কোদণ্ডের টঙ্কার

কোদণ্ডের টঙ্কার

কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের জাদুঘরসদৃশ বিশাল ড্রয়িংরুমে ইদানীং রবিবারের আড়াটা দারুণ জমজমাট হয়ে ওঠে। পুলিশের গোয়েন্দা ও অপরাধ দফতরের হোমরাচোমরা লোকেরা তো আসেনই, কর্নেলের মতো রিটায়ার-করা সামরিক অফিসাররাও কেউ কেউ এসে জোটেন। নিজের নিজের লাইনে সবাই তারা অভিজ্ঞ লোক এবং রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা কারুর কম নেই। কাজেই প্রত্যেকেরই যেন চেষ্টা থাকে, কে কত সাংঘাতিক অভিজ্ঞতার কথা বলে অন্যদের টিট করতে পারবেন।

এ রবিবারে কথার সূত্রপাত সম্প্রতি গঙ্গাসাগর মেলায় সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশী এক স্মাগলারকে গ্রেফতার নিয়ে। ডিটেকটিভ দফতরের রণবীর মণ্ডল ঘটনার রোমাঞ্চকর জায়গায় সবে পৌঁছেছেন, ব্রিগেডিয়ার ইকবাল সিং বেমক্কা বলে উঠলেন, ওয়েট, ওয়েট। এভাবে বাধা দেওয়ার জন্য আমি দুঃখিত। কিন্তু মণ্ডলসায়েব তত ছদ্মবেশী সন্ন্যাসীর কথা বলছেন। নেপাল বর্ডারে আমি সীমান্ত বাহিনীতে থাকার সময় এক সত্যিকার সন্ন্যাসীকে স্মাগলিংয়ের কারবারে জড়িত থাকার জন্য পাকড়াও করেছিলুম।

ক্রাইম ব্রাঞ্চের মণি চ্যাটার্জি মুচকি হেসে বললেন, সত্যিকার সন্ন্যাসী? সাধু-সন্ন্যাসী-ফকির এঁরা তো মশাই সংসারত্যাগী পুরুষ! এঁরা স্মাগলিং করতে যাবেন কোন্ দুঃখে?

ব্রিগেডিয়ার ইকবাল সিং বললেন, তা বলতে পারব না। যা দেখেছি, তাই বলছি। সন্ন্যাসীর বোঁচকার ভেতর পাওয়া গিয়েছিল একগাদা কোকেন, মারিজুয়ানা, এলএসডি, কয়েকরকম নার্কোটিক্স।

ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের রঘুবীর শর্মা তাকে সমর্থন করে বললেন, চ্যাটার্জিসায়েব! সত্যি বলতে কী, সাধু বলুন, সন্ন্যাসী বলুন, ফকির বলুন, কেউ সংসারত্যাগী নন।

চ্যাটার্জি বললেন, কেন নন?

শর্মা হাসলেন। মশাই, কোনও মানুষের পক্ষে কি সত্যিই সংসার ত্যাগ করা সম্ভব? একটু ভেবে দেখলেই ব্যাপারটা বুঝনেন। ওঁরা আসলে নিজেদের ব্যক্তিগত সংসার ত্যাগ করেছেন, তার মানে পরিবার বা আত্মীয়স্বজনকে ছেড়েছেন। কিন্তু তার বদলে অন্যান্য মানুষকে নিয়েই তাদের চলতে হয়। আমাদের মতোই তাদের ট্রেনে-বাসে চাপতে হয়।

ব্রিগেডিয়ার সিং দাড়ি চুলকে মন্তব্য করলেন, প্লেনেও।

হ্যাঁ, প্লেনেও, শর্মা জোর দিয়ে বললেন। তাছাড়া তাদের পেটে খেতেও হয়। না খেলে তো বাঁচা যায় না।

মণ্ডল বললেন, শুনেছি, কোনও-কোনও সাধু নাকি স্রেফ বাতাস খেয়ে থাকেন।

কর্নেল এক কোণায় বসে আপনমনে আতশকাচ দিয়ে এক টুকরো হাড়ের মতো দেখখে কী একটা জিনিস পরীক্ষা করছিলেন। মুখ তুলে ফোড়ন কাটালেন, সাপকে বায়ুভুক বলা হত প্রাচীনকালে। কথাটা ভুল।

ভুল তো বটেই, শর্মা দাপটের সঙ্গে বললেন। শুধু বাতাস খেয়ে কোনও প্রাণীর পক্ষে বাঁচা সম্ভব নয়। কাজেই যা বলছিলুম, নিছক খাদ্যের জন্যও সাধু-সন্ন্যাসী-ফকিরদের সংসারের নাগালে। থাকতেই হয়।

চ্যাটার্জি বললেন, কী বলছেন! হিমালয়ের দুর্গম স্থানে কত সাধু থাকেন।

ইকবাল সিং হাসতে-হাসতে বললেন, আপনার কথায় লজিক নেই। যদি দুর্গম স্থানে সত্যি কেউ থাকেন, তাঁকে দেখল কে? তাছাড়া হিমালয় বাস্তবিক তত দুর্গম নয়। প্রাচীন যুগ থেকেই মানুষের পা তার সবখানেই পড়েছে। আমি দেখেছি, হিমালয়ে যত সাধু থাকেন, সকলের ডেরা কোনও-না-কোনও তীর্থে অথবা তীর্থপথের ধারে। তীর্থপথের আনাচে-কানাচেও কাউকে থাকতে দেখেছি। শর্মাসায়েব ঠিকই বলেছেন। সাধু-সন্ন্যাসীদের সংসারত্যাগী বলা হয় বটে, কিন্তু সংসারী মানুষদের ছাড়া তাদের চলে না। অবশ্য বলতে পারেন, ছোট সংসার ছেড়ে বড় সংসারে ঢোকেন তারা।

মণ্ডল বললেন, তা না হয় মেনে নিচ্ছি। কিন্তু সাধুদের অলৌকিক ক্ষমতা সম্পর্কে আপনার কী বক্তব্য।

মানুষের সমস্ত ক্ষমতা লৌকিক শর্মা বললেন, সাধুরা কেউ কেউ ম্যাজিক দেখান আসলে।

ইকবাল সিং তাকে সমর্থন করে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, চ্যাটার্জি বলে উঠলেন, ম্যাজিক কী বলছেন মশাই! কোনারকের ওখানে এক সাধুকে এক হাত উঁচুতে, স্রেফ শূন্যে বসে ধ্যানস্থ দেখেছি।

শর্মা এবং সিং হো-হো করে হেসে উঠলেন। মণ্ডল বললেন, বলেন কী! হঠযোগীরা এমন করেন শুনেছি।

চ্যাটার্জি বললেন, নিজের চোখকে তো মশাই অবিশ্বাস করতে পারব না, সে আপনারা যাই। বলুন। সমুদ্রের ধারে পরিষ্কার জ্যোৎস্না ছিল। সাধুবাবা মিনিট-দুয়েক ওইভাবে শূন্যে থাকার পর মাটিতে নামলেন।

একটু তফাতে আমার পাশে বসে ছিলেন প্রাইভেট গোয়েন্দা কৃতান্তকুমার হালদার। কে কে। খাদার নামে ইদানীং পরিচিত। ঢ্যাঙা গড়নের মানুষ। পেল্লায় গোঁফ। পুলিশের সিআই ছিলেন মফস্বলে। রিটায়ার করে প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলেছেন গণেশ অ্যাভেনিউতে, তিনতলা একটা বাড়ির ছাদে অ্যাসবেস্টসের চাল চাপানো একটা ছোট্ট ঘর। রাস্তা থেকে সাইন বোর্ডটা চোখে পড়ে : হালদার ডিটেকটিভ এজেন্সি। তলায় ইংরেজিতে লেখা : রহস্যের ধাঁধায় পড়লে, চলে আসুন।

হালদারমশাই আজ কর্নেলের আড্ডায় কেন এসেছেন জানি না। কর্নেলের কাছে বোধ করি কোনও ব্যাপারে পরামর্শ নিতেই এসে থাকবেন। হোমরা-চোমরাদের কথার মধ্যে এতক্ষণ নাক গলাতে ভরসা পাচ্ছিলেন না হয়তো। কিছুক্ষণ থেকে ওঁকে উসখুস করতে এবং ঘন ঘন নস্যি নিতে দেখছিলুম। বাথরুমে বারবার হাঁচতে যাচ্ছিলেন, সে অবশ্য হলফ করে বলতে পারি। এবার আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। বললেন, যদি কিছু মনে না করেন স্যার–

ব্রিগেডিয়ার সিং বললে, না, না! বলুন কী বলতে চান।

হালদারমশাই বললেন, চ্যাটার্জির্সায়েব তো শূন্যে সাধুবাবাকে ধ্যান করতে দেখেছেন। আমি সম্প্রতি কোদণ্ডগিরির জঙ্গলে গিয়েছিলুম বেড়াতে। সেখানে আমার এক ভাগ্নে ফরেস্ট অফিসার। খুব তেজি আর সাহসী

শর্মা বিরক্ত হয়ে বললেন, আহা! কী দেখেছেন, তাই বলুন।

হালদারমশাই মুখে বিস্ময় ফুটিয়ে বললেন, স্বচক্ষে দেখে এলুম স্যার, এক সাধুবাবা বেমালুম অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন, আবার দৃশ্য হচ্ছেন। এক্ষুনি অদৃশ্য হচ্ছেন, আর তক্ষুনি দৃশ্য হচ্ছেন। এই অশরীরী, এই শরীরী। একবার দেখছি নেই, একবার দেখছি আছেন।

বলার ভঙ্গিতেই ঘরে অট্টহাসির ঘুম পড়ে গেল। তারপর শর্মা ভুরু কুঁচকে বললেন, আপনাকে চেনা-চেনা লাগছে যেন? আপনি?

অধমের নাম কে কে হালদার, হালদারমশাই কঁচুমাচু মুখে বললেন। তবে চিনবেন বইকী স্যার! আপনিই তো আমার প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির লাইসেন্সের দরখাস্তে কাউন্টারসাইন করেছিলেন। নইলে লাইসেন্স পাওয়া কঠিন হত।

শর্মা হাসতে হাসতে বললেন, তাই বলুন! আপনিই সেই গোয়েন্দা হালদার? বুঝেছি। এবার এইসব গুলতাপ্পি ঝেড়ে মক্কেলের সংখ্যা বৃদ্ধির মতলব করেছেন বুঝি?

বিব্রত হালদারমশাই জিভ কেটে বললেন, ছি, ছি! এ কী বলছেন স্যার! এই জয়ন্তবাবুকে জিজ্ঞেস করুন, ওঁদের দৈনিক সত্যসেবকে এ-খবর বেরিয়েছে কি না।

চ্যাটার্জি বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেখেছিলুম বটে।

শর্মা আমার দিকে চোখের ঝিলিক তুলে বললেন, বাঃ! তাহলে জয়ন্তকে ম্যানেজ করে ফেলেছেন! সত্যি, আপনার কোনও তুলনা হয় না হালদারমশাই!

আমি ঝটপট বললুম, কখনও না। খবরটা নিউজ এজেন্সি থেকে পাওয়া। তাছাড়া হালদারমশাইও ব্যাপারটা যে দেখে এসেছেন, এ আমি এইমাত্র শুনছি।

ব্রিগেডিয়ার সিং দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, নিউজ এজেন্সির যে রিপোর্টার এই খবর জোগাড় করেছে, তার সঙ্গে হালদারমশাইয়ের যোগাযোগ ঘটেছিল কি না আমরা অবশ্য জানি না।

হালদারমশাই কী বলতে যাচ্ছিলেন, চ্যাটার্জি ঘড়ি দেখে লাফিয়ে উঠেলেন। মাই গুডনেস! সাড়ে দশটা বাজে। করছি কী আমি? সিপি-র সঙ্গে জরুরি কনফারেন্স! মিঃ শর্মা, মিঃ মণ্ডল, কী ব্যাপার? আপনাদের তাড়া দেখছি না যে!

দুজনেই তাই তো বলে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর তিন পুলিশ-জাঁদরেল কর্নেলের উদ্দেশে বাই হেঁকে বেরিয়ে গেলেন। ব্রিগেডিয়ার সিংও হাই তুলে উঠে দাঁড়ালেন। তিনিও কর্নেলের কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।

ষষ্ঠী ডাইনিং ঘরের দরজায় পর্দা ফাঁক করে উঁকি দিচ্ছিল। বলল, যা বাব্বা! আবার যে কোফি করলুম একগাদা। খাবে কে এত?

কর্নেল হাড়ের মতো জিনিসটা আর আতশকাচ রেখে বললেন, কোফি করেছিস?

আজ্ঞে বাবামশাই।

কর্নেল হালদারমশায়ের উদ্দেশে বললেন, কী হালদারমশাই, সাধুকে তো অদৃশ্য হতে দেখেছেন। কিন্তু কখনও কোফি খেয়েছেন কি? এ বস্তু একমাত্র ষষ্ঠীই বানাতে পারে।

ষষ্ঠী ট্রে নিয়ে আসছিল। জিভ কেটে বলল, কঁফি! কঁফি!

ঠিক আছে। কঁফিই খাওয়া যাক। কর্নেল উঠে আমাদের কাছে এসে বসলেন।

কর্নেলের এ পরিহাসে মন নেই হালদারমশাইয়ের। ফেঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললেন, কীরকম অপমানিত হলুম দেখুন কর্নেল! আপনার মতো বহুদর্শী জ্ঞানী লোক আমার কথাটা উড়িয়ে দিতে পারছেন না। আর এই সব পুঁচকে ছোকরা অফিসার—আমার ছেলের বয়সী সব!

দুঃখ করবেন না হালদারমশাই, কর্নেল সান্ত্বনা দিয়ে বললেন। তারপর নিজের হাতে কফি ঢেলে প্রচুর দুধ মিশিয়ে পেয়ালা এগিয়ে দিলেন তার দিকে। বাস্তব কিছু-কিছু ঘটনা অনেককে প্রচণ্ড ধাক্কা দেয়। জানেন তো, টুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন?

বললুম, কোদণ্ডগিরির সাধুর ব্যাপারটা আপনি বাস্তব ঘটনা বলছেন নাকি?

কর্নেল আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন না। হালদারমশাই সড়াক শব্দে গরম কফি টেনে ব্যস্তভাবে গিলতে গিলতে বললেন, বাস্তব মানে? স্বচক্ষে দেখে এসেছি আমি। মাত্র একটা ঝরনার

এধার-ওধার। ওধারে পাথরের উপর সাধুবাবা, এধারে পাথরের আড়ালে আমি।

দিনে, না রাত্তিরে?

রাত্তিরে। তবে জ্যোৎস্না ছিল। পরিষ্কার ঝলমলে আলো। তাছাড়া শুধু ওখানে নয়, পরে ট্রেনেও।

ফোন বাজলে ওঁর কথায় বাধা পড়ল। কর্নেল হাত বাড়িয়ে ফোন তুলে সাড়া দিলেন। তারপর বললেন, কে? কে কে হালদার? হুঁ, আছেন। ধরুন, দিচ্ছি।

হালদারমশাই খপ করে ফোন কেড়ে নিয়ে চড়া গলায় বললেন, দুলাল নাকি?…কী? পালিয়ে গেছে? হতভাগা বাঁদর ছেলে! তোকে পইপই করে বলা আছে…না, না। কোনও কথা শুনতে চাইনে তোর। যেমন করে পারিস, খুঁজে ধরে নিয়ে আয়। নইলে…হ্যাঁ, হ্যাঁ। আশেপাশে… কাছাকাছি… যত্ত সব!

শব্দ করে ফোন রেখে হালদারমশাই গোঁজ হয়ে বসলেন কর্নেল মৃদু স্বরে বললেন, পাখি নাকি?

হুঁঃ!

কথা-বলা পাখি?

হুঁঃ!

বুঝতে পারছিলুম, হালদারমশাই রেগে আগুন হয়ে আছেন এবং আনমনে হুঃ দিচ্ছেন শুধু। এবার কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, কথা-বলা পাখিটা কি কোদণ্ডগিরির জঙ্গল থেকে এনেছিলেন। হালদারমশাই?

কৃতান্ত হালদার তড়াক করে ঘুরে বললেন, আরে, ওটার ব্যাপারেই তো আসা আপনার কাছে। এখন দেখুন তো কী করি! আমার ভাগ্নে দুলালকে নজর রাখতে বলে এসেছিলুম। পর-পর দুরাত্তির বাড়িতে চোর আসছে। অদ্ভুত ব্যাপার, চোর জানালার ধারে দাঁড়িয়ে শিস দেয়। তখন পাখিটাও শিস দেয়। বড় রহস্যময় ব্যাপার নয়, কর্নেল?

রহস্যময় বলেই মনে হচ্ছে। তা পাখিটা পালাল কীভাবে?

দুলাল বলল, বাইরে কে ডাকছিল। গিয়ে দ্যাখে, কেউ না। তারপর ফিরে এসে দ্যাখে, বারান্দার খাঁচা খোলা। অথচ দেখুন, বারান্দায় গ্রিল আছে।

বাড়িতে আর কোনও লোক নেই?

আজ্ঞে না। হালদারমশাই নস্যির কৌটো বের করে অনেকটা নস্যি নাকে খুঁজে হাঁ করে রইলেন। কিন্তু হাঁচি এল না।

কর্নেল বললেন, পাখিটা কি কাকাতুয়া, না ময়না?

ময়না, হালদারমশাই করুণ মুখে বললেন। ওটার ব্যাপারেই আপনার সঙ্গে কনসাল্ট করতে আসা কর্নেলস্যার! আপনি ঠিকই ধরেছেন। কোদণ্ডগিরির জঙ্গলে একটা আদিবাসী ছেলে ফাঁদ পেতে পাখিটা ধরেছিল। কথা বলতে পারে দেখে কিনে নিয়েছিলুম।

তাহলে নিশ্চয় কারুর পোষা পাখি। উড়ে গিয়ে জঙ্গলে বেড়াচ্ছিল।

ঠিক বলেছেন। কিন্তু সেটা কোনও রহস্য নয়। রহস্য হল পাখিটার বুলি। প্রথমে বুঝতে পারিনি। পরে বুঝলুম, বলছে : মাই নেম ইজ গঙ্গারাম। আই অ্যাম কিচ্ছু বাই গঙ্গারাম। গঙ্গারাম কেন গঙ্গারামকে কিল করবে, এটা একটা রহস্য নয় স্যার?

অবশ্যই। কর্নেল পর্যায়ক্রমে টাক এবং সাদা দাড়িতে ঘন ঘন হাত বুলোতে থাকলেন।

বুঝলুম, রহস্যটা মনে ধরেছে আমার বৃদ্ধ বন্ধুর। তাতে আরও একটু জোগান দেওয়ার ইচ্ছেয় বললুম, রাত্তিরে চোর এসে শিস দিচ্ছিল বললেন হালদারমশাই!

হালদারমশাই বললেন, আর পাখিটাও পালটা শিস দিচ্ছিল! মজাটা বুঝুন একবার।

কর্নেল একটু হাসলেন। সুতরাং রহস্য ঘনীভূত হল বলা যায়।

আমি বললুম, হালদারমশাই, এর সঙ্গে সেই অদৃশ্য হতে পারা অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন সাধুর ব্যাপারটার কোনও যোগাযোগ নেই তো?

হালদারমশাই এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে নিয়ে চাপা স্বরে বললেন, আছে বলেই তো কর্নেলস্যারের কাছে আসা। ট্রেনে পাখিটাকে লুকিয়ে আনছিলুম। নইলে রেলবাবুরা আপত্তি করতেন। তো মাঝরাত্তিরে হঠাৎ চোখ খুলে দেখি, এক সাধু আমার বাংকের কাছে এসে উঁকিঝুঁকি মারছে। তড়াক করে উঠে বসেছি। আর অবাক কাণ্ড, সাধু অদৃশ্য। বেমালুম হাওয়া।

কর্নেল বললেন, আশা করি, স্বপ্ন দেখছিলেন না?

কখনও না। ট্রেন জার্নিতে আদপে আমার ঘুম হয় না।

আবার ফোন বাজল। কর্নেল ফোন তুলে সাড়া দিয়েই কৃতান্ত হালদারকে দিলেন। হালদারমশাই আগের মতো চড়া গলায় বললেন, দুলাল?…কী? লোম? সাদা ললাম? বলিস কী?…যাচ্ছি। এখনই যাচ্ছি।

ফোন ছেড়ে উত্তেজিতভাবে হালদারমশাই বললেন, কর্নেল, এক্ষুনি আমার সঙ্গে চলুন দয়া করে। খাঁচায় আর বারান্দা জুড়ে একগাদা সাদা লোম দেখতে পেয়েছে দুলাল। কী সাংঘাতিক রহস্য বুঝুন।

 

দুই

এই লোমরহস্য আমার তত সাংঘাতিক মনে হচ্ছে না হালদারমশাই, কর্নেল সাদা লোমগুলো পরীক্ষা করতে করতে বললেন। এগুলো নিছক বাঁদরের লোম। তবে সাধারণ বাঁদর নয়, খুদে বাঁদর। স্কুইরেল মাংকি বলে যাদের।

কৃতান্ত হালদার অবাক হয়ে বললেন, স্কুইরেল মানে তো কাঠবেড়ালি।

হ্যাঁ। কাঠবেড়ালির সঙ্গে অনেকটা মিল আছে বটে। বাঁদরটা দশ-বারো ইঞ্চি লম্বা। দিব্যি পকেটে রাখা যায়।

কিন্তু এখানে কোত্থেকে এল অমন উদ্ভুট্টে জীব? কিছু যে বোঝা যাচ্ছে না স্যার!

কর্নেল গ্রিল-দেওয়া বারান্দায় একটু ঘোরাঘুরি করে এদিকে-ওদিক দেখে নিয়ে বললেন, পাখিটার কিছু পালক পড়ে আছে দেখেও বুঝতে পারছেন না?

আমার বুদ্ধিসুদ্ধি গুলিয়ে গেছে, কর্নেল! বারান্দায় একটা চেয়ারে হতাশভাবে বসে পড়লেন হালদারমশাই। ডাক্তার পরের রোগ ধরে চিকিৎসা করেন। কিন্তু নিজের রোগ হলে অন্য ডাক্তার ডাকেন। কেন ডাকেন, হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি। উরেব্বাস! বিস্তর রহস্য ঘেঁটেছি, এবার আমাকেই রহস্য-রোগ এসে জাপটে ধরেছে।

কর্নেল হাসলেন। স্কুইরেল মাংকির লোম আর ময়নাপাখির পালক পড়ে থাকাটা মুল রহস্যরোগ নয়, হালদারমশাই! নেহাত উপসর্গ।

কখন থেকে মুখ খোলার জন্য উসখুস করছিলুম। এবার বললুম, ব্যাপারটা ধরতে পেরেছি মনে হচ্ছে।

কর্নেল বললেন, বলো ডার্লিং!

কেউ একটা ট্রেন্ড খুদে বাঁদর পাঠিয়ে পাখিটা খাঁচা থেকে হাতিয়ে নিয়েছে। মিথ্যা করে বাইরের দরজায় কলিং বেল টিপেছে। দুলাল দেখতে গেছে কে ডাকছে, আর এদিকে তার বাঁদর গ্রিলের ভেতর দিকে ঢুকে খাঁচা খুলে পাখিটা ধরেছে। পাখি আর বাঁদরে একটু ধস্তাধস্তি হওয়া স্বাভাবিক। তাই এসব লোম আর পালক।

কৃতান্ত হালদার লাফিয়ে এসে আমাকে জাড়িয়ে ধরলেন। শাবাশ জয়ন্তবাবু! শাবাশ! দেখছেন? এই সামান্য ব্যাপারটা কিছুতেই আমার মাথায় আসছিল না।

কর্নেল ততক্ষণে বাইরে চলে গেছেন। বাড়িটা একতলা এবং পুরনো পূর্ব শহরতলি এলাকার নিরিবিলি পরিবেশে অবস্থিত। আশেপাশে পোড় জঙ্গলে জমি, একটা পুকুর আর প্রচুর গাছপালাও রয়েছে। কিছু নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে এখানে-ওখানে। তার ওপরে একটা বিস্তীর্ণ মুসলিম গোরস্থান। এমন জায়গায় শুধু চোর কেন, ভূতপেরেতদেরও দিনদুপুরে হানা দেওয়া স্বাভাবিক।

হালদারমশাইয়ের ভাগ্নে শ্রীমান দুলালের বয়স পনেরো-ষােলোর বেশি নয়। সবে স্কুল-ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে। এখনও রেজাল্ট বেরোয়নি। মামার মতোই লম্বাটে ছিপছিপে গড়ন। মুখচোরা ছেলে বলে মনে হচ্ছিল। এই কাণ্ডের পর বেচারা ভীষণ মুষড়ে পড়েছে। দেয়ালে হেলান দিয়ে প্যাটপ্যাট করে তাকাচ্ছে খালি। আমার কথা শোনার পর সে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ। বাইরের দরজা খুলে কাউকে দেখতে না পেয়ে যখন রাস্তা দেখছি, পাখিটার চঁচামেচি কানে এসেছিল যেন। এতক্ষণে মনে পড়ল।

ভাগ্নেকে ভেংচি কেটে হালদারমশাই বললেন, আঁতক্ষণে মনে পড়ল! স্কুলে তুই স্ট্যান্ড করিস হাতি করিস! মুখস্থ বিদ্যের শিরোমণি! রিয়্যাল লাইফে তুই স্ট্যান্ড করতে পারবি ভেবেছিস? সে-গুড়ে বালি।

দুলালকে কাছে টেনে নিয়ে বললুম, আহা! মিছিমিছি ওকে বকবেন না হালদারমশাই! আপনি বাড়িতে একা থাকলেও একই ব্যাপার ঘটত না কি?

বুঝতে পেরে হালদারমশাই ধাতস্থ হলেন। গোঁফ চুলকে বললেন, কিন্তু মাই নেম ইজ গঙ্গারাম। আই অ্যাম কিল্ড বাই গঙ্গারাম। ব্যাপারটা কী বলুন তো? পাখিটা এমন উদ্ভুট্টে কথা শিখল কী করে? ধরে নিচ্ছি, কেউ শিখিয়েছে। কিন্তু গঙ্গারাম গঙ্গারামকে খুন করে কীভাবে? সুইসাইড মনে হয় না আপনার?

বললুম, হ্যাঁ, সুইসাইড ধরে নিলে একটা অর্থ দাঁড়ায়।

কর্নেল বাইরে থেকে ঘুরে এসে বললেন, এখানে আর কোনও সূত্র মিলবে না, হালদারমশাই! কোদণ্ডগিরিতে গেলে কিছু সূত্র মিলতেও পারে। পাখিটা যখন সেখানেই পেয়েছিলেন!

হালদারমশাই বললেন, তা না হয় যাওয়া গেল। কিন্তু গঙ্গারাম ইজ কিল্ড বাই গঙ্গারাম ব্যাপারটা যে আত্মহত্যা, তাতে জয়ন্তবাবু আর আমি একমত হয়েছি কর্নেল স্যার!

কর্নেল আনমনে বললেন, পাখির কথা ঠিকমতো বুঝতেও ভুল হতে পারে। আমি একবার শুনতে পেলে হয়তো বুঝতে পারতুম, ঠিক কী বলছে।

দুলাল নড়ে উঠল। আমি টেপ করে রেখেছি। শুনবেন? বলে দৌড়ে সে ঘরে গিয়ে ঢুকল। তারপর একটা টেপরেকর্ডার নিয়ে এল।

কৃতান্ত হালদার খি-খি করে হেসে বললেন, ওর জন্মদিনে আমার ছোটবোন—মানে ওর মাসি প্রেজেন্ট করেছে। দেখছেন কাণ্ড? পাখির কথা টেপ করে বসে আছে।

টেপ চালিয়ে দিল দুলাল। প্রথমে কিছুক্ষণ কাক আর চড়ুইদের ডাক শোনা গেল। তারপর শোনা গেল দুলালের গলা। নাও বিগিন মিঃ ব্ল্যাকি! বিগিন!..ও নো নো! প্লিজ মিঃ ব্ল্যাকি! তারপর শিসের শব্দ। ময়নাপাখির গায়ের রং কালো। ঠোঁট টুকটুকে হলুদ। দুলাল ওকে মিঃ ব্ল্যাকি নাম দিয়েছিল তাহলে! একটু পরেই ব্ল্যাকির কথা শোনা গেল : মাই নেম ইজ গঙ্গারাম। আই অ্যাম কিড্ড বাই গঙ্গারাম। একবার নয়। বার পাঁচ-ছয় একই কথা।

কর্নেল বললেন, আরেকবার টেপটা চালাও তো দুলাল।

দুলাল টেপটা উলটো দিকে ঘুরিয়ে নিল রিভার্স বোম টিপে। তারপর প্লে বোতামটা টিপল।

আবার সেইসব শব্দ। দুলালের কথা। তারপর পাখির গলা।

কর্নেল চোখ বুজে শুনছিলেন। দুলাল টেপ বন্ধ করে বলল, আবার চালাব কর্নেলদাদু?

কর্নেল একটু হেসে বললেন, না। হালদারমশাই, আপনি ভুল শুনেছেন।

ভুল? হালদারমশাই বললেন। সে কী! গঙ্গারামই তো বলল। তাই না জয়ন্তবাবু?

সায় দিয়ে বললুম, তাই তো মনে হল।

কর্নেল বললেন, পাখিটা বলছে, মাই নেম ইজ গঙ্গারাম। আই অ্যাম কি বাই বংকারাম।

বংকারাম! এমন নাম আবার হয় নাকি? গঙ্গারাম নাম শুনেছি বটে।

হয় ডার্লিং! কর্নেল একটু হাসলেন। কোদণ্ডগিরি তো ওড়িশায়। ওড়িশায় বংকাবিহারী, বংকারাম এসব নাম খুব কমন।

হালদারমশাই উত্তেজিতভাবে বললেন, তাহলে তো আর দেরি করা উচিত নয়, স্যার! এখনই

কোদণ্ডগিরি রওনা দিতে হয়।

একটু পরে হালদারমশাইয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লুম আমরা। বেলা প্রায় বারোটা বাজে। আমার সাদা ফিয়াট গাড়িটা আস্তেসুস্থে চালিয়ে আনছিলুম। দুদিন থেকে গণ্ডগোল করছে গাড়িটা। যখন-তখন অদ্ভুত শব্দ করতে করতে স্টার্ট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। একটু ঠেলে দিলে আবার স্টার্ট নিচ্ছে অবশ্য। ওবেলা গ্যারেজে না দিলেই নয়।

আজ হালদারমশাইয়ের বাড়ি আসার সময় কোনও গণ্ডগোল করেনি। কিন্তু ফেরার পথে সুন্দরীমোহন অ্যাভেনিউতে পৌঁছেই ঘড়ঘড় করতে করতে থেমে গেল। একটু হেসে বললুম, কর্নেল। ঠেলতে হবে।

কর্নেল গুম হয়ে বসে ছিলেন। চোখ বন্ধ এবং দাড়িতে আঙুলের চিরুনি। বুঝতে পারছিলুম, গোয়েন্দাপ্রবর গঙ্গারাম বনাম বংকারাম নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন। আমার কথায় চোখ খুলে বেজায় চমকানো গলায় বললেন, কী বললে?

ঠেলতে হবে। বলে দরজা খুলে সবে নেমেছি, অবাক হয়ে দেখলুম কর্নেলও হন্তদন্ত নামলেন বটে, কিন্তু নেমেই প্রকাণ্ড শরীর নিয়ে হঠাৎ দৌড়তে শুরু করেছেন। হকচকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। তারপর দেখি উনি সামনের বাসস্টপে সদ্য-এসে-দাঁড়ানো একটা বাসের পাদানিতে উঠে পড়লেন। তারপর বাসটা ছেড়ে গেল।

এতকাল ধরে ওঁর বিস্তর উদ্ভুটে আচরণ দেখে আসছি। কিন্তু এমনটি কখনও দেখিনি। রাগ করার মানে হয় না, বিশেষ করে এমন একটা ক্ষেত্রে। ফুটপাথের বাসিন্দা একদঙ্গল ছেলে আমার অবস্থা দেখে দৌড়ে এল। তাদের কিছু বলতে হল না। তারা গাড়িটা ঠেলতে শুরু করল। গাড়ি স্টার্ট নিলে তাদের বখশিশ দিয়ে নিজের ডেরায় ফিরে চললুম।

ছুটির দিন আজ। কাগজের আপিসে যাওয়ার তাড়া নেই। খেয়েদেয়ে অভ্যাসমতো ভাতঘুম দিয়ে যখন উঠে পড়লুম, তখন প্রায় পাঁচটা বাজে। মার্চের মাঝামাঝি বেশ গরম পড়েছে। লোডশেডিং না হয়ে গেলে ছটা অব্দি বিছানায় পড়ে থাকতুম।

ব্যালকনিতে বসে তারিয়ে-তারিয়ে চা খাচ্ছি, আমার রাঁধুনি-কাম-কাজের ছেলে ফটিক এসে বলল, সেই দাড়িওলা সায়েব এসেছেন দাদাবাবু!

তারপর কর্নেলের গলা শুনতে পেলুম ডার্লিং, আশা করি এ বুড়োর ওপর থেকে রাগটা এতক্ষণে পড়ে গেছে। হুঁ, মুখের অবস্থা দেখে বুঝতে পারছি, প্রিয় ভাতঘুমখানা চমৎকারই হয়েছে। রাগের পক্ষে নিরেট একখানা ঘুমই যথেষ্ট। যাই হোক, ঝটপট তৈরি হয়ে নাও। কোদণ্ডগিরি এক্সপ্রেস ট্রেন সওয়া ছটায় ছাড়বে হাওড়া থেকে। ভাগ্যিস মিঃ রাঘবনকে ফোনে পেয়েছিলুম। আস্ত একখানা কুপের ব্যবস্থা করা গেছে। কর্নেল আমার কাঁধে থাবা হাঁকড়ালেন। উঠে পড়ো, উঠে পড়ো! হালদারমশাই এতক্ষণে স্টেশনে পৌঁছে হাপিত্যেশ করছেন আমাদের জন্য।

কিছুক্ষণ পরে ট্যাক্সিতে যেতে যেতে ভাবলুম, তখন অমন করে হঠাৎ আমাকে ফেলে পালিয়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইব। কিন্তু গোয়েন্দাপ্রবর তখনকার মতো চোখ বুজে দাড়িতে আঙুলের চিরুনি চালাচ্ছেন এবং বলা যায় না, তখনকার মতোই যদি হঠাৎ রোকে বলে ট্যাক্সি থামিয়ে

আবার বেমক্কা অদৃশ্য হয়ে যান। ওঁকে বিশ্বাস নেই। অতএব চেপে গেলুম।

দশ নম্বর প্ল্যাটফর্মের গেটে কৃতান্ত হালদার দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমাদের দেখে উত্তেজিতভাবে চাপা গলায় বললেন, পাখি বাঁদর সাধু! সব একত্র, সব!

কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, একবার শরীরী, একবার অশরীরী? এই আছে, এই নেই!

হাত প্রচণ্ড নেড়ে হালদারমশাই ফিসফিস করে বললেন, আপন্ গড। একটু আগে এক সাধু আমার দিকে চোখ কটমট করে তাকাতে তাকাতে প্ল্যাটফর্মে ঢুকল। তার কাঁধের ঝোলায় স্পষ্ট দেখলুম একটুকু একটা বাঁদরের মুণ্ডু উঁকি মেরে আছে।

বললুম, আর পাখি?

কর্নেলের পিছন-পিছন হালদারমশাই প্ল্যাটফর্মে ঢুকে তেমনি ফিসফিসিয়ে বললেন, পাখিটা নির্ঘাত ঝোলার ভিতর আছে। এটা অঙ্কের ব্যাপার, বুঝলেন না? সাধু আর বাঁদর যেখানে, পাখি সেখানে থাকতে বাধ্য। আর জানেন? সাধু একা নয়, তার সঙ্গে একজন চেলাও আছে দেখলুম।

কোদণ্ডগিরি এক্সপ্রেস দাঁড়িয়ে ছিল প্ল্যাটফর্মে। আমাদের কুপেটা পিছনে গার্ডের কামরার লাগোয়া। সামনে একটা গুডস কম্পার্টমেন্ট। ছোট্ট কুপে মাত্র তিনটে বাংক। জিনিসপত্র রেখে আমি ও কর্নেল বসে পড়লুম! হালদারমশাই সাধুবাবাকে খুঁজতে গেলেন। গাড়ি ছাড়ার এখনও মিনিট-দশেক দেরি আছে। ভাবলুম, ট্রেন ছাড়লে তবে কর্নেলের অমন করে ছুটে গিয়ে বাসে ওঠার ব্যাপারটা তুলব। কর্নেল আর যাই করুন চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ দেবেন না নিশ্চয়।

কর্নেল চুরুটের বাক্স বের করে পছন্দসই একটা চুরুট বেছে নিলেন। তারপর লাইটার জ্বেলে চুরুটটা ধরিয়ে একরাশ ধোঁয়ার মধ্যে হঠাৎ বললেন, ডঃ সীতাকান্ত পট্টনায়কের কথা তোমার মনে থাকা উচিত, ডার্লিং।

একটু অবাক হয়ে বললুম, খুব মনে আছে। ফরেনসিক এক্সপার্ট সেই ওড়িয়া ভদ্রলোক তো?

শুধু ফরেনসিক এক্সপার্ট নন উনি, বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাতেও ওঁর অগাধ জ্ঞান। যেমন ধরো, আণবিক জীববিজ্ঞান জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান। এমনকী, সম্প্রতি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর ওঁর একটা গবেষণাপত্র বিদেশে খুব হইচই সৃষ্টি করেছে। এমন অল-রাউন্ডার জিনিয়াস সচরাচর দেখা যায় না—বিশেষ করে যুগটা যখন স্পেশালিস্টদেরই, তখন এতগুলো বিদ্যায় যিনি সমান স্পেশালিস্ট তাঁকে এতদিন কেন নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয়নি, জানি না।

কর্নেলের বক্তব্যের উদ্দেশ্য বুঝতে না পেরে বললুম, দেবেখন। কিন্তু হঠাৎ ডঃ পট্টনায়কের কথা কেন?

কর্নেল হাসলেন। সম্প্রতি ডঃ পট্টনায়ক কলকাতা এসেছেন। সুন্দরীমোহন অ্যাভেনিউতে ফরেনসিক ল্যাবরেটরি এবং ডিটেকটিভ ট্রেনিং সেন্টারটা তুমি দেখে থাকবে, জয়ন্ত। আজ রবিবার বারোটায় ওঁর সেখানে একটা লেকচার দেওয়ার কথা ছিল।

কী কাণ্ড! হাসতে হাসতে বললুম। তাই হঠাৎ অমন করে দৌড়ে গেলেন—

আমার কথা কেড়ে কর্নেল বললেন, তুমি যেই বললে ঠেলতে হবে অমনি প্রাচীন গ্রিক বিজ্ঞানী আর্কিমেডিসের মতো আমার মাথা খুলে গিয়েছিল। সেই ইউরেকা ব্যাপারটা ঘটে গিয়েছিল আর কি! তক্ষুনি ফরেনসিক ল্যাবরেটরির হলে পৌঁছে ডঃ পট্টনায়কের কানে কানে বললুম, রহস্য ফাঁস করেছি ডঃ পট্টনায়ক! PUSHPA শব্দটা আসলে PUSH PANEL A অর্থাৎ এ-মার্কা প্যানেলটা ঠেলতে হবে। খামোখা পুষ্প বা ফুল নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিলুম।

কিন্তু জিনিসটা কী?

জিনিসটা আজ সকালে তুমি আমার হাতে দেখেছ, ডার্লিং!

ভ্যাট! ওটা তো একটুকরো হাড় বলে মনে হচ্ছিল, কিংবা পাথুরে ফসিল!

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, মোটেও না জয়ন্ত। ছোট্ট মাউথ অর্গানের মতো জিনিসটা আসলে একটা রিমোট কন্ট্রোল যন্ত্র। দুটো প্যানেলে ভাগ করা, এ এবং বি। এ-কে ঠেলে দিতেই ওটা চালু হয়ে গেল। কিন্তু আমার বা ডঃ পট্টনায়কের তো জানা নেই মূল কোন যন্ত্রকে এটা চালিত করে দূর থেকে। তাই সঙ্গে সঙ্গে বি প্যানেলটা ঠেলে নিষ্ক্রিয় করে দিলুম। হ্যাঁ তোমাকে বলা উচিত, এই অদ্ভুত যন্ত্রটা মাস দুই আগে পট্টনায়কই কুড়িয়ে পেয়েছিলেন পার্বতী নদীর বালির চড়ায়। বালিতে প্রায় পুরোটা ঢাকা অবস্থায় ছিল। কিন্তু সিলিকন ধাতুর পাতে মোড়া। তাই ময়লা হয়ে গেলেও নষ্ট হয়ে যায়নি।

পার্বতী নদীর নাম তো কখনও শুনিনি! সেটা আবার কোথায়?

কোদণ্ডগিরি এলাকায়।

কী? আমি নড়ে বসলুম এবং ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম!

কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, সুতরাং হালদারমশাই আসার আগেই কোদণ্ডগিরি যাত্রার জন্য তৈরি হচ্ছিলুম ভেতর-ভেতর। যথাসময়ে জানতে পারতে। আশা করি, কাল সকালের মধ্যে ডঃ পট্টনায়কও প্লেনে ভুবনেশ্বর পৌঁছে যাবেন। কোদণ্ডগিরি টাউনশিপে আমাদের সাক্ষাৎ হবে। তারপর কাজে নামব আমরা।

এই সময় হালদারমশাই হাঁফাতে হাঁফাতে এসে পড়লেন। চাপা গলায় বললেন, সাধু, পাখি, বাঁদর-সব একত্র। সামনে দুটো কম্পার্টমেন্টের পরেরটায় উঠেছে। কর্নেলস্যার! রহস্য একেবারে জমজমাট।

 

তিন

হালদারমশাই বলেছিলেন, ট্রেন জার্নিতে তার নাকি আদপে ঘুমই হয় না। অথচ সারা পথ দেখলুম, দিব্যি নাক ডাকিয়ে ওপরের বাংকে ঘুমোচ্ছেন। ভোর সাড়ে-ছটায় কোদণ্ডগিরি স্টেশনে যখন ট্রেন ঢুকছে, তখন উনি ঘুমে কাঠ। ওঁকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেওয়ামাত্র তড়াক করে উঠে বসলেন এবং বললেন, খড়গপুর এল মনে হচ্ছে।

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, না হালদারমশাই, কোদণ্ডগিরি এসে গেছি। নিন, উঠে পড়ুন।

হালদারমশাই আঁ বলে দমাস করে বাংক থেকে লাফ দিলেন। ট্রেন তখনও থেমে যায়নি। সে অবস্থায় দরজা খুলে প্ল্যাটফর্মে আর একটা ঝাঁপ দিলেন। আছাড়ও খেলেন দেখলুম। তারপর আর ওঁকে দেখতে পেলুম না। বুঝলুম সাধু, পাখি ও বাঁদরের খোঁজেই উধাও হলেন।

সত্যিই উধাও। প্ল্যাটফর্মে বিস্তর তেঁড়াছুঁড়ি করেও আর ওঁর পাত্তা পাওয়া গেল না। অগত্যা ওঁর বোঁচকা আমাকেই বইতে হল। কর্নেলকে কিন্তু একটুও উদ্বিগ্ন মনে হল না। নির্বিকার মুখে বললেন, চলো জয়ন্ত, আমাদের এখন প্রায় বারো কিলোমিটার পাড়ি জমাতে হবে। হালদারমশাইয়েরই ভাগ্নেবাড়ি। কাজেই যথাসময়ে উনি পৌঁছে যাবেন।

একটা অটো-রিকশো ভাড়া করে আমরা রওনা দিলুম। আমার কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও ভাল ঠেকছিল না। হালদারমশাই কোনও বিপদে পড়েননি তো? কর্নেল সেটা আঁচ করে মৃদু হেসে বললেন, ভেবো না জয়ন্ত! হালদারমশাই সারা জীবন পুলিশে চাকরি করেছেন। তত নিরীহ মানুষ নন।

তবু আমার উদ্বেগ রয়ে গেল। স্টেশনের আশেপাশে খনি এলাকা। চারদিকে রুক্ষ টিলা পাহাড় আর কলকারখানা। অনেকটা গিয়ে তারপর সবুজের ছোপ চোখে পড়ল। পুরনো কোদণ্ডগিরি আসলে একটা গ্রাম। তার পাশে দিয়ে হাইওয়ে চলে গেছে। পার্বতী নদীর ব্রিজ পেরিয়ে টাউনশিপ শুরু। এটাই নতুন কোদণ্ডগিরি এবং চেহারা-চরিত্রে আধুনিক শহর। এবার উঁচু পাহাড় চোখে পড়ছিল। টাউনশিপটা সেই সব পাহাড়ের মাঝখানে এক উপত্যকায় গড়ে উঠেছে।

টাউনশিপ ছাড়িয়ে আবার পার্বতী নদী চোখে পড়ল। একেবারে নদীর ধারেই একটা টিলার গায়ে সুন্দর ছবির মতো একটা বাংলোবাড়ি দেখিয়ে কর্নেল বললেন, ওই দ্যাখো জয়ন্ত, ওটাই কোদণ্ডগিরি ফরেস্ট কনজারভেটর প্রদীপ রায়ের বাংলো। আমাদের হালদারমশাইয়ের অসংখ্য ভাগ্নের একজন।

বলে উনি বাইনোকুলারে সম্ভবত পাখি খুঁজতে থাকলেন। হাইওয়ে ছেড়ে আমাদের অটো-রিকশো প্রাইভেট রোডে ঢুকল। রাস্তাটা এঁকেবেঁকে টিলায় উঠেছে। গেটের কাছে একজন শক্তসামর্থ গড়নের এবং সাদা স্পোর্টিং শার্ট, শর্টস ও টেনিস জুতো পরা ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার মাথার টুপিটাও সাদা। আমাদের হাসিমুখে অভ্যর্থনা করে নিয়ে গেলেন। ইনিই প্রদীপ রায়।

প্রদীপবাবু একটু হেসে বললেন, একটু আগে মামাবাবু ফোন করছিলেন স্টেশন থেকে। একটা কাজে আটকে গেছেন। পৌঁছুতে সামান্য দেরি হতে পারে। অবশ্য আপনাদের খবরও মামাবাবু জানিয়ে দিয়েছেন। আমি দুঃখিত, কাল থেকে আমার জিপটা গ্যারাজে। নইলে আপনাদের আনার জন্য পাঠিয়ে দিতুম।

তাহলে গোয়েন্দাগিরিতে পুরোপুরি নেমে পড়েছেন হালদারমশাই। হেস্তনেস্ত না করে ছাড়বেন না। বাংলোর দক্ষিণ-পূর্ব কোনার সবচেয়ে সুন্দর ঘরখানায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছেন প্রদীপবাবু। দ্রুত ব্রেকফাস্ট খাইয়ে দিলেন আমাদের। তারপর কফির পেয়ালা হাতে গল্প করতে থাকলেন আমাদের সঙ্গে। আমাদের আসার কথা গতকাল বিকেলেই ট্রাঙ্ককল করে জানিয়ে দিয়েছেন হালদারমশাই। ভুবনেশ্বর থেকে ডঃ সীতাকান্ত পট্টনায়কের আসার কথাও বলেছেন।

আমরা দক্ষিণের বারান্দায় বসে ছিলুম। পার্বতী নদী এই টিলার পূর্ব ও দক্ষিণ দিয়ে বইছে। কিছুটা এগিয়ে বাঁক নিয়ে পাহাড়ের ভেতর অদৃশ্য হয়েছে। নদীটা মাঝারি গড়নের। বিশেষ জল নেই, খালি বালি আর পাথরে ভর্তি। ওপারে ঘন জঙ্গল দেখা যাচ্ছিল। কাছে এবং দূরে প্রায় সব পাহাড়ই জঙ্গলে ঢাকা। এই জঙ্গল পুরোটাই সংরক্ষিত এবং পশুপাখিদের অভয়ারণ্য। তাই গাছ কাটতে দেওয়া হয় না। প্রদীপবাবু বলছিলেন, তবু লুকিয়ে গাছ কেটে নিয়ে যায় তোক। চোরাশিকারিদেরও খুব উপদ্রব। কালই একটা শম্বর মেরেছিল। নিয়ে যেতে পারেনি ফরেস্ট গার্ডদের তাড়া খেয়ে। শেষে শম্বরের মাংসটা আদিবাসীদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হল। এই জঙ্গলকে ওরা প্রাণ দিয়ে ভালবাসে। তাই চোরাশিকারি বা গাছ চোরদের দেখলে ওরা নিজেরাই তাড়া করে, আবার খবরও দিয়ে যায় চুপিচুপি।

কর্নেল হঠাৎ বললেন, আপনার মামাবাবু একটা ময়নাপাখি কিনেছিলেন এখানে। পাখিটা নাকি অদ্ভুত কথা বলে!

প্রদীপবাবু বললেন, হ্যাঁ—পাখিটা চুরি গেছে শুনলুম। ব্যাপারটা ভারি অদ্ভুত, জানেন? দিন-পনেরো আগে মামাবাবু এসেছিলেন বেড়াতে যাওয়ার দিন জঙ্গলে কোথায় একটা আদিবাসী ছেলের কাছে পাখিটা কেনেন। পাখিটা আর কোনও কথা বলে না। খালি বলে, মাই নেম ইজ গঙ্গারাম। আই অ্যাম কিচ্ছু বাই গঙ্গারাম। গঙ্গারাম কে, কে জানে! আর গঙ্গারাম গঙ্গারামকে খুন করল, এর মানেই বা কী?

কর্নেল বললেন, উঁহু ভুল শুনেছেন। কথাটা হবে আই অ্যাম কি বাই বংকারাম। গঙ্গারাম নয়।

 

চার

প্রদীপবাবু চমকে উঠে বললেন, বংকারাম! কী আশ্চর্য!

কর্নেল বললেন, চেনেন নাকি বংকারামকে?

চিনতুম—খুবই চিনতুম, প্রদীপবাবু অবাক হয়ে বললেন। ওঁকে এখানকার লোকে বাবু বংকারাম সেনাপতি বলে জানত। রাজাগজা লোক বললেই চলে। পুরনো কোদণ্ডগিরিতে ওঁর বাড়ি। ওঁর পূর্বপুরুষেরা নাকি এই কোদণ্ডগিরি পরগনার শাসক ছিলেন। পরে রাজত্ব ঘুচে গিয়েছিল ইংরেজের কোপে পড়ে। সেটা ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের সময়কার ঘটনা। যাই হোক, বাবু বংকারাম ছিলেন দুর্ধর্ষ প্রকৃতির লোক। পুলিশের খাতায় খুনে ডাকাত বলে নাম লেখা ছিল। কিন্তু পুলিশ ওঁকে কিছুতেই ধরতে পারছিল না। গত বছর মার্চ মাসে জঙ্গলের ভেতর একটা ঝরনার কাছে দেখি, একটা খাকি পোশাক পরা লোক রাইফেল হাতে নিয়ে বসে আছে। এ জঙ্গলে শিকারের পারমিশন দেওয়া হয় না। তাই সোজা গিয়ে চার্জ করলুম। লোকটা আমাকে গ্রাহ্যই করল না। বলল, আমি কে জানো? বাবু বংকারাম সেনাপতির নাম শুনেছ? আমি সেই! শুনে তো ভয় পেয়ে গেলুম। ওঁকে ঘাঁটাতে সাহস হল না। তাছাড়া আমি নিরস্ত্র এবং একা ছিলুম। তাই চুপচাপ চলে এলুম। দিন দুই পরে হঠাৎ বাবু বংকারাম সন্ধ্যার সময় আমার এই বাংলোয় হাজির। তাঁকে খাতির করে বসালুম। বাবু বংকারাম বললেন, আমার উপর খুব খুশি হয়েছেন। কারণ পুলিশের কানে তুলিনি যে, ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। এখন আসল কথাটা হল, জঙ্গলের ভেতর ওঁর কিছু গোপন কাজকর্ম আছে। জঙ্গলের রেঞ্জার বা গার্ডদের যেন আমি সাবধান করে দিই, ওঁকে দেখতে পেলেও যেন না ঘটায় এবং পুলিশের কানে না তোলে। আদিবাসীরা ওঁর ভক্ত। কাজেই তারা এঁর বিরুদ্ধে কিছু করবে না।

প্রদীপবাবু দম নিয়ে ফের বললেন, তার কিছুদিন পরে সেই ঝরনার ধারে বাবু বংকারামের ডেডবড়ি পাওয়া গেল।

কর্নেল নড়েচড়ে বসলেন। বললেন, ডেডবডি?

হ্যাঁ। গলায় একটা মিহি নাইলনের দড়ির ফাঁস অটকানো। জিভ বেরিয়ে রয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, দড়িটা অন্তত সাত-আট মিটার লম্বা। কেউ যেন অতটা দূর থেকে হ্যাচকা টানে শ্বাস রুদ্ধ করে ওঁকে মেরে ফেলেছে।

আমি বললুম, আত্মহত্যা নয় তো?

প্রদীপবাবু জোর গলায় বললেন, কক্ষনো নয়। অমন মিহি দড়ি—প্রায় সুতোই বলতে পারেন, তা দিয়ে আত্মহত্যা করা যাবে কীভাবে? গাছের ডালে বেঁধে ঝুলে পড়লেই তো ছিঁড়ে যাবে। তাছাড়া জায়গাটা ফাঁকা। ঝোপঝাড় অবশ্য আছে প্রচুর। কিন্তু কাছাকাছি দশ-বারো বর্গমিটারের মধ্যে কোনও উঁচু গাছই নেই।

কর্নেল বললেন, রাইফেলটা?

ওঁর রাইফেলটার কথা বলছেন কি? নাঃ, ওটা পাওয়া যায়নি। যে ওঁকে ফাঁস আটকে মেরেছিল, সম্ভবত সেই নিয়ে পালিয়েছিল। পুলিশের সন্দেহ, কাজটা গোপেশ্বর নামে ওঁর এক স্যাঙাতের। সে-ও সাংঘাতিক লোক।

কর্নেল দাড়ি চুলকে বললেন, তাহলে দেখা যাচ্ছে, পাখিটার কথা যদি সত্যি হয়, গঙ্গারামকে বংকারাম খুন করেছিল এবং শেষে বংকারামকেও কেউ খুন করল।

আমি বললুম, গঙ্গারামের অনুগত গোপেশ্বর প্রতিশোধ নিয়ে থাকবে।

প্রদীপবাবু হাসতে হাসতে বললেন, মামাবাবু যদি পাখিটার কথা বুঝতে ভুল না করতেন, তাহলে বাবু বংকারামের হত্যা-রহস্য নিয়ে উঠে-পড়ে লাগতেন।

কর্নেল বললেন, আপাতত আপনার মামাবাবু গঙ্গারামের হত্যারহস্য নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছেন। দেখা যাক, কত দূর এগোতে পারেন। তবে এটুকু বলতে পারি, শেষ পর্যন্ত বংকারামের হত্যারহস্যেই জড়িয়ে পড়বেন হালদারমশাই—বিশেষ করে সাধু, পাখি, আর বাঁদরের নাগাল যখন পেয়ে গেছেন।

সাধু, পাখি আর বাঁদর? সে আবার কী?

কর্নেল সংক্ষেপে ঘটনাটা বললেন। শোনার পর প্রদীপবাবু খুব অবাক হয়ে গেলেন। বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, –সাধুর ব্যাপারটা কিন্তু সত্যি আশ্চর্য, জানেন? ইদানীং সারা এলাকা জুড়ে খালি ওই নিয়ে আলোচনা। যাকে জিজ্ঞেস করবেন, সে-ই বলবে, সে স্বচক্ষে দেখেছে এক সাধুবাবা হঠাৎ তার সামনে দেখা দিয়েই নাকি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন।

কর্নেল বললেন, আপনার মামাবাবুও নাকি দেখেছেন স্বচক্ষে!

হ্যাঁ–মামাবাবু নাকি জঙ্গলের ভেতর সেই ঝরনার কাছে দেখেছেন। আর লোকেরা দেখেছে রাস্তাঘাটে, বাড়ির দরজায়, কিংবা নিরিবিলি গাছতলায়। এমনকী, আমার রাঁধুনি হলধর ঠাকুর দেখেছে কিচেনের জানালার বাইরে। ডাকব নাকি ওকে? প্রদীপবাবু হাসতে লাগলেন।

না, থাক, কর্নেল বললেন। ব্যাপারটা সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?

প্রদীপবাবু একটু ভেবে নিয়ে বললেন, সমস্যা হচ্ছে, মামাবাবুকে অবিশ্বাস করতে বাধছে। নইলে নিছক গুজব বলেই উড়িয়ে দিতে পারতুম। মামাবাবু অবশ্য ভুল দেখতে পারেন, তাও ঠিক। তবে ঝরনার ওখানে পাহাড়ের ওপর এক সাধুকে নাকি আমাদের গার্ডরা কয়েকবার দেখেছিল। অদৃশ্য হতে দেখেনি যদিও। কিন্তু–

কর্নেল বললেন, কিন্তু?

প্রদীপবাবু একটু হাসলেন। ওই ঝরনা সম্পর্কে এখানে খুব ভয়ঙ্কর সব গল্প আছে। জায়গাটা নাকি ভূতের বাথান। রাতবিরেতে আলো-টালো দেখা যায়। হ্যাঁ, আলো আমি নিজেও দেখেছি কয়েকবার। কিন্তু কাল দিনদুপুরে একটা ব্যাপার দেখে খুব অবাক হয়ে গেছি।

কর্নেল সোজা হয়ে বসে বললেন, বলুন।

কালকের ব্যাপারটা খুবই আশ্চর্য, জানেন? প্রদীপবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন। তখন প্রায় একটা বাজে। সবে খাওয়া-দাওয়া করে এই বারান্দায় এসে বসেছি, হঠাৎ দেখি কী— বলে উনি হাত বাড়িয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে আঙুল নির্দেশ করলেন। ওই যে ছুঁচলো অদ্ভুত গড়নের পাহাড়টা দেখতে পাচ্ছেন—নিচের দিকটা কতকটা পিরামিডের মতো আর মাথাটা গির্জার চূড়া বা মিনারের মতো উঠে গেছে?

দেখতে দেখতে বললুম, কী আশ্চর্য! আমি তো ওটা পাহাড়ের ওপর বাদশাহি আমলের কোনও মসজিদের মিনার বলে ভাবছিলুম। আগ্রার কাছে ঠিক এমনি একটি স্থাপত্য দেখেছি।

প্রদীপবাবু বললেন, না। ওটা একটা প্রাকৃতিক স্থাপত্যই বলতে পারেন। লক্ষ্য করে দেখুন, পাহাড়টা যেন বাণ-লাগানো বিশাল এটা ধনুক। কোদণ্ড মানে ধনুক। স্বয়ং শিবের ধনুক। আর গিরি হল পাহাড়। ওই পাহাড়টারই নাম তাই কোদণ্ডগিরি। তাই থেকে এলাকা এবং জনপদটার নামও হয়েছে কোদণ্ডগিরি। তা গতকাল বেলা একটা নাগাদ হঠাৎ দেখি কী, ওই ছুঁচলো চুড়ো থেকে একটা গোলমত প্রকাণ্ড জিনিস আকাশে ছিটকে গেল। ছাইরঙা মস্ত বড় একটা গোলা যেন। মাত্র কয়েক সেকেন্ড সেটা ভেসে রইল আকাশে। তারপর নেমে এল চুড়ার মাথায়। তারপর আর দেখতে পেলুম না। ভাবলুম চোখের ভুল নাকি!

কর্নেল নিস্পলক চোখে তাকিয়ে ছিলেন। বললেন, একটা বাজে তখন?

হ্যাঁ! প্রায় একটা।

জিনিসটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য দেখেছিলেন! আজ্ঞে হ্যাঁ।

ছাইরঙের গোলাকার জিনিস?

হ্যাঁ, প্রকাণ্ড। এখান থেকে ওই পাহাড়টার দূরত্ব প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। ঝরনাটা আছে ঠিক তার নিচেই।

মিঃ রায়, আপনি নিশ্চয় চন্দ্র-অভিযানের লুনার মডিউলের ছবি দেখেছেন, কিংবা আমাদের দেশ মহাকাশে যেসব কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়েছে, তাদেরও ছবি দেখেছেন?

প্রদীপবাবু চোখ বড় করে বললেন, মাই গুডনেস! আপনি–

কর্নেল একটু হেসে বললেন, আপনি সম্ভবত ওই ধরনেরই কোনও জিনিস দেখে থাকবেন। এমনও হতে পারে, জিনিসটা আধুনিক কোনও আকাশযান। তথাকথিত উড়ন্ত চাকি বা ফ্লাইং সোরের মডেলে তৈরি।

সে কী! প্রদীপবাবু নড়ে বসলেন।

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। কাল বেলা একটা নাগাদ কয়েক সেকেন্ডের জন্য দেখেছেন তো? বলে পা বাড়ালেন ঘরের দিকে। আমার ধারণা, আমি আপনাদের হয়তো একটা বিস্ময়কর ম্যাজিক দেখাতে পারব। অন্তত নিরানব্বই শতাংশ চান্স আছে। কর্নেল পরদা তুলে ঘরে ঢুকে গেলেন।

একটু পরে বেরিয়ে এলেন। হাতে গতকাল সকালে দেখা সেই হাড়ের টুকরো অথবা মাউথ অর্গান অথবা রিমোট কন্ট্রোল যন্ত্র নিয়ে। চেয়ারে বসে বললেন, দেখা যাক, কী ঘটে। মিঃ রায়, জয়ন্ত! তোমরা ওই ছুঁচলো পাহাড়টার দিকে লক্ষ্য রাখো। রেডি—ওয়ান, টু, থ্রি!

আমাদের চোখের সামনে সকালবেলার উজ্জ্বল রোদে পাঁচ কিলোমিটার দূরের ওই পাহাড়ের ছুঁচলো ডগা থেকে একটা গোলাকার ধূসর রঙের প্রকাণ্ড জিনিস ছিটকে গেল আকাশে। স্থির ভেসে রইল। কর্নেল বললেন, বেশিক্ষণ এই ম্যাজিক দেখানো ঠিক নয়। আরও কারুর চোখে পড়তে পারে। অতএব ম্যাজিকের খেলা সাঙ্গ হল। জয়ন্ত, এই খেলাটার নাম দিলাম, কোদণ্ডের টঙ্কার।

গোলাটা নেমে এসে যেন চূড়ায় মিশে গেল। শ্বাস ছেড়ে বললুম, PUSH PANEL A এবং PUSH PANEL B-এর জাদু। কোদণ্ডের টঙ্কার।

ঠিক বলেছে ডার্লিং! বলে কর্নেল প্রদীপবাবুর দিকে ঘুরলেন। প্রদীপবাবু হতবাক হয়ে বসে আছেন।

উনি মুখ খুলতে যাচ্ছেন, এমন সময় ওঁর মালি এসে সেলাম দিয়ে বলল, গেটের কাছে এই চিঠি লটকানো ছিল, স্যার। প্রদীপবাবু চিঠিটা খুলে পড়ে ভীষণ গম্ভীর মুখে কর্নেলকে এগিয়ে দিলেন। উঁকি মেরে দিখে, ইংরেজিতে যা লেখা আছে, তার মানে হল : তোমার আঙ্কেলকে আমরা আটকে রেখেছি। রাত দশটায় ঝরনার কাছে একা দেখা করবে। তখন কথা হবে। সাবধান, গণ্ডগোল বাধানোর মতলব করলে আঙ্কেলের মুণ্ডু উপহার পাবে।

 

পাঁচ

বেনামী চিঠিটা পেয়ে প্রদীপবাবু খুব মুষড়ে পড়েছিলেন। কর্নেল ওঁকে আশ্বাস দিয়ে আমাকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছিলেন। ডঃ সীতাকান্ত পট্টনায়ক দুপুরের আগে এসে পৌঁছতে পারবেন বলে মনে হয় না। ততক্ষণ একটু ঘোরাঘুরির ইচ্ছে হয়েছিল কর্নেলের। রাস্তায় একটা খালি অটো-রিকশো পাওয়া গিয়েছিল। পুরনো কোদণ্ডগিরিতে পৌঁছে কর্নেল হিন্দিতে রাস্তার একটা লেককে জিজ্ঞেস করলেন, বাবু বংকারাম সেনাপতির বাড়িটা কোথায়?

লোকটা অবাক হয়ে আমাদের দেখতে দেখতে বলল, বাবু বংকারাম তো মারা গেছেন গত বছর।

জানি। তার বাড়িতে তো লোকজন আছে।

লোকটা আরও অবাক হয়ে বলল, কেউ নেই। আর বাড়ি তো শুধু নামেই। চলে যান সিধে রাস্তা ধরে। জঙ্গলের ভেতরে ভাঙা দালানবাড়ি দেখতে পাবেন।

গ্রামটা এক সময় হয়তো সমৃদ্ধ ছিল। এখন প্রায় জনহীন ছন্নছাড়া বসতি। যারা বাস করছে, তাদের বোধহয় অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগ নেই। আগাছার জঙ্গল, ধ্বংসস্তুপ তার মধ্যে একটা করে কুঁড়েঘর। কিছুটা যাওয়ার পর ডান দিকে গাছপালা আর ঝোপের ভেতর একটা ভাঙা দেউড়ি দেখা গেল। লতাপাতায় ঢাকা দেউড়ির পাশ দিয়ে সাবধানে এগিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় পৌঁছলুম আমরা। সামনে, ডাইনে, বাঁয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা ঘরগুলোর বুকে ঘন আগাছা গজিয়ে উঠেছে। কর্নেল চারিদিক দেখতে দেখতে আনমনে বললেন, আশ্চর্য তো!

জিজ্ঞেস করলুম, আশ্চর্যটা কী?

কর্নেল একটু হাসলেন। ডাকাত হওয়ার আগে বাবু বংকারাম নিশ্চয় এই বাড়িতে বাস করতেন। কিন্তু থাকার মতো আস্ত কোনও ঘর তো দেখতে পাচ্ছি না। লক্ষ্য করে দ্যাখো জয়ন্ত, এসব ঘর অন্তত পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে ভেঙে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে।

তাই হচ্ছে বটে, কিন্তু এই ভূতের আস্তানায় আপনার হানা দেওয়ার উদ্দেশ্য খুঁজে পাচ্ছি না।

কর্নেল আমার কথার জবাব না দিয়ে পা বাড়ালেন। একটু তফাতে একটা ফোকর দেখা যাচ্ছিল। ফোকরটা লতাপাতায় প্রায় ঢাকা পড়েছে। আমি বারণ করার আগেই কর্নেল গুড়ি মেরে ঢুকে পড়লেন। অগত্যা আমি ওঁকে অনুসরণ করলুম। একটা সুড়ঙ্গ পথই বলা যায়। দিনদুপুরে আঁধার হয়ে আছে। একটু পরে সামনেটা ফাঁকা হয়ে গেল। একটা ছোট চত্বরে পৌঁছলুম আমরা। কর্নেল বললেন, এদিকটাই ছিল বাড়ির অন্দরমহল।

এখানেও একই অবস্থা। উঁচু সব ধ্বংসস্তুপ চারপাশে আগাছা আর লতাপাতার ঝালরে ঢাকা। বুনো ফুলের কড়া গন্ধ মউমউ করছে এই ধ্বংসপুরীতে। পাখপাখালির ডাকাও শোনা যাচ্ছে। কিন্তু কর্নেলের এখন পাখি দেখার মন নেই। এমনকী ওঁর দাড়ি ঘেঁসে প্রজাপতিও আনাগোনা করছে, যেন দেখতেও পাচ্ছেন না। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে ওপাশ থেকে একটা বটগাছের ডালপালা ঝুঁকে এসেছে আমার মাথার উপর। হঠাৎ উপর থেকে কী-একটা জিনিস ধুপ করে আমার ঘাড়ে পড়ল। আঁতকে উঠে লাফ দিতেই গলায় হ্যাচকা টান এবং সঙ্গে সঙ্গে দম আটকে এল। গোঁ গোঁ করতে করতে পড়ে গেলুম ঘাসের উপর।

তারপর কানে এল গুলির শব্দ। তারপর মাথার কাছে কর্নেলের ডাক শুনতে পেলুম, জয়ন্ত! জয়ন্ত!

আস্তে আস্তে উঠে বসলুম। তাকিয়ে দেখি, কর্নেলের হাতে কতকটা কাঠবেড়ালির মতো দেখতে একস্টা খুদে বাঁদর। পিটপিট করে তাকাচ্ছে বাঁদরটা। কর্নেল তাঁর কাধটা শক্ত করে ধরে রেখেছেন। তাই বাঁদরটার নড়াচড়ার সাধ্য নেই। আমাকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে কর্নেল বললেন, জোর বেঁচে গেছ ডার্লিং! আর একটু দেরি হলে বাবু বংকারামের অবস্থা হত তোমার। যাই হোক, গলার ফাসটা এবার খুলে ফেলল।

এবার শিউরে উঠে দেখলুম, আমার গলায় মিহি নাইলনের সুতো জড়ানো। ব্যাপারটা বুঝতে এক সেকেন্ডও দেরি হল না। কাঁপা কাঁপা হাতে গলা থেকে সুতোটা খুলে ফেললুম।

কর্নেল বললেন, ভ্যাগ্যিস বাঁদরটাকে আগে দেখতে পেয়েছিলুম। তোমার মাথায় উপর ওই ডাল বেয়ে এগিয়ে আসছিল। ফসটা নিয়ে যেই তোমার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়েছে, আমিও এক লাফে এগিয়ে ওকে ধরে ফেলেছি। তবে ফাঁস ধরে যে টান দিয়েছিল, তাকে দেখতে পাইনি। আন্দাজে রিভলভারের গুলি ছুড়ে তাকে ভাগিয়ে দিয়েছি। লোকটা সম্ভবত বটগাছের গুড়ির উপর কোথাও বসে ছিল। কারণ তার লাফিয়ে পড়া আর দৌড়ে যাওয়ায় ধুপধুপ শব্দ শুনতে পেয়েছি।

উঠে দাঁড়ালুম। মাথা ঝিমঝিম করছে। কুৎসিত বাঁদরটার দিকে তাকাতেও আতঙ্ক হচ্ছে। ওই ব্যাটা আমার ঘাড়ে লাফিয়ে ফাঁসটা আটকে দিয়েছিল আর ওর শয়তান মনিব নাইলনের শক্ত এই সুতোটার অন্য প্রান্ত থেকে ছিপে এ্যাচ মেরে মাছ বেঁধানোর মতো হ্যাচকা টান মেরেছিল। মানুষ মারার বিদঘুটে ফন্দি বটে। এমনি করেই তাহলে বাবু বংকারামকে দম আটকে খুন করা হয়েছিল।

সুতোটা প্রায় দশ-বারো মিটার লম্বা। ল্যাসোর কে খুদে সংস্করণ আর কি! গুটিয়ে পকেটে রাখলুম, কর্নেলের জাদুঘরে উল্লেখযোগ্য সংযোজন হিসেবে উপহার দেব এটা। সঙ্গে একটা চিত্রকুটে লেখা থাকবে : এই নিরীহ সুতোটি প্রখ্যাত সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরিকে যমের বাড়ির দরজা অব্দি টেনে নিয়ে গিয়েছিল।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, এই সেই ময়নাচোর স্কুইরেল মাংকি, ডার্লিং! হালদারমশাইয়ের সাধু, পাখি আর বাঁদরের মধ্যে বাঁদরটা হাতে এল। বাকি রইল পাখি আর সাধু। একটুর জন্য সাধু ফসকে গেছে। তবে আশা করি, আবার তার দেখা আমরা শিগগির পাব। শুধু পাখিটার জন্য ভাবনা হচ্ছে।

বললুম, আমার আর এক সেকেন্ডও এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না কর্নেল। তাছাড়া শ্বাসনালিতে ব্যথা করছে।

কর্নেল বললেন, ঠিক আছে। চলো, ফেরা যাক। পরে আবার এসে বাবু বংকারামের ডেরা খোঁজা যাবে। তারপর খুদে প্রাণীটাকে জ্যাকেটের ভিতরকার পকেটে ঢুকিয়ে বোতাম আঁটলেন। বাঁদরটা নড়ল না একটুও।

গ্রামের রাস্তায় ফিরে যাওয়ার সময় একটা ভিড় চোখে পড়ল। একটা কুঁড়েঘরের সামনে পুরুষ, স্ত্রীলোক, কাচ্চাবাচ্চা ভিড় করে কী যেন দেখছে। উঁকি মেরে দেখি, একটা কালো মরা পাখি পড়ে আছে মাটিতে। সেটাই সবাই ভিড় করে দেখছে। কর্নেলের দিকে তাকালুম। খুব চঞ্চল হয়ে উঠেছেন। গোয়ন্দাপ্রবর। একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার, মরা পাখি দেখার জন্যে এত ভিড় কেন?

সে বলল, সায়েব, এটা একটা ময়নাপাখি।

তা তো দেখতেই পাচ্ছি। পাখিটা মরল কী করে?

একজন বুড়ো বলল, হুজুর, পাখিটা আমার নাতনি কুড়িয়ে পেয়েছে মাঠে। তখনও ধুকছিল। এনে মুখে জল দিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করল। বাঁচল না। এ পাখিটা আমরা চিনতে পেরেছি। সেজন্য এই ভিড়।

পাখিটা কার?

বাবু গঙ্গারাম দাস বলে একটা লোক ছিল, এ তারই পাখি। পাখিটা ভাল বুলি বলতে পারত, হুজুর! ওড়িয়া, হিন্দি আবার ইংরেজিতেও নাকি বুলি বলত। বাবু গঙ্গারাম দাস ছিল লেখা-পড়াজানা লোক। বড় খেয়ালি আর দিলদরিয়া ছিল তার মেজাজ। গরিব লোকদের জন্য খুব দয়া ছিল তার।

আমি চমকে উঠেছিলুম। কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, তিনি এখন কোথায় আছেন?

বুড়ো বলল, জানি না হুজুর! বাবু গঙ্গারাম থাকত বাবু বংকারামের বাড়িতে। শুনেছি ওরা নাকি ছিল মাসতুতো ভাই। বছরখানেক আগে বাবু বংকারাম জঙ্গলে ঝরনার ধারে খুন হয়েছে। বাবু গঙ্গারাম তারপর থেকে নিপাত্তা। পুলিশ তাকে আর গোপেশ্বর নামে একটা লোককে খুনি বলে সন্দেহ করেছিল বটে, কিন্তু আমরা এ কথা বিশ্বাস করি না; অমন নিরীহ আর দয়ালু লোক গঙ্গারাম মানুষ খুন করতে পারে! খুনোখুনির কাজ গোপেশ্বর পারত বটে। সেও ছিল এক সাংঘাতিক ডাকাত। বাবু বংকারামের স্যাঙাত।

কর্নেল পাখিটার দিকে তাকিয়ে বললেন, এ পাখি যে বাবু গঙ্গারামের, তোমরা চিনলে কেমন করে?

সবাই হইচই করে উঠল জবাব দেওয়ার জন্য। সবাইকে থামিয়ে বুড়ো বলল, ওই যে দেখছেন পাখিটার একটা পায়ে রুপোর আংটা। বাবু গঙ্গারাম সবসময় পাখিটাকে কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াত। ওই আংটার সঙ্গে ছিল সরু চেনা চেনটা থাকত বাবু গঙ্গারামের গলায় জড়ানো। মনে হচ্ছে, আংটা থেকে চেন ছিঁড়ে কী ভাবে পাখিটা পালিয়ে বেড়াচ্ছিল এতদিন।

কর্নেল হাঁটু ভাঁজ করে ঝুঁকে পাখিটাকে ভাল করে দেখতে গেছেন, অমনি তার জ্যাকেটের ভিতর থেকে দুটো বোতামের মাঝখান দিয়ে বজ্জাত খুদে বাঁদরটা সুড়ুত করে পিছলে পড়ল। তারপর লোকগুলোর পায়ের ফাঁক দিয়ে গলে চোখের পলকে কুঁড়েঘরের চালে চড়ে বসল। এবার তাজ্জব হয়ে দেখলুম, বাঁদরটা মরা পাখিটাকে হাতিয়ে নিয়েছে।

সবাই হকচকিয়ে গিয়েছিল। কর্নেলও হতভম্ব। হাঁ করে তাকিয়ে আছেন। আমিও তাই, তারপর লোকগুলো চেঁচিয়ে উঠল, ভুণ্ডুরাম! ভুণ্ডুরাম!

চ্যাঁচামেচিতে হয়তো ভয় পেয়েই বাঁদরটা পাখিটা নিয়ে এক লাফে কুঁড়েঘরের পেছনের দিকে উধাও হয়ে গেল। ওর গতি আর ভঙ্গি অবিকল কাঠবেড়ালির মতো। কর্নেল বাজখাই গলায় চেঁচিয়ে বললেন, পাকড়ো। পাকড়ো! বখশিশ মিলেগা!

বখশিশের লোভে হইচই করতে করতে অনেকেই ছুটে গেল। বুড়ো কর্নেলকে আশ্বস্ত করে বলল, চুপ করে বসে থাকুন হুজুর! খাটিয়া এনে দিচ্ছি। ভুরামকে ওরা এক্ষুনি ধরে ফেলবে। ওটা তো একটা পোষা বাঁদর।

সে ঘর থেকে দুটো খাটিয়া এনে দিল। আমরা বসলুম। তারপর কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, বাঁদরটাও তোমাদের চেনা দেখছি!

বুড়া হাসতে হাসতে বলল, হুজুর কি ভুণ্ডুরামকে কিনে আনলেন ভগিয়ার কাছ থেকে?

কর্নেল বললেন, বাঁদরটা আমি ভগিয়ার কাছে কিনিনি। অন্য একজনের কাছে কিনেছি।

বুড়ো অবাক হয়ে বলল, সে কী! ভগিয়া ভুরামকে তাহলে বেচে দিয়েছিল! কার কাছে বলুন তো হুজুর?

কর্নেল বললেন, নাম জানি না। বাবু বংকারামের বাড়ির ওখানে একটা লোক—

বুড়ো কথা কেড়ে বলল, বুঝেছি। বেঁটেমতো, মাথায় টাক আছে তো? নব।

ভগিয়া কে?

নবর ভাই। ভগিয়া যে সারাদিন ভুণ্ডুরামকে নিয়েই ব্যস্ত থাকত। তাই নব বলত বটে, বাঁদরটাকে জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসবে, নয়তো কাউকে বেচে দেবে।

ভগিয়া এমন জাতের বাঁদর পেল কোথায়?

জঙ্গল থেকে নাকি ধরে এনেছিল। খেলা শিখিয়েছিল। যা বলত, তাই শুনত ভুণ্ডুরাম।

ভগিয়াকে এখন কোথায় পাওয়া যাবে?

বলা কঠিন। শুনেছি সে নাকি এক সাধুবাবার চেলা হয়েছে। কোথায়-কোথায় ঘোরে সাধুবাবার সঙ্গে।

এক সাধুবাবা নাকি অদৃশ্য হতে পারেন—তারই চেলা হয়নি তো ভগিয়া?

বুড়ো মুখ বেঁকিয়ে বলল, সে সাধুবাবা স্বয়ং শিব। ভগিয়া তার চেলা হবে? তাহলে পুবের সূর্য পশ্চিমে উঠবে না? হুজুর, ভগিয়ার সাধুবাবা আর কেমন হবে? ভগিয়ার মতোই হবে। কেউ কেউ বলে, সাধুটা নাকি গোপেশ্বর। পুলিশের ভয়ে সাধু সেজে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে।

লোকগুলো হইচই করে ফিরে এল। ফঁসুড়ে ভুণ্ডুরামকে ধরে এনেছে ওরা। মরা পাখিটাকে এখনও বজ্জাতটা আঁকড়ে ধরে রয়েছে। কর্নেল বাঁদরটাকে আগের মতোই জ্যাকেটের ভিতর পকেটে চালান করলেন এবং একটা হাত চেপে রাখলেন, যাতে আর না পালাতে পারে। মরা পাখিটাকে আমি রুমালে জড়িয়ে নিলুম কর্নেলের আদেশে।

ওদের বখশিশ দিয়ে বুড়োর কাছে বিদায় নিয়ে কর্নেল হঠাৎ আমাকে চাপা গলায় ইংরেজিতে বললেন, জয়ন্ত, দূরে একটা লোককে দৌড়ে আসতে দেখছি। মনে হচ্ছে, লোকটা ভগিয়ার দাদা নব। ওই দ্যাখো, সামনে বড় রাস্তার মোড়ে একটা অটোরিকশা দাঁড়িয়ে রয়েছে। দৌড়নোর জন্য তৈরি হও। ওয়ান, টু, থ্রি-রান!

পিছনের লোকগুলো নিশ্চয় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে আছে। জীবনে এমন দৌড় কখনও দৌড়ইনি, কিংবা পঁয়ষট্টি বছরের খ্রিসমাস সান্টা ক্লজ চেহারার এই বৃদ্ধ ভদ্রলোককেও দৌড়তে দেখিনি।

অটো-রিকশোয় চেপেই কর্নেল বললেন, ডবল ভাড়া সর্দারজি! তুরন্তু চালিয়ে, ইধার টাউনশিপ হোকে সিধা।

ড্রাইভার কী বুঝল কে জানে, তক্ষুনি, স্টার্ট দিয়ে বাহনটাকে রকেটের বেগে ছুটিয়ে দিল পার্বতী নদীর ব্রিজের দিকে। ব্রিজ পেরিয়ে গিয়ে সে মুচকি হেসে বলল, ইধার গোপেশ্বর ডাকু রহতা হ্যায়! কভি ইধার মাত আইয়ে জি।

প্রদীপবাবুর বাংলোবাড়িতে পৌঁছে দেখি, সবে ডঃ সীতাকান্ত পট্টনায়ক ভুবনেশ্বর থেকে নিজেই জিপ চালিয়ে হাজির। কর্নেল পকেট থেকে ভুণ্ডুরামকে বের করলে উনি চমকে গিয়ে। বললেন, স্কুইরেল মাংকি মনে হচ্ছে? কোথায় পেলেন?

কর্নেল হালদারমশাইয়ের প্রসঙ্গ থেকে শুরু করলেন। কথা শেষ হলে পট্টনায়ক বললেন কী আশ্চর্য! কাল দুপুরে কলকাতার ফরেনসিক ল্যাবরেটরি হলে যখন আপনি আমার সঙ্গে দেখা করলেন, তখন যদি গঙ্গারামের ব্যাপারটা বলতেন, তখনই সব জানিয়ে দিতুম আপনাকে।

কর্নেল বললেন, চেনেন নাকি গঙ্গারামকে?

ভীষণ চিনি, ডঃ পট্টনায়ক উত্তেজিতভাবে বললেন। ভদ্রলোক ছিলেন বাঙ্গালোর স্পেস রিসার্চ সেন্টারের জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী। খুব খেয়ালি স্বভাবের মানুষ। হঠাৎ চাকরি ছেড়ে নিখোঁজ হয়ে যান। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ওল্ড কোদণ্ডগিরিতে বাবু বংকারামের বাড়িতে এসে জুটেছিলেন।

বাবু বংকারামের নাকি মাসতুতো ভাই উনি।

হতে পারে, ডঃ পট্টনায়ক বললেন। কেন এখানে এসেছিলেন, তাও আঁচ করতে পারছি। জঙ্গলের ভেতর কোদণ্ডগিরি পাহাড়ে নিশ্চয় গোপনে মহাকাশ সংক্রান্ত গবেষণা করছিলেন। একটু আগে মিঃ রায়ের কাছে যা শুনলুম তাতে ওঁর সাফল্যের প্রমাণও পেয়েছি। এমন একটা রিমোট কন্ট্রোল সিস্টেম এ যাবৎ আবিষ্কৃত হয়নি।

হ্যাঁ। রিমোট কন্ট্রোল যন্ত্রটা সত্যি বিস্ময়কর।

কিন্তু এসব কাজের জন্য প্রচুর টাকা দরকার। এত টাকা কোথায় পেলেন জি আর ডি? ডঃ পট্টনায়ক একটু হেসে বললেন, হা, –ডঃ গঙ্গারাম দাস জি আর ডি নামেই বিজ্ঞানীমহলে পরিচিত ছিলেন।

কর্নেল বাঁদরটার পিঠে হাত বুলাতে বুলোতে বললেন, তাহলে কি বাবু বংকারামকে ডাকাতি করে টাকা জোগাড় করার জন্য উনিই প্ররোচিত করেছিলেন? হয়তো বাবু বংকারামকে কোনও লোভ দেখিয়েছিলেন।

প্রদীপবাবু এসে বললেন, লাঞ্চ রেডি। দেড়টা বাজতে চলল। এবার দয়া করে উঠে পড়ুন।

 

ছয়

খাওয়াদাওয়ার পর মরা ময়নাপাখিটা নিয়ে কর্নেল এবং ডঃ পট্টনায়ক কী-সব পরীক্ষায় বসলেন। ডঃ পট্টনায়কের সঙ্গে সবসময় একটা খুদে পোর্টেবল ল্যাবরেটরি থাকে। দেখতে সেটা একটা প্রকাণ্ড স্যুটকেসের মতো। টেবিলে সেটা খুলে বসেছেন।

ফঁসুড়ে ভুণ্ডুরাম এখন প্রদীপবাবুর জিম্মায়। ওকে বন্য প্রাণী গবেষণাগারের হেফাজতে দেওয়া হবে। রাত জেগে ট্রেন জার্নি, তার ওপর যমের দুয়ার থেকে ফেরার ধাক্কায় আমি ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছিলুম। শ্বাসনালির ব্যথাটা গরম জলের গাৰ্গলে অনেকটা কমেছে। সবে চোখ বুজে আসছে ভাতঘুমে, এমন সময় কর্নেল এবং ডঃ পট্টনায়কের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনে ঘুমের রেশ ছিঁড়ে গেল। কর্নেল বললেন, কী আশ্চর্য! এ যে দেখছি একটা নকশা!

ডঃ পট্টনায়ক বললেন, হ্যাঁ–ব্লুপ্রিন্ট বলতে পারেন। নিশ্চয় গোপনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্লুপ্রিন্ট। তা না হলে পাখির পায়ে রুপোর আংটার মধ্যে রোল করে লুকিয়ে রাখা হবে কেন? এটা কিন্তু সাধারণ কাগজ নয়। গুপ্তচররা ব্যবহার করে এগুলো। এক বর্গফুট কাগজও রোল করে নখের মধ্যে লুকিয়ে রাখা যায়। এবার বোঝা গেল, পাখিটা পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। ফাঁদে আটকে আদিবাসী ছেলেরা ওকে ধরে। হালদারমশাই কিনে নিয়ে যান। তার বাড়ি থেকে পাখিটা উদ্ধার করে আনার সময় আবার হাত ফসকে পালিয়েছিল। পালাতে গিয়ে বিদ্যুতের শক খেয়ে শেষে মারা পড়ে।

কর্নেল বললেন, মাঠে পড়ে ছিল নাকি পাখিটা। ওখানে বিদ্যুতের তার গেছে দেখছি।

ডি সি বিদ্যুতের শকে ছিটকে পড়াই সম্ভব। এ সি হলে তারে আটকে থাকত।

বুঝেছি। হালদারমশাইয়ের সঙ্গে সাধু আর তার চেলা যখন ধস্তাধস্তি করছিল, তখনই পাখিটা পালিয়ে থাকবে।

হালদারমশাইয়ের সঙ্গে ধস্তাধস্তি?কর্নেল হাসলেন। বেনামী চিঠিতে বলা হয়েছে, ওঁকে ওরা আটকে রেখেছে। তার মানে ধস্তাধস্তিটা খুব সাংঘাতিকই হয়েছে। হালদারমশাই তো সহজে বন্দি হবার পাত্র নন। ওঁকে কায়দা করতে হাত ফসকে পাখির পালানোই স্বাভাবিক।

ডঃ পট্টনায়ক আবার নকশাটার উপর আতশকাচ নিয়ে ঝুঁকে পড়লেন। তারপর চাপা গলায় বললেন, কর্নেল, আমার মনে হচ্ছে, এটা কোদণ্ডগিরি পাহাড়ে জি আর ডির ল্যাবরেটরি এবং স্পেস রিসার্চ সেন্টারের ব্লুপ্রিন্ট। ওই গোপন জায়গায় যাওয়ার হদিশও এতে আছে যেন। এই চিরুনির মতো চিহ্নটা দেখুন। এটা সম্ভবত ঝরনা। আর তার উলটোদিকে এই লাল ফুটকিটা কি সেই লাল রঙের প্রকাণ্ড পাথরটাই—যেটা আমি দেখে গিয়েছিলুম জানুয়ারিতে এসে?

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। এখনই বেরিয়ে পড়া যাক। আড়াইটে বাজাতে চলল। দিনের আলো থাকতে থাকতে বেরিয়ে পড়াই ভাল। জয়ন্ত, তুমি যাবে নাকি?

তড়াক করে উঠে বসলুম। বললুম, যাব না মানে? দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার লক্ষ-লক্ষ পাঠক হা-পিত্যেশ করে বসে আছে না?

ডঃ পট্টনায়ক বললেন, হাঁটা-পথেই যাব। অবশ্য পথ বলা ভুল। জানুয়ারিতে এসে কোদণ্ডগিরি পৌঁছতে খুব হন্যে হয়েছিলুম। একবার হাতির পালের সামনে, আর একবার চিতাবাঘের সামনেও পড়েছিলুম। আমার সঙ্গে ছিলেন অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস কমিশনের এক বিশেষজ্ঞ। তিনি তো আতঙ্কে মারা পড়ার দাখিল।

প্রদীপবাবু এসে ওঁর কথা কান খাড়া করে শুনছিলেন। বললেন, জানুয়ারিতে এসেছিলেন আপনারা? জঙ্গলে বেড়াতে নাকি?

মিঃ রায়। নিছক বেড়াতে এলে তো আপনি জানতে পারতেন। আপনার শরণাপন্ন না হয়ে উপায় ছিল না। আমরা এসেছিলুম একটা সরকারি তদন্তে। কোদণ্ডগিরি পাহাড়ে নাকি অদ্ভুত সব আলো দেখা যায়। আগুনের গোলাও দেখা যায়। আমার ধারণা ছিল, ওখানে প্রচুর প্রাকৃতিক গ্যাস আছে ভূগর্ভে। কিন্তু এসে কিছুই হদিশ করতে পারিনি। আর পাহাড়টায় চড়াও একেবারে অসম্ভব। পুরোটা গ্রানাইট শিলায় তৈরি। যাই হোক, ফেরার পথে পার্বতী নদীর ধারে বালির চড়ায় ওই রিমোট কন্ট্রোল যন্ত্রটা কুড়িয়ে পেয়েছিলুম।

প্রদীপবাবু বললেন, আগুনের গোলার কথা আমিও শুনেছিলুম।

কর্নেল বললেন, আজ সকালে দেখতে পেলেন।

প্রদীপবাবু চমকে উঠে বললেন কিন্তু ওটা তো আগুনের গোলা নয়। ছাই-রঙের একটা গোলক।

রাতে ওটা থেকে রশ্মি ঠিকরে পড়ে। তাছাড়া মহাকাশযান বা কৃত্রিম উপগ্রহ রাতের আকাশে আগুনের গোলার মতো দেখাতে পারে।

প্রদীপবাবুও আমাদের সঙ্গ ধরলেন। এতে খুশিই হলেন কর্নেল এবং ডাঃ পট্টনায়ক। প্রদীপবাবু কোদণ্ডগিরি জঙ্গলের নাড়িনক্ষত্র জানেন। রাস্তা ভুল হওয়ার চান্স থাকবে না।

পাহাড়ি জঙ্গলের সৌন্দর্য তুলনাহীন। তাছাড়া এখন বসন্তকাল। কত রকম ফুল ফুটেছে চারিদিকে। মিঠে গন্ধে মউ-মউ করছে বনপথ। পাখ-পাখালি গান ধরেছে মনের সুখে। কিন্তু এসব দিকে আমাদের কারুর মন নেই। প্রদীপবাবু সতর্কতার জন্য একটা শটগান হাতে নিয়েছেন। বুনো জন্তুর পাল্লায় পড়লে ভয় দেখিয়ে তাড়ানোর জন্যই। এ জঙ্গলে পশুপাখি হত্যা নিষিদ্ধ।

একবার হাতির চিঙ্কার কানে এল। প্রদীপবাবু বললেন, পার্বতী নদীতে দিনের শেষে খেলতে নেমেছে হাতির পাল। বাতাস ওদিক থেকে বইছে। কাজেই আমাদের গন্ধ পাবে না ওরা।একখানে টিলার উপর মহুয়া গাছে ভালুক দেখিয়ে দিলেন। বহু দূরে একবার যেন বাঘের গর্জনও শুনলুম।

পাঁচ কিলোমিটার দূরত্ব পেরুতে ঘণ্টা-দেড়েক লেগে গেল। এর কারণ রাস্তা বেশ দুর্গমই। চড়াই-উতরাই বিস্তর। ঝরনা এড়িয়ে আমরা কোদণ্ডগিরির পশ্চিমে গিয়ে দাঁড়ালুম। পাহাড়টা অন্তত হাজার-দশেক ফুট উঁচু। দূর থেকে শর লাগানো ধনুক বা পিরামিডের মতো মনে হয় বটে, কাছ থেকে সেটা বোঝা যাচ্ছিল না। শুধু মিনারের মতো খাড়া ছুঁচালো চূড়াটা চোখে পড়ছিল। পাহাড়ের নিচে বিশাল-বিশাল পাথর পড়ে আছে। অনেকটা জায়গা জুড়ে পাথর আর ঝোপ। তারপর উচু গাছের জঙ্গল। তাই এখানে বিকেলের গোলাপি রোদ ছড়িয়ে আছে।

কর্নেল ও ডঃ পট্টনায়ক সেই নকশা আঁকা চিরকুট খুলে পরামর্শ করছিলেন। হঠাৎ কর্নেল বললেন, লাল ফুটকি? হুঁ, দেখুন তো ডঃ পট্টনায়ক! ওই লাল পাথরটাই তো?

ডঃ পট্টনায়ক বললেন, হ্যাঁ, ওটাই। চলুন, দেখা যাক।

কর্নেল বললেন, সাবধান! সবাই গুঁড়ি মেরে পাথরের আড়ালে-আড়ালে এগিয়ে চলুন।

লাল পাথরটার কাছে পৌঁছে আবার দুজনে নকশা দেখে নিজেদের মধ্যে চাপা গলায় পরামর্শ করলেন। তারপর কর্নেল বললেন, সবাই হাত লাগান। দেখা যাক, পাথরটা সরানো যায় কি-না।

লালপাথরটা কিন্তু তত ওজনদার নয়। একটু ঠেলতেই সরে গেল। ওটা যত সরল, তত নিচের দিকে একটা গর্ত দেখা যেতে থাকল। কর্নেল বললেন, এই তো দেখছি সুড়ঙ্গের মুখ। একে একে নামা যাক। টর্চ জ্বালতে হবে মনে হচ্ছে।

প্রথমে কর্নেল, তারপর ডঃ পট্টনায়ক, তারপর আমি এবং সব শেষে প্রদীপবাবু গর্তে নামলেন। ধাপে ধাপে সিড়ি একটু নেমে যাওয়ার পরে উপরের দিকে উঠে গেছে। কেমন একটা ভ্যাপসা গন্ধ টের পাচ্ছি। টর্চের আলোয় কালো পাথরের ধাপ ক্রমশ উঠছে তো উঠছেই। আমরাও উঠছি। অনেকখানি ওঠার পর কিছুটা করিডোরের মতো সমতল জায়গা। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলুম, সামনে আলোর ছটা বেরিয়ে আসছে। কর্নেল থমকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আবার পা বাড়ালেন। করিডোরের মতো জায়গাটা প্রায় দুমিটার চওড়া। আলোটা আসছে বাঁদিক থেকে। করিডোর বেঁকে গিয়ে আবার সিঁড়ির মুখে শেষ হয়েছে। সিঁড়ির মাথায় হলুদ একবিন্দু আলো। ঠিক আলো নয়। অদ্ভুত একটা রশ্মি যেন। কর্নেল ধাপে পা রেখেছেন, অমনি গমগমে গলায় কেউ বলে উঠল, সাবধান গোপেশ্বর! আর এক পা এগোনোর চেষ্টা কোরো না। বুঝতে পেরেছি, তুমি এতদিনে আমার ল্যাবরেটরিতে ঢোকার নকশা পেয়েছ। আমার দুর্ভাগ্য গোপেশ্বর, পাখিটা শয়তান বংকারাম চুরি করে নিয়ে পালিয়েছিল। তাছাড়া আমার আরসিএস যন্ত্রটাও চুরি করেছিল ডাকাত হতচ্ছাড়া। ওকে খুন করে তুমি সব হাতিয়েছ আমি জানতুম। কাল দুপুরে এবং আজ সকালে আমার স্পেসশিপ দু-দুবার ছিটকে বেরিয়ে গিয়েছিল। আমি জানি, তুমি আরসিএস তো হাতিয়েছ। উপরন্তু ওটা ব্যবহার করার কৌশলও জেনে গেছ। শোনো গোপেশ্বর, আমি তোমাকে ঢুকতে দেব একটা শর্তে।

কর্নেল বলে উঠলেন, বলো গঙ্গারাম!

তোমার বাঁ দিকে একটা ঘুলঘুলি দেখতে পাচ্ছ?

পাচ্ছি।

নকশা আর, আরসিএস যন্ত্রটা ওখানে দিয়ে ঢুকিয়ে দাও।

তাহলে ঢুকতে দেবে তো গঙ্গারাম?

দেব।

দেখলুম ডঃ পট্টনায়ক কর্নেলকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কর্নেল গ্রাহ্য করলেন না ওঁকে। নকশা আর সেই রিমোট কন্ট্রোল যন্ত্র ঘুলঘুলির ভিতর ফেলে দিলেন। অমনি হা-হা হাসির শব্দ এসে আমাদের কানে ধাক্কা দিল। হলদে আলোর ফুটকিটা নিভে গেল। নেপথ্য থেকে নিষ্ঠুর কথা গমগম করে ভেসে এল, গোপেশ্বর, বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি মৃত্যু। মৃত্যুর জন্য তৈরি হও।

কর্নেল চিৎকার করে বললেন, ডঃ দাস, আমি গোপেশ্বর নই। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার! আমার সঙ্গে আছেন আপনার পুরনো বন্ধু ডঃ সীতাকান্ত পট্টনায়ক, সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরি এবং এই জঙ্গলের কনজারভেটর প্রদীপ রায়। আপনি আগে দেখুন, আমরা কারা। তারপর শাস্তি দেবেন।

ডঃ পট্টনায়কও জোরে চেঁচিয়ে বললেন, জি আর ডি! আমি পট্টনায়ক।

অন্তত এক মিনিট পরে কথা ভেসে এল, গোপেশ্বর কোথায়?

আমরা জানি না ডঃ দাস, কর্নেল বললেন। দয়া করে আমাদের ঢুকতে দিন। সব বলব।

আপনারা আসুন।

আবার হলুদ আলোর ফুটকি দেখতে পেলুম। সিঁড়ি বেয়ে আমরা উঠতে থাকলুম। শেষ ধাপের পর আবার একটা করিডোর। বাঁ দিকে একটা কালো দরজা খুলে গেল। একে একে ভিতরে ঢুকলুম। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। বিশাল এক ল্যাবরেটরি। একপাশে রকেটের মতো দেখতে এটা প্রকাণ্ড সাদা চোঙা ছাদ ফুঁড়ে চলে গেছে। সেখানে রেলিং ঘেরা। অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে নানারকম। শোঁ শোঁ….ব্লপ ব্লিপ…কিটকিট….বিচিত্র সব শব্দ। কিন্তু কোনও লোক দেখতে পাচ্ছি না।

ডঃ পট্টনায়ক বললেন, জি আর ডি, কোথায় তুমি?

অমনি সামনে একটু তাকাতে চোখ-ধাঁধানো নীল আলো খেলে গেল এক সেকেন্ডের জন্য। তারপর দেখি, সেখানে লম্বা রোগা ফর্সা, একমাথা সাদা চুল, গেরুয়া আলখাল্লার মতো পোশাক পরা এক সৌম্য চেহারা প্রৌঢ় দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে মিটিমিটি হাসি। কী পট্টনায়ক, অলৌকিক কীর্তি ভাবছ নাকি? তোমাকে বলেছিলুম পট্টনায়ক, যে-কোনও পদার্থকে ভরহীন ফোটনে পরিণত করা যায় এবং তা চর্মচক্ষে অদৃশ্য মনে হবে। তুমি বলেছিলে, ফোটনে পরিণত হলে তা আলোর সমান গতিবেগ পাবে এবং তাই বিশ্বজগতে ছড়িয়ে পড়বে। ঠিক ঠিক। কিন্তু লেসার রশ্মি দিয়ে ফ্রেমের মতো ঘিরে রাখতে পারলে তা ছড়াবে না এবং ফোটনগুলোকে আবার আগের মতো ভরযুক্ত পদার্থ-কণিকায় রূপান্তরিত করা যাবে। এখন স্বচক্ষে দেখলে তো পট্টনায়ক, সেই অসম্ভব আমি সম্ভব করেছি?

দেখলুম ভাই! তোমার কোনও তুলনা হয় না।

বিজ্ঞানী গঙ্গারাম দাস কর্নেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, একসময় খবরের কাগজ পড়তুম। তখন আপনার অনেক কীর্তিকলাপ কাগজে পড়েছি। বসুন, বসুন। আপনারা আমার সম্মানিত অতিথি।

আমরা বসলুম। ডঃ দাস বিশাল টেবিলের ওধারে বসলেন। তারপর বোতাম টিপলেন। তক্ষুনি খটখট শব্দে একটা ছোট্ট মানুষের গড়নের রোবট এসে আমাদের সামনে দাঁড়াল। ডাঃ দাস বললেন, চা কফি কোল্ড ড্রিংক্স—যা খেতে চান, সেই বোতাম টিপুন। পেয়ে যাবেন।

কর্নেল কফির বোতাম টিপলেন। খট করে একটা কাগুজে পেয়ালা পড়ল রোবটের পেটের  নিচের খোঁদলে। তারপর গড়গড় করে কফি বেরিয়ে পেয়ালা ভর্তি হয়ে গেল।

আমরা সবাই কফিই নিলুম। তারপর রোবটটা চলে গেল। ডঃ পট্টনায়ক বললেন, পাহাড় কেটে এই ল্যাবরেটরি বানিয়েছ দেখে অবাক লাগছে জি আর ডি! এ যে দৈত্যের কীর্তি! কী করে বানালে?

জি আর ডি বললেন, আমি তো বানাইনি, ভাই। এটা বংকারামের পূর্বপুরুষের তৈরি গোপন দুর্গ। এটার জন্যই ওর সঙ্গে ভাব করেছিলুম। ওকে মিথ্যা লোভ দেখিয়েছিলুম, দুর্গের ভিতর ওর পূর্বপুরুষের গুপ্তধন আছে। উদ্ধার করে দেব। কিন্তু ও চিরকালের বজ্জাত। যখন বুঝল আমি ল্যাবরেটরি বানাচ্ছি, তখন থেকে বদমাইশি শুরু করল। গোপেশ্বর নামে ওর এক ডাকাত-স্যাঙাত আছে। তাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করল শয়তানটা। যাকগে, গোপেশ্বর ওকে খুন করেছে। তবু আরসিএস এবং নকশাটা হাতাতে পারেনি।

কর্নেল সংক্ষেপে আগাগোড়া সব ঘটনা বললেন। ডাঃ পট্টনায়ক আরসিএস যন্ত্রটা কোথায় পেয়েছিলেন, তাও বললেন। ডঃ দাস খুব হাসতে লাগলেন শুনে। শেষে গম্ভীর হয়ে বললেন, কিন্তু মিঃ রায়ের মামা প্রাইভেট ডিটেকটিভ ভদ্রলোকের কথা শুনে আমার ভয় হচ্ছে। গোপেশ্বর ডাকু সাংঘাতিক লোক। ওকে কিছু বিশ্বাস নেই। তবে এটুকু আশ্বাস দিতে পারি, ঝরনার ধারে রাত দশটায় ব্যাটা আসবে বলেছে তো? তখনই আমি ওকে ধরতে রোবট পাঠিয়ে দেব। রোবটের টিপুনি খেয়ে সে কবুল করবে মিঃ হালদারকে কোথায় আটকে রেখেছে। তারপর ব্যাটাকে পুলিশের কাছে জিম্মা দেবেন মিঃ রায়।

কর্নেল বললেন, একটা কথা ডঃ দাস। পাখিটাকে অমন কথা কেন শিখিয়েছিলেন?

বিজ্ঞানী মুচকি হেসে বললেন, বিংকারাম যদি আমাকে সত্যি খুন করে, তাহলে পাখিটা সাক্ষ্য দিতে পারবে, এই ভেবেই। ওকে আমি বিশ্বাস করতে পারছিলুম না যে।

আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে এবং ল্যাবরেটরি দেখে আমরা বিদায় নিলুম। এবার আমাদের উল্টো দিকে ঝরনার ধারের গোপন দরজা খুলে বের করে দিলেন ডঃ দাস। তারপর আমাকে চমকে দেওয়ার জন্য আবার হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেলেন, বুঝলুম হালদারমশাই তাহলে ঠিকই দেখেছিলেন।

বাংলোয় ফিরে আমরা আবার অবাক। হালদারমশাই জলজ্যান্ত বসে রয়েছেন। শুধু মাথায় একটা ব্যান্ডেজ। বললেন, আমার নাম কে. কে. হালদার। আমাকে আটকে রাখবে ওই পুঁচকে দুটো লোক? রেলইয়ার্ডে সাধু আর তার চেলাকে ফলো করছিলুম। হঠাৎ ওরা মালগাড়ির আড়ালে লুকিয়ে গেল। আসলে ওত পেতে বসেছিল, বুঝলেন? যেই গেছি, লাফিয়ে পড়েছে। শেষে মাথায় ডাণ্ডার বাড়ি। জ্ঞান হলে দেখি, মালগাড়ির ওয়াগনে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছি। গায়ে জোর আসতে দেরি হচ্ছিল, তাই। নইলে কখন বাঁধন কেটে বেরিয়ে আসতুম। যাক গে, এবার আপনাদের খবর বলুন, কর্নেল স্যার? হালদারমশাই মাথার ব্যান্ডেজে হাত বুলোতে থাকলেন।

কর্নেল বললেন, আপাতত খবর হল, আজ রাত দশটায় আপনার সেই সাধু ওরফে গোপেশ্বর আর চেলা ভগিয়া ঝরনার ধারে রোবটের হাতে বন্দি হবে।

হালদারমশাই বললেন, রোবট? যাঃ! খি-খি করে বেজায় হাসতে লাগলেন গোয়েন্দা কৃতান্ত হালদার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *