০১. প্লাস্টারের বাঁধন

ভিক্টোরিয়া ভিলা

০১.

অবশেষে ডাক্তাররা আমাকে প্লাস্টারের বাঁধন থেকে মুক্তি দিয়েছেন। তারপর তারা আমাকে নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া করেছেন মনের সুখে, নার্সরা জ্ঞান দিয়েছেন যেন খুব সাবধানে হাত-পা গুলো ব্যবহার করি। ডাক্তার মার্কাস কেন্ট বলেছেন এবার যেন কোনো গ্রামে গিয়ে বসবাস করি। উত্তম হাওয়া শান্ত জীবন আর কর্মহীন থাকাই আমার একমাত্র প্রেসক্রিপশন। আমার বোন আমার দেখাশোনা করবে।

জবাব না পাওয়ার ভয়ে জিজ্ঞেসই করিনি, আবার আকাশে প্লেন নিয়ে উড়তে পারবো কিনা। গত পাঁচমাসে একবারও জিজ্ঞেস করিনি যে, আমাকে এরকম চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতে হবে কিনা।

আমি জানি পঙ্গু হওয়ার অবস্থা আমার হবে না। পা দুটো আমি ঠিক চালাতে পারব।

বড়ো খাঁটি ডাক্তার এই কেন্ট। তিনি বললেন, এখন বেশ বুঝতে পারছি, তোমার ঝটপট সেরে ওঠার জন্যে ধৈৰ্য্যচুতি হলে চলবে না। প্রশ্নটা যেখানে স্নায়ু আর পেশি শক্ত করার সেখানে মগজই শরীরকে মদত দেবে। এতদিন ধরে নানা ঔষধপত্রের ফলে তোমার স্নায়ু দুর্বলতা দেখা দিয়েছে আর সেজন্যে তোমার গ্রামে গিয়ে শান্ত, সুস্থির জীবন-যাপন করো। গ্রামে একটা বাড়ি বানিয়ে ফেল। পড়শীদের স্থানীয় কেচ্ছাগুলো উপভোগ করো।

অবশেষে তাই হল, জোয়ানা (আমার বোন) আর আমি বাড়ির দালালদের কাছে সারা বৃটিশ দ্বীপপুঞ্জের সুন্দর বাড়ির তালিকা পাগলের মতো ঘেঁটে শেষে লিমস্টকের লিটলফার্জ বাড়িটা পছন্দ করলাম। ঐ অঞ্চলটা বা সেখানকার কাউকে আমরা চিনি না।

ছিমছাম একতলা, সাদা বাড়ি, ভিক্টোরিয়ার আমলের ঢালু, সবুজ রঙের বারান্দা।

এ বাড়ির মালিক বারটন পরিবারের সবাই অবিবাহিতা মহিলা, তাদের মধ্যে এখন একমাত্র জীবিতা সদস্যা কনিষ্ঠা মিস এমিলি বারটন। ছোটোখাটো মিষ্টি বুড়ি কেমন নরম সুরে জোয়ানকে বোঝালেন, এ বাড়িতে আগে কাউকে ভাড়া দেওয়া হয়নি, পারলে কখনো দিতেনও না, কিন্তু এখন ট্যাক্সের বোঝা, স্টক আর শেয়ারের গচ্ছিত টাকা থেকে কিছুই প্রায় আয় হচ্ছে না। দিনকাল কত কঠিন হয়ে পড়েছে। আর তোমাকে দেখে আমার মনে হচ্ছে এ বাড়িটায় একটা নবীন জীবনের প্রয়োজন। তবে একটা কথা, এখানে কোনো বেটাছেলেকে থাকতে দিতে আমার আপত্তি আছে ভাই।

কথাবার্তার এই পর্যায়ে জোয়ানা আমার ব্যাপারটা খুলে বলতেই মিস এমিলি সামলে নিয়ে বললেন, ওহো, বড়ো দুঃখের কথা! উড়তে গিয়ে অ্যাকসিডেন্ট? তাহলে তোমার ভাই তো প্রায় পঙ্গুই একরকম..

ধরেই নেওয়া যায় এমিলি বারটনের যা ভয় তেমন কোনো পুরুষোচিত কাজকর্ম আমি করি না। ভীরু কণ্ঠে এমিলি জানতে চায় যে আমি ধূমপান করি কিনা। জোয়ানা বলে, বাব্বা জাহাজের চিমনির মতো! তবে আমিও সিগারেট খাই।

–তা তো বটেই! আমারই বোকামি। বুঝলে ভাই, আমার বোনেরা সব বেশি বয়সের ছিলেন, মাও বেঁচে ছিলেন ৯৭ বছর অবধি। যথেষ্ট বাছবিচার ছিল। তবে হ্যাঁ, আজকাল সবাই ধূমপান করে। একটা ব্যাপার, এ বাড়িতে কোনো ছাইদানি নেই।

জোয়ানা বলে, ছাইদান আমরা অনেকগুলো আনবো।

অতএব ফয়সালা হলো। ছ-মাসের জন্যে আমরা ভাড়া নিলাম। আরো তিন মাসের আগাম ভাড়ার অভিপ্রায় জানানো রইল। জোয়ানাকে মিস বারটন জানালেন, এ বাড়ি ছেড়ে গেলেও তাঁর নিজের কোনো অসুবিধে হবে না। তারই এক পুরনো পরিচারিকা বিশ্বাসী ফ্লোরেন্সের হেপাজতে দু-কামরা ঘরে চলে যাবেন তিনি। ফ্লোরেন্স ওঁদের সঙ্গে পনেরো বছর বসবাস করে অবশেষে বিয়ে করেছে। স্বামী বাড়ি তৈরির ব্যবস্থা করে। হাই স্ট্রিটে সুন্দর বাড়ি বানিয়েছে। সেখানে খুব আরামেই থাকব।

চুক্তিপত্রে সই হলো। মিস এমিলির আগের ঝি প্যারট্রিজ রাজী হয়েছিল আমাদের সঙ্গে থাকতে। সে মাঝবয়সী, একটু মোটা বুদ্ধির একগুয়ে স্ত্রীলোক। তার তদারকিতে থাকতে পেরে আমরাও দায়মুক্ত হলাম। তবে দেরি করে রাত্রিভোজন সে পছন্দ করতো না।

লিটল ফার্জে থাকার এক হপ্তা পর মিস এমিলি একদিন তার নামের কার্ড রেখে গেলেন। তার দেখাদেখি উকিলপত্নী মিসেস সিমিংটন, ডাক্তারের বোন মিস গ্রিফিথ প্রায়র্স-এন্ডের মিঃ পাই ওরাও এসে যে যার কার্ড রেখে গেলেন।

চমৎকৃত জোয়ানা বলল, জানতাম না লোকে সত্যি সত্যিই এরকম কার্ড দিয়ে দেখা করে! জোয়ানার চেয়ে আমি বছর পাঁচেকের বড়ো। ছেলেবেলায় আমাদের বেঢপ, মস্ত সাদা অগোছালো বাড়িটার কথা মনে পড়ে। আমার বয়স যখন সাত, জোয়ানা তখন দুই, আমরা গেলাম লন্ডনে এক পিসির বাড়ি। এর পরে ক্রিসমাস, ইস্টারের ছুটিগুলো আমাদের কাটতে লাগল পুতুলনাচ, নৌ-বিহার আর স্কেটিং করে। আগস্ট মাসে আমাদের নিয়ে যাওয়া হত সমুদ্রের ধারে এক হোটেলে।

এখন আমার পঙ্গুত্বের কথা চিন্তা করে মনে আশঙ্কার খোঁচা লাগে। জোয়ানাকে বলি, এখানে থেকে তোকে কতকিছুই না খোয়াতে হবে।

কারণটা হল জোয়ানা বেশ সুন্দরী, স্ফুলিঙ্গ, নাচের আসরে ককটেল ভালোবাসে, প্রেম ট্রেম, জোরালো বেগে গাড়ি হাঁকানো সে পছন্দ করে। জোয়ানা হেসে বলে, এর জন্য তার কোনো হেরফের হবে না।

জোয়ানার প্রেমের ঘটনাগুলো প্রায় একই খাতে চলে বরাবর। একেবারে মেরুদণ্ডহীন ছোকরাগুলো যাদের কোনো প্রতিভা নেই, তাদের জন্যে সে প্রেমে পাগল হয়ে ওঠে। তাদের পরিচিতি দেবার জন্যে আপ্রাণ খাটে। তারপর তারা যখন অকৃতজ্ঞ বলে ধরা পড়ে তখন জোয়ানা মর্মাহত হয়। এই বুক ভেঙে যাওয়া ব্যাপারটা মোটামুটি তিনহপ্তা স্থায়ী হয়, যতক্ষণ না আবার একটি গোমড়ামুখো ছেলের আবির্ভাব হয় ওর জীবনে তাই জোয়ানার ভাঙা হৃদয়কে আমি তেমন গুরুত্ব দিই না।

তবে এটা খেয়াল করলাম আমার আকর্ষণকে বোনটির কাছে পাড়াগাঁয়ের জীবন যেন একটা নতুন খেলার মতো লাগছে।

সেদিন দেখলাম একটা স্কার্ট পরেছে উৎকট চেকে, তার ওপর ঝুলিয়েছে হাস্যকর একটা ছোটো হাতার জার্সি। পায়ে সিল্কের মোজা, আনকোরা ব্রোগ জুতো।

আমি বললাম, তোকে খাপছাড়া লাগছে। তোর উচিত ছিল, একটা টুইডের স্কার্টপরা আর সবুজ কিংবা রংচটা হলে আরো ভালো হত। সুন্দর উলের জাম্পার আর একটা কার্ডিগান তাহলে তুই লীমস্টকের পটভূমির সঙ্গে মিশে যেতে পারতিস।

জোয়ানা হেসে বলল, তুমি ভেবেছ ওরা আমাকে ভীষণ কিছু মনে করবে? আমি বললাম, না, ভাববে উদ্ভুটে।

আমাদের দর্শনাকাঙ্খী প্রতিবেশীর কার্ডগুলো এরমধ্যে পড়ে দেখতে শুরু করেছিল জোয়ানা। কোনো কারণে ভিকার পত্নীর কার্ডটাই তার দৃষ্টি কেড়েছে। হঠাৎ সোৎসাহে সে বলল, জেরি! যাই বলল, এটা বেশ মজার জায়গা। এখানে কোনো বাজে ব্যাপার ঘটতে পারে তা যেন ভাবাই যায় না বলো?

জানতাম কথাটা ঠিক নয়, তবু ওর সঙ্গে একমত হলাম। ভাবতে আজব মনে হয় যে ঠিক একসপ্তাহ বাদেই আমরা সেই পয়লা নম্বর চিঠিটা পেলাম।

আমি শুরুটা ঠিকভাবে করিনি। লিমস্টকের কোনো বর্ণনাই দিইনি। জায়গাটা কেমন সেটা না বুঝলে আমার গল্পটা বোঝাই সম্ভব হবে না।

প্রথমেই বলি, লিমস্টকের মূল আছে অতীতের ইতিহাসে। নর্মান বিজয়ের সময় লিমস্টক ছিল গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, তার প্রধান কারণ অবশ্য ধর্মীয়। একটা মঠে পরপর অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও শক্তিশালী মঠাধ্যক্ষ দীর্ঘদিন কাজ চালিয়েছেন। আশপাশের গ্রামের লর্ড আর ব্যবসায়ীরা নিজেদের কিছু জমি ছেড়ে দিতেন মঠকে। লিমস্টকের মঠ তাই কয়েক শতাব্দী ধরে ধনে-মানে ফুলে ওঠে ক্ষমতা জাহির করছে। অবশ্য যথাকালে অষ্টম হেনরির পাল্লায় পড়ে তাদের ভাগ্য দাঁড়ায় অন্য সহযাত্রীদের মতো। সে সময় শহরে জাঁকিয়ে উঠেছিল একটা ঝড়। তবুও তারা তখন কিছু ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।

অবশেষে ১৭০০ সাল বা কাছাকাছি সময়ে প্রগতির জোয়ারে লিমস্টক ভেসে গেলো পেছনের এদো খাঁড়িতে। ধসে পড়ল গড়। লিমস্টকের কাছাকাছি রইল না কোনো বড় সড়ক বা রেলপথ। একটা ছোটোখাটো গ্রাম্য বাজার শহর, জলাভূমি নিয়ে শান্ত আবাদ আর ক্ষেতজমি গজিয়ে উঠল।

সপ্তাহান্তে একদিন গরু ভেড়ার পালের হাট বসে। বছরে দুবার নাম না জানা ঘোড়াদের রেস হয়। একটা চমৎকার সদর রাস্তা (হাইস্ট্রিট) রয়েছে। একটা পোশাকের দোকান, ডাকঘর, দুটো কসাইখানা আর একটা আন্তর্জাতিক বিপণী। একজন ডাক্তার আর মেসার্স গ্যালব্রেথ এ্যান্ড সিমিংটন নামের আইন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানটি। একটা বিপুলায়তন গির্জা ১৪২০ সাল থেকে দাঁড়িয়ে আছে। পাশেই একটা স্কুলবাড়ি, দুটো শবখানা। এই হলো লিমস্টক। এমিলি বারটনের উস্কানিতে কেউ কেটা যেই হোক একবার এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করে যায়। এখানকার সবকিছুর মধ্যেই একটা নতুন মজার স্বাদ পাই। ডাক্তার কেন্টের উপদেশ মনে পড়ে স্থানীয় কেচ্ছাগুলো উপভোগ করবে কিন্তু সেসব কেচ্ছা আমার নজরে আসবে কোনদিক দিয়ে?

আজব ব্যাপার, চিঠিখানা যখন এল, তখন যে অন্য কিছুর চেয়ে আমরা মজাটাই পেলাম বেশি। চিঠিটা এসেছিল আমাদের প্রাতঃরাশের সময়ে। পরে খুলব ভেবে খামটা উল্টে রেখে দিয়েছিলাম। শুধু নজরে পড়েছিল ওটা একটা স্থানীয় চিঠি ঠিকানাটা টাইপ করা। লন্ডনের ডাক ছাপমারা বাকি দুখানা চিঠির আগে ওটাই প্রথম খুললাম, কারণ বুঝেছিলাম, লন্ডনের দুটোর মধ্যে একটায় আছে বিল, আরেকটায় আত্মীয়ের ঘ্যানর ঘ্যানর বকুনি।

চিঠি খুলে দেখি একখণ্ড কাগজের ওপর কিছু ছাপা অক্ষর আর শব্দ আঠা দিয়ে সেঁটে আটকানো। দু-এক মিনিট কিছুই মাথায় ঢুকছিল না।

জোয়ানা চমকে উঠে বলল, ওটা কী…কী ওটা?

অত্যন্ত অভব্য ভাষায় চিঠিটার লেখক বলতে চেয়েছে যে জোয়ানা আর আমি ভাই-বোন নই।

আমি প্রাথমিক চমক কাটিয়ে বললাম, ওটা একটা জঘন্য বেনামী চিঠি।

জোয়ানা উৎসাহে চঞ্চল হয়ে বলে, কী লিখেছে চিঠিটাতে?

এধরনের বেনামী চিঠি মহিলাদের দুর্বল স্নায়ুকে আঘাত করতে পারে তাই তাদের বাঁচাতে কেউ এ ধরনের জিনিস তাদের দেখায় না। আমার মাথায় এটা একেবারেই আসেনি তাই আমি ওর হাতে চিঠিটা দিয়ে দিলাম।

ও চিঠিটা পড়ে বলল, কি বিচ্ছিরি নোংরা চিঠি! এধরনের বেনামী চিঠি আগে কখনও দেখিনি। এগুলো কি এই ধরনেরই হয়?

-তা বলতে পারি না। তবে এ অভিজ্ঞতা আমারও এই প্রথম।

–ওরা হয়তো মনে ভেবেছে আমি কোনো ঘরছাড়া নষ্ট স্ত্রীলোক।

-সে তো বটে। আমাদের বাবা ছিলেন চৌকো চোয়াল, কালচেপানা, দীর্ঘ চেহারার মানুষ। আর মার নীল চোখ, হালকা কটা চুল, বেঁটেখাটো। এবার আমি দেখতে হয়েছি বাবার মতো আর তোর মিল মার সঙ্গে।

–ঠিক, একেবারেই মিল নেই আমাদের চেহারায়। কেউ ভাই-বোন বলে ভাববে না। তবে ব্যাপারটা একটা ভয়ানক তামাশা বলে মনে হচ্ছে।

সবচেয়ে ভালো, ঘেন্নার আওয়াজ করে ওটাকে আগুনে ছুঁড়ে দেওয়া।

যেমন বলা, কাজটাও হল তেমনি। হাততালি দিয়ে উঠল জোয়ানা। তারপর ও বাইরের রোদে বেরিয়ে গেল। আমি প্রাতঃরাশের পরের সিগ্রেটটা ধরিয়ে ভাবতে লাগলাম, জোয়ানা ঠিক কথাই বলেছে, কেউ আমাদের এখানে আসাটা অপছন্দ করছে। হেসে উড়িয়ে দিলেই ভালো, কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে ব্যাপারটা মোটেই মজার নয়।

সেদিন সকালে এলেন ডাক্তার গ্রিফিথ। তার সঙ্গেই সপ্তাহে সপ্তাহে একবার করে শরীর পরীক্ষার বন্দোবস্ত করে নিয়েছিলাম। গ্রিফিথকে আমার পছন্দই হয়। কেমন যেন থেমে থেমে কথা বলেন, লাজুক প্রকৃতির মানুষ।

জানালেন, আমার স্বাস্থ্যের উন্নতি যথেষ্ট উৎসাহজনক। বললেন, আজ সকালে কি একটু ঠান্ডা লাগিয়ে ফেলেছেন?

-না। ঠিক তা নয়। সকালের কফির সঙ্গে একটা বিশেষ ধরনের কুৎসাভরা বেনামী চিঠি পাই, বোধহয় তারই বিশ্রী স্বাদটা মুখে লেগে আছে।

উত্তেজিত মুখে ডাক্তার ধপ করে মেঝের ওপর হাতব্যাগটা রাখলেন। বললেন, বলতে চান আপনিও ঐ একইরকমই চিঠি পেয়েছেন?

–তার মানে? এরকম ব্যাপার কি চলছে?

–হা কিছুদিন ধরে। কি লিখেছে চিঠিতে।

-ও, তাই বলুন। আমি ভাবছিলাম, বাইরের লোক হিসেবে আমাদের এখানে আসাটা কেউ পছন্দ করছে না। যাই হোক, আপনাকে বলতে আমার আপত্তি নেই। চিঠিটায় স্রেফ একথাই বলেছে আমি সঙ্গে করে যে শখের পায়রাটিকে এনেছি সে মোটেই আমার বোন নয়। সৎ বোনও নয়।

ডাক্তারের মুখখানা রাগে লাল হয়ে গেল। বললেন, কি ইতরামো! তবে কি জানেন, এসব বিকৃত মানসিকতা। মাথা নেড়ে সায় দিই, কে এর পেছনে আছে ধারণা করতে পারেন কিছু?

-না, তবে এটা একজন বিশেষ লোক বা কিছু লোকের বিরুদ্ধে কাদা ছোঁড়া, মানে অভিসন্ধিমূলকই বলা চলে। সেক্ষেত্রে পত্রলেখকের কারুর প্রতি নির্দিষ্ট রাগ থাকে বা শোধ ভোলার জন্যে সে একটা জঘন্য কারচুপির রাস্তা ধরে। পত্ৰলেখক হয় কোনো খেদিয়ে দেওয়া ভৃত্য, নয়তো হিংসুটে স্ত্রীলোক এইরকম আর কি! এধরনের চিঠিগুলো এলোমেলো পাঠানো হয়, আর পাগলামিটা বেড়েই চলে।

গত বছর এই জেলার অন্য দিকটায় এরকম কিছু বিশ্রী ঘটনায় ধরা পড়ল একটা বড় পোশাক কারখানার মার্জিত রুচির শান্ত ধরনের এক মহিলা। আমি নিজে এরকম একখানা চিঠি পেয়েছি। উকিল সাহেব সিমিংটন একখানা পেয়েছেন। এছাড়া আমার গরীব পেশেন্টদের মধ্যেও কেউ কেউ পেয়েছেন।

–সবগুলোই মোটামুটি এই ধরনের?

-হা হা। যৌন সম্পর্কের ওপরেই আসল বক্তব্য, সিমিংটনের চিঠিতে বলা হয়েছিল তিনি নাকি তার মহিলা কেরানীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক রেখেছেন। বেচারি মিস গিঞ্চ, বয়েস চল্লিশ, খরগোসের মতো দাঁত উঁচু। সিমিংটন সোজা গেলেন পুলিশের কাছে। আমার চিঠিগুলোতে অভিযোগ, আমি আমার মহিলা রোগীনীদের সঙ্গে পেশাগত ভদ্রতা লঙ্ঘন করেছি। সবই স্রেফ ছেলেমানুষি, তবু বলব আমি ভয় পেয়েছি। আর কখনো কখনো বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, বুঝলেন।

-তা তো বটে। আমার চিঠিটা অশিক্ষিত ধরনের লেখা, মনে হয় এমন কেউ লিখেছে যে বলতে গেলে লেখাপড়াই শেখেনি।

-তাই বুঝি? বলে গ্রিফিথ বিদায় নিলেন।

এই তাই বুঝি-কথাটা আমার মনকে বড় অশান্ত করে তোলে।

.

০২.

 ঐ বেনামী চিঠি প্রাপ্তি মুখে একটা বিস্বাদ রেখে দিলেও অল্প কদিনে মন থেকে মুছে গেছে।

পরবর্তী ঘটনা ঘটল প্রায় এক হপ্তা বাদে। প্যারট্রিজ জানালো, আমাদের রোজকার কাজের মেয়ে বিয়েট্রিজ আজ আসবে না। কারণ স্যার, খবর পেলাম মেয়েটা একেবারে অস্থির হয়ে পড়েছে।

আমি ভাবলাম, বিয়েট্রিজের হয়তো পেটের গণ্ডগোল হয়েছে। তাই বললাম, দুঃখিত, তবে আশা করি শীগগিরই সেরে উঠবে। প্যারট্রিজ বলল, না স্যার, মেয়েটা ভালোই আছে, তবে একখানা চিঠি পেয়ে ওর মন অস্থির হয়ে পড়েছে…ওতে কিছু খারাপ ইঙ্গিত করা হয়েছে।

প্যারট্রিজের চোখের কঠিন ভাব আর ইঙ্গিত কথাটার ওপর বিশেষ জোর আমাকে শঙ্কিত করে তুলল–তবে কি আমাকে জড়িয়েই কোনো ইঙ্গিত। কিন্তু বিয়েট্রিজ সম্পর্কে আমি এতই অজ্ঞ যে ওকে শহরের মধ্যে দেখলে আমি চিনতেই পারব না। চটা মেজাজে বললাম, কী সব বাজে কথা বলছো?

মেয়েটির মাকে তো এ কথাটাই বোঝালুম। এ বাড়িতে আমার তদারকিতে কোনো কাণ্ডকারখানা কখনো ঘটেনি, ঘটবেও না। আর বিয়েট্রিজের ব্যাপার? আসল সত্যিটা হল, ও ঐ গ্যারেজের যে ছোকরাবন্ধুর সঙ্গে ঘোরাফেরা করে, সেও ঐরকম একটা নোংরা চিঠি পেয়েছে।

আমি রেগে গিয়ে বললাম, এমন ঘটনা আমি জীবনে কখনো শুনিনি।

–আমার মতে স্যার, ও মেয়েটাকে বিদায় করতে পারলেই ভালো। বলতে চাইছি, আগুন না থাকলে ধোঁয়াও থাকবে না।

তখন ভাবিনি ঐ শেষ প্রবাদটা আমায় পরে কী দারুণ হয়রান করে তুলবে।

.

সেদিন সকালে একটু অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজেই গ্রামের দিকে হেঁটে যাবো ঠিক করলাম। (যদিও লিস্টককে গ্রাম বললে স্থানীয় লোকেরা আমার ওপর খেপে যাবে, তথাপি জোয়ানা আর আমি গোপনে এটাকে গ্রামই বলি।)

জোয়ানাকে আমার সঙ্গে যেতে কড়াভাবে বারণ করেছি, বলেছি, মনে রাখিস, যে একলা চলে সেই চলে জলদি। এছাড়া গ্যালব্রেথ সিমিংটনে যাব শেয়ারগুলো সরিয়ে আমার ব্যাপারে সইসাবুদ করতে, রুটিওয়ালার কাছে গিয়ে কিছু রাস্টরুটির ব্যাপারে নালিশ জানাব, ধার করা বইখানা ফেরৎ দেব। ব্যাঙ্কেও যাবো। ঠিক হল জোয়ানা গাড়ি করে আমায় তুলে নিয়ে আসবে যাতে লাঞ্চের সময়ে পাহাড়ে ফিরতে পারি।

আমি একাই এগোলাম। অবশ্য দুশো গজ যেতে না যেতে পিছন থেকে শুনি সাইকেলের ঘণ্টা, তারপর সজোরে ব্রেক কষতে গিয়ে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল মেগান হাটার।

উঠে হাত-পা নেড়ে মেগান বলল, হ্যালো।

মেগান মেয়েটাকে আমার বেশ ভালোই লাগে। ও হল উকিল সিমিংটনের সৎ মেয়ে অর্থাৎ মিসেস সিমিংটনের আগের বিয়ের সন্তান। মিস্টার হান্টার নাকি বিয়ের পর থেকেই স্ত্রীর ওপর জুলুম চালাতেন। বিয়ের বছর দুয়েকের মধ্যেই ঐ মহিলা ডিভোর্স নিয়ে ছোটো মেয়েটিকে নিয়ে লিমস্টকে বাস করতে শুরু করেন সব কিছু ভোলার জন্যে। শেষ পর্যন্ত রিচার্ড সিমিংটনকে বিয়ে করেন। দ্বিতীয় বিয়ের ফলে হয় দুটি ছেলে, যাদের প্রতি ভীষণ অনুরক্ত সিমিংটন দম্পতি। আমার ধারণা, মেগানের এক সময়ে এদের পরিবারে উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো মনে হয়। তার মায়ের খর্বাকৃতি, ম্রিয়মান চেহারার সঙ্গে তার কোনো মিলই ছিল না।

মেগান ঢ্যাঙা, বয়স কুড়ি যদিও দেখায় ষোলোর মতো, একরাশ বাদামী চুল, সবুজ চোখের তারা, আর মন কাড়া হাসি। পোশাকে একটা অগোছালো ভাব। এক নিশ্বাসে হুসহুস করে কথা বলে।

-বুঝলেন, ল্যাশারদের ঐ খামার বাড়িটায় হাঁসের ডিমের আশায় গিয়েছিলাম। কী চমৎকার সব খুদে খুদে শুয়োরের বাচ্চা। কী মিষ্টি। আপনি শুয়োর পছন্দ করেন? আমার তো ওদের গন্ধটা অবধি ভালো লাগে।

-তাই বুঝি?

–দেখলাম আপনি একা শহরের দিকে হেঁটে চলেছেন, তাই ভাবলাম নেমে আপনার সঙ্গে হাঁটি। বড্ড আচমকা সাইকেল রুখেছি।

কিন্তু তোমার মোজা ছিঁড়ে ফেলেছ। তুমি কি মোজা টোজা সেলাই করো না? তুমি এখন বড়ো হয়ে গেছ, সেটাই বোধহয় বোবঝা না।

-মানে বলতে চান, আমার উচিত আপনার বোনের মতো সেজেগুজে পুতুল হওয়া? ও বড় সুন্দর। আপনি একেবারেই ওর মতো নন। তাই না?

-ভাই-বোন সবসময় একরকম দেখতে হয় না।

–তা সত্যি। আমি যেমন ব্রায়ান বা কলিনের মতো নই। আবার ব্রায়ান কলিনের নিজেদের মধ্যেও কোনো মিল নেই। বড়ো মগজ গুলোনো ব্যাপার…

–কি?

–এই আত্মীয় পরিবার। সংক্ষেপে জবাব দেয় মেগান। আমিও সায় দিয়ে বলি, তাই হয়তো।

খানিকক্ষণ চুপচাপ হাঁটলাম দুজনে। তারপর লাজুক হেসে মেগান বলল, আপনি বুঝি প্লেন চালান?

-হ্যাঁ।

–উড়তে গিয়ে জখম হয়েছিলেন?

–হ্যাঁ, প্লেন ভেঙে পড়েছিল।

 –এ তল্লাটে কেউ প্লেন চালায় না।

–মেগান, তুমি প্লেনে উড়তে চাও?

যেন অবাক হয়ে গেল মেগান। আমি? না না। অসুস্থ হয়ে পড়লে…ট্রেনে চড়লেই অসুস্থ হয়ে পড়ি। তারপর একটু চুপ থেকে সরল শিশুর মতো বলে উঠল, আবার সেরে উঠলে প্লেন চালাতে পারবেন? নাকি ঠুটো জগন্নাথ হয়ে পড়ে থাকবেন?

–আমার ডাক্তার বলেছেন, আমি সম্পূর্ণ সেরে উঠবো। আমারও স্থির ধারণা আমি সেরে উঠবোই।

–তাহলে ভালোই। কিন্তু অনেক লোক বড় মিথ্যে কথা বলে। আমার ভয় ছিল আপনি বোধহয় চিরকালের মতো ঠুটো হয়ে থাকবেন, তাই আপনাদের অমন খাট্টা মেজাজ। তবে এটা স্বাভাবিক হলে অন্য কথা।

আমি শান্তভাবে বলি, আমি তো বদমেজাজী নই।

–তাহলে বলব, একটু তিরিক্ষি।

–তিরিক্ষি কারণ, তাড়াতাড়ি সুস্থ হওয়ার তাগিদ। কিন্তু এ ব্যাপারে তাড়াহুড়োটা তো কাজের নয়।

–তাহলে হুজুতি কেন?

–শ্রীমতি, কোনো কিছু তাড়াতাড়ি ঘটুক এ কি তুমি চাও না?

–না তা কেন চাইব? কোনো কিছু নিয়ে তাড়াহুড়ো করলে কিছুই ঘটে না।

–আমি প্রসঙ্গ বদলানোর জন্য বলি, এখানে নিজেকে নিয়ে তোমার কীভাবে সময় কাটে বল তো?

করার আর কী আছে? চোখ কুঁচকে ও বলে।

–মানে, তোমার কোনো শখ-টখ নেই কিংবা খেলাধুলা করো না? অথবা বন্ধুবান্ধব নেই?

খেলাধুলা আমি ভালোবাসি না। এদিকটায় কোনো মেয়ে নেই, যাও বা আছে তাদের ভালো লাগে না। ওদের ধারণা বড় বদখট।

-বাজে কথা। তা কেন ভাববে ওরা?

মেগান মাথা নাড়ল।

স্কুলে যাওনি পড়তে?

–হ্যাঁ। বছরখানেক আগে ছেড়ে এসেছি।

–স্কুল তোমার ভালো লাগেনি?

-মন্দ ছিল না। যদিও শেখানো হত, কিন্তু এলোমেলো। এর একটু ওর একটু। সস্তার স্কুল, বুঝলেন, শিক্ষকরাও ভালো না। কোনো প্রশ্নেরই সঠিক জবাব দিতে পারতেন না। কিন্তু শিক্ষিত হিসেবে প্রত্যেক শিক্ষকেরই সঠিক জবাব জানা উচিত। অবশ্য আমার মাথাটাও মোটা। তবু এত কিছু পড়ানো হয় যা আমার কাছে অখাদ্য মনে হয়। যেমন ধরুন ইতিহাস–একেকটা বইয়ে একেকরকম ব্যাখ্যা।

-আরে মজাটা তো সেখানেই।

–আর ব্যাকরণ; আজে-বাজে রচনা লেখা। শেলী, স্কাইলার্ক নিয়ে কিচিমিচি, তারপর ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেকপীয়ার।

-শেকস্পীয়র আবার কী গলতি করলেন? উদগ্রীব হয়ে প্রশ্ন করি।

–একটা কিছু বলতে গেলেই জড়িয়ে পেঁচিয়ে এমন জটিল করে তোলেন যে তার নাগালই পাই না। তবু তার কিছু লেখা আমার ভালো লাগে।

–আর কোনো বিষয় তোমার ভালো লাগে না?

-হ্যাঁ, অঙ্ক। অঙ্ক তো দারুণ লাগতো, তবে তেমন ভালো করে শেখান হয় না। আমি চাইতাম সত্যিকারের গণিত শিক্ষা।

এবার আমরা হাইস্ট্রিটের মুখে এসে পড়লাম। মেগান তীক্ষ্ণস্বরে বলল, ঐ গ্রিফিথ আসছে। ওকে ঘেন্না করি আমি। ঐ হতচ্ছাড়া গাইডের দলে ভেড়াবার জন্য আমার পেছনে পড়ে আছে। ইতিমধ্যে হুড়মুড় করে ঘাড়ের ওপর এসে পড়ল মিস গ্রিফিথ। একটু পোড়খাওয়া পুরুষালি ধরনের হলেও বেশ সুদর্শনা।

হেঁকে বললেন, এই যে দুজন। মেগান, তোমাকেই খুঁজছিলাম। কনজার্ভেটিভ এ্যাসোসিয়েশনের জন্যে কিছু খামে ঠিকানা লিখবার লোক চাই।

মেগান বিড়বিড়য়ে কিছু বলেই সাইকেলে চলে সুট করে কেটে পড়ল।

তাকে লক্ষ্য করে গ্রিফিথ বললেন, অস্বাভাবিক হর্দ কুঁড়ে মেয়ে। ওর মা অনেকবার চেষ্টা করেছে ওকে একটা কিছুর মধ্যে লাগিয়ে দেবার–শর্টহ্যান্ড, টাইপ কিংবা রান্না-বান্না। কিন্তু ওকে নিয়ে ওর মায়ের দারুণ হতাশা। হ্যাঁ, সবাই তো এক ছাঁচের হয় না। আমি নিজের জীবন ভালোবাসি, তাই চাই যে অন্যরাও জীবনটাকে উপভোগ করুক। এই গ্রামদেশেই আমি সদাব্যস্ত, সবসময় সুখী। গ্রামে একটা না একটা কিছু ঘটছেই। গাইডদের নিয়ে, নানান কমিটি নিয়ে আমার সময় কেটে যায়।

ঠিক এই সময় মিস গ্রিফিথ রাস্তায় তার এক পরিচিত ব্যক্তিকে দেখতে পেয়ে হাঁক পেড়ে ছুটলেন। আমিও রেহাই পেয়ে এগোলাম ব্যাঙ্কের দিকে।

 আমি মিস গ্রিফিথের জীবনীশক্তির তারিফ করি। ব্যাঙ্কের কাজটা ভালোয় ভালোয় মিটে গেলে আমি চললাম, গ্যালব্রেথ অ্যান্ড সিমিংটনের দপ্তরে। দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত আইনব্যাবসার পুরানো স্যাঁতসেতে গন্ধটা আমার নাকে ভালো লাগে। দেখলাম প্রচুর দলিল বাক্স রয়েছে, তাতে লেবেল সাঁটা লেডি হোপ, স্যার এভারার্ড কার ইত্যাদি।

যে দলিলগুলো আমি সঙ্গে এনেছিলাম, মিঃ সিমিংটন সেগুলো ঝুঁকে পড়ে দেখছেন। ওঁকে খুঁটিয়ে দেখলাম, দীঘল গলা, কণ্ঠস্থি উঁচু, পাংশু মুখমণ্ডল। নাকটা সরু লম্বা। নিঃসন্দেহে সৎ স্বামী ও পিতা।

একটু পরে মিঃ সিমিংটন ধীরে, স্পষ্ট উচ্চারণে নিজের বক্তব্য বললেন। নিজের বক্তব্যের পেছনে যথেষ্ট বোধশক্তি ও তীক্ষ্ণ বিচার ক্ষমতা। আমি এরপর বেরিয়ে এলাম। বাইরের অফিসে এক বুড়োমানুষ কিছু লিখে চলেছে। আর উসকোখুশকো চুল, চোখে চশমা একজন মাঝবয়সী মহিলা টাইপ করে চলেছে সবেগে, টেবিলে ঝোঁক দিয়ে দিয়ে।

এরপর রুটিওয়ালার দোকানে গিয়ে কিউরাট রুটিটা সম্পর্কে একটু নালিশ শোনালাম। যথারীতি বিস্ময় ও অবিশ্বাসের সঙ্গে সব শুনে দোকানদার একটা গরম রুটি আমার বগলে খুঁজে দিয়ে বলল, এই এক্ষুনি চুল্লি থেকে নামল।

দোকান থেকে বেরিয়ে রাস্তার এধার ওধার দেখতে লাগলাম জোয়ানার আসার অপেক্ষায়, কিন্তু জোয়ানার কোনো হদিশ নেই। হেঁটে যথেষ্ট ক্লান্ত বোধ করছি।

হঠাৎ আমার চোখদুটো অবিশ্বাস্য বিস্ময় আর আনন্দে দেখল এক সাক্ষাৎ দেবী যেন ফুটপাথ ধরে আমার দিকে এগিয়ে আসছে।

নিখুঁত মুখশ্রী, কোঁকড়া সোনালি চুল, দীঘল সুগঠিত অঙ্গ। আমার এই গভীর উত্তেজনায় আমার মুঠো থেকে খসে পড়ল পাঁউরুটি আর একটা লাঠি। আর পিছলে গিয়ে আমিও পড়ি আর কি?

সেই দেবীর সবল বাহু আমাকে টেনে ধরল। আমি তোতলাতে লাগলাম–ধন্যবাদ অজস্র। আমি ভীষণ দুঃখিত।

মেয়েটা তার সদয় হাসির সঙ্গে উৎসাহ দিয়ে বলল, কোনো ধন্যবাদ নয়, আমার কোনো অসুবিধাই হয়নি। আমি নজর করিনি, অথচ জোয়ানা কোনো সময় রাস্তার কোণে আমার পাশটিতে গাড়ি এনে দাঁড় করিয়েছে। জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার?

নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, কিছু না এই ট্রয়ের হেলেন-টেলেনের কথা ভাবছিলাম।

–ওসব ভাবার কি আর জায়গা পেলে না? তুমি বগলে রুটি নিয়ে, হাঁ করে কিরকম বেখাপ্পা কায়দায় দাঁড়িয়ে আছে।

–শক খেয়ে গিয়েছিলাম। একবার ট্রয় দর্শন করিয়েই আমায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা হল। আমিও দূরে মিলিয়ে যাওয়া সুললিত ভঙ্গির দিকে দেখিয়ে বললাম, চিনিস নাকি? কে ও?

পেছন থেকে ভুরু কুঁচকে জোয়ানা বলল, ও সিমিংটনের বাচ্চাদের গভর্নেস। এই দেখে তুমি থ মেরে গেছ? দেখতে ভালো ঠিকই কিন্তু ভাদভ্যাদে।

–জানি সদয় সুশ্রী মেয়ে। আর আমি ভেবে বসেছিলাম প্রেমের দেবী অ্যাফ্রোদিতে।

জোয়ানা গাড়ির দরজা খুলল, আমি ঢুকলাম। বলল, বেশ মজার ব্যাপার তাই না। কিছু লোকের রূপ আছে কিন্তু আবেদন একেবারেই নেই। তাদের দেখে বেশ দুঃখ হয় আমার।

-যদি মেয়েটা শিশুদের গুরুমা হয় তাহলে বোধহয় ঠিকই আছে।

.

০৩.

 সেদিন বিকেলে আমরা মিঃ পাই-এর বাড়িতে চায়ের নেমন্তন্নে এসেছি।

ছোটখাটো, মোটাসোটা চেহারার মিঃ পাই একেবারেই মেয়েলি ধরনের। যে জমিতে সেই প্রাচীন প্রায়রির ধ্বংসাবশেষ তারই কক্ষের মধ্যে ওর বাসস্থান–প্রায়র্স লজ। নানা টুকিটাকি কারুশিল্প, সূক্ষ্মকাজের চেয়ার এইসব নিয়েই তিনি মশগুল।

মিঃ পাইয়ের বাড়িটি বড়ই মনোগ্রাহী ও খোলতাই। প্রতিটি আসবাব পালিশ করা এবং মানানসই জায়গায় বসানো। পর্দা আর কুশনগুলো দামী সিল্কের, অপরূপ তাদের কারুকার্য ও রং। এ বাড়িতে কারোর বাস করা মানে কোনো জাদুঘরের ঐতিহাসিক কক্ষে বাস করা।

–এখানকার এই ছোটো সমাজটার জন্যে যদি এমন এক সংগ্রহ রাখতে পারি তাতেই আমার আনন্দ। নিজের চোখে দেখেছি এইসব গ্রাম্য চাষাড়ে লোকগুলো একটা আঠারো শতকের শেরাটন চেয়ার–দুর্দান্ত নিখুঁত–যাকে বলে খাঁটি সংগ্রাহকের পিস..তো সেটা রাখা হয়েছে একটা যেমন-তেমন ভিক্টোরিয়া টেবিলের পাশে। তারপর ধরুন গাঢ় রংচড়ানো ওককাঠের বুকশেলফ, রং করা ওক? শুনেছেন কখনো? কেন লোকে কুৎসিত জিনিস দিয়ে নিজেদের ঘিরে রাখে?

-জোয়ানা বলে, ব্যাপারটা অদ্ভুত।

–অদ্ভুত? ক্রিমিনাল। অপরাধমূলক। এই ধরুন আপনারা যে বাড়িটা নিয়েছেন মিস এমিলি বার্টনের বাড়ি-বাড়িটা চমৎকার। দু-একটা জিনিসও রীতিমতো পয়লা শ্ৰেণীর। রুচিও আছে, তবে সে ব্যাপারে আমি আগের মতো নিশ্চিত নই।

মিঃ পাই এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি তো পরিবারটা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। কিন্তু জানা থাকলে ভালো। আমি যখন আসি বুড়ি মাটি তখনও বেঁচে। বুড়ি রীতিমতো ডাইনি। গতরখানা তিনমন তো হবেই, আর পাঁচটি কন্যারত্ন চারপাশে ঘুরঘুর করছে। মেয়েদের সবসময় অর্ডার করে যেতেন আর মেয়েরা স্রেফ গোলামের মতো পালন করে যেত। মেয়েরা বিয়ে করছে না বলে গঞ্জনা দিতেন, অথচ ঐ মহিলা ওদের জীবনে এমন রাস্তাই রাখেনি যাতে ওরা কারুর সঙ্গে মেলামেশা করতে পারে। আমার ধারণা এমিলি কিংবা অ্যাগনেস কোনো গ্রাম্য যাদুকরের সঙ্গে একটু জড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু তার পরিবারটি তেমন কিছু নয়, অতএব মা-ঠাকরুন অবিলম্বে বিয়েটা ভণ্ডুল করলেন।

–এ যে উপন্যাসের গল্প মশাই, জোয়ানা বলল।

-হ্যাঁ ভাই। উপন্যাসই বটে। অবশেষে বুড়ি গত হলেন। কিন্তু ততদিনে বড়ো দেরি হয়ে গেছে। মেয়েরা ঐভাবেই জীবন কাটাতে লাগলেন। কিন্তু তাদের দৈহিক শক্তি তেমন ছিল না। তাই এক এক করে বিদায় নিলো দুনিয়া থেকে। এডিথ ইনফ্লুয়েঞ্জাস, মিনি একটা অপারেশনে বেচারী মেরেলের হলো স্ট্রোক। বেচারী এমিলি গত দশ বছর ধরে শুধু সেবাই করে যাচ্ছে, আজকাল সে অর্থচিন্তায় বড়ই কাতর…সব গচ্ছিত টাকারই মূল্য পড়ে যাচ্ছে।

–ওঁর বাড়িটা দখল করে আমাদের খারাপ লাগছে, বললে জোয়ানা।

–না না, ইয়ং লেডি ওভাবে নেবেন না ব্যাপারটা।

আমি বললাম, ভারি স্নিগ্ধ একটা আবহাওয়া আছে বাড়িটাতে।

-সত্যি, তাই অনুভব করেন নাকি? আমিও আবহাওয়ায় বিশ্বাস করি বুঝলেন। মানুষের চিন্তা, অনুভূতি–দেয়ালে আসবাবপত্রে তার ছাপ রেখে যায়।

আমি দু-এক মুহূর্ত চুপ করে প্রায়র্স লজের চারদিকে তাকাচ্ছিলাম। মনে হল, এখানে কোনো আবহাওয়া নেই। আর সেটাই আশ্চর্য।

এবার সবাই এলাম বাইরের হলঘরে। সামনের দরজার দিকে এগোতেই চিঠির বাক্সের ভেতর দিয়ে গলানো একটা খাম মেঝেতে পড়ল।

খামটা তুলে নিলো মিঃ পাই, বললেন, বিকেলের ডাক। তিনি আমাদের বিদায় জানালেন।

দু-দুবার করমর্দন করে তিনি আমাদের গাড়িতে তুলে দিলেন। জোয়ানা হুইলে বসল। নিখুঁত সবুজ একখণ্ড জমিতে সাবধানে চক্কর দিয়ে অবশেষে সামনের সোজা রাস্তায় উঠে সে হাত নেড়ে গৃহকর্তাকে বিদায় জানালেন।

কিন্তু আমাদের ইশারা ইশারাই রয়ে গেল।মিঃ পাই তার হাতের চিঠিটা খুলে ফেলেছিলেন। আর ভোলা কাগজটার দিকে মুখখানা কুঁচকে, রাগে আর বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন। প্রথমটায় আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। পর মুহূর্তে অনুভব করলাম ঐ খামটার চেহারা যেন আমার চেনা চেনা। জোয়ানা বলল, কী ব্যাপার! ভদ্রলোকের হলোটা কি?

বললাম, আমি যেন আন্দাজ করছি…আবার সেই গোপন হাতের কাজ।

জোয়ানা আমার দিকে অবাক চোখে তাকালো। বলল, মানে, যে ধরনের চিঠি তুমি পেয়েছিলে সেইরকম একটা?

–আমার ধারণা তো তাই বলছে।

-এ জায়গাটার হলোটা কি! দেখলে তো মনে হয় দেশের সবচেয়ে শান্ত আর ঘুমন্ত এক প্রান্ত কিন্তু এসব কে লিখছে জেরি?

-বাছা, আমি তা কি করে জানবো?

হবে কোনো স্থানীয় আধপাগলা। তবে তুই আমাদের ডাক্তার আওয়েনকে জিজ্ঞেস করতে পারিস।

–ডাঃ আওয়েন আমায় পছন্দ করে না। আমাকে হাইস্ক্রিট ধরে আসতে দেখলেই রাস্তার ওপারে চলে যান। কিন্তু জেরি, এই চিঠি লেখার ব্যাপারটা মোটেই তামাশার ব্যাপার নয়। কেন লোকে বেনামী চিঠি লিখবে?

-ঐ তো যা বলছিলাম। কোনো মানসিক তাড়নার তৃপ্তি খোঁজে বোধহয়। কেউ যদি ভাবে তাকে খাটো করা হয়েছে কিংবা অবহেলিত করা হয়েছে অথবা তার জীবনটা যদি হয়ে যায় একঘেয়ে শূন্য, তাহলে বোধহয় সে সুখী আর আনন্দে মশগুল কাউকে দেখলে পেছন থেকে ছুরি মেরে আত্মপ্রসাদ অনুভব করে।

ব্যাপারটা মোটেই ভালো নয় জেরি।

–ভালো তো নয়ই। তবে এই দেশগাঁয়ে মানুষদের ভেতরমুখো হবার দিকে ঝোঁক–তাই কিছু বিকৃত আজব মানুষ দেখা যায়।

তার মানে খুব অশিক্ষিত, ভাবপ্রকাশে অক্ষম তাই না…

জোয়ানার কথার আমি আর কোনো উত্তর দিইনি।

পাহাড়ী রাস্তায় ওঠার আগে শহরের ভেতর দিয়ে আসার সময় কৌতূহলভরে দেখলাম হাইস্ট্রিটে বিচরণমান কয়েকটা অস্পষ্ট মূর্তি। ঐ ভীড়েই হয়তো কেউ ঈর্ষা আর কুটিলতার বিষ লুকিয়ে শান্ত মুখখানাকে আড়ালে রেখে আবার কোনো নতুন মতলব করছে।

.

দুদিন বাদে আমরা সিমিংটনদের বাড়িতে ব্রীজ খেলার পার্টিতে গেলাম। শনিবারের বিকেল। দপ্তর বন্ধ, এ কারণেই সিমিংটনরা বরাবরই শনিবারে ব্রীজের আসর বসান।

দুটো খেলার টেবিল। খেলুড়ে সিমিংটন দম্পতি, মিস গ্রিফিথ, আমরা দুজন, মিঃ পাই, মিস বারটন আর কর্নেল অ্যাপলটন যার সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়নি। বয়স তার ষাট। জোয়ানার দিকে তার আকর্ষণটা এমন বর্ধিত রূপ ধারণ করছিল যে বিকেলটা একবারও ওর ওপর থেকে নজর সরাননি।

যখন আমরা সেখানে পৌঁছালাম, তখন বাচ্চাদের গভর্নের্স এলসি হল্যান্ড ক্রিজ স্কোরের খাতা টেবিলের দেরাজ হাতড়ে খুঁজছে।

হাতে খাতা নিয়ে আর পাঁচটা ঝি-এর মতো বকবক করতে লাগল, এগুলোই বুঝি, মিসেস সিমিংটন? কি বোকা আমি, সেদিন প্রায়ান তার রেলগাড়িটা কোথায় খুঁজতে থাকল, আর আমি নিশ্চয় এটাকে কোনো গলদ জায়গায় ঢুকিয়ে ওর কাছে ছুটেছিলাম। এগুলো ঠিক না। আমি বাচ্চাদের একটু লংব্যারোতে নিয়ে যাচ্ছি।

সুশীলা, সুশ্রী ঝলমলে মেয়ে। জোয়ানার দিকে তাকাতেই দেখলাম ও হাসছে। আমি কড়া চোখে ওকে দেখি।

ব্রীজ খেলতে বসলাম আমরা। শ্রীমতী সিমিংটন খুবই ওস্তাদ খেলুড়ে। তাঁর স্বামীও ভালো খেলেন, একটু অতিরিক্ত সতর্ক। মিঃ পাই তো ব্রিলিয়ান্ট। আজকের আসরের আয়োজনটা যেহেতু আমাদের সম্মানে তাই আমি আর জোয়ানা বসেছি সিমিংটন পত্নী আর মিঃ পাই-এর সঙ্গে এক টেবিলে। মিস বারটন দলের সবচেয়ে উঁছা খেলুড়ে, তবে খেলে দারুণ মজা পান।

খেলা এমনিতে ভালোই চলছিল, শুধু মাঝেমধ্যে জোয়ানার দিকে তাকিয়ে থাকার জন্যে কর্নেল সাহেবের কিছু ভুলচুক হচ্ছিল। টেবিল ঘিরে চায়ের আসর বসল ডাইনিং রুমে। খাওয়ার শেষপর্বের সময় দুটো ছোট বাচ্চা হুড়মুড় করে ঢুকে এলো। ওদের পরিচয় দেবার সময় মিসেস সিমিংটন মাতৃগর্বে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন।

মাথা ঘুরিয়ে দেখি মেগান আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ওঃ!..এই হলো মেগান–বললেন ওর মা।

মেগান বেয়াড়াগোছের একটা করমর্দন করল, কোনো শোভনতাই নেই।

-বাছা, আমি তোর চায়ের কথাটা একেবারে ভুলেই গিয়েছিলাম। মিস হল্যান্ড আর ছেলেদুটো বাইরে খেয়ে নিয়েছে, তাই বাচ্চাদের চা হয়নি।

–ঠিক আছে, আমি নয় রান্না ঘরেই যাচ্ছি, মেগান বলল। ও কামরা ছেড়ে বেরিয়ে গেল। একটা বিব্রত হাসি হেসে মিসেস সিমিংটন বললেন, এ আমার বেচারী মেগান। সবে স্কুল ছেড়েছে, ঠিকমতো বড়োও হয়নি, আনাড়ি গোছের।

দেখলাম জোয়ানা ঝা করে মিসেস সিমিংটনের দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু মেগানের বয়স তো কুড়ি, তাই না?

-হা হা, তাই তো? কিন্তু বয়সের তুলনায় ও বড্ড বেশি কাঁচা। আসলে আমার ধারণা সব মায়েরাই তার ছেলেপিলেদের কোলের শিশু করে রাখতে চান।

আমি খেয়াল করলাম মিসেস সিমিংটনের ঐ পাংশু, ম্লান সুশ্রীতার পেছনে একটা স্বার্থপর, আগ্রাসী প্রকৃতি লুকিয়ে আছে। আমার বিরাগ ভাবটা আরো বেড়ে গেল যখন উনি বললেন, আমার বেচারী মেগান। মেয়েটা রীতিমতো ঝঞ্ঝাটে। চেষ্টা করছি কিছু একটা কাজের মধ্যে ওকে রাখতে তা ও কিছুই শিখবে না।

–তা ওর খাতিরে একটা নাচের মজলিশ করুন না? জোয়ানা কৌতুক করে বলল।

–নাচ? না না, ওসব জিনিস আমাদের এখানে চলে না। মিসেস সিমিংটন বললেন।

আমরা এরপর ওঁদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম।

জোয়ানা উগ্রভাবে এ্যাকসিলেটারে চাপ দেয়। গাড়ি প্রায় লাফিয়ে ওঠে। বলে, মেগানের জন্যে আমার খুব দুঃখ হয়। ওর মাটা ওকে একেবারে দেখতে পারে না।

–আরে জোয়ানা, ব্যাপারটা অতো খারাপ কী আর?

-খারাপ নয়? এরকম অনেক মা-ই আছেন যারা বাচ্চাদের ভালোবাসেন না। অভিমান আছে এমন কোনো প্রাণীর মধ্যে এই বোধটা ভীষণ অসুখী ভাবের সৃষ্টি করতে পারে। মেগান যথেষ্ট অনুভূতিশীল।

-হ্যাঁ, আমারও তাই ধারণা, বলে আমি চুপ করে রইলাম।

জোয়ানা খানিকক্ষণ বাদে দুষ্টুমিভরা হাসি হেসে বলল, ঐ গভর্নেসের ব্যাপারে তোমার ভাগ্যটাই খারাপ। যতবার ওর দিকে চেয়েছে তোমার চেহারার পুরুষসুলভ হতাশার ভাবটা আমি বুঝি লক্ষ্য করিনি? তবে তোমার সঙ্গে একটা ব্যাপারে আমি একমত, অত রূপ, জলে গেছে।

-তুই কিসের কথা বলছিস আমি বুঝতে পারছি না।

–দেখতে তো সত্যিই ভালো মেয়েটা। অদ্ভুত, যে একটুও অন্য আবেদন নেই! এমন জিনিস যা কোনো মেয়ের আছে, কোনো মেয়ের আদৌ নেই। কোনো মেয়ে সামান্য কিছু বললেও পুরুষরা হাঁ করে তার কথা শুনতে চায়।

-জোয়ানা, তোর কথা শেষ হলো?

–আগে বল আমার কথা মানছো?

হার মেনেও মেনে নিচ্ছি।

তাছাড়া যুগ্যি আর কে আছে এখানে? হয়তো শেষে এমিলি গ্রিফিথকে বেছে নিতে হবে।

-ও তো আমার চোখে একটা পুরুষালি মেয়ে ছাড়া কিছু নয়। তোর নিজের বেলা কী করতে যাচ্ছিস শুনি?

-আমি?

–হ্যাঁ। তোরও তো একটু মুখ বদলাবার সময় এসেছে।

–তুমি পলের কথা ভুলে যাচ্ছো! জোয়ানা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল।

–তুই আর দশটা দিন পরই বলবি, কে পল? কোন পল? কোনো পল-টল চিনি না।

–তুমি ওকে কোনোদিনই পছন্দ করোনি। কিন্তু ও সত্যি একটা জিনিয়াস গোছের ছিল।

–হয়তো ছিল, তবে আমার সন্দেহ আছে, ঐ জিনিয়াস লোকদের ঘেন্না করা উচিত। তবে তুই এ তল্লাটে একটাও জিনিয়াস খুঁজে পাবি না।

জোয়ানা আফশোসের সুরে বলল, তা হতে পারে না।

-তোকে শেষে আওয়েন গ্রিফিথেরই শরণ নিতে হবে, তবে তুই যদি কর্নেল অ্যাপল্টনকে বেছে নিস। সারা বিকেলটা তোর দিকে ভুখা কুত্তার মতো তাকিয়েছিল।

–ঠিক ধরেছে। আমার ভীষণ বিব্রত লাগছিল।

জোয়ানা নীরবে গাড়ি গেটের ভেতরে দিয়ে গ্যারেজের সামনে আনে।

জোয়ানা বলে, আমি বুঝি না কোনো লোক কেন ইচ্ছা করে এড়াবার জন্যে অন্য পথ ধরে? ব্যাপারটা অভব্য।

-ও তাই। লোকটাকে ঠান্ডা মাথায় তক্কেতক্কে থেকে শিকার করছি।

 ধীরে ধীরে সাবধানে গাড়ি থেকে বেরিয়ে লাঠিদুটো সামলে নিই।

আমি কঠিন গলায় বলি, আমরা এখানে এসেছি একটু নির্ঝঞ্ঝাট শান্তির খোঁজে যাতে তা পাই তাই দেখব। কিন্তু নির্ঞ্ঝাট শান্তি বোধহয় আমাদের কপালে ছিল না।

.

০৪.

 হপ্তাখানেক পরের ঘটনা। প্যারট্রিজ এসে জানালো মিসেস বেকার আমার সঙ্গে দু-এক মিনিট কথা বলতে চান।

মিসেস বেকার? কিছুতেই নামটার হদিশ করতে পারলাম না। মিস জোয়ানার সঙ্গে তো সে কথা বলতে পারে। কিন্তু পরে বুঝলাম, মিসেস বেকার হল বিয়েট্রিজের মা এবং আমিই একমাত্র ব্যক্তি যার সঙ্গে সে সাক্ষাৎ করতে চায়। আমি সম্মতি জানালাম।

বিশাল বপু, পোড়খাওয়া চেহারার মিসেস বেকার অনর্গল দ্রুতগতিতে বলে যেতে লাগল, আমি ভেবে দেখলাম স্যার, আপনি একমাত্র লোক, যিনি আমার এ অবস্থায় কি করা উচিত তা বুঝিয়ে বলতে পারেন।

-হ্যাঁ, নিশ্চয়…ইয়ে আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারলে খুশী হবো

মিসেস বেকার একটা চেয়ারে বসে বললেন, হ্যাঁ স্যার, আমিও চাইছিলাম আপনার কাছে আসতে। আর কিছু করাও দরকার, জানেনই তো আজকালকার ছেলেছোকরাদের মাথা গরম, কোনো কথাই শোনে না। আমি বিয়েট্রিজকে বলেছি–তাকে আচ্ছা মতো শিক্ষা দিতাম, আর ঐ মিল পাড়ার মেয়েটাও, কী বলেন?

আমি হতভম্বের মতো বললাম। দুঃখিত, আপনার কথা আমি ঠিক বুঝছি না।

-ঐ তো, চিঠিগুলো স্যার। বিচ্ছিরি-নোংরা চিঠিগুলো। কথাগুলো কি নোংরা, ঐ একটাই পেয়েছিল। আর যার জন্য ওকে এ-বাড়ির কাজ ছাড়তে হলো।

আমি কিছু বলতে গেলাম কিন্তু মিসেস বেকার বাধা দিয়ে বলতে থাকলেন, আমাকে আর বলতে হবে না স্যার। ওতে যা লেখা ছিল তা ডাহা মিথ্যে কথা। আমি ভালোই বুঝি, আপনি ও জাতেরই নন স্যার, তার ওপর পঙ্গু। তবু মেয়েটাকে বলি এ বাড়ির কাজ ছেড়ে দিতে। একটা সমর্থ্য মেয়ে কতো সাবধান হতে পারে?

মিসেস বেকার আবার দম নিয়ে শুরু করল, ভেবেছিলাম, এবার বোধহয় বিষ ছড়ানো বন্ধ হলো কিন্তু জর্জ মানে ঐ গ্যারেজের ছেলেটা যার সঙ্গে বিয়েট্রিজ ঘোরাফেরা করত, সেও পেল ঐ রকম একটা চিঠি। যাতে লেখা ছিল, বিয়েট্রিজকে নিয়ে নাকি ফ্রেন্ড লেডবেটারের টম ফস্টিনস্টি করছে–আমি হলফ করে বলতে পারি স্যার, ও ভদ্রতা করেই যা একটু কথাবার্তা বলে ওনার সঙ্গে।

-আমার মাথাটা গুলিয়ে যেতে লাগল, বললাম, দাঁড়ান, বুঝে নিই ব্যাপারটা। বিয়েট্রিজের… হয়ে জোয়ান বন্ধু..বেনামী চিঠি পেয়েছি যাতে অভিযোগ বিয়েট্রিজ অন্য ছেলের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়েছে, এই তো?

–ঠিক স্যার..আর তাতেই ঐ ছোকরা রেগে আগুন। বিয়েট্রিজ বলেছে, মিথ্যে কথা, কিন্তু ছেলেটা বিশ্বাস না করে মেজাজ দেখিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেছে। আর বেচারী বিয়েট্রিজ…ওকে এতো ভালোবাসতো…তাই স্যার আপনার কাছে ছুটে এলাম।

–তা আমার কাছে এসেছেন কেন?

-স্যার আমি জানি আপনিও ওরকম একটা চিঠি পেয়েছেন, তাই ভাবলাম স্যার আপনি তো লন্ডনের মানুষ, আপনি জানেন ওগুলো নিয়ে কি করতে হয়।

-আমি আপনার জায়গায় হলে পুলিশের কাছে যেতাম।

-না স্যার। পুলিশের কাছে যেতে পারবো না। কখনো পুলিশের সঙ্গে মেলামেশা করিনি, ও জিনিস আমরা কেউ কখনো করিনি।

–আমি তো আপনাকে শুধু এই পরামর্শ দিতে পারি।

মিসেস বেকার চুপ। আমার কথা শুনে তার একেবারেই মনঃপুত হয়নি। তখন আমি সামনে একটু ঝুঁকে প্রশ্ন করি, মিসেস বেকার, আপনার কোনো ধারণা আছে, এ ধরনের চিঠিগুলো কে লিখেছে?

ভেবেছিলাম কোনো নাম উল্লেখ করতে অনিচ্ছুক হবেন মহিলা, কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে সে ঝপ করে বলে মিসেস ক্লিট…আমাদের সকলের ধারণা স্যার, ঐ মিসেস ক্লিটই, কোনো সন্দেহ নেই।

–ক্লিট? মিসেস ক্লিট কে?

জানলাম, একজন বুড়ো ঠিকে বাগানমালীর স্ত্রী। মিলের দিকে যাবার রাস্তায় এক কটেজে থাকে।

অবশেষে তাকে বিদায় দিয়ে তার কথাগুলোই ভাবছিলাম। ঠিক করলাম, গ্রিফিথের কাছে গিয়ে সব ব্যাপরটা আলোচনা করব। সে তো ক্লিটকে চেনে।

অবশেষে গ্রিফিথের সার্জারির কাজ-শেষের সময়টা আন্দাজ করে তার সঙ্গে দেখা করলাম।

–ও হো, বার্টন যে?

আমি মিসেস বেকারের সঙ্গে কথাবার্তার বিবরণ দিয়ে তাকে আমার ধারণাটিও জানিয়ে দিলাম।

গ্রিফিথ আমাকে হতাশ করে জানালো, ব্যাপারটা অতো সরল নয়। তুমি জানো না, মিসেস ক্লিটকে এ অঞ্চলের সবাই ডাইনি মনে করে।

–কি আশ্চর্য! আমি অবাক হই।

-হ্যাঁ ভাই! এ যুগে শুনতে অদ্ভুত লাগলেও ব্যাপারটা কিন্তু সত্যি। মিসেস ক্লিট এসেছে এক দিব্যজ্ঞানী পরিবার থেকে। এই অস্বাভাবিক, কিংবদন্তী মহিলা খুব সহজেই–কোনো বাচ্চা নিজের আঙুল কেটে ফেলেছে কিংবা আছাড় খেয়েছে কিংবা মাম্পসে ভুগছে, তো সে মাথা নেড়ে বলে দেয়, হবে না! খারাপ অভিশাপের হাত থেকে বাঁচতে মহিলারা ঘরে তৈরি কেক বা মধু এনে মিসেস ক্লিটকে দেয়। কুসংস্কার আর বোকামি জেনেও ওরা এটাকে স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছে আর ভেবে নিয়েছে সেই এ-সবের গোড়ায়।

–মিসেস ক্লিট যদি জড়িত না থাকে তাহলে চিঠিগুলো সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা—

না বার্টন, কিছুই জানি না। তবে এর থেকে কোনো ক্ষতি হতে চলেছে।

বাড়ি ফিরে দেখি মেগান হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে সিঁড়িতে বসে আছে। বলল, আপনাদের এখানে দুপুরের খাবার খেতে পারি?

নিশ্চয়। বলে আমি রান্নাঘরের দিকে প্যারট্রিজকে জানিয়ে দিতে গেলাম। প্যারট্রিজ একবার জোরে নাক টেনে বুঝিয়ে দিল এই মেগান সম্বন্ধে তার ধারণা খুব উঁচু নয়।

আমি ফিরে এসে বললাম, আইরিশ স্টু হচ্ছে।

মেগান তার ধুলোমাখা পা-দুখানা ছড়িয়ে দিয়ে বলল, আমি নিজে মোজা রিপু করেছি।

আমি দেখলাম বিপরীত রঙের উলের একটা দলাপাকানো অংশই রিপু বলে ঘোষিত হয়েছে।

মেগান বলল, ফুটোর চেয়ে এটাই বেশি কষ্টকর।

-তাই মনে হচ্ছে। আমি সায় দিলাম, দুজনে চুপ করে রইলাম খানিকক্ষণ। বেশ সাহচর্যময় নীরবতা।

হঠাৎ নীরবতা ভেঙে ঝাঝালো গলায় মেগান বলে উঠল, আর সকলের মতো আপনিও নিশ্চয় আমাকে ভয়ানক কিছু মনে করেন?

আমি আরাম করে পাইপ টানছিলাম। ওর কথায় চমকে আমার পাইপখানা মুখ থেকে খসে পড়ল আর ভেঙে গেল। রাগ সামলে বললাম, দেখ তো কি করলে!

ও দন্তবিকশিত করে হেসে বলল, আপনাকে আমার ভালোই লাগে।

আমি ভাঙা পাইপের অংশগুলো তুলতে তুলতে বললাম, হ্যাঁ, কি যেন বলেছিলে?

আপনি কি আমাকে ভয়ানক কিছু ভাবেন?

-কেন সেরকম ভাববো?

কারণ আমি তো তাই।

আমি তীক্ষ্ণকণ্ঠে বললাম, বোকার মতো কথা বলো না।

–সেটাই তো কথা, মেগান মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, লোকে আমাকে বোকা ভাবে। কিন্তু সত্যিই আমি বোকা নই। আমি ওদের ঘেন্না করি।

মেগান ওর বিষাদমাখা, কিন্তু শিশুসুলভ নয় চোখে আমার দিকে তাকায়। বলে আমার মতো হলে আপনিও মানুষকে ঘেন্না করতেন। যদি কেউ আপনাকে না চাইত

–মনটা বেশ উগ্র বিকারের দিকে ঝুঁকেছে বলে আন্দাজ হয় না তোমার?

–হ্যাঁ, লোকে ওরকমই ভাবে। ব্যাপারটা তো ঠিকই। মা আমাকে পছন্দ করে না। আমি বোধহয় তাকে আমার সেই নিষ্ঠুর বাবার কথাই মনে করিয়ে দিই। লোকের কথায় যা বুঝি, বড়ো ভায়ানক লোক ছিলেন তিনি। বেড়ালেরা যে বাচ্চাটিকে পছন্দ করে না তাকে খেয়ে ফেলে, কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে তা হয় না, তাকে পুষতেই হয়। আসলে মায়ের ইচ্ছে আমার সত্বাপ আর ছেলে দুটোকে নিয়ে আলাদা সংসার পাতা।

তাহলে তুমি সব কিছু ছেড়ে চলে গিয়ে কোনো কিছুর একটা ট্রেনিং নিয়ে, নিজস্ব জীবন বেছে নিচ্ছ না কেন। যেমন শর্টহ্যান্ড-টাইপ কিংবা বুককিপিং

-ওসব আমি পারব বলে মনে হয় না। তবে কেন আমি চলে যাবো। কেন আমায় যেতে বাধ্য করা হবে? ওরা আমাকে না চাইলেও আমি থাকবো। থাকবো আর প্রত্যেক হতচ্ছাড়া শুয়োরগুলোকে কাদাব। আমি গাধা? আমি কুচ্ছিত? আমি এই লিমস্টকের প্রত্যেকটা লোককে দেখিয়ে দেব।

একটা অর্বাচীনসুলভ, বেয়াড়া, করুণ রাগ।

বাড়ির কোণে পায়ের শব্দ হতেই ওকে ধমক দিয়ে বলি, যাও ড্রয়িংরুমের ভেতর দিয়ে ওপরে গিয়ে বাথরুমে চোখ-মুখ ধুয়ে এসো। জলদি। মেগান অদ্ভুত একটা লাফ মেরে চলে গেল। জোয়ানা ততক্ষণে কোণের দিকটা থেকে সামনে এল।

উঃ কি গরম পড়েছে। বলে জোয়ানা আমার পাশে বসে পড়ল।

–আমারও তাই মনে হচ্ছে। ভালো কথা, আজ দুপুরে মেগান এখানে খেতে আসছে।

–সত্যি? বেশ তো! মেয়েটাকে পরীতে পেয়েছে। বুঝলে, পরীরা ওকে দোরগোড়ায় ফেলে রেখে আসল মেয়েটাকে নিয়ে চলে গেছে। ভারী মজার ব্যাপার। উফ, এবার যাই, গা ধুয়ে আসি।

-তা তো পারবি না, মেগান বাথরুমে আছে যে! বলতে বলতে মেগান বাথরুমের জানলা দিয়ে বেরিয়ে এল। এখন তাকে বেশ শান্ত, পরিচ্ছন্ন দেখাচ্ছে। সংশয়ভরা চোখে সে জোয়ানাকে দেখল।

-হ্যালো, তুমি লাঞ্চে এসেছো জেনে খুশী হলাম। চলো, চলো, ভীষণ খিদে পেয়েছে আমার। জোয়ানা বলল।

ও মেগানের একটা হাত ধরে বাড়ির ভেতর চলে গেল।

.

.

০৫.

 আমার গল্পের মধ্যে একটা বিষয় বাদ পড়ে গেছে, সেটা হল মিসেস ডেন কলপ অথবা তার স্বামী রেভারেন্ড কালেব ডেন কলপের কথা যৎসামান্য উল্লেখ করলেও বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি।

অথচ ভিকার সাহেব ও তার স্ত্রী এখানকার বিশিষ্ট চরিত্র। ভিকার সাহেব দৈনন্দিন জীবনে নির্লিপ্ত থেকে বইপত্র, পড়ার ঘর আর প্রাচীন চার্চ সংক্রান্ত ইতিহাসের গভীর জ্ঞানের মধ্যে ডুবে থাকেন। তার স্ত্রী কিন্তু উল্টো, সবকিছুর মধ্যেই তিনি হাজির। গতানুগতিক ভিকার পত্নীদের মতো তিনি নন। তিনি কখনো কোথাও নাক গলান না অথচ কোনো অদ্ভুত ক্ষমতায় সব কিছু জেনে ফেলেন। কোনো উপদেশ দেন, তবু বিবেক পীড়িত যেকোনো মানুষের কাছে তিনি যেন ওপরওয়ালার প্রতিনিধি। গ্রামের প্রতিটি মানুষ তাকে কিছুটা ভয় করে চলে। লম্বা রোগাটে বিনীত মুখখানা, এমন প্রত্যয়ের সঙ্গে কথা বলেন যেন সবকিছু উড়েফুড়ে দেবেন।

মেগান লাঞ্চ খাওয়ার পরের দিন উনি আমায় ধরলেন হাইস্ট্রিটে।

–ওহো। মিস্টার বার্টন। বললেন তিনি, এমন বিজয়গর্বে যেন একটা বিশেষ কঠিন ধাঁধার সমাধান করে ফেলেছেন।

আমি পরিচয়ের সমর্থন দিতেই তিনি বললেন, হ্যাঁ, কী জন্যে যেন আপনাকে খুঁজছিলাম? কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, হ্যাঁ, কোনো একটা বিশ্রী জিনিসের কথা।

ভড়কে গিয়ে বললাম, বুঝলাম না, দুঃখিত।

এবার কলপ চেঁচিয়ে উঠলেন, ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। বেনামী চিঠি! এসব কি গল্প আপনি আমদানী করেছেন বেনামী চিঠির ব্যাপারে?

–আমি আমদানী করিনি। এখানে আগে থেকেই চলছিল।

–তবুও আপনি আসার আগে তো কেউ এসব পায়নি, অভিযোগের সুরে বললেন ভদ্রমহিলা।

–মিসেস কলপ, ঝামেলা তো আগেই শুরু হয়েছিল।

-ওঃ, তাই বুঝি! আমার মোটেই এসব ভালো লাগছে না। ঈর্ষা, বিদ্বেষ বা ঐ জাতের ছোটোখাটো পাপ তো আছে, কিন্তু এ ধরনের কাজ করবার মতো এখানে কেউ আছে বলে ভাবিনি। বুঝলেন–অন্তত আমার তো জানার কথা নয়।

এবার একটা উদ্বেগ, শিশুর মতো সরল হতবুদ্ধিতা যেন ওঁর চোখের মধ্যে লক্ষ্য করলাম। বললেন, কিন্তু আপনিই বা জানবেন কী করে? কালেব শাস্ত্র ব্যাখ্যা করে, সে হল পুরোহিতের কর্তব্য। কিন্তু তার স্ত্রীর কর্তব্য হল, লোকে কী ভাবে, কী বোঝে সেটুকু জানা। সে এ ব্যাপারে কিছু করতে না পারলেও, এটা তো ধারণা করতে পারে যে কার মগজ কাজ করেছে এর পেছনে

হঠাৎ কথাটা বন্ধ করে আনমনা জুড়লেন, তাছাড়া এমন গোমুখের মতো চিঠিগুলো।

সামান্য সংকোচ, ইতস্তত করেও আমি জিজ্ঞেস করে ফেলি, আপনি…মানে…ইয়ে…আপনিও কি এমন চিঠি পেয়েছেন?

উনি চোখদুটো বড়ো করে বললেন, ও হ্যাঁ, দুটো..না তিনটে। ঠিক মনে পড়ছে না কথাগুলো তবে, কালেব আর স্কুল মিস্ট্রেসকে নিয়ে অতি বোকা বোকা, উদ্ভট কথা। কারণ কালেবের কোনো দিনই ব্যাভিচারের দিকে কোনো প্রবণতা ছিল না। বেশি রকম বই ঘেঁষা না হলে কালেব তো রীতিমতো সাধুই হয়ে দাঁড়াত।–ঠিক কথা, ঠিকই।

এবার মিসেস কলপ রহস্যময় উপায়ে স্বামীর প্রসঙ্গ থেকে চিঠির প্রসঙ্গে চলে গেলেন। বললেন, কতো কিছুই আছে, যা ঐ চিঠিগুলো বলতে পারত, কিন্তু বলেনি। এটাই আশ্চর্য লাগে।

অখুশীভাবেই বলি, কেউ চিঠিগুলোতে সংযত থেকে ভুল করেছে, এমন কথা আমি ভাবতেই পারি না।

–তারা কিন্তু আসল ঘটনা কিছুই জানে না। এখানে গোপন কলঙ্কের তো সীমা নেই। চিঠির লেখক সেগুলো কেন ব্যবহার করে না? এবার বলুন আপনার চিঠিতে কী লিখেছিল।

-ইঙ্গিত দিয়েছিল, আমার বোন আমার বোনই নয়।

 মিসেস কলপ উৎসুকভাবে প্রশ্ন করলেন, সে তো আপনার বোনই?

নিশ্চয়ই, জোয়ানা আমার বোন।

—তাহলেই দেখুন, আমি যা বলতে চাইছি। এরকম আরো ব্যাপার আছে যা বলতে পারি –তিনি আমার দিকে নির্মল, নিস্পৃহ চোখে চেয়ে থাকলেন।

প্রত্যেকেরই জীবনে কিছু গোপন অধ্যায় আছে। আমার মনে হয় মিসেস কলপ তা সবই জানেন।

হঠাই শুনলাম এইমি গ্রিফিথের দরাজ কণ্ঠ গমগম করে উঠল-হ্যাল্লো মর্ড! ভালোই হলো তোমাকে ঠিক সময়ে ধরতে পেরেছি। হাতের কাজের জিনিসগুলো বিক্রির তারিখটা বদলাতে চাইছি। মর্নিং, মিঃ বাৰ্টন। তোমার অসুবিধা না থাকলে দুজনে একটু ইনস্টিটিউটে যাবো। কেমন?

-হা হা, কোনো আপত্তি নেই, বললেন মিসেস কলগ্রুপ।

এইমি আন্তর্জাতিক বিপণীতে ঢুকলে, মিসেস কলপ বললেন, বেচারী। আমি অবাক হলাম তিনি এইমির জন্যে করুণাববাধ করছেন না। আবার বলতে শুরু করলেন, অন্ধ ঘৃণা, হ্যাঁ অন্ধ ঘৃণা…ঐ চিঠিগুলো বুঝলেন, ঐ অন্ধও দৈববশে কারুর হৃদপিণ্ডে ছুরি বসিয়ে দিতে পারে।…আর তখন কি ঘটবে, মিঃ বার্টন?

আরেকটা দিন কেটে যাবার আগেই তা জানার দুর্ভাগ্য হল আমাদের।

.

শোকসংবাদটা প্রথম নিয়ে এলো প্যারট্রিজ।

জোয়ানা কামরায় জানলার পর্দা তুলে দিতে দিতে সে মুখে একটা অতিরিক্ত বিষাদের ভঙ্গিতে বলল, আজ সকালে একটা ভয়ানক খবর আছে, মিস।

লন্ডনের অভ্যাসমতো জোয়ানার ঘুম ছাড়তে দু-এক মিনিট সময় লাগল। বলল, এমন কী ভয়ানক খবর?

-বেচারী মিসেস সিমিংটন মারা গেছেন।

–আঁ, মারা গেছেন? জোয়ানা বাস্তবিকই প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছে খবরটায়।

-হা মিস, কাল বিকেলে। আরো যেটা খারাপ, আত্মহত্যা করেছেন তিনি। যদিও অবশ্য মনে হয়, তিনি দায়ে পড়ে মরণ ডেকেছেন। বেচারী!

দায়ে পড়ে মরণ? জোয়ানা বলে, ইয়ে নয় তো?

–হা গো তাই..ওই রকমই একটা নোংরা চিঠি।

 প্যারট্রিজের আফশোস যে সে-খবরটা সে সংগ্রহ করতে পারেনি।

এরপর একটা ড্রেসিং গাউন চড়িয়ে ও আমার ঘরে এল খবরটা দিতে। আমার আওয়েন গ্রিফিথের কথা মনে পড়ল, আজ হোক কাল হোক, অন্ধকারে মোক্ষম জায়গায় তীর গিয়ে বিধবেই। তাই ঘটেছে মিসেস সিমিংটনের বেলায়। বাইরে থেকে অভাবনীয় মনে হলেও মহিলার হয়তো কিছু গোপন দিক ছিল।

জোয়ানা আমাকে বলল, তোমার কোনো আপত্তি নেই যদি মেয়েটাকে মানে মেগানকে। আমাদের এখানে দু-একদিন থাকতে চায়? বাচ্চাগুলোর তো সমস্যা নেই? ওদের গভর্নেন্স আছে। তবে আমার ধারণা ও যে ধরনের চীজ, মেগানের মতো মেয়েকে পাগল করে ছাড়বে।

মেগানকে এখানে আনার কথা আমারও মনে হচ্ছিল, কিন্তু জোয়ানা নিজের থেকে কথাটা পেড়েছে বলে আমি খুশী হলাম।

প্রাতঃরাশের পরে আমরা সিমিংটনের বাড়ি গেলাম। সৌভাগ্যক্রমে ওদের গেটের মুখে আওয়েন গ্রিফিথের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তাকে চিন্তিত আর অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল।

–বার্টন, ভালোই হলো তুমি এসেছে। একদিন যা ঘটবেই বলে আমার ভয় ছিল, সেটাই ঘটল। বড়ো দুঃখের ব্যাপার।

-গুডমর্নিং ডক্টর গ্রিফিথ! জোয়ানা বলে উঠল।

গ্রিফিথ হকচকিয়ে লাল হয়ে বলল, ওঃ হো গুড মর্নিং, মিস জোয়ানা।

–আমি ভাবলাম আমাকে দেখতেই পাননি।

–খুবই দুঃখিত, আসলে মনটা অন্য দিকে ছিল তো তাই..

–হ্যাঁ, হবেই তো, হাজার হলেও আমি প্রমাণ সাইজের মানুষ

আমি জোয়ানাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে গ্রিফিথের দিকে মন দিলাম। ওকে বললাম, গ্রিফিথ, শোন, আমরা ভাবছিলাম, মেগানকে এখান থেকে নিয়ে গিয়ে দু-একদিন আমাদের কাছে রাখলে মিঃ সিমিংটন কিছু ভাববেন? তোমার কী মনে হয়? আসলে এখানকার পরিবেশ মেয়েটার পক্ষে বেশ দুঃসহই মনে হয়।

–আমার তো মনে হয় ভালোই হবে। একটু বেয়াড়া গোছের অনুভূতিপ্রবণ মেয়ে তো, এখান থেকে দূরে রাখাই ওর পক্ষে ভালো হবে।

আমি একটু ইতস্তত করে বলি, ব্যাপারটা তো–আত্মহত্যাই?

–তা তো বটে। অ্যাকসিডেন্টের মতো কিছু নয়। উনি এক টুকরো কাগজে লিখে গেছে, আমি আর পারছি না। আর চিঠিটা এসেছিল কাল বিকেলের ডাকে। খামখানা তার চেয়ারের পাশে মেঝের ওপর পড়েছিল আর চিঠিখানা দলা পাকিয়ে চুল্লিতে ফেলা হয়েছিল।

আমি তোতলামি করে বলি, কী বলেছিল…মা…মানে মাপ চাইছি।

–জিজ্ঞেস করে দোষের কিছু করোনি। চিঠিটা করোনারের আদালতই পড়ে শোনাবে। একই ধারার ভাষা–সেই নির্দিষ্ট অভিযোগ তা হল দ্বিতীয় ছেলেটি, মানে কলিন, সিমিংটনের সন্তানই নয়।

-তা কি সত্যি হতে পারে বলে মনে হয়?

–সে সিদ্ধান্তে আসার তো কোনো উপায় নেই। আমি এখানে পাঁচ বছর এসেছি। যতদূর জানি সিমিংটন দম্পতি শান্ত সুখী দম্পতিই ছিল। তবে এটা সত্যি যে ছেলেটার বাপ-মায়ের সঙ্গে কোনো মিল ছিল না। কিন্তু এরকম তো অনেক শিশুই আছে, যারা ঠাকুরদা বা দাদামশাইদের মতো দেখতে।

–চেহারার অমিলই পত্ৰলেখককে অভিযোগ আর প্ররোচনা জুগিয়েছিল। আমি বললাম।

-খুবই সম্ভব। স্রেফ লাগামছাড়া প্রতিহিংসা। কিন্তু বেশ জুতসই জায়গাতেই ঘা মেরেছে, তা নাহলে আত্মহত্যার আর কোনো কারণ ছিল বলুন? জোয়ানা বলল।

গ্রিফিথ বলল, বেশ কিছুদিন ধরে মিসেস সিমিংটন অসুস্থ ছিলেন। মানসিক রোগ, হিস্টিরিয়ার মতো। আমিই ওঁর স্নায়ুর চিকিৎসা করেছি। আমার মনে হয়, তার নিজের মনে এই ধারণা জন্মেছিল যে তিনি অস্বীকার করলেও তার স্বামী তাকে বিশ্বাস করবেন না। সব মিলিয়ে লজ্জা ঘেন্নায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় আত্মহত্যা করেন।

গ্রিফিথ ধীরে ধীরে রাস্তার দিকে পা বাড়াল।

সামনের দরজা খোলাই ছিল। আমরা ঢুকলাম।

মিঃ সিমিংটন জড়োসড়ো হয়ে চেয়ারে বসে আছেন, চোখে উদ্রান্তের দৃষ্টি।

মিস এলসি হল্যান্ডের গলা পাওয়া গেল।

-না, মিঃ সিমিংটন আপনাকে কিছু খেতেই হবে। সকালে কিছুই খাননি, রাতেও কিছু মুখে তোলেননি। ডাক্তার বলে গেছেন, শরীরে জোর রাখা দরকার আপনার।

সিমিংটন নিস্তেজ গলায় বলেন, মিস হল্যান্ড, তোমার মনে এত দয়ামায়া…

 মিস হল্যাণ্ড তাকে জোর করে গরম এককাপ চা ধরিয়ে দিলেন। সিমিংটন বললেন, তুমি যা করছে, তাতে ধন্যবাদ না জানিয়ে পারি না, তোমার তুলনা হয় না।

হল্যাণ্ড লজ্জায় লাল হয়ে বলল, যতোটা করতে পারি, তাতে আপনার সম্মতি থাকলেই আমি খুশী। বাচ্চাদের নিয়ে বা চিঠি লেখা, টেলিফোন ধরা নিয়ে চিন্তা করবেন না।

মিঃ সিমিংটন ফের বললেন বড়ো স্নেহময়তা তোমার।

ঘুরে দাঁড়াতেই হল্যান্ডের আমাদের দিকে দৃষ্টি পড়ল। চাপা গলায় বলল, কি ভয়ানক কথা বলুন তো?

আমি দেখলাম ওর সুন্দর নীল চোখের কিনারায় গোলাপী ছোঁয়া, যেটা জানিয়ে দিচ্ছে তার মনিবগিন্নির মৃত্যুতে সেও চোখের জল ফেলেছে।

জোয়ানা বলল, মিঃ সিমিংটনকে বিরক্ত করতে চাই না, তোমার সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতে পারি।

হল্যাণ্ড আমাদের অন্যদিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে যেতে বলল, হ্যাঁ, ওঁর পক্ষে তো একটা ভীষণ রকম আঘাত। কিছুকাল হল গিন্নিমা অদ্ভুত ধরনের ব্যবহার করছিলেন। ভয়ঙ্কর রকমের ছটফটানি আর কান্নাকাটির ঝোঁক, ডাক্তার গ্রিফিথ বলতেন, তার শরীরে কোনো গলদ নেই।

জোয়ানা বলল, আসলে আমরা এটুকু জানতে এসেছি যে, মেগানকে আমাদের সঙ্গে দু-একদিন রাখতে পারি কিনা অর্থাৎ সে যদি আসতে চায়।

একটু অনিশ্চিত সুরে হল্যাণ্ড বলল, মেগান? মানে আপনারা তো ঠিকই ভেবেছেন, তবে কে জানে, সে তো কেমন অদ্ভুত গোছের মেয়ে–এসব ব্যাপারে কী বলবে কে জানে। সে বোধহয় এখন ওপরতলায় পুরানো নার্সারিতে আছে। সবার থেকে দূরে থাকতে চায়।

জোয়ানার ইশারাতে আমি চট করে বেরিয়ে ওপরতলার চিলের ছাদে পুরানো নার্সারিতে গিয়ে দেখলাম একটা আবছা আলোআঁধারিতে দেওয়ালে ঠেস দেওয়া একটা ডিভানে গুটি মেরে বসে আছে মেগান।

আমি ওকে নানা কথা বলে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজী করালাম আমাদের সঙ্গে যেতে। তার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে আসতে বলে আমি নিচের তলায় ওদের এসে বললাম, মেগান আসছে।

এলসি বিস্মিত হয়ে বলল, আঁ, তবে ভালোই হলো। একটু কোটর ছেড়ে বেরুতে পারবে। এতসব কাজের মধ্যে ওর ঝুটঝামেলা না থাকলে আমিও মহা স্বস্তি পাবো। মিস বার্টন, বড়ো দয়ার কাজ করলেন, যা হোক। ওরে বাবা! টেলিফোন–বলে হল্যান্ড কামরা ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

ইতিমধ্যে মেগান সুটকেস নিয়ে নেমে এল। তাকে গাড়িতে তুলে আমরা সোজা লিটল ফার্জে এলাম।

ড্রয়িংরুমে ঢুকে স্যুটকেস রেখে মেগান একটা চেয়ারে বসেই কান্নায় ভেঙে পড়ল। যাকে বলে হাউ-মাউ কান্না। একটু কাদার পর ভারী গলায় বলল, আমি এরকম কাণ্ড করে ফেললাম বলে কিছু মনে করবেন না।

জোয়ানা বলল, না, তাতে কী হয়েছে। এই নাও আরেকখানা রুমাল। আমি মেগানের হাতে একটা ভরা পানীয়র গ্লাস তুলে দিলাম।

–কী এটা?

–ককটেল, আমি বললাম।

–ককটেল? আগে কখনো আমি ককটেল খাইনি।

মেগান এক ঢোকে সবটাই খেয়ে ফেলল।

মেগান এবার জোয়ানার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি এখানে এসে কান্নাকাটি করে নিজেকে কি বিদঘুঁটে করে তুলেছিলাম, এখন ভাবলেই অস্বস্তি হচ্ছে। আপনারা যে নিজের থেকে আমাকে সাহায্য করেছেন, এর জন্যে আমি কৃতজ্ঞ।

–কৃতজ্ঞতা জানিও না ভাই, লজ্জা পাবো। আসলে জেরী আর আমার সব কথাবার্তাই ফুরিয়ে গেছে, আর কোনো কথাই খুঁজে পাই না আমরা।

আমি বলি, এবার আমরা গনেরিল রিগনি, ঐরকম নানা মজার্দার চরিত্র, শেক্সপীয়র নিয়ে অনেক হৃদয়গ্রাহী আলোচনা করতে পারব।

-হুঁ, বুঝেছি, তোমরা সব ভারী ভারী উঁচু কথা বলবে। আমার তো শেক্সপীয়রকে ভীষণ রসকষ শূন্য মনে হয়।

আমি মেগানকে জিজ্ঞেস করলাম, এখন কেমন বোধ করছো? মাথা ঘোরা নেই তো!

–বিলকুল ঠিকঠাক, ধন্যবাদ।

জোয়ানা মেগানকে নিয়ে ওপরতলায় চলে গেল। প্যারাট্রিজ মুখটা বেজার করে ভেতরে এসে বলল, লাঞ্চের জন্যে শুধু দু-কাপ কাস্টার্ড বানিয়েছিলাম, এখন তাহলে কী করা যাবে?