আই, ডেম আগাথা

আই, ডেম আগাথা

জন্ম হয়েছিল আমার রক্ষণশীল পরিবারে।

বৃটিশ সমাজ ব্যবস্থা অনুসারে আমি ছিলাম সেই ফেলে আসা হারানো যুগের প্রতিনিধি। তখনও অবশিষ্ট ছিল ভিক্টোরিয়া যুগের নীলরক্তের অহমিকা। আর মাঝে মধ্যেই সমাজের এখানে ওখানে চোখে পড়তো সন্নিবদ্ধ মানব সভ্যতার অবয়ব। ছোট্টবেলাটা আমার কেটে গিয়েছিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা গ্রাম আর শহরের মধ্যে। ছোট থেকে কেমন ভাবুক আর উদাস প্রকৃতির ছিলাম আমি। সবসময় অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম প্রকৃতির রঙ্গশালার দিকে। দেখতাম কেমন করে সেখানে ঋতু পরিবর্তন হয়। শীতের দিনে হঠাৎ তুষারকণারা এসে ঢেকে দিতে সমস্ত পরিবেশ। মনে হতো প্রাণস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে গেছে বুঝি! আবার বসন্ত বাতাস বয়ে যাবার সাথে সাথে চারিদিকে জেগে উঠতে প্রাণের স্পন্দন। পৃথিবী নিজেকে সাজাতে মোহিনী ভালোবাসায়। এইসবই চোখে পড়তে আমার। ছোট থেকেই ছিলাম বেশ ভাবুক প্রকৃতির। সমবয়েসী বন্ধু-বান্ধবদের সাথে খেলাধুলা করতে খুব বেশী ভালো লাগতো না আমার। যখন তারা ব্যস্ত থাকতো খেলার মাঠে, আমি তখন চুপচাপ বসে বসে তাকিয়ে থাকতাম চারপাশের পরিচিত পৃথিবীর দিকে আর অবাক হয়ে দেখতাম মানুষজনের দিকে।

কত বিভিন্ন চরিত্র চোখের সামনে ভেসে উঠতো আমার। মনে হতো, প্রত্যেকেই যেন তাদের না বলা কথা শোনাতে চাইছে। ঐ যে আঙ্কেল পিটার, তার চেহারার মধ্যে কেমন একটা শেয়ালের মত ধূর্ততা লুকিয়ে আছে বুঝি। অথবা আণ্টি মেরী তিনি কি সত্যি সত্যি যীশুর উপাসনা করেন নাকি। এমনভাবেই সকলকে চেষ্টা করেন।

হোটবেলা থেকেই মনে হতো আমার প্রতিটি মানুষ তার মুখের ওপর একটি মুখোশ পরে ঘুরে বেড়ায়। আর এই মুখোশের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা সত্যিকারের মুখের ছবিটি চোখের সামনে ফুটিয়ে তুলতেই বুঝি আগ্রহী ছিলাম আমি। কে জানে হয়তো তখন থেকেই মনে মনে স্থির করেছিলাম ভবিষ্যতে আমাকে হতে হবে একজনের রহস্য কল্পকার। তাহলেই পৃথিবীর অনেক গোপন রহস্য সহসা উন্মোচিত হয়ে যাবে আমার কাছে।

দেখতে দেখতে অতিক্রান্ত হলো ছোটবেলার সুন্দর সোনালী দিনগুলো, আমি পা রাখলাম কৈশোর কালে। তখনও আমার মনের মধ্যে অনুসন্ধিৎসা কিন্তু একেবারে নির্বাপিত হলো না। তখন আমার পরিধি অনেক বৃহত্তর হয়ে গেছে। আমি পরিচিত বন্ধু-বান্ধবদের গণ্ডী পার হয়ে হাজির হয়েছি আরো অনেক নতুন মানুষের সন্ধানে। নিত্য নতুন মানুষ এসে কড়া নাড়ছে মনের দরজায়। কি বিচিত্র তাদের রূপ, কি অদ্ভুত তাদের প্রকৃতি। সকলেরই বোধহয় সেই না বলা কথার অ্যালবাম কখনও রয়ে গেছে মনের মধ্যে জমা, আর আমাকেই দায়িত্ব দিয়েছে তারা, তার থেকে সুন্দর কাহিনী বের করে সকলের সামনে উপস্থাপিত করতে।

ছোট থেকেই ডায়েরি লেখার শখ ছিল আমার। ডায়েরির মধ্যে লিখে রাখতাম নানা অদ্ভুত ঘটনাকে। পরবর্তীকালে আমার অনেক গল্পের উপকরণ হিসাবে আমি ব্যবহার করেছি ডায়েরির সেইসব ঘটনাকে।

খবরের কাগজের পাতায় চোখ রাখতে ভীষণ ভালোবাসতাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তাম সমস্ত সংবাদ। হঠাৎ কোথাও ঘটে যাওয়া কোন হত্যাকাণ্ডের খবরে আমি কেমন বিচলিত বোধ করতাম। আর ভাবতাম এর অন্তরালে নিশ্চয়ই কোন এক রহস্য লুকিয়ে আছে। নাহলে মানুষ কেন ফুলের মত নিষ্পাপ আর একটি মানুষকে অকারণে সরিয়ে দেবে পৃথিবীর বুক থেকে।

এমনভাবেই তৈরী হতে থাকে আমার অনুসন্ধিৎসু মন। আর কোহলী মনন আর নিজেকে আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকি ভবিষ্যতের লেখিকার পদে আসীন হবো বলে।

ইতিমধ্যে একটি ঘটনাতে ইংল্যাণ্ড জুড়ে দারুণ হৈ চৈ সৃষ্টি হয়েছিলো।

দুই কিশোরী মেয়েকে কে বা কারা রাতের অন্ধকারে শ্বাসরোধ করে খুন করে খামারবাড়ীতে তার মৃতদেহ ফেলে পালিয়ে যায়। যথানিয়মে পুলিশ আসে। সমস্ত সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় বড় বড় অক্ষরে প্রকাশিত হয়, এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সচিত্র বিবরণ। তারপরেই আমার মনে হয়েছিলো, এর ভেতরে নিশ্চয়ই কোন আত্মীয়স্বজন উপস্থিত আছে। তা নাহলে বাইরের কারো পক্ষে এমনভাবে ঐ প্রাসাদোপম দুর্গ বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে দুটি মেয়েকে হত্যা করা কোনমতেই সম্ভব নয়। এমন কি আমার মনের এই অনুমানের কথাটা জানিয়ে দিলাম বাবাকে। বাবা প্রথমে বিশ্বাস করতে চান নি। এ তাঁর কিশোরী মেয়ের নেহাতই কল্পনার কথা। কিন্তু সত্যি সত্যি একদিন গোয়েন্দারা বের করে আনলো যে, ঐ দুটি নিষ্পাপ কিশোরীর সম্মাই ছিলো তাদের খুনের অন্তরালে। তখন সমস্ত পরিবারে আমার সম্মান ও খাতির এক মুহূর্তে অনেকখানি বেড়ে গেল। সকলে আমাকে ডাকতে লাগলো খুদে গোয়েন্দা বলে। আর মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ইচ্ছের পাখী আকাশে মেলে দিলো তার ডানা। সত্যি সত্যি আমি বোধহয় তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শক্তির সাহায্যে একের পর এক রহস্য বের করে পৌঁছে যাবো আমার নির্দিষ্ট লক্ষ্যপথে, এমনটি ধারণা হতে লাগলো আমার।

স্কুলের অবসরে, ছুটির সময়, বরষার সন্ধ্যায় আমি মাঝে মধ্যেই কাগজের ওপর কিছু কিছু গল্প লেখার চেষ্টা করতাম। গল্প না বলে সেগুলোকে বরং বলা যেতে পারে গল্পের খসড়া। সেই খসড়া থেকেই স্কেচের মত অনেক ছোট গল্পের জন্ম হয়েছে ভবিষ্যতে, আর সতেরো বছর বয়েসেই আমি প্রথম একটি উপন্যাস লেখার চেষ্টা করি। পরবর্তীকালে অবশ্য এই উপন্যাসটি প্রকাশ করিনি। কিন্তু আমার মনে এই উপন্যাস যথেষ্ট প্রেরণার সৃষ্টি করে। এই প্রথম আমি বিচিত্রতর ক্যানভাসে অনেকগুলি চরিত্রের মাধ্যমে অনেক কথাকে প্রকাশ করতে পেরেছিলাম কাগজ আর কলমের সাহায্যে। হলোই বা এক ব্যর্থ প্রয়াস। কিন্তু ভবিষ্যতে সাহিত্য জীবনে চলার পথে এই উপন্যাসটির নাম আমি কোনদিন মুছে ফেলতে পারবো না। পড়াশুনার পাট শেষ করে যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করি তখন আমার মধ্যে একটি বোধ জেগে ওঠে যে, আর কিছু নয়–পেশাগতভাবেই আমাকে লেখিকা হতে হবে। কেননা পেশার সঙ্গে লেখাকে যোগ না করলে আমি কোন দিন পৌঁছতে পারবো না আমার স্বপ্নের রাজপথে। আমাকে চিরদিনেই শখের লেখিকা হিসেবে পরিচিত হতে হবে, যা মোটেই কাম্য নয়। তাই শুরু হলো আমার সারাদিন রাতের প্রয়াস। এমন কি রাতের পর রাত কাটাতে লাগলাম আমার নিরন্তর সাধনাতে। আর ঠিক অবসরে আত্মপ্রকাশ করে আমার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস

প্রথম উপন্যাসটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকমহলে সাড়া পড়ে যায়। প্রশংসার চিঠি পেতে থাকি আমি। মন ভরে ওঠে এক আশ্চর্য প্রশান্তিতে। তাহলে আমিও পারি আমার মনের ভাব আর ভাবনাকে কথার মাধ্যমে প্রকাশ করে তা পৌঁছে দিতে সাধারণ পাঠক-পাঠিকাদের মনের কাছে।

শুরু হয় নিরন্তর সাধনা। যা ছিলো নেহাতই খামখেয়ালী মনোভাবের প্রকাশ, এখন তার মধ্যে এসেছে পেশাদারিত্ব মনোভঙ্গী। আমি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিয়েজিত করলাম আমার লেখার জগতে। ধীরে ধীরে জমে উঠতে থাকে আমার লেখনী, একের পর এক নতুন নতুন লেখার মাধ্যমে আমি অচিরেই লাভ করি পাঠকসমাজের কাছে স্বীকৃতি। সত্যি কথা বলতে কি, সাহিত্য জীবনে চলার শুরু থেকেই এমন অজস্র অভিনন্দন আর প্রশংসা না পেলে হয়তো আমার পক্ষে এতখানি পথ অতিক্রম করে আজ এখানে এসে উপনীত হওয়া সম্ভব হতো না।

বিভিন্ন পত্রিকাতে নিয়মিত লেখার আমন্ত্রণ আসতে থাকে। এ ব্যাপারে আমি ছিলাম অত্যন্ত সাবধানী। সব পত্রিকাতে লিখতাম না। তখনকার বিখ্যাত কয়েকটি মাত্র পত্রিকার পাতাতেই ধারাবাহিক উপন্যাস এবং গল্প লিখতাম আমি ।

অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেছেন যে–কেন আমার প্রধান চরিত্র এরকুল পোয়ারোকে এরকম সাজিয়েছি? যখন অন্যান্য বিখ্যাত গোয়েন্দারা ঝকঝকে স্মার্ট, সুতনু সুদেহী যুবক, তখন আমার গোয়েন্দা কেন এক প্রৌঢ়, মাথায় টাক? এর অনেক উত্তর আছে। তবে তার প্রথম কথা হলো, আমি দেখাতে চেয়েছি যে, গোয়েন্দা আমাদের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে। তাদের চেহারার মধ্যে এমন কোন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থাকে না যা তাকে অন্য সকলের থেকে আলাদা করে দেয়। শুধু আছে তার একটি ক্ষুরধার মস্তিষ্ক, আর তার সাহায্যে সে একের পর এক রহস্য ভেদ করে। ঠিক যেমন আমার গোয়েন্দা এরকুল পোয়ারো বিন্দুমাত্র আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার না করে, হিংসা বা মারামারির আশ্রয় না নিয়ে, একের পর এক রহস্যজাল ভেদ করেছে। তেমনই কত গোয়েন্দা লুকিয়ে আছে আমাদের চারপাশে, কেউ তার খবর রাখে না।

লিখতে লিখতে মনে হয়েছে আমার, শুধুমাত্র একটি গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টি করলেই বোধহয় সমস্ত কথা আমি ঠিকভাবে প্রকাশিত করতে পারবো না। তাই জন্ম হয়েছে মিস মারপলের। ইংরেজী সাহিত্যে এর আগে এমনভাবে কোন মহিলা গোয়েন্দার আবির্ভাব হয়েছে বলে আমার জানা নেই। সেদিন থেকে আমার মিস মারপল সত্যি সত্যি এক অনন্য সাধারণত্বের দাবী করতে পারে। তাকেও আমি দেখিয়েছি এক আশ্চর্য চরিত্রে নারী হিসেবে। তার চোখ দুটি ঘুরছে কোন নতুনতর সহস্য অন্বেষণে। একের পর এক ক্লান্তিহীন অভিযানে সে ভেদ করছে রহস্য যবনিকা আর নতুনতর সূর্যোলোকে উদ্ভাসিত হচ্ছে তার মুখ।

পার্কার পাইন হলো আমার তৃতীয় গোয়েন্দা। তাকেও কি অন্য সকলের থেকে একটু আলাদা হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে? পার্কার পাইন জীবনের বিচিত্রতর অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ মানুষ। অনেকবার তাকে দেখা গেছে উপত্যকায় নির্লিপ্তভাবে পায়ে হেঁটে যেতে। আবার কখনো কখনো বা সে ভাবিত ও তাড়িত হয়েছে অতি সামান্য সমস্যা সমাধান করতে, পার্কার পাইনের মধ্যে লুকিয়ে আছে আধুনিক সমাজ ও সভ্যতার আশ্চর্য গল্প গাথা। সত্যি সত্যি তো মাঝে মধ্যে আমরা বিরাট সমস্যার সামনে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াই। কোন সমস্যাকে সহসা অতিক্রম করতে ভয় লাগে আমাদের। আমার আর একটি যুগল গোয়েন্দা আছে। তার নাম হয়তো ইতিমধ্যে আপনারা জেনে ফেলেছেন, টু ফ্রেন্ডস অব টনি। এরা মাঝে মাঝেই এমন সব কাণ্ডকারখানা বাঁধিয়ে তোলে, যা হাসির সাথে সাথে প্রচণ্ড কৌতূহলের সৃষ্টি করে, অবশ্য বিরাট লেখনী সম্ভারের মধ্যে এই জোড়া গোয়েন্দাকে আমি খুব একটা বেশী ব্যবহার করিনি। কেননা সত্যি বলতে কি, এদের প্রতি কেমন একটা মায়া আছে আমার। তাই বার বার ব্যবহার করলে পাছে এদের প্রতি আপনাদের ভালোবাসা কমে যায়, তাই তাদের ইমেজকে রক্ষা করে চলতে হয়েছিলো আমাকে। এবার আমার লেখার প্রসঙ্গে কিছু বলি। আমার লেখার প্লট বা কাহিনীর গল্প গাথায় ছড়িয়ে আছে সেই যে কি যেন বলছিলাম, আমার ফেলে আসা জীবনের কথা। বৃটিশ রক্ষণশীলতা, অনাবিল প্রকৃতি বিচিত্র মানুষ–এসব নিয়েই তো কেটে গেছে আমার শৈশবকাল।

জন্মেছিলাম আমি টর্কিটে। আর যখন প্রথম উপনন্যাস লিখি তখন সবেমাত্র শেষে হয়েছে। অথবা শেষ হতে চলেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এই বিশ্বযুদ্ধ আমাদের প্রচলিত ধ্যানধারাণার মূলে কুঠারাঘাত করেছিলো। এতদিন পর্যন্ত যে সমস্ত ঘাত-প্রতিঘাতকে আমরা জীবনের চরমতম অবলম্বন বলে ধরেছিলাম, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দশকে যারা জন্মেছিলো হৃদয়ের সঙ্গে আত্মার আত্মীয় হয়ে হঠাৎ দেখা গেল সেইসব প্রথাগত ধারণার মূলে কারা যেন কুঠারাঘাত করেছে আর নূতন ঊনবিংশ শতাব্দী এসে সজোরে কড়া নাড়ছে মনের দরজায়।

বিশ্বযুদ্ধ যে শুধুমাত্র পৃথিবীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংজ্ঞাটিকেই পাল্টে দিয়োছিলো তা নয়। মানুষের মনের জগতে ঘটিয়ে দেয় এর বিরাট বিপ্লব। আর সেই বিপ্লবের সাথী ছিলাম আমি।

বিশ্বযুদ্ধ যখন বাধে তখন সমস্ত ইউরোপে জুড়ে দেখা দিয়েছে অর্থনৈতিক বন্যা। জিনিসপত্রের দাম বাড়তে শুরু করেছে। সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে এসেছে ঘন অন্ধকার। বিপদ এসে দেখাচ্ছে তার প্রচণ্ড মুখ ব্যাদান। মধ্যবত্তি সমাজ বুঝি আর কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছে না। এই সামাজিক অবক্ষরের সঙ্গে তাল দিতে দিতে দেখা দিয়েছে নানা ধরনের অসামাজিক কাজকর্ম। যেসব রমণী এতদিন ধরে সযত্নে রক্ষা করে চলছিলো তাদের আব্রু তাদেরকে দাঁড়াতে হয়েছে পথের পশারিণী হয়ে। যেসব মানুষ হৃদয়ের মধ্যে সতোর প্রদীপশিখা জ্বালিয়ে রেখেছিলো বাইরের ঝোড়ো হাওয়ার আক্রমণের মধ্যে থেকে, তারাও মুহূর্তে অসৎ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে যেন পৃথিবীর সবাই এক অদ্ভূত ইঁদুর দৌড়ে প্রতিযোগী হয়ে ছুটে চলেছে টাকা আর টাকার সন্ধানে।

এই সামাজিক অবক্ষয়ের ছবিটা আমার কাছে আরো ভালোভাবে ধরা পড়েছিলো। কেননা আমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলাম। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মহিলাকর্মী হিসাবে। সেই অবস্থাতে আমি লক্ষ্য করেছি–কিভাবে মানুষ শুধুমাত্র উন্মাদ উত্তেজনায় হত্যা করে প্রিয়জনকে। দুহাতে পরম প্রিয়জনের রক্ত মেখেও উল্লাসের হাসি হেসে ওঠে তার ঠেটের কোণে। এইসব দৃশ্য চোখের সামনে ঘটতে দেখে আমার কেবলই মনে হয়েছে, মানুষ আসলে চারপেয়ে এক জন্তু। তার মধ্যে আমরা যতোই ঈশ্বরত্ব আর মনুষ্যত্বের বীজ প্রোথিত করার চেষ্ট করি না কেন, কোন পরিবর্তনই হবে না তার চরিত্রে। আমার লেখার মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এইসব টুকরো টুকরো স্মৃতির ছবি বার বার ছায়াপাত করেছে। তাই হয়তো এতখানি জীবন হয়ে উঠতে পেরেছে আমার লেখনী সম্ভার।

বিশ্বযুদ্ধের সময় আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো প্রকৃতির আদলে গড়া একটি মানুষের। যাকে আমরা বেলিজয়াম গোয়েন্দার ভূমিকায় সাজিয়েছি এবং পরবর্তী কালে সেই একদিন শার্লক হোমসের মত কিংবদন্তী নায়কের সমকক্ষ হয়ে উঠবে তা হয়তো জানা যায় নি।

আমার প্রথম সেই উপন্যাসে, দি মিষ্ট্রিরিয়াস অ্যাফেয়ার্স অ্যাট স্টাইলস, যেটি প্রকাশিত হয়েছিলো কর্নেএড পাবলিশিং কোম্পানি থেকে। আসলে সেটি আমাকে আমার ঈঙ্গিত লক্ষ্যের দিকে পৌঁছে দেয়। প্রথম উপন্যাসের মধ্যে আমি বিরাট প্রেক্ষাপটের একাধিক মানুষের হৃদয়ের গহন গভীর অরণ্যে লুকিয়ে থাকা লোভ, প্রেম-ভালোবাসা, কামনা-বাসনার ছায়া ছবিগুলিকে খণ্ড খণ্ড বিমূর্ত প্রতাঁকের মাধ্যমে চিরায়ত করে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছিলাম, হয়তো-বা জীবনের প্রথম লেখা বলে এর মধ্যে ছিলো আতিশয্য। হয়তো আমি ভেসে গিয়েছিলাম অকারণ সংলাপের প্রাচুর্যে, হয়তো ঠাসবুনুনি গল্পের প্রকার বা প্রকাশ ঘটেনি তার মধ্যে, কিন্তু পরম মমতায় আমি এখনও পর্যন্ত আমার প্রথম উপন্যাসটিকে বাকি সব লেখার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হিসেবে গণ্য করি। এই উপন্যাসটি সৃষ্টি করতে না পারলে আমি তো কোনদিন আগাথা ক্রিস্টি নামে পরিচিত হতে পারতাম না আপনাদের মনের দুয়ারে। আমি পৌঁছে যেতাম অপরিচিতার অন্ধকারে।

দেখতে দেখতে অতিক্রান্ত হলো আরো ছ-ছটি বছর। তখন প্রত্যেক বছর একটি করে উপন্যাস লিখে চলেছি আমি আর বিভিন্ন লেখার মধ্যে বিষয় বৈচিত্র্যে নিত্য-নতুন নৈপুণ্য আনবার প্রয়াসে মগ্ন রয়েছি। দেখা আর শোনার জগতের পরিধি অনেক বেড়ে গেছে। কত মানুষ এসে ধরা দেয় অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায়, কেটে যায় ক্লান্ত মৌন প্রহর। কিন্তু মনের মধ্যে সব সময় জ্বলে অতৃপ্তির আগুনশিখা। মনে হয়, এমন এক লেখা সৃষ্টি করতে হবে, যা মৃত্যুর পরেও আমাকে দেবে অমরত্ন। যার মাধ্যমে আমি পৌঁছে যেতে পারবো যে কোন লেখকের সেই বহু ঈপ্সিত আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পথে।

১৯৬২ সালে প্রকাশিত হলো আমার রহস্য উপন্যাসটি দি মার্ডার অব রজার অ্যাট রাইট এবং পরবর্তীকালে সমার্লোচকদের মতে এটি নাকি আমার অন্যতম মাস্টারপিস যার মধ্যে শুধুমাত্র রহস্য গল্পের ছোঁয়া নেই, আছে এক সাহিত্যের ছায়া। প্রতিটি মানুষ মনে মনে যে যতই অসৎ হোক না কেন সত্য এবং শিবের পূজারী। সত্যম শিবম সুন্দরম্-এর আদর্শপ্লুত মানুষের এই জয়গানকেই আমি প্রতিধ্বনিত করতে চেয়েছি দি মার্ডার অব রজার অ্যাট রাইট এর পাতায় পাতায়। আমার চোখে কোন খুনী বদমাস ধৰ্ষকও প্রকৃতপক্ষে একজন সাধারণ ভীরু অসহায় মানুষ। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে নিরন্তর সংগ্রাম করতে করতে দুহাতে মাখতে হয়েছে পরম প্রিয়জনের রক্ত। চোখ ঢাকতে হয়েছে লোভ আর লালসার মুখোসে। আমাদের সামনে এক লোভী হণ্ডারকের বেশে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু যদি কোন সময় উন্মোচিত হয়ে যায় তার মুখোসখানি। আবার চোখে পড়ে তার স্নিগ্ধ সৌকুমার্য ভরা মুখ। তাহলে দেখবো সেখানে কত রাতের ক্লান্তি টলটল করছে তার চোখের তারায়। মনে আছে কোন না বলা কথা। তার বুকের গভীর দহনে খাঁচার থেকে উৎসারিত দীর্ঘ নিঃশ্বাসের মত প্রতি মুহূর্তে নিষ্ক্রান্ত হচ্ছে কত বেদনা।

আর তখনই পরমশক্তিমান ঈশ্বরের প্রতি অত্যন্ত শত্রুভাবান্ন হয়ে উঠি আমি। মনে মনে ছুঁড়ে দিই অসংখ্য প্রশ্ন–হে ঈশ্বর, তুমি কেন মানুষকে অসহায়তার মধ্যে পাঠালে পৃথিবীর বুকে? কেন তাকে সাজালে না মন্ত্রে, যে মন্ত্র তাকে উদ্বুদ্ধ করবে জীবনের চলার পথে পা ফেলতে।

এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিলো কলিন্স থেকে। এর মধ্যে দিয়েই আমাদের মধ্যে একটি সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। ৫০ বছরের আগের পুস্তক প্রকাশন থেকেই আমার ৫০ টি বই প্রকাশিত হয়েছিলো। যা সারা পৃথিবার পাঠক সমাজে একেবারে স্তম্ভিত করে দেয়। মি মার্ডার অব রজার অ্যাট রাইট-কে আর একটা কারণে মনে রাখতে হবে। কারণ এই বইটি প্রথম নাট্যাকারে মঞ্চস্থ হয়েছিলো লণ্ডনের বিশিষ্ট প্রেক্ষাগৃহে। এবং রাতের পর রাত অভিনীত হওয়ার সূত্রে লক্ষ লক্ষ মানুষ সেটিকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। নাটকে এর নাম দেওয়া হয়েছিলো অ্যালিবাই। ওয়েস্ট এণ্ডের মতো থিয়োরেটিক্যাল হলে কত রজনী উপস্থাপিত হয়েছিল তার কোন সংখ্যা হয়তো আমার জানা নেই। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করতে পারি যে মাউসট্রাপ নামে যে উপন্যাসটি আমি লিখেছিলাম সেটি হলো আমার সবচেয়ে বিখ্যাত। তা একটানা উনিশ বছর ধরে অভিনীত হয়ে বিশ্বের রঙ্গসাহিত্যের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করেছিলো।

এমনভাবেই অতিক্রম হতে থাকে বছরগুলি। একের পর এক উপন্যাস এসে ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। মনে হয়, এটাই বোধহয় আমার জীবনের একমাত্র ডেসটিনি বা ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ রেখা। যতদিন বাঁচবো, যতদিন শ্বাসগ্রহণ করতে হবে আমাকে, যতদিন সচল থাকবে আমার মস্তিষ্ক এবং চেতনাপুঞ্জ, ততদিন নিরন্তর লেখনীর মধ্যে আত্মনিয়োগ করতে হবে আমায়, এছাড়া কোন মুক্তি নেই।

দেখতে দেখতে অনেকগুলি উপন্যাস লেখা হলো আমার। বিশেষ করে মনে পড়ে এ বি সি মার্ডার, দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য ক্রীসমাস পুডিং, আফটার দ্য ফিউনারেল, অ্যাণ্ড দেন দেয়ার ওয়্যার নাম ইত্যাদি।

যে উপন্যাসগুলির কথা আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না তার মধ্য একটি হলো ওয়ান টু বাকল মাই সু। এখানে অত্যন্ত সাধারণ ঘটনার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা রহস্য যবনিকা আমি উন্মোচিত করেছি পাঠক-পাঠিকার সামনে। আপাততুচ্ছ ক্ষুদ্র বিষয় যে কত সুন্দর হয়ে উঠতে পারে, কত রোমাঞ্চিত তার আবরণ-তা বোধহয় এই উপন্যাসটি পড়লে বোঝা যেতে পারে।

ইভিল আণ্ডার দ্য সান হলো আমার আর একটি প্রিয় উপন্যাস। এই উপন্যাসটির পটভূমিতে আমি দেখিয়েছি প্রিয়জন হঠাৎ হণ্ডারকের বেশে এসে মাথার শিয়রে দাঁড়ায় এবং এক নিমেষে জীবন কেড়ে নিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা বোধ করে না। স্পার্কলিং সায়ানাইড হলো আমার একটি বুদ্ধিদীপ্ত উপন্যাস। সম্পূর্ণ প্রতীকধর্মী রূপক শব্দের ব্যবহারে আমি সাজিয়েছি আমার রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনীকে।

দি হলো একটি সাঙ্কেতিক উপন্যাস। ছোট্ট ছকের মধ্যে মানুষের নিয়তির কান্না জমে আছে এই উন্যাসের ক্যানভাসে, যা মানুষকে মনে করায়-এ জীবন কত নশ্বর, কোন কিছুই এখানে চিরস্থায়ী হতে পারে না।

থ্রি অ্যাক্ট ট্রাজেডি একটি বেদনাবিধুর গাথা। এখানে ধ্বনিত হয়েছে এক অসহায় মানুষের প্রবল আকুতি। ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাকে সাজতে হয়েছিলো। খুনীর রক্তাক্ত সজ্জায়, অন্তিমে যার জীবন নির্ধারিত হয়ে যায় জেলাখানার অন্ধকারে। তারও অন্তরে প্রোথিত ছিলো ব্যথা আর অভিমান, এইসব কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে ট্রাজেডির পাতায় পাতায়।

দি মার্ডার অ্যাট দ্য ভিকারেজ, মার্ডার ইজ ইজি, মার্ডার অন্য দ্য লিংকস-খুন আর খুনের মিছিল শোনাচ্ছে না কি? তাহলে শুনবেন, এখনও শেষ হয়নি এই মার্ডার ইতিবৃত্ত। মার্ডার অন্য দি ওরয়েন্ট এক্সপ্রেস, এ মার্ডার ইজ অ্যানাউনসড, মার্ডার ইন দ্য নিউজ, মার্ডার ইন সোপটেমিয়া ইত্যাদি আরো কত কি, আসলে মার্ডার মার্ডার করেই তো আমার সাহিত্যের সবখানে বেজে ওঠে স্পন্দন। সে মৃত্যু কখনো আসে মধ্যরাতে বোরখা পড়ে, আবার কখনো তার হাতে ঝলসে ওঠে তীক্ষ্ণ ছুরিকা। হাসতে হাসতে সে অনায়াসে ছুরি চালিয়ে দেয় তার প্রিয়জনের বুকের মধ্যে।

মৃত্যু যে কত বিচিত্র রূপে মানুষকে ভয় দেখায়। শয়তানের বেশে, কখনো গৈরিক ভঙ্গিমায়, কখনো বা তুষারাবৃত পর্বতের নিরাপত্তায়। আমরা তার সব খবর হয়তো জানি না।

এরকুল পোয়ারোর মত ধুরন্ধর গোয়েন্দা আছে বলেই উন্মোচিত হয় প্রতিটি রহস্যের যবনিকা জাল। যা ছিল ঘন কুঙ্কুটিকায় আচ্ছন্ন তার অন্তরালে সূর্য ঝিলিক মেরে ওঠে। আমরা বুঝতে পারি জীবনের চলার পথ যতই কণ্টকাকীর্ণ হোক না কেন তার কোথাও না কোথাও জেগে উঠবে কুসুম রেখা।

পোয়ারোর কথা বলতে গেলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে কি?

লোকটা অত্যন্ত সাধারণ। মাথা জোড়া টাক, নাদুসনুদুস চেহারা। কিন্তু কত সহজে তিনি যে পৌঁছে যেতে পারে রহস্যের গভীরে, আর একেবারে শেষ বিন্দুটিকে আহরণ না করা পর্যন্ত এক মুহূর্তের ছুটি মেলে না তাঁর। বোধহয় লেখা আছে আমার বিভিন্ন উপন্যাসের পাতায় পাতায়।

আর কিছু গল্প করা যাক। শুনুন সিক্রেট অ্যাডভারসরীর কথা দি, আখ্যায়িকা, দি স্লিপিং মার্ডারের ইতিহাসে, দী স্পার্কলিং সায়ানাইডের বিচ্ছুরণ।

প্রতিটি গল্পেই বোধহয় বিষয়-বৈচিত্র্যে একে অন্যের চেয়ে অন্য দিগন্তের বাসিন্দা। একটি গল্প পড়লে তার সঙ্গে অন্য গল্পটির কোন মিল পাওয়া যাবে না। চেষ্টা করেছি আমি সম্পূর্ণ নতুনতর আঙ্গিকে একটির পর একটি কাহিনীকে আপনাদের চোখের সামনে তুলে ধরতে। যাতে মনে হবে যে, কোন কাহিনী বুঝি আগে আপনারা পড়েননি।

পোয়ারো ছাড়াও, আগেই বলেছি, আমার অত্যন্ত প্রিয় চরিত্র হলো পার্কার পাইন। যদিও অনেক বেশী কাহিনীর মধ্যে সে এসে দাঁড়ায়নি আপনাদের বিস্মিত চোখের পাতায়। কিন্তু সীমায়িত পরিসরে পার্কার পাইন যে সমস্ত অসাধ্য সাধন করেছে তারই বা কম মূল্য আছে নাকি?

মিস মারপল, তার কথাও জানিয়েছি আগে। বোধহয় বিশ্বের এক অনন্য সাধারণ মহিলা গোয়েন্দা, দেখতে অতি সাধারণ হলে কি হবে অনেকের মত সে কিন্তু তার বুদ্ধিদীপ্ত চোখের তারায় সব সময় ঘুরঘুর করছে কোন এক রহস্য রোমাঞ্চ আস্বাদনে।

আসলে মিস মারপলের মধ্যে আমার অত্যন্ত পরিচিত পরিজনের ছায়া আছে। মিস মারপল আসলে আমার ছোটবেলার স্কুলে হারিয়ে যাওয়া এক আন্ট। ক্লাসে দেখতাম সেই আন্ট সবসময় প্রশ্নের পর প্রশ্নবানে বিদ্ধ করছে আমাদের মত বালিকাদের হৃদয়। আর পরিশেষে জানতে চাইছে এমন অনেক কথা-যার উত্তর আমাদের জানা নেই।

টিফিনের সময়, অবসরে, প্লে গেমসের আসরে, আমরা মাঝে মধ্যেই ধরা পড়ে যেতাম সেই মিস মারপলের কাছে আর ভয়ে ভয়ে সব কিছু কবুল করতে হতো। তখন থেকেই বোধহয় কল্পনার রঙে রসে মিলেমিশে একটি নারী গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টির ইতিহাস জেগে ছিলো মনের মধ্যে। পরবর্তীকালে যার প্রকাশ ঘটে আমার লেখনীর পাতায় পাতায়।

যৌবন অতিক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কখন যে বার্ধক্য এসে আঁকড়ে ধরেছিল, কে তার খবর রাখে। ১৯৭১ সাল শুধুমাত্র লেখার জন্য আমাকে দেওয়া হলো বহু ঈপ্সিত ডেনের সম্মান। হলাম আমি বৃটিশ রাজতন্ত্রের প্রতিভূ শিরোপা মাথায় দেওয়া এক সম্মানীয়া নারী, তখন থেকেই নানা সেমিনারে, অধিবেশনে নিয়মিত ডাক পড়তো আমার। আর কি আশ্চর্য, যে ভাষণ দেওয়াতে আমি অত্যন্ত লজ্জাবোধ করতাম, মাঝে মাধ্যে সেই ভাষণ দিতে হতো আমায়। বহু উপেক্ষিত উপস্থিত শ্রোতারা বার বার ছুঁড়ে দিতে অজস্র প্রশ্ন। এরকুল পোয়ারো নামে সত্যি সত্যি কোন গোয়েন্দা আছে না কি পৃথিবীর বুকে? যদি বা থাকে তাহলে তার আসল পরিচয় কি? কোথায় থাকে সে? কি খায়? কেমন করে এত সহজে চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে একটির পর একটি রহস্য যবনিকার আবরণ উন্মোচিত করে। এমন কত শত প্রশ্ন।

বুঝতে পারতাম আমি আমার রহস্য কাহিনীর প্রতিটি অক্ষরকে সাধারণ পাঠক-পাঠিকারা সত্য বলে মনে করেছে। আর এই সত্যটাকে প্রকাশ করতে চাইছে এমন আকুলতা জমে আছে তাদের হৃদয়ের মধ্যে।

বড় মায়া হতো আমার, বড় সাধ হতো আমার, ভাবতাম, ঈশ্বর যদি আমাকে সে শক্তি দিতো তাহলে আমি হয়তো উপন্যাস লিখে জয় করতে চেষ্টা করতাম তাদের হৃদয়, পর মুহূর্তেই অন্যতর এক উন্মাদনা এসে ক্লান্ত করতে আমার হৃদয়কে। আমি ক্রাইম উপন্যাসের মধ্যে যে থ্রিল সাধারণ পাঠিকারা অনুভব করে। বৃহত্তম সামাজিক উপন্যাসের প্রেক্ষাপটে তা অনেকখানি অপ্রাপ্তব্য থেকে যায় তাদের কাছে। এমন উপন্যাসের অনেক চরিত্রের সঙ্গে সে নিজের মিল খুঁজে পায়। এমন অনেক চরিত্রের দর্পণে সে খুঁজে পায় তার হারানো দিনের প্রতিচ্ছবি যে, সেই কাহিনীর সঙ্গে একীভূত হতে তার কোন বাদ সাধে না।

উপন্যাসের ক্ষেত্রে এমনটি সবসময় না-ও ঘটতে পারে।

আমি তো আর চার্লস বা বার্নাড শ হবার স্বপ্ন দেখি না। ঈশ্বর বোধহয় আমার নির্দিষ্ট গণ্ডীপথ স্থির করে দিয়েছেন। আর তার মধ্যেই নিরন্তর পথ চলে জীবনের অন্তিম সময়ে পৌঁছতে হবে আমাকে।

এসব কথা চিন্তা করার সঙ্গে সঙ্গে শান্ত সমাহিত হতো মন। আমি আবার ডুবে যেতাম আমার লেখনীর জগতে। সাধারণতঃ সকাল থেকে বেলা দশটা অব্দি লিখতাম আমি। তারপর সামান্য কিছু খাওয়াদাওয়া সেরে লনে পায়চারি করতাম। দুপুর বেলা শুরু হতো আমার দ্বিতীয় পর্বের লেখা। যখন সূর্য যেতো অস্তাচলে তার মায়াবী আলোয় পৃথিবী হয়ে উঠতে আরো বেশী রমণীয় এবং মনোমুগ্ধকর, তখন হঠাৎ লেখা থামিয়ে ডেস্ক থেকে এসে দাঁড়াতাম ছোট্ট পোর্টিতে। আর দেখতাম কেমনভাবে আসন্ন সন্ধ্যার ঘন অন্ধকার এসে অপসৃয়মান পৃথিবীর ওপর এঁকে দেয় চুম্বিত চুম্বনখানি। আর সন্ধ্যায় আকাশে মেঘ বালিশে মাথা রেখে তারা শোনে অশ্রুত অব্যক্ত কাহিনী।

এই সব কাহিনীর মধ্যেই তো লুকিয়ে আছে জীবনরহস্য। ঐ আকাশে নিভু নিভু তারায়, বাতাসের শিরশিরানিতে, থমকে যাওয়া কাঠবেড়ালির চলায়, দূর থেকে ভেসে আসা কোন জাহাজের সঙ্কেত ধ্বনিতে, রেলওয়ে সিগন্যালের অপসৃয়মান শব্দ কোথায় না রহস্য নেই, কেউ কি বলতে পারে?

বিধাতা বোধহয় পৃথিবীর প্রতিটি পল অনুপলকে এমনভাবে রহস্যের আবরণে আচ্ছাদিত করেছেন। তাই তো জীবন তার সমস্ত একঘেঁয়েমি এবং গতানুগতিকতা সত্ত্বেও এত আকর্ষণীয়ভাবে ধরা দেয় আমাদের চোখের সামনে।

প্রকৃতি আর মানুষ–এই দুই নিয়েই তো সাহিত্যিকের জীবন। কখনো প্রকৃতির বৃহৎ প্রেক্ষপটে নীরব নিরুচ্চার মানুষের প্রেম, দুঃখ, ভালোবাসা, আবার কখনো মানুষের মহত্তর চরিত্র সৃষ্টির কাছে প্রকৃতির ক্ষুদ্র এই অহর্নিশ হাত আর জিতের লড়াই নিয়েই যে সাহিত্যিকের সাহিত্য ভাণ্ডার পরিপুষ্ট হয়।

সর্বমোট ৭৯ খানি গল্প সংকলন এবং উপন্যাস লিখতে হয়েছে আমাকে। তার মাধ্যমে বিশ্লেষিত করার চেষ্টা করেছি আমার ফেলে আসা জীবনের অনেক বাহিনী। এ পর্যন্ত ৪৪ টি বিদেশী ভাষায় অনুদিত হয়েছে আমার লেখা। এবং সব মিলিয়ে বোধহয় ১ কোটিরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে শুধুমাত্র ইংরেজী ভাষাতে। বিদেশী ভাষাতেও তা বিক্রির সংখ্যা ১ কোটি কাটিয়ে যাবে। অনেকে বলে থাকে যে বাইবেল এবং শেক্সপীয়ার ছাড়া আর কোন সাহিত্য এত বেশী জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি।

কথা শুনে নতমস্তক হয় আমার। অহঙ্কার এসে কি গ্রাস করতে চায় আমাকে। সত্যিই তো কখন যে ৭৯ টি রহস্যধর্মী উপন্যাস আর ছোট গল্প লিখেছি, ১৯টি নাটক আর মেরী ওয়েস্ট নামের আড়ালে ছটি রোমান্টিক রচনা লিখতে হয়েছে আমাকে। সেসব খবর বোধহয় আর মনে পড়ে না।

আগাথা ক্রিস্টি এখন কি সহস্র সম্রাজ্ঞী হবার স্বপ্ন দেখতে পারে তার বিস্মিত চোখের তারায়?

আমার শেষ কাহিনী প্রকাশিত হলো ১৯৭৫ সালে। একটির নাম হলো কার্টেন, পোয়ারোর লাস্ট কেস। অপরটিকে বলা হয় স্লিপিং মার্ডার। এখানে মিস মারপলের কথা আছে। এটি প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৭৬ সালে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এই বইটিকে বেস্ট সেলারের আখ্যা দেওয়া হয়েছিলো। একদিন যাত্রা শুরু করেছিলাম দি মিস্ট্রিরিয়াস অ্যাফেয়ার্স দিয়ে। দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে নিরন্তর লেখনীর মাধ্যমে এবার বোধ হয় শেষ হতে চলেছে আমার কাহিনী, তাই কার্টেনের পর্দা টেনে দিয়ে আমি শেষ করতে চাই আমার জীবন নাটকের যবনিকা। কিন্তু জানি পাঠক-পাঠিকাদের মোটেই মনঃপুত হবে না। এই অংশটি। কেননা জানার কি শেষ আছে? রহস্য কি কোনদিন ফুরিয়ে যায়? চিরদিন তার মাথাখানি শুধু দেখা যায়, বাকী অংশটুকু লুকিয়ে আছে গভীর সমুদ্রে অতল তলে।

হে পাঠক-পাঠিকা, এবার সত্যি সত্যি বোধহয় বিদায় নিতে হবে আপনাদের স্নেহের দরবার থেকে। যদিও জানি স্লিপিং মার্ডার বা ঘুমন্ত মৃত্যু এসে যখন গ্রাস করবে আপনাদের; তখনও আপনারা অসহায় আর্তনাদে তাকিয়ে থাকবেন মিস মারপল, পার্কার পাইন অথবা এরকুল পোয়ারোর দিকে।

শুধু কি রহস্য সাহিত্য লেখার জন্যে জন্ম হয়েছে আমার। বোধহয় তা নয়। আমর এই আত্মজীবনী এবং অপর একটি উপন্যাস কাম টেল মি হাউ ইউ লিভ-এর রোমান্টিকতা অনেকের হৃদয়কে স্পর্শ করেছে। চুপি চুপি একটি কথা জানিয়ে রাখি, এইসব লেখনীর অন্তরালে আছে আমার প্রত্নতাত্ত্বিক স্বামী ম্যাক্স ম্যালোয়ানের অবদান। ম্যাক্সের মত স্বামী না পেলে এত সুন্দর লেখা লিখতে পারতাম না। কেননা ম্যাক্সই তো আমার দৈনন্দিন জীবনের সমস্ত কাজ নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে আমার জীবনে চলার পথকে অনেকখানি মসৃণ করে দিয়েছিলো।

আর একটি কথাও জানিয়ে রাখতে হবে, এই দুটো উপন্যাস আমি লিখেছিলাম আগাথা ম্যাক্স ম্যালোয়ান নামে। তার একটি হলো কাম টেল মি হাউ লিভ অপরটি হলো স্টার ওভার বেথেলহেম। সামাজিক উপন্যাস লেখার যে ইচ্ছে আমার মনের মধ্যে ছিলো অনেকদিন ধরে, সেই ইচ্ছেপাখীর সফলতা আকাশে ডানা মেলে দিয়েছে এই দুটি উপন্যাসের মাধ্যমে।

আমার দুর্ভাগ্য, আপনাদের কাছে আমি পরিচিত শুধুমাত্র একজন রহস্য লেখিকা হিসেবে। কোনদিনই আপনারা অন্বেষণ করেন নি যে, আগাথা ক্রিস্টি রহস্য সাহিত্যের জননী হিসেবে পৃথিবীর আপামর জনসাধারণের হৃদয়ে বেঁচে থাকতে চায় না। সে চায় একজন সাহিত্যিক হিসাবে মানুষ তাকে মনে রাখুক। কিন্তু প্রথম কাহিনীর মধ্যে দিয়েই তার ললাটে রহস্য লেখিকার যে ছাপ পড়ে গেছে, জীবনের ওপ্রান্তে দাঁড়িয়ে সে-ও বোধ হয় সেই ছাপ থেকে নিজেকে একেবারে বিমুক্ত করতে পারছে না। এটাই তার অহঙ্কার, অভিমান, কলঙ্ক বা অনুগত্য যা-ই হোক না কেন এর কোন উত্তর কি আপনাদের জানা আছে?

মেরী ওয়েস্ট মারকট নামে আমি ছ-ছটি উপন্যাস লিখেছি। সেগুলো হলো অ্যাবসেন্ট ইন দ্যা স্প্রিং, দি বার্ডেন এ ডটার, জায়েন্টস ব্রেড, দি রোজ অ্যাণ্ড দ্য টিউট্রি এবং আনফিনিসড পোট্রেট।

এই সাতটি উপন্যাসই মোটামুটিভাবে জনপ্রিয় হয়েছিলো। আমার ছদ্মনাম দেখে অনেকেই ভাবতে পারেনি যে মেরী ওয়েস্ট মারকট আসলে আগাথা ক্রিস্টিরই ছদ্মনাম। তাই একজন নবাগতা লেখিকার লেখা রচনা তারা সাদরে গ্রহণ করেননি। কিন্তু যখনই আমার প্রকাশিত পুস্তক তালিকার মধ্যে এই নামটি প্রকাশিত হয়। তখন হঠাৎ বেড়ে যায় তাদের প্রকাশ তালিকা। তারা সবাই ছুটে আসে যে রহস্য সম্রাজ্ঞী আগাথা ক্রিস্টি কেমন রোমান্টিক উপন্যাস লিখতে পারে সেটা জানতে। আর তখনই ভীষণ-দুঃখ হয়েছিলো আমার। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, সাহিত্যের অঙ্গনে একজন নবাগতার কোন স্থান নেই, যতক্ষণ না সে সাফল্যের স্বর্ণশিখর প্রাঙ্গণে উপনীত হতে পারছে ততক্ষণ তাকে এই অপমানের জ্বালা বহন করতে হবে।

এবার বোধহয় শেষ হয়ে আসছে আমার আত্মজীবনীর পালা। অনেক কথা বলবো বলে কলম ধরেছিলাম, কখন যে দেখতে দেখতে অতিক্রান্ত হয়ে গেল সারা বেলা, সূর্য এখন বসেছে পাটে। এবার যদি কলম না থামাই তাহলে অনেক বেশী বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে নাকি।

পাঠক-পাঠিকারা, যাবার আগে আবার আপনাদের মনের দরজায় করাঘাত করে যাই। যদি মনে হয় আগাথা ক্রিস্টির রচনা আপনাদের মনকে অনাস্বাদিত আনন্দে পরিপূর্ণ করতে পারেনি, তাহলে দোহাই আপনাদের আর পড়বেন না, এরকুল পোয়ারোর কীর্তিকাহিনীর দিকে তাকিয়ে থাকবেন না, পার্কার পাইনকে দেখে বিস্মিত হবেন না। মিস মারপলের ছলকলায় আপনারা ভুলে যান আগাথাকে, ভুলে যান তার লেখনীসম্ভার। টুপি খুলে কুর্নিশ জানান নতুন যুগের নতুন সাহিত্যস্রষ্টাকে। যার অদম্য কৌতূহল, অগম্য আশা আর সৃষ্টিজাল বুনে সে আপনাদের মনকে পরিপ্লাবিত করুক অনাস্বাদিত আনন্দে।

বিস্মৃতির কোন ক্ষণে, কোন বৈকালিক সান্ধ্য আসরে হাঠৎ মনে পড়ে যায় এরকুল পোয়ারো নামের সেই বেলজিয়ান গোয়েন্দাকে। তাহলে ক্ষণকাল স্তব্ধ হয়ে স্মৃতি ভারে টলমল তরণী ভাসান জীবনের উদ্যানে আর ভাবুন তার স্রষ্টা আগাথা ক্রিস্টির কথা! জীবনের প্রথম প্রহর থেকে যার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো সৎসাহিত্যের মাধ্যমে আপনাদের হৃদয়ের কাছাকাছি পৌঁছে যাবার।

অতিরিক্ত সংযোজনা–আই, ডেম আগাথা-রহস্য সাহিত্য সম্রাজ্ঞী আগাথা ক্রিস্টির এক অসাধারণ রচনা। এই রচনার মধ্যে আগাথা ক্রিস্টি অকপট স্বীকার করেছেন তার ফেলে আসা শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনের নানা কাহিনী। কেমন করে তিনি লেখিকা হবার স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং ধীরে ধীরে প্রবল আত্মবিশ্বাসকে পাথেয় করে অবশেষে সফল করে তুলেছিলেন তার এই স্বপ্ন। সেই কথা আমাদের সকলকে বিস্ময়ে অভিভূত করে। শুধুমাত্র পাঠক পাঠিকারাই নয়, আগামী দিনে যারা সাহিত্যরচনা করবে যাদের হৃদয়ের মধ্যে লুকিয়ে আছে একজন মহান সাহিত্যিকের সমস্ত গুণাবলী। তাদের অবশ্য পড়া উচিত আগাথা ক্রিস্টির এই আত্মকাহিনী। এই আত্মকাহিনী একটি হারিয়ে যাওয়া আর্থ-সামাজিক অবস্থায় মূল্যায়ন! এখানে ইংলণ্ডের ক্ষয়িষ্ণু সমাজের শেষ প্রতিভূ হিসেবে আমরা আগাথাকে ধরে নিতে পারি। যিনি চেষ্টা করেছিলেন নীলরক্তের অহমিকার মধ্যেও সাধারণ মানুষের মনের মধ্যে বৃদ্ধিত আশা আকাঙ্ক্ষার ছবি আঁকতে। অভিজ্ঞতার রঙীন ক্যানভাসে সেই ছবি হয়তো মাঝে মধ্যে হয়ে গেছে রক্ত রঞ্চিত। কখনো বা সেখানে এসে ভয় দেখিয়েছে প্রতি মুহূর্তে প্রেম, ঘৃণা, ভালোবাসা কিন্তু অচিরেই মানুষ যে মানুষ, তার মধ্যে লুকিয়ে আছে মনুষ্যত্বের বীজ, এই কাহিনী বোধহয় সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি করেছে। তাই আমাদের উচিত আগাথা ক্রিস্টির রচনাবলী পাঠের মাধ্যমে বর্তমান প্রজন্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রহস্য সম্রাজ্ঞীর উদ্দেশ্যে আমাদের শ্রদ্ধা বিনম্র প্রণাম জানানো, জীবনে জটিল কঠিন চলার পথে একা একা তিনি অতিক্রম করেছেন শত সহস্র বাধা, নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে রচনা করেছেন। এতগুলি রহস্য উপন্যাস, তার দুঃখ ছিলো যে, সামাজিক উপন্যাসের কেন তার উত্তোরণ ঘটবে, সেই সব সামাজিক উপন্যাসও আমাদের অনুধ্যান সহকারে পাঠ করতে হবে। যাতে আমরা লেখিকা আগাথার দুটি সত্ত্বাকে সম্পূর্ণ উপলব্ধি করতে পারি। একদিকে তিনি ছিলেন রহস্য লেখিকা অন্যদিকে তিনি ছিলেন সামাজিক ঔপন্যাসিক। এই দুই বিরোধী সত্ত্বার পারস্পরকি সংঘর্ষে মানুষ এবং লেখিকা হিসাবে যে আগাথা ক্রিস্টি আমদের চোখের সামনে মূর্ত ও প্রতীয়মান হয়ে ওঠে। তার উদ্দেশ্যে নত মস্তকে প্রণাম জানানো ছাড়া আর কি-ই বা করতে পারি আমারা।

তাই হে এরকুল পোয়ারো, পার্কার পাইন, মিস মারপল এবং অন্যান্য গোয়েন্দাবৃন্দ, প্রায় ফুরিয়ে আসা এই বিংশ শতাব্দীর এই শেষ শতকে যখন পৃথিবী ক্রমশঃ ছোট হয়ে যাচ্ছে, বিস্মরণের পক্ষে যখন গোয়েন্দারা আর মত্ত মাতাল অভিসারে ব্যস্ত থাকে না বুদ্ধির লড়াইতে আততায়ীকে আক্রমণে, যখন ফিঙ্গার প্রিন্ট কমপিউটার ক্রিমিনোলজির সাহায্যে অতিসহজেই চিহ্নিত করা যাচ্ছে একজন অপরাধীকে আর ঘোষণা করা হচ্ছে সে কোন খুন ধর্ষণের অন্তরালে আছে মনস্তাত্ত্বিক আঘাত তখন বোধ হয় এরকুল পোয়ারোর ছুটি নেবার সময় হয়ে এলো। তাকে তো এখন অসামরিক যুদ্ধে নামতে হবে সুপারম্যানের সঙ্গে। সে কি লড়াই করতে পারবে ব্যাটম্যানের সঙ্গে খালি হাতে? ফানটাসির জগতে সে যে অচল তার ক্ষুরধার বুদ্ধি নিয়ে সে কোনদিনই সুপারসনিক বিমানে এগিয়ে যেতে পারবে না। মুহূর্তের মধ্যে ধরাশায়ী করতে পারবে না অত্যন্ত শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে। তাই বোধহয় বর্তমান প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীদের কাজে আগাথা ক্রিস্টি আর আগের মতো এতখানি জনপ্রিয় নন। যদিও আমার বিশ্বাস রাখি যে, আগাথা সাহিত্যের মৃত্যু নেই। বহমান সমুদ্র প্রবাহের মত, ধীর ভাস্বর আকাশের দীপ্তমান রশ্মির মত আগাথা ক্রিস্টি চিরকাল ভাস্বর হয়ে থাকবেন আমাদের মনের আকাশে। যতদিন সভ্যতা থাকবে, চন্দ্র সূর্য তারা থাকবে ততদিন আগাথার মৃত্যু নেই। সত্তায় এগিয়ে যাবেন তার ঈপ্সিত লক্ষ্যের দিকে। সে লক্ষ্য হলো সফলতার আনন্দের আশা এবং সকলের এই বিশ্বাস আমরা রাখতে পারি।

আগাথা সাহিত্য সম্বন্ধে কয়েকজনের অভিমত–

আগাথা ক্রিস্টির রচনাবলীকে প্রথমে অনেকেই মহৎ সাহিত্যের সংজ্ঞা দিতে চান নি। বৃটিশ সাহিত্যের উন্মাসিক সমার্লোচকের এই সব রহস্য কাহিনীর কপালে ব্রাত্যের টিকা পরিয়ে ছিলেন যখন আগাথার জনপ্রিয়তা স্বর্ণশিখরে উপনীত হয়। মাসের পর মাস ধরে তার লেখা নাটক লণ্ডনের অভিজাত পাড়াতে দর্শক প্রেক্ষাগৃহ পরিপূর্ণ হয়ে থাকে, যখন বেস্ট সেলার তালিকায় দশটির মধ্যে ছটিই থাকে আগাথার নাম তখন মতবাদ পাল্টাতে বাধ্য হয়ে ছিলেন তারা।

ডগলাস হার্ভের মত এক দুদে বৃটিশ সমার্লোচক মন্তব্য করেছিলেন লণ্ডন টাইমসের পাতায়–যদিও আগাথা ক্রিস্টি রহস্য সাহিত্যের অঙ্গন উজ্জ্বল তারা। কিন্তু সামাজিক রচনা ক্ষেত্র ও তার মুন্সিয়ানা আমাদের বিস্মিত করে। অতি সামান্য তুচ্ছ ঘটনাকে অবলম্বন করে তিনি যে বৃহৎ উপন্যাস সৃষ্টি করেন, তার প্রতিটি ছত্রে মহতী লেখিকার প্রবল জীবনবোধ এবং জ্ঞান পিপাসার পরিচয় আমাদের মুগ্ধ বিস্ময়ে আবিষ্ট করে দেয়।

ম্যানচেষ্টার গার্ডেনের পাতায় প্রখ্যাত গ্রন্থসমার্লোচক স্যার ডরোথি স্মিথ এই অভিমত প্রকাশ করেছেন যে–আগাথা ক্রিস্টির লেখা দি এলিফ্যান্টস ক্যান রিমেমবারেকে আমরা অনায়াসে এই শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসাবে অ্যাখ্যা দিতে পারি। এই কাহিনীর মধ্যে মানব রহস্য অন্বেষণে লেখিকার নিরন্তর পদচারণা আমাদের বিস্মিত করে। কত সহজে বিভিন্ন মানুষে মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা লোভ, কামনা, বাসনার ছবি এঁকেছেন, তা অবাক হয়ে দেখতে হয়।

পরিশেষে তার রহস্য ছিন্ন করা একান্ত ভঙ্গিমাটি আমাদের অবাক বিস্মিত করে দেয় এই কারণে যে, বিনা রক্তপাতে, বিনা বুলেট আক্রমণে এরকুল পোয়ারো নিজের প্রচণ্ড বুদ্ধিদীপ্তকে পাথেয় করে সম্ভাব্য আততায়ীকে চিহ্নিত করেছেন এবং তাকে উপযুক্ত শাস্তি বিধানে কুণ্ঠা বোধ করেননি। এখানেই লেখিকার মুন্সিয়ানা।

শুধুমাত্র বৃটিশ সাহিত্যের সমার্লোচকরাই নয়, আগাথা ক্রিস্টির রচনা পৃথীবীর যে সমস্ত ভাষাতে অনূদিত হয়েছিলো সেই সব ভাষার প্রখ্যাত সমার্লোচকরা মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করেছেন আগাথার অনন্যসাধণ কৃতিত্ব। আফ্রিকা থেকে জাপান, নিউফাউল্যাণ্ড থেকে ভারতবর্ষ, পাকিস্তান থেকে ইন্দোনেশিয়া সর্বত্রই সমানভাবে পঠিত এবং রচনারাজি। এখানে ভেঙে গেছে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বিশ্বের আবরণ। প্রথম দুনিয়া এসে হাত মিলিয়েছে তৃতীয় দুনিয়ার সাথে। মাল্টিমিলিয়নের সাথে একই ডিনারে পাশাপাশি বসে আগাথার রচনা পাঠ করে দরিদ্রতম ব্যক্তি। সাহিত্য যে সামাজিক সমস্ত বাধাকে এক নিমেষে অতিক্রম করতে পারে আগাথা ক্রিস্টির রচনাবলী হলো তারই উজ্জ্বলতম নিদর্শন।

শুধু কি তাই? রহস্য সাহিত্যকে তিনি আপন রচনার ঐশ্বর্যে নিশ্চিন্ত করেছেন চিরায়ত সাহিত্যের অঙ্গনে, এটাই তার অনন্যসাধারণ কৃতিত্ব–আজ উন্মাসিক পাঠক-পাঠিকারাও অনায়াসে অবগাহন করেন ক্রাইম লিটারেচারের পাতায়, অনুভব করেন এক অনাস্বাদিত আনন্দ-এর অন্তরালে আছে রহস্যসম্রাজ্ঞীর অপূর্ব লৈখনী শৈলী। আগাথা যে শুধু ক্রিমিনাল কাহিনীকে উদ্ভাস করেছেন তাই নয়, তার কপালে লেখন করেছেন বিশ্ববিজয়ের জয়টীকা সৃষ্টি করেছেন লক্ষ লক্ষ মুগ্ধ পাঠক-পাঠিকা। তাই টুপি খুলে কুর্নিশ করতে হয় বিশ্বের রহস্যকাহিনীর নায়িকা আগাথা ক্রিস্টিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *