তুরুপের তাস

তুরুপের তাস

এক

কাগজের খবর

অক্টোবর মাসের এক অত্যুজ্জ্বল রবিবারের সকালে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারে ফ্ল্যাটে আড্ডা দিতে গিয়ে দেখি, বৃদ্ধ প্রকৃতিবিদ একপ্রকার কিম্ভুত আকৃতির ক্যাকটাসের সামনে চোখ বুজে ধ্যানস্থ রয়েছেন এবং তার কানে হেডফোন চাপানো। হেডফোনের তার গিয়ে ক্যাকটাসটার গায়ে বেঁধানো একটা আলপিনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।

পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকেছিলুম, বুড়োকে একটু চমকে দেওয়ার আশায়। কিন্তু উল্টে আমাকেই ভীষণ চমকে উঠতে হল, যখন উনি হঠাৎ ঠকঠক করে কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে কাঁপতে শুরু করলেন।

আমি ভাবলুম, ইলেকট্রিক শক খেয়েছেন কর্নেল। তাই শশব্যস্তে কাছে গিয়ে প্রথমে দেয়ালের সুইচবোর্ডের সঙ্গে হেডফোনের সংযোগ খুঁজলুম। না দেখতে পেয়ে ধারণা হল, হয়তো ওই উদ্ভুট্টে উদ্ভিদটা থেকেই কোনও মারাত্মক বিদ্যুৎশক্তি নির্গত হয়ে ওঁকে মুহুর্মুহু শকে জর্জরিত করছে।

অতএব তক্ষুণি ক্যাকটাসের গা থেকে পিনটা উপড়ে ফেললুম।

অমনি কর্নেল আহা হা করে বাজখাই গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন এবং আমাকে দেখতে পেয়ে করুণ স্বরে বললেন, করলে কী জয়ন্ত! আমার বাইশ ঘন্টার রক্ত জল করা পরিশ্রম বরবাদ করে ফেললে?

আমি তো অপ্রস্তুত। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললুম, আমি ভেবেছি আপনার ইলেকট্রিক শক লেগেছে।

কর্নেল হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর হেডফোনের মতো যন্ত্রটা মাথা থেকে খুলে বললেন, তুমি কী ক্ষতি যে করলে জয়ন্ত, তোমায় বোঝাতে পারব না। এই যে যন্ত্রটা দেখছ, এটা উদ্ভিদবিজ্ঞানী স্যার জগদীশ বসুর গবেষণার ওপর ভিত্তি করে এক রুশবিজ্ঞানী সম্প্রতি তৈরি করেছেন। উদ্ভিদের যে ভাষা আছে, তা এই যন্ত্রের মাধ্যমে বোঝা যায় এবং সে যা বলছে, তার জবাবও তার ভাষায় দেওয়া যায়।

অবাক হয়ে বললুম, আপনি ম্যালেরিয়ায় পাওয়া লোকের মত ঠকঠক করে কাঁপছিলেন—তা কি ওই হতচ্ছাড়া ক্যাকটাসটার সঙ্গে বাতচিত?

ঠিকই ধরেছ। বলে ঘুঘুমশাই কোণের দিকে আরামকেদারায় গিয়ে বসলেন। তারপর চুরুট ধরালেন।

পাশের ডিভানে বলে বললুম, না জেনে দোষ করার জন্য ক্ষমা চাইছি।

কর্নেল সন্দেহে হাসলেন। জয়ন্ত! তোমায় একটা বই দেব। দি সিক্রেটস অফ প্ল্যান্ট লাইফ। পড়লে বুঝতে পারবে, উদ্ভিদ কীভাবে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায়। যাক্ গে, বসো। কফি-টফি খাও! ষষ্ঠীকে বলি।

বলে তিনি ষষ্ঠীচরণকে হাঁক দেওয়ার জন্যে ঠোঁট ফাঁক করার সঙ্গে সঙ্গে ষষ্ঠীচরণ ট্রে হাতে ঘরে ঢুকল। একগাল হেসে বলল, কাগজের দাদাবাবু! প্রতাপগড়ের পেত্নীর খবরটা কি সত্যি গো?

ষষ্ঠী ইদানিং আমায় কাগজের দাদাবাবু বলে সম্ভাষণ করে। তবে দুঃখের বিষয় কাগজের লোক বলেই কাগজের খবরে আমার রুচি নেই। ময়রা কি সন্দেশ খেতে ভালবাসে? তাই বললুম, ষষ্ঠী! পেত্নীর খবরের চেয়ে তোমার কর্তামশাইয়ের যে কীর্তি এইমাত্রার দেখলুম, সেটাই আজকের বড় খবর।

ষষ্ঠীচরণ বেজার মুখে চলে গেল। কর্নেল কফির পেয়ালা তুলে চুমুক দিয়ে বললে, হুম! ষষ্ঠীকে অবহেলা কোরো না ডার্লিং। আজকাল আমি বিবিধ বিষয়ে ওর পরামর্শ নিই। জয়ন্ত, ইনটুইশান বলে একটা ব্যাপার আছে—যা প্রকৃতি অনেক মানুষকে দিয়েছেন এবং এতে শিক্ষিত অশিক্ষিত ভেদাভেদ রাখেননি। তাছাড়া তুমি তো জানো, প্রখ্যাত নাট্যকার ইবসেন নাটক লিখে আগে তার পরিচারিকাকে শোনাতেন।

বললুম, আপনার ভাষণের লক্ষ্য কী কর্নেল? প্রতাপগড়ের পেত্নী?

কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, ষষ্ঠীর মধ্যে প্রকৃতিদত্ত সেই সূক্ষ্মবোধ আছে জয়ন্ত। আজ ওই খবরটার দিকে সে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছে বারবার। আমি ক্যাকটাস নিয়ে ব্যস্ত থাকায় মন দিতে পারিনি। তবে আমার ধারণা, খবরটা নিশ্চয় সামান্য খবর নয়।

পাশে টেবিলের ওপর সেদিনের কয়েকটা কাগজ ছিল। আমাদের কাগজ দৈনিক সত্যসেবককে আমি তত গুরুত্ব দিই না। তাই অন্য একটি বাংলা দৈনিক তুলে নিলুম। প্রথম পাতার নিচের দিকে খবরটা দেখতে পেলুম।

ডাকুরানি লছমীর প্রেতাত্মা?

প্রতাপগড়, ১২ অক্টোবর—সম্প্রতি এ অঞ্চলে অদ্ভুত ধরনের কয়েকটি ডাকাতির খবর পাওয়া গেছে। শেষ ডাকাতি ঘটেছে একটি পেট্রল পাম্পে। গতকাল এই পাহাড়ী শহরের প্রান্তে রাত নটার সময় ডাকুরানি লছমী আচমকা হাজির হয়। তাকে দেখামাত্র পাম্পের কর্মচারীরা হতবাক হয়ে যায়। কারণ লছমী গতমাসে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হয়েছে এবং অসংখ্য মানুষ তার মৃতদেহ দেখেছে। অবিকল সেই রক্তাক্ত মৃতদেহ জীবিত, মানুষের মতো পেট্রল পাম্পে উপস্থিত হয়েছে এবং তার হাতে যথারীতি রিভলভারও রয়েছে দেখে কর্মচারীরা আতঙ্কে কেউ মুছিত হয়ে পড়ে, কেউ দিশেহারা হয়ে পালিয়ে যায়। পাম্পের মালিক পুলিশকে জানিয়েছেন, তার ক্যাশে তখন সতেরো হাজার টাকা ছিল। সে টাকা আর পাওয়া যায়নি। পুলিশের ধারণা, কেউ লছমী সেজে একাজ করে বেড়াচ্ছে। ইতিপূর্বে ঠিক এমনি ঘটনা আরও কয়েকটি ঘটেছে।

উল্লেখ করা যায়, এই পেট্রল পাম্পের মালিকের বাড়িতেও কদিন আগে মৃতা লছমী একইভাবে হানা দেয়। তখন তিনি তার রাইফেল থেকে গুলি চালান। আশ্চর্য, লছমীর গায়ে একটা গুলিও লাগেনি। পুলিশ অবশ্য এ ঘটনার ব্যখ্যা দিয়ে বলেছে যে গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিল।

কাগজটা মুড়ে রেখে দিলুম। কর্নেল বললেন, তোমার ইনটুইশন কি জয়ন্ত?

পুলিশ যা বলেছে।

অর্থাৎ লছমী সেজে ডাকাতি করে বেড়াচ্ছে?

হ্যাঁ, আবার কী?

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, ষষ্ঠীর ইনটুইশন অন্য কথা বলেছে। লছমীর পেত্নী ডাকাতি করে বেড়াচ্ছে?

না। ওই খবরের কিছু গোলমেলে ব্যাপার সে ধরিয়ে দিয়েছে। কর্নেল মুখে সেই হাসি রেখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। মুখে রহস্যের ভঙ্গি—যা দেখে আমি বরাবর উত্তেজনা অনুভব করি। বললুম সংস্কৃত শ্লোকে আছে—সংসর্গজা দেশগুণাঃ ভবন্তি। তা ষষ্ঠীচরণ আপনার মতো ধুরন্ধর গোয়েন্দার সংসর্গে থেকে বুঝি পাতিগোয়েন্দা হয়ে উঠেছে? দেখুন কর্নেল, খবরের কাগজের প্রত্যেকটা খবরে গোলমাল থাকবেই থাকবে। সেটাই নিয়ম। কারণ খবর যিনি পাঠান এবং যিনি তা অনুবাদ করেন..

বাধা দিয়ে কর্নেল বললেন, জয়ন্ত, জয়ন্ত! আমার কথাটা আগে শোনো।

বলুন।

বরং এক কাজ করা যাক, ষষ্ঠীচরণের মুখেই তার ধারণার কথা শোনা ভাল।

বলে কর্নেল ডাকলেন, ষষ্ঠী! ও ষষ্ঠী এদিকে একবার আসবে কি?

ষষ্ঠীচরণ যেন ওৎ পেতেই ছিল। পর্দা তুলে গম্ভীর মুখে বললল, বলুন স্যার!

কর্নেল বললেন, পেত্নীর খবরের কী যে খটকা আছে বলছি লে তখন?

অভিমান দেখিয়ে ষষ্ঠী বলল, আছে। শুনলেন না তো!

এবার বলো, শুনব। তোমার কাগজের দাদাবাবুও শুনবেন। ষষ্ঠী ফিক করে হাসল সঙ্গে সঙ্গে। বলল, মজাটা দেখুন। প্রতাপগড় তো স্যারের সঙ্গে কতবার আমি গেছি। কাগজের দাদাবাবুও গেছেন। টাউনের শেষে বড় রাস্তার ধারে পেট্রল পাম্প। কেমন তো? রাত নটায় সেই পাম্পে সতেরো হাজার নগদ টাকা মজুত রেখেছে মালিক! বিশ্বাস হয় বলুন? বললুম, চুরি-ডাকাতির পর ললাকে পুলিশকে বাড়িয়েই বলে।

বলুক না! কিন্তু একই লোকের ওপর পেত্নী দুবার হামলা করল? সতেরো হাজার টাকা এবং গুলি গায়ে লাগেনি—দুটোতে খটকা বাধছে কাগজের দাদাবাবু!

কিসের খটকা বুঝলুম না ষষ্ঠী?

ষষ্ঠী ক্ষুব্ধভাবে বলল, বেশি লেখাপড়া জানিনে কাগজের দাদাবাবু! কিন্তু আমার মনে খটকা বেধেছে। মনে হচ্ছে, বড় কিছু ঘটবে, এগুলো তারই গোড়াপত্তন। তাছাড়া ডাকাতি শুধু একজনই করল? দলবল সঙ্গে নেই, একা? আর তার চেয়ে বড় কথা, পেত্নী-ডাকাত? দেখবেন, নির্ঘাৎ বড় কিছু ঘটবেই।

ষষ্ঠীর হাবভাবে হাসি পাচ্ছিল। কিন্তু বেচারাকে দুঃখ দেওয়া ঠিক নয় ভেবে মুখে চিন্তার ভাব ফুটিয়ে বলুলম তুমি যা আঁচ করছ, সত্যি হতে পারে বৈকি।

আমার কথা শুনে সে কর্নেলের দিকে খুব আশা নিয়ে তাকাল। কর্নেল সেটা টের পেয়ে বললেন, ক্যাকটাসটা নিয়ে ব্যস্ত না থাকলে ব্যাপারটা দেখে আসা যেত। তাছাড়া এ শরৎকালে প্রতাপগড়ের তুলনা হয় না। প্রকৃতি তাকে এ সময়টা দারুণ সাজিয়ে তোলে, না? হুম্ জয়ন্ত, রথদেখা কলা-বেচার সম্পূর্ণ সুযোগ ছিল! ষষ্ঠী হতাশভাবে ঘর থেকে পেয়ালা দুটো নিয়ে বেরিয়ে গেল।

আমি ষষ্ঠীর কথাটা তখনও ভাবছিলুম। লোকটার কপালে দুর্ভোগ আছে বোঝা যাচ্ছে। ওকে গোয়েন্দারোগে ধরেছে এবং সব তাতেই ওর খটকা লাগতে শুরু করেছে। প্রতাপগড়ের কে ভদ্রলোকের পেট্রল পাম্পে ও বাড়িতে দুবার ভূত সেজে কেউ ডাকাতি করেছে, তাই নিয়ে ও রীতিমতো একটা গোয়েন্দা-থিসিস খাড়া করে ফেলেছে।

বললুম, কর্নেল! আপনার এই অনুচরটিকে সামলান! এর ভবিষ্যৎ ভেবে শিউরে উঠছি।

কিন্তু কর্নেল আমার কথার জবাব দিলেন না। চেয়ারে তখনকার মতো বসে হেডফোন জাতীয় যন্ত্রটা পরতে ব্যস্ত রয়েছেন।

গতিক দেখে আমি উঠে দাঁড়ালুম। বললুম, আসি কর্নেল।

তবু কর্নেলের কোনও সাড়া না পেয়ে বেরিয়ে গেলুম। ওঁর এমন অদ্ভুত আচরণ এতদিনে গা সওয়া হয়ে গেছে। আজকাল আর একটুও গায়ে মাখিনে।

সেদিন কাগজের অফিসে আমার বিরতির দিন। দুপুরে ঘুমিয়ে গেছি খেয়েদেয়ে, একসময়  ফোন বাজল। কানে তুলতেই চেনা কণ্ঠস্বর ভেসে এল।—ডার্লিং জয়ন্ত! তুমি কি ঘুমোচ্ছিলে? দিনদুপুরে ঘুমই বাঙালির পতনের কারণ। তো শোন কাল ভোরে সাড়ে পাঁচটায় আমরা প্রতাপগড় রওনা হচ্ছি। তৈরি থেকো!

চমকে উঠেছিলুম। ডাক এসেছে নাকি সেখান থেকে?

হুম। ঠিকই ধরেছ।

পুলিশের ডাক বুঝি?

কখনও না, কখনো না। মোহনপ্রসাদ সিং—মানে যাঁর পাম্পে লছমীরানির ভূত হামলা করেছিল, তিনিই আমাকে ডেকেছেন।

বলেন কী! যে কেউ ডাকলেই আজকাল বুঝি আপনি চাকরের মতো…

না, না। মোহনজি আমার সুপরিচিত জয়ন্ত। একবার ওঁর আতিথ্যে কাটিয়ে এসেছিলুম। অমায়িক সজ্জন মানুষ। সকালে তুমি চলে যাওয়ার পর উনি ট্রাঙ্ককল করেছিলেন।

তাহলে ষষ্ঠীচরণের গোয়েন্দাগিরি আর ঠেকানো গেল না।

না। হাসতে হাসতে কর্নেল বললেন, ঠিক আছে। তৈরি থেকো…

 

দুই

রক্তাক্ত মৃতদেহ

মোহনপ্রসাদ সিং প্রতাপগড়ে সেসময়ে নাকি দামি মানুষ ছিলেন। কারণ, তখন উনি রাজনীতি করতেন। পরে রাজনীতি ছেড়ে বাণিজ্যে মন দেন। খুব একটা বড় ব্যবসায়ী হতে পারেননি। একটা পেট্রল পাম্প, একটা ট্রাক এবং একটা জিপগাড়ি, আর একটা কাঠগোলার মালিক হয়েছেন। মাইল পাঁচেক দুরে প্রতাপগড় রিজার্ভ ফরেস্ট। মরসুমে সেখানে সরকার বন এলাকায় গাছ বিক্রি করে। টেন্ডার ডাকা হয়। মোহনজি তদ্বির করে টেন্ডার জোগাড় করেন। তবে চোরাই কাঠ চালানকারীরাও কম নেই তল্লাটে। যারা কাঠগোলার ব্যবসা করে, তার তাদের মা-বাবা।

মোহনজির বাড়িতে থাকাটা ঠিক মনে করেনি কর্নেল। আমরা উঠেছি সেচ-দফতরের বাংলোয়। মোহনজি তার জিপটা আমাদের সেবায় দিয়েছেন। ড্রাইভারের নাম মহাবীর। গাঁট্টাগোট্টা চেহারা। লছমী ডাকুরানির অসংখ্য গল্প সে জানে। কীভাবে লছমী নদীর ধারে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে মারা পড়েছিল, তা সে স্বচক্ষে দেখেছে। লছমীর রক্তাক্ত লাশের একটা ভয়ংকর বিবরণ তার কাছে শুনেছি আমরা। তাছাড়া মোহনজির পাম্পে ডাকাতির সময় সে ওখানে উপস্থিত ছিল। সেই রক্তাক্ত লাশকে জীবিত মানুষের মতো হানা দিতে দেখে আঁতকে সে পালিয়ে গিয়েছিল!

শুধু তাই নয়, যে রাতে মোহনজির বাড়িতে লছমীর ভূত হামলা করে, সে রাতেও সে খাটিয়া পেতে বারান্দায় শুয়েছিল। ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টির মধ্যে লছমীর আবির্ভাব হয়। মহাবীর কিরে কেটে বলেছে, সেই রক্তাক্ত মড়া হয়ে মছমী বাড়ি ঢুকেছিল। মোহনজির রাইফেল আছে। মাঝে মাঝে কাঠ আনতে জঙ্গলে যান বলে রাইফেল কিনেছেন। তো লছমীর দিকে পরপর চারটে গুলি ছোঁড়েন তবু লছমীর গায়ে আঁচড় লাগেনি। কিন্তু বাড়িসুষ্ঠু লোক জেগে গেছে। হইহল্লা করেছে। তাই শেষপর্যন্ত অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যায়।

পরদিন সকালে আমরা ব্রেকফাস্ট করতে বসেছি, কর্নেল সবে প্রাতঃভ্রমণ সেরে এসেছেন, এমন সময় আমাদের পরিচিত পুলিশ অফিসার শর্মাজি এসে হাজির হলেন।

শর্মাজি হাসতে হাসতে বললেন, মোহনপ্রসাদ আমাদের ওপর আস্থা রাখতে পারেননি। তাই আপনাকে টেনে এনে এনেছেন। তাতে অবশ্য আমি খুশিই।

কর্নেল যেন অপ্রস্তুত হওয়ার ভান করে বললেন, না, না মিঃ শর্মা! আপনি তো বিলক্ষণ জানেন, প্রতাপগড় আমার কত প্রিয় জায়গা! ;

শর্মা চোখ নামিয়ে বললেন, লুকিয়ে লাভ নেই কর্নেল। স্বয়ং মোহনজি কথাটা আমাকে জানিয়ে এসেছেন। ওঁকে তো জানেন বড্ড খামখেয়ালী মানুষ, তবে একথা ঠিক, ইদানীং পরপর পাঁচটা এ ধরনের ডাকাতি হয়েছে প্রতাপগড়ে। পাঁচটাই লছমীর ভূতের কীর্তি বলে ভিকটিমরা স্টেটমেন্ট দিয়েছে। সময় রাত নটা থেকে দশটা, শুধু—একটি কেসে সন্ধেবেলা। আমার ধরণা, কেউ লছমী সেজে এসব করছে। কিন্তু কোনও সূত্র আমরা খুঁজে পাচ্ছিনে।

কর্নেল বললেন, দুটো কেস তো মোহনজির। বাকি তিনটে কোথায়—কোথায়, কীভাবে ঘটল, বলবেন কি মিঃ শর্মা?

শর্মাজি বললেন, তিনটেই নেহাত পেটি কেস। একটি স্লাম এরিয়ায়। এক বুড়ির ওপর হামলা করে তার অল্পসল্প টাকাকড়ি ছিনিয়ে নেয়। বুড়ি-বাড়ি ঝিয়ের কাজ করে পয়সা জমিয়েছিল। আর একটা এই রাস্তার ধারে চায়ের দোকানে! লোকজন বিশেষ ছিল না তখন! রাত প্রায় দশটা। চা-ওলা ঝাঁপ ফেলতে যাচ্ছে, লছমীর ভূত হাজির।… বাকি কেসটা রাহাজানির মতো। এক দেহাতী ছোট ব্যবসায়ী সাইকেলে চেপে সন্ধেবেলা ফিরে যাচ্ছিল। হাইওয়েতে হঠাৎ তার সামনে লছমীর ভূত এসে দাঁড়ায়। মজার কথা, দেহাতী লোকটির যে গ্রামে বাড়ি, লছমী সে-গাঁয়েরই মেয়ে। লোকটি ভয়ে ভির্মি খায়। জ্ঞান হলে দেখে টাকাকড়ি সব খোয়া গেছে।

আরও কিছুক্ষণ একথা নিয়ে আলোচনার পর শর্মাজি চলে গেলেন। যাওয়ার সময় বলে গেলেন, আপনাকে মোহনজি এনেছেন বলে অবশ্যই আমি এতটুকু ক্ষুব্ধ হইনি কর্নেল। বরং আপনার সাহায্য আমিও চাই। প্রতাপগড়ে কয়েকটা কেসে আপনার সাহয্যের জন্য পুলিশ এখনও কৃতজ্ঞ। নতুন অফিসাররা আপনার কথা জানেন না। আমি জানিয়ে দেব বরং।

শর্মাজি চলে গেলে কর্নেল বললেন, মোহনপ্রসাদ পুলিশের কানে আমার আসার খবর তুলতে গেলেন কেন? অদ্ভুত লোক তো!

বললুম, আপনার প্রতি মোহনজির প্রবল আস্থা। তাই আপনাকে নিয়ে পুলিশের কাছে বাজি ধরেছেন।

অর্থাৎ আমি ওঁর তুরুপের তাস। বলে কর্নেল কী যেন ভাবতে থাকলেন।

বারান্দায় গিয়ে বসলুম। নিচে নদী। তার ওপারে একটা টিলার মাথায় লাল রঙের একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছিল। বাড়িটা আগে এসেও দেখেছি এবং কেন কে জানে, কেমন রহস্যের গন্ধ টের পেয়েছি। বাড়ির একতলাটা দেখতে কতকটা দুর্গের মতো। বহুকালের পুরনো দেওয়ালের ফাটলে আগাছা গজিয়ে রয়েছে। বাড়িটা নিশ্চয় হানাবাড়ি।

মহাবীর লনের ওপাশে মালির সঙ্গে কথা বলছিল। তাকে ডেকে জিগ্যেস করলুম, ওই বাড়িটায় কে থাকে? কার বাড়ি বলতে পারো?

মহাবীর বলল, বাড়িটা স্যার প্রতাপগড়ের এমএলএ রঘুনন্দনজির। ওঁর বাবা এক সায়েবের কাছে কিনেছিলেন শুনেছি। তাই কেউ কাছে যেতেও ভয় পায়।

মহবীরের সঙ্গে প্রতাপগড়ের হালচাল নিয়ে কথা বলছি, কর্নেল বেরিয়ে এসে বললেন, জয়ন্ত! আমি একটু বেরুচ্ছি। তুমি বরং মহাবীরকে নিয়ে জিপে করে ঘুরে এস কোথাও।

মহাবীর বলল, আপনাকে পৌঁছে দিই স্যার, যেখানে যাবেন। তারপর ছোট সায়েবকে নিয়ে বেরুব।

কর্নেল বললেন, না না। দরকার হবে না। আমি বেশিদূর যাব না।

কর্নেল আমাকে ফেলে যাওয়ার মনে অভিমান জেগেছিল। কিন্তু ওঁর সঙ্গে বেরুনোর ঝক্কি কী, মনে পড়ায় শেষ পর্যন্ত খুশিই হলুম। কোথায় কোথায় টো টো ঘুরবেন কে জানে! তার চেয়ে চুপচাপ প্রকৃতি দেখা আনন্দজনক।

মহাবীর বলল, যাবেন নাকি স্যার কোথাও ঘুরতে?

বললুম, বরং এক কাজ করা যাক। চলো, এই পোড়োবাড়িটা দেখে আসি। আঁতকে উঠল মহাবীর। না স্যার। ভুলেও ওখানে পা বাড়াবেন না। তাছাড়া জিপ যাওয়ার রাস্তা নেই ওদিকে। বরং চলুন, ওয়াটার ড্যাম দেখিয়ে আনি।

দেখেছি তোমাদের ওয়াটার ড্যাম। তুমি যাও মহাবীর, গল্প করো গে মালীর সঙ্গে। আমি পায়দল ঘুরে আসি।

আমার কথা শুনে মহাবীর টের পেল আমি রাগ করেছি। সে কঁচুমাচু মুখে বলল, আমার কথা বিশ্বাস করুন স্যার। ওখানে শঙ্খচূড় সাপের আড্ডা। মালীকে জিগ্যেস করুন!

মালি শুনছিল। সায় দিয়ে বলল, হ্যাঁ স্যার। বড় সাপ ওখানে।

এরপর আর ওই হানাবাড়িতে যাওয়ার সাহস হল না। অগত্যা ঘরে গিয়ে জানলার ধারে একটা বই নিয়ে বসলুম। যা একটু পরে খোলা জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি, হানাবাড়িটা নদীর ওপারে দেখা যাচ্ছে। আর তার ছাদে কে যেন দড়িয়ে আছে। বাড়ির ছাদের ওপর একটা প্রকাণ্ড গাছ ঝুঁকে পড়ায় তার ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা মূর্তিটা ভাল করে ঠাহর হচ্ছিল না। কর্নেলের বাইনোকুলারটা খুঁজলুম। সঙ্গে নিয়ে গেছেন যথারীতি। অগত্যা বারান্দায় গিয়ে ভাল করে দেখার চেষ্টা করলুম।

এবার অবাক হয়ে গেলুম। মূর্তিটা স্ত্রীলোকের।

ওই পোড়ো বাড়িতে সাপের ভয় তুচ্ছ করে কোনও স্ত্রীলোক দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, এটা বেশ অস্বাভাবিক ব্যাপার। মহাবীরকে ডাকলুম। মহাবীর আমার কথা শুনে ওদিকে তাকাল। তারপর দুহাতে চোখ ঢেকে ভয় পাওয়া গলায় বলে উঠল, স্যার, স্যার! ওই সেই লছমী ডাকুনী!

শোনামাত্র আমার মাথায় জেদ চাপল। দ্রুত ঘরে ঢুকে ব্যাগ থেকে আমার পয়েন্ট ৩৮ ক্ষুদে রিভলভারটায় গুলি ভরে বেরিয়ে এলুম। কিন্তু তখন আর মুর্তিটা নেই।

মহাবীর বলল, কোথায় যাচ্ছেন স্যার?

আসছি। বলে গেট পেরিয়ে রাস্তা থেকে বাঁদিকে নেমে বড় বড় পাথর আর ঝোপঝাড় পেরিয়ে সেই টিলার কাছে পৌঁছলুম। এবার ভয় জাগল। সাপের ভয়। সাবধানে নজর রেখে টিলায় উঠতে শুরু করলুম।

বাড়িটা কোনওক্রমে টিকে আছে। আগাছার জঙ্গলে ঘিরে ফেলেছে তাকে। ফাঁকা জায়গা দিয়ে এগিয়ে প্রাঙ্গণে ঠুকলুম। তারপর মনে হল, বাড়িতে যেন মানুষ থাকার গন্ধ পাচ্ছি। এটা বুঝিয়ে বলা কঠিন, ষষ্ঠীর মতো একটা ইনটুইশন হতে পারে—কোনও স্পষ্ট চিহ্ন না থাকলেও মনে হচ্ছিল, এখানে মানুষ বাস করে।

ঘরগুলোর কপাটে মরচেধরা তালা আটকানো রয়েছে। বারান্দার শেষেপ্রান্তে সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে চলে গেলুম। কেউ কোথাও নেই।

হঠাৎ চোখে পড়ল একটা কালো ক্লিপ। চুল আঁটার মেয়েলি ক্লিপ। ক্লিপে চুল লেগে রয়েছে। শুকে সস্তা গন্ধতেলও টের পেলুম।

বাড়িটার আনাচে কানাচে তন্নতন্ন খুঁজেও সেই স্ত্রীলোকটিকে দেখতে পেলুম না। উঠানে দাঁড়িয়ে ভাবছি, দরজার তালা ভেঙে দেখব নাকি ভেতরে কী আছে, হঠাৎ আমার বাঁ-দিকে কয়েক গজ তফাতে আগাছার মধ্যে কী পড়ে আছে দেখতে পেলুম।

ঘাসে পা ফেলতে ভয় করছিল। শঙ্খচূড় থাকলে অবশ্য পায়ের শব্দে অনেক আগে ফণা তুলবে। লড়াই করার সময় পাব, অন্য বিষাক্ত সাপ থাকলে মুশকিল। গায়ে পা না পড়া পর্যন্ত অনেক বিষাক্ত সাপও ফেঁস করে না।

যা দেখলুম, আমার শরীরে রক্ত চলাচল থেমে গেল যেন।

একটি দেহাতী যুবতী চিত হয়ে পড়ে রয়েছে। তার গলা, কপাল ও বুকের ক্ষতচিহ্নে টাটকা রক্ত দলা বেঁধে রয়েছে। কাপড় রক্তে মাখামাখি। নিস্পন্দ মৃতদেহ ছাড়া কিছু নয়। মুখটা অবশ্য তত বিকৃত নয়।

মাত্র কয়েক সেকেন্ড দেখে আর তাকাতে পারছিলুম না। এমন খুন-খারাপি দেখিনি, এমন নয়। কিন্তু একটু আগে এ বাড়ির ছাদে যাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি, সেই যে এইমাত্র খুন। হয়েছে–আমি হয়তো যখন নদীর ব্রিজে ছিলুম তখনই—একথা ভেবেই আমার কষ্ট হচ্ছিল। তার আর্তনাদ কেন শুনতে পাইনি, সেটাই আশ্চর্য!

এখন দরকার খবর দেওয়া। সাপের কথা ভুলে হনহন করে এগিয়ে গেলুম। ভাঙা ফটক পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে যাচ্ছি, কর্নেলের টুপি দেখলুম ঝোপের আড়ালে। বুড়ো হাসিমুখে চাপা গলায় বললেন, জয়ন্ত যে!

রুদ্ধশ্বাসে বললাম, শিগগির আসুন! ওখানে একটা খুন হয়েছে।

বুড়ো একটুও চমকালেন না। বললেন, তাই নাকি? চলো তো দেখি।

ভেতরে যেতে যেতে ব্যাপারটা বললুম। কর্নেল কোনও মন্তব্য করলেন না। কিন্তু প্রাঙ্গণে সেই ঝোপের মধ্যে গিয়েই আমি আবার থ। লাশটা নেই।

বললুম, সর্বনাশ! এখানেই তো ছিল! গেল কোথায়?

কর্নেল হাঁটু দুমড়ে ঘাসের ভেতর থেকে কী একটা তুলে নিলেন। চমকে উঠে দেখি, রক্তের দলা ঘাঁটছেন আঙুলে। ছ্যা ছ্যা। ঘেন্না হচ্ছে না একটুও?

 

তিন

সম্ভাব্য ছয় নম্বর

বলে পারলুম না আর। কর্নেল! করছেন কী! ওই নোংরা রক্ত ঘাঁটছেন কেন?

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে আঙুল দুটো আগাছার পাতায় মুছতে মুছতে বললেন, জিনিসটা ততকিছু নোংরা নয়, ডার্লিং!

তারপর এগিয়ে গেলেন বারান্দর কোনায় সিড়ির দিকে। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে গেলেন। পেছন পেছন গেলুম। কর্নেল বাইনোকুলার চোখে রেখে এদিকে-ওদিকে কী খুঁজছিলেন। একটু পরে একদিকে স্থির হয়ে দাঁড়ালেন! ডাকলেন, জয়ন্ত! ওই দেখো তোমার শ্রীমতী মৃতদেহ স্নান করছেন। অর্থাৎ তেল-সিঁদুর ধুয়ে ফেলছেন।

বাইনোকুলারটা নিয়ে চোখে রেখে দেখি, হ্যাঁ—সেই দেহাতী যুবতীই বটে! নদীর বাঁকে মস্ত পাথরের আড়ালে ডোবামতো জায়গায় রগড়ে রং ধুচ্ছে।

বললুম, ব্যাপারটা কী বলুন তো?

কর্নেল একটু হেসে বললেন, ব্যাপারটা যৎকিঞ্চিৎ। ওখানে একজন পুরুষ মানুষও রয়েছে, যদি তুমি খুঁজে তাকে বের করতে পারো। সে আছে গাছের তলায় বসে।

দেখতে পেয়েছি কর্নেল! উত্তেজিতভাবে বললুম!

চিনতে পারছ তাকে?

আশ্চর্য! ওকে মহাবীর ড্রাইভার বলে মনে হচ্ছে।

দ্যাটস রাইট, ডার্লিং! এবারে চলে এস। কেটে পড়া যাক। সাবধান, আমরা এবার উল্টো দিকে বড় ব্রিজ পেরিয়ে বাংলোয় ফিরব।

কিছুক্ষণ পরে দুর্গম জায়গায় অশেষ কষ্ট করে হেঁটে হাইওয়ের বড় ব্রিজে পৌঁছলুম দুজনে। তারপর বললুম, আপনি ওখানে জুটলেন কীভাবে?

কর্নেল চুরুট জ্বেলে ধোঁয়া ছেড়ে হাসতে হাসতে বললেন, আজ সকাল থেকে টোপ খেলানো হচ্ছে। অর্থাৎ বাংলোর উল্টোদিকে নদীর পারে রঘুনন্দনজির ওই পোড়ড়া বাড়ির ছাদে আমাদের লছমীর প্রেতাত্মা দর্শনের ব্যবস্থা করে দিচ্ছিল কেউ। প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েই আমার নজরে পড়েছিল! কিন্তু আমল দিইনি। তখন সঙ্গে দূরদর্শন যন্ত্রটা ছিল না। ফিরে এসে, তখনও তুমি ঘুমিয়ে আছ, বস্তুটা চোখে রেখে দেখলুম-হ্যাঁ, যা ভেবেছি তাই। তখন ঘুরপথে বেরিয়ে পড়লুম। এগোতে যাচ্ছি, হঠাৎ দেখি, তুমি আসছ। বুঝতে পারলুম কেন আসছ অমন হন্তদন্ত হয়ে। তবে তুমি আমার সঙ্গী এবং কলকাতার লোক। ভূত বিশ্বাস করবে না এবং অনর্থ ঘটাবে জেনে মহাবীরের বউ…

অবাক হয়ে বললুম, মহাবীরের বউ? বলেন কী!

হ্যাঁ জয়ন্ত!

কাল মোহনজির বাড়িতে মেয়েটাকে দেখছি আমরা।

তাই বলুন! কিন্তু হঠাৎ অমন লাশ হয়ে পড়েছিল কেন?

তোমাকে ধোঁকা দিতে। মুখোমুখি হতে যাচ্ছিলে প্রায়। হঠাৎ বুদ্ধি খাটিয়ে ও লাশ হয়ে পড়ে রইল। তুমি ধাঁধায় পড়ে গেলে। পুলিশকে খবর দিতে ছুটবে, এ তো জানা কথা! সেই ফাঁকে নিরাপদে পালানোর সুযোগ করে নিল।

তাহলে মহাবীরের বউ লছমীর ভূত সেজে ডাকাতি করে বেড়াচ্ছে?

হুম্। বলে কর্নেল একরাশ ধোঁয়া ছাড়লেন! তারপর ফের বললেন, তখন বললুম না? আমায় মোহনজি তুরুপের তাস করতে ডেকে এনেছেন!

ঠিক বুঝলুম না।

বুঝবে সময়মতো। এস আপাতত আমরা কিছুক্ষণ প্রকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করি।…

দুপুরে আজ মোহনজির বাড়ি খাওয়ার নিমন্ত্রণ ছিল। বাংলো থেকে নিয়ে যেতে এলেন মোহনজি নিজে। মহাবীরকে আর দেখতে পাইনি ত্রিসীমানায়! মোহনজিকে সকালের ঘটনা জানাতে নিষেধ করেছিলেন কর্নেল। বলেছিলেন, যা বলার আমি বলব। তাই চুপ করে থাকলুম।

মোহনজি বললেন, দেরি হয়ে গেল কর্নেল সাব! অনুগ্রহ করে এবার আসুন।

কিন্তু কর্নেল গোমড়ামুখে বললেন, ক্ষমা চাচ্ছি মোহনজি! রাত থেকে প্রচণ্ড পেটের অসুখে ভুগছি। কিছু মুখে দেওয়ার উপায় নেই! জয়ন্তকে নিয়ে যান!

মোহনজি অবাক হয়ে বললেন, সে কী! এতসব আয়োজন করেছি।

কর্নেল আরও গম্ভীর হয়ে বললেন, উপায় নেই মোহনজি! আমি মহাবীরকে বলে পাঠাব। ভেবেছিলাম, খুঁজে পেলাম না।

মেহনজি ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, এটা কেমন কথা! আমি কত আশা করে…

বাধা দিয়ে কর্নেল একটু হেসে বললেন, আপনার আশা না মেটাতে পারায় আমি দুঃখিত। আর মোহনজি, আমার এই এক বেয়াড়া স্বভাব—আমায় কেউ প্রতারণা করছে জানতে পারলে তার ছায়া আমি মাড়াইনে।

মোহনপ্রসাদ চমকে উঠলেন। আমি আপনাকে প্রতারণা করেছি! কী বলছেন?

হ্যাঁ। কর্নেল দৃঢ় স্বরে বললেন। আপনার ড্রাইভার মহাবীরের বউকে আপনি লছমীর ভূত সাজিয়ে এত কাণ্ড করেছেন। আবার সেই রহস্য ফাঁস করতে আমাকে ডেকে এসেছেন। উদ্দেশ্যটা কী?

মোহনপ্রসাদ চেঁচিয়ে উঠলেন, ঝুট। বিলকুল ঝুট! এ আপনি কী বলছেন?

কর্নেল অন্যদিকে ঘুরে বললেন, যা বলার আমি বলেছি। এখন আপনি আসতে পারেন।

মোহনপ্রসাদ রাঙা মুখে গটগট করে বেরিয়ে গেলেন। বাইরে ওঁর জিপের অওয়াজ শোনা গেল। তারপর আমি বললুম, ওঁকে খামোকা রাগিয়ে দিলেন কেন কর্নেল?

কর্নেল বললেন, সাবধান করার জন্য। জানিয়ে দিলুম, ওঁর চালাকি ধরে ফেলেছি। আশাকরি তুমি আগাথা ক্রিস্টির এ বি সি মার্ডার পড়েছে। খুনির উদ্দেশ্য সি-কে খুন করা। পুলিশকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করার জন্য সে এ এবং বি-কে খুন করেছিল।

কিন্তু এক্ষেত্রে পাঁচটি কেস তো ডাকাতি। খুন নয়!

কর্নেল হাসলেন।… প্রথম দুটো কেস মোহনপ্রসাদের পাম্প এবং বাড়িতে হামলার। ওটা ওঁর সাজানো গল্প। বাকি তিনটে ঠিক। কিন্তু দুটোর উদ্দেশ্য লছমীর ভূতের কথা প্রচার করা। বাকি তিনটে সেই প্রচারের ভিত্তি মজবুত করতে। আমার ধারণা এবার ছনম্বর কেস আমার উপস্থিতিতে করার প্ল্যান ছিল মোহনজির। যেহেতু উনি আমাকে এনেছেন এই রহস্যের পর্দা তুলতে এবং সে কথা পুলিশকে জানিয়েও দিয়েছেন, সেইহেতু এই পরিকল্পিত এবং সম্ভাব্য ছনম্বর কেসেও তার প্রতি এতটুকু নজর পড়ার কথা নয় পুলিশের।

সেজন্য আপনি তুরুপের তাস কথাটা বারবার বলছিলেন?

ঠিক ধরেছ ডার্লিং। ছনম্বর কেসে কী ঘটতে পারে ভেবেছিলেন?

একটা বড় কিছু। কর্নেল চিন্তিতমুখে বললেন। ষষ্ঠীর ইনটুইশন খুব খাটি। কিন্তু সেই বড়টা কী মাথায় আসছে না। তবে সেটা থেকে মোহনপ্রসাদ যাতে নিবৃত্ত হন, তাই মুখের ওপর জানিয়ে দিলুম সব কথা। আশাকরি আর উনি এগোবেন না।

বলে কর্নেল পায়চারি শুরু করলেন। বিড়বিড় করে বলতে শুনলুম, কী হতে পারত ছনম্বর ঘটনাটা? কী সেটা?

তারপর ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, জয়ন্ত! মনে হচ্ছে, এ বি সি মার্ডারের অন্তিম লক্ষ্যের মতো ওঁর যে নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ওঁর জীবনে। পূর্বপ্রতিহিংসা চরিতার্থ করা—নাকি কোনও আর্থিক লাভালাভের ব্যাপার?

হাসতে হাসতে বললুম, যা ঘটেনি এবং আশা করি আর ঘটবে না—আপনি যেহেতু ওঁর কীর্তিকলাপ জেনে গেছেন, তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ কী? এদিকে আমদের খিদেও পেয়ে গিয়েছে। চলুন, কোনও হোটেলের দিকে পা বাড়াই।

কর্নেল বললেন, হুঁ, ছনম্বর ঘটনা আমি আটকে দিয়েছি। কিন্তু জানতে ইচ্ছে করছে, কী ঘটতে যাচ্ছিল! সম্ভবত সেটা শুধু ডাকাতি নয়, খুন-খারাপি। হ্যাঁ, লছমীর ভূতের হাতে একটি মৃত্যু।

করুণ মুখে বললুম, কর্নেল! আপনার সত্যি খিদে পেয়েছে।

বৃদ্ধ গোয়েন্দাপ্রবর বিচলিত হয়ে উঠলেন সঙ্গে সঙ্গে। হ্যাঁ, চলো, চলো।…

প্রতাপগড় থেকে ফেরার দিন পনেরো পরে কর্নেল একদিন ফোন করলেন। জয়ন্ত, প্রতাপগড়ের এমএলএ রঘুনন্দন সিংয়ের ডেডবডি পাওয়া গেছে নদীর ধারে। লছমীর ভূতের হাতেই খুন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি, স্রেফ খুন। শর্মাজি ট্রাংককলে জানালেন এইমাত্র। রঘুনন্দনের কাছে ঢিট হয়ে মোহনজি রাজনীতি ছেড়েছিলেন। অবশ্য আমি শর্মাজিকে লছমীর ভূত রহস্য ফাঁস করে না এলে মোহনজিকে সন্দেহ করতেন না ওঁরা। যাই হোক, মোহনজিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। লছমী আর মহাবীর তো আমরা চলে আসার পরই গা-ঢাকা দিয়েছিল। এখনও পুলিশ তাদের খুঁজছে। তাহলে দেখলে তো? ছনম্বর শিকার কে ছিল? ষষ্ঠীচরণের মাইনে বাড়িয়ে দিলুম, জয়ন্ত। সময় করে চলে এসো।…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *