০৬. কনভেন্ট স্কুল

০৬.

শহরে যে কটা কনভেন্ট স্কুল আছে, সব কটা খুঁজেও কোথাও বাচ্চার হদিশ না পেয়ে ডিনসমেড বাড়ি ফিরে চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল।

-হ্যালো।

–হ্যালো মিস জুলিয়েট। আমি ডিনসমেড।

–বলুন মিঃ ডিনসমেত, খবর কী? বাচ্চা কেমন আছে?

বাচ্চার কোনো খবর জানি না।

-মানে, বাচ্চা এখনও নিজের কাছে আনেননি বুঝি? আপনার কথা শুনে আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।

–আমার পরের কথা শুনে আরো ঘাবড়ে যাবেন।

–তা কথাটা কী?

–জোন্স অ্যাপার্টমেন্ট সহ ফার্নিচার বেচে বাচ্চা নিয়ে উধাও।

 –পালিয়েছে? জুলিয়েটের গলায় বিস্ময়ের আওয়াজ।

–হ্যাঁ।

–কিন্তু আমি ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারছি না।

–আমার কথা শুনলেই বুঝবেন। এইমাত্র ওর ওখান থেকে এসেই আপনাকে ফোন করছি।

-কোথায় গেছে কেউ বলতে পারছে না? মিসেস হেনেসকেও কিছু বলে যায়নি?

–সে বলতে পারছে না। তাকে বলেছে বাচ্চাকে শহরের একটা কনভেন্টে দেবে।

–তাহলে দেখা মিলতে পারে।

–সেগুড়ে বালি। আমি আশেপাশের সব কনভেন্টগুলিতে খবর নিয়েছি। ও মিথ্যে কথা বলেছে।

–অথচ বাচ্চাকে আপনার কাছে দেবে বলল।

–হ্যাঁ, আমি তো তাই জন্যই আনতে গিয়েছিলাম।

তাছাড়া বাচ্চাকে মানুষ করবে কী করে? একটু ভালোভাবে মানুষ করতে গেলে চাই টাকা। সে ও পাবে কোথায়? আর তাছাড়া গাইডেন্স?

-টাকার ব্যবস্থা করেই গেছে। অ্যাপার্টমেন্ট বেচে চল্লিশ হাজার টাকা নিয়ে গেছে।

–কাকে বেচেছে কিছু জানতে পেরেছেন?

–হ্যাঁ ম্যাকডোনাল্ড নামে এক ভদ্রলোককে। দিন পাঁচেক হল বেচেছে।

–ও।

–আমি এখন কী করি? স্ত্রী শুনলে ভীষণ আপসেট হয়ে পড়বে।

 –পড়বে তো। নেহাৎ বন্ধুর মেয়ে বলেই আপনি দেখাশোনা করতে গিয়েছিলেন অথচ

জানেন আমি এখনও ভাবতে পারছি না জোন্স বাচ্চাকে নিয়ে পালিয়েছে।

–আমারও এক অবস্থা।

–আমি কী থানায় যাবো?

–থানায় গিয়ে কোনো ফল হবে বলে মনে হয় না।

পুলিশ ওদের খুঁজে বার করবে।

–কেমন করে?

–তাও তো বটে, ওদের ছবি তো আমার কাছে নেই। আপনার কাছে আছে?

–উঁহু, তবে একটা ডায়েরি করে রাখুন।

–তাই করি। জোন্স যে এভাবে ডোবাবে

অথচ গেলে তো কত ভালো ব্যবহার করত। কথায় কথায় চা-কফি নিয়ে আসত। আর বাচ্চার কথা বলত সবসময়। আর সেই বাচ্চার ক্ষতি করার জন্য ও উঠে পড়ে লেগেছে।

-সত্যি, বাচ্চার কথা ভেবে আমি দিশেহারা হয়ে পড়েছি।

–ও বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাবে। আর জোন্স একসঙ্গে অত টাকা পেয়ে হয়তো বেপরোয়া জীবন শুরু করবে।

–আমারও তো একই চিন্তা আর আপনাকে যে টিচার রাখব কথা দিয়েছিলাম তাও খেলাপ হল।

–আপনি আর কী করবেন! আমার দুর্ভাগ্য এমন একটা সুন্দর বাচ্চা পড়াবার ভার পেয়েও হারালাম।

–সবই ভবিতব্য। তাহলে ছাড়ি।

–হ্যাঁ। আর কোনো খবর পেলে ফোনে জানাবেন।

 –নিশ্চয়ই।

.

–হ্যালো।

–হ্যালো সুসান, আমি ডিনসমেড কথা বলছি।

–বল, এত দেরি করছ কেন?

–একটু পরেই ফিরছি।

-আর দেরি করো না। আমি ছেলে-মেয়েদের বাচ্চাটার কথা বলেছি, ওরা কেবলই ওকে দেখতে চাইছে। আমি ভুলিয়ে রেখেছি।

–সুসান খারাপ খবর আছে।

–বলল, তা খবরটা কী?

–জোন্সকে পাওয়া যাচ্ছে না। সেই সঙ্গে বাচ্চাটাও।

তার মানে?

 –ও বাচ্চাটাকে নিয়ে কোথায় চলে গেছে কেউ তা জানে না।

–তুমি থানায় খবর দিয়েছ?

–না, প্রথমেই ওরা ছবি চাইবে, তা আমার কাছে নেই। মিস জুলিয়েটও একই কথা বলেছেন।

তাকেও জানিয়েছে?

–হ্যাঁ।

মেয়েটা তাহলে এভাবে হারিয়ে যাবে?

–কী করবো বল? আমার তো কিছুই করার নেই।

–জোন্সের মেয়েটাকে নিয়ে পালানোর পিছনে কী উদ্দেশ্য আছে?

–তা ওই জানে?

–অথচ তুমি জোন্সের কত প্রশংসা করতে।

–তখন তো এমন ছিল না।

–যাক তবু একটা ডায়েরি করে এসো।

–আচ্ছা।

.

০৭.

–হ্যালো।

 –হ্যালো। মিঃ ডিনসমেড বলছেন? আমি পিটার বলছি।

–বল কী খবর?

–স্যার একটা খবর আছে। হয়তো শুনে খুশী হবেন।

–তা খবরটা কী?

–স্যার একটা তৈরি বাড়ির সন্ধান পেয়েছি।

–কোথায়?

–গ্রীন উডে।

–তোমায় গ্রীন উড়ে বাড়ি দেখতে কে বলেছে? একেবারে গ্রাম।

–গ্রাম কিন্তু এমন সুন্দর বাড়ি শহরেও পাবেন না। আর পেলেও তার দাম দুই-তিন লাখ টাকা চাইবে।

-কিন্তু আমি তোমায় শহরের বাড়ির কথাই বলেছিলাম।

–আমার চেষ্টার ত্রুটি নেই।

–তাই দেখো।

ডিনসমেড কথাটা বলল বটে কিন্তু শহরে সে হাঁপিয়ে উঠেছে। রবার্টের চিন্তা সারাক্ষণ মনমরা করে তুলেছে। তারপর বাচ্চাটাও হারিয়ে গেল। তারপর কী মনে হওয়ায় আবার জিজ্ঞাসা করল–তা বাড়িটার দাম কত?

-ষাট হাজার টাকায় একটা পুরো বাংলো। তিনটে শোবার ঘর, কিচেন, ডাইনিং স্পেস, সামনে বাগান।

–পঞ্চাশ হলে ভালো হত।

–স্যার আপনার অফার তাকে জানাবো।

তবে গ্রামে থাকতে ঠিক মন চাইছে না।

–স্যার ওখানে কিছু অসুবিধা হবে না। সবকিছু আছে। আমি নিজে গিয়ে দেখে এসেছি।

–তা দেখেছো যখন তখন সত্যি করে বলল ওখানে কী কী সুবিধা অসুবিধা আছে?

–স্যার বাড়িয়ে বলা অধর্ম। এ শর্মা তা করে না।

–ঠিক আছে বল।

 পিটার একটা লম্বা ফিরিস্তি দিল যার সুবিধা বেশি অসুবিধা নামে মাত্র।

-যাক সব শুনলাম তবু শহরই।

-তা তো ঠিক, তবে আপনি বলেছিলেন না একটু নিরিবিলি জায়গা, তাই ওখানটা খুঁজেছিলাম।

-নিরিবিলি?

– স্যার, ওখানকার মতো মুক্ত বাতাস, অদূরে পাহাড়ে, পাখির ডাক অন্য কোথাও পাবেন না। ওখানে ঠেলাঠেলি, নোংরা বাতাস-এর কিছুই এখানে নেই। স্যার রোববার বাড়িটা একবার দেখে আসবেন না?

দাঁড়াও আগে মিসেস-এর সঙ্গে কথা বলি।

–ঠিক আছে কাল আমি আবার ফোন করব।

–আচ্ছা, তা বলে শহরের বাড়ির কথা ভুলো না যেন।

–সেকি কখনও হয় স্যার? ছাড়ি স্যার।

–ঠিক আছে।

নিরিবিলি কথাটা বরাবরই তার খুব ভালো লাগে। সত্যি সে নিরিবিলিতে থাকতে চায়। একটা চাপা নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে, অথচ ডিনসমেড পিটারকে তার সঙ্গে আর বন্ধু রবার্টের বেঁচে থাকার সময় বলেছিল তার বাড়ির পাশে বন্ধুর জন্যও একটা বাড়ি খুঁজতে। যাতে তারা দুজনে আরো বেশি করে যোগাযোগ রাখতে পারে তার জন্য। এখন সেই বন্ধুর স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলতেই তিনি এখন থেকে পালাতে ইচ্ছুক। রবার্টকে ভুলতে সে নিজেকে সবসময় কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখে।

কিন্তু স্মৃতির হাত থেকে কারো মুক্তি নেই। সেই স্মৃতি তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এ যেন অসহ্য হয়ে উঠেছে। আগে তার এক ঘুমে রাত কেটে যেত। এখন অতি কষ্টে রাতে ঘুম এলেও মাঝে ঘুম ভেঙে যায়, আর ঘুম আসে না। দেওয়াল ঘড়ির টিক টিক্ শব্দ তাকে যেন অনেক কিছু বলতে চায়।

শুধু তাই নয় মাঝেমধ্যে রবার্টের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দৃশ্য ডিনসমেডের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তখন রবার্ট তাকে হাত নেড়ে ইশারা করে ডাকে এবং হাতটা বাড়িয়ে দেয়। কী বীভৎস সেই হাত! অথচ রবার্টের হাত ছিল মেয়েদের হাতের মতো সুন্দর।

এক আধদিন এই দৃশ্য দেখে সে ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। সুসান তখন স্বামীকে জল খাইয়ে সুস্থির করে। এই ঘটনার পর ডিনসমেড পাত্তারি গুটিয়ে অন্যত্র চলে যাবার চেষ্টায় আছে। ডিনসমেড ঠিক ভয় পায়নি। আসলে সে রবার্টকে নিয়ে এত বেশি ভাবে যে তার অবচেতন মনে এই সমস্ত দেখা দেয়। সুতরাং গ্রামের বাংলোবাড়িই শ্রেয়।

অন্যদিনের তুলনায় আজ ডিনসমেড একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছে বলে সুসান খুব খুশী।

একটু পরেই সুসান কফি নিয়ে আসে। স্বামী-স্ত্রী মুখমুখি বসে কফি পান করছে। কফিতে চুমুক দিয়ে ডিনসমেড বলে–

–তোমার সঙ্গে একটা জরুরী কথা আছে।

জরুরী? কী ব্যাপারে?

–বাড়ির।

–সত্যি এ বাড়িতে আর থাকা যায় না।

–হঠাৎ এ কথা বলছ?

 –রজার লাঞ্চের পর এসেছিল। রাতে তোমার সঙ্গে দেখা করবে বলে গেছে।

–ওকে ঠিক দোষ দেওয়া যায় না। ওর ছেলে আসবে।

–আমাদের অসুবিধাটা তো উপেক্ষণীয় নয়। তা তুমি কী বলছিলে যেন?

–পিটার একটা বাড়ির খোঁজ এনেছে।

–কোথায়?

–একটু গ্রামের দিকে।

–ওসব গ্রামে ফ্রামে গিয়ে থাকতে পারব না।

–কিন্তু…তোমার কথার যৌক্তিকতা অস্বীকার করা যায় না। তবু বলছিলাম…

–বল, তবে গ্রামের ব্যাপার বাদে। এতদিন শহরে থেকে তারপর গ্রামে থাকব কী করে?

–তোমার কথা ভিত্তিহীন বলে আমি উড়িয়ে দিচ্ছি না। কিন্তু সুসান এখানে থাকলে আমি বাঁচব না।

–এসব কথা আসে কোত্থেকে?

রবার্টের ছায়া আমায় কাছে পেতে চায়। সে সমানে আমায় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

–ওসব অলক্ষুণে কথা মনে আনবে না।

সুসান স্বামীর কথায় ভয় পেয়ে যায়। মনে পড়ে রাতের স্বপ্নের কথা।

–তোমার দিকটা যে আমি বুঝতে পারছি না তা নয়, কিন্তু..

-তোমার গ্রামে গেলে একটু অসুবিধা হবে, শহরের বিলাসিতা থেকে বঞ্চিত হবে। কিন্তু এখানে রবার্টের হাতছানি সর্বদা আমায় তাড়িয়ে নিয়ে যাবার জন্য ওঁৎ পেতে আছে।

-না না, ওসব বলল না। বাড়িটা কোথায়?

–গ্রীন উডে।

–সে তো এখান থেকে অনেক মাইল দূরে। সেখানে স্কুল আছে তো?

–তা থাকবে না কেন? ওখানকার বাচ্চারা কী পড়াশুনা করে না?

–তা এতো বড়ো একটা বাংলোর দাম ষাট হাজার টাকা চাইছে?

–তাও আমি ষাট হাজারে রাজী হইনি, পঞ্চাশ হাজার বলেছি।

–দেখো, আর কী বলব?

–না, তোমার মত না পেলে…।

–তোমার মতই আমার মত।

–তাহলে একদিন গিয়ে বাংলোটা দেখে আসি?

–ঠিক আছে।

–আচ্ছা সামনের রবিবার যাওয়া যেতে পারে?

–হ্যাঁ তাই চলো।

.

০৮.

 সুন্দর সকাল, পরিষ্কার আকাশ দেখে কে বলবে গত রাতে প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়ে গেছে।

চার্লস গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। উইক এন্ডে সে কোথাও না কোথাও পাড়ি জমায়। এই ঘোরাই নাকি ওকে সারা সপ্তাহের রসদ জোগায়।

চল্লিশ বছরের সুপুরুষ চার্লস লম্বায় প্রায় ছফুটের কাছাকাছি, পেশিবহুল, চওড়া কাঁধ। দুপুরের ছেঁড়া মেঘ দেখে সে ভাবছে এই মেঘ কেটে যাবে।

চার্লস একটা রেস্তরাঁর সামনে গাড়ি পার্ক করে লাঞ্চ সারে। এবং সেখানেই কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে শহরের দিকে গাড়ি নিয়ে এগোয়।

চার্লস আকাশ দেখে ভয় পেয়ে যায়। চারিদিকে রাশিকৃত কালো মেঘ তার সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। চার্লস দ্বিগুণ বেগে গাড়ি চালিয়ে চলেছে। তারপরই যত গণ্ডগোল। সে গাড়ি থামিয়ে দেখে পথের মাঝে গাছ ভেঙে পড়ে আছে। স্থানীয় লোকের চেষ্টায় অনেক কষ্টে ঘণ্টা দুয়েক পরে গাছ সরানো সম্ভব হল।

চার্লস ওদের টাকা মিটিয়ে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে ভালোয় ভালোয় শহরে পৌঁছোতে পারলে হয়। একটু পরেই বৃষ্টি থামল। চার্লস ঝড়ের বেগে গাড়ি চালিয়ে যায় শহরে পৌঁছোবার আশায়, নইলে সমূহ বিপদ–যা ঠান্ডা। রাস্তার দুধারে পাহাড়ের সারি। অদূরে ঘন জঙ্গল।

হঠাৎ বৃষ্টি থেমে গেল। বৃষ্টি না পড়লে কয়েক ঘন্টায় শহরে পৌঁছোবে।

কিন্তু মানুষ যা ভাবে তা হয় না। এবার আরো জোরে বৃষ্টি এলো।

লোকালয় থেকে চার্লস অনেক দূরে চলে এসেছে। একটা বাড়ি থেকে অপর বাড়ির দূরত্ব অনেক। আবার সন্ধে হয়ে এসেছে।

হঠাৎ ওয়াইপারটা কাজ করছে না। চার্লস হাত দিয়ে মুছে গাড়ি চালায়। বৃষ্টি হয়েই চলেছে। থামবার কোনো লক্ষণ নেই বরং বেড়েই চলেছে।

এখন পিচের রাস্তা ছেড়ে কাঁচা মাটির উপর দিয়ে গাড়ি চলেছে। গাড়ির গতি না কমালে যেকোনো মুহূর্তে পিছলে পাশের গভীর খাদে পড়বে। মিনিট পাঁচেক পর চার্লসকে গাড়ি থামিয়ে দিতে হয়। জলের তোড়ে গাড়ি চলে না।

চার্লস কী করবে? বিপদ অনিবার্য। গাড়ি থেকে নেমেই বা কী করবে? কোথায়ই-বা যাবে? আশপাশে কোনো বাড়ি নেই। চারিদিকে শুধু জল আর জল। তার উপর যা হাড়কাঁপানো ঠান্ডা।

চার্লস ভাবে মরতে হলে গাড়িতে মরবে কিছুতে গাড়ি থেকে নামবে না। সীটে বসে হুইস্কির বোতলটা খুলে খানিকটা হুইস্কি খায়। এতে ঠান্ডা কিছুই কমে না। তবে খানিকটা তাজা বোধ হয়।

চার্লস গাড়িতে স্টার্ট দিলে খানিক চলার পর গাড়ি বন্ধ হয়ে যায়। ইঞ্জিনে জল ঢুকেছে গাড়ি আর চলবে না। এখন উপায়? চার্লস ভাবে কোথাও গাড়ি কারখানা পাওয়া যাবে? এতো বাজে আবহাওয়ায় কোনো মেকানিক কী আসতে চাইবে? মোটা টাকা দিলে আলাদা কথা।

হঠাৎ গাড়ি চলতে শুরু করে। ইঞ্জিন বন্ধ। গাড়ি জলের তোড়ে চলছে। তারপর গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির মডগার্ড আঁকড়ে ধরে কোনোরকমে গাড়ির গতি রোধ করে। তার পর গাড়িতে একটা মোটা নাইলনের দড়ি ছিলো, তাই দিয়ে কোনোরকমে গাড়িটাকে একটা গাছের সাথে বেঁধে ওভারকোট দিয়ে মাথা ঢেকে সে সামনের দিকে এগিয়ে চলে।

মিনিট দশেক চলার পর সে একটা আলোর অস্পষ্ট রেখা দেখতে পায়। তার গতি দ্বিগুণ বেড়ে যায়। কারণ শীতে সে জমে যাচ্ছিল, একটা আশ্রয় না পেলে সে মরেই যাবে।

হ্যাঁ, চার্লস ঠিকই দেখেছে। ওটা একটা বাংলো বাড়ি। চার্লস ঘড়ির রেডিয়ামের দিকে তাকিয়ে দেখে সাতটা বাজে।

চার্লস প্রায় বাড়িটার কাছে এসে গেছে আর হাত দশেক বাকি পৌঁছোতে। ঠান্ডায় সে ঠক ঠক করে কাঁপছে।

দরজার সামনে এসে হাত বাড়িয়ে বেলটা বাজায়, হঠাৎ বেলের শব্দে ডিনসমেড থমকে যায়। ডিনার টেবিলে বসে সে ব্যাবসাসংক্রান্ত কাগজ দেখছিল। এই ঝড়জলের রাত্রে কে বেল বাজাচ্ছে?

জর্জ তার বাবার কাছে বসে ছিল। সেও চমকে যায়। সুসান কিচেন থেকে বেরিয়ে এসে বলে–বাইরে কে যেন বেল বাজাচ্ছে।

–আমারও তাই মনে হল।

–কে আবার আসতে পারে?

–না না।

–কেন মা?

বেলটা তখনই বেজে উঠল বেশ জোরে।

–মাম্মি খুলি?

–জিনসমেড বলে–কোনো অশরীরী আত্মা নয় তো?

–সে আবার কী কথা?

–হয়তো রবার্ট।

–আঙ্কেল তো মরে ভূত হয়ে গেছে। জর্জ হাসে।

হতেও তো পারে।

 জর্জ দরজার দিকে এগিয়ে যায়–নিশ্চয় কেউ বিপদে পড়েছে।

 তারপর জর্জ দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে–ভেতরে আসতে পারি?

–নিশ্চয়ই। আপনি যে একেবারে ভিজে গেছেন।

পথের মাঝে গাড়িটা বিগড়ে গিয়ে এই বিপত্তি।

এর মধ্যে বাবা-মার কাছে মেরী এবং শার্ট এসে হাজির। ওরা কিচেনে মায়ের সঙ্গে রান্নায় সাহায্য করছিল। মাকে ছুটে আসতে দেখে ওরা থাকতে পারেনি।

–এসে ফায়ার প্লেসের কাছে বসুন। ডিনসমেড চার্লসের দিকে এগিয়ে যায়।

 চার্লসের কাঁপা থামেনি–আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

–আরে এতে ধন্যবাদের কী আছে? আজ আপনি বিপদে পড়েছেন কাল আমিও পড়তে পারি। জর্জ ততক্ষণে একটা চেয়ার নিয়ে ফায়ার প্লেসের কাছে রেখে–আপনি এতে বসুন।

-ধন্যবাদ ভাই।

–ফায়ার প্লেসের কাছে বসে গনগনে আগুনের কাছে হাত বাড়িয়ে দেয় চার্লস।

–আপনার পরিচয়টা জানা হল না।

–আমার নাম চার্লস বো ভারা।

–কোথায় থাকেন?

–পাম এভিনিউতে।

 –তা এদিকে কোথায়?

–নিছক ঘুরতে। বলতে গেলে প্রায় উইক এন্ডেই বের হই।

–তাহলে ঘোরা আপনার নেশা কী বলুন?

–হ্যাঁ তা বলতে পারেন।

 হঠাৎ একটা জিনিসের দিকে নজর পড়তেই সুসান বলে ওঠে-শার্লট।

শুধু নাম উচ্চারণ করতেই শার্লট দ্রুত ভেতরে চলে যায়। চার্লস ব্যাপারটা দেখল। যুবতী নারীর দিকে বারবার তাকানো যায় না।

ডিনসমেড বলে–আপনাকে একটু ব্র্যান্ডি দিতে বলি?

-তাহলে তো খুব ভালো হয়। সত্যি আপনাদের আশ্রয় না পেলে…

–কিছুই হত না। অন্য কোথাও পেতেন।

–এখানে আপনার বাড়ি ছাড়া তো অন্য কোনো বাড়ি নজরেই এলো না।

–হ্যাঁ কাছে পিঠে আর নেই।

এর মধ্যে ব্র্যান্ডি ভর্তি গ্লাস আনে মেরী-এই নিন।

পানীয় নিয়ে মেরীর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে অস্পষ্ট করে বলে–ধন্যবাদ।

 চার্লস ব্র্যান্ডি পান করে কিছুটা চাঙ্গা বোধ করে।

-এই দেখুন কী ভুলো মন, আপনি এখনও ভিজে জামাকাপড়ে রয়েছেন।

–ঠিক আছে,-চার্লস সত্যিই লজ্জা পেয়ে যাচ্ছে।

-তা বললে হয়? এই ভিজে জামাকাপড়ে আপনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন আর আমিও লজ্জায় মারা যাবো। একরাত কষ্ট করে আমার জামা পরে চালান।

হঠাৎ চলে গিয়ে শার্লট আবার ফিরে এসেছে দেখে চার্লস খুশী। দুবোনের মধ্যে সেই সুন্দরী। ডিনসমেড বলে–মেরী তুমি চার্লসকে বাথরুমটা দেখিয়ে দাও।

–আসুন আমার সঙ্গে।

অগত্যা মেরীকেই অনুসরণ করতে হয়।

পোশাক পাল্টে চার্লস আর ডিনসমেড ডিনার টেবিলে মুখোমুখি বসেছে।

ডিনসমেড বলল–আপনার নেশার কথা জানা গেল কিন্তু পেশার…

–পেশায় আমি একজন ইঞ্জিনিয়ার।

জর্জ বলে ওঠে। জানেন আমারও ইঞ্জিনিয়ার হবার শখ।

চার্লস জর্জের দিকে তাকায়,-রোগা ছিপছিপে গড়ন, কটা চোখ, ধূসর চুল, বয়স ষোল হবে।

-ভালো কথা।

–আমি এখানে একটা ছোট্ট ল্যাবোরেটরি তৈরি করেছি।

–ভেরি গুড। যাবার সময় দেখে যাবো।

 আমি পেশায় কন্ট্রাক্টর।–ডিনসমেড বলে।

–কীসের?

বাড়ির। অথচ আমার নিজের বাড়ি হল না।

–এটা?

–কিনেছি।

–আচ্ছা এখান থেকে শহর কত দূরে?

–ত্রিশ-চল্লিশ মাইল হবে।

–আপনার ছেলে কোথায় গিয়ে পড়াশোনা করে?

—এই গ্রামের শেষের দিকে স্কুল-কলেজ আছে।

-বাজার হাট?

–টিন ফুড ভরসা।

–বলেন কী?

মেরী বলে–মাংসওয়ালাই সপ্তাহে মাত্র একদিন দোকান খোলে।

-তাই নাকি?

 ডিনসমেড বলে–হ্যাঁ, কে বলুন তো টিন ফুডের সৃষ্টি করেছিল? তাকে ধন্যবাদ না জানিয়ে থাকা যায় না।

–ঠিক বলতে পারব না। চার্লস মেরীর দিকে তাকায়। বয়স আঠারো হবে, মাথায় একরাশ ধূসর চুল, কটা চোখ, স্লিম ফিগার, পরনের ম্যাক্সি।

ওদিকে শার্লট ও সুসান ডিনার সাজাতে ব্যস্ত। শার্লটকে একনজরে দেখে নেয়। সতেরো হবে, নীল চোখ, লম্বা ধূসর চুল, সুন্দরী।

ওরা তারপর ডিনারে বসল। কোণার রাস্তার ধারের ঘরে চার্লসের থাকার কথা হল। ডিনসমেডের কথামতো চার্লস সেই ঘরে শুতে গেছে। তাকে সবকিছু দেখিয়ে দেবার জন্য দুবোন এসেছে। শার্লট বলল-ঘরের সঙ্গে বাথরুম রয়েছে।

চালর্স তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে শার্লটের দিকে তাকায়।

-ধন্যবাদ। কিন্তু ম্যাডাম আপনার নামটাই জানা হল না।

 –শার্লট ডিনসমেড।

–এই অধমের নাম…

–শুনেছি।

–সুন্দরী মেয়ের সাথে কথা বলা থেকে ভগবান বঞ্চিত করে রেখেছে।

মেরী বলে–টেবিলে আপনার জন্য জল আছে। তবে টেবিলটা পরিষ্কার করতে পারিনি।

–যা করেছেন তাই যথেষ্ট। আপনার নামও অজানা।

–মেরী ডিনসমেড।

–দুঅক্ষরের ছোট্ট সুন্দর নাম। আমি একটু বাথরুম থেকে আসছি।

দুই বোন বিছানাটা একটু ঠিকঠাক করে চলে গেল। ক্লান্ত চালর্স শুতে যাবার আগে জলের গ্লাসের দিকে হাত বাড়িয়ে চমকে গেল। এভাবে এটা কে লিখল? কার লেখা হতে পারে? এ ধরনের লেখার অর্থ বা উদ্দেশ্য কী হতে পারে? এর পেছনে কী রহস্য লুকিয়ে আছে?

চার্লস আবার লেখাটার দিকে তাকায়, টেবিলের ধুলোর উপর লেখা আছে–এস.এ.এস. অর্থাৎ সেভ আওয়ার সেলভস–এই লেখাটার কীই বা হেতু হতে পারে?

আর কিছুই ভাবতে পারে না চার্লস, ক্লান্ত হয়ে অবশ দেহে ঘুমে অচৈতন্য হয়ে পড়ে। তবে ভোরেই জানতে হবে কথাটা কে লিখেছে এবং কেন? নইলে সে এখান থেকে যেতে পারবে না।

পাখির ডাকে চার্লসের ঘুম ভাঙে, চোখ মেলে বাইরে তাকায়। চোখ জুড়িয়ে যায়। অদূরে পাহাড়, চারিদিকে ঘন জঙ্গলের জটলা, পরিষ্কার আকাশ, সূর্য ওঠার প্রতীক্ষা। সে এক অনিন্দ্য সুন্দর মুহূর্ত।

চার্লস এসে বাগানে গুটি গুটি পায়ে হাঁটতে থাকে, ঠিক তখনই সে মেরীকে দেখে গাছের পরিচর্যা করেত।

–গুড মর্নিং, মিস মেরী।

–গুড মর্নিং, মিঃ চার্লস।

–আচ্ছা, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতাম।

 –আমাকে? বলুন।

–গতরাতে আমার ঘরের টেবিলে কে এস.ও.এস. লিখেছে?

–আমি।

–কেন?

–তা জানি না।

–না জেনেই লিখেছেন? বিশ্বাস হয় না।

–আমি যাই বলে মেরী আর দাঁড়ায় না।

চার্লস আশ্চর্য হয়ে ভাবে মেরী ওভাবে চলে গেল কেন? এর পেছনে কী রহস্য থাকতে পারে? শার্লট বাগানের দিকে আসছিল কিন্তু চার্লসকে দেখেই চলে যেতে চায়। চার্লস বলে–মিস শার্লট, গুড মর্নিং।

-গুড মর্নিং, মিঃ চার্লস।

-প্লিজ, চলে যাবেন না। একটা কথা, আপনি কী কাল আমার ঘরের টেবিলে এস.ও.এস. লিখেছেন?

-না, আমি যাই।

দাঁড়ান আমার মনে হয় আপনি লিখেছেন।

–কিসে বুঝলেন? আর যদি লিখেও থাকি তাতে কী হয়েছে? শার্লট হাসে।

–না, কিছুই হয়নি। কথাটার মানে জানেন?

–না। চলুন ব্রেকফাস্ট তৈরি।

–হ্যাঁ, চলুন।

চার্লস ভাবে, এই এস.ও.এস.-এর মধ্যে কী রহস্যের সৃষ্টি হতে পারে?

.

০৯.

 স্বনামধন্য গোয়েন্দা এরকুল পোয়ারো, বহু রহস্যের জাল ভেদ করে খুনীকে ধরেছে। যার প্রশংসায় সবাই ধন্য ধন্য করেছে।

— পোয়ারো বার কয়েক চেষ্টার পর চার্লসের লাইনটা পেয়ে যায়। চার্লস তার কলেজের বন্ধু। একে অপরকে মনের কথা ব্যক্ত না করে থাকতে পারে না। তবে পোয়ারোর লাইনের গোপনীয়তা যৌক্তিকতা চার্লস বোঝে। কারণ সে ভালো করে জানে সব লাইনের কিছু না কিছু গোপনীয়তা আছে। যা নিজের স্ত্রীর কাছেও বলা যায় না। অবশ্য পোয়ারো চার্লসের কাছে অনেক কথাই অকপটে বলে এবং বুদ্ধি পর্যন্ত নেয়।

-হ্যালো!

–হ্যালো, আমি পোয়ারো বলছি।

–বলুন স্যার।

–তোমার সাহেব ফিরেছে?

–না স্যার, সেই জন্য বড় চিন্তায় আছি।

–চিন্তার কিছু নেই। কোথায় গেছে জানো?

–না স্যার।

সঙ্গে আর কেউ গেছে?

–না, একাই গেছে।

–এলে আমায় ফোন করতে বলল।

–আচ্ছা স্যার। গুড নাইট।

.

-হ্যালো।

 –চার্লস ফিরেছে? পোয়ারো জানতে চায়।

–না স্যার, রাত প্রায় এগারোটা বাজে।

 –ঠিক আছে যত রাতেই ফিরুক আমায় ফোন করো।

নিশ্চয়ই স্যার।

.

পরদিন সকাল নটা নাগাদ চার্লস ফিরেছে। তবে নিজের গাড়িতে নয়, কিছুটা ট্রাকে এবং বাকিটা ট্যাক্সিতে। ডিনসমেডের জিম্মায় গাড়িটা রেখে এসেছে। উনি গ্যারেজ থেকে লোক আনিয়ে সারিয়ে চার্লসের বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন।

চার্লস বাড়ি আসার সঙ্গে সঙ্গে উদ্বিগ্ন চাকর বার্ট নানা কথা জিজ্ঞাসা করে। সে বাড়ির চাকর হলেও তার অবিবাহিত জীবনে বিরাট ভূমিকা আছে।

চার্লস তাকে বুঝিয়ে বলার পর বার্ট বলে–স্যার এক্ষুনি একবার মিঃ পোয়ারোকে ফোন করুন।

-হা করছি। কয়েকবার ফোন করেছে তো?

 –হ্যাঁ স্যার।

–এক কাপ কফি দাও তো।

–এক্ষুনি আনছি। কাল রাতে উনি দুবার ফোন করেছেন, সকালেও দুবার ফোন করেছেন।

–তাই নাকি? ভাবছিলাম একটু বিশ্রাম নেবো, এক্ষুনি একবার যাই। বলে উঠে দাঁড়াল।

–স্যার কফি খাবেন না?

–না থাক।

একটা ট্যাক্সি ধরে মিনিট দশেকের মধ্যে পোয়ারোর বাড়ি পৌঁছালো চার্লস। পোয়ারো একটু ধমকের সুরে বলল–এই যে ধাড়ি খোকা, তোমার খবর কী?

-খুবই গুরুতর।

–তা কাল প্ৰেজার ট্রিপ মারতে কোথায় গিয়েছিলে? গ্রীন উড ছাড়িয়ে? সঙ্গে কে ছিল?

–কেউ না। কফি আনতে বল।

তারপর কফি এলো। কফি খেতে খেতে চার্লস ডিসমেডের পরিবারের প্রশংসা করে তাদের আতিথ্যের বর্ণনা করল এবং বলল রাতে তাকে থাকতে না দিলে সে জীবন পেত না!

বন্ধু, ও অবস্থায় কেউ কাউকে ফেরাতে পারে না।

–এবার আর কোথাও তোমায় ছাড়া বেরোচ্ছি না। তার আগে তোমায় ডিনসমেডের দুই কন্যার বিবরণ দিই। বন্ধু, বয়সে বড়ই ছোটা।

–গল্পটার গোড়াতেই কেঁচিয়ে দিলে।

বুঝিয়ে বলবে তো কীসে?

–সাধে কী তোমায় লোকে অবিবাহিত বলে?

বন্ধু, তুমিও তো একই দোষে দোষী।

–তা বয়স কত? একেবারে মায়ের কোলে দুধ খাচ্ছে না তো?

–না তা নয় দুজনেই সতেরো আঠারো হবে।

–এইজন্যই বলি অবিবাহিত লোকগুলো যেমন অবিবেচক তেমনি আহাম্মক।

বন্ধু, উপরে থুতু ছেটালে তা নিজের গায়ে এসেই পড়ে।

-তা ঠিক। তবে তোমার মতো আহাম্মক নই। একটু উঁচু ধরনের। কেউ সাতেরো আঠেরো বয়সের মেয়েদের বলে বয়সে বড়ই ছোটো।

বন্ধু, তোমার বয়স কত?

–ওদের সঙ্গে কথা বললে আমাদের বয়সও তখন পঁচিশের নিচে গিয়ে দাঁড়াতো। নইলে সেদিন পার্টিতে মিস জার্ডিন আমার সান্নিধ্য না পেয়ে অভিমানে কত কী বলেছিলো।

–আর তুমি কথা দিয়েও পরের দিন জার্ডিনের বাড়ি যাওনি।

–আহাম্মক তো।

–স্বীকার করছ? চার্লস হো হো করে হাসে–আজ আর অফিস গেলাম না।

হা ডুব মারলে তো দেখতেই পাচ্ছি আর তার সঙ্গে আমারও ক্ষতি করালে।

বরং তোমায় একটা কেস দিতে এসেছি।

–এখন আর কোনো কেস না। দুটো কেস সমাধান করতে গিয়ে নাজেহাল, এখন শুধু বিশ্রাম।

–তাই বুঝি কাল আমার সাথে প্রেজার ট্রিপে গেলে না? বিশ্রাম তোমার ঠিকুজি কোষ্ঠিতে নেই। ভগবান তোমার পায়ে চাকা লাগিয়ে দিয়েছে বন বন করে ঘোরার জন্য। আর মন দিয়েছে চিন্তা ভাবনার জন্য। এই কাজ করার স্পৃহা তোমার মধ্যে যথেষ্ট রয়েছে। আমার অফিস ডুব মারার প্রসঙ্গে তুমি বললে, এসে আমার কাজের ক্ষতি করেছ।

ব্র্যাভো বন্ধু।

–আধা গোয়েন্দা কী বলো? তবে তোমার ট্রেনিং-এ কিছুদিন থাকতে পারলে পুরো হয়ে যেতে পারি।

তুমি অন্তত হবে না। নইলে মিস হবসের মতো পাত্রীকে তুমি প্রত্যাখ্যান করো। সে বিশাল সম্পত্তির একমাত্র অধিকারিণী।

-করাটা বোধহয় উচিত হয়নি। আসলে সেদিন আধো অন্ধকার জায়গায় আমায় টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে গদগদ গলায় কী সব বলতে লাগলো, তাতেই আমি ভ্যাবাচাকা খেয়ে পালিয়েছি।

-তুমি একটা ইডিয়েট।

–বল, আমরা ইডিয়েট।

পোয়ারো হাসে–সত্যি বোধহয় তাই। তা কেসটা কী একটু শুনি।

দ্যাটস লাইক এ গুড বয়। এর মধ্যে একটা ঘন রহস্যের জাল আছে সেটা বার করতে। হবে।

–একটু খুলে বলো তো।

 –তাহলে কেসটা টেকআপ করলে?

–আগে কেসটার মেরিট বুঝি।

–মেরিট আছে। আমার দুটো জিনিসের ওপর দারুণভাবে সন্দেহ আছে।

 –সে দুটো জিনিস কী?

-প্রথমত আমি মিঃ ডিনসমেডের বাড়িতে ঢুকে তার ছেলে জর্জ ও স্ত্রী-এর সঙ্গে পরিচয় করার পর তার দুই মেয়েরা এলো।

–তাদের নাম।

–মেরী ও শার্লট।

এদের মধ্যে কে বড়ো?

–মেরী।

–বয়স কত?

–আঠারো হবে। শার্লটের বয়স সতেরো হবে। দুজনেই আমার কাছে এসে পড়বার পর মিসেস ডিনসমেড চাপা গলায় শার্লটকে হিসহিস করে উঠলো। কেন জানি না।

-তারপর কী হল?

–শার্লট চলে গিয়ে একটু পরে ফিরে এল।

–হঠাৎ চলে গেল কেন?

–তা ঠিক বুঝতে পারলাম না, তবে শার্লট যখন এল তখন ওর চুলের রং ধূসর দেখলাম। কিন্তু আমার মনে হয় ওর চুলের সে রং ছিল না।

–কী রং ছিল?

–সম্ভবত সোনালি। কিন্তু মিসেস ডিনসমেড ওভাবে শার্লট বলে ডাকল কেন? আর কেনই বা শার্লট চলে গিয়ে একটু পরে ফিরে এল?

-তুমি কী ওদের কিছু জিজ্ঞেস করেছ?

-না আসলে তখন সবে আশ্রয় পেয়েছি শেষে যদি ঘাড় ধরে বের করে দেয়, আর সব ব্যাপারে কৌতূহল ভালো না।

–আর দ্বিতীয় পয়েন্ট?

–আমায় শুতে দেওয়া হয়েছিল একধারে কোণের ঘরে। আমায় ঘরটা দেখিয়ে দিয়ে দুই বোন লজ্জিতভাবে বলল টেবিলটা ভালোভাবে পরিষ্কার করা হয়নি।

–তুমি গলে গিয়ে তখন কী বললে?

–অবজেকশান। তবে সাময়িকভাবে গলে গিয়ে হেসে বললাম, যা করেছেন যথেষ্ট। এরপর বাথরুম থেকে ফিরে এসে টেবিলের উপর দেখলাম এস.ও.এস.লেখা।

এস. ও. এস.?

—হ্যাঁ।

 –কাউকে লিখতে দেখেছ?

–না। হয়তো দুবোনের মধ্যে কেউ লিখেছে।

–তুমি বাথরুম থেকে এসে কাউকে দেখনি।

–না।

–তুমি কখন কোথায় জিজ্ঞাসা করেছ?

–সকালে বাগানে পায়চারী করার সময়।

ডিনসমেড দম্পতি জানে?

 –না।

এই বলে চার্লস মেরী ও শার্লটকে যা যা বলেছে বা তারা যা যা বলেছে সবই জানায় পোয়ারোকে। তাকে চিন্তিত দেখায়। চার্লস জানায় পোয়ারোকে এই ঘটনার কারণ বের করতে হবে। পোয়ারোকে বেশ গম্ভীর দেখায়।

.

১০.

 বেলা বারোটায় মাঝারি আকারের একটা ঘর নিয়ে ছোট্ট কোম্পানিডিনসমেড কনস্ট্রাকশনের সামনে দাঁড়ায় পোয়ারো। ভেতরে একটা অল্পবয়সী ছেলে কাজ করছে আর টেবিলের ওপর একটা বাড়ির প্ল্যান দেখছে ডিনসমেড।

কালো রং-এর ওপর নীল লাল স্ট্রাইপ করা স্যুট, পায়ে চকচকে স্যু, টাইয়ের রং নীল তার ওপর সাদা কাজ। ভেতরে ওয়েস্ট কোট তার ওপর দিয়ে সাদা জামা উঁকি মারছে।

সুপ্রভাত জানিয়ে ডিনসমেডের সঙ্গে আলাপ করেন পোয়ারো। নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে সে মিথ্যে কথা বলে। বসবাস স্থান জানায় ওয়েস্ট রোড আর পেশা হিসাবে বলে কলেজের শিক্ষকতা। ডিনসমেড তার পোশাকে সম্মানিত বলে আখ্যা দিয়ে বলে

-একটু কফি আনাই?

–না, এক্ষুনি খেয়ে বেরিয়েছি। আর শুধু কফির ওপর দিয়ে চালালে হবে না। আপনার আতিথ্যের প্রত্যাশায় চার্লস পঞ্চমুখ। তাই একদিন সকালে ওর সঙ্গে আপনার বাড়ি যাবো আর ফিরবো সন্ধ্যা বেলায়।

ডিনসমেড রাজী হয়। গ্রামের দিকে বাড়ি হবার জন্য পোয়ারো শহরের সঙ্গে সে জায়গার তুলনা করে জানায় খুব ভালো জায়গায় বাড়ি। তারপর বাড়ির দাম শুনে অবাক হয়ে যায় পোয়ারো, মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকা, এই চড়া দামের বাজারে। তারপর পোয়ারো জানতে পারে পনেরো বছর হল তারা ওখানে। প্রথমে তার স্ত্রীর আপত্তির কথাও পোয়ারোকে জানায়।

তারপর পোয়ারো বলে–যদি আমি আপনার বাড়ি যাই তবে আপনার ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী বিব্রত বোধ করবে না তো?

-না না, আমার স্ত্রী ভীষণ মিশুকে। আর ছেলে-মেয়েরা কলেজে পড়ে, ওরা সঙ্গী চায়।

–গুড, ছেলে না মেয়েরা বড়ো?

–মেয়েরা।

–মেয়েরা কোথায় পড়ে আর ছেলে কোথায় পড়াশুনা করে?

–মেয়েরা কুরীতে আর ছেলে হোবার্ট ইনস্টিটিউটে পড়ে।

আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেরোবার মুখে পোয়ারোর চোখে পড়ে একটা ছবি, এতে একজন মিঃ ডিনসমেড অপরজন কে?

অপরজন রবার্ট।

পোয়ারো রবার্টের সম্বন্ধে সবকিছুই জানতে পারে ডিনসমেডের কাছ থেকে। তারপর আবার একটা মিথ্যের জাল বোনে। বলে–আমার এক বন্ধু খুব ভালো ফুটবল খেলত। খেলতে খেলতে আঘাত পেয়ে তাতেই মারা যায়। সেই থেকে আমি আর খেলার মাঠে যাই না। কোথাও ফুটবল সম্বন্ধে আলোচনা হলেও আমি সেখান থেকে চলে যাই।

-এখনো তার কথা ভোলেননি, বোঝা যাচ্ছে।

–এরপর হয়তো ভুলে যাবো। আপনার তো আমার মতোই অবস্থা।

–হ্যাঁ, আসলে বড় বেশি রবার্টকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলাম।