৫. সিনেটের সিভিল সার্ভিস

সিনেটের সিভিল সার্ভিস পেনশনের এনকোয়ারি কমিটিতে কাজ করছে ইসাবেলা। পরের মাসে প্রমাণ সংগ্রহের জন্য তাই আরো দু’জন সদস্যসহ ট্রান্সভ্যাল যেতে হল। জোহানেসবার্গে হোলি এবং গ্যারির বাসায় উঠে সকালবেলা ফোন করল অ্যারনের কাছে।

 ছোট্ট একটা রেস্টোরেন্টে দেখা করল দু’জনে। ক্রেফিস আর ককটেল খেতে খেতে হালকা চালে জানাতে চাইল নিউক্লিয়ার রিসার্চ ইনস্টিটিউড সম্পর্কে।

“ওহ, আর বলো না। সবকিছু আসলেই অনেক বোরিং। এন্টি পার্টিকেল আর প্রাথমিক সব কণা হাসতে হাসতে এড়িয়ে যেতে চাইল অ্যারন।” তুমি জানো কোয়ার্ট নামটা জেমস জায়েসের উক্তি থেকে এসেছে, “থ্রি কোয়ার্কস ফর মাস্টার মার্ক, কোয়ার্ট বলা উচিত আসলে।”

“বাহু, বেশ মজা তো।” টেবিলের নিচে অ্যারনের উরুতে হাত রাখল বেলা; অ্যারনও হাত ধরল, “তোমার কাজ নিশ্চয়ই বেশ কঠিন?”

“হ্যাঁ, তা বলতে পারো।” কয়েক ইঞ্চি উপরে উঠে গেল অ্যারনের আঙুলগুলো।

“হুম, বুঝতে পেরেছি।” চোখ বড় বড় করে ফেলল বেলা, “ডিনারের পর ডান্স করবে?”

“তার বদলে কফি খেতে আমার অফিসেও যেতে পারি।”

“আমার আসলে তেমন ক্ষিধে নেই। ক্রে ফিস্ খেয়েই পেট ভরে গেছে। পরের কোর্সটা বাদ দেই। কী বলো?”

“ওয়েটার, বিল প্লিজ।”

পোলিনডাবাতে কম্পাউন্ডের ভেতরে অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকে অ্যারনের ফ্ল্যাট আছে। ফ্যাসিলিটির মেইন রিসার্চ আর রিঅ্যাকটর এরিয়ার মতো এখানে সিকিউরিটি তেমন কড়া না হলেও ভিজিটর বুকে সাইন করতে হল বেলা’কে। তাকে’ও ভিজিটর পাশ দিয়ে দিল গার্ড।

বহুদিন পুরুষ সঙ্গ থেকে বঞ্চিত বেলা’কে তৃপ্ত করে দিল অ্যারন। প্রথমে খানিক ভদ্র আচরণ করলেও বেলা’র আকাঙ্ক্ষা টের পেয় সে নিজেও বেশ তৎপর হয়ে উঠল।

শীর্ষ সুখের সন্ধিক্ষণে জানতে চাইল তৃপ্ত বেলা :

“তোমার রাশি কী?”

 “বৃশ্চিক।”

“আহ্, সে জন্যেই-বৃশ্চিক রাশির জাতকেরা প্রেমিক হিসেবে অসাধারণ। কোন দিন?

“সাতই নভেম্বর।”

ডিম আর হাসি দিয়ে সকালবেলা একসাথে ব্রেকফাস্ট সারল দুজনে। অ্যারনের পাজামা পরে ওকে অফিসের জন্য বিদায় জানাল বেলা।

“মেইন গেইটের গার্ডের সাথে আমি কথা বলে নেব। তৈরি না হওয়া পর্যন্ত বের হতে হবে না।” বেলা’কে কিস করল অ্যারন, “আর যদি লাঞ্চ পর্যন্ত ও থেকে যাও, আমি কিছুই মনে করব না।”

“নাহ, উপায় নেই।” মাথা নাড়ল বেলা। “আজ আমার অনেক কাজ।”

অ্যারন চলে যেতেই ভালভাবে দরজা আটকে দিল বেলা। স্টাডিতে সেটা আগেই দেখেছে। এটাকে লুকিয়ে রাখার কথা কেউ ভাবেইনি। অ্যারনের ডেস্কের পাশে চৌকানো একটা বাক্সের গায়ে ছয় সংখ্যার কম্বিনেশন ল।

হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়ল বেলা।

 “নভেম্বরের সাত তারিখ” বিড়বিড় করে আপন মনেই হিসাব করে নিল,

“আর বয়স তেতাল্লিশ কিংবা চুয়াল্লিশ। তার মানে ১৯৩১ কিংবা ১৯৩২

 চারবারের চেষ্টাতে ক্লিক করে ভাগ্য খুলে গেল।

“সত্যিকারের ব্রিলিয়ান্ট লোকগুলো কেন এত বোকা হয়?” হেসে ফেলল বেলা। তবে পুরু স্টিলের দরজাটা খোলার আগে সিলের গায়ে আঙুল বোলালো বেলা। একপাশে ছোট্ট একটা সেলোটেপ। “নাহু একেবারে বোকা তো নয়।”

 বোঝাই যাচ্ছে যে অ্যারন বাসাতেই কাজ করতে পছন্দ করে। ফাইলগুলো সুন্দরভাবে গোছানো আছে। বেশির ভাগই অবশ্য আর্মসকোরের পরিচিত সুবজরঙা ফাইল।

মাদ্রিদ এয়ারপোর্টে লাল গোলাপকে এই অ্যাসাইনমেন্ট দেবার পর থেকে নিউক্লিয়ার উইপন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছে বেলা।

লণ্ডনে বাড়তি দু’দিন কাটিয়েছে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের রিডিং রুমে পড়াশুনা করে। ছাত্রাবস্থায় করা লাইব্রেরি কার্ড ব্যবহার করে জোনে গেছে বুদ্ধিমান মানুষের তৈরি সবচেয়ে ভয়ংকর অস্ত্র সম্পর্কে সবকিছু।

 স্তূপের সবচেয়ে উপরের সবুজ ফাইলটাতে হাইয়েস্ট সিকিউরিটি ক্লিয়ারান্সের স্ট্যাম্প লাগানো হয়েছে। আটটা কপির মধ্যে এটা হলো চতুর্থ। ক্লিয়ার্যান্সের মাঝে ডিফেন্স মিনিস্টার, বিভিন্ন বিজ্ঞানি, অ্যারনসহ ওর বাবার নামও আছে।

সবুজ কাভারের উপরে কোড় নেইমের জায়গায় লেখা আছে, প্রজেক্ট স্কাইলাইট”। খুব সাবধানে ফাইলটাকে তুলে নিল বেলা; খেয়াল রাখল যেন সেইফের অন্য কোনো কিছুর ক্ষতি না হয়। নিজের থিসিসের ম্যাটেরিয়াল জোগাড় করার সময়েই দ্রুত পড়ার টেকনিক বের করে নিয়েছিল বেলা আর আজও কাজে লাগল সেই বিদ্যা।

 বেশিরভাগ অংশই অবশ্য বেশ দুর্বোধ্য ঠেকল; যার কিছুই সে বুঝতে পারল না। তবে এটা বুঝতে পারল যে পোলিনড়াবা’র প্রগ্রেস সম্পর্কে এখানে সিরিজ আকারে রিপোর্ট লেখা হয়েছে।

কালানুক্রমিকভাবে সাজানো রিপোর্টগুলো পড়ে শেষ পৃষ্ঠায় যাবার আগেই জেনে গেল যে প্রায় তিন বছর আগেই সফলতা নিশ্চিত হয়ে গেছে আর এজন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ইউরেনিয়াম ২৩৫ প্রস্তুত করা হয়েছে প্রায় ২০০ এক্সপ্লোসিভ ২০৬ ডিভাইস তৈরি করার জন্য যার প্রায় ৫০ কিলোটন ওজন হবে। এগুলোর বেশির ভাগই চলে যাবে ইস্রায়েলের কাছের। কেননা ইস্রায়েল টেকনিক্যাল সহায়তা ছাড়াও ইউরেনিয়াম উৎপাদনে সাহায্য করেছে। তথ্যটা হজম করতে খানিক সময় নিল বেলা। বিশ কিলোটনের হিরোশিমা বোমা এগুলোর কাছে। কিছুই না।

ফাইলটাকে একপাশে রেখে পরেরটাতে হাত দিল বেলা। ঠিকঠাক জায়গামতো ফাইলগুলোকে রাখতে গিয়ে রীতিমতো ঘাম ছুটে যাচ্ছে। প্রজেক্ট স্কাইলাইটের মূল উদ্দেশ্য হল এমন সব ট্যাকটিক্যাল নিউক্লিয়ার অস্ত্র বানানো যেন এয়ারক্রাফট কিংবা গ্রাউন্ড আর্টিলারি উভয় স্থান থেকেই সেগুলোকে নিক্ষেপ করা যায়। রিপোর্টে জিফাইভ ক্যাটাগরির নিউক্লিয়ার উইপন তৈরিতে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

নিউক্লিয়ার উইপনের মূল নীতিটা তো সবারই জানা। তারপরেও রিপোর্ট গুলো পড়তে পড়তে উত্তেজিত হয়ে নোট নিতে লাগল ইসাবেলা। নিজেকে যেন এই ডেভেলপমেন্ট টিমেরই একজন মনে হচ্ছে। বেশ কয়েকবার এই বিশাল কাজের মাঝে খুঁজে পেল বাবা’র প্রভাব; যাতে চূড়ান্তভাবে সফল হতে চলেছে এহেন গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট।

ফাইলের শেষ রিপোর্টটাতে মাত্র পাঁচদিন আগের তারিখ দেয়া আছে। দ্রুত একবার পড়ে নিয়ে আবারো রিপোর্টটা পড়তে শুরু করল বেলা।

আজ থেকে দুই মাসেরও কম সময়ের মাঝে প্রথমবারের মতো পরীক্ষা করা হবে দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বপ্রথম নিউক্লিয়ার অ্যাটোমিক বোমা।

“কিন্তু কোথায়?” মরিয়া হয়ে উত্তর খুঁজে চলেছে বেলা, পরের ফাইলটাতেই অবশ্য পেয়েও গেল।

ফাইলগুলোকে ঠিকঠাক জায়গা মতে রেখে দিয়ে সেলোটেপ আটকে কম্বিনেশনের সিকোয়েন্স ঠিক করে উঠে দাঁড়াল বেলা।

***

টেস্ট সাইট খুঁজতে গিয়ে পণ্ড হতে বসেছে মূল্যবান দুটো বছর। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে যেন রেডিও অ্যাকটিভের কারণে কোনো ক্ষতি না হয়।

অ্যান্টর্কটিকার গাফ দ্বীপে দক্ষিণ আফ্রিকার আবহাওয়া অফিস থাকলেও ধোপে টিকল না এ আইডিয়া। কেননা অন্যেরা নাক গলাতে পারে। বিশেষ করে

অস্ট্রেলিয়া পৃথিবীর পাদদেশে অবস্থিত এই মহাদেশটাকে বেশ মায়া করে।

নিরাপত্তার খাতিরে তাই দক্ষিণ আফ্রিকার আকাশ সীমা কিংবা এর মাটিতেই যা করার করতে হবে। তবে এরিয়াল টেস্টের চিন্তাও বাদ দিতে হল। কেননা উপর থেকে ঝড়ে পড়া আবর্জনা আত্মহত্যার সামিল হবে।

অবশেষে সবাই একত্র হলো আন্ডারগ্রিউন্ড টেস্ট করতে। দক্ষিণ আফ্রিকার সোনার খনিগুলোই পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরে অবস্থিত। ষাট বছর ধরে দক্ষিণ আফ্রিকানদেরকেই ডিপমাইনিং কৌশলের অগ্রদূত ধরা হয়। ডিপ ড্রিলিংকে তারা প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে।

ওরিয়ন এক্সপ্লোরেশন নামক ড্রিলিং কোম্পানির মালিক হলো কোর্টনি এন্টারপ্রাইজ। ওরিয়নের বুড়ো যাদুকরের দল মাটির নিচে দুই-মাইল পর্যন্ত গত করে তুলে আনতে পারে রাশি রাশি পাথর। গর্তকে সোজা কিংবা যে কোনো দিকে বাঁকাতেও এরা খুবই ওস্তাদ। অথবা দেড় মাইল গর্ত খুঁড়ে পয়তাল্লিশ ডিগ্রি বেঁকে যেতেও এদের জুড়ি মেলা ভার।

আজ, রৌদ্রস্নাত চমৎকার ঝকমকে দিনটাতে টেস্ট সাইটে দাঁড়িয়ে গভীর শ্রদ্ধা ভরে এই অবিশ্বাস্য দক্ষতার নিরীক্ষণ করছেন শাসা কোর্টনি।

আধুনিক কালের ফায়ার ইঞ্জিনের মতো দেখতে একটা ট্রাকে বসানো হয়েছে পুরো পাওয়ার প্ল্যান্ট। আরেকটা ট্রাকে কন্ট্রোল রুম আর ইলেকট্রনিক মনিটরিং ইকুপমেন্ট রাখা হয়েছে। তৃতীয়টাতে আছে সত্যিকারের ড্রিল আর বেসপ্লেট। চতুর্থটাতে হাইড্রলিক লিফট আর ক্রেন।

ড্রিল সাইটের চারপাশে জড়ো হয়েছে ক্যারাভ্যান আর সাপ্লাই ট্রাকের বহর। আশেপাশের বহু একর নিয়ে ছড়িয়ে রাখা হয়েছে রড। রাত হলে পুরো এলাকায় জ্বলে উঠে নীল সাদা-আলো। ঘড়ির কাটা ধরে এগিয়ে চলেছে পুরো কাজ। কাজটা শেষ হলে প্রায় বলা যায় পানিতেই ডুবে যাবে পুরো তিন কোটি ইউ এস ডলার।

টুপি খুলে হাত দিয়ে ভ্রু’র উপরে মুছলেন শাসা। কালাহারি মরুভূমির এ অংশে আজ বেশ গরম পড়েছে।

নিচু আর ছোট ছোট লাল বালিয়ারীগুলোকে দূর থেকে মনে হচ্ছে সমুদ্রের ঢেউ। শুকিয়ে রূপালি হয়ে আছে মরুভূমির ঘাস। সবচেয়ে কাছের গাছটাতে বাসা বেঁধেছে বাবুই পাখির দল। শত শত জোড়া মিলে তৈরি করেছে এ কলোনি। প্রতি জোড়ার জন্য আছে পৃথক খোপ আর সবাই মিলে প্রতিবছর এর রক্ষণাবেক্ষণও করে। অরেঞ্জ রিভারে উপিংটনের কাছে এরকমই একটা বাসায় শত বছর ধরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরভাবে বাস করছে বাবুই পাখির ঝাঁক।”

 কোর্টনি মিনারেল এক্সপ্লারেশন কোম্পানির মালিকানাধীন ১ লক্ষ ৫০ হাজার একর জমির পুরোটাতেই বেড়া দিয়ে ঘিরে পাহারা বসানো আছে। এখানেই চলছে ড্রিলিং-এর কাজ। কোম্পানির বাইরের কেউ কখনোই এখানে আসতে পারে না-যদি কেউ এসেও পড়ে….তাহলে শুরু হবে আরেকটা ড্রিলের কাজ।

আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকালেন শাসা। মেঘের কোনো ছিটেফোঁটাও নেই। কালাহরির এই অংশ সংরক্ষিত সামরিক এলাকা হওয়াতে কর্মাশিয়াল কিংবা প্রাইভেট কোনো ধরনের এয়ারক্রাফটই উড়তে পারে না। দক্ষিণে মাত্র কয়েকশ মাইল দূরে অবস্থিত কিম্বার্লি আর্টিলারী আর ট্যাঙ্ক স্কুল প্রায়ই এখানে সামরিক মহড়া বসায়।

তারপরেও উদ্বেগে আছেন শাসা। ডি মাইনাস এইট। শনিবার সন্ধ্যায় বিজ্ঞানীদের দল আর রোমানকে নিয়ে ভারী কনভয় রওনা হয়ে যাবে পেলিনডাবা থেকে, পৌঁছবে রবিবার দুপুরে। তার আগেই গর্তটা তৈরি হওয়া চাই।

সোমবার সন্ধ্যার ভেতরে গর্তে বসানো হবে টেস্ট বোমা। কেপটাউন থেকে ডিফেন্স মিনিস্টার আর জেনারেল মালান ডি মাইনাস ওয়ানে ফ্লাই করবেন।

মাথা নাড়লেন শাসা। “নাহ, সবকিছু তো সুন্দর মতই এগোচ্ছে।”

চিফ ড্রিলিং ইঞ্জিনিয়ার গত বারো বছর ধরেই কাজ করছে ওরিয়নে। শাসা’কে মোবাইল কন্ট্রোল রুমের সিঁড়িতে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিল লোকটা।

“সব কেমন চলছে মাইক?”।

“জবরদস্ত, মিঃ কোর্টনি!” খুশি খুশি গলায় জানাল চিফ ইঞ্জিনিয়ার, “আজ সকালে নয়টায় তিন হাজার মিটারের মার্ক ছুঁয়েছি আমরা।”

ডিসপ্লে স্ক্রিনে পুটটাকে ইশারায় দেখাল মাইক। বিস্ফোরণ গিলে খেতে সাহায্য করবে এই লাইন।

“আমি তোমাকে বিরক্ত করবনা।” লোকটার পাশে বসলেন শাসা, “তুমি কাজ করে যাও।”

 আবারো, পূর্ণ মনোযোগে কন্ট্রোল কসসোল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল মাইক।

চরুট ধরিয়ে নিলেন শাসা আর কল্পনার চোখে স্টিলের একটা কীটকে মাটির গভীর নেমে যেতে দেখলেন-একেবারে ম্যাগমা পর্যন্ত নেমে যাচ্ছে পোকাটা। যেখানে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাসা বাড়িতে ব্যবহৃত ওভেনেরই সমান।

কন্ট্রোল রুমে ফোন বেজে উঠল, কিন্তু আপন কল্পনায় বুঁদ হয়ে আছেন শাসা। জুনিয়ার টেকনিশিয়ান তাই দু’বার ডাকার পর সাড়া দিলেন মিঃ কোর্টনি।

“কে জিজ্ঞাসা করে মেসেজ রেখে দাও।” খানিকটা বিরক্ত হলেন শাসা।

 “মিঃ ভরসটার স্যার।”

 “কোন মিঃ ভরসটার?”

“প্রধানমন্ত্রী স্যার; ব্যক্তিগত লাইনে আছেন।”

ছোঁ মেরে রিসিভার টেনে নিলেন শাসা। হঠাৎ করেই অমঙ্গলের আশংকায় কেঁপে উঠল বুক।

“জ্যা, ওম জন?”

“শাসা গত এক ঘণ্টায় নিজ নিজ সরকারের পক্ষে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে ব্রিটেন, আমেরিকা আর ফরাসি কূটনীতিকগণ।”

“কেন?”

“আজ সকাল নয়টায় একটা আমেরিকান স্যাটেলাইট ড্রিল সাইটটার ছবি তুলে ফেলেছে। আমরা তো গভীর গাঁজায় পড়ে গেলাম! ওরা কোনো না কোনো ভাবে স্কাইলাইট সম্পর্কে জানতে পেরে দাবি করছে এখনি যেন এই টেস্ট বন্ধ করা হয়। কেপ টাউনে ফিরতে তোমার কতক্ষণ লাগবে?

 “স্ট্রিপে আমার জেট পঁড়িয়ে আছে। চার ঘণ্টার ভেতরে আপনার অফিসে পৌঁছে যাবো।”

“ফুল কেবিনেট মিটিং ডেকেছি, তুমি ওদেরকে ব্রিফ করবে।”

“ঠিক আছে।”

জন ভরসটারকে আর কখনো এতটা উদ্বিগ্ন আর রেগে যেতে দেখেননি। শাসা। হাত মেলানোর সময় তো রীতিমতো গর্জন করে উঠলেন, “তোমার সাথে যখন কথা বলছি তখন নিরাপত্তা পরিষদে জরুরি সভা বসিয়েছে রাশানরা যদি টেস্ট অব্যাহত রাখি তাহলে জোরপূর্বক স্থগিতাদেশেরও হুকমি দিয়েছে।”

 “আমেরিকান আর বিট্রিশরাও সতর্ক করে দিয়েছে যে টেস্ট করলে আমাদের হয়ে ভেটো দিতে পারবেনা।”

“আপনি কিছু স্বীকার করেননি তো মিঃ প্রাইম মিনিস্টার?”

 “আরে নাহ মাথা খারাপ।” ঘেউ ঘেউ করে উঠলেন ভরসটার।

“কিন্তু ওরা সকলেই ড্রিল সাইট দেখতে চায়। তাদের কাছে এরিয়াল ফটোগ্রাফ আছে-এমনকি কোডনেইমটাও জানে স্কাইলাইট।”

 “আমাদের কোড জানে?” হা হয়ে তাকিয়ে রইলেন শাসা। মাথা নাড়লেন ভরসটার।

“হ্যাঁ”

“আপনি বুঝতে পারছেন এর মানে কী? কেউ একজন বিশ্বাসঘাতকতা করেছে-একেবারে টপ লেভেলের কেউ।”

***

জাতিসংঘ তৃতীয় বিশ্ব আর জোট নিরপেক্ষ দেশগুলোর প্রতিনিধিরা একের পর এক উঠে দাঁড়িয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার নিন্দা জ্ঞাপন করল। অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রধান মন্ত্রীর নিশ্চয়তা সত্ত্বেও গ্রেট ব্রিটেন আর ইউনাইটেড স্টেটস এর কূটনীতিকেরা ব্যক্তিগতভাবে দেখতে চাইল টেস্ট সাইট। তবে তারা পৌঁছানোর আগেই সরিয়ে ফেলা হয়েছে সব যন্ত্রাংশ।

“ড্রিলিং এর উদ্দেশ্য কী ছিল” এনিয়ে কয়েকবার শাসা’কে প্রশ্নটা করলেন ব্রিটিশ কূটনীতিক।

“তেল অনুসন্ধান।” সরাসরি লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলেন শাসা।–কুঁচকে তাকালেও আর কোনো মন্তব্য করলেন না স্যার পার্সি। যাই হোক তিনদিন পরে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবিত নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে ভেটো দিল ব্রিটেন। আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে এলো ঝড়।

 ইস্রায়েলের উদ্দেশ্যে রওনা হবার আগে ইসাবেলাকে ফোন করল অ্যারন ফ্রাইডম্যান। গো ধরল বেলাও যেন ওর সাথে যায়।

“তুমি অনেক লক্ষ্মী, অ্যারন।”

জানালো ইসাবেলা। “কিন্তু আমাদের দুজনের জীবনধারাই ভিন্ন। হয়তো অন্য কোনো একদিন আবার আমাদের দেখা হবে।”

“আমি তোমাকে কখনো ভুলবো না। বেলা।”

দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটে ফর স্টেট সিকিউরিটি সাড়াশি অভিযান চালানো বিশ্বাসঘাতকের খোঁজে। কিন্তু মাস পার হয়ে গেলেও কিছুই না পেয়ে ধরে নেয়া হল যে দেশ ছেড়ে যাওয়া চারজন ইস্রায়েল বিজ্ঞানীদের কেউ একজন নিশ্চয়ই এমনটা ঘটিয়েছে।

তদন্তের গোপন রিপোর্টটা পড়ে অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন শাসা; জানতে পারলেন তার আদরের কন্যাও একরাত কাটিয়ে এসেছে পেলিনডাবাতে।

“ওয়েল, তুমি নিশ্চয় ভাবোনি যে বেলা এখনো কুমারী নাকি? সেনটেইন চাইলেন ছেলেকে সান্তনা দিতে।

“নাহ, সেটা না।” স্বীকার করলেন শাসা। “তারপরেও এমনটা হবে ভাবিনি।”

“বেলা হয়তো একটা চেঞ্জও চেয়েছিল।”

 “যাই-হোক, ভালই হয়েছে যে প্রফেসর-ব্যাটা চলে গেছে।”

“কিন্তু একেবারে খারাপ ছিল না।” খোঁচা দিলেন সেনটেইন।

 স্তব্ধ হয়ে গেলেন শাসা।

 “কী বলছ, লোকটার বয়স জানো?”

 “বেলা’রও ত্রিশ চলছে। প্রায় বুড়ি।”

“সত্যি?” বিস্মিত হয়ে গেলেন শাসা, “বছর যে কোথা দিয়ে কেটে যায়।”

“ও’কে এখনই একটা হাজব্যান্ড খুঁজে দেয়া উচিত।”

 “এত তাড়াহুড়ার তো কিছু নেই।” মেয়েকে হারাতে চান না শাসা, মন চাইছে সব এভাবেই চলুক যেভাবে চলছে।

***

খুব দ্রুত পুরস্কার পেয়ে গেল ইসাবেলা। মাসখানেকের ভেতর নিকি’র সাথে হলিডে কাটানোর অনুমতি পেয়ে গেল। ওকে আরো জানানো হলো যেন দুই সপ্তাহের ছুটি নিয়ে নেয়; দেশের বাইরে কাটানোর জন্য।

 “দুই সপ্তাহ!” আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল বেলা, “উইদ মাই বেবি! আমারতো বিশ্বাসই হচ্ছে না।”

এক ফুয়ে উড়ে গেল সব অপরাধবোধ। স্কাইলাইট দুনিয়াতে হেডলাইন হয়ে যাওয়ার পর নিজেকে এই বলে সান্তনা দিয়েছিল যে মানবজাতিকে বড় একটা হুমকির হাত থেকে বাঁচিয়েছে ওর বিশ্বাসঘাতকতা।

পরিবারের সদস্যদের সাথে কিংবা পার্লামেন্টে অন্য সিনেটরদের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করার সময় দেশপ্রেমের ফুলকি ছোটালেও গভীর গোপনে ঠিকই জানে-বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

নানা আর শাসা’কে জানালো যে হ্যারিয়েট ব্যচ্যাম্পের সাথে দেখা করতে জুরিখ যাচ্ছে। কম্বি ভাড়া করে দুই সপ্তাহ সুইজারল্যান্ডে কাটানোর কথা এই বলে শেষ করল যে,

“ফিরে আসার আগে আর কোনো সংবাদ আশা করো না।”

 “তোমার কাছে প্রয়োজনীয় অর্থ আছে?” জানতে চাইলেন শাসা।

“অহেতুক বাজে বকো না তো বাবা-” শাসা’কে কিস করে বেলা জানাল, “আমার ট্রাস্ট ফান্ড তত তুমিই করে দিয়েছ, সিনেটের ডাবল বেতন দিচ্ছ।”

“তারপরেও লুজানের ক্রেডিট সুইসের একজনের দাম দিচ্ছি, যদি প্রয়োজন পড়ে”

“ইউ আর সো সুইট, কিন্তু আমি তো কিশোরী নই আর!”

“মাঝে মাঝে মনে হয় তা হলেই ভাল হত, মাই লাভ।”

 জুরিখের উদ্দেশ্যে সুইস এয়ারফ্লাইট ধরলেও নাইরোবিতে নেমে গেল বেলা। নরফোক হোটেলে চেক ইন করে নানা’কে ফোন করল; ভান করল যেন জুরিখেই আছে।

“হ্যাভ ফান আর চোখ-কান খোলা রেখো যদি কোনো মিলিওনিয়ারকে পাকড়াও করতে পারো।”

“তোমার জন্য নানা?”

 “তোমার বয়সও তো কম হলো না মিসি”।

নির্দেশ মতো এয়ার কেনিয়া ফ্লাইটে চড়ে জামিয়ার লুসাকা’তে চলে এলো বেলা। এয়ারলাইন বাস ধরে পৌঁছে গেল রিজওয়ে হোটেল।

ডিনারের আগে সুইমিং পুল টেরাসে বসে জিন আর টনিকের অর্ডার দিল বেলা। কয়েক মিনিট পরে সুদর্শন আর কৃষ্ণাঙ্গ এক তরুণ এলো তার টেবিলে।

“লাল গোলাপ?”

“বসুন।” মাথা নাড়লেও ধুপধুপ করে উঠল বুক, ঘামতে লাগলো হাতের তালু।

“আমার নাম পল।” ড্রিংকের অফার প্রত্যাখ্যান করে বলে চলল কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ, “প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো রকম বিরক্ত করব না আপনাকে। কাল সকাল নয়টার মাঝে রেডি হতে পারবেন? হোটেলের সদর দরজায় ট্রান্সপোর্টে দেখা করব।”

“কোথায় নিয়ে যাবেন?”

“আমি জানি না।” উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল তরুণ, “আর আপনিও জানতে চাইবেন না।”

পরদিন কথামতো তৈরি হয়ে গেল বেলা। দোমড়ানো একটা ভক্সওয়াগানে করে ওকে এয়ারপোর্টে ফিরিয়ে নিয়ে এলো সুদর্শন কৃষ্ণাঙ্গ। কিন্তু কর্মাশিয়াল টার্মিনাল ছাড়িয়ে গাড়ি এগিয়ে গেল সংরক্ষিত সামরিক এলাকার দিকে।

 ঝাঁ ঝাঁ রোদের মাঝে অ্যাপ্রন পরে দাঁড়িয়ে আছে জাম্বিয়ার অবশিষ্ট মিগ ফাইটারস স্কোয়াড্রন। মাত্র গত মাসেই চারবার দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। অর্থের অভাবে ধুঁকতে থাকা ফাইটার স্কোয়াড্রনকে সকলে তাই ডাকে “দ্য ফ্লাইং বম্বস।”

ফাইটারদের পেছনেই দেখা গেল বিশাল একটা আনমাকর্ড এয়ারক্রাফট। চারটা টার্বো-ফ্যান ইঞ্জিন অলা প্লেনটার লেজ দোতলা বাড়িয়ে চেয়েও বড়। ইসাবেলা চিনতে না পারলেও এর নাম হল আইলুশিন আই ওয়ান-৭৬ ন্যাটো যাকে ডাকে “ক্যান্ডিড”। স্ট্যান্ডার্ড রাশান মিলিটারি হেভি ক্যারিং ট্রান্সপোর্ট।

গেইটের গার্ডদের সাথে কথা বলে ব্রিফকেস থেকে কয়েকটা ডকুমেন্ট দেখাল পল। কাগজগুলোকে পরীক্ষা করে টেলিফোনে সুপিরিয়রকে ফোন করল গার্ড কম্যান্ডার। তারপর পলকে আবার কাগজগুলো ফিরিয়ে দিয়ে গেইট খুলে দিল।

 ক্যান্ডিডের রিফুয়েলিং-এর কাজ তদারকি করছে ওভারঅল পরিহিত দুই পাইলট। মেইন-হ্যাঙ্গারের পাশে গাড়ি পার্ক করে এগিয়ে গেল পল। পাইলটের সাথে কথা বলে বেলা’কে ইশারা করল এগিতে যেতে। অথচ স্যুটকেশ নিয়ে গলদৰ্ঘম ইসাবেলাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো না একজন পাইলট’ও; বদলে পল জানাল,

“প্লেনে উঠে বসুন।”

লাগেজ? জানতে চাইল বেলা। কাঁধ ঝাঁকিয়ে ভারী স্বরে জানাল চিফ পাইলট, “ওখানেই থাক। আমি দেখব। আসুন।”

 কার্গো দিয়ে ভর্তি হয়ে আছে প্লেনের পুরো হোল্ড। বিভিন্ন সাইজের ভারী ভারী সব কাঠের বাক্স। বিশাল কম্পার্টমেন্টের পাশের একটা সিঁড়ি দিয়ে বেলা’কে ফ্লাইট ডেকে নিয়ে এলো পাইলট।

“বসুন। ভাজ করে রাখা একটা ফোল্ডিং জাম্প সিট দেখিয়ে দিল বেলা’কে বসার জন্যে আর কোনো রকম ফর্মালিটি ছাড়াই ঘণ্টা খানেক পর আকাশে উঠে পড়ল ক্যান্ডিড।

নিজের আসনে বসেও পাইলটের কাঁধের উপর দিয়ে ইনস্ট্রমেন্ট প্যানেল স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে বেলা। ৩০০ ডিগ্রি কোর্স ধরে ত্রিশ হাজার ফুট উচ্চতায় লেভেল হয়ে আছে উড়োজাহাজ।

 হাতঘড়িতে সময় দেখল বেলা। ঘন্টাখানেক পর মনে হল প্লেন জাম্বিয়া ছাড়িয়ে অ্যাঙ্গোলা পৌঁছে গেছে। খানিকটা কেঁপে উঠল বেলা। এখানে হলিডে কাটানোর কোনো ইচ্ছেই নেই তার। সিনেটের আফ্রিকান অ্যাফেয়ার্স কমিটির মেম্বার হওয়াতে অ্যাঙ্গোলা সম্পর্কে মিলিটারি গোয়েন্দাদের পাঠানো সব ধরনের রিপোর্টই পড়েছে বেলা। সমস্যা জর্জরিত দেশটার সবকিছুই তাই তার জানা আছে।

বহুকাল যাবৎ পর্তুগিজ সাম্রাজ্যের মুক্তো ছিল অ্যাঙ্গোলা। দক্ষিণ আফ্রিকার পরে এটাই হচ্ছে আফ্রিকার সবচেয়ে সুন্দর আর বিত্তবান দেশ।

 মেরিন রিসোর্চে সমৃদ্ধিশালী দেশটাতে কদিন আগেই তেল আর প্রাকৃতিক গ্যাসের ভাণ্ডার খুঁজে পেয়েছে আমেরিকান অফশোর ড্রিলিং কোম্পানি। তেল ছাড়াও হীরা। সোনা আর আকরিক লোহা উৎপাদন করে অ্যাঙ্গালা। উর্বর সমভূমি আর উপত্যকায় রা দেশটাতে অসংখ্য নদী আর বনাঞ্চলও আছে।

প্রকৃতির এহেন আশির্বাদ সত্ত্বেও ভয়ংকর গৃহযুদ্ধ প্রায় দর্শক ধরে রক্তাক্ত হয়ে আছে অ্যাঙ্গোলা। পাঁচশো বছরের পুরাতন কলোনিয়াল শাসন ব্যবস্থা উপড়ে ফেলার জন্যে যুদ্ধ করেছে দেশটির জনগণ।

 কিন্তু এক্ষেত্রেও একতার অভাব আছে। বিভিন্ন গালভরা নামধারী সেনাবাহিনী কেবল পতুগিজদের বিরুদ্ধে নয়; লড়াই করছে একে অন্যের সাথে। আছে এম পি এল, এফ এন এল এ, ইউনিট। এছাড়া আছে অসংখ্য প্রাইভেট আর্মি আর গেরিলা আন্দোলন।

এরপর হঠাৎ করেই পর্তুগালে সামরিক অভ্যুত্থান হওয়াতে অ্যাঙ্গোলা’কে স্বাধীনতা দেয়া হয়। নতুন সরকার ও সংবিধানের জন্য শুরু হয় নির্বাচন।

এখন নির্বাচনের নামে নতুন করে টালমাটাল হয়ে উঠেছে পুরো দেশ। ক্ষমতা পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে বিভিন্ন অংশ। অন্যদিকে আফ্রিকার অন্যা দেশগুলোও নিজ নিজ সমর্থকের জন্য বিভিন্ন চাল চলছে। সামরিক গোয়েন্দাদের পাঠানো রিপোর্ট পড়ে বেলা’র তাই মনে হয়েছে পাহাড়-জঙ্গল দূরে থাক, খোদ রাজধানী লুয়ান্ডা’তে যে কী ঘটছে তা কেউই জানে না।

বর্তমানে এম পি এল এর রাজা কোটিনহো গর্ভনর জেনারেল হলেও আমেরিকান সি আই এ, চীন আর উত্তর কোরিয়া সকলেই এফ এন এ’র পক্ষে।

***

ক্রেমলিন দুর্গের গেইট দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছে ব্ল্যাক চাইকা’র মোটর শোভাযাত্রা।

একেবারে সামনের লিমুজিনে আছে দু’জন কিউবান জেনারেল। দ্বিতীয় গাড়িতে প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ট্রোর সাথে বসে আছে জেনারেল রামোন মাচাদো।

ইথিওপিয়াতে সফলভাবে রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে ফেরার সাথে সাথে পদোন্নতি পেয়েছে রামোন।

 কেজিবি’র সবচেয়ে তরুণ জেনারেল এখন রামোন। ওর ইমিডিয়েট সিনিওয়ের বয়সও তিপান্ন। জন্মসূত্রে রাশান না হওয়াতে আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে এ পদোন্নতি।

ইথিওপিয়ার সাফল্যের পরপরই অ্যাঙ্গোলাহো’ও নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেছে রামোন। গর্ভনর জেনারেল রোজা কোটিনহো’র সাথে সখ্যতা গড়ে তোলার মাধ্যমে স্থাপন করেছে রাজনৈতিক বন্ধুত্ব।

“যে কোনো মূল্যে নির্বাচন ঠেকাতে হবে।” রামোনকে জানিয়েছে রোজা, “তাহলে প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে জয়ী হয়ে যাবে জোনাস সাভিষি; যেহেতু তার গোত্রই দেশটাতে সবচেয়ে বড়।”

“ঠিক তাই।” একমত হলো রামোন। অ্যাঙ্গোলার গেরিলা লিডারদের মাঝে সবচেয়ে সফল জোনাস। কিন্তু মার্কসিস্ট কিংবা সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা অনুসরণ না করায় তাকে ক্ষমতায় বসানোর ঝুঁকি নিতে পারে না রামোন।

“এক্ষেত্রে সম্ভাব্য সমাধান হলো, ঘোষণা করে দিন যে অরাজকতা অব্যাহত থাকাতে এখন কোনোমতেই নির্বাচন সম্ভব নয়। এম পি এল এর সামর্থ্যকে তুলে ধরে লিসবনকে বাধ্য করুন অগাস্টিনহো নেটো’র হাতে ক্ষমতা অর্পণ করতে।”

বলা বাহুল্য যে, নেটো’কে নির্বাচন করেছে সোভিয়েত; কেননা দুর্বল আর শঠ চরিত্রের নেটোকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে; সাভিম্বি’কে নয়।

“আমি রাজি।” মাথা নাড়ল কোটিনহো।” কিন্তু রাশিয়া আর কিউবা থেকে সমর্থন পাবো তো?”

“যদি আমি এই সমর্থন দেবার প্রতিজ্ঞা করি তাহলে কি আপনাদের মিলিটারি বে ও এয়ারফিল্ডে সেনাবাহিনী আর সামরিক রসদ জড়ো করার অনুমতি দিতে প্রস্তুত আছেন?”

“এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকুন।” ডেস্কের ওপাশ থেকে হাত বাড়িয়ে দিল অ্যাডমিরাল। বিজয়ীর চোরা আনন্দ নিয়ে হাত মেলাল রামোন।

 সোভিয়েতের হাতে দুই দুটো দেশকে তুলে দিল কয়েকদিনের ব্যবধানে। আফ্রিকাতে এতটা সফলতা আর কেউ পায়নি।

“এখান থেকে আমি সরাসরি হাভানা’তে চলে যাবো।” কোটিনহোকে নিশ্চয়তা দিয়েছে রামোন।” আশা করি কয়েকদিনের মাঝেই কিউবা আর মস্কোর উত্তর পেয়ে যাবো। এ মাসের শেষেই তা আপনাকে জানিয়ে দেব।”

উঠে দাঁড়াল কোটিনহো, “আপনার মতো মানুষ হয় না, কমরেড কর্নেল জেনারেল। সমস্যার, এতটা গভীরে যেতে আর দক্ষ সার্জনের মতো পদক্ষেপ নিতে আমি আর কাউকে দেখেনি।”

চাইকাতে প্রেসিডেন্ট ফিদের ক্যাস্ট্রোর-পাশে বসে এখন এগোচ্ছে রামোন।

মিউজিয়ামের গেইটে লাইনে দাঁড়ানো বিদেশি পর্যটকেরা তাকিয়ে আছে। তাদের মোটর শোভাযাত্রার দিকে। দ্বিতীয় গাড়িতে বসা ক্যাস্ট্রোকে চিনতে পেরেই কৌতূহলী হয়ে উঠল সকলে।

 স্কোয়ার পার হয়ে মিনিস্টারস বিল্ডিং-এর সদর দরজায় এসে থামল গাড়ির বহর।

ডেপুটি মিনিস্টার আলেক্সেই ইউদিনিচ এগিয়ে এসে ক্যাস্ট্রোকে জড়িয়ে ধরলেন, তারপর নিয়ে গেলেন মিনিস্টারদের কাউন্সিলে। হল অব মিরর’য়ে লম্বা টেবিলের মাথায় নিজ আসনে বসে বক্তব্য শুরু করলেন কাস্ত্রো।

পরিষ্কারভাবে কথা বলে চললেন ক্যাস্ট্রো মাঝে মাঝে থেমে রাশান দোভাষীকে সুযোগ দিলেন। উপস্থিত সকলে তো বটেই এমনকি রামোন নিজেও মুগ্ধ হয়ে গেল তার আফ্রিকান জ্ঞান দেখে; বিস্তারিতভাবে তুলে ধরলেন সমস্ত সম্ভাব্য ঝুঁকি আর সফলতার ক্ষেত্র। বোঝাই যাচ্ছে রামোনের কথা তিনি কতটা আত্মস্থ করেছিলেন।

 “পশ্চিম ইউরোপের কোনো মেরুদণ্ড নেই আর ন্যাটো তো সামরিকভাবে আমেরিকার উপরেই নির্ভরশীল তাই অ্যাঙ্গোলা’তে আমাদেরকে ঠেকানোর কেউ নেই।”

“কিন্তু আমেরিকা?” ভাবে জানতে চাইলেন ইউদিনিচ।

 “ওদের ভিয়েতনাম ক্ষত এখনো শুকায়নি। তাই তাদের সিনেট কখনো সৈন্য পাঠাতে রাজি হবে না। তাই লেজ গুটিয়ে জিরিয়ে নিচ্ছে। তবে তো একটা ভয় রয়ে যায় যে, তারা হয়ত কোনো সারোগেট আর্মি বেছে নেবে ওদের হয়ে যুদ্ধ করার জন্যে।”

“দক্ষিণ আফ্রিকা।” ভবিষ্যৎ বাণী করে দিলেন ইউদিনিচ।

“ঠিক তাই। আফ্রিকাতে একমাত্র এরাই সবচেয়ে ভয়ংকর। কিসিঞ্জার হয়ত এদেরকে নিয়োগ করে অ্যাঙ্গোলা সীমান্তে পাঠিয়ে দিতে পারে।”

“দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়াটা কী ঠিক হবে?” ওদের সৈন্যরা তো আফ্রিকার সবচেয়ে দক্ষ বুশ ফাইটার আর সাথে যদি পায় আমেরিকান অস্ত্র আর রসদ…”

“ওদের সাথে আমাদের যুদ্ধ করতে হবে না” প্রতিজ্ঞা করলেন ক্যাস্ট্রো।

“সীমান্ত আর দক্ষিণ আফ্রিকা কিউবা কিংবা সোভিয়েতের জোরে নয়, বর্ণবাদ নীতির কারণে।”

 “ব্যাখ্যা করে বলুন মিঃ প্রেসিডেন্ট।”

“পশ্চিমে, আমেরিকান লিবারেল পার্টি আর ইউরোপে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন মুখিয়ে আছে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকারকে উৎখাত করার জন্য। তাই প্রথমজন দক্ষিণ আফ্রিকান সৈন্য সীমান্ত ক্রস করার সাথে সাথেই আমরা জিতে যাবো। আমেরিকান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি আর ইউরোপ তথাকথিত গণতান্ত্রিকগণ এমন চিৎকার জুড়ে দেবে যে বিশ্বব্যাপী শুরু হয়ে যাবে প্রতিবাদ। দক্ষিণ আফ্রিকা নিজেই তখন সরে দাঁড়াবে। অ্যাঙ্গোলা হয়ে যাবে আমাদের।”

সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। রামোন আর একবার মুগ্ধ হল ক্যাস্ট্রোর সম্মোহন শক্তি দেখে। এ কারণেই তাঁকে মস্কোতে নিয়ে এসেছে সে। এমনভাবে বলার ক্ষমতা কাস্ট্রোর আর কোনো মিনিস্টার কিংবা জেনারেলের ছিল না।

 “উনি আমাকে গোল্ডেন ফক্স ডাকেন।” আপন মনেই হাসল রামোন, “কিন্তু তিনিই হচ্ছেন সবচেয়ে বড় শিয়াল পণ্ডিত।”

যাই হোক এখনো শেষ করেননি ক্যাস্ট্রো। কোকড়ানো দাঁড়িতে হাত বুলাতে গিয়ে হাসলেন, “অ্যাঙ্গোলা আমাদেরই হবে; কিন্তু এটা তো কেবল সূচনা। এর পরের পালা খোদ দক্ষিণ আফ্রিকার।”

এতটা সাগ্রহে সবাই সামনে ঝুঁকে এলো যেন রক্তের গন্ধ পেয়েছে একদল নেকড়ে।

“একেবারে অ্যাঙ্গোলা হাতে এসে গেলেই কৃষাঙ্গ মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে ঘিরে ফেলব দক্ষিণ আফ্রিকা। আফ্রিকা রত্ন ভাণ্ডার আর অর্থনৈতিক পাওয়ার হাউস দক্ষিণ আফ্রিকাকে কজা করতে পারলেই পদানত হবে পুরো মহাদেশ।”

 বিশাল হাতের তালুদুটো টেবিলের উপর বিছিয়ে এবার সামনে ঝুঁকলেন ক্যাস্ট্রো নিজে।

“এ কাজের জন্য যত সৈন্য প্রয়োজন আপনি নিতে পারেন। আর অস্ত্রশস্ত্র ও ট্রান্সপোর্ট যদি দিতে পারেন তাহলে পাকা টসটসে ফল ঘরে তোলার সময় হয়েছে। রাজি আছেন কমরেড়স? তৈরি আছেন এই সাহসী পদক্ষেপ নেবার জন্যে?”

***

এই মিটিং এর মাত্র এক মাস পরেই পতুর্গিজ মিলিটারি অফিসারদের এক দল, সোরিমো’তে অবস্থিত মিলিটারি এয়ারফোর্স বেস কিউবান এয়ারফোর্সের লজিস্টিকস চিফের হাতে হস্তান্তর করে দেয়।

চব্বিশ ঘণ্টা পর সোরিমো’তে ল্যান্ড করে প্রথম আইলুশিন ক্যান্ডিড ট্রান্সপোর্ট। যাত্রী হিসেবে আসে পঞ্চাশজন কিউবান পরামর্শক আর মিলিটারি অস্ত্র-শস্ত্র ভর্তি বিশাল এক কার্গো। একই এয়ারক্রাফটে আসে রাশান মিলিটারি অবজার্ভার কর্নেল জেনারেল রামোন মাচাদো।

প্রচণ্ড ক্লান্তি আর উত্তেজনা নিয়ে রামোনের দিন কাটছে। মহাদেশের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছে ওর নাম।

“এল জোরো” বিদেশেও সবাই ফিসফিস করে বলে,” এল জোরো পৌঁছে গেছে। বল এখন তাই দ্রুত গড়াতে থাকবে।”

ঠিক শিয়ালের মতই সারাক্ষণ দৌড়ের উপরে আছে রামোন। একই বিছানায় পরপর দু’রাত কখনোই ঘুমানো হয় না। কখনো কখনো তো বিছানাই থাকে না। ঘাসের কুড়ে ঘরের মাটির মেঝে; কিংবা হালকা কোনো এয়ারক্রাফটের দোমড়ানো সিট অথবা নোংরা কোনো নদীতীরেই ঘুমিয়ে পড়তে হয়।

অন্যদিনকে এল জোফের ধারণাই সঠিক। পশ্চিমাদের কোনো নড়চড় নেই। সাংবাদিকেরাও কোনো ধরনের প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারেনি কোটিনহো’র কল্যাণে। সোরিমো কিংবা কঙ্গোর ব্রোজাভিলেতে অস্ত্র আর সৈন্য এনে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত এম পি এল এ ক্যাডারদের হাতে।

তবে অ্যাঙ্গোলা হল রামোনের একগাদা দায়িত্বের একটি। এছাড়াও ইথিওপিয়া মোজাম্বিক, এজেন্টদের নেটওয়ার্ক, দক্ষিণ আফ্রিকাতে মুক্তিযোদ্ধাদের কো-অর্ডিনেশন সবকিছু নিয়েই তাকে মাথা ঘামাতে হয়। কিন্তু অ্যাঙ্গোলা’তেই-সোয়াপো আর এ এন সি’র ট্রেনিং ক্যাম্প বসিয়েছে রামোন।

দেশের পৃথক দুটি অংশে স্থাপন করা হয়েছে এই দুই সংগঠনের হেডকোয়াটার। তবে রামোন এএনসি’র ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী। এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারে না যে পুরো মহাদেশের প্রবেশ পথ হলো দক্ষিণ আফ্রিকা আর এএনসি তাদের মুক্তিযোদ্ধা। রালেই তাবাকা, তার পুরনো কমরেড এখন অ্যাঙ্গোলা’তে এএনসি লজিস্টিকস চিফ।

দুজনে মিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চষে বেরিয়েছে পুরো দেশ। তারপর খুঁজে পেয়েছে চিকাম্বা নদী তীরে অবস্থিত ছোট্ট জেলে গ্রাম। ঠিক হয়েছে এখানেই হবে তাদের বেস্।

যুদ্ধের সময় পরিত্যক্ত এই গ্রামটা দক্ষিণ আফ্রিকার সীমান্ত কিংবা যে কোনো বেস্ থেকেও বহুদূরে অবস্থিত। ইস্রায়েলীয়দের মতো দক্ষিণ আফ্রিকানরা’ও গেরিলাদের ধাওয়া করার জন্য কোনো আন্তর্জাতিক সীমানার পরোয়া করে না কিন্তু আউট অব রেঞ্জ হওয়াতে চিকাষাতে কোনো হেলিকপ্টার নামতে পারবে না। হাজার হাজার কি.মি. জঙ্গল আর পাহাড় পর্বতের বাধা পেরিয়ে স্থলবাহিনী পাঠানোও সম্ভব নয়। বেসের নাম রাখা হল টার্সিও।

প্রথম পাঁচশো এএনসি ক্যাডারকে নিয়ে টার্সিও’তে পৌঁছে গেলেন তাবাকা। শুরু হলো এয়ারস্ট্রিপ আর ট্রেনিং ক্যাম্পের কনস্ট্রাকশনের কাজ। দশ দিন পরেই এলো রামোন। ততদিনে প্রায় তৈরি হয়ে গেছে এয়ারস্ট্রিপ।

দ্বিতীয়বার পরিদর্শনে এসে পুরো এলাকাটা চক্কর দিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেল রামোন। ঠিক করল নদীর মুখে তৈরি করবে আলাদা কম্পাউন্ড; আর এটাকে ব্যবহার করবে প্রাইভেট হেডকোয়াটার হিসেবে। সবসময় এরকম একটা নিরাপদ জায়গা চেয়েছিল যেখানে কেজিবি’র ট্রেনিং, প্ল্যানিং নির্বিঘ্নে সারা যাবে আর বন্দিদের ইন্টোরোগেশন আর হাপিশ করে ফেলাও কোন ব্যাপার হবে না। কেউ জানতেই পারবে না।

রালেই তাবাকা’র নির্মাণকর্মীদেরকে আদেশ দেয়ার কিছুদিনের মাঝেই এগিয়ে গেল কাজ।

হাভানাতে ফিরে গিয়ে প্রয়োজনীয় রেডিও আর ইলেকট্রনিক ইকুপমেন্টের ব্যবস্থা করে পাঠিয়ে দিল টার্সিও’র হেডকোয়ার্টারে।

***

হাভানা আর মস্কোতে দৌড়াদৌড়ি করলেও আফ্রিকা মহাদেশের নিজের আরো ডজনখানেক প্রজেক্টের কথাও ভুলে যায়নি রামান। এদের মাঝে বিশেষ একটি হলো লাল গোলাপ অপারেশন। লন্ডন আর স্পেনের দিনগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় যে বুঝতেও পারেনি কোনো একদিন মেয়েটা কত মূল্যবান হয়ে উঠবে।

দক্ষিণ আফ্রিকার সিনেটে যোগ দেবার পর থেকে অসাধারণ সব গোয়েন্দা রিপোর্ট আর সুপারিশ ডেলিভারী দিয়েছে লাল-গোলাপ। এরপর ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তো আফ্রিকান অ্যাফেয়াস এর সিনেট অ্যাডভাইজারি বোর্ডেরও সদস্য হয়ে গেছে। ওর মাধ্যমেই রামোন জেনে গেল যে দক্ষিণ অ্যাঙ্গোলাতে সাউথ আফ্রিকা সামরিক অভিযান চালালেও নাক গলাবে না প্রেসিডেন্ট ফোর্ড আর হেনরী কিসিঞ্জার। লুবিয়াঙ্কাতে সুপিরিয়রদেরকে জানিয়ে দিয়ে ক্যাস্ত্রোর সাথে পরামর্শ করার জন্যে হাভানাতে উড়ে এলো রামোন।

“আপনি ঠিকই ধরেছিলেন এল জোফ” প্রশংস ভঙ্গিতে বলে উঠল রামোন, “ইয়াংকি তাদের নোংরা ঘাটাবার জন্য বোয়াদেরকে পাঠাবে।”

“তাহলে আমরাও চাই ওরা ফাঁদে পা দিক।” হেসে ফেললেন কাস্ট্রো।” এখনি অ্যাঙ্গোলাতে ফিরে যাও, আমাদের বাহিনীকে তুলে এনে রাজধানীর দক্ষিণে নদীতীরে ডিফেন্সিভ পজিশনে বসাও। এগিয়ে আসতে দাও আংকেল স্যামের বাহিনীকে।”

 অক্টোবার সাউথ আফ্রিকান অশ্বারোহী বাহিনী কুনিন নদী পার হয়ে দিন কয়েকের মাঝে রাজধানীর দেড়শ মাইলের ভিতরে চলে এলো। সুপ্রশিক্ষিত, তরুণ যোদ্ধারা অবশ্য নদীর ওপারে ভারী অস্ত্র-শস্ত্র আনতে ব্যর্থ হল।

এদিকে সিগন্যাল পাঠিয়ে দিল রামোন।

 “এবারে, বলে উঠলেন কাস্ট্রো, “সময় হয়েছে আমাদের খেলা দেখাবার।”

নদীতীরে দক্ষিণ আফ্রিকার বাহিনীকে রুখে দিল রাশান টি-৫৪ ট্যাংক আর অ্যাসল্ট হেলিকপ্টার। পশ্চিমা গণমাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকার উপস্থিতির কথা ছড়িয়ে দিল রামোন। আর সফল হলো কাস্ট্রোর ভবিষ্যৎ বাণী। শুরু হয়ে গেল ডিপ্লোম্যাটিক ঝড়।

এর কিছুদিন পরেই নাইজেরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে নিল সোভিয়েত সমর্থিত এমপিএলএ সরকার। ইউনাইটেড স্টেটসের সিনেটে আইওয়ার ডেমোক্র্যাটিক প্রতিনিধি ডিক ক্লার্ক সিআইএ’কে অভিযুক্ত করলেন অবৈধভাবে দক্ষিণ আফ্রিকাকে সহযোগিতা করার জন্য; ফলে মুখ ফিরিয়ে নিল কিসিঞ্জার আর সিআইএ। জয়েন্ট চিফ মেম্বারস এর পদত্যাগের হুমকির ফলে তুলে নেয়া হলো নেয়া হল সমস্ত আমেরিকান সাপোর্ট। ডিসেম্বরের মধ্যেই সিনেটে পাস হয়ে গেল ডিক ক্লার্ক এর সংশোধনী। ফলে অ্যাঙ্গোলাতে দক্ষিণ আফ্রিকার সামরিক সহায়তা বন্ধ হয়ে গেল। আর এসবই ঘটল ঠিক যেভাবে চেয়েছিলেন ক্যাস্ট্রো।

আরেকটি আফ্রিকান দেশ পেয়ে গেল সোভিয়েত ইউনিয়ন আর হাজার হাজার কৃষাঙ্গ অ্যাঙ্গোলানস্ বাধ্য হলো দশক জুড়ে গড়িয়ে চলা গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে। অর্ডার অব লেনিন অ্যাওয়ার্ড পেয়ে গেল কর্নেল জেনারেল রামোন মাচাদো। এদিকে আবার ছুটতে হল ইথিওপিয়ার উদ্দেশ্যে।

***

আদ্দিস আবাবা’তে নামার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে আইলুশিন। রাশান পাইলটের পেছনে বসে পার্বত্য অঞ্চল দিয়ে ঘেরা দেশটার দিকে তাকিয়ে আছে রামোন।

শত শত বছর ধরে রাজধানীর চারপাশে গাছগুলোকে কেটে ফেলতে পাহাড়গুলো হয়ে পড়েছে শূন্য। প্রাচীন এই ভূমিতেই একদা দাস, আইভরি আর অন্যান্য সম্পদের খোঁজে মিশরীয় ফারাওরা পাঠিয়েছিলেন তাদের প্রথম সেনাবাহিনী।

স্বভাবে উদ্ধত আর যোদ্ধা প্রকৃতির ইথিওপীয় জনগণকে ১৯৩০ সাল থেকে শাসন করে আসছেন সম্রাট হালি সেলসি। নিজের হাতে সর্বময় ক্ষমতা ধরে রাখলেও এই দয়ালু আর সহৃদয় একনায়ককে জনগণ ভালবাসে। ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত সাদাসিধে জীবন যাপনে অভ্যস্ত সম্রাট সেলাসির একমাত্র চিন্তা ছিল নিজের জনগণের সমৃদ্ধি। সিংহাসনে আরোহণের পাঁচ বছরের মধ্যেই মুসোলিনি জেনারেলরা এসে তাঁর রাজ্যকে তছনছ করে দিলেও তাদেরকে রুখে দেয় ইথিওপিয়রা। ট্যাংক, হাল আমলের এয়ারক্রাফট আর বিষাক্ত গ্যাসের সাথে এরা লড়েছে রাইফেল, তরবারি কখনো বা শূন্য হাত দুটো নিয়ে।

অক্ষ শক্তির পরাজয়ের পর আবারো ইংল্যান্ড থেকে ফিরে এসে ইথিওপিয়া সিংহাসনে বসেন হালি সেলাসি। কিন্তু দেশকে আধুনিক করার বাসনা নিয়ে বিংশ শতাব্দীর সাথে তাল মেলাতে গিয়ে নিজের ছোট রাজ্যে ভাইরাস ঢোকার অনুমতি দিয়ে বসেন সম্রাট।

 আদ্দিস আবাবা’তে স্থাপিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই শুরু হয়েছে ইনফেকশন। লম্বা চুলের বন্য দৃষ্টি মাথা ইউরোপীয়রা এসে তরুণ ছাত্রদেরকে শেখাতে থাকে সকল মানুষই সমান; রাজা কিংবা অভিজাতরা কোনো স্বর্গীয় অধিকার নিয়ে জন্মায়নি। এদিকে ফুরিয়ে আসতে থাকে বৃদ্ধ সম্রাটের শারীরিক শক্তি; অন্যদিকে মাথা চাড়া দিতে থাকে ষড়যন্ত্র। এরপর ইথিওপিয়াতে শুরু হয় প্রচণ্ড খরা আর দুর্ভিক্ষ। মাটি শুকিয়ে যায়, গবাদি পশু মারা যায়, মায়ের কোরে শুয়ে থাকে হাড় জিরজিরে শিশু; কঙ্কালসার দেহে ভেসে থাকে বড় বড় চোখ।

তারপরেও টনক নড়ে না সভ্য জগতের। অতঃপর টেলিভিশন ক্রু নিয়ে ইথিওপিয়াতে আসে বিবিসি’র রিচার্ড ডিম্বেলবি। তুলে ধরে গ্রামগুলোর ভয়াবহ দুর্দশার চিত্র। খুব সাবধানে দুর্ভিক্ষ আর মৃত্যুর ছবি প্রচার করা হয় রক্ত লাল আর সোনালি লেস লাগানো সাদা আলখাল্লা পরিহিত আনন্দে মত্ত অভিজাতদের ছবির পাশাপাশি; এবারে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয় দুনিয়া। বিদ্রোহে ফেটে পড়ে আদ্দিস আবাবা’র শিক্ষার্থীরা। চার্চ আর মিশনারীরাও আওয়াজ তোলে একনায়কের বিরুদ্ধে।

এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল আর পুরাতন হিসাব মেলাতে বসে ডার্গ। একই সাথে আরবীয় তেল উৎপাদনকারীরাও বাড়িয়ে দেয় তেলের দাম। ইথিওপিয়াতে দুর্ভিক্ষের সাথে দেখা দেয় মুদ্রাস্ফীতি। অনাহারী উপোসী মানুষ শুরু করে লুটতরাজ।

আদ্দিস আবাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী বহু তরুণ অফিসারের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে বসে সেনাবাহিনী। এদের হাতে চলে যায় ডার্গের নিয়ন্ত্রণ।

প্রধানমন্ত্রী আর রাজপরিবারের সদস্যদেরকে বন্দি করে প্রাসাদে আলাদা করে ফেলা হয় সম্রাট সেলাসিকে। অর্থ আত্মসাতের গুজব ছড়িয়ে দেয়ায় জনগণ দাবি করে সম্রাটের পদত্যাগ ডার্গের মাধ্যমে সম্রাটকে গ্রেফতারের উদ্যোগ নেয় মিলিটারি কাউন্সিল।

 প্রাসাদের সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে আনার সময় বলে উঠেন বৃদ্ধ সম্রাট; “তোমরা যা করছ তাতে যদি আমার জনগণের উপকার হয় তাহলে আমি সানন্দে চলে যাবো আর এও প্রার্থনা করব যেন তোমরা সফল হও।”

শহরের বাইরে ভাঙ্গাচোড়া একটা কুঁড়েঘরে বন্দি করে রাখা হয় সম্রাটকে কিন্তু ছোট্ট ঘরটার সামনে জড়ো হয় হাজার হাজার ইথিওপিয়। প্রকাশ করতে চায় নিজেদের বিশ্বস্ততা আর সমবেদনা।

বেয়নেট দেখিয়ে তাদেরকে ছঙ্গভঙ্গ করে দেয় মিলিটারি কাউন্সিল।

আদ্দিস আবাবা এয়ারেপোর্টের মাটিতে নেমে এলো আইলুশিন। বিশটা জিপ আর ইথিওপিয় সেনাবাহিনী বোঝাই ট্রাক এগিয়ে এলো এটিকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য।

লোডিং র‍্যাম্প দিয়ে এয়ারক্রাফট থেকে নেমে এলো রামোন।

“ওয়েলকাম কর্নেল জেনারেল জিপে থেকে নেমে এগিয়ে এলো কর্নেল গেটাশ আবিবি।

একে অন্যের সাথে হাত মিলিয়ে আকাশের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল দ্বিতীয় আইলুশিন। একের পর এক মাটিতে নেমে এলো বিশাল চারটা এয়ারক্রাফট।

ইঞ্জিন বন্ধ হতেই আইলুশিনগুলোর গহ্বর হতে বেরিয়ে এলো চে গুয়েভারা রেজিমেন্টের সৈন্যদল।

“লেটেস্ট পজিশন কী?” সংক্ষেপে জানতে চাইল রামোন।

“ডার্গ আনদামের জন্য ভোট দিয়েছি।” আবিবি জানাতেই সিরিয়াস হয়ে গেল রামোন। জেনারেল আমান আনাদাম হলেন সেনাবাহিনী প্রধান। অত্যন্ত বুদ্ধিমান আর সৎ এই লোকটাকে সাধারণ মানুষও বেশ পছন্দ করে। তাই এতে আশ্চর্যের কিছু নেই যে তিনিই হবেন জাতির নতুন নেতা।

“তিনি এখন কোথায়?”

“উনার প্রাসাদে- এখান থেকে প্রায় পাঁচ মাইল দূর।”

 “সাথে কতজন আছে?”

 “পঞ্চাশ কিংবা ষাটজন দেহরক্ষী…”

 নিজের প্যারাসুপারদের দিকে তাকালো রামোন।

“ডার্গের কতজন তোমার সমর্থন করে?”

ডজন খানেক নাম আউরে গেল আবিবি। সকলেই বাম ঘেষা তরুণ অফিসার।

“টাফু?” রামোন জানাতে চাইলে মাথা নাড়ল আবিবি। কর্নেল টাফু হচ্ছেন সেনাবাহিনীর সবচেয়ে আধুনিক ইউনিট আর রাশান টি-৫৩ ট্যাংক স্কোয়াড্রনের কমান্ডার।

“অল রাইট” মোলায়েম স্বরে বলে উঠল রামোন, “এটা আমাদের জন্য কোনো ব্যাপারই না-কিন্তু খুব দ্রুত এগোতে হবে।”

কিউবান প্যারাস্টপারদের কমান্ডারকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়ার পরপরই কাঁধে অস্ত্র নিয়ে সারি বেঁধে অপেক্ষারত ট্রাকের দিকে এগোল রামোনের বাহিনী।

আবিবি’র পাশে রামোন উঠে বসার পরপরই শহরের দিকে এগোল পুরো বহর।

শহরের বাইরে দেখা মিলল উট আর খচ্চরের ক্যারাভান। ভাবলেশহীন চোখে সেনাবাহিনীর দিকে তাকিয়ে রইল যাত্রীরা। সম্রাটের পতনের পর থেকেই রাস্তায় সেনাবাহিনী দেখা যেন নিত্যদিনের দৃশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমহারিক ভাষায় দ্রুত রেডিওতে কথা বলে নিল আবিবি; তারপর রামোনকে অনুবাদ করে শোনাল।

“আমার লোকেরা আনদোমের প্রাসাদের উপর নজর রেখেছে। মনে হচ্ছে তিনি ডার্গের সমর্থনকারীদের মিটিং ডেকেছেন। সবাই এসে জড়ো হচ্ছে, প্রাসাদে।”

“গুড। সবকটা মুরগিকে একসাথে খাঁচায় পোরা হবে।”

শহর থেকে মোড় নিয়ে খোলা মাঠ দিয়ে ছুটল সেনা বহর। খরার প্রভাবে চারপাশে সবুজের কোনো অস্তিত্বই নেই। ধুলির মতো সাদা হয়ে আছে খটখটে মাটি।

“এই তো এসে গেছি।” সামনের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল আবিবি।

লাল টেরাকোটার মোটা দেয়াল দিয়ে ঘেরা জেনারেলের প্রাসাদ দেখে এক নজরেই রামোন বুঝতে পারল এর ক্ষমতা। দেয়াল ভাঙ্গার জন্যে গোলন্দাজ বাহিনী লাগবে।

ওর মনের কথা পড়ে ফেলল আবিবি। “আমাদেরকে দেখে ওরা এমনিতেই ভড়কে যাবে। তাই গেইট দিয়ে ঢোকা হয়তো কঠিন হবে না…”

“না” বলে উঠল রামোন। “ওরা এয়ারক্রাফটগুলো আসতে দেখেছে। এ কারণেই হয়ত জরুরি সভা ডেকেছে আনদোম।”

 ওদের সামনে দিয়েই প্রাসাদের দিকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে গেল একটা স্টাফ কার।

 “এখানেই থামো।” রামোনের নির্দেশে থেমে গেল পুরো বহর। খোলা জিপের পেছনের সিটে দাঁড়িয়ে বাইনোকুলার দিয়ে দূরের প্রাসাদের দিকে তাকাল রামোন।

“টাফু আর তার ট্যাংকগুলো কোথায়?”

“শহরের অন্য প্রান্তে ব্যারাকে।”

“এখানে আসতে কতক্ষণ লাগবে?”

 “দুই ঘণ্টা।”

 “প্রতিটি মিনিটই গুরুত্বপূর্ণ।”

বাইনোকুলার না নামিয়েই বলে উঠল রামোন, “যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওর যুদ্ধযান নিয়ে আসতে বলে দাও টাফু’কে-কিন্তু আমাদেরও হাত গুটিয়ে বসে থাকা চলবে না।”

 রেডিও নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল আবিবি। বুকে বাইনোকুলার ঝুলিয়ে জিপে থেকে নেমে এলো রামোন। প্যারাট্রুপারস কমান্ডার আর কোম্পানি লিডাররা ওর চারপাশে জড়ো হতেই জানিয়ে দিল বিভিন্ন নির্দেশ।

মাইক্রোফোন রেখে এগিয়ে এলো আবিবি, “শহরে সম্রাটের প্রাসাদ পাহারা দিচ্ছে একটা টি-৫৩। ওটা ঘন্টাখানেকের মধ্যে এখানে পৌঁছে যাবে। বাকি স্কোয়াড্রন নিয়ে রওনা হচ্ছেন কর্নেল টাফু।”

“ভেরি গুড।” মাথা নাড়ল রামোন।

 “এখন আনদোমের প্রাসাদের নকশা বলো। ওকে কোথায় পাবো?”

ধুলার মাঝে স্কেচ এঁকে অভ্যন্তরের নকশা বুঝিয়ে দিল-আবিবি। রামোনের নির্দেশে আবারও এগোতে শুরু করল সেনা বহর। তবে এবারে কমান্ড জিপের উপর উড়তে লাগল সাদা পতাকা। স্ট্রপ ক্যারিয়ারের হুডের নিচে লুকিয়ে পড়ল প্যারাট্রুপার বাহিনী আর অস্ত্র-শস্ত্র।

প্রাসাদের কাছাকাছি হতেই গেইটের দেয়ালের উপর বেশ কয়েকটা মাথা দেখা গেলেও সাদা পতাকা থাকায় কোনো গুলি উড়ে এলো না এদিকে।

গেইটের সামনে জিপ পৌঁছাতেই এর শক্তি পরীক্ষা করে দেখল রামোন। এক ফুট মোটা কাঠের গায়ে রট আয়রন লাগানো গেইটে ট্রাক চালিয়ে দেয়া পাগলামি ছাড়া কিছু হবে না।

মাথার উপরে বিশ ফুট উঁচু দেয়াল থেকে চ্যালেঞ্জ করে বসল গার্ডদের ক্যাপ্টেন। নেমে এলো আবিবি। বেশ কয়েক মিনিট বাগবিতণ্ডা চললো দু’জনের মাঝে।

 রামোন যখনি বুঝতে পারল যে সব গার্ডদের মনোযোগ কেবল জিপের দিকে নিবিষ্ট, তাড়াতাড়ি রেডিওতে নির্দেশ দিতেই ট্রাকগুলো গর্জন করে ছুটে এসে ডানে-বামে দাঁড়িয়ে গেল লাইন করে। ছাদে চড়ে বসল লুকিয়ে থাকা প্যারাট্রুপারদের দল। গ্রাপলিং হুক লাগানো দশ জন সশস্ত্র প্যারাট্রুপার দেয়াল বেয়ে উঠতে শুরু করল।

“ওপেন ফায়ার!” রামোন রেডিওতে চিৎকার করে উঠতেই শুরু হয়ে গেল গুলিবর্ষণ। সাথে সাথে সরে গেল গার্ডদের মাথা; তবে অন্তত একজনের গায়ে লাগল গুলি। বাতাসে গোত্তা খাওয়া হেলমেট দেখতে পেল রামোন।

বানরের মতো দাড়ি বেয়ে উঠে সেকেন্ডের ভেতরেই জনা ত্রিশেক প্যারাট্রুপার নেমে গেল প্রাসাদের বাগানে। অটোমেটিক ফায়ার আর গ্রেনেড ফাটার আওয়াজ কানে আসার একটু পরেই খুলে গেল কাঠের দরজা। জিপ নিয়ে আগে বাড়ল রামোন।

আঙ্গিনাতে ছড়িয়ে আছে প্রাসাদের গার্ডদের মৃতদেহ। ড্রাইভারের সিটের উপর রাখা ৫০ ক্যালিবার ব্রাউনিং হেভিমেশিন গানের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো রামোন। শুইয়ে দিল ভুট্টা খেতে দৌড়াতে থাকা খরগোশদের মতো পলায়ন পর গার্ডদেরকে।

কিন্তু হঠাৎ করেই হাঁটু গেড়ে বসে আর পি জি ৭ রকেট লঞ্চার তুলে নিল এক গার্ড।

জিপের দিকে নিশানা করতেই ব্রাউনিং ঘুরিয়ে নিল রামোন। ঠিক সেসময় পড়ে থাকা মৃতদেহে আটকে গেল জিপের চাকা। ফলে এইম হারিয়ে ফেলল রামোন।

হুশ করে এগিয়ে এসে জিপের মাঝখানে রেডিয়েটরে ধাক্কা খেল রকেট। বিস্ফোরণের সাথে সাথে ঘুরে গেল পুরো জিপ।

রামোনেরা চারপাশে লাফিয়ে নামলেও প্রবেশ মুখে গিয়ে আটকে গেল জিপ। ফলে পিছোতে বাধ্য হল ট্রাক বহর।

এরই মাঝে ডিফেন্সে নেমে পড়ল প্রাসাদের বাহিনী। সমস্ত দরজা আর জানালা দিয়ে শুরু হয়ে গেল অটোমেটিক ফায়ার।

কিউবান সেনারা তাড়াহুড়া করে ট্রাক থেকে নেমে আগে বাড়ল। কিন্তু এগিয়ে এলো দ্বিতীয় রকেট। রামোনের মাথা থেকে মাত্র ইঞ্চি খানেক উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে আঘাত করল ট্রাকের বনেটে। ডিজেল ফুয়েলের কালো ধোয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল পুরো আঙিনা।

কোনো একটা জানালা থেকে শুরু হল ভারী মেশিন গানের গর্জন। গড়িয়ে গড়িয়ে সরাসরি জানালার মাটির দেয়ালের নিচে চলে এলো রামোন। মেশিন গানের শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড়।

পকেট থেকে ছোঁ মেরে গ্রেনেড তুলে নিয়ে পিন টেনে ছুঁড়ে দিল জানালা দিয়ে; সাথে সাথে আবার উপুড় হয়ে কান ঢেকে বসে পড়ল।

উন্মত্ত একটা আর্তচিৎকারের সাথে সাথে নীরব হয়ে গেল মেশিন গান।

“তাড়াতাড়ি এসো।” চিৎকার করে আদেশ দিল রামোন। হাফ ডজন প্যারাট্রুপার নিয়ে ঢুকে পড়ল খোলা জানালার ভেতরে। মেশিন গানটা জায়গা মতো থাকলেও রক্তে থকথক করছে মেঝে।

শুরু হয় গেল এক রুম থেকে আরেক রুমে দৌড়ে দৌড়ে হাতাহাতি যুদ্ধ। কিন্তু ধীরে ধীরে ধৈর্য হারিয়ে ফেলছে রামোনের স্যৈরা। মনে মনে প্রমাদ শুনল রামোন। এখন যদি আরো সৈন্য সমাবেশ করে আনদোম তাহলে শেষ হয়ে যাবে ওর বিপ্লবের স্বপ্ন।

অন্যদিকে হতোদ্যম সৈন্যদেরকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে আবিবি। ধোয়া আর ধুলার মধ্য দিয়ে চিৎকার করে কথা বলছে সৈন্যদের সাথে। এমন সময় হামাগুড়ি দিয়ে ওর কাছে গেল রামোন।

“ব্লাডি ট্যাংকটা আর কতদূর?”

“আমি ফোন করেছি কতক্ষণ হয়ে গেল?”

“প্রায় ঘণ্টাখানেকেরও বেশি।” এত আগে! মনে হচ্ছে মাত্র মিনিট খানেক আগে শুরু হয়েছে আক্রমণ।

“রেডিওতে আবার খবর পাঠাও…”

 ঠিক সেই মুহূর্তে দুজনেই শুনতে পেল যান্ত্রিক একটা শব্দ।

“কাম অন!” লাফ দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল রামোন। একসাথে দৌড় দিল দু’জনে। মাথার পাশ দিয়ে শিষ কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে বুলেট।

আঙিনাতে এসে দেখতে পেল প্রবেশমুখে দাঁড়িয়ে থাকা ট্যাংক। ডান হাত উইন্ডমিলের মতো ঘুরিয়ে সামনে এগোবার নির্দেশ দিল রামোন।

 কাছেরই একটা মাটির দেয়াল গুঁড়িয়ে দিয়ে এগোতে শুরু করল টি-৫৩। রামোন আর তার কয়েকজন সৈন্য ঢুকে পড়ল খোলা ব্রিচ দিয়ে ভেতরে। সামনে যা পেল দেয়াল, কাঠ, মানুষের শরীর সবকিছু মাটির সাথে মিশিয়ে দুমড়ে মুচড়ে এগোতে লাগল যান্ত্রিক দানব।

বন্দুক ছেড়ে এদিক সেদিক পালাতে লাগল আনদোম বাহিনী। ভাঙ্গা দালান ছেড়ে অনেকেই হাত তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল।

“আনদোম কই?” ধূলি-আর চিৎকারের চোটে খসখসে হয়ে উঠল রামোনের গলা, “ওকে পেতেই হবে; কিছুতেই পালাতে দেয়া যাবে না।”

সবার শেষে এসে আত্মসর্মপণ করলেন জেনারেল। মেইন হলের পুরু মাটির দেয়াল গুঁড়িয়ে দিল টি-৫৩; চারজন সিনিয়র অফিসারকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন আনদোম। কপাল আর বাম চোখের উপর রক্তে ভেজা ব্যান্ডেজ। দাড়িতেও লেগে আছে রক্ত আর ধুলা।

কিন্তু ধকধক করে জ্বলছে অক্ষত চোখ। আহত সত্ত্বেও গমগমে স্বরে বলে উঠলেন,

“কর্নেল আবিবি, এটা বিদ্রোহ আর বিশ্বাসঘাতকতা। আমিই ইথিওপিয়ার প্রেসিডেন্ট-আজ সকালেই ডার্গ আমার নিয়োগকে বৈধতা দিয়েছে”।

প্যারাট্রুপারদের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল রামোন। তারা জেনারেলের বাহু ধরে হাঁট গেড়ে বসে পড়তে বাধ্য করল। নিজের হোলস্টার থেকে টোকারেভ পিস্তল নিয়ে আবিবি’র হাতে তুলে দিল রামোন।

বন্দির দু’চোখের মাঝখানে পিস্তল তাক করে ঠাণ্ডা স্বরে বলে উঠল আবিবি, প্রেসিডেন্ট আমান আনদোম, জনগণের বিপ্লবের নামে আমি তোমাকে পদত্যাগ করতে বলছি।” আর উড়িয়ে দিল জেনারেলের খুলি।

সামনের দিকে ঝাঁকি খেয়ে পড়ে গেল নিষ্প্রাণ দেহ; হলুদরঙা মগজ এসে ছিটকে পড়ল আবিবি’র পায়ে।

ধন্যবাদ কর্নেল-জেনারেল।” টোকারে আবার রামোনকে ফিরিয়ে দিল আবিবি।

“এই দায়িত্ব পালন করতে পেরে আমি সম্মানিত বোধ করছি।” আনুষ্ঠানিকভাবে মাথা নোয়ালে রামোন।

“আনদোম ডার্গের কতজন সদস্য ভোট দিয়েছিল?” সেনা বহর আবার ছুটে চলেছে আদ্দিস আবাবার দিকে।

“তেষট্টি জন।”

 “তাহলে বিপ্লবকে নিরাপদ করার জন্য এখনো বহু কিছু করতে হবে।”

রেডিও নিয়ে কর্নেল টাফুকে মেসেজ পাঠালো, আবিবি। নির্দেশ দিল যেন ডার্গের মেইন বিল্ডিংকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলা হয়। সেনাবাহিনীর অন্যান্য অংশকে নির্দেশ দেয়া হলো সমস্ত বিদেশি দূতাবাস আর কনস্যুলেটগুলোকে বন্ধ করে দেয়ার জন্যে।

দেশের মাঝে অবস্থানরত সমস্ত বিদেশি বিশেষ করে সাংবাদিক আর টেলিভিশন পার্সোনেলদেরকে তৎক্ষণাৎ এয়ারপোর্টে নিয়ে যাওয়া হলো প্লেনে তুলে দেয়ার জন্য। যা ঘটবে তার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী থাকা চলবে না।

আবিবি’র সবচেয়ে বিশ্বস্ত কয়েকজন সৈন্যের ছোট্ট একটা ইউনিট আর কিউবান প্যারটুপাররা মিলে ঢুকে পড়ল মিলিটারি কাউন্সিলে আর ডার্গের সেসব সদস্যদের বাড়িতে যারা আনদোমকে ভোট দিয়েছিল। হেঁটে হিঁচড়ে অপেক্ষমাণ ট্রাকে তুলে সকলকে নিয়ে আসা হলো মেইন অ্যাসেম্বলি চেম্বারের বিপ্লবী আদালতে। দালানের উঠানে ফায়ারিং স্কোয়াড একের পর এক নিশ্চিহ্ন করে দিল সকলকে।

 সবকটি মৃতদেহের পা একসাথে করে বেঁধে টেনে নিয়ে ভোলা হলো ট্রাকের উপরে। তারপর রাস্তা ধরে ট্রাক চলে গেল শহরের বাইরের ডাস্টবিনে।

“জনগণকে বিপ্লবের ন্যায়বিচার আর অবাধ্যতার শাস্তি কিরূপ তা দেখাতে হবে।” এহেন প্রদর্শনীর প্রয়োজন বুঝিয়ে বলল রামোন।

মৃতদেহ না সরানোর পক্ষে এবং পরিবারের সদস্যদের কোনোপ্রকার শোক পালনের বিপক্ষে আদেশ জারি করল কোর্ট।

মাঝরাত পর্যন্ত চলল এই হত্যাযজ্ঞ। কিন্তু অসম্ভব পরিশ্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও ঘুমোবার ফুরসৎ পেল না রামোন কিংবা ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট। রেডিওর পাশে বসে রিপোর্ট শুনতে শুনতে নিজের প্যাকের ভদকা আবিবি’কে এগিয়ে দিল রামোন।

 সকাল নাগাদ এয়ারপোর্ট, রেলওয়ে স্টেশন, রেডিও-টেলিভিশন ব্রডকাস্টিং-স্টুডিও, মিলিটারি দুর্গ আর ব্যারাক সমস্ত কিছু নিজেদের দখলে নিয়ে নিল আবিবির বিশ্বস্ত অফিসারদের দল। এরপরই মাত্র কয়েক ঘণ্টা ঘুমালো দু’জনে। কিন্তু দুপুরের মাঝেই আবার ইউনিফর্ম পরে তৈরি হতে হল ডার্গের মিটিংএর জন্যে।

আবিবিকে কনগ্রাচুলেট করতে গিয়ে কর্নেল জেনারেল মাচাদো বলে উঠল, “যদি তুমি ব্রুটাসকে মেরে ফেলো তাহলে তার ছেলেদেরকেও মেরে ফেলতে হবে। ১৫১০ সালে নিকোলো মেকিয়াভেলী বলে গেলেও আজও এটা সমান তাৎপর্যপূর্ণ, মিঃ প্রেসিডেন্ট।”

“তার মানে এখনি শুরু করতে হবে।”

 “হ্যাঁ।” একমত হল রামোন।”

“রেড টেরর’কে থামতে দেয়া যাবে না।”

***

“দ্য রেড টেরর শ্যাল ফ্লারিশ” শহরের প্রতিটি রাস্তার কোণায় কোণায় টাঙ্গিয়ে দেয়া হলো চার ভাষায় লেখা, তাড়াহুড়া করে প্রিন্ট করা শোস্টার।

 “জানি কারা পরবর্তীতে খাঁটি মার্কসিজমকে অবজ্ঞা করে বসবে। তাই এখনই তাদেরকে উপরে ফেলতে হবে।” টুপি খুলে মাথার ঘন কালো কোকড়া চুলে আঙুল ঢুকিয়ে দিল রামোন মাচাদো। শারীরিক অবসাদ সত্ত্বেও একটুও দিশেহারা হয়নি ভয়ংকর সবুজ চোখ জোড়া। এই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল আবিবি।

“শুধু বিরোধিতাকারীদেরকে নয়। বরঞ্চ বিরুদ্ধ মতকেও সমূল্যে উৎপাটন করে ফেলতে হবে। যেন আত্মমর্যাদার কোন বোধই-অবশিষ্ট না থাকে। আর তখনই-একদম নতুন করে দেশকে পুনর্নির্মাণ করে তোলা সম্ভব হবে।” রাস্তার মোড়ে মোড়ে জমে উঠল লাশের পাহাড়। এমনকি গলিতে খেলতে থাকা শিশুদেরকে তুলে নিয়েও বাবা-মায়ের সামনেই হত্যা করা হলো।

কয়েকজন বৃদ্ধ সৈনিক আর তাদের পরিবার-পার্বত্য অঞ্চলে লুকিয়ে পড়লেও এড়াতে পারল না ডেথ স্কোয়াড। পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলল ট্যাংক। মাঠে নিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তে বাধ্য করা হলো পুরুষদেরকে। গায়ের উপর দিয়ে চলে গেল যান্ত্রিক দানব। খরা শুকিয়ে যাওয়া মাটিতে মিশে গেল মৃতদেহের পেস্ট।

“এবারে সময় হয়েছে ধর্ম প্রচারকদের মোকাবেলা করা।” ঘোষণা করল রামোন।

“রাজতন্ত্রকে উৎখাতের ব্যাপারেও কাজ করেছে এরাই।” মনে করিয়ে দিল আবিবি।

অমানুষিক নির্যাতন করে মেরে ফেলা হলো এদের পুত্র-কন্যাদেরকে।

 “ব্রুটাসের সমস্ত ছেলেরাই মৃত্যুবরণ করেছে।” রামোনকে জানাল আবিবি।

“না, সবাই নয়।” রামোনের কথা শুনে হা করে তাকিয়ে রইল নতুন প্রেসিডেন্ট।

 “এখন আর ফিরে আসার কোনো পথ নেই; ঠিক যেমনটা হয়েছিল রাশান সেলারে, জার-নিকোলাস আর তার পরিবারের সাথে কেবল তখনই নিরাপদ হবে বিপ্লব।”

“কে করবে?” কোনো দ্বিধা ছাড়াই উত্তর দিল রামোন, “আমি।”

“এটাই সবচেয়ে ভাল হবে। নিজের স্বস্তি লুকাতে অন্যদিকে তাকাল আবিবি। “যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেরে ফেলুন।”

একা একটা খোলা জিপ চালিয়ে শহরের পুরোন অংশে চলে এলো। রামোন। মৃতদেহ পচনের গন্ধে রাস্তা দিয়ে চলা দায়। মানুষ নয়, শহরের জীবন্ত প্রাণী হিসেবে কেবল কাক আর শকুন চিলদের দেখা মিলেছে।

সিল্কের স্কার্ফ মুখে, মাথায় পেঁচিয়ে ভাবলেশহীন মুখে এগিয়ে চলল বিজয়ী জেনারেল।

কুঁড়েঘরটার সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে দু’জন গার্ড। রামোনকে দেখে চিনতে পেরে সাথে সাথে স্যালুট করল।

“আজকের মতো তোমাদের ডিউটি শেষ। এখন যাও।” আদেশ দিল রামোন।

দরজা খোলার আগে নিশ্চিত হয়ে নিল যে গলির শেষ মাথায় উধাও হয়ে গেছে গার্ড দু’জন। আলো আধারী মাখা রুমটাতে ঢুকে সানগ্লাস খুলে ফেলল রামোন। পুরো রুমে ছড়িয়ে আছে অসুস্থতার গন্ধ। বিছানার উপর ঝুলছে একটা রুপার কপাটিক ক্রস। মেঝেতে বসে থাকা এক নারী রামোনকে দেখে মাথায় কাপড় দিল।

“যাও।” ইশারায় দরজা দেখিয়ে দিতেই ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে মেঝের উপর হামাগুড়ি দিয়ে চলে গেল বাইরে।

কমব্যাট বুট পরিহিত পা দিয়ে দরজাটা আটকে দিল রামোন।

“নেগাস নেগাস্তি, রাজাদের রাজা রামোনের গলা শুনে নড়ে উঠল বিছানায় শুয়ে থাকা বৃদ্ধ।

কংকালসার এই দেহের সুস্থ চেতনা সম্পর্কে ভালই জানে রামোন। টলটল করছে পরনের সাদা আলখাল্লা। মোমের মতো দেহত্বক ভেদ করে দেখা যাচ্ছে প্রতিটা হাড়। প্লাটিনামের মতো জ্বলজ্বল করছে বহুদিনের নাকাটা চুল আর দাড়ি। উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছে নবিদের মতো বড় বড় ঘন কালো চোখ জোড়া।

“আমি তোমাকে চিনেছি।” মোলায়েম স্বরে জানালেন সম্রাট হালি সেসি।

“আমাদের কখনো দেখা হয়নি। শুধরে দিল রামোন।

“তারপরেও আমি জানি তুমি কে। আমি তোমার গন্ধ চিনি। তোমার চেহারার প্রতিটি রেখা, কণ্ঠস্বরের গভীরতা সব আমি জানি।”

“তাহলে বলুন, আমি কে?”

 “তোমার নাম মৃত্যু।”

“আপনি তো বেশ জ্ঞানী” কথা বলতে বলতে বিছানার দিকে এগোল রামোন।

“আমার সাথে যা করেছ তার জন্য তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম” জানালেন ইথিওপিয়ার সম্রাট হালি সেলসি, “কিন্তু আমার জনগণের সাথে যা করেছ তার জন্য কখনোই তোমাকে মাফ করব না।”

“ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সঁপে দিন বুড়ো।” বিছানার উপর থেকে বালিশ তুলে নিল রামোন, “দুনিয়া আপনার জন্য নয়।”

বুড়োর মুখে বালিশ চেপে ধরল রামোন।

ফাঁদে আটকে পড়া পাখির মতো ছটফট শুরু করলেন হালি সেলসি। লাথি মারতে শুরু করতেই আলখাল্লা উঠে এলো হাঁটুর উপরে। আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়ল শুকিয়ে যাওয়া সিগারেটের মতো দুটো পা।

তারপরেও আরো পাঁচ মিনিট পর্যন্ত বালিশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয় রইল রামোন। ভেতরে ভেতরে অনুভব করল একধরনের ধর্মীয় পরমানন্দ। ঠিক যেন তার সিদ্ধিলাভ হয়েছে। এতটা সন্তুষ্টি আর কখনো কোনো কাজেই পায়নি আগে।

এইমাত্র একজন রাজাকে খুন করেছে।

 সোজা হয়ে সরিয়ে ফেলল হাতের বালিশ। আলখাল্লাটাকে সুন্দর করে পা পর্যন্ত নামিয়ে দিয়ে ছোট্ট হাত দুটোকে বুকের উপর ভাজ করে বসিয়ে দিল। এরপর বুড়ো আঙুল দিয়ে স্পর্শ করে নামিয়ে দিল চোখের পাতা।

কী ভেবে যেন বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দেখল মৃত সম্রাটের চেহারা। বুঝতে পারল এটা তার জীবনের অন্যতম সন্ধিক্ষণ। পৃথিবীতে যা যা কিছু ও ধ্বংস করতে চায় তার প্রতীক হলো এই কংকালসার দেহ।

তাই সারা জীবনের জন্য ধরে রাখতে চাইল এই স্মৃতিচিহ্ন।

***

সম্ভাব্য সকল বিরুদ্ধমতই ধ্বংস হয়ে গেছে। মৃত্যুবরণ করেছে ব্রুটাসের পুত্রেরা। বিপ্লব এখন তাই সম্পূর্ণ নিরাপদ।

এবারে আফ্রিকার অন্যান্য বিষয়ের দিকে মন দিতে হবে। তাই ইথিওপিয়া। সরকারের সামরিক পরামর্শকের পদটি হস্তান্তর করে দিল জার্মান ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিকের এক সিকিউরিটি পুলিশের হাতে; যে কিনা প্রায়ই রামোনের মতই দক্ষ হাতে সিধে করতে পরে অবাধ্য জনগণ।

আবিবি’কে জড়িয়ে ধরে আবারো আইনুশিনে চড়ে বসল রামোন। গন্তব্য টার্সিও বেস। নীল আটলান্টিকের বুকে সূর্য ডুবে যেতে না যেতেই পৌঁছে গেল রামোন।

এয়ারস্ট্রিপ থেকে হেডকোয়ার্টার পর্যন্ত যেতে যেতে তার অনুপস্থিতিতে ঘটে যাওয়া সব সংবাদ জানিয়ে দিল রালেই তাবাকা।

খড়ের ছাদঅলা রামোনের প্রাইভেট কোয়ার্টারটা দেখতে অত্যন্ত সুন্দর হয়েছে। মেঝে কার্পেট শূন্য হলেও স্থানীয় কাঠুরেদের তৈরি আসবাবগুলো বেশ আরামদায়ক। আধুনিক বলতে একমাত্র লাগানো হয়েছে ইলেকট্রনিক কম্যুনিকেশন ইকুমেন্ট। মস্কো, গুয়ান্ডা, লিসবন আর হাভানার সাথে সরাসরি স্যাটেলাইট লিঙ্ক স্থাপন করা হয়েছে।

 ভেতরে পা দেবার সাথে সাথে মনে হলো আপন ঘরে পৌঁছে গেছে। রালেই তাবাকা চলে যাবার সাথে সাথেই কমব্যাট ইউনিফর্ম খুলে ফেলে মশারীর ভেতরে ঢুকে পড়ল রামোন। খোলা জানালা দিয়ে উষ্ণ বাতাস এসে পরশ বুলিয়ে দিল নগ্ন দেহে।

 কঠিন একটা কাজ অত্যন্ত দক্ষতা আর সফলতার সাথে শেষ করলেও এখনো ঠিক যেন তৃপ্তি পাচ্ছে না। মোজার্ট কিংবা মাইকেল এনজেলো’কেও ছাড়িয়ে গেছে ওর সৃষ্টি। কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করেছে একটা দেশ আর এর জনগণ, পর্বত, উপত্যকা, নদী, লেক, সমভূমি আর হাজার হাজার মানুষ, রক্ত, ধোঁয়া আর গুলি থেকে গড়ে তুলেছে মাস্টারপিস। এই দুনিয়াকেই ঈশ্বর মানে রামোন। আর রামোন তাঁর দূত। কাজ তো সবে শুরু হয়েছে। প্রথমে একটা দেশ, তারপর আরেকটা, অন্য একটা; এভাবে পুরো মহাদেশ।

কিন্তু হঠাৎ করেই মনে এলো সম্পূর্ণ ভিন্ন এক প্রসঙ্গ। হতে পারে এটা কুঁড়ে ঘর, বাতাস কিংবা সমুদ্রের গর্জনের জন্য-যেটাই হোক না কেন; মনে পড়ে গেল নিকোলাসের কথা। ঘুমের মাঝে ছেলেকে স্বপ্নেও দেখল রামোন। লাজুক হাসি ওর কণ্ঠস্বর…জেগে উঠার পর তো মনে হল কিছুতেই আর তর সইছে না। খানিকক্ষণের জন্যে হাভানা আর মস্কো থেকে পাওয়া কোডেড মেসেজ নিয়ে ভুলে থাকলেও কাজ শেষে খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই কল্পনায় ভেসে এলো রোদে পোড়া ছোট্ট একটা দেহ।

হতে পারে-আদ্দিস আবাবা’র রাস্তায় দেখা মৃতদেহ কিংবা আবুনা’র পুত্রদের নির্যাতনের চিত্র থেকেই জন্ম নিয়েছে এ অবসেশন। কিন্তু টার্সিও বেস ছেড়ে এখন নড়ার উপায় নেই। বল গড়াতে শুরু করেছে; হাতে প্রচুর কাজ বাকি। তাই হাভানাতে স্যাটেলাইট মেসেজ পাঠিয়ে দিল। ঘণ্টাখানেকের মাঝে উত্তরও চলে এলো।

ইথিওপিয়ার পরে ওকে আর অবজ্ঞা করার সাহস নেই কারো। পরের ফ্লাইটেই রামোনের কাছে পৌঁছে গেল নিকোলাস আর আদ্রা।

আইলুশিনের র‍্যাম্প বেয়ে ছেলেকে নেমে আসতে দেখে উদ্বেল হয়ে উঠল রামোনের বুক। মাথা উঁচু করে চোখ ভর্তি আগ্রহ নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামছে, ওর ছেলে। বাবাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল।

সানগ্লাসের পেছনে চোখ লুকিয়ে সৈন্যদের ভিড়ে দাঁড়িয়ে থেকে বহুক্ষণ ধরে ছেলেকে দেখল রামোন। কিন্তু উদ্ধত মন কিছুতেই এই অনুভূতিকে স্বীকার করতে রাজি নয়। “ভালোবাসা” শব্দটা নিয়ে মোটেই কোনো আগ্রহ নেই তার।

এরপরই ওকে দেখতে পেল নিকোলাস। প্রথমে দৌড় শুরু করলেও খানিক পরেই থেমে গেল। ঢেকে ফেলল অনিন্দ্য সুন্দর মুখখানাতে ফুটে উঠা আনন্দ। ভাবলেশহীন মুখে হেঁটে এলো রামোনের জিপের কাছে।

“গুড ডে পাদ্রে,” নরম স্বরে বলে উঠল নিকোলাস, “কেমন কাটছে। তোমার দিন?”

হঠাৎ করেই ইচ্ছে হল বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে ছেলেকে; কিন্তু নিশ্চল হয়ে বসে রইল রামোন। খানিক বাদে কেবল হাত মেলালো।

বাবার পাশের সিটে উঠে বসল নিকোলাস। গেরিলা ক্যাম্প পার হয়ে চলে এলো কম্পাউন্ডে। আগ্রহ নিয়ে সবকিছু দেখছে নিকোলাস। বেশ দ্বিধা নিয়ে বলে উঠল- প্রথম প্রশ্ন,

“এখানে এত মানুষ কেন? ওরাও কি আমাদের মতো বিপ্লবের পুত্র, পাছে?”

রামোন বিরক্ত না হওয়ায় সাহস পেয়ে গেল নিকি। এবারেও উত্তর পাওয়ায় বেশি সহজ হয়ে গেল ওর আচরণ।

জিপ থেকে রাস্তার সবাই স্যালুট করতেই নিজের সিটে শক্ত হয়ে গেল নিকোলাস; তারপর আবার সেও স্যালুট করে ফিরিয়ে দিল উত্তর। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হেসে ফেলল রামোন। হেসে ফেলল বাকিরাও।

কম্পাউন্ডে ফেরার পর দ্রুত কয়েকটা মেসেজের কিনারা করে আদ্রা আর নিকোলাসের জন্য বরাদ্দ করা কুঁড়েঘরে গেল রামোন। এতক্ষণ উত্তেজিত হয়ে গল্প করলেও ওকে দেখে থেমে গেল নিকি। সর্তক চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। “তোমার বাথিং সুট এনেছ?” জানতে চাইল রামোন।

“হ্যাঁ, পাদ্রে।”

“গুড। চট করে পরে নাও। আমরা একসাথে সাঁতার কাটব।”

একসাথে সাঁতার কাটা শেষ করে পাথরের উপর উঠে বসল পিতা-পুত্র। গল্প করার ছলে খুব সাবধানে ছেলেটাকে পরখ করে দেখল রামোন। বয়সের তুলনায় যথেষ্ট লম্বা আর শক্তিশালী নিকির কথা বলার টঙ একেবারে পূর্ণবয়স্ক মানুষের মতন।

বারান্দাতে বসে একসাথে ডিনার করল দু’জনে। বহুদিন পর পেট পুরে খেল আদ্রা’র রান্না। পানি মিশিয়ে নিকোলসাকে হাফ গ্লাস ওয়াইনও দিল। বেশ বড় বড় ভাব নিয়ে চুমুক দিয়ে খেল নিকোলাস।

এবারে আদ্রা ঘুমাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য আসলে বিনা বাক্য ব্যয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেও চলে এলো বাবার কাছে।

 “এখানে এসে আমার অনেক ভাল লাগছে, পাদ্রে?” ফর্মালি হাত বাড়িয়ে দিল নিকি।

হাত বাড়িয়ে দিতেই বুকর ভিতর রীতিমতো ঝড় অনুভব করল রামোন।

সপ্তাহখানেকের ভেতর টার্মি ক্যাম্পের সবার আদর কেড়ে নিল নিকোলাস। কয়েকজন এএনসি প্রশিক্ষক পরিবার নিয়ে বাস করাতে তাদেরই একজনের স্ত্রী ক্যাম্পের বাচ্চাদের জন্য স্কুল খুলে বসল। নিকি’কেও পাঠিয়ে দিল রামোন।

সাথে সাথেই বোঝা গেল যে নিকোলাস নিজের চেয়েও তিন চার বছরের বড় বাচ্চাদের মতনই বুদ্ধিমান। ইংরেজি এখানে শেখানের ভাষা হওয়াতে দ্রুত রপ্ত করে নিল নিকোলাস। আর সাথে করে নিয়ে আসা সকার-বলটার কল্যাণে সঙ্গীদের মাঝে প্রেস্টিজও বেড়ে গেল। কর্নেল জেনারেল রামোন মাচাদোর নির্দেশে স্কুলেই তৈরি করা হলো ফুটবল খেলার জায়গা আর গোল পোস্ট। নিকোলাসের দক্ষতা দেখে ওকে পেলে পেলে ডাকতে শুরু করল সকলে আর রোজকার ম্যাচে তো প্রতিদিনের দৃশ্য হয়ে উঠল।

জেনারেলের পুত্র হিসেবে সবকিছুতে বাড়তি খাতির পায় নিকোলাস। অস্ত্র নাড়াচাড়া করতেও বাধা দেয় না প্রশিক্ষকের।

একে ‘৪৭ অ্যাসল্ট রাইফেল সম্পর্কে নতুনদেরকে শিক্ষা দেয় নিকি আর গর্বিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে দেখে রামোন; কেমন করে বিশটার মাঝে বারো রাউন্ড নিশানা মতো লাগাতে পারে নিকোলাস।

 রামোনের অজান্তেই নিকিকে জিপ চালানো শিখিয়েছে কিউবা ড্রাইভার জোসে। জানতে পারে যখন কুশনের উপর বসে জিপ চালিয়ে বাবাকে এয়ারস্ট্রিপে নিয়ে যায় নিকি।

তাদের গাড়ি দেখলেই “ভাইভা পেলে!” বলে চিৎকার জুড়ে দেয় দু’পাশের লোকেরা।

 ক্যাম্পের টেইলার নিকোলাসকে ক্যামোফ্লেজ কমব্যাট পোশাক আর কিউবান স্টাইলের নরম টুপি বানিয়ে দিল। বাবার মতই এক চোখের উপর খানিকটা হেলিয়ে টুপি পরে নিকি। রামোনের আনঅফিসিয়াল ড্রাইভার নিকোলাস বাবার প্রতিটি হাবভাব যেন নকল করে;

মাঝে মাঝে বিকেল বেলা পঞ্চাশ হর্সপাওয়ার আউটবোর্ড মটরঅলা নৌকাটাকে নিয়ে চলে যায়, নীল আটলান্টিকের শৈলশিরায় মাছ ধরতে। হ্যান্ড লাইনস ব্যবহার করে কোরালের মাছ ধরে। ময়ূরকণ্ঠী নীল, সবুজ, হলুদ আর উজ্জ্বল লাল রঙা মাছগুলো মাঝে মাঝে এত বড় হয় যে পানি থেকে টেনে তুলতে নিকোলাসকে সাহায্য করে রামোন। কিন্তু কারো সহায়তা নিতে চায় না। নিকি। এমনকি বাবা’র সাহায্যও না আর দিন শেষ হয়ে গেলেও ওর মাছ ধরার নেশা যায় না। “আরেকটা পাত্রে জাস্ট একটা,” অবশেষে জোর করে বঁড়শি কেড়ে নেয় রামোন।

একদিন একটু বেশিই সন্ধ্যা হয়ে গেল। চারপাশে অত্যন্ত শীতল বাতাস বইছে। শিরশির করে নিকোলাসের সব লোম দাঁড়িয়ে গেল ঠাণ্ডা আর উত্তেজনায়।

 এক হাতে নৌকার স্টিয়ারিং ধরে অন্য হাতে ছেলের কাধ ধরল রামোন। প্রথমে শক্ত হয়ে গেলেও একটু পরে গুটিসুটি মেরে বাবার বুকের ভেতর সেধিয়ে গেল নিকোলাস।

হাতের মাঝে কাঁপতে থাকা ছোট্ট দেহটাকে নিয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল রামোন। আবারো মনে পড়ে গেল আদ্দিস আবারা’তে দেখা আবুনা’র ছেলেদের মৃতদেহের কথা। সকেট থেকে বেরিয়ে এসেছে চোখ, আঙুলের সমান কর্তিত পুরষাঙ্গ ঝুলছে মৃত ঠোঁটে। তবে এসব কিছুরই প্রয়োজন ছিল; যেমন ছিল বুকের কাছে লেপ্টে থাকা বাচ্চাটাকে পানিতে ডুবিয়ে রাখা। মাঝে মাঝে কঠিন আর নিষ্ঠুর দায়িত্ব পেলেও পিছপা হয় না। রামোন। তারপরেও এখনকার মতো আর কখনো সন্তানপ্রেমে আপ্লুত হয়নি।

নৌকা থেকে নেমে লণ্ঠনের আলোয় ক্যাম্পে ফেরার সময়েও রামোনের হাত ধরে রইল নিকোলাস। কম্পাউন্ডের গেইটে না পৌঁছানো পর্যন্ত পিতা-পুত্র কেউই কোনো কথা বলল না। এরপর আস্তে আস্তে নিকি জানালো : “আমার ইচ্ছে করছে তোমার সাথে সবসময় এখানেই থাকতে।”

রামোন এমন ভাব করল যেন কিছুই শুনতে পায়নি;

কিন্তু বুকের মাঝে কেমন যেন টনটন করে উঠল।

মাঝ রাতের পরে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিল সিগন্যাল ক্লার্ক। ঘরের দরজায় হালকা একটা টোকার শব্দ শুনলেই টোকারেভ পিস্তল নিয়ে পুরোপুরি সজাগ হয়ে যায় রামোন।

“কী হয়েছে?”

“মস্কো থেকে লাল গোলাপের মেসেজ এসেছে।” লাল গোলাপ যখনই যোগাযোগ করুক না কেন দিনে কিংবা রাতে সাথে সাথে রামোনকে ডেকে তোলার নির্দেশ দেয়া আছে ক্লার্কের উপর।

“আমি এখনি আসছি।”

স্কাইলাইট প্রজেক্টের সিডিউল ডেট আর প্লেস জানিয়ে দিয়েছে লাল গোলাপ।

মেইন এএনসি ক্যাম্পে ড্রাইভার পাঠিয়ে দিল রামোন। চল্লিশ মিনিটের মাঝে রাতেই তাবাকা চলে এলো।

 “আমাদেরকে এখনি লন্ডনে যেতে হবে।” রালেই মেসেজটা পড়তে পড়তে জানালো রামোন। “এটা এত গুরুত্বপূর্ণ যে এখান থেকে কো-অর্ডিনেট করা যাবে না। লন্ডন অ্যামব্যাসি আর ইউকে এএনসি অফিসের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে হবে।”

তৃপ্তির হাসি হাসল রামোন। সপ্তাহ শেষ হবার আগেই নিরাপত্তা পরিষদের সামনে পাটি পেতে বসে পড়বে বোয়ারা।”

নিকোলাসকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বিদায় জানাল রামোন।

“তুমি কখন ফিরে আসবে পাদ্রে?” কোনো রকম দুঃখবোধ না দেখিয়েই জানতে চাইল নিকি।

“জানি না, নিকি।” প্রথমবারের মতো ডাকনামটা ধরে ছেলেকে ডাকল রামোন। ওর ঠোঁটে কেমন যেন আজব লাগল শব্দটা।

“তুমি ফিরে আসবে তো পাদ্রে?”

“হ্যাঁ। প্রমিজ করছি।”

“হ্যাঁ, নিকি তুমি আর আদ্রা এখানেই থাকবে।”

 “আর আমাদেরকেও এখানে থাকতে দেবে? তাই না?”

“থ্যাংক ইউ। আমি খুব খুশি হয়েছি।” জানাল নিকোলাস, “গুড বাই পাদ্রে।”

একে অন্যের সাথে হাত মিলিয়ে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে অপেক্ষারত জিপে, উঠে বসল রামোন।

***

স্কাইলাইট টেস্টকে ভণ্ডুল করে দেয়া তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। কারণ প্রায় তিন বছর আগে থেকেই দক্ষিণ আফ্রিকার পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রচেষ্টা সম্পর্কে সবকিছুই তারা জানে।

যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো পশ্চিমা বিশ্বের কাছ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকাকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া; রাজনৈতিক অঙ্গনে দক্ষিণ আফ্রিকার ললাটে কালিমা লেপন করে দেয়া।

 সোভিয়েত অ্যামব্যাসির সেলারে অ্যামব্যাসাডরের সেইফ রুমে জড়ো হলো সকলে। মস্কো থেকে উড়ে এসেছেন জেনারেল বোরেদিন আলেক্সেই ইউদিনিচ। বোঝাই যাচ্ছে ফরেন মিনিস্ট্রি কেজিবি’র আফ্রিকান সেকশনকে কতটা গুরুত্ব দেয়। ফলে বহুগুণে বেড়ে গেল কর্নেল জেনারেল রামোন মাচাদোর পার্সোনাল প্রেস্টিজ।

আসছে সপ্তাহেই স্কাইলাইট টেস্ট করা হবে। তাই পুরো ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু বেশ বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠিয়েছে লাল গোলাপ। বোমার স্পেসিফিকেশন, নতন ডিফাইভ আর্টিলারী রাউন্ডের ডেলিভারী, টেস্ট হোলের গভীরতা আর অবস্থান; এমনকি ডিটোনেট করার ইগনিশন সিস্টেম পর্যন্ত সমস্ত কিছুই রিপোর্টে লেখা আছে।

“আজ ঠিক করতে হবে যে আলোচনা শুরু করলেন ইউদিনিচ, “এই তথ্যকে কিভাবে কাজে লাগানো যায়।”

“আমার মনে হয় কমরেড়” আগ্রহ নিয়ে যোগ করল রালেই লন্ডনে একটা প্রেস কনফারেন্স করার অনুমতি দিয়ে দিন।”

রামোনের ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠল বাঁকা হাসি।

“কমরেড সেক্রেটারী-জেনারেল চওড়া হাসি হাসলেন ইউদিনিচ, “আমার মনে হয় ঘোষণাটা যদি সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট দেন, তাহলে ব্যাপারটা যথোচিত গুরুত্ব পাবে।” বিদ্রুপের স্বরে বলে উঠলেন ইউদিনি। তিনি আবার কালোদেরকে পছন্দ করেন না।

এই মিটিং-এর আগে ব্যক্তিগতভাবে রামোনকে জানিয়ে ছিলেন- এসব “বানর” কে আলোচনা থেকে বাদ দেয়ার কথা। আপনার তো ওদের সাথে মেশার ভালো অভিজ্ঞতা আছে, কমরেড। এক প্যাকেট বাদাম নিয়ে আসব নাকি, কী বলেন?; মিটি মিটি হেসেছেন ইউদিনিচ।

ঝাড়া বিশ মিনিট ধরে কোনো কথা বলল না রামোন। বাকি দুজনের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় দেখে অবশেষে মধ্যস্থতা করলেন বোরোদিন : “আচ্ছা কমরেড জেনারেল মাচাদোর রায় জানলে হয় না? উনার সোর্সের কাছ থেকে তো তথ্যটা এসেছে- হয়তো উনিই ভাল বলতে পারবেন যে এ থেকে কতটা ফায়দা লোটা যায়।”

সকলে এবার রামোনের দিকে তাকাল। উত্তরটা আগেই তৈরি করে রেখেছে কর্নেল জেনারেল।

“কমরেড আপনাদের সবার কথাতেই যুক্তি আছে। কিন্তু এএনসি হোক কিংবা সোভিয়েত রাশিয়া উত্তেজনা একদিনেই ফুরিয়ে যাবে। তাই আমার মনে হয় খানিকটা করে তথ্য চাউর করে দেখা যাক কী ঘটে।”

সবাই চিন্তায় পড়ে গেল। রামোন বলে চলল, “আমার মনে হয় নিজেরা না বলে এই ঘোষণা দেবার দায়িত্ব আমেরিকার সবচেয়ে শক্তিশালী কণ্ঠের উপর ছেড়ে দিলেই ভালো হবে; যা ইউনাইটেড স্টেটসহ শাসন করে পুরো পশ্চিমা বিশ্ব।”

দ্বিধায় পড়ে গেলেন ইউদিনিচ, জেরাল্ড ফোর্ডঃ ইউনাইটেড স্টেটসের প্রেসিডেন্ট?”

“না, কমরেড মিনিস্টার। গণমাধ্যম। আমেরিকার সত্যিকারের সরকার। ফ্রিডম অব স্পিচের মতো শক্তিশালী আর কোনো অস্ত্র নেই। আমরা কোনো প্রেস কনফারেন্স কিংবা অ্যানাউসমেন্ট কিছুই করব না। যা করার করবে আমেরিকান টেলিভিশন নেটওয়ার্কস। খানিকটা গন্ধ ছড়িয়ে দিলে তারা নিজে থেকেই খুঁজে বের করবে। খরগোশের গর্ত। এটা যে কতটা কার্যকরী তা তো আপনারা নিজেরাই জানেন, হাউন্ডের মতো তাদের উত্তেজনা বেড়ে যাবে যখন জানতে পারবে যে শিকার পুরোপুরি একা। “ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম” নামে আদর করে ডাকে যারা তাদের সরকার। সরকারের মিত্র আর ক্যাপিটালিস্ট সিস্টেমের সবচেয়ে ক্ষতি করতে পারে। অথচ তাদেরকেও সাহায্য করে এই সিস্টেম।”

এক দৃষ্টিতে খানিক তাকিয়ে থেকে হেসে ফেললেন ইউদিনিচ “আমি শুনেছি আফ্রিকাতে আপনাকে নাকি সবাই ফক্স ডাকে কমরেড জেনারেল।”

 “দ্য গোল্ডেন ফক্স।” বোরোদিন শুধরে দিতেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল ইউদিনিচ।

“নিজের নামের সার্থকতা আপনি যথেষ্টই প্রমাণ করেছেন কমরেড জেনারেল। তাহলে আরো একবার আমাদের হয়ে কাজ করে দিক আমেরিকা আর ব্রিটেন।”

***

স্কাইলাইট অপারেশনের সফলতা শতগুণে বাড়িয়ে দিল লাল গোলাপের মূল্য। কিন্তু কিছু সমস্যাও দেখা দিল।

দক্ষ হাতে এখন মেয়েটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। একই সাথে উৎসাহও দিতে হবে। স্কাইলাটের জন্য ওকে এখনই পুরস্কার অর্থাৎ নিকোলাসের কাছে আসার সুযোগ দিতে হবে।

সম্প্রতি তার মাঝে বসতি করা বুর্জোয়া মনোভাবের কারণে দায়িত্বের অবহেলা করতে মোটেই রাজি নয় রামোন। ভালই জানে যে প্রয়োজন পড়লে নিকোলাসকেও উৎসর্গ করতে এক মুহূর্তও দ্বিধা করবে না।

তার আগ পর্যন্ত কোনো ভাবেই নিকোলাসকে কোনো বিপদের মুখে পড়তে দেয়া যাবে না। বিশেষ করে লাল গোলাপ কিংবা অন্য কেউই যাতে ছেলেটাকে রামোনোর কাছ থেকে নিয়ে যাবার চেষ্টা না করতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

তাই আবারো স্পেনে হাসিয়েন্দার কথাই মনে এলো। কিন্তু যদি দক্ষিণ আফ্রিকার এজেন্টের মাধ্যমে মাদ্রিদে ব্রিটিশ অ্যামবাসিতে নিকিকে নিয়ে চলে যায় লাল গোলাপ? না স্পেনও নিরাপদ নয়।

হ্যাঁ মস্কো কিংবা হাভানা’তে দেখা করার ব্যবস্থা করা যায়। কিন্তু তাতেও তার প্রভুদের অস্তিত্ব জেনে যাবে লাল গোলাপ। তারমানে এই পথও বন্ধ।

হাতে বাকি রইল চিকাৰ্মা নদীর ধারে। টাসিও বেস। এখানে হাজার মাইলের ভেতরে কোনো বিদেশি দূতাবাস নেই। নিকোলাস তো আছেই। লাল গোলাপকে আনতেও তেমন ঝামেলা হবে না। টার্সিওতে এলে পৃথিবীর কারো সাধ্য নেই

লাল গোলাপকে রামোনের হাত থেকে বাঁচায়।

 সুতরাং টার্সিওই সই।

***

ঘুম থেকে জেগে উঠলেও ইসাবেলা প্রথমে বুঝতেই পারল না যে কোথায় আছে। এরপরই বুঝতে পারল যে বদলে গেছে আইলুশিনের ইঞ্জিনের শব্দ না ঘুমানোর মতো চেষ্টা সত্তেও জাম্প সিটের উপর বসে চোখ বুজে ফেলেছিল।

দ্রুত একবার হাতঘড়ি দেখে নিল। লুসাকা ছাড়ার পর দুই ঘণ্টা পঞ্চাশ মিনিট পার হয়ে গেছে। সিটের উপর খানিক উঠে বসে পাইলটের কাঁধের, উপর দিয়ে ইনস্টমেন্ট প্যানেল চেক করল বেলা। একই হেডিং’য়ে থাকলেও নামতে শুরু করেছে প্লেন।

ককপিটের উইন্ডস্ক্রিন দিয়ে সামনে তাকাতেই দেখা গেল অলস সন্ধ্যাতে পানির মাঝে ডুবে যাচ্ছে সূর্য।

লেক? স্মৃতি হাতড়ে এতবড় কোনো আফ্রিকান লেকের কথা মনে করতে না পারলেও আচমকা চিন্তাটা এলো মাথায়।

 “দ্য আটলান্টিক! আমরা পশ্চিম উপকূলে পৌঁছে গেছি।” আবারো চোখ বন্ধ করে আফ্রিকার ম্যাপ মনে করতে চাইল বেলা, “অ্যাঙ্গোলা, কিংবা জায়ারে।”

নীল আটলান্টিকের বুক চিরে ফুটে উঠেছে সাদা কোরাল সৈকত।

বেশ চওড়া আর বাদামি রঙা একটা নদীর মুখ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কঙ্গো কিংবা লুয়ান্ডা নদী নয়। হৃদের উপরে কয়েক মাইল গেলেই নদী জোড়া এসের রূপ নিয়েছে। এর সামনেই লাল কাদামাটির ল্যান্ডিং স্ট্রিপ। নদীর মোড়ে এখানে গড়ে উঠেছে খড়ে ছাওয়া কুঁড়ে ঘরের বিস্তৃত বসতি।

মাটিতে নেমে ট্যাক্সি করে স্ট্রিপের শেষ মাথা পর্যন্ত চলে গেল ক্যান্ডিড। পাইলট ইঞ্জিন বন্ধ করতেই এগিয়ে এলো কয়েকটা ট্রাক। দেখা গেল ক্যামোফ্লেজ পোশাক পরিহিত অসংখ্য সশস্ত্র সৈন্য।

 “এখানেই-অপেক্ষা করুন।” জানাল পাইলট, “আপনাকে নিতে আসবে।”

ফ্লাইট ডে’কে প্রবেশ করল দুই অফিসার। এদের মাঝে একজন মেজর। ব্যাজ কিংবা ব্যাঙ্ক ছাড়া আর কোনো চিহ্ন নেই।

কোন দেশি হতে পারে ভাবতে ভাবতেই মেজর স্প্যানিশ বলে উঠল, “ওয়েলকাম সিনোরা, প্লিজ আমাদের সাথে আসুন।”

“আমার স্যুটকেস” দেখিয়ে দিতেই একজন লেফটেন্যান্ট অপেক্ষারত ট্রাকে নিয়ে এলো বেলার লাগেজ।

চুপচাপ নিঃশব্দে বিশ মিনিট ধরে গাড়ি চালিয়ে নদীর মুখে ইসাবেলাকে নিয়ে এলো মেজর। পথিমধ্যে আকাশ থেকে দেখা কুঁড়েঘরগুলো দেখতে পেল বেলা। সশস্ত্র গার্ডেরা গেইট পাহারা দিচ্ছে। গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে দেখা যাচ্ছে আকাশ।

অপেক্ষাকৃত ছোট্ট একটা কম্পাউন্ডে এসে ঢুকলো গাড়ি। পাশ দেখাতেই ভেতরে ঢুকতে দিল গার্ড। এখানকার ঘরগুলো ছোট হলেও অন্যগুলোর চেয়ে পরিষ্কার। সবমিলিয়ে সৈকতের ধারে নয়টা ঘর আছে।

ট্রাক থেকে নেমে চারপাশে তাকালো বেলা। মন্দ নয়-সমুদ্র বালি, তাল গাছ আর কুঁড়ে ঘর হলিডে কাটানোর জন্য মোটামুটি আদর্শ বলা চলে।

অত্যন্ত বিনয়ের সাথে সবচেয়ে বড় কুঁড়েঘরটার কাছে নিয়ে গেল সাথে আসা মেজর। কিন্তু ইউনিফর্ম পরিহিত দুই নারীকে দেখেই বুকের মধ্যে হাতুড়ির বাড়ি পড়ল। আবারো সেই ভয়ংকর শারীরিক লাঞ্চনার মাঝে দিয়ে যেতে হবে এখন।

কিন্তু এবারে ভয় অমূলক। প্রায় অপরাধীর ভঙ্গিতে বেলার স্যুটকেস আর হ্যান্ডব্যাগ চেক করে দেখল দু’জনে; এমনকি পোশাক খোলার কথাও বলল না। শুধু কোডাকের সুইংগার টাইপ ক্যামেরা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল দুই নারী। ক্যামেরাটা বোধহয় হারাতেই হবে। তাড়াতাড়ি তাই বেলা বলে উঠল,

“এটা তেমন দামি কিছু না। যদি চান তো নিয়ে যান।”

অবশেষে বাড়তি দু’টো ফিল্মসহ ক্যামেরা নিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল নারীদ্বয়।

দেয়ালের পিপ হোল দিয়ে এতক্ষণ সবকিছুই দেখতে পেয়েছে রামোন। সতর্ক থাকার নির্দেশ দিলেও অনর্থক খোঁচাখুঁচি বারণ করে দিয়েছিল। হাতে ক্যামেরা নিয়ে এবারে তাই মাথা নাড়ল নারী সৈন্যদের উদ্দেশ্যে। খুব দ্রুত একবার চেক করে আবার ফিরিয়ে দিল।

ক্যামেরাটা ফিরে পেয়ে অসম্ভব খুশি হলো বিস্মিত ইসাবেলা। অন্যদিকে মনোযাগ দিয়ে মেয়েটাকে দেখছে রামোন। চুলগুলো লম্বা হয়েছে আর চেহারাতেও এসেছে পরিণত ভাব। হাবে ভাবে কর্তৃত্বপরায়ণ মেয়েটা ভালো ভাবেই জানে কতটা সফল হতে পেরেছে।

 শারীরিকভাবে স্লিম হলেও ফিট। প্রটেশনাল অ্যাথলেটদের মতো পেশিবহুল দেহত্বক। বেশ ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে যে রামোনের দেখা শত শত নারীর মাঝে বিশেষ ভাবে আকষর্ণীয় তিন থেকে চার জনের মাঝে বেলাও থাকবে। যাই হোক বেশ সন্তুষ্ট হলো রামোন। এই মেয়েটার জন্যই ওর নিজের ক্যারিয়ারেও বেশ কিছু সফলতা এসেছে।

এতক্ষণে সার্চ শেষ করে আবারো ইসাবেলার স্যুটকেসের ডালা আটকাল দুই নারী। এদের একজন এবারে সুটকেস তুলে বেলাকে নিয়ে গেল কম্পাউন্ডের শেষের গেইটের কাছে। দেয়াল ঘেরা জায়গাটার মাঝে মাত্র দুটো কুঁড়ে ঘর।

 একপাশে মশারি টানানো বিছানা অলা বড়সড় একটা লিভিং রুমে বেলা’কে রেখে চলে গেল উর্দিধারী নারী।

খুব দ্রুত আশপাশ দেখে নিল বেলা। পেছন দিকে একটা শাওয়ার রুম আর মাটির টয়লেট আছে। সব দেশে শুনে চিজোরা কনসেশনে শ’নের হান্টিং ক্যাম্পের কথা মনে পড়ে গেল।

পর্দা ঘেরা শেলফ দেখা যেতেই স্যুটকেস খুলতে শুরু করল বেলা। কিন্তু কাজ শেষ হবার আগেই চিৎকার শুনে তাড়াতাড়ি খোলা জানালা দিয়ে সৈকতের দিকে তাকাল।

 যেখানে কিংবা যখনই শুনুক না কেন এই আনন্দ মাখা কণ্ঠস্বর চিনতে কখনো ভুল হবে না।

নিকোলাস!

 বাদিং ট্রাঙ্ক পরা নিকোলাস আগের চেয়েও ইঞ্চি খানেক বেড়ে গেছে।

সাদা-কালো ডোরাকাটা একটা মনগ্রেল পাপি’র সাথে খেলছে নিকি। হাসতে হাসতে কান ফাটানো চিৎকার করছে নিকি, অন্যদিকে কুকুরের বাচ্চাটাও হিস্টিরিয়ার মতো তীক্ষ্ণ স্বরে ঘেউঘেউ করছে।

হাতে থাকা লাঠিটা সজোরে সমুদ্রে ছুঁড়ে মারল নিকি। আর চিৎকার করে কুকুর ছানাকে আদেশ দিল, “নিয়ে আয়।” খুব দ্রুত সাঁতার কেটে ঠিকই চোয়ালে করে লাঠিটাকে নিয়ে ফিরে এলো কুকুরটা।

“গুড বয়। কাম অন” উৎসাহ দিল নিকোলাস। কিন্তু কুকুরছানাটা তীরে এসে গা ঝাঁপটা দিতেই নিকি’র শরীরে এসে পড়ল পানির ছিটে। লাঠির এক মাথা ধরে ঘোৎ ঘোৎ করে উঠল নিকি। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে লাগল কুকুর আর মনিব।

ঝাপসা হয়ে এলো ইসাবেলা’র চোখ। ঘর থেকে বেরিয়ে আস্তে আস্নেত চলে এলো পানির কিনারে। কিন্তু খেলায় ব্যস্ত নিকোলাস খেয়ালই করল না যে দশ মিনিট ধরে চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে বেলা।

যখন দেখতে পেল সাথে সাথে বদলে গেল ওর আচরণ। কুকুর ছানাকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে আদেশ দিল “সিট।” জলের ধার রেখে এগিয়ে এলো বেলার কাছে।

 “গুড ডে, মাম্মা।” শ্রদ্ধাভরে হাত বাড়িয়ে দিল নিকি, “কেমন কাটছে দিন?”

“তুমি জানতে যে আমি আসব?”

“হ্যাঁ, আর তোমার সাথে লক্ষ্মী হয়েই থাকতে হবে।” সহজভাবে উত্তর দিল নিকি।

“কিন্তু এ কয়দিন স্কুলে যেতে পারব না।”

 “তুমি স্কুল পছন্দ করো নিকোলাস?”

“হা, মাম্মা, অনেক। আমি তো এখন পড়তেও পারি। ইংরেজিও শিখছি।” এই ভাষাতেই উত্তর দিল নিকি।

 “তোমার ইংরেজি তো বেশ ভালো মজার ব্যাপার হচ্ছে আমিও তোমার জন্য কয়েকটা ইংরেজি বই এনেছি।” নিকি’র দুঃখ কমাতে চাইল বেলা, “মনে হয় তোমার ভাল লাগবে।”

 “থ্যাঙ্ক ইউ।”

 কেন যেন মন খারাপ হয়ে গেল। কোথায় যেন একটা তাল কেটে গেছে বলে ভাবল বেলা।

“তোমার কুকুর ছানার নাম কী?”

“জুলাই ছাব্বিশ।”

 “এটা তো বেশ অদ্ভুত নাম। কেন এই নামে ডাকো?”

মায়ের অজ্ঞতা দেখে অবাক হয়ে গেল নিকি। “জুলাই ছাব্বিশেই তো বিপ্লব শুরু হয়েছিল। সবাই জানে।”

“ওহ্, আচ্ছা তাই তো। আমি কী বোকা।”

“আমি অবশ্য শুধু ছাব্বিশ ডাকি।” শিষ বাজাতেই দৌড়ে এলো নিক্রি ছাব্বিশ। “সিট” হ্যান্ড শেক কর।”

একটা পা তুলে এগিয়ে দিল ছাবিশ।

“তোমার ছাব্বিশ তো বেশ চালাক। ভালই ট্রেনিং দিয়েছ।”

 “হ্যাঁ।” শান্ত স্বরে মেনে নিল নিকি। “ও হচ্ছে দুনিয়ার সবচেয়ে চালাক কুকুর।”

“মাই বেবি।” আপন মনে ভাবল বেলা, “ওরা তোমার কী হাল করেছে? ছোট্ট মনটার উপর কতটা ছাপা ফেলেছে যে ভয়ংকর কোনো এক রাজনৈতিক ঘটনার নামে নিজের কুকুরের নামে রেখেছ?” নিকোলাস কোন বিপ্লবের কথা বলছে বুঝতে না পারলেও বেলা’র চোখে মুখে ফুটে উঠল নিদারুণ যন্ত্রণা। বিস্মিত নিকি তাই জানতে চাইল, “তুমি ঠিক আছে, মাম্মা?”

“ওহ! হ্যাঁ, ঠিক আছি।”

“চলো আদ্রার কাছে নিয়ে যাই।” হাঁটতে গিয়ে ছেলের হাত ধরতে চাইল বেলা; কিন্তু আস্তে করে সরিয়ে নিল নিকি।

“তুমি যে সকার বল দিয়েছিলে, সেটা এখনো আমার কাছে আছে।” বেলা’কে প্রবোধ দিতে চাইল নিকি। আবারো তাকে ছেলের সাথে ভাব করার জন্য শুরু থেকে চেষ্টা করতে হবে ভাবতেই ভিজে উঠল চোখ।

“আমাকে সবকিছু সহজভাবেই নিতে হবে।” নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করল বেলা। “ওকে বেশি চাপ দেয়া যাবে না।”

বেলার কোনো ধারণাই ছিল না যে ছেলেকে কমব্যাট পোশাকে দেখবে। এক চোখের উপর হেলানো টুপি আর বেল্টে পোড়া বুড়ো আঙুল নিয়ে নিকি চাইল মায়ের মনোযোগ পেতে। নিজের মানোঃকষ্ট লুকিয়ে রেখে তাই মাঝে মাঝেই প্রশংসা করতে বাধ্য হলো বেলা।

সাথে করে এমন কিছু বই নিয়ে এসেছে যা নিকোলাসের বয়সী ছেলেরা পছন্দ করে। ভাগ্য ভালো এর মাঝে ফক অব দ্য বুশভেল্ড আছে; একজন লোক আর তার পোষা কুকুর নিয়ে রচিত আফ্রিকান ক্লাসিক।

মলাটের ছবিটা দেখে সাথে সাথে খুশি হয়ে গেল নিকি। কাহিনী সহজভাবে লেখা হলেও বেশ সুন্দর। আর নিকোলাসের মেধা দেখে অবাক হয় বেলা। একটা কি দুটো অপরিচিত শব্দ বাদে একাই পড়ে ফেলল পুরো গল্প।

এরপর আদ্রা এসে ওকে ঘুমাতে নিয়ে যাবার মাঝেই আবারো বেশ অন্তরঙ্গ হয়ে উঠল দু’জন।

গুডনাইট জানিয়ে মায়ের সাথে হাত মেলাতে এসে আচমকা বলে উঠল নিকি : “গল্পটা বেশ ভালো। জা দ্য ডগ’মে আমার অনেক পছন্দ হয়েছে। আর তুমি আসাতেও ভালো লাগছে। তাই স্কুলে না গেলেও কোনো ক্ষতি নেই।” নিজের বক্তব্যে নিজেই লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি রুম থেকে চলে গেল ছোট্ট বুড়া।

নিকি’র বেডরুমের আলো নিভে যেতেই আদ্রা’র খোঁজে বের হলো বেলা। জানতে ইচ্ছে করছে রামোন কোথায়, নিকি’কে অপহরণের ব্যাপারে ওর ভূমিকাটাই বা কতটা ছিল।

 রান্নাঘরে ডিনারের ডিশগুলো ধুতে ব্যস্ত আদ্রা বেলা’কে দেখেই একেবারে চুপ মেরে গেল। এক শব্দে ইসাবেলার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিলেও চোখের দিকে তাকাচ্ছে না। চেষ্টা ছেড়ে তাই নিজের ঘরে চলে এলো বেলা।

ভ্রমণের ক্লান্তি সত্ত্বেও আরাম করে ঘুমোল। ভোরবেলা তাড়াতাড়ি উঠে গেল পুত্রের সঙ্গ পাবার জন্য। তবে সারাদিন ছাব্বিশ’কে নিয়ে সৈকতেই কাটিয়ে দিল দু’জন। ব্যাগ ভর্তি উপহারের মধ্যে নিকোলাস একটা টেনিস বল পেয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এটা নিয়ে আনন্দ করল নিকি আর টুয়েন্টি-সিক্স।

 এরপর রীফে সাঁতার কাটল দুজনে মিলে; মা’কে কোরালের গর্ত থেকে সী-ক্যাট বের করে আনার কৌশল দেখাল নিকি। ছোট ছোট অক্টোপাসগুলোকে নিয়ে মায়ের ভয় দেখে হেসে বাঁচেনা নিকি।

 “আদ্রা। ডিনারে রান্না করে দেবে, কোন সমস্যা নেই।” প্রমিজ করল। নিকোলাস।

“তুমি আদ্রা’কে বেশ ভালোবাসো, তাই না? জানতে চাইল বেলা।

“অবশ্যই। আদ্রা তো আমার মা।” কী বলেছে বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিল নিকি মানে তুমি আমার মাম্মা; কিন্তু আদ্রা’ই তো আমার আসল মা।”

বেলা’র ইচ্ছে হল চিৎকার করে কেঁদে উঠে।

দ্বিতীয় দিন বাইরে ভোরের আলো না ফোঁটার আগেই ওর ঘরে এসে ঘুম থেকে ডেকে তুলল নিকি। “চলো, আমরা মাছ ধরতে যাবো। জোসে আমাদেরকে বোটে করে নিয়ে যাবে।”

আসার সময়ই ক্যাম্পের গার্ডদের মাঝে জোসে’কে দেখেছে বেলা। মনে হচ্ছে নিকি’র সাথে এই কৃষাঙ্গ তরুণের বেশ ভাব। নৌকা আর ফিশিং লাইন ঠিক করার সময় গল্পে মেতে উঠল দু’জন।

“তুমি ওকে পেলে কেন ডাকো?’ স্প্যানিশ জোসে’কে কে জিজ্ঞেস করল বেলা; কিন্তু উত্তর দিল নিকি।

“কারণ স্কুলে আমিই হচ্ছি সকার প্লেয়ার চ্যাম্পিয়ন, তাই না জোসে?”

সেদিন সন্ধ্যায় একসাথে বসে ফকের আরেকটা চ্যাপ্টার পড়ল নিকি আর বেলা।

নিকোলাস ঘুমিয়ে পড়ার পর আবারো আদ্রার সাথে কথা বলার চেষ্টা করল বেলা; কিন্তু চেষ্টাই সার; কোনো লাভ হলো না। কিন্তু রান্নাঘর থেকে চলে আসার সময় অন্ধকারে ওর পিছু নিল আদ্রা। তারপর আচমকা হাত ধরে প্রায় বেলা’র কানের কাছে বলে উঠল, “আমি আপনার সাথে কথা বলতে পারব না; ওরা সবসময় নজর রাখছে।”

বেলা কিছু বোঝার আগেই আবারো রান্নাঘরে ফিরে গেল আদ্রা।

সকালবেলা নিকোলাসের কাছ থেকে আরেকটা সারপ্রাইজ পাওয়া গেল। সৈকতে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল জ্যোসে। নিকি বলা মাত্রই ওর হাতে অস্ত্র তুলে দিল। দ্রুত আর দক্ষ হাতে একে এমে’র সবকটি অংশ খুলে নিল নিকি।

“কত দূর?” জোসে’র কাছে জানতে চাইল নিকি।

 “পঁচিশ সেকেন্ড পেলে।” শ্রদ্ধা ভরে হেসে উঠল ক্যাম্পের গার্ড।

 “পঁচিশ সেকেন্ড মাম্মা” গর্বিত ভঙ্গিতে ইসাবেলাকে জানাল নিকি।

“জোসে, আমার লাগানো শেষ হলেই আবার সময় জানাবে ঠিক আছে? আর তুমি আমার ছবি তুলবে মাম্মা।” আদেশ দিল নিকি।

রাইফেল নিয়ে পোজ দিল নিকি, তারপর আরেকটা ছবি ভোলার বায়না করল। লেন্সের মধ্য দিয়ে ছেলের মুখ দেখে ভিয়েত-কঙ্গের শিশু যোদ্ধাদের কথা মনে পড়ে গেল। বেলা’র আরো মনে পড়ে গেল এই ছোট্ট মানুষগুলোই কী কী ঘটায়। নিকোলাসও কী এদের মতই হয়ে যাচ্ছে? মনে হলো মাথা ঘুরে পড়ে যাবে।

“গুলি করব জোসে?” খানিক বাকবিতণ্ডার পর নিকোলাসকে অনুমতি দিয়ে দিল জোসে।

 খালি একটা বোতল লেগুনে ছুঁড়ে মারতেই পানির কিনারে দাঁড়িয়ে গুলি করল নিকি। গান ফায়ারের শব্দে কম্পাউন্ড থেকে দৌড়ে এলো হাফ ডজন প্যারাট্রুপার আর নারী সিগন্যালার। সকলে মিলে সোল্লাসে উৎসাহ দিল নিকি’কে পঞ্চম বারের মাথায় বোতলটা বিস্ফোরিত হতেই” ভাইভা পেলে?” ‘সাহসী পেলে?” চিৎকারে কান পাতা দায় হয়ে উঠল।

“আর আরেকটা ছবি তোল মাম্মা।” দু’পাশে সমর্থকের দল আর বুকের কাছে রাইফেল নিয়ে পোজ দিল নিকি।

আদ্রা’র বেঁধে দেয়া ফল আর ঠাণ্ডা স্মোকড ফিশ দিয়ে সৈকতে পিকনিক লাঞ্চ করল বেলা আর নিকি। গালভর্তি খাবার নিয়ে হঠাৎ করেই নিকোলাস বলে ফেলল : “জোসে অনেক যুদ্ধ করেছে। রাইফেল দিয়ে পাঁচটা মানুষও মেরেছে। একদিন আমিও হব বিপ্লবের সত্যিকারের সন্তান-ওর মত।”

সে রাতে মশারির নিচে শুয়ে ছটফট করে উঠল বেলা। “আমার ছেলেটাকে ওরা দানব বানিয়ে ফেলছে। কিন্তু কী করব? কিভাবে ওদের হাত থেকে নিকি’কে বাঁচাবো?”

ওরা যে কে সেটাও তো জানে না বেলা।

“ওহ, রামোন তুমি কোথায়? শুধু ওর সাহায্য পেলেই কিছু করা সম্ভব। ও পাশে থাকলে আমি সবকিছু পারব।”।

আবারো আদ্রা’র সাথে কথা বলতে চাইল, কিন্তু ওর শীতলতা কিছুতেই কাটে না।

নিকোলাসও কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। এখনো বেশ নম্র আর বন্ধুভাবাপন্ন থাকলেও বেলা বুঝতে পারল ছেলেটা কেবল ওর সঙ্গ আর তেমন পছন্দ করছে না। বারে বারে শুধু স্কুল, ওর বন্ধু, সকার ম্যাচের কথা বলে। গল্পের বইয়ের মাঝে আর আটকে রাখা যাচ্ছে না ওকে।

বেলার মাঝেও মরিয়ামভাব চলে এসেছে। শুধু ভাবছে কেমন করে এইসব থেকে নিকি’কে নিয়ে যাওয়া যায় ওয়েল্টেভ্রেদেনের সভ্য আর নিরাপদ জগতে। ফার্স্ট ক্লাস পাবলিক স্কুলের ড্রেসে কেমন দেখাবে নিকি!

 “আমার ছোট্ট বেবি’কে যদি ফিরিয়ে দেয়-ওরা যা বলবে করব।” আপন মনে স্বপ্ন দেখলেও বেলা জানে যে কোনো লাভ নেই।

রাত নেমে এলে ভয়ংকর নব চিন্তা এলো বেলা’র মাথায়। নাহ, কিছ একটা করতেই হবে।

জোসের রাইফেলটা নেয়া যায়। নিকোলাসকে বললেই ওকে দেখতে দেবে…কিন্তু না।

কর্নেল জেনারেল রামোন মাচাদো ভালোভাবেই ধরতে পারল বেলার এ পরিবর্তন। এই ভয়টাই পাচ্ছিল।

গত দশ দিন ধরে খুব কাছ থেকেই বেলা’র উপর নজর রেখেছে। কুড়ে ঘরে বেলা’র অজান্তে লাগানো আছে বহু ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন। সৈকতে কিংবা নৌকায় থাকলেও হাই পাওয়ার টেলিস্কোপিক লেন্স দিয়ে ওদের ছবি ভোলা হয়।

অনুমান করল মেয়েটা এমন একটা স্টেজে পৌঁছে গেছে যে উন্মাদের মতো কিছু করে বসতে চাইবে।

আদ্রাকে তাই নতুন নির্দেশ দেয়া হলো।

 সন্ধ্যায় ডিনার সার্ভ করার সময় কয়েক মিনিটের জন্য নিকি’কে বাইরে পাঠিয়ে দিল আদ্রা। তারপর ইসাবেলার’র বাটিতে ফিশ স্যুপ দেয়ার সময় ইচ্ছে করে এমন ভাবে দাঁড়াল যে বেলা’র গালে এসে পড়ল আদ্রা’র চুল।

‘কথা বলবেন না কিংবা আমার দিকে তাকাবেন না।” ফিসফিস করে উঠল আদ্রা, “মার কুইসের মেসেজ আছে। উনি জানিয়েছেন যে আপনার কাছে আসতে চেষ্টা করবেন; কিন্তু ব্যাপারটা বেশ কঠিন আর বিপদজনক। এও জানিয়েছেন যে হি লাভ ইউ। সাহস রাখুন প্লিজ।”

আত্মঘাতী সমস্ত চিন্তা নিমেষেই উধাও হয়ে গেল। রামোন আশেপাশেই কোথাও আছে। রামোন ওকে ভালবাসে। অন্তরের অন্তঃস্থলে ঠিকই জানে যে রামোন সাহায্য করলে ও সবকিছু পারবে।

 বাকি দুই দিন এ চিন্তাতেই বিভোর হয়ে রইল বেলা। নিকোলাসের সাথে নতুন উদ্যমে মিশতে তাই কোনো সমস্যাই হলো না।

রাত হলেই একা একা জেগে বসে থাকে; দ্বিধা কিংবা ভয়ে নয়, রামোনের অপেক্ষাতে।”

“ও আসবে, আমি জানি ও আসবে।”

 কিন্তু রামোনোর পরিবর্তে মেসেজ নিয়ে এলো লাগেজ সার্চকারী নারী কেজিবি’র একজন।

“আগামীকাল সকাল নয়টায় আপনার ফ্লাইট।”

 “দ্য চাইল্ড?” জানতে চাইল বেলা, “নিকোলাস-পেলে?”

মাথা নাড়ল কেজিবি। “ও থাকবে। আপনার সময় শেষ। ঠিক আটটায় আপনাকে নিতে লোক চলে আসবে তৈরি থাকবেন।”

ছেলের সাথে কাটানো স্মৃতি হিসেবে কিছু নিয়ে যেতে চাইল বেলা। শাওয়ার করে ডিনারের জন্য তৈরি হবার পর বারমুডার ভেতরে লুকিয়ে নিল এক জোড়া নেইল সিজার। ডিনার টেবিলে নিকি বসতেই কিছু না বলে ওর পিছনে গিয়ে ঘন কোকড়ানো চুল কেটে নিল বেলা।

“হেই, তুমি কী করছ?”

 “চলে যাবার পর যেন তোমাকে স্মরণ করতে পারি।”

খানিকক্ষণ কী যেন ভেবে লাজুক স্বরে নিকি জানতে চাইল। “তাহলে আমিও কী ভোমার কয়েকটা চুল রাখতে পারি?

বিনা বাক্যব্যয়ে ওর হাতে কাঁচি তুলে দিল বেলা। মায়ের সামনে দাঁড়াল নিকি ”বেশি না কিন্তু।” বেলা’র সাবধান বাণী শুনে হেসে ফেলল নিকি।

“তোমার চুল বেশ নরম-আর সুন্দর। তোমাকে কি যেতে হবে মাম্মা?”

 “হুম।”

 “আবারো আসবে আমাকে দেখতে?”

“ইয়েস, আই উইল। প্রমিজ।”

“আমি আমার ফক বইতে এই চুলগুলো রেখে দেব। যখনি বইটা পড়ব। তোমার কথা ভাবব।”

কুঁড়েঘরের খোলা অংশ দিয়ে ঘরে ঢুকেছে চাঁদের রুপালি আলো। সময়ের সাথে সাথে সরেও যাচ্ছে মেঝের উপর দিয়ে।

“ও নিশ্চয়ই আসবে” শক্ত ম্যাট্রেসের উপর আশা নিয়ে শুয়ে রইল বেলা, “প্লিজ ওকে আসতে দাও।”

হঠাৎ করেই সিধে হয়ে গেল বেলা। কিছুই দেখেনি কিংবা শোনেইনি তারপরেও নিশ্চিতভাবে অনুভব করছে যে ও কাছেই কোথাও আছে। নাম ধরে ডেকে উঠার ইচ্ছে বহুকষ্টে সংবরণ করল। সবটুকু ইন্দ্রিয় সজাগ করে বসে রইল বেলা। আর তারপরেই বিনা কোনো শব্দে চলে এলো রামোন।

গলার কাছে উঠে আসা কান্না গিলে ফেলল বেলা। মশারি থেকে বের হয়ে দ্রুত তিন কদম হেঁটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল রামোনের বুকে। নিঃশব্দে ও’কে নিয়ে বাইরে চলে এলো রামোন।

 “আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই।” নরম স্বরে ওকে সাবধান করে দিল। আরো জোরে আঁকড়ে ধরল বেলা।

 “আমাদের সাথে এসব কী হচ্ছে ডালিং?” অনুনয় করে উঠল বেলা,

“আমি এসবের কিছুই বুঝতে পারছি না। কেন তুমি আমাদের সাথে এমন করছ?”

“তুমি যেই কারণে আদেশ মানতে বাধ্য হচ্ছ! নিকোলাসের জন্য, তোমার জন্য!”

“আমি বুঝতে পারছি না; কিন্তু আর সহ্য হচ্ছে না। একেবারে শেষ হয়ে গেছি।”

আর বেশি দেরি নেই। ডার্লিং। আমি প্রমিজ করছি শীঘ্রিই আবার আমরা তিনজন একসাথে হবো।

“গতবারেও তুমি একথাই বলেছিলে ডার্লিং, যতটুকু পেরেছি আমি করেছি…।”

“আমি জানি বেলা, এটাই আমাদেরকে বাঁচিয়েছে। আমাকে আর নিকোলাসকে। তুমি না থাকলে আমরা কবেই খতম হয়ে যেতাম। তুমি আমাদেরকে বাড়তি সময় আর জীবন দিয়েছ।”

“ওরা আমাকে দিয়ে জঘন্য সব কাজ করাচ্ছে রামোন। আমি আমার পরিবার আর দেশের সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা করেছি।”

“ওরা তোমার উপরে সন্তুষ্ট হয়েছে বেলা। এই ভ্রমণই তার প্রমাণ। নিকোলাসের সাথে কাটানোর জন্যে দুই সপ্তাহ সময় দিয়েছে। যদি পারো তাহলে আরেকটু-আর খানিকটা কাজ করে দাও।”

“ওরা আমাকে কখনোই ছাড়বে না, রামোন, আমি জানি আমার শেষ রক্তটুকুও শুষে নিবে।”

“বেলা, ডার্লিং” সিল্কের নাইট গাউনের উপর দিয়ে ওর পিঠে আলতো করে চাপড় দিল রামোন, “আমার প্ল্যান শোন, যদি তুমি ওদেরকে আরেকটু খুশি করতে পারো, তাহলে আগামীবার ওরা আরো নরম হবে। তোমাকে বিশ্বাস করবে। অসাবধান হলেই-প্রমিজ করছি নিকিকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দেব।”

“কারা ওরা?” ফিসফিস করে উঠল বেলা; কিন্তু ওকে আদর করতে শুরু করল রামোন। প্রশ্নের তাই উত্তরটা আর জানা হলো না।

“চুপ করো, মাই লাভ। তুমি না জানলেই ভাল হবে।”

“প্রথমে তো আমি ভেবেছিলাম এরা রাশানস; কিন্তু আমার স্কাইলাইট মেসেজ তো আমেরিকানদের কাজে লেগেছে আর অ্যাঙ্গোলা’তেও কাজে লেগেছে। এরা কী তবে সি আই-এ?”

“হয়ত তুমি সত্যি; কিন্তু নিকির খাতিরে এদেরকে ঘাটাতে যেও না।”

“ওহ গড, রামোন। আমার কিছু ভাল লাগছে না। বিশ্বাসই হচ্ছে না সভ্য কোনো লোক অন্যদের সাথে এমন করতে পারে।”

“আর বেশি দিন নয়।” ফিসফিসিয়ে জানাল রামোন। “ধৈর্য ধরো। ওদের আরেকটু কাজ করে দাও; তারপরেই আমি আর নিকি তোমার কাছে চলে আসব।”

“আমাকে অনেক আদর করো রামোন। না হলে আমি পাগল হয়ে যাবো।”

***

পরের দিন সকাল বেলা মা’কে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিল নিকোলাস। জিপের পেছনে বসে আছে জোসে আর রেগুলার ড্রাইভার। হঠাৎ করেই ওদের কথা কানে যেতে চমকে উঠল বেলা। “পেলে হচ্ছে সত্যিকার শিয়াল ছানা। এল জোরো।”

আইলুশিনের র‍্যাম্পে একে অন্যকে বিদায় জানাল নিকি আর বেলা।

“তুমি প্রমিজ করেছ যে আবার আমাকে দেখতে আসবে, মাম্মা।” মনে করিয়ে দিল নিকি।

“অফ কোর্স নিকি। এবারে কোন উপহার আনব?”

“আমার সকার বলটা মিইয়ে যাচ্ছে। ম্যাচের সময় বারে বারে পাম্প করতে হয়।”

“ঠিক আছে আরেকটা এনে দেব।”

“থ্যাঙ্ক ইউ মাম্মা।” হাত বাড়িয়ে দিল নিকি। কিন্তু নিজেকে সালমাতে পারল না বেলা, ধপ করে হাঁটু গেড়ে বসে জড়িয়ে ধরল।

প্রথমে মুহূর্তখানেক চুপ করে থাকলেও হঠাৎ করেই জোর করে হাত ছাড়িয়ে খানিক মায়ের দিকে তাকিয়েই দৌড় দিল নিকি। রাগে পুরো মুখ লাল হয়ে গেছে। খালি হয়ে গেল বেলা’র ভেতরটা।

লিবিয়া’তে নেমে সুইস এয়ার ফ্লাইট ধরে জুরিখে চলে এলো বেলা। ন্যানি সহ বাসার সবাইকে পোস্টকার্ডও পাঠাল আর সুইজারল্যান্ডেই আছে। বোঝানোর জন্য নিজের ক্রেডিট কার্ডও ব্যবহার করল। এমনকি লুজানে’তে পরিচিত ব্যাংকার’কে ফোন করেও দশ হাজার ফ্র্যাংক তুলে নিল। যেন কারো কোন সন্দেহ না থাকে ওর অবকাশ যাপন নিয়ে।

 নিকোলাসের ছবিগুলো অসম্ভব সুন্দর হয়েছে। এমনকি রাইফেল হাতে ধরা ভয়ংকর ছবিগুলো’ও প্রাণ ভরে দেখল বেলা। নিকোলাসের জন্য একটা জার্নাল বানিয়েছে বেলা। কাভারের ভেতর পকেট অলা মোটাসোটা একটা বই। বছরের পর বছর ধরে জড়ো করা বিভিন্ন জিনিস এখানে রেখেছে বেলা।

লন্ডনে একটা ফার্ম হায়ার উদ্ধার করা নিকোলাসের স্প্যানিশ বার্থ সার্টিফিকেট আর অ্যাডপশন পেপারস; মালাগার’র ফ্ল্যাট থেকে পাওয়া ছোট্ট মোজা; নার্সারী স্কুল আর ক্লিনিকের রিপোর্টসহ ওকে পাঠানো প্রতিটি ছবি। এর পাশাপাশি বিভিন্ন পাতায় লিখে রেখেছে ওর নিজস্ব মন্তব্য, আশা, হতাশা আর ভালোবাসার কথা।

ওয়েল্টেভ্রেদেনে গিয়ে এবারে যোগ করল নিকি’র চুল আর একসাথে কাটানো দিনগুলোর গল্প।

 যখনই খুব মন খারাপ হয়ে যায়, নিজের রুমে চুপচাপ বসে বসে জার্নালের পাতা ওল্টায়।

এভাবেই পায় টিকে থাকার শক্তি।

***

সোজা ছুটে গিয়ে মোড় নিল বীচক্রাফট। পেছনের সিটে বসে মাধ্যাকর্ষণের চাপে কেমন যেন হালকা বোধ করল বেলা।

“ওই তো” পাইলটের বামপাশের সিট থেকে চিৎকার করে উঠল গ্যারি, “দেখেছ? পাহাড়ের নিচে, তিনটা।”

 নিচে জঙ্গলের মাথার দিকে তাকাল বেলা। পাথরে দুর্গ, উপত্যকা দিয়ে ভরে আছে পুরো বনানী।

 আকাশে উন্মত্ত চিৎকার করে ঘুরপাক খেতে লাগল একদল সবুজ রঙা কবুতর; এতটাই কাছে যে ওগুলোর লাল ঠোঁট আর পুঁতির মতো চকচকে চোখ জোড়াও দেখা যাচ্ছে। এরপর হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেল অরণ্য। নিচে বিছিয়ে আছে শীতের ধূসর ঘাস। গর্জন করতে করতে সোজা দূরের পাহাড়চূড়ার দিকে ধেয়ে গেল বীচ ক্রাফট।

“ওই তো! বেলা দেখেছ?” আবারো বলে উঠল গ্যারি।

“ইয়েস! ইয়েস! কত্ত বড় না?” পাল্টা চিৎকার করে উঠল বেলা।

পরিষ্কার জায়গাটুকুর শেষ মাখা গিয়ে একসাথে দৌড়ে যাচ্ছে তিনটা মন্দা হাতি। আরবীয় নৌকার পালের মতো ছড়িয়ে আছে কান। বাকানো আইভরি উঠে গেছে উপরের দিকে।

একেবারে সামনের হাতিটার বিশ ফুট উপরে প্লেন যেতেই তেড়ে এলো স্থল দানব। লম্বা শৃড় উঁচিয়ে এমন ভাব করল যেন তাদেরকে আকাশ থেকে পেড়ে ফেলবে। কন্ট্রোল কলাম টেনে ধরল গ্যারী। মেঘ বিহীন আফ্রিকান আকাশে উঠে গেল বিমান।

 “সবচেয়ে বড়টার ওজন সত্ত্বর পাউন্ডের কম হবে না।” সিটের উপর বসে ঝুঁকে দেখে হাতিটার ওজন আন্দাজ করল গ্যারি।

 “এগুলোও কি আমাদের এলাকা। বাবা?” কাঁধের উপর দিয়ে তাকিয়ে বাবার কাছে জানতে চাইল।

“এর কিনারেই।” গ্যারির ডান পাশের আসনে বসে আছেন শাসা। গ্যারি’কে তিনিই বিমান চালানো শিখিয়েছেন; জানেন ওর দক্ষতা।

“ওদিকে ন্যাশনাল পার্ক দেখা যাচ্ছে জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে বাউন্ডারি লাইনও দেখতে পাবে।”

“ওই বুড়ো জাম্বোগুলো তো এদিকেই আসছে।” বাবা’র দিকে হেলে এলো বেলা; হাসলেন শাসা।

“হুম, এতে কোনো সন্দেহ নাই।”

“তার মানে ওরা জানে যে কোনটা শিকারির জায়গা আর কোনটা ওদের জন্য নিরাপদ?”

“যেভাবে তুমি তোমার নিজের বাথরুম চেনো; যে কোনো সমস্যার গন্ধ পেলেই ওরাও ঘরের দিকেই ছোটে।”

“ক্যাম্প দেখতে পাচ্ছো?” জানতে চাইল গ্যারি।

 “ওই তো দক্ষিণে। ধোয়াও দেখতে পাবে।”

খুব নিচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছে বিমান। ছোট্ট একটা জেবরা’র দল নিচে ঘাসের চাদরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু উড়োজাহাজের শব্দ পেয়েই দিল দৌড়।

নিচে পার্ক করে রাখা খোলা ট্রাক দেখতে পাচ্ছে বেলা। হুইলে বড় ভাইকে দেখার আশা নিয়ে তাকালেও দেখা গেল বসে আছে কৃষাঙ্গ ড্রাইভার। দু’বছরের উপর হয়ে গেল; শন’কে দেখে না।

জোড়া ইঞ্জিনের বীক্রাফট’কে শেষবারের মতো ঘোরাল গ্যারি। ড্যাসবোর্ভে জ্বলে উঠল তিনটা সবুজ বাতি। কন্ট্রোলের উপর ঘুরে বেড়ালো শক্তিশালী আর নিশ্চিত আগুলগুলো।

 “ওতো বেশ ভালোই প্লেন চালায়।” ভাইয়ের কৌশলের প্রশংসা করল বেলা, “প্রায় বাবা’র মতই ভালো।”

 কোনো রকম ঝাঁকুনি ছাড়াই বীচক্রাফট’কে মাটিতে নামিয়ে আনল গ্যারি। স্ট্রিপের শেষ মাথার গাছগুলো দ্রুত এগিয়ে আসতেই ম্যাক্সিমাম সেইফ ব্রেকিং’য়ে চাপ দিল। এরপর ট্যাক্সিং করে এগিয়ে গেল অপেক্ষারত ট্রাকের দিকে।

 মোটরের গুঞ্জন শেষ হতেই চারপাশে ভিড় করে এলো ক্যাম্পের স্টাফ। হ্যাচ খুলে নিচে নেমে সকলের সাথে কুশল বিনিময় করলেন শাসা। কোম্পানির শুরু থেকেই এখানে কাজ করছে বেশিরভাগ সাফারি স্টাফ।

 কিন্তু ওদের খুশি দ্বিগুণ হয়ে গেল ইসাবেলা’কে দেখে। মেয়েটাকে সকলেই ভালবাসে কোয়েজি দ্য মর্নিং স্টার নামে ডাকে।

“তোমার জন্য তাজা টমেটো আর লেটুস রেখে দিয়েছি কোয়েজি।”

নিশ্চিত করল মালিদের প্রধান, লট। মহিষ আর হাতি’র গোবরের সার পাওয়াতে উর্বর হয়ে থাকে চিজোরা ক্যাম্পের বাগান। আর বেলা’র সালাদ প্রীতিও সকলের জানা আছে।

 “তোমার তাবুটা ক্যাম্পের একেবারে শেষে পেতে দিয়েছি, কোয়েজি।” জানালো ক্যাম্পের বাটলার। আইজ্যাক। “যেন সকালবেলাতে পাখিদের গান শুনতে পাও আর শেফ তোমাকে স্পেশাল চা এনে দেবে।”

 বীচক্রাফটকে নিয়ে জ্যাকেল-ওয়্যার হ্যাঙ্গারে রেখে দিল গ্যারি; যেন রাতের বেলা সিংহ কিংবা হায়েনা এর টায়ারে দাঁত বসাতে না পারে।

এরপর খোলা ট্রাকের উপর লাগেজ উঠিয়ে নিল স্টাফেরা আর হুইলে বসল গ্যারি।

শনের কঠোর নিয়ম হলো ক্যাম্পের দু’মাইলের মধ্যে কোনোরূপ গোলাগুলি চলবে না। বর্ষার পরে পানি শুকিয়ে গেলে খেলাও ফুরিয়ে যায়। পুরো ক্যাম্প গুটিয়ে দলবল নিয়ে তখন কারি লেকের তীরে ক্যাম্পে চলে যায় শন।

জঙ্গলের মাঝে পাতা হয়েছে সবুজ তাঁবুর সারি। প্রতিটার পিছনেই আছে। শাওয়ার রুম আর মাটির শৌচাগার। খড়ের দেয়াল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে ডাইনিং টেন্ট। দিন-রাত জ্বলতে থাকা ক্যাম্প ফায়ারের চারপাশে রাখা হয়েছে। ক্যানভাসের চেয়ার।

বাতি জ্বালানো আর রেফ্রিজারেটর সচল রাখার দায়িত্ব পালন করে পোর্টেবল জেনারেটর। খড়ে ছাওয়া রান্নাঘরে বসে মুখরোচক সব খাবার তৈরি করে শেফ। বার টেবিলের উপর বরফ কুচি ছাড়াও আছে সারি সারি লিকার বোতল। পাওয়া যাবে পৃথক পৃথক পাঁচটা ব্রান্ডের প্রিমিয়াম হুইস্কি আর তিনটা সিংগল সল্ট। প্রতিটি গ্লাস স্টয়াট ক্রিস্টালের তৈরি।

স্নান সেরে, তরতাজা হয়ে ক্যাম্প ফায়ারের কাছে এসে বসল পুরো পরিবার। হাতঘড়ির দিকে তাকালেন শাসা।

“এক পেগের জন্যে কি বেশি তাড়াতাড়ি হয়ে গেল নাকি?”

“কী যেন বলো না। আমরা তো ছুটিতে এসেছি।” বারম্যান’কে ডেকে অর্ডার দিল গ্যারি।

 ঠাণ্ডা হোয়াইট ওয়াইনে চুমুক দিল ইসাবেলা। গত দু’বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো মনে হলো কেমন যেন নিরাপদ মনে হচ্ছে নিজেকে বেশ শান্তি শান্তিও লাগছে। কেবল মাইকেল’কে মিস করছে। অন্যদিকে বাবা আর গ্যারি মিলে শনে’র ক্লায়েন্টের কথা আলোচনা করছে। জার্মান ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট অটো হায়দার।

“শনের চেয়ে বছর বিশেকের বড় হলেও দুজনে যেন হরিহর আত্ম; একসাথে যে তারা কী করে, গড।” বলে উঠলেন শাসা, “বিপদের গন্ধ এতটাই ভালবাসে লোকটা যে শন ছাড়া আর কারো সাথেই শিকার করতে চায় না।”

“আমি স্পেশাল সার্ভিসকে দিয়ে ওর উপর পুরো রিপোর্ট তৈরি করেছি।” মাথা নাড়ল গ্যারি। কোম্পানির সিকিউরিটি থেকে শুরু করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এসপিওনাজ পর্যন্ত সমস্ত কিছুর দেখভাল করে এই ইন্টিলিজেন্স সিস্টেম। “অটো হায়দারের সম্পত্তির বিবরণ চার পাতা ছাড়িয়ে গেলেও লোকটা বেশ বুনো প্রকৃতির। আমার মনে হয় আর্থিকভাবে উনার সাথে জড়িয়ে পড়াটা ঠিক হবে না।”

“আমারও তাই মনে হয় মাথা নাড়লেন শাসা। “কিন্তু লোকটা বেশ ইন্টারেস্টিং। জানো উনি সাথে করে ব্লান্ড-ব্যাংক ও নিয়ে আসেন; যদি হাতি পাড়া দেয় কিংবা ষাঁড়ের গুঁতো খান!”

“এটা তো জানি না।” ক্যাম্প চেয়ারের সামনে ঝুঁকে এলো গ্যারি।

হেসে ফেললেন শাসা, “সেল্ফ অ্যাডমিনিস্টারিং ট্রান্সফিউশনস্।”

 “মানে? ইসাবেলা’ও এবারে আগ্রহী হয়ে উঠল।

“সাথে দু’জন কোয়ালিফায়েড নার্স নিয়ে আসেন। দুজনেই যথেষ্ট সুন্দরী বয়স পঁচিশ আর রক্তের গ্রুপ এবি পজিটিভ। রক্ত লাগলেই দু’জনের কাছ থেকে নেবার পাশাপাশি সেবাও পাওয়া যাবে।”

“আর রক্ত যদি নাও লাগে সাফারি’তে ওদের সঙ্গ’ও মন্দ হবে না।”

“ইউ আর ডিসগ্যাস্টিং, গ্যারি।” গ্যারির মন্তব্য শুনে হেসে ফেলল বেলা।

“আমি! ওই ব্যাটা অটো’র বুদ্ধি দেখেছ; আমার মনে হয় ওর সাথে ব্যবসা খারাপ হবে না।”

“বাদ দাও। সকালেই নার্সদেরকে নিয়ে চলে যাবেন অটো। আমাদের আসল ক্লায়েন্ট আসবেন কাল দুপুরবেলা। শন্ অটো’কে সালিশ ব্যুরিতে নামিয়ে দিয়ে উনাকে নিয়ে ফিরবেন” হঠাৎ করে কথা থামিয়ে ক্যাম্পের সামনের অংশে তাকালেন শাসা।

“শনের ট্রাকের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। হ্যাঁ, ওই তো ও আসছে।”

মাইল খানেক দূর থেকে খোলা প্রান্তরের উপর দিয়ে এগিয়ে আসছে হান্টিং ভেহিকেল।

“মাস্টার শনের তো মনে হচ্ছে বেশ তাড়া আছে।”

গর্জনের মতো শোনা গেল ট্রাকের ইঞ্জিনের আওয়াজ। পানি খেতে আসা জন্তুগুলো ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল।

কাছে এগিয়ে আসতেই খোলা টয়েটার আরোহীদেকে স্পষ্ট দেখা গেল। ইঞ্জিনে বনেটের উপর ফেলে রাখা হয়েছে উইন্ডস্ক্রিন। পেছনের উঁচু আসনে বসে আছে চারজন। শনের কৃষাঙ্গ দুই টাকার আর দু’জন শ্বেতাঙ্গ নারী। এরাই হয়তো জার্মান নার্স, ভাবল ইসাবেলা।

 সামনের প্যাসেঞ্জার সিটে বসে আছেন মধ্য বয়স্ক এক পুরুষ। চোখে গোল্ড রিমের চশমা। ইনিই নিশ্চয়ই অটো।

হুইলে বসে থাকা শন’কে দেখে ক্যাম্প চেয়ার ছেড়ে দৌড় দিল ইসাবেলা।

বুশ শার্ট পরিহিত শনের অনাবৃত বাহুদ্বয় একেবারে তেল চকচক করছে, পেশি আর স্বাস্থ্যের আভায়। কাধ পর্যন্ত লম্বা চুল।

 দ্রুত জোরে ব্রেক কষল যে গাড়ির পেছন পেছন উড়ে আসা ধূলিঝড়ের মাঝখানে থেমে গেল হেভি ভেহিকেল। লাফিয়ে নেমেই ওদের দিকে দৌড়ে এলো শন। পরনে থাই পর্যন্ত লম্বা খাকি শর্টস আর মোজা বিহীন চামড়ার জুতা।

“শন?” ভাইকে দেখে আনন্দে চিৎকার করে উঠল বেলা। কিন্তু চোখে মুখে ভয়ংকর একটা ভাব নিয়ে বোন’কে এড়িয়ে চলে গেল শন। হা হয়ে তাকিয়ে রইল বেলা।

একই ভাবে বাবাকেও ছাড়িয়ে গিয়ে দাঁড়ালো ছোট ভাইয়ের সামনে।

“নিজেকে কী ভাবো তুমি। বলোতো?” শীতল ক্রোধ নিয়ে জানতে চাইল শন; মুছে গেল গ্যারি’র হাসি।

“তোমাকে দেখে খুশিই হয়েছি।” আস্তে করে জানালো গ্যারি।

কিন্তু সামনে এগিয়ে গ্যারির শার্ট চেপে ধরল শন। ঝাঁকি দিতেই ক্যানভাস চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল গ্যারি।

“শোন তাহলে” হিসহিস করে উঠল শন, “পুরো সিজনে দেখা সবচেয়ে সুদর্শন মদ্দাটার পেছনে আমি চারদিন ধরে ঘুরে মরছি। অথচ তুমি এসে সব ভণ্ডুল করে দিলে!”

“দেখ, শন্ আমি তো…”গ্যারি চাইল ভাইকে শান্ত করতে; কিন্তু কিছুই শুনছে না শন।

“ধুত্তোরি, কাকে মুগ্ধ করতে চাও, অ্যাঁ?”

“শন” হাত বাড়িয়ে দিল- গ্যারি,

বুঝতে চেষ্টা করো, আমি তো জানতাম না যে এমন হবে।”

“বুঝতে চেষ্টা করব? আমার সবকিছু ভেস্তে দিয়েছ আর শান্ত হবো? আমার ক্লায়েন্টকে চটিয়ে সাফারির শেষ সুযোগটাকে হারিয়ে ঠাণ্ডা হবো?”

“বলেছি তো আমি দুঃখিত।”

“যদি এখনি সরি হও, তাহলে আগামী পাঁচ মিনিটে কেমন দশা হবে” বলে উঠল শন। বাম হাত দিয়ে পেছন দিকে ধাক্কা দিল গ্যারি’কে, কিন্তু গ্যারি নিজেকে সামলাতেই আবার চড়াও হল শন।

পাঁচ ইঞ্চি দূর থেকে শনের ঘুষি খেয়ে গ্যারি’র দাঁতে দাঁতু ঠেকে গেল। পেছনে হেলে যেতেই চোখ থেকে খসে পড়ল চশমা। ক্যাম্প চেয়ারে হাঁটু গেথে ধপাস করে পেছন দিকে পড়ে গেল গ্যারি।

“থাক, এখন বেশ ভালো লাগছে।” পড়ে থাকা চেয়ার সরিয়ে মুঠি পাকিয়ে ভাইয়ের দিকে দৌড়ে গেল শন।

“শন” এতক্ষণে হুশ ফিরে পেল বেলা। “স্টপ ইট, শন! ওকে ছেড়ে দাও!” ভাইদের মারামারি থামাতে দৌড়ে গেল বেলা, কিন্তু হাত ধরে ওকে থামালেন শাসা। মুক্তি পাবার জন্য ছটফট শুরু করল বেলা।

বসে থেকেই নিজেকে সালমাতে চাইল গ্যারি। নাক টেনে চেষ্টা করল রক্ত পড়া থামাতে; হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে উপরের ঠোঁট মুছে চোখের সামনে এনে ভালোভাবেই তাকাতেই অবিশ্বাসে হা হয়ে গেল চোখ।

“উঠে এসো, বেকুব কোথাকার।” গ্যারি’র সামনে গিয়ে দাঁড়াল শন।” উঠে দাঁড়াও।”

“ওকে ছাড়ো শন, প্লিজ।” ওর অত্যন্ত প্রিয় দু’জন মানুষ এমনভাবে মারামারি করছে দেখে ভয় পেয়ে গেল বেলা, “স্টপ ইট! স্টপ প্লিজ।”

“চুপ করো, বেলা! মেয়ের হাত ধরে ঝাঁকি দিলেন শাসা, “ওদেরকেই সামলাতে দাও।”

ধুলার মাঝে বসে বড়সড় সেন্ট বানার্ড ডগের মতো নিজেকের ঝাঁকি দিল গ্যারি।

“কাম অন, মিঃ ব্লাডি চেয়ারম্যান অব দ্য বোর্ড।” ভর্ৎসনা করে উঠল শন। “চলো, তোমার স্টাইল দেখাও মিঃ ফরচুন ম্যাগাজিন ৫০০।”

“ওদেরকে ওদের মতো থাকতে দাও, বেলা।” এখনো হাত ধরে রেখেছেন শাসা, “বিশ বছর ধরে জমানো রাগ এবারে বেরিয়ে আসছে। ওরাই মিটিয়ে ফেলবে।” হঠাৎ করেই সবকিছু বুঝতে পারল বেলা। সারা জীবনের জমানো রাগ উগরে দিচ্ছে শন।

প্রথম সন্তান হিসেবে সমস্ত সম্মান আর পদবী ওরই প্রাপ্য ছিল। কিন্তু শন্ কিছুই পায়নি।

 “পিস্-বেড” বলে উঠল-শন,”

“ফোর আইজ।” ছোট্টবেলায় এসব বলে গ্যারি’কে অপমান করা হত। বড় ভাই হওয়াতে সবসময় গ্যারি’কে দিয়ে বিভিন্ন কাজ করাত শন্। শীতকালে ঘুম থেকে টেনে তুলে টয়লেটে পাঠিয়ে দিত ওর জন্য সিটটাকে গরম করে তোলার জন্য; সবকিছু মনে করল বেলা। মনে পড়ে গেল এরকম আরো হাজারো অজুহাত যার মাধ্যমে গ্যারি’কে অপমান করত শন্।

উঠে দাঁড়াল গ্যারি। বিশ বছর পরিশ্রম আর সাধনা করে সারিয়ে তুলেছে নিজের দুর্বল শরীর। গড়ে তুলেছে পেশি বহুল বুক আর মনোভাব। তারপরেও দাঁড়াবার পর দেখা গেল বড় ভাইয়ের চেয়ে অন্তত ইঞ্চি চারেক খাটো।

 “এটাই” আস্তে করে বলে উঠল গ্যারি,” শেষবার। এরপর এরকম আর হবে না, বুঝেছ?”।

“না” মাথা নাড়ল শন্। “আমি কিছুই বুঝিনি বিছানায় মুতুকারী। আমাকে বোঝাও।”

টয়োটা থেকে নেমে শনে’র পিছু পিছু এলো তার জার্মান ক্লায়েন্ট আর সুন্দরী নার্স দু’জন। বোঝা গেল বেশ মজা পাচ্ছে।

চশমা ছাড়া, পেঁচার মতো চোখ পিটপিট করে উঠল গ্যারি। কিন্তু চোয়ালের সাথে দাঁতগুলো এত জোরে আটকে ধরল যে কানের নিচে ওয়ালনাটের মতো ফুলে উঠল পেশি। সুখে হাসি নিয়ে আগে বাড়ল শন্ এগিয়ে এলো গ্যারি।

মদ্দা ষাঁড়ের মতই দ্রুত এগিয়ে এলো নিজের ভারী শরীর নিয়ে; কিন্তু চিতাবাঘের মতো ক্ষিপ্র শন্। গ্যারি’র পেটের বামদিকে দিল গুঁতো। যুদ্ধ ট্যাংকের গায়ে যেন ইট ছোঁড়া হলো। একচুলও নড়ল না গ্যারি। কাঁধ ঝাঁকিয়ে আবার ছুটে এলো।

ঠোঁটে গা জ্বলানো হাসি নিয়ে ওর সামনে লাফাচ্ছে শন। গ্যারি’কে কাছে এগিয়ে আসার সুযোগ দিয়ে কেবল তো মেরে যাচ্ছে।

 কিচকিচ করে উঠল জার্মান নাসদ্বয়। রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এসেছে ক্যাম্পের ভৃত্যেরা। চোখ বড় বড় করে দেখছে সবকিছু।

 “ওদেরকে থামাও। ড্যাডি।” ইসাবেলা’র আকুতি কানেই তুললেন না শাসা। যেরকমটা হবেন ভেবেছিলেন সবকিছু সেভাবেই এগোচ্ছে।

 প্রতিবার পাঞ্চ মেরে দর্শকদেরকে দেখে নিচ্ছে শন্। বিশেষ করে নার্সদেরকে। নিজের স্টাইল নিয়েও বেশ সচেতন।

 অন্যদিকে, গ্যারি বাঁচিয়ে চলছে ওই ভয়ংকর ঘুসিগুলো। কিন্তু ওর মাথায় কিছুতেই আঘাত করতে পারছে না শন। পেশি বহুল কাঁধ দিয়ে প্রতিবার ওকে ঠেকিয়ে দিচ্ছে গ্যারি।

একই সাথে দ্রুত নিজের হাতও চালাচ্ছে। মাথা বরাবর এগিয়ে আসা শনের বেশ কিছু ঘুসি বাইসেপে আটকে গেল।

প্রথমে মনে হচ্ছিল গ্যারি বুঝি এমনি এমনিই তেড়ে আসছে। কিন্তু একটু পরে শাসা খেয়াল করলেন যে শন’কে দেয়ালের দিকে কোণঠাসা করে ফেলছে গ্যারি। শন্ সরে গেলেও ধৈর্য ধরে ঠিকই নিজের কাজ করে যাচ্ছে গ্যারি। নাকের রক্ত মুখ বেয়ে গড়িয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে খাকি শার্ট।

এবারে মুছে গেল শনের হাসি; তিরস্কারের ধারও কমে গেছে। অন্যদিকে একই ছন্দে ও’কে ক্রমাগত পেছন দিকে ঠেলছে গ্যারি। দিকবিদিক জ্ঞানশূন্যের মতো করে ঘুসি ছুড়ছে শন। এতক্ষণে গ্যারির চাল ধরতে পেরে গোত্তা খেয়ে ডান দিকে সরে যেতে চাইল। কিন্তু পথ আটকে দিল গ্যারি। নিচু হয়ে গ্যারি’র হাতের নিচে দিয়ে বের হয়ে যেতে চাইল শন; কিন্তু এবারে ঘুষি মেরে বসল গ্যারি।

 দম বদ্ধ করে তাকিয়ে রইল সমস্ত দর্শক। দু’শ পাউন্ড ওজনের পেশি হাড় আর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে বজ্রকঠিন আঘাত করল গ্যারি। বাতাসে শিস কেটে গিয়ে আঘাত লাগল শনে’র চুল ছাড়িয়ে মাথার খুলিতে।

এক মুহূর্তের জন্য যেন অন্ধ হয়ে গেল শন। হাঁটু দুটো কাঁপতে শুরু করল। কোন মতে সামলালেও মুখে ব্যথা ফুটে উঠে আতঙ্কও দেখা দিল। ভালুকের মতো ওর দিকে তেড়ে আসছে গ্যারি।

এতক্ষণ ধরে এর অপেক্ষাতেই ছিল গ্যারি। পুরোন বন্ধুর মতো দুহাত ছড়িয়ে এগোলেও সবাইকে বিশেষ করে শন’কে বোকা বানিয়ে একেবারে শেষ মুহূর্তে প্রচণ্ড জোরে লাথি মেরে বসল। ঠিক যেমন করে শিকার ধরতে এগিয়ে যায় মদ্দা ষাড়।

স্তম্ভিত শন্ কিছুই করতে পারল না। ডাইনিং টেন্ট ছিঁড়ে একসাথে জড়াজড়ি করে পড়ে গেল দু’জনে। মূল্যবান আর প্রাচীন সব ওয়াইন, ক্রিস্টাল নিয়ে উপুড় হয়ে গেল বার টেবিল। ফেনার মেঘের ভেতরে ডুবে গেল দুই ভাই।

 ডাইনিং টেবিল ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল দামি বাসন-কোসন। সারা শরীরে দড়িদড়া আর ক্যানভাস পেঁচিয়ে তাঁবুর পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে এলো দু’জনে। আতঙ্ক আর উত্তেজনায় ছুটাছুটি শুরু করে দিল ভুত্যের দল।

বৃত্তের মতো করে একে অন্যকে ধাওয়া শুরু করল দুই ভাই। কিছুতেই ছাড়তে রাজি নয় গ্যারি। শনের পেছনে ডাবল লক করে ধরে রেখেছে। পাইথনের মতই পিষে ফেলতে চাইছে শিকার।

 শনের একটা হাত ভয়ংকরভাবে বেঁকে গেছে। খোলা হাতটা দিয়ে দুরমুশের মতো গ্যারি’র মাথায় পেটাতে লাগল; কিন্তু আগের মতো তেমন জোর নেই। যদিও গ্যারি’র ঠোঁটও কেটে গেল।

একে অন্যকে ধরা অবস্থাতেই আবারো সকলের মাঝখানে চলে এলো শন আর গ্যারি। নার্সদের একজন কিছু বুঝে উঠার আগেই ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল। স্কার্ট উল্টে আন্ডারওয়্যার বেরিয়ে গেলেও কেউ তাকিয়ে দেখল না।

শন’কে মাটি থেকে তুলে ফেলতে চাইছে গ্যারি। বুকে গ্যারি’র মোচড়ের চোটে শনের চেহারা ঘেমে নেয়ে অন্ধকার হয়ে উঠলেও বিড়ালের মতো ঠিকই প্রতিবার ঘোরার পরেও মাটিতে নেমে আসছে। একেবারে ক্যাম্প ফায়ারের মাঝখানে ভাইকে নিয়ে এলো গ্যারি। শনে’র শূন্য পায়ের নোম পুড়ে গেল; চামড়ার জুতায় আগুন ধরে গেল।

 ভয়ংকর গর্জন করে লাফ দিল শন আগুন এড়াতে পারলেও গ্যারি’র মুঠি সরাতে পারল না। হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ল শন্! ঝুঁকে এলো গ্যারি।

শনে’র ফুসফুস থেকে বাতাস বেরিয়ে গেল; মুখে ভরে গেল রক্ত। এরপরেও মুঠি আলগা করল না গ্যারি। শনে’র চোখজোড়া মনে হচ্ছে সকেট থেকে বেরিয়ে যাবে; চোয়াল হা হয়ে ঝুলে পড়ল।

 “গ্যারি! তুমি ওকে মেরে ফেলছ?” আর্তচিৎকার করে উঠল ইসাবেলা। কিন্তু শাসা কিংবা গ্যারি, মনে হলো কেউই ওর কথা শুনতে পায়নি।

এবারে শনে’র পাজর ভেঙে যাবার স্পষ্ট শব্দ শুনতে পেল সবাই। চিৎকার করে গমের খালি বস্তার মতো আছড়ে পড়ল গ্যারি’র হাতের উপর। ওকে ছেড়ে পিছিয়ে এলো গ্যারি। এতক্ষণের পরিশ্রমে ওর নিজের চেহারাও ঘেমে নেয়ে একাকার।

উঠে বসতে চাইলেও বুক চেপে ধরে গোঙ্গাতে লাগল শন্। দুই-হাত দিয়ে মাথার চুল ঠিক করছে গ্যারি।

“রাইট!” শান্ত স্বরে জানিয়ে দিল গ্যারি, “এবার থেকে সমঝে চলবে বুঝেছ?”

এক হাতে বুক ধরে কোনমতে উঠে দাঁড়াল শন।

“শুনেছ আমার কথা?” এগিয়ে এলো গ্যারি।

 “গোল্লায় যাও।” ফিসফিস করে বললেও বুকে ব্যথা পাচ্ছে শন্।

খানিকটা ঝুঁকে মোটাসোটা শক্ত বুড়ো আঙুল দিয়ে ভাইয়ের বুক স্পর্শ করল গ্যারি,

“আমার কথা শোননি?”

ওকে, ওকে। শুনেছি।” হাল ছেড়ে দিল শন।

 “গুড।” মাথা নেড়ে দাঁড়িয়ে থাকা নার্সদের দিকে তাকাল গ্যারি, “ফ্রাউলেইন” যথাসাধ্য জার্মানে বলে উঠল “আপনাদের সাহায্য দরকার।”

দুজনেই দৌড়ে গিয়ে দুপাশ দিয়ে শকে ধরে ওর তাবুর দিকে নিয়ে গেল।

ইসাবেলা’র হাত ছেড়ে দিলেন শাসা।

“তো” বিড়বিড় করে বলে উঠলেন, অবশেষে সব সাঙ্গ হল।” ডাইনিং টেন্টের ভগ্নদশা’র দিকে তাকিয়ে হাঁক ছাড়লেন, “ওরে কে কোথায় আছিস, চিভাস নিশ্চয়ই শেষ হয়ে যায়নি।”

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *