৪-৬. আলো ঝলমলে দুপুরে

০৪.

 ২৫শে ডিসেম্বর।

আলো ঝলমলে দুপুরে পোয়ারো বাগানে বেড়াচ্ছিল। সেখান থেকে সে দেখল পিলার আর হ্যারিকে সাঁতার কাটতে।

এমন সময় মিসেস জর্জ লী এসে জানালো ব্যাপারটা কেমন যেন খাপছাড়া। কাল রাতে অমন ঘটনার পর এমন দৃশ্য বেমানান। তারপর সে পিলার সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করল এবং বলল, তার শ্বশুরের মৃত্যুটা ইংরেজ সুলভ নয়। এবং সে সেখান থেকে চলে যায়।

তারপর সাগডেন এসে জানায় হারবারি সত্যি কথা বলেছে। সে সত্যিই তার মেয়েবন্ধুর সাথে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল এবং তার লেখিকা তার সাথেই ছিল। আর ওয়েস্টবরিংহামের থেকে ফোন যে এসেছিল তার ছমিনিট পর সে ফোন কেটে যায়। আর এর থেকে বোঝা যায় মিসেস জর্জ লী মিথ্যে কথা বলেছিল তাহলে সে এখন কোথায় ছিল আর ফোন ছাড়ার দশমিনিট পর আর্তনাদ শোনা যায় তবে সেই সময় জর্জ কোথায় ছিল?

এবার পোয়ারো ম্যাগজলেনের কাছ থেকে জানা কথাটা সত্যি কীনা জানতে চাইল সাগডেনের কাছে। সাগডেন পিলার যে কুড়িয়েছিল তাই বলেছিল। কুড়িয়েছিল রবারের টুকরো ছিদ্রসহ আর একটা পেরেক।

এবার ওরা ডায়েরী খুলে সকলের কথাগুলো পড়ে সাগডেন বলল, হ্যারির নাম উঠে আসবে বলে সে বাবাকে না মেরে বাঁচিয়ে রাখতেই চাইবে। মিঃ আর মিসেস অ্যালফ্রেডকেও বাদ দেওয়া যায়। পিলারকেও সন্দেহ-এর বাইরে রাখা যায় আর স্টিফেন যে এমনিও বেড়াতে এসেছে তাকে বাদ দিলে জর্জলী আর মিঃ ও মিসেস ডেভিড। এদের মধ্যে জর্জ লীই সন্দেহজনক আর মিসেস জর্জ লীও সন্দেহ তালিকভুক্ত। কারণ তারও টাকার উপর সমান লোভ।

ডেভিড লীকে তারা সন্দেহ করছে এই ভেবে যে, সে তার মার মৃত্যুর ঘটনা ভুলতে পারছে না। তাই হয়তো…

তারা আলোচনা করতে করতে বলল, বিকেলে পারিবারিক মিলননোৎসবে সকলে যখন একত্র হবার পর চলে যাচ্ছিল তখন হিলডা কিছুক্ষণের জন্য ঘরে ছিল। তার পর আসে অ্যালফ্রেডও আর তার পর আসে হ্যারি। এরপর সে ফোন করে সাগডেনকে। হয়তো রাত আটটার পর সে আসল চোরকে ধরতে পারে মিঃ অথবা মিসেস জর্জ আবার পিলারও হতেপারে। তার বাবাও একজন অপরাধী আর তার জন্য সেও অপরাধ করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়, এবং ঐ বৃদ্ধকে খুন করতে বাধ্য হয়।

সাগডেন শহরের লোকের মতামত বলতে গিয়ে জানালো তারা বলছে মিঃ সাইমন লীর অনেক মেয়েকে বিয়ে করে আর সেই স্ত্রীকে পরে টাকা দিয়ে ছাড়ে এজন্য তার স্ত্রী ভগ্ন হৃদয়ে মারা যান। এই প্রতিশোধ নিতে গিয়েই হয়তো কোনো ছেলে তাকে খুন করে।

পোয়ারো একটা কথা বলতে গিয়ে থামল। তাদের দিকে হিলডা আসছে। সাগডেন বাড়ির ভেতরে চলে গেল।

হিল পোয়ারোকে বলল, আপনাকে দেখে আমার সবচেয়ে বুদ্ধিমান বলে মনে হয়েছে, আর মনে হয়েছে আপনিই আমাকে সাহায্য করতে পারতেন। আমার স্বামী মায়ের ভক্ত। বলে সে স্বামীর মনোভাবের কথা, বাবার ওপর ডেভিডের মনোভাবের কথা জানালো। সে বলল, তার স্বামী তার বাবাকে সহজেই খুন করতে পারে কিন্তু সেই সময় সে পিয়ানো বাজাচ্ছিল।

এই কথা বলতে বলতে উপস্থিত হল ডেভিড। সে হিলডাকে নিয়ে গেল খ্রীস্টমাসের আনন্দ উৎসব দেখতে।

বাগানে হাঁটতে হাঁটতে তার দেখা হল লিডিয়ার সঙ্গে। সে জানালো তার স্বামী তার সাথে দেখা করে যায়। এখন সে ঘুমোচ্ছে তাই একটু পরই পোয়ারোর সাথে সে দেখা করবে।

তারপর লিডিয়া খুনের ব্যাপারে জানতে চাইলে পোয়ারো বলে বাড়ির কেউ একজন তাকে খুন করেছে।

 এই কথার পর লিডিয়া চলে যায় আর পোয়ারো বাগানে হাঁটতে হাঁটতে চারিদিক পর্যবেক্ষণ করছিল। হঠাৎ সে কতকগুলো নুড়ি সরিয়ে সরিয়ে কতকগুলো অদ্ভুত জিনিষ দেখতে পেল। ভাবতে লাগল এর অর্থ কী?

.

০৫.

 ২৬শে ডিসেম্বর।

কর্নেল জনসন আর সাগডেন তাকিয়ে আছে পোয়ারোর দিকে। একী এগুলো যে হীরে, পেলেন কোথা থেকে?

মিসেস অ্যালফ্রেডের সাজানো বাগান থেকে। এক সময় ওটা সমুদ্রের নীচে ছিল তাই এমন পাথর থাকা কোনো অস্বাভাবিকই নয়।

তাহলে বেশ আঁটঘাট বেধে নেমেছিল।

হয়তো মিসেস লী ওটা সরিয়ে ছিলেন কারণ হয়তো তিনি বুঝেছিলেন কিছু একটা ঘটতে চলেছে।

তবে হীরে সরালেও সে খুন করেনি। কারণ খুনের সময় বৃদ্ধ খানসামা তাকে ঘরে দেখেছিল।

সাগডনে জানালো সে কিছু নতুন তথ্য আবিষ্কার করেছে–ম্যাগজলেন কমাণ্ডার জোন্সের নিজের মেয়ে নয়। এই ঘটনা সাইমন লী জানত তাই মিসেস লী হয়তো ভয় পেয়েছিলেন। তার স্বামীকে জানালো বিবাদ হবে তাই হয়তো সে খুন করেছে। টেলিফোনের গল্পটা বানানো। জর্জ লী আর তার স্ত্রী ঘরে ঢোকার পর তাদের সুপ্রভাত জানিয়ে প্রশ্ন করা শুরু হয়।

আচ্ছা আপনি ফোনে কথা বলতে শুরু করেন আটটা উনষাটে আর কথা বলা শেষ হয় নটা চার-এ। আর খুন হয় সোয়া নটায়, এই মধ্যের সময় আপনি কোথায় ছিলেন?

–আমি ফোন করছিলাম।

–না, হয়তো ভুলে যাচ্ছেন; হয়তো অন্য কোথা ফোন করছিলেন

এরপর ম্যাগজলেনকে প্রশ্ন করা শুরু হয়–আপনি তো বলেছিলেন এই ঘরে আপনি একা ফোন করছিলেন আসল কথা আপনি ফোন করেনই নি। আপনি কোথায় ছিলেন?

পুলিশের জুলুমবাজী আমরা আলাদতে তুলব। এই বলে ঘর থেকে স্বামী-স্ত্রী চলে যায়।

তারা তিনজন ওদের নিয়ে আলোচনা করছিল ঠিক সেই সময় ঘরে ঢুকল ম্যাগজলেন। সে জানালো যে, সে তার ছেলেবন্ধুকে ফোন করতে গিয়ে দেখেছিল জর্জ ফোন করছে। সে যাতে জানতে না পারে তাই ম্যাগজলেন সিঁড়ির আড়ালে লুকিয়ে ছিল আর তখনই..

ডাইনিংরুমের জানলার কাছে লিডিয়া দাঁড়িয়ে ছিল নিঃশব্দে ঘরে ঢুকল পোয়ারো। হঠাৎ একটা আওয়াজ হললিডিয়া তাকিয়ে দেখল পোয়ারো।

পোয়ারো বলল, আমি নিঃশব্দে চলি।

–আমি ভেবেছি হারবারি। সে এমন ভাবে এসে অনেক গোপন কথা শোনে। আপনার কী মনে হয়? সে আমাদের এমন ভাবে কথা শুনে ব্ল্যাকমেল করতে পারে? যদি হারবারি চোর আর খুনী না হয় তাহলে–চোর বা খুনী আমাদের বাড়ির কেউ হবেই। তাই আমার আর আমার স্বামীর মত সেই মানুষকে যদি আদালতে নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে আমাদেরই বদনাম। অনেক কেস তো চাপা পড়ে যায় তাই এটাকেও চাপা দিলে কেমন হয়?

আপনি হয়তো জানেন খুনী কে কিন্তু আমি ঠিক বলতে পারব না। তাই এখনই কোনো মতামত দিতে পারছি না।

মিউজিক রুমে পিলার আর স্টিফেন কথা বলছিল। তারা চলে যেতে চায় কিন্তু পুলিশ যেতে দেবে না। তারপর তারা কথা বলছিল উইল সম্পর্কে। হঠাৎ দেখা হল পোয়ারোর সাথে সে ঘরে বসে ছবি দেখছিল। আর বলল–লী পরিবারের বেশীর ভাগের মুখ মার মত। শুধুমাত্র হ্যারির বাবার মত।

একটা তরুণীর ছবি দেখিয়ে পোয়ারো বলল, একদম মিসেস সাইমন লী।

পিলার জানালো যে, ওটা তার মার ছবি তারপর নিজের গলার লকেটে তার বাবা-মার ছবি দেখালো।

পোয়ারো পিলারের পাশপোর্ট দেখতে চাইল এবং সেটা দেখার পর চলে গেল। তখন দেখা হল মিঃ আর মিসেস অ্যালফ্রেডের সাথে।

অ্যালফ্রেড বলল–আপনি আমার প্রস্তাবের কথা কী ভাবলেন?

পোয়ারো বলল–সে খুনীকে প্রায় ধরে ফেলেছে এবং হীরের ব্যাপারও জানালো। তারপর মিঃ সাইমন লীর যুবক অবস্থার ছবি চাইল।

.

০৬.

 ২৭শে ডিসেম্বর।

সলিসিটার মিঃ চার্লটন এসে উইলের কথা জানালো। এতে জানা গেল পরিবারের সকলে নিজেদের প্রাপ্য পেয়েছে বাদ পড়েছে কেবল পিলার। সকলে নিজেদের প্রাপ্য থেকে পোয়ারোকে দিতে রাজী হল। জর্জ লী তাকে পোষাকের জন্য কিছু দিতে রাজী হল। মনের দুঃখে সে ঘর ছেড়ে চলে গেল।

খাওয়া-দাওয়ার পর অ্যালফ্রেড আর তার স্ত্রী পিলারকে তার সম্পত্তির ভাগ দিতে চাইল কিন্তু পিলার তা নিতে চাইল না।

ঠিক সেই সময় ট্রেসিলিয়ান পোয়ারোকে জানালো দরজার ধারে দুটো বড় ভারী পাথর ছিল তার একটা পাওয়া যাচ্ছে না। আর তার পর সাগডেন এসে জানালো স্টিফেন ফার মারা গেছে দুবছর আগে এখানে যে এসেছে সে মিথ্যে বলেছে।

তারপরই শোনা যায় একটা আর্তনাদ। ওপরে গিয়ে জানা গেল যে পাথরের বলটা পাওয়া যাচ্ছিল না সেই বলটা পিলারের দরজার উপরে রাখা ছিল তাকে খুন করার জন্য কিন্তু পেরেকে আর স্কার্টটা আটকে যায় তার ফলেই সে বেঁচে যায়।

পোয়ারো সকলকে একত্র হতে বলে আর সেই সময় স্টিফেন জানায় তার আসল পরিচয়। তার নাম স্টিফেন গ্রাণ্ড, স্টিফেন ফার তার বন্ধু ছিল তার কাছ থেকেই সাইমন লীর কথা আর ট্রেনে মিস পিলারের ব্যাগে এখনকার ঠিকানা দেখে সে চলে আসে।

পিলার বলল, সে আসলে পিলার নয়। বলল, গাড়িতে পিলারের সঙ্গে তার আলাপ। বোমায় পিলার মারা যায় কিন্তু তার কিছু হয়নি। আগেই সে শুনেছে পিলারের সব কথা আর তাদের পাশপোর্টের ফোটো একরকম তাই চলে এসেছে এখানে, তবে সে শপথ করে জানায় যে খুন। বা চুরি কিছুই করেনি।

পোয়ারো সকলকে সন্দেহ করতে করতে আসল কথায় আসে–এ খুন স্টিফেন বা পিলার কেউই করেনি। এ খুন করেছে রক্তের একজন। তারপর পোয়ারো সাগডেনকে বলে–আপনার  মা টাকার জন্য সাইমন লীকে ছেড়ে অন্য লোককে বিয়ে করতে বাধ্য হন আর তার সেই অপমানের প্রতিশোধ নিতেই আপনি এই খুন করেন।

কিন্তু আমি যখন যাই তখন তিনি জীবিত।

তিনি তখন জীবিত কী মৃত কেউই তা দেখতে যায়নি। আপনাকে মিঃ লী ফোন করেননি বরং আপনিই তাকে মিথ্যে হীরে চুরির গল্প বলে আপনি এখানে আসেন তারপর দেখেন আসল হীরে আলমারীতে। তারপর ফায়ার প্লেসের সামনে আপনারা বসে কথা বলেন আর তখনই আপনার আসল পরিচয় জানান লীকে। এবং তখনই তার কণ্ঠনালী কেটে তাকে মেরে ফেলেন সঙ্গে করে দড়ি নিয়ে এসেছিলেন যা দিয়ে ঘরের সব আসবাবপত্র বাঁধেন এবং একটা বোতলে জানোয়ারের রক্ত নিয়ে এসেছিলেন সেটাকেও দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে যান। দড়িটাকে জানলে দিয়ে ঝুলিয়ে রেখে হীরেগুলো চুরি করে নিয়ে বাগানে সাজিয়ে রাখেন। যাতে চোর ও খুনী বাড়ির কাউকে মনে করে। এরপর চলে যাওয়ার সময় ঘরের দরজা বাইরে থেকে লক করে রেখে যান যাতে কেউ ঘরে ঢুকতে না পারে। তারপর সোয়া নটা নাগাদ এসে জানালা দিয়ে দড়ি টেনে সব জিনিষগুলো ফেলে দেন। আর একটা বেলুন রেখে যান যেটাতেও একটা দড়ি বাঁধা থাকে–যেটার দড়ি ফেলার সাথে ঐ বিকট আওয়াজ বেরিয়ে আসে। আমি মিঃ লীর ছবি নিয়ে গিয়ে তাতে নকল গোঁফ লাগিয়ে দেখি তার সাথে আপনার মুখের হুবহু মিল। আর পিলারও আপনাকে একই কথা বলেন, আর প্রথমে ওর বেলুনে রবারের ছিপি দেখে পিলার। তাই যদি আরো কিছু বলে দেয় তাই আপনি তাকেও মারার চেষ্টা করেন। এসব কথা শুনে সাইমন বলে হ্যাঁ, আপনার কথা সত্যি আমিই তাকে খুন করেছি। আমি এর জন্য নিজেকে অপরাধী বলে মনে করি না। আমি এর জন্য খুব খুশী, সত্যিই খুশী। এখানে মি সাইমন লীর আর্তনাদ নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলে।

মিঃ জর্জ লী বলেন এটা একটা মানুষের আর্ত চিৎকার।

 মিসেস জর্জ লী আর মিঃ ডেভিড বলল, এটা এমন একটা চিৎকার যার আত্মা নেই।

মিসেস ডেভিড লী বলেন একটা নারকীয় চিৎকার শোনা গেল।

মিঃ এণ্ড মিসেস অ্যালফ্রেড লী বলেন এই চিৎকার এক জানোয়ারের। মিঃ হ্যারি লী তিনি খুব কাছাকাছি গেছেন, তিনি বলেন এই চিৎকার শুনে মনে হয়েছিল শূকরছানার চিৎকার। আর মিস পিলার এমনই একটা বেলুন মেলায় কেনেন, আর তখনই আমার সন্দেহ বাস্তব রূপ পায়।