২. স্বর্ণ তৃষা

স্বর্ণ তৃষা :

মারপলের বসার ঘরে সবাই উপস্থিত। মিঃ পেনডার, মিঃ পেথোরিক এখন আসেনি। হেনরি, মিস মারপল নিচু স্বরে গল্প করছেন। জয়েস ও রেমণ্ড চুল্লীর পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। বাকি দুজন একসাথে ঢুকলেন।

চা পর্ব চুকে গেলে রেমণ্ড তার কাহিনী শুরু করল।

আমি যে গল্পটা শোনাব এই পরিবেশে উপযুক্ত হবে কিনা জানি না। শেষ জানি না এবং পুরোটাই রহস্যময় রয়ে গেছে, আমার কাছে।

আমার কাছে কাহিনীটা আশ্চর্যজনক। পুরো কাহিনী শোনার পর আপনারা কেউ হয়তো রহস্য ভেদ করতে পারবেন। সমস্বরে সবাই তাকে গল্পটি বলার অনুরোধ করলো।

প্রায় ছবছর আগের ঘটনা। আমি তখন নিউম্যানের অতিথি।

 জয়েস বলল–কর্নওয়ালে?

রেমণ্ড বলল, কেন?

না, তেমন কিছু নয়। আমার গল্পের পটভূমিও কর্নওয়াল। সমুদ্রতীরে জেলেদের একটা ছোটো গ্রাম রাদোল। তোমার গল্পটা নিশ্চয় ওখানকার নয়।

আশ্বস্ত করে বলল জয়েসকে, গ্রামটির নাম পলপেরানী। প্রাকৃতিক দিক থেকে রুক্ষ; পাথুরে, বন্য। যার অতিথি ছিলাম, তার সঙ্গে আলাপ বেশি দিনের নয়। অল্প দিনের বন্ধুত্ব। প্রথমদিনই ওর জ্ঞান এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার ছোঁয়া পাই। বেশিরকম কল্পনাপ্রবণ থাকায় মাথায় ঘুরত আজগুবি কল্পনা।

মধ্যযুগীয় ইতিহাসে ছিল তার প্রচুর জ্ঞান। স্পেন থেকে যে জাহাজ ইংল্যান্ড আসত, বিশেষতঃ স্পেনীয় আর্মাডার যাত্রাপথ সম্পর্কে বহু গবেষণা করেছেন। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যখন তিনি যাত্রাপথের বিবরণ দিতেন তখন মনে হত তিনি যেন সেই জাহাজের নাবিক ছিলেন। উত্তেজিত কণ্ঠে হাত-পা নেড়ে গল্প করার সময় মনে হত সত্যিই উনি জাতিস্মর হয়ে এসেছেন এবং গতজন্মে দুর্ধর্ষ স্পেনীয় নাবিক ছিলেন।

মারপল সস্নেহে তাকিয়ে বলেন, ছোঁয়াচে কল্পনার ছায়া তোমার ভালোই লেগেছে।

বিরক্ত হয়ে প্রতিবাদ করে রেমণ্ড বলল-না পিসি, আমি নই, তার কল্পনা জগতে তিনি নিমজ্জিত থাকেন।

নিউম্যানের মোদ্দা কথা হল, ওই বিখ্যাত আর্মাডার একটি জাহাজ প্রচুর সোনা ও ধনরত্ন নিয়ে ইংল্যান্ডে আসার পথে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। সর্পিল ডুবো পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। নিউম্যানের স্থির বিশ্বাস কর্নওয়ালের উপকূলে কোথায় জাহাজডুবি হয়।

একটা কোম্পানিও তৈরি হয় ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহাজের স্বর্ণ উদ্ধারের জন্য। অনুসন্ধান ব্যর্থ হয়। নিউম্যানের কল্পনা ছিল গগনচুম্বী। ধনরত্ন উদ্ধারের জন্য নাছোড়বান্দা হয়ে জলের দরে কোম্পানিটা কিনে নেয়। ওর ধারণা স্প্যানিস জাহাজের স্বর্ণসম্পদ সাগরের তলায় আছে। আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হবে স্বর্ণ তুলে আনতে।

খেয়াল মেটাতে সেইখানে পল হাউস নামে একটি বাড়ির লিজ নেবেন। অবাক হয়ে গেলাম নিউম্যানের মতো ধনী ব্যক্তি টাকা উড়িয়ে হয়তো কয়েকশো টাকা দামের খেলো জিনিস পায়। তার অদ্ভুত খেয়াল আমাকেও প্রভাবিত করল। আমিও মনশ্চক্ষে দেখতাম ঝড়ঝঞ্ঝা উপেক্ষা করে তাদের এগিয়ে যাওয়া। তারপর পাহাড়ে ধাক্কা লেগে ঘটে সলিল সমাধি।

নিউম্যানের আমন্ত্রণ যোড়শ শতাব্দীর পটভূমিকায় উপন্যাস লেখার উপযুক্ত রসদ।

শুক্রবার ভোরে প্যাডিংটন থেকে রওনা দিলাম কর্নওয়ালের উদ্দেশ্যে। সঙ্গী লম্বা চেহারার মানুষটিকে প্রথমেই চেনা লাগছিল। মনে পড়ল ইনি হলেন পুলিশ ইনসপেক্টর ব্যাজওয়ার্থ এডার্সন, নিরুদ্দেশ মামলায় ওর সঙ্গে আলাপ। মামলা সম্পর্কে ধারাবাহিক লেখার সময় ব্যাজওয়ার্থের শরণাপন্ন হতে হত।

পরিচয় দিতেই চিনতে পেরে সারা পথ গল্প করে কাটালাম। পলপেরানী যাচ্ছি শুনে বলেন–আমিও তো ওখানেই যাচ্ছি।

আমি ও অঞ্চলে যাবার উদ্দেশ্য জানিয়ে ডুবে যাওয়া স্প্যানিস জাহাজ সম্পর্কে বন্ধুর আগ্রহের কথাও বললাম।

জাহাজের কথা আমিও জানি, নাম জুয়ান ফারনানডেস। অনেক মানুষ ব্যর্থ হয়েছে ডুবন্ত জাহাজের সন্ধান করতে গিয়ে।

আমি বললাম–সবই কল্পনা মাত্র। জাহাজ ডুবলেও কোনো ধনরত্ন তাতে ছিল না।

অবাক করেই ইনসপেক্টর বলেন–একটা নয় অনেক জাহাজডুবি হয়েছিল। আর ওইরকম ধ্বংসগ্রাপ্ত জাহাজ ওটারনাটো নামে একটা জাহাজে ধাক্কা লেগে ডুবে যায়।

আমি বলি, ঘটনাটা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

ব্যাজওয়ার্থ বলেন, প্রাণহানি না ঘটলেও প্রচুর সোনার বাট ছিল জাহাজে। ব্যাক অন্ ইংল্যান্ডের ভল্টে যাচ্ছিল।

ডুবুরি নামিয়েও সোনা উদ্ধার করা যায়নি।

অবাক হয়ে বললাম–সোনা তো উবে যেতে পারে না।

 ব্যাজওয়ার্থ বললেন–ধাক্কা খাবার সময় স্ট্রংরুমে ফাটল ধরে, যেখানে সোনা মজুত ছিল। ডুবুরিরা ফাটলের মধ্যে স্ট্রংরুমে ঢুকে সোনা পায়নি। আসল প্রশ্ন হল সোনা অপহৃত হয় ডোবার আগে না পরে। নাকি সোনা জাহাজে আদৌ তোলা হয়েছিল।

অদ্ভুত ব্যাপার তো।

ব্যাজওয়ার্থ বলেন, কেউ পকেটে ভরে নিতে পারে না, কারণ প্রচুর সোনার বাট। হয়তো, জাহাজ যাত্রা করার আগে কোনো প্রতারক সোনা সরিয়ে ফেলেছিল বা কেউ বাটগুলি অপহরণ করে। এই রহস্য উন্মোচন করতেই পলপেরানী যাত্রা।

নিউম্যান এককোণে দাঁড়িয়েছিল। দেখেই হৈ হৈ করে এগোল। বলল, মেরামতির জন্য গাড়িটা আনতে না পারায় লরি নিয়ে এসেছি। থাকা খাওয়ার অসুবিধার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করল।

আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে লরি চলল। গ্রামের ভিতর দিয়ে যাওয়ার পর গাড়ি উপরে উঠল। উঁচুতে ওঠার পর সমতল জায়গা, সেখানেই পাথরের প্রাসাদ পল হাউস।

পল হাউস আপনাকে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। আর সেই সঙ্গে খোদিত স্পেনীয় জাহাজও সুউচ্চ চূড়ায় বাড়িটি। তিন চারশো বছরের। সামনে প্রসারিত মহাসমুদ্র। পিছনে বিস্তৃত কৃষিক্ষেত্র। পাহাড়, নিবিড় জঙ্গল। প্রকৃতির রূপে প্রশান্ত চিত্ত উপন্যাস শেষ করার আদর্শ জায়গা।

সন্ধ্যায় নিউম্যান যাবতীয় কাগজপত্র নিয়ে জুয়ান ফারনানডেস জাহাজ সম্পর্কে অনেক নথিপত্র দেখাল। মানচিত্র খুলে বোঝাল কোন অঞ্চল দিয়ে গিয়ে কোথায় ধাক্কা খায়। কোন যন্ত্রপাতি দিয়ে সোনা উদ্ধার করবে তাও বোঝাল। বিমোহিত হয়ে পড়লাম।

ব্যাজওয়ার্থের সঙ্গে আলাপের কথা বললাম, এবং তার আসার কারণটা। আগ্রহ সহকারে সব শুনে বলল-উপকূলভাগের লোকেদের রক্তের মধ্যে দসুতা এবং ধ্বংসের প্রবৃত্তি আছে। এই অঞ্চলে জাহাজ ধাক্কা খেয়ে ডুবে গেলে, ডুবন্ত জাহাজের সম্পত্তি তাদের মনে করে, হস্তগত করতে কালক্ষেপ করে না।

এইরকম লোকের সঙ্গে আপনার আলাপ করিয়ে দেব, যেন কোনো জলদস্যু।

পরদিন প্রথম সূর্যের আলোয় আমি আর নিউম্যান গ্রামে এলাম। একটু ফিরে গেলাম সমুদ্রতীরে কোম্পানির জাহাজঘাটায়, পরিচয় হল ডুবুরি হিগনিসের সঙ্গে, বিরাট চেহারার সঙ্গী, ধূসর পলকহীন ভাবলেশহীন মুখ। হ্যাঁ বা না ছাড়া কিছুই বলল না।

স্থানীয় রেস্তরাঁয় থ্রি অ্যাসকোরের বিয়ার খেতে গেলাম। বিয়ার খেতে খেতে আলাপ হল হিগনিসের সঙ্গে। নানা বিষয়ে কথা বলল।

জানতে চাইলাম কেমন দেখতে সমুদ্রের তলা। কি রকম মাছ ও গাছপালা আছে। ডুবুরির পোশাকে কেমন অনুভূতি।

শান্ত মেজাজেই উত্তর দিচ্ছিল। হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলল-লন্ডন থেকে গোয়েন্দা এসে জানবে নভেম্বরে ডুবে যাওয়া জাহাজে কত সোনা ছিল। বহু জাহাজও ডুবি হয়েছে। সরকারী সোনাও লুট হয়েছে।

হঠাৎ কার গলা শুনে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল, মিঃ কেলডিন।

আগ্রহের সঙ্গে কেলডিনকে দেখে বুঝলাম চেহারায় বিশেষ ছাপ আছে। পেশীবহুল তামাটে রং। রক্তবর্ণ চোখ ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখেই মনে হল নিউম্যান বর্ণিত জলদস্যু সর্দার।

হঠাৎ তাকিয়ে বলল, বিদেশীদের নাক গলানো তারা সহ্য করবে না, শুধু পুলিশ নয় অন্যদেরও। এই বলে তীব্র দৃষ্টি ফেলে চলে গেল থ্রি-অ্যাসকোরের মালিক কেলডিন।

বাড়ি ফেরার পথে নিউম্যান কথাবার্তায় ভয় দেখানোর হুমকি দিল। তার কাজকর্ম সে পছন্দ করছে না। নিউম্যান ওর কথায় গা করল না।

মন থেকে সন্দেহ গেল না। মনে হল এই ধরনের লোক যে কোনো ঘৃণ্য অপরাধ করতে পারে। মনে হল কোথাও গণ্ডগোল হতে পারে। এই আশঙ্কায় ঘুম এল না।

মেঘলা আকাশ। ঝড়বৃষ্টি নামতে পারে। সঙ্গে অজানা আশঙ্কায় মন ছিল ভারাক্রান্ত। প্রাতঃরাশের টেবিলে নিউম্যান জানতে চাইল মুখ গম্ভীর হওয়ার কারণ।

মনের কথা জানাতেই নিউম্যান গুরুত্ব না দিয়ে বলল–অবস্থার জন্য মেঘলা আকাশ দায়ী।

একটু বেড়াতে বেরিয়েও ফিরে আসতে হল। উপন্যাস লেখার চেষ্টা ব্যর্থ, গল্প শোনার আশায় হিগনিসের খোঁজ করা হল কিন্তু পাওয়া গেল না।

সন্ধেবেলা নিউম্যানের মোটর বোটে বেরিয়ে পড়লাম।ঝড়বৃষ্টির মুখে ফিরে আসি।কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হয় প্রচণ্ড ঝড়। ঝড়ের দাপাদাপিতে বন্ধ ঘরে থাকলাম।

ঘরে ফিরে অজানা আশংকায় মন ভার হয়ে গেল। বুকটা ভার। কাঁটা বিঁধছিল মনে। যেন কিছু ঘটবে। অবস্থান বোঝাবার নয়। দশটা নাগাদ ঝড় কমল।

জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে নিউম্যান বলল-কিছুক্ষণের মধ্যে আকাশ পরিষ্কার হয়ে যাবে। ক্লান্ত হয়ে জানালাম–গত রাত্রে ঘুম না হওয়ায় প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে আমার। তাকে একাই যেতে বললাম।

ঘুমের মধ্যে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম। মনে হল গভীর গহ্বরের পাশ দিয়ে সে হাঁটছে। পা ফসকালেই মৃত্যু। বাইরে চোখ পড়তেই দেখলাম, একটা মানুষ বাগানের পিছনে কবর খুঁড়ছে। চোখ মুছে দেখি বাগানের মালী লম্বা গর্তটি খুঁড়ছে। পাশে রয়েছে কয়েকটা গোলাপের চারা।

মালী সুপ্রভাত জানিয়ে বলল–আজকের দিনটা ভালোই যাবে। প্রত্যুত্তরে আমিও সম্মতি জানালাম।

মেঘ কেটে ঝঝকে নীল আকাশ। সমুদ্রে বেড়াতে যাবার ইচ্ছা জাগল। গ্রাম থেকে আসা স্ত্রীলোক প্রাতঃরাশের টেবিল সাজাল।

সকালে নিউম্যানের খোঁজ করে জানা গেল, সে সকালেই বেড়িয়েছে।

কথাটা শুনেই ছুটলাম শোবার ঘরের দিকে। গিয়ে দেখলাম গতকালের নিউম্যানের পোশাক নেই। সম্ভবত কাল রাত্রে উনি বেরিয়েছেন।

আশংকায় মন দৃঢ় হল। বলেছিলেন ঝড় থামলে বেরোবেন। না ফেরার কারণ হিসেবে মনে হল পাহাড় থেকে পড়া বা কোনো দুর্ঘটনা।

কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কিছু লোক জোগাড় করে বেরিয়ে নিউম্যানের খোঁজে চূড়া থেকে নেমে সমুদ্রতীরে তন্নতন্ন করে খোঁজা হল। কিন্তু কোথাও তাকে না পেয়ে ব্যাজওয়ার্থের শরণাপন্ন হলাম।

সব শুনে বললেন–নিশ্চয় দুর্ঘটনা ঘটেছে। কারণ সন্দেহজনক অপরাধী লোক প্রচুর রয়েছে। থ্রি-অ্যাসকোরের মালিকের সঙ্গে আলাপের কথা জানালাম। ব্যাজওয়ার্থ বলল-গুণ্ডামী এবং মারদাঙ্গার অভিযোগে সে জেল খেটেছে।

কেলডিনদের ধারণা বিদেশী হয়েও ওদের ব্যাপারে সে নাক গলাচ্ছে। ব্যাজওয়ার্থ যোগ দিল তল্লাশীতে। নতুন উদ্যোগে খোঁজা শুরু হল। বিকেলে সন্ধান পাওয়া গেল। বাগানে গভীর খাদে পড়েছিল। মুখ, হাত-পা শক্ত করে বাঁধা, যাতে আওয়াজ না করতে পারে।

দীর্ঘক্ষণ বন্দী থাকায় প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছে। কিছুক্ষণ পরে সুস্থ হয়ে আমাকে এবং ব্যাজওয়ার্থকে সব বলল।

বলল–ঝড়জল থামলে বেড়াতে বেরিয়ে ভালোই লাগছিল। হাঁটতে হাঁটতে সে সমুদ্রতীরে পাহাড়ের গায়ে যে গুহা আছে যা চোরাচালানকারীদের গুহা বলে পরিচিত সেখানে চলে আসে।

হঠাৎ জ্বলা-নেভা আলো দেখে এগিয়ে দেখতে পেল কিছু লোক মোটর বোট থেকে ভারী জিনিস তুলে গুহার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কৌতূহলী হয়ে একটু বেশি এগোতেই কেউ একজন তাকে দেখে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গীদের সতর্ক করে দেয়। ওরা আসছে বুঝতে পেরে নিউম্যান পালাতে গেলে শক্ত দুটো হাত ওকে ধরে ফেলে। প্রচণ্ড আঘাতে সে জ্ঞান হারায়। জ্ঞান ফিরলে দেখল সে লরির ভিতর বন্দী। লরির গতিবিধি দেখে বুঝল লরিটা ওর বাড়ির গেটে ঢুকছে। কিছু দূর গিয়ে ওরা একটা গভীর খাদে তাকে ফেলে দিল।

সঠিক তথ্য দিতে না পারলেও মনে হল তারা কর্নিল প্রদেশীয় নাবিক। তারা কিন্তু তাকে ভালোই চেনে।

বিবরণ শুনে ব্যাজওয়ার্থ বলেন–সোনাগুলি চোরাই। কিন্তু সোনার সন্ধানে বেরোলে বুঝতে পারি সোনা স্থানান্তরিত হচ্ছে। এবং সম্ভবত এই জায়গা থেকে সোনা সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

লোকজন নিয়ে ইনসপেক্টর সেই গুহায় গেল। প্রমাণও পেল সোনা রাখার, কিন্তু সন্ধান পেল না কারণ বোঝা গেল দূরতম দ্বীপে বা গুহায় তা সরিয়ে ফেলেছে।

ব্যাজওয়ার্থের একটা ক্ষীণ সূত্র মিলল। গুহার পাশে চাকার দাগ এবং দাগটা নিউম্যানের বাড়ি পর্যন্ত গেছে। এবং লরিটা পেছনের গেট দিয়ে বেরিয়েছে। নিউম্যান ছাড়া কেলডিনের একটি লরি আছে।

তরুণ বয়সে কেলডিন ডুবুরি ছিল জানতে পেরে অনুমান করল সেই চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। সোনা তুলতে কেলডিনের মতো ডুবুরিই দরকার।

ধারণা বদ্ধমূল করতে তারা হাজির হল গ্যারাজে। তন্নতন্ন করে খুঁজে হঠাৎ উল্লসিত হয়ে পড়ল। বলল–যে ভাঙ্গা টায়ারের দাগ মিলেছে, এটি সেই টায়ার। ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই সোনার হদিশ মিলবে।

রেমণ্ড সবাইকে জিজ্ঞেস করল তারা কি কিছু অনুমান করতে পেরেছে? কারা পাচারকারী?

জয়েস অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল, সোনা কি পাওয়া গেছে?

রেমণ্ড বলল, সোনা মেলেনি এবং কেলডিনকেও গ্রেফতার করা যায়নি। নির্দোষিতা প্রমাণের পক্ষে দুটি সাক্ষ্যই যথেষ্ট।

প্রথম প্রমাণ একজন নার্স। যিনি রাতের ডিউটিতে সারারাত বসেছিলেন জানালার ধারে। তিনি কোনো গাড়িকে বের হতে দেখেননি।

দ্বিতীয় হল, মহিলা শিল্পী স্বয়ং কোমরের ব্যথা বাড়ায় সে রাত্রে যন্ত্রণায় ঘুমোতে পারেনি।

রেমণ্ড বলল, টায়ারের ব্যাপার ছাড়া আর কোনো প্রমাণ কেলডিনের বিরুদ্ধে ছিল না।

হেনরি বলেন–ঘটনাটা সে আগাগোড়া জানে কারণ সেই সময় তিনি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে ছিলেন। রহস্য প্রকাশ এখন নয়।

রেমণ্ড মারপলকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, বন্ধু নির্বাচনে তার সতর্ক হওয়া উচিত; যে সবকিছু সহজেই বিশ্বাস করে তাই ঠকে যায়।

মিঃ হেনরি মারপলকে বলেন–তিনি নিউম্যানের আসল রূপটা ধরে ফেলেছেন। কি করে সম্ভব হল।

নিউম্যানের অতীত জীবন অন্ধকারময়। ডুবে যাওয়া ওটারনাটো জাহাজের সোনা চুরির পাণ্ডা সে। কারণ সোনাগুলির বেশির ভাগ মেলে পল হাউসের বাগানে।

 জাহাজ উদ্ধারের নামে পুরানো কোম্পানিটা কিনে লোকজন লঞ্চ ডুবুরি এনেছিল নির্জন জায়গায়। পল হাউস কিনে ঘাটি গেড়ে বসে। যেন, প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চালানোর কায়দায়। শুধু ছিল সাক্ষীর প্রয়োজন।

যখন জানতে পারল রেমণ্ড যোড়শ শতাব্দীর পটভূমিকায় উপন্যাস লিখতে বইয়ের সন্ধান করছিল, তখন মতলবটা তার মাথায় আসে। জাহাজ ডোবা নিয়ে রোমাঞ্চকর গল্প বানিয়ে পল হাউসে, তাকে নিমন্ত্রণ করল। গল্পের আসল উদ্দেশ্য ছিল ওটারনাটো থেকে সোনা অপহরণ।

খ্যাতনামা সাহিত্যিক হওয়ায় রেমণ্ডের সাক্ষ্য অত্যন্ত দামী ছিল, এবং পুলিশ যাতে তাকে সন্দেহ না করতে পারে সেইজন্য কেলডিনকে সামনে রাখে।

জয়েস, লরির চাকার প্রসঙ্গ তুলতেই মারপল বলেন–নিউম্যানের লোকেরাই কেলডিনের লরির চাকা খুলে তার লরিতে লাগিয়েছিল। ডুবুরি দিয়ে সোনা তুলে দুর্গম গুহায় রাখছিল।

ইনসপেক্টর ব্যাজওয়ার্থের আসার কথা জেনে ঝড়বৃষ্টিতে সুবর্ণ সুযোগ বুঝে গুহা থেকে লঞ্চে সোনা এনে লরি করে বিভিন্ন জায়গায় পাঠায়। টায়ারের দাগ স্পষ্ট করতেই লরিকে পেছন গেট দিয়ে বের করে তারপর চাকা যথাস্থান লাগিয়ে দেয়–যেন, সন্দেহ করে কেলডিনকেই।

মালী সাজা লোকটাকে যাতে সন্দেহ না হয় তাই খোঁড়ার সময় সামনে ছিল গোলাপ চারা। গর্তে সোনা রেখে চারাগুলি পোঁতা হয়। সুযোগ বুঝে পরে তুলবে। তার লোকেরাই হাত-পা বেঁধে তাকে গর্তে ফেলে দেয়।

রেমণ্ডের প্রশ্ন–লোকটা আসল মালী নয়?

 উত্তরে মারপল বলল–সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় মালীরা সোমবার কাজ করে না।

জয়েস হাসতে হাসতে বলল-প্রমাণ হল, ঘটনাটা বাস্তব বলে বর্ণনা করলেও রেমণ্ড কল্পনা জাগতের মানুষ।

হেনরি বলেন–রেমণ্ড তাদের চমকপ্রদ রহস্যজনক গল্প শুনালে, দ্বিতীয় চিত্রশিল্পীর গল্প শোনার প্রস্তাব দিয়ে সভা শেষ করল।

.

ফুটপাথে রক্তের দাগঃ–

মারপল চুল্লীর পাশে চেয়ারে বোনার সরঞ্জাম নিয়ে হেনরির সঙ্গে গল্প করছেন। পোড়া পাইনের মৃদু সৌরভ। জয়েসের উচ্চকিত স্বর, এবং হাসি শোনা যায়। পরিচারিকা চা নিয়ে প্রবেশ করল। জয়েস পরিবেশন করল। দেরিতে আসার জন্য মিঃ পেথোরিক ক্ষমতা চাইলেন উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল। চায়ের কাপ হাতে পেনডার লেমিপ্রিয়েরকে অনুরোধ করেন গল্প শুরু করতে।

ঘটনাটা যে গ্রামে ঘটে তার নাম রাদোল। ধীবর প্রধান গ্রাম। শান্ত, যেন শিল্পীর তুলির জলরঙের ল্যান্ডস্কেপ।

প্রাকৃতিক দৃশ্য আঁকতে পনেরো দিনের জন্য গেছিলাম ঐ গ্রামে। উঠেছিলাম পলবারুইথ আরমস পান্থশালায়। যেটি আশ্চর্যজনকভাবে রক্ষা পায় আর্মাডার যুদ্ধ জাহাজের কামান দাগা থেকে। শুধু দিক নির্দেশিকা নষ্ট হয়।

রেমণ্ডের মন্তব্য, ইতিহাস কি তাই বলে?

রাস্তা পর্যন্ত ছড়ানো ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলি জয়েস আঁকত।

একদিন রৌদ্রকরোজ্জ্বল সকালে একটা গাড়ি পান্থশালায় এসে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে নামল একজন পুরুষ এবং উজ্জ্বল পোশাক পরিহিতা মহিলা। পান্থশালা পার হয়ে এগোলেন সমুদ্রের দিকে।

কিছুক্ষণ পরে অন্য গাড়ি থেকে নামলেন কমলা রংয়ের পোষাকে সজ্জিত এক মহিলা যিনি গাড়িটির চালক। মাথায় খড়ের টুপি তাতে বাঁধা ছিল হলুদ লাল ফিতে।

আগের গাড়িতে আসা ভদ্রলোক শব্দ শুনে তাকিয়ে আনন্দে চিৎকার করে বলেন–তুমি ক্যারল না? আরও বললেন, তার স্ত্রী তাকে দেখে খুব অবাক হবে। এই বলে উপরে উঠে এল।

সুপুরুষ লোকটি জেনিস। তারা বেড়ানো, সমুদ্র স্নান নিয়ে কথা বলছিল। পান্থশালার থেকে কিছুটা দূরত্বে একটা পাহাড়ের গুহা আছে যেখান থেকে পুরো অঞ্চল দেখা যায়। পরে স্থির হয় ক্যারল পদব্রজে এবং জেনিস মার্জারি বোটে করে গিয়ে সেখানে মিলিত হবে।

স্নানের পোশাক নিয়ে তারা বেরিয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পরে জয়েসও স্নানের পোশাক এবং খাবার-দাবার নিয়ে বেরোল।

স্নান সেরে টিনের খাবার ও কফি দিয়ে দুপুরের খাবার শেষ হল। অলস মহ্যাহ্নে গ্রামটি ঘুমিয়ে পড়েছে। সূর্য পশ্চিম গগনে; আঁকার উপযুক্ত পরিবেশ।

কিছুক্ষণ পর মুখ তুলতেই দেখা গেল একটি লোক পিলারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রোদে পোড়া তামাটে চেহারা ও পোশাক দেখে মনে হল তার পেশা মাছধরা। লম্বা কালো দাড়ি, চওড়া কাঁধওলা টুপিতে যেন ছবির জলদস্যু।

স্থির করলাম তার ছবি আঁকার। তবে হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল সে সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকবে। আঁকা যখন প্রায় শেষ তখন দেখা গেল সে জয়েসের দিকে এগিয়ে আসছে। এবং বলল এই রদোল আকর্ষণীয় সুন্দর। ছবি আঁকার জন্য উপযুক্ত। তার নানা ঘটনা বলতে লাগল।

লোকটির বর্ণনা শুনে জয়েসের মনে হল তার চাউনি এবং বলার ভঙ্গিতে কোথাও যেন নিষ্ঠুরতার মানে লুকিয়ে আছে।

তার কথা শুনতে শুনতে আঁকতে লাগলাম। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম সূর্য রশ্মির বদলে একেছি রক্তের ছাপ। হঠাৎ রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ফুটপাথে লাল আভার পরিবর্তে রক্ত পড়ে রয়েছে। চোখ খুললেই দেখা যাচ্ছে রক্তের ছোপ। লোকটিকে জিজ্ঞেস করায় সে বলল, আজকাল রক্ত দেখা যায় না। কারণ ঘটনাটা কয়েকশো বছরের পুরানো।

সেই সময় রাস্তায় বেরিয়ে এলেন জেনিস। বিমূঢ় চোখে তাকিয়ে শুকনো জামাকাপড় তুলতে লাগলেন।

জেনিস কিছুটা এগিয়ে এসে দাড়িওলা ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করল তার সঙ্গী মহিলাটি ফিরেছেন কিনা? কিন্তু জানা গেল বহুক্ষণ আগেই তিনি ফিরে গেছেন। বহুক্ষণ হয়ে গেল তবুও সে ফিরল না। মনে হয় পাহাড়ের রাস্তা ছিল পিছল।

জেনিস তার স্ত্রীকে জানাল এখনও ক্যারল ফিরল না, তার কি করা উচিত। তারপর জেনিস বলল, তারা তার জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে পারবে না। পেরিনদার-এ আজকের মধ্যে যেতে হবে।

কিছুক্ষণ পরে কালো দাড়িওয়ালা লোকটির গলা তার কানে এল। জিজ্ঞেস করল জয়েসকে যে, তিনি সত্যিই রাস্তায় রক্তের দাগ দেখেছেন কিনা? যদি সত্যিই দেখেন তবে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই কোনো জায়গায় রক্তপাত বা খুনের ঘটনা ঘটতে পারে। লোকটি আরও বলল, এখানকার গীর্জায় একজন ব্যক্তির মৃত্যুর বর্ণনা আছে।

কিছুক্ষণ পরে জয়েস দেখতে পেল ক্যারল নামে ভদ্রমহিলাটি ফিরে আসছে কিন্তু মনে হল যেন উনি রক্ত মেখে আসছেন।

জয়েসের রক্ত শুনে রেমণ্ড বলল–যদি এটাই গল্পের শেষ হয় তবে বলতে হবে, সেটা তার মনের কল্পনা।

সঙ্গে সঙ্গে জয়েস বলল-ঘটনার কয়েকদিন পর নতুন একটা খবর, আনার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যু।

গ্রাম থেকে কিছু দূরে সমুদ্রের তীরের কাছে একটা জায়গায় ক্যাপ্টেন জেনিস জ্যাক্রের স্ত্রী স্নান করতে গিয়ে ডুবে যান। প্রথমে তারা ঠিক করেছিলেন সমুদ্রে স্নান করবেন। কিন্তু খারাপ আবহাওয়ার জন্য না গিয়ে গলফ খেলতে গেলেন। কিন্তু আকাশ পরিষ্কার হলে সে তার স্ত্রীকে নিয়ে সমুদ্রে গেল। অনেকক্ষণ ধরে ফিরছে না দেখে কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে স্ত্রীর খোঁজে বেরোল। কিন্তু কোন চিহ্ন খুঁজে পেল না। তিন চারদিন পর পেলেন মাছে ঠোকরানো স্ত্রীর মৃতদেহ। মাথায় ছিল গভীর ক্ষত। প্রথমে স্ত্রীকে চিনতে পারল না কিন্তু বিয়ের আংটি দেখে সনাক্ত করল। অনুমান করা হল ঝাঁপ দেবার সময় মাথায় আঘাত লেগে জ্ঞান হারিয়ে ভেসে যান।

হেনরি হাসতে হাসতে বলেন–এটি নিছক আদি ভৌতিক ব্যাপার। কিন্তু স্বভাবস্নিগ্ধ ভাবে কেশে বলেন, মাথার ক্ষতচিহ্নটি মামুলি নয়।

রেমণ্ড মন্তব্য করল, বদহজমের ফল এবং কাকতালীয়।

 ডঃ পেনডার বলেন–বিশেষ কোনো সূত্র নেই যাতে রহস্য ভেদ করা যায়।

এরপর জয়েস আগ্রহ সহকারে মারপলের দিকে তাকাল। তিনি বললেন–এমন কিছু। পোশাক আছে তাতে কিছু রহস্য লুকিয়ে আছে তা পুরুষের বোঝা অসম্ভব।

মারপলের মন্তব্য শুনে জয়েস বুঝতে পারল যে পিসি রহস্য ধরতে পেরেছে। কারণ ঘটনা শোনার পর আসল রহস্য বোঝা কঠিন হয়নি। কারণ ঝুল বারান্দা থেকে শুকোতে দেওয়া কাপড় থেকে জলমেশানো রক্ত বিন্দু। খুনীর অজান্তেই পোশাকে রক্তের দাগ লেগেছিল।

হেনরি মারপলকে বলে-পুরো ব্যাপারটা তার অন্ধকার লাগছে। তার মনে হল জয়েস এবং মারপল ব্যাপারটা বুঝেছে।

এরপর জয়েস শেষ পর্বটা বলা শুরু করল। আসল ঘটনা হল, জেনিস সব সময় সাদামাটা সরল চেহারার মহিলাকে বিয়ে করে স্ত্রীর নামে প্রচুর লাইফ-ইনস্যুরেন্স করত। স্ত্রীকে বেড়াতে নিয়ে আসত সমুদ্রের কাছাকাছি কোনো জায়গায়। ঘটনাস্থলে হাজির থাকত আসল স্ত্রী। তারপর স্নানের অজুহাতে জলের ভিতর খুন করে ভাসিয়ে দিত জলে আর হোটেলে ফিরত। নববধূর সঙ্গে ক্যারলের পোশাকের মিল থাকায় কেউ সন্দেহ করত না। তারপর জেনিস পেয়ে যেত ইনস্যুরেন্সের সব টাকা। এইভাবে তারা চালাত হত্যাকাণ্ড।

রেমন্ডের প্রশ্নের উত্তরে মারপল বলেন, মার্গারিক যখন খুন হয় ওদের অজান্তেই রক্ত ছিটকে এসে পোষাকের লাল রংয়ের সঙ্গে মিশে যায়। ওরা বুঝতে পারেন। তাই ফুটপাতের উপর রক্তের দাগ দেখা যায়।

মারপলের রহস্য ভেদের প্রখর বুদ্ধি দেখে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন সকলে।

পরিশেষে ভালো গল্প শোনাবার জন্য জয়েসকে ধন্যবাদ দিল না শুধু, বলল-সময়মতো পুলিশকে খবর দিয়ে অনেক নিরীহ মেয়ের জীবনও রক্ষা করেছে।

পরের মঙ্গলবার মিঃ পেথোরিককে রহস্য গল্প শোনাবার অনুরোধ জানিয়ে সভা শেষ করল।

.

নীল খাম :

ঘটনার কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন বৃদ্ধ মানুষ। নাম সাইমন ক্লড। লন্ডনের অদূরবর্তী শহরতলীতে একটি প্রসাদোপম বাড়িতে বাস করেন।

ছোট্ট টিলার উপরে প্রাসাদ। বড় বড় গাছের বাগান প্রাচীর দিয়ে ঘেরা, চারপাশের দৃশ্য ছবির মতন।

বিত্তশালী লোক। সন্তান জন্মাবার সময়ে স্ত্রী মারা যায়। একমাত্র সন্তান প্রথম মহাযুদ্ধে নিহত হয়। পুত্রবধূও সন্তান জন্ম দেবার সময় মারা যায় সুতরাং নাতনিই একমাত্র বৃদ্ধের অন্ধের ষষ্ঠি।

কিন্তু দুঃখের কথা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে, ডাক্তারের সব চেষ্টাকে বিফল করে দিয়ে ক্রিস চলে গেল। ক্রিসের শোকে তিনি পাগলপারা। স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ল।

দুঃখ বোধহয় একা আসে না। কয়েক মাসের মধ্যে ক্লডের একমাত্র ভাই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। স্ত্রী আগেই মারা গেছে। গ্রেস, মেরী এবং ভাইপো জর্জকে নিয়ে এলেন তার শূন্য ঘরে।

কৈশোর অতিক্রম করে তারা যৌবনে পা দিল। কলেজের পড়াশুনা শেষ করে জর্জ ব্যাঙ্কে চাকরি নিল। কেমিস্ট্রির অধ্যাপক ফিলিপের সঙ্গে গ্রেসের বিয়ে হল। মেধাবী ছাত্র, দুজনে লন্ডনে তাদের বাড়িতে থাকত।

সাইমনের স্ত্রী হল মেরী। শান্ত প্রকৃতির মেয়ে। গেরস্থালিতে মনোযোগী। মেয়েটির পরিচর্যায় ক্রিসের শোক ক্রমে ভুলতে বসল।

উইল সংক্রান্ত ব্যাপারে একদিন তাকে ডেকে পাঠাল সাইমন। তার অগাধ সম্পত্তি জর্জ মেরী ও গ্রেসের মধ্যে ভাগ করে দিলেন। এরপর দীর্ঘদিন কোনো যোগাযোগ ছিল না।

হঠাৎ একদিন সাইমনের ভাইপো জর্জের সাথে তার দেখা হল। এবং জর্জের মুখ থেকে জানতে পারলাম তার কাকা বর্তমানে প্রেতচর্চার বিষয়ে খুব আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। এবং ইউরিডিস নামে এক মহিলা জিডিয়াসকেও সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন।

জর্জের মুখ থেকে সব শোনার পর হাজির হলাম সাইমনের বাড়িতে। ইউরিডিসকে দেখেই ধারণা হল যে, তিনি একজন চতুর প্রতারক মহিলা। তিনি এবং তার স্বামীটিও পাকাঁপোক্তভাবে ঘাঁটি গেড়েছেন এই বাড়িতে। পতিপ্রবরটির নাম অ্যাবসালোম প্রাগ, পাতলা দুঃখী দুঃখী চেহারা। কিন্তু ছাই রঙের চোখে প্রচ্ছন্ন লোভ।

ইউরিডিসের প্রসঙ্গ তুলতেই সে বলল–তার মতো মহিলা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করাই অসম্ভব। এত মহান যে তিনি-ক্রিসকেই দেখতে পাই না কিন্তু রোজ রাতে সেই সুরেলা গলা শোনেন। রোজ রাতে ক্রিসকে ডাকে ইউরিডিস। ক্রিস তাকে বলেছে সে প্রেতলোকে বাবা-মার সঙ্গে থাকে আর খুব আনন্দেই দিন কাটাচ্ছে। কিন্তু একটা কথায় কাটা খচখচ করতে লাগল। যখন জানালাম ক্রিস বলেছে তার বাবা-মাও ইউরিডিস মাসিকে ভালোবাসে।

বুঝলাম ইউরিডিসের উপর থেকে বিশ্বাস ভাঙানো খুব শক্ত। এবং সে সত্যিই প্রতারক মহিলার পাল্লায় পড়েছে সুতরাং সাইমনকে বাঁচাতে গ্রেসের স্বামীর শরণাপন্ন হলাম। এবং বুঝিয়ে বললাম, বেশিদিল চললে গ্রেস ও তার ভাইবোনদের পক্ষে মঙ্গলজনক হবে না। আরও বললাম যদি আধ্যাত্মিক বিষয়ক কোনো পণ্ডিতের সঙ্গে পরিচিত হয় তবে এই নেশা কাটবে।

তড়িঘড়ি ফিলিপ, প্রফেসর লঙম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পারলৌকিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়ে ইনি একজন পণ্ডিত। ব্যক্তিগত জীবনে সৎ, স্পষ্টবক্তা এবং তথ্যানুসন্ধানী। প্রফেসর সাইমনের বাড়িতে দুটি প্রেতচর্চার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সাইমন, ইউরিডিস, লঙম্যান এই বৈঠকে হাজির ছিলেন।

প্রফেসর ফিরে গিয়ে একটি চিঠির মাধ্যমে জানাল ইউরিডিস প্রতারক না হলেও ওর আত্মা আনবার পদ্ধতি সঠিক নয়। সাইমনের মত থাকলে তিনি একজন সুখ্যাত, সৎ মিডিয়াম পাঠাবেন।

সাইমনকে জানাতে সে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ করল এবং অত্যন্ত অশ্লীল কথাবার্তা ফিলিপকে বলল। হতাশায় ফিলিপ বাড়ি ফিরে আসে, বুঝতে পারে সব চেষ্টা বৃথা।

ঘটনার কিছুদিন পর সাইমন পেথোরিককে ডেকে পাঠাল। গিয়ে দেখল সাইমন মৃত্যু শয্যায়। তাকে ডেকে নতুন উইলের কথা জানাল। নতুন উইল অনুসারে জর্জ মেরী এবং গ্রেস প্রত্যেকে পাবে পাঁচ হাজার পাউন্ড। বাকি অগাধ সম্পত্তি লেখা হয়েছে ইউরিডিস প্যাগের নামে। শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতার সঙ্গে। বুঝতে পারলাম মহিলার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হল। তাছাড়া সাক্ষী হিসাবে রাখল পরিচারিকা এমা গনন্ট এবং অন্য যুবতী রাঁধুনি।

সই-সাবুদের পূর্বে উইলটা নীল খামে রাখার পর হঠাৎ অদ্ভুত শব্দ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। অসুস্থ লাগছিল। এসমার পরিচর্যায় সুস্থ হল।

কিছুক্ষণ থেমে ঘটনার পরের অংশ বলতে শুরু করল পেথোরিক। সাইমনের কাজ মিটিয়ে বেরোতে গেলে মেরীর সাথে দেখা হল। মেরী চায়ের আমন্ত্রণ জানাল। উত্তপ্ত আরামদায়ক ঘরে চা খাবার সময় জর্জ এসে পড়ল। জর্জ তাকে বলল–একটা সম্পত্তির ব্যাপারে তার পরামর্শ খুব জরুরী। কতগুলি শেয়ারের ব্যাপারে কোম্পানির কাগজপত্র সে বেশ দেখে দেয়। প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে ঘর থেকে বেরোবার সময় মনে পড়ল ওভারকোটটার কথা। যেটা ফেলে এসেছে ড্রয়িংরুমে। মেরী এবং সে ঘুরে ঢুকতেই দেখল ওভারকোটের কাছে ইউরিডিস কি যেন করছে।

কথা না বাড়িয়ে ওভারকোটাটা পরে যাবার প্রস্তুতি নিতেই দেখা গেল উইলভরা নীল খামটা মাটিতে পড়ে আছে। ভেতরে কাগজটা আছে কিনা দেখে অফিসে ফিরে এল।

অফিসে ফিরে খামটা হাতে নেবার উদ্যোগ করতেই তার সহকারী জানাল তার একটি জরুরী ফোন এসেছে। ফোনে কথাবার্তা শেষ করে ঘরের দিকে এগোতেই বেয়ারা জানাল একজন ব্যক্তি তার সাক্ষাৎ প্রার্থী। গিয়ে দেখেন বসে আছেন স্বয়ং ইউরিডিসের স্বামী অ্যাবসালোম প্রাগ।

তার সঙ্গে বহু অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা বলার পর হঠাৎ খেয়াল হল উইলসুদ্ধ খামটা টেবিলে রেখে দিয়েছিল। সেটি তুলে সিন্দুক তালা বন্ধ করে দিলেন।

কিছুদিন পর সাইমন মারা গেলেন। কিছুক্ষণ পর যখন সিল ভেঙে খামটা খুলল দেখল খামে কোনো উইল নেই, আছে একটা সাদা কাগজ।

কারণটা মিস মারপেল ব্যাখ্যা করলেন। নানা ঘটনার ভিড়ে মিঃ পেথোরিক আসল রহস্যটা লুকিয়ে রেখেছেন। উকিল মানুষ তিনি; মারপ্যাঁচ ভালোই জানেন। এই বলে শেষ করলেন।

সবাই যখন ঘটনাটা সম্পর্কে বিভিন্ন মত পোষণ করছেন তখন মিঃ পেথোরিক একটি গল্পের অবতারণা করলেন। সেটি হল–ফিলিপ একটি কাহিনী শোনাল তাকে।

তার এক বন্ধু বৃদ্ধ আত্মীয়ের থেকে বিপুল সম্পত্তি পাবে বলে আশা করে। পরে জানতে পারে বৃদ্ধ তাকে বঞ্চিত করে একজন অযোগ্য লোককে সম্পত্তি দিয়ে যাচ্ছে।

তখন সে পরিচারিকাকে কিছু নির্দেশ দেয় এবং কালি ভর্তি কলম দেয়। আরও বলেন যখনই বৃদ্ধ কলম চাইবে সে যেন তখন এই কলমটি দেয়। কারণ বৃদ্ধের পক্ষে নতুন কলম ধরা সম্ভব হবে না। কারণ দুটি দেখতে একইরকম।

পরিচারিকাটি নিপুণ বিশ্বাসের সঙ্গে কাজটি সমাধা করল। ফিলিপ তাকে প্রশ্ন করল সে তার বন্ধুকে চেনে কিনা, মিঃ পেথোরিক উত্তরে বলেছিল এইরকম কোনো ইচ্ছেই তার নেই, সবশেষে অন্য কথা বলে সে বিদায় নিল।

প্রশ্নের উত্তরে ফিলিপ বলেছিল বন্ধুটি স্বয়ং সে এবং পরিচারিকাটি এমা।

জয়েস অদৃশ্য কালির রহস্য জানতে চাইলে মিঃ পেথোরিক বর্ণনা করেন যে, একপ্রকার গাছের রস জলে গুলিয়ে তাতে আয়োডিন মেশালে এক প্রকার কালি তৈরি হয় সেই কালিতে লিখলে, লেখা পাঁচ দিনের মধ্যেই অদৃশ্য।

মারপলের দূরদর্শিতায় সকলে মুগ্ধ! সকলেই তার রহস্য উদ্ধারের আশ্চর্য ক্ষমতায় বিস্মিত কারণ আগেই একটি কাগজে তিনি লিখেছেন অদৃশ্য কালির বুদ্ধিটা বেরিয়েছে কেমিস্ট্রি ছাত্র ফিলিপ গ্যারোডের মাথা থেকে।

আগামী মঙ্গলবার সকলে আবার মিলিত হবে এবং সেই দিন মিস মারপলের কাছ থেকে জটিল রোমহর্ষক গল্প বলার সম্মতি নিয়ে সভা শেষ করল।