১. ফোনটা ধরল মিস লেমন

ডেড ম্যানস ফলি (এরকুল পোয়ারো) – আগাথা ক্রিস্টি

ফোনটা ধরল মিস লেমন, পোয়াবোর যোগ্য সেক্রেটারি। চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসেছিল তখন এরকুল পোয়ারো। মিস লেমন রিসিভারে হাত চাপা দিয়ে নিচু স্বরে জিজ্ঞাসা করেল পোয়ারোকে, আপনি কি ধরবেন ন্যাসেকম্বডেভন থেকে আপনার ব্যক্তিগত কল।

ভ্রু কুঁচকে উঠল পোয়ারোর। অবশ্য তার কাছে জায়গাটা এমন কিছু নয়। সাবধানে বলল পোয়রো, জিজ্ঞাসা কর কে ফোন করছেন।

সে পোয়ারোর দিকে একটু পরে তাকিয়ে বলল–এরিয়াডন অলিভার।

এরকুল পোয়াবোর মনে পড়ল একটি স্মৃতি..বাতাসে ভেসে যাওয়া ধূসর কেশ একটা ঈগলের প্রোফাইল–সে রিসিভারটা নিজের হাতে তুলে নিল উঠে এসে।

-হ্যাঁ, আমি কথা বলছি, এরকুল পোয়ারো।

আপনিই যে মিঃ পোয়ারো এটা ঠিক তো? মিসেস অলিভার আমি, আমাকে আপনার মনে আছে কিনা জানি না।

ম্যাডাম, আপনাকে নিশ্চয়ই মনে আছে।

আপনাকে কি কেউ ভুলতে পারে। পোয়ারো উত্তর দিলো। তারপর জানতে চাইল, আমার সঙ্গে কি আপনার কিছু দরকার আছে? মিসেস অলিভার বলল, এখনই দরকার, আপনি প্লেনে আসতে পারবেন?

দুঃখিত আমি কেমন যেন অসুস্থতা বোধ করি প্লেনে চড়লে-বলল পোয়ারো।

হা আমারও এরকম হয়। মিসেস অলিভার বলল, অতএব আপনি বরং ট্রেনেই আসুন। বেলা বারোটায় ট্রেন প্যাডিংটন থেকে ন্যাসেকম্ব স্টেশনে। আপনার জন্য গাড়ি অথবা চালকসহ ট্যাক্সি থাকবে স্টেশনে। ন্যাসে হাউস-এ আসবেন সেখান থেকে।

পোয়ারো জানতে চাইল, ব্যাপারটা কি এবং আমাকে আপনার কি জন্য দরকার, সেটা তো বলবেন।

এমন বিশ্রী জায়গায় টেলিফোনটা রাখা আছে, মিসেস অলিভার বলল, সবাই যাতায়াত করছে, হলের মধ্যে দিয়ে, সেজন্য ভালো করে শোনাও যাচ্ছে না। তবে আপনাকে আশা করছি আমি। সবাই খুব খুশী হবে। গুডবাই।

পোয়ারো টেলিফোনটা নামিয়ে রাখতেই, মিস লেমন জিজ্ঞাসা করল, এই ভদ্রমহিলা কে স্যার?

পোয়ারো বলল, মিসেস অলিভার, একজন গোয়েন্দা ঔপন্যাসিক। তুমি হয়তো একা বসে থাকবে–এখনি তিনি আমাকে যেতে বললেন ডেভনশায়ারে, আজকেই। চমকে একপলকে সে ঘড়ির দিকে তাকাল–এগারোটা পঁয়ত্রিশ।

একজন যাত্রীই মাত্র অবতরণ করল ন্যাসেকম্ব স্টেশনের ট্রেন থেকে, তিনি হলেন এরকুল পোয়ারো।

অনেকগুলো সেলুন দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখানে, স্টেশনের বাইরে এসে সে দেখলো, এগিয়ে এলো তার দিকে ইউনিফর্ম পরিহিত একজন সোফার। বিনয়ের সঙ্গে সে জানতে চাইলো– আপনিই কি মঁসিয়ে পোয়ারো?

সোফার পোয়ারোর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিল। তারা শহরতলির পথে এসে নামল স্টেশন থেকে ওভারব্রিজ পেরিয়ে। পোয়ারো অভিভূত হল সামনে সুন্দর একটা নদী আর পাহাড়ের ঘেরা সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে। সোফার একটা ঝোঁপের সামনে গাড়ি থামাল।

সোফার বলল, এইটা হেলম নদী স্যার, কাছেই ডারমুর। প্রশংসা করার মতো সুন্দর জায়গা বটে, অস্ফুট স্বরে পোয়ারো বলল, অপূর্ব! যেন ডেভনে সে পোয়ারোর গাইড-এর ভূমিকা নিয়েছে এমন করে সোফার তাকে বোঝাচ্ছিল, ইয়ুথ হোস্টেলটা স্যার আমাদের বাড়ির পাশেই। মিঃ ফ্লেচারের জায়গা ব্যবহার করা হয়েছে, হুডাইন পার্ক। এখানে গ্রীষ্মের সময় খুব ভীড় হয়। এখানে কয়েক রাত্রির বেশি থাকতে দেওয়া হয় না। এখানে নারী-পুরুষ সকলেই আসে, বেশিরভাগ বিদেশী।

পোয়ারো আনমনে মাথা নাড়ল, সে অবাক হয়নি মোটেই এখানে প্রথম আসার জন্য, কিন্তু তার চক্ষু পীড়ার উপক্রম হলো পিছনের দুই মেয়েকে দেখে। চোখ তার বন্ধ হয়ে গেল যন্ত্রণায়। যুবতীরা কেন যে এধরনের পোশাক পরে থাকে? এককভাবে কি একেবারেই আকর্ষণীয় নয়। ঐ রক্তবর্ণের উরুগুলো। সে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো, মনে হচ্ছে ওরা বোঝার ভারে আক্রান্ত।

সত্যি স্যার, এখান থেকে আরও দুমাইল দূরে হুডাইন পার্ক, যদি আপনার আপত্তি না থাকে আমরা ওদের লিফট দিতে পারি, সোফার জিজ্ঞাসা করল।

বিনয়ের সঙ্গে বললো পোয়ারো-নিশ্চয়ই দিতে পারি। মেয়ে দুটি অত্যন্ত ভারী ঝোলার ভারে নুইয়ে পড়েছিল। তারা জানতো না যে পুরুষদের আকর্ষণ করতে হলে কীরকম পোশাক পরতে হয়। সোফার গাড়ি থামাল মেয়ে দুটির সামনে এসে। পথ চলার ক্লান্তি দূর হওয়ার আশায় তাদের ক্লান্ত মুখে আশ্বস্ততার ছায়া ফুটে উঠল। মেয়ে দুটি উঠে এলো গাড়িতে। পোয়ারো সেই মাত্র দরজা খুলে দিল। একটি মেয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলল, আপনার অশেষ মহানুভবতা। দেখতে ভালো মেয়েটি, বিদেশীদের টান তার কণ্ঠস্বরে। পথটা অনেক দূর মনে হয়। অপর মেয়েটি কথায় ব্যক্ত করতে না পারলেও বারবার মাথা নেড়ে কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করতে ভুলল না পোয়ারোর দয়া প্রদর্শনের জন্য। বেশি প্রাণবন্ত ও হাসিখুশী দেখাচ্ছিল যে মেয়েটিকে, দেখতে ভালো তাকেই।

সুদর্শনা বলল, ইংল্যান্ড থেকে আসছি দু-সপ্তাহের ছুটিতে। আমার খুব প্রিয় জায়গা ইংল্যন্ডে। আমি দেখতে এসেছি এখানকার বিখ্যাত বিউটি স্পটগুলি। আগামীকাল যাব প্লিমাউথে– এখানকার নদী পেরিয়ে নতুন বিশ্বের আবিষ্কার দেখতে।

অপর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল, সিনোরিনা, তুমি? তার কোঁকড়ানো চুলের মাথা বেঁকিয়ে সে কেবল হাসল। ডাচ মেয়েটি বলল, ও বিশেষ ইংরাজি বলতে পারে না। আমরা একটু আধটু ফরাসি বলতে পারি, এইভাবেই আমরা ট্রেনে কথাবার্তা চালিয়েছি। ও আসছে মিলান-এর কাছ থেকে। ওর এক আত্মীয়ার বিয়ে হয়েছে ইংল্যান্ডের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। এক্সেটারে ভদ্রলোকের একটা মুদী দোকান আছে। ও, ওর এক বন্ধুর সঙ্গে এক্সেটারে এসেছিল গতকাল। পেটের গোলমালে অসুস্থ হয়ে পড়ে বন্ধুটি, তাই সেখানেই আছে সে এখন।

রাস্তার সন্ধিস্থল–এই সময় গাড়ি থামাল সোফার–মেয়ে দুটি পোয়ারোকে ধন্যবাদ জানাল দুটি পৃথক ভাষায় গাড়ি থেকে নামার পর, তারপর হাঁটতে শুরু করল বাঁ দিকের রাস্তা ধরে। সোফার এবার গাড়ি চালিয়ে দিল ডানদিকের রাস্তা ধরে। অরণ্যের পথে গিয়ে পড়ল গাড়িটা একটু পরেই। অবশ্য খুব গভীর অরণ্য নয়। ওদের মধ্যে বেশ কিছু যুবতী খুব চমৎকার। হুডাইন পার্ক ইয়ুথ হোস্টেলের ব্যাপারে সোফার তার শেষ রায় দিল উপরের কথায়। আবার সে বলল, তাদের বোঝানো খুব কষ্টকর বহিরাগতদের ব্যাপারে। বেদনাদায়কভাবেই তারা প্রবেশ করে। আমাদের বন-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে তারা সব সময় প্রবেশ করে থাকে। আর এমন ভান করে যে, আপনি তাদের কি বলছেন তারা বুঝতে পারছেন না। অরণ্যের ঢালু পথ দিয়ে গাড়িটা নামছিল তখন বড় একটা গেটের সামনে এসে দাঁড়াল গাড়িটা একটু পরেই। বিরাট সাদা জর্জিয়ান হাউস, সামনেই নদী। দীর্ঘদেহী কালোচুলের খানসামা সিঁড়ির মুখে এগিয়ে এলো সোফার গাড়ির দরজা খুলতেই।

বিড়বিড় করে খানসামাটি বলল, মিঃ এরকুল পোয়ারো। পোয়ারো সংক্ষেপে বলল, হু।

স্যার, আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন মিসেস অলিভার। চলুন আপনাকে পথ দেখিয়ে পৌঁছে দিই।

মিসেস অলিভার পোয়ারোকে দেখে উঠে দাঁড়াতেই, তার কোল থেকে আপেলগুলো মাটিতে পড়ে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। তখন অলিভার-এর মুখে আপেল ভর্তি ছিল, কোনো রকমে অস্পষ্টভাবে সে বলল, বুঝতে পারি না কেন যে আমি সবসময় মাটিতে আপেলগুলো ফেলে দিই। মঁসিয়ে পোয়ারো কেমন আছেন? পোয়ারো উত্তর দিল, ভালো, এবং নরম সুরে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কেমন আছেন?

যেমন দেখেছিল পোয়ারো আগেরবার মিসেস অলিভারকে, এবার যেন অন্যরকম দেখাচ্ছিল–সে অবশ্য একটু আভাস দিয়েছিল ফোন করার সময়।

মিসেস অলিভার আনন্দে অধীর হয়ে বলে উঠল, জানতাম অবশ্যই আপনি আসবেন। পোয়ারো বলল, আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করি, কেন আমি এখানে এলাম।

মিসেস অলিভার বলল, আমি এর উত্তর জানি। সেটা হল কৌতূহল।

পোয়ারো তার দিকে তাকিয়ে দেখল তার চোখ দুটি চকচক করছে। আপনার মতো বিখ্যাত নারীর স্বতলব্ধ জ্ঞান সম্ভবত কৌতূহল।

হাসবেন না আমার জ্ঞানের কথা শুনে এর মধ্যে খুনিকে আগে ঠিকমতো চিহ্নিত করিনি?

অলিভার বলল।

 পোয়ারো চুপ করে রইল, না হলে সে উত্তর দিত। সব সময় সেটাও সম্ভবত হয় না, পঞ্চমবার চেষ্টা করার পরও, সেটা না বলে সে চারিদিক তাকিয়ে দেখে নিয়ে বলল, এখানে এই বিশাল বাড়ি, সম্পত্তি, দারুণ ব্যাপার।

মঁসিয়ে পোয়ারো এ সব কিন্তু আমার নয়, আপনি কি তাই ভাবছেন। না, না এসব অন্য লোকেদের।

ওইসব লোকেরা কারা? পোয়ারো জানতে চাইল।

অস্ফুটভাবে মিসেস অলিভার বলল, না না, তারা সত্যি কেউ না। আপনি মনে করে নিন তারা খুব ঐশ্বর্যশালী। আর আমি এখানে এসেছি আমার পেশাগত কাজ করতে। অর্থাৎ বলা যায় একটা খুনের ব্যবস্থা করার জন্য।

পোয়রো তারদিকে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকালো। মশাই, না না এটা সত্যিকারের খুনের ব্যাপার নয়। তাকে আশ্বস্ত করার জন্য বলল মিসেস অলিভার, এখানে একটা বিরাট সামাজিক উৎসব হতে চলেছে আগামীকাল, আর সেখানে একটা খুন হতে চলেছে। আমিই করেছি সে খুনের ব্যবস্থা। বুঝলেন ব্যাপারটা ট্রেজার হান্টর মতো। এই রকম নকল ট্রেজার হান্ট দেখতে এখানকার লোকেরা এতবেশি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে যে…

এর মধ্যে একটা নতুনত্ব থাকবে তারা ভেবেছে। সেজন্য মোটা টাকার দক্ষিণা দিয়ে তারা আমাকে এখানে এনেছে। এটা একটা সাদাসিধা মজার ব্যাপার। বাস্তবিকই একটা পরিবর্তন আনা যাবে গতানুগতিক উৎসব-এর।

আচ্ছা কাজটা কিভাবে হবে? জানতে চাইলে পোয়ারো।

শিকার অবশ্যই একজন হবে। আর সব গতানুগতিক কু, সন্দেহ-বুঝলেন ভ্যাম্প, ব্ল্যাকমেইলার তরুণ প্রেমিক প্রেমিকারা, খানসামা ইত্যাদি, ইত্যাদি।

শিকার কে, খুনী কে, মোটিভ কি, কু কী এসব আপনাকে খুঁজে বার করতে হবে। তারপর পুরস্কার দেওয়া হবে।

এরকুল পোয়রা মন্তব্য করল–অভিনবত্ব! আছে। মিসেস অলিভার বিমর্ষ কণ্ঠে বলল, আসল কথা চিন্তা করার থেকে বাস্তবে এসব করা খুবই কঠিন। আপনাকে সুযোগ দিতে হবে ভাবনা চিন্তা করার, সত্যিকারের বুদ্ধিমান লোককে, অবশ্য তাদের সেরকম কিছু হওয়ার প্রয়োজন নেই আমার বইতে। পোয়ারো তার ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেলল, আর আপনি কি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন এ সমস্ত ব্যবস্থাপনায় আপনাকে সাহায্য করার জন্য?

না না, কখনোই নয়, মিসেস অলিভার সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন। আমি নিজেই সেসব আয়োজন করে রেখেছি। সবই প্রস্তুত আগামীকালের জন্য। একটা সম্পূর্ণ পৃথক কারণে আমার আপনাকে দরকার।

সেই কারণটা কি? পোয়ারো প্রশ্ন করলো।

মিসেস অলিভার তার চুলে হাত দিয়ে বিলি কাটতে কাটতে, সেই অতি পুরানো পরিচিত কায়দায় বললেন, আমি বোকা, খুবই বোকা। আমি সাহস করে এটা বলতে বাধ্য হচ্ছি। অথচ কোথায় যেন মস্ত বড় একটা ভুল হয়ে গেছে, এটা আমি মনে করছি।

অবাক চোখে তার দিকে তাকালো পোয়ারো, বড় রকমের ভুল? কেমন করে হলো?

যদিও আমিই-এর উদ্যোক্তা….কিন্তু আমার মনে হয়–অতএব যদি আপনার ইচ্ছা হয় আপনি আমাকে বোকা ভাবতে পারেন। তবুও আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, আগামীকাল যদি নকল খুনের বদলে সত্যিকারের খুন হয়; আমি আশ্চর্য হবো না।

মন্তব্য করলো পোয়ারো, দারুণ কৌতূহলের ব্যাপার তো। উৎসাহভরে সে আরও বলল, আপনি একটু আগে বললেন, আপনার মনে হচ্ছে যে আগামীকাল নকল খুনের পরিবর্তে আসল খুন–এটা আপনি ভাবলেন কি করে তাহলে এটা কি প্রতারণা? একটু বিশদভাবে বলবেন, এর কি ব্যাখ্যা হতে পারে?

মিসেস অলিভার বললেন, ব্যাপারটা বোঝানো খুবই কঠিন–এককথায় বলতে হয় ঐ খুনের পরিকল্পনাটা আমার। আমারই পরিকল্পনা, এবং আমারই ভাবনা–অবশ্য সব কিছুই ঠিক হিসাব মতোই। লেখক-লেখিকারা একেবারে কোনো উপদেশ সহ্য করতে পারে না, তাদের সম্বন্ধে যদি আপনার সম্যক ধারণা থাকে তবে। যদি কেউ বলে ভলো হয়েছে, তবুও এটা করলে বা ঐটা করলে ভালো হয় না। অথবা যদি বলে এর পরিবর্তে বিকে শিকার করলে হতো, না হলে ডি-র পরিবর্তে ই খুনী হলে আমার ভালো হত। যাই হোক, তোমারাই তাহলে নিজে লেখনা কেন? এতই যদি জান, এটা আমার বলতে ইচ্ছা হয়।

পোয়ারো মাথা নেড়ে বলল, এটাই কি ঘটতে চলেছে?

না, তা ঠিক নয়–তবে এই ধরনের বিশ্রী প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে সাধারণ এবং মামুলি পরিবর্তনটা আর বিশেষ লক্ষ্য না করেই, চিন্তা না করেই আমি মেনে নিয়েছি।

পোয়ারো বলল, তাই নাকি? অল্পস্বল্প পরিবর্তন সেটা কি খুবই আপত্তিজনক?

বলল মিসেস অলিভার–আমি ঠিক সেইভাবেই বোঝাতে চাইছি। আমি অনুমান করতে পারছি অবশ্যই এর খারাপ দিকটা। তার ফলে খুবই চিন্তিত আমি।

কে দিয়েছে এইসব পরিবর্তনের প্রস্তাব? জানতে চাইলো পোয়ারো।

মিসেস অলিভার জানাল-ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি। আমার পায়ের নিচের মাটি সজাগ থাকতে, যদি একজন কেউ হতো, তাহলে আমার চিন্তার কিছু ছিল না।

আপনার কোনো ধারণা আছে, সেই একজন কে হতে পারে? প্রশ্ন করলো পোয়ারো।

 মাথা নেড়ে অলিভার জানাল, যে ব্যক্তিই হোক সে অতি চতুর এবং সাবধানী।

 সীমিত হওয়া উচিত চরিত্রগুলি, পোয়ারো বলল, এবং সেই চরিত্রগুলির নোক কে কে?

স্যার জর্জ স্টাবস, এই জায়গার মালিক, বৈশিষ্ট্যহীন, বিত্তবান আর কাজের বাইরে সে ভীষণ বোকা। লেডি স্টাবস–হ্যাটি, বয়সে কুড়ি বছরের ছোট হবে স্বামীর থেকে, অপূর্ব সুন্দরী কিন্তু বাকশক্তিহীন–(মাছের মতো) তার বোধশক্তি সাধারণ মানুষের অর্ধেক এবিষয়ে আমি নিশ্চিত। গহনা আর পোশাক ছাড়া আর অন্য কোনো ভাবনা নেই, টাকার জন্য জর্জকে বিয়ে করেছে।

মাইকেল ওয়েম্যান, আরেকজন, বয়সে যুবক এবং সুপুরুষ, একজন আর্কিটেক্ট সে।

একটা টেনিস প্যাভিলিয়ন তৈরি করছে সে জর্জ-এর জন্য আর ফলি মেরামত করছে।

 সেটা আবার কি ফলি–মুখোশধারী? জানতে চাইলো পোয়ারো।

না, এটা একটা স্থাপত্য শিল্প, জানালো অলিভার। সেক্রেটারি হাউসকিপার হলেন মিস ব্রেউইস।

সাহায্যকারী হিসাবে সেই সঙ্গে আরও কিছু লোক আছে। নদীর ধারে তরুণ দম্পতি আলেক লেগি আর তার স্ত্রী শেলি। আর আছেন মাস্টারটন-এর এজেন্ট ক্যাপ্টেন ওয়ারবারটন। মাস্টারটন এবং বৃদ্ধা মিসেস ফোলিয়াট তারাও অবশ্য থাকছেন, তারা লজে থাকেন। নাসের মালিক ছিলো তার স্বামীর প্রজারা। আজ তারা মৃত অথবা যুদ্ধে নিহত। ডেথ-ডিউটি না দিতে পেরে তাদের উত্তরাধিকারীরা জায়গা বিক্রি করে দেয়।

পোয়ারো একটা তালিকা তৈরি করল এইসব চরিত্রগুলির। কেবল তার নামগুলিই হাতে এল এই মুহূর্তে। এবার সে অগ্রসর হলো প্রধান বিষয়ে।

কার মাথা থেকে উদ্ভূত মার্ডার হান্ট। জানতে চাইলো পোয়ারো।

অলিভার উত্তর দিল, আমার মনে হয় মিসেস মাস্টারটন-এর আইডিয়া। তিনি স্থানীয় এম.পি.র স্ত্রী, তার সংগঠন খুব ভালো। তিনি একটা সামাজিক উৎসব করতে বলেন এখানে স্যার জর্জকে।

প্রশ্ন করলো পোয়ারো, আমি যে এখানে হাজির হবই আপনি ভাবলেন কি করে?

মিসেস অলিভার বলল, এটা খুব সহজ কথা। আপনাকে বিতরণ করতে হবে মার্ডার হান্ট-এর পুরস্কার। সবাই শিহরিত হয়ে উঠেছিল আপনার নাম প্রস্তাব করতেই।

সবাই কি আপনার প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল, জানতে চাইলো পোয়ারো।

সবাই শিহরিত হয়েছিলো–একথাই তো বললাম, ভাবলেন মিসেস অলিভার-যুবকদের মধ্যে দু-একজন জিজ্ঞাসা করেছিল কে এই পোয়ারো? অবশ্য এখানে সেকথা বলার প্রয়োজন নেই।

সকলেই সম্মত ছিল? একজন কেউও আপনার প্রস্তাবে বিরোধিতা করেনি? পোয়ারো প্রশ্ন করল।

মাধা নেড়ে অলিভার না জানাল।

অবশ্যই সেটা দুঃখজনক–আমার উপস্থিতি কাম্য হওয়া উচিত নয় একজন বহু অপরাধীর কাছে। বললো এরকুল পোয়ারো।

বিষণ্ণ গলায় মিসেস অলিভার বলল–হয়তো আপনি ভাবছেন সমস্তটাই আমার কল্পনা এবং এটাই আমার ধারণা।

আশ্বাসপূর্ণ কণ্ঠে বললো পোয়ারো, শান্ত হন।

আমি যুগপৎ আগ্রহী এবং মুগ্ধ। এখন আমরা কোনখান থেকে শুরু করব একথাই ভাবছি।

তার হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মিসেস অলিভার বলল, চলুন আমরা এখন বাড়িতে ফিরে যাই, চায়ের সময় হয়ে গেছে। এরপরে আপনি সেখানে সবার সঙ্গে মিলিত হতে পারবেন।

পোয়ারো এখানে এসেছিল যে পথে ঠিক তার বিপরীত পথ ধরে তাকে নিয়ে এলেন মিসেস অলিভার।

বলল মিসেস অলিভার, এই পথে আমরা অতিক্রম করি বোট-হাউস। এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে যেন ভেসে উঠল চোখের সামনে বোট-হাউস–সেটা যেন ভাসছে নদীর বুকে, দূর থেকে দেখে তাই মনে হলো। মিসেস অলিভার বলল, এখানেই নিয়ে যাওয়া হবে দেহটা। দেহটা অর্থাৎ মার্ডার হান্ট-এর জন্য।

পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল, কেউ হয়তো বা খুন হতে পারে?

একজন তরুণ যুগোস্লাভিয়ান এ্যাটম সাইনটিস্ট-এর প্রথমা স্ত্রী, যে একজন ভ্রমণরত মেয়ে, অলিভার বলল।

পোয়ারো চিন্তিতভাবে তাকালো।

এ্যাটম সাইনটিস্ট তাকে হত্যা করেছে এটা আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে। কিন্তু বাস্তবে এত সহজে সমাধান করা সম্ভব নয়।

অবশ্যই, আপনি যখন জড়িত, বললো পোয়ারো। মিসেস অলিভার হাসলো, পোয়ারোর প্রশংসায় সে বলল, তাকে খুন করেছে আসলে অন্য একজন–অবশ্য তার মোটিভ অভূতপূর্ব আমার বিশ্বাস হয় না, যদিও পঞ্চম কু-তে সেটা পরিষ্কারভাবে বোঝানো হয়েছে, তবুও এখানকার লোকেরা সেটাকে ঠিকভাবে মেনে নেবে কি না? মিসেস অলিভারের প্ল্যানের সারবস্তু বাতিল করে দিয়ে পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু আপনি কি করে করবেন উপযুক্ত দেহের ব্যবস্থা।

মিসেস অলিভার বলল, গাইড গার্ল। আর একটা চরিত্র হল শেলি লেগি, কিন্তু এখন তারা তাকে টুপি পড়া অবস্থায় জ্যোতিষীর ভূমিকায় সাজাতে চায়। মারলিন টাকার নামে এই গাইড গার্ল ব্যাকশক্তিহীন আর শাসকষ্টের টানে ভুগছে।

বাখ্যা দিতে গিয়ে সে বলল, কাজটা খুবই সোজা। মাটিতে পড়ে যাবে সে কারো পায়ের শব্দ শুনলেই, আর দড়ির ফাস পরিয়ে দেবে মেয়েটির গলায়।

বেচারা তাকে একা একা থাকতে হবে সেখানে বোট-হাউসে তাকে আবিষ্কার না করা পর্যন্ত, আমি অবশ্য এক বাণ্ডিল কমিকস্-এর ব্যবস্থা করে রেখেছি তার জন্য। খুনীর একটা ক্ল পাওয়া যাবে বস্তুতপক্ষে–অতএব এইভাবে সব ঠিকঠাক কাজ হয়ে যাবে।

সম্মোহিত করার মতো আপনার উদ্ভাবতী ক্ষমতা, এটা চিন্তার ব্যাপার, ঘটনাটা আপনি যে ভাবে সাজিয়েছেন। বলল পোয়ারো।

এটাতে কোনো অসুবিধা নেই, অর্থাৎ চিন্তা করার ব্যাপারে–বলল মিসেস অলিবার।

মুশকিলের কথা হচ্ছে বেশি চিন্তা করেন আপনি এবং ব্যাপারটা সেজন্য জটিল হয়ে পড়ে। সেজন্য আপনাকে বাদ দিয়ে দিতে হবে কতকগুলো ব্যাপার এবং সেটাই হল চিন্তার বিষয়। আসুন এবার আমরা এই পথ দিয়ে যাব।

তারা এগিয়ে যেতে থাকে নদীর ধারে খাড়াই আঁকাবাঁকা পথ ধরে, পিছন ফিরে একটি যুবককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল কিছুটা দূরে, পরনে তার ফ্ল্যানেলের ট্রাউজার এবং সবুজ রঙ-এর শার্ট। তাদের দিকে এগিয়ে এলো সে ঘুরে দাঁড়িয়ে।

মিসেস অলিভার পরিচয় করিয়ে দিল, মিঃ মাইকেল ওয়েম্যান এবং ইনি মাঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো।

পোয়ারোর সঙ্গে পরিচয়-এর সময় তাচ্ছিল্যের ভঙ্গীতে মাথা নাড়ল সে। পোয়ারো ঠিক লক্ষ্য করল।

যুবকটি তিক্তস্বরে বলল, অভূতপূর্ব সুন্দর একটা বোট-হাউস নদীর ধারে, কিন্তু উপায় আছে নাকি এর সৌন্দর্য দেখার। কেটে ফেলতে হবে কম করেও কুড়িটা গাছ। হয়তো তাহলে নদীর বুক থেকে বোট-হাউসের সৌন্দর্য অবলোকন করা যাবে। মোটেই উপযুক্ত নয় জায়গাটা। মিসেস অলিভার বলল, হয়তো অন্য আর জায়গা ছিল না।

মুখ বিকৃত করে ওয়েম্যান বলল, কোনো সৌন্দর্যবোধ নেই এইসব পুঁজিপতিদের। আবার ইনিই একটা ফলির ফরমাশ দিয়েছেন। কোথায় সেটা বসানো হবে, এখানে এই জঙ্গলের ভিতর ছিমছাম একটা পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে জায়গাটা পরিষ্কার করে। তার ফলে এখানকার লোকেরা ফলির স্থাপত্যশিল্পের কদর উপলব্ধি করতে পারবে। বরদাস্ত করা যায় না যে, ঐ লোকটি এমন একটি সুন্দর জায়গার মালিক হয়ে বসে থাকবে।

মনে মনে ভাবল পোয়ারো, এই যুবকটি একেবারে জর্জ স্ট্যাবস-এর বিপরীত। নদীর ধারের মাটি ক্রমশ নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে, আলগা হয়ে যাচ্ছে মাটি, জায়গাটি খুব শীঘ্রই বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। তার থেকে নতুন করে বাঁধানোর ব্যবস্থা করলে ভালো হয়। বোট-হাউস-এর সামনে নদীর ধারটা। এটাই আমার মতামত, কিন্তু আমার কথায় কান দেয় না ঐ জেদী বৃদ্ধ মানুষটা।

যাক খবর কি তোমার টেনিস প্যাভিলিয়নের? জানতে চাইলো মিসেস অলিভার।

যুবকটির কণ্ঠস্বর গোঙানির মতো শোনালো। সে বলল–তিনি এক ধরনের চাইনিজ প্যাগোডা চান। আবার সেই সঙ্গে যদি ড্রাগন-এর ব্যবস্থা করা যায়। কারণ লেডি স্টাবস নিজেকে সাজিয়ে তুলতে ভালোবাসেন চাইনিজ টুপি মাথায় দিয়ে। আচ্ছা এটা কি একটা স্থাপত্য শিল্প? যার কাছে অর্থ নেই তার হয়তো ইচ্ছা করে কোনো জিনিস সুন্দর করে সাজিয়ে তুলতে, আবার যার অর্থ আছে? সে একটা বীভৎস কিছু করে।

আমি আপনাকে গভীরভাবে সমবেদনা জানাচ্ছি, আমি অনুভব করি আপনার ব্যথাটা কোথায়? পোয়ারো বলল, গম্ভীর স্বরে।

মাইকেল বলল, আসল কথা হল টাকা থাকলেই সুন্দর কিছু করা যায় না, রুচি পছন্দ থাকা দরকার। আবার সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় অর্থ খরচ করার মনও দরকার।

তাহলে বেশ তো এমন লোক পাকড়াও করো যে টাকা খরচ করবে, এছাড়া কখনই–তুমি কাজ পাবে না, বলল মিসেস অলিভার। মিসেস অলিভার তারপর বাড়ির দিকে চলতে লাগল। তাকে অনুসরণ করলো পোয়ারো এবং আর্কিটেক্ট যুবকটি নিরুৎসাহভাবে।

একজন ছোটখাট চেহারার বয়স্ক মহিলা নদীর ধারে আগাছা ছাঁটাই-এর কাজে ব্যস্ত–সে সম্ভাবষণ জানালো তাদের উঠে দাঁড়িয়ে।

মহিলাটি বলল, বহু বছর ধরে এখানকার সব কিছুই অবহেলিত। এমন একজন লোককে পাওয়া যায় না আজকাল যার আগাছা সম্পর্কে জ্ঞান আছে, তারা জানে না সেগুলো ঠিকমতো পরিষ্কার করতে পারলে কত সুন্দর করে তোলা যায় জায়গাটাকে। এই পাহাড়ী জায়গাটা মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত রঙিন ফুল ফুটে আলো হয়ে উঠবে, কিন্তু এবছর খুব হতাশ হতে হচ্ছে–প্রাণহীন সমস্ত গাছকে গত হেমন্তে কেটে ফেলা হয়েছিল।

মিসেস অলিভার পরিচয় করিয়ে দিলেন, মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো ইনি–আর এই মহিলাটি মিসেস ফোলিয়াট। পোয়ারোর দিকে স্থির চোখে তাকাল বয়স্কা মহিলাটি। আচ্ছা ইনিই সেই মহান মঁসিয়ে পোয়ারো? আগামীকাল আমাদের সাহায্য করার জন্য এখানে এসে যে কষ্ট স্বীকার করলেন এটা আপনার মহানুভবতার পরিচয়। আমাদের ধাঁধায় ফেলার মতো একটা সমস্যার কথা ভেবেছেন এই চতুর মহিলাটি–সেটা এমন মনোগ্রাহী হবে–

পোয়ারোও কম অবাক হলো না। এই নাতিদীর্ঘ মহিলাটির সহজ সরল আন্তরিকতায়। সে তাকে কার হোস্টেস ভেবে থাকবে, এটাই তার মনে হলো।

অত্যন্ত বিনয়ী কণ্ঠে পোয়ারো বলল, আমার পুরোনো বন্ধু মিসেস অলিভার। আমি খুবই আনন্দিত যে, ওর আমন্ত্রণে এখানে আসতে পেরেছি। খুবই চমৎকার জায়গাটা, আর এই ম্যানসনটাও অপূর্ব।

মিসেস ফোলিয়াট খুশী হলো, হ্যাঁ ১৭৯০ সালে আমার ঠাকুরদা এটি তৈরি করেন। এখানে একটা এলিজাবেথিও বাড়ি ছিল আগে। সেটা ভেঙ্গে পড়ে এবং আগুন লেগে পুড়ে যায় প্রায় ১৭০০ সাল নাগাদ। আমাদের পরিবার এখানে বাস করছে ১৫৯৮ সাল থেকে।

তার বাচনভঙ্গী শান্ত এবং সংযত। তাকে দেখলো পোয়ারো খুব কাছ থেকে গভীর দৃষ্টি দিয়ে।

সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় হল তার চেহারার মধ্যে চোখ দুটি–চায়না ব্লু।

সংশয়ভরা চোখে বাড়ির দিকে যেতে গিয়ে পোয়ারো মন্তব্য করল–আপনার নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হবে এখানে আগন্তুকদের থাকতে দিলে।

মিসেস ফোলিয়াট উত্তর দিল সামান্য সময় চুপ করে থাকার পর, আবেগ মাখানো কৌতূহলে ভরা এবং পরিষ্কার ছিল তার কণ্ঠস্বর-অনেক কিছুই তো কঠিন মঁসিয়ে পোয়ারো।

ড্রয়িংরুমটা বেশ বড় ধরনের। পোয়ারো এখানে এসে ঢুকলো মিসেস ফোলিয়াটকে অনুসরণ করে। লোক ছিল প্রায় সমস্ত ঘরটা জুড়ে, মনে হচ্ছিল তারা যেন এখুনি কথা বলবে।

মিসেস ফোলিয়াট পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল। জর্জ, ইনি মঁসিয়ে পোয়ারো, আমাদের সাহায্য করতে এসেছেন অনুগ্রহ করে, আর উনি স্যার জর্জ স্টাকস।

এতক্ষণ উচ্চস্বরে কথা বলছিল জর্জ স্টাবস। এবার ফিরে তাকালো। বিশাল চেহারা তার। সামান্য অনুচ্চিত দাড়ির সমাবেশ তার লাল উজ্জ্বল মুখে। ঠিক যেন এক অভিনেতার মনে অস্বস্তিকর প্রভাব, ঠিক মনস্থির করতে পারেনি এখনো সে অভিনয় করবে কিনা কোনো গ্রাম্য মানুষের ভূমিকায়। তাকে কখনই নেভির লোক বলে মনে হয় না, মাইকেল ওয়েম্যানের মন্তব্য অনুযায়ী। মাইকেলের কণ্ঠস্বর হাসিখুশীতে ভরা এবং স্বভাবতই আমোদপ্রিয়। অথচ তার ছোট ছোট দুটি চোখ এবং তার দৃষ্টি ধারালো ও কঠিন।

আন্তরিকভাবে সে সম্ভাষণ জানাল পোয়ারোকে। সে বলল, আমরা বিশেষভাবে খুশী হয়েছি কারণ আপনার বন্ধু মিসেস অলিভার আপনাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে এখানে আনতে পেরেছেন। এখানে আপনি ভয়ঙ্করভাবে আকর্ষণীয় হবেন। তার চোখের দৃষ্টি কেমন উদাস হয়ে গেল একথা বলার সময়।

সে ডেকে উঠল, হ্যাটি, সাড়া না পেয়ে আবার সে উচ্চস্বরে ডাকল, হ্যাটি। তখন অদুরে একটা বড় আরাম কেদারায় বসে মিসেস স্টাবস অন্যদের সঙ্গে গল্প করতে ব্যস্ত। সে কান দিচ্ছিল না স্বামীর ডাকে উপরন্তু মুচকে হাসছিল। পোয়ারো যখন তার নিকটবর্তী হল, ছেলেমানুষের মতো অবাক হয়ে সে বলে উঠল–কি ব্যাপার! পরিচয় করিয়ে দিলেন স্যার জর্জ এগিয়ে এসে পোয়ারোর সঙ্গে। ইনি হলেন মিসেস মাস্টারটন। মাস্টারটনের চেহারাটা চমকপ্রদ, পোয়ারোকে তুলনামূলকভাবে ব্লাড হাউন্ডের কথা মনে করিয়ে দিল। সম্পূর্ণ ঝুলে আছে যেন চোয়াল দুটো, চোখ-দুটি যেন একটু রক্তবর্ণ।

জিল, শোন, মিটিয়ে ফেলতে হবে টি টেন্টের এই বিশ্রী ঝামেলাটা, জোর দিয়ে বলল, স্যার জর্জ ওদের একটু জ্ঞান থাকা উচিত এ ব্যাপারে।

পুরো শোটা তো আর বানচাল করে দেওয়া যায় না, এইসব নির্বোধ মহিলাদের ঘরোয়া মনোমালিন্যের জন্য।

তিনি ধমেক উঠলেন, আচ্ছা তুমি কি থামবে একটু। স্যার জর্জ বলল, ক্যাপ্টেন ওয়ারবারটন।

একটা অস্পষ্ট ঘোড়ার ছাপ, চেক স্পোর্টস পরিহিত ক্যাপ্টেন ওয়ারবারটন-এর চেহারায়, মনে হল যেন একটি নেকড়ে হাসছে, তার সাদা তেতো হাসি দেখলে মনে হয়। এর পর সে আলোচনার জের টানল। সে বললো, চিন্তা করবেন না আমি এর মীমাংসা করে নেব। আমি তাদের সঙ্গে কথা বলব, ডাচ কাকার মতো। এবার বলুন, ভবিষ্যৎবক্তার টেন্টের কি খবর? যে খালি জায়গাটা আছে ম্যাগনোলিয়ার পাশে সেখানে হবে কি? তা না হলে যেখানে হলুদ ফুলের বাগান আছে লনের একেবারে শেষ প্রান্তে, সেখানে হবে কি?

তার পরিচয় পর্ব চালিয়ে যেতে থাকে স্যার জর্জ, এরা হলেন মিঃ আর মিসেস লেগি। মিঃ লেগির চেহারা লম্বাটে ধরনের, সেঁতো হাসি রোদে পোড়ামুখে। আকর্ষণীয় লাল চুল তার স্ত্রীর মাথায়, মাথা নাড়লে সে বন্ধুসুলভ মুখে হাসি ফুটিয়ে। তারপর বিতর্কে জড়িয়ে পড়ল মিসেস মাস্টারটনের সঙ্গে।

আমাদের সবাইকে ইনি পরিচালনা করেন, ইনি হলেন মিস ব্রেউইস। পরিচয় করিয়ে দিল জর্জ মিস ব্রেউইস একটা রুপোর চায়ের ট্রের পাশে বসেছিল।

ভদ্রমহিলার বয়স চল্লিশের বেশি হবে, তবে তাকে দেখে যোগ্য বলে মনে হয়। জানতে চাইল সে, কেমন আছেন সঁসিয়ে পোয়ারো। আশা করি ট্রেনে বিশেষ কষ্ট হয়নি। এসময়ে খুব কষ্টকর ব্যাপার ট্রেনে যাতায়াত করাটা। আপনাকে চা দিই এখন, দুধ, চিনি দেবো তো চায়ে?

খুব কম দেবেন দুধ মাদমোয়াজেল, আর চার টুকরো চিনির ট্যাবলেট। তার অনুরোধে মিস ব্রেউইসকে তৎপর হতে দেখে পোয়ারো আরো বলল, আপনারা সবাই দেখছি কাজে ব্যস্ত।

হ্যাঁ, তা তো করতেই হবে। যত সব কাজ তো শেষ মুহূর্তেই এসে যায়। টেলিফোন রিসিভ করতেই সকালের অর্ধেক পার হয়ে গেছে–বললেন, মিস ব্রেউইস। পোয়রোর হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়ে মিস্ ব্রেউইস বলল, মঁসিয়ে পোয়ারো, একটা স্যান্ডউইচ দেবো না কি? পরক্ষণেই তার মনে পড়ল চার টুকরো চিনির কথা। সে বলে উঠল, মনে হয় আপনি ক্রীম কেকই পছন্দ করবেন। সত্যিই তাই। বলে, পোয়ারো নিজের হাতেই তুলে নিল এক টুকরো ক্রীম কেক।

তারপর ধীরে ধীরে গিয়ে বসলো সে তার হস্টেস-এর পাশে। তার অলঙ্কার সামলাতেই ব্যস্ত ছিল সে তখন। পোয়ারোর প্রতি দামি অলঙ্কারে দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিজের থেকেই সে বলে উঠল, খুব চমৎকার এগুলোদেখুন, তাই নয় কি? পোয়ারো তাকে নিরীক্ষণ করছিল খুব সাবধানী দৃষ্টিতে। বড় আকারের একটা কুলি টুপী তার মাথায়, মুখ ও গায়ের চামড়া মৃতের মতো সাদা বিবর্ণ।

সে সাজিয়ে তুলেছিল নিজেকে ইংরেজ ফ্যাশানে। অথচ অবাক করে দিয়েছিল তার চোখ দুটো পোয়ারোকে।

অকম্পিত, নিশ্চল, ভাবলেশহীন, চোখ দুটো তার শিশুর মতোই। সেইভাবেই সে তার প্রশ্নগুলো করছিল, বাচ্চাছেলেরা যেমন চুপিচুপি ছেলে মানুষের মতো কথা বলে থাকে।

আংটিটাও সুন্দর, তাই না? ছেলেমানুষের মতো পোয়ারোও তাকে প্রশ্ন করে বসলো।

খুব খুশী দেখালো তাকে। আমাকে এই আংটিটা দিয়েছে জর্জ সবেমাত্র গতকাল, সে বলল।

 হয়তো কিছু গোপন কথা বলছে এমনভাবে তার কণ্ঠস্বরকে খাদে নামিয়ে আনল, সে আমাকে অনেক জিনিসই দিয়েছে। খুব ভালো মানুষ সে।

একটা প্রশ্ন জাগল পোয়ারোর মনে : তারা ফাঁদ পাতে না, কিংবা জাল বিস্তারিত করে না তারা-লেডি স্টাবস ফঁদ পাততে পারে; এ কথা হয়তো ঠিক, অথবা জাল বিস্তার করতে পারে, অবশ্যই সে একথা কল্পনাও করতে পারে না, তা সত্ত্বেও কেন যেন তার মনে হয়, তার সবকিছুই যেন কৃত্রিমতায় ভরা। সাধারণভাবেই বলল পোয়ারো, আপনার কি মনে হয় না, চমৎকার দেশ এই ডেভনশায়ার।

হা দিনের বেলায়, অবশ্য বৃষ্টি না হলে, তারপরেই অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাল লেডি স্টাবস, একটা নাইট ক্লাবও নেই এখানে।

ও, তাই নাকি? আপনি বুঝি নাইট ক্লাব পছন্দ করেন। সোৎসাহে বলল স্টাবস, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।

আচ্ছা কেন বলুন তো? জিজ্ঞাসা করল পোয়ারো। কারণ সেখানে গান, নাচ, মিউজিক থাকে। আর সেখানে আমি সুন্দরভাবে সাজগোজ করে যেতে পারি। হাতে সুন্দর আংটি, ব্রেসলেট পরতে পারি। অন্য মহিলারাও সুন্দর পোশাক ও অলঙ্কার পরে থাকে। অবশ্য আমার মতো এত ভালো নয়। নিজেই সে তৃপ্তি বোধ করে হেসে উঠল। পোয়ারো তার জন্য করুণা বোধ করল। আর আপনি খুব আনন্দ পান না ঐসবগুলো দেখে, তাই না। প্রশ্ন করলো পোয়ারো।

অবশ্যই। আমি খুব পছন্দ করি ক্যাসিনোও। আচ্ছা বলুন তো কেন ইংল্যান্ডে একটা ক্যাসিনোও নেই? প্রশ্ন করল লেডি স্টাবস।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে পোয়ারো বলল, অনেক সময় আমার অবাক লাগে, তবে এ বিষয়ে যতদূর সম্ভব অনুমতি পাওয়া যাবে না, ইংরাজদের চরিত্র অনুযায়ী। পোয়ারো আবার বলল, তাছাড়াও ম্যাডাম এক সর্বনেশে খেলা, লোকসানই বেশি হয়, লাভের থেকে

না না, আমাদের কাছে সেটা কেনো ব্যাপার নয়। জর্জ-এর বেশ অর্থ আছে। আপনার কি মনে হয় না, বিত্তবান হওয়া খুব সুখের ব্যাপার। বলল, লেডি স্টাবস! নম্বভাবে বলল পোয়ারো, হ্যাঁ সত্যিই ভালো হয়।

আমি যদি ধনী না হতাম, তবে আমাকে এলিতেলীর মতো দেখাত। এবার তার দৃষ্টি পড়ল চায়ের টেবিলে বসে থাকা মিস ব্রেউইস-এর দিকে। আচ্ছা আপনার কি ওকে খুব কুৎসিত মনে হয়না? সঙ্গে সঙ্গে মিস ব্রেউইস চোখ তুলে তাকাল তাদের দিকে। তার চোখ দুটো ঝলসে উঠল হঠাৎ। খুব একটা জোরে কথা বলেনি লেডি স্টাবস। পোয়ারো কিন্তু আশঙ্কা করলো, যে আমাদ্দা ব্রেউইস হয়তো তাদের কথা শুনে ফেলেছে।

যেইমাত্র পোয়ারো তার দৃষ্টির পরিবর্তন করলো তার চোখাচোখি হয়ে গেল ক্যাপ্টেন ওয়ারবারটনের সঙ্গে। বিদ্রুপে ভরা ছিল ক্যাপ্টেনের দুচোখের দৃষ্টি। তাকে দেখে মনে হল, সে বোধহয় বেশ কৌতুকবোধ করছে।

পোয়ারো প্রসঙ্গ পরিবর্তনের চেষ্টা করল।

 সে প্রশ্ন করল, আপনি খুবই ব্যস্ত উৎসবের কাজে?

মাথা নেড়ে হ্যাটি স্টাবস জানাল, না না, খুবই বিরক্তিকর সব কিছু করা এবং বোকামিও বটে। বাড়িতে চাকর-বাকর, মালিরা থাকতে আমি কেন এসব কাজ করতে যাব। হঠাৎ মিসেস ফোলিয়াট কথা বলল তাদের কথাবার্তার মাঝখানে। আমার প্রিয় মহিলা, ওসব কথা এখন অচল হয়ে গেছে। তোমার এইরকম মনোভাব আইল্যান্ড এস্টেট থেকে আমদানী করা। ইংল্যান্ডের জীবনযাত্রা এখন সেরকম নয়, যা তুমি ভাবছে। অনেক বদলে গেছে এখন। ওসব মান্ধাতা আমলের সব ব্যাপার হয়ে গেছে এখন, আমার যা মনে হয়। মিসেস ফোলিয়াট দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এখন সকলেই নিজের হাতে নিজের কাজ করে থাকে। লেডি স্টাবস কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, আমার মনে হয় এসব বোকারাই করে থাকে। তাহলে ধনী হওয়ার মানে কি, যদি নিজেই সব করতে হবে?

হয়তো কেউ কেউ এটা মজার ব্যাপার মনে করতে পারে, মিসেস ফোলিয়াট হাসতে হাসতে বলল। তবে সব বাজে নয়, কিছু কিছু কাজ আমি নিজের হাতে অবশ্যই করে থাকি। বাগানের পরিচর্যা আমি নিজের হাতে করি, আমি উৎসবের কাজ করতে ভালোবাসি নিজের হাতে, যেমন আমি আগামীকাল করব। মিসেস ফোলিয়েট একটু থামলো, তারপর বলল, শোন হ্যাটি, তুমিও এই গ্রাম্য পরিবেশে এখানকার কিছু কিছু কাজ করো। এটা আমি আশা করি। আনন্দ উপভোগ কর এই গ্রাম্য পরিবেশের। তুমি সকালবেলায় বিছানায় না পড়ে থেকে আমাদের সাহায্য করবে এটাই আশা করেছিলাম।

বিরক্ত হয়ে হ্যাটি বলল, আমার মাথার যন্ত্রণা হচ্ছিল। এবার সে মেজাজ বদল করে নরম সুরে বলল, আমি ঠিক ভালো হয়ে যাব আগামীকাল দেখবে। আমি সব কাজ নিজের হাতে করব তুমি যা বলবে।

সে তো খুব ভালো কথা, প্রিয় হ্যাটি আজই কিছু নতুন পোশাক পেয়েছি, সেগুলো সকালে এসেছে। চলো আমার সঙ্গে ওপরে এসো, ওগুলো দেখবে চলো। বলল হ্যাটি।

মিসেস ফোলিয়াট দোনামনা করছিল। লেডি স্টাকস উঠে দাঁড়াল এবং জোরের সঙ্গে বলল, তোমাকে যেতেই হবে; অনুরোধ করছি, একবার চলল, দেখবে কি সুন্দর পোশাক!

জোর করে হাসার চেষ্টা করে মিসেস ফোলিয়াট বলল, আরে সে তো খুব ভালো কথা।

লেডি স্টাবস মিসেস ফোলিয়াটকে সঙ্গে নিয়ে চলে যাওয়ার পর অবাক হয়ে ভাবছিলো পোয়রো, কি অদ্ভুত এই মহিলা, অর্থের কি বিরাট অহমিকা। ভীষণ চিন্তিত নিজের হাতে কাজ করার ব্যাপারে, তারপর হঠাৎ মিসেস ফোলিয়াটের অনুরোধে তার মনোভাব পাল্টে গেল, অন্য সকলের সঙ্গে আগামীকাল কাজে যোগদানের প্রতিশ্রুতি দিল হাসিমুখে–এসব পরিবর্তনের কি মানে হতে পারে। সে কোনো তোয়াক্কা করে না সামাজিক মুখোশের। তাহলে তার এই পবির্তন কেন? তা হলে কি তার অভিনয় এটা? না, হয়তো বা তার থেকেও বেশ কিছু? হয়তো সে কোনো অসুখে ভুগছে এখন, যা অন্য কোনো নারীর মতো এখনো সে বলেনি। হয়তো সে মনে করে মানুষের সহানুভূতি দয়া তার কাম্য নয়।

ক্যাপ্টেন ওয়ারবারটন বলে উঠল হ্যাটির পরিত্যক্ত চেয়ারে বসে পড়ে–উনি একখানা চমৎকার জীব তাই না? সে আড়চোখে দেখল স্যার জর্জ বেরিয়ে যাচ্ছে মিসেস মাস্টারটন এবং মিসেস অলিভারের সঙ্গে। বেশ কায়দাদুরস্ত জর্জ স্টাবস। হিসাবমতো ঠিক।

তবে এসব কিছুই ভালো নয় ভদ্রমহিলার পক্ষে, কারণ এইসব গহনা পোশাক অর্থ সবই মূল্যহীন বলে মনে হবে। আজও আমি সে কথা জানতে পারলাম না যে, স্যার জর্জ কি উপলব্ধি করতে পারছেন? তার স্ত্রীর চাহিদা বাড়তে বাড়তে একসময় কোথায় পৌঁছে যাবে! এটা কোন ব্যাপার নয়, সম্ভবত তিনি একথাই ভাবেন। সাধারণত এই মোটামাথা সম্পন্ন বিত্তবানেরা বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গ পছন্দ করে না।

পোয়ারো কৌতূহল প্রকাশ করল, আচ্ছা বলুন তো উনি কোন জাতি?

দক্ষিণ আমেরিকানদের মতো তো দেখতে, তবে আমার মনে হয় উনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের লোক। চিনি আর মাদকদ্রব্য বিদেশে চালান হয়, সেইসব দ্বীপপুঞ্জের যে কোনো একটা থেকে, আর ওঁর খুব প্রিয় এ দুটো জিনিসই। হয়তো কোনো প্রাচীন পরিবার সেখানে গিয়েছিল। তা বলে এটা ঠিক নয় সেমিশ্রজাত। আমার মনে হয় এইসব দ্বীপপুঞ্জে প্রচলন আছে অন্তর্বিবাহের। যাকে মানসিক ভারসাম্যের অভাব বলে।

যুবতী মিসেস লেগি এগিয়ে এল তাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য। জিমকে সে বলল, দেখ জিম, আমাদের দিকে তোমাকে আসতে হবে। সেইখানেই টেন্টটা করতে হবে, আমরা যেখানে ঠিক করেছিলাম।

একেবারে লনের শেষপ্রান্তে। ওটাই একমাত্র উপযুক্ত জায়গা।

সেরকম কিছু মনে করেন না মাস্টারটন-জিম বলল।

আচ্ছা, তাহলে তুমি বরং ওর সঙ্গে এ ব্যাপারে একবার কথা বলে দেখ। ধূর্ত শৃগালের হাসি ফুটে উঠল তার মুখে।

পুনরায় স্যার জর্জ প্রবেশ করল, বলল সে, শেলি তুমি এখানে ওঃ–তুমি এখানে। আমার দরকার আছে তোমার সঙ্গে, আচ্ছা বলল এ্যামি ফোলিয়াট কোথায়?

উপর তলায় গেছেন তিনি হ্যাটির সঙ্গে–শেলি বলল।

ওঃ তাই নাকি? স্যার জর্জকে অসহায়-এর মতো দেখাচ্ছিল। ওদিকে ব্রেউইস লাফিয়ে উঠল টিকিট লেখা ছেড়ে, এবং বলে উঠল স্যার জর্জের উদ্দেশ্যে, আমি ওঁকে ডেকে নিয়ে আসব স্যার জর্জ?

আমাদ্দা ধন্যবাদ, তারপর অস্পষ্ট স্বরে বলল, কিছু তার-এর জাল নিয়ে এসো তো?

উৎসবের জন্য? না সেজন্যে নয়। শক্ত বেড়া দিতে চাই অরণ্যে, হুডাইন পার্ক আর আমাদের এস্টেটের মাঝখানে। ভেঙে গেছে পুরানো বেড়া আর সেইপথ দিয়ে তারা ঢুকে পড়ে।

কারা?

অনধিকার-প্রবেশকারীরা। হঠাৎ স্যার জর্জ বলে ফেলল। কি আর বলব, ইয়ুথ হোস্টেলটা যেদিন থেকে চালু হয়েছে, বোর্ডাররা সেদিন থেকে আমার এখানে অনধিকার প্রবেশ করছে। অবিশ্বাস্য শর্টস মেয়েদের পরনে, এমনভাবে তাকায় তারা আমার দিকে যেন আমি তাদের আঘাত করছি। ওদের মধ্যে অর্ধেক জন ইংরাজি বলতে পারে না। ভাঙাভাঙা কথায় প্রশ্ন করবে নদী কোথায়? কোথায় ফেরি? এদিকে নয় ওদিকে যতই তাদের বোঝাবার চেষ্টা করি, কিছুতেই ওরা বুঝতে পারে না, চোখ পিটপিট করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। ইতালিও, যুগোশ্লাভিও, ডাচ, ফিনিশ, এস্কিমো ইত্যাদি নানা জাতের মানুষ তারা। একটুও আশ্চর্য হবে না, তাদের মধ্যে অর্ধেক মানুষ যদি কম্যুনিস্ট হয়। আক্ষেপের সুরে জর্জ তার বক্তব্য শেষ করল।

বলল মিসেস লেগি, এসো জর্জ, কমিউস্টিদের আলোচনা এখন আর শুরু করো না। তাকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে গেল সে। তারপর জিমের দিকে ফিরে সে বলল, জিম এসো মহৎ কাজের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়।

পুরস্কার বিতরণ করতে যাচ্ছেন মঁসিয়ে পোয়ারো। সেটা ভালো কথা, সেজন্য ভাবছি ওঁকেও আমি তাড়াতে চাই মার্ডার হান্টের ব্যাপারে।

ভালো কথা তো তুমি এখন থেকেই শুরু করে দাও।

পোয়ারো রাজী হয়ে গেল। বলল, আমি এখানে আপনার জন্য অপেক্ষা করব। চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল আলেক লেগি, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, রমণী যেন ওরা মৌমাছির ঝাক। ঘুরে দাঁড়াল সে জানালার দিকে মুখ করে, মন্তব্য করল, কি মানে হয় এসমস্ত কিছুর। কার কি যায় আসে এতে, যত সব কদাকার বাগান।

পোয়ারো বলল, অবশ্যই এসে যায়। কোনো কোনো লোকের তত ভালো লাগতে পারে।

এখানকার মানুষদের সামান্যতমও বিচার বুদ্ধি নেই কেন এটাই বুঝতে পারি না, তারা কেন চিন্তা করে না সারা বিশ্ব এখন ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে।

সারা বিশ্বের মানুষ এখন আত্মহত্যা করার জন্য ব্যস্ত, তারা কেনই বা এটা উপলব্ধি করে না। এইসব মন্তব্য করছিল আলেক লেগি।

 ভেবে দেখলো পোয়ারো, তার এ প্রশ্নের উত্তর না দিলেও চলবে। এজন্য সে দ্বিধাগ্রস্তভাবে মাথা নাড়ল।

আলেক লেগি যেন ফেটে পড়ল–আমি যদি কিছু না করি তাহলে বেশ দেরি হয়ে যাবে। উত্তেজনায়, ক্রোধে তার মুখটা ভারী হয়েছিল। সে বলল, আচ্ছা, তাই তো আপনি যেন কি ভাবছেন, অবশ্য আমি জানি। বলল পোয়ারোকে, আমার স্নায়ুকোষগুলো দুর্বল, নিউরোটিক রোগী আমি। সেইসব অকর্মণ্য ডাক্তাররা যারা উপদেশ দিয়েছে, বিশ্রাম, সমুদ্রের বায়ুসেবন, স্থান পরিবর্তনের জন্য। সেই কারণেই এখানে এসেছি আমি আর শেলি। একটা মিল কটেজ ভাড়া নিয়েছি তিন মাসের জন্য। তাদের প্রেসক্রিপসন অনুসারেই আমি কাজ করছি।

এখানে আমি সূর্যস্নান করি, মাছ ধরি, ঘুরে বেড়াই

পোয়ারো বিনীতভাবে বলল, ঠিক, আপনাকে আমি দেখেছি সানবাথ নিতে। সব ঠিক হয়ে যাবে তাহলে, যদি ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস রাখেন।

যেন আলেক লেগি কোনো মজা পেল, বলল ভালো কথা,-আপনার কাছ থেকে এ যেন অভাবনীয় কিছু পাওয়া। আচ্ছা যাই হোক, জানেন মঁসিয়ে পোয়ারো, এদেশে কি দেখতে চাই আমি?

হেসে ফেলে বলল পোয়ারো–এবিষয়ে কিছু সন্দেহ নেই যে আপনি বল প্রয়োেগ ও অপ্রীতিকর কিছু দেখতে চান।

তেমনি গাম্ভীর্যপূর্ণ স্বরে আলেক লেগি বলল, আমি চাই প্রত্যেকটি দুর্বলচিত্তের মানুষকে বের করে দেওয়া হোক এখনই। তারা যেন নিঃশ্বাস গ্রহণ করতে না পারে। ধরুণ একটা প্রজন্ম, কেবলমাত্র বুদ্ধিমান লোকদের নিঃশ্বাস নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। তাহলে চিন্তা করে দেখুন পরিস্থিতিটা কি হবে।

শুষ্ক কণ্ঠে পোয়ারো জানালো, তাহলে রোগীদের সংখ্যা ভীষণভাবে বেড়ে যাবে সাইক্রিয়াট্রিক ওয়ার্ডে।

আপনাকে জানিয়ে রাখলাম মিঃ লেগি, যদি কেউ ফুলের বাগান করে তাহলে গাছের শিকড় সমেত ফুল চাইবে সে। কারণ ফুলের গাছ বাঁচতেই পারে না শিকড় না থাকলে। ফুলের বাগান সম্ভব কি শিকড় নষ্ট করে দিলে, লেথাল চেম্বারের একজন প্রার্থী হিসাবে আপনি কি লেডি স্টাবকে বিবেচনা করবেন?

অবশ্যই তাই। আলেক লেগি মতামত জানালো।

কি লাভ বলুন ওর মতো মহিলা থেকে। কি অবদান আছে তার সমাজে? তিনি আর কিছুই ভাবতে পারেন না, দামী গহনা আর ভালো পোশাক ছাড়া। তাহলে কি করে তিনি ভালো মহিলার পায়ে পড়েন।

শান্তভাবে পোয়রো বলল, আপনি আর আমি নিশ্চয়ই বুদ্ধিমান লেডি স্টাবস-এর থেকে। দুঃখের অনুভূতি দেখিয়ে মাথা নেড়ে বলল আবার, আমার সত্যিই ভয় হয়, দামী দামী গহনার মতো আমরা কেবল শোভাবর্ধন করেই চলবে না তো? মিসেস অলিভার এবং ক্যাপ্টেন ওয়ারবারটেন পুনঃপ্রবেশে বাধা পেল মিঃ আলেক, না হলে সে প্রচণ্ড ক্রোধে চিৎকার করতে যাচ্ছিল, শোভাবর্ধন মানেটা

অবশ্যই আপনার মার্ডার হান্ট-এর ক্ল-গুলো দেখা উচিত, আসুন মঁসিয়ে পোয়ারো, এক নিঃশ্বাসে বলল মিসেস অলিভার। তাদের অনুসরণ করল পোয়ারো বাধ্য ছেলের মতোই।

তারা তিনজন একটা ছোট্ট সুসজ্জিত অফিস ঘরে গিয়ে প্রবেশ করল হলঘর পার হয়ে।

মারাত্মক সব অস্ত্র রয়েছে আপনার। বাঁ দিকে লক্ষ্য করল ক্যাপ্টেন ওয়ারবারটন একটা টেবিলের দিকে দৃষ্টি ফেলে। একটা ছোট পিস্তল পড়ে ছিল টেবিলের ওপর, একটা সিসার পাইপ, একটা নীল রঙের বিষের বোতল লেবেল আঁটা, একটা লম্বা কাপড়ের টুকরো, আর একটা হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ।

মিসেস অলিভার বলল, ঐগুলো অস্ত্র, আর সন্দেহভাজন ব্যক্তি হলেন এরা। আগ্রহ সহকারে পড়তে লাগলো পোয়ারো একটা ছাপানো কার্ড তার হাতে তুলে দিতেই।

অনুমিত অপরাধী :

এস্টেল গ্লাইন : — সুন্দরী এবং রহস্যময়ী যুবতী, অতিথি

কর্নেল ব্রান্ড-এর — স্থানীয় গ্রামবাসী, যার মেয়ে

 যোয়ান — বিবাহিতা

পিটার গেই-এর সঙ্গে — তরুণ এ্যাটম বিজ্ঞানী

 মিস উইলিং — হাউস-কীপার

কোয়েট — খানসামা

মায়াস্টেভিস্কি — ভ্রমণরত মেয়ে

এস্টেবান লওয়ালা — অনাহুত অতিথি

না বোঝার ভান করে চোখ পিটপিট করে মিসেস অলিভারের দিকে তাকিয়ে পোয়ারো বলল, দারুণ সব চরিত্রের মিলন। আবার সে নম্রভাবে বলল, যদি ম্যডাম আপনি আমাকে অনুমতি দেন তবে জিজ্ঞাসা করি জানতে পারে প্রতিযোগীদের কী করতে হবে?

ক্যাপ্টেন ওয়ারবারটন বলল, উল্টে দেখুন কার্ডটা। পোয়ারো সেটা উল্টে দেখল, কার্ডের উল্টোদিকে ছাপানো ছিল :

নাম আর ঠিকানা :
সমাধান :
 খুনীর নাম, মোটিভ, সময় ও স্থান, অস্ত্র, সিদ্ধান্তে আসার কারণ।

ক্যাপ্টেন ওয়ারবারটন তাড়াতাড়ি ব্যাখ্যা করে বলল, প্রত্যেককে এই কার্ড দেওয়া হবে প্রবেশ করা মাত্র। একটা নোটবই এবং পেনসিলও দেওয়া হবে কু-গুলো কপি করার জন্য।

ক্লু থাকবে ছটি, দেখে যান একটার পর একটা ক্লু, সন্দেহজনক জায়গায় লুকানো থাকবে ট্রেজার হান্টের অস্ত্রগুলো। একটা ফটো–এই হল প্রথম ক্লু।

এখান থেকে শুরু করতে হবে প্রত্যেককে।

সেই ছোট্ট প্রিন্টটা তার কাছ থেকে নিয়ে ক্রু কুঁচকে পোয়ারো পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। তার বিস্ময় ভাবটা থেকেই গেল উল্টে পাল্টে দেখার পরেও।

ওয়ারবারটন হাসল কি ভেবে।

এই ফটোগ্রাফের কৌশলটার মধ্যে যে একটা নতুনত্ব আছে, স্বীকার করতেই হবে, তাই না? বলল ওয়ারবারটন। তার ওষ্ঠাধারে একটি তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল। আপনি যদি এর সম্বন্ধে একবার জানতে পারেন, তাহলে ব্যাপারটা দেখবেন খুব সাদাসিধা।

কিন্তু পোয়ারোকে খুব অসন্তুষ্ট দেখালো, যেহেতু সে ব্যাপারটা জানে না। সে বলল, জালের আবরণ দেওয়া জানালা।

হ্যাঁ, স্বীকার করছি আমি অনেকটা দেখতে সেইরকম। তবে এটা একটা টেনিস নেট। বলল ওয়ারবারটন।

একটা স্বস্তিজনক শব্দ উচ্চারণ করে পোয়ারো আবার একবার দেখল ম্যাপটা। হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন, সেই রকমই বটে। বলল পোয়ারো।

আপনি জিনিসটাকে কিভাবে দেখেছেন সবটাই তার ওপর নির্ভর করে। ওয়ারবারটন একথা বলে হাসল।

হ্যাঁ, কথাটা নির্ভেজাল সত্য। বলল পোয়রো।

 দ্বিতীয় ক্লু পাওয়া যাবে টেনিস নেটের ঠিক মাঝখানে একটা বাক্সর ভিতর থেকে। এই বোতলটা খালি অবস্থায় পাওয়া যাবে বাক্সের মধ্যে আর এখানে এই আলগা কর্কটা, জানাল ওয়ারবারটন।

মিসেস অলিভার বলল, এটা একটা স্কুটপড বোতল। সুতরাং কর্কটা সত্যিই একটা ক্লু–এটা বুঝতে পারছেন।

ম্যাডাম, আমি জানি, আপনি আপনার ক্রাইম স্টোরিতে থাকেন সবসময়ই। তবু ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছি না আমি–জানালো পোয়ারো।

মিসেস অলিভার তার কথায় বাধা দিয়ে বলল, হা হা, নিশ্চয়ই এটা একটা ম্যাগাজিন সিরিয়ালের মতো একটা সারাংশ। সে পুনরায় জিজ্ঞেস করল ক্যাপ্টেন ওয়ারবারটনের দিকে তাকিয়ে–পেয়েছেন লিফলেটগুলো?

প্রিন্টার্স-এর কাছ থেকে সেগুলো এখনো আসেনি, তবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সন্ধ্যা ছটায় দেবে। আমি নিজে যাব গাড়ি নিয়ে সেগুলো আনার জন্য। বলল ক্যাপ্টেন ওয়ারবারটন।

হায় ভগবান! দীর্ঘশ্বাস ফেললো মিসেস অলিভার, আর সে পোয়ারোর দিকে তাকালো।

আচ্ছা তাহলে আমিই আপনাকে বলছি এই নাটকের সারাংশ। মঁসিয়ে পোয়ারো, অসুবিধা হল এই যে আমি ঠিক ভালো করে গল্প বলতে পারি না লিখতে খুব দক্ষ আমি, কিন্তু কেমন যেন জট পাকিয়ে ফেলি মুখে বলতে গেলে। আর কখনও আমি আমার প্লট কাউকে বলি না একমাত্র সেই কারণে। সে যাই হোক, মিসেস অলিভার আবার বলতে শুরু করলেন একটু থামার পর :

আচ্ছা বলি-গল্পটা এরকম : একজন তরুণ এ্যাটম বিজ্ঞানী পিটার গেই, তাকে সেন্দহ করা হয় একজন কমিউনিস্ট হিসাবে। সে বিয়ে করে যোয়ান ব্লান্ড নামে একটি মেয়েকে। সবাই জানে যে তার প্রথম স্ত্রী মৃত, কিন্তু আসলে সে মৃত নয়। সে একজন সিক্রেট এজেন্ট।

অথবা তা নয়, কিন্তু তার আবির্ভাব ঘটতে দেখা যায়। এটা আমি বোঝাতে চাইছি যে, সে হয়তো সত্যিকারের একজন ভ্রমণবিলাসী মেয়ে। লওয়োলা নামে এক ব্যক্তি, তার সঙ্গে এই প্রথমা স্ত্রীর হয়তো কোনো সম্পর্ক থাকতেও পারে, হয়তো সেই জন্য সেই লোকটি তার সঙ্গে দেখা করতে আসবে, অথবা এটাই হতে পারে যে, সে তার ওপর গোয়েন্দাগিরি করার জন্য আসবে। তারপর একটা চিঠি পাওয়া যাবে ব্ল্যাকমেইল করার জন্য-চিঠিটা হয়তো খানসামা লিখে থাকবে, অথবা হাউস-কীপার। এর মধ্যে সে ও রিভলবারটা উধাও হয়ে যাবে। ব্ল্যাকমেইল করার জন্য কে সেই চিঠি লিখে ছিল ধরুন সেটা আপনি জানেন না, অথবা কেই বা হাইপোডারমিক সিরিঞ্জটা নৈশভোজের টেবিলে ফেলে গিয়েছিল, যদিও সেটা তারপর উধাও হয়ে…।

তার গল্প শেষ করল ঠিক এই জায়গায় এসে মিসেস অলিভার। সহানুভূতির সঙ্গে সে অনুভব করল পোয়ারোর প্রতিক্রিয়া এবং বলল, আমি হয়তো ঠিকমতো গল্পটা বলতে পারিনি এবং আপনিও ঠিক বুঝতে পারেননি, এটা আমি জানি। আমার মাথায় এখন সব ঠিকমতো আসছে না এটাই সত্য কথা। এই গল্পের সারাংশের ছাপানো লিফলেট যখন আপনি পাবেন তখন দেখবেন বিষয়বস্তু আপনার কাছে জলের মতো স্বচ্ছ হয়ে যাবে। গল্প শেষ হবার পর অলিভার বলল, আচ্ছা যাই হোক, আসলে কাহিনী বিশেষ কিছুই নয়, তাই না? অর্থাৎ আপনার কাছে বিশেষ কিছু নয় অত্যন্ত চমৎকার সব প্রাইজ, আপনার কাজ তো পুরস্কার বিতরণ করা। রিভলবারের আকারে তৈরি রুপোর একটা সিগারেট কেস প্রথম পুরস্কার, এই অভিনব পুরস্কারের ব্যবস্থার কারণ, সমাধানকারী কত না চতুর তা বোঝনোর জন্য।

সমাধানকারী সত্যিই চতুর হয়ে থাকে, নিজের মনে ভাবলো পোয়ারো। তবে তার মনে বিশেষ সন্দেহ আছে, সমাধানকারী পাওয়া যাবে কিনা। তার কাছে মনে হচ্ছে মার্ডার হান্ট-এর সমস্ত প্লট আর কার্যকলাপ হয়তো কুয়াশাচ্ছন্ন হয়েই থাকবে।

মিসেস অলিভার পোয়ারোর হাত চেপে ধরে প্রশ্ন করলো, ক্যাপ্টেন ওয়ারবারটন যখন লিফলেটগুলো আনতে চলে গেল, এর মধ্যে কিছু পেলেন কি আপনি? অথবা অন্য কিছু চিহ্নিত করতে পারলেন?

একেবারে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে সকলকে এবং সব কিছুই, বলল পোয়ারো।

জিজ্ঞাসা করল অলিভার, স্বাভাবিক? হয়তো এটা ঠিক কথা নয়। আপনি যেমন বললেন।

লেডি স্টাবস, অবশ্যই স্বাভাবিক নয় এবং মিঃ লেগিকে দেখে স্বাভাবিক মনে হয় না। মন্তব্য করলো পোয়ারো।

হা হা, মিঃ লেগি ঠিক আছে, অলিভার অধৈৰ্য্য হয়ে বলল, তবে একটুতেই সে খুব নার্ভাস হয়ে পড়ে।

কথাটা যদিও মেনে নিল পোয়ারো তবুও তার বক্তব্যকে সমর্থন জানাতে পারল না।

সবার অল্পবিস্তর উত্তেজনা বা নার্ভ ফেল করার সম্ভাবনা থেকেই যায়, এরকম একটা কিছু মনোরঞ্জক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে গেলে। আচ্ছা সেটা যাই হোক, আপনি কেবল একটু আলোকপাত করুন–বলল পোয়ারো।

মুখে আঙুল স্পর্শ করে অলিভার বলে উঠলেন, চুপ এদিকেই আসছে যেন কে

মিস ব্রেউইস এসে দাঁড়ালেন দরজার সামনে।

–তাই তো, আপনি এখানে মাঁসিয়ে পোয়ারো?

আর আমি চারিদিকে খুঁজে বেড়াচ্ছি আপনাকে ঘর দেখানোর জন্য, বলল ব্রেউইস।

মিস ব্রেউইস পোয়ারোর ঘর দেখানোর সময় কথা প্রসঙ্গে বলল, মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার পছন্দ হয়েছে তো, দোতলার নদীর ধারে এমন সুন্দর ঘর। দারুণ পছন্দ হয়েছে, হাসতে হাসতে বলল পোয়ারো। ভাবছি আমার ধন্যবাদটা কাকে জানাব, আমার আকর্ষণীয় হোস্টেলকে না আপনাকে?

বেশ একটু তেতো গলায় মিস ব্রেউইস বলল, আকর্ষণীয়!

হ্যাঁ, তা ঠিক। লেডি স্টাবস তার বেশির ভাগ সময় ব্যয় করেন নিজের সৌন্দর্য পরিস্ফুট করে তোলার জন্য।

মহিলা সাজসজ্জা-বিলাসী-কৌতুক-এর স্বরে বলল পোয়ারো।

 পোয়ারোর চোখে দৃষ্টি স্থির রেখে নীরস কণ্ঠে বলল মিস ব্রেউইস, আপনার যেমন বক্তব্য…

লেডি স্টাবস বেশ ভালোভাবেই জানেন তিনি কি করছেন। আপনি যেমন বললেন, সাজগোজ-বিলাসী মহিলা, তাছাড়াও বেশ চতুর মহিলা তিনি!

যখনই মিঃ পোয়ারো তার দিকে বিস্মিত চোখে তাকাতে যাবে, তার পূর্বেই দ্রুত পায়ে মেয়েটি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পোয়ারো অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো, ব্রেউইস একজন রীতিমতো অভিজ্ঞ মেয়ে হয়ে তার মতো একজন আগন্তুক-এর কাছে কি করে খোলাখুলিভাবে সব কিছু বলল, বিশেষজ্ঞ লেডি স্টাবস সম্পর্কে? অভিজ্ঞতা থেকে সঙ্গে সঙ্গে পোয়ারো বুঝতে পারল যে, সে একজন বিদেশী। বিদেশীদের কাছে কিছু প্রকাশ করাটা ইংরেজরা ধর্তব্যের মধ্যে চিন্তা করে না।

মনোসন্নিবিষ্ট করে পোয়ারো ভাবছিলো, যেন হুঁশ ফিরে পেয়ে সে এসে দাঁড়ালো জানালার সামনে। এই সময়ে সে দেখল লেডি স্টাবস মিসেস ফোলিয়াটের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে আসছেন। কিছু দূরে ম্যাগনোলিয়া গাছের নিচে দুজনে কিছুক্ষণ কথা বলার পর মিসেস ফোলিয়াট মাথা নেড়ে বিদায় নিল তার কাছ থেকে। ফোলিয়াটের হাতে ছিল গ্লাভস এবং বাগান পরিচর্যা করার ঝুড়ি। অন্যমনস্কভাবে গাছ থেকে একটা ম্যাগনোলিয়া ফুল তুলে লেডি স্টাবস নদীর দিকে এগিয়ে গেল ফুলের ঘ্রাণ নিতে নিতে। মাত্র একবার সে পিছন ফিরে তাকাল দৃশ্যের বাইরে চলে যাওয়ার আগে। মাইকেল ওয়েম্যানকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল ওদিকের ম্যাগনোলিয়া গাছের পেছন থেকে। থামল সে একমুহূর্তের জন্য তারপর এগিয়ে গেল নদীর দিকে।

পোয়ারো চিন্তা করল সুদর্শন এই তরুণটি, কর্মকুশলও বটে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে স্যার জর্জ স্টাবস-এর থেকে অনেক বেশি আকর্ষণীয়, ভাবলো সে। তাহলে এর অর্থ কি, যদি তাই হয়? এই যে বৈষম্য স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তাহলে তাদের জীবনের কি পরিণতি হতে পারে? স্বামী ধনবান, মাঝবয়স্ক, আকর্ষণহীন; আর স্ত্রী সুদর্শনা যৌবনবতী যার মানসিক বিকাশে এখনো পূর্ণতা আসেনি–এরকম এক রমণীর কাছে একজন বিচক্ষণ সুপুরুষ যুবকের যোগাযোগের কি অর্থ হতে পারে। এরকুল পোয়ারো মিসেস অলিভারের টেলিফোনে জরুরী তলবের পিছনে কিছু একটা ইঙ্গিত বহন অনুভব করল। মিসেস অলিভারের অনুমান ক্ষমতা নিঃসন্দেহে প্রখর তবুও…।

নিজের মনে অস্পষ্টভাবে উচ্চারণ করে বলল পোয়ারো। কিন্তু যাই হোক, আমি কোনো পরামর্শদাতা নই এসব অবৈধ ঘটনার ব্যাপারে। কোথায় যেন একটা এলোমেলো কিছু ঘটতে যাচ্ছে এটাই অলিভারের ধারণা। সত্যিই কি অস্বাভাবিক কিছু ঘটতে যাচ্ছে? মিসেস অলিভার নিজেই একা, সব কিছু তালগোল পাকিয়ে ফেলে। এরকম লেখিকা যে কি করে নিপুণভাবে গোয়েন্দা কাহিনী লিখে থাকে, পোয়ারো একথাটা বুঝতে পারে না। তবুও হঠাৎ এক একটি সত্য উদঘাটন করে, মহিলাটি তাকে এক একসময় চমকে দেয়।

পোয়ারো স্বগতভাবেই বললো, সময় খুব সংক্ষিপ্ত।