজে বের করো আমার ছেলেকে।

আস্তে আস্তে মাথা ঝাঁকালেন অগি। সর্বাত্মক চেষ্টা করবো।

মিসেস ডরিস তার ছেলের জন্য একটা ঘর ছেড়ে দিয়েছিলেন, আমরা চলে আসার আগে আমাদেরকে সেখানে নিয়ে গেলেন মিস্টার স্ট্রাউড।

আশ্চর্যের ব্যাপার কী, জানো? বললেন তিনি। ছেলেটা কখনও থাকেনি এখানে। আমি ফিরে আসার পর কখনও এই ঘরে ঢুকেছে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ আছে।

একটা ঘর দীর্ঘদিন বদ্ধ অবস্থায় থাকলে একরকমের বাজে গন্ধ পাওয়া যায়, ওই ঘরের দরজা খোলামাত্র সে-রকম একটা গন্ধ যেন বাড়ি মারল আমার নাকে। ভিতরে ঢোকামাত্র মুখোমুখি দেয়ালটার উপর নজর পড়ল আমার, সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম অগির দিকে তাঁর প্রতিক্রিয়া দেখতে চাইছি।

একটা কম্বল ঝুলিয়ে যদি ঢেকে দেয়া হতে দেয়ালটা, অনেকগুলো সাদা-কালো ফটো যেন সেভাবে ঢেকে রেখেছে ওটাকে। আরও আছে নিউজপেপার ক্লিপিংস, এবং ওই মিসাইল ঘাঁটি যখন চালু ছিল তখন উপর থেকে-তোলা ওটার কিছু ফটো।

হ্যাঙ্কের ঘরের বিশেষ সেই দেয়ালের প্রতিটা ইঞ্চিতে যেন লেপ্টে আছে রহস্যময় ওই সামরিক ঘাঁটি।

দীর্ঘদিন ধূমপান করলে একজন ধূমপায়ীর দাঁতে যে-রকম হলুদাভ দাগ পড়ে, অনেকটা সে-রকম হলুদ হয়ে গেছে নিউজপেপার ক্লিপিংগুলো। মলিন হয়ে গেছে প্রায় সব ফটো, আঠা শুকিয়ে গিয়ে দেয়াল থেকে খসে পড়ার মতো অবস্থা হয়েছে কোনো কোনোটার। ফটোশুটিং-এর সময় অনুযায়ী বিবেচনা করলে বেশি-পুরনো-নয় এ-রকম ছবি খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু সে-রকম কিছু নজরে পড়ল না।

আমাদের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করেছেন মিস্টর স্ট্রাউড। বললেন, হ্যাঁ, একসময় ওই মিসাইল ঘাঁটির প্রতি মোহ ছিল হ্যাঙ্কের।

আবারও তাকালাম অগির দিকে।

নিস্পৃহ একটা ভাব ফুটে আছে তার চেহারায়।

এবার তাকালাম মিস্টার স্ট্রাউডের দিকে। হ্যাঙ্ক কি ওই ঘাঁটির ব্যাপারে কখনও কিছু বলেছে আপনাকে?

কী বলবে?

অনিশ্চিত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকালাম। যে-কোনোকিছু?

কিছু যদি বলেও থাকে সে, আমার মনে নেই। কারণ যা বলেছিল, তার কোনো মানে বুঝতে পারিনি আমি।

যেমন?

অগির দিকে তাকালেন মিস্টার স্ট্রাউড। হ্যাঙ্কের নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে কি ওই ঘাঁটির কোনো যোগসূত্র আছে?

না, বললেন অগি।

আবার আমার দিকে তাকালেন টম স্ট্রাউড। ওই ঘাঁটির ব্যাপারে ভাষণ-দেয়ার-কায়দায় কী যেন বলত হ্যাঙ্ক মাঝেমধ্যে। যেহেতু সে অসুস্থ, ওর সেসব ভাষণের কোনো গুরুত্ব দিইনি কখনও।

কী বলত?

 সেখানে গোপন কী-সব যেন লুকানো আছে, যারা পাহারা দিচ্ছে ওই ঘাঁটি তারা খুব খারাপ, মানুষের মন নিয়ে নাকি খুবই গোপন আর সাংঘাতিক কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছে তারা…ইত্যাদি ইত্যাদি। তিতা একটা হাসি দেখা দিল মিস্টার স্ট্রাউডের চেহারায়। হ্যাঙ্কের ওসব ভাষণ শুনে কখনও কখনও মজা লাগত আমার।

তারপর? আলোচনাটা ধরে রাখতে চাইলাম আমি।

 কাঁধ ঝাঁকালেন মিস্টার স্ট্রাউড। ডরিস মাঝেমধ্যে ঠাট্টা করে বলত, হ্যাঙ্ক যা বলছে ঠিকই বলছে–হয়তো আসলেই কোনো গোপন ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে ওই ঘাঁটিতে, লোকচক্ষুর অন্তরালে আজব কোনো পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে সেখানে। আরও বলত, হ্যাঙ্ক ছোট থেকে মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল না। যেহেতু সে ওই ঘাঁটির আশপাশে ঘুরঘুর করত, ওখানকার লোকেরা হয়তো একদিন জোর করে ধরে নিয়ে যায় ওকে, কিছু একটা করে দেয় ওর মস্তিষ্কে, তারপর থেকে অসুস্থ হয়ে গেছে সে।

ঘরের ভিতরে নীরবতা।

দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়ে হেসে ফেললেন টম, নীরবতা ভাঙল তাতে। ডরিস আসলেই ঠাট্টা করে বলেছিল কথাগুলো। মানসিক অসুস্থতা সবারই কমবেশি আছে। যাদেরটা চোখে পড়ে, তাদেরকে পাগল বলি আমরা। আবার, একটা মানুষ কিন্তু যে-কোনো বয়সে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। কাজেই ডরিসের কথাও তেমন গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করিনি আমি।

.

১৪.

আমাদের সেই হাইস্কুলের বর্তমান প্রিন্সিপালের নাম ডেবোরাহ কেরেন। তাঁর সঙ্গে মোটামুটি খাতির আছে আমার। ফোন করলাম তাঁকে।

কেমন আছেন জিজ্ঞেস করামাত্র তিনি বললেন, আট মাস চলছে।

একটু থতমত খেয়ে গেলাম। আট মাস চলছে মানে কি তার গর্ভধারণের আট মাস চলছে?

জিজ্ঞেস করলাম কথাটা।

 জবাবে হ্যাঁ বললেন তিনি। আরও বললেন, শুরুতেই বললাম কথাটা, কারণ যাদের সঙ্গে কালেভদ্রে দেখা বা কথা হয় আমার, তারা আমার প্রেগন্যান্সির ব্যাপারটা শোনামাত্র বলে, ও মা, তা-ই নাকি? কতদিন হলো? ছেলে না মেয়ে? অতি রসিক কেউ আবার বলে, কীভাবে? এসব প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে অতীষ্ঠ হয়ে গেছি আমি। কিন্তু আমার যে কী অবস্থা, তা কারও চোখে পড়ে না। …একবার শুয়ে পড়লে আর উঠে বসতে পারি না, অন্যের সাহায্য লাগে। বসা অবস্থা থেকে দাঁড়াতে পারি না, অন্যের সাহায্য লাগে। খুব কষ্ট করে বাথরুম করতে হয়।

অভিনন্দন, বললাম আমি।

কী! আমার হয়েছে মরার দশা, আর আপনি অভিনন্দিত করছেন আমাকে?

পৃথিবীর সেরা পূর্ণতাটা পেতে যাচ্ছেন আপনি আর কিছুদিন পর। কাজেই অভিনন্দিত করবো না? …কাদামাটি দিয়ে একটা মূর্তি বানানোর চেষ্টা করে দেখুন কত কষ্ট লাগে। কিন্তু মূর্তিটা যখন বানিয়ে ফেলবেন, টের পাবেন কত খুশি লাগে। যখন বানাচ্ছিলেন মূর্তিটা, তখনকার কোনো কষ্টই আর মনে থাকবে না। …নিজের সুস্থসবল বাচ্চাকে যখন কোলে নেবেন, প্রেগন্যান্সি-পিরিয়ডের কোনো কষ্টই আর মনে থাকবে না আমার।

ধন্যবাদ। আপনার কথা শুনে ভালো লাগল।…কেন ফোন করেছেন?

হ্যাঙ্ক স্ট্রাউডের ব্যাপারে।

ইন্টারেস্টিং।

কেন বললেন কথাটা?

স্কুলের বাচ্চাদের অভিভাবকরা ওই লোকের ব্যাপারে নালিশ জানাতে জানাতে কান ঝালাপালা করে দিয়েছে।

বুঝলাম। কিন্তু…আমি পুলিশে চাকরি করি…আমাদের কাছে মিসিং পার্সন হিসেবে রিপোর্ট করা হয়েছে হ্যাঙ্কের নাম।

আমার ধারণা ভাইরাল ভিডিওর কারণে কোথাও পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে সে।

ভিডিওর ব্যাপারটা তা হলে জানেন আপনি?

 জানাটাই কি স্বাভাবিক না? আমার স্কুলে কী হচ্ছে না-হচ্ছে, সে-খবর রাখার দায়িত্ব তো আমারই। তা ছাড়া ওই ভিডিওর ব্যাপারটা এ-কদিনে জেনে গেছে আমেরিকার অর্ধেক মানুষ।

আচ্ছা, আপনি কি কখনও দেখেছেন, নিজের জামাকাপড় খুলে সবকিছু দেখাচ্ছে হ্যাঙ্ক?

যদি সেরকম কিছু দেখতাম, আপনাদেরকে কি খবর দিতাম না?

 তারমানে দেখেননি?

 না।

কী মনে হয় আপনারও-রকম কোনো কাজ কি সত্যিই করেছে সে?

আমার মনে হওয়া না-হওয়ায় কিছু যায়-আসে না। আমি তাঁকে বিপজ্জনক বলে মনে করি না, অথচ কখনও চাই না তাঁর মুখোমুখি হতে। এমনকী, আমার স্কুলের কোনো ছাত্র বা ছাত্রী তাঁর সামনাসামনি পড়ক, সেটাও চাই না।

হ্যাঙ্কের সেই ভিডিও দেখেছেন আপনি?

 দেখেছি।

 ভিডিওটা কে করেছে, জানেন?

জানি…মানে অনুমানে বলতে পারবো, কিন্তু কোনো প্রমাণ দিতে পারবো না।

প্রমাণের দরকার নেই আমার।

দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ পাওয়া গেল। অষ্টম গ্রেডে একটা মেয়ে পড়ে, নাম মারিয়া হ্যানসন। আপনি ইচ্ছা করলে যোগাযোগ করতে পারেন আমার সেক্রেটারির সঙ্গে, ওই মেয়ের ঠিকানা বলে দিতে পারবে সে। মারিয়ার মা মাঝেমধ্যেই আসেন আমার কাছে। এবং যখনই আসেন, তখনই নালিশ জানান হ্যাঙ্কের বিরুদ্ধে। আমি তাকে বেশ কয়েকবার বলেছি, হ্যাঙ্ক যতক্ষণ পর্যন্ত আইনবিরোধী কোনোকিছু না করছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে আইনি প্রতিকার চাওয়া যাবে না। আমার ওই কথা শুনে প্রতিবারই চেহারা কালো করে ফেলেছেন তিনি।

ঠিক আছে। আপনার সেক্রেটারিকে একটু ডাকুন তা হলে। মারিয়া হ্যানসনের ঠিকানাটা জেনে নিই তাঁর কাছ থেকে। …মেয়েটার মার নাম কী?

সুযান হ্যানসন।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *