১৬. রোগা পাতলা মেয়েটি

১৬.

–শুভ সন্ধ্যা, মিসেস বেটারটন।

-শুভসন্ধ্যা মিস জেনসেন।

চশমা পরা রোগা পাতলা মেয়েটিকে বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছিলো। মোটা কাঁচের পেছনে চোখ দুটো চকচকে করছে। বললো, আজ রাত্রে একটা পুনর্মিলন উৎসব হবে। পরিচালক স্বয়ং আমাদের সামনে ভাষণ দেবেন।

-বাঃ ঢমকার, কাছেই পিটার্স দাঁড়িয়ে ছিলো, সে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো। পরিচালককে একবার চোখে দেখার জন্য আমি দিন গুনছিলাম।

মিস জেনসেন কড়া চোখে তাকিয়ে বললো, আমাদের পরিচালক, অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি।

-এখানে থাকার সবচেয়ে মুশকিল হচ্ছে, কোথায় যে যাচ্ছেন তা কখনোই সঠিক জানতে পারবেন না। আমিও আমেরিকা ছাড়ার আগে যদি জানতে পারতাম যে এসব আদর্শ টাদর্শ ধোঁকা, আসলে কোনো স্বৈরাচারীর খপ্পরে গিয়ে পড়ছি, তাহলে

–আসলে যে এরা তা নয়, সেটাও কিন্তু এখনও জানতে পারেননি, হিলারী স্মরণ করিয়ে দিলো।

–হুঁ, এখানের বাতাসে যেন সেই রকম গন্ধই পাচ্ছি।

–সত্যি! হিলারী প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো। আপনি এখানে আছেন বলে কী ভালোই না লাগছে।

মিস জেনসেনের ঘোষণা মতো নৈশভোজের পর সেই পুনর্মিলন উৎসবের আসর বসলো, সংস্থার প্রতিটি সদস্য এসে বিশাল বক্তৃতা ঘরে জড়ো হয়েছে।

শ্রোতাদের মধ্যে সবরকমের পেশার লোক রয়েছে এখানে। কারিগরী শিক্ষার লোকজন ছাড়াও সেখানে রয়েছে ব্যালে নাচের একটি দল, সামরিক তকমা আঁটা কিছু হোমরাচোমরা। এছাড়া একপাশে রয়েছে সুন্দরী মেয়েদের দল। এরা এই সংস্থার যে-সমস্ত পুরুষের স্ত্রী নেই বা যারা এখানকার নারী কর্মীদের সঙ্গে কোনোরকম বিশেষ সম্পর্ক পাতায়নি তাদের দৈহিক সাহচর্য দান করে সংস্থার সেবা করে।

বেটারটনের পাশে বসে হিলারী দারুণ উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছিলো, কখন সেই প্রায় অলৌকিক চরিত্রটি পরিচালক, বক্তৃতা মঞ্চে পা দেবেন। টমকে জিজ্ঞেস করায় কিছু ভাসা ভাসা উত্তর পেয়েছে সে।

টম বলেছিলো, দেখার মতো কোনো বৈশিষ্ট্য তার নেই, কিন্তু তার উপস্থিতির একটা তীব্র প্রভাব আছে। আসলে আমিও তাকে দুবারের বেশি দেখিনি। প্রত্যেকে অনুভব করে কী দারুণ প্রভাব ওঁর-সত্যিই তাই, অথচ কেন, তা আমি আজও বুঝতে পারিনি।

শ্রদ্ধায় গদগদ মিস জেনসেন ও আর কটি মহিলা পরিচালক সম্পর্কে আলোচনা করছিলো। হিলারী মনে মনে পরিচালকের একটি ছবি ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করলোসোনালি শ্মশ্রুগুম্ফমণ্ডিত আনন, শ্বেতশুভ্র উত্তরীয়-আবৃত দীর্ঘ ঋজু দেহ–অনেকটা দেবতার মতো আবছা একটা ছবি।

শ্রোতৃবৃন্দ নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াতে হঠাৎ সে চমকে দাঁড়ালো। হিলারী দেখলো, একজন মধ্যবয়সী মোটাসোটা লোক ধীর পায়ে মঞ্চে উঠে এলো।

তিনটি ভাষায় তিনি বক্তৃতা করলেন। প্রথমে ফরাসি, তারপর জার্মান তারপর ইংরেজি তিনটি ভাষায় সমান সাবলীলতায় অনর্গল কথা বলছিলেন।

নবাগত সহকর্মীদের কিছু প্রশস্তি জানিয়ে তিনি এই সংস্থার উদ্দেশ্য এবং চিন্তাধারা সম্পর্কে দীর্ঘ বক্তৃতা করলেন।

পরে তাঁর কথাগুলো মনে করতে চেষ্টা করে বিফল হয়েছে হিলারী।

নিরাসক্তির প্রবল বাধাসত্ত্বেও কথাগুলো যেন তীব্র উন্মাদনায় হিলারীর মনের অর্গল মুক্ত করে তাকে নাড়া দিতে লাগলো, তাকে ভাসিয়ে নিয়ে চললো। পরিচালক অত্যন্ত সহজভাবে ব্যাখ্যা করছিলেন। তাঁর বক্তৃতার প্রায় সবখানি জুড়ে যৌবনের গুণগান। যৌবনের পরেই মানবজাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।

পুঞ্জীভূত অর্থ, প্রতিপত্তি, ক্ষমতাবান মুষ্টিমেয় পরিবার–এ সমস্ত পুরোনো দিনের নির্ধারক শক্তি। কিন্তু আজ, যুবসমাজই সেই শক্তির ধারক। মানুষের বুদ্ধিই হচ্ছে আসল শক্তি। সে বুদ্ধি রসায়নশাস্ত্রে, পদার্থবিদ্যায়, শারীরবিদ্যায়…গবেষণাগার থেকেই ব্যাপক ধ্বংসকার্যের শক্তি স্ফুরিত হয়। আমাদের এই সংস্থা, সারা দুনিয়ার সেই শক্তিমানদের সমন্বয় ক্ষেত্র। এখানে আপনারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে জড়ো হয়েছেন, সঙ্গে এনেছেন সৃজনী বিজ্ঞানের নানান তথ্য জ্ঞান, আর এনেছেন–আপনাদের যুবশক্তি। এমন একদিন আসবে, যখন আমরা আমাদের একটা অছি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারবো। বৈজ্ঞানিক বুদ্ধিমত্তার জিম্মাদার হবে এই অছি-সংস্থা। পুঁজিপতি আর রাজাদের ওপর আমরা হুকুম করবো–সৈন্যবাহিনী আর শিল্পসংস্থা চলবে আমাদের নির্দেশে।

আচমকা বক্তৃতা শেষ করলেন পরিচালক। সাহস এবং জয়। শুভরাত্রি! হলঘর থেকে বেরিলয়ে এলো হিলারী–কেমন যেন স্বপ্নাচ্ছন্ন মূক। আশপাশের সব মুখগুলোই এই অনুভূতির ছাপ দেখলো।

হঠাৎ কনুইয়ের কাছে তার স্পর্শ অনুভব করলো হিলারী। অ্যান্ড্রু পিটার্স! কানের কাছে মুখ এনে বললো, চলুন ছাদে যাই। একটু হাওয়ার দরকার এখন।

লিফটে উঠে কেউ কোনো কথা বললো না। ছাদে এসে, তারাভরা আকাশের নিচে পামগাছের জটলার মধ্যে হারিয়ে গেলো দুজনে। পিটার্স গভীর শ্বাস টেনে বললো, আ! এইটাই দরকার ছিলো। এমন হাওয়া যা অহঙ্কারের ঘন মেঘকে দূরে তাড়িয়ে নিয়ে যায়।

হিলারী উত্তরে শুধু দীর্ঘ করে একটা শ্বাস ফেললো। এখনও যেন ঠিক প্রকৃতিস্থ হতে পারছে না সে।

পিটার্স আলতো করে ওর হাতখানা তুলে নিলো। এসব ভুলে যাও অলিভ। এসব ভুলে যাও। তুমি নারী সম্পূর্ণ নারী হয়ে যাও। বাস্তবে ফিরে এসে রূঢ় বাস্তবকে দেখো। এই অহঙ্কারের বিষ বাষ্পের রেশ যখন কেটে যাবে, তখন বুঝতে পারবে–সেই আগের মতো, সেই পুরোনো কথাগুলিই তুমি শুনছিলে।

–কিন্তু সত্যিই সুন্দর মানে, চমৎকার আদর্শ এটা।

–আদর্শের নামে এ পাগলামি। ঘটনাগুলো সাজাও। যুবশক্তি এবং মস্তিষ্ক–চমৎকার! একেবারে স্তোত্রপাঠ। আর এই যুবশক্তি আর মস্তিষ্কের ধারক কারা? এতক্ষণ যে বক্তৃতা শুনে এলে তার মোদ্দা কথা হচ্ছে-সাংঘাতিক ক্ষতিকর পাগলামি।

আলসের ওপর বসে পড়ে হিলারী বললো, আপনি হয়তো বুঝবেন আপনার কথাই ঠিক বলে আমি বিশ্বাস করি…কিন্তু অহঙ্কারের সেই ঘন মেঘ যে এখনও থমকে রয়েছে। এই মেঘ উনি কিভাবে সৃষ্টি করতে পারলেন? উনি কি নিজেই এসব বিশ্বাস করেন?

উদাস স্বরে পিটার্স বললো, শেষ পর্যন্ত কিন্তু সব জিনিষেরই একই পরিণতি হয়। আর প্রত্যেক পাগলই নিজেকে ঈশ্বর বলে ভাবে।

হঠাৎ হিলারীর কি মনে হলো, বললো, কাজটা বোধহয় ঠিক করিনি। বেটারটন কী ভাববে? নিশ্চয়ই বিসদৃশ লাগবে ওর চোখে।

-না না, আমার তা মনে হয় না। ও হয়তো খেয়ালই করেনি।

 সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে পিটার্স বললো, আমি দুঃখিত অলিভ। এ জায়গাকে তোমার নিশ্চয়ই সাজানো নরক বলে মনে হচ্ছে। তোমার স্বামী ধীরে ধীরে সেই নরকের পাঁকে ডুবে যাচ্ছে।

এখান থেকে আমাদের পালাতেই হবে–পালাতেই হবে।

 আমরা পালাতে পারবো।

একথা তো আগেই বলেছো পিটার্স–কিন্তু এতটুকুও এগোতে পারিনি আমরা–ওর হাতটা আঁকড়ে ধরলো হিলারী।

পেরেছি বইকি। আমি চুপ করে বসে নেই। বিস্ময়ে স্তব্ধ মুক দৃষ্টি তুলে তাকালো হিলারী।

কোনো পরিকল্পনা ঠিক করিনি, কিন্তু তলে তলে আমি একে ধ্বংস করার কাজ শুরু করে দিয়েছি। প্রচণ্ড অসন্তোষ ধুমায়িত হয়ে রয়েছে এখানে–সে অসন্তোষ, সে বিদ্বেষ আমাদের ‘প্রভু পরিচালক কল্পনা করতেও পারবেন না। এ অসন্তোষ এখানকার নিচুতলার মধ্যেই সবচেয়ে ব্যাপক। খাদ্য, অর্থ, বিলাসিতা এবং নারীই জীবনের সবকিছু নয়। আমি তোমাকে এখান থেকে উদ্ধার করবোই, অলিভ।

–আর টম?

পিটার্সের মুখখানা থমথমে হয়ে উঠলো। শোনো অলিভ, আমার কথা বিশ্বাস করো, টম এখানে থাকার জন্যই আপ্রাণ চেষ্টা করবে। হ্যাঁ সে…বাইরের জগতের চেয়ে এখানেই অনেক বেশি নিরাপদ মনে করবে।

নিরাপদ? কী বলছো তুমি পিটার্স? হিলারী বললো, তুমি ঠিক কি বলতে চাইছো আমি বুঝতে পারছি না, টম–নিশ্চয়ই এ কথা বোঝাতে চাইছে না যে, সে সম্পূর্ণ পাগল হয়ে গেছে।

মোটেই না। হয়তো সে খুবই অস্থির হয়ে পড়েছে, কিন্তু আমি বলবো বেটারটন ঠিক তোমার আমার মতোই সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ।

–তাহলে সে নিরাপদে এখানে থাকবে, একথা বলছো কেন?

খুব ধীরে ধীরে পিটার্স বললো, খাঁচার মতো নিরাপদ জায়গা আর নেই, একথা স্বীকার করবে?

-না, প্রায় চিৎকার করে উঠলো হিলারী। তুমিও যে একথা বিশ্বাস করো তা বোলো না আমায়। নিরাপদ, পোষমানা, সুখী জীবন? না, আমরা বিদ্রোহ করবোই। মুক্তি আমাদের চাই-ই।

-জানি, কিন্তু…তুমি জানো না টম এখান থেকে মুক্তি পাবার জন্য ছটফট করছে।

–টম হয়তো জানে না তার পক্ষে কোন্টা ভালো কোন্টা মন্দ।

 হঠাৎ টমের কথায় হিলারীর মনে পড়ে গেলো। তাই তো, সে যদি কোনো গোপন তথ্য ফাস করে দিয়ে থাকে, তাহলে তো তাকে সরকারী গোপনীয়তা রক্ষা আইনানুসারে শাস্তি পেতে হবে! হিলারী আবার বললো, টমও যাবে আমাদের সঙ্গে।

পিটার্সের গলায় তিক্ততার আভাস পেয়ে ভীষণ চমকে গেলো হিলারী। নিজের কথা আগে ভাবো। আমি বার বার তোমায় বলেছি, অলিভ। ওই লোকটা কে–কেন তুমি ওর জন্য এত ভেবে মরছো আমি বুঝতে পারছি না।

আতঙ্কে স্থির চোখ মেলে চেয়ে রইলো হিলারী। অনেক অনেক কথা সে বলতে চেয়েছিলো। অনেক কষ্টে সে নিজেকে সংযত করলো।

বিছানায় শুয়ে টম সিগারেট টেনে হিলারীকে বললো, আমেরিকান বন্ধুটির সঙ্গে খুব ভাব জমেছে দেখছি!

হিলারীর গাল দুটো লাল হয়ে উঠলো। বললো–আমরা একসঙ্গে এখানে এসেছি। তাছাড়া কিছু কিছু বিষয়ে আমাদের চিন্তা-ভাবনাও এক।

টম বলে উঠল, না না, তোমাকে আমি দোষ দিচ্ছি না। সত্যিই তোমাকে খুব সুন্দর দেখতে অলিভ।

সেই প্রথম দিন থেকে হিলারী টমকে বার বার অনুরোধ করেছে তাকে তার স্ত্রীর নাম ধরে ডাকতে। এতদিনে আজ ডাকলো।

হিলারীকে ভালো করে দেখে টম বললো, সত্যিই তুমি অসম্ভব সুন্দরী। একটিবার অত্যন্ত এটা আমার চোখে পড়া উচিত ছিলো। কিন্তু এখন সবকিছুর মতো এও আমার মনে রেখাপাত করে না।

হিলারী বললো, হয়তো এটাই স্বাভাবিক। হিলারী টমের পাশে গিয়ে বসলো। বললো, তোমার কী হয়েছে বলে তো টম?

–তোমাকে তো বলেছি, একটুও কাজে মন বসাতে পারছি না আমি। বিজ্ঞানী হিসেবে আমি চুরচুর হয়ে ভেঙে পড়েছি। এই জায়গা

–অন্যেরা সবাই-বা বেশির ভাগ লোকই এখানে–তোমার মতো কই ভাবে না তো?

–কারণ–তারা সব জঘন্য অনুভূতিশূন্য মানুষের খোলস।

অনেকেরই কিন্তু অনুভূতি বেশ প্রবল। তোমার যদি এখানে একজন বন্ধু থাকতো সত্যিকারের একজন বন্ধু

-হ্যাঁ আছে, ওই মার্চিসন। মাথায় অবশ্য কিসসু নেই। সম্প্রতি টরকুইল এরিকসনের সঙ্গে বেশ জমিয়ে নিয়েছে।

–সত্যিই মাথা আছে লোকটার। ওর মতো যদি আমার বুদ্ধি থাকতো।

হিলারী বললো, কেমন যেন অদ্ভুত লোক। ভদ্রলোককে তো আমার সবসময়ে ভীতিকর বলে মনে হয়।

–ভীতিকর? টরকুইল? না না–একেবারে মাটির মানুষ ও। ছোট্ট শিশুর মতো–দুনিয়া সম্পর্কে কোনো জ্ঞানই জন্মায়নি এখনও।

হিলারী আতঙ্কে বললো, তবুও আমার যেন কেমন ভয় ভয় করে।

–উ–তোমার মনের জোর কমে আসছে মনে হচ্ছে।

-এখনও কমেনি, তবে কমবে বলেই ভয় হচ্ছে। টম-তুমি ওই টরকুইল এরিকসনের সঙ্গে বেশি মিশো না।

স্থির চোখে তাকালো টম, কেন?

-তা জানি না। কিন্তু আমার মনে হয়–আমি অনুভব করি এটা।

.

১৭.

 ঘনঘন কাঁধ ঝাঁকাতে লাগলো লেবল্যাঙ্ক। ওরা যে আফ্রিকা ছেড়ে গেছে, এটা কিন্তু নিশ্চিত।

ফরাসি ভদ্রলোকটি বললো, ঠিক নিশ্চিত না হলেও সেটা একটা সম্ভাবনার দিক।

–আমরা যা ভাবছি সেটাই যদি ওদের গন্তব্যস্থল হয়, তাহলে আফ্রিকা থেকে ওরা যাত্রা শুরু করবে কেন? ইউরোপের যে-কোনো স্থল থেকেই এটা অনেক সহজ হতে পারতো।

–তা ঠিক। কিন্তু এখানে জড়ো হয়ে এখান থেকে যাত্রা করার কথা কেউ সন্দেহই করতে পারবে না।

এছাড়া আরো কিছু কারণ আছে বলে আমার মনে হচ্ছে, জেসপ বললো। ওই বিমানবন্দরে একমাত্র ছোট প্লেনই ওঠানামা করে। ভূমধ্যসাগর পার হবার আগে তাকে তেল নেবার জন্য এখানে নামতেই হবে। আর এখানে তারা তেল নিতে নামবে, সেখানে কিছু না কিছু সূত্র পড়ে থাকবেই।

–তেজস্ক্রিয়তা ধরার বিশেষ যন্ত্রে একসময়-না-একসময়ে ধরা পড়বেই। খুব অল্প সংখ্যক প্লেন পরীক্ষা করলেই চলবে।

জায়গাটা আমরা খুঁজে পাবোই। জেসপ নাছোড়বান্দা হয়ে বললো। আমার মনে হচ্ছে কি জানো?

আমরা তো ধরেই নিয়েছি ওরা উত্তর দিকে গেছে–মানে ভূমধ্যসাগরের দিকে-ধরো তার বদলে, ওরা যদি দক্ষিণে গিয়ে থাকে।

–মানে–একই পথে ওরা দুবার ঘুরে গেছে বলতে চাইছেন? কিন্তু তাহলে ওরা যাবে কোথায়? সুউচ্চ অ্যাটলাসের উঁচু উঁচু চুড়ো–আর তার ওপারে অনন্ত বিস্তৃত মরুভূমি।

.

মিশকালো গম্ভীর মুখটার দিকে চিন্তিতভাবে তাকালো পিটার্স। ওই কালো চেহারায় ধবধবে সাদা পোশাকে অপূর্ব দেখাচ্ছিলো মহম্মদকে। পিটার্স বললো, আমরা যদি এখান থেকে বেরোতে পারি তবেই তোমার বাসনাটা পূরণ হবে।

কালো ঠোঁটের আড়াল থেকে ঝকঝকে কটা সাদা দাঁত হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। না পারলে মৃত্যু আমার ক্ষেত্রে এটা নিশ্চিত। আপনার ক্ষেত্রে হয়তো তা হবে না কারণ এদের কাছে আপনি মূল্যবান।

–এখানে এরা মৃত্যুকে খুব সাধারণ চোখে দেখে, তাই না?

 মহম্মদ বললো, মৃত্যু! কী তা জানি না। সেটাও নিশ্চয়ই আল্লাহর ইচ্ছা।

-তোমাকে কী কী করতে হবে বুঝে নিয়েছ তো?

-বুঝেছি, বাবু। অন্ধকার নামলে আপনাকে ছাদে নিয়ে আসতে হবে। আমি আর অন্যান্য চাকরবাকরেরা যে পোশাক পরি, সেইরকম একটা পোশাক আপনার ঘরে রেখে আসতে হবে। পরে–অন্য কাজগুলো করতে হবে।

-ঠিক আছে, এবার বরং তুমি আমাকে লিফট থেকে নামিয়ে দাও। কেউ হয়তো দেখে ফেলবে যে, বার বার আমরা ওঠানামা করছি। হয়তো কিছু সন্দেহ করবে।

নাচ চলছিলো, অ্যান্ড্রু পিটার্স জেনসেনের সঙ্গে পা মেলাচ্ছিলো। জেনসেনের কানের কাছে কিছু বলছিলো। ঘুরতে ঘুরতে ওরা হিলারীর কাছে এলো। আর তখনি হিলারীকে চোখ টিপে কী যেন ইঙ্গিত করলো।

হিলারী দ্রুত চোখ সরাতেই ওধারে বেটারটনকে দেখলোটরকুইল এরিকসনের সঙ্গে গল্প করছে। দুজনকে একসাথে দেখে নিজের অজান্তেই ভুরু দুটো কুঁচকে উঠলো হিলারীর।

হিলারীর কানের কাছে এসে মার্চিসন জিজ্ঞেস করলো, আমাদের সঙ্গে একটু নাচবে নাকি অলিভ?

বললো, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই নাচবো, সাইমন।

মার্চিসন সাবধান করে দিলো হিলারীকে, আগেই কিন্তু বলে রাখছি, আমি মোটেই ভালো নাচতে পারি না। হিলারীকে বললো, বিয়াঙ্কাকে তোমার কথা বলেছিলাম, এখানে এসে চমৎকার মানিয়ে নিয়েছ তুমি। সত্যিই চমৎকার জায়গা। টাকাপয়সার জন্য ভাবতে হয় না, আয়কর দেবার ঝঞ্ঝাট নেই, কোথায় কখন কোনটা প্রয়োজন, আগে থেকেই সে ব্যবস্থা করে রাখে।

আচ্ছা–টম কোথায় গেলো?–ও ওই তো টরকুইলের সঙ্গে গল্প করছে। টরকুইল ডোকরা তোমার ভক্ত হয়ে পড়েছে।

এক চক্কর নাচ শেষ হলো। অ্যান্ড্রু পিটার্স পরের বার হিলারীর সঙ্গে নাচতে চাইলো।

–আমি আমার কাজ গোছাচ্ছিলাম, দেখেছো তো? আঁ! ওই জেনসেনের সঙ্গে?

–হা, রাখঢাক না করে যদি বলি তাহলে বলতে হয়, এই ধরনের মেয়েদের পটাতে পারলে খুব সহজেই গলে যায়।

-তুমি নিশ্চয়ই ওর প্রেমে পড়ার ভান করছো?

-তা তো বটেই। এই মেয়েটাকে ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলে অনেক খোঁজখবর আমরা পাবো; অলিভ, এখানকার অভিসন্ধি ও সব জানে। এখানে কিছু লোকের সমাবেশ ঘটবে, এটা ওঁর কাছ থেকে জানতে পারলাম।

অ্যান্ড্রু তুমি কি ভাবছো তখন কোনো সুযোগ পাওয়া যাবে…?

-না, তা আমি মনে করছি না। কারণ, আমার ধারণা ওই সময়ে যথেষ্ট কড়া ব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু এর থেকে অনেক ধারণা গড়তে পারবো–এই সময়ে কেমন ধরনের ব্যবস্থা করা হয়। সেইমতো পরের বার কিছু ব্যবস্থা করা যাবে। এই সময়টাতে জেনসেনকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখলে ওর কাছ থেকে খোঁজখবর আদায় করতে পারবো।

-যারা আসছে তারা এখানকার সম্পর্কে সবকিছু জানে?

–আমাদের-মানে এই সংস্থা সম্পর্কে কিছু জানে না। আমার মনে হয় ওরা শুধু এখানকার ব্যবস্থাপত্র দেখবে একটু, বড়জোর ডাক্তারি গবেষণাগারগুলো একবার পরিদর্শন করবে। এই জায়গাটাকে ইচ্ছে করেই একটা গোলকধাঁধার মতো করে সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে বাইরের কেউ ভেতরে এলেও এর কোথায় কী আছে সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা করতে না পারে। আমার ধারণা–কোনো একটা গোপন দরজা আছে, যেটা বন্ধ করে দিলে আমাদের এদিকটা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

সবকিছুই যেন কেমন অদ্ভুত শোনাচ্ছে। জানি, এখানে থাকলে অর্ধেক সময়ই স্বপ্নের ঘোরে কাটাতে হয়। এখানকার সবচেয়ে আশ্চর্য জিনিষ হচ্ছে–এখানে একটি শিশু দেখা যায় না। নেই তাই রক্ষে! তোমারও যে কোনো শিশুসন্তান নেই এটা তোমার পক্ষে যথেষ্ট সুখের বিষয়।

হিলারীকে হঠাৎ কেমন আড়ষ্ট হয়ে যেতে দেখলো পিটার্স। নিজেও সে অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। আমি দুঃখিতনা জেনে হয়তো ভুল কিছু বলে ফেলেছি!

-না না, কিছু ভুল বলনি তুমি। সত্যিই আমার সন্তান ছিলো…সে মারা গেছে…

–তোমার সন্তান ছিলো? বিস্ময়ে স্থির হয়ে তাকালো পিটার্স। আমি ভেবেছিলাম–মানে শুনেছিলাম যে বেটারটনের সঙ্গে তোমার মাত্র ছমাস আগে বিয়ে হয়েছে!

অলিভ আরক্ত হয়ে উঠলো, তাড়াতাড়ি বললো, হ্যাঁ ঠিকই শুনেছে। কিন্তু আমি আগেও একবার বিয়ে করেছিলাম। প্রথম স্বামীর সঙ্গে আমার বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেছে।

হিলারী বলে উঠলো, আমিও তোমার কথা কিছুই জানি না। কেমনভাবে তুমি মানুষ হয়েছে, কোথায়–তোমার বাড়ির কথা

–আমি একদম কড়া বৈজ্ঞানিক আবহাওয়ায় মানুষ। বিজ্ঞানের কথা ছাড়া আর কোনো কথা কেউ বলতো না। হঠাৎ পিটার্স বলে উঠলোনাঃ, ওসব কথা আর ভাবতে চাই না–এখানে, এই মুহূর্তে আমাদের অনেক কাজ রয়েছে।

হিলারী, টরকুইল এরিকসনকে দেখে চিন্তা করলো যে ওর সাথে বোরিস গ্লাইদরের বর্ণনা হুবহু মিলে যাচ্ছে। জেসপের কাছ থেকে বোরিসের যে বর্ণনা শুনেছিলো, তার সঙ্গে এ বর্ণনার এতটুকুও পার্থক্য নেই। হিলারী পিটার্সকে জিজ্ঞেস করলো, উনি সত্যিই এরিকসন তো? মানে–অন্য কেউ হতে পারে না নিশ্চয়? না মানে আমি বলতে চাইছি–উনি এরিকসন সেজে এখানে আসেননি তো?

ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ চিন্তা করলো পিটার্স। না, আমার তা মনে হয় না, ও যে বিজ্ঞানী এতে কোনো সন্দেহ নেই, তাছাড়া…এরিকসন, ওদেশে অতি সুপরিচিত ব্যক্তি।

–কিন্তু এখানকার কেউ তো ওঁকে আগে কখনো দেখেনি? কিংবা একদিকে উনি হয়তো সত্যিই এরিকসন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় একটা সত্তাও ওঁর থাকতে পারে।

-তুমি বলতে চাইছে-এরিকসন দ্বৈত জীবন যাপন করছে? হ্যাঁ, তা হতে পারে। কিন্তু এটা বোধহয় ঠিক বাঞ্ছনীয় নয়।

-না! মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়।

না, এরিকসন কক্ষনো বোরিস গ্লাইদর হতে পারে না। কিন্তু অলিভ বেটারটন কেন বার বার টমকে বোরিস সম্পর্কে সাবধান করে দেবার জন্য পীড়াপীড়ি করেছিলো? সে কি জানতে পেরেছিলো যে, রোরিস এই সংস্থায় আসার জন্য রওয়ানা হয়ে গেছে? আচ্ছা এও তো হতে পারে–লন্ডনে যে লোকটা বোরিস গ্লাইদর বলে পরিচয় দিয়েছিলো, আসলে সে বোরিস নয়? সেই হয়তো আসলে টরকুইল এরিকসন! বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। এখানে আসার পর থেকে সে টমের প্রতি বড্ড বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। যাইহোক্ এরিকসন যে একজন সাংঘাতিক লোক হতে পারে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

অলিভ-কী হলো তোমার? এমন করছো কেন?

-নাহ ও কিছু না। ওদিকে দেখো, সহকারী পরিচালক বোধহয় কিছু ঘোষণা করবেন বলে মনে হচ্ছে।

ডাঃ নিয়েলসন হাত তুলে সবাইকে চুপ করতে বলছিলেন, বন্ধু এবং সহকর্মীবৃন্দ। আগামীকে আপনাদের সকলকে জরুরী বিভাগে থাকার জন্য নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। বেলা ঠিক এগারোটার সময়ে আপনারা এক জায়গায় জড়ো হবেন, সেখানে প্রত্যেকের নাম ডাকা হবে। আপনাদের সামান্য যেটুকু অসুবিধা হবে তার জন্য আমি দুঃখ প্রকাশ করছি।এই বলে তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন, আবার বাজনা শুরু হলো।

আবার আমাকে জেনসেনের শরণাপন্ন হতে হবে, পিটার্স বললো। থামের আড়াল থেকে ও সাগ্রহে আমাকে লক্ষ্য করছে। ওর কাছ থেকে জেনে নিতে হবে, এই জরুরী বিভাগের কোথায় কী আছে। এই বলে সে জেনসেনের দিকে এগিয়ে গেলো।

নতুন করে আবার ভাবতে লাগলো অলিভ। সত্যিই কি তার এই চিন্তাটা নেহাত কল্পনা? টরকুইল এরিকসন? বোরিস গ্লাইদর? এরা কি…

বিশাল হলঘরে এক এক করে নাম ডাকা হচ্ছিল। সবাই উপস্থিত। নাম ডাকার সঙ্গে সঙ্গে এক-একজন করে সাড়া দিচ্ছিলো। নাম ডাকা শেষ হতে সবাইকে দাঁড় করানো হলো, তারপর কুচকাওয়াজের ভঙ্গিতে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দেওয়া হলো।

পথ সেই একই রকম, অজস্র বারান্দায় পাক খাওয়া গোলকধাঁধার জটিলতা। অলিভ পিটার্সের পাশে পাশে হাঁটছিলো। পিটার্সের হাতের চেটোয় যে ছোট্ট দিকদর্শক যন্ত্র লুকানো আছে, সে জানে। এর থেকে পিটার্স একমনে দিক ঠিক করার চেষ্টা করছিলো।

–নাঃ, এতে কাজ হবে না মনে হচ্ছে, হতাশ সুরে গলা নামিয়ে বললো পিটার্স। কী জানি কেন–এই মুহূর্তে এটা কাজ করছে না। কিন্তু এক সময় হয়তো কাজে লাগবে–শেষ বারান্দার প্রান্তে একটা দরজা দেখা গেল। দরজাটা আপনা থেকে খুলে যেতে দেখে, সবাই একসঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়লো।

পিটার্স পকেট থেকে সিগারেট বের করার সাথে সাথেই ভ্যান হিদেম স্পষ্ট স্বর ভেসে এলোধূমপান করবেন না দয়া করে। একথা আগে থেকেই আপনাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

–দুঃখিত স্যার। পিটার্স বললো।

–একটু পরেই সবাইকে এগোতে বলা হলো।

হিলারী বললো, ঠিক যেন ভেড়ার পাল যাচ্ছে।

মেয়েদের থাকার জায়গায় আলাদা–ডানদিকে, মিস জেনসেন মেয়েদের নিয়ে ডানদিকে বেঁকে গেলো। ছেলেরা বাঁ-দিকে।

লম্বা শয়নঘরটা অনেকটা হাসপাতালের রোগীদের ঘরের মতো–দেওয়ালের দুধারে সার সার করে খাট পাতা-শালীনতা রক্ষার জন্য প্লাস্টিকের পর্দা টেনে আড়াল করার ব্যবস্থা তাতে। বিছানার পাশেই ছোট্ট একটা দেরাজ। হাসপাতালের মতোই কিসের গন্ধে ম ম করছে ঘরটা।

মিস জেনসেন বললো, এখানকার ব্যবস্থাপত্র একেবারেই ছিমছাম। ওই ডানদিকে স্নানঘর, আর ওপাশের ওই দরজার ওধারের ঘরে সকলের গল্পগুজব, খেলাধুলার ব্যবস্থা আছে।

গল্প করার ঘরে মেয়ে পুরুষ আবার একসাথে মিলিত হলো।

দিনের বেলাটা ভালোই কাটলো। ছোট্ট পর্দায় দুটো ছবি দেখানো হলো। ঘরে আলোর ব্যবস্থা চমৎকার। ঘরে যে জানালা নেই এটা ঢাকা দেবার জন্যই যেন দিনের আলো ফোঁটাবার সার্থক প্রয়াস। সন্ধ্যার দিকে নতুন আলোর ব্যবস্থা।

-বাঃ! চমৎকার বুদ্ধি তো! পিটার্স বললো। যাতে কেউ চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দী রয়েছে না ভাবতে পারে তার চমৎকার ব্যবস্থা।

হিলারী ভাবছিলো নিজেরা কত অসহায়। এখানে কোথাও তাদের খুব কাছেই, বাইরের দুনিয়া থেকে একটি দল এসে রয়েছে। অথচ তাদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করার কোনো উপায় নেই।

পিটার্স মিস জেনসেনের সঙ্গে গল্প করছে বসে। হিলারী মার্চিসনদের কাছে ব্রিজ খেলার প্রস্তাব করলো। টম বেটারটনকে রাজি করানো গেল না। তার কিছুতেই মন বসছে না। ডাঃ ব্যারন ওদের সঙ্গে তাসে বসলেন।

আশ্চর্য! খেলতে খেলতে একসময় হিলারীর মনে হলো, খেলতে তো খারাপ লাগছে না। বেশ জমেছিলো খেলাটা, হিলারী হাতঘড়িটা দেখলো একবার। ও বাবা–অনেক রাত হয়ে গেছে দেখছি! তা আমাদের মহামান্য অতিথিরা এতক্ষণে নিশ্চয়ই চলে গেছেন–নাকি রাত্রে এখানে থাকবেন?

সাইমন বললো, ঠিক বলতে পারব না।

 বিয়াঙ্কা বললো, যাই বলো ব্যবস্থাপত্র কিন্তু দারুণ ভালো। হিলারীকে সঙ্গে নিয়ে সে মেয়েদের ঘরে যাবার জন্য এগোল।

হিলারী তাকে এগিয়ে যেতে দিয়ে ইচ্ছে করেই একটু পিছিয়ে পড়লো। আর তখনই হাতে একটা মৃদু স্পর্শ অনুভব করলো। চট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলো, দীর্ঘকায় একজন সুরেশ ভৃত্য তার পাশে দাঁড়িয়ে। কালো গায়ের রঙ। ভৃত্যটি বললো, মাফ করবেন, মাদাম, আপনাকে আমার সঙ্গে আসতে হবে।

-আসতে হবে? কোথায় আসতে হবে?

দয়া করে আমার সঙ্গে আসুন—

 মুহূর্তের সংশয় নিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইলো হিলারী। বিয়াঙ্কা ঘরে চলে গেছে। এ ঘরে মার্চিসন আর ডাঃ ব্যারন কী যেন আলোচনায় মগ্ন। হাতের ওপর আবার সেই জরুরী তাগিদের স্পর্শ। আসুন মাদাম।

হিলারী একটু ইতস্তত করে পা বাড়ালো।

অন্যান্য ভৃত্যদের তুলনায় এই ভৃত্যটির পোষাক-আশাক যে অনেক অভিজাত সেটা হিলারী দেখলো।

বসার ঘরের এককোণের একটা ছোট্ট দরজা দিয়ে সে তাকে নিয়ে চললো। তারপর আবার সেই গোলকধাঁধা বারান্দা। যে পথ দিয়ে তারা এখানে এসেছিলো, এটা সে পথ বলে মনে হলো না। সমস্ত পথগুলোই এমন নিখুঁত পরিকল্পনায় তৈরি যে, সবগুলোই একই রকম মনে হয়।

শেষ পর্যন্ত একটা বারান্দার শেষে এসে, দেওয়ালের গাছে একটা বোতাম টিপলো লোকটা। দেওয়ালের খানিকটা অংশ একপাশে সরে গেলো। পেছনে একটা ছোট্ট লিস্ট। হিলারীকে উঠতে ইঙ্গিত করে সে নিজেও উঠলো।

এবার সরাসরি প্রশ্ন করলো হিলারী। কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমায়?

 লোকটি বললো, কর্তার কাছে, মাদাম, এটা আপনার পক্ষে দারুণ সম্মানের বিষয়।

-কর্তা–মানে? পরিচালকের কথা বলছো?

–না-কর্তার কাছে..

লিফট থামলো। একপাশে সরে দরজা খুলে সে হিলারীকে নামতে বললো। তারপর আবার বারান্দা পেরিয়ে একটা দরজা-ভৃত্যটি আস্তে আস্তে টোকা দিতে দরজাটা খুলে গেলো। এখানে আরেকজন ভৃত্য দাঁড়িয়ে আছে।

নতুন লোকটি হিলারীকে একটা ছোট্ট লাগোয়া ঘরের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে চললো। ঘরের মেঝেতে লাল কার্পেট, ওধারের দেওয়ালের ভারী পর্দা একদিকে সরানো। সেই নিচু নিচু সোফা, কফির টেবিল, নকশা কাটা সুন্দর পর্দা। আর একটা নিচু ডিভানে বসে একটা আবছা মূর্তি নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারলো না হিলারী। চামড়া কোঁচকানো, হলুদ রঙের ছোট্ট এক বৃদ্ধ–। অবিশ্বাসভরে স্থির চোখে বৃদ্ধ মিঃ অ্যারিস্টাইডসকে দেখতে লাগলো হিলারী।

.

১৮.

 আসুন মাদাম, মিঃ অ্যারিস্টাইডস অভ্যর্থনা জানালেন। তার হাতের ইঙ্গিতে হিলারী একটা ডিভানে বসলো।

মিঃ অ্যারিস্টাইডসের গলায় অদ্ভুত চাপা অট্টহাসি ফুটলো। খুব অবাক হয়েছেন, তাই না? একেবারে অপ্রত্যাশিত, কি বলেন?

হিলারী বললো, তা বটে, আমি কল্পনাও করতে পারিনি যে, আপনি

মিঃ অ্যারিস্টাইডসকে চিনতে পারার সঙ্গে সঙ্গে, গত দশদিনের অবাস্তব স্বপ্নময় জগতের ছবিটা ভেঙে খান খান হয়ে গেলো। সত্যিই এটা একটা অবাস্তব সংস্থা। বাইরে থেকে যা বলে এটাকে প্রচার করা হয় আসলে এটা মোটেই তা নয়। মহামান্য পরিচালকের ওই মোহময় কণ্ঠস্বর, ওটাও অবাস্তব–আসল সত্য লুকিয়ে রয়েছে এখানে–এই ছোট্ট প্রাচ্য অনুভূতি মাখা ঘরটায়। এই বিশাল কর্মকাণ্ডের মধ্যমণি হিসেবে মিঃ অ্যারিস্টাইডসকে দেখে সবকিছুরই পরিষ্কার অর্থ খুঁজে পাওয়া গেলো–নিষ্ঠুর অথচ বাস্তব দৈনন্দিন জীবনের ছবিটা স্পষ্ট ফুটে উঠলো হিলারীর চোখে।

-এতক্ষণে বুঝলাম, এ সবকিছুই আপনার তাই না?–হিলারী বললো।

–ঠিকই বুঝেছেন, মাদাম।

–আর পরিচালক? আপনার ওই পরিচালক?

 মিঃ অ্যারিস্টাইডস প্রশংসা করে বললো, খু-উ-ব ভালো লোক, অগাধ টাকা মাইনা দিই। ওঁকে। পুনরভ্যুত্থান সংক্রান্ত সভার বক্তৃতা দেওয়াই ওঁর প্রধান কাজ।

চিন্তিতভাবে কমুহূর্ত নীরবে ধূমপান করার পর তিনি হিলারীকে বললেন, ওখানে আপনার পাশে তুরস্কের বিখ্যাত পানীয় আছে। কিছু মিষ্টিও আছে। ইচ্ছে করলে নিতে পারেন। আবার কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললেন, আমি একজন জনহিতৈষী সামান্য মানুষ, মাদাম। আর আপনি তো জানেন আমি বিরাট ধনী। আমার এই অগাধ অর্থ নিয়ে, জনগণের সেবা করার একটা কর্তব্যজ্ঞান বার বার আমাকে পীড়িত করে। তাই এই মরুপ্রান্তরে কুষ্ঠরোগীদের সেবার জন্য আমি একটা আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছি। দুনিয়ার সবচেয়ে নামীদামী ডাক্তার, বিজ্ঞানীরা কুষ্ঠরোগ নিরাময়ের জন্য মূল্যবান গবেষণা চালাচ্ছেন এখানে। দেখা গেছে কয়েক ধরনের কুষ্ঠরোগই সারানো সম্ভব বাকিগুলো সম্ভব নয়, কিন্তু আমরা হাল ছাড়িনি। লোকে যেমন কুষ্ঠরোগকে ছোঁয়াচে মনে করে সেরকম ছোঁয়াচে নয়। বসন্ত, টাইফয়েড, প্লেগ বা ওই ধরনের রোগগুলো যেমন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, কুষ্ঠরোগ তত দ্রুত ছড়ায় না। তবুও আপনি যদি কাউকে বলেন, ওটা কুষ্ঠরোগীদের আশ্রম, সে সভয়ে অনেক দূরে চলে যাবে। কুষ্ঠরোগীদের প্রতি ভীতি সেই বাইবেলের কাহিনী থেকে শুরু হয়েছে। এই আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে আমি নিজেকে শান্তি দিয়েছি।

–শুধু এইজন্যই আপনি এ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন?

-হ্যাঁ। এখানে ক্যানসার নিয়ে গবেষণারও আলাদা বিভাগ রয়েছে আর যক্ষ্মারোগ নিয়ে উন্নতমানের কাজ সমাপ্তপ্রায়। জীবাণু নিয়ে গবেষণা চলছে। আমার এই বিস্ময়কর কাজ দেখে সারা দুনিয়া অবাক হয়ে গেছে। পৃথিবীখ্যাত ডাক্তার, শল্যচিকিৎসক, আর রসায়নবিদেরা মাঝেমাঝেই এখানে এসে আমাদের কাজ দেখে বিস্মিত হন। তেমনি একটা দল আজ এসেছে। এখানকার বাড়িগুলো অত্যন্ত নিপুণভাবে তৈরি, যার ফলে এর একটা বিশেষ অংশ বাইরের জগতের সামনে সম্পূর্ণ বন্ধ, এমনকি আকাশ থেকেও তা দেখা যায় না। অতি গোপনীয় গবেষণাগারগুলো পাহাড়ের নিচে সুড়ঙ্গ কেটে তৈরি। কোনো দিক দিয়েই কেউ এতটুকুও সন্দেহ করতে পারবে না কারণ–আমি কী বিরাট ধনী তা তো আপনি জানেনই।

-কিন্তু কেন? হিলারী বললো, কেন এই ধ্বংস যজ্ঞের আয়োজন?

–ধ্বংসের প্রতি আমার কোনো স্পৃহা নেই, মাদাম। আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন।

 মিঃ অ্যারিস্টাইডস বলে চললেন, আমি একজন ব্যবসায়ী, সেই সঙ্গে আমি একজন সংগ্রাহকও। অর্থ যখন মানুষের কাছে পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে তখন তার থেকে মুক্তি পাবার একটামাত্র উপায়। সারাজীবনই অজস্র জিনিষ সংগ্রহ করেছি আমি। যেমন ধরুন–ইউরোপের সবচেয়ে সুন্দর এবং দামী ছবি, বিশেষ ধরনের মৃৎশিল্প এবং ডাকটিকিট সংগ্রহ। বিশেষ কয়েকটা জিনিষের নমুনা সংগ্রহ যখন সম্পূর্ণ তখন অন্য কিছু সংগ্রহের দিকে ঝোঁক পড়েই। আমি বৃদ্ধ মানুষ, তাছাড়া সংগ্রহ করার মতো কিছু বাকি নেই দেখে শেষ পর্যন্ত মানুষের মস্তিষ্ক সংগ্রহ করতে লেগে গেলাম।

হিলারী আঁতকে উঠে বললো, মস্তিষ্ক?

আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন তিনি, হ্যাঁ, মস্তিষ্ক মানুষের বুদ্ধি। সমস্ত বুদ্ধিমান মাথাগুলোকে এখানে এনে জড়ো করেছি। বুদ্ধিমান কাঁচামাথা, শুধু এরাই আমার সংগ্রহ।

বুঝতে পারছেন এটাই আমার পেশা হিলারীকে বললো, আমি টাকার ব্যাপারী।

–আপনি বলছেন–এসবের সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই? বিশ্বশক্তিকে নিজের হাতের মুঠোয় আনতে চান না?

ভর্ৎসনায় ভরে উঠলো তার মুখ। ঈশ্বরের আসনে বসার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই।

–কিন্তু এতসব নামী নামী লোকদের আপনি এখানে আনলেন কী করে?

–ওদের আমি কিনেছি। বেশির ভাগ সময়েই ওঁদের আমি কিনি আদর্শের বিনিময়ে। কখনো কখনো আমি তাদেরও কিনি যারা আইনের চোখে অপরাধী–তাদের কিনি নিরাপত্তার বিনিময়ে।

হিলারী বললো, এতক্ষণে সব বুঝতে পারলাম। এখানে আসার পথে যা যা দেখে আমি সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছিলাম, এতক্ষণে সেগুলো পরিষ্কার হলো।

-ও! আসার সময় তাহলে খুব আশ্চর্য হয়েছিলেন আপনি?

-হ্যাঁ। ছোট্ট প্লেনের পাঁচটি যাত্রী–প্রত্যেকের লক্ষ্য কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন। অ্যান্ড্রু পিটার্স, ওই–আমেরিকার যুবকটিকে দেখে মনে হয় সম্পূর্ণ বামমার্গী। কিন্তু এরিকসন, অতিমানবে শুধু বিশ্বাসী তাই নয়–একেবারে বদ্ধ পাগল। হেলগা নীডহেইম তো উদ্ধত, নিকৃষ্ট ধর্মের চণ্ডনীতির একনিষ্ঠ পূজারী। ডাক্তার ব্যারন, উনি স্রেফ টাকার জন্যই এসেছেন।

হ্যাঁ সত্যিই আপনি বুদ্ধিমতী, মাদাম। ফেজ-এ আপনাকে প্রথম দেখেই আমি বুঝে নিয়েছিলাম। আপনি হয়তো জানেন না, মাদাম, আমি ফেজ-এ গিয়েছিলাম স্রেফ আপনাকে দেখার জন্য।

-আচ্ছা! বিস্ময় প্রকাশ করলো হিলারী।

 এখানকার অনেক কিছুই আস্তে আস্তে আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন মাদাম। তবে একটা বিষয়ে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন যে, যদিও এখানকার লোকেরা সবাই ভিন্ন ভিন্ন আদর্শ নিয়ে এসে মোহমুক্ত এবং বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে, কিন্তু আমি বলছি, শেষ পর্যন্ত এরা সব্বাই একটা মাত্র আদর্শ মেনে নিতে বাধ্য হবে।

হিলারী বললো, নিশ্চিতভাবে সে কথা আপনি বলতে পারেন না আপনি।

–এ দুনিয়ার কোনো বিষয়েই কেউ সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারে না। এদিক থেকে আমি আপনার সঙ্গে একমত।

কেমন যেন আতঙ্কিত চোখে তাকালো হিলারী। কী সাংঘাতিক! ঠিক যেন টাইপিস্টদের একটা দল-মুখের কথা খসামাত্রই মেসিন থেকে কিছু উগরে বের করে দেবে। টাইপিস্টদের বদলে আপনি এখানে কিছু মস্তিষ্কের সমাবেশ ঘটিয়েছেন শুধু।

–ঠিক তাই। ভারি সুন্দর ভাবে জিনিষটা বুঝিয়েছেন মাদাম।

আর এই দল থেকে আপনি এক-একজন বিজ্ঞানীকে বিক্রি করবেন যে সবচেয়ে বেশি দাম দেবে তার কাছে?

-হ্যাঁ, মোটামুটি এটাই হচ্ছে আমার সাধারণ নীতি, মাদাম। লোবোটমি কথাটা কখনও শুনেছেন, মাদাম? কপালে ভাঁজ পড়লো হিলারীর।

মস্তিষ্কে একধরনের অস্ত্রোপচার, তাই তো?

–ঠিক বলেছেন, আসলে উন্মাদ রোগের চিকিৎসার জন্য এই অস্ত্রোপচার প্রচলিত। আপনাকে আমি সহজ ভাষায় বলছি, এই অস্ত্রোপচারকে আমরা নতুন কাজে লাগিয়েছি। এই অস্ত্রোপচারের পর সেই রোগীর আর আত্মহত্যা করার কোনো স্পৃহা থাকবে না, অপরাধবোধ হারিয়ে যায়, সে তখন অবচেতন মন নিয়ে উদাসভাবে ঘুরে বেড়ায়, কাজ করে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা অত্যন্ত প্রভুভক্ত হয়ে পড়ে।

-এ পরীক্ষায় আপনি সফল হয়েছেন কি?

–অতীতে হইনি। কিন্তু এখন এ বিষয়ে গবেষণায় আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেছি। আমার এখানে এখন তিনজন নামকরা শল্যচিকিৎসক রয়েছেন, একজন রাশিয়ার, একজন ফ্রান্সের আর একজন অস্ট্রিয়ার। মস্তিষ্কের বিভিন্নরকম পরীক্ষা চালিয়ে তারা এই সিদ্ধান্তেই এসেছেন যে, মানুষের স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তিকে এতটুকুও খর্ব না করেই এই অস্ত্রোপচারের সাহায্যে তাকে সম্পূর্ণ বশীভূত করা সম্ভব।

–কিন্তু কী ভয়ঙ্কর-ওঃ! চিৎকার করে উঠলো হিলারী।

-না, প্রয়োজন। অবিচল স্বরে শুধরে দিলেন অ্যারিস্টাইডস। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটা মানুষেরই উপকারের জন্যই।

–এরকম যে কোনোদিন হবে, আমি বিশ্বাস করি না।

-শুনুন মাদাম, আমি যদি বলি এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করার যোগ্য নন আপনি, আমায় মাফ করবেন।

-আমি বলতে চেয়েছিলাম–কর্মসচেষ্ট, বিশ্বস্ত একটা জানোয়ার যে সত্যিকারের কোনো বুদ্ধির কাজ দেখিয়ে কোনো কিছু সৃষ্টি করতে পারে, এ আমি বিশ্বাস করি না।

–আপনি বুদ্ধিমতী, হয়তো ঠিকই বলেছেন। সময়েই সেটা দেখা যাবে। গবেষণা পরীক্ষা নিরীক্ষা তো চলছে, দেখা যাক।

পরীক্ষা-নিরীক্ষা! মানে? মানুষ নিয়ে পরীক্ষা?

–তা তো বটেই, মাদাম। সত্যিকারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার একমাত্র মাধ্যমই তো মানবদেহ।

–কিন্তু কী ধরনের মানবদেহ সেগুলো?

অযোগ্য লোকদের নিয়েই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়। যারা এখানকার জীবনযাত্রার সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারে না। তারা আমাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার চমৎকার মাধ্যমে পরিণত হয়।

আঁতকে উঠলো হিলারী। সামনে বসা বৃদ্ধটিকে কেমন যেন বীভৎস অমানুষ বলে মনে হলো অথচ ওর কথাগুলো মিথ্যে নয়, অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ। হিলারী বললো, আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না? আপনি বাইবেল পড়েন তো?

নিশ্চয়ই, রোজ পড়ি মাদাম।

–মোজেস আর অ্যারন, ফারাওকে কী বলেছিলেন মনে আছে? বলেছিলেন, আমার লোকজনদের যেতে দাও।

অদ্ভুত হাসলেন অ্যারিস্টাইডস। তাহলে আমি হচ্ছি ফারাও?–আর আপনি একই দেহে মোজেস এবং অ্যারন? আপনি আমাকে এটাই বোঝাতে চাইছেন তাই তো, মাদাম? এই লোকগুলোকে যেতে দিতে বলছেন–সব্বাইকে নাকি শুধু–বিশেষ কাউকে!

-আমি তো বলবো সব্বাইকে।

–কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, এতে শুধুই সময় নষ্ট হবে। তার চেয়ে বরং…আপনার স্বামীর জন্য ওকালতি করলে ভালো হতো না?

–সে এখন আপনার কাছে অপ্রয়োজনীয় এতদিনে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন?

-আপনার কথাই হয়তো ঠিক, মাদাম। হ্যাঁ, টমাস বেটারটন সম্পর্কে দারুণ হতাশ হয়েছি আমি। আমি ভেবেছিলাম আপনি আসার পর সে আবার প্রতিভার উন্মেষ ঘটাতে পারবে। কিন্তু আপনি আসার পরও ওর কাজে কোনো উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। স্রেফ শুধু সাধারণ কাজ করছে।

হিলারী বললো, এক-এক জাতের পাখি, যারা খাঁচাবন্দী অবস্থায় তেমন মিষ্টি সুরে গান গাইতে পারে না। হয়তো বিজ্ঞানীদের মধ্যেও তেমন জাত আছে, যারা বিশেষ বিশেষ অবস্থা সৃষ্টির চিন্তায় মনোনিবেশ করতে পারে না।

–তা হতে পারে। আমি অস্বীকার করছি না।

–তাহলে আপনি বেটারটনকে বাইরের জগতে ফিরে যেতে দিন।

–তা সম্ভব নয়, মাদাম। বাইরের দুনিয়ার কাছে এই জায়গায় খবর পৌঁছে দেবার মতো প্রস্তুতি এখনও গড়ে তুলতে পারিনি আমি।

–ও কাউকে কিছু বলবে না, এই শপথ করিয়ে নিতে পারেন।

 –শপথ ও করবে–হ্যাঁ কিন্তু সে শপথ রাখবে না।

 নিশ্চয়ই রাখবে। আমি বলছি ও কথা রাখবে।

-এই তো ঠিক সহধর্মিণীর মতো কথা। তবে এক্ষেত্রে বউদের কথা তেমন যুক্তিগ্রাহ্য নয়। অবশ্য ও যদি এখানে জামিন হিসেবে কাউকে রেখে যায়, তাহলে হয়তো ওর মুখ বন্ধ থাকবে।

–তার মানে?

–আমি বলতে চাইছিলাম ধরুন টমাস বেটারটন যদি চলে যায় আর তার জামিন হিসেবে আপনি এখানে রইলেন–ব্যাপারটা কেমন লাগবে আপনার? আপনি কি রাজি হবেন?

হিলারী জেসপের কথা শুনতে পাচ্ছে। আর তার নির্দেশগুলো মনে করার চেষ্টা করছে। টমাস বেটারটনকে মুক্ত করার যদি কোনো সুযোগ পাওয়া যায়, তা এখনই, পরিবর্তে তাকে এখানে থাকতে হবে। হিনারী জানে সাধারণভাবে জামিন বলতে যা বোঝায় সে তা নয়। একথা অবশ্য মিঃ অ্যারিস্টাইডস জানেন না। জানেন না যে টমাস বেটারটনের কাছে তার এতটুকুও মূল্য নেই। যে স্ত্রীকে সে ভালোবাসতো আগেই সে মারা গেছে, সুতরাং…

-আমি রাজি, বললো হিলারী।

-আপনার সাহস, নিষ্ঠা এবং আত্মত্যাগের যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে। যা বাকি কথাগুলো অন্যসময় আলোচনা করা যাবে।

-ওহ না না। হিলারী হঠাৎ দুহাতে মুখ ঘাটলো। এ আমি সহ্য করতে পারছি না। কী ভয়ঙ্কর অমানুষিক!

অত অস্থির হবেন না, মাদাম। বৃদ্ধ লোকটির গলায় সান্ত্বনার আশ্বাস। আজ আপনাকে আমার লক্ষ্য এবং উচ্চাশার কথা বলতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত। আমি বলতে পারি কিছুদিন পরে সবকিছুই আপনার কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হবে।

-না-না! ফুঁসে উঠলো হিলারী। কক্ষনো না, কক্ষনো না।

–আচ্ছা–এই তো লালচুলের বীরত্ব ঘুচে আবেগ ঝরছে! আমার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী-তারও লালচুল ছিলো। লালচুলওয়ালা সবসময়েই আমি প্রশংসা করি। আপনারও কিছু গুণ আছে–আপনার প্রাণপ্রাচুর্য, আপনার সাহস এবং আপনার একান্ত নিজস্ব একটি বুদ্ধিমান মাথা। এখানে অনেক নারী আছে কিন্তু এমন বেশ উত্তেজক মানসিক সঙ্গিনীর প্রয়োজন আমার। বিশ্বাস করুন, আপনার সাহচর্য আমাকে অনেকখানি শান্তি দিয়েছে।

-আচ্ছা ধরুন–এতক্ষণ যে সমস্ত কথা আমাকে বললেন, আমি যদি আপনার স্বামীকে সব বলে দিই?

অ্যারিস্টাইডস হেসে বললেন, ও আচ্ছা ধরে নিলাম আপনি বলে দেবেন। কিন্তু সত্যিই কী আপনি বলবেন?

-না–মানে আমি ঠিক জানি না।

-আচ্ছা! খুব চালাক আপনি। এমন কিছু জিনিষ আছে যা মেয়েদের চেপে রাখাই উচিত। আপনি এখন ভীষণ ক্লান্ত, বিপর্যস্ত তাই বলে ফেললেন। যাক মাঝে মাঝে আমি যখন এখানে আসবো, আপনাকে ডাকবো–অনেক কিছু আলোচনা করা যাবে।

হিলারী হঠাৎ দুহাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, আমাকে এখান থেকে যেতে দিন-দয়া করে আমাকে যেতে দিন।

অ্যারিস্টাইডস আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বললেন, কী করে আপনাকে যেতে দিতে পারি বলুন? এখানে আপনি যা যা দেখেছেন, সেই গল্প বাইরের জগতে কী করে ছড়াতে দিতে পারি, আপনিই বলুন?

-আমি যদি শপথ করে বলি যে একটা কথাও আমি কাউকে বলবো না, বিশ্বাস করবেন না আমায়?

-না বিশ্বাস করবো না, বিশ্বাস করলে বোকামি করবো।

–আমি এখানে থাকতে চাই না। এই বন্দীশালায় এক মুহূর্তও থাকতে চাই না আমি। আমায় মুক্তি দিন।

-কিন্তু এখানে আপনার স্বামী রয়েছেন। সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় মিলিত হবার জন্যই আপনি এখানে এসেছিলেন।

–কিন্তু কোথায় আসছি তা আমি জানতাম না, কোনো ধারণাই ছিলো না আমার।

না, সত্যিই আপনার কোনো ধারণাই ছিল না। কিন্তু আমি আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি যে বিশেষ জগতে আপনি এসে পড়েছেন সে জগৎ অনেক সুখের। এখানে আপনার প্রয়োজনের সবকিছুই হাতের কাছে পাবেন।

উঠে দাঁড়িয়ে তিনি আস্তে করে কাঁধ চাপড়ে দিলেন হিলারীর। এখানে আপনি ঠিক মানিয়ে চলতে পারবেন। একবছর, বড়জোর দুবছরের মধ্যে আপনি নিজেকে সবচেয়ে সুখী বলে মনে করবেন।

.

১৯.

 পরের রাত্রে ভীষণ চমকে ধড়মড় করে জেগে উঠলো হিলারী। আধশোয়া হয়ে কান খাড়া করে শব্দটা শুনতে চেষ্টা করলো, টম, টম–শুনতে পাচ্ছো?

-হ্যাঁ–একটা উড়োজাহাজ-খুব নিচু দিয়ে উড়ছে, ও নিয়ে ঘাবড়াবার কিছু নেই। মাঝে, মাঝেই এমনি ওপর দিয়ে যায়।

–ও আমি ভেবেছিলাম–কথাটা সে শেষ করলো না।

ঘুম এলো না আর, শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলো। অ্যারিস্টাইডসের সঙ্গে অদ্ভুতভাবে দেখা হওয়া, কথাবার্তা বার বার সব মনের মধ্যে তোলপাড় করতে লাগলো। বুড়ো যেন-হঠাৎ খেয়ালে ওর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছে।

বুড়োর এই খেয়ালটাকে ও কি কাজে লাগাতে চেষ্টা করবে? ভালোবাসার অভিনয় করে, শেষ পর্যন্ত বুড়োর সঙ্গে বাইরের জগতে ফিরে যাবার জন্য কি তার ওপর চাপ ফেলতে পারবে?

পরের বার বুড়ো যখন আসবে, তখন যদি আবার ডেকে পাঠায়, হিলারী ওর লালচুলওলা বউয়ের আলোচনা পাড়বে। অন্ধকারে হিলারী হাসলো। ওর মনে পড়ে গেলো চেলটেমহ্যামের জর্জ কাকার কথা। জর্জ কাকা আর অ্যারিস্টাইডসের মধ্যে পার্থক্য নেই।

টমকে সেদিন হিলারী বলেছিলো, এখান থেকে মুক্তি পাবার একটা পথ আমি বের করবোই। সেই পথ কী অ্যারিস্টাইডস? তা যদি হয় পথটা সহজ হবে না…

খবর, শেষপর্যন্ত একটা খবর এসেছে, লাফিয়ে উঠলো লেবল্যাঙ্ক।

সবেমাত্র একটা আর্দালি একটা কাগজ দিয়ে গেছে। কাগজের ভাজ খুলেই সে উত্তেজিত। আমাদের পরিদর্শক প্লেনের একজন চালক এই খবর পাঠিয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলে এক বিশেষ স্থানে আসতেই সে লক্ষ্য করলো, সঙ্কেত বাতিটা জ্বলছে নিভছে। বিশেষ সাঙ্কেতিক তারবার্তা পরপর দুবার। সে এই বার্তা সংগ্রহ করে। এই যে দেখুন। জেসপের সামনে সে কাগজটা মেলে ধরলো।

ইংরেজীতে লেখা। C.O.GL.E.PR.O.S.I.E.S.L. শেষ দুটো অক্ষর পেনসিলের দাগ দিয়ে আলাদা করে দিলো লেবল্যাঙ্ক। বললো–SL–এটা আমাদের সঙ্কেত লিলি–যার অর্থ, প্রাপ্তি স্বীকার করতে হবে না।

আর COG হচ্ছে–যা দিয়ে সঙ্কেতবার্তা শুরু হচ্ছে তার আদ্যাক্ষর এবং আমাদেরই লোকের পাঠানো সঙ্কেতের প্রমাণ, তাই তো? বললে জেসপ।

হা। তাহলে বাকিটুকুই হচ্ছে আসল সংবাদ, বাকি অক্ষরগুলোর তলায় মোটা করে দাগ টানলো লেবল্যাঙ্ক। বললো, বাকি রইলো LEPROSIE, অনিশ্চিত শব্দটা বার বার দেখতে লাগলো সে।

-Leprosy? মানে কুষ্ঠ? জেসপের মুখে কথাটা যেন আপনা থেকেই জুগিয়ে গেলো।

তোমাদের এখানে কুষ্ঠরোগীদের কোনো নামজার্দা বা সাধারণ আশ্রম-টাম আছে নাকি?

লেবল্যাঙ্ক একটা বিরাট মানচিত্র এনে টেবিলের ওপর বিছিয়ে দিলো। আঙুল দিয়ে একটা স্থান নির্দেশ করলো। এই যে, এই জায়গাটুকুর ওপর আমাদের এই প্লেনের পর্যবেক্ষণের ভার ছিলো। দাঁড়ান, খুঁজে দেখি মনে হচ্ছে পাবো।

দ্রুতপায়ে ঘর থেকে বেরিলয়ে গিয়ে আবার ফিরে এসে বললো, পেয়েছি। এই জায়গাটায় এক বিখ্যাত ভেষজ গবেষণাকেন্দ্র আছে। একজন সুপরিচিত জনহিতৈষী এর প্রতিষ্ঠাতা এবং কর্ণধার। জায়গাটা মরুভূমির মাঝখানে–একেবারে নির্জন। কিন্তু যতদূর জানি এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আমাদের প্রজাতন্ত্রে রাষ্ট্রপতি স্বয়ং এর পৃষ্ঠপোষক।

-হুঁ। দারুণ চমৎকার কাজ স্বীকার করতেই হবে। জেসপের চোখে মুখে প্রশংসা ফুটলো।

 কিন্তু যে-কোনো সময় পরিদর্শন করার জন্য এ জায়গা উন্মুক্ত। এই বিষয়ে উৎসাহী ডাক্তার গবেষকরা প্রায়ই পরিদর্শনে যান ওখানে।

এবং তাদের যা দেখার নয়, তা দেখতে পান না। কেনই বা পাবেন বলো? সর্বোচ্চ সম্মানের আড়ালে কোনো খারাপ কাজ করা যত সহজ, এত সহজ আবহাওয়া আর কিছুতেই সৃষ্টি করা যায় না।

তা অবশ্য ঠিক,-লেবল্যাঙ্ক বললো, হতে পারে যাত্রাপথে কেউ কেউ হয়তো ওখানে থামে। মধ্য ইউরোপের দু-একজন ডাক্তার নাকি একবার অমনি নেমেছিলে শুনেছি। এরকম ছোট্ট ছোট্ট দল, যেমন একটি দলের সন্ধান পেয়েছি আমরা–তারা হয়তো তাদের গন্তব্যস্থলে যাবার পথে কটা দিন ওখানে কাটিয়ে যায়।

তারচেয়েও অনেক বেশি কিছু বলে আমার মনে হচ্ছে। আমার মনে হয়–সম্ভবত এখানেই যাত্রা শেষ হয়।

কুষ্ঠরোগীদের আশ্রম–কথাটা বেশ ইঙ্গিতবহ মনে হচ্ছে।…আমার বিশ্বাস, আধুনিক, চিকিৎসায় কুষ্ঠরোগ আজকাল বাড়িতেও সারানো সম্ভব।

-সভ্যদেশে হয়তো সম্ভব। কিন্তু এ দেশে সেকথা কেউ চিন্তাও করতে পারে না।

-ঠিক তা নয়। কুষ্ঠরোগ–কথাটার মধ্যেই যেন মধ্যযুগীয় চিন্তাধারা লুকিয়ে রয়েছে, যখন কুষ্ঠরোগীদের গলায় ঘন্টা ঝুলিয়ে পথচারীদের পথ ছেড়ে দেবার জন্য সাবধান করে দেওয়া হতো। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক কে? সেই জনহিতৈষী দানশীল মহাপুরুষের নামটা জানতে পারি?

সহজেই জানা যাবে। একটু দাঁড়ান। কয়েক মিনিটের মধ্যে পাশের ঘর থেকে একটা নথি নিয়ে এলো।-বেসরকারী একটি সংস্থা এই আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা। জনহিতৈষী কিছু লোক– যাঁদের মধ্যে প্রধান হচ্ছেন মিঃ অ্যারিস্টাইডস। নিশ্চয় জানেন–এই ভদ্রলোকের অগাধ টাকা। প্যারিস এবং সেভিলিতে বিরাট বিরাট হাসপাতাল তৈরি করে দিয়েছেন উনি। এই প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পনা এবং কাজকর্ম সবকিছুই তার, অন্যান্য দাতারা নামেমাত্র তার সহযোগী।

–আচ্ছা তাহলে এটা একটা অ্যারিস্টাইডসের সংস্থা! আর এই অ্যারিস্টাইডস অলিভ বেটারটন যখন ফেজ-এ ছিলো তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

-অ্যারিস্টাইডস! লেবল্যাঙ্ক পাথর হয়ে গেলো। কিন্তু এও কি সম্ভব?

 –সম্ভব!

–এ–সম্পূর্ণ অবাস্তব?

বাস্তবিকই!

–যাই বলুন–এ কিন্তু ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক কাজ।

–বটেই তো।

–কিন্তু কাজটা যে কতখানি বিপজ্জনক তা কি বুঝতে পারছেন? লেবল্যাঙ্ক উত্তেজনায় ছটফট করে উঠলো। এই অ্যারিস্টাইডস, বলতে গেলে দেশের সবকিছুর ওপরেই এঁর প্রভাব রয়েছে। ব্যাঙ্ক, কলকারখানা, অস্ত্রশস্ত্র, পরিবহন, সরকার সবকিছুর পেছনেই এঁর অদৃশ্য হাত। কেউ তাঁকে কোনোদিন চোখে দেখেনি, বড়জোর হয়তো ওঁর নাম শুনেছে। প্রচুর প্রতিপত্তি তার।

এই সমস্ত নিরুদ্দেশ সংক্রান্ত ব্যাপারে অ্যারিস্টাইডসের হাত থাকতে দেখলে মোটেই আশ্চর্য হবে না, বরং বলবো–একথা আগেই আমাদের চিন্তা করা উচিত ছিলো। এটা একটা চমৎকার ব্যবসায়িক চাল। রাজনীতির সঙ্গে বিন্দুমাত্র সংস্রব নেই এর। কিন্তু আসল প্রশ্ন হচ্ছে–এ ব্যাপারে আমরা কী করছি?

লেবল্যাঙ্কের মুখে যেন অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। না না, এ কাজ মোটেই সহজ নয় বুঝতেই পারছেন, আমাদের ধারণা যদি ভুল হয় তাহলে কী যে হবে বুঝতেই পারছেন। আর যদি সত্যি হয়, তাহলে এটা যে সত্যি তা আমাদের প্রমাণ করতে হবে। এমনকি আমরা যদি অনুসন্ধান শুরুও করি, তাহলেও যে-কোনো মুহূর্তে ওপরওয়ালাদের সর্বোচ্চ স্তর থেকে অনুসন্ধান বন্ধ করার নির্দেশ আসতে পারে–বুঝতে পারছেন? কিন্তু এ কাজ সহজ না হলেও আমাদের করতেই হবে।

.

২০.

 পাহাড়ী পথেও ঝড় উড়িয়ে গাড়িগুলো পাহাড়ের গায়ে বসানো বিশাল ফটকটার সামনে এসে থামলো। চারটে গাড়ির প্রথমটায় রয়েছেন ফরাসি মন্ত্রীসভার একজন সদস্য আর আমেরিকান রাষ্ট্রদূত। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় গাড়িতেও নামকরা লোক আছেন। চতুর্থটির যাত্রীরা সাধারণ লোকের কাছে তেমন সুপরিচিত নন, কিন্তু নিজ নিজ পদমর্যাদায় এঁরা যথেষ্ট নামী লোক। এঁদের মধ্যে রয়েছে ক্যাপ্টেন লেবল্যাঙ্ক এবং মিঃ জেসপ। ধোপদুরন্ত সোফাররা গাড়ির দরজা খুলে বিশিষ্ট অতিথিদের সম্মান দেখাবার জন্য নুয়ে পড়লো। বিশাল ফটকটা যেন হুট করে খুলে গেলো। পরিচালক স্বয়ং অভ্যর্থনায় এগিয়ে এলেন, সঙ্গে সহপরিচালক, দুজন নামকরা ডাক্তার এবং রসায়নশাস্ত্রের গবেষক একজন।

অনেকক্ষণ ধরে অভ্যর্থনাপর্ব চললো। দু-পক্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় শেষ হতে মন্ত্রীমহাশয় জিজ্ঞেস করলেন, অ্যারিস্টাইডসকে দেখছি না। সে আমাকে কথা দিয়েছিল এখানে আমার সঙ্গে দেখা করবে।

অ্যারিস্টাইডস গতকালই স্পেন থেকে এসেছেন, উনি আপনাদের জন্য ভেতরে অপেক্ষা করছেন।

ছোট্ট দলটা এগিয়ে চললো। মন্ত্রীমহাশয় যেন ঈষৎ উদ্বিগ্ন। ভয়ে ভয়ে ডানদিকের মোটা লোহার বেড়ার দিকে তাকালেন। ফাঁক দিয়ে সামান্য দেখা গেলো, কুষ্ঠরোগীরা যেন সব সারবন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে।

চমৎকার সাজানো গোছানো অতি আধুনিক লাউঞ্জে অতিথিদের অপেক্ষায় বসেছিলেন মিঃ অ্যারিস্টাইডস।

একজন সাংবাদিক অ্যারিস্টাইডসকে বললো, বাঃ! একটা চমৎকার জায়গা তৈরি করেছেন, স্যার।

অমায়িক হাসি হেসে অ্যারিস্টাইডস বললেন, হ্যাঁ, এ জায়গা আমার গর্ব।

অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য চমৎকার ভোজর আয়োজন করেছিলেন অ্যারিস্টাইডস। নানারকমের পানীয় এলো। তুর্কী কফির পর পরিদর্শনের কাজ শুরু হলো।

ঘণ্টাদুয়েক ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু তারা দেখলেন। পরিদর্শনের কাজ শেষ হতে মন্ত্রীমহাশয় খুব খুশী। মন্ত্রীমহাশয় মুগ্ধ হলেও অন্যদের অনুসন্ধিৎসা কিন্তু বাধ মানছিলো না। এখানকার ডাক্তার গবেষকরা কীরকম জীবন কাটান, রোগীদের কী ভাবে রাখা হয় ইত্যাদি নানারকম খুঁটিনাটি প্রশ্নে তারা ডাঃ ভ্যান হিদেমকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলেন।

লেবল্যাঙ্ক আর জেসপ, যথাক্রমে মন্ত্রীমহাশয় ও ব্রিটিশ বাণিজ্যদূতের সঙ্গে হাঁটছিলো। দুজনেই ইচ্ছে করে খানিক পিছিয়ে পড়লো। অন্যান্য লাউঞ্জে গিয়ে বসলো। লেবল্যাঙ্ক ফিসফিস করে বললোকই কোনোরকম সূত্র তো পাওয়া যাচ্ছে না–একটুও কিছু পাচ্ছি না–

-না, কোনো সঙ্কেতই পাচ্ছি না।

–তা যদি হয়, মানে আমরা যদি ভুল পথে এসে থাকি তাহলে যে কী হবে ভাবতে পারছি না।

-এখনও বিশ্বাস হারাচ্ছি না আমি, জেসপ বললেন। আমাদের বন্ধুরা এখানেই আছে। এ বিষয়ে আমি স্থির নিশ্চিত।

–কিন্তু তাদের তো কোনো পাত্তাই নেই।

–তা অবশ্য ঠিক। হয়তো নিজের সন্ধান জানাবার কোনো সুযোগই তারা পায়নি।

–তাহলে আমরা প্রমাণ পাবো কী করে?

–অস্থির হয়ো না, লেবল্যাঙ্ক। আমি বলছি, এখনি হতাশ হবার মতো কোনো কারণ ঘটেনি।

 –আপনি খুব আশাবাদী…হতাশ ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকালো লেবল্যাঙ্ক।

 –গাইবার কাউন্টারের নাম শুনেছো, লেবল্যাঙ্ক?

–নিশ্চয়ই শুনেছি। কিন্তু আমি বিজ্ঞানী নই, বুঝতেই পারছেন।

–আমিও নই। তবে এটুকু জানি যে গাইগার কাউন্টার, তেজস্ক্রিয় ধরার অতি শক্তিশালী যন্ত্র। সুতরাং

–সুতরাং?

–আমাদের বন্ধুরা এখানেই আছে, আমার গাইগার কাউন্টার তাই বলছে। আমাদের বন্ধুরা এখানে খুব কাছাকাছি রয়েছে। এই অট্টালিকা অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে গোলকধাঁধার মতো করে সৃষ্টি করা হয়েছে। এখানে কোনো একটা অংশ নিশ্চয়ই আমার দেখতে পাচ্ছি না। সেটা আমাদের দেখানোও হয়নি।

–শুধু তেজস্ক্রিয়তার সূত্র ধরেই কি আপনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছচ্ছেন?

–ঠিক তাই।

আমার প্রধান ভরসাস্থল ঐ সাংবাদিকরা। খবর সংগ্রহ করার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে ওদের। গোপন কিছু গন্ধ পেলেই ওদের কান খাড়া হয়ে ওঠে। সাধারণ লোকে যা একেবারে হেসে উড়িয়ে দেয় সে খবরও বিশ্বাস করে ওরা। আর বিশ্বাস আছে আমার–ওই বৃদ্ধ মানুষটির ওপর।

সবশেষে মন্ত্রীমহাশয় চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে একটু যেন শঙ্কিত স্বরে বললেন, তাহলে–আমার মনে হয়, এখন আমাদের যাবার সময় হয়েছে। যা যা দেখার ছিলো সবই আমাদের দেখা হয়ে গেছে…শেষ কথাগুলো একটু যেন তাৎপর্যপূর্ণ। ঝোঁক টেনে বললেন, এবার আমরা বিদায় নিতে পারি। আপনারা কি বলেন?

কথাগুলো একদিক থেকে একেবারে সাধারণ ভদ্রতা দেখানোর মতো। আসলে কিন্তু সমস্ত কথাগুলোই ইঙ্গিতপূর্ণ। মন্ত্রীমহাশয় তাঁর সঙ্গীদের ঘুরিয়ে একথাই বোঝালেন, আপনারা তো সবই দেখলেন, কিছুই নেই। আপনারা যা সন্দেহ করেছিলেন, যে আশঙ্কা ছিলো আপনাদের, তার বিন্দুমাত্র চিহ্নও এখানে নেই। এবার আমরা মনে শান্তি নিয়ে ফিরতে পারি।

ঠিক সেই মুহূর্তে গম্ভীর স্বরে জেসপ মন্ত্রীকে বললেন, আপনার অনুমতি নিয়ে আমি কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই, স্যার।

-ও-নিশ্চয়ই। হ্যাঁ মিঃ জেসপ, প্রশ্ন করুন।

 জেসপ সোজা ডাঃ ভ্যান হিদেমের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অ্যারিস্টাইডসকে এড়িয়ে গিয়ে বললেন, এখানে আপনাদের অনেক লোকজন দেখলাম। সত্যিই অবাক হতে হয়। কিন্তু আমার এক পুরানো বন্ধু এখানে আছে, তার সঙ্গে কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। যাবার আগে তার সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করতে আপনাদের কোনো অসুবিধে হবে না আশা করি?

-আপনার বন্ধু? ভীষণ চমকানিটা সামলে নিলেন ডাঃ ভ্যান হিদেম।

–হ্যাঁ–ঠিক বলতে গেলে–দুজন বন্ধু। একজন মহিলা, মিসেস বেটারটন, অলিভ বেটারটন। যতদূর জানি, তার স্বামী এখানে গবেষণা কাজে লিপ্ত। আগে হারওয়েল থাকতেন, তার আগেও আমেরিকায় ছিলেন। যাবার আগে ওঁদের সঙ্গে একটু দেখা করতে পারলে খুশি হতাম।

ভ্যান হিদেমের চোখেমুখে চিন্তার ছায়া পড়লো। কপালে বিস্মরণের ভাজ ফেলে বললেন, বেটারটন-মিসেস বেটারটন। না এ নামে এখানে কেউ নেই বলেই আমার বিশ্বাস।

একজন আমেরিকান ভদ্রলোকও এখানে থাকেন, জেসপ বললেন, অ্যান্ড্রু পিটার্স। খুব সম্ভবত রসায়নশাস্ত্র নিয়ে গবেষণা তার পেশা। হ্যাঁ আমি ঠিক বলেছি বোধহয়, তাই না স্যার? বলেই তিনি মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দিকে তাকালেন।

রাষ্ট্রদূত অত্যন্ত চতুর। কূটনৈতিক বুদ্ধি যেমন প্রখর, তেমনি আদর্শবান। জেসপের চোখে চোখ রেখে বললেন, আরে তাই তো, অ্যান্ড্রু পিটার্স। খেয়ালই ছিল না আমার, সত্যিই ওর সঙ্গে দেখা হলে খুব খুশি হতাম। ভ্যান হিদেমের শান্ত বিস্ময়টা ক্রমশ বিস্ফারিত হতে লাগলো। জেসপ এবার অ্যারিস্টাইডসকে দেখে নিলেন।

অ্যান্ড্রু পিটার্স? না স্যার, আপনারা কোনো ভুল সংবাদ পেয়েছেন বলেই আশঙ্কা হচ্ছে আমার। ও নামে আমাদের এখানে কেউ নেই, কাউকে চিনিও না।

–টমাস বেটারটনের নামটা নিশ্চয়ই শুনেছেন, তাই না? আচমকা প্রশ্ন করলেন জেসপ।

–টমাস বেটারটন? হা মানে, মনে হচ্ছে–

সাংবাদিকদের একজন হঠাৎ যেন কথাটা লুফে নিলো। টমাস বেটারটন। হা, কী হয়েছে? বিরাট খবর হয়ে উঠেছিলেন তিনি। মাত্র ছমাস আগে, তিনি নিরুদ্দেশ হন। সমস্ত দেশবিদেশ তোলপাড় করে পুলিস তাকে খুঁজেছে।

ভ্যান হিদেম বললেন, আশঙ্কা করছি, কেউ আপনাদের ভুল খবর দিয়েছে। সম্ভবত কেউ ধোঁকা দেবার চেষ্টা করেছে আপনাদের। আমাদের প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি কর্মীকে আজ আপনারা দেখেছেন। সমস্ত কিছুই দেখেছেন আপনারা।

পুরোপুরি সবকিছু নয় বলেই আমার মনে হচ্ছে, ঠান্ডা গলায় বললেন জেসপ। এরিকসন নামে আর-একজন যুবকও আছে, আর আছেন ডাঃ লুই ব্যারন, আরও সম্ভবত মিসেস কেলভিন বেকার

-ও-ডাঃ ভ্যান হিদেম যেন আশার আলো দেখতে পেলেন। কিন্তু ওই নামের সব্বাই তো মরক্কোর কাছে এক প্লেন দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন।

-তাহলে আপনি বলছেন–আমি ভুল করেছি? বলছেন–এই লোকগুলোর কেউ এখানে নেই?

কি করে তারা এখানে থাকতে পারেন, আপনিই বলুন স্যার? তারা তো সবাই প্লেন দুর্ঘটনায় নিহত। যতদূর জানি, সব মৃতদেহগুলোই পাওয়া গিয়েছিলো।

যে দেহগুলো পাওয়া গিয়েছিলো সেগুলো এমন ভয়ঙ্করভাবে পোড়া যে, সেগুলো যথাযথভাবে সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।

কাঁপা কাঁপা সরু একটা গলা ভেসে এলো, কী বললেন? আপনি কি বলছেন যে, মৃতদেহগুলো যথাযথভাবে সনাক্ত করা হয়নি? অবসরপ্রাপ্ত জজসাহেব, লর্ড অ্যালভারস্টোক দুহাতে কান আড়াল করে বুকে পড়লেন।

-সরকারীভাবে যথাযথ সনাক্তকরণ সম্ভব ছিলো না, স্যার, জেসপ বললেন, আমাদের বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, এই লোকগুলি প্লেন দুর্ঘটনায় মারা যায়নি।

–বিশ্বাস? অখুশিভাবে প্রায় চিৎকার করে উঠলেন লর্ড অ্যালভারস্টোক।

–বিশ্বাস ঠিক নয়, এঁরা যে বেঁচে আছেন তার প্রমাণও আছে আমার কাছে।

–প্রমাণ? কী ধরনের প্রমাণ আছে মিঃ জেসপ?

মিসেস বেটারটন যখন ফেজ থেকে ম্যারাকাশের পথে রওনা হন, তখন তাঁর গলায় একটা ঝুটো মুক্তোর আঁটা হার ছিলো। সেই হারেরই একটা মুক্তো, প্লেনটা যেখানে পুড়েছে তার থেকে আধমাইল দূরের একটা জায়গায় পাওয়া গিয়েছে।

নিশ্চিত করে কী করে আপনি বলছেন যে, যে মুক্তোটা পাওয়া গিয়েছে সেটা মিসেস বেটারটনের হারেরই?

কারণ ওই হারের প্রতিটি মুক্তোয় এমন একটা করে ছোট্ট চিহ্ন ছিল যা খালি চোখে দেখা যায় না, কিন্তু শক্তিশালী আতস কাঁচে দেখা যায়।

–মুক্তোগুলোর গায়ে এই চিহ্ন কে দিয়েছিলো?

–আমি দিয়েছিলাম, লর্ড অ্যালভারস্টোক–আমার এই সহকর্মী, লেবল্যাঙ্কের সামনে এ কাজ আমি করেছিলাম।

-মুক্তোগুলোর গায়ে ওইরকম চিহ্ন এঁকে দেবার নিশ্চয়ই কোনো কারণ ছিলো আপনার?

-হা, লর্ড অ্যালভারস্টোক। আমার বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ ছিল যে, মিসেস বেটারটন আমাদের তার স্বামীর কাছে পৌঁছে দেবেন, যাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।–জেসপ বলে চললেন। আরও দুটো মুক্তো আমাদের নজরে পড়ে। দুটোই পাওয়া যায়, যেখানে প্লেন দুর্ঘটনা ঘটেছে সেখান থেকে আসার মধ্যবর্তী পথে। মুক্তোগুলো যেখানে যেখানে পাওয়া যায়, সেখানে সেখানে খোঁজখবর নিয়ে ছজন লোকের বর্ণনা পেয়েছি আমরা। এই ছজনের সঙ্গে যারা পুড়ে গেছে বলে প্রকাশ তাদের বর্ণনা প্রায় হুবহু মিলে গেছে। এই দুজন যাত্রীর মধ্যে একজনের কাছে ছিলো আমাদের দেওয়া দস্তানা। যার গায়ে জ্বলজ্বলে ফসফরাসের রঙ লাগিয়ে দেওয়া ছিল। এই ফসফরাসের ছাপ একটি গাড়ির গায়ে দেখতে পাওয়া যায়, যে গাড়িটা এই যাত্রীদের আসার পথে অনেকখানি পথ বয়ে এনেছে।

লর্ড অ্যালভারস্টোক মন্তব্য করলেন, খুব গুরুতর ব্যাপার।

চেয়ারের মধ্যে বসে থাকা মিঃ অ্যারিস্টাইডস জিজ্ঞেস করলেন, শেষ কোথায় এই দলটির দেখা পাওয়া যায়?

–একটা পরিত্যক্ত বিমানঘাঁটিতে। জেসপ জায়গাটার মোটামুটি একটা বর্ণনা দিলেন। অ্যারিস্টাইডস বললেন, সে তো এখান থেকে অনেক দূরে।…যেহেতু বিমানঘাঁটিটা এখান থেকে কয়েক শো মাইল দূরে, আমি বুঝতে পারছি না কিসের ভিত্তিতে আপনি বলছেন যে তারা এখানেই এসেছেন। কেনই বা তারা আসবেন এখানে?

–কিছুদিন আগে আমাদের একটা সন্ধানী প্লেন একটা সঙ্কেতবার্তা ধরে ফেলে। সেই বার্তাটি লেবল্যাঙ্কের কাছে যায়। গোপন সঙ্কেতলিপি দিয়ে শুরু করা সেই বার্তাটি সন্ধান দেয় যে, যাদের আমরা খুঁজছি সেই লোকগুলো কোনো এক কুষ্ঠ আশ্রমে আছে।

এবার অ্যারিস্টাইডস বললেন, সত্যিই খুব গুরুতর ব্যাপার মনে হচ্ছে, খুবই গুরুতর। কিন্তু আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, আপনাদের যে ভুল পথে নিয়ে আসা হয়েছে এ বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এঁদের কেউ এখানে নেই। আমার এই প্রতিষ্ঠানে যেমন খুশি অনুসন্ধান করার পূর্ণস্বাধীনতা আপনাদের রয়েছে–আপনারা দেখতে পারেন।

-খুঁজে কিছু পাবো কিনা সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে, স্যার-জেসপ বললেন, মানে ওপর ওপর খুঁজে কিছু পাওয়া যাবে না। এবার এক মোম চাল চাললেন জেসপ, কিন্তু ঠিক কোন্ জায়গা থেকে অনুসন্ধান শুরু করতে হবে সেটা আমি জানি।

–আচ্ছা! তা সে জায়গাটা কোথায় শুনি?

 –দ্বিতীয় গবেষণাগার পেরিয়ে চতুর্থ বারান্দার একেবারে শেষে বাঁদিকে যেতে হবে।

হঠাৎ কেমন চঞ্চল হয়ে উঠলেন ডাঃ ভ্যান হিদেম। হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে জেসপ বললেন, দেখতেই পাচ্ছেন ডাক্তার, আমাদের হাতে অনেক পাকা খবর আছে।

তীক্ষ্ণস্বরে চটপট জবাব দিলেন ভ্যান হিদেম, এ অসম্ভব। সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। আপনারা ইঙ্গিত করছেন যে, কিছু লোককে আমরা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এখানে আটকে রেখেছি। এ অভিযোগ আমি সরাসরি অস্বীকার করছি।

মন্ত্রীমহাশয় বললেন, মনে হচ্ছে আমরা কানাগলিতে ঢুকে পড়েছি।

মিঃ অ্যারিস্টাইডস শান্ত স্বরে কথা বললেন, আপনাদের তত্ত্বটা সত্যিই চমকপ্রদ কিন্তু নেহাতই তত্ত্ব। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তিনি ব্যস্ত হয়ে বললেন, মহাশয়রা আমায় মাফ করবেন, এবার আপনাদের উঠতে হবে। বিমানঘাঁটি পর্যন্ত অনেকখানি রাস্তা আপনাদের মোটরে পাড়ি দিতে হবে, সময়মতো পৌঁছতে না পারলে চারদিকে আবার খবর চলে যাবে আপনাদের সন্ধান করার জন্য সুতরাং

লেবল্যাঙ্ক এবং জেসপ দুজনেই উপলব্ধি করলেন, এই মুহূর্তে সামনাসামনি ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় এসে গেছে। অ্যারিস্টাইডস তার ব্যক্তিত্বকে কাজে লাগাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এরা কিছু করুক বা না করুক তা আর সে চাইছে না।

অ্যারিস্টাইডস জেসপ আর লেবল্যাঙ্কের মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছেন। কিন্তু ওপরওলার নির্দেশ ছাড়া ওরা কিছুই করতে পারবে না।

লর্ড অ্যালভারস্টোক বললেন, আমার মত–আমাদের যাত্রাকে ত্বরান্বিত করা উচিত হবে না। কারণ এখানে এমন একটা ঘটনা রয়েছে যার ভালো ভাবে তদন্ত প্রয়োজন। অত্যন্ত সাংঘাতিক সব অভিযোগ করা হয়েছে, আমার মতে ছেড়ে দেওয়া যায় না। এই অভিযোগ খণ্ডন করার আইনসঙ্গত সুযোগ এঁদের দেওয়া উচিত।

–প্রমাণ করার দায়িত্ব কিন্তু আপনার উপর বর্তাবে, অ্যারিস্টাইডস তাঁর ব্যক্তিত্বের রোশনি ছড়ালেন।

দারুণ চমকে বোঁ করে ঘুরে দাঁড়ালেন ডাঃ ভ্যান হিদেম। একজন মুর ভৃত্য কখন সামনে এগিয়ে এসেছে। চমৎকার স্বাস্থ্যবান ভৃত্যটির গায়ে কাজ করা সাদা পোশাক, মাথায় মরক্কো টুপি; তেলতেল কালো মুখটা চকচক করছে।

নিগ্রোদের মতো পুরু ঠোঁটের আড়াল থেকে পরিষ্কার শুদ্ধ ইংরেজি উচ্চারণ শুনে সমস্ত দলটা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো।

ভৃত্যটি বলে উঠলো, প্রমাণ আছে। আপনারা এখনই আমার সাক্ষ্য নিতে পারেন। এই ভদ্রলোক বলছেন যে, অ্যান্ড্রু পিটার্স, টরকুইল এরিকসন, মিঃ এবং মিসেস বেটারটন ও ডাঃ লুই ব্যারন এখানে আছেন–এবং তাদেরই প্রতিনিধি। এক পা এগিয়ে এসে সে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সামনে দাঁড়ালো। বললো, এই মুহূর্তে হয়তো আমাকে চিনতে আপনার কষ্ট হচ্ছে স্যার–আমি অ্যান্ড্রু পিটার্স।

অ্যারিস্টাইডস তার দিকে তাকিয়ে একটা ক্ষীণ শব্দ করে ভাবলেশহীন মুখ নিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন।

সব্বাইকে এখানে লুকিয়ে রাখা হয়েছে, পিটার্স বললো, মিউনিখের স্কুয়াজ, হেলগা নিডহেইম, আমেরিকার পল ওয়েড, ইংরেজ বিজ্ঞানি জেফ্রি এবং ডেভিডসন, ইতালির রিকোসেটি, বিয়াঙ্কা এবং মার্চিসন–সবাই এখানে আছেন। মাঝখানের দরাজাটা বন্ধ করার এমন অপূর্ব কৌশল যে খালিচোখে সে দরজার হদিস কেউ পাবে না। গোপন গবেষণাগারগুলোও তৈরি করা হয়েছে, পাহাড়ের তলায় সুড়ঙ্গ কেটে।

–হায় ভগবান, মার্কিন রাষ্ট্রদূত বললেন, ভৃত্যটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তিনি বললেন, না, এখনও যে তোমাকে ঠিক চিনতে পেরেছি তা বলবো না আমি।

ঠোঁটে প্যারাফিন ইনজেকশন নেওয়ার ফলে এইরকম হয়েছে স্যার। আর গালের রঙের ব্যাপারটা না বললেও চলবে।

-তুমি যদি পিটার্স হও, এফ.বি.আই.-এর কোন নাম্বারে তুমি কাজ করছো?

–৮১৩৪৭১ স্যার।

বেশ। আর তোমার ছদ্মবেশের আদ্যাক্ষর?

 বি.এ.বি.ডি.জি. স্যার।

রাষ্ট্রদূত বললেন, এ লোক পিটার্স কোনো সন্দেহ নেই আমার, মন্ত্রীর দিকে ফিরলেন তিনি।

মন্ত্রীবর পিটার্সকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি বলছো–এই সমস্ত লোকদের তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে এখানে আটকে রাখা হয়েছে?

-কেউ কেউ স্ব-ইচ্ছায় আছেন, কেউ কেউ নয়, স্যার।

–হু, সে ক্ষেত্রে তাদের জবানবন্দি নিতেই হবে। পুলিসের বড়কর্তার দিকে তাকালেন তিনি। ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন।

–একটু দাঁড়ান, অ্যারিস্টাইডস নির্দেশ দিলেন। ধীর শান্ত হতাশ স্বরে বললেন, সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে, আমার বিশ্বাসের ওপর চরম আঘাত হেনেছে এরা। আরক্ত শীতল দৃষ্টিতে ভ্যান হিদেম এবং পরিচালককে বললেন, বিজ্ঞানের আবিষ্কার উন্মাদনায় মেতে আপনারা এখানে কী যে করেছেন তা আমার জানা নেই। আমার এই কল্যাণ প্রতিষ্ঠানের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো বিজ্ঞানের সাধনা। যদি এঁদের অভিযোগ সত্য হয় তাহলে এই মুহূর্তে সেই লোকদের আপনি এখানে হাজির করুন, যাদের বেআইনিভাবে এখানে আটকে রাখা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।

কিন্তু স্যার, এ অসম্ভব। আমি–মানে এতে–

কোনরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা যদি ভেবে থাকেন, তা এখানেই শেষ করতে হবে। আশাকরি, মহাশয়দের এ আশ্বাস আমাকে মুখ ফুটে বলে দিতে হবে না যে, এখানে সত্যিই যদি কোনো বেআইনী কাজ কারবার চলে থাকে তা সম্পূর্ণ আমার অগোচরেই ঘটেছে।

এ যেন জবাবদিহি নয়, আদেশ। এ আদেশ অর্থের, এ আদেশ অসীম ক্ষমতার এবং বিশাল প্রতিপত্তির। মিঃ অ্যারিস্টাইডস, দুনিয়াজোড়া যাঁর নাম, তাকে এ ব্যাপারে জড়ানো চলবে না। তবে এই অপরাধের পঙ্কিল আবর্ত থেকে যদিও তার হাতে দাগ না লাগে, তবুও এ তার পরাজয়। এ পরাজয়, এ ব্যর্থতা জীবনে বার বার এসেছে তার। ব্যর্থতা কাটিয়েই মাথা উঁচু করেছেন মিঃ অ্যারিস্টাইডস।

অদ্ভুত হাতের ভঙ্গি করে বললেন তিনি, ঈশ্বর করুন, এসব ব্যাপারে আমার যেন কোন সংস্রব না থাকে।

পুলিশ অধিকর্তা এগিয়ে এলেন। বললেন, কোনোরকম বাধা যেন না দেওয়া হয়। আমার কর্তব্য আমাকে করতে দিতে হবে।

ফ্যাকাসে মুখ নিয়ে এগিয়ে এলেন ভ্যান হিদেম। আমার সঙ্গে আসুন, আমাদের সংরক্ষিত ঘরগুলো আপনাদের দেখিয়ে দিচ্ছি আমি।