০৬. করোনার আদালত

০৬.

তিনদিন পর বসল করোনার আদালত, দর্শকদের যথেষ্ট ভিড়ও হয়েছে। মহিলারা গালগল্পে মত্ত।

মিসেস সিমিংটনের মৃত্যুর সময়টা ধরে নেওয়া হল বেলা তিনটে থেকে চারটের মধ্যে। তখন বাড়িতে তিনি ছিলেন একা। সিমিংটনের অফিসের পরিচারিকারা ছুটির দিন বলে বাইরে, এলসি হল্যান্ড বাচ্চাদুটোকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিল, মেগান সাইকেলে চলে ঘুরতে যায়।

বিকেলের ডাকে চিঠিটা পেয়ে মিসেস সিমিংটন উত্তেজিতভাবে বাগানের চালাঘরে গিয়ে বোলতার বাসা নষ্ট করার পটাশিয়াম সায়ানাইড বিষ জলে গুলে খেয়ে ফেলেন। বিষ খাবার আগে শেষ বিক্ষুব্ধ কথাগুলো লিখে যান : আমি আর পারছি না।

আওয়েন গ্রিফিথ মিসেস সিমিংটনের ক্ষীণ স্নায়বিক সহ্যশক্তির ডাক্তারি সাক্ষ্য দিলেন। ভদ্র ও বিবেচক করোনার তীব্র ভাষায় বেনামী, শয়তানীভরা চিঠির লেখকের নিন্দা করে বলেন, ঐ চিঠিই এই খুনের জন্য নৈতিকভাবে দায়ী। তিনি আশা করেন পুলিশ অপরাধীকে খুঁজে বের করবে এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। জুরিরা রায় দিলেন, সাময়িক অপ্রকৃতিস্থতার মধ্যে আত্মহত্যা।

গ্রাম্য মহিলাদের ভিড় থেকে সেই একটা কথাই ফিসফিসানির সুরে শোনা গেল–আগুন না থাকলে ধোঁয়া হয় না।

.

এর পরের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হল পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট ন্যাসের আগমনের আগে স্থানীয় বাসিন্দারা আমরা সঙ্গে দেখা করে গেছে।

করোনার আদলতের পরদিন সকালে মিস গ্রিফিথ এসে হাজির।

সুপ্রভাত, শুনলাম মেগান হান্টারকে আপনারা এখানে এনেছেন?

–হ্যাঁ, এনেছি।

সে কথায় কথায় আমার কাছে প্রস্তাব রাখে যে, মেগানকে সে তার কাছে নিয়ে গিয়ে বাড়ির কাজকর্মে পোক্ত করে তুলবে। কিন্তু আমি তার প্রস্তাবে রাজী হইনি।

মিস গ্রিফিথ বলল, মিসেস সিমিংটন সম্বন্ধে কোনো কালেও আমার উঁচু ধারণা ছিল না, যদিও অবশ্য কখনো সন্দেহ করিনি আসল ব্যাপারটা।

ধারালো গলায় জিজ্ঞেস করি, আসল ব্যাপার মানে?

মিস গ্রিফিথ বলে, এসব ব্যাপারে যে অমনিভাবে বেরিয়ে আসবে আদালতের মধ্যে। সিমিংটনের জন্যে ভীষণ দুঃখ হয় আমার।

–কিন্তু ওঁকে তো বলতে শুনেছেন? ঐ চিঠির মধ্যে একবিন্দুও সত্য ছিল না–এ সম্পর্কে উনি সুনিশ্চিত?

–স্ত্রীর সপক্ষে যে, কোনো পুরুষকেই দাঁড়াতে হয়। তাই অমন কথা বলেছেন। আমি ডিক সিমিংটনকে বহুকাল ধরেই চিনি। উনি প্রায়ই এসে থাকতেন আমাদের আগের উত্তরে এলাকার দেশে। আমি ডিককে ভালোমতোই চিনি। খুব অহংকারী, চাপা স্বভাবের মানুষ।

ইচ্ছা করেই বলি, তাতেই তো বোঝা যায় মিসেস সিমিংটন কেন তাকে চিঠিটা দেখাতে বা ওটার কথা বলতে ভয় পান? তিনি শঙ্কিত ছিলেন অস্বীকার করলেও হয়তো তার স্বামী বিশ্বাস করবেন না।

-হে ভগবান, আপনি কি তাহলে ভাবেন একটা মিথ্যা অভিযোগের স্বীকার হয়ে মহিলা একগাদা পটাশিয়াম সায়ানাইড গিলে বসবে?

করোনার এবং আপনার ভাইও সেটাই ভেবেছেন।

-পুরুষরা সব সমান। কিন্তু আপনি আমাকে ওসব আষাঢ়ে গল্প বিশ্বাস করাতে পারবেন না। কোনো নির্দোষ মহিলা বেনামী চিঠি হেসেই ছুঁড়ে ফেলে দেবে। আমিও তাই…বলে থেমে গিয়ে আবার বলল, করতাম।

আমি কিন্তু ওর কথার ছেদটা লক্ষ্য করলাম। আমি প্রায় নিশ্চিত যে সে আসলে আমিও তাই করেছি-বলতে গিয়েও থেমে গেল।

শত্রুর শিবিরেই লড়াইটা নিয়ে যেতে চাই আমি। মিঠে সুরে বলি, তাহলে আপনিও একখানা চিঠি পেয়েছেন?

এক মিনিট সবুর করে মুখ রাঙা করে বলল, হ্যাঁ পেয়েছিলাম। কয়েকটা শব্দ পড়েই বুঝলাম পাগলের প্রলাপ। সঙ্গে সঙ্গে সিধে ছুঁড়ে দিলাম বাজে কাগজের ঝুড়িতে। এসব নিয়ে যত কম কথা বলা যায়, তত শীঘ্রই মিটে যায়।

আমি মিস গ্রিফিথকে জিজ্ঞেস করলাম, মেগানের টাকাকড়ির বিষয়ে কিছু ধারণা আছে আপনার? এ বিষয়ে আমার অহেতুক কোনো কৌতূহল নেই। কিন্তু ভাবছিলাম, ওর নিজের উপার্জন করার দরকার আছে কিনা।

–মনে হয় না সেটার খুব জরুরী প্রয়োজন আছে। ওর ঠাকুমা সামান্য কিছু আয়ের টাকা রেখে গিয়েছিলেন বলে আমার মনে হয়। ডিক সিমিংটন ওর খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন ঠিকই, কিন্তু কথা সেটা নয়, কথা হল নীতির।

–কি নীতি?

-কাজ, মিঃ বার্টন, কাজ। কাজের মতো কিছুই নেই। সে পুরুষই হোক বা মেয়েরা। অলসতাই একমাত্র ক্ষমতার অযোগ্য পাপ।

-দেখুন স্যার এডোয়ার্ড গ্রে-কে তাঁর দুরারোগ্য আলসেমির জন্যে অক্সফোর্ড থেকে তাড়ানো হয়েছিল, পরে তিনি আমাদের বিদেশমন্ত্রী হন। আর মিস গ্রিফিথ কখনো ভেবে দেখেছেন, জর্জ স্টিফেনসন যদি বিরক্ত হয়ে বয়স্কাউট ছেড়ে রান্নাঘরে বসে কেটলির ওপর ঢাকনাটার অদ্ভুত নাচ না দেখতেন, তবে কি আজ কোনো ভালো এক্সপ্রেস ট্রেন আপনি দেখতে পেতেন?

এইমি একথা শুনে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল।

আমি বলে চললাম, আমার থিওরি বলে, যত বড় আবিষ্কার তার মূলে আছে অলসতা–স্বেচ্ছায় হোক বা বাধ্যতা বশেই হোক। মানুষে চিন্তা অন্যের চিন্তা ধার করেই পুষ্ট হবে, কিন্তু সে পুষ্টির অভাব ঘটলে তখন দায়ে পড়ে নিজে থেকে ভাবতে শুরু করে। আর তখনই সৃষ্টি হয় মৌলিক, অমূল্য ফল!

–মিঃ বার্টন, আপনার মনোভাব হল বেশির ভাগ পুরুষের মার্কামারা মনোভাব। আপনি চান, মেয়েরা কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে পুরুষদের প্রতিদ্বন্দ্বী হোক। আমার ডাক্তারি পড়ার খুব ইচ্ছে ছিল, কিন্তু আমার বাবা-মা ফি জমা দেবার কথা কানেই নিলেন না। কিন্তু ভাইয়ের বেলায় সঙ্গে সঙ্গেই ফি-এর টাকা জুটে গেল। হয়তো আমি ওর চেয়ে ভালো ডাক্তার হতে পারতাম।

–শুনে দুঃখ পেলাম মিস গ্রিফিথ।

-ওসব আমি এখন আর মনে রাখিনি! আমার প্রচুর ইচ্ছাশক্তির দ্বারা আমি সর্বদাই কাজ নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখি। আমি একজন সুখী মানুষ। মেয়েদের কাজ করার বিভিন্ন প্রাঙ্গণ আছে। মেয়েদের স্থান সবসময় রান্নাঘরে, এই সাবেকি ধারণাকে আমি মনে-প্রাণে ঘেন্না করি।

-আমি যদি আপনাকে কোনো আঘাত দিয়ে থাকি, তাহলে দুঃখিত। আসলে আমি বলতে চেয়েছি, মেগানকে ঘরোয়া কাজের ভূমিকায় দেখতে আমি একেবারেই চাই না।

-না, বেচারী মেয়েটার কোনো কাজের পক্ষেই যোগ্যতা নেই। ওর বাপটি বুঝলেন..বলে থেমে গেল এইমি।

আমি ভোতা গলায় জবাব দিলাম, ঠিক বুঝলাম না। প্রত্যেকেই দেখি ওর বাপটি-বলে থেমে যায়। কী করেছিলেন ভদ্রলোক? বেঁচে আছেন?

–ঠিক জানি না। তবে খুবই খারাপ লোক ছিলো নিশ্চয়ই। আমার বিশ্বাস, জেল খাটা এবং মাথার গণ্ডগোলও ভালোরকম ছিল। মেগানের মধ্যেও তার প্রভাব রয়েছে।

নিজের বোধজ্ঞানের ওপর ওর যথেষ্ট দখল আছে। আমি ওকে বুদ্ধিমতী মেয়েই মনে করি। জোয়ানারও ওকে পছন্দ।

–আমরা সকলেই ভেবে আবাক হই, কী করে এই অজপাড়াগাঁয়ে আপনারা ডুব মেরে রয়েছেন?

–ডাক্তারের হুকুম। শান্ত পরিবেশই আমার একমাত্র দাওয়াই। এখন দেখছি লিমস্টকের ক্ষেত্রে অবশ্য সে কথা ততটা খাটে না।

-না না, তা বটে। এইমি উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শোনাল, বুঝলেন…এসব কাণ্ডকারখানা যেমন করেই হোক বন্ধ করতে হবে।

-পুলিশ কি কিছু করছে না?

-সেরকমই তো ধারণা হয়। কিন্তু আমার মনে হয় ব্যাপারটা নিজেদের হাতেই তুলে নিতে হবে। আমাদের বোধহয় ওদের চেয়েও বেশি কাণ্ডজ্ঞান আর বুদ্ধি আছে! যেটা দরকার, সেটা হলো স্থির সংকল্প।

হঠাৎই বিদায় নিল এইমি।

.

সেদিন বিকেলে শহরে সিমিংটনের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম।

তাকে জানালাম, আর কটা দিন মেগান আমাদের সঙ্গে থাকলে আপনার আপত্তি নেই তো?

-ওঃ…ইয়ে…মেগান? ও হা হা, ভালোই বলেছেন আপনি।

সেইসময় থেকে সিমিংটনের ওপর আমার বিতৃষ্ণা ধরে গেল। এত সহজে নিশ্চিন্তে উনি মেগানকে মন থেকে বিদায় দিয়েছেন? উনি সরাসরি ঘৃণা করতে পারতেন মেগানকে কিন্তু নিজের সৎ মেয়ের প্রতি তার ঘোর উদাসীনতা আমায় বিরক্ত করল।

বললাম, ওর সম্পর্কে ভেবে রেখেছেন কিছু?

-মেগানের ব্যাপারে? যেন চমকে উঠলেন, সে তো মানে আগের মতোই আমার বাড়িতে থাকবে।

আমি একথা শোনার পর ওখানে আর বসতে পারিনি।

.

সেদিন সবে চায়ের টেবিলটা সাফ হতেই এলেন এমিলি বারটন। দুজনে প্রায় আধঘণ্টা কথা হোল। তারপর দুজনে বাড়ির দিকে এগোলাম।

হঠাৎই গলার আওয়াজ খাটো করে বললেন, আশা করি মেয়েটা…তেমন হয়তো মুষড়ে পড়েনি, এইসব ভয়ানক কাণ্ডের পর?

-আপনি ওর মায়ের মৃত্যুর কথা বলছেন?

–হ্যাঁ, সে তো বটেই। ব্যাপারটার পেছনে কোনো অপ্রীতিকর…

 মিস বারটনের মনের প্রতিক্রিয়াটা জানার জন্যে আমি উৎসুক হয়ে উঠি।

প্রশ্ন করি, আপনার কি মনে হয়? সত্যি সেরকম কিছু?

-না, না, না–নিশ্চয়ই নয়। আমার দৃঢ় ধারণা মিসেস সিমিংটন কখনোই…মানে ছেলেটা তা নয়। যদিও বলা চলে এ এক ধরনের বিচার।

–বিচার? অবাক চোখে তাকাই তার দিকে।

–এইসব ভয়ানক চিঠি আর তার ফলে এই দুঃখ-যাতনা যেন বিশেষ উদ্দেশ্য করেই পাঠানো–আমি ভেবে পাই না।

–উদ্দেশ্য করে পাঠানো তো বটেই–গম্ভীরভাবে বলি।

-না, না, মিঃ বার্টন, আপনি কথাটা ধরতেই পারলেন না। বলছি এসবের পেছনে রয়েছে বিধাতার হাত।

–সর্বশক্তিমান ঈশ্বর আরেকটু সুপাচ্য দাওয়াই ব্যবহার করতে পারতেন নিশ্চয়ই?

মিস এমিলি নিচু গলায় বললেন, ঈশ্বরের পন্থা রহস্যময়।

-না, আমি জোর দিয়ে বললাম, মানুষ নিজের ইচ্ছায় যেসব দুষ্কর্ম করে, তার জন্যে ঈশ্বরকে দায়ী করে। আমি মনে করি এরজন্যে শয়তানকে দায়ী করা উচিত।

–আমি এটা বুঝি না, কেন এমনতরো ইচ্ছে একজনের জাগবে?

–বিকৃত মানসিকতা, আমি বলি।

–বড়োই করুণ মনে হয়।

–আমার করুণ মনে হয় না, আমি এদের অভিশাপ দিই।

–কিন্তু মিঃ বার্টন কেন? এ থেকে কী মজা পেতে পারে একজন?

 –ঈশ্বরকে ধন্যবাদ এ আপনার আর আমার বোঝার বাইরে।

গলার স্বর নিচু করে বললেন এমিলি, ওরা সবাই মিসেস ফ্লীটের কথা বলে, আমার তো বিশ্বাসই হয় না। এধরনের ঘটনা আমার জ্ঞানতঃ কখনো ঘটেনি। এমন চমৎকার একটা সমাজ ছিল এখানে। আমার মা বেঁচে থাকলে কী বলতেন? ঈশ্বরের মহিমা যে তিনি রেহাই পেয়ে গেছেন।

মনে মনে ভাবি, বুড়ি বারটনের সম্বন্ধে যা শুনেছি, তাতে মনে হয় এই উত্তেজক পরিস্থিতি তিনি যথেষ্ট তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতেন।

এমিলি বলে চলেছেন, আমি তো ভীষণ কাতর হয়ে পড়ি।

 আমি সাহসভরে জিজ্ঞাসা করে ফেলি, আপনি..মানে…নিজে এ ধরনের কিছু পাননি?

 উনি লাল হয়ে গেলেন, না, না, না, উঃ, সে তো ভয়ানক কথা হত।

আমি তাড়াতাড়ি ক্ষমা প্রার্থনা করলাম। তিনি বেশ বিচলিত মুখেই প্রস্থান করলেন।

–আমি বাড়ির ভেতরে এলাম। জোয়ান ড্রয়িংরুমে চুল্লিতে সবে আগুনটা দিয়ে দাঁড়িয়েছে।

ওর হাতে একটা খোলা চিঠি।

আমি ঢুকতেই জোয়ানা বলল, জেরি। চিঠির বাক্সে এটা পেলাম। কেউ হাতে দিয়ে গেছে। শুরুর সম্বোধনে বলা হয়েছে, ওহে রং মাখা ঘর-মজানি…।

-আর কি লিখেছে?

–ঐ একই আবর্জনা-বলে ও চিঠিটা আগুনের দিকে ছুঁড়ে দিল।

আমি চট করে আগুন ধরার আগেই চিঠিটা তুলে নিলাম।

বললাম, এটা দরকার হতে পারে পুলিশের জন্যে।

পরদিন সকালে আমার কাছে এলেন পুলিশের সুপারিটেন্ডেন্ট ন্যাস। লম্বা, সৈনিকসুলভ, শান্ত চিন্তামগ্ন চোখদুটো–যাকে বলে সেরা জগতের সি. আই. ডি. জেলা সুপার।

সুপ্রভাত মিঃ বার্টন। নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন আমি কী ব্যাপারে আপনার কাছে এসেছি।

-হ্যাঁ, ঐ চিঠির ব্যাপার তো!

তিনি মাথা ঝাঁকালেন। শুনলাম আপনিও একখানা চিঠি পেয়েছিলেন, চিঠির কথাগুলো আপনার মনে আছে?

একমিনিট ভেবে চিঠির কথাগুলো যথাসম্ভব মনে করে সাজিয়ে বললাম।

-বুঝলাম, ন্যাস বললেন, চিঠিটা রাখেননি মিঃ বার্টন?

-না, ভেবেছিলাম নতুন এসেছি বলে কেউ বিদ্বেষ বশে একাজ করেছে, নেহাৎই বিচ্ছিন্ন একটা ব্যাপার তবে আমার বোন গতকাল একটা চিঠি পেয়েছিল, সেটা আছে।

আমি দেরাজের তালা খুলে ন্যাসকে চিঠিটা দিলাম। ন্যাস পুরোটা পড়ে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি আগের খামের মতোই? 

-যতটা স্মরণ করতে পারি, তাই মনে হয়।

 চিঠির বয়ানে আর খামের ওপর একটা রকম তারতম্য?

-হ্যাঁ, খামটা ছিল টাইপ করা, আর চিঠিটা শুধু একটা কাগজের ওপর সাঁটা ছাপা অক্ষর।

 ন্যাস চিঠিখানা পকেটে পুরে বললেন, মিঃ বার্টন, আপনাকে একটু আমার সঙ্গে থানায় আসতে হবে। কিছু শলা-পরামর্শের ফলে আমরা সময়ের অপব্যয় বাঁচাতে পারবো।

গাড়িতে উঠলাম। ন্যাস জানালেন যে, ব্যাপারটার গোড়া অবধি পৌঁছবেন বলে তাদের আশা। তার জন্যে ডাকঘরের ওপর নজর, টাইপরাইটার পরীক্ষা, আঙুলের ছাপ এগুলো তদন্ত করে দেখতে হবে।

পুলিশ থানায় পৌঁছে দেখি সিমিংটন আর গ্রিফিথ আগেই সেখানে হাজির। একজন দীর্ঘকায়, চৌকোমুখো সাধারণ পোশাকের ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল ইনসপেক্টর গ্রেভস। ইনি লন্ডন থেকে এসেছেন। বেনামী চিঠিপত্রের ব্যাপারে উনি একজন বিশেষজ্ঞ।

-এই কেসগুলো সবই এক ধরনের, গম্ভীর গলায় বললেন গ্রেভস, শুনলে অবাক হবেন না, শব্দ চয়ন আর বক্তব্য প্রায় বহুবহু একরকম।

গ্রেভস কয়েকটা চিঠি টেবিলে ছড়িয়ে দেখছিলেন। তিনি জানালেন, কাজ শুরু করার মতো অনেকগুলো চিঠি আমাদের হাতে এসেছে। ভদ্রমহোদয়গণ; আমি অনুরোধ করব, চিঠি যদি আরো কেউ পান সঙ্গে সঙ্গে এখানে নিয়ে আসবেন। যদি অন্য কেউ চিঠি পেয়েছে বলে জানতে পারেন, তাহলে চেষ্টা করবেন তাদের এখানে আনতে। আমার হাতে এখন মিঃ সিমিংটনকে লেখা চিঠি, মিস গিঞ্চকে পাঠানো, মিসেস মাজকে, আরেকটা থ্রি-কাউন্স-এর বার-পরিচারিকা জেনিফার ক্লার্কের নামে। এছাড়া মিসেস সিমিংটন এবং মিঃ বাৰ্টনের চিঠিও আছে। এর মধ্যে একটিও নেই যার জুড়ি আমার পুরনো কেসগুলোর মধ্যে পাইনি। সেই একঘেয়ে বাঁধা বুলি…।

সিমিংটন বললেন, লেখক কে হতে পারে সে সম্বন্ধে কোনো নির্দিষ্ট মতে পৌঁছতে পেরেছেন?

গলা খাঁকারি দিয়ে সাফ করে গ্রেভস ছোটোখাটো একটা বক্তৃতা শুরু করলেন : কতকগুলো নির্দিষ্ট মিল সব চিঠিগুলোতেই আছে। যেমন–একটা ছাপা বইয়ের পাতা কেটে কেটে অক্ষর সাজানো হয়েছে। পুরানো বই, আমার হিসেবে ১৮৩০ সালের কাছাকাছি ছাপা। পত্ৰলেখক তার হাতের লেখা লুকোবার জন্যেই এই পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। হাতের ছাপ লুকোবার জন্যে সে গ্লাভস ব্যবহার করেছে। এছাড়া চিঠি বা খামগুলোর ওপর ডাক বিভাগের লোকেরা নাড়াচাড়া করার পরও আবার প্রকল্পের এবং আরো অনেকের এলোমেলো আঙুলের ছাপ, কিন্তু সবগুলোতে বিশেষ একটা সাধারণ ছাপ-এর অভাব। খামগুলো টাইপ করা হয়েছে ৭ নম্বর উইগুসর মেশিনে, যা যথেষ্ট ব্যবহৃত এবং পুরানো। ওতে এ আর টি আবার দুটো বেঁকে গেছে। বেশির ভাগ চিঠিই স্থানীয় ডাকে বা হাতে গুঁজে দেওয়া হয়েছে। ব্যাপারটার উৎপত্তিস্থল একান্তই স্থানীয় এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। পত্রগুলো লিখেছে কোনো মহিলা এবং তিনি অবিবাহিতা এবং বয়স্কা।

আমি বলি, তাহলে আপনাদের প্রধান সূত্র ঐ টাইপ মেশিনটা? তাহলে তো এই ছোটো জায়গায় বেশি মুশকিল হবার কথা নয়।

ন্যাস বললেন, দুর্ভাগ্যক্রমে টাইপরাটারটা বড়োই সহজলভ্য। মিঃ সিমিংটনের অফিসের একটা পুরানো মেশিন মহিলাদের ইনস্টিটিউটে দেওয়া হয়েছিল, যেখানে সকলেরই অবাধ প্রবেশ।

–বিশেষ স্পর্শ বৈশিষ্ট্য…নাকি ওইরকম তো বলেন আপনারা–এসব দেখে কিছু বলতে পারেন?

গ্রেভস বললেন, এই খামগুলো টাইপ করা হয় একটা মাত্র আঙুল ব্যবহার করে। সে যে অনভ্যস্ত তা নয়, সে এটা করেছে আমাদের বুঝতে দিতে চায় না বলে। মহিলাটি বেশ ধূর্তই। তবে নিশ্চয়ই কোনো গেঁয়ো মহিলা নন। এখানে তো বেশিরভাগই নিরক্ষর, শব্দ বানান করতে পারে না।

আমি ভাবতে লাগলাম মিসেস ক্লিট বা তার মতো কোনো মহিলার কথা।

 সিমিংটন আমার চিন্তাটাকে কথায় প্রকাশ করলেন, তিনি জোর দিয়ে বললেন, এ জায়গাটায় তো আধডজন থেকে একডজন এমন লোক পাওয়া যাচ্ছে। করোনার আদালতে আমি যা বলেছিলাম আমি আজও তাই বলতে চাই। নিছক স্ত্রীর মর্যাদা রাখতেই ঐ বক্তব্য পেশ আমি করিনি। আমি জানি এটা মিথ্যা। আমার স্ত্রী ছিলেন স্পর্শকাতর স্বভাবের.আর ইয়ে ব্যাপারে যাকে বলে নীতিবাগীশ। এ ধরনের কোনো চিঠি তার পক্ষে রীতিমতো আঘাত। এছাড়া তার স্বাস্থ্যও ছিল দুর্বল।

সিমিংটন কাঁপতে লাগলেন, বললেন, আশাকরি খুব শিগগিরই আপনারা ঐ পত্রলেখিকা খুনীকে খুঁজে বার করতে পারবেন। একটু থেমে বললেন, এখন সে নিজে কি ভাবছে কে জানে -বলে সিমিংটন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।

গ্রেভস বললেন, এই বেনামী চিঠি ছাড়ার পর অভ্যাসটা প্রেরক ছাড়তে পারবে না। বারবার করতে থাকবে। সবসময় তাই করে।

শিউরে উঠে আমি দাঁড়িয়ে ওদের জিজ্ঞেস করি, আমাকে আর তাঁদের প্রয়োজন আছে কিনা। এই উৎকট আবহাওয়া থেকে আমি বাইরে খোলা বাতাসে যেতে চাই। তারা আমাকে রেহাই দিলেন এবং বললেন, কেউ কোনো চিঠি পেলেই যেন পুলিশকে তা রিপোর্ট করে একথা লোককে জানাবেন।

গ্রেভস জিজ্ঞেস করলেন, এমন কাউকে জানেন কি মিঃ বার্টন, যিনি আপনার ধারণায় কোনো বেনামী চিঠি পাননি।

আমি ইতস্তত করে এমিলি বারটনের সঙ্গে আমার কথাবার্তার এবং তিনি ঠিক যা যা বলেছিলেন তার পুনরাবৃত্তি করলাম। গ্রেভস জানালেন, এটা হয়তো পরে কাজে লাগবে, আমি নোট করে রাখব।

আমি গ্রিফিথের সঙ্গে বিকেলের রোদের মধ্যে বেরিয়ে এলাম।

 আমি বললাম, বলো তো গ্রিফিথ, পুলিশ কি কিছু জানে? কোনো ধারণা ওদের মাথায় আছে?

–ঠিক জানি না। তবে ওরা আসল ব্যাপার ফাস করে না। ওদের আশ্চর্য কলাকৌশল আছে। দুজনে হাইস্ট্রিট ধরে হাঁটছি। বাড়ির দালালদের অফিসের সামনে এসে দাঁড়ালাম। বললাম, আমার বাড়িভাড়ার দ্বিতীয় কিস্তি আগাম দেবার সময় হয়ে গেছে। কেবল মনে হচ্ছে টাকাটা মিটিয়ে এখান থেকে জোয়ানাকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাই। তবে আমি যাব না। কারণ ইতর কৌতূহলের জোর মনের দুর্বলতাকে ছাড়িয়ে যায়। শেষপর্যন্ত কী হয় সেটাই দেখার।

আমি দালাল অফিসের দরজা ঠেলে ঢুকলাম। যে মহিলাটি টাইপ করছিল তাকে আমার চেনা চেনা লাগছিল। দু-এক মিনিট চিন্তা করার পর মনে পড়ল উনি সিমিংটনের অফিসের মিস গিঞ্চ। আমি সে কথাটা বলেই ফেলি, আপনি তো গ্যালব্রেথ এ্যান্ড সিমিংটনে ছিলেন, তাই না?

-হ্যাঁ, তাই তো। এখানে আমার ভালো পদ, মাইনে যদিও অততটা নয়। তবে কিছু জিনিস আছে যার মূল্য টাকার চেয়ে বেশি, তাই মনে হয় না আপনার?

–নিঃসন্দেহে, আমি বললাম।

মিস গিঞ্চ এরপর ফিসফিস করে বলল, ঐ বিচ্ছিরি চিঠিগুলো। আমি পেয়েছিলাম ভয়ানক একখানা…আমাকে আর মিঃ সিমিংটনকে জড়িয়ে। আমি সোজা পুলিশকে জমা দিলাম। এরপরেও দেখলাম লোকে আমাদের নিয়ে গালগল্প করছে। এহেন পরিস্থিতিতে আমার উচিত মন্দ পরিবেশ ত্যাগ করা, যদিও মিঃ সিমিংটন আর আমার মধ্যে কখনোই খারাপ কিছু ছিল না।

-না না, তা তো ছিল না। আমি বিব্রত হয়ে বলি।

–কিন্তু লোকের মন তো মন্দ। হায়, কী মন্দই যে তাদের মন!

বিচলিতভাবে তার চোখের দৃষ্টি এড়াতে চাইলেও আমার নজর পড়ে গেল সেদিকেই, আর একটা অত্যন্ত অস্বস্তিজনক ব্যাপার আবিষ্কার করে বসলাম।

মিস গিঞ্চ ব্যাপারটা পুরোপুরি উপভোগ করছে। আজ এখানে আসার আগেই একবার এমন লোককে দেখেছি বেনামী চিঠিতে আনন্দের পরিচয় পেয়েছেন, তবে সেটা তার পেশাগত। মিস গিঞ্চের আনন্দটা দেখছি নেহাত্র ইঙ্গিতময় অর বিতৃষ্ণাজনক।

আমার চমক-খাওয়া মনে একটা কল্পনা ঝিলিক মেরে যায়।

মিস গিঞ্চ নিজেই কি এইসব চিঠি লিখেছিল?

.

০৭.

 বাড়ি ফিরে এসে দেখি মিসেস ডেন কলপ জোয়ানার সঙ্গে গল্প করছেন। তাকে কেমন যেন বুড়োটে আর অসুস্থ দেখাচ্ছে। বললেন, আমার কাছে এটা ভীষণ আঘাত মিঃ বার্টন। বেচারী… বেচারী।

বললাম, হ্যাঁ, কাউকে বাধ্য হয়ে জীবন শেষ করতে দেখলে প্রচণ্ড দুঃখ হয় বৈকি।

–আপনি কি মিসেস্ সিমিংটনের কথা বলছেন?

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন আপনিও তো তাই বলছিলেন?

–হা, ওঁর জন্যে দুঃখ তো হয়ই, তবে ঐ ব্যাপারটা একদিন না একদিন তো ঘটতই।

–তাই নাকি? ঘটত নাকি? জোয়ানা বলল।

 মিসেস কলপ বললেন, হ্যাঁ, বাছা, তাই-ই মনে হয়। আত্মহত্যাই যদি বিড়ম্বনার থেকে মুক্তি বলে মনে করো, তাহলে যাহোক কিছু বিড়ম্বনাতেই সেটা করা সম্ভব। যেকোনো রকমের বিশ্রী আঘাতের মুখোমুখি হলেই তিনি এ কাজ করতেন। উনি ঐ ধরনেরই মহিলা ছিলেন।

–কিন্তু একটু আগে আপনি বেচারী কাকে বোঝাচ্ছিলেন?

–যে ঐ চিঠিগুলো লিখেছিল সেই মহিলার কথা বলছি।

–মাপ করবেন। তার জন্যে সমবেদনা জানিয়ে বাজে শব্দ খরচ করা আমার পোষাবে না।

–কিন্তু আপনি কি মনে করেন না আপনার অনুভূতি নেই? কল্পনাশক্তি নিয়ে ভাবুন, কি প্রচণ্ড মরিয়া, অসুখী মন নিয়ে কেউ এ ধরনের চিঠি লিখতে পারে। সে সমাজ থেকে কতটা বিচ্ছিন্ন। আমি দুঃখ পাই এই শহরে এমন ভয়ঙ্কর অসুখী একজনের আমি খবর রাখি না। বেচারী হতভাগী!

তিনি যাবার জন্যে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর সঙ্গে আমার একমত হবার মতো মন ছিল না। উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করি, মিসেস কলপ, এই মহিলা কে সে সম্বন্ধে আপনার একটুও ধারণা নেই? ধন্দে পড়া দুটো চোখ আমার দিকে ফিরিয়ে বললেন, হ্যাঁ, আন্দাজ করতে পারি। কিন্তু আমার ভুল হতে পারে। তাই না?

দরজা দিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাবার সময় মাথাটা ফিরিয়ে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, মিঃ বার্টন, আপনি এখনো বিয়ে করেননি কেন? আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কি প্রথমে উত্তর দেব ভেবে পাই না, তারপর বললাম, বোধহয় সঠিক মেয়েটির সাক্ষাৎ পাইনি, তাই।

মিসেস কলপ বললেন, জবাবটা খুব ভালো হলো না, কারণ কতো মানুষই তো দেখেশুনেও ভুল মেয়ে বেছে নেয়। এবার উনি সত্যিই বিদায় নিলেন।

.

পরদিন সকালে আমি আর জোয়ানা একটু দেরি করে ব্রেকফাস্ট করছি।

ঘরের বাইরে বেরিয়ে দেখি এইমি গ্রিফিথ মেগানের সঙ্গে কথা বলছে।

আমাদের দেখে হাসিমুখে বলল, হ্যালো কুঁড়ের বাদশারা, আমি তো উঠেছি কোন ভোরে। এই মিস মেগানকে একটু জিজ্ঞেস করছিলাম আমাদের রেডক্রশ স্টলটার জন্যে কিছু শাকসজী দান করতে পারবে কিনা। যদি হয়, তাহলে আওয়েনকে বলে দেব গাড়িতে তুলে নিয়ে যেতে।

হঠাৎ টেলিফোনটা ঝনঝন করে বেজে উঠল। আমি এইমির কাছ থেকে অনুমতি চেয়ে ভেতরে গেলাম টেলিফোনটা ধরতে। কথা বলে জানলাম কোনো এক অ্যাগনেস ওয়াডল, প্যারট্রিজকে চাইছে।

আমি প্যারট্রিজকে জানালাম। সে বেশ একটু অপ্রতিভ হয়ে, ঝাডুটা ফেলে খরখর করে নিচে নেমে গেল। আমি খাবার ঘরে ঢুকলাম।

প্যারট্রিজ টেলিফোনে কথা বলার শেষে জোয়ানাকে গম্ভীর গলায় বলল, মিস, টেলিফোনে কথা বলার জন্যে আমি মাফ চাইছি। কর্তাকে ফোন করতে হল, আমাকে ডাকতে হল, এসমস্ত ঝামেলার জন্যে আমি দুঃখিত।

জোয়ানা বলল, আরে তাতে কী হয়েছে!

প্যারট্রিজের মুখখানা আরো গোমড়া হয়ে গেল। বলল, এই বছর ষোলোর অ্যাগনেস মেয়েটা অনাথ আশ্রম থেকে সোজা এখানে আসছে। তাকে পরামর্শ দেবার মতো কেউ নেই। কিছু একটা ব্যাপারে ও আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। তাই বলছিলাম, আজ বিকেলে ওকে রান্নাঘরে চা খেতে বলতে পারি?

জোয়ানা হতভম্বের মতো বলল, তাতে কি? সবার সঙ্গে চা খেতে বলায় তোমার অসুবিধে কোথায়?

হঠাই প্যারট্রিজ আরো কঠিন হয়ে জবাব দেয়, বুড়ি মা-ঠাকরুণ এবং মিস এমিলি কখনোই বাইরের লোককে রান্নাঘরে ঢুকতে দেননি।

জোয়ানা প্যারট্রিজের সঙ্গে ঠিক তেমন সুবিধে করে উঠতে পারে না। প্যারট্রিজ চলে যেতে জোয়ানা বলল, বুঝতে পারি না বেশিরভাগ লোক আমাকে পছন্দ করলেও প্যারট্রিজের আমাকে ভালো লাগে না কেন?

আমি বলি, হয়তো জবরদস্ত গৃহকত্রী নস বলে ওর অপছন্দ।

কয়েক মিনিট আগে মেগান বাগানের দিকে গিয়েছিল। এখন সে বাগানের দিকে আনমনে তাকিয়ে আছে। আমি যেতেই আচমকা বলল, ভাবছি আজই আমাকে বাড়ি ফিরে যেতে হবে।

ওর এই কথায় আমি উত্তেজিত ও শঙ্কিত হয়ে উঠি। তখন আমি আর জোয়ানা অনেক বুঝিয়েও তার মন বদলাতে পারলাম না। অগত্যা জোয়ানা তাকে গাড়িতে করে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করে।

.

স্বীকার করতে আপত্তি নেই, মেগান যেভাবে হট করে চলে গেল, ওতে আমি বেশ খানিকটা চমকে গেছি।

ঠিক দুপুরের খাওয়ার আগে আওয়েন গ্রিফিথ এল গাড়ি নিয়ে। আমিও একটু ড্রিঙ্ক দেব বলে শেরী আনতে ভেতরে গেছি, দেখি, জোয়ানা তার কাজ শুরু করে দিয়েছে।

আওয়েনকে সে নানান প্রশ্ন, যেমন, সরকারী ডাক্তারের চাকরি তার পছন্দ কিনা, এবং এর চেয়ে স্পেশালিস্ট হলে আরো ভালো হত কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। আর গ্রিফিথও তার তিন নম্বর শেরীর গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে নানা শারীরিক জটিল প্রতিক্রিয়া সংজ্ঞার বক্তব্য বকে চলেছে।

জোয়ানাকে বেশ গভীর উৎসাহীর মতো দেখাচ্ছে। আমার মনে হল, জোয়ানার গ্রিফিথের মতো ভালোমানুষকে নিয়ে এমন টানাটানি ঠিক কাজ হচ্ছে না।

এরপর জোয়ানা তাকে লাঞ্চের নিমন্ত্রণ করায় গ্রিফিথ জানালো, তার বোন তার জন্যে অপেক্ষা করছে। জোয়ানা তখন ফোন করে এইমি গ্রিফিথকে জানিয়ে দিল। অতএব গ্রিফিথ লাঞ্চের জন্যে রয়েই গেল। মনে হল সে বেশ আমোদই পাচ্ছে।

.

সেদিন এমিলির বাড়িতে আমরা চায়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেলাম। একটি রোগা, ঢ্যাঙা স্ত্রীলোক আমাদের দরজা খুলে জানালো মিস বারটন এখন নেই, আমরা যেন অপেক্ষা করি। বোঝাই যাচ্ছে, এই হল বিশ্বাসিনী ফ্লোরেন্স। তার পিছু পিছু উপরের কামরায় গিয়ে বসলাম। আসবাবের বাড়াবাড়ি থাকলেও বেশ আরামদায়ক বসার ঘর।

ফ্লোরেন্স তিরস্কারের চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, যতটা পারি ওনাকে আরামে রাখার চেষ্টা করি। ওনার তো নিজের বাড়িতেই সঠিকভাবে মাথা গুঁজে থাকা উচিত।

-তা, মিস বারটনই তো বাড়িটা আমাদের ভাড়া দিতে চেয়েছিলেন।

–বাধ্য হয়েছিলেন। গভর্নমেন্ট তো তাকে ছেড়ে দেবে না। অঢেল টাকাপয়সা ছিল। শেয়ারে নাকি আগের মতো টাকা হয় না। কিন্তু তাই-বা কেন, শুনতে চাই? যিনি হিসেবপত্র বোঝেন না, তাকে পথে বসানো? যে যার নিজেরটা ঠিক বোঝে। আমি যদ্দিন থাকবো, এ জুলুম সহ্য করবো না। ওঁর চাই দেখাশোনা। মিস এমিলির জন্যে আমি সবকিছু করতে রাজী।

এরপর ফ্লোরেন্স দরজা ভেজিয়ে গটগট করে চলে গেল।

কিছু পরে দরজা খুলে গেল। ঢুকলেন মিস এমিলি। কিছুটা হাঁপিয়ে, বিভ্রান্ত কণ্ঠে বললেন, আহা দেখুন তো! দেরি করে ফেললাম।

এই শহরে একটু কেনাকাটার ছিল। আপনাদের এতক্ষণ বসিয়ে রাখার জন্য খারাপ লাগছে। জোয়ানা বলল, আসলে আমরাই একটু আগে এসে পড়েছিলাম।

এমিলি বললেন, চায়ের মতো মেয়েলি খানাপিনায় আসতে চেয়েছেন এটাই কতো বড়ো কথা মিঃ বার্টন। মনে হয় এমিলির মনের আঁকা পুরুষটি হল–হুইস্কি সোডা আর চুরুট খেয়ে যাওয়া আর গাঁয়ের মেয়েদের সঙ্গে সুযোগ বুঝে ফষ্টিনষ্টি।

ইতিমধ্যে আমাদের কেক, স্যান্ডউইচ, প্রচুর কেক দেওয়া হল, তার সঙ্গে চীনদেশের চা। অপূর্ব স্বাদ।

স্বাভাবিকভাবেই আমাদের আলোচনায় ডাক্তার গ্রিফিথের প্রসঙ্গ এলো। মিস এমিলি তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সিমিংটনের প্রসঙ্গ ওঠায় উনি বললেন, সিমিংটন চতুর আইনজ্ঞ, বারটনকে সাহায্য করেছিলেন ইনকাম ট্যাক্স থেকে কিছু টাকা বাঁচাতে। আর মিসেস সিমিংটনের উচিত ছিল মরার আগে তার ছেলেপুলের কথা চিন্তা করা।

কথাপ্রসঙ্গে এমিলি জানালেন, খবরের কাগজে দেশভ্রমণ সম্বন্ধে পড়ে তার খুবই বিদেশ ঘুরতে ইচ্ছে হয়।

জোয়ানা প্রশ্ন করল, তাহলে যান না কেন?

-না না, অসম্ভব। একলা কি যাওয়া যায়? খরচের ব্যাপারটা নয় বাদই দিলাম। একা ভ্রমণ করাটা বড়ো অদ্ভুত দেখাবে না। তাছাড়া বিদেশে বন্দরে নেমে ঐ লটবহর নিয়ে কিভাবে চলব, জানি না।

জোয়ানা এমিলির আশঙ্কাভরা মনটাকে শান্ত করার জন্যে উদ্যম উৎসবের কথা বলল। স্বাভাবিকভাবেই মিসেস ডেন কলপের দিকে কথাবার্তা মোড় নিল।

–বুঝলেন বন্ধুরা, উনি সত্যি এক অদ্ভুত ধরনের মহিলা। আমি আপনাদের ঠিক বোঝাতে পারব না, এমন সব আচমকা কথা বলেন না উনি…যেন আপনি সেখানে নেই, তার সামনে অন্য কেউ। তবে উনি খুব ভদ্রঘরের মেয়ে। তার স্বামীর খুব অনুরক্ত। ভদ্রলোকও খুব জ্ঞানীগুণী, নিষ্ঠাবান মানুষ। তবে এখানকার গণ্ডিতে পড়ে থেকে সব অকেজো হয়ে যাচ্ছে।

আরও কিছু কথাবার্তার পর আমরা বিদায় প্রার্থনা করলাম।

.

সেদিন রাতে খেতে বসে জোয়ানা প্যারট্রিজকে জিজ্ঞেস করল, অ্যাগনেসকে নিয়ে তার চা পার্টি কেমন হল?

প্যারট্রিজ মুখ লাল করে জানালো যে, অ্যাগনেস কথা দিয়েও আসেনি। সে তত তাকে নেমতন্ন করে ডেকে পাঠায়নি। তার আজকের দিনটা ছুটি ছিল বলে কি প্রসঙ্গে পরামর্শ নিতে নিজের থেকে আসতে চেয়েছিল। তা এলো না। তবে দেখা হোক, প্যারট্রিজ জানালো, তার সঙ্গে দেখা হলে ঝাল ঝাড়বে তার ওপর। বলে রেগে টং হয়ে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।

আমরা বেনামী চিঠিগুলোর ব্যাপারে কথা বলতে শুরু করলাম।

জোয়ানা বলল, মিসেস সিমিংটনের আত্মহত্যার পর আজ ঠিক এক হপ্তা হলো। ন্যাস, গ্রেভস কতদূর কি এগোলেন কে জানে?

ঠিক এক হপ্তা–কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমার একটা অস্বস্তি হতে লাগল। আমি কেমন আনমনা হয়ে পড়লাম। মন তখন টুকরো টুকরো ঘটনাকে জোড়া দিতে ব্যস্ত। আমি জোয়ানাকে অবাক করে গিয়ে প্রশ্ন করলাম, পরিচারিকারা হপ্তায় একদিন ছুটি কাটাতে যায়, তাই না?

-হ্যাঁ, সেটাই তো বরাবরের নিয়ম।

আমি ঘড়িটার দিকে তাকাই। রাত সাড়ে দশটা। আমি সিমিংটনের বাড়িতে ডায়াল করলাম। অপর প্রান্তে মিস এলসি হল্যান্ডের কণ্ঠ ভেসে এলো।

বললাম, আমি জেরি বলছি, তোমাদের কাজের মেয়ে অ্যাগনেস ফিরেছে? এলসি আমাকে রিসিভার ধরতে বলে দেখতে চলে গেল।

দুমিনিট বাদে সে রিসিভার তুলে জানাল, না, অ্যাগনেস ফেরেনি।

তখনই বুঝলাম আমার আন্দাজটা ভুল নয়।

 তারপরই সিমিংটনের গলা শুনতে পেলাম, হ্যালো বার্টন, ব্যাপার কি?

–আপনার কাজের মেয়ে এখনো ফেরেনি?

-না। কিন্তু ওর কোনো অ্যাকসিডেন্ট হয়নি তো? মেয়েটির কিছু ঘটেছে, সে রকম ধারণা করার মতো কিছু ঘটেছে নাকি?

গম্ভীর গলায় বললাম, হলে অবাক হবো না।

.

০৮.

 রাতে ঘুমটা বড়ো বিচ্ছিরি হল। মনের মধ্যে সারা রাজ্যের ধাঁধার মতো টুকরো ছবিগুলো ঘুরতে লাগল।

আমি ছটফট করতে লাগলাম, কোথাও নিশ্চয়ই একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। তার নকশাটা যদি বুঝতে পারতাম। আমাকে জানতেই হবে ঐ হতচ্ছাড়া চিঠিগুলো কার লেখা। কোথাও একটা নিশ্চয়ই সূত্র আছে…

স্বপ্ন দেখি মিসেস কলপ একটা গ্রে-হাউন্ড হয়ে গেছেন আর আমি তাকে বগলেশ আর শেকলে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছি।

.

টেলিফোনের শব্দে লাফিয়ে উঠে পড়ি। সাড়ে সাতটা বাজে। রান্নাঘর থেকে প্যারট্রিজ বেরিয়ে আসার পূর্বক্ষণেই আমি রিসিভার তুলে নিই, হ্যালো?

শুনলাম, মেগান ফোঁপাতে ফোঁপাতে আমাকে তার কাছে একবার আসতে বলছে। আমি রাজী হলাম।

আমি সিমিংটনের বাড়ি যেতেই মেগান আমাকে জড়িয়ে ধরল। ও কাঁপতে কাঁপতে ফ্যাকাসে মুখে বলল, আমি সিঁড়ির তলায় কাপবোর্ডের ভেতরে অ্যাগনেসকে মৃত অবস্থায় দেখেছি। আমি ওর বাইরে যাবার পোশাক কামরাতে পরে থাকতে দেখে ওকে খুঁজতে খুঁজতে ওখানে দেখতে পেলাম। মেগানের থেকে আরো জানলাম, মিঃ সিমিংটন পুলিশকে ফোন করেছে।

ইতিমধ্যে ওদের রাঁধুনী রোজের কাছ থেকে জানলাম, অ্যাগনেসকে মিসেস সিমিংটনের মৃত্যুর পর থেকেই কেমন বিচলিত দেখাত আর সে ক্রমে উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়ছিল, কেবলই বলত ওর কী করা উচিত ভেবে পাচ্ছে না।

একসময় এলসির সঙ্গে দেখা হয়, ও আমাকে দেখেই বলল, উঃ কী ভয়ানক, এমন শয়তানি কাজ কে করতে পারে? আর বেচারী অ্যাগনেস, আমার মনে হয় না ও কারোর ক্ষতি করতে পারে। এলসি চলে গেল।

তারপর একটা দরজা খুলে গেল, সুপারিন্টেন্ডন্ট ন্যাস ঢুকলেন, পিছনে মিঃ সিমিংটন। উনি আমাকে দেখে খুশী হলেন। মিঃ সিমিংটনকে তিনি প্রাতঃরাশ খেয়ে নেবার পরামর্শ দিয়ে আমাকে নিয়ে বৈঠকখানায় ঢুকলেন এবং দরজা বন্ধ করে দিলেন।

আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, খবর পেলেন কিভাবে। আমি জানালাম, মেগান ফোন করেছিল। তাকে আরও জানালাম, প্যারট্রিজকে অ্যাগনেসের ফোন করা এবং শেষ অবধি তার না আসার কথা। এবার আমি প্রশ্ন করি ন্যাসকে, ঠিক কি ঘটেছিল?

কাজের মেয়েদের ছুটির দিন–হ্যাঁ, মনে হয় দুটি বোন এখানে কাজ করত। তারা একসঙ্গে বেরুতে চাইত বলে মিসেস সিমিংটন সেরকম ব্যবস্থা বহাল করে দেন। তারপর এ দুজন এলেও ঐ একই ব্যবস্থা বহাল থাকল। ওরা নিজেদের ঠান্ডা খাবার ডাইনিংরুমে রেখে যেত, শুধু মিস হালন্ড ওদের গরম চা দিত। একটা জায়গা পরিষ্কারের, রোজ নেদার মিকফোর্ডের বাসিন্দা বলে ছুটির দিনে তাকে সেখানে যেতে বেলা আড়াইটের বাস ধরতে হয়। তাই সবসময় অ্যাগনেসকেই দুপুরের বাসন মাজতে হত। শোধবোধের জন্য রোজ রাতে ফিরে এসে রাত্রি ভোজনের থালাবাসন মাজতো। কালও ঐ একই ব্যাপার হয়েছিল। দুটো পঁচিশে রোজ যায় বাস ধরতে, তিনটে বাজতে পঁচিশে সিমিংটন চলে যান অফিসে, এলসি বেরিয়ে যান তিনটে নাগাদ, পাঁচ মিনিট বাদে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যায় মেগান। আমার যদ্র ধারণা, অ্যাগনেস সাধারণতঃ তিনটে থেকে সাড়ে তিনটের মধ্যে বের হতো।

–তাহলে তখন বাড়িটা খালি পড়ে থাকে?

–ও বিষয় নিয়ে এখানকার লোকদের কোনো মাধাব্যথা নেই। যা বলছিলাম, তিনটে বাজার দশমিনিট আগে অ্যাগনেস একাই ছিল এবং ও যে বাড়ি থেকে বের হয়নি সেটা পরিষ্কার কারণ ওর গায়ে বাড়ির টুপি আর অ্যাপন ছিল।

–মৃত্যুর সময়টা জানতে পেরেছেন?

–হ্যাঁ, ডাক্তার গ্রিফিথের মতে দুটো থেকে সাড়ে চারটের মধ্যে। এটা তাঁর সরকারী রায়।

–কেমনভাবে খুন হয় মেয়েটি?

–মাথার পেছনে প্রথমে আঘাত করে নিঃসাড় করে দিয়ে, তারপর খুব ছুঁচলো করে শানানো একটা রান্নাঘরের সাধারণ নিকি তার ঠিক খুলির পেছন গোড়ায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।

একটা বিরক্তি প্রকাশ করে ন্যাস বলল, সেই একই কুসংস্কার ওদের, পুলিশের সঙ্গে মেলামেশা করবে না। ওর দুশ্চিন্তার ব্যাপারটা আমাদের কানে এলে হয়তো ওকে বাঁচানো যেত।

-আপনি এ-ব্যাপারে আর কি জানতে পেরেছেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

–আরো জানতে পেরেছি, মিসেস সিমিংটনের আত্মহত্যার দিন বিকেলে দুজন পরিচারিকারই বাইরে যাবার কথা, ওদের ছুটির দিন বলে। কিন্তু অ্যাগনেস বাড়ি থেকে বেরিয়েও ফিরে আসে। সে তার ছেলেবন্ধু র‍্যানডেলের সঙ্গে দেখা করতে যায়, র‍্যানডেল এর মধ্যে একটা উড়ো চিঠি পায়, যাতে ইঙ্গিত ছিল, অ্যাগনেসের ভজাবার মতো আরো ছোকরা আছে–অতএব বেঁধে গিয়েছিল দুজনের মধ্যে ঝগড়া। আর অ্যাগনেস রাগ করে বাড়ি ফিরে আসে, বলল, ফ্রেড যতক্ষণ না মাফ চাইছে ও আর বেরুবেই না। এবার খেয়াল করুন, মিঃ বার্টন, মিসেস সিমিংটনের চিঠিটা এসেছিল বিকেলের ডাকে। এবং সেটাতে ব্যবহৃত স্ট্যাম্প লাগানো হয়েছিল। কিন্তু আসলে কেউ হাতে ভরে দিয়ে যায়। বিকেলের ডাক আসে পৌনে চারটে নাগাদ। অ্যাগনেস তার ছোকা বন্ধুর আসার অপেক্ষায় গেটের দিকে নজর রেখেছিল রান্নাঘরের জানলা দিয়ে।

আমি বললাম, আর সে দেখল সেই ব্যক্তিটিকে, চিঠিটাকে বাক্সে ঢোকাতে।

–ঠিক মিঃ বার্টন। অ্যাগনেস জানতো কে সেই পত্র লিখেছিল। কিন্তু তার দৃষ্টি ছিল সব সন্দেহের উর্ধ্বে, কেননা সে ব্যাপারটাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি, ভেবেছিল, কেউ একজন বাক্সে চিঠি ফেলে গেল। কিন্তু সে যে বেনামী চিঠির সঙ্গে জড়িত একথা তার মাথায় আসেনি বা ভাবতেই পারেনি সেই মূহুর্তে। কিন্তু পরে এ নিয়ে চিন্তা করতে থাকলে সে অস্থির হয়ে পড়ে এবং ঠিক করে প্যারট্রিজকে সবকথা খুলে জানাবে। কিন্তু কোনোক্রমে বিষকলম সেটা ধরে ফেলে।

–কিভাবে মিঃ ন্যাস?

–গ্রামদেশে খবর ছড়ানো এক তাজ্জব ব্যাপার। ঘরে ঘরে টেলিফোন। আপনি যখন ফোনে অ্যাগনেসের সঙ্গে কথা বলছিলেন কে কে শুনেছিল?

–আমার বোন, মিস গ্রিফিথ শুনে থাকতে পারে।

এদিকে অ্যাগনেসের কথা হয়তো মিস হল্যান্ড, রোজ ওরাও শুনে থাকবে। এছাড়া রেনডেল ছোকরাও ওদের ঝগড়া করে বাড়ি ফিরে যাওয়াতে ব্যাপারটা রটাতে পারে। এখন আমাদের হাতে দুটো নির্দিষ্টকাল বিকেল এবং এক সপ্তাহ আগের বিকেল।

-কাল কী ঘটেছিল বলে আপনার ধারণা?

–আমার ধারণা বিশেষ এক মহিলা শান্ত, হাসিমুখে বিকেলের দর্শনার্থী হিসেবে কিংবা হাতে কোনো পার্সেল নিয়ে বেল টেপে। অ্যাগনেস খুলে দেয় এবং আগন্তুক তার পেছন ফেরার সুযোগে মাথায় আঘাত করে। এখানকার মহিলারা বড়ো ব্যাগ নিয়ে ঘুরতে অভ্যস্ত। তাতে নিকি এনেছিল। আর পরে সেটা বেঁকিয়ে কাবার্ডে ফেলে দিয়ে যায়।

আমি প্রশ্ন করি, অ্যাগনেসকে কাবার্ডে পোরার কি দরকার ছিল?

মৃত্যুর সঠিক সময়টা গোলমেলে করে তোলার জন্যেই। সঙ্গে সঙ্গে মিস হল্যান্ড মৃতদেহ দেখতে পেলে মিনিট দশেকের মধ্যে ডাক্তার ডাকলেন।মিসেস সিমিংটনের আত্মহত্যাটা বিষকলমকে ভয় পাইয়ে দেয়। সে হাওয়া বুঝে ফেলে। এখন আমাদের একজনের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে, তিনি সম্মানিত, যাঁর সম্পর্কে সবার উঁচু ধারণা রয়েছে, বুঝলেন মিঃ বার্টন?

একটু পরে ন্যাসের সঙ্গে আমিও রোজের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। এর মধ্যে ন্যাসের কাছে রোজ দু-রকম কাহিনী শুনিয়েছে। ন্যাস এবার মিঠে-কড়া পদ্ধতিতে রোজকে জিজ্ঞেস করল, অ্যাগনেস কি কোনো ইঙ্গিতই দেয়নি, তার মনে কেন উদ্বিগ্ন থাকত? উত্তরে রোজ জানিয়েছে, না। রোজ আরও জানিয়েছে যে, সে বেলা আড়াইটার বাস ধরে নেদার মিকফোর্ডে পৌঁছে সারাটা বিকেল আর সন্ধে কাটিয়ে, সেখান থেকে আটটার বাস ধরে ফেরে।

এবার হল্যান্ডের সঙ্গে দেখা করলাম। সেও জানালো, অ্যাগনেস তাকে কোনো মানসিক অস্বস্তির কথা জানায়নি কোনোদিন। এছাড়া সে আরও জানালো যে, সে ছেলেদের নিয়ে মাঠের ধার ধরে মাছ কিনতে গিয়েছিল। মাছের টোপ নিতে ভুলে গিয়েছিল বলে, আবার বাড়ি ফেরে তিনটে বাজতে কুড়িতে..বা তার সামান্য পরে। সে সময় মেগান আসছিল, পরে মন বদলালো, সে বাইসাইকেল নিয়ে বেরুচ্ছিল। মেগান নিশ্চয়ই রওনা দিয়েছিল আর অ্যাগনেসকে সে তখন দেখেনি।

–কটার সময় বাড়িতে ঢোকেন?

–পাঁচটা বাজতে দশে। ছেলেদের ওপরে চা দেবার ব্যবস্থা করি। সিমিংটন এলেন, ছেলেদের পড়ার ঘরে চা খাবেন বললেন। আমি নিচে গিয়ে তার চা নিয়ে এলাম।

-সাধারণ সময়ে কেউ যায় ঐ কাবার্ডটার দিকে?

-না, না। স্রেফ হাবিজাবি জিনিস রাখার জায়গা ওটা, মাসের পর মাস কেউ হয়তো ওটার দিকে যায় না।

–বিকেলের ডাকগুলো কে ওপরে নিয়ে যেত?

–আমি ফেরার সময় চিঠির বাক্স দেখে চিঠি থাকলে তা হলকামরার টেবিলে রেখে দিতাম। মিসেস সিমিংটন নিচে নেমে এসে চিঠি নিয়ে যেতেন।

-ঐ বিষ চিঠিটা সম্পর্কে আপনার নিজস্ব মত কি? আপনি ও ধরনের চিঠি পেয়েছেন?

–না, একেবারেই তা মনে হয় না। মিসেস সিমিংটন ছিলেন স্পর্শকাতর, শুচিবেয়ে…ও ধরনের কিছু…মানে…হতেই পারে না। আর আমি সত্যিই ও-ধরনের কোনো চিঠি পাইনি।

ন্যাস আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মিঃ বার্টন, যা শুনবেন সবই বিশ্বাস করবেন না। মিস বার্টনও এধরনের চিঠি পেয়েছিলেন। তার পুরানো রাঁধুনিটার কাছে খবর পেয়েছি। তাহলে উনি একথা আমার কাছে লুকোলেন কেন?

সুরুচির পরিচয়, অশ্লীল বিষয় এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে। চিঠির বক্তব্য ছিল, উনি ওঁর মা, বোনেদের বিষ খাইয়ে মেরেছেন।

.

০৯.

 এ বাড়ি থেকে বেরুবার আগে আমি মেগানকে খুঁজে বের করে আবার একটু অনুরোধ জানালাম যাতে আবার কিছু দিন আমার সঙ্গে এসে থাকে। কিন্তু সে অরাজী হওয়ায় আমি আর ন্যাস লিটল ফার্মে ফিরে এলাম।

ন্যাস প্যারট্রিজের কাছে কিছু জানবার আগ্রহ নিয়ে গেলেন, কিন্তু তিনি আশাহত হলেন, নতুন কিছু বার করতে পারলেন না। প্যারট্রিজ আপনাদের ঠিকে ঝি মিসেস এমোরিকে অ্যাগনেসের ফোনের ব্যাপারে বলেছিলো, এবার এমোরির মাধ্যমে সারা শহরে রাষ্ট্র হয়ে থাকবে।

ন্যাস জোয়ানার দিকে তাকিয়ে বললেন, মিস বার্টন, আপনার নামের চিঠিটার খামটা লক্ষ্য করেছিলেন? সেখানে চিঠিটার প্রকৃত প্রাপকের নাম ছিল, মিস বার্টন পরে র কেটে ট করা হয়েছিল।

এরপর ন্যাস বিদায় নিলেন। জোয়ানা আমাকে বলল, চিঠিটা যদি এমিলির উদ্দেশ্যে লেখা হয়, তাহলে শুরুতে ওহে রংমাখা ঘর জ্বালানি-কথাটা থাকবে কেন? জেরি, তোমার উচিত ছিল শহরে গিয়ে সবাইকার মতামত যাচাই করা।

আমি জোয়ানাকে আস্তে আস্তে বললাম, দ্যাখ, ঐ অ্যাগনেস মেয়েটা প্যারট্রিজকে কী বলেছিল, সেটা আমরা শুধু ওর মুখ থেকেই শুনেছিলাম। ধর যদি অ্যাগনেস বলে, কেন সেদিন প্যারট্রিজ এসে চিঠিটা ফেলেছিল?..হয়তো প্যারট্রিজ উত্তরে বলে, সে বিকেলে ওর কাছে গিয়ে সব ব্যাখ্যা করে বলবে।

কিন্তু চিঠির সূত্রগুলো নষ্ট করার মতো মনোভাব বা জ্ঞান প্যারট্রিজের আছে বলে আমার মনে হয় না।

জোয়ানা বলল, আমার মনে হয় মধ্যবয়েসী মিঃ পাই এর সঙ্গে জড়িত।

–ভুলিস না তিনিও একটা ওরকম চিঠি পেয়েছেন। ওটা আমাদের অনুমান। উনি যথেষ্ট চালাক এবং তাঁর পূর্বপরিকল্পিত অভিনয় আমরা প্রত্যক্ষ করে থাকতে পারি।

.

জোয়ানার কথামতো হাইস্ট্রিট ধরে যেতে যেতে প্রথমে গ্রিফিথের সঙ্গে দেখা হলো। ওকে ভীষণ অসুস্থ এবং ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। কারণ জিজ্ঞাসা করে জানলাম, দুশ্চিন্তা করার মতো কিছু কেস সম্প্রতি দেখেছে। তার মধ্যে অবাধে ঘুরে বেড়ানো উন্মাদটিও আছে।

.

গ্রিফিথ জানালো সে জোয়ানাকে কিছু ফটোগ্রাফ দিতে যাবে। গ্রিফিথ চলে গেল।

এরপর তার বোন মিস গ্রিফিথের সঙ্গে দেখা।

আমাকে পেয়েই গমগমে গলায় বলতে শুরু করল, কী বীভৎস ব্যাপার! ঐ অ্যাগনেস মেয়েটার মুখটাও আমি মনে করতে পারছি না। আমার মনে হয় ওরই কোনো বয়ফ্রেন্ড একাজ করে থাকবে।

আমি কথা ঘুরিয়ে বলি, বলুন তো মিস গ্রিফিথ, আপনিই কি মেগানকে বাড়ি ফেরার পরামর্শ দিয়েছিলেন?

-হ্যাঁ, মিসেস সিমিংটনের মৃত্যুর পর থেকেই লোকে বলছে, মিস হল্যান্ড নাকি দুনম্বর মিসেস সিমিংটন হবার জন্যে মিঃ সিমিংটনের কাছে নিজেকে অপরিহার্য করে তুলেছে। তার মতো নিখুঁত মেয়ে শুধু নিজের কর্তব্যটুকুই করে চলেছে। মেয়েটার জন্যে আমি দুঃখ পাই। মোটামুটি সে কারণেই আমি মিস মেগানকে বাড়ি ফিরে যেতে পরামর্শ দিই। বাড়িতে শুধু ডিক আর হল্যান্ড থাকার চেয়ে এ বরং ভালো দেখাবে। একথা বলে সজোরে হেসে সে পা বাড়ালো।

.

চার্চের কাছেই পেয়ে গেলাম মিঃ পাইকে। উনি এমিলি বারটনের সঙ্গে কথা বলছিলেন। –এই যে বার্টন, সুপ্রভাত! জোয়ানা কেমন আছে?

-ভালো আছে।

-উনি আবার আমাদের গ্রাম্য পার্লামেন্টে যোগ দেননি তো? আরে খুনের ব্যাপারটা বলছিলাম। একটি সামান্য কাজের মেয়ের পাশবিক হত্যা, অবশ্য অপরাধের বিচারে এটা একটা খবর তো বটেই।

আমি পাইকে জিজ্ঞেস করি, কাল মিস গ্রিফিথ আপনাকে আর মিস অ্যাগনেসের কাল বিকেলে প্যারট্রিজের কাছে চা খাবার কথা ছিল–একথা বলেছিল আপনাকে?

সেরকমই তো বলছিল। ও বলেছিল, এ তো নতুন প্রথা দেখছি চাকর-বাকর আজকাল তাদের মালিকদের ফোন ব্যবহার করছে।

মিস এমিলি বললেন, প্যারট্রিজ এমন কাজ করবে আমি তো স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। এসব আমি আর সইতে পারছি না, বলে মিস এমিলি হাঁটা মারলেন।

আমি পাইকে বললাম, এইসব ঘটনাগুলো সম্পর্কে আপনার প্রকৃত ধারণা কি?

-আমার মতে, বাইরে থেকে আপাত সম্ভাবনাহীন লোকই অনেক সময় এসব কাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকে। সব রীতিমতো উন্মাদ, বুঝলেন মশাই।

-কে?

তার চোখের দৃষ্টি আমার ওপর। হেসে বললেন, না না, বার্টন, সে তো বদনাম করা হবে। এত কিছুর ওপর বদনাম জিনিসটা করতে চাই না। উনি প্রায় লাফিয়েই রাস্তা ধরলেন।

.

চার্চের কাছে দাঁড়িয়ে আছি, ধীরে ধীরে খুলে গেল চার্চের দরজা। বেরিয়ে এলেন মাননীয় পাদ্রি কালেব ডেন কলপ।

সুপ্রভাত মিঃ…ইয়ে..ইয়ে

আমি বলি, বার্টন।

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়। আজ দিনটা বড়ো চমৎকার, তাই না। আমি সংক্ষেপে বলি, হ্যাঁ।

–কিন্তু ঐ কী যেন…মেয়েটা সিমিংটনের বাড়িতে কাজ করত, সত্যিই বিশ্বাস করা কঠিন যে আমাদের মধ্যেই একজন খুনী রয়েছে।

-হ্যাঁ, কেমন যেন উদ্ভট ব্যাপার! আমি বলি।

কাপুরুষের কাজ, ইতর ভীরুতা—

আমি বললাম, বিলকুল!

.

লাঞ্চের মিনিট কয়েক আগে বাড়ি ফিরে দেখি জোয়ানা আনমনে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে আছে।

বাইরের বারান্দায় এসে দেখি দুখানা চেয়ার, দুটো খালি শেরীর গ্লাসের পাশে একটা বস্তু রয়েছে।

জিজ্ঞেস করলাম জোয়ানাকে, এটা কি?

-ওঃ, ওটা একটা ফটোগ্রাফ–রোগাক্রান্ত পিলের। আমি আগ্রহভরে ফটোগুলো দেখলাম। হয়তো জোয়ানা মিঃ গ্রিফিথের কাছে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেছিল।

যাই হোক, আমি ছবিগুলোকে রাখার জন্যে একটা বইয়ের সন্ধান করতে করতে বুককেসের তলার তাক থেকে একটা ভারী বই টেনে বের করি। কোনো এক বিস্ময়কর কারণে সেই ধর্মীয় গ্রন্থের পাতাগুলো অনায়াসে খুলে গেল। দেখলাম, বইটার মাঝখান থেকে অনেকগুলো পাতা পরিচ্ছদভাবে কেটে নেওয়া হয়েছে। ১৮৪০ সালে প্রকাশিত। আর কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয় যে, এই বইয়ের পাতাগুলো থেকে বেনামী চিঠির শব্দগুলো কেটে সাজানো হয়েছে।

সন্দেহের তালিকায় প্রথমেই এমিলি বারটনের কথা মাথায় এল। কিন্তু তার ঘরে অন্য কোনো আগন্তুক অর্থাৎ সামাজিক প্রতিষ্ঠা সম্পন্ন কেউ আসতে পারে! সেও পাতাগুলো কাটতে পারে! প্যারট্রিজও কেটে নিতে পারে! এমিলির ড্রয়িংরুমে তো অনেকের অবাধ প্রবেশ ছিল। মিঃ পাই, এইমি গ্রিফিথ, মিসেস কলপ।

.

বইটা নিয়ে আমি আর জোয়ানা থানায় এলাম।

গ্রেভস ছিলেন না, শুধু ন্যাস। উনি বইটা পেয়ে উল্লসিত হলেন এবং পরীক্ষার জন্য পাঠালেন। আমার আর প্যারট্রিজের আঙুলের ছাপ ছাড়া কিছু পেলেন না তিনি। ঝাড়পোঁচ করার জন্যেই প্যারট্রিজের হাতের ছাপ রয়েছে।

ন্যাস আর আমি উত্রাইয়ের পথে হেঁটে চললাম।

ন্যাস বললেন, জাল ক্রমশ গুটিয়ে আনছি মিঃ বার্টন। এখন বাকি মিস গিঞ্চ। কাল বিকেলে এক মক্কেলের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল আর মক্কেলের বাড়ি সিমিংটনের বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে হয়। এছাড়া মিসেস সিমিংটনের আত্মহত্যার দিনটিই ছিল গিঞ্চের সিমিংটনের অফিসে শেষ কাজের দিন। ঐদিন সে বেলা তিনটে থেকে চারটের মধ্যে কিছু বেশি দামের স্ট্যাম্পের ঘাটতি পড়ায় অফিস থেকে কিছুক্ষণের জন্য বের হয়। কাজটা বেয়ারা দিয়েও হতে পারত কিন্তু উনি বলেন তার মাথা ধরেছে, একটু ভোলা বাতাসের প্রয়োজন। এইটুকু সময়ই একটা চিঠি গুঁজে ফিরে আসার পক্ষে যথেষ্ট। তবে প্রতিবেশী কেউ তাকে দেখেনি।

-আপনার থলিতে আর কি আছে?

-মিস গ্রিফিথ। উনি কাল ব্রেনটনে গার্ল মিটিং-এ গিয়েছিলেন। ফিরেছিলেন অনেক দেরিতে। তাকে তত বেশ স্থির বুদ্ধির মহিলা বলেই মনে হয়।

আগের সপ্তাহেও বাক্সের মধ্যে তিনি চিঠি গুঁজে এসেছিলেন?

 –হতে পারে। কাল বিকেলে একটু জলদিই বাজারে গিয়েছিলেন। আর আগের হপ্তায় হেঁটে গিয়েছিলেন সিমিংটনের বাড়ি ছাড়িয়ে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে।

আমি ধীরে ধীরে বলি, তাহলে কেটেছেটে চারজন দাঁড়াচ্ছে সন্দেহের তালিকায়, মিস গিঞ্চ, মিঃ পাই, মিস গ্রিফিথ আর মিস বারটন?

-ও, না না। আরো গোটা দুয়েক এবং মিসেস কলQপও রয়েছেন। উনি নাকি কাল বিকেলে জঙ্গলে পাখি অবলোকন করছিলেন–পাখিরা তো তার হয়ে সাক্ষী দেবে না?

আওয়েন গ্রিফিথকে দেখে ন্যাস ওর দিকে তাকালেন।

–হ্যালো ন্যস। আমাকে নাকি খুঁজছিলে?

–হ্যাঁ, শুক্রবারে ময়নাতদন্ত, যদি আপনার পক্ষে সুবিধাজনক হয়।

–ঠিক আছে। আজ রাতেই পোস্টমর্টেম করব।

–আচ্ছা মিঃ গ্রিফিথ, মিসেস সিমিংটন কিছু তৈরি ঔষুধ, পাউডার খাচ্ছিলেন, সেটা একটু বেশি মাত্রায় পড়লে মৃত্যু ঘটতে পারত?

-যদি অবশ্য একসঙ্গে পঁচিশ ডোজ খেতেন। তবে তাঁর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে কোনো সন্দেহই থাকতে পারে না, পরিষ্কার সায়ানাইড বিষ। সায়ানাইডে মৃত্যু অনিবার্য, কিন্তু উনি যদি ঘুমের ঔষধ খেতেন বেশি ডোজে, তাহলেও আপনি রুগীকে ফের সুস্থ করে তুলতে পারেন, মানে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাপারটা ঘটলে।

 গ্রিফিথকে ন্যাস ধন্যবাদ জানালো। ও বেরিয়ে গেল। আমিও ন্যাসের কাছে বিদায় চেয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। জোয়ানা বেরিয়েছে। টেলিফোনের খাতাটাতে লেখা, ডাঃ গ্রিফিথের ফোন এলে যেন বলি, মঙ্গলবারে আমি পারছি না, একেবারে বুধ বা বৃহস্পতিবারে যাওয়া সম্ভব হবে।

হঠাৎ বিরক্তি জাগল, আওয়েনের হঠাৎ আসায় ন্যাসের উল্লেখিত আরো দুজন কথোপকথনে আমাদের ছেদ টানতে হয়। কে হতে পারে সেই আরো দুজন সম্ভাব্য ব্যক্তি?

আমার চেতনায় অনেকগুলো নাম ঘুরপাক খাচ্ছিল। আমি ড্রয়িংরুমে একটা চেয়ারে বসে চিন্তা করতে থাকি। ঘুম প্রায় এলো বলে।

দু-এক মিনিট ঘুমিয়েছি কিনা সন্দেহ একটা সজোর কণ্ঠস্বরে ঘুম ভেঙে গেল।

–এ ব্যাপার বন্ধ করতেই হবে। এইসব চিঠি, খুন। অ্যাগনেসের মতো নির্দোষ মেয়েদের খুন হওয়া চলতে দেওয়া যায় না।

 আমি চমকে উঠে বসি, বলি, কি করতে বলেন আপনি? পুলিশ তো যথাসাধ্য করছে।

–তাদের কাজের নমুনা তো দেখতেই পাচ্ছি। অ্যাগনেস খুন হয়ে গেল। আমি একজন সত্যিকারের বিশারদকে ডেকে আনতে যাচ্ছি। আমি যার কথা বলছি উনি চিঠি বিশারদ না হতে পারেন, কিন্তু তিনি মানুষ চেনেন। যিনি বদমায়েশি সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল।

আমি কিছু বলতে যাবার আগেই তার প্রস্থান ঘটেছে।

.

১০.

 অ্যাগনেসের ময়না তদন্তের আদালত বসলো। রায় বের হলো অজ্ঞাত ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণ দ্বারা হত্যা।

প্রায় প্রত্যেকের চোখেই আশঙ্কা, আধা উৎসুক চাহনির ঝিলিক।

সন্ধ্যা হলেই জোয়ানা আর আমি জানালার পর্দা টেনে সম্ভাব্য নামগুলো নিয়ে খতিয়ে দেখার আলোচনাই চালাই।

এরমধ্যে এমিলি বারটন চা খেতে এসেছিলেন। মেগান এসেছিল লাঞ্চে। মিঃ গ্রিফিথ তার প্র্যাকটিস নিয়ে ব্যস্ত। একদিন পাইয়ের ওখানে শেরী পান করে এলাম। এরপর একদিন গেলাম ভিকার সাহেবের বাড়িতে।

দেখলাম, মিসেস কলপের সেই শেষ সাক্ষাৎকারের মারমুখী মেজাজ শান্ত হয়ে গেল। উনি এখন ফুলকপি আর বাঁধাকপির চারাগুলো নিয়ে ব্যস্ত।

অতিথি মিস মারপল খবরটা শুনে স্বাভাবিকভাবেই চঞ্চল হয়ে উঠলেন। উনি অ্যাগনেস খুনের ব্যাপারে সমস্ত কিছু শুনলেন আমাদের মুখে। সবকিছু শুনে তিনি আশ্চর্য হলেন।

.

এর ঠিক দুটি রাত পরে আমি একা গাড়িতে করে ফিরছি হ্যাম্পটদ থেকে। অন্ধকার নেমে এসেছে, লিমস্টকে ঢোকার মুখে বাতিতে কিছু গণ্ডগোল হতে নেমে গোলমালটা সারিয়ে ফেললাম।

সামনেই অবস্থা দেখা যাচ্ছে কতকগুলো বাড়ির তার মধ্যে একটা মহিলা-ইনস্টিটিউট বাড়িটাও। মনের প্রবল ইচ্ছের তাড়নায় আমি সেখানে ঢুকতে চাইলাম। মনে হল কোনো আবছা গোপনকারী সটকে গেটের ভেতর ঢুকল।

গেটটা সামান্য খোলা ছিল, ঢুকে একটুখানি পথ গিয়ে, চারটে ধাপ সিঁড়ি উঠে দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ আমার পাশেই টের পেলাম একটা মেয়েদের পোশাকের খসখস শব্দ।

আমি চট করে বাড়িটার কোণায় গেলাম। তারপর বাড়ির পেছনে। আমার দুফুট দূরেই একটা খোলা জানলা ছিল।

গুটি মেরে শোনার চেষ্টা করেও কিছু শুনতে পেলাম না। কিন্তু আমার দৃঢ় ধারণা হল কেউ ভেতরে রয়েছে।

আমি জানালার গ্রিলের ওপর ঝুঁকতে গিয়ে একটু আওয়াজ করে ফেলেছি। তখুনি একটা ক্ষীণ শব্দ পেলাম। পকেটে টর্চ ছিল, বোতাম টিপতেই শুনি–নেভান ওটা।

উনি আমাকে পাকড়ে একটা দরজার ভেতরে নিয়ে এসে বললেন, মিঃ বার্টন, ঠিক এই মুহূর্তটাতেই আপনার এখানে আসার সময় হল?

–দুঃখিত, ক্ষমা চেয়ে নিলাম।

কাউকে দেখেছেন?

–সঠিক বলতে পারছি না, মনে হল সামনের গেট দিয়ে কাউকে ঢুকতে দেখলাম।

ব্যাপারটা ঠিকই। একজন কেউ এসেছিল। একজন বেনামী চিঠির লেখক চিঠি না লিখে থাকতেই পারে না, এই তথ্য নির্ভর করে আমি এখানে এসেছি। সে একই মেশিনে ওগুলো টাইপ করতে চাইবে। অন্য মেশিন বা হাতে লেখার ভরসা পাবে না।

এরপর রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে আসি। আমার গাড়ির পাশে একটা আবছা ছায়া। চিনতে পারলাম মেগানকে।

হ্যালো, এখানে কি করছিলে মেগান?

–আমি তো বেড়াতে বেরিয়েছি। রাতে বেড়াতে ভালোবাসি। রাতে সবকিছু কেমন রহস্যময় হয়ে ওঠে।

আমি ওকে গাড়ি করে পৌঁছে দিলাম বাড়িতে। সিমিংটন মেগানের ওপর রাগ করলেন। আমার দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, আপনিই ওকে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন বলে ধরে নিতে পারি। ভাবলাম ঐভাবেই প্রশ্নটা থাক।