২. মেয়েটার পৃথিবী উজ্জ্বল আর আনন্দময়

রামোন’কে পেয়ে আরো উজ্জ্বল আর আনন্দময় হয়ে উঠেছে মেয়েটার পৃথিবী।

দুনিয়ার বুকে স্বর্গ হয়ে উঠেছে প্রাণশক্তিতে ভরপুর শহর লন্ডন। সোনালি কুয়াশা মাখা উত্তেজনা ছেয়ে আছে চারপাশ। সোনার উপর বসানো মূল্যবান পাথরের মতই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে রামোনের সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত।

 তিন বছর আগে লন্ডনে এসে পড়াশোনা শুরু করার পর ব্যাচেলার ডিগ্রি লাভ করেছে ইসাবেলা। এরপর বাবার উৎসাহে ডক্টরেট করার জন্য ভর্তি হয়েছে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরিয়েন্টাল আর আফ্রিকান স্টাডিজ স্কুলে। থিসিসের বিষয় হিসেবে পছন্দ করেছে “আ ডিসপেনশেসন ফার পোস্ট কালোনিয়াল আফ্রিকা।” ভালই এগোচ্ছে থিসিস; আশা করছে কেপ টাউনে ফেরার আগেই শেষ করতে পারবে।

যাই হোক এ সমস্ত কিছুই রামোনের সাথে দেখা হবার আগের ঘটনা। স্পেন থেকে ফেরার পর একবারও নিজের শিক্ষকের সাথে দেখাও করেনি কিংবা বই খুলে দেখারও সময় পায়নি।

এখন বরঞ্চ রামোনের কাছে শিখছে জুড়ো আর আত্মরক্ষার রহস্য। মাঝে মাঝে আবার হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়ায় গ্যালারি আর মিউজিয়ামে। আর সবকিছুই শেষ হয় কেনসিংটনে রামোনের ফ্ল্যাটের বিছানাতে গিয়ে। ভেবেও দেখে না ব্যাংকে সময় না দিয়ে ওর সাথে কিভাবে এত সময় কাটায় ছেলেটা। রামোনের সান্নিধ্য পেয়েই সে ধন্য, কৃতজ্ঞ।

উপরন্তু ব্যাংকের রহস্যময় কোনো এক প্রয়োজনে রামোন আটদিনের জন্য লন্ডন ছেড়ে যাবার পর কেমন নির্জীব আর মনমরা হয়ে গেল বেলা। প্রতীক্ষার বিরহে আকুল হয়ে সকালে ঘুম থেকে উঠার পর বমি করা শুরু করে দিল।

 ফ্ল্যাটের সবকিছু গুছিয়ে রাখা। ফুল সাজানো আর চমৎকার সব রান্না নিয়ে ব্যস্ত রইল সারাক্ষণ।

অবহেলা করতে লাগল অ্যামবাসির দায়িত। অফিসিয়াল নিমন্ত্রণ বাতিল করে শেফ আর স্টাফদেরকে নিজেদের মতো করে কাজ করার উপর ছেড়ে দিল। উদ্বিগ্ন হয়ে শাসা একদিন মেয়েকে বললেন, “তুমি তো ঘরেই থাকো না

বেলা। একটা জিনিসের জন্যও তোমার উপর ভরসা করতে পারি না। এর উপর আবার ন্যানি জানাল, গত সপ্তাহে নাকি মাত্র দুদিন নিজের বিছানায় ঘুমিয়েছ।”

“ন্যানি তো গল্প বানাতে ওস্তাদ।”

“কী হয়েছে ইয়াং লেডি?”

“আমার বয়স একুশেরও বেশি ডালিং পাপা, আর তোমার সাথে তো আমার অ্যাগ্রিমেন্ট হয়েছে যে ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কিছু বলতে বাধ্য নই।”

 “তোমার সাথে এও অ্যাগ্রিমেন্ট হয়েছে যে মাঝে মাঝেই আমার রিসেপশনে নিজের চেহারা দেখাবে।”

 “চিয়ার আপ, পাপা।” বাবাকে কিস্ করে ঘুস দিতে চাইল মেয়েটা। “কয়েক মাসের মধ্যেই তো আমরা কেপ টাউনে ফিরে যাচ্ছি। তখন আমাকে নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না।”

সে সন্ধ্যাতেই রামোনের কাছে বেলা জানতে চাইল দক্ষিণ আফ্রিকার জনপ্রিয় লেখক অ্যালান প্যাটনের লন্ডন আগমন উপলক্ষে স্ট্রাফালগার স্কোয়ারে অ্যামব্যাসিতে শাসার দেয়া ককটেইল পার্টিতে আসবে কিনা সে।

পুরো এক মিনিট ধরে সাবধানে চিন্তা করার পর মাথা নাড়ল রামোন। “তোমার বাবার সাথে দেখা করার জন্য সঠিক সময় এখনো আসেনি।”

“কেন না ডার্লিং?” মুহূর্তখানেক আগেও ব্যাপারটা ওর কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না; কিন্তু এবারে প্রত্যাখ্যাত হয়ে খানিকটা নাখোশ হল বেলা।

“অনেক কারণ আছে।” মাঝে মাঝে এত অদ্ভুত আচরণ করে ছেলেটা। বুঝতে পারল কোনো লাভ নেই। অসম্ভব সুদর্শন ওই চেহারার নিচেই আছে। ইস্পাতের মতো কঠিন এক বর্ম।

“আর এতে করেই বেড়ে গেছে ওর আকর্ষণ।” আপন মনেই হাসল বেলা। আর কারো সাথেই রামোনকে শেয়ার করতে চায় না। পরস্পরে মগ্ন এই জুটির অন্য কাউকে তাই প্রয়োজন নেই।

মাঝে মধ্যে হ্যারিয়েট কিংবা অন্য কোনো পরিচিতের সাথে লেস এ অথবা হোয়াইট এলিফ্যান্ট এ খেতে যাওয়া; এক আধবার অ্যানাবেল’ এর পার্টিতে নাচতে যাওয়া ছাড়া পারতপক্ষে কারো মাথে মেশে না বেলা আর রামোন। ছেলেটার নিজের কোনো বন্ধু নেই কিংবা থাকলেও বেলার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়নি। যদিও এসব নিয়ে মোটোওভাবে না বেলা।

যেসব উইকেন্ডে আ্যামবাসির কাজ থেকে কৌশলে পালাতে পারে, সেসব দিনে মিনি কুপারের পেছনে ওভার নাইট ব্যাগ আর টেনিস র‍্যা গ্রামের দিকে চলে যায় বেলা আর রামোন। রবিবারে শহরে ফিরতে ফিরতে হয়ে যায় গভীর রাত।

আগস্টের শুরুতে, নির্জনে বাসের অভ্যাস ছেড়ে দু’জনে অতিথি হিসেবে গেল হ্যারিয়েট কু-চ্যাম্পের পারিবারিক এস্টেটে।

রামোনের হয়ে বন্দুক লোড় করে দিল ইসাবেলা। বারোটা গুলিতে বারোটা পাখি মারল ও শ্যেনচক্ষু দিয়ে দেখে মাথা নেড়ে বলে উঠল, “তেত্রিশটা সিজনে আমি এমনটা আর কেউ দেখিনি।” ইংরেজ ইতিহাসের দক্ষ বন্দুকবাজদের কথা স্মরণ করিয়ে দিল হ্যারিয়েটের আর্ল বাবাকে।

দেখা গেল সন্ধ্যায় লম্বা ডিনার টেবিলে বসে বিশপ আর ব্যারোনেটদেরকে ছাপিয়ে, রামোনের সাথেই কথা বলছেন ভদ্রলোক। মনে হচ্ছে ভালোই কাটবে উইকেন্ড। বিশাল দুর্গের মতো পুরাতন কাউন্ট্রি হাউজের একেবারে কোণার দিকের লাগোয়া রুম দিয়েছে হ্যারিয়েট দু’জনকে। ব্যাখ্যা হিসেবে বলল, “পাপা’র ইনসমনিয়া আছে। আর তুমি আর রামোন তো যা শব্দ করো!”

 “তুমি এত পচা কথা বলো না। প্রতিবাদ করে উঠল ইসাবেলা।

“আমার কথা ছাড়ো। রামোন’কে বলেছ তোমার সাইপ্রাইজের কথা?” মিষ্টি স্বরে জানতে চাইল হ্যারিয়েট।

“নাহ্, সঠিক মুহূর্তটার জন্য অপেক্ষা করছি।” আত্মরক্ষায় তাড়াতাড়ি বলে উঠল বেলা। “অভিজ্ঞতা থেকে জানি এ ধরনের সংবাদের জন্য সঠিক মুহূর্ত বলে কিছু নেই।”

অন্তত একবারের জন্য হলেও ঠিক কথাটাই বলেছে মেয়েটা। উইকেন্ড কেটে গেল। কোন সুযোগ পাওয়া গেল না। লন্ডনের কাছাকাছি পৌঁছে তাই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সব ঝেড়ে ফেলে দিল বেলা, ভাগ্য ভালো ফাস্ট-ক্লাস কম্পার্টমেন্টে কেবল তারাই আছে।

“ডার্লিং, গত বুধবারে আমি ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম অ্যামব্যাসি ডাক্তার নয়, হ্যারিয়েটের পরিচিত একজন। টেস্টের রেজাল্ট পেয়েছি। শুক্রবারে।” একটু থেমে রামোনের অভিব্যক্তি দেখল। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। একই রকম সুদূরের সবুজ দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে বেলার দিকে। জানে একে অপরের প্রতি তাদের ভালোবাসায় কেউ চিড় ধরাতে পারবে না। তারপরেও কেমন একটা দূরত্ব থেকেই যায়। তাড়াতাড়ি তাই শেষ করার জন্য বলল,

 “আমি প্রায় দু’মাসের অন্তঃসত্ত্বা। নিশ্চয় স্পেনেই হয়েছে। সম্ভবত গ্রানাডা’তে, ষাঁড়ের লড়াইয়ের পর…” দম হারিয়ে কাঁপতে শুরু করল যেন, তারপরেও বলতে লাগল, “আমি আসলে কিছুই বুঝতে পারছি না। মানে, আমি নিয়মিতো পিল খেয়েছি। তুমি দেখেছ…” বুঝতে পারল ঠিকভাবে কিছুই বলতে পারছে না, তারপরেও শেষ করল, “জানি আমি বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম; কিন্তু তুমি কিছু ভেবো না। এখনো সময় আছে। গত বছর হ্যারিয়েটের সাথেও একই হয়েছিল। আমস্টারডামে গিয়ে ডাক্তার দেখানোর পরে সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় গিয়ে রবিবারেই লন্ডনে ফিরে এসেছে একদম নতুন হয়ে। ও আমাকে ঠিকানা দিয়েছে, বলেছে প্রয়োজন হলে সাথেও যাবে।”

“ইসাবেলা!” তীব্র স্বরে চিৎকার করে উঠল রামোন। “চুপ করো একদম চুপ। আমার কথা শোন! ভয়ার্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইল বেলা।

তুমি জানই না যে কী বলছ। তুমি কী কসাই!”

“আই এম সরি, রামোন।” অবাক হয়ে গেল বেলা। “আমার আসলে তোমাকে বলাটা উচিত হয়নি। হ্যারিয়েট আর আমি মিলেই….”

“হ্যারিয়েট একটা শয়তানের বাচ্চা। আর ওর হাতে আমার সন্তানের জীবন তুলে দিলে তোমাকেও ছাড়ব না।”

হা হয়ে তাকিয়ে রইল ইসাবেলা। এমনটা তো আশাই করেনি।

“এটা একটা মিরাক্যল ইসাবেলা। বিশ্ববক্ষান্তের সবচেয়ে বড় রহস্য। আর তুমি একে ধ্বংস করে ফেলার কথা বলছ। ও আমাদের সন্তান, ইসাবেলা। নতুন একটা জীবন, ভালোবেসে আমরা যার সৃষ্টি করেছি। বুঝতে পারছ না?”

পাশে এসে মেয়েটার হাত ধরতেই রামোনের দৃষ্টির শীতলতা কেটে গেছে দেখতে পেল বেলা।

 “তুমি রাগ করোনি?” দোনোমোনো করে জানতে চাইল-বেলা, “আমি তো ভেবেছি তুমি খেপে যাবে।”

“আমি গর্বিত। ডিয়ার।” ফিসফিসিয়ে উঠল রামোন। “আই লাভ ইউ। আমার কাছে তুমিই হচ্ছ সবচেয়ে দামি।” বেলার হাত ভাজ করে কব্জিতে ধরে পেটের উপর রাখল রামোন।” ওখানে যে আছে আমি তাকেও ভালোবাসি। ও ‘ও আমার কাছে তোমার মতই মূল্যবান।” অবশেষে জানালো, “আই লাভ ইউ।”

 “ওহ, রামোন!” কেঁপে উঠল বেলার স্বর, “তুমি এত সুন্দর, এত ভালো! আর সবেচয়ে বড় মিরাক্যল হলো তোমার সাথে আমার দেখা হওয়া।”

“তুমি আমাদের সন্তানের জন্ম দিবে, মাই ডার্লিং বেলা।”

“হ্যাঁ, হাজার বার আমি হ্যাঁ-ই বলব ডার্লিং। ইউ হ্যাভ মেইড মি সো প্রাউড, সো হ্যাপি!”

অনিশ্চয়তা কেটে গিয়ে উত্তেজনা এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেল মেয়েটার বাকি সবকিছু।

***

এতদিনে উদ্দেশ্য আর গন্তব্য খুঁজে পেয়েছে তার আর রামোনের ভালোবাসা। সারাক্ষণ মগ্ন হয়ে কেবল সে কথাই ভাবে বেলা। কয়েক বার ভেবেছে ন্যানিকে জানাবে, কিন্তু তারপরেই বুঝতে পেরেছে এই বুড়ী উত্তেজনার চোটে পেট ফেটে মরে যাবে আর চব্বিশ ঘন্টার মাঝে জেনে যাবে বাবাসহ পুরো অ্যামবাসি আর দুনিয়া। তাই অপেক্ষা করছে কিছু কাজ না সারা পর্যন্ত। তবে অবাক হচ্ছে এই ভেবে যে ন্যানি কিছু টের পাচ্ছে না কেন। বুড়ীর দৃষ্টি এত তীক্ষ্ণ যে ওয়েল্টেভ্রেডেনের বাড়িতে কোনো মেইডের এমনটা হলেই বুঝে ফেলে অব্যর্থভাবে। আর বাসায় থাকলে তো সে-ই বেলাকে স্নান করিয়ে দেয়।

সন্ধ্যাবেলা দ্রুরি লেইনে ফ্ল্যামেঙ্কো ফেস্টিভ্যালের টিকেট কেটে এনেছে রামোন; কিন্তু ব্যাংকের প্রাইভেট নাম্বারে ওর কাছে ফোন করল বেলা।

“রামোন ডার্লিং, আজ রাতে বের হতে মন চাইছে না। তার চেয়ে বরং তোমারি সাথে একাকী সময় কাটাতে চাই। আমি ডিনার তৈরি করব। তুমি ফ্ল্যাটে আসতে আসতে আমি রেডি করে ফেলব, তারপরে একসাথে ভন কারান’র নতুন ডিস্ক শুনব।”

সারা সপ্তাহ ধরে এ উৎসবের জন্য অপেক্ষা করেছিল রামোন। মাঝে মাঝে স্প্যানিশ নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করে। বেলা’কে তো চাপ দিচ্ছে ভাষাটা শেখার জন্য। এক সেট রেকর্ডও কিনে দিয়েছে। যাই হোক অবশেষে রাজি করাল বেলা।

অ্যামব্যাসি থেকে ফ্ল্যাট পর্যন্ত আসতে আসতে কয়েকবার গাড়ি থামিয়ে সেন্ট জেমস্ স্ট্রিট থেকে পোল রজার আর মাচেট’র বোতলসহ হ্যারোডস্ থেকে কিনে নিল দুই ডজন হুইট স্ট্যারেল অয়েস্টার আর এক জোড়া নিখুঁত বাছুরের মাংসের কাটলেট।

 সামনের জানালা দিয়ে রামোনকে দেখা গেল। ব্রি-পিস স্যটে পাক্কা সাহেব দেখাচ্ছে ছেলেটাকে। এটা এমন এক অদ্ভুত গুণ যে সব পরিবেশেই চমৎকারভাবে মানিয়ে যায় রামোন, যেন জন্ম থেকেই এভাবে আছে।

শ্যাম্পেন খুলে সদর দরজায় রামোনের চাবির আওয়াজ শুনতেই দুজনের গ্লাস ভরে নিয়ে রেখে দিল বরফ কুচি দিয়ে ভরা রূপার ট্রে’র পাশে, যার উপর সাজিয়ে রেখেছে খোলা অয়েস্টার। ইচ্ছে হল দৌড়ে যায়, তা না করে লিভিং রুমে রামোন এলে পর কিস দিয়ে ভরিয়ে তুলল ছেলেটাকে।

 “বিশেষ কিছু নাকী?” বেলা’র কোমরে হাত রেখেই জানতে চাইল রামোন। লম্বা টিউলিপ গ্লাসের একটা তুলে ওর হাতে দিল বেলা আর নিজের গ্লাসের কিনারা দিয়ে চোখ তুলে তাকাল রামোনোর দিকে।

“ওয়েলকাম হোম, রামোন। আমাকে বিয়ে করলে তুমি কী কী পাবে। তার ছোট্ট একটা নমুনা দেখালাম শুধু।”

রামোনের চোখ জোড়া কেঁপে উঠল; এতটা তীক্ষ্ণ আর মর্মভেদী দৃষ্টি আর কখনো দেখেনি বেলা। সবসময় স্থিরভাবেই তাকায় ছেলেটা।

ওয়াইনে একটুও চুমুক না দিয়ে গ্লাসটাকে একপাশে রেখে দিল রামোন। মনে মনে প্রমাদ গুনল বেলা।

“কি হয়েছে, রামোন?” জানতে চাইল তড়িঘড়ি করে।

বেলার হাত থেকেও শ্যাম্পেনের গ্লাস নিয়ে ওয়ালনাট টেবিলের উপর রেখে দিয়ে রামোন বলে উঠল, “বেলা।” নরম স্বরে মেয়েটার নাম ধরে ডেকে কি করল খোলা হাতের তালুতে।

“কী হয়েছে রামোন? বলো?” বুক শুকিয়ে গেল মেয়েটার।

“আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না ডার্লিং অন্তত এখন না।” বেলার পায়ের নিচের জমি কেঁপে উঠল যেন। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। ধীরে ধীরে হেঁটে আর্মচেয়ারে গিয়ে বসে পড়ে জানতে চাইল, “কেন?” ওর সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসল রামোন। না তাকিয়েই বেলা আবার জানতে চাইল, “আমি তোমার সন্তান বহন করতে পারলে আমাকে তুমি বিয়ে করতে পারবে না কেন?”

“বেলা, তোমার মতো স্ত্রী আর তোমার সন্তানের পিতা হবার জন্য আমি সব করতে পারি, কিন্তু…?”

“কিন্তু কী?”

“প্লিজ আমার কথা শোন। পুরোটা না শুনে কিছু বলল না।”

 এবারে চোখ তুলে ওর দিকে তাকাল বেলা।

“আমি নয় বছর আগে মিয়ানিতে একটা কিউবান মেয়েকে বিয়ে করেছিলাম।”

চোখ বন্ধ করে ফেলল বেলা।

“কিন্তু শুরু থেকেই সব কিছু নষ্ট হয়ে যায়। বিচ্ছিন্ন হবার আগে কয়েক মাস মাত্র একসাথে ছিলাম। কিন্তু আমরা দুজনেই ক্যাথলিক…” কথা বন্ধ করে বেলার ফ্যাকাসে গালে স্পর্শ করল রামোন। পিছিয়ে গেল বেলা। ছেলেটা জানাল, “তাই, আমরা এখনো বিবাহিত।”

“ওর নাম কী?” চোখ না খুলেই জানতে চাইল ইসাবেলা।

 “কেন জানতে চাও?”

“বলো।”

“নাটালি।” কাঁধ ঝাঁকাল রামোন।

“ছেলেমেয়ে?” আবারো জানতে চাইল বেলা, “তোমাদের কয়টা ছেলে মেয়ে আছে?”

“একটাও না।” উত্তরে জানাল রামোন। “তুমিই আমার প্রথম সন্তানের মা হবে।” দেখতে পেল ফিরে এলো মেয়েটার গালের রঙ। খানিক পরে চোখ খুললেও দেখা গেল হতাশার ভার গিয়ে সবটুকু নীল কালো হয়ে গেছে।

“ওহ, রামোন, এখন কী করব আমরা?”

“আমি এরই মাঝে আমার কাজ শুরু করে দিয়েছি। স্পেন থেকে ফেরার পর; তুমি আমাকে বাচ্চার কথা বলার আগেই বুঝতে পেরেছিলাম যে স্ত্রী হিসেবে তোমাকেই চাই।

“ওহ, রামোন।” শক্ত করে ওর হাত চেপে ধরল বেলা।

“নাটালি এখনো মিয়ামিতে ওর পরিবারের সাথে বাস করে। কয়েকবার টেলিফোনে কথাও বলেছি। জানিয়েছে এমন কিছু নেই যার কারণে আমাকে ডির্ভোস দিতে রাজি হবে।”

হা করে তাকিয়ে থেকে অবশেষে ভয়ংকর দুঃখের সাথে মাথা নাড়তে লাগল ইসাবেলা।

“তিনটা সন্ধ্যায় ওকে ফোন করেছি আর অবশেষে এমন এক বস্তুর সন্ধান মিলেছে যা ওর কাছে ঈশ্বর আর পাপ স্বীকারের চেয়েও জরুরি।”

“কী?’

“টাকা।” গলায় ব্যাকুলতা এনে বলল রামোন। “কবুতর মারা প্রতি যোগ্যতা থেকে পাওয়া অর্থের বেশির ভাগটাই এখনো রয়ে গেছে। পঞ্চাশ, হাজার ডলারের বিনিময়ে ডির্ভোস ফাইল করতে অবশেষে রাজিও হয়েছে।

 “ডার্লিং! “ খুশিতে চকচক করে উঠল ইসাবেলার চোখ। “ওহ্ থ্যাঙ্ক গড়! কখন? কখন মুক্তি দিবে তোমাকে?”

“এইখানেই সমস্যাটা। সময় লাগবে। আমি ওকে জোর করতে পারব না। নাটালি’কে ভালোভাবেই চিনি আমি। যদি সে তোমাকে খুঁজে পায় আর বুঝতে পারে কেন ডিভোর্স চাইছি তাহলে আরো ব্ল্যাকমেইল করবে। আগামী মাসের শুরুতে রেনো যেতে রাজি হয়েছে। মায়ের অবস্থাও তেমন ভালো না।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, কিন্তু কতদিন সময় লাগবে?” অধৈর্য হয়ে জানতে চাইল বেলা।

“রেনো’তে থাকার ব্যাপারে নেভাডা স্টেট ল’র নিয়ম হল ডিভোর্স গ্রান্ট করতে তিন মাস লেগে যায়।”

“ততদিনে ছয় মাস হয়ে যাবে। ড্যাডি আর আমি ইতিমধ্যে কেপ টাউনে ফিরে যাবার সমস্ত প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছি। ওহ্ রামোন এখন কী হবে?”

“তুমি কেপ টাউনে ফিরবে না।” সোজা-সাপ্টা জানিয়ে দিল রামোন। “আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না আর তোমার বন্ধু আর পরিবারের সকলেও জেনে যাবে ততদিনে।”

“তাহাল আমি কী করব? কী চাও?”

“আমার ডির্ভোস ফাইনাল না হওয়া পর্যন্ত আমার সাথে থাকো। আমার ছেলের জীবনের একটা দিনও মিস করতে চাই না।”

অবশেষে বেলার মুখে হাসি ফুটল। “ছেলেই হচ্ছে তাহলে তাই না?”

“অবশ্যই।” ভান করে বলে উঠল রামোন। “পারিবারিক পদবী দেবার জন্য উত্তরাধিকার তো লাগবে তাই না? আমার সাথে থাকবে তত বেলা?”

“তাহলে বাবা আর দাদীমাকে কী বলল? পাপা’কে না হয় মানিয়ে নিতে পারব কিন্তু দাদী…!” চোখ পাকালো ইসাবেলা। “সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকমস হলেন পারিবারিক ড্রাগন। তার নিঃশ্বাসে আসলেই আগুন ঝড়ে আর ভিকটিমের তো হাড় পর্যন্ত চিবিয়ে খায়।”

“আমি তোমার ড্রাগনকে পোষ মানাবো।” প্রমিজ করল রামোন।

“আমার সত্যিই মনে হয় তুমি পারবে।” দুঃশ্চিন্তা মুক্ত হয়ে সন্তুষ্টি ফুটল মেয়েটার চোখে। নানা’কে কেউ খুশি করতে পারলে তুমিই পারবে, ডার্লিং।”

***

সেনটেইন কোর্টনি ম্যালকমস্ ছয় হাজার মাইল দূরে থাকায় সহজ হয়ে গেল কাজটা। খুব যত্ন করে সবকিছুর ছক করল ইসাবেলা। প্রথমেই নজর দিল বাবা’র দিকে। রাতারাতি বনে গেল অত্যন্ত দায়িত্বশীল কন্যা আর নিখুঁত হোস্টেজ। কূটনৈতিক কাজে শাসা কোর্টনির শেষ কয়েক সপ্তাহে বেশ কিছু সোশ্যাল প্রোগ্রামের আয়োজন করল বেলা।

 “যেখানেই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলে সেখান থেকে ফিরে আসায় ওয়েলকাম ব্যাক। জানো তোমাকে কতটা মিস্ করেছি।” বেলা’র আয়োজনকৃত সুন্দর একটা ডিনার পার্টির পরম মন্তব্য করলেন উফুল্ল শাসা। হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে পিতা-কন্যা। হাইভেন্দ্রের সামনের দরজার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দেখছে লিমুজিনে চড়ে সর্বশেষ অতিথির প্রস্থান।

 “সকাল একটা বাজে।” হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করলেন শাসা। কিন্তু তাকে থামিয়ে দিল ইসাবেলা।

 “এত তাড়াতাড়ি বিছানায় যাবার কী দরকার?” বাবার হাতে চাপ দিল বেলা। “চল তোমার জন্য সিগার নিয়ে আসি। সারা সন্ধ্যাতে তোমার সাথে একটুও কথা বলতে পারি নি।”

রুমের একপাশে রাখা চামড়ায় মোড়া আর্মচেয়ারে আরাম করে বসলেন শাসা। স্পষ্ট আনন্দ নিয়ে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। ঠিক যেন তার আস্তাবল থেকে আসা টগবগে কোনো বাচ্চা ঘোড়া কিংবা আর্ট কালেকশনে থাকা রতুগুলোর একটা। অবশেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে তার এই মেয়ে হলো কোর্টনিদের মাঝে সবচেয়ে সুন্দরী।

তরুণ বয়সে তার মা’ও ছিলেন একই রকম সুন্দরী। বহু বছর হয়ে যাওয়ায় শাসা’র স্মৃতিতে তেমন উজ্জ্বল না থাকলেও ওয়েল্টেভ্রেডেনের ড্রইং রুমে পোর্ট্রেট করা আছে বেলা’র দাদীমা’র ছবির কালো চোখ জোড়া দিয়েও ঠিকরে বের হচ্ছে তার চারিত্রিক মাধুর্যতা।

বাবা’র ডেস্ক থেকে স্বর্ণের কাটার বের করে সিগারের মাথা কেটে শাসা কে তৈরি করে দিল বেলা। মেয়ের দিকে তাকিয়ে অ্যামব্যাসডর নিশ্চিত হলেন যে, যৌবনের তারুণ্যে দাদীমা’র রূপকেও হার বানিয়ে দিয়েছে ইসাবেলা।

“আজ সকালে প্রোফেসর সিমন্স আমার থিসিসের লেটেস্ট অংশটা পড়েছেন।”

“তার মানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পদধূলি দিয়ে এখনো তুমি তাদেরকে ধন্য করো।” আগুনের নরম আলোতে মেয়ের খালি কাঁধের দিকে তাকালেন শাসা। মায়ের আইভরি রঙা দেহতুক পেয়েছে মেয়েটা।

“ওনার ধারণা ভালই হয়েছে।” খোঁচাটুকু এড়িয়ে গেল বেলা।

“তুমি আমাকে যে প্রথম একশ পৃষ্ঠা পড়তে দিয়েছিলে, যদি সেরকমই হয় তাহলে প্রফেসরের ধারণাই সঠিক।”

“উনি চান আমি যেন এখানে থেকেই বাকিটুকু শেস করি।” বাবা’র দিকে না তাকিয়েই বলে উঠল বেলা। বুকের মাঝে কেমন যেন করে উঠল শাসা কোর্টনির।

“একা একা লন্ডনে?” তাড়াতাড়ি জানতে চাইলেন।

“একা একা? পাঁচশ বন্ধু, কোর্টনি এন্টারপ্রাইজের কর্মচারীরা, আমার মা…!” বাবার কাছে ব্যান্ডি বেলুন এনে জুড়ে দিল বেলা, ‘অদ্ভুত এই শহরে একেবারে একা থাকব না, পাপা।”

কগন্যাবো চুমুক দিতে দিতে মরিয়া হয়ে কোনো কারণ খুঁজতে লাগলেন যাতে করে সাথে যেতে বাধ্য হবে বেলা।

“কোথায় থাকবে?” জানতে চাইলেন শাসা।

“পারলেন না বাবা, হেরে গেল।” পিতার মুখের উপর হেসে হাত থেকে সিগার নিয়ে নিল বেলা। লাল রাঙানো ঠোঁটে এক গাল ধোয়া বানিয়ে ছুঁড়ে মারল বাবার মুখের উপর। “সাদোগান স্কোয়ারে প্রায় মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের একটা পারিবারিক ফ্লাট খালি পড়ে আছে।”

সবচেয়ে অমোঘ অস্ত্রটা হানার জন্য প্রস্তুত হলো বেলা। “পাপা, তুমিই তো চাইতে যেন আমি ডক্টরেটটা শেষ করি। এখনো মানা করবে না, তাই না?”

শাসাও খেলতে চাইলেন; উত্তরে মেয়েকে বলে উঠলেন, “তুমি এত সাবধানে সব কিছু ভেবে রেখেছ; তাহলে এরই মাঝে দাদীমা’কেও নিশ্চয় জানিয়েছ?”

চুপ করে আমচেয়ারে বসে থাকা বাবার কোলের উপর বসে পড়ে কপালে কি করে বেলা বলে উঠল, “ডার্লিং ড্যাডি আমি তো আরো ভাবলাম যে আমার হয়ে তুমিই নানা’কে সব খুলে বলবে।

দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন মিঃ অ্যামবাসাডর।

যাক, নিশ্চিন্ত হলো বেলা। নানা’কে বাবাই সামলাবে। কিন্তু ন্যানিও তো আছে। যাই হোক আগে ভাগেই ওর সতের জন নাতী-নাতনীর নাম মুখস্থ করে বেলা জানাল, “ভেবে দেখো ন্যানি তুমি তিন বছর ধরে বাড়ি যাওনি। কেপে নৌকা থামার সাথে সাথে জোহানসকে দেখবে দাঁড়িয়ে আছে ঘাটে।” সবচেয়ে প্রিয় পুত্রের কথা শুনে চক্ করে উঠল ন্যানির চোখ। তাই দু’দিন জোরাজুরির পর বেলা’র কাছেই হেরে গেল বুড়ী।

 সাউদাম্পটনে সবাইকে বিদায় জানাতে এসেছে বেলা। জিরাফের গলার মতো লম্বা ক্রেন দিয়ে ইউনিয়ন ক্যাসেল লাইনারে ভোলা হচ্ছে শাসা’র নতুন অ্যাশটন মার্টিন। সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে গেল পরিচারকদের দল। শফার ক্লোনকি থেকে শুরু করে মালয় শেষ পর্যন্ত সবাইকে জড়িয়ে ধরে বিদায় জানাল বেলা। ইসাবেলা কিস্ করতেই কান্নায় ভেঙে পড়ল ন্যানি।

“তুমি হয়ত এই বুড়ীর চেহারা আর দেখতে পাবে না। চলে গেলে মনে করো আমার কথা স্মরণ করো ছোটবেলায় তোমাকে কিভাবে পেলেছি…।”

“যাও তো ন্যানি। তুমি না থাকলে আমার বাচ্চাদের কে দেখবে?”

“তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে এসো সোনা। বুড়ী ন্যানি তাহলে তোমাকে চোখে চোখে রাখতে পারবে। তোমাকে সুন্দর একটা দক্ষিণ আফ্রিকান ছেলে খুঁজে দেব।”

 শাসা’কে গুডবাই বলতে এসে হঠাৎ করে কাঁদতে শুরু করে দিল বেলা। ভাবল-ব্রেস্টেড ব্লেজারের পকেট থেকে কড়কড়া সাদা রুমাল মেয়ের দিকে বাড়িয়ে দিলেন শাসা। বেলা কাজ সেরে বাবাকে দিতেই তিনি নিজেও শব্দ করে নাক মুছলেন।

“এত বাতাস না এখানে?” ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “হাঁচি শুরু হয়ে যাচ্ছে।”

 জেটি ছেড়ে আস্তে আস্তে নদীর দিকে চলে গেল লাইনার। অন্যান্য প্যাসেঞ্জারদের থেকে আলাদা হয়ে জাহাজের রেইল ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন লম্বা, ঋজুদেহী শাসা। ডির্ভোসের পর আর কখনো বিয়ে করেননি। বেলা জানে ডজন ডজন মেধাবী-সুন্দরী’র দেখা পেলেও একাই পথ চলেছে বাবা।

 “কখনো তাঁর একা লাগত না?” জাহাজের ডেক্‌ অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে হাত নাড়তে নাড়তে ভাবল বিস্মিত বেলা। “ গাড়ি চালিয়ে লন্ডনে ফেরার সময় কান্নার জলে ঝাপসা হয়ে গেল সামনের রাস্তা।

“এই বাচ্চাটাই আসলে আমাকে এত সেন্টিমেন্টাল করে তুলেছে!” পেটে হাত দিয়ে চাইল কারো অস্তিত্ব টের পাবার। পরিবর্তে সোজা। সমান মধ্যদেশে হাত দিয়ে ভাবল, “ঈশ্বর, যদি সবকিছুই মিথ্যে আশংকা হয়!”

মন খারাপ ভাব আরো বেড়ে যেতেই মিনি’র বদ্ধ প্রকোস্টে হাতড়ে বের করে আনল ক্লিনেক্সর প্যাকেট।

যাই হোক ফ্ল্যাটের সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই খুলে গেল দরজা। রামোন এসে হাত ধরতেই শুকিয়ে গেল সব কান্না।

***

অত্যন্ত রুচিশীল আর সুসজ্জিত কাডোগান স্কোয়ারের পারিবারিক ফ্ল্যাটের প্রথম দুই ফ্লোর ভিকটোরিয়ান আমলের লাল ইট দিয়ে তৈরি।

শুধুমাত্র ঠিকানা হিসেবে ঐ বাড়িকে ব্যবহার করা ইসাবেলা শুক্রবারে এসে চিঠি-পত্র নিয়ে যায় আর নিচের ভাড়ার ঘরে বসে ফুলটাইম হাউজকীপারের সাথে চা খেয়ে যায়। ওয়েল্টেজ্ৰেদেন আর অন্যান্য জায়গা থেকে আসা লং ডিসটেন্স ফোনগুলো ভালোভাবেই সামাল দেয় বেলার এই সুহৃদ হাউজকীপার।

রামোনের ছোট্ট ফ্ল্যাটটাকেই সত্যিকারের ঘর বানিয়েছে ইসাবেলা। এখানকার ওয়াডড্রোবে জায়গার সংকুলান না হওয়ায় কাডোগান স্ট্রিটের বাড়িসহ দু’জায়গায়তেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে পোশাক। বিছানার এক কোণাতে ছোট্ট করে বানিয়েছে তার স্টাডি।

 বিবাহিত দম্পত্তিদের মতো রুটিন মেনে চলে রামোন আর ইসাবেলা। গাইনোকোলজিস্ট জগিং করতে বারণ করায় জিমে কিংবা রাইডিং করে। এরপর রামোন ব্যাংকে যাবার পর লাঞ্চ পর্যন্ত মন দিয়ে থিসিসের কাজ করে বেলা। অ্যালকোহল ছেড়ে দিয়ে বাচ্চার সুস্থতার দিকে নজর দেয়ায় জাস্টিন ডি ব্ল্যাঙ্ক কিংবা হ্যাঁরোড’য়ে গিয়ে বসে দুজনে।

“আমি ব্যাঙের মতো ফুলে যেতে চাই না।”

“আমার কাছে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত রমণীই হচ্ছ তুমি, আর গর্ভবতী হওয়াতে তো যৌবন পূর্ণতা পেয়েছে।”

বেলা’র বিশাল উদরে হাত দিয়ে স্পর্শ করল রামোন।

লাঞ্চের পরে টিউটরের সাথে দেখা করে কিংবা ব্রিটিশ মিউজিয়ামের রিডিং রুমে বসে বাকি বিকেলটা কাটিয়ে দেয় বেলা। এরপর মিনিতে চেপে বাসায় ফিরে যায় রামোনের ডিনার রেডি করার জন্য। ভাগ্য ভালো ডিপ্লোম্যাটিক প্লেট নাম্বার এখনো ব্যবহার করতে পারে বেলা; বাবা’ই সব ঠিকঠাক করে গেছে। তাই ট্রাফিক সত্ত্বেও সময় মতো পৌঁছে যায় ফ্ল্যাটে।

পারতপক্ষে এখন আর রাতের বেলা কোথাও বের হয় না। মাঝে মাঝে শুধু থিয়েটার কিংবা গিয়ে বসে হ্যারিয়েট আর তার লেটেস্ট বয়ফ্রেন্ডের সাথে।

 আস্তে আস্তে স্ফীত হতে লাগল সমান মধ্যদেশ। সিল্কের ড্রেসিং গাউনের সামনের অংশ খুলে গর্বিতভাবে দেখাল রামোন’কে। উচ্ছল আনন্দে বলে উঠল, “দেখো”।

 “হ্যাঁ, ছেলে না হয়ে যায় না।” সায় দিল রামোন।

“তুমি কিভাবে জানো?”

“এখানে।” বেলার হাত ধরে নির্দিষ্ট একটা জায়গায় বসিয়ে দিয়ে রামোন বলল, “বুঝতে পারছ না?”

“আহ, একেবারে বাপের মতই হয়েছে নিশ্চয়। ঘুম পেয়ে গেছে আমার।”

মেয়েকে হ্যারোজস এর চার্জ কার্ড দিয়ে গেছেন শাসা। সেখান থেকেই কিনেছে বেলা। যদিও তরুণী হবু মায়েদের জন্য পোশাক বানাতে বিশেষ নিত্য নতুন বুটিক খুঁজে বের করে হ্যারিয়েট।

প্রতি মাসে অন্তত একবার সপ্তাহখানেক বা তার চেয়েও বেশি সময়ের জন্য ব্যাংকের কাজে শহরের বাইরে যায় রামোন। যাই হোক, সুযোগ পেলেই ফোন দেয় বেলাকে। তাই ছেলেটা ফিরে আসার পর পর আনন্দ বেড়ে যায় শতগুণ।

এরকম এক ট্রিপের পর হিথ্রো থেকে রামোনকে সরাসরি ফ্ল্যাটে নিয়ে এলো বেলা। হলে ট্রাভেল ব্যাগ ফেলে টেয়ারের উপর জ্যাকেটটাকে ছুঁড়ে রেখে বাথরুমে চলে গেল রামোন।

 হঠাৎ করেই জ্যাকেটের ভেতরের পকেট থেকে পাসপোর্টটা স্লিপ করে পড়ে গেল কার্পেটের উপর। উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে রামোনের ছবি দেখতে পেল বেলা। একই সাথে জন্ম তারিখও পেয়ে গেল। মনে পড়ে গেল আর মাত্র দুই সপ্তাহ পরেই রামোনের জন্মদিন। ভাবতে লাগল কিভাবে এবার স্মরণীয় করে রাখা যায় দিনটাকে। প্ল্যান করে ফেলল মে-ফেয়ার বুটিক শপে দেখা কাঁচের নগ্ন মূর্তি কিনে গিফট করবে ছেলেটাকে। রেনে লালিক’র তৈরি মূর্তিগুলো ঠিক যেন তার দেহ সৌষ্ঠরের মতো করেই বানানো হয়েছে।

পাসপোর্টের আরো কয়েকটা পাতা ওল্টাতেই ভিসা দেখে চোখ আটকে গেল। বিস্মিত হয়ে দেখল আজ সকালেই মস্কোর স্ট্যাম্প লাগানো হয়েছে।

“ডার্লিং” বাথরুমের দরজার এপাশ থেকে জানতে চাইল বেলা, আমি তো ভেবেছিলাম তুমি রোমে গেছ। মস্কো’র সিল কেন তাহলে?” সারা জীবনের শিক্ষা থেকে জানে রাশিয়া হলো সবচেয়ে বড় খ্রিস্ট-বিদ্বেষী দেশ। তাই পাসপোর্টে মিলটা দেখেই কপালের চুলগুলো দাঁড়িয়ে গেছে।

বন্ধ দরজার ওপাশে মিনিট খানেকের জন্য নেমে এলো নীরবতা। এরপর হঠাৎ করেই বের হয়ে বেলা’র হাত থেকে পাসপোর্ট কেড়ে নিল রামোন। শীতল অভিব্যক্তি আর চোখ দুখানা দেখে ভয় পেয়ে গেল বেলা।

“আর কখনো আমার কোনো বিষয়ে নাক লাগবে না।” নরম স্বরে ঘোষণা করল রামোন।

পরে আর কখনোই এ বিষয়ে কিছু না বললেও প্রায় সপ্তাহখানেক পর বেলা’র মনে হল যে তাকে মাফ করে দিয়েছে রামোন। এতটা খারাপ লাগল যে বেলা নিজেও চেষ্টা করল পুরো ব্যারটাকে ভুলে যেতে।

 নভেম্বরের শুরুতে, কাদোগান স্কোয়ারে রুটিন ভিজিটের সময় হাউজকীপার হাতে তুলে দিল এক গাদা চিঠি। সবসময়ের মতই বাবার চিঠি এসেছে। কিন্তু এবারে তার সাথে ভাই মাইকেলের হাতের লেখা খামের উপর দেখে খুশি হয়ে উঠল বেলা।

তিন ভাইয়ের প্রত্যেকেই চেহারা, ব্যক্তিত্ব আর চারিত্রিক দিক থেকে এতটাই ভিন্ন যে বিশেষভাবে কাউকে পছন্দ করা অসম্ভব।

অ্যাডভেঞ্চার স্বভাবের বড় জন শন তার দেখা সবচেয়ে সুপুরুষ। এখন অবশ্য রামোন সে জায়গা নিয়েছে। সৈন্য আর শিকারী শন্ এরই মাঝে রোডেশিয়া’তে বীরত্ব দেখাবার জন্য সিলভার ক্রস’ও পেয়েছে। তাই সন্ত্রাসীদের পেছনে দৌড়ানো ছাড়া তার আরেকটা কাজ হল জাম্বেজি উপত্যকায় কোর্টনি এন্টারপ্রাইজের হয়ে শিকারের আয়োজন করা।

 মায়োপিয়া আর অ্যাজমা রোগে ভুগতে থাকা দ্বিতীয় ভাই গ্যারিক নিজের শারীরিক অক্ষমতাকে পূরণ করেছে চরিত্রের মাঝে কোর্টনি’দের দৃঢ় প্রত্যয় আর অদম্য উৎসাহ ধারণ করার মাধ্যমে। ছোটবেলায় “বেচারা গ্যারি” উপাধি পাওয়া ছেলেটাই” কসরৎ করে গড়ে তুলেছে পুরুষালী গড়ন; হয়ে উঠেছে গলফ প্লেয়ার, রাইফেল আর শট গানে সিদ্ধহস্ত বন্দুকবাজ।

এর পাশাপাশি কোর্টনি এন্টারপ্রাইজের চেয়ারম্যান আর চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার হয়ে বাবা’র স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। এখনো বয়স ত্রিশও হয়নি, এরই মাঝে মাল্টি বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি চালানো পরিশ্রমী গ্যারি কখনোই বেলা’র জন্মদিন ভুলে যায় না। বোনের যে কোনো আবদার মেটাবার জন্য কখনো পিছপা’ও হয় না; হোক না সেটা যতটা তুচ্ছ কিংবা মূল্যবান। বড়-সড় আদুরে স্বভাবের ভাইটাকে “টেডি বিয়ার” ডাকে বেলা।

এরপর হচ্ছে নম্র-ভদ্র, ভাবুক। সহানুভূতিশীল, কবিমনা আর পারিবারিক শান্তি রক্ষাকারী মাইকেল, যে কিনা কোর্টনি হওয়া সত্ত্বেও, বাবা আর অন্য দুই ভাইয়ের উদাহরণ কিংবা উৎসাহে আমল না দিয়ে সারা জীবনে কখনো একটাও পাখি কিংবা জীব হত্যা করেনি। এর বদলে প্রকাশ করেছে তিনটা বই। একটা কবিতা আর অন্যাটা দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাস আর রাজনীতি নিয়ে লেখা। শেষের দু’টো তত দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যবসায়ী সমাজ নিষিদ্ধ করেছে সে দেশে। এছাড়াও অত্যন্ত বিখ্যাত সাংবাদিক মাইকেল গোল্ডেন সিটি মেইল নামক ইংরেজি পত্রিকার ডেপুটি এডিটর। যারা শক্ত কণ্ঠে লিখে চলেছে, জন ভরসটার আর তার বর্ণবাদী নীতির বিপক্ষে। অবশ্য পত্রিকাটার আশি শতাংশ শেয়ার কোর্টনি এন্টারপ্রাইজের। নতুবা এত কম বয়সে এতটা দায়িত্বশীল পদ পাওয়া সম্ভব হত না।

ইসাবেলার শৈশবে মাইকেলই ছিল তার রক্ষক আর উপদেষ্টা। নানা’র পরে সেই-ই হচ্ছে মেয়েটার প্রিয় গল্পকথক। নিজের জীবনে অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে মাইকেলকেই সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে বেলা।

এবারে তাই ভাইয়ের হাতের লেখা দেখে আনন্দের সাথে সাথে অনুতপ্ত বোধও এলো মনে। রামোনের সাথে দেখা হবার পর থেকে ছয় মাস ধরে কোনো চিঠি লেখেনি ভাইকে।

প্রথম পাতার দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফে চোখ যেতেই সাথে সাথে চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করে দিল বেলা…।

 বাবা বলেছে তুমি নাকি কাদোগান স্কোয়ারের ফ্ল্যাটে বেশ মনোযোগ দিয়েই থিসিসের কাজ করছ। গুড ফর ইউ, বেলা। যাই হোক, তুমি নিশ্চয় পাঁচটা বেডরুমের সবক’টি কাজে লাগাচ্ছে না। তাই আশা করি আমার জন্য কোথাও না কোথাও একটু জায়গা হয়ে যাবে। এ মাসের পনের তারিখ থেকে তিন সপ্তাহের জন্য লন্ডনে থাকতে হবে আমাকে। প্রতিদিন সারাক্ষণই বাইরে থাকব। প্রচুর ইন্টারভিউ আর মিটিং আছে। তাই প্রমিজ করছি তোমার পড়া শোনায় বিরক্ত করব না…।

তাই বাধ্য হয়ে এ সময়টা কাদোগান স্কোয়ারেই কাটাতে হবে। একদিকে খুশিই হল বেলা, কেননা এ সময় রামোনের’ও বিদেশে ট্রিপ পড়েছে। তাই অন্তত মাইকেলের সঙ্গ পাওয়া যাবে।

 জোহানেসবার্গে মেইলের’ অফিসে চিঠির উত্তর পাঠিয়ে কাদোগান স্কোয়ারকে সাজাতে বসল বেলা। এখনো এক সপ্তাহ সময় আছে হাতে। সবকিছু এমনভাবে ঠিকঠাক করতে হবে যেন সত্যিই সে এখানে থাকে।

“ওকে অনেক কিছু নিয়েই কৈফিয়ত দিতে হবে।” ঈষৎ ফোলা পেটের উপর হাত রেখে রামোনকে বলল বেলা।” তাও ভালো যে মাইকেল বেশ সমঝদার। আমি নিশ্চিত তোমাদের দু’জনের ভালই মিলবে। শুধু যদি দেখা

“তোমার ভাই থাকতে থাকতে কাজ সেরে লন্ডনে চলে আসতে চেষ্টা করব।”

“ওহ, রামোন ডার্লিং, খুব মজা হবে তাহলে প্লিজ চেষ্টা করো।”

হিথ্রো এয়ারপোর্টের আন্তজার্তিক ব্যারিয়ার দিয়ে লাগেজ ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে বের হয়ে এলো মাইকেল। হাস্যমুখে দাঁড়িয়ে থাকা বোনকে দেখেই কোলে নেয়ার মতো ভঙ্গি করে উপরে তুলে ফেলল। কিন্তু বেলা’র পেট নিজের শরীরে লাগতেই তাড়াতাড়ি অতি সাবধানে নামিয়ে দিল মেঝেতে।

মিনিতে করে শহরে নিয়ে আসার সময় মাঝে মাঝেই ভাইয়ের দিকে তাকাল বেলা। রোদে পোড়া দেহত্বক সত্ত্বেও চুলগুলি বেশ লম্বা হয়ে গেছে। যাই হোক হাসিটা এখনো বেশ অকপট আর নীল কোর্টনি চোখ জোড়াতে অন্যদের মতো শব্দ চাহনি নয় বরঞ্চ বেশ চিন্তাশীলতার ছাপ।

ভাইয়ের কাছ থেকে বাসার টুকটাক খবর নিতে নিতে কায়দা করে নিজের বিষয় এড়িয়ে যেতে চাইল বেলা। মাইকেলের কাছ থেকে জানা গেল বাবা নাকি আমর্সকারের চেয়ারম্যান হিসেবে নতুন পদে রীতিমতো জাকিয়ে বসেছেন। আর ওয়েস্ট্রেভেদেনের উপর নানা’র শাসন দিনে দিনে আরো বেশি কঠোর হয়ে উঠছে। শন্ এখনো গেরিলাদের প্ল্যাটুনের পাশাপাশি সঁড়ের দলকেও খতম করে চলেছে। অন্যদিকে শেয়ার হোল্ডারদেরকে রেকর্ড পরিমাণ লাভের ভাগ দিয়েছে গ্যারি। তার স্ত্রী হোলি অন্তসত্ত্বা হওয়ায় এবারে সবাই কন্যা শিশুর জন্যই দিন গুনছে।

সবকিছুর ফাঁকে ফাঁকে বোনের দিকেও ঠিকই তাকাচ্ছে মাইকেল। তাই ব্যাখ্যা দেয়ার ভয়ে অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল বেলা। অবশেষে মিনি এসে পৌঁছল গন্তব্যে।

জেট ল্যাগের ধকল কাটিয়ে উঠার জন্য মাইকেল স্নান সেরে নিতে নিতে হুইস্কি আর সোডা এনে দিল বেলা। টয়লেটের সিটের বন্ধ ঢাকনির উপর বসে কথা বলতে লাগল ভাইয়ের সাথে। এভাবে ফেনায় গা ডুবিয়ে গোসল করার সময় শন্ কিংবা গ্যারির সাথে কথা বলার ব্যাপারে চিন্তাও করবে না বেলা; কিন্তু মাইকেলের ব্যাপার ভিন্ন। নগ্নতা এই দু’ভাই বোনের কাছে অস্বাভাবিক কিছু না।

“আচ্ছা তোমার সেই অনর্থক ছড়াটা মনে আছে?” অবশেষে জানতে চাইল মাইকেল।

“ডাম ডি ডাম-ডাম,

 বাবা শুধোলেন ‘নেলী,

কী আছে তোমার পেটে।

 যা যায়নি তোমার মুখে! “

একটুও লজ্জা না পেয়ে হাসল বেলা। এর মানেই হল সাংবাদিকে শ্যেন দৃষ্টি? কিছুই তোমার চোখ এড়ায় না, তাই না মিকি?”।

 “চোখ এড়াবে?” হেসে ফেলল মাইকেল। “তোমার পেট তো আমার সাংবাদিকের প্রশিক্ষিত চোখ’কেও হারিয়ে দিয়েছিল আরেকটু হলে!”

“সুন্দর না?” যতটুকু সম্ভব পেট ঠেলে বের করে দিয়ে হাত বুলালো ইসাবেলা।

‘অসম্ভব!” ঐকমত হল মাইকেল বাবা আর নানা দেখলেও একই কথা বলবে।”

“তুমি তো বলবে না, তাই না মিকি?”

“তুমি আর আমি তো কখনো একে অন্যের সিক্রেট বাইরের কাউকে বলিনি। কখনো বলবোও না। কিন্তু শেষতক হুম ফলাফল নিয়ে তুমি কী করবে?”

“আমার ছেলে, তোমার ভাগনে-ফলাফল হলো? তোমার লজ্জা হলো না মিকি? রামোন তো বলে এ হলো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে বড় রহস্য আর মিরাক্যাল।”

“রামোন! তো কালপ্রিটটার নাম হলো রামোন। আশা করছি নানা’র পুরনো আর তৃঞ্চাৰ্ত শর্টগানের হরিণ মারার গুলি এড়াবার জন্য বুলেট প্রুফ পোশাক পরে যাবে বদমাশটা।”

“ও একজন মারকুইস, মিকি। দ্য মারকুইস ডি সান্টিয়াগো-ই-মাচাদো।”

“আহ, খানিকটা কাজ হবে মনে হচ্ছে। নানা’ও হয়ত পশু মারার গুলি না নিয়ে পাখি মারার গুলি নিয়ে নেবে।”

“নানা যতক্ষণে সব জানবে, ততদিনে আমি মারকুইসা হয়ে যাবো।”

 “এখন?”

“একটু সমস্যা আছে। কিন্তু বেশি দেরি নেই।” স্বীকার করতে বাধ্য হল বেলা।

“তারমানে ও এরই মাঝে বিয়ে করেছে আগেও?”

 “তুমি কিভাবে জানো মিকি?” অবাক হয়ে জানতে চাইল বেলা।

“আর তার স্ত্রী তাকে এখন ডির্ভোস দিতে চাইছে না?”

 “মিকি!”

 “মাই লাভ, এই পাড় শয়তানগুলো সব এক গোয়ালের গরু।”

উঠে দাঁড়িয়ে তোয়ালে নিল মাইকেল।

 “তুমি তো ওকে চেনোও না মিকি। ও এমন নয়।”

“বুঝতে পারছি তুমি কতটা অন্ধ হয়ে গেছ।” গায়ে তোয়োলে জড়িয়ে নিল মাইকেল।

“ও আমাকে ভালবাসে।”

 “তাতো দেখতেই পাচ্ছি।”

 “এমন করো না মিকি।”

“আমাকে কথা দাও, বেলা, যদি কখনো কোনো সমস্যা হয়, তাহলে সবার আগে আমার কাছে আসবে। ঠিক আছে?”

মাথা নেড়ে বেলা জানালো; “হ্যাঁ, ঠিক আছে। তুমি এখনো আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু। কিন্তু দেখে নিও কোনো সমস্যাই হবে না।

এরপর মাইকেলকে ওয়ালটন স্ট্রিটে’র মা কুইজিনে ডিনার করাতে নিয়ে গেল বেলা। ভাই লন্ডনে আসছে, জানার সাথে সাথে রিজাভেশন না দিলে হয়ত জায়গাই পেত না এই জনপ্রিয় রেস্টোরেন্টে।

“সবাই আমাকে এমন ঘুর ঘুর করে দেখছে যেন আমিই সবকিছুর জন্য দায়ী।”

 “ননসেন্স। ধ্যাৎ, তুমি এত হ্যান্ডসম যে সবাই তাই দেখছে।” এরপর নিজ নিজ কাজ নিয়ে কথা বলল দুজনে। ইসাবেলা প্রমিজ করল ভাইকে নিজের থিসিস পড়তে দেবে। মাইকেল জানাল যে বর্ণবাদী আন্দোলনের উপর সিরিজ আটিকেল আর ব্রিটেনে দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনীতির খবর লেখার জন্য লন্ডনে এসেছে।

“প্রধান সারির কয়েকজন নেতা’র ইন্টারভিউ নিতে হবে : অলিভার টাম্বো। ডেনিস ব্রুটাস…” 

কিন্তু আমাদের সেন্সর তোমাকে সেসব ছাপাতে দেবে? বিশেষ করে লাভের আশায় জল ঢাললে গ্যারি তো খেপে আগুন হয়ে যাবে।”

মিটমিট করে হেসে ফেলল মাইকেল। “বেচারা গ্যারি। জীবন ওর কাছে এতটা সহজ সাদা-কালো নীতি বোধ নয় বরঞ্চ লাল আর কালো ব্যাংক স্টেটমেন্ট।

 ডেজার্ট শেষ করেই মাইকেল হঠাৎ করে জানতে চাইল, “মা’র কোন খবর জানো? এর ভেতর দেখা হয়েছিল?”

“মা-মাম্মি। কিছুই নয়।” তিক্ত স্বরে ভাইকে শুধরে দিল বেলা, “তুমি তো জানই এসব শব্দকে বুর্জোয়া হিসেবে ভাবে সে। কিন্তু তোমার প্রশ্নের উত্তর হলো না, তারা’র সাথে অনেকদিন ধরেই আমার কোনো দেখা সাক্ষাৎ হয় না।

“উনি আমাদের মা, বেলা।”

“বাবা আর আমাদের সবাইকে ছেড়ে ওই কালো বিপ্লবীটার সাথে চলে আসার সময় সে তো সেটা ভাবেনি। আবার ওই বাদামি বাস্টাড় টাকেও বহন করেছে।”

“বাস্টার্ড বহন করার কথা এলে তোমার ব্যাপারটাও নিশ্চয় আসবে।” নরম স্বরে বললেও বোনের চোখে আঁধার ঘনাতে দেখল মাইকেল।” আমি দুঃখিত বেলা। কিন্তু তোমার মতই সবকিছুরই নির্দিষ্ট কারণ আছে বেলা। ওনাকে তাই এভাবে বিচার করতে পারব না আমরা। তুমি তো জানেনা বাবাকে বিয়ে করা কোন সহজ কাজ নয়। আর নানা’র নিয়মানুযায়ী চলাও যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। আমার ধারণা প্রথম থেকেই পরিবারে খাপ খাওয়াতে পারেননি তারা। সবসময় অবহেলিতদের প্রতিই ছিল তাঁর সহানুভূতি আর এরপর তো মোজেস গামা এলেন…”

 “মিকি ডার্লিং”-টেবিলের ওপাশ থেকে ঝুঁকে এসে ভাইয়ের হাত ধরল বেলা-”তুমি হচ্ছ পৃথিবীর সবচেয়ে বুঝদার অনুকম্পী ব্যক্তি। সারা জীবন ধরে আমাদের জন্য অযুহাত খুঁজে ভাগ্যের হাত থেকে বাঁচাতে চেয়েছ। আই লাভ ইউ সো মাছ। তাই এ ব্যাপারে কোনো তর্ক করতে চাই না।”

 “সেটাই ভালো।” বোনের হাতে চাপ দিল মাইকেল। “তাহলে চলো দু’জনে মিলে তারা’র সাথে দেখা করে আসি। উনি তোমাকে অসম্ভব ভালবাসেন ইসাবেলা, মিস করেন। তাই তুমি তাকে অবহেলা করলে মনে কষ্ট পান।”

“ওহ, মিকি তুমি তো মহা শয়তান। আমাকে ফাঁদে ফেলছ।” সেকেন্ডের মতো ভেবে নিয়ে বেলা জানাল, “কিন্তু আমার এই অবস্থায়?”

তারা তোমার মা। তোমাকে অসম্ভব রকম ভালোও বাসেন। তাই তার চেয়ে উদার আর কেউ হতে পারে না। তুমি আঘাত পাবে এরকম কিছুই যে করবে না, তা তুমিও জানো।”

“তোমাকে খুশি করার জন্য; শুধু তোমার জন্যই যাব, মিকি।”

তাই পরের শনিবারে সকাল বেলা ব্রম্পটন রাস্তাতে দুই ভাই-বোনকে দেখা গেল লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটছে। বেলা’র সাথে তাল মেলানোর জন্য মাইলকে বেশ কষ্টই করতে হল।

 “তুমি কি পরের অলিম্পিকের জন্য ট্রেনিং নিচ্ছ নাকি?” হাসি মাখা মুখে বোনের দিকে তাকাল মাইকেল।

“তুমি দেখছি ইদানীং বেশি বেশি সিগারেট খাচ্ছো?” ভাইকে মৃদু ভর্ৎসনা করল বেলা।

“আমার এই একমাত্র দোষ।”

তারা কোর্টনি কিংবা বর্তমানে নিজেকে তারা গামা নামে পরিচয় দেয়া ভদ্রমহিলা ক্রমওয়েল রোডে আবাসিক হোটেল পরিচালনা করেন। ক্লায়েন্টদের বেশির ভাগই হচ্ছে বিশেষ করে আফ্রিকা, ভারত আর ক্যারিবীয় থেকে আসা প্রবাসিগণ।

কাদোগান স্কোয়ার থেকে এই জায়গার দূরত্ব সাকুল্যে বিশ মিনিট। ইসাবেলা অবাক হয়ে ভাবে যে কোন এক সময় এই একই ব্যক্তি সামলেছেন ওয়েল্টেভ্রেদেনের সেই ফরাসি দুর্গ। মায়ের স্মৃতি বলতে মনে পড়ে ফুল লেংথ বল গাউন আর শুভ্র গলা-কানে হানি’র কোর্টনি খনি থেকে আসা হলুদ হীরে পরিহিত মা নেমে আসছেন মার্বেলের সিঁড়ি বেয়ে। ইসাবেলা কখনোই বুঝতে পারেনি যে সেই রাজকীয় দেহাবয়েবের মাঝে লুকিয়ে ছিল এতটা অতৃপ্তি আর বেদনা।

তারা’র মাথা ভর্তি ঝলমলে সেই চুলগুলোর জায়গা নিয়েছে সস্তা রঙ করা আদা আর ধূসরের আভা। জন্মসূত্রে যা ইসাবেলা পেয়েছে সেই কমনীয় দেহত্বক অনাদর অবহেলায় বয়সের ছাপে জড়িয়ে আছে। নাকে, গালে ব্ল্যাকহেডস, মুখের তুলনায় বড় ফল দাঁতের ভারে নষ্ট হয়েছে ঠোঁটের সৌন্দর্য।

কোলনের গন্ধ ছড়িয়ে হোটেলের সদর দরজার সিঁড়ি বেয়ে হন্তদন্ত হয়ে নেমে এলেন তারা। আগ্রহ নিয়ে জড়িয়ে ধরলেন মেয়েকে। খানিকটা অপরাধবোধ নিয়ে বেলা নিজেও আলিঙ্গন করল মা’কে।

“দেখি তো আমার ডার্লিং মেয়েটাকে।” দু’হাতের মাঝে ইসাবেলাকে ধরে তাকাতেই সাথে সাথে চোখ চলে গেল নিচের দিকে। “তুমি তো আরো সুন্দর হয়ে গেছ বেলা; অবশ্য কারণটাও বোঝা যাচ্ছে। খুশি আর আনন্দ ভরা ছোট্ট একটা পুটুলি বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছ তাহলে, তাইনা।”

খানিকটা বিরক্তি মেশানো হাসি হাসলেও কথা বাড়াল না বেলা।

“তোমাকেও ভাল দেখাচ্ছে মাম্মি-মানে তারা।”

“কত মাস কেটে গেছে; অভিযোগ করলেন তারা, “প্রায় বছরই বলা যায়। তুমি তো ঐ রাস্তার শেষ মাথাতেই থাকো। অথচ বুড়ী মাকে দেখতেও আসো না।”

এবারে যোগ দিল মাইকেল। সত্যিকারের উষ্ণ মমতা নিয়ে জড়িয়ে ধরল জননী’কে।

“মিকি, আমার ছেলে-মেয়েদের মাঝে তুমিই সবসময় ছিলে সবচেয়ে মিষ্টি আর আদুরে।”

অন্যদিকে মুখে হাসি ধরে রাখলেও ইসাবেলা’র মাথায় ঘুরছে কতক্ষণে এখান থেকে পালাতে পারবে। মনে হচ্ছে না সহজ হবে ব্যাপারটা। দুদিকে দুজনের হাত ধরলেন তারা। দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ঢুকলেন হোটেলের ভেতরে।

“তোমাদের জন্য চা-বিস্কুট রেডি করে রেখেছি। যখন থেকে মাইকেল বলেছে যে তোমরা আসছ, আমার আর তর সইছিল না।

শনিবারের এই সকালবেলায় তারা’র অতিথি’তে ভরে আছে লর্ড কিচেনার হোটেলের পাবলিক লাউঞ্জ। সিগারেটের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে বাতাস। সবার সাথে সন্তানদেরকে পরিচয় করিয়ে দিলেন তারা। যদিও আগেও এদের অনেককেই দেখছে বেলা।

“দক্ষিণ-আফ্রিকার কেপ টাউন থেকে আমার ছেলে আর মেয়ে এসেছে।” আর দেশের নাম শুনতেই কয়েক জনের চোখ পিট পিট করে জ্বলে উঠল। দেশে থাকলে নিজেকে লিবারেল হিসেবেই মনে করে বেলা কিন্তু বিদেশে এলে এ ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখলে কেমন যেন দেশপ্রেমিকের ভাব আসে মনে।

অবশেষে লাউঞ্জের এক কোণাতে তাদের নিয়ে বসাল তারা। কাপে চা ঢালতে ঢালতে এমন চনমনে স্বরে কথা বলতে লাগল যে এত বড় রুমের সকলেই শুনতে পেল : “তো বেলা, এখন তোমার বেবি’র সম্পর্কে বলো। ডেলিভারী ডেট কবে আর বাবা’ই বা কে?”

 “এই জায়গাটা কিংবা সময় কথা বলার মতো নয়, তারা।” বিবর্ণ মুখে জানাল বেলা; কিন্তু হেসে ফেলল তারা।

“ওহ্, এখানে সবাই আমরা একটা বড় সড় পরিবারেরই মতন। তুমি নিশ্চিন্তে কথা বলতে পারো।”

এবারে মাইকেল খুব দ্রভাবে বলে উঠল : নিজের ব্যক্তিগত বিষয় দুনিয়াকে জানাতে চায় না বেলা। আমরা এ বিষয়ে পরে কথা বলব তারা।”

“ধ্যাৎ তোমাদের যত সেকেলে চিন্তা।” টেবিলের ওপাশ থেকে বেলাকে ধরতে চাইল- তারা; কিন্তু চা ছলকে পোশাকে পড়াতে ক্ষান্ত দিল চেষ্টা।

 “যথেষ্ট হয়েছে তারা। তারপর তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ বদলাবার জন্য বলে উঠল, “বেনজামিন কোথায়? কী করছে এখন?”

‘ওহ্ বেনই হচ্ছে আমার আনন্দ আর গর্ব।” বিষয়টা যেন লুফে নিল তারা। এই তো কয়েক মিনিটের জন্য বাইরে গেছে। ও অসম্ভব বুদ্ধিমান হয়েছে। এ বছরই এ লেভেল করছে। হেডমাস্টার তো বলেন যে রায়হাম গ্রামারে এত দক্ষ ছেলে গত দশ বছরেও আর দেখেননি। আর মেয়েরা তো, ওর মহা ভক্ত’ও এতটাই সুদর্শন হয়েছে।” তারা’র গল্প শুনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল বেলা। যাক কথা বলতে হচ্ছে না।

 মা-র এই ভিন্ন দুনিয়াতে খাপ খাওয়াতে না পারার আরেকটা কারণ হলো বেনজামিন গামা। এই স্ক্যান্ডালের মাধ্যমে কোর্টনি পরিবারকে তারা এতটাই কলঙ্কিত করেছে যে নানা ওর নাম উচ্চারণও ওয়েল্টেভ্রেদেনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।

 শুধু মাইকেল-ই এ বিষয়ে কথা বলে বেলা’র সাথে বেলা’কে এও জানিয়েছে যে মোজেস গামা গ্রেফতার হবার পরেও তারা’র বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করা হয়নি আর কোন প্রমাণও পাওয়া যায়নি যে তারা কোনো অপরাধের সাথে যুক্ত ছিল।

“কিন্তু পরিবারের সুনাম বাঁচাতে বাবা কি কিছু করেননি?”

“তুমি নিজেই তাকে জিজ্ঞেস করো।” একবার বেলা চেষ্টাও করেছিল; কিন্তু ওই একবারই তার সাথে গোমড়া মুখে শীতল আচরণ করেছেন শাসা। ইসাবেলা’ও বেঁচে গেছে। কেননা সত্যি কথা বলতে মায়ের অপরাধের মাত্রা সম্পর্কে জানতে ওর’ও ইচ্ছে ছিল না। বুকের গভীরে ভাবতেও ভয় লাগত যে মা এমন এক কুখ্যাত “গাই ফকস” দলের সদস্য যারা কিনা মোজেস গামা’কে দিয়ে উড়িয়ে দিতে চেয়েছে সাউথ আফ্রিকান পার্লামেন্ট ভবন আর যদি এ পরিকল্পনা সফল হত তাহলে মারা যেত ওর নানা, তারা’র নিজের বাবা। তাই মাকে বিশ্বাসঘাতক ধরে নেয়াটাই শ্রেয়। আর স্কুল এ ব্যাভিচার দক্ষিণ আফ্রিকার আইনে জঘন্য অপরাধ হওয়ায় বেলা অবাক হয়ে ভাবল যে সে এখানে কী করছে।

 হঠাৎ করেই তারা’র মুখে ভেসে উঠল হারিয়ে যাওয়া সৌন্দর্যের ঝলক। খুশিতে নেচে উঠল চোখ মুখ।

“বেন!” চিৎকার করে উঠল ছেলেকে দেখে। “দেখ, আমাদেরকে দেখতে কে এসেছে। তোমার ভাই-বোন। বেশ মজা না?”

নিজের চেয়ারেই ঘুরে বসল ইসাবেলা। পেছনে, হোটেল লাউঞ্জের দরজাতে দাঁড়িয়ে আছে ওর সৎ ভাই। গত এক বছরে বেশ বড় হয়ে গেছে। কিশোর থেকে পুরুষালী ভাব এসেছে চেহারাতে।

“হ্যালো বেনজামিন।” কণ্ঠে উৎসাহ নিয়ে ডেকে উঠল বেলা। কিন্তু মুখে হাসি সত্ত্বেও বেনে’র মাঝে কঠোর ভাবটা চোখ এড়াল না।

 মা-হলেও একটুও বাড়িয়ে বলেননি তারা। বেনজামিন আসলেই বেশ সুন্দর হয়েছে দেখতে। আফ্রিকান উজ্জ্বতার সাথে মিশে গেছে মায়ের রূপ। তামাটে গায়ের রঙে ঘন কোকড়াচুল।

“হ্যালো ইসাবেলা।” মুগ্ধ হয়ে আফ্রিকার সন্তানের কণ্ঠে লন্ডনের টান শুনল বেলা। তবে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টাও করল না। প্রথমবার সাক্ষাতের সময় থেকেই আপনাতেই গড়ে উঠেছে এ নিয়ম। দুজনেই হাত মিলিয়ে পিছিয়ে গেল। আর কি বলা যায় ভাবার আগেই মাইকেলের দিকে ফিরল বেনজামিন।

এবারে ঝকঝকে দাঁত আর ভালো চোখ জোড়াসহ সবখানে ছড়িয়ে পড়ল একরাশ হাসি।

“মিকি!” দ্রুত দুই কদম এগিয়ে এসে একে অপরকে জড়িয়ে ধরল দুই ভাইয়েরই মতন।

চারপাশের সবার মনে বিশ্বাস জন্মানোর মাইকেলের এই গুণকে ঈর্ষা করে ইসাবেলা। ইসাবেলার সাথে খানিকটা দূরত্ব রেখে চললেও মাইকেলের সাথে কতটা সহজ এই বেনজামিন! একটু পরে দেখা গেল তারা, বেন আর মিকি মিলে বেশ খোশ গল্পে মেতে গেছে। নিজেকে কেমন অচ্ছুত লাগল বেলার।

 যাক, খানিক পরেই লাউঞ্জ পার হয়ে তারা’র কাছে এসে জানাল কুষাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকান এক ছাত্র। ঘড়ির দিকে তাকাল তারা।

“ওহ্ ঈশ্বর, আমাকে মনে করিয়ে দেবার জন্য ধন্যবাদ নেলসন। আমরা এতই গল্পে মজে গেছি যে সময় খেয়াল করিনি।” লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল তারা। “চলুন সবাই! ট্রাফালগার স্কোয়ারে যেতে হলে এখনি বের হতে হবে।”

 লাউঞ্জের সবার মাঝে চঞ্চলতা দেখা যেতেই মাইকেলের দিকে তাকাল বেলা।

“এসবের মানে কী মিকি? মনে হচ্ছে তুমিও জানো সবকিছু।”

 “ট্রাফালগার স্কোয়ারে র‍্যালি আছে।”

“ওহ গড না! সেসব বর্ণবাদ বিরোধী জাম্বুরী নয় নিশ্চয়ই। আমাকে বলল নি কেন?”

“তাহলে তুমি সটকে পড়ার বাহানা পেয়ে যেতে।” বোনের দিকে তাকিয়ে হাসল মাইকেল। “চলো, তুমিও চলো।”

“না, থ্যাঙ্কস্। বাবা অ্যামব্যাসিতে আসার পর থেকে গত তিন বছর ধরে এ ঝামেলাই সহ্য করছি। তুমিই বা কেন যাচ্ছ অযথা এই হ্যাপা’র মাঝে?”

“বেলা, মাই সুইটি, এটাই আমার কাজ। তোমার কথা মতো এই হ্যাপা নিয়ে লেখার জন্যই আমি লন্ডনে এসেছি। এখন চলল আমাদের সাথে।”

“কেন?”

“খানিকটা চেঞ্জের জন্য বেড়ার ওপাশ থেকে দেখলে দুনিয়াকে হয়ত ভালই লাগবে-তাছাড়া আমিও আছি। একসাথে বেশ ভাল সময় কাটবে।” অনিশ্চিতভাবে হাত নাড়ল বেলা। বিষয়টা বাদে মাইকেলের সঙ্গ আসলেই পছন্দ করে। এছাড়া রামোন না থাকাতেও একা হয়ে পড়েছে।

“যাব যদি বাসের উপরে চড়ে বেড়ানো যায় তাহলে। টিউবে না।”

নেলসন লিটালুঙ্গি, সেই কৃষাঙ্গ ছাত্রসহ জনা বিশেকের দল গেল লর্ড থেকে। লাল বাসের উপর তলায় বেলার জন্য একটা সিট খুঁজে নিয়ে গাদাগাদি করে বসল তিনজন। সামনের বেঞ্চে তারা আর বেন। কিন্তু মাথা ঘুরিয়ে সারাক্ষণ একসাথে হাসি তামাশা করল সকলে মিলে। ইসাবেলার নিজেরও একেবারে খারাপ লাগল না। সবকিছুর মধ্যমণি মাইকেল। নেলসন আর সে মিলে গানও গাইতে লাগল। দুজনের কণ্ঠই বেশ মধুর। দিস ইজ মাই আইল্যান্ড ইন দ্য সান-গানের সাথে গলা মেলানো বাকিরা। হ্যাঁরী বেলাফন্টে’কে নকল করতে পারে নেলসন। দেখতেও অনেকটা তার মত। প্রথম থেকেই জমে গেছে মাইকেল আর তার জুটি।

ন্যাশনাল গ্যালারীর সামনে বাস থেকে নামতেই দেখা লম্বা থামের নিচে খোলা চত্বরে এরই মাঝে জমায়েত হয়ে গেছে সকলে। নেলসন আর হোরাশিওকে নিয়ে কী একটা ঠাট্টা করল মাইকেল। হাসতে হাসতে চতুরের দিকে পা বাড়ালো পুরো দল। পায়ের কাছ থেকে পাখা ঝাপটে মেঝের মতো করে উড়ে গেল কবুতরগুলো।

চতুরের শেষ দিকে সাউথ আফ্রিকা হাউজের ঠিক সামনে টেমপোরারি তার টাঙ্গানো হয়েছে। দড়ি দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে পুরো এরিয়া। পেছনের সারিতে বসে পড়ল মাইকেলরা। প্লাস্টিকের শপিং ব্যাগ থেকে হাতে আঁকা ব্যানার বের করল তারা। মেলে ধরতেই দেখা গেল লেখা আছে, “মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হল বর্ণবাদ।”

মায়ের কাছ থেকে সরে গিয়ে ইসাবেলা এমন ভাব করতে চাইল যেন কেউ কাউকে চেনে না। “এত মানুষ তাঁকে দেখছে। এটা নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই উনার, তাই না?” ভাই’কে ফিসফিস করে বলতেই হেসে ফেলল মাইকেল।

 “বহুদিনের চেষ্টায় আসলে এমন হয়ে গেছেন।”

মোটের উপর এই বৈচিত্র্যময় সমাবেশের অংশ হতে পেরে মজাই পেল ইসাবেলা। এর আগে বহুবার এ ধরনের মানুষগুলোর দিকে বিতৃষ্ণা নিয়ে তাকিয়েছিল অ্যামব্যাসির উঁচু জানালা দিয়ে আর আজ দেখছে পুরোপুরি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। মজা দেখার জন্য দাঁড়িয়ে থাকা চারজন ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশ কৌতুক শোনার মতো করে হেসে ফেলল এক বক্তার মুখে প্রিটোরিয়ার মতই লন্ডনও পুলিশ স্টেট আর খারাপ হবার কথা শুনে। নিজের সাপোর্ট প্রকাশের জন্য খুব সুন্দর করে হাসি দিয়ে বক্তার দিকে কিস্ ছুঁড়ে দিল ইসাবেলা।

প্লাটফর্মের উপর থেকে বক্তারা তুলোধুনো করে ছাড়ল ট্রাফিক আর বেগুনি বাসগুলোকে। এর সবকিছুই আগেও শুনেছে ইসাবেলা। তবে দিনের সবচেয়ে হাস্যকর অবস্থার উদ্রেক হল যখন মাথার উপর ঘুরতে থাকা একটা কবুতর পায়খানা করে দিল এক বক্তার চকচকে টাকের উপর। চিৎকার করে উঠল বেলা : “ফ্যাসিস্ট পাখি, বর্ণবাদী প্রিটোরিয়া শাসকের প্রতিনিধি!”

 মিটিঙের শেষে ভোট হলো যে জন ভরসটার আর তার অবৈধ শাসন তন্ত্র নিপাত যাক, ক্ষমতা দিয়ে দেয়া হোক ডেমোক্র্যাটিক পিপলস গভর্নমেন্ট অব সাউথ আফ্রিকার হাতে। সকলেই একবাক্যে মেনে নিল এ ঘোষণা। ফুটবল ম্যাচ দেখে ফেরা ভিড়ের চেয়েও শান্তভাবে সাঙ্গ হলো মিটিং।

 “চলো একটা পাবে যাই।” বলে উঠল মাইকেল। “ফ্যাসিস্ট সরকারের কথা শুনতে শুনতে তেষ্টা পেয়ে গেছে।

“স্ট্যান্ডে বেশ ভাল একটা পাব আছে।” পথ বাৎলে দিল নেলসন।

 “চলো তবে।” উৎসাহ দিল মাইকেল।

জিনজার বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে ইসাবেলা জানাল, “এভাবে আসলে আগের মতই সময় নস্ট হবে শুধু। দুইশ মানুষ বাতাস গরম করে তুললেই কিছু আর বদলে যাবে না।”

“এতটা নিশ্চিত হয়ো না।” হাত দিয়ে ঠোঁটের উপর লেগে থাকা ফেনা মুছে ফেলল মাইকেল। “হয়ত এটা বাঁধের দেয়ালের গায়ে একটুখানি আঁচড়-শীঘ্রিই হয়ে যাবে দফায় দফায় ঢেউ আর তারপরেই ভয়ংকর সামুদ্রিক গর্জন।”

“ওহ্ পাগল হলে নাকি মিকি।” একবাক্যে ভাবনাটা খারিজ করে দিল ইসাবেলা। “সাউথ আফ্রিকা এতটাই ধনী আর শক্তিশালী। এছাড়া আমেরিকা আর ব্রিটেনও অনেক বিনিয়োগ করেছে সে দেশে তাই তারা নিশ্চয়ই আমাদের জন্মগত অধিকারকে একদল মার্কসিস্টের হাতে ছেড়ে দেবে না।” গত তিন বছরে অ্যামব্যাসাডর বাবার মুখে শোনা কথাগুলোই হুবহু বলে দিল বেলা। মা সৎভাই–নেলসন কিংবা লড় কিচেনার হোটেলের আরো বিশজন আবাসিকের সাথে কাটানো সান্নিধ্য ও তার যুক্তিকে একটুও টলাতে পারে নি। কাদোগান স্কোয়ারে ফিরে তাই মাইকেলকে বলে দিল নিজের অপছন্দের কথা।

“ওরা বড্ড বেশি রাগী ছিল, মিকি।”

“এটা সম্পূর্ণ নতুন একটা পরিস্থিতি বেলা। যদি সারভাইভ করতে হয় এর সাথে মীমাংসা করতেই হবে।”

“এমন তো না যে ওদের সাথে খারাপ আচরণ করা হচ্ছে। ওয়েল্টেভ্রেদেনে ন্যানি, ক্লোনকি, গ্যামিয়েট আর অন্যদের কথাই ধরো না। আমি বলতে চাইছি যে অন্য বহু শ্বেতাঙ্গের চেয়েও ওরা অনেক ভাল আছে।”

 “আমি তোমার কথা বুঝতে পেরেছি, বেলা। সঠিক আর ভুল ভেবে ভেবে তুমি পাগল হয়ে যাবে; কিন্তু শেষতক একটাই কথা তাদের অনেকেই অনেক ভালো আর সুন্দর। তাহলে কোন অধিকার বলে আমরা তাদেরকে জন্মভূমির সব কিছু সহভাগীতা করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারি?”

“থিরি অনুযায়ী ঠিকই আছে। কিন্তু আজ সন্ধ্যায় তো ওরা সশস্ত্র যুদ্ধের কথাই বলছিল। তার মানে নারী আর “শিশুদেরকে টুকরো টুকরো করে ফেলা। রক্ত আর মৃত্যু মিকি। ঠিক আইরিশদের মত। তাই না?”

“জানি না বেলা। মাঝে মাঝে মনে হয়না! হত্যা, জ্বালিয়ে দেয়া উচিত নয়। কিন্তু আবার একেক সময় মনে হয়-কেন না? শত শত বছর ধরে নিজেকে আর তার জন্মগত অধিকারকে রক্ষার জন্য মানুষই খুন করে আসছে মানুষকে। দক্ষিণ আফ্রিকায় সশস্ত্র বিপ্লবের কথা শুনে আমাদের বাবা বক্তৃতা দেয়, চিৎকার করে, কিন্তু একই মানুষটাই ১৯৪০ সালে হারিকেনে চড়ে ইথিও পিয়া, ইটালী আর জার্মানীর উপর গুলি ছুঁড়েছেন নিজের স্বাধীনতার আশায়। নানা, আইনের ধ্বজাধারী হয়েও মুক্ত বাজারের রক্ষক হিসেবে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর আর রক্তাক্ত ঘটনা, হিরোশিমা নাগাসাকির উপর বোমা বর্ষণের ঘটনায় খুশি খুশি মাথা নেড়ে বলেন, “ভাল হয়েছে, তাহলে আমাদের কিংবা আমাদের পরিবারের তুলনায় তারা, বেনজামিন আর নেলসন কতটাই বা রক্ত পিপাসী? কে ঠিক আর কে ভুল, বেলা?”

“তুমি আমার মাথা ধরিয়ে দিয়েছে।” উঠে দাঁড়াল বেলা। “আমি শুতে যাচ্ছি।”

***

সকাল ছয়টায় ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ওপাশে রামোনের গলা শুনতেই। বেলা’র উপর থেকে বিষণ্ণতার চাদর সরে গেল।

“ডার্লিং, তুমি কোথায়?”

 “এথেন্স।”

“ওহ, খানিকটা চুপসে গেল বেলা। “আমি আরো ভেবেছিলাম বোধহয় হিথ্রোতে।”

“আমার দেরি হবে। আরো অন্তত তিনদিন থাকতে হবে এখানে। তুমিও চলে এসো না?”

“এথেন্সে?” এখনো আধো ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে বেলা।

“হ্যাঁ। কেন নয়? তুমি চাইলে দশটার বি ই এ ফ্লাইট ধরতে পারো। তিন দিন কাটানো যাবে একসাথে। চাঁদের আলোয় অ্যাক্রোপলিস কেমন লাগবে বলো তো? দ্বীপে ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ কিছু মানুষের সাথে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিব।”

“ঠিক আছে। তোমার ফোন নাম্বার দাও। প্লেনে উঠেই তোমাকে ফোন দেব।” ব্রিটিশ ইউরোপীয়ান এয়ারওয়েজের রিজার্ভেশনের প্রতিটা লাইন ব্যস্ত থাকায় মিনি’তে করে ওকে এয়ারপোর্টে নিয়ে এলো মাইকেল। হাতে সময়ও বেশি নেই।

 “তোমার রিজার্ভেশন কনফার্ম না হওয়া পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করছি।” জানাল মাইকেল।

“না, মিকি, আমি জানি তুমি অনেক লক্ষ্মী। হলিডে সিজন তো শেষ। তাই কোনো সমস্যা নেই। তুমি যাও। রামোন আর আমি বাসায় ফেরার সময় ফ্ল্যাটে তোমাকে ফোন করব।”

টার্মিনাল দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো নিরাশ হয়েই না ফিরতে হয় শেষমেষ। উদ্বিগ্ন মুখে লাগেজ নিয়ে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে পর্যটকেরা। বহুকষ্টে অবশেষে ইনফর্মেশন ডেস্কে পৌঁছাতে শোনা গেল ফরাসি এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারদের স্ট্রাইকের কারণে সব ফ্লাইট পাঁচ ঘণ্টা করে ডিল হয়ে গেছে। এছাড়া এথেন্সের ফ্লাইট’ও পুরো বুকড়। তাই ফাস্ট ক্লাসে সিট পেতে হলেও ওয়েটিং লিস্টে অপেক্ষা করতে হবে।

পাবলিক টেলিফোন ব্যবহার করার জন্য দাঁড়াতে হলো আরেকটা লাইনে। রামোনকে জানাতেই বেলার মতো সেও মন খারাপ করে ফেলল।

“আমি এত সহজে হাল ছাড়ছি না। দরকার হয় সারাদিন এখানে বসে থাকব।” ঘোষণা করল বেলা।

হতাশা আর অনিশ্চয়তা নিয়ে পার হল পুরো দিন। অবশেষে বিকেল পাঁচটায় ফ্লাইট ছাড়ার কথা শুনে প্রার্থনা করতে করতে চেক ইন কাউন্টারে দাঁড়াল বেলা। সামনে না হলেও আরো আধডজন লোক একই প্রার্থনাই করছে। কিন্তু কোনো লাভ হল না। অনুতপ্ত হবার মতো করে মাথা নাড়ল। বুকিং ক্লার্ক।

“আয়্যাম সো সরি, মিস্ কোর্টনি।”

আগামীকাল সকাল দশটার আগে এথেন্সের আর কোনো ফ্লাইট নেই। আশা হত ইসাবেলা আবারো রামোনকে ফোন করল। কিন্তু ওকে না পেয়ে মেসেজ রেখে দিল বেলা। আশা করল রামোন বুঝতে পারবে যে বেলা নিরুপায় হয়ে যাবার আশা বাতিল করেছে।

বেলার মতো অন্য শত শত প্যাসেঞ্জার’ও নিরাশ হয়ে বাড়ির পথ ধরাতে কোনো ট্যাক্সিও পাওয়া যাচ্ছে না। ফুটপাতে ব্যাগ রেখে শহরে ফেরার জন্য। বাসস্ট্যান্ডে লাইনে দাঁড়াল বেলা।

আটটার’ও পরে বাসে উঠে ফ্ল্যাটে পৌঁছে মনে হল কেঁদে দেবে। সুস্বাদু রান্নার গন্ধ নাকে আসতেই বুঝতে পারল কতটা ক্ষিধে লেগেছে। লবি’তে ব্যাগ রেখে জুতা ছুঁড়ে ফেলে কিচেনে দৌড় দিল বেলা। বোঝাই যাচ্ছে যে মাইকেল নিজেই ডিনার তৈরি করেছে। ব্রেকফাস্টের বাসন-কোসন এখনো পড়ে আছে। নিজের জন্য বেঁচে যাওয়া চিকেন কিয়েভ আর চিজ কেক নিয়ে নিল বেলা। সিঙ্গের দিকে চোখ যেতেই দেখা গেল দুটো এন্টো ওয়াইন গ্লাস আর বাবার নুটস্ সেন্ট জর্জেস ১৯৬১। তার পরেও মাথায় অন্য কোনো সন্দেহ এলো না।

উপরের তলায় মাইকেলের বেডরুম থেকে হার্ড মিউজিকের শব্দ আসছে। সোজা পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে মাইকেলের রুমের দরজা খুলেই থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল বেলা।

এমন কিছু দেখবে কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি; তাই কী দেখছে বুঝতেই কেটে গেল ক্ষাণিক সময়।

এরপরই মনে হল মাইকেলকে বোধ হয় কেউ আক্রমণ করেছে। মন চাইল চিৎকার করে উঠে। তাড়াতাড়ি মুখে হাত চাপা দিতেই বুঝতে পারল কী ঘটছে।

ডাবল বেডের উপর হাঁটু গেড়ে আছে নিরাভরণ মাইকেল। মেঝেতে গড়াচ্ছে সাটিনের বিছানার চাদর।

একইভাবে উলঙ্গ অবস্থায় পাশেই হাঁটু গেড়ে বসে আছে নেলসন। মাইকেলের চির পরিচিত অনিন্দ্য সুন্দর মুখখানায় এমন একটা অভিব্যক্তি দেখতে পেল যে কেপে উঠল বেলা।

 চোখের দৃষ্টি স্পষ্ট হতেই বোন’কে দেখতে পেল মাইকেল, শরীরে ভয়ংকর রকম ঝাঁকি দিয়েই নেলসনের কাছ থেকে সরে গিয়ে চাইল বালিশ দিয়ে নিজেকে ঢাকতে।

তাড়াহুড়া করে রুম থেকে চলে এলো ইসাবেলা।

সারদিনের ক্লান্তির কল্যাণে ঘুমিয়ে পড়লেও আধ-ছেঁড়া সব স্বপ্ন দেখল। একবার তো মনে হল উলঙ্গ অবস্থায় ভয়ংকর কোনো দানবের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে যুঝছে মাইকেল। ঘুমের মাঝেই এত জোরে চিৎকার করে উঠল যে ঘুমই ভেঙে গেল।

ভোর হবার আগেই রেস্ট নেবার চেষ্টা ছেড়ে উঠে গেল বেলা। রান্নাঘরে যেতেই দেখা গেল গত রাতের নোংরা প্লেট গ্লাস সব পরিষ্কার করে জায়গামতো রেখে দেয়া হয়েছে। খালি ওয়াইন গ্লাস আর বোতল উধাও হয়ে ঝকঝক করছে পুরো রান্নাঘর।

কফি পার্কোলেটরের সুইচ্ অন্ করে লেটার বক্স চেক করতে গেল বেলা। এত ভোরে নিউজ পেপার আসার সম্ভাবনাও নেই। তাই ফিরে এসে এক কাপ কফি ঢেলে নিল। জানে বেবি’র জন্য ক্যাফেইন মোটেও ভাল না; কিন্তু এ সকালবেলায় না হলে আর চলছে না।

কফি’তে প্রথম চুমুক দিতেই সিগারেটের গন্ধ পেয়ে তাড়াতাড়ি চোখ তুলে তাকাল। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে মাইকেল।

“কফি’র গন্ধটা বেশ লাগছে।” নীল চোখ জোড়ায় একরাশ অপরাধ বোধের ছায়া নিয়ে সিল্কের ড্রেসিং গাউন পরে দাঁড়িয়ে আছে মাইকেল। ঠোঠের কোণে অনিশ্চয়তা আর আত্মপ্রত্যয়হীনতা নিয়ে বলে উঠল; “আমি ভেবেছিলাম তুমি এথেন্সে চলে গেছ-স্যরি।”

 রান্নাঘরের দু’প্রান্ত থেকে কয়েক সেকেন্ড মাত্র পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল দু’ ভাই-বোন। অথচ মনে হল অনন্তকাল পার হয়ে গেছে। উঠে দাঁড়াল। ইসাবেলা। বুড়ো আঙুলের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ভাইয়ের গালে কিস্ করল। বলল,

“আই লাভ ইউ মিকি। আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয়তম ব্যক্তি হলে তুমি।”

গভীরভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মাইকেল। “থ্যাঙ্ক ইউ বেলা। আমার বোঝ উচিত ছিল যে তুমি কতটা আন্ডারস্টান্ডিং। তারপররে’ও ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। হয়ত আমাকে প্রত্যাখ্যান করে বসবে ভাবতে গিয়ে আমি যে কতটা ভয় পেয়েছি তুমি জানো না।”

“না, মিকি। তোমার ভয় পাবার কিছু নেই।”

“আমিই তোমাকে বলতাম। শুধু সঠিক সময়টার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”

“আমাকে কিংবা অন্য কাউকেই দোহাই দেয়ার কিছু নেই। এটা একান্তই তোমার ব্যাপার।”

 “না, আমি চাই তুমি পুরোটা জানো। আমাদের মাঝে কোনো সিক্রেট তো কখনো ছিল না। জানতাম যে আগে কিংবা পরে তুমি ঠিকই জানবে। শুধু চেয়েছিলাম ওই ঈশ্বর, যেভাবে জেনেছে সেরকমই কখনো চাইনি। পুরো ব্যাপারটা নিশ্চয় তোমাকে প্রচণ্ড ঠাক্কা দিয়েছে।”

চোখ বন্ধ করে ফেলল বেলা। মন চাইল, যা দেখেছে তা দূর হয়ে যাক মাথা থেকে। কোনো হরর সিনেমার দৃশ্যের মতো এখনো চোখে ভাসছে মাইকেলের সেই নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণাক্লিস্ট চেহারা।

“কোনো সমস্যা নেই মিকি। কিছুই যায় আসে না এতে।”

“অবশ্যই যায়, বেলা।” আলতো করে বোন’কে চোখের সামনে ধরে চাইল মেয়েটার মনের ভাব বুঝতে। যা দেখল তাতে মনটা আরো বেশি খারাপ হয়ে গেল। ইসাবেলা’র কাঁধে হাত রেখে ব্রেকফাস্ট টেবিলের চেয়ারে বসিয়ে দিল মাইকেল।

“অদ্ভুত ব্যাপার কী জানো, একদিকে স্বস্তি পেয়েছি যে তুমি জেনে গেছ। যেভাবে দেখেছ তা মেনে নিতে কষ্ট হলেও, পৃথিবীতে একটাই মানুষ আছে, যার কাছে আমি আমার মতো করেই থাকতে পারি। যার কাছে আমাকে মিথ্যে বলতে হবে না।”

“কেন লুকিয়ে রেখেছিলে মিকি। ১৯৬৯ সালে এসে এখনো কেন নিজেকে মেলে ধরতে পারো না? কেভাবে কার কথা?”

ড্রেসিং গাউনের পকেট থেকে সিগারেট বের করে একটা জালিয়ে নিল মাইকেল। জ্বলন্ত সিগারেটটার দিকে মুহূর্তখানেক তাকিয়ে থেকে বলে উঠল : “অন্যদের জন্য এটা সত্যি হতে পারে; কিন্তু আমার জন্য না। পছন্দ করি বা না করি, আমি একজন কোর্টনি, এখানে নানা আছে, বাবা, গ্যারি, শ পারিবারিক সুনাম সব জড়িত।”

ইসাবেলার মন চাইল প্রতিবাদ করে। কিন্তু বুঝতে পারল এটাই চরম সত্যি।

“নানা আর বাবা” আবারো বলে উঠল মাইকেল, “জানতে পারলে পুরোপুরি ভেঙে পড়বে।”

ভাইয়ের হাতের উপর হাত রেখে সান্ত্বনা দিতে চাইল ইসাবেলা। জানে সত্যি কথাই বলছে মাইকেল। কখনোই নানা কিংবা বাবাকে জানানো যাবে না। তাদের জন্য এটা বহন অসম্ভব দুঃসহ হবে এমনকি তারার চেয়েও বেশি। তারা তো বাইরের মানুষ; কিন্তু মাইকেলের দেহে বইছে কোর্টনি বংশের রক্ত। দাদীমা আর বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না। কবে তুমি নিজের এই দিকটা সম্পর্কে জানতে পারলে?” আস্তে করে জিজ্ঞেস করল বেলা।

 প্রিপারেটরী স্কুলের সময় থেকে।” খোলামেলাভাবেই উত্তর দিল মাইকেল। “আমি বহুবার চেষ্টা করেছি নিজেকে সামলাতে। চাইনি এমন কিছু হোক। কখনো মাস, এমনকি বছর পর্যন্ত কিন্তু পারি নি বেলা। মনে হয়েছে এমন একটা পশু আছে ভেতরে যে আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই এর উপর।”

 প্রশ্রয় দেয়ার ভঙ্গিতে হাসল বেলা। “ন্যানি কী বলবে জানো-হট কোর্টনি ব্লাড়। আমাদের সবার মাঝেই এটা আছে। কেউই খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি; বাবা, গ্যারি, শন, তুমি কিংবা আমি কেউই না।”

 “এ ব্যাপারে কথা বলতে তোমার খারাপ লাগছে না তো? আমি তো সবসময় ঢেকে রাখতেই চেয়েছি।”

“যেভাবে ইচ্ছে বলল। আমি শুনছি।”

“পনের বছর ধরে এভাবেই আছি আর মনে হচ্ছে আরো পঞ্চাশ বছরও এভাবেই কেটে যাবে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো-পারিবারিক কারণে যা জানলে সবাই বেশি আহত হবে-কৃষণাঙ্গরাই কেবল আমাকে আকর্ষণ করে। নানা, বাবা আর আমাদের গৃহ আদালতে এ কারণেই বেশি দোষী হব!” থর থর করে কেঁপে উঠেই সিগারেট ফেলে দিল মাইকেল। আর প্রায় সাথে সাথেই আরেকটা জ্বালালো।

 “কালো পুরুষরা যে কেন আমায় এত আকর্ষণ করে বুঝি না। অনেক বার ভেবেছি। মনে হয়, তারা’র মতো হয়েছি। হয়ত অবচেতন মনে একটা অপরাধবোধ কিংবা আকাঙ্খা রয়ে গেছে ওদের উন্মা প্রশমন করার। মিটমিট করে হেসে ফেলল মাইকেল। অনেক দিন ধরেই তো ওদেরকে দমিয়ে রাখছি, তাই কিছু যদি ফেরত দেয়া যায়?”

“নাহ!” নরম স্বরে জানাল ইসাবেলা। এমনভাবে কথা বলে নিজেকে ছোট করো না মিকি। তুমি অসম্ভব সুন্দর আর ভদ্র একজন মানুষ। আর প্রবৃত্তির জন্য আমরা কেউ দায়ী নই।”

ইসাবেলা’র মনে পড়ল যে মাইকেল কতটা লাজুক, স্নেহশীল আর পরোপকারী; তারপরেও কেমন যেন বিষণ্ণ। এবারে এই বিষাদের কারণও বুঝতে পারল। আপন হৃদয়ে অনুভব করল যে, যা দেখেছে তা নিয়ে আর কোনো ঘৃণ্য ভাব নেই মনে। শুধু খারাপ লাগছে এই ভেবে যে তার প্রিয়। মানুষটা কতটাই না মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করছে।

‘মন খারাপ করো না, মিকি ডার্লিং।”

 “না।” স্বীকার করল মাইকেল। “যতক্ষণ তুমি আমার পাশে আছে।”

***

দুদিন পর। ইন্টারভিউ নিতে বাইরে গেছে মাইকেল। ডেস্কের উপর রাজ্যের বই আর কাগজ পত্র ছড়িয়ে নিয়ে বসে আছে ইসাবেলা। এমন সময় বেজে উঠল ফোন। অন্যমনস্ক থাকায় প্রথমে বুঝতেই পারল না যে কী শুনছে কিংবা কে কথা বলছে।

“রামোন? তুমি? কোনো সমস্যা হয়েছে? কোথায় তুমি? এথেন্সে?”।

“আমি আমাদের ফ্ল্যাটে…”

“এখানে? লন্ডনে?”

“হ্যাঁ। জলদি আসতে পারবে? আই নিড ইউ।”

লাঞ্চ আওয়ারের ট্রাফিকের মাঝ দিয়ে দ্রুত গতিতে মিনি চালিয়ে ফ্ল্যাটে পৌঁছে একেকবারে দুটো করে সিঁড়ি টপকে যখন দরজার সামনে পৌঁছাল মনে হল দম বেরিয়ে যাবে এক্ষুনি।

“রামোন!” কোনো সাড়া না পেয়ে বেডরুমের দিকে দৌড় লাগাল বেলা। রামোনের কিট ব্যাগ বিছানার উপর খোলা পড়ে আছে। মেঝের উপর দুমড়ানো শার্টের গায়ে রক্তের দাগ শুকিয়ে যাওয়া পুরনো রক্ত ছাড়াও নতুন তাজা রক্ত।

“রামোন! ওহ্ ঈশ্বর! রামোন!

শুনছ?

বাথরুমের দরজার দিকে দৌড় দিল বেলা। কিন্তু দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। একটু পিছিয়ে হিলসহ লাথি দিল তালা’য়। জুড়ো’র এই কৌশল ওকে রামোন শিখিয়েছিল। ঠুনকো তালাটা ভেঙে পড়তেই খুলে গেল দরজা।

টয়লেটের পাশে টাইলসের মেঝেতে পড়ে আছে রামোন। পড়ে যাবার সময় বোধহয় ওয়াশবেসিনের উপরকার শেফ ধরে ফেলেছিল, বেসিন আর পুরো মেঝেতে ছড়িয়ে আছে বেলা’র কসমেটিকস্। কোমর থেকে উপর পর্যন্ত পুরোপুরি নিরাভরণ রামোনের বুকে ভারী ব্যান্ডেজ। এক নজর দেখেই বুঝতে পারল যে দক্ষ হাতে কেউ ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছে। শার্টের মতো ব্যান্ডেজের গায়েও ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। কিছু পুরনো, কিছু একেবারে তাজা।

হাঁটু গেড়ে বসে রামোনের দিকে তাকাল বেলা। পার মুখে নাকে সিকনির ঘাম। কোলের উপর রামোনের মাথা নিয়ে ঝুলতে থাকা তোয়ালে দিয়ে কাছের ঠাণ্ডা পানির নল থেকে পানিতে ভিজিয়ে মুছে দিল মুখ আর গলা।

পিট পিট করে উঠল রামোনের চোখের পাতা। তাকাল বেলার দিকে।

 “রামোন।”

দৃষ্টি পরিষ্কার হতেই বিড়বিড় করে বলে উঠল, “আমার সারা পৃথিবী দুলছে।”

“মাই ডার্লিং, তোমার কী হয়েছে? কিভাবে এত আঘাত পেয়েছ?”

 “আমাকে বিছানায় নিয়ে চলো।” রাইডিং আর টেনিস খেলা বেলা নিজেও যে কোনো পুরুষের মতই শক্তিশালী। কিন্তু রামোন’কে উঠে বসাতে গিয়ে মনে হলো কারো সাহায্য ছাড়া এ কাজ সম্ভব না।

“যদি আমি ধরে রাখি, দাঁড়াতে পারবে?”

মাথা নেড়ে চেষ্টা করতে গিয়েই দুলে উঠল রামোন। ব্যথার চোটে খামচে ধরল বুকের ব্যান্ডেজ।

“আস্তে আস্তে।” ফিসফিস করে উঠল বেলা। মিনিট খানেকের মতো উপুড় হয়ে থেকে আস্তে আস্তে সোজা হল রামোন।

“অল রাইট।” দাঁতে দাঁত ঘসল রামোন। নিজের কাঁধে ওর বেশির ভাগ ভার নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল বেলা।

“তুমি কি এথেন্স থেকে এভাবেই এসেছ?” অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে জানতে চাইল ইসাবেলা।

মাথা নেড়ে মিথ্যেটাতে সম্মতি দিল রামোন। আসল কথা হল কুরিয়ারের কাজ করার জন্যই বেলা’কে এথেন্সে ডেকে পাঠিয়েছিল। হঠাৎ করেই তৈরি হয়েছিল প্রয়োজনটা। অন্য কোনো এজেন্ট খালি না থাকায় আর বেলার জন্যও সময় হয়ে যাওয়ায় ঠিক করেছিল এটাই উপযুক্ত সময়। এখন মেয়েটার যা অবস্থা বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিবে রামোনের নিদেশ। প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে তেমন কষ্টও হবে না। সুন্দরী সরল আর গর্ভবতী হওয়ায় চট করে সহানুভূতি আদায় করাটা ওর জন্য সহজ হত। এছাড়া পৃথিবীর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে একেবারেই নতুন মুখ হিসেবে অচেনা মেয়েটাকে মোসাদ’রাও চিনবে না। এর উপরে আবার বেলা’র কাছে আছে দক্ষিণ আফ্রিকার পাসপোর্ট। আর এই দেশটার সাথে ইস্রায়েলের সম্পর্ক বেশ অন্তরঙ্গই বলা চলে।

 প্ল্যান ছিল এথেন্স থেকে ফ্লাইটে চডে তেল আবিব গিয়ে পিক আপ সেরে আবার একই পথ ধরে ফিরে আসবে বেলা। খুব বেশি হলে একদিনের কাজ। কিন্তু এথেন্সে পৌঁছাতে না পারায় পাল্টে গেল পুরো ব্যাপারটা। পিক্‌ আপটা বেশ জরুরি ট্র্যাকটিক্যাল নিউক্লিয়ার ওইপন্স সিস্টেম উন্নয়নের কাজে জড়িত ইসরায়েল আর দক্ষিণ আফ্রিকান বিজ্ঞানের সবকিছু ছিল এই প্যাকেটের মাঝে। মোসাদ ওর আদ্যপান্ত জানে জেনেও রিস্কটা নিয়েছে রামোন।

যতটা সম্ভব ছদ্মবেশ ধারণ করে রওনা দিয়েছে সাথে কোনো অস্ত্র ছাড়াই। সাথে অস্ত্র নিয়ে ইসরায়েলি সিকিউরিটি চেক পার হবার চেষ্টা করা পাগলামি ছাড়া আর কিছু না। মেক্সিকান পাসপোর্ট বহন করলেও নিশ্চয়ই বেন গারিয়ান। এয়ারপোর্টে ওকে চিনে ফেলে টিকটিকি লাগিয়ে দিয়েছে পেছনে।

 ফেউ’টাকে রামোনও চিনে ফেলেছিল। কিন্তু খসাতে পারেনি। তাই মোসাদ এজেন্টের ঘাড় ভেঙে দেয়ার সময় নিজেও গুলি খেয়েছে। পরে ভয়ংকর রকম আহত হলেও তেল আবিবের পি এল ও সেফ হাউজে চলে, গেছে। বারো ঘন্টার ভেতরে সিরিয়াতে ওদের পাইপ লাইনের মাধ্যমে রামোনকে বের করে দিয়েছে ওরা।

 যাই হোক, লন্ডন হচ্ছে সবচেয়ে বড় সেফ হাউজ। ইনজুরী আর রিস্কের কথা চিন্তা করে দামাস্কাসও ছেড়ে আসতে হয়েছে। স্থানীয় কেজিবি’র স্টেশন হেড পাহারা দিয়ে অ্যারোফ্লোট ফ্লাইট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেছে। সেখান থেকে। লন্ডন। বহুকষ্টে ফ্ল্যাটে পৌঁছেই ফোন করেছে বেলা’কে। আর তারপর কোনো মতে বাথরুমে গিয়েই আবার পড়ে গেছে।

“আমি ডাক্তারকে ফোন করছি।” বলে উঠল বেলা।

“না, কোনো ডাক্তার ডেকো না!” দুর্বলতা সত্ত্বেও সেই চির পরিচিত শীতল কণ্ঠে আদেশ দিল রামোন। যা অবাধ্য করার সাহস নেই বেলা’র।

“তাহলে কী করব?”

“টেলিফোন আমার কাছে নিয়ে এসো।” তাড়াহুড়া করে সিটিং রুমে দৌড় দিল বেলা।

“রামোন, তোমার অবস্থা বেশ খারাপ। কিছু অন্তত করতে দাও এক বাটি স্যুপ নিয়ে আসি?”

মাথা নেড়ে সম্মতি দিল রামোন। এক মনে ডায়াল করছে ফোন। রান্না ঘরে গিয়ে ক্যান থেকে ঘন ভেজিটেবল স্যুপ নিয়ে গরম করল বেলা। কাজ করতে করতেই কানে এলো স্প্যানিশে কারো সাথে ফোনে কথা বলছে রামোন। কিন্তু এ বিষয়ে জ্ঞান দুর্বল থাকায় আলাপচারিতার কিছুই বুঝল না বেলা। স্যুপ আর প্রো-ভিটা বিস্কেটের ট্রে নিয়ে এসে দেখল ফোন রেখে দিয়েছে রামোন।

 “ডার্লিং, কী হয়েছে তোমার? কেন ডাক্তারকে ফোন করতে দিলে না?”

মুখ বাঁকা করে ঠোঁট উল্টালো রামোন। কোনো ব্রিটিশ ডাক্তার যদি দেখে ফেলে এ ক্ষত; তাহলে রিপোর্ট করতে বাধ্য হবে। অন্যদিকে কিউবান অ্যামবাসির ডাক্তার দেখলেও রক্ষে নেই। ফাঁস হয়ে যাবে রামোনের কাভার। তাই বাধ্য হয়ে অন্য ব্যবস্থা করতে হয়েছে। যাই হোক বেলার প্রশ্নের জবাব না দিয়েই জানাল, “এখনি একটু বাইরে যেতে হবে তোমাকে। শ্লোয়ান স্কোয়ার আগ্রাউন্ড স্টেশনের পশ্চিম দিকে প্লাটফর্মে গিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকবে। কেউ একজন তোমাকে একটা খাম দিয়ে যাবে…”

“কে? তাকে চিনবই বা কিভাবে?”

“তুমি চিনবে না।” বেলা’র চিন্তা খারিজ করে দিল রামোন। “সে-ই তোমাকে চিনে নেবে। কিন্তু কোনোভাবেই তার সাথে কথা বলবে না কিংবা চেনার চেষ্টা করবে না। খামের ভেতরে আমার প্রেসক্রিপশন আর চিকিৎসার : যাবতীয় কিছু লেখা থাকবে। পিকাডেলী সার্কাসে গিয়ে প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে দরকারি ওষুধগুলো নিয়ে আসবে। যাও।”

“ঠিক আছে রামোন; কিন্তু এটা তো বলবে যে আঘাত পেলে কিভাবে?”

“যা বলেছি সেভাবেই কাজ করা শিখতে হবে-এত্ত প্রশ্ন করো না তো। এখন যাও!”

“হা যাচ্ছি।” নিজের জ্যাকেট আর স্কার্ফ নিয়ে ঝুঁকে রামোনকে কিস্ করল বেলা।

“আই লাভ ইউ।”

সিঁড়ি দিয়ে অর্ধেক নেমেও গেছে। হঠাৎ করেই একটা কথা মনে পড়াতে থেমে গেল ইসাবেলা। শৈশবের পর থেকে নানা ছাড়া আর কেউ ওর সাথে এতটা হুকুমের স্বরে কথা বলেনি। এমনকি বাবাও অনুরোধ করেন, আদেশ নয়। অথচ এখন স্কুল গার্লের মতই রুদ্ধশ্বাসে ছুটছে নির্দেশ পালনের জন্য। রাস্তায় নেমে এলো বেলা।

আন্ডারগ্রাউন্ড প্লাটফর্মের শেষ মাথায় তখনো পৌঁছেনি; এমন সময় কে যেন আলতো করে কব্জি ছুঁয়ে পেছন থেকে খাম্ ঢুকিয়ে দিল হাতের মাঝে। কাঁধের উপর দিয়ে তাকাতেই দেখা গেল লোকটা এরই মাঝে উল্টো দিকে হাঁটা ধরেছে।

ডিসপেনসারীর বিক্রেতা প্রেসক্রিপশনটা পড়ে জানতে চাইল : “আপনার কেউ কি খুব মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে?” মাথা নাড়ল বেলা।

“আমি ডাক্তার এলভিসের রিসেপশনিস্ট। এত কিছু জানি না।”

 আর কিছু না বলেই ওষুধ প্যাক করে দিল লোকটা।

মনে হচ্ছিল রামোন ঘুমাচ্ছে। কিন্তু বেলা ঢোকার সাথে সাথে চোখ মেলে তাকাল। সে চেহারা দেখেই মনের মাঝে ভয় ফিরে এলো বেলা’র। দুদিনের বাসী মরা’র মতো গায়ের চামড়া; গাঢ় দাগের মাঝে গর্তের ভেতরে ঢুকে আছে চোখ জোড়া। যাই হোক এসব আজে বাজে চিন্তা একপাশে সরিয়ে নিজেকে শান্ত করতে চাইল বেলা।

 বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সময় রেডক্রসের উপর একটা কোর্স করেছিল। এছাড়া ওয়েন্টেলেদেনে ভিজিটিং ডাক্তারের সাথে কুষাঙ্গ কর্মচারীদের। চিকিৎসায় সাহায্যও করেছে। তাই আঙুল কাটা, থেতলানো পা কিংবা ফার্মের মেশিন থেকে পাওয়া অন্যান্য আঘাতও যথেষ্ট দেখেছে।

কেমিস্টের কাছ থেকে আনা ওষুধ বের করে তাড়াতাড়ি পড়ে নিল খামে রাখা টাইপ করা নির্দেশিকা। বেসিনে হাত ধুয়ে পানিতে হাফ কাপ ডেটল মিশিয়ে রামোনকে তুলে বসাল; তারপর খুলতে শুরু করল ব্যান্ডেজ।

রক্ত শুকিয়ে যাওয়ায় ক্ষতের সাথে লেগে গেছে ব্যান্ডেজ। চোখ বন্ধ করে ফেলল রামোন। কপাল আর চিবুকে গড়িয়ে পড়ল হালকা ঘামের ফোঁটা।

“আয়্যাম স্যরি।” ফিসফিস করে ওকে ভোলাতে চাইল বেলা। “চেষ্টা করছি যত কম ব্যথা দেয়া যায়।”

অবশেষে খুলে এলো ড্রেসিং আর ক্ষত দেখে মনে হল গলা ছেড়ে চিৎকার করে উঠবে বেলা। বহুকষ্টে নিজেকে থামাল। বুকের একপাশে বেশ গভীর একটা গর্ত আর দ্বিতীয় ক্ষতটা মসৃণ পিঠের উপর একই জায়গায় জমাট বাঁধা কালো রক্তও দেখা যাচ্ছে। তেতে আছে ক্ষতের চারপাশের চামড়া। ইনফেকশনের হালকা গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে।

দেখা মাত্রই এর কারণ বুঝে গেল বেলা। শেষবার শর্তনের সাথে জাম্বেজী উপত্যকায় শিকারে যাবার পর সন্ত্রাসদের হামলার পর বাটোঙ্কা গ্রামে সাহায্যের জন্য যেতে হয়েছিল। সেখানেই প্রথম দেখেছে একপাশ দিয়ে গুলি ঢুকে অন্যপাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ায় তৈরি ক্ষত। রামোন ওর দিকে তাকিয়ে থাকায় কিছুই বলল না বেলা; চেষ্টা করল মনের ভাব মুখে না আনতে। চুপচাপ ডিসইনফেক্টাষ্ট দিয়ে ক্ষতের চারপাশ মুছে দিল। এরপর ফ্রেশ ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল।

নিজেও বুঝতে পারল যে ভালই হয়েছে ওর সেবা; তারপরেও নিশ্চিত হল বালিশে শুইয়ে দেবার সময় রামোনের বিড়বিড়ানি শুনে। “গুড়। তুমি ভালোভাবেই জানো কী করছ।”

 “এখনো শেষ হয়নি। তোমাকে ইনজেকশন দিতে হবে। ডাক্তারের আদেশ।” হালকা করতে চাইল বেলা, “এবারে তোমার মোটকু পাছু দেখাও সোনা।”

বিছানার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে রামোনের জুতা-মোজা আর ট্রাউজার খুলে নিল বেলা।

“এবারে আনডারপ্যান্টস।” অন্তর্বাস নিচে নামিয়ে কপট স্বস্তি ফুটিয়ে বলে উঠল, “যাক বাবা, স্পেশাল সবকিছু ঠিকঠাকই আছে। নয়ত আমি পাগল হয়ে যেতাম।” এবারে হেসে ফেলে পাশ ফিরল রামোন।

অ্যাপুল থেকে অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে ডিসপোজেবল সিরিঞ্জে ভরে রামোনের পশ্চাদ্দেশে ঢুকিয়ে দিল বেলা। এরপর আস্তে করে চাদর দিয়ে ঢেকে দিল শরীরের নিচের অংশ।

“এখন, ওষুধ নিয়ে এলো বেলা, “এই দুটো পিল্ খেয়ে ঘুম।”

কিছু বলল না রামোন। চুপচাপ ওষুধ খেয়ে নিতেই বেডসাইড লাইট জ্বালিয়ে ওকে কিস করে চলে এলো বেলা, “আমি সিটিং রুমেই আছি, যদি কোনো দরকার লাগে।”

***

সকাল হতেই দেখা গেল গায়ের রঙের বেশ উন্নতি হয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক তার কাজ শুরু করেছে। শরীরের উত্তাপ কমে গিয়ে চোখ দুটোও পরিষ্কার হয়ে গেছে।

“ঘুম কেমন হল?” জানতে চাইল বেলা।

“পিলগুলো একেবারে ডিনামাইটের মতো ছিল। মনে হচ্ছিল চূড়া থেকে পড়ে যাচ্ছি, এখন তো গোসলও করতে পারব।”।

স্নানের সময় সাহায্য করল বেলা। ব্যান্ডেজের চারপাশ পরিষ্কার করতে করতে সাবান মাখা স্পঞ্জ নিয়ে দুষ্টুমিতে মেতে উঠল বেলা।

“আহ, শরীরের উপরের দিকে ব্যথা পেলেও নিচের দিকের সব দেখছি ভালই কাজ করছে।”

ডিয়ার নার্স, তুমি কি কাজ করছ না মজা করছ?”

“একটুখানি একটা আর বেশির ভাগই অন্যটা।” স্বীকার করল বাধ্য মেয়ে বেলা।

বিছানায় এসে বেলা’কে আবারো সিরিঞ্জে অ্যান্টিবায়েটিক ভরতে গিয়ে বাধা দিতে চাইল রামোন। সোজা কথা শুনিয়ে দিল মেয়েটা : “ছেলেরা এত ভীরু হয় না! নাও পাছা তোল!” বাধ্য হয়ে গড়িয়ে গেল রামোন। “গুড বয়। এবারে তোমার ব্রেকফাস্টের সময় হয়েছে।”

রামোনের সেবা করতে মজাই পাচ্ছে বেলা। অন্তত এই একটা জায়গায় ওকে আদেশ দেয়া যাচ্ছে আর রামোনও মেনে নিচ্ছে। রান্নাঘরে কাজ করার সময় শুনতে পেল আবারো কার সাথে যেন স্প্যানিশে দ্রুত বকবক করছে রামোন। মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝল না বেলা। শোনার চেষ্টা করতেই ফিরে এলো গত রাতের আশঙ্কাগুলো। জোর করে মাথা থেকে সন্দেহ দূর করার জন্য সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল টিউর স্টেশনের বিপরীত কর্ণারে থাকা ফল ফুলের দোকানে।

ফিরে এসেও দেখল রামোন তখনো ফোনে কথা বলছে।

ব্রেকফাস্ট ট্রে’তে সুন্দর করে গোলাপ আর পীচু সাজিয়ে নিল বেলা। বেডরুমে যেতেই চোখ তুলে তাকাল রামোন। হাসল তার সবচেয়ে সুন্দর আর রেয়ার হাসি।

বিছানার কিনারে বসে কাটা চামচ দিয়ে সাবধানে ফল খাওয়াতে লাগল রামোনকে। মুখে নিয়েই আবার ফোনে কথা বলছে ছেলেটা। খাবার শেষ হতেই ট্রে-রান্নাঘরে রেখে আসতে গেল বেলা। ধুতে ধুতে শুনতে পেল রিসিভার জায়গামতো রেখে দিচ্ছে রামোন।

তাড়াতাড়ি বেডরুমে ফিরে এসে রামোনের পাশে পা দুটাকে একপাশে মুড়ে নিয়ে বসল বেলা।

 “রামোন” নরম স্বরে হলেও সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে উঠল, “এটা বুলেটের ক্ষত তাই না?”

সাথে সাথেই ভয়ংকর শীতল আর সবুজ হয়ে গেল রামোনের চোখ। ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে তাকালো বেলার দিকে।

“কিভাবে হয়েছে?” এবারেও চুপচাপ তাকিয়ে আছে ছেলেটা। বেলা বুঝতে পারল তার সাহস ফিকে হয়ে আসছে; তারপরেও শক্ত হতে চাইল।

“তুমি কোনো ব্যাঙ্কার নও, তাই না?”

“বেশির ভাগ সময়েই আমি ব্যাঙ্কার।” মোলায়েমভাবে উত্তর দিল রামোন।

“আর অন্য সময়ে? কী কর তখন?”

 ‘একজন দেশপ্রেমিক। দেশের জন্য কাজ করি।”

স্বস্তির তপ্ত হাওয়া বয়ে গেল বেলা’র বুক জুড়ে। সারারাত জুড়ে কত যে হাবিজাবি ভেবেছে : ড্রাগ স্মাগলার, ব্যাংক ডাকাত কিংবা অপরাধী চক্রের সদস্য হওয়াতে গ্যাং ওয়ারে আহত হয়েছে।

 “স্পেন।” জানতে চাইল বেলা, স্প্যানিশ সিক্রেট সার্ভিসের সদস্য তাই না?”

এবারেও কিছুই না বলে সাবধানে বেলা’কে পরখ করছে রামোন। অল্প অল্প করে ফাঁদের কাছে টেনে নিয়ে আসতে হবে।

“তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ বেলা, যদি ঘটনা এরকম হয়ও আমি তোমাকে বলতে পারব না।”

“অবশ্যই।” খুশি খুশি হয়ে মাথা নাড়ল মেয়েটা। এই বিপদজনক আর উত্তেজনাময় এসপিওনাজ দুনিয়ার আরেকটা লোক’কে চিনত সে। রামোনের আগে একমাত্র ওই লোকটাকেই ভালবেসেছিল বলে মনে করেছিল। দক্ষিণ আফ্রিকান সিকিউরিটি পুলিশের সেই বিগ্রেডিয়ারই একমাত্র তার বন্য আবেগগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। জোহানেসবার্গের ফ্ল্যাটে ছয় মাস উদ্দাম আনন্দে কাটিয়েছে বেলা আর লুথার ডিলা রে। স্বামী-স্ত্রী’র মতই কাটানো সেই দিনগুলোকে কোনোরকম ওয়ার্নিং ছাড়াই শেষ করে দিয়েছে লুথার। প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছিল বেলা। এখন বুঝতে পারে যে কতটা বোকা ছিল সেসময়। খানিক সেই মোহের সাথে কোনো তুলনা নেই তার আর রামোন মাচাদোর এই বন্ধন।

 “আমি বুঝতে পেরেছি ডার্লিং। তুমি আমার উপর ভরসা করতে পারো। আর একটাও অহেতুক প্রশ্ন করব না।”

“আমি তা জানি। এ কারণেই তো প্রথম তোমাকেই ডেকেছি সাহায্যের আশায়।”

“আই এম প্রাউড অব দ্যাট। তুমি স্প্যানিশ আর আমার সন্তানের পিতা হওয়াতে নিজেকেও স্প্যানিশই মনে হয়। তাই যতটা সম্ভব তোমাকে সাহায্য করতে চাই।”

“হ্যাঁ।” মাথা নাড়ল রামোন। “বুঝতে পেরেছি। বেবি’র কথা প্রায়ই মনে পড়েছে।” হাত বাড়িয়ে বেলা’র পেট স্পর্শ করল রামোন। কিন্তু হাতটা বেশ শক্ত আর ঠাণ্ডা। “আমি চাই আমার পুত্র স্পেনে জন্ম নিক। তাহলে স্প্যানিয়াত হবার পাশাপাশি ওর টাইটেলও ঠিক থাকবে।

মুগ্ধ হয়ে গেল বেলা। ধরেই নিয়েছিল যে তার সন্তান লন্ডনে হবে। ম্যাটারনিটি হোমে এরই মাঝে সম্ভাব্য রিজার্ভেশন দিয়ে রেখেছেন গাইনোকোলজিস্ট।

“আমার জন্য এটা করবে, বেলা? আমার সন্তানকে পরিপূর্ণভাবে একজন স্প্যানিয়ার্ড হিসেবে তৈরি করে তুলবে?” রামোন জানতে চাইলে এক মুহূর্তও দ্বিধা করল না বেলা।

“অফ কোর্স। মাই ডার্লিং। তুমি যা চাও তাই হবে।” ঝুঁকে রামোনকে কি করল বেলা। এরপর পাশে রাখা বালিশের উপর শুয়ে পড়ে বলল, “তুমি যদি এরকমটা চাও, তাহলে তো জোগাড় যন্তর শুরু করতে হবে।”

 “আমি এরই মাঝে অনেক কিছু গুছিয়ে রেখেছি।” স্বীকার করল রামোন। “মালাগার ঠিক বাইরেই চমৎকার একটা প্রাইভেট ক্লিনিক আছে। ওখানকার ব্যাংকের হেড অফিসে আমার বন্ধু আছে। ও আমাদেরকে ফ্ল্যাট আর মেইড খুঁজে দেবে। হেড অফিসে ট্রান্সফারের বন্দোবস্তও করে ফেলেছি। তাই বেবি হওয়ার সাথে সাথে তোমার কাছে চলে যেতে পারব।”

 “শুনে তো বেশ ভাল লাগছে।” একমত হল বেলা। “তাহলে তুমি যদি ঠিক করো যে বেবি কোথায় হবে, আমিও ঠিক করব যে আমরা বিয়ে কোথায় করব। দু’জনে সমান সমান, তাই না?”

হেসে ফেলল রামোন, “হ্যাঁ সেটাই ভালো।”

“আমি চাই আমাদের বিয়ে হবে ওয়েল্টেভেদেনে। দেড়শ বছর আগে তৈরি পুরানো একটা গির্জা আছে এস্টেটে। গ্যারি’র বিয়ের সময় দাদীমা নানা এটাকে সম্পূর্ণ নতুন করে ঠিকঠাক করে নিয়েছেন। পুরো গির্জা ভরে দিয়েছিলেন ফুলে ফুলে। আমিও তেমনটাই চাই। অরাম লিলি’স। কেউ কেউ ভাবে যে এ ফুলগুলো অশুভ, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার ফেরারিট ফুল আর আমি কুসংস্কারে’ও বিশ্বাসী নই…”।

 ধৈর্য ধরে মেয়েটার কথা শুনছে রামোন। মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে উৎসাহ দিচ্ছে। অপেক্ষায় আছে কখন নিজের পরের চাল চালবে; এক্ষেত্রে ও’কে বেলাই পথ দেখাল।

“কিন্তু রামোন ডার্লিং, সবকিছু রেডি করার জন্য নানা অন্তত ছয় সপ্তাহ সময় নিবে। ততদিনে আমি ছোট খাট একটা পাহাড় হয়ে যাব। বেদী থেকে নেমে এলে ওরা আমাকে নিয়ে “বেবি এলিফ্যান্ট ওয়াক” গান গাইতে থাকবে।”

“না, বেলা।” ইসাবেলা’কে থামিয়ে দিল রামোন। বিয়ের সময় তুমি পুরোপুরি স্লিম আর সুন্দরীই থাকবে। কারণ ততদিনে তো আর প্রেগন্যান্ট থাকবে না।”

বিছানার উপর বসে থাকার মতো করে উঠে বেলা জানতে চাইল, “কী বলতে চাইছ রামোন কী হয়েছে?”

“হ্যাঁ, তুমি ঠিকই ধরেছ, খবর তেমন ভালো না। নাটালি’র খবর পেয়েছি ও এখনো ফ্লোরিডাতেই আছে। একগুয়ে মেয়েটার কারণে আইনি জটিলতাও বাড়ছে।”

“ওহ রামোন!”

“আমার অবস্থাও তোমার মত। বিশ্বাস করো যদি কিছু করার থাকত, আমি নিশ্চিত করতাম।”

“আই হেইট হার।” ফিসফিস করে উঠল বেলা।

“হ্যাঁ, মাঝে মাঝে আমারো তাই মনে হয়। কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে, অহেতুক ঝামেলা ছাড়া বড় কোনো ক্ষতিও হবে না। আমাদের বিয়ে হবে, তোমার অরাম লিলিও থাকবে। শুধু এ সবকিছুর আগেই আমাদের সন্তান জন্ম নেবে।”

 “প্রমিজ করো, রামোন, আমার কসম-তুমি মুক্ত হবার সাথে সাথে আমরা বিয়ে করব।”

“প্রমিজ।”

রামোনের পাশে শুয়ে ভালো কাঁধের উপর মাথা তুলে দিল বেলা। মুখটা আড়াল করে রাখল; যেন বিতৃষ্ণার ভাবটা রামোন দেখতে না পায়।

“আই হেইট হার, বাট আই লাভ ইউ।” ইসাবেলার ঘোষণা শুনে তৃপ্তির হাসি হাসল রামোন। দেখতে পেল না বেলা।

***

ক্ষত ভালো না হওয়ায় আরো এক সপ্তাহ ফ্ল্যাটে বন্দি হয়ে রইল রামোন। তাই কথা বলার প্রচুর সময় পাওয়া গেল। রামোন’কে মাইকেলের কথা জানাতেই ওর আগ্রহ দেখে খুশি হয়ে গেল বেলা।

একে একে সবকিছু বলে দিল রামোনকে। মাইকেলের গুণ, ওদের মাঝের বিশেষ সম্পর্ক। এমনকি পরিবারের বাকি সদস্যদের কথা, তাদের গোপনীয়তা, দুর্বলতা এমনকি স্ক্যান্ডালের কথা। শাসা আর তারা’র ডির্ভোস। কোনো এক সময় আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের মরুভূমিতে বাস্টার্ড চাইল্ডের জন্ম দেয়া সংক্রান্ত নানা’র বিরুদ্ধে সন্দেহের কথাও জেনে গেল রামোন।

 “কেউ কখনো এটা প্রমাণ করতে পারেনি। আসলে পারবেও না। নানা যা চীজু একটা!” হেসে ফেলল বেলা। “যাই হোক, তারপরেও ১৯২০ সালে কিছু তো একটা ঘটেছিল।”

 একেবারে শেষে, আবারও মাইকেলের প্রসঙ্গ টেনে আনল রামোন। “যদিও এখন লন্ডনেই থাকে, তাহলে আমাদের দেখা করিয়ে দিচ্ছ না কেন? আমার ব্যাপারে লজ্জা পাচ্ছে নাকি?”

 “ওহ সত্যি? সত্যি ওকে এখানে নিয়ে আসব রামোন? তোমার সম্পর্কে ওকে খানিকটা বলেছি। জানি ও’ও তোমার সাথে দেখা করতে চায় আর তোমার’ও ভাল লাগবে। ও হচ্ছে সত্যিকারের লক্ষ্মী কোর্টনি। আর আমরা বাকিরা…!” চোখ পাকালো বেলা।

বগলের নিচে বাবার ব্যার্গান্ডি থেকে বোতল একটা নিয়ে এসে পৌঁছাল মাইকেল। “আমি ভেবেছিলাম ফুল আনব,” ব্যাখ্যা দিয়ে বলে উঠল, “পরে ভাবলাম, থাক দরকারি কিছু নিয়ে যাই।”

হাত মেলাতে গিয়ে খুব সাবধানে পরস্পরকে মেপে নিল মাইকেল আর রামোন। উদ্বিগ্ন মুখে তাকিয়ে রইল বেলা, প্রাণপণে চাইছে যেন দুজনে দুজনকে পছন্দ করে।

 “এখন পাজরের কী অবস্থা?” জানতে চাইল মাইকেল। ইসাবেলা আগেই ভাইকে জানিয়েছে যে ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে পাজরের তিনটা হাড় ভেঙে ফেলেছে রামোন।

“তোমার বোন তো আমাকে বন্দি করে রেখেছে। আমার কিছুই হয়নি-এমন কিছু না যে এই অসাধারণ বার্গান্ডি খেয়ে সারবে না। নিজের চরিত্রের বিশেষ সেই চার্ম প্রদর্শন করল রামোন; যার আকর্ষণ কেউ এড়াতে পারে না। স্বস্তির হাপ ছাড়ল বেলা।

বার্গান্ডি নিয়ে রান্নাঘরে গেল ছিপি খোলার জন্য। ভোলা বোতল আর দুটো গ্লাস নিয়ে ফিরে আসতেই দেখল বিছানার পাশের চেয়ারে বসে মাইকেল; ইতিমধ্যেই গল্পে মজে গেছে দু’জনে।

“ব্যাংকে তোমার গোল্ডেন সিটি মেইল’র কপি পড়তে পারি। তোমার ফিনানসিয়াল আর ইকোনমিক কাভারেজ আমার বেশ পছন্দ।”

“আহ, তো তমি ব্যাংকিং পেশায় আছ, বেলা তো আমাকে বলেনি।”

“মার্চেন্ট ব্যাংকিং। বিশেষ করে সাব-সাহারা আফ্রিকা।” জুতা খুলে নীল জিন্সের নিচের অংশ গুটিয়ে রামোনের পাশে বিছানায় উঠে বসল বেলা। আলোচনায় অংশ না নিলেও মনোযোগ দিয়েই শুনল সবকিছু।

 তার জানাই ছিল না আফ্রিকা নিয়ে রামোন এতটা ভাবে। বেলার মাতৃভূমির বিভিন্ন স্থান, ব্যক্তি আর ঘটনা সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান এই ছেলের। এই আলোচনার সাথে বেলার সাথে হওয়া পূর্বের সব গল্পই কেমন ফিকে মনে হল। দু’জনের কথা শুনতে শুনতে একেবারে নতুনভাবে অনেক কিছুই উপলব্ধি করল বেলা।

মাইকেলের অবস্থাও একই। এমন কাউকে পেল, বুদ্ধিমান হওয়া সত্ত্বেও যে কিনা তার মতো করেইভাবে।

মধ্যরাত পার হয়ে গেছে; ওয়াইনের প্রথম, বোতল আর বেলার ছোষ্ট্র রান্নাঘর থেকে নিয়ে আসা বোতল-টা’ও শূন্য হয়ে গেছে। পুরো বেডরুম আচ্ছন্ন হয়ে আছে মাইকেলের সিগারেটের ধোঁয়ায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল বেলা : “তোমাকে তো মাত্র একটা ড্রিংকের জন্য দাওয়াত করেছিলাম মিকি আর রামোনের’ও শরীর খারাপ। এখন বিদায় হও।” ভাইয়ের ওভারকোর্ট তুলে নিল বেলা।

“তুমি যদি রাজনৈতিক প্রবাসীদের নিয়ে কোনো সিরিজ করতে চাও তাহলে তো সেটা রালেই তাবাকাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।” বিছানা থেকে নরম স্বরে জানাল রামোন।

অনুতপ্ত হবার মতো করে হাসল মিকি। “তাবাকা’কে পেলে তো বর্তে যেতাম। রহস্যময় সেই মানুষটা। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়।”

“ব্যাংকের বিভিন্ন কাজের সুবাদে উনার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। সবার খবরই রাখতে হয়। তুমি চাইলে আমি ব্যবস্থা করে দিতে পারি।” কোটের হাতায় একটা হাত ঢুকিয়ে বরফের মতো জমে গেল মাইকেল।

 “গত পাঁচ বছর ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছি। যদি তুমি পারো…”

“আগামীকাল লাঞ্চ টাইমের দিকে ফোন দিও। দেখি কী করতে পারি।” জানাল রামোন।

দরজায় দাঁড়িয়ে বোনকে বিদায় জানানোর সময় মাইকেল বলে উঠল, “তার মানে আজ রাতে তুমি ঘরে ফিরছ না।”

“এটাই তো ঘর।” ভাইকে জড়িয়ে ধরল বেলা। “তোমাকে দেখানোর জন্যই তো সাময়িকভাবে ছিলাম কাভোগান স্কয়ারের ফ্ল্যাটে। এখন আর তার দরকার নেই।”

“তোমার রামোন তো বেশ আকর্ষণীয়।” মাইকেলের কথা শুনে বেলার মনে হঠাৎ করেই কেমন যেন হিংসা জন্ম নিল। মনে হল অন্য কোনো নারী এমনটা বলছে। নিজেকে সামলাতে চাইল বেলা। এই প্রথম মিকি’র কোনো কিছু এতটা খারাপ লাগল। বেডরুমে এসে রামোনের কথা শুনে আরো বেড়ে গেল এই ব্যথ্য বোধ : “তোমার ভাইকে আমার পছন্দ হয়েছে। ওর মতো মানুষ দেখা পাওয়া সত্যিই ভার।”

নিজের কথা ভেবে লজ্জা পেয়ে গেল বেলা। শুধু শুধু মিকি’কে সন্দেহ করল। জানে মাইকেলের প্রাণশক্তি আর বুদ্ধিমত্তার জন্যই ওকে পছন্দ করেছে রামোন-কিন্তু তারপরেও কিসের যেন কাঁটা খোঁচাচ্ছে মনের ভেতর।

বিছানার উপর ঝুঁকে এতটা আবেগ নিয়ে রামোনকে কিস করল যে বেলা নিজেই নিজের উপর অবাক হয়ে গেল। প্রথমে বিস্মিত হলেও পরে রামোনও সাড়া দিল।

অবশেষে শান্ত বেলা বলল, “আমাকে ছেড়ে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ইউরোপে ঘুরে বেড়িয়েছ; যাও বা এলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুধু খাও আর ঘুমাও। “

নিজের প্রয়োজন জানাতে ব্যাকুল হয়ে উঠল বেলা, “নার্সের কথা একটু খেয়াল নেই। এখন আমার সবকিছু শোধ করো মাস্টার রামোন।”

“আমি তো সাহায্য ছাড়া পারব না।” সাবধান করে দিল রামোন।

“ঠিক আছে তুমি শুধু শুয়ে থাকো। বাকি সব আমি দেখছি।”

বুকের ব্যান্ডেজের যেন একটুও ক্ষতি না হয়; এরকম সাবধানে রামোনের উপর উঠে বসল বেলা। সবুজ চোখ জোড়াতে ভেসে উঠতে দেখল ওর মতই ব্যাকুলতা। কেটে গেল সব সংশয়। রামোন তার শুধু তার।

 রামোনের সুস্থ বুকের ওমে নিরাপত্তা খুঁজে নিল তৃপ্ত বেলা। আধো ঘুম আধো জাগরণে কথা বলতে শুরু করল দু’জনে। কিন্তু রামোন আবারো মাইকেলের কথা তোলায় ঝিলিক দিয়ে উঠল খানিক আগের দ্বিধা। এতটাই রিলাক্সড মুডে আছে যে ভাবল রামোন’কে সব বলে দেয়া যাক।

 “বেচারা মিকি, কখনো বুঝতেই পারি নি যে এত বছর ধরে ও কতটা যন্ত্রণা সহ্য করছে। অন্য যে কারো চেয়ে আমি ওর সবচেয়ে কাছের হয়েও কিছুই টের পাইনি। মাত্র কদিন আগে দুর্ঘটনাবশত জেনে গেছি যে ও হোমো…”

কী বলছে বুঝতে পেরেই চুপ করে গেল বেলা। কাঁপতে কাঁপতে ভাবতে লাগল যে এটা সে কী কল। মাইকেল ওকে বিশ্বাস করে। যাই হোক এরপর যা শুনল তা মোটেও আশা করেনি।

“হ্যাঁ।” শান্তস্বরে একমত হল রামোন। আমি জানি। কিছু ব্যাপার খেয়াল করলেই স্পষ্ট বুঝা যায়। প্রথম আধা ঘণ্টাতেই আমি টের পেয়েছি।”

স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল বেলা। রামোন জানে, তার মানে বেলার দিক থেকে কোনো বিশ্বাসঘাতকতা হয়নি।

“তোমার কি খারাপ লেগেছে?”

“না, একদম না।” উত্তরে জানাল রামোন। এদের বেশির ভাগই বেশ সৃজনশীল আর উদ্যমী হয়।”

“হ্যাঁ, মিকি’ও তাই।” আগ্রহ নিয়ে বলল বেলা। “প্রথমে চমকে গেলেও এখন আমার কিছুই মনে হয় না। শুধু চাই ওকে যেন অপরাধী সাব্যস্ত না করা হয়।”

“আমার তো মনে হয় না তার কোনো সুযোগ আছে। সমাজ এরই মাঝে মেনে নিয়েছে।”

 “তুমি বুঝতে পারছ না রামোন। মাইকেল শুধু কৃষাঙ্গ ছেলেদেরকেই পছন্দ করে আর দক্ষিণ আফ্রিকাতে থাকে।”

“হ্যাঁ, এবারে চিন্তান্বিত স্বরে জানাল রামোন, “এতে কিছু সমস্যা হতে পারে।”

***

দুপুরের খানিক আগে ফ্লিট স্ট্রিটের পে-বুথ থেকে ফোন দিল মাইকেল। দ্বিতীয় রিং’য়ে সাড়া দিল রামোন!

“খবর বেশ ভালো। রালেই তাবাকা এখন লন্ডনে আর তোমাকেও চেনেন। রেজ’ নামে ১৯৬০-এ তুমি কোনো অটিকেল লিখেছিলে?”

“হ্যাঁ, মেইল এর জন্য ছয়টার একটা সিরিজ। কিন্তু এ কারণে সিকিউরিটি পুলিশ নিষিদ্ধ করেছিল কাগজটা।”

“তাবাকা লেখাগুলো পড়েছেন আর পছন্দও করেছেন। তাই রাজি হয়েছেন তোমার সাথে দেখা করতে।”

“মাই গড রামোন। বলে বোঝাতে পারব না যে আমি কতটা কৃতজ্ঞ। এর মতো ব্রেক-”।

বাধা দিল রামোন। “আজ সন্ধ্যায় তোমার সাথে দেখা করবেন। কিন্তু কিছু শর্ত দিয়েছেন।”

“যে কোনো কিছু।” তাড়াতাড়ি মেনে নিল মাইকেল।

“তুমি একা আসবে। সাথে অস্ত্র তো দূরে থাক, টেপ রেকর্ডার কিংবা ক্যামেরাও থাকবে না। ছবি কিংবা ভয়েসের কোনো রেকর্ড রাখতে চান না। শেপার্ডস বুশ-এ একটা পাব আছে।” ঠিকানাটা বুঝিয়ে দিল রামোন। “সন্ধ্যা সাতটায় থেকো। এক হোড়া ফুল নিয়ে যেও-কার্নেশনস। কেউ একজন এসে তোমাকে নিয়ে যাবে।”

“রাইট, বুঝতে পেরেছি।”

“আরেকটা কথা। ইন্টারভিউ নিয়ে লেখা তোমার কপিগুলো প্রিন্টের আগেই তাবাকাকে দেখাতে হবে।”

খানিকক্ষণের জন্য চুপ মেরে গেল মাইকেল। সাংবাদিকতার নীতি অনুযায়ী মেনে নিতে পারছে না এই শর্ত। মনে হচ্ছে ওর পেশার উপর সেন্সরশীপ ফেলা হচ্ছে। কিন্তু পুরস্কার হিসেবে পাবে আফ্রিকার মোস্ট ওয়ানটেড মানুষগুলোর একজনের ইন্টারভিউ।

 “অলরাইট।” ভারি সরে উত্তর দিল মাইকেল।” উনাকেই সবার আগে পড়তে দিব।” এরপরই চন মনে হয়ে উঠল কণ্ঠ, “তুমি আমার অনেক উপকার করলে রামোন। কাল সন্ধ্যায় এসে তোমাকে সব জানাব।”

“ওয়াইনের কথা ভুলো না।”

তাড়াহুড়া করে কাভোগান স্কোয়ারে ফিরে এলো মাইকেল। টেলিফোন হাতে নিয়েই দিনের বাকি অ্যাপয়েন্টমেন্ট সব বাতিল করে দিল। এরপর বসল ইন্টারভিউ’র স্ট্র্যাটেজি নিয়ে। প্রশ্নগুলো এমন হবে যেন তাবাকা’র মড় ঠিক রেখেই পেটের কথা বের করে নেয়া যায়। ইচ্ছে করেই সংঘর্ষ আর রক্তপাতের পথ বেছে নেয়া মানুষটার সামনে মাইকেলকে হতে হবে সিনসিয়ার, সিমপ্যাথেটিক আর তীক্ষ্ণ। বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য প্রশ্নগুলোকে নিরপেক্ষ হতে হবে। আবার একই সাথে এমন হবে যেন নিজেকে মেলে ধরেন। তাবাকা মোদ্দা কথা হল, সাদামাটা কোনো বৈপ্লবিক শ্লোগান চায় না মাইকেল। “সন্ত্রাসী” শব্দটা দিয়ে সাধারণভাবে বোঝায় এমন কোনো ব্যক্তি যে কিনা রাজনৈতিক দমননীতির কারণে এমন কোনো সংঘর্ষ ঘটায় যার নিশানা হয় বে-সামরিক জনগণ কিংবা স্থাপনা; এতে করে বেড়ে যায় নির-অপরাধ মানুষের ভোগান্তি আর মৃত্যু। আপনি কি এই সংজ্ঞাটা মেনে নিচ্ছেন? যদি তাই হয় তাহলে উমকুম্ভ সিজো’র উপরে এই লেবেল দেয়া যায়?”

 প্রথম প্রশ্নটা ঠিক করে আরেকটা সিগারেট জ্বালিয়ে পুনরায় পড়তে বসল মাইকেল।

“যাক। ভালই হয়েছে। এর মানেই হচ্ছে দুই পা সোজা করে লাফ দেয়া। কিন্তু কী যেন বাদ রয়ে গেছে। আরেকটু ঘষামাজা করতে হবে। এক মনে কাজ করতে করতে সাড়ে পাঁচটা নাগাদ মন মতো বিশটা প্রশ্ন তৈরি হয়ে গেল। স্মোকড স্যামন স্যান্ডউইচ আর এক বোতল গিনেস খেয়ে আবারো স্ক্রিপট নিয়ে রিহার্সাল করল মাইকেল।

এরপর ওভারকোট কাঁধে নিয়ে কোণার দোকান থেকে কেনা এক তোড়া কার্নেশনস হাতে নিয়ে রাস্তায় নেমে এলো। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মাঝেই ট্যাক্সি নিয়ে চলল স্লোয়ান স্ট্রিট।

মানুষের দেহের উত্তাপে ঝাপসা হয়ে আছে পাব। হাতের কানেশনস তুলে ধরে মৃদু নীল রঙা সিগারেটের ধোঁয়ার মধ্যে তাকাল মাইকেল। প্রায় সাথে সাথেই বার কাউন্টার থেকে উঠে ভিড়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে এলো পরিষ্কার নীল উলের থ্রি-পিস স্যুট পরা এক ইন্ডিয়ান।

“মি. কোর্টনি, আমি জোভান।”

“নাটাল থেকে।” উচ্চারণ চিনতে পারল মাইকেল।

“স্টানজার থেকে।” হেসে ফেলল জোভান। “কিন্তু তাও ছয় বছর আগে।” মাইকেলের কোর্টের কাঁধ খেয়াল করে বলল, “বৃষ্টি থেমে গেছে? ভাল, চলুন হাঁটি। খুব বেশি দূরে নয়।”

 মেইন রাস্তায় নেমে শখানেক গজ হেঁটে যাবার পর হঠাৎ করেই পাশের একটা গলিতে নেমে গেল জোভান। দেখাদেখি মাইকেল। এরপরই দ্রুত পা চালাল লোকটা। তাল মেলাতে গিয়ে প্রায় লাফাতে হচ্ছে মাইকেলকে।

 গলি’র মাঝেই মোড় নিয়ে কোণার কাছে থেমে গেল জোভান। মাইকেল কিছু বলতে যেতেই হাত ধরে ওকে থামিয়ে দিল। পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করল দু’জন। কেউ তাদেরকে অনুসরণ করছে না নিশ্চিত হবার পরেই কেবল মুঠি আলগা করল জোভান।

“আপনি আমাকে বিশ্বাস করেননি।” হেসে ফেলল মাইকেল। পাশের ডাস্টবিনে ফেলে দিল কার্নেশনস।

“আমরা কাউকেই বিশ্বাস করি না। আবারো পথ দেখাল জোভান। “বিশেষ করে বোয়াদেরকে। প্রতিদিনই তারা নতুন কোনো না কোনো নষ্টামী শিখছে।”

দশ মিনিট পরে বেশ প্রশস্ত আর আলোকিত এক রাস্তায় আধুনিক ফ্ল্যাট ব্লকের বাইরে থামল দু’জনে। সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে সব মার্সিডিজ আর জাগুয়ার। যত্ন সহকারে ছেটে রাখা হয়েছে অ্যাপার্টমেন্টের সামনের লন আর বাগান। বোঝাই যাচ্ছে বেশ বড়লোকি হালত এই এলাকার বাসিন্দাদের।

“আমি এখন যাচ্ছি।” বলে উঠল জোভান। “ভেতরে যান। লবি’তে জানাবেন আপনি মিস্টার কেন্দ্রিকের গেস্ট। ফ্ল্যাট-৫০৫।”

 ইটালিয়ান মার্বেলের মেঝে, কাঠের প্যানেল লাগানো দেয়াল, সোনালি কারুকাজ করা লিফটের দরজা। উর্দিধারী পোর্টর মাইকেলকে স্যালুট করে জানতে চাইল “ইয়েস, মিঃ কেন্ড্রিক আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন, মিঃ কোর্টনি। প্লিজ ফিফথ ফ্লোরে উঠে যান।”

লিফটের দরজা খুলতেই দেখা গেল শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে দুই কৃষাঙ্গ তরুণ।

“এদিকে আসুন মিঃ কোর্টনি।” কার্পেটে মোড়া প্যাসেজ ধরে ৫০৫ নম্বর ফ্ল্যাটে পৌঁছে গেল মাইকেল।

দরজা বন্ধ হবার সাথে সাথে দ্রুত কিন্তু পুখানুপুঙ্খ বাপে মাইকেলের। দেহ তল্লাশী করল দুই তরুণ। হাত উঁচু করে মাইকেল’ও সাহায্য করল। এরই ফাঁকে সাংবাদিকের দৃষ্টি মেলে দেখে নিল চারপাশ। অর্থ আর রুচির চমৎকার মেলবন্ধন ঘটেছে এই ফ্ল্যাটের সাজসজ্জাতে।

সন্তুষ্ট হয়ে পিছিয়ে দাঁড়াল দুই কৃষ্ণাঙ্গ। একজন আবার মাইকেলের জন্য খুলে দিল সামনের জোড়া দরজা।

বেশ বড়সড় আর সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখা একটা রুমে ঢুকল মাইকেল। কনোলী চামড়া দিয়ে মুড়ে রাখা হয়েছে ক্রিম রঙা সোফা আর ইজি চেয়ার। মোটা ওয়াল-টু-ওয়াল কার্পেটের রঙ হালকা কফি। ক্রিস্টাল আর ক্রোম দিয়ে তৈরি হয়েছে টেবিল আর ককটেল বার। দেয়ালে ঝুলছে হনির সুইমিং পুল সিরিজের চারটা বিশাল পেইন্টিং।

একেকটার দাম না হলেও পনের হাজার করে, মনে মনে হিসাব কষে নিল মাইকেল আর তখনি চোখে পড়ল রুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার অবয়ব।

 ইদানীংকালের ভেতর তার কোনো ছবি ভোলা না হলেও, মেইলের আর্কাইভে থাকা বহু পুরাতন ঝাপসা একটা ছবি দেখাতে, এক নজরেই মানুষটাকে চিনে ফেলল মাইকেল।

“মিঃ তাবাকা” অস্ফুটে বলে উঠল। মাইকেলের মতই লম্বা হলেও কাঁধ বেশ চওড়া আর কোমর সরু।

“মিঃ কোর্টনি” এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিলেন রালেই তাবাকা। পদক্ষেপে বক্সার সুলভ আচরণ।

দৃঢ় আর গম্ভীর গলার স্বরে আফ্রিকার স্পষ্ট অনুরণন পাওয়া গেল। পরনে খাঁটি উলের নতুন স্যুট, সিল্পের টাই’য়ে গুচির নকসা। দেখতেও বেশ সুদর্শন রালেই তাবাকা।

“আপনার সাথে দেখা করার সুযোগ পেয়ে আমি কৃতজ্ঞ।” বলে উঠল মাইকেল।

“আপনার” রেজ “সিরিজটা আমি পড়েছি।” কালো পাথরের মতো চোখ জোড়া দিয়ে মাইকেলকে দেখছেন তাবাকা, “আমার জনগণকে ভালোই বুঝতে পারেন। তাদের আশা আকাঙ্ক্ষাকেও ভালোভাবেই তুলে ধরেছেন।”

“সবাই অবশ্য আপনার সাথে একমত হবে না। বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকার দায়িত্বে আছেন যারা।”

হেসে ফেললেন রালেই। পরিষ্কার চকচকে সাদা নিখুঁত দাঁতের সারি। “আমি আপনাকে যা বলব সেটা শুনেও উনারা তেমন খুশি হবেন না। যাই হোক তার আগে একটা ড্রিংক নিন?”

“জিন আর টনিক।”

“হুম, এই জ্বালানি পেয়েই সচল থাকে সাংবাদিকদের মগজ। তাই না?” তাবাকার গলার স্বরে টের পাওয়া গেল অবজ্ঞার ভাব। তারপর বারে গিয়ে নিয়ে এলেন স্বচ্ছ ড্রিংকটুকু।

“আপনি ড্রিংক করেন না?” মাইকেলের প্রশ্ন শুনে আবারো ভ্রুকুটি করলন রালেই।

“এত এত কাজ বাকি আছে, শুধু শুধু মাথা জ্যাম করে লাভ কী?” হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন; “এক ঘন্টা সময় দিচ্ছি আপনাকে, এরপর আমাকে যেতে হবে।”

“আমি এর এক মিনিটও নষ্ট করব না।” মাথা নাড়ল মাইকেল। ক্রিম রঙা কনোলী চামড়ায় মোড়া চেয়ারে মুখোমুখি বসে পড়ল দুজনে : “আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে মোটামুটি সবই জানিঃ জন্ম তারিখ, স্থান, সোয়াজিলল্যান্ডের ওয়াটারফোর্ড স্কুরে আপনার শিক্ষা জীবন। মোজেস গামার সাথে সম্পর্ক, এ এন সি’তে আপনার বর্তমান অবস্থান। তাহলে এখন আগে বাড়ি?”

সম্মতি দিলেন রালেই।

“সন্ত্রাসী” শব্দটা বলতে…” মাইকেলের সংজ্ঞা শুনতে শুনতে রেগে গেলেন রালেই। শরীর শক্ত করে বসে রইলেন। তারপর জানালেন, দক্ষিণ আফ্রিকাতে নিরাপরাধ বলে কেউ নেই এটা একটা যুদ্ধ। তাই কেউই নিজেকে নিরপেক্ষ বলে দাবি করতে পারবে না। আমরা সবাই যোদ্ধা।”

“তরুণ কিংবা বৃদ্ধ কোনো ব্যাপারই না? আপনার জনগণের আকাঙ্খার প্রতি কতটা সহানুভূতিশীল সেটাও ধর্তব্যের বিষয় নয়?”

“না।” আবারো একই কথা বললেন রালেই। “দোলনা থেকে সমাধি, আমরা সবাই যুদ্ধ করছি। দুটো ক্যাম্পের যেকোনো একটাতেই যেতে হবে সবাইকে-নিপীড়িত কিংবা নিপীড়নকারী।”

“পুরুষ। নারী কিংবা শিশু কারোরই কিছু বলার নেই?” জানতে চাইল মাইকেল।

“হ্যাঁ, বলতে পারবে-যে কোনো একটা দিক বেছে নিতে পারবে। কিন্তু নিরপেক্ষ থাকার কোনো অপশন নেই।”

“ভিড়ে-ভিড়াক্কার কোনো সুপার মার্কেটে বোমা বিস্ফোরণ হয়ে মারা গেল আপনার নিজের লোক, অনেকে আহতও হল। আপনি অনুতপ্ত হবেন না?”

“অনুশোচনা কোন বৈপ্লবিক অনুভূতি নয়। যেমন বণর্বাদের অপরাধীদের কাছেও এটা কোনো অনুভূতিই নয়। তাই যারা মৃত্যুবরণ করে হয় তারা সাহস আর সম্মানের সাথে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে, নতুবা শত্রুর ক্ষয় ক্ষতিতে সামিল হয়েছে। যুদ্ধ ক্ষেত্রে এদেরকে এড়িয়ে যাবার উপায় নেই, বরঞ্চ কাঙিক্ষতই বলা চলে।”

নোটপ্যাডের উপর খসখস করে লিখে চলেছে মাইকেল। ভয়ংকর এসব ঘোষণা শুনে রীতিমতো কাঁপছে, একই সাথে বেশ উত্তেজনাও বোধ করছে।

মনে হচ্ছে। মথ পোকার মতই ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে আগুনের কাছে। মানুষটার ক্রোধের উত্তাপে না জানি পুড়েই যায় সে। জানে শব্দগুলোর হুবহু রেকর্ড রাখলেও এতটা আবেগ কিছুতেই ফুটে উঠবে না ছাপা কাগজে।

সময় এতটা দ্রুত চলে যাচ্ছে যে একটা সেকেন্ডও যাতে নষ্ট না হয়, হিমমিস খাচ্ছে মাইকেল। তাই হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে রাতেই তাবাকা উঠে দাঁড়ালেও চাইল বাধা দিতে।

“আপনার যে শিশু যোদ্ধাদের কথা বলেছেন, তাদের বয়স কত?”

“অস্ত্র হাতে সাত বছর বয়সী বাচ্চাদেরকেও দেখাতে পারি আপনাকে আর সেকশনের কমান্ডার হিসেবে পাবেন দশ বছর বয়সীদেরকে।”

“আমাকে দেখাবেন?” হতবাক হয়ে গেল মাইকেল, “সত্যিই কি আমাকে দেখাবেন?”

 দীর্ঘ কয়েক মুহূর্ত মাইকেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন রালেই। মনে হচ্ছে রামোন মাচাদো’র কথাই ঠিক। লোকটা অসম্ভব বুদ্ধিমান। একে ভালই কাজে লাগানো যাবে। তার উদ্দেশ্য পূরণের জন্য পুরোপুরি ফিট এই মাইকেল। লেনিনের “উপকারী বোকার” মত। প্রথমে একে ব্যবহার করতে হবে কোদাল আর লাঙলের ফলা দিয়ে জমি চাষ করার মতো করে। আর তারপরই যখন সময় এসে যাবে, হয়ে উঠবে যুদ্ধের তলোয়ার।”

“মাইকেল কোর্টনি” নরম স্বরে জানালেন তাবাকা, “আমি আনপাকে বিশ্বাস করছি। মনে হচ্ছে আপনি আসলেই বেশ ম্ল আর জ্ঞানী। যদি আপনিও আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারেন। তাহলে এমন সব জায়গায় নিয়ে যাবো যা নিয়ে কেবল স্বপ্নই দেখেছেন এতদিন। সোয়েতো’র রাস্তায় নিয়ে যাব। আমার লোকদের হৃদয়ে আর হ্যাঁ, শিশুদেরকেও দেখাব।”

 “কবে?” জানে সময় আর বেশি নেই, তাই উদ্বিগ্ন মুখে জানতে চাইল মাইকেল।

“শীঘ্রিই।” প্রমিজ করল রালেই আর সাথে সাথে সদর দরজা খোলার আওয়াজ পাওয়া গেল। “আমি আপনাকে কিভাবে খুঁজে পাবো?”

“আপনি পাবেন না। আমিই আপনাকে খুঁজে নেব।”

সিটিং রুমের জোড়া দরজা খুলে যেতেই দোরগোড়ায় দেখা গেল এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। রালেই তাবাকা’কে নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও লোকটাকে দেখে জমে গেল মাইকেল। স্ট্রিট ক্লথ পরনে থাকলেও দেখার সাথে সাথে তাকে চিনে ফেলল। কেন্ড্রিক নামটা শুনে আগেই ঠাওর করার দরকার ছিল আসলে।

 “ইনি হচ্ছেন আমাদের হোস্ট, এই অ্যাপার্টমেন্টের মালিক।” পরিচয় করিয়ে দিলেন তাবাকা। “অলিভার কেন্ড্রিক, ইনি মাইকেল কোর্টনি।”

হাসলেন অলিভার কেন্ড্রিক। ব্যালে ডাঙ্গার সুলভ ঝরণার মতো এগিয়ে এসে মাইকেলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। ঠাণ্ডা হাতটা’র হাড়গুলো ঠিক পাখির মতই হালকা। পরিস্কার বোঝা গেল কেন লোকে তাঁকে “দ্য ব্ল্যক সোয়ান” নামে ডাকে। পাখির মতই লম্বা, অভিজাতগলা আর চোখ জোড়া তো দ্রুতটাই আলো ছড়াচ্ছে যেন চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে কোন পুল। একই রকম গাঢ় দ্যুতি ছড়াচ্ছে দেহত্বক।

কেন্ড্রিক এগিয়ে আসতেই মনে হল দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে মাইকেল। স্টেজের রোমান্টিক আলোর চাইতেও বেশি সুদর্শন লাগছে বাস্তবের অলিভারকে। মাইকেলের হাত ধরা অবস্থাতেই রালেই’র দিকে তাকালেন অলিভার। “এত তাড়াহুড়া কিসের, রালেই?” মনে হল যেন পশ্চিম ভারতীয় গানের ছন্দে আকুতি জানালেন।

“আমাকে যেতেই হবে।” মাথা নাড়লেন তাবাকা। “প্লেন ধরতে হবে।”

আবারো মাইকেলের দিকে ফিরলেন অলিভার। এখনো ওর হাত ধরে আছেন। “এত জঘন্য একটা দিন গেছে না। মনে হচ্ছে মরেই যাবো। আমাকে একা রেখে যাবেন না মাইকেল। এখানে থাকুন। মনে হচ্ছে বেশ মজা হবে। তাই না?”

অলিভারকে ভেতরে রেখে ফ্ল্যাট ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন তাবাকা। কিন্তু বিল্ডিং এর বাইরে নয়। এর বদলে লোক এসে রালেই’কে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল খানিক দূরের দ্বিতীয় আরেকটা ফ্ল্যাটে। ছোট্ট রুমটাতে তাবাকা’কে দেখেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল দ্বিতীয় আরেকজন। লোকটাকে ইশারায় বসতে বলে জানালার দিকে এগোলেন রালেই। লম্বা আর চিকন কাঠামোটা দেখতে পুরোপুরি একটা ফুল লেংথ ড্রেসিং-মিররের মত। আয়না দেখে বোঝা গেল দু’পাশ থেকেই অন্য পাশের সব দৃশ্য পরিষ্কার দেখা যায়।

আয়নার অপর দিকে দেখা যাচ্ছে অলিভার কেন্দ্রিকের অ্যাপার্টমেন্ট। হালকা অয়েস্টার আর মাশরুম রঙা রুমের বেড কাভারটা চমৎকারভাবে মিশে গেছে কার্পেটের সাথে। আয়নার টাইলস করা সিলিং-এ আলো ফেলছে লুকানো বাতি। বিছানার দিকে মুখ করে থাকা কুঠুরিতে রাখা আছে হিন্দু মন্দির থেকে আনা এক মূল্যবান অ্যান্টিক। রুমটা খালি থাকায় টু ওয়ে আয়নার এপাশের ক্যামেরা ইকুপমেন্টের দিকে চোখ দিলেন রালেই।

অ্যাপার্টমেন্ট আর ক্যামেরা সবকিছুই অলিভার কেন্দ্রিকের সম্পত্তি। এর আগেও রালেইকে ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। ভাবতে অবাক লাগে যে এহেন সাজানো নাটকে অংশ নিতে কখনো দ্বিধা করেন না কেভ্রিকের মতো মেধাবী আর বিখ্যাত লোক। যাই হোক তিনি নিজে যে সাগ্রহে একাজ করছেন তা নয়, এসব কিছুর প্রস্তাবও দিয়েছেন অলিভার স্বয়ং। এতটা আনন্দ নিয়ে পুরো কাজের উদ্ভাবন করেছেন যে বোঝাই যাচ্ছে এসব তার কতটা পছন্দের। একটাই মাত্র শর্ত দিয়েছেন যেন নিজের বিশাল কালেকশনে রাখার জন্য পুরো ভিডিও’র একটা কপি তাঁকে দেয়া হয়। আলো-আঁধারী পরিবেশেও অত্যন্ত নিখুঁত কাজ করা এই পেশাদার ক্যামেরার ফলাফল দেখে মুগ্ধ রালেই।

আরো একবার হাতঘড়ি দেখে নিলেন। দেহরক্ষী দু’জন ভালোভাবেই সামলে নিতে পারবে সবকিছু। তারা আগেও একই কাজ করেছে বহুবার। কিন্তু নিজের কৌতূহলও দমাতে পারলেন না। প্রায় আধা ঘণ্টা কেটে যাবার পর খুলে গেল বেডরুমের দরজা। আয়নার ওপাশে দেখা গেল কেন্ড্রিক আর মাইকেল কোর্টনি। দ্রুত নিজ নিজ জায়গায় চলে গেল রালেই’র দেহরক্ষীদ্বয়। একজন ভিডিও রেকর্ডারের কাছে আরেকজন ট্রাইপতে বসানো ক্যামেরায়।

ওপাশের বেডরুমে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কিস্ করল দুই পুরুষ। হালকা একটা গুঞ্জন ছড়াচ্ছে ভিডিও-রেকর্ডার।

সাটিনের চাদরের উপর শুয়ে অপেক্ষা করতে লাগল শ্বেতাঙ্গ কোর্টনি। অন্যদিকে আয়নার সামনে এসে উলঙ্গ দেহে দাঁড়িয়ে রইল কৃষাঙ্গ কেন্ড্রিক। ভাব দেখাল যেন নিজের শরীর দেখছে। অথচ ভালোভাবেই জানে আয়নার ওপাশে কারা আছে। বহু ঘণ্টা কসরৎ করে গড়ে তুলেছেন নিজের পেশি বহুল দেহ সুপুরুষ চেহারা।

গর্বিত ভঙ্গিতে আয়নার দিকে তাকিয়ে মাথা ঘোরাতেই ঝিলিক দিয়ে উঠল কানের হীরের দুল। ঠোঁট জোড়া ফাঁক করে জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে তাকিয়ে রইলেন রালেই তাবাকা’র চোখে। পুরো ব্যাপারটাতে এমন একটা ঘৃণ্য ভাব আছে যে কেঁপে উঠলেন তাবাকা। বিছানার দিকে চলে গেলেন কেন্ড্রিক। কৃষাঙ্গ পশ্চাদ্দেশের চমক দেখে হাত বাড়িয়ে দিল বিছানায় শুয়ে থাকা শ্বেতাঙ্গ।

 ঘুরে দাঁড়িয়ে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হবার জন্য হাঁটতে শুরু করলেন তাবাকা। লিফটে করে নিচে নেমে চলে এলেন সান্ধ্য রাস্তায়। বুকের কাছে ওভারকোট শক্ত করে ধরে নিঃশ্বাস নিলেন পরিষ্কার ঠাণ্ডা বাতাসে। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগোলেন সামনের দিকে।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *