০৭. অভিব্যক্তিহীন চোখে

সপ্তম পরিচ্ছেদ

৭.১

কর্নেল ওয়েস্টনের দিকে অভিব্যক্তিহীন চোখে তাকিয়ে ক্রিস্টিন বললো, না-মানে, কেউ হয়তো ওকে ব্ল্যাকমেল করছিলো।

কিন্তু আপনি কি তা জানেন?

ঘটনাচক্রে ব্যাপারটা আমি জানতে পারি। একদিন হঠাই কিছু কথা আমার কানে আসে। ঘটনাটা ঘটে দুদিন–না তিনদিন আগে রাতে। আমরা তখন ব্রীজ খেলছিলাম। মনে আছে মঁসিয়ে পোয়ারো? আমি ও আমার স্বামী। আর আপনি এবং মিস ডার্নলি–এই চারজনে তাস খেলছিলাম। ঘরের বদ্ধ হাওয়ায় আমার শ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছিলো তাই একটু খোলা হাওয়ার লোভে বাইরে যাই। সমুদ্রতীরের উদ্দেশ্যে নামছি। হঠাৎ আর্লেনা মার্শালের কণ্ঠস্বর কানে এলো। আমাকে শুধু শুধু চাপ দিয়ে কোনো লাভ নেই। আর টাকার জোগাড় করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার স্বামী সন্দেহ করবে। তারপর কোনো পুরুষের কণ্ঠস্বর ভেসে উঠলো। ওসব হেঁদো কথায় আমি ভুলছি না। যেমন করে তোক টাকা আমার চাই। আর্লেনা বললো, নিচ, ইতর জানোয়ার কোথাকার? লোকটা বললো, জানোয়ার হই আর যাই হই, দেবী। টাকা তোমাকে দিতেই হবে। আমি তখন হোটেলের দিকে ফিরলাম। আর্লেনা ঝড়ের বেগে আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। বিচলিতভাবে।

আর লোকটা, তাকে চিনতে পেরেছেন?

 না, সে খুব নীচু গলায় কথা বলছিলো। তার গলার স্বর খুব অস্পষ্ট এবং কর্কশ ছিলো।

ধন্যবাদ, মিসেস রেডফার্ন।

.

৭.২

ইনসপেক্টর বললেন, যাক এতক্ষণে একটু আলোর ইশারা পাওয়া গোল। এই হোটেলেরই কোনো বাসিন্দা মৃতা মহিলাটিকে সযত্নে ব্ল্যাকমেল করছিলো।

পোয়ারো বললেন, কিন্তু সেই ব্ল্যাকমেলার নিহত হয়নি। মারা গেছে তার শিকার।

হ্যাঁ, ব্ল্যাকমেলার কখনও তার শিকারকে খুন করে না। কিন্তু মিসেস মার্শাল আজ সেই অজ্ঞাত ব্ল্যাকমেলারের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন এবং সঙ্গত কারণেই তিনি চাননি, এ ঘটনা তার স্বামী বা রেডফার্ন জানতে পারুক। উপযুক্ত কাজের উপযুক্ত স্থানই বটে। মিসেস মার্শাল তার নিত্যনৈমিত্তিক অভ্যাস মতো ভেলায় ভেসে পড়লেন। তিনি পিক্সি কোভে গোপন সাক্ষাৎকারের জন্য রওনা হন।

পোয়ারো বলেন, হ্যাঁ, গোপন সাক্ষাৎকারের পক্ষে জায়গাটা আদর্শ স্থান। দ্বীপের দিক থেকে পৌঁছবার একমাত্র পথ, ঝোলানো ইস্পাতের মইটা। ঝুলন্ত পাহাড়ের নিচে বলে ওপর থেকে বেলাভূমি থেকে পাহাড়ের আড়ালে। তাছাড়া ওখানে না কি একটা গুপ্ত গুহা আছে। যার প্রবেশ পথ পাওয়া মুস্কিল। সেখানে যে কেউ আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে।

ওয়েস্টন বললেন, হ্যাঁ, পিক্সি গুহার কথা শুনেছি বটে।

কলগেট বললেন, জায়গাটা আমাদের–একবার সরেজমিনে তদন্ত করে দেখা উচিত, হয়তো কোনো সূত্র পেলেও পেতে পারি।

হ্যাঁ, কলগেট, তোমার কথাই ঠিক। মিসেস মার্শাল পিক্সি কোভে কেন গিয়েছিলেন? সেখানে কার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন।

হোটেলের চাকর-বাকরদের বাদ দিয়ে থাকেন মার্কিন ভদ্রলোক গার্ডেনার, মেজর ব্যারী, মিঃ ব্ল্যাট, ধর্মযাজক স্টিফেন। মার্কিন ভদ্রলোক তো সারাটা সকাল সমুদ্রতীরেই ছিলেন, শুধু মাঝে একবার স্ত্রীর জন্য একটা উলের গোছ নিয়ে আসতে গিয়েছিলেন। মেজর ব্যারী আজ সকাল দশটায় বেরোন, ফিরে আসেন দেড়টা নাগাদ।মিঃ লেন বেরোন আরও সকালে। আটটার সময় তিনি প্রাতঃরাশ সেরে বলেন একটু পদব্রজে ভ্রমণে যাচ্ছেন। মিঃ ব্ল্যাট রোজকার মতো সাড়ে নটা নাগাদ নৌকা নিয়ে বেরোন। এখনো কেউ ফেরেননি।

ইনসপেক্টর বলেন, নৌকো নিয়ে বেরিলয়েছিলেন, আমাদের সন্দেহের কাঠামোয় এই ভদ্রলোক চমৎকার মানিয়ে যাচ্ছেন, স্যার।

আচ্ছা, এই ব্ল্যাট ভদ্রলোকের সঙ্গে একবার কথা বলবো। একবার রোজামন্ড ডার্নলি আর ওই ব্রুস্টার মহিলা, যিনি রেডফার্নের সঙ্গে মিসেস মার্শালের মৃতদেহ আবিষ্কার করেন।

বেশ বুদ্ধিমতী মহিলা স্যার। পরিচ্ছন্ন পরিপাটি।

এই মৃত্যু সম্পর্কে তার বক্তব্য কি?

 যদ্দুর জানি কোনো খবর তার কাছে নেই। এছাড়া রয়েছেন মার্কিন ভদ্রলোক ও তার স্ত্রী।

ওদের সবাইকে এখানে আসতে বল; যত তাড়াতাড়ি পার ঝামেলা মিটিয়ে ফেলা যাক। হয়তো এই ব্ল্যাকমেল সম্পর্কে কিছু জানা যাবে।

.

৭.৩

মিসেস গার্ডেনার তার বিশদ ব্যাখ্যা শুরু করলেন। আমাদের অবস্থাটা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, কর্নেল, এই ঘটনায় আমি মানসিক আঘাত পেয়েছি। আর মিঃ গার্ডেনার আমার স্বাস্থ্য সম্পর্কে বরাবরই সতর্ক–তিনি আমাকে বললেন, ব্যারি তুমি একা যাবে না। আমি সঙ্গে যাবো। তদন্তের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ পুলিশের পদ্ধতি অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও উন্নতমানের আমি তা বিশ্বাস করি। যখন স্যাভয় হোটেলে আমার ব্রেসলেট হারিয়ে গেলো তখনকার তদন্তের সময় আমি বুঝতে পেরেছি। ব্রেসলেটটা সত্যি হারায়নি, আমি ভুল করে রেখেছিলাম। আর মিঃ গার্ডেনারও আমার সঙ্গে একমত হবেন, ব্রিটিশ পুলিশকে সাহায্য করার জন্য আমরা সর্বদাই উদগ্রীব।

কর্নেল ওয়েস্টন বলেন, মিসেস গার্ডেনার, শুনলাম আপনি ও আপনার স্বামী সারা সকালটা আজ সমুদ্রতীরেই কাটিয়েছেন?

হ্যাঁ, সেখানেই তো ছিলাম আমরা–কি সুন্দর, শান্ত ছিলো আজকের সকালটা। আমরা ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। বাঁক পেরিয়ে ওই নির্জন সৈকতে কি কাণ্ডটাই না ঘটে চলেছে।

মিসেস মার্শালকে আজকে দেখেছেন কি?

না, সেইজন্যই তো ওডেলকে বলছিলাম–মিসেস মার্শালকে তো দেখছি না। প্রথমে তার স্বামী খোঁজ করল, তারপর এলো ঐ সুদর্শন যুবকটি। সে ছেলেটির যে কি অধৈৰ্য্য কি বলবো। মিসেস মার্শালকে আমরা সাংঘাতিক মেয়ে বলে মনে করি। ক্যাপ্টেন মার্শালের মতো এমন চমৎকার ভদ্রলোক কি করে যে ওকে বিয়ে করে বসলেন, তাছাড়া তার মেয়ে এখন বড় হয়েছে। ক্যাপ্টেন মার্শালের যদি সামান্যতম বাস্তববুদ্ধি থাকতো। তাহলে তিনি ডার্নলির মতো মহিলাকেই বিয়ে করতেন। রোজামন্ড ডার্নলির দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন, তার বুদ্ধির অভাব নেই। যে কোনো কাজ পরিকল্পনা মাফিক শেষ করবে। আমি যে তাকে কতখানি শ্রদ্ধা করি। মিস ডার্নলি তো মার্শালের প্রেমে অন্ধ। শুনেছি ওরা নাকি ছোটবেলা থেকেই পরস্পরকে চিনতেন। আমাকে সংকীর্ণমনা ভাববেন না, আমি অভিনয় পছন্দ করি। কিন্তু ওই মেয়েটার মধ্যে কোথায় যেন একটা অশুভ ছায়া লুকিয়েছিল।

কর্নেল ওয়েস্টন মরিয়া হয়ে বললেন, আচ্ছা ধন্যবাদ। মিসেস গার্ডেনার তাহলে আপনারা কেউই কিছু দেখেননি।

উঁহু-সেরকম কিছুই না। মিসেস মার্শাল বেশিরভাগ সময়েই রেডফার্নের সঙ্গে ঘুরতো সে তো সবাই জানে।

কিন্তু তার স্বামী কি তাতে অসন্তুষ্ট হতেন?

ক্যাপ্টেন মার্শাল খুব চাপা স্বভাবের, বাইরে থেকে দেখে তার মনের কথা বোঝা যায় না।

.

৭.৪

 মেজর ব্যারী যে সত্যি সত্যিই বিস্মিত ও আতঙ্কিত তা তার স্বরেই বোঝা যাচ্ছিল, যে কোনোভাবে আপনাদের সাহায্য করতে পারলে আমি খুশি হবো। অবশ্য পাত্রপাত্রী কারো সঙ্গেই অমার পরিচয় নেই, আমি কিছু জানি না। বস্তুত এই ঘটনাটা আমাকে সিমলার একটা ঘটনা মনে করিয়ে দেয়। লোকটির নাম ছিলো রবিনসন নাকি ফ্যালেকনার। সে ছিলো ইস্ট উইস্টশ অথবা নর্থ সারেস-এর লোক। শান্তবিষ্ট মানুষ বইয়ের পোকা–মনে হয় একেবোরে ভিজে বেড়ালটি। একদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ নিজের স্ত্রীকে গলা টিপে ধরে। বউটা না কি অন্য কার সঙ্গে ইয়ে চালিয়ে যাচ্ছিলো। অল্পের জন্য মেয়েটা প্রাণে বেঁচে যায়। আমরা কখনো ভাবিনি, লোকটার ভেতর এত তেজ আছে।

পোয়ারো বললেন, আর এই ঘটনার সঙ্গে মিসেস মার্শালের মৃত্যুর একটা সাদৃশ্য আছে, তাই তো?

হা–মানে। হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ভয়ঙ্কর কিছু একটা করে বসা।

আপনার ধারণা, ক্যাপ্টেন মার্শাল তাই করেছেন।

না, মিঃ মার্শাল সম্পর্কে কোনো কথাই আমি বলিনি, সে অত্যন্ত ভালোমানুষ।

কিন্তু, একটু আগে একজন প্রতারিত স্বামীর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার কথা বলেছেন।

হ্যাঁ, মানে, রেডফান ছেলেটাকে মিসেস মার্শাল একেবারে সুতোয় করে নাচাচ্ছিলেন। কিন্তু মজার ব্যাপার, নিজের স্ত্রীর ব্যাপারে স্বামী দেবতারা বিশ্বাসে একেবারে অন্ধ। পুনায় এরকম একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। খুব সুন্দরী মেয়েটি। ওঃ, নিজের স্বামীকে কম ঝাটে ফেলেনি সে।

কর্নেল ওয়েস্টন বললেন, ঠিক আছে মেজর-ব্যারী। আপনি তাহলে ব্যক্তিগতভাবে এমন কিছু জানেন না, যা আমাদের তদন্তে সাহায্য করতে পারে?

সেরকম কোনো তথ্য আমি দিতে পারছি না।

আজ সকালে মিসেস মার্শালকে দেখেননি?

সকালে কারও সঙ্গেই আমার দেখা হয়নি। সেন্ট লু-তে গিয়েছিলাম। এমনই দুর্ভাগ্য যে, ঘটনার দিনই আমি অনুপস্থিত।

আপনি তাহলে সেন্ট লু-তে গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ, একটু টেলিফোন করার দরকার ছিলো। এখানে ফোনের ব্যবস্থা নেই।

আপনার ফোনের বক্তব্য গোপনীয় ছিলো?

মেজর চোখ টিপে সহাস্যে বললেন, হ্যাঁ, চেয়েছিলাম আমার এক বন্ধুকে ডেকে তার মারফত একটা বিশেষ ঘোড়ার ওপর বাজি রাখতে। কিন্তু লাইন পেলাম না।

আপনি কোথা থেকে ফোন করেছিলেন?

 সেন্ট লু-র প্রধান ডাকঘর থেকে। এই তো, সবে আধঘণ্টা হলো ফিরেছি।

সেন্ট লু-তে কারও সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিলো?

স্বভাবসিদ্ধ চাপা হাসিতে মেজর ব্যারী বললেন, অ্যালিবাই প্রমাণ করতে বলছেন? সেন্ট লু-তে প্রায় হাজার পঞ্চাশ লোককে দেখেছি।

এ ধরনের মিয়মমাফিক প্রশ্ন আমাদের করতেই হয়।

সে কথা ঠিক। সাহায্য করতে পারলে খুশী হবো। আমিও চাই খুনী ধরা পড়ুক। নির্জন সমুদ্র সৈকতে হত্যাকাণ্ড।

ইনসপেক্টর ধন্যবাদ বলে তাকে বিদায় দিয়ে এসে বললেন, সেন্ট লু-তে কোনো খোঁজখবর নেওয়া একটা কষ্টকর হবে। কারণ সেখানে এখন ছুটির মরসুম।

পুলিশপ্রধান বললেন, হ্যাঁ, মেজর ব্যারীকে সন্দেহের তালিকাভুক্ত করা চলে। অবশ্য এইরকম ক্লান্তিকর বাঁচাল বৃদ্ধ বহু দেখা যায়। কিন্তু তবুও মেজরের দিকে নজর রাখতে হবে। কলগেট খোঁজ নিয়ে দ্যাখো, কটার সময় তিনি গাড়ি নিয়ে বেরিলয়েছেন, ট্যাঙ্কে কতটা তেল ছিলো। হয়তো কোনো নির্জন জায়গায় গাড়ি রেখে তিনি দ্বীপে ফিরে পিক্সি কোভে যান।

কলগেট বললেন, হ্যাঁ, বিশেষ করে আজই প্রচুর স্যারাব্যাং গাড়ি এখানে উপস্থিত আছে। জোয়ার ছিলো সাতটায়। আর ভাটা হবে বেলা একটায়। সুতরাং লোকেরা কংক্রীট সেতু এবং বেলাভূমিতে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছিলো।

ওয়েস্টন বললেন, কিন্তু তাকে সেতু পার হয়ে হোটেলের পাশ দিয়েই তো আসতে হবে।

ঠিক পাশ দিয়ে না এসে অন্য রাস্তায় গেছেন তিনি, হয়তো নৌকো বেয়ে ঘুর পথে পিক্সি কোভে গিয়ে থাকবেন।

ওয়েস্টন সম্মতি জানিয়ে, এটা অবশ্য যুক্তিগ্রাহ্য। যদি সমুদ্রের কিনারায় তিনি আগে থাকতেই নৌকাটা রেখে থাকেন, তাহলে পিক্সি কোভে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। সুতরাং ব্যাপারটা আমি তোমার ওপর ছেড়ে দিচ্ছি কলগেট। এখন, তাহলে মিস ফ্রস্টারের সঙ্গে কথা বলা যাক।

.

৭.৫

 এমিলি ব্রুস্টার নতুন কোনো তথ্য দিতে পারলেন না।

ওয়েস্টন বললেন, তার মৃতদেহ আবিষ্কার ছাড়া আপনি এমন কিছু জানেন, যা আমাদের তদন্তে সাহায্য করতে পারে?

ব্রুস্টার বললেন, উঁহু। তবে আশা করি খুব শীগগির এর একটা সমাধান করতে পারবেন।

কি বলতে চান আপনি?

শুধু বলতে চাই, এ ধরনের ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে সমাধান সহজেই হওয়া উচিত।

আপনি তাকে পছন্দ করতেন না?

 না, কারণ আমার খুড়তুতো ভাই আরস্কিনদের একজনকে বিয়ে করে। আপনারা হয়তো জানেন। আর্লেনা বৃদ্ধ রবার্টের ওপর এমন প্রভাব বিস্তার করে যে, তিনি নিজের আত্মীয়-স্বজনকে বঞ্চিত করে সমস্ত সম্পত্তি ওই মেয়েটিকে দিয়ে যান। প্রথমতঃ আর্লেনার সঙ্গে তার ঘনিষ্ট সম্পর্ক এক চরম কেলেঙ্কারীর সৃষ্টি করে তার ওপর ওকে পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড উইল করে দেওয়ায় বোঝা যায় যে, সে কি চরিত্রের মেয়ে ছিলো। আর একজন হতভাগ্য যুবক ওর জন্য পাগল হয়ে ওর পেছনে খরচ করার জন্য কিছু শেয়ার তছনছ করে দিয়েছে। কেমন করে রেডফার্ন ছেলেটার মাথাটা চিবিয়ে খাচ্ছিলো। যদি জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করতে ভালো হতো। গলা টিপে খুন, ভীষণ বিশ্রী।

তাহলে আপনার ধারণা, খুনী মিসেস মার্শালের অতীত জীবনের কোনো শত্রু? সে সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে মূল ভূখণ্ড থেকে এসেছে?

তাকে দেখবার লোক কোথায়? সকলেই তো সমুদ্রতীরে ছিলাম। অবশ্য মিস ডার্নলি ছাড়া…

কেন, মিস ডার্নলি কোথায় ছিলেন?

হোটেলের পশ্চিমদিকের পাহাড়ের কিনারায় সানি লজে। আমি ও মিঃ রেডফার্ন নৌকা বেয়ে যখন যাচ্ছিলাম তাকে বসে থাকতে দেখেছি।

কর্নেল ওয়েস্টন বললেন, আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন, মিস ব্রুস্টার, মিসেস মার্শালের অতীত জীবনে নিহিত কোনো সূত্রই আমাদের নজর এড়িয়ে যাবে না।

.

৭.৬

 ইনসপেক্টর বললেন, ভদ্রমহিলা একটু একরোখা প্রকৃতির। আর মৃতা মহিলার সম্পর্কে যা বললেন–তাতে বোঝা যাচ্ছে যে, মধুর সম্পর্ক ছিল না।

আপনি কি তার হাত দুটো লক্ষ্য করেছেন? যে কোনো পুরুষের মতো বড়সড়। তাছাড়া তার শরীরের গঠনও বেশ ঋজু–অনেক পুরুষের চেয়েও তার শক্তি বেশি…আপনি বলছেন মঁসিয়ে পোয়ারো, তিনি আজ সকালে একবারের জন্যও বেলাভূমি ছেড়ে যাননি?

প্রিয় ইনসপেক্টর, তিনি যখন সমুদ্রতীরে আসেন তখন মিসেস মার্শাল পিক্সি কোভেতে পৌঁছাননি এবং মিঃ রেডফার্নের সঙ্গে নৌকা নিয়ে বেরোবার সময় পর্যন্ত আমার চোখের সামনেই ছিলেন।

তাহলে তো তাকেও বাদ দিতে হয়।

.

৭.৭

 রোজামন্ড ডার্নলি প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই এরকুল পোয়ারো খুশির একটা উদ্বেল অনুভব করলো।

রোজামন্ড বললো, আপনারা বোধহয় আমার নাম ঠিকানা জানতে চান? রোজামন্ড অ্যান ডার্নলি। রোজামন্ড লিমিটেড নামে, ৬২২, ব্রুক স্ট্রিটে আমার একটা পোশাক তৈরির প্রতিষ্ঠান আছে।

ধন্যবাদ, মিস ডার্নলি। আজ সকালে আপনার গতিবিধি

সাড়ে নটায় প্রাতঃরাশ শেষ করে ওপরে ঘরে গিয়ে কয়েকটা বই ও সূর্য আচ্ছাদন নিয়ে সানি লজ-এ চলে যাই। তখন দশটা পঁচিশ হবে। বারোটা বাজতে দশ নাগাদ আমি হোটেলে ফিরে আসি। টেনিস র‍্যাকেট নিয়ে টেনিস কোর্টে যাই, প্রায় মধ্যাহ্নভোজ পর্যন্ত খেলেছি।

আজ সকালে মিসেস মার্শালকে দেখেছিলেন?

না।

 তিনি যখন ভেলা ভাসিয়ে পিক্সি কোভের দিকে যান তখন কি সানি লজ থেকে আপনি দেখেছিলেন?

না। হয়তো আমি সেখানে পৌঁছাবার আগেই উনি পার হয়ে যান।

 মিঃ রেডফার্ন এবং মিস ব্রুস্টারকেও নিশ্চয় আপনি যেতে দেখেননি?

না, দেখিনি।

মিঃ মার্শালের সঙ্গে তো আপনার আগেই পরিচয় ছিলো, তাই না?

ক্যাপ্টেন মার্শাল আমাদের পরিবারের একজন পুরোনো বন্ধু। একসময় পাশাপাশি বাড়িতে থাকতাম। মাঝে প্রায় বারো বছর আমাদের দেখা হয়নি…।

আর মিসেস মার্শাল? ওদের সম্পর্ক কেমন ছিলো, জানেন কি?

আমি যদুর জানি-খুবই ভালো ছিলো।

মিসেস মার্শালকে আপনি পছন্দ করতেন?

না। মহিলা মহলে আর্লেনা মার্শাল তেমন জনপ্রিয় ছিলেন না। কিন্তু আর্লেনার পোশাকের প্রশংসা না করে পারছি না। ওকে আমার দোকানের খদ্দের করতে পারলে সত্যিই খুশি হতাম।

আচ্ছা, মিসেস মার্শালকে কেউ কি ব্ল্যাকমেল করছিলো?

ব্ল্যাকমেল করছিলো আর্লেনাকে।

 কিন্তু অসম্ভব তো নয়।

না। এ পৃথিবীতে সবকিছুই সম্ভব। সেটা ঠেকে শিখতে হয়। কিন্তু আর্লেনাকে কেন ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছিলো?

হয়তো এমন কতগুলো বিষয় ছিলো যেগুলো তার স্বামীর কানে যাতে না যায়?

হতে পারে। আর্লেনা বরাবরই একটু বেপরোয়া। নিজেকে কখনো সতী সাবিত্রী বলে জাহির করতো না।

তাহলে তার স্বামী সবই জানতেন?

আসলে মনে হয় কেনেথ মার্শাল আর্লেনাকে আর্লেনা হিসেবেই মেনে নিয়েছেন, ওর সম্পর্কে কোনো ভ্রান্ত ধারণা ছিলো না। পুরুষেরা ভীষণ বোকা। আর কেনেথ মার্শালের পক্ষে স্ত্রীকে অন্ধ বিশ্বাস করাটা অসম্ভব নয়।

তাহলে আপনি মিসেস মার্শালের শত্রুকে জানেন না?

শুধুমাত্র ক্ষুব্ধ স্ত্রীদেরই আর্লেনার ওপর আক্রোশ ছিলো। কিন্তু শ্বাসরুদ্ধ করে ওকে নিশ্চয়ই কোনো পুরুষ খুন করেছে। আপনারা বরং আর্লেনার অন্তরঙ্গ সঙ্গীদের কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।

ধন্যবাদ, মিস ডার্নলি।

মঁসিয়ে পোয়ারোর জিজ্ঞেস করার কিছু আছে।

এরকুল পোয়ারো হেসে বললেন, না–এই মুহূর্তে কোনো প্রশ্ন নেই।