১. রেমণ্ড ওয়েস্ট

টুয়েস ডে ক্লাব মার্ডার (মিস মারপল)

রেমণ্ড ওয়েস্ট একরাশ সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে, নিজের ভেতর মগ্ন হয়ে কথাটা উচ্চারণ করল। চোখে মুখে একটা আত্মতৃপ্তি ফুটে উঠল। অনুদঘাটিত রহস্যাবলী কথাটি আবার উচ্চারণ করে তৃপ্তি সহকারে ঘরের চারদিকটা দেখে নিল।

প্রাচীন ঘর। পুরানো ঐতিহ্যের সাক্ষী বিশাল কড়িবরগাগুলি। আবসুল কাঠের কারুকার্য করা আসবাবপত্রগুলো প্রাচীনতার সঙ্গে খাপ খেয়ে গেছে। বাইরে ঝরছে ঝির ঝির করে তুষার, আর ভেতরে বিরাট ফায়ার প্লেসের উষ্ণ আমেজ। রেমণ্ড একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক। এই ধরনের ত্রুটিহীনতাই তার পছন্দ। পিসিমা জেন-এর প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত বাড়ি, ব্যক্তিত্বপূর্ণ চারিত্রিক দৃঢ়তা, সব কিছুর মধ্যে মাধুর্যতা আর লেখকমনের সন্তুষ্টি।

চুল্লীর পাশে বিশাল আরামকেদারায় বসে আছেন পিসিমা মিস জেন মারপল। কালো ব্রোকেডের পোশাক পরিহিতা। উর্ধাঙ্গে মেকলিন লেম, তুষার শুভ্র চুল ঢাকা পরেছে সূক্ষ্ম কাজের লেমের টুপিতে। সাদা পশমের পোশাক বুনছিলেন। আবছা নীল চোখ, স্নেহভরা দৃষ্টি, মুখে মৃদু হাসি। প্রশান্তির দৃষ্টি নিয়ে তাকালো ভাইপো এবং অতিথিদের দিকে।

রেমণ্ড একজন স্ফুর্তিবাজ আত্মসচেতন যুবক। পাশে জয়েস লেমপ্রিয়ের। জয়েস একজন চিত্র-শিল্পী। মরাল গ্রীবা, ছোট করে ছাঁটা রেশম কালো চুল, হালকা সবুজ চোখ, ধারালো নাকে-মুখে খুব আকর্ষণীয়া। তার দৃষ্টি পড়ল স্যার হেনরি ক্লিারিং নামে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ভদ্রলোকের দিকে। তাছাড়া আছেন সৌম্য বৃদ্ধ যাজক ডাঃ পেনডার, আইনজীবী মিঃ পেথোরিক।

অনুদঘাটিত রহস্য না যেন কি বললে রেমণ্ড? ওটা কি ব্যাপার? অভ্যাসমতো কেশে গলা পরিষ্কার করে কথাগুলো বললেন।

আমার মনে হয় ওসব কিছু নয়। গুরুগম্ভীর রাশভারী শব্দ রেমণ্ডের পছন্দ। হয়তো কোনো মানেই নেই। বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলল তেমপ্রিয়ের। ভ্রু-কুঁচকে কপট ভঙ্গীতে তাকাল রেমণ্ড।

জয়েস চাউনি দেখে শব্দ করে হেসে বলল–আচ্ছা পিসি, রেমণ্ডের কথার কি মাথামুণ্ড আছে? আপনি সব জানেন?

জেন মারপল মৃদু হাসলেন। কিন্তু উত্তর দিলেন না।

যাজক মহাশয় শূন্যের দিকে গম্ভীরভাবে তাকিয়ে বললেন–মানবজীবনটাই অজানা অনুদঘাটিত রহস্য।

রেমণ্ড অধৈৰ্য্য হয়ে বিরক্ত সহকারে সিগারেটটা ছাইদানিতে রেখে বললেন, আমি যেটা বলতে চাই সেটা অন্য ব্যাপার। দার্শনিক কথাবার্তা নয়। আমার বক্তব্য হল কিছু ঘটনা, যা সত্য, প্রকৃতই ঘটেছে এবং যার কোনো ব্যাখ্যা কেউ করতে পারেনি।

মিস মারপল বললেন, তুমি যা ববাঝাতে চাইছ; সেরকম ঘটনাও আমি জানি। মিসেস ক্যারুদারসের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। তিনি এলিঘটের দোকান থেকে দুটো গলদা চিংড়ি কিনলেন। দুটো দোকান ঘুরে যখন বাড়ি ফিরলেন দেখলেন মাছ দুটো উধাও। কোথাও খুঁজে না পেয়ে আবার দোকানে ফিরে গেলেন। না ওখানে ফেলে আসনেনি, গেল কোথায়? আমার তো বেশ আশ্চর্য মনে হচ্ছে।

স্যার হেনরি মন্তব্য করলেন, ঘটনাটা জোলো এবং একদম সাধারণ। অবশ্য এ ব্যাপারে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গীতে অনেক ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। মিস মারপলের গাল উত্তেজনায় লাল হল। যেমন ধরা যাক, কেউ…।

রেমণ্ড মজা পাওয়ার ভঙ্গীতে, পিসি আমি এইসব গ্রাম্য ঘটনায় যাচ্ছি না। বলছি সত্যি খুন বা নিরুদ্দেশের কিনারা না হওয়া ঘটনাগুলি। স্যার হেনরি যদি জানেন এবং হাতে সময় থাকে তবে অনুদঘাটিত ঘটনার কয়েকটা কথা বলুন। উল্লেখ্য স্যার হেনরি কিছুদিন আগেও স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের কমিশনার ছিলেন।

স্যার হেনরি বিনীতভাবে বললেন, নিছক গালগল্প আমি ভালো বলতে পারি না।

জয়েস বলল, আমার মনে হয় অনেক খুন বা রহস্য আছে যা পুলিশ এখনও কিনারা করতে পারেনি।

পেশাগত গাম্ভীর্যে মিঃ পেথোরিক বলেন, এটা একটি স্বীকৃত সত্য। ভাবতে আশ্চর্য লাগে রহস্যের জট ছাড়াতে যে ধরনের কল্পনাপ্রবণ বুদ্ধি বা চাতুর্যতা দরকার তার খুবই অভাব পুলিশের রেমণ্ড মন্তব্য করল।

তিক্ত কণ্ঠে স্যার হেনরি বলেন–আমি মানি না। এগুলো একান্তভাবে অজ্ঞ মানুষের ধারণা।

হাসতে হাসতে জয়েস বলল–তাহলে এসব বিচারের জন্য কমিটি বসাতে হয়। দর্শক কল্পনা এগুলো লেখকদের একচেটিয়া সম্পত্তি। মাথা ঝুঁকিয়ে রেমণ্ডের প্রতি কপট শ্রদ্ধা জানাল জয়েস।

রেমন্ড গম্ভীর হয়ে ফায়ার প্লেস থেকে জ্বলন্ত কাঠ তুলে সিগারেট ধরিয়ে বলল, লেখককে মানুষের প্রকৃতির ভেতরটা জেনে লিখতে হয়। ফলে এক ধরনের অন্তদৃষ্টি জন্মায়। সাধারণ লোকে যা লক্ষ্য করতে পারে না, যেমন কোনো ব্যক্তির অভিসন্ধি

মারপল স্নেহের দৃষ্টিতে বললেন, সোনা জানি তোমার বইগুলো বিদগ্ধ। তোমার চরিত্রগুলি সত্যিই অতটা খারাপ?

শান্তভাবে রেমণ্ড বলে–পিসিমণি জগৎ ও মানুষের প্রতি তোমার বিশ্বাস আমি ভাঙতে চাই না।

মিস মারপল ভুরু দুটো কুঁচকে পশম বোনার ঘরগুলো মিশিয়ে বললেন, লোকগুলো সবাই খুব ভালো বা খুব খারাপ নয়, ভালো-মন্দ মিশিয়ে।

মিঃ পেথোরিক খুক খুক করে কেশে রেমণ্ডকে বলেন, আচ্ছা, তোমার কি মনে হয় না–তুমি কল্পনা ব্যাপারটাতে বেশি জোর দিচ্ছ? আমরা আইনজীবীরা ভালোই বুঝি কল্পনা কতটা সাংঘাতিক। সত্যি বলতে কী, এটা জানতে হলে তোমাকে নিরপেক্ষভাবে সাক্ষ্য প্রমাণ দিতে হবে। বিচার বিবেচনা করে সত্যটা বের করতে হবে। এটাই তো বিচারের যুক্তিপূর্ণ পদ্ধতি। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে বলছি এই পথেই সত্য প্রমাণিত হয়।

জয়েস রেশম কালো চুল ঝাঁকিয়ে হাত তুলে বলল-বাঃ, আমি কিন্তু আপনাদের হারাতে পারি। আমি একজন মেয়ে। মেয়েদের ঈশ্বর প্রদত্ত ষষ্ঠেন্দ্রিয় অনুভূতি কিন্তু ছেলেদের থাকে না। শিল্পী হয়ে চোখে যা দেখি না, কল্পনায় সেটা দেখি। বহু মানুষ, দেশ এবং জীবনকে যেভাবে জেনেছি, মারপল পিসিও বোধহয় তা জানেন না।

মিস মারপল উলবোনার থেকে মুখ তুলে বললেন–আমি সত্যিই জানি না সোনা। কিন্তু এই ছায়াঘেরা শান্ত মেরি মীড গ্রামেও মাঝে মাঝে বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটে।

মৃদু হেসে পেনডার বললেন–আমি কি বলব? আজকাল পাত্রী পুরোহিতদের অবজ্ঞা করা ফ্যাশন। কিন্তু আমরা এমন অনেক ঘটনা শুনি, চরিত্রের নানা দিক জানতে পারি যা বাইরের পৃথিবীতে কোনোদিনই পৌঁছাবে না।

উৎসাহ নিয়ে জয়েস বলল–ঠিক আছে, এখানে সব ধরনের প্রতিনিধিত্বমূলক মানুষ হাজির আছেন, আমরা সংঘ তৈরি করি? আজ মঙ্গলবার হওয়ায় সংঘের নাম মঙ্গলবারের সান্ধ্য বৈঠক। প্রত্যেক মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মিলিত হয়ে, প্রত্যেক সদস্য একটা করে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে অনুদঘাটিত রহস্যের কথা বলবেন। যে রহস্য সম্পর্কে জানেন এবং নিজে সমাধান করতে পারবেন, সেই সব ঘটনা বলবেন। আমরা কতজন? পাঁচজন! আঃ ছয় জন হলে ভালো হত।

মিস মারপল হাসতে হাসতে বলেন–তুমি সোনা আমাকে ভুলে গেছ।

জয়েস হকচকিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, বাঃ। তাহলে তো খুব ভালোই হয়। আমি ভাবলাম এ ধরনের খেলা ঠিক আপনার পছন্দ নয়।

মিস মারপল বলেন–আমার ধারণা ব্যাপারটা খুব আকর্ষণীয় হবে। এতজন বুদ্ধিমান ব্যক্তির সমাবেশ। আমি বুদ্ধিমতী না হলেও এত বছর সেন্ট মেরি মীডে থেকে মানুষের চরিত্র সম্পর্কে অন্তদৃষ্টি জন্মেছে।

বিনীত হেনরি বলেন, আপনার সহযোগিতা খুবই মূল্যবান হবে।

 জয়েস বলল, কে শুরু করবেন?

ডাঃ পেনডার বলেন, আমরা ভাগ্যবান, স্যার হেনরির মতো সম্মানীয় ব্যক্তি আমাদের মধ্যে থাকতে কোনো দ্বিধাই থাকতে পারে না,…কথা শেষ না করে সম্মানের ভঙ্গীতে তাকালেন।

 স্যার হেনরি মিনিট দুয়েক চুপ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, পা তুলে আরাম করে বসে আরম্ভ করলেন তার কাহিনী –

একটি দুঃখজনক ঘটনা :

আপনারা যে ধরনের কাহিনী শুনতে চান সেটা বাছাই করা সত্যিই অসুবিধাজনক। এমন ঘটনা যা অনুসন্ধিৎসা মেটাবে। এবং সে ঘটনা বছরখানেক আগে খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। রহস্যের কিনারা হয়নি। ধামাচাপা পড়ে গেছে। কিন্তু দিনকয়েক আগে আমার হাতে এসে পড়ে সমাধান হল।

সহজ সরল ঘটনা। তিন জন রাতের খাবার খেতে বসেছিলেন। টিনে ভর্তি রান্না-করা গলদা চিংড়ি খেয়ে, রাত্রি বেলা তারা অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডাক্তারবাবুকে ডাকা হল, দুজন সেরে উঠল। তৃতীয়জন মারা পড়েন, টোমেন জাতীয় বিষই মৃত্যুর কারণ। সেই মর্মে ডেথ সার্টিফিকেট দিলেন। তাকে সমাধি করা হল। কিন্তু ঘটনাটা ওখানে থেমে থাকল না।

মিস মারপল বুঝদারের মতো মাথা নেড়ে বলেন–নিশ্চয়ই, অনেক গুজব ছড়িয়ে ছিল যেভাবে ছড়ায়।

স্যার হেনরি বলে চলেন নাটকের কুশলীদের একটু পরিচয় দিই। তিনজনের এক দম্পতি ধরুন ওদের নাম মিঃ ও মিসেস জোনস, অপর জন মিস ক্লার্ক, শ্রীমতি জোনসের সাহচর্য সঙ্গিনী।

জোনস ওষুধ সংস্থার ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি। পঞ্চাশ বছর, সুদর্শন, সৌখিন। জোনসের স্ত্রীর পঁয়তাল্লিশ, সাদামাটা ধরনের। মিস ক্লার্কের বয়স ষাটের কোঠায়। শক্ত সামর্থ্য, লালচে মুখের মহিলা। এরা কেউই আকর্ষণীয় নয়। গোলমালের সূত্রপাত আশ্চর্যরকম ভাবেই।

জোনস ঘটনার আগের দিন রাত কাটান বারমিংহামের একটি হোটেলে। চিঠি লিখতে যে ব্লটিং পেপার ব্যবহার করেছিলেন সকালে সেটি পরিচারিকার হাতে পড়ে। মজা পাবার জন্য ব্লটিং পেপারটি আয়নার সামনে ধরলে কয়েকটি শব্দ তাতে ফুটে উঠে। কয়েকদিন পর কাগজে যখন চিংড়ি মাছ খেয়ে জোনসের মৃত্যুর সংবাদটা প্রকাশিত হয়, পরিচারিকাটির তখন ফুটে ওটা শব্দগুলি স্মরণ হয়। হোটেলের অন্যান্য কর্মীর কাছে ব্লটিং পেপার থেকে উদ্ধার হওয়া চিঠির কথাগুলি বলে। সেগুলি ছিল..সম্পূর্ণভাবে আমার স্ত্রীর উপর নির্ভরশীল..যখন সে মারা যাবে তখন আমি..শয়ে শয়ে হাজার হাজার…।

আপনাদের হয়তো স্মরণ থাকতে পারে, কিছুদিন আগে কাগজে প্রকাশিত স্ত্রীকে বিষ প্রয়োগে হত্যা ঘটনাটি। ঘটনাটি পরিচারিকার মনে পড়ে এবং এই ব্যাপারে উদ্দীপিত হয়ে ওঠে। পরিচারিকার এক আত্মীয় জোনসের বাড়ির কাছাকাছিই থাকে, চিঠিতে জানা যায়। জোনস স্থানীয় ডাক্তার কন্যার প্রতি আসক্ত। তেত্রিশ বছর বয়সী, সুন্দরী। গুজব নোক মুখে ছড়াতে লাগল।

শেষে স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছে দরখাস্ত গেল। স্ত্রীর মৃত্যুর জন্য দায়ী করে অসংখ্য বেনামী চিঠি আসতে লাগল। বলে রাখি, অন্য কোনো সন্দেহ আমাদের মধ্যে ছিল না। নেহাতই গ্রাম্য গুজব মনে করেছিলাম। আদেশ হল কবর খুঁড়ে মৃতদেহ তোলার। গুজবের সুদৃঢ় কোনো ভিত্তি নেই কিন্তু গুজব আশ্চর্যজনকভাবে সত্যি প্রমাণিত হল। ময়না তদন্তে পাকস্থলিতে প্রচুর বিষ পাওয়া যায়। এবং মৃত্যুর কারণ ঠান্ডা মাথায় খুন। স্থানীয় প্রশাসন নয় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের উপর ভার পড়ল হত্যাকারীদের বা হত্যাকরীকে খুঁজে বের করার।

উল্লাসিত জয়েস বলল,-বাঃ, আমি এইরকমটাই চেয়েছিলাম। সত্যি রহস্যময় ঘটনা।

স্যার হেনরি আবার শুরু করলেন–সব সন্দেহই গিয়ে পড়ল স্বামীর উপর। তিনি আর্থিক ভাবে উপকৃত। রটেছিল হাজার হাজার, লাখ লাখ কিন্তু প্রায় আট হাজার পাউন্ডের মালিক হলেন। চাকুরির টাকা ছাড়া সঞ্চিত অর্থ ছিলই না। মহিলা সংসর্গে মুক্ত হস্তে খরচা করতেন। আমরা সন্তর্পণে খোঁজ-খবর নিয়ে দেখলাম।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল এক সময় উভয়ের মধ্যে সত্যিই গভীর সম্পর্ক ছিল। কিন্তু মাস দুয়েক আগে বিচ্ছেদ ঘটে। দুজনকে আর একসঙ্গে দেখা যায়নি। ডাক্তারবাবু ভোলামেলা সরল মানুষ, কোনোরকম সন্দেহই করা যায় না। ময়নাতদন্ত রিপোর্টে হতবাক। ঘটনার দিন রাত্তিরে তাকে যখন ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়, তিনি দেখেন তিন জনই অসুস্থ। মিসেস জোনসের অবস্থা বুঝতে পেরে তৎক্ষণাৎ একজনকে পাঠান কিছু আফিমের বড়ি আনতে। কিছুটা ব্যথা উপশমের জন্য। কিন্তু সবরকম চেষ্টা সত্ত্বেও মিসেস জোনস মারা গেলেন। কিন্তু ডাক্তারবাবুর একটু খারাপ সন্দেহ হয়নি। খাবারের মধ্যে ছিল টিনে ভর্তি গলদা চিংড়ি। স্যালাড, ঝটি বিজ এবং প্রচুর সরে তৈরি মিষ্টি। টিনজাত চিংড়ি মাছই মৃত্যুর কারণ।

দুর্ভাগ্যবশত চিংড়ি মাছের এককণাও অবশিষ্ট ছিল না। সবটাই খেয়ে নিন ফেলে দেওয়া হয়েছিল। ডাক্তারবাবু রাধুনি গ্ল্যাডিস লিচেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। সে একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছিল। সবসময় কাঁদছিল আর উত্তেজিতও ছিল। গ্ল্যাডিসের কাছ থেকে কোনো হদিশ পাননি। কিন্তু গ্ল্যাডিস বলেছিল, ও মাছে হাতই দেয়নি আর মাছটা খুব ভালোই ছিল।

যার উপর নির্ভর করে আমরা এগোচ্ছিলাম এই হচ্ছে সেই সব তথ্য। যদি ধরে নিই যে, জোনস স্ত্রীকে বিষ প্রয়োগ করেছিল এটা ঠিক যে জোনস খাবারে বিষ মেশায়নি। কারণ তারা খাবারগুলি খেয়েছিল। তাছাড়া আর একটা সূত্র যে, জোনস বারমিংহাম থেকে সোজা খাবার টেবিলে আসে সুতরাং আগে সে বিষ মেশাতে পারে।

জয়েস বলে ওঠে–ওই সঙ্গিনী হাসিমুখ ভদ্রমহিলাটির কি ব্যাপার?

সম্মতি জানিয়ে হেনরি বলেন, মিস ক্লার্ককেও অবজ্ঞা করিনি। কিন্তু তার কি উদ্দেশ্য, মিসেস জোনস তো তার উত্তরাধিকার নয় বরং মহিবাণীর মৃত্যুতে চাকরি খুঁজতে হয়েছিল।

জয়েস ভেবে বলল,–তাকে বাদ দিতেই হয়। স্যার হেননি বলে চলেন,এক ইনসপেক্টর একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আবিষ্কার করে। খাবার পর সেই রাত্রে জোনস একবাটি কর্নফ্লাওয়ার চেয়েছিল, স্ত্রী অসুস্থ বোধ করায়। গ্ল্যাডিস কর্নফ্লাওয়ার তৈরি করা পর্যন্ত জোনস রান্নাঘরেই ছিলেন। এরপর নিজে খাবার নিয়ে স্ত্রীর ঘরে যান। কেসটা নতুন মোড় নিল।

আইনজীবী পেথোরিক মাথা নাড়েন। কর গুনে বলেন এক নম্বর উদ্দেশ্য এবং দুই সুযোগ। ওষুধ সংস্থার কর্মী হিসেবে বিষ পাওয়া সহজ জোনসের।

যাজক পেনডার মন্তব্য করেন,–ভদ্রলোক যখন দুর্বল প্রকৃতির মানুষ।

রেমণ্ড ওয়েস্ট হেনরির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,–এখানেই কোথাও জটটা আছে। আপনারা জোনসকে গ্রেপ্তার করলেন না কেন?

স্যার হেনরি হতাশভাবে হেসে বললেন,–দুর্ভাগ্যটা এইখানেই। এতক্ষণ সব কিছু ঠিক ঠিক এগোচ্ছিল, গ্রেফতারের জায়গায় হোঁচট খেলাম। মিস ক্লার্ককে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারলাম বাটিভর্তি কর্নফ্লাওয়ারটি খেয়েছেন তিনি, মিসেস জোনস নয়।

মিস ক্লার্ক যা বললেন তা হল, তিনি রোজকার মতো মিসেস জোনসের ঘরে গেলেন। মিসেস জোনস বলেন, মিলি (মিস ক্লার্কের ডাক নাম) আমি ভালো বোধ করছি না। চিংড়িটা আমার ছোঁয়া উচিত হয়নি। আমি অ্যালবার্টকে একবাটি কর্নফ্লাওয়ার দিতে বলেছি। কিন্তু এখন খেতে ইচ্ছে করছে না।

ক্লার্ক বলেন- গ্ল্যাডিস এত সুন্দর কর্নফ্লাওয়ার তৈরি করেছে। আজকাল মেয়েরা এত ভালো বানাতেই পারবে না। আমার তো দেখেই খিদে পাচ্ছে। আস্তে আস্তে খেয়ে নিন, আমার খাওয়া উচিত নয়।

স্যার হেনরি একসময় বলেন,-মিস ক্লার্ক ওজন কমানোর জন্য ডায়েটিং করেন, মিসেস জোনস তাকে বলেন, তোমার ডায়েটিং করা উচিত নয়। ভগবান যদি মোটা দেখতে চান তবে তাই হও। তুমি কর্নফ্লাওয়ারটা খেয়েই নাও।

উপায়ন্তর না দেখে এক চুমুকে বাটি শেষ করলেন মিস ক্লার্ক। জোনসের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ নষ্ট হয়ে গেল। জোনসকে চিঠির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, অস্ট্রেনিয়া তার এক ভাই অর্থ সাহায্যের জন্য চিঠি লেখায় তিনি এই উত্তর দেন। চিঠিতে লেখেন সম্পূর্ণভাবে তিনি স্ত্রীর উপর নির্ভরশীল। স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি অর্থের মালিক হলে তখন কিছু সাহায্য করবেন। আরও লেখেন, পৃথিবীতে হাজার হাজার শয়ে শয়ে মানুষ এইরকম দুর্ভাগা।

ডাঃ পেনডার বলেন, তাহলে কেসটা একদম নস্যাৎ হল।

স্যার হেনরি বলেন, একেবারেই নস্যাৎ। সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে জোনসকে গ্রেফতার করা গেল না।

সবাই চুপচাপ নিথর নৈঃশব্দ। জয়েস বলে উঠল, সব শেষ, না কি?

স্যার হেনরি বলেন,–গত বছর পর্যন্ত এর বেশি জানা যায়নি। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে সমাধানে পৌঁছে গেছে। দুই তিন দিনের মধ্যে কাগজে পড়বেন সবটা।

জয়েস বলে,–আসল রহস্যটা কি? মিনিট পাঁচেক ভেবে সিদ্ধান্ত নেব।

রেমণ্ড মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে ঘড়ি দেখল। পাঁচ মিনিট পার হলে ডাঃ পেনডারের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি প্রথমে বলবেন?

বৃদ্ধ পেনডার হতাশভাবে বলল,-আমি স্বীকার করি আমি বিভ্রান্ত। আমার মনে হয় পতিটি কোনোভাবে দোষী। কিন্তু কি উপায়ে কার্য সমাধা করলেন তা জানি না। এখনও আবিষ্কৃত হয়নি কিভাবে বিষ প্রয়োগ করা হল। এতদিন পরে কি করে রহস্যের সমাধান হল তাও বোধগম্য হচ্ছে না।

এবার জয়েসের পালা। নিশ্চিতভাবে বলল-সঙ্গিনী ভদ্রমহিলাটিই অপরাধী। কি উদ্দেশ্যে কে জানে? বৃদ্ধা মোটাসোটা কুৎসিত হলেও জোনসের প্রেমে পড়তে বাধা কোথায়? কোনো কারণে মিসেস জোনসকে আন্তরিকভাবে ঘৃণা করতেন। সদা হাস্যময়ী কিন্তু ভিতরে ভিতরে কষ্ট চেপে রেখেছেন। আর একদিন না পেরে খুন করে বসলেন। সন্তর্পণে কর্নফ্লাওয়ারের বাটিতে আর্সেনিক মিশিয়ে এবং মিথ্যে রটিয়ে দিলেন উনি নিজেই সেটা খেয়েছেন বলে।

মিঃ পেথোরিক কোর্টে সওয়াল করার ভঙ্গীতে হাতজোড় করে বললেন, যা তথ্য জেনেছি তাতে এখন কিছু বলা উচিত নয়।

জয়েস জোসের সঙ্গে বলে উঠলেন আপনাকে বলতেই হবে। সব সময় আইন মেনে মতামত চেপে রাখতে পারেন না। এটা নিছক খেলা। আপনি খেলবেনই।

মিঃ পেথোরিক বলেন–বর্তমান তথ্যে কিছুই বলার নেই। আমার ব্যক্তিগত মত হল এই ধরনের কেসে প্রকৃত দোষী স্বামী। তথ্য বিশ্লেষণে একটাই মত, সেটা হল মিস ক্লার্ক কোনো কারণে বা ইচ্ছাকৃতভাবে জোনসকে আড়াল করছেন।

তাদের হয়তো গোপন আর্থিক চুক্তি ছিল। জোনস জানত সেও সন্দেহভাজন তালিকায় এবং ক্লার্কের কষ্টের জীবন ফিরে আসছে বুঝে দুজনেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। টাকার বিনিময়ে কর্নফ্লাওয়ার খাওয়াতে নিজেকে জড়ায়, যদি এটাই সত্যি হয় তবে বুঝতে হবে ঘটনাটা খুবই গোলমেলে।

রেমণ্ড বলে উঠল, আমি একমত নই, আপনারা ভুলে গেছেন উল্লেখযোগ্য তথ্য নেই। সেই টিনে ভর্তি গলদা চিংড়ি সত্যি খারাপ ছিল। বিষক্রিয়ার কারণে ডাক্তার ডাকা হলে তিনি দেখেন মিসেস জোনস প্রচণ্ড ব্যথায় কাতর। অবস্থা বুঝতে পেরে আফিমের বড়ি আনালেন।কিন্তু নিজে যাননি। মেয়েটিই ওষুধপত্তর দিয়ে থাকে। তিনি ডাক্তারের প্রণয়ী। তখনই আদিম প্রবৃত্তি জেগে উঠল। মাহেন্দ্রক্ষণেই সে পাবে ভবিষ্যতের চাবিকাঠি। পাঠানো বড়িগুলি আর্সেনিকের, আফিমের নয়।

জয়েস ধৈৰ্য্য ধরতে না পেরে বলল–স্যার হেনরি বলে দিন না।

 স্যার হেনরি বলেন–মিস মারপল কিছু বললেন না তো।

 মিস মারপল এদিক ওদিক মাথা নেড়ে চোখ তুলে বললেন–হ্যায়রে গোনায় ভুল হল। এই দুঃখজনক ঘটনা আমাকে মিঃ হারগ্রেভের কথা মনে করিয়ে দিল। হারগ্রেভের মৃত্যুর পর সমস্ত টাকা পেল অন্য মহিলা। তাদের পাঁচটি সন্তান ছিল। একসময় মহিলা হারগ্রেভের পরিচারিকা ছিল।

রেমণ্ড অধৈৰ্য্য হয়ে বলল, পিসি, মৃত হারগ্রেভের সঙ্গে এর মিল কোথায়?

মারপল বলেন–মিলগুলি খুব আশ্চর্যজনক। বেচারী সব স্বীকার করায় আপনারা জানতে পারলেন। তাই না, মিঃ হেনরি।

রেমণ্ড বলল–পিসি তুমি কোন মেয়েটির কথা বলছ?

মারপল বললেন-বেচারী গ্ল্যাডিস লিচেন, ওকে যখন ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসাবাদ করছিল, উত্তেজিত হয়ে কেঁদেও ফেলেছিল। অসহায় মেয়েটিকে খুন করানোয় জোনসের ফাঁসি হবে। মেয়েটিরও ফাঁসি হবে।

মিঃ পেয়োরিক হতাশ হয়ে বললেন–আপনি ভুল বুঝলেন।

 কিন্তু মিস মারপল জোরের সাথে মাথা নেড়ে হেনরির দিকে আশান্বিত চোখে তাকিয়ে বললেন–হাজার হাজার মিষ্টি খাবার এগুলি কিভাবে চোখ এড়াল।

রেমণ্ড প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলল–কি বলছ তুমি, হাজার মিষ্টি খাবার…

মিস মারপল রেমণ্ডের দিকে ঘুরে বললেন, রাধুনীরা প্রচুর মিষ্টি তৈরি করে। এই ছোটো ছোটো পিঠের মতো মিষ্টিগুলির নাম শয়ে শয়ে, হাজার হাজার। যেগুলি ছিল ওদের খাদ্যতালিকায়। দুটো জিনিসকে একত্র করাতে বোঝা গেল আর্সেনিকের প্রয়োগ কৌশল। এবং ভার পড়ল রাঁধুনির উপর।

জয়েস তাড়াতাড়ি বলল–তিনজনেই তো মিষ্টি খেলল, কি করে সম্ভব?

মারপল বললেন, না না। মিস ক্লার্ক আহার প্রস্তুত করছিলেন। মেদ কমাতে চাইলে মিষ্টি ছোঁয়া উচিত নয়। আমার ধারণা খুব সুচতুরভাবে জোনস মিষ্টিগুলি সরিয়ে রাখে।

প্রত্যেকে হেনরির দিকে তাকাল। ধীরে ধীরে বললেন–খুব আশ্চর্যজনকভাবে মারপল সত্য উদঘাটন করলেন। সন্তানসম্ভবা গ্ল্যাডিসকে জোনস বলেছিল স্ত্রীকে সরিয়ে তোমাকে বিয়ে করব। আর্সেনিকের বড়ি তৈরি করে মিষ্টির সঙ্গে মেশাতে তাকে শিখিয়ে দিয়েছিল। গ্ল্যাডিসের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে গর্ভের বাচ্চাটিও মারা যায়। মৃত্যু শয্যায় গ্ল্যাডিস সব কিছু স্বীকার করে।

নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে জয়েস বলল–সাবাস পিসি, তুমি এক পয়েন্ট এগিয়ে রইলে। আমার তো ভাবতেই অবাক লাগছে তুমি কি করে রহস্যটা ধরলে। কারণ রাঁধুনিটার সাথে এই ঘটনার মিল কোথায়?

মারপল বললেন-সোনা, মানুষকে আমি যতটা জানি তুমি ততটা জানো না। যখন শুনলাম গ্ল্যাডিস নামে একটি সুন্দরী যুবতী আছে, জোনসের মতো মানুষ তাকে ছাড়বে না। শয়তানের কবলে পড়ে একটি মেয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করল। এটা বোঝাবার নয় যে, মিসেস হারগ্রেভের দুঃখে গ্রামের মানুষের বারুদ্ধ হয়েছিল।

রেমণ্ড উঠে দাঁড়িয়ে বলল–আজকের মতো বৈঠক শেষ। রাত হয়েছে। পরের মঙ্গলবার কে বলবেন? চারিদিকে তাকিয়ে বলল–ডঃ পেনডার।

জয়েস তাকে সমর্থন করল।

পেনডার বললেন–জীবনে রহস্যময় ঘটনা বলতে কিছুই নেই তবুও আপনাদের অনুরোধে শোনাব।

.

অ্যাসটার্টের অভিশাপ–কুয়াশা ঘেরা :

দ্বিতীয় মঙ্গলবারের সন্ধ্যায় একে একে সবাই এলেন। পেনডার এলেন শেষে, সবাই আছে কিনা দেখে কফির কাপে চুমুক দিয়ে হেনরি বললেন, বলুন ডাঃ কি শোনাবেন?

বৃদ্ধ যাজক হেসে বলেন–আমার জীবন কেটেছে শান্ত পরিবেশে, ঈশ্বরের করুণায়। যখন তরুণ ছিলাম একটি বিষাদময় অভিজ্ঞতা হয়েছিল।

পেনডার বলে চলেন–ওই ঘটনা আমার জীবনে এমন একটা দাগ ফেলেছিল সে স্মৃতি রোমন্থন করলেই এই সময়ের ভীতি ও বিভীষিকা আমি স্পষ্ট অনুভব করি। আপনারা একে অনুদঘাটিত বলবেন কি না জানি না। বাহ্যিক কোনো অস্ত্র ছাড়াই মানুষ খুন হল। ঘটনাস্থলে উপস্থিত কেউ চিন্তাভাবনা করে কারণ খুঁজে পায়নি। এমন অনেক কিছু আছে যার বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা সম্ভব নয়।

অভিযোগের সুরে হেনরি বলেন–আপনি তো আমাদের ভয় পাইয়ে দিচ্ছেন?

ডাঃ পেনডার বলেন–আমার তাই হয়েছিল। পরিবেশের কথা উঠলে হেসে উড়িয়ে দিতে পারি না। আমার জীবনে এর প্রভাব যথেষ্ট। কিছু কিছু জায়গায় অশরীরী দৈবশক্তির বিস্ময়কর ক্ষমতা আছে।

মিস মারপল মন্তব্য করলেন–হ্যাঁ, এরকম জায়গা বা বাড়ি আছে। লারশেদের বাড়িতে মিঃ স্মিারস সর্বস্বান্ত হয়ে বাড়ি ছাড়েন। সিঁড়ি থেকে পড়ে পা ভেঙে মিসেস ক্লারকে দক্ষিণ ফ্রান্সে চলে গেছেন। বাড়ির মালিক বানডেরার বাড়িতে আসার পরেই শক্ত অপারশেন হয়েছে।

মিঃ পেথোরিক বলেন-কুসংস্কারে জড়িয়ে থাকার ঘটনায় কত বড়ো বড়ো ক্ষতি হতে পারে।

স্যার হেনরি বলেন–কড়া ধাচের ভূত বা ভুতুড়ে বাড়ির গল্প আমিও জানি। বলে হেসে উঠলেন।

রেমণ্ড মন্তব্য করলেন-পেনডারের গল্পটা বলতে দেওয়া হোক।

জয়েস উঠে দাঁড়িয়ে আলো দুটো নিভিয়ে দিল। শুধু ধিকিধিকি আগুনের আভা। আলো আঁধারী মায়াময় ঘর। জয়েস বলল–এটাই গল্প শোনার উপযুক্ত পরিবেশ।

পেনডার চশমাটা খুলে মৃদু হেসে জয়েসের দিকে তাকিয়ে শুরু করেন।

আপনারা ডার্টমুর জায়গার নাম শুনেছেন? যেই অঞ্চলটার কথা বলছি সেটা ডান্টমুট সীমান্তে। মনমুগ্ধকর পরিবেশ। সম্পত্তিটা অজ্ঞাত কারণে অবিক্রিত ছিল। শীতকালে নিসর্গ দৃশ্য মনোরম। সম্প্রতি আমার বন্ধু হেভেন জমিদারিটা কেনেন। কলেজ জীবনের বন্ধু। দেখা সাক্ষাৎ বহুদিন না হলেও অটুট বন্ধুত্ব। তাই সাইলেনট গ্রোভ-এর যাবার নিমন্ত্রণ সাদরে গ্রহণ করি।

নিমন্ত্রিতদের মধ্যে হেভেনের খুড়তুতো ভাই এলিয়ট, লেডি ম্যানারিং, কন্যা ডায়োলেট। মেয়েটি সুশ্রী এবং সাধারণ ব্যক্তিত্বের। আর সস্ত্রীক ক্যান্টেন রজার্স। পোড়খাওয়া মানুষ রজার্স অশ্বারোহণ ও শিকার জীবনের প্যাশন। তরুণ হলেও ডঃ সাইমন্ড খ্যাতিবান প্রতিষ্ঠিত। অন্যজন মিস ডায়না অ্যালেলে, অসামান্য সুন্দরী। নানা ফ্যাসন পত্রিকায় ছবি ছাপত। আকর্ষণীয়া, দীর্ঘাঙ্গী, গায়ের রং তামাটে। মসৃণ কোমল ত্বক। দীর্ঘ আঁখি পল্লবের জন্য মনে হত যেন কোনো প্রাচ্য দেশীয় রমণী। দূরাগত ঘণ্টাধ্বনির মতো মধুর কণ্ঠস্বর।

ওখানে গিয়েই বুঝতে পারি রিচার্ড ডায়নার প্রতি আসক্ত। এবং অনুষ্ঠানের আয়োজন সেইজন্য।

ডায়না আত্মসচেতন খেয়ালী মেয়ে। একদিন সারাক্ষণ রিচার্ডের সঙ্গে–তো অন্যদিন ভাই এলিয়টের সঙ্গে। পরের দিন ভুবনজয়া হাসিতে ভরাল তরুণ ডাক্তারকে।

যাবার পরদিন পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখলাম। অদ্ভুত সুন্দর। ঝড়ঝঞ্ঝা উত্থান পতনের সাক্ষী গ্রানাইট পাথরে তৈরি প্রাসাদটি। পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে অলংকৃত ক্রেসকোর আয়না, দেওয়ালগিরী, পুরাতন অস্ত্রশস্ত্র, পুরাতাত্ত্বিক সামগ্রী। নানা জীবজন্তুর মাথা আর ঝাড়লণ্ঠনে সজ্জিত অলিন্দ। দরজা জানলায় গাঢ় রংয়ের ভারী পর্দা, অতিথিদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরগুলি সাজানো, উষ্ণ আরামদায়ক। জানলা দিয়ে দেখা যায় দিগন্ত বিস্তৃত প্রান্তর, ঢেউ খেলানো পাহাড়গুলি। মেঘ পালক মেষ চড়াচ্ছে। রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশে ঈগল চিলের আনাগোনা। দূরে নিবিড় বনানী।

রিচার্ড বলছিল–প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে পাহাড়ের ঢালু জায়গায় মানুষের ব্যবহৃত নিদর্শন পাওয়া যায়। খননে কিছু ব্রোঞ্জের সামগ্রী মিলেছিল। অতীত দিনের এইসব স্মারক বহুমূল্যে সংগ্রহ করে বাড়িতে সাজিয়ে রাখত আগ্রহের সঙ্গে।

বাড়ির নামকরণ কেন সাইলেন্ট গ্রোভস বা নিস্তব্ধ অরণ্য রাখা হল তাও বোঝাল। বেশির ভাগ অংশ প্রস্তরাকীর্ণ হলেও কয়েকশ গজ দূরে একটা নিবিড় অরণ্য আছে। বহুবছর গাছপালা জন্মাচ্ছে, মরছে। আবার জন্মাচ্ছে। কিন্তু অরণ্যের আকার একই রয়েছে। জায়গাটা অজানা কারণে শব্দবিহীন। এই জন্যই নাম নিস্তব্ধ অরণ্য।

এখানে এসে ঘুরে বেড়িয়ে, গুহা দেখে কাটানোর পর অরণ্যে বেড়াতে এলাম। পা দিয়েই অদ্ভুত অপার্থিব অনুভূতিতে শিউরে উঠলাম। থমথমে নিস্তব্ধতা। পাখিরা ডাকল না, ছমছমে পরিবেশ। জমা পাতা স্পঞ্জের মতো লাগছিল। অনেক ডুবে যাচ্ছিল। ডালপালা সরিয়ে পথ করলাম।

রিচার্ড কৌতূহলী হয়ে বলল–জায়গাটার বিশেষ অনুভূতি আছে না?

 শান্তভাবে বললাম–অস্বস্তিকর। ঠিক ভালো নয়।

রিচার্ড বলেন–মনে হচ্ছে কেউ যেন নিষেধ করছে এটাই বহুশ্রুত দেবী অ্যাসটার্টের অরণ্য। কে তিনি? ডাক্তার সাইমণ্ডল জিজ্ঞেস করেন। রিচার্ড হলেন–অ্যাসটার্ট ফিনিশীয়দের দেবী। অনেক শতাব্দী আগে ফিনিশীয়রা অনেক দেব-দেবীর প্রতিষ্ঠা করেন। কালের প্রভাবে অন্যগুলি নষ্ট হলেও অরণ্যের দেবী অ্যাসটার্টের মন্দিরটি অক্ষত। সাক্ষ্য প্রমাণিত না হলেও অরণ্যটি দেবী অ্যাসটার্টের। ঘনবৃক্ষরাজরি মধ্যে হত দেবীর পূজার্চনা।

বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল অ্যালেলে পবিত্র লোকাঁচার, পূজার্চনার শব্দগুলি। লোকাঁচারের নিয়মগুলি কি? অস্ফুট স্বরে বলল ডায়না।

ক্যাপ্টেন উচ্চস্বরে হেসে বলেন–হয়তো নরবলি হত!

রিচার্ড ঠাট্টাকে অবজ্ঞা করে আমাদের দিকে চেয়ে বললেন–অরণ্যের মাঝখানে মন্দির থাকাটা বইতে পড়েছিলাম। মাথাব্যথা না থাকলেও কল্পনা করতে দোষ কোথায়?

ঠিক সেই মুহূর্তে জঙ্গল ছাড়িয়ে খোলামেলা জায়গার মাঝখানে দেখলাম, শ্বেত পাথরে কারুকার্য করা চূড়াযুক্ত মন্দির। স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন।

অবাক হয়ে আমরা দেখছিলাম। অনুসন্ধিৎসু চোখে ডায়না তাকাল রিচার্ডের দিকে।

 প্রশ্নটা বুঝতে পেরে বলল–মনে হয় এটাই সেই মন্দির।

মন্দিরের ভেতরে মেহগনি কাঠের এবড়ো খেবড়ো থামের উপর বসানো ব্রোঞ্জের খোদাই করা অদ্ভুত মূর্তি চোখে পড়ল। সিংহের ওপর উপবিষ্টা, অর্ধচন্দ্রাকৃতি শৃঙ্গবিশিষ্ঠা, ছোটো দেবী মূর্তি, অপূর্ব কারুকাজ করা।

রিচার্ড বললেন–ব্রিটিশ মিউজিয়ামে বইয়ের পাতায় দেখা দেবীমূর্তি হলেন ফিনিশীয়দের চাঁদের দেবী।

চাঁদের দেবী? লাফিয়ে উঠল ডায়না। তন্ময়ভাবে বলল–আজ রাতে পুরানো আমলে ফিরে গিয়ে ধর্মীয় উৎসবে মেতে পুরানো দিনের পোশাকে সাজব। কেমন হবে? চাঁদ উঠলে সবাই মিলিত হয়ে দেবীর সামনে ধর্মীয় প্রথা পালন করব।

ঠিক সেই মুহূর্তে আমার শরীরটা কেঁপে ওঠায় এলিয়ট বলে উঠল–এসব বোধহয় আপনার পছন্দ নয়?

গম্ভীরভাবে বললাম-পুরানো নিয়ে এসব করা আবার ঠিক নয়।

কৌতূহলী দৃষ্টিতে এলিয়ট আমাকে দেখে বলল–এটা যে প্রাচীন দেবীর পবিত্র অরণ্য কেউ সঠিক জানে? এটা রিচার্ডের কল্পনার বিলাস মাত্র।

ধরুণ যদি তাই-ই হয়?

আমার প্রশ্নে এলিয়ট হাসল–আপনি অবশ্যই এসব বিশ্বাস করতে পারেন না। একজন যুক্তিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে এগুলি বিশ্বাস করা যায় না। কবে মুছে গেছে প্রথাগুলি। চিন্তা করে বললাম–পরিবেশের প্রভাবে অভিভূত হওয়ার মানুষ আমি নই। কিন্তু জঙ্গলে ঢোকার পর থেকে মনে হচ্ছে আমার চারদিকে অমঙ্গলের ছায়া ঘনিয়ে উঠেছে।

চারিদিকে চোখ বুলিয়ে অস্বস্তিকরভাবে এলিয়ট বলল–অদ্ভুতই বটে। আমার মনে অতিরিক্ত কল্পনাই এর জন্য দায়ী। তোমার কি মত সাইমণ্ডল?

তরুণ ডাক্তার কয়েক মিনিট চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে বলল-বোঝাতে পারব না, আমার কেন ভালো লাগছে না। পরিবেশটা অস্বস্তিজনক।

সেই মুহূর্তে ডায়োলেট এগিয়ে এল আতঙ্ক চোখে। ফ্যাকাসে সাদা মুখে চিৎকার করে বলল–বিষম যাচ্ছেতাই জায়গা আমার দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে। চলুন চলে যাই।

আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে এগোলাম সবাই। কিন্তু ফিরে দেখি ডায়না নিবিষ্টি মনে মূর্তির দিকে তাকিয়ে। পরে আমার সঙ্গ নিলেও আনমনে হাঁটতে লাগল।

ফিরে আসার পথে মন্দির, দেবী, নিবিড় অরণ্যের বিশ্রী অনুভূতির কথা বলতে লাগল। বাড়ি ফিরে মজার পোশাক পরে চাঁদ উঠলে মন্দিরে যাবার আগ্রহে চলল কে কী পোশাক পড়বে। আড়াপাতা, ফিসফিসানি এইসব।

সবাই যখন নানা সাজে সজ্জিত হয়ে খাবার টেবিলে এল বিস্ময়ে আনন্দের হুল্লোড় পড়ে গেল। ক্যাপটেন ও স্ত্রী পরেছেন নিতথিলিক যুগের গুহামানবদের পোশাক। রিচার্ড সেজেছেন ফিনিশীয় নাবিকের পোশাকে। এলিয়ট দস্যুদলের সর্দার। সাইমণ্ডল পাঠক সেজেছে, লেডি ম্যানারিং নার্স এবং কন্যা ডায়োলেট ক্রীতদাসীর বেশ, ক্রীশ্চান সাধুর বেশ ছিল আমার। সর্বশেষে নীল আলখাল্লা সর্বাঙ্গে জড়িয়ে এল ডায়না।

চপল ভঙ্গিতে ডায়না বলে–হ্যাঁ, আমি অপরিচিতা, এখন খেতে চলুন।

খাওয়া-দাওয়া সেরে গুমোট গরমের পর ঝির ঝির হাওয়ায় বেড়াতে বেরোলাম। আকাশের বুকে চাঁদ উঠেছে। এলোমেলোভাবে ঘুরে একঘণ্টা কাটাবার পর দেখলাম ডায়না নেই।

রিচার্ড বলল–ডায়না শুতে যায়নি নিশ্চয়।

মাথা ঝাঁকিয়ে ডায়োলেট বলল-পনেরো মিনিট আগে জঙ্গলের দিকে গেছে। আবছা আলোয় অরণ্য কালো অন্ধকারের রূপ নিয়েছে।

রিচার্ড বলল–দেখি তো গিয়ে–নিশ্চয় কোনো দুষ্টু বুদ্ধি খেলেছে।

সবাই মিলে এগোতে গিয়ে ভাবছি–কি উদ্দেশ্য জঙ্গলে যাবার। আমার অনিচ্ছা ছিল, মনে হচ্ছিল শক্তিশালী কেউ যেন আমাকে বাধা দিচ্ছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই অনুভূতিটা প্রত্যেকের কিন্তু স্বীকার করতে লজ্জা পাচ্ছি। মহীরুহ এমন ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিল যে, উজ্বল আলো তা ভেদ করতে পারল না। চারিদিকে মৃদু আওয়াজ ফিসফিসানো পরিবেশকে ভীতিপ্রদ করে তুলল।

হঠাৎ আমরা ভোলা জায়গায় এলাম। আর যে দৃশ্য দেখলাম তাতে বাকরুদ্ধ..মন্দিরের সামনে উজ্জ্বল আলোয় দাঁড়িয়ে এক অপূর্ব নারীমূর্তি। সর্বাঙ্গে স্বচ্ছ আবরণে সুগঠিত নারী দেহ। একরাশ চুল ভেদ করেছে অর্ধচন্দ্রাকৃতি শৃঙ্গ দুটি। সুন্দর আর ভয়ঙ্করের মিলন।

রিচার্ড বলল–কে এ? কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

 ডায়োলেট চেঁচিয়ে উঠে বলল–এ যে ডায়না। নিজেকে কেমন সাজিয়েছে।

তার দিকে এগিয়ে যেতেই সেই মূর্তি হাত উপরে তুলল। বেজে উঠল জলতরঙ্গের মতো কণ্ঠস্বর–আমি দেবী অ্যাসটার্টের যাজিকা। অগ্রসর হলে সাবধান। মৃত্যু আমার হাতে।

প্রতিবাদে লেডি ম্যানারিং বললেন–ডায়না তুমি আমাদের ভয় পাইয়ে দিও না।

 রিচার্ড ডায়নার দিকে এগিয়ে মৃদুস্বরে বলল, ডায়না সত্যিই তুমি অপূর্ব।

চাঁদের আলোয় চোখ স্থির হল, পরিষ্কার দেখা গেল অন্য এক ডায়নাকে, ডায়না যেন চাঁদের দেবী ডায়না। দ্যুতিতে নিষ্ঠুরতা। অধর জুড়ে মোহময়ী হাসি।

হাত উঁচু করে আবার সতর্কবাণী–অগ্রসর হয়ো না। আমার অভিশাপে অঙ্গ স্পর্শ করলেই মৃত্যু নিশ্চিত।

আবেগতাড়িত রিচার্ড বলল–আর নয় ডায়না, আমার ঠিক ভালো লাগছে না। বলতে বলতে তার দিকে এগোল।

ঠিক তখনই কঠিন স্বরে ডায়না বলল-স্থির হও। আর অগ্রসর হলেই অ্যাসটার্টের মোহিনী অস্ত্রে আঘাত হানব।

উচ্চস্বরে হেসে রিচার্ড এগিয়ে যেতে ঘটল আশ্চর্য ঘটনাটা। থমকে গিয়ে হোঁচট খাবার ভঙ্গিতে রিচার্ড পড়ে গেল। আর উঠল না।

হঠাৎ প্রাণহীন করা হাসির শব্দে কেঁপে উঠলাম। নির্জন বনানীতে ছড়িয়ে পড়ল সেই ভয়ঙ্কর হাসি।

চাপা শপথ বাক্য পাঠ করে এগিয়ে গেল এলিয়ট, আর সহ্য হচ্ছে না। রিচার্ড উঠে পড়ুন। রিচার্ড নিশ্চল হয়ে পড়ে রইল। রিচার্ডের কাছে পৌঁছে হাঁটু গেড়ে বসে চিৎ করে শুইয়ে, ঝুঁকে পড়ল, পরমুহূর্তে ডাক্তার সাইমণ্ডল চিৎকার করে বলল, এদিকে আসুন। মনে হচ্ছে ও মারা গেছে। সাইমণ্ডল দৌড়ে গেল আর এলিয়ট ধীর পায়ে আমাদের দিকে এল। অদ্ভুতভাবে তাকাল হাত দুটোর দিকে।

সেই মুহূর্তে আর্তনাদ করে উঠল ডায়না, হায়! আমি খুন করেছি। এ আমি চাইনি। পরক্ষেণেই মূর্ছা গেল।

মিসেস রজার্স কান্নাভেজা গলায় বলল–অ্যাসটার্টের অভিশাপই কি মৃত্যুর কারণ? এই ভয়ঙ্কর জায়গা ছেড়ে চলুন–আরও ভয়ঙ্কর কিছু ঘটার আগেই।

এলিয়ট কাঁধে হাত রেখে বিড় বিড় করে বলল–এ অসম্ভব। একটা জলজ্যান্ত মানুষ এভাবে খুন হতে পারে?

আমি শান্ত করার চেষ্টার বললাম–রিচার্ডের হৃদপিণ্ড দুর্বল ছিল এবং আকস্মিক উত্তেজনায়

এলিয়ট শেষ করতে দিল না। হাত দুটি মেলল। বিস্ময়ে দেখলাম দুটো হাতে রক্তের ছাপ।

কোনো আকস্মিক ভয়ে মরেনি। ছুরিকাঘাতে মৃত্যু এবং সোজা হৃদপিণ্ডে। অস্ত্রের কোনো চিহ্ন নেই রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। এলিয়ট কষ্টবোধ করল।

সাইমণ্ডল রিচার্ডকে পরীক্ষা করে আমাদের কাছে এল। ফ্যাকাসে চোখ-মুখ। কাদস্বরে বলল–আমরা পাগল হয়ে গেলাম। বিশ্বাস করা যায় দেবীর অভিশাপের কথা! আজকের যুগে–কিন্তু যেটা ঘটল।

 অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম–সত্যি কি রিচার্ডমৃত? সম্মতি জানিয়ে সাইমণ্ডল বলল–তীক্ষ্ণ দীর্ঘ অস্ত্রের আঘাত। কিন্তু অস্ত্র তো দেখিনি।

এলিয়ট প্রায় চেঁচিয়ে বলল-কাছাকাছি কোনো অস্ত্র নিশ্চয়ই আছে। খুঁজে দেখি চলুন–বৃথাই খোঁজা।

ডায়োলেট হঠাৎ বলল–জায়না যখন ভয় দেখাচ্ছিল ছড়ি জাতীয় জিনিস হাতে জ্বলছিল।

 এলিয়েট মাথা নেড়ে বলল–রিচার্ড তিন গজের মধ্যে যায়নি।

লেডি ম্যানারিং ঝুঁকে ডায়নাকে দেখে বলল-হাতে কিংবা আশেপাশে কিছুই নেই। ডায়োলেট পেয়েছ কিছু?

ডাক্তার সাইমণ্ডল ডায়নাকে পরীক্ষা করে দেখল; অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শিথিল, আস্তে নিশ্বাস পড়ছে। কপালে ঘাম। নার্ভের গতি ধীর। এখনি বাড়ি নিয়ে যেতে হবে।

লেডি ম্যানারিং, সাইমণ্ডল, রজার্স মিলে মূৰ্ছিতা ডায়নাকে নিয়ে গেল। মৃতদেহ পাহারা দিচ্ছি আমি, ডায়োলেট আর রজার্স। অস্ত্রের সন্ধান করলাম। কিন্তু চাঁদের আলোতেও কোনো অস্ত্র পাওয়া গেল না। রিচার্ডের দেহ তোলার সময়ও ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছিল। মিসেস রজার্স ডুকরে কেঁদে উঠল। ডায়োলেট যেন মূর্ছা যাবে।

চারিদিকে চোখ বুলিয়ে পেনডার বলেন, গোয়েন্দা গল্প পড়ে জানা যায় মৃতদেহ সরাতে নেই। তথ্যটি আমাদের অজানা ছিল। তাই রিচার্ডের দেহ বাড়িতে আনলাম।

মালিকের মৃত্যুতে পরিচারক-পরিচারিকা সবাই বারহিত। যে বৃদ্ধা পরিচারিকা ছোটোবেলা থেকে মানুষ করেছিল রিচার্ডকে, সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। পুলিশ চৌকিতে খবর পাঠাল এক পরিচারক।

আমাকে ডেকে এলিয়ট বলল–সেই জঙ্গলে আবার যাবে। অস্ত্রটি খুঁজে বার করবেই। অস্ত্র না পাওয়ার সন্দেহের কথা জানিয়ে বললাম, ওখানে না যাওয়াই ভালো।

ঝাঁকুনি দিয়ে এলিয়েট বলল–আপনি মনে করেন অপ্রাকৃত শক্তিই মৃত্যুর কারণ। যে অস্ত্রটি মৃত্যুর কারণ সেটা খুঁজে বের করবই। এখন জঙ্গলে গিয়ে অস্ত্রটা নিয়ে ফিরব।

নানাভাবে এলিয়টকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করলাম। অরণ্যের নিবিড়তায় মনে হচ্ছিল ভয়ঙ্কর বিপদ ওত পেতে আছে। রহস্য ভেদের জন্য আলো নিয়ে এলিয়েট বেরিয়ে পড়ল।

ভয়ঙ্কর রাত্রি। কেউ ঘুমোতে পারিনি। সাইমণ্ডল এবং মেয়েরা ডায়নার পরিচর্যায় ছিল। সার্জেন্টের নেতৃত্বে তিনজন পুলিশ ঘোড়ায় চড়ে এল, ঘটনাটা শুনে অবিশ্বাস্য ধরে নিয়েছিল। ডায়নাকে জিজ্ঞেস করার আগ্রহ দেখালে ডাঃ সাইমণ্ডল তীব্র প্রতিবাদ করেন। কয়েক মিনিটের জন্য ডায়নার জ্ঞান ফিরলেও ঘুমের ওষুধ দিয়ে আবার ঘুম পাড়ালেন। মৃতদেহ পরীক্ষার জন্য পুলিশ ডাক্তার আনবে এবং অকুস্থলে গিয়ে অনুসন্ধান করবে।

পরদিন সাতটায় চায়ের টেবিলে খোঁজ পড়ল এলিয়টের। সাইমণ্ডলকে গত রাতের সব কথা জানালাম। গম্ভীর হয়ে বলল গিয়ে বোকামী করেছে। আমরা দুজনে অরণ্যে প্রবেশ করলাম। ডাকতে ডাকতে ভোলা জায়গাটায় এলাম। বিবর্ণ ভৌতিক জায়গা। বিস্ময়কর শব্দে সাইমণ্ডল হাত জাপটে ধরল। দেখি যেখানে রিচার্ডের মৃতদেহ ছিল, সেইখানে উপুড় হয়ে আর একটি দেহ।

দৌড়ে গিয়ে দেখি উপুড় হয়ে এলিয়ট। জামা ভিজে গেছে রক্তে, রক্ত মাটিতেও পড়েছে।

ডাক্তার সাইমণ্ডল নাড়ী ধরে দেখে বলল–মরেনি, নাড়ীর গতি ভালোই।

আমি নিচু হয়ে দেখি নিঃশ্বাস পড়ছে ধীরে। একটি সরু ব্রোঞ্জের অস্ত্র কাঁধে বিধে রয়েছে। অস্ট্রটায় হাত দিতে গেলে ডাঃ বলল–অস্ত্রটায় হাত দেবেন না। খুললেই রক্ত পড়তে শুরু করবে। আঘাত লেগেছে কাঁধে, হৃদপিণ্ডে নয়। সব ঘটনা ওর মুখেই শুনব।

ধরাধরি করে আনার পর সাইমণ্ডলের চিকিৎসার গুণে ব্রাণ্ডির প্রভাবে এলিয়ট সুস্থ হয়ে উঠল। আহত হওয়ার ব্যাপারে আলোকপাত করতে পারল না। ভাসা ভাসা বিবরণ। অনেক খুঁজেও কোনো অস্ত্র পাইনি। শান্ত হয়ে মন্দিরের কাছে যেতেই মনে হল গাছের আড়াল থেকে কেউ যেন লক্ষ করছে। হঠাৎ কনকনে হাওয়া বইল, আমার মন হল মন্দির থেকে হাওয়াটা আসছে। ভেতরে উঁকি মারতেই কপালে প্রচণ্ড আঘাতে ছিটকে পড়ে টের পেলাম কাঁধে প্রচণ্ড যন্ত্রণা।

যে ছুরিটি এলিয়টের কাঁধে বেঁধা ছিল সেটি ব্রোঞ্জের তৈরি প্রাচীন অস্ত্র। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে পাওয়া যায়। হেভেন বহু টাকা দিয়ে অস্ত্রটি কেনেন, কিন্তু বাড়িতে না মন্দিরে রেখেছিলেন সঠিক বলতে পারলেন না।

পুলিশের ধারণা হয়েছিল যে, ডায়নাই রিচার্ডকে আঘাত করে। কিন্তু আমাদের দেখে তারা বুঝল এত লক্ষণীয় প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যের বিরুদ্ধে ডায়নাকে অভিযুক্ত করা যাবে না। শেষ পর্যন্ত ঘটনাটি রহস্যজনকই রয়ে গেল।

ডাঃ পেনডার অল্পক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন। জয়েস লেমপ্রিয়ের বলে উঠল-চমৎকার কিন্তু বীভৎস ভৌতিক কাহিনী-আমি হত্যাকারীকে খুঁজে পেলাম না।–আপনি জানেন?

বৃদ্ধ পেনডার মাথা নাড়লেন। কার্যকারণ সম্পর্কে তখন একটা অদ্ভুত ধারণা তার হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অজ্ঞাতই রয়ে গেছে।

প্রেতচর্চার বৈঠকে উপস্থিত থেকে এই ঘটনাকে জন-সম্মোহন জাতীয় কিছুকে হত্যার কারণ মনে হয়েছে। মেয়েটি অ্যাসটার্টের যাজিকায় রূপান্তরিত হয়ে রিচার্ডকে ছুরি বিদ্ধ করে, পরে ছুরিটি ফেলে দেয় এটুকু বলে জয়েস থামল।

রেমণ্ড মন্তব্য করে, চাঁদের আলোয় সব দেখা না গেলেও মনে হয় বর্শা জাতীয় অস্ত্র দূর থেকে ছুঁড়ে মারাত্মক আঘাত হানা যায়। উপস্থিত সবাই ঘটনাকে সম্মোহন বলে ধরে নিয়েছিল।

হেনরি বলেন, কোনো ওস্তাদ লোক গাছের আড়াল থেকে অস্ত্রটা ছুঁড়েছিল। এলিয়টের মনে হয়েছিল আড়ালে কেউ নজর রাখছে আর ডায়নার হাতে ছুরি ছিল কিনা এ নিয়ে মতভেদ রয়েছেই।

পেথোরিক কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেন–আমরা একটা প্রয়োজনীয় তথ্য এড়িয়ে যাচ্ছি।

অস্ত্রটা ডায়না নিশ্চয় লুকোতে পারেনি, আর গুপ্ত ঘাতক অস্ত্রটা ছুঁড়লে রিচার্ডের দেহেই থাকত। যুক্তিপূর্ণ কারণ হচ্ছে রিচার্ড নিজেকে ছুরিবিদ্ধ করেছে। এবং এটি আত্মহত্যাই।

অবিশ্বাসের সুরে রেমণ্ড বলল, উনি কেন আত্মহত্যা করবেন?

পেথোরিক বলেন, আমি অনুমানে না গিয়ে তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তেই আসতে পারি যে নিজেকে ছুরিবিদ্ধ করার পর মাটিতে পড়ার সময় ছুরিটি ছিটকে পড়ে।

মারপল বলেন–আমি আপনার সঙ্গে একমতনই। ঘটনাটা বিভ্রান্তিজনক। সেদিন চড়ুইভাতিতে গলফ নম্বর প্লেট সাজাতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে লোকটা পাঁচ মিনিট অজ্ঞান ছিল।

রেমণ্ড পিসিকে বলল-লোকটা তো ছুরিবিদ্ধ হয়নি।

পিসি বলেন–একজনেইর সুযোগ ছিল ছুরি মারার। সুযোগ উপস্থিত হতেই মানসিক ইচ্ছা পূরণ করতে রিচার্ডকে খুন করে। তার দৃষ্টি ছিল ডায়নার দিকেই, তাই গাছের শিকড়ে বা পাথরে হোঁচট খান।

পেনডনার বিস্মিত হয়ে মারপলের দিকে তাকিয়ে বলেন, আপনি বললেন না একজনেরই সুযোগ ছিল।

মারপল বলেন–হ্যাঁ-এলিয়ট জনজাতি মানুষ ছিলেন তো? আমি নিশ্চিত; নিজেই নিজের কাঁধে ছুরি মেরেছিল। যেমন আবাস-এর যুদ্ধের পর জ্যাক বেনেস নিজের পায়ে নিজেই গুলি করেছিল। যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে আর গোলাগুলি দেখে যাতে ওকে যুদ্ধে যেতে না হয়। হাসপাতালে সব খুলে বলে লজ্জিত হয়েছিল। এলিয়ট কি জঘন্য অপরাধটি করে খুব লাভবান হয়েছে।

এলিয়ট হেভেন?–চিৎকার করে ওঠে রেমণ্ড।

অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে মারপল বলেন–অন্য কেউ খুন করতে পারে না। মিঃ পেথোরিক বাস্তব দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ। তাই প্রকৃত তথ্য হল মাটিতে পড়ার সময় প্রথম এলিয়েটই কাছে যায়। চিৎ করে শোয়ানোর সময় ঘটনাটি ঘটায়।

মারপলের কথা শেষ হলে পেনডার ধীরে ধীরে বলেন, সত্যটা পাঁচ বছর পর জানতে পারি। এলিয়টের মনে হয়েছিল প্রথম থেকেই ও সন্দেহের তালিকায় ছিল। তাৎক্ষণিক প্ররোচনায় ঘটে ব্যাপারটি, কারণ সে ডায়নাকে তীব্র ভালোবাসত। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে ব্যর্থ ব্যারিস্টার। রিচার্ড যদি মারা যায় উত্তরাধিকারী হবে এলিয়ট। পথের কাঁটা সরে যাবে। ডায়না তারই হবে।

রিচার্ডের কাছে উপুড় হয়ে বসতেই প্রলোভনে বিভ্রান্ত হয়ে রিচার্ডকে আচমকা ছুরিবিদ্ধ করে। স্বস্তি ফিরে আসতেই কোমর বন্ধনীতে ছুরি রেখে দেয়। সন্দেহমুক্ত হতে নিজেকে আহত করার মতলব আঁটে। নিজেকে ছুরিবিদ্ধ করে, যাতে সবার ধারণা হয় অশরীরী কেউ ফিনিশীয় অস্ত্র দিয়ে হত্যা করতে এসেছিল অরণ্যে প্রবেশ করার অপরাধে। ঘটনার পর ডায়না অপ্রকৃতিস্থ থাকলেও তার মনে হয়েছিল রিচার্ডকে সেই খুন করেছে।

দক্ষিণ মেরু অভিযানের সময় এলিয়ট চিঠিটা আমাকে দেয়। আশংকা ছিল অভিযান থেকে উনি ফিরবে না। সে ফিরে আসতে চাননি। মারপল ঠিকই বলেছেন, লাভ তো হয়নি বরং দুঃসহ নরকযন্ত্রণা ভোগ করেছে। চিঠির শেষ কথাটি ছিল সম্মানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ সঠিক প্রয়াশ্চিত্ত। নিঃশব্দে কয়েক মুহূর্ত কাটল।

চেয়ারে হেলান দিয়ে আবার শুরু করলেন পেনডার-ঈশ্বরের কৃপায় কোনো অপরাধী ছাড়া পায় না। অপরাধ প্রমাণিত না হলেও কিংবা আইনের চোখে দোষী না হলেও ঈশ্বরের আদালতে শাস্তি পাবেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস অশুভ পরিবেশই ঘৃণ্য কাজের জন্য দায়ী। মিস মারপলকে ধন্যবাদ দিয়ে বললেন–আপনি আবার রহস্যমোচন করলেন।

ঘটনার আশ্চর্য পরিসমাপ্তিতে সবাই চুপ। চুল্লির লালচে আভা সবার মুখে। জয়েস উঠে আলো জ্বালিয়ে দিয়ে পেনডারকে বলে–অদ্ভুত ঘটনা শোনানোর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। পরের মঙ্গলবার গল্পকার রেমণ্ড অনুদঘাটিত রহস্য গল্প শোনাবে।

পেথোরিক বললেন, আমি সমর্থন জানাচ্ছি।

রেমণ্ড বলল-জয়েসের ধারণা আমার জীবন পেশা সবই কল্পনাভিত্তিক। পরের মঙ্গলবার বাস্তব ঘটনা শোনাব।