০১. প্যারিস থেকে ক্রয়ডন

ডেথ ইন দ্য ক্লাউডস (এরকুল পোয়ারো)

০১.

 প্যারিস থেকে ক্রয়ডন

লা বুর্জেতে বিমানবন্দরের সেপ্টেম্বরের প্রখর রোদে পুড়তে পুড়তে যাত্রীরা ক্রয়ডনগামী বিমান প্রমিথিউস-এ উঠেছে। জেনে গ্রে তার জন্য নির্দিষ্ট ১৬ নম্বর আসনে এসে বসলো। কয়েকজন যাত্রী মাঝের দরজা দিয়ে সামনের কামরায় চলে গেছে। পেছনের কামরাও প্রায় ভর্তি। এক মহিলার তীক্ষ্ণ কণ্ঠ ভেসে আসছে মাঝখানের যাতায়াতের ওপাশ থেকে। জেনের ঠোঁট দুটো একটু বেঁকে গেল। ওই বিশেষ গলা ওর অচেনা নয়। আরে দারুণ। কোথায় চললে? চুয়ান লে পিনস? হ্যাঁ, লা পিনেতা-হা, সব সেই পুরানো লোক। এখানে এসো না। আঁতা হয় না। কে? ও আচ্ছা। তারপরই একজন বিদেশী নম্র পুরুষের গলা–আনন্দে মাদাম। জেন একপলক দেখলোবেঁটে মতো, ডিমের মতো মাথা আর একজোড়া গোঁফ বিশিষ্ট এক বিদেশী ভদ্রলোক মালপত্র গুছিয়ে আসন ছেড়ে উঠে যাচ্ছে। জেনের কাছে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেলো যে ওই মহিলা দুটিকে একসঙ্গে বসার সুযোগ দিতে ভদ্রলোক অন্য আসনে চলে গেলেন। জেনের কৌতূহল বেড়ে গেছে লা পিনেত-এর উল্লেখে কারণ সেও ওখান থেকেই ফিরছে। একজন মহিলাকে ও স্পষ্ট চিনতে পারলো তাকে শেষবার দেখেছিলেন জুয়ার টেবিলে। ক্ষুদে হাতদুটো মুঠো হচ্ছে, খুলছে–প্ৰসাধন করা নিপুণ চীনা পুতুলের মতো মুখটা পর্যায়ক্রমে হর্ষবিষাদে জ্বলছে নিভছে। একটু চেষ্টা করলেই ওর নামটা জেনের মনে এসে যাবে–ম্যাগী না কি যেন নাম। জেন ভাবলো অন্য মহিলাটি গেঁয়ো ঘোড়ার মতো দেখতে। একেবারে আসলী চিজ। ভাবতে ভাবতে জেন ওদের কথা ভুলে গিয়ে বিমান বন্দরের ছায়া দেখতে লাগল। জেন পণ করে রইলো মুখোমুখি বসা নীল সোয়েটার পরা যুবকটির দিকে ও তাকাবে না যাতে চোখাচোখি না হয়। প্লেন গড়াতে শুরু করলো। এই দ্বিতীয়বার জেন আকাশে উড়ছে, তাই দমবন্ধ করে বসে রইলো। ক্রয়ডনের পথে মধ্য দিনের যাত্রা শুরু হলো। সামনের কামরায় দশজন। পেছনে এগারোজন, দুজন বৈমানিক ও দুজন পরিচারক–মোট একুশজন যাত্রী প্লেনে। প্রমিথিউস ইংলিশ চ্যানেলের দিকে উড়ে চলল। জেন গ্রে ভাবছিল কোনো বিশেষ ঘটনা নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করি যাতে ওর দিকে না তাকাতে হয়। একটি রোমাঞ্চকর ঘটনা, সেই আইরিস লটারীর একটা টিকিট কেনা থেকেই শুরু। যে কেশবিন্যাস সংস্থায় জেন ও আরো পাঁচটি মেয়ে কাজ করতো সেখানে অনেক হাসাহাসি, ঠাট্টা তামাশা হয়েছিল এটা নিয়ে। অনেক টাকার পুরস্কারের বদলে একশো পাউণ্ড পুরস্কার ও পেয়েছিল। এই দিয়ে জেন লা পিনেত যাচ্ছে বা সবেমাত্র সেখান থেকে ফিরছে। ওদের মুখে শুনে শুনে ওরও ওখানে যাওয়ার সাধ ছিল বহুদিনের। জেন ওখানে পৌঁছে একটু আনন্দ করার জন্য প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় জুয়াখেলায় মাপা কয়েকটা টাকা খরচ করতো। কিন্তু প্রথমে খেলতে এসে তার কপাল মার খেল। এতদিন মিতব্যয়ীর মতো খরচ করে চারদিন খেলার পর সেই বাজিটাই সেদিনের শেষ বাজি ছিল। সামান্য জিতেছে কিন্তু অনেক বেশি হেরেছে। পাঁচ আর ছয়–সে নম্বর দুটোর ওপর এখনও কেউ বাজি ধরেনি–ভাবতে ভাবতে জেন ছয় নম্বরের ঘরের দিকে হাত বাড়ালো এবং তার উল্টোদিকে বসা একজন খেলোয়াড় পাঁচের ঘরে বাজি রাখলো। পাঁচ নম্বরে গিয়ে ঘুটি স্থির হলো। জেন তাই বাজির টাকায় হাত না বাড়ানোয় তার উল্টোদিকের লোকটি জেনকে টাকাগুলো নিতে বললো। জেনকে অবাক হতে দেখে লোকটি জানাল সে ছয় ধরেছিল আর জেন পাঁচ। এই অপরূপ সুন্দর যুবকের কথায় একটু ভেবে জেন বাজি জেতার টাকাটা নিল। ভাবলো ওই হয়তো পাঁচ নম্বরটা ধরেছিল। লোকটি সহজভাবে হেসে তখনকার মতো বিদায় জানালো। এই বিমানে জেনের উল্টোদিকে বসা সেই লোকটিকেই দেখে জেনের ভালো মনে হয়েছিল কারণ সে তাকে টাকাটা নিতে দিয়েছিল। এরপর শেষ দুটো দিন সে প্যারিসে কাটিয়ে এখন ফিরতি প্লেনে বাড়ি ফিরছে। বিমানে বসে জেন লক্ষ্য করলো চীনা পুতুলের মতো মহিলাটি একজন পরিচারককে ডাকলো এবং অন্য কামরা থেকে তার দিকে পাঠিয়ে দিতে বললো। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাতে ছোটো গয়নার বাক্স নিয়ে একটি ফরাসি মেয়ের আবির্ভাব ঘটলো। ম্যাডেলিন নামক এই মেয়েটিকে লেডি হরবেরিল ফরাসি ভাষায় নির্দেশ দিলেন তার লাল মরক্কো চামড়া-মোড়া বাক্সটা আনতে এবং মেয়েটি সেই প্রসাধন বাক্সটি নিয়ে এলো শেষপ্রান্তে উঁই করা বাক্স কম্বল থেকে। মিসিলি হরবেরিল তাকে বিদায় দিলেন। লেডি হরবেরিল এরপর সাজগোজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। যা দেখে জেন বিরক্ত বোধ করলো। মহিলা দুটির পেছনে সেই ক্ষুদেবিদেশী লোকটা প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিল। তার পাশে বসা একজন লম্বা মতো লোক বাঁশির বাক্স খুলে বাক্স বাঁশি ঘষে চকচকে করছিলো যাকে দেখে জেনের মনে হল উকিল বা ডাক্তার। ওই দুজনের পেছনে দুজন ফরাসি বোধহয় বাবা ও ছেলে হবে বলেছিল। এদিকে জেন কোনো অজ্ঞাত কারণে তার উল্টোদিকে বসা সেই লোকটার দিকে তাকাবে না বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। নরম্যান গেল নামে এই সুন্দর যুবকটি জেনকে চিনতে পেরে তাকে দেখছিল এবং জেনের সৌন্দর্য উপভোগ করছিল। জেনকে ওখানে বাজিতে জিতিয়ে দেওয়ার জন্য নিজেকে বাহবা দিচ্ছিল। ভীষণ উত্তেজিত হয়ে যুবকটি এক পরিচারককে গলা ভেজাবার মতো কিছু দিতে বললো। হরবেরিলর কাউন্টেস তার পাশে বসা ভেনেসিয়া কার ও ভাবছিল তার পাশে বসা মহিলাটি ক্ষুদে ডাইনীর মতো জঘন্য। এরা দুজনেই স্টিফেন নামক একজনের প্রতি অনুরক্ত। এরপর এরা দুজনেই সিগারেট খেতে ব্যস্ত হয়ে উঠল কিন্তু পরিচারকের বাধা পেয়ে বিরক্ত বোধ করলো। ওদিকে বসা সেই ক্ষুদে বিদেশী মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো ভাবছিল জেন এত সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও উল্টোদিকে বসা সুন্দর যুবকটি সম্পর্কে এত সচেতন নয় কেন? ডাঃ ব্রায়ান এরপর গান করে চিন্তামুক্তি কাটালেন। মঁসিয়ে দ্যুপ যাকে বাবা বলে মনে হয়েছিল তিনি তার ছেলেকে ধমকাচ্ছিলেন। তিনি জার্মান ইংরেজ আমেরিকান ও প্রাগৈতিহাসিক সব কিছুকে ভুল বলে প্রতিপক্ষ করতে চাইছিলেন। মঁসিয়ে দূপ প্রমাণের মাধ্যমে তা প্রমাণ করতে চায়। আরম্যন্ত ট্রুপ পুরানো বাক্স খুলে একটি ফরাসি নল দেখিয়ে তা খৃষ্ট পূর্ব ৫০০০ সালের মাটির কাজের মতো বললেন। রহস্য কাহিনীকার মিঃ ক্ল্যান্সি মহাদেশীয় রেলের টাইম টেবিল নিয়ে এলেন যা থেকে তার রহস্য গল্পের জন্য অজুহাত তৈরি করতে হবে। মিঃ রাইজ্যার ভাবছিলেন যে তার নিজের লভ্যাংশ ঠিক রেখে কি করে অন্যদের বেশি দেবেন। মাদাম গিজেল সামনে ঝুঁকে পড়লেন, সবাই ভাবল যে তিনি ঘুমোচ্ছেন, আসলে তিনি মারা গেছেন।

.

০২.

 আবিষ্কার

হেনরি মিচেল নামক পরিচারক সবার কাছ থেকে বকশিশ নিচ্ছিল। সে সবার কাছ থেকে বকশিশ নিয়ে গোঁফওয়ালা বেঁটে লোকটি ও পিছনের বৃদ্ধা মহিলার কাছ থেকে সে বকশিশ আশা করে ছিল। কিন্তু ক্রয়ডন পৌঁছাবার আগে সে মাথা ঝুঁকিয়ে বৃদ্ধা মহিলাকে বলল, মাফ করবেন ম্যাডাম, আপনার বিল। সে কাঁধে হাত রাখার পর আস্তে নাড়া দেওয়ায় মাদামের দেহটা ধপ করে পড়ে গেল-খড়ির মতো সাদা দেহটা ছিল মৃতদেহ।

দ্বিতীয় পরিচারক অ্যালবার্ট ডেভিস বলল, তাই কখনো হয় নাকি? হেনরি বললো যে, সে ভদ্রমহিলাকে অজ্ঞান হতে দেখেছে। মিনিট খানেক তারা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না– তারপর পরবর্তী কর্মসূচী ঠিক করে ফেলল। সকল যাত্রীর কানের কাছে তিনি ডাক্তার কিনা জিজ্ঞাসা করল। নরম্যান গেল দাঁতের ডাক্তার বলে কিছু করতে পারলেন না। ডাঃ ব্রায়ান নিজের পরিচয় দিয়ে পরিচারকের পেছনে পেছনে চললেন। ডাঃ ব্রায়ান আসনের সামনে ঝুঁকে পড়লেন এবং স্বাস্থ্যবতী মহিলাকে পরীক্ষা করে উনি মরে গেছেন বললেন, তিনি মিচেলকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন কখন তাকে শেষ দেখেছে সে?

মিচেল ভেবে বলল, সে প্রায় ৪৫ মিনিট হবে। দুজনের আলোচনায় কৌতূহল জাগাতে লাগল। মিচেলের মতে তার স্বামীর মতো ভদ্রমহিলার তড়কা রোগ আছে। ডাক্তার ব্রায়ান হতবুদ্ধির মতো মাথা নাড়লেন।

গোঁফওয়ালা মাফলার জড়ানো লোক দুটি ভদ্রমহিলার গলায় একটা দাগ দেখতে পেলেন। সত্যিই তার মাথা একপাশে হেলে পড়ায় সূক্ষ্ম দুটি দাগ দেখা যাচ্ছিল। দা দ্যুপ নামে ছেলেটিকে বলল যে ভদ্রমহিলা ভীমরুলের কামড়ে মারা গেছেন। ডাঃ ব্রায়ান এ বিষয়ে তার সম্মতি জানালেন। পরিচারিকা জিজ্ঞাসা করল মিনিট খানেকের মধ্যে তারা ক্রয়ডন পৌঁছে যাবে, তার কিছু করার আছে কিনা, ডাক্তার দেহটা ওখান থেকে সরাতে বারণ করলেন।

ডাঃ ব্রায়ান সকলকে নিজের জায়গায় বসতে অনুরোধ করলেন। পরিচারক তার কথায় সম্মতি জানালেন। ক্ষুদে লোকটি কী যেন একটা পড়ে থাকতে দেখলেন। হলুদ আর কালো একটা জিনিস স্কার্টের কোণার আড়ালে মেঝেতে পড়ে রয়েছে। এরকুল পোয়ারো পকেট থেকে চিমটে বের করে মূল্যবান বস্তুটি আবিষ্কার করলেন। কমলালেবু আর কালো রঙের সিল্কের সেসা দিয়ে পাকানো একটা ছোট্ট আঁটির মতো জিনিস সঙ্গে একটা অদ্ভুত ধরনের কাটা লাগানো। কাটার ডগাটার রঙ চটে গেছে।

মিঃ ক্ল্যান্সির গলা দিয়ে বিস্ময়ের প্রকাশ হল। তিনি জিনিসটির অসাধারণত্ব স্বীকার করলেন। তিনি বললেন যে এটি এক ধরনের দেশী কাটা। বাঁকা নল থেকে ছোঁড়া হয় যার মুখের সামনে বিষ লাগানো থাকে। এটা যে একটা ছোটো বর্শা থেকে ছোঁড়া হয়েছে তা সন্দেহাতীত। মিঃ ক্ল্যান্সি নিজে জীবনে এটা প্রথম দেখলেন। প্লেনটা তখন ক্রয়ডন বিমান বন্দরে মাথার ওপর নামার জন্য চক্কর দিচ্ছে।

.

০৩.

ক্রয়ডন

ক্ষুদে লোকটি বিজ্ঞের মতো কথা বলছিল, তার হুকুম সকলে মানবে এরকম নিশ্চিন্ত ভাব দেখাচ্ছিল। মিচেলের কানে কানে সে কি বলল।

মিচেল সকলকে নিজের সামনে বসতে বলল, এবং বেশিক্ষণ তাদের আটকানো হবে না বলা হল। লেডি হরবেরিল, সিসিলি মড়া আটকে রাখতে চাইলেন না। ভেনেসিয়া কারও তাদের কথায় সম্মতি জানালেন এবং সিগারেট খেতে চাইলেন। ব্যতিব্যস্ত মিচেল তাতে সাড়া দিলেন। ডেভিস জরুরী অবস্থায় দরজা দিয়ে ওপরওয়ালার আদেশ আনতে গেছিল।

একটু পরেই একটা সাদা চেহারার লোক মিচেল ও ডাঃ ব্রায়ানের মন্তব্য শুনে মৃতদেহটার উপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে সকল যাত্রীকে নামতে অনুরোধ করলেন। বিমানবন্দরের একটা নির্জন ঘরে তাদের বসানো হল।

মিঃ জেমস রাইজ্যার লন্ডনে ব্যবসায়িক জরুরী কাজ আছে বলে বসতে চাইছিলেন না। লেডি হরবেরিলও না। কিন্তু খুনের ঘটনা বলে ইনসপেক্টর তাদের বসতে বললেন। মিঃ ক্ল্যান্সির। সন্দেহ মিলল বলে তিনি খুশী হলেন।

ভেনেসিয়া কার শুধু বসতে সম্মতি জানালেন। ডাক্তার ব্রায়ানের সঙ্গে ইন্সপেক্টার কথা বললেন। ছোটোখাটো গোঁফওয়ালা লোকটিও সাহায্য করতে চাইল। মঁসিয়ে পোয়ারোকে নিয়ে ব্রায়ান ও তিনি দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন যা ঘরে সন্দেহের সৃষ্টি করল।

সিসিলি হরবেরিল আটকে থাকতে চাইছিলেন না। ভেনেসিয়া কার লোকটিকে ফরাসি পুলিশের চর বা শুল্ক বিভাগের চর বলে মনে করলেন। নরম্যান গেল জেনকে লা-পিনেত-এ দেখেছিলেন বলে দাবী করল। এই নিয়ে দুজনের মধ্যে কথা হচ্ছিল। দুপরা নিজেদের মধ্যে ফরাসিতে আলোচনা করছিল। সিসিলি হরবেরিল বলে অত্যন্ত রেগে গিয়ে ছিলেন, মিঃ রাইজ্যার ছোটো ছোটো বইয়ের হিসাব করছিলেন।

কাছের একটি ঘরে ইনসপেক্টার জ্যাপ ডাঃ ব্রায়ান এবং এরকুল পোয়ারোর সঙ্গে কথা বলছিলেন। এরকুল পোয়ারো বললেন, সে আশাতীত জায়গায় তিনি পৌঁছে যান, পোয়ারো জবাব চাইলেন ক্রয়ডন বিমান ঘাঁটি, আপনার ঠিক পথে পড়ে নাকি বন্ধু।

প্রথমে ইন্সপেক্টর পরে ডাঃ ব্রায়ান নাম ঠিকানা চাইলেন। নাক, কান, গলার বিশেষজ্ঞ ডাঃ রজার জেমস্ ব্রায়ান–৩২৯ নং হার্লে স্ট্রিটে তার ঠিকানা জানালেন। তাকে তিনি মৃত্যুর সময় জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি জানালেন যে মৃত্যুর প্রায় আধঘণ্টা পর তিনি যে মারা গেছেন ডাক্তার ধরতে পেরেছিলেন। তার পরিচারকটির কথা শুনেছিলেন যে তিনি প্রায় আধঘণ্টা খানেক আগে মারা গেছেন। ইন্সপেক্টার তিনি কোনো সন্দেহজনক কিছু জেনেছেন কিনা জিজ্ঞাসা করা উচিত মনে করলেন না। ডাক্তার সম্মতি জানালেন। এরকুল পোয়ারো তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বললেন। তাকে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, ওটা পোস্টমর্টেমে পরীক্ষা বিশ্লেষণের ব্যাপার।

মিঃ জ্যাপ বিধিমতো সকলকে নিয়ে কয়েকটা কাজ করতে চান। ডাঃ ব্রায়ান বললেন যে, তার কাছে বাঁকানল বা অন্য কোনো অস্ত্র লুকানো ছিল না। রজার্স সেটা দেখবে, বললেন তিনি। ছোটো বাক্সে রাখা সেই কাটাটাকে দেখিয়ে তার সম্পর্কে ডাক্তারকে ঢপ জিজ্ঞাসা করলেন।

ব্রায়ান বললেন, আদিবাসীরা কিউবার বিষ ব্যবহার করে। উটকো লোকের কাছে বিষ পাওয়া যেতে পারে। জ্যাপ ইয়ার্কি করে ডাক্তারকে ভালো করে খুঁজতে বললেন।

তারা দুজন মানে রজার্স এবং জ্যাপ ঘর থেকে বেরোলেন। জ্যাপ ও পোয়ারো প্লেনের মধ্যে তার ঘোড়াকে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় বললেন। হাতের ছাপ নেবার জন্য একজন লোক ও ফটোগ্রাফার এখুনি এসে পড়বে তা বললেন। এরপর দুজন পরিচারক পাসপোর্ট নিয়ে এলেন। মেরী মরিসো ফরাসি–পাসপোর্ট নিয়ে এলেন। মেরী মরিসো ফরাসি-পাসপোর্ট দেখে জ্যাপ তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। তারা মাদামের কি ব্যবসা তা বলতে পারল না। ছোটো পরিচারক বলল, কদিন আগে সকালের প্লেনে তাকে দেখেছিল। সেটা প্যারিস থেকে আটটায় ছাড়ে। মিচেল জানালো সে সম্ভবত দুটোর সময় চ্যানেলের উপর দিয়ে উড়বার সময় তাকে কফি দেওয়ার সময় তার সঙ্গে জীবিত অবস্থায় দেখা হয়েছিল। মিচেলকে জিজ্ঞাসা করায় সে বলল কফি দেওয়ার প্রায় ১৫ মিনিট পর শেষ তার সঙ্গে মিচেলের দেখা হয়েছিল। তিনি তখন বোধহয় মারা গেছিলেন। জ্যাপ তীরটি দেখালে সে তা দেখেনি বলল।

জ্যাপ তাদের কিভাবে খাবার দেয় জিজ্ঞাসা করলেন। তারা বলল তারা পিছন দিক থেকে সামনের দিকে খাবার দেয়। পোয়ারো মাথা নাড়লেন। জ্যাপ মহিলা প্লেনে কারো সাথে কথা বা সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়েছিলেন কিনা জিজ্ঞাসা করায় তারা না বলল। হেনরি মিচেল ব্যাপারটি তার বিশ্রী লেগেছে জানাল। জ্যাপ বললেন এটা ঠিক, কিন্তু তিনি তার জন্য মিচেলকে দোষী করতে চান না। তিনি তাদের চলে যেতে বললেন।

মঁসিয়ে পোয়ারো একটি প্রশ্ন করার অনুরোধ জানাল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তারা দুজন (পরিচারক) প্লেনের মধ্যে একটা ভীমরুল দেখতে পেয়েছিল কিনা। পোয়ারোকে তারা জানাল তারা ভীমরুল দেখতে পায়নি। একি ভুল বলে তিনি বললেন যে একটা ভীমরুল ছিল যা এখন কোনো যাত্রীর ডিসে পড়ে রয়েছে। তারা বলল যে তা হতে পারে, তবে তারা দেখেনি। পরিচারকরা ঘর থেকে বেরোতে প্লেনে এক ভদ্রমহিলা কাউন্টেস ছিলেন তাকে ডাকার কথা জ্যাপ বললেন।

মঁসিয়ে পোয়ারো জ্যাপকে বললেন যে তিনি সকল যাত্রীর মালপত্র খুঁটিয়ে তল্লাশি করবেন। এটা তার মনে হয়। জ্যাপ বাঁকা নল খুঁজবার জন্য এই কথা বলেছিলেন। তার ধারণা লেখক দুষ্কর্ম করার জন্য তীর ছুঁড়েছেন। জ্যাপ সকলকে তল্লাশি করবেন এই মনস্থ করলেন।

একটা সঠিক তালিকা করা যেতে পারে–পোয়ারো একটা আভাস দিলেন। যাত্রীদের মালপত্র থেকে কি খোঁজা হচ্ছে সে বিষয়ে সঠিক হতে জ্যাপ পোয়ারোকে বললেন এবং পোয়ারো সঠিক জিনিসটি কি তা জানেন না বলায় জ্যাপ তাকে সবকিছুকে কঠিন করে দেখতে একথা বললেন। লেডি হরবেরিলকে ডেকে পাঠানো হল।

হরবেরিল নিজেকে আর্যের পত্নী পরিচয় দিলেন। ঠিকানা জানালেন হরবেরিল চেজ, সাসেক্স, এবং ৩১৫ লন্ডন। তিনি লা পিনেত থেকে প্যারিস হয়ে লন্ডন যাচ্ছেন, মৃতা মহিলা সম্পূর্ণ তার অপরিচিত। তিনি সামনে মুখ করে বসে থাকায় পেছনের ঘটনা দেখার সুযোগ তার হয়নি। যিনি পরিচারক দুজন ছাড়া কাউকে যেতে দেখেননি। দুজন ব্যক্তিকে তিনি প্রসাধন করে যেতে দেখেছেন। তিনি ভীমরুল দেখেননি।

এরপর মিসেস ভেনেসিয়া অন্যকার সাক্ষ্য হুবহু তার বন্ধুর মতোই। ঠিকানা লিটল প্যডক্স হরবেরিল সাসেক্স। তিনি পিছনের কয়েকজন যাত্রীর মধ্যে একটি ভীমরুল মারার চেষ্টা করতে করতে একজনকে খাবার দিয়ে যাবার পর ভীমরুল মারতে দেখেন।

জ্যাপ মঁসিয়ে পোয়ারোকে ভীমরুল সম্পর্কে বেশি উৎসাহ বলে দাবী করলেন। তার মতে ফরাসি লোকদুটো যারা বিদেশী ছাপমারা ঝরঝরে স্যুটকেস নিয়ে এসেছে তাদের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করলেন। তিনি প্যারিসের সেরা গোয়েন্দা দপ্তরের সাহায্য নিতে চান। কিন্তু পোয়ারো বললেন এই জ্যাপ পদবীযুক্ত লোকদুটি প্রত্নতত্ত্ববিদ। পিতা ও পুত্র যারা পারস্যে একটা খননকার্য সেরে মাত্র কয়েকদিন আগে দেশে ফিরেছেন। জ্যাপ কিছুটা অবিশ্বাসী তাদের প্রতি। তার তাদের গুণ্ডা মনে হয়। কিন্তু পোয়ালরা তার যুক্তি খণ্ডন করেন। পিতা আরল্যান্ড জ্যাপ সম্পূর্ণ অপরিচিতা মহিলাটির মৃত্যুর সম্পর্কে কিছুই জানেন না। কারণ তিনি তার পুত্রের সঙ্গে দরকারী আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন। পুত্র বলল যে ভীমরুলের অত্যাচারে বিরক্ত হয়ে তাকে মেরে ফেলে।

শেষে এলেন মিঃ ফ্যান্সি। তিনি বাঁকানল সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন। তার নিজের কাছে ছিল এ কথা জানার সাথে সাথে তাকে আক্রমণ করলেন জ্যাপ। এ বিষয়ে তিনি যে কথাটা বললেন তা হল তিনি বই লিখছেন যাতে এরকমভাবে খুন করা হয়। তিনি আঙুলের ছাপ বাঁকানলের উপর কিভাবে পড়ে তা দেখার জন্য চ্যারিং ক্রস রোডে বাঁকানল কিনেছিলেন। তার এক চিত্রশিল্পী বন্ধু লাল পিঁপড়ের রহস্য বলে একটা বই-এর যথেষ্ট অনুগ্রহ করে এর একটা ছবি এঁকে দিয়েছিল। আঙুলের ছাপ সমেত অত্যন্ত অসংলগ্নভাবে তিনি এই কথাগুলো বললেন।মিঃ ফ্যান্সির কাছে যেতে বইটা যখন চাওয়া হল তখন তিনি বললেন ওটা সঙ্গে নেই। তিনি বললেন যে ঘটনা ঘটার অনেক আগে মহিলার পাশ দিয়ে গেলেন বর্ষাতির পকেট থেকে টাইম টেবিল আনতে। বাকি প্রশ্নের নেতিবাচক উত্তর মিলল। তিনি ভীমরুল দেখেছিলেন। কিন্তু সেটিকে তিনি মারতে পারেননি। তারও নাম-ঠিকানা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হল।

তোতলামি করে কথা বলায় জ্যাপের একটু সন্দেহ হল। এরপর নরম্যান গেলকে ভাবা হল। যিনি দন্ত চিকিৎসক। তিনি প্লেনের মধ্যে সন্দেহজনক কিছু পাননি। কোনো ভীমরুল তার চোখে পড়েনি।

এরপর জেমস্ রাইজার রেগে সবার শেষে এলেন। তিনি কোনো চিৎকার শোনেননি। দুজন পরিচারক ছাড়া কাউকে আসতে দেখেননি। বাঁকানল তিনি চেনেন না। একজন কনস্টেবল ঘরে ঢুকে বললেন যে তিনি বাঁকানল খুঁজে পেয়েছেন যাতে কোনো আঙুলের ছাপ নেই, তবে সার্জেন্ট তাকে এটা সাবধানে মুড়ে রাখতে বলেছেন।মিঃ রাইজ্যার উৎসাহভরে দেখলেন এবং জিনিসটার অভিনবত্ব স্বীকার করলেন।

এটি কোথা থেকে পাওয়া গেছে এ প্রসঙ্গে জানা গেল ৯ নম্বর আসনের পিছনের থেকে এটি পাওয়া গেছে। পোয়ারো বললেন ৯ নম্বর আসনটা তার ছিল। মিঃ রাইজ্যার জ্যাপকে বললেন এটা জ্যাপের পক্ষে একটু অস্বাভাবিক। জ্যাপ মনে করলেন যে এটা দিয়ে কাজ সারা হয়েছে।

এরপর জেন গ্রে নামক একজন সুন্দরী তরুণীকে জেরা করা হল। সে বলল যে, তার বাড়ি বাটন স্ট্রিটে–ঠিকানা ২০ নং হারগেট স্ট্রিট, নর্থ ওয়েস্ট ৫, সে লা পিনেত থেকে ইংল্যান্ডে ফিরছে। পরের প্রশ্ন, সেই লটারীর টিকিট কেনার কথা ক্রমে মনে পড়লো, বাঁকানল মেয়েটি চেনে না। সেই মহিলাও তার অপরিচিত। তাকে লা বুর্জেত-এ লক্ষ্য করেছে। জেনের কাছ থেকে কোনো প্রয়োজনীয় তথ্য বের করতে পারা গেল না। জ্যাপ বাঁকানলের চিন্তায় মন দিলেন। এ ব্যাপারে তিনি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ চাইবেন বলে ঠিক করলেন। পোয়ারো বললেন, ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যায় এক টুকরো ছোটো কাগজ ওই নলটির গায়ে আটকানো আছে। দেখে মনে হয় নলটার দাম লেখা টিকিটের একটা ছেঁড়া অংশ। তার ধারণা এই বিশেষ জিনিসটা কোনো গ্রামাঞ্চল থেকে কোনো দুর্লভ শিল্পসংগ্রহকারী দোকান থেকে ঘুরে এসেছে। পোয়ারো মালপত্রের তালিকার কথা জিজ্ঞাসা করলেন। জ্যাপ তার প্রয়োজন নেই বললেন। দাম লেখা ছেঁড়া টিকিটটা ছিঁড়তে বলছিলেন। এই খুনের ব্যাপারটা এতই সোজা যে কোনো রদ্দিমার্কা লেখকও এটার সমাধান করে দিতে পারে।

.

০৪.

 বিচার তদন্ত

চারদিন পর, মেরী মরিসের হত্যা সম্পর্কে বিচার বিভাগীয় তদন্ত বসলো। মৃত্যুর ধরন জনসাধারণের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করল।

প্রথম সাক্ষী মেত্র আলেকজাণ্ডার নিয়ো, ফরাসি ভদ্রলোক ইংরেজিতে উত্তর দিচ্ছিলেন। বিচারক জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি মৃতদেহ চেনেন কিনা। তিনি বললেন যে সেটি তার মক্কেল, মেরী অ্যাঞ্জেলিক মরিসোর। উনি আর কোনো নামে পরিচিত কিনা জানার জন্য তিনি বললেন, মাদাম গিজেল নামে যা তার ব্যবসায়িক নাম ছিল। তিনি একজন নামকরা মহাজন ছিলেন। তিনি ব্যবসা চালাতেন তিন নম্বর জুলিয়েন স্ট্রিটে, তার বাসভবনে। বিচারকের ধারণা তিনি প্রায়ই লন্ডনে যেতেন। জের আলেকজান্ডারের মতে তিনি ইংরেজদের উচ্চ পেশার মহিলাদের সঙ্গে বিচক্ষণতার সঙ্গে ব্যাবসা করতেন। তিনি বললেন যে, তিনি নিজেই ব্যবসা-বাণিজ্য চালাতেন, শুধু আইনগত দিকটাই আলেকজাণ্ডার নিজে দেখাশোনা করতেন। বিভিন্ন প্রশ্নের রেশ ধরে তিনি বললেন, তিনি ধনী মহিলা ছিলেন, তিনি শত্রহীনা ছিলেন কিনা তা তিনি বলতে পারেননি।

এরপর হেনরি মিচেল বললেন যে সে ইউনিভার্সাল এয়ারলাইন্স লিমিটেডে কাজ করে। সে বলল যে ছমাস আগে সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটের প্লেনে নিযুক্ত ছিল। তখন সে দু-একবার তাকে প্লেনে দেখেছে। মাদাম গিজেল নাম সে আগে শোনেনি। সে মারা যাওয়ার দিনের ঘটনা বলল সে কি কি দেখেছে।

এরপর তাকে (হেনরি) বাঁকা নল দেখানো হলে সে বলল, এ জিনিস সে দেখেনি। অ্যালবার্ট ডেভিস নামে পরিচারককে জেরা করতে গিয়ে জানতে চাইলেন সে কিভাবে মৃত্যু সংবাদ জানতে পারল। সে বলল, সে মিচেলের কাছ থেকে একজন যাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েছিল এটা শুনেছিল। সেও বাঁকানল নামক যন্ত্রটা দেখেনি এটা বলল।

রজার ব্রায়ান এরপর সাক্ষী দিলেন। তিনি বললেন যে, তিনি মৃত্যুর আধঘণ্টা পর পরীক্ষা করে দেখেছিলেন। তিনি গলার কাছে ফুটো লক্ষ্য করেছিলেন।

এরপর ডাঃ হুইগলার বলেন, গত মঙ্গলবার বিকাল তিনটার একটু পরে মাঝবয়সী মহিলার মৃত দেহ দেখানো হয়। ঘাড়ের পাশে এটা গোল ফুটো তার চোখে পড়ে। ঠিক গলার পাশে ধমনীর উপর ফুটোর সঙ্গে ভীমরুলের কাটা ফোঁটানোর দাগ অথবা যে কাটাটা দেখানো হয়েছিল সেই কাঁটা ফোঁটানোর দাগ ছিল। তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন রক্তের সঙ্গে ফীব বা গাছের কড়া বিষ মেশানোর ফলেই মৃত্যু হয়েছে। এই বিষ সম্পূর্ণ তার অজ্ঞাত।

এরপর মিস্টার উইন্টারশুন বললেন যে তিনি বিশ্লেষণ করে দেখেছেন মূলতঃ এই তীর একটা দেশীয় কিউবার বিষের মধ্যে ডোবানো হয়েছিল–যে বিষ কোনো কোনো উপজাতি তীরের বিষ হিসাবে ব্যবহার করে। দক্ষিণ আফ্রিকার বুম্মত নামে এক বিষাক্ত সাপের বিষ দেওয়া হয়েছে। এই বিষ চামড়ার নিচে সাংঘাতিকভাবে রক্তক্ষরণ করে। হৃৎপিণ্ডের প্রতিক্রিয়া হয়। মিঃ উইন্টারস্পুন বললেন, এইভাবে তিনি কাউকে খুন করতে দেখেননি।

ডিটেকটিভ সার্জেন্ট উইলসন তার সাক্ষ্যে বললেন, একটা আগুনের গণ্ডির পিছনে ওই বাঁকানল তিনি দেখতে পান, দেখা গেছে ওটা ছুঁড়লে প্রায় দশগজ পর্যন্ত যায়।

হরবেরিল কাউন্টেস-এর বক্তব্য থেকেও কিছু পাওয়া গেল না, মাদাম ভেনেসিয়া কারো বক্তব্য থেকেও কিছু পাওয়া গেল না।

এরপর জেমস বেল রাইজার নামক এলিস ভেন সিমেন্ট কোম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেক্টার তিনি বাঁকানল দেখেননি, তিনি আসন উঁচু বলে কারোকে দেখতে পাননি। তিনি কারোকে বাঁকা নল তাক করতে দেখেননি। তিনি দুজনকে উঠে সামনে প্রসাধন ঘরের দিকে যেতে দেখেছেন কিন্তু তাদের হাতে কিছু ছিল না। দাঁতের ডাক্তার নরম্যান গেল নেতিবাচক সাক্ষ্য দিল, মিঃ ফ্ল্যান্সি সাড়া জাগাতে পারলেন না।

মিঃ ফ্ল্যান্সি তার নিজস্ব বাঁকানল আদালতে দেখালেন, তিনি যে খুন করেননি বা খুনে তার বাঁকানল ব্যবহার করা হয়নি এটা প্রমাণ করতে। কিন্তু তাতে তিনি বিচারকের কাছ থেকে নাস্তানাবুদ হলেন। তাকে ন্যায় বিচারে সাহায্য করার জন্য আনা হয়েছে। নিজের প্রতি সন্দেহের জবাবদিহির জন্য নয়।

জেন গ্রে সাংবাদিকদের কলমে কিছু বলতে পারলেন না। মঁসিয়ে আরম্যন্ত জ্যাপ মৃত মহিলাটির অপরিচিত এবং তিনি প্যারিসে খুব যান বলে মহিলার নাম জানেন না। তিনি পৃথিবীর অনেক জায়গায় ঘুরলেও তিনি বিষ বা ওই ধরনের কোনো জিনিস লক্ষ্য করেননি। দুপ-এর পুত্র বলেন, ভীমরুলটা তিনি মেরেছিলেন।

বিচারক এরপর রায় দিলেন যে, ঘটনাটি যখন প্লেনে ঘটেছে অতএব কোনো যাত্রীর দ্বারা হয়েছে। কেউ কিছু দেখতে না পেলেও এটা প্রমাণ হয় বাঁকা নলের মধ্যে বিষ তীর দিয়ে ভদ্রমহিলাকে খুন করা হয়েছে। পুলিশের কাজ এখন কোথায় খুনের সূত্র আছে তা খুঁজে বের করা, যেহেতু খুনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি।

একজন সদস্য বিচারককে জিজ্ঞাসা করলেন বাঁকানল কোথায় পড়েছিল। মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারোর সিটের তলা থেকে তা পাওয়া যায়। যিনি একজন সুপরিচিত ও শ্রদ্ধেয় গোয়েন্দা। বেসরকারী গোয়েন্দা শুনে অবিশ্বাসী নজর তার উপর স্থির হয়ে রইল। একজন আদালী বিচারকের হাতে কাগজ ঢুকিয়ে দিলেন যার ফলে রায় হল, বিষের প্রভাবে মহিলার মৃত্যু হয়েছে কিন্তু কে এই বিষ ঢুকিয়েছিল তা প্রমাণ করার মতো যথেষ্ট প্রমাণ হাতে নেই।

.

০৫.

খবর নিয়ে

নরম্যান গেল আদালীর কাগজে কি লেখা ছিল তাতে উৎসাহ প্রকাশ করতে এরকুল পোয়ারো বললেন ওটাতে তাকে খুনী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। জেন ও পোয়ারো দুজনে হেসে ফেললেন এবং পোয়ারো নিজেকে কালিমামুক্ত করবেন বলে আশ্বাস দিলেন। গেল পোয়ারো যে গোয়েন্দা সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করল। তিনি আশা করলেন ছদ্মবেশ পড়লেও তাকে চেনা যাবে। এ বিষয়ে জেন জানাল যে এখন গোয়েন্দারা আর ছদ্মবেশ ধরে না, এক জায়গায় বসে মনস্তাত্ত্বিক দিক চিন্তা করেন। কিন্তু মার্কফার মোড়া ভদ্রলোককে তারা দুজনেই ধর্তব্যের মধ্যে ধরলো না। এরপর দুজনে একসঙ্গে চা খেতে গেলেন।

জেনকে গেলের বেশ পছন্দ হয়েছিল। সে বলল যে খুনটুন যাচ্ছেতাই ব্যাপার। জেন তার এই সাক্ষ্য দেওয়ায় তার চাকরিতে অসুবিধে আসতে পারে, একথা বলল নরম্যান গেল। ব্যাপারটাতে তার কোনো দোষ নেই, তিনি খুবই চটে গেলেন। জেন বললেন, তাতে রাগ করার কিছু হয়নি, জেনের বক্তব্য যে তিনিও খুন করতে পারেন কারণ তিনিও সন্দেহের উর্ধ্বে নয়। গেল বললেন তিনি খুন করতেই পারেন না। জেন বললেন, তিনি এ ব্যাপারে এত নিশ্চিত নন কারণ তার একজন ঘ্যানঘেনে গলার খদ্দের আছে যাকে তার খুন করতে ইচ্ছে করে। মনে হয় এটা করলে তার সকাজ করা হবে। কিন্তু খুনটা তিনি করেননি এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। জেন বলল যে, দাঁতের ডাক্তার গেল খুন করেছেন। যদি রোগীরা ভেবে নেয় তাতে এতে কোনো সুরাহা হবে না। গেল বলেন, ওতে তার ভবিষ্যত ক্ষতিগ্রস্থ হবে। দাঁতের ডাক্তার বলে জেন তাকে অপছন্দ করেছেন এটা জানতে চাওয়ায় গেলকে জেন বললো, নিঃসন্দেহে সে একজন সহকারী, চুল বাঁধনেওয়ালীর থেকে অনেক উপরে। গেল জেনকে একদিন ডিনারে নিমন্ত্রণ করলেন, তিনি জেনের লা পিনেত কেমন লাগল জিজ্ঞাসা করায় জেন তাকে লটারী জেতার কথা জানাল। তাদের দুজনের কথাবার্তার মাঝে একজন লোক এসে দাঁড়াল, তিনি সাপ্তাহিক হাউস পত্রিকা থেকে আসছেন। তিনি টাকার বিনিময়ে খুনের ঘটনা লিখতে চান, পঞ্চাশ বা ষাট ডলারের বিনিময়ে। এই কাজে জেন আগ্রহী হল না। সে বলল, সে পারবে না। ভদ্রলোক তাকে অনুলিখনের আশ্বাস দিল। কিন্তু জেন তা করতে না চাওয়ায় ব্যক্তিটি গেলকে একশো ডলার দিতে চাইল। কিন্তু জেন তা করতে না চাওয়ায় ব্যক্তিটির অভিজ্ঞতা জানতে চাইল। কিন্তু তিনি সম্মত হলেন না। ব্যক্তিটি বলেন যে এই প্রচারের যুগে এতে তার পরিচিতি বাড়বে কিন্তু গেল তাতে ভয় পেলেন এবং তিনি তার রোগীদের কথা ভেবে একাজে রাজি হলেন না। তার মতে তার রোগীরা ভাববেন তিনিও খুনের মামলায় জড়িত। এরপর তিনি লোকটিকে যেতে বললেন।

বেশ খুশী মনে ব্যক্তিটি দোকান থেকে বেরিয়ে গেল। যাবার আগে সে তার উক্তিটি দিয়ে গেল।

সাপ্তাহিক হাউসের পরের সংখ্যাতেই মাঝ আকাশে হত্যা রহস্য শিরোনামে দুই সাক্ষীর বক্তব্য বেশ ফলাও করে ছাপা হলো। মিস্ জেন গ্রে কিছু বলেননি। নরম্যান গেল তার পেশার ক্ষতির জন্য কিছু বলতে চাননি। জেন ঘটনাটি পড়ে বলল যে, ওই লোকটা নামী লোকের কাছে কেন গেল না। গেলের বক্তব্য যে সম্ভবতঃ তার কাছে তারাই (জেন ও গেল) নামী লোক। জেনকে গেল জিজ্ঞাসা করলেন যে প্লেনের মধ্যে অন্য কেউ এটা করতে পারে, কিন্তু বিচারকের কথায় ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়। কিন্তু তার মতে গেল খুন করেননি। তবে অবশ্যই সে নিজেও করেনি। তবে তার কোনো ধারণা নেই।

এ বিষয়ে নরম্যান গেলের ধারণা জিজ্ঞাসা করা হলে সে বলল, যে সে কিছুই দেখেননি এবং তার মনে হল কিছু দেখা উচিত ছিল। কিন্তু সে ব্যস্ত ছিল জেনকে দেখতে যাকে সে বিয়ে করতে চায়। তার মনে হল যে সাংবাদিকদের কথায় রাজি হলে ভালো হত। জেনেরও গেলকে খুব পছন্দ হয়েছিল। সেও মুগ্ধ চোখে তাকে দেখায় অন্য কিছু দেখার সুযোগ পাননি।

জেনকে জিজ্ঞাসা করায় কে খুন করতে পারে সে বলল, তার মনে হয় পরিচারক নয় আসলে গেল দুই ভদ্রমহিলাকে সন্দেহ করলেও মিস হরবেরিল জেনের মতে খুনী হতে পারেন না এবং মিস কার একেবারে গেঁয়ো, তিনি খুন করতে পারেন না। এ বিষয়ে গেল একমত, তার মতে গেঁয়ো লোক সন্দেহের উর্ধ্বে নয়। ডাক্তারটিকে তারা সন্দেহ করলেও সঠিক প্রমাণের অভাবে সেও ঠিক সন্ধিগ্ধ হল না।

জেন বলল, উনি যদি মহিলাটিকে খুন করতে চাইতেন, তাহলে এমন কিছু ব্যবহার করতেন, যার নাম পর্যন্ত কেউ কোনোদিন কানেও শোনেনি। নরম্যান এটা ঠিক একটু খুঁতখুঁতে ভাবে বলল, বেঁটে মতো ভদ্রলোক মিঃ ফ্ল্যান্সিকে সন্দেহ করেননি গেল। কিন্তু জেন মনে করেন যে তিনি যদি সত্যিই খুনী হতেন তাহলে তিনি বাঁকানলটি দেখাতেন না। এই কথায় গেল সম্মতি দিলেন। জেনের সন্দেহের তীর এবার রাইজ্যার এবং ফরাসি পিতাপুত্রের দিকে। তার মতে ফরাসি দুজনের মধ্যে যে ছোটো তাকে চিন্তিত দেখাচ্ছিল। গেলের মতে তারা দুজনে পৃথিবীর বিদঘুঁটে জায়গা ঘুরে এসেছেন যার জন্য তাদের প্রতি সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক এবং কেউ যদি কাউকে খুন করে তাহলে অবশ্যই তাকে চিন্তিত দেখাবে। জেন বলল যে তারা দুজনে যেন খুনী না হন তাহলে সে খুশী হবে।

গেল বলল, কাজটা সহজ হবে না। জেনের মতে মৃত মহিলার সম্পর্কে সবকিছু ভালোভাবে জানতে হবে। জেনের মতে আন্দাজে ঢিল ছোঁড়া হচ্ছে। জেনের মতে এর প্রয়োজন আছে। গেল বললো, এই খুন তাদের জীবনকে জড়িয়ে ধরেছে। এর কালো ছায়া তাদের ভবিষ্যত জীবনের ওপর কী প্রভাব বিস্তার করতে চলেছে তা অজ্ঞাত। জেন এটা শুনে অত্যন্ত ভীত হল। এবং এ কথা বলতে বারণ করল।

গেল বলল যে, সে নিজের সম্পর্কে ভীত হয়ে পড়েছে।

.

০৬.

 শলাপরামর্শ

এরকুল পোয়ারো আবার বন্ধু ইনসপেক্টার জ্যাপের সাথে মিশলেন। পোয়ারোকে বললেন, যে অল্পের জন্য তিনি জেলে ঢোকার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। পোয়ারো নিজের পেশার প্রতি খুব চিন্তিত।

রোগা লম্বা মতন লোকটি ফরাসি গোয়েন্দা দপ্তরের একজন লোক, মঁসিয়ে ফার্মে এই খুনের মামলার সাহায্য করার জন্য এসেছেন।

ফার্নে করমর্দন করে বললেন যে বেশ কয়েকবছর আগে তার এরকুল পোয়ারোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। মঁসিয়ে গিরাদের কাছে তার অনেক কথা শুনেছেন। পোয়ারো তাদের দুজনকে তার বন্ধু মেত্র নিয়োর সঙ্গে নৈশাহারের নিমন্ত্রণ করলেন। পোয়ারো বললেন একজন মহিলাকে তিনি বলেছেন তার চরিত্রের কলঙ্ক মোছর জন্য খুব উদ্বিগ্ন। জ্যাপ বললেন যে জুরী ভদ্রলোকের পোয়ারোর চেহারাটা পছন্দ হয়নি।

ফার্নে, থিবো, জ্যাপকে এরকুল পোয়ারো বেশ লোভনীয় খাবার খাওয়ালেন, তাতে সকলেই বেশ খুশী মনে হল। ইনসপেক্টার জ্যাপের সঙ্গে থিবো আলোচনা করে খুব তাড়াতাড়ি যে সিদ্ধান্তে এসেছিলেন তাতে তিনি মৃত্যুর ঘটনা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ব্যাপারগুলি শুধু জানতে পেরেছিলেন। থিবো বললেন যে, মাদাম গিজেল সম্পর্কে তিনি খুব সামান্য জানেন, সারা দুনিয়া তাকে যেভাবে জানে, তাকে সেইসব সাধারণ মানুষ হিসাবেই জানেন, মঁসিয়ে ফার্নে বেশির ভাগ জানেন বলে তিনি বলেন যে, তার (গিজেল) এই চরিত্রের জুড়ি মেলা ভার, বয়সকালে তাকে দেখতে ভালোই ছিল। জলবসন্তের ফলে তার সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়। তিনি ছিলেন এমন একজন মহিলা, যিনি ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করেছেন, অগাধ ক্ষমতাও ধরতেন। ব্যাবসার ক্ষেত্রে তিনি খুবই বিচক্ষণ ছিলেন, তিনি ক্রমশই একজন কঠিন মনের ফরাসী মহিলা যিনি আবেগের বশবর্তী হয়ে কখনোই ব্যাবসার ক্ষতি হতে দিতেন না। কিন্তু যথাযথ সতোর সঙ্গে ব্যাবসা চালাবার বিরাট সুনাম তার ছিল।

ফার্মে বললেন, মাদাম গিজেল খুব সৎ ছিলেন অবশ্য তার সামর্থ্য অনুযায়ী যদিও সাক্ষ্য প্রমাণ পেলে অদূর ভবিষ্যতেই হয়তো আদালতে তার ডাক পড়তো। তিনি ব্ল্যাকমেল করে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করতেন, মাদাম গিজেলের টাকা ধার দেওয়ার একটি বিশেষ রীতি ছিল, যাকে খালি হাতে টাকা ধার দেওয়া বলে তাই। অবশ্য কত টাকা ধার দেবেন এবং সেটা কি ভাবে শোধ দিতে হবে, সেটা তার ইচ্ছে অনুযায়ী ঠিক হতো, কিন্তু তার কর্মপদ্ধতি এমনই ছিল যে টাকা তিনি নিশ্চয়ই ঠিক ফেরত পেতেন।

মাদাম গিজেলের নিজস্ব একটা গোয়েন্দা দপ্তর ছিল। তার মক্কেলরা ছিল সমাজের উঁচুতলার লোক। যারা কুৎসা রটার ভয়ে ভীত থাকেন। তার দপ্তরের লোকজন তার মক্কেল সম্পর্কে খবর রাখত। মাদাম বিশ্বাসী লোকেদের প্রতি বিশ্বাস রাখতেন। টাকা উপায় করার জন্য কখনই গোপন অস্ত্র ব্যবহার করতেন না। যদি না আগে সেই টাকাটা কেউ তার কাছ থেকে ধার নিয়ে থাকতো। যদি টাকা না পাওয়া যেত তখন তিনি যে সমস্ত খবরাখবর জোগাড় করতেন সেগুলো ফাস করে দিতেন কিংবা এ ব্যাপারে জড়িত কোনো লোককে খবরটা জানিয়ে দিতেন। এর ফলে তার সরাসরি লাভ হত না বটে পরোক্ষভাবে হত, এতে অন্যরা ভয় পেয়ে ঠিকমতো টাকা মিটিয়ে দিত। জ্যাপ বললেন যে এর ফলে খুনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটা ধারণা পেতে পারি। তার পরই প্রশ্ন ওঠে টাকাকড়ি কে পাবে।

থিবো বললেন তার মেযে মাদমোয়াজেল অ্যান মরিসে টাকাটা পাবেন। সে তার মায়ের কাছে থাকতেন না। তার মা তাকে একেবারে ছোট্টবেলার পর দেখেননি, কিন্তু বেশ কয়েক বছর আগের উইলে তিনি সমস্ত সম্পত্তি তার মেয়েকে দিয়ে যান। তার টাকার পরিমাণ আশি নব্বই লক্ষ ফ্রা হবে–যা এক লক্ষ পাউণ্ডের থেকে বেশি। উনি যদি প্লেনের মধ্যে না থাকতেন টাকার লোভে মাকে খুন করার জন্য ওই মেয়েকেই সন্দেহ করা যেত, জ্যাপ বললেন। মেয়েটির বয়স চব্বিশ-পঁচিশ হবে। মেয়েটিকে খুনের ব্যাপারে জড়ানোর কোনো কারণ আছে বলে মনে হচ্ছে না।

জ্যাপের মতে প্লেনের কেউ মিথ্যা কথা বলেছে। সেই লোকটাকে খুঁজে বার করতে হলে মাদাম গিজেলের গোপন নথিপত্র দেখলেই হবে। কিন্তু থিবো বললেন, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে জানা গেছে তার সমস্ত নথিপত্র সিন্দুকে থাকত, সব কাগজপত্র পুড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। তার মৃত্যুর আগে তিনি তার সহকারিণী এলিসকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তার কত্রীর কোনে বিপদ-আপদ ঘটলে সে সিন্দুক খুলবে এবং সিন্দুকের সমস্ত জিনিস পুড়িয়ে ফেলবে। লানের বললেন যে মাদাম থিবো অত্যন্ত ক্রুর ছিলেন কিন্তু অবিশ্বাসের কাজ যারা করত তাদের কাছে। তিনি নিষ্ঠুর ব্যবহার করতেন অবিশ্বাসীদের প্রতি। মেত্র থিবো চলে যাচ্ছিলেন এবং যাবার আগে তিনি আশ্বাস দিলেন যদি আর কোনো খোঁজখবর পাওয়া যায় তাহলে তার ঠিকানা অন্যদের জানাই আছে। এই বলে তিনি চলে গেলেন।

.

০৭.

সম্ভাবনা

মেত্র থিবো চলে যাবার পর অন্য তিনজনের মধ্যে আলোচনা চলতে থাকল। জ্যাপ বললেন, প্রমিথিউস বিমানে ১১ জন যাত্রী ছিলো শুধু পেছনের কামরায়। এই ১১ জন ছাড়া ২ জন পরিচারক। তার মধ্যে একজন নিশ্চয়ই খুন করেছে। ইংরেজের ব্যাপারটা উনি নিজেই দেখবেন। কিন্তু ফরাসি অনুসন্ধান করার কাজ ফার্নের, ফার্নের মতে গ্রীষ্মকালে মাদাম গিজেল ফ্রান্সের উপকূলের নানা জায়গায় যেমন দোভিশ, ল্যাপিনেত, উইমারো প্রভৃতি জায়গায় এলাহি কারবার খুলে বসতেন। দক্ষিণ দিকে অ্যালিটবগ, নাইস এসব জায়গায়। জ্যাপের মতে আসল খুনের ব্যাপারটা জানতে হবে, প্রমাণ করতে হবে বাঁকানল ব্যবহার করার মতো সুবিধাজনক জায়গায় কি ছিলো। প্রথমে একজন যাত্রীকে আলাদাভাবে বেছে নিয়ে যুক্তি প্রমাণ দিয়ে বিচার করা আরও প্রয়োজন–সম্ভাবনার দিকগুলো বিচার করে পোয়ারো মনে করেন তাকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হোক; জ্যাপও এতে গভীরভাবে অসম্মতি জানালেন। পরিচারক দুজনকে সন্দেহের উর্ধে রাখা হল। কারণ তারা দুজন মোটা টাকা ধার নিয়েছিল, তা বিচার্য নয়। কিন্তু সম্ভাবনার কথা বিচার করলে তারা খুন করেছে এটা হতে পারে। এদের পক্ষে এমন জায়গা ঠিক করে বাঁকানল ছোঁড়া যেতেই পারে। ডানদিকের এই কোণটা থেকে। কিন্তু এটা অসম্ভব, কামরাভর্তি সকলের চোখ এড়িয়ে এটা করা সম্ভব নয়। খুনীর পাগলামি ছাড়া আর কিছু নয়। এইরকম ঘটনা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়, খুনীকে আমরা ইতিমধ্যে চার-পাঁচবার ধরে ফেলেছি।

পোয়ারোর মতে এটা পাগলামি হলেও এটা ঠিক যে আর তিনজন যে আলোচনা করছে যে কে খুন করেছে। এটাতে খুনী সফল। তার যুক্তি হল সেই প্রবাদ ফলেন পরিচয়তে, অর্থাৎ খুনী এ ব্যাপারে সফল। পোয়ারো বললেন, আমরা ডাক্তারী প্রমাণ পেয়েছি, অস্ত্রটা আমাদের হাতে রয়েছে। কিন্তু কয়েকদিন আগে ওটা এটা হাস্যস্পদ ব্যাপার হত।

ফার্নের মতে মনস্তত্ব বিচার করতে হবে খুনীর মনস্তত্ব বিষয়ে। জ্যাপের নাম দিয়ে ভোস ভোস শব্দ করলেন অর্থাৎ এ বিষয়ে তার পছন্দ নয় জ্যাপ বললেন, ফার্নের যা সন্দেহবাতিক তাতে এই ঘটনা হওয়া সম্ভব যে ভদ্রমহিলা এইভাবে খুন হননি, কিন্তু ফার্নে এতে অসম্মতি দিলেন, বললেন খুন যে বাঁকা নলের মাধ্যমে হয়েছে এটা ঠিক। জেন গ্রে-কে এরপর সবাই খুন করেছিল বাঁচাকে খুন করার জন্য সাপেরতে খরচ করেছে, তার মানে হতে শতকরা দুজনের আছে কিনা যায় না। এছাড়া সাপের বিষ রহে বুড়াটাকে সন্দেহ করেন। যে মেয়েটি লটারীতে টাকা পেয়ে লা পিনেতে খরচ করেছে, তার মানে মেয়েটি জুয়ারী। কিন্তু মেয়েটি বুড়ীকে খুন করার জন্য সাপের বিষ পাবে কোথা থেকে। সে যে বুড়ীটাকে খুন করেছিল বা টাকা ধার করেছিল তা জানা যায় না। এছাড়া সাপের বিষ ব্যবহার করার জ্ঞান পৃথিবীতে শতকরা দুজনের আছে কিনা সন্দেহ। পোয়ারো বললেন, অমি জিনিসটা এইভাবে দেখছি, খুনী নিশ্চয়ই এই দুই শ্রেণীর যেকোনো এক শ্রেণীতে পড়বে। হয় সে এমন লোক, যে পৃথিবীর সমস্ত বিদঘুঁটে জায়গায় ঘুরে এসেছে, এমন লোক যে সাপখোপ সম্পর্কে কিছু অন্তত জানে এবং অসভ্য উপজাতি লোকেরা তাদের শত্রুদের খতম করার জন্য কতো রকমের সাংঘাতিক বিষ ব্যবহার করে সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, অন্য শ্রেণী হল বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলে গেছোসাপের বিষ যা নিয়ে ভয়ানক উঁচু শ্রেণীর গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। যা উইন্টারশূনের থেকে জানা গেছে। সাপের বিষ, মানে কেউটে সাপের বিষ ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করা হয়, তবে দুটো শ্ৰেণীই গ্রে মেয়েটির সঙ্গে মেলে না। ওর সঙ্গে এ ব্যাপারে যেটুকু সম্পর্ক তাতে খুনের উদ্দেশ্য অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে। বিষ জোগাড় করার সম্ভাবনাও খুবই কম এবং বাঁকানল ব্যবহার করা অসম্ভব!

জ্যাপ বললেন যদি মেয়েটি তার জায়গায় থেকে না উঠে থাকে তাহলে মাদাম গিজেলের ঘাড় তাক করে কাটাটা ছোঁড়া সম্ভব নয়। তাহলে তাকে সন্দেহ থেকে বাদ দেওয়া যেতেই পারে।

নরম্যান গেল উল্টোদিকে ১২ নম্বর আসনে বসেছিল। ওর পক্ষে সাপের বিষ জোগাড় করার সম্ভাবনা বেশি। জ্যাপ বলে চললেন, তার ধারণা নরম্যান এমন জায়গায় যাতায়াত করে যেখান থেকে এই ওষুধপত্র জোগাড় করা সম্ভব, তার হয়তো কোনো বিজ্ঞানী বন্ধু আছে। কিন্তু যুক্তি প্রমাণের কথা বিচার করলে ওকে বাদ দেওয়া যায়। প্রসাধন কক্ষে ফেরার সময় সে মাঝখানে এই পর্যন্ত এই যে দেখুন এর বেশি এগোতে পারে না। আর ওখান থেকে বাঁকানল ছুঁড়ে মহিলার ঘাড়ে কাটা ফুটিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। এবং কাটা তার পোষমানা নয় সেটা বললেই সমকোণে ঘুরে গিয়ে বিধতে পারে না, তিনজন নকশার উপর এটি ঝুঁকে পড়ে দেখছিলেন।

এরপর ১৭ নম্বর আসনে মিসেস ভেনেসিয়ার প্রতি নজর পড়ল। এর পক্ষে মাদাম গিজেলের কাছ থেকে টাকা ধার নেওয়া অসম্ভব নয়। এর প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া উচিত জ্যাপ বললেন, এর আগা থেকে তীর ছোঁড়া সম্ভব। তাহলে মাননীয়া ভেনেসিয়ার পক্ষে কোণাকুণি তীর ছোঁড়া সম্ভব, অবশ্য এতে সফল হওয়া অসম্ভব। কারণ তিনি একজন মহিলা যিনি বন্দুক ছুঁড়তে পারেন, অভ্যাস ঠিক থাকলে খুন করতে পারা যায়। পৃথিবীর অদ্ভুত জায়গায় বিরাট শিকার করার ফলে তার যেসব বন্ধু আছে তাদের থেকে সন্দেহজনক বলে জিনিস জোগাড় করেছেন। ব্যাপারটা আজগুবি মনে হচ্ছে এর পেছনে কোনো যুক্তি নেই। ফার্নে এতে সহমত। তবে তাকে ফার্নে খুনী মানতে রাজী নয়।

লেডি হরবেলি লা পিনেতে জুয়া খেলতে গিয়ে অগাধ টাকা খুইয়েছেন। তিনিও মাদাম গিজেলের মতো ঘুঘু মেরেছিলেন। ফার্নে এই খবর দিলেন। যাতে সকলেই একমত। তিনি নিশ্চয়ই তার সামনের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে ২৩ নম্বর আসন থেকে এই কাজ করেননি। অতএব সন্দেহের তালিকা থেকে ইনিও বাদ।

নয় ও দশ নং আসনে মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো ও ব্রায়ান বসেছিলেন। এরকুল পোয়ারো বললেন, তার পেট ব্যথা করছিল।

এবার সন্দেহ হল ডাঃ ব্রায়ানের উপর। তিনি একজন হোমরাচোমরা ডাক্তার, তিনি ফরাসি মহিলার কাছ থেকে টাকা ধার করবেন এটা মনে হয় না। ডাঃ ব্রায়ানের পক্ষে এ কাজ করা অসম্ভব কিছু নয়। তার বড়ো বড়ো গবেষকদের সঙ্গে চেনাজানা খুব স্বাভাবিক। সেই সূত্রেই তিনি হয়তো সহজেই এক শিশি সাপের বিষ পাচার করেছেন।

পোয়ারো প্রতিবাদ করলেন, বাগানের ঝুমকো ফুল ভোলার মতো নয় এইসব জিনিস! তারা মিলিয়ে রাখেন।

জ্যাপ বললেন মিলিয়ে দেখলেও ক্ষতি নেই। যে কোনো চালাক লোকই ওই শিশির বদলে অন্য একটা ক্ষতিকারক বিষের শিশি রেখে আসতে পারে। একাজ সম্ভব শুধু একটি মাত্র কারণে। কারণ ডাঃ ব্রায়ান একটি মাত্র লোক যাকে কেউ সন্দেহ করতে পারে না, কিন্তু একটা খোচ থেকে যাচ্ছে, তিনি কেন বললেন না যে ব্যক্তির স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি।

পোয়ারোর ধারণা ওটা ছিল ডাক্তারের প্রথম অনুমান। সত্যি কথা বলতে গেলে মনে হয় ব্যাপারটা স্বাভাবিক। সম্ভবতঃ ভীমরুলের কামড়ে…।

না, এই ভীমরুলের কথা আর ভুলবেনা দেখছি। প্রথম থেকে ভীমরুল ভীমরুল করে গেল। পোয়ারো বললেন ঘটনাচক্রে তিনি মেঝে থেকে কাটা কুড়িয়ে পেয়ে বুঝতে পারেন ঘটনাটা খুন। যেভাবেই হোক ঘটনাটা চোখে পড়তেই জ্যাপ বললেন। পোয়ারো বললেন, না এ সম্ভাবনাও ছিলো যে কেউ দেখার আগে কাটাটা তুলে নিত। সে ব্রায়ান বা অন্য কেউ হোক। ওটা দুষ্কর কাজ।

ফার্নে বললেন যে, খুন বলে ঘটনাটা যদি জানতে না পারা যায়, তাহলে কোনো ভদ্রমহিলার হার্ট ফেল হলে, সেই সময়ে কোনো লোক তার গায়ের পাশে একটা রুমাল ফেলে দিয়ে নিচু হয়ে সেটা কুড়িয়ে নেয়, তা কেউ লক্ষ্য করেছে কী।

জ্যাপ এটা মেনে নিলও। তার ধারণা ব্রায়ান সন্দেহজনক ব্যক্তি। একটু চেষ্টা করলেই তিনি মাথা ঘুরিয়ে খুব সহজেই কোণাকুণিভাবে বাঁকানল থেকে তীর ছুঁড়তে পারতেন।

ফার্নে বললেন, এর মধ্যে মনস্তাত্বিক কারণ আছে। যার মতানুযায়ী একটা ঘরে আছেন বলে কেউ যদি সেই সময়ে ছুরি বের করে কাউকে খুন করে, তখন কেউ তাকে লক্ষ্য করবে না।

পোয়ারো বললেন, বিষ খাইয়ে মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এই প্রশ্নটাই উঠেছিল। সেখানেও একটা মনস্তাত্বিক মুহূর্ত ছিল। আমরা যদি আবিষ্কার করতে পারি যে এমিথিউসের প্যারিস থেকে ক্রয়ডন আসার সময়টুকুর মধ্যে এমন কোনো মুহূর্ত এসেছিলো যাতে খুনীর হাত ছিলো, নিশ্চয়ই সে সঠিক চেষ্টার ফলে মুহূর্তটা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল।

জ্যাপ বললেন ৮ নম্বর আসনে ড্যানয়েল মিচেল ক্ল্যাইন্স, যাকে সবচেয়ে সন্দেহ করা যায়। একজন রহস্য কাহিনীকারের চেয়ে আর কার পক্ষেই বা সাপের বিষ নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার, আর কার পক্ষেই বা একজন রসায়নবিদের সঙ্গে জানাশোনা থাকতে পারে, যে সমস্ত সাংঘাতিক জিনিস নিয়ে নাড়াচাড়া করে। ভুলে গেলে চলবে না উনি মাদাম গিজেলের সামনের পাশ দিয়ে একবার পেছনের দিকে গেছিলেন, অতগুলো যাত্রীর মধ্যে একমাত্র ইনিই।

পোয়ারো এটা ভোলেননি বললেন, জ্যাপ বললেন তিনি কাছ থেকে বাঁকানলটা খুঁজতে পারতেন। আর এ ব্যাপারে রেহাই পাবারও যথেষ্ট সুযোগ তার ছিলো, বাঁকানল সম্পর্কে সবকিছুই তিনি জানেন তাই বলেছিলেন তিনি।

একেবারে নির্ভেজাল চতুরতার কাজ, জ্যাপ বললেন, তার সন্দেহ আদালতে যে বাঁকানলটা দেখানো হয়েছে সেটা দু-বছরের পুরানো। একজন মানুষ যে সর্বক্ষণ কেবল খুন-খারাপির কথা ও গোয়েন্দা গল্প নিয়ে জাবর কাটবে এটা আমার ঠিক স্বাস্থ্যকর বলে মনে হয় না। ৪ নম্বর আসনে রাইজ্যার, আসনটা মৃত মহিলার আসনের ঠিক সামনেই, তাকে ছেড়ে দেওয়া যায় না। তিনি একবার প্রসাধন ঘরে গিয়েছিলেন। ফেরার সময় হয়তো খুব কাছ থেকে বাঁকা নলে ফুঁ দিয়েছিলেন। তেমন কোনো অসুবিধা নেই। এই কাজ করার সময় শুধু তাকে এই প্রত্নতত্ত্ববিদদের কাছে পর্যন্ত এলেই চলবে। তারা হয়তো ব্যাপারটা দেখেও থাকবেন কিন্তু কিছু করতে পারেননি।

পোয়ারো বেশ চিন্তিতভাবে মাথা নেড়ে বললেন, প্রত্নতত্ত্ববিদরা যদি নিজেদের মধ্যে মগ্ন থাকবেন তাদের কোনো জ্ঞানই থাকবে না। তারা হয়তো খৃষ্টপূর্ব ৫০০০ বা তারও আগের কোনো সময়ের জগতে চলে গিয়েছিলেন যাদের কাছ ১৯৩৫ সালের অস্তিত্ব ছিল না।

জ্যাপ বলতে চাইলেন তারা সারা পৃথিবীর যতসব বিদঘুঁটে জায়গা চষে নানারকম জিনিস খুঁজে বের করেছেন। তাদের কাছে সাপের বিষ বের করা খুবই সহজ। সন্দেহজনকভাবে মাথা নাড়লেন এবং বললেন তারা আগে প্রাচীন নিদর্শন বিক্রয় করতেন। শুধুমাত্র প্রত্নতত্ত্বের নেশায় ওইরকম একটা জমজমাট ব্যাবসা তুলে দেন। তারা খুন করতে পারেন এটা অসম্ভব তবে মামলার পর সবই বিশ্বাস করা।

জ্যাপ একটা কাগজ টেনে নিলেন যাতে তিনি লিখছেন, জেন গ্রের যুক্তি-প্রমাণ খুব কম, সম্ভাবনা একেবারে নেই। গেল-এর যুক্তি-প্রমাণ খুব কম। সম্ভাবনা একেবারেই নেই। মিস বার বার যুক্তি-প্রমাণ খুব কম, সম্ভাবনা এক্ষেত্রে একেবারেই নেই। লেডি হরবেরিল যুক্তি এখন ভালই-সম্ভাবনা–একেবারেই নেই। ব্রায়ান যুক্তি-প্রমাণ এবং সম্ভাবনা দুটোই বেশ ভালো, রাইজ্যার যুক্তি-প্রমাণ অনিশ্চিত। সম্ভাবনা খুবই ভালা, দুপরা কি উদ্দেশ্য সম্পর্কিত যুক্তি-প্রমাণ, সম্ভাবনা ভালোই।

তিনি বললেন ফ্ল্যানিস ও ব্রায়ানের সম্পর্কে অনুসন্ধান করবেন। রাইজ্যারের ক্ষেত্রেও তাই। উইলসনকে তাদের পেছনে লাগিয়ে দেবো। মঁসিয়ে ফার্নেকে দুপদের দায়িত্ব দেবেন।

ফার্নে বললেন মাদাম গিজেলের সহকারিণী এলিসের কাছ থেকে আর কিছু খোঁজ খবর পাওয়া যায় কিনা তিনি দেখবেন। তিনি লা পিনেত গত গ্রীষ্মে গিয়েছিলেন কিনা তা খবর নেবেন, তার প্রতিটি কাজকর্ম পরীক্ষা করে দেখবেন।

পোয়ারো মঁসিয়ে ফার্নের সঙ্গে প্যারিসে যাবেন বলে ঠিক করেছেন। পোয়ারো একটা কিছু চিন্তা করছিলেন, এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে তিনি বললেন তার আসনের পিছনে যে বাঁকানল লুকিয়ে রাখতেন। কিন্তু পোয়ারোর বক্তব্য–হাওয়া চলাচলের জন্য যে একটা ছোট্ট গর্ত তাতে পাতলা কাঁচ টেনে খোলা-বন্ধ করা যায়। ওই পথ দিয়ে বাঁকানল ফেলে দিয়ে ওর হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায় তা ভালোই। এক্ষেত্রে খুনী ভয় পেয়েছিল বোধ হয়। জ্যাপ বললেন যে কারণেই হোক বাঁকানল তার আসনের পেছনে লুকানো হয়েছিল। পোয়ারো বললেন, ভালো কথা যাত্রীদের মালপত্রের তালিকা করতে বলেছেন, তা মনে আছে? সেটা করেছেন।

.

০৮.

 তালিকা

 জ্যাপ মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বললেন, তিনি যা বলেন তাই করেন। তিনি টাইপ করা একটা কাগজ বার করে বললেন, এই যে আপনার মালপত্র, পোয়ারো কাগজগুলো টেবিলের উপর বিছিয়ে পড়তে শুরু করলেন।

জেমস রাইজ্যার–নাম লেখা লিনেনের রুমাল। মানিব্যাগ–সাতটা এক পাউন্ডের নোট, তিনটে ব্যবসায়িক কার্ড। একটা চিঠি তাতে অংশীদার জাগ এবার ম্যান আশা করেছেন। ধারের টাকার ব্যবস্থা…না হলে আমরা ডুবে যাব, মাও নামে কেউ টেকাভোরের সঙ্গে পরের দিন সন্ধ্যায় দেখা করার কথা লিখেছে। (সাক্ষী কাগজ)। রূপার সিগারেট কেস মোড়া দেশলাই, কলম, একগোছা চাবি, দরজার চাবি, ফরাসি ইংরেজি মুদ্রার কিছু খুচরো পয়সা।

অ্যাটাচি কেস-সিমেন্ট কেনাবেচার কাগজ, একটা কাফ সিরাপ।

ডাঃ ব্রায়ান পকেটে–দুটো লিনেন রুমাল, মানি ব্যাগ, বিশ পাউন্ড এবং ৫০০ গ্রাঃ। কিছু মুদ্রা, সাক্ষাত বই, সিগারেট কেস, কলম, দরজার দাবি আর একগোছ চাবি। বাক্সের মধ্যে বাকি ও স্মৃতিবাহক স্মারক পত্র। নরম্যান গেল–পকেটে সিল্কের রুমাল, মানিব্যাগে একটা ইংরেজি এক পাউন্ডের নোট দুশো ফ্রাঁ, খুচরো পয়সা, দুটো ফরাসি ব্যবসায়িক সংস্থার কার্ড, দুটো দাঁতের যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারকের ব্রায়ান এন্ড যে কোম্পানির দেশলাই বাক্স। লাইটার বনগোলাপ ডালের পাইন, রবারের তৈরি তামাকের ফলে, দরজার চাবি, অ্যাটাচিতে সাদা লিনেনের কোট, দুটো ছোটো ডাক্তারী আয়না, তুলোর বান্ডিল, একটি পত্রিকা স্ট্যান্ড, ম্যাগাজিন, একখানা অটোকার পত্রিকা।

আরম্যান্ড দ্যুপ

 পকেটে মানিব্যাগ একটা, এক হাজার ফ্লা এবং ইংরেজি দশ পাউন্ড। খাপে ভরা চশমা, কিছু ফরাসি খুচরো পয়সা, সুতির রুমাল, সিগারেটের প্যাকেট, মোড়া দেশলাই, এক প্যাকেট তাস, দাঁত খোঁচার কাঠি, অ্যাটাচিতে বয়গলি এশিয়াটিক সোসাইটির ঠিকানা লেখা পাণ্ডুলিপি, জার্মান প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ক বই, মৃৎশিল্পের নকশা আঁকা দুটো খসড়া কাগজ, কারুকার্য করা একটা বেকের থালা। ন-খানা আলোকচিত্র, সবই মৃৎশিল্পের।

জ্যাঁ দ্যুপ

পকেটে মানিব্যাগে ইংরেজি পাঁচ পাউন্ড ও তিনশো ফ্রা, সিগারেট কেস, সিগারেট হোল্ডার, লাইটার, কলম, পেন্সিল (২), ছোটো নোটবই লেখায় ভর্তি, ইংরেজিতে লেখা চিঠি, তাতে ম্যারিয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছে টোটোহান কাছাকাছি একটা রেস্তরাঁয়, ফরাসি খুচরো পয়সা।

ড্যানিয়েল ক্ল্যান্সি– রুমাল, কলম, মানিব্যাগে চার পাউন্ড, একশো ফ্রা, সাম্প্রতিক কয়েকটি অপরাধ বিষয়ক কাগজ থেকে কেটে নেওয়া অংশ থেকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে। দেশের জমিজমা সংক্রান্ত দুটো চিঠি। সাক্ষাৎ বই, চারটে পেনসিল, পেনসিল কাটা ছুরি, তিনটে রসিদ আর চারখানা বিল, গর্ডন-পত্রিকা থেকে একখানা চিঠি–মাথায় লেখা এম. এস. সিনোটের। অসম্পূর্ণ ক্রসওয়াল পাজল-টাইমস পত্রিকা থেকে কাটা, নোট বইয়ের কতগুলো গল্পের বিষয়বস্তুর খসড়া, ইতালি, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ডের কিছু খুচরো পয়সা। কেপলাস–কোনো হোটেলের রসিদ, বিরাট একজোড়া চাবি, ওভারকোটের পকেটে-ভিসুভিয়াস হত্যার রহস্য বইয়ের পাণ্ডুলিপি, আন্তর্দেশীয় রেলের টাইম টেবিল, একটা একজোড়া সোজা টুথব্রাশ, প্যারিসের হোটেলের রসিদ।

মিসকার-হাতব্যাগে লিপস্টিক, পাউডার, দুটি সিগারেট হোল্ডার, সিগারেট কেস, এক জোড়া দেশলাই, রুমাল, দুপাউন্ড খুচরো পয়সা, একটা চাবি।

সাজগোছের বাক্সটা ঘোড়ার চামড়ায় মোড়া। নানারকম শিশি, বোতল, তুলি, বুরুশ, চিরুনি ইত্যাদি নখ পালিশ করার সরঞ্জাম, একটা ছোটো টুথ ব্রাশ, শক্ত, দাঁতের মাজন, সাবান একটা কচি। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের লেখা পাঁচখানা ইংরেজি চিঠি। দুখানা উপন্যাস, দুটো ড্যানিয়েল কুকুরের ছবি। মিস গ্রে-হাতব্যাগে লিপস্টিক, ব্রোজ, পাউডার, একটা দরজার চাবি, তোরঙ্গের চাবি পেনসিল, সিগারেট কেস হোল্ডার, মোড়া দেশলাই, ফরাসি প্রবাদবাক্যের একটা ছোট্ট বই, ছোটো একটা ব্যাগে একশো ফ্রা ও দশ শিলিং ফরাসি এবং ইংরেজি মিলিয়ে কিছু খুচরো পয়সা, নাচের আসরের টিকিট।

কোটের পকেটে–প্যারিসের পোস্ট কার্ড, দুটো রুমাল, সিল্কের মাথায় বাঁধার রুমাল, গ্ল্যাডির একটা চিঠি, এক শিশি অ্যাসপিরিন।

লেডি হরবেরিল-হাতব্যাগে দুটো লিপস্টিক, রুজ, পাউডার, রুমাল, তিনটে নোট, ইংরেজি ছ-পাউন্ড খুচরো পয়সা, একটা হীরের আংটি, ফরাসি ডাকটিকিট, দুটো সিগারেট হোল্ডার বাক্সে জোড়া লাইটার।

 সাজগোছের বাক্সে-সাজসজ্জার এলাহি সরঞ্জাম, নখ রং করার হাজারো উপকরণ। ছোট্ট একটা শিশিতে বোরিক পাউডার।

পোয়ায়োর পড়া শেষ হওয়া মাত্র জ্যাপ বললেন, বোরিক পাউডার না ছাই, এই বোতলের সাদা বোরিক পাউডার নয়–কোকেন।

জ্যাপ বললেন যে একজন মহিলা যদি কোকেন নিয়ে ঘুরে বেড়ান তার মানসিক অবস্থা নিয়ে চিন্তা আছে। পোয়ারো বললেন যে এগুলো পড়ে বোঝা যায় কে খুনী? জ্যাপ বললেন কে খুনী পোয়ারো তা বলতে পারবেন? পোয়ারো বললেন, হ্যাঁ। জ্যাপ বললেন, যে পোয়ারো তাকে বোকা বানাচ্ছেন।

ফার্নের মতে এই তালিকা থেকে বেশি দূর এগোনো যাবে না।

পোয়ারো বললেন যে এই আমলার কিছু বিশেষ জিনিস সঙ্গে মিলিয়ে কিছু বোঝা যাচ্ছে। তিনি বললেন এগুলোর মধ্যে থেকে তিনি কিছু খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ঘটনাটির অনেক কিছু আছে যা তার কাছে অন্ধকারাচ্ছন্ন। কিন্তু তার একটা বিশেষ সন্দেহ আছে।

জ্যাপ বললেন, তিনি লন্ডনের ওদিকে কাজ করবেন। ফার্নেকে প্যারিসে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হলো যেখানে তার সাথে পোয়ারো থাকবেন।

ফার্নে কাল সকালে ক্রয়ডনে দেখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিলেন।

পোয়ারো একটা পত্রিকায় লা পিনেত-এ হরবেরিলর কাউন্টেস এবং মিঃ রেমন্ড ক্যাবেলসা দুটো ছবি দেখলেন। এই সেই পথ ধরে এগোনোর কথা ভাবলেন।

.

০৯.

এলিস গ্রেঞ্জার

সকাল ৮-৪৫ মিনিটে বিমানে পোয়ারো ও ফার্নে প্যারিস চলেছেন। ফার্নে ও পোয়ারো ছাড়া কামরাটায় আরো মাত্র পাঁচ-সাতজন যাত্রী। ফার্নে পকেট থেকে একটা ছোট্ট বাঁশের টুকরো বের করে, বার তিনেক সেটাকে ঠোঁটের কাছে তুলে যে কোনো একটা নিশানা করে বললেন, তার বিভিন্ন ভঙ্গিমা সবসময়েই কোনো না কোনো যাত্রীর মনোযোগ আকর্ষণ করল। শেষবার সত্য বলতে কি, প্লেনের সব লোকের দৃষ্টি যেন তার উপর আটকে গেলো।

ফার্নে নিরুৎসাহ হয়ে ধপ করে বসে পড়লেন। আর পোয়ারোকে বললেন যে, পরীক্ষা করে দেখে নেওয়া ভালো, পোয়ারো এতে একমত। তার এই হাতেকলমের পরীক্ষার ফল হল প্রতিবার কেউ না কেউ তাকে দেখে ফেলেছে। সবাই না হলেও কিন্তু একটা সফল খুনের ব্যাপারে যেখানে সেখানে এটা কার্য নয়। সেক্ষেত্রে যুক্তিযুক্ত ভাবেই নিশ্চিত হতে হবে কেউ আপনাকে দেখতে পাবে না, পোয়ারো বললেন।

ফার্নে বললেন, সেটা সাধারণ অবস্থায় অসম্ভব।

এরকুল পোয়ারো বললেন যে এমন কোনো মনস্তাত্বিক মুহূর্তের সৃষ্টি হয়েছিল যাতে প্রত্যেকের দৃষ্টি অঙ্ক কষে সেদিকে পড়েছিলো।

ইনসপেক্টার জ্যাপ এই বিষয়ে অনুসন্ধান করছেন। মঁসিয়ে পোয়ারো বললেন যে, তার মনে হয় এই ঘটনায় চাক্ষুষ অন্যপথে চালিত হতে পারে, তাই মনের চক্ষু খোলা থোক। মাথার ভেতর ক্ষুদ্র কোষকে কাজের সুযোগ দেওয়া হোক।

ফার্নেকে তিনি বোঝালেন যে আপনার বন্ধু গিরাদ থাকলে আমার পাগলামিতে কান দিত না। এই বলে তিনি কতগুলো অসংলগ্ন কথা বললেন। মিনিট কয়েক পর জানা গেল তিনি চোখ বুজে চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছেন।

প্যারিসে পৌঁছে তারা মাদাম গিজেলের অফিসে এসে পৌঁছলেন। দ্বাররক্ষী পুলিশ দেখে খুব বিরক্ত হলো। ফার্নে গিজেলের অফিসের ঘরে গেলেন। তিনি পোয়ারোকে বুঝিয়ে দিলেন যে ফরাসি পুলিশ প্রথম থেকেই সাবধানতা অবলম্বন করেছেন। এখানে আমাদের কাজে লাগাতে পারে এটা মনে করে তারা সিলমোহর খুলে মাদামের ঘরে ঢুকলেন।

মাদাম গিজেলের অফিসের ঘরটি ছোটো গুমোট, এর কোণে একটা পুরানো আমলের সিন্দুক, বেশ বড়ো গোছের একটা টেবিল আর অনেকগুলো ছোবড়া বের করা গদি আঁটা চেয়ার। একটিমাত্র জানলা তাও মনে হয় কোনদিন ভোলা হয়নি।

পোয়ারোর টেবিলের তলা থেকে একটা থলি বার করলেন যেটা দারোয়ানদের ডাকার জন্য ব্যবহার করা হয়। সেই ঘর থেকে কোনো ব্যক্তিগত জিনিস পাওয়া গেল না।

সিন্দুকটার দিকে নজর দিয়ে বোঝা গেল ওটা ঠিক শক্তসামর্থ নয়। ফার্নে রায় দিলেন ওটা খুব পুরানো আমলের। ওটা যে খালি এবং যেটা তার ঝি করেছে এ সম্পর্কে দুজনে নিশ্চিত। তারা দুজনে ওই সহকারিণীর সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছুক। ফার্নের মতে তিনি কোনো সাহায্য করবেন না। এই ঘরের একটা জিনিস খুব অর্থপূর্ণ।

মিঃ পোয়ারো বললেন, এই ঘরে ব্যক্তিগত কোনো জিনিসের চিহ্নমাত্র নেই। আমার কাছে এটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। মাদাম গিজেলের ভাবালুতা বলে কোনো জিনিস ছিল না।

এলিস গ্রেঞ্জার নামক সহকারিণীর সঙ্গে দুজন দেখা করলেন। তিনি খুব দুঃখপ্রকাশ করলেন এই বলে মাদামকে বিষ দিয়ে খুন করা হয়েছে। তিনি বললেন যতখানি সম্ভব পুলিশকে অবশ্যই সাহায্য করবে। মাদামের কোনো শত্রু আছে যে এ বিষয়ে সে সন্ধিগ্ধ। এলিস রায় দিল টাকা সুদে খাটাবার সূত্রে মাদামের মক্কেলরা মাঝে মাঝে খুব অযৌক্তিক ব্যবহার করত। তারা মাদামকে শাসাত না। তারা গজগজ করে অনুযোগ করে অত টাকা দিতে পারবে না বলে অভিযোগ জানাত। পোয়ারো বললেন মাঝে মাঝে তারা হয়তো টাকা ফেরত দিতে পারত না। এলিস গ্রেঞ্জার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল তারা শেষ পর্যন্ত টাকা দিয়ে দিত। মাদাম গিজেল খুব কড়া লোক নয় ন্যায়কার্য করতেন, এটা এলিসের মত। এলিস অধৈর্য হয়ে উঠল। এখন বলা হল প্রভাবিত মানুষদের তার দুঃখ হয় কিনা। তার মতে নিজের সামর্থ্যের বাইরে যদি কেউ দেনা করে এবং শোধ না দেয় তাতে মাদামের কোনো দোষ নেই। মাদাম নিজের দেনা সসম্মানে মিটিয়ে দিতেন। তাহলে তার পাওনা আশা করাটা বিচিত্র নয়। তার অনেক দয়ামায়া ছিল। তিনি অনেক দাঁতব্য প্রতিষ্ঠানে দান করেছেন। তার মতে, মাদামকে তিনি বোঝেননি।

ফার্নে বললেন যে, মাদাম টাকা আদায়ের কি ব্যবস্থা করেছিলেন তা কি জানেন না। এলিস কিছু বলতে অস্বীকার করায় ফার্নে বললেন যে, তাহলে তিনি ব্যাবসার কাগজপত্র কেন পুড়িয়ে ফেলেছেন। এলিস বলল, মাদামের সেরকম নির্দেশ ছিল যে তিনি দুর্ঘটনায় পড়লে এবং যদি অসুখে পড়ে তাহলে যেন কাগজপত্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পোয়ারো বললেন, নিজের ঘরের সিন্দুকের কাগজপত্র কোথায় গেল। এলিস বোঝাতে চাইলেন ওখানেই কাগজপত্র আছে। কিন্তু সেখানে মোটেই কাগজপত্র ছিল না। সিন্দুকটা বড়ো পুরানো কাঠের কোনো নবীশ ওটা অনায়াসে খুলে ফেলবে। কাগজপত্র বোধহয় মাদামের শোবার ঘরে ছিল।

এলিস বললেন যে হ্যাঁ মাদামের শোবার ঘরে কাগজপত্র থাকত। এলিস শোবার ঘরে গিয়ে একটা তরঙ্গ খুলে একটা পুরানো আমলের পশমের পোশাকের বিরাট পকেটের মধ্যে থেকে বের করে সেখানে কাগজপত্র ছিলো এটা বললেন। ওগুলো একটা বড়ো খামে সীলমোহর করা ছিল।

ফার্নে বললেন, তিন দিন আগে তিনি অন্য সুরে কথা বলেছিলেন কেন।

তিনি বললেন, কাগজগুলো কোথায় ছিল তখন প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়নি।

ফানে বললেন, তার কাগজপত্র পুড়িয়ে দেওয়া উচিত ছিল না। তিনি তাকে বোঝালেন মাদামকে খুন করার পেছনে যারা ছিলেন তাদের কারো সম্বন্ধে ওই কাগজে লেখা ছিল। এলিস নিশ্চয় কাগজগুলো পোড়ানোর সময় চোখ বুলিয়েছে। তিনি যেন আদালতকে সেটা জানান। পুলিশকে যথেষ্ট সাহায্য করবে, হয়তো এর থেকে খুনীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর মতো প্রয়োজনীয় তথ্যও পাওয়া যেতে পারে। তাহলে কি ধরে নেবোকাগজপত্রগুলো হারিয়ে ফেলার আগে সেগুলোয় আপনি একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েছিলেন। এলিস বললেন, তিনি কিছু না দেখে সীলমোহর পর্যন্ত না খুলে সেটা পুড়িয়ে দিয়েছেন।

.

১০.

একটি ছোট্ট কালো মলাটের বই

 ফার্নে একমুহূর্ত তার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তারপর সে মিথ্যে কথা বলছে না বুঝে হতাশভাবে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। তিনি খুব বিশ্বস্ততার কাজ করেছেন এটা বললেও এটা দুঃখের বিষয় জানাতে দ্বিধা করলেন না। ফার্নে মাদাম গিজেলদের মক্কেলদের নাম জিজ্ঞাসা করায় এলিস বললেন, মাদাম কখনো তার মক্কেলদের নাম উচ্চারণ করতেন না। তবে মাঝে মাঝে তার মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ত। তিনি নিজের ব্যাবসা নিয়ে নিজে থাকতেন।

এলিস বললেন…একটা চিঠি এসেছে। মাদাম চিঠিটা খুললেন। একটুকরো হাসি হেসে বললেন, কী বোকা! কী বোকা! ভেবেছে বিনা জামিনেই আমি ওদের টাকা ধার দিয়ে দেব। সঠিক তথ্যই হচ্ছে জামিন বুঝলে এলিস। এরকম কিছু কথা তিনি বলতেন।

মাদামের মক্কেলরা এ বাড়িতে আসতেন তাদের কাউকে তিনি দেখেছেন কি না তা এলিসকে প্রশ্ন করলেন। তিনি বললেন যে মাদামের মক্কেলরা সন্ধ্যাবেলায় আসায় তাদের কাউকে তিনি কখনো দেখেননি, তিনি বললেন ইংল্যান্ড যাবার আগে তিনি প্যারিসেই ছিলেন না, তিনি প্রতিবার সেপ্টেম্বরের মত দোভিল, লা পিনেত, প্যারিস প্লেজ আর উইমারা গিয়েছিলেন। এলিস বললেন যে এবছর মাদামের ব্যাবসা ভালোই যাচ্ছিল। তিনি সকালের টিকিট না পাওয়ায় বেলা ১২টার প্লেনে আসন মিলল। তিনি বললেন অন্যবারের মতো যাবার আগের দিনই তিনি জানতে পারেন মাদাম ইংল্যান্ডে যাচ্ছেন। ফার্নে তার পকেট থেকে সাক্ষীদের ছবি বার করলেন; জিজ্ঞাসা করলেন এদের কাউকে সে চেনে কিনা। এলিস বলল, না, তবে তিনি জর্জেসকে দেখতে বললেন। জর্জেস আবার চোখে দেখতে পায় না। এলিসকে তারা দুজনে কিছু বলতে ভুলে গেছেন কিনা জিজ্ঞাসা করাতে সে বলল, সে সবকিছুই বলেছেন।

মঁসিয়ে পোয়ারো বললেন যে, তিনি কি কিছু খুঁজেছেন, মাদাম গিজেল বা তার পরিবারের কোনো ছবি।

এলিস বললেন, তার কোনো পরিবার ছিল না। পোয়ারো তার মেয়ের কথা জানতে চাইলে তিনি বললেন একটা মেয়ে ছিল। তাকে তিনি খুব ছোটো বয়সে দেখেছিলেন। তারপর আর দেখেননি। এর কারণ হিসেবে তিনি জানান মেয়েটি তার বিবাহের পূর্বের সন্তান। তিনি খুব সন্দরী ছিলেন। বাচ্চাটার একটা বন্দোবস্ত হবার পর, মাদামের জলবসন্ত হয়। তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও বেঁচে ওঠেন এবং সমস্ত ব্যবস্থা করে মাদাম ব্যাবসা নিজে দেখতে থাকেন। তিনি তার সমস্ত সম্পত্তি তার মেয়েকে দিয়ে গেছেন। মাদাম নিঃসঙ্গ ছিলেন। তিনি তার টাকার থেকে খুব কম খরচ করতেন। তিনি বিলাসী ছিলেন না। মাদাম যে তাকেও দয়া করে টাকাপয়সা দিতেন।

ফার্নে যাবার আগে জর্জেস-এর সঙ্গে কিছু কথা বলে যেতে চান। পোয়ারো তখন এলিসকে জিজ্ঞাসা করলেন কে তার কত্রীকে খুন করেছে বলে মনে হয়। তার মনে হয় না কে খুন করেছে বা তার ধারণা নেই, একথা তিনি বললেন। এলিস পুলিশের লোককে অন্য কথা বলতে পারেন এটা বলতে তিনি খুব রেগে যান। পোয়ারো বললেন পুলিশকে খবর দেওয়া এক জিনিস আর কোনো বেসরকারী ব্যক্তিকে বলা এক জিনিস। পোয়ারো বললেন যে তিনি একজনকে যখন সন্দেহ করছেন যতক্ষণ না সন্দেহের অবকাশ হচ্ছে ততক্ষণ সে অপরাধী।

এলিস গ্রেঞ্জার, তাকে সন্দেহ করা হচ্ছে ভেবে ভীষণ রেগে গেলেন। পোয়ারো বললেন মাদামের খুনের ব্যাপারে আপনি প্রত্যক্ষভাবে না হোক, পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছেন। আপনি হয়তো মাদামের ভ্রমণসূচীর যথাযথ বিবরণ কাউকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বললেন তিনি তা করেননি। পোয়ারো বললেন তাকে বিশ্বাস করলেও, তার মতে অপরাধমূলক মামলায় আমরা দেখেছি সাক্ষীদের জেরা করার সময় প্রত্যেকেই কিছু না কিছু গোপন করে।

মঁসিয়ে ফার্নে বললেন যে তিনি একটু মুশকিলে পড়েছেন। তিনি জানেন না কি করলে মাদাম খুশী হতেন। মাদামের বিশ্বস্ততাকে তিনি হারাতে চান না। তার পরলোকগতা কত্রীর পক্ষে বিশ্বাস রেখে বললেন। তিনি বললেন যে মাদাম তার প্রতি খুব সদয় ছিলেন। একথা স্বীকার করতে লজ্জা নেই যে তিনি নিঃসহায় এক মহিলা ছিলেন, যার একটি সন্তান ছিলো, তিনি বাচ্চাটাকে ভালো খামারে মানুষ করতে পাঠান। তখন তিনি মাদাম যে সন্তানের মা সেটা বলেন, এবং আরো বলেন যে ছোট্ট মেয়েটির জন্য তিনি ভালো ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সে হয়তো কোনো ভালো ব্যাবসা বা পেশায় লেগে যাবে। তাছাড়া মাদামের মৃত্যুর পর সব টাকাকড়ি সেই পাবে। তার ধারণা মতো শিশুটির বাবা একজন ইংরাজ নির্দিষ্ট কিছু নয়। তবে এলিস মনে করেন মাদামের ব্যবসায়িক লেনদেনে তিনি ইংরাজ সমাজের উঁচুতলার লোকদের বেশি শোষণ করতেন।

এলিস বললেন তার মেয়ে পাঁচবছর হলো মারা গেছে। তিনি কয়েক মিনিট পর একটা ছোটো নোটবই দিলেন। যেটা মাদামের একান্ত দরকারী ছিল। তিনি চলে যাবার পর এলিস সেটা খুঁজে পান। মাদামের কোন নির্দেশ না থাকায় সেটাকে তিনি পুড়িয়ে ফেলতে পারেননি। এলিস যখন মাদামের মৃত্যু সংবাদ শুনলেন এটা জানতে চাইলে। এলিসকে বললেন যে তিনি মারা যাবার পর পুলিশের কাছে তিনি কাগজ পোড়ানোর কথা স্বীকার করলেও তিনি অনেক পরে ওগুলো পোড়ান। তিনি বললেন যে পোয়ারো, যেন একথা পুলিশকে না বলেন। এলিসকে পোয়ারো বললেন যে মাদামের কাগজ পুড়িয়ে তিনি ভালো মন নিয়েই কাজ করেছেন।

সেই নোটবইটা মাদামের ব্যক্তিগত স্মারকলিপি, ওতে মাত্র কয়েকটা সংখ্যা লেখা আছে। উপযুক্ত দলিল ও ফাইলপত্র ছাড়া সংখ্যাগুলো একেবারে অর্থহীন–এটা, এলিস বললেন।

নোটবইতে সময়, স্থান, যোগাযোগ করার কথা লেখা ছিল। এলিসের মত ছিল এটা প্রয়োজনীয় নয়। কিন্তু এটা খুব মূল্যবান জিনিস মনে হল মিঃ পোয়ারোর কাছে। এলিসের অভিমত নিয়ে তিনি এই ডায়েরিটা পুলিশের হাতে তুলে দিতে বলেন এবং এটাও বলেন যে তাকে যেন পুলিশ কোনো দোষারোপ না করেন এটা যেন তিনি দেখেন।

মাদামের আসন সংরক্ষণের জন্য তখন এলিস যে ইউনিভার্সাল এয়ারলাইন্সের অফিসে ফোন করেছিলেন সেটা যে ২৪ ক্যপুনিকাস বুলেভার্ডে তার ছোট্ট নম্বরটা পোয়ারো লিখে রাখেন।

.