একটি অসমাপ্ত কবিতা

[ আমার প্রথম গল্পের কাহিনীটি আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।]

একটি অসমাপ্ত কবিতা

যেন এক অসমাপ্ত কবিতা। যার শুরু আছে শেষ নেই। আদৌ শেষ হবে কিনা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।

বছর পাঁচেক আগেই তাদের বিবাহিত জীবনের সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছিল কিন্তু হেলেনা তা ঘটতে দেয়নি। কাজটা খুব সহজ ছিল না। তবে মনের জোরেই সে সফল হয়েছিল বলা যেতে পারে।

অন্ততঃ তার শক্ত মনটা।

আর সেই কারণেই বোধ হয় জিম তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছিল, তাকে যদি আর একবার সুযোগ দেওয়া হয় তাহলে সে তার পথ এবং মত বদলাতে পারে।

অনেকদিন ভেবেছে হেলেনা। সত্যি এই ঘটনার পরে কি আর কোন সুযোগ দেওয়া উচিত জিমকে? ভাবতে ভাবতে অবশেষে ক্লান্ত হয়ে সেই সুযোগ দিলো হেলেনা। জীবন তো একটাই। তাকে এভাবে মাঝখান থেকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে কি লাভ? দেখাই যাক না, জিম নিজেকে বদলাতে পারে কিনা। সে তাকে প্রমাণ করতে পারে কিনা বিশ্বস্ত স্বামী হিসেবে। এমন ভালোবাসার অভিনয় এই প্রথম নয়। এর আগে বেশ কয়েকবার সে হেলেনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলো। হেলেনার বন্ধুরা প্রায়ই বলে থাকে, তার উচিত জিমকে ছেড়ে চলে আসা এবং তার সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ করা। কিন্তু বদ্ধপরিকর সে, তাদের বিয়েটা দীর্ঘায়িত করার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাবে সে।হেলেনা ভেবেছিল।

তারপর অতিবাহিত হয় আরো পাঁচ-পাঁচটি বছর। জিমের স্বভাবে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যায়নি। আগের মতোই বেপরোয়া উচ্চুঙ্খল জীবন যাপন করছে যদিও অভিনয়ের তাগিদে সেইসময় সে মুখের ওপর পরেছিল বিশ্বস্ততার মুখোশ। অফিস ছুটির পরেই বাড়িতে ফিরে আসতো। আগের সব আড্ডা বন্ধ করে দিয়েছিল। হেলেনাকে না নিয়ে বাড়ির বাইরে যেতো না।

প্রথম বছরটা কঠিন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে কাটলো। হেলেনা খুব সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ্য করছে প্রতিটি দিন। ঝানু গোয়েন্দার মতো স্বামীর প্রতিটি চলাফেরার ওপর রেখেছে কড়া নজর। যদি কোন সময় চোখে পড়ে কোন বেলেল্লাপনা তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তার আগের সিদ্ধান্তে ফিরে যাবে সে।

মনে হয় কেউ যেন টাইম বোমা বিস্ফোরণের প্রহর গুণে চলেছে। উদ্বিগ্ন হয়ে ভেবেছে না জানি কোনদিন তার জীবনে সেই পরম বিপর্যয় ঘনিয়ে আসবে। কিন্তু সেরকম কিছুই ঘটেনি। তারপর বছর দুই বাদে হেলেনা তার বন্ধুদের কাছে বলতে শুরু করল, সে সফল হয়েছে। একটা প্রকাণ্ড বিপর্যয়ের মুখ থেকে সে তাদের বিচ্ছেদটাকে রুখতে পেরেছে।

সময়ে সঙ্গে তাল দিয়ে হেলেনা তার বিশ্বাসটাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়। নিজের সাফল্যে সে স্বভাবতই গর্বিত। গর্ববোধ শেষ পর্যন্ত অহঙ্কারের দিকে মোড় নিলো। বন্ধুরাও তার গর্বের কথা ক্রমাগত শুনতে শুনতে হাঁপিয়ে উঠলো। ফলে তারা তাকে এড়িয়ে যেতে থাকে। হেলেনার তাতে কিছু আসে যায় না। বন্ধুরা তাকে ছেড়ে গেলেও জীবনের ধ্রুবতারার মত সে তো আঁকড়ে ধরতে পারবে তার স্বামী জিমকে। এবং সেই সঙ্গে সফল হবে তাদের বিবাহিত জীবনের প্রতিটি প্রহর।

তারপর এক রোববারে জিম তাকে নিয়ে এলিটে একটা সিনেমা দেখতে বেরোলো। সেই থেকে প্রায় প্রতি বোরবার সে সিনেমায় যাচ্ছে বলে একা একা বেরোতে থাকলো। হেলেনার ছবি দেখতে তেমন আগ্রহ নেই। সিনেমা বন্ধ হলে তার মাথা ধরে যায়। তাই জিমকে একা একাই ছবি দেখতে যেতে হয়। কিন্তু এর মধ্যে জিমের তেমন কোন দোষ সে খুঁজে পেলো না। মাথা ঘামাল না এ ব্যাপারে।

এক রোববার অনেক রাত করে বাড়ি ফিরলো জিম। হেলেনা তখন বিছানায় তার দেহটাকে এলিয়ে দিয়েছে। ছবি নিয়ে আর কোন আলোচনা হলো না। পরের দিন সকালে ঝড়ের গতিতে ব্রেকফাস্ট সারলো জিম। তবু সেই ফাঁকে হেলেনা জানতে চাইলো কালকের ছবি তার ভালো লেগেছে কিনা।

জিম কেমন যেন নিষ্ক্রিয় কণ্ঠস্বরে বলে–নতুনত্ব কিছু নেই।

আলোচনাটা সেখানেই থেমে গেল। জিম ঝড়ের গতিতে অফিসে চলে গেল।

সেদিন দুপুরে হেলেনা গেল হগ মার্কেটে মার্কেটিং করতে। টুকিটাকি জিনিস কেনার পর জেলির দোকানের সামনে সে থমকে দাঁড়ালো।

জিম সেদিন জেলির কথা বলেছিল। কিন্তু কি ধরনের জেলি তার পছন্দ তা তো জানে না। তাই সে ঠিক করলো-জিমকে তার অফিসে ফোন করে জেনে নিলে কেমন হয়। কথাটা মনে হতেই সে পাবলিক টেলিফোন বুথে গিয়ে জিমের অফিসের নাম্বার ডায়াল করলো।

জিমের সেক্রেটারী মিস পামেলা, রিসিভার তোলার আগে অনেকক্ষণ রিং হয়ে যাবার শব্দ হলো। তারপর একসময় সে রিসিভার তুলে খুব সংক্ষেপে কথা বললো।

তার গলায় স্বর বোঝার আগে তাকে একটু সময় অপেক্ষা করতে বললো। কারণ জিম অন্য লাইনে কথা বলছে।

জিমের চেম্বারে লাইনটা দেওয়ার সময় তার সেক্রেটারী সম্ভবতঃ ইন্টারকমের সুইচটা অফ করতে ভুলে গিয়েছিল। দূর থেকে ভেসে আসার মতোই জিমের গলা শুনতে পেলো সে। তবে অস্পষ্ট নয়। তবে কান পেতে শুনলে স্পষ্ট শোনা যায়?

হেলেনা উৎকর্ণ হলো—

 গতকাল তরুণী সোফিয়াকে দেখলাম। জিমকে বলতে শোনা গেল।

হেলেনার মুখটা কঠিন হয়ে উঠলো। এবং সেই সঙ্গে অবিশ্বাস এবং ঘৃণায় তার সারা মুখ ছেয়ে গেল।

তারপর জিমকে বলতে শোনা গেল–দেখ, আমার একটা ফোন এসেছে। একটু অপেক্ষা করো।

পরমুহূর্তেই হেলেনার রিসিভারে জিমের কণ্ঠস্বর সরাসরি শোনা গেল।

-হ্যালো। হ্যালো।

কিন্তু হেলেনা উত্তর দিলো না। রিসিভারটা নামিয়ে রাখলো সে। রাগে উত্তেজনায় তার মুখ থমথম করছিল তখন। নিউমার্কেটের একটা দোকান থেকে ফোন করেছিল সে। ফোন চার্জ মিটিয়ে দিয়ে তেমনই উত্তেজিত হয়ে সে বেরিয়ে আসতে গেল।

দোকানের মালিক অবাক চোখে নিরীক্ষণ করছিল তাকে। এবার তাকে জিজ্ঞাসা করলো, কি ব্যাপার? কি কারণে তার অমন রাগের কারণ ঘটলো?

এবারও হেলেনা কোন উত্তর দিলো না। কারো জন্যে অপেক্ষা করার সময় নেই তার কাছে। কোন কিছুর জন্য এখন এখানে দাঁড়াবার প্রয়োজন নেই।

বাইরে বেরিয়ে এসে তেমনি উত্তেজিত ভাবে এবং দ্রুতগতিতে সে পথ চলছিল। তার দুচোখে অবিশ্বাসের ছায়া। এমন একটা কিছু যে ঘটবে ভাবতেও পারেনি সে। একটা সিগারেটের দোকানের সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো। দোকানী তার পোডড়া চেহারা দেখে অবাক চোখে তাকালো। হেলেনার চোখের ভরা জল তখন আর কোন বাধা মানলো না। দুচোখের কোল ছাপিয়ে জলের ধারা নামলো। দুহাতে মুখ ঢেকে আবার তাড়াতাড়ি চলতে শুরু করল।

তারপর থেকে হেলেনা প্রায় সকাল সন্ধ্যে বাইরে কাটিয়ে দিতে থাকলো। কখনো বোটানিক্যাল গার্ডেন, কখনো জুওলজিক্যাল গার্ডেন। তার এই পরিবর্তন নিজের কাছেই কেমন যেন খাপছাড়া লাগে। তবে জিম তার ব্যাপারে কদাচিৎ মাথা ঘামিয়ে থাকে। আজও সে হেলেনার হঠাৎ এই পরিবর্তনে কোন কৌতূহল প্রকাশ করলো না। ওদিকে হেলেনা তখন ভীষণ ব্যস্ততায় মনের অসুখ সারাচ্ছে। বন্ধুদের কাছে তাদের দীর্ঘ বিবাহিত জীবনের সব গল্প, সব অহঙ্কার ধুলোয় মিশে যাওয়ার কথা চিন্তা করছে। এবং এই সব কথা চিন্তা করে অত্যন্ত হতাশ এবং উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে সে।

জিমের ওপর এখন তার যত না রাগ, তার চেয়ে বেশি রাগ গিয়ে পড়লো বন্ধুদের ওপর। কারণ কথাটা জানাজানি হয়ে গেল তারা কাকের মতো কা কা রব তুলে চীৎকার করে দেবে আর নিন্দায় সরব হয়ে উঠবে। তারা বলবে, হেলেনার স্বামী আবার তার আগের স্বভাবে ফিরে গেছে। হয়তো এটাই তার পথ এবং সোজা কথা হলো হেলেনা বড্ড বেশী অহঙ্কারী হয়ে উঠেছিলো।

এসব কথা তাদের কাছে জানাজানি হওয়ার মুহূর্ত মাত্র তাকে নিয়ে পূরণ করা সেই সব সরস গল্পগুলো আবার সকলের মুখে মুখে আলোচিত হতে থাকবে। হেলেনার চোখের সামনে হয়তো তার কপট সহানুভূতি জানাতে বসবে। মুখে রুমাল চাপা দিয়ে হাসবে। মনে মনে কৌতুক অনুভব করবে তারা। তাকে তার অহঙ্কারের কি ফল হতে পারে সেটা স্মরণ করিয়ে দেবে। একজনের জীবনে যেটা ব্যর্থতা, অপরের কাছে সেটা আনন্দের উপভোগের সামিল হয়ে দাঁড়ায়। আর হেলেনার এই ব্যর্থতা স্বভাবতই তাদের কাছে উপভোগ্য। মানুষ বড় বিচিত্র আর বিচিত্র তাদের মন।

আবার শুরু করে। হয় বাড়িতে সেই আগের মতো সন্দেহ। সেইরকম উত্তেজনা। একই বাড়িতে একই ঘরে থেকেও দুজনের মধ্যে রচনা হয় ব্যবধানের প্রাচীর। বেড়াল ইঁদুরের খেলা খেলবে দুজনে। জিমকে খুশী খুশী দেখাবে। কোন পরিবর্তন দেখা যাবে না। সে জানে এবং সবসময় তার ধারণা এইরকমই যে হেলেনা তার কোন খবরই রাখে না। রাখার প্রয়োজন মনে মনে করে না। অতএব তার এই পরিবর্তনের কথা সে এক বিন্দুবিসর্গ জানতে পারবে না। রোজকার অভ্যাস মতো প্রতি সন্ধ্যায় বাড়িতে গিয়ে জিম যখন তাকে জড়িয়ে ধরে তার ঠোঁটে উচ্চ চুম্বনের আলপনা এঁকে দেবে–তখন বাধ্য হয়েই হেলেনাকে মিথ্যে ভান করতে হবে না। যেন সে জিমের বর্তমান স্বভাবের কথা আদৌ জানে না। জানে না সোফিয়া নামে এক তরুণীর সঙ্গে জিমের নতুন বন্ধুত্ব হয়েছে। এই মিথ্যে অভিনয় করতে গিয়ে তার বুক ফেটে যাবে কিন্তু মুখ ফুটে কোন কথা বলতে পারবে না। এমনকি চোখের কোণে উদগত অশ্রুরেখাকে অতিকষ্টে সংবরণ করে ঠোঁটের কোণে সে ফুটিয়ে তুলবে হালকা হাসির ইশারা।

এই ভাবেই জিম তাকে ফেলে রেখে সিনেমা দেখতে গেলে অসভ্য হয়ে উঠবে সে। আস্তে আস্তে একদিন সে পাগল হয়ে উঠবে। আর জিমেরই বা কি চতুর কথা বলার কৌশল। জিম বেশ ভালভাবেই জানে, হেলেনা সিনেমা দেখে না। তাই সে বুদ্ধি করে তার কাছে সিনেমা যাওয়ার গল্পটা ফেঁদে বসে রোজ। কিন্তু এবার সে আর সহ্য করবে না। এবার সে কেবলই প্রবঞ্চিত হবে না। আর তার খেলার পুতুল হয়ে বসে থাকবে না। হেলেনা কথাগুলো খুব মন দিয়ে ভাবলো। সোফিয়া নামটা গলার কাছে আটকে গেছে।

তরুণী সেফিয়া। হ্যাঁ, অবশ্যই সে তরুণী। এ ধরনের মেয়েরা সবক্ষেত্রে অল্প বয়স্ক তরুণী হয়ে থাকে। তরুণী এবং সহানুভূতিহীন।

ক্ষণিকের সুখ-তৃপ্তির জন্যে সুখসংসার ভেঙে তছনছ করে দিতে কোন দ্বিধা নেই, কোন সংকোচ নেই তাদের। সম্ভবতঃ এই অঞ্চলেই থাকে। নামটা খুব চেনা চেনা। সোফিয়া? নামটা যে সে এর আগে শুনেছে এ ব্যাপারে একেবারে নিশ্চিত।

জিম ফোনে লোকটির নাম বলেছিল। হেলেনা জানে আর কজন লোক সোফিয়াকে চেনে। জিম কি এতই নির্লজ্জ? এতই বেহায়া? আবার হয়তো এমনও হতে পারে, আজ সে আর কাউকে পরোয়া করে না। সম্ভবত সে এখন চায় হেলেনা জানুক তার গোপন অভিসারের কথা। যাতে সে নিজে থেকেই ছেড়ে চলে যায়।

কিন্তু হেলেনা তাকে ছেড়ে যেতে দেবে না। কখনোই না। জিম তুমি যা চাইছে, তা তুমি পাবে না। পেতে পারো না। মানুষের বিশ্বাসের টুটি চেপে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে তুমি ওপরে উঠতে পারবে না।

হেলেনা ভাবলো, এখন তার কি করা উচিত। আর এখন জিমের অন্যায় কাজটা আর বেশিদিন চালিয়ে যেতে দেওয়া উচিত নয়। তাছাড়া জিমকে ছেড়ে আসার কথাটা সে চিন্তা করতে পারে না। অথচ সবাই যে বলবে সে ব্যর্থ, এই কথাটাও সে মানতে রাজী নয়। কিন্তু এসব কথা চিন্তা করতে গিয়ে তার মনে হলো, এবার কিছু একটা করা দরকার। হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। একটা সম্ভাবনার কথা মনে পড়ে গেল তার। আর সেই সম্ভাবনার মধ্যে যেন একটা অদ্ভুত থ্রিল আছে, রোমাঞ্চ আছে, উত্তেজনা আছে, ঠিক এই মুহূর্তে তার মত নির্যাতিত কত বধূ এই চিন্তাটিকে করছে এবং মনের ভয়ের জন্যে তারা চিন্তাটিকে বাস্তব রূপ দিতে সাহস পাচ্ছে না। এই প্রসঙ্গে এক অবহেলিত নির্যাতিত মহিলার কাহিনীটির কথা মনে পড়ে গেল।

ভদ্রমহিলা শেষপর্যন্ত তার লম্পট দুশ্চরিত্র স্বামীকে কিভাবে জব্দ করেছিল তার গল্প মনে পড়ে গেল হেলেনার।-লোকটি রোজ মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরতো আর রান্নাঘরে ডাইনিং টেবিলের ওপর ঘুমিয়ে পড়তো। তারপর ঘুম ভেঙে যেতেই পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট এবং লাইটার বার করে সিগারেট ধরাতো। একদিন তার স্ত্রী, মাতাল স্বামী ডাইনিং টেবিলের ওপর ঘুমিয়ে পড়তেই ইনডোর গ্যাসের সুইচটা অন করে দিলো। তারপর রান্নাঘরের সব জানালা দরজা বন্ধ করে বাইরে চলে গিয়ে সিঁড়ির মুখে অপেক্ষা করতে থাকলো।

লোকটা ঘুম থেকে উঠে জেগে সিগারেট খাওয়ার জন্যে যখন লাইটার জ্বালবে তখন রান্নাঘরে অবশ্যই বিস্ফোরণ ঘটবে। কারণ ইতিমধ্যে সমস্ত রান্নাঘর গ্যাসে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে।

হলোও তাই। লোকটা আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিল। পুলিশ জানলো, এটা দুর্ঘটনা মাত্র। অসাবধানতাবশতঃ গ্যাসের সুইচটি বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল মেয়েটি। একটি নিখুঁত খুন সংঘটিত হলো। কিন্তু কথা হচ্ছে, জিম তাকে সেরকম কোন সুযোগই দেয় না। সে যাইহোক। তাকে সুযোগ অবশ্যই করে নিতে হবে। হেলেনা মনে মনে ভাবতে থাকে কথাগুলো।

পরের রোববার জিম জানালো, সে আবার সিনেমা দেখছে যাচ্ছে। একটা খুব আকর্ষণীয় ছবি এসেছে। যে ছবিটা দেখার জন্য কয়েকদিন ধরে অপেক্ষা করছিল সে।

তাই নাকি? হেলেনা শান্ত কণ্ঠে বলে–ঠিক আছে। যদি তুমি একান্তই যেতে চাও তাহলে এক কাজ করো। ইভনিং শোয়েতে গিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসো। একা থাকতে আজকাল আমার ভীষণই ভয় করে। তোমাকে আমি বলিনি গত সপ্তাহে যখন রাত প্রায় এগারোটা হবে মনে হয় বাড়িতে বোধহয় চোর ঢুকেছিল।

–সেকি? জিম চমকে উঠে জিজ্ঞাসা করে–তুমি পুলিশে খবর দিয়েছিলে?

–না। পরের দিন সকালে এই প্রসঙ্গ নিয়ে মিসেস অ্যানের সঙ্গে আলোচনা করছিলাম। সে বলে, মনে হয় ও বোধহয় শব্দটব্দ শুনেছিল। মিসেস অ্যান তাদের পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা। দৃঢ় প্রকৃতির মহিলা। কোন ঝামেলায় যেতে চায় না। বিশেষ করে চুরি চামারির ব্যাপারে সে মুখে খুলতে চায় না। ভীষণ ভয় পেয়ে গেল সে। অতএব হেলেনা অতি সহজেই মিসেস অ্যানের কাছে কথাটা জাহির করতে সক্ষম হলো। মিসেস অ্যান বিশ্বাস করলো হেলেনার ফ্ল্যাটে সত্যি সত্যি চোর ঢুকেছিল সেদিন। প্রয়োজন হলে সে তাকে সমর্থন করে সাক্ষ্য দেবে। হেলেনা মনে মনে হাসলো। জিমের কথায় সম্বিত ফিরে পেলো।

–তাহলে তুমি কি চাও আমার বন্দুকটা বের করে রেখে যাবো? জিম জিজ্ঞাসা করে।

আর্মি থেকে সে একটা ৪৫ ক্যালিবারের রিভলবার বাড়িতে এনেছিল। এবং সেটা তার ড্রয়ারে তালা দিয়ে রেখেছিল প্রয়োজনে ব্যবহার করার জন্য। হেলেনা মাত্র একবারই সেটা দেখেছিল, তবে সে জানতো, সেটা জিমের ড্রয়ারের মধ্যেই আছে।

-ওসব জিনিস আমার ভীষণ ভয় লাগে। হেলেনা ভয়ে ভয়ে বললো।

-ওটা একটা সহজ ব্যাপার, জিম তাকে বোঝাবার জন্য চেষ্টা করে বললো-একটা রিভলবার কাছে থাকলে বুঝবে তুমি নিজেকে নিরাপদ মনে করতে পারবে।

-আমার নিরাপত্তার কথা তুমি এত গভীর ভাবে চিন্তা করো, হেলেনা বলল। হেলেনার কথার মধ্যে লুকিয়ে ছিল ব্যঙ্গ। জিম ধরতে পারলো না। তাই শব্দ করে হেসে উঠে বললো –নিশ্চয়ই। তারপর বেডরুমের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল–স্ত্রীর প্রতি প্রত্যেক স্বামীরই নজর দেওয়া উচিত। জিমের কথাগুলো কেমন সন্দেহজনক। হেলেনা বুঝতে পারলো।

জিম সেই ৪৫ ক্যালিবারের রিভলবারটা এনে বলল–এটা তোমার কাছে রেখে দাও। তখনই হেলেনা বলে–আজ রাতে রান্নাঘরের মেঝেটা সাবান সোডা দিয়ে ভিজিয়ে রাখবো। বড্ড নোংরা হয়েছে। তাই বলছিলাম কি তুমি পাশের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকো।

জিম উত্তর দেয়–ঠিক আছে তোমার যাতে সুবিধা হয় তাই করবো। টেবিলের ওপর রিভলবারটা রাখতে গিয়ে জিম বলল–এটা এখানে রইলো। বিপদের সময় মানুষের এটা পরম বন্ধু। আমাদের ফ্ল্যাটের যা দৈন্য চেহারা তাতে মনে হয় না কোন চোর চুরি করার প্রেরণা পাবে। তবু যদি আসে গুলিভর্তি রিভলবারটা রেখে যাচ্ছি। যদি কোন আগন্তুককে আসতে দেখো, জিম হাসতে হাসতে বলল, এটা তুলে নিও। এবং সঙ্গে সঙ্গে তাকে লক্ষ্য করে ট্রিগার টিপে দিও।

হেলেনা বলে–বুঝেছি। আমি তোমার উপদেশ মতোই কাজ করবো।

তারপর জিম সেখানে থেকে বেরিয়ে গেল। তখন রাত প্রায় আটটা হবে। হেলেনা চুপচাপ বসে রইলো সেখানে, তারপর তার দৃষ্টি পড়ে রইলো টেবিলের ওপর রাখা রিভলবারটার ওপর। নটার সময় মিসেস অ্যানের ফ্ল্যাটে গেল হেলেনা। সানডে ম্যাগাজিনটা তার কাছে। থেকে চেয়ে আনার জন্যে।

কিছুক্ষণ আগে জিম সিনেমা দেখতে গেল, হেলেনা বলল তাকে।

-তাহলে রাত বারটা পর্যন্ত তুমি তোমার ফ্ল্যাটে একলা আছে। মিসেস অ্যান কথাটা বলে তার দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকালো।

হা, হেলেনা তার কথায় সায় দিয়ে বলল, বাড়ি ফিরতে তার বারোটা-একটা হয়ে যাবে নিশ্চয়ই।

রাত সাড়ে দশটা নাগাদ ফ্ল্যাটের আলোেগুলো নিভিয়ে দিয়ে হেলেনা বেডরুমে প্রবেশ করল, শোয়ার আয়োজন করার জন্য। রিভলবার হাতে তুলে সঙ্গে নিয়ে এলো হেলেনা। বিছানায় নামিয়ে কৌচের ওপর বসলো সে। এবং অপেক্ষা করতে লাগল হাতে ধরা ঐ রিভলবারটা নিয়ে। দৃষ্টি প্রসারিত বাইরে রাতেই অন্ধকারে দিকে।…হেলেনা মনে মনে ছবি আঁকতে থাকলো। তার মনের আয়নায় জিম আর সোফিয়ার পাশাপাশি দুটো ছবি ভেসে উঠলো-জিম তাকে বলবে এখন থেকে তার কাছে সে একটু সকাল সকাল আসবে। সোফিয়া হয়তো প্রশ্ন করবে, কেন তোমার স্ত্রীর সঙ্গে গণ্ডগোল হয়েছে নাকি। জিম বলবে, না না, সেসব কিছু নয়। আসলে চোরের উপদ্রবে স্ত্রী ভীষণ আতঙ্কিত। ও যেন কেমন নার্ভাস হয়ে পড়েছে। সোফিয়া ধূর্ত চোখে তাকাবে। তার ঠোঁটে রহস্যময় হাসি খেলে যাবে। বলবে–তা তুমিও কি কম চোর। তারপর তারা দুজনেই হাসিতে ফেটে পড়বে। এ ওকে জড়িয়ে ধরে হাসিতে লুটোপুটি খেতে থাকবে।

এমন সময় হঠাৎ হেলেনা বাইরে বারান্দায় জিমের পায়ের শব্দ শুনতে পেলো। খুব ধীরে ধীরে হাঁটছিল সে। তার পায়ের শব্দ শুনে অন্ততঃ তাই মনে হলো। বেডরুমের কাছাকাছি আসতে হেলেনা জিমের হাতে চাবির গোছার শব্দ শুনতে পেল। পকেট থেকে সেই মুহূর্তে সে চাবির গোছাটা বের করল। ঠিক তখনই হেলেনার মাথায় রক্ত চড়ে গেল যেন। তার রাগ আরো বেড়ে গেল। মুখের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো। সে আরো কঠিন হলো। উঠে দাঁড়ালো। নো, নো মার্সি। এখন সেন্টিমেন্টের কোন প্রশ্ন নেই। রিভলবারটা দরজার দিকে তাক করে তেমনি উত্তেজিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইলো সে, তার হাতের একটা আঙুল ট্রিগারের ওপর শক্ত হয়ে বসলো। ডোর ল্যাচে চাবি ঢোকানোর শব্দ পেলো হেলেনা। পরক্ষণে দরজাটা খুলে গেল তার চোখের সামনে।

দরজার কপাটটা খুলে যেতেই বাইরের অস্পষ্ট আলোয় ঘরের জমাট অন্ধকারটা একটু বোধহয় ফিরে এলো। দরজার কপাটটা আবার বন্ধ হয়ে গেল। আবার অন্ধকার ঘনীভূত হয়েছে ইতিমধ্যে। জিম তখন ঘরের ভেতরে। অন্ধকারে এক ছায়ামূর্তি ঘরের ভেতর প্রবেশ করলো। আর এক ছায়ামূর্তি অপেক্ষা করছিল সেখানে তার জন্যে। জিম তাকে দেখতে পেলো। চিনতে পারলো। তখন সে স্তব্ধ হতবাক। হেলেনার হাতে তার রিভলবার। তার দিকে তাক করা।

হেলেনা!

জিম তাকে আবার দেখলো। কয়েক মুহূর্ত মাত্র। ঝলসানো বিদ্যুতের আলোয় ৪৫ ক্যালিবার গর্জে উঠলো। একটা পশুর শক্তি যেন তার দেহের ওপর নিয়োগ করা হলো এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা ধাক্কা খেয়ে টেবিলের ওপর আছড়ে পড়লো। তখন তার বুকের ভেতর আগুন জ্বলছিলো। সে আগুন নেভাবার মতো নয়।

হেলেনা এবার ধীরে ধীরে সুইচ বোর্ডের সামনে গিয়ে ঘরের সুইচের ওপর হাত রাখলো একটা যান্ত্রিক শব্দ উঠতেই ঘরটা আলোয় আলোকিত হয়ে উঠলো। সেই আলোয় হেলেনা তার দিকে বরফ চোখে তাকালো। তারপর সে চোখ ঢেকে চিৎকার করে উঠলো।

পুলিশ হেলেনাকে সহানুভূতি জানিয়ে গেল। বেশ ভালো ব্যবহার করলো তার সঙ্গে। হেলেনা খুব শান্ত ভাবে ঘটানাটিকে বলল। হেলেনার জবানবন্দী নেবার সময় একটুও সন্দেহপ্রকাশ করল কি কেউ?

হেলেনা তাদের বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে এবং কিছুটা নিজের সুনিপুণ অভিনয়ের গুণে : কেমন অনায়াসে একটা সাজানো গল্প শুনিয়ে দিলো। নিতান্ত দুবৃত্ত ভেবে তার হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর তাগিদেই তাকে রিভলবার ব্যবহার করতে হয়েছিল। হেলেনার বক্তব্য এইরকম। ঘটনার আনুপূর্বিক বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখের জলে ভাসিয়ে দিলো সবকিছু। সন্দেহ করা দূরে থাক, পুলিশ তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তবে একেবারে নিঃসন্দেহ হবার জন্যে পুলিশ হেলেনার পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা মিসেস অ্যানের কাছে গিয়ে খোঁজখবর নিলো। নীচু গলাতেই তারা গোপন আলোচনা করলে তার সাথে।

মিসেস অ্যানকে নানা প্রশ্ন ব্যতিব্যস্ত করে তুলেতে চাইলো। কিন্তু সন্দেহজনক কোন তথ্য সংগ্রহ করতে পারলো না। পুলিশ যাতে করে হেলেনাকে তার স্বামীর হত্যকারী হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে এমন কোন কু মিললো না। এমন কি মিসেস অ্যানও স্বীকার করলো যে, গত রোববার সে-ও হেলেনার ফ্ল্যাটে চোর ঢোকার শব্দ পেয়েছিলো। অতএব আজ ও জিমকে চোর ভেবে হেলেনার রিভলবার চালানোটা স্বাভাবিক ভাবেই গ্রহণ করলো পুলিশ। হেলেনাও শেষপর্যন্ত নিখুঁত অভিনয় করে গেল। মনে মনে ভাবলো, যে ব্যাপারটা কতই না সহজ বলে মনে হচ্ছে তার কাছে। সঙ্গে সঙ্গে তার মনটা খুশীতে ভরে উঠলো সোফিয়াকে আঘাত হানতে পারার জন্যে। এখন আমার ভীষণ ইচ্ছে করে সত্যি ঘটনাটা তোমাকে জানিয়ে দিই। তোমাকে এবং জিমকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে চেয়েছিলাম। এবং আজ আমি এক সফল নারী, এই কথাটা সবাইকে চিৎকার করে ডেকে বলবো।

কি ভেবে হেলেনা ব্যাপারটা চেপে গেল এখানেই।

 দুদিন পরের ঘটনা।

হেলেনা রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলো একা একা। মুখে তৃপ্তির হাসি। সোফিয়ার গোপন ইচ্ছেটা সে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিতে পেরেছে। সে আর কোন দিন কাটাতে পারবে না কোন আনন্দিত, বিননাদিত সন্ধ্যা অবসর।

সোফিয়া এখন আর তার কাছে ভয়ের কারণ নয়। সব ভয়ের ইতি টেনে দিয়েছে সে জিমকে সরিয়ে দিয়ে। কিন্ত এসব সত্ত্বেও পরিপূর্ণ একটা তৃপ্তির আমেজ উপভোগ করতে পারছিলো কৈ?

আরো একটা আকাঙ্খা তাকে কেবলই তাগিদ দিচ্ছিল সেই শুরু থেকে। যেদিন থেকে ঘটনার সূত্রপাত সেদিন থেকে। তার এখন ভীষণ ইচ্ছে মেয়েটিকে দেখার জন্য। কে সেই নারী? যে নারী জিমকে তার কাছ থেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। আচ্ছা সেই মেয়েটি কি তার থেকেও বেশী সুন্দরী?…ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ সে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো একটা জায়গায় এসে। তার পা দুটো কে যেন মাটির সঙ্গে পেরেক দিয়ে গেঁথে দিয়েছে। মুহূর্তে চলার শক্তি হারিয়ে ফেললো সে। তার বুকটা হাহাকার করে উঠলো। কথা বলতে পারছিল না। তখন দেহটা অবশ হয়ে আসছিল। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল। হেলেনা ভালো করে তাকালো ল্যাম্পপোস্টের দিকে। সেই ল্যাম্পপোস্টে সিনেমার বিজ্ঞাপন আর তলায় লেখা রয়েছে সোফিয়ার নাম!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *