০৬. হোটেলের অতিথি

যষ্ঠ পরিচ্ছেদ

৬.১

হোটেলের অতিথি তালিকার নামগুলো কর্নেল ওয়েস্টন সশব্দে পড়লেন।

ইনসপেক্টর বললেন, মনে হয় মাস্টারম্যান ও কাওয়ান পরিবার দুটো বাদ দেওয়া যায়। আজ সকালে ওরা খাবার সঙ্গে নিয়ে দিনভর নৌকাভ্রমণে বেরিলয়েছিলেন। অ্যান্ড্রু বাস্টন ওদের নৌকা করে নিয়ে যায়। তার কাছেই আমরা মিসেস ক্যাসল-এর কথা যাচাই করে নিতে পারবো।

ওয়েস্টন বললেন, আমারও তাই ধারণা। অবশিষ্টদের মধ্যে কোনো ইঙ্গিত দিতে পারেন, মঁসিয়ে পোয়ারো।

ভাসা ভাসা ভাবে দেওয়া সম্ভব। গার্ডেনাররা মধ্যবয়স্ক বিবাহিত দম্পতি, আচরণে হাসিখুশী এবং ভ্রমণবিলাসী। সুতরাং নজরে পড়ার মতো কিছু নেই–মিঃ রেডফার্ন বয়সে তরুণ, মহিলাদের কাছ প্রলোভনের বস্তু, প্রতিদ্বন্দ্বী সাঁতারু। ভালো টেনিস খেলোয়াড় ও প্রথম শ্রেণীর নাচিয়ে। তাঁর স্ত্রী শান্ত প্রকৃতির, তিনি স্বামীর প্রতি যথেষ্ট অনুরক্ত। তার মতো বুদ্ধি কিন্তু আর্লেনা মার্শালের ছিলো না।

ইনসপেক্টর বললেন, মোহের কাছে বুদ্ধির কোনো গুরুত্ব থাকে না বলেই মনে হয়।

হয়তো থাকে না। কিন্তু মিসেস মার্শাল সম্পর্কে মোহাচ্ছন্ন হলেও মিঃ রেডফার্ন প্রকৃতপক্ষে তার স্ত্রীকেই ভালোবাসেন।

তিনি আবার বলতে লাগলেন। মেজর ব্যারী ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক। নারীসৌন্দর্যের পূজারী। দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর কাহিনীর কথক মিঃ হোরেস ব্ল্যাট একজন ধনী ব্যক্তি। কিন্তু কেউই তাকে তেমন পছন্দ করে না। তাছাড়া মিঃ ব্ল্যাটের কোথাও একটা গোলমাল রয়েছে নিশ্চিত।

এরপর রোজামন্ড ডার্নলি। তার প্রতিষ্ঠানের নাম রোজামন্ড লিমিটেড। তিনি একজন বিখ্যাত পোশাক বিশেষজ্ঞ। তিনি ক্যাপ্টেন মার্শালের একজন পুরোনো বন্ধু।

ওয়েস্টন বললেন, বলেন কি? তাই নাকি?

হ্যাঁ, তবে মাঝে কয়েকবছর তাদের দেখা হয়নি।

 পোয়ারো একটু থেমে আবার বলতে লাগলেন, মিস স্টার সম্পর্কে আমি কিঞ্চিৎ আশঙ্কিত। তার কণ্ঠস্বর পুরুষ সাদৃশ্য। আচরণে রূঢ় হলেও আন্তরিকতা আছে। নৌকা বাইতে ভালোবাসেন এবং গলফ খেলায় পারদর্শিনী।

ওয়েস্টন বললেন, এরপর বাকি রইলেন ধর্মযাজক স্টিফেন সেন্ট। কে এই ধর্মযাজক? ব্যস, আমাদের লিস্ট শেষ। কিন্তু বন্ধুবর আপনাকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে।

কারণ আজ সকালে মিসেস মার্শাল যখন ভেলা নিয়ে রওনা হন তখন আমাকে জানান তার কথা কাউকে না জানাতে। ভেবেছিলাম তিনি সম্ভবত প্যাট্রিক রেডফার্নের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন, তাই তিনি চান না তার গতিবিধি সম্পর্কে তার স্বামী অবহিত হোক। কিন্তু তিনি চলে যাওয়ার পরই ক্যাপ্টেন মার্শাল সমুদ্রতীরে এসে আমাকে প্রশ্ন করেন, প্রায় একই সঙ্গে প্যাট্রিক রেডফানও ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে মিসেস মার্শালের খোঁজ নেয়। তাহলে আজ সকালে, আর্লেনা মার্শাল কার সঙ্গে দেখা করতে যান?

ইন্সপেক্টর কলগেট বললেন, আপনার বক্তব্য সমর্থন করছি। লন্ডন অথবা অন্য কোনো জায়গা থেকে আসা জনৈক অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির সঙ্গে

এরকুল পোয়ারো মাথা নেড়ে বললেন, ইতিমধ্যে আপনার কাল্পনিক ব্যক্তির সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে। তাহলে মার্শাল কার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন?

পোয়ারো মাথা নেড়ে বললেন, সুন্দরী শ্রেষ্ঠা মেল অথবা নিউটনের মতো মানুষ–এই দুজনের ক্ষেত্রে আরোপিত নিঃসঙ্গ বন্দীজীবন-এর যে পার্থক্য, তা নিয়ে এক জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ লিখেছিলেন এক ব্যক্তি। আর্লেনা মার্শালের নিঃসঙ্গতায় স্থান নেই, পুরুষের প্রশংসায় সর্বদা প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু কে সেই ব্যক্তি।

.

৬.২

 কার্নেল ওয়েস্টন বললেন, এখন জবানবন্দীগুলো সেরে নেওয়া প্রয়োজন, তাহলে আমাদের কাজের সুবিধে হবে। প্রথমে তাহলে মার্শাল মেয়েটিকেই ডাকা যাক।

লিন্ডা মার্শাল অগোছালো ভঙ্গীতে এলো, শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত। লিন্ডাকে দেখে এক অদ্ভুত স্নেহের আবেগ অনুভব করলেন কর্নেল ওয়েস্টন। বেচারী মেয়েটা এই কচি বয়সে ভীষণ মানসিক আঘাত পেয়েছে।

আপনাকে এ অবস্থায় বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত-মিস লিন্ডা। আপনার ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমরা শুধু চাই, আপনি যেটুকু জানেন, আমাদের খুলে বলুন।

তার মানে–আর্লেনা সম্পর্কে?

 হ্যাঁ, আজ সকালে তাকে দেখেছেন?

না। কারণ আর্লেনা বরাবরই বেলায় নিচে নামে।

ওয়েস্টন বললেন, আজ সকালে উঠে আপনি কি কি করেছিলেন, আমাদের একটু খুলে বলুন।

হা, প্রথমে স্নান সেরে তারপর প্রাতঃরাশ সেরে মিসেস রেডফার্নের সঙ্গে গাল কোভে যাই।

কটার সময় আপনারা রওনা হয়েছিলেন?

 সাড়ে দশটার মিনিট তিনেক আগেই রওনা হয়ে যাই।

পোয়ারো বললেন, গাল কোভে আপনারা কি করলেন?

আমি গিয়ে সোজা তেল মেখে সূর্যস্নানে মন দিই। আর মিসেস রেডফান আপন মনে ছবি আঁকেন। তারপর আমি সমুদ্রে স্নান করতে নামি। আর ক্রিস্টিন হোটেলে ফিরে যান টেনিস খেলার জন্য পোশাক পালটে প্রস্তুত হতে।

সেই সময়টা আপনার মনে আছে।

 কখন, যখন মিসেস রেডফার্ন হোটেলে ফিরে যান?-পৌনে বারোটা। আমি ঘড়ি দেখেছিলাম।

যে ঘড়িটা আপনি এখন পরে আছেন?

 হা।

 ঘড়িটা একবার দেখতে পারি?

লিন্ডা ওর মণিবন্ধ এগিয়ে ধরলো। ঘড়িটা মিলিয়ে হেসে বললেন, সেকেন্ড পর্যন্ত নির্ভুল… আচ্ছা–মিসেস রেডফার্ন যাওয়ার পর আপনি স্নান করতে নামেন? তারপর হোটেলে ফিরলেন কখন? প্রায় একটা নাগাদ। আর ফিরেই শুনলাম–আর্লেনা-মারা গেছে…

আশাকরি সম্মায়ের সঙ্গে মানিয়ে চলতে আপনার–ইয়ে–মানে অসুবিধা হতো না।

না-হতো না।

পোয়ারো বলেন, আপনি কি তাকে পছন্দ করতেন?

 হ্যাঁ–আর্লেনা আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতো।

ওয়েস্টন বললেন, ভালো কথা। কখনও কখনও ঈর্ষা–সংসারে অশান্তির কারণ হয়। ধরুন মেয়ে ও বাবার মধ্যে মধুর সম্পর্ক। বাবা নতুন বিয়ে করাতে মেয়ে একটু বিরক্ত বা ক্ষুব্ধ হলেও হতে পারে। নিশ্চয়ই আপনার ক্ষেত্রে তা হয়নি? আমার ধারণা, আপনার বাবা ইদানীং তার স্ত্রীকে নিয়ে একটু বেশিই ব্যস্ত ছিলেন।…

আমি ঠিক জানি না।

মিস লিন্ডা, এবারের প্রশ্নটা খুব ভেবেচিন্তে উত্তর দিন। আপনার সম্মাকে কে খুন করতে পারে? এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্য হয় এমন কিছু কি আপনি জানেন?

অনেক ভেবে বললো, না, আর্লেনাকে কে খুন করতে চেয়েছে জানি না, অবশ্য মিসেস রেডফান ছাড়া।

কিন্তু কেন?

কারণ তার স্বামী আর্লেনার প্রেমে পড়েছিলেন। হয়তো তার মনে হতো আর্ণেনা মরে গেলে ভালো হয়–এই চিন্তা আর সত্যি খুন করা এক জিনিষ নয়। তাছাড়া, মিসেস রেডফার্নের পক্ষে এ ধরনের কাজ করা অসম্ভব, মানে তিনি উগ্র প্রকৃতির নন।

পোয়ারো বললেন, আমি আপনার সঙ্গে একমত। মানসিক আবেগসঞ্জাত কোনো ঝায় তিনি বিচলিত হবেন না–যদিও সর্বদা একটা ঘৃণা মায়াবী মুখমণ্ডল তার চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে–অথবা অনুভব করছেন নিজের আক্রোশে মুষ্টিবদ্ধ হাত–তা সত্ত্বেও তিনি বিচলিত হবেন না

কাঁপা স্বরে লিন্ডা বললো, আমি তাহলে এখন যাই। আপনাদের আর কিছু জিজ্ঞাসা আছে?

 হ্যাঁ, যাবেন। আপনার সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ।

কর্নেল ওয়েস্টন হাফ ছেড়ে বললেন, বড় বিশ্রী আমাদের এই পুলিসের চাকরি। ওর বাবা ও সত্যয়ের সম্বন্ধে প্রশ্ন করতে নিজেকে খুব ছোট লাগছিলো। খুন সবসময়েই খুন। এক্ষেত্রে লিন্ডাই একমাত্র ব্যক্তি যার পক্ষে সমস্ত ঘটনার চরিত্র জানা সম্ভব।

পোয়ারো বললেন, আমিও সেরকম অনুমান করি।

ওয়েস্টন বললেন, ওর কাছ থেকে আমরা খুব কম কথাই জানতে পেরেছি। শুধু রেডফার্ন মহিলাটির একটা অ্যালিবাই পাওয়া গেলো।

পোয়ারো বললেন, মিসেস রেডফার্নকে সন্দেহভাজনের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার কারণ দৈহিক ও মানসিক দিক থেকে কাউকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা তার পক্ষে অসম্ভব। তাছাড়া তার হাতের গড়ন অস্বাভাবিক রকম হালকা ও ছোট।

কলগেট বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। মিসেস রেডফার্নকে আমরা স্বচ্ছন্দে বাদ দিতে পারি। ডাঃ নিসডন বলেছেন যে দুটো হাতের চাপে শ্বাসরোধ হয়ে মিসেস মার্শাল মারা গেছেন, তাদের হাতের গড়ন মোটেই হালকা ও ছোট নয়।

ওয়েস্টন বললেন, এবারে তাহলে রেডফার্নদের ডাকা যাক।

.

৬.৩

 ইতিমধ্যে প্যাট্রিক রেডফার্ন পুরোপুরি সামলে উঠছে।

আপনিই মিঃ প্যাট্রিক রেডফার্ন! তা মিসেস মার্শালের সঙ্গে আপনার পরিচয় কতদিনের?

তিন মাসের;

ক্যাপ্টেন মার্শাল বলেছেন, একটা ককটেল পার্টিতে মিসেস মার্শালের সঙ্গে আপনার প্রথম আলাপ হয়।

হা–প্রথম পরিচয় এইভাবেই হয়।

ক্যাপ্টেন মার্শালের অজান্তে আপনাদের কি দেখা-সাক্ষাৎ প্রায়ই হতো?

রক্তিম মুখে রেডফার্ন বললো। হ্যাঁ, তবে তিনি জানতেন কি না–তা আমি বলতে পারছি না।

 পোয়ারো বললেন, আশা করি আপনার স্ত্রীও এ সম্পর্কে কিছু জানতেন না?

আমি ওকে একদিন কথায় কথায় বলেছিলাম, বিখ্যাত আর্লেনা স্টুয়ার্টের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে।

ওয়েস্টন বললেন, আপনাদের এই দ্বীপে দেখা হওয়ার কথা কি আগে থাকতেই ছিলো?

দেখুন–ব্যাপারটা আজ না হয় কাল জানাজানি হবেই। আর্লেনার জন্যে আমার বিচারবুদ্ধি হিতাহিতজ্ঞান সবই যেন লোপ পেয়েছিলো–ও চেয়েছিলো আমিও এই দ্বীপে বেড়াতে আসি–ওর অনুরোধ এড়াতে পারিনি। পুরুষদের ওপর ওর প্রভাব ছিলো এতই মারাত্মক।

পোয়ারো বললেন, যা, তিনি ছিলেন পুরুষদের কাছে আকর্ষণের বস্তু-রূপোলী জলকন্যার মতো।

আপনাদের সঙ্গে আমি খোলাখুলি আলোচনা করছি–আর্লেনা আমাকে যেন আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। ও সেই ধরনের মেয়ে যারা কোনো পুরুষদের দেহ-মন জয় করার পর তার সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়ে। আজ সকালে, পিক্সি কোভের সৈকতে, আমি যখন ওর মৃতদেহ আবিষ্কার করি তখন মনে হয়েছিলো–যেন আমার মাথায় সারা আকাশ ভেঙে পড়েছে।

পোয়ারো ঝুঁকে বললেন, আর এখন?

যা সত্যি, সবই আপনাদের বললাম। আর্লেনার মৃত্যুর সঙ্গে এ সবের তো আর কোনো যোগাযোগ নেই। আর এ ব্যাপারটা আলোচিত হলে আমার স্ত্রী ভীষণ কষ্ট পাবে। আপনারা ভাবছেন, এতদিন আমার স্ত্রীর খেয়াল কোথায় ছিল। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি ওকে ভীষণ ভালোবাসি। আর অন্য ব্যাপারটা নিছক একটা পাগলামো-পুরুষরা মাঝে মাঝে মোহাচ্ছন্ন হয়ে ভুল করে করুণ কণ্ঠে বললেন, এ কথাগুলো যদি আপনাদের বিশ্বাস করাতে পারতাম।

পোয়ারো বললেন, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি।

ধন্যবাদ

কর্নেল ওয়েস্টন বললেন, ইয়ে–মানে, আপনাদের এই অন্তরঙ্গতার সঙ্গে খুনের কোন গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকতে পারে। হয়তো এই দৃষ্টিকোণ থেকেই আমরা খুনের উদ্দেশ্যটাকে প্রতিষ্ঠা করতে পারবো।

হ্যাঁ, মিঃ রেডফার্ন। ক্যাপ্টেন মার্শাল সম্ভবত এ ব্যাপারটা হঠাৎই জানতে পারবেন।

আপনি বলতে চান, তিনি তখন সব দেখেশুনে তার স্ত্রীকে খুন করেছেন?

কেন, কথাটা আপনার কখনও মনে হয়নি?

না,-আশ্চর্য। কথাটা আমি একবারও ভাবিনি। মার্শাল অতি শান্তমানে এটা সম্ভব বলে, ভাবতে পারছি না।

ওয়েস্টন বললেন, আচ্ছা ব্যাপারটা তার স্বামীর কানে যাবে ভেবে তিনি কি কোনো অস্বস্তি অনুভব করতেন?

ও চাইতো না, ওর স্বামী এ নিয়ে কোনোরকম সন্দেহ করুক।

মাপ করলেন, মঁসিয়ে রেডফার্ন, এ প্রসঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের কথা কখনও ওঠেনি?

না। মার্শালকে বিয়ে করে ও পুরোপুরি সন্তুষ্ট ছিলো। মার্শাল বলতে গেলে একজন রহিস আদমী–জমিদার–তাছাড়া পয়সাকড়িও আছে। ওর অনুগামী হতভাগ্য, অপদার্থ, মোহাবিষ্ট পুরুষদের তালিকায় আমি ছিলাম সর্বশেষ সংযোজন-নিছক সময় কাটানোর জিনিস। সব বুঝেও আমি ওর প্রতি আকর্ষিত ছিলাম…।

আচ্ছা মিঃ রেডফার্ন, আজ সকালে কি মিসেস মার্শালের সঙ্গে আপনার দেখা করবার কথা ছিলো?

না, সকালবেলা আমাদের সাধারণতঃ সৈকতে দেখা হতো। ভেলায় চড়ে সমুদ্রে আমরা ভেসে বেড়াতাম। আজ সকালে তাকে বেলাভূমিতে না দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। কারণ ভেবে পাচ্ছিলাম না।

যদি তিনি অন্য কারো সঙ্গে দেখা করবার ব্যবস্থা করে থাকেন, তাহলে সেই একজন কে, আপনি জানেন?

রেডফার্ন মাথা নাড়লো।

আপনি একান্তে তার সঙ্গে কোথায় সাক্ষাৎ করতেন?

গালকোভে, বিকেলের দিকে ভীড় কম থাকে তাই।

 পিক্সি কোভ কখনও যাননি।

না। কারণ, পিক্সি কোভটা দ্বীপের পশ্চিম দিকে হওয়ায় পড়ন্ত সূর্যের আলো সেখানে অনেকক্ষণ থাকে। আর সেখানে নির্জনতা নেই। কোনো কোনো সুন্দর রাতে, নৈশভোজের পর আমরা দ্বীপের অনেক অজানা অংশে পায়চারি করে বেড়িয়েছি।

ওয়েস্টন বললেন, এ অঞ্চলের কাছাকাছি তার কোনো বন্ধুবান্ধব ছিলো?

উঁহু, সেরকম কেউ বোধ হয় ছিলো না।

মিঃ রেডফার্ন, খুব ভেবেচিন্তে উত্তর দিন এবার। মিসেস মার্শালকে আপনি লন্ডনে থাকতেই চিনতেন তাই তার বন্ধুবৃত্তের মধ্যে এমন কেউ কি আছে যার মনে মিসেস মার্শালের প্রতি বিদ্বেষ ভাব ছিলো? হয়তো এমন কেউ, যাকে স্থানচ্যুত করে আপনি মিসেস মার্শালের মনে জায়গা করে নিয়েছেন?

না। সেরকম কাউকে মনে পড়ছে না।

তাহলে কোনো অজ্ঞাত পরিচয় খুনী–জনৈক বিকৃত মানসিকতার ব্যক্তি, যে ঘটনাচক্রে স্থানীয় অঞ্চলে উপস্থিত ছিলো।

রেডফার্ন বলে উঠলো, আমার বিশ্বাস এই সম্ভাবনাটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক।

উঁহু। এই ঘটনাটা ঠিক “পড়ে যাওয়া শিকার” ধরনের নয়। বিশেষ করে পিক্সি কোভ জায়গাটা যখন রীতিমতো দুর্গম। হয়তো সেই লোকটাকে কংক্রীট সেতু পেরিয়ে হোটেলের পাশ দিয়ে গোটা দ্বীপটা অতিক্রম করে মই বেয়ে পিক্সি কোভে নামতে হয়েছে-নৌকো বেয়ে নয়তো সে সমুদ্রের দিক থেকে এসেছে।

আপনি বলছেন তিনটে সম্ভাবনা রয়েছে

হ্যাঁ, কারণ প্রথম সম্ভাবনা এই দ্বীপে মাত্র দুজন ব্যক্তি রয়েছেন, যাদের এই খুনের পেছনে জোরালো উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রথম জন তার স্বামী। দ্বিতীয়জন আপনার স্ত্রী।

আমার স্ত্রী ক্রিস্টিন! এ খুনের পেছনে ক্রিস্টিনের হাত রয়েছে। আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত ক্রিস্টিন! যা একেবারে অবিশ্বাস্য হাস্যকর।

তবুও মিঃ রেডফার্ন, ঈর্ষা, বড় সাংঘাতিক।

কিন্তু ক্রিস্টিন এ ধরনের মেয়েই নয়। হয়তো ও অসুখী–কিন্তু ওর মধ্যে এতটুকু উগ্রভাব নেই। আর তাছাড়া এ সন্দেহ অযৌক্তিক। কারণ আর্লেনা ক্রিস্টিনের চেয়ে দ্বিগুণ শক্তিশালী ছিলো। তার ওপর পাহাড়ের গায়ে ঝোলানো এই মইটা বেয়ে সমুদ্রতীরে নামা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। ওঃ পুরো ব্যাপারটাই একটা অবাস্তব, উদ্ভট কল্পনা।

হ্যাঁ, অবাস্তব হলেও আমাদের সর্বপ্রথম বিচার করতে হবে খুনের উদ্দেশ্য এবং সুযোগ।

.

৬.৪

 রেডফার্ন চলে যেতেই পুলিসপ্রধান মন্তব্য করলেন, তার স্ত্রীর যে একটা নিশ্চিদ্র অ্যালিবাই রয়েছে সে সম্পর্কে তিনি কি বলেন সেটাই আমার শোনার ইচ্ছে ছিলো। ব্যাপারটা তাকে জোরালো ঝাঁকুনি দিয়েছে।

এরকুল পোয়ারো বললেন, রেডফার্ন যেসব যুক্তিতর্ক রেখেছেন। তাদের গুরুত্ব অ্যালিবাইয়ের চেয়ে কম নয়।

হ্যাঁ, সে কথা মানছি– ক্রিস্টিন ও কাজ করেননি। আর তার দৈহিক শক্তির দিক থেকে তো একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে মার্শালও নির্দোষ।

কলগেট কেশে বললেন, আমার মনে হয়, তিনি যদি স্ত্রীকে হত্যার পরিকল্পনা আগেই করে থাকেন তাহলে চিঠিগুলো আগে থাকতে টাইপ করে রাখাটা তার পক্ষে অসম্ভব নয়।

কথাটা মন্দ নয়, ব্যাপারটা আমাদের খোঁজ করে

ক্রিস্টিন রেডফার্ন ঘরে ঢুকলেন শান্তভাবে। পরনে দুধসাদা টেনিস ফ্রক এবং হাল্কা নীল সোয়েটার। তার মুখে সাহস ও শুভ বাস্তব বুদ্ধির ছোপ। পোয়ারো মাথা দোলালেন।

কর্নেল ভাবলেন, চমৎকার মহিলা। অবশ্য ছেলেটার বয়সও অল্প। বসুন, মিসেস রেডফার্ন। প্রত্যেককে তাদের সকালবেলার গতিবিধি সম্পর্কে বিশদভাবে প্রশ্ন করা হচ্ছে, অবশ্য সেটা পুলিসি নথিভুক্ত করার জন্য।

এরকুল পোয়ারো বললেন, প্রথমে বলুন আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনি কি করেছেন?

আজ সকালে উঠে প্রাতঃরাশ সারতে যাওয়ার পথে আমি লিন্ডা মার্শালের ঘরে গিয়ে ওর সঙ্গে গাল কোভে যাওয়ার কথা ঠিক করি। সাড়ে দশটায় নিচে হলঘরে আমরা দেখা করবো কথা হয়।

আপনার স্বামী তো প্রাতঃরাশেই স্নান সারেন; আপনি প্রাতঃরাশের আগে স্নান করেননি?

না। আমি একটু শীতকাতুরে। রোদের তাপে সমুদ্র বেশ গরম না হওয়া পর্যন্ত আমি জলে নামি না।

আচ্ছা, আপনি যখন লিন্ডা মার্শালের ঘরে যান, তখন কটা বাজে।

 সাড়ে আটটা বা একটু বেশি হবে।

মিস মার্শাল কি তখন ঘুম থেকে উঠেছিলেন?

 হ্যাঁ, ও কোথায় যেন বেরিলয়েছিলেন, ফিরে এসে বললো, ও নাকি স্নান করতে গিয়েছিলো।

 তারপর?

তারপর নিচে থেকে প্রাতঃরাশ সেরে ছবি আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে আমরা হোটেল ছেড়ে বেরিলয়ে পড়ি।

তখন কটা বাজে?

সাড়ে দশটা হবে। তারপর গালকোভে গিয়ে দ্বীপের পূর্বদিকে, সমুদ্রের কোণ ঘেঁষে যে জায়গাটা আছে সেখানে গিয়ে আয়েস করে বসে ছবি আঁকতে শুরু করি আর লিন্ডা সূর্যস্নানে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

আপনারা ফিরলেন কখন?

পৌনে বারোটা নাগাদ। কারণ বারোটায় আমার টেনিস খেলার কথা ছিলো।

আপনার সঙ্গে ঘড়ি ছিলো?

না, আমি লিন্ডাকেই সময় জিজ্ঞেস করেছিলাম। তারপর ছবি আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে হোটেলে ফিরে আসি। আর লিন্ডা সমুদ্রে স্নান করতে নামে।

আপনি সৈকত ছেড়ে আসার আগেই কি লিন্ডা মার্শাল জলে নেমেছিলেন?

একটু ভেবে দেখি। ও সমুদ্রতীর ধরে ছুটে গেলো। আমি বাক্স বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালাম-হ্যাঁ, ফিরে আসার সময় ওর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ার শব্দ শুনেছিলাম।

এ নিয়ে আপনার কোনো সন্দেহ নেই তো মাদাম? বলে যান মিসেস রেডফার্ন–তারপর?

আমি হোটেলে ফিরে খেলার পোশাক পরে টেনিস কোর্টে গিয়ে অন্যান্যদের সাথে দেখা করি।

অন্যান্যরা বলতে?

ক্যাপ্টেন মার্শাল, মিঃ গার্ডেনার এবং মিস ডার্নলি। আমরা দু সেট শেষ করে সবে তৃতীয়টা ধরেছি। এমন সময় খবরটা এলো-মানে মিসেস মার্শালের মৃত্যু সংবাদটা।

পোয়ারো বললেন, খবরটা শুনে আপনার কি মনে হলো?

খবরটা শুনে–ঘটনাটা একটা জঘন্য বীভৎস ব্যাপার বলে মনে হয়েছিলো।

 ক্রিস্টিন চকিত নয়নে পোয়ারোর দিকে তাকায়। ওর দৃষ্টিতে অনুরোধের ইশারা।

মাদাম, বুদ্ধিমতী বিচারবুদ্ধিসম্পন্না মহিলা হিসেবে বলছি। মিসেস মার্শাল কি ধরনের মহিলা ছিলেন, সে সম্পর্কে কিছু যদি বলেন।

আপনি কি বলতে চান সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। মিসেস মার্শালের আকস্মিক মৃত্যুতে আমি অবাক হইনি বরং আকস্মিক আঘাত পেয়েছিলাম। কিন্তু উনি ছিলেন সেই ধরনের মহিলা

পোয়ারো বললেন, সেই ধরনের মহিলা যাদের জীবনে এই পরিণতিই স্বাভাবিক…হ্যাঁ মাদাম, আজ সারা সকাল এ ঘরে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও চরম সত্য বক্তব্য এটা। মাদাম, মৃতা মিসেস মার্শাল সম্পর্কে আপনি সত্যি সত্যি কি ভাবেন, বলুন তো।

কিন্তু আমি কিই বা বলবো? উনি ছিলেন সেই ধরনের মহিলা যারা আমার মতে একেবারে অপদার্থ। ওর মন বলে কিছু ছিলো না। বুদ্ধি তো দূরের কথা। শুধু ভাবতেন পুরুষ, পোশাক ও প্রেম। উনি ছিলেন সমাজের এক স্বার্থপর পরগাছা মাত্র। পুরুষের কাছে ওর আকর্ষণ ছিলো ওর একমাত্র গুণ। ওর মতো চরিত্রের মেয়েরাই ব্ল্যাকমেল–ঈর্ষা প্রভৃতি নোংরা আবেগসংক্রান্ত জঘন্য ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ে। মানুষের নিচ প্রবৃত্তিকে জাগিয়ে তুলতে ওর জুড়ি ছিলো না…।

তিনি সামনে ঝুঁকে বললেন, মিসেস রেডফার্ন। মিসেস মার্শালের কথা বলতে গিয়ে আপনি হঠাৎ ব্ল্যাকমেল শব্দ উল্লেখ করলেন কেন?