৪.১৬ সম্রাট উরদূশের রোগ

॥ ষোল ॥

ন্যায় বিচারক নওশেরওয়াঁর পৌত্র সম্রাট উরদূশের এমন রোগের কবলে পড়ে যার চিকিৎসা রাষ্ট্রীয় চিকিৎসকদের সাধ্যের বাইরে চলে গিয়েছিল। এই রোগের সূচনা হয় পরপর তিন পরাজয়ের কঠিন মানসিক আঘাত থেকে। কিন্তু এই মানসিক অসুস্থতা এখন দৈহিক অসুস্থতার রূপ পরিগ্রহ করে। ঔষধেই এ রোগের চিকিৎসা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, যেন সে ঔষধ নয়; বরং ঔষধই তাকে কুরে কুরে খেয়ে নিঃশেষ করে দিচ্ছে।

উরদূশেরের উপর নীরবতা ছেয়ে যায়। নিজ যুগের প্রতাপশালী ফেরাউন হওয়া সত্ত্বেও এখন তার অবস্থা মরুভূমির আলোর মত নিভু নিভু। রাষ্ট্রীয় চিকিৎসক এ ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক ছিল, যেন যুদ্ধ সংক্রান্ত কোন খারাপ সংবাদ উরদূশের পর্যন্ত পৌঁছতে না পারে। কিন্তু বাস্তবে এটা সম্ভব ছিল না। কারণ, কখনো মুখ খুললে প্রথমে সে এ কথাই বলত যে, রণাঙ্গনের কোন খবর এল কি?

“সুসংবাদই আসছে জাঁহাপনা!” সর্বদা পাশে উপস্থিত চিকিৎসক তাকে জবাব দিত এবং তাকে বাঁচাতে কখনো বানিয়ে বলত “মুসলমানরা এভাবে পিছু হটছে যেন কোন দৈত্যের মুখোমুখি হয়েছে তারা। আবার কখনো বলত “পারস্য সাম্রাজ্য একটি অজেয় প্রান্তর। এ প্রান্তরে যেই মাথা ঠুকতে চেষ্টা করেছে তার মাথা ছিদ্র হয়েছে। আবার কখনো তার প্রাণের রাণী এই বলে তাকে প্রবোধ দিত যে, “আরবের বুদ্দুরা কিসরার শৌর্য-বীর্যের প্রতাপ কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না।”

এই প্রবোধ ও সান্ত্বনামূলক বাক্য কিসরার উপর ঔষধের মত উল্টো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে থাকে। কোন কিছুতেই তার নীরবতা ভঙ্গ হয় না। এবং চেহারায় উদাসীনতার ছাঁপ হ্রাস পাওয়ার পরিবর্তে ক্রমে তা গভীর থেকে গভীর হতে থাকে।

তার একান্ত পছন্দের নর্তকী তার সামনে গিয়ে রূপ-নাগিনীর মত দেহে ঢেউয়ের উত্তাল তরঙ্গ তোলে। শরীর অর্ধনগ্ন করে দেয়। উরদূশেরের ম্রিয়মান চেহারার উপর সুগন্ধিযুক্ত রেশমের মত মোলায়েম কেশদাম ছড়িয়ে ছায়া বিস্তার করে। অতঃপর সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে নাচের ঝড় তোলে। রূপ-লাবন্যে মোহিত করে কিসরার রুগ্ন সন্তানকে প্রাণবন্ত করে তুলতে প্রয়াস পায়। কিন্তু ফলাফল জিরো। অবস্থা এমন দাঁড়ায়, যেন নর্তকী বিজন জঙ্গলে নেচে চলছে আর তার নাচের নৈপুণ্য জঙ্গলের হাওয়ায় উড়ে উড়ে যাচ্ছে।

একসময় তার প্রিয় শিল্পীরা যারা তাকে গানে গানে মাতিয়ে দিত এবং দারুণ বিমোহিত করত এ সময় তাদের প্রাণ মাতানো গানও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এ সকল নর্তকী এবং শিল্পীরা পারস্য খ্যাত ছিল। পারস্যের ভুবনখ্যাত সুন্দরী-রূপসীরা হরমে ফুলের মত প্রস্ফুটিত ছিল। এদের কতক আবার অর্ধ-উম্মিলিত ফুলকলিও ছিল। উরদূশের এ সমস্ত প্রস্ফুটিত উম্মিলিত ফুল ও তার কলির নাদুস-নুদুস শরীরের ঘাণে দিন-রাত বিভোর থাকত। কিন্তু এখন তাদেরই এক একজন করে তার নির্জন সঙ্গীরূপে গেলেও সে কাউকে মনোরঞ্জনের সাথীরূপে বরণ করেনা। কেউ তার দেহ মনে নয়া যৌবনের তুফান তো দূরে থাক বিন্দুমাত্র উষ্ণ শিহরণ জাগাতে পারে না।

‘ব্যর্থ, সকল চেষ্টা ব্যর্থ” পারস্য-রাণী বাইরে এসে ঐ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসকের কাছে ব্যর্থতা প্রকাশ করে বলে, যার সম্পর্কে সবাই জানত যে, তাকে দেখে মৃত্যুও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। রাণী দরাজগলায় চিকিৎসককে বলে আপনার জ্ঞান-অভিজ্ঞতাও ফেল হয়ে গেল? এটা কোন রং তামাশা নয় তো? কিসরার ঠোঁটে মুচকি হাসির আভা আনতেও কি আপনি পারেন না? কে বলে, আপনার ছোঁয়ায় মৃত্যুও জেগে ওঠে?”

যরথুস্ত্র আপনার প্রতি সদয় হোন পারস্য-সম্রাজ্ঞী।” বয়োবৃদ্ধ চিকিৎসক মুখ খোলে কারো জীবন-মৃত্যু আমার হাতে নয়। আমি জীবন-মৃত্যুর মধ্যবর্তী এক দুর্বল প্রাচীর মাত্র। মৃত্যুর হাত এত মজবুত ও শক্তিশালী যে, সে ঐ প্রাচীরকে দরজার খিলের মত খুলে ফেলে এবং অসুস্থ ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে যায়। মৃত্যুর এই শক্তির সামনে আমার জ্ঞান-অভিজ্ঞতা তুচ্ছ হয়ে রয়ে যায়।”

“শব্দ, কেবল শব্দ” সম্রাজ্ঞী গালিচায় পা জোরে ছুঁড়ে বলে “নিষ্প্রাণ শব্দ মাত্র।… শুধু গালভরা বুলি কোন দুঃখীর দুঃখ মুছে দিতে পারে? কোন রুগ্ন ব্যক্তিকে তার রোগ থেকে মুক্তি দিতে পারে? আপনার মুখে এমন শক্তি আছে যে, কিসরার রোগ চুষে নিতে পারে?”

“না মাননীয় সম্রাজ্ঞী!” চিকিৎসক বড় ধৈর্যের সাথে বলে এবং কম্পিত হাতে সম্রাজ্ঞীর বাহু ধরে তাকে বসিয়ে বলে “কেবল বুলি কারো দুঃখ এবং কারো রোগ নিরাময় করতে পারে না। তবে দুঃখ এবং রোগের যন্ত্রণা কিছুটা লাঘব করে থাকে। বাস্তবতার সামনে শব্দের কোন অর্থ নেই। আর বাস্তবতা যদি রূঢ় ও বিস্বাদ হয় তবে জ্ঞানীর মুখ থেকে নির্গত শব্দ মনে হয়, যেন হেমন্তের গোধূলিতে বৃক্ষের হলুদ পাতা ঝরে ঝরে পড়ছে। শুকনো ঐ পাতা আবার বাতাসের দোলায় হেলে-দুলে নাচতে থাকে।”

“আমরা কিসরাকে বাস্তব থেকে দূরে রাখছি” সম্রাজ্ঞী বলে “আমি তাকে গান বাদ্যে ভুলিয়ে…।”

“কিন্ত কতদিন নাগাদ? “বৃদ্ধ চিকিৎসক তার কথার মাঝপথে কেটে দিয়ে বলে “মাননীয় সম্রাজ্ঞী! আপনারা কিসরা হতে রুঢ় বাস্তবতা কতদিন গোপন করে রাখবেন। এই নৃত্য, গান এবং মখমলের মত নরম ও যৌবনদীপ্ত শরীর কিসরা উরদূশের মন ভুলাতে পারবে না। কিসরা কেবল সম্রাট হলে তিনি নিজেকে চমৎকারভাবে প্রতারিত করতে পারতেন। পালিয়ে গা বাঁচাবার সুগম পথ ধরতে পারতেন। কিন্তু তিনি কেবল সম্রাটই নন; বীরযোদ্ধাও বটে। তার ঘোড়ার পদভারে জমীনের তলদেশে কম্পন তুলেছিল। পারস্যের এই বিশাল সাম্রাজ্য কিসরার বাহুবলেরই ফসল। এই সম্রাজ্য তিনি রোমীয়দের শক্তিশালী সৈন্যদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। কিসরা নিজেও অস্ত্র ধারণ করেছেন। ভয়ানক যুদ্ধ করেছেন। ঘুমন্ত সেই সিংহ এখন জাগ্রত। এতদিন তিনি বিলাসিতায় বিভোর থাকলেও এখন তিনি সতর্ক। ফলে নৃত্য, গান এবং জাদুরূপী নারী সবই তার মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। এখন তিনি কোন নর্তকী কিংবা কণ্ঠশিল্পী নয়; বরং হুরমুজ, আন্দারযগার, বাহমান এবং আনুশাযানকে ডেকে ফিরছেন।… কোথায় এখন তার এ সকল শ্রেষ্ঠ সেনাপতিরা? আপনি তাকে কিভাবে ধোঁকা দিবেন?”

“না, না,” সম্রাজ্ঞী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে “ধোঁকা দিয়ে আর কি লাভ।… আপনি ঠিকই বলেছেন।… কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে করণীয় কি? আমার মাথায় কিছুই আসছে না। আমাদের প্রতিপক্ষ ঐ মুসলমানদের সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন? কয়েকজন ইহুদী এসেছিল। তারা মন্তব্য করছিল, মুসলমানদের এমন এক ভরপুর শক্তি আছে যার মোকাবিলা করার সামর্থ্য কারো নেই।… আর আমি লক্ষ্য করেছি যে, দজলা আর ফোরাতের সংগমস্থলে যে সকল মুসলমানকে পুনর্বাসিত করে তাদেরকে আমাদের গোলাম বানিয়ে রেখেছিলাম এবং যাদেরকে আমরা কীট-পতঙ্গের ঊর্ধ্বে জানতাম না, তারাই আজ মদীনাবাসীর শক্তিতে পরিণত হয়েছে। আমাদের সৈন্যরা তাদের সামনে দিয়ে বকরীর মত পালিয়ে বেড়াচ্ছে।”

“এটা চেতনা-বিশ্বাসের শক্তি মাননীয় সম্রাজ্ঞী।” বৃদ্ধ চিকিৎসক বলে “একটি কথা বলতে চাই, যদিও তা আপনার ভাল লাগবে না। মুসলমানরা বিশ্বাস করে যে, বাদশাহীর অধিকার একমাত্র আল্লাহ্ তা’য়ালার। পৃথিবীর সকল মানুষ তাঁরই আজ্ঞাবহ।… তারা আরো বলে যে, সেই আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই।… আপনি এই রহস্যের গূঢ় তথ্য বোঝেন মাননীয় সম্রাজ্ঞী?

“না, জনাব চিকিৎসক।” সম্রাজ্ঞী জবাবে বলে “আমি আপনার কথার মর্মার্থ সম্বন্ধে অবগত নই। আমি সাধারণভাবে যা বুঝি তা হলো, বাদশাহী একটি খান্দানী ব্যাপার। খান্দানের সদস্যরাই পর্যায়ক্রমে বাদশাহ হয়।”

এই খান্দানী রীতির করুণ পরিণতি আপনি নিজে চোখে দেখছেন মাননীয় সম্রাজ্ঞী!” চিকিৎসক বলে “যিনি নিজেকে জনগণের সম্রাট বলে মনে করতেন আজ তিনি নির্জীব, নিষ্প্রাণ হয়ে ভেতরে পড়ে আছেন। স্বীয় রাজত্ব শত্রুর কবল থেকে রক্ষা করতে পারছেন না। তার সেনাবাহিনী শুধু পিছপাই হচ্ছে। বেচারা সিপাহীদের এত কি দায় ঠেকেছে যে, একটি খান্দান এবং ব্যক্তির রাজত্বের জন্য নিজেদের জীবন-যৌবন মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিবে? হাজার হাজার যারা মারা যাচ্ছে অধিকাংশই পালাতে গিয়ে মরছে। তারা যখন দেখছে যে, এখানে যুদ্ধে জয়ী হবার বেলায়ও মালে গণীমত নেই তখন তারা লড়তে দ্বিধা করছে। তারা আপনাদের সরকারী কোষাগার হতে মাসিক বেতন লাভের উদ্দেশ্যে জীবিত থাকতে চায়।”

“আর মুসলমানরা?” সম্রাজ্ঞী উৎসুক হয়ে জানতে চায়।

‘মুসলমানরা!” চিকিৎসক বলে “তারা কোন ব্যক্তিস্বার্থে লড়ে না। তারা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় লড়ে এবং সেনাপতির নির্দেশ মেনে চলে। বস্তুত এ কারণেই সংখ্যায় স্বল্প হয়েও তারা তুফানের গতিতে ধেয়ে আসছে।… মাননীয় সম্রাজ্ঞী! প্রত্যেকের চেতনা-বিশ্বাস এবং মাজহাব ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। আমি জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতার কথা বলছি। যখন কোন খান্দান কিংবা কোন ব্যক্তি নিজেকে রাজাধিরাজ জ্ঞান করে এবং অন্য মানুষকে মানুষ বলে গ্রাহ্য করা ভুলে যায় তখন একদিন এমন আসে যখন সে সমস্ত সৈন্য এবং জনগণকে ধ্বংস এবং বিপর্যয়ের গভীর আবর্তে নিক্ষেপ করে।”

‘আমি এসব সূক্ষ্ম কথা বুঝি না” সম্রাজ্ঞী বলে “এবং বুঝতেও চাই না। আমি শুধু চাই, যে কোন উপায়ে কিসরা সুস্থ হয়ে উঠুক। এর জন্য যা যা দরকার তা করুণ মাননীয় চিকিৎসক।

“কোন কিছুতেই কিছু হবে না। মাননীয় সম্রাজ্ঞী!” ডাক্তার বলে–“কোন কিছু করে লাভও নেই। মুসলমানদেরকে পারস্যের সীমানা হতে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে–এই খবরটুকু শুধু এনে দিন। কিংবা খালিদ বিন ওলীদকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে কিসরার সামনে এসে উপস্থিত করুন, দেখবেন কিসরা উঠে দাঁড়িয়েছেন। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছেন।”

“এমন খবর কোথা থেকে আনব।” সম্রাজ্ঞী আশাহত এবং পরাজিত কণ্ঠে বলে, “মদীনার এই সেনাপতিকে কিভাবে জিঞ্জিরে বেঁধে আনব?… আমার সেনাপতি যদি পরাজিত হয়ে জীবিত ফিরে আসত, তবে আমি তার পা মাটিতে পুঁতে তাকে কুকুর দিয়ে খাইয়ে দিতাম।”

অতঃপর সে মাথা নীচু করে সেখান থেকে প্রস্থান করে। চিকিৎসকের কথার রূঢ় বাস্তবতা সে সহ্য করতে পারে না।

***

একটি ঘোড়া ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে আসে এবং শাহী মহলের বহির্ভাগে এসে থামে। সম্রাজ্ঞী অশ্বের খুরধ্বনি শুনেই বাইরে বেরিয়ে আসে। বৃদ্ধ চিকিৎসকও তার পিছনে পিছনে ছুটে আসে। আগত অশ্বারোহী একজন কমান্ডার। ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমেই সে সম্রাজ্ঞীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। তার মুখ খোলা এবং চোখ সাদা হয়ে গিয়েছে। চেহারায় শুধু ক্লান্তিই নয়; আতঙ্কও বিরাজ করছিল।

“কোন সুসংবাদ এনেছ?” সম্রাজ্ঞী জিজ্ঞাসা করে এবং রাজকীয় দাপটের সাথে বলে “উঠে বস এবং জলদি বল।”

কোন ভাল খবর নেই” কমান্ডার বড় বড় শ্বাস ফেলে বলে “মুসলমানরা সমস্ত সৈন্যকে হত্যা করেছে। তারা আমাদের হাজার হাজার লোককে ধরে নিয়ে গিয়ে খুসাইফ নদীর পাড়ে এমনভাবে হত্যা করেছে যে, নদীতে রক্তের স্রোত বয়ে গেছে। নদী শুষ্ক ছিল। মুসলমানদের সেনাপতি উপর থেকে নদীর বাঁধ খুলে দিলে নদীতে রক্তের প্রবাহ শুরু হয়ে যায়।” “আপনি কেন জীবিত ফিরে এলেন?” সম্রাজ্ঞী ক্রুদ্ধকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে, “আপনি আমার হাতে নিহত হতে এখানে এসেছেন?”

পরবর্তী যুদ্ধে লড়ার জন্য আমি জীবিত ফিরে এসেছি” কমান্ডার জবাবে বলে “আমি লুকিয়ে আমাদের সৈন্যদের মস্তক ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হতে দেখেছি।”

“সাবধান!” সম্রাজ্ঞী নির্দেশের সুরে বলে “এই সংবাদ আর কোথাও যেন রাষ্ট্র না হয়। পারস্য সম্রাটকে…।”

“পারস্য সম্রাট এই খবর শোনার জন্যই কেবল জীবিত আছে” উরদূশেরের আওয়াজ ভেসে আসে।

সম্রাটের আওয়াজ পেয়ে সম্রাজ্ঞী এবং চিকিৎসক উভয় বিস্ফোরিত নেত্রে আওয়াজের উৎস পথে চায়। একটি পিলারে ভর দিয়ে তাদের অদূরেই সম্রাটকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। দুই অপূর্ব সুন্দরী এবং তন্বী যুবতী সম্রাটের হাত নিজেদের কাঁধে স্থাপন করে রেখেছিল।

“এখানে এস” সম্রাট কমান্ডারকে নির্দেশ দেয় “আমি অনুমান করেছিলাম হয়ত বা কোন দূত এসেছে।…বল, কি খবর এনেছ?”

কমান্ডার পালাক্রমে সম্রাজ্ঞী এবং চিকিৎসকের দিকে তাকায়।

“এদিকে তাকাও” উরদুশের গর্জে উঠে বলে “সংবাদ শুনাও।”

কমান্ডার নিরুপায় হয়ে এক এক করে সকল ঘটনা খুলে বলে। পরাজয়ের সংবাদ শুনার সাথে সাথে উরদূশেরের মাথা সামনের দিকে হেলে যায়। বাহু ধরে রাখা দু’নারী সম্রাটকে ভর দিয়ে রাখে। সম্রাজ্ঞী ছুটে এসে সম্রাটের হেলে পড়া মাথা উপরে তুলে ধরে। বৃদ্ধ চিকিৎসক সম্রাটের নাড়িতে হাত রাখে। সম্রাজ্ঞী অসহায়ভাবে চিকিৎসকের দিকে তাকায়। চিকিৎসক নিরাশার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ায়।

“পারস্য সাম্রাজ্য কিসরা উরদূশের থেকে চির বঞ্চিত হয়ে গেছে” চিকিৎসক কান্নাঝরা কণ্ঠে বলে চোখ মুছে।

মুহূর্তে শাহী মহলে হুলস্থুল পড়ে যায়। কান্নার রোল ওঠে। উরদূশেরের লাশ হাতে হাতে তার ঐ কামরায় নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে বসে সে কয়েকবার বলেছিল আরবের ঐ লুটেরা বুদ্দুদের ইরান সাম্রাজ্যে পা রাখবার সাহস কিভাবে হল। সে এই কামরায় বসে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু কে জীবিত অথবা মৃত উপস্থিত করার নির্দেশ দিয়েছিল। এ নির্দেশ প্রতিপালিত হওয়ার পূর্বেই তার লাশ পড়েছিল এই কামরায়। পরাজয়ের ক্রমাঘাতেই তার মৃত্যু হয়েছিল।

সম্রাজ্ঞী নির্দেশ জারী করে যে, লড়াইরত সৈন্যরা যেন কিসরার মৃত্যুর খবর জানতে না পারে। মুসলিম শিবিরে একটি ঘোড়া ছুটে এসে প্রবেশ করে। অশ্বারোহী জোরে চিৎকার করে বলছিল।

“জনাব খালিদ কোথায়?” ঘোড় সওয়ার দু’হাত উঁচু করে নাড়াতে নাড়াতে আসছিল “বাইরে আসুন জনাব খালিদ!”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু দ্রুতবেগে বাইরে আসেন।

“জনাব খালিদ” আরোহী বলতে বলতে আসছিল, “আল্লাহ আপনার উপর রহম করুন। আপনার আতঙ্ক উরদূশেরের জীবন সংহার করেছে।” “তুমি উন্মাদ হয়ে গেলে ইবনে হারেছা!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সামনে এগিয়ে গিয়ে বলেন। আগত আরোহী ছিলেন মুসান্না ইবনে হারেসা। তিনি ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নামেন এবং এত আনন্দে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ হন যে, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু পড়ে যেতে যেতে কোন রকমে রক্ষা পান। “মাদায়েনে শোক বইছে” হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু আনন্দের আতিশয্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলে বলেন “শাহী মহল এখন কান্নার মহলে পরিণত। উরদূশের মারা গেছে চার দিন আগে। আমার দু’ব্যক্তি মাদায়েনের শাহী মহলে ছিল। সেখানে কড়াভাবে নিষেধ করে দেয়া হয়েছে, যেন সৈন্যদেরকে কিসরার মৃত্যুর সংবাদ জানানো না হয়।” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু দুহাত আসমান পানে তোলেন। আমার মাওলা!” তিনি বলতে থাকেন “আপনার শুকরিয়া আদায় করার ভাষা আমার নেই। বিজয়ের গর্ব-অহংকার থেকে আমাকে দূরে রাখুন। পরওয়ারদেগার! সকল প্রশংসা আপনার। আপনিই সমস্ত প্রশংসার উপযুক্ত।হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু হাত নীচে নামান এবং এদিক-ওদিক তাকিয়ে উচ্চকণ্ঠে বলেন “সমস্ত সৈন্যকে এ সংবাদ জানিয়ে দাও যে, পারস্যের বিশাল সাম্রাজ্যের স্তম্ভ ভেঙ্গে পড়েছে। আর এটা সম্পূর্ণ আল্লাহর অনুগ্রহ। সবাইকে জানিয়ে দাও যে, তোমাদের ভীতি ও আতঙ্ক কিসরার প্রাণ হরণ করেছে।”

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে নিজের তাঁবুতে নিয়ে গিয়ে সামনে কোন শহর আছে কিনা জানতে চান।

“কিছুদূর পরেই ইরানের একটি বড় শহর আমিনিশিয়া আছে” হযরত মুসান্না বলেন “পারস্যের ফৌজ এখানে থাকার কারণে শহরটিকে বড় একটি সামরিক ঘাটি বলা যেতে পারে। শহরটি বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্রও বটে। এর আশে-পাশের ভূখণ্ড অত্যন্ত উর্বর। বাণিজ্য তরি-তরকারি এবং বাগিচার ফল-মূলের কারণে আমিনিশিয়া শাহী শহর বলে খ্যাত। শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত মজবুত। শহরের ফটকও ইস্পাতদৃঢ়। প্রাচীরের কাছে ভিড়তে চেষ্টা করলে তীরবৃষ্টি হয়।… জনাব খালিদ এই শহর পদানত করতে ব্যাপক জান-মালের কুরবানী দিতে হবে। আপনি এই শহর করায়ত্ত করতে পারলে মনে করবেন, শত্রুর একটি মোটা রগ আপনার হাতে মুষ্টিবদ্ধ।” “এখনও সেখানে সৈন্য আছে?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু জানতে চান– “যদি থাকে তাহলে তারা সংখ্যায় কত হবে?”

“যে পরিমাণ পূর্বে ছিল তেমনটি এখন নেই” হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু জবাবে বলেন “আমার জানা মতে উলাইয়িস যুদ্ধে এ শহর থেকেও কিছু সৈন্য নেয়া হয়েছিল।”

একটি ছোট নদী এঁকে-বেঁকে ফোরাত নদীতে গিয়ে মিলত। নদীটির নাম ছিল বাদকলি। এই নদীর সঙ্গমস্থলের উপকূলে অমিনিশিয়া শহরটি অবস্থিত ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মর্মে মর্মে অনুধাবন করেন যে, তাঁর প্রতিটি অগ্রবর্তী কদম পূর্ববর্তী কদম থেকে কঠিন হয়ে উঠছে। তদুপরি তিনি নির্দেশ দেন যে, এখনই আমিনিশিয়া অভিমুখে মার্চ কর। তৎক্ষণাৎ নির্দেশ দানের পিছনে তার উদ্দেশ্য ছিল, ইরানীদের সামনে এগুবার সুযোগ না দেয়া।

সতের

৬৩৩ খ্রিস্টাব্দ। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহের প্রথম দিন। খালিদ বাহিনী এ দিনে উলাইয়িস থেকে রওনা হয়। মদীনার মুজাহিদগণ বিজয়ী ফৌজের মর্যাদায় অভিষিক্ত। পরবর্তী মঞ্জিল সবুজ-শ্যামলিমা এবং যথেষ্ট উর্বর ছিল। মানুষ এবং অশ্বের খাদ্যের কোন ঘাটতি ছিল না। তবে আমিনিশিয়ার প্রতিরক্ষার দিকটি হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলছিল।

শহরের প্রাচীর আর কেল্লাশৃঙ্গ নজরে আসতে থাকলে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সৈন্যদের থামার নির্দেশ দেন। হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু মূল বাহিনী থেকে আগেই পৃথক হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি গেরিলা আক্রমণে অত্যন্ত পটু ছিলেন। অনুগত বাহিনীও তার সাথে সাথে ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তার কাঁধে এ দায়িত্ব অর্পণ করেন যে, যে কোন বেশে কিছু লোক আমিনিশিয়া পাঠিয়ে সেখানে কত সৈন্য আছে তা যেন জানতে চেষ্টা করে।

একটু পরেই হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু ফিরে আসেন।

“জনাব খালিদ!” তিনি হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বলেন “আমার বিশ্বাস এটা ধোঁকা ছাড়া আর কিছু নয়। মনে হয়, ইরানিরা সম্মুখ যুদ্ধ এড়িয়ে এখন থেকে ধোঁকা এবং প্রতারণামূলক লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”

“আগে তো বল, তুমি কি দেখে এসেছ?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করেন “আর সে ধোঁকা কেমন, যা ইরানীরা আমাদের দিচ্ছে?”

“পুরো শহর ফাঁকা” হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “শহরের ফটক উন্মুক্ত। কেল্লাশৃঙ্গ এবং প্রাচীরে একজনেরও পাত্তা নেই।”

“তোমার লোকেরা শহরের ভেতরে গিয়েছিল?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু জানতে চান।

“না, জনাব খালিদ!” হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু জবাবে বলেন “তারা ফটক পর্যন্ত গিয়েছিল। শহর কবরস্থানের মত খাঁ খাঁ করছিল। তারা বলছে দরজা দিয়ে তারা কোন মানুষ কিংবা পশুর দেখা পায় নি।… আপনার মতে এটা কি প্রতারণা বা ফাঁদ নয়?”

“হ্যাঁ ইবনে হারেছা!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “তোমার লোকদের ব্যাপারে আমি এই সন্দেহ করতে পারি না যে, তারা মিথ্যা বলছে। তারা স্বপ্ন না দেখে থাকলে আমাদেরকে সতর্কতার সাথে সামনে অগ্রসর হতে হবে।”

“খোদার কসম! তারা মিথ্যা বলার মত লোক নয়” হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু দৃঢ়তার সাথে বলেন “তাদের ঈমান এত দুর্বল হলে ইরানীদের জুলুম নির্যাতন থেকে বাঁচতে তারা অনেক পূর্বেই ইসলাম ত্যাগ করত।… আর শুনে রাখুন জনাব খালিদ। সবার পূর্বে আমার লোকেরাই শহরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করবে। যদি এটা ধোঁকা, ফাঁদ কিংবা প্রতারণা হয়ে থাকে তবে এর শিকার প্রথমে আমার লোকেরাই হবে। আপনার সৈন্যরা নিরাপদ থাকবে।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তার সালারদের ডেকে পাঠান এবং তাদেরকে অবহিত করেন যে, আমিনিশিয়া ফাঁকা; জনশুণ্য। এটা প্রতারণা হতে পারে।

“ধোঁকা এই ছাড়া আর কি হবে যে, শহরের ফটক খোলা দেখে আমরা তার মধ্যে ঢুকে পড়ব” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “সবাই ঢুকে পড়লে হঠাৎ দরজা বন্ধ হয়ে যাবে আর আমরা অবরুদ্ধ হয়ে যাব।…আমরা শীঘ্রই শহরে আক্রমণ করতে যাচ্ছি।… ইবনে হারেছা!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে সম্বোধন করে বলেন “তোমার বাহিনী মূল সৈন্যদের থেকে দূরে থাকবে। তোমার দৃষ্টি সর্বদা সৈন্যদের উপর থাকবে। দুশমন কোথাও হতে বের হয়ে এলে তোমার বাহিনী নিজেদের যোগ্যতানুযায়ী হামলা করবে। গেরিলা ধরনের আক্রমণ তারা করতেই থাকবে। তোমাকে আর বেশি কিছু বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।”

অবশিষ্ট সৈন্যকে তিনি তিনভাগে ভাগ করে ফেলেন। পূর্বের মত ডান এবং বাম বাহিনীর নেতৃত্বে হযরত আছেম বিন আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং হযরত আদী বিন হাতেম রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে রাখেন। তবে এবার তাদের দায়িত্ব ছিল ভিন্ন। শহরের দরজা খোলা থাকায় শহরের অভ্যন্তরে যাওয়া হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর জন্য জরুরী ছিল। হযরত আছেম রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে তার সাথে সাথেই থাকতে হয়। যাতে প্রয়োজনের মুহুর্তে তিনি তাকে সাহায্য করতে পারেন। হযরত আদী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নেতৃত্বাধীন বাহিনীকে কেল্লার চতুর্দিকে ছড়িয়ে রাখতে বলা হয়।

পরিকল্পনা চূড়ান্ত এবং সকলের পজিশন ও দায়িত্ব বণ্টন শেষে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সামনে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দেন।

***

তিনভাগে বিভক্ত বাহিনী একসাথে শহরের নিকট পর্যন্ত গিয়ে এরপরে সবাই পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে যায়। হযরত মুসান্নার জানবায সৈনিকেরা শহরের বাইরের এলাকায় টহল দিয়ে ফিরছিল। পাশেই একটি বন ছিল। কিছু এলাকা ছিল খাঁ খাঁ প্রান্তর। হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু তার বাহিনীকেও কয়েকটি দলে ভাগ করে দিয়েছিলেন। এসব ক্ষুদ্র টিম ঐ সকল স্থান তল্লাশি করে ফেরে যেখানে শত্রুর লুকানোর সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু কোথাও শত্রুর নাম-গন্ধ পাওয়া যায় নি। অতঃপর তারা দূর দূর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।

সৈন্যদের তিনও অংশ শহরের প্রাচীরের নিকট পৌঁছলে সালার হযরত আদী ইবনে হাতেম রাযিয়াল্লাহু আনহু তার বাহিনীকে শহরের চতুর্দিকে উচ্চস্বরে ঘোষণা করান যে, শহরের লোকজন যেন বাইরে বেরিয়ে আসে। “শহরবাসী বেরিয়ে না এলে একটি ঘরও আস্ত রাখা হবে না। সব ধুলিস্মাৎ করে দেয়া হবে।” “অগ্নিপূজারীরা! বাঁচতে চাইলে বেরিয়ে এস।”

“সালারদের বল, তারা যেন কাপুরুষতার পরিচয় না দেয়।”

এভাবে একের পর এক ঘোষণা হতে থাকে। কিন্তু দরজার ওপাশে পূর্ববৎ নীরবতা বিরাজ করতে থাকে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু খাঁপ থেকে তলোয়ার টেনে বের করেন। উচ্চ আওয়াজে বলেন, “আমার পিছনে পিছনে এস।” এরপর তিনি ঘোড়া ছুটিয়ে দেন। যে সমস্ত সৈন্য তাঁর সাথে ছিল তারা বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতের মত শহরের দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ে। সর্বাগ্রে অশ্বারোহী বাহিনী ছিল।

ভেতরে ঢুকেই ঘোড়াগুলো ছড়িয়ে পড়ে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু প্রতিটি ঘরে তল্লাশী চালাতে বলেন। তিনি নিজে একটি উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে যান এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে থাকেন। তিনি সালার হযরত আছেম রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বরাবর এই পয়গাম দিয়ে দূত পাঠান যে, তিনি যেন নিজ বাহিনীকে ভিতরে নিয়ে আসে এবং পদাতিক তীরন্দাজদেরকে শহর প্রতিরক্ষা প্রাচীরে ছড়িয়ে দেন।

মুহূর্তে হযরত আছেম রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর তীরন্দাজ ইউনিট সমস্ত প্রাচীরের উপর ছড়িয়ে যায়। তারা ভিতর-বাহির উভয় দিক খেয়াল রাখছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু প্রাচীরের উপরে ওঠেন এবং শহরের চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করে আসেন। শহরের অভ্যন্তরে নিজের সৈন্য ছাড়া অন্য কেউ তার নজরে আসেনা। বাইরে হযরত আদী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বাহিনী পূর্ণ সতর্কাবস্থায় ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর দৃষ্টি যতদূর যায় শত্রুর কোন নাম-নিশানা তার চোখে পড়ে না। বহু দূরে দু’তিন অশ্বারোহী দল তিনি দেখতে পান। তারা হযরত মুসান্নার বাহিনী ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু উপর থেকে ভেতর বাহির সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে নীচে নেমে আসেন। এ সময় তাকে জানানো হয় যে, এক দুর্বল লোক একটি ঘরের খাটে শুয়ে কাতরাচ্ছে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু দ্রুত সে ঘরে গিয়ে হাজির হন। লোকটি ছিল অত্যন্ত বৃদ্ধ। তার চোখ আধা খোলা ছিল। মুখও খোলা। খাটে পড়ে থাকা লাশ মনে হচ্ছিল। তার আওয়াজ ছিল ফিসফিস। সে কিছু বলছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁর এক দেহরক্ষীকে বৃদ্ধ লোকটির মুখের কাছে কান লাগিয়ে তার কথা শুনতে বলেন।

“যাদের ভয়ে শহর জনশূন্য তোমরা কি তারা?” বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করে।

“আমরা মুসলমান” দেহরক্ষী বলে।

“মদীনার মুসলমান? বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করে এবং জবাবের অপেক্ষা না করেই বলতে থাকে “আমি এখানকার একজন ইহুদী। ধুকে ধুকে মরার জন্য তারা আমাকে এখানে রেখে গেছে। শহরের সবাই চলে গেছে।”

“কোথায় চলে গেছে?” দেহরক্ষীর প্রশ্ন।

“পালিয়ে গেছে” বৃদ্ধ বলে “সালার, সৈন্যরা পালিয়ে গেলে সাধারণ জনতা না পালিয়ে যাবে কোথায়? খালিদ বিন ওলীদ কি তোমাদের সেনাপতি?… এখানকার সবাই তাকে জ্বিন এবং দৈত্য মনে করে।…হ্যাঁ, ঠিকই।… কিসরার শক্তিশালী ফৌজকে যে এভাবে পরাস্ত করতে পারে সে মানুষ হতে পারে না।” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও তাকে বলেন না যে, যাকে তারা জ্বিন বা দৈত্য মনে করে সে তার সামনে দাঁড়ানো। তিনি তথ্য সংগ্রহের পর তাকে দুধ পান করানোর নির্দেশ দেন।

“সৈন্যরা গেল কোথায়?” বৃদ্ধের কাছে জানতে চাওয়া হয়।

“সামনে হীরা নামে একটি শহর আছে” বৃদ্ধ জবাবে বলে “আমাদাবাহ তার শাসক। হয়ত সেই নির্দেশ দেয় যে, লোকজন যেন সব হীরায় চলে আসে।… আমাদের এই শহরের যুবকরা মদীনাবাসীদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়েছিল। অধিকাংশ মারা গিয়েছে। যারা প্রাণ নিয়ে ফিরে এসেছিল তারা সবাই হীরা চলে গিয়েছিল। বৃদ্ধ, নারী এবং শিশুরা ছিল এখানে। এখানকার লোক খালিদ বিন ওলীদের নামে ভয়ে কম্পমান। পলায়নপর যুবকরা এই ভীতি আরো ব্যাপকতর করে। তারা বলত, মুসলমানরা রক্তের নদী বইয়ে দেয়। তারা এদিকেই এগিয়ে আসছে।… এরপর সবাই পালিয়ে যায়। কেউ এখানে থাকার সাহস করেনি। পালিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমি দাঁড়াতেও পারি না। তারা এখানে আমাকে মরার জন্য ফেলে রেখে গেছে।”

এই বৃদ্ধকে উটনীর দুধ পান করিয়ে নিজের অবস্থার উপর তাকে রেখে দেয়া হয়।

প্রায় সকল ঐতিহাসিক এ ব্যাপারে একমত যে, পুরো শহর এভাবে জনশূন্য হয়ে গিয়েছিল যে, গৃহস্থালী আসবাবপত্র এবং মূল্যবান বস্তু-সামগ্রী ঘরেই পড়েছিল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল, ঘরের বাসিন্দারা ক্ষণিকের জন্য সদ্য কোথাও যেন গেছে। মানুষ পালানোর ক্ষেত্রে এত তাড়াহুড়ো করে যে, টাকা-পয়সা এবং সোনা-রূপাও ফেলে যায়।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নির্দেশে সমস্ত সৈন্যকে শহরে ডেকে পাঠানো হয় এবং তাদেরকে গণীমতের মাল সংগ্রহ করার অনুমতি দেয়া হয়। এটা যেহেতু আমীর শ্রেণীর লোকদের অধ্যুষিত শহর ছিল, তাই ঘরে ঘরে মূল্যবান সম্পদ এবং বস্ত্রের সম্ভার ছিল। মুজাহিদরা কিছু কিছু জিনিস দেখে রীতিমত অবাক হচ্ছিল। এ সকল দামী বস্তু তারা স্বদেশে নিয়ে যাবার আগ্রহ ব্যক্ত করতে থাকে।

মাল-সম্পদ জমা করা হলে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু অন্তর্ভেদী দৃষ্টি মেলে তার দিকে চেয়ে থাকেন।

“আগুনে জালিয়ে দাও এসব বস্তু-সামগ্রী” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নির্দেশ দিয়ে বলেন “এগুলো ভোগ-বিলাসের সামগ্রী ও উপকরণ। এ সব সম্পদই মানুষকে কাপুরুষ বানায়। তাদের পরিণতি দেখ। তাদের মহল এবং ঘর-বাড়ী দেখ। খোদার কসম! আল্লাহ যাকে ধ্বংস করতে চান তাকে ভোগ-বিলাসিতায় নিক্ষেপ করেন।…

আমাদেরকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।… এ সকল জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ভস্ম করে দাও। আর স্বর্ণ, হীরা অলঙ্কার, টাকা-পয়সা আলাদা জমা কর।”

আল্লামা তবারী রাহিমাহুল্লাহ বিশেষভাবে লিখেছেন যে, হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এ দিক লক্ষ্য করে মূল্যবান পাত্র, রেশমী কাপড় এবং শাসক শ্রেণীর গৃহস্থালীর আসবাবপত্র জ্বালিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন, যেন এ সকল বস্তুর আকর্ষণ সৈন্যদের মনে প্রভাব ফেলে তাদেরকে যুদ্ধ হতে বিরত না রাখে। তবারী ছাড়াও অন্যান্য ঐতিহাসিকরাও লিখেছেন যে, এই শহর থেকে যে পরিমাণ গণীমতের মাল পাওয়া যায় যা অন্য কোন স্থান থেকে এরপূর্বে অর্জিত হয় নাই। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নিয়মানুযায়ী চার অংশ সৈন্যদের মাঝে বণ্টন করে দেন। আর বাকী এক অংশ মদীনার বাইতুল মালের উদ্দেশে খলীফা হযরত আবুবকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বরাবর পাঠিয়ে দেন।

মুহাম্মাদ হুসাইন হায়কাল বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের সূত্রে লেখেন, মালে গণীমতের যে পঞ্চমাংশ মদীনায় প্রেরণ করা হয় তার নেতৃত্বে ছিল আযাল গোত্রের যানদাল নামক এক ব্যক্তি। ইরানীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত ইতোপূর্বে তিন যুদ্ধে যে সকল ইরানী যুদ্ধবন্দী হয়েছিল মদীনায় প্রেরিত কাফেলায় তারাও ছিল। খলীফা হযরত আবুবকর রাযিয়াল্লাহু আনহু যুদ্ধবন্দীদের মধ্য হতে এক রূপসী বাঁদীকে যান্দালকে পুরস্কার স্বরূপ প্রদান করেন।

আল্লামা তবারী লেখেন, খলীফা মদীনার মুসলমানদেরকে মসজিদে ডেকে তাদেরকে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নেতৃত্বে অর্জিত বিভিন্ন বিজয়ের বিস্তারিত বিবরণ শুনান। তিনি বলেন “হে কুরাইশ জাতি। তোমাদের সিংহ আরেক সিংহের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে কুপোকাত করে ফেলেছে। এখন কোন নারী খালিদের মত সন্তান জন্ম দিতে সক্ষম নয়।”

“জনাব খালিদ!” হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু কে সম্বোধন করে বলেন, “সামনে পারস্য সাম্রাজ্যের আরেকটি বড় শহর হীরা রয়েছে। এ শহরটি পারস্যের সত্যিকার ‘হীরা’ বলা যায়। কিন্তু এটা পদানত করা সহজ হবে না।”

“ঠিকই বলেছ ইবনে হারেছা!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “আমিনিশিয়ার সমস্ত সৈন্য এবং সকল ইহুদী যুবক হীরায় আশ্রয় নিয়েছে। তারা সম্মিলিতভাবে আমাদের মোকাবিলায় নেমে আসবে। আর তাদের আসাটাই স্বাভাবিক।… তা মাদায়েনের কি খবর?”

“আজই আমার এক গুপ্তচর ফিরে এসেছে” হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “তার বর্ণনা কিসরার প্রাসাদে এখনও মাতম চলছে।… সুসংবাদ হলো এখন আর সেখান থেকে কোন বাহিনী আসবে না।”

“এরা কি এখনো অনুধাবন করতে পারেনি যে, সিংহাসন, রাজমুকুট এবং ধনদৌলত এমন শক্তি নয়, যা শত্রুর হাত থেকে পরিত্রাণ দিতে পারে?” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “এটা কি আমাদের দায়িত্ব ও জিম্মাদারী নয় যে, এ সকল লোকের কানে আল্লাহর সত্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই বাণী পৌঁছে দেব যে, শক্তি এবং প্রাচুর্য কেবল আল্লাহর হাতে। ইবাদতের উপযুক্ত একমাত্র আল্লাহই। তাঁর কোন অংশীদার নেই।”

“হ্যাঁ জনাব খালিদ।” হযরত মুসান্না বলেন “আল্লাহর পয়গাম তাদের পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া অবশ্যই আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য।”

“এর সাথে সাথে আমি ঐ সম্ভাবনারও শিকড় উপড়ে ফেলতে চাই, যা ইসলামের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে।” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “কুফরের মূলোৎপাটন আমাকে করতেই হবে।”

ইসলামী ইতিহাসের এই প্রাথমিক যুগটি বড়ই স্পর্শকাতর ছিল। ইসলামের সমরেতিহাসের ঐতিহাসিক ভিত্তি রচনার যুগ ছিল। এটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি উম্মতের প্রগাঢ় ভালবাসা ও তার গভীরতার নজির স্থাপনের সময় ছিল এটি। এ ইতিহাসের ভিত্তি এই অকাট্য নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হবে যে, সংখ্যায় নগণ্য এবং শক্তির স্বল্পতা পরাজয়ের কারণ হতে পারে না। আদর্শিক চেতনা-প্রেরণা আর ইসলামের প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসা এই শূন্যতা পূরণ করতে পারে।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন এবং সূক্ষ্ম দূরদর্শীতার মাধ্যমে অনুধাবন করেন যে, তার সৈন্যদের স্বদেশ তথা মদীনা হতে ক্রমে দূরে সরে পড়া, প্রতিটি যুদ্ধের পর সৈন্যের হ্রাস এবং একের পর এক লড়াইয়ে সৈন্যদের ক্লান্তি সম্পর্কে পূর্ণ অবগত হওয়া সত্ত্বেও তিনি যে তাদের নিয়ে লড়াই অব্যাহত রেখেছেন এটাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য জলন্ত ইতিহাস ও নজির হয়ে রবে। অভিযানের মাঝপথে সমস্যা দেখা দিলে কিংবা লৌহবৎ প্রাচীর সম অন্তরায়ের সম্মুখীন হলে সেনাপতি তার বাহিনীকে ফেরৎ আনবে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এমন দৃষ্টান্ত, ইতিহাস ও নজির সৃষ্টি করতে চান না।

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সপক্ষে খেলাফতের পূর্ণ সমর্থন এবং সার্বিক সহযোগিতা ছিল। তৎকালীন যুগের রাষ্ট্রীয় পলিসিতে কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব কিংবা সমঝোতার কোনই অবকাশ ছিল না। শত্রুকে শত্রু হিসেবেই বিবেচনা করা হত। শত্রু কত দূরে এবং কত শক্তিশালী তা মোটেও বিবেচ্য ছিল না। একমাত্র মৌলনীতি এটাই ছিল যে, দুশমনের ঘাড়ে লাফিয়ে পড় এবং তার জন্য ত্রাস ও আতঙ্ক হয়ে যাও।

পারস্য সাম্রাজ্য কোন যেনতেন শক্তি ছিল না। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এই বিশাল শক্তির পেটে গিয়েও পিছু হটার কল্পনা করেননি। তিনি এটাও বিবেচনায় আনেননি যে, সৈন্যদেরকে একটু বিশ্রামের সুযোগ দিবেন এবং তাদের শৃঙ্খলা ও ধারাবাহিকতায় কোন ত্রুটি দেখা দিলে তা দূর করবেন। হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকে হীরায় মোকাবিলা বড় কঠিন হবে জানালেও হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার চিন্তা মাথায় আনেননি। এবং তৎক্ষণাৎ তিনি সালারদের সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা করতে তাদের ডেকে পাঠান।

“খোদার কসম!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সালারদের বলেন “আমার বিশ্বাস তোমরা এ চিন্তা করছ না যে, আমরা যতই অগ্রসর হচ্ছি আমাদের বিপদ ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

“না জনাব খালিদ!” এক সালার বলেন “আমাদের কেউ এমনটি চিন্তা করছে না।”

“আর আমাদের কেউ এমনটি চিন্তাও করবে না” অপর সালার বলেন।

“আমার এ বিশ্বাস আছে যে” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “তোমাদের কেউ এ চিন্তা করবে না যে, না জানি শত্রু কত শক্তিশালী।”

“না জনাব খালিদ।” সালার হযরত আছেম রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “আপনি খুলে বলুন তো, আজ এমন কথা কেন বলছেন?”

“তোমার উপর আল্লাহর রহমত হোক!” হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন “আমাদের পরবর্তী মঞ্জিল বড়ই দুস্তর। আল্লাহই ভাল জানেন, আমাদের মধ্য হতে কে জীবিত থাকবে আর কে দুনিয়া থেকে চলে যাবে। মনে মনে কল্পনা কর যে, নিজ জিম্মাদারী পালন না করে আল্লাহর সামনে গেলে তোমাদের ঠিকানা বড়ই খারাপ হবে।

তোমরা ভাল করেই জান যে, সেই ঠিকানা কি এবং কেমন দৃষ্টান্ত আজ তোমরা রেখে যাবে তা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য উত্তরাধিকার হিসেবে বিবেচ্য হবে। আর এই দৃষ্টান্ত ইসলামের অস্তিত্ব সুরক্ষা কিংবা ধ্বংসের কারণ হবে। ইসলামের স্থায়িত্ব এবং তাকে চিরসমুন্নত রাখতে আমাদের লড়তে হবে। কুরআনের নির্দেশ স্মরণ কর, কুফরী ফিৎনা জগতে বিদ্যমান থাকা নাগাদ তোমরা অবিরত লড়তে থাক। আর শত্রু যখন অস্ত্র সমর্পণ করে তোমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে তখন তাদের ক্ষমা করবে। অতঃপর তাদেরকে এমন কঠিন শর্ত পালনে বাধ্য কর, যাতে সে আর ছোবল দিতে না পারে এবং তার অন্তর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রেমিকদের ভয়ে কাঁপতে থাকে। সালারদের প্রেরণা নতুনভাবে চাঙ্গা করে হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তাদের বলেন যে, সামনে ইরানীদের একটি বড় সামরিক ঘাটি রয়েছে। এর নাম হীরা। এখানকার শাসক আযাদাবাহ প্রচুর সৈন্য সমবেত করে রেখেছে। ইরানীরা প্রথম যুদ্ধে অসংখ্য নৌযান নিয়ে এসেছিল। সেগুলো বর্তমানে মুসলমানদের অধিকারে আছে। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এ সকল নৌযানে করে মুজাহিদদেরকে হীরায় নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। পানিপথ তুলনামূলক সহজ, নিরাপদ ও নিকটবর্তী ছিল। এটাই ছিল সর্বপ্রথম যুদ্ধ যে যুদ্ধে মরুভূমির সিংহরা দরিয়ার পিঠে সওয়ার হয়।

নৌযানে আরোহিত সৈন্যদের হেফাজতের জন্য হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেন যে, নদীর উভয় তীর ধরে একশ থেকে দেড়শ অশ্বারোহীর ব্যবস্থা রাখেন। তারা গার্ড দিয়ে নৌচারীদের নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দিবে। বিজয়ে উন্মাদ সৈন্যরা উজ্জীবিত প্রেরণা এবং ইসলামের ভালবাসার টানে ফোরাত নদীর বুকে চেপে চলছিল। রণসঙ্গীতের প্রতিধ্বনি ছিল যা ফোরাতের লহরের তালে তালে ভাব-বিহলতা সৃষ্টি করছিল। পরে এই সঙ্গীত কালেমা তৈয়্যেবায় বদলে যায়। ১৮ হাজার মুসলমানদের এক আওয়াজ, এক অভিলাষ এবং একই প্রেরণা ছিল। তাদের অন্তরে এক আল্লাহ এবং এক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভালবাসা আর প্রেম ছিল।

শত্রু ঘুমিয়ে ছিল না। হীরার শাসনকর্তা আযাদাবাহ রাতেও নিদ্রা যেত না। সম্রাট উরদূশেরের মৃত্যুর খবর হীরায় জানানো হয় না। সে এখনও প্রতিটি কথা এবং প্রতিটি নির্দেশ দিতে গিয়ে উরদূশেরের নাম উচ্চারণ করত।

একদিন আযাদাবাহ শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিল। সে শহরের হাজার হাজার সৈন্য সমবেত করেছিল। সে ঘুরতে ঘুরতে যে দলের সামনে যেত তাদেরকে জোরে জোরে বলত “যরথুস্ত্রের কৃপা হোক তোমাদের প্রতি! যারা কাজিমা, মাজার এবং উলাইয়িসে মরু বুদ্দুদের হাতে পরাস্ত হয়েছে তারা কাপুরুষ ছিল। তাদের মৃত দেহ যরথুস্ত্রের অগ্নিশিখা চাটছে।… হে ঈসা-মসীহের অনুসারীরা। তোমারা আমাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়তে এসেছ। স্মরণ কর, তোমাদের ঐ কন্যাদের কথা যারা বাঁদী হয়ে মদীনায় পৌঁছে গেছে। স্মরণ কর ঐ যুবক পুত্রদের, যাদের মরদেহের গোশত নেকড়ে, শিয়াল এবং চিল-শকুন খেয়ে উদরপূর্তি করেছে। যারা বন্দী হয়ে মদীনাবাসীর গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ হয়েছে। তাদের কথাও আজ বিশেষভাবে স্মরণ কর।… মুসলমানরা বিজয়ের নেশায় নির্ভীকভাবে এগিয়ে আসছে। তাদের জন্য এমন ভয়ঙ্কর বিপদে পরিণত হও। যেন তারা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে না পারে। মহান সম্রাট উরদূশের নিজেই তোমাদের মোবারকবাদ দিতে আসবেন। তিনি তোমাদেরকে পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত করবেন।

শহর প্রতিরক্ষা প্রাচীর ও তার শৃঙ্গ পরিদর্শনের এক পর্যায়ে সে দূর থেকে এক অশ্বারোহীকে বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে আসতে দেখে। দরজা খুলে দাও” আযাদাবাহ চিৎকার করে বলে “এই অশ্বারোহী আমিনিশিয়ার দিক থেকে আসছে।” একসাথে একাধিক আওয়াজ ওঠে “দরজা খুলে দাও, অশ্বারোহীকে ভেতরে আসতে দাও।” আযাদাবাহ অত্যন্ত দ্রুত প্রাচীর থেকে নেমে আসে। অশ্বারোহী পৌঁছার পূর্বেই নগরদ্বার খুলে দেয়া হয়। অশ্বারোহী গতি শ্লথ না করেই ভেতরে প্রবেশ করে। আযাদাবাহ ঘোড়ার পিঠে ছিল। সে ঘোড়া ছুটিয়ে দেয় এবং আগত অশ্বারোহীর দিকে এগিয়ে যায়। উভয় ঘোড়া পাশাপাশি এসে থেমে যায়।

“কোন খবর আছে?” আযাদাবাহ উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে।

“তারা আসছে” অশ্বারোহী হাঁফাতে হাঁফাতে বলে “সমস্ত সৈন্য নৌযানে চড়ে আসছে।”

অশ্বারোহী হযরত খালিদ বাহিনীর আগমনের খবর দিচ্ছিল।

“নৌযানে?” আযাদাবাহ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে “বাঁধ থেকে কত দূরে?”

“অনেক দূরে অশ্বারোহী জানায় “এখন পর্যন্ত অনেক দূরে আছে তারা।” আযাদাবাহর ছেলে সালার ছিল। সে ছেলেকে ডেকে পাঠায়। ছেলের নাম ইতিহাসে পাওয়া যায় না। “আযাদাবাহর ছেলে বলে ইতিহাসে তার উল্লেখ পাওয়া যায়।

“আজ তোমার পরীক্ষার দিন প্রিয় বৎস!” আযাদাবাহ ছেলেকে বলে “এক অশ্বারোহী বাহিনী সাথে নিয়ে তুফানের চেয়েও দ্রুত গতিতে বাঁধ পর্যন্ত পৌঁছে যাও এবং সেখানে গিয়ে ফোরাতের পানি এমনভাবে চুষে নিবে যাতে ফোরাত শুকিয়ে যায়। মুসলিম বাহিনী নৌযানে করে আসছে। দেখব তুমি সেখানে প্রথমে পৌঁছাও নাকি মুসলমানরা!”

তার ছেলে এক অশ্বারোহী ইউনিট নিয়ে ঝড়ের বেগে শহর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

***

হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বাহিনী বেশ দ্রুত গতিতেই আসছিল। বর্ষার মৌসুম না হওয়ায় নদীতে পানি তুলনামূলক কমই ছিল। তবে নৌযান চলার জন্য যথেষ্ট ছিল। আকস্মিক পানি কমতে শুরু করে। পানি কমতে কমতে এক সময় পূর্ণ শুকিয়ে যায় এবং সকল নৌযান কাদায় আটকে যায়। মদীনার মুজাহিদরা এতে শংকিত হয়ে পড়ে। চোখের সামনে এভাবে হঠাৎ করে নদী শুকিয়ে যাওয়া উদ্বেগজনক ব্যাপারই ছিল। হযরত খালিদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজেও চরম দুশ্চিন্তায় পড়েন।

“মোটেও ঘাবড়াবেন না জনাব খালিদ!” কূল থেকে হযরত মুসান্না রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর আওয়াজ শোনা যায়। “মদীনাবাসী তোমরাও ভীত হয়ো না। নদীর অদূরে একটি বাঁধ আছে। আমাদের শত্রুরা বাঁধের সাহায্যে পানি আটকে রেখেছে।”

খুবই দ্রুত গতিতে নৌযানের আরোহীরা নৌযান থেকে ঘোড়া বের করে এবং একটি অশ্বারোহী দল জলদি বাঁধ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে। আযাদাবাহর ছেলে তখনও তার বাহিনীর সাথে সেখানে ছিল। মুসলিম অশ্বারোহী দল তাদের উপর একযোগে চড়াও হয় এবং একজনকেও জিন্দা রাখে না।

শত্রু নিধন শেষে মুসলমানরা পানির বাঁধ খুলে দেয়।

নৌযান পর্যন্ত পানি পৌঁছে গেলে নৌযানগুলো কাদামুক্ত হতে থাকে। মাঝি মাল্লারা হাল নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। নৌযান ভাসতে এবং সাতরাতে থাকে।

আযাদাবাহ সুসংবাদের অপেক্ষায় প্রাচীরে দাঁড়িয়ে অস্থির হয়ে উঠছিল। তার এক সালার মাথা নীচু করে নিকটে এসে দাঁড়ায়।

“বড়ই দুঃসংবাদ এসেছে” সালার বলে।

“কোথা হতে” আযাদাবাহ হতচকিয়ে প্রশ্ন করে “তবে কি আমার পুত্র…।”

“মাদায়েন থেকে” সালার তার কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে “সম্রাট উরদূশের মারা গেছে। তবে এই খবর গোপন রাখতে হবে। সৈন্যদের জানানো যাবে না।”

ইতোমধ্যে এক অশ্বারোহী তাদের নিকটে আসে এবং ঘোড়া হতে নেমে নিয়মতান্ত্রিক শিষ্টাচার পর্ব শেষ করে।

‘কর্তব্য না হলে আনীত সংবাদ মুখে উচ্চারণ করতাম না” আগন্তুক আরোহী বলে।

“আমি তা শুনেছি” আযাদাবাহ বলে “কিসরা উরদূশের…।”

“না” অশ্বারোহী বলে “আমি এ খবর আনিনি। আমি যে মর্মান্তিক খবর এনেছি তা হলো, আপনার পুত্র বাঁধের ওখানে নিহত হয়েছে। তার সহযাত্রী সকল অশ্বারোহী মুসলমানদের হাতে নির্মমভাবে মারা গেছে।”

“আমার পুত্র!” আযাদাবাহর কম্পিত ঠোঁট থেকে এ শব্দ বের হয় এবং তার চেহারা লাশের মত ফ্যাকাশে হয়ে যায়।

───────

অন্তত একবার পড়ুন

ইতিহাস মুক। সমর বিশেষজ্ঞগণ বিস্মিত। সকলের অবাক জিজ্ঞাসা– ইয়ারমুকের যুদ্ধে মুসলমানরা রোমীয়দের কিভাবে পরাজিত করল? রোমীয়দের সেদিন চূড়ান্ত পরাজয় ঘটেছিল। এ অবিশ্বাস্য ঘটনার পর বাইতুল মুকাদ্দাস পাকা ফলের মত মুসলমানদের ঝুলিতে এসে পড়েছিল।

এটা ছিল অভূতপূর্ব সমর কুশলতার ফল। ইয়ারমুক যুদ্ধে হযরত খালিদ বিন ওলীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু যে সফল রণ-কৌশল অবলম্বণ করেছিলেন আজকের উন্নত রাষ্ট্রের সেনা প্রশিক্ষণে গুরুত্বের সাথে তা ট্রেনিং দেয়া হয়।

ইসলামের ইতিহাস অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির সম্মুখীন হয়েছে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক এবং জীবনীকার কোন কোন ঘটনায় পদস্খলনের শিকার হয়েছেন। একই ঘটনা একাধিকরূপে চিত্রিত হয়েছে। ফলে তা হতে সত্য ও বাস্তব তথ্য আহরণ পাঠকের জন্য গলদঘর্মের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।…

এ উপন্যাসের প্রত্যেকটি ঘটনা সত্য-সঠিকরূপে পেশ করতে আমরা বহু গ্রন্থের সাহায্য নিয়েছি। সম্ভাব্য যাচাই-বাছাই করেছি এবং অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তা লিখেছি।

যে ধাঁচে এ বীরত্ব-গাঁথা রচিত, তার আলোকে এটাকে কেউ উপন্যাস বললে বলতে পারে, কিন্তু এটা ফিল্মি স্টাইল এবং মনগড়া কাহিনী ভরপুর বাজারের অন্যান্য ঐতিহাসিক উপন্যাসের মত নয়। এর পাঠক উপন্যাসের চাটনিতে ‘ঐতিহাসিকতার পথ্য’ গলধঃকরণ করবেন গোগ্রাসে। এতে ঐতিহাসিকতা বেশী, ঔপন্যাসিকতা কম।

এটা কেবল ইতিহাস নয়, ইসলামী ঐতিহ্যের অবয়ব। মুসলমানদের ঈমানদীপ্ত ঝাণ্ডা। পূর্বপুরুষের গৌরব-গাঁথা এবং মুসলিম জাতির জিহাদী জযবার প্রকৃত চিত্র। পাঠক মুসলিম জাতির স্বকীয়তা জানবেন, সাহিত্যরস উপভোগ করবেন এবং রোমাঞ্চ অনুভব করবেন।

বাজারের প্রচলিত চরিত্রবিধ্বংসী উপন্যাসের পরিবর্তে সত্যনির্ভর এবং ইসলামী ঐতিহ্যজাত উপন্যাস পড়ুন। পরিবারের অপর সদস্যদের পড়তে দিন। নিকটজনদের হাতে হাতে তুলে দিন মুসলিম জাতির এ গৌরবময় উপাখ্যান।

এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ
লাহোর, পাকিস্তান

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *