০৫. বারটেন্ডারের নাম হ্যাল

০৫.

বারটেন্ডারের নাম হ্যাল। ল্যারি অ্যান্ড ক্রেইগস বার অ্যান্ড গ্রিল-এ কাজ করে সে। বিষণ্ণ ও ব্যাকুল একটা ভাব ফুটে আছে তার চেহারায়।

মেয়েটা ছিল সাংঘাতিক সেক্সি, বলল সে। অন্তত ওই বুড়োর জন্য।

নামে যদিও বার অ্যান্ড গ্রিল, কিন্তু ল্যারি অ্যান্ড ক্রেইগস-এ বার আছে, গ্রিল নেই। বারের মেঝে কেমন তেলতেলে। কাঠের গুঁড়োর সঙ্গে চীনাবাদামের খোসা মিশিয়ে বানানো মণ্ডের প্রলেপ দেয়া আছে সারা মেঝেতে।

আমার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকালেন রেনল্ডস। অর্থাৎ, জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়ে যাওয়ার ইশারা করলেন।

ওই মেয়ে দেখতে কেমন ছিল? জানতে চাইলাম।

কেমন ছিল মানে?

 লালচুলো, বাদামি-চামড়ার, নাকি সাদা-চুলের?

বাদামি চামড়ার।

আর কিছু?

আর কিছু মানে?

ওর সঙ্গের লোকটা কেমন ছিল? জিজ্ঞেস করলেন রেনল্ডস।

কাকের মুখে কমলা যেমন, ওই লোকের সঙ্গে ওই মেয়েও তেমন।

 ওরা কি একসঙ্গে এসেছিল বারে? জানতে চাইলাম আমি।

না।

আগে কে এসেছিল?

বুড়োটা। আমি যেখানে বসে আছি, ইঙ্গিতে সে-জায়গা দেখিয়ে দিল হ্যাল। ওখানেই বসে ছিল।

লোকটা দেখতে কেমন ছিল?

বয়স সম্ভবত সত্তর। মাথায় লম্বা চুল। গালে এলোমেলো দাড়ি। নাকটা বেশ বড়। ওকে দেখলে মনে পড়ে যায় শুয়োরের কথা। কিন্তু ধূসর স্যুট, সাদা শার্ট আর নীল টাই পরে ছিল সে-রাতে।

লোকটার কথা তো ভালোই মনে আছে। মেয়েটার কথা কি কিছুই মনে নেই?

সে-রাতে যে-কালো পোশাক পরেছিল ওই মেয়ে, তা যদি দেখতেন, অন্যকিছু মনে রাখার কথা আপনার মাথায় আসত না।

তারমানে, অসহিষ্ণু কণ্ঠে বললেন রেনল্ডস, এখানে বসে ড্রিঙ্ক করছিল লোকটা। তারপর একসময় বারে ঢোকে মেয়েটা, এগিয়ে আসে ওই লোকের দিকে।…মেয়েটার কতক্ষণ আগে বারে ঢুকেছিল ওই লোক?

ঠিক জানি না। বিশ-ত্রিশ মিনিট হবে হয়তো।

এখানে এসে কী করল মেয়েটা?

 খারাপ মেয়েরা যা করে, তা-ই। …বুঝতে পেরেছেন আমার কথা?

পেরেছি, বললাম আমি। কী মনে হয় আপনার মেয়েটার সঙ্গে পূর্বপরিচয় ছিল লোকটার?

মনে হয় না।

কেন?

যেহেতু জানতে চাইছেন সেহেতু সোজাসুজিই বলি…মেয়েটাকে কলগার্ল বা বেশ্যা বলে মনে হয়েছে আমার। বারে মদ খেতে-আসা নিঃসঙ্গ পুরুষদের কাছে নিজেদের শরীর বিক্রি করার জন্য ও-রকম মেয়ে হরহামেশাই আসে বিভিন্ন বারে।

এই বারেও আসে?

কাঁধ ঝাঁকাল হ্যাল, বোঝা যাচ্ছে উপযুপরি প্রশ্নে ক্লান্তি বোধ করছে সে। এই বারের এক মাইলের মধ্যে দুটো স্ট্রিপক্লাব আছে। খদ্দেরের খোঁজে ওখান থেকেও মেয়েরা আসে মাঝেমধ্যে।

সবজান্তার ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালাম আমি। ওই মেয়েকে আগে কখনও দেখেছেন আপনি?

দেখেছি। দুবার।

এই বারে?

 হ্যাঁ।

কী করছিল?

সরাসরি বলবো?

 হ্যাঁ।

ওই বুড়োর মতো দুজন খদ্দের জুটিয়ে নিয়ে চলে গেছে।

আমার মনে হচ্ছে, গলার কাছে কিছু একটা শক্ত হয়ে আটকে গেছে। বেশ কয়েকবারের চেষ্টায় ঢোক গিলতে পারলাম।

খুঁতনি চুলকাল হ্যাল। একটা কথা বলি?

মাথা ঝাঁকালাম।

ওই মেয়ে বেশ্যা না-ও হতে পারে।

কথাটা কেন মনে হলো আপনার?

জানি না। কিন্তু মনে হলো। আসলে…হতে পারে…ওই মেয়ে বেশ্যার ভূমিকায় অভিনয় করছিল।

কেন অভিনয় করবে সে?

 জানি না। আমার মনে হলো কথাটা, তাই বললাম।

 মেঝেতে পা ঠুকলেন রেনল্ডস। ভিডিও রেকর্ড দেখান।

টিভিটা পুরনো মডেলের। ওটাকে বারের উপর বসিয়ে রেখেছে হ্যাল। আমাদের কথা বাদ দিয়ে বললে দুজন খদ্দের আছে বারে। কিন্তু দুজনই ডুবে আছে মদের গ্লাসে, দুনিয়ার কোনোকিছুতেই আগ্রহ নেই ওদের।

সুইচ টিপে টিভি চালু করে দিল হ্যাল। তারপর চালু করল ভিসিআর।

ভিডিও কোয়ালিটি খুবই খারাপ। কেমন হলুদাভ একটা আভা ছড়িয়ে পড়েছে সারা স্ক্রীনে। ক্যামেরার ফোকাস নির্দিষ্ট কোনোকিছুর উপর আছে বলে মনে হচ্ছে না।

অনেক উঁচু থেকে দেখা যাচ্ছে পার্কিংলটটা। রঙের তারতম্য দেখে বুঝে নিতে হচ্ছে কোটা রাস্তা আর কোনটা গাড়ি। লাইসেন্স প্লেট দেখা যাচ্ছে না কোনো গাড়ির।

স্ক্রীনের উপরের দিকের ডান কোনা স্পর্শ করল হ্যাল। আমাদের ধারণা, এটাই সেই ভাড়া-করা গাড়ি।

মাথা ঝাঁকালাম আমি। ফাস্ট ফরওয়ার্ড করে দিন।

কথামতো কাজ করল হ্যাল।

 থামুন! কিছুক্ষণ পর বললাম আমি।

দুটো মানুষ…বলা ভালো, দুজন মানুষের দেহাবয়ব দেখা যাচ্ছে এখন। বার থেকে এইমাত্র বের হয়েছে তারা। ক্যামেরার দিকে উল্টো ঘুরে আছে।

ধীর পায়ে হেঁটে একটা পার্ক-করা গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে একটা মেয়ে।

নিজের হৃৎস্পন্দন টের পাচ্ছি আমি। খুবই পরিচিত মনে হচ্ছে ওই পদক্ষেপ।

মনে পড়ে যাচ্ছে সেদিনের কথা, যেদিন প্রথমবার দেখেছিলাম ওই পদক্ষেপ।

একটা গান খুব পছন্দ করতেন বাবা। সে-গানের একটা লাইন ছিল এ রকম:

I like her better when she walks away.

.

কিন্তু মোরা যখন এগিয়ে আসত আমার দিকে, তখন মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগত আমার। কাঁধ দুটো কিছুটা পেছনের দিকে ঝুঁকিয়ে মোহিনি ভঙ্গিতে হাঁটত সে।

আমি আর আমার ভাই লিও প্রায় একই সময়ে প্রেমে পড়ি। ক্যাপ্টেন অগির মেয়ে ডায়ানা স্টাইলসকে ভালোবেসে ফেলে আমার ভাই। আর আমি…থাক, আমার প্রেমের কথা নতুন করে বলতে চাই না।

আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন রেনল্ডস বললেন, কিছু বুঝতে পারলেন?

 খুব সম্ভব মোরা, নিচু গলায় বললাম কথাটা; নিজের অজান্তেই চাইছি, কেউ যেন শুনে না ফেলে।

আপনি নিশ্চিত?

জবাব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম না। তাকিয়ে আছি। ভিডিওফুটেজের দিকে।

 ধূসর চুলের লোকটা গাড়ির দরজা খুলে ধরেছে। অনেকটা যেন পিছলে প্যাসেঞ্জার সিটে উঠে পড়ল মোরা। গাড়ির পেছনদিকটা ঘুরে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে উঠল ওই লোক। ব্যাক গিয়ার দিল সে। পার্কিংলট থেকে একসময় বেরিয়ে গেল গাড়িটা। এখন আর দেখা যাচ্ছে না ওটাকে।

কত রাউন্ড মদ খেয়েছিল ওরা? জিজ্ঞেস করলাম হ্যালকে।

গুনিনি। তবে ভালোই খেয়েছিল। …আরেকটা কথা। ওই মেয়ের নাম মোরা না। অন্য একটা নাম ব্যবহার করছিল সে।

কী নাম? জানতে চাইলেন রেনল্ডস।

 ডেইজি।

আমার দিকে তাকালেন রেনল্ডস।

মুখ ফিরিয়ে নিলাম আমি। খারাপ লাগছে।

আপনি ঠিক আছেন? আমাকে জিজ্ঞেস করলেন রেনল্ডস।

কীভাবে ঠিক থাকি? যে-মেয়েকে একসময় পাগলের মতো ভালোবেসেছি, অবচেতন মনে পাগলের মতোই যে-মেয়ের পথ চেয়ে আছি গত পনেরোটা বছর, আজ শুনতে হচ্ছে, সে হয় একজন বেশ্যা নয়তো বেশ্যার ভূমিকায় অভিনয় করে। আজ শুনতে হচ্ছে, নিজের নাম বদল করে উত্তেজক পোশাক পরে সে-মেয়ে হাজির হয়েছিল এই বারে, তারপর একজন অচেনা পুরুষকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেছে ভাড়া-করা একটা গাড়িতে করে।

উঠে দাঁড়ালাম আমি, বিড়বিড় করে ধন্যবাদ দিলাম হ্যালকে, চটজলদি বেরিয়ে এলাম বারের বাইরে। দ্রুত পায়ে হাজির হলাম পার্কিংলটে। তাজা বাতাস না-হলে আর চলছে না।

কিন্তু একটা গোয়েন্দাসত্তা আছে আমার ভিতরে, এবং সেটা সম্ভবত আমার প্রেমিকসত্তা থেকে শক্তিশালী। তাই নিজেকে সামলে নিতে সময় লাগল না। ঠিক যেখানে পার্ক করে রাখা হয়েছিল ভাড়া-করা গাড়িটা, তাকালাম সেদিকে।

পেছনে কারও পদশব্দ শুনতে পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম।

 রেনল্ডস।

কোনো থিউরি? জানতে চাইলেন তিনি।

লোকটা মোরার জন্য গাড়ির দরজা খুলে দিয়েছিল। তারপর ঠিকমতো হেঁটে গিয়ে উঠেছে ড্রাইভিং সিটে।

তো?

 একটুও টলমল করছিল না সে। চাবি দিয়ে দরজার লক খুলতে সময়। লাগেনি ওর, তারমানে অনুমান করা যায় হাত কাঁপেনি। এমনকী, একজন মেয়েমানুষের সঙ্গে দ্র আচরণ করতে হয় কী করে, তা-ও ভোলেনি।

তো?

সে কীভাবে গাড়ি চালিয়ে চলে গেল, দেখেছেন?

দেখেছি।

হঠাৎ করে গতি বদল করেনি, আচমকা ব্রেক কষেনি।

আপনার কথার মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছি না।

 হাঁটতে শুরু করলাম আমি।

আমার পিছু নিলেন রেনল্ডস। কোথায় যাচ্ছেন?

 হাঁটা থামালাম না।

হত্যাকাণ্ডটা যেখানে সংঘটিত হয়েছে, সে-জায়গায় পৌঁছাতে পাঁচ মিনিটের বেশি লাগল না আমাদের।

জায়গামতো পৌঁছে ঘুরে তাকালাম বারের দিকে। তারপর তাকালাম যেখানে লুটিয়ে পড়েছিল রেক্স, সেদিকে।

এখন পর্যন্ত তেমন কিছু বুঝতে পারিনি আমি। কিন্তু এটা টের পাচ্ছি, কিছু একটা খেলা করছে আমার মগজে। যেন কোনো একটা মাছ ধরতে গিয়েও ধরতে পারছি না, অথচ জানি, একসময়-না-একসময় ঠিকই ধরা পড়বে মাছটা। যেন কোনো একটা গন্তব্য কাছিয়ে আসছে।

রেক্স খুব জলদি ধরে ফেলেছিল তথাকথিত মিলারকে, বললাম আমি।

হয়তো বারের কাছেই কোথাও অপেক্ষা করছিল সে।

আপনার সঙ্গে একটা বাজি ধরতে চাই আমি।

ভ্রু কুঁচকে গেল রেনল্ডসের।

অনেকক্ষণ সময় নিয়ে দেখবো বারের ভিডিও ফুটেজ, বলে চললাম। বাজি ধরলাম, একাধিক মাতালকে টলমল পায়ে বেরিয়ে যেতে দেখবো আমরা। দেখবো, মাতাল অবস্থায় গাড়ি নিয়ে পার্কিংলট ছেড়েছে ওদের অনেকে।

তো?

আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ওদের কাউকে কেন ধরল না রেক্স?

অনিশ্চিত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকালেন রেনল্ডস। হয়তো…ওই লোকগুলোর গাড়ির নম্বরপ্লেট লোকাল ছিল। আর তথাকথিত মিলারের গাড়িটা ছিল ভাড়া-করা।

 পুরো ব্যাপারটা একটু বেশি কাকতালীয় মনে হচ্ছে আমার কাছে। ভাড়া-করা একটা গাড়ি। অনেক মদ খাওয়ার পরও মাতাল না-হওয়া এক বুড়ো…মোরার মতো দশটা মেয়ে দেখলেও যার শারীরিক চাহিদা জাগার কথা না। সবচেয়ে বড় কথা, যে-লোক খুন হলো, সে একসময় মোরার সঙ্গে একই স্কুলে পড়ত।

জোরালো এক ঝলক বাতাস বয়ে গেল। রেনল্ডসের কিছু চুল উড়ে এসে পড়ল তার চেহারায়। সেগুলো সরিয়ে কানের পেছনে গুঁজে দিলেন তিনি। এর চেয়েও বড় কাকতালীয় ঘটনা দেখেছি আমি আমার ক্যারিয়ারে। শুনলে বিশ্বাস করতে চাইবেন না।

আমিও দেখেছি।

আর কিছু বললাম না। পুরো ঘটনাটা কল্পনা করার চেষ্টা করছি।

বার থেকে একসঙ্গে বের হলো মিলার আর মোরা…গাড়িতে উঠল ওরা…গাড়িটা কিছুদূর যেতে-না-যেতেই ওটা রেক্স থামাল গাড়িটা…

ন্যাপ?

খেয়াল করলাম, আমাকে ডুমাস ডাকেননি রেনল্ডস। বললেন, আরও একটা ভিডিওফুটেজ দেখানোর আছে আপনাকে।

.

০৬.

স্যাল’স রেন্ট-আ-ভেহিকেল এর ভিডিও ফুটেজের মান যথেষ্ট ভালো। চুপ করে বসে আছি আমি, বলতে গেলে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে দেখছি ওই ফুটেজ।

বেশিরভাগ সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয় উচতে, স্যালস-এর ক্যামেরাও ব্যতিক্রম না। সম্ভবত প্রত্যেক খারাপ লোকই জানে ব্যাপারটা, এবং জানে বলেই খুব সহজ একটা টেকনিক অবলম্বন করে ক্যামেরাকে ফাঁকি দেয়ার জন্য।

 যেমন, তথাকথিত মিলারকে দেখা যাচ্ছে, একটা বেসবল ক্যাপ পরে আছে, মিচু করে রেখেছে সেটা। শুধু ক্যাপই না, মাথাও নিচু করে রেখেছে সে। ফলে কোনো অ্যাঙ্গেল থেকেই ওর চেহারা পরিষ্কার দেখতে পাওয়ার উপায় নেই। দাড়ির একটুখানি আভাস পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। তবে সেটা আমার কল্পনাও হতে পারে। খোঁড়াচ্ছে সে…এটাও সম্ভবত অভিনয়।

লোকটা আসলে খোঁড়া না, মুখ খুললাম শেষপর্যন্ত।

রেনল্ডস কিছু বললেন না।

রেন্ট-আ-ভেহিকেল এর অফিস থেকে বাইরে এলাম আমরা।

রাত নেমেছে ইতোমধ্যে। ফুরফুরে বাতাস বয়ে যাচ্ছে, একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। দূরে সিগারেট ধরাল একটা লোক। মুখ উঁচু করে লম্বা লম্বা টান দিচ্ছে সে সিগারেটে। বাবাও একই কাজ করতেন। তিনি মারা যাওয়ার পর সিগারেট খাওয়া ধরেছিলাম আমি। বছরখানেক খেয়েছিলাম। তারপর, কেন যেন, ব্যাপারটা পাগলামি বলে মনে হয় আমার কাছে। কারণ, জানা থাকার পরও হঠাৎ করেই যেন উপলব্ধি করতে পারি, সারাটা জীবন তামাকপোড়া ধোঁয়া গিলে শেষদিকে এসে ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগে মারা গেছেন বাবা। যেটার ধোঁয়া গিললে পেট ভরে না, বরং ফুসফুস পচে, সেই বিষের শলাকা একদিন ছেড়ে দিই আমি হঠাৎ করেই। সেদিন কেন যেন। মোরার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল আমার। মোরাও একদিন আমাকে অনেকটা একইভাবে ছেড়ে দিয়েছিল।

আমার মনে হয় লোকটা বয়সের দিক দিয়েও ধোঁকা দিয়েছে, বললাম রেনল্ডসকে।

যেমন?

লোকটার লম্বা লম্বা চুল, এলোমেলো দাড়ি-সবই সম্ভবত নকল। এমন একাধিক অপরাধীকে চিনি আমি, যারা লোকের চোখে ধুলো দেয়ার জন্য বয়স্ক সেজেছিল। এতে সবচেয়ে বড় লাভ: লোকে আন্ডারএস্টিমেট করবে আপনাকে। …রেক্স যখন থামিয়েছিল তথাকথিত মিলারের গাড়ি, হয়তো ভেবেছিল, এই বুডোর ব্যাপারে সাবধান হয়ে আর কী করবো? সতর্কতায় ঢিল পড়াটাই ওর জন্য কাল হয়েছে হয়তো। …একটা কথা বলি?

বলুন।

আমার একটা যমজ ভাই ছিল।

কিছু বললেন না রেনল্ডস, আমার বাকি কথার জন্য অপেক্ষা করছেন।

ওর নাম ছিল লিও। ডায়ানা স্টাইলস নামের একজন গার্লফ্রেন্ড ছিল ওর। আমরা সবাই বড় হয়েছি ওয়েস্টব্রিজে…আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য যেখানে গিয়েছিলেন আপনারা।

শহরটা ছোট, কিন্তু সুন্দর।

মাথা ঝাঁকালাম। যে-সময়ের কথা বলছি, তখন ডায়ানার সঙ্গে নিয়মিত ডেটিং করছে লিও। একরাতে ওরা বাইরে গেল। আমি তখন শহরে ছিলাম না। হকি খেলার জন্য গিয়েছিলাম অন্য একটা শহরে।

নীরবতা।

তারপর কিছুক্ষণ পর বললেন রেনল্ডস।

তারপর শহরে ফিরে এসে শুনি, চলন্ত ট্রেনের নিচে একইসঙ্গে কাটা পড়েছে লিও আর ডায়ানা। সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় ওরা।

 হাঁ হয়ে গিয়েছিল রেনল্ডসের মুখ, একটা হাত তুলে মুখ চাপা দিলেন তিনি। কিছুক্ষণ পর হাত সরিয়ে বললেন, আমি খুবই দুঃখিত।

আমি কিছু বললাম না।

ওটা কি আসলেই দুর্ঘটনা? নাকি আত্মহত্যা?

কাঁধ ঝাঁকালাম। কেউ জানে না। অথবা…হয়তো শুধু আমি জানি না।

 আনুষ্ঠানিক কোনো তদন্ত হয়নি?

মাথা ঝাঁকালাম।

রিপোর্ট কী?

দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু। হাইস্কুল-পড়ুয়া একটা ছেলে আর একটা মেয়ে… দুজনের রক্তেই পাওয়া যায় মাত্রাতিরিক্ত মদ আর ডাগসের উপস্থিতি। …আমাদের শহরে রেললাইনের উপর দিয়ে হাঁটার বদভ্যাস আছে অনেকেরই। কেউ কেউ আবার বোকার মতো দুঃসাহসী কিছু কাজও করে। যেমন, একবার বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে চলন্ত ট্রেনের সামনে দিয়ে লাফিয়ে রেললাইনের একপাশ থেকে অন্যপাশে যেতে গিয়ে মারা যায় এক ছেলে।

 রেনল্ডস কিছু বললেন না।

 লিও আর ডায়ানার মৃত্যুতে ভেঙে পড়ে স্কুলের প্রায় সব ছেলেমেয়ে; সবাই মনে সাংঘাতিক চোট পেয়েছিল। ওই দুর্ঘটনা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল মিডিয়ার। আমাদের সমাজটা যে ঘুণেধরা, নতুন প্রজন্ম যে বিপথগামী ইত্যাদি প্রচার করছিল ওরা ফলাও করে।

আমাদের সমাজ আসলেই ঘুণেধরা এবং নতুন প্রজন্ম অবশ্যই বিপথগামী।

মন্তব্য করলাম না।

আপনার ভাই যখন ডেটিং করছিলেন ডায়ানার সঙ্গে, আপনিও কি তখন ডেটিং করছিলেন মোরার সঙ্গে?

মাথা ঝাঁকালাম।

ঠিক কখন পালিয়ে গেলেন মোরা?

দুর্ঘটনাটার পরই। …মোরার মা কথাপ্রসঙ্গে আমাকে একদিন বলেছিলেন, ওয়েস্টব্রিজের মতো বাজে কোনো শহরে থাকতে দিতে চান না তিনি তাঁর একমাত্র সন্তানকে। কারণ ওই শহরের স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েরা মদ খায়, ড্রাগস খায়, চলন্ত ট্রেনের সামনে স্টান্টবাজি করে।

তার কথা বিশ্বাস হয়নি আপনার, তাই না?

না।

আপনার ভাই আর তাঁর প্রেমিকা যে-রাতে মারা গেল, সে-রাতে কোথায় ছিলেন মোরা?

জানি না।

আমার দিকে এক কদম এগিয়ে এলেন রেনল্ডস। কী মনে হয় আপনার–লিও’র মৃত্যুর ব্যাপারে কিছু জানেন মোরা?

জবাব দিলাম না।

কী মনে হয় আপনার, ন্যাপ?

খুব সম্ভব।

.

০৭.

আমার একটা জীবন এবং একটা চাকরি আছে। কাজেই ওয়েস্টব্রিজে ফিরে আসার জন্য গাড়ি ভাড়া করতে হলো।

ফোন করে আপডেট জানতে চাইল এলি আমার কাছে। কিন্তু ক্লান্তির অজুহাত দিয়ে আমি বললাম, এখন বরং থাক। আগামীকাল সকালে ব্রেকফাস্ট করতে পারবে আমার সঙ্গে?

কোথায়?

আর্মস্ট্রং ডিনার-এ।

ঠিক আছে।

বন্ধ করে দিলাম সেলফোনটা, বন্ধ করলাম দুই চোখও। বাকিটা পথ। ঘুমালাম।

বাসার কাছে পৌঁছে গাড়ি থামাল ড্রাইভার, বিল চুকিয়ে দিলাম। বললাম, এখানেই কোথাও কাটিয়ে দিতে চাও নাকি আজকের রাতটা? সেক্ষেত্রে কোনো মোটেলে থাকার একরাতের খরচ দিতে পারি তোমাকে।

ধন্যবাদ, লাগবে না। আমাকে ফিরে যেতে হবে।

আরও কিছু বখশিস দিলাম লোকটাকে।

অন্য দশজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে তুলনা করলে ধনীই বলা যায় আমাকে। কারণ আমি আমার বাবার একমাত্র উত্তরাধিকারী। কেউ কেউ বলে, টাকাপয়সা নাকি নষ্টের গোড়া। আবার কেউ বলে, টাকা দিয়ে নাকি সুখ কেনা যায়। আসলে বলা উচিত ছিল, টাকা দিয়ে সুখ কিনতে গিয়েই যত নষ্টামির সূচনা হয়। যা-হোক, আমি বলি, টাকা ঠিক পথে খরচ করতে পারলে স্বাধীনতা কেনা যায়, জীবনের কাছ থেকে সময় কেনা যায়।

মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। ওয়েস্টব্রিজে ফেরার সময় যেহেতু ঘুমিয়েছি, ঘুম আসতে দেরি হবে। নিজের গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম তাই। গিয়ে হাজির হলাম ক্ল্যারা মাস মেডিকেল সেন্টারে। নিজের আই.ডি. কার্ড দেখিয়ে জেনে নিলাম কোন্ ফ্লোরে আছে ট্রে। ওর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখি, ঘুমিয়ে আছে সে। প্লাস্টারে বাঁধা অবস্থায় একটা রিং-এ ঝুলছে ওর ভাঙা পা।

একজন নার্স এগিয়ে এল আমার দিকে। এই সময়ে ভিজিটর অ্যালাউড না, স্যর।

আবারও দেখালাম নিজের আইডি কার্ড। তারপর ইশারায় দেখালাম ট্রে-কে। যে বা যারা হামলা চালিয়েছে ওই লোকের উপর, তাদেরকে ধরার ব্যাপারে তদন্ত করছি আমি।

কিন্তু…এখন অনেক রাত হয়ে গেছে, স্যর। তা ছাড়া পেশেন্টও ঘুমিয়ে গেছেন। তাঁকে জাগানো যাবে না এখন। প্লিজ।

মেনে নেয়ার ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকালাম আমি। কী অবস্থা ওর?

 অন্যের সাহায্য ছাড়া হেঁটেচলে বেড়াতে কমপক্ষে ছমাস লাগবে তার।

ঠিক এ-কথাটাই জানতে চেয়েছিলাম।

নার্সকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে এলাম বাসায়। শুয়ে পড়লাম বিছানায়, তাকিয়ে আছি ছাদের দিকে।

আমার মতো বয়সের অনেকেই বিয়ে করে বাচ্চাকাচ্চার বাবা হয়ে গেছে। কেউ আবার বিয়ে করেনি, চুটিয়ে লিভ-টুগেদার করছে। আমার মতো একজন ব্যাচেলরকে কীভাবে মেনে নিচ্ছে আমার প্রতিবেশীরা, ভাবলে মাঝেমধ্যে আশ্চর্য হই। তবে একই ব্যাপারে বার বার আশ্চর্য হওয়ার কারণে ওটাতে ধাতস্থ হয়ে গেছি।

মনে পড়ে গেল, হকি খেলতে গিয়েছিলাম আমি অন্য একটা শহরে।

আমাদের দলের নাম ছিল পারসিপানি হিলস। দুটো গোল করেছিলাম আমি নিজে। আর আমার পাসে আমার এক সহখেলোয়াড় গোল করেছিল আরও দুবার। আমাদের প্রতিপক্ষ গোল করেছিল তিনটা। আমার দ্বিতীয় গোলটা ছিল ম্যাচ-নির্ধারণী-ওটার কারণে ৪-৩ গোলে জিতে যাই আমরা।

 নীল দাগটা অতিক্রম করার আগেই পাক (আইসহকি খেলার জন্য ব্যবহৃত রাবারের চাকতি) ছিনিয়ে নিই আমি প্রতিপক্ষের এক খেলোয়াড়ের কাছ থেকে, বা দিক দিয়ে বলতে গেলে, উড়াল দিই প্রতিপক্ষের গোলকিপারের দিকে, সাবলীল কায়দায় ধোঁকা দিই তাকে, তার কাঁধের উপর দিয়ে জালে জড়িয়ে দিই পাকটা।

 খুশিতে ফেটে পড়ে আমাদের সমর্থকরা।

দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। জীবনটা কী ছিল একসময়! আর এখন কী হয়ে গেছে।

জীবনের বাস্তবতা আমাদের কাছ থেকে জীবন কেড়ে নেয়।

খুশিতে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম সে-রাতে। আইভি লিগের স্কাউটরা ছিল আমাদের সঙ্গে। আমার ম্যান-অভ-দ্য-ম্যাচ পারফরমেন্সে যার-পর-নাই সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে প্রেম-নিবেদন করে দুটো চিয়ারলিডার মেয়ে। কিন্তু আমি তখন বাড়ি ফেরার ক্ষণ গুনছি–সব বলতে হবে লিও আর মোরাকে…কী দারুণ খেলেছি আমি, আমার কারণে কীভাবে জিতে গেল আমাদের দলটা।

বাসায় ফিরে দেখি, লিও নেই। বাবার সঙ্গে কিচেনে বসে পড়ি আমি, অপেক্ষা করতে থাকি ভাইয়ের জন্য। কোনো ভালো খবর শেয়ার না-করা পর্যন্ত ভালো হয় না। কিন্তু আমার সেই অপেক্ষা শেষ হয়নি আজপর্যন্ত। আমার ভাই আর কখনও ফিরে আসেনি। রাত দশটা বাজল একসময়, চিন্তার ছাপ পড়ল বাবার চেহারায়। এগারোটা বাজল, চেয়ার ছেড়ে উঠে পায়চারি শুরু করলেন তিনি। ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁতেই বেরিয়ে পড়লেন তিনি লিও’র খোঁজে। রাত দুটোর দিকে একটা গাড়ি এসে থামল আমাদের ড্রাইভওয়েতে। নিঘুম আমি একছুটে গিয়ে দাঁড়ালাম সদর-দরজায়।

নিজের স্কোয়াড কার থেকে তখন নামছেন অগি।

.

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হয়ে গেল। সময় নিয়ে গোসল করলাম গরম পানিতে। চাইছি, ফুরফুরে হয়ে যাক মনটা। ফিটফাট হয়ে গিয়ে উঠলাম গাড়িতে, রওয়ানা দিলাম আর্মস্ট্রং ডিনারের উদ্দেশে।

 একদিকের এক কোনার টেবিলে আমার জন্য অপেক্ষা করছে এলি। লিও আর মোরাকে বাদ দিয়ে যদি বলি, এলির মতো ভালো বন্ধু পাইনি কখনও। যখন যেখানে দেখা করতে চেয়েছি ওর সঙ্গে, নিজের সব কাজ ফেলে চলে এসেছে সে। এবং প্রতিবারই আমার আগে এসেছে, আমার জন্য অপেক্ষা করেছে।

গুড মর্নিং! এলির মুখোমুখি যখন বসে পড়ছি, তখন বলল সে।

 জবাব না দিয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেললাম আমি।

এই কাজটা পছন্দ করে এলি। ওর সম্ভাষণের জবাবে যতবারই আমি বিরক্ত হই, ততবারই খুশি হয় সে। ওকে খুশি করার জন্য বিরক্ত হওয়ার ভান করি আমি।

পিঠ খাড়া করে বসল এলি। কাকে দিয়ে শুরু করবে? রেক্স নাকি ট্রে?

 কে?

এবার ভ্রু কোঁচকাল এলি। ট্রে।

না বোঝার ভান করলাম।

ট্রে হচ্ছে ব্রেন্ডার বয়ফ্রেন্ড, মনে করিয়ে দেয়ার কায়দায় বলল এলি। ব্রেন্ডাকে পিটিয়ে আধমরা করে দিয়েছিল।

ও, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। কী হয়েছে লোকটার?

কেউ একজন বেসবল ব্যাট দিয়ে পিটিয়েছে ওকে। আগামী কয়েক মাস আর হাঁটাচলা করতে পারবে না লোকটা।

খারাপ কথা। ব্রেন্ডার কী খবর?

এখন ভালো। ফিরে যেতে পারবে। সবচেয়ে বড় কথা, আগামী কয়েকটা মাস নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে। কাজেই, যে মানুষটা হামলা চালিয়েছে ট্রের উপর, তার প্রতিটা কিছুটা হলেও কৃতজ্ঞতা বোধ করছি। একইসঙ্গে স্বীকার করছি, কাজটা ভালো করেনি সে।

একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে এলি।

সে কি ট্রের ব্যাপারে সন্দেহ করছে আমাকে?

মাথা ঝাঁকিয়ে একমত হওয়ার ভান করলাম। এসো প্রসঙ্গ বদল করি। রেক্সকে নিয়ে কথা বলি।

আমাদের দিকে এগিয়ে এল বানি-মানে একজন ওয়েইট্রেস, আগুনগরম কফি ঢেলে দিল দুটো কাপে।

 আমি এর এলি প্রায়ই আসি এই রেস্টুরেন্টে, কাজেই আমাদেরকে চেনা হয়ে গেছে বানির। আমরা কী খেতে পছন্দ করি, তা-ও জেনে গেছে সে এতদিনে।

বলল, স্যান্ডউইচ, বেকন আর ডিম?

মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালাম আমি।

 খাবার আনতে চলে গেল বানি।

এবার বলল রেক্সের কী খবর, বলল এলি।

খুনের ঘটনাস্থলে ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে। ওই প্রিন্ট মোরার।

এলির মুখ হাঁ হলো না, কিন্তু চোখ বড় হয়ে গেল।

 ওর এই ব্যাপারটা আমার ভালো লাগে–যত অপ্রত্যাশিত খবরই শুনুক না কেন সে, অন্য অনেকের মতে বলো কী! জাতীয় ডায়ালগ দিয়ে মেকি আবেগের ভান করে না।

আমার কোনো পরিবার নেই, গার্লফ্রেন্ড নেই, জীবনের কাছ থেকে কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই, এমনকী একগাদা ভালো বন্ধুও নেই। আমার শুধু আছে এলি…চমৎকার একজন মেয়েমানুষ। ইচ্ছা করলে আমার দিকে সহমর্মিতার হাত না-ও বাড়াতে পারত সে। আমার প্রতিবেশী আর হাতেগোনা আত্মীয়দের মতো সে-ও ইচ্ছা করলে আমাকে একা ছেড়ে দিতে পারত। কিন্তু ইচ্ছাটা করেনি সে। বরং কোনোরকম প্রতিদানের আশা না করেই আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু হয়ে গেছে। আমি নিজে যেমন জানি, সে-ও তেমন জানে, আমি আমার পক্ষ থেকে কখনোই কিছু দিতে পারবো না ওকে।

যা ঘটেছে এবং যা জানতে পেরেছি, সব বললাম এলিকে।

কী মনে হয় তোমার? আমার কথা শেষ হওয়ার পর বলল সে। মোরা কি আসলেই…

মাথা নাড়লাম। মোরা আসলে কী করছে জানি না, কিন্তু আমার মনে হয় না পতিতাবৃত্তির সঙ্গে জড়িয়ে গেছে সে। বারে বারে গিয়ে নিঃসঙ্গ খদ্দের জোগাড় করার মতো মেয়ে না সে।

তা হলে?

তারচেয়েও খারাপ কোনোকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে অথবা জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছে সে।

কীভাবে?

কাঁধ ঝাঁকালাম। অনুমানের খেলা খেলে কোনো লাভ নেই, এলি। রেনল্ডস যতক্ষণ পর্যন্ত কিছু না-জানাচ্ছেন আমাকে, ততক্ষণ অন্ধকারেই থাকতে হবে।

 গতকাল যখন কথা বলছিলাম তোমার সঙ্গে, মোরার ফিঙ্গারপ্রিন্টের ব্যাপারটা জানতে, তাই না?

মাথা ঝাঁকালাম।

সঙ্গে করে একটা ডাফলব্যাগ নিয়ে এসেছিল এলি, ওর পায়ের কাছে মেঝেতে রেখেছিল এতক্ষণ, এবাও ওটা তুলে নিল কোলের উপর। খুলে ভিতর-থেকে বের করল বড় একটা বই। কিছু একটা পেয়েছি।

কী? ক্রু কুঁচকে গেছে আমার।

 হাইস্কুলের ইয়ারবুক।

টেবিলের উপর নামিয়ে রাখল এলি বইটা।

আমরা যখন সিনিয়র ইয়ারে উঠেছি, তখন এই বইয়ের অর্ডার করেছিলে তুমি। পরে যে-কোনো কারণেই হোক, আর নাওনি বইটা। তোমার হয়ে আমি সংগ্রহ করি এটা, নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলাম।

তোমার কাছে রেখে দিয়েছিলে…পনেরো বছর ধরে?

এবার এলির কাঁধ ঝাঁকানোর পালা। আমি ছিলাম ইয়ারবুক কমিটির প্রধান।

মনে পড়ে গেল, হাইস্কুলে এলি ছিল ছিমছাম একটা মেয়ে। বেশিরভাগ সময় সোয়েটার পরে থাকত সে। কানে পরত মুক্তোর দুল, গলায় মুক্তোর মালা।

বললাম, এটা এখন কেন দিচ্ছ আমাকে?

 কারণ কিছু একটা দেখানোর আছে তোমাকে।

এতক্ষণে খেয়াল করলাম, বইয়ের কোনো কোনো পাতা গোলাপি কাগজ-দিয়ে চিহ্নিত করা আছে।

বইটা হাতে নিল এলি, খুলে পেছনদিকের একটা পাতায় চলে এল। লিও আর ডায়ানার ব্যাপারে কী করেছিলাম আমরা, মনে আছে তোমার?

কী করেছিলাম মানে?

মানে ইয়ারবুকে কী করেছিলাম। ওদের ব্যাপারটা নিয়ে দুভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল আমাদের কমিটি। তখন সিন্ডি মোরোন…মনে আছে মেয়েটার কথা?

মাথা ঝাঁকালাম আমি।

সিন্ডি তখন বলল, মেইন লিস্টিং পেইজে লিও আর ডায়ানার খবর দেয়ার দরকার নেই। ওই পেইজ নাকি গ্র্যাজুয়েটিং সিনিয়রদের জন্য।

খাবার দিয়ে গেল বানি। সুগন্ধে যেন মোচড় দিয়ে উঠল আমার পেট। স্যান্ডউইচের প্লেটটা টেনে নিলাম নিজের দিকে। কিন্তু গ্র্যাজুয়েশন করার আগেই তো মারা গেল লিও আর ডায়ানা।

ঠিক।

 এলি?

বলো।

তুমি আসলে কী বলতে চাইছ?

নিজের স্যান্ডউইচে কামড় বসাল এলিও। ইয়ারবুকের বিশেষ একটা পাতা খুলল। ওটা দেখাল আমাকে।

 লিও’র ছবি দেখা যাচ্ছে।

আমার একটা ব্লেযার পরে আছে সে। যমজ ভাই হওয়ার পরও আমাদের দুজনের মধ্যে আমি ছিলাম একটু বড়সড়। অষ্টম গ্রেডে পড়ার সময় ওই ব্লেয়ার কিনেছিলাম আমি। আর লিও’র গলায় যে-টাই দেখা যাচ্ছে, ওটা বাবার। নট বাঁধতে পারত না সে। ওই কাজ করতে গেলে সাংঘাতিক গণ্ডগোল বেঁধে যেত ওর। বাবাই সবসময় করে দিতেন কাজটা।

ছবিতে হাসছে লিও ওকে হাসতে দেখে, অনেকটা নিজের অজান্তেই, একচিলতে হাসি ফুটে উঠল আমার ঠোঁটের কোনাতেও।

আমি এই পৃথিবীর একমাত্র মানুষ না, যে তার যমজ ভাইকে অকালে হারিয়েছে। কোনো সন্দেহ নেই, লিও’র মৃত্যু আমার জন্য একটা বিপর্যয়, তারপরও ওটা আমার জীবনের শেষ না। ধাক্কাটা সামলাতে পেরেছিলাম আমি…যেভাবেই হোক। বিশেষ সেই রাতের সপ্তাহ দু-এক পর ফিরেও গিয়েছিলাম স্কুলে। এবং যেদিন ফিরে গিয়েছিলাম স্কুলে, তার পরের শনিবারে হকি ম্যাচও খেলেছি। জানি না আমার রাগটা ছিল কার বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষের এক খেলোয়াড়কে বাজে ফাউল করার কারণে শাস্তি হিসেবে খেলা-চলাকালীন-সময়ে সাইড-লাইনে বসে থাকতে হয়েছিল আমাকে দশ মিনিটের জন্য। আরও পরে ইতিহাস পরীক্ষায় আমার গ্রেড যখন খারাপ হলো, তখন মিসেস গ্রিডম্যান, অর্থাৎ যিনি স্কুলে ইতিহাস পড়াতেন, আমাকে ডেকে নিয়ে কড়া গলায় বললেন, ভাইয়ের মৃত্যু পরীক্ষায় খারাপ করার কোনো অজুহাত হতে পারে না।

ঠিকই বলেছিলেন তিনি। জীবনের নিয়মেই চলতে দেয়া উচিত জীবনকে। রাগ বা শোক কিছুসময়ের জন্য আচ্ছন্ন করে রাখে একটা মানুষকে। সেগুলো যখন কেটে যায়, তখন কী বাকি থাকে?

এসব আমাকে কেন দেখাচ্ছ, এলি?

 লিও’র ব্লেয়ারের কলারে যে-ভাঁজ করা অংশটা আছে, সেটা দেখো।

দেখলাম।

 রুপার ছোট্ট একটা পিন গাঁথা আছে লিও’র ব্লেযারের কলারে।

মুচকি হাসলাম। কন্সপাইরেসি ক্লাব।

ওয়েস্টব্রিজ হাইস্কুলে কোনো কন্সপাইরেসি ক্লাব ছিল না।

অফিশিয়ালি ছিল না। গোপনে গোপনে ছিল। গুপ্তসংঘ বলতে যা বোঝায়, অনেকটা সে-রকম ছিল ওই ক্লাব।

তারমানে এই ব্যাপারটা জানা ছিল তোমার?

অবশ্যই।

তুমি ওই ক্লাবের সদস্য ছিলে?

না।

তোমার পরিচিত আর কে-কে সদস্য ছিল ওই ক্লাবের?

জানি না। একটু আগেই বলেছি, ক্লাবটা ছিল অনেকটা গুপ্তসংঘের মতো। কাজেই কে-কে সদস্য ছিল ওই ক্লাবের, জানার উপায় ছিল না আমার। জানার তেমন একটা ইচ্ছাও ছিল না।

কেন ইচ্ছা ছিল না?

ওই বয়সে কত রকমের পাগলামিই তো ভর করে মানুষের মনে। লিওদেরকে কোন্ পাগলামি পেয়ে বসেছিল, জানাটা জরুরি মনে করিনি।

পাতা উল্টিয়ে এবার রেক্সের একটা ছবি বের করল এলি, দেখাল আমাকে। গতকাল যখনই রেক্সের ঘটনাটা বললে, ইয়ারবুকের কথা মনে পড়ে যায় আমার। …ভালোমতো তাকিয়ে দেখো, রেক্সের ছবির সঙ্গে কোনো মিল পাও কি না লিও’র ছবির।

কন্সপাইরেসি ক্লাবের একটা রুপার-পিন দেখা যাচ্ছে রেক্সের ব্লেযারের কলারেও।

রেক্সও যে ওই ক্লাবের একজন সদস্য ছিল, জানতে? জিজ্ঞেস করল এলি।

মাথা নাড়লাম। জানতাম না, এবং ওই ব্যাপারে কখনও কিছু জিজ্ঞেসও করিনি ওকে। আসলে আমার কাছে ওই ক্লাবের তেমন কোনো গুরুত্ব ছিল না।

ক্লাবের অন্য কোনো সদস্যকে চিনতে?

না। এসব নিয়ে তেমন একটা কথা বলত না ওরা। ইয়ারবুকের পাতা থেকে চোখ তুলে তাকালাম এলির দিকে। মোরার ছবিও কি আছে এই বইয়ে?

না। সে যখন বদলি হয়ে যায়, এই বই থেকে ওর ছবি সরিয়ে ফেলি আমরা। আচ্ছা, মোরা কি ক্লাবটার সদস্য ছিল?

মাথা ঝাঁকালাম আমি।

আমরা যখন জুনিয়র ইয়ারের শেষদিকে ছিলাম, বাবা-মার সঙ্গে তখন এই শহরে আসে মোরা। সে ছিল আমাদের সবার জন্য এক রহস্য। সুপার হট একটা মেয়ে, কোনোকিছুর প্রতিই যার তেমন কোনো আগ্রহ নেই। হাইস্কুলের লিখিত-অলিখিত বিভিন্ন নিয়ম মানার চেয়ে না-মানার প্রতি ওর ঝোঁক ছিল বেশি। সপ্তাহান্তে ম্যানহাটনে যেতে পছন্দ করত সে। কাকে যেন বলেছিল, কাঁধে ব্যাকপ্যাক ঝুলিয়ে ইউরোপের দেশে-দেশে ঘুরেছে। ওকে দেখলেই আমার মনে হতো, ছায়া হয়ে ওর সঙ্গে সবসময় আছে বিপদ। মনে হতো, কলেজপড়ুয়া কোনো ছেলের সঙ্গে অথবা আমাদের স্কুলের কোনো শিক্ষকের সঙ্গে ডেটিং করছে সে। তখন আমরা প্রায় সবাই এক-রকমের সংকীর্ণতায় ভুগতাম ওকে নিয়ে।

লিও’র সঙ্গে মোরার বন্ধুত্ব হয়ে গেল কীভাবে, তা আজও এক রহস্য হয়ে আছে আমার কাছে। একদিন বাসায় ফিরে দেখি, কিচেন-টেবিলে বসে আছে ওরা দুজন, হোমওয়ার্ক করছে। থমকে দাঁড়িয়ে যাই আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না দৃশ্যটা।

ডায়ানার ছবিটাও দেখেছি আমি, বলল এলি।

ওর কণ্ঠের অস্বস্তিটা আমার কান এড়াল না, স্মৃতির কারাগার থেকে বাস্তবে ফিরতে গিয়েও ফেরা হলো না আমার।

দ্বিতীয় গ্রেডে পড়ার সময় ডায়ানা ছিল এলির সবচেয়ে ভালো বন্ধু। এবং ডায়ানার সঙ্গে এলির ঘনিষ্ঠতা ছিল বলেই আমি আর এলি ঘনিষ্ঠ হতে পেরেছি। কারণ এলি হারিয়েছে ডায়ানাকে, আর আমি হারিয়েছি লিওকে– আমাদের দুজনের হাহাকারবোধ কাছাকাছি নিয়ে আসে আমাদেরকে।

 ডায়ানায় ব্লেযারে কোনো পিন ছিল না, বলল এলি। তারমানে ওই ক্লাবের সদস্য ছিল না সে। তা ছাড়া আমার সঙ্গে নিজের সব কথা শেয়ার করত সে। সে যদি ওই ক্লাবের সদস্য হতো, আমাকে বলত।

এমনও হতে পারে, লিও’র সঙ্গে ডেটিং শুরু করার পর ক্লাবে যোগ। দিয়েছিল সে।

কন্সপাইরেসি ক্লাবের ব্যাপারে কী জানো তুমি?

ব্রেকফাস্টের পর সময় হবে তোমার? জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলাম আমি।

হবে।

তা হলে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলবো তোমার সঙ্গে। বোঝাতে সহজ হবে।

কী মনে হয় তোমার–লিও আর ডায়ানার মৃত্যুর সঙ্গে ওই ক্লাবের কোনো যোগাযোগ আছে?

থাকতে পারে। তোমার কী মনে হয়?

আমার সবসময় মনে হয়েছে এবং এখনও মনে হয়, দুর্ঘটনায় মত্য হয়েছে লিও আর ডায়ানার। অন্য কিছু যদি ভেবে থাকো, আমি বলবো, সেটা তোমার কষ্ট-কল্পনা।

যা কল্পনা করতে কষ্ট হয়, তা যে অবাস্তব বা অসম্ভব হবে, এমন কোনো কথা নেই।

কেন বললে কথাটা?

ডায়ানাকে যদি কন্সপাইরেসি ক্লাবের সদস্য ধরে নিই, তা হলে স্বীকার করে নিতে হবে, ওই ক্লাবের অন্তত তিনজন সদস্যের অপমৃত্যু হয়েছে।

শুধু তা-ই না, পনেরো বছর আগে গায়েব-হয়ে-যাওয়া মোরাকে দেখা গেছে রেক্সের খুনের-ঘটনাস্থলে।

 আরও কথা আছে। ইয়ারবুকের জন্য যখন ছবি তোলা হয়েছিল, হতে পারে সে-ঘটনার পর ওই ক্লাবে যোগ দিয়েছিল ডায়ানা। তাই ওর ইয়ারবুকের-ছবির ব্লেযারে কোনো পিন নেই।

কষ্ট-কল্পনা।

জবাব দিলাম না।

খাচ্ছি। তাকিয়ে আছি খাবারের প্লেটের দিকে, না-দেখতে পেলেও জানি আমাকে দেখছে এলি।

ন্যাপ?

বলো।

একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে পুরো ইয়ারবুক চেক করেছি আমি। কার কার ব্লেযারে ওই রুপার-পিন আছে, বের করার চেষ্টা করেছি।

মুখ তুললাম। অন্য কারও ব্লেযারে দেখতে পেয়েছ ওই পিন?

মাথা ঝাঁকাল এলি। আমাদের আরও দুজন সহপাঠীর ব্লেযারে ওই পিন ছিল।

.

০৮.

বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন মিডল স্কুলের পেছন দিয়ে পুরনো একটা পথ চলে গেছে, ওটা ধরে হাঁটছি আমি আর এলি।

পথটা যে এখনও আছে, বলল এলি, বিশ্বাস হয় না।

ওর দিকে বাঁকা চাহনিতে তাকালাম। প্রায়ই কি এখানে আসা হতো তোমার?

আমি? আমি কেন আসতে যাবো এখানে? এই পথ উচ্ছঙ্খল ছেলেপেলের জন্য।…তুমি আসতে?

মাথা ঝাঁকালাম। সিনিয়র ইয়ারে থাকতে প্রায়ই আসা হতো।

কীসের জন্য? মদ খেতে? নাকি ড্রাগস? নাকি সেক্স?

তিনটাই। তবে… একচিলতে তিক্ত হাসি ফুটে উঠল আমার ঠোঁটের কোনায়, মদ আর ড্রাগসের উপর তেমন একটা আগ্রহ ছিল না আমার।

কার ছিল তা হলে? মোরার?

জবাব দিলাম না।

মনে পড়ে যাচ্ছে, আমাদের স্কুলের মাঝখানের অংশটার পেছনের দিক ছিল ঝোঁপজঙ্গলে-ভরা। ছেলেপেলে সেখানে সিগারেট টানতে যেত। কেউ কেউ সঙ্গে করে নিয়ে যেত মদের বোতল। কেউ আবার ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে সেক্স করত গার্লফ্রেন্ড বা বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে। সব শহরেই চলে এসব। আমাদের ওয়েস্টব্রিজও ব্যতিক্রম ছিল না।

এই শহর বিশাল না। আবার পুঁচকেও না। সব মিলিয়ে হাজার ত্রিশেক লোকের বাস এখানে। এলিমেন্টারি স্কুল আছে মোট ছটা। মিডল স্কুলের সংখ্যা দুই। আর হাইস্কুল একটা। শহরের আয়তন প্রায় পনেরো হাজার বর্গমাইল। এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি আমি সেখান থেকে, লিও আর ডায়ানা যে-জায়গায় মারা গেছে সে-জায়গায় গাড়িতে করে যেতে কমপক্ষে দশ মিনিট লাগবে।

মোরাকে আসলে সেভাবে চিনতাম না আমি, বলল এলি। কবে ভর্তি হয়েছিল সে আমাদের স্কুলে? জুনিয়র ইয়ারে?

হ্যাঁ। আমার মনে আছে, তখন ছিল গরমকাল।

ওকে কেন যেন বয়সে-বড় বলে মনে হতো আমার।

 বয়সে বড়?

মাথা ঝাঁকাল এলি। অথবা…পরিপক্ক বলতে পারো। উঁচড়েপাকাও বলা যায়। বিশেষ করে সেক্সের ব্যাপারে ওকে অভিজ্ঞ মনে হতো আমার।

তর্কে গেলাম না। আমি নিজে যার সঙ্গে সেক্স করেছি, সে-মেয়ে সেক্সে অভিজ্ঞ কি না, তা নিয়ে কথা বলা বাতুলতা।

 ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল এলি। আমার কথা কি খারাপ লাগছে তোমার কাছে?

না…খারাপ লাগার কী আছে? …কন্সপাইরেসি ক্লাবের আরও দুজন সদস্যের ব্যাপারে বলতে চাইছিলে।

মাথা ঝাঁকাল এলি। একজনের নাম বেথ ল্যাশলি। আরেকজন হ্যাঙ্ক স্ট্রাউড। …ওদের কথা মনে আছে তোমার?

 আছে। তবে আমার চেয়ে লিও’র সঙ্গে বেশি খাতির ছিল ওদের। তুমি চিনতে ওদেরকে?

 চিনতাম…মোটামুটি। অঙ্কে মাথা-ভালো ছিল হ্যাঙ্কের। মনে আছে, ফ্রেশম্যান ইয়ারে একসঙ্গে ক্যালকুলাসের ক্লাস করতাম আমরা। সে বোধহয় পরে এম.আই.টি.-তে যায়, না?

হু…আমিও সে-রকম শুনেছিলাম।

 ওর কী অবস্থা এখন?

যতদূর জানি, শহরেই আছে।…সে একসময় ভালো বাস্কেটবল খেলত।

 মাস ছয়েক আগে ট্রেন স্টেশনের কাছে দেখা হয়েছিল ওর সঙ্গে। তখন দেখি, বিড়বিড় করে কথা বলছে নিজের সঙ্গে। থেকে থেকে চিৎকার করে ভাষণ দিচ্ছে…সেটাও নিজের উদ্দেশেই। বেচারা আসলে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। …খুব খারাপ লাগল দৃশ্যটা দেখে।

কিছু বললাম না।

থামল এলি, একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। আলোচনার সুবিধার্থে ধরা যাক, ডায়ানাও যোগ দিয়েছিল ওই ক্লাবে।

ঠিক আছে।

তা হলে মোট ছজন সদস্য পেলাম আমরা। লিও, ডায়ানা, মোরা, রেক্স, হ্যাঙ্ক আর বেথ।

আবার হাঁটতে শুরু করলাম আমি। আমার পিছু নিল এলি। আমার পাশাপাশি এসে বলল, লিও মারা গেছে। ডায়ানা মারা গেছে। রেক্সকে খুন করা হয়েছে। মোরা হারিয়ে গেছে। হ্যাঙ্ক মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে।

আর বেথ? জানতে চাইলাম আমি। ওর কী অবস্থা?

জানি না। স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার পর আর কোনো খবর নেই ওর। আমাদের ক্লাসের অ্যালামনাই কো-অর্ডিনেটর হিসেবে ওকে খুঁজেছিলাম আমি…

খুঁজেছিলে মানে?

ওর বাসার ঠিকানা বের করার চেষ্টা করেছিলাম।

 কেন?

রি-ইউনিয়নের দাওয়াত দিতে চেয়েছিলাম ওকে। কিন্তু ঠিকানাটা বের করতে পারিনি।

ওর বাবা-মা?

যতদূর জানতে পেরেছিলাম, তাঁরা ফ্লোরিডায় চলে গিয়েছিলেন। আমি চিঠি পাঠিয়েছিলাম তাদের কাছে, কিন্তু কোনো জবাব পাইনি।

তারমানে…মনে মনে বললাম আমি…হ্যাঙ্ক আর বেথের সঙ্গে কথা বলতে হবে আমাকে। কিন্তু কী নিয়ে কথা বলবো?

আমরা কোথায় যাচ্ছি, ন্যাপ?

এই তো…বেশি দূরে কোথাও না।

আমি আসলে কিছু-একটা দেখাতে চাইছি এলিকে। নাকি…আমি নিজেই কিছু-একটা দেখতে চাইছি?

বাতাসে পাইন গাছের ফলের সুবাস। এখানে-সেখানে পড়ে আছে মদের ভাঙা বোতল অথবা সিগারেটের খালি প্যাকেট।

 কাছিয়ে আসছে জায়গাটা। বাতাস হঠাৎ করেই স্থির হয়ে গেছে যেন…জানি, এটা আমার কল্পনা। আমার কেবলই মনে হচ্ছে, অদৃশ্য কেউ একজন আছে এখানে, দেখছে আমাদেরকে।

একটা গাছের সামনে থেমে দাঁড়ালাম আমি, হাত বুলাচ্ছি ওটার কাণ্ডে। মরচে-পড়া পুরনো একটা পেরেকে আটকে গেল আমার একটা আঙুল। গিয়ে দাঁড়ালাম পাশের গাছটার সামনে, হাত বুলাতে লাগলাম ওটার কাণ্ডেও। আবারও একটা মরচে-ধরা পুরনো পেরেকে আঙুল আটকে গেল আমার।

ইতস্তত করছি আমি।

কী সমস্যা? জানতে চাইল এলি।

আজ থেকে অনেক বছর আগে একসময় এই গাছগুলোই ছিল আমার সীমানা।

মানে?

এই গাছগুলোর পরে যে-জায়গা দেখতে পাচ্ছ, সেখানে ঢুকিনি আমি কখনও।

কেন?

নিষেধ ছিল। …এই পেরেকগুলো দেখতে পাচ্ছ? এগুলোতে একসময়, প্রবেশ নিষেধ জাতীয় কিছু সাইনবোর্ড লটকানো ছিল।

অর্থাৎ অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ?

ওসব সাইনবোর্ডে কী লেখা ছিল, তা আজও মনে আছে আমার সাবধান! সরকারি এলাকা। প্রবেশ নিষেধ। কথাটার নিচে লাল কালিতে কিছু কোড-নম্বর লেখা ছিল। কোথাও কোথাও লেখা ছিল: ছবি তোলা নিষেধ। কোথাও আবার লেখা ছিল: অনুপ্রবেশের দায়ে গ্রেপ্তার করা হতে পারে আপনাকে, সার্চ করা হতে পারে। বাঁকা অক্ষরে আরেকটা কথা লেখা ছিল দু-এক জায়গায়: ডেডলি ফোর্স ই অথরাইযড়।

আসলেই?

 মাথা ঝাঁকালাম আমি।

তোমার স্মৃতিশক্তি ভালো।

স্মৃতিশক্তি ভালো বলেই আজ আমার এই অবস্থা।

এই অবস্থা মানে?

 মানে, আজও আমি তাড়া খেয়ে বেড়াচ্ছি আমার অতীতের।

দোষটা তোমার অতীতের না। দোষটা তোমার নিজের। যা চলে গেছে, যা হারিয়ে গেছে তোমার জীবন থেকে, কেন তা আঁকড়ে ধরে আছ? কেন গা ভাসিয়ে দিচ্ছ না বর্তমানের স্রোতে?

পারছি না।

কেন পারছ না?

কারও কারও অতীত তার জন্য অক্টোপাসের মতো–শুঁড় দিয়ে একবার পেঁচিয়ে ধরলে ছাড়া পাওয়া খুব মুশকিল। আমি সে-রকম একজন মানুষ।

কিছু বলল না এলি। আমার কথায় সম্ভবত বিরক্ত হয়েছে।

ও-রকম একটা প্রবেশ নিষেধ জাতীয় সাইনবোর্ড চুরি করেছিল মোরা, মূল প্রসঙ্গটা ধরে রাখতে চাইলাম আমি। তারপর ওটা নিয়ে গিয়ে লটকে দিয়েছিল ওর বেডরুমে।

দুষ্টুমি করছ নাকি?

কাঁধ ঝাঁকালাম।

কনুই দিয়ে আমার পাজরে আলতো করে গুঁতো দিল এলি। পচা একটা মেয়ের সঙ্গে প্রেম করেছিলে তুমি।

সম্ভবত।

এবং বাজি ধরে বলতে পারি, এখনও ওই পচা মেয়েকে ভালোবাসো।

 কিছু বললাম না।

হাঁটছি আমরা। একসময় যে-গাছগুলোতে প্রবেশ নিষেধ জাতীয় সাইনবোর্ড লাগানো ছিল, সেগুলো ছাড়িয়ে এসেছি। কেমন যেন লাগছে আমার। মনে হচ্ছে, এতগুলো বছর কোনো অদৃশ্য শক্তি বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ওই গাছগুলোর কাছে, ভিতরে ঢুকতে দেয়নি আমাকে। আজ হঠাৎ করেই যেন পতন ঘটেছে ওই শক্তির, আজ হঠাৎ করেই নিষিদ্ধ একটা রাজ্যে ঢুকে পড়েছি।

 গজ পঞ্চাশেক এগোনোর পর দেখা মিলল কাঁটাতারের বেড়ার। আসলে কাঁটাতারের বেড়া না-বলে ওগুলোর অবশেষ বললে ভালো হয়। সাবধানে ছাড়িয়ে এলাম ওই বেড়া। এখন অনতিদূরে দেখা যাচ্ছে কয়েকটা শ্যাকের ধ্বংসাবশেষ। বিক্ষিপ্তভাবে জন্মে-ওঠা ঝোঁপজঙ্গলের আড়ালে বলতে গেলে অদৃশ্য হয়ে গেছে ওগুলো।

জুনিয়র ইয়ারে থাকতে এই এলাকার উপর একটা রিপোর্ট তৈরি করেছিলাম আমি।

এই এলাকার উপর মানে?

মানেটা জানা আছে তোমার, ঠিক না?

 ঠিক। কিন্তু আমি চাইছি এলি নিজে থেকেই বলুক সেটা।

মিসাইল বেস, বলল এলি। অনেকেই তখন বিশ্বাস করেনি কথাটা, আজও করে না। কিন্তু আমি জানি, আমি ভুল রিপোর্ট করিনি। শীতল যুদ্ধের সময়, মানে সেই উনিশ শ পঞ্চাশের দিকে, আমেরিকার সেনাবাহিনি এ-রকম অনেকগুলো ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল ওয়েস্টব্রিজের মতো, উপশহরগুলোতে। যেসব শহরের উপকণ্ঠে খেতখামার আছে, অথবা যেসব শহর জঙ্গলে ভরা, সে-রকম জায়গা বেছে নিয়েছিল ওরা ওসব ঘাঁটি স্থাপন করার জন্য। অনেকেই তখন ভেবেছিল, এসব গাঁজাখুরি গল্প। কিন্তু আমি জানি, এসব সত্যি।

থম মেরে আছে বাতাস। কোনো গাছের একটা পাতাও নড়ছে বলে মনে হচ্ছে না। ওই শ্যাকগুলোর আরও কাছে গেলাম আমরা। এখন বুঝতে পারছি, একসময় মিলিটারি ব্যারাক ছিল এই জায়গায়। দৃশ্যটা কল্পনা করার চেষ্টা করলাম–একঝাঁক সৈন্য, তাদের গাড়ি, মিসাইল লঞ্চপ্যাড।

নিউক্লিয়ার ওয়্যারহেডযুক্ত চল্লিশ ফুট লম্বা মিসাইল ছোঁড়া সম্ভব ছিল এখান থেকে, বলল এলি; এমন ভঙ্গিতে এদিকওদিক তাকাচ্ছে, যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে মিসাইলগুলো। এখানে সেনাঘাঁটি স্থাপনের উদ্দেশ্য একটাই: সোভিয়েত মিসাইল অথবা বিমান হামলা থেকে নিই ইয়র্ক শহর বাঁচানো।

ওই ওয়্যারহেডযুক্ত মিসাইলের কার্যক্রম কবে শেষ হয়েছিল, জানো?

 উনিশ শ সত্তরের শুরুর দিকে।

মাথা ঝাঁকালাম আমি। আর আমাদের এই ওয়েস্টব্রিজের ঘাঁটি বন্ধ ঘোষণা করা হয় উনিশ শ চুয়াত্তরে।

তার প্রায় পঁচিশ বছর পর হাই স্কুলে ভর্তি হই আমরা।

ঠিক। …আমাদের শহরের কোনো বুড়ো লোককে যদি জিজ্ঞেস করো, জানতে পারবে, উত্তর নিউ জার্সিতে এ-রকম যে-কটা গোপন ঘাঁটি স্থাপন করা হয়েছিল, সেগুলোর কোনোটাই শেষপর্যন্ত গোপন ছিল না। এবং সেগুলোর গোপনীয় কার্যক্রম সম্পর্কে অনেক আগেই অবগত হয়েছিল স্থানীয় লোকজন। তা না হলে রিপোর্ট লিখতে পারতে না তুমি। কাজেই, যাকে বলে ওপেন সিক্রেট, মার্কিন সেনাবাহিনির ওয়্যারহেডযুক্ত-মিসাইল কার্যক্রম ছিল আসলে সে-রকম। শুনেছি, একবার নাকি আমাদের জাতীয় দিবসের প্যারেডে ওয়্যারহেডেড মিসাইল প্রদর্শিতও হয়েছে। তবে কথাটা সত্যি নাকি মিথ্যা, জানি না।

হাঁটছি আমরা। পুরনো এই ঘাঁটির আরও ভিতরে ঢুকে পড়তে চাইছি আমি…কেন, জানি না।

লিভিংস্টোনে এ-রকম একটা ঘাটি ছিল, বলল এলি, ওটা এখন আর্টিস্ট পার্কে পরিণত হয়েছে। ইস্ট হ্যানোভারের ঘাঁটিটা সরকারের কাছ থেকে বুঝে নিয়েছে একটা হাউজিং কোম্পানি। স্যাণ্ডি হুকের ঘাঁটিটা আগের মতোই আছে, তবে সেটা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে আমজনতার জন্য।

একজায়গায় থামলাম আমরা। একটা গাছের পাতাও নড়ছে না। কোনো পাখি ডাকছে না। নিজের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি।

এই ঘাঁটি বন্ধ করে দেয়ার পর ঠিক কী ঘটেছিল এখানে? আমাকে জিজ্ঞেস করল এলি।

কন্সপাইরেসি ক্লাবের সদস্যরা মনে হয় জানার চেষ্টা করেছিল জবাবটা, বললাম আমি।

.

০৯.

গাড়ি নিয়ে এসেছিল এলি, ওর পাশাপাশি হেঁটে ওর গাড়ি পর্যন্ত গেলাম। ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল সে, দরজাটা লাগিয়ে দিলাম আমি। সাবলীল গতিতে গাড়ি চালিয়ে চলে গেল এলি।

আমার মোবাইল ফোন বেজে উঠল এমন সময়।

 রেনল্ডস।

রিসিভ করলাম কলটা। হ্যালো?

যে-জায়গায় খুন হয়েছে রেক্স ক্যান্টন, পাল্টা সম্ভাষণের ধার দিয়েও গেলেন না রেনল্ডস, সেখানে আগেও তিনবার তিনজন মাতাল ড্রাইভারকে আটক করেছিল সে।

 কিছু বললাম না। বুঝতে পারছি, কথা শেষ হয়নি রেনল্ডসের।

ন্যাপ?

যাদেরকে আটক করেছিল রেক্স, তাদের সবাই পুরুষমানুষ ছিল, তা-ই না?

 ঠিক।

এবং পারিবারিক জীবনে তারা সবাই ছিল অসুখী, ছাড়াছাড়ির পর্যায়ে চলে গিয়েছিল তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক। খোঁজ করলে দেখা যাবে, বাবা নাকি মা-ডিভোর্স হয়ে গেলে বাচ্চা কার কাছে থাকবে তা নিয়ে আদালতে শুনানিও হয়ে গিয়েছিল কারও কারও।

 তিনজনেরই হয়েছে।

আমার সন্দেহ, মাতাল ড্রাইভারদেরকে ধরার জন্য ও-রকম আরও কিছু স্পট ছিল রেক্সের।

রেক্স যাদেরকে ধরেছিল, তাদের একটা তালিকা করার চেষ্টা করছি আমি। একটু সময় লাগবে।

নিজের গাড়িতে উঠে পড়লাম আমি, চালু করলাম ইঞ্জিন। ডেইল মিলারের গাড়িটা বার ছেড়ে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে সেটার পিছু নেয় রেক্স।

হয়তো…ওই এলাকাতেই ছিল সে তখন, গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল কোথাও।

কিন্তু আমরা দুজনই বারের সিসিটিভির ফুটেজ দেখেছি। একবারও কি মনে হয়েছে, মাতলামি করছিল মিলার? কাজেই আমার প্রশ্ন হচ্ছে, কেন মিলারের পিছু নিল রেক্স? আরেকটা কথা। তখন মিলারের সঙ্গে ছিল মোরা-রেক্সের সঙ্গে একই হাইস্কুলে পড়ত সে। বেশি বেশি কাকতালীয় হয়ে যাচ্ছে না? …কেন যেন মনে হচ্ছে আমার, হয় রেক্সের খুনের ঘটনাটা, নয়তো সে-রাতে মারার উপস্থিতি-যে-কোনো একটা পূর্বপরিকল্পিত।

বুঝলাম না। খুনের ঘটনাটা যদি পূর্বপরিকল্পিত হবে, কোত্থেকে উড়ে এসে হাজির হলো ডেইল মিলার?

জানি না।

আপনার সাবেক প্রেমিকা কি কোনোভাবে সাহায্য করছিল ওই লোককে?

 মনে হয় না।

আপনি কি এখনও ভালোবাসেন ওই মেয়েকে?

 জানি না।

এবং ভালোবাসেন বলেই কি ওর উপর থেকে অপরাধের দায় সরিয়ে দিতে চাইছেন?

 দেখুন, একটা কথা বার বার বলতে ভালো লাগে না। বললাম তো, মোরাকে এখনও ভালোবাসি কি না, জানা নেই আমার। আর যদি বাসতামও, এবং সে যদি কোনো অপরাধ করত, সেটার দায় সরিয়ে দিতে চাইতাম না ওর উপর থেকে। আমার কাছে মনে হয়েছে মোরা সাহায্য করছিল না মিলারকে, তাই বলেছি কথাটা।

কেন মনে হয়েছে?

 বারটেন্ডার কী বলেছে, মনে নেই?

কোনটা?

মিলারের পরে বারে এসেছিল মোরা সে-রাতে। লোকটার সঙ্গে মদ খেয়েছিল, বলা ভালো নিজে মদ খাওয়ার ভান করে মাত্রাতিরিক্ত মদ খাইয়েছিল ওই লোককে, তারপর লোকটার সঙ্গে তার গাড়িতে গিয়ে উঠেছিল।

তো?

মিলার আর মোরা একসঙ্গে মিলে যদি খুন করে থাকে রেক্সকে, এত নাটক করার দরকার হতো না। যেভাবে গুলি চালিয়ে রেক্সকে খুন করেছে। মিলার, সেভাবে ইচ্ছা করলে যে-কোনো জায়গায় খুনটা করতে পারত সে একাই। আমি বরং বলবো, খুনের রাতে লোকটাকে মোরার সঙ্গে দেখা গেছে বলে ওই লোকের চেহারা মনে রেখেছে বারটেন্ডার এবং হয়তো আরও কয়েকজন। কাজেই মোরা উপস্থিত থাকায় লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হয়েছে মিলারের…যদি না ভিতরে অন্য কোনো প্যাঁচ থেকে থাকে।

ঠিকই বলেছেন,..যদি না ভিতরে অন্য কোনো প্যাঁচ থেকে থাকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন রেনল্ডস। তারপর বললেন, তা হলে আপনার ধারণা রেক্সের সহকারী হিসেবে কাজ করছিলেন মোরা?

হ্যাঁ।

সেক্ষেত্রে আরেকটা প্রশ্ন চলে আসে আমাদের সামনে। মোরা যদি রেক্সের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত না-ই থাকবেন, তা হলে এখন কোথায় আছেন তিনি?

জানি না।

রেক্সকে খুন করার পর মিলার হয়তো পিস্তল তাক করেছিল মোরার দিকে। হয়তো তাকে বাধ্য করেছে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসতে, তারপর গাড়ি চালিয়ে নিজের ইচ্ছামতো জায়গায় যেতে।

সম্ভবত।

তারপর?

অনুমানের ঘোড়াটা একটু বেশিই ছুটিয়ে ফেলছি আমরা। তারচেয়ে, আমাদের হাতে যেসব সূত্র আছে সেগুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা ভালো।

যেমন?

আপনি বললেন, খুনের স্পটে নাকি আরও তিনজন মাতাল ড্রাইভারকে পাকড়াও করেছিল রেক্স। ওই লোকগুলোর স্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারেন। আমার ধারণা, ওই ভদ্রমহিলারা বলবেন, সাহায্যের জন্য তারা নিজে থেকেই গিয়েছিলেন রেক্সের কাছে।

কীসের সাহায্য?

 স্বামীর মান-সম্মান যাতে ক্ষুণ্ণ হয়, সে-রকম কোনো কাজে লোকটাকে জড়িয়ে ফেলার ব্যাপারে সাহায্য।

সাহায্যটা করল কীভাবে রেক্স? ভাড়া খেটেছিল ওই ভদ্রমহিলাদের হয়ে? যদি তা-ই হবে, ওকে ভাড়া করল কীভাবে ওই ভদ্রমহিলারা?

খুব সম্ভব কোনো ডিভোর্স অ্যাটর্নির মাধ্যমে। রেনল্ডস, আমাদের পক্ষ থেকে এটাই হবে প্রথম চাল। খোঁজ নিয়ে দেখুন, ওই তিন ভদ্রমহিলা একই উকিলের শরণাপন্ন হয়েছিলেন কি না। যদি হয়ে থাকেন, খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন লোকটাকে। তার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু জানা যেতে পারে রেক্স আর মোরার ব্যাপারে।

লোকটা বলছেন কেন? ওই উকিল তো মহিলাও হতে পারে?

হ্যাঁ, একমত হলাম আমি, পারে।

ঠিক আছে। আসুযান মিলারকে নিয়ে কথা বলি। ওকে নিয়ে সুখে থাকতে পারছিলেন না ওর স্ত্রী। তাই একজন ডিভোর্স অ্যাটর্নির দ্বারস্থ হন ভদ্রমহিলা। ওই উকিল তখন রেক্সের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন ভদ্রমহিলাকে। আমাদের অনুমান যদি সত্যি হয়, তা হলে মিলার ছিল রেক্সের টার্গেট।

হ্যাঁ…যদি অনুমানটা সত্যি হয়, লাইন কেটে দিয়ে গাড়ি আগে বাড়ালাম।

কন্সপাইরেসি ক্লাবের ব্যাপারে কিছু কি জানাবো রেনল্ডসকে? থাক, আপাতত দরকার নেই। তিনি যে-পথে এগোচ্ছেন, সেটা জরুরি বেশি এখন। কেন যেন মনে হচ্ছে, আমার ভাই লিও’র মৃত্যুর সঙ্গে কোনো-না কোনো যোগসূত্র আছে রেক্সের হত্যাকাণ্ডের। কিন্তু মনে হলেই তো হবে না, নিরেট প্রমাণ দরকার। সবচেয়ে বড় কথা, ওই ক্লাবের ব্যাপারে আসলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু জানি না আমি এখনও। কাজেই, মাতাল ড্রাইভারদের অথবা তাদের স্ত্রীদের সূত্র ধরে যদি কিছু খুঁজে পান রেনল্ডস, ক্ষতি কী? আমি বরং ওয়েস্টব্রিজেই থাকি, দেখি রহস্যময় ওই ক্লাবের ব্যাপারে আরও কিছু জানা যায় কি না।

তারমানে, মনে মনে বললাম নিজেকে, হ্যাঙ্ক স্ট্রাউড আর বেথ ল্যাশলি। তবে তার আগে যোগাযোগ করা দরকার অগির সঙ্গে।

ইচ্ছা করলে আরও পরে করতে পারি আমি কাজটা। আসলে…একটা ইতস্তত ভাব পেয়ে বসেছে আমাকে। এত বছর আগের জঞ্জাল ঘাঁটতে কেন যেন ইচ্ছা করছে না। কেন যেন হানা দিতে ইচ্ছা করছে না অগির ব্যক্তিগত জীবনে। এবং এটাও মনে হচ্ছে, যা ঘটেছে এবং ঘটছে, তা জানানো উচিত অগিকে। আজব এই কেসে তার সাহায্য দরকার হতে পারে আমার।

কিন্তু একটা কথা মনে রাখতে হবে আমাকে। অগি, ডায়ানার বাবা। কাজেই আমি যা বলবো, তা হয়তো স্বাভাবিকভাবে না-ও নিতে পারেন তিনি।

রুট এইটির কাছাকাছি পৌঁছেছি, এমন সময় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। আমার স্টিয়ারিং হুইলে বিশেষ একটা সুইচ আছে, ওটার সঙ্গে বিনা-তারে যোগাযোগ আছে আমার মোবাইল ফোনের। সুইচটা চাপ দিয়ে কন্ট্যাক্টের নাম বললে মোবাইল ফোন থেকে অটো-ডিটেকশন পদ্ধতিতে ফোন করা যায়।

চাপ দিলাম সেই সুইচে, অগিকে কল করতে বললাম আমার সেলফোনকে।

হ্যালো, ন্যাপ, চিরাচরিত কর্কশ কণ্ঠে সম্ভাষণ জানালেন অগি।

চোখের সামনে যেন ভেসে উঠল অগির বিশালদেহী শরীরটা। তার বুকের ছাতিটা পিপার মতো। বললাম, হিলটন হেড থেকে ফিরেছেন?

হা…গতকাল রাতে।

তারমানে এখন বাসাতেই আছেন।

আছি। কেন?

আজ আমার ডিউটি শেষে দেখা করতে আসা যাবে?

কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। অগি কি দ্বিধায় ভুগছেন?

 বললেন, ঠিক আছে, অসুবিধা নেই।

 কেমন বেড়ালেন?

 দেখা হলে বলবো, লাইন কেটে দিলেন অগি।

 এত তাড়া কেন অগির?

 তিনি কি বাসায় একা? নাকি তার কোনো বান্ধবীর সঙ্গে আছেন?

গার্লফ্রেন্ড বললাম না, কারণ গার্লফ্রেন্ড বলতে যে-বয়সের মেয়েদের বোঝায়, তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার মতো বয়স নেই অগির। তিনি তাই বন্ধুত্ব করেন বেশি বয়সের মহিলাদের সঙ্গে। সে-রকম কেউ কি আছে এখন তার সঙ্গে?

থাকলে থাকুক, আমার কী?

.

ওক স্ট্রীটের একটা ব্রিক গার্ডেন অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন অগি। তার মতো আরও কয়েকজন ডিভোর্সপ্রাপ্ত-নিঃসঙ্গ-পুরুষ থাকেন ওখানে।

আজ থেকে আট বছর আগে ডায়ানার মা অড্রের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় অগির। তখন তিনি গিয়ে ওঠেন ওই অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে। নিজেদের সেই বাড়ি…যেখানে তারা দুজনে বড় করে তুলেছিলেন ডায়ানাকে…ছেড়ে আসতে কতখানি কষ্ট হয়েছিল অগির, জানি না। মেয়েকে হারিয়েছেন তিনি, ভুল বোঝাবুঝির কারণে হারালেন মেয়ের মাকে, তারপর হারালেন এতদিনের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটা।

 দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে গাড়ি পার্ক করলাম অ্যাপার্টমেন্ট হাউস-সংলগ্ন রাস্তার একদিকে। জীবনের বাস্তবতা কখনও কখনও আসলেই জীবন কেড়ে নেয় মানুষের কাছ থেকে। অগিকে ডিভোর্ড দেয়ার কয়েক মাস পর তাঁকে কিছুই না জানিয়ে তাঁদের সেই বাড়ি বিক্রি করে দেন অড্রে।

ডোরবেলে চাপ দিলাম আমি, দরজাটা খুলে দিতে বেশি সময় নিলেন না অগি। এখানে আগেও এসেছি আমি, জানি দরজাটা খুলে দেয়ামাত্র দেখতে পাবো ছোট্ট একটা করিডর; সেখানে এখন দেখতে পাচ্ছি অগির কয়েকটা গল্ফ ক্লাব।

কেমন বেড়ালেন? ড্রয়িংরুমের একটা সোফায় বসতে বসতে জবাব–পাওয়া প্রশ্নটা আবার জিজ্ঞেস করলাম আমি।

ভালো।

ইঙ্গিত করলাম করিডরের দিকে। গল্ফ-ক্লাবগুলো নতুন কিনেছেন নাকি?

মাথা ঝাঁকালেন অগি। কিন্তু আমি গল্ফ খেলি না।

 তা হলে?

ওগুলো যোভনের জন্য।

ডান ভ্রু’র কাছটা চুলকালাম আমি। য়োভন…সুন্দর নাম। বুঝে নিলাম, অগির নতুন সঙ্গিনীর নাম ওটা।

ভদ্রমহিলার সঙ্গে এখনও দেখা হয়নি আমার, কথা হয়নি। তবে কল্পনা করে নিলাম, যেহেতু অগির সঙ্গিনী, সেহেতু ভদ্রমহিলা নিশ্চয়ই আত্মবিশ্বাসী; তিনি যখন হাসেন, একান-ওকান হয়ে যায় তার হাসি। জড়াজড়ি করে যখন হাঁটেন তাঁরা, তখন তাদেরকে কেমন দেখায়, কল্পনা করার চেষ্টা করলাম সেটাও।

একদৃষ্টিতে দেখছি অগিকে। কাঁধ ঝাঁকালেন তিনি।

স্থানীয় চিত্রমেলায় যেতে পছন্দ করেন অগি, সেখান থেকে কিনে আনেন নিত্যনতুন পেইন্টিংস। একই পেইন্টিং দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রাখেন না ঘরের দেয়ালে। মাস-দুমাস পর পরই ঘরের পেইন্টিংস বদলানো তাঁর একটা শখ। ওক কাঠে বানানো কয়েকটা বুকশেল্ফ আছে ড্রয়িংরুমে, সেগুলোর সামনের দিকে কাঁচ লাগানো; প্রায় প্রতিটা শেল্ফই বইয়ে-ঠাসা।

 অগি একজন সর্বগ্রাসী পাঠক। তাঁর মতো বইপড়ুয়া লোক আর দেখিনি আমি। ফিকশন আর ননফিকশন–এই দুই ক্যাটাগরিতে ভাগ করে ফেলেছেন তিনি তার বইগুলোকে। শুধু যা করেননি তা হলো: লাইব্রেরির মতো বর্ণানুক্রম অনুযায়ী সাজাননি বইগুলো।

ব্যক্তিগত কোনোকিছু দিয়েই ড্রয়িংরুম সাজাননি অগি। কোনো ফটোগ্রাফ নেই, সার্টিফিকেট নেই, পুরস্কার নেই। নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট না।

ডিউটি শেষ? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

হ্যাঁ। আপনার?

আমারও।

অগি এখনও ওয়েস্টব্রিজ পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ক্যাপ্টেন। আর এক বছর পর চাকরির মেয়াদ শেষ হবে তার। তিনি যদি আমাকে সময়ে-সময়ে গাইড না করতেন, আজ আমি পুলিশে চাকরি পেতাম না অথবা পেলেও চাকরি করতে পারতাম না।

আমার হাতে ওয়াইনের একটা বোতল দিলেন তিনি। ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখলাম বোতলটা। দুশ ডলার দাম।

চমৎকার, বললাম আমি।

খোলো ওটা।

এত দামি একটা বোতল…বিশেষ কোনো উপলক্ষে খুললেই কি ভালো হতো না?

বোতলটা আমার হাত থেকে বলতে গেলে কেড়ে নিলেন অগি, নিজেই ভ্রু খুলছেন। দামি মদের বোতল শুধু বিশেষ উপলক্ষে খুলতে হবে…কে শিখিয়েছে তোমাকে? তোমার বাবা?

একটুখানি হাসলাম। না।

যখন ছোট ছিলাম, আমাদের দাদার-বাবার কথা প্রায়ই বলতেন বাবা। আমাদের দাদার-বাবা নাকি ভালো মন্দ সবসময়ই রেখে দিতেন বিশেষ কোনো উপলক্ষের জন্য। প্যারিসে থাকতেন তিনি; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনি যখন হামলা চালায় ওই শহরে, তখন মারা পড়েন তিনি। কোনো এক বিশেষ উপলক্ষের কথা ভেবে ভালো মদ সঞ্চয় করে রেখেছিলেন তিনি তাঁর বাসার সেলারে, সেই উপলক্ষ আর দেখে যেতে পারেননি তিনি। এবং তার সেই মদ যায় নাৎসি সৈন্যদের পেটে।

 আমাদের দুই ভাইকে এ-রকম আরও কিছু ঘটনা জানিয়ে বাবা জিজ্ঞেস করতেন, বলো তো, কী শিখলে?

মুখ চাওয়াচাওয়ি করতাম আমরা দুই ভাই।

বাবা তখন নিজেই বলে দিতেন উত্তরটা: কোনো উপলক্ষের কথা ভেবে নিজেকে ভালো জিনিস থেকে বঞ্চিত করার মানে হয় না। কারণ তুমি জানো না, সেই উপলক্ষ তোমার জীবনে আদৌ আসবে কি না।

তাই ভালো ভালো জিনিস ব্যবহার করে বড় হয়েছি আমরা দুই ভাই। সবসময় ভালো ভালো কাপড় পরেছি আমরা। ওয়াটারফোর্ড ক্রিস্টালের সুদৃশ্য গ্লাসে পানি খেয়েছি সবসময়। বাবা যখন মারা যান, তখন তাঁর ওয়াইন সেলার বলতে গেলে খালি ছিল।

তিনি বলতেন, যতক্ষণ বেঁচে আছ, ভরপুর বেঁচে থাকার চেষ্টা করা। ধুঁকতে ধুঁকতে বেঁচে থাকাকে বেঁচে-থাকা বলে না।

সেই তিনিই তার যমজ দুই ছেলের একজনের লাশ ট্রেন-লাইনের উপর পেয়ে জীবনূত হয়ে গেলেন, ধুঁকতে ধুঁকতে কিছুদিন বেঁচে থাকার পর একদিন হঠাৎ মারা গেলেন।

কী খবর, ন্যাপ? নিজের মদের-গ্লাসে চুমুক দিলেন অগি।

রেক্সের হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে মোরার ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া পর্যন্ত যা যা ঘটেছে, বললাম তাকে। মদ খেতে খেতে আমার সব কথা শুনলেন তিনি, টু শব্দটাও করলেন না।

ঘটনার বর্ণনা শেষ করে জানতে চাইলাম, কী বুঝলেন?

আমার মুখোমুখি আরেকটা সোফায় বসেছিলেন অগি, উঠে দাঁড়ালেন। আমার কেস না। কাজেই কোনোকিছু বোঝাটাও আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। তবে তুমি নিশ্চয়ই কিছু একটা বুঝতে পেরেছ?

কী বুঝতে পেরেছি?

 মোরার ব্যাপারটা।

মোরার কোন্ ব্যাপারটা? নিজের মদের-গ্লাসে ছোট একটা চুমুক দিলাম।

জবাব না দিয়ে কিছুক্ষণ পায়চারি করলেন অগি। তারপর হঠাৎ করেই মুখোমুখি হলেন আমার। আমি যদি অনুমান করি, রেক্সের হত্যাকাণ্ডকে লিও আর ডায়ানার মৃত্যুর সঙ্গে জোড়া দিতে চাইছ তুমি, তা হলে কি ভুল হবে?

জোড়া দিতে চাইলেও জোড়া দিতে পারবো কি না, সন্দেহ আছে আমার।

জোড়া দিতে চাওয়ার ইচ্ছা হলো কেন তোমার?

রেক্স আর লিও একজন আরেকজনকে ভালোমতো চিনত।

রেক্স হয়তো ডায়ানাকেও ভালোমতো চিনত। তোমরা সবাই একই ক্লাসে পড়তে না? …আমাদের শহরটা তখন এত বড় ছিল না।

কথা বের করা যাচ্ছে না অগির পেট থেকে। সঙ্গে-করে-আনা ব্যাগ থেকে ইয়ারবুকটা বের করলাম আমি।

ওটার দিকে বিষদৃষ্টিতে তাকালেন অগি। একমাত্র সন্তানকে হারানোর কষ্ট এখনও যায়নি তাঁর বুক থেকে।

কন্সপাইরেসি ক্লাব আর রুপার পিনের ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম অগিকে। শুনতে শুনতে একটুখানি হাসলেন তিনি।

তো…এখন তোমার থিউরিটা কী, ন্যাপ?

কিছু বললাম না আমি।

হাসিটা চওড়া হলো অগির। তারমানে তোমার ধারণা, ওই সামরিক ঘাঁটির গোপন কোনোকিছুর খোঁজ পেয়ে গিয়েছিল কন্সপাইরেসি ক্লাব? এমন কিছু, যার কারণে চিরতরে চুপ করিয়ে দিতে হয়েছিল লিও আর ডায়ানাকে?

আরেক চুমুক মদ খেলাম। জবাব দিলাম না। যা বলার, বলেছি আমি। এবার যদি কথা বের করতে হয় অগির পেট থেকে, বেশিরভাগ সময় চুপ করে থাকতে হবে আমাকে। অনেক বছর আগের একটা কষ্টে ভুগতে ভুগতে যা-বলার তিনিই বলবেন।

 আবারও পায়চারি শুরু করলেন অগি। এবার…পনেরো বছর পর…চুপ করিয়ে দিতে হয়েছে রেক্সকে। তোমার থিউরি যদি ঠিক হয়, যে বা যারা খুনগুলো করছে, তাদের জন্য পনেরো বছর আগে হুমকিস্বরূপ ছিল না রেক্স। সেই খুনিরা…সিক্রেট এজেন্টরা…এত বছর পর আবার, সক্রিয় হয়েছে।

 আগেরবারের মতো হঠাৎ থেমে দাঁড়ালেন অগি, আগেরবারের মতোই মুখোমুখি হলেন আমার। মদের বোতলটা যেভাবে থাবা দিয়ে কেড়ে নিয়েছিলেন আমার হাত থেকে, এগিয়ে এসে সেভাবে ছোঁ মেরে নিয়ে নিলেন ইয়ারবুকটা। কয়েকটা পাতা উল্টে থামলেন একজায়গায়।

 বেথ ল্যাশলি, বললেন তিনি। সে-ও কি…মানে, ওকেও কি খুন করা হয়েছে?

 মনে হয় না। ওর মৃত্যুর ব্যাপারে…বলা ভালো ওর ব্যাপারে কোনোকিছু শুনিনি আমি।

আবারও পাতা উল্টালেন অগি। হ্যাঙ্ক স্ট্রাউড। আমি জানি এখনও এই শহরেই আছে ছেলেটা। এবং বেঁচে আছে।

আবারও পাতা উল্টালেন তিনি, এবং সঙ্গে সঙ্গে স্থির হয়ে গেলেন মূর্তির মতো।

স্থির হয়ে গেছে তাঁর হাতে-ধরা ইয়ারবুকও। এবং যেন স্থির হয়ে গেছে। এই ঘরের সময়।

 অখণ্ড নীরবতা এখন আমার চারদিকে। অগির চোখের পলক পড়ছে না, তাকিয়ে আছেন তিনি ইয়ারবুকের বিশেষ একটা পাতার দিকে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, বেদনা নামের আবেগটা একটু একটু করে জমাট বাঁধছে তাঁর চেহারায়। এতক্ষণ স্থির হয়ে ছিলেন, এখন অল্প অল্প কাঁপছে তাঁর হাত। সান্ত্বনা জানানোর জন্য কিছু একটা বলতে চাইলাম, কিন্তু কথা ফুটল না আমার মুখে। সন্তান-হারানো বাবাকে সান্ত্বনা জানানোর মতো কোনো কথা থাকতে পারে না এই পৃথিবীতে।

কাজেই চুপ করে থাকলাম। মুহূর্তের পর মুহূর্ত কেটে যাচ্ছে।

নিজের সতেরো-বছর-বয়সী মেয়ের ফটোর দিকে তাকিয়ে আছেন অগি, আর আমি তাকিয়ে আছি তার দিকে। আজ থেকে অনেক বছর আগে একরাতে আমার ভাইয়ের সঙ্গে ঘুরতে বের হয়েছিল মেয়েটা, তারপর আর। ফেরেনি।

একসময় কথা বলে উঠলেন অগি। তাঁর কণ্ঠ শুনে মনে হলো, তার গলা চেপে ধরে রেখেছে কেউ।

তখন ওদের বয়স ছিল কম, ন্যাপ।

টের পেলাম, মদের গ্লাসে শক্ত হয়ে চেপে বসেছে আমার আঙুলগুলো।

তখন ওরা ছিল বোকাটে, অনভিজ্ঞ। মদ খাওয়াকে বীরত্বপূর্ণ কিছু একটা বলে মনে করত, তাই দেদারসে গিলত। কেউ কেউ আবার মদের সঙ্গে মিশিয়ে নিত নেশার-বড়ি। …ঘটনাটা যে-রাতে ঘটেছিল, সে-রাতে ছিল ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। রাতও হয়েছিল অনেক। কেউ জানে না, রেললাইনের উপর দাঁড়িয়ে ছিল কি না ওরা দুজন। কেউ জানে না, নেশার ঘোরে হাত ধরাধরি করে হাসতে হাসতে রেললাইন উপর দিয়ে দৌড়াতে শুরু করেছিল কি না ওরা। কেউ জানে না, চলন্ত ট্রেনের সামনে দিয়ে লাফিয়ে রেললাইন পার হওয়ার চেষ্টা করছিল কি না ওরা নেশার-ঘোরে। জিমি রিকো নামের একটা ছেলে ওই একই খেলা খেলতে গিয়ে অনেকের চোখের সামনে মরেছে উনিশ শ তিয়াত্তর সালে।

মন্তব্য করলাম না।

ঠিক কী ঘটেছিল, আসলে জানি না আমি, ন্যাপ। যদি জানতে পারতাম, ভালো হতো। যদি জানতে পারতাম, মুহূর্তের মধ্যে মারা গিয়েছিল কি না ডায়ানা…নাকি অনেকক্ষণ তড়পাতে হয়েছিল ওকে, ভালো হতো।

এবারও মুখ বন্ধ করে রাখলাম।

দেখো, নিজের মেয়েকে রক্ষা করাটা আমার দায়িত্ব ছিল। সে-দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছি আমি। সে-রাতে ওকে স্বেচ্ছায়-সজ্ঞানে যেতে দিয়েছি বাড়ির বাইরে। …মাঝেমধ্যে জানতে ইচ্ছা করে, সে যে মরতে চলেছে, তা জানা ছিল কি না ওর। জানতে ইচ্ছা করে, বাঁচার-আকুতিতে শেষবারের মতো আমাকে ডেকেছিল কি না চিৎকার করে। জানতে ইচ্ছা করে, শেষবারের মতো আশা করেছিল কি না, অলৌকিকভাবে হলেও আমি পৌঁছে যাবো ঘটনাস্থলে, বাঁচাবো ওকে।

চুপ করে আছি আমি। নড়ছি না। নড়তে পারছি না আসলে।

তুমি বোধহয় এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে চাইছ, না?

মাথা ঝাঁকালাম আমি।

ইয়ারবুকটা ফিরিয়ে দিলেন অগি। তা হলে ঘাটাঘাটির কাজটা একাই করতে হবে তোমাকে, আমি কিছু করতে পারবো না তোমার জন্য। একমাত্র সন্তানকে হারানোর কষ্টটা নতুন করে পেতে চাই না আমি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *