৪. ফলির চারপাশে ঘোরাঘুরি

যখন সে ফলির চারপাশে ঘোরাঘুরি করছিল তখন দেখল মিসেস লেগি বসে আছে এক জায়গায়। যেন লাফ দিয়ে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে যখনই পোয়ারোকে দেখতে পেল মিসেস লেগি। আপনি মঁসিয়ে পোয়ারো, চমকিতভাবে বলল সে, একেবারেই শুনতে পাইনি আপনার পায়ের শব্দ, ভীষণ চমকে দিয়েছেন আমাকে।

মনে হয়, আপনি কিছু খুঁজছেন ম্যাডাম? পোয়ারো বলল, হয়তো বা ভুল করে কিছু ফেলে গেছেন এখানে, না হয় আপনার কিছু হারিয়েছে। নিশ্চয়ই আপনি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেননি, এটা আমার পক্ষে খুব দুর্ভাগ্যের ব্যাপার।

মিসেস লেগি চেতনা ফিরে পেয়ে উত্তর দিল, কেউ কি এখানে এই সকালবেলায় কারো সঙ্গে দেখা করতে আসে?

পূর্ব নির্দিষ্ট কোনো জায়গায় কখনো কখনো কেউ আসে বোধহয়। পোয়ারো উত্তর দিল।

সে আবার বলল, স্বামীরা খুব ঈর্ষাপরায়ণ হয়, সব মেয়েদেরই অভিযোগ থাকে তাদের স্বামীর বিরুদ্ধে, বিশেষতঃ ইংরাজ স্বামীদের ক্ষেত্রে তো বটেই। তাহলে আপনিও কি সেই দলে? প্রশ্ন করলো মিসেস লেগি।

পোয়ারো বলল, আমি দুঃখিত ম্যাডাম, আমি কিন্তু স্বামী নই।

মিসেস শেলি লেগি উত্তর দিল, এর মধ্যে দুঃখিত হবার কিছুই নেই সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। আর আপনি যে বেশ সচেতন এবং অবিবাহিত থাকতেই পছন্দ করেন, তাও আমি নিশ্চিত রূপে জানি।

ম্যাডাম, একথা ঠিক নয়, সেটা খুবই ভয়ঙ্কর, জীবনে আমি যে ভুল করেছি, এখন আমি সেটা। বুঝতে পারছি, উত্তর দিল পোয়ারো।

শেলি লেগি বলল, আমার কিন্তু ধারণা, নির্বোধ লোকেরাই বিবাহ করে।

আচ্ছা ম্যাডাম, আপনার এখন সেই দিনগুলোর জন্য দুঃখ হয় না, সেই চেলসির দিনগুলিতে যখন আপনি ছবি আঁকতেন? প্রশ্ন করলো পোয়ারো।

আপনি দেখছি সমস্তই জানেন আমার সম্পর্কে, মঁসিয়ে পোয়ারো? বলল শেলি লেগি।

একজন লেখক আমি, এরকুল পোয়ারো বলল, আমি সবকিছু জানতে চাই মানুষের সম্বন্ধে।

ম্যাডাম, আপনার দুঃখ হয় না সেই ফেলে আসা দিনগুলোর জন্য, আবার বললো পোয়ারো। মিসেস লেগি একটা আসনে বসে বলল, ঠিক জানি না। পোয়ারো তার পাশের জায়গাটাতে বসলো। প্রথম যখন আমি এখানে ছুটি কাটাতে আসি, আমি ভেবেছিলাম সব কিছুই আগের মতো চলবে এখানে। অথচ কার্যতঃ তা হলো না। কেন জানি না, আলেক লেগি কিরকম যেন খেয়ালি; কি হয়েছে তার জানি না। ভীষণ দুর্বল ওর স্নায়ু। মাঝে মাঝে কেউ ওকে ফোন করে ভয়ঙ্কর কোনো খবর দেয়। কিন্তু ও কিছু জানায় না আর আমাকে পাগল করে তোলে এই ব্যাপারটা, হয়তো কোনো নারী ওর জীবনে এসেছে আমি সেটাই ভেবেছিলাম। না না, সেটাও নয়…। কথাগুলি ক্রমশ বলে গেল শেলি লেগি।

পোয়ারোর দৃষ্টিতে পড়ল যেন শেলি লেগির কণ্ঠস্বরে সন্দেহের আভাস। পোয়ারো প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে জিজ্ঞাসা করলো, ম্যাডাম আপনি কি গতকাল বিকালে চায়ের আসরে ছিলেন?

ভ্রূ তুলে পোয়ারার দিকে তাকাল শেলি, বলল চায়ের আসরে? দ্রুত বলল, হ্যাঁ নিশ্চয়ই, জ্যোতিষীর ছদ্মবেশে একভাবে বসে থাকা কি বিরক্তিকর আপনি তো জানেন না?

আমার মনে হয় ম্যাডাম, একটু আগে আপনি এখানে কিছু একটা খুঁজতে এসেছিলেন! বলল পোয়ারো। দেখুন তো এটা খুঁজছিলেন কিনা? পোয়ারো তাকে একটা সুদৃশ্য সোনার টুকরো দেখালো হাতে করে।

ঠিক বলেছেন, হ্যাঁ, আমি তো এটাই খুঁজছিলাম, শেলি বলল। মঁসিয়ে পোয়ারো ধন্যবাদ, আর আপনি কোথা থেকে এটা পেলেন? জানতে চাইলো শেলি লেগি।

পড়েছিল এই ফলির মেঝের ওপর, পোয়ারো বলল।

এটা হয়তো ফেলে দিয়ে থাকবে, বলল মিসেস লেগি।

পোয়ারো প্রশ্ন করলো, গতকাল কি?

 হয়তো আগে কোনো একদিন হবে, না না, কালকে নয়। বললো শেলি।

জোর-এর সঙ্গে পোয়ারো বলল, না ম্যাডাম গতকাল বিকালেই, কারণ আমি তখন আপনার কব্জির ব্রেসলেটে এটা দেখেছিলাম, গতকাল যখন আপনি টেন্টে আমার ভবিষ্যতের কথা বলছিলেন।

আর কেউ বোধহয় পোয়ারোর মতো এভাবে মিথ্যে কথা জানে না। আসল কথাটা হল, এইভাবে অন্যের কাছ থেকে, মিথ্যে চাপ দিয়ে তার পেটের কথা বার করে নিতে জানে সে। আর ফলও হলো তাতে।

ঠিক মনে করতে পারছি না আমি, বলল শেলি লেগি। আমি যে এটা হারিয়েছি তা আজ সকালবেলায় আমি লক্ষ্য করলাম।

মিসেস শেলি লেগি পোয়ারোকে আর একবার ধন্যবাদ জানিয়ে দ্রুতগতিতে ফলি থেকে বেরিয়ে গেল।

ভাবতে থাকলো পোয়ারো অপসৃয়মান শেলি লেগির দিকে তাকিয়ে–এই ফলির ভেতরে গতকাল বিকেল চারটের সময়, নিশ্চয়ই কারো সঙ্গে আপনি দেখা করতে এসেছিলেন, বোট-হাউসে যাওয়ার পথে।

পোয়ারো আরো একবার শুনতে পেল কারো পায়ের শব্দ। স্বগতভাবে সে বলল, মিসেস লেগি তার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছিল এখানে, যেই আসুক না কেন। সে অস্ফুট স্বরে বললো, আবার ভুল করলাম আলেক লেগিকে আসতে দেখে।

শুনতে পেয়েছিল কথাটা আলেক লেগি। প্রশ্ন করলো, কি বলছিলেন যেন মঁসিয়ে পোয়ারো, ভুল কি ব্যাপারে?

পোয়ারো বলল, জানেন আমার বিশেষ একটা ভুল হয় না, তবে আমি এখানে আপনাকে আশা করিনি।

প্রশ্ন করল আলেক, তাহলে আপনি কাকে দেখবেন আশা করেছিলেন?

পোয়ারো জানালো, আমি মনস্তত্ববিদ, আশা করেছিলাম, একটি যুবকের দেখা পাব এখানে, প্রায় কিশোর বয়েসেরই হবে সে। আমার মনে হয় সে আপনার বন্ধুই হবে, সে ফিরে গেছে ইয়ুথ হোস্টেলে, সেখানে গিয়ে তাকে খুঁজে বার করতে হবে, যদি আপনি তার দেখা পেতে চান।

আপনি তাহলে এজন্যই এখানে এসেছেন, পুরস্কার বিতরণের জন্য নয়। অবশ্য আমার সেটা আগেই বোঝা উচিত ছিলো, বলল আলেক লেগি। ফিরে তাকালো সে পোয়ারোর দিকে। তার মুখটা অপ্রসন্ন এবং শুকনো। বলল সে, ফাঁদ পেতে ইঁদুর ধরবেন ভেবেছেন আপনি, অথচ কিছু করতে পারবেন না আপনি। আপনি কি জানতে চান, সেটা কি জানেন? আপনি আপনার প্রমাণ পেয়ে গেছেন, এটা আমার ধারণা।

তারপর সে ফিরে চলল এলোমেলো পায়ে, পেছন ফিরে তাকাল না একবারের জন্যও। বড় বড় চোখ নিয়ে এরকুল পোয়ারো তার দিকে তাকিয়ে থাকলো।

অস্ফুটস্বরে পেয়ারো উচ্চারণ করলো, সবই যেন কেমন রহস্যময় মনে হচ্ছে, এতে প্রচুর খোরাক আছে, রহস্য ও কৌতূহলের। আমার প্রয়োজনীয় প্রমাণ আমি পেয়ে গেছি। আমি কি পাইনি? কিসের প্রমাণ? খুনের?

চমৎকার চেহারার সুপারিনটেনডেন্ট বল্ডউইন বসেছিলেন হেলমাউথ পুলিস স্টেশনে। ইনসপেক্টর ব্লান্ড বসেছিলেন তার বিপরীত দিকের আসনে।

ব্লান্ড বললো, তার টুপিটা ঠিকই আছে, এই ধরনের টুপিই তিনি পড়তেন, ঈষৎ লাল রঙের, তার পরিচারিকা জানিয়েছে। এখন ব্যাপারটা হচ্ছে, গতকাল তো তিনি পরেছিলেন কালো রঙ-এর টুপি। নদী থেকে আপনি উদ্ধার করেছেন। ঠিক এ ধরনের চিন্তা আমরাও করেছিলাম।

বল্ডউইন বললো, তবু এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় না। কারণ নদীতে টুপিটা যে কেউ ফেলে দিতে পারে।

অবশ্যই, ইয়ট থেকে বা বোট-হাউস থেকে যে কেউ ফেলে দিতে পারে। বলল ব্লান্ড। বল্ডউইন অবাক স্বরে প্রশ্ন করলো, ইয়ট? তিনি এখনো সেখানেই আছেন, জীবিত অথবা মৃত।

আর তার মৃতদেহটা কি সেখানেই পড়ে আছে, আপনার মতামত কি? এটা বলার কারণ হলো যে নদীতে জোয়ারভাটা খেলে গিয়ে থাকতে পারে ইতিমধ্যেই, সেরকম যদি হয়, ব্লান্ড জানতে চাইলো।

বল্ডউইন বলল, হ্যাঁ, আমি ওয়াটার ওয়েটের সঙ্গে আজ সকালে কথা বলেছি। আমি জোয়ারভাটার ব্যাপারে সব সময়ই তার সঙ্গে আলোচনা করে থাকি; সে জানিয়েছে যদি এই সময় সেই হেলেমে গিয়ে থাকে নদীতে পুরো জোয়ার ছিল তখন, পূর্ণিমার সময়। অতএব একথা বোঝা অসম্ভব নয় যে, তার মৃতদেহ নিশ্চয়ই কোরনিশ উপকূলে ভেসে গেছে হয়তো, নদীর জোয়ারের টানে। তবে এটা বলা সম্ভব নয় যে ঠিক মৃতদেহটা কোথায় গিয়ে পড়েছে। তবে আবার ভাটার টানে যে কোনো দিন মৃতদেহটা ফিরে আসতে পারে।

ব্লান্ড বলল, আর সেটা যদি না হয়, তবে খুবই মুশকিল হবে তার মৃতদেহ খুঁজে পাওয়াটা।

বল্ডউইন জিজ্ঞেস করলো ব্লান্ডকে, আপনি নিশ্চিত যে তিনি নদীর দিকেই গিয়েছিলেন?

ইনসপেক্টর ব্লান্ড বললো, আমি তো আর কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না, এ ছাড়া। সর্বত্র খুঁজে দেখেছি আমরা, তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে এটা এখন বলা মুশকিল যে, সমুদ্রে তার মৃতদেহ সত্যি সত্যি ভেসে গিয়েছে নাকি তাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে কোথাও এই এস্টেটে।

বল্ডউইন জানতে চাইলো, আর কিছু জানা গেছে কি অপর মেয়েটি সম্পর্কে? ব্লান্ড বললো, একেবারে শেষে, সেটা জানা। বল্ডউইন বলল, দুজন পুলিশ ইনসপেক্টর এসপারেন্সে গিয়েছিল সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে। ডি সৌউসা সার্চ ওয়ারেন্টের কথা শুনে রুক্ষ স্বরে প্রথমে বলেছিলো– আপনারা বোধহয় ভেবেছেন, যে আমার জ্যাঠতুতো বোন লেডির স্টাবসকে আমি বোধহয় এখানে লুকিয়ে রেখেছি। তাহলেই নিজের চোখে দেখে যান আপনারা লেডি স্টাকসকে পাওয়া যায় কিনা। পুলিশ অফিসার যখন ইয়ট থেকে লঞ্চে করে ফিরে আসছিল, তখন দেখেছিল সৌউসা তাদের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে আছে।

তদন্তের কাজে যখন ব্যস্ত ইনসপেক্টর ব্লান্ড তখন ন্যাসে হাউসে পোয়ারো তার নিজস্ব পদ্ধতিতে কাজ সেরে নিচ্ছিল। সে গিয়ে ঢুকলো ম্যাডাম জ্বলেকার ফরচুন টেন্টে।মিসেস শেলি লেগি গতকাল বিকেলে এখানেই জ্যোতিষী জ্বলেকার ভূমিকায় ঘোষণা করেছিলেন পোয়ারোর ভবিষ্যত কি হতে পারে।

গুটি গুটি পায়ে ঝোঁপঝাড় পেরিয়ে টেন্টের পেছনের দিকের পর্দা তুলে অবশেষে মানার হাউসে গিয়ে ঢুকলো পোয়ারো। আলোর প্রাচুর্য সেই ঘরে ছিল না, ঘরটা বেশ অন্ধকার। কয়েকটা সরঞ্জাম এবং দুটো ভাঙা হকি স্টিক পড়ে থাকতে দেখা গেল। একটা পুরু ধুলোর আস্তরণ ছিল মেঝেতে। আর তার চোখে পড়ল সেই ধূলিমলিন মেঝের উপর কয়েকটা অনিয়মিত চিহ্ন। সে তার পকেট থেকে একটা টেপ বের করে হাঁটু মুড়ে বসে মাপ নিলো। সাবধানে সেই অনিয়মিত দাগগুলির।

সে মাথা নাড়তে লাগলো তারপর আপন মনেই। একটা আত্মতুষ্টির ছাপ ফুটে উঠল তার চোখে মুখে। এরপর ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে সে এগিয়ে চলল বোট-হাউসের দিকে। চাবি ছিলো তার কাছে। ঘরে ঢুকলো সে দরজা খুলে। বাকি সমস্ত কিছুই তখন বোট-হাউসে আগের মতোই পড়েছিল, শুধুমাত্র সরানো হয়েছিল মারলিন-এর মৃতদেহ, চায়ের কাপ ডিস, ট্রে ইত্যাদি অপসারণ করা হয়েছিলো। পোয়ালরা দেখতে পেল টেবিলের ওপর গাদা করা কমিকস-এর বই পড়ে আছে। সে কমিকস বইগুলোর পাতা একটার পর একটা ওল্টাতে থাকলো। সে লক্ষ্য করল একটা পাতায় মেয়েটি মারা যাবার আগে লিখে গেছে এইরকম সুসান ব্রাউস-এর সঙ্গে গেছে জ্যাকি ব্লেক। পিটার মেয়েদের চিমটি কাটে সিনেমা হলে। জর্জি পেগ অরণ্যে ভ্রমণার্থী মেয়েদের চুমু খায়। ছেলেদের পছন্দ করে বিডিং ফক্স। আলবার্ট সময় কাটায় জোরিনের সঙ্গে।

পোয়ারো লেখাগুলির মধ্যে মারলিনের কিশোরী মনের বেদনাদায়ক মন্তব্য লক্ষ্য করল। তার মনে পড়ল মারলিনের সরল মুখের ছবিটা। হয়তো সিনেমা হলের ছেলেরা তাকে চিমটি কাটতো না। তার সেই গোয়েন্দাগিরির মধ্যেই হতাশ মারলিন একটা অদ্ভুত রোমাঞ্চ অনুভব করতো। সম্ভবত ব্যাপারটা মারলিন-এর কাছে জরুরী ছিল, কারণ এটা তার লক্ষ্য করার কথা নয় এইসব ছোটোখাটো ঘটনা এবং যা অতি সাধারণ। আর মারলিনের ধারণা ছিল না, এটা কারো কাছে একান্ত জরুরী বিষয়।

পোয়ারো সন্দিগ্ধভাবে মাথা নাড়ল, এ সমস্ত অনুমাননির্ভর বিষয়। যখন সে কমিকসগুলো ঠিকভাবে সাজিয়ে রাখছিলো তখন যেন তার মনে হল, এর মধ্যে থেকে কিছু একটা সরানো হয়েছে।

কিন্তু কি? কি সরানো হয়েছে? যেটা থাকা উচিত ছিলো এখানে…তার অস্পষ্ট অনুভূতিটা ফিকে হয়ে আসছিলো, সে আপন মনে মাথা নাড়লো।

পোয়ারো ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো বিষাদগ্রস্ত মনে বোট-হাউস থেকে। নিজের মনে ভাবতে থাকে অপ্রসন্ন পোয়ারো। খুন প্রতিরোধ করার জন্য এরকুল পোয়ারোকে ডেকে আনা হয়েছিলো এখানে, কিন্তু সে রোধ করতে পারলো না, এটাই সব থেকে তার কাছে বেদনাদায়ক ব্যাপার।

এটা একটা কলঙ্কময় ব্যাপার। আগামীকাল সে লন্ডনে ফিরে যাবে পরাজয় বরণ করে। ভীষণভাবে কমে গেছে তার অহংকারী ভাবটা।–এর ওপর উল্লেখ্য হলো যে তার একান্ত প্রিয় গোঁফটাও নত হয়ে গেছে।

ন্যাসে হাউসের খুনের কেসের ব্যাপার ভাবছিলো এরকুল পোয়ারো, তার লন্ডনের ঘরে একটা চারচৌকো প্লেসের সামনে বসে। তার কাছে এসেছিলো কিছুক্ষণ পূর্বে ইনসপেক্টর ব্লান্ড, সে লন্ডনে এসেছিলো পুলিশের কাজে। সে জানতে এসেছিলো মঁসিয়ে পোয়ারোর কাছে। পোয়ারো কোনোরকম সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছে কিনা, ন্যাসে হাউস-এর দুর্ঘটনার ব্যাপারে।

তার নিজের ধারণার কথাও জানাল পোয়ারোকে। পার হয়ে গেলো প্রায় একমাস কি পাঁচ সপ্তাহ, তা সত্ত্বেও জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া যায়নি লেডি স্টাবসকে এখনো পর্যন্ত। অতএব একথা একমাত্র বাতুলরাই চিন্তা করতে পারে যে, সে জীবিত আছে। পোয়ারো ব্লান্ড-এর সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হল এ ব্যাপারে।

ব্লান্ড বললো, তবে একথা ঠিক যে নদীর স্রোতে কখনই কোথাও ভেসে যায়নি মৃতদেহ।

জীবিতই হোক আর মৃতদেহই হোক, জলে ডুবলে বেশিক্ষণ সেটা ডুবে থাকতে পারে না। একসময় ভেসে উঠবেই।

পোয়ারো তার মন্তব্য জানালো, তবে তৃতীয় একটা সম্ভাবনা আছে।

ব্লান্ড জানালো, অবশ্যই। সে কথা আমিও চিন্তা করে দেখেছি, যেটা আর কি আপনি বলতে চাইছেন যে, তার মৃতদেহ ন্যাসেতেই কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে, অথচ আমরা ভেবে দেখিনি সেখানে খুঁজে দেখার কথা, তাই না?

সেটা আপনি শত চেষ্টা করলেও খুঁজে বার করতে পারবেন না, সেখানে এমন কতকগুলি জায়গা আছে।

ব্লান্ড আবার বলতে থাকে একটু থামার পর, ন্যাসে-হাউস সংলগ্ন একটা বাগানের পাশে, আর একটা বাড়ি আছে। আমি সেটা খুঁজে বার করেছি মাত্র কয়েকদিন আগে। সেটা ঠিক বাড়ি বলা চলে না, যুদ্ধ সমাপ্ত হবার সময়, তারা সেটা তৈরি করেছিল এয়ার শেল্টার হিসাবে। যুদ্ধের সময় দূর অস্ত, এবং সেই শেলটারও এখন পরিত্যক্ত, এখন শান্তির সময় আসলে সেটাকে আমার প্রিস্ট হোল মনে হয়েছিল প্রথমে। ১৭৯০ সালে বাড়িটা তৈরি হয়। এটা মিঃ ওয়েম্যান বলে, অবশ্য তখন কোনো প্রয়োজন ছিল না ধর্মযাজকদের আত্মগোপন করে থাকার। তবে সেখানে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটেছে, তবে কে সেই বিবরণ জানাতে পারবে? মঁসিয়ে পোয়ারো আপনার তাহলে কি মনে হয় এই ব্যাপারে?

পোয়ারো উত্তর দিল, এটা সম্ভব হতে পারে, লেডি স্টাবস-এর মৃতদেহ এখানে লুকিয়ে রাখা যায়, আর যারা ন্যাসে হাউসে থাকে তারা যে কেউ এই অদৃশ্য হওয়ার ব্যাপারটা লক্ষ্য করে থাকবে।

ইনসপেক্টর ব্লান্ড বলল, আমি এখনো ডি সৌউসকে সন্দেহ করি। বাড়ির যে কোনো ব্যক্তিকেই সন্দেহ করা যেতে পারে, আপনি যেমন বললেন চাকর-বাকর অথবা তাদের পরিবারের যে কোনো একজন জানতে পারে।

লেগি দম্পতিরা বহিরাগত, আমার তো মনে হয় না বাইরে থেকে কোনো লোক এসে, এমন কিছু খারাপ করবে?

ঐ বাড়িতে যার খুব বেশি যাতায়াত আছে সেও জানতে পারে, অথবা সবাই জানতে পারে, তবে মিসেস ফোলিয়াটের সেখানে বেশি যাওয়া-আসা আছে। পোয়ারো বলল এবং আরও বলল, মিসেস ফোলিয়াট এক ডাকে সাড়া দেবেন আপনি প্রশ্ন করলে।

আমি নিজে তার সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করেছি। সে অত্যন্ত ভদ্র এবং চমৎকার মহিলা, কিন্তু সম্পূর্ণভাবে তিনি বদলে গেছেন সেই দুর্ঘটনার পর থেকে।

আমার কেন জানি না মনে হয়েছিল তার মুখ চোখ দেখে যে, তিনি আমাদের কোনোরকম উপকারে আসতে পারেন না।

পোয়ারো এবং ব্লান্ড যুগপৎ ভাবছিলো, মিসেস ফোলিয়াট কোনো উপকারে আসতে পারবেন?

আপনি তাদের জোর করতে পারেন না, ভয় দেখাতে পারেন না এমনকি অনুরোধও করতে পারেন না এক ধরনের মহিলা আছেন তাদেরকে, বললো ব্লান্ড।

ঠিক বলেছেন, বলল পোয়ারো, আপনি মিসেস ফোলিয়াটকে জোর করতে বা হুমকি দিতে পারেন না।

এরকুল পোয়ারোকে ডেকে পাঠিয়েছিল মিসেস অলিভার, গোড়ার দিকে পোয়ারোকে সে খুন প্রতিরোধ করতে বলেছিল, কিন্তু সে পারেনি। খুনীকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পোয়ারোকে সে অনুরোধ করেছিল খুন হয়ে যাওয়ার পর। সেক্ষেত্রেও ব্যর্থ হয়েছে পোয়ারো। পোয়ারো এইসব ভাবছিলো তার পর সে উঠে দাঁড়ালো। একটা নোট বুক বার করলো সে পকেট থেকে। কয়েকটা ছোট চরিত্র লিখল তাতে। আলেক লেগি, ইটিয়েন ডি সৌউসা, আমাদ্দা ব্রেইউস, মাইকেল ওয়েম্যান, শেলি লেগি। অন্য সদস্য অর্থাৎ ন্যাসে হাউসে থাকে তাদের নাম এই কারণে লিখল না যে, কারণ দৈহিক দিক থেকে তার খুনী হিসাবে সক্ষম নয়। তবে ইয়ুথ হোস্টেলের সেই ছেলেটিকে তার সম্ভাব্য তালিকায় রাখলো সে।

তারপর সে নোটবুকের পাতা উল্টে লিখল, মিস ব্রেউইসকে কি লেডি স্টাবস বলেছিল মারলন টাকার-এর চা নিয়ে যাওয়ার জন্য? কেনই বা তাহলে মিস ব্রেউইস সেই কথার উল্লেখ করলো? যদি স্টারস না বলে থাকে? মিস ব্রেউইস যদি ইচ্ছা করতো তাহলে সে নিজের খুশীতেই মারলিনের জন্য কেক, ফুট ড্রিঙ্কস এবং চা নিয়ে যেতে পারতো। পোয়ারো এই বিশেষ পয়েন্টটার উপর খুব জোর দিল। কেনই বা সে তাহলে ওরকম একটা মিথ্যা কথা বললো। বোট-হাউসে গিয়ে তাহলে কি মিস ব্রেউইস মারলিনকে মৃত অবস্থায় দেখতে পেয়েছিল? কেন সে মারলিন-এর মৃত্যুর খবরটা চেপে গেল, যদি সে অপরাধী না হয়? সে স্থির দৃষ্টিতে এই দুটি প্রশ্নের দিকে তাকিয়ে রইল। সে তার নোট বুকে আরও কিছু লিখলো মিনিট পাঁচ পরে–সে তার চিঠিতে লিখেছিল, ইটিয়েন ডি সৌউসা–সে তিন সপ্তাহ আগে ন্যাসে হাউসে আসছে। সত্য না মিথ্য তার এই চিঠির তথ্য?

পোয়ারো সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে এটা একেবারে মিথ্যা। তাহলে পরবর্তী চিঠিটা পেয়েছিল উৎসবের দিন স্যার জর্জ এবং লেডি স্টাবস, আর কেনই বা তারা অযথা বিস্মিত হওয়ার ভান করতে যাবে? তাহলে ইটিয়েন যে মিথ্যা কথা বলছে এর থেকে বোঝা গেল, এবং সেই বা কেন মিথ্যা কথা বললো? অর্থাৎ সে কি এই কথা বোঝাতে চেয়েছিল, মিথ্যা কথা বলে সে আহূত এবং সে কথাটা পূর্বেই সে জানিয়েছে। যদিও এটা হয়, তা সত্ত্বেও সন্দেহের কারণ থেকে যায়। অর্থাৎ কোনো প্রমাণ নেই তার বর্ণিত সেই প্রথম চিঠির।

পোয়ারো এবার থামলো। স্যার জর্জ ডি সৌউসাকে চেনে না। তাকে লেডি স্টাবস জানত না, এছাড়া তাকে দেখেওনি কখনো, তাহলে কি আলাদা কোনো তথ্য এর মধ্য লুকিয়ে আছে? সেই লোকটি কি আসল ইটিয়ন ডি সৌউসা নয়?

সেদিন উৎসবে যে লোকটা এসেছিল? তখনই এই প্রশ্নটা পোয়ারোর মনে উদর হলো। তখন সে ভাবল যদি লোকটি আসল ডি সৌউসা না হয়। তবে তার কি উদ্দেশ্য ছিল উৎসবে এসে নিজেকে ডি সৌউসা হিসাবে পরিচয় দেওয়ার, এবং তার এতে লাভ কি ছিলো? আচ্ছা সেটা পরের কথা, অন্তত কখনই সৌউসা লাভবান হয়নি হ্যাটির মৃত্যুতে। হ্যাটির নিজস্ব অর্থ বলতে কিছুই ছিল না, এটা পুলিশ-এর খবর। হ্যাটি কি বলেছিল উৎসবের দিন সকালে? পোয়ারো মনে করার চেষ্টা করলো সে কথা।

হ্যাটি বলেছিল লোকটা বদ প্রকৃতির এবং অনেক কুকাজ সে করেছিল। ব্লান্ড-এর কথা অনুযায়ী তার স্বামী জর্জকে লেডি স্টাবস নকি সৌউসা সম্বন্ধে বলেছিল, সে অনেক লোককে খুন করেছিল।

এই ব্যাপারটা উল্লেখযোগ্য বলে ধরা যায়। নতুন করে আবার পরীক্ষা করে দেখতে হয় এইসব তথ্যগুলো।

আবার ভাবলো পোয়ারো–অনেক লোককে খুন করেছিল ইটিয়েন ডি সৌউসা।

ইটিয়েন যেদিন ন্যাসে হাউসে এসেছিল–সেদিন সম্ভবত দুইজনকে খুন করেছিল একজন লোক। এমন জোর দিয়ে এই কথাটা মিসেস ফোলিয়াট বলেছিলেন যে-কারোর কর্ণপাত করা উচিত নয় হ্যাটির এরকম নাটকীয় মন্তব্যে। কথাটা পোয়ারোর বেশ কানে বেজেছিলো।

তাহলে কি মিসেস ফোলিয়াট…। ভাবলো এরকুল পোয়ারো ভ্র কুঞ্চিত করে। আমি কেন ফিরে আসছি সর্বদাই মিসেস ফোলিয়াট-এর প্রসঙ্গে..আমার এখন আর এই চেয়ারে বসে থাকা উচিত নয়। ডেভনে ফিরে যেতে হবে এখনি ট্রেনে করে এবং দেখা করতে হবে মিসেস ফোলিয়াট-এর সঙ্গে।

এরকুল পোয়ারো ন্যাসে হাউসের বিরাট দরজার সামনে অল্পক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে রইল। এখন মিসেস ফোলিয়াট বাড়িতে নেই, বেরিয়েছে হয়তো পরিচর্যা করতে অথবা তার কোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। অনেক প্রতিবেশী বন্ধু আছে তার। অনেক বছর ধরে সে এখানে আছে তার এই বাড়িতে।

ফেরিঘাটের সেই বৃদ্ধ লোকটি পোয়ারোকে বলেছিল, ফোলিয়াটারই সর্বেসর্বা ন্যাসে হাউসে, একথা তার এখন মনে পড়ল।

ফোলিয়াট পোয়ারোকে দেখে প্রশ্ন করলো। আপনি মঁসিয়ে পোয়ারো? পোয়ারো ভাবলো এক মুহূর্তের জন্য যেন সে মিসেস ফোলিয়াটের চোখে এক অজানা ভয়ের ছায়া দেখতে পেল। হয়তো এটা তার কল্পনাও হতে পারে। ম্যাডাম ভেতরে আসতে পারি? বিনীতভাবে পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল।

মিসেস ফোলিয়াট নিজেকে সংযত করে নিয়েছিলো ততক্ষণে–বলল, অবশ্যই আসতে পারেন। আপনার জন্য একটু চা করে নিয়ে আসি কেমন? এই বলে সে ড্রইংরুম থেকে নিষ্ক্রান্ত হল।

ঘরের চারদিকে তাকিয়ে দেখছিল ততক্ষণে পোয়ারো সময় কাটানোর জন্য। এই সময় তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো দেওয়ালে টাঙানো একটা ফটোগ্রাফ। চায়ের ট্রে নিয়ে যখন মিসেস ফোলিয়াট ঘরে এসে প্রবেশ করলো, সেই ফটোটার দিকে নির্দেশ করে পোয়ারো জানতে চাইল, ম্যাডাম, ওই ফটোটা কি আপনার স্বামীর?

সংক্ষিপ্ত উত্তরে সম্মতি জানালো মিসেস ফোলিয়াট এবং বলল, দেখুন মিঃ পোয়ারো, আমার কোনো আকর্ষণ নেই ফটোর প্রতি। জীবন্ত ছিল যেটা অতীতে, আজ তা মৃত। সকলেরই শিক্ষা নেওয়া উচিত, অতীত ভুলে যাওয়ার জন্য। কেটে ফেলা উচিত মরা গাছের মতোই।

পোয়ারো আশ্চর্যবোধ করল, ভাবল, কত নম্র; ভদ্র ও সৌজন্যময় ভদ্রমহিলার বাইরের রূপটা অথচ অন্তরটা কত কঠিন; কি নিষ্ঠুর। এখন পোয়ারোর মনে পড়ল, প্রথম যেদিন তাকে বাগান পরিচর্যা করার সময় মৃত গাছগুলিকে যেভাবে নির্দয়-এর মতো কেটে দিতে দেখেছিল, অতএব মনে হয় শুধু সে মরা গাছই কেটে বাদ দেয় না, মৃত মানুষ তার আপনজন হলেও সে তাকে জীবন থেকে বাদ দিয়ে দেয়।..

মিসেস ফোলিয়াট পোয়ারোর হাতে চায়ের কাপ দেবার সময় বলল, আমি ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিলাম আপনাকে দেখে। ভাবতেই পারিনি যে, আপনি আবার এখানে ফিরে আসবেন।

এখান দিয়ে কি আপনি অন্য কোথাও যাচ্ছিলেন?

না, মহাশয়া আমি আংশিকভাবে আপনার কাছেই এসেছি। পোয়ারো জানাল। যেহেতু কোনো খবর নেই মিসেস লেডি স্টাবস-এর এটা প্রথম কথা।

সত্যিই, খুব দুঃখের ব্যাপার, খুব মর্মাহত হয়েছে মিঃ জর্জ, জানাল মিসেস ফোলিয়েট।

 পোয়ারো জানতে চাইল, আচ্ছা জর্জ কি এখনো বিশ্বাস করেন যে, তার স্ত্রী জীবিত আছেন?

 মিসেস ফোলিয়াট খুব শান্তভঙ্গীতে মাথা নাড়ল, বলল সে, তিনি বোধহয় সে আশা ত্যাগ করেছেন, এটা আমার মনে হয়।

পুলিশ কি এখনো খোঁজ করছে তার স্ত্রীকে? পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল।

আমি ঠিক বলতে পারব না, জানাল ফোলিয়াট, তবে মনে হচ্ছে পুলিশ খোঁজ করছে। আর দেখা হয় না জর্জের সঙ্গে। তিনি এখন লন্ডলে কাটাচ্ছেন বেশিরভাগ সময়।

আর যে মেয়েটিকে খুন করা হয়েছে? ধরা পড়েছে কি খুনী? জানতে চাইলো পোয়ারো।

না, আমি কিছু বলতে পারব না পুলিশের ব্যাপারে, বলল মিসেস ফোলিয়াট। আবার বললো সে, একেবারেই নিরর্থক।

এ যেন এক উদ্দেশ্যহীন অপরাধ, একথা বলা যায়, মেয়েটি হতভাগিনী কিশোরী-ম্যাডাম, আপনি কিন্তু এখনো বিমর্ষ হয়ে পড়েন মেয়েটির কথা মনে পড়লে। বলল পোয়ারো।

মিসেস ফোলিয়াট বলল, নিশ্চয়ই, এমন কি মরার বয়স ছিল ঐ বাচ্চা মেয়েটির? অন্তত তার থেকে আগে আমাদেরই মরা উচিত ছিল কারণ, আমাদের বয়স হয়েছে। আবার ফোলিয়াট বলল, আমার আর বেশিদিন বাঁচতে ইচ্ছা হয় না জানেন মিঃ পোয়ারো? আমার পরিবার নেই, কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। অবশ্য অনেক বন্ধুবান্ধব আছে আক্ষেপের সুরে সে বলল।

বাড়ি আছে তো আপনার, অর্থাৎ এই ন্যাসে হাউস? বলল পোয়ারো। অবশ্য সেটা স্যার জর্জ-এর সম্পত্তি কিন্তু প্রায় বেশি সময়েই তো তিনি লন্ডনে থাকেন। আর আপনার হাতেই তো এখানকার সাম্রাজ্য শাসনের ভার, তা নয় কি?

ক্ষুণ্ণ মনে মিসেস ফোলিয়াট বলল, আমি জানি না, আপনি কি বলতে চাইছেন। আমাকে দয়া করে স্যার জর্জ এখানে একটা লজ ভাড়া দিয়েছেন। আমার আর এর বেশি কিছু পাওনা নেই। তবুও সুখে, স্বস্তিতে থাকতে পারতাম যদি এরকম দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা না ঘটত। অতএব এই পরিস্থিতিতে আগের শান্তি কি এখানে আর আছে বলুন?

ঝুঁকে পড়লো পোয়ারো মিসেস ফোলিয়াট-এর দিকে। বলল, এখানে কেন আজ শান্তি বিঘ্নিত আপনি তো বেশ ভালোভাবেই জানেন সেটা। খুনের ব্যাপারে সম্ভবত সমস্ত কিছুই আপনি জানেন। কে সেই কিশোরীকে হত্যা করেছিল, হ্যাঁ সেটাও আপনি জানেন। আর হ্যাটি স্টাবসকেই বা কে খুন করেছিল তাও আপনার অজানা নয়। আর স্টাবস-এর মৃতদেহ এখন কোথায় সম্ভবত আপনি সেটাও জানেন।

প্রচণ্ড চিৎকার করে মিসেস ফোলিয়াট বলে উঠল, না, আমি জানি না, কোনো কিছুই জানি না।

আপনি হয়তো জানেন না, তবে অনুমান করতে পারেন। আমি সে বিষয়ে নিশ্চিত। পোয়ারো বলল।

আপনি অসম্ভব কথা বলছেন, আমায় মাপ করুন, বলল ফোলিয়াট।

কখনোই অবাস্তব কথা নয়–এ সম্পূর্ণ অন্যরকম–এক বিভীষিকাময় বিপজ্জনক খেলা, বলল পোয়ারো।

ফোলিয়াট প্রশ্ন করলো, কি বললেন, বিপজ্জনক? কার ক্ষেত্রে?

ম্যাডাম আপনার ক্ষেত্রে। কারণ কে খুনী আপনি বেশ ভালোমতোই জানেন, আর এইজন্যই আপনার বিপদ, সেই জানাটা আপনি যদি নিজের মনের মধ্যেই গোপন রাখেন। পোয়ারো এই সকল কথা বলছিলো। আবার সে বলল, খুনীদের আমি বেশি ভালো করেই জানি ম্যাডাম, আপনার থেকেও।

মিসেস ফোলিয়াট বলল, আমাকে আর এ ব্যাপারে কিছু বলবেন না, এখানেই ইতি টানুন, কিছুই আর করার নেই।

ম্যাডাম,এটা আপনি কি করে বলতে পারেন? কোনো তদন্তই কখনো শেষ হয়ে যেতে পারে না খুনীর প্রসঙ্গে, তা আমি নিজের জ্ঞান থেকে বলতে পারি, বললো পোয়ারো।

প্রায় কঠিন স্বরে বলল ফোলিয়াট, না, আমি বলছি সব শেষ। কারণ পুলিশও হাল ছেড়ে দিয়েছে সম্পূর্ণরূপে এই ব্যাপারে।

পোয়ারো বেশ জোড়ে মাথা নাড়লো। ম্যাডাম, না না, তা নয়। আপনার এখানেই ভুল হচ্ছে। পুলিশ হতোদ্যম হয়নি, আর আমিও আশা ছেড়ে দিইনি, বললো পোয়ারো। ম্যাডাম, খেয়াল রাখবেন, আমি এরকুল পোয়ারো সম্পূর্ণ আশা ছেড়ে দিইনি।

এরকুল পোয়ারো গ্রামের রাস্তা ধরল, ন্যাসে ছেড়ে এসে। নিহত মারলিন টাকারের বাড়িতে গিয়ে তার অভিবাবকদের সঙ্গে আলোচনা করা, এটাই হল তার বর্তমান গন্তব্যস্থল।

মিসেস টাকার, মারলিন-এর মা তাকে সাদর আমন্ত্রণ জানালো, স্যার ভেতরে আসবেন না?

মিসেস টাকার তাকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে গিয়ে বসাল। বলল, আমি ঠিক মনে করতে পারছি না, আপনার নাম? বলল পোয়ারোকে।

আমি এরকুল পোয়ারো, এখন চিনতে পারছেন তো? পোয়ারো বলল, আপনার মেয়েকে যে হত্যা করেছে তার খোঁজ নিশ্চয়ই পাওয়া গেছে, আমার বিশ্বাস।

তিক্তস্বরে মিসেস টাকার বলল, না, এখনো তার নামও শোনা যায়নি, ধরাও পড়েনি। পুলিশ হয়তো নিজেদেরকে ব্যস্ত করতে চাইছে না আমরা গরীব বলে, এটাই আমার ধারণা।

পুলিশ তাদের কাজ নিয়মমাফিক করে যাচ্ছে। এটা বলা যায়, বললো পোয়ারো, তবে দেরি হওয়ার কারণ হল, কেসটা খুবই জটিল। এইমাত্র কথা বলে এলাম মিসেস ফোলিয়াট-এর কাছ থেকে। খুব গভীরভাবে তিনিও এটা নিয়ে চিন্তা করছেন। মিসেস টাকার বলল, হ্যাঁ, তিনিও বেশ ভেঙ্গে পড়েছেন, তিনি নিজের বাড়ির দুর্ঘটনা বলে মনে করছেন অর্থাৎ আমার মেয়ের খুনের ব্যাপারটা নিয়ে।

পোয়ারার আর একবার মনে হল, ন্যাসে হাউস এখনো যেন মিসেস ফোলিয়াটেরই, এখানকার প্রত্যেক লোকেরই অবচেতন মনে এরকম ধারণা।

পোয়ারো প্রশ্ন করলো, আচ্ছা মিসেস টাকার, কে প্রস্তাব দিয়েছিলো, মারলিনকে মার্ডার হাটে অভিনয় করার?

তৎক্ষণাৎ জবাব দিলো মিসেস টাকার, লন্ডনের লেখিকা।

এখানে তো তিনি একজন আগন্তুক মহিলা, তার ওপর তিনি মারলিনকে চিনতেনও না, অতএব…বললো পোয়ারো।

বোধহয় আমার মেয়েকে অভিনয়ের প্রস্তাব দেয় মিসেস মাস্টারটনই, বললো মিসেস টাকার। আর খুশী হয়েছিল মারলিনও, অভিনয় করার সুযোগ পেয়ে। পোয়ারোর মনে হল আর একবার বোধহয় কেউ আড়াল থেকে স্বনামধন্যা মিসেস অলিভার-এর মাধ্যমে তাদের ইচ্ছেটা পূরণ করবে। এরা ক্ষমতাহীন অধিষ্ঠিত ব্যক্তিত্ব-মিসেস অলিভার এবং মিসেস মাস্টারটন। কিন্তু মারলিন অত খুশী হলো কেন অভিনয় করার সুযোগ পেয়ে? সে গরীব ঘরের মেয়ে। তবে কি সে অর্থ বা কোনো দামী জিনিসের প্রলোভনে পড়েছিলো?

পোয়ারো প্রশ্ন করল, আমার এই রকম আশঙ্কা হচ্ছে, আপনার কি জানা আছে মারলিনকে কেউ কিছু উপহার দিয়েছিল? এই ধরুন কোনো চমৎকার মহিলা।

ও হ্যাঁ, আপনি কি মিল কটেজের মিসেস লেগির কথা বলছেন? মারলিনকে সে একবার একটা লিপস্টিক উপহার দিয়েছিলো। জানালো মিসেস টাকার। আমি তখন প্রায় পাগলের মতো রেগে গিয়ে বলেছিলাম, তুমি তোমার মুখে ঐ সব নোংরা জিনিস লাগাতে পারবে না। মারলিন উত্তরে বলেছিল, তাকে লিপস্টিক দিয়েছিল লওডরস কটেজের লেডি।

পোয়ারো আরও জানতে পারে মারলিনের ছোট বোন-এর কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে যে, তার দিদিকে মিসেস লেগি একটা স্কার্ফ উপহার দেয়। অতএব এইবার বোঝা যাচ্ছে যে, মার্ডার হান্টে নিহত মেয়েটির ভূমিকায় অভিনয় করতে রাজী হয়েছিল মারলিন তার শখের জিনিসের লোভে।

আপনি কি আর কিছু হারিয়েছেন ম্যাডাম।

পরবর্তী প্রশ্ন করল পোয়ারো।

স্ত্রীর হয়ে উত্তর দিল মিঃ টাকার, হ্যাঁ, আমার স্ত্রীর বাবা, মনে হয় পা পিছলে নদীতে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি, ফেরি পেরিয়ে জেটিতে নামার সময়, ফলে তিনি জলে ডুবে মারা যান।

মিসেস টাকার এবার বলল, অতীতে বহু বছর ধরে মিঃ ফোলিয়াটের পরিবারের সমস্ত কিছু দেখাশুনা করত আমার বাবা, তাদের সমস্ত কিছু আমার বাবার জানা ছিল। আর তারাও খুব পছন্দ করতেন তাকে। মিসেস ফোলিয়াট এই তো সেদিন বাবার অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ার জন্য অনেক টাকা খরচ করলেন।

ব্যাপারটা পোয়ারোর মনে দাগ কেটে গেল। মিসেস ফোলিয়াট-এর যে উদ্দেশ্যই থাকুক না কেন এই আর্থিক সাহায্যের পেছনে। আচ্ছা আপনার বাবা কি সেই জেটির বৃদ্ধ লোকটি? আমার যেন মনে পড়ছে আমি কথা বলেছি তার সঙ্গে। আচ্ছা তার নাম যেন কি?

মারডেল স্যার। বিয়ের আগে ঐ পদবী ছিল, বলল মিসেস টাকার।

আমার যদি ঠিক মনে থাকে, আপনার বাবা ছিলেন ন্যাসে হাউস-এর প্রধান মালি। বলল পোয়ারো।

না, সেটা হল আমার সব থেকে বড় ভাই। আমরা মোট এগারজন ভাই-বোন, সব থেকে ছোট আমি। বহুবছর ধরে আমি ন্যাসেতে কাজ করে আসছি, অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে বলল সে।

পোয়ারো মৃদু গলায় বলল, ফোলিয়াটদের নাম সব সময়ই শোনা যায় ন্যাসে হাউসে।

তাকে কথাটা বলেছিল বৃদ্ধ মারডেল। অতএব মারলিন মারডেলের নাতনি। আমি এখন  দেখতে পাচ্ছি–পোয়ারো ভাবলো এক মুহূর্ত নীরব থাকার পর। কিন্তু ভেতরে সে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলো ভীষণভাবে।

আপনার বাবা নদীতে ডুবে মারা গেছেন, আপনি বলছেন?

এটা একটা দুর্ঘটনা বলতে পারেন স্যার–বলল মিসেস টাকার।

পোয়ারো বিস্মিত হয়ে বলল, দুর্ঘটনা, ঠিক তা নয়, যেটা আপনি ভাবছেন, এটা আমি আশঙ্কা করি। পোয়ারো উঠে দাঁড়াল এবং বলল অনেক আগেই আমার ধারণা করা উচিত ছিলো। আসলে আমাকে সতর্ক করে দিয়েছিলো মারলিনের মৃত্যু।

বাইরে বেরিয়ে এলো পোয়ারো মিসেস টাকারকে তার মেয়ের মৃত্যুর জন্য সমবেদনা জানিয়ে, তারপর ভাবল সে, আমি কি নির্বোধ। এতদিন যে পথে চলেছি তা বেঠিক। মেরিলিন-এর ফিসফিস আওয়াজ শুনে তার ভাবনা থেমে গেল। সে পোয়ারোর কাছে এসে বলল, সমস্ত কিছু মা জানে না। সেই কটেজের লেডির কাছ থেকে মারলিন স্কার্ফটা পায়নি। সে কিনেছিল টরকোয়ে থেকে। শুধু তাই নয়, সেন্ট, লিপস্টিক, সবই সে সেখান থেকে কিনত। সিনেমায় যেত দিদি মাঝে মাঝে। মেরিলিন হাসল দাঁত বার করে, বলল, মা এসবের কিছুই জানে না। তাও তিনি জানতেন না, এসব কেনার জন্য মারলিন যে কোথা থেকে টাকা পেত। আমাকে বারণ করে দিয়েছিল দিদি এসব কথা কাউকে বলতে।

পোয়ারো তার হাতে পাঁচ শিলিং গুঁজে দিল, এবং তাকে বলল, তুমি খুব চালাক মেয়ে। তারপর তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসে দাঁড়াল সে নিকটবর্তী একটি পাবলিক টেলিফোন বুথ-এ। ইনসপেক্টর ব্লান্ডকে ফোন করতে হবে।

ফোনে প্রশ্ন করল ব্লান্ড, মঁসিয়ে পোয়ারো। কোথা থেকে কথা বলছেন আপনি? পোয়ারো উত্তর দিল ন্যাসেকম্ব থেকে। জানতে চাইলো পোয়ারো, আচ্ছা কি রকম দেখতে ছিল, টিয়েন ডি সৌউসার ইয়টটা?

উত্তর দিল ব্লান্ড, আপনি যেরকম ভাবছেন সেটা নয়। কোনো খোপটোপ আমরা দেখতে পাইনি সেই ইয়টে লুকিয়ে রাখার মতো চোরাই জিনিসপত্র আর কি?

পোয়ারো বলল, আপনার ভুল হচ্ছে, আমি জানতে চাইছি যে ইয়টটা বড় ছিল না ছোট?

ইনসপেক্টর ব্লান্ড, একগাল হেসে বলল, শুধু বড় নয় স্যার বেশি রকমের সৌখীন এবং বিসালবহুল সেই ইয়ট, মঁসিয়ে পোয়ারো আপনি এর থেকে কি বুঝতে পারলেন?

ডেড ম্যানসন ফলি একজন বিত্তবান লোক ইটিয়েন এবং অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি সে, বলল পোয়ারো।

জানতে চাইলে ব্লান্ড, কেন, কি ব্যাপার স্যার?

পোয়ারো বলল, আমার শেষ উপলব্ধি এটাই। আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি অবশেষে, অত্যন্ত বোকা ছিলাম আমি একটু আগে পর্যন্ত। তারপর সে ফোনটা কেটে দিল। এবার মিসেস অলিবারের পোন নম্বরটা ডায়াল করলো পোয়ারো।

মিসেস অলিভার ফোনে উত্তর দিল আমি খুব খুশী হয়েছি যে, আপনি আমাকে ফোন করেছেন। তবে আপনি ফোন করেছেন মঁসিয়ে পোয়ারো কি মনে করে? অলিভার জানতে চাইল।

পোয়ারো বলল, আপনার মার্ডার হান্টের কয়েকটি চরিত্র সম্বন্ধে প্রশ্ন করতে চাই মিসেস অলিভার। ম্যাডাম, সেই এ্যাটম বৈজ্ঞানিকটি কে?

উত্তর দিল অলিভার, আলেক লেগি।

অর্থাৎ শেলি লেগির স্বামী! আলেগ লেগি! একজন বৈজ্ঞানিক কি সে? জানতে চাইলে পোয়ারো।

বস্তুত, সেই বৈজ্ঞানিক। হারয়েল নয়, তারা ছিল হেসলে হলিডে কটেজে। বলল অলিভার।

আর আপনার মনে মার্ডার হান্টের এই চরিত্রটা উদয় হয়, ন্যাসে হাউসে তার সঙ্গে আলাপ হওয়ার পরেই–তাই নয় কি? প্রশ্ন করলো পোয়ারো, অথচ তার স্ত্রী যুগোস্লাভিয়ান হয়তো?

মিসেস অলিভার বলল, না না, একজন খাঁটি ইংরেজ শেলি।

পোয়ারো বলল, আচ্ছা তাই নাকি? তাহলে আমি এখন অনেক কিছুই দেখতে পাচ্ছি।

অলিভার প্রশ্ন করল, এত বিলম্ব হয়ে গেল?

সময় তো একটু লাগবেই, কেউ কখনো সিদ্ধান্তে আসতে পারে না সব সময় হঠাৎ করে, পোয়ারো নিজের সমর্থনে বলল। আবার বললো পোয়ারো, পুলিশ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।

আক্ষেপের সুরে জানালো অলিভার, পুলিশের কথা বলছেন তো, এখন যদি একজন মহিলা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের প্রধান হত।….

বুঝতে পারলো পোয়ারো সেই সুপরিচিত উক্তির কথা, তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আমি অতি বিশ্বস্ততার সঙ্গে বলছি যদিও কেসটা খুব জটিল তবুও এখন আমি সিদ্ধান্তে এসে গেছি।

কোনো ভাবাবেগ বোঝা গেল না মিসেস অলিভারের মধ্যে। এরই মধ্যে কিন্তু দুদুটো খুন হয়ে গেছে, এটা আমি সাহসের সঙ্গে বলছি, বলল সে।

পোয়ারো সংশোধন করে বললো, তিনটে।

অলিভার প্রশ্ন করলো তিনটে খুন? কে হল, তৃতীয় শিকার?

পোয়ারো বললো, সে একজন বৃদ্ধ তার নাম মারডেল। আর সে মারডেলের মৃত্যুর ঘটনা ব্যাখ্যা করে জানালো।

জানতে চাইলো অলিভার, আপনি বলছেন তাহলে, এটা দুর্ঘটনা নয়? তাহলে বলুন দয়া করে কে খুন করেছে তাকে?

পোয়ারো বলল, এত খবর টেলিফোনে দেওয়া যায় না ম্যাডাম।

মিসেস অলিভার বলল, তাহলে ফোন ছেড়ে দিই?

না, আপনাকে আমি আরও দুটি প্রশ্ন করতে চাই, বলল পোয়ারো।আপনি কি প্রথমে সেই মেয়েটির মৃতদেহের জায়গাটা নির্দিষ্ট করার জন্য বোট-হাউসটাই মনোনীত করেছিলেন, আপনার মার্ডার হান্টের পরিকল্পনার সময়? এটা আমার প্রথম প্রশ্ন।

অলিভার বলল, না, প্রথমে আমি আমার হাউসটা বেছে নিই। এখন আমার তার নামটা মনে পড়ছে না। কে যেন আমাকে পীড়াপীড়ি করতে লাগল যে মৃতদেহটা যেন ফলিতেই অবিষ্কৃত হোক। কি অদ্ভুত পরিকল্পনা। আর লোকেরাও কি বোকা! আমি রাজী হইনি অবশ্য প্রথমে সেই প্রস্তাবে।

অবশ্য আপনি শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়েছিলেন সেই বোট-হাউসটাকেই, বলল পোয়ারো।

আচ্ছা! এবার আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন, চূড়ান্ত কু লেখা আছে কমিকস-এ, আমাকে আপনি বলেছিলেন, একথা কি আপনার মনে আছে, আর সেগুলো মারলিনকে পড়তে দেওয়া হয়েছিল তার সময় কাটাবার জন্য।

অলিভার বলল, অবশ্যই মনে আছে বইকি!

বলুন এবার তাহলে সেটা ঠিক এইরকম ছিল : ডেরিনের সঙ্গে অ্যালবার্ট বেড়াতে যায়। অরণ্যে জর্জি গোর্জি ভ্রমণার্থীদের চুমু খায়। সিনেমায় মেয়েদের চিমটি কাটে পিটার।

আহত কণ্ঠে বলল মিসেস অলিভার, আশ্চর্য তো, আমি কেন ওসব নোংরা কথা লিখতে যাব বলুন?

না, অতি প্রাঞ্জল ছিল আমার ক্লু। রহস্যময় স্বরে নিচু গলায় বলল অলিভার-ভ্রমণার্থীর ঝোলা ব্যাগ দেখুন।

আশ্চর্য! তাহলে এই ক্লু লেখা কমিকসটা সেখান থেকে সরিয়ে ফেলা হয়, এবং অন্য মতলব ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তার পরিবর্তে, বলল পোয়ারো। তাহলে বোট-হাউসের মেঝের উপর সেই ঝোলা ব্যাগটা নিশ্চয় পাওয়া গিয়েছিলো? অলিভার জানতে চাইলো।

আঃ, অন্য একটা ঝোলা ব্যাগ সেটা, আর সেটাই আমাকে ভাবাচ্ছে, বলল পোয়ারো।

মারলিনের হতে পারে সেটা, তবে সেটা হাওয়া উচিত ছিলো সেই যুগোস্লাভিয়ান স্ত্রীর। আপনি বুঝতে পারছেন আমি কি বলতে চাইছি? বললো অলিভার।

পোয়ারো বলল, অবশ্যই বুঝেছি, সে চেষ্টা করলো আর একবার কুয়াশায় অন্ধকারে ডুব দেওয়ার জন্য।

তবে শুনুন, বিষে ভরা একটা ওষুধের বোতল ছিল সেই ঝোলাব্যাগের মধ্যে, গ্রাম্য লোকেরা তাদের স্ত্রীকে হত্যা করে থাকে যা খাইয়ে। লক্ষ্য করুন, নার্সের ট্রেনিং নিতে সেই যুগোস্লাভিয়ান স্ত্রী এখানে এসেছিল। নার্সটি তখন বাড়িতে ছিল, যখন কর্নেল ব্লান্ড অর্থের জন্য তার স্ত্রীকে বিষ খাইয়ে হত্যা করে। আর বিষের বোতলটা তখন হাতে পেয়ে সরিয়ে ফেলল সেই নার্সটি। পরে সে ব্ল্যাকমেল করতে আসে কর্নেল ব্লান্ডকে। আবার নার্সটিকে হত্যা করল সেই কর্নেল ব্লান্ড। জিজ্ঞাসা করল অলিভার, এটা আপনার উপলব্ধি হলো মঁসিয়ে পোয়ারো?

না, কিছুতেই নয়, বলার সঙ্গে সঙ্গে সে আবার বলল, ম্যাডাম, জানেন কি এটাই আমার আনন্দ যে কেউ পুরস্কৃত হলো না, মার্ডার হান্ট এমনই নির্লিপ্ত সহজ সরল সে।

তবে অনেক দেরিতে, একজন পুরস্কার পেয়েছিল অবশ্য, এক বৃদ্ধা মহিলা সেদিন প্রায় সাতটার সময় উল্লিসিত হয়ে বোট-হাউসে ছুটে আসে তার আবিষ্কৃত কু বলার জন্য, অবশ্য তখন আবিষ্কৃত হয়ে গেছে মারলিনের মৃতদেহ। অবশ্য পুরস্কৃত করা হয়। বলল মিসেস অলিভার, আরো বলল সে, সে ভয়ঙ্কর যুবকটি বলেছিল, আমি নাকি ড্রিঙ্ক করি মাছ খাওয়ার মতো, কখনো তাকে আর ক্যামেলিয়া গার্ডেনে দেখা যায়নি।

পোয়ারো বলল, ম্যাডাম আপনি আপনার এই কাহিনী হয়তো একদিন আমাকে বলবেন।

মিসেস অলিভার বলল, আমি আমার লেখার মধ্যে এই ঘটনার রূপ দেওয়ার চিন্তা করছি। পোয়ারো অবাক হয়েছিল বছর তিনেক পরে মিসেস অলিভারের লেখা, দ্য ওম্যান ইন দ্য উড, এই বইটা পড়ে। তার বইটা পড়ে কিছু কিছু ঘটনা এবং চরিত্র যেন পরিচিত মনে হচ্ছিল, অস্পষ্টভাবে।

ইনসপেক্টর ব্লান্ড এবং চীফ কনস্টেবল কৌতূহলী চোখে তাকাল এরকুল পোয়ারের দিকে। চীফ কনস্টেবলের ধারণা, এই ছোটোখাটো চোহারার বেলজিয়ান ভদ্রলোকটি হয়তো একসময় যাদুকর ছিল, এখন তার বয়স হয়েছে অতএব সেই আগের কর্মকুশলতা হয়তো আর নেই। তাকে বোঝালো ইনসপেক্টর ব্লান্ড যে, এরকুল পোয়ারো উপস্থিত ছিল সেই দুর্ঘটনা স্থলে, সেজন্য তার পর্যবেক্ষণ আমাদের কাজে লাগাতে পারে। এছাড়াও তারা এই কেসে এগোতে পারেনি এক পাও, তদন্তের কাজ সেই তিমিরেই পড়ে আছে। পুলিশের আর কোনো উপায় নেই, অন্ধকারে দেওয়ালে পিঠ দিয়ে পোয়ারোর পরামর্শ নেওয়া ছাড়া।

চীফ ইনসপেক্টর বস্তুতপক্ষে আজ তার নৈশভোজের পাটিতে যাওয়া বাতিল করে দিয়ে অপেক্ষা করছিল এরকুল পোয়ারোর জন্য একমাত্র মিঃ রান্ড-এর জেদ-এর খাতিরেই।

শেষ পর্যন্ত তাহলে আপনি এখানে এলেন মঁসিয়ে পোয়ারো? করমর্দন করে চীফ ইনসপেক্টর বলল। আপনার অপেক্ষায় আমরা সবাই বসে আছি অসহায় অবস্থায়।

পোয়ারোর কানে তার কথাগুলো বিদ্রুপাত্মক শোনালো, দৈহিক দিক থেকে যদিও সে ক্লান্ত এতটা পথ আসার জন্য, তবে মানসিক দিক থেকে সে কোনোমতেই দুর্বল নয়। সেজন্য পোয়ারো জোরের সঙ্গে বলল, আগে আমি কি করে এই সত্যটা বুঝতে পারিনি, এটা এখন আমি কল্পনাও করতে পারি না।

চীফ ইনসপেক্টর উদাসীন কণ্ঠে বলল, অতএব আমরা কি এখন ধরে নিতে পারি যে, আপনি এখন সেই সত্যটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন?

পোয়ারো বলল, অবশ্যই, আমি এখন আপনাদের তারই বিস্তারিত বিবরণ দেবো।

চীফ ইনসপেক্টর বলল, আমরা প্রমাণ চাই।

আপনার কাছে কি কিছু প্রমাণ আছে, মিঃ পোয়ারো?

ভালো কথা তো-বলল, পোয়ারো আমি নির্দেশ দিতে পারি যে কোথায় প্রমাণ পাওয়া যাবে।

ইনসপেক্টর ব্লান্ড বলল, উদাহরণ দিন।

আচ্ছা ধরুন, এদেশে ছেড়ে কি চলে গেছে ইটিয়েন ডি সৌউসা?

ব্লান্ড বলল তীক্ষ্ণ স্বরে, হা সে চলে গেছে দু-সপ্তাহ আগেই। খুবই মুশকিল তাকে খুঁজে পাওয়া। ওয়ারেন্ট অর্ডার দেওয়া হবে।

তাকে নিয়েই তো সব ঘটনা–এটা সে প্রশ্ন নয়, পোয়ারো বলল।

চীফ ইনসপেক্টর উত্তেজিত ভাবেই বলল, মঁসিয়ে পোয়ারো, সেই ঘটনাটা কি? আপনি এত সহজভাবে সেটা বলছেন?

ঠিক ঘটনাগুলো এইরকম–এখানে যেভাবে এক বিলাসবহুল ইয়টে এসেছিল ইটিয়েন ডি সৌউসা, তাতে মনে হয় বেশ বিত্তবান তার পরিবার। মারলিন টাকারের পিতামহ (আমি এ খবর আজকের আগে জানতাম না) বৃদ্ধ মারডেল; লেডি স্টাবস ভালোবাসতেন কুলি ধরনের পোশাক মাথায় দিতে।

মিসেস অলিভারের বল্গাহীন অবিশ্বাস্য কল্পনা আছে, কিন্তু নিজেকে উপলব্ধি করার ক্ষমতা নেই। তিনি অত্যন্ত রূঢ় চরিত্রের বিচারক।

 তার নিজস্ব ড্রয়ারের ভেতর লুকানো ছিল মারলিন টাকারের প্রসাধন জিনিস ও লিপস্টিক। মিথ্যে করে মিস ব্রেউইস বলেছিল লেডি স্টাবস নাকি তাকে বলেছিলেন মারলিনের জন্য বোট-হাউসে চা, কেক, ফুট ড্রিংকস নিয়ে যেতে।

অবাক চোখে তাকিয়ে চীফ ইনসপেক্টর বলল, এইগুলি ঘটনা? আপনি ঘটনা বলছেন এই গুলিকে। তবে কোনো নতুনত্ব নেই এর মধ্যে।

আপনি সত্য প্রমাণ চান? অর্থাৎ ধরুন মৃতদেহ লেডি স্টাবস-এর। বললো পোয়ারো।

 অর্থাৎ, আপনি কি খুঁজে পেয়েছেন লেডি স্টাবস-এর মৃতদেহ? জানতে চাইলো ইনসপেক্টর।

আমি দেখিনি, তবে কোথায় মৃতদেহ লুকিয়ে রাখা আছে জানি। ঘটনাস্থলে আপনারা যাবেন যদি মৃতদেহ পান সেখানে গিয়ে তাহলেই হাতে-নাতে প্রমাণ পেয়ে যাবেন।

সব প্রমাণ অর্থাৎ যা যা আপনাদের জানা দরকার, বলল পোয়ারো।

তাহলে কে সেটা লুকিয়ে রেখেছে?

সেই স্বভাবসুলভ বেড়ালের হাসি দেখা গেল পোয়ারের ঠোঁটে। নম্র গলায় সে বলল, সচরাচর যে ব্যক্তি হয়ে থাকে এসব ক্ষেত্রে তার স্বামী। হ্যাঁ তার স্ত্রীকে হত্যা করেছেন স্যার জর্জই, বলল পোয়ারো।

অসম্ভব মঁসিয়ে পোয়ারো। একথা অসম্ভব আমরা জানি, বলল চীফ ইনসপেক্টর।

না, এটা একেবারেই অসম্ভব নয়–বললো পোয়ারো, তা হলে আমি সমস্ত খুলেই বলছি আপনাদের।

.

নিজেই দরজা খুলে দিল মিসেস ফোলিয়াট, তাতে অবাক হলো না পোয়ারো, মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সে যেন কেমন বুড়ো হয়ে গেছে।

আপনি আবার এলেন মঁসিয়ে পোয়ারো? বলল মিসেস ফোলিয়াট।

আপনি কি অনুমান করতে পারছেন না? তাহলে ঠিক আছে, আমিই বলছি, সে বলতে লাগল, হ্যাটি স্টাবস, মারলিন আর মারডেল এখানে তিনটে খুন হয়েছে।

প্রায় চিৎকার করে বলল ফোলিয়াট, মারডেল? ওটা তো দুর্ঘটনা একটা। সে পড়ে গিয়েছিল জেটি থেকে। সে প্রচুর মদ খেয়েছিল সেদিন, অনেক বয়সও হয়েছিল তার ওপর প্রায় অন্ধ।

পোয়ারো জানাল দুর্ঘটনা নয় সেটা; অনেক কিছু দেখে ফেলেছিল সে সেজন্য

সে জানাল কি করে?

সে হয়তো চিনে ফেলেছিল কারোর মুখ দেখে অথবা কণ্ঠস্বর শুনে নয়তো চালচালন দেখে।

–হয়তো এরকম কিছু একটা হবে, পোয়ারো বলল। ফোলিয়াট পরিবার সম্বন্ধে সে নাকি অনেক কিছুই জানত–সে আমাকে প্রথম দিনেই বলেছিল। আপনার শ্বশুর, স্বামী এবং ছেলেদের সম্পর্কে। আপনার এক ছেলে জেমস কিন্তু বেঁচে আছে, যদিও যুদ্ধে আপনার এক ছেলে হেনরি নিহত হয়েছে। প্রথমে জেমস-এর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও সে কিন্তু মরেনি, আপনিই রটিয়ে দেন মরে গেছে। কেনই বা লোকে অবিশ্বাস করবে, আপনার কথা কেউই অবিশ্বাস করবে না। তারপর আপনি অভিভাবিকা হন এক অস্বাভাবিক ধরনের যুবতীর। অবশ্য মেয়েটি সম্পদশালী ছিলো। আপনি প্রচার করেন যে, তার সব টাকা তার অভিভাবক নষ্ট করে ফেলে, অতএব মেয়েটি গরীব হয়ে যায়। আপনি মেয়েটিকে উপদেশ দেন তার থেকে বয়সে অনেক বড় এক বিত্তবান পুরুষকে বিয়ে করার জন্য। কেনই বা কেউ অবিশ্বাস করবে আপনার সেই কাহিনী। আপনি ঘোষণা করেন, তার বাবা-মা ও আত্মীয়স্বজন সব নিহত বলে। ফরাসি আইনজ্ঞদের একটা ফার্মে কাজ করে, সান মিওয়েলের আইনজ্ঞদের নির্দেশে–তারা বলে মেয়েটি যদি বিয়ে করে তাহলেই সৌভাগ্যের অধিকারিণী হবে, না হলে নয়! মেয়েটি স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন ছিলো না, সেকথা পূর্বেই বলেছি। তার স্বামী বিয়ের পর যখন যেমন একটার পর একটা নথিপত্রে সই করতে বলেছে, বিনা দ্বিধায় সে তাই করেছে। তার স্বামী তার আকাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছে যায় সব শেষে। প্রচুর সচ্ছলতা হয় তার। আপনার ছেলের অনুমিত নতুন ব্যক্তিতে বিত্তবান হয়ে যায় স্যার জর্জ স্টাবস, আর তার স্ত্রী তখন কপর্দকহীন নিঃস্ব। আপনার ছেলে জেমস ওরফে জর্জ স্টাবস, বয়স বেড়ে যাওয়ার দরুন ও মুখের দাড়ি-গোঁফের জন্য চোহারা বদলে যায়। তাকে কিন্তু একমাত্র বৃদ্ধ মারডেল চিনতে পেরেছিল। সেজন্যই সে প্রথম দিনেই আমাকে বলেছিল, তারা ন্যাসে হাউসে চিরদিনই থাকবে। আপনি স্নেহ করতেন খুবই হ্যাটি স্টাবসকে, সেজন্য ভেবেছিলেন, যেহেতু মেয়েটির অর্থেই বিত্তবান হয়েছে আপনার ছেলে সেজন্য হ্যাটির প্রতি সে প্রসন্ন হবে এবং সুখে রাখবে। আপনার ছেলে যে আগেই বিবাহিত ছিলো তা কি আপনি কখনো ভেবেছেন? আপনার ছেলে ট্রিয়েস্ট অপরাধ জগতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি মেয়েকে বিয়ে করে। তারা তাদের বিবাহ সম্পর্ক অটুট রেখেছে।

অর্থের লোভে আপনার ছেলে হ্যাটিকে বিয়ে করেছিলো কিন্তু তার মনে প্রথম থেকেই অন্য ফন্দি ছিলো।

আমি এটা বিশ্বাস করি না, কখনোই নয়, বলল মিসেস ফোলিয়াট–কেবল সেই শয়তান মেয়েটার জন্যই সে…

একথা সত্য যে, আপনার ছেলে মতলব করেছিল হ্যাটিকে হত্যা করার। কোনো আত্মীয়স্বজন ছিলো না হ্যাটির, শুধু কজন বন্ধুবান্ধন ছিলো। প্রথম দিন সন্ধ্যায় ন্যাসে হাউসে হ্যাটিকে বাড়ির চাকর-বাকররা খুব সামান্য সময়ের জন্য দেখে থাকবে, আর তারা যে মেয়েটিকে পরদিন সকালে দেখেছিল, সে হ্যাটি নয়, মেয়েটি ছিলো আপনার ছেলের বিবাহিতা স্ত্রী। বাড়ির লোকেদের সঙ্গে সে ব্যবহার করতে থাকে হ্যাটির মতো চালনচলন করে। এখানে বেশ ভালোভাবেই জীবন কাটিয়ে দিতে পারতো নকল হ্যাটি, কিন্তু ওদিকে আসল হ্যাটি অভাবনীয়ভাবে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে নতুন চিকিৎসার ফলে। লেডি স্টাবস-এর মানসিক অসুস্থতা তখন খুবই কমের দিকে; আগেই বুঝতে পেরেছিল সেক্রেটারি মিস ব্রেউইস। আকস্মিকভাবে তখনই এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটে যায়। ন্যাসে হাউসে আসছে সে ইয়ট ট্রিপে, চিঠি লিখে জানায় হ্যাটির এক খুড়তুতো ভাই। তার সেই খুড়তুতো বোনকে দেখে সন্দেহ নাও হতে পারে। কিন্তু আমার তখনই একটা সম্ভাবনার কথা মনে হয়। হয়তো ডি সৌউসা নকল ডি সৌউসা হতে পারে। অতএব সত্য সব সময় প্রকাশ হয়ে পড়ে–সেই হ্যাটিও আসল হ্যাটি নয় এটা বলা যেতে পারে। যদি ইংলন্ডে থাকত ডি সৌউসা তবে, নকল হ্যাটি হয়ত সেই অপ্রীতিকর ঘটনা এড়িয়ে যেতে পারত। কিন্তু হঠাৎ ডি সৌউসার আবির্ভাব হ্যাটির জীবনে সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল।

আর একটা জটিল সমস্যা দেখা দেয় ওদিকে, তার নাতনির সঙ্গে গল্পগুজব করতে গিয়ে বৃদ্ধ মারডেল হঠাৎ একদিন বলে ফেলে–সে অরণ্যে একটি মহিলার মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেছে। আর স্যার জর্জ স্টাবস আসলে মিঃ জেমস। এজন্যই মেয়েটির তাদের প্রতি একটা বিরূপ ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়।

এর ফলেই অবশ্য মেয়েটি তার নিজের মৃত্যুর জন্য কবর খোঁড়ে। স্যার জর্জ আর তার স্ত্রী চাননি যে তাদের কাহিনী প্রচার হয়ে যাক। আমার অনুমান মিঃ জেমস মেয়েটির হাতে কিছু টাকা দিয়ে তার পরিকল্পনা রচনা করতে থাকে। খুব সতর্কতার সঙ্গে তারা তাদের প্ল্যান করতে থাকে। আগেই তারা জানত হেলমাউথে ডি সৌউসা কখন আসবে। ওদিকে মিলন হয় তার এখানে উপস্থিত হওয়ার দিন এবং উৎসবের দিন। ঠিক সেদিনেই যদি মারলিনকে খুন করে, লেডি স্টাবস-এর উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রচার করা যায়, তবে সন্দেহ জাগিয়ে ভোলা যাবে ডি সৌউসার মনে। এইবার লেডি স্টাব পরিকল্পনামতো নতুন চাল চালেন, ডি সৌউসাকে দুষ্ট প্রকৃতির লোক বলে প্রচার করলে এবং লোকটা মানুষ খুন করে এই বলে অভিযোগ আনল। এবার চিরতরে উধাও হতে হবে লেডি স্টাবসকে (সম্ভবত অনামী মৃতদেহ স্যার জর্জ কর্তৃক সনাক্ত হতে পারে। এবং তার স্থলাভিষিক্ত হতে পারে এক নতুন ব্যক্তিত্ব। তার নিজস্ব ইতালীয় অভিবক্তিতে ফুটে উঠবে হ্যাটি। ইতালীয় স্ত্রীকে চব্বিশ ঘণ্টা ধরে অভিনয় করতে হবে দ্বৈত ভূমিকায়। স্যার জর্জ সহযোগিতা করায় কাজটা খুব সহজ হয়ে যায়। যেদিন আমি এখানে আসি, সম্ভবত লেডি স্টাবস চায়ের সময় পর্যন্ত অসুস্থতার দোহাই দিয়ে নিজের ঘরে পড়ে থাকবে। অন্য কেউ তখনো জানত না স্যার জর্জ ছাড়া আসলে সে ঘর থেকে বেরিয়ে এক্সেটারে যায় বাস কিংবা ট্রেন ধরে, আর একজন ছাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যায় এক্সেটার থেকে। সে হোস্টেলে ফিরে আসে তারপর। লেডি স্টাবসকে ড্রইংয়রুমে দেখা যায় চায়ের সময়। সে একটু তাড়াতাড়ি শুতে চলে যায় নৈশভোজের পর। তাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে মিস ব্রেউইস। একটু পরেই আবার সে ন্যাসে হাউসে ফিরে আসে, রাতে হোস্টেল থেকে সবার অলক্ষে লেডি স্টাবস রূপে ব্রেকফাস্টের জন্য।

বিকেল চারটেয় চূড়ান্ত নাটক মঞ্চস্থ হয়। মারলিনের কাছে ড্রিঙ্কস, ফল, চা নিয়ে যেতে বলে লেডি স্টাবস। তারপর একসময় সে ঢুকে পড়ে ফাঁকা জ্যোতিষীর টেন্টে, এরপর সামার হাউসে চলে যায় টেন্টের পিছন দিক দিয়ে বেরিয়ে।

সেখানে ছিল তার ভ্রমণার্থীর ঝোলানো ব্যাগ এবং কস্টিউম রাখা ছিল তার মধ্যে। সে বোট-হাউসে গিয়েছিল, তারপর অরণ্য পথে এবং ডেকে দরজা খুলে দেওয়ার জন্য বলেছিল।

ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সে মেয়েটির গলা টিপে ধরে এবং তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। তারপর সে তার মাথার কুলিটুপিটা ভাসিয়ে দেয় নদীতে। এরপর ভ্রমণার্থীর পোশাক পরে সেতারপর সে তার হোস্টেলের ডাচ ছাত্রীকে নিয়ে স্থানীয় বাস ধরে উধাও হয়ে যায় নিমেষে।

যাকগে সেকথা এখন, পুলিশ আর খুঁজছে না ইতালির মেয়েটিকে, খুঁজছে হ্যাটি স্টাবসকে।

পোয়ারো আবার বলল–এখন ম্যাডাম, হ্যাটি স্টাবস বেচারী মৃত। সমস্ত কিছুই আপনি ভালো করে জানেন। আপনি বেশ আঘাত পান মারলিন-এর মৃত্যুতে। তবে আপনি এটা জানতেন না যে, তাকে খুন করা হবে। আপনি যখন হ্যাটির প্রসঙ্গে কথা বলেন আমি লক্ষ্য করেছি দুটি ভিন্ন ব্যক্তির কথা বলেন, এমন একজন মহিলা যাকে আপনি অপছন্দ করতেন; ভাবতেন তার মৃত্যু হওয়া অনেক ভালো, আবার আমাকে আপনি সতর্ক করে দিয়েছিলেন তার সম্পর্কে যে, বিশ্বাস করবেন না সে যা বলে। আর খুবই স্নেহ করতেন আপনি অপর মেয়েটিকে, ভালোবাসতেন।

আপনি মনে হয় বেচারী হ্যাটি স্টাবস-এর অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন ম্যাডাম, আমার মনে হয়…

দীর্ঘ নীরবতা নেমে এল এরপর। তখনো তার চেয়ারে বসেছিলো মিসেস ফোলিয়াট। এবার একসময় নীরবতা ভঙ্গ করল ফোলিয়াট; মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার পুরো গল্পটাই ফ্যান্টাস্টিক। আমি এখন বাস্তবিক মনে করছি আপনি বোধহয় পাগল হয়ে গেছেন। আপনার স্নায়ুকোষ থেকে বেরিয়েছে এ সমস্ত কল্পনা, অথচ কোনো প্রমাণ আপনার কাছে নেই।

কপাট খুলে দিল পোয়ারো একটা জানালার সামনে গিয়ে। ঐ দেখুন ভাঙ্গা হচ্ছে ফলির কংক্রিটের গাঁথুনি–কি সুন্দর জায়গা কবর দেওয়ার। মৃতদেহ কবর দেওয়া হয়েছে একটা ছোেট জায়গায় ফলি তৈরি হয়েছে তার উপর-পোয়ারো নম্র গলায় বলল : ফলিটা স্যার জর্জের… ন্যাসে হাউসের মালিকের ফলি।

ফোলিয়াট কোনোরকমে দীর্ঘশ্বাস চেপে চুপ করে রইল।

নিজের থেকেই আবার বললো পোয়ারো–যে লোকটি এখানকার মালিক–সেই কেবল একজন শয়তান।

মিসেস ফোলিয়াট এবার বলল, আমি জানি নিশ্চয় জানি–সর্বদাই জানতাম–সে আমাকে ভয় দেখাত নিতান্ত শিশু বয়স থেকেই, সে নিষ্ঠুর ছিল, দয়ামায়াহীন, বিবেক বর্জিত সে। তবুও আমারই ছেলে তো সে। আমি তাকে ভালোবাসি। অবশ্য আমার মুখ খোলা উচিত ছিল হ্যাটির মৃত্যুর পর। কিন্তু বললাম যে, সে তো আমারই ছেলে, কি করে বলব আমি তার সঙ্গে সব সম্পর্ক ছেদ করে দিতে?

আমার নীরবতা এজন্য। বেচারি মারলিন খুন হলো মাঝখান থেকে। এবার কি সেই বৃদ্ধ মারডেল-এর পালা–কি জানি এর শেষ কোথায়?

পোয়ারো বলল, খুনীর শেষ বলতে কোনো সংজ্ঞা নেই। ফোলিয়াট দুহাতে চোখ ঢেকে মাথা নিচু করে রাখল। তারপর মিসেস ফোলিয়াট ন্যাসে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পোয়ারোর দিকে ফিরে তাকাল, বলল মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনাকে ধন্যবাদ, নিজে আমাকে এখানে এসব কথা বলতে এসেছেন, এইজন্য। দয়া করে এবার কি আপনি আমাকে মুক্তি দেবেন? এবার এমন কিছু কাজ করতে হবে- যা বোধ হয় একা একা নিজেকেই নিজের সামনাসামনি হতে হয়…।